জ্বীনবর (সিজন ৬) – ভয়ংকর ভূতের গল্প

জ্বীনবর (সিজন ৬) – ভয়ংকর ভূতের গল্প: মধ্যরাতে দুলাভাই আর আপুর শ্বাশুড়ী ফিরলেন। আশ্বাস দিয়ে জানালেন নরমাল ব্যথা। ডাক্তাররা ডেলিভারির ফিক্সড ডেট দিয়েছেন। সকাল হলে চেক আপ করে আপুকে রিলিজ দিবে। আলফি আর আপুর শ্বশুড় ওখানে’ই আছেন।


পর্ব ০১

“এই জায়গাটাকে জ্বীনের আস্তানা বলে জানিস, আমি ইউটিউবে দেখেছি। এই এলাকায় ভয়ংকর সব জ্বীন থাকে।”
আপুর কথা শুনে আমি তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, “জ্বীনগুলোর নাম বলেনি?

এই ধর ভুতেদের যেমন অনেক নাম থাকেঃ কল্লাকাটা, মেছোভূত, গেছোভূত, শাকচুন্নী। নামগুলো মেনশন করে দিলে বুঝতে পারতাম কোনটা কেমন ভয়ংকর!”

আপু কপাল কুচকে বিড়বিড় করে কিসব বলল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে লাগেজ নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। বাহিরে থেকে বাসাটা যত সুন্দর, ভেতরে ততটাই গোছালো আর মনোমুগ্ধকর। লাগেজটা দরজার পাশে রেখে এদিক সেদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম, এত গোছানো বাসা দেখে কে বলবে এটা অনেকদিন যাবত খালি পড়ে ছিল।

দুইতলা বাসা, ঢুকতেই মাঝখানে ড্রয়িং রুম তার অন্যসাইডে কিচেন আর ডাইনিং টেবিল। বা দিকে একটা রুম তারপর সোজা বরাবর একটা লন, লনের শুরুতে ২টা রুম আর শেষমাথায় একটা রুম।

মজার ব্যাপার, বাসার সামনে-পিছনে দুইজায়গায় ই বড়সড় খোলা বারান্দা। বারান্দার এককোণে খোলা সিড়ি বেয়ে উঠে গেছে উপরের তলার মেইন দরজায়। উপরের তলার ডিজাইনটা আমার ভালো লাগলনা, সামনে ফাকা একখানি ছাদ ছাড়া আর বিশেষ কিছুই নেই। দেখতে ঠিক যেন একটা চিলেকোঠা।

আর না এগিয়ে গিয়ে বারান্দা ঘুরে বাসার বাহিরে চলে এলাম। বাসার চারদিকে হাফওয়াল দিয়ে বাউন্ডারি করা, তার ধার ঘেষে কয়েকটা মাঝারি আকারের গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মোটামুটি ভালোই লাগল, এর মধ্যে দেখলাম দুলাভাই গাড়ি থেকে বাকি ব্যাগপত্র নিয়ে নামছেন।

দুলাভাই গাড়ি থেকে নেমে আসতেই আপু ও বেরিয়ে এলেন। কিছুটা হতাশা নিয়ে বললেন,
~ এমন একটা জায়গায় বাসা নেওয়ার কি দরকার ছিল? আগের জায়গায় ই তো বেশ ছিলাম। একে তো ইসলামাবাদ থেকে কিছুটা দূরে, তার উপর নির্জন গ্রামের মত। একটা থেকে একটা বাড়ীর দূরত্ব দেখেছো! দুলাভাই মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন,

~ আমাদের মত কিউট কাপলদের জন্য এমন রোমান্টিক জায়গা ই তো দরকার তাইনা! তুমি কি বলো, রেহজান?
আমি মুখ চেপে হাসলাম, আপু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙ্গালেন। এর অর্থ হল, তাদের রোমান্টিকতা দেখে আমার এমন হাসাটা খুব গুরুতর অন্যায় হয়েছে।

সব গুছিয়ে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, এয়ারপোর্ট থেকে এসেই নতুন বাড়ীতে উঠলাম। নিজের দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে আসার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলনা, কিন্তু আপুর জন্য চলে আসলাম।

আমরা দুবোন আর এক ভাই। খুলনার প্রত্যন্ত একটা অঞ্চলে মা-বাবাসহ ছোট্ট একটা পরিবার নিয়ে থাকতাম। রওনক আপু আমার চেয়ে ২বছরের বড় আর ভাই রাইয়ান আমাদের সবার ছোট। হঠাৎ একদিন কিছু না জানিয়ে আপু উধাও হয়ে গেল, কিছুদিন পর জানাজানি হল আপু নাম-পরিচয়হীন এক ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছে।

এরমধ্যে আপু দুলাভাইসহ ফিরে এসে বাবার সামনে দাড়াল, কিন্তু বাবা তাদের মেনে নিলেননা বরং আপুকে ত্যাজ্য করার ভয় দেখিয়ে সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করলেন।

পরিবারের সবাই আপুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমি পারিনি, লুকিয়ে লুকিয়ে যোগাযোগ রাখতাম আপুর সাথে। অবশ্য ধরা ও পড়েছি বাবার কাছে। সেদিন বাবা আমাকে ডেকে নেওয়ায় ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা আমাকে তেমন কিছু না বলে শুধু করুণকন্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমার মেয়েটা সুখে আছে তো?”
বাবার কষ্টটা আমি সেদিন গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলাম।

এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, বেডটেবিল থেকে ফোন হাতে নিয়ে বাবার নাম্বারে ডায়াল করলাম। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে মায়ের উদ্বেগজড়িত কন্ঠস্বর শোনা গেল,
~ কখন পৌছেছিস? জানাবি না, আমি আর তোর বাবা কত চিন্তায় পড়ে গিয়েছি। আমার রেনু আর জামাই ভালো আছে তো?

মায়ের এমন একনাগাড়ে হাজারটা কথা বলার অভ্যাস টা রওনক আপু পেয়েছে। একবার শুরু করে দিলে প্রশ্নের ঝুড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপরপক্ষ কোনো সুযোগ পাবেনা।

~ আমি বিকালেই পৌঁছেছি মা। তাদের আজকেই নতুন বাসায় উঠে যাওয়ার কথা ছিল, তাই আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে সোজা নিয়ে এল। গোছগাছ করতে একটু সময় লাগল। ওরা সবাই ভালো আছে, চিন্তা করোনা।
মা যেন একটু আশ্বস্ত হলেন, কিন্তু তাতে তাকে দমানো গেলনা।

~ তোর আপুর দিকে ভালো করে খেয়াল রাখবি, আর ব্যাগে কয়েকটা আচারভর্তি বয়ামসহ কিছু সাবুদানা, বালাচাও ও দিয়েছি ওইগুলো খাইয়ে দিস। খুব বেশী কাজ করতে কিংবা সিড়ি বাইতে দিবিনা। সবসময় নজরে নজরে রাখিস।

~ ঠিক আছে, চিন্তা করোনা। আমি তোমার মত করে না পারলেও তোমার চেয়ে কম খেয়াল রাখবনা। তুমি বাবাকে আমার সালাম জানিও আর ওদের খেয়াল রেখো।

ফোন রেখে ব্যাগ থেকে জিনিসগুলো বের করে নিলাম। আপুর মা হওয়ার খবর শুনে মায়ের এসব বানানোর ধুম পড়ে গিয়েছিল। বানানোর সময় একবারো ভাবেনি এইগুলো কিভাবে পাঠাবে, বানানোর পর শুকনো মুখ করে জিজ্ঞেস করেছিল, ” রেহজান, ওইখানে কুরিয়ার সিস্টেম আছে? নাকি প্ল্যানে পাঠাতে হবে?”

আপুর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেও তার প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা কখনোই কমেনি সেটা আমার বুঝতে বাকি ছিলনা।
জিনিস গুলো হাতে নিয়ে আপুর রুমের দরজায় নক করলাম, ভিতরে ঢুকে দেখি আপু হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আমাকে দেখে একলাফে উঠে বসে বলল,
~ রেহজানরে! জ্বীনের ও অনেক নাম আছে, আমি সেগুলো পেয়ে গেছি। এবার তোকে বলে দিচ্ছি কোনটা কেমন ভয়ংকর।

আমি জিনিসগুলো আপুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
~ মা তোর জন্য পাঠিয়েছে। আর আসার পর থেকে কি টপিক নিয়ে কথা শুরু করেছিস! তোর এসব শোনার কোনো ইন্টারেস্ট নাই আমার। দুলাভাইয়ের মাথা সারাদিন এগুলো বলেই খাস।

আপু জিনিসগুলো হাতে পেয়ে গভীর মমতায় সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল, আমার কথাগুলো হয়ত তার কানে পৌছায়নি। ছলছল চোখে আপু আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ একটা সত্যি কথা বলবি বোন? তোর দুলাভাই তোকে অনুরোধ করেছিল এখানে আসার জন্য?

আমি চুপ করে রইলাম। দুলাভাই একবার শুধু মুখ ফুটে বলেছিল, “তোমার বোনের এই অবস্থায় তাকে আমি একা রাখতে ভয় পাই, যদি তুমি আসতে আমি নিশ্চিন্ত হতাম।”

কথাটা বাবাকে জানানোর পর বাবা কেমন জানি উতলা হয়ে পড়েছিলেন। দেরী না করে আমার ভিসা-পার্সপোর্ট রেডি করার ব্যবস্থা করেছেন। আসার সময় আমার মাথা হাত রেখে বলেছিলেন “সাবধানে রাখিস আমার মেয়েটাকে।”

~ দুলাভাই বলবে, আর আমি সবকিছু ফেলে এখানে চলে আসব? আমি কারো কথায় আসিনি, ইচ্ছে হয়েছে এসেছি।
তারপর আমি ওইরুম থেকে বেরিয়ে চলে এলাম। আমি জানি, আপু এখন কাদবে। হয়ত আমার কথার মর্মার্থ বুঝে খুশি হয়ে, নয়ত না বুঝে কষ্ট পেয়ে।

কেন জানি আমি এমন ই, ইমোশন জিনিসটা আমার মধ্যে কাজ করেনা। যেটুকু থাকে তা কাউকে দেখাতেও ইচ্ছা করেনা। আপুর স্বভাব একদম আমার বিপরীত, প্রচন্ড আবেগী। ওর আবেগ কন্ট্রোল করার জন্য আমি কতশত শক্ত কথা শুনাই, কিন্তু তাতে তার বয়ে ই গেছে। আমাকে কাচকলা দেখিয়ে তার আবেগ যেন আরো বেশী বাড়ে।

অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি, কিন্তু ঘুম আসলনা। নতুন জায়গায় আসলে আমার এই অবস্থা হয় কিছুতেই ঘুমোতে পারিনা। ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা না করে রুম থেকে বেরিয়ে পিছনের বারান্দায় আসলাম। লনের শেষ রুমটা নেওয়ায় এক প্রকার ভালোই হয়েছে, রাতে যখন-তখন বারান্দায় এসে বসতে পারব।

আমার নিজের বাড়ীতেও ছাদের সিড়ির সামনাসামনি আমার রুম, রাতে ঘুম না হলে আমি ছাদে উঠে বসে থাকি। আপু যখন আমার সাথে ঘুমাত, আপুর ও একই অভ্যাস ছিল। তবে তার অভ্যাসটা খুব অদ্ভুতুড়ে। মাঝরাতে বা সন্ধ্যাবেলা আমাকে নিয়ে ছাদে উঠে বসে থাকত।

গালে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলত,
~ আমার না খুব জ্বীন দেখার শখ। শুনেছি, চুল খোলা রেখে এইসময় ছাদে বসে থাকলে জ্বীন দেখা দেয়। বলতে বলতে আপু তার খোপা খুলে কোমড় সমান চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে দিত।

আপুর এসব কর্মকান্ডে আমি ভীষণ ভয় পেতাম, দিলাম একদিন মাকে বলে। সেদিন কি উড়ুম ধোলাই না খেয়েছিল আপু। তারপর থেকে আপুর ছাদে যাওয়া বন্ধ ছিল কয়েকমাস। রাগ করে আপু কয়েকদিন আমাকে হুমকি দিত, “দাড়া, একবার জ্বীনের দেখা পাই তোকে আচ্ছা কিলানি খাওয়াব।”

আমি তার হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে রোজ দুবার তার সামনে ছাদ ঘুরে আসতাম। বেচারী কিছু বলতে পারতবা, শুধু ফুসত। আজ ওইসব মনে পড়ে হাসি পাচ্ছে। বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে তাও আপুর মধ্যকার বাচ্চামি গেলনা।

ভাবতে ভাবতে বারান্দার এককোণায় এসে দাড়ালাম, পুরো বারান্দাটা অন্ধকার- এখনো বাহিরের লাইট লাগানো হয়নি। অন্ধকারে থাকার অভ্যাস বেশী বলে অসুবিধা হচ্ছিলনা, তার উপর রাস্তার পাশের খানিকটা দূরের ল্যাম্পপোস্ট থেকে হালকা আলো পড়ছিল এই কোণায়।

হঠাৎ অন্ধকারে চোখে পড়ল কেউ একজন সিড়ির কাছে দাড়ানো, বোধহয় উপর তলার দিকে যাচ্ছে। মূহুর্তে কিছু একটা ভেবে জোরে হাক ছাড়লাম, “কে রে ওখানে? চোরের ঘরের চোর তোরে আজকে পাইসি।”
দৌড়ে গিয়ে তাকে ঝাপটে ধরে লাফাতে লাগলাম, সে আমার থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমাকে ছাড়াতে না পেরে আবার চেষ্টা করতে করতে আমার সাথে এক তালে স্প্রিং বলের মত লাফাতে থাকল।


পর্ব ০২

আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
লোকটা ক্রমাগত নিজেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে, আমি তার শক্তির সাথে পেরে উঠতে পারছিনা। কিছু বুঝে উঠার আগেই অবয়বটা আমার দিকে থু থু ছুড়ে মারল, সাথে সাথে লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে সরে পড়লাম। সে আর একমূহুর্ত দেরী করলনা, দৌড়ে গিয়ে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে মিশে হয়ে গেল।

আমি থ হয়ে দাড়িয়ে ভাবতে থাকলাম, এটা কি আসলেই চোর ছিল! যখন তাকে চোর ভেবে ঝাপটে ধরলাম মাথায় একটা চিন্তা কাজ করছিল এইখানে চোর আসবে কিভাবে!
দেশে থাকতে আমি দুইবার চোর ধরেছিলাম, এই নিয়ে গ্রামের সবাই বেশ প্রশংসা করেছিল আমার।

রুমে ঢুকতে একবার মনে হল, আপু আর দুলাভাইকে ডেকে জানাই। কিন্তু ভাবলাম, এখন না জানানো ই ভালো। আপু অল্পতেই খুব হাইপার হয়ে যায়, এই অবস্থায় তাকে দুঃশ্চিন্তা ফেলার মানে হয়না।

সকালে নাস্তার টেবিলে দুলাভাইকে কথায় কথা জিজ্ঞেস করলাম, “এই গ্রামে কি চোরের উপদ্রব আছে?”
কথাটা শুনে আপু চোখ একরাশ উদ্বেগ নিয়ে আমার দিকে তাকাল। হয়ত কিছুটা আচ করতে পেরেছে। আপু কিছু জিজ্ঞেস করার আগে দুলাভাই খেতে খেতে বলল,
~ আমার জানামতে নেই।

দুলাভাই কথা শেষ করার আগে আপু কথা টেনে নিয়ে আমার হাত চেপে বলল,
~ তুই কি এখানে চোর দেখেছিস? ওরকম কিছু মনে হয়েছে?
তোর দুলাভাইকে বার বার বলেছি জায়গাটা আমার ঠিক লাগছেনা, এমন নির্জন জায়গায় চোর-ছিনতাইকারী থাকা অসম্ভব না।

আপুর হাতের উপর হাত রেখে ওকে কিছু স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
~ তুই অযথা হাইপার হচ্ছিস। আমি একবারো বলেছি এখানে চোর আছে। জাস্ট সচেতন থাকা প্রয়োজন বলেই জিজ্ঞেস করেছি। চোর সবজায়গায় ই থাকে, কোথাও বেশী কোথাও কম। তোর চোর নিয়ে ভয় আজও গেলনা।

দুলাভাই আমার দিকে মুচকি হেসে বলল,
~ তোমার বোন একটু বেশি ই ভীতু। তুমি আসায় আমি বেশ আশ্বস্ত হয়েছি, এখন অফিসে গেলে তোমার আপুর ব্যাপারে দুঃশ্চিন্তায় থাকতে হবেনা।
তোমরা নিজেদের খেয়াল রেখো, আমি বের হচ্ছি।
দুলাভাই উঠে যাওয়ার পর আপু আমার হাত টেনে নিয়ে বলল,
~ তোর হাতে ফোস্কা পড়ল কিভাবে?

আমি আপুর কথা শুনে হাতের পিঠের দিকে তাকালাম। বেশ কয়েকটা লাল ফোস্কা পড়েছে, কিন্তু এতক্ষণ আমি টের পাইনি। যতটুকু মনে পড়ছে কাল এই জায়গাটায় চোরের মুখের থু থু পড়েছিল। থু থুর কারণে ফোস্কা পড়ল, ব্যাপারটা অবাক করার মত। ওটা থু থু ছিল নাকি অন্য কিছু!
আপু এরমধ্যে মলম এনে লাগিয়ে দিল, মলম লাগানোর পর জ্বালা অনুভূত হচ্ছে।

বিকালে বাসার বাহিরটা ভালো করে চেক করলাম, বাসার চারদিকটা হাফওয়াল দিয়ে বাউন্ডারি করা হলেও দেয়াল টপকে ভিতরে আসার স্কোপ নেই। কারণ, দেয়ালের উপর ছোট ছোট কাটার ডেকোরেশন করা আছে। গেইট ও অনেক উচু, তাতেও কাটার ডেকোরেশন। তাহলে চোরটা ভিতরে ঢুকল কি করে! এত বুদ্ধিজীবী চোর, কোনো চিহ্নমাত্র রেখে গেলনা।

ভিতর থেকে আপুর ডাক আসায় চলে এলাম আপুর রুমে। আপু আচারের বয়াম নিয়ে টিভির সামনে বসে আছে। এক হাত বয়ামের ভিতরে, আরেক হাতে রিমোট চাপছে।

আমি নাক কুচকে বললাম, আনহাইজেকনিক!
আপু এক টুকরো আচার মুখে পুরে নিয়ে বলল,
~ এটার মজা তুই বুঝবিনা! এই চ্যানেলের জ্বীনের মুভি দেখাচ্ছে, বস একসাথে দেখি।
আমি আপুর পাশে বসে তার হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে দিলাম। আপু বিমর্ষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।

~ অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। এসব নিয়ে তোর অনেক পাগলামী আমি এ্যালাউ করেছি, আর নয়। এসব বাচ্চামী বাদ দে, নিজের অনাগত বাচ্চার ব্যাপারে সচেতন হ। এসময় তুই যা করবি- যা ভাব্বি, তার সব এফেক্ট তোর বাচ্চার উপর পড়বে।

জ্বীনে বিশ্বাস করি, আর না করি এইটুকু আমি ভালো করে জানি তারা খারাপ জাতি। সো, তোর বাচ্চাটার বিপদ ডেকে আনিসনা।
আপু চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। আমি আপুর দিকে একবার তাকিয়ে উঠে চলে এলাম, এসব বলা আসলে খুব জরুরী ছিল। আপুর জ্বীনের প্রতি মারাত্মক পাগলামী সেই ৪বছর আগ থেকেই। মাঝে মাঝে ভয় হত, তার এই আসক্তি কোনো খারাপ পরিণাম না ডেকে আনে।

বিয়ের পর এসব কেটে গিয়েছিল জানতাম, কিন্তু এখন আবার শুরু হয়েছে দেখে ভয় হচ্ছে।
প্রায় ৯টা বাজে দুলাভাই এসে রুমে ঢুকলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “গল্প করতে করতে রওনক ঘুমিয়ে পড়েছে?”
আমি মুচকি হেসে আপুর গায়ে কাথা টেনে দিয়ে বললাম,
~ গল্প শুনলে ঘুম এসে যায় আপুর, তাছাড়া এই সময় একটু বেশী ক্লান্তি কাজ করে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।
আমি সরে আসতেই দুলাভাই আপুর পাশে বসলেন, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন, রওনক খেয়েছে তো?
আমি হ্যাসূচক বাক্যে মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে এলাম।
আপু-দুলাভাইকে দেখলে মনের মধ্যে আলাদা প্রশান্তি কাজ করে। দুলাভাই আপুর প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল, তেমনি ভালোবাসার ও কোনো কমতি রাখেননি। আপু দুলাভাইকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়ে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি।

দুলাভাই হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে আমার নাম ধরে ডাকলেন। আমি চমকে উঠে তার দিকে তাকালাম। দুলাভাইকে দেখে ইরানী মনে হয় আমার। তার বাংলা বলার ধরণ ও ভাঙ্গা ভাঙ্গা। হয়ত অন্য দেশের নাগরিক বলে তাকে বাবা মেনে নেননি। কিন্তু দেখতে দুলাভাই বেশ সুন্দর এবং সুঠাম গড়নের, যেমনটা ইরানীয় ছেলেগুলো হয়।

দুলাভাই ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বললেন,
~ ধন্যবাদ আমার অনুরোধ রাখার জন্য। তোমার আগমন আমাকে কতটা আশ্বস্ত করেছে, তা বলে বোঝাতে পারবনা। রওনকের কাছে শুনেছি তুমি বুদ্ধিমান এবং ভীষণ বুঝদার। তোমাকে দেখে আমার তাতে কোনো সন্দেহ রইলনা।
আমি জানি, তুমি তোমার আপুর প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখবে। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে অবশ্যই জানাবে।
~ আমার প্রতি ভরসা রাখার জন্য ধন্যবাদ। উনি যেমন আপনার স্ত্রী তেমনি আমার বোন। এই সময় তার পাশে থাকা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

আমি কেবল এই কারণেই এতদূর ছুটে এসেছি, এর জন্য আলাদা ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। আর জানানোর মত তেমন সমস্যা হলে আপনাকে অবশ্যই জানাব।
তবে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল, আপনার পরিবারে কেউ নেই?
দুলাভাই ছোট করে উত্তর দিলেন, না।

খেয়ে উঠতে বাবার ফোন এল, আমি ব্যাক করে কথা বলতে বলতে বারান্দার দিকে গেলাম। ফোনে কথা বললেও দৃষ্টি সজাগ রাখলাম চারপাশে। আপুর নিরাপত্তার ব্যাপারে আমি কোনো ঝুকি নিতে চাইনা, আর ইচ্ছে করেই দুলাভাইকে আলাদা পেয়েও কাল রাতের ব্যাপারে কিছু বলিনি। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম দুলাভাই আপুকে নিয়ে এমনিতেও অনেক দুশ্চিন্তা করছেন। তাই খুব কঠিন কোনো সমস্যা ছাড়া তাকে জানানোর প্রয়োজন নেই।

কথা বলতে বলতে সিড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠছিলাম, সিড়ির শেষমাথায় দাড়াতেই দেখলাম কেউ এই মাথা থেকে ওই মাথায় পায়চারি করছে। দেখে আমার হাতপা কেমন জানি কাপতে লাগল, এই চোরের দেখি অনেক সাহস। আজ কিছুতেই একে ছাড়া যাবেনা।

তাড়াতাড়ি সিড়ি থেকে নেমে বারান্দার দিকে এলাম, বারান্দার কোণে রাখা মোটা রড হাতে নিয়ে ছুটে গেলাম উপরতলায়। চোরটা ঠায় ওখানে দাড়িয়ে আছে, তার পিছনে এসে দাড়িয়ে রড উচু করে ধরে তার মাথায় বাড়ি দিতে উদ্ধত হলাম।


পর্ব ০৩

যে-ই আমি অবয়বটার মাথায় আঘাত করতে যাব, তখন ই সে একহাত দিয়ে রড টাকে শক্ত করে ধরে ফেলল তাও পিছনে না ঘুরে। আমি রডটাকে তার হাত থেকে ছাড়ানোর জন্য টানাটানি করতে থাকলাম, সে কিছুতেই ছাড়ছিলনা।

আমিও হাল ছাড়ছিলামনা, রেগে গিয়ে বলতে লাগলাম,
~ ইডিয়ট, একই বাড়ীতে দ্বিতীয়বার চুরি করতে আসতে লজ্জা করেনা। চোর হলেও মিনিমাম কমনসেন্স থাকা উচিত, এভাবে চোরজাতির সম্মান নষ্ট করার জন্য আপনাকে চোর কমিটি থেকে বহিষ্কার করা উচিত!
কথাগুলো শোনার পর অবয়বটা রড ছেড়ে দিল, আমি তখনো টানাটানি করতে থাকায় টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে ছাদের কিনারায় পড়তে নিলাম।

অবয়বটা দ্রুত আমার হাতের রডটা টেনে আমাকে নিশ্চিত পড়ার হাত থেকে বাচাল। সোজা হয়ে দাড়িয়ে মুখ বাকিয়ে বললাম,
~ চোর হলেও মানুষ ভাল। কিন্তু আপনার পরিচয় কি? কি চুরি করতে এসেছেন এখানে?
বলতে বলতে ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে দিলাম। ধারণা করেছিলাম, এক্ষুনি সে পালানোর চেষ্টা করবে। তাই ফন্দি করে পালানোর আগে চেহারা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলাম।

ফ্ল্যাশ অন করতেই সে উল্টো দিকে ফিরে দাড়াল। আমি দ্রুত তার সামনে দাড়িয়ে গেলাম, ফ্ল্যাশের আলোয় চেহারা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কাপা কন্ঠে বললাম,
~ দুলাভাই আপনি! আপনি এত রাতে ছাদে এলেন, আমি ভাবলাম….
~ আমাকে চোর কমিটির সদস্য বানিয়ে দিলে! আমার রাতে ছাদে আসার অভ্যাস আছে, আর তুমি এইসময় বাহিরে কেন? যাও বাসায় যাও।

দুলাভাইয়ের কন্ঠ এই প্রথম ঝাঝালো মনে হল। যদিও আগে থেকেই উনার সাথে আমার খুব বেশী কথা হতনা, যতবার হয়েছে শান্তগলায় কথা বলেছেন। আমি আর কথা বাড়ালামনা, ধীর পায়ে হেটে রুমে চলে এলাম। একটু রাগ কাজ করল, উনি প্রথমে আমাকে বললে পারতেন। তাহলে এত কাহিনী হতনা। তাছাড়া সেদিনও যদি অবয়বটা তিনি হয়ে থাকেন, তবে অদ্ভুতভাবে পালিয়ে গেলেন কেন!

টেবিলের উপর থাকা পানিভর্তি গ্লাসটা ফাকা করে শুয়ে পড়লাম। বুঝতে পারছিলামনা, এর আগের দিন ও কি উনি ছিলেন নাকি! কাল জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে ভেবে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিলাম।

চোখ ডলতে ডলতে নাস্তার টেবিলে এসে বসলাম, আপু আমার দিকে পাউরুটি আর ওমলেট এগিয়ে দিল। তাতে কামড় বসাতে বসাতে বললাম,
~ দুলাভাই কোথায়? নাস্তা করতে ডাকিসনি?

~ সে তো একটু আগে নাস্তা করে বেরিয়ে গেল। তোকে বেলা করে ঘুমাতে দেখে আর জাগাতে দিলনা। শরীর ঠিক আছে তোর? এত দেরী করে উঠলি?

~ ঠিক আছে, একটু ক্লান্ত ছিলাম। আর আসার পর নতুন জায়গায় হিসেবে ঘুম হয়নি।
আচ্ছা আপু, দুলাভাইয়ের রাতে ছাদে যাওয়ার অভ্যাস আছে?

~ সে তো খানিকটা আছে। বেশ বাতাস আর জ্যোৎস্না থাকলে আমাকে নিয়ে ঘুরে আসে। এই বাসায় এসে ভেবেছিল রাতে একবার ছাদ ঘুরে আসবে, কিন্তু সেদিন এত ক্লান্ত ছিল যে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
আপুর কথা শুনে ভাবলাম, তাহলে পরশুদিন যাকে দেখেছিলাম সে আসলেই চোর ছিল। কালকে হয়ত সত্যিই দুলাভাই ছাদে ছিল।

আর কিছুদিন এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করলামনা, সেদিনের পর খানিকটা লজ্জায় দুলাভাইয়ের সাথেও খুব বেশী কথা বাড়াতামনা। কিন্তু দুলাভাই আমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ ই করছিল।

সন্ধ্যাবেলা আপু আর আমি বসে মুভি দেখছিলাম, হঠাৎ বাহিরের গেটে কারো নক করার শব্দে আমি বাসার বাহিরে এসে গেইট খুললাম। মাঝে মাঝে মনে হয় যে গেইটে একটা দারোয়ান থাকলে ভালো হত, বাসা থেকে এসে বাহিরের গেইট খোলা ঝামেলা লাগে। গেইট খুলে দেখি কেউ নেই, কিন্তু এতক্ষণ খুব শব্দ করেই নক হচ্ছিল।

গেইটের বাহিরে বেরিয়ে এপাশ ওপাশে চোখ ঘুরালাম, কাউকেই দেখতে পেলামনা। কোন উড়নচণ্ডী পোলাপান ফাজলামী করল কে জানে!
ঢুকে গেইট লক করতেই ভিতর থেকে আপুর আত্মচিৎকার ভেসে আসল। কিছু না ভেবে দৌড়ে ভিতরে এসে দেখি আপু মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছে, তার পেটের একপাশে ছোট্ট ভারী টেবিলটা পড়ে আছে।

সেই সাথে আপুর কোমড়ের নিচের অংশে রক্ত ঝরছে। তাড়াতাড়ি টেবিলটা উঠিয়ে ফেললাম। এরমধ্যে আপু অসাড় হয়ে পড়েছে।
আপুর এই অবস্থা দেখে আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম, দুলাভাইয়ের নাম্বারে কল দিলাম। কিন্তু আমার ফোনের সিগনাল উঠানামা করায় রং হওয়ার আগেই কেটে যাচ্ছে।

কি করব বুঝতে পারছিলামনা, আশেপাশে কোনো প্রতিবেশী ও নেই যে সাহায্য চাইব।
এই দেশের কোনো এ্যাম্বুলেন্স নাম্বার আমি জানিনা, কোথায় হেল্প চাইব বুঝতে পারছিনা।

গুগল থেকে নাম্বার কালেক্ট কাছের হসপিটালে কল দিলাম, সিগনাল উঠানামা করায় সেখানেও কল গেলনা। নিরুপায় হয়ে রাস্তায় এসে ট্যাক্সি ক্যাব খুজতে লাগলাম, কিন্তু কোনো ক্যাব দাড়াচ্ছেনা। দাড়ালেও কেউ আমার ইংলিশ বা ভাঙ্গা ভাঙা উর্দু বুঝতে পারছেনা, কেউ বা আপুকে বাহির করে আনার ব্যাপারে হেল্প করতে চাইছেনা।

শেষমেষ একটা পারসোনাল গাড়ির মালিক আমাকে সাহায্য করল। বাসার ভিতর থেকে আপুকে কোলে তুলে বের করে গাড়ীতে উঠাল। খুব দ্রুত হাসপাতালে পৌছে আপুকে এডমিট করলাম, দুলাভাইকেও ফোন করে জানালাম।
ওয়েটিং রুমে বসে মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি, ভিতরটা বারবার অনুশোচনা এবং আতঙ্কে কেপে উঠছিল।

চোখ-মুখ শক্ত করে বসে আছি। অপরিচিত সাহায্যকারী আমার পাশের সিটে এসে বসলেন, আমি তার দিকে না তাকিয়ে ইংরেজীতে ধন্যবাদ জানালাম। উনি আমার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন,
~ চোখেমুখে পানি দিয়ে নিন। আমি এবার তারদিকে তাকিয়ে পানির বোতল নিলাম।

তখনকার পরিস্থিতিতে তার দিকে তাকানোর সুযোগ হয়নি, এখন একনজর দেখলাম অপরিচিত সাহায্যকারী একজন সুঠাম তরুণ। দেখে মনে হচ্ছে, খাস পাকিস্তানী। পরনের কাঠালি রঙ্গের টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টারে আবছা রক্ত, বা হাতে রোলাক্স ঘড়িটা উল্টো হয়ে ঝুলছে।

একসাইডে রাখা পরিপাটি চুলগুলো ভিজে এলোমেলো হয়ে আছে, নাকে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা। তার ধূসর ঘোলাটে চোখের দিকে দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস পেলামনা। ভিন্নদেশী ছেলেগুলো আমার কাছে আতংকস্বরুপ। আমি উঠে করিডোরের দিকে এসে চোখে-মুখে পানির ছিটে দিলাম।

দুলাভাই দৌড়ে এসে হাপাতে হাপাতে আমার সামনে দাড়ালেন, এর মধ্যে ডাক্তার অটি থেকে বেরিয়ে আসায় দুলাভাই তার কাছে ছুটে গিয়ে কথা বললেন।

আমি এগোতে তিনি চোখ দিয়ে ইশারা করলেন ওখানেই দাড়াতে। কথা শেষ করে এগিয়ে এসে বললেন,
~ তোমার আপু ঠিক আছে, অল্পের জন্য বাচ্চার বড়ধরণের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে আল্লাহ না করুন, এই এক্সিডেন্টে বেবির কোনো অংশ বিকালাঙ্গ হতে পারে। উনারা এই ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নয়। আরো দুমাস পর স্পষ্ট বুঝা যাবে।

কথাটা শুনে মাথা ঘুরছিল, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম এমন কিছু যাতে না হয়। দুলাভাই আবার বললেন,
~ চলো তোমায় বাসায় দিয়ে আসি। কাল হয়তবা তোমার আপুকে রিলিজ করে দিবে।
~ আমি এখানে থাকতে পারি?

~ আমি আছি, তুমি বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। বাহিরে দাড়াও, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি।
চুপচাপ হসপিটালের বাহিরে দাড়িয়ে আলোয় সাজানো ব্যস্ত শহরটা দেখতে লাগলাম। চারদিক লোকারণ্য, দুইলেনের রাস্তা দিয়ে ঘন ঘন গাড়ী শা শা করে ছুটে যাচ্ছে। আশেপাশে ফল-খাবারের দোকান থেকে বিভিন্ন কথা ভেসে আসছে। প্রত্যেকে ভীষণ ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে।

পাশ থেকে অপরিচিত মানুষটার প্রশ্ন,
~ আপনার রোগী এখন কেমন আছেন?
আমি ছোট্টশ্বাস ছেড়ে বললাম,
~ ভালো আছে, বেবির বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে বিকালাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা আছে।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সহযোগিতা করার জন্য। আমি এই পরিবেশের সাথে পরিচিত নই, তাই এইসব হ্যান্ডেল করা অসম্ভব ছিল। দুলাভাইকে বেরোতে দেখে উনাকে বিদায় জানিয়ে চলে এলাম।


পর্ব ০৪

আপুর জন্য চিকেন স্যুপ বানিয়ে নিয়ে তার রুমের দিকে যাচ্ছিলাম, দরজার কাছে আসতেই আপু-দুলাভাইয়ের কিছু টুকরো কথোপকথন কানে ভেসে এল। পার্সোনাল কথা বলছে সেটা ভেবে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াব অমনি কানে এল দুলাভাই বলছে,
~ রেহজানের উপর আমার পুরো আস্থা ছিল, সে অন্তত তোমার প্রতি যত্নশীল থাকবে। কালকের ঘটনার পর আমি অনেকটা হতাশ।

আপু কন্ঠে করুণ একটা সুর এনে বলল,
~ কালকের ঘটনার জন্য রেহজান কোনোভাবেই দায়ী ছিলনা। ও আমার অনেক খেয়াল রাখে, তুমি না থাকাকালীন আমাকে সর্বক্ষণ সঙ্গ দেয়। কালকে হঠাৎ গেইটে নক পড়ায় ও দেখতে বেরিয়েছিল, এর মধ্যে আমি উঠতে গিয়ে মেঝেতে পড়া পানির উপর পিছল খেয়েছি।

আপুর কথায় দুলাভাই আশ্বস্ত হতে পারলেননা। আমার প্রতি ভরসাটা উনি হয়ত হারিয়ে ফেলেছেন।
~ হুম.. আমি তোমার জন্য একজন অভিজ্ঞ মহিলা সার্ভেন্ট এর ব্যবস্থা করব।
~ তুমি রেহজানকে আর ভরসা করতে পারছোনা?

দুলাভাই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
~ আমি আর কোনো ঝুকি নিতে চাচ্ছিনা।
আমি কিচেনে ফিরে এলাম। একটা চাপা খারাপলাগা কাজ করছে, মনে হচ্ছে কালকের ঘটনার জন্য আমি সত্যি দায়ী।

ফোনের ওপাশ থেকে বাবার ক্ষিপ্ত আওয়াজ, ” তোকে আমি সেখানে কেন পাঠিয়েছিলাম? তুই থাকতে এত বড় ক্ষতি হতে যায় কিভাবে!”
বাবার পাশ থেকে মায়ের কথা শোনা গেল, ” ও হয়ত বুঝতে পারেনি, এত বকবেননা মেয়েটাকে। আমাকে ফোনটা দিন।”

বাবা রাগ দেখিয়ে মায়ের হাতে ফোন দিলেন,
~ তোর বাবার কথায় মনে কষ্ট নিসনা, জানিস ই তো রেনুকে নিয়ে কত চিন্তিত থাকেন। শোন, এখন থেকে রেনুকে কখনোই একা ছাড়বিনা। কখন কি লাগবে সব খেয়াল রাখিস, টুকটাক উর্দু ভাষা শিখে নিস। মাঝেমাঝে বেরিয়ে চারপাশে কোথায় কি আছে চিনে রাখবি, প্রতিবেশীদের সাথে মিশবি।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
~ ঠিক আছে। তুমি সবার খেয়াল রেখো।

ফোন রেখে বারান্দার চেয়ারে বসলাম, আপু গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে মুখোমুখি বসে বলল,
~ আমার জন্য অনেক বকা শুনেছিস তাইনা? কেন জানাতে গেলি বাবা-মাকে?
~ জ্ঞানী ভাব ধরবি না একদম। এইবার থেকে আমাকে ছাড়া এদিক সেদিকে এক পা ও দিবিনা, একা একা বারান্দায় এসেছিস কেন!

আপু দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল বাগানের গাছগুলোর দিকে। উদ্দেশ্য তার চোখের পানি আমার থেকে আড়াল করা। আমি বুঝতে পেরে আপুর পেটের উপর আলতো করে হাত রাখলাম,
~ পুচকো টা, বেরিয়ে যেন অভিযোগ করতে না পারে তার খালামনি তার এবং মায়ের যত্নে ক্রুটি রেখেছে। আমি কিন্তু তার আধো আধো আদর পেতে চাই, ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ নয়। আপু ফিক করে হেসে উঠে আমাকে কাছে টেনে জড়িয়ে নিল।

দুলাভাইয়ের আগ্রহে একজন মাঝবয়সী মহিলা সার্ভেন্ট রাখা হল। এখন সে ই সারাক্ষণ আপুর দেখাশোনা করে, রুটিনমাফিক সবরকম খেয়াল রাখে। বন্ধুর মত মিশে আপুর সাথে, এসব দেখে আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত হই।
চিন্তা আসে, এখন আমি দেশে ফিরে যেতে পারব। দুলাভাইয়ের মনে কষ্টের কারণে আমারো থাকতে ইচ্ছে করছেনা, যতক্ষণ তার সামনে থাকি এক অজানা অপরাধীর মত অনুশোচনায় দগ্ধ হই।

আপুর কাছে ফিরে যাওয়ার কথাটা তুলতেই আপু এক ধমক দিয়ে বলল,
~ আমাকে এই অবস্থায় এভাবে ফেলে ফিরে যাওয়ার জন্য তুই এসেছিস? এই তোর বোনের প্রতি ভালোবাসা! এমন ভালোবাসা শত্রুর ও যেন না থাকে।
~ আপু আমি শুধু ভেবেছি, চলে তো যাচ্ছিনা।

~ আমি চাই তুই আজীবন আমার কাছে থাক, আমার বাচ্চাকাচ্চা পালবি-বড় করবি আর আমি শরীর দুলিয়ে আরামে দিন কাটাব। ইস! আমার যদি একটা দেবর থাকত, তবে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম।
আপুর এমন কথায় আমার হাসি পায়, ফিরে যাওয়ার যে আগ্রহ গড়ে উঠেছিল সেটা আর খুজে পাইনি। নিজেকে একরকম স্বার্থপর আর অবিবেচক ও মনে হয়েছিল। আপুর এমন অবস্থায় অবশ্যই তার নিজের কাউকে প্রয়োজন।

গেইট খুলে সেদিনের অপরিচিত সাহায্যকারীকে দেখে খানিকটা ভড়কে গেলাম। উনি এখানে কেন এসেছেন প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। উনি উর্দু ভাষায় বললেন,
~ কেমন আছেন? আরো বেশ কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করলেন যেগুলো আমার বোধগম্য হলনা। উর্দু না জানায় বেশ লজ্জা পড়ে যাচ্ছি। কোনোরকম জড়তা নিয়ে ইংরেজীতে বললাম,
~ আমি উর্দু তেমন জানিনা। উনি স্যরি বলে ইংরেজীতে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার রোগী কেমন আছেন?”

~ জ্বী ভালো। আপনি এখানে কি করে?
ছেলেটা চোখের সানগ্লাস খুলে ফেলে ব্যাগ নিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, “এই বাসাটা আমার। আপনারা নিচের তলা ভাড়া নিয়েছেন। আর আমি মাঝে মাঝে এসে উপরতলায় থাকি।”

আমি হু-হা করে উনার কাছ থেকে কোনোরকম পালিয়ে চলে এলাম। উনাকে বিশেষ করে উনার ধূসর বর্ণের চোখগুলো দেখলে আমার কেমন একটা ঘোর কাজ করে। কথায় জড়তা চলে আসে, গুছিয়ে কিছু বলতে পারিনা।
আপুর কথায় সন্ধ্যার দিকে ছেলেটাকে চা দিতে গিয়ে দেখি দুলাভাই উপরতলায় যাচ্ছেন। পিছু পিছু যাওয়া ঠিক হবেনা ভেবে আমি বারান্দায় দুলাভাইয়ের নেমে আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম।

অনেকটা সময় পর দুলাভাই নেমে এলেন, আমার চোখে চোখ পড়তেই দ্রুত ভিতরে চলে গেলেন। আমার কেমন একটা খটকা লাগল, দুলাভাইয়ের চোখ ভেজা ভেজা ছিল আর বারবার নাক টানছিল।

আমিও আর উপরতলায় না গিয়ে ফিরে এলাম, দুলাভাইকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস আমার নেই। তবে বেশ বুঝতে পেরেছি উপরতলায় গিয়ে দুলাভাই কান্না করেছিলেন। কিন্তু কি কারণে? ছেলেটা কি উনাকে কিছু বলেছে?
মাথায় হাজার প্রশ্ন নিয়ে উপরতলার দিকে পা নাড়ালাম। উদ্দেশ্য দুলাভাই আর ছেলেটার মধ্যে কি হয়েছে তা জানা।


পর্ব ০৫

উপরতলায় এসে দাড়াতেই শরীরটা কেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। উপরতলার বারান্দায় টিমটিমে আলোর একটা বাতি জ্বলছে, বাহিরে থেকে বোঝার উপায় নেই বাসায় কেউ আছে কিনা! নক করব কি করবনা ভাবতে ভাবতে দুটো টোকা দেওয়ার মাঝে দরজা খোলার আওয়াজ আসে।

ছেলেটা বেরিয়ে আমার সামনে এসে দাড়াল। পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর পাতলা একটা বাদামী টি-শার্ট। টি-শার্ট তাড়াহুড়ো করে পড়ায় সেটার সামনে গলা নেমে এসেছে বুক অবধি। তাতে বুকের কিছু লোম বেরিয়ে এসেছে যা দেখে আমার একটু অস্বস্তি লাগে। চট করে চোখ নামিয়ে ধরাগলায় বললাম,
~ ” আপনার জন্য চা এনেছিলাম।”

আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে ধন্যবাদ জানায় ছেলেটা। আমি পরনের ওড়নার এককোণা আঙ্গুলে পেচাতে পেচাতে কোনোরকম সাহস সঞ্চার করে জিজ্ঞেস করলাম,
~ দুলাভাইকে কি আপনি কিছু বলেছেন?

কি এমন বলেছেন আমি জানতে চাই!
ছেলেটা চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে কাপটা আবার পিরিচে রেখে আমার দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকাল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে উত্তর দিল,
~ আপনার দুলাভাইয়ের সাথে আমার এখনো দেখা হয়নি।

কথাটা শুনে যতটা রাগ নিয়ে ছেলেটাকে ঝাড়তে এসেছিলাম, ততটা হতাশা নিয়ে ফিরে এলাম। ব্যাপারটা বোঝার মত সাধ্য আমার হলনা। আপুর রুমে ফিরে এসে আপুর পাশে গিয়ে বসলাম,
~ আপু দুলাভাই কোথায়?
~ বেরিয়েছে একটু। তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি! তোকে খুজেছিল তোর দুলাভাই।

কথাটা কর্ণগোচর হওয়ামাত্র হৃদপিন্ডে ক্রমশ ক্ষুদ্র ঝড় বয়ে গেল। অপেক্ষায় থাকলাম দুলাভাই বাসায় ফেরার। কিন্তু অনেক রাত বাড়ার পর ও দুলাভাই ফিরছেননা, আপু ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ আগেই। জেগে থাকলে পেরেশানিতে হয়রান হত। বারান্দায় পায়চারি করতে করতে বারবার গেইটের দিকে দৃষ্টিপাত করছি। কখন ছেলেটা আমার বিপরীত দিকে এসে দাড়িয়ে খেয়াল করিনি।

তাকে দেখামাত্র তার উপর হামলে পড়লাম,
~ আপনি দুলাভাইকে কিছু একটা নিশ্চিত বলেছেন। সত্যি করে বলুন, কি বলেছেন তাকে? নাহলে আমি আপনাকে ছাড়ছিনা।

ছেলেটা নাক-মুখ কুচকে আমার দিকে তাকায়। টেনশানের চোটে এর সাথে বাংলা বলে ফেলছি, এখন কোনো ইংলিশ ওয়ার্ড আমার মাথায় আসছে না। কিঞ্চিত বিরক্তি নিয়ে তার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। ছেলেটা আমার পাশে এসে দাড়িয়ে আলতো করে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলল,
~ বেশী বেশী নাক-মুখ কুচকালে তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যায়।

আমি ফোসতে ফোসতে তার দিকে তাকালাম, আমার শরীর তখনো টেনশানে কাপছে। ছেলেটা হঠাৎ এক অদ্ভুত কান্ড করে বসল একটানে আমাকে তার বুকে চেপে ধরে মাথায় হালকা হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

  • ডোন্ট বি আপসেট। এভরিথিং উইল বি ফাইন।
    ক্লেম ডাউন।

এক মূহুর্তের জন্য হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল মনে হল। নিজেকে ছাড়াতে ইচ্ছে হলেও পারলামনা। কেমন জানি এক তৃপ্তিকর প্রশান্তি খুজে পাচ্ছিলাম, চিন্তাগুলো ও যেন চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে স্থির হয়ে গেল। শরীরটা হালকা লাগছিল। এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানিনা, যখন চেতনায় এলাম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রুমে ফিরে এলাম গম্ভীর মুখে।

প্রায় মধ্যরাতে দুলাভাই ফিরলেন, এসে আমার সাথে তেমন বাক্যবিনিময় করলেননা। তার চোখ-মুখ কঠিন দেখে আমিও কোনো প্রশ্ন করিনি। সকাল হতেই দুলাভাই সবকিছু গোছগাছ করছেন। আপু তো জিজ্ঞেস করে করে হয়রান, কোথায় যাচ্ছি আমরা! কোনো সমস্যা হয়েছে?

দুলাভাই কোনো উত্তর দিচ্ছিলেননা, আমি দৌড়ে গেলাম উপরতলায়। নিশ্চিত ছিলাম, ছেলেটা দুলাভাইকে এমন কিছু বলেছে যার দরুণ তিনি বাসাটা ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু উপরতলায় গিয়ে আমি হতাশ, দরজায় তালা ঝুলছে।
ছেলেটার উপর একসমুদ্র ক্ষিপ্ততা নিয়ে দুলাভাইদের সাথে ক্যাবে উঠলাম।

আপুর কাপড়গুলো লাগেজ থেকে বের করে ড্রায়ারে গুছিয়ে রাখতে রাখতে চট করে প্রশ্ন করলাম, “এখানে তোর শ্বশুড়বাড়ি আছে, আর তুই সেটা জানতি না?”
আপু একটু নিশ্চুপ থেকে বলল,
~ ওকে আমি কখনো তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি।

ভেবেছি, বিয়ের পর তো তার পরিবারে নিয়ে আসবে আমাকে। কিন্তু বিয়ের পর ও যখন তার লেশমাত্র দেখলামনা, জিজ্ঞেস করেছিলাম। সেদিন সে প্রত্যত্তুরে বলেছিল, “আমার সাথে একটা পরিবার বানানো যায়না?”
~ তবে কি তোকে বিয়ে করা নিয়ে পরিবারে কোনো ঝামেলা হয়েছিল? তোর বিয়ের ব্যাপারেও তো কখনো কিছু বলিসনি!
~ তা জানিনা। সে লম্বা কাহিনী, পরে বলব তোকে।

এই বাসায় ঢুকার আগ পর্যন্ত জানতামনা এটা আপুর শ্বশুড়বাড়ি। শহরের এককোণে এমন পুরোনো তবে আভিজাত্য ধাচের বাড়ী দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বাসায় পা রাখতেই এক মাঝবয়সী মহিলা অতি সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। পরে জানতে পারলাম উনি আপুর শ্বাশুড়ী, উনি ছাড়াও বাসায় আপুর শ্বশুড়, ননদ, ছোটভাগ্নি, চাচীশ্বাশুড়ী ছিলেন। সবাই এত পরম মমতায় আপুকে গ্রহণ করলেন। আমি একটু বিষম খেয়ে গেলাম যে এতদিন এই পরিবার কোথায় ছিল!

এর আগেও যখন দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করেছি উনার পরিবারে কেউ আছে কিনা! উনি একউত্তরে না বলেছিলেন।
~ ভাইয়া আপনি এতদিন আপনার পরিবার নিয়ে কিছু জানাননি কেন?
আমার প্রশ্নে দুলাভাই একটু হোচট খেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “এখন তো জানলে। আশা করি, তুমিও এখন নিশ্চিন্ত থাকবে তোমার আপুর যত্ন নেওয়ার জন্য তার আরেকটা পরিবার আছে।”

দুলাভাই আমার আসল প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন, যেহেতু উনি বলতে চাননি আমিও জোর করিনি।
জানালা খুলে বাহিরের দিকে তাকালাম, চারিদিকটা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত। খুব সুন্দর কড়া বেলী ফুলের ঘ্রাণ আসছে, বাসায় ঢুকতে একপাশে অনেকগুলো ফুলের গাছ খেয়াল করেছিলাম। আমি রুমের ল্যাম্প বন্ধ করে দিলাম, এমন একটা পরিবেশে নিজেকে অনুভব করিনি কতদিন।

চোখ বুজে বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছিলাম এমনসময় কারো খুব জোরে ভ্যাউউ শব্দে দম আটকে এল। হঠাৎ ভয় পাওয়ায় হৃদপিন্ড এমন লাফালাফি করছিল যেন বেরিয়ে আসবে, একছুটে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। ছেলেটা আমার সামনে দাড়াল, তখনো আমার হৃদপিন্ডের অস্বাভাবিক ধুকপুকানিতে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলনা।

সে কালকের মত একটানে আমাকে তার বুকের কাছে জড়িয়ে রাখল। ব্যাপারটায় শক খেলেও আমি যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে শান্ত হয়ে আসলে তার বুকে কয়েকটা কিল বসিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বললাম,
~ অসভ্যের মত আচরণ করেন কেন? আর এই বাড়ীতে আপনি কি করছেন?

সে দুহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে স্বাভাবিককন্ঠে বলল,
~ কারণ এটাও আমার ই বাসা।
~ বললেই হলো! আপনি কে হন এই বাসার?
~ মালিকের ছেলে।
বুঝতে কষ্ট হলনা, উনি ই আপুর ছোট দেবর। কিন্তু কোথাও যেন হিসেব গড়মিল রয়েই গেল। সেও একবারো নিজের আসল পরিচয় দিলনা, আর দুলাভাইও তার পরিচয় দিলনা৷ সেদিন রাতের ব্যাপার পুরোপুরি না হলেও কিছুটা মাথায় ধরেছে।
“আপু এবার তো আমি চলে যেতে পারি? বাবা-মাকে তোর শ্বশুড়বাড়ীর ব্যাপারে বলেছি, উনারা এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত।”
~ আসার পর থেকেই তোর চলে যাওয়ার তাড়া! এই বাড়ীতে তোকে কেউ কিছু বলেছে? কারো কথায় কষ্ট পেয়েছিস?
~ দূর, তোর কাছে যত আলতু-ফালতু কথা। কে আমাকে কি বলবে? আর তোর শ্বশুড়বাড়ীর কার কথা আমি বুঝি! উর্দু-আরবি মিলিয়ে কথা বলে, আমি শুধু হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।

সত্যি বলতে, আপুর শ্বশুড়দের মত পরিবার আমি কখনো দেখিনি। যেমন শালীন, তেমনি মিষ্টভাষী। আপু এত ভাল একটা পরিবার পাবে সেটা আমি কল্পনা করিনি। আর আপুর দেবর আলফি সে তো একটা ছিনে জোক, সারাক্ষণ পিছনে লেগে থাকে। প্রথম প্রথম দা-কুমড়ার মত সম্পর্ক থাকলেও এখন কিছুটা ভাব হয়েছে তার সাথে। এখন তার মিশে বুঝেছি তার মত ছেলে হয়না, সবসময় আমাকে আর আপুকে মাতিয়ে রাখে। ভাবতে ভাবতে একটা বড় প্যাকেট নিয়ে আলফি আমাদের রুমে ঢুকল।

আপুকে প্যাকেটটা দিয়ে উর্দুতে বলল, “তোমার আর বেয়াইনের জন্য কিছু ব্যান্ডেড চকলেট এনেছি। শুনো, আবার একা খেয়োনা, তোমার বেচারা দেবর কিন্তু শুকিয়ে যাচ্ছে।”
~ আমি চকলেট খাইনা, আমার ভাগের সবক’টা উনাকে দিয়ে দে তো আপু। আমার বাংলা কথা বুঝতে না পেরে সে হতভম্ব হয়ে আপুর দিকে তাকায়। আপুও হাসতে হাসতে বুঝিয়ে দেয়।
~ তাহলে আপনি কি খাবেন?

~ নিমের রস। বলে উঠে চলে এলাম, হঠাৎ করে মুড অফ হওয়ায় সব বিরক্ত লাগছে। আপুকে এতবার যাওয়ার কথা বলছি, আপু কানেই তুলছেনা। কেন জানি মনে হচ্ছে, না যেতে পারার কারণে প্রিয় জিনিসটা হারিয়ে ফেলব।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর আলফি ছাদে এল, অবশ্য আমি তার ই অপেক্ষা করছিলাম। এই মন খারাপের সময় তার সঙ্গটা আমার অত্যাবশ্যক। এসেই সামনে দাড়িয়ে গলা কেশে হাতের গ্লাসটা এগিয়ে দিল।
~ এটা কি?

~ নিমের রস।
চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালাম। আমি রাগের বশে নিমের রস খাব বলেছিলাম ছেলেটা সত্যিই নিমের রস নিয়ে চলে এল। এই বলদ কি জানেনা, নিমের রস খেতে কেমন!
~ দেখুন আলফি, আমি মজা করে বলেছিলাম। আমি নিমের রস খাইনা।

~ কোনো কথা শুনবনা, আপনি খাবেন বলে আমি কত কষ্ট করে এটা সংগ্রহ করেছি। না খেলে তো আমার পরিশ্রম বৃথা। ঢকঢক করে খেয়ে ফেলুন তো।
~ আমি কিছুতেই খাবনা।

~ না খেলে আমি নিচে গিয়ে সবাইকে বলে দিব আপনি আমাকে অযথা নাজেহাল করেছেন। মান-সম্মান খোয়ানোর ভয় সবার ই আছে, তাই খেতে বাধ্য হলাম। প্রতি ঢোক আমাকে জোর করে গিলানোর হচ্ছিল, দুই ঢোক শেষে আর না পেরে বাকিটা তার মুখে ছুড়ে দিয়ে নিচে পালিয়ে এলাম।

খাওয়ার টেবিলে তার চোখে চোখ পড়তেই বিড়ালের মত পানসে মুখ করে নিজের খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলাম। সে এসে হুংকার ছাড়ল, আজ আমি ভাত-রুটি কিচ্ছু খাবনা। ফ্রিজে যত মিষ্টি আছে দাও, আজ সব খাব।
আমি নিজের খাওয়া রেখে তার খাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি সত্যি ২বক্স মিষ্টি সে একাই খেল। সামান্য তিতো মুখে পড়ে তার এই অবস্থা দেখে পেট ফেটে হাসি আসছিল। এক ফাকে বলে ফেললাম,
~ বেয়ানসাহেব, তিতো হলেও জিনিসটা উপকারী।

~ আজ বুঝলাম, আপনার মুখে সবসময় এত তিতো কথা কিভাবে উৎপাদন হয়!
বলে শিস বাজিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। আমি দাত কটমট করে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

পর্ব ০৬

দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার আর আলফির সম্পর্কের একটা নাম হয়েছিল, “বন্ধুত্ব”। কিন্তু তখনো আপনি শব্দটা তুমিতে রুপান্তরিত হয়নি। সবমিলিয়ে আপুর পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠছিলাম। আপুর তখনো সবে ৮মাস, ডেলিভারির ডেট ঘনিয়ে আসছে। শ্বশুড়বাড়ীর সবাই তার খুব যত্ন-আত্তি করলেও আমি আপুর খেয়াল রাখতে ভুলতামনা।

এক বিকালে হঠাৎ নেমে আসা এক পশলা বৃষ্টি দেখে হুট করে ভিজতে যাওয়া অভ্যাস থেকে নিজেকে আটকাতে পারিনি। তাতেই ঘটল যত বিপত্তি! ছাদে শ্যাওলাপানিতে পিছল খেয়ে ডান হাত ভেঙ্গে ফেললাম। আমার হাত প্লাস্টার করতে দেখে আপুর সে কি কান্না! বিরক্ত হয়ে এক ঝাড়ি দিলাম,
~” এমন মরাকান্না জুড়েছিস কেন? হাত ই তো ভেঙ্গেছে, মরে তো যাইনি!”

কার কথা কে শোনে! আমার কথায় তার আবেগ দমেনা, বরং ফুটন্ত ভাতের ফেনার মত টগবগ করে। দুলাভাই আমার অবস্থা দেখে বিষন্নবোধ করলেন। বিমর্ষচিত্তে বারবার বললেন,
~ “আমাদের তোমার প্রতি খেয়াল রাখা উচিত ছিল। আমি তোমাকে স্ব-দায়িত্বে এনেছিলাম, কিন্তু তা পালনে ব্যর্থ হলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

~ “এতে আপনার কি দোষ! আমার ই সর্তক থাকা উচিত ছিল। আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, এভাবে সবাইকে অস্বস্তিকর পরিবেশে ফেলার জন্য।”

দুলাভাই সেইসময়টায় আমার যত্নে কোনো ক্রুটি রাখেননি, তাকে নিজের আপন বড়ভাইয়ের আসনে বসিয়ে ফেলেছিলাম। দুলাভাইও অনেকটা সহজ হয়ে এলেন আমার সাথে। বড় ভাইয়ের মত স্নেহ-ভালোবাসা দিতেন।
হাত ভাঙ্গার সময় আলফি বাসায় ছিলেননা। বাসায় ফিরে খবর পেয়ে ছুটে এলেন আমাকে দেখতে। পানি জমে থাকা লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে টানা একঝাড় বকে তবে উনি ক্ষান্ত হলেন। বলতে গেলে, আলফি ই তখন আপুকে অবসর দিয়ে আমার খেয়াল রেখেছিল।

চুল বাধতে গিয়ে আমার কোমড় অবধি লম্বা চুল দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
“বিনুনি করলে গলায় পেচিয়ে শ্বাস আটকে যাবেনা তো!” তার বোকামত প্রশ্নে সেদিন হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছিল। চুল বাধতে পারতনা তাও কোনোরকম পেচিয়ে মাথার উপর আস্ত পিরামিড বানিয়ে বলত,
~ “এটা নিউ হেয়ারস্টাইল, বাজারে খুব চলছে।”

আপুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব ও নিয়ে নিলেন উনি। আমাকে খাওয়াতে গিয়ে আমার হা করার সঙ্গে নিজেও বড় হা করত। উনার এসব ব্যাপারগুলো আমার হাত ভাঙ্গার যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখত।
প্রতিরাতে টের পেতাম আমি ঘুমিয়ে পড়া অবধি উনি সামনের বারান্দায় পায়চারি করতেন, কখনো বা বই হাতে নিয়ে আমার জানালা বরাবর বসে বারবার উকি দিয়ে আমাকে দেখতেন।

কখনো মনে হত গভীর রাতে উনি আমার মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কেটে দিতেন, গায়ের কম্বল ঠিক করে দিতেন কিংবা বৃষ্টি হলে এসে এসি বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু যখন টের পেতাম চোখ খোলামাত্র তাকে দেখতে পেতামনা। মনে হয়েছিল, এটা আমার কল্পনা। গভীররাতে আমার রুমে আসার মত বোকামি উনি অন্তত করবেননা।

হাতের প্লাস্টার খুলে ফেলার পর যখন আস্তে আস্তে হাত নাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম তখন উনি দু হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিচের ঠোট কামড়ে ধরে চোখে একরাশ বেদনা-ভীতি নিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন। মনে হচ্ছিল, আমি হাতে ব্যথা পেলে উনি কোকড়িয়ে উঠবেন।

আলফি হঠাৎ একটা ইন্টারেস্টিং কাজ করলেন। হুট করে রাতের বেলা কল দিয়ে বললেন,
” তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বারান্দায় আসুন, জ্যোৎস্না দেখতে বের হব।” কেন জানি তার মুখের উপর কখনো না শব্দটা বলতে পারতামনা। আমিও বেশ উৎসাহ নিয়ে আকাশী রঙ্গের পাকিস্তানি থ্রি-পিস পড়ে পরিপাটি সাজে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। তিনিও বেরিয়ে মূহুর্তে আমার এক হাতে টেনে রকেটগতিতে ছুটে বাহিরে নিয়ে এল।

চুপচাপ দুজন রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হাটছিলাম আর আড়চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। খেয়াল করলাম উনিও আজ বেশ পরিপাটিরূপ নিয়ে বেরিয়েছেন। কনুই অবধি হাত গোটানো পরনের মিষ্টি রঙ্গে শার্টে ল্যাম্পের হলুদাভ আলোয় উনাকেও দেখতে মিষ্টি লাগছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তার খোচা খোচা দাড়িতে হাত বুলাতে, পরক্ষণে এমন অসভ্য ইচ্ছে ভেবে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আসত। এখন তার ধূসর চোখের দিকে তাকাতে ভয় হয়না আমার, বরং সুযোগ পেলে বারবার লুকিয়ে তাকাই।

উনার সাথে তখন কাটানো মূহুর্তগুলো স্মরণীয় ছিল। ল্যাম্পের আলোতে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে রাতের ছোট্ট শহরটা দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন, রাস্তার ধারে অভূতপূর্ব পরিবেশে ধাবার মজাদার ভিন্ন স্বাদের চা-তন্দুরী রুটি খাইয়েছেন, সবার শেষে আমার উড়তে থাকাখোলা চুলে নিপুনভাবে খোপা বেধে দিয়েছেন। সেই এক এক মূহুর্তের অনুভূতি ছিল স্বর্গীয়তুল্য।

ফোনের অপরপাশ থেকে শোনা খবরটা আমাকে কিছু মর্মাহত করল। চোখে জল নামার বদলে আমার ঠোটের কোণে উপহাসের হাসি ফুটল। এইকারণে আমি বারবার দেশে ফিরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শেষ ভরসা ছিল আমার অনুভূতির দাম সে দিবে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছাদের মেঝে থেকে উঠে দাড়াতে দেখি আলফি আমার পানে কাতরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কিছু বলার আগে একটানে আমাকে তার বুকে টেনে জড়িয়ে রাখল,
~ রেহজান, ফেলা আসা ভালোবাসার মূল্য কি এতই বেশী যে চোখের সামনে বিস্তীর্ণ অনুভূতির ভালোবাসা তুচ্ছ মনে হচ্ছে?

আমি নিচের ঠোট কামড়ে ধরে মাথা উচিয়ে আলফির দিকে তাকালাম। টের পাচ্ছি তার শরীর থেকে থেকে কেপে উঠছে। আবারো কিছু বলতে যাব এর আগে আলফি আমার হাত দুটো তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে ঘনঘন ঢোক গিলে বলল,
~ রেহজান, সেদিনের উপভোগ্য প্রতিটি সুন্দর মূহুর্তের দাম যদি চাই দিবেন?
~ কি চান?

~ এমনি হাজারো অনেক মূহুর্ত আপনার সাথে কাটাতে চাই। আমি কি বলব বুঝতে পারছিলামনা। শুধু ভাবছিলাম আলফির জন্য আমার অন্তরে যা আছে তা কি ভালোবাসা নাকি কেবল আন্তরিকতার টান!
~ আমি একটু সময় চাই নিজের অনুভূতিগুলোকে বোঝার জন্য। আলফি আর কিছু বললনা। ঘন ঘন মাথা নাড়াতে নাড়াতে আমাকে ছেড়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল।
সারারাত মাথার মধ্যে গেথে যাওয়া ভাবনাগুলো আমাকে ঘুমাতে দিলনা। তখনো স্থির হতে পারছিলামনা আলফিকে আমি ভালোবাসি কিনা! পরেরদিন বিকাল গড়ালেও আলফির সাথে আমার আর দেখা হলনা, আপুর কাছে জানতে পারলাম ও কোনো জরুরী কারণবশত সকালে দেশের বাহিরে গেছে। ওখানেই হয়ত থাকতে হবে কয়েক মাস। খুব দ্রুত ফ্লাইট ঠিক হয়েছিল বিধায় কাউকে বলে যেতে পারেনি। বুক ফুড়ে একটা ভারী নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসল, বুকের বা পাশটা কেমন এক অজানা ব্যথায় ছেয়ে গেল।

পর্ব ০৭

আলফি চলে যাওয়ার পর থেকে আমার সময়’টা যেন থমকে গেছে। সবকিছুতে বিরক্তি খুঁজে পাই। ওর শূণ্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখন বুঝতে পারছি আলফি ছিল আমার সব ভালোলাগার একটা উৎস। ওর চিন্তা আমার মাথায় বেশ ঝেকে বসেছে।

প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি সে হয়ত একবার আমাকে ফোন করবে। ওর নাম্বার আমার কাছে থাকা সত্ত্বেও কল দেওয়ার সাহস পাইনা। কতবার কাপা হাতে নাম্বার ডায়াল করেছি কল করার জন্য, কিন্তু দেওয়া হয়নি একবারো। আমার মত শক্ত মেয়ে সব আত্মপ্রত্যয় ভুলে ওর জন্য প্রচন্ড ইমোশোনাল হয়ে উঠছে! কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে এসব না ভেবে আমার মস্তিষ্ক শুধু তার সাথে কাটানো মূহুর্তগুলোকে নাড়া দিচ্ছে।

মনভার নিয়ে আপুর পায়ের কাছে গিয়ে বসি। আপু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, “কিরে, বোর হচ্ছিস?” আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজে’ই বলতে লাগল,
~ আলফি না থাকায় বাসা’টা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ওর মত এত সহজবোধ্য মানুষকে ভাই হিসেবে পেয়ে আমি ভীষণ খুশি। পুরো পরিবারটা’ই আমার স্বপ্নের মত।

আমি কোনোরকম মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম,
~ ” আসলেই। তা তিনি ফিরছেন কবে? কথা হয়েছে তোর সাথে?”
~ নাহ যাওয়ার পর সে ই যে একবার কথা হয়েছিল, আর হয়নি। ফিরতে হয়ত দেরী হবে। আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে উদাসকন্ঠে অস্ফুটস্বরে বললাম, “ওহ।”

সন্ধ্যের মৃদ্যুমন্দ বাতাসে বেলী ফুলের ঘ্রাণ নাকে ভেসে আসছে। আকাশ হলুদটে রঙ ধারণ করেছে তাই চারিপাশের সবকিছু’ই হলুদাভ দেখাচ্ছে। এত সুন্দর পরিবেশটাও আমার কাছে তিক্ত লাগছে। বুকের ভিতর আলফি নামের ব্যথাটা থেকে থেকে বেড়ে উঠছে। মস্তিষ্কে একটা বাক্য বারবার বাড়ি খাচ্ছে।

আমি কি আলফিকে ভালোবাসি? নিজের মন আমাকে প্রশ্ন করল, “তোর এখনো সন্দেহ আছে? যদি না ভালো’ই না বাসতি, তাহলে তার অনুপস্থিতি তোকে এত পোড়াচ্ছে কেন হতভাগী!”
ফোনের টোনের শব্দে আমার ধ্যান ভাঙ্গল। এই শব্দটাকে এখন সবচেয়ে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসতে’ই সব বিরক্তি-খারাপলাগা যেন একনিমিষে উধাও হয়ে গেল।

তাকে আর কথা বলার সুযোগ দিয়ে অনর্গল তার ভালো-মন্দ সম্পর্কিত একগাদা প্রশ্ন করে বসলাম। সে খুব’ই শান্ত গলায় উত্তর দিচ্ছিল এমনসময় ফোনটা কেটে গেল। বারবার ব্যাক করলাম কিন্তু কল ঢুকছেনা। হতাশ হয়ে তার আবার কল দেওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু অনেকটা সময় পার হলেও আর ফিরতি কল এলনা। ভাগ্যটা যেন আমার সাথে তামাশা করছে।

ফোনের ওপাশ থেকে বাবার উৎফুল্ল কন্ঠস্বর, “কেমন আছিস রে মা? আমার রওনক কেমন আছে?”
~ তোমাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। তোমার কন্ঠ এত উদ্দীপ্ত লাগছে কেন বাবা? কোনো ভালো খবর আছে কি!
~ তোর চেয়ে আমাকে ভালো আর কেউ বুঝেনা। ভালো খবর নিশ্চয়ই আছে। তার জন্য তোদের খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরতে হবে। তোর জন্য একটা বড়বাড়ির সম্বন্ধ এসেছে। আমার তো খুব’ই পছন্দ হয়েছে। এখন কেবল তুই ফিরলে দেখা-সাক্ষাত করে বাকিটা এগোব।

কথাটা শুনে আমার শিরা-ধমনীর রক্ত যেন আরো দ্রুত গতিতে ছুটছে। কান দু’টো প্রচন্ড গরম হয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। সাথে সাথে ফোনটা কেটে কপালে দুহাত ঠেকিয়ে উবু হয়ে বসে রইলাম। আমার উতলা কয়েকগুন আরো বেড়ে উঠল “আপনি কবে ফিরবেন আলফি?”

দিন কয়েকের মাথায় আলফি ফিরল। পিপাসায় মৃতপ্রায় ব্যক্তি যখন পানি পেয়ে আনন্দিত হয়, আমার মধ্যে ঠিক তেমনি অনুভূতি প্রাণোদন হচ্ছিল। নিজেকে শক্ত রাখা দায় হয়ে পড়েছিল আমার। ইচ্ছে হচ্ছিল এক্ষুনি তাকে জড়িয়ে ধরে জমানো কথাগুলো বলে ফেলি। কিন্তু সবার সামনে নিজেকে বহুকষ্টে সামলালাম।

এর মাঝে আলফি সুযোগ পেয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলল,
“উপস্থিতি যখন বুঝাতে অক্ষম, অনুপস্থিতি দ্বিগুণ পোড়াতে মোক্ষম।”
কথাটা মানে বুঝতে সময় লাগেনি আমার। সত্য’ই আলফির অনুপস্থিতি আমাকে ভীষণভাবে পুড়িয়েছে তাই তার গুরুত্ব এবং তার প্রতি অনুভূতিগুলো আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। যা তার উপস্থিতিতে আমার কাছে অপ্রকাশ্যমান ছিল।

আলফি ফেরার পর থেকে তাকে আমি একা পাচ্ছিলামনা। তাতে আমার ভিতর’টায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। কতবার তার রুমের সামনে ঘুরে আসলাম। কিন্তু দুলাভাই তার সাথে জরুরী কথাবার্তায় ব্যস্ত। এমনি সময় হঠাৎ আপুর ব্যথা বাড়ে। আপুকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ছুটে যায় দুলাভাই আর আলফি। সাথে আপুর শ্বশুড় ও যায়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে সাথে মেয়েলোক নিতে চায়নি আপুর শ্বশুড়। তাও আপুর শ্বাশুড়ীর অস্থিরতায় বাধ্য হয়ে তাকে সঙ্গে নিল। দুঃশ্চিন্তায় আমি একদন্ড হয়ে স্থির হয়ে বসতে পারছিলামনা। একটা খবরের অপেক্ষায় সারারাত জেগে বসে রইলাম।

মধ্যরাতে দুলাভাই আর আপুর শ্বাশুড়ী ফিরলেন। আশ্বাস দিয়ে জানালেন নরমাল ব্যথা। ডাক্তাররা ডেলিভারির ফিক্সড ডেট দিয়েছেন। সকাল হলে চেক আপ করে আপুকে রিলিজ দিবে। আলফি আর আপুর শ্বশুড় ওখানে’ই আছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিশ্রাম নিতে গেলাম। চোখ দু’টো ঘুমের জন্য বারবার বন্ধ হয়ে আসছে।
সকালে আপু সুস্থাবস্থায় বাসায় ফিরে আসল। আলফির ধূসর চোখ দুটোয় ঘুমহীন রাত্রির ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তখন তেমন কোনো কথা হলনা। সে রুমে গিয়ে গোসল দিয়েই গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল।

ছাদের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। আজ আকাশে কোনো তারা নেই, চাদ থাকলেক তার আলো নিস্তেজ। ধীরব ধীরে পূর্ণগ্রাস হচ্ছে তার। বাতাসহীন এক অন্ধকার থমথমে পরিবেশে এককোণায় পড়ে থাকা আমি চুপচাপ অপেক্ষার প্রহর গুনছি।

পায়ের শব্দে টের পেলাম আলফি আমার পাশে এসে ঠায় দাড়িয়ে আছে। আমি উঠে দাড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ আমার দিকে নিবদ্ধ। সে ছোট্ট করে মিষ্টি স্বরে আমায় ডাকল, “রেহজান।”
আমি একটু কাছে এগিয়ে আসলাম। সে হয়ত আশা করেছিল আমি তাকে জড়িয়ে ধরব কিংবা অনেক প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ করতে করতে আমার চোখ ছলছল করে উঠবে।

আলফি হতাশা আর কৌতূহলের সংমিশ্রণ কন্ঠে বল,
~ রেহজান, আপনি কি নিজের অনুভূতিগুলো বুঝতে পেরেছেন? আমি প্রত্যুত্তরে চুপ করে রইলাম। আলফি এককদম এগিয়ে এসে আমার চোখে চোখে রেখে বলল,
~ আমার অনুপস্থিতি কি আপনার হৃদয় কে নাড়া দিতে ব্যর্থ? আমি কঠিন চোখ-মুখে স্বাভাবিক কন্ঠে’ই তাকে প্রশ্ন করলাম,
~ আপনি কি সত্যিই জ্বীন?
আমার প্রশ্নে আলফি চোখ বিস্ফোরিত হয়ে এল, তার ঠোটগুলোর কম্পন আমি অনুভব করছি। থমথমে পরিবেশটা আমাদের দুজনের নীরবতায় আরো কঠিন হয়ে উঠল।

পর্ব ০৮

নীরবতার দেয়াল কেবল বিস্তৃত হচ্ছে। আলফি এখনো তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করে কিছু একটা ভাবনায় ব্যস্ত। আমার ওর চুপ থাকা সহ্য হচ্ছিলনা। গলার স্বর উচিয়ে পুনরায় বললাম,
~ আমি সত্যিটা বলুন। আপনি আসলে’ই জ্বীন? হ্যা কিংবা না। আলফি চোখ তুলে আমার দিকে একপলক তাকায়। তারপর কিছু না বলে ছাদ থেকে দৌড়ে নেমে যায়। পিছু ডাকলাম কয়েকবার কিন্তু সে কর্ণপাত করলনা।

আমি রিক্তশূন্য মুখে আবার ছাদের মেঝেতে’ই বসে পড়লাম। আলফি কেন উত্তর না দিয়ে চলে গেল প্রশ্নটা আমার মস্তিস্কে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমন একটা অবাস্তব প্রশ্ন কখনো কাউকে করতে হবে আমি ভাবতেও পারিনি। তবে আলফির এভাবে পালিয়ে যাওয়া আমাকে ব্যাপারটা গুরুতর ভাবাচ্ছে।
দেয়ালে মাথা ঠেস দিয়ে চোখ বুজতে’ই কালকে মধ্যরাতের ঘটনা চোখে ভেসে উঠল।

দুলাভাই হসপিটাল থেকে ফেরার পর আমাকে রুমে ডাকলেন। আচমকা এভাবে ডাকতে দেখে আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আপুর গুরুতর কোনো সমস্যা হয়নি তো! সাতপাচ ভাবতে ভাবতে দুলাভাইয়ের দরজায় কড়া নাড়লাম। উনি হাতের কাজ করতে কারতে গম্ভীর স্বরে দরজা লক করে তার সামনে বসতে বললেন। আমি চুপচাপ তার আদেশমত কাজ করলাম। কিছু সময় নীরবতায় কেটে যাওয়ার পর আমি প্রশ্ন করলাম, “আপনার কি আপুর ব্যাপারে কিছু বলার ছিল?”

দুলাভাই ল্যাপটপ অফ করে আমার দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর হয়ে বললেন, “তোমাকে কিছু বলার জন্য ডেকেছি। উত্তেজিত না হয়ে মনোযোগ দিয়ে আগে আমার কথাগুলো শুনবে।” আমি মাথা নাড়লাম।
~ রেহজান, আমি জানি আলফি আর তোমার মধ্যে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশিকিছু চলছে। এই ব্যাপারটায় আমার আপত্তি আছে তা নয়, আমি বরং খুশি ই। কিন্তু যেহেতু তোমরা একে অপরের প্রতি সিরিয়াস, সেহেতু তোমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমি সত্যটা বলতে বাধ্য হচ্ছি।

আমাদের ব্যাপারটা দুলাভাইয়ের মুখে এভাবে শুনে আমি লজ্জায় নেতিয়ে পড়লাম। শেষের কথাগুলো আমার কানে বাজল। কিছুটা অস্থির হয়ে কৌতূহলমিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন করলাম, “কি সত্য?”
~ জানি তুমি এই জেনারেশনের মেয়ে হয়ে কথাটা বিশ্বাস করবেনা তবুও এটা’ই সত্য। আর সত্যটা হল আলফি একজন জ্বীন।

আচমকা কথাটা শুনে আমি অবাক-সন্দেহমিশ্রিত দৃষ্টিতে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম। দুলাভাইয়ের গম্ভীর চেহারা দেখে আমার মনে হচ্ছে না উনি মজা করছেন।
~ আপনি কিসের ভিত্তিতে এত দৃঢ়কন্ঠে এটা বলতে পারছেন? আলফি জ্বীন এটা সুস্থমস্তিষ্কের কেউ কখনো’ই বিশ্বাস করবেনা।

~ তুমি হয়ত জ্বীনদের ব্যাপারে তেমন কিছু’ই জানোনা। তারা মানুষের সাথে এমনভাবে মিশে থাকে, আপাততদৃষ্টিতে তাদের ঠাহর করা মুশকিল। আলফিও তেমন একজন। তাকে দেখতে মানুষের ন্যায় লাগলেও সে জ্বীনজাতির একজন।

আমার কেন জানি এখন রাগ হতে লাগল, সহ্য করতে পারছিলামনা এসব অবাস্তব কথা। রেগে চেচিয়ে উঠলাম,
~ দুলাভাই সে আপনার ভাই। এসব কি বলছেন ভেবে বলছেন তো! আপনার কথাগুলো আমার ভিত্তিহীন মনে হচ্ছে। আপনি বিশ্রাম নিন, আল্লাহ হাফেজ।

উঠে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতে’ই থেমে গেলাম। ঘোরলাগা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম।
দুলাভাই মাথা নাড়িয়ে পুনরায় কথাটা বললেন,
~ ঠিক ই শুনেছো। আলফি আমার আপন ভাই নয়, ইনফ্যাক্ট ও আমার পরিবারের ই কেউ নয়।
আমি ফিরে এসে আগের জায়গাতে ধপ করে বসে গেলাম। আমার শরীর অজানা কারণে কাপছে।

ডানহাতের পিঠ দিয়ে বারবার ঘমার্ক্ত কপাল মুছছি। দুলাভাই আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বললেন,
~ আমরা জাতে ইরানী, খুব ছোট্টবেলায় আব্বা দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে৷ স্থায়ী হয়েছিলেন। তখন পাকিস্তানের শহরগুলো এত ঘনবসতিপূর্ণ ছিলনা। শোনা কথা ছিল প্রায়শ অধিকাংশ বাসা খালি পড়ে থাকত জ্বীনের উপদ্রবে।

“জ্বীনের বাড়ী” নামে খ্যাত এমন এক পরিত্যক্ত বাসায় আমরা উঠি। আব্বা সাহসী ছিলেন এসব জ্বীন-ভূত বিশ্বাস করতেননা। তাই অনেকের বারণ সত্ত্বেও সস্তায় এমন বাসা ভাড়া পেয়ে উঠে যান আমাদেরকে নিয়ে। বাসায় উঠার পর থেকে আমরা আলাদা একজনের অস্তিত্ব খুজে পাই।
এইটুকু বলে দুলাভাই থামলেন। আমি পানি খাওয়া শেষ করে দুলাভাইয়ের দিকে আগ্রহের সহিত তাকালাম। আমার সায় পেয়ে দুলাভাই হাত মুষ্টি করে বলল,

~ সে ছিল নিতান্ত ৫ বছরের বাচ্চা। রাতে উপরতলা থেকে তার কান্নার আওয়াজ আমাদের ভীত করে তুলত। যা দিনের বেলায় শুনতামনা। অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, সে উপরতলা থেকে কখনোই নিচতলায় নামতনা। প্রথম ২দিন আব্বা ব্যাপারটা বিড়ালের কান্না বলে ভেবেছিলেন। তাই আমরাও কেউ উপরতলায় গিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করিনি। যেহেতু আমরা কেবল নিচতলা ভাড়া নিয়েছিলাম, তাই উপরে যাওয়ারঅও দরকার হয়নি।

৩য় দিন আম্মা রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমি আর আমার বোন বাহিরে খেলছিলাম। আম্মার ভাষ্যমতে, সে রান্নাঘরে টুপ করে ঢুকে পড়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে আরবিতে বলে,
~ মা, আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
আকস্মিক এমন ফুটফুটে বাচ্চা দেখে আম্মা ভয় পেলেও তাকে খেতে দেয়। আব্বা খবর পেয়ে কাজ ফেলে বাসায় এসে দেখে ছেলেটি আম্মার কোলে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে।

ঘুম থেকে উঠলে তাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করে। সে শুধু জ্বীনের বাচ্চা, তার নাম আলফি এইটুকু ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেনি। আব্বা তাকে খেদিয়ে দিতে চাইলেও আম্মা পারেননি। এতে আব্বা কড়া শাসন করে বললেন,
~ এই বাচ্চার মা-বাবা আমাদের ক্ষতি করতে পারে। তাছাড়া একে আমরা রেখে আমাদের নিজেদের বাচ্চার ক্ষতি করতে পারিনা।

কিন্তু আম্মা ছিলেন একরোখা। কিছুতেই উনি বাচ্চাটাকে ছাড়বেননা। একে তিনি সন্তানের মত পালন করবেন। আব্বা আম্মার জেদের কাছে হার মেনে নিলেন সেই থেকে আলফি আমাদের পরিবারের একজন। এসব আমি বড় হওয়ার পর জেনেছি, আর কেউ এসব ব্যাপারে অবগত নয়।

দুলাভাইয়ের বলা কথাগুলো সত্য মনে হলেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনোরকমে নিজের রুমে এসে অবশের মত শুয়ে রইলাম। সারারাত এপাশ ওপাশ করেও নিজের মন কে শান্ত করতে পারলামনা। সকালবেলা সিদ্ধান্ত নিলাম সত্যটা আলফির কাছ থেকে জানব। আলফি যদি জ্বীন হয়, তবে সেটা তার নিজের ভালো করে জানার কথা। মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিল, যদি সত্যিই আলফি জ্বীন হয় তাহলে এই সম্পর্কের কি পরিণতি হবে…..
পাশে কেউ বসেছে টের পেয়ে চোখ মেলে তাকালাম। আলফি তখনো মাথা নিচু করে আমার পাশে বসে আছে।

একটু চুপ থেকে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলল,
~ আপনি আমার নিজের একজন। আপনার থেকে সত্যটা লুকিয়ে রাখতে চাইনা। আমি একজন জ্বীন।
কথাটা শুনে আমার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটলনা। হয়ত আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম এমন একটা উত্তর শুনব। ধীরগলায় বললাম,
~ আপনি নিজের জাতির কাছে কেন ফিরে যাচ্ছেন না?

আলফি নাক টেনে নিয়ে ধরাগলায় বলল,
~ বুঝ হওয়ার পর থেকে এই পরিবারটাকে নিজের পরিবার হিসেবে জেনেছি। কখনো মনে হয়নি আমি তাদের মত কেউ নয়। আর আমার জাত-পরিবার! যারা ৫বছরের বাচ্চাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিল একা একটা বাড়ীতে। ৪দিন আমি অনাহারে ছিলাম, মাটির সাথে শরীর লেগে গিয়েছিল।

তাও উপরতলা থেকে সরতাম না এই ভেবে যদি মা-বাবা এসে আমাকে না পায়। সারারাত মায়ের জন্য কাদতাম, আর দিনের বেলা ক্ষিধে নিয়ে ঘুমাতাম। একদিন ক্ষিধে সইতে না পেরে নিচে নেমেছি, মনে হয়েছিল চোখের সামনে যেন মাকে দেখছি। সেদিন থেকে উনি ই আমার মা আর এরাই আমার পরিবার। আমি মনে রাখতেও চাইনি এই পরিবারের ছেলের বাহিরে আমার আর কোনো পরিচয় থাক।

আমি চুপ করে আলফির কথা শুনছিলাম। আলফি হঠাৎ আমার হাতটা তার গালে চেপে ধরে ফুপিয়ে কাদতে কাদতে বলল,
~ আমি আপনাকে হারানোর ভয়ে সত্যটা কখনো আপনাকে জানাতে চাইনি। আমি সত্যি আপনাকে নিজের মানুষ হিসেবে পেতে চাই। অনুগ্রহ করে, জ্বীন বলে আমাকে ফিরিয়ে দিবেননা! আমাকে সারাজীবন আপনার পাশে থাকার সুযোগ দিন।

আমি আলফির কাছ থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। আর এক মূহুর্ত সেখানে না থেকে দৌড়ে রুমে চলে এলাম।
ভিতরে ঢুকে দুলাভাইকে আমার রুমে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি এখানে!”
~ কাল পুরো কথা না শুনে চলে এলে, তাই আরো কিছু কথা বলতে এলাম।
আমি স্বাভাবিক হয়ে তার মুখোমুখি বসে বললাম,
~ বলুন।

পর্ব ০৯

আমার মধ্যে তখনো তিক্ত যন্ত্রণা ঘুরপাক খাচ্ছে। দুলাভাইয়ের কথার দিকে মনোযোগ দেওয়ার মত মানসিকতা পাচ্ছিনা। তাও মেঝের দিকে তাকিয়ে তার কথা শোনার অপেক্ষা করছিলাম। দুলাভাই আমার দিকে একবার তাকিয়ে একটু গলা ঝেড়ে কেশে বলা শুরু করলেন,
~ আমি জানি, তোমরা দুজন গভীর প্রণয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছো। দু’জনার দু’জনকে ছাড়া থাকা কষ্টকর হয়ে পড়বে।

তোমরা যদি চাও সব সত্য আর বাস্তবতা মেনে নিয়ে এক হতে তবে আমি তোমাদের সাহায্য করব। তার আগে তুমি একটু চিন্তা-ভাবনা করে নাও বাস্তবতা মেনে নিতে পারবে তো! জেনে-বুঝে জ্বীনজাতির একজনের সাথে আজীবন কাটানোর সাহস তোমার আছে?

ধরে নিলাম তুমি পারবে। কিন্তু একসময় যদি আলফির মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে কিংবা তার পরিবার তাকে ফিরিয়ে নিতে আসে তখন তুমি কি করবে? আমি চাইনা তুমি তোমার আপুর মত আবেগের ঝোকে ভুল করে বসো। তার মত ক্রেজি হও। তুমি অনেক বুদ্ধিমতী এবং শক্ত ধরণের মেয়ে। তাই যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে জানিও সেই অনুযায়ী আমি পরবর্তী পদক্ষেপ নিব।

আমি আর কিছু বলার সুযোগ পেলামনা। দুলাভাই কথাগুলো শেষ করে বেরিয়ে গেলেন। আমি দরজা আটকে শুয়ে রইলাম। মাথার মধ্যে দুলাভাইয়ের কথাগুলো টাইফুনের মত ঘুর্ণিপাক খাচ্ছে। সত্যি’ই তো এই সম্পর্কের ভবিতব্য কি? অন্য জাতির কাউকে বিয়ে করা জায়েয হবে? আলফির মানসিকতা বা আচরণ কখনো পরিবর্তন হবেনা তার গ্যারান্টি কি? এতগুলো প্রশ্নের উত্তর অন্ধকারে পথ হারানোর পথিকের মত হাতড়ে বেড়াচ্ছি।

এইদিকে একনাগাড়ে ফোনের টোন বেজে যাচ্ছে। আলফি অবিরত কল করায় ফোনটা সাইলেন্ট করে টেবিলের উপর ছুড়ে ফেললাম। মাঝরাতে টের পেলাম কেউ আমার মুখের উপর ঝুঁকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের উপর দু’ফোঁটা চোখের পানি পড়ামাত্র উঠে বসে ল্যাম্প জ্বালিয়ে অবাককন্ঠে বললাম,
~ আপনি এখানে কেন এসেছেন? দরজার দিকে একনজর উঁকি দিয়ে বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করলাম, কিভাবে এলেন? কেউ দেখে নিলে কি কেলেঙ্কারি ঘটবে আপনার ধারণা আছে! এক্ষুনি বেরিয়ে যান।

আলফি প্রতিবারের ন্যায় একটানে আমাকে বুকের কাছে জাপটে ধরে। তার হৃদপিন্ডের প্রতিটি স্পন্দন আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি। কিছুটা সময় যাওয়ার পর এক ধাক্কায় তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। রোষপূর্ণ চাহনীতে তার দিকে তাকালাম। সে আমার কোলে মাথা ঝুকিয়ে বাচ্চাদের মত কাঁদছে আর মিনমিনে গলায় বলছে,
~ ভালোবাসা সংজ্ঞা আমার জানা নেই রেহজান। কিন্তু এই মূহুর্তে আমার কেবল এটা’ই মনে হচ্ছে আপনাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আমি বুঝতে পারি আপনার-ও আমার জন্য অনুভূতি কাজ করে। আপনিও আমাকে চান। কেবলমাত্র আলাদা জাতির জন্য সমস্ত কিছু মিথ্যে করে দিতে চাচ্ছেন।

আপনি আর আমি যদি একে অপরের পাশে থাকি, তবে আল্লাহ চাহে কোনো জাত-বিভেদ আমাদের বিচ্ছেদ করতে পারবেনা। এইটুকু বলে সে মাথা তুলে আমার পানে তাকায়।
আমি প্রাণহীনদৃষ্টি মেলে তাকে জিজ্ঞেস করি,
~ এই সম্পর্কের ভবিতব্য কি? আদৌ আলাদা জাতিতে সম্পর্ক জায়েয? আমাদের আগামী প্রজন্ম সংকটাপন্ন হবেনা তার নিশ্চয়তা আপনি দিতে পারবেন?

আলফি রিক্তশূন্য চেহারায় অসহায় চাহনীতে আমার দিকে তাকাল। আমি আবেগহীন কন্ঠে জোর এনে বললাম,
~ আগে নিজের বিবেকের কাছে এসব প্রশ্ন করুন। আবেগ দিয়ে বাস্তবতা সাজাতে যাবেননা। আপনি প্লীজ এখান থেকে চলে যান। আমি এসব নিয়ে আর কোনো কথা বাড়াতে চাইনা।

আমি খুব শক্ত ধাঁচের মেয়ে। মুখের উপর সোজা কথা বলতে পছন্দ করি। অযথা ইমোশোন দেখাতে পারিনা। এইজন্য অনেকে ভাবে আমি নন-ইমোশোনাল। ইমোশোন দেখাতে পারিনি বলে যাকে অনেকবছর ধরে পছন্দ করে আসছিলাম সে কখনো আমাকে বুঝতে পারেনি। তাই নিজেকে অন্য কারো সাথে জড়িয়ে নিয়েছে।

আলফি যেন এতদিনের আমি’কে বদলে দিল। সবকিছু ভুলে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। আলফি’কে আমি নিজের করে চাই এটা চরম সত্য। কিন্তু বাস্তবতার টানা-পোড়নে মনের সুপ্ত চাওয়াটাকে কবর দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ’ই খোলা নেই। আলফি’র কথায় আমার ধ্যান ভাঙ্গে। চট করে ওড়নায় চোখ দু’টো মুছে নিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকালাম।

ওর দৃষ্টি বাগানের প্রস্ফুটিত বেলীফুলগুলোর দিকে। শেষ বিকেলের সিগ্ধ রোদ ওর মুখে এসে পড়ছে। রক্তবর্ণা রোদে তার চেহারা আরো মায়াময় হয়ে উঠেছে। এলোমেলো চুল আর চোখের নিচে কালশেটে বর্ণ দাগ নিষ্পাপ একটা চাহনী তৈরী করেছে। আমি তার ধূসর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারলামনা। সবভুলে তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছি। দৃষ্টি আমার দিকে এনে আলফি কান্নাজড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে,
~ আপনি সত্যি’ই ফিরে যাচ্ছেন?

~ মায়া বাড়িয়ে কি লাভ যেখানে মায়া ত্যাগ করা উচিত! আলফি থম মেরে যায়। তারপর ছলকে উঠা চোখ বুজে বপড় বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
~ যেতে চাইলে আটকাবনা। আমি আপনাকে কখনো’ই ভুলতে পারবনা। আর কোনোদিন আপনার সামনে না পড়লেও আমার অস্তিত্ব আপনাকে সবসময় আবিষ্ট করে রাখবে। যেখানে’ই থাকবেন, ভালো থাকবেন।

বলে দ্রুতপদে বাসা থেকে বেরিয়ে চলে গেল আলফি। এক অজানা ঘূর্ণিঝড়ে আমার পৃথিবী’টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। নিজের ভিতরে বড় কিছু হারিয়ে ফেলার কষ্ট তীব্র হয়ে উঠছে। এখন আলফি’র বাহুডোর ই যেন আমাকে শান্ত করতে পারে।

ব্যাগ গুছানোর সময় আপু আমার রুমে ঢুকে বিছানার উপর থাকা পাসপোর্ট, ভিসা পেপার ছো মেরে নিয়ে নেয়। আমি অবাক হয়ে বললাম,
~ আপু এসব কি পাগলামী!
~ সেটা আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি এসব কি পাগলামী করছিস তুই? আজীবন উপরের শক্ত ঢালাই দেখিয়ে আমাকে আর কত বোকা বানাবি!
~ আমি কাউকে বোকা বানাচ্ছিনা। আমি চলে যেতে চাচ্ছি আমার এখানে আর ভালোলাগছেনা। এসব নিয়ে কোনো কথা বলিসনা।

~ ঠিক আছে বলবনা। শুধু এটা জিজ্ঞেস করব, আলফি’র দোষটা কি? বাবার মত তুইও ভিনদেশী বলে মানতে পারছিসনা।

~ যা জানিসনা তা নিয়ে কথা বাড়াসনা। আলফি আর আমার মিল কখনোই সম্ভব নয় শুধু এইটুকু জেনে রাখ।
~ সবসময় তোর জেদ-একঘেয়েমি উপরে রেখেছিস। নিজের ভিতরটাকে কখনো বুঝতে শিখিসনি। চলে গিয়ে তুই ভালো থাকবি? আলফিকে কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা এই খবরটা তোর ভিতরকে এতটুকুও নাড়া দেয়নি!
কথাটা শুনে আমি ব্যাগ গুছানো বন্ধ করে আপুর দিকে তাকালাম। মূহুর্তে আমার কি হয়ে গেল টের পেলামনা।

আপুকে কাছে টেনে অনবরত জিজ্ঞেস করলাম। আপু জানাল, কাল বিকালের পর থেকে আলফি বাসায় ফিরেনি। ফোন ও সুইচ অফ। একটু আগে রুস্তম বেরিয়েছে ওর খোজ করতে। না পেলে থানায় জিডি করবে।
আমি রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখি আপুর শ্বাশুড়ী এককোণায় বসে নিশ্চুপে কাদছেন। বাকিরাও চিন্তায় অস্থির।

আপুর শ্বাশুড়ী আমাকে দেখে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। আমার হাত টেনে নিজের রুমে নিয়ে চলে আসেন। তারপর দরজা লক করে কেদে কেদে বলেন,
~ আমাকে যখন আলফি প্রথমবার মা ডেকেছিল আমি সেই ডাকে থমকে গিয়েছিলাম। এত মধুময়, আবেগী ডাক বুকের ভিতর’টা এক শীতল ঠান্ডা অনুভূতি এনে দিয়েছিল। আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। জ্বীনের বাচ্চা জেনেও ওকে নিজের সন্তানের চেয়ে কোনো অংশে কম দেখিনি।

বরং ওর আমার প্রতি ভালোবাসা দেখে মনে হত সে আমার নিজের ছেলে। জ্বীন জেনেও এতগুলো বছর আমি তো ওকে বুকে ধরে লালন-পালন করতে কার্পণ্য করিনি। তবে তোমার কেন তাকে মেনে নিতে এত আপত্তি?
ভবিষ্যতের কথা ভাবছো তো? যেখানে সৃষ্টিকর্তা তোমাদের জুটি বেধে দিয়েছেন সেখানে তুমি কিসের চিন্তায় উতলা! তোমরা দু’জন একে অপরের ভাগ্যে থাকলে, আল্লাহ তোমাদেরকে মিল লিখে রাখলে কি নিয়ে এত সংশয়-দ্বিধা!
আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, সব উনার ইচ্ছেতে’ই হচ্ছে।

আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শুধু মাথায় ঘুরছে, আলফি কোথায়? ওকে ফেরাতে হবে। আমি পাগলের মত বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এলাম আলফিকে খুজতে। কিন্তু কোথাও খুজে পেলামনা। দুলাভাই এসে জানাল উনিও আলফির খোজ পাননি। থানায় জিডি করে এসেছেন, তারা খোজ পেলে’ই জানাবে। শুনে সবাইকে এক বিমর্ষতা আকড়ে ধরল। আমি শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছিলাম, আলফিকে যেন ফিরে আসে।

পর্ব ১০

ঈশান কোণে ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা, চারিদিকে হালকা ঝড়ো বাতাস বইছে। বিকেলটা’কে এখন সন্ধ্যা নামার পূর্বমূহুর্ত মনে হচ্ছে। ছাদের কোণায় দাড়িয়ে রাস্তার ব্যস্ত মানুষগুলোর ছুটোছুটি দেখছি একমনে। কখন যে খোপা আলগা হয়ে চুলগুলো বাতাসে উড়তে শুরু করেছে খেয়াল করিনি।

আপু কিছুক্ষণ আগে নিচে নেমে যাওয়ার জন্য ডাক ছাড়ল। তা আমার কর্ণকুহরে অন্দরে প্রবেশ করলনা। ঠায় একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছি। আলফি অপরাধী চোখ-মুখ নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়াল। আমি তার দিকে ফিরে-ও তাকালামনা। নামার উদ্যোগ নিতে’ই সে দুইহাত প্রসারিত করে আমার পথ আটকাল। মাথা নিচু করে বলল,
~ দুঃখিত। আমার এভাবে সবাইকে চিন্তায় ফেলা উচিত হয়নি। তার কথায় আমার জমানো ক্ষোভ মূহুর্তে বাঁধ ভেঙ্গে কন্ঠে উপচে পড়তে লাগল।

~ আমি নাহয় আপনার কেউ না। আমার চিন্তা করা না করায় আপনার কিছু এসেও যায়না। কিন্তু আপনার পরিবারের কথা তো একবার ভাববেন, যারা এতদিন স্নেহে-যত্নে আপনাকে আগলে রাখল তাদের কষ্টের কথা তো মাথায় রাখবেন।

~ আমি কেবল আপনার করা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজতে গিয়েছিলাম। আর উত্তর নিয়ে’ই ফিরে এসেছি।
~ আমার কোনো উত্তরের প্রয়োজন নেই। আপনি জানেন আমিও আপনাকে নিজের করে আজীবন পাশে চাই। বাকি’টা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তার হাতে ছেড়ে দিলাম। আলফি বিস্ফোরিত নেত্রে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি প্রথমবারের মত স্বেচ্ছায় আলফির হাত ধরলাম।

হাতটা এত তুলতুলে কেন ঠিক যেন একদলা তুলোর পাজড়! আলফি ঠোটে মুচকি হাসি, আর দৃষ্টিতে একরাশ ঘোর লেগে আছে। আমার শক্ত ধাচের রূপের আড়ালের অন্য রুপ দেখে সে হয়ত প্রচন্ড অবাক। আমি তার হাত আমার দুহাতের মুঠোয় রেখে বললাম,
~ আমাদের চলার পথ অন্যান্য দাম্পত্য জীবনের মত এত মসৃণ হবেনা হয়ত। হতে পারে অনেক প্রত্যাশিত কিছু আমাদের অপেক্ষায় আছে। পাশে থেকে একসাথে সব বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়ে লড়াই করতে আপনি প্রস্তুত তো?

আলফি একটানে আমাকে বুকের কাছে জাপটে ধরল। তার বেড়ে যাওয়া শব্দ উত্তোলিত হৃদস্পন্দন আমি অনুভব করতে পারছি। আমার খুলে যাওয়া চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে হালকা বিলি কাটতে কাটতে বললেন,
~ শেষ নিঃশ্বাস অবধি আপনার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। ইনশা-আল্লাহ সব খারাপ সময়ের বিপরীতে আমরা জয়ী হব।

দুই পরিবারের মত নিয়ে আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হল। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বিয়ের কার্য অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সবাই। ভিসাসংক্রান্ত ঝামেলার কারণে আমার পরিবার বিয়ের আগে পাকিস্তানে আসতে পারছেনা। তবে উনারা জানিয়েছেন, বিয়ের তারিখে আসার চেষ্টা করবেন। সম্ভব না হলে বিয়ের পর পর’ই উপস্থিত হবেন।

আমার বিয়ের সকল দায়িত্ব দুলাভাইয়ের উপর অপর্ণ করলেন, দুলাভাই-ও হাসিমুখে দায়িত্বের ভার নিয়ে উনাদেরকে আশ্বাস দিলেন। মা-বাবা, রাফিন আসবেনা জেনে মনটা বিমর্ষিত ছিল। আপু আমাকে ছোট্ট বাচ্চাদের মত বুঝাচ্ছিল। ভীষণ ভালোলাগছিল আমার আবেগী বোনটা আজ দায়িত্বশীলের মত আচরণ করছে। বিয়ের সপ্তাহখানেক আগে আমাকে আগের বাসায় নিয়ে এল আপু। পরিবারের লোকজন দুপক্ষে বিভক্ত হয়ে গেছে। আপু, তার চাচীশ্বাশুড়ী আর ননদ কনেপক্ষ হয়ে আমার সাথে আলাদা বাসায় উঠলেন। দুলাভাই উকিলের কাজ করার দায়িত্ব নিলেন।

সবমিলিয়ে এক অপূর্ব মূহুর্ত পার করছিলাম। বিয়ের সকল আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন হয়ে গেছে। আলফি হাতে হাতে দুলাভাইকে এসব সাহায্য করছে, তাই বিয়ের আগে আমাদের দুজনের ও দেখাদেখি হচ্ছিলনা। টুকটাক কথাবার্তায় তা সীমাবদ্ধ। মেহেদী রাঙ্গা হাত দেখে বারবার চেহারা লাজরঞ্জিত হয়ে যাচ্ছিল। কাল রাতে আমাদের বিয়ে এইকথা ভেবে শিহরিত হচ্ছিলাম। জানিনা, ভাগ্যে কি আছে! তবে সব যেন ভালোই ভালোই হয়ে যায়।
ফোনের স্ক্রিনে আলফির নাম ভাসামাত্র কল রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে ফিসফিস কন্ঠে উপরতলায় আসতে বলা হল। সবার অগোচরে, বাড়ীভর্তি লোকচক্ষু ফাকি দিয়ে উপরতলায় ছুটে এলাম। সারারার ওড়না মাটিটে লুটোপুটি খাচ্ছে সেদিকে নজর নেই আমার।

আলফি মুখ থেকে কালোচাদর সরিয়ে আমার দিকে বিমোহিত চাহনীতে তাকাল। আমি সেই চাহনীতে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গেলাম। আজ আমাকে বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মাঝ বরাবর সিথি করে দুইপাশে কার্লি করে চুল ছেড়ে দেওয়া সাথে ম্যাচিং করে বড় টিকলী-ঝুমকো পড়িয়েছে, পরনে মেরুন রঙ্গের সারারা, হালকা ব্রাইড সাজ আর দুইহাত ভর্তি শুকিয়ে যাওয়া মেহেদী।

আলফি এগিয়ে আমার বামহাতের মাঝখানের আঙ্গুলটা শক্ত করে ধরল আর অস্ফুটস্বরে বলল, আমার জান্নাতের হুর। আমি এইদিক সেদিক তাকিয়ে তাড়া দিলাম,
~ এখন চলে যান। কাল রাত পর্যন্ত আমাকে আপনার বধূরূপে গ্রহণ করার জন্য অপেক্ষা করুন। ঠেলে ঠেলে সিড়ি পর্যন্ত আনতেই আলফি থেমে আমার দিকে ফিরে তাকাল।
মুচকি হেসে স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলল,
~ আমি আপনাকে ভালোবাসি রেহজান।

চারদিক থেকে এক মিষ্ট অবশ অনুভূতি আমাকে আবিষ্ট করে রাখল। আলফি এর আগে কখনো আমার সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলেনি। এতদিনে আমি উর্দু ভাষা প্রায় রপ্ত করে ফেলেছিলাম। আলফির মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনে আমার ভিতরে তোলপাড় শুরু হল। এক পরম ভালোলাগায় ডুবে রইলাম আমি।
পার্লার থেকে আনা মহিলাগুলো আমার সাজ করিয়ে আয়নার সামনে বসাল। একপলক নিজের দিকে তাকালাম, বিয়েটা পাকিস্তানী ট্রাডিশনাল মেনে হচ্ছে বলে সাজ সেই কালচারে দেওয়া হয়েছে।

ভারী পুতি-জরির কাজ করা হালকা মিন্ট কালার গাউন সাথে ভারী কাজের ওড়না, একপাশে সিথি করে টিকলী-জড়োয়া পরিয়েছে, হালকা-ভারী মিলিয়ে গয়না, ব্রাইডাল মেক আপ, খোপায় কয়েকটা গোলাপ ফুল গোজা। প্রতিটি মেয়েকে’ই বউসাজে অন্যরকম সুন্দর লাগে, আমার ক্ষেত্রেও তেমন লাগছে। আর কিছুক্ষণ রওয়ানা দিব, দুলাভাই গাড়ি নিয়ে আসার অপেক্ষা করছি। মেসেজ টোনের আওয়াজে ফোন হাতে নিলাম। শেরওয়ানি পরিহিত অবস্থায় বরসাজে আলফির ছবি আর নিচে ক্ষুদ্র বার্তা।

“তোমার আগমনের প্রতীক্ষায়…..”
আলফি’র ছবি থেকে চোখ সরাতে পারছিনা। নিজের অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে এল মাশা আল্লাহ। সাদা শেরওয়ানিতে ওকে রাজকুমারের মত লাগছে। আলফি যদি এখন আমার সামনে থাকত, নিশ্চিত আমি একনিশ্বাসে কবুল বলার মত ছ্যাচড়ামি করে ফেলতাম।

আপু পাশে এসে দাড়াতে’ই আমার ধ্যান ভাঙ্গল। আপু আমার দিকে তাকিয়ে কপালে ছোট্ট চুমু দিয়ে বলল,
“মাশা আল্লাহ। আমার বোনকে আজ অনিন্দ্য সুন্দর লাগছে।” আমি মুখ রাঙ্গা করে আনন্দে আপুকে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ প্রচন্ড কষ্টে আমার নিঃশ্বাসে টান পড়ল। ধীরে ধীরে আপুকে ছেড়ে দিয়ে পেটের দিকে তাকালাম। সদ্য ক্ষত থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। পুরো গাউন রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। আপু এগিয়ে এসে তার হাতে থাকা ধারালো ছুরি আরো ২-৩ বার আমার ক্ষতস্থানে ঢুকিয়ে বের করে নেয়।

আমি আর দাড়িয়ে থাকতে পারলামনা, মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। ভীষণ যন্ত্রণায় ক্ষতস্থান হাত দিয়ে চেপে রাখলাম। মুখ দিয়ে আমার কোনো কথা বের হচ্ছিলনা। মনে হচ্ছিল আমার কন্ঠটা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। চারপাশ ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছিলাম। একসময় আমার শরীর-চোখ অবশ হয়ে পড়ে, তখন ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম অন্ধকার মৃত্যুর জগতে….

পর্ব ১১

সহসা বড় একটা বেদনার দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইফা। পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখল আর কোনো পাতা অবশিষ্ট নেই। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আধছেঁড়া এবং প্রায় বিকৃত পুরোনো বইটার অপলক তাকিয়ে রইল। রেহজানের করুণ পরিণতির শোক তার ভিতরটায় তান্ডবলীলা চালাচ্ছে। ইফার ঘনিষ্ঠা বান্ধবী জাইমা পাশের চেয়ারটা টেনে বসল, একপলক বইটার দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল,

~ “রেহজানের এমন মৃত্যু কাম্য ছিলনা!” ইফা একরাশ দুঃখ জড়ানো গলায় বলল,
~ শেষ হইয়াও হইলনা শেষ। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে হচ্ছে রেহজান কি সত্যিই মারা গেছে? আলফির কি অবস্থা হয়েছিল? তার বড় বোন কিভাবে পারল এমনটা করতে?
উফফ! আর ভাবতে পারছিনা।

ইফা টেবিলের উপর মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইল। তার মস্তিষ্কের হাজারটা ধাধা তোলপাড় করছে। মাথা তুলে জাইমার খোজে আশেপাশে তাকাল। জাইমা ততক্ষণে দু’কাপ চা নিয়ে হাজির। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ইয়ুশফা বলল, “বইটার নিশ্চয়ই আরো কিছু পাতা ছিল।”
~ আমি ঠিক জানিনা। দাদুর পুরোনো লাইব্রেরির এককোণায় এটা এই অবস্থায় পড়ে ছিল। এতটা বিকৃত অবস্থা দেখেও ইন্টারেস্টিং লেগেছে বলে নিয়ে নিলাম।

~ আচ্ছা এটা কি সত্যি কাহিনী? নাকি কোনো লেখকের কাল্পনিক গল্প?
~ অবশ্যই কাল্পনিক গল্প। জ্বীন কখনো মানুষের প্রেমে পড়ে নাকি? তার উপর বিয়ে, আকাশ-কুসুম কল্পনা প্রায়।
ইফা চা শেষ করে ব্যাগ গুছিয়ে জাইমার বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। এসেছিল গ্রুপ স্টাডি করতে, কিন্তু জাইমার দেওয়া বইটা পড়ার চক্করে আর কিছু করা হলনা। একপলক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত বাসার দিকে পা চালায় সে। বাড়ির সামনে এসে নিচ থেকে উপরের ঘরটায় উকি দেয়। এরপর আবার ঘড়ির দিকে তাকায় সে, ৫ মিনিট লেট হয়ে গেছে। হতাশামাখা মুখে নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় সে।

খবরের কাগজ রেখে ইফার রুমের দরজায় টোকা দেন আশফাক ইবনে সিনার। ইফা ক্লান্তি ঝেড়ে উঠে বসে ভিতরে আসতে বলে। জনাব আশফাক ভিতরে ঢুকে ইফার দিকে তাকায়। ইফার চেহারায় বেশ খানিকটা বিষন্নতার ছাপ। দেখে আশফাকের কলিজা কেপে উঠে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মা তুই ঠিক আছিস?”
~ একদম। শুধু একটু ক্লান্ত। জনাব আশফাক ইফাকে বিশ্রাম নিতে বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসেন। একমাত্র ভাগ্নিকে নিজের মেয়ের মত’ই ভালোবাসেন। ২ বছর আগে ইফার মা-বাবা দুজন অজানা রোগের সংক্রমণে মারা যান। ইফা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেচে ফিরে। তখন আশফাক স্বজন-পরিজনবিহীন ইফাকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে নিজের কাছে নিয়ে আসেন।

উনি একা ছন্নছাড়া মানুষ, জার্নালিজমকে পেশা আর ট্রালেভিং নেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ভালোই আছেন। মা-বাবাহীন মেয়েটাকে কাছে পেয়ে দায়িত্বশীল হতে শিখেছেন সবে। ইফাও বেশ বুদ্ধিমতী এবং চঞ্চল ধরণের মেয়ে। পাকিস্তানের লাহোরের একটা ভালো কলেজে পড়াশোনা করে। এখানে সে নিজেকে সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছে। আশফাক পুনরায় খবরের কাগজে মুখ গুজতে’ই কলিংবেল বাজল। দরজা খুলে বাড়ীওয়ালীকে দেখে রাশভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
~ আপনি অসময়ে কি মনে করে?

~ ইফার জন্য খাবসা নিয়ে এসেছি। মেয়েটা বেশ পছন্দ করে তো।
আশফাক কোনো প্রত্ত্যতুর না করে খবরের কাগজ পড়ায় মন দেয়। ইফা তখন ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দাড়িয়েছে। বাড়ীওয়ালী আন্টিকে দেখে ছুটে এসে তার হাত থেকে বক্সটা নিল। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
~ আন্টি চা বসিয়েছি খেয়ে যাও। মামা তোমাকে এক কাপ দিব? আশফাক আড়চোখে মহিলার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নাড়ালেন।

ইফা দূর থেকে তাদের এই চোখাচোখি দেখে মুচকি হাসল। বাড়ীওয়ালী আন্টি অনেক আগে থেকে তার মামাকে বেশ পছন্দ করে, সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব ও দিয়েছিল। মামা নাকোচ করেছিলেন। আন্টিও দমে যাননি, রোজ একবার মামাকে না দেখে গেলে তার শান্তি লাগেনা। মানুষ হিসেবে আন্টি খুব ভাল, ইফাকে বেশ আদর করেন। এইকারণে মামা বাসা বদলাতে চাইলেও ইফার আপত্তির কারণে পারেনি।

বাসাটা তিনতলা, সামনে কিছুটা খালি জায়গা। তার সাথে একটা সরু রাস্তা। ইফা ও তার মামা নিচতলায় থাকে, দ্বিতীয়তলায় আন্টি ও তার বৃদ্ধ মা। তিনতলায় থাকে এক গোমড়ামুখো ছোকরা। বেশ কিছুদিন আগে উঠেছে। সবার সাথে তার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ইফা কৌতূহলের বশে দু-একবার কথা বলতে চেয়েছে ছেলেটা কোনোরকম ফর্মালিটি সেরে কেটে পড়েছে। এরপর আর ইফা নিজে যেচে কথা বলতে যায়নি। তবে কৌতূহল থেকে ছেলেটার উপর নজর রাখে।

টুকটাক কাজ সেরে পড়তে বসে ইফা। বইয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে রেহজান-আলফি’র কথা। এখন কেন জানি তারও ইচ্ছে করছে একটা জ্বীনকে বিয়ে করতে। সব জ্বীনরা কি আলফির মত ভালোবাসতে জানে? এতটা কেয়ারিং হয়? হঠাৎ মাথায় ভূত চাপে সে ও একটা জ্বীনবর খুজবে। তারপর তাকে নিয়ে আলফির কাছে যাবে। আর বের করবে রেহজানের মৃত্যুর রহস্য। ইস! রেহজান যদি মারা না যেত তবে কত সুন্দর একটা সংসার হত তাদের। রেহজানের কথা ভাবতে ভাবতে বুকটা ভারী হয়ে আসে ওর।

নিজেকে হালকা করার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় ছাদের দিকে। চোখ আটকে যায় ছাদের এক কোণায় দাড়িয়ে থাকে ৬ফুটের বেশী মানুষটাকে। ইফা ধীরে ধীরে গিয়ে তার পাশে দাড়ায়। খানিকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও মানুষটা তার দিকে ফিরেও তাকায়না। বেশ রাগ হয় ইফার, তাও নরমকন্ঠে বলে,
~ শুনেছি সন্ধ্যাবেলা একা ছাদে থাকলে জ্বীন-পরী ধরে বিয়ে করে ফেলে। ছেলেটা ভ্রু কুচকে ইফার দিকে তাকায়, তারপর স্বাভাবিক ভাবে বলে,
~ আপনি কি সেই কারণেই এসেছেন?

~ বেশ বুদ্ধিমান আপনি। আমিও তাই চাই। আমাকে বিয়ে করে নিক তারপর আজীবন পস্তাক।
ইফার কথায় ছেলেটা হাসল। মুক্তোঝরা হাসি যাকে বলে। ইফা মুগ্ধচোখে হা করে তাকিয়ে দেখে। যারা খুব কম হাসে, তাদের হাসিটা’ই বেশী সুন্দর হয়। কথাটা ছেলেটার সাথে যায়। ছেলেটা হাসি থামিয়ে জ্বলজ্বল করা চোখে বলে উঠে,
~ কে পস্তাবে সে যদি তা জানত! সময় থাকতে সর্তক হওয়া ভাল। এমন স্বপ্ন দেখা উচিত নয়, যা একপর্যায়ে কাল হয়ে দাড়ায়।

ছেলেটা মূহুর্তে তরতর করে নিচে নেমে যায়। ইফা অবাক হয়ে একইভাবে দাড়িয়ে ছেলেটার কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করে। অতঃপর নিজমনে ই বলে উঠে,
~ দেখা ই যাক কি হয়! তবে আশা ছাড়ছিনা।

পর্ব ১২

কলেজ যাওয়ার আগে ইফা রাস্তা থেকে তিনতলার বারান্দার দিকে একবার উঁকি মেরে দেখে। বেশ কৌতূহলের বশে’ই প্রতিদিন সে একবার উঁকি মারে। কিন্তু কখনোই ছেলেটাকে বারান্দায় দেখেনা। সারাদিন একটা মানুষ রুমে বন্দি থাকতে পারে সেটা ইফার মাথায় ধরেনা। চোখ বুজে একবার ছেলেটার নাম মনে করার চেষ্টা করে। কি যেন নাম শুনেছিল কিন্তু মনে পড়ছেনা। জাইমা ততক্ষণে ইফার পাশে এসে বসল। ফিসফিস কন্ঠে বলল,
” আমার মনে হয়, আমি একটা ক্লু পেয়েছি।”

ইফা চোখ না তুলে’ই জিজ্ঞেস করে, “কিসের?”
~ রেহজানকে কে মারতে পারে? রেহজান চমকে জাইমার মুখের দিকে তাকাল। বিজয়ের আনন্দে জাইমার চোখ দু’টো চকচক করছে। ইফা চাপা গলায় কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করে,
~ কে মারতে পারে?

~ আলফি। দেখ, আলফি যেহেতু জ্বীন। সে যেকোনো সময় অন্যকে ডাইভার্ট করে নিজের কাজ হাসিল করতে পারে কিংবা অন্যের রুপ ও ধরতে পারে। সো, আলফি রেহজানকে মারার পসিবিলিটি বেশী।
জাইমার এমন কথায় ইফার চোখ কপালে উঠল। সাথে সাথে জাইমার মাথায় গাট্টা মেরে হালকা রাগ দেখিয়ে বলল, ~ ফালতু গবেষণা। আলফি রেহজানকে ভালোবাসে, সে কেন রেহজানকে মারতে যাবে?

জাইমা গাট্টা দেওয়া জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ এটা’ই তো রহস্য মনে হচ্ছে। আর ও হচ্ছে জ্বীন। আদৌ ভাল নাকি খারাপ সেটা তো উল্লেখ করা হয়নি। তাদের মন কখন কোনদিকে ঘুরে যায় তার ঠিক আছে?

ইফা গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। জাইমার কথাগুলোও ফেলে দেওয়ার মত নয়। জ্বীনজাতির সম্পর্কে ও যতটুকু শুনেছে তারা ভালোর চাইতে খারাপ কাজে বেশী ইনভলপ। কিন্তু এটা মেনে নেওয়ার মত না! আলফির যদি রেহজানকে মেরে ফেলার প্ল্যান থাকত তবে এতকিছুর কি প্রয়োজন ছিল? সবকিছু ধোঁয়াশা লাগছে।

ক্লাস শেষ করে বাসায় ফেরার সময় মাঝপথে বৃষ্টিতে আটকে যায় ইফা। একটা ছোট্ট বন্ধ দোকানের ছাউনির নিচে মাথা গুঁজে বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করে। মাথার মধ্যে তখনো গোঁজামিলের ধাঁধা মিলানোর প্রচেষ্টা চলছে। একনজর বাহিরের দিকে তাকায়, বৃষ্টির টিপটিপ ফোঁটাগুলো দেখতে ভালোলাগছে। ছাউনির বাহিরে হাত বাড়িয়ে দেয়, বৃষ্টির ফোঁটা তার হাতের তালুতে জমা হচ্ছে।

হঠাৎ একটা প্রশ্ন মাথায় আসে ওর, আচ্ছা জ্বীনরা তো আগুনের তৈরী! তবে পানি লাগলে কি তাদের কোনো সমস্যা হয়? ওর ঝুলিতে যে জ্বীন সম্পর্কে কত কৌতূহলী প্রশ্ন জমা আছে! যদি কোনো জ্বীন দূর্ভাগ্যক্রমে তার মুখোমুখি হয় তবে প্রশ্নের আঘাতে’ই নিশ্চিত ছিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে। ভেবে মুচকি মুচকি হাসে।

অনেকক্ষণ পর ও বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখলনা তখন সিদ্ধান্ত নিল বাসার দিকে এক দৌড় দিবে। এক দৌড়ে নিশ্চয়ই খুব বেশী একটা ভিজবেনা। সাধারনভাবে মাথায় দেওয়া শিফনের ওড়নাটা ভালো করে পেচিয়ে নেয়। তারপর ব্যাগটা বুকের কাছে ঝাপটে ধরে দৌড়াতে থাকে সরু রাস্তায়। খানিকটা দৌড়ার পর পা পিছলে রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে যায়। তাতে পুরো শরীর কাচা কাদায় মাখামাখি। নিজের এই অবস্থা দেখে তার রীতিমত কান্না পেল।

উঠার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার পড়ে যায়। একা একা উঠতে পারছেনা। হঠাৎ কারো খিলখিল হাসি শুনে পিছনে ফিরে তাকায় সে, গোমড়ামুখো ছেলেটা ছাতা মাথায় তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এটা দেখে তার জোরে জোরে কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু চোখ আটকে যায় গোমড়ামুখোটার বামপাশের টোলে। ইফাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি বন্ধ করে বড় ফ্রেমের চশমাটা আরেকটু ঠেলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হয়। পিছন থেকে ইফা কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলে,
~ আমি বাসায় যাব!
ছেলেটা ফিরে তাকিয়ে বলল, “তো যান।”

~ আমাকে টেনে তুলুন। ছেলেটা হকচকিয়ে উঠে বিরক্তিমাখা চেহারায় হাত বাড়িয়ে দেয়। ইফার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যায়, নিজে উঠে দাড়িয়ে ছেলেটাকে টান দিয়ে ফেলে দেয়। ছেলেটার হাত থেকে ছাতা ছিটকে অদূরে পড়ে যায়। ছেলেটা কাদামাখা মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে হালকা থরথর করে কেপে উঠছে, চোখ-মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। যতটা সম্ভব হাত দিয়ে নিজেকে বৃষ্টির ফোঁটা থেকে বাচানোর চেষ্টা করছে।

ইফা ছেলেটার এই অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। দ্রুত ছাতা নিয়ে এসে ছেলেটার দিকে এগিয়ে দেয়। ছেলেটা ছাতা মাথায় দিয়ে উঠে দাড়িয়ে ইফার দিকে রোষানল দৃষ্টিতে তাকায়। ইফা চোখ নামিয়ে নেয়, এই দৃষ্টি তাকে ভস্ম করে দিবে মনে হচ্ছে। ছেলেটা গটগট করে হেটে মূহুর্তে চোখের আড়াল হয়ে যায়। ইফা তার হাটার সাথে তাল মিলাতে সক্ষম হলনা।

ইফা অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে তিনতলায় ছেলেটার ঘরের সামনে আসে। কাপা কাপা হাতে কয়েকবার দরজায় টোকা দিল। কিছুক্ষণ পর ছেলেটা বেরিয়ে আসে। ইফা এক্নজর ছেলেটার দিকে তাকায়। চশমা ছাড়া গোমড়ামুখোকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। ফর্সা চোখ-মুখ এখনো লাল হয়ে আছে। পরনে হোয়াইট টি-শার্ট আর ব্লু ট্রাওজার। ভেজা হালকা লালচে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।

ইফাকে দেখে ছেলেটা বাজখাঁই গলায় বলল, ‘কি চাই?’ ইফা চোখ নামিয়ে অনুশোচনা নিয়ে বলল, ‘তখনকার ঘটনার জন্য দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি বৃষ্টিতে আপনার সমস্যা হয়।’ ছেলেটা প্রত্যুত্তরে কিছু বললনা। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ইফার অভিমান হয় বিড়বিড় করে বলে, ‘ চল্লিশ ডাকাতের গুহার দরজা পাইসে উনি। সারাদিন আটকে রাখতে হয়।’ বলে দরজায় একটা কষে লাথি মারে।

ভিতর থেকে বাজখাই গলার আওয়াজ আসে। কালক্ষেপন না করে দৌড়ে নিচে নেমে আসে।
আশফাক সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে চা খাচ্ছেন। তামাম দুনিয়ার এই একটা জিনিসে তিনি খুব মনোযোগী। এই সময় তার সামনে টর্নেডো হয়ে গেলেও তার হুশ হবেনা। ইফার মনে হয়, চা খাওয়ার সময় মামা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেন।

ইফা গালে হাত দিয়ে মামার চা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। চা শেষ হওয়ার আগে সে যত কথা ই বলুক মামার হু-হা উত্তর ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবেনা।

অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে যায় ইফা, এই এক চাপ চা শেষ করতে মামা ঘন্টাখানেক সময় লাগিয়ে দিবেন। ‘মামা তোমার চায়ে তেলাপোকা পড়েছে’ বলে চায়ের কাপটা হাত থেকে কেড়ে নেয় ইফা। আশফাক সাহেব লাফিয়ে উঠে এগিয়ে আসে, ‘কই দেখি দেখি!’
~ দেখতে হবেনা, তেলাপোকা সহ খাবে নাকি? আমি ফেলে দিয়ে আসছি।
~ আরেক কাপ নিয়ে আয় তাহলে।

~ চায়ের ফ্ল্যাক্স খালি, আবার বানাতে হবে। সন্ধ্যায় খেয়ো।
আশফাক সাহেব সেটা শুনে দুঃখী মুখ নিয়ে সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ে।
~ মামা, তুমি জ্বীনে বিশ্বাস করো?
আশফাক সাহেব তড়িঘড়ি করে লাফিয়ে উঠে বসে কাচুমাচু কন্ঠে বলে, “অবশ্যই।”
ইফা কৌতূহলী কন্ঠে বলে, “তুমি কখনো দেখেছো?”

~ দেখিনি, শুনেছি আমার জেঠা দেখেছেন, ইয়া বড় দানবের মত। হাতির মত কান, আগুনের মত চোখ। জোকারের মত নাক, গোপাল ভাড়ের মত ভুড়ি। মাথায় ষাড়ের মত দুখানা শিং। আমার জেঠা যখন মাঝরাতে তাজা মাছ নিয়ে বাজার থেকে তেতুলগাছের নিচ দিয়ে ফিরছিলেন তখন জ্বীনটা তার সামনে দু’পা চেগিয়ে দাড়ায়। বলে কি জানিস, আমাকে মাছ দিয়ে দে নাহলে আমার পায়ের নিচে দিয়ে যা।

জেঠা ছিল খুব বুদ্ধিমান। বলে, মাছ দিয়ে দিব। কিন্তু আগে আমি বাড়ি পৌছাই তারপর। নাহলে গ্যারান্টি কিআপনাকে মাছ দেওয়ার পর আমাকে মারবেন না?
জ্বীনটা রাজি হল। জেঠা বাসায় ফিরে মাছ রেখে খুন্তি গরম করে বাহিরে এসে জ্বীনকে বলে, আপনি চোখ বন্ধ করে হা করুন আমি আপনার মুখে মাছ ঢুকিয়ে দিচ্ছি।

জ্বীন সেটাই করে, খুন্তি ঢুকানোর সাথে সাথে লাফাতে লাফাতে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। পরদিন জেঠা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে উঠানে একটা কাক মরে পড়ে আছে। কাকটা আসলে ওই জ্বীন ছিল বুঝলি।
ইফা হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ে। ছোটবেলা থেকে মা-বাবা বান্ধবী সহ ১৪ গুষ্টির কাছে একই গল্প শুনতে শুনতে তার কানে তালা লেগে গেছে। সে আজও বুঝতে পারেনা ঘটনাটা আসলে কার?

‘আলফির মত একটা জ্বীনকে স্বামী হিসেবে পেলে মন্দ হতনা। মানুষের চেয়ে জ্বীনরা বেশী কেয়ারিং। আর আলফি তো কোনোভাবেই রেহজানকে মারতে পারেনা। তার বোন রওনক আগে জ্বীনের জন্য ক্রেজি ছিল, সে কি তবে হিংসা থেকে এমন করেছে? কিন্তু সে নিজের স্বামী নিয়ে তো সুখেই ছিল।’ ইফা বাহিরের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছে। হঠাৎ তার মাথায় আসে, এই রাতেরবেলা চুল ছেড়ে ছাদে বসে থাকলে কি জ্বীন দেখা দিবে?

ইফা ধীরপায়ে ছাদের দরজা কাছে দাড়ায়। দরজা ভেজানো দেখে ভাবে আন্টি তাহলে এখনো দরজা আটকায়নি। ছাদে ঢুকে একদম কোণায় গিয়ে বসে। বাসার পাশের মস্ত বড় দেবদারু গাছের অর্ধেক ডালপালা ছাদের এই কোণায় ছড়িয়ে আছে। ইফার পরনে লাল ফতুয়া আর কালো লেগিংস। ঠোটে একটুখানি লাল লিপস্টিক মেখে এসেছে। চুলের খোপা খুলে পিঠের উপর ঘন কালো কোকড়া চুল ছড়িয়ে দিয়েছে।

আজ সে এক্সপেরিমেন্ট করবে এসব করলে আসলেই জ্বীন আসে কিনা!
কোণায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা সহকারে বসে আছে সে। বৃষ্টি হওয়াতে আবহাওয়া আজ তুলনামূলক ঠান্ডা। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে ইফার শরীর ভয়ে কাটা দিচ্ছে। তবুও সে নামছেনা, আজ একটা ফলাফল দেখে ছাড়বে। হঠাৎ করে ইফার চারপাশ কেমন জানি ভারী লাগছে, আগের চেয়ে বেশী ঠান্ডা অনুভব করছে।

তার মনে হচ্ছে সারা ছাদময় কেউ ধীরে ধীরে হেটে বেড়াচ্ছে। তার মাথাটা হালকা ভার লাগছে, শরীর অসারশূন্য হয়ে আসছে। ইফার আর থাকতে ইচ্ছে হলনা। দৌড়ে দরজার কাছে এসে খোলার চেষ্টা করে দেখে দরজা আটকানো। তার ভয় ক্রমশ বাড়ছে। চোখে পড়ল ছাদের কোণা থেকে একটা ভয়ংকর কালো আবয়ব তার দিকে এগিয়ে আসছে। ইফার চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু কেন জানি করতে পারছেনা। ভয়ে থরথর কাপছে সে, হৃদপিন্ড এত অস্বাভাবিকভাবে লাফাচ্ছে যে মনে হচ্ছে এক্ষুনি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে।
অবয়ব টা তার মুখোমুখি এগিয়ে এসে সজোড়ে ইফার বামগালে একটা থাপড় দেয়।

পর্ব ১৩

সকালের কাঁচা রোদ চোখে পড়তে’ই চোখ মেলে উঠে বসল ইফা। চারদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল, সে ছাদের এক কোণায় বসে আছে। কাল রাতের ঘটনা মনে পড়তে’ই বা’গালে টনটন ব্যথা অনুভব করল। ধীরে ধীরে উঠে ছাদের দরজার কাছে আসে। দরজা কাল রাতের মত ভেজানো আছে।

কেমন এক ঘোরের মধ্যে আছে ইফা! নিষ্প্রভ দেহে ধীরে ধীরে ছাদ থেকে নেমে নীচতলায় এল। উকি দিয়ে দেখল তার মামা এখনো ঘুমাচ্ছে। রুমে ঢুকে সোজা ওয়াশরুমে গেল। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাড়াল। হলদে ফর্সা বা’গাল টকটকে লাল হয়ে আছে। চুলগুলো বেশ এলোমেলো, জামার গলা ভিজে আছে। বেশ জোরে ঘষে লিপস্টিক উঠানোর ফলে ঠোটগুলো হালকা ফুলে লাল হয়ে গেছে।

ইফা ড্রেস চেঞ্জ করে মিষ্টি রঙ্গের কামিজ পড়েছে। চুলে হাত দিয়ে জট খুলতে খুলতে বারান্দায় এসে দাড়াল। সূর্য তখন পূর্বের দিকে আকাশে তার আলোর ছটা ছড়িয়ে দিয়েছে। ইফার মন বেশ ভার। তার মোটেও কাল রাতের ঘটনাকে স্বপ্ন মনে হচ্ছেনা। এসব যে বাস্তবে ঘটেছে বা’গালের লাল আভা তার প্রমাণ। কিন্তু অকারণে এত জোরে থাপড় কেন দিল! ভেবে’ই ফ্যালফ্যাল কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে ইফার।

এমন নির্দয় জ্বীনের জন্য সে এত কষ্ট করেছে! নিজেকে নিজে ধিক্কার দিচ্ছে। যদি ওই ব্যাটা এখন তার সামনে আসত, সে বুঝিয়ে দিত ইফার মাইরের পাওয়ার। চুল কোনোরকম পেচিয়ে ঘরে ঢুকার সময় দেখল গোমড়ামুখো তিনতলা’র বারান্দায় ঝুঁকে দাড়িয়ে আছে। অন্যসময় হলে হয়ত কৌতূহল দেখিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলত কিন্তু এখন সে নীরবে প্রস্থান করল। আর সেটা ছেলেটার চোখ এড়ালনা।

সারাদিনটা ইফা রুমের এককোণে বসে কাটিয়ে দিল। কেবল চড় খাওয়াতে তার মন ভার তা নয়, সে ভাবতে পারেনি জ্বীন’রা এত নির্দয় হতে পারে। জ্বীনবর পাওয়ার ইচ্ছে তার চড় খাওয়ার পর ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এসব নিয়ে ভবিষ্যতে আর না ভাবার বড়সড় প্রতিজ্ঞা করেছে। মন একটু হালকা হতে’ই সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তখন গোমড়ামুখো বাহিরে থেকে এসে গেইট আটকাচ্ছে।

ইফার দিকে চোখ পড়ামাত্র উপহাসের হাসি দিয়ে বলল, ‘কেমন হল জ্বীনের উপর এক্সপেরিমেন্ট?’ ইফা মনে মনে অবাক হলেও সেটা চেপে রেখে স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘জ্বীন তো বিজ্ঞানের কোনো বিষয়-বস্তু নয় তার উপর এক্সপেরিমেন্ট করা যাবে!” পুনরায় চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কিভাবে জানলেন?” ‘মাঝরাতে আমার বারান্দার সামনে দিয়ে অত সেজেগুজে ছাদে উঠলে বরং না জানা ই অস্বাভাবিক।’ ছেলেটা আর কথা বাড়ালনা। শিস দিতে দিতে উপরের দিকে চলে গেল। ইফা চোখ ছোট ছোট তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, ‘ছেলেটার মতি-গতি ভালো ঠেকছেনা।’

“সব জ্বীনরা আলফির মত হয়না কেন? হলে একজনকে আমি সিউর বিয়ে করে নিতাম। তার পিঠে চড়ে পুরো দুনিয়া চষে বেড়াতাম।” ইফার কথা শুনে জাইমার হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল। ইফা ভ্রু কুঁচকে জাইমার দিকে তাকাল, জাইমা কোনোরকম হাসি চেপে বলল,
~ ” জ্বীনকে তুই পঙখীরাজ ঘোড়া পেয়েছিস?”

ইফা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ওর সামান্য ইচ্ছে’র কথা শুনে জাইমা যেভাবে উপহাস করল, কাল রাতের ঘটনা শুনলে তো ইজ্জত রাখবেনা। তাই ইফা সেসব কথা মালুম চেপে গেল। জাইমাকে নিয়ে ছাদে উঠার সময় গোমড়ামুখোর মুখোমুখি হয় ইফা। জাইমা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,
~ কে এই সুর্দশন যুবক?

ইফা ঠিক যে ভয় পেয়েছিল তাই হল। ছেলেটা জাইমার সামনে কালকের ঘটনার ঝুলি খুলে দিল। ‘এক্সপেরিমেন্ট করে জ্বীনের দেখা পেয়েছিলেন?’ কথাটা শুনে জাইমা ইফাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই জ্বীনের এক্সপেরিমেন্ট করেছিলি? আমাকে তো একবারো বললিনা।’ গোমড়ামুখো এইটুকু বলে ক্ষান্ত হলনা, ইফার দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলল, ‘ আপনার বা’গাল এমন লাল হয়ে আছে কেন? কেউ মেরেছে নাকি?’

ইফা দাঁত কটমট করতে করতে নিচে নেমে আসে। ছেলেটার কথা শুনে জাইমা ইফা বেশ ভালোভাবে চেপে ধরল। অগত্যা ইফা জাইমাকে সব আদ্যপাদন্ত খুলে বলল। জাইমা দুঃখীভাব নিয়ে বলল, ‘বলেছিলাম এসব করতে যাসনা। এখন কেউ জানলে কি বলবে- জ্বীনের হাতে থাপড় খেয়ে ইফা অজ্ঞান।’ ইফার বেশ রাগ হচ্ছে। মন হালকা করার জন্য জাইমাকে নিজের বাসায় ডাকাটা’ই ভুল হয়েছে। ওর মান-সম্মান সব ডুবল। এখন জাইমার সামনে জ্বীনের কথা উঠলে সে এসব বলে লজ্জা দিবে। ইফা কঠিন চেহারায় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তিনতলা’র বারান্দার দিকে তাকায়। কাপ হাতে গোমড়ামুখো বোকামত হাসি দিয়ে ওর তাকিয়ে হাত নাড়ায়।

মনে মনে বলে, ‘এবার যদি মেয়েটা ক্ষান্ত হয়!’
ইফার বা’গালের দিকে লক্ষ্য করলেন আশফাক সাহেব। কিছুটা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ গালে কি হয়েছে?’ ইফা অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দেয়, ‘জ্বীনের বাচ্চা জ্বীন মেরেছে।’ পরক্ষণে হুশে এসে বলল, ‘বৃষ্টিতে মশা বেড়েছে মামা। ঘুমের ঘোরে মশা মারতে গিয়ে এই অবস্থা।

‘ মামা হো হো করে হেসে বলল, ‘মশাকে এত জোরে মারলে পোস্টমর্ডেম করার জন্য তার বডি স্ট্রাকচার ও পাওয়া যাবেনা।’ ইফার খুব বিরক্ত লাগছে। চারিদিকের সবাই যেন ওকে নিয়ে তামাশায় মেতেছে। এর মাশুল তো দিতে হবে ওই ব্যাটাকে।

সারাদিনে অনেকবার করা প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে রাতে আবার গেল ছাদে। সাথে পাড়ার বাচ্চাদের থেকে ধার করা দু-তিনটা ক্রিকেট ব্যাট ও নিয়েছে। ছাদে দাড়িয়ে ব্যাট ঘুরাতে ঘুরাতে ভাবল, ‘আজ সব ছক্কা মারবে।

‘ ছাদের দরজায় দুই হাত বন্ধনী করে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে ছেলেটা। দৃষ্টি ইফার দিকে নিবদ্ধ। তার ঠোট হালকা ডানদিকে প্রসারিত। ইফা বিড়বিড় করতে করতে দু হাতে দুইটা ব্যাট নিয়ে ছাদে এই মাথা থেকে ওই মাথা পায়চারি করছে।

মাঝে মাঝে দাড়িয়ে হাত-পা ছুড়ছে। ছেলেটা দুইদিকে দুইবার মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল, “এই মেয়ে সহজে দমে যাওয়ার নয়।” ইফা এই সময় গোমড়ামুখোকে ছাদে দেখে ভয়ে কিছুটা দমে গেল। ছেলেটা ব্যাটের দিকে দৃষ্টি নিপাত করে বলল, ” জ্বীনের সাথে ক্রিকেট খেলতে এসেছেন? বল এনেছেন তো?”
~ আপনি এখানে কি করেন?

~ আপনার সহযোগী ব্যাটম্যান হতে এসেছেন। দৌড়ে দৌড়ে রান নিব। জ্বীন এখনো আসেনি? খেলা কখন শুরু করবেন? ইফা চোখ রাঙ্গিয়ে বলল, ‘মজা করেন? আমি ব্যাট দিয়ে খেলতে নয় মারতে এসেছি বজ্জাতটাকে। আসুক আজকে সামনে।’
~ অনেক শক্তি আপনার। ভয় পাবেননা?

~ আমার ডিকশনারীতে ভয় নামক কোনো শব্দ নেই। আজকের পর ওই শালা আমাকে ভয় পাবে। ছেলেটা একটু চুপ রইল। তারপর চিৎকার করে ছাদের দরজার দিকে একদৌড় দিল। ইফা খানিকটা হতভম্ব হয়ে ব্যাট ফেলে চিৎকার দিয়ে নিজেও লাফাতে লাফাতে দৌড়াল। তিনতলার বারান্দায় এসে হাপাতে হাপাতে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “এভাবে দৌড়ালেন কেন?”

~ এক্সারসাইজ করলাম। আপনি কেন দৌড়ালেন? ইফা ছেলেটার কথা শুনে বোকাবনে গেল। ক্রোধান্বিত হয়ে বিড়বিড় করতে করতে নিচে নেমে গেল।

ইফা চুপিচুপি পা টিপে টিপে গোমড়ামুখোর রুমের সামনে এসে দাড়াল। দরজায় সচরাচরের মত তালা দেওয়া। ইফা বুঝে উঠতে পারেনা, ছেলেটা এত কড়াকড়ি সাবধানতা কেন অবলম্বন করে? ছেলেটার মধ্যে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। ইফা ঘুরে ছাদের চিলেকোঠার দিকে যায়।

ওখানে তিনতলার রুমের একটা ব্যাকআপ জানালা আছে। জানালার কাছে এসে দাড়ায় ইফা। জানালার কাঁচের অবস্থা ভালো নয়। জায়গায় জায়গায় ফেটে আছে। বড় ফাটা জায়গায় চোখ রাখল সে।

ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই আঁধারের মধ্যে পাশের রুম থেকে সুক্ষ্ম হলদেটে আলো এসে পড়েছে। ইফা আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য চোখ সরিয়ে অন্য ফাটা অংশে রাখবে এমনসময় দেখল সেই আলোতে একটা নারীমূর্তির ছায়া পড়ছে। ইফা আরেকবার দেখার আগে ছায়াটা চোখের পলকে সরে গেল।

সে চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে ভাবতে লাগল, এতদিন জানত গোমড়ামুখো এই বাসায় একা থাকে। কিন্তু তার সাথে কোনো মেয়ে আছে সেটা সে গোপন রাখল কেন? আর থাকলে মেয়েটা কেন বেরিয়ে আসেনা। অদ্ভুত রহস্যময় ব্যাপার। আরেকটু পর্যবেক্ষণ করতে হবে, আরো গভীরে যেতে হবে।

পর্ব ১৪

জাইমা আর ইফা বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে গল্প জুড়েছে। জাইমা গল্প করায় ব্যস্ত থাকলেও বারবার চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরাচ্ছে।

তা অবশ্য ইফার চোখ এড়াচ্ছেনা। একসময় কথায় কথায় জাইমা প্রশ্ন করল, ‘ইফা সেই সুদর্শন ছেলেটা কোথায়?’ ইফা বিরক্তিমাখা গলায় বলল, ‘জানিনা।’ জাইমা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করে, ‘তার নাম?’ ইফা আবার উত্তর দেয়, ‘তাও জানিনা।’

জাইমা ইফার মাথায় গাট্টা দিয়ে বলল, ‘মাথার উপরে এত সুদর্শন বালক থাকে তার সামান্য খোঁজ রাখিসনা। উপরন্তু নামও জানিসনা। জ্বীন ছেড়ে মানুষের দিকে তো একটু নজর দে।’ ইফা প্যাঁচার মত মুখ করে বলল, ‘আই এম নট ইন্টারেস্টেড!’ জাইমা এবার খোঁচা মেরে বলল, ‘যার উপর ইন্টারেস্ট ছিল তার হাতে চড় খেয়ে অজ্ঞান হলি।

তোর তাও সৌভাগ্য অন্তত চড়ের অজুহাতে জ্বীন তো দেখলি।’ ইফার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, দাত-মুখ খিচে মনে মনে গোমড়ামুখো আর বজ্জাত জ্বীনকে বকা দিতে লাগল। এসব অপমান আর নেওয়া যাচ্ছেনা। বজ্জাত জ্বীনকে একটা শিক্ষা দিতে’ই হবে। এমনসময় গোমড়ামুখো বাহিরে থেকে ভিতরে ঢুকে গেইট আটকাল। জাইমা চায়ের কাপ ফেলে ছুটে গেল তার দিকে। ইফা অনিচ্ছাসত্ত্বেও গোমড়ামুখোর দিকে তাকায়।

তার ঘমার্ক্ত চেহারায় একরাশ উজ্জ্বলতা আভা দীপ্তিমান। পরনের বেগুনি রঙ্গের শার্ট ভিজে শরীরের সাথে এটে আছে। জেল দিয়ে একসাইড করে রাখা চুল থেকে দু-একটা কপালের সামনে চলে এসেছে। গোমড়ামুখো একবারো সরাসরি জাইমার দিকে তাকাচ্ছেনা, মাথা নিচু করে কথা বলছে।

দু-একটা কথা হতে’ই ব্যস্ততা দেখিয়ে কেটে পড়ল সে। জাইমা মোহময় দৃষ্টিতে একপলক গোমড়ামুখোর দিকে তাকিয়েই রইল। জাইমার এমন আচরণে ইফা শরীরটা জ্বলে উঠল। তাড়াতাড়ি জাইমাকে একপাশে টেনে এনে জিজ্ঞেস করল, “এর সাথে এত ফুসুরফাসুর কিসের?” জাইমা উৎফুল্লিত হয়ে বলল, ‘দেখেছিস, কত সুন্দর লাগছিল তাকে! এবার বোধহয় আমার একাকিত্বের অবসান ঘটবে।

তুই কিন্তু এই ব্যাপারে আমাকে হেল্প করবি।’ ইফা মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল, ‘আমার বয়ে গেছে। আমাদের ভাড়াটিয়ার দিকে নজর দিবিনা।’ জাইমা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে, ‘এমনভাবে বলছিস যেন তোর জ্বীনবরের দিকে নজর দিচ্ছি। আমার বাবা জ্বীনবরের দরকার নেই, যা দিনকাল পড়েছে ওর মত একটা মানুষবর হলেই যথেষ্ট।’ গোমড়ামুখোর প্রতি জাইমার এমন গদগদ ভাব ইফার বিরক্ত লাগছে। কেন জানি সে চাচ্ছেনা জাইমা ছেলেটাকে নিয়ে এসব বলুক।

আশফাক সাহেব চা শেষ করে বইয়ে মুখ গোঁজামাত্র বাড়ীওয়ালী আন্টি এসে ইফাকে ডাকলেন। ইফা রান্নাঘর থেকে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল। আন্টির দিকে তাকিয়ে সে থ হয়ে দাড়িয়ে রইল। আন্টি লেমন কালারের শাড়ি পড়েছে, চুলগুলো খোপা করে চোখে একটু কাজল ও ঘষেছে বোধহয়। তাকে এতটা মাধুর্যময়ী লাগছে যে কেউ দেখলে তাকে বাঙ্গালি মেয়ে ভেবে ভুল করতে বাধ্য। ইফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আন্টি তুমি হঠাৎ শাড়ি পড়েছো?

‘ আন্টি খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল,
‘ কেন দেখতে কি খারাপ লাগছে?’ ইফা দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘একদম না।’ ইফা আশফাক সাহেবের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। উনি হা করে বাড়ীওয়ালীর দিকে একপলকে চেয়ে আছেন। ইফা যা বুঝার বুঝে নিল, তার এখন কেটে পড়াই শ্রেয়। চুপচাপ ছাদের দিকে পা বাড়াল সে।

আসলে প্রেম মানুষকে অনেক বদলে দেয়। যেমনটা বদলে দিয়েছিল আলফিকে। উর্দুভাষী হয়েও রেহজানের জন্য শুদ্ধ বাংলায় ভালোবাসি বলা শিখেছিল। আর সারাজীবন লাউন আর স্কার্ট পড়া আন্টি আজ মামার জন্য শাড়ী পড়েছে। শুধু তার জীবনেই প্রেম এলনা। মনে হচ্ছে জ্বীনবর না পাওয়ার শোকে তাকে আজীবন চিরকুমারী ই থাকতে হবে। ছাদের এককোণে গোমড়ামুখোকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে ইফা।

তাকে ঘাবড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পিছন থেকে শক্ত করে মুখ চেপে ধরে ইফা। গোমড়ামুখো তাতে একটুও বিচলিত না হয়ে ইফার হাত বাকিয়ে সামনে টেনে আনল। ইফা কোনোরকম নিজেকে ছাড়িয়ে লাফিয়ে হাতটা নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘জ্বলে গেল রে। ওই ছেলে আপনার মুখে কি আগুন ভরে রেখেছেন? আপনি মানুষ নাকি!’
‘তো আমি কি থাপড় মারা জ্বীন নাকি?’

এমন খোচামার্কা কথা শুনে ইফা রোষানল দৃষ্টিতে গোমড়ামুখোর দিকে তাকিয়ে নিচে নেমে আসে। হাতের তালুর দিকে লক্ষ্য করে দেখে সেখানে দুটো ফোস্কা পড়ে গেছে। এমন একটা ঘটনা ও কোথায় জানি দেখেছিল মনে হচ্ছে! কিন্তু সঠিক মনে পড়ছেনা। ওসব নিয়ে ইফা আর মাথা ঘামালনা। ওর এখন দুটো টার্গেট বজ্জাত জ্বীন আর গোমড়ামুখোটাকে আচ্ছামত শায়েস্তা করা।

ফেরার সময় বিষন্ন মুখে আন্টিকে ২য় তলায় উঠতে দেখে ইফা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে আন্টি?’
আন্টি চোখ তুলে ইফার দিকে তাকায়। আন্টির চোখে সযত্নে দেওয়া কাজল লেপ্টে আছে। বাড়ীওয়ালা আন্টি ধরাগলায় বলল, ‘কি আর হবে? প্রতিবারের মত এবারো রিজেক্ট হলাম।’ বলে মুচকি হেসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ইফার বেশ খারাপ লাগছে। সে বুঝে উঠতে পারেনি আন্টিকে মেনে নিতে মামার এত অসম্মতি কেন?

সে ভালো করেই জানে মামাকে আন্টির মত কেউ এত ভালোবাসতে পারবেনা। এই ব্যাপারটা নিয়ে একসময় আশফাক সাহেবের সাথে খোলাখুলি কথা বলার সিধান্ত নেয় ইফা।
চারদিক মাগরিবের আযানের ধ্বনিতে কলরব। ইফা পা টিপেটিপে তিনতলার বারান্দায় উঠে আসে। সর্তক শিকারীর মত আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়।

দরজার তালার দিকে একবার তাকিয়ে ওড়নার আড়াল থেকে একগোছা চাবি বের করে। এই চাবিগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে এই তলার ডুপ্লিকেট চাবি। সে নিশ্চিত জানেনা কোনটা! তবে বাড়ীওয়ালা আন্টিকে বলতে শুনেছে। চাবির গোছা হাতে নিয়ে আরেকবার নিচের দিকে তাকায়। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে সবাই রুমে ঢুকে গেছে। মামা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য বাজারে গেছে। আন্টি হয়ত নামায পড়ছে আর তার মা প্যারালাইসিস রোগী।

গোমড়ামুখোটাকে একটু আগে কাধের ব্যাগ নিয়ে কোথাও বের হতে দেখল। গত দুইদিন এই সুযোগটার’ই অপেক্ষা করছিল ইফা। একটার পর একটা চাবি দিয়ে তালা খোকার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। অবশেষে একটা চাবি দিয়ে তালা খুলতে সক্ষম হল সে। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সাথে থাকা টর্চ জ্বালায়। এই ঘরে সে আগে কখনো আসেনি।

গোমড়ামুখো কাউকে ভদ্রতার খাতিরেও ঢুকতে দেয়না। সামনে রুমের সবকিছু নিপুণ হাতে গোছানো। কেউ দেখে বলবেনা এটা একটা ব্যাচেলর ছেলের বাসা। ইফা পুরো রুমের কোণায় কোণায় খুজল। এখানে কেউ নেই দেখে ভিতরের রুমের দিকে পা বাড়ায় সে। এই রুমে বেডরুম, আয়না আর পড়ার টেবিল। এটা বেশ অগোছালো হয়ে আছে। ইফা ধীরে ধীরে পুরো রুম পর্যবেক্ষণ করে। রান্নাঘরেও একবার উকি মারে।

আবার ভিতরের রুমে ফিরে এসে পড়ার টেবিলের কাছে দাড়াল। এখানে কিছু কাগজ আর বইপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই ঘরে গোমড়ামুখো ছাড়া আর কেউ থাকেনা তাহলে সেদিন যে নারীমূর্তি ছায়া দেখেছিল সেটা কার! তবে কি সে ভুল দেখেছে! এসব ভেবে ইফা হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।

ইফার কোমড়ের সাথে ধাক্কা লেগে টেবিল থেকে কিছু কাগজ পড়ে যায়। ইফা কোমড়ে হাত বুলাতে বুলাতে মেঝেতে থেকে সেগুলো কুড়িয়ে নিতে যায়। কাগজ গুছিয়ে নেওয়ার সময় একটা নেইমপ্লেট লকেট তার হাতে পড়ে। নামটা উর্দুতে লেখা। ইফা উচ্চারণ করে পড়ল, “আলফি!”

আলফি নাম পড়েই তার চোখ কপালে উঠে গেল, বুকের ভেতর টা কেমন ধড়াস করে উঠল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসছে। ইফা নিজে নিজে ভাবে সে কি ঠিক দেখছে? হাতে একটা চিমটি কেটে লকেটের দিকে তাকায়। সে ঠিক’ই দেখছে। এটা আলফি নেমপ্লেট লকেট। লকেট টা কি তবে গোমড়ামুখোর? গোমড়ামুখো আলফি নয় তো? এসব প্রশ্ন মাথায় আসতে’ই ইফা হকচকিয়ে উঠে।

পর্ব ১৫

ইফা সিড়ি দিয়ে নামার সময় গোমড়ামুখোর সামনে পড়ে যায়। ইফার সাহস হয়না ছেলেটার চোখের দিকে তাকানোর। শরীরের হালকা কাঁপুনি টের পাচ্ছে সে। গোমড়ামুখো তাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল, “এইসময় এখানে কি করছেন?” ইফা হকচকিয়ে উঠল।

কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে, কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে ‘কিছুনা’ বলে ছুটে পালিয়ে এল। গোমড়ামুখো ই আলফি জানার পর থেকে ইফার ভিতরে এক ভয়ানক তান্ডব চলছে। একের পর এক প্রশ্ন মস্তিষ্কে হামলে পড়ছে। সে যদি আলফি হয় তবে এখানে কেন? রেহজান কি সত্যি’ই মারা গেছে? রেহজানের শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি আলফি! এমন অনেক প্রশ্ন তাকে চারদিক ধুম্রজাল থেকে চেপে ধরেছে।

ইফা দীর্ঘসময় নিয়ে ছোট্ট চায়ের কাপে চুমুক দিল। জাইমা আড়চোখে ইফার দিকে তাকিয়ে আছে, ইফার এমন গম্ভীর চেহারা আগে কখনো’ই দেখেনি। জাইমা কোনো প্রশ্ন করার আগে ইফা জিজ্ঞেস করল, “ডায়েরী টা কি অনেক পুরোনো?” জাইমা নিচের ঠোঁট দাতে কামড় দিয়ে একটু ভেবে নিয়ে বলল, “মনে হয়না। তবে এই ডায়েরী বা বই যাই বলিস, এটা অবস্থা এত খারাপ যে মনে হচ্ছে খুব পুরোনো।”

ইফা হঠাৎ করে জাইমার হাত চেপে ধরে বলল, “আচ্ছা তোর কি মনে হয়, রেহজান কি বেঁচে থাকতে পারে?” ইফার এমন উদ্ভুত প্রশ্নে জাইমার কপালে ভাঁজ পড়ল। নিজের কৌতূহল আর দমিয়ে রাখতে পারলনা সে।
~” কি হয়েছে তোর? এমন অদ্ভুত সব প্রশ্ন কেন করছিস?”

~ বলনা তুই, রেহজান কি বেঁচে থাকতে পারে? এতদিনে আলফি আদৌ তার শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছে?
~ এটা একটা কাল্পনিক রহস্যময় গল্প। অতএব, আমার অনুমানে এর কোনো পরিবর্তন ঘটবেনা কিংবা বাস্তব ও হবেনা। তবুও আমার ভাবনায় আসে, রেহজান হয়ত সত্যি মারা গেছে। তারপর আলফি তার শোকে স্তব্ধ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। একদিন হয়ত সেই গল্পের মোড় ঘুরে গেছে, আলফির জীবনে নতুন কেউ এসেছে।
ইফার চোখ দু’টো চকচক করে উঠল।

তার মন এখন অনেকটা হালকা। জমে থাকা এত প্রশ্নের ভারে তার শ্বাস নেওয়া’ই কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। বাসায় ফিরে তিনতলায় একবার উঁকি মারে সে। চোখাচোখি হয় গোমড়ামুখোর সাথে। খানিকটা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায় সে। সবকিছুতে সে অজানা ভালোলাগা খুঁজে পাচ্ছে।

দরজায় টোকা পড়ায় চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে ছেলেটা। ইফাকে বড় একটা বক্স হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চেহারায় বিস্ময়ের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে।

~ “আপনি এখানে?” ইফা একগাল হেসে বলল, “দরজায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবেন নাকি ভিতরেও আসতে বলবেন?”
~ “দুঃখিত। আপনাকে ভিতরে আসতে বলতে পারছিনা।”

ইফার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। আগেও একবার ইফাকে দরজা থেকে বিদায় দিয়েছিল। ছেলেটা কিছুতে’ই কাউকে বাসার ভেতর ঢুকতে দেয়না। তবে আজ ইফার কাছে কারণ টা পরিষ্কার। পুনরায় ঠোটের হাসি প্রসারিত করে বলল,
~ “ব্যাপার না। আজ মেঘলা দিন দেখে খিচুড়ি রান্না করেছিলাম। কিছুটা আপনার জন্য ও নিয়ে এলাম।”
~ “ধন্যবাদ। তবে আমার প্রয়োজন নেই। আমি রান্না সেরে ফেলেছি।” “নিলে কোনো সমস্যা দেখছিনা।” বলে ইফা গোমড়ামুখোর হাতে বক্স ধরিয়ে দিয়ে ভৌ-দৌড় দেয়। ছেলেটা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বক্স নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

ইফার অনুরোধে আশফাক সাহেব ছেলেটিকে একদিন বাসায় দাওয়াত দেন। আশফাক সাহেব ছেলেটিকে এর আগে দু-একবার দেখলেও আলাপ করার সুযোগ পাননি।

যতবার দেখা হয়েছে ছেলেটার ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। আশফাক সাহেবের অনুরোধ না ফেলতে পেরে ছেলেটি দুপুরে নিচতলায় আসল। ইফা সবে রান্নাবান্না সেরে গোছগাছ করে বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকক্ষণ আগুনের কাছে থাকায় মুখ ঘর্মাক্ত এবং লালবর্ণ ধারণ করেছে। গোমড়ামুখোর দিকে চোখ পড়ায় অপলক তাকিয়ে রইল সে।

আজ আলফিকে ভীষণ সুদর্শন দেখাচ্ছে। জুম্মাবার বলেই হয়ত পাঞ্জাবী পড়েছে। আকাশী রঙ্গে তাকে অনেক মানিয়েছে। বা হাতে সচরাচর পড়ে থাকা ঘড়ি, চুলে আজ যত্ন করে চিরুনী বুলিয়েছে মনে হচ্ছে। গোমড়ামুখোর সালাম শুনে ধ্যান ভাঙ্গল ইফার। ইফা তটব্যস্ত হয়ে ভিতরে আসার অনুরোধ করল।

ছেলেটা নাকোচ করে বলল,
~ উনি একসাথে নামাযে যাওয়ার কথা বলেছেন। ডেকে দিন উনাকে, আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।
আশফাক সাহেব আর ছেলেটা খেতে খেতে টুকটাক কথা বলছে। ইফা অপলক দৃষ্টিতে গোমড়ামুখোর দিকে তাকিয়ে আছে।

আশফাক সাহেবের কথায় একটু নড়েচড়ে বসে কৌতূহলসহকারে কান খাড়া করে ইফা। আশফাক সাহেব ছেলেটিকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করেছেন। খাওয়া বন্ধ করে ছেলেটি উত্তর দিল, “আমার নাম সারোফার নেওয়াজ শাহর। বাসা পিন্ডিতে। আম্মা-আব্বা সেখানেই থাকেন। পড়ালেখার এবং কর্মসংস্থানের জন্য লাহোরে আসা।”

আশফাক সাহেব মাথা ঝুকিয়ে বলল, ” খুব ভাল। আসলে ব্যস্ততার কারণে তেমন আলাপ হয়নি। কোনোকিছু প্রয়োজন হলে আমাকে অবশ্যই জানাবে।”

ইফা গোমড়ামুখোর দিকে বেশ কয়েকবার আড়চোখে তাকাল। আলফি তার আসল পরিচয় গোপন রেখেছে দেখে সে খুব একটা হতবাক হলনা। রেহজান মারা যাওয়ার পর হয়ত সে নিজেকে আলাদা পরিচয়ে বাচিয়ে রাখতে চাচ্ছে। ইফা মনে মনে আলফিকে আশ্বাস দিল, “আমি আছি আপনার পাশে।”

ইফা বেশ কয়েকটা একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত। ডায়েরীতে রেহজানের দেওয়া বর্ণনায় আলফির চোখের রং ধূসর ছিল। সেদিন শাহরের চোখে সরাসরি তাকিয়ে সে ধূসর বর্ণ দেখলনা। জাইমা বই ঘাটতে ঘাটতে ইফাকে বলল,
~” এই বইয়ে হয়ত পড়েছিলাম জ্বীনরা যেকোনো সময় যেকারো রুপ ধারণ করতে পারে।

যেকোনো পশু থেকে শুরু করে মানুষ। এরা নিজেদের আসল রুপে মানুষের সাথে মিশেনা। ধারণা করা হয়, এদের আকৃতি কিংবা অন্য কোনো আলাদা বিশেষত্ব থাকার ফলে মানুষ সন্দেহ করতে পারে তাই এরা অন্য কারো রূপে মানুষের কাছাকাছি বাস করে।”

ইফা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। আলফিকে একটু একপ্টু করে সে বুঝতে পারছে, চিনতে শিখছে। তার কাছে আসার চেষ্টা করছে। আলফি কিন্তু তাকে অত পাত্তা দিচ্ছেনা। তাতে ইফা হাল ছাড়ছেনা। একদিন না একদিন আলফিও তাকে বুঝতে পারবে সে এই প্রত্যাশা পোষণ করছে।

ইফা তিনতলার বারান্দা এসে দাঁড়াল। শাহরের দরজায় তালা ঝুলছে। এই ভরসন্ধ্যায় সে কোথায় গিয়েছে কে জানে! দাত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বারান্দার এই মাথা থেকে ওই মাথা চক্কর দিচ্ছে ইফা। ডায়েরী পড়ার পর থেকে ইফার আলফির প্রতি ভালোলাগা সৃষ্টি হয়েছিল, রেহজানের করুণ পরিণতিতে আলফির জন্য সে কষ্ট অনুভব করত। মনে মনে শুধু চাইত, আলফির মত জ্বীনবর তার জীবনে আসুক।

আল্লাহ যে আলফিকে’ই এনে দিবে সেটা সে কল্পনা ও করতে পারেনি। শাহর ই আলফি জানার পর সেই ক্ষুদ্র ভালোলাগা ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়েছে। এখন সে মনে প্রাণে চায়, সে আলফির একাকিত্ব ভুলিয়ে নতুন করে আলফির জীবন সাজিয়ে তার সাথে জীবনের বাকিটা পথ হেটে বেড়াতে।

আলফিকে মনের কথা বলার জন্য ভেতরটা ছটফট করতে থাকে। শাহর বারান্দায় এসে ইফাকে দেখে অবাক হলনা। ইদানিং ইফা কোনো না কোনো প্রায়সময় তার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। এই অল্পবয়সী চঞ্চল মেয়ের মাথায় কখন কি চলে সে তা বুঝতে পারেনা। ইফার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “আজও কি লবণ শেষ? কি চাই?”

ইফা মুখ ফসকে অস্ফুট স্বরে বলে ফেলে, “আপনাকে।” পরক্ষণে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “কিছুনা। ছাদে গিয়েছিলাম নামার সময় দেখি আপনি এখনো ফিরেননি। তাই পাহারা দিচ্ছিলাম। আপনি এসে গেছেন এখন আমার ছুটি।” শাহর কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নেমে আসে সে। কেন জানি আলফি সামনে এলে কিছু বলার সাহস পায়না সে।

বাড়ীওয়ালা আন্টির মা মারা যাওয়ায় তাকে সমবেদনা জানাতে তার কাছে গিয়ে বসল ইফা। এই মানুষটার জন্য সে কষ্ট অনুভব করে। দুনিয়ায় একদম একা হয়ে গেছেন উনি। মামা যদি এইসময় তাকে সঙ্গ দিত তবে হয়ত তার একাকিত্ব একটু কমত। আশফাক সাহেব রাতের খাবার শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন।

বারান্দার অন্ধকার তার ভালোই লাগছে। মনের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। এমনসময় ইফা চায়ের কাপ নিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়।

~ “মামা একটা কথা বলব।” আশফাক সাহেব চায়ের কাপ নিয়ে মাথা ঝাকায়। ইফা সাহস করে বলল,
~ “তুমি জানো, আন্টি তোমাকে অনেক ভালোবাসে। এতবার ফিরিয়ে দেওয়ার পরও তোমার অপেক্ষা করে। সব জেনেও তুমি কেন তাকে বারবার নাকোচ করছো?

আমার বিশ্বাস আন্টির মত কেউ তোমাকে ভালো রাখতে পারবেনা। আশফাক সাহেব মুচকি হাসেন। ইফার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
~ ” ভালোবাসা কারো জন্য একবার হারিয়ে গেলে সেটা অন্যের প্রতি সহজে আসেনা। একজনের জন্য গড়া আসনে অন্য কাউকে বসানো অনেক কঠিন ব্যাপার।

বড় হলে বুঝবি।” ইফা একটু গম্ভীর হয়ে যায়, পরক্ষণে বলেঃ
~ “অতীত আকঁড়ে ধরে নিজেকে কষ্ট দেওয়া মানে সেই মানুষটাকেও কষ্ট দেওয়া। তার জায়গা হয়ত কাউকে দেওয়া সম্ভব নয় কিন্তু কাউকে পাশে রাখা তো অন্যায় হতে পারেনা। হারিয়ে ফেলা কারো জন্য জীবন থামিয়ে রাখা নিতান্ত বোকামো।”

ইফা নিশ্চুপে রুমে ফিরে এল। তার ও মনে চলছে অনিশ্চয়তার ঝড়। আলফি মামার মত কারণ দেখিয়ে তার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবে না তো? রেহজানের জায়গা আর কাউকে দিতে পারবে না বলেই কি এখনো সে ইফা পাত্তা দিচ্ছেনা? সব বুঝেও এইজন্য চুপ করে আছে? ইফার বুক ফুঁড়ে আংশকামিশ্রিত অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

পর্ব ১৬

শেষবারের মত ইফা আয়নার দিকে একনজর তাকাল। অনেকদিন পর আজ যত্ন করে সেজেছে। ওড়না দিয়ে সামান্য ঘোমটা মাথায় চড়িয়ে ছাদে এসে দাঁড়ায়। শাহর ছাদে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল।

ইফা তার দিকে এগিয়ে আসে। শাহর একপলক ইফার দিকে তাকায়। কালো ড্রেসে ইফাকে বেশ পরিপাটি এবং সুন্দর লাগছে। প্রতিদিনের চঞ্চল মেয়েটাকে অনেক শান্ত দেখাচ্ছে। ইফা চোখ বুজে একবার বড় নিঃশ্বাস নিল।

তারপর শাহরের খুব কাছাকাছি এসে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ আমি জানি আপনার একটা ভয়ানক কালো অতীত আছে। যার শোক আপনি এখনো বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’ ইফা একটু থেমে শাহরের গালে আলতো করে হাত রেখে আবার বলা শুরু করল,
” আমি আপনাকে ভালোবাসি।

আপনার খারাপ সময় থেকে আপনাকে বের হতে সাহায্য করতে চাই, আজীবন সবরকম পরিস্থিতিতে আপনার পাশে থাকতে চাই। অনুগ্রহ করে কোনো অযুহাতে আমাকে ফিরিয়ে দিবেননা।” এক নিঃশ্বাসে পুরোটা বলে ইফা দৌড়ে পালিয়ে গেল। শাহর হতভম্ব হয়ে পাথরের ন্যায় দাড়িয়ে আছে। তার ঘোর এখনো কাটছেনা, এসব কি বলে গেল ইফা! শাহর চিন্তিত হয়ে নিচে নেমে এল।

ইফা বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটু আগে ঘটে যাওয়া রোমাঞ্চকর মূহুর্তের কথা ভাবছে। অবশেষে সে তার মনের কথা বলতে পেরেছে। তার অটুট বিশ্বাস আলফি তার ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিবে। আলফি কে আর কোনো রকম কষ্ট পেতে দিবেনা সে, ছোট্ট বাচ্চার ন্যায় আগলে রাখবে। এবার রেহজানের শোক নিশ্চয়ই কেটে যাবে।

বাড়ীওয়ালা আন্টি কে এইসময় নিচতলায় দেখে ইফা অবাক হল। বেশ কয়েকদিন ধরে উনি কারো সাথে কথা বলছেন না আর খুব একটা বের ও হচ্ছেননা। ইফা এগিয়ে এসে আন্টিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেমন আছো আন্টি?” শুষ্ক চেহারায় হাসি ফুটিয়ে আন্টি জবাব দিলেন, “আলহামদুলিল্লাহ।

তোমার মামার হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠানোর কারণ কি?” ইফা নিস্তব্ধ হয়ে ভাবনায় পড়ল। মামা কি তবে কালরাতে তার বলা কথার মর্মার্থ বুঝে আন্টিকে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? ইফা বিস্তর হাসি দিয়ে আন্টিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে যায়।

আশফাক সাহেব কাজে ব্যস্ত ছিলেন, ইফা’দেরকে দেখে কাজ বন্ধ করে এগিয়ে আসলেন। ইফার সামনে উনি কথা বলতে ইতস্তত বোধ করছেন দেখে ইফা বের হয়ে আসে। ইফা চলে যাওয়ার পর আশফাক সাহেব গলা পরিষ্কার করে বললেন, “শক্ত থাকতে শিখো।

এভাবে গুটিয়ে নিজেকে রেখে ভালো থাকা যায়না নাহার।” নাহার অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “আমি ঠিক আছে। আমাকে ডাকার কারণ কি?” আশফাক সাহেব কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন। তারপর জড়তা নিয়ে বললেন, “কাল রাতে ইফার সাথে তোমাকে নিয়ে কথা হয়েছিল। সে চায় আমি তোমাকে গ্রহণ করি।” নাহার সম্ভিত ফিরে পেয়ে চোখ তুলে বলল,
“আর আপনি?”

“আমিও চাই তোমাকে গ্রহণ করতে। কিন্তু আমার অতীতে আমি একজনকে ভালোবেসেছিলাম, তাকে না পেয়ে আজ আমি যাযাবরের মত জীবনযাপন করছি। এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পরেও তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমি যদি তোমাকে গ্রহণ করি, আমার মনে এখনো অন্য কেউ আছে জানার পরে কষ্ট পাবে।

তোমার পক্ষে মেনে নেওয়া হয়ত সহজ হবেনা। তাই আমি এতদিন তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছি।”
~ “ভালোবাসার মানুষের সবকিছুকে সম্মান করতে হয়। সেই হিসেবে আমি আপনার ভালোবাসাকেও সম্মান করি। আপনি তার জায়গা কখনো নিতে চাইবনা। যদি এইটুকু চেয়েছি আপনার পাশে থাকতে, স্ত্রীকে হিসেবে সামান্য হলেও আপনার ভালবাসা পেতে।”

~ “তুমিও ইফার মত ই কথা বলছো। ইফা নাহয় বাচ্চা মানুষ, আবেগ দিয়ে কথা বলে। সবকিছু বোঝার সাধ্য নেই।”
~ “ইফা কি বলেছে জানিনা। আমি আমার মনের কথাটা বললাম। আমার আপনার অতীত নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।”
ইফা আড়াল থেকে এইটুকু শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। তার মবে চিন্তা এল, আলফিও কি রেহজানকে কখনো ভুলতে পারবেনা? সবটুকু দিয়ে তাকে ভালোবাসতে পারবেনা?

ইফাকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাহিরে বসে থাকতে দেখে নাহার তার পাশে এসে বসে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আমার জন্য যা করেছো তার জন্য অনেক কৃতজ্ঞ আমি।” ইফা হাটুতে গুজে রাখা মাথা তুলে বলল, “অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিলাম তোমাকে।”

নাহার হেসে বলল,
~”আমি তা মনে করিনা। তোমার মামা হয়ত নিজে থেকে তাকে ভুলতে চাইছেননা, তাকে আকড়ে ধরেছিলেন। যখন আমাকে উনি পাশে পাবেন তখন আমার ভালোবাসা পেয়ে উনি এটা বোধ করবেন এই পরিবর্তন উনার আরো আগে প্রয়োজন ছিল। আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে আমি একদিন ঠিক উনার মন জয় করতে সক্ষম হব।”

আন্টির কথায় ইফা অনুপ্রেরণা খুজে পায়। তার নিজের ও মনে হতে থাকে, সেও পারবে একদিন আলফির মনে জায়গা করে নিতে।
শাহর দরজা খুলে বাহিরে এসে দেখে ইফা দাঁড়িয়ে আছে। শাহর ইফার দিকে এগিয়ে আসা মাত্রই ইফা মূহুর্তে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

শাহরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
~ আমি জানি একদিন আপনিও আমাকে সাদরে গ্রহণ করে নিবেন। সবটুকু দিয়ে ভালোবাসবেন। শাহর ইফাকে সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এসব কি তোমার স্বল্পমেয়াদী আবেগ?”

ইফা শাহর গলা জড়িয়ে ফিসফিস কন্ঠে বলল, “নাহ, দীর্ঘমেয়াদী ভালোবাসা। আমাকে বিশ্বাস করুন।” শাহর কপাল কুঁচকে বলল, “আমি ভেবে দেখব। রাত-বিরাতে এভাবে এসোনা। এটা ভালো দেখায়না। বাসায় ফিরে যাও, অপেক্ষা করো।

পজিটিভ উত্তর হলে অবশ্যই তোমাকে মুখোমুখি জানাব আর যদি নেগেটিভ হয়….” ইফা শাহরের মুখ চেপে ধরে, “এই কথা আর যেন না শুনি।” শাহর চুপ থেকে বলল, “এখন বাসায় ফিরে যাও।” ইফা আরেকবার শাহরকে জড়িয়ে ধরে সিড়ি দিয়ে নেমে আসে।

সন্ধ্যাবেলা শাহরের ঘরের দরজা এভাবে হাট করে খোলা দেখে ইফা অবাক যায়। শাহর তো কখনো ভুলেও এভাবে দরজা খোলা রেখে বাহিরে যায়না। শাহরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ইফা ভিতরে প্রবেশ করে। পুরো বাসায় কারো সাড়াশব্দ নেই। শাহরের বেডরুম থেকে খুট খুট আওয়াজ আসতে শুনে ইফা সেদিকে এগিয়ে যায়।

অন্ধকারে খাটের এককোণায় কাউকে বসে থাকতে দেখে ইফা হাতড়ে সুইচ খুজে আলো জ্বালায়। ওপাশের মানুষটাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠে। অতি সুদর্শন একটা ছেলে হাতের উপর মুখ রেখে বসে আছে।

পরনে ধূসর বর্ণের টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার জিন্স। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের সামনে পড়ে আছে। ফর্সা হলেও মায়াবী চেহারার অধিকারী। চোখগুলো ধূসর বর্ণের। সেই চোখে ইফার দিকে খানিকটা বিব্রত হয়ে চেয়ে আছে। ইফার চোখ পড়ল তার গলায় থাকা লকেটের দিকে। এইটা তো সেই নেইমপ্লেট লকেট। ইফা নিশ্চিত হল এটা আলফির আসল রুপ। হুবহু তার বইয়ে পড়া বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে।

পিছন থেকে শাহরের ডাকে ঘুরে তাকায় ইফা। তার চোখে-মুখে এখনো বিস্ফোরিত অবাকতা। শাহর ইফাকে তার দিকে টেনে এনে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কি করছো?”
~” আলফি তুমি ওখানে বসেছিলে না!” বলে ঘুরে তাকায় ইফা। খাটের কোণে কেউ নেই। শাহর ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে, “আমি তো এখানে। আর আলফি কাকে ডাকছো?”
ইফা শাহরের টি-শার্ট টেনে কাছে নিয়ে এসে বলে,
~” তোমার আসল রূপ দেখে আমি সত্যিই বিমোহিত। আমার এখনো ঘোর কাটছেনা। বারবার তোমার ধূসর চোখের মায়ায় হারিয়ে যাচ্ছি। ওই রূপে আবার এসোনা, মনে ভরে একটু দেখি।”
~ “এসব কি বলছো ইফা? ইফা ধমকের সুরে বলে,
~ ” আমি সব জানি আলফি। তুমি একজন জ্বীন, তোমার ব্যাপারে সব আমার জানা। এখন আর আড়ালে থেকোনা।”

~ “আমি শাহর কোনো জ্বীন নই। আমাকে আলফি বলে ভুল করছো। আর আলফি কে? তোমার কি হয়েছে?”
ইফা নিজেকে সংযত করে জিজ্ঞেস করে, “তুমি জ্বীন নও?”
~ “জ্বীন নিয়ে ভাবতে ভাবতে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। জলজ্যান্ত আমাকে জ্বীন বানিয়ে দিচ্ছো। তুমি কি আমার সাথে মজা করছো ইফা?”

ইফা ধাক্কা দিয়ে শাহর সরিয়ে দেয়। তারপর রুমের চারিদিকে একবার তাকিয়ে আলফিকে খুজতে থাকে। শাহর ইফার কাছে এগিয়ে আসতে চাইলে ইফা বাধা দিয়ে দেয় আর দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। শাহর অসহায় দৃষ্টিতে ইফার চলে যাওয়া দেখে। ইফার এমন অদ্ভুত আচরণের মানে সে বুঝতে পারছেনা।

পর্ব ১৭

ইফা বিষন্ন মনে হাঁটুতে মুখ রেখে বসে জানালার বাহিরের দৃশ্য দেখছে। পাশে জাইমা চিন্তিত চেহারায় মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। নীরবতা ভেঙ্গে জাইমা বলল, ” আমি ঠিক ই ধরেছি আলফি আলফি করে তোর মাথাটা গেছে। একটা নেইমপ্লেট লকেটের ভিত্তিতে শাহরকে তুই আলফি ভেবে বসে আছিস। আবার এখন বলছিস শাহর আলফি নয়, তুই সত্যি রেহজানের আলফিকে দেখেছিস।

আমি তোর কথার কিছুই বুঝতে পারছিনা। আচ্ছা দুনিয়াতে কি আলফি একজন ই?” ইফা কপালে ভাঁজ ফেলে চুপ করে আছে। নেইমপ্লেট লকেটের উপর ভিত্তি করে সে শাহরকে আলফি ভেবে নিয়েছে এটা ঠিক। কারণ, তখন তার মাথায় কেবল জ্বীনবর আলফির চিন্তা ঘুরছিল। তাই সে কিছু না ভেবে বোকার মত শাহরকে জ্বীন আলফি ভেবে নিয়েছিল। এটা তার মাথায় আসেনি, আলফি কেবল একটা গল্পের চরিত্র।

বাস্তবে এমন কিছু হতে পারেনি। ইফা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবতে থাকল, তার সাময়িক আবেগী চিন্তা জাইমার কথাতে কেটে যেতে পারত যদি সে নিজের চোখে কাল আলফিকে না দেখত। আলফি যদি গল্পের চরিত্র হয়ে থাকে তবে কাল রাতে দেখা আগন্তুকের সাথে বর্ণনার মিল কি করে থাকতে পারে? শাহরের রুমে সে কি করে আসল? আর আলফির অস্তিত্ব না থাকলে শাহরের কাছে আলফি নেইমপ্লেট লকেট কেন? কিছু একটা তো রহস্য আছে। যেটা ওকে খুজে বের করতে হবে।

শাহর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের বারান্দায় দাঁড়ানো ইফাকে দেখছে। ইফা খুব ব্যস্ত হয়ে জিনিসপত্রের তদারকি করছে। শাহরের মনে হচ্ছে ইফা তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। ২-৩দিন ধরে ইফা উপরতলায় আসেনি, আগে তার সাথে যা টুকটাক কথা হত তাও হচ্ছেনা। ইফার পাগলামী-আবেগ গুলোতে তার বিরক্তি আসতনা, বরং মুগ্ধ হত। ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ইফার চোখ পড়ে শাহরের দিকে।

চোখাচোখি হওয়ামাত্র শাহর মুচকি হেসে হাত নাড়ায়। ইফা মূহুর্তে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘরে ঢুকে ইফা খেয়াল করে আশফাক সাহেব খুব যত্ন সহকারে কনের জন্য আনা জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে রাখছেন। ইফা দেখে ডাক ছাড়লেন। ইফা মুচকি হেসে এগিয়ে আসে।

আজ সন্ধ্যায় ঘরোয়াভাবে তার মামা আর নাহার আন্টির বিয়ে হবে। অবশেষে তারা একসাথ হওয়াতে ইফা প্রচন্ড খুশি। আশফাক সাহেব সাজ-সরঞ্জাম ভর্তি থলে ইফার হাতে দিয়ে বললেন, “লিস্টে যা যা দিয়েছিস সব এনেছি। এগুলো তোর আন্টির কাছে পাঠিয়ে দিস।”

ইফা হেসে বলল,
” এখনো আন্টি বলব? এবার তো আমার চাচাকে রেহাই দাও। চাচী যদি বাংলাদেশ থেকে জানে আমি এখানে চাচার আরেকটা বউ বানিয়ে ফেলেছি তবে কি হবে বুঝতে পারছো!” আশফাক সাহেব হাসতে হাসতে বলল,
” এতদিন তো আন্টি ই ডেকেছিস!”

” তখন উনি সিঙ্গেল ছিল।” ইফার এমন রসিকতায় আশফাক সাহেব মুখ চেপে হেসে ভাবে মেয়েটা এখনো বাচ্চাদের মত কথা বলে। সন্ধ্যার পর বিয়ের সমস্ত কাজ শেষ হয়। অতিথি হিসেবে যারা এসেছে ইফা তাদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত। শাহর বসে একমনে ব্যস্ত ইফাকে দেখছে। আশফাক সাহেবের বিয়েতে শাহরও আমন্ত্রিত।

ইফা শাহরের দিকে ফিরে তাকাচ্ছেনা। তার এই লাপাত্তা ভাব শাহর মেনে নিতে পারছেনা, সে চাচ্ছে ইফা তার সাথে কথা বলুক। ইফার পাগলামীগুলো সে প্রচন্ড মিস করছে। ইফার সাথে একটু কথা বলার জন্য শাহর উঠে দাঁড়াল। কিন্তু একবারের জন্যও ইফাকে ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছেনা। সে হতাশ হয়ে ফিরে এল। সব কাজ শেষ করে বর-কনেকে রুমে পাঠিয়ে ইফা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার অনেক ক্লান্ত লাগছে, চোখে ঘুম ঘুম ভাব। বাহিরে হালকা বাতাস দেখে চোখ বুজে রিলেক্স হওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ কেউ তার হাত টেনে উঠোনে নামিয়ে আনে।

ইফা আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে দেখে শাহর তার হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইফা খানিকটা আতঙ্ক নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার?” শাহর ইফার কাছাকাছি এগিয়ে এসে বলল, “আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো কেন? উত্তর দিতে দেরী করেছি বলে? জানতে চাও উত্তরটা!” ইফা শাহরের দিকে একপলক তাকায়। ছেলেটার চাহনীতে লুকিয়ে রাখা অনুভূতি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

ইফা নিজেই শাহরের মুখোমুখি হতে চেয়েছিল কিছু প্রশ্ন নিয়ে। মামার বিয়ে থাকায় সবকিছুর পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রেখেছিল। কিন্তু সে ভাবতে পারেনি শাহর তাতে এতটা উতলা হয়ে নিজেই ছুটে আসবে। ইফা দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দেয়,

~ “আমি সেই উত্তর জানার প্রয়োজনবোধ করছিনা। কিন্তু কিছু প্রশ্ন করতে চাই। যার উত্তর আমার জানা আবশ্যক। সেসব আমি আপনাকে পরে জিজ্ঞেস করব। তার আগে একটা ব্যাপার আপনাকে ক্লিয়ার করা দরকার। এতদিন আমি যেসব পাগলামী-বেহায়াপনা করে আপনাকে বিরক্ত করেছি তার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমি আপনাকে আলফি ভেবে এত দুর্বলতা দেখিয়েছিলাম। যা করেছি সব ছিল আলফির জন্য।” এইটুকু বলে ইফা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। শাহর অন্ধকারে পাথরের মত নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ইফা শাহরের ঘরের দরজায় নক করে একবার চারপাশে তাকাল। এই রাতের বেলা সে এখানে এসেছে কেবল শাহরের কাছ থেকে অজানা উত্তর গুলো জানতে। দরজা খুলতেই ইফা ভিতরে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। ফিরে তাকিয়ে দেখে সেই রাতের সুদর্শন আগন্তুক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যাকে সে আসল আলফি ভেবেছে। ঘরের ঝলমলে আলোতে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ইফা হতভম্ব হয়ে ভালো করে তার দিকে তাকায়। সে কিছুতে’ই ভুল দেখছেনা। কাপা কাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ” আপনি কি সত্যিই আলফি?”

ছেলেটা একটু অবাক হয়। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “হ্যাঁ আমি আলফি। কিন্তু তুমি আমাকে কিভাবে চিনো?” ইফা আবেগে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল, “সেসব পরে বলব। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি কি জ্বীন? জ্বীন আলফি যার সাথে রেহজানের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল।”
~ “হ্যাঁ। তুমি রেহজান সম্পর্কেও জানো?”

~ “আপনি এখানে কিভাবে এলেন? জনাব শাহরের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”
~ ” তুমি ঠিক ই জানো আমি একজন জ্বীন। শাহর সম্পর্কে আমার ছোটভাইয়ের মত। ওর সাথে আমার পরিচয়ের খুব বেশীদিন হয়নি। ছয় মাসখানেক আগে ওকে এক দুর্ঘটনা থেকে আমি বাচিয়েছিলাম, তারপর থেকে মাঝে মাঝে ওর সাথে দেখা করতে আসি। তার কারণেই আজ আমি এখানে। ও আমার ব্যাপারে সবকিছু জানে তাই আমাকে আড়াল করে রাখার জন্য তোমার সামনেও না জানার ভান করেছে।”

ইফা আলফিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আপনি জানেন আমি আপনার জন্য কতটা পাগল। এতদিন শাহরকে আলফি ভেবে অনেক পাগলামী করেছি।” আলফি ইফার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “তুমি আমার ব্যাপারে কিভাবে জানো? আর কিভাবে ই বা বুঝতে পারলে আমি আলফি।” ইফা ঢোক গিলে বলতে শুরু করে,
~ “আমি একটা পুরোনো বইয়ে আপনার আর রেহজানের ভালোবাসার কাহিনী পড়েছি।

রেহজানের মারা যাওয়ার কাহিনী পড়ে আপনার জন্য ভীষণ খারাপ লেগেছে। তারপর থেকে আমার মনে আপনাকে নিয়ে অনেক চিন্তা আসে। আমি আপনার মত একজন জ্বীনবর চেয়েছি, এমন আলফিকে ভালোবাসতে চেয়েছি।”

আলফি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কিসের বই? কত পুরোনো?”
~ “কত পুরোনো তা জানিনা। তবে বইয়ের অবস্থা দেখে মনে হল বছর দশেক হতে পারে। বইটা আমার বান্ধবী তার দাদুর লাইব্রেরিতে পেয়েছে।”

~ “আমার আর রেহজানের ঘটনাটা বছরখানেক আগের। সেটা বইয়ে আসবে কিভাবে?”
~ “ঠিক বই হবেনা, এটা ডায়েরী। রেহজানের ডায়েরী হয়ত, সবকিছু তার নিজের কথায় লেখা। আচ্ছা রেহজান কি সত্যিই মারা গেছে?”

আলফি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “রেহজান মারা গেছে?”
ইফা আলফি বিস্ময়মাখা চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি রেহজানের মৃত্যুর ব্যাপারে জানেন না?”

আলফি অসারশূন্য হয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। শাহর আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল, আলফির এই অবস্থা সে বেরিয়ে এসে আলফিকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে ভাই?” ইফা আলফির অবস্থা দেখে এটা ভেবে অবাক হয়, রেহজানের মৃত্যুর ব্যাপারে আলফি কিছুই জানেনা। সে ঢোক গিলে বলে, ” তাহলে রেহজান কোথায়?

উনি কি বেঁচে আছেন?” আলফি একটু চুপ থেকে বলে,
” আমাকে ওই বইটি এনে দিতে পারবে?” ইফা দাত দিয়ে নিচের ঠোট কামড়ে ধরে। তারপর দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায়।

শাহর আলফির দিকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ভাই রেহজানের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনি জানেন না?” আলফি একনিঃশ্বাসে পুরো পানি শেষ করে না সূচক বাক্যে মাথা নাড়ায়। শাহর আর কোনো প্রশ্ন করার আগে আলফি বলে, “আমি একটু একা থাকতে চাই।”

ইফা নিজের রুমে এসে বইয়ের তাক চেক করে, সেখানে ডায়েরীটা নেই। পুরো রুম চেক করেও বইটা পায়না। জাইমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, জাইমা উত্তরে বলে, “কয়েকদিন আগে ই তো তুই বইটা আমার থেকে নিয়ে গেলি!” ইফা হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে ভাবতে থাকে, সে ২দিন আগেও বইটা বইয়ের তাকে দেখেছিল।

তাহলে সেটা গেল কোথায়? বইটা না দিতে পারলে তো সে আলফির কাছে মিথ্যাবাদী হয়ে যাবে। আলফি যদি রেহজানের মৃত্যুর ব্যাপারে না ই জেনে থাকে তবে রেহজান কোথায়?

পর্ব ১৮

শাহর বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও ইফাকে ফিরতে না দেখে হতাশ হয়ে আলফির দিকে তাকাল। আলফি দুই হাত ছড়িয়ে মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে। তার মাথার দুই পাশের রগ ফুলে আছে, কপালে সামান্য ভাঁজ। শাহর হালকা গলা ঝেড়ে বলল, “তোমার কি মনে হয় ইফার কাছে রেহজানের ডায়েরী থাকতে পারে?” আলফি মাথা না তুলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “রেহজানের ডায়েরী লেখার অভ্যাস ছিল।

কিন্তু ওর ডায়েরী ইফার কাছে থাকতে পারে এটা আমার ভাবনার বাহিরে। ইফার সম্পর্কে আমাকে কিছু তথ্য দিতে পারবে?”

শাহর মাথা ঝাকিয়ে বলল, “যতটা জেনেছি ও বাংলাদেশী। মা-বাবার মৃত্যুর পর লাহোরে মামার কাছে চলে এসেছে, তাও প্রায় ২বছর আগে। ও একটু বেশী চঞ্চলা আর আবেগপ্রবণ। আর আমার মনে হয়না ও মিথ্যা বলছে।”
ইফা ঘরজুড়ে অস্থিরচিত্তে পায়চারি করছে। নাহার আন্টি ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইফাকে এমন অস্থির হতে দেখে তার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন,
~” কি হয়েছে তোমার?”

ইফা চেয়ারে বসে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ” আমার একটা জরুরী ডায়েরী পাচ্ছিনা। কাল এটা সর্বশেষ বইয়ের তাকে দেখেছিলাম।” নাহার একমূহুর্ত কিছু একটা ভেবে বেরিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ইফার দিকে হাতের ডায়েরী বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা খুজছিলে?” ইফা ডায়েরীটা একটানে নিয়ে নিল, এতক্ষণে যেন ও প্রাণ ফিরে পেল। উৎফুল্লস্বরে জিজ্ঞেস করল,
~ “এটা তোমার কাছে কি করে এল?”

~ “তোমার মামা ডায়েরীর অবস্থা খারাপ দেখে ফেলে দিয়েছিল। আমার আবার এসব পড়ার শখ আছে। তাই তুলে রেখেছিলাম। দেখো সব ঠিক আছে নাকি? দু-একটা পাতা নাও থাকতে পারে।”

কথাটা শুনে ইফার টেনশান লাগল। তাড়াতাড়ি ডায়েরীর সব পাতা একবার দেখে নিল। সবগুলো’ই আছে কিন্তু লাস্ট পাতা নেই যেখানে রেহজানকে মেরে ফেলার ঘটনা লিখা ছিল। ইফা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। এবার কি হবে? নাহারের দিকে ফিরে তাকিয়ে করল, “একটা পাতা মিসিং। ওইটা কোথায় গেল?”

~ “তোমার মামা যখন ফেলেছিল সবগুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিল। আমি যা পেয়েছি তাই নিয়ে রেখেছি।” ইফা ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে,
~ “কোথায় ফেলেছে মামা?”

~ “ছাদের কর্ণারে যে পানি জমানোর ট্রাংক আছে সেখানে।”
ইফা একমূহুর্ত দেরী না করে ছাদের দিকে দৌড় দিল। তিনতলায় আসতে’ই শাহর পথ আটকে বলল, “তুমি ডায়েরীটা পেয়েছো?” ইফা তাড়াহুড়োয় শাহরকে সরিয়ে ছুটে যেতে যেতে বলল, “আমি এসে বলছি।”

ইফা ছাদের ট্রাংকের চারপাশ আর ভিতরে খুঁজল। সেখানে ডায়েরীর পাতার চিহ্নমাত্র নেই। হতাশ হয়ে নিচে নেমে এল। শাহর আর আলফি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। ইফা তাদের মুখোমুখি হতে’ই আলফি প্রশ্ন করে, “পেয়েছো?” ইফা কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়েরী এগিয়ে দিয়ে বলল, “শেষ পাতা হারিয়ে গেছে যেখানে রেহজানের মৃত্যুর ঘটনা লেখা ছিল।”

আলফি ডায়েরী হাতে নিয়ে শাহরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আসছি।” ইফা আলফির হাত ধরে কান্না কান্না চেহারায় বলল, “আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেননা?” আলফি ইফার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই মূহুর্তে নয়, ডায়েরী পড়ার পর বলতে পারব। নিজেকে সত্যবাদী প্রমাণ করতে হলে শেষ পাতা ও খুঁজে বের করতে হবে তোমায়।”

ইফা কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে আসে। বিড়বিড় করতে থাকে, আলফি এত কঠিন কেন? এই আলফিকে তো সে নিজের জ্বীনবর হিসেবে চায়নি। একটাবার ও হেসে কথা বললনা তার সাথে। কষ্টে তার বুকটা চিরে যাচ্ছে। মামার ডাকে চোখ মুছে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ায় ইফা।

আশফাক সাহেব ঘুমানোর আগে ইফার হাতে বানানো চা না খেলে শান্তি পাননা। তাই ইফা আগে রান্নাঘরে ঢুকে আগে চা বানিয়ে নেয়। তারপর চা হাতে মামার স্টাডি রুমে ঢুকে। আশফাক সাহেব কাজ বন্ধ করে ইফার হাত থেকে চা নিয়ে খেতে থাকেন। ইফা ধপ করে চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। তার মনভার এখনো কাটেনি।

শুকনো মুখে বলে,
~ “কাজ রেখে কয়েকটা দিন মামীকে তো সময় দিতে পারো।” আশফাক সাহেব হেসে উঠে বলেন,
~ “এক বউ পেয়ে আরেক বউকে কিভাবে ছেড়ে দিই বল! ভালো থাকতে চাইলে দু’টোকে ই সামাল দিতে হবে।”
আশফাক সাহেব আবার চা খাওয়ার দিকে মনোযোগ দেয়। ইফা চা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইল। হঠাৎ টেবিলের দিকে চোখ পড়তে লাফিয়ে উঠল। টেবিল থেকে ডায়েরীর পাতা নিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করল,
~ “এটা তোমার কাছে ছিল?”

~ ” তোর ঘরে একটা পুরোনো ডায়েরী দেখেছিলাম। ওটার অবস্থা খারাপ দেখে ফেলে দিয়েছিলাম ছাদের ট্রাংকে। শেষ পাতা ইন্টারেস্টিং লাগল তাই এনে রেখেছিলাম।”

ইফা খানিকটা ভ্রু কুঁচকে বলল,
~ “এত জায়গা থাকতে ছাদের ট্রাংকে কেন ফেললে? আর শেষ পাতায় কি এমন পেলে?”
~ ” তোর মামীর একটা বদঅভ্যাস আছে পুরোনো ডায়েরী পেলে তার পড়ার শখ জাগে। তখন আর এটার অবস্থা বা কার সেটা দেখবেনা তাই ওইখানে ফেলেছি।

আর শেষ পাতা পড়ে দেখলাম মেয়েটাকে তার বোন মেরে ফেলেছে। যেটা আমার ঠিক বিশ্বাস হলনা। কারণ, প্রথম দুই পৃষ্ঠা যখন পড়েছিলাম তখন তার বোনকে আমার নিতান্ত সহজ-সরল আর আবেগী মনে হয়েছিল।”
~ “উপর থেকে কি মানুষ চেনা যায় মামা? ভালো মানুষের মুখোশ তো যে কেউ পড়ে থাকতে পারে।”

~ “মুখোশ সবাই পড়ে থাকতে পারে কিন্তু সহজ-সরল থাকার ভং সবাই ধরতে পারেনা। আর একজন প্রেগন্যান্ট মহিলা কিভাবে কয়েকবার ছুরি দিয়ে জোরে পোঁচ মারতে পারে যেখানে সে সামান্য টেবিল সরাতে সক্ষম নয়!”
ইফা গালে হাত দিয়ে চট করে ভেবে নেয়, “তবে কি রওনক তার বোনকে মারেনি? কিন্তু এই শেষ পাতা আমি আলফিকে দিবনা। সে আমার অনুভূতিগুলোর কোনো মূল্য দিচ্ছেনা, খুব কঠিন হয়ে আমার সাথে কথা বলছে।”

আশফাক সাহেব ইফাকে চায়ের কাপ ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার ছেলেটার জন্য খারাপ লাগছে। সে যখন বুঝতে পারবে তাদের এক হওয়া হলনা তখন সে কেমন উন্মাদনায় মাতাল হবে! আমি হয়ত আগের অতীত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি কিন্তু সে কি আদৌ পারবে ওই মেয়েটির স্থান অন্য কাউকে দিতে?”

মামার কথায় চমকে উঠে ইফা। তার ভিতরটা এক হাহাকার শূন্যতায় ছেয়ে যায়। এই মূহুর্তে নিজেকে তার বড় অপরাধী মনে হচ্ছে, যেন সে ই আলফি আর রেহজানকে আলাদা করে দিচ্ছে। সারারাত ইফা একফোঁটা ঘুমাতে পারলনা। কখন সে আলফিকে শেষ পাতা দিতে পারবে সেই তাড়নায় ছটফট করছে।

আলফি ইফার দেওয়া পাতায় একবার চোখ বুলায়। পুরোটা পড়ার পর তার ভিতরে ভয়ংকর সাইক্লোন চলছে তাতে ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে রওনক ভাবীর প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। রেহজান যেদিন সে হারিয়েছিল তখন অন্তত এই ভরসায় ছিল রেহজান ঠিক ফিরে আসবে। কিন্তু আজ কেন জানি সেই ভরসা মিলিয়ে যাচ্ছে। চারপাশ থেকে হুংকার আসছে, “রেহজান মারা গেছে।

সে আর কখনো ফিরে আসবেনা।” আলফি কঠিন স্বরে বলল, “সবকিছুর জবাব ভাবীকে দিতে হবে।” আলফি দৌড়ে নিচে নেমে গেল। ইফা শাহরের দিকে চেয়ে বলল, “উনি কোথায় গেলেন? উনার মানসিক অবস্থা ভালো মনে হচ্ছেনা। চলুন, আমরাও উনার পিছু নিই।”

শাহর বাসা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আলফির নাগাল পায়। তার কাঁধে হাত জড়িয়ে বলে, “ভাইয়া আমরাও তোমার সাথে যাব।”

ইফা, শাহর আর আলফি একটা আভিজাত্য বাসায় ঢুকল। বাসাটা ফয়সালাবাদে, লাহোর থেকে ১২০ কি.মি দূরে। আলফি বাসায় ঢুকামাত্র একজন মাঝবয়সী মহিলা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল।

মহিলার ডাকে বাসার বাকিরাও বেরিয়ে এল। ইফা আর শাহর বাসার ভিতরে ঢুকে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইফা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকাল। আলফি মাঝবয়সী মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” আম্মা আমি ভাবীর সাথে কথা বলতে এসেছি। তাকে একবার ডাকো।

” কাউকে ডাকতে হলনা, প্রায় সাথে সাথে একজন শাড়ী পরা শ্যামলা বর্ণের মেয়ে আর প্রায় পাকিস্তানীদের মত দেখতে একজন ছেলে উপর থেকে নেমে এল। ইফা মনে মনে আন্দাজ করে নিল এরাই রেহজানের দুলাভাই আর ভাবী। আলফি রওনকের দিকে এগিয়ে জিজ্ঞেস করল, ~ “সেদিন রেহজানের সাথে কি করেছিলে তুমি?”

কথাটা বলামাত্র রওনকের হাসিমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে উপস্থিত সবার দিকে একনজর তাকিয়ে আলফির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
~ “আমি কি করেছি মানে?” রেহজানের দুলাভাই কিছু বলতে চাইলে আলফি বাধা দিয়ে বলল, ” আমি আর ভাবী কথা বলছি। বলতে দাও, মাঝখানে এসোনা ভাইয়া।”

আলফির কথায় তার ভাই রুস্তম মাঝবয়সী মহিলার কাছে এসে বলল, “আম্মা আলফি রওনককে এসব কি বলছে?” মহিলা শান্তগলায় বলল, ” ওদেরকে কথা বলতে দাও।”
আলফি হাতের ডায়েরীটা উচিয়ে ধরে পুনরায় রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ডায়েরী রেহজানের।

তার সাথে সেদিন ঘটে যাওয়া ঘটনা এখানে লেখা আছে। স্পষ্ট লিখা আছে রওনক ভাবী সেইরাতে তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে।” রওনকসহ উপস্থিত সবাই আতঁকে উঠল আলফির কথায়। ইফা শাহরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ” উনাকে দেখে কেউ বলবেনা উনি কাউকে খুন করতে পারে।

” শাহর ইফার হাত ধরে বলল, ” চুপ থাকুন।” ইফা তার শক্ত করে ধরা হাতের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল।
রওনক অবাক হয়ে বলক, “আমি নিজের বোনকে কিভাবে মারব? এসব রেহজান কেন লিখবে।”
~ ” তাহলে ডায়েরীতে যা লিখা আছে তা মিথ্যা?”

~ “আমি জানিনা। আমি আমার বোনকে মারিনি, এটা কিভাবে সম্ভব? আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। আমি জানিনা ও কোথায় আছে?”

~ “সেদিন শুধু তোমরা দুজন ই বাসায় ছিলে। তাহলে রেহজান কোথায় সেটা তোমার থেকে ভাল কে জানবে?”
~ “আমি সত্যিই জানিনা ভাই। সেদিন ও কোথায় চলে গিয়েছে তার ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।” এইটুকু বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রওনক। ইফার ভীষণ মায়া লাগছে মেয়েটার জন্য। তার নিজেরও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে রওনক রেহজানকে হত্যা করেনি।

কিন্তু ডায়েরীর লেখা সত্য তো ফেলে দেওয়া যায়না। আলফি আর কিছু বলার আগে রুস্তম হুংকার ছাড়ে, “ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিসনা। ও সত্যিই কিছু জানেনা। আমি জানি সব, আর আমি ই করেছি।” আলফি সহ প্রত্যেকে অবিশ্বাসী চোখে রুস্তমের দিকে তাকায়। আলফি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
~ “কি জানো তুমি ভাইয়া?”

পর্ব ১৯

রুস্তম রওনকের কাঁধ শক্ত করে জড়িয়ে বলে, “রওনক এমন কিছু করেনি। সেদিন রেহজানকে আনার জন্য আমি যখন সেই বাসায় গিয়ে পৌঁছাই, তখন রেহজানের রুমে রওনককে অজ্ঞান অবস্থায় পাই।

সারাবাড়ী খুঁজেও রেহজানকে কোথাও পাইনি। টেবিলের উপর এই ডায়েরীটা পড়ে ছিল, সেটা পড়ার পর আমি নিজে’ ই হতভম্ব হয়ে যাই। রেহজান যদি মরে গিয়ে থাকে ওর লাশ কোথায়?

আর কিভাবে’ ই বা এসব ডায়েরীতে লিখে রেখে যাবে? তাও আমি ভয় পেয়ে যাই। তোমরা ডায়েরী পাওয়ার পর হয়ত এতকিছু ভাববে না সোজা দোষ দিবে রওনককে। তাই আমি রেহজানের হাতের লেখা নকল করে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, আমি স্বেচ্ছায় এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমার খোঁজ করোনা।”

আলফি একটু চুপ থেকে বলল,
-” এই মিথ্যা চিঠির জন্য আমাকে কত মানসিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে ভাইয়া সেটা তুমি জানো। অন্তত সত্যটা বলতে পারতে। আমি জানি, ডায়েরীতে লিখা মৃত্যুর কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সেটা আমি ডায়েরী পড়ার পর পর ই বুঝেছিলাম। মারার যাওয়ার পর সে কিভাবে এসব ডায়েরীতে লিখে যাবে! তাও এতক্ষণ বললাম শুধু সত্যটা জানার জন্য।” রওনক চোখ চকচক করে বলল,
~ “তাহলে আমার বোন মরেনি, কিন্তু কোথায় আছে সে?”

ইফা বিস্ময়ের ঘোরলাগা কন্ঠে বলল, “এটা তো একবারো আমার মাথায় আসেনি। ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই আপনাদের এসব বলে ফেলেছি।” শাহর ইফার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ “ডায়েরী পড়ার পর ভাইয়া সেটা ধরে ফেলেছিল।”

~ “তাহলে এতক্ষণ ডায়েরীর লেখার সূত্র ধরে উনাদের জেরা করছিলেন কেন?”
শাহর ইফার বোকা প্রশ্নে হোচট খায়। তাও নিজে সামলে নিয়ে বলে, “ভাইয়ার সন্দেহ উনারা কিছু জানেন সেটা লুকাচ্ছেন। তাই এভাবে জেরা করে সত্য বের করলেন।”

ইফা অস্ফুটস্বরে বলল, “আলফি শুধু হ্যান্ডসাম ই নয়, ব্রিলিয়ান্ট ও।” আলফি রওনকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,
~ “সেদিন তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে কিভাবে? তখন রেহজান কোথায় ছিল?”

~ “আমি রেহজানের রুমে আসামাত্র দেখি সারাগায়ে চাদরমুড়ানো এক ভয়ানক ব্যক্তি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে রেহজানকে দেখলামনা। সেই ব্যক্তির হাতে বেশ বড় বড় নখ ছিল, সে আমাকে আচড়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসছিল। আচড় দেওয়ার মূহুর্তে আমি জ্ঞান হারালাম।”

~ “এই সত্যগুলো একবছর না লুকিয়ে রাখলে আমি হয়ত এতদিনে রেহজানকে খুঁজে বের করতাম। তোমরা এটা কিভাবে করলে আমার সাথে?”

রওনক কাপা কাপা কন্ঠে বলল, “তোমার ভাই আমাকে সেদিনের ব্যাপারে কোনো কথা বলতে নিষেধ করেছিল।”
রুস্তম আলফির কাধে হাত রেখে বলল, “আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তোর ভাবীকে বাঁচানোর জন্য আমই মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছি।”

আলফি মাঝবয়সী মহিলার কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলল, “এই পরিবারকে আমি নিজের পরিবার ভেবে এসেছি। তোমাকে নিজের জন্মদাত্রী মায়ের মত ভালোবাসি। তুমি চাওনি বলে আমার আসল পিতা-মাতা আমাকে ফিরিয়ে নিতে আসলেও আমি যাইনি।”

মহিলা আলফির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আমি তোকে কখনো ভালো রাখতে পারিনি। এইসব কিছুর জন্য দায়ী আমি। আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস।”

আলফি অন্ধকারে চুপচাপ ছাদে বসে আছে। রুস্তম ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে আলফির দিকে তাকিয়ে আছে। তার সাহসে কুলাচ্ছেনা আলফির কাছে গিয়ে কথা বলার। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। আলফি পিছনে না তাকিয়ে বলল, “ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন ভাইয়া? এখানে এসে বসো।”

আলফির কথায় রুস্তম ভরসা পায়না তাও ধীর পায়ে আলফির পাশে এসে বসে। আলফিকে সে কখনো তার সাথে এত গম্ভীর হয়ে কথা বলতে দেখেনি। হয়ত আজও দেখত না যদি সে মিথ্যা না বলত। রুস্তম সংকোচ নিয়ে বলে, ~ “তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আমার। তবুও বলতে চাই, আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি একজন দোষী।”

আলফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর একটু চুপ থেকে বলে,
~ “ভাইয়া তোমার মনে আছে? যেদিন আমি অজ্ঞান-ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় রওনক ভাবীকে নিয়ে বাসায় ফিরে তোমাকে বলেছিলাম ওকে গ্রহণ করো।

সবসময় ওকে আগলে রেখো, কোনো বিপদের আঁচ তার উপর পড়তে দিওনা। তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই কথা দিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিলে। একবারো তার পরিচয় জিজ্ঞেস করোনি, শুধু বলেছিলে তাকে আমি কোথায় পেয়েছি।”

~ “তুই উত্তরে বলেছিলি জ্বীনের কারণে তার এই অবস্থা। পরে রওনকের কাছে জেনেছিলাম ও জ্বীনের প্রতি খুব বেশী কৌতূহলী ছিল। যার ফলাফল একদিন খারাপ জ্বীনের পাল্লায় পড়েছিল। আমি ই নাকি সেদিন ওকে রক্ষা করেছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার রুপ ধরে তুই ওকে খারাপ জ্বীনের কবল থেকে উদ্ধার করেছিস।”
~ ” তুমি কিন্তু এখনো আমাকে দেওয়া সেই কথা রাখছো, তাহলে তুমি আমার চোখে কিভাবে দোষী হবে ভাইয়া?

রুস্তম উত্তর দিতে পারেনা, তার ভীষণ কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে নিজেকে সামলানোর অদম্য চেষ্টা করে বলল, “আমি চেয়েছিলাম রেহজান সব জেনে ই তোকে গ্রহণ করুক। আমি চাইছিলামনা রওনকের মত কেবল আকৃষ্ট হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিক।”

~ ” সেটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার হয়ে তুমি ব্যাপারটা জানিয়ে দেওয়ায় আমি আশ্বস্ত হয়েছিলাম। আমি হয়ত কোনোদিন বলতে পারতামনা।”
~ “রেহজানকে খুঁজে বের করবিনা?” আলফি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ” জানিনা ও কোথায় আছে? তবে খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করব।”

ইফা বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে আশফাক সাহেব একটু বকাঝকা করেছে না বলে কোথায় গিয়েছিল সেই প্রসঙ্গে। ইফা কিছু বলেনি বলে আরো বেশী বকা খেয়েছে। সেসব নিয়ে অবশ্য তার মন খারাপ নয়। তার মন ভার হচ্ছে আলফির কথা ভেবে। রেহজানের মিথ্যা চিঠি পেয়েও আলফি রেহজানকে ভুলে যায়নি, তার উপর রাগ পুষে রাখেনি। এই এক বছর চুপচাপ তার ফেরার অপেক্ষা করেছে।

আচ্ছা ভালোবাসা বুঝি এটাই? এতদিন ইফা ভেবেছিল সে আলফিকে ভালোবাসে। এখন মনে হচ্ছে, সে ভালোবাসার মানে টাই জানেনা। শাহর তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইফার দিকে তাকিয়ে আছে। আশফাক সাহেব বকা দেওয়াতে হয়ত তার মন খারাপ। শাহর দ্বিধায় পড়ে একবার যাবে ইফার কাছে! এই চঞ্চলা মেয়েটাকে চুপচাপ স্বভাবে একদম মানাচ্ছেনা, এভাবে দেখে তার বুকেও ফাকা ফাকা লাগছে। অস্বস্তি হচ্ছে।

মেয়েটার প্রতি তার একটা সুক্ষ্ম টান আছে, যেটা সে প্রায় সময় অনুভব করে। সেরাতে ইফাকে এতজোরে চড় মারতে তার খারাপ লেগেছিল বটে কিন্তু ইফার মাথা থেকে জ্বীনের ভূত নামানোর আর বিকল্প উপায় তার জানা ছিলনা।

যখন জেনেছে ইফা আলফির প্রতি দূর্বল। তখন নিজেকে ভীষণ রিক্তশূন্য লাগছিল। এক তীব্র যন্ত্রণা তাকে প্রতিটি মূহুর্ত কষ্ট দিচ্ছিল যা সইতে না পেরে সে আলফিকে অনুরোধ করেছিল একবার ইফার সাথে এই নিয়ে কথা বলতে। কখন যে আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়া শুরু করল ইফা টের পেলনা। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেলেও তার উঠতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। ভালো লাগছে এভাবে বসে ভিজতে।

ভিতরটা হালকা হচ্ছে ক্রমশ। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা তুলে তাকায় সে। শাহর তার মাথার উপর ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে তার পানে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শাহরের দৃষ্টি তার বুকে ছোটখাট তোলপাড় সৃষ্ট করল। শাহর ইফার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, ইফা কাপতে কাপতে হাত ধরে উঠে দাড়াল।

শাহর তার টি-শার্টের নিচের অংশ দিয়ে ইফার মাথা মুছার চেষ্টা করে। তারপর ইফা মাথা তার বুকের কাছে ঠেকিয়ে শার্ট দিয়ে ঢেকে দেয় খানিকটা। ইফা সবকিছু চুপ হয়ে দেখতে থাকে। তার নিজের ও কোথাও জানি ভালোলাগা কাজ করছে।

ঝড়ো হাওয়া চোখ বুজে অনুভব করছে আলফি। রুস্তম সেই কখন তাকে নামতে বলে নেমে গেছে, কিন্তু আলফির নামতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। রেহজানের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত তার মস্তিষ্কে কড়া নাড়ছে। আশার সঞ্চার করছে রেহজান নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।

এতগুলো দিনের অপেক্ষা বৃথা যাবেনা। বৃষ্টির ফোটা ধীরে ধীরে জোরে পড়া শুরু করেছে। আলফির গায়ের সাদা শার্ট অল্পতে ভিজে গেছে। আলফির টনক নড়েনি, তার মনে হচ্ছে রেহজান এক্ষুনি ফিরে আসবে। পাশ থেকে একটা পরিচিত কন্ঠে চমকে উঠল আলফি। ফিরে তাকিয়ে দেখে রেহজান দাঁড়িয়ে আছে।

রেহজান তার গায়ের ওড়না দিয়ে আলফির মাথা ঢেকে দেয়। আলফি বুঝতে পারছেনা এটা কি তার ঘোর নাকি বাস্তব? তার মুখে কোনো কথা সরছেনা। আগের মত একটানে রেহজানকে টেনে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে রাখে সে। এক অন্যরকম প্রশান্তি তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে। বৃষ্টি বাড়ছে, কিন্তু আলফির ফেরার তাড়া নেই। রেহজানকে ছাড়তে তার প্রচন্ড ভয় করছে। ছাড়লেই বুঝি এই ঘোর ভেঙ্গে যাবে!

পর্ব ২০

খানিকবাদে বৃষ্টির তোড় কিছুটা কমে এসেছে। আলফি বোজা চোখ খুলে রেহজানের দিকে তাকায়। এতক্ষণ তার মনে হচ্ছিল সে কল্পনার জগতে ছিল।

কিন্তু রেহজানকে এখনো তার বুকে দেখে তার বুকের ভিতরে খুশির মাতোয়ারা বয়ে যায়। সে রেহজানের গাল দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে বলল, ” তুমি সত্যিই ফিরে এসেছো রেহজান?” রেহজান অশ্রুসিক্ত চোখে আলফির দিকে তাকায়। আলফির হাত আলতো করে স্পর্শ করে বলল, “আমি আপনার কাছে ফিরে এসেছি।” আলফি ব্যাকুলচিত্তে প্রশ্ন করে,
~” এতদিন কোথায় ছিলে? কি হয়েছিল সেদিন রাতে?”

রেহজান উত্তরে নিস্তব্ধ থাকে। তারপর একটু সময় নিয়ে বলে, ~” সময় হলে আমি নিজে থেকে সব বলব। এখন এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেননা।” আলফি ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ঠিক আছে। এখন নিচে চলো, সবাইকে বলি তুমি ফিরে এসেছো।” আলফি রেহজানের হাত টেনে নিচে নামতে উদ্ধত হলে রেহজান যেতে চায়না। আলফি কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে রেহজান?”

রেহজান স্বাভাবিক গলায় বলে, “আমাকে দু’টো দিন সময় দিতে পারবেন?” আলফি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কিসের জন্য?”
~ “আমাকে দু’টো দিন অন্য কোথাও নিয়ে যাবেন? আমি এখন কারো মুখোমুখি হতে চাচ্ছিনা। একটু সময় প্রয়োজন। আপনার সাথে কোথাও একান্ত কিছু সময় কাটাতে চাই।”

রেহজানের এমন প্রস্তাবে আলফি অবাক হলেও কিছুটা খুশি হয়। কতগুলো দিন সে রেহজানের অপেক্ষা কাটিয়েছে, এখন সত্যিই তাদের নিজস্ব কিছু সময় কাটানো প্রয়োজন। রেহজান যেহেতু চায়নি তাই আলফি রেহজানের ফেরার কথা কাউকে বলেনি। পরেরদিন ভোর হতেই চুপিচুপি রেহজানকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে।

ইফা একমনে ছাদের কোণের দেবদারু গাছের দিকে চেয়ে আছে। হালকা বাতাসে দেবদারু গাছের পাতাগুলো নড়ছে, সেটার দিকে তাকিয়ে ইফা গভীরচিন্তায় মগ্ন। কালরাতের ঘটনা তার হৃদয়ের অক্ষপটে বারবার ভাসমান হচ্ছে। কাল শাহরের বুকে মাথা রেখে সে যে প্রশান্তি অনুভব করেছিল সেটা আগে কখনো পায়নি। ইফা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেই দীর্ঘশ্বাসে এতদিন আলফির জন্য করা পাগলামী, আবেগের আফসোসমিশ্রিত ছিল। নিচতলায় নেমে ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় ইফা। গেইটের কাছে আলফিকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠে সে। আলফির পিছন থেকে শাহর বেরিয়ে ইফার দিকে এগিয়ে আসে।

~ “ইফা তোমার মামা কোথায়?” ইফা বিস্মিত গলায় বলে,
~ “বাসায় আছে। এই সকালবেলা আলফি এখানে কেন?”
~ “জানতে পারবে। তুমি মামাকে ডেকে নিয়ে এসো।”

ইফার চাসহ ট্রে নিয়ে সামনের ঘরে এসে দাঁড়ায়। এখানে আশফাক সাহেব, শাহর, আলফি আর এক অপরিচিত মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি নিকাব পড়া তাই ইফা তার মুখশ্রী দেখতে পাচ্ছেনা। ভ্রু কুঁচকে একবার মেয়েটির দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে সবাইকে চা পরিবেশন করে। আশফাক সাহেব গলা পরিষ্কার করে বলেন, ” নাহারের মা মারা যাওয়ার পর থেকে ২য় তলা খালি ই পড়ে আছে।

অবশ্য আমাদের কিছু ফার্নিচার আছে। সেটা ভাড়া দিতে কোনো অসুবিধা নেই। তা আপনারা শুধু দুজন’ই থাকবেন?” আলফি চায়ের কাপ হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলল, “জ্বি। আমি আর আমার স্ত্রী কিছুদিনের জন্য ২য় তলা ভাড়া নিতে চাচ্ছি। পুরো মাসের এডভান্সড পেমেন্ট করতে আপত্তি নেই।” আশফাক সাহেব হেসে বললেন,
~” সমস্যা নেই। কবে থেকে উঠবে?”

~ “আজ থেকেই।” আশফাক সাহেব ভ্রু কুচকে একবার আলফির দিকে তাকালেন। তার মনে হচ্ছে, এরা দুজন পালিয়ে বিয়ে করেছে। এই কাজটিকে তিনি কখনো’ই সমর্থন করেননি। কিন্তু প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার পর থেকে একটা আফসোস কাজ করেছিল কেন তখন তিনি এই সিদ্ধান্ত নেননি! ইফা আলফির কথায় অবাক হয়ে পুনরায় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, “এক রাতে আলফি বিয়ে করে ফেলল! রেহজানকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা তার পক্ষে কিভাবে সম্ভব হল?

” মনে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে বারবার ঘুরে মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে ইফা। মেয়েটি পাথরের মত নিশ্চুপ বসে আছে। আলফি ২য় তলার চাবি নিয়ে মেয়েটির হাত ধরে উপরতলায় চলে যায়। ইফা হা করে সেটা তাকিয়ে দেখে। শাহর বেরিয়ে আসামাত্র তার হাত চেপে ধরে বলল, ” আলফি একরাতের মধ্যে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল! আর বিয়ে করলেও নিজের বাসা ছেড়ে এখানে কেন উঠল?” শাহর মুচকি হেসে বলল,
~ “সব জানতে পারবে।

আগে নবদম্পতিকে সংসার গুছিয়ে নিতে দাও, তখন গিয়ে আলাপ করে জেনে এসো।”
শাহর এভাবে কথা এড়িয়ে যাওয়ায় ইফার অভিমান হয়। শাহর সবকিছু জেনেও তাকে কেন বলতে চাচ্ছেনা! সাত-পাঁচ ভেবে ইফা ২য় তলার দিকে পা বাড়ায়। এসে দেখে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। ইফার অভিমান আরো বাড়ে, কেন জানি তার এখন হিংসে হচ্ছে। মুখ ভেঙ্গচিয়ে মনে মনে বলে, ~” আসা মাত্র রোমান্স শুরু করতে হয় নাকি!”

রেহজান নিকাব খুলে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। অনেকদিন পর সে শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। আলফি একপলক রেহজানের দিকে তাকায়। আগের থেকে কিছুটা শুকিয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন সে শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। চেহারা দেখে অনেক মায়া হচ্ছে তার। রেহজান চট করে উঠে বসে বলল, “আমার জন্য কিছু শাড়ি-কুর্তি নিয়ে আসবেন।

কাল রাতে কার না কার কুর্তি নিয়ে এসেছেন তাও ওড়না-সেলোয়ার ছাড়া।” আলফি লজ্জায় মাথা চুলকায়। রুম থেকে বেরিয়ে এসে শাহরের ঘরে দিকে যায়। সকাল থেকে দুজনের কিছু খাওয়া হয়নি তার উপর একেবারে ফাকা হাতে বাসায় উঠেছে। কিছু টুকটাক কেনাকাটা করে আনবে। শাহর আর আলফিকে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যেতে দেখে ইফা ভ্রু কুচকে তাকায়। এই সুযোগে একবার আলফির বউকে দেখে আসাটা মন্দ মনে হয়না তার।

২য় তলায় এসে দরজায় কড়া নাড়ে ইফা। রেহজান চোখ পিটপিট করে দরজার দিকে তাকায়। আলফি সবেমাত্র বেরিয়েছে, এত তাড়াতাড়ি তো ফেরার কথা নয়। তবে কি নিচতলার কেউ এসেছে? দরজা খোলা রেহজানের কাছে এখন সেইফ মনে হলনা।

সে নিচুগলায় হাক ছাড়ে,
~ “মাফ করবেন, বাসায় কেউ নেই।” ইফা কথাটা শুনে হতাশ হয়ে নিচে নেমে আসে। পরক্ষণে ভাবে, তাকে কি বোকা বানাল হল! বাসায় কেউ না থাকলে হাক ছাড়ল কে? আর তাকে ভিক্ষুক ধরে নিয়েছে নাকি?” নিজের বোকামির কারণে নিজের উপর রাগ হল তার। এখনো মাথায় একটু বুদ্ধি হলনা।

রেহজান আলফির আনা কয়েকটা শাড়ি থেকে বেছে মেরুন রঙ্গের শাড়ি পড়েছে। লম্বা চুলগুলো নিচু করে খোপা করেছে। আলফি অপলক রেহজানের দিকে তাকিয়ে আছে। কতদিন পর এই হাসি-খুশি রেহজানকে দেখছে সে। রেহজানের দু-একটা চুল ছাড়া পেয়ে মুখের সামনে চলে এসেছে। তাতেই তাকে বেশ অপূর্ব দেখাচ্ছে। রেহজান আলফির পাঞ্জাবীর বোতাম নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, “চলুন বাহিরে থেকে বেড়িয়ে আসি।” আলফি মনে মনে অনেক খুশি, রেহজানের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত তার স্বর্গীয় মনে হচ্ছে। এমনসময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে আলফি দরজা খুলে। ইফা শাহরের হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শাহর প্রাণপণে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।

ইফা আলফিকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে। আলফি গাঢ় সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে তাতে তাকে নুরানী লাগছে। আলফি ভ্রু কুচকে বলল,
~ “এই সন্ধ্যাবেলা তোমরা এখানে?” শাহর অসহায়দৃষ্টিতে আলফির দিকে তাকায়। ইফা রুমের ভিতরে চারিদিকে একবার দৃষ্টি ঘুরায়। তারপর বলে উঠে,
~ “আপনি নাকি রেহজানের জন্য অপেক্ষা করছেন?

তাকে ভালোবাসেন! তাহলে এক রাতের মধ্যে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে নিলেন কিভাবে?” ইফার উচ্চচিৎকার শুনে রেহজান বেরিয়ে আসে।

অবাকদৃষ্টিতে ইফা’দের দিকে তাকায়। আলফি মুখ চেপে হেসে বলল, ” আমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছি সেটা তোমায় কে বলল?” ইফা কিছু বলার আগে তার চোখ পড়ে রেহজানের দিকে। মায়াবী চেহারার একটা শাড়ি পড়া মেয়ে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। কোনো সাজ-গোজ ছাড়াই মেয়েটাকে দেখতে বেশ মিষ্টি লাগছে।

~ “আপনি জানেন না উনার একটা বিয়ে করা বউ আছে?”

রেহজান চিন্তিত হয়ে আলফির দিকে তাকায়। আলফি রেহজানের কাধ জড়িয়ে কাছে টেনে ইফার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও ই রেহজান।” ইফা চমকে উঠে আবার রেহজানের দিকে তাকায়। রেহজান ফিরে এসেছে এটা তার বিশ্বাস ই হচ্ছেনা।

আলফি পুনরায় বলল,
~ “রেহজান ফিরে এসেছে। এর বেশী আর কিছু জানতে চেয়োনা এখন। আমরা বের হচ্ছি, তোমরা যাবে আমাদের সাথে?” শাহর আপত্তি করতে নিলেও ইফা সায় দিল। রেহজানকে দেখে ইফার ভীষণ হিংসে হচ্ছে। আলফি আর রেহজান হাত ধরাধরি করে বসে চা খাওয়ার দৃশ্য দেখে ইফা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।৷ আলফির প্রতি তার ভালোবাসা না থাকলেও ভালোলাগা ছিল।

সেই ভালোলাগা থেকে তার খানিকটা খারাপ লাগছে। তার ও ইচ্ছে হচ্ছে কাউকে নিয়ে এভাবে বসে চা খেতে। এমনসময় শাহর ইফাকে একটানে নিজের দিকে টেনে নেয়। তারপর ধমকের সুরে বলল,
~ “একটু কেয়ারফুলি থাকবানা, এক্ষুনি বাইকের সাথে ধাক্কা খেতে।

” ইফার কানে শাহরের কথা ঢুকছেনা, সে এক আবেশদৃষ্টিতে শাহরের দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, শাহরের কাছে আসলে তার এমন প্রশান্তি কাজ করে কেন? আশেপাশের সবকিছু ভুলে যায়! এটা কি ভালোবাসা নাকি ভালোলাগা? রেহজান আলফির সাথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর একদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, “আলফি আমাকে এই মূহুর্তে বিয়ে করতে পারবেন?”

রেহজানের কথায় হোচট খায় আলফি। এমন একটা প্রস্তাব তার কল্পনার বাহিরে ছিল। রেহজানের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকায় আলফি। সামনে কমিউনিটি সেন্টার, সেখানে বিয়ের আয়োজন চলছে। রেহজানের সামনে এসে দাঁড়ায় আলফি, তারপর দুহাত দিয়ে গাল জড়িয়ে ধরে বলল,
“অবশ্যই, চলো।” রেহজান অবাকদৃষ্টিতে আলফিকে অনুসরণ করতে থাকে।

পর্ব ২১

হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে রেহজান। চোখ মেলে দেখে মাস্ক পড়া এক আগন্তুক তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ার্ত চোখে ধড়পড়িয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। আগন্তুক তার মুখোমুখি বসে শব্দ করে হাসে। তারপর ফিসফিস কন্ঠে বলে, “আমি আগেই বলেছি পালানোর চেষ্টা করিসনা।

ফলাফল খুব খারাপ হবে।” রেহজান আগন্তুকের মুখায়ব থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলে,
~ “আমাকে এভাবে আটকে রেখে কি কাজ হাসিল করতে চাচ্ছেন?” আগন্তুক হাসে কিন্তু নিঃশব্দে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে রেহজানের দিকে ঝুঁকে বলল, “হাসিল করার সময় তো মাত্র ই এলো। তুমি তোমার পরিবারের কাছে যেতে পারবে তবে একশর্তে।” রেহজান কপাল কুচঁকে বলল, “কি শর্ত?”

আগন্তুক সরে গিয়ে আগের স্থানে বসে।
আলফি একদৃষ্টিতে রেহজানের দিকে তাকিয়ে আছে। রেহজান কেমন জানি উশখুশ করছে। ইফা আর শাহর একে অপরের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে। আলফি রেহজানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এত অস্বস্তিবোধ করছো কেন? একজন হুজুর তোমার সাথে একান্ত কিছু কথা বলে বিয়ের আয়োজন করবেন।

রেহজান চমকে উঠে আলফির দিকে তাকায়। ধরা পড়া অপরাধীর মত ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, ” হুজুর কিসের জন্য?” আলফি রেহজানের হাত টেনে ছাদে নিয়ে আসে। সজোড়ে এক থাপড় দিয়ে বলে,
~ “চালাকি করার চেষ্টা করোনা। তুমি ধরা পড়ে গেছো। নিজের আসল রূপে এসো এক্ষুনি। নতুবা তোমার এমন অবস্থা করব আর নিজের জায়গা ফিরতে পারবেনা।”

মেয়েটি রেহজানের রূপ পরিবর্তন করে নিজের রূপে আসল। আলফি মেয়েটির দিকে একনজর তাকল। শ্বেতবর্ণ গায়ের রং, পরনে ঢোলা জোব্বার ন্যায় বস্ত্র, চোখ দুটো ভিতরের কোটরে ডেবে আছে। আলফির মনে হচ্ছেনা সে আগে কোথাও মেয়েটিকে দেখেছে। মেয়েটিকে প্রশ্ন করে,
~ “কে তুমি? রেহজানের রূপ ধরে কেন এসেছো?”

মেয়েটি চোখ তুলে আলফির দিকে তাকায়। তার চোখগুলো যেন জ্বলন্ত আগুনের কুন্ডলী। আলফির বুঝতে দেরী হলনা মেয়েটি একজন জ্বীন। মেয়েটি খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। এভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া আসলেই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, তাতে আলফি তাকে সন্দেহ করেছে।

~ “আমি এসেছি আপনাকে জ্বীন রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। অনুগ্রহ করে আপনার আসল জগতে ফিরে চলুন।”
আলফির মাথায় রাগ চড়ে যায়।

ক্রোধান্বিত গলায় বলল,
~ ” রেহজান কোথায়? সত্যিটা যদি না বলো তবে এক্ষুনি আমি তোমাকে মারতে উদ্যত হবো।” মেয়েটি ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়। পিছন থেকে ডাক আসে, “আলফি”।

আলফি পিছু ফিরে তাকায়। রেহজান তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, রেহজানের মাথার একপাশে ব্যান্ডেজ। আলফি অবাক হয়ে রেহজানের দিকে ভালো করে তাকায়। রেহজানের লম্বা চুল এলোমেলো হয়ে আছে, পরনে মেয়েটির মত’ই ঢোলা কালো জোব্বা। চেহারায় ভীষণ ক্লান্তির ছাপ। আলফি রেহজানের দিকে এগিয়ে আসে।

রেহজান কাতরদৃষ্টিতে আলফির দিকে তাকায়। আলফির আর ভুল হয়না আসল রেহজানকে চিনতে। এই দৃষ্টি যে তার বড়ই পরিচিত। রেহজানকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আলফি খেয়াল করে মেয়েটি পালাচ্ছে। আলফি পিছু নিতে গেলে রেহজান তার হাত চেপে ধরে আটকায়। আলফি মেয়েটির কথা ভুলে রেহজানের দিকে নজর দিয়ে বলল, ” তুমি কোথায় ছিলে এতদিন?

মাথায় আঘাত পেলে কি করে?” রেহজান নিভু নিভু দৃষ্টিতে আলফির দিকে তাকায়। তার চোখের সামনের সবকিছু আধার হয়ে আসছে, মাথা হালকা ঘুরছে। রেহজান অবশের মত আলফির বুকে ঢলে পড়ল।
রেহজানের জ্ঞান ফিরে এসেছে, আলফি তাকে ফু দিয়ে স্যুপ খাওয়াচ্ছে। দেখে ইফা খানিকটা স্বস্তি পায়। আলফি-রেহজানের জুটি দেখে ওর মন জুড়িয়ে যায়।

অনেকক্ষণ হল শাহরকে আশে-পাশে দেখতে পাচ্ছেনা সে। কেমন জানি ছটফট লাগছে! ইফা বেশ কয়েকবার শাহরের বারান্দায় পায়চারি করতে করতে শাহরের ফেরার অপেক্ষা করতে লাগল। এর মধ্যে কখন যে শাহর তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা সে টের পেলনা। শাহরের কন্ঠে নিজের নাম শুনে ফিরে তাকায় ইফা। শাহরের চোখে-মুখে বিষণ্ণতার ছাপ।

যা দেখে ইফার অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। ইফা প্রশ্ন করে, “আপনি ঠিক আছেন তো?” শাহর সম্বিৎ পেয়ে চোখ তুলে ইফার দিকে তাকায়। তারপর ইফাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, “হয়ত কথাগুলো বলার আমার আর সুযোগ হবেনা। আমি চেয়েছি সময় নিয়ে এগোতে, কিন্তু মাঝপথে থেমে যেতে হবে ভাবতে পারিনি।”

ইফা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শাহর তাকে জড়িয়ে ধরার সাথে তার শরীরের শিরা-উপশিরায় এক ঠান্ডা অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে। হৃদস্পন্দনের শব্দ প্রখর হচ্ছে। এক ভালোলাগার ঘোর তাকে চারিদিক থেকে আবিষ্ট করে আছে। ইফা কম্পিত গলায় বলে, ” আপনার কথা ঠিক বুঝলামনা।”
~ “আচ্ছা ইফা আমি আপনার প্রতি এত মুগ্ধ কেন?

আপনার চঞ্চলতা, বোকামি, হাসিমুখ আমাকে এত আনন্দ দেয় কেন? আপনাকে ভালো না বাসার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু আপনি আমাকে আপনার ভালোবাসায় বন্দি করেই ফেললেন।” ইফা কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা।

সেও তো শাহরকে ভালোবাসে কিন্তু তা মুখ ফুটে বলার মত সাহস তার এখনো হচ্ছেনা। শাহর একটু চুপ থেকে ইফাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিনা এর উত্তর নাহয় আমার অজানা থাক। আপনাকে ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছি এটা’ই আমার প্রশান্তি।” ইফাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শাহর ঘরে ঢুকে যায়।

শাহর, ইফা, রেহজান, আলফি আর রেহজানের বোন-দুলাভাই সবাই একত্রে গোল হয়ে বসে আছে। রেহজানের মুখে সবকিছু জানার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। রেহজানের ডানহাত মুঠোয় নিয়ে রওনক মাথা নিচু করে নিশ্চুপে কাঁদছে। রেহজান হালকা ধমকের সুরে বলল,
~ “ফ্যালফ্যাল কাঁদার অভ্যাস পরিবর্তন কর।

আমি এখনো বেচে আছি।” রওনক বকা শুনেও কান্না থামায় না। রেহজান আলফির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যখন নতুন বাসায় উঠি তখন ই খেয়াল করেছি কোনো এক আগন্তুক রাতে সেই বাসায় প্রবেশ করে। তাকে কাছ থেকে দেখতে গেলে সে আমার হাতে থুতু ছিটায় তাতে আমার হাতে ফোস্কা পড়ে যায়। বিয়ের দিন জানতে পারি সেই আগন্তুক আপুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া খারাপ জ্বীন।

সে নানাভাবে আপুর ক্ষতি করার চেষ্টা করছে, পেটের বাচ্চা নষ্ট করতে চাইছে। সেই আগন্তুক আমাকে সেদিন মারতে ধেয়ে আসে আর আমার ডায়েরীতে আপুর কথা উল্লেখ করা। যাতে সবাই আপুকে দোষী সাব্যস্ত করে তাড়িয়ে দেয় আর জ্বীন তাকে নিজের দখলে নিয়ে আসতে পারে।” রেহজানের কথা শুনে রুস্তম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “সেই জ্বীন তোমাকে বন্দি করেছিল?”

রেহজান ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
~ ” নাহ, সে আমাকে মারতে চেয়েছিল। তার হাত থেকে আমাকে রক্ষা করে আলফির জন্মদাত্রী মা। তিনি ই আমাকে বন্দি করে রাখেন। উনার ধারণা ছিল, আমাকে না পেয়ে আলফি তাদের কাছে ফিরে যাবে আর তারা নিজের পছন্দের জ্বীনজাতির কাউকে পুত্রবধূ বানাবেন।

তাতে যখন কাজ হলনা, উনি বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করলেন আলফিকে নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নেওয়ার।” এইটুকু বলে শাহরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমিও তো তোমার ভাইকে ফিরিয়ে নিতেই এসেছো তাইনা?” শাহর এই প্রশ্নের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল।

সে মাথা নিচু করে বলল,
~ “আম্মা আমাকে সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি জানতামনা আপনি তার হাতে বন্দি। ভাইয়াকে ফিরিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম আমি। পরে আপনার সাথে ভাইয়ার এত মহাব্বত দেখে আমি বিমুগ্ধ হয়েছি। আম্মাকে অনুরোধ করেছি উনি যেন এই প্রচেষ্টা বন্ধ করেন।”

~ “আপনি যখন নাকোচ করেন তখন তিনি আমার বেশে একজন জ্বীন মেয়েকে পাঠান। উনি ভেবেছেন, তাকে দিয়ে জ্বীনরাজ্যে ফেরত আনবেন আলফিকে। কিন্তু যখন সেও ব্যর্থ হয় উনি বাধ্য হয়ে আমাকে পাঠিয়েছেন আলফি বুঝাতে।”

আলফি রাগান্বিত চেহারায় রেহজানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কিছুতেই যাবনা। এদেরকে আমার আম্মা-আব্বা ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে। আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কিসের এত আক্ষেপ তাদের? ৫বছর বয়সে যারা আমাকে একা ফেলে যেতে দ্বিধাবোধ করেনি।”

রেহজান শান্ত কন্ঠে বলে, “আপনাকে তো ফিরে যেতেই হবে। আপনি যদি না ফিরে চান এটা ভেবে আমি আপনাকে গ্রহণ করব। তবে ভুল! এতকিছুর পর আপনাকে গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব, আমার অনুরোধ আপনি আপনার আম্মা-আব্বার কাছে নিজের স্থানে ফিরে যান।”

রেহজানের কাছ থেকে এমন কথা আশা করেনি আলফি। তার আর কিছু বলার থাকলনা। চোখের পানি আড়াল করে শাহরের উদ্দেশ্যে বলল, “রাতে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও।”
শাহর ইফার হাত শক্ত করে ধরে জল ছলছল করা চোখে বলল, “আমি আমার ভালোবাসা নিয়ে ফিরে যাচ্ছি।

আপনি ভালো থাকবেন। আর কখনো হয়ত আমাদের দেখা হবেনা, তবে সবসময় আপনাকে ভালোবাসব।” ইফা খুব ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে, চাইলেও যেন সে কিছু বলতে পারছেনা। শাহর ইফার কপালে হালকা করে ঠোট ছোয়াল। অনিচ্ছাকৃত মুচকি হেসে বলল, “আল্লাহ হাফেজ।”

আলফি রেহজানের পাশে এসে দাঁড়াল। রেহজান অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। আলফি নিচুকন্ঠে বলল, “আমার জন্য তুমি অনেককিছু সহ্য করেছো তার জন্য আমি সত্যই দুঃখিত। আশা করি আমি ফিরে যাওয়ার পর তোমাকে আর কোনো খারাপ কিছুর মুখোমুখি হতে হবেনা। ভালো থেকো।” রেহজান চুপ করে রইল। আলফি একপলক রেহজানের দিকে তাকিয়ে ওকে একটানে বুকের কাছে এনে জড়িয়ে ধরল। রেহজান ছাড়া পাওয়ার চেষ্টায় সামান্য হাত ছুড়ল।

আলফি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, ” এটা’ই শেষবার।” রেহজান চুপ করে আলফির বুকে পড়ে রইল। শাহরের ডাক শুনে আলফি রেহজান কে ছেড়ে দিয়ে অন্ধকার বারান্দায় মিলিয়ে গেল। একবারের জন্য ও ফিরে তাকালনা। রেহজান শুকনোমুখে অপলক সেইদিকে চেয়ে রইল।

পর্ব ২২

রওনক চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একবার রেহজানের দিকে তাকায়। রেহজান গম্ভীর মুখে চা খেতে ব্যস্ত। ওর চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই তার মনে কি চলছে! অভিব্যক্তি সবসময়ের মত চুপচাপ আর স্পষ্টবাদী। রওনকের আলফির কথা ভেবে ভীষণ খারাপ লাগছে।

নিজের জ্বীন আসক্তির জন্য কতজন ভোগান্তিতে পড়েছে! রেহজান এমনটা কেন করল ভেবে পাচ্ছেনা রওনক। সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করার মত সাহস হচ্ছেনা। নীরবতা ভেঙ্গে রওনক সংশয়পূর্ণ অভিব্যক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,
~ “তোর কি আলফির জন্য একটুও কষ্ট হচ্ছে?”

রেহজান চা’য়ে চুমুক দেওয়া বন্ধ করে সটান হয়ে চুপ করে থাকে। তারপর ঠোট দুটো প্রসারিত করে রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ “কষ্ট হবে কেন? আমি তাকে তার নিজস্ব স্থানে পাঠিয়েছি যেখানে তার থাকার কথা। আর সেখানে’ই সে ভালো থাকবে।”
রেহজানের এমন কথায় রওনক অবাক হলনা।

সে এমনটা’ ই আশা করেছিল। রেহজান সবসময় নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে। তার ব্যবহার-আচরণে সে সব নিজেকে একজন বাস্তববাদী হিসেবে ফুটিয়ে তোলে। রওনক ছোট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার মনে হচ্ছে রেহজানের ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। আর এই কষ্ট অনুভব করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে রওনকের।

রেহজান কিভাবে পারছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। রেহজানের জায়গায় সে হলে এতক্ষণে কেদে কেদে অথৈ সমুদ্র বানিয়ে ফেলত, আর সবচেয়ে বড় কথা সে কখনো’ই আলফিকে ফেরত পাঠাত না। রেহজান রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশ্ন করে,
~ তোর বাচ্চা শেষমেষ পৃথিবীর আলো দেখতে পারলনা!
রেহজানের কথায় চমকে উঠে রওনক।

মৃত বাচ্চার শোক কাটাতে তার বেশ সময় লেগেছিল। অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চাকে বাঁচাতে না পারার জন্য নিজেকে দায়ী করে হতাশায় ডুবে ছিল। রুস্তম এইসময় তাকে যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছিল, নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছিল। যার কারণে সে আজ এতটা স্বাভাবিক।

রেহজান ভেবেছিল তার এই কথায় তার বোন ফ্যাল ফ্যাল করে কেদে বসবে। কিন্তু তার ধারণা মিথ্যা করে দিয়ে রওনক মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
~ “তাই তো সে আবার আমার গর্ভে ফিরে এসেছে। তার মাকে দ্বিতীয় বার সুযোগ দিচ্ছে, এইবার তার মা তাকে আর হতাশ করবেনা ইনশা আল্লাহ।”

রেহজানের চোখে খুশির ঝলক দেখা গেল। রওনক আবার মা হতে যাচ্ছে, এই মূহুর্তে এই সংবাদ যেন তার বুকে জমে থাকা কষ্টের ভার কমিয়ে দিল। উঠে এসে রওনক কে জড়িয়ে ধরল রেহজান। রওনকের বাচ্চা নষ্ট হওয়ায় সে এক মানসিক অপরাধে ভূগছিল। আজ যেন সে অপরাধের হতাশা তাকে মুক্তি দিল।

ইফা শুকনোমুখে রুটি তাওয়ায় ভাজছে। নাহার পাশে দাঁড়িয়ে বেলে বেলে রুটিগুলো ইফার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। অন্যমনস্ক থাকায় ইফার হাতে একটু ছ্যাঁক লেগে যায়। ইফা টের পেয়ে যন্ত্রণায় আতঁকে উঠে। নাহার তাড়াতাড়ি ঠান্ডা পানি ভর্তি বোলে ইফার হাত চুবিয়ে দেয়।

তারপর একটু ধমকসুরে বলে, “এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে আছো কেন? লাল হয়ে কতটা ফুলে গেছে।” ইফার চোখে তখন পানি ছলছল করছে। যন্ত্রণায় নাকি কাউকে খুব মনে পড়ায় সেটা নাহার বুঝতে পারলনা। ইফা হাত সরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে করতে বলে, “ঠিক হয়ে যাবে।”

নাহার আড়চোখে ইফার দিকে তাকাল। ইফার চোখের পানি গড়িয়ে নাকের ডগায় এসে জমেছে। নাহার এতদিন জানত ইফা এতবড় হয়েও ভ্যা ভ্যা করে কাদে। এখন নিঃশব্দে কাদতে শিখে গেছে। এই কয়েকটা মাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে ইফার মাঝে। সারাদিন বকবক করতে থাকা মেয়েটি এখন অপ্রয়োজনে কথা বলে, চঞ্চলতা গুলো ঢাকা পড়ে গেছে তার চুপচাপ থাকার চেষ্টায়। মাঝরাতে প্রায়শ একা একা ছাদে বসে থাকে, তিনতলার বারান্দায় পায়চারি করে।

এত পরিবর্তনেও নাহার মুখ ফুটে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অপেক্ষায় ছিল ইফা কবে নিজে থেকে সবকিছু বলবে। তার কোনো লক্ষণ না দেখে নাহার নিজে থেকে’ই প্রশ্ন করে, ” তোমার কি হয়েছে? ইদানিং তোমার অনেক পরিবর্তন লক্ষ করছি।” ইফা আড়ালে চোখ মুছে একফালি হাসি টেনে বলল, “তেমন কিছুই না মামী।” নাহার বুঝল ইফা বলতে চায়না, তাই সেও আর কোনো প্রশ্ন করলনা।

রেহজান আর ইফা ছাদে পাশাপাশি বসে আছে। দুজনের দৃষ্টি’ই আকাশে থাকা এক ফালি চাঁদের দিকে নিবদ্ধ। পিনপতন নীরবতায় দুজনের মনের মধ্যে’ই এক তুমুল হাহাকার চলছে। ইফা তার দৃষ্টি রেহজানের দিকে ফেরাল। চাদের আলোয় বোরকা পরিহিত রেহজানকে আরব দেশের কোনো সুন্দরী মনে হচ্ছে। একসময় এই রেহজানকে সে প্রচুর হিংসে করত, ভাবত রেহজানকে কি কারণে আলফি এত ভালোবাসত।

কিন্তু রেহজানের সাথে মিশার পর তার মনে হচ্ছে সে একটা বড় বোন পেয়েছে। যতক্ষণ সে রেহজানের সাথে থাকে, ওর মনখারাপের লেশমাত্র থাকেনা। রেহজান আর তার মধ্যে বোনের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। ইফা ধীরকন্ঠে প্রশ্ন করে, “আপু তুমি আলফি ভাইয়াকে মিস করোনা?”
ইফার প্রশ্নে রেহজান তার দিকে ফিরে তাকায়।

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে যা ইফা টের পায়না। তারপর মুচকি হেসে বলে,
~ “যে সর্বক্ষণ হৃদয়ে থাকে, তাকে কিভাবে মিস করব?”
রেহজানের উত্তরে ইফা মুগ্ধ হয়। চোখ বুজে একবার শাহরের মুখখানি মনে করার চেষ্টা করে। তার কল্পনায় ভেসে উঠে শাহরের গেজ দাতের সুন্দর হাসিমাখা মুখ।

ইফা ছোট ছোট নিঃশ্বাস নিতে নিতে পুনরায় প্রশ্ন করে,
~ “তুমি জানো, আলফি ভাইয়া আর কখনো ফিরবেনা। তাও তুমি ফিরে যেতে বললে কেন? উনি নিজেও তো চায়নি তার পরিবারের কাছে ফিরতে। তুমি কি পারতে না তার পাশে থেকে তাকে আগলে ধরে রাখতে! এখন তোমার আফসোস হয়না?”

ইফার কথাগুলো রেহজানের হৃদপিন্ডে ছুরির ন্যায় আঘাত করে। সবাই তার বাহিরের শান্ত রুপ দেখে ভাবে সে আলফিকে ছাড়া ভালোই আছে। তার ভিতরের তুমুল শূন্যতা-হাহাকার কেউ বুঝতে পারেনা। অবশ্য সেও বুঝতে দেয়না। রেহজান ইফার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ “না।

আফসোস তখন হত যদি আমি স্বার্থপরের মত আলফিকে নিজের কাছে রেখে দিতাম। আমার বোন রওনকের কথা না ভেবে নিজের জীবন সাজাতে ব্যস্ত হতাম।” ইফা অবাক হয়ে রেহজানকে দেখে। অস্ফুটস্বরে বলে, “তবে তুমি তোমার বোনের কথা ভেবে আলফিকে ফেরত পাঠিয়েছো?”

রেহজান কষ্টের মধ্যেও মুচকি হাসে। তীর্যক দৃষ্টিতে চারপাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি না বেরুতে দেবার চেষ্টা করে বলল,
~ “শুধু আমার বোনের কথা ভেবে নয়, আলফির কথা ভেবেও।

তার মা-বাবা আমাকে হুমকি দিয়েছিল তাদের কথামত আলফিকে যদি ফিরে যেতে না বলি তবে আমার আপুর পিছনে সেই খারাপ জ্বীনকে লেলিয়ে দিবে।
আমি তাতে ভাবনায় পড়ে গেল, রাজি হতে দ্বিধাবোধ করছিলাম। তখন উনারা আমাকে বললেন যদি আলফি একবারের জন্য হলেও জ্বীনরাজ্যে ফিরে না যায় তবে তাদের জাতি তাকে মারতে বাধ্য হবে। অতএব, আমার কিছু করার ছিলনা।”

ইফা এবার রেহজানের কষ্ট টা বুঝতে পারে। তার প্রচন্ড মায়া হয়৷ ভাবে, এই মেয়েটার সহ্যশক্তি এত বেশী কেন? ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছে কিন্তু বাহিরে ভীষণ শান্ত। রেহজান নিজেকে সামলে নিয়ে ইফাকে প্রশ্ন করে,
~ “তুই তো চাইলেই শাহরকে আটকে রাখতে পারতি? আটকালি না কেন? সে যদি জানত তুইও তাকে ভালোবাসিস তবে সে সবকিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে তোর কাছে থাকত।”

~ ” আমি তখন পর্যন্ত সংশয়ে ছিলাম। আর সে কেন বুঝতে পারলনা বলো তো! এখন আমার বড্ড আফসোস হয়, কেন তখন বলিনি। আসলে তার প্রতি অনুভূতিগুলো যথেষ্ট শক্ত ছিলনা। স্বল্পকালীন আবেগ ভেবে দ্বিধায় ছিলাম।”

রেহজান মুচকি হাসে, তারপর ইফার হাতে হাত রেখে বলল,
~ “উপস্থিতি যখন বুঝাতে অক্ষম, অনুপস্থিতি দ্বিগুন পোড়াতে মোক্ষম।” ইফা চট করে বলল, “এটা তোমাকে আলফি ভাইয়া বলেছিল তাইনা?”

রেহজানকে উত্তর দেয়না, গম্ভীর হয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
ইফা রেহজানের কাধে মুখ রেখে হতাশায় আপ্লুত কন্ঠে প্রশ্ন করে, “আপু ওরা কি আর কখনো আমাদের কাছে ফিরবেনা?”

রেহজান আরো গম্ভীর হয়ে যায়। ধরাগলায় বলে
~ “হয়ত ফিরবেনা। খানিকটা আমাদের উপর অভিমানে নতুবা ফেরার আর উপায় নেই বলে।”

ইফার চোখ থেকে দু’ফোটা জল গালে বেয়ে পড়ে। রেহজান টের পায়, কিন্তু বাধা দেয়না। সে না কাঁদতে পারুক, ইফা তো পারে। কান্না করলে তার কষ্ট খানিকটা হালকা হবে। কিন্তু নিজের অপ্রকাশিত কষ্ট কখনো হালকা হওয়ার নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, “একটু আবেগী হলে মন্দ হতনা। অন্তত কষ্টগুলো কিছুটা কমত।”

ইফা একটুপর কিছুটা স্বাভাবিক হয়। নিজের প্রতি কিছুটা রাগ হয়, কিছুতেই নিজের ইমোশোন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। অথচ তার পাশে বসা মানুষটা হাজার কষ্ট বুকে চেপে রেখে কেমন শান্ত! সবকিছু আড়াল করে হাসে। ইফা পরিবেশ সহজ করার জন্য প্রশ্ন করে, “আপু চা খাবে?”

রেহজান নাসূচক বাক্যে মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,
~ “খুব তাড়াতাড়ি হয়ত আমি বাংলাদেশে ফিরে যাব। নিজের দিকে খেয়াল রাখতে ভুলিসনা যেনো।”
ইফা আচমকিত হয়। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
~ “ফিরবে কেন?”

~ “মা-বাবা চাচ্ছেন আমি যাতে ফিরে যাই তাই।”
~ “উনারা যদি তোমার বিয়ে দিয়ে দেয় তখন কি করবে?”

রেহজান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে একটু চুপ থেকে বলল, “জানিনা। তবে আজীবন একজনকে’ই ভালোবেসে যাব।”
ইফা রেহজানের হাত শক্ত করে চেপে ধরে কান্না কান্না ভাব নিয়ে বলে, “আপু আমরা কি ওদের ফিরিয়ে আনতে পারিনা? জ্বীনরাজ্যে যেতে পারবনা?”

রেহজান ইফার মাথায় হাত রেখে বলল, “এসব আমাদের কল্পনার-ও বাহিরে… এক কথায় অসাধ্য। আমি আজ আসি, বাংলাদেশ যাওয়ার আগে একবার এসে দেখা করে যাব। নিজের খেয়াল রেখো।”

রেহজান ছাদ থেকে নেমে যায়। ইফা একা বসে থাকে আর তাকিয়ে থাকে দেবদারু গাছের দোলাদুল্যমান শাখার দিকে। ঝড়ো হাওয়ার মতো তীব্র বেগে হু হু করে চাপিয়ে রাখা কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। ম্লান মুখে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, “শাহর আপনি কি আর কোনোদিনও আমার কাছে ফির

পর্ব ২৪

মহিলা বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর খাদেমা দুজন ফিরে এল। ততক্ষণে পাশের সুরম্য গোসলখানা থেকে রেহজান আর ইফা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এল। খাদেমা দুজন তাদের দিকে পরিধানবস্ত্র এগিয়ে দিয়ে চলে গেল। ইফা কপালে ভাঁজ ফেলে রেহজানের দিকে তাকাল।

রেহজানকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। ইফা নিচুগলায় বলল, “আপু তুমি কি কোনোকিছু আঁচ করতে পারছো?” রেহজান না সূচক বাক্যে মাথা নাড়ায়। তারপর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে এতকিছু করার পর উনি আমাদের কে মেনে নিতে চাইছেন।

” ইফা কৌতূহলী কন্ঠে প্রশ্ন করে,
~” আপু এটাও হতে পারে আলফি আর শাহর উনাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন!” রেহজান চোখ তুলে বলল,
~ ” হতে পারে। তাই উনি পরীক্ষা জুড়ে দিয়েছেন। আমার ধারণা হচ্ছে উনি আমাদের খুব কঠিন কোনো পরীক্ষায় ফেলবেন।

তাতে আমরা উত্তীর্ণ না হতে পারলে উনি উনার ছেলেদেরকে অন্তত বুঝ দিতে পারবেন।” ইফা গম্ভীর হয়ে যায়। শাহরকে ফিরে পাওয়ার যে এক আশা তার মনে উদিত হয়েছিল, তা যেনো ঝড়ো হাওয়ার সাথে প্রদীপের শিখার ন্যায় প্রাণপণে টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে। এভাবে চিন্তায়-আশঙ্কায় একদিন কেটে গেল। মহিলা তখনো কোনো খবর পাঠাননি।

তাছাড়া তাদের এই কামরায় বাহিরে যাওয়া নিষিদ্ধ। দরজার সামনে সর্বক্ষণ পাহারাদার ছিল। এই বন্দিদশা কর্মকান্ড রেহজান আর ইফার সন্দেহকে শক্ত করে তুলছে। প্রায় বিকালের দিকে একজন খাদেমা এসে তাদেরকে তার সঙ্গে যেতে বলল। রেহজান আর ইফা প্রায় ভয়ে ভয়ে খাদেমাকে অনুসরণ করে কামরা থেকে বের হল। ওরা মহলের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

আশেপাশে কত লোকজন কিন্তু তারা তাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেনা। ইফা ফিসফিস কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “এরা সবাই কি জ্বীন?” রেহজান চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল, “হুম হয়ত। জ্বীনরাজ্যে জ্বীন ই থাকার কথা।” ইফা কৌতূহলবশত অন্যদিকে পা বাড়ালে খাদেমা হুংকার ছাড়ে, “আমাকে অনুসরণ করো।”

রেহজান ইফার হাত শক্ত করে ধরে এগিয়ে যায়। মহলের শেষ মাথার কামরার সামনে এসে খাদেমা দাঁড়িয়ে গেল। চোখ না তুলে কামরা দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ভেতরে যাও!” রেহজান আর ইফা কামরার ভিতরে ঢুকল। মহিলা সেখানকার পালঙ্কে গা গুটিয়ে বসে আছেন। রেহজান আর ইফা সালাম দিল। মহিলা সালামের উত্তর দিয়ে তাদেরকে বসতে ইশারা করলেন।

তারপর মহিলা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “জ্বীন মানুষের বিয়ের ব্যাপারে শুনেছো কখনো?” ইফা রেহজানের দিকে তাকায়। রেহজান স্পষ্টগলায় বলে, “নাহ।” মহিলা মুচকি হাসে, তারপর বলে, “তোমরা যদি জ্বীন বিয়ে করো তবে তোমাদেরকে জ্বীনরাজ্যে থাকতে হবে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জ্বীনদের ভয়ানক আসল রুপ দেখতে হবে।

এমন বদ্ধ কামরায় জীবন কাটাতে হবে। কোনো জ্বীন যদি জানতে পারে তোমরা জ্বীনরাজ্যে আছো তোমাদের কতল(খুন) করতে পারে।” ইফার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রেহজানের দিকে তাকায়। রেহজান চিন্তিত গলায় বলল, “আপনি কি আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন? আর আমরা তো আপনার ছেলেদের ধারেকাছেও নেই, আপনিই আমাদের তুলে এনেছেন। বিয়ের কথাও আপনি বলেছেন।”

~” হ্যা বলেছি। এখন বিয়ের পরবর্তীতে তোমাদের জীবন যাপন কেমন হবে তাও বলছি। তোমরা এখানে থাকতে পারবেনা কোনোমতেই। এই জায়গা না তোমাদের থাকার উপযোগী না তোমাদের জন্য নিরাপদ!”

ইফা এবার প্রশ্ন করে বসল, “সব জেনে তাহলে আমাদেরকে তুলে আনলেন কেন?” মহিলা রহস্যময় চোখে তাদের দিকে তাকায়, তারপর নিচুগলায় বলে, “তোমরা হয়ত এখানে থাকতে পারবেনা, কিন্তু শাহর-আলফি তোমাদের কাছে থাকতে পারবে। তোমাদের সাথে বিবাহ করে জীবনযাপন করতে হলে তাদেরকে সাধারণ জ্বীন হিসেবেই বাকিজীবন কাটাতে হবে। তারা জ্বীনরাজ্যে আর ঢুকতে পারবেনা। শক্তি-সামর্থ্যহীন জ্বীনের ন্যায় বাকিটা জীবন মানুষের মত কাটাতে হবে।” কথাটা শুনে রেহজান আর ইফা অবাক হয়।

পরক্ষণে মহিলা আবার বললেন, “শাহর-আলফি এই ব্যাপারে শুনেছে। তারা সবকিছু জেনেও রাজি তোমাদের সাথে বাকি জীবন কাটাতে। তাই আমি তোমাদেরকে তুলে আনলাম এটা জানতে আমার ছেলেরা যাদের জন্য এত নড় ত্যাগ স্বীকার করছে, নিজের বাসস্থান-পরিবার ছাড়া হচ্ছে তারা আসলেই আমার ছেলেদের যোগ্য কিনা?”
রেহজান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এখন আপনার কি মনে হচ্ছে? আপনি কি আপনার ছেলেদের ত্যাগ মেনে নিবেন?”

~ “আমার ছেলেরা বরাবর ই তাদের বাসস্থান আর পরিবার ছাড়া থেকেছে। আমি তাদেরকে সেভাবে রেখেছি যাতে তারা সবসময় নিজেকে এমন একটা দিনের জন্য প্রস্তুত রাখতে পারে। শাহরকেও ৫বছর বয়সে আলফির মত অচেনা জায়গায় ফেলে এসেছিলাম। তবে ওর সাথে আমি প্রায় দেখা করতে যেতাম, কিন্তু আলফির দেখা আমি আর পাইনি।” ইফা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে, “আপনি জানতেন এমন একটা দিন আসবে?” মহিলা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“না জানতামনা।

তবে প্রায়শ আমাদের জ্বীনগোত্রদের মধ্যে যুদ্ধ চলতেই থাকে। এই যুদ্ধে হয়ত কতল হতে হয় নয়ত জ্বীনরাজ্য ছাড়া হতে হয়। আমার আর আমার স্বামীর যদি কিছু হয়ে যায় এই আশংকায় আমরা আমাদের ছেলেদেরকে এভাবে রেখেছি। একটা সময় সিদ্ধান্ত নিলাম যুবক বয়সে ওদের ফিরিয়ে এনে বিয়ে দিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দিব। ওরা তো যথেষ্ট অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এখন আমাদের কিছু হলেও নিজেরা নিজেদের পথ খুজে নিতে পারবে।”

রেহজান মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর কাছে সবকিছুই এখন পরিষ্কার হয়েছে। এতদিন আলফির মায়ের চাওয়াটাকে নিতান্ত ই তার আলফিকে কষ্ট দেওয়ার কারণ বলে মনে হত।

এখন সে বুঝতে পারছে কেন তার মা নিজের সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য এতকিছু করেছে! শুধুমাত্র মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের সন্তানদের সাথে জীবন কাটানোর জন্য। রেহজান মহিলার দিকে একনজর তাকাল। কেন জানি ওর মনে হচ্ছে মহিলা কাঁদতে চাচ্ছেন কিন্তু পারছেননা।

রেহজান কোমলকন্ঠে প্রশ্ন করল, “আলফি-শাহর আমাদের সাথে চলে যেতে চাইলে আপনি তাদের আটকাবেননা?”
মহিলা অসহায় কন্ঠে বলল, “না। আমি চাই তারা সুখে থাকুক। আর তারা তো আমার কাছে কিছুদিন ছিল তাতেই আমার মন শান্তি পেয়েছে। এখন যেতে চাইলে আটকাবনা।”
ইফা চোখে পানি টলমল করছে।

এক পলশা বৃষ্টির মত তার চোখের পানি ঝরে পড়তে চাইছে কিন্তু ইফা ঠোট কামড়ে ধরে পানি আটকে রাখার চেষ্টা করছে। নিজেকে স্বাভাবিক করতে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি আমাদের কি পরীক্ষা নিতে চান?” মহিলা এতক্ষণে গভীর বিষাদে ডুবে ছিলেন, ইফার কথায় নিজেকে সামলে নিয়ে সচেতন হয়ে বললেন, “রাতে বলব। এখন তোমরা বিশ্রাম নাও।”

এই বলে খাদেমাকে ডেকে তাদেরকে তার সাথে পাঠিয়ে দিলেন। ইফা বেরিয়ে এসে চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারলনা, তা গাল বেয়ে টপটপ করে ঝরতে লাগল। ইফা নিশ্চুপে চোখ মুছে খাদেমাকে অনুসরণ করছে। এমনসময় তার ভারী পর্দার ওপাশে চোখ পড়ল। পর্দার একপাশ অনেকটা গুটিয়ে আছে তাতে দেখা যাচ্ছে ওপাশে বসে থাকা শাহরকে। ইফা শাহরকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল।

শাহর আর আলফি মুখোমুখি বসে আছে আর মাঝেমাঝে টুকটাক কথা বলছে। শাহর দৃষ্টিতে উদাসীনতা, চোখ দুটো বিষাদগ্রস্ত। ইফা শাহরের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে খাদেমা তার হাত চেপে ধরে বলল, “এখন ওদিকে যেওনা। তোমাদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে বেগম উনাদেরকে তোমাদের এখানে আনার ব্যাপারে জানাতে চাননা।” ইফা মনভার করে রেহজানের দিকে তাকায়।

রেহজানের দৃষ্টি তখনো আলফির দিকে। তার বুকের ভিতর ধক করে উঠছে, ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি আলফির কাছে ছুটে যেতে। এরমধ্যে কেউ একজন পর্দা সম্পূর্ণ টেনে দিয়ে গেল। রেহজান হতাশার চাহনীতে ইফার দিকে তাকিয়ে যাওয়ার ইশারা করল।

ইফা রেহজানের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। রেহজান অন্যমনস্ক হয়ে ইফার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। বিষাদভরা কন্ঠে ইফা রেহজানকে বলল, “আমার মন মানছেনা আপু। আমি এক্ষুনি শাহরের কাছে যেতে চাই।” রেহজান মুচকি হেসে বলল, “একটু তো ধৈর্য্য ধরতে হবে। আল্লাহ আমাদের জন্য নিশ্চয়ই ভালো কিছু রেখেছেন।”

ইফা চিন্তিত হয়ে বলল, “উনি বলেছেন পরীক্ষার ব্যাপারে রাতে জানাবেন। কিন্তু এখনো এলেননা তো!” রেহজান দরজার পানে উকি মেরে বলল, “আমিও তাই ভাবছি।” রেহজানের কথা শেষ হতে না হতেই মহিলা কক্ষে প্রবেশ করলেন। ইফা লাফিয়ে উঠে বসল। দুজন একসাথে সালাম দিল। মহিলা হাসিমুখে সালামের উত্তর নিয়ে ওদের মুখোমুখি বসে বললেন, “নামায আদায় করেছো?”

দুজনে মাথা নাড়াল। তারপর প্রশ্ন করলেন, “কুরআন পড়তে জানো?” দুজনে হ্যা সূচক বাক্যে মাথা নাড়াল। উনি খাদেমাকে ডেকে পাঠালেন। খাদেমা গেলাফ সহকারে দুটো কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। মহিলা কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে চুমু খেয়ে রেহজান আর ইফার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
~ “এখান থেকে কিছুটা দূরে একটা পাহাড়ের চূড়ায় এক নবীর দুয়া কবুল হয়েছিল।

আমি চাই, তোমরা দুজন মধ্যরাতে ওখানে গিয়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়ো। সাথে কুর আন তিলাওয়াত করে আল্লাহর কাছে শুকরান গুজার করে নিজেদের জন্য দুয়া করো। ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ তোমাদের মনের আশা কবুল করবেন।” রেহজান আর ইফা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

রেহজান বলল, “ইনশা-আল্লাহ।” মহিলা উঠতে উদ্যত হয়ে খাদেমাকে বলল, “ওদেরকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেও।” খাদেমা মাথা নাড়িয়ে মহিলার সাথে বেরিয়ে গেল। ইফা উত্তেজিত হয়ে বলল, “পরীক্ষা এত সহজ কিছু হবে আমি ভাবতেই পারিনি।” রেহজান মুচকি হেসে বলল, “আল্লাহ ভরসা। দেখা যাক কি হয়!” মধ্যরাত হতেই দুজন ওযু করে কোরআন শরীফ আর তজবীহ হাতে কক্ষ থেকে বের হল। খাদেমা সদর দরজার বাহিরে আলো হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

দুজন গুটি গুটি পায়ে সেদিকে এগুচ্ছে। হঠাৎ কেউ ইফার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। ইফা পিছু ফিরে দেখে শাহর তার হাত চেপে ধরে তাএ দিকে তাকিয়ে আছে। ইফা খুশিতে আত্মহারা হয়ে শাহরকে জড়িয়ে ধরতে যায়, পরক্ষণে নিজেকে সংযত করে বলল, “আপনি এখানে?” শাহর অবাক চাহনী দিয়ে ইফাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল, “তুমি এই সময় কোথায় যাচ্ছো?”

ইফা ঢোক গিলে দরজার দিকে তাকায়। রেহজান ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। ইফা বুঝতে পারেনা শাহরকে কি জবাব দিবে? যাই হোক, সত্যিটা এখন বলা যাবেনা। শাহর উৎকন্ঠা নিয়ে আবার প্রশ্ন করে, “ইফা তুমি এখানে কি করে এলে?” শাহরের প্রশ্নে ইফা চমকে উঠে। বারবার ঢোক গিলছে আর দরজার দিকে তাকাচ্ছে।

পর্ব ২৫

ইফা কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে শাহরকে বলল, “আমাকে একটু পানি খাওয়াবেন?” শাহর ইফার হাত ধরে বলল, “চলো, দিচ্ছি।” ইফা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বার বার বাহিরে তাকাচ্ছে।

ভাবছে, রেহজান তার অপেক্ষা করবে তো? অবশেষে হাত ছাড়াতে না পেরে নিরুপায় হয়ে ইফা শাহরের সাথে ভিতরে যায়। শাহর তার হাত ধরে রেখেই পেয়ালায় পানি নিচ্ছে।

ইফা শাহরের এমন আচরণে কিছুটা অবাক হয়। কেন জানি তার মনে হচ্ছে পাশে থাকা ব্যক্তি শাহররূপি কোনো জ্বীন। ইফা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলল, “শাহর আপনার মনে আছে আসার আগে আপনি আমায় কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন?” কথাটা শুনে শাহর থতমত খেয়ে তার দিকে তাকায়। হেসে হেসে বলে, “কি প্রতিশ্রুতি?”

“বিয়ের আগে আপনি আমার হাত স্পর্শ করবেননা!” এই কথায় শাহর হতভম্ব হয়ে তাৎক্ষণিক তার হাত ছেড়ে দেয়। ইফার বুঝতে বাকি রইলনা এই ব্যক্তি শাহর নয়। ইফা মনে সাহস সঞ্চার করে শাহরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এখানে কিভাবে এলাম আপনাকে সবটা খুলে বলছি।

আপনি আমার সাথে আপনার আম্মার কামরার চলুন। উনাকে জিজ্ঞেস না করে বলা আমার অপরাধ হবে।” শাহর বিব্রত চাহনীতে তার দিকে তাকায়। পানির পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে আমতা আমতা করে বলে, “আম্মা এখন ঘুমাচ্ছে। তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা।

আমি কাল সকালে শুনব। এই নাও পানি, খেয়ে কামরায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়ো।” ইফা পানি খেয়ে সাধারণভাবে বিদায় জানিয়ে কামরার দিকে হাঁটা দেয়। শাহর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেখান থেকে প্রস্থান করে। ইফা কিছুক্ষণ বাদে কামরা থেকে বেরিয়ে আশেপাশে উকি মারল। কোথাও শাহরকে দেখতে না পেয়ে সর্তকতার সাথে পা টিপে টিপে দরজার বাহিরে এসে দাঁড়াল।

চারদিকে ভালো করে নজর বুলাল, রেহজান বা খাদেমাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছেনা। তবে ওরা তাকে ফেলে চলে গেল? ইফা চিন্তায় পড়ে যায়, “রেহজান আপু তাকে ফেলে যাওয়ার মত মেয়ে নয়! তবে কি আপু তার অনুপস্থিতি টের পায়নি?” ভাবতে ভাবতে ইফা হাঁটা শুরু করে। যতটুকু শুনেছিল পাহাড় বেশী দূরে নয়, প্রায় ২০মি. এর পথ।

ইফা চোখের উপর হাত উচিয়ে পাহাড় দেখার চেষ্টা করল। খানিকটা দূরে পাহাড়ের কিছু অংশ আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে লক্ষ্য করে ইফা দ্রুতপদে হাঁটতে থাকে। বাহিরে উজ্জ্বল চাঁদের জ্যোৎস্না, তাই আলো ছাড়া হাটতে তার সমস্যা হচ্ছেনা। চারদিকে কেমন এক সুন্দর সুবাস ছড়িয়ে আছে। ইফার বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে।

পরক্ষণে ইফার মনে হল কেউ তার পিছু নিয়েছে। তার শরীর ভয়ে হিম হয়ে আসছে, শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সে শুনতে পেল রেহজানের কন্ঠ। তাকে পিছন থেকে বারবার ডাকছে। ইফা থমকে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ঢোক গিলল, ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। পিছন থেকে আরো উচ্চস্বরে তাকে ডাকা হল।

ইফা পিছু ফিরে তাকালনা, দ্রুতপদে হাঁটা শুরু করল। বুকের কাছে কোরআন-শরীফ শক্ত করে চেপে ধরে অনবরত আয়াতুল কুরসী পাঠ করতে লাগল। বের হওয়ার আগে রেহজান তাকে বারবার করে বলে দিয়েছে, ” হাঁটার সময় কিংবা নামায পড়াকালীন যে-ই ডাকুক পিছু ফিরে তাকাবিনা। বেশী ভয় লাগলে আয়াতুল কুরসী পড়বি।” ইফা তখন হেসে বলেছিল, “আপু তো তুমি তো আমার সাথে থাকবে। ভয় কেন পাব?”

রেহজান উত্তরে বলেছিল, “আমার মন টা কেন জানি খচখচ করছে।” ইফা খানিকক্ষণ পর আর ডাক শুনতে পেলনা। তাও ভয়ে ভয়ে আল্লাহর নাম জপতে জপতে আরো দ্রুত হাঁটতে লাগল। রেহজান হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। আশেপাশে একবার তাকাল, চারদিকে ঘন বিশাল বিশাল ঝোপঝাড়। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে ঝি ঝি পোকার ডাকসহ বিভিন্ন শব্দ ভেসে আসছে।

তাতে এই আবছা অন্ধকার পরিবেশ ভয়ংকর লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় চলে এল সে? ঠিক বুঝে উঠতে পারলনা রেহজান। দরজার বাহিরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে কিসের এক ঘোরে সে একা’ই হাঁটা শুরু করেছিল। এখন হুঁশে আসার পর নিজেকে ঘন ঝোপঝাড় ভর্তি জঙ্গলে আবিষ্কার করে। রেহজানের খানিকটা ভয় করতে লাগল।

কিভাবে বের হবে এখান থেকে? সবগুলো পথ একইরকম লাগছে। ভেবে ভেবে সামনের সরু পথে এগোয়, কিছুক্ষণ হাঁটার পর খেয়াল করল ঘুরে ফিরে সে একই জায়গায় চলে এসেছে। এভাবে একে একে ডান-বামের পথে গিয়েও পুনরায় আগের জায়গায় ফিরে এসেছে রেহজান। এবার সে সত্যিই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।

চারপাশের ঝোপঝাড় এত ঘন যে সে বুঝতে পারছে না বের হওয়ার রাস্তা কোনদিকে? হঠাৎ তার ভাবনায় আসে, “এই কোনো জ্বীনের কারসাজি না তো?” ছোটবেলায় একবার শুনেছিল জ্বীনরা মানুষের পথ ভুলিয়ে বারবার একই জায়গায় নিয়ে আসে। রেহজান মনে সাহস সঞ্চার করে আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে সামনে পথে এগোতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর সে জঙ্গল থেকে বের হতে সক্ষম হয়। রেহজান মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে দরজার সামনে ফিরে আসে। খাদেমা আর ইফাকে কোথাও দেখতে পেলনা সে। এক অজানা আশংকায় রেহজানের হৃদপিন্ড কেঁপে উঠে। ইফাকে নিয়ে একগাদা দুশ্চিন্তায় তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।

ইফার নাম ধরে কয়েকবার উচ্চস্বরে ডেকেও কোনো সাড়া পেলনা রেহজান। খাদেমা ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে রেহজানকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কোথায় গিয়েছিলে?” রেহজান হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “ইফা কোথায়?” খাদেমা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল, “ও এখানে নেই। আমি তো ওকে বের হতেও দেখিনি। আমার মনে হয় ও কোন ফাঁকে পাহাড়ে চলে গেছে।”

রেহজানের কলিজার পানি শুকিয়ে আসে, মনের মধ্যে বারবার কু-ডাক ডাকছে। খাদেমার হাত থেকে আলোর কুপি নিয়ে পাহাড়ের দিকে ছুটে সে। ইফা পাহাড়ের চূড়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। অবশেষে নির্বিঘ্নভাবে পৌঁছাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইফা। জোরে জোরে হেঁটে কিছুটা হাপিয়ে উঠেছে সে।

চূড়ার গুহায় বিছানো পাটির উপরবিশ্রাম নিতে বসে। আশে-পাশে উঁকি দিয়ে রেহজানকে না দেখতে পেয়ে তার ভীষণ দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে।”তবে কি রেহজান আপু ও তার মত কোনো বিপদে পড়েছে?” এই ভেবে দ্রুত গুহা থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে আসে ইফা।

আরেকটু এগিয়ে আসতে চোখে পড়ে রেহজান তার দিকেই আসছে। তার চোখ দুটো’তে খুশির ঝলক দেখা যায়। রেহজান এসে তার সামনে দাঁড়ায়। ইফা হাসিমুখে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি? আমার যে কি দুশ্চিন্তা হচ্ছিল!” রেহজান ইফার দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “চলো এখান থেকে।

” ইফা অবাক হয়ে রেহজানের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন আপু? আমরা তাহাজ্জুদের নামায পড়ব না! এখনো তো অনেক সময় আছে।” রেহজান রাগান্বিত দৃষ্টিতে ইফার দিকে তাকায়। ইফাকে চড় দেওয়ার জন্য হাত উচিয়ে তোলে। ইফা আতঙ্কে চোখ বুজে ফেলে। চড় দেওয়ার আগমূহুর্তে রেহজানের গায়ে কোথা থেকে কুপির আগুন এসে পড়ে।

ইফা তাকিয়ে দেখে রেহজান কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। রেহজানরুপী ব্যক্তি হুংকার ছাড়তে ছাড়তে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। রেহজান এগিয়ে এসে ইফাকে জড়িয়ে ধরে। ইফা রেহজানকে পেয়ে বাচ্চাদের মত ফ্যাল ফ্যাল করে কেঁদে উঠে। ইফাকে কোমলভাবে সামলে তাকে নিয়ে গুহার ভেতরে ঢুকে রেহজান নামাযের প্রস্তুতি নেয়।

দুজন নামায পড়াকালীন টের পায় বাহিরে বিভৎস রকমের তান্ডব হচ্ছে সাথে ভয়ংকর রক্তহিম করা শব্দ। গুহার মুখে অনেক ছোট টুকরো পাথর ছুঁড়ে মারা হয়। ভয়ে ইফার চোখ-মুখ শুকিয়ে যায় তবুও নামায থেকে বিরত থাকেনা কেউ ই। নামায শেষ লম্বা মুনাজাতে কান্না ভেঙ্গে পড়ে রেহজান।

ইফা ও কেঁদে কেঁদে মুনাজাতে দুয়া করে। অতঃপর দুজন কুরআন পড়তে বসে, গুহার ভিতরে জ্বালানো কুপির আবছায় দুজনে মিষ্টি সুরে তিলাওয়াত করে। প্রায় অনেকক্ষণ আগে বাহিরের তান্ডব বন্ধ হয়ে এসেছে, দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসে ফযরের আযান। দুজন নামায আদায় করে একসাথে গুহার মুখে এসে দাঁড়ায়।

স্বল্প আলোয় দেখতে পায় অসংখ্য পাথর এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। খাদেমা তাদের সালাম জানিয়ে গুহার ভিতরে আসে। দুজনের চোখে কাপড় বেঁধে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাদের কামরায়। কামরায় ঢুকে ইফা বাধঁন খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। দুহাত মাথার নিচে রেখে রেহজানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে, “এরা আমাদের চোখ কেন বেঁধে দেয়?

কই কাল রাতে তো বাঁধেনি!” রেহজান ইফার পাশে শুয়ে বলল, “আমার ধারনা হচ্ছে এটা ওরা নিরাপত্তার খাতিরে করে। রাতের বেলা আধাঁর ছিল তাই হয়ত দেয়নি, তাছাড়া কাল রাতে ঘটা ঘটনাগুলো ও কারণ হতে পারে। জানতাম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া খুব সহজ হবেনা। আল্লাহর রহমতে আমরা পেরেছি।

” ইফা আনমনে হতাশার কন্ঠে বলে, “শাহরকে কবে দেখতে পাব আপু? আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনা।” রেহজান ইফার কথায় গভীর চিন্তার অতলে তলিয়ে যায়।
রেহজান ঘুম থেকে উঠে দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাগরিবের আযান কানে ভেসে আসছে। ইফাকে ডাকতে ডাকতে উঠে বসে চুলে হাতখোপা করে ঘোমটা টেনে নেয় রেহজান।

সেই সকালে ঘুমিয়ে পড়েছিল কেউ তাদের এরমধ্যে ডাকেও নি, কি অদ্ভুত! রেহজানের ডাকে ততক্ষণে ইফা উঠে বসে। ইফা চোখ ডলতে ডলতে বলে, “সন্ধ্যা হয়ে গেছে?” রেহজান মাথা নাড়িয়ে বলে, “হুম। চল আগে নামায সেরে নিই।” নামায শেষ করে উঠতেই খাদেমা এসে কামরায় প্রবেশ করল।

খাদেমাকে দেখে রেহজান প্রশ্ন করে, “এত বেলা হয়ে গেল, আপনি আমাদের ডাকতে এলেন না যে!” খাদেমা প্রত্যত্তুরে বলে, “আমি ব্যস্ত ছিলাম। তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।” ইফা ভ্রু কুচঁকে প্রশ্ন করে, “আপনার বেগম কোথায়? উনি কি আমাদের ফিরে আসার কথা জানেন না?”
~ “উনি জ্বীনরাজ্যে নেই।

জরুরী প্রয়োজনে বেরিয়েছেন। ফিরলে অবশ্যই তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।” এই বলে খাদেমা বেরিয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পর অন্য এক মেয়ে এসে তাদের খাবার দিয়ে গেল। ইফার এখন বেশ বিরক্তবোধ হচ্ছে। এত কষ্ট করে মহিলার দেওয়া নির্দেশ মেনে সব করার পরও শাহরের দেখা পাচ্ছেনা। বুকের ভিতর তীব্র হতাশা বন্দি পাখির ন্যায় ডানা ঝাপটাচ্ছে।

রেহজান ইফার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, “চিন্তা করিসনা। আশা করি উনি উনার প্রতিশ্রুতি রাখবেন।” রেহজানের কথায় ইফার মন ভার কমলনা। ওর হঠাৎ ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। মামার কথা খুব মনে পড়ছে। মামা কি তার খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেছেন? এখান থেকে ফিরে সে মামাকে কি জবাব দিবে?

আর এখান থেকে সে কবে ফিরতে পারবে! ইফা চুপচাপ উঠে গিয়ে বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে রইল। রেহজান ইফার এই অবস্থা দেখে তাকে কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দিল।
কিছুক্ষণ পর ইফা চোখ মেলে উঠে বসে। কামরায় রেহজানকে কোথাও দেখতে পেলনা। মন ভার করে উঠে কামরার বাহিরে চলে এল রেহজানকে খুঁজতে।

কামরা থেকে বেরিয়ে দেখে পুরো মহল আবছা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আশেপাশে কেউ নেই। ইফার মাথায় বুদ্ধি আসে, “এখন সে শাহরকে একনজর দেখে আসবে। কেউ টের পাবেনা।” এই ভেবে অন্দরমহলের দিকে হাঁটা দেয় ইফা। রেহজান গোসল সেরে কামরায় ফিরে ইফাকে দেখতে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। ভাবনায় পড়ে, “খাদেমা কি ইফাকে ডেকে নিয়ে গেছে?

” ইফাকে ডাকতে ডাকতে সেও ভিতর মহলের দিকে চলে যায়। ইফা সেই জায়গায় এসে দাঁড়ায় যেখানে এসে সেদিন শাহরকে বসে থাকতে দেখেছিল। মৃদ্যুকন্ঠে শাহরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ভিতরের দিকে যায় সে। এমনসময় আবছা আলোয় দেখে কেউ তার থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। ইফা শাহর ভেবে দৌড়ে কাছে এসে দেখে একজন আগন্তুক রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

তার লালরঙ্গা চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলছে। উপরের অংশ দেখতে ছাগল জাতীয় প্রাণীর মত, পা দুটো ঘোড়ার মত। মাথা কুকুরের ন্যায়, তাতে দুখানা মস্ত শিং। প্রাণীটি তার ভাল্লুকের মত ঘন পশমওয়ালা লম্বা নখযুক্ত হাত দিয়ে ইফার গলা শক্ত করে চেপে শুন্যে উঠিয়ে নেয়। ইফা চাইলেও চিৎকার করতে পারছে, গলা চেপে ধরার যন্ত্রণায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে সে মারা যাবে। রেহজান ভিতরমহলে এসেও ইফাকে পায়না। চারদিকে এত আবছা অন্ধকার দেখে তার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এমনসময় ভারী কিছু একটা গড়াতে গড়াতে তার পায়ের কাছে এসে পড়ে। হাতের আলোর কুপি দিয়ে মাথা ঝুকিয়ে দেখে ইফার ছিঁড়ে ফেলা মাথা। দেখে চিৎকার করে দুপা পিছিয়ে যায় রেহজান।

পিছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে ঘুরে তাকায় সে। দেখতে পায় বিভৎস কদাকার চেহারার একজন অর্ধউলঙ্গ লোককে। তার শরীর থেকে পুঁজ পড়ছে, মাথার খুলির এক অংশ বেরিয়ে এসেছে। এসব দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় রেহজান। চিৎকার করার মত শক্তিটুকুও সে পাচ্ছেনা। লোকটি এগিয়ে এসে রেহজানকে দূরে ছুড়ে মারে। ছিটকে এসে দেয়ালের সাথে বাড়ি খায় সে। যন্ত্রণায় কোকড়ে উঠে রেহজান। লোকটা আবার এগিয়ে আসছে তার দিকে।

পর্ব ২৬

ইফার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগমূহুর্তে অদ্ভুত- কিম্বাকার প্রাণীটির হাতে কেউ আঘাত করে, সাথে সাথে প্রাণীটি তাকে ছেড়ে দেয়। শুন্য থেকে মেঝেতে পড়ার আগে কেউ তাকে কোলের মধ্যে ঝাপটে ধরে।

ভয়ে সে তখন হিতাহিতজ্ঞান শূন্য, আধবোজা চোখ মেলে তাকানোর মত সাহস হচ্ছেনা। খানিকক্ষণের মধ্যে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। রেহজানের সামনে এসে দাঁড়ায় আলফি। হুংকার ছেড়ে বলে, “তোমাকে হুকুম করছি এখান থেকে চলে যাও, নতুবা জান নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারবেনা।”

আলফির কথায় আগন্তুক অদৃশ্য হয়ে যায়। আলফি রেহজানের দিকে ফিরে তাকিয়ে তার কাছে এসে বলল, “রেহজান তুমি এখানে?” রেহজানের তখনো হাত-পা কাঁপছে। সর্বাঙ্গে ঘাম ছুটছে, মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা। অস্পষ্ট ভাবে কেঁদে কেঁদে বলল, “ইফা কোথায়? ইফাকে খুঁজে দাওনা…” আলফি রেহজানকে একটানে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে।

কিন্তু তাতেও রেহজান শান্ত হচ্ছেনা। আলফি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ” একটু শান্ত হও। আমি ইফাকে খুঁজে আনব। চলো আমার সাথে।” রেহজান ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ইফার ছেড়া মাথাটা যেখানে দেখেছিল সেখানে একনজর তাকায়, সেখানে ইফার বিচ্ছেদ্য মাথাটা নেই।

রেহজানের কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে গেল। আলফির হাত চেপে ধরে বলল, “ইফার কাটা মাথা এখানে ই ছিল। কোথায় গেল? ইফাকে কি খারাপ জ্বীনগুলো মেরে ফেলেছে?” ভিতর ঘর থেকে শাহরের গলার স্বর ভেসে আসে, ” ভাই, দ্রুত এদিকে আসুন। ইফা এখানে।” আলফি রেহজানকে শক্ত হাতে চেপে ধরে বলল, “ইফার কিচ্ছু হয়নি।

জ্বীনগুলো তোমাকে ভয় দেখিয়ে দূর্বল করে আক্রমণ করার জন্য ই এমন ভ্রম সৃষ্টি করেছে।”

রেহজান ইফার মাথার কাছে বসে আছে, ইফার ডান হাত শক্ত করে ধরে অপলক ইফার দিকে তাকিয়ে তার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছে। আলফি আর শাহর বিছানার অন্যপ্রান্তে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রেহজান এখনো স্বাভাবিক হয়ে কিছু বলছেনা, এই কারণে দুজনের উদ্বিগ্নতা আরো বাড়ছে।

প্রায় কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর ইফার জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরা মাত্র সে রেহজানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। শাহর ইফার দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে আলফি বাধা দিয়ে বলল, “ওদেরকে স্বাভাবিক হতে দাও।” রেহজান ইফার কপালে চুমু দিয়ে বলল, “আল্লাহর রহমতে তোর কোনো ক্ষতি হয়নি। আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া।” ইফার চোখ পড়ে শাহর আর আলফির দিকে।

আচমকিত হয়ে প্রশ্ন করে, “তোমরা?” রেহজান কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল, “ওরা আমাদেরকে উদ্ধার করেছে।” ইফা আতংকিত চোখে রেহজানের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, “আপু ওরা কি সেসব ব্যাপার সম্পর্কে জানে? মহিলা আমাদের বারবার বারণ করেছেন। এর জন্য উনি আমাদেরকে আবার ওদের থেকে বিচ্ছেদ করে দিবেন না তো?” রেহজান প্রত্যুত্তরে কিছু বলেনা, গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ে।

শাহর এগিয়ে এসে ইফার হাত শক্ত করে ধরে, তারপর ঠোটের কাছে লেপ্টে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে বলল, “ইফা তুমি এখানে কিভাবে এসেছো? কখন এসেছো?” ইফা বাকা চোখে একবার রেহজানের দিকে তাকায়। শাহরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রাখে। আলফি রেহজানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এসো আমার সাথে।”

রেহজান ইতস্ততবোধ নিয়ে আলফির হাত ধরে তার সাথে চলে যায়। শাহর দু’হাতে ইফার গাল জড়িয়ে বলক, “ভয় পেয়োনা। আমি তোমার পাশে আছি, নির্ভয়ে আমাকে সবটা খুলে বলো।” রেহজান নিচুগলায় আলফিকে সব বলার পর আলফি এক অদ্ভুত কাজ করে বসল। রেহজানের কপালে ছোট স্পর্শ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।

রেহজান চোখ বন্ধ করে আলফিকে জড়িয়ে ধরল। এতদিন পর সে প্রশান্তি অনুভব করছে, সে চাচ্ছে এই মূহুর্ত যেন কখনো শেষ না হয়। আলফি কান্না থামিয়ে রেহজানের গালে হাত রেখে বলল, “এসব করতে ভয় করলনা? যদি খারাপ কিছু হয়ে যেত!” রেহজান মুচকি হাসে, আলফির হাতের উপর হাত রেখে বলল, “ভালোবাসায় ভয় কিসের?

ভয় পেলে তোমাকে জয় করে নিতাম কিভাবে? তোমার সাথে সারাজীবন একসাথে কাটানোর চাইতে আর কোনোকিছুই অধিক মূল্যবান নয়।” শাহর ইফার মুখে সব শুনে অবাকদৃষ্টিতে ইফার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। তারপর ইফার গাল হালকা টেনে দিয়ে বলল, “পিচ্চি মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন দুঃসাহসিক কাজ করতে ভয় পায়না… আগে তো জ্বীন দেখেই অজ্ঞান হয়ে যেত।” ইফা গাল ফুলিয়ে অভিমান দেখায়, “মোটেও না।

” শাহর দুহাতে ইফার গলা জড়িয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস কন্ঠে বলল, “এতকিছু কেন করলে?” ইফা চোখ বন্ধ করে বলল, “আপনাকে আজীবনের মত নিজের করে নেওয়ার জন্য, আপনাকে অনেক বেশী ভালোবাসার সুযোগ হারাতে চাইনা বলে…..” শাহরের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এল। তার হৃপিন্ড অস্বাভাবিক গতিতে লাফাচ্ছে, ইফা তাকে তার নিজের চেয়েও বেশী ভালোবাসে এই যে তার সবচেয়ে বড় পাওয়া। ইফার কন্ঠ শুনে রেহজান আলফির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।

চোখে-মুখে তার লজ্জার আভাস। আলফি তার খুব কাছাকাছি এসেছিল, এতটাই কাছে যে আলফির নিঃশ্বাস তার মুখের উপর পড়ছিল। শাহর আলফির দিকে এগিয়ে এসে বলল, ” ভাই আম্মাকে ফেরার জন্য জরুরী তলব করো।” আলফি মাথা নাড়িয়ে বাহিরে চলে যায়।

কামরায় শাহর-ইফা, আলফি-রেহজান আর তাদের আম্মা সহ সবাই মুখোমুখি বসে আছে। ইফা ভয়ার্ত চেহারায় শাহরের জামার হাতা খামচে ধরে আছে আর বারবার রেহজানের দিকে তাকাচ্ছে। রেহজান কপালে ভাঁজ ফেলে মহিলার মুখাবয়বের তাকিয়ে তার মেজাজ বুঝার চেষ্টা করছে।

আলফি শান্তকন্ঠে বলল, “আম্মা আপনি আমাদেরকে এসব জানাননি কেন? ওদের এমন ভয়ংকর পরীক্ষায় ফেলা কি খুব জরুরী ছিল?” শাহর ও আলফির
সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “আম্মা, ওদের যদি কোনো বিপদ হত আপনি কি তার দায় নিতে পারতেন?

আর এভাবে তাদেরকে একা মহলে রেখে যাওয়া উচিত হয়নি!” তাদের আম্মা অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে তাকায়, নীচুকন্ঠে বলল, “তোমরা দুজন তাদের জন্য নিজের জাতি-শক্তি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছো, তাই আমি এটা জানার আগ্রহ হল এরা কি সত্যি তোমাদের যোগ্য!” তারপর উনি একটু থেমে বললেন, “জ্বীনের সাথে জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জ্বীনের আসল চেহারা তাদের দেখা উচিত।

তাই আমি ওদেরকে একা মহলে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি তারা হিংস্র হয়ে ওদের মারতে চাইবে…” উনি ইফা আর রেহজানের দিকে এগিয়ে আসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমরা সত্যিই আমার পুত্রদের যোগ্য সহধর্মিণী। আমি তোমাদের বিবাহে সম্মতি দিলাম। আলফি শাহর তোমরা কি সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত?

কোনো সংশয় নেই তো?” আলফি তার মায়ের হাত ধরে বলল, “না আম্মা আমাদের কোনো সংশয় নেই। আপনি শুধু দোয়া রাখবেন।” মহিলা হেসে বললেন, “তাহলে এখানে বিয়ের আয়োজন করি?” ইফা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, “ভুল মার্জনা করবেন বেগম। আমার পরিবার কে ছাড়া আমি এভাবে বিবাহ করতে ইচ্ছুক নই।

আমার মামা হয়ত আমার খোজ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে, আপনি আমাদেরকে আমাদের স্থানে পাঠিয়ে দিন।” রেহজান ও ইফার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “আমার ও তাই মত। আমাদের পরিবারের অবর্তমানে বিবাহ করতে চাচ্ছিনা।” মহিলার চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল। তাও আদুরে গলায় বললেন, “আমি তো সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবনা। তাই চাচ্ছিলাম এখানে বিয়েটা হোক।

প্রয়োজন হলে তোমাদের পরিবারের লোকদের উপস্থিত করা হবে…” রেহজান আতকে উঠে বলল, “সেটা আমাদের জন্য ভালো হবেনা। অন্যদের কাছে ওদের জ্বীনপরিচয় আমরা প্রকাশ করতে চাইনা, সবাই ওদের এড়িয়ে চলবে। কিংবা পরিবারের কেউ ওদের জামাই হিসেবে মানতে চাইবেনা।”

মহিলা রাগে ভীষণ ফোস ফোস করতে লাগলেন, তার রোষানলপূর্ণ দৃষ্টিতে বারবার রেহজান আর ইফার দিকে তাকালেন। হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে দ্রুত কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন…

পর্ব ২৭

গম্ভীরমুখে নিজের কামরার পালঙ্কে পা তুলে বসে আছেন শাহর-আলফির আম্মা। খাদেমা নিরবে কামরায় প্রবেশ করে সালাম দিল। সালামের উত্তর না পেয়ে প্রশ্ন করল,

  • “বেগম আপনি কি নিয়ে এত চিন্তিত?”

খাদেমার প্রশ্নে মহিলার ধ্যান ভাঙ্গল। রাগে ফুসতে ফুসতে বললেন, “আমি তো মানুষের মেয়ে দু’টো কে অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। তবুও ওরা আমার কথার বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন করলনা। আমার পুত্ররাও ওদের কথাকে স্বীকৃতি দিল।” খাদেমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “শান্ত হন বেগম। ওরা হয়ত সমস্যার কারণে’ই এভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।”

মহিলা ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে খাদেমার দিকে তাকাল। তাতে খাদেমা ভয়ে চুপসে গেল। তারপর মহিলা নিজে নিজে বিড়বিড় করতে লাগল, “আমি এর শেষ দেখে তবে ক্ষান্ত হব।” ইফা আর শাহর ভিতর মহলের বারান্দায় পাশাপাশি বসে আছে। তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আলফি আর রেহজান। ইফা একবার তাদের দিকে দৃষ্টিপাত দিল।

আলফি কিসব জানি বলছে তাতে রেহজান মুখ টিপে টিপে হাসছে আর আলফির চুলে আলতো করে হাত বুলাচ্ছে। ইফার দৃষ্টি অনুসরণ করে শাহর ও ওদের দিকে তাকাল। তারপর ইফাকে জড়িয়ে বুকের একপাশে টেনে নিয়ে এনে বলল, “মন খারাপ তোমার?” ইফা কাদো কাদো মুখ করে বলল, “আমি বাড়ি যাব।”

শাহর ইফার মুখের আর বাচ্চার মত কথা বলার ধরণ দেখে হেসে ইফার গাল টেনে দিয়ে বলল, “যাব তো। আম্মা একটু শান্ত হলে তার অনুমতি নিয়ে আমরা বাড়ি যাব। তারপর….” ইফা কৌতূহলী কন্ঠে বলল, “তারপর কি?”

শাহর ইফার নাক টেনে বলল, “এই পিচ্চিটাকে বউ বানিয়ে নিব।” ইফা খানিকটা লজ্জা পেয়ে শাহরের বুকে মুখ লুকোয়। এইসময় তাদের আম্মা এসে উপস্থিত হন। তারা তড়িঘড়ি নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে শালীনভাবে দাঁড়ায়। মহিলা গম্ভীরমুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আমি তোমাদের ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি।

তবে তোমাদের বিবাহে আমি উপস্থিত থাকব। আর বিবাহের সমস্ত আয়োজন আমার ইচ্ছে অনুযায়ী করতে চাই। এতে তোমাদের আপত্তি নেই তো?” রেহজান আর ইফা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলল, “নাহ আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে আপনাদের আসল পরিচয় যাতে প্রকাশ না পায় এমনভাবে করুন।” মহিলা ঘনঘন মাথা নাড়ালেন, ঠোটের কোণে তার অদ্ভুত রহস্যময় হাসি।

ইফাকে দেখে আশফাক সাহেব উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এতদিন কোথায় ছিলিরে তুই?” ইফা একনজর শাহরের দিকে তাকায়। কিছুটা দম নিয়ে বলল, “মামা আমাকে অপহরণ করা হয়েছিল তখন শাহর ই আমাকে উদ্ধার করে। মানসিক অবস্থা তেমন ভাল না থাকায় শাহরের বাড়ীতে’ই ছিলাম।” আশফাক সাহেব কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল, “তোমাকে কিভাবে ধন্যবাদ জানাব ভেবে পাচ্ছিনা!” শাহর অবাকদৃষ্টিতে ইফার দিকে তাকিয়ে ছিল।

তার পিচ্চি ইফা কখন যে বড়দের মত কথা বলতে শিখে গেল। আলফি আর রেহজান বাসায় প্রবেশ করামাত্র রওনক এসে রেহজানকে হাজার প্রশ্ন করতে শুরু করল। রেহজান প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোমলকন্ঠে বলল, “আমাকে একটু জিরোতে দিবি?

” রওনক রেহজান এমন কোমলস্বরে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। সে যখন ই রেহজানকে বকাবকি করত কিংবা বাড়াবাড়ি রকমের প্রশ্ন করত তখন রেহজান উল্টো তাকে বকা দিয়ে চুপ করাত। আজ বোনের অন্যরুপ দেখে আলফির দিকে ভ্রু কুচকে তাকালে আলফি সবক’টা দাত দেখিয়ে বোকামার্কা হাসি দেয়।

শাহর-আলফির আম্মা মাঝবয়সী মহিলার বেশে ইফার বাড়ীতে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসলেন। ইফার মামা ভ্রু কুচকে একবার মহিলাকে পরখ করে দেখলেন। এটা জেনে বেশ অবাক হলেন শাহর-আলফি দু’জন আপন ভাই। মহিলা মুচকি হেসে বললেন, “ভাই আপনার মেয়েটাকে আমার শাহরের বউ হিসেবে চাই। না করবেননা, আমি কিছুদিন পর হজ্জ্বের জন্য রওনা দিব।

তাই দেরী করতে চাইনা।” শেষমেষ ইফার মামা আশফাক সাহেব মত দিলেন। ইফা আর রেহজান মহিলার কাছে এসে বসল। ইফা বলল, “আম্মা আপনি আমাদের ডেকেছিলেন?” মহিলা উৎফুল্ল দেখিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, আমি তোমাদের পরিবারকে বিয়ের ব্যাপারে রাজি করিয়েছি। বিয়ের তারিখ ও ঠিক করা হয়েছে।

বিয়ের সমস্ত আয়োজন করে ফেলছি। আমি চাচ্ছিলাম বিয়ের আগে তোমরা আর আমার ছেলেদের সাথে দেখা না করো, কিছুদিনের জন্য যোগাযোগ স্থগিত রাখো। আর যেহেতু তোমাদের দুজনের’ই মা এখানে উপস্থিত নেই তাই আমি তোমাদের অভিভাবকের দায়িত্ব নিচ্ছি। এই কয়েক’টা দিন তোমরা আমার কাছেই থাকো।”

রেহজান আর ইফা আপত্তি করলনা। আলফি আর শাহরকে রুস্তমের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল, রেহজান আর মহিলা ইফাদের বাসায় থেকে গেল। মাঝরাতে দরজায় কারো নক করার আওয়াজে মহিলা অতি সন্তুপর্ণে দরজা খুললেন, খাদেমা চাদর মোড়ানো অবস্থায় ভিতরে ঢুকার সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, “যা আনতে বলেছিলাম এনেছো তো?”

খাদেমা চাদরের নিচ থেকে একটা রৌপ্যের কৌটা বের করে মহিলার হাতে দিতে দিতে বললেন, “আপনি কি তাদের পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিচ্ছেননা?” মহিলা কৌটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ক্রোধমিশ্রিত স্বরে বলল, “এমন অবাধ্য মেয়েদের আমি নিজের মেয়ে হিসেবেও কখনো মানতামনা… এত বড় দুঃসাহস এদের আমাকে হেয় করে? আমার কথাকে মূল্যায়ন করেনা?

আমিও দেখব এরা কিভাবে এই দুনিয়ায় সুখে সংসার করে!”
খাদেমা আকুতিভরা কন্ঠে বলল, “এমন করবেননা বেগম। আপনার পুত্রদের কি হবে? তাদের সুখের কথা চিন্তা করবেননা?” মহিলা উপহাসের হাসি হেসে বলল, “আমার পুত্রদের আবার বিয়ে দিব।

এই ভেষজের প্রভাবে ওরা ধীরে ধীরে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে, একসময় নিজেরা নিজেদের সহ্য করতে না পেরে নিজেকে মরতে বাধ্য হবে। আমার পুত্ররা একটু শোকাহত হবে বটে, একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।”
খাদেমার কিছুটা খারাপ লাগছে রেহজান আর ইফার জন্য। এমন ভালো মেয়ে সে খুব কম ই দেখেছে, কিন্তু তার কিছু করার নেই।

দায়িত্বের কাছে তার হাত-পা বাঁধা। চাইলেও রেহজান-ইফার করুণ পরিণতি সে আটকাতে পারবেনা…
ইফা হাতে থালাভর্তি খাবার নিয়ে মহিলার কক্ষে প্রবেশ করল। মহিলাকে কক্ষে না দেখে কয়েকবার ডাকল, সাড়া না পেয়ে চলে যেতে উদ্ধত হতে গিয়ে দেখে মেঝেতে একটা রৌপ্যের কৌটা পড়ে থাকতে দেখল। কৌটা থেকে এমন উদ্ভত গন্ধ আসছে। রেহজান কৌতূহলে সেটা হাতে নেওয়ামাত্র মহিলা কক্ষে প্রবেশ করলেন।

ইফার হাতে কৌটা দেখে মহিলা হুংকার ছেড়ে বললেন, “তুমি এখানে কি করছো?” সাথে সাথে ইফার হাত থেকে কৌটা কেড়ে নিয়ে বললেন, “অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করোনা নাকি!” ইফা অপরাধীর মত মাথা নিচু করে বলল, “ক্ষমা করবেন। আপনি ঘরে ছিলেননা সেটা আমি জানতামনা।”

  • “তাই বলে আমার জিনিসপত্রে হাত দিবে?” ইফা মহিলার ধমকে একটু ভয় পেয়ে গেল, সামান্য কৌটায় হাত দেওয়ায় এভাবে বকছে ভেবে তার কান্না পাচ্ছে।
  • “আম্মা কৌটা নিচে পড়ে ছিল। প্রয়োজনীয় হতে পারে ভেবে উঠিয়ে রাখতে গিয়েছিলাম, আমাকে ক্ষমা করবেন।” মহিলা একটু নরম হলেন, “আমার কক্ষে কি বোধ করে এলে?” ইফা কন্ঠে স্বাভাবিকতা এনে টেবিলের উপর থেকে থালা নিয়ে মহিলার সামনে রেখে বলল, “রেহজান আপু কিছু পিঠা-মিষ্টি বানিয়েছে। আপনারা তো এসব বেশ পছন্দ করেন। আমি খুব যত্নসহকারে আপনার জন্য পরিবেশন করে নিয়ে এসেছি।” মহিলা থালার দিকে তাকালেন। বিশাল থালায় কয়েকপ্রকার পিঠে-মিষ্টি সুন্দরভাবে সাজানো। দেখে তার লোভ লেগে যাচ্ছে, মোহনীয় গন্ধ তাকে টানছে। মহিলা গলা পরিষ্কার করে বলল, “ঠিক আছে তুমি যাও। আমি খেয়ে নিব।” ইফা নিরবে কক্ষ থেকে বের হয়ে উকি মেরে দেখল মহিলা গপাগপ করে খেয়ে নিচ্ছেন। তার দৃশ্যটা দেখে ভীষণ ভালোলাগল, সে পুনরায় কক্ষে ফিরে বলল, “আম্মা।” মহিলা খাওয়া বন্ধ করে চমকে উঠলেন, মুখভর্তি খাবার নিয়ে কথা বলতে পারছেননা। ইফার সামনে এই অবস্থায় ধরা পড়ে তার লজ্জা লাগছে। ইফা মুচকি হেসে বলল, “আম্মা আরো লাগলে বলবেন৷, এসব বিশেষ করে আপনার জন্য ই বানানো হচ্ছে। রেহজান আপু এখনো বানাচ্ছে।

আপনার আরো প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবেন, আমি নিয়ে আসব।” বলে ইফা বেরিয়ে গেল। মহিলা একনজর সেদিকে তাকিয়ে রইলেন আর ভাবছেন, “মেয়েগুলো তাকে শ্বাশুড়ী হিসেবে বেশ সমাদর করছে…” এক মূহুর্তের জন্য তাদের ভালোবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে।

রেহজান আর ইফাকে সাজানো হচ্ছে। সাজের তদারকি করছেন স্বয়ং তাদের শ্বাশুড়ি। ইফার অনেক ইচ্ছে ছিল বাঙ্গালি সাজে বিয়ে করার। কিন্তু শ্বাশুড়ীর কড়া আদেশ গাউন-নিকাব পড়েই বিয়ে করতে হবে। অবশ্য তাতেও তাদেরকে খারাপ দেখাচ্ছেনা। দুজনের জন্য সবকিছু একই ধরণের এনে রেখেছেন মহিলা। তার শুভ্র সাদা রঙ অনেক পছন্দ, তাই তাদের গাউন-নিকাব সব সাদা।

মাথার মুকুট আর সাদা পাথরের আংটি ছাড়া আর কোনো গহনা পরানো হচ্ছেনা। হাতে-পায়ে সাদা মোজা, কেবল সাজানো চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। সাজ শেষ হলে রেহজান আর ইফা আয়নার দিকে তাকাল। ইফা মিনমিন কন্ঠে বলল, “আপু ইচ্ছে ছিল বিয়েতে বাঙ্গালী সাজ সাজব।” রেহজান হেসে বলল, “সাজ দেখে আমার নিজেকে আরবীয় রাজকুমারী মনে হচ্ছে। শ্বাশুড়ীমায়ের পছন্দ খারাপ না কি বলিস…!”

ইফা মাথা নাড়াল। সত্যিই নিজেকে আরবীয় দেশের রাজকন্যা মনে হচ্ছে। মহিলা দুটো দুধের গ্লাসে ভালো মত কৌটার ভেষজ মিশিয়ে নিলেন। চামচ নাড়াতে নাড়াতে রহস্যময় হাসি দিচ্ছেন। অতঃপর দুধের গ্লাস দুটো ট্রে তে নিয়ে রেহজান-ইফার কক্ষের উদ্দেশ্যে হাটা দিলেন।

রেহজান ইফার হাত ধরে বলল, “আমি জানি শ্বাশুড়ী আম্মা আমাদের উপর এখনো রেগে আছেন। তাই আমাদের উনার কোনো কথা ফেলা উচিত হবেনা। তাছাড়া আমরা উনার সাথে আজীবন থাকব ও না, বিয়ে শেষ হলে উনি ফিরে যাবেন। যতক্ষণ আছেন, তার কথা শুনে চলি। তাতে উনার রাগ কমে যাবে আর আমরা নতুন জীবন শুরুর ক্ষেত্রে দোয়া পাব।” ইফা উৎফুল্ল হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, “তাই হবে আপু।”

পর্ব ২৮

শাহর-আলফির আম্মা দুধের গ্লাস দুটো নিয়ে ইফা’দের কক্ষে প্রবেশ করলেন। রেহজান আর ইফা তখন রওনকের সাথে গল্পে মশগুল। মহিলা একবার ওদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন।

মেয়ে দু’টোকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে, যে কারো-ই চোখ ফেরানো দায়। মহিলা রওনককে নিজের কাছে ডাকলেন। রওনক এগিয়ে আসতে বললেন, “তোমার বর এখনো গাড়ী নিয়ে এলনা যে?

ওরা কখন রওনা দিবে! তাড়াতাড়ি একটা ফোন দিয়ে খোঁজ নাও তো মা।” রওনক মাথা নাড়াতে নাড়াতে ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রেহজান আর ইফা উঠে এসে মহিলাকে সালাম করল, ওদের এই কান্ড দেখে মহিলা একটু অবাক হল। তারপর মুচকি হেসে বলল, “আল্লাহ তোমাদের ভালো করুন। সারাদিন তেমন কিছু খাওনি, তাই আমি একটু দুধ গরম করে আনলাম।”

বলে ট্রে থেকে গ্লাস দুটো নিয়ে রেহজান আর ইফার হাতে দিলেন। ইফা একটু নাক কুচকে বলল, “আম্মা আমি তো দুধ খেতে পারিনা। না খেলে হবেনা?” মহিলা থতমত খেয়ে জোর দিয়ে বললেন, “উহু কোনো কথা নয়, পুরো দুধ শেষ করতে হবে।

এটা নিয়ম।” রেহজান ইফাকে নিচুস্বরে বলল, “একটু কষ্ট করে খেয়ে নে। তখন কি বলেছিলাম মনে নেই!” ইফা মাথা নাড়াল, শ্বাশুড়ী-আম্মা কে খুশি করার জন্য একগ্লাস দুধ খাওয়া ই যায়। রেহজান-ইফা গ্লাসে চুমুক দিবে দেখে মহিলার চোখ দুটো চরম খুশিতে ঝলকানি দিচ্ছে। এমনসময় কেউ দরজায় নক করল, মহিলা একটু বিরক্ত হলেন। তাও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “তোমরা খাও, আমি দেখছি।

” ভেজানো দরজা খুলে দিতে কক্ষে প্রবেশ করল সাদা আলখেল্লা-জোব্বা পরিহিত লম্বামতন এক সুঠানদেহী মাঝবয়সী লোক। তার মুখে কালো কাপড়ের মুখোশ। দীপ্তিমান চোখগুলো দেখা যাচ্ছে শুধু। এই অদ্ভুত লোককে দেখে ওরা না খেয়ে অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মহিলা লোকটিকে দেখে হকচকিয়ে উঠে বলল, “স্বামী আপনি এখানে?”

পুরুষটি ইফা-রেহজানের দিকে তাকিয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল, “আমার পুত্র এবং তার জীবনসঙ্গীনিদের দোয়া দিতে এসেছি।” তার কথা শুনে ইফা ফিসফিস কন্ঠে বলল, “আপু উনি তাহলে আমাদের শ্বশুড়। কিন্তু উনাকে আগে কখনো দেখিনি কেন?” রেহজান চাপাস্বরে উত্তর দেয়, “আমি শুনেছি উনি প্রায়সময় ই তালীমের কাজে ব্যস্ত থাকেন। চল, সালাম করি।” রেহজান-ইফা সালাম দিয়ে বলল, “কেমন আছেন বাবা?”

ওদের মুখে এত মায়াময় বাবা ডাক শুনে লোকটির বিরস চেহারায় প্রসন্ন ভাব দেখা গেল। উনি এগিয়ে এসে বললেন, “আল্লাহ আমাকে ভাল রেখেছেন। তোমাদের দুজনের ব্যাপারে অনেক কিছু শুনেছি, আজ নিজচোখে দেখে মনে হচ্ছে আমার পুত্ররা বেছে বেছে খাটি হিরে খুজে নিয়েছে। দোয়া করি সুখী হও আর আজীবন সুখে-দুঃখে আমার পুত্রদের পাশে থাকো।”

লোকটি ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তার হাত লেগে একটি দুধের গ্লাস টেবিল থাকে মেঝেতে পড়ে যায়। লোকটি দুঃখী চেহারায় মেঝেতে বসে গ্লাসটির দিকে তাকিয়ে বলল, “দুঃখিত, আমি খেয়াল করিনি।” হঠাৎ উনি একটু চুপ থেকে উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে অপরগ্লাসটি হাতে নিয়ে নাকের কাছে নিয়ে শুকে রেহজানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল, “এই দুধ তোমাদের জন্য কে এনেছে?” রেহজান একটু বিব্রত হয়ে উত্তর দিল, “আম্মা এনেছেন।”

লোকটি এবার মহিলার দিকে এগিয়ে এল। ততক্ষণে মহিলার চেহারায় ভীতি ফুটে উঠেছে। লোকটি রাগমিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “এই দুধে গুল্ম ভেষজের গন্ধ কেন?” মহিলা আমতা আমতা করতে লাগলেন। লোকটি প্রচন্ড হুংকার ছেড়ে বললেন, “ভেষজ কেন মিশিয়েছো? নিজের পুত্রবধূদের বদ্ধ উন্মাদ করতে চাও?

তুমি আসলেই একজন মা?” মহিলা কান্নারত চেহারায় বলল, “আমাকে ক্ষমা করুন স্বামী। আমি রাগের চোটে এই কাজ করে ফেলেছি।” লোকটি দুধের গ্লাস ছুড়ে ফেলে বলল, “তোমার মত পাপীর জায়গা আর আমার পাশে নেই। তোমার সাথে আমি সম্পর্ক বিচ্ছেদ করব। তার আগে তোমার পুত্রদের তার মায়ের আসল রুপ দেখানো উচিত।”

কথাটা শুনে মহিলার কান্নার শব্দ আরো বেড়ে যায়। লোকটি বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে রেহজান পিছু ডাকে, “বাবা, আপনি ওদের এই ব্যাপারে কিছু বলবেননা।” লোকটি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো সে কত বড় অন্যায় করতে যাচ্ছিল? তোমাদের পানীয়তে সে বদ্ধ উন্মাদ হওয়ার ভেষজ মিশিয়েছে।

সে কেবল তোমাদের ক্ষতি করতে চায়নি, তার পুত্রদের জীবন ও নষ্ট করতে চেয়েছে।” রেহজান শান্তকন্ঠে বলল, “ভুল মার্জনা করবেন বাবা। আমরা জানি উনি আমাদের উপর রেগে আছেন, হয়ত আমাদের পছন্দ ও করেননা। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি উনার মন জয় করার, এটা আমাদের ব্যর্থতা। আম্মার যদি এই বিবাহে সম্মতি না থাকে তবে এই বিবাহ হবেনা।

মায়ের অসম্মতিতে আমরা এই বিবাহ করে কখনো সুখী হবনা বাবা। কিন্তু আপনি আলফি-শাহরের নিকট এসব বলবেননা। ওরা আজীবন তাদের মাকে ছোট করে দেখবে এটা তাদের মায়ের কাছে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক হবে।” রেহজানের কথা শুনে মহিলা তুমুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ইফা এগিয়ে এসে মহিলার হাত ধরে বলল, “আম্মা চিন্তা করবেননা আপনার অসম্মতিতে কিছু হবেনা। এই বিবাহ বন্ধ করে দিব।

মহিলা এবার অসহায়ের দৃষ্টিতে তার স্বামীর দিকে তাকালেন, “আমাকে ক্ষমা করুন স্বামী।” লোকটি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, “ক্ষমা ওদের কাছে চাও। আর নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত করো।” মহিলা কাদতে কাদতে বললেন, “তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। রাগের বশে আমি অন্যায় করতে যাচ্ছিলাম। এই বিবাহে আমার পূর্ণ সম্মতি আছে, তোমাদের মত পুত্রবধূ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।” রেহজান-ইফা মহিলার কাছে এসে তার কান্না থামানোর প্রচেষ্টা করতে লাগল।

ইফা-রেহজান ধীরে ধীরে শামিয়ানায় সজ্জিত মঞ্চের দিকে এগোচ্ছে। তাদের দুইপাশে রওনক আর তাদের শ্বাশুড়ী। আলফি-শাহর এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে তাদের নিজেদের পাশে এনে বসাল। এরমধ্যে আলেম ও এসে উপস্থিত হলেন। আলফি-শাহর ও সাদা রঙ্গের শেরওয়ানী আর মাথায় টুপি পড়েছে। তাদেরকে আলোকিত শুভ্র নূরের ন্যায় লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সুনিপুনভাবে তাদের বিবাহকার্য সমাধা হল।

ইফা ফুল দ্বারা সজ্জিত কক্ষে উৎফুল্লচিত্তে বসে আছে। তার মামা তার পাশে বসে রসিকতা করে বলছে, “জামাইকে দেখে আমার ভীষণ লাজুক মনে হল। দেখিস তোর সংসার ঝগড়া-ঝাটি ছাড়া স্মুথলি চলবে।” পাশ থেকে নাহার তাড়া দিল, “আপনি ঘরে চলুন তো। মেয়েজামাই এক্ষুনি এসে মামাশ্বশুড়কে দেখলে কি ভাববে?” মামী মামাকে নিয়ে যাওয়ার পর শাহর কক্ষে প্রবেশ করল। ইফার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “জ্বীন বিয়ে করার শখ মিটেছে পিচ্চি?”

ইফা মুখ বাকিয়ে বলল, “চড় খেতে খেতে খুব মিটেছে।” শাহর শব্দ করে হেসে উঠল। তারপর ইফার পাশে বসে তার হাত ধরে বলল, “জ্বীনের চড় খাওয়ার জন্য হলেও তোমার এই জ্বীনকে ভালোবাসতে হবে।” ইফা চোখ বড় বড় করে বলল, “আজীবন কি চড় মেরে যাবেন নাকি?” শাহর হেসে হেসে বলল, “মাঝে মাঝে তোমার আবেগ ঠিক রাখার জন্য দু-একটা মারা যেতে পারে কি বলো!” ইফা মুখ ভেঙ্গাল। তারপর একটু থেমে স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলল, “ভালোবাসি ইফা।” ইফা অবাক হয়ে বলল, “এটা কি করে জানলেন?”

~ “আলফি ভাইয়ার থেকে শিখেছি।” ইফা শাহরকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমিও ভালোবাসি আমার চড় মারা জ্বীনবরকে।”

রেহজানের মধ্যাঙ্গুলে একটি সুন্দর আংটি পড়িয়ে দিল আলফি। তারপর মুচকি হেসে বলল, “মনে আছে আমাদের হলুদের রাতে লুকিয়ে দেখা করতে গিয়ে তোমার আঙ্গুলের মাপ নিয়েছিলাম।

সেই মাপ দিয়ে বিয়ের দিন এই আংটি টা বানিয়েছিলাম। দেরীতে হলেও বিশেষমূহুর্তে তোমাকে আংটি পড়াতে পেরেছি।” রেহজান আলফির গাল টেনে দিয়ে বলল, “জ্বীন হলেও আমার বর অনেক রোমান্টিক।” আলফি বরাবরের মত রেহজানকে একটানে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আগের মত স্পষ্ট বাংলায় বলল, “ভালোবাসি।” রেহজান এক প্রশান্তিতে চোখ বুজে আলফির বুকে নিজেকে সমপর্ণ করল।

আলফি রেহজানের কপালে চুম্বন করতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলল আলফি, খুলে ইফাকে দেখে চোখ কপালে উঠল। ইফা ছুটে গিয়ে রেহজানের কাছে বসে গল্প জুড়ল। ইফার পিছনে ঘরে ঢুকল শাহর। তার মুখেও একরাশ হতাশা।

ইফা আর রেহজান হেসে হেসে কথা বলছে। আলফি আর শাহর দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাদের সামনে দাড়িয়ে আছে। আলফি ফিসফিস করে বলল, “তুই নিজের বাসরের সাথে সাথে কি আমার বাসর নষ্ট করার প্ল্যান করেছিস?”

শাহর অসহায় কন্ঠে বলল, “এই পিচ্চিকে আমি কিভাবে সামলাব আল্লাহ!” আলফি কনুই দিয়ে শাহরের পেটে গুতো দিয়ে বলল, “সে আমি জানিনা। আমার বাসর নষ্ট হলে তোর খবর আছে।”

শাহর ইফার হাত ধরে বলল, “চলো বউ, ভাইয়া-ভাবী গল্প করুক।” ইফা চোখ পিটপিট করে বলল, “আপু ভাইয়া কি আমাকে হিংসে করছে নাকি?” রেহজান হাসতে হাসতে আলফির দিকে তাকায়। আলফি নিচের ঠোট কামড়ে ধরে হতাশামাখা মুখে দাড়িয়ে আছে। শাহর ইফার কানে কানে বলল, “এখন তুমি ঠিক করো আজকে জ্বীনবরের আদর খাবে নাকি চড়?”

ইফা উঠে দাড়িয়ে যেতে যেতে বলল, “আপু তুমি তোমার জ্বীনবরকে সামলাও, আর আমাকে আমার জ্বীনবর সামলে নিক…” তারপর শাহরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “অনেক চড় খাওয়ার বিনিময়ে জ্বীনবর পেয়েছি বলে কথা…” শাহর মুচকি হাসে। এই চঞ্চল পিচ্চি মেয়েটার মুখে আদুরে “জ্বীনবর” ডাক শুনতে তার ভীষণ ভালোলাগে।

লেখা – আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “জ্বীনবর (সিজন ৬) – ভয়ংকর ভূতের গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – জ্বীনবর (সিজন ১) – লোমহর্ষক ভয়ানক ভুতের গল্প ২০১১

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *