তুমি আমার প্রোপারটি – আই লাভ ইউ (সিজন ০১)

তুমি আমার প্রোপারটি – আই লাভ ইউ: আমি মেয়েটার দিকে ভালোভাবে তাকাতেই যেনো আমার চোখদুটো কপালে উঠে যাওয়ার অবস্থা হলো। কারণ আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি আর কেউ নয় এটা “রাই”। তার মানে আমার ওগুলো স্বপ্ন ছিলো না! বরং সব কিছুই বাস্তব। রাই যখন আছে তার মানে আমার রাজও আছে।


পর্ব ১

~ একি কি করছেন কি আপনি? ছুরি দিয়ে কি করবেন আপনি? প্লিজ আমার হাত ছাড়ুন আমার ভীষণ ভয় লাগছে। আপনি আমার হাত কাটছেন কেন? আআআআ।
আকুতির সুরে কথাগুলো বলে কান্না করতে লাগলাম আমি। কিন্তু আমার কোন কথা না শুনে আমার হাতে ছুরি চালালেন সামনে বসে থাকা ভদ্রলোকটা। আর ছুরি দিয়ে আমার হাতে স্পষ্ট ভাবে লিখে দিলেন “Raj”। লেখাটা শেষ হতেই ছুরি টা পাশে সরিয়ে রাখলেন উনি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ডেভিল হেসে বলে উঠলেন,

~ আমার সব জিনিসের ওপর আমার নাম লেখা থাকে। তাহলে যেটা শুধুমাত্র আমার অন্য কারো নয়, সেটার উপর নিজের নাম লেখা থাকবে না সেটা তো হতে পারে না তাই না?
কথাগুলো বলেই বাঁকা হাসলেন উনি। ওনার কথার কোন কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। কি বলতে চাইছেন উনি আমাকে? অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম আমি ওনার দিকে। আর হাত কেটে যাওয়ার জ্বালায় কান্না করতে লাগলাম। আমাকে এভাবে কান্না করতে দেখে উনি চিৎকার করে ডাক্তার কে ডাক দিলেন। উনার ডাকে যেন এক মুহূর্ত দেরি করলেন না ডাক্তার, দ্রুত এসে হাজির হল কেবিনে।
ডাক্তার কেবিনে এসে পৌঁছাতেই রাজ আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে ডাক্তারকে উদ্যেশ্য করে বলে উঠলেন,

~ ডক্টর যত দ্রুত সম্ভব ওর হাতের ব্লাড পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিন। তবে হ্যাঁ এই ঘা যেনো না শুকায় এমন ঔষুধ দেবেন। এটা যেন কখনোই না শুকায় এটা সারা জীবন এভাবেই থাকবে।
ওনার কথা শুনে আমি এবং ডাক্তার দুজনেই বেশ অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু আমি এখনো কান্না করে চলেছি হাতের যন্ত্রণায়। ডাক্তার কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন,
~ এ আপনি কি বলছেন মিস্টার রাজ! এই জায়গার ঘা না শুকালে তো ওনার হাতে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে? আর তাছাড়া ঘা না শুকালে অনেক সমস্যা হয়ে যেতে পারে ওনার হাতের!
রাগি চোখে ডাক্তারের দিকে ফিরে তাকালো রাজ। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বললো,

~ আমি এত কিছু শুনতে চাই না ডাক্তার। আমি চাই আমার এই নাম যেন সারা জীবন ওর হাতে লেখা থাকে। Because Rahi is just my property.
রাজের কথা শুনে অনেকটাই অবাক হয়ে গেলেন ডাক্তার। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে রাজকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

~ ঠিক আছে মিস্টার রাজ, আপনি চিন্তা করবেন না আমি ওনার ঘা শুকানোর জন্য ওষুধ দেবো ঠিকই, তবে উনার হাতের এই কেটে যাওয়ার দাগটা কখনো শুকাবে না। ওখানে সারাজীবন সাদা দাগ হয়ে থাকবে। আর আপনার নামটাও স্পষ্ট দেখা যাবে। কিন্তু ঘা না শুকালে ওনার হাতে ইনফেকশন হয়ে, পড়ে হাত কেটে ফেলতে হতে পারে। এখন বলুন আপনি কি চাঁন?
ডাক্তারের কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কি যেনো ভাবলেন রাজ। তারপর উনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

~ ঠিক আছে আপনি তাহলে সেটাই করুন ডাক্তার। কিন্তু খবরদার আমার নাম এখানে যেন সারা জীবন থাকে। আমার নাম টা যেনো স্পষ্ট দেখা যায় সারাজীবন।
এতক্ষণ আমি চুপ করে থাকলেও এখন আর চুপ থাকতে পাড়লাম না। অসম্ভব রাগ কাজ করলো আমার মাঝে। আমি নিজের হাতটা ঝারি মেরে তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রাগী গলায় বলে উঠলাম,

~ কি পেয়েছেন কি আপনি? আর এমন করার মানে কি আমার সাথে? আমি আপনার সম্পত্তি মানে! কে বলেছে আমি আপনার সম্পত্তি? আজ বাদে কাল আমার বিয়ে আর আপনি এসব কি শুরু করেছেন আমার সাথে?

বিয়ের কথাটা বলতেই উনি লাফিয়ে উঠে আমার সামনে দাঁড়িয়ে, মুখের সামনে মুখ এনে রাগি গলায় বললেন,
~ কে বলেছে তোমার বিয়ে? তোমার বিয়ে হলে শুধু এই রাজের সাথে হবে। অন্য কারো সাথে নয়। আজ থেকে তুমি এই রাজের সম্পত্তি। শুধু এই রাজের। You are just my property understand?

হুংকার ছেড়ে কথাগুলো বললেন উনি। ওনার কথায় আমার সামনে থাকা ডাক্তার ও যেন কেঁপে উঠলেন, আর সাথে আমিও। আমি ওনার থেকে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমি, কেন এমন করছেন উনি আমার সাথে? গতকাল ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্যেই কি আমার এমন অবস্থা? আমি কাঁপা কাঁপা গলায় উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার? যে আপনি আমার সাথে এমন করছেন? কালকে আপনাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়াই কি আমার ভুল ছিল? কেন এমন করছেন আপনি আমার সাথে?

কথাগুলো বলতে বলতে অঝোর ধারায় কান্না করতে লাগলাম আমি। আমাকে এভাবে কান্না করতে দেখে উনি ওনার রাগ দমন করে অনেকটাই শান্ত হয়ে গেলেন। তারপর আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বেডের উপর বসিয়ে ডাক্তার কে ইশারা করে ব্যান্ডেজ করে দিতে বললেন। কিন্তু আমার কোন কথার উত্তর দিলেন না উনি। আমারও কেন জানি আর সাহস হচ্ছে না ওনাকে কিছু বলার। ডাক্তার আমার হাতে ব্যান্ডেজ করে চলে যেতেই উনি পাশ থেকে আবারো সেই ছুরি টা হাতে তুলে নিলেন। এবার ওনার হাতে ছুরি দেখে যেন প্রাণ পাখিটা উড়ে যাওয়ার অবস্থা হল আমার। আমি ওনার থেকে দূরে সরতে সরতে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

~ ছু ছুরি দিয়ে কি করবেন আ আপনি? প্লিজ আমার হাত আর কাটবেন না। আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি কোন ভুল করে থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দিন কিন্তু এভাবে আমাকে কষ্ট দেবেন না প্লিজ।
কথাগুলো বলতে বলতে ভয়ে কান্না করে ফেললাম আমি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে ছুরিটা এবার নিজের হাতে চালালেন। এবং ওনার নিজের হাত কেটে সুস্পষ্টভাবে লিখলেন “Rahi”। ওনার হাতে আমার নাম লিখতে দেখে অবাক চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম আমি ওনার দিকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলেন,

~ তুমি যেমন আজ থেকে আমার সম্পত্তি, তেমন আমিও আজ থেকে শুধু তোমারি সম্পত্তি। তাই তোমার হাতে যদি আমার নাম লেখা থাকে, তাহলে আমার হাতে কেন তোমার নাম লেখা থাকবে না?
উনার কথার কোন কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। শুধু অবাক চোখে উনার দিকে তাকিয়ে দেখছি। আসলে কি বলতে বা বোঝাতে চাইছেন উনি আমাকে? কোন কিছুই আমার মাথায় ঢুকছেনা। আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে দেখে উনি নরম গলায় বলে উঠলেন,

~ এখন তুমি সোজা বাসায় চলে যাও রাহি। এসব নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। বাকি কথা তোমার সাথে আমার কালকে হবে। so good bye.

উনার কেবিন থেকে বেরিয়ে আমি দৌড়াতে লাগলাম হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার জন্য। আমি জানি না উনি কেন এমন করছেন আমার সাথে। উনাকে তো আমি ঠিক করে চিনিও না। আর না উনি আমাকে চেনেন। তাহলে উনি আমার নামটাই বা কি করে জানলেন? যে নিজের হাতে লিখলেন? গতকাল বান্ধবীর বাসা থেকে ফেরার সময় রাস্তায় ওনাকে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আমি তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসি। তারপর আজকে উনার কি অবস্থা সেটা জানতে আশাতেই উনি আমার সাথে এমন করলেন। কিন্তু কেন এমন করলেন এটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা?

আমার নাম আফিয়া আক্তার রাহি। আমি বাবা মার দুই মাত্র সন্তান। আমার একজন বড় ভাই আছে আর আমি ছোট। ভাইয়ার নাম রাকিব। বাবা-মা এবং ভাইয়ার অনেক আদরের মেয়ে আমি। পরিবারের ছোট বলে সবাই অনেক বেশি ভালোবাসে আমায়। আগামী শুক্রবার মানে আগামি কাল আমার বিয়ে। আমার বিয়েটা আব্বু ই ঠিক করেছেন ওনার পছন্দের ছেলের সাথে। আর ওনাদের পছন্দ মানে আমারও পছন্দ। ছেলেকে যদিও আমি একবার দেখেছি মাত্র। কিন্তু তবু আমি কারো মুখের উপর না করিনি।

কেননা আব্বু-আম্মু কখনোই আমার খারাপ চাইবে না। আর তাছাড়া আমিও তাদের কথামতো সব সময় চলাফরা করি। আম্মুর কথা মত আমার দুজন বান্ধবী কে বিয়ের কার্ড দেওয়ার জন্য আমি কালকে বের হয়েছিলাম। আর বিয়ের কার্ড বান্ধবীর কাছে দিয়ে বাসায় ফেরার পথে মাঝ রাস্তায় দেখতে পাই একটি ছেলে আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। ছেলেটির হাতে কপালে এবং পায়ে বেশ কিছুটা আঘাত লেগেছে।

কিন্তু আশে পাশে এত মানুষ থাকা সত্বেও কেউ তার পাশে এগিয়ে আসছে না। একেই বুঝি বলে ঢাকা শহর! আমি আর কোন কিছু না ভেবে ওনার কাছে দ্রুত এগিয়ে যাই। তখনই দেখতে পারি ওনার কপাল কেটে অনেকটা রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে। সৌভাগ্যবশত আমার কাছে সব সময় একটি রুমাল থাকে। যে রুমালটি আমি অনেক শখ করে বানিয়ে ছিলাম। সেই রুমালটা আমার ব্যাগ থেকে বের করে আমি ওনার কপালে বেধেঁ দেই। তারপর চিৎকার করে আশেপাশের মানুষের কাছে হেল্প চাইতে থাকি। তখন আমার আশে পাশের কয়েকজন মানুষ এগিয়ে আসেন এবং আমাকে উনাকে নিয়ে হাসপাতালে আসতে সহযোগিতা করেন। কালকে আমি ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে বাসায় ফিরে যাই। আজকে আবারো এক বান্ধবীর বাসায় আসার সময় মনে পড়ে যায় ওনার কথা। তাই হাসপাতালে ওনাকে দেখতে এসেছিলাম।

কিন্তু উনি যে আমার সাথে এমনটা করবেন সেটা আমি কোনভাবেই ভাবতে পারিনি। আর আমি বুঝতে পারছি না উনি এই অল্প সময়ের মাঝে আমার নামই বা কিভাবে জানলেন? আমি তো ওনাকে নিজের নাম বলিনি। আর ওনাকে যখন আমি হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম তখন উনি জ্ঞানে থাকলেও কথা বলার মত অবস্থায় ছিলেন না। যে আমার নাম ধাম সবকিছু জেনে নেবেন। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই দ্রুতো এসে একটি সিএনজিতে উঠলাম আমি। তারপর রওনা হলাম বাসায় ফেরার উদ্যেশে।


পর্ব ২

বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছি আমি। আর ভেবে চলেছি হাসপাতালের সেই ঘটনাগুলো। এখন পর্যন্ত আমার মাথায় ঢুকছেনা উনি আমার সাথে কেন এমন ব্যবহার করলেন? হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর আমার হাতে ব্যান্ডেজ দেখে সবাই অনেক উত্তেজিত হয়ে পড়েন। আমার হাতে কি হয়েছে সেটা জানার জন্য। আমি তাদের সত্যিটা বলতে পারিনি। তাই মিথ্যা করে বলেছি আসার সময় ছোট একটি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তখন হাত কেটে গেছে। যদিও আমার মনে হয় না এটা সবাই বিশ্বাস করলেও ভাইয়া বিশ্বাস করেছে! তবুও তাদের এটাই বলেছি আমি। আমি কখনোই নিজের পরিবারের কাছে কোন বিষয়ে মিথ্যা বলি না। কিন্তু আজকে কেন জানিনা সত্যিটা বলার মত সাহস ছিল না আমার। তাই মিথ্যাটা কে আকড়ে ধরলাম। কিন্তু সেই থেকে মনটাকে আর সায় দিতে পারছি না। বাবা-মার কাছে এত বড় একটি মিথ্যা কথা বলে।

জানিনা সেই লোকটিকে বাঁচানোর অপরাধে কেন তিনি আমার হাতটা এভাবে কাটলেন। এবং নিজের নাম লিখে দিলেন। এখন শুধু একটাই চিন্তা হচ্ছে আমার এই ব্যান্ডেজ খোলার পরে যদি হাতে সেই রাজ নাম লেখাটা স্পষ্ট দেখা যায়! তাহলে সকলের কাছে আমি কি উত্তর দিব? কি করে বোঝাবো যে অ্যাক্সিডেন্টে আমার হাতে এই লেখা চলে এসেছে? এসব কথা ভাবতে ভাবতেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। তখনই পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে ঘুরে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ভাইয়াকে দেখে অনেকটাই ঘাবড়ে গেলাম আমি। তবুও নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে মুচকি হেসে বললাম,
~ তুমি কখন এখানে এসে দাঁড়িয়েছো ভাইয়া?

ভাইয়া আমার কথার উত্তর না দিয়ে আমাকে ভালো করে একবার পর্যবেক্ষণ করল। তারপর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমার কেটে যাওয়া হাতটা এক টানে নিজের কাছে এগিয়ে নিল। তারপর হাতটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক করে দেখে বলে উঠল,

~ সত্যি করে বলতো পুচকি তোর হাতে কি হয়েছে? আমার কাছে একদম মিথ্যে বলার চেষ্টা করবি না বলে দিলাম!

ভাইয়ার কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললাম আমি। যতটা বুঝতে পেরেছি ভাইয়া এখন আমার কাছ থেকে সত্যিটা না জেনে আমায় ছাড়বে না। কিন্তু ওকে দেখে আমি খুব ভয় পাই। যদিও পরিবারের মধ্যে মনে হয় আমায় সব চাইতে বেশি ভালবাসে ভাইয়া আর আদর করে পুচকি বলে ডাকে। কিন্তু তবুও ভাইয়ার শাসন টা অনেক কড়া। যখন শাসন করতে শুরু করে তখন তার শাসন টা একটু বেশি কড়া হয়ে যায়। অনেক ভয় করছে আমার এখন ওকে দেখে। আমাকে চুপ করে ভাবতে দেখে ভাইয়া আবারও রাগি গলায় ধমকের সুরে বলে উঠলো,
~ কি রে পুচকি, আমি তোর কাছে কিছু জানতে চাইছি। বল কি হয়েছে তোর হাতে?

ভাইয়ার ধমক খেয়ে হালকা কেঁপে উঠলাম আমি। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলাম,
~ ভাইয়া বিশ্বাস করো আমার কোন দোষ নেই। আমি কালকে একজন আহত লোককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম বলেছিলাম না?
~ হ্যা বলেছিলি, তো সেটা তো ভালো কথা। তার সাথে হাত কাটার সম্পর্ক কি?

~ আজকে তমাদের বাসা থেকে আমাদের বাসায় ফেরার পথে হাসপাতাল সামনে পড়লে ভাবলাম লোকটাকে একটু দেখে আসি, উনি কেমন আছে। তাই আমি বাসায় না ফিরে হাসপাতালে ওনাকে দেখতে যাই। আর তখন উনি!

এতটুকু বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। তখন গম্ভির গলায় হাতের মুঠ শক্ত করে ভাইয়া বলে উঠলো,
~ তখন উনি কি?

ভাইয়ার গম্ভীর গলায় বলা কথা শুনে কান্নার তেজ যেন আরো বেড়ে গেল আমার। আমি এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে সবকিছু খুলে বললাম ভাইয়ার কাছে। হাসপাতালে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা। আমার মুখে সবকিছু শুনে রাগে কটমট করতে লাগলো ভাইয়া। নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে বলল,

~ ওই লোকটার এত বড় সাহস আমার বোনের হাত কেটে নিজের নাম লিখে দেয়? তাকে বাঁচানোর ফলাফল এইভাবে দিলো বুঝি সে? তুই চিন্তা করিস না পুচকি আমি ওকে দেখে নেব। তুই এসব নিয়ে একদম ভাববি না। আর আব্বু আম্মুকে কিছু বলার দরকার নেই। তারা শুধু শুধু চিন্তা করবে। হাতের কেটে যাওয়া নিয়েও টেনশন করিস না। তোর হাতের ঘা শুকানোর জন্য আমি ঔষুধ এনে লাগিয়ে দেবো। দেখবি হাতে কোনো দাগই থাকবে না।

কথাগুলো বলে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে নিজের বুকে টেনে নিল ভাইয়া। আমিও ছোট বাচ্চাদের মত ভাইয়ের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আমার কান্না থামানোর জন্যে দুষ্টুমি করে বলল,
~ এই পাগলি একদম কাঁদবিনা। কাল না তোর বিয়ে? আজকে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে পেত্নী সেজে বসে থাক। তারপর কালকে তোর বর তোকে বিয়ের আসরে দেখে পেত্নী ভেবে বিয়ে না করে ভয়ে দৌঁড় দিবে।

কথাগুলো বলেই হা হা করে হাসতে লাগলো ভাইয়া। ভাইয়ার কথা শুনে কান্না করতে করতেই হাসতে লাগলাম আমি। তারপর ভাইয়ার বুকে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি মারতে লাগলাম।
ভাইয়া আমার হাতে কিল ঘুষি খেয়ে ছাদের উপর দৌঁড়াতে লাগল। আমিও ভাইয়ার পিছু পিছু ওকে ধরার জন্য দৌড় দিলাম। এভাবে বেশ কিছুক্ষন আমাদের ভাই বোনের খুনসুটি চললো ছাদে। তারপর ভাইয়া থেমে গিয়ে হাটুর ওপর হাত ভড় করে কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলে উঠল,
~ পুচকি এবার থেমে যা প্লিজ। আমি অনেক হাপিয়ে গেছি।

ভাইয়া কে থামতে দেখে আমিও থেমে গিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললাম,
~ বলো আরো আমাকে পেত্নী বল, তারপর এভাবেই দৌঁড় করাব তোমাকে। একদম দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বুড়ো হয়ে যাবে তুমি।
ভাইয়া আমার কান টেনে দিয়ে বললো,

~ পুচকি কি বললি তুই আমাকে? আমি বুড়ো হয়ে যাব? আরে দেখ আমি কত হ্যানসাম একটি ছেলে, আমার পিছু কত মেয়ের লাইন পড়ে থাকে তুই জানিস?
~ থাকবেই তো দেখতে হবে না ভাইটা কার? রাহির ভাই বলে কথা সুন্দর তো হতেই হবে তাই না? আচ্ছা ভাইয়া চলো এখন নিচে যাওয়া যাক সন্ধ্যা হয়ে আসছে। একটু পরে মাগরিবের আজান হবে।
~ তুই নিচে যা আমি এক জায়গায় যাব!
~ এখন আবার কোথায় যাবে তুমি?

~ হাসপাতলে যাব ওই লোকটিকে দেখতে। যার এত বড় সাহস যে আমার বোনের হাত কেটে নিজের নাম লিখে দেয়! ওর আজকে খবর করে দিবো আমি। তুই শুধু কেবিন নাম্বারটা বল!
~ ভাইয়া প্লিজ এখন এসব ঝামেলার মধ্যে যেওনা। যা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে। শুধু শুধু এসব ঝামেলায় জড়িয়ে কি লাভ বল? আর তাছাড়া আমি তো আর যাচ্ছি না উনাকে দেখতে। কাল তো আমার বিয়ে হয়ে যাবে তাই না? আজকে সময় টা অন্তত আমাকে দাও। কথাও যেওনা ভাইয়া। চলো না আজকে সবাই একসাথে অনেক মজা করি। কাল তো তোমাদের সকলকে ছেড়ে চলেই যাব।
কথাটি বলে মুখ গোমরা করে ফেললাম আমি। আর নিচের দিকে মাথা দিয়ে নিশ্চুপে কান্না করতে লাগলাম।

আমার কথা শুনে ভাইয়া আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
~ ধুর পাগলী কে বলেছে তুই কালকে বাড়ি ছেড়ে একেবারে চলে যাবি? তোকে আমি আমার কাছেই রেখে দেবো। সকালবেলা উঠে তোকে না দেখলে আমার সারাদিন ভালো যায় না জানিস না তুই? প্রত্যেকদিন আমি যাব তোকে দেখার জন্য তোর শশুরবাড়িতে বুঝলি। এখন এসব নিয়ে চিন্তা করিস না আমি যাব না হাসপাতলে। চল নিচে যাই।

রাত ১২.০৫ মিনিট,

বিভোরে ঘুমিয়ে আছে রাহি ও ওর বাসার সবাই। হঠাৎ ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে ঘুম ভাঙে রাহির।
রাহি অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে নাম্বার না দেখে কল রিসিভ করে কানের কাছে ধরে ঘুমু ঘুমু গলায় বলে,
~ হ্যালো কে বলছেন?

অপরপাশ থেকে কোনো উত্তর আসে না। রাহি ফোনটা কানের কাছে রেখেই আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। রাহির নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছে রাজ। ও ফোনটা কানের কাছে ধরে নিয়েই মুচকি হেসে মনে মনে বলে,

~ ফাজিল মেয়ে আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে কি সুন্দর নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে দেখো? ওয়েট করো রাহি বেবি কাল তোমার জন্যে একটি বড় ধামাকা অপেক্ষা করছে। মনে মনে
কথাগুলো মনে মনে ভেবেই বাঁকা হাসলো রাজ। তারপর বেশ কিছুক্ষণ রাহির নিঃশ্বাসের শব্দ শোনার পর ফোনটা কেটে দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো।


পর্ব ৩

বাইরে থেকে সকলের চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার। ঢুলুঢুলু চোখে ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে খাট থেকে নিচে নেমে দরজা খুললাম আমি। দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম বাড়ি ঘর সাজানো নিয়ে সবাই ব্যস্ত। বিয়ের তোরজোর বেশ ভালোভাবে শুরু হয়েছে। কিন্তু আমাকে এখনো কেউ ডাকেনি কেন? ভাবতেই মনে পড়ে গেল আমিতো নববধূ তাই হয়তো কেউ বিরক্ত করতে চায়নি আমায়। আর এটা নিশ্চই ভাইয়ার কথাতেই হয়েছে। মনে মনে বেশ হাসি পেল আমার কথাটা ভেবে। তারপর আর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে না থেকে মাথার খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে এগিয়ে গেলাম ওয়াশরুমের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ পরে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম আম্মু বসে আছে খাটে। আমাকে দেখেই মিষ্টি করে একটি হাসি দিয়ে আমার কাছে এসে বললো,
~ খাটের উপর তোমার হলুদের শাড়ি আর ফুলের জুয়েলারি রেখে গেলাম। এগুলো পড়ে বাইরে এসো একটু পর তোমার গায়ে হলুদ হবে।

আম্মুর কথা শুনে বেশ কিছুটা বিরক্ত হলাম আমি। কেননা এই গায়ে হলুদ দেওয়াটা আমার একদমই পছন্দ হয় না। তাই অসহায়ের মত লুক করে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ আম্মু এই হলুদটা কি না করলেই নয়? আমার এগুলো একদম বিচ্ছিরি লাগে। প্লিজ এসব বাদ দাও না!

আমার কথায় আম্মু মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,

~ তা বললে কি আর হয় মামনি? আজকে তোমার বিয়ে। আর বিয়েতে যদি গায়ে হলুদ ই না হয় তাহলে বিয়ের মজাটা কোথায় বলো? তুমি আমাদের একমাত্র মেয়ে তোমার বিয়েতে কোন কিছুর কমতি রাখতে চাই না আমরা। তুমি চেয়েছিলে বলে তোমায় শাড়ি পড়াতেও কেউ আসেনি। তুমি একা একা পড়বে বলে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে শাড়িটা পড়ে জলদি বাইরে আসো। সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে আমি গেলাম।

কথাগুলো বলেই আমার কপালে একটি চুমু এঁকে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন আম্মু। আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে খাটের উপরে আম্মুর রেখে যাওয়া জিনিসগুলো দেখে নিলাম। যেহেতু রাগ করে কোন লাভ হবে না এগুলো আমাকে পড়তেই হবে। তাই আর কোনো চিন্তাভাবনা না করে মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটালাম। তারপর শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম সেগুলো পড়ে আসার জন্য।

একটু পর ওয়াশরুম থেকে শাড়ি পড়ে বের হলাম আমি। তারপর আয়নার সামনে বসে সেই ফুলের জুয়েলারি গুলো এঁকে এঁকে গলায় হাতে কানে মাথায় সব জায়গায় পড়ে নিলাম। ডান হাতে ব্যান্ডেজ থাকায় সে হাতে কিছু পড়লাম না আমি। তারপর চোখে হালকা করে কাজল দিয়ে মুখে হালকা মেকআপ সাথে ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক পড়লাম। নিজেকে একবার আয়নায় দেখলাম বেশ সুন্দর লাগছে আমাকে দেখতে। তখন এগুলো পড়তে বিরক্তি লাগলেও এখন খুব একটা খারাপ লাগছে না নিজের কাছে। বরং নিজেকে এভাবে দেখে ভালই লাগছে। যাক গে বিয়ে তো জীবনে একবারই হয় একটু না হয় হলুদ ই দিয়ে দিলো সবাই তাতে কি এমন ক্ষতি? কথাগুলো মনে মনে ভেবে আনমনেই হেসে দিলাম আমি।

হঠাৎ হুড়মুড় করে আমার রুমের মাঝে প্রবেশ করল আমার বয়সী বেশ কয়েকটি মেয়ে। তাদের মাঝে থেকে একটি মেয়ে দৌড়ে এসে আমার কাছে বসে পড়লো। মেয়েটিকে দেখতে অনেক কিউট। সে এসেই আমার কাছে বসে আমার হাত দুটি ধরে বলল,

~ ভাবি কেমন আছো তুমি? তোমাকে দেখার অনেক ইচ্ছা ছিল জানো! যখন থেকে তোমার কথা শুনেছি শুধু তোমার কথাই ভেবে চলেছি আমি। আমার যে কত খুশি লাগছে তোমাকে সামনে দেখতে পেয়ে! তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না।

মেয়েটির কথায় আমি কোন উত্তর দিচ্ছি না। আমি শুধু অবাক চোখে মেয়েটিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। কারণ এর আগে এই মেয়েটিকে কোথাও দেখেছি বলে আমার মনে হয় না। আর চিনিও না তাকে। আচমকা কোথা থেকে এসে আমার সাথে এমন করে কথা বলতে শুরু করল কিছুই বুঝলাম না আমি। তাই অবাক চোখে শুধু তাকিয়ে আছি ওর দিকে। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজের মাথায় নিজে একটি গাট্টা মেরে বলে ওঠলো মেয়েটি,

~ উফস্ সরি ভাবি ভুল হয়ে গেছে আমার। আমি তোমার কাছে আমার পরিচয় দিতেই ভুলে গেছি। আসলে কি বলবো বলতো, তোমাকে দেখে এতটা এক্সাইটেড হয়ে গেছি যে নিজের পরিচয়টা দেবো সেটাই মনে নেই। আচ্ছা শোনো আমি হলাম তোমার একমাত্র ননদীনি। মানে তোমার হবু বরের একমাত্র ছোট বোন বুঝলে? আর আমার নাম হলো রাইশা ইসলাম। কিন্তু ভাইয়া আমাকে ভালবেসে রাই বলে ডাকে। তুমিও আমায় রাই ই ডেকো কেমন?

মেয়েটির কথা বলার স্টাইলটা অনেক সুন্দর এবং প্রাণবন্ত। ওর কথাগুলো শুনতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। তবে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছি মেয়েটা একটু বাঁচাল আর চনচলা টাইপের। নইলে প্রথম দেখায় এত কথা কেউ বলতে পারে না। আমি মেয়েটির দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ হুমম বুঝলাম, কিন্তু আপনাকে তো এর আগে দেখিনি আমি? মানে যেদিন আপনার ভাইয়ারা সবাই আমাকে দেখতে এসেছিল তখন এতগুলো মানুষের মধ্যে কই আপনাকে তো দেখি নি? বা আপনার কথা শুনিও নি কারো মুখ থেকে?

আমার কথায় মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভাবলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো,
~ আসলে কি হয়েছিল বলতো, সেদিন না আমার কলেজের একজন বান্ধবীর বাসায় ওর বার্ডেপার্টি ছিল। আমি সেখানেই গিয়েছিলাম বলে এখানে আসতে পারিনি। আচ্ছা সেসব বাদ দাও, তুমি কিন্তু খবরদার আমায় আপনি করে বলবে না। আমি না তোমার একমাত্র ছোট ননদিনী! আমাকে তুই করে বলবে অথবা তুমি করে ঠিক আছে?
মেয়েটির কথায় আমিও হেসে দিয়ে উত্তর দিলাম,
~ আচ্ছা ঠিক আছে তাই হবে রাই।

আমার মুখে নিজের নামটি শুনে এবার খুশিতে যেন গদগদ হয়ে পড়ল রাই। তারপর আমার হাত ধরে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে বললো,
~ চলো এখন তোমার গায়ে হলুদ হবে আমরা তোমাকে গায়ে হলুদ দিতেই এসেছি।

আমার হাত ধরে নিয়ে আমাকে বাইরে নিয়ে আসলো তারা। তারপর বেশ ধুমধাম করে এবং অনেক হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে আমার গায়ে হলুদ কমপ্লিট হলো। তারপর আমায় আরো একটি লাল পেরের হলুদ শাড়ি পড়িয়ে হালকা সাজে আলাদা একটি রুমে বসানো হলো। রাই আসার পর থেকে সেই যে বকবক শুরু করেছে তা আর থামার নাম নেই। আমিও ওর কথায় তাল মিলিয়ে একটু আকটু হু হা করছি। এভাবে বেশ কিছু সময় কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ রাই এর ফোন বেজে উঠলো। ও ফোনটা রিসিভ করে আমার কাছ থেকে উঠে দূরে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
~ ভাবি তুমি থাকো আমি তোমার বিয়ের সব জিনিস নিয়ে আসছি কেমন। ভাইয়া তোমার জন্য বিয়ের ডালা পাঠিয়ে দিয়েছে।

কথাটি বলেই রুম থেকে বাকি মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে গেল রাই। আমি শুধু নিশ্চুপে তাকিয়ে থাকলাম ওদের চলে যাওয়ার দিকে। ওরা চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেই ভাইয়া আমার কাছে আসলো। আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে আমার পাশে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

~কেমন আছিস রে পুচকি? তোর কি মন খারাপ এভাবে মন খারাপ করে বসে আছিস কেন বলতো?
আমি ভাইয়ার দিকে অভিমানী চোখে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ তুমি খুব পঁচা ভাইয়া! সেই সকাল থেকে একটি বারো আমার কাছে আসলে না। আমি না আজকে তোমাদের সকলকে ছেড়ে চলে যাব? আর তুমি একটিবার আমার কাছে আসলে না? আব্বুও আসলো না। তোমার কি এখনি পর করে দিচ্ছো আমায়? একটুও খারাপ লাগছে না আমি চলে যাব বলে?
আমার কথা শুনে ভাইয়া আমার গালে আস্তে করে আদরের থাপ্পড় দিয়ে বলে উঠলো,

~ ধুর পাগলী এসব কি বলছিস তুই? তুই কখনই আমাদের পর হবি না। সারা জীবন তুই আমাদের আপন হয়েই থাকবি আমার পুচকি হয়ে। আসলে কি বলতো আমার একমাত্র পুচকি বোনের বিয়েতে যেন কোন রকম কোমতি না থাকে সে দায়িত্ব তো আমার আর আব্বুর ই বল! তাই সকাল থেকে বিয়ের সব তোড়জোড় করার ফাঁকে তোর কাছে আসার একদমই সময় হয়নি। কিন্তু যখন একটু ফাঁকা পেয়েছি দেখ তোর কাছে চলে এসেছি প্লিজ তুই রাগ করিস না বোন আমার।

ভাইয়ার কথা শুনে আমি ভাইয়ার বুকে মুখ লুকিয়ে কান্না করে দিলাম। সকাল থেকে এমনিতেই মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে এখন ভাইয়ার কথায় যেন আরো বেশি খারাপ লাগছে আমার। আমি এই পরিবারকে ছেড়ে কি করে গিয়ে একটি অচেনা অজানা জায়গায় থাকবো? ভাবতেই যেন বুকটা চিরে কষ্ট হচ্ছে আমার। ভাইয়া আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলতে লাগল,
~ এই পাগলি কাঁদছিস কেন তুই? দেখবি তোকে যেখানে বিয়ে দিচ্ছি ওরা তোকে মাথায় করে রাখবে। তুই একদম রাজরানী হয়ে থাকবি বুঝলি? আর যদি কেউ তোর সাথে খারাপ আচরণ করে ওমনি আমাকে এসে বলবি, আমি তার নাক ফাটিয়ে দেবো। বিশেষ করে তোর বরের নাকটা ঘুষি মেরে বোঁচা করে দিলে মন্দ হবে না। নাক বোঁচা বরের বউ হবি তুই। তখন কত মজা হবে তোকে সারাক্ষণ খেপাতে পারব নাক বোঁচা বরের বউ ডেকে।

কথাগুলো বলেই দুষ্টুমি করে হাসতে লাগলো ভাইয়া। আমি বেশ বুঝতে পারছি ভাইয়া আমাকে হাসানোর জন্য কথাগুলো বলছে। তাই আমিও মুচকি হেসে দিয়ে অভিমানের সুরে বলে উঠলাম,
~ ভাইয়া তুমিও না!

ভাইয়া আমার কথা শুনে এবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

~ আচ্ছা তুই থাক আমি এখন দেখি বাইরের কাজ কতটা এগোলো। আর তাছাড়া এখন একদল মেয়ে এসে বসবে তোর কাছে তুই তো জানিসই মেয়েদের আমার কতটা এলার্জি মনে হয়।
কথাগুলো বলে আমার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে হাসতে হাসতে দরজার কাছে যেতেই রাইয়ের সাথে ধাক্কা লাগল ভাইয়ার। ভাইয়া এক নজর রাই এর দিকে তাকিয়ে রাই কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আর রাই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আমার পাশে এসে বসে বললো,

~ ভাবী ঐ বাদর ছেলেটা কে ছিল? এভাবে তোমার রুম থেকে বেরোতে নিয়ে আমাকে ধাক্কাদিয়ে আবার এভাবে পালিয়ে গেল? যেন আমি তাকে ধরে খেয়ে ফেলবো? কেমন বাঁদর ছেলে রে বাবা একবার সরিও বললো না?

রাই এর কথা শুনে মুখ টিপে টিপে হাসলাম আমি। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ উনি আমার ভাইয়া তুমি তো অবশ্যই তোমার ভাইয়ের কাছে শুনে থাকবে ভাইয়ার কথা। আসলে ও মেয়েদের থেকে সব সময় একটু দূরে দূরে থাকে। মেয়েদেরকে নাকি এলার্জি মনে হয় ওর কাছে। তাই তোমার থেকে এভাবে পালিয়ে গেল। প্লিজ তুমি রাগ করো না ওর হয়ে আমি তোমায় সরি বলে দিচ্ছি।

আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি যেন ভাবলো রাই। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
~ ও তার মানে উনি আমার বিয়াই সাব তাই না? আমার একটা এমন বিয়াই সাবের ই দরকার ছিলো। যে মেয়েদেরকে এলার্জি মনে করে। আমি যে কতটা এলার্জি এবার তাকে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়াব। আচ্ছা বাদ দাও ওসব, এই যে তোমার বিয়ের ডালা এসে গেছে দেখ তো পছন্দ হয় কিনা? গাড়িতে আরো অনেক কিছু আছে তুমি বস আমি এখনি নিয়ে আসছি।

কথাগুলো বলেই আমাকে আর কিছু কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল রাই। আমিও আর কিছু বললাম না। তারপর ফিরে তাকালাম বিছানা পুরা করে রাখা বিয়ের সব ডালার দিকে। রাই এবং আরও ছয় সাত জন মেয়ে মিলে এতগুলো জিনিস নিয়ে এসেছে। এসব জিনিস দেখে যেন আমার চোখ দুটো কপালে উঠে যাওয়ার অবস্থা হল। কেননা আমি যতদূর জানি আমি যেমন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে, তেমনি আমার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে ও একজন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে। আমার জানা মতে তাদের পক্ষে এত কিছু দেওয়া সম্ভব নয়। বেশ খটকা লাগলো আমার ডালাতে থাকা জিনিসগুলো দেখে।

একটি ডালাতে প্রায় সাত আটটা শাড়ি রয়েছে। প্রতিটি শাড়ি অসম্ভব সুন্দর এবং দামি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এক একটি শাড়ি হয়তো ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার নিচে নয়। আরেকটা ডালাতে একটা লাল রঙের লেহেঙ্গা রয়েছে। লেহেঙ্গা টা এতটাই সুন্দর যে কল্পনার বাহিরে। হয়তো এই লেহেঙ্গাটার দাম 50 হাজার টাকার উপরে ছেড়ে নিচে হবে না। আমি শুধু অবাক হচ্ছি উনারা একটি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে হয়ে এত দামি জিনিস কিভাবে কিনে দিলো? আরো বেশ কিছু দামি দামি কসমেটিকস রয়েছে বাকিগুলো ডালাতে। তখনই রাই এবং আরো সব মেয়েরা মিলে আরো অনেক গুলো ডালা হাতে নিয়ে হাজির হল রুমে। এবার প্রতিটি ডালায় যেন ভরি ভরি সোনার গহনা রয়েছে। আমি অবাক চোখে সেগুলো দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ রাই এসব কি?
~ কেনো ভাবি এগুলো তোমার বিয়ের সামগ্রী!

~ আমি যতদূর জানি তোমার ভাইয়া তো অতটা ও বড়লোক নয় যে বিয়েতে এত কিছু দিতে পারে? কিন্তু এগুলো কি রাই? তোমরা কি ভুল করে অন্য কারো বিয়ের ডালা আমার কাছে নিয়ে এসেছো?
আমার কথায় বেশ থতমত খেয়ে গেল রাই। তারপর অপরাধী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিয়ে বলল,
~ না ভাবি এগুলো তোমার বর মানে আমার ভাইয়া ই পাঠিয়েছে।

ও নিজে পছন্দ করে তোমার জন্য কিনেছে এসব। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। তুমি শুধু দেখে যাও পরে সব জানতে পারবে।
আমি ওর কথা শুনে বেশ অবাক হলাম। পরে কি জানতে পারবো আমি? আসলে কি হচ্ছে কি আমার সাথে? হঠাৎ বাইরে খুব হট্টগোলের শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার। আমি উঠে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম বাইরে আব্বু আম্মু এবং ভাইয়া বেশ কয়েকজন লোকের সাথে অনেক কথা কাটাকাটি করছে। ভাল করে খেয়াল করে দেখতেই বুঝলাম আমার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সেই ছেলেটি এবং তার পুরো ফ্যামিলি এসে দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের সাথেই কথা কাটাকাটি হচ্ছে আব্বু আম্মু আর ভাইয়ার। কিন্তু কি নিয়ে কথা কাটাকাটির হচ্ছে এটা বুঝতে পারছিনা আমি। ভাইয়াকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অসম্ভব রেগে আছে। তবে আমি যতটা জানি আমার ভাইয়া অনেক শান্তি প্রকৃতির মানুষ। সে খুব সহজে রাগ করে না। আর একবার যদি রেগে যায় তাহলে তার রাগ কমানো অনেক কঠিন। কিন্তু কি এমন হলো এই অল্প সময়ের মাঝে যে পাত্রপক্ষের সাথে এভাবে সবার কথা কাটাকাটি চলছে? বিষয়টা যে করেই হোক জানতে হবে আমায়। মনে হাজারো কৌতুহল নিয়ে একপা একপা করে বাইরে বের হয়ে আসলাম আমি। আমার পিছু পিছু রাই ও বাইরে বেরিয়ে আসলো।


পর্ব ৪

আমি গুটি গুটি পায়ে সবার কাছে এগিয়ে যেতেই আমার কাছে এগিয়ে আসলো ভাইয়া। তারপর রাগী গলায় বলে উঠলো,
~ তুই এখানে কেন এসেছিস রাহি? ঘরে যা তুই একদম ঘর থেকে বাইরে বের হবি না।

আমি ভাইয়ার কথা শুনে অবাক হলাম। ভাইয়া এতটা রেগে কখনো কথা বলেনি আমার সাথে। আমি ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
~ কি হয়েছে ভাইয়া এখানে এত চেঁচামেচি কেন? আমাকে কেন ঘরে যেতে বলছো তুমি?

আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে আমার হাত ধরে টানতে টানতে রুমে নিয়ে গেল ভাইয়া। তারপর ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। আমি শুধু অবাক হয়ে ভাইয়াকে দেখছি। হঠাৎ কি এমন হলো যে ভাইয়া এতটা রেগে গেলো? বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো ভাইয়া,
~ সত্যি করে বলতো রাহি! যে ছেলেটিকে তুই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলি, তার সাথে তোর কোন সম্পর্ক আছে কিনা? মানে তোরা কি দুজন দুজনকে ভালোবাসিস? খবরদার আমার কাছে মিথ্যা বলার চেষ্টা করবি না?

ভাইয়ার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালাম আমি। এখন আমি কী উত্তর দেবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। ভাইয়া কি করে ভাবতে পারল আমি এমন কোন কাজ করতে পারি? যে আমি কি না কখনো কোন ছেলের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলি না! সেই আমি একজন ছেলেকে ভালোবাসি? কথাটা ভাবতেই যেনো মাথা ঘুরছে আমার। কিভাবে কী উত্তর দেবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ভাইয়া এবার আমার দুবাহু ধরে জোরে ঝাকি দিয়ে বলে উঠলো,

~ কি হলো চুপ করে আছিস কেন রাহি! সত্যি করে বল আমি যেটা বলছি সেটা কি ঠিক? তুইকি ওই ছেলেটাকে ভালোবাসিস? আর তাই নিজের হাতে ওর নাম লিখেছিস?
ভাইয়ার কথায় কোন উত্তর দিতে পারছি না আমি। শুধু আমার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নদীর স্রোতের মতো নোনাজল। আমি কি করে ভাইয়াকে বোঝাবো যে আমি এমন কিছুই করিনি। তাহলে তারা আমাকে কেন এমন অপবাদ দিচ্ছে। সেটা ভাবতে পারছিনা আমি।

ভাইয়া কে তো আমি সকালেই বলেছি যে আমার হাত কেটে ঐ লোকটি নিজের নাম লিখে দিয়েছে। তাহলে ভাইয়া এমন কথা কি করে বলতে পারছে আমায়? কথাগুলো ভাবতেই যেন বুক চিরে কান্না বের হয়ে আসছে আমার। ভাইয়া আমাকে কান্না করতে দেখে এবার নিজেকে অনেকটা শান্ত করে নিল। তারপর চুপ করে বিছানার উপর কিছুক্ষণ বসে থেকে বিছানার ওপর থাকা সব বিয়ের ডালায় রাখা জিনিস গুলো দেখল। দেখে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শান্তকণ্ঠে বলে উঠলো,

~ দেখ রাহি তুই আমার একমাত্র ছোট বোন। পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি যদি কাউকে ভালোবাসি আমি তাহলে সেটা তুই। আমি কখনো চাইবো না যে তুই অসুখি হোস। তুই যদি ওই ছেলেটিকে ভালোবেসে থাকিস তাহলে আমাকে কেন বলিস নি বলতো? আজ তোর জন্য তুই বলিস নি বলে বাড়ির উপর এসে অন্যরা আমাদের অপমান করে যাচ্ছে। সেটা আমি কি করে সহ্য করবো বল? আমি আমাদের সকলের অপমান মেনে নিতে পারি কিন্তু তারা তোর চরিত্র তুলে কথা বলছে। এটা আমি কি করে মানবো বল?

কথাগুলো বলে ভাইয়া নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। এবার ভাইয়ার কথায় যেন নড়ে চড়ে বসলাম আমি। আমি ভাইয়ার কাছে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে উঠলাম,

~ ভাইয়া সত্যি করে বলতো আসলে কি হয়েছে বাইরে? আর তুমি আমাকে এসব কথা কেনো জিজ্ঞেস করছো?
আমার কথায় ভাইয়া এবার আমার দিকে ফিরে তাকাল। তারপর কান্নাভেজা চোখে আমার দু গালে হাত রেখে শান্ত গলায় বলতে শুরু করল,
~ বিশ্বাস কর রাহি তোকে নিয়ে কেউ কোনো কিছু বললে আমি একদম সহ্য করতে পারি না। যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম তার পুরো ফেমিলি এসে আজ তোর নামে উল্টোপাল্টা কথা বলছে। এটা কি করে মেনে নেই বল? এমনকি শুধু তাই নয় তারা নিজেদের প্রমাণ ও দেখিয়েছে যে তুই ওই ছেলেটিকে ভালবাসিস!

ভাইয়ার কথায় যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো আমার। তারা কি এমন প্রমাণ দেখালো যে আমি ঐ ছেলেটিকে ভালোবাসি? আমি তো কালকের আগে ঐ ছেলেটিকে দেখিওনি কখনো। তাকে বাঁচিয়েছি বলেই কি আজ আমার এত অপমান সহ্য করতে হচ্ছে? আমি কাঁপা কাঁপা গলায় ভাইয়ের হাতে হাত রেখে বলে উঠলাম,
~ কি প্রমান ভাইয়া?

কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে পকেট থেকে বেশ কয়েকটি ছবি বের করল ভাইয়া। তারপর আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
~ তুই যদি ওই ছেলেটিকে ভালবেসে না থাকিস তাহলে এই ছবিগুলো কিসের রাহি?

আমি ভাইয়ার কথার কোন উত্তর না দিয়ে হাত থেকে ছবিগুলো নিয়ে দেখতে লাগলাম। সেই ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমি ওই ছেলেটির পাশে বসে তার সাথে হেসে হেসে কথা বলছি। আর ছুরি দিয়ে নিজের হাত নিজে কেটে ওনার নাম লিখছি। ছবিগুলো দেখেই যেন পায়ের নিচের মাটি সরে গেল আমার। এটা কিভাবে সম্ভব আমিতো এমন কিছু করিনি? তাহলে ছবিতে এগুলো আসলো কোথা থেকে? আমি এখন কি করে সবাইকে বোঝাবো যে এগুলো সব মিথ্যে? আমার চোখ দিয়ে শুধু অঝোরে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি এখন কি বলবো কিছুই মাথায় ঢুকছেনা আমার। তখনই হঠাৎ বাইরে থেকে এক অচেনা কন্ঠে আমার নাম ধরে ডাকতে লাগলো কেউ একজন।

ডাকটা শুনে আমি কিছু বলার আগেই ভাইয়া গিয়ে দরজা খুলে দিল। আর দরজা খোলার সাথে সাথে রুমের মধ্যে প্রবেশ করল আব্বু আম্মু রাই এবং হাসপাতালে থাকা সেই লোকটি। লোকটিকে দেখে বেশ অবাক হলাম আমি। কেননা উনি এখন যেভাবে সেজে এসেছে এভাবে একজন বর বিয়ে করার আগে সাজে। শেরওয়ানি পড়ে মাথায় পাগড়ি পড়ে একদম বর সেজে আমার সামনে দাড়িয়ে আছে লোকটি। মুখে তার মিষ্টি হাসি। তার পাশে আব্বু এবং আম্মু ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। রাই এর মুখেও মিষ্টি হাসি। আমি সবাইকে এভাবে দেখে কিছু বুঝতে পারছিনা। আমি কিছু বলার আগেই ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

~ কে আপনি আর এখানে এভাবে বর সেজে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?

ভাইয়ার কথার কোন উত্তর না দিয়ে লোকটি সোজা ভাইয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলল,
~ আরে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না ভাইয়া? আমি আপনার বোনের হবু বর, যার সাথে আপনার বোনের আজকে বিয়ে হবে। ছবিতে দেখেও কি আমাকে চিনতে পারেননি আপনি?
ওনার কথা শুনে ভাইয়া ওনাকে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে একবার ছবিতে আর একবার ওনার দিকে তাকালো। তাকিয়ে দেখে বলে উঠলো,
~ তুমি রাজ?
~ হ্যাঁ ভাইয়া আমি রাজ। আমি আরিয়ান আহমেদ রাজ চৌধুরি।

উনার কথায় বেশ বিরক্ত বোধ করল ভাইয়া। ভাইয়া ওনার দিকে বিরক্তি চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,

~ এসবের মানে কি? আমি সবকিছু জানতে চাই তোমরা কি সত্যি আগে থেকে পরিচিত? আর তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসো? তাহলে এতদিন কেন আমার কাছে বলনি এসব?
~ আসলে ভাইয়া রাহির কোন দোষ নেই, ও সবাইকে বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি ওকে মানা করেছিলাম। শুধু শুধু ওর পড়াশোনা নষ্ট হবে বলে। কিন্তু আপনারা যে এভাবে ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলবেন সেটা ভাবতে পারিনি। তাই এখন বাধ্য হয়ে এই বিয়ের দিন এভাবে এসে বলতে হচ্ছে আমায়।

ওনার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম আমি। কি বলছে উনি এসব? উনি কি তাহলে প্রমাণ করতে চাইছে যে ওই লোকেরা যেগুলো বলেছে সেগুলো সত্যি? উনার আর আমার কোন সম্পর্ক আছে? এসব ভাববেই যেন মাথা ঘুরতে শুরু করলো আমার। আমি শুধু নীরব দর্শকের মত সকলের কথা শুনে যাচ্ছি। তখনই ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ রাহি এসব কি বলছে ও? সত্যি করে বল ওর কথা কি সত্যি?

আমি কিছু বলার আগেই ওই লোকটি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

~ ভাইয়া আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আপনার সাথে আমার একটু ব্যাক্তিগত কথা ছিল। প্লিজ ভাইয়া একটু সময় চাই আমি আপনার কাছে। তারপর আপনার যেটা ভালো মনে হয় আপনি না হয় সেটাই করবেন? আমি আপনাদের কারো উপর জোর করব না প্লিজ ভাইয়া আমার এই রিকোয়েস্ট টা রাখুন।

ওনার কথা শুনে ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে তারপর আবার উনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

~ ঠিক আছে চলো, আমি জানতে চাই তুমি কি বলতে চাও আমায়!

কথাটি বলে লোকটিকে নিয়ে আমার রুম থেকে অন্য একটি রুমে চলে গেল ভাইয়া। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি চুপচাপ গিয়ে বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়লাম। আমার পাশে আম্মু এগিয়ে এসে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

~ তুই যদি অন্য কাউকে ভালবাসিস তাহলে আগে কেন বলিসনি রাহি? তোর সুখের ওপর আমাদের আর কোন কিছু বলার নেই। তুই নিজের খুশিমতো যাকে খুশি বিয়ে করতে পারিস। আমি জানি তুই কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবি না। তোর উপর এতটুকু বিশ্বাস আছে আমাদের।

কিন্তু মা বাবাকে এতোটাই পর মনে করলি তুই, যে একবারও কথা গুলো বলার প্রয়োজন মনে করলি না?

আম্মুর কথার কি উত্তর দেবো আমি, কিছুই আমার মাথায় ঢুকছেনা। তাই শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কান্না করে চলেছি। এখানে যে আমার কিছু বলার নেই। কেননা আমার কাছে কোন কিছু শোনার আগেই তারা আমাকে অবিশ্বাস করে বসে আছে। আমি জানিনা আমার সাথে কেন এমন হচ্ছে। এসব এর মানে টাই বা কি? বেশ অনেকটা সময় কেটে যাবার পর ভাইয়া এবং ওই লোকটি একসাথে রুমে ঢুকলেন। দুজনের মুখেই কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে রয়েছে। ভাইয়া আমার পাশে এগিয়ে এসে বললো,

~ আম্মু আব্বু তোমরা বিয়ের ব্যবস্থা করো আজকেই আমাদের রাহির বিয়ে হবে রাজের সাথে। আর আমাদের রাহি অনেক সুখি হবে ইনশাআল্লাহ।
আমি এখনো চুপ করে বসে আছি। কি বলব সে ভাষা খুজে পাচ্ছি না আমি। তাই চুপচাপ বসে থাকাই শ্রেয় মনে করছি। তখনই সকলকে অবাক করে দিয়ে রাজ বলে উঠল,
~ আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি রাহির সাথে একটু আলাদা ভাবে কথা বলতে চাই। জাস্ট 5 মিনিটের জন্য।

ওনার কথা শুনে একে একে সবাই রুম থেকে চলে গেল। আমি এখনো সেই আগের মত একই জায়গায় বসে আছি। সবাই চলে যেতেই রাজ দরজাটা হাল্কা ভিড়িয়ে দিয়ে এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,

~ আই এম সরি রাহি। আমি জানি এখানে কি হচ্ছে সেসব কোন কিছুই হয়তো তোমার মাথায় ঢুকছে না। কিন্তু বিশ্বাস করো এগুলো করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না, তোমার বিয়েটা আটকানোর। আর তাছাড়া তোমার উসিলায় আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। তোমাকে আমি অন্য কারো হতে দেবো না রাহি। Because you are just my property Rahi. আমি তোমায় কথা দিচ্ছি রাহি, বিয়ের পর তোমার সকল রাগ অভিমান নিজের ভালবাসা দিয়ে মুছে দেবো আমি। পৃথিবীর সবটুকু সুখ এনে দেবো তোমার কাছে। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার পাশে থেকে শুধু তোমাকেই ভালবাসবো। আমি বেঁচে থাকতে তিল পরিমাণ কষ্টও তোমায় পেতে দিবো না আমি। And it’s my promise,

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ফেললেন উনি। আমি ওনার কথার কোন উত্তর দিলাম না। চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন উনি। তারপর গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে ভাইয়াকে ডেকে বললেন, যত দ্রুত সম্ভব আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে।

কিছুক্ষণ পর রাই এবং আরো বেশ কয়েকজন মেয়ে আসলো আমার রুমে। তারপর বিয়ের ডালা তে থাকা যাবতীয় জিনিস দিয়ে অনেক সুন্দর করে লেহেঙ্গা পরিয়ে বধু বেশে সাজানো হলো আমায়। নিজেকে আয়নায় দেখে মনে হচ্ছে যেন ডানা কাটা কোনো পরী। যদিও সে দিকে এখন আমার কোন খেয়াল নেই। আমার এখন কেমন লাগছে আমি নিজেও জানিনা। সারা পৃথিবী যেন ভো ভো করে ঘুরছে আমার চারিদিকে। আমার মাঝে কোন রকম ফিলিংস কাজ করছে না।

আমি চুপচাপ পাথরের মূর্তির মত বসে শুধু যে যা করছে সেটাই চুপ করে মেনে নিচ্ছি এবং শুনছি। অনুভূতিহীন এক পাথরের মূর্তি মনে হচ্ছে নিজেকে। বিয়ের সাজ কমপ্লিট হওয়ার পর রাই আমার পাশে বসে অনেক ছবি তুললো আমার। অনেক মজার মজার কথা ও বলল। কিন্তু কোন কথাই যেন কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না আমার। আমি চুপটি করে বসে আছি। চোখ দিয়েও কোনো পানি পড়ছে না আর। একটু পর ভাইয়ার সাথে কাজি আসলেন আমার রুমে। এবং আমাকে কবুল বলতে বললেন তারা বারবার। বেশ কয়েকবার বলার পর ভাইয়া যখন পাশে এসে আমাকে কবুল বলার জন্য তারা দিল। তখন আমি ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলাম, কবুল কবুল কবুল।

তারপর আমার সামনে কাবিনের কাগজ পত্র এগিয়ে দিলে নিঃশব্দে তাতে সাইন করে তাদের হাতে দিয়ে দিলাম আমি। সবাই আমার রুম থেকে চলে গেল। চারিদিকে খুশির হৈ-হুল্লোড় শোনা যাচ্ছে। বিয়ের আমেজ বুঝি শুরু হয়েছে। কিন্তু না আমার মাঝে কোন প্রকার ফিলিংস কাজ করছে না। আমি যেন এক মোমের পুতুল হয়ে গেছি। কি হলো আমার সাথে কেন হলো কোনো কিছুই যেন ব্রেন নিচ্ছে না আমার। মনে যেন এক কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেল কিছুক্ষনের মাঝে। হঠাৎ চারিদিকে অন্ধকার হয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম আমি রাই এর কোলে।


পর্ব ৫

ফুলে ফুলে সাজানো অসম্ভব সুন্দর করে ডেকোরেট করা একটি রুমের মাঝে বিছানায় অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছে রাহি। রাহির ঠিক পাশেই চুপটি করে বসে ওর দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে রাজ। রাজের চোখেমুখে আজ এক রাজ্য ভালোবাসা এবং তৃপ্তির ছাপ। বোঝাই যাচ্ছে অনেক দিনের চাওয়া কোন কিছু হয় তো আজ পেয়ে গেছে সে। যার জন্যে হয়তো অনেক প্রতীক্ষা করেছে সে। আজ যেন সেই প্রতীক্ষার শেষ হয়েছে তার। রাজ অনেকক্ষণ এভাবে রাহির দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর ওর পাশে শুয়ে পড়লো। নিজের গালের নিচে এক হাত রেখে রাহির দিকে তাকিয়েই একটি মুচকি হাসি দিলো সে। কিন্তু রাহিকে স্পর্শ করল না ওর থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বিছানায় শুয়েছে সে। তারপর রাহির দিকে তাকিয়ে থেকেই বলতে শুরু করল,

~ সুইটহার্ট, তুমি কি জানো! তুমি এমনই একটি মেয়ে যে আমার মতো পাথরের বুকে ফুল ফুটিয়েছো। আমার মনটা একটি পাথরের মত হয়ে গিয়েছিল। আমি মেয়ে মানুষদের ঘৃণা করি। প্রতিটি মেয়েকে এক রকম ভেবেছি আমি সারাজীবন। সবাইকে শুধু ঘৃণা করেছি। আমার জীবনে মেয়ে মানুষ বলতে শুধু একজনই ছিল আর সেটা হলো আমার বোন রাই। কিন্তু আজকের পর থেকে তুমি সেখানে যোগ হলে। তবে তুমি শুধু আজকে নয় বরং ছয় মাস আগে থেকে আমার মনের মনিকোঠায় দখল নিয়েছিলে। হয়তো সেটা আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম তখন তোমার বিয়ে অন্য কারো সাথে ঠিক হয়ে গেছে। তাই তো আর সহ্য করতে না পেরে এতটা নাটক করে তোমাকে কাছে পেতে হল আমার। য

দিও এগুলো করতে গিয়ে তোমার দুর্বলতার সুযোগ নিতে হয়েছে আমার। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি কখনই চাইনি তোমাকে এভাবে দুর্বল করে দিয়ে তোমার সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তোমাকে কাছে পেতে। তাই তো আজ বিয়ে করেও তোমার থেকে দূরে রয়েছি আমি। আর হ্যা যতদিন না তুমি আমাকে মন থেকে মেনে নিতে পারবে ততদিন তোমার কাছে স্বামীর অধিকার চাইবোনা। আর না তোমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করব। কিন্তু বিশ্বাস করো কখনোই তোমাকে আমার থেকে ছেড়ে যেতে দেব না আমি। Because #you_are_my_property.

কথাগুলো আস্তে আস্তে বলে একটি ছোট করে নিঃশ্বাস নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো রাজ। তারপর ভাবনার জগতে ডুবে দিল সে। সেই ছয় মাস আগে যখন সে প্রথম দেখেছিল রাহিকে।

৬ মাস আগে,

“বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং টপ বিজনেসম্যান হলো আরিয়ান আহমেদ রাজ চৌধুরী। রাজকে দেখতে যেমন সুন্দর ও হ্যানসাম ও ঠিক ততটাই রাগি ও জেদি। রাজের হাইট ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। বেশ বডি বিল্ডারও সে। গায়ের রঙ লাল ফর্সা, মাথায় ঘন কালো চুল। যে কোনো মেয়ে একবার দেখলেই হয়তো ক্রাশ খাবে তার ওপর। রাজের পৃথিবীতে শুধুমাত্র ওর ছোটবোন রাইশা ছাড়া অন্য কেউ নেই। বাবা অনেক আগে মারা গেছে তার। রাজের একটি খারাপ দিক হলো ও কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারে না। কোন মেয়ের কথা শুনলে যেন মাথায় আগুন ধরে যায় তার। এই বিষয়টার কোন কিছুই এখন অব্দি খুঁজে বের করতে পারেনি রাই। রাজ কেন কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারে না এটা সবার কাছে একটি গোলক ধাঁধার মত। কিন্তু নিজের বোন রাই কে নিজের চাইতেও বেশি ভালবাসে রাজ। অসম্ভব আদর করে তাকে। শুধু রাই ছাড়া পৃথিবীতে অন্য কোন মেয়ের কথা শুনলে যেন আগুন ধরে যায় তার শরীরে।

রাজ একবার বিজনেস এর কাজের জন্য লন্ডন গিয়েছিল। আর লন্ডনে নিজের সব কাজ কমপ্লিট করে ঢাকায় ফেরার পর। মাঝ পথে গাড়ির ভিতর থেকে দেখতে পায় একটি ছোট বাচ্চা ছেলে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কান্না করছে। আর সেই রাস্তার অপর প্রান্তে থেকে একটি ট্রাক দ্রুত বেগে ছুটে আসছে।

ছেলেটিকে এমন অবস্থায় দেখেই রাজ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। ছেলেটিকে বাঁচাবে বলে। কিন্তু ওর গাড়িটা বেশ খানিকটা দূরে থাকায় ওর দৌড়ে আসতে আসতেই ট্রাকটা অনেক কাছে চলে আসে ছেলেটির। আর তখনই একটি অপরিচিত মেয়ে দৌড়ে এসে ছেলেটিকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে যায়। কিন্তু ছেলেটিকে বাঁচাতে গিয়ে হাতে এবং মাথায় বেশ চোট লাগে মেয়েটির। দূর থেকে এ সব কিছুই খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করছিল রাজ। রাজ এর ভেতরে অনেক বেশি ভালো লাগা সৃষ্টি হয় মেয়েটির প্রতি।

কারণ মেয়েটি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়ে ছিলো সেই ছোট্ট ছেলেটিকে। কিন্তু তখনই রাজ আবার নিজের ভালো লাগা টাকে দূরে সরিয়ে রাখে। কারণ মেয়েদের ও ঘৃনা করতো। তার পরে যখনই রাজ আবার গাড়িতে উঠে চলে যেতে নেয়, তখন খেয়াল করে সেই ছোট ছেলেটির মা মেয়েটিকে ভুল বুঝে উল্টাপাল্টা কথা শোনাচ্ছে। এমনকি মারতে যাচ্ছে পর্যন্ত। কারণ ছেলেটির মা মনে করেছে যে মেয়েটি তার ছেলেকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো ওই মেয়েটি তার কোনো কিছুরই প্রতিবাদ করছে না। বরং কান্না করতে করতে এক সময় অজ্ঞান হয়ে নিচে পড়ে যায় সে। মেয়েটিকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে দেখে আর নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারেনি রাজ। ও দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে সেখানে এগিয়ে গিয়ে সেই পিচ্চি ছেলেটির মা-কে বলে ওঠে,

~ হেই ইউ, কেমন মা আপনি যে নিজের ছোট্ট ছেলেকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? আর যে মেয়েটি আপনার ছেলেকে বাঁচালো তাকে উল্টোপাল্টা গালি দিচ্ছেন? আপনার মত মহিলাদের জন্যই আজ কত সন্তানের জীবন সারা জীবনের মতো শেষ হয়ে যায়। এই জন্য আপনাদের মত মহিলাদের কে আমি ঘৃণা করি। আপনার সাহস হয় কি করে এই মেয়েটিকে এভাবে গালি দেওয়ার? যে কিনা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনার ছেলেকে বাঁচিয়েছে? আপনি কি আপনার ছেলেকে একবারও জিজ্ঞেস করতে পারতেন না আসলে কি হয়েছিলো? এই মেয়েটির যদি কিছু হয় তাহলে আপনাকে আমি আস্তো ছাড়বো না! কথাগুলো মনে রাখবেন আপনি?

কথাগুলো একনাগাড়ে রাগী গলায় বলেই সেদিন মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয় রাজ। কিন্তু তখনই সেই ছেলেটির মা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে,
~ আমাকে ক্ষমা করবেন ভাইয়া আসলে আমি বুঝতে পারিনি যে মেয়েটি আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছে। আমি আসলে শপিং মলের ভেতরে ছিলাম, আমার ছেলে কখন আমার পাশ থেকে রাস্তায় চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করবেন।

ওই মহিলাটির কথা শুনে রাজ সেদিন কোনো উত্তর করেনি শুধু রাগি চোখে তার দিকে একবার তাকিয়ে সোজা মেয়েটিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। তারপর মেয়েটিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে যায় রাজ। আর ডাক্তারকে বলে ওকে সুস্থ করে তুলতে। ডাক্তার মেয়েটির ক্ষতস্থান পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে বাইরে আসে। তারপর যখন রাজের কাছে জানতে চায় যে মেয়েটি ওর কি হয়, তখন রাজ জানায় ওর কিছু হয় না সে। বরং রাস্তায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়েছিল তাই সে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে। তারপর রাজ সব কথা খুলে বলে ডাক্তারকে। আর জানায় হয়তো এক্সিডেন্ট এর ফলে সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। কিন্তু তখন রাজের কথা শুনে ডাক্তার একটি বিস্ময়কর কথা রাজকে জানায়। যেটা সেদিন রাজ এক মাত্র জানতে পেরেছিল সেই মেয়েটির বিষয়ে। ডাক্তার বলেছিলো,

~ আপনি ভুল ভাবছেন মিস্টার রাজ। এই মেয়েটির মাথায় আঘাত পাওয়ার জন্য বা এক্সিডেন্টের কারণে সে অজ্ঞান হয়নি। বরং ওনার একটি সমস্যা বা রোগ আছে বলতে পারেন। আর সেই কারণে উনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

ডাক্তারের কথাশুনে রাজ সে দিন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিল,
~ ওনার কি এমন সমস্যা আছে ডাক্তার? যে উনি ঐ মহিলার কথার কোনো প্রতিবাদ না করে বরং অজ্ঞান হয়ে গেলেন?
~ আসলে আমাদের প্রতিটি মানুষেরই একটা করে দুর্বল দিক থাকে। বা কোন একটা ভয়ের কারণ থাকে। যেটা আমরা অন্য কারো সাথে শেয়ার করতে পারিনা। তখন আমরা অন্য কোন কিছু ভাবতেও পারিনা। তেমনি এই মেয়েটারও একটি এমন দুর্বলতা আছে।

যেটা হচ্ছে এই মেয়েটির ওপর যদি কেউ মিথ্যা কোনো দোষারোপ করে বা মিথ্যা অপবাদ দেয়। তাহলে সবার মতো মেয়েটি তার প্রতিবাদ করতে পারে না। বরং সে পাথরের মূর্তির মত সহ্য করতে শুরু করে আর একসময় সেই মিথ্যে অপবাদটা যখন তারওপর অতিরিক্ত চেপে বসে তখন সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তেমনি আপনার কথা অনুযায়ী উনি ওই ছেলেটাকে বাঁচানোর পর যখন ওই ছেলেটির মা এই মেয়েটির উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল। মেয়েটি সেই কথা গুলো সহ্য করতে না পেরে, প্রতিবাদ করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাছাড়া এক্সিডেন্টের কারণে উনি অজ্ঞান হয়নি।

সেদিন ওই ডাক্তারের কথাশুনে মেয়েটির দুর্বলতা জেনে গিয়েছিল রাজ। কিন্তু সেদিন মেয়েটির নাম জানতো না সে। সেদিন মেয়েটিকে হাসপাতালে রেখেই চলে যায় সে। তারপর মেয়েটি কোথায় গেছে না গেছে সেগুলো আর খোঁজ-খবর নেয়নি কখনো রাজ। কারণ সে মেয়েটির ওপর দুর্বল হওয়ার আগে ওর থেকে পালাতে চেয়েছিল। কারন মেয়েদের ঘৃনা করে ও। তাই সে কখনোই চায়নি যে মেয়েটির ওপর ও দুর্বল হয়ে পরুক। কিন্তু না, ও যতই দৌড়ে পালাতে চেয়েছে মেয়েটির থেকে, ততই যেন মেয়েটি আরো কাছে টেনে নিয়েছে ওকে। নানা রকম ভাবে অনেক জায়গায় মেয়েটির সাথে দেখা হয়ে যায় রাজের। যদিও মেয়েটি হয়তো ওকে কখনোই দেখেনি। একসময় রাজ নিজের মনের কাছে হার মেনে সত্যিই মেয়েটির ওপর দুর্বল হয়ে পড়ে। আর মেয়েটি সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে শুরু করে। আর সবার কাছে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে মেয়েটির নাম আফিয়া আক্তার রাহি।

তখন থেকে আড়ালে থেকে মেয়েটাকে ভালোবাসতে শুরু করে রাজ। এক সময় মেয়েটির পিছু নিতেও শুরু করে। কিন্তু তখনই রাজ জানতে পারে রাহির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তখন রাজ চিন্তা করে রাহির কাছে সে নিজের মনের কথা বলবে এবং ওর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আগের বিয়ে ভেঙে দেবে। তাই সেদিন রাহির সাথে দেখা করতে ছুটে যায় রাজ। কিন্তু মাঝ রাস্তায় গিয়ে ওর শত্রুদের হাতে আহত হয় রাজ। তখন রাহি ই সেখান থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে আসে ওকে। তার পরের ঘটনা তো সবাই জানেন। “

রাহির সেই দূর্বলতার কথা একমাত্র রাজ ছাড়া কেউ জানে না। আর তাই সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ওর ওপর মিথ্যে ভালোবাসার অপবাদ দিয়ে ওকে বিয়ে করেছে রাজ। আর সেজন্যই তো রাহি কারো কোনো কথার প্রতিবাদ করতে পারেনি। বরং অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল তখন।

চোখ বন্ধ করে থেকে অতীতের সেই কথাগুলো ভেবে মুচকি হাসল রাজ। যে করেই হোক সে তো পেয়েছে তার রাহিকে। তার ভালোবাসার ছোট্ট একটি পুতুল কে। যাকে তার পাথর মনটা ভালোবেসে ছিল এতদিন লুকিয়ে। যেভাবেই হোক না কেন তাকে আপন করে নিতে পেরেছে রাজ। এটাই তার কাছে অনেক। যদিও রাহির এই অভিমান ভাঙাতে হয়তো অনেক বেশি দাম দিতে হবে রাজকে। কিন্তু রাজ তার রাহির জন্যে যেকোনো কিছু করতে রাজি।

সকালের মিষ্টি রোদ চোখে এসে লাগতেই ঘুম ভেঙে গেল আমার। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম আমি। আর তাকিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটি অপরিচিত রুমে। এই রুমটা আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না আমার। চারিদিকে নানা রকম রং-বেরংয়ের ফুল এবং লাভ সেভ বেলুনের মেলা। পুরো রুমটা যেন মনে হচ্ছে একটি ফুলের বাগান। রুমের মাঝে তাজা ফুলের ঘ্রাণে যেন ম ম করছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসে বোঝার চেষ্টা করলাম এখানে ঠিক হয়েছে, আর আমি এখানে কি করে আসলাম। উঠে বসে নিজের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে চারিদিকে তাকাতেই কালকের কথা মনে পড়ে গেল আমার। সেই সাথে মনে পড়ে গেল আমার উপর দেওয়া সকলের অপবাদ এবং জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসে অপরিচিত একজনকে বিয়ে করার কথা। যে কিনা প্রথম দেখাতেই তাকে বাঁচানোর অপরাধে আমার হাত কেটে নিজের নাম লিখে দিয়েছিলো।

কথাগুলো মনে পড়তেই যেন তার প্রতি ঘৃনায় শরীর শিরশির করে উঠল আমার। তবে কি আমি এখন সেই লোকের বাসাতেই আছি? সে কি আমায় নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে? তাই কি আমি আজ ফুলে ফুলে বাসর সাজানো রুমে শুয়ে আছি এভাবে? কথাগুলো মনে পড়তেই আমার রাগটা প্রচুর ভাবে চেপে বসলো মনে। আমি দ্রুত খাট থেকে নিচে নেমে দাঁড়ালাম। তারপর রুম থেকে বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে হাটা দিলাম। দরজার কাছে পৌঁছতেই কালকে দেখা সেই লোকটি সামনে এসে দাড়ালো আমার। মুখে তার মিষ্টি হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বলে উঠলো,

~ গুড মর্নিং সুইটহার্ট।

উনাকে দেখে আমি দু পা পিছিয়ে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম। রাগে যেনো শরীর জ্বলে যাচ্ছে আমার। উনি একপা একপা করে আমার অনেক কাছে এগিয়ে এসে বললেন,
~ ঘুম কেমন হয়েছে রাহি? এটা তোমার নতুন বাড়ি। আজ থেকে তুমি এই বাড়ির মাল্কিন। আর মিসেস রাজ চৌধুরী। আমার সুইট হার্ট।


পর্ব ৬

~ আমি আপনার সাথে এ বাড়িতে থাকতে চাইনা! আমাকে আমার বাবার বাড়িতে যেতে দিন। আমি সেখানেই থাকতে চাই আর কলেজে পড়াশোনা করতে চাই।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর হঠাৎ ওপরের এই কথাটি বলে উঠলাম আমি। আমার কথা শুনতেই আমার সামনে বসে থাকা রাজ চৌধুরী যেন অবাক হয়ে ফিরে তাকালেন আমার দিকে। সে হয়তো আমার কাছ থেকে এমন কথা আশা করেন নি। তারপর আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে উঠলেন,
~ তুমি যা চাইবে তাই হবে রাহি, কিন্তু আমার একটি শর্ত আছে।

আমি তার কথা শুনে অন্য দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইলাম। তার কোন কথার উত্তর দেওয়ার মত মন মানসিকতা নেই আমার মাঝে। কেন না এই মুহূর্তে আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে ঘৃনার কোন লোক থাকলে সেটা শুধুমাত্র এই লোকটি। যে আমার জীবনে ঝড় এর বেগে এসে সব কিছু ওলট পালট করে দিয়েছে। আমার বাবা-মার কাছে আমাকে মিথ্যাবাদী করে তুলেছে এই লোকটি। আমি কি করে ক্ষমা করব একে? আর কীভাবেই বা মেনে নেব নিজের স্বামী হিসেবে? আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সে নিজেই বলে উঠলো,

~ আমি তোমার সকল চাওয়া পূরণ করবো রাহি। তুমি যেটা চাও সেটাই হবে। কিন্তু তার আগে আমার একটি শর্ত আছে। আর শর্তটি হলো তুমি তোমার বাবার বাসায় থাকবে ঠিক আছে, আমি ততদিন পর্যন্ত তোমার উপর নিজের স্বামীর অধিকার খাটাবো না যতদিন না তুমি নিজে থেকে মেনে নিয়ে আমার কাছে চলে আসো। তবে তুমি সেখানে থাকবে ঠিকই কিন্তু আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন ছেলের সাথে কথা বলা তো দূর চোখ তুলেও তাকাতে পারবে না। আর যদি আমার কথা অমান্য করো তাহলে সেদিনই হবে তোমার ওই বাড়িতে শেষ দিন। এটা মাথায় রাখতে হবে তোমার!
তার বলা কথাগুলো শুনে অসম্ভব রাগ হল আমার মাঝে। কত বড় সাহস এই লোকের যে আমার ওপরে নিজের আদেশ খাটাতে চাইছে!

কি হয় উনি আমার, তাকে আমি চিনিনা জানিনা। আমার সরলতার ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সে আমাকে বিয়ে করেছে। আমার তো এ বিয়েতে মত ছিল না! কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি কারো মুখের ওপর কোন কথা বলতে পারিনি। জানিনা আমার কেন এমন হয়। কেন নিজের ওপর কোনো মিথ্যা অপবাদের প্রতিবাদ করতে পারি না আমি। কিন্তু তাই বলে তো এই নয় যে এই লোকটার সবকথা মেনে নেবো আমি? কখনোই না।

এসব কথা মনে মনে ভেবে চুপ করে রইলাম আমি। তার কোন কথার উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা করছে না এই মুহূর্তে আমার। আমাকে চুপ থাকতে দেখে তিনি আবারো বলে উঠলেন,
~ কি হলো রাহি আমি তোমাকে কিছু বলছি! আমার কথার উত্তর দাও? আমি তোমাকে যে শর্তটা দিয়েছি তুমি যদি সেই শর্তটা সঠিকভাবে মানতে পারো তবেই আমি তোমাকে আমার বাসা থেকে তোমার বাবার বাড়িতে যেতে দেব। আর তুমি যতদিন না আমাকে মন থেকে স্বামী রুপে মেনে নাও, ততদিন সেখানে থাকতে দেবো।

আমি কখনোই তোমার কাছে জোর করে স্বামীর অধিকার চাইবো না। তুমি সেখান থেকেই কলেজে পড়াশোনা করতে পারবে। কিন্তু তোমার জীবনে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষ থাকতে পারবে না। এটা তোমাকে প্রমিস করতে হবে আমার কাছে?

তার কথাগুলো শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চিন্তা করলাম আমি। এখন তার প্রতিটি কথা মেনে নেওয়াই সঠিক হবে আমার জন্য। কারণ যেভাবেই হোক এই বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরতে হবে আমায়। আর সবকিছু বুঝিয়ে বলতে হবে ভাইয়াকে। আমার বিশ্বাস আর কেউ আমার কথা বিশ্বাস না করলেও ভাইয়া নিশ্চয়ই আমার কথা বিশ্বাস করবে। আমার সাথ দেবে। আর এই লোকটিকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে সাহায্য করবে। তাই মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ ঠিক আছে আপনি যেমন বলছেন তাই হবে। আমি ওই বাসায় থেকে কলেজে পড়াশোনা করব। আর আপনি ছাড়া অন্য কোন ছেলের সাথে কথা বলবো না। এটা আপনার কাছে আমার প্রমিস।
আমার কথা শুনে উনি যেন বিশ্ব জয় করা এক হাসি দিলেন। তারপর লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে খুশি হয়ে বললেন,

~ থ্যাংক ইউ রাহি থ্যাংক ইউ সো মাচ। আমি জানতাম তুমি আমার কথা অবশ্যই রাখবে। আর আমিও নিজের কথা রাখবো। তোমার যা দরকার সব কিছু তোমাকে আমি সেখানে দেবো। আর তুমি যাতে তোমার বাবার বাড়ি থেকে কলেজে পড়তে পারো, সেই সব কিছুর ব্যবস্থা করব আমি তোমার জন্য। এখন রুমে গিয়ে আলমারিতে দেখো তোমার জন্য কাপড় রাখা আছে। সেটা বের করে রেডি হয়ে নাও আমি নিজে গিয়ে তোমার বাড়িতে তোমায় রেখে আসবো।

কথাটি বলেই তিনি অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। আমিও আর দেরি না করে দ্রুত নিজের রুমে ছুটে এসে আলমারি খুলে দেখলাম অনেক সুন্দর একটি কালো রঙের গাউন জামা। আমি জামাটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। তারপর জামা কাপড় চেঞ্জ করে গোসল করে গাউনটা পড়ে বেরিয়ে আসলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা একটু সেজে নিলাম আমি। চোখে হালকা করে কাজল, ফোটে হালকা লিপস্টিক, কানে এক জোড়া ঝুমকো, ব্যাস এতটুকুই যথেষ্ট।

রেডি হয়ে উপর থেকে নিচে নেমে আসলাম আমি। নিচে নেমে আসতেই দেখতে পেলাম রাজ সোফার উপর বসে ফোনে কথা বলছেন কেউ একজনের সাথে। ওনাকে দেখতেই না চাইতেও যেন নিজের নজরটা আটকে গেল ওনার দিকে। ওনাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আমি হয়তো এর আগে এভাবে ওনার দিকে একবারও লক্ষ করিনি। তিনি যেমন লম্বা ফর্সা সুন্দর এবং স্মার্ট। তার চাইতেও বেশী ভালো লাগছে এখন মনে হচ্ছে। তিনি আমার সাথে ম্যাচিং করে কালো রংয়ের কোট প্যান্ট পরেছেন। সাথে চোখে পড়ে আছে দামী সানগ্লাস। হাতে দামি ওয়াচ। সবকিছু মিলিয়ে যেন অসাধারণ সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে। আমি হা করে তাকিয়ে আছি তার দিকে। হঠাৎ ফোনটা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন উনি। তারপর একপা একপা করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন।

ওনাকে এগিয়ে আসতে দেখে যেন হুশ ফিরল আমার। আমি অনেকটাই অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম ওনাকে এগিয়ে আসতে দেখে। তবুও নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমাকে দেখলেন। তার পর অন্য দিকে ঘুরে তাকিয়ে নরম কন্ঠে বলে উঠলেন,
~ আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে রাহি, চলো এবার বের হতে হবে। তোমাকে ঐ বাসায় রেখে অফিসে যাবো আমি। আর তাছাড়া রাই কেও আনতে যেতে হবে।

ওনার কথা শুনতেই রাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল আমার। সত্যিই তো এই বাসায় আসার পর থেকে একবারও তো রাইকে দেখিনি। তাহলে ও কথায় গেলো? আমি অবাক হয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম,

~ কেনো রাই এখানে নেই? ও কোথায়?
~ রাই তোমাকে আর আমাকে একা থাকতে দেবে বলে নিজের বান্ধবীর বাড়িতে থেকে গেছে কাল। সেখান থেকেই ওকে আনতে যাব আমি। ওকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। এবার চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে অফিস যেতে হবে আমায়।

কথাটি বলেই সামনের দিকে হাটা দিলেন উনি। ওনার কথা শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমি, যে উনার কথায় যেন অনেক কষ্ট জড়িয়ে আছে। কিন্তু এই কষ্টটা কিসের আমি সেটা বুঝতে পারলাম না। আর বোঝার চেষ্টাও করছি না। উনার পিছু পিছু সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। উনি ড্রাইভিং সিটে বসে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন,
~ সামনে এসে বসো, এভাবে পিছন সিটে বসে থাকলে যে কেউ দেখে তোমার ড্রাইভার মনে করবে আমায়।

উনার কথায় বেশ বিরক্ত হলাম আমি। তবুও বিরক্ত টাকে প্রকাশ না করে পেছন থেকে সামনে এসে বসে পড়লাম। আমাকে বসে পড়তে দেখে উনি অন্য দিকে তাকিয়ে বারবার গাড়ির হর্ন বাজাতে লাগলেন। আমি ওনার এমন হর্ন বাজাতে দেখে বেশ বিরক্ত ফিল করতে লাগলাম। সামনে এসে তো বসেছি তাহলে আবার কেন হর্ন বাজাচ্ছেন উনি? তাই বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললাম,
~ আপনার এই খাম্বা মার্কা গাড়ি টাকে এভাবে ষাঁড় গরুর মত চেঁচাচ্ছেন কেন বারবার?

আমার কথা শুনে উনি আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর জোরে জোরে হা হা করে হাসতে লাগলেন। ওনাকে এভাবে হাসতে দেখে যেন এবার বিরক্তির সীমা পার হয়ে গেল আমার। আমি বিরক্তিকর কন্ঠে বলে উঠলাম,

~ এভাবে হাসির কি হল? কিছুক্ষণ আগেই তো বলছিলেন আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে! এখন আবার এমন শুরু করেছেন কেন? তাড়াতাড়ি চলুন আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবেন।
আমার কথায় উনি এবার হাসি থামিয়ে বলে উঠলেন,

~ লাইক সিরিয়াসলি রাহি? আমার এই দামী গাড়িটাকে তোমার খাম্বা বলে মনে হয়? আর গাড়ির হর্ন এর শব্দকে ষাঁড়ের ডাক মনে হয় তোমার?

ওনার কথায় চুপ করে বসে রইলাম আমি। উত্তর দেওয়ার মতো কোনো ইচ্ছেই এখন আমার নেই। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে এবার উনি হাসি থামিয়ে বেশ অনেকটাই গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর কিছু একটা ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমাকে নিয়ে আমার বাবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে, তিনিও নেমে পড়লেন। তাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ আপনি এখানে নামছেন কেন? আপনি না বললেন আপনি অফিসে যাবেন?
উনি আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে গাড়ির পিছন থেকে অনেকগুলো ফল মিষ্টির প্যাকেট আর শপিং ব্যাগ বের করলেন। তারপর আমাকে পাশ কাটিয়ে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমার আগেই উনি আমাদের বাসার গেটের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। আমি অবাক চোখে ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

কেমন লোক রে বাবা, এমন ভাব করছে যেন আমাকে উনি চেনেই না। যেন আমাকে সাথে করে নিয়ে আসেন নি। আর এই বাড়িটা যেন ওনার, আমি এ বাড়ির কিছুই নই। বেশ বিরক্ত সহকারে রাগ নিয়ে উনার পিছু পিছু আমিও বাসার দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। উনি কলিংবেল চাপতেই আম্মু এসে দরজা খুলে দিয়ে আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে খুশি হয়ে বলে উঠলো,
~ তোমরা এসে গেছো বাবা? আমি তোমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।


পর্ব ৭

গত 30 মিনিট যাবত একের পর এক খাবার গিলে যাচ্ছেন রাজ। উনাকে এভাবে খেতে দেখে যেন চোখদুটো কটোর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে আমার। এত যে কেউ খেতে পারে সেটা এই রাজকে না দেখলে হয়তো কেউ বুঝতেই পারবে না। আর আমার মা বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন বাড়িটা আমার বাবার বাড়ি নয় বরং ঐ রাজের বাবার বাড়ি। মা বাবাও যেনো আমার নয়। আমার দিকে কারো কোনো খেয়ালই নেই। তারা তো নিজেদের নতুন জামাইকে নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু এদিকে যে আমি সকাল থেকে কিছুই খাইনি। সেদিকে কারো খেয়ালই নেই। কেমন যেন নিজেকে আজ বাবার বাড়িতে পর পর মনে হচ্ছে। তাহলে এখানে আমি থাকবো কি করে? ভাবতেই দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে চাইছে। কিন্তু কান্না করতে পারছিনা আমি। শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে ঐ রাজের খাবার গেলা দেখছি।

হঠাৎ মাথায় কারো গাট্টা মারার আঘাত পেয়ে সে দিকে ফিরে তাকালাম আমি। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
~ কিরে পুচকি এভাবে আমাদের নতুন জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন রে? বেচারার তো পাতলা পায়খানা হবে তোর নজরে।

এমনিতেই অনেকক্ষণ হলো রেগেছিলাম। ভাইয়ার কথায় যেন আরো বেশি রাগ টা বেড়ে গেল আমার। ইচ্ছা তো করছে এবার ভাইয়ার সাথে আচ্ছা করে ফাইটিং শুরু করে দেই। কত বড় কথা আমি নাকি ওনাকে নজর দিয়ে ওনার পেট খারাপ করে দিবো! রাগে আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেলাম আমি। আমাকে এভাবে যেতে দেখে বেশ কয়েকবার পিছু ডাকলো ভাইয়া। আমি তার কথায় থামলাম না, সোজা নিজের রুমে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বেলকুনিতে চলে আসলাম। ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার ইচ্ছে করছে হাত পা ছাড়িয়ে চিৎকার করে কান্না করি। কিন্তু সেটারও উপায় নেই। তাই গাল ফুলিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে প্রকৃতি দেখতে লাগলাম। এদিকে ক্ষুধায় মনে হচ্ছে পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে আমার। সেদিকে যেন কারো খেয়ালই নেই। একদিনেই কি এতটা পর হয়ে গেছি আমি সবার? ধুর কিচ্ছু ভাল্লাগে না।

বেশ কিছুক্ষণ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকার পরে দরজায় কেউ বারেবারে টোকা দিতে লাগলো। আমি দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ শুনে বিরক্তি নিয়ে সে দিকে তাকালাম। কিন্তু দরজা খুললাম না। দরজা খোলার কোনো ইচ্ছেই আমার মাঝে নেই এখন। কারন এমনি তে একা থেকে আমি যতই রাগ দেখাই না কেনো। কারো সামনে গিয়ে সেই রাগটা প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই আমার। জানিনা আমার সাথেই কেনো এমনটা হয়। নিজের ফিলিংস গুলো কেনো কাউকে বোঝাতে পারিনা আমি! আমার ভাবনায় ছেদ কাটিয়ে আবারো কে যেন বারবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে উঠলো।

এবার শুধু ধাক্কা দিয়েই থামলো না, সে আমার নাম ধরেও ডাকতে লাগল। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে ফেললাম আমি। আর দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম আমার সামনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন রাজ। তার হাতে খাবারের প্লেট। উনাকে দেখেই যেন বিরক্তিটা আরো একশ গুণ বেড়ে গেল আমার। আমি ভ্রু কুঁচকে রাগি গলায় বলে উঠলাম,

~ কি হয়েছে? কি সমস্যা আপনার? বারবার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন কেনো?

উনি আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে হুড়মুড় করে আমাকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে পড়লেন। তারপর উনার হাতের খাবারের প্লেট টা টেবিলের উপর রেখে আমাকে সরিয়ে দিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। তারপর আমার হাত ধরে নিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দিলেন। ওনার এমন কার্যকলাপে অবাক এর চাইতে রাগটাই যেন বেশি হচ্ছে আমার। আমি ওনার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে যাব তার আগেই উনি বলে উঠলেন,

~ এখন রাগ না দেখিয়ে তাড়াতাড়ি খাবারটা খেয়ে নাও। এখন না খেলে দুপুর অব্দি কিছু না খেয়েই থাকতে হবে।
ওনার কথা শুনে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম আমি,
~ না খেয়ে থাকতে হবে মানে কি?

উনি আমার কথায় এবার মুখটি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন,
~ না খেয়ে থাকতে হবে কারণ এ বাসার সবাই জানে যে তুমি সকালে আমার খাবার সহ দু প্লেট খাবার খেয়ে এসেছো। আর আমাকে না খাইয়ে রেখেছো। তাই তো সবাই তোমাকে ছেড়ে আমাকে খাওয়াচ্ছিল এতক্ষণ বুঝলে?

উনার কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লাম আমি। এ লোক বলে কি! আমি নাকি দুই প্লেট খাবার খেয়ে এসেছি! আজ অব্দি জীবনে কখনো এক প্লেটের বেশি খাবার খেয়েছি কিনা আমি নিজেই জানি না। আর উনি কি না আমার নামে এতবড় একটা মিথ্যা কথা বলছে? রাগে যেন এবার শরীর জ্বলে যেতে লাগলো আমার। কত্ত বড় সাহস এই লোকের, আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার বাবা-মার কাছে আমার সম্পর্কেই এত বড় মিথ্যা কথা বলেছে উনি? আর আব্বু আম্মু বা কেমন কিভাবে ওনার কথা মেনে নিলেন যে আমি দুই প্লেট খাবার খেয়েছি? ভাবতেই যেন মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে আমার। তবে নিজের মাথার নয় এই লোকটির মাথার। আমি রাগে কোন কথা না বলে সেখান থেকে সরে বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।

আমাকে বেলকুনিতে আসতে দেখে উনিও আমার পিছু পিছু এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। তারপর বাইরের দিকে চোখ রেখেই বলে উঠলেন,

~ বেশিক্ষণ তোমার সাথে এক রুমে দরজা আটকে থাকলে সবাই কি ভাববে বলতো? আমাদের তো নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে, তাই দেরি না করে খাবার গুলো খেয়ে নাও তাহলে আমি বাইরে যেতে পারবো।
~ তো আপনাকে আটকে রেখেছে কে বাইরে যাওয়া থেকে? যান না তাড়াতাড়ি চলে যান। আপনাকে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে কে? আর দরজা লাগিয়ে রেখেছেন কেন আপনি?
~ কারণ এই খাবারটিও আমি খাব বলে নিয়ে এসেছি। এখন দরজা খুলে আমি বাইরে যাওয়ার পর আমার শাশুড়ি আম্মা শশুর মশাই যদি দেখে যে আমার খাবারটা তুমি আবারও খেয়ে নিয়েছো, তাহলে তারা সবাই তোমাকে রাক্ষসী ভাববে বুঝলে। তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে প্লেটটা খালি করে দাও আমি নিয়ে চলে যাই।

ওনার কোথায় যেন পায়ের নিচের মাটি সরে গেল আমার। লোকটা বলে কি, গত আধাঘন্টা হলো খেয়েও, এখনও নাকি আরও এক প্লেট খাওয়ার জন্য নিয়ে এসেছে উনি? এবার তো আমার সন্দেহ হচ্ছে এটা আদৌ কোনো মানুষ না কী আস্ত একটি রাক্ষস? আমাকে ওনার দিকে এমন বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি কেমন লজ্জা পাওয়ার ভাব নিয়ে বললেন,

~ দেখো রাহি, তোমাকে আমি আগেই বলেছি তুমি আমাকে মন থেকে মেনে না নিলে আমি তোমার কাছে স্বামীর অধিকার চাইবো না। এখন তুমি যদি আমার দিকে এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকো, তাহলে কিন্তু আমি ধরে নেবো তুমি আমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছো। তখন কিন্তু আমি তোমার ওপর, বুঝতেই তো পারছো!

ওনার কথা শুনে চোখ নামিয়ে নিলাম আমি। সাথে শুকনো ঢোক গিলে রাগী ভাব নিয়ে রুমে এসে খাবারের প্লেটটা নিয়ে খাবার খাওয়া শুরু করলাম। এমনিতেই অসম্ভব খিদে লেগেছে আমার। ক্ষুধায় একদম হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গিয়েছে বলা চলে। তাই আর রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। আমার খাওয়া দেখে উনি আমার পাশে এসে বসে আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলেন। ওনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ অস্বস্তি লাগল আমার। আমি ওনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ আপনার না অফিসের খুব জরুরী কাজ আছে? তাহলে আপনি এখানে আছেন কেন অফিসে যাবেন না?

~ এটাই তো আমার অফিস আর যে কাজগুলো করছি এটাই হল আমার সেই জরুরী কাজ বুঝলে? এখন কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি খাবারটা খেয়ে নাও। আমাকে আবার রাইকে আনতে যেতে হবে।
ওনার কথা শুনে খাওয়া বাদ দিয়ে বড় বড় চোখে ওনার দিকে তাকালাম আমি। উনি হয়তো আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বলে উঠলাম,

~ আমি তোমার কাছে মিথ্যা কথা বলিনি রাহি। সত্যিই অফিসে কাজ আছে আমার। তবে এখানের চাইতে ওটা জরুরী নয়। তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও আমি একটু পরেই চলে যাব। আর তোমার সাথে একদম কলেজেই দেখা হবে আমার। এখানে হয়তো আর তেমনভাবে আসা হবে না। অনেক বেশি মিস করব তোমায় আমি রাহি।

কথাগুলো কেমন অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন উনি। আমি ওনার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তাড়াতাড়ি খাবারটা খেয়ে নিলাম। তারপর প্লেটটা ওনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম,
~ এবার তাড়াতাড়ি বিদায় হন!

উনি আমার কথাটা শুনে আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি ওনার চাওনি টাকে দেখে অন্য দিকে ঘুরে তাকালাম। উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন প্লেটটা নিয়ে।


পর্ব ৮

সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিট
নিজের রুমের বেলকুনিতে চেয়ার পেতে বসে চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। কাউকে বুঝাতে পারছি না আমার মনের কষ্ট গুলোর কথা। এই দুদিনে আমার জীবনটা হঠাৎ করে কেমন হয়ে গেল কিছুই যেন বুঝতে পারলাম না আমি। হঠাৎ কোনো এক কালবৈশাখী ঝড়ের মত জীবনে সব কিছু ঘটে গেলো। আমার সবকিছু তছনছ করে দিলো সকল স্বপ্নকে শেষ করে দিলো। জানিনা আদৌ আমি এই বাস্তবটাকে মেনে নিতে পারবো কিনা। নাকি সারা জীবন এভাবে কাঁদতে হবে আমায়।

হঠাৎ কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে ধ্যান ভাঙ্গলো আমার। আমি আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ভাইয়া আমার দিকে এক পলকে তাকিয়ে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়াকে দেখে দ্রুত নিজের চোখের জল গুলো মুছে ফেললাম। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
~ কিছু বলবে ভাইয়া?

আমার প্রশ্নের উত্তরে ভাইয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরেকটি চেয়ার নিয়ে এসে আমার পাশে বসলো। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠলো,
~ সব সময় মানুষ যেটা দেখে সেটা কখনোই ঠিক হয়না। হয়তো তার পিছনে অনেক বড় কোন কিছু কারণ থাকে। জীবনে চলতে গেলে এমন কিছু জিনিসের সম্মুখীন হতে হয় সেটার কথা আমরা কখনও কল্পনাও করিনি। কিন্তু সেটাই আমাদের জীবনে এক অদ্ভুত সময় হয়ে চলে আসে। আমাদের মেনে নিতে অনেক কষ্ট হয় তখন। কিন্তু সেই সময় টা আমরা ঠিকই পার হয়ে যাই। তবে সেই সময়কার কিছু দাগ রয়ে যায় আমাদের মনে। তাই সে সময় টাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে শিখতে হয়। কে জানে সেই সময়ের সেই অভিজ্ঞতার আড়ালে হয়তো অন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তাই ভেঙে না পড়ে পরিস্থিতি মেনে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আমি ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। কেমন রহস্যের মত করে কথাগুলো বলল ভাইয়া। ভাইয়ার কথা গুলো বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা এখন আমার মাঝে নেই। তাই সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে আবারও আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। এখন যেন এই আকাশ টাকেই চিরসাথী মনে হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ নেই আমার। আমি যেন বড্ড একা যেভাবে একাই এসেছিলাম পৃথিবীর বুকে ঠিক তেমন। ভাবতেই একটি বড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে।

গভীররাত চারদিকে নিরব নিস্তব্ধ অন্ধকারে ঢাকা। কোন দিকে কোন পাখিরও শব্দ নেই। সবাই যেন ঘুমে বিভোর হয়ে রয়েছে। সবার মত আমিও ঘুমাচ্ছি বিভোরে। কিন্তু হঠাৎ কেন জানি না ঘুমের ঘোরে আমার মনে হচ্ছে আমাকে যেন খুব কাছ থেকে কেউ পর্যবেক্ষণ করছে। আমাকে দেখছে অনেকক্ষণ হলো এক নজরে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে আমার ঘুমের মাঝেই। অস্বস্তিটা কোনমতোই কাটিয়ে উঠতে পারছিনা আমি। ঘুমটাও যেন ভাঙতে চাইছে না।

কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি আমি যে আমার পাশে কেউ আছে আর আমাকে সে এক নজরে তাকিয়ে থেকে মোহনীয় দৃষ্টিতে দেখছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর অসম্ভব রকমের বিরক্তি নিয়ে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ঘুম ভাঙতেই লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম তেমন কেউ নেই রুমে। আমি একাই রয়েছি। তবে আমার পায়ের দিকের জানালাটা খোলা। আমি বিরক্তি নিয়ে উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। তারপরে হাই তুলতে তুলতে এসে আবার শুয়ে পরলাম।

সকালে আম্মুর আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার। আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখেই আম্মু ব্রেকফাস্ট করার কথা বলে চলে গেলো। আমি আরমোরা ভেঙে উঠে বসলাম। তারপর দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই আমার চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। সকাল দশটা বেজে গেছে। আমি তো এত বেলা অব্দি কখনো ঘুমায়নি? তখনই মনে পড়ে গেল কাল রাতে ঘটে যাওয়া সেই অস্বস্তিকর কথাগুলো। তাই আর কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে জামাকাপড় চেঞ্জ করে নিয়ে কলেজের জন্য একদম রেডি হয়েই রুম থেকে বের হলাম। তারপর আম্মুর কাছে গিয়ে টেবিলে বসতেই আম্মু আমার জন্য খাবার দিয়ে বলে উঠলেন,

~ আজকে প্রথম নতুন কলেজে যাচ্ছো এত লেট করলে চলে! সেই কখন থেকে ডাকছি তোমায় আমি। কিন্তু তোমার এত ঘুম কিসের বলোতো?
আম্মুর কথায় অবাক চোখে আম্মুর দিকে তাকালাম আমি। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলাম,

~ কি বলছো তুমি আম্মু? নতুন কলেজ মানে? আমি তো এই কলেজে প্রায় দুই বছর হলো পড়াশোনা করছি? তাহলে তুমি নতুন কলেজ বলছ কেন আম্মু?

আমার কথার উত্তর না দিয়ে একটা কাজের জন্য তাড়াতাড়ি চলে গেলেন আম্মু রান্নাঘরে। তখনই ভাইয়া এসে আমার পাশে বসে আমার প্লেট থেকে খাবার নিয়ে খেতে খেতে বলে উঠলো,
~ দু’বছর আগে তুই একটি কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিলি মনে আছে তোর পুচকি? সে কলেজের খরচ বেশি বলে আব্বু চাওয়া সত্যেও তোকে ভর্তি করতে পারেনি। সে জন্য অবশ্য তুই সহ বাসার সবারই মন খারাপ ছিল। তবে পরবর্তীতে তুই আর সে মন খারাপ মনে রাখিস নি। আজ থেকে তুই সেই কলেজেই পড়বি। আর তাই আম্মু বলছিল তোকে নতুন কলেজের কথা। এখন দেরি না করে তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে নে তোকে নিয়ে আমি কলেজে যাব।

ভাইয়ার কথায় যেন কিছুই বুঝলাম না আমি। আমাকে যে কলেজে দু’বছর আগে ভর্তি হতে দেয়নি টাকা খরচ বেশি বলে, তাহলে এখন কেন সেই কলেজে পড়তে যাবো আমি? কথাগুলো মনের মধ্যে আসতেই ভাইয়ার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম,

~ কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ভাইয়া? দুই বছর আগে যখন আমি সেই কলেজে পড়তে চেয়েছিলাম তখন খরচ বেশি বলে আব্বু সেই কলেজে আমায় ভর্তি করতে পারেনি। তাহলে এখন আমি কি করে সেই কলেজে পড়বো? আর তাছাড়া আমাদের অবস্থাও তো ততটা ভালো নয়! ঐ কলেজের খরচা টানা আব্বুর জন্য অনেক কষ্টের হয়ে যাবে। আমার ওই কলেজে পড়তে হবে না। তুমি আব্বুকে বলে দেও আমি বরং আমার আগের কলেজেই পড়বো!

আমার কথা শুনে ভাইয়া আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
~ এত ঢং করতে হবেনা এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বাইরে আয় আমি তোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি কলেজে পৌঁছাতে হবে তোকে অনেক লেট হয়ে গেলো। আর সেখানে তোর এডমিশন কনফার্ম হয়ে গেছে। তাই আর কথা বাড়াস না জলদি আয়।

কথাটি বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে চলে গেল ভাইয়া। মনের মাঝে অনেকগুলো প্রশ্ন আসলেও এখন আর ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করার মত ইচ্ছা হল না আমার। আর তাছাড়া ওই কলেজে পড়ার স্বপ্ন আমার প্রায় দুই বছর হলো। যদিও স্বপ্নটাকে মনের মাঝে পুতে রেখেছিলাম সত্যি হবে না জেনে। তবে এতদিন পর যেহুতু স্বপ্নটা পূরণ হতে যাচ্ছে তাই ভীষণ ভালো লাগছে। কোনো মতে খেয়েদেয়ে ছুটে চলে আসলাম বাইরে। আসার আগে আম্মুকে শুধু একবার ডেকে বলে এসেছি কলেজে যাওয়ার কথা।

বাইরে আসতেই দেখতে পেলাম ভাইয়া একটি রিকশা নিয়ে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত গিয়ে ভাইয়ার পাশে বসে পড়লাম। ভাইয়া আমাকে নিয়ে কলেজ এর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মনের মাঝে ভীষণ আনন্দ লাগছে আমার। আজকে স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে, যে কলেজে পড়ার স্বপ্ন আমি অনেক আগে থেকেই দেখে এসেছি। বেশ কিছুক্ষণ পরেই কলেজের সামনে পৌঁছে গেলাম আমরা। ভাইয়া ভাড়া মিটিয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে কলেজের দিকে এগিয়ে গেল। কলেজের দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছি ততো যেন বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে আমার। একেই বুঝি বলে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আনন্দ। এটাতো কোনো ভয় বা অন্য কিছুর ধুকপুকানি নয়। শুধুমাত্র স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আনন্দে এমন হচ্ছে আমার।

কলেজের গেটের কাছে পৌঁছাতেই একটি মেয়ে আমাদের দিকে দৌড়ে আসতে লাগলো। মেয়েটাকে দেখে আমার আর চিনতে অসুবিধা হলো না। এটা আমার ননদিনী রাই। রাই দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বলে উঠলো,

~ ভাবি তুমি এসেছ? আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আর তুমি কিনা এত দেরিতে আসলে? প্রথম দিনেই এত দেরী করলে চলে বুঝি?
আমি ওর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,

~ আমি যে এই কলেজে আসছিলাম তুমি আগে থেকে জানতে? আর তুমি এখানে কি করছ রাই?
~ আমি তো এই কলেজেই পড়ি। আর তাছাড়া কালকে যখন আঙ্কেল তোমার এখানে এডমিশনের জন্য এসেছিল তখন আঙ্কেলের সাথে দেখা হয়ে এসব জেনে গিয়েছিলাম আমি। তাই জানতাম তুমি আজকে আসবে। এখন বলো কেমন আছো তুমি?
~ হুমম ভালো আছি। তুমি?

~ তুমি চলে এসেছো এখন আমি বিন্দাস আছি।

আমরা দুজন যখন কথা বলায় ব্যস্ত তখন ভাইয়া বিরক্তি নিয়ে আমাকে বলে উঠল,
~ আচ্ছা পুচকি তুই তাহলে থাক আমি চলে যাচ্ছি। আবার কলেজ টাইম শেষ হলে নিতে আসবো কেমন।
ভাইয়া কথাটি বলতেই রাই চট করে বলে উঠলো,

~ আরে বিয়াই সাব আপনার কথা তো আমি ভুলেই গেছি। আসসালামু আলাইকুম বিয়াই সাব। কেমন আছেন আপনি?
রাইয়ের কথায় যেন কেঁপে উঠল ভাইয়া। ভাইয়া যেনো এতক্ষণ এটারই ভয় পাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারিনা ভাইয়া সব মেয়েদের কে দেখে এত বিরক্তি বোধ কেন করে। রাই এর কথা শুনে মনের মাঝে বিরক্তি নিয়ে মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে ভাইয়া বলে উঠলো,
~ ওয়ালাই কুমুসসালাম, এইতো ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?

ভাইয়ার মুখে কথাটি শুনে রাই যেন এবার খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো। ভাইয়ার একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,

~ বিয়াই সাপ আপনাকে দেখার পরে তো আরো বেশি বিন্দাস আছি আমি। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটি কথা বলতে পারি, ঠিক কথা নয় একটি রিকোয়েস্ট করতে পারি?
রাইয়ের কথা শুনে ভাইয়া যেনো এবার বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। ভাইয়া মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ কি রিকোয়েস্ট?

ভাইয়ার উত্তরের অপেক্ষায় যেন এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল রাই। রাই হুট করে বলে উঠল,

~ সেটা এখন বলব না কলেজ টাইম শেষে দেখা করবেন তখন বলবো। আপনার সাথে একটু কথা আছে এখন বলা যাবেনা। আচ্ছা এখন আপনি যান আমি ভাবীকে নিয়ে যাচ্ছি।
যাওয়ার কথা শুনে যেন ভাইয়া হাপ ছেড়ে বাঁচল। দ্রুত গেট দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলো। আমাকে একবার বললও না। ভাইয়া এভাবে চলে যাওয়া দেখে হিহি করে হেসে দিল রাই। আমি রাই এর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রাই হাসি থামিয়ে বলে উঠলো,

~ আচ্ছা ভাবী তোমার ভাইটা এত আনরোমান্টিক কেন? মনের মাঝে কোন ফিলিংস নেই? এত সুন্দরী একটা বিয়াইনসাব সামনে রয়েছে, তার সাথে কোথায় একটু ইয়ার্কি ঠাট্টা করবে! তা নয় উনি মুখ গোমরা করে যেন পালিয়ে বাঁচলো। তোমার ভাইয়াকে না দেখলে জানতামই না কোনো মানুষ এমন গোমরা মুখোও হয়।

রাই এর দিকে রাগি চোখে তাকালাম আমি। আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে রাই নিচের দিকে চোখ নামিয়ে নিল। আমি তখন হেসে দিয়ে বলে উঠলাম,
~ চিন্তা করো না, তোমার মত রোমান্টিক একটি বিয়ানসাব যখন পেয়েছে আমার ভাইয়া। তখন দেখবে সেও একদিন রোমান্টিক হয়ে যাবে। এখন চলো কলেজে যাওয়া যাক।

কথাটি বলেই রাইকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে নিয়ে কলেজের মধ্যে প্রবেশ করলাম আমরা। কলেজের মাঝে আসার সাথে সাথে চোখটা শীতল হয়ে এল আমার। অসম্ভব সুন্দর একটি কলেজ এটা। কলেজের সামনে বিশাল বড় মাঠ, আর মাঠের মাঝে রয়েছে বিশাল বড় বড় অনেকগুলো গাছ। সেই গাছের নিচে অনেকখানি করে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। কলেজের একপাশে নানা রকম রং-বেরংয়ের ফুলের বাগানের মত অনেক ফুল গাছ লাগানো। অসম্ভব সুন্দর কলেজটি। মাঠের বড় গাছগুলোর বাঁধানো জায়গা গুলোতে বসে আছে অনেক ছাত্র-ছাত্রী।

সবাই নিজেদের মাঝে কথাপোকথনে ব্যস্ত। আমাদের দুজনকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু আমি একটা জিনিস বেশ ভালো করে লক্ষ্য করলাম, কলেজে যেসব ছেলেরা আমাদের আশেপাশে দিয়েই বসে ছিল, তারা আমাকে কলেজে আসতে দেখে সবাই কেমন দূরে সরে যাচ্ছে। এমনকি একনজর তাকিয়ে সবাই মাথা নিচের দিকে করে ফেলছে। আমি এদের এমন আচরণের কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। মনের মাঝে অনেকগুলো প্রশ্নের সৃষ্টি হল। “আচ্ছা আমাকে কি খুব খারাপ দেখতে নাকি? আমাকে দেখে কি ওরা ভয় পাচ্ছে? এভাবে চোখ সরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করছে কেন সবাই? “

কথাটাকে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম আমি। হয়তো আজ প্রথম কলেজে এসেছি বলে অপরিচিত মেয়ে দেখে কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না। এটাই নিজের মনকে বোঝালাম আমি। তারপরে আর চিন্তাভাবনা না করে রাই কে সাথে নিয়ে ক্লাসের দিকে রওনা হলাম।


পর্ব ৯

বেলকুনিতে রকিং চেয়ারের ওপর রাহির একটি ছবি নিয়ে বসে আছে রাজ। ছবিতে থাকা রাহি অনেক মিষ্টি করে হাসি মুখে রয়েছে। রাহির এই হাসিটা যেন রাজের বুকটা ক্ষতবিক্ষত করতে যথেষ্ট। রাজ যে তার এই হাসিতেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে পারবে সারাটি জীবন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকার পর রাজ আনমনেই বলে উঠলো,

~ জানি না রাহি কি আছে তোমার মাঝে? আমি কেনই বা এতটা পাগলের মত ভালবাসতে শুরু করলাম তোমায়? যে রাজ কখনো কোন মেয়ের নাম অব্দি সহ্য করতে পারত না, কোনো মেয়েকে দেখলে রাগে ফায়ার হয়ে যেত, আশেপাশে কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারত না। আজকে সেই রাজ দেখো তোমার প্রতি মুগ্ধ হয়ে যেন এক পলকের জন্য তোমাকে আড়াল হতে দিতে ইচ্ছে করে না। আমার শুধু মনে হয় তোমাকে আমার চোখের আড়াল করলেই হয়তো তোমায় হারিয়ে ফেলবো আমি। জানিনা এতটা পাগল তুমি আমায় কি করে করে ফেললে!

তবে এই পাগলামির ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে।
কথাগুলো আনমনে বলে একটি হাসি দিল রাজ। তারপর রাহির ছবিতে ছোট্ট করে একটি চুমু এঁকে দিয়ে রকিং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে উঠে নিজে ড্রাইভ করে একটি শপিংমলে পৌঁছাল রাজ। তারপর সেখান থেকে কিছু একটা কিনে নিয়ে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো কলেজের উদ্যেশে।

কলেজ টাইম শেষের সময় হয়ে যাওয়ায় কলেজের সামনে রাকিব এসে দাঁড়িয়ে আছে রাহিকে নিয়ে যাবে বলে। হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠল, ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো সে। ওই পাশ থেকে কেউ একজন কিছু বলে উঠলে মুচকি হাসল রাকিব। তারপর ফোনটা কেটে পকেটে রেখে বাসার দিকে হাঁটা দিল। বাসাতে চলে যাওয়ার জন্য। তখন ই পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
~ এই যে মিষ্টার বিয়াই সাব কই পালান আপনি?

রাইয়ের কথা শুনে অনেকটা বিরক্তি নিয়েই ফিরে তাকাল রাকিব। তারপর পিছন দিকে তাকিয়ে দেখল রাই এবং রাহি একসাথে হাসতে হাসতে কলেজ থেকে বের হচ্ছে। আর রাকিব ফিরে তাকাতেই রাই ওকে চোখ টিপ মেরে দিল। এটা দেখে রাকিব কাশতে শুরু করলো। রাকিব এর এমন অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে শেষ রাই। কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে রাহি কিছুই বুঝতে পারছেনা। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে রাকিবের দিকে এগিয়ে দিল রাই। তারপর হাসতে হাসতে বলে উঠলো,

~ কি ব্যাপার বিয়াই সাব কি এমন দেখলেন, যে এভাবে কাশি উঠে গেল আপনার? আর আপনি এতো ভীতু কেন বলুন তো? আপনি এখন কোথায় পালাচ্ছিলেন? আপনি কি ভুলে গেছেন আপনাকে আমি সকালে কি বলেছিলাম?

একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করে থামলো রাই। ওর প্রশ্নে যেন এবার প্রান যায় যায় অবস্থা হল রাকিবের। ওদের দুজনের অবস্থা দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো রাহি। তারপর ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবারো রাই বলে উঠলো,

~ ভাবি তুমি একা একাই একটু বাসায় চলে যাও। আমার বিয়াই সাব এর সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে। যদি কিছু না মনে করো তাহলে আমি বিয়াই সাবকে সাথে নিয়ে একটু কফি খেতে যেতে পারি!
রাই এর কথায় রাকিব কিছু বলবে তার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো রাহি,

~ ঠিক আছে রাই আমার কোন আপত্তি নেই। তুমি ভাইয়াকে নিয়ে যেতে পারো। আমি একাই বাসায় চলে যেতে পারব। তোমরা যাও আমি বাসায় যাচ্ছি।

কথাটি বলতেই কাউকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রাকিবের হাত ধরে একপ্রকার দৌড়ে সেখান থেকে নিয়ে গেল রাই। বেচারা রাকিব অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে এক প্রকার জোর করে রাই এর পিছু পিছু যেতে লাগল। বেশ কিছুটা দূরে যেতেই রাকিবের হাত ছেড়ে বলে উঠলো রাই,

~ এই যে মিষ্টার আপনার কি আক্কেল বলতে কিছু নাই? আমি আপনাকে নিয়ে ওখান থেকে কেন কেটে পরলাম বুঝতে পারছেন না? ভাইয়া কি আপনাকে ফোন করে কিছু বলেনি? আর আপনি সেখানে হাবলার মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেনো? কোথায় নিজেই বলবেন যে আমি আপনাকে সকালে কেন আমার সাথে যেতে বললাম, তা না উল্টো আমাকে এসব বলে নিয়ে আসতে হলো আপনাকে। বলি মেয়েদেরকে দেখে আপনি এত ভয় পান কেন হুহহ? মেয়েরা কি বাঘ না ভাল্লুক যে আপনাকে গিলে খাবে?

রাগী গলায় একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে থামল রাই। ওর কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো রাকিব। তারপর মাথা নিচু করে বলল,

~ ইয়ে মানে আসলে আমি মেয়েদের সাথে তেমন একটা কথা বলি না। তাদেরকে এড়িয়ে চলতে ভালোবাসি, তাই আরকি। আপনি কিছু মনে করবেন না। সরি,
~ It’s ok no problem, কিন্তু একটা কথা বলেন তো! মেয়েরা আপনার এমন কি ক্ষতি করেছে যে আপনি মেয়েদের এড়িয়ে চলেন? নাকি কেউ ছ্যাঁকা ট্যাকা দিয়ে পালিয়ে গেছে আপনাকে, কোনটা?

~ আমরা কি রাস্তায় দাঁড়িয়েই গল্প করবো! নাকি কফি খেতেও যাবো বিয়াইন সাব?
হঠাৎ রাকিবের এমন করে বিয়াইন সাব ডাক শুনে যেন বুকটা কেঁপে ওঠলো রাইয়ের। ও আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে বলল,
~ সরি,

ওকে সরি বলতে দেখে এবার মুচকি হাসল রাকিব। তারপর দুজনে একসাথে কফি শপের দিকে রওনা হলো।

ভাইয়া আর রাই চলে যাওয়ার পর সেই তখন থেকে কলেজের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছি আমি। একটা রিক্সার জন্য। কিন্তু কোন রিক্সার চিহ্নটুকুও নেই আশেপাশে। অসম্ভব বিরক্ত লাগছে আমার। কেন জানিনা কলেজের মাঝের সব ছেলেগুলো আমার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ আমার দিকে ভুল করেও তাকাচ্ছে না। বুঝতে পারছি না সবাই আমাকে এত এড়িয়ে যাচ্ছে কেন? কিন্তু এখন সে দিকে খেয়াল করার মতো কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমাকে এখন যে করেই হোক রিক্সা নিয়ে বাসায় পৌঁছাতে হবে।

এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখলাম কালো রঙের একটি বিশাল গাড়ি এগিয়ে আসছে আমার দিকে। গাড়িটা দেখে কেন যেন ভয় হতে লাগল আমার। এমন এক অচেনা ফাঁকা রাস্তায় আমি একা একটা মেয়ে আমার ভয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়ে পিছু সরে দাঁড়ালাম আমি। তখনই আশ্চর্য জনক ভাবে গাড়িটা এসে ঠিক আমার সামনে দাঁড়ালো। গাড়িটাকে সামনে দাঁড়াতে দেখে যেন এবার আরো বেশি বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে গেল আমার। তখনই গাড়ির জানালার কাঁচটা নিচে নেমে গেল। আর এর মধ্য থেকে একটি চেনা হাস্যজ্জল মুখ আমার দিকে তাকিয়ে নিজের চোখের চশমা খুলে ফেলল।

আমি তাকে দেখে আঁতকে উঠলাম। যেন বুকের মাঝে একটি তীর বিদ্ধ হল আমার। জানিনা এটা ভাললাগার তীর নাকি ভয়ের? তার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করলাম আমি। ইতিমধ্যে সে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বুকের সাথে দুই হাত বেঁধে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অসম্ভব সুন্দর দেখতে লাগছে তাকে। তাকে দেখে যেন চোখ ফেরাতে পারছিনা আমি। এর আগে হয়তো এভাবে কখনো তাকে লক্ষ্য করিনি। তাই বুঝতে পারিনি সে কতটা কিউট।

রাজ সাদা শার্ট এর ওপর কালো রঙের কোট ও প্যান্ট পড়েছে। সাথে চোখে সানগ্লাস, হাতে দামী ঘড়ি, চুলগুলো জেল দিয়ে স্টাইল করা। পায়ে দামী শু সাথে মুখে বাকা হাসি আর মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে যেনো একদম কিলার লুক ওনার।

আমাকে এভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বলে উঠলো,
~ হয়েছে?
আমি ওনার কথায় অবাক হয়ে মাথা নিচের দিকে দিয়ে বললাম,
~ কি?

তখন উনি হেসে দিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে হালকা আমার দিকে ঝুঁকে বলে উঠলেন,
~ আমাকে দেখা হয়েছে? মন ভরে দেখেছ, নাকি আরো দেখতে চাও?

ওনার কথা শুনে অসম্ভব লজ্জা পেয়ে গেলাম আমি। লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছা করছে আমার। আমাকে লজ্জা পেতে দেখে উনি নিজের বুকের বা পাশে হাত ঘষতে ঘষতে বলে উঠলেন,
~ ইশশ আমাকে কি মেরে ফেলার প্যান করেছো নাকি রাহি বেবি? এমন লজ্জা মাখা লুক দেখিয়ে আমার এইখানটায় ঘায়েল করো না প্লিজ। আমি এমনিতেই তোমার প্রেমে আর্ধেক মরে আছি। এমন করলে তো পুরোটাই মরে যাবো।

ওনার কথায় যেন লজ্জায় এবার মরে যাওয়ার মত অবস্থা আমার। আমি এখন কি বলব বা কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা। তাই দ্রুত ওনাকে পাশ কাটিয়ে অন্য দিকে যেতে যেতে বলে উঠলাম,
~ আমি বাসায় যাব অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আম্মু আমার জন্যে টেনশন করবেন।

কথাটি বলেই সামনের দিকে রওনা হলাম আমি। তখনই উনি ছুটে এসে আমার হাত ধরে আমাকে এক টানে নিজের কাছে নিয়ে বলে উঠলেন,
~ কেউ টেনশন করবে না। সবাই জানে তুমি এখন তোমার বরের সাথে আছো। আমি ফোন করে বলে দিয়েছি সবাইকে।

উনার কথার উত্তরে আমি কিছু বলবো তার আগেই উনি আমাকে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই কোলে তুলে নিলেন। এমন আকস্মিকভাবে কোলে তুলে নেওয়ায় অনেকটাই ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেলাম আমি। তাই খিঁচে চোখ বন্ধ করে নিয়ে ওনার গলা জরিয়ে ধরলাম। উনি আমায় কোলে নিয়ে মুচকি হেসে আমাকে নিয়ে সোজা গাড়িতে বসিয়ে দিলেন। তারপর তিনি পাশের সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

~ ভয় নেই আমি তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছি না। আমি কিন্তু তোমারি বর মনে রেখো রাহি বেবি।


পর্ব ১০

~ আচ্ছা আপনি মেয়েদের দেখে এতটা অসস্তি ফিল করেন কেনো বলুন তো? আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই দেখছি, আপনি সব সময় মেয়েদের এড়িয়ে চলেন। সবার কথা বাদ দিলাম আমি তো আপনার এক মাত্র বিয়ান সাব তাই না? আমার সাথে অন্তত একটু দুষ্টুমিষ্টি কথা বলতে পারেন, তা নয় আমাকেও এভাবে এড়িয়ে চলতে হয়?
কফির মগে চুমুক দিতে দিতে কথাগুলো বলে উঠলো রাই। ওর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাকিব মুচকি হেসে বলে উঠলো,

~ আসলে তেমন কিছুই নয়! আমি আসলে মেয়েদের সাথে একটু কম কথা বলি ছোট বেলা থেকে। সে কারণেই এ ভাবে এড়িয়ে চলি সবাইকে।
রাই নিজের চেয়ার টা আরেকটু রাকিব এর কাছে এগিয়ে এসে বসে, ওর দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে বলল,

~ You know what মিষ্টার বিয়াই সাব। আমি মুখ দেখে সকলের মনের কথা বলে দিতে পারি। আর এখন আমি 100 পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যে আপনি আমার কাছে মিথ্যে বলছেন। মেয়েদের এড়িয়ে চলার ব্যাপারে অবশ্যই কোন না কোন কারন আছে আপনার মাঝে। যেটা আপনি এখন আমাকে বলতে চাইছেন না। বাট আমার নামও রাইশা, আমি আসল কথা না শুনে আপনাকে আজ ছাড়ছি না।

রাই এর কথা শুনে শুখনো ঢোক গিললো রাকিব। তারপর মনে মনে বলল,

~ এটা মেয়ে নাকি অন্যকিছু? আমার মুখ দেখে কি করে মনের কথা বুঝে ফেলল? এখন এর কাছে আমি সত্যি কথাটা লুকোবো কি করে? মনে মনে
কথাটা ভেবেই নিজের মাথা চুলকাতে লাগলো রাকিব। ওকে নিজের মাথা চুলকাতে দেখে রাই এবার হাসতে হাসতে বলে উঠলো,

~ এত ভাবতে হবে না বিয়াই সাব। আমি আপনার সাথে মজা করছিলাম। বলতে না চাইলে সমস্যা নাই। তবে একদিন না একদিন ঠিক আপনার কাছ থেকে আমি এটার রহস্য জেনেই ছাড়বো। আর এটা আপনার কাছে এই রাই এর চ্যালেঞ্জ। বাই দ্যা ওয়ে কফিটা কিন্তু অনেক সুন্দর খেতে ছিল ঠিক আপনার মতো।

রাই এর মুখের শেষ কথাটা শুনতে ই কাশি উঠে যায় রাকিব এর। রাকিব কাশতে কাশতে যেন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে যায়। তখন ই রাই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে রাকিবের মাথায় হালকা থাপ্পর দিতে দিতে ফু দিতে থাকে। একসময় রাকিবের কাশি থেমে গেলে রাই অস্থির হয়ে বলে ওঠে,
~ আর ইউ ওকে রাকিব?

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে রাই এর কথায় সায় দেয়। রাই নিশ্চিত হয়ে নিজের চেয়ার টেনে বসে পড়ে। তারপর রাকিবের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলে,
~ আই এম সো সরি রাকিব। আমি বুঝতে পারিনি আপনার সাথে মজা করলে আপনার এমন অবস্থা হবে। প্লিজ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি আর কখনো আপনার সাথে এভাবে মজা করবোনা আম ভেরি সরি।

রাইকে এত অনুতপ্ত হতে দেখে যেন বুকের মাঝে হালকা ব্যথা অনুভব হয় রাকিবের। রাই এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
~ এটস্ ওকে রাই। আমি আপনার কথায় কিছু মনে করিনি। আসলে আচমকা কফিটা মাথায় উঠে যাওয়ায় এমন হয়েছে। প্লিজ ইউ ডোন্ট বি আপসেড।
তারপর এভাবেই দুজনে অনেকক্ষণ একসাথে বসে কফি খেতে খেতে গল্প করে। এখন রাকিব যেন অনেকটাই ফ্রি হয়ে গেছে রাই এর সাথে। রাই ও বেশ ভালই কব্জা করে নিয়েছে রাকিব কে। রাকিব এর মনে হয়তো জায়গাও করে নিতে শুরু করেছে সে।

দীর্ঘ ত্রিশ মিনিট যাবত্ চুপটি করে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছি আমি। আর গাড়ি টাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন রাজ তার কোন কিছুই আমার মাথায় ঢুকছেনা। ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো সে সাহসটাও হয়ে উঠছে না আমার মাঝে। তাই বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে ব্যাস্ত আমি। কিন্তু বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারছি আমরা শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি। এটা হয়তো কোনো একটি গ্রামের দিকে যাচ্ছে। এভাবে অনেকক্ষন বসে থাকার কারণে এবার অনেকটাই ঘুম ধরে যাচ্ছে আমার। তাই গাড়ির সিট এর সাথে হেলান দিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিতে যাচ্ছি আমি। আর তখনই হঠাৎ গাড়িটা ব্রেক কষায় ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। পাশে উনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি আমার পাশে নেই। গাড়িটা একদম ফাঁকা। উনাকে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজবো তার আগেই উনি আমার পাশের গাড়ির দরজার কাছে এসে গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

~ নেমে এসো রাহি বেবি। আমরা চলে এসেছি।

আমি একবার ওনার হাতের দিকে একবার ওনার মুখের দিকে এভাবে বেশ কয়েকবার তাকালাম। তারপর উনাকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি থেকে নিচে নেমে গেলাম। উনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে ছিলেন আমি উনার হাত না ধরায় হয়তো অনেকটাই কষ্ট পেলেন উনি। তাই মুখটাকে হাল্কা গম্ভীর বানিয়ে নিচের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর আবারও মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন,

~ আমার সাথে আসো রাহি!

আমি ওনার কথায় কোন উত্তর না দিয়ে উনার পিছু পিছু হাটতে লাগলাম। আমার দৃষ্টি এখন নিচে মাটির দিকে। আশেপাশের কোন কিছুই দেখছি না আমি। বেশ কিছুক্ষণ সামনে হেঁটে যাওয়ার পরেই কানে পানির শব্দ শুনতে পেলাম। তখনই সামনে ফিরে তাকাতেই যেন মনটা ভরে গেল আমার। সামনে বিশাল বড় এক নদী। আর নদীর কিনারায় অসংখ্য কাশফুল গাছ। সাদা সাদা কাশফুল যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। অসম্ভব সুন্দর একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য। আমার জীবনে হয়তো এত সুন্দর দৃশ্য এত কাছ থেকে আমি কখনও দেখিনি।

এ যেনো এক স্বপ্নপুরী। নিজেকে যেনো আজ প্রকৃতির সুন্দর্য্যে ডানামেলে উড়ে যাওয়া এক পাখি মনে হচ্ছে। আমি আশেপাশের সব কিছু ভুলে গিয়ে নদীর কিনারে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ধরে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলাম। প্রতিটি কাশফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম। আমার হাতের ছোঁয়ায় আর এলোমেলো বাতাসে কত সুন্দর করে প্রতিটি কাশফুল থেকে ছোট ছোট কাশফুলের কনা উড়ে যাচ্ছে চারিদিকে। ইচ্ছে করছে আমি ওদের সাথে ভেসে ভেসে উড়ে যাই আকাশ নীলে। এতটা আনন্দ হয়তো জীবনে কখনো পাইনি আমি। আমি পাগলের মত এদিক থেকে ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলাম।

আর প্রকৃতির এই সুন্দর্যকে নিজের মনের মাঝে আকরে ধরতে লাগলাম।

এভাবে অনেক্ষণ ছোটাছুটি করার পর অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে গেলাম আমি। তখন ধপ করে নিচে ঘাসের উপর বসে পড়লাম আমি। এখানে আমি কার সাথে এসেছি সে কোথায় এগুলো কোন কিছুই যেন খেয়াল নেই আমার। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে ফিরে তাকালাম আমি। আর তাকাতেই দেখলাম রাজ আমার পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে একটা ব্যাগ রয়েছে। আমি ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার অন্য দিকে দৃষ্টি রাখলাম। নদীতে প্রতিটা শ্রোত খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম আমি। আমি তো এই প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেছি পাশে থাকা লোকটির দিকে যে আমার একদমই খেয়াল নেই। তখন ই সে আমার পাশে বসে পড়ে ব্যাগটি খুলে তার মাঝে থেকে খাবার বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

~ খাবারটা খেয়ে নাও রাহি। তুমি সেই সকাল বেলা বাসা থেকে খাবার খেয়ে বের হয়েছ। এখন অনেক বেলা হয়ে গেছে, সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি তোমার। খাবারটা খেয়ে নাও তারপর প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য দেখাবো আমি তোমায়।

ওনার কথায় আমি কোন উত্তর দিলাম না। খাবারের প্যাকেট এর দিকে একবার তাকাতেই যেন পেটের মাঝে ইঁদুর দৌড়াতে লাগল আমার। সত্যিই অসম্ভব ক্ষুদা লেগেছে আমার। আমি ক্ষুধা একদমই সহ্য করতে পারিনা। তাই ওনার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ওনার হাত থেকে ছো মেরে খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে নিলাম। তারপর পাশে থাকা ওয়াটার বোতল থেকে পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিয়ে খাবার খাওয়া শুরু করলাম।

যতক্ষণ সময় নিয়ে আমি খাবার খেয়েছি ততক্ষণ একনজরে উনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমারও বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে ওনার সাথে। কিন্তু আমি একটি বারের জন্য ওনাকে জিজ্ঞেস করিনি উনি খেয়েছেন কিনা? বা কখন খাবেন? জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও বোধ করছিনা আমি। ওনার সাথে আমার বিয়ে হলেও আমি এখন অব্দি ওনাকে মন থেকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারিনি। উনার প্রতি কোন আলাদা ফিলিংসও জন্ম নেয়নি আমার মনে। বরং ওনার দিকে তাকালেই সব সময় একটি ঘৃণ্য কাজ করে আমার মনের ভেতর।

যেটা আমি প্রকাশ না করতে পারলেও মনের মাঝে ঠিকি উকি দিয়ে যায়। উনি আমার সাথে যেটা করেছেন সেটা হয়তো অন্য কোন মেয়েই মেনে নিতে পারবে না। উনি শুধু আমার বিয়েটা ভেঙে দেয় নি বরং সকলের চোখে আমাকে একটি চরিত্রহীন মেয়ে বানিয়ে দিয়েছেন। এমনকি আমার হাত কেটে নিজের নাম লিখে সেটাও আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন উনি। আমি কি করে ভুলব সে কথা? নিজের হাতের দিকে তাকালে যে সেই সব স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার। আমি ওনাকে কখনোই মেনে নিতে পারব না কখনোই না।

কথাগুলো মনে মনে ভাবতে ভাবতে খাবার খাচ্ছিলাম আমি। হঠাৎ খাবার গলায় আটকে গিয়ে অসম্ভব ভাবে কাশি শুরু হয়ে গেল আমার। কাশতে কাশতে যেন চোখ নাক মুখ সব লাল হয়ে যেতে লাগলো। আমাকে এভাবে কাশতে দেখে অনেক টাই ঘাবড়ে গেলেন রাজ। উনি উত্তেজিত হয়ে বোতলের মুখা খুলে আমার মুখে পানির ধরলেন। আমি বেশ কয়েক ঢোক পানি খেয়ে অনেকটাই শান্ত হয়ে গেলাম। শান্ত হয়ে ওনার দিকে তাকাতেই দেখতে পারলাম ওনার চোখে পানি টলমল করছে। আমাকে তাকাতে দেখে উনি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,
~ তুমি ঠিক আছো রাহি? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো আমায়?

আমি এবারও ওনার কথার কোন উত্তর দিলাম না। খাবারের খালি প্লেট টা ওনার সামনে রেখে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর হেঁটে হেঁটে কাশ ফুলের কাছে চলে গেলাম। উনি বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলেন।

বেশ কিছুক্ষণ কাশফুলের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর পর উনার ডাকে পিছু ফিরে তাকালাম আমি। তাকিয়ে দেখতে পেলাম একটি ডিঙ্গি নৌকার উপরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে সেদিকে ডাকছেন। নৌকায় চড়ার শখ আমার অনেক ছোট থেকেই। কিন্তু সাঁতার জানিনা বলে আব্বু কখনোই আমাকে নৌকায় চড়তে দেয়নি।

তাই নৌকা দেখতেই যেন খুশিতে মনটা গদগদ হয়ে গেল আমার। আমি দ্রুত দৌড়াতে দৌড়াতে নৌকার পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলাম। উনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় আমাকে ওনার হাত ধরে নৌকায় উঠতে বললেন। আমি এবার স্বইচ্ছায় নিজের হাতটা ওনার হাতে রেখে ওনার হাত ধরে নৌকায় উঠে পড়লাম। তারপর আমি নৌকার এক প্রান্তে আর উনি আরেক প্রান্তে বসে নৌকা চালাতে শুরু করলেন। নৌকায় আমরা দুজন ছাড়া বাড়তি কোনো মানুষ নেই। উনি নৌকা চালানোর জন্য বৈঠা নিয়ে প্রস্তুতি হলেন।


পর্ব ১১

প্রায় একঘন্টা হলো নদীর বুকে ভেসে চলেছি আমরা দুজন। নৌকার ওপর থেকে একবার পানিতে হাত বুলাচ্ছি তো একবার খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে খলখলিয়ে হাসছি আমি। অসম্ভব ভালো লাগছে এই সময়টা আমার। এমন একটি মুহুর্ত পেতে যেন সবসময় স্বপ্ন দেখতাম আমি। আজ যে সেই স্বপ্নটা এভাবে পূরণ হয়ে যাবে কখনো ভাবতে পারিনি। পৃথিবীর সবকিছু যেন ভুলে গিয়ে শুধু এই মুহূর্তটার আনন্দ ভোগ করতে মেতে উঠেছি আমি। আনন্দের মুহূর্তের মাঝেও বেশ কয়েকবার রাজের সাথে চোখাচোখি হয়েছে আমার।

আর যতবারই আমি ওর দিকে তাকিয়েছি ততবারই দেখেছি উনি এক নজরে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু সেই তাকানো টাকে অনুভব করার মত অনুভুতি টা এখন আমার মাঝে নেই। কারণ আমি এখন প্রকৃতির প্রেমে মুগ্ধ হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি। কিন্তু এতোটুকু বুঝতে পারছি যে উনি আমার দিকে দেখছে প্রকৃতিকে নয়। কিন্তু আমিতো তাকে এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারিনি! হয়তো কখনো মানতে পারব কিনা তাও সন্দেহ। তবে আজকের দিনের এই উপহারটা আমার সারা জীবন মনে গেঁথে থাকবে। সত্যি উনি আমাকে অনেক খুশি উপহার দিলেন আজ। মন দিয়ে চারিদিকে দেখছি আর এসব কথা মনে মনে ভাবছি আমি। হঠাৎ উনার ডাকে ধ্যান ভাঙলো আমার,

~ অনেক হয়েছে রাহি বেবি, এবার আমাদের তীরে ফিরতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, অন্ধকার হলে নদীর বুকে থাকা ঠিক নয়।
ওনার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। আমি ঠোঁট উল্টে বলে উঠলাম,

~ আরেকটু থাকি না প্লিজ! আমি এমন মুহূর্তের অনেক স্বপ্ন দেখেছি। আর আজ যখন এমন একটা মুহূর্ত পেয়েছি আর যেতে ইচ্ছা করছে না। প্লিজ আমাকে আর একটু থাকতে দিন আমি আর আরেকটু কাছ থেকে অনুভব করতে চাই এই সময়টাকে।

~ আমি তোমাকে আবার নিয়ে আসবো রাহি বেবি। আই প্রমিস ইউ। কিন্তু এখন আর এখানে থাকা ঠিক হবে না চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। আর তাছাড়া রাতের অন্ধকারে এই জায়গাটা মোটেও ভালো না। তাই আমাদের এখনই ফিরতে হবে। আমি তোমাকে আবার এখানে নিয়ে আসব। এখন চলো তীরে ফেরা যাক।

কথাগুলো বলে আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উনি বৈঠা চালিয়ে তীরের দিকে যেতে লাগলেন। আমি আর কোন কিছু না বলে মুখ গোমরা করে চুপ করে নৌকার একপাশে বসে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পরেই নৌকাটা এসে নদীর কিনারায় থেমে গেল। উনি নৌকা থেকে নেমে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন আমাকে ওনার হাত ধরে নামার জন্য। কিন্তু আমি ওনার হাত না ধরে উনাকে পাশ কাটিয়ে নিজে নিজেই নেমে সোজা গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে মৃদু হাসলেন। তারপর এসে আমার পাশের সিটে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটি শ্বাস নিয়ে বললেন,

~ মাই রাহি বেবি, তুমি কি জানো রাগলে তোমাকে কতটা সুন্দর এবং আকর্ষণীয় লাগে? ইচ্ছে করে বারবার তোমাকে রাগিয়ে দেই। আচ্ছা তোমাকে রাগাতে হলে আর কি কি করতে হবে বলতো?
ওনার কথায় অসম্ভব বিরক্ত হলাম আমি। কত বড় ফাজিল একটা লোক। আবার বলে কিনা রাগলে আমাকে সুন্দর লাগে, আর কিভাবে রাগানো যায়? ইচ্ছে তো করছে উনার গলা টিপে এখানেই মেরে ফেলি। কিন্তু সেটাও তো পারব না। কেন জানিনা আমি কখনোই নিজের রাগগুলোকে কাউকে দেখাতে পারি না। ধুর কিছু ভালো লাগে না।

মনে মনে কথাগুলো ভেবে বাইরে জানালার দিকে ফিরে তাকালাম আমি। উনিও আর কিছু না বলে একটি মুচকি হাসি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। তারপর গাড়ি চলতে থাকল আপন গতিতে।

একটি রিক্সায় চড়ে রাই এবং রাকিব একসাথে বাসায় ফেরার জন্য রওনা হয়েছে। যদিও রাকিব প্রথমে রাই এর সাথে আসার জন্য একদমই রাজী ছিল না। কিন্তু রাই এর জোড়াজড়িতে শেষে বাধ্য হয়েই ওর সাথে এক রিক্সায় বসতে হয়েছে তার। রাই বলেছে রাস্তার মোড়ে দুজন আবার আলাদা রিক্সায় উঠে চলে যাবে আর সে কারণেই এক রিক্সায় উঠতে রাজি হয়েছে রাকিব। কিন্তু রিক্সায় ওঠার পর থেকেই একদম চুপচাপ বসে রয়েছে মুখে তার কোনো রকমের কথা নেই। এটার জন্য অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছে রাই।

সে একা একা অনেক বকবক করলেও বিপরীতে কোনো উত্তর ই পাচ্ছে না সে রাকিবের কাছ থেকে। এতটা গম্ভিরও যে কোন মানুষ হতে পারে এটা জানা ছিল না রাই এর। কিন্তু কে জানত যে এই রকম একটি গম্ভির লোকের ওপর ই এভাবে ফিদা হয়ে যাবে সে? আর তাকেই মনে মনে ভালোবেসে ফেলবে? হয়তো সেটা প্রকাশ করতে পারছে না রাই, তবে সে বুঝতে পারছে যে তার আচার-আচরণ চালচলনে বেশ অনেকটাই বুঝে গেছে রাকিব যে, সে তাকে পছন্দ করে। বেশ অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর এবার বেশ কিছুটা রেগে বলে উঠলো রাই,

~ আচ্ছা আপনার সমস্যাটা কি বলুন তো? আমি সেই কখন থেকে একের পর এক বকবক করেই যাচ্ছি। আর আপনি কোন রকম কথা বলছেন না! বলি এতো গম্ভীর হয়ে থাকতে কেমন লাগে আপনার? মুখে কি একটুও ব্যথা করে না?

রাই এর দিকে এমন করে তাকাল রাকিব যেন রাই এমন কিছু বলেছে জে তার কল্পনার বাইরে ছিল। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে এবার রাগটা যেন মাথায় চড়ে বসলো রাইয়ের। রাই খপ করে রাকিবের হাতটা ধরে ফেলে বলল,

~ এই যে মিস্টার আপনি যে পর্যন্ত আমার সাথে ভালোভাবে কথা না বলবেন সে পর্যন্ত আপনাকে এই রিকশা থেকে নামতে দিচ্ছি না আমি। দরকার হলে আপনাকে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে যাব। অবশ্য সেখানে আপনার সমস্যা হবে না। কারন সেটা তো আপনার বোন জামাইয়ের ই বাড়ি তাই না?

~ ছিঃ রাই কি হচ্ছে কি? আপনি আমার হাত ধরছেন কেন এভাবে? আশেপাশের লোক দেখলে কি ভাববে বলুনতো? আমার হাত ছাড়ুন। আমি এজন্য আপনার সাথে এক রিক্সায় উঠতে চাইনি আপনি একটু বেশি কথা বলেন।

রাকিবের এমন কথায় যেন রাগ এর চাইতে বেশি অভিমান দেখা দিলো এবার রাই এর মাঝে। রাই কোন কথা না বলে আস্তে করে রাকিবের হাতটা ছেড়ে দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে বলল,
~ মামা রিক্সা থামান আমি এখানেই নেমে যাব!

কথাটি বলে রিক্সা থামতেই রিক্সা থেকে নেমে পরল রাই। রাই কে বেশ কয়েকবার পিছু ডাকলো রাকিব। কেন রিক্সা থেকে নেমে পড়ল সেটা জানার জন্য। কিন্তু একবারের জন্যও ওর দিকে ফিরে তাকাল না রাই। রাকিব রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে রিক্সা থেকে নামার আগেই রাই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ও অনেক খুঁজেও আর রাই এর দেখা পেলো না। শেষে একটি ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের বাসার দিকে রওনা হলো রাকিব।

গ্রাম পেরিয়ে শহরের দিকে ঢুকতেই রাজ খেয়াল করলো রাহি বিভোরে ঘুমিয়ে আছে গাড়ির মধ্যে। রাজ আস্তে করে রাহির মাথাটাকে নিয়ে নিজের ঘাড়ের ওপরে রেখে দিল। তারপর গাড়িটিকে রাস্তার এক সাইডে ব্রেক করে ফিরে তাকাল রাহির ঘুমন্ত মুখটার দিকে। ওকে ঘুমন্ত অবস্থায় যেন অনেক বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। রাজ এক নজরে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর রাহিকে ঠিকঠাক করে বসিয়ে দিয়ে নিজের ঘাড়ের উপরে ওর মাথাটা নিয়ে আবার গাড়ি চালাতে শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেল নিজের বাসায়। রাজ খুব সাবধানে রাহির মাথাটা আস্তে করে গাড়ির সিটের সাথে হেলান দিয়ে রেখে গাড়ি থেকে নেমে অন্য পাশে এসে রাহিকে কোলে তুলে নিল। তারপর তাকে নিয়ে সোজা চলে গেলো নিজের বেডরুমে।

খুব যত্ন সহকারে রাহিকে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর জুতা খুলে দিয়ে শরীরের ওপর চাদর টেনে দিয়ে ব্যালকনিতে চলে এলো রাজ। তারপর রাকিব এর কাছে ফোন করে বলে দিল রাহি কে নিয়ে নিজের বাসায় আসার কথা। তারপর আবারো রুমে ফিরে এসে রাহির সামনে গিয়ে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসলো। রাহির মুখের ওপর পরে থাকা এলোমেলো চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলো রাজ। তারপর মনে মনে বলে উঠলো,

~ তুমি আমাকে কবে বুঝবে রাহি? কবে মেনে নেবে মন থেকে নিজের স্বামী হিসেবে? আর কত অপেক্ষা করতে হবে আমার তোমার কাছে নিজের স্বামীর অধিকার পাবার জন্য? তোমাকে এতটা কাছে পেয়েও নিজের করে না পেয়ে যে বড্ড বেশি কষ্টে আছি আমি। তুমি কি আমার সে কষ্টটা দেখতে পাও না? বুঝতে পারো না আমার অনুভূতিগুলো?

কেন নিজেকে এতো শক্ত করছো রাহি? একবার ভালোবাসার চোখ দিয়ে দেখো তুমিও আমায় ভালবাসতে বাধ্য হবে। আর কতদিন আমাকে এভাবে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে রাহি? তুমি আমাকে কবে নিজের করে কাছে ডাকবে? এমন তো হবে না, যে তুমি আমাকে নিজের কাছে ডাকার আগেই আমি তোমার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাব? তখন কী করবে তুমি রাহি? আমার জন্য কি তোমার একটুও কষ্ট হবে না তখন? কখনো কি ভুল করেও খুঁজবে আমায়? নিজের করে পাওয়ার জন্য। নাকি সারা জীবন এভাবে অবহেলায় হারাবে আমায়? আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি জানি রাহি। কিন্তু সেই কষ্ট দেওয়ার আড়ালেও যে তোমার ভালোর কারণ ছিল। সে কারণটা হয়তো কখনোই তোমাকে জানাতে পারবো না আমি। Please Rahi You love me. you feel my love.

কথাগুলো মনে মনে একনাগাড়ে বলে দু চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো রাজের। রাজ সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। তারপর ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা নিচে নেমে গেল। নিচে নামতেই রাজ দেখলো রাই সোফার ওপর গাল ফুলিয়ে বসে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে অসম্ভব রেগে আছে সে। রাজ ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে একটি আপেল নিয়ে তাতে কামড় দিয়ে খেতে খেতে রাই এর পাশে এসে বসে পরলো। তারপর ওর মাথায় আস্তে টোকা দিয়ে বলে উঠলো,
~ কিরে কি হয়েছে তোর? এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে আছিস কেন?

রাজের প্রশ্নের উত্তরে রাই ওর দিকে ছলছল চোখে তাঁকালো। তারপর কিছু না বলেই কান্না করতে করতে নিজের রুমে চলে গেল। রাইয়ের এমন আচরণ আগে কখনো দেখেনি রাজ। রাই ওর একমাত্র কলিজার টুকরা ছোট বোন। নিজের চাইতেও বেশি ভালবাসে ও রাইকে। ওকে এমন কান্না করে চলে যেতে দেখে এবার অনেকটাই ঘাবড়ে গেলো রাজ। রাই এর পিছু পিছু ও নিজের ছুটতে লাগলো রাই এর রুমের দিকে। কিন্তু তার আগেই দরজা লাগিয়ে দিয়েছে রাই। রাজ গিয়ে দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে রাইয়ের নাম ধরে ডাকতে লাগল। আর দরজা খোলার জন্য বলতে লাগলো। কিন্তু কোনো কিছুতেই দরজা খুলছে না রাই। এবার অনেক টাই রেগে গেল রাজ। রেগে গিয়ে বলে উঠলো,

~ রাই কি হয়েছে তোর? ভালোভাবে বলছি দরজা খোল। আমি কিন্তু দরজা ভেঙ্গে ফেলবো। তুই এভাবে কাঁদছিস কেন? আমাকে না বললে আমি কিভাবে বুঝবো বল? প্লিজ বোন আমার এভাবে আমাকে কষ্ট দিস না। তুই কেন বুঝিস না তোর চোখের অশ্রু জল আমি সহ্য করতে পারিনা। প্লিজ বোন দরজাটা খোল আর বল আমায় তোর কি হয়েছে?

কথাগুলো বলতে বলতে দরজা ধাক্কাতে লাগলো রাজ। রাই এবার রাজের কথা শুনে এসে দরজাটা খুলে দিয়ে সোজা রাজকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগল। রাইয়ের এভাবে কান্না করতে দেখে যেন আরো বেশি ভয় কাজ করতে লাগল রাজের মনে। ও কাঁপা কাঁপা হাতে রাই এর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

~ কি হয়েছে বল আমাকে, কে কি করেছে তোর সাথে? শুধু একবার বলে দেখ তোকে যে কষ্ট দিয়েছে তাকে আমি চিরতরে শেষ করে ফেলব। বল আমার কাছে কি হয়েছে তোর?
রাজের কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগল রাই। এবার যেন সহ্যের সীমা পেরিয়ে যেতে লাগল রাজের। কলিজাটা যেন বেড়িয়ে আসতে চাইল তার। নানা রকম ভয় এবং কিছু অজানা কারণে। তাই ও ধমক দিয়ে বলে উঠলো,

~ রাই কি হয়েছে তোর সত্যি করে বল আমায়? আমার কিন্তু এবার সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে। তুই কেন এভাবে কাঁদছিস আমাকে না বললে আমি কি করে বুঝবো বল? বল আমায় কি হয়েছে তোর? প্লিজ বোন বল?

~ আমি ভাবির বড় ভাই রাকিবকে ভালোবেসে ফেলেছি ভাইয়া। আমি ওকে নিজের জীবন সাথী হিসাবে পেতে চাই।
আপনার পছন্দের গল্প পড়তে পেইজটি তে লাইক দিন এবং কমেন্টে আমাদের গ্রুপের লিংক দেওয়া আছে জয়েন হয়ে যান।


পর্ব ১২

~ আমি ভাবির বড় ভাই রাকিবকে ভালোবেসে ফেলেছি ভাইয়া। আমি ওকে নিজের জীবন সাথী হিসাবে পেতে চাই।
কথাগুলো বলেই আবারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো রাই। ওর কথায় যেনো বড় সড় একটা ধাক্কা খেলো রাজ। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
~ তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে রাই? মাত্র দুদিনের পরিচয়ে কখনো কাউকে ভালবাসা যায় না। এটা তোর আবেগ। আর আবেগ দিয়ে কখনো সারাজীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না রাই। তুই সময় নিয়ে একবার ভেবে দেখ তাহলে বুঝতে পাড়বি!

~ আমি ওকে এক বছর আগে থেকে ভালবাসি ভাইয়া।

রাইয়ের এমন কথায় ওকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে ওর দিকে বড় বড় করে তাকালো রাজ। তারপর সোজা গিয়ে সোফার উপর ধপ করে বসে পড়ে রাই এর দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ মানে?

রাই গুটি গুটি পায়ে রাজের কাছে এগিয়ে এসে ওর পাশে সোফার উপর বসে মাথা নিচু করে বলতে শুরু করল,
~ মানে, আমি ওকে এক বছর আগে থেকে চিনি ভাইয়া। এক বছর আগে সর্ব প্রথম যেদিন ওকে দেখেছিলাম আমি তখনই ওর প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করে আমার মনে। আমার বান্ধবীর বার্থডে পার্টিতে প্রথম দেখেছিলাম আমি ওকে। ও ওর বন্ধুর সাথে এসেছিল। আর ওর বন্ধু ছিল আমার বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড। সেদিন হয়তো রাকিব আমাকে ঠিক করে খেয়াল করেনি কিন্তু আমি ঠিকই পুরো পার্টিতে শুধু ওকেই খেয়াল করেছিলাম। ওর প্রতি ভালোলাগাটা সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণই ছিল মেয়েদেরকে ওর এড়িয়ে চলা।

যদিও আমি জানতাম না ও কেন মেয়েদের কে এড়িয়ে চলে। আর সে ভাবে বলতে গেলে ও মেয়েদের কে ভয় পায়। মেয়েদের থেকে সব সময় দূরত্ব বজায় রেখে চলতো। আমি সেই পার্টিতে দেখেছি আমার অনেক বান্ধবী ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ও সব সময় এড়িয়ে চলেছে সবাইকে। তখন থেকেই ওর প্রতি আমার ভালো লাগার সৃষ্টি হয়। আমি ওর ব্যাপারে সকল খোঁজ-খবর নিতে শুরু করি। ধিরে ধিরে ওর পরিবার সম্পর্কে সব কিছু জেনে যাই আমি। আর জানো ভাইয়া তুমি যখন বললে রাকিবের বোন মানে ভাবি কে তুমি ভালোবাসো! তখন সবচাইতে বেশি খুশি হয়েছিলাম আমি। আর সেই খুশির কারণটাও ছিল রাকিব। কারন ও আমার বিয়াই সাব হচ্ছিলো তখন সম্পর্কে। প্লিজ ভাইয়া তুমি কিছু করো!

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে রাজের দিকে ফিরে তাকাল রাই। তাকিয়ে দেখল রাক চুপচাপ বসে আছে ওর মুখে কোন কথা নেই। বিস্ময় চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে এভাবে থাকতে দেখে এবার রাই কিছুটা ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলো,
~ কি হলো ভাইয়া কিছু বলবে না তুমি?

রাই এর প্রশ্নে ওর দিকে ফিরে তাকাল রাজ। তারপর অট্ট সুরে জোরে হাসতে শুরু করল। ওকে এভাবে হাসতে দেখে রাগ এবং অভিমান দুটোই বাসা বাঁধলো রাই এর মাঝে। রাই চুপ করে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। তারপর হাসতে হাসতে রাজ বলে উঠল,

~ সত্যিই রাই, ইউ আর রিয়েলি মাই সিস্টার। আর তাই তো তুই আমাকেও ছাড়িয়ে গেছিস রে। গত এক বছর হল তুই একটি ছেলেকে ভালবাসিস? আর শুধু ভালবাসিস তাই ই না তার নাম ধাম ঠিকানা পরিবার সম্পর্কে যাবতীয় কিছু খোঁজখবরও নেওয়া শেষ তোর। ও মাই গুডনেস। আমি তো এসব কথা ভেবেই শিহরিত হচ্ছি।
~ ভাইয়া তুমি প্লিজ কিছু একটা করো।

এবার হাসি থামিয়ে বেশ কিছুটা সিরিয়াস মুডে আসলো রাজ। তারপর রাই এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ তুই এতদিন আমায় এই কথা বলিসনি কেন? আর হঠাৎ আজকে ই কেন বলছিস বলতো?

~ অ্যাকচুয়ালি ভাইয়া তোমাকে বলার মত সাহস আমার এতদিন হয়ে উঠেনি। কিন্তু আজকে আর না বলে থাকতে পারলাম না। আমি সত্যিই রাকিবকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি ভাইয়া। কিন্তু রাকিব সবসময় আমাকে এড়িয়ে চলে। যেটা আমি একদমই সহ্য করতে পারছিলাম না আর তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে বলতে হলো। প্লিজ ভাইয়া তুমি কিছু একটা করো। আমি রাকিবকে নিজের জীবন সাথী হিসেবে পেতে চাই।

এতোটুকু বললেই আবারো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলো রাই। রাই কে কান্না করতে দেখে এবার কি বলে ওকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছে না রাজ। কারণ ও ভালো করেই জানে রাই অসম্ভব জেদি এবং রাগী মেয়ে। ও একবার যেটার জেদ ধড়বে সেটা ওর চাই ই চাই। কিন্তু এ কথাটি কে প্রশ্রয় দিলে চলবে না সেটা ভালভাবেই বুঝতে পারছে রাজ। তাই রাজ কিছুটা গম্ভির গলায় বলে উঠলো,

~ রাই এখন কান্না থামিয়ে তুই নিজের ঘরে যা। আমি দেখছি কি করা যায়। আর হ্যাঁ এই ব্যাপারে তোর কাছ থেকে আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না। তোর জন্য যেটা ভালো হবে আমি সেটাই করব। আর একটা কথা বলে দিচ্ছি তোকে, এসব ব্যাপারে জেদ চলে না। ভুলে যাস না তুই কোন ছেলে নয় তুই একটি মেয়ে। এবার যা রুমে যা আমি দেখছি কি করা যায়।

রাজের কথায় আবারও রাই কিছু বলবে তার আগেই ধমক দিয়ে উঠল রাজ। ওর ধমকে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল রাই। রাজ খুব ভাল করেই জানে এই দরজা আর সকাল হওয়ার আগে খুলবে না। সারারাত বসে বসে কান্না করবে ও। কিন্তু রাজের কোন উপায় নেই ওকে বোঝানোর। রাজকে এখন যেভাবেই হোক রাকিবের সাথে কথা বলতে হবে। তবে শিওর নয় রাকিব কি বলবে ওকে। বেশ টেনশন কাজ করতে লাগল রাজের মাঝে। হঠাৎ সিড়ি বেয়ে কারো নিচে নামার শব্দ শুনে সে দিকে ফিরে তাকাল রাজ।

তাকিয়ে দেখল রাহি ঘুম থেকে উঠে গুটি গুটি পায়ে নিচে নেমে আসছে। চোখ মুখ বেশ কিছুটা ফুলা ফুলা লাগছে তার। হয়তো ঘুমের কারণে হালকা ফুলে গেছে। আর এই হালকা ফলে যাওয়াতে যেন আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে মুখটা তার। এক নজরে সব ভুলে রাহির দিকেই তাকিয়ে রইল রাজ। রাহি গুটি গুটি পায়ে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলে উঠলো,
~ আমি বাসায় যাব!

রাজের কাছ থেকে বেশ কিছুক্ষণ পরেও কোন উত্তর না পেয়ে এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলে উঠলো রাহি,
~ আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আমি বাসায় যাব প্লিজ আমায় বাসায় নিয়ে চলুন!
~ হুমম ওকে চলো!

এতো সহজেই রাজ রাজি হয়ে যাওয়ায় যেন বেশ কিছুটা অবাক হল রাহি। কিন্তু সেই অবাকতা টা রাজকে বুঝতে না দিয়ে ওর পিছু পিছু গিয়ে গাড়িতে উঠল। পুরো রাস্তায় আর একটাও কথা বলেনি দুজন। সোজা এসে রাহির বাসার সামনে গাড়ি থামলো রাজ। রাত তখন প্রায় নয়টা বাজতে চললো। বাসায় গিয়ে কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দিল রাকিব।
দরজা খোলার পর রাকিব কিছু বলবে তার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো রাজ,

~ রাহি তুমি ভেতরে যাও। আমার রাকিবের সাথে কিছু কথা আছে!

ওর কথা শুনে ওর দিকে ফিরে তাকাল রাহি। তারপর কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ভাব্বার পরেও কোন কিছু বুঝতে না পেরে সে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। ও চলে যেতেই রাকিব রাজের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

~ আমি হয়তো জানি রাজ তুমি আমায় কি বলতে চাইছ? আর আমিও তোমার কাছে কিছু বলতে চাই। তো চলো দুজন ছাদে গিয়ে বসি!
রাজ যেন ওর থেকে এই কথাটি শোনার ই অপেক্ষা করছিল। তাই কথাটি শুনে মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। তারপর রাকিবের হাত ধরে নিয়ে সোজা ছাদের দিকে এগোলো দুজন। ছাদে উঠে দুটি চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসে পরলো দুজন। তারপর রাজকে কিছু বলতে না বলতে দিয়ে রাকিব বলে উঠল,

~ আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার সাথে রাই এর বিষয়ে কথা বলতে এসেছ তাই না রাজ?

রাকিবের প্রশ্নে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল রাজ। ওর থেকে সায় পেয়ে আবারো বলতে শুরু করলো রাকিব,

~ তাহলে শোনো রাজ, আমিও তোমাকে রাই এর বিষয়েই কিছু বলতে চাই। আমি জানি রাই আমাকে পছন্দ করে। এবং আমি এটাও জানি রাই আমাকে গত এক বছর আগে থেকেই পছন্দ করে। হয়তো সেউ পছন্দ করাটা এখন ভালোবাসার রূপ নিয়েছে। কিন্তু তবুও আমি ওকে এড়িয়ে চলি। এমনটা নয় যে আমি ওকে পছন্দ করি না বা আমার অন্য কোন গার্লফ্রেন্ড আছে। কিন্তু তবুও ওকে এড়িয়ে চলার কিছু কারণ আছে আমার।
~ সেই কারন টা কি রাকিব?

~ আজ থেকে তিন বছর আগের কথা। তখন আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। সেই সময় আমার একমাত্র প্রাণপ্রিয় আমার ভাইয়ের মতো বন্ধু ছিল তন্ময়। তাকে আমি নিজের থেকেও বেশী ভালবাসতাম। সব সময় মনে হতো আমাদের দুটি দেহ কিন্তু একটি প্রাণ। সেই তন্ময় একটি মেয়েকে ভালোবাসতে শুরু করে। মেয়েটির নাম ছিল তন্নী। মেয়েটিও তন্ময় কে পছন্দ করত। দুজনের রিলেশনশিপ খুব ভালো ভাবেই চলছিল। আমি ওদের দেখতাম এবং মনে মনে খুবই ভালো লাগা কাজ করতো আমার। সবসময় ভাবতাম আমার জীবনে ও যদি এরকম কেউ আসতো যাকে আমি ভালোবাসবো। আর সেও আমায় ভালবাসবে! কিন্তু আমার চোখের সামনে ওদের রিলেশনশিপে ফাটল ধরলো।
ওদের রিলেশনশিপের ছয় মাসের মাথায় দেখা গেল তন্ময় কেমন পাগলামি করতে শুরু করল। আমি ওকে হাজার বার বোঝানোর চেষ্টা করতাম কিন্তু ও আমার কথা বুঝনা। আমার সাথে দেখা করতে চাইত না ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতো না। পড়াশোনা করত না। শুধু পাগলের মত নেশায় ডুবে থাকতো। তখনও ওর পরিবর্তনের কারণ আমি কোন কিছুই জানতাম না। তারপর যখন আমি খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করি তখন জানতে পারি তন্নী ওকে মিথ্যা ভালোবাসার নাটকে ফাসিয়ে শুধুমাত্র পকেটের টাকা খেয়েছে। আর এখন তন্নী অন্য কারো সাথে রিলেশনশিপে জড়িয়ে ওকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু তন্ময় সত্যিই ওকে ভালবাসত যে কারণে সেই কষ্টটা সহ্য করতে না পেরে সে নেশা কে আপন করে নেয়। তারপর একদিন হঠাৎ করে।

এতোটুকু বলে কান্না করতে শুরু করে রাকিব। ওকে কান্না করতে দেখে ওর কাঁধে হাত দিয়ে রাজ বলে উঠে,
~ তারপর একদিন কী হল রাকিব? বল আমায় তারপর কি হয়েছিল?

~ তারপর একদিন সকালবেলা কলেজ থেকে ফোন পেয়ে ঘুম ভেঙে যায় আমার। ফোন রিসিভ করতেই জানতে পারি তন্ময় গলায় রশি দিয়ে সুইসাইড করেছে। কথাটি শুনতেই পাগলের মতো ছুটে যাই আমি। গিয়ে দেখি কলেজের সেই রুমে সেই জায়গায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে সুইসাইড করেছে তন্ময়। যেখানে আমরা দুজন বসে ক্লাস করতাম। ওর ঝুলন্ত লাশ দেখে সহ্য করতে পারিনি আমি। হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়ে পাগলের মতো কান্না করেছিলাম সেদিন।

ইচ্ছা করছিলো তন্নী নামের ওই মেয়েটিকে নিজের হাতে শেষ করে ফেলি আমি। কিন্তু সেটা আমার সাধ্যের বাইরে ছিল। তবে সেই সময় থেকে আমি প্রতিটি মেয়েকে ঘৃণা করতে শুরু করি। কারন আমার কাছে মনে হতো সব মেয়েরাই হয়তো এক রকম হয়। মেয়েদের প্রতি আমার ভেতর থেকে একটি ঘৃণা কাজ করতো। ভালোবাসা তো দুরের কথা রিলেশনশিপ নামেরও কোন কিছুতে জড়ানোর কোন ইচ্ছা ছিল না আমার। কিন্তু আমার এই সব কিছুকে ভুল প্রমাণ করে দিল রাই।

এতোটুকু একনাগাড়ে বলে থেমে গেল রাকিব। ওকে থামতে দেখে ওর কাঁধে হাত রেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাজ। তারপর বলতে শুরু করল,

~ রাকিব আমি বুঝতে পারছি তোমার ফিলিংস টা। তোমার এভাবে প্রতিটি মেয়েকে ঘৃণা করাটা স্বাভাবিক। কেননা তুমি তোমার প্রাণের চাইতে প্রিয় একজন বন্ধুকে হারিয়েছো। কিন্তু তবুও আমি তোমাকে বলবো তুমি তো আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছুই জানো। আর কেউ না জানলেও সেটা আমি তোমার সাথে শেয়ার করেছি। তাহলে এতো কিছুর পরেও আমি যখন তোমার বোন রাহিকে এতটা ভালবাসতে পেরেছি! আপন করে নিতে পেরেছি নিজের জীবনের সাথে। তাহলে তুমি কেন রাই কে ভালবাসতে পারবে না? রাই সত্যিই তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি রাখিব। তবে আমি তোমাকে জোর করব না আমার বোনকে বিয়ে করার জন্য। সেটা সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছার উপর ডিপেন্ড করে। তুমি ভেবে আমাকে জানিও আমি অপেক্ষা করবো। সাথে রাই ও।

রাজের কথা শুনে মাথা নেড়ে সায় দিলো রাকিব। তারপর দুজনে ছাদ থেকে নেমে নিচে চলে আসলো। রাহির মা বাবা ও রাকিব রাজকে ওদের বাসায় থাকতে বললে রাজ অন্য একদিন আসবে বলে বিদায় নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে এলো।


পর্ব ১৩

পুরো বাড়িটা ফুল এবং রংবেরঙের ছোট ছোট টিপটপ বাতিতে সাজানো হয়েছে। নিজের রুমে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছি আমি। বাড়িটাকে অন্যরকম এক সৌন্দর্য যেন ঘিরে রেখেছে চারিদিকে। ঠিক একই ভাবে সাজানো হয়েছিল কয়েক মাস আগেও আমাদের এই বাড়িটা। সেদিন ছিল আমার বিয়ে। কিন্তু বিয়েটা হয়ে ওঠেনি সেদিন। ঠিক একই ভাবে আজকেও সাজানো হয়েছে বাড়িটাকে। কারণ আজকে আমার ভাইয়ার বিয়ে। হ্যা আজকে রাই এর সাথে ভাইয়ার বিয়ে। সকাল থেকেই বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে বেশ ধুমধাম করে। চারিদিকে আত্মীয়-স্বজন মেহমানে ভর্তি। সবার হৈ-হুল্লোড়ে যেন চারিদিকে মাতিয়ে রেখেছে পরিবেশটা। আমি চুপটি করে নিজের রুমে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সেগুলোই দেখছি। কিন্তু কেন জানিনা আমার ভেতরে কোন অনুভূতি কাজ করছে না। না লাগছে আনন্দ আর না লাগছে কষ্ট। যেন এক অথৈ সমুদ্রের মাঝে ভেসে আছি আমি।

যার কোন কূল কিনারা নাই। আমি বুঝতে পারছিনা আমার এমন কেনো লাগছে। ভাইয়ার বিয়েতে আনন্দ করা নিয়ে আগে কত রকম স্বপ্ন দেখতাম আমি। কিন্তু আজকে তার কোনো কিছুই যেন আমার মাথায় কাজ করছে না। বরং নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে গুটিয়ে রেখেছি একটি বন্ধু রুমের মাঝে। কিছু ভালো লাগছে না আমার। শুধু বার বার মনে হচ্ছে আমার জীবনটা কেন এমন হলো? হঠাৎ করে একজন ঝড়ের মত আমার জীবনে এসে কেন আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিল? কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার কিচ্ছু না!

কথাগুলো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছি আর নীরবে চোখের জল ফেলেছি আমি। হঠাৎ দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার। আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। আর দরজা খোলার আগে নিজের চোখ টাকে ভালো করে মুছে নিলাম। যাতে কেউ বুঝতে না পারে আমি কান্না করেছি। দরজা খুলতেই ভাইয়া হাসিমুখে আমার রুমে ঢুকে পড়লো। তারপর দরজাটা হাল্কা ভিড়িয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে এসে বিছানার উপর বসিয়ে দিলো। আমার সামনাসামনি বসিয়ে বলে উঠলো,
~ কি রে এভাবে একা একা দরজা বন্ধ করে বসে আছিস কেনো তুই?

~ এমনি আসলে মাথাটা একটু ব্যাথা করছিল তাই বসে আছি। তুমি আবার এখন এখানে আসতে গেলে কেন ভাইয়া! একটু পরেই না তোমার গায়ে হলুদ?
~ সেজন্যই তো এখানে এসেছি আমার গায়ে হলুদ আর পুচকিটা সেখানে নেই এটা কি করে হয় বল? আচ্ছা তোর আসলে কি হয়েছে বল তো? তুই তো জানিস যে তোকে ছাড়া আমি গায়ে হলুদ করবো না। আমার পুচকি ছাড়া কি আর গায়ে হলুদ করা সম্ভব? চল আমার সাথে।

~ আমার এখন ভালো লাগছে না ভাইয়া। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। তুমি যাও গায়ে হলুদে না থাকলাম তোমার বিয়ের সময় তো অবশ্যই তোমার পাশে থাকব তাইনা? আমি এখন একটু শুয়ে রেস্টে থাকতে চাই প্লিজ। আমাকে আর ডেকো না তুমি যাও ভাইয়া।

আমার কথা শুনে ভাইয়া বেশ কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর উঠে দরজার কাছে গিয়ে আবারও ফিরে এলো আমার কাছে। তারপর আমার পাশে বসে আমার হাতটা নিজের হাতের মাঝে রেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল,

~ আমি জানি রাহি কেন তোর মন খারাপ! আর কেন তুই এভাবে রুমের মাঝে বন্দী হয়ে আছিস। তবে আমি তোর বড় ভাই হিসেবে তোকে একটা কথাই বলতে চাই। মানুষের জীবনে এমন কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে যার জন্য মানুষ প্রস্তুত থাকে না। কিন্তু তাই বলে জীবন টাকে সেখানে থামিয়ে দিলে চলবে না। বরং এই ঘটনাটিকে মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই হবে। তবেই সে বিজয়ী হতে পারবে নিজের জীবনে। আর তাছাড়া আমাদের অজান্তে এমন অনেক ঘটনা থেকে যায় যেটা আমাদের দৃষ্টিগোচর না হলেও আমাদের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী এবং ভালো হয়ে থাকে। হতেও তো পারে তোর অজান্তে হয়তো এমন কিছু আছে যেটা তোর জন্য অনেক মঙ্গলজনক। আর তাই তুই এমন পরিস্থিতে পড়েছিস।

তাই বলবো এভাবে নিজেকে গুটিয়ে না রেখে মুক্ত পাখির মতো নিজেকে উড়তে দে। পিছনের সবকিছু ভুলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু কর রাজের সাথে। রাজ অনেক ভালো ছেলে। তুই হয়তো এখনো ওকে মেনে নিতে পারছিস না। তবে এমন যেন না হয় যে যখন ওকে তুই চাইবি তখন ও তোর জীবন থেকে হারিয়ে যায়। তখন কিন্তু আফসোসের সীমা খুঁজে পাবি না। জানিস তো গুরুজনেরা বলে “দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝা যায় না” তোর বেলায় যেন ঠিক এমনটা না হয় রাহি। আমি শুধু এটাই চাই। আমার কথাগুলো ভেবে দেখিস। আসছি,

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে আমার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালো ভাইয়া। তারপর সোজা দরজা খুলে চলে গেল। আমি সেই আগের মতো একইভাবে বিছানায় বসে থেকে ভাইয়ার কথাগুলো ভাবতে লাগলাম। ভাইয়ার সব কথা ঠিক ভাবে না বুঝলেও কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি আমি। আমার দৃষ্টির আড়ালে এমন কি ঘটেছে যেটা আমার জন্য ভাল অথচ আমি জানিনা? আর সত্যিই কি আমি রাজকে মেনে না নিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রেখে অনেক বড় ভুল করছি? সত্যিই কি এর জন্য আমাকে পরে আফসোস করতে হবে?

এসব কথা ভাবতে ভাবতে যেনো আমার মাথা ধরে যাওয়ার অবস্থা হল। আমার সারা পৃথিবী ঘুরতে লাগল চোখের সামনে। আমি নিজের মাথাটা চেপে ধরে চুপ্টি করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর আবারও দরজায় টোকা শব্দে সেদিকে চোখ মেলে তাকালাম আমি। তাকিয়ে দেখলাম আম্মু একটি ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে হাসি মুখে। আমি আম্মুকে দেখে উঠে বসলাম। আম্মু রুমে এসে ব্যাগটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,

~ রাহি এর মাঝে তোমার জন্য একটি ড্রেস আছে এটা পড়ে রেডি হয়ে নাও। রাকিবের গায়ে হলুদ সম্পন্ন হয়েছে একটু পরে তোমাকে ও বাড়ি যেতে হবে হলুদের বাটি নিয়ে। দেরি করো না তাড়াতাড়ি আসো।

কথাটি বলে ব্যাগটা আমার পাশে রেখে আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন। বিয়ের ব্যস্ততার কারণে অতিরিক্ত ব্যস্ত আছেন আম্মু। তাই হয়তো আমার কথা শোনার সময় হলো না তার। আমি কিছু না ভেবে ব্যাগটা খুললাম। তার মধ্যে অনেক সুন্দর একটি হলুদ রঙের লাল পাথর ও সুতার কাজ করা গাউন জামা। জামাটা সত্যিই অসম্ভব সুন্দর আর গায়ে হলুদের জন্য একদমই পারফেক্ট। খুবই পছন্দ হলো আমার জামাটা। জামাটা কে হাতে নিয়ে দেখছিলাম হঠাৎ খেয়াল করলাম জামা টার নিচে ম্যাচিং করা কিছু জুয়েলারি। সবগুলো জিনিসই অসম্ভব সুন্দর। আমি আর দেরি না করে হাসিমুখে সেগুলো নিয়ে রেডি হতে চলে গেলাম। সবকিছু পড়ে তারপর আয়নার সামনে বসে মুখে হালকা সাজ দিতে লাগলাম।

চোখে চিকন করে কাজল দিলাম, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। গলায় ও কানে ফুলের মালা ও দুল পড়লাম। হাতে ফুলের চুরি কপালে ফুলের টিকলি আর চুলে পড়লাম পুরো একটি ফুলের গাজরা। সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে অপরূপ সুন্দরী লাগছে আয়নায়। নিজেকে দেখে যেন নিজের ক্রাশ খাচ্ছি আমি। বেশ কিছুক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমি।
রুম থেকে বাইরে বের হতেই সবার নজর যেন আমাতেই আটকে গেল। সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এবার বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি। তখনই আম্মু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,

~ বাহ আমার মেয়েটাকে তো আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছে! সত্যিই জামা টাতে তোমাকে অসম্ভব সুন্দর মানিয়েছে। এখন যাও দেরি না করে সবকিছু রেডি করে রাখা আছে সেগুলো নিয়ে মেয়ের বাড়িতে যাও। এমনিতেই অনেক লেট হয়ে গেল।

আম্মুর কথায় কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মুচকি হাসলাম আমি। তারপরে সবাইকে সাথে নিয়ে ডালায় সাজিয়ে রাখা সবকিছু নিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা হলাম রাজের বাসার উদ্দেশ্যে। বাসার সামনে গিয়ে গাড়ি থামতেই সবাই এক এক করে নেমে গেলো বাসার মধ্যে। সবার পিছু পিছু আমিও বিয়ের ডালা হাতে এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগলাম বাসার ভেতর দিকে। কেন জানি না আজকে এ বাসায় আসা তে অনেক বেশি নার্ভাস লাগছে আমার। বুকের মাঝে ধুকপুকানি যেনো প্রতিমুহূর্তে বেড়েই চলেছে। আর বারবার মনে হচ্ছে কেউ আমাকে এক নজরে তাকিয়ে থেকে দেখছে। কিন্তু কই আমি তো আসেপাশে তেমন কাউকে দেখতে পাচ্ছি না? তবে এমন অনুভূতি কেন হচ্ছে আমার? ভীষণ আনইজি ফিল করছি আমি এই মুহুর্তে।

এ সবকিছুর চিন্তাভাবনাকে দূরে ঠেলে রেখে এবার হাসিমুখে বাসার মধ্যে প্রবেশ করলাম আমি। প্রবেশ করতেই দেখি রাই একটি সুন্দর চেয়ারের ওপর হলুদ শাড়ি আর ফুলের গয়না পড়ে সুন্দর করে সেজেগুজে বসে আছে। আমি ওর পাশে গিয়ে দাড়াতেই মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ আসতে এত দেরী করলে কেন ভাবি? আমি আর ভাইয়া সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি!

রাই এর প্রশ্নে যেনো সব কথা হারিয়ে গেল আমার। কি উত্তর দিব কোন কিছুই খুঁজে পাচ্ছিনা আমি। তবে কেন জানি না চোখটা বারবার তাকে খুঁজছে। আমি আশেপাশে বারবার তাকাতে লাগলাম রাজ কোথায় আছে তাকে দেখার জন্য। কিন্তু ওকে কেন খুঁজছি আমি নিজেও জানিনা। হঠাৎ হাতে টান অনুভব করায় সে দিকে ফিরে তাকালাম আমি। আমার হাত ধরে টেনে দুষ্টু হেসে বলল রাই,
~ কি ব্যাপার ভাবি আসার পর থেকে শুধু ভাইয়া কেই খুঁজে চলেছো! বলি ননদিনির দিকেও তো একটু নজর দিবে নাকি? আর আমি তো তাছাড়া তোমার এখন বড় ভাবি হতে চলেছি। বড় ভাবির কাছে থেকে বরকে খুঁজা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়।

কথাগুলো বলেই দুষ্টুমি ভরা হাসি হাসতে লাগল রাই। ওর কথায় বেশ লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি। সত্যিই তো আমি কেমন বেহায়ার মত ওর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে রাজকে খুঁজে চলেছি। আর দুষ্টু টা ঠিক ধরে ফেলেছে। এখন নিজের লজ্জা টাকে যেভাবেই হোক লুকোতে হবে। তাই আমি ওর হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
~ এই ধরো এটা তোমাকে ভাইয়া দিতে বলেছে। তুমি পড়ো আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।

কথাটি বলে যেন তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে ওখান থেকে সরে গেলাম আমি। আমার হাতে থেকে ভাইয়ার দেওয়া চিরকুট পেয়ে খুশিতে যেন গদগদ হয়ে গেল রাই। কিন্তু বেচেরি তো আর জানে না যে ওটা আসলে একটা সাদা কাগজ। যা লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্যে ওকে মিথ্যে বলে দিয়েছি আমি।

রাই এর কাছ থেকে সবার আড়ালে গিয়ে একটি রুমের মাঝে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। রুমটাতে কেউই নেই। হয়তো এখন এই দিকে কেউ আসবেও না। তাই রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে একা একাই হাসতে লাগলাম আমি। সত্যিই ভীষণ লজ্জা লাগছিল আমার রাই এর কথায়। যদিও জানি না আমার হঠাৎ এত লজ্জা লাগতে শুরু করলো কেন। আর কেনইবা আমি রাজকে এভাবে খুঁজে চলেছি চার দিকে। হঠাৎ রুমের মাঝের আলো নিভে যাওয়ায় ধ্যান ভাঙলো আমার। আমি অনেকটাই চমকে উঠে রুমের ভিতরে চোখ বুলাতে লাগলাম। রুমে এখন অনেকটাই অন্ধকার। দিনের বেলা হলেও জানালা দিয়ে হালকা আলোতে যতটুক আলোকিত হয়েছে ততটুকুই।

আমি ভালোভাবে চারিদিকে তাকিয়ে থেকে দেখতেই একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম। যে ছায়ামূর্তিটি ধিরে ধিরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু আমি এবার ভয় পেয়ে যখন চিৎকার দিতে যাব, তখনি উনি দ্রুত এগিয়ে এসে আমার মুখটা চেপে ধরলেন। আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম এটা আর কেউ নয় এটা হলো রাজ।


পর্ব ১৪

দিনের বেলা হলেও জানালা দিয়ে হালকা আলোতে যতটুক আলোকিত হয়েছে ততটুকুই। আমি ভালোভাবে চারিদিকে তাকিয়ে থেকে দেখতেই একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম। যে ছায়ামূর্তিটি ধিরে ধিরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু আমি এবার ভয় পেয়ে যখন চিৎকার দিতে যাব, তখনি উনি দ্রুত এগিয়ে এসে আমার মুখটা চেপে ধরলেন। আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম এটা আর কেউ নয় এটা হলো রাজ। ওনাকে দেখতেই ছোটাছুটি বন্ধ করে থেমে গেলাম আমি। আমাকে থামতে দেখে উনি এবার আমার মুখটা ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলেন,

~ আরে এমনিতে তো কথা বলো খুব কম। কিন্তু এখন এভাবে চিৎকার করতে নিয়েছিলে কেন? এখনোই তো আমাকে জনগণের হাতে মার খাওয়া তে গিয়েছিলে তুমি!

ওনার কথা শুনে আমি বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালাম। উনি আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে মুচকি হেসে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর ভালোভাবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমাকে দেখতে লাগলেন। ওনার চাহনিতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি একটি মায়া কাজ করছে। যে মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে আছি শুধু আমি।

ওনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখ নামিয়ে নিলাম আমি নিচের দিকে। কেনো জানি না অসম্ভব লজ্জা কাজ করতে লাগলো মনের মাঝে। হঠাৎ ওনার কথায় ধ্যান ভাঙলো আমার। উনি উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
~ মাশা আল্লাহ।

ওনার এই ছোট্ট একটি শব্দে যেনো বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো আমার। আমি ওনার দিকে আবারও ফিরে তাকালাম। তাকাতেই দেখলাম উনার চোখে স্পষ্ট যেন নেশা কাজ করছে। উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে আলতো হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,

~ আমার সামনে এটা কে দাঁড়িয়ে আছে? সে কি কোনো পরী না কি কোনো রূপকথার রাজকন্যা?

হঠাৎ করে এভাবে আমার কাছে এগিয়ে এসে কোমর জড়িয়ে ধরে এমন কথা বলায়, কেঁপে উঠলাম আমি। ওনার চোখের দিকে তাকানোর সাহস টাও যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। কথা যেন গলাতে এসেই থেমে গেছে। মুখ পর্যন্ত আর পৌঁছাতে পারছেনা আমার। সারাটা শরীর যেন কি কারনে থর থর করে কাঁপতে লাগলো। উনি হয়তো আমার ভয়টা বুঝতে পারলেন। তাই দ্রুত আমাকে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বলে উঠলেন,

~ সরি রাহি আসলে আমি ভুলে গিয়েছিলাম ডাক্তারের বলা কথা।
এত টুকু বলে আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন উনি। উনার কথার অর্থ আমি কোন কিছুই বুঝতে পারলাম না। ডাক্তার এমন কি কথা বলেছেন যে উনি এভাবে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন? আর সত্যিই তো আমি কেন হঠাৎ এই ভাবে কাঁপতে শুরু করলাম ওনার স্পর্শে?

বেশ কিছুক্ষণ রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে এই কথাগুলো ভাবতে লাগলাম আমি। হঠাৎ বাইরে থেকে রাই এর ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার। আমি দ্রুতো রুম থেকে বাইরে বের হতেই দেখলাম রাই মুখ ফুলিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাছে এগিয়ে আসতেই ও বলে উঠলো,

~ কি ব্যাপার ভাবি সেই এসেছ থেকে ভাইয়ার সাথে রুমের মধ্যে কি গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছো বলো তো? বলি তোমার ননদিনীর যে অনেক দেরি হয়ে গেল হলুদ লাগানোর। সে খেয়াল কি আছে তোমার? এত দেরিতে হলুদ লাগালে তাহলে বিয়েটা হবে কখন বলো তো? আর আমি কখন যাব আমার রাকিব এর কাছে? ইশশ আমার যে আর তর সইছে না।

রাই এর কথা শুনে ওর দিকে বড় বড় চোখে তাকালাম আমি। এই মেয়ে বলেটা কি? লজ্জা শরম বলতে কি কোন কিছু নাই? আমি যে সম্পর্কে এর ভাবি তাছাড়া ও এখন ননদিনী হবো সে কথা যেন ওর মাথাতেই নেই। বিয়ে হওয়ার আগেই কিনা আমার ভাইয়ার চিন্তায় ওর এই অবস্থা! তাহলে বিয়ে হওয়ার পরে ভাইয়ার কি অবস্থা করবে ভাবতেই যেন মাথা ঘুরছে আমার। ভাইয়া টা তো এবার গেল, এই রাই নামের প্যারায় না জানি তার কি অবস্থা হবে। যে ভাইয়া কি না মেয়েদের থেকে পাঁচ হাত দূরে থাকতো সব সময়! এখন সেই ভাইয়া দেখি এটার জ্বালায় পাগল হয়ে পাবনা চলে যাবে। কথাগুলো মনে মনে ভাবতেই খিলখিল করে হেসে দিলাম আমি। আমাকে এভাবে হাসতে দেখে মুখ ফুলিয়ে রাই বলল,

~ কি হলো হঠাৎ এভাবে পাগলের মত হাসছো কেন তুমি? বলি আমার কি গায়ে হলুদ টা আদৌ হবে?
ওর কথায় হাসি থামিয়ে বলে উঠলাম আমি,

~ রিলাক্স মাই ভাবিজান রিল্যাক্স। এখানি তোমার গায়ে হলুদের ব্যবস্থা করছি চলো। তবে আমি শিওর আমার ভাইয়াটা তো এবার গেল।

আমার কথা শুনতেই রাই বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাল। আমি এবার আরো জোরে খলখলিয়ে হেসে দিলাম। হাসতে হাসতেই সামনে তাকিয়ে দেখলাম একজন গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার হাসি মাখা মুখটা দেখছে বুকের সাথে হাত গুঁজে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওনার চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিলাম আমি। আর হঠাৎ করেই যেন একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরল আমায়।
পা টা ও যেন থমকে গেল সেই জায়গাতেই। আমাকে সামনে এগোতে না দেখে এবার রাই কোমরে হাত দিয়ে রাগি চোখে তাকালো আমার দিকে। আমি ওর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাতেই ও রাগী গলায় বলে উঠলো,

~ ভাইয়া তুমি কি দয়া করে এখান থেকে যাবে? এখন তো দেখছি আমার ভাইয়া টা ই আমার সবচাইতে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। আমার গায়ে হলুদটা বুঝি আর হবে না গো। ভাইয়া তুমি এখান থেকে যাবে প্লিজ! নইলে তোমার এই বউ মানে আমার ভাবি টা আমায় আজ গায়ে হলুদ করতে দেবেনা আমি শিওর।

রাই এর কথা শুনে এবার রাজও খলখলিয়ে হেসে দিয়ে রাই এর মাথায় একটি গাট্টা মেরে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মেরে সেখান থেকে চলে গেল। ওনাকে এভাবে চোখ মারতে দেখে আমার চোখ দুটো যেন কপালে উঠে গেল। সত্যিই আজ কেন জানি না ওনার এমন আচরণে অসম্ভব লজ্জা অনুভব করছি আমি। কিন্তু এই লজ্জা টা কি কারনে আমার মাঝে বাসা বাঁধছে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। উনি চলে যেতেই একপ্রকার জোর করেই রাই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের ওখানে। সেখানে আশেপাশে আরও অনেকেই বসে আছে রাইকে গায়ে হলুদ দেবে বলে। কিন্তু আমার জন্যই হয়তো এতটা দেরি হয়ে গেল।

তারপর সবকিছু মন থেকে ঝেড়ে ফেলে রাইকে গায়ে হলুদ লাগাতে মেতে উঠলাম সবাই। সকলের মাঝে দুষ্টু মিষ্টি হাসিতে যেনো ছেঁয়ে গেল। রাই কে গায়ে হলুদ লাগানো শেষ হতেই ১০-১২ বছর বয়সি একটি মেয়ে এসে আমার হাত ধরে টান দিলো। আমি মেয়েটার দিকে ফিরে তাকাতেই মেয়েটি বলে উঠলো,

~ আপু আপু তোমাকে ওই পাশে একজন ডাকে। আমার সাথে আসো।

আমি মেয়েটার কথা শুনে কিছু বলার আগেই মেয়েটি আমার হাত ধরে একদিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আমিও মেয়েটার সাথে সাথে সে দিকে যেতেই মেয়েটি আমাকে রেখেই দৌড়ে পালালো। সামনে তাকাতেই দেখতে পেলাম রাজ আবারও সেই দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে আমার দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওনাকে দেখে আমি পিছন দিকে ঘুরতে যাব তখন ই উনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম আমরা ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। তারপর আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি আচমকাই আমার দুই গালে নিজের হাতে হলুদ রাঙিয়ে দিলেন। আমি অবাক চোখে ওনার দিকে বড় বড় করে তাকাতেই উনি হেসে দিয়ে বলে উঠলেন,

~ নিজেদের বিয়েতে তো তোমাকে এভাবে হলুদ লাগাতে পারিনি। তাই সেই শখটা এখন পূরণ করে নিলাম। আমার হলুদ পরী কে হলুদ রাঙিয়ে দিয়ে।

কথাটি বলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার নাকের সাথে নাক ঘষে নিয়ে মুচকি হেসে সেখান থেকে চলে গেলেন উনি। আমি যেন পাথরের মূর্তির মতো সেখানেই চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কি হলো কিছুই যেন বুঝতে পারছি না আমি। শুধু এতোটুকুই বুঝতে পারছি মনের মাঝে একটি অন্যরকম ভাললাগার অনুভূতি যেনো দোলা দিয়ে গেল আমার। এ যেন এক অন্য রকম অনুভুতির আভাস পেলাম আজ আমি। যে অনুভুতিটা শুধু এই রাজ নামের ছেলেটাকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ।


পর্ব ১৫

বেশ ধুমধাম করেই ভাইয়া আর রাই এর বিয়েটা সম্পন্ন হলো। সবাই অনেক আনন্দে মেতে উঠেছে আজ। সকলের সাথে সাথে আমিও ভীষণ আনন্দিত। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর এবার ভাইয়ার তাড়াহুড়ো শুরু হল রাই কে নিয়ে বাড়িতে ফেরার। সাথে আমারও। সবাই যখন বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সেসময় আম্মু আমার কাছে এগিয়ে এলো। আম্মুকে এভাবে কাছে এগিয়ে আসতে দেখে আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। আম্মু আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে আমাকে সবার থেকে কিছুটা আড়ালে নিয়ে গেলেন। তারপর বলে উঠলেন,

~ তুমি কোথায় যাওয়ার জন্য রেডী হচ্ছ রাহি? তুমি এখানেই থাকবে। আমরা শুধু রাইকে নিয়ে যাবো এখান থেকে। ভুলে যেও না এটা তোমার স্বামীর বাড়ি। আর তুমি এবাড়ির বউ। তাই আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে। তোমার আর আমাদের বাড়িতে কোন জায়গা নেই। শুধু কিছুদিন পর পর অন্য মেয়েদের মতো বাবার বাড়িতে দুই একদিনের জন্যে ঘুরতে যেতে পারো।

আম্মুর হঠাৎ এমন কথা একটুও আশা করিনি আমি। আম্মুর কথায় যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আমার। কি বলছে আম্মু এসব? আজ থেকে কি তাহলে আমাকে তারা নিজেদের থেকে দূরে ঠেলে দিল? আমাকে কি পর করে দিলো তারা? কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে আমার। আমি শুধু অসহায় দৃষ্টিতে আম্মুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আম্মু আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার চোখটা আমার চোখ থেকে সরিয়ে নিল। তারপরে আমি কিছু বলার আগেই দ্রুত আমার সামনে থেকে সরে গেল আম্মু। কিন্তু যাওয়ার আগে আমি স্পষ্ট খেয়াল করলাম আম্মু কান্না করছেন।

যদিও আমি জানি না এই কান্না করার মানেটা কি! আমি সেখানেই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার আর তাদের সাথে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। সবাই একে একে বিদায় হতে শুরু করলো। রাই যাওয়ার আগে রাজকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করলো। রাজের চোখেও জল স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। কিন্তু আমার মাঝে কোন রকমের কোন অনুভূতি নেই। আম্মুর বলা কথাটা যেনো বার বার কানে এসে বারি খেতে লাগলো আমার।

সবাই চলে যাওয়ার পর বাসাটা একদম খালি হতেই আমি হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লাম। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছা করছে এখন আমার। কিন্তু কেন জানিনা সেই কান্না টাও গলা পর্যন্ত এসেই থেমে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে আর বের হচ্ছে না। আমি চুপটি করে বেশ অনেকক্ষণ বসে রইলাম নিচে। রাতটাও প্রায় গভীর হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সে দিকে ফিরে তাকালাম আমি। তাকিয়ে দেখলাম দুটি মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলবো তার আগেই তারা বলে উঠলো,
~ ম্যাডাম আপনি আমাদের সাথে আসুন।

মেয়েদুটিকে চিনতে আমার একটুও অসুবিধা হলো না। এ দুজন মেয়ে পার্লার থেকে এসেছিল রাইকে বধুর সাজে সাজাতে। তাদের কথার উত্তরে আমি কিছু বলবো তার আগেই দুজনে আমার হাত ধরে আমাকে নিচ থেকে টেনে তুলল। তারপর কিছু বলতে না দিয়ে আমার হাত ধরে আমাকে নিয়ে গেল একটি রুমে। যে রুমে রাইকে বধু সাজে সাজানো হয়েছিল। রুমে গিয়ে আমার হাতে তারা তুলে দিলো লাল পেড়ে সাদা রঙের একটি শাড়ি। পরো শাড়িটা গোল্ডেন কালার পাথড় ও সুতার কাজ করা। অসম্ভব সুন্দর এবং ভারী শাড়িটা। শাড়ি টা দেখে যেন চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার অবস্থা হল আমার। আমি শাড়িটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে তাদেরকে বলে উঠলাম,

~ এটা আমায় দিচ্ছেন কেন?

~ ম্যাডাম এটা আপনাকে পড়তে হবে। আপনাকে আমরা বধু সাজে সাজাবো।

কথাটি বলেই আমার থেকে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে তারা আমাকে সাজাতে লাগলো। আমার কি হলো জানিনা আমিও পাথরের মূর্তির মত কোন উত্তর না দিয়ে তাদের ইচ্ছা মত সাজতে লাগলাম। শাড়িটা অনেক সুন্দর করে পরিয়ে দিলো তারা আমায়। তারপর শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা স্বর্ণের অনেক সুন্দর এবং ভারী জুয়েলারি পরিয়ে দিতে লাগলো আমায়। কানে অনেক বড় দুটি ঝুমকা। গলায় স্বর্ণের নেকলেস। মাথায় টিকলি। খোঁপায় তাজা ফুলের গাজরা। কোমরে বিছা, দুহাত ভর্তি স্বর্ণের চিকন চিকন চুড়ির সাথে মোটামোটা ডিজাইনের বালা। চোখে গাড়ো কাজল, ঠোঁটে গাড়ো লাল লিপস্টিক। হালকা মেকাপ। সব মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর লাগছে আমায়। আয়নায় নিজেকে দেখে যেনো চিনতে পারছি না আমি।

সাজানো শেষ হতেই মেয়েদুটি আমাকে হাত ধরে চেয়ার থেকে দাঁড় করালো। তারপর আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলে উঠল,
~ সত্যিই রাজ স্যারের পছন্দ অনেক সুন্দর। আপনাকে একদম সাদা পরীর মত লাগছে ম্যাডাম। আপনাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে এই সাজে।

মেয়ে দুটির কথায় কোন ভাবান্তর দেখা গেল না আমার মাঝে। তারা আমার হাত ধরে নিয়ে গেল রাজের রুমের দিকে। তারপর রুমের মাঝে ঢুকতেই যেন চমকে উঠলাম আমি। পুরোটা রুম’ই ফুলে ফুলে সাজানো। অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে রুমটা। তাজা ফুলের গন্ধে পুরোটা রুম যেন ম ম করছে। আমি চারিদিকে তাকিয়ে রুম টাকে দেখতে লাগলাম। মেয়েদুটি মুচকি হেসে বলে উঠলো,
~ এটা আপনার জন্য সাজানো হয়েছে ম্যাডাম। আপনি এখানে বসুন আমরা চলে যাচ্ছি। একটু পর স্যার আসবে।

কথাটি বলেই মেয়ে দুটি আমাকে খাটের ওপর বসিয়ে রেখে চলে গেল। আমি চুপটি করে খাটের উপর বসে আশেপাশে তাকিয়ে সমস্ত জিনিস দেখতে লাগলাম। কি হচ্ছে এসব, কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না আমার।

বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার। আমি রুমের মধ্যে চোখ বোলানো থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে ফিরে তাকালাম। তাকাতেই দেখতে পেলাম বেশ কয়েকটি লাল রঙের লাভসেপ বলুন উড়ে এলো রুমে। আর বেলুনগুলোর সাথে কিছু লেখা। আমি চুপ করে বসে থেকে কিছুক্ষণ বেলুনগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর আর দেরি না করে খাট থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম বেলুন গুলোর কাছে। তাতে লেখা দেখতে পেলাম
“ছাদে আসো আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি”

লেখাটা দেখে আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু কেন জানি না ছাদে গিয়ে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। তাই আর দেরি না করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে ধীরে ধীরে ছাদে উঠতে লাগলাম। ছাদের দরজায় পৌঁছাতেই ছাদের উপর থেকে ঝলমলে আলো লাগলো চোখে। আমি ধীরে ধীরে ছাদের ওপর পৌঁছাতেই দেখতে পেলাম পুরো ছাদের উপরে ফুলের পাপড়ি বিছানো রয়েছে। আর অসম্ভব সুন্দর করে ডেকোরেট করা। আমি ধীরে ধীরে উপরে উঠে ছাদের উপরে কাউকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু না ছাদে তো আমি ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না! যখনই ভাবলাম কেউ নেই, ভেবে পিছন দিকে ঘুরতেই সামনে তাকিয়ে দেখলাম রাজ হাঁটু গেড়ে বসে আছে হাতে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে। আমি ঘুরে দাঁড়াতেই ও মাথা নিচু করে বলতে শুরু করলো,

~ জানিনা কখন কিভাবে তুমি আমার এই পাথর হওয়া মন টার মাঝে ফুল হয়ে ফুটে ছিলে। আমার মনে জায়গা করে নিয়েছিলে তুমি। যে আমি কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারতাম না। মেয়েদের নাম শুনলে মাথায় আগুন লেগে যেত আমার। সেই আমি জানিনা কিভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেলি। শুধু ভালোবেসে ক্ষান্ত হয়নি আমি। আমি জানি তোমার সাথে আমি প্রতারণা করেছি। আর প্রতারণা করে আমি জোর করে তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার নামে মিথ্যা অপবাদ ও দিয়েছি। সেজন্য আমি তোমার কাছে অসম্ভব লজ্জিত। দয়া করে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। তবে আজকে রাতে আমি তোমাকে আপন করে পেতে চাই নিজের স্ত্রী হিসেবে। আশা করি তুমি আমায় ফিরিয়ে দেবেনা রাহি। জানি আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি।

সেজন্যই হয়তো এতটা কষ্ট দিচ্ছ আমায়। এত দিন হয়ে গেল বিয়ের পরেও তুমি আমার থেকে আলাদা থাকছো। কিন্তু আর নয় রাহি আমি তোমাকে ছাড়া আর একটি মুহূর্ত আলাদা থাকতে পারছিনা। প্লিজ তুমি আমাকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নাও। আমরা তো এখন স্বামী-স্ত্রী তাই না! শুধু শুধু আমার ওপর রাগ করে থেকে কেন আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছো রাহি। আমাকে আর দূরে সরিয়ে রেখো না।

আপন করে নাও রাহি। ভরিয়ে দাও নিজের ভালোবাসায়। আমার জীবনে যে ভালোবাসার বড়ই অভাব। তাই এ ভালোবাসার জন্য যে আমি সব সময় ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে থাকি তোমার পানে। তুমি কি সেই ভালোবাসার ব্যাকুলতা দেখতে পাও না? প্লিজ রাহি আজ আমায় ফিরিয়ে দিও না। আমি পাগল হয়ে যাব তোমাকে ছাড়া আর একটি মুহূর্ত দূরে থাকলে। আমাকে একটু ভালোবাসা দাও রাহি। তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যে আমি ব্যাকুল হয়ে আছি। আমার জীবনটা যে বড্ড ভালোবাসা শূন্য রাহি। ছোটবেলা থেকে ভালোবাসা বলে কোন কিছু পাইনি আমি। যে ভালোবাসা পেয়েছি তোমাকে ঘিরে।

কিন্তু সেটাকে আজ অব্দি আপন করে নিতে পারিনি আমি। প্লিজ তুমি আমায় ফিরিয়ে দিও না। নিজের ভালোবাসায় আজ রাঙিয়ে দাও আমায়। আমি তোমার কাছে শুধু এতোটুকুই চাই। আই লাভ ইউ রাহি, আই লাভ ইউ সো মাচ।
নিচের দিকে মাথা দিয়ে কথাগুলো একনাগাড়ে বলে আমার দিকে ফিরে তাকালেন উনি। আমিও এক নজরে তার দিকেই তাকিয়ে আছি। সে উঠে দাড়িয়ে আমার দুগালে হাত রেখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন,

~ উত্তর দিচ্ছ না কেন তুমি? তুমি কি আমায় ভালোবাসো না রাহি। এই এতদিনের সম্পর্কেও কি আমার প্রতি একবিন্দু ভালবাসাও বাসা বাঁধেনি তোমার মনে?
উনি আমার দিকে প্রশ্ন ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তার চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় বলে উঠলাম,

~ না আমি আপনাকে ভালোবাসি না। শুনেছেন আপনি? আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না। আমার মনে আপনার জন্য এক বিন্দু জায়গাও নেই। আপনি আমার জীবনের একটি অভিশাপ। অভিশাপ হয়ে এসেছেন আপনি আমার জীবনে। আমার জীবন থেকে সবকিছু একে একে কেরে নিচ্ছেন আপনি। আমি আপনাকে কখনোই ভালোবাসিনা। আর কখনো বাসবোও না। আমি অন্য কাউকে ভালবাসি। আমার ভালোবাসার অন্য একজন আছে। যাকে আমি নিজের মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসি। কিন্তু সে আপনি নন।


পর্ব ১৬

~ না আমি আপনাকে ভালোবাসি না। শুনেছেন আপনি? আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না। আমার মনে আপনার জন্য এক বিন্দু জায়গাও নেই। আপনি আমার জীবনের একটি অভিশাপ। অভিশাপ হয়ে এসেছেন আপনি আমার জীবনে। আমার জীবন থেকে সবকিছু একে একে কেরে নিচ্ছেন আপনি। আমি আপনাকে কখনোই ভালোবাসিনা। আর কখনো বাসবোও না। আমি অন্য কাউকে ভালবাসি। আমার ভালোবাসার অন্য একজন আছে। যাকে আমি নিজের মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসি। কিন্তু সে আপনি নন।

এতোটুকু বলে থেমে গেল রাহি। ওকে থামতে দেখে বোবার মতো পিছনদিকে কয়েক পা পিছিয়ে গেল রাজ। তারপর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল,
~ তুমি এসব কি বলছ রাহি? তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো? কবে থেকে?

~ যখন থেকে রাজ নামের অভিশাপ আমার জীবনে এসেছে তখন থেকে ভালোবাসি আমি অন্য কাউকে। শুনতে পেরেছেন আপনি? আপনাকে আমি ঘৃণা করি। আপনি এমন একজন মানুষ যে আমার কপালে কলঙ্কের দাগ লাগিয়েছেন। শুধু তাই নয় আপনি জোর করে আমার হাত কেটে আমার হাতে নিজের নাম লিখে দিয়েছেন। যা আমি এখনো নিয়ে বেড়াচ্ছি নিজের হাতে। অন্যের সামনে নিজের হাত বের করতে লজ্জা লাগে আমার। আপনি এমনই একজন মানুষ যে জোর করে বিয়ে করে আমাকে জোর করে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছেন। আপনি কি করে ভাবলেন এতকিছুর পরেও আমি আপনাকে মেনে নেব? কক্ষনো না আমি আপনাকে কখনো মেনে নেব না। আই জাস্ট হেট ইউ মিস্টার রাজ চৌধুরী। আই হেট ইউ সো মাচ।

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে কান্না করতে করতে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলাম আমি। তারপর রুমে গিয়ে ফুল দিয়ে সাজানো সবকিছু ছিড়ে ফেলে দিতে লাগলাম। সবকিছু এলোমেলো করে নিচে খুলে ফেলে দিয়ে বিছানায় পড়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলাম আমি। আমি জানিনা আমি কেন এমনটা করলাম রাজের সাথে। তবে আমি শুধু একটি কথাই জানি আমার এতটা রাগ লাগছে যে কোনো কিছুই সহ্য হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে আমার আজকে শুধুমাত্র রাজ এর জন্যে এই অবস্থা। তাই আজ আমার আম্মু আমার সাথে এমন আচরণ করেছেন। যেন আমি তাদের থেকে পর হয়ে গেছি। এগুলোর সব কিছুর জন্যে দায়ী শুধু মাত্র রাজ আর কেউ নয়।

তাই ওকে আমি কখনো নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারব না। ভালবাসতেও পারব না কখনো। কথাগুলো ভাবছি আর ফুঁপিয়ে কান্না করছি আমি। হঠাৎ রুমে কারো উপস্থিতি টের পেলাম কিন্তু সে দিকে ফিরে তাকালাম না আমি। তারপরে হাতে টান অনুভব করতেই উঠে বসলাম আমি। রাজকে দেখলাম ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বিছানায় বসে তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলাম। সে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাতদুটো তার দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে শুরু করলেন,

~ আমি জানি রাহি, তুমি আমাকে যে কথাগুলো বলেছো সেগুলো রাগের বশে বলেছ। তুমি অন্য কাউকে নয় তুমি শুধু আমাকেই ভালোবাসো। আমি আমার জন্য তোমার চোখে ভালোবাসা দেখতে পেরেছি। তাহলে কেন শুধু শুধু নিজের রাগকে এভাবে ঘৃণায় পরিনত করছো আমার প্রতি। প্লিজ রাহি এমনটা করো না। আমি যে শেষ হয়ে যাবো। আমার পৃথিবীতে ভালবাসা বলতে কেউ নেই। এত বছর পর তোমাকে নিজের ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিতে চাইছি। তোমার মাঝে পৃথিবীর সব ভালোবাসা খুঁজে নিতে চাইছি আমি। তুমি আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিওনা রাহি।

আমি শেষ হয়ে যাবো আমার মাঝে থেকে সবকিছু হারিয়ে যাবে। আমি আবারও সেই আগের মতো পাথরের মূর্তি হয়ে যাব। যার মাঝে থাকবে না কোন অনুভূতি কোনো মায়া কোনো ভালবাসা। প্লিজ আমার ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো। আমি বুঝতে পারছি আমি ভুল করেছি। আর সে জন্য তোমার কাছে আমি ক্ষমাও চাইছি। রাহি তুমি আমাকে যে শাস্তি ইচ্ছা দিতে পারো আমাকে খুন করে ফেললেও আমি নিষেধ করব না। কিন্তু দয়া করে তুমি একথা বলো না যে তুমি আমাকে ভালোবাস না। আমার সাথে থাকতে চাও না। এটা যে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবোনা রাহি। আমি যে তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি।

পাগলের মত উত্তেজিত হয়ে কথা গুলো বলতে লাগল রাজ। কিন্তু তার কোন কথাই যেনো এখন আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। আমার মস্তিষ্কের মাঝে এখন এক প্রকার আগ্নেয়গিরির লাভা দৌড়াদৌড়ি করছে। অসম্ভব রাগ লাগছে আমার। আর সেই রাগের কারণ হিসাবে এখন আমি দায়ী করছি শুধু এই রাজ নামের লোক টিকে। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে রাজ আবারো বলে উঠলো,
~ কি হলো রাহি তুমি চুপ করে আছো কেন? তুমি আমায় বলো তুমি অন্য কাউকে নয় তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো।

তারপর তুমি যেটা চাইবে সেটাই হবে। প্রয়োজন হলে আমি নিজের মুখ কখনোই তোমাকে দেখাবো না। তবুও তুমি এ কথা বলো না যে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো। তাহলে যে আমার মাঝে থেকে সব বিশ্বাস হারিয়ে যাবে। আমি আর কখনো কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না। ভালবাসতে পারব না কাউকে। নিজেকে যে পাথর করে ফেলব আমি। তখন যে জীবনটা বড়ই কঠিন হয়ে যাবে রাহি। তুমি এমন টা করো না আমার সাথে। আমি বদলে গেলে তখন পস্তাবে সবচেয়ে বেশি তুমি। যেটা আমি কখনোই চাইনা।

উনি আমার গালে হাত রেখে অনেক বিনয়ের সুরে কথাগুলো বললেন। কিন্তু ওনার কোন কথাই যেন এখন আমার মস্তিষ্কে কাজ করছে না। আমি ওনার হাত ঝাড়ি মেরে ছাড়িয়ে দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে ওনার থেকে দূরে সরে এসে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বলতে শুরু করলাম,

~ খবরদার আপনি আমাকে স্পর্শ করবেন না। আপনি যত কিছু বলেন না কেন আমার মুখ থেকে একটা শব্দ ই শুনতে পারবেন। সেটা হচ্ছে আমি আপনাকে কখনোই ভালোবাসিনি ভালবাসি না আর কখনো ভালবাসবোও না। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। আপনার সাথে আমি থাকতে চাই না। আপনার যা খুশি করতে পারেন সেটা দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। তবে একটা কথা শুনে রাখুন আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কাউকে ঘৃণা করলে সে আপনি। আর কেউ নয়। আই হেট ইউ মিস্টার রাজ চৌধুরি আই হেট ইউ।

কথাগুলো বলে দরজার দিকে পা বাড়ালাম আমি রুম থেকে বেরিয়ে যাব বলে। হঠাৎ চুলে কারো টান অনুভব করতেই পিছন দিকে ঘুরে তাকালাম আমি। আর পিছনে ঘুরে তাকাতেই যেন অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার। কারণ রাজকে এখন অসম্ভব ভয়ানক দেখতে লাগছে। ওর চোখগুলো পুরো লাল টকটকে হয়ে গেছে। মুখটায় হিংস্রতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আমার চুলের মুঠি ধরে এক ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিলো ও। নিচে পরে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেয়ে কুকিয়ে উঠলাম আমি। তারপর রাজ চিৎকার করে বলে উঠলো,

~ ভেবেছিলাম সারা পৃথিবীর মেয়েরা এক রকম হলেও তুই হয়তো অন্যরকম। তাই তোকে সবচাইতে বেশি ভালোবেসেছিলাম আমি। কি করি নি তোর জন্য আমি? তোকে বিয়ে করার পর তোর স্বামী হওয়া সত্বেও কখনো তোর উপর জোর করে নিজের স্বামীত্য খাতাইনি আমি। আর তুই কিনা নিজের স্বামীকে ছেড়ে অন্য কাউকে ভালোবাসিস বলছিস?

আজকে তোকে আমি খুন করে ফেলবো। তোদের মতন মেয়েদের জন্য আমার মত কত পুরুষের জীবন নষ্ট হয়। তোকে আমি শেষ করে ফেলব। এই জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই তোর। আজ তুই প্রমাণ করে দিলি যে আমি ভুল ছিলাম। তোকে বিশ্বাস করে সবচাইতে বড় ভুল করেছি আমি। তুইও সেই মহিলাদের মত যারা পুরুষদের জীবন নষ্ট করে। এমনকি নিজের বাচ্চাকাচ্চার জীবনটাও নষ্ট করে, শুধু নিজের কথা ভেবে। তোর মত মেয়েদের জন্য সমাজে আজ কত শত পুরুষ লাঞ্চিত। তোকে আমি শেষ করে ফেলব। তোর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

কথাগুলো একনাগাড়ে বলেই কোমরের বেল্ট খুলতে লাগলেন উনি। ওনাকে এত হিংস্র রুপে দেখে এবার ভয়ে কেঁপে উঠলাম আমি। আজ অব্দি কখনো ওনাকে এমন হিংশ্র রুপে দেখিনি আমি। যেন এক হিংস্র বাঘ দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।

ওনাকে বেল্ট খুলতে দেখে আমি ভয়ে ভয়ে ছেচরিয়ে ছেচরিয়ে পিছন দিকে যেতে লাগলাম। কিন্তু উনি যেন দমে যাওয়ার পাত্র নয়। বেল্ট খোলার চেষ্টা করে আমাকে পিছাতে দেখে বেল্ট না খুলে উনি আবার দৌড়ে এগিয়ে আসলেন আমার কাছে। তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,

~ এই বলনা বল, কি নেই আমার মাঝে। তুই আমাকে কেন ভালবাসতে পারিস না। আর কাকে ভালোবাসিস তুই? তুই বিবাহিত মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কাকে ভালোবাসিস? তুই একবার শুধু তার নামটা বল তাকে নিজের হাতে শেষ করবো আমি। তারপরে তোকেও শেষ করে ফেলবো। তুই কেন আমাকে ভালোবাসিস না একটা কারণ বল। আমাকে ভালো না বাসার মত একটা কারণ বল শুধু।

কথা বলে বললেই রাগ সহ্য করতে না পেরে আমার মাথাটা সজোরে ধাক্কা দিলেন উনি। সাথে সাথে আমার মাথা গিয়ে দেওয়ালে জোরে করে বারি খেলো। সাথে সাথে সারা পৃথিবী যেন চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসলো আমার। আমি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে লাগলাম। আর জ্ঞান হারানোর আগে শুধু একটা কথাই শুনতে পারলাম। সেটা হল রাজ উত্তেজিত কণ্ঠে পাগলের মত চিৎকার করে বলে উঠলো,
” রাহিইইইইইইই,”


পর্ব ১৭

মাথায় হালকা ব্যাথা নিয়ে চোখ মেলে তাকালাম আমি। তাকাতেই নিজের রুমে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। চোখ মেলে তাকিয়ে আশেপাশে তাকাতেই দেখলাম আব্বু আম্মু ভাইয়া সবাই আমাকে ঘিরে ধরে বসে আছে। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠল। আম্মু ছলছল চোখে আমার পাশে এগিয়ে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
~ এখন কেমন লাগছে মা?

আম্মুর কথার উত্তর না দিয়ে আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। তখনই ভাইয়া আমার পাশে এগিয়ে এসে আমাকে ধরে তুলে বালিসের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো। তারপর বলল,
~ নিজের উপর এতো প্রেশার দিস না রাহি। তাহলে তোর সমস্যা হতে পারে। তুই এখনো পুরোপুরি সুস্থ নোস। চুপচাপ শুয়ে থাক।
ভাইয়া কথার কোন উত্তর না দিয়ে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে দিতে লাগলাম আমি। তার পরেই আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ আমার কি হয়েছিল আম্মু? আমি এখানে এলাম কি করে?

~ তুই পা স্লিপ করে ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছিলি। আমরা তোকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিয়েছি। ডাক্তার বলেছে তোকে রেস্ট নেওয়ার জন্য। একটু রেষ্ট হিলেই সুস্থ হয়ে যাবি তুই। কেন তোর কি কিছু মনে নেই রাহি?

পাশে বসে থেকে কথাগুলো বলে উঠলো ভাইয়া। ভাইয়ার কথা শুনে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকালাম আমি। “এসব কি বলছে ভাইয়া? আমি ওয়াশরুমে কখন পা স্লিপ করে পড়ে গেলাম? “
~ এসব তুমি কি বলছো ভাইয়া? আমি ওয়াশরুমে কেন পড়ে যাব? আমাকে তো রাজ,
এতোটুকু বলতেই ভাইয়া আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
~ রাজ? কিসের রাজ? কে রাজ? কার কথা বলছিস তুই রাহি?

ভাইয়ার এমন কথায় যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আমার। এসব কি বলছে ভাইয়া? রাজকে চেনে না? আবার বলছে কিসের রাজ কে রাজ?
~ ভাইয়া এসব কি বলছ তুমি? তুমি রাজ কে চেন না? রাজ আমার স্বামী। যার সাথে তোমরা আমাকে বিয়ে দিয়েছিলে।
আমার কথা শুনে এবার আম্মু কিছুটা রাগি গলায় বলে উঠলো,

~ তুই কি পাগল হয়ে গেলি রাহি? ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে কি তোর মাথায় কোন সমস্যা হয়ে গেল? তোর তো এখনো বিয়ে’ই হয়নি। তাহলে তোর স্বামী কোথা থেকে। কোন রাজের তোর সাথে বিয়ে হয়েছে? নাকি তুই কোন স্বপ্ন দেখেছিস?

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো, পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যেতে লাগল। কি বলছে আম্মু এসব! আমার এখনো বিয়ে হয়নি? রাজ নামের কেউ নেই? তাহলে এতদিন আমার সাথে যেটা ঘটে গেল সেগুলো কি সব স্বপ্ন? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব। আমি এত বড় স্বপ্ন কিভাবে দেখতে পারি? তখনই হঠাৎ আমার মনে পরল আমার হাতে লেখা রাজের নামের কথা। সেটা তো নিশ্চয়ই মিথ্যে হতে পারে না। কথাটি ভাবতেই নিজের হাতের দিকে তাকালাম আমি। আর তাকাতেই দেখতে পারলাম হাতে ব্যান্ডেজ লাগানো আছে। আমি তখন’ই উত্তেজিত সরে বলে উঠলাম,

~ তোমরা রাজকে চিনতে পারছ না? রাজের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। ও আমার স্বামী। যার নাম আমার হাতে লেখা ছিল। এই দেখো ব্যাণ্ডেজ করা রয়েছে এখানে আমার রাজের নাম লেখা আছে।
আমাকে এমন কথা বলতে দেখে আব্বুর কি যেনো হল সে দ্রুত আমার রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আর ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

~ তুই হয়তো কোনো স্বপ্ন দেখেছিস পুচকি। তোর হাতে কারো নাম লেখাই নেই। তুই ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে তোর হাত কেটে গেছে। এজন্যই তোর হাতে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। যখন ব্যান্ডেজ খোলা হবে তখন দেখতে পারবি এখানে কারো নাম লেখা’ই নেই।

ওরা এসব কি বলছে কোন কিছুই মাথায় ঢুকছেনা আমার। আমার সাথে এই এত কিছু ঘটে গেলো অথচ সবাই বলছে এগুলো আমার স্বপ্ন! তাহলে এত বড় স্বপ্ন আমি কিভাবে দেখতে পারি? যেটা সত্যি একদম বাস্তব এর মত কেটেছে আমার সাথে? আচ্ছা আমার এটা যদি স্বপ্ন না হয়ে থাকে তবে তো ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে রাই এর সাথে। কথাটা মনে পড়তেই আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,
~ ভাইয়া রাই কোথায়? তোমার সাথে যার বিয়ে হয়েছে মানে আমার ভাবি কোথায়? ভাইয়া রাইকে নিয়ে আসো। আমি ওকে দেখতে চাই।

তোমরা আমার কথা বিশ্বাস না করলেও রাই করবে।
আমার কথা শুনে এবার আম্মু মুখে আঁচল গুঁজে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল কান্না করতে করতে। আম্মুকে এভাবে চলে যেতে দেখে যেন আরো বেশি অবাক হয়ে গেলাম আমি। এবার ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,

~ প্লিজ রাহি শান্ত হ। এগুলো সব তোর স্বপ্ন আমি এখনো বিয়ে করিনি। আর রাই বলে আমাদের জীবনে কেউ নেই। সব তোর মনের ভুল।

ভাইয়ার কথায় এবার যেন আরো বেশি অবাক হয়ে গেলাম আমি। রাজ বলে কেউ নেই, এমনকি রাই বলেও কেউ নেই? আর ভাইয়া এখনো বিয়ে করেনি? এটা কিভাবে সম্ভব? আমি সব কিছু এখন পর্যন্ত মনে করতে পারছি। সব চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে। এতটা বাস্তবতা কিভাবে স্বপ্নের মাঝে থাকতে পারে?

আর কিভাবে বলছে ওরা যে রাজ বা রাই বলে কেউ নেই? সবকিছুই আমার মনের ভুল? উফ মাথা ধরে যাচ্ছে আমার এসব ভাবতে ভাবতে। যখনই কিছু বলতে যাব তখনি আব্বু একজন ডাক্তার কে সাথে নিয়ে রুমের মাঝে প্রবেশ করলেন। এই ডাক্তারকে আমি আগেও দেখেছি। এনার কাছে’ই আমি রাজ কে রাস্তা থেকে আহত অবস্থায় তুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছিলাম। ইনিই ছিলেন সেই হাসপাতালের ডাক্তার। আমি চুপ করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি আমার কাছে এসে আমার পালস্ চেক করলেন তারপর আরো একটু চেকাপ করে কিছু ঔষুধ লিখে দিয়ে বললেন,

~ কোন সমস্যা নেই আপনার মেয়ে এমন অনেকটা সুস্থ আছে। যে ঔষুধ গুলো লিখে দিলাম এগুলো কিনে নিয়ে এসে নিয়ম করে খাওয়ান ইনশাআল্লাহ উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।
ডাক্তারের হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিলেন আব্বু। তারপর ডাক্তার কে সাথে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। আমি ডাক্তার আঙ্কেলকে ডাক দিয়ে বলে উঠলাম,
~ ডাক্তার আঙ্কেল আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আপনার হাসপাতালে আমি একটি লোককে আহত অবস্থায় নিয়ে ভর্তি করেছিলাম। যার নাম ছিলো রাজ চৌধুরি। আপনার মনে আছে তার কথা?

আমার কথা শুনে আঙ্কেল পেছন ফিরে তাকালেন আমার দিকে। তারপর কিছু একটা ভেবে আমার কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

~ তুমি একটু রেস্ট নাও মামনি। এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করো না। তোমার এখন রেস্ট এর প্রয়োজন। আর তোমাকে আমি আগে থেকেই চিনি তোমার আব্বুর বন্ধু হিসাবে। মাথায় বেশি প্রেশার দিও না। এতে তোমার সমস্যা হতে পারে।

কথাগুলো বলে আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে আব্বুর সাথে বেরিয়ে চলে গেলেন ডাক্তার আংকেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তাদের চলে যাওয়ার দিকে। এগুলো কি হচ্ছে আমার সাথে? কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছে না কেনো। তাহলে কি সত্যিই আমি এসব কিছু স্বপ্ন দেখেছি? আর তাছাড়া ডাক্তার আংকেল আমার আব্বুর বন্ধু হলেন কিভাবে? আমিতো এর আগে কখনো আব্বুর সাথে তাকে দেখেনি? আব্বুর কাছে ওনার কথাও শুনিনি কখনো। ভাইয়া পাশে বসে থেকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

~ এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা বাদ দিয়ে এবার একটু শুয়ে রেস্ট নে পুচকি। আমি তোর জন্য গরম দুধ নিয়ে আসছি। গরম দুধ খেলে তোর একটু ভালো লাগবে। আর এসব স্বপ্ন দেখা বন্ধ কর তোর শরীর বেশি ভালো নয় বুঝলি।

কথাটি বলে মাথায় হাত বুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ভাইয়া। আমি চুপটি করে বসে সবকিছু নিয়ে ভাবতে লাগলাম। তাহলে এসব কি সত্যিই আমার স্বপ্ন? রাই বা রাজ বলে কি সত্যিই কারো অস্তিত্ব নেই এ পৃথিবীতে?


পর্ব ১৮

বিকেলে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছি আমি। কিছু ভালো লাগছেনা আমার। সেদিনের পর কেটে গেছে সাতটা দিন। এই সাত দিনে সত্যিই মনে হয়েছে রাজ এবং রাই কে নিয়ে যেসব কথা ভাবছি আমি সেগুলো সবই আমার স্বপ্ন ছিল। বাস্তবে হয়তো তারা কেউই নেই। না হলে এই সাত দিনের মাঝে আমি কারো মুখেই তাদের নাম শুনেনি। রাজের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু রাই তো অবশ্যই ভাইয়ার কাছে আসতো! কারণ রাই তো ভাইয়ার জন্য পাগল ছিলো। তাহলে কেন এলো না ও। তারমানে সবকিছুই ছিল আমার স্বপ্ন, আর কিছু নয়।

তবে কেন জানিনা এটাকে স্বপ্ন হিসেবে মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি সাত দিন কেটে যাওয়ার পরেও এখনো নিজের স্বপ্ন টাকে মেনে নিতে পারেনি। আমার কেন যেন মনে হয় রাজ যদি আবার আমার জীবনে ফিরে আসতো! আমার স্বামী রুপে! আমি যে ওকে ভালোবেসেছি মনে অজান্তে। যদিও সেই ভালবাসাটা রাগের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। বলতে পারেনি ওকে রাগের কারণে। মিথ্যে কথা বলেছিলাম যে আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। কিন্তু আমার সেই ভালোবাসা টা যে শুধুই রাজকে ঘিরেই ছিলো। সেটা ওকে বোঝাতে পারেনি। কেন মনে হয় বারবার রাজ আবার আমার জীবনে ফিরে আসুক। আমার হাতে নিজের নাম লিখে দিক। আমি ওর নাম নিজের হাতে নিয়ে বেরাতে চাই। সকলের কাছে বলতে চাই আমি রাজের বউ। রাজ আমার স্বামী ওকে আমি ভালবাসি।

আচ্ছা স্বপ্নগুলো কেন এমন হয়? কেন স্বপ্ন কখনো সত্যি হয়না? আর কিছু স্বপ্ন কেন পুরো বাস্তবের মতো মনে হয়। যেগুলো শেষ হয়ে গেলে ভীষণ কষ্ট হয়। আচ্ছা আমি কি আদৌ এগুলো স্বপ্ন দেখেছিলাম, স্বপ্ন কি এই এত বড় হতে পারে? কিন্তু স্বপ্ন যদি না-ই হবে তাহলে আমার হাতে লেখা রাজের নাম টা কোথায় গেল?

শুধু কাটা চিহ্ন কিভাবে আসলো হাতে? আর তাছাড়া আমার পরিবারের এতগুলো মানুষ তো আমায় মিথ্যে বলবে না! আর মিথ্যে বললেও কি সত্য লুকিয়ে আছে এর পিছনে? যে কারণে সবাই আমার কাছে এত বড় মিথ্যে বলবে? না না এ হতে পারে না কেউ মিথ্যা বলছে না। ওগুলো হয়তো আমার স্বপ্ন-ই ছিল। তবে কখনো যদি স্বপ্নের রাজ আমার জীবনে ফিরে আসে। তাকে শুধু আমার জীবন সাথী হয়েই থাকতে হবে। আমি ওকে অন্য কারো হতে দেবো না। যে ভুল একবার করেছি দ্বিতীয়বার আর সে ভুল করবো না আমি।

( হ্যাঁ সেদিন রাজের কাছে রাগের বশে রাহি বলেছিল যে অন্য কাউকে ভালোবাসে রাজ কে নয়। তবে সত্যিটা হলো ওর রাজের প্রতি’ই দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছিল। রাহির মন ধীরে ধীরে রাজকেই ভালোবেসে ফেলেছিল। কিন্তু কোনো এক কারণে অসম্ভব রাগের বশে সেদিন মিথ্যা কথা বলেছিল ও রাজকে। কেন জানিনা রাজ এত কিছু করার পরেও ও রাজকে মেনে নিতে পারছিল না। ওর অসম্ভব রাগ লাগছিল সেদিন। অবশ্য ওর এমন হওয়ার পিছনেও একটা কারণ আছে। যে কারণ টা রাহি একদমই জানেনা। )

কারো ডাকে ধ্যান ভাঙলো আমার। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়া আমার পাশে এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
~ কিরে এই বিকেল বেলা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থেকে কি এত ভাবছিস হুমম? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে তোকে নিয়ে শপিং-এ যাবো।

ভাইয়ার কথায় ভ্রু কুঁচকালাম আমি। তারপর বলে উঠলাম,

~ এখন শপিং মল কেনো যাবো ভাইয়া?

~ কেন আবার কাল থেকে তোর কলেজ সুরু হবে সেজন্য তোকে বোরকা কিনে দেবো এখন থেকে বোরকা পরে কলেজে যাবি বুঝলি।
~ কিন্তু এতদিন তো আমি বোরকা ছাড়াই কলেজে গিয়েছি। তাহলে হঠাৎ এখন কেন বোরকা পড়ে যেতে হবে আমায় ভাইয়া?
~ কারণ এখন তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস। তাই বেশি কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে আমিও রেডি হয়ে আসছি।

কথাগুলো বলে আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ভাইয়া। আমিও আর কিছু না ভেবে ছোট্ট করে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে রেডি হয়ে নিলাম শপিংমলে যাওয়ার জন্য।

গত আধঘন্টা হল বসে আছি শপিংমলে একটি বোরকার দোকানে। ভাইয়া আমাকে এখানে বোরকা পছন্দ করতে বলে নিজের জন্যে প্যান্ট কিনতে গেছে। কিন্তু একটি বোরকাও পছন্দ হচ্ছে না। শুধু একটা করে দেখছি আর নাড়াচাড়া করে রেখে দিচ্ছি। অসম্ভব বিরক্তি লাগছে আমার। কেনো যেনো মনের ভিতর অসম্ভব অস্থিরতা কাজ করছে। বুকের ভিতর ধুকপুকানি যেন প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। কেন যেন মনে হচ্ছে এখন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে চলেছে আমার সাথে। যেটা হয়তো আমি কল্পনার বাহিরে রেখেছি।

~ কী হল ম্যাম আপনার কি একটা বোরকাও পছন্দ হচ্ছে না? আমি কি নতুন আরো কিছু কানেকশন দেখাবো?

দোকানদারের কথায় ধ্যান ভাঙলো আমার। এবার বেশ কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললাম আমি,

~ আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। আমি বরং অন্য কোনো দোকানে দেখে আসছি। এক্সকিউজ মি।

কথাটি বলেই উঠতে নেবো আমি তখনি একটি মেয়ের সাথে আচমকাই ধাক্কা লাগল আমার। মেয়েটি দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলে উঠলো,
~ সরি সরি আসলে আমি খেয়াল করিনি আপু। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।

আমি মেয়েটার দিকে ভালোভাবে তাকাতেই যেনো আমার চোখদুটো কপালে উঠে যাওয়ার অবস্থা হলো। কারণ আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি আর কেউ নয় এটা “রাই”। তার মানে আমার ওগুলো স্বপ্ন ছিলো না! বরং সব কিছুই বাস্তব। রাই যখন আছে তার মানে আমার রাজও আছে।

কথাগুলো ভাবতেই খুশিতে মন ভরে গেল আমার। আমি দ্রুত রাই এর পাশে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত দুটো ধরে বললাম,

~ রাই কেমন আছো তুমি? এতদিন কোথায় ছিলে? আর রাজ কোথায়? তোমরা আমার খোঁজ নিলে না কেন? আমি যে অসুস্থ ছিলাম রাজ কেন আমায় দেখতে এলো না? আর তোমার সাথে ভাইয়ার কি কিছু হয়েছে? ভাইয়া তোমার কথা স্বীকার কেন করল না? এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? কেন আসলে না আমাদের বাসায় ভাইয়ার কাছে?

আমার কথা শুনে কপাল কুঁচকে তাকালো রাই আমার দিকে। তারপর আমার হাত থেকে নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্তির স্বরে বলে উঠলো,

~ এক্সকিউজ মি আপু। আপনি হয়তো কিছু ভুল করছেন। আমার নাম রাই নয়। আমার নাম আখি। আর তাছাড়া আমি আপনাকে চিনতে পারলাম না। আপনি কে বলুন তো? আর আপনি রাজের কথা বলছিলেন! এই রাজটাই বা কে?

~ তুমি আমাকে চিনতে পারছো না রাই? আমি তোমার ভাবি তোমার ভাইয়া রাজের বউ রাহি। তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? এত তাড়াতাড়ি কি করে ভুলে যেতে পারো তুমি আমায়? আর তাছাড়া তোমার নাম তো রাই, আখি কেন হবে? তোমার কি হয়েছে রাই তুমি কেন আমায় না চেনার ভান করছো? নিজেকে আখি কেন বলছো? তুমি তো আসলে রাই আমার ভাইয়া রাকিব এর বউ আমার ভাবি রাই তুমি। একবার ভেবে দেখো ভালো করে তাকিয়ে দেখো আমি রাজের বউ তোমার ভাবি রাহি।

আমার কথাগুলো শুনে এবার রাই এর মুখে যেন বিরক্তি ভাবটা স্পষ্ট ফুটে উঠলো।

~ আরে আপনি কি পাগল নাকি আমি বলছি তো আমার নাম রাই নয়, আমার নাম আখি, আমি হলাম আখি চৌধুরী। প্লিজ আপনি আর এভাবে আমার সময় ওয়েস্ট করবেন না। আমার অনেক জরুরী মিটিং আছে এক্ষুনি যেতে হবে। আমার রাস্তা ছাড়ুন।

কথাটি বলে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল রাই। আমি অবাক চোখে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।


পর্ব ১৯

~ আরে আপনি কি পাগল নাকি আমি বলছি তো আমার নাম রাই নয়, আমার নাম আখি, আমি হলাম আখি চৌধুরী। প্লিজ আপনি আর এভাবে আমার সময় ওয়েস্ট করবেন না। আমার অনেক জরুরী মিটিং আছে এক্ষুনি যেতে হবে। আমার রাস্তা ছাড়ুন।

কথাটি বলে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল রাই। আমি অবাক চোখে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

রাই আমি যে দোকানে বসে ছিলাম তার পাশের একটি দোকানে গিয়ে বসে কাপড় চোপড় পছন্দ করতে লাগলো। আমি ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসে অসহায় দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ রাই তুমি কি সত্যি আমায় চিনতে পারছো না? তাই যদি সত্যি হয় তাহলে এতদিন আমার সাথে যেগুলো ঘটেছে সেগুলো কি সবই আমার স্বপ্ন ছিল? কিন্তু স্বপ্ন যদি হবে তাহলে তুমি বাস্তবে এলে কিভাবে? স্বপ্ন তো কখনো সত্যি হয়না! তাহলে হুবহু আমি তোমাকে স্বপ্ন দেখলাম কিভাবে?

রাই আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে আবার কাপড় চোপড় নাড়াচাড়া করতে করতে বলতে লাগলো,

~ আমার মনে হচ্ছে আপনার মেন্টালি কোন সমস্যা আছে। দয়া করে আপনি আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। আমি সত্যিই আপনাকে চিনি না, আর না এর আগে কখনো আপনাকে আমি দেখেছি। শুধু শুধু আপনি কেন এভাবে আমার পিছনে পড়ে আছেন বলুন তো? আমাকে তাড়াতাড়ি একটি সুন্দর দেখে ড্রেস কিনে নিয়ে বাসায় পৌঁছতে হবে। আমার হবু ভাবীর জন্য। তাই দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না প্লিজ।

~ কিন্তু তুমি তো একটু আগে বললে তোমার জরুরি কোনো এক মিটিং আছে সেখানে যেতে হবে রাই? আর তাছাড়া তোমার হবু ভাবি মানে? কার কথা বলছো তুমি?

~ আরে আজব তো আপনি তো দেখছি বড্ড গায়ে পরা মেয়ে। আমি বারে বারে বলছি আমি আপনাকে চিনি না। তার পরেও আমাকে একের পর এক কথা বলে বিরক্ত করে যাচ্ছেন। আরে বাবা আমি মিটিংএ যাই বা যেখানে খুশি সেখানে যাই। সে কৈফিয়ত কি আপনাকে দেবো নাকি? আচ্ছা এ দোকানে কোন সিকিউরিটি গার্ড নাই? আপনারা কি দেখতে পাচ্ছেন না এই ভদ্রমহিলা আমাকে কখন থেকে বিরক্ত করে যাচ্ছে। আপনারা কিছু বলবেন নাকি আমি দোকান থেকে অন্য কোন দোকানে গিয়ে বসবো?

দোকানের দুজন গার্ড আমার পাশে এগিয়ে এসে বলে উঠলেন,

~ ম্যাম আপনি বাইরে যান, আপনি দয়া করে আমাদের কাস্টমারদের আর বিরক্ত করবেন না। এরকম করলে আপনাকে আমরা এখান থেকে জোর করে বের করে দিতে বাধ্য হব। তাই আপনি এখান থেকে ভালো ভাবে চলে যান। নইলে কিন্তু মোটেও ভালো হবে না আপনার জন্যে।

আমি গার্ডদের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলাম,

~ রাই তুমি কেন এমন করছ আমার সাথে? তুমি কিভাবে পারো আমার সাথে এমন টা করতে? ওরা আমার সাথে এরকম আচরণ করছে তুমি এটা সহ্য করতে পারছো রাই? তুমি কি সব ভুলে গেছো পুরনো দিনের কথা? তোমাদের সকলের কি হয়েছে বলোতো কেন সবাই আমাকে চিনেও না চেনার ভান করছ?

কথাগুলো বলতে বলতে কান্না করে ফেললাম আমি। আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে রাই সেখান থেকে উঠে অন্য দোকানে চলে গেল। রাইকে এভাবে চলে যেতে দেখে, এবার গার্ড দুটো ভীষণ রেগে গিয়ে আমার হাত ধরে বের করে দিতে গেলেই ভাইয়া এসে তাদের থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

~ কি সমস্যা কি আপনাদের? আমার বোনের সাথে কেন এমন করছেন?

~ আপনার বোন কাস্টমারদের বিরক্ত করছেন। আমাদের এখানের একটি বড় কাস্টমার ওনার কারনে চলে গেছে। আপনি একে নিয়ে যান নইলে আমরা এ্যাকশন নিতে বাধ্য হবো।
গার্ডদের কথার কোন উত্তর না দিয়ে ভাইয়া আমার হাত ধরে নিয়ে এসে দোকান থেকে বেরিয়ে আসলো। আমি কান্না করে ফেললাম এবার। তারপর ভাইয়াকে বললাম,

~ভাইয়া আমি রাইকে দেখেছি। কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করছে না ও। আমাকে চিনতে পারছে না। ভাইয়া রাই তো তোমার বউ তাই না! তুমি চলো তুমি গিয়ে ওর সাথে কথা বলো, ও অবশ্যই তোমাকে চিনতে পারবে। আমাকে চিনতে না পারলেও তোমাকে চিনতে পারবে ভাইয়া।

ভাইয়া অনেকটা বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

~ রাহি তুই যদি এমনটাই করতে থাকিস তাহলে সবাই তোকে পাগল মনে করবে। তুই কি সত্যিই দিনে দিনে পাগল হয়ে যাচ্ছিস নাকি? তোকে কতবার বলবো আমি এখনো বিয়ে করিনি আর রাই নামে আমি কাউকে চিনি না। তার পরেও তুই সেই কখন থেকে একই কথা বারবার বলে যাচ্ছিস! আসলে তোর কী হয়েছে বলতো কেন এমন করছিস তুই?

ভাইয়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে সোজা নিচে বসে পড়লাম আমি। অসম্ভব অসহায় লাগছে নিজেকে আমার। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী একদিকে আর আমি আরেক দিকে চলে এসেছি। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে আমার। কেন এমনটা হচ্ছে আমার সাথে কি এমন ভুল ছিল আমার যে আমার জীবনটা এমন হয়ে যাচ্ছে। আমাকে বসে পড়ে এভাবে কান্না করতে দেখে এবার ভাইয়াও কান্না করে দিল। কিন্তু নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে আবার আমার হাত ধরে আমাকে উঠে দাঁড় করিয়ে বলল,

~ চল বাসায় যাব।
তারপর রিক্সায় উঠে বসলাম দুজন। কান্নার কারনে চোখে এতটাই পানি জমেছে যে চোখে স্পষ্ট দেখছি না কোনো কিছু। ভাইয়া আমার মাথাটা নিজের কাঁধের ওপর নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে কলেজের জন্য রেডি হচ্ছি আমি। কালকে শপিং মল থেকে বাসায় আসার পর অনেকক্ষণ সময় নিয়ে আমি কারো সাথে কথা বলিনি। নিজেকে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ এখন অনেকটাই নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছি। নিজের মনকে বুঝিয়েছি সবকিছু আমার স্বপ্ন ছিল আর কিছু নয়। তাই এখন কলেজের জন্য স্বাভাবিকভাবেই রেডি হচ্ছি আমি। রাতে ভাইয়া গিয়ে শপিং মল থেকে আমার জন্য একটি সুন্দর দেখে বোরকা নিয়ে এসেছে। আমি এখন সেটা পড়েই কলেজের জন্য রেডি হয়ে নিচ্ছি।

রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে ভাইয়ার সাথে কলেজের জন্য রওনা হলাম আমি। যে কলেজে রাজের কথা মত আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল সেই কলেজেই চলে আসলাম। আমার মন বলছে যে আমি যেসব ভাবছি সেগুলো সবই সত্যি। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে হয়তো সেগুলো আমার স্বপ্ন’ই ছিল। তাই কেউ আমাকে চিনতে পারছেনা। তাই এই কলেজে আসা নিয়ে ভাইয়াকে আর কোন প্রশ্ন করলাম না আমি। হয়তো এটাই বাস্তব, হয়তো এখানে আমায় ভর্তি করে দিয়েছিল আব্বু। যেটা আমার মনে নেই। হয়তো আমার মাথার কোন সমস্যা আছে যে কারণে এমন উদ্ভট চিন্তা করছি আমি।

আমাকে কলেজের গেটে নামিয়ে দিয়ে ভাইয়া চলে গেলো। আমি কিছুক্ষণ ভাইয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলেজের মধ্যে রওনা হলাম। কলেজের ভিতরে ঢুকতেই পিছন থেকে খুব পরিচিত একজনের হাসির শব্দ শুনে পিছনে ঘুরে তাকালাম আমি। আর তখনই যেন দম বন্ধ হয়ে আসলো আমার। মাথায় যেন সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেল আবার আগের মতো। কারণ আমার পিছনে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজ। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে। ইচ্ছে করছে এক নজরে শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। সাদা শার্ট কালো প্যান্ট কালো কোট চোখে কালো সানগ্লাস। হাতে দামী ঘড়ি। পায়ে কালো রঙের শু। চুলগুলো স্পাইক করা। সাথে মুখে বাঁকা হাসি। সব মিলিয়ে যেনো অসম্ভব সুন্দর একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।

আমি বেশ কিছুক্ষণ রাজ কে পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত পায়ে ওর কাছে ছুটে যেতে লাগলাম। আর তখন’ই কয়েক পা এগিয়ে যেতেই থেমে গেলাম আমি। কেননা রাজের পাশে একটি সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজ ঐ মেয়েটির হাত ধরে মেয়েটির দিকে তাকিয়েই এভাবে হাসছে। আমার পা দুটো যেন সেখানেই জমে গেল।

আমি একনজরে তাকিয়ে থাকলাম ওদের দিকে। ওরা এমন আচরণ করছে যেন দুজন গার্লফ্রেন্ড আর বয়ফ্রেন্ড। ওদের দুজনের মাঝে হয়ত এমনি কোনো সম্পর্ক আছে। আমি না চাওয়া সত্যেও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। একপা একপা করে রাজের কাছে এগিয়ে যেতে লাগলাম আমি। আমি এগিয়ে যাওয়ার আগেই রাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেয়েটি কলেজের মধ্যে ঢুকে গেল। মেয়েটি চলে গেলে রাজ গাড়িতে উঠে চলে যেতে নিবে। তখন’ই আমি গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে দেখে রাজ গাড়ি থেকে নেমে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,

~ এক্সকিউজমি আপনি এভাবে আমার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন কেন?

আমি রাজের কথার উত্তর না দিয়ে একনজরে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। তারপর শুধু আলতো স্বরে বলে উঠলাম,
~ রাজ!

ও আমার কথা শুনে নিজের চোখের চশমাটা খুলে ফেলে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
~ রাজ মানে? কে রাজ?

~ আপনি রাজ। আমার রাজ, আমার স্বামী রাজ।

~ সরি মিস,আপনি হয়তো কিছু ভুল করছেন, আমার নাম রাজ নয় আমার নাম আরিয়ান। আমি চৌধুরী গ্রপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এর মালিক আরিয়ান চৌধুরী। আপনি প্লিজ আমার গাড়ির সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। আমাকে একটি মিটিংয়ে যেতে হবে।

কথাটা বলেই আমার উত্তরের কোন অপেক্ষা না করে চোখে চশমা পড়ে নিল রাজ। তারপর গাড়িতে উঠে বসে আমাকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। আমি এক নজরে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ওর গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেন জানিনা বুকের মাঝে অসম্ভব শূন্যতা অনুভব করছি আমি। কি হচ্ছে এসব আমার সাথে। কাল রাই আর আজ রাজ ও আমাকে চিনতে পারল না? কিন্তু ওরা কেনো এমন করছে আমার সাথে?

লেখা – এম সোনালী

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “তুমি আমার প্রোপারটি – আই লাভ ইউ” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ুন – তুমি আমার প্রোপারটি – আই লাভ ইউ সোনা (সিজন ০২)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *