আমার তুমি (সিজন ৩: ১ম খণ্ড) – Romantic premer golpo bd

আমার তুমি (সিজন ৩: ১ম খণ্ড) – Romantic premer golpo bd: বিয়ের আগে কিছুই করব না। কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েও আসিনি। ভালোবাসি তোমায়। বিয়ে করলে তোমাকেই করব। একদিন হবে আমার তুমি।” বলে হাত দিয়ে পরীর গাল ছুঁয়ে সেই হাতেই চুমু খেয়ে উঠে চলে যায়।


পর্ব ১

“তুই কোমর বের করে টি-শার্ট পড়বি তাও স্লিভলেস। আর তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবো ভেবেছিস? চিকনচাকন কোমর মানুষকে দেখিয়ে বেড়ানোর ধান্দা?”
কথাটুকু বলেই জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে পরীর কাছে এগিয়ে যায় জয়। পরী আকুতি ভরা স্বরে বলে,
“মাফ চাই জয় ভাই। আর কখনোই এমন পোশাক পড়বোনা সত্যি বলছি। তোমার কসম।”
জয় কপট রেগে বলে,

“একেই তো অন্যায় করেছিস আবার বলিস আমার কসম? হ্যাঁ রে পরী তোর মনে কি ডর ভয় একেবারেই নেই?”
“তোমার কসম বলেছি বলে তুমি রাগ করেছো? আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আমার কসম।”
“কোনো রং ঢং এর কথা আমি শুনছি না। ছেলে বন্ধুদের সাথে ধিঙ্গি হয়ে ঘুরে বেড়ানোর শখ মিটাচ্ছি। বাড়িতে হাজারটা ছেলে বন্ধু কেন আসবে তোর?”
“হাজারটা ছেলে বন্ধু কোথায় পেলে? মাত্র তিনজন ছেলে আর পাঁচজন মেয়ে এসেছে। ওরা আমার ক্লাসমেট। মাত্র তিনজনকেই তুমি হাজারটা বানিয়ে দিলে?”
“তুই আমার মুখে মুখে তর্ক করছিস? আমার মুখে মুখে?”

পরী আমতা আমতা করে বলে,
“কই তর্ক করলাম? আমি তো শুধু উত্তর দিলাম।”
“কে বলেছে তোকে উত্তর দিতে? আমি বলেছি? বল আমি বলেছি?”
পরী মাথাটা নিচু করে বলে,
“না।”

“তাহলে দিলি কেন বল?”
পরী চুপ।
“কিরে এখন আবার চুপ করে আছিস কেন?”
“উত্তর দিলেও দোষ না দিলেও দোষ। ভাবলাম চুপ করে থাকাই ভালো।তাই তো চুপ করে ছিলাম।”
“এতবেশি বুঝা শুরু করেছিস কবে থেকে? তুই কি বিশিষ্ট ভাবনাবিদ হয়ে গিয়েছিস?”
পরী দুই হাত সামনে নিয়ে বলে,

“হাত জোর করে মাফ চাইছি ভাই। মাফ করে দাও। তবুও কথায় কথায় এত ভুল ধরো না।”
“তোর সাহস তো কম না। তুই আমার কথায় বিরক্ত হোস?”
পরীর এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে। কিন্তু এই মানুষটার ওপর রাগ খাটানোর মত কোনো সাহস নেই পরীর। তাই চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। পরীকে চুপ থাকতে দেখে আচমকা জড়িয়ে ধরে জয়।
“তুই বুঝিস না পরী আমি তোকে কতটা ভালোবাসি? এত অবুঝ কেন তুই?”
“পরী।”

খুব কাছের সেই মানুষটার মুখে নিজের নাম শুনে কেঁপে উঠে পরী। ভাবনার জগৎ থেকে ছিটকে আসে। এই মানুষটার সাথে কাটানো আগের সময়গুলোর কথা ভাবতেই তার প্রবেশ। কেন এসেছে এখানে জয় ভাই? চোখের পানি আড়াল করে পিছন ঘুরে দাঁড়ায়।
“কিছু বলবে জয় ভাই?”
জয় এক পলকে তাকিয়ে আছে পরীর দিকে। এই কি সেই পরী যে জয়ের ভালোবাসার জন্য কাতর ছিল? জয় বলতে পাগল ছিল? পরীর মুখে আগের সেই লাবণ্য নেই। চোখের নিচে কালো দাগ। না জানি কত চিন্তাই করে। করবেই না বা কেন? পরিবারের দায়িত্ব এখন মেয়েটার ওপর। জয় পরীকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই পরী দূরে সরে যায়। জয়ের চোখে পানি টলমল করছে। এতটা পর করে দিয়েছে পরী জয়কে? পরী গলায় কাঠিন্য এনে বলে,
“নিজেকে সংযত করো জয় ভাই। তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।”

“তুই এভাবে বদলে কেন গেলি রে পরী? ভালোই তো ছিলাম আমরা। চারটা বছরের সম্পর্ক কি কিছুই না তোর কাছে?”
“তুমি কেন বুঝতে চাইছো না? আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না। আর খালামনির শরীরটাও ভালো না। খালামনির কথার বিরুদ্ধে যেয়ো না।”
“তোর পরিবারের দায়িত্ব আমি নিবো বলেছি তো।”
“আমি কারো দয়া ভিক্ষা নিবো না জয় ভাই। তাছাড়া তুমি এসব কথা কেন বলছো বলো তো? রাত পোহালেই তোমার গায়ে হলুদ। তুমি এখানে কেন এসেছো?”
জয় চোখের পানি মুছে বলল,

“তুই অনেক পাল্টে গেছিস রে পরী। অনেক পাল্টে গেছিস। ভেবেছিলাম শেষ সময়ে হলেও তুই আমায় ফিরিয়ে দিবিনা। ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নিবি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তোকে চিনতে পারিনি আমি। তুই তো আমায় কখনো ভালোইবাসিসনি। যদি ভালোবাসতি তাহলে কখনোই এভাবে আমায় ফিরিয়ে দিতে পারতি না। আমি তোকে কখনো ক্ষমা করবো না পরী। কখনো না।”
বাম হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যায় জয়। পরী ফ্লোরে বসে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে।
“আমায় ক্ষমা করে দিয়ো জয় ভাই। আমি তোমায় সুখী দেখতে চাই। হয়তো আজ আমি তোমার চোখে খারাপ। কিন্তু সুখের দেখা যখন পাবে তখন পরী নামটাই ভুলে যাবে তুমি।”
জয় চলে যাওয়ার প্রায় পাঁচ মিনিট পরই জয়ের মা রুমে আসে। বড়খালাকে দেখে চোখের পানি মুছে দাঁড়িয়ে যায়।
“খালা তুমি?”
“জয় কি বলতে এসেছিল?”

“এমনিই। কিছুনা।”
বড়খালা পরীর হাত ধরে বলেন,
“মা রে আমার ছেলেটারে সুখী হতে দে। ওর কান্নাকাটির কাছে ইমোশোনাল হয়ে আবার ওর কাছে ফিরে যাস না। আমার মান-সম্মানও জড়িয়ে আছে এখানে। তুই ভাবিস না , তোর বাবা নেই বলে আমি তোকে ছেলের বউ করিনি। তুই তো জানিসই তুই কখ”
“কিছু বলতে হবেনা খালামনি। আমি জয় ভাইয়ের কাছে কখনো ফিরে যাবো না।”
পুরো কথা বলার আগেই পরী তাকে থামিয়ে দেয়।
“তুই আমায় আরেকটা কথা দিবি মা?”

“বলো।”
“জয় নিশ্চয়ই তোকে বলেছে বিয়েতে যেতে? তুই বিয়েতে আসিস না মা। তুই আসলে জয় বিয়েটা করবেনা। পাগলামি শুরু করবে।”
“যাবো না।”
“আমায় কথা দিচ্ছিস তো তুই?”
“হ্যাঁ।”

বড়খালা পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ভেতর থেকে পরীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। বিপদে পড়লে মানুষ চেনা যায়। চেনা যায় তখন রক্তের মানুষকেও।
পরী এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে নিহি সেজ। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড় ভাই থেকেও নেই। বাবা মারা গিয়েছে আজ ১মাস ১৭দিন। এখন মা আর ছোট ভাইটাকে নিয়েই পরীর সংসার। পরিবারের দায়িত্বও এখন পরীর কাঁধে। মায়ের বয়স হয়েছে। তার কাজ করার সাধ্যি নেই। বাবা মারা যাওয়ার পরই সব এলোমেলো হয়ে গেল। চার বছরের ভালোবাসাকেও বির্সজন দিতে হলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ফাইল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো পরী। একজনকে চাকরীর ব্যাপারে কথা বলতে বলেছিল অফিসে। সেই আজ দেখা করতে বলেছে। পরীর একদম ইচ্ছে করছে না বাহিরে যেতে। কষ্টে বুক ফেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু চাকরীটাও পরীর খুব দরকার। জয়দের বাড়ির সামনে দিয়েই যাওয়া লাগে। বাড়ির সামনে আসতেই বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা শুরু হলো। পুরো বাড়িটা কি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। পরী একবার দাঁড়িয়ে পুরো বাড়িটায় চোখ বুলিয়ে নিলো। তখনই চোখ গেল জয়ের রুমের ব্যালকোনিতে। কতটা সময় দুজনে একসাথে এই ব্যালকোনিতে কাটিয়েছে, খুনসুটি, ঝগরা করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তখনই ব্যালকোনিতে জয় আসে। জয়ের দৃষ্টি পরীতে স্থির। এই চোখের ভাষা খুব গভীর খুব। এক আকাশ সমান ভালোবাসা আছে এই দু’চোখে। এ চোখে একসময় ভালোবাসা খুঁজতো পরী কিন্তু এখন তাকানোরও সাহস নেই। পরী চোখ সরিয়ে নিয়ে দ্রুত হাঁটা শুরু করলো। পিছুটানে পড়তে চায় না পরী। যেই পিছুটানে জয়ের হারানোর প্রাপ্তি বাড়বে সেই পিছুটানে কিছুতেই পড়বে না পরী।


পর্ব ২

সূর্যের তাপে রাস্তায় হাঁটা যাচ্ছে না। অন্যান্য সময়ের তুলনায় সূর্যের তাপটা দুপুরেই বেশি টের পাওয়া যায়। ফুটপাথের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পরী। চাকরীটা হয়েও হলো না। চাকরী পাকাপোক্ত করার জন্য নাকি টাকা লাগবে। যাকে বিশুদ্ধ ভাষায় বলে ঘুষ। ঘুষ দেওয়া বা নেওয়া কোনোটাই পছন্দ না পরীর। তবে এই মুহুর্তে হাতে যথেষ্ট টাকা থাকলে ঘুষ দিয়ে হলেও চাকরীটা নিতো। বর্তমানে এখন যোগ্যতার আগে দেখে টাকা। যার টাকা বেশি সে যোগ্যতা ছাড়াও উপরের লেভেলের চাকরী পেয়ে যায়। এটাই তো বাস্তবতা। আর কঠিন বাস্তবতাকে পরীর মত মেয়ের উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই। বাড়িতে গিয়ে ফ্যান ছেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ে পরী। পরীর ছোট ভাই নিশাত এক গ্লাস পানি এনে দেয়। পরী একটু হেসে পানিটুকু শেষ করে।
নিশাত এবার জেএসসি দিয়েছে। মাথার ব্রেন খুবই ভালো। সব কয়টা পরীক্ষাতেই ভালো রেজাল্ট করে। নিশাতের ইচ্ছে বড় হয়ে ডক্টর হবে। শুধু নিশাতের নয়। এটা বাবারও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পরী জানেনা এমন করুণ অবস্থায় ভাইকে ডাক্তারী পড়া পড়াতে পারবে নাকি। যদিও এখন সেই সময়টা অনেক দেড়ি। তবুও নাইন থেকে সায়েন্সেই পড়াতে হবে। বিজ্ঞান শাখায় পড়ানোরও অনেক খরচ। হাতে গোণা কয়েকটা সাবজেক্ট ছাড়া মোটামুটি সব সাবজেক্টেই প্রাইভেট পড়তে হয়। পরী পারবে কি সব কুলিয়ে বাবা আর ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে?
নিশাত এক পলকে তাকিয়ে আছে পরীর দিকে। পরী হাতের ইশারায় কাছে ডাকে।
“এখানে বোস।”

নিশাত চুপ করে বসে পড়ে। পরী নিশাতের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“দুপুরে খেয়েছিস?”
“হুম।”
“মুখটা ওমন মলিন কেন?”
“তুমি কেন আমার বড় হলে আপু?”
পরী হাসে।

“কেন বলতো? তোর ছোট হলে কি হতো?”
“তুমি আমার জায়গায় আর আমি তোমার জায়গায় থাকলে তোমাকে এত কষ্ট করতে হতো না। চাকরী না পেলে রিক্সা তো অন্তত চালাতে পারতাম।”
ছোট ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে বুকটা কেঁপে উঠে। নিশাতকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কেঁদে ফেলে দুই ভাই-বোন।
“তুই আমার বড় হোস নি তাতে কি? এইযে তুই আজ যে কথাটা বললি এটাই আমার মনে কতটা শান্তি বয়ে দিয়েছে তুই ভাবতেও পারবিনা। আমার ভাইটার কোনো কষ্ট করা লাগবে না। তুই শুধু মন দিয়ে পড়বি কেমন?”
“আমি পড়বো না আপু। আমিও কাজ করবো। তাহলে আমাদের সংসার আবার আগের মত হয়ে যাবে।”

“চাইলেই কি আর সব আগের মত হয়রে? সব চাওয়া সত্যি হয় না ভাই। যখন তুই বড় হবি তখন তোকে বাঁধা দিবো না। অনেক বড় ডাক্তার হবি তুই। আব্বুর স্বপ্ন পূরণ করতে হবে তো বল?”
নিশাতের কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। পরী নিশাতের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
“একদম কাঁদবি না। আমাকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে তোর?”
নিশাত মাথা দুইপাশে নাড়ায়। যার উত্তর “না।”

“মা কি খেয়েছে?”
“অনেক কষ্টে জোর করে খাইয়েছি। একা একাই কিসব বিলাপ করে। মা আবার আগের মত হয়ে যাবে তো আপু?”
“হবে সোনা। সবকিছু আগের মত হয়ে যাবে।”

পরী মনে মনে ভাবে,
“সত্যিই কি সবকিছু কখনো আগের মত ঠিক হয়ে যায়? ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। আগের মত হয়ে যাবে।’ এই কথাগুলো শুধুই শান্তনা। আসলে কোনো কিছুই আগের মত ঠিক হয়না। সব হয় অন্যরকম। আমাদের চাওয়ার বিপরীত। তবুও ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ এই কথাটাতেও আলাদা এক প্রশান্তি লাগে। এই কথাটাই বা ক’জন বলে?

রাতের রান্নার জন্য সবকিছু গোছগাছ করছে পরী। ঘরে ডিম ছাড়া আপাতত কোনো বাজার নেই। কাল বাজারে যেতে হবে। বাবার জমানো টাকা দিয়েই চলছে। সাথে পরীর যে কয়টা টাকা জমানো ছিল সেগুলোও এ-কাজে ও-কাজে ভাঙ্গতে হচ্ছে। যদি চাকরীটা না হয় তাহলে বড্ড বিপদে পড়ে যাবে পরী। একবার কি বড় মামার সাথে কথা বলে দেখবে? বড় মামা তো বলেছিল কোনো দরকার হলে তাকে জানাতে। বড় মামা তার পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়া থাকে। তাই বাবার মৃত্যুর পরও আসতে পায়নি। হুটহাট আসার ফ্লাইট পায়নি। তবে মামা বলেছে সে দ্রুত দেশে আসার চেষ্টা করবে। কিন্তু মামার কাছে কি সাহায্য চাওয়া ঠিক হবে? না চেয়েও তো উপায় নেই। পরী নিজের জন্য এখন আর ভাবেনা। সব ভাবনা মা আর ভাইটাকে নিয়ে। বাবা মারা যাবার পর থেকেই মা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। অসুখ তো সাথে লেগেই আছে। সবকিছু মিলিয়ে আর কোনো উপায় দেখছে না। মামাকেই বরং একবার বলে দেখবে।
তিনটা ডিম সিদ্ধ করে খোসা ছাড়াচ্ছিল তখনই নিশাত রান্নাঘরে আসে।
“আপু?”

“বল।”
“জয় ভাইয়ার গায়ে হলুদে যাবে না?”
এতক্ষণ সংসারের চিন্তায় জয়ের বিয়ের কথা মাথায়ই ছিল না। নিশাতের মুখে শুনে মনে হচ্ছে ক্ষতটা নাড়া দিয়েছে। পরী কাজ করতে করতেই বলল,
“না রে। আমি তো রান্না করছি। আর বিয়ে-টিয়ের অনুষ্ঠান এখন আর ভালো লাগেনা। তোদের মত কি আর ছোট আছি বল?”
“তাহলে আমি যাই? খালা সকালে বলে গেছিল আমি যেন গায়ে হলুদে যাই।”
“আচ্ছা তাহলে যা।”


পর্ব ৩

ধুমধাম করে জয়ের গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। আর্থিকভাবে পরীর বড়খালারা যথেষ্ট ভালো। জয় তার একমাত্র ছেলে। তাই কোনো কিছুরই কমতি নেই। সবকিছু তার ইচ্ছেমত, পছন্দমত হচ্ছে। এমনকি মেয়েটাও তারই পছন্দের। বাড়ির পাশে বিরাট বড় একটা মাঠ আছে। শুক্রবারে বড়রা এখানে ক্রিকেট খেলে। আর বাকি দিনগুলোতে বাচ্চারা বিকেলে ক্রিকেট খেলে। গায়ে হলুদের প্যান্ডেল সেখানেই করা হয়েছে। কতশত মানুষ এসেছে দাওয়াতে। জয় প্যান্ডেলে বসে শুধু এদিক সেদিক চোখ বুলাচ্ছে। হয়তো পরী আসবে। জয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু সামির জয় আর পরীর সম্পর্কের কথা জানে। জয়ের চোখ দেখেই বুঝে গেছে ও পরীকে খুঁজছে।
সামির জয়ের কাঁধে হাত রেখে বলে,

“তুই যাকে খুঁজছিস সে আসেনি।”
জয়ের চোখ টলমল করছে। কেন করছে পরী এমন? নিশাতকে দেখে জয় ডাকলো। নিশাত কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলো,
“পরী কোথায় রে? আসেনি?”
“না। আপু রান্না করছে।”

“আমি এখন তোর সাথে বাসায় যাবো। আমি বাহিরে দাঁড়াবো তুই পরীকে ডেকে দিবি?”
“তুমি বাসায় গেলে কি হবে?”
“কিছু হবেনা। পারবি নাকি বল?”
সামির বলে,

“মানে কি জয়? গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান রেখে তুই এখন পরীর কাছে যাবি?”
“যাবো দোস্ত। আমাকে যেতেই হবে। শেষ আরেকটা চেষ্টা করতেই হবে। আমি জানি আমার পরী এখনো আমায় ভালোবাসে।”
“কিন্তু সবাই যখন তোর খোঁজ করবে? বিশেষ করে আন্টি?”
“আমি এখন সুযোগ পেলেই যাবো। তুই এদিকটা একটু ম্যানেজ করিস প্লিজ।”
সামির জয়ের গালে হাত রেখে বলে,
“করবো।”

অনেক চেষ্টার পর সুযোগ পেয়ে নিশাতকে নিয়ে পরীদের বাসায় গেল জয়। বাড়ির সামনে গিয়ে ভাবলো এখানে পরী আসবে তো? মন বলছে আসবেনা। তাই নিশাতের সাথে বাড়ির ভিতর গেল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখে চুলা নিভানো। অর্ধেক রান্না তরকারি। সবকিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পরীর রুমের সামনে গিয়ে দেখলো দরজা ভেতর থেকে লক করা। জয় সমানে দরজা ধাক্কাচ্ছে।
“পরী প্লিজ দরজাটা খুল। পরী প্লিজ।”

রুমের ভেতরে জয়ের মা পরীকে ফিসফিস করে বলে,
“বলেছিলাম না আমি? জয় আসবেই। প্যান্ডেলের পেছন থেকে শুনেই তো আমি ছুটে তোর কাছে আসলাম। তুই কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিস পরী।”
তিনি পরীর হাত নিজের মাথায় নিয়ে বলেন,

“মাথায় হাত রেখে বল তুই জয়ের কাছে ফিরে যাবিনা।”
খালামনির চোখে পানি। এটা কি সত্যিই পানি? নাকি সবটাই নাটক। কিন্তু পরীর চোখ দিয়ে বের হচ্ছে ভালোবাসা হারানোর কষ্ট।
“আমার কথা আমি রাখবো খালা।”

“আমি লুকাচ্ছি। তুই যেভাবে পারিস ওকে বুঝিয়ে বিয়ে করতে পাঠিয়ে দে মা।”

খালা ওয়াশরুমে যাওয়ার পর পরী চোখের পানি মুছে নিলো। দরজা খুলতেই জয় এক পলক তাকালো। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো পরীকে। নিজেকে যতটা শক্ত করে জয়ের সামনে দাঁড়িয়েছিল এবার আর শক্ত থাকতে পারলো না। বেহায়া মন নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। জয়কে ধরে হুহু করে কেঁদে দিলো। পরক্ষণেই খালার কথা মনে হলো। জয় কেঁদে কেঁদে বলল,
“আমি জানতাম তো, আমার পরী আমায় কতটা ভালোবাসে। আমায় ছাড়া আমার পরী থাকতে পারবেনা।”
“তুমি ভুল জানো জয় ভাই। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি।”

জয় পরীকে ছেড়ে দিয়ে পরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

“আমায় ভুলে যাও জয় ভাই। খালা যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছে তুমি তাকেই বিয়ে করে নাও।”
“তোর একারই জিদ আছে শুধু? আমার নেই? তুই আমায় ফিরিয়ে দিবি? বেশ আমিও করবো না এই বিয়ে।”
“পাগলামি করো না।”
“আমি পাগলামি করছি আমি? চল তুই আমার সাথে চল। আজ সবার সামনে তুই আমায় কিভাবে ফিরিয়ে দিবি আমিও দেখবো।”

জয় পরীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পরী জোড়াজুড়ি করেও ছাড়াতে পারছেনা। অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। বটি সামনে নিয়ে বলে,
“আমি কিন্তু নিজের ক্ষতি করে ফেলবো বলে দিলাম। রোজ রোজ তোমার এইসব প্যারা আমার ভালো লাগেনা। এত অবুঝ কেন তুমি? তুমি বুঝোনা আমি তোমাকে চাইনা? আর বিয়ে করবেনা মানে কি? তোমার জন্য আমি মানুষের কথা শুনবো? সবাই বলবে পরীর জন্য জয় বিয়ে করেনি? আমি কোনো দোষের ভাগিদার হতে পারবোনা। সত্যি বলছি জয় ভাই, তুমি যদি এই বিয়েটা না করো আমি নিজেকে শেষ করে দিবো।”
টলমল করা অশ্রুশিক্ত চোখ নিয়ে জয় বলে,
“বিয়ে না করলে তুই নিজেকে শেষ করে দিবি? আর এই বিয়েটা করায় যে আমি শেষ হয়ে যাবো। তার বেলায় কিছু হবেনা? পরী এই হাত দিয়ে আমি তোর গালে ভালোবাসার পরশ দিয়েছি। মাথায় বিলি কেটে দিয়েছি। এই বুকে আমি তোর মাথা রেখেছি। সেখানে অন্য কাউকে এই অধিকারগুলো আমি কিভাবে দিবো বলতো? একটাবারও তুই আমার কথা ভাবলি না? তোর কি মনে পড়েনা, তুই বলেছিলি আমাদেরও ছোট্ট একটা পরী হবে? সেই পরীটা আমি অন্য কারো কাছ থেকে পাবো? তুই সহ্য করতে পারবি তো এসব?”
পরী মনে মনে বলে,

“তুমি তো জানোই না, আমি তোমায় কোনো পরী দিতে পারবো না জয় ভাই।”

চোখের পানি মুছে জয় আবার বলে,
“বেশ! তুই যদি এসব সহ্য করতে পারিস তবে এই বিয়ে আমি করবো। আমার চোখের সামনে তোর শেষটা আমি সহ্য করতে পারবোনা। তুই সুখে থাক তবুও। ভালো থাক পরী।”
জয় কাঁদতে কাঁদতেই চলে গেল। আর এদিকে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়লো পরী। পরীর এই আত্মচিৎকার কি জয়ের কানে পৌঁছিয়েছে? পরী যে জয়কে ছাড়া ভালো নেই সেটা কি জয় কখনো জানবে?
বড়খালা রুম থেকে বেরিয়ে দেখে পরী কাঁদছে। পরীকে কিভাবে শান্তনা দিবে সে? তারও খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই। যতই হোক বোনের মেয়ে তাই বলে কি জেনে শুনে এমন মেয়েকে কোনো শ্বাশুরী ছেলের বউ করবে? যে কিনা কখনো মা’ই হতে পারবেনা? জয়ের মাও পারেনি। ছোট বেলায় পরীর জরায়ুতে টিউমার হয়। তখন থেকেই পরী মা হওয়ার ক্ষমতা হারায়। যেটা পরী নিজেও জানতো না। যখন খালার মুখে জানলো তখন মনে হলো জয়কে ভালোবেসে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। কাউকে ভালোবাসার যে যোগ্যতা নেই পরীর। তিনি নিরবে পরীদের বাসা ত্যাগ করলেন।

পরেরদিন খুব ধুমধাম করেই জয়ের বিয়ে হয়ে যায়। রাত এগারোটার দিকে জয় বউ নিয়ে বাড়িতে আসে। পরী তখন দুইটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে গভীর নিদ্রায়। নাহলে যে এই রাতটা খুব কাঁদাতো পরীকে। পরী ক্লান্ত কাঁদতে কাঁদতে। ঘুম প্রয়োজন এখন ওর। যে ঘুম পরীকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিবে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন কষ্ট থেকে পালিয়ে বেড়াবে পরী?

পর্ব ৪

আজ পাঁচদিন হলো জয়ের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বউয়ের সাথে স্বাভাবিক না একদম। সূচী নামের এই মেয়েটি দেখতে ভারী মিষ্টি। কিন্তু জয়ের কাছে এসব তুচ্ছ। সূচীর সাথে এখনো পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলেনি জয়। সূচী প্রথমে বিষয়টা নিয়ে না ঘাটালেও ইদানীং খুব ভাবাচ্ছে। মনমরা হয়ে বসে থাকে সূচী। জয়ের মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না। সূচীর মন খারাপের কারণও তিনি আন্দাজ করতে পারেন।
নিশাত ফোন নিয়ে দৌঁড়ে পরীর রুমে আসে। পরী তখন শুয়ে ছিল।
“আপু।”

“কি হয়েছে?”
“মামা ফোন করেছে?”
এ কয়দিনে পরী একদম ভুলেই গিয়েছিল মামাকে ফোন করতে। ভালোই হলো মামা নিজেই ফোন দিয়েছে। ভিডিও কলে কথা বলছে।
“কেমন আছো মামা?”
“আমি তো ভালো আছি মা। তুই কেমন আছিস?”

“তোর মামী রান্না করে। আর টুম্পা খেলছে। ভালো আছে ওরা সবাই। তোর মায়ের খবর কি?”
“আগের মতই। সুস্থ হওয়ার লক্ষণ দেখছি না।”
“তুই ভাবিস না। আমি আগামী মাসেই দেশে আসছি। আপুর ভালো হাসপাতালে চিকিৎসা করাবো।”
“হুম।”
“শোন যে কারণে তোকে ফোন করলাম। তোরা যে বাড়িতে আছিস রুম ভাড়া কত?”
“সাত হাজার। কেন?”
“এই বাড়িটা ছেড়ে দে। সাভারে আমার যে তিন তলার ফ্লাট আছে ওখানে চলে যা তোরা। রুম ভাড়াটা তো বাঁচবে।”

“ঐ ফ্লাট না ভাড়া দিয়েছো?”
“ভাড়া আরকি! বন্ধুর ছেলে এসে মাঝে-মাঝে থাকে দুই তলার ফ্লাটে। তিন তলা খালি। ওখানেই থাকতে পারবি তোরা।”
“অনেক উপকার করলে তুমি মামা। বিপদের এই সময়ে ফেরেশতা হয়ে এসেছো তুমি।”
“পাগলী মেয়ে। তুই তো আমার মা।”
আরো কতক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলো। মনে মনে খুব খুশি হয়েছে পরী। এখান থেকে গেলো জয়কে ফেস করতে হবেনা। জয় নিজেও হয়তো ভুলতে পারবে। ফ্লাটের চাবি আনার জন্য গ্রামে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে যেতে পারবে ততই ভালো।
পরেরদিন সকালেই চন্দ্রা থেকে গুলিস্তান যাওয়ার বাসে উঠে। নিশাতকে মায়ের কাছে রেখে গিয়েছে। আজমেরী গ্লোরি বাসটাই গুলিস্তান যাওয়ার জন্য ভালো। দুইপাশে মাত্র দুইটা সীট ফাঁকা। একজন বয়স্ক লোকের পাশে এক সীট আরেকটা সীট ফাঁকা একটা ইয়ং ছেলের পাশে। পরী ঐ ছেলেটার কাছে গিয়ে বললো,
“ভাইয়া সরুন।”

ছেলেটা মোবাইলে গেম খেলছিল। সীট থেকে উঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“আপনি জানালার সাইডে বসুন।”
পরী বসতে বসতে বলে,
“ধন্যবাদ।”
ছেলেটা বসে ফোনে গেম খেলতে খেলতে বলে,
“ধন্যবাদ কেন? জানালার পাশে বসতে দিয়েছি তাই?”
“হু।”

ছেলেটা হেসে বলে,
“আরে ধুর! আমার সুবিধার জন্যই আমি এখানে বসেছি।”
পরী প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়। ছেলেটা পরীর দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হাসে।
“আকাশটা মেঘলা দেখেছেন? যেকোনো সময়ে ঝুমবৃষ্টি শুরু হবে। আমার আবার বৃষ্টি পছন্দ না। তাই আপনাকে জানালার পাশে বসতে দিয়েছি।”
পরী অবাক হয়। বৃষ্টি পছন্দ করেনা এমন মানুষও হয়? পরীর জয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তখন পরী ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ে। কলেজ ছুটি হওয়ার আগেই তুমুল বেগে বৃষ্টি শুরু হয়। পরীর অবশ্য সমস্যা ছিল না। কারণ ছাতা ছিল ব্যাগে। পরীর বৃষ্টির সাথে শত্রুতা ছিল। ভিজলেই জ্বর আসবে। তাই বৃষ্টিতে ভেজা এড়িয়ে চলতো পরী।
ছুটি হওয়ার পর বাহিরে এসে দেখে জয় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে গেইটের কাছে। পরী ছাতা নিয়ে কাছে গিয়ে বলে,
“তুমি বৃষ্টিতে ভিজতেছো কেন?”
“তোকে বলবো কেন?”

পরী বিড়বিড় করে বলে,
“ঘাড়ত্যাড়া।”
“কি বললি?”
“কই? কিছুনা তো।”
“ছাতা বন্ধ কর।”
“ছাতা বন্ধ করবো মানে? বৃষ্টিতে ভিজে যাবো তো।”
“গাধী। বৃষ্টিতে ভেজার জন্যই তো ছাতা বন্ধ করতে বললাম।”

“না জয় ভাই। বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসবে।”
“তুই এত আনরোমান্টিক কেন রে পরী? জ্বরের ভয়ে বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ মিস করতে চাচ্ছিস?”
“জ্বর আসলে মা খুব বকবে জয় ভাই।”
“বকুক। আমার কাছে নিয়ে আসবো তখন। আদর করে জ্বর ভালো করে দিবো।”
“ছিঃ। কি বলো এগুলা?”
“ইশ! আমার লজ্জাবতী।”
জয় ছাতাটা নিয়ে বন্ধ করে ডান হাতে নেয়। বাম হাত দিয়ে শক্ত করে পরীর হাত ধরে বৃষ্টিতে হাঁটতে থাকে। পরী চুপ করে আছে। জয়ই বললো,
“রিক্সায় উঠবি?”

“না। রিক্সায় হুড তুলে দিয়ে তুমি শুধু আমায় লজ্জা দাও।”
পরীর কথা শুনে জয় হো হো করে হেসে দেয়।

“আচ্ছা যা হুড তুলবো না। আর লজ্জাও দিবো না।”
জয় একটা রিক্সা থামায়। হুড নামিয়ে দুজনে পাশাপাশি বসে। পরীর ভীষণ শীত করছে বুঝতে পেরে জয় এক হাত দিয়ে পরীকে টেনে বুকে নেয়।
“কি করছো জয় ভাই? মানুষ দেখছে তো।”
“দেখুক। আমি আমার পিচ্চি বউটাকে বুকে নিয়েছি। মানুষের দেখায় কি আসে যায় আমার?”
“শুনছেন?”

কানের কাছে জোরে কথা বলায় হকচকিয়ে উঠে পরী। পাশে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে পরী এখন বাসে। তারমানে অতীত কল্পনা করছিল এতক্ষণ। মনটা এক রাশ বিষন্নতায় ভরে যায়। কান্না পাচ্ছে খুব। কিন্তু কান্না করাও সম্ভব না। এদিক সেদিক তাকিয়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করছে পরী। ছেলেটা তখনও পরীর দিকে তাকিয়ে আছে।
“আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না?”
“জ্বী পাচ্ছি। বলুন।”

“কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন?”
“মানে?”
“আপনি জানেন। কখন থেকে ডাকছি আপনি তো শুনছেনই না। জেগে জেগে ঘুমানোর অভ্যাস আছে নাকি?”
“জ্বী না।”
“আচ্ছা। জানালার কাঁচটা লাগিয়ে দিন। বৃষ্টির ঝাপটা আসছে।”
পরী জানাল কাঁচ টানছে কিন্তু লাগাতে পারছেনা। ছেলেটা একটু কাছে এসে বলে,
“দেখি সরুন।”
পরীর সামনে কিছুটা ঝুঁকে জানালার কাঁচ টেনে দেয়। পরী স্পষ্ট পারফিউমের ঘ্রাণ পায় যেটা জয় ইউজ করে। পরী একটু সরে বসে। ছেলেটা কানে হেডফোন গুজে বলে,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“হু।”
“ঐপাশে একটা সীট খালি থাকতেও আমার পাশে কেন বসলেন? না মানে, এমনিতে তো মেয়েরা ইয়ং ছেলেদের ইগনোর করেই চলে।”
“আপনার কি সমস্যা হয়েছে আমি এখানে বসাতে? হলে বলুন সামনের বাসস্টপে সীট খালি হলে চলে যাবো।”

“না, না আমি সেটা বলিনি। এমনিই জানতে চাইলাম আরকি।”
“দেখুন বর্তমান এই যুগে, বাবার বয়সের লোকদের কাছ থেকে একজন ইয়ং ছেলের কাছে নিজেকে বেশিই সেফ মনে হয়। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে বাসে যাতায়াত করিতো। অনেক সময় দাঁড়িয়েও যাওয়া লাগে তখন দেখি একেকটা মানুষ রূপী জানোয়ার।”
“হুম বুঝলাম।”

ছেলেটা এবার গান শোনায় মনোযোগ দেয়। পরী মনোযোগ দিয়ে দেখছে বৃষ্টির পানি। জানালার কাঁচ চুইয়ে চুঁইয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো দারুণ লাগছে। পরীর বারবার মনে পড়ছে জয়ের কথা। এমন কত যে বৃষ্টিবিলাস করেছে দুজনে। জয়ের কাঁধে মাথা রেখে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কত স্বপ্ন বুনেছে দুজনে। যার সবই শুধু স্বপ্নই রয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই জয় গান শুনতে খুব পছন্দ করতো। মাঝে মাঝে গান গেয়ে পরীকেও শুনাতো।
“গান শুনবেন?”
পরী ছেলেটার দিকে তাকায়। বড্ড কথা বলে। বিরক্ত লাগছে খুব। গায়ে পড়া স্বভাবের নাকি কে জানে! দেখে তো মনে হয় হাজারও মেয়ের ক্রাশ। এমন ছেলে কি গায়ে পড়া স্বভাবের হতে পারে?
পরী মুখে কৃত্রিম হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
“না।”
“ওকে।”
ছেলেটা কান থেকে হেডফোন খুলে রাখে। জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাসের অনেক যাত্রীই আরামে ঘুমাচ্ছে। সত্যি বলতে পরীরও খুব ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু ঘুমানোর উপায় নেই। পাশে অপরিচিত ছেলে। ঘুমানোটা ঠিক হবেনা। ছেলেটা সীটের সাথে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান ধরে,
“Kabhi jo badal barse
Na dekhu tujhe ankhe varke,
Tu lage mujhe peheli bar
Ishqee duaa
Tere pehelu main rehelu main

Khud ko pagal kehelu,
Tu gam deya khushiya sehelu sathiyaa”
ছেলেটার কণ্ঠে যেন আল্লাহ্ সব মধু ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু এসব বারবার জয়কে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
একসময় পরী ঘুমের সাথে না পেরে ঘুমিয়ে পড়ে। জানালার দিকে ঘাড় কাঁত করে ঘুমিয়ে আছে। বাসের ঝাঁকুনিতে পরী পড়তে নিলে ছেলেটা ধরে ফেলে।
“কি মেয়েরে বাবা! ঘুমিয়ে পড়লো এইটুকু সময়েই।”
সীটের সাথে পরীর মাথাটা এলিয়ে দিলো। সামনের কাটা কয়েকটা চুল পরীর কপাল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা পরীর সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ করে দিয়েছে। ফোন বেজে ওঠে হঠাৎ। ফোনের স্ক্রিনে মা লেখা ভেসে ওঠেছে। হাসিমুখে ফোনটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে মা বলে,
“আব্বু তুই এমন কেন বলতো? হুটহাট রেগে বাড়ি থেকে চলে যাস।”

মাথার চুল হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে উত্তর দেয়,
“আমাকে বকার সময় এটা মনে থাকেনা আম্মাজান? শুনো, আমার রাগ কবে কমবে আমি জানিনা। যতদিন না কমে ততদিন বাড়ি ফিরবো না। আমার কাছে দশ হাজার আছে এখন। কাল টাকা বিকাশ করে পাঠিয়ে দিও।”
“আব্বু না ভালো। তুই বাসায় আয়। আমি তোরে আরো বিশ হাজার দিমু। তাও বাসায় আয় আব্বু।”
“নো আম্মাজান। হবেনা। এই তুর্য যা বলে তাই করে। তুর্যের কথার কোনো নড়চড় কোনোদিন হয়নি আর হবেও না।”
“আব্বু”
“রাখি আম্মাজান। একটা সুন্দর দৃশ্য দেখছিলাম আর তুমি এখনই ফোন দিলে?”

তুর্য আর কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়।
তুর্যর ইচ্ছে হলো এলোমেলো হয়ে ঘুমানো পরীর মুখটার ছবি তুলতে। কাজটা কি ঠিক হবে? না হলে নাই। তুর্য যেই ফোনের ক্যামেরা অন করে পরীর মুখের সামনে নিয়েছে ওমনি পরী চোখ মেলে তাকায়।এদিকে তুর্য থতমত খেয়ে যায়।

পর্ব ৫

পরী চোখমুখ কুঁচকে বলে,
“কি করছিলেন আপনি?”
তুর্য আমতা আমতা করে উত্তর দেয়,
“না মানে ইয়ে, ফোনে নেট পাচ্ছিলাম না তো তাই”

“তাই কি হ্যাঁ? আমার মুখে কি টাওয়ার লাগানো আছে যে ফোন মুখের সামনে ধরে রেখেছিলেন?”
“না, না ভুল বুঝছেন আমায়।”
“চুপ করে বসে থাকুন। না হলে আর একটা কথা বললে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে ফেলে দিব।”
তুর্য ঠোঁটের ওপর এক আঙুল রেখে বলে,
“এইযে আমি চুপ করলাম।”

পরী আর কিছু বলল না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। তুর্য মনে মনে ভাবে,
“বাবারে মেয়ে তো না যেন ধানীলঙ্কা!”
জানালার কাঁচ ধরে অনেকবার টানার পরও খুলতে পারছেনা পরী। তুর্য বিষয়টা খেয়াল করেও চুপ করে বসে থাকে। একটু পরপর আড়চোখে দেখছে পরী শক্ত করে ধরে টেনেও খুলতে পারছেনা। পরী বিরক্ত হয়ে বলে,
“চোরের মত না তাকিয়ে তো একটু সাহায্য করলেও পারেন।”
তুর্য মনে মনে বলে,

“এই মেয়ে না জানি আর কি কি উপাধী দিবে।”
মুখে হতাশ ভাব এনে জানালার কাজটা সরিয়ে দেয় তুর্য। বৃষ্টি এখন কমে গিয়েছে। হালকা হালকা ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে সেটাই দেখছে পরী। কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়ে টেরও পায়না।
বাস চৌরাস্তায় আসতেই উঠে দাঁড়ায় তুর্য। কারণ ওর গন্তব্য এতটুকুই। নামার আগে পরীর ঘুমন্ত মুখটার দিকে একবার তাকায়। তারপর আপনমনেই হাসতে হাসতে বাস থেকে নেমে যায়।
পরীর যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন গুলিস্তানের কাছাকাছি এসে পড়েছে। পাশে তাকিয়ে দেখে তুর্য নেই। একজন মহিলা বসে আছে। পরী হাফ ছেড়ে বাঁচে।
গ্রামের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরীর বিকেল হয়ে যায়।

কপালে হাত দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে জয়। সূচী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক দেখছে জয়কে। মানুষটাকে দেখলেই মনে হয় ভেতরে ভেতরে কোনো একটা কারণে খুব পুড়ছে। কিছু একটা নিয়ে খুব হতাশায় ভুগছে। কিন্তু কি কারণ সেটা? সূচী এগিয়ে যায় জয়ের কাছে। খুব ধীর গলায় বলে,
“শুনেছি কপালে হাত দিয়ে শুয়ে থাকা নাকি ভালো না।”
জয় একবার চোখমেলে সূচীর দিকে তাকায়। তারপর আবার আগের মতই শুয়ে থাকে। সূচী কি বলবে। বলার মত কিছুই খুঁজে পায় না। জয়কে তার ভালো লাগে। খুব বেশিই ভালোলাগে। সেই প্রথম দেখা থেকেই। আর এখন তো নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসে। কিন্তু এই মানুষটা কেন বুঝতে চায় না সূচীর ভালোবাসা?
সূচীকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জয় উঠে বসে।
“আপনি কি কিছু বলবেন?”

সূচী তার গাঢ় কাজল চোখে জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বলতে তো কত কিছুই চাই। শোনার মত সময় হবে কি আপনার?”
“জরুরী কোনো কথা থাকলে বলতে পারেন। নয়তো আপনি এখন আসতে পারুন। একা থাকতে চাই আমি।”
“আচ্ছা তাহলে পরে বলব।”
নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করে সূচী।
ছেলে মানুষদের কেন সবার সামনে কাঁদতে বারণ? কেন নিজের কষ্টগুলো সবার সাথে শেয়ার করতে পারেনা? কাদের থেকে এই নিয়মটা চালু হয়ে আসছে। যদি এই নিয়মটা না থাকত, জয় একটু মন খুলে কাঁদতে পারতো। বড় হওয়ার সাথে সাথে যে এটাই শুনে আসছে ছেলেদের কাঁদতে নেই। নিজেকে আর ঠিক রাখতেও পারছেনা। বুকের ভেতর হাহাকার হচ্ছে। জয় আপনমনেই ভাবে,

“কেন পরী? কেন এমনটা করলি তুই? কেন আমায় আপন করে নিলি না? এই দিন তো আমি দেখতে চাইনি। তোর জায়গায় অন্য কেউ আমার বউ। আমি তো তাকে মানতে পারিনা পরী। আজ যদি ঐ মেয়েটার জায়গায় তুই থাকতি তাহলে আমাদের সংসারটাই অন্যরকম হতো। কেন তুই আমার হলি না? আমাদের ভালোবাসায় কি কোনো ক্ষুত ছিল যে কারণে বিধাতা আমাদের এক হতে দিলো না।”
ছেলের এমন আকুতি ভরা চাহনী, কষ্ট দূর থেকেই দেখে জয়ের মা। ছেলের কষ্ট যে তাকেও পুড়াচ্ছে। ছেলের ভালো করতে গিয়ে কি বড় কোনো ভুল করে ফেলল সে?

পরেরদিন বিকেলে নানুকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে পরী। নানুর খুব ইচ্ছা মায়ের কাছে থাকবে। পরীও আর না করেনি। জব হলে পরী সারাদিন বাহিরেই থাকবে। নিশাত স্কুলে থাকবে। মাকে দেখার মত কেউই নেই। যদিও বয়সের ভাড়ে নানু নিজেই তেমন চলতে পারেনা তবুও মনের কোণে আশা থাকবে কেউ একজন বাড়িতে আছে।
রিক্সা যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় তখন জয়ের সাথে দেখা হয়। পরী সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। জয় একবার পরীর দিকে তাকিয়ে নানুর দিকে তাকায়। মুখে হাসি টেনে বলে,
“ভালো আছো নানু?”
“হ নানুভাই ভালো আছি। তুই কেমন আছোস?”

জয় পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“বেঁচে আছি নানু।”
তিনি হয়ত জয়ের কথাটা ভালোমত ঠাহর করতে পারেননি। জয়কে বলে,
“বাড়িতে আসিস। দাঁড়াই থাকতে পারতাছিনা।”
“আচ্ছা যাও।”
পরী নানুকে নিয়ে বাসায় যায়। জয় তাকিয়ে আছে যাওয়ার পথে। পরী এতটা স্বাভাবিক কিভাবে? যেন কিছুই হয়নি। সত্যিই তো। কিছু কি হয়েছে? কিছুই তো হয়নি পরীর। যা হওয়ার আমার হয়েছে। ভালোবাসাটা হয়ত এক তরফা আমারই ছিল শুধু।
আপনমনেই কথাগুলো ভেবে হাঁটা ধরে জয়।
নানু বাসায় আসার পর নিশাতই খাওয়া-দাওয়ার সব ব্যবস্থা করছে।

“নানুর কাছে থাকিস নিশাত।আমি গোসল করে আসি।”
“আচ্ছা।”
পরী বাথরুম ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এতক্ষণ আটকে রাখা চোখের পানিগুলো ছেড়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। জয়ের চোখমুখই বলে দিচ্ছিল জয় ভালো নেই। পরী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি জয় চাইনি। আমি এভাবে তোমাকে সত্যিই দেখতে চাইনি। তোমায় ছাড়া আমি নিজেও যে ভালো নেই। কিন্তু কি করবো বলো? এই নিষ্ঠুর নিয়তি তো আমাদের এক হতে দিলো না জয়। তুমি কেন আমায় ভুলে যাচ্ছো না? কেন নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছো কেন!”
কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে যায়। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসায় কেন এত বিরহ। কেন বাস্তবতা এত নিঠুর কেন।
নিশাত দরজায় কড়া নারে,
“আপু হয়নি তোর?”

পরী নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলে,
“এইতো হয়ে গেছে।”
“তাড়াতাড়ি আয়। আমার ক্ষুধা লেগেছে।”
পরী এবার তাড়াতাড়ি গোসলটা সেরে নেয়। একদমই ভুলে গিয়েছিল যে পরী বাসায় থাকলে নিশাত একা খায় না।
গোসল সেরে নিশাতকে নিয়ে খেয়ে নেয়।
পরী টেবিল পরিষ্কার করছিল তখন নিশাত এসে বলে,

“দেখো আপু কাকে নিয়ে এসেছি।”
পরী চোখ তুলে সামনে তাকায়। খুব বেশি ভুল না হলে এটাই সূচী। খালা একবার ছবি দেখিয়েছিল।
পরী কিছু বলার আগে নিশাতই বলল,
“জয় ভাইয়ার বউ। তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
এবার পরীর বুকটা কেঁপে ওঠে। আমার সাথে দেখা করতে এসেছে মানে? জয় কি তবে সব বলে দিয়েছে?
মনের সব প্রশ্নগুলোকে এক সাইডে রেখে পরী হাসি মুখে বলে,
“আরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।”

“ঠিক আছি আমি।”
“আপনি বসুন। আমি আসছি।”
পরী রান্নাঘরে গিয়ে চা বানালো আর সাথে বিস্কুট নিয়ে আসলো। টি-টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল,
“গরীবের বাড়িতে এসেছেন। দেওয়ার মত ঘরে তেমন কিছুই নেই।”
“এসবের প্রয়োজন ছিল না পরী। আমি শুধু তোমার সাথেই দেখা করতে এসেছিলাম।”
“আচ্ছা শুনবো সব। চা টা অন্তত খান।”
“হুম। কিন্তু তুমি আমাকে আপনি আপনি বলছো কেন? আমি তোমার সমবয়সী। আমাকে তুমি করেই বলো।”
এরপর সূচী চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বলল,
“তুমি আমার বিয়েতে আসোনি কেন?”

“মা অসুস্থ ছিল তো। তাই যাওয়া হয়নি।”
“ওহ। কে কে থাকো এখানে?”
“আমি, মা আর ছোট ভাই। কাল গ্রামে গিয়েছিলাম সাথে নানুও আসলো। এখন মোট চারজন।”
“তোমার বাবা?”
পরী মলিন মুখে উত্তর দেয়,

“নেই।”
“উফস স্যরি স্যরি। মা বলেছিল। আমি ভুলে গিয়েছিলাম।”
“সমস্যা নেই।”
“তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। সমস্যা না থাকলে একটু গল্প করি।”
“কোনো সমস্যা নেই বলো।”
“আসলে বাড়িতে বসে বসে বোর হচ্ছিলাম। তখন মাকে বললাম। মা বললো তোমার সাথে গল্প করতে।”
“খালা বলেছে?”
“হুম।”
পরী বেশ খানিকটা অবাক হয়। এই খালা নামক মানুষটাকে বুঝে উঠতে পারেনা পরী। কখন কি চলে মনের ভেতর আল্লাহ্ মালুম। অনেকক্ষণ পরী আর সূচী গল্প করলো। সূচীর সাথে কথা বলে পরী এটা বুঝতে পারলো যে, সূচী খুব মিশুক আর ভালো মনের একটা মেয়ে। যদি জয়ের মনে একবার জায়গা করে নিতে পারে তাহলে দুজনই ইনশাল্লাহ সুখী হবে। পরী তো মনে মনে এটাই চায় জয় সুখী হোক অনেক সুখী।

তিরা একের পর এক ফোন দিয়েই যাচ্ছে তুর্যকে। কিন্তু তুর্য ফোন তুলছে না। তিরার পাশে বসে হাসফাস করছে তুর্যর মা।
“কি হলো? ফোন ধরেছে?”
“না মা। রিসিভ করছে না তো।”
“এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারিনা। টেনশনে টেনশনেই কবে জানি মারা যাবো আল্লাহ্।”
“উফফ মা! আপনার মুখে কি বাজে কথা ছাড়া আর কিছু নেই?”
তিরার ধমকে চুপ হয়ে যায় তাহমিনা বেগম। বড় ছেলে সূর্যর বউ তিরা। রূপে-গুণে মাশআল্লাহ্। তিরা এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে পাঁচ বছরের মত হবে। তাহমিনা বেগমের কখনোই মনে হয়নি তিরা ছেলের বউ। নিজের মেয়েও বোধ হয় এত ভালোবাসেনা শ্বাশুরীকে। যতটা তিরা ভালোবাসে। এমন ছেলের বউ পেয়ে তাহমিনা বেগম আল্লাহ্কে শুকরিয়া জানান। তিরা আর সূর্যের তিন বছরের একটা ছেলেও আছে। নাম সেজান। আরেকটা নতুন অতিথিও আসছে। তিরা এখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
টানা ২০ বার ফোন দেওয়ার পর রিসিভ করে তুর্য। তিরা ধমক দিয়ে বলে,

“কতবার ফোন দিয়েছি তোমায়?”
তুর্য আদুরে গলায় বলে,
“আমার সুইটমিট ভাবী, এত হাইপার হচ্ছো কেন? তোমার কিন্তু এই সময়ে মোটেও এত হাইপার হওয়া ঠিক না।”
“ফোন রিসিভ করোনি কেন?”
“ওহ। এই কারণ? আমি তো গাছে উঠছিলাম।”

“গাছে উঠছিলে?”
তিরার মুখে গাছে উঠার কথা শুনে তাহমিনা বেগম চেঁচিয়ে বলে,
“হায় আল্লাহ্! আমার আব্বু গাছে উঠছে ক্যান? ও তিরা ওরে বলো গাছ থেকে নামতে। পইড়া গেলে হাত-পা ভাইঙ্গা যাইব।”
ফোনের ওপাশ থেকে তাহমিনা বেগমের কথা শুনে হাসে তুর্য। হাসতে হাসতেই বলে,
“ভাবী মাকে বলো, আমি আর বাচ্চা নেই এখন। বড় হয়েছি।”
তুর্য ফোন রেখে দিলো। তুর্যর মনটা কাল থেকেই বেশ উদাস উদাস। কি হয়েছে কে জানে!

পর্ব ৬

মাসের আজ ২৮ তারিখ। নিশাত আর পরী মিলে বাড়ির সব মালপত্র গোছগাছ করছে। কাল সকালেই পিকআপে করে সবকিছু নিয়ে পাড়ি জমাবে সাভারের উদ্দেশ্যে। গায়ের ওড়না মাথায় দিতে দিতে পরী নিশাতকে বলল,
“হাঁড়ি-পাতিলগুলো ঐ বড় বস্তাটায় ভরিস। আমি বাড়িওয়ালাকে ভাড়াটা দিয়ে আসি।”
“আচ্ছা।”

পরীরা যে বাসায় থাকে সেটা পাঁচ তলার একটা ফ্লাট। তৃতীয় তলায় পরীরা থাকতো। বাড়িওয়ালারা ভীষণ ভালো মানুষ। তিন বছর হবে ওরা এই বাসায় থাকে। তাই তাদেরও পরীরদের ওপর মায়া জন্মে যায়। ভাড়া দিয়ে আসার সময় তিনি খুব মনমরা হয়েই কথা বলেন। কাল পিকআপে সব মালপত্র উঠিয়ে দেওয়া এবং সেগুলো সাভারের বাড়িতে ঠিকঠাক জায়গায় রাখার দায়িত্ব নিয়েছে বাড়িওয়ালার বড় ছেলে ও তার কিছু বন্ধু। পরীকে নিজের বোনের মতই ভালেবাসে ওরা।
বাড়িওয়ালার ফ্লাট থেকে বের হওয়ার সময় সূচীর সাথে দেখা হয়। সূচী একগাল হেসে বলে,
“তোমার কাছেই এসেছিলাম।”
“ভালোই হলো এসেছ। নাহলে তো আর দেখাই হতো না।”
“কেন বলো তো?”
সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে উঠতে পরী ওদের চলে যাওয়ার বিষয়টা সূচীকে জানায়। সব শুনে সূচী ছোট করে বলে,
“ওহ।”
এতক্ষণে ওরা রুমেও চলে এসেছে। পরী জিজ্ঞেস করে,
“চা খাবে?”
“না। খেয়েই এসেছি।”

“আচ্ছা বসো। আমি কাপড় গুছাই।”
“আমি তোমাকে হেল্প করি?”
“না, না। লাগবে না।”
“তুমি চলে কেন যাচ্ছো পরী?”
পরী একবার সূচীর দিকে তাকায়। মনে মনে বলে,
“এর অন্যতম কারণ যে তোমার স্বামী। তোমার সংসার। আমি থাকলে কখনোই হয়তো সুখের দেখা মিলবে না।”
“কি ভাবছো?”
“ভাবছি তোমায় মিস করবো।”

“এহ্! মিথ্যে কথা। তুমি কখনোই আমায় মিস করবে না আমি জানি। আমি আসার পর তোমায় একটাবারও দেখিনি ঐ বাড়িতে যেতে।”
“ব্যস্ততায় যাওয়া হয়ে উঠে না।”
“তোমরা কাজিনরা সবাই এক নাকি বুঝিনা বাবা। কয়দিন হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে? এরমধ্যেই জয়ের অফিসে যাওয়া শুরু করতে হলো?”
পরী কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না। এর কোনো সঠিক উত্তর কি পরীর আদৌ জানা আছে? আর থাকলেই বা কি? সেই উত্তরগুলে না পরী কখনো সূচীতে দিতে পারবে আর না সূচী সেই উত্তরগুলো হজম করতে পারবে। পরীকে চুপচাপ কাপড় গুছাতে দেখে সূচী হাত টেনে পরীকে বিছানায় বসায়। কোলে মাথা রেখে বলে,
“রোবট হয়ে যাও নাকি মাঝে মাঝে?”

সূচীর এহেন আচরণে হতভম্ব হয়ে যায় পরী। মেয়েটা নিতান্তই ছেলেমানুষি করে। আচ্ছা পরীর জায়গায় যদি অন্য কোনো মেয়ে থাকতো? সে কি কখনো তার ভালোবাসার মানুষটার বউকে এভাবে কোলে শুইয়ে হাসিমুখে গল্প করতে পারতো? নাকি নিজেকে তার থেকে দূরত্বে রাখতো? উত্তরটা পরীর জানা নেই। জানতেও চায় না। কি দরকার এতসব কিছু ঘাটিয়ে কষ্টগুলোকে বাড়িয়ে?
সূচী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিরসমুখে বলল,
“তোমার কি কোনো রিলেশন আছে পরী?”
“না।”

“কখনো কাউকে ভালোবাসোনি?”
“ভালোবাসোনি এই কথাটা আমার জীবনে নেই। আমি এখনো তাকে ভালোবাসি। হয়তো নিয়তি এক হতে দেয়নি কিন্তু ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি।”
“ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট অনেক তাই না পরী?”
“হু।”
সূচী এবার সোজা হয়ে উঠে বসে। ছলছল করা চোখে বলে,
“কেন জানিনা তোমার সাথে কথা বললে আমার শান্তি লাগে। তোমাকে চোখ বন্ধ করেও বিশ্বাস করতে মন সায় দেয়। তাই ঘরের কথাও তোমায় শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। আমি জয়কে খুব ভালোবাসি পরী। কিন্তু জয়ের মনে কোনো এক জায়গাজুড়েও আমি নেই। বললে হয়তো বিশ্বাস করবেনা, এখনো পর্যন্ত আমাদের মধ্যে ফিজিক্যাল কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি আমি নিজে থেকে কাছে যেতে চাইলেও সে খুব সুনিপুণভাবে আমাকে এড়িয়ে গেছে। তুমিই বলো, ভালেবাসার মানুষটার থেকে কি এমন ব্যবহার সহ্য করা যায়?”
পরীর বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। নিয়তি এই কোন খেলায় মাতলো তিনজনকে নিয়ে? এখানে তো জয় বা সূচীর কোনো দোষ নেই। সব দোষ পরীর। পরীর ভাগ্যের। তাহলে জয় আর সূচী কেন কষ্ট পাবে? জয়কে পরী ভালোবাসে। এখনো খুব ভালোবাসে। জয় এখন অন্যের স্বামী। আর অন্যের স্বামীকে ভালোবাসা অন্যায়, অপরাধ। কিন্তু পরীই বা কি করবে? অবাধ্য, বেহায়া মন তো আর সেটা বুঝতে চায় না। তবে পরীকে কিছু একটা করতে হবে। জয় সুখী না হলে সূচী সুখী হবেনা। আর ওরা এখন একে অপরের পরিপূরক। একজনের সুখ আরেকজনের ওপর অন্তর্নিহিত। ওরা সুখী না হলে পরী কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
পরী নিজেকে ধাতস্থ করে সূচীর দিকে তাকালো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বাচ্চাদের মত কাঁদছে। সূচীর দুই বাহু ঝাঁকিয়ে পরী বলল,
“আমার দিকে তাকাও।”
সূচী ছলছল করা চোখে তাকায়।

“এত অল্পতেই কাঁদলে চলবে বলো? নিজের ভালোবাসাকে ভালোবাসা দিয়েই জয় করতে হবে। তবে তার আগে দরকার কি জানো? তুমি জয় ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষ, ওয়াইফ হওয়ার আগে ভালো একজন বন্ধু হও। তার কষ্টগুলো বন্ধুত্বের মাধ্যমে কৌশলে দূর করার চেষ্টা করো। যদি বন্ধুত্বও গ্রহণ না করে তবে জোর খাটাও। ভালোবাসা না হয় জোর করে হয়না। কিন্তু বন্ধুত্বের ভালোবাসা, দায়িত্ব তো তুমি জোর করেও আয়ত্তাধীন করতে পারো। তখন একটা সময়ে দেখবে জয় ভাইয়া তোমাকে আপন করে নিবে। অল্পতে হার মেনে নিও না সূচী। জয় ভাইয়া এখন তোমার সারাজীবনের সঙ্গী। তোমাকে তার পাশে থাকতে হবে। তাকে সাপোর্ট করতে হবে। তার ভালোলাগা, খারাপ লাগাগুলো বুঝতে হবে। ভালো সলিউশন দিতে হবে। একজন সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ হয়ে তাকে ভালোবাসায় রাঙিয়ে নিতে হবে। না চাইতেও আল্লাহ্ তোমাদের ভালোবাসাকে বিয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা দিয়েছে। হয়তো জয় ভাইয়ার দিক থেকে এখনো সেটা পায়নি তবে তোমাকে বেশিদিন দূরেও রাখতে পারবেনা। তুমি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে সূচী।”
আচমকা সূচী পরীকে জড়িয়ে ধরে।

“তুমি খুব ভালো পরী খুব। তুমি চলে গেলে কে আমাকে এভাবে বুঝাবে? তুমি আমার আপন বোন হলে না কেন বলো তো?”
পরীর চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। কি সুন্দর স্বার্থপরের মতো ভালোবাসার মানুষটিকে আবদ্ধ করার জন্য বলে দিল সূচীকে। মাঝে মাঝে একটু স্বার্থপর হতে হয়। এতে অন্তত পারিপ্বার্শিক মানুষগুলো তো ভালো থাকবে।

ভোরেই মালপত্র সব গাড়িতে উঠিয়ে রওনা দেয় ওরা। যাওয়ার আগে একবারও দেখা করেনি খালা, জয় বা সূচীর সাথে। সূচী বারবার করে বলেছিল যাওয়ার আগে দেখা করতে। পরী ইচ্ছে করেই করেনি। যেখানে নতুন পথে পা বাড়াচ্ছে সেখানে আর পুরনো ক্ষত বাড়িয়ে লাভ নেই।
রাস্তায় যানজট কম হওয়ায় সাভার পৌঁছাতে খুব একটা সময় লাগলো না। গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটা ভালো করে নিলো পরী। এই বাড়িতে এর আগে কখনো আসেনি। পুরো বাড়িটা আকাশী আর সাদা রং করা। বাহির থেকে দেখে মনে হবে এটা আকাশের নীড়। আশেপাশে বিভিন্ন গাছগাছালি। তিনতলায় গিয়ে তালা খু্লে ভিতরে গিয়ে আরো অবাক হলো। চার রুমের ফ্লাট। রুমগুলোও বেশ বড়সড়। প্রতিটা রুমেই এটাচড বাথরুম। একটা কিচেন আর ড্রয়িংরুম। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যিনি বাড়িটা বানিয়েছিলেন বেশ শখ করেই বানিয়েছে। মামা বাড়িটা কিনেছে দুই কি তিন বছরের মত হবে।

বাড়িওয়ালার ছেলে আর নিশাত মিলে ঘরের ফার্ণিচারগুলো সাজাচ্ছে। পরী বলে দিয়েছে কোথায় কি রাখতে হবে। টুকটাক যা পেরেছে সবার জন্য রান্না করেছে পরী। সবকিছু গোছাতে গোছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সবাই বেশ ক্লান্ত এখন। সন্ধ্যায় নাস্তা করে ওরা সবাই চলে যায়। মায়ের শরীরটা এখনো ভালো না কারো সাথেই তেমন কথা বলেনা।

বাকি জিনিসগুলো হাতে হাতে গুছিয়ে নেয়। এখনো অনেক কিছুই বাকি। আপাতত এখন কোনো কাজে মন বসছে না। বাড়ি পাল্টানোর মত ঝামেলা বোধ হয় আর কিছু নেই। এমনিতেও জার্নি করেও খুব ক্লান্ত পরী। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দশটা বাজে। লাইট নিভিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এতক্ষণ ঘুম আসলেও এখন আর পরীর ঘুম আসছে না। কতক্ষণ এপাশ-ওপাশ করলো। এরপর ধীর পায়ে ছাদের দিকে এগুলো।
ছাদে পা রাখতেই বিশুদ্ধ বাতাস পরীকে ছুঁয়ে গেল। প্রাণভরে কিছুক্ষণ শ্বাস নিলো পরী। আকাশে আজ চাঁদ নেই। শুধু কয়েকটা তারা আছে। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে খোলা চুলগুলো উড়ছে পরীর। পরী আনমনে গান ধরে,
“Ab jane hum a pyar kya hai
Darde jigar mushkil bada hai,
Sunta nehi kehena koyi bhi
Dil bekhabar jitbe ara hai,,
Hare hare hare
Hum to dil se hare
Hare hare hare

Hum to dil se hare!!”
চিলেকোঠায় বসে ফোন চাপছিল তুর্য। নারীকণ্ঠে গান শুনে সোজা হয়ে বসলো। এত করুণ হয়ে কে গান গাইছে? কত না পাওয়া, বিষাদ যেন এই কণ্ঠে লুকিয়ে আছে। সামনে তাকিয়ে আবছা আলোয় একটা নারী অবয়ব দেখছে। এই সময়ে ছাদে কে আসতে পারে? মোবাইলে তাকিয়ে দেখে ১২:১ বাজে। আল্লাহ্ জানে কোন ভূত্নী ছাদে এসে গান শোনাচ্ছে। দোয়া-দরূদ পড়ে বুকে ফুঁ দেয় তুর্য। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় সামনে

পর্ব ৭

তুর্য ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় আর বিড়বিড় করে বলে,
“লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউর আজিম।”
পায়ের শব্দ পেয়ে পিছনে ঘুরে তাকায় পরী। হঠাৎ এভাবে কাউকে দেখে চমকে যায়। অন্ধকারে মুখ তেমন একটা বোঝা যাচ্ছে না। থমথমা গলায় পরী জিজ্ঞেস করে,
“কে আপনি?”

তুর্য ফ্লাশ অন করে পরীর মুখের ওপর ধরে। পরী দুই হাত দিয়ে আলো আড়াল করে।
“হচ্ছেটা কি? এভাবে মুখের ওপর আলো ধরেছেন কেন? আর কে আপনি?”
তুর্য আলো অন্য সাইডে ঘুরায়। আর পরীও মুখের ওপর থেকে হাত সরায়। এবার মুখ কিছুটা স্পষ্ট। তুর্য বলে,
“আরে আপনি?”
“আমি কি?”
“আমায় চিনতে পেরেছেন?”

“চেনার কথা কি?”
“অবশ্যই। এই দেখুন।”
ফোনের ফ্লাশ এবার নিজের দিকে তাক করলো তুর্য। পরীর চিন্তে অসুবিধা হলো না।
“চিনেছেন?”
“হু। আপনি এখানে কেন?”

“এটা আমার মামার বাড়ি।”
“ওহ আচ্ছা। আপনিই তাহলে আঙ্কেলের ভাগ্নি। এখন থেকে এখানেই থাকবেন?”
“হু।”
“আমি দুই তলায় থাকি।”
“জানি।”
“কিভাবে?”

“মামা বলেছিল।”
তুর্যর গলার স্বর খুশিতে গদগদ।
“তার মানে আপনি আমাকে আগে থেকেই চিনেন?”
“আজ্ঞে না। আমি শুধু জানতাম দুই তলায় মামার বন্ধুর ছেলে থাকে।”
“ওহ আচ্ছা। এতরাতে ছাদে যে?”
“এমনি।”
“ভয় করে না?”
“না।”

তারপর দুজনই চুপ। নিরবতা কাটিয়ে তুর্য বলল,
“আপনি খুব ভালো গান করেন।”
পরী একবার তুর্যর দিকে তাকায়। তারপর কিছু না বলেই সিঁড়ির দিকে হাঁটা ধরে। পরীর এমন আচরণে হতভম্ব হয়ে যায় তুর্য। যাওয়ার আগে কিছু তো অন্তত বলে যায় কেউ। পরীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে ছিল তুর্য। ছাদের মাঝখানে গিয়েই দাঁড়িয়ে যায় পরী। পিছনে ঘুরে বলে,
“আপনি আমার চেয়েও অনেক ভালো গান করেন।”
কথাটা রোবটের মতই বলল পরী। তারপর সোজা নিচে নেমে গেল। পরীর কথা শুনে মুচকি হাসলো তুর্য।

পরেরদিন সকালে সূচী ঘুম থেকে উঠেই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। জয় তখন অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। সূচী বলল,
“পরীর নাম্বার আছে আপনার কাছে?”
সূচীর কাছে পরীর নাম শুনে অবাক হলো জয়।
“আপনি পরীকে চিনেন?”

“না চেনার কি আছে? ও তো আপনার কাজিন।”
জয় চুপ হয়ে যায়।
“নাম্বার আছে নাকি বললেন না তো।”
“না নেই।”
সূচীর মনটা খারাপ হয়ে যায়।
“ওহ।”

পরক্ষণেই আবার বলে,
“ওর ফেসবুক একাউন্ট? আছে কি?”
জয়ের মেজাজটা এবার খারাপ হয়ে যায়। ধমক দিয়ে বলে,
“ওর এত ডিটেইলস আপনার কেন লাগবে? আর ওর এত ইনফরমেশন কি আমি পকেটে নিয়ে বসে আছি?”
সূচী কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
“বকেন কেন? ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে বলেই তো চাইলাম।”
“কথা বলার এতই যখন ইচ্ছা তখন ওর বাসায় গেলেই তো পারেন।”

“লাভ নেই। ও তো এখানে নেই।”
জয় এবার ঘুরে সূচীর দিকে তাকায়।
“নেই মানে?”
“আপনি জানেন না? ওরা তো এখান থেকে চলে গেছে।”
“কোথায়?”
“সাভার।”

“কবে গেল?”
“কাল সকালে।”
জয়ের বুকটা মোচর দিয়ে উঠলো। বাড়ি ছেড়েও চলে গেল। অথচ একটাবার জানানোরও প্রয়োজন মনে করলো না। আর বলবেই বা কেন? আমি তো পরীর কেউ না। আমাকে বলার তো কোনো রিজনও নেই।
জয় কিছু না বলেই না খেয়েই অফিসে চলে গেল।

১০টার দিকে বাজারে যায় পরী। আকাশ তখন মেঘলা ছিল। বাজার করে যখন আসছিল তখন অলরেডী বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। কোনো গাড়িও নেই তেমন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একটা রিক্সা পায়। অর্ধেক রাস্তা আসার পর দেখে একটা মেয়ে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে গাড়ির জন্যই অপেক্ষা করছে। মেয়েটার সামনে রিক্সা যেতেই পরী থামাতে বলে।
“মামা রিক্সা থামান।”
রিক্সা থামানোর পর পরী মেয়েটার উদ্দেশ্যে বলে,
“আপনি কি গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন?”
“হ্যাঁ। কিন্তু গাড়ির তো কোনো হুদিসই নেই।”

“কোথায় যাবেন?”
“এইতো সামনেই।”
“আমিও ঐদিকেই যাচ্ছি। সমস্যা না হলে এই রিক্সায় উঠতে পারেন।”
“অনেক ধন্যবাদ আপু।”
রিক্সায় বসে মেয়েটা বলল,
“নাম কি তোমার?”

“পরী। আপনার?”
“রুমকি। কোন বাসায় থাকো?”
“দুলাল মামাকে চিনেন? তিন তলার যে ফ্লাটটা? ঐ বাসায়।”
“ওহ আচ্ছা। চিনেছি। কিন্তু আগে তো তোমায় দেখিনি।”
“আমি কালই এসেছি।”

“ওহ। কি করো? আই মিন স্টাডি বা জব?”
“অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। আর পাশাপাশি একটা জব খুঁজছি।”
“কেমন জব করবে? না মানে আমার একটা শো রুমের দোকান আছে মেয়েদের জিনিসপত্র বিক্রি করি আরকি। তিনজন সেলসম্যান আছে। আর একজন লাগবে।”
“কোথায় এটা?”
“এই যা এসে পড়েছি। এখানেই আমার বাড়ি। তুমি আমার নাম্বারটা রাখো। ফোনে বিস্তারিত বলবো।”

“আচ্ছা।”
রুমকি নাম্বার দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়। আর দুই মিনিট গেলেই পরীর বাড়ি। ভাড়া মিটিয়ে পরী বাড়ির ভেতর ঢুকে।
তুর্য, নিশাতসহ আরো কয়েকটা বাচ্চা নিশাতের বয়সী হবে। ক্রিকেট খেলছে। বাড়ির সামনে খোলামেলা জায়গা থাকায় অনায়াসে এখানে ফুটবল, ক্রিকেট খেলা যাবে। পরীর মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়।বৃষ্টিতে ভিজে খেলার কোনো মানে হয়? পরী তেড়ে যায় নিশাতের দিকে। পরীকে দেখেই নিশাত তুর্যর পিছনে লুকায়।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পরী বলে,
“লুকাচ্ছিস কেন এখন? সামনে আয়।”

তুর্য হাত সামনে তুলে বলে,
“ওয়েট ম্যাম। এত রেগে যাচ্ছেন কেন?”
“সেই কৈফিয়ত আপনাকে দিব কেন? আর আপনার কি মিনিমাম কমনসেন্সও নেই? বৃষ্টিতে ভিজে বাচ্চাগুলো নিয়ে ক্রিকেট খেলছেন। জ্বর আসলে কি তখন আপনি সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সেবা করে আসবেন?”
“ওহ মাই গড! আপনাকে দেখে ভাবতাম আপনি সাধাসিধা একটা মেয়ে। এখন তো দেখছি পুরাই রাগের গোডাউন।”
“কথা ঠিক করে বলেন।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার না বৃষ্টি খুব পছন্দ? তাহলে ভাইকে ভিজতে দিতে সমস্যা কি?”

“আমার আর ওর বিষয় আলাদা।”
“বুঝলাম। আপনি তো জানেনই আমার বৃষ্টি পছন্দ না। তাই বৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করেই খেলতে আসলাম। আপনার ভাই এখানে নতুন এসেছে। ভাবলাম একটু খেলি ওর সাথে।”
“আপনার ভাবাভাবি বরং আপনার কাছেই রাখেন। নিশাত আয় আমার সাথে।”
নিশাত পেছন থেকে তুর্যকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“না। গেলেই তুমি এখন আমায় মারবা।”
“এখন যদি না আসিস তাহলে ডাবল মাইর খাবি।”
তুর্য বলে,
“আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি যান।”

পরী একবার চোখ গরম করে তুর্যর দিকে তাকায়। তারপর নিশাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আজ তুই বাসায়। মজা বুঝাচ্ছি তোকে।”
বাজারের ব্যাগ হাতে গটগট করে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায় পরী। আনমনেই হাসে তুর্য। সবার উদ্দেশ্যে বলে,
“আজকে খেলা এই পর্যন্তই। কাল আবার খেলবো কেমন?”
“ওকে ভাইয়া।”
বাচ্চারা সবাই সবার বাসায় চলে যায়। নিশাত তখনো কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশাতের হাত ধরে বলে,
“চলো।”
“আমি যাবো না। আপু মারবে আমায়।”
“আরে আমি আছি তো। মারবে না আসো।”

“না ভাইয়া। আপনি যান।”
“আচ্ছা তাহলে আমার ফ্লাটে চলো।”
নিশাত তুর্যর সাথে দুই তলায় যায়। একটা টাউজার আর টি-শার্ট নিশাতকে দিয়ে চেঞ্জ করে আসতে বলে। নিশাত চেঞ্জ করার পর তুর্যও চেঞ্জ করে নেয়। চা বানানো ছিল। গরম করে দুই কাপ চা নিয়ে আসে। একটা নিশাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে আরেকটা নিজে নেয়।
“আমি চা খাইনা ভাইয়া।”
“আজ খেয়ে দেখো ভালো লাগবে।”
নিশাত চা টা নেয়। তুর্য পাশে বসতে বসতে বলে,
“তারপর বলো কিসে পড়ো?”

“জেএসএসসি দিয়েছি।”
“ওহ। বাড়িতে কে কে থাকে?”
“আম্মু, নানু, আপু আর আমি।”
“তোমার আব্বু?”
“আব্বু মারা গেছে।”
তুর্যর বুকটা ধক করে উঠে। নিশাতের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ ছলছল করছে ওর। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“মন খারাপ করো না ভাই। একদিন সবাইকেই এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে।”
“হু।”

“মুভি দেখবে? ভূতের মুভি?”
নিশাত হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না। তুর্য নিশাতকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ল্যাপটপে ‘দ্যা কেবিন’ মুভি অন করে। অর্ধেক মুভি দেখেই ঘুমিয়ে যায় নিশাত। তুর্যরও খুব ঘুমঘুম পাচ্ছে। ল্যাপটপ বন্ধ করে একটা কাঁথা টেনে নেয় দুজনের ওপর। তারপর চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে।
ঐদিকে এখনো নিশাতকে আসতে না দেখে ব্যালকোনিতে গিয়ে উঁকি দেয় বাহিরে। কেউই তো নেই। পরীর এবার টেনশন হয়। ভয়ে আবার কোথায় লুকিয়ে রইলো ভেজা অবস্থায়? পরী তাড়াতাড়ি নিচে নেমে খুঁজে কিন্তু নিশাতকে পায় না।
“নিশাত দুই তলায় নেই তো?”
পরী দুই তলায় গিয়ে কলিংবেল বাজায়। কিন্তু কেউই দরজা খুলে দিচ্ছে না। আস্তে করে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে দেয়।
“অদ্ভুত তো! দরজা ভেতর থেকে লক করেনি নাকি।”

তুর্য মূলত পরীর জন্য দরজা লক করেনি। কারণ তুর্য জানতো নিশাতের খোঁজে পরী আসবে। আর বেল বাজালে নিশাত ভয়ে দরজা খুলতে দিবে না। তাই বাধ্য হয়ে দরজা লক করেনি। আর এখন তো দুজনই গভীর ঘুমে।
পরী এখন পড়েছে দোটানায়। মামা বলেছিল বন্ধুর ছেলে মাঝে-মাঝে থাকে। তার মানে একাই থাকে। ব্যাচেলর! যদি ভেতরে নিশাত না থাকে? আর ঐ লোকটার স্বভাব, চরিত্র কেমন সেটাও তো জানেনা পরী। যদি একলা ফ্লাটে পেয়ে? পরক্ষণেই পরী নিজের গালে নিজে আস্তে চড় দেয়।
“ছিঃ ছিঃ পরী! এসব তুই কি ভাবছিস। হয়তো লোকটা একটু বেশি কথা বলে। কিন্তু চরিত্র খারাপ মনে হচ্ছে না। কিন্তু তবুও। এভাবে পারমিশন ছাড়া ফ্লাটে ঢুকা কি ঠিক হবে?”
দোনোমোনো করতে করতে শেষমেশ ফ্লাটে ঢুকেই পড়ে। পা টিপে টিপে সামনে যায়। বাকি রুমগুলো বাহির থেকে লক করা। শুধু একটা রুমের দরজা খোলা। পরী পা টিপে টিপে ঐ রুমে যায়। রুমে গিয়ে তো পরী অবাক।
নিশাত আর তুর্য দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে মগ্ন। কাঁথাটাও পায়ের কাছে এসে পড়েছে। নিশাতের যে ঠান্ডা লাগছে তা নিশাতের গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকা দেখেই বুঝেছে। পরীর হঠাৎ বড় ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। নিশাত বড় ভাই নিহালকেও এভাবেই ধরে ঘুমাতো। বুকটা কেঁপে উঠে। কেন সে এসব অতীত ভাবতে যাচ্ছে। পরী এগিয়ে গিয়ে কাঁথাটা নিশাতের গায়ে দিয়ে দেয়। পরেই আবার কি মনে হলো কে জানে! তুর্যর গায়েও কাঁথা জড়িয়ে দিলো। নিশাতের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কপালে চুমু খায়। ভয়ে বাসায় না গিয়ে এখানে ঘুমিয়ে আছে ভাবতেই হেসে ফেলে পরী। উঠে আসার সময়ই ফট করে হাত ধরে ফেলে তুর্য। চোখ মেলে অমায়িক একটা হাসি দেয়। পরী একবার তুর্যর দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার ধরে রাখা হাতের দিকে। তুর্য সেটা বুঝতে পেরে হাতটা ছেড়ে দেয়। চোখ দুইটা ছোট ছোট করে বলে,
“স্যরি।

পর্ব ৮

তুর্য স্যরি বলেই আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। এই ছেলের ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলার স্বভাব আছে নাকি কে জানে! পরী আর সেখানে দাঁড়ালো না। সোজা তিন তলায় চলে গেল।
রাতের রান্নাবান্না শেষ করে একটু বিশ্রাম নেয় পরী। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৭:০৫ বাজে। আটটার দিকে মাকে খাইয়ে আবার ওষুধ খাওয়াতে হবে। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে রুমকির নাম্বারে ডায়াল করে। তিনবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হয়। পরী সালাম দিয়ে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আপু।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন?”

“আমি পরী। আজ যে দেখা হলো।”
“ওহ হ্যাঁ। চিনেছি। কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌ আপু। আপনি?”
“হ্যাঁ ভালো আছি। তো তুমি কি জবটা করতে চাও?”
“আপাতত অন্যান্য জবের বিষয়ে তো কিছুই বলতে পারছি না। এইদিকে সংসারটাও আমাকেই সামলাতে হচ্ছে। তাই আমার কোনো অসুবিধা নেই।”
“কে কে থাকো?”
“আম্মু, নানু, ছোট ভাই আর আমি।”

“বাবা, বড় ভাই নেই?”
“না।”
“আচ্ছা বাদ দাও এসব। তাহলে কাল আসো আমার শো রুমে। আমি এড্রেস ম্যাসেজ করে দিচ্ছি। যদি তোমার ভালো লাগে তাহলে জবটা করতে পারো।”
“কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত?”
“সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা। আমি তোমাকে মাসে সাত হাজার দিবো। চলবে?”

“হ্যাঁ।”
আরো কিছুক্ষণ দুজনে কথা বলে ফোন কেটে দেয়। প্লেটে খাবার বেড়ে মায়ের ঘরে যায়। নানু আর মা এক রুমেই থাকে। নানু ফ্লোরে বসে পান ছেঁচছিল। প্লেট টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে পরী বলে,
“আমি ছেঁচে দেই?”
“হইয়া গেছে। খাইছোস তুই?”
“না। মাকে আগে খাইয়ে নিই। তুমি এখন পান খাচ্ছো কেন? ভাত খাবে না?”
“পরে খামু। তগোর ওপর কি যে অভিশাপ আইলো।”

নানুর চোখে পানি স্পষ্ট। কষ্ট তো পাওয়ারই কথা। পরী নানুকে শান্তনা দিয়ে বলে,
“তুমি শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছো। একটা ভালো খবর আছে। আমার একটা চাকরী হয়েছে।”
“যাক। আল্লাহ্ মুখের দিকে তাকাইছে।”
পরী চুপচাপ ওর মাকে খাইয়ে দিয়েছে। তার মুখে কোনো কথা নেই। যেন বাক্যহীন হয়ে গিয়েছে। বাবার মৃত্যুটা মা মেনে নিতে পারেনি। যার করুণ দশা এখন পোহাতে হচ্ছে। খাওয়ার শেষে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে মাকে শুইয়ে দেয়। পাশে বসে চুলে বিলি কেটে দেয়। এরকমটা আগে হতো। তবে উল্টো। যখন পরী বাড়ির কারো সাথে খুব রাগ করতো তখন না খেয়ে থাকতো। মা জোর করে খাইয়ে দিয়ে চুলে বিলি কেটে দিত। আদর করতো। আর আজ? আজ সবই শুধু অতীত।

নিশাতের ঘুম ভেঙ্গেছে। বিছানায় বসে আড়মোড়া ভেঙ্গে দেখে তুর্য মোবাইলে গেম খেলছে। নিশাতকে উঠতে দেখে তুর্য হেসে বলে,

“ঘুম হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“চলো বাহির থেকে খেয়ে আসি।”

“না ভাইয়া। আপু রাগ করবে।”
“রাগ করবে কেন?”
“আপু তো আমার জন্য রান্না করেছে।”
“তুমি না ভয়ে ফ্লাটে যাচ্ছিলে না?”
“হ্যাঁ ভয় তো পাই। কিন্তু আমার আপু অনেক ভালো। যতই রাগ দেখাক। খুব ভালোবাসে আমায়।”
“তাই? আজ আমার এখানেই থাকো।”
“না। আপু চিন্তা করবে।”

“তোমার আপু বোধ হয় এসেছিল।”
“কখন?”
“সেটা মনে নেই। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছিলাম নাকি সত্যিই এসেছিল বুঝতেছি না।”
“ওহ। আপনি কি একাই থাকেন ভাইয়া?”
“হ্যাঁ এখানে একাই থাকি। আমার বাড়ি বসুন্ধরা।”
“ওহ। আচ্ছা ভাইয়া আমি তাহলে এখন আসি।”

“আচ্ছা যাও।”
নিশাত পা টিপে টিপে তিনতলার ফ্লাটে ঢুকে। পরী তখন নানুকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিল। নিশাত পেছন থেকে পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমার মিষ্টি আপুনি।”
“ফাজিল। তোর মিষ্টি আপুনি ছুটাচ্ছি আমি। ছাড় আমাকে।”
“না, না, না।”
“এখানে এসেছিস কেন? এতক্ষণ যার কাছে ছিলি তার কাছে যা।”

“স্যরি আপু। আর এমন হবে না। প্রমিস।”
“হইছে। এখন খেতে বোস।”
নিশাত পরীকে ছেড়ে দিয়ে গালে চুমু খেল। পরীর রাগও তখন ভ্যানিশ হয়ে গেল। পরম আদরে নিশাতের চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো।
“নানুর কি কি লাগে দেখিস। আমি দুধটুকু গরম করে আনি।”

“আচ্ছা।”
পরী রান্নাঘরে চলে যায়। আজ মুরগির মাংস ভুনা করেছিল আর ডাল রান্না করেছিল। নিশাত প্লেটে খাবার নিয়ে ভাত মাখছিল তখন ওর তুর্যর কথা মনে হয়। তুর্যর তো এখানে কেউ নেই। নিশাত একবার উঠে রান্নাঘরে উঁকি দিলো। তারপর ফিরে এসে প্লেটে ভাত আর মাংস বেড়ে নিল। নানুকে বলল,
“নানু, মায়ের রুম থেকে কি কোনো শব্দ পেলে?”
“কিয়ের শব্দ?”
“জানিনা তো। তুমি একটু দেখে আসবে? তোমার তো খাওয়া প্রায় শেষ।”

“দাঁড়া দেইখা আহি।”
নানু যাওয়ার পরই প্লেট নিয়ে দুই তলায় চলে আসে নিশাত। তুর্য তখন বাহিরে খেতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। নিশাত প্লেট নিয়ে তুর্যর সামনে দাঁড়াতে তুর্য প্রশ্ন করে,
“হাতে কী?”
উপরের প্লেট সরাতে সরাতে নিশাত উত্তর দেয়,
“ভাত আর মাংস। আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।”
“কেন?”
“কেন মানে? আপনি তো এখানে একাই থাকেন। রান্না করে দেয় কে?”
“কেউ না। আমি রেষ্টুরেন্টে গিয়ে খাই।”
“আপনি রান্না করতে পারেন?”
“না।”

“আমার আপুর রান্না খেয়ে দেখেন। হেব্বি টেষ্ট।”
“লুকিয়ে এনেছ?”
“হুম।”
“এটা একদম ঠিক করোনি। বাসায় নিয়ে যাও।”
“আমি এত কষ্ট করে আনলাম আর আপনি খাবেন না? এগুলো ফেরত নিলে আপু আমায় মারবে ভাইয়া।”
“কিন্তু”
“প্লিজ ভাইয়া। একবার খেয়ে দেখুন। ভালো না লাগলে আর খেতে হবে না।”
নিশাতের আবদার ফেলতে পারে না তুর্য। হাত ধুয়ে খেতে বসে।
“তুমি খেয়েছ?”

“হায় আল্লাহ্। আমি তো ভাত মেখে রেখে এসেছি টেবিলে। আমি যাই।”
নিশাত দৌঁড়ে চলে গেল। তরকারীর চেহারাই লোভনীয়। যে রান্না দেখতে সুন্দর সেই রান্না খেতেও মজা। তরকারীর সুগন্ধ নাকে যেতেই চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নেয় তুর্য। তরকারী দিয়ে ভাত মেখে এক লোকমা মুখে নিতেই অবাক হয়। সত্যিই মেয়েটা ভালো রাঁধে। সব ভাত খেয়ে পানি পান করে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে। পেটে হাত বুলিয়ে বলে,
“জম্পেশ খাওয়া হলো আজ। ভাগ্যিস নিশাত লুকিয়ে খাবার এনেছিল। আহ্! কতদিন পর বাড়ির রান্না খেলাম। রেষ্টুরেন্টের খাবার সবসময় ভালো লাগে নাকি। মাঝেমাঝে এভাবে লুকিয়ে খাবার আনলে মন্দ হয় না।”

রাতে অফিস শেষ করে বাড়ি ফিরে জয়। গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে ওয়াশরুমে যায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে সূচী। গোসল শেষে টাওয়াল পেঁচিয়ে হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। জয়কে এভাবে দেখে খাট থেকে পড়তে নিয়েও নিজেকে সামলে ফেলে সূচী। মনে মনে বলে,
“মা গো মা! আমার হাজবেন্ড এত্ত কিউট আর হ্যান্ডসাম! উফ আল্লাহ্ ভাগ্যগুণে জয়কে স্বামী হিসেবে পেয়েছি বলতে হবে। আচ্ছা পরী যেন কি বলেছিল? বন্ধু হতে বলেছিল না? হুম। কথাগুলো এপ্লাই করার সময় এসে গেছে।”
সূচী বিছানা ছেড়ে উঠে আসে।

“পানি খাবেন?”
জয় টি-শার্ট পড়তে পড়তে বলে,
“না।”
“আপনি কি এমনই?”
“কেমন?”
“এইযে চুপচাপ থাকেন।”

“হুম।”
“আমরা কি বন্ধু হতে পারি?”
সূচীর কথা শুনে জয় আপাদমস্তক দেখে সূচীকে। সূচী ঢোক গিলে বলে,
“এভাবে কি দেখছেন?”
“ড্রিঙ্কস করেছেন নাকি?”
“ছিঃ! এসব কেন খেতে যাবো। স্বামী-স্ত্রী কি বন্ধু হতে পারে না?”
“জানিনা।”

জয় খাওয়ার রুমে চলে গেল। সূচীর রাগ হচ্ছে খুব। এত এটিটিউড একটা মানুষের কি করে থাকতে পারে? পরক্ষণেই সূচী নিজেকে ধাতস্থ করে।
“না সূচী অল্পতেই এত রেগে যাওয়া যাবে না। পরী বলেছে ধৈর্য ধরতে। আশা না হারাতে। পরীর কথা আমায় শুনতে হবে। জয়ের মন জয় করতেই হবে।”
সূচীও গিয়ে জয়ের পাশে বসে। জয়ের বাবা-মা আগেই খেয়ে নিয়েছে। তারা এখন তাদের রুমে। জয় চুপচাপ খাচ্ছে। সূচী ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে,
“খাইয়ে দেন তো।”
জয় চোখ গরম করে তাকায়।
“ওভাবে তাকান কেন হ্যাঁ? আমি তো আর আপনাকে খেতে চাইনি। কয়টা ভাতই খেতে চেয়েছি। দিননা খাইয়ে।”
“আপনার হাত কি লুলা হয়ে গেছে?”

“আপনার হাতে খাওয়ার জন্য কি নিজের হাত লুলা বানাতে হবে? তখন সবাই কি বলবে? জয়ের বউ লুলা?”
“বড্ড বেশি কথা বলেন আপনি।”
“পরী শিখিয়েছে।”
“কিহ্!”
“না মানেআসলে”
“কি মানে আসলে? সবসময় শুধু পরী পরী আর পরী।”
সূচী মুখটা কাচুমুচু করে বলে,
“আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?”

“রাগ হয়েছে তাই।”
জয় খাবার প্লেটে পানি ঢেলে রুমে চলে যায়। সূচী আহমক হয়ে বসে আছে। করতে চাইলো কি আর হলো কি!
সূচীও না খেয়ে জয়ের কাছে যায়। জয় ব্যালকোনিতে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। জয়কে অবাক করে দিয়ে সূচী সিগারেটটা ফেলে দেয়। জয় রাগে ফুঁসতে থাকে। জয়কে আরো অবাক করে দিয়ে সূচী জড়িয়ে ধরে জয়কে।

আজও ছাদের চিলেকোঠায় বসে আছে তুর্য। প্রায়ই এখানে এসে বসে থাকে। রাতের ঠান্ডা বাতাসে মনটা শান্ত হয়ে যায়। পরীও ছাদে আসে। ছাদের কার্ণিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে আজ আকাশে অনেক তারা আর সাথে অর্ধবৃত্ত চাঁদ। পরীকে দেখে তুর্যর মুখে হাসি ফুঁটে। হেলেদুলে পরীর কাছে এসে পিছন থেকে বলে,
“এই ভূত্নী।”
পরী পিছনে তাকিয়ে বিরক্তিস্বরে বলে,
“কিসের ভূত্নী? আমার নাম পরী।”

“জ্বীন, পরী, ভূত, ভূত্নী, পেত্নী একই হলো।”
পরী আর কিছু বললো না। তুর্যই বলল,
“তারা গুণছেন? আমি কি আপনাকে হেল্প করবো? এতগুলো তারা তো একা গুণতে পারবেন না।”
“এত গায়ে পড়া স্বভাবের কেন আপনি?”
“এটা কিন্তু মিথ্যা কথা। আমি গায়ে পড়লাম কখন?”
পরীর রাগে শরীর জ্বলছে। আর তুর্য মিটমিট করে হাসছে।
“এমন সাপের মত ফুঁসতেছেন কেন পরী বেগম?”
“আমি বেগম?”
“আচ্ছা তাহলে পরীবানু?”

“বিরক্তিকর।”
“আমায় বিরক্তিকর বললেন? আমায়? আমি অভিশাপ দিলাম যান। আমার মতই একটা হাজবেন্ড যেন আপনি পান। তখন দেখব কিভাবে সহ্য করেন।”
“শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।”
“তাহলে চলুন বিয়ে করে দেখাই?”
কথাটা চোখ মেরে বলল তুর্য।

পর্ব ৯

তুর্যর কথা শুনে অবাক না হয়ে পারে না পরী। মাত্র দু’দিনের পরিচয়ে একটা মানুষ কিভাবে এত অবলীলায় বিয়ের কথা বলতে পারে? পরী কপট রেগে বলে,
“আপনার মাথায় কোনো সমস্যা আছে?”
“আগে তো ছিল না। তবে এখন মনে হয় হবে।”

“শুনুন এসব ফাইজলামি আমার সাথে চলবে না। নেহাৎ আপনি মামার বন্ধুর ছেলে। নয়তো এই বাড়ি থেকে বের করার ব্যবস্থা করতাম।”
“আহা! রমণী এমন রণচণ্ডী হলে চলে নাকি? রমণী হতে হবে কোমল। যেন বারবার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে।”
“আপনাকে যদি এখন ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারতাম তাহলে আমার শান্তি হতো।”
“শান্তি হতো না ছাই। পরে ভূত হয়ে আপনার ঘাড়েই চাপতাম। একদিক দিয়ে ভালোই হতো। আপনি ভূত্নী আর আমি ভূত। দুজনের কেমিস্ট্রি জমে ক্ষীর হয়ে যেত।”
“ধ্যাত! একটু ছাদে এসেও শান্তি নেই।”

রাগের চোটে ছাদ থেকেই নেমে গেল পরী। আর তুর্য খিলখিল করে হেসে উঠলো। পরীকে রাগিয়ে দিতে কেন জানি ভালো লাগে তুর্যর। মেয়েটা রেগে গেলে বাচ্চা বাচ্চা লাগে। এজন্যই বোধ হয় ভালো লাগে পরীকে। তবে তুর্য ভালোলাগা আর ভালোবাসা বিষয়টাকে এক করে না। ভালোলাগা এক জায়গায় আর ভালোবাসা আরেক জায়গায়।

বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে সূচী। একটু আগে করা কাহিনীর কথা ভাবতেই লজ্জায় শিউরে যাচ্ছে সূচী। কিভাবে জয়কে জড়িয়ে ধরলো। সূচী ভেবেছিল জয় হয়তো বকবে বা মারবে। কিন্তু জয় এমন কিছুই করেনি। শুধু সূচীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ছাদে চলে যায়। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে করতে ভাবতে থাকে কবে সে জয়কে নিজের করে পাবে। কবে জয় সূচীকে মন থেকে ভালোবাসবে।
সকালে ঘুম ভাঙ্গে সূচীর। জয় পাশে নেই।রাতে ঘুমানোর সময়ও জয়কে দেখেনি। হয়তো অনেক রাতে ছাদ থেকে এসেছিল। সূচী ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। শ্বাশুরী তখন বসে বসে টিভি দেখছিল। সূচী শ্বাশুরীর উদ্দেশ্যে বলে,
“মা আপনার কাছে কি পরীর নাম্বার আছে?”
সূচীর কথা শুনে টিভি থেকে চোখ সরিয়ে একবার সূচীর দিকে তাকান তিনি।
“কেন?”
“কথা বলতাম একটু।”
“ওর সাথে এত কিসের কথা?”

“এমনিতেই। তেমন কোনো জরুরী নয়।”
“তাহলে কথা বলার দরকার নেই। টেবিলে খাবার আছে খেয়ে নাও।”
সূচীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। প্রথমদিন নিজেই পরীর কাছে পাঠিয়েছিল। আর আজ মুখভঙ্গি এমন যে তিনি পরীকে সহ্যই করতে পারছেন না। ঐদিকে জয়েরও পরীর ওপর রাগ বোঝা গেল। এই বাড়ির মানুষগুলোর সমস্যা কী? তারা কেন পরীকে দেখতে পারেনা। নয়ছয় ভাবতে ভাবতে সূচী চেয়ার টেনে বসে। ড্রয়িংরুম আর জয়ের বাবা-মায়ের রুম পাশাপাশি হওয়ায় রুম থেকেই জয়ের বাবা সূচী ও তার স্ত্রীর কথোপকথন শুনতে পান। তিনি সূচীকে ডাকেন।
“বৌমা এক গ্লাস পানি দাও তো।”
ব্রেডে জেলী লাগাচ্ছিল সূচী। শ্বশুরের ডাক শুনে এক গ্লাস পানি নিয়ে রুমে যায়।
“বাবা আপনার পানি।”
“টেবিলের ওপর রাখো।”

সূচী টি-টেবিলের ওপর গ্লাসটা রাখলো। তিনি বললেন,
“পরীর সাথে কথা বলাটা কি খুব জরুরী?”
“না বাবা তেমন নয়। একটু কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল আরকি!”
“আমার ফোনে নাম্বার আছে দেখো।”
সূচী খুশিতে হকচকিয়ে উঠে। নিজের রুমে দৌঁড়ে গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসে। তারপর শ্বশুরের ফোন থেকে পরীর নাম্বারটা তুলে নেয়। শ্বশুরকে ধন্যবাদ বলে বেরিয়ে যায়। প্লেটে খাবার নিয়ে নিজের রুমে যায়। জয়ের মা বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরে নিজের রুমে আসে। স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে,
“পরীর নাম্বার দিয়েছ?”

“হুম।”
“কেন?”
“কেন আবার কী? সূচী কথা বলতে চেয়েছে তাই।”
“সংসারে অশান্তি না করে কি তুমি ছাড়বে না? শেষমেশ খাল কেটে কুমির না আনে সূচী।”
“তোমার মানসিকতা এত নিচু কেন বলো তো? তুমি সত্যিই পরীর খালা? নিজের ভাবনা-চিন্তাকে একটু উন্নত করো। দেখবে আশেপাশের সবকিছুই ভালো হচ্ছে।”
“এখন দোষ তো আমার হবেই। সংসার নষ্ট হলে আমার হবে। তাতে তোমার তো আর কিছুনা।”
“যেভাবে বলছ যেন সংসারটা তোমার একারই।”
“তোমার সাথে কথা বলা মানেই সময় নষ্ট।”
“উচিত কথা সবার সহ্য হয় না।”
বেশ কিছুক্ষণ এ নিয়ে দুজনের কথা কাটাকাটি হয়।

নয়টা বাজার দশ মিনিট আগেই শো রুমে পৌঁছে যায় পরী। দরজা ঢেলে ভেতরে ঢুকতেই রুমকি মিষ্টি হেসে বলে,
“কেমন আছো পরী?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌ আপু। আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। বসো এখানে।”
পরী একটা চেয়ার টেনে বসে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে সেলসম্যানরা কাজ করছে। তিনজন সেলসম্যানের মধ্যে একজন ছেলে ও বাকি দু’জন মেয়ে। আর একটা পিচ্চি মেয়ে শো রুমের ভেতর গুটিগুটি পায়ে দৌঁড়াচ্ছে। বয়স চার বছরের মধ্যে হবে। রুমকি জিজ্ঞেস করল,
“ব্রেকফাস্ট করেছ?”

“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা। ওদের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেই।”
রুমকি ওদের তিনজনকেই ডাকলো। একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।দেখতে লম্বা, চিকন ও সুদর্শন ছেলেটির নাম সিয়াম। অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ে। কোঁকড়া চুল, চশমা পড়া মেয়েটার নাম রিনি। ডিগ্রী ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। আর ছিপছিপে গড়নের ফর্সা মেয়েটার নাম শশী। রুমকির কথার মধ্যে সিয়াম বলল,
“আপু আমার একটা আর্জি আছে।”
“তোর আবার কি আর্জি?”
“পরীকে আমার দলে দিতে হবে।”
“তোর আবার কিসের দল? !

“তুমি জানো না আপু? রিনি আপু আর শশী এক দলে। সময় পেলেই আমায় পঁচাবে। ভেবেছিলাম এবার একটা ছেলে সেলসম্যান আনবে। কিন্তু তা তো আর হলো না। সেই মেয়েদের দলই ভারি হবে। তাই পরীকে আমার দলে থাকতে হবে।”
সিয়ামের কথা শুনে সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। শশী মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তা হবে না। পরী আমাদের দলেই থাকবে।”
সিয়াম পরীর দিকে তাকিয়ে করুনস্বরে বলল,
“দয়া করিয়া আপনি আমার দলে থাকিবেন কি?”
এবারও সিয়ামের কথা শুনে কেউ না হেসে পারলো না। হাসি থামিয়ে রুমকি বলল,
“ওরা সবাই অনেক ফ্রি। আমরা একটা পরিবারের মতো। সবাই সবার সাথে সুখ, দুঃখ শেয়ার করি। ফাইজলামি করি।আজ থেকে তুমিও আমাদের পরিবারের একজন। তুমি আবার ওদের কথায় কিছু মনে করো না।”
“না, না আপু। কিছু মনে করার কী আছে!”
“হুম। তুমি আজ থেকে কসমেটিক্সের সেকশনে বসবে।”

“ঠিক আছে।”
ঐ পিচ্চিটা এতক্ষণে দৌঁড়ে এসে রুমকির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
“মাম্মাম এই আন্টিটা কে?”
রুমকি মেয়ের গালে চুমু খেয়ে বলে,
“এটা তোমার নতুন আন্টি। এখানে কাজ করবে এখন থেকে।”
“আন্টিটা খুব সুন্দর মাম্মাম।”
পিচ্চিটার কথা শুনে হাসলো পরী। রুমকির কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে বলল,
“নাম কি তোমার?”
“সকাল।”

“বাহ্! অনেক সুন্দর নাম তো।”
“থ্যাঙ্কিউ আন্টি।”
যে যার জায়গায় বসে পড়লো। শপটা যতটা ছোটখাট মনে হয়েছিল তা নয়। অনেক বড় এই দোকানটা। আর বেশ নামীদামীও। কাষ্টমার বেশি আসে সন্ধ্যার পর থেকে। তার আগে তেমন কারো আনাগোনা নেই। সিয়াম ছেলেটা খুব ফাজিল। এত মজার মজার কথা বলে যে কেউ না হেসে পারে না। আর সুযোগ পেলেই পরীকে লাইন মারছে। পরী বুঝেও হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে। সিয়াম নিজের সেকশন ছেড়ে পরীর সেকশনে এসে বলে,
“এই কিউটিপাই কি করছো?”
“নাচি। নাচবেন?”
“তুমি আমার সাথে নাচলে কোনো সমস্যা নেই।”

“নিজের কাজে যান।”
পাশ থেকে শশী বলে,
“খবরদার পরী। সিয়াম ভাইয়ের ফাঁদে ভুলেও পা দিয়ো না। পাক্কা চিটিংবাজ কিন্তু।”
সিয়ামের মুখের রং পাল্টে যায়। শশীকে ধমক দিয়ে বলে,
“নিজের কাজ করো না বাপু। নিজে তো প্রেম করলেই না। এখন অন্য কাউকেও করতে দিচ্ছো না।”
“হুহ! বয়েই গেছে আপনার সাথে প্রেম করতে।”
সিয়াম শশীকে মুখ ভেংচি দিয়ে পরীকে বলে,
“কি জানি বলছিলাম?”

“জানিনা ভাইয়া।”
“ভাইয়া? আমি তোমার ভাইয়া লাগি? দিলে তো মনটা ভেঙ্গে আমার। নাহ্! এই জীবনে আর প্রেম হবে না আমার।”

তিনটার দিকে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে জয়। উদ্দেশ্য এখন সাভারে যাওয়া। পরী কেন এভাবে না বলেই চলে গেল সেটা একবার জানতে চায় জয়। যদিও জয় জানে পরীর কাছে এখন জয়ের কোনো মূল্য নেই। তবুও জয় যাবে। কিছু বলার মত না পেলে বলবে নানুকে দেখতে এসেছিল। রাতে মামাকে ফোন দিয়ে বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়েছে। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাসে উঠে পড়ে।
নবীনগরের কাছাকাছি আসতেই মনে হলো বাসায় চলে যেতে। পরীর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে? কী বলবে? কিন্তু মন চলে যেতে সায় দিচ্ছে না। চোখের দেখা একটাবার হলেও দেখতে চায় জয়।
পড়ন্ত বিকেলে চারজন একসাথে শো রুমে আসে। পরী তখন সকালের সাথে কথা বলছিল। রুমকি তাদের উদ্দেশ্যে বলে,
“কি লাগবে আপনাদের?”
তাদের মধ্যে একটা মেয়ে উত্তর দেয়,
“কসমেটিক্স দেখব।”

আরেকজন উত্তর দেয়,
“ড্রেস দেখব।”
রুমকি পরী ও রিনির উদ্দেশ্য বলে,
“তারা যা দেখতে চায় দেখাও।”
রুমকির কথা শুনে সেদিকে তাকায় পরী। ওদের চারজনের মধ্যে দুইজন মেয়ে। আর দুইজন ছেলে। ছেলেদের মধ্যে একজন তুর্য।একটা মেয়ের সাথে তুর্য পরীর সেকশনে এগিয়ে আসে। মেয়েটা পরীকে বলে,
“আপু ভালো কিছু লিপস্টিক দেখান।”
পরী অনেকগুলো লিপস্টিক বের করে দিলো। মেয়েটা লিপস্টিকগুলো দেখছে। তুর্য উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে পরীর দিকে। কারেন্ট না থাকায় জেনারেটর চলছে। এসি বন্ধ। পরীর মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। পরী আর দ্বিতীয় বার তুর্যর দিকে তাকায়নি।

পর্ব ১০

তুর্য এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে পরী খুব বিব্রতবোধ করছে। মেয়েটা লিপস্টিক দেখছে। এক পর্যায়ে তুর্যকে জিজ্ঞেস করে,
“দেখ তো ভাইয়া কোন লিপস্টিকগুলো বেশি সুন্দর?”

তুর্য ধমক দিয়ে বলে,
“আমি কি মেয়ে? নাকি আমি লিপস্টিক দেই যে আমায় জিজ্ঞেস করছিস।”
মেয়েটা মুখে ভেংচি কেটে বলে,
“যখন বউর জন্য কিনবি তখন তো ঠিকই পছন্দ করতে পারবি। আর বোনের বেলায় শুধু ধমক তাই না?”
আরেকটা মেয়ে যে ওদের সাথে এসেছিল। সে কাছে এসে বলে,
“কি শুরু করলি তরী? এটা বাড়ি না।”

“ওরে বাবারে! তুই আমার বান্ধবী নাকি শত্রু রে? ভাইয়ার পক্ষ নিচ্ছিস কেন? ভাইয়াকে পটানোর ধান্দা তাই না?”
তরীর এই কথায় মেয়েটা ঘাবড়ে যায় আর সাথে লজ্জাও পায়। পরী তাকিয়ে তাকিয়ে সবাইকে দেখছে আর ওদের কথা শুনছে। আর কিছুদূর কথা এগোতে দিলেই তুমুল ঝগরা বাঁধিয়ে ফেলবে। তাই পরী যথাসম্ভব ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
“আপু আমি পছন্দ করে দিলে চলবে?”
তরী যে পরীর কথায় খুব খুশি হলো তা ওর মুখভঙ্গি দেখেই বুঝা গেল। তেমনভাবেই বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ আপু নিশ্চয়ই।”
পরী মিষ্টি হেসে তিনটা লিপস্টিক তরীর দিকে এগিয়ে দিলো।

“এই তিনটা লিপস্টিকেই আপনাকে খুব মানাবে। যেটা ভালো লাগে নিতে পারেন।”
“তাহলে আমি এই তিনটাই নিবো।”
তরী আরো কিছু কসমেটিক্স, ড্রেস কিনলো। যতক্ষণ ওরা পরীর সাথে কথা বলেছে ততক্ষণ তুর্য খুব নিরপেক্ষভাবে পরীকে লক্ষ্য করেছে।
কেনাকাটা শেষে ওরা চলে যেতেই পরী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সেলসম্যানের কাজ করা চারটেখানি কথা নয়। এত বেশি কথা বলতে হয় যে পরী প্রায় হাঁপিয়ে গেছে।
সকাল এক গ্লাস পানি এনে পরীকে দিলো। পরী অবাক হয়ে বলল,
“পানি কেন?”
“তুমি যে এত কথা বললে পানি খাবে না? সব আন্টিদের তো পিপাসা পায়। তোমার কি পায়নি?”
পরী সকালের গাল টেনে দিয়ে বলল,

“লক্ষী মেয়েটা।”
পরী এক চুমুকে পানিটুকু পান করে। তারপর সকালের সাথে খুনসুটি করে। হুট করেই পরীর খালার কথা মনে পড়ে গেল। পরী কোনোদিনই মা হতে পারবে না। মা ডাক শুনতে পারবে না। পরীর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। এই একটা সমস্যা জয়কে কেড়ে নিলো। এই সমস্যার জন্য কোনোদিন মা ডাকও শোনা হবে না। এমন পোড়া ভাগ্য নিয়ে যেন আল্লাহ্ কখনো কোনো মেয়েকে পৃথিবীতে না পাঠায়।
রুমকি সুদর্শন একটা ছেলেকে পরীর সেকশনে নিয়ে এসে বলে,
“পরী দেখো তো সূর্য ভাইয়া কী নিবে। উনি কিন্তু আমাদের পরিচিত কাষ্টমার। ভাবী আসেনি সাথে। মেয়েদের জিনিস তো তাই একটু পছন্দমত ভালো জিনিস দিয়ো।”
পরী হালকা হেসে বলল,
“ঠিক আছে।”
রুমকি সকালকে নিয়ে যেতে চাইলে সকাল যাবে না বলে। পরীকে সকালের খুব মনে ধরেছে। পরীর সঙ্গ ওর ভালো লাগে বিধায় যতটা সময় দোকানে থাকে পরীর কাছেই থাকে।
পরী জিজ্ঞেস করল,
“কি নিবেন ভাইয়া?”

“কাঁচের চুড়ি আছে?”
“হ্যাঁ।”
পরী বিভিন্ন রঙের কাঁচের চুড়ি বের করে দিলো। সকাল খুব জ্বালাচ্ছিল পরীকে। তাই সূর্য সকালকে কোলে নেয়। আর পরী চুড়িগুলো খুলে খুলে দেখাচ্ছে। সূর্য ইতস্তত করে বলল,
“যদি আপনার সমস্যা না হয় তাহলে চুড়িগুলো কি একটু পড়ে দেখাবেন? আসলে আমার ওয়াইফ আপনার মতই চিকন-চাকন। হাতের মাপও একই হবে।”
“না ভাইয়া সমস্যা নেই। আমি দেখাচ্ছি।”

পরীর বাসায় এসে কলিংবেল বাজানোর পর নিশাত দরজা খুলে দেয়। জয়কে দেখে নিশাত জড়িয়ে ধরে। জয় হেসে বলে,
“কেমন আছিস?”
“ভালো আছি ভাইয়া। তুমি কেমন আছো?”
“আছি। বাড়ির সবাই কোথায়?”

“বাসায় আছে। আসো।”
নিশাত জয়কে বাড়িতে নিয়ে যায়। জয় পরীর মাকে দেখে নানুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল। জয় আসার সময় ফলমূল নিয়ে এসেছিল। নিশাত সেখান থেকে কয়টা কেটে জয়ের সামনে দেয়। জয় জিজ্ঞেস করে,
“তুই এগুলো করছিস কেন? পরী কোথায়?”
“আপু তো দোকানে।”
“কিছু কিনতে গেছে?”
“না। শপে সেলসম্যানের জব নিয়েছে।”
“কোথায় এটা?”

“তুমি যাবে? চলো নিয়ে যাই।”
“তোর যেতে হবে না। তুই ঠিকানা দে।”
জয় নিশাতের থেকে ঠিকানা নিয়ে পরীর শো রুমে যায়। বাহির থেকে কাঁচ ভেদ করে দেখতে পায় পরীকে। সামনে এগোতে গিয়েও থেমে যায়। পরীর মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তবুও কি সুন্দর সামনের লোকটির সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। লোকটার কোলে থাকা বাচ্চাটার সাথেও কি সুন্দর দুষ্টুমি করছে। নিশ্চয়ই পূর্বপরিচিত হবে। জয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলে,
“যাক ভালোই আছে তাহলে পরী। ও ঠিকই ওর ভালো থাকার নীড় খুঁজে নিয়েছে। শুধু স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি আমি। পরী ভালো থাকুক এটাই তো চাই আমি।”
জয় আর পরীর সাথে দেখা করলো না। উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছে।

সূর্য মোট ৭৫ ডজন চুড়ি কিনেছে। বউকে সারপ্রাইজ দিবে তাই। অনেক কিছুই বলল তার সম্পর্কে। পরী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলো সব। কত ভালোবাসা তার বউয়ের প্রতি। এমন একটা দিন হয়তো জয় আর পরীর আসতো যদি না সেই কালবৈশাখীর মত সমস্যা থাকতো। পরী মনযোগ দিয়ে শুনছিল সূর্যর কথা। তখন যদি একটাবার বাহিরে তাকাতো তাহলে হয়তো সেই চেনা পরিচিত মুখটা দেখতে পারতো।
বিল মিটিয়ে সূর্য চুড়িগুলো নিয়ে চলে যায়। পরী মোবাইলে দেখে নেয় পাঁচ মিনিট কম পাঁচটা বাজে। সবকিছু গুছি নিলো। পরীর ডিউটি আজকের মত শেষ। সকালকে আদর করে রুমকিকে বলে চলে গেল।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই নিশাত রুমে প্রবেশ করে।
“আপু তুমি শপে ছিলে না?”

“হু। শপেই তো ছিলাম।”
“জয় ভাইয়া গিয়ে যে তোমায় পেল না।”
জয়ের কথা শুনে উঠে বসে পরী। অবাক হয়ে বলে,
“জয় ভাইয়া এসেছিল?”

“হুম। তোমার সাথে দেখা করতে দোকানেও গিয়েছিল। তোমায় পায়নি তাই আবার বাড়িতে এসেছিল।”
“কিন্তু আমি তো দোকানেই ছিলাম। চলে গেছে জয় ভাই?”
“হ্যাঁ। আর যাওয়ার আগে বলল তোমার টেবিলে নাকি কি রেখে গেছে।”
“আচ্ছা তুই যা।”
নিশাত চলে যাওয়ার পরই পরী উঠে টেবিলে কি রেখে গেছে খুঁজতে থাকে। নোটখাতা সরাতেই একটা সাদা গোলাপ আর একটা চিঠি পায়। চিঠিটা পরীর নোটখাতা ছিঁড়েই লিখেছে।
“তোর তো সাদা গোলাপ খুব পছন্দ তাই নিয়ে এলাম। তবে এখন আমার দেওয়া ফুল তোর ভালো নাও লাগতে পারে। ভালো না লাগলে ফেলে দিতে পারিস। তোর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম তো বেশ ভালোই আছিস তুই। তাই বাহির থেকে একবার দেখেই চলে এসেছি। সবসময় এমনই হাসি-খুশি থাকিস।”

পরী নিস্তব্ধ হয়ে রইল। জয় কি ভাবলো? পরী খুব ভালো আছে? পরী খুব স্বার্থপর! এমনটাই ভেবেছে হয়তো। ভাবুক। এমন ভেবে হলেও যেন জয় সূচীকে মেনে নিতে পারে। গোলাপটা যত্ন করে বইয়ের ভাঁজে রেখে দিলো।
ফ্রেশ হয়ে রাতের রান্না বসালো। রান্না করতে করতে অন্য মনষ্ক হয়ে যায়। বারবার মনে হয় জয়কে কিছু বলার দরকার। পরী জয়কে যতটুকু জানে তাতে এটা তো শিওর যে, জয় এখনো সূচীকে মেনে নেয়নি। সূচীকে যতই বোঝাক তাতে খুব একটা লাভ হবে না। কারণ দুজনের সারাজীবন একসাথে থাকার জন্য জয়ের দিক থেকে পজেটিভ সিগন্যাল আগে দরকার। জয় যদি সূচীকে মেনে না নেয় তাহলে কখনোই সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। সংসার না টিকলে সমস্যা কমবে বৈ’কি বাড়বে। সূচী অনেক ভালো মেয়ে। মাঝখান থেকে ওর জীবনটা নষ্ট হবে। আর এটা তো হতে দেওয়া যায় না। একটা বার বিষয়টা নিয়ে জয়ের সাথে কথা বলা উচিত এবং সেটা সরাসরি। তাই পরী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সামনের শুক্রবারেই জয়ের বাসায় যাবে।
রান্না শেষ করে একটু ছাদে যায় পরী। ছাদ থেকে এসে খেয়ে ঘুমাবে। তাই আগেই ছাদে চলে যায়। তাছাড়া দেড়ি করে গেলে তুর্যও থাকে ছাদে। যেটা পরী একদমই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু ভাবনার গুড়ে বালি। তুর্য আগে থেকেই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।
ছাদের দরজার দিকে পরীকে দেখে বলে,
“আসেন আসেন ভূত্নী আসেন।”
পরী কয়েকটা কথা শুনাতে গিয়েও দমে যায়। নিচে নামার সময় তুর্য পেছন থেকে বলে,
“ভয় পেলেন নাকি?”
পরী এবার খ্যাঁক করে উঠে। তুর্যর দিকে এগোতে এগোতে বলে,
“প্রথমদিনই ভয় পাইনি আর এখন ভয় পাবো?”
“তাহলে চলে যাচ্ছিলেন কেন?”
“আপনার আউলফাউল কথা আমার পছন্দ হয় না তাই।”

“কত মেয়ে আমার কথা শোনার জন্য পাগল আপনি জানেন?”
“না জানিনা। আর জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও নেই। পাগল বলেই তারা আপনার আউলফাউল কথা শুনতে চায়। কোনো ভালো, সুস্থ মানুষ অবশ্যই আউলফাউল কথা শুনতে চাইবে না। আর আমিও একজন সুস্থ মানুষ। কোনো পাগল নই।”
“ওহ হ্যাঁ তাই তো! আপনি কেন পাগল হতে যাবেন? আপনি তো ভূত্নী।”
“সমস্যা কি আমার? এত ভূত্নী ভূত্নী করেন কেন? আমাকে কি দেখতে ভূতের মত?”
“আপনি পরীর মত দেখতে নাকি আমি সেটাও বলতে পারছি না। কারণ আমি কখনো পরী দেখিনি। আবার আপনি ভূতের মত দেখতে নাকি সেটাও বলতে পারলাম না। কারণ আমি ভূতও দেখিনি।”
“পরীর মত দেখতে হই বা না হই। আমার নাম তো পরী। ডাকতে হলে এই নামেই ডাকবেন নয়তো এমন উদ্ভট কোনো নামে আমায় ডাকবেন না।”
“তাহলে বউ ডাকি?”
“আজব! এমন ছেচ্রা স্বভাবের কেন আপনি?”
“সবার সাথে তো এমন না। শুধু আপনার সাথে ছেচ্রামি করি।”
“কেন? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি?”

“কোনো ক্ষতিই করেননি। এইযে আপনি আমায় পাত্তা দেন না, দেখতে পারেন না এজন্যই এমন ছেচ্রামি করি। কারণ ছেচ্রাদের সাথে ছেচ্রামি করে মজা নাই।”
“যদি আমিও আপনার সাথে ছেচ্রামি করি তাহলে কি আপনি আর ছেচ্রামি করবেন না?”
পরীর কথা শুনে হো হো করে হেসে দিলো তুর্য। পরীর দিকে মুখটা একটু এগিয়ে নিয়ে বলল,
“সবাই ছেচ্রামি করতে পারেনা। আর আপনিও পারবেন না।”
“সেটাই। সবাই তো আর আপনার মত ছেচ্রা হয় না।”
“তা ঠিক। তবে এটাও সত্যি সবার সাথে ছেচ্রামি করে মজাও নেই।”
“ছেচ্রামি করার জন্য কি আমাকেই পেলেন আপনি?”
“আমি পেলাম কোথায়? আল্লাহ্ আপনাকে পাইয়ে দিলো।”
পরী চুপ করে রইলো। তুর্য বলল,
“কিছু বলছেন না যে?”
“আপনার সাথে বকবক করতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
“শুনুন।”

“হু।”
“আপনার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো অনেক সুন্দর লাগে। মুক্তার কণার মত লাগে।”
তুর্যর কথা শুনে পরী হতভম্ব হয়ে গেল। জয় পরীকে সবসময়ই এমনভাবে বলতো। মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম জয় মুছতে দিতো না। পরী একসময় বিরক্ত হয়ে জয়ের শার্টেই মুছে ফেলতো।
পরীর তুর্যর দিকে তাকাতে তুর্য বলল,
“সত্যি বলছি। শপে তো আপনার দিকে তাকিয়েই এটাই খেয়াল করেছি।”
“সবকিছুতে এত বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। নিজের সীমার মধ্যে থাকেন। আমি আপনার অপরিচিত আর আপনিও।”
“প্রথম মানুষ অপরিচিতই থাকে। পরে পরিচিত হয়। আচ্ছা আমরা কি বন্ধু হতে পারি? বন্ধু হলে আর এভাবে জ্বালাবো না। হবেন?

পর্ব ১১

পরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তুর্যর দিকে। কী রকম নিঃসঙ্কোচ আবেদন। পরীকে চুপ থাকতে দেখে তুর্য জিজ্ঞেস করে,
“কী হলো?”
“কিছুনা।”
“বন্ধু হবেন না?”
“না।”

“কেন?”
“বন্ধুর প্রয়োজন নেই তাই।”
“এটা কোনো উত্তর হলো?”
“হ্যাঁ হলো।”
“সমস্যা কী বন্ধু হতে?”
“বন্ধু না হলেই বা সমস্যা কী?”
“আপনাকে আমার ভালো লাগে। তাই আমরা বন্ধু হতেই পারি।”

“আপনাকে আমার ভালো লাগে না। আর কিছু বলবেন?”
“আপনি কি জানেন আপনি খুব অদ্ভুদ?”
“জানি।”
“এমন কেন আপনি?”
পরী এক পলক তুর্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
“খুব বাজে পরিস্থিতির সম্মুখীন কখনো হয়েছেন? কখনো নিজের ভালোবাসাকে হারিয়েছেন? বাবার মৃত্যু চোখের সামনে হতে দেখেছেন? মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের কষ্ট কখনো উপলব্ধি করেছেন? চোখের সামনে আপন মানুষগুলোর পরিবর্তন কখনো দেখেছেন? যদি আপনার উত্তর ‘না’ হয় তাহলে আমার এই অদ্ভুদ হওয়ার পেছনের কাহিনীও আপনি কখনোই উপলব্ধি করতে পারবেন না।
জীবনের একটা সময়ে এসে বোঝা যায় জীবনের আসলে মানেটা কী! যখন পিছাতে পিছাতে পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় তখন উল্টো পথে হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তখন আপনার মতই অনেকে উপাধি দেয় স্বার্থপর, বেঈমান, রোবট, অদ্ভুত। জীবন খুব বৈচিত্র্যময়। জীবনের আসল মানেটা সবার সামনে আসে না।”
তুর্য কি বলবে বুঝতে পারছে না। পরীর প্রতিটা কথায় তীব্র কষ্ট রয়েছে। একটা মানুষ মনের ভেতর এত কষ্টও পুষে রাখতে পারে? পরী তুর্যর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে,

“আসি।”
মৃদুমন্দ চাঁদের আলোতেও পরীর ছলছল করা চোখ তুর্যর চোখ এড়ায়নি। পরী চলে যাচ্ছে আর ওর প্রতিটা কথা কানে বাজছে তুর্যর।
সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাবান্না করে শপে চলে যায় পরী। পরী যাওয়ার পরপরই নিশাত তুর্যর জন্য খাবার নিয়ে যায়। সকাল আর দুপুরের খাবার ঠিকমত নিতে পারলেও রাতের খাবারটা সবসময় লুকিয়ে নিতে পারে না। প্রতিদিনের মত আজও সকালে খাবার নিয়ে তুর্যর ফ্লাটে যায়। নিশাত তুর্যকে দেখে মিষ্টি হাসে।
“শুভ সকাল ভাইয়া।”
“শুভ সকাল। ভেতরে আসো।”

নিশাত ভেতরে গিয়ে টেবিলের ওপর খাবার রাখে। তুর্য জিজ্ঞেস করে,
“তুমি খেয়েছো?”
“না। আমি বাসায় গিয়ে খাবো।”
“তোমার আপু আছে বাসায়?”
“না।”
“তাহলে চলো আজ তোমাদের ফ্লাটে নাস্তা করবো।”
“আচ্ছা চলেন।”
নিশাত তুর্যকে নিয়ে নিজেদের ফ্লাটে আসে। নাস্তা করতে করতে ওদের পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছুই শোনে তুর্য। পরীর একার রোজগারে পরিবার চলে ভাবতেই পরীর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় তুর্যর। তুর্য খেতে খেতে বলে,
“তোমার আপু কারো সাথে রিলেশন করে না?”
“কী জানি! আমি তো জানিনা।”

“ওহ্। তোমার আপু পড়াশোনা কি ছেড়ে দিয়েছে?”
“না, না। আপু এত বোকা না। পড়াশোনা কেন ছাড়বে? আজকাল পড়াশোনা না জানলে কোনো দাম নেই। আপু অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। মাস্টার্স কমপ্লিট হলেই একটা ভালো চাকরী করবে।”
“খুব ভালো। কোনো পরিস্থিতিতেই পড়াশোনা বন্ধ যেন না করে। আচ্ছা তোমার মা কেমন অসুস্থ?”
“মা মানসিকভাবে খুব ডিপ্রেশড। আব্বু মারা যাওয়ার পরই মায়ের এই অবস্থা। সবসময় চুপচাপ থাকে। কারো সাথেই কথা বলে না। মাঝে মাঝে একা একাই কথা বলে। খুব কাঁদে।”
“ডক্টর দেখাওনি?”
“দেখিয়েছি।”
“আমি কি তোমার মায়ের সাথে একটু দেখা করতে পারি?”

“আচ্ছা।”
ড্রয়িংরুম থেকে দুজনের কথোপকথন শুনে নানু রুম থেকে বাহিরে আসে।
“কার সাথে কথা কস নানুভাই?”
“নানু উনি তুর্য ভাইয়া। দুই তলায় থাকে।”
তুর্য নানুর দিকে তাকিয়ে সালাম দেয়।

“আসসালামু আলাইকুম নানু।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছো?”
“হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ্‌। বসেন।”
“সারাক্ষণ বইসাই থাকি। এমনে আর ভালো লাগে নারে ভাই! মাইয়ার এমন অবস্থা আবার নাতনীডা আমার কি কষ্ট করে। ওগোর ঘাড়ের ওপর আইসা আবার আমি জুটলাম।”
“পরীর মাকে একটু দেখব নানু।”
“আহো।”

তুর্য আর নিশাত নানুর পিছন পিছন যায়।
রুমের লাইট অন করে দেখে পরীর মা নাহিদা বেগম চুপ করে শুয়ে আছে। চোখের কোণা বেয়ে পানি পড়ছে অনবরত। তুর্য তাকে ধরে বিছানায় বসায়। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“কেমন আছেন?”
তিনি কোনো উত্তর দেয় না। গাঢ় দৃষ্টিতে তুর্যর দিকে তাকিয়ে আছে।
“বাহিরে ঘুরতে যাবেন?”
“চলে গেছে।”

“কে চলে গেছে?”
“পরীর বাবা চলে গেছে। কেন গেছে? তাকে কি এনে দিতে পারবা?”
“আঙ্কেল এমন জায়গায় চলে গেছে যেখান থেকে কেউ তাকে ফেরত আনতে পারবে না।”

“তাহলে আমি যাবো তার কাছে। আমায় নিয়ে চলো।”
“আপনি চলে গেলে আপনার পরী আর নিশাতের কী হবে? ওরা কাকে নিয়ে থাকবে? আপনিই তো ওদের বেঁচে থাকার অবলম্বন।”
তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তুর্য তাকে ধরে বাহিরে আনলো। হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। কতদিন পর নাহিদা বেগম বাহিরে আসলেন। ছায়ার মধ্যে তুর্য হাত ধরে ধরে তাকে হাঁটাচ্ছে। সাথে নিশাতও আছে।
“হাঁটতে কি কোনো সমস্যা হচ্ছে আন্টি?”
“না। ভালো লাগছে।”
“মাঝে মাঝে বাহিরে এসে একটু হাঁটবেন। সবার সাথে কথা বলবেন। তাহলে আর উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় আসবে না। অতীত আঁকড়ে ধরে আপনি নিজের অজান্তেই নিশাত আর পরীকে কষ্ট দিচ্ছেন। আপনাকে এভাবে দেখে কি ওদের ভালো লাগে? স্বাভাবিক হতে হবে আপনাকে। ওদের সাথে সময় কাটাবেন। নিজেকে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখা কোনো সমাধান নয়। বরং এতে মানসিকভাবে আপনি ভেঙ্গে পড়ছেন।”

পাঁচটা বিশ যখন বাজে তখন শপ থেকে বাড়িতে আসে পরী। ক্লান্ত শরীর আর চলতে চাইছে না। জীবনটা যে এত কষ্টের, পরিশ্রম যে এত কষ্টের সেটা আগে জানা ছিল না পরীর। নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। রুম থেকেই নিশাতকে ডাকে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। পরীর ডাকাডাকি শুনে নানু ঘরে আসে।
“ডাকোস ক্যা ওরে?”
“নিশাত কোথায়?”
“ছাদে গেছে।”
“ওহ। মায়ের কি অবস্থা? দুপুরে খাইয়েছিলে?”

“হ। আজকে ঐ পোলায় খাওয়াই দিছে।”
“ঐ পোলা মানে? কে?”
“ঐযে দুই তলায় থাকে। নামডাও তো মনে নাই। পোলাডা খুব ভালো। কত সহজে মানুষের লগে মিশতে পারে। নাহিদারে আজকে কতকিছু বুঝাইলো। তোর মা আজকে মেলা কথা কইছে। আল্লাহ্ মনে হয় ঐ পোলারে তগোর ভালোর লেইগাই পাঠাইছে। ওর উছিলায় যেন নাহিদা স্বাভাবিক হইয়া যায় মাবুদ।”
পরী অবাক হয়ে যাচ্ছে নানুর কথা শুনে। নাহিদা বেগম যতটুকুই কথা বলেন সেটা শুধু পরী, নিশাত আর নানুর সাথে। সেখানে বাহিরের একটা ছেলের সাথে এত ভাব জমেছে? তার হাতেও পর্যন্ত খেয়েছে? পরী বিস্ময় লুকিয়ে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করল,
“মা কোথায় নানু?”
“তোর মা’ও ছাদে।”

“আচ্ছা আমি যাচ্ছি।”
পরী ছাদে গিয়ে তো রীতিমত আরো অবাক হয়। তুর্য নাহিদা বেগমের চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। নিশাত আর তুর্যর কথা শুনে নাহিদা বেগম হাসছে। এমন দৃশ্য দেখার জন্য পরী একদমই প্রস্তুত ছিল না।
পরী এক পা, দু’পা করে ওদের দিকে এগিয়ে যায়। অপলক চোখে মাকে দেখছে। তুর্যর দিকে চোখ পড়তেই চোখমুখ কুঁচকে বিড়বিড় করে বলে,
“এসব কি আমায় পটানোর ধান্দা?”

তুর্যও ফিসফিস করে পরীর কানের কাছে এসে বলে,
“এসব পটানো আমাকে দিয়ে হবে না। পটানোর মত পরিস্থিতি হলে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম। আপনার মায়ের জন্য যা করছি তা আলাদা ভালোবাসা থেকে করছি। তাই আপনার সাথে আপনার মায়ের বিষয়টা একদম গুলিয়ে ফেলবেন না যেন।”

ব্যালকোনিতে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে জয়। আগে মাঝে-মাঝে খেলেও এখন সিগারেট খাওয়ার পরিমাণটা বেড়েই চলেছে। সূচী বেশ কিছুক্ষণ ধরে পায়চারী করছে রুমের ভেতর। জয়ের কাছে যাওয়ার সাহস হয়ে উঠছে না। অবশেষে ভয়কে জয় করে ব্যালকেনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। জয় একবার সূচীর দিকে তাকিয়ে আবার সিগারেট খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। সূচী সাহস সঞ্চয় করে বলল,
“সিগারেট খেতে কি খুব মজা?”
“জানিনা।”
“আমিও খেতে চাই। এটার টেস্ট কেমন জানার খুব ইচ্ছা।”
জয় হাতে থাকা সিগারেটের প্যাকেটটা সূচীর দিকে এগিয়ে দেয়। জয়ের ব্যবহারে সূচী খুব অবাক হয়। সূচী ভেবেছিল জয় হয়তো ধমক দিবে। বকবে। কিন্তু তা না করে উল্টো সিগারেট খেতে দিচ্ছে!
সূচী ইতস্তত করে বলে,

“কী সাংঘাতিক!”
“কী?”
“আপনি। আমি না হয় বললামই যে সিগারেট খাবো। তাই বলে কি আপনার সত্যি সত্যিই দিতে হবে?”
“তাহলে কি মুখের ওপর না করবো?”
“যদি সিগারেটের বদলে অন্যকিছু চাইতাম? দিতেন?”

“দেওয়ার মত হলে অবশ্যই দিতাম।”
“আমি একটু ভালোবাসা চাই। শুধু আপনার অল্প একটু ভালোবাসা।”
জয় সূচীর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যর একটা হাসি দিলো। সিগারেটের ছাই এ্যাশট্রেতে রাখতে রাখতে বলল,
“আমার কাছে কোনো ভালোবাসা নেই। সব ভালোবাসা সিগারেটের মত পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এই বুকে যা আছে সব কয়লা আর ছাই। ভালোবাসা বলতে কোনো শব্দ নেই আর আমার কাছে।”
সূচী দুম করে জয়ের কোলে বসে পড়ে। দু’হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“আপনি কি এই প্রবাদ বাক্যটা শুনেছেন?

‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’ আমারও এই ছাইযুক্ত ভালোবাসাই চাই। আমার নিজের ভালোবাসা দিয়ে না হয় রাঙিয়ে নিবো। তাছাড়া আমি শিওর, এই ছাইয়ের মধ্যেও অমূল্য কিছু অবশ্যই আছে। যেটা আমার জন্যই অবশিষ্ট ছিল। ভালোবাসাকে খুব সহজে অর্জন করা গেলেও বর্জন করা অতি সহজ নয়। ভালোবাসা এখনো আছে আপনার বুকে। বরং আপনিই সেটা ছাই ভেবে দূরে রাখছেন। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। আমায় কি একটু ভালোবাসা যায় না?”

পর্ব ১২

জয় বেশ ঠান্ডা গলায় বলে,

“উঠুন।”
“কী?”
“কোল থেকে উঠুন।”
সূচী আরেকটু জোরে জয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“না। উঠবো কেন? আমি কি পরপুরুষের কোলে বসেছি নাকি? আমি আমার স্বামীর কোলে বসেছি।”
“মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার।”
“ইশ! কী আমার মানুষ। তার আবার মেজাজ!”

“খুব ঝগরুটে তো আপনি।”
“আগে ছিলাম না। এখন হয়েছি। কেন হয়েছি জানেন?”
“না।”
“আপনাকে শায়েস্তা করার জন্য।”
“আপনি আমাকে শায়েস্তা করবেন?”, বলেই হোহো করে হেসে উঠলো জয়। সূচী মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে জয়ের হাসি। এত সুন্দর করে হাসতে পারে। অথচ সারাক্ষণ মুখটা গোমড়া করে রাখবে। সূচীর মনের ভেতর শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। পরক্ষণেই মনে মনে ভাবে,
“না। এই ছেলের সামনে নরম হওয়া যাবে না। তাহলে দেখা যাবে আমাকেই উল্টো ঝাড়ি দিয়ে বসিয়ে রাখবে।”
তাই মুগ্ধতাকে আড়াল করে চোখমুখ কুঁচকে বলে,
“এত হাসির কিছু নেই ঠিক আছে? আমাকে আপনি চিনেন না।”

জয় হাসি থামিয়ে বলে,
“তাই নাকি? তো কে আপনি শুনি?”
“আমি সূচনা। ছোট্ট করে সবাই ডাকে সূচী।”
“সূচনা নামটা সুন্দর।”
“আমি কি কম সুন্দর নাকি?”
জয় বাঁকা হাসলো। সূচীকে কোলে নিয়ে রুমের ভেতর গিয়ে বিছানার উপর বসালো। জয় চলে যেতে নিলেই সূচী হাত ধরে টান দিলো। জয় ভাবেনি সূচী এমন কিছু করবে। তাই টাল সামলাতে না পেরে সূচীর উপরই পড়ে। আবার সাথে সাথেই সরে গেল। সূচী তখন জয়ের শার্ট খাঁমচে ধরে বলে,
“এতকাছে এসেও দূরে যাওয়ার জন্য এত তাড়া কীসের?”
জয় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

“আমি সবসময় আপনার মত রোমান্টিক মুডে থাকি না।”
তারপর ব্যালকোনিতে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো বাহির থেকে। সূচী গালে হাত দিয়ে বসে মনে মনে বলে,
“আমিও দেখব আপনি কতদিন আমাকে এড়িয়ে চলতে পারেন।”

নানু আর নাহিদা বেগম ঘরে বসে টুকটাক কথা বলছেন। বেশি কথা নানুই বলছে। নাহিদা বেগম ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। পরী রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিল মায়ের জন্য। নানু চা খাবে নাকি জিজ্ঞেস করার জন্য যখন কিচেন থেকে বের হলো তখন অদ্ভুদ একটা দৃশ্য ওর চোখে পড়লো। রান্নাঘরের দেয়ালে আড়ালে চলে গেল পরী। উঁকি দিয়ে দেখছে নিশাত প্লেটে খাবার বাড়ছে। খাবার বাড়ছে ভালো কথা কিন্তু চোরের মতো এদিক-সেদিক কেন তাকাচ্ছে? ভাত আর তরকারী নেওয়া শেষে লুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো। পেছন পেছন পরীও গেল। দুইতলায় গিয়ে তুর্যর ফ্লাটে ঢুকলো নিশাত। পরী তো অবাক হয়ে যাচ্ছে। ভাই তলে তলে এটা করছে! ভাগ্যিস নিশাত মেয়ে নয়। তাহলে তো এই পাজি ছেলেটা নিশাতকে পটিয়ে প্রেম করতো। পরী দ্রুত নিজের ফ্লাটে এসে পড়ল। চা বানিয়ে মা আর নানুকে দিয়ে আসলো। নিশাত এলো বেশ কিছুক্ষণ পর। পরী এমন একটা ভাব করছে যে কিছুই দেখেনি।

সবাই একসাথে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে উঠে রান্নাবান্না করে শপের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো। প্রতিদিনের মতো আজও নিশাত তুর্যর জন্য খাবার নিয়ে যায়। কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দেয় পরী। পরীকে দেখে নিশাতের পরি কি মরি মরি অবস্থা। পিছনে তুর্য কাচুমুচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরী দু’হাত কোমরে রেখে নিশাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“কী হু?”
“ইয়ে মানে আপু।”
“হু ইয়ে কী? কবে থেকে চলছে এইসব চোরাচালান?”
নিশাত কী বলবে বুঝতে পারছে না। পরী ধমক দিয়ে বলে,

“যা রুমে যা।”
পরীর ধমকে ভয় পেয়ে যায় নিশাত। কিন্তু নড়েচড়ে না। সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। পরী পাশের টেবিল থেকে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে আসে। একটু এগিয়েই আবার থেমে যায়। তারপর আবার নিশাতের কাছে এগিয়ে যায়। চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে হেসে বলে,
“আমাকে বলে দিলে কি আমি না করতাম? তোর আপু কী এমন? এভাবে চুরি করে আনার কী ছিল? এখন থেকে আর চুরি করে আনবি না। মনে থাকবে?”
নিশাত মাথা নাড়িয়ে বলে,
“হুম।”
“গুড। এখন থেকে তাকে নিয়ে আমাদের ফ্লাটে খাবি। আমাদের সাথেই খাবে সে।”
নিশাত তো পরীর কথা শুনে খুশি হয়ে যায়। অপরদিকে তুর্য অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। নিশাত এক হাত দিয়ে পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আই লাভ ইউ আপুনি।”
“লাভ ইউ টু সোনা। আসি এখন।”

পরী তুর্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
“খাবার নিয়ে আমাদের ফ্লাটে চলে যান। নিশাতও খায়নি এখনো। ওর সাথেই খান।”
কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে,
“ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। আবার ভাববেন না যেন মাকে স্বাভাবিক জীবনে আনার জন্য আপনাকে খাওয়াতে রাজি হয়েছি। এই বিষয়গুলো আলাদা। আপনি নিশাতের অনেক পছন্দের একটা মানুষ। ও আপনাকে ভালোবেসেই খাবার লুকিয়ে আনে। যেহেতু ও ছোট তাই ভয়ে আমায় বলতে পারেনি। আমি শুধু পারমিশনটাই দিলাম আমাদের সাথে খাওয়ার জন্য। আর আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ এই জন্য যে, আমার মাকে সময় দেওয়ার জন্য।”
তুর্য হা করে তাকিয়ে আছে পরীর দিকে। পরী কথা শেষ করে মিষ্টি হেসে চলে যায়। তুর্য বুকের বামপাশে হাত রেখে বলে,
“হায়ে! এভাবে কেউ হাসে! আমি তো মরেই যাব।”

পরীর সময়গুলো এভাবেই ব্যস্ততায় কাঁটছিল। পাশাপাশি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল ভালো কোনো চাকরীর জন্য। মামা আসলে ভালো কোনো চাকরীর ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে। ততদিন পর্যন্ত শপেই জবটা করতে হবে। ডিউটি শেষ করে বাড়িতে ফিরে পরী। দরজা খুলে দিয়েই নিশাত দৌঁড়ে ভেতরে চলে যায়। পরী দরজা লাগিয়ে ভেতরে যায়। কিচেনের সামনে দিয়েই পরীর রুমে যাওয়া লাগে। কিচের সামনে যখন আসলো তখন পরীর চোখ ছানাবড়া। পুরো কিচেন ভর্তি কাঁচাবাজার। তুর্য আর নিশাত দুজনে মিলে রান্না করছে। নিশাত রান্নাঘরের কেবিনেটের ওপর বসে পাকা টমেটো খেতে খেতে বলে,
“আপু আজ তোমার ছুটি। রাতের রান্না আমি আর তুর্য ভাইয়া মিলেই করছি। রান্না খেয়ে কিন্তু নাম্বার দিতে হবে।”
“হঠাৎ?”
তুর্য পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“নিষেধ আছে?”
“না।”
“তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই।”
পরী আর কিছু বলল না। সোজা নিজের রুমে চলে গেল। জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। গরমে ঘেমে গেছে। গোসল করলে একটু ভালো লাগবে। গোসল শেষ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঝাড়ছিল তখন হাসির শব্দ কানে আসে। মেয়েলি হাসি। আর সেটা পরীর পাশের রুম থেকেই আসছে। ঐ রুমে তো মা আর নানু থাকে।কৌতুহল নিয়ে পরী ঐ রুমে যায়। একজন মহিলা আর নাহিদা বেগম কথা বলতে বলতে হাসছে। সাথে আবার নানুও আছে। কিন্তু এই মহিলা কে!
নাহিদা বেগম পরীকে দেখে বলে,
“ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।”
আজ কতদিন পর মা এত স্বাভাবিক হয়ে পরীকে ডাকলো। পরী এগিয়ে যেতেই মহিলাটি বলে,
“আসো মা। আমায় চিনেছ?”
পরী ঈষৎ হেসে বলে,

“না”
“আমি তুর্যর মা। সেই যে রাগ করে বাড়ি থেকে এসেছে ছেলেটা এখনো বাড়ি যায়নি। পরে আজ সকালে ফোন দিয়ে এখানে আসতে বলল। তোমার মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। কয়েকটা দিন আমরা এখানেই থাকবো।”
“ওহ আচ্ছা। চা খাবেন?”
“বেশ কয়েকবার খেয়েছি। আবার দিলে মন্দ হয় না।”

“আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি।”
পরী চলে যাওয়ার পরই তাহমিনা বেগম আর নাহিদা বেগম গল্প শুরু করে দেয়। বেশ খাতির হয়েছে বলা যায়। এরজন্য অবশ্যই তুর্য কৃতজ্ঞতার দাবি রাখে। পরী জানেনা তুর্য কেন এতকিছু করছে। তবে যে কারণেই করুক না কেন হাজারটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে পরীর। মা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাক আগের মত এটাই তো চায় সবাই।
তিন কাপ চা ঐ রুমে দিয়ে এসে পরী ব্যালকোনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। মনটা খুব ফ্রেশ লাগছে মাকে এত স্বাভাবিক দেখে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অস্বাভাবিক লাগাও শুরু করে। কারণ মা জানেনা জয়ের বিয়ের কথা। যখন জানবে তখন মায়ের প্রতিক্রিয়া কী হবে? মা প্রথম থেকেই জয় আর পরীর সম্পর্কের কথা জানে।
পেছন থেকে কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছনে ঘুরে তাকায়। নাহিদা বেগম দাঁড়িয়ে আছে। পরী ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
“মা তুমি!”
পরী মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি অনেক খুশি মা। তুমি আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছো।”
“আমার সাথে সবকিছু কেন স্বাভাবিক হচ্ছে না?”

পরী মাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
“মানে? ওহ তুমি বাবার কথা বলছো? এটা নিয়ে আর মন খারাপ করো না মা।”
“আমি জয়ের কথা বলছি।”
পরীর বুকটা এবার ধক করে উঠে। মনে মনে যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই হলো। নাহিদা বেগম আবার বললেন,
“জয় বিয়ে করেছে তাই না?”
“তোমায় কে বলল?”
“নিশাত।”
“জয়ের কোনো দোষ নেই মা। আমিই ওকে জোর করেছি বিয়ে করার জন্য।”
“কেন করলি এমনটা?”
“মা তুমি তো সব জানোই।”
তিনি একটু চেঁচিয়েই বললেন,
“না জানিনা আমি কিছু। জানতে চাই না। তুই”
নাহিদা বেগম তার কথা সমাপ্ত করতে পারলেন না। রুমে তুর্য এসেছে।
তুর্য মা আর মেয়েকে একসাথে দেখে বলে,
“স্যরি বিরক্ত করলাম।”

“তেমন কিছু না বাবা। কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ। মা ডাকছিল আপনাকে।”
“আচ্ছা চলো।”
নাহিদা বেগম তুর্যর সাথে চলে যাচ্ছিলেন। একবার থেমে টইটুম্বুর করা চোখভর্তি পানি নিয়ে বললেন,
“এতকিছুর পরও তুই এত স্ট্র!সবকিছু একা হাতে সামলাচ্ছিস। আমি অবাক হই তোকে দেখে। তুই সত্যিই আমার মেয়ে তো? আমার ব্রেফ গার্ল তুই। আল্লাহ্ তোকে উপহারস্বরূপ বোধ হয় আমাকে দিয়েছে। আমার গর্ব হয় তোকে নিয়ে মা।”
শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে তিনি পরীর রুম ত্যাগ করলেন। এই চোখের পানি শুধু কষ্টকে প্রকাশ করেনি। করেছে মেয়েকে নিয়ে তার গর্ববোধ।

পর্ব ১৩

দুপুরের তপ্ত কড়া রোদের মধ্যে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে পরী। শুক্রবার বন্ধ থাকায় অনেকগুলো কাপড়চোপড় ধুয়েছে। সেগুলোই শুকাতে দিতে ছাদে এসেছিল। তারপর হঠাৎই ইচ্ছে হলো চারিপাশটা একটু দেখতে। তুর্য একটা নয়নতারা ফুল নিয়ে পিছন থেকে পরীর সামনে ধরে। ফুলের দিকে নজর আসায় পরীও পিছনে তাকায়। একবার ফুলের দিকে তাকিয়ে আবার তুর্যর দিকে তাকায়। তুর্য একগাল হেসে বলে,
“সুন্দর না?”
“ছাদের গাছ থেকে ছিঁড়েছেন তাই না?”
“হুম।”
“ফুলটা ছিঁড়লেন কেন?”
“একটা সুন্দর মনের মানুষকে দেওয়ার জন্য।”
“গাছের ফুল গাছেই মানায়। অযথাই ফুলটা ছিঁড়লেন।”
“আচ্ছা স্যরি। এভাবে অর্ধেক ভেজা অবস্থায় ছাদে কেন? তাও আবার রোদের মধ্যে।”

“আপনাকে বলব কেন?”

“আচ্ছা বলতে হবে না। আমি একটা কথা বলি?”
“হু।”
“জয়কে এখনো ভালোবাসেন?”
তুর্যর কাছে জয়ের কথা শুনে পরী অবাক হয়ে গেল। তুর্যর তো জানার কথা নয় জয়ের ব্যাপারে। পরীকে চুপ থাকতে দেখে জয় আবার জিজ্ঞেস করে,
“ভালোবাসেন?”
“আপনি জয়কে চিনেন?”
“না তো।”
“তাহলে?”
“কথায় কথায় সেদিন আপনার মা জয়ের কথা বলল। তখনই তো নিশাত বলল জয় বিয়ে করেছে।”

“বিয়ে করেছে মানে সে এখন অন্য কারো। অন্য কারো স্বামীকে কি ভালোবাসা উচিত?”
“প্রশ্নটা কি উচিত, অনুচিতের মধ্যে পড়ে?”
“আমি জানিনা।”
“আপনি জানেন। কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছেন।”
“এভাবে জেরা কেন করছেন?”
“জেরা করছি না। জানার আগ্রহ থেকেই প্রশ্নটা করেছি।”

“সব আগ্রহ প্রকাশ করতে নেই।”
“আমি আগ্রহ, কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারি না।”
“সেটা নিতান্তই আপনার বিষয়।”
“হুম। তবে আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই করে।”
“সেটা আমি জানি এবং মানিও। কিন্তু আপনি কোন অর্থে বললেন এই কথাটা?”
“এইযে আমার রাস্তা ক্লিয়ার।”
“কীভাবে?”

“জয় অবিবাহিত হলে তো আপনাকে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো না।”
“কী বলতে চাচ্ছেন?”
“খোলাশা করে বলব?”
“অবশ্যই।”
“তাহলে শুনুন। আপনাকে আমার ভালো লাগে। খুব বেশিই ভালো লাগে। কিছুদিন আগেও ভালোলাগা আর ভালোবাসা বিষয়টাকে আমি আলাদাভাবে দেখেছি। কিন্তু এই ভালোলাগা থেকে কবে যে তা ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে সেটা আমি জানিনা। তবে আমি অনুভব করতে পারি আপনাকে। অনুভব করতে পারি আপনার কষ্টকে।”
পরী বাঁকা হাসল। এই হাসির অর্থ অনেক বিস্তৃত। ঠোঁটে সেই বাঁকা হাসি বজায় রেখেই পরী বলে,
“ভালোবাসা এত সহজ?”
“সহজ কী না জানিনা। তবে খুব কঠিনও বোধ হয় নয়। তবে কেন ভালোবাসি এটার প্রাসঙ্গিক কোনো সঙ্গা আমার কাছে নেই। শুধু বলব ভালোবাসা থেকেই ভালোবাসি।”
“আপনি আমায় কতটুকু জানেন?”
“একটা মানুষকে ভালোবাসার জন্য, তাকে জীবনসঙ্গী করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন।”

পরী একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল।
“জীবনসঙ্গী করার জন্য যতটুকু জানা প্রয়োজন আপনি ততটুকু জানেন না। আপনার কী মনে হয় জয় আমায় চিট করেছে?”
“জানিনা। কিন্তু জয় অন্য কাউকে কেন বিয়ে করল সেটাও আমার অজানা।”
“আমি বলেছি বলেই জয় অন্য কাউকে বিয়ে করেছে।”
“মানে? আপনি জয়কে ভালোবাসতেন না?”

“এখনো ভালোবাসি।”
“তবে?”
“একটা তিক্ত সত্য আমাদের আলাদা করেছে।”
“কী সেই সত্য?”
“হজম করতে পারবেন তো?”
“মানসিকভাবে আমি যথেষ্ট স্ট্রং।”
“আমি এই তিক্ত সত্যটা জয়কে জানাতে পারিনি। এর জন্যও ছিল বাঁধা। জয় যদি কোনোভাবে সেটা জানতো তাহলেও জয় অন্য কাউকে বিয়ে করতো না। কিন্তু আপনাকে বলার কারণ হচ্ছে যাতে নিজের ভুলটা সংশোধন করতে পারেন। সবাই ভালোবাসার যোগ্য না। সবাইকে ভালোবাসাও যায় না।”
“একটু ক্লিয়ার করে বলবেন প্লিজ?”

“আমি কোনোদিন মা হতে পারব না।”
পরীর কথাটা একদম বুকে গিয়ে বিঁধলো তুর্যর। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আপনি মজা করছেন?”

“এত নিচু মানসিকতা আমার নেই যে মাতৃত্ব নিয়ে মজা করব। মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কার না থাকে? কোন ছেলের ইচ্ছে না হয় বাবা ডাক শোনার? এসব জেনেশুনে কেউ চায় বাবা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত হতে? তাই বলছি, আমায় ভালোবাসার মত ভুল করবেন না। জীবনটা অনেক সুন্দর। সবাই সেটা ভালোভাবে উপভোগ করার মতো সুযোগ পায় না। কিন্তু আপনার সেই সুযোগটা আছে।”
কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না পরী। বালতি নিয়ে সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। চিলেকোঠার দেয়ালের আড়াল থেকে পরীর শেষের সব কথাগুলো শুনেছে তাহমিনা বেগম। দুপুরে লেবুর শরবত করে খাবেন বলে ছাদে এসেছিল গাছ থেকে তাজা লেবু ছিঁড়তে। আর তখনই কানে আসে পরীর কথাগুলো। সত্যিই কথাগুলো ভীষণ তিক্ত ভীষণ!
শাওয়ার ছেড়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে পরী। এখন আর এসব মনে করে কান্না পায় না। চোখের পানিগুলোও বোধ হয় হাঁপিয়ে উঠেছে। কান্না না আসাতেই বরং কষ্টগুলো আরো বাড়ে। বুকের ভেতরটা ভেঙ্গেচুরে চুুরমার করে দেয়। কিছুক্ষণ কাঁদলে মনটা হালকা হয়ে যায়। কিন্তু সেই উপায়টা আর নেই। ভেতরের রক্তক্ষরণ বাহিরে প্রকাশ করা অন্তরায়। প্রতিটাক্ষণ এই দহনে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে পরী।

রেস্টুরেন্ট মুখোমুখি বসে আছে জয় আর পরী। পরীই ফোন করে জয়কে বিকেলে দেখা করতে বলেছিল। জয় চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসে পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। পরী মাথা নিচু করে বসে আছে আর হাতের আঙ্গুল মোচড়াচ্ছে।
জয় ওয়েটারকে ডেকে কফি অর্ডার করল। তারপর সোজা হয়ে বসে বলল,
“কেমন আছিস?”

“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
“ভালোই। হঠাৎ দেখা করতে বললি! কোনো সমস্যা?”
সব দ্বিধাবোধ লুকিয়ে পরী স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। তারপর বলল,
“সূচীর সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?”
“মানে?”

“মানে এটাই যে, তুমি সূচীকে মেনে নিয়েছ?”
“ভালোবেসেছি একজনকে। তারপর ঘর করছি অন্য একজনের সাথে। এটার কষ্ট তুই জানিস?”
“বাচ্চাদের মত কথা বলছ কেন? তুমি ম্যাচিউর একটা ছেলে হয়ে ইমম্যাচিউচ কথাবার্তা বললে সেটা মানায় না।”
“তুই আমায় ভালোবেসে অন্য একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করিয়েছিলি যখন তখন সেটা খুব ম্যাচিউর মেয়ের কাজ ছিল তাই না?”
পরী জয়ের চোখের দিকে তাকালো। এই চোখে এখন পরীর প্রতি রয়েছে তীব্র ক্রোধ। পরী শান্তস্বরে বলল,
“নিয়তির উপর আমাদের কোনো হাত নেই জয় ভাই। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটা আমাদের হাতে নেই। কখন কার সাথে দেখা হবে, কার সাথে জীবন জুড়ে যাবে এটা আমরা কেউই বলতে পারবো না। হয়তো তোমাকে পাওয়ার ভাগ্য নিয়ে আমি পৃথিবীতে আসিনি। কিন্তু সূচী? সে তো কোনো অন্যায় করেনি। এক বুক আশা, স্বপ্ন নিয়ে তোমার বাড়িতে পা রেখেছিল। তার বিনিময়ে তুমি তাকে কী দিচ্ছ? অবহেলা। আমি জানি, আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। কিন্তু তার ফল ঐ মেয়েটা কেন ভোগ করবে বলো?”

“আমি তোকে ভুলতে পারিনা পরী।”
জয়ের এমন কথায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে পরী। কিন্তু নিজেকে তো তার স্থির রাখতেই হবে।
“জয় ভাই অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়া খুব বড় ধরণের বোকামি। এভাবে না তুমি সুখী হবে। আর না সূচী। অতীত কষ্ট দিতে জানে, কাঁদাতে জানে। অথচ সেই অতীতকেই আমরা আঁকড়ে ধরে থাকি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটাও আমরা বলতে পারি না। তবে বর্তমানকে আমরা সঠিক কাজে লাগাতে পারি।”
“কী বলতে চাচ্ছিস তুই?”

“আমি বলতে চাই এবং মন থেকে চাই তুমি সূচীকে মেনে নাও। ওকে ওর প্রাপ্য অধিকার দাও। নতুন করে ওকে ভালোবাসো। জীবনটা সূচীকে সাথে নিয়ে সাজাও। তোমরা অনেক সুখী হবে দেখো।আজ তোমার সাথে দেখা করার কারণ এটাই। সূচী তোমাকে খুব ভালোবাসে খুব। ওকে তুমি ভালোবাসা একটা সুযোগ দাও।”
শেষের কথাগুলো বলার সময় গলা ধরে এসেছিল পরীর। ফোন আসার মিথ্যা অজুহাত দিয়ে বলল,
“আমায় এখন যেতে হবে জয় ভাই। নিশাত ফোন করেছে। আমার কথাগুলো একটু মন থেকে ভেবো প্লিজ। একটা সুযোগ দিয়ো ওকে। ভালো থেকো।”
পরী চলে যাচ্ছে আর জয় চেয়ে আছে। জয়ের কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। সত্যি বলতে বলার ইচ্ছেও নেই। পরীকে জয় চেনে। মানসিকভাবে পরী যে কতটা শক্ত সেটাও জয়ের অজানা নয়। অন্যের জন্য ভাবাটাই যেন ওর সব। শুধু ওর ভাবার সময় হলো না জয়কে নিয়ে।
জয়ের বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

পরী দুই তলায় এসে দেখে তুর্যর ফ্লাট লক করা। তিন তলায় গিয়েও তুর্য বা ওর মাকে পেলো না। পরী সোফায় বসতে বসতে নিশাতকে বলল,
“তাহমিনা আন্টি খেয়েছে?”
“না। তুর্য ভাইয়াও খায়নি। তুমি বাহিরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই চলে গেছে।”
“কোথায়?”
“তাদের বাসায়।”
পরীর ঠোঁটে আবারও সেই বাঁকা তাচ্ছিল্যর হাসি। হাসিটার ব্যাখা অজানা নয় কারো।

পর্ব ১৪

সময় তার গতিমত চলছিল। সাতটা দিন এভাবেই পার হয়ে যায়। এর মধ্যে তুর্য আর আসেনি। এটা নিয়ে অবশ্য পরীর কোনো মাথাব্যথাও নেই।
আজও শুক্রবার। সব কাজ শেষ করে বিকেলে পরী ছাদে যায় গাছে পানি দেওয়ার জন্য। বাড়ির ছাদটা বেশ বড়সড়। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো ছাদে এত যে গাছ এই সবগুলো তুর্য লাগিয়েছে। তবে যত্ন তেমন করতে পারেনি বললেই চলে। গাছগুলো ছাদের সৌন্দর্য অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মনের আনন্দে গাছে পানি দিচ্ছিল পরী। তখন নিশাত ছাদে এসে বলে,
“আপু তোমার ফোন।”
“ছাদে ফোন নিয়ে এসেছিস কেন?”
“কে যেন ফোন করেছিল। আননোন নাম্বার”
“কই দেখি।”

হাতে মগটা নিচে রেখে ওড়নায় হাত মুছে।নেয়। নিশাতের থেকে ফোনটা নেওয়ার পর নিশাত চলে যায়। পরী কল ব্যাক করার পর ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে। পরী সালাম দেয়।
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি কি পরী?”
“হ্যাঁ।”
“আমি সূচী।”
“সূচী! আমার নাম্বার কোথায় পেলে তুমি?”

“বাবার কাছ থেকে নিয়েছি।”
“আচ্ছা। কেমন আছো বলো?”
“আমি তো বিন্দাস আছি।”

“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ। জয়কে জব্দ করছি বুঝলে?”
“জব্দ করছো? সেটা কীভাবে?”
“বলতে পারবো না। আমার লজ্জা করে।”
ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেলেও পরী হেসে বলে,
“আচ্ছা ঠিক আছে। বলতে হবে না। কি করছো?”
“মোগলাই বানাই উনার জন্য।”
“জয়ের জন্য?”

“হুম। মোগলাই তো উনার খুব পছন্দ।”
“হুম জানি। তো হঠাৎ ফোন দিলে যে? কোনো কারণে নাকি এমনিই?”
“এমনিই দিলাম। সেই কবে কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু ফোন দিব দিব করে আর দেওয়া হয়নি।”
“ওহ।”
“হুম। তুমি কী করো?”
“গাছে পানি দিচ্ছিলাম।”
“গাছ কোথায় পেলে?”

“ছাদে আছে।”
“একদিন আসবো জয়কে নিয়ে।”
“এসো।”
“তুমি আসো না কেন? শুক্রবার তো তোমার বন্ধই থাকে।”
“পুরো সপ্তাহের কাজ বাকি পড়ে থাকে। সেগুলো করতে করতেই শুক্রবার কেটে যায়।”
“একদিন সময় নিয়ে এসো প্লিজ।”

“আচ্ছা আসবো।”
“ওকে বেবি এখন রাখছি। আমার মোগলাই বানানো হয়ে গেছে। এখন সাহেবের কাছে যাই।”
“আচ্ছা যাও।”
সূচী চারটা মোগলাই একটা প্লেটে নিয়ে জয়ের কাছে যায়। জয় তখন ব্যালকোনিতে ছিল। সূচী প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এইযে আপনার মোগলাই।”
“রেডি হয়ে নিন।”
“কী?”

“কানে শোনেন না? রেডি হতে বলেছি।”
“শুনেছি। কিন্তু কেন?”
“অফিস থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে।”
“আমরাও যাবো?”
“হুম।”
“সত্যিই? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
“বিশ্বাস করুন।”
“আমার প্রেমে পড়েছেন তাই না?”
“হোয়াট?”

“হয়েছে হয়েছে। আর ভাব ধরতে হবে না। আমি সব বুঝি।”
“অনেক বেশিই বুঝেন আপনি। অফিসের বস নতুন বিয়ে করেছেন। সেই কাপলদের জন্য ট্যুরের ব্যবস্থা করেছেন।”
“ওয়াও গ্রেট! কখন যাচ্ছি আমরা?”
“আজ রাতেই।”
“আচ্ছা আমি সব গোছগাছ করে রাখছি।”
“হুম।”
জয় মোগলাই খাওয়া শুরু করে। সূচী তখন পাশ থেকে জয়ের গাল টেনে বলে,
“আমার সুইট বর-টা।”

খাবার মুখে নিয়েই বিষম খায় জয়।

ফোন কাটার পর পরী আকাশের দিকে তাকায়। সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে। পুরো আকাশ রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে। একদিকে ভালোলাগা কাজ করলেও অন্যদিকে কীসের যেন এক বিষন্নতা। চারদিক নিরব, স্তব্ধ। কোনো কোলাহল নেই। পাখিরা উড়েউড়ে তাদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। তখনই ছাদে পা রাখে তুর্য। পরী কিছু বুঝে উঠার আগেই তুর্য দ্রুত পায়ে কাছে এসে পরীকে জড়িয়ে ধরে। পরী কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ বনে যায়। এটা কী হলো! আশেপাশে তাকিয়ে দেখল অন্যান্য ছাদে মানুষ আছে নাকি। না নেই।
পরী তুর্যকে সরাতে চাচ্ছে কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। পরী বিরক্ত নিয়ে বলে,
“করছেন টা কী আপনি? এমন বেয়াদবের মতো জড়িয়ে ধরেছেন কেন? ছাড়ুন বলছি আমায়।”
পরীকে ছেড়ে দিয়ে তুর্য মাথা নিচু করে বলে,
“স্যরি।”
পরী ভালো মতো খেয়াল করে দেখে তুর্যর চোখে পানি।
“আপনি কি কাঁদছেন?”

পেছন থেকে গুটিগুটি পায়ে একটা বাচ্চা ছেলে ছাদে এগিয়ে আসে। তুর্যর হাত ধরে আধো আধো বুলিতে বলে,
“ছোত আব্বু আমাল মাম্মি কোতায়? তুমি যে বললে আমাতে মাম্মিল কাছে নিয়ে যাবে।”
পরী আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। তুর্য বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে। তুর্যর অদ্ভুত অদ্ভুর কাজকর্মে পরী ভড়কে যায়। পরী জিজ্ঞেস করে,
“ছেলেটা কে?”
তুর্য চোখের পানি মুছে বলে,
“আমার ভাতিজা।”

“ওহ।”
পরী কথা বলার মতো আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। তাই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে তুর্য বলে,
“আমার ভাবি মারা গেছে পরী।”
পরী থেমে যায়। বুকটা কেঁপে উঠে। তাহলে কি তুর্যর সেদিন চলে যাওয়ার পেছনে এই কারণটাই ছিল? পরী তুর্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
“কবে?”
“শুক্রবার রাতেই। আপনার সাথে কথা বলার কিছুক্ষণ পরই ভাইয়া ফোন করে বলে হাসপাতালে যেতে। ভাবির অবস্থা ভালো নয়। মাকে নিয়ে তখনই হাসপাতালে চলে যাই। ভাবি প্রেগন্যান্ট ছিল। হঠাৎ অসময়ে পেইন উঠে।বাচ্চা আর ভাবি কাউকেই বাঁচানো যায়নি।”

পরীর ভেতরটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বাজে খবর ছিল এটা। তুর্যর ভাবি হয়তো পরীর কিছুই হয় না। কিন্তু এতবেশি কষ্ট হচ্ছে যে চোখ দুটো পানিতে ছলছল করছে। তুর্য করুণভাবে পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“একটা কথা বলবো?”
“হু।”

“কিছুদিনের জন্য সেজানের দায়িত্ব নিবেন প্লিজ? তিরা ভাবি মারা যাওয়ার পর থেকেই ভাইয়া মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছে। এইদিকে সেজানও বারবার ওর মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাঁদছে। মা-ও ওকে সামলাতে পারছে না।”

“আমি! কিন্তু”
সেজান তুর্যকে বলে,
“ছোত আব্বু এতাই কি আমাল মাম্মি? কিন্তু আমাল মাম্মি তো দেখতে এমন না। আমাল মাম্মি কোতায়? তুমি যে বলেছিলে আকাশে গেছে। আসেনি সেখান তেকে?”
তুর্য অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে। সেজানের প্রতিটা কথা বুকে বাঁধছে খুব। আপনাআপনি পরীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। পরী এক হাতে চোখের পানি মুছে ফেলে। হেসে বলে,
“বাবু আমিই তোমার মাম্মি। আমি যখন আকাশে গেছি তখন ম্যাজিক করে আমার মুখ বদলে দেওয়া হয়েছে। এজন্যই তো আগের চেহারার সাথে আমার মিল নেই।”
“ইয়ে! তুমি সত্যিই আমাল মাম্মি। শুধু আমাল মাম্মিই আমাতে বাবু বলে দাকে।”

সেজান পরীর কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। পরীর সারা মুখে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। তারপর পরীর দু’গালে সেজানের ছোট্ট ছোট্ট হাত রেখে বলে,
“মাম্মি তুমি কেন আমাতে লেখে গেছিলে? তোমাল পেতে যে আমাল পুতুল বুনু ছিল। ওকে সাতে নিয়েছ অথচ আমালে নাওনি। তুমি কি আমালে ভালোবাছো না মাম্মি?”
পরীর গভীর মমতায় সেজানের গালে চুমু খেয়ে বলে,
“আল্লাহ্ পুতুলকে নিয়ে গেছে বাবু। পুতুল তো একা যেতে ভয় পাবে তাই আমি দিয়ে এসেছি। আমি তো আমার সেজানকে খুব ভালোবাসি।”
“পুতুলকে নিয়ে গেছে কেন?”

“তা তো আমি জানিনা সোনা।”
“মাম্মি তোমালে ছালা তাকতে আমাল খুব কস্ত হয়েছে।
“আর কষ্ট হবে না এখন থেকে।”
সেজান দুহাত দিয়ে পরীর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। তুর্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। কে বলবে পরী সেজানের আসল মা নয়? কত সহজে বুঝিয়ে, মানিয়ে নিল ছোট্ট সেজানকে!
পরী তুর্যকে বলে,
“কখন এসেছেন?”

“একটু আগেই। এখানে এসেই সোজা আপনার কাছে এসেছি।”
“আপনি একাই এসেছেন?”
“না। সবাই এসেছি।”
“সবাই মানে?”
“আব্বু,আম্মু, ভাইয়া, আমি, তরী আর সেজান।”
“সবাই এখানে কেন?”
“আপনার জন্য।”

“বুঝলাম না।”
“আসলে সেজান বারবার ভাবির কাছে যাওয়ার জন্য কাঁদছিল। তখন মাকে আপনার কথা বললাম। মা বলল সেজানকে আপনার কাছে নিয়ে আসতে। ভাইয়া তো এখন অফিসে যায় না। অফিস আমাকে আর আব্বুকেই সামলাতে হয়। আপনি যখন ডিউটিতে যাবেন তখন তো সেজানকে রাখতে হবে। তাই মা-ও এসেছে। ঐদিকে ভাইয়া একা থাকলে আরো মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বে। এজন্য ভাইয়াকেও সাথে করে নিয়েছি। আর তরী তো একা থাকতে পারবে না। আমাকে খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে তাই না?”
“স্বার্থপর মনে হবে কেন?”
“এইযে নিজের স্বার্থে সেজানের দায়িত্ব আপনাকে দিলাম।”
“কাজটা আমার কাছে নিঃস্বার্থ মনে হচ্ছে। আমার নিজের বাচ্চা তো কোলে নেওয়ার ভাগ্য নেই। ওর মাধ্যমে অন্তত মা হওয়ার সুখটা তো পাবো। এদিক থেকে আমি কৃতজ্ঞ।”
“আমি প্রথমে বিষয়টা নিয়ে ভয়ে ছিলাম।”

পরী ঈষৎ হেসে বলল,
“আমি রান্না বসাচ্ছি। আন্টিকে রাঁধতে বারণ করিয়েন।”
“না, না। আপনাকে কষ্ট করে সবার জন্য রাঁধতে হবে না।”
“আমার সমস্যা হবে না। মাত্রই তো সবাই আসলেন। আপনাদের আজ রান্না করতে হবে না। আর আমি সেজানকে সাথে নিয়ে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
পরী তিন কদম আগানোর পর তুর্য আবারও পিছু ডাকে। পরী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। তুর্য অমায়িক হেসে বলে,
“ভালোবাসি।”

পর্ব ১৫

তুর্যর মুখে ‘ভালোবাসি’ শুনে পরী জিজ্ঞেস করে,
“সবকিছু জানার পরও বলছেন ভালোবাসি?”
তুর্য পরীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
“হ্যাঁ বলছি। কারণ স্বার্থ দিয়ে ভালোবাসা হয় না।”
“এখানে স্বার্থ কীভাবে আসলো? প্রতিটা মেয়ে যেমন মা হতে চায়। তেমনি প্রতিটা ছেলেও বাবা হতে চায়।”
“আপনি মা হতে পারবেন না এটা যদি মেনে নিতে পারেন। তাহলে আপনাকে ভালোবেসে আমি বাবা হতে পারব না। এটা কেন মেনে নিতে পারব না আমি?”
“আপনি পাগল হয়ে গেছেন।”
“সেই পাগল তো আপনিই আমায় বানিয়েছেন।”

তুর্যর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বিধায় পরী আর কিছু বলল না। সেজানকে নিয়ে সোজা নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে গেল।
পরীর মা এখন অনেকটা সুস্থ ও স্বাভাবিক। তিনি ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন। পরীর কোলে সেজানকে দেখে নাহিদা বেগম জিজ্ঞেস করেন,
“তোর কোলে কে?”
“সেজান।”
“কার বাচ্চা?”
“তুর্যর ভাতিজা।”
“ওরা এসেছে?”
“হ্যাঁ।”
“না বলে চলে গেছিল কেন?”
“মা, তুর্যর ভাবি মারা গেছে।”

“কী বলিস! কীভাবে?”
“ভাবি প্রেগন্যান্ট ছিল। বেবি হওয়ার সময়ই মারা যায়।”
“বাচ্চা কোথায়?”
“বাচ্চাকেও বাঁচানো যায়নি। তখনও বেবি হওয়ার ডেট আসেনি।”

“হায় আল্লাহ্! পেটেরটা তো সাথেই গেল। কিন্তু এতিম হয়ে গেল এই বাচ্চাটা। আল্লাহ্ বাচ্চাটারে এতিম করে দিল। যার মা,বাবা নাই দুনিয়ায় তার জীবনে কিছুই নাই।”
বেশ আক্ষেপ করেই তিনি কথাগুলো বললেন। আসলেই তো তাই। মাথার উপর বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেয় বাবা। পরীর বাবা বেঁচে নেই বলেই পরীর জীবনে নেমে এসেছে দুর্ভিক্ষ। মাথার উপর ছায়াটাও নেই। আর মা? সে তো জীবনের সবকিছুর সাথে জড়িয়ে থাকে। ভালো, খারাপ সব সময়ে পাশে থাকে। সব বিপদ থেকে সন্তানকে আগলে রাখে। কিন্তু এই ছোট্ট সেজান হারিয়ে ফেলল তার মাকে।
পরী সেজানকে নাহিদা বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“সেজানকে একটু রাখো মা। আমি তাদের জন্য রান্না বসাই।”

“আমি রান্না করি।”
“না। গরমের মধ্যে তোমায় এখন রান্নাঘরে যেতে হবে না।”
“গরমে মনে হয় আগে কখনো রান্না করিনি?”
“করেছ। কিন্তু এখনো তুমি পুরোপুরি সুস্থে নও। আগে সুস্থ হবে তারপর রান্না করবে।”
“আমার মা বলেছে এখন তো আমায় তার কথা মানতেই হবে।”
নাহিদা বেগমের কথা শুনে পরী ফিক করে হেসে দেয়। সেজান নাহিদা বেগমের কোলে বসে পরীকে জিজ্ঞেস করে,
“মাম্মি এতা কে?”

“এটা তোমার নানু।”
“নানু? কিন্তু আমাল নানু তো দেকতে এমন না। নানুলও কি চেহালা পাল্তে দিছে?”
“না বাবু। এটা তোমার আরেকটা নানু। তুমি এখন তোমার নানুর সাথে বসে টিভি দেখো। আমি রান্না করি।”
“আততা।”

সেজানের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে পরী রান্নাঘরে চলে গেল।
টিভি দেখতে দেখতে নাহিদা বেগমকে মনে হয় হাজারটা প্রশ্ন করছিল সেজান। নানু এতা কী, ওতা কী? ওলা কী কলে? ইত্যাদি ইত্যাদি। নাহিদা বেগমও হেসে হেসে উত্তর দিচ্ছিল সব। বাহিরে ফুটবল খেলতে গেছিল নিশাত। খেলা শেষ করে ঘেমে বাড়িতে আসে। ড্রয়িংরুমে সেজানকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
“এই বাচ্চাটা কে মা?”
“তুর্যর ভাতিজা।”

“ভাইয়ারা এসেছে?”
“হুম।”
“কী কিউট বাচ্চা!”, বলেই সেজানের গাল ধরতে যায় নিশাত। নাহিদা বেগম হাত সরিয়ে দিয়ে বলেন,
“আগে ফ্রেশ হয়ে আয় যা। নোংরা হাত দিয়ে ধরবি না।”
“ওরে বাবারে! ঠিক আছে আসছি ফ্রেশ হয়ে।”
নিশাত গোসল করতে যাওয়ার পর সেজান জিজ্ঞেস করে,
“এতা কে নানু?”

“এটা তোমার মামা।”
“মামা? মামা কী?”
“তোমার মাম্মির ছোট ভাই। তোমার মামা হয়। তুমি মামা বলে ডাকবে।”
“আততা। আমি মামাল কাছে যাই?”
“ও তো গোসলে গেছে নানুভাই।”
“আমি লুমে গিয়ে তুপ কলে বসে তাকব।”
সেজানের আধো আধো বুলিতে কথা শুনে নাহিদা বেগম হেসে ফেলেন। বলেন,
“যাও।”

গুটিগুটি পায়ে সেজান দৌঁড়ে যায় নিশাতের রুমে। এদিক-সেদিক তাকিয়ে একটা টুল খুঁজে বের করে। তারপর টুলের ওপর দাঁড়িয়ে বিছানায় উঠে বাবু হয়ে বসে থাকে। নিশাত গোসল শেষ করে এসে দেখে সেজান লক্ষী ছেলের মতো বাবু হয়ে বসে আছে। সেজানের সামনে নিশাত হাঁটু গেড়ে বসে বলে,
“তুমি বিছানায় উঠলে কীভাবে?”
“তুল দিয়ে।”
নিশাত হেসে ফেলে। সেজানের গাল টেনে বলে,
“কিউট বাবুটা।”
“আমালে কোলে নাও মামা।”

“মামা?”
“তুমি তো আমাল মামাই। নানু বলেছে তুমি আমাল মামা হও।”
“নানু? কে?”
“ধুল! তুমি কিছুই জানো না। কোলে নাও।”

নিশাত আর না ঘাটিয়ে সেজানকে কোলে নিয়ে চুমু খায়। নিশাতের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“মাম্মি কোতায় মামা?”
“তোমাদের বাসায় মনে হয়।”
“আমি মাম্মিল কাছে যাব।”
“আচ্ছা চলো। দিয়ে আসি।”
নিশাত সেজানকে নিয়ে দুই তলায় যাচ্ছিল তখন নাহিদা বেগম জিজ্ঞেস করেন,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“ওর মায়ের কাছে।”
“পরী রান্নাঘরে আছে। দিয়ে আয়।”

“আপুর কাছে নিব কেন?”
“পরীর কাছে দিয়ে আয়। তারপর সব বলছি।”
নিশাত গিয়ে সেজানকে পরীর কাছে দিয়ে আসে। সেজান কেবিনেটের উপর দু’পা তুলে বসে আছে। আর পরী রান্না করছে।
“মাম্মি আমি একতা গাজর খাই?”
“খাও।”
সেজান পাশের ঝুড়ি থেকে গাজর নিয়ে খাওয়া শুরু করে। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে পরী খেয়াল করছে সেজান ভালো মতো গাজরটা খেতে পারছে না। সেজানের থেকে গাজরটা নিয়ে কিউব কিউব করে কেঁটে ধুয়ে দেয়। এবার শান্তিমত খেতে পারছে।

রান্নাবান্না শেষ করে সব গোছগাছ করে সাজিয়ে নেয়। নাহিদা বেগমের কাছে সব শুনেছে নিশাত। নিশাতকে নিয়ে খাবারগুলো দুই তলায় নিয়ে দিয়ে আসে। তারপর আবার সেজানকে নিয়ে যায়। এবার ভেতরে ঢোকার সময় এক বিপত্তি ঘটে। সেজানের বাবা যে দরজার পাশে বসে ছিল সেটা পরী দেখেনি। তার পায়ের সাথের হোঁচট খেয়ে ধিরিম করে পড়ে যায় পরী। ভাগ্যিস সেজান নিশাতের কোলে ছিল। পড়ে গিয়েই ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠে পরী। বাম হাতে আর কোমরে ভালো ব্যথাই পেয়েছে। পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে তুর্য দৌঁড়ে আসে।
“আরে পড়লেন কীভাবে?”
পরী দাঁত কটমট করে বলে,
“আরেকবার কি পড়ে দেখাব?”
উঠে বসতে বসতে দেখতে পায় সেজানের বাবাকে। কেমন ভয় নিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। পরী তার দিকে হাত তাক করে বলে,
“উনি এখানে কেন?”

তুর্য জিজ্ঞেস করে,
“আপনি চিনেন? ও আমার বড় ভাই।”
“আপনার ভাই? সূর্য? সে তো আমাদের শপে প্রায়ই আসতো এটা, ওটা কিনতে।”
“হুম। ভাবির জন্য কিনতো।”
সেজান সূর্যর কাছে গিয়ে বলে,
“পাপা তুমি মাম্মিতে পেলে দিছো কেন?”

পরী বলে,
“তোমার পাপা আমায় ফেলেনি। আমিই পড়ে গেছি।”
তুর্য নিশাকতে বলে,
“সেজানকে নিয়ে ভেতরের রুমে যাও। আর আমার বোন তরীকেও একটু পাঠিয়ে দিয়ো প্লিজ। বলবে সূর্য ভাইয়াকে রুমে দিয়ে আসতে।”
“আচ্ছা ভাইয়া।”
নিশাত চলে যাওয়ার পর তুর্য পরীকে ধরে উঠায়। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“কোথায় ব্যথা লেগেছে ম্যাম? মালিশ করে দেবো?”

পরী চোখ পাকিয়ে তাকায় তুর্যর দিকে। তুর্য সেই চাহনীকে পাত্তা না দিয়ে পরীর আরেকটু কাছে গিয়ে বলে,
“এভাবে তাকাবেন না প্লিজ। আমার কেমন কেমন যেন লাগে।”
পরী কনুই দিয়ে তুর্যর পেটে গুঁতো দিয়ে বলে,
“ধুর মিয়া।”

সন্ধ্যা ছয়টার দিকে গাবতলী পৌঁছে যায় জয় আর সূচী।সেখান থেকেই সবাই একসাথে যাবে। জয় গিয়ে দেখে কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই এসে পড়েছে। সবার সাথে সূচীকে পরিচয় করিয়ে দেয় জয়। তারপর গিয়ে বাসে বসে। সূচী জানালার কাছে বসেছে। আর পাশে বসেছে জয়। সূচীর আজ খুব খুশি খুশি লাগছে। এই প্রথম জয়ের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে। অন্যরকম অনুভূতিতে শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। সবাই আসার পর নির্দিষ্ট সময়ে বাস ছেড়ে দেয়। জানালা খুলে রেখেছে সূচী। জানালা দিয়েই প্রবলবেগে বাতাস ছুটে আসছে। সূচী জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটা তো বললেন না।”
“সিলেট।”
“সিলেটের কোথায়?”

“বিছানাকান্দি।”
“সত্যিই? আমার কতদিনের ইচ্ছে ছিল বিছানাকান্দি যাওয়ার।”
জয় পাশে ঘুরে ওর কলিগদের সাথে গল্প করছিল। সূচী তখন জয়ের এক হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। জয় কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। কারণ কিছু বললেই ওর কলিগরা জেনে যাবে ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। আর ঘরের খবর পরকে জানানোর কোনো ইচ্ছে নেই জয়ের। তাই কিছু বলেনা। এদিকে সূচী চোখ বন্ধ করে জয়ের শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছে। এই প্রথম জয়ের কাঁধে মাথা রেখেছে। আলাদা একটা শান্তি লাগছে সূচীর। সূচী চোখ বন্ধ করে অস্ফুট স্বরে বলে,
“ভালোবাসায় বুঝি এত সুখ!”

পর্ব ১৬

বিছানাকান্দি পৌঁছানোর পর সূচীর বিস্ময় আকাশ সমান। খুশিতে পাগল প্রায়। পানি দেখে ছটফট ছটফট করছে। দুগালে হাত রেখে লাফাতে লাফাতে বলে,
“ওহ মাই গড! ওহ মাই গড! এত সুন্দর পানি।”
জয় বিরক্ত হয়ে বলে,
“এভাবে বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছেন কেন?”

“আপনার চোখে কি ন্যাবা হয়েছে? দেখতে পাচ্ছেন না এত সুন্দর প্রকৃতি?”
“হ্যাঁ দেখছি। তাই বলে লাফাতে হবে?”
“প্রকৃতি উপভোগ করছি।”
“লাফিয়ে লাফিয়েও প্রকৃতি উপভোগ করা যায় জানতাম না।”
“জানবেন কী করে? প্রকৃতি উপভোগ করার মতো মন আছে আপনার? একটু রসকষ কিচ্ছু নেই।”
জয় কিছু বলতে যাবে তখন এক কলিগ এসে বলে,
“কী ভাই? পানিতে নামবে না?”
জয় হেসে বলে,

“হ্যাঁ আসছি।”
সূচী জিজ্ঞেস করে,
“উনার নাম কী?”
“কেন?”
“বলেন।”
“আলতাফ।”

“দেখেছেন আলতাফ ভাই কত ভালো? বউকে নিয়ে পানিতে নেমেছে। শেখেন একটু দেখে শেখেন। দেখে একটু রোমান্টিক হোন।”
জয় ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সূচী দৌঁড়ে পানিতে নেমে যায়।
বিছানাকান্দির সৌন্দর্যে যেকোনো মানুষ বিমোহিত হবে। পানিতে টইটুম্বুর জায়গা। পানিতে পাথরে পাথরে ভর্তি। উপরে নীল আকাশ। শুভ্র সাদা মেঘ। জয়ও গিয়ে পানিতে নামে। এক অন্যরকম প্রশান্তি লাগছে। সব ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। বিছনাকান্দির সৌন্দর্য অসাধারণ। দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত শুধু পাথর আর পাহাড়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় আকাশ আর মেঘের সাথে পাহাড়ের দলগুলো মিশে আছে। যতোই কাছে যাই পাহাড়গুলোর ততোই আকাশ থেকে যেন দূরে যেতে থাকে। আর পাহাড়ের গায়ে বেপরোয়া সাদা মেঘের দলগুলো যেন আঠার মতো লেগে থাকে। পাথর, পানি, পাহাড় আর মেঘ নিয়েই যেন বিছনাকান্দি।
জয় পানির মধ্যে একটা পাথরের উপর বসে আছে। সূচী এসে জয়ের পাশে বসে। জয়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। জয় চোখ পাকিয়ে তাকায় সূচীর দিকে। সূচী ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে বলে,
“শসসসসস! একদম বকা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। তাহলে কিন্তু সবাই জেনে যাবে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়।”
“ব্লাকমেল করছেন?”

“উঁহু। শুধু একটু ভালোবাসা চাচ্ছি।”
“যেটা পাবেন না সেটা চেয়ে লাভ কী?”
“আপনি মন থেকে একবার ভালোবাসার চেষ্টা করেই দেখুন না। ঠিকই পারবেন।”
“পারবো না।”
“কেন পারবেন না? আমি কি আপনার ভালোবাসার যোগ্য নই?”
“এমন কিছু না।”
“তবে কেমন কিছু?”
“বলা যাবে না।”

“বলা যাবে না। নাকি বলতে চান না?”
“বলতে চাই না।”
ওদের কথার মাঝে আলতাফ বলে,
“ধূসর চলো কাপড় বদলে তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। নৌকায় চড়ে ঘুরতে হবে তো।”
“হ্যাঁ চলেন।”

সূচীর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জয় চলে যায়। কী মনে করে যেন পেছনে ঘুরে বলে,
“বসে আছো কেন এখনো? চলো।”
জয়ের মুখে তুমি শুনে সূচী হা হয়ে যায়। কাছে এসে বলে,
“কী বললেন? এই আপনি কি তুমি করে বললেন?”
জয় ফিসফিস করে বলে,
“এত খুশি হওয়ার কিছু নেই। কেউ যাতে কিছু না বুঝে এজন্যই তুমি বলেছি।”
সূচী মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,
“হুহ।”

দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই নৌকা ভাড়া করতে বের হয়। নৌকায় করে বিছানাকান্দি, লক্ষনছড়া, পান্থুমাই তিনটি জায়গা ঘোরার জন্য নৌকা ভাড়া করা হয়। জায়গাগুলো একদিকে হওয়ায় তিনটি জায়গাই একদিনে ঘুরা যাবে। নৌকায় বসে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে সবাই। কেউ কেউ ছবি তুলছে। সূচী ফোনের ক্যামেরা অন করে বলে,
“সবাই ছবি তুলছে আর আমরা তুলব না? আসেন ছবি তুলব।”,বলেই জয়ের গালে চুমু দিয়ে ফটাফট কয়েকটা সেলফি তুলে নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় জয়। পাশের কয়েকজন কলিগ দেখেছে। তারা এখন মুখ টিপে টিপে হাসছে। জয় সূচীকে কয়েকটা কথা শোনাতে গিয়েও থেমে যায়। কী ভেবে যেন হেসে ফেলে।

দুপুরে শপে ছিল পরী। তখন নিশাত দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে শপে ঢুকে। দৌঁড়িয়ে আসার কারণে হাঁপিয়ে গেছে। পরী বলে,
“এভাবে দৌঁড়িয়ে আসলি কেন?”

“দাঁড়াও একটু জিরিয়ে নিই।”
লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিশাত বলে,
“আপু রেজাল্ট দিয়েছে। আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি।”
পরী খুশিতে ভাইকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়।
“আমি তো জানতাম আমার ভাইটা ভালো রেজাল্ট করবেই।”
সিয়াম এগিয়ে এসে বলে,
“পরী মিষ্টি খাওয়াও এবার।”
“হুম কাল খাওয়াব।”

রুমকি এসে বলে,
“পরী আজ তোমার ছুটি যাও। ভাই এত ভালো রেজাল্ট করেছে। পরিবারের সাথে সময় কাটাও।”
“থ্যাঙ্কিউ আপু।”
পরী নিশাতকে নিয়ে বাড়িতে যায়। ফ্ল্যাটে ঢুকেই দেখতে পায় মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে ড্রয়িংরুম ভর্তি। ড্রয়িংরুমের সোফায় নাহিদা বেগমের কোলে শুয়ে টিভি দেখছে সেজান। পরীকে দেখে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। পরী ব্যাগ রেখে মাকে জিজ্ঞেস করে,
“এত মিষ্টি কে এনেছে?”
“তুর্য।”
“কেন?”
“নিশাতের রেজাল্টের কথা শুনে।”
“তাই বলে এত মিষ্টি আনবে? এত মিষ্টি খাবে কে?”

“শুধু এগুলোই নাকি? প্রতিবেশীদেরও দিয়ে এসেছে।”
তুর্য নাচতে নাচতে পরীদের ফ্ল্যাটে ঢোকে। তুর্যর হাভভাব দেখে মনে হচ্ছে আজ নিশাতের নয় তুর্যর রেজাল্ট দিয়েছে। পরী চোখমুখ কুঁচকে বলে,
“এত মিষ্টি কেন? আর আপনিই বা কেন মিষ্টি আনবেন?”
তুর্য পরীর দিকে সামান্য ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,
“শত হলেও তো আমার শালাবাবুর রেজাল্ট দিয়েছে আজ।”
“ঢং যত্তসব!”

পরীর কথা শুনে তুর্য হেসে দেয়। তারপর নিশাতকে বলে কয়েক প্যাকেট মিষ্টি পরীর শপে দিয়ে আসতে। পরী সেজানের কাছে গিয়ে বলে,
“কী করো বাবু?”
“তুমি আমাল সাতে কতা বলবা না।”
“কেন? আমি কী করেছি?”
“তুমি আমালে লেকে কোতায় গেছিলা? আমি কত কাঁতছি।”
“আমার বাবুটার কষ্ট হয়েছিল?”

“অনেকগুলা।”
“কতগুলা?”
সেজান দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে বলে,
“এই এত্তগুলা।”
নাহিদা বেগম, তুর্য, পরী তিনজনেই হেসে দেয়। সেজানকে কোলে নিয়ে চুমু খায়। সেজান পরীর মুখে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। তারপর বলে,
“মাম্মি।”

“বলো।”
“তুমি আমালে আবাল ছেলে যাবে না তো?”
“না বাবু।”
“তাইলে তুমি কোতায় গেছিলা?”
“আমি তো কাজে গেছিলাম।”
“আমালেও নিয়ে যাবা আততা?”
পরীও সেজানের মতো করে বলে,
“আততা।”
সেজান পরীর গালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমাল মিস্তি মাম্মি।”

নাহিদা বেগম নিজের ঘরে চলে যাওয়ার পর তুর্য গিয়ে পরীর পাশে বসে। সেজানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই তুর্যর কোলে ঝাপিয়ে পড়ে।
“মাম্মিকে পেয়ে চাচ্চুকে ভুলে গেছ?”
“চাচ্চু পসা আল মাম্মি ভালো।”
“ওহ এখন চাচ্চু পঁচা হয়ে গেল তাই না?”, বলে সেজানকে সুড়সুড়ি দিতে থাকল। সেজান খিলখিল করে হেসে উঠল।
রাতের জন্য আজ বিরিয়ানি, আলাদা করে গরুর মাংস, সাদা ভাত আর সালাদ বানায় পরী। পরী অবশ্য একা রান্না করেনি। সাথে তুর্য সাহায্য করেছে। পরী বারবার না করা সত্ত্বেও তুর্য শোনেনি। রান্না শেষ করে সবাই আজ একসাথে খেতে বসেছে। সেজান পরীর কোলে বসেছে। পরীর এক পাশে নিশাত। আর অন্যপাশে তুর্য বসেছে। সূর্য বসেছে পরীর মুখোমুখি। আজ সূর্য একদম গম্ভীর হয়ে আছে। পরী সেজানকে বিরিয়ানি খাইয়ে দিচ্ছে। খেতে খেতে সেজান বলে,
“মাম্মি তুমিও কাও।”

“আগে তুমি খাও।”
“মাম্মি আমি গাজল কাবো।”
গাজরের একটা টুকরা সেজানের হাতে দেয়। এবার পরী নিজেও খাওয়া শুরু করে। সেজান খেতে খেতে বলে,
“আজ আমি পাপা আল মাম্মিল সাতে তাকবো লাতে।”
সেজানের কথা শুনে পরীর নাকেমুখে ভাত উঠে যায়। উপস্থিত সকলেই একটু ভড়কে যায়। তুর্য টেবিলের নিচ দিয়ে পরীর হাতটা শক্ত করে ধরে বসে।

পর্ব ১৭

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন চাপছে জয়। সূচী হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। খুব বাতাস হচ্ছে। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব আকাশে। যেকোনো সময়েই বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। ভাবতে না ভাবতেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু করে। সূচী রুমে চলে আসে। জয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী করছেন?”

“কিছু না।”
“ওহ।”
“হুম।”
সূচী আর কিছু বলল না। চুপ করে বিছানায় বসে রইল। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে একবার সূচীর দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে?”
“ভাল্লাগছে না।”
“কেন?”
“জানি না।”

“শুয়ে পড়ুন।”
সূচী তবুও ঠায় বসে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“একটা গান শোনাবেন?”
“পারি না।”
“মিথ্যা বলবেন না। মা বলেছে আপনি অনেক সুন্দর গান করেন।”
“আপনি কখনো নিজে শুনেছেন?”

“না।”
“তাহলে মায়ের কথা বিশ্বাস করার কী আছে?”
“মা তো আর মিথ্যা বলবে না।”
“হুম।”
“শোনান না একটা গান প্লিজ।”
“বললাম তো পারি না।”

সূচীর মন খারাপ হয়ে গেল। মুখটা কালো করে মাথা নিচু করে বসে আছে। পায়ের নোখ দিয়ে ফ্লোরে খোঁচাচ্ছে। সূচীর মন খারাপ হয়েছে বুঝতে পারে জয়। পরীর সাথে বলা লাস্ট কথাগুলো মনে পড়ে। দুজনের দহনে দগ্ধ হচ্ছে সূচী। তাও আবার বিনা দোষে। জয় কী সত্যিই অন্যায় করছে সূচীকে এভাবে দূরে রেখে? সূচী কি ওর প্রাপ্য অধিকার পেতে পারে না?
সূচী বিছানা থেকে উঠে আবার বারান্দায় চলে যায়। বৃষ্টির ঝাপটা এসে পড়ছে মুখে, শরীরে। জয়ও সূচীর পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুহাত পকেটে পুরে গান ধরে,
“Chehere main tere
Khud ko main dhundu
Ankhoke darmiya
Tu ab hai istarhaa
Khabo ko bhi jaga
Na mile!!
Yee mosam ki baarish,
Yee baarish ka pani
Yee pani ke bunde
Tujhe hi to dhunde
Yee milne kee khahees
Yee khahees purani
Ho, puri tujhee se
Meri yee kahani”
গান শেষে সূচী দুহাতে জড়িয়ে ধরে জয়কে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আপনাকে এত ভালোবাসি কেন বুঝেন না আপনি?”

“আমায় কেন ভালোবাসেন না? আমি যে আপনার ভালোবাসার কাঙাল আপনি বুঝেন না?”
জয় তাকিয়ে আছে সূচীর চোখের দিকে। পানিতে চোখের পাতা ভিজে গেছে। জয় কিছু বুঝে উঠার আগেই সূচী নিজের ঠোঁটজোড়া জয়ের ঠোঁটে ডুবিয়ে দেয়। দুহাতে খামচে ধরে জয়ের শার্ট। না চাইতেও জয়ের হাত সূচীর পিঠে চলে যায়। বদ্ধ পাগলের মতো চুমু খাচ্ছে সূচী। সূচীর এমন পাগলামীতে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে জয়। জয়কে আজ নিজের করে ছাড়বে এমনই কোনো প্রতিজ্ঞা সূচী নিয়েছে বলে মনে হয়। জয় নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে না। সূচীকে কোলে নিয়ে রুমে চলে যায়। বিছানায় বসিয়ে লাইট নিভিয়ে দেয়। মুখ ডুবিয়ে দেয় সূচীর গলায়। এ রাত হোক আজ শুধু দুজনার।

সেজানের কথা শুনেই বিষম খেয়ে বসে আছে পরী। আর অন্যদিকে তুর্য হাত ধরায় সাথে হেঁচকিও যোগ হয়। নাহিদা বেগম তাড়াতাড়ি পানি এগিয়ে দেন পরীকে। পানি পান করে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। বিষম খাওয়ায় চোখে পানি চলে এসেছে। গলাটাও ভীষণ জ্বলছে। তুর্যর থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করেও লাভ হচ্ছে না। এদিকে তুর্যর বুকের ভেতর ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। সেজানের মাথায় যখন এই ভূত চেপেছে তখন একসাথে থাকার জন্য আরো কান্নাকাটি করবে। ভাইয়া আর পরী এক রুমে? নো ওয়ে। অসম্ভব। তাছাড়া পরীর মা-ই বা কী ভাববে! যেভাবেই হোক বিষয়রাকে ম্যানেজ করতে হবে। তুর্য কিছু বলার আগে সূর্য বলল,

“সবাইকে আমার একটা কথা বলার আছে।”
তুর্যর বাবা জিজ্ঞেস করে,
“কী কথা?”
“আমি কয়েকদিনের মধ্যেই লন্ডনে যাচ্ছি।”
“হঠাৎ লন্ডনে কেন?”

“একটু ভালো থাকার জন্য। আমি এভাবে আর থাকতে পারছি না। তিরার স্মৃতি আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমি একা থাকতে চাই। সবার থেকে দূরে থাকতে চাই।”
“সেজানের কী হবে? আর তুই-ই বা কীভাবে ওকে ছাড়া থাকবি?”
“আমার কথা বাদ দাও। সেজানকে দেখার জন্য পরী তো আছে-ই। বাকিটা সময় তোমরা সামলে নিয়ো।”
আর কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে এঁটো হাত নিয়েই চলে গেল।

কী থেকে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না কেউ।
বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে সেজানকে নিয়ে ছাদে যায়। সেজান সূর্যের কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে পুরো ছাদজুড়ে হাঁটছে সূর্য। হাজার কষ্ট, হাহাকার নিয়েই চলে যেতে হবে। সেজানকে চুমু খেয়ে বলে,
“আমাকে কখনো ভুল বুঝিস না বাবা।”
বেশ কিছুক্ষণ পর সেজান ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত সেজানকে নিয়ে পরীর রুমে যায়। পরী টেবিলে বসে তখন পড়ছিল। সূর্যকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। সূর্য বলে,
“আমি কালই চলে যাচ্ছি।”
“কোথায়?”

“এখন এক বন্ধুর বাসায় উঠব। তারপর সেখান থেকেই লন্ডন চলে যাবো।”
“সেজানের কথা ভাবা উচিত ছিল আপনার।”
“আপনি আছেন তো। আপনাকে বিশ্বাস করতে মন সায় দেয়। আমার ছেলেটাকে দেখে রাখবেন।”
পরী নিশ্চুপ। সূর্য আবার বলল,
“আমি তো কাল চলেই যাচ্ছি। সমস্যা না থাকলে সেজান আজ আমার কাছে থাকুক?”
“এখানে সমস্যার কী আছে? আপনার ছেলে আপনার কাছে থাকবে।”
“আচ্ছা আসছি।”
“শুনুন।”
“কিছু বলবেন?”

“ধন্যবাদ।”
“কেন?”
“সেজানকে ঘুম পাড়ানোর জন্য। না হলে কী করত কে জানে।”
সূর্য মৃদু হাসল।
“আসি।”
সূর্য সেজানকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর পরী আবারও পড়তে বসল। ঘরের জানালা একটা আরেকটার সাথে বারি খাচ্ছে বাতাসে। বৃষ্টি নেই এখানে কিন্তু প্রচুর বাতাস হচ্ছে। বই বন্ধ করে কিছু অতীত ঘাটতে যাবে তখনই তুর্য এসে হাজির হয়। পরীর মন কিছুতেই খারাপ না হওয়ার প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ তুর্য। রুমে ঢুকে বলে,
“কী করো টুকটুকি?”

“কে টুকটুকি? আর আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন?”
“তুমি টুকটুকি। পিচ্চি একটা মেয়েকে আপনি করে ডাকব? এতদিন ডেকেছি ভদ্রতার খাতিরে। কিন্তু এখন তো ভালোবাসি। এত ভদ্রতা দেখিয়ে লাভ কী?”
“আপনি কি এখন অভদ্র হতে চাচ্ছেন?”

“অবশ্যই। ভালোবাসলে অভদ্র, অসভ্য হতে হয়। না হলে ভালোবাসা জমে নাকি?”
“মেইন দরজা তো লক করা ছিল। আপনি আসলেন কীভাবে? কলিংবেলের আওয়াজও পেলাম না।”
“আমি তো নিশাতের রুমে ছিলাম।”
“কেন?”
“এইযে তোমার সাথে সময় কাটাব বলে।”
“মানে কী?”

“দেখাচ্ছি।”
পরীকে টেনে বিছানায় নিয়ে যায়। ভয়ে পরীর গলা শুকিয়ে আসছে। বিছানার উপর দুহাতে ভর দিয়ে পরীর দিকে একটু ঝুঁকে শোয় এমনভাবে যাতে স্পর্শ না লাগে। পরী রেগে বলে,
“আমি কিন্তু চিৎকার করব।”
“আমিও সেটাই চাই। তুমি চিৎকার করলে সবাই ছুটে আসবে। তখন আমাদের একসাথে দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে। তখন আরো কাছে আসতে পারব।”
“মাথায় কি সবসময় বদ বুদ্ধি নিয়ে ঘুরেন?”
“না। ভালোবাসার বুদ্ধি নিয়ে ঘুরি। ভালোবাসবে আমায় একটু?”
“এই আপনি সরেন তো।”

“কী বারবার সরেন সরেন করতেছ?”
তুর্য এবার আরেকটু কাছে যায়। একদম পরীর মুখের সামনে মুখ নিতেই পরী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। তুর্য এক হাত দিয়ে মুখটা সোজা করে চোখে চোখ রেখে বলে,
“বিয়ের আগে কিছুই করব না। কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েও আসিনি। ভালোবাসি তোমায়। বিয়ে করলে তোমাকেই করব। একদিন হবে আমার তুমি।”,বলে হাত দিয়ে পরীর গাল ছুঁয়ে সেই হাতেই চুমু খেয়ে উঠে চলে যায়।”
পরী তাকিয়ে থাকে তুর্যর যাওয়ার পথের দিকে। বাইরের ঝড়ের সাথে পরীর নিজের ভেতরও তুমুল ঝড় হচ্ছে। এ কেমন ভালোবাসার দোটানায় আটকে গেল পরী!

পর্ব ১৮

পুরো শপের ভেতর দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে সেজান। বাসায় শান্ত থাকলে হবে কী! এখানে এসে দুষ্টুমি শুরু করে দিয়েছে। তার মধ্যে সঙ্গী জুুটেছে সকাল আর সিয়াম। সিয়াম তো সময় পেলেই দুষ্টুমি করছে। শপের সবাই খুব আদর করে সেজানকে। সব ঠিকঠাক থাকলেও সমস্যা একটা জায়গায়। তা হলো কোনো ছেলে কাষ্টোমারকে পরীর দিকে ঘেঁষতে দেয় না। কথা বলতে দেয় না। অপরিচিত কোনো ছেলের সাথে কথা বললেই ঠাটিয়ে চিৎকার দেয়। এটা নিয়ে পরী বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করে না। এটা পরীর কাজের জায়গা। কাজের সৌজন্যতায় অনেকের সাথে কথা বলতে হয়। কিন্তু এই কথাটাই বা কে বোঝাবে এই ছোট্ট সেজানকে? সারাটা দিন এভাবেই জ্বালিয়ছে।

কাজ শেষ করে বাসায় গিয়ে দেখে তুর্য অফিসের পোশাক পরেই সোফায় বসে আছে। পড়নের শার্ট একসাইডে ইন করা। টাইটা আধখোলা। সামনের চুলগুলো ঘেমে কপালে লেপ্টে আছে। অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে।
পরীকে দেখে এগিয়ে আসে তুর্য। সেজানের দিকে হাত বাড়াতেই সেজান তুর্যর কোলে চলে যায়। পরী জিজ্ঞেস করে,
“ওর বাবা চলে গেছে?”

“হুম।”
“উনার এই সিদ্ধান্তটা আমার একদম ভালো লাগেনি। সেজানের দিকটা ভাবা উচিত ছিল।”
“আমরা সবাই সবার জায়গায় সঠিক পরী।”

“আমরা এরকমটা মনে করি তার মানে কিন্তু এটাই নয় যে আমরা আসলেই সঠিক।”
“তা ঠিক।”

“বাদ দিন। অফিসের পোশাকে এখানে কেন? আর এত তাড়াতাড়ি আসলেন যে?”
“সত্যিটা বললে তো বিশ্বাস করবে না।”
“অবিশ্বাসের কী আছে?”
“তাহলে বলি?”
“হুম।”

“তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল।”
“আপনি ঠিক কেমন পাগল আমি বুঝিনা। আবেগে আছেন নাকি মোহে?”
“আবেগের বয়সটা এখন আর নেই। আর বাকি রইল মোহ? মোহর প্রসঙ্গ যদি তুলো তাহলে বলব হাজারও সুন্দরী আমার পেছনে লাইন ধরে থাকে।তাদের প্রতি যখন মোহ কাজ করে না। তখন এটাও মোহ নয়। খুব ভালোবাসি তোমায়।”
“আপনার এই ভালোবাসাকে আমি মোহ ছাড়া আর কোনো নামই দিতে পারছি না।”
“ফ্রেশ হয়ে নাও।”

“হুম। কিন্তু একটা কথা। হুটহাট ফ্ল্যাটে আসা, আমার রুমে চলে যাওয়া, আমার কেয়ার করা। এসব করা থেকে বিরত থাকবেন। আপনি আমার হাজবেন্ড নন।”
“হতে সময় লাগবে না। শুধু তুমি রাজি হলেই হয়।”
“কখনোই হবো না।”
“তুমি কি বিয়ে করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছ?”
“না।”

“তবে?”
“অবশ্যই বিয়ে করব। তবে বিবাহিত কাউকে। যার বউ নেই। কিন্তু বেবি আছে।”
“তাহলে আমার ভাইকে বিয়ে করো। করবে?”
পরী একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল জয়ের দিকে। তারপর বলল,
“এমন পরিস্থিতি আসলে করতেও পারি।”
পরীর কথা শুনে রাগে মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তুর্যর। কিন্তু সেজান থাকায় কিছু বলতে পারেনি। পরী চলে যাওয়ার পর সেজান বলল,
“চাচ্চু মাম্মি কুব পসা।”

“কেন বাবা?”
“মাম্মি অন্ন মানুছেল সাতে কতা বলে। আমাল বালো লাগে না।”
তুর্য কী বলবে এখন সেজানকে? পরীর যেটা কাজ সেটা তো ওর করতেই হবে। নিশ্চয়ই সেজান আজ খুব জ্বালিয়েছে। কিন্তু পরী একবারের জন্যও কোনো বিচার দেয়নি। উল্টো সেজানই পরীর নামে বিচার দিল। তুর্য বলল,
“আচ্ছা আমি তোমার মাম্মিকে বলব কারো সাথে যেন কথা না বলে।”
“আততা।”
পরী ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে তুর্য সেজানের সাথে দুষ্টুমি করছে।
“সেজানকে আমার কাছে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
“আচ্ছা।”
“খেয়েছেন?”
“না।”

“আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়েন।”
তুর্য ভ্রু কুঁচকিয়ে বলে,
“কী ব্যাপার? বউর মতো কথা বলছ কেন?”
“বউর মতো কোনো কথা বলিনি। যা বলেছি মানবিকতার থেকে।”
“বাব্বাহ্! তোমার এত মানবিকতা।”
“হুহ।”

পরী ভেংচি কাঁটল। তুর্য তা দেখে হেসে ফেলল। তুর্য চলে যাওয়ার পর সেজানের হাত-মুখ ধুইয়ে খাইয়ে দেয়। ঘুমে সেজানের চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে গেছে। পরী সেজানকে ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দেয়। রাতের জন্য রান্না করতে হবে। একদম ইচ্ছে করছে না এখন রান্না করতে। কিন্তু না করেও তো উপায় নেই।

পরী রান্নাঘরে যাওয়ার পর তুর্য আবারও আসে।
“রান্না করছ?”

“না নাচি। নাচবেন?”
“অবশ্যই। কেন নয়?”, বলেই পরীর এক হাত নিয়ে নিজের কাঁধে রাখে। আর এক হাত পরীর কোমরে রাখে। অন্য হাত দিয়ে পরীর হাত ধরে ঘুরে ঘুরে নাচছে। তুর্যর এমন কাণ্ডে পরী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। মুখ দিয়ে কোনো কথাও বের হচ্ছে না। হঠাৎ পরীর তলপেটে খুব ব্যথা উঠে ডান সাইডে। যেমন তেমন ব্যথা নয় এটা। অসহনীয় ব্যথা। প্রথমে তুর্যকে ধরে চিৎকার দিলেও পরে পেট ধরে চিৎকার করে নিচে বসে পড়ে। ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদছে। পরীর এমন অবস্থা দেখে তুর্যর অবস্থা প্রায় পাগল পাগল। পরীকে বুকের মধ্যে নিয়ে বলে,
“এই পরী কী হলো তোমার? পরী? কাঁদছ কেন? আমি কি তোমায় ব্যথা দিয়েছি? প্লিজ কিছু বলো।”

পরী কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছে না। প্রচণ্ড রকম ব্যথা হচ্ছে। পরীর কান্না শুনে নাহিদা বেগম, নিশাত ও নানু দৌঁড়ে আসে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? পরী? পরীর কী হয়েছে তুর্য?”
তুর্যর মুখে কান্না কান্না ভাব।
“জানিনা আন্টি। হুট করেই পেট ধরে কাঁদছে।”

কান্নাকাটি আর চিৎকারের শব্দে সেজানও উঠে গেছে ঘুম থেকে। কাঁদছে। নিশাত দৌঁড়ে যায় সেজানের কাছে। তুর্য তখনই পরীকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানায় এটা অ্যাপেনডিসাইটিসের ব্যথা। অ্যাপেন্ডিক্সের সংক্রমণের কারণেই অ্যাপেনডিসাইটিস হয়। ডাক্তার অপারেশন করার কথা বললে তুর্য রাজি হয়ে যায়। নাহিদা বেগম তখনও কেঁদেই চলেছে। পরীর অপারেশন শুরু হলে তুর্য নাহিদা বেগমকে বলে,
“আন্টি আপনি টেনশন করবেন না। এটা তেমন কিছু নয়। অপারেশনের পর কয়েকদিন রেস্ট নিলেই সুস্থ হয়ে যাবে।”
মায়ের মন কি আর এতসব কিছু বুঝে? সন্তানদের পিঁপড়া কামড় দিলেও সেটার যন্ত্রণা বুঝি মায়েরাই ভোগ করে। তিনি বাচ্চাদের মতো কেঁদেই চলেছে। সেজানকে কোলে নিয়ে নিশাত হাসপাতালে আসে। তুর্যর কোলে দিয়ে বলে,

“ভাইয়া ওর কান্না থামানো যাচ্ছে না। আপুর কাছে আসার জন্য কাঁদছে।”
তুর্য সেজানকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। হেঁটে হেঁটে অনেক কষ্টে কান্না থামায়। অপারেশনের সব টাকা তুর্যই দিয়েছে। অপারেশন সাক্সেসফুল হওয়ার পর তুর্য দূর থেকেই একবার পরীকে দেখায় সেজানকে। পরীকে দেখে সেজানের কান্না আরো বেড়ে যায়। কিন্তু মাত্রই অপারেশন হয়েছে এখন তো আর সেজানকে পরীর কাছে নেওয়া যাবে না।

সকালে পরীর ঘুম ভাঙ্গার পর সেজান আর তুর্যকে দেখতে পায়। তুর্য বসে বসে ঝিমুচ্ছে আর সেজান ওর কোলে ঘুমাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে সারা রাত ঘুমায়নি। নাহিদা বেগম ওয়াশরুম থেকে এসে বলেন,
“ঘুম ভেঙ্গেছে তোর। দাঁড়া আমি ডাক্তারকে ডাকি।”
“মা।”
“কিছু বলবি?”
“রাতে তোমরা কেউ হাসপাতালে ছিলে?”

“হ্যাঁ। আমি, তুর্য আর সেজান।”
“সেজানকে কেন রেখেছিলে? এতটুকু একটা বাচ্চা। এভাবে কোলে ঘুম হয়?”
“আমার কী দোষ? সেজান এখান থেকে যেতে নারাজ বলেই তো রাখতে হয়েছে। অর্ধেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। কোনো দুষ্টুমি করেনি।”
“তুমি ওকে তুলে আগে খাওয়াও।”
ডাক্তার এসে পরীকে দেখে গেছে। আর নার্স এসে পরীকে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। নাহিদা বেগম তুর্যকে একবার ডাকতেই ঘুম থেকে উঠে যায়। চোখ মেলে আগে পরীকে দেখে। তারপর মুচকি হেসে বলে,
“কেমন আছো এখন?”

“ভালো।”
নাহিদা বেগম বলেন,
“তুর্য বাসায় যাও তুমি সেজানকে নিয়ে। সারা রাত তো ঘুমাওনি।”
“আমি এখন আর বাসায় যাব না আন্টি। আপনি সেজানকে নিয়ে যান। আমি এখান থেকে সোজা অফিসে যাব দুপুরে। দুপুরে তরী কলেজ থেকে আসলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েন।”
“না। তুমি তাহলে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমাও বাসায়।”
“সমস্যা নেই আন্টি। আপনি যান।”

অগত্যা ঘুমন্ত সেজানকে নিয়ে তিনি বাড়িতে চলে যান। তুর্য ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে পরীর সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে। পরী নির্বাক দৃষ্টিতে দেখছে। কাঁপা কাঁপা হাতে পরীর হাতটা ধরে তুর্য। পরী বাঁধা দেয় না। পরীর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাতটা দেখতে থাকে। চোখ নিচের দিকে। যখন চোখ তুলে পরীর দিকে তাকায় তখন তুর্যর চোখে পানি স্পষ্ট। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে তুর্যর ঠোঁটে হাসি। তুর্য বলল,
“জানো পরী, যখন তুমি ব্যথায় কাঁদছিলে তখন আমার পায়ের নিচে মাটি ছিল না। আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু যখন ডাক্তার বলল টেনশনের কোনো কিছু নেই তখন একটু শান্তি লাগছিল। তবুও যতবার তোমার কান্নার দৃশ্য চোখে ভাসে ততবার বুকের ভেতর কষ্ট অনুভূত হয়।”

পরী তখনো চুপ। তুর্য আবার বলে,
“আমি জানি না, কেন তোমায় এত ভালোবাসি। আমি জানি না, কখনো তুমি আমায় ভালোবাসবে নাকি। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা সীমাহীন।”
কথাগুলো বলার সময় তুর্যর গলা ধরে আসছিল। চোখ থেকে পানিগুলো যেকোনো মুহূর্তে ঝড়ে পড়বে। পানিগুলো আড়াল করার জন্যই তুর্য উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। তখনই পেছন থেকে তুর্যর হাত টেনে ধরে পরী।

লেখা – মুন্নি আক্তার প্রিয়া

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “আমার তুমি (সিজন ৩: ১ম খণ্ড) – Romantic premer golpo bd” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – আমার তুমি (সিজন ৩: শেষ খণ্ড) – Romantic premer golpo bd

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *