ভালোবাসা হারানোর গল্প

শেষ ইচ্ছে – ভালোবাসা হারানোর গল্প

শেষ ইচ্ছে – ভালোবাসা হারানোর গল্প: আমার স্ত্রীর ক্যান্সার। গতকাল তাকে হাসপাতালে নিয়েছি। ডাক্তার বলেছে খুব বেশি হলে আর ২ মাস সে এই পৃথিবীতে বাঁচবে। কথা টা শোনার পর মনে হয়েছিল আমার জীবনটাও বোধ হয় আর ২ মাস আমার দেহে থাকবে। এক রাশ দুঃখ নিয়ে কেবিনে ঢুকলাম। মা বসেছিল। আর আমার বাচ্চা মেয়েটা, শিমু ওর মায়ের সাথে গল্প করছিল।

  • মামুনি! তুমি এভাবে শুয়ে আছো কেন?

আমি রোদেলাকে (আমার স্ত্রী) থামিয়ে দিয়ে বললাম,

  • বাবাই। তোমার মামুনি তো একটু অসুস্থ। তাই এভাবে শুয়ে আছে। একটু সুস্থ হলেই আমরা আবার তোমার মামুনিকে নিয়ে বাসায় যাব।
  • ও তাই বুঝি।

তুমি তারাতারি সুস্থ হও মামুনি। (রোদেলার কপালে চুমু দিয়ে)। আমরা আবার সমুদ্র দেখতে যাব। কেমন?

  • হ্যা মামুনি (কান্নাটা অনেক কষ্টে চেপে রেখে কথা টা বলল রোদেলা)

আমিঃ বাবাই তুমি একটু তোমার দাদি আপুর সাথে বাহিরে যাও তো। ওখানে না অনেকগুলো ছোট ছোট বাচ্চা আছে। ওদের সাথে খেলা করো।

  • আচ্ছা বাবাই।

আমি গিয়ে রোদেলার পাশে বসলাম। আমার ভেতরটা ফেটে বেরিয়ে আসছিল। রোদেলার ডান হাতটা মুঠোয় নিলাম। একটা চুমু দিলাম।

  • ডাক্তার কি বলল আরমান?
  • বাদ দাও না। এরা ভুল ভাল বকে। আমি তোমাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাব।
  • আরমান, তুমি ভুলে যাচ্ছ। আমি নিজেও একজন ডাক্তার।

আমার কাছে আর খুব বেশি হলে দুই আড়াই মাস সময় আছে।

  • আচ্ছা তুমি প্লিজ চুপ করবা? এরকম কিছুই না। এরা ভালো ভাবেই পরীক্ষাই করতে পারে না।
  • কয় মাস আছে আমার হাতে?
  • ……
  • বলো আরমান। কয় মাস আছে?
  • (আমি এটা কিভাবে বলব ওকে? আমার বাকশক্তিটাই হারিয়ে যাক। আমি পারব না। বলতে)
  • আরমান, মৃত্যু চিরন্তন সত্য। বলো?
  • ২ মাস।

এটা বলেই আমি ওকে আমার বুকে জড়িয়ে নিলাম। আর ডুকরে কেদে উঠলাম। খুব শক্ত করে রোদেলাকে বুকের সাথে চেপে ধরে আছি। খুব শক্ত করে।

  • আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না রোদেলা। তোমার কিছু হলে আমি নিজেও সুইসাইড করব। তুমি, তুমি ছাড়া আমার পৃথিবী অন্ধকার। আমি তোমাকে ছাড়া একটা মুহুর্ত কাটাতে পারব না। আমি পারব না তোমাকে ছাড়া থাকতে। আমি মরে যাব। আমি, আমি, আমি তোমার কিছু হতে দেব না। আমি তোমাকে যেতে দেব না। আমি, আমি প্রমিস করেছিলাম না।

আমরা একসাথে বাঁচব নইলে একসাথে মরব। বাচতে তো পারব না। কিন্তু একসাথে মরব। কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। (কেদে কেদে অস্থির আমি)

এসব বলেই রোদেলার কপালে, চোখে, গালে, থুতনিতে, ঠোটে। পাগলের মতো চুমু দিতে লাগলাম। আর বললাম,

  • কিচ্ছু হবে না তোমার। আমার জানপাখি ঠিক সেরে উঠবে।
  • বোকাদের মতো কেন কথা বলছ আরমান? (কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে) শক্ত হও। আমাদের একটা বাচ্চা মেয়ে আছে না। ওর কি হবে বলো? ওকে কে দেখে রাখবে? তুমি আমাকে প্রমিস করেছিলে না শিমুকে সারাজীবন আগলে রাখবে? তোমাকে তো তোনার প্রমিস রাখতে হবে।
  • আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমি শুধু এত টুকুই জানি।
  • পাগলামি নয় আরমান। প্লিজ। (আমার কপালে একটা চুমু দিল)
  • না রোদেলা। আমি পারব না। আমিও মরে যাব।
  • আরমান। আমার কিছু শেষ ইচ্ছে পুরণ করবে?
  • কি বলো এসব তুমি? কিসের শেষ ইচ্ছে? তোমার কিচ্ছু হবে না।
  • প্লিজ আরমান। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। না করো না প্লিজ।

আমি জানি আমি ওর জেদের সাথে পারব না। তাই রাজি হলাম।

পরদিন ওকে নিয়ে বের হলাম। সিলিন্ডার ব্যাগটা পেছনে আর নাকের নিচ দিয়ে গ্যাসের লাইনটা। তার প্রথম ইচ্ছে বাইকে নিয়ে ঘুরতে হবে। তাই করলাম। সারাটাদিন ঘুরলাম। সন্ধ্যে বেলা বাসায় ফেরার পর বলল,

  • আমাকে নিয়ে একটু টি এস সি তে হাটবা আরমান। ক্যাম্পাসের দিনগুলোর মতো। তুমি একটা পাঞ্জাবি পরে আর আমি একটা শাড়ি পরে।

টি এস সি তে হাটছি। আমার হাতটা ধরে আছে রোদেলা। আমি চোখের পানি কিছুতেই থামিয়ে রাখতে পারছি না। কি হবে আমার ওকে ছাড়া? আমি পারব না ওকে ছাড়া থাকতে। অনেক অনেক ভালোবাসি। ভাষা নাই আমার সেটা প্রকাশ করার।

  • ফুচকা খাওয়াবে আরমান?
  • কেন খাওয়াব না পাগলি। (কেদে কেদে)
  • কাদতে নেই পাগল। শক্ত হও। মনে করো দুই মাস পরে কি হবে সেটা তোমার মনে নেই। ওটা ভুলে যাও।

ও ফুচকা নিল। বেশ ঝাল দিয়ে। কারন আমি ঝাল খেতে পারি না। ও আমার মুখে তুলে দিল। এর আগে সব সময় বাধা দিয়েছি ঝাল খেতে পারি না বলে। কিন্তু আজ বাধা দিলাম না। ঝাল তো ঝাল ই খুব ঝাল লাগছে আমার। কিন্তু কষ্ট টা অন্য জায়গায়।

  • কি ব্যাপার? তোমার এখনও ঝাল লাগছে না?
  • হুম লাগছে তো?
  • আমাকে বলবা না? এই দিকে আসো।

আমাকে নিয়ে একটু আড়ালে গেল। আমার ঠোটে ঠোট চেপে রাখল। বেশ কিছু সময় পর ছেরে দিল।

  • আমি যখন থাকব না তখন আর ফুচকা খেয় না। হ্যা? ঝালটা কে মিটিয়ে দেবে বলো? তাই।

আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখের পানি একদম আটকাচ্ছে না।

কিছুদিন গেল। ওর ছোট ছোট ইচ্ছে গুলো পুরন করছি।

একদিন খুব সকালে। আমাকে তারাতারি তুলে দিল।

  • চলো না আরমান একটু বাহিরে যাব। কাজ আছে।

আমি কোনো কথা বললাম না। ওকে নিয়ে বাহিরে আসলাম।

  • জুতোটা খুলে ফেল। আমি তোমার হাত ধরে ভেজা ঘাসের উপর হাটব।

আমি আড়ালে চোখের পানিটা মুছে নিলাম। ওর হাত ধরে ভেজা ঘাসে হাটছি। কিছুদুর এগিয়ে বসে পরল। আমাকে বসিয়ে দিল। তারপর আমার হাতটা ধরে কাধে মাথা রাখল।

  • এভাবে বসে থাকতে খুব ভালো লাগছে আরমান।

আমি মুর্তের মতো বসে রইলাম। বাক শক্তি টা যেন সত্যিই হারিয়ে গেছে।

শিমু কে কিছু জানানো হয় নি। ও তো বাচ্চা মেয়ে। এগুলা নিতে পারবে না।

আর দশ দিন বাকি। সেদিন রাতে রোদেলা এসে আমার বুকে শুয়ে পরল।

  • আরমান, আমাকে আগের মতো করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে?
  • কেন ঘুমাব না পাগলি?

আমি ওর ডান হাতটা আমার মাথার নিচে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে নাকটা গলায় লাগিয়ে শুয়ে রইলাম। ও খুব শক্ত করে আমাকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে আছে। আগের মতো রূপ- লাবণ্য টা আর নেই। চেহারাটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর। কিন্তু ওর মিষ্টি সুবাস টা? উহুম। সেটা আগের মতোই আগে। আমাকে আগের মতোই আকৃষ্ট করে।

নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে রোদেলা। মেডিকেল ট্রিটমেন্ট টা বাসাতেই নিচ্ছে। এটা ওর ইচ্ছা। যেন ওকে বাসাতেই রাখা হয়। মাঝ রাতের দিকে। আমি ওর পাশে শুয়ে ছিলাম।

  • আরমান, আরমান, আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার হাতে, আমার হাতে বেশি সময় নেই। (হাপাতে হাপাতে)
  • কি বলছ এসব।
  • আমাকে একটু কোলে নাও তো। ছাদে নিয়ে চলো।

আমি দেরি না করে ওকে কোলে নিলাম। ছাদে নিয়ে আসলাম। ওর ইচ্ছে মতো দোলনায় বসালাম।

  • মনে আছে আরমান? আমাদের জীবন টা এই ছাদেই শুরু হয়েছিল। এই দোলনায় বসে?

সেদিন আমি একটা বেনারশি পরেছিলাম। খুব সুন্দর করে সেজেছিলাম। তোমার জন্য। আর আজ। জীবনের শেষ দিনটাও ঠিক এখানেই। কিন্তু আমি আর আগের মতো নেই।
আরমান এত দিন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি। কিন্তু আজ আর পারছি না আরমান। তোমাকে ছেরে যাবার কথা এখন আমি ভাবতেও পারছি না। (কান্না করছে। ভীষণ কান্না)

আরমান, আরমান আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি মরতে চাই না আরমান। আমি তোমার সাথে আমার মেয়েটাকে নিয়ে বাচতে চাই। (ওর মুখে এসব শুনে আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। শুধু বুকের সাথে চেপে ধরে আছি)

আরমান, আমাকে কথা দাও। আমাদের মেয়েটার কোনো অযত্ন করবে না। ওর যেন কখনই না মনে হয় ওর মা বেচে নেই। তুমি ওকে অনেক ভালোবাসা দিবা। বলো আমায়?

  • আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচব রোদেলা?

তাও কথা দিলাম।

  • আমাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে?

আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলাম।

কিছু সময় পর ও শরীরটা ছেরে দিল। শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ আর আসছে না।

১৫ বছর পর। শিমুকে নিয়ে রোদেলার কবর জিয়ারত করতে এসেছি।

দেখ, তোমার মেয়ে আজ কত বড় হয়েছে। আমি ওকে মানুষ করেছি। বাকিটা জীবন আমি ওকে নিয়ে কাটিয়ে দেব। তোমার আমার শেষ স্মৃতি ও। তুমি আমি মিলেই ওকে গড়িয়েছি।

তুমি হয়ত বেচে নেই রোদেলা। কিন্তু এ মন এর পুরোটা জুরেই তুমি আছো। তুমি ছিলে। তুমি থাকবে। ওপারে ভালো থেকো। খুব শীঘ্রই হয়ত তোমার কাছে চলে আসব।

সমাপ্ত

অনুগল্পঃ শেষ ইচ্ছে
লেখাঃ মাহবুব অভ্র

আরো পড়ুন – বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *