জ্বীনবর (সিজন ২) – ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প বলো

জ্বীনবর (সিজন ২) – ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প বলো: কাল রাতে মেহরাব আমার উপর আক্রমণ করেছিল। আমি যখন তাহাজ্জুদের নামায পড়তে মসজিদে গিয়েছিলাম ও আমার পথ আটকে দাঁড়ায়। তখন ওর সে কি ভয়ংকর রুপ ছিল।


পর্ব ০১

আবছা অন্ধকার পথে আর পা দুটো চলছেনা। রাস্তাটা প্রচন্ড নির্জন, জনমানবহীন একটা দুটো গাড়িও চলছেনা।অবশ্য চলবেই বা কি করে রাত ২টোর বেশি বাজে।

ফোনের ব্রাইটনেস কমে আসছে, একটু পর অফ ই হয়ে যাবে।তখন আর অন্ধকারে হাটতেও পারবনা। বাস থেকে নামার পর শুধু একটা মানুষ খুজছি যে আমাকে ঠিকানাটা চিনিয়ে দিবে, এখন সেটার আশা করা কেবল বৃথা। এত ভারি ব্যাগ নিয়ে তখন থেকে হেটে চলছি ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে, এখন আর পারছিনা। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে, শরীরটাও আর সায় দিচ্ছেনা।

থপ করে রাস্তায় ই বসে পড়লাম ব্যাগটা পাশে রেখে।চারিদিকে একবার চেয়ে নিলাম, নিস্তব্ধ রাস্তায় আমি একা দূর হতে কিছু কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। খুব কাদতে ইচ্ছে করছে, এমন বিপাকে আমি আগে কখনোই পড়িনি। এমন একটা অচেনা জায়গায় কে আমাকে সাহায্য করতে আসবে।কখন কোন বিপদ হয় সেটাই বা কে বলতে পারে, ভেবেই পরনের কালো বোরকাটা হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখলাম।

ভয়ে বারবার শরীরটা কেপে কেপে উঠছে, ফোনটার দিকে চোখ পড়তেই ডায়াল লিস্টে থাকা বাবার নাম্বারটায় কল দিলাম। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছেনা। ৩বার ট্রাই করার পর আমার ফোনটাই অফ হয়ে গেল। এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধক করে উঠল। হঠাৎ রাস্তার পাশের জঙ্গল থেকে কারো হাটার শব্দ ভেসে এল।

ক্রমশ শব্দটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, চট করে উঠে দাড়ালাম। এক-দু পা এগিয়ে জঙ্গলের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখার ট্রাই করলাম। দুজোড়া ঘন সবুজ চোখ দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠলাম। এমন পাহাড়ী জঙ্গলে নেকড়ে-শিয়াল থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু এখন আমার কি হবে?
ওদের ক্ষুধার্ত থাবার হাত থেকে কি করে বাচাব নিজেকে।

চোখ বুজে আল্লাহর নাম জপতে জপতে পিছু হাটতে লাগলাম। এক চোখ একটু খুলে দেখলাম চোখজোড়া জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে, এই বুঝি ঝাপিয়ে পড়ে আমাকে ছিড়ে খেয়ে নিল। আরেক পা পিছুতেই কারো শক্ত বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে সেখানে পড়ে বসে পড়লাম। পায়ে ব্যথা পেয়ে আস্তে কঁকিয়ে উঠলাম। পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে কাপা কন্ঠে বললাম,
~ কে ওখানে?

ওপাশ থেকে পুরুষের সুকন্ঠে উত্তর এল,
~ এত রাতে এখানে কি করছেন? একটু ভরসা পেয়ে বললাম,
~ আমি এখানে একটা ঠিকানা খুজতে এসেছি।

কিন্তু কাউকে পাচ্ছিলামনা তাই রাস্তায় ই বসে পড়লাম।তখনি
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিকানাটা দেখি। হাতে গুজে রাখা কাগজটা বের করে তার বাড়ানো হাতে দিয়ে দিলাম। উনি মনোযোগ দিয়ে ঠিকানা দেখতে লাগলেন। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছিলনা, কেবল বুঝতে পারছিলাম অনেকটা লম্বামতন একটা ছেলেবয়সী লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে। গায়ে পাতলা চাদর মোড়ানো, এই গরমকালে কেউ চাদর পড়ে জানা ছিলনা।

উনি আবার বললেন, আমার পিছু পিছু আসুন।
পায়ে ব্যথা পাওয়ায় নিজে নিজে উঠতে কষ্ট হচ্ছে। উনার দিকে হাতটা বাড়িয়ে বললাম, আমাকে একটু টেনে তুলুন তো। উনি একটু থম মেরে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, নিজেই উঠতে শিখুন।

শুনে মেজাজ পুরাই হাই হয়ে গেল।কি কমনসেন্সলেস মানুষ! উনি মনে করেছে উনাকে ধরার জন্য বাহানা করছি নাকি! কষ্ট করে ব্যাগ আর মোবাইলটা হাতে নিয়ে উঠে উনাকে ফলো করতে লাগলাম। ইচ্ছে হল বলি, এগিয়ে যখন দিচ্ছেন ব্যাগটা একটু নিয়ে হেল্প করুন। কিন্তু বললামনা, আবার যদি ইন্সাল্ট করে বসে। হাতি গর্তে পড়লে তেলাপোকাও লাথি মারে, তেমনি কিছু। কিছুটা হেটে যাওয়ার পর বলল, ব্যাগটা আমায় দিন।

আমি ভাব দেখিয়ে বললাম, লাগবেনা আমি নিতে পারব। ভেবেছি জোর করে নিয়ে নিবে, তেমন কিছুই করলনা। চুপচাপ আবার হাটতে থাকল। ভাব দেখাতে গিয়ে কি হাতের ব্যথা উঠাব নাকি। বুদ্ধি খাটিয়ে ডেকে বললাম, ব্যাগটা একটু ধরুন তো। আমি নিকাব ঠিক করব।

সে চুপ করে ব্যাগ টা নিয়ে নিল। মনে হল যেন মুখে উপহাসের হাসি লেগেই আছে। তাতে আমার কি! হাটতে হাটতে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম।

“এত রাতে এমন নির্জন রাস্তায় এই লোক কিভাবে এল? না জেনেশুনে এই লোকের পিছুপিছু যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? কি ই বা করার আমার, ওখানে বসে থাকলে নেকড়ের খাবার হতে হত!”
হঠাৎ ধ্যান ভেঙ্গে দেখি একটা আধ-পুরোনো দোতলা বড় বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি।

বাড়ির বারান্দায় জ্বলতে থাকা লাইটের আলোতে দেখলাম ব্যাগটা আমার পাশে রাখা, কিন্তু তথাকথিত সেই লোকটি নেই!
এবার সত্যি ই ভয় পেয়ে গেলাম, কোথায় গেল লোকটা! নিচের তাকিয়ে চিন্তামগ্নে হাটার কারণে খেয়াল ও করিনি। এইদিক ওইদিক চেয়ে দেখলাম কেউ নেই। বাড়ির নেইমপ্লেটের উপর চোখ পড়ল।

এই বাড়ির ঠিকানাই তো খুজছিলাম এতক্ষণ। যাক বাবা, নিশ্চিন্ত হলাম। লোকটা সঠিক ঠিকানায় পৌছে দিয়ে গেছে। এক পা দুই পা করে ব্যাগ নিয়ে দরজার সামনে এসে দরজা ধাক্কালাম। কয়েকবার ধাক্কানোর পর কোনো সাড়া পেলামনা।

এতরাতে সবাই নিশ্চয়ই গভীর ঘুমে আছন্ন। দরজার ধাক্কানোর আওয়াজটা বোধহয় ওদের কানে যাবেনা। তাই ক্লান্ত হয়ে বারান্দায় হেলান দিয়ে বসলাম।
মুখের সামনের নিকাবটা সরিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

কেন ভাগ্য আমার সাথে এমন করছে জানা নেই! বাসা থেকে এত দূরে অচেনা জায়গায় পালিয়ে এলাম তাও একটা ঠিকানার উপর নির্ভর করে।
আমার মত বোকা হয়ত আর কেউ নেই। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আল্লাহ তুমি ই আমার সহায় হও।

ফোনটা অন করার চেষ্টা করলাম কয়েকবার। নাহ পারলামনা। সাতপাচ ভাবতে লাগলাম বসে বসে। আমি মুশায়রা, বাবাই শখ করে নামটা রেখেছিলেন। বাবা মাঝে মাঝে বলত এই নামটা নাকি খুব বিশেষ একজনের ছিল।আমি যেন তার মত হই, তাই বাবা এই নামটা রেখেছে। সবাই অবশ্য আদর করে মুশু ডাকে।
আমি সেই বিশেষ মানুষের মত হতে পেরেছি কিনা জানিনাহ তবে খুব দুষ্ট আর বাচাল স্বভাবের। মাকে খুব জ্বালাতাম তাই মা সেই অভিমানে ৬মাস আগে অন্য জগতে পাড়ি জমেছিলেন।

আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম বাচানোর কিন্তু চোখের সামনে ধুকে ধুকে মারা গেল আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটা। পরীর মত একটা বোন ছিল আমার, নাম রেখেছিলাম শিরিন। ৯বছর বয়সী পরীটা ঠিক আমার মতই হয়েছিল। দুবোন একসাথে বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখতাম। তার সঙ্গী বলতে আমি ই ছিলাম। সারাটা দিন পিছু পিছু ঘুরে বেড়াত।

কিন্তু
কারো ডাকে ঘুমটা ভাঙ্গল আমার। কখন যে বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল ই করিনি। বয়স্ক মহিলাটি পানের পিক ফেলে আঙ্গুল দিয়ে দাত পরিষ্কার করতে করতে বললেন, কে তুমি বাছা! এখানে ঘুমিয়েছো কেন?
আমি ড্যাব ড্যাব করে উনার লালরঙ্গা গালের দিকে তাকিয়ে রইলাম।


পর্ব ০২

মহিলাটির বাজখাই গলার শব্দে চমকে উঠলাম। মাথা নিচু করে বললাম, আমি মুশায়রা, আমার বাবা মোশাররফ উল্লাহ।নওয়াবগঞ্জে থাকি। মহিলাটি চুপ করে আমার দিকে আবার ভালো করে তাকালেন। পরে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুই সেই ছোট্ট মুশায়রা, কত্ত বড় হয়ে গেছিস! আমি তোর ফুপি রে মুশু।

সেই ছোট্টবেলায় বাড়ী থেকে পালিয়ে চলে আসার সময় তোকে দেখেছিলাম, তারপর আর যোগাযোগ হয়নি তোদের সাথে। ভাই আমাকে ক্ষমা করেনি আজো, তাই তার সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি।

চল তুই ভেতরে চল। কতটা পথ জার্নি করে এসেছিস, আগে ফ্রেশ হয়ে নে। তারপর গল্প করা যাবে। আমি মাথা নাড়িয়ে তার পিছু পিছু দোতলার দক্ষিনের একটা সুন্দর বেডরুমে আসলাম। বাড়িতে দুটো মেয়ে ছাড়া আর কাউকে বিশেষ দেখতে পেলামনা। ফুপি ব্যাগ টা রুমের এক কোণে রেখে বলল, মা তুই ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়, আমি নাস্তার ব্যবস্থা করি।
~ ফুপি এত ব্যস্ত হয়োনা।

~ আমি হব না তো কে হবে! এই প্রথম ফুপিকে দেখতে এলি, তুই ফ্রেশ হ। আমি যাচ্ছি। ফুপি চলে যেতেই আমি খাটের উপর বসলাম। পায়ে এখনো হালকা ব্যথা আছে, আর চোখে ঘুম। শাওয়ার নিলে হয়ত ঘুমভাবটা কাটবে ভেবে ফোনটা চার্জে দিয়ে শাওয়ারে গেলাম। মাথা ভেজাতে ভেজাতে ভাবলাম, বাবা তো কখনোই বলেনি আমার ফুপি আছে, আমি শুধু জানি আমার বাবারা দুই ভাই।

ফুপি যদি থেকেই থাকে তবে বাবা আমাকে আগে কখনোই বলেনি কেন? এলোমেলো ভাবনা সব মাথায় ঝেকে বসল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই ফুপি ডেকে নিচে নিয়ে এল। তার দুই মেয়ের সাথে নাস্তা করতে বসলাম। তার বড় মেয়ে সীমার ১৯বছর, আমার বয়সী।

ছোটবোন স্বপ্নার বয়স ১৬ হবে, নাস্তা করতে করতে জানলাম ফুপির স্বামী দেশের বাহিরে থাকে। দুই মেয়ে নিয়ে ফুপি এখানেই থাকে।আনুমানিক ২০-২১বছর আগে নাকি ফুপি বাবা-কাকার অমতে নিজের পছন্দের ছেলের সাথে পালিয়ে এসেছিল, তারপর বাবা তার সাথে সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন।

এসব শুনে যতটা না খারাপ লাগল তার চেয়ে বেশি চিন্তায় পড়ে গেলাম। হিসাব মিলাতে পারছিলামনা কিছুর। এসব নিয়ে এখন আর ভাববোনা, বাবাকে একসময় জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে নিব। রুমে এসে ফোনটা নিয়ে বাবাকে আবার কল দিলাম ছয়-সাতবার, রিং হয়েই যাচ্ছে কিন্তু এখনো রিসিভ করছে। তবে কি বাবা এখনো ঘুমাচ্ছে? তা কি করে হয় বাবা তো শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামায পড়েন। চিন্তায় চিন্তায় মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে, তাই এসব নিয়ে ভাবনা বন্ধ করলাম।

ফুপি-সীমার সাথে গল্প করে কাটালাম সারাদিনটা। এখন খুব ভালোলাগছে, ফ্রেশ লাগছে ভেতরটা।এত ভালো ফুপির সাথে বাবা খুব অন্যায় করেছেন, না হয় নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছিল তাই বলে এমন করবে। বাবা তো সামনের মাসে আমারো বিয়ে ঠিক করেছিলেন, তবে কেন পালিয়ে আসার সময় বাধা দিলেন নাহ!
ব্যাগ থেকে কাপড়-চোপড় নামিয়ে গোছগাছ করে রেখে দিতে গিয়ে লক্ষ করলাম ব্যাগ থেকে হালকা সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।

তার উৎস বের করতে গিয়ে দেখে ব্যাগের বড় চেইনের সাথে সামান্য ছেড়া কাপড় বিধে আছে, হাতে নিয়ে কালো কাপড়টা দেখতেই মনে পড়ল কালকের ভদ্রলোক এই কাপড়ের চাদর পড়েছিলেন। কিন্তু এটা ব্যাগের সাথে ছিড়ল কি করে! লোকটা কিন্তু বেশ অদ্ভুত ছিলেন।

না নিলেন ধন্যবাদ, না জানালেন পরিচয়। ভাগ্যিস খারাপ উদ্দেশ্য ছিলনা, মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম। সন্ধ্যায় রুমের বারান্দায় বসে ফোনে বাবাকে ট্রাই করছিলাম। বাহিরে বেশ সুন্দর চাদের আলো দেখে রুমের লাইট অফ করে বারান্দায় বসে আছি। হালকা হাওয়া আসছে মাঝে মাঝে।

তখন মনে হল আমার থেকে ৩-৪হাত দুরত্বে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি দরজার পাশে বসে ছিলাম, যেহেতু চাদের আলো ততটুকুতে সীমাবদ্ধ ছিল। ফোনের আলো দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু দেখতে পাচ্ছিলামনা। হঠাৎ ফোনটাই অফ হয়ে গেল। অন করার ট্রাই করার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কি হল এটা?

ফুল চার্জ থাকা সত্ত্বেও ফোন অফ হল কি করে! পাশ থেকে হালকা হাসির শব্দ এল। হাসি থামিয়ে একটা পুরুষকন্ঠ বলল, ফোনের কিছু হয়নি। আপাতত বন্ধ হয়েছে যাতে আপনি আলো ফেলে আমার বিরক্ত না করতে পারেন।
ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বলল, কে আপনি?

আমার রুমে কি করছেন? বেরিয়ে যান বলছি।ফুপি সীমা
~ এভাবে বাদরের মত চেচ্চাছেন কেন?
~ একে তো অনুমতি না নিয়ে একটা মেয়ের রুমে ঢুকে পড়লেন, আবার বাদর বলছেন। ঠিক করে বলুন আপনি কে?

~ সত্যিটা বললে ভয় পাবেন, হয়তো গলার সাউন্ড আরো বেড়ে যাবে।
রেগে গেলাম আমি। একটা ঝাড়ি দিয়ে বললাম, মশকরা করছেন? আমি এক্ষুণি ফুপিকে ডাকছি।

উঠে দাড়ালাম ঠিকিই কিন্তু রুমে ঢুকার সাহস পেলামনা। রুমের অন্ধকারে যে একটা অপরিচিত ছেলে আছে, যদি কিছু করে বসে। ভয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পায়ের নখ দিয়ে মেঝেতে খুটছিলাম। উনি বললেন, অত ভয় যখন পাচ্ছেন, বীরত্ব জাহির না করে ওখানেই বসুন।
~ বসবনা আমি। আপনি বলবেন আপনি আসলে কে?
~ বললে ভয় পাবেন না তো?

~ আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি ভয় পাচ্ছি! বাবা বলতেন তুমি যদি কাউকে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করো, সে তোমার উপর আক্রমণ করার জোরদার সাহস পায়। তাই আমি যে ভয় পাচ্ছি তা আমি প্রকাশ করছিনা। আবারো দৃঢ় কন্ঠে বললাম, আপনি বলবেন আপনি কে?

ওপাশ থেকে গম্ভীরকন্ঠে উত্তর এল, আমি জ্বীন মেহরাব। কাল রাতে আপনাকে ঠিকানায় পৌছে দিয়েছিলাম।
এইবার আমার হাত-পা কাপাকাপি অবস্থায় চলে গেল। যদিও আমি কখনোই এসবে বিশ্বাস করিনি বাবা বলা সত্ত্বেও। আজ সেই বিভীষিকা আমার সামনে।

মনে হল কেউ আমার সাথে মজা করছে, মজা করলেও সে কি করে কাল রাতের ঘটনা জানবে। আর জানলেও এভাবে আমার রুমে কি করে ঢুকতে পারবে।
সব যুক্তির জোরে বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি আমার মুখোমুখি একটা জ্বীন দাঁড়িয়ে আছে।

~ কি ব্যাপার? বিশ্বাস হচ্ছেনা!
~ আপনি যদি জ্বীনই হয়ে থাকেন তবে আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন? কেন এসেছেন?
~ আপনাকে সঙ্গ দিতে কেবল। আমার দ্বারা আপনার কোনো ক্ষতির আশংকা নেই, অতএব আপনি নিশ্চিন্ত হোন।

~ দয়া করে আপনি চলে যান, আমি কোনো জ্বীনের সঙ্গ চাইনা। আর আমি কি আপনাকে বলেছি আমার কারো সঙ্গ প্রয়োজন। উপকার করেছিলেন তার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আর বিরক্ত না করলে খুশি হব।
অতএব আমি আশা করছি আপনার আমার সামনে আর আসবেননাহ। যেতে পারেন এখন।

কথাগুলো মনে হল তাকে খুব আঘাত করল। অনেকটা নরম কন্ঠে বলল,
~ আচ্ছা তাই হবে। তবে কখনোও যদি মনে হয় আমাকে প্রয়োজন তবে মন থেকে স্মরণ করবেন।
~ আপনাকে আমার কখনোই প্রয়োজন হবেনা। আপনি আসতে পারেন।
খানিকক্ষণের মধ্যে রুমটা কেমন হালকা হয়ে গেল। মনে হল চলে গেছে তাও আমি নিশ্চিত না হয়ে রুমে ঢুকলামনা।

রুমের আলো জ্বলে উঠল হঠাৎ। সীমা আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, কি হয়েছে তোর? আলো নিভিয়ে বসে ছিলি কেন!
আমি রুমে ঢুকে বললাম, বাহিরে চাদের আলো ছিল তাই।

~ চাদের আলো তো বারান্দা অবধিই। তা কি আর রুমে আসবে নাকি!
শোন, আজ আমি তোর সাথে শুবো। সারারাত একসাথে গল্প করতে পারব কি বলিস! তোর কোনো আপত্তি নেই তো।

~ আরেহ না! কিসের আপত্তি থাকবে।
ভাবলাম সীমাকে একবার ব্যাপারটা বলব। কিন্তু ও যদি বিশ্বাস না করে উলটো ভয় পেয়ে যায়। না থাক না বলাই ভাল। উনি তো বলেছেন উনি আর আসবেননা। শুধু চিন্তা নিয়ে আর দিয়ে লাভ নেই।

তাও কেমন জানি চিন্তা হচ্ছে। এত কড়াভাবে বলার পরো উনি রাগান্বিত হলেন না! তাছাড়া এটাই বুঝলামনা উনি আমাকে কেন সঙ্গ দিতে চাচ্ছেন, কি করে বুঝলেন এই মূহুর্তে আমার কারো সঙ্গ খুব প্রয়োজন।

একটা জ্বীন কি করে মানুষের সঙ্গী হতে পারে! উফফফস আর ভাবতে পারছিনা। দিন দিন মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। এমনিতে বাবাকে নিয়ে চিন্তায় আছি, তারপর ফুপিকে নিয়ে এলোমেলো প্রশ্ন মনে কাটার মত বিধে আছে। এসবের মধ্যে আবার জ্বীনকাহন শুরু হল।

এক প্রকার ডিপ্রেশনে পড়ে গেলাম। সারারাত এপাশ ওপাশ করেও ঘুমাতে পারলামনা। কিছুক্ষণ বাদে বাদে ঘুম ভেঙ্গে যায়। জীবনটা ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে।

উঠে গিয়ে দোতলার ছাদে চলে গেলাম। গভীর রাত, চারিদিকে ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। ধীরে ধীরে হেটে ছাদের শেষ কোণে গিয়ে দাড়ালাম।ইচ্ছে করছে লাফ দেই নিচের দিকে। তাতে যদি মরে গিয়ে জটিলতা শেষ হয়, আর ভালোলাগছেনা।মৃত্যু টাকেই সমাধান মনে হচ্ছে। শিরিনটার কথা খুব মনে পড়ছে। হঠাৎ দেখি শিরিন আমার দুহাত সামনে দাঁড়িয়ে আপু আপু বলে ডাকছে। ওকে ধরার জন্য এক পা বাড়াতেই বুঝতে পারলাম আমি ছাদের শেষ কোণা ছেড়ে এসেছি


পর্ব ০৩

সাথে সাথে নিচে বেকে থাকা রডটা ধরে ফেললাম। দোতলা বাসা হলে অনেকটা উচু মাটি থেকে, নিচে আবার পাকা বারান্দা। এখান থেকে মাথা ফাটবে কিংবা হাত-পা দুটোই ভাঙ্গবে। রডটা খুব হালকা, কতক্ষণ ঝুলে থাকতে পারব জানিনাহ।

চিৎকার করলেও কেউ শুনবেনা, আর শুনে যদি আসেও অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে আমাকে। এত রাতে ছাদে আসার জন্য কৈফিয়ত কম দিতে হবেনা, পড়লাম উভয় সংকটে। ইস! এখন যদি এখান থেকে কেউ আমাকে টেনে তুলে দিত কোনো প্রশ্ন ছাড়াই, রডটা আরেকটু নেবে গেল।

ভয় পেয়ে ওইটা আরো শক্ত করে ধরলাম। মানুষগুলো এমনিই, যারা বলে মরে যাব, মরে যাব। তারাও মৃত্যুর সন্নিকটে এসে বাচার জন্য আকুল চেষ্টা করে।আর ঝুলে থাকতে পারছিনা, হাতগুলো অবশ হয়ে এসেছে। নিজে থেকে উঠতে পারব এমন কোনো উপায় দেখলামনা। হাতটা আস্তে আস্তে রড ছেড়ে দিচ্ছে, শত চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারছিনা।

আল্লাহ এভাবে মরতে চাইনাহ আমি, তুমি বাচাও আমাকে। হঠাৎ দেখি একটা লম্বা হাত কেউ আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেই চাদরে মুখ ঢেকে রাখা লোকটা। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, হাতটা ধরে উঠে আসুন। নতুবা পড়ে যাবেন।
বুঝতে পারছিনা কি করব, এমনিতেই ঝুলে আছি পড়পড় অবস্থা, তাতে নাকি উনার হেল্প নিব। নিজের ইগোতে লাগছে ব্যাপারটা।

উনি আমি হাত ধরার অপেক্ষা করলেননা, নিজের হাতটাকে আরেকটু লম্বা করে আমার এক হাত ধরলেন। উনার ছোয়ায় পুরো শরীরটা যেন কেপে উঠল। যেমন কোমল হাত, তেমনি ঠান্ডা। টেনে ছাদের উপর উঠিয়ে নিলেন। আমি গা ঝেড়ে উনার দিকে তাকাতেই দেখি উনি আশে পাশে নেই।

এইটুকু সময়ের মধ্যে উধাও হয়ে গেলেন ই বা কেন? এইবারও ধন্যবাদ দেওয়া হলনা। আমি আর ছাদে দাড়ালামনা, অনেকটা পালিয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। শরীরের প্রতিটা পশম এখনো খাড়া হয়ে আছে, অনুভূতিটা অদ্ভুত। ছোটবেলা থেকে মাদ্রাসা আর বাবার নিয়মে চলতাম বলে কখনো কোনো ছেলের সাথে মেশা হয়নি, ছোয়াছুয়ি তো দূরের কথা।

আজ কি প্রথম তার ছোয়া পেয়ে এমন অনুভূতি হচ্ছে নাকি কেবল তার ঠান্ডা হাতের জন্য। সাত-পাচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানিনাহ। সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই উঠতে কষ্ট হচ্ছিল, পুরো শরীরে হালকা ব্যথা। কপালে হাত দিতেই বুঝলাম জ্বর হয়েছে, মাথাটাও ঘুরাচ্ছিল। বিছানায় ই পড়ে রইলাম, সীমা-ফুপি মাথায় পানি দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেন তাও কমলোনা।

ফুপি ওষুধ খাইয়ে দিতে দিতে বললেন, আজ বিকালে ভাবলাম তোকে আর সীমাকে নিয়ে একটু বের হব, তুই তো দেখি জ্বর বাধিয়ে রেখেছিস।
~ কোথায় যেতে ফুপি?

~ কাল-পরশু সীমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, তাদের আপ্যায়ন করার জন্য কিছু জিনিস পত্র লাগবে আর কিছু কেনাকাটা তো করতে হবে। কিন্তু তোকে এই অবস্থায় একা রেখে এসব কি করে আনতে যাই!
ঘরে তোর আংকেল বা পুরুষ মানুষ নেই যে সে এসব করবে। না করলেও তো চলছেনা।
~ তোমরা যাওনা ফুপি। আমি একা থাকতে পারব, আর বিছানায় শুয়ে ই তো থাকব। সমস্যা হবেনা, তুমি অইসব সেরে আসো সীমাকে নিয়ে।

~ তুই বলছিস? সীমা আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, কিচ্ছু হবেনা তো। এয় চিন্তা করিসনা, তোরা যাহ।
~ সীমা চল আমরা বরং যাই। আর স্বপ্না তো আছেই ওর সাথে থাকবে।

স্বপ্না শুনে মুখ গোমড়া করে ফেলল। কেদে কেদে বলল, তোমরা সবসময় আমার সাথে এমন করো! আমাকে রেখে যেতে খুব ভালোলাগে তাইনা। যাবনা আমি কখনো। কেদে-অভিমান করে এমন অবস্থা করেছিল সে, আমিই জোর করে ফুপিকে বুঝিয়ে ওকে তাদের সাথে পাঠিয়ে দিলাম।

তারা বের হতে হতে মাগরিবের আযান পড়ে গেল, বিদায় দিয়ে সদরদরজা বন্ধ করে রুমে চলে আসলাম। শরীরটা বড্ড দূর্বল লাগছে, ব্ল্যাককফি খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু শরীরে তেমন বল পাচ্ছিনা যে নিজে সিড়ি বেয়ে নেমে কফি বানাব।

অগত্যা শুয়ে রইলাম বিছানায়। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, ছেলেটা কি আমার উপর সত্যি অভিমান করেছে সেদিন এভাবে বলায়। নিশ্চয়ই করেছে নাহলে কাল একদন্ড না দাঁড়িয়ে চলে গেল কেন! আমার আসলে এভাবে বলা উচিত নয়নি, সত্যিকার অর্থে আমার কারো সঙ্গ দরকার।

কিন্তু জ্বীন বলে আমি তাকে মেনে নিতে পারছিলামনা। মানব ই বা কি করে, সেটা পরিবেশ কিংবা সমাজের নিয়মের বিরুদ্ধ। আমি আসলেই ঠিক করিনি, উনি তো কেবল সঙ্গ দিতে চেয়েছিলেন ক্ষতি করা তো তার উদ্দেশ্য ছিলনা। আর যে সমাজের ভয়ে আমি উনাকে দূরে সরাচ্ছি, তাদেরকে না বললেই তো হয়।

ব্যাপারটা শুধু আমার মাঝে থাকল, জ্বীনের সঙ্গ পাওয়ার মত ভাগ্য কয়জনের ই বা হয়। উনি বলেছিলেন মন থেকে স্মরণ করলেই তিনি আসবেন।
মনে মনে তাকে কয়েকবার স্মরণ করলাম।

ঠিক তখনি লোডশেডিং হল, এতক্ষণ পরে আমার একটু ভয় ভয় করতে লাগল। আমি যে পুরো বাড়ীতে একা এখন খুব খারাপভাবে উপলব্ধি করছি। হাতড়ে ফোনটার ফ্ল্যাশ অন করে অন্যদিক ঘুরিয়ে রেখে দিলাম। শোয়া থেকে উঠে বসামাত্রই নাকে ব্ল্যাককফির ঘ্রাণ লাগল। মাথাটা ঘুরিয়ে দেখি বেডটেবিলে কফির মগ রাখা আছে, তা থেকে ধোয়া উঠছে। মগটা হাতে নিয়ে ভাবলাম, এটা কি উনার কাজ?
এমনসময় ওপাশ থেকে তার গলার স্বর ভেসে এল।

~ কফিটা কেমন হল? আমি চুমুক দিয়ে বললাম, আপনি বানিয়েছেন?
উনি উত্তর না দিয়ে বললেন, জ্বর কমেছে?

আমি বুঝতে পারলামনা জ্বর কমেছে কিনা, তবে এখন অনেকটা বেটার ফিল করছি। আমাকে নীরব থাকতে দেখে উনি এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখলেন। আমার খুব ভালোলাগছিল, মনে হল এভাবে যদি উনি হাতটা কপালে রাখেন আমার জ্বর এমনিতেই সেরে যাবে।
হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন, ইনশা আল্লাহ আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।

আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে আবার অন্ধকার কোণে বসে পড়লেন। আমার খারাপ লাগল, মনে মনে চাচ্ছিলাম উনি আমার পাশে বসুক।
~ আপনি অন্ধকারে থাকেন কেন? নিজেকে আমার সামনে প্রকাশ করতে চান না কেন?

~ যেদিন বৈধতা পাব সেদিন প্রকাশ করব।
~ মানে বুঝলামনা।
~ আপনার কি আমার উপর রাগ কমেছে?

~ আমি সেদিনের ঘটনার জন্য সত্যিই দুঃখিত। আমার এমন টা করা ঠিক হয়নি, মানসিক ডিপ্রেশন থেকে করে ফেলেছি। ক্ষমা করে দিবেন।
উনি কিছু বললেননা। একটু নীরব থেকে বললেন, আপনার নামটা খুব সুন্দর। এটা কার নাম জানেন কি?
~ না তো, আপনি জানেন?

~ হ্যাঁ জানি। এটা সেই মেয়ের নাম, যার সাথে আমাদের জ্বীনবংশের ছেলে মুস্তফার সাথে বিয়ে হয়েছে। তাদের একটা মেয়েও হয়েছিল পরবর্তীতে।
~ এটা কি আদৌ সম্ভব?
~ কেন সম্ভব নয়?

~ একটা মানুষের সাথে একটা জ্বীনের কি করে বিয়ে হতে পারে! যেখানে দুজন ই ভিন্ন উৎস থেকে সৃষ্টি, সবকিছুই ভিন্ন।
~ তাতে কি! এক সৃষ্টিকর্তার ই তো সৃষ্টি। আল্লাহ যদি চান, তবে এটা হওয়া অসম্ভব কিছুনাহ।
~ হয়তবা।

অনেকটা সময় গল্প করলাম তার সাথে, সবি আমার পছন্দ-অপছন্দের কথাবার্তা। অনেক ভালোলাগছে এখন, সত্যিই এমন একটা সঙ্গী আমার খুব দরকার ছিল। কথার মাঝে জিজ্ঞেস করে বসলেন,
~ বাসা থেকে পালিয়ে এলেন কেন?

আমি থ মেরে গেলাম, সে কি করে জানল। অবশ্য জানা অসম্ভব কিছুনা। কিন্তু এর উত্তর আমি কি দিব। আমি তো নিজেও জানিনা আমি কেন পালিয়েছি।
আমার অস্বস্তিটা বুঝতে পেরে বলল, আপনাকে একটা অনুরোধ করব?

~ হ্যাঁ করুন।
~ এইবার থেকে নিয়মিত নামায পড়ুন, দেখবেন মন ভাল থাকবে। এবং আল্লাহ আপনার সহায় থাকবেন।
তার এই কথায় খানিকটা লজ্জা পেলাম। ছোট থেকেই আমার এসবে অনীহা ছিল।

বাবা হুজুর, কিন্তু তার মেয়ে বেনামাযী এমন কথাও শুনতে হয়েছিল। তাও পাত্তা দিতামনা, একটু বেশিই দুষ্ট ছিলাম। তাই দুষ্টুমিতে মেতে থাকতাম, এসবে কখনো মন দেওয়ার সুযোগ পাইনি। আজ উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যিই এসবে মন দেওয়া উচিত। যে আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তার শোকর গুজার করা আবশ্যক।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আচ্ছা।
এমন সময় নিচে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেলাম। নিশ্চয়ই ফুপিরা চলে এসেছে। এখন তো উনি চলে যাবেন। করুনমুখে অন্ধকার কোণে তাকালাম।

উনি বললেন, আসি আমি, আপনি নিচে গিয়ে দরজা খুলুন।
আল্লাহ হাফেজ। আমি নিচে নেমে এলাম, শরীরটা ফুরফুরে লাগছে।
ফুপিরা এসে ঢুকল বাসায়, এলাহি কেনাকাটা হয়েছে দেখছি।

পর্ব ০৪

সীমার সাথে ছাদে হাটাহাটি আর গল্প করছিলাম। রাত ১১টার বেশি বাজে, দুজনের চোখেই ঘুম নেই। সীমার ঘুম না আসার কারণ ও খুব নার্ভাস ফিল দেখতে আসা নিয়ে, আমি তো মেহরাবের কথা ভেবেই চলেছি। উনি খুব ভালো, নিজের আপন লোক মনে হয় উনাকে। সীমা আমার হাত ঝাকিয়ে বলল,
~ আচ্ছা মুশু, ওদের আমাকে পছন্দ হবে তো?

~ বোকা মেয়ে কেন হবেনা! এত ভালো একটা মেয়ে তুই, সুন্দরী আর কিউট ও বটে। তুই যে ঘরের বউ হয়ে যাবি, ওরা খুব লাকি হবে।

~ আসলে মুশু, ছেলেটাকে আমার খুব বেশীই পছন্দ হয়েছে। ছবি দেখে, উনার সম্পর্কে জেনেই প্রেমে পড়ে গেছি, আমি এমন একজনকেই চাচ্ছিলাম মনে মনে। তাই আম্মা যখন বিয়ের জন্য বলল, আমি আর না করলামনা।

~ টেনশান করিসনা তোহ। ইনশাআল্লাহ সব ভালোই ভালোই মিটবে।
~ তাই যেন হয় রে
~ হবে, জাস্ট রিলেক্স।
~ আচ্ছা, মুশু তোর পছন্দের কেউ নেই? তুই কি কারো প্রতি সিরিয়াস!
~ না রে সীমা। বাবাকে তো তুই চিনিসনা, উনি কোনো ছেলের সাথে মিশতে দেননা। তবে মনে হচ্ছে মনের মধ্যে একটু ভালোলাগা ঝেকে বসেছে।

~ কার জন্য? বিনাদ্বিধায় বলতে পারিস, আমি আম্মাকে দিয়ে মামুর কাছে কথাটা উঠাব। দেখবি আমার বিয়ের পরই তোর ও উনার সাথে বিয়ে হবে।

বিয়ের কথা শুনে সারাশরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠল, মনটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেল।
আমার তো মেহরাবকে ভালোলাগে, কিন্তু উনি তো জ্বীন। উনার সাথে আমার বিয়ে কি আদৌ সম্ভব? আর বাবা কি করে মেনে নিবে এমন সম্পর্ক।

এসব আমি কি ভাবছি, উনাকে জাস্ট আমার ভালোলাগে। তার মানে এই না যে উনাকে আমি আমার লাইফে চাই কিংবা উনাকে স্বামী হিসাবে পেতে চাই!
আমি ইদানিং এসব ব্যাপার নিয়ে একটু বেশি ভাবছি। ভালোলাগাটা কিছুতেই প্রগাড় হয়ে ভালোবাসায় রুপান্তরিত হতে দেওয়া যাবেনা, মন থেকে বাজে চিন্তাগুলো কে দূর করতে হবে।

কিন্তু চিন্তাগুলো আর দূর হলনা, এর মাঝ থেকে আমার ঘুম ই আমাকে টাটাহ বলে কেটে পড়ল। সীমাকে অনেকক্ষণ আগেই ঘুমুতে পাঠিয়ে দিয়েছি, আমি কেবল ছাদে রয়ে গেছি।

ছাদের পরিবেশটা খারাপ নাহ, মৃদু বাতাস, এক পাশে লাগানো ফুলের গাছে থেকে হালকা ফুলের সুগন্ধ, চিলেকোঠার বারান্দায় লো পাওয়ারের কয়েকটা রঙ্গিন ঝাড়।এই সময় উনি থাকলে মন্দ হতনা, বেশ জমিয়ে গল্প করতে পারতাম। ভাবতে ভাবতে ছাদে পেতে রাখা বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে নিজের চিন্তাভাবনা গুলো সাজিয়ে নিচ্ছিলাম।
পাশ থেকে প্রশ্ন, ” কি এত ভাবছেন?”

চোখ খুলে পাশে তাকালাম, উনি শরীরে চাদর মুড়িয়ে আমার থেকে ৩-৪হাত দূরে বসে আছেন। অবাক হয়ে বললাম, “আপনি?”
~ ঘুমাবেন না?

~ আসছেনাহ। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
~ জ্বীহ অবশ্যই।
~ সত্যি কি জ্বীন আর মানুষের বিয়ে হয়, সংসার হয়?
~ হ্যাঁ হয়। এমন বহুবার হয়েছে, কিছু ভালবাসা পূর্ণতা পেয়েছে কিছু পায়নি।

শুনে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
অবশ চোখে তার দিকে তাকালাম। জানি না কিছু বুঝতে পারল কিনা! পা দুটো বেঞ্চির উপর উঠিয়ে উচু করে বলল,
~ আমার কোলে মাথা রাখুন তো।
আমিও কাঠের পুতুলের মত তার কথামত কোলে মাথা রাখলাম। হয়ত আমিও তার সঙ্গ চাচ্ছিলাম। উনি ধীরে ধীরে চুলে বিলি কেটে দিলেন। খুব আরাম লাগছিল, ঘুমহীন চোখগুলো প্রচন্ড ঘুমে বার বার বন্ধ হয়ে আসছে।

চোখে রোদ পড়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দেখি সবে সূর্য উঠছে, আমি সেই বেঞ্চিতে শুয়ে আছি। গায়ের উপর পাতলা চাদর, মাথার নিচে বালিশ। কাল রাতের কথা মনে পড়তে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। উঠে গিয়ে বালিশ-চাদর চিলেকোঠার ঘরে রেখে নিচে নেমে ফ্রেশ হলাম।

মনটা আজ ভীষণ ভালো, কি কারণে তা জানা নেই। ঠোটের কোণে হাসি লেগেই আছে। সারাটাদিন খুব ভালোই কাটল আমার।বিকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার কথা ভাবছিলাম, এমন সময় ২৫-২৬ বয়সী সুদর্শন, হাল্কা ফর্সা ফরমাল টাইপ ছেলে এসে আমাকে পিছন থেকে ডাকল। আমি অবাক হয়ে বললাম, “জ্বী বলুন।”
~ কেমন আছেন?
~ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কিন্তু আপনি কে?

~ সেটা তো জানতে পারবেন। যতটা আশা করেছিলাম আপনি তার থেকে বেশি সুন্দরী এবং স্মার্ট। আচ্ছা আপনার চেহারাটা এত মায়াবী কেন? চোখ দুটো ভীষণ সুন্দর, একদম টানা টানা।
~ স্যরি, আপনি এসব কি বলছেন? কে আপনি? বিনা অনুমতিতে কারো রুমে প্রবেশ কর উচিত নয় আপনার জানা নেই?

ছেলেটা সোজা আমার হাত ধরে নিচে নিয়ে এল। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম, উনি এত শক্ত করে ধরে রেখেছেন যে ছাড়াতে পারলামনা।

নিচের ড্রয়িংরুমে ফুপি, আরো দুজন মহিলাসহ একজন বয়স্ক লোক এবং ২জন প্রাপ্তবয়ষ্ক ছেলে ও ছিলেন। আমাকে এভাবে আনতে দেখে উনারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটি বয়স্ক মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
~ মা আমার পাত্রী পছন্দ হয়েছে।

~ তুই কাকে পছন্দ করেছিস?
~ কেন যাকে তোমরা পছন্দ করে রেখেছো। তোমরা বিয়ে ঠিক করে ফেলো মা।
ততক্ষণে সীমা শাড়ি পড়ে নিচে নেমে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ঘটনা বুঝার ট্রাই করল।আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
~ ভাইয়া আপনার ভুল হচ্ছে।

~ মানে বুঝলামনা। ছেলেটির মা সীমাকে দেখিয়ে বললেন,
~ আমরা তোর জন্য সীমাকে পছন্দ করেছিলাম। এই হচ্ছে সীমা, তোমার হবু বউ।
ছেলেটি একপলক সিমাকে দেখে নিল।
ছেলেটির মা সীমাকে পাশে এনে বসিয়ে বলল, তুমি কোথায় ছিলে মা?

~ আমি দক্ষিণের শেষ রুমে ছিলাম। উনি ভুল করে এর আগের রুমে ঢুকে পড়েছেন।
~ হ্যা সেজন্যই এই মেয়েটিকে সে তুমি ভেবে ভুল করেছে।আমি চমকে দিব বলে তোমার ছবি ওকে দেখাইনি।
তাহলে ভাবী বিয়ের তারিখ টা ঠিক করে ফেলি।ভাইজান তো সামনের মাসে আসছেন তাইনা।

ছেলেটি থামিয়ে দিয়ে বলল,
~ মা একটু অপেক্ষা করো। আমি উনাকে বিয়ে করতে পারবনা, আমার এই মেয়েটিকেই পছন্দ হয়েছে। আর আমি উনাকেই বিয়ে করব।

আমি অবাক হয়ে সীমার দিকে তাকালাম। ওর চোখে পানি টলমল করছিল।
আমি কিছু বলার আগেই ফুপি বলল, বাবা, ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি ওকে কি করে বিয়ে করবে? ও আমার ভাইয়ের মেয়ে, ওর স্বামী ওকে বেড়ানোর জন্য কিছুদিন এখানে রেখে গেছে।

ছেলেটি আমার দিকে ভাল করে তাকিয়ে বলল,
~ বিবাহিত মেয়ের নাকে নাকফুল, হাতে চুড়ি কোথায়? আপনি আমাকে বোকা বানাচ্ছেন। এত কিছু বুঝিনা, পরশুদিন আমি এসে ওকে বিয়ে করে নিয়ে যাব। মা চলো এখন।

সবাই চলে গেল। সীমা সেখানে এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে কাদতে কাদতে রুমে চলে গেল। ফুপি রেগে আমাকে বলল,
শান্তি হয়েছে তোর? এটাই তো চেয়েছিলি নিশ্চয়ই। আপন মানুষ বলে তোকে ঘরে ঠাই দিলাম, এত ভালোবাসলাম। তুই তার এমন প্রতিদান দিলি? আমার মেয়ের জীবনটাই শেষ করে দিলি। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম আমি, ভাবিনি একদিন তুই আমাকেই ছোবল মারবি? শেষে কিনা ভাইয়ের অসম্পূর্ণ প্রতিশোধ তুই নিতে এসেছিস! ছিঃ এত নীচ তোরা।

ফুপি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন ভেতরে। চোখের পানি সীমার ঘরের দিকে গেলাম আমি। কয়েকবার দরজা ধাক্কালাম, কিন্তু সীমা দরজা খুলল না।

হয়ত ও আমাকে ভুল বুঝে বসে আছে ফুপির মত। এত অলক্ষী কেন আমি! গুটি গুটি পায়ে পায়ে ছাদে এসে থ মেরে বসে রইলাম। নিঃশব্দে ফুপির কথাগুলো ভেবে কাদছি, আমি তো এখানে আসতে চাইনি। ভাগ্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এমনসময় টের পেলাম, মেহরাব আমার পাশে বসে আছে, নীচুকন্ঠে
জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে আপনার?

পর্ব ০৫

আমি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে চোখের পলকে উনাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেদে উঠলাম। উনি বাধা না দিয়ে চুপচাপ আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। একটু পর কান্না হালকা থেমে এলে উনি শান্তকন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
~ কেউ কিছু বলেছে আপনাকে? কথাটা শুনে হুশ ফিরে এল।

আজ ফুপি আমাকে অনেক কড়া কথা বলেছেন, শুধু আমাকে নয় আমার ফেরেশতার মত বাবাকেও তিনি অপবাদ দিয়েছেন। এই অপমান আমি কি করে সহ্য করব! ভেবেই আমার কান্নাগুলো ক্ষোভে পরিণত হল। এক ধাক্কায় উনাকে সরিয়ে দিলাম, ধাক্কা সামলাতে না পেরে উনি ছাদের মেঝেতে পড়ে গেলেন। হালকা উহ শব্দ করে উঠলেন। আমি রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম,
~ সহানুভূতি দেখান আমাকে? আমি চেয়েছি আপনার সহানুভূতি।

কি ভেবেছেন টা কি আমাকে। একটু উপকার করে, ভালো সেজে আমাকে গলাবেন। এসব আপনার চাল তাইনা, কে বলেছে আপনাকে আমার জীবনে এন্ট্রি নিতে। জ্বীন তো কি হয়েছে, নিজেদের পরিসীমার মধ্যে থাকুন। আমার জীবনে অশান্তি পাকাতে এসেছেন কেন? আসলেই আপনারা মানুষের দেখতে পারেননা। জানিনা কোন জন্মে আপনার কি ক্ষতি করেছি, আপনি আমার পিছুই ছাড়ছেন না।

উনি কিছু বলতে চাইলেন বোধহয়, আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,
~ আপনার মন গলানো কথা বা বিহেভ দেখতে আমি মোটেও আগ্রহী নই। আমার জীবনে আমাকে আমার মত বাচতে দিন, ভুলেও আমার সাথে জড়ানোর চেষ্টা করবেননা।

আমি আপনাকে চাচ্ছিনা কথাটা বুঝতে পেরেছেন নাকি আরো পরিষ্কার করে বলতে হবে। আচ্ছা আরো সুন্দরভাবে বলছি আপনাকে, আপনি আর কখনোই আমার সামনে আসবেননা।

আমার কারো সঙ্গ চাইনাহ। আর যদি কখনো দেখেছি আপনি আমার সামনে এসেছেন, আমি নিজেকে নিজে শেষ করতে দুবার ভাবব নাহ। অসহায় হতে পারি কিন্তু আত্মসম্মান টা অনেক বেশি।
আপনি এক্ষুনি এখান থেকে দূর হন। আমি আপনাকে আর সহ্য করতে পারছিনা।

এসব বলে আর এক মিনিটের জন্য ও ছাদে দাড়ালামনা। নিচে নেমে এলাম, এসে দেখলাম রুমের দরজা খোলা। সীমা বেরিয়ে গেছে, রুমে ঢুকে দেখি তার শাড়ি, গয়না সব এলোমেলো করে রেখেছে বিছানার উপরে। আলমিরা থেকে ব্যাগটা বের করে আমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম।

যে বাড়ীতে আমার বাবাকে অপমান করা হয়, সে বাড়ীতে থাকার কোনো ইচ্ছে ই আমার নেই। আমি আমার বাবার কাছেই ফিরে যাব, আর কখনো কোথাও পালাব না। উচিত শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। সব এক এক করে গুছিয়ে ব্যাগটা বেডের পাশে রেখে দিলাম। সকাল হলেই বাস ধরে বাসায় চলে যাব। বিছানা থেকে সীমার শাড়ি-গয়না সরিয়ে নিজে শুয়ে পড়লাম।

এতকিছুর পরো আমার রাগটা কমছেনা, রাগের চোটে ঘুম ও আসছেনা। একবার ইচ্ছে হল ছাদে গিয়ে দেখে আসতে মেহরাব এখনো আছেন কিনা! পরক্ষণেই ভাবলাম, এত আদিক্ষেতা দেখানোর কি আছে, আমার কে ও! উড়ে এসে জুড়ে বসা শত্রু কেবল। ওর কথা আমি আর ভাববনা, এসব আপদের থেকে দূরে থাকাই ভাল।

কাল ভালোই ভালোই ফিরতে পারলেই বাচি, এসব মাথা থেকে একেবারের জন্য ঝেড়ে ফেলব।
এমন সময় দেখি সীমা ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে আমার পায়ের কাছে বসে আমার দিকে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে। মায়া লাগছে ওকে দেখে, বেচারীর কি দোষ! ও তো ছেলেটাকে মনে প্রাণে স্বামী হিসেবে মেনেই নিয়েছিল।

ছেলেটার কমনসেন্স টুকুও নেই। মুখের উপর বলে দিল, ওকে আমার পছন্দ নয়, আমি উনাকে বিয়ে করতে চাই। তোর মত ছেলেকে আমি মরে গেলেও বিয়ে করতামনা। একটা সুন্দর চেহারা আর বড়লোকি ভাব পেয়ে কি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে নাকি যে সে যা বলবে তাই হবে? তুই ও আমাকে কি করে বিয়ে করিস আমি দেখব? কাল সকালেই আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।

সন্বিৎ ফিরে পেলাম সীমার চোখের পানি আমার পায়ে পড়ায়। তক্ষুনি উঠে বসলাম। ও কেদে কেদে বলল, মুশু মায়ের হয়ে আমি তোর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আম্মা এসব মন থেকে বলেনি বিশ্বাস কর। আর তোর ও তো কোনো দোষ ছিলনা, সবটাই আমার কপালের লিখন।

আমি ওর চোখ মুছে দিয়ে বললাম, টেনশন করিসনা বোন। আমি চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল সকালেই আমি চলে যাব এখান থেকে। দেখবি ছেলেটা তোকেই বিয়ে করবে।

সীমা আমার কথা শুনে আরো বেশি কাদতে লাগল। ততক্ষণে ফুপি এসে রুমে ঢুকল। চোখের পানি নিয়ে মিনতিভরা কন্ঠে বলল, মা আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি রাগের মাথায় তোকে কিনা কি বলে ফেলেছি।

উনার এমন আকুতি দেখে আমার মনটা গলে গেল। ফুপির হাত ধরে বললাম,
~ ফুপি তুমি তো আমার মায়ের মত। সামান্য ভুল বুঝাবুঝির জন্য মা সন্তানের কাছে ক্ষমা চায় বলো। আমি কাল এখান থেকে চলে যাব, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কখনো এইখানে ফিরবনা।

~ মা তুই যদি এভাবে চলে যাস ছেলেটা সীমাকে কখনো বিয়ে করবেনা। জানিস ই তো সীমা ছেলেটাকে কত ভালোবেসে ফেলেছে। এখন বলছে সুইসাইড ই করে বসবে।

আমি অবাক হয়ে সীমার দিকে তাকালাম। ওর চোখ দেখেই বুঝলাম এটা করা ওর পক্ষে অসম্ভব কিছুনা।
~ ফুপি আমি এখানে থাকলে ছেলেটা আমাকে বিয়ে কর‍তে চাইবে, তখনো তো সীমার বিয়েটা ওর সাথে হবেনা। তাই আমি ভেবেচিন্তে বললাম আমি এখান থেকে চলে যাব।

~ মা, তুই ই পারবি ওর সাথে সীমার বিয়ে দিতে।
~ আমি কি করে পারব ফুপি? যদি সত্যিই পেরে থাকি বলো কি করে পারব! আমি তাই ই করব।
~ তুই নিজে বিয়ে করেই পারবি সীমার বিয়েটা দিতে।

অবাক হয়ে গেলাম ফুপির কথা শুনে।কথা বন্ধ হয়ে গেল আমার। ফুপি আমার শরীর ঝাকিয়ে বলল,
~ কি পারবিনা? তোর বোনের জন্য এই কাজটা করতে। আজ যদি সীমার জায়গায় শিরিন হত, তুই কি এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতি বল।

~ কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব ফুপি? বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করা, আর এই ২-১দিনের মধ্যে তুমি পাত্র কোথায় পাবে! আর বড় কথা হল সেই ছেলেটাই বা আমার এসব শুনে সীমাকে বিয়ে করবে কি করে।

~ ভাই আর পাত্র খোজার ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দে মা। আর আমাদের গায়ের একটা নিয়ম আছে, ছেলেরা কখনো বিয়ের আসর থেকে খালি হাতে ফিরে যেতে পারেনা। যদি যায় গায়ের মানুষ তাদের একঘরে করে দেয়। এখন তুই যদি এখান থেকে চলে যাস, ওরা খবর পেলে আসবেও না।

~ কিন্তু ফুপি
সীমা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগল। আমার নিজের খুব খারাপ লাগছে, অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। ফুপি আকুতি -মিনতি করে বললেন,
~ মা তুই না করিস না, তুই যদি না করিস আমার মেয়েটা মরে যাবে। তুই কি চাস বল তোর বোন চোখের সামনে মরে যাক?

শিরিন হলে কি তুই এটা হতে দিতে পারতিস?
শিরিনের কথা শুনে অজান্তে আমার চোখের পানি ঝড়ে পড়ল। আমি কাপা কাপা কন্ঠে বললাম, “ফুপি আমি রাজি। তুমি যা করতে চাও, তার ব্যবস্থা করো। সীমার জন্য আমি এই বিয়েটা করব।”

ফুপি আমার কপালে চুমু খেয়ে বলল, আমি জানতাম তুই আমাকে নিরাশ করবিনা। দেখিস তুই খুব সুখী হবি, রাজপুত্রের মত বর খুজে দিব তোকে।’
মনে মনে বললাম, “পোড়াকপালীর আবার সুখ।”

ব্রাশ করতে করতে ছাদে উঠলাম। চারিদিকটা বেশ সুন্দর লাগছে, কিন্তু সুর্যের মুখ দেখা যাচ্ছেনা, আকাশটা কেমন গুমোট হয়ে আছে। হয়ত তার মনেও ভীষণ কষ্ট, একটু পরেই কেদে দিবে। ব্রাশ করতে করতে এইধার ওধারে ঘুরছি। হঠাৎ পায়ের কিছু একটা লাগল। হাতে নিয়ে দেখলাম এটা একটা পেরেক, পেরেকে ফোটা ফোটা লাল রক্ত মাখানো। অবশ্য শুকিয়ে গেছে, ফ্লোরে তাকিয়ে দেখি ওখানেও কিছুটা শুকনো রক্ত ছড়িয়ে আছে।

কাল রাতের উনার উহ শব্দ টা মনে পড়ল। আমার জন্য কাল তিনি আঘাত পেয়েছেন, এইটা আমি কি করলাম। পুরো দুনিয়াটা মনে হল আমার সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

চিৎকার করতে কাদতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পারছিনা। রাগ ঝাড়তে গিয়ে এমন রাগ ই ঝাড়লাম, উনি এতে কেমন কষ্ট পাবেন তাও ভাবলামনা। পেরেকটা মুঠো করে ধরে চোখ বুজে মনে মনে উনাকে স্মরণ করতে লাগলাম।

কিন্তু উনি আসলেননা, ওহ হ্যাঁ উনি তো দিনের বেলা আমাকে কখনোই দেখা দেননা। রাতে একবার ডাকব, আসলে উনার পা ধরে হলেও ক্ষমা চাইব। ক্ষমা না চাওয়া অব্ধি আমি একদন্ড ও শান্তি পাচ্ছিনা। দুইদিন ধরে উনাকে ডেকেই যাচ্ছি কিন্তু উনি একটিবারের জন্য ও এলেননা। খুব ডিপ্রেশনে পড়ে গেলাম।

এইদিকে ফুপিও নাকি ছেলে ঠিক করে ফেলেছেন, কাল দুপুরেই আমার আকদ হয়ে যাবে ঘরোয়াভাবে। সে নিয়ে আমি একটুও চিন্তিত নাহ, আমার সব চিন্তা এখন মেহরাব কে নিয়ে।

পর্ব০৬

আয়নার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে নিজেকে দেখছি। লাল বেনারসি, খোপায় গাজরা, গায়ে হালকা গয়না, হাতভর্তি মেহেদী, হালকা সাজ সবমিলিয়ে বিয়ের কনে লাগছে। সীমা পিছনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, মুশু তোকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। তোর স্বামী তো চোখ ই ফেরাতে পারবেনাহ।

আসলেই নিজের অন্য একটা সুন্দর রুপ দেখছি। ছোটবেলা থেকে কত ইচ্ছে ছিল বউ সেজে রাজপুত্রের সাথে পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে দূরের দেশে হারিয়ে যাব। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক ফুড়ে। একটু পরে আমার কাবিন হবে, বসার ঘরে বরপক্ষরা বসে আছে।

ঘরোয়াভাবে হচ্ছে তাই অতিরিক্ত কোনো জাক-জমক নেই। বাবার অজান্তে তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে জানলে বাবা কত কষ্ট পাবে, ভেবেই কান্না পাচ্ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে বাবার নাম্বারে কল দিলাম, ফোনটা সুইচ অফ। অজানা আশঙ্কায় কেপে কেপে উঠলাম। এখানে এসেছি এতগুলো দিন হল, বাবা একবারো যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেননা। উনি কি আমার পালিয়ে আসাটায় ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন।

রুম থেকে বেরিয়ে নিচে বসার ঘরের দিকে উকি মারলাম। সীমা আর ফুপি বরপক্ষকে আপায়্যানে ব্যস্ত, একি এটা আমার বর হবে? দেখেই চক্ষুচড়ক গাছ। সবার মাঝখানে নাকে রুমাল ধরে শেরওয়ানি পরিহিত এক অর্ধবৃদ্ধ লোক বসে আছে। মুখে কাচাপাকা দাড়ি, ভীষণ কালো তার উপর ৬৪-৬৫ বছর বয়স তো হবে।

শেষে কিনা ফুপি ঘাড়ের বোঝা নামানোর জন্য এক বৃদ্ধলোকের সাথে আমার বিয়ে দিচ্ছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলামনা, দৌড়ে রুমে চলে এলাম। ঝড়ানোর মত চোখের পানিও নেই আমার, এই ২দিন কাদতে কাদতে সব শুকিয়ে গেছে। এখন আর কান্না আসেনাহ, বুক ফুড়ে দীর্ঘশ্বাস ই বের হয়। ভাগ্যের উপর জীবনটাকে ছেড়ে দিলাম, আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছেন তাই হবে।

এটা নিয়ে আর কাদব না, কষ্ট পাবনা। এমনসময় সীমা আর ফুপি কাজী নিয়ে রুমে ঢুকলেন। সযত্নে আমাকে খাটে বসিয়ে দিল, কাজী বিয়ের কাজ শুরু করলেন। আমি আড়চোখে সীমা আর ফুপির দিকে তাকালাম।

তাদের মুখে দিগ্বিজয়ী হাসি শোভা পাচ্ছে। কাজী আমাকে কবুল বলতে বললেন, পাথর হয়ে যাওয়া গলা দিয়ে আমার কবুল শব্দ বের হচ্ছিলনা। সীমা আর ফুপির মুখ কালো হয়ে এল। ফুপি বারবার তাড়া দিতে লাগলেন, বল মা কবুল বল।
সীমা হাত ঝাকিয়ে বলল, মুশু কাজী সাহেব অপেক্ষা করছেন। কবুলটা বলে দে।
কাজী আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, কনের কি বিয়েতে মত নেই?

ফুপি রাগান্বিত কন্ঠে আমাকে বলল, বিয়েই যখন করবি বললি, কবুল বলার সময় এত নাটক কেন করছিস? সে দিন নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার জন্য বললি সীমার জন্য বিয়েটা করবি তুই। এখন মুখে কুলুপ এটে বসে আমাদেরকে অপমান করছিস কেন! সীমা আমি তোকে বলেছিলামনা, এই মেয়ে আমাদেরকে ডুবাবে। ও তোর সুখ চায়না।

শুনে চোখে জমিয়ে রাখা পানিগুলো ছেড়ে দিয়ে বললাম,
~ কবুল হে।
কাজী আর ফুপি মুখে হাসি টেনে বলল, আলহামদুলিল্লাহ।

তারা কখনোই জানতে পারবেনা, এই মেয়েটা তার বুকে পাথর চেপে অনিচ্ছায় কবুল বলেছে। নিজের সবকিছুকে বিসর্জন করে দিয়েছে সীমা আর ফুপির ভালোর জন্য। তাও শুনতে হবে আমি তাদের ভালো চাইনাহ।
ফুপি কাজীকে বলল, কাজী সাহেব আর দেরী কেন? এইবার বরের কবুলটা নিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলুন। চলুন আমার সাথে নিচে চলুন।

সীমা পাশে বসে আমার নীচু করে রাখা মুখটা হাত দিয়ে তার দিকে ফিরিয়ে বলল, তোর এই অবদানের কথা আমি কখনো ভুলব না মুশু। তুই সত্যি আমার বোনের মত কাজ করেছিস। বলেই জড়িয়ে ধরল। আমি অবশের মত তার বুকের সাথে লেগে রইলাম।

হঠাৎ নীচ থেকে হট্টগোলের আওয়াজ এল। সীমা সেটা দেখার জন্য আমাকে একা রেখে নিচে চলে গেল। আমি আর নড়তে পারছিলামনা, নিচে কি হচ্ছে সেটা দেখার ইচ্ছেটাও নেই। যা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আর নতুন করে কিছু হওয়ার নেই। মা তুমি যাওয়ার সময় কেন আমাকে নিয়ে গেলে না!
প্রায় ঘন্টাখানেক পর ফুপি ফিরে এল আমার রুমে। মিষ্টি কন্ঠে বলল,
~ মা তোর জন্য খাবার নিয়ে আসি?
~ না, ফুপি। আমার ক্ষিধে নেই।

~ কি যে বলিস, সকাল থেকে কিচ্ছু খাসনি! আমি সীমার হাতে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে নিবি কিন্তু। ওইদিকে বরপক্ষরা খেয়ে নিয়েছে। ওরা আজ তোকে নিবেনা, কাল একেবারে সীমার বিয়ের পর নিয়ে বের হবে। তুই যে আমাকে কতটা চিন্তামুক্ত করলি বলে বুঝাতে পারবনা। কাল যদি ভালোই ভালোই সীমার বিয়েটা অন্তত হয়ে যায়, আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত।
~ হুম।

~ ওই তো সীমা এসে গেছে খাবার নিয়ে। সীমা ওকে খাইয়ে দে, আমি নিচে বরপক্ষ দের দেখে আসি।সীমা আমাকে জোর করে অল্প কিছু খাইয়ে দিয়েছে।
আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম,
~ সীমা তুই খুশি তো?

সীমা চকচক করা চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম, এই চোখের ভাষা আমি বুঝে ফেলেছি।
ইচ্ছে করছে কাউকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমত কাদি। মেহরাব থাকলে হয়ত ও আমাকে বুঝত। ছেলেটা ভীষণ বুঝে আমাকে, কিচ্ছু বলতে হতনা ওকে। নিজের দোষে তাকেও হারালাম। জীবনে শুধু সব হারিয়ে যাচ্ছি।

এমনসময় দুটো মহিলা আর কয়েকটা অল্পবয়সী ছেলে ঢুকল আমার রুমে। মহিলা আমাকে দোয়া করলেন এবং তারা দেখে বারবার বলছিল, বউটা বেশ মিষ্টি।

মনে মনে নিজেকে নিয়ে উপহাস করছিলাম, এতটাই মিষ্টি যে কপালে বুড়ো জামাই জুটল। একে একে ওরা সবাই বিদায় নিল। রাত নেমে এল, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছি এক দৃষ্টে।
সীমা এসে আমার পাশে দাড়াল। আস্তে করে বলল, দুলাভাই তোর কাছে আসছে। আমি রুমের লাইট টা জ্বালিয়ে দেই?

~ না নিভানোই থাক। তুই যা এখন। উনি আসুক।
সীমা চুপচাপ চলে গেল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ই রইলাম। কোনো রিয়েকশান নেই আমার, ওই যে একটা প্রবাদ আছে ” অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর।”

বুড়ো লোকটা আজ আমার উপর স্বামীত্ব জাহির করবেন, আমি শুধু চিড়িয়াখানার প্রাণীর মত বন্দি হয়ে দেখে যাব। নিশ্চুপ থাকলে এটা ভেবে বুকটা কাপছে।
কেউ এসে রুমের দরজায় নক করল। আমি কাপা কন্ঠে পিছনে না তাকিয়ে বললাম, দরজা খোলা আছে, ভিতরে আসতে পারেন।

বুঝলাম উনি ভিতরে ঢুকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি বললাম, অন্ধকারে প্রোবলেম হলে৷ আলো জ্বালাতে পারেন।
উনি শান্তকন্ঠে বললেন, না প্রোবলেম নেই। আপনার সাথে একটু গল্প করতে এসেছি কেবল, আপনার অস্বস্তি হয় এমন কিছু করবনা আমি।

আমি ভেবেছিলাম উনি এসেই আমার উপর হিংস্র প্রাণীর মত ঝাপিয়ে পড়বেন। এমন কথা শুনে ভয়টা হালকা কমল এবং শ্রদ্ধাটা জাগল।

উনি বললেন, আমার মনে হচ্ছে আমি আসায় আমি অস্বস্তি ফিল করছেন। সমস্যা নেই, আমি এখন চলে যাচ্ছি। কাল কথা হবে।
ঘুমিয়ে পড়ুন, শুভ রাত্রী।

আমি কিছু বললামনা। বলার মত কোনো কথাই নেই আমার কাছে। সত্যিই আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি যখন পিছনে তাকালাম দেখলাম উনি বাহির হয়ে গেছেন। দরজা টাও ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন।
চুপচাপ খাটে শুয়ে পড়লাম, সারাদিনের এত প্যারায় নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আজ ঘুম ও আমার সাথে বেইমানী করলনা, শুয়ে পড়ামাত্র ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।

লোকটা কোথায়, কেন গেল এসব নিয়ে চিন্তাটুকুও করলামনা। তার জন্য আমার মনে কোনো টান অনুভব করছিনাহ। এখনো স্বাভাবিক হতে পারছিনাহ আমি। জানিনাহ সারাটা জীবন তার সাথে আমি কিভাবে কাটাব। সবচেয়ে বড় চিন্তা হচ্ছে এই মুখ নিয়ে বাবার সামনে গিয়ে কি করে দাড়াব।

পর্ব ০৭

অনেক দেরী করে ঘুম থেকে জাগলাম। ফ্রেশ হয়ে শাড়ি চেঞ্জ করে নিলাম। ভেজা চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে বসলাম। হঠাৎ দেখলাম আয়নায় মেহরাবের ছায়া অবয়ব ফুটে উঠল। এক মূহুর্তে এত খুশী হয়ে গেলাম, একটানা বলেই চললাম, ” এই কয়েকদিন কোথায় ছিলেন আপনি? একবারো বুঝলেন না মেয়েটা আপনাকে কতটা মিস করছিল। সেদিনের জন্য সত্যিই লজ্জিত এবং দুঃখিত।

আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন। কি হল? কিছু বলছেন না যে। ক্ষমা করবেন না আমাকে?” ফুপি রুমে ঢুকে বলল,
~ কি হল? কার সাথে বিড়বিড় করছিস? ফুপির কথায় চমকে উঠে এক পলকে আয়নায় তাকালাম। সেখানে কেবল আমার ই প্রতিচ্ছবি। হতাশকন্ঠে বললাম,
~ তেমন কিছু নাহ। কিছু বলতে এসেছিলে?

~ একি তোর হাত,গলা খালি কেন?
~ মাত্র গোসল করে আসলাম তো তাই খুলে রেখেছি।
ফুপি হাতে কিছু চুড়ি আর নাকে নথটা পরিয়ে দিয়ে বলল, এইবার ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি নিচে আয়, জামাই তোর সাথে নাস্তা করার জন্য বসে আছে।

জামাই কথাটা শুনেই বিরক্ত লাগল। ফুপি নিজের বয়সী একটা লোককে জামাই বলে সম্বন্ধ করছে, আর ওই বুইড়া ব্যাটার শেষ বয়সে এত কিসের রস আসে! আমার জন্য অপেক্ষা করতে বলল কে। না এখন আমি নিচে যাবনা। লোকটা খেয়েদেয়ে উঠে পড়ুক, তারপর যাব। কিন্তু এভাবেই বা কতক্ষণ! আজ তো উনার সাথে আমি চলে যাব উনার বাড়ীতে। তখন তো কিছুতেই এইভাবে এড়িয়ে চলতে পারবনা।
“ফুপি তুমি যাও, আমি আসছি একটু পরে। বাবাকে ফোন করে নিই।”

~ এখন আবার ভাইকে ব্যস্ত করছিস কেন? কাল-পরশু জামাইকে নিয়ে তো যাবিই। এখান থেকে চলে যাওয়ার পর তো আমাদেরকে আর মনেই থাকবেনা, হয়ত আর আসবিও না দেখতে। বিড়বিড় করে বললাম,
~ তোমাদেরকে ভুলি কি করে, আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছো। এই অপূরণীয় ক্ষতি কি আমি কখনো ভুলতে পারি! এর মেয়াদ তো আমার সারাজীবন।
~ কিছু বললি মুশু?
~ নাহ ফুপি। তুমি যাও, আমি রেডি হয়ে নামছি।

রেডি হয়েও বসে রইলাম ফোন হাতে নিয়ে। বাবা কেন এমন করছে আমার সাথে? ফোনটা ও বন্ধ করে রেখেছে, যতদিন না বাড়ীতে ফিরছি ততদিন কোনো খোজ নিতে পারবনা আর এসব জানাতেও পারবনা। হঠাৎ নিচ থেকে হট্টগোলের আওয়াজ এল। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে ড্রয়িংরুমে এসে দাড়ালাম। আরেহ সীমার হবু স্বামী এসেছে কিছু লোকজন নিয়ে। চেহারা দেখে খুব রাগান্বিত মনে হচ্ছে। আমাকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকাল।

কাছে এগিয়ে এসে বলল,
~ তুমি কি আমাকে প্রমাণ দেখানোর জন্য আজ চুড়ি, নথ, শাড়ি পড়ে বউ সেজেছো? ফুপি ভয়ার্তকন্ঠে বললেন,
~ বাবা, সত্যিই ও বিবাহিত। ওর বিয়ে হয়ে গেছে।
~ মুশায়রা আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি।

~ ফুপি যা বলছেন তাই ঠিক, আমি বিবাহিত। আর আপনি কে যে আপনাকে প্রমান দেখানোর জন্য আমি এসব করব। সে আমার হাত চেপে ধরে বলল,
~ আমি বিশ্বাস করছিনা, এই মূহুর্তে আমি তোমাকে বিয়ে করব৷ কাজী সাহেব আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।
~ আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আমি তো বললাম আমি বিবাহিত। আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
~ অহহ আচ্ছা, তা কার সাথে হয়েছে? কে তোমার বর! তাকে ডেকে আনো, সেই এসে বলুক তোমাকে বিয়ে করেছে।

পিছন থেকে কেউ একজন বলল, মুশায়রাকে আমি বিয়ে করেছি। অবাক হয়ে পিছনে তাকালাম। কালকের সেই অর্ধবৃদ্ধ নয়, একজন সুঠাম সুদর্শন ছেলে এই কথাটা বলল। লম্বা, ফর্সা এবং মায়াবী চেহারা ছেলেটার।পুরো রাজকুমারের মত দেখতে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, এই ছেলেটা কে?

ছেলেটা এসে আমার হাত ধরে বলল, আমিই ওর স্বামী। আপনার কিছু বলার আছে?
~ আপনাকে ভাড়া করে আনা হয়েছে তাইনা নিজেকে তার স্বামী বলে পরিচয় দেওয়ার জন্য! আমাকে বোকা পেয়েছেন আপনি?

ছেলেটা কাজীর দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে বলল,
~ কি ব্যাপার কাজী সাহেব? আপনি কি চুপ করে থাকবেন? কাল আপনিই তো আমাদের বিয়ে পড়ালেন। সত্যিটা আপনি বলুন, তাদেরকে আপনার রেজিষ্টার খাতাটা দেখান।

কাজী এইবার মুখ খুললেন,
~ আসলে এতক্ষণ ভেজাল দেখে চুপ করে ছিলাম। এই মেয়েটি আর এই ছেলেটির বিয়ে কাল বাদ যোহরে আমিই পড়িয়েছিলাম। এই খাতায় উনাদের স্বাক্ষর এখনো আছে।

আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলামনা। এই ছেলেটাই বা কে? কোথা থেকে আসল। আমি কি করে ওর বিয়ে করা বউ হব, আমি তো বিয়ে করেছিলাম ওই বুড়ো টাইপ লোকটাকে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ফুপির কাছে ছেলেটির মা বলতে লাগল, বিয়াইন আজকে এখনিই আমি আপনার মেয়েকে আমার বউমা করে ঘরে তুলতে চাই। ছেলেটি এসব শুনে বলল,
~ মা তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব না এই মেয়েটিকে বিয়ে করা।

ছেলেটির মা রেগেমেগে বলল,
~ সিদ্ধান্ত, তোর সব পাগলামী আমি সহ্য করে আসছি। আর নয়, এক্ষুনি তুই সীমাকে বিয়ে করবি। তোর এসব পাগলামীর জন্য আমরা একঘরে হতে পারবনা, তুই যদি এই বিয়েটা না করিস আমাদের আর মুখ দেখানোর জো থাকবেনা।

তুই যদি বিয়েটা না করিস, আজ থেকে আমি ভুলে যাব তুই আমার ছেলে। যে ছেলে বংশের মুখে চুনকালি লাগাতে পারে, তাকে ত্যাজ্য করতে আমি দ্বিধা করবনা।
ছেলেটার মুখ হতাশায় ঢেকে গেল। খানিকটা সময় চুপ থেকে বলল,
~ মা তুমি যা বলবে, তাই হবে।

সীমার বিয়েটা ঝামেলাহীন ভাবে মিটে গেল। ফুপা কলে তাদেরকে দোয়া করলেন, আজ কি মিষ্টি লাগছে সীমাকে! ওদের দুজনকে খুব মানিয়েছে বটে। কিন্তু আমার বর দাবী করা ছেলেটাকে তো কোথাও দেখছিনা। একটু ভালো করে উঁকি -ঝুকি দিয়ে দেখতেই খেয়াল করলাম তিনি অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত।

একটু একা ও পাচ্ছিনা উনাকে যে জিজ্ঞেস করব কাহিনীটা কি? বর বদল হল নাকি লোকটা জাদুর কেরামতিতে ছেলে হয়ে গেলেন।

কাল তো আমি ভুল দেখিনি, স্পষ্ট দেখেছিলাম লোকটাই বর সেজে বসে ছিল, ফুপি তাকে জামাই বলে সম্বন্ধ করছিল। উফফফফ! কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা আর। সীমার পাশে গিয়ে বসে তার কানে কানে বললাম,
~ তোর সাথে একটু কথা আছে আমার।
~ হ্যাঁ বল।
~ এখানে না, উপরে চল একটুখানি।

~ কিন্তু
~ কিন্তু কিছুনা, আয় আমার সাথে।
ওকে উপরে নিয়ে এসে ভিতরে ঢুকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম। সীমা অবাক হয়ে বলল, কি এমন বলবি যে দরজা বন্ধ করতে হল।

~ ওই ছেলেটা কি সত্যিই আমার বর?
~ হ্যাঁ, তোর ই তো বর।
~ কিন্তু আমি যে কাল এক বয়স্ক লোককে দেখলাম। সীমা মাথার ঘোমটা ঠিক করতে করতে বলল, তুই সেটা দেখে নিয়েছিস?

~ ইয়ার্কি মারিস না তো। সত্যিটা বল আমাকে।
~ আচ্ছা আচ্ছা বলছি ওয়েট। কাল নিচে ভীষণ ঝামেলা হওয়ার আওয়াজ পেয়েছিলি?
~ হ্যা, পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানিনা ওটা কিসের ঝামেলা ছিল?

~ আরেহ যে বয়স্ক লোকের সাথে তোর বিয়ে ছিল তার প্রথম ৩টা বউ এসে এখানে ভীড় করেছিল। পরে অই ব্যাটাকে মারতে মারতে বিয়েটা হওয়ার আগেই এখান থেকে বের করে নিয়ে যায়। আমরা তো প্রচুর টেনশানে পড়ে গিয়েছিলাম। তোকে কে বিয়ে করবে ভেবে! তখন ওই ব্যাটার দূরসম্পর্কের ভাগ্নে বলল, সে তোকে বিয়ে করতে রাজী। তাই আমরা ও অত কিছু না ভেবে মত দিয়ে দিলাম।
তার সাথেই তোর বিয়েটা হল।

~ কিন্তু চিনিনা, জানিনা এমন ছেলের সাথে ফুপি বিয়ে দিতে রাজি হল?
~ ছেলেটা যথেষ্ট শিক্ষিত আর ধনী। দাদী ছাড়া আর কেউ নেই ওর। দেখতেও তো কত সুন্দর, হ্যান্ডসাম। নিজেকে ভাগ্যবতী ভাব, এমন ছেলেকে স্বামী হিসাবে পেয়েছিস।

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,
~ চিনিনা, জানিনা এমন ছেলেকে স্বামী হিসেবে মেনে নিব। পুরাই অসম্ভব। সুন্দর তো কি হয়েছে, তাই বলে কি মেনে নিতে হবে।
কেউ একজন দরজায় নক করায় দরজা খুললাম। ফুপি সাথে সাথে রুমে ঢুকে বলল, সীমা তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে তোর শ্বাশুড়ি। আর মুশু তুইও রেডি হয়ে নে, এক্ষুনি তোকে নিয়ে জামাই রওনা দিবে। নিচে আয় দুজন তাড়াতাড়ি।

আমি আর কি রেডি হব! যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থায় শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নামলাম, সীমা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগল। আমিও আর কান্না আটকে রাখতে পারলামনা, কান্না মুছে ওকে গাড়িতে তুলে দিলাম। জনাব সিদ্ধান্ত হতাশচোখে আরো একবার শেষবারের মত আমার দিকে তাকালেন। বেচারাটাহ!

সীমার গাড়ি চলে যাওয়ার পর ফুপিকে সালাম করলাম, স্বপ্নাকে জড়িয়ে চুমু খেলাম। ফুপু কান্নাভেজা চোখে বলল,
~ ভালো থাকিস মা, এই ফুপিটাকে হয়ত খারাপ ভাবছিস। কিন্তু তোর ফুপি তোকে অনেক ভালোবাসে। পরিস্থিতির চাপে তোকে অনেক কিছু বলে ফেলেছি, ক্ষমা করে দিস আমাকে।

আমি ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলাম। হয়ত মা বেচে থাকলে বিদায়বেলায় মাকেও এভাবে জড়িয়ে ধরতাম। আজ ফুপির মাঝে মাকে খুজে নিলাম। উনি গাড়ি নিয়ে বাড়ির সামনে ওয়েট করছিলেন, আমি ফুপিকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে উনার পাশে বসলাম।

উনি একমনে ড্রাইভ করছিলেন, আর মাঝেমাঝে আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমি কয়েকবার তার চোখাচোখি হয়ে গেলাম। তারপর একটু রেগে বললাম,
~ দেখার জন্য অনেক সময় পাবেন,ঠিকমত ড্রাইভিংটা করুন।
সে উত্তরে কেবল মুচকি হাসল।

আমি আর কিছু না বলে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। মেহরাবের কথা মনে পড়ছে খুব, সত্যিই কি উনি আর কখনো আমার সামনে আসবেননা। ছোট একটা ভুলের এত বড় শাস্তি! উনি তো আমাকে অনেক বুঝেন, এইটুকু বুঝেননি সেদিনের একটা কথাও আমি মন থেকে বলিনি।

সবটা রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। জ্বীন হয়েছেন ঠিকিই কিন্তু বডড অবুঝ তিনি।
পাশে ড্রাইভিন সীটে বসে থাকা মানুষটার জন্য আমার কোনো টান অনুভব হচ্ছেনা, মাথায় শুধু মেহরাবের চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
হঠাৎ একটা বড় বাড়ীর সামনে গাড়ি থামালেন উনি। মুচকি হেসে বললেন,
~ আমরা পৌছে গেছি বউ।
চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম, “এসব কি ডাক?”

~ সবাইকে ক্লিয়ার করতে হবেনা আপনি আমার বউ। নাহলে কে কখন হাত টেনে নিয়ে বলে আমাকে বিয়ে করুন।
আমি বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম, “জাস্ট লেইম একটা জোক্সস।”

পর্ব ০৮

তিনিও গাড়ি থেকে নেমে বললেন, যাই ই বলুন আমি আপনাকে বউ বলেই ডাকব। চোখ রাঙ্গিয়ে তার দিকে তাকালাম। উনি মুচকি হেসে বললেন,
~ আসুন ভেতরে আসুন। দাদীমা, আন্টি তোমরা কোথায়? এসো তোমাদের বউমাকে দেখবে।

আমি উনার পিছু পিছু গিয়ে বাসায় ঢুকলাম। অনেক বড় বাড়ী তার, চারিদিকেই গোছগাছ, বাগান সবমিলিয়ে আভিজাত্য এর পরিচয় বহন করে।

ঢুকতেই একজন বৃদ্ধমহিলা, অন্য একজন ফুপিরবয়সী আর কিছু অল্পবয়সী মেয়ে এসে আমাকে ঘিরে ধরল। আমি মহিলাদেরকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। উনার হাসিমুখে আমাকে বলল, মাশা আল্লাহ বেশ সুন্দর তুমি, অনেক সুখি হও। উনি পাশ থেকে ফোড়ন কেটে বললেন, আমাকে কি সুন্দর দেখতে নাহ? আমারো কি সুখি হওয়া লাগবেনা নাকি?

বৃদ্ধমহিলা তার কান চেপে ধরে বলল, ফাজলামি বন্ধ করবি। এখন আর বাচ্চা নস তুই। আমি মনে মনে বললাম, বেশ হয়েছে, আরো জোরে কান মলো।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মজা পাচ্ছেন তাইনা!
আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

এই ব্যাটা দেখি মনের কথাও বুঝে নেয়। অল্পবয়সী মেয়েদের একজন আমাকে উপরের একটা সুন্দর রুমে নিয়ে গেল। লাগেজটা রুমের এক কোণে রেখে দিয়ে বলল, ভাবী এটা আপনার রুম। অনেকদূর থেকে এসেছে টায়ার্ড নিশ্চয়ই আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি যাই।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। এতক্ষণে একটু ভালোলাগছে, বেডে বসে রুমের চারিদিকে তাকালাম। বেশ বড় এবং পরিপাটি রুমটা, দেয়ালে আল্লাহর কালামের ওয়ালম্যাট ঝুলানো। মনে হচ্ছে এরা ঈমানদার ফ্যামিলি। মানিয়ে নিতে কষ্ট হবেনা, আমি মধ্যবিত্ত হলেও একটা ঈমানদার পরিবারের মেয়ে।

ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কালো-লাল একটা সেলোয়ার-কামিজ পড়ে নিলাম। যদিও দেখেছি নতুন বউরা সবসময় শাড়ি পড়ে থাকে, কিন্তু কি করার! বিয়েটা তো ফুপি দিল তাই কপালে বিয়ের দিনে ১টা শাড়ি ছাড়া তেমন কিছু পাইনি। বাবা হলে হয়ত মেয়েকে খালি হাতে শ্বশুড়বাড়িতে পাঠাত না।

এটাই রক্তের সম্পর্ক আর কাছের সম্পর্কের ব্যবধান। দায় নামাতে এমনিতেও ফুপি কিছু কম করেনি, যা করেছে তাও বেশী। আমি আবার কিসব ভাবতে বসলাম, তার চেয়ে বরং নিচে যাই। নতুন বউ গুটিয়ে বসে থাকলে বেমানান লাগবে। বের হব এমন সময় উনি রুমে ঢুকলেন।

আমাকে এক পলক দেখে বললেন,
~ শাড়ি পরেননি যে? নতুন বউরা বেশ কিছুদিন শাড়ি পরতে হয় এই কিছুদিন শাড়ি পরে থাকার অস্বস্তিটা মানিয়ে নিতে হয় বউ।

~ আমার কোনো অস্বস্তি হচ্ছিলনা। আমার কাছে আর শাড়ি বলতে গিয়ে বললামনা। এসব কথা বললে বাবার বাড়ির মানুষদেরকে ছোট করা হবে, আর সেটা আমি কখনোই করতে চাইনাহ। উনি বললেন, থেমে গেলেন যে?
~ না, কিছুনা।

উনি আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে দিয়ে বললেন,
~ এই নিন। আপনার সব প্রয়োজনীয় জিনিস এখানে রাখা আছে, লাগলে নিয়ে নিবেন। আর হ্যাঁ নিচের তাকের সব কিছু আমার, এগুলো ঘাটাবেননা। অনেক কষ্ট হয় গুছিয়ে রাখতে বুঝলেন।

রাগ হল শুনে, আমাকে কি উনি অকাজের মনে করেন নাকি। ধরতে যাবে কে উনার জিনিস! রাগটা চেহারায় ফুটামাত্রই উনি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। তারপর বেরিয়ে গেল। আমি ড্রেস চেঞ্জ করতে যাব এই সময় আবার এসে বললেন, সুন্দর করে সেজেগুজে নামবেন কিন্তু বেশী সময় নিবেননা। পরে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা সকাল হয়ে যাবে।

~ আপনি জানেন আমি চেঞ্জ করব তাও এভাবে অসভ্যের মত চলে এলেন?
~ স্যরি বউ। আমি কিন্তু তাকাইনি।

রাগ হাই হয়ে গেল আমার। ড্রেসিং টেবিল থেকে বডি লোশনের ভারী ডিব্বাটা ছুড়ে মারলাম উনার দিকে, উনি তার আগে লাফিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
~ বান্দর পোলা একটা।

রেডি হয়ে নিচে নেমে এলাম। সবাই সাথে বসে ডিনার করলাম। খেতে খেতে জানতে পারলাম, বৃদ্ধমহিলাটি উনার দাদীমা। ফুপির বয়সী মহিলাটি ছোট থেকে উনাকে দেখাশুনা করে আসছেন, আন্টি বলেই সবাই সম্মান করে। বাকি মেয়ে ৩টাকে বাসার কাজে রাখা হয়েছে।

সবাই খুব মিশুক, আমাকে সহজেই তাদের আপন করে নিল। একবারো এই প্রশ্নটা করলনা, আমার বাবা কি করে? আমার ফ্যামিলির স্ট্যাটাস কেমন? শুধু যতটা না জানলেই নয় ততটাই জিজ্ঞেস করলেন।

তার চেয়ে বড় কথা, এভাবে হুট করে বিয়েটা হয়ে যাওয়ায় কাউকে অখুশি মনে হল না। খুব সহজ ভাবেই আমাকে মেনে নিয়েছেন ওরা। এমন উদার আর ভাল ফ্যামিলি আমি কোথাও দেখিনি। আচ্ছা আমার সমস্যা কি! আমি তো বিয়েটা সহজ ভাবে নেইনি কিংবা মন থেকে মানিওনি। তাহলে তারা কেমন বা নতুন বউ কেমন থাকে না থাকে ওইসব নিয়ে এত ভাবছি কেন?

কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা, একবার শুধু বাবার বাড়ি যাই। আমি আর ফিরব নাহ। এই বিয়েটাও আর মানবনা, যতদিন না অবধি বাবার কাছে যাচ্ছি ততদিন এসব আমাকে মেনে নেওয়ার ভান করতে হবে।

আমি রুমে ঢুকার প্রায় অনেকক্ষণ পর উনি রুমে ঢুকলেন। মনে অনেক ভয় কাজ করতে লাগল। উনি যদি করে বসেন, তখন আমি কি করব! ধীরে ধীরে এসে আমার পাশে বসলেন। গলা ঝেড়ে বললেন,
~ বউ, আজ আমাদের বাসর রাত। জানো তো?

এটা শুনে আমার হাত-পা কাপাকাপির পর্যায়ে চলে গেল। উনার এতক্ষণের আপনি শব্দটা তুমিতে রুপান্তরিত হতে দেখে বুঝে নিলাম, এই ছেলে নিশ্চয়ই কিছু করে বসবে।
~ কি হল বউ? চুপ করে আছো যে?

~ কিহ বলব?
~ আমি কিন্তু তোমার ব্যাপারে সবকিছু জানি।
~ কি কি জানেন?

~ এই যে তোমার বিয়ে করার কাহিনী আজ সীমা আপুর বিয়ে দেখে আন্দাজ করতে পারলাম।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। উনি আবার বলতে শুরু করলেন,
~ আমি জানি এই অবস্থায় তোমার একটু অস্বস্তি কাজ করতেই পারে,আর সব মানতে সময় লাগবে। তুমি কি আমার থেকে একটু সময় চাও?

মনে মনে ভাবলাম, সময় নিয়েই নিই। বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়া অব্ধি উনাকে আমার থেকে দূরে রাখতে হবে।
আমি সরুগলায় বললাম, হ্যা, সময় দেওয়া দরকার আমাকে। এখন আপনার ইচ্ছে বাকিটা।
~ আচ্ছা বেশ দিলাম সময়। জানেন তো, বাসর রাতে স্বামী-স্ত্রীকে এক সাথে শোকরানা নামায পড়তে হয়। অবশ্য এটা যেকোনো সময় পড়লেই হয়, তাই ভাবলাম যেদিন আমরা সত্যি অর্থে স্বামী-স্ত্রী হয়ে উঠতে পারব সেদিনই পড়ব।
আর হ্যাঁ, এই নাও তোমার মোহরানার টাকা।

আমি টাকাটার দিকে তাকালাম, “শুনেছি স্ত্রীর শরীর স্পর্শের আগে মোহরানার টাকা দিতে হয়। কিন্তু আমি এই টাকা কেন নিব, যেহেতু আমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠবেইনা।”
তাই টাকাটা না নিয়ে বললাম,
~ আমারো একি যুক্তি। সেদিন আমিও টাকাটা গ্রহণ করব।

উনি মুচকি হেসে টাকাটা রেখে দিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ অনেক রাত হয়েছে তাছাড়া তুমি বেশ ক্লান্ত। এখন ঘুমিয়ে পড়।
~ আপনি কোথায় ঘুমাবেন?

~ তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে তোমার পাশে।
~ আপনার ইচ্ছে যেহেতু এটা আপনার নিজস্ব রুম।
~ তোমারো অংশীদারী আছে এতে।
~ সেটা আমি এখন নিতে চাচ্ছিনাহ।

~ আচ্ছা ঘুমাও। বলেই আলো নিভিয়ে দিলেন উনি। পুরো রুমটা অন্ধকারে ঢেকে গেল। আমি উলটো পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে মেহরাবের সাথে কাটানো সময় গুলো কল্পনা করতে লাগলাম।

পর্ব ০৯

এ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল, উঠতেই ইচ্ছে হচ্ছিলনা। ভাবলাম আরো একটু ঘুমাব, এ্যালার্ম অফ করার জন্য ফোন হাতে নিতেই উনি আমার জন্য চা নিয়ে এসে বলল, চা খেয়ে নাও ঘুমটা কেটে যাবে। তারপর নামায পড়ে নাও।
~ এত সকালে আপনি চা বানালেন?

~ হ্যাঁ, আমি বানিয়েছি। এখন রান্নাঘরে কেউ নেই, একটু পর সবাই নামায পড়তে উঠে পড়বে। ধরো, খেয়ে নামায পড়ো। টেবিলে জায়নামায,খিমার, অসবীহ সব রাখা আছে।

বলে টুপি হাতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি চায়ে চুমুক দিলাম, খুব ভাল চা বানাতে পারেন উনি। চা শেষ করে ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে নিলাম। রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে আসতে দেখি মেয়েগুলো কাজে লেগে পড়েছে। এই বাড়ির সবাই দেখছি খুব পানচুয়্যাল। যতটা সহজে মানিয়ে নিতে পারব ভেবেছি ততটা সহজ বোধহয় হবেনা। আমি এসে হাত লাগাতেই তাদের একজন বলল,
~ ভাবী, আপনি আবার কষ্ট করে রান্নাঘরে আসলেন কেন? আপনার চা আমরা পাঠিয়ে দিতাম। মুখ ফসকে বলতে যাব, আমি চা খেয়েছি।

বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। এটা নিশ্চয়ই ভাল দেখাবেনা, আমি আরামে ঘুমিয়েছি আর আমার স্বামী আমার জন্য হাত পুড়িয়ে চা বানিয়েছে। আমি ওদেরকে বললাম,
~ আজকের নাস্তাটা আমি বানাব। কি কি বানাতে হবে বলো?

~ আপনি কেন বানাবেন ভাবী? আমরা কেন আছি!
~ কেন বানাতে পারবনা?

~ হ্যাঁ, পারবেন তো। কিন্তু বাকিরা জানলে রাগারাগি করবে নতুন বউ আসতে না আসতে রান্নাঘরে ঢুকেছে জানলে। আচ্ছা ভাবী আপনি চা টাই বানান শুধু।
উনি এসে রান্নাঘরের সামনে দাড়ালেন। হেসে হেসে বললেন,
~ চা বানাতে জানো তো? সেটা খাওয়া যাবে তো?

~ আপনার কি আমাকে অকর্মা মনে হয়? কাল ও বললেন গুছিয়ে রাখতে অনেক কষ্ট হয়, এসব বলে কি মিন করেন আপনি? রান্নাবান্না না হয় একটু কম জানি, তাই বলে সব কাজে অপটু আপনাকে কে বলল?

~ শাকি তোর ভাবীকে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে দে তো। নাহলে কখন ব্লাস্ট হয়ে যাবে বলা যায়না। এ কথা শুনে মেয়েগুলো মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল। শাকি রুটি বেলতে বেলতে বলল,
~ ভাইয়া এটা ঠিক হচ্ছেনা, সকাল সকাল কেন ভাবীর পিছনে লেগেছো বলো তো। ভাবী মোটেও রাগী না, অনেক ভালো।
~ সেই গুনগান ই কর। আমার জানা হয়ে গেছে।

~ আপনি এখান থেকে যাবেন নাকি কথা না শেষ করে হাতে থাকা চায়ের জন্য নেওয়া পানি তার গায়ে ছুড়ে মারলাম। এইবার আর মিস হলোনা, একদম কাকভেজা হয়ে গেল বেচারা।
নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে বলল, আপনার মত জংলী মেয়ে আর একটাও নেই।
~ কি বললেন?
~ জংলী বলছি।

~ আমি জংলী, দাড়ান আপনি এদিক ওদিক কিছু একটা খুজতে লাগলাম।
আর দাড়ালনা উনি, ছুটে চলে গেলেন। মেয়েগুলো খিলখিল করে হাসতে লাগল। এবার মনে হচ্ছে কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি আমার। লজ্জায় চুপ হয়ে গেলাম। বাড়ির নতুন বউ কিনা আসামাত্রই দুষ্টুমি শুরু করল। কি লজ্জার ব্যাপার! দাদীমা-আন্টি জানলে কি ভাববে? আমার আর দুষ্টুমির স্বভাব টা গেলনা। পরিবেশ বুঝে চলিনা।

মেয়েগুলো হেসে হেসে বলল,
~ কেউ তোমায় বকবেনা ভাবী। ভাইয়া তো এমনি, তাকে নিয়েই তো সারাক্ষণ বাসায় দুষ্টুমি, খুনসুটি চলে। যেদিন বাসায় থাকেনা, বাসাটা ফাকা ফাকা মনে হয়। এখন আর লাগবেনা, আরেকটা দুষ্টু ভাবী চলে এসেছে।
~ কিন্তু উনি যদি দাদীমার কাছে নালিশ করে? তাহলে তো দাদীমা আমাকে খারাপ ভাববে।
~ আরেহ না ভাবী। কেউ কিচ্ছু ভাববেনাহ। আমি নতুন করে চায়ের পানি বসিয়ে দিচ্ছি। তুমি ভয় পেয়োনা তো আর।

ভয় টা তাও কাটলনা, ডাইনিং টেবিলে নাস্তা করতে বসতেই দেখি উনি চলে এসেছেন। ভয় পাচ্ছিলাম কখন না এসব বলে বসেন। কিন্তু কিচ্ছু বললেন না, উলটো দাদিমার সাথে মজা করতে লাগলেন। যাক পোলাটা ভাল আছে।
~ দাদিমা, জানো আজ কি হয়েছে? তোমার নাতবউ কি করেছে?

এইবার ভয় পেয়ে গেলাম, ব্যাটাকে ভাল বলতে না বলতেই ইজ্জতের ফালুদা বানাইতে ব্যস্ত হয়ে গেছে। শয়তান পোলা একটা। তার চোখের তাকিয়ে ইশারা করলাম যেন না বলে। দাদিমা খেতে খেতে বলে,
~ নাতবউ আবার কি করল? সে আমার দিকে তাকাল গম্ভীরমুখে। আমি যে কতবার ইশারায় ক্ষমা চাইলাম, কান ধরলাম পাত্তাই দিলনা।

~ সে আজ লজ্জায় চোখ বুজে নিলাম। এইবার নিশ্চয়ই দাদীমা আমাকে বকবেন।
~ দাদীমা, সে আজ সকাল সকাল উঠে সবার জন্য চা বানিয়েছে। খেয়ে দেখো তো খাওয়ার মত হয়েছে কিনা! আলসে মেয়ে তো।

যাক বাবা বাচলাম, বলেনি তাহলে। আমি সবার জন্য চা ঢেলে দিয়ে বললাম,
~ দাদীমা, যার খেতে এত ভয়। সে বরং আজ চা না খাওয়াই ভাল।

~ দিস না এই বাদরটাকে চা।
সে আমার দিকে তাকাতেই আমি ভেংচি কেটে দিলাম। সে দাদীমাকে আবার বলতে লাগল, “দাদীমা, আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আজ মুশায়রা
~ এই নিন আপনার চা। ঠিক আছে কিনা দেখুন তো।

হাসতে হাসতে চুমুক দিয়ে বলল, চায়ে চা পাতা এত কম দিলা কেন? চিনিটা দুই-তৃতীয়াংশে রাখবা। দুধ স্কয়ারিং এ দিবা, তাহলে পারফেক্ট হবে। চাপাতা টেবিল চামুচের অর্ধেকের ব্যাসার্ধে দিবা যদি কম রাখতে চাও। আর যদি কড়া করতে চাও গোল চামুচের এক- তৃতীয়াংশের অধের্কের তুলনায় বেশি ব্যাসার্ধে নিয়ে তার দুই স্কয়ার বেশি দিবা।
উনার এসব গাণিতিক হিসাব শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। এই পোলা বলে কি? বাপের জন্মেও এমন চা বানানো শুনিনি। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ বুঝোনি? বুঝবে কি করে? নিশ্চয়ই অংকে কখনোই ডিম ছাড়া কিছু পাওনি।

সব উনার কথা শুনে হাসতে লাগল, আমি তো মনে মনে রাগে ভীষণ ফুসছি। একবার সুযোগ পাই, ব্যাটার ১২টা বাজাব। আন্টি হাসি থামিয়ে বলল,
~ না রে মা, চা টা ভীষণ ভালো হয়েছে। ওর কথা শুনোনাহ তো, সবার পিছনে লাগাটাই ওর অভ্যাস।

মুচকি হাসলাম আমি। অভ্যাসের উত্তর যদি আমি না দেই তবে আমিও
উনি আমার উঠে দাঁড়িয়ে আমার কানে ফিসফিস করে বললেন,
~ মুশায়রা নয় তাই তো!
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।

সব বুঝে ফেলার ক্ষমতা আছে নাকি উনার! সারাটা দিন ভীষণ ভালো কাটল আমার, একবারের জন্য ও মনে হলনা আমি একা। এত মিশুক আর ভাল এই বাড়ীর মানুষগুলা শুধু ওই হনুমানটা ছাড়া!
সারাটাদিন ই আমার পিছনে লেগে থাকেন।

পরেরদিন সকালে ড্র‍য়িংরুমে এসে দেখি ফুপি, সীমা, স্বপ্না আর জনাব সিদ্ধান্ত এসেছেন আমাকে দেখতে। ফুপিকে সালাম দিতেই জড়িয়ে ধরে বললেন, কেমন আছিস মা? আমি হেসে বললাম,
~ ভালো আছি ফুপি। তোমরা কেমন আছো?
~ হ্যাঁ রে ভালো আছি।

আমি তাদের দেখে অবাক হলাম। ভাবতে পারিনি এরা আমাকে দেখতে আমার শ্বশুড়বাড়িতে আসবে। ভাবার কথা ও না, ফুপি তো নিজের দায় সারতে আমার বিয়ে দিয়েছিল, ভাইয়ের মেয়েকে যে নিজের খরচে বিয়ে দিয়েছে তাও অনেক।
খানিকবাদে উনিও নেমে এসে ফুপিকে সালাম করে জনাব সিদ্ধান্তের সাথে হাত মিলিয়ে বললেম, আপনার সংসার কেমন চলছে দুলাভাই?

জনাব সিদ্ধান্ত শুকনো মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
~ আপনাদের দোয়ায় কি খারাপ চলে? আপনাদের কি অবস্থা!
উনি খানিকটা ফিসফিস করে বললেন, কি আর বলব দুঃখের কথা? আপনি তো ওকে বিয়ে না করে বেচে গেলেন, ফেসে গেলাম তো আমি কি কষ্টে যে দিন যাচ্ছে বলে বুঝাতে পারবনা।
~ কেন কি হয়েছে ভাই?

~ আপনার ভাবি সারাদিন ফরমায়েশের উপর রাখে, কাল রাতে অদ্ভুত আবদার করল তাকে নাকি এক সপ্তাহের মধ্যে টুইন বেবি দিতে হবে! ভাই বেবি দেওয়া কি আমার হাতে? আর সবেমাত্র বিয়ে করলাম এত তাড়াতাড়ি কি বেবি নেওয়া যায়? বুঝেও না একটু।
~ বলেন কি ভাই?

~ জ্বি ভাই, কথা না শুনলে হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে মারে। কখনো লোশনের ডিব্বা, কখনো পানি। পুরো লাইফ টা তেজপাতা আমার।বিয়ে করে কি ভুল টাই না করলাম।
~ ওকে দেখে তো কখনো এমন মনে হয়নি।

~ আরেহ ভাই, সুন্দরী মেয়েদের চেহারা আর মন একি কথা বলে নাকি! সীমা
আপুকে তো দেখলেই বুঝা যায় উনি অনেক ভালো। সত্যি বলছিনা ভাই?
~ হ্যাঁ, আমাকে অনেক মান্য করে, যা বলি তাই শুনে।

~ আর আমারটার কথা কি বলব, আমাকে উলটো তার কথা শুনে চলতে হয়। দেখেন কি লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে। পারছেনা শুধু কাচা চিবিয়ে খেয়ে নিতে।
আমার কানে সব কথাই আসছে, মনে মনে রাগে ফুসছি।কি মিথ্যে কথাটাই না বলল আমার নামে! সত্যিই পারলে কাচা ই চিবিয়ে খেয়ে নিতাম।

সীমাকে নিয়ে উপরে আমার রুমে চলে এলাম গল্প করতে। সীমা রুমটা দেখে বলল, দুলাভাইয়ের রুচি আছে বলতে হয়, বেশ সুন্দর রুমটা।
~ হুহ আর রুচি! গুছিয়ে রাখে নাকি!
~ হিহিহি, তা তোর বাসর কেমন হল মুশু?

~ অই ফাজলামি করবিনা বলে দিচ্ছি তোর কি খবর সেটা বল? উনি তোকে মেনে নিয়েছে?
~ না মেনে যাবে কোথায়? মাইনকা চিপায় পড়ছে না!
~ তোকে কিন্তু বেশ সুন্দর লাগছে।

ফুপি জুস এর গ্লাস হাত নিয়ে রুমে ঢুকে বলল, তোকেও তো কম সুন্দর লাগছেনা, যা ই হোক বড়লোকের বাড়ীর বউ তুই এখন। আমরা তো ভাবি ই নি এমন শ্বশুড়বাড়ী পাবি তুই! আমি উত্তরে মুচকি হাসলাম।
~ হ্যারে মুশু, তোর শ্বশুড়বাড়ি থেকে কি কি দিল ফুপিকে দেখা একটু। আমরাও দেখি আমাদের বাড়ির মেয়েকে তারা কেমন ভরিয়ে রেখেছে।

আমার ফুপির এমন কথা শুনে মোটেও অইসব দেখাতে ইচ্ছে করছেনা। আমি ওদের থেকে কম কিছু পাইনি, যে বেশি পেয়েছি তা হল ভালবাসা। ওইসবের মূল্য ফুপি বুঝবেনা।
এখন না দেখালে আমার শ্বশুরবাড়ির নিন্দে করবে, যাদেরকে আমি এত ভালবাসি তাদের নামে নিন্দে আমি করতে দেই কি করে।

আলমিরা থেকে একে একে সব শাড়ি আর গয়না নামিয়ে দেখালাম। ফুপির মুখ দেখে বুঝলাম তার সবি পছন্দ হয়েছে। হঠাৎ ফুপির হাতে জুসের গ্লাসটা সীমার শাড়ির উপর পড়ে পুরো শাড়িটা ভিজে ভিজে হয়ে গেল। ফুপি বলল,
~ ইস! পুরো শাড়িটা ভিজে গেল, আমি যে কি করিনা!
~ ঠিক আছে মা, আমি মুছে নিচ্ছি।

~ মুছে নিবি কি করে সীমা? ভিজা শাড়ি পড়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। আর শাড়ি আনিসনি?
~ উফ মা, আমি তো আনতে চেয়েছিলাম। তুমিই তো বারণ করে বললে আমরা ওখানে থাকতে যাচ্ছিনা।
~ মুশু তোর একটা শাড়ি সীমাকে আপাতত পড়ার জন্য দে, ভিজা শাড়ি পড়ে থাকলে মেয়েটার ঠান্ডা লেগে যাবে।
~ মা, শুকিয়ে যাবে তো।
~ তুই চুপ থাক তো।

আমি সবচেয়ে সুন্দর আর দামী শাড়ি আর ভারী গয়না সীমার হাতে দিয়ে বললাম, এইগুলো তোর। তোর বিয়েতে আমি কিছু দিতে পারিনি, এখন এইগুলো দিলাম। ফুপি ওর হাত থেকে নিয়ে বলল, খুব সুন্দর তো।
~ মুশু এসবের দরকার ছিলনা, তোর দোয়াটাই বেশি আমার কাছে।

~ ভালোবেসে মুশু এসব দিচ্ছে, তুই না করছিস কেন? মেয়েটা কষ্ট পাবেনা।
~ সীমা, তুই শাড়ি চেঞ্জ করে নে। ফুপি আমি যাই তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করি।
~ যা মা।

আমি রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই শুনলাম সীমা ফুপিকে বলছে, তুমি এসব ইচ্ছে করে করেছো তাইনা মা?
~ চুপ থাক তুই, ও কত বড়লোক স্বামী পেয়েছে দেখেছিস। তাও আমাদের জন্য, তাই এসব নেওয়া অন্যায় কিছুনা। ওকে বিয়ে দিতেও তো আমাদের খরচ হয়েছে কিছু টাকা। ওইসব পুষিয়ে নিবনা।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে নেমে এলাম।

পর্ব ১০

ফুপিদের দেখে মেহরাবের কথা আরো বেশি মনে পড়তে লাগল। সত্যি বলতে মেহরাবকে আমি জীবন সঙ্গী হিসাবে চেয়েছিলাম, আস্তে আস্তে ওর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম।

পুরোপুরি দূর্বল হওয়ার আগেই আমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করে ওকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। এখন তো আমি অন্যের স্ত্রী, চাইলেও ওর সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারবনা। আর ও তো আমাকে কখনো ভালোবাসেই নি, যদি বাসত এতগুলো দিনে একবার হলেও আমার সামনে আসত।

আচ্ছা একবার ফুপির বাসায় গেলে কেমন হয়? যদি একবার তার দেখা পাই। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে এসব কথা ভাবছিলাম, কখন যে উনি রুমে ঢুকলেন আমি বুঝতে পারলামনা। হালকা আলোর ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিয়ে বললেন,
~ রাতে খেলেন না যে? আমি বাহিরের দিকে তাকিয়েই বললাম,
~ ইচ্ছে করেনি।

~ কারো জন্য কি মন খারাপ করছে?
~ কার জন্য করবে?

~ না মানে, ফুপিরা চলে যাওয়ার পর থেকে তোমাকে কেমন যানি মনমরা দেখাচ্ছে। কি হয়েছে বলতে পারো! টলমল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ আমাকে একবার ফুপির বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাবেন?

উনি নিশ্চুপ হয়ে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি জানো তোমার ফুপি কেমন? আমার থেকেও বেশি ভাল জানো। উনারা যদি সত্যি তোমাকে আপন ভাবত, তাহলে কি একটা বুড়োবয়সী লোকের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করতে পারো? নিজের মেয়ের ভালোর জন্য ভাইয়ের মেয়ের খারাপ চাইতে পারো বলো। আমি চাইনা তুমি ওই বাড়ীর সাথে আর কোনো সম্পর্ক না রাখো।
~ কিন্তু
~ স্বামী হিসেবে এটা আমার আদেশ নয় নিতান্ত অনুরোধ। জনাব সিদ্ধান্তকে আমি আজ অনেক মিথ্যে বলেছি, কৌতুক করে নয়। যাতে উনি সীমা আপুকে নিয়ে সুখে থাকেন, তোমার উপর আর নজর না দেন। তার জন্য তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি বৌ।

~ আচ্ছা, আপনি যা বলেন তাই হবে। কিন্তু আমার বাবার কাছে তো নিয়ে যেতে পারেন, বাবা এখনো জানেন না আমি বিয়ে করেছি। জানিনা উনি ক্ষুব্ধ হবেন নাকি খুশি হবেন?

~ কোনো বাবাই তার মেয়ের সুখে অখুশি হননা, তবে তুমি যদি অখুশি হউ সেটা ভিন্ন কথা। আর বুঝোই আমাদের বিয়ে হয়েছে এক সপ্তাহ ও হয়নি, এই সময় যদি আমরা হুটহাট বেড়াতে চলে যাই। কেউ সেটা ভালোভাবে নিবেনা, তুমি আরো কিছুদিন এই পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নাও। সংসার করো মন দিয়ে, তারপর আমরা বাবার কাছে যাব।

আমি মন খারাপ করে ফেললাম। উনি আমার হাত স্পর্শ করে বললেন,
~ কথা দিচ্ছি বউ। আমি চমকে উঠলাম উনার স্পর্শে, স্পর্শটা আমার খুব চেনা লাগছে। এর আগে তো উনি আমাকে স্পর্শ করেননি, তবে কি সেটা আমার মনের ভুল! জানিনা কিছু। উনি আমাকে হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিলেন,
~ দুপুরে যে খেয়েছিলে, আর কিছুই খাওনি। এখন একটু না লেগে শরীর খারাপ লাগবে। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।

~ আপনি কেন আনতে গেলেন? আমার ক্ষিধে পেলে আমি নিজেই নিচে গিয়ে খেয়ে আসতাম।
~ তুমি কেমন সেটা আমার জানা হয়ে গেছে বউ। বুক ফেটে যাবে তাও মুখ ফুটবেনা তোমার। নাও খা কর, আমি খাইয়ে দেই।
~ আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা।

~ বউ!!!!
~ আচ্ছা আমি নিজে খাচ্ছি।
~ না আমার হাতে খাও, মানলাম স্বামী ভাবো না কিন্তু ঘৃণা করো তা জানতামনা।
~ এসব কি বলছেন আপনি? দিন খাইয়ে দিন।

অতিযত্নে আমাকে খাইয়ে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলেন। আমি শুইয়ে পড়ার পর উনি গায়ের উপর কাথা চাপিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে চুলে বিলি কেটে দিলেন ঠিক মেহরাব যেমন দিয়েছিল। দুটো মানুষের মধ্যে আমি যেন একটু একটু মিল খুজে পাই, কিন্তু অমিলটাই বেশি। মেহরাবকে আমি কখনো দেখিনি তার উপর ও একজন জ্বীন, আমার চোখের সামনে থাকা মানুষটা তো জলজ্যান্ত একটা ছেলে। মেহরাবের কথা খুব মনে পড়ছে তো তাই সর্বত্র ওকে খুজে বেড়াচ্ছি আমি।

আচমকা একটা শব্দে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল ভারী কিছু নিচে পড়ে ভেঙ্গে গেছে। উঠে বসলাম, লাইট নেভানো তাই চারিদিকেই অন্ধকার। হাত দিয়ে বিছানাটা হাতড়ালাম উনি আছেন কিনা দেখতে। কিন্তু পাশে উনি নেই, তবে কি উনি নিচে শুয়েছেন? বেডল্যাম্পটা জ্বালালাম, না রুমে আমি একা আর কেউ ই নেই। বিছানা থেকে নেমে ব্যালকুনির সামনে এসে দাড়ালাম।

এখানে তো অনেক অন্ধকার, হঠাৎ পায়ের নিচে ভাঙ্গা কিছু টুকরো পড়ল। তার মানে ব্যালকুনির দরজায় যে ফুল এর টবটা ছিল সেটা ভেঙ্গে গেছে। আরেকটু এগিয়ে আসতে দেখলাম দুজোড়া জ্বলজ্বল করা চোখ। অন্ধকারের প্রতিবিম্বতে বোঝা যাচ্ছিল একজন আরেকজনের গলা চেপে ধরেছিল। অন্যজনের গলা থেকে ঘড়ঘড় আওয়াজ আসছিল, এই বুঝি মারা পড়ল সে জন! কিছু না ভেবেই চোখ বুযে চিৎকার করে উঠলাম।

একটু সময় পর রুমের আলো জ্বলল, উনি আমার পাশে এসে দাড়ালেন। আমি উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “দেখুন ব্যালকুনিতে কেউ একজন আরেকজনের গলা চেপে ধরেছে। লোকটা হয়ত বাচবেনা, ওকে বাচান অন্যজনের হাত থেকে।”
উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
~ রিলেক্স বউ। ওখানে কেউ নেই দেখো।

আমি উনাকে ছেড়ে দিয়ে ব্যালকুনির কোণায় তাকালাম। সেখানে কেউ নেই, তবে কি আমি ভুল দেখলাম। না ভুল দেখিনি, আমার পায়ের নিচে ভাঙ্গা টুকরো গুলো তো পড়েছিল।
~ ফুলের টব ভাঙ্গার শব্দে আমি এখানে এসেছিলাম, এই দেখুন আমার পায়ের নিচে সেটার ভাঙ্গা টুকরো আছে।
~ বউ তোমার পায়ের নিচে কিছু নেই দেখো।

আমি তাকালাম সত্যিই তো কিছু নেই। এমন সময় রুমের দরজায় নক করল কেউ। উনি দরজা খুলতে চলে গেলেন, আমি ব্যালকুনিতে টব টা খুজতে লাগলাম। না ভাঙ্গলে টবটা তো এইখানেই থাকবে, ঘুমানোর আগেও আমি টবটা এখানে দেখেছি।

দাদীমা রুমে ঢুকে বললেন, নাতবউ চিৎকার করছিলে কেন? ভয় পেয়েছিলে নাকি?
আমি মাথায় শাড়ির আচল দিয়ে মুখ নিচু করে কিছু বলার আগেই উনি বলে বসলেন, কি দেখে যেন ভয় পেয়েছে! ভীতুর ডিম তো। তুমি আবার এখন উঠে আসলে কেন? যাও ঘুমাও, চলো তোমায় আমি দিয়ে আসি।
~ দাদীমা, ব্যালকুনিতে কেউ ছিল।
~ ওহ বউ, এটা তোমার মনের ভুল ছিল। দাদীমা উনার দিকে হতাশচোখে তাকিয়ে বললেন, চল আমাকে দিয়ে আসবি।

~ বউ তুমি শুয়ে পড়ো, আমি দাদিমা কে রুমে দিয়ে আসছি।
ভয়ে ভয়ে বেডে বসে পড়লাম। এভাবে চিৎকার করা উচিত হয়নি, দাদিমা কি না কি ভাবলেন! কিন্তু এটা তো মিথ্যে নয় আমি ওখানে দুজনের ছায়া দেখেছি, ওরা নিজেদের মধ্যে ধস্তাধস্তি করছিল।
কেউ যখন বিশ্বাস করছেনা, তবে এটা নিয়ে না ভাবাই ভাল।

সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাধছিলাম। উনি এসে উবু হয়ে ড্রেসিংটেবিল থেকে তার ঘড়িটা নিচ্ছিলেন। চোখে পড়ল তার বা গালে কয়েকটা নখের আঁচড়। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
~ আপনার গালে কি হয়েছে?

~ কই কি হয়েছে? ওহ তেমন কিছু না, কিসের সাথে মনে হয় আচড় লেগেছে কাল রাতে দাদীমার ঘরে। আমার মনে হল উনি মিথ্যে বলছেন, স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এইগুলো নখের আঁচড়। আমি বললাম,
~ আপনি বসুন, আমি ফাস্ট এইডের বক্সটা নিয়ে আসছি।

~ প্রয়োজন হবেনা বউ, আমাকে এক্ষুনি বের হতে হবে। তাড়া আছে আমার।
~ একটু দেরী হলে কিচ্ছু হবেনা, আপনি বসুন।

আমি উনার গালে ওষুধ লাগিয়ে দিলাম, কাছ থেকে লক্ষ করে বুঝলাম এইগুলো নখের ই আচড়। কেন উনি আমাকে মিথ্যে বলছেন বুঝতে পারলামনা।
উনার কোনো অবৈধ সম্পর্ক নেই তো? ছিহঃ এসব আমি কি ভাবছি! আমার মাথায় এত খারাপ চিন্তা আসে কি করে?

আচ্ছা উনার রিলেশান থাকলেও আমার কি! আমি তো তাকে স্বামী হিসাবে মানিনা। কখনো ভালো ও বাসিনি! তাহলে তার সামান্য কিছু আমাকে কেন কষ্ট দেয়?

তাহলে কি আমি উনাকে
আমার মনের ভালোবাসাটুকু তো মেহরাবের জন্য। সেখানে কি করে উনার জায়গা হতে পারে?? অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম এসব ভাবতে ভাবতে। উনি আমার নাক ছুয়ে দিয়ে বলল, বউ কি ভাবছো?
~ কিছুনা তো।
~ আমি যাচ্ছি।

~ সাবধানে যাবেন, আল্লাহ হাফেজ।
দাদীমার রুমের সামনে দিয়ে যেতেই কিছু টুকরো কথা কানে ভেসে এল। আন্টিকে দাদীমা বলছিল, আমি একটা বড় ঝড়ের আভাস পাচ্ছি খানম।

~ কিসের ঝড় বড় আম্মা?
~ যে ঝড়ে আমার নাতি আর মুশায়রার সংসার ভেঙ্গে যেতে পারে। ওদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাবে, বুঝতে পারছিনা কি করব!
~ বড় আম্মা সে কি সত্যি ই আসছে?

~ হ্যাঁ খানম।
~ তাহলে তো সত্যিই বড় অশান্তি হবে। তুমি টেনশান করোনা আম্মা। ওকে আমি বুঝিয়ে বলব, ও অশান্তি করবেনা।

এইটুকু শুনে আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম, কে আসছে আমাদের মাঝে? কিসের ঝড়ের আশঙ্কা করছেন দাদীমা। দাদীমা আর আন্টি তবে সবটা জানে, কিছু একটা আমার কাছে লুকিয়ে যাচ্ছে।

বিকালে রান্নাঘরে সবার জন্য পাকোড়া বানাচ্ছিলাম। একজন বোরকাপড়া মেয়ে এসে দাড়াল আমার সামনে। বয়স আমার থেকে ১-২বছর বেশি হবে। চোখ ২টো ছা ড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিলনা। মিষ্টিকন্ঠে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
~ দাদীমা কোথায়?

~ তার রুমে আছে, আপনাকে তো চিনলাম না বোন।

দাদীমা পিছনে এসে বলল, তুই কখন এলি?
সে দাদীমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল, মাত্রই। তোমাকে তো জানিয়েছিলাম আমি আসব। কেমন আছো তুমি?
~ হ্যা ভালো আছি উম্মে। তুই ভাল আছিস?

~ একদম। বলে নিকাব আর বোরকা খুলে নিল। এত সুন্দর মেয়েটি, মনে হল চেহারায় জ্যেতি ঝলকাচ্ছে। মাশা আল্লাহ আল্লাহ তাকে যথেষ্ট রুপ দিয়েছে, হেসে হেসে কথা বলছে, বিহেভ ও অনেক ভালো।
দাদীমাকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদীমা, কে উনি?

~ আমার আরেকটা ভালো নাতনী উম্মে। মেয়েটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
~ দাদীমা, উনি কে? আগে তো কখনো দেখিনি।

কথাটা শুনে দাদীমার মুখ কালো হয়ে গেল। আমি কে সেটা বলতে এত আমতা আমতা করছেন কেন দাদিমা? তক্ষুনি আন্টি এসে উম্মে কে জড়িয়ে ধরে কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। উম্মে এদিক সেদিক উকি মেরে বলল,
~ তোমার দুষ্টু নাতিটা কোথায় দাদীমা?
~ কাজে গেছে একটু, চলে আসবে। তুই যা গিয়ে বিশ্রাম কর।

উনারা উম্মেকে নিয়ে উপরে চলে গেলেন। সন্ধ্যায় আমি ওর রুমে গেলাম ওকে কফি দেওয়ার জন্য। আমাকে দেখে বলল,
~ বসো একটু গল্প করি। তোমার সাথে আলাপ ই তো হল না।

~ আমি মুশায়রা, এই বাড়ীর বউ।
~ কার বউ তুমি?
~ দাদীমার নাতবউ।

এই কথা শুনে উম্মের চোখ-মুখে অবাকতা লক্ষ করলাম। কিছু বলার আগেই শাকি ডেকে বলল, ভাবী তোমার ফোন বাজছে রুমে। অনেকক্ষণ ধরেই বাজছে, গিয়ে দেখো।
~ আমি আসছি একটু। বলে চলে এলাম। মেয়েটা ঠায় অবাক হয়ে বসে রইল।

উনি এসে আজ সোজা রুমে ঢুকলেননা, প্রথমে উম্মের রুমে গেলেন। ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও আমার কাছে কেমন জানি খারাপ লাগল। আমি আসলেই একটু বেশি বেশি ভাবছি। বাসায় মেহমান এসেছে, তারপর উনার আত্মীয়। প্রথমে তো তার সাথেই দেখা করা উচিত। ১মিনিটের মধ্যেই উনি ওখান থেকে বেরিয়ে আসলেন দেখে স্বস্তি পেলাম।

রুমে এসে চুপচাপ বসে রইলেন ব্যালকুনিতে। প্রতিদিনের মত আমাকে জ্বালালেন না, বকবক করলেন না আমার সাথে। তেমন কথাও বলেননি। আমার ভিতরটা কেমন অস্থির লাগল উনার এই অবস্থা দেখে। আমি নিজে থেকে কথা বলতে গেলাম উনার ফোনটা বেজে উঠল।

উনি “১মিনিট আসছি” বলে ফোন নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি চুপচাপ ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে রইলাম। এমনসময় লোডশেডিং হয়ে গেল, অসময়ে এভাবে লোডশেডিং এখন আলো খুজব কি করে?
রুমের দিকে যাব এমন সময় সেই চিরপরিচিত কন্ঠ শুনতে পেলাম ব্যালকুনির অন্ধকার কোণ থেকে।
~ কেমন আছো মুশু?
~ মেহরাব?

~ মনে আছে আমাকে?
~ হ্যা মনে আছে। আপনার এত রাগ কেন? সেদিনের পর আর আমার সামনে এলেন না, আপনি একবারো বুঝলেন না ওইসব আমার রাগে বলা কথা ছিল।

আমাকে ক্ষমা করে দিন, রাগের মাথায় কত কিছু বলে দিয়েছি।
মেহরাব কিছুটা কাছে এসে বলল, তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই মুশু। আমায় ভালোবাসো মুশু?
আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম এই প্রশ্নে। কাপা কাপা কন্ঠে বললাম,
~ মেহরাব আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি এখন বিবাহিত।

সে তার হাত দিয়ে আমার গাল দুটো ধরে বলল,
~ সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসতে পারবেনা মুশু? আমি তোমাকে নিয়ে আমার জগতে চলে যাব। সেখানেই আমরা ঘর বাধব।
~ তা হয়না মেহরাব!
~ কেন হয়না? চল আমার সাথে।

~ কিন্তু
~ তুমিও আমাকে ভালোবাসো আর আমিও তোমাকে তাহলে কিসের এত দ্বিধা মুশু? তুমি তো তাকে স্বামী হিসেবে মেনে নাওনি।

আল্লাহ তুমি আমাকে এ কেমন দ্বিধায় ফেললে? কোনটা বেছে নেব আমি! পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার। মনে হচ্ছে এমন পরিস্থিতি আসার আগে কেন আমি মরে গেলাম না।

পর্ব ১১

আমি মেহরাবের হাতটা আমার হাত থেকে সরিয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে ভুলে যান মেহরাব। আমি এখন অন্যের স্ত্রী, আর আমি তাকেই ভালোবাসি। আমি আপনার সাথে যেতে পারবনা।

দোয়া করে এমন আবদার নিয়ে আমার সামনে আর আসবেননা। আপনি আমার অতীত আর উনি আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যত। আর আপনি অনেক দেরী করে ফেলেছেন, তখন যদি বলতেন আপনি জ্বীন হলেও আমি আপনার হাত ধরতাম সবকিছুর বিনিময়ে। এখন তা আর সম্ভব না। আপনি ফিরে যান।

মেহরাব পিছু হটতে হটতে বলল, আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো মুশু?
আমি চোখের পানি মুছে বলল, হ্যাঁ। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না দোয়া করে। আমি আপনাকে ভুলে গেছি, আমিও চাই আপনিও আমাকে ভুলে যান।

~ ভালো থেকো, আল্লাহ হাফেজ। শুনে মনে হল তাকে পিছু ডাকি, কিন্তু আমার বিবেকে সেটা আটকাল। যেটা চলে গেছে সেটা নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। অতীতকে ভুলে যাওয়াই ভাল। তখনি বিদ্যুৎ চলে এল, রুমের আলো জ্বলে উঠল। আর কিছুক্ষণ মন ভরে কেদে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলাম। উনি তো এখনো এলেন না! কোথায় বের হলেন এই রাতের বেলা। একবার নিচে গিয়ে দেখি বরং। নিচে নেমে আসলাম, কিন্তু কোথাও উনি নেই।

দেখলাম শাকি পানি ভর্তি জগ নিয়ে দাদীমার ঘরের দিকে যাচ্ছে। ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার ভাইয়াকে দেখেছো?”
~ অনেকক্ষণ আগে দেখলাম বাগানের দিকে গেলেন।

~ আচ্ছা ঠিক আছে, দাদীমাকে ওষুধটা খাইয়ে দিও।
বেরিয়ে বাগানের দিকে এলাম। কিছুটা দূরে দেখলাম উনি উলটো দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন। এত রাতে বাগানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন? কোনো কারণে কি উনার মন খারাপ? যাব একবার? না থাক একা থাকুক। বিরক্ত না করাই ভাল। কিছুটা এগিয়ে ফিরে আসব এমন সময় কিছু কথা কানে এল।

কাছের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম উনি একা নয়, উম্মেও আছে উনার সাথে। দুজন দাঁড়িয়ে জোরে জোরে কথা বলছে। কোনো ব্যাপারে কি কথা কাটাকাটি হয়েছে তাদের মাঝে? শুনলাম উম্মে কাদতে কাদতে বলছে, তুমি এটা কি করে করতে পারো আমার সাথে?
~ আমার কিছু করার নেই উম্মে।

~ তাহলে কি এতদিনের সব আশা ব্যর্থ আমার? ৮বছর ধরে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, কিছুদিন পর আমাদের বিয়েও হত। দাদীমাই তো সব ঠিক করে রেখেছিল আমি তার নাতবউ হব। উনিও কি করে তোমার এই কাজটা সমর্থন করল?
~ উম্মে শান্ত হও, আমার কথাটা একটু শুনো।
~ আমাকে ঠকিয়েছো তুমি।

~ না ঠকাইনি তোমাকে। হ্যাঁ এটা ঠিক আমি তোমাকে ভালোবাসতাম, তোমাকে বিয়েও করব বলেছিলাম। কিন্তু এখন আমি মুশায়রাকে বিয়ে করে ফেলেছি। ব্যাপারটা এখন আমার কর্তব্যে সীমাবদ্ধ নেই উম্মে, এখন ওকে আমি ভালোবাসি ও।
~ আমাকে কি ভালোবাসতে না তুমি?

~ বাসতাম, সেটা অতীত। এখন আমার স্ত্রী আছে এটা আমি অস্বীকার করতে পারিনা। আল্লাহর ইচ্ছেতেই আমাদের বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে। এটাই বলব তুমি আমার আশা ছেড়ে দাও উম্মে।
এসব শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে। উনি আর উম্মে একে অপরকে ভালোবাসতেন আর আমি তাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। সেদিন কর্তব্যের খাতিরে উনি আমাকে বিয়ে করে নিজের ভালোবাসাটাকে ত্যাগ করে দিলেন। এত অলক্ষী কেন আমি? যেখানে যাই, কারো না কারো সর্বনাশ করে ছাড়ি।

খুব শব্দ করে কান্না আসছিল। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আবার তাদের কথায় কান দিলাম। উম্মে চোখ মুছে বলল,
~ আসলেই তুমি আমার কপালে ছিলেনা, তাই এমনটা হয়ে গেল। এসব নিয়ে আর কষ্ট পাবনা আমি। কিন্তু তুমি আমাকে এটা বলো জ্বীন হয়ে তুমি একজন মানুষকে কেন বিয়ে করলে?

~ সেটা তোমাকে আগেও বলেছি। আমি কেন জ্বীনজগত ছেড়ে এখানে পড়ে আছি দাদীমাকে নিয়ে! সেই একি কারণে আমি মুশায়রাকে বিয়ে করেছি। এখন আমি চাই বাকি জীবন টা ওর সাথেই কাটাতে।
~ শুধুমাত্র কর্তব্যের খাতিরে মেহরাব?

~ না আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি, আর এটাও জানি ও আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তাই এখন আমাদের ছাড়াছাড়ি কিছুতেই সম্ভব নয়।

আমি এসব শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। উম্মে ওকে জ্বীন বলছে, মেহরাব বলে ডাকছে। তার মানে যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সে আর কেউ নয়, মেহরাব। তাহলে এতদিন কেন ও পরিচয় গোপন রাখল, একটু আগেও তো সে ভালোবাসার দাবী নিয়ে এসেছিল আমাকে নিয়ে যেতে। যদি সে মেহরাব ই হবে তাহলে এত ছলচাতুরি কেন করল! তার কন্ঠটাই বা এতদিন আমার কাছে অচেনা ঠেকল কেন? কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা আমি।
উম্মে মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি যেটা তে সুখে থাকো তাই করো। আমার কাছে তোমার সুখটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

~ আমাকে ভুল বুঝোনা উম্মে।
~ উহু ভুল বুঝিনি। মেহরাব আমার সত্যি গর্ববোধ হচ্ছে তোমার মত একজন নিঃস্বার্থ মানুষকে আমি ভালোবেসেছি। তুমি মুশুকে নিয়ে সুখে থেকো, শুধু বন্ধু হিসেবে আমাকে পাশে রেখো।
~ থাকবে সবসময়।

~ আমি কাল জ্বীনজগতে ফিরে যাব মেহরাব।
~ ফিরে যাবে কেন?
~ ভেবেছিলাম তো তোমাকে বিয়ে করব। সেটা যখন হচ্ছেনা, তবে বাবার পছন্দের জ্বীনকেই বিয়ে করতে হবে। সেখানে ফিরেই বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলব।
~ সুখে থেকো দোয়া করি।

~ তুমিও সুখে থেকো মেহরাব। কখনো যদি মনে হয় আমাকে পাশে পাওয়া দরকার, স্মরণ করো।
আমি ওখান থেকে চলে এলাম। অনেক প্রশ্ন আমার মনে জট বেধে আছে, ওকে সবগুলোর উত্তর দিতে হবে। উত্তর না পাওয়া অব্ধি আমি শান্তি পাচ্ছিনা।
মেহরাব রুমের সামনে আসতেই দাদীমা ওকে ডেকে বলল,
~ উম্মে সব মেনে নিয়েছে তো?
~ হ্যা দাদীমা।

~ এটা নিয়েই আমি ভয়ে ছিলাম। আমি চাইনি মুশুর মত এত ভাল মেয়েটার সংসারে অশান্তি হোক। যাক সব ভালোই ভালোই মিটেছে এটাই আমার শান্তি। তুই ও আর দেরী করিসনা নিজেদের দূরত্বটা কাটিয়ে ফেল। সব সত্যিটা ওকে বলে দে।

~ সবটা বলতে পারব কিনা জানিনা। তবে যেটা বলা প্রয়োজন সেটা বলব।
~ কিন্তু
~ সবটা বলার সময় এখনো আসেনি দাদীমা। তুমি চিন্তা করোনা, বিশ্রাম নাও।
উম্মের কাছে যাও, ওকে ভালো করে বুঝাও যাতে আমাকে ভুল না বুঝে। এসব নিয়ে কষ্ট না পায়।
~ আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।

মেহরাব এসে রুমে ঢুকল। আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে কপালে হাত দিয়ে বলল,
~ শরীর খারাপ নাকি বউ?
~ না ঠিক আছি। কোথায় ছিলেন আপনি?

~ উম্মের সাথে কথা বলছিলাম। সারাদিনে কথা হয়নি তো তাই।
~ হুম। মেয়েটা অনেক ভালো।
~ হ্যা। বউ আমি যদি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই!
~ হ্যা বলুন কি বলবেন?

~ তুমি তো একটা জ্বীনকে ভালোবাসতে, যে সবসময় তোমার পাশে থাকত, তোমাকে আগলে রাখত
~ হ্যা, কিন্তু ওর কথা আর বলবেন না। ওকে তো আমি ভুলে গেছি, তাকে তো আমি না করে দিয়েছি আপনার কথা ভেবে।

~ এখন যদি জানতে পারো সে আর আমি আলাদা কেউ নই, একজন ই। তবে তুমি কি করবে?
~ তাহলে তুমি সত্যিই মেহরাব?

~ হ্যা বউ। আমি ই তোমার মেহরাব।
~ যদি মেহরাব হও তবে তোমার কাছে আমার অনেক প্রশ্ন আছে।
~ আমি সব প্রশ্নের ই উত্তর দিতে প্রস্তুত।

~ তুমি এতদিন কেন জানাওনি? আর তোমাদের কন্ঠ আলাদা হয় কি করে?
কিছুক্ষণ আগে কেন বা বললে তোমার সাথে চলে যাওয়ার কথা?

আমার উপর তোমার কিসের কর্তব্য রয়েছে যার জন্য তুমি তোমার ৮বছরের ভালোবাসা ত্যাগ করে দিলে?
মেহরাব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি সব শুনে নিয়েছো?
~ হ্যা শুনেছি। এখন উত্তর দাও।

~ বেশ, শুনো। এতদিন নিজেকে আমি প্রকাশ করিনি, কারণ তোমাকে আমি সময় দিয়েছিলাম তোমাকে মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার জন্য। হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় তুমি অনেক ডিপ্রেশড হয়ে গিয়েছিলে, তার উপর তুমি আমার উপর খুব রেগে ছিলে। আমি জ্বীন, আমি কন্ঠ আর রুপ দুটোই পরিবর্তন করতে পারি।

আমি চাইনি তুমি অত তাড়াতাড়ি আমার সত্যিটা জেনে ফেলো তাই কন্ঠ পরিবর্তন করেছি। উম্মের সাথে আমার সম্পর্ক শেষ করার আগে আমার এটা জানা প্রয়োজন ছিল তুমি কাকে চাও? আর আমাকে ভালোবেসে আমার সাথে সংসার করতে চাও কিনা? এটা সিউর হওয়ার জন্যই এসব করা।

তারপর মেহরাব আমার গাল দুহাতে জড়িয়ে বলল,
~ অতীতে কি ছিল সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তুমি আমার বিবাহিত স্ত্রী, তোমার উপর আমার স্বামী হিসেবে কর্তব্য আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবাসি। সেদিন থেকে ভালোবেসে ফেলেছি।

মেহরাবের কন্ঠে বলল, মুশু আমি কিচ্ছু চাইনা, শুধু চাই বাকিজীবন টা তোমার সাথে তোমাকে ভালোবেসে কাটাতে।
আমি উনাকে জাপটে ধরে বললাম, আমিও আপনাকে খুব ভালোবাসি।

পর্ব ১২

মেহরাব আলতো করে কপালে চুমু খেয়ে বলল, এভাবেই থেকো আমার সাথে। কখনো ছেড়ে যেও না বউ। তাহলে বড্ড একা হয়ে যাব।

আমি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, উহু। কখনোই যাবনা। এত্তগুলা ভালোবাসি তোমায়।
~ আমিও এত্তগুলা ভালোবাসি। অযু করে এসো একসাথে নামায পড়ব। এতদিন যেদিনটার অপেক্ষা করেছি, সেদিনটা এসে গেছে বউ।

আমি লজ্জামাখা মুখে আচ্ছা বলে অযু করে এলাম। একসাথে নামায পড়লাম, এটা এত সুন্দর অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবনা। নামায পড়া শেষে উনার পা ধরে সালাম করলাম, উনি মুচকি হেসে আরেকটা চুমু দিয়ে কোলে তুলেন আমায়। আমি উনার শার্ট আকড়ে ধরে বললাম,
~ কি করছেন কি! নামান আমায়। পড়ে যাব তো।

~ উহু পড়বেনা। কোলে করে ব্যালকুনিতে নিয়ে এসে দোলনায় বসালেন। আস্তে আস্তে দোল দিতে দিতে বললেন, বউ
~ হুম।
~ তোমার জন্য একটা উপহার রেখেছিলাম বাসররাতে দিব বলে। সেদিন আর দিতে পারিনি, আজ দিব।
~ কি উপহার?

~ তুমি চোখ বুজে বসো। আমি রুম থেকে নিয়ে আসছি। না বলা অব্ধি তাকাবেনা। আমিও বাধ্য মেয়ের মত চোখ অফ করে বসে রইলাম। উনি এসে মাথার উপর কি যেন জড়িয়ে দিলেন। চোখ খুলে দেখলাম একটা টকটকে লাল শাড়ি, গলায় একটা হার পড়িয়ে দিলেন তাতে একটা অক্ষর ছিল ‘ M’
আমি অবাক হয়ে বললাম, এতকিছু?

~ সামান্য ই। এসো তোমায় মেহেদী পরিয়ে দেই।
~ পরাতে পারবেন?

~ বউয়ের জন্য এইটুকু পারব না? উনি মেহেদী পরিয়ে দিলেন আমি অবাকচোখে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা জ্বীন এত পাগলামী করতে পারে জানা ছিলনা। এরপর বলে শাড়িটা পরে এসো। শাড়ি জড়ালাম কিন্তু মেহেদীর জন্য কুচি করতে পারছিলামনা। উনি এসে ভাজে ভাজে কুচি করে দিলেন।

আয়নার সামনে বসিয়ে চুলে খোপা করে দিলেন তাতে আবার ফুল গুজে দিলেন। চোখে কাজল পরিয়ে দিলেন। শাড়ির আচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা চড়িয়ে দিয়ে বললেন, এবার একদম বউ বউ লাগছে। আমি লজ্জায় উনার বুকে মুখ গুজলাম। জ্যোৎস্না ভরা চাদের দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ দেখুন আজকের চাদটা কত সুন্দর।

~ আমার বউয়ের থেকে বেশী নয়। লজ্জামাখা চোখে উনার চোখের দিকে তাকালাম। সেখানে আমার জন্য হাজারো অনুভূতি আর ভালোবাসা দেখয়ে পেলাম। এই প্রথম বুঝতে পারলাম জ্বীনরা ক্ষতি করতে নয়, ভালোবাসতে জানে। মানুষের চেয়ে বেশী ভালোবাসা আর পবিত্রতা তাদের মনে আছে। এমন একটা জ্বীনবর পেয়ে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। মুখে বলেই ফেললাম, জ্বীনবর, প্রচন্ড ভালোবাসি তোমায়।

পরেরদিন গুলো আমার এত আনন্দে কেটে গেল, মনেই হল না দুঃখ নামক বস্তু আমার জীবনে আছে। এত ভালোবাসে জ্বীনবরটা আমায়! আমার চোখেমুখে সবচেয়ে সুখী বউয়ের ছাপ লেগে থাকে। সারাটাদিন খুনসুটি, একসাথে নামায পড়া, আমাকে রান্না শিখিয়ে দেওয়া, মাঝে মাঝে ছোটছোট সারপ্রাইজ, ঘুরতে যাওয়া,রাত হলেই তার বুকে মাথা রেখে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়া সবমিলিয়ে জ্বীনবর আর আমার সংসার।

এর মাঝে ফুপি একবার এসে দেখে গেলেন আমাকে। এত সুখী দেখে হয়ত চোখে-মুখে একটু হিংসে ভাব জেগে ছিল। সীমা খুশি হয়ে বলেছিল, ” মুশু তুই সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী, ভাগ্য করে একটা হীরে পেয়েছিস। আগলে রাখিস, হারিয়ে যাতে না যায় তোর অবচেতনে।”

এর মধ্যে দাদীমা মারা যায় অদ্ভুতভাবে। কেউ যেন তাকে অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে মেরে ফেলেছে। আমরা দুইজন খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম, তাও ও অনেক শক্ত ছিল। আমাকে খুব আগলে আগলে রাখত, একা ছাড়ত না বেশিক্ষণের জন্য।
ভাবলাম, “অতি আপনজনকে এভাবে হারিয়ে, ওর মধ্যে ভয়টা ঝেকে বসেছে। তাই ও আমাকে নিয়েও ভয় পাচ্ছে। আমি ওকে যথেষ্ট বোঝার চেষ্টা করতাম।

সেদিন রাতে মেহরাব বাসায় ছিলনা, আমি রুমে বসে হাদিসের বই পড়ছিলাম। হঠাৎ নিচ থেকে ধুপধাপ শব্দ আসতে লাগল। ভয় পেয়ে গেলাম একটু, নিচে তো শাকি রা আর আন্টি আছেন। কি হল তাদের আবার?
বইটা রেখে নিচে আসলাম। আন্টির ঘরের সামনে আসতে দেখি দরজা হাট করে খোলা।

আস্তে আস্তে রুমে ভিতরে ঢুকে যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা। একটা কালো লোমশ ভয়ানক প্রাণী আন্টির পেটে তার বড় বড় চোখ ঢুকিয়ে পেটের সব বের করে আনছে। আন্টি চিৎকার চিৎকার করতে চুপ হয়ে গেলেন, আমি এই অবস্থা দেখে জোরে চিৎকার করে উঠলাম।

প্রাণীটি শরীর না ঘুরিয়ে শুধু মাথাটা ঘুরিয়ে লাল লাল চোখে আমার দিকে তাকায়। তার সারা মুখে রক্তমাখা। মুচকি হেসে আমাকে ধরার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে লম্বা করে।

এসবদেখে আমি স্থির থাকতে পারলামনা দৌড়ে রুমে এসে দরজা লক করে ওয়াশরুমে চলে এলাম। চোখের সামনে পুরো ঘটনাটা যেন ভাসছে। আর সহ্য হলনা, বমি করে দিলাম। ফ্রেশ হওয়ার পর যেন শক্তি পাচ্ছিলামনা উঠে দাড়ানোর। তাও রুমে আসলাম এমনসময় দরজা জোরে জোরে ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। এতজোরে ধাক্কাচ্ছে মনে হচ্ছে ভেঙ্গে ই যাবে।

জোরে জোরে আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলাম।
কয়েকবার পড়ার পর দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়ে গেল। কিছুটা সাহস ভর করে দরজা খুলে দেখতে যাব, অল্প খুলতেই প্রাণীটির ভয়াবহ চিৎকার শুনলাম। সাথে সাথে আবার লক করে বিছানার উপর গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম। মেহরাব যে কোথায়? আমার ভীষণ ভয় করছে।

বাবা বলেছিলে কখনো বিপদে পড়লে সুরা তিলওয়াত করতে। মনে মনে যত সুরা পারি সব পড়লাম, আল্লাহকে ডাকছিলাম। তখনো কিন্তু দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়নি। হঠাৎ দরজার বাহিরে ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনলাম। মনে হল খুলে দেখি, কিন্তু দ্বিতীয়বারের মত সাহসটা পেলামনা। প্রায় কিছুক্ষণ পর মেহরাবের গলা পেলাম,
~ মুশু দরজা খুলো।

তাড়াতাড়ি নেমে দরজা খুলতে যাব, তখন আরেকটা আওয়াজ এল,
~ বউ আমি না বলা অব্ধি দরজা খুলবেনা। থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম, আবার আওয়াজ, মুশু দরজা খুলো, ওটা নাহলে আমাকে মেরে ফেলবে। আমার কন্ঠে নকল করে সে তোমাকে বাধা দিচ্ছে। মুশু বাচাও আমাকে।
~ বউ, ওর কথায় ভুলোনা। যতক্ষণ না ফজরের আযান পড়ছে, তুমি ঘর থেকে বের হবেনাম এটা তোমার স্বামীর আদেশ।

দরজা না খুলে জায়নামাজ বিছিয়ে সেজদা দিয়ে লম্বা মোনাজাত ধরলাম। আমি বুঝে গেছি কে আসল আর কে নকল। বিয়ের পর থেকে মেহরাব আমাকে কখনোই মুশু বলে ডাকত না, এটাও আমি জানি ওর জীবন যত বিপন্ন হোক ও আমাকে ওকে বাচাতে বলবে না। অপেক্ষা শেষ হল, ফজরের আযান দিয়ে দিল। নামায শেষ করে দরজা খুলতে গেলাম। ভয় আর দুশ্চিন্তায় সারা রাত কেদেছি, আমার মেহরাবের কিছু হয়ে যায়নি তো।

দরজা খুলে দেখলাম, ও মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কপাল আর মুখে আচড়ের দাগ। নিশ্চয়ই ধস্তাধস্তিটা ওর সাথেই হয়েছিল। সেদিন রাতেও তবে এই প্রাণীটির সাথে মেহরাবের সংঘর্ষ হয়েছিল। অনেক কষ্টে ও উঠিয়ে বিছানায় শোয়ালাম। প্রাথমিক চিকিৎসা দিলাম, আমার ভাবনা হতে লাগল এত কিছু হয়ে গেল শাকি বা বাকি মেয়েগুলোর কোনো সাড়াশব্দ পেলামনা কেন?

তার মানে কি ওদেরকেও! আল্লাহ কে এ শত্রু যে আমাদের সুখের জীবনে অভিশাপ লাগাতে এসেছে। প্রায় কিছুক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরল। খুব কষ্ট পাচ্ছিল ও। আমি ওকে জড়িয়ে ধরল। ও আমাকে শান্ত্বনা দিতে লাগল এই বলে যে, আমার কিছু হয়নি বউ। কেদোনা।
~ কে ওই প্রাণীটি? এভাবে কেন আঘাত করছে আমাদেরকে?

~ বউ ভয় পেয়োনাহ। কিচ্ছু হবেনা, আমার খুব বড় ভুল হয়ে গেছে তোমাকে একা রেখে গিয়ে। আর কখনো তোমায় একা ছাড়বনা।
~ আমরা আর এখানে থাকবনা মেহরাব।
~ কোথায় যাবে?

~ আমার বাবার কাছে যাব।
~ এটা হয়না বউ।
~ কেন হয়না? আমি এত বুঝি বুঝতে চাইনা মেহরাব। আপনি আমার সাথে বাবার বাড়ীতে যাবেন। নতুবা আমি কিন্তু কিছু করে বসব।

মেহরাব অনেক পীড়াপীড়ি তে হ্যা বলতে বাধ্য হল। সব গুছিয়ে আমরা বিকেলের দিকে বের হলাম। গাড়িতে উঠে টলমল চোখে বাড়ীটাকে দেখতে লাগলাম। এই বাড়ীতে এতদিন সুখে সংসার করলাম, এই বাড়ীটাই ছেড়ে যেতে হচ্ছে। সবার কথা খুব মনে পড়ছে। চোখের পানি মুছে নিলাম পড়ার আগেই। মেহরাব দেখলে কষ্ট পাবে, ওকে আমি কষ্টে রাখতে চাইনা।

অনেকদিন পর নিজের বাড়ীতে পা রাখলাম, যে বাড়ী থেকে একদিন রাতের আঁধারে পালিয়েছিলাম। আমি একটা জ্বীনকে বিয়ে করেছি বাবা জানলে জানিনা কি হবে! কিন্তু মেহরাবকে দেখলে বাবা মানতে বাধ্য, ও যে অনেক ভাল।

দরজা নক করতেই চাচ্চু দরজা খুলল। আমি সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরল, আমাকে দেখে খুব খুশি হল চাচ্চু। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
~ এতদিন কোথায় ছিলাম?

~ চাচ্চু আমি বিয়ে করে ফেলেছি। শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম।
~ বলিস কি! এত খুব খুশির সংবাদ। জামাই কই আমাদের?
~ আসছে, গাড়ি থেকে লাগেজ নামাচ্ছে।

~ আয় জামাই নিয়ে আগে ভেতরে আয়। তারপর বাকি কথা হবে।
~ তুমি যাও, আমি উনাকে নিয়ে আসছি।

মেহরাব লাগেজ নিয়ে চলে আসল একটু পর। আমি বাসা দেখিয়ে বললাম,
~ এটা তোমার শ্বশুড়বাড়ি। এসো ভেতরে এসো। বাবা একটু রাগী, তবে খুব ভাল। জ্বীন বিয়ে করেছি জানলে হয়ত একটু রাগ করবে। সমস্যা নেই চাচ্চু আছে। বাবাকে মানিয়ে নিতে পারবে। এসো ভেতরে এসো।

আমি ভেতরে ঢুকার পরো দেখলাম উনি বাহিরে দাঁড়িয়ে কি যেন চিন্তা করছে। ভেতরে ঢুকতে ইতস্তত বোধ করছিল। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
~ কি হয়েছে?

~ কিছু না তো। আমি হাত টেনে ভেতরে নিয়ে আসলাম। চাচ্চু ওকে দেখে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমাকে দূরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
~ তুই কাকে বিয়ে করেছিস?

পর্ব ১৩

আমি অবাক হয়ে চাচ্চুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চাচ্চু কি বুঝে ফেলল মেহরাব যে জ্বীন। সাধারণ দৃষ্টিতে কারোর ই মেহরাবকে জ্বীন মনে হওয়ার কথা নয়। তার নূরানী আর মায়াবী চেহারাটা আট-দশটা মানুষের মতই।

চাচ্চুর বুঝে ফেলাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেননা বাবার মত চাচ্চু ও একজন আলেম, খুব সুন্দর ওয়াজ করেন। তবে তার চেয়ে বাবার জনপ্রিয়তা ই বেশি ছিল। বাবাকে সবাই খুব সম্মান করত। বলতে দ্বিধা হচ্ছে তাও বলাটা দরকার। কেননা, চাচ্চু ছাড়া কেউ বাবাকে মানাতে পারবেনা। ছোটভাইকে বাবা অসম্ভব ভালোবাসেন।

আমি হেসে বললাম,
~ চাচ্চু উনিই আমার স্বামী। ফুপিই আমাদের বিয়ে দিয়েছিলেন মাসখানেক আগে। তার পরিবারে দাদীমা ছাড়া কেউ ছিলনা, কিছুদিন আগে তিনিও মৃত্যুবরণ করেছেন। এমন সময় চাচীমা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এতদিন কোথায় ছিলি মুশু?

~ কেদোনা চাচীমা, আমি ফুপির কাছে ছিলাম। সেখান থেকে বিয়ে করে শ্বশুড়বাড়িতে। তোমাদের জামাইয়ের সাথে এলাম বাবাকে দেখতে!
~ বিয়ে করে নিলি আর আমাকে একবারো জানালিনা!
~ সবকিছু হুট করেই হয়ে গেল চাচীমা।

~ আমাদের জামাই কই?
~ রুমে একা বসে আছে, যাও দেখা করে এসো।

~ মুশুর জামাই এসেছে!!😍 হ্যা দেখবোই তো তার আগে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করি। হ্যাঁ গো, আপনি যান জামাইয়ের কাছে। এই প্রথমবার এলো, একটু অস্বস্তি বোধ করবে। আর ভালো করে আপ্যায়ন ও তো করতে হবে।

~ আমি যাচ্ছি, তুমি যাও সালেহা। চাচীমার কোনো সন্তানাদি নেই। মা মারা যাওয়ার পর আমাকে আর শিরিন কে চাচীমাই দেখাশুনা করত। বাবার বকার হাত থেকে বাচাতে চাচীমা সবসময় এক পা এগিয়ে থাকত। মায়ের শূন্যতা উনি বুঝতে দেননি কখনো। নিজের মেয়ের মত আগলে রেখেছেন সবসময়।
~ চাচীমা, শুনো।

~ হ্যা বল মা
~ বাবা কোথায় গো? অনেকক্ষণ হল এসেছি, দেখতে পেলামনা তো। কোথাও বেরিয়েছেন নাকি? বাবা তো নামায পড়েই ফিরে সবসময়। মাগরিবের আযান তো কত আগে দিয়ে দিল। চাচীমা ব্যস্ততা দেখিয়ে গলার সুর ক্ষীণ বলল,
~ হ্যা আছে। তুই জামাইয়ের কাছে যা, আমি আসছি।

আমার মাথায় টেনশন ঘুরছে, বাবা এখনো কেন আসছেন না? এসে মেহরাবের বিস্তারিত জানতে পারলে জানিনা কি হবে। এর আগেই চাচ্চুকে ম্যানেজ করতে হবে। চাচ্চুর হাত ধরে বললাম, চাচ্চু তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।

~ হ্যা বল।
~ তুমি বাবাকে এটা নিয়ে ম্যানেজ করে নিও প্লীজ। হয়ত বাবা এটা নিয়ে রাগ করতে পারে।
~ কি ব্যাপার বল!
~ আমার স্বামী মেহরাব একজন জ্বীন। আমি জ্বীনকে বিয়ে করে ফেলেছি। বাবা জানলে জানিনা ব্যাপারটা কেমন ভাবে নিবে! তুমি একটু ম্যানেজ করে নিও প্লীজ। তুমি দ্বিমত করোনা অন্তত, তাহলে বাবাকে আমি কিছুতেই মানাতে পারবনা।

~ তুই মেহরাবকে বিয়ে করেছিস? চাচ্চু অবাক হয়ে আমাকে প্রশ্ন টা করল।
খানিকবাদে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে বলল, মুশু তোকে একটা কথা বলিনি। ভাবলাম বলবনা, কিন্তু এখন না বলে উপায় ও নেই। তোর বাবা আর নেই মুশু।

শুনে আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। চাচ্চু এসব কি বলছে! আমার বাবা সত্যিই আর নেই!
~ মুশু, তুই পালিয়ে যাওয়ার পরই তোর বাবাকে কেউ নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এতটাই বিভৎসভাবে মেরেছে যা কোনো সুস্থ ভাবে করতে পারেনা। আমি আর চুপ থাকতে পারলামনা। বোবা চোখ-মুখ টা কঠিনতা কাটিয়ে জোরে কান্নার রোল উঠাল। আমি এত আশা নিয়ে এই বাড়ীতে এসেছি বাবাকে দেখার জন্য, সেই দেখার সুযোগটাও পেলামনা।

~ চাচ্চু, কে করল এমন কাজটা? আমড় ফেরেশতার মত বাবাকে কে মারল! বাবা কার কি ক্ষতি করেছিল যে আমার কাছ থেকে আমার শেষ আপনজনকেও কেড়ে নিল। কিভাবে হলো এসব চাচ্চু? কে এতবড় সর্বনাশ করল আমার! বলোনা চাচ্চু।

~ তোর জ্বীনবর মেহরাব। শুনে আমার কান কে বিশ্বাস করতে পারলামনা। কিসব বলছে চাচ্চু!
~ চাচ্চু তুমি এসব কি বলছো? আমার স্বামী এমন কাজ করতে পারেনা। উনি তো বাবাকে চিনেও না, কখনো দেখেওনি। উনি কেন মারবে? উনার সাথে বাবার কি শত্রুতা থাকবে! এমন অপবাদ দিওনা চাচ্চু।
চাচ্চু কাদতে কাদতে বললেন,
~ মুশুমা, এটাই সত্যি।

পুরোটা শুনলেই তুই বুঝতে পারবি মেহরাব আসলেই তোর বাবার খুনি কিনা!
চাচ্চু একটু থেমে চোখটা মুছে নিয়ে আবার বলতে লাগল,
~ মেহরাব তোকে অনেক আগেই পছন্দ করেছিল। ওর কু-নজর পড়েছিল তোর উপর। তখন ও ভাইয়ের কাছে তোকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ভাই সেটা সোজা না করে ওকে বের করে দেয় এবং শাসায় তোর আশেপাশে যেন ও না আসে। কারণ, ভাই জেনেছিল মেহরাব বদজ্বীনের সর্দার।

ও তোকে যেমনটা দেখায় ও তেমন নয়। মানুষের ক্ষতিসাধন করাই ওর কাজ। জ্বীনরাজ্য দখলের জন্য অনেকবার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিল,এর জন্য সে জ্বীনজগত থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। তখন সে ঠিক করে মানুষের মধ্যে বিশৃঙখলা সৃষ্টি করে জ্বীনজগতকে অস্থিরতায় ভরিয়ে তুলে সেটা নিজের আয়ত্বে আনবে।
এই জন্য সে মানুষবেশে দাদীকে নিয়ে এখানে পড়ে আছে। সে নাকি উম্মে নামক জ্বীন এর সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত ছিল।

সেইদিনের ঘটনায় মেহরাব প্রচন্ড অপমানবোধ করে। একে একে তোর মা আর তোর বোন শিরিন করে হত্যা করে। তাদের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিলনা মুশু। এতকিছুর পরও ভাই তার সিদ্ধান্ত এ অনড় থাকায় সে হুমকি দেয় তোর ক্ষতি করবে।কিছু মনে পড়ে কিনা দেখ?
চোখের সামনে সেইরাতের কাহিনী ভেসে উঠল। রাতের বেলা বাবা তার রুমে এসেছিল কাদতে কাদতে। এসে বলেছিল, মুশু তুই পালিয়ে যা এখান থেকে।

~ বাবা তুমি কাদছো কেন? আর কেন পালাব আমি!
~ তুই সবার চোখের আড়ালে এক্ষুণি পালাবি। ব্যাগ গুছিয়ে নে।
~ বাবা কি বলছো এসব? পালাব কেন তোমাকে ছেড়ে!
~ আমাকে ছেড়েই পালাবি। আমার কসম রইল আর কোনো প্রশ্ন না করে আমি যা বলি তাই করবি। ব্যাগ গুছিয়ে নে, এক্ষুনি বের হতে হবে।

~ পালিয়ে কোথায় যাব বাবা?
~ আমি তোকে একটা ঠিকানা দিচ্ছি সেখানে গিয়ে আমার নাম বলবি। আর সেখানেই থাকবি। আমি যতদিন না বলব তুই এখানে ফিরবিনা।

সেদিন রাতে সবার আড়ালে বাবা আমাকে বাসে তুলে দেয়। বাস ছাড়া অবধি সারাটা সময় বাবা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছিল। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগমূহুর্তে আমাকে বলছিল,
~ মুশু জানিনা মা তোর সাথে আমার আর দেখা হবে কিনা! তবে তুই ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস। আল্লাহর কাছে দোয়া করি উনি যেন তোকে যোগ্য স্থানে হেফাজতে রাখেন।

বাবার কথাগুলা বুকের তীরের মত বিধে ছিল। সারাটা পথ কেদেছিলাম। কসমের কারণে চুপচাপ কোনো প্রশ্ন না করে অজানায় পাড়ি দিয়েছিলাম।

সবাই জানবে আমি পালিয়ে গেছি কিন্তু সেই আমিই জানিনা আমার পালিয়ে যাওয়ার কারণটা কি!
মনে পড়তেই বুক টা ফেটে যাচ্ছিল। তবে কি সত্যিই মেহরাব আমার বাবাকে হত্যা করেছে! তা না হলে চাচ্চুর ওর ব্যাপারে এত কিছু কি করে জানবে? পালিয়ে যাওয়ার পরই কিন্তু ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল।

সব হিসাব মিলে যাচ্ছে, জটগুলো ও খুলে যাচ্ছে। চাচ্চু আমার নীরবতা দেখে বলল,
~ তুই পালিয়ে গিয়েছিস শুনে ও তোর বাবাকে মেরে গেলে। ও বুঝে গেছে এর পিছনে তোর বাবা ছিল। এই হাতে ভআইকে কবরে নামাতে হয়েছিল আমার।

এর থেকে কষ্টের কি হতে পারে বল! আর তুই সেই খুনিকেই বিয়ে করলি মুশু। আমার কান্নাটা রাগে পরিণতি হল। এমন জানলে আমি কখনোই মেহরাবকে পাশে জায়গা দিতামনা। এত নীচ ও! নিজের উপর ই ঘৃনা হচ্ছে এখন।
~ এসব ভুলে যাওয়াই ভাল মুশু। বিয়ে হয়ে গেছে, ও এখন আমাদের জামাই। অতীতে যা হয়েছে সব ভুলে সুখে সংসার কর তোরা।

~ একজন খুনির সাথে সংসার আমি কখনোই করবনা। এই মূহুর্তে ওর সাথে সব বিচ্ছেদ করব আমি। এমন কাউকে আমার জীবনে চাইনা।
আর একমূহুর্ত না দাঁড়িয়ে আমি মেহরাবের কাছে চলে গেলাম।

পর্ব ১৪

রুমে গিয়ে দেখি ও জানালায় মুখ রেখে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে দাড়াতেই দেখি ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে, কিছু একটা নিয়ে ভীত। আমি ডাকলাম, “মেহরাব!” ও চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। ওর ফ্যাকাশে মুখটা আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে কাপা কন্ঠে বলল,
~ এতক্ষণ কোথায় ছিলে বউ?

এই কথা শুনে আমার রাগ আরো বেড়ে যাচ্ছে। এতকিছু করার পরও ও কিভাবে আমাকে বউ বলে ডাকছে, এমন ভাব করে আছে মনে হচ্ছে ওর চেয়ে নিষ্পাপ কেউ নেই আর। আমি সোজা ওর শার্টের কলার টেনে ওকে উঠিয়ে কাছে টেনে আনলাম। ও পুরো ব্যাপারটায় অবাক হয়ে গেল। বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকাল।

আমি আরো শক্ত করে কলার চেপে ধরে বললাম,
তোর কি ক্ষতি করেছিল আমার পরিবার? এভাবে কেন আমার পরিবারটাকে শেষ করে দিলি? তুই তো আমাকে চেয়েছিস তাইনা! আমাকে বলতে পারতি, আমি তোর নোংরা লালসা মিটাতাম। তুই আমার পরিবারকে কেন মারলি?

ও চমকে উঠে বলল, এসব তুমি বলছো বউ? আমি চোখ রাঙ্গিয়ে বললাম,
~ একদম চুপ, কোন অধিকারে আমাকে বউ ডাকিস? আমি তোর বউ না, একজন খুনির বউ আমি কিছুতেই হতে পারিনা। কাদতে কাদতে বললাম,
~ আমার মা-বাবা, বোন তোর ক্ষতি করেছিল রে?

তুই তো জ্বীন, তুই ই তো আমাকে বুঝিয়েছিস তোদের ভালোবাসা পবিত্র, তোরা মানুষের ক্ষতি করতে পারিসনা। কিন্তু কাজে কি প্রমাণ দিলি? নৃশংস ভাবে আমার পরিবারের সবাইকে মেরে দিলি! পরে এসেছিলি আমাকে ভালোবাসতে?

সবটাই তোর নাটক ছিল শুধু আমাকে আয়ত্বে আনার জন্য। তোর তো অবৈধ সম্পর্ক ছিল উম্মের সাথে। সেই সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তুই আমাকে বিয়ে করেছিস, ভালোবাসা দেখিয়েছিস। কেন করলি এসব?

কিসের এত চাওয়া তোর!
~ বউ আমার কথা শুনো আমি হুংকার ছেড়ে বললাম,
~ উহু, ওই নামে আমাকে ডাকবিনা। তুই আমার স্বামী নস, আমার পরিবারের খুনী। একটা বদজ্বীন, উহু শুধু বদজ্বীন তো না তুই তো বদজ্বীনের সর্দার। তোর সব সত্যি আমি জেনে গেছি, আর আমার কাছে ভালো সাজতে আসিসনা।

ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম আমি। বেডের সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে গেল ও। ব্যথা পেয়েছে, তাও উঠে দাড়াল। আমি চোখ মুছে বললাম,
~ তুই এই মূহুর্তে আমাকে তালাক দিবি।

এরপর থেকে আর কখনো আমার জীবনে ফেরার চেষ্টা করবিনা। যদি পারিস আমাকেও মেরে ফেল, যদি পারিস কি? তুই তো সব পারিস। তোর মনে খারাপ ছাড়া ভালো কি আছে!
তালাক দিয়ে এই বাড়ির ত্রিসীমানা ছেড়ে চলে যা
কি হল? তাকিয়ে দেখছিস কি! তালাক দে।

ও কিছু বলতে চেয়েও আবার চুপ করে গেল। এই কাদো কাদো চেহারাটা দেখে বড্ড মায়া লাগছে। এমন চেহারার মানুষ কি করে এতটা নীচ হতে পারে।

ও মাথা নিচু করে বলল, আমি তালাক দিতে পারবনা বউ। তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। আমি দরজা খুলে দিয়ে বললাম,
~ বেরিয়ে যান। ও কান্নামাখা চোখে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল।

~ কি হল? বের হয়ে যেতে বলছি।
ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি চাচ্চুকে ডাক দিতেই চাচ্চু চলে এল।
~ চাচ্চু তুমি উনাকে চলে যেতে বল। আমি আর নিতে পারছিনা।

বলে ওখান থেকে চলে এলাম। পিছন থেকে ও কতবার বউ বলে ডাকল ফিরেও তাকালামনা। আর এই মায়ায় জড়িয়ে ফেলতে চাইনা নিজেকে। জানালা দিয়ে একবার বাহিরের দিকে তাকালাম চাচ্চু ওর কলার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে ও বাসার দিকেই তাকিয়ে আছে অপলক। আমার কপালটা কেন এমন?
রাত্রে চাচীমা আমার রুমে আসলেন খাবার নিয়ে। এসে আমাকে বলল, মুশু আসার পর থেকে তো কিছুই খেলিনা। এভাবে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বি। একটু কিছু খেয়ে নে।

~ আমার ইচ্ছে করছে না চাচীমা।
~ দেখ মুশু যা হওয়ার তো হয়ে গেছে, সেটা নিয়ে ভেবে নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস? সব ভুলে যা মা। এই বিয়েটা তোর জন্য ভালো ছিলনা।

চাচীমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, মেয়েদের জীবনে বিয়ে একবার আসে চাচীমা।আমার ক্ষেত্রে ও তাই। আমি তো কোনো দোষ করিনি তাহলে আমার সাথে কেন এমন হল! ফুপির অকথ্য অসহনীয় কথার চাপে পড়ে সীমার জন্য বিয়েটা করেছিলাম, সব তো ঠিকই চলছিল। ছোট্ট একটা সংসার করেছিলাম ওর সাথে।

এত ভালোবাসত মেহরাব আমায় কখনো মনে হয়নি ও খারাপ হতে পারে! আমার সাথে ছলনা করতে পারে। সবসময় আমাকে আগলে আগলে রাখত, নিজের সবটুকু দিয়ে ওকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু শেষে কিনা জানলাম সেই ই আমার পরিবারের সবাইকে খুন করেছে।

চাচীমা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে, আমারো মনে হয়না ছেলেটা এমন।

এমন সময় চাচ্চু রুমে ঢুকল। চাচীমা আমাকে ছেড়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়ল। চাচ্চু উনার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখে কি সবাই কে চেনা যায় কার ভেতর কি রয়েছে? আমার মেয়েটার জীবনটা শেষ করে দিল, আর তুমি ওকে এসব বলছো? মেয়েটার শোক কাটানোর চেষ্টা না করে তার মন বিক্ষিপ্ত করছো।
~ আমি তো এমনিই বললাম।

~ তোমার আর কিছু বলা লাগবেনা। এসব কথা আর মুশায়রা মায়ের সামনে বলবেনা। মুশু ছেলেটা ভালো ছিলনা, তার জন্য তুই নিজেকে কষ্ট দিসনা। ভুলে যা ওর কথা। জ্বীনের সাথে কখনো মানুষের মিল হয় বল?
ওরা মানুষের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু করতে পারেনা। নে মা খেয়ে নে।
সালেহা তুমি ওর খেয়াল রাখো ঠিকমত।

এসব বলে চাচ্চু চলে গেল। আজ চাচ্চুর ব্যবহারে অনেকটা রুক্ষতা পেলাম। বাবার খুনি কে পেয়ে চাচ্চু বেশিই রেগে গেছে। মেহরাব কোথায় এখন? ও ও তো সারাদিন কিছু খায়নি। কোথায় চলে গেল? খেয়েছে কিনা সেটাও জানিনাহ।

সারারাত ছটফট করলাম ঘুম আসলোনা। দিন দিন শরীরটাও খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।
আজ অনেকদিন পর বাবার রুমে ঢুকলাম। আগের মতই আছে সবকিছু, শুধু মানুষটাই নেই। কিছুটা ধুলো পড়েছে রুমে, চাচীমা আর একা কত করবেন! আমিই ভাবলাম পরিষ্কার করে দেই। বাবা একটুও অপরিষ্কার পছন্দ করতেননা। সবসময় আমিই বাবার ঘর গুছিয়ে দিতাম। বাবার জায়নামায, টুপি, পাঞ্জাবি ধুয়ে রোদে দিয়ে দিলাম।

একটা পুরোনো রুমাল এনে বাবার শেলফ, ওয়ার ড্রব মুছলাম। এমন সময় একটা পুরোনো ধুলোমাখা ডায়েরী চোখে পড়ল।
বাবাত কাছে এমন টুকটাক ডায়েরী থাকা অবাক হওয়ার ব্যাপার নাহ।বাবা এসবে নিজের কাজের বিবরণ, দোয়া-মাছুরা লিখে রাখেন।

কিন্তু এমন ডায়েরী কখনো দেখিনি বাবার কাছে। যাই হোক মুছে নিলাম এটা।
তুলে রাখতেই ওটা থেকে একটা চিরকুট নিচে পড়ে গেল।

তাতে লেখা ছিল ” আমার শেষ আর্তনাদ যাতে আমার মেয়ের কানে না যায়!”
লেখাটা পড়েই বুকের মধ্যে কেমন জানি করে উঠল।

এতে বাবার কথা লেখা থাকতে পারে ভেবে খুললাম। এমন সময় চাচ্চুর ডাক এলো। ডায়েরীটা ওড়নার মধ্যে লুকিয়ে নিজের রুমের শেলফে রেখে দিলাম।

পরে সময় বের করে পড়ব।
ওইটায় কি লেখা আছে জানার জন্য মন ছটফট করছে।

পর্ব ১৫

ডায়েরীটা লুকিয়ে চাচ্চুর বৈঠকখানায় আসলাম। চাচ্চু আমাকে দেখে কাছে ডাকল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিরে মা, মন খারাপ তোর?

~ নাহ, আমি ঠিক আছি। ডেকেছিলে?
~ হ্যাঁ রে মা।তোর সাথে কিছু কথা ছিল আমার।
~ বলো চাচ্চু।

~ কাল রাতে মেহরাব আমার উপর আক্রমণ করেছিল। আমি যখন তাহাজ্জুদের নামায পড়তে মসজিদে গিয়েছিলাম ও আমার পথ আটকে দাঁড়ায়। তখন ওর সে কি ভয়ংকর রুপ ছিল। আমি তাড়াতাড়ি করে সুরা-কেরাত পড়া শুরু করি। একটু পরে দেখি ও নেই। কালকের ঘটনাটার পর আমি খুব চিন্তিত তোকে নিয়ে।

আমার বিশ্বাস হলনা কথাগুলো। আমার মেহরাব এসব করতে পারে বলে আমার মনে হয়না। তাও অবিশ্বাস করার উপায় নেই, চাচ্চু বলছেন। তাছাড়া যে এতগুলো মানুষকে নিজের স্বার্থের জন্য মেরে ফেলতে পারে, যে তার মুখোশ খুলে দিল তাকে মারতে যাওয়া কোনো কঠিন ব্যাপার না। কি হচ্ছে আমার?

আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা। আমি চাইলে মেহরাবকে ঘৃণা করতে পারছিনা। বার বার মনে হচ্ছে আমি ভুল করছি। মেহরাবের ভালোবাসায় কোনো খুত নেই। এসব ও করতে পারেনা। কিন্তু নিজের মনটা সঠিক ভাবার মত কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই।

~ চাচ্চু তুমি একটু সাবধানে থেকো। আমাকে নিয়ে চিন্তা করোনা।
~ চিন্তা তো করতে হয় মা। এখন তো তোর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ভাই-ভাবী দুজনেই তোকে ছেড়ে চলে গেছেন। এখন তোর সব দায়িত্ব আমার। আমার একটা কিছু হয়ে গেলে তোকে কে দেখবে?

বোনের কথা তো আমি ভাবতে পারিনা, ওর উপর আমার কোনো ভরসা নেই। ২১বছর আগে নিজের প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে চলে গেল বংশের মুখে চুনকালি মাখিয়ে। তোর বিয়েও দিয়ে দিল কোনো বাছ-বিচার ছাড়া নিজের মেয়ের স্বার্থে।

ওকে বোন বলতেও লজ্জা করে আমার।
~ না চাচ্চু ফুপি খুব ভালো। ফুপি ছিল বলেই তো এতদিন একটা নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলাম। আমার জন্য অনেক করেছে ফুপি, তার ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারবনা।

~ মা তুই বড্ড সরল। সবকিছুকে তোর মতই সরল ভাবিস।
~ না চাচ্চু।
~ ওসব নিয়ে আর ভাবিসনা মা। আমি তোকে যেটা বলার জন্য ডেকেছি সেটাই বলি। আমি চাচ্ছি তোকে আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য।

~ সেটা কিছুতেই করতে পারবনা আমি চাচ্চু।
~ দেখ মা তুই একটা সাবালিকা মেয়ে। তোর দায়িত্ব নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু গ্রামের সবাই জেনে গেছে তুই ফিরে এসেছিস। কখন তোর উপর কোন কলংক চাপিয়ে দেয় তার ঠিক নেই। এমন মেয়ে ঘরে থাকলে লোকে তোর বদনাম করবে।

আমি তোর বাবার মত, বাবা হয়ে কি করে মেয়ের বদনাম সহ্য করি?
সবাই এখনো ভাবে সেরাতে তুই পালিয়ে গিয়েছিলি তোর ফুপুর মত। আড়ালে-আবডালে লোকে তোকে নিয়ে এখনো সমালোচনা করে।

আমি চুপ করে রইলাম। কথাগুলো খারাপ লাগলে এটাই সত্যি। চাচ্চুর ঘাড়ের উপর বসে খেলে নিন্দে করবেই। তাছাড়া সারাগ্রাম রটে গিয়েছিল আমি পালিয়ে গিয়েছি। যাওয়ার পিছনে কি কারণ তা তো তারা বুঝতে চাইবেনা, জানার চেষ্টা তো দূরে থাক। নিজেদের মত করে গল্প রটিয়ে দিবে।

কিন্তু সব বুঝেও আমি কিছু করতে পারছিনা, আমার পক্ষে আর বিয়ে করা সম্ভব না। আমার সবটা জুড়ে এখনো মেহরাব ই আছে, ওর স্থান কাউকে দেওয়া সম্ভব না।
চাচ্চু একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, একবার ভেবে দেখিস মা।

তুই যদি না চাস আমি জোর করবনা। তোর সারাজীবনের দায়িত্ব নিব। কিন্তু মেহরাবের হাত থেকে আমি কতদিন বেচে ফিরব। আমার যদি ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায় তবে তোর কি হবে? এই গ্রামের লোকেরা তো তোকে হিংস্র প্রাণীর মত ছিড়ে খাবে। তোর চাচীমা মেয়ে মানুষ, মুখ ফুটে কিছু বলার মুরোদ নেই তার। সে তোকে নোংরা লালসার হাত থেকে কি করে বাচাবে?

এই জন্যই আমি তোকে নিয়ে বড্ড চিন্তিত। তাই বলছি একটু ভেবে দেখ। কথা দিচ্ছি তোর জন্য খুব ভালো পাত্র খুজে এনে দিব। খুব সুখে রাখবে তোকে।

আর আমি তোর সুখ ই চাই মুশু। আমার নিজের তো কোনো সন্তান নেই, ছোট থেকে তোকেই নিজের মেয়ে ভেবে এসেছি। তোর খারাপ কিছু আমি সহ্য করতে পারবনা। বলতে বলতে চাচ্চু কেদে দিলেন।
চাচ্চুর কান্না দেখে আমিও চোখের পানি আটকে রাখতে পারলামনা। চাচ্চুর কোলে লুটিয়ে পড়লাম।

চাচ্চু মাথায় হাত বুলিয়ে কান্নামিশ্রিত স্বরে বললেন,
~ আমার মেয়েকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে, কিন্তু আমার মেয়েকে সারাজীবন নিরাপত্তা দিতে পারব কিনা আমি জানিনা রে মা। কিন্তু ভেবে দেখ, আমাকে জানাস।

তোর মতের বিরুদ্ধে আমি কিছু করবনা। এখন কাদিসনা, তোর কান্না আমার বুকে আঘাত করে। সালেহা মুশুকে খেতে দাও, মেয়েটার মুখটা বড্ড শুকনো লাগছে।

শরীর ভালো নেই মা?
~ কিছুদিন ধরে একটু খারাপ যাচ্ছে।

~ এসব নিয়ে ভাবলে তো খারাপ হয়ে যাবে। বিকালে একটু বাহির থেকে ঘুরে আসিস। কেউ কিছু বললে কথা বলবিনা। আমাকে এসে বলিস! এখন তোর চাচিমার কাছে যা, কিছু খেয়ে নে।
আমি একটু বের হব। একটা সালিশের কাজ আছে।
~ সাবধানে যেও চাচ্চু।

আমার এত খারাপ লাগছে এখন বলার বাহিরে। আমার জন্য গ্রামের মানুষ চাচ্চুকে বাজে কথা বলে তাও চাচ্চু আমার প্রতি এত যত্নশীল। নিজের কাছে সারাজীবন রেখে দিতেও রাজি। কিন্তু এভাবে কতদিন চাচ্চুর ঘাড়ের উপর বসে খাব। নিজেরও যাওয়ার মত কোনো জায়গা নেই, বিয়ে করেও সুখের জীবন পেলামনা। এটাই শুনতে হল আমার স্বামী খুনি।

মরে যেতে ইচ্ছে করছে। না পারছি চাচ্চুর কাছে থাকতে, না পারছি মেহরাবের কাছে ফিরতে আর না পারছি বিয়ে করতে!

এখন মরে গিয়ে পরকালটা ও হারাতে চাচ্ছিনা। সময় যত যাচ্ছে, নিজেকে খাপছাড়া পাগল মনে হচ্ছে। বিকালে একটু বের হলাম চাচ্চুর কথামত। এখানে পাশে একটা দীঘি আছে। যেখানে বসলেই আমার মন ভালো হয়ে যেত, খুব ভালো লাগত। অনেকদিন পর এসেছি দীঘিটার পারে।

আগের মতই আছে দীঘিটা। কত হেটেছি বাবার সাথে এর পাড়ে, শিরিন কে নিয়ে সাতার কেটেছি, নৌকা ভাসিয়েছি দুবোন মিলে। ভাবলেই কষ্টটা তীব্র হয়।

দীঘির পাড়ে বসতেই গ্রামের পরিচিত পাগল হোসাইন মিয়া এসে হাজির।
হাসতে হাসতে বলল,
~ উত্তর খুজচ্ছিস? এত সহজে তো পাবিনা।

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
~ বড় জালে আটকা পড়েছিস, বের হবি কেমনে? তাই তাই তোর কোনো গতি নাই। বাচাতে চাইলে উত্তর খোজ, নাহলে অকালে সবাই মরবি।

বলে দৌড়ে পালিয়ে গেল। পিছু ডাকলাম শুনলনা। তার কথাটা গুলো খুব গভীর। সত্যিই আমি প্রতিনিয়ত উত্তর খুজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কে দেভে আমাকে সব উত্তর।

এমনসময় আমার গ্রামের আগের মেয়েবন্ধু দের সাথে দেখা হল। পানি আনতে এসেছিল আমাকে দেখে বলল,
~ আমাদের মুশু যে! কেমন আছিস রে তুই?
~ ভাল আছি, তোরা?

~ আমাদের খবর আর কে নেয় বল! শুনলাম চুপি চুপি নাকি গ্রামে আসলি, তা একবার আমাদের সাথে দেখা করলিনা! নাকি এখন সখী ভাবতে ইচ্ছে করেনা।

~ তা নয়, শরীর খারাপ ছিল তাই বের হইনি।
~ অহ! মুশু তোর বর কোথায় রে যার হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলি। ছেড়ে দিয়েছে নাকিরে? এত রুপ দিয়েও তাকে বেধে রাখতে পারলিনা। একেই বলে কপাল! আমরা তো না পালিয়েও সুখে আছিরে মুশু।

বংশের নাম ডুবাইনি বলে এখনো সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে পারি। ঘরের এক কোণে বসে হা-হুতাশ করিনা।
এখন তোর কি হবেরে মুশু? স্বামীর মুখ কি আর এই জীবনে দেখবি!
আমার মাথাটা ঘুরাচ্ছে এসব শুনে। গায়ে কাটা দেওয়া কথা, এক একটা ছুড়ির মত শরীরে ঢুকে যাচ্ছে মনে হল। তাও নিজেকে সামলে বললাম,
~ এসব কি না বললেই নয়।

~ তুই কর‍তে পারিস? আর আমরা বললেই দোষ। এতকিছুর পরো তুই কিভাবে মুখ দেখিয়ে বেড়াচ্ছিস আল্লাহ ই জানে। আমরা হলে তো গলায় কলসি বেধে ডুবে মরতাম। আমাদের চামড়া তো আর গন্ডারের চামড়া না, যে লাজ-লজ্জা নেই।

~ আমি আসছি।
~ আর কত পালাবি রে মুশু? সেই পালিয়ে তো চাচার ঘাড়েই উঠলি। এই জন্য ই বলে পাপ বাপ কেও ছাড়েনা। আল্লাহ তোকে এভাবেই খাওয়াক সারাজীবন। স্বামীর ভাত তো কপালে জুটল না, চাচার ভাত ই খা।

~ যার ভাত ই খাই ভাতের অভাবে তোদের দোরগোড়ায় যাচ্ছিনা আল্লাহর কাছে এইটুকু শুকরিয়া। আর এত কথা বলছিস যে, তোর স্বামী তো শুনলাম তোকে সুখে রাখার জন্য আরেকটা সতীন নিয়ে এসেছে। সেই সুখে নাকি তুই ঝগড়া করে বাপের বাড়ীতে এসেছিস। আল্লাহ তোকে সুখ ভরিয়ে দিয়েছেরে।
~ তুই আমাকে অপমান করছিস?

~ অপমান কেন করব, যা শুনলাম তাই বলছি।
~ চল রে সবাই। আমরা ওর মত মানুষের কথা নিয়ে পড়ে থাকিনা। ওর মত নষ্টা নাকি আমরা যে স্বামীর উষ্টা খেয়ে চলে আসব।
এইজন্য ই মা বলেছিল ওর থেকে দূরে থাকতে। তাও এতদিনের সখী বলে গল্প করতে এলাম, মুখের উপর অপমান করল।

এভাবে কথা গুলো বলে ওরা চলে গেল। বাড়ী ফেরার সময় কিছু মানুষের চোখে পড়ে গেলাম। সবাই আমার সামনেই শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল,
~ হানিফ হুজুরের মেয়ে মুশায়রা না? যে নাগরের সাথে পালিয়েছিল।
স্বামীর উষ্টা খাইয়া আবার বাপের ঘরে আসছে।

এই মেয়েগুলার জন্য গ্রামের সব মেয়ে সাহস পায়, যেমন কর্ম তেমন ফল ই পাইসে। নষ্টা মাইয়া একটা।
এতকথা শুনার পর ও যে আমি চুপ আছি এটা দেখে নিজের ই অবাক লাগল। আল্লাহ কষ্টের সাথে সাথে ধের্য্য ও বাড়িয়ে দিসে। এই সেই মানুষগুলা যাদের জন্য আমি অনেক কিছু করেছিলাম।তাদের সুখ-দুঃখে সবসময় পাশে ছিলাম।

নিজের জমা টাকা খরচ করে এদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলাম, আজ সেই মানুষগুলো আমাকে থুথু দিচ্ছে।
এরা পারেও! কেন যে আল্লাহ তুমি আমাকে মৃত্যু দিচ্ছোনা।
আমার জন্য চাচচু না জানি কত কথা শুনে, কত অপমানের মুখোমুখি হয়। সত্যিই মনে হচ্ছে চাচ্চুর কথায় বিয়েটা করা জরুরী। এই গ্রাম থেকে বের হতে পারলে নিজের অপরাধবোধটা আর ঝেকে বসবেনা।

আবার মনে হচ্ছে আমি বিয়ে কি করে করব? আমার তো একবার বিয়ে হয়েছেই। মেহরাব কে ছাড়া কাউকে মানা আমার পক্ষে সত্যিই সম্ভব না।
বড় একটা প্যাচে পড়ে আছি।

পর্ব ১৬

অনেক ভেবে-চিন্তে ঠিক করলাম চাচ্চুর কথায় ই রাজী হয়ে যাব। আমার জন্য চাচ্চুর এত অপমান আমি আর মেনে নিতে পারছিনা, আর মেহরাব যে অপরাধ করেছি তার শাস্তি ওকে আমি এভাবেই দিব।

পারলে বিয়ে আটকে দেখিয়ে দিক। আমারো কষ্ট হবে অন্য কাউকে মেনে নিতে, কিন্তু কষ্ট পেয়ে কি লাভ? যার জন্য কষ্ট পাব সেই তো আমার সবচেয়ে বড় শত্রু। সন্ধ্যায় চাচ্চুর রুমের দরজায় এসে কড়া নাড়লাম। চাচ্চু-চাচীমা মিলে কথাবার্তা বলছিলেন। আমাকে দেখে চাচ্চু উঠে বসে বললেন, আয় মা, ভেতরে আয়।

চাচীমা হাত ধরে নিয়ে এসেছে খাটের উপর বসিয়ে নিজে আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। চাচ্চু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ কিছু বলবি মা? খাওয়া-দাওয়া করেছিস তোহ?

~ হ্যা, চাচ্চু। তোমাকে কিছু বলার ছিল।আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।
~ কি সিদ্ধান্ত নিলি মা?
~ আমি বিয়েটা করব।
~ আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছিস মা। আমি তাহলে পাত্র দেখা শুরু করি?

~ করো চাচ্চু। বলার সাথে সাথে আমার কেমন জানি খারাপ লাগতে শুরু করল। আমি মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমে ধরে এসে বমি করলাম। মাথাটা ভীষণ ঘুরাচ্ছে। চাচীমাও আমার এই অবস্থা দেখে ছুটে আসলেন। ফ্রেশ হওয়ার পরই চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। শরীরটা নাড়ানোর মত ক্ষমতা নেই আমার। চাচীমা পরমযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। চাচ্চু গম্ভীরমুখে ঘরের এক কোণে পায়চারি করছেন। জ্ঞান ফেরার পর চাচীমা চাচ্চু কে বললেন, মুশুর জ্ঞান ফিরেছে।
~ চাচীমা কি হয়েছে?
চাচ্চু আমার দিকে গম্ভীরমুখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। চাচীমা ফিসফিস করে বলল,
~ ডাক্তার এসে বলল তুই মা হতে যাচ্ছিস।

এই সংবাদে আমি খুশি হব না কষ্ট পাব বুঝতে পারছিনা। আমার আর মেহরাবের অনাগত সন্তান আমার গর্ভে। নিজের অজান্তেই পেটে হাত বুলালাম। চাচীমা দেখে বলল, তোর চাচ্চু একটুও খুশি না রে মুশু। বার বার বলছে একটা বদ ও খুনি জ্বীনের সন্তান ওটা। আমি চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললাম,
~ চাচীমা আমাকে একটু একা থাকতে দেবে।

চাচীমা নতমুখে মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। আমি দরজা আটকে দিয়ে কাদতে লাগলাম। পৃথিবীতে আসার আগেই আমার সন্তানের একটা পরিচয় হয়ে গেল।

এই সন্তান আমার পবিত্র ভালোবাসার ফল, কিন্তু মেহরাবের কথা আমি জানিনা।
ও এই সংবাদ জানলে কি খুব খুশি হত? নাকি নিজের সন্তানকে অস্বীকার করত!
বুঝতে পারছিনা আমার কি করা উচিত? এমন সময় সেই ডায়েরীটা আমার চোখে পড়ল যেটা সকালে আমি বাবার ঘর থেকে এনে লুকিয়ে রেখেছিলাম।

পড়ার মত মনের অবস্থা আমার নেই তাও ডায়েরীটা হাতে নিলাম। মনে ভাবনা আসল হয়ত এই ডায়েরী থেকে জানা যাবে আমার মেহরাব খুনি কিনা? আমার এখনো বিশ্বাস ও সম্পূর্ণ নির্দোষ।

তাই আর দেরী না করে ডায়েরীটা খুললাম। প্রথম পাতায় কিছু দোয়া-মাছুরা দেখে হতাশ হলাম। কিন্তু কৌতুহলে মাঝের পৃষ্টা উল্টালাম। সেখানে একটা তারিখ আর কিছু কথা লেখা আছে। তারিখটা মায়ের মৃত্যুর দিন।
” আমি জানি শাহানা, তোমার মৃত্যুটা স্বাভাবিক হতেই পারেনা। তোমাকে কেউ ইচ্ছে করেই মেরে ফেলেছে। জানিনা, আমার এত বড় ক্ষতি কে করল? তবে কথা দিচ্ছি তাকে আমি খুজে বের করব।”
এটা পরে একটু খটকা লাগল।

বাবা কি তখনো জানতেননা যে, মেহরাবই এসব করছে। এর পরের কিছু পাতা খালি, তারপরের পাতায় শিরিনের মৃত্যুর তারিখ লেখাঃ
” আমার ছোট্ট নিষ্পাপ মেয়েটাকেও ছাড়ল না অচেনা জালিমটা। ছাদের থেকে ওকে ইচ্ছে করেই ফেলা হয়েছে মারার জন্য।

আমার খুব ভয় হচ্ছে, আমার মুশু মা কে নিয়ে। এরপরের শিকার কি আমার মুশু মা???”
শিরিনের মৃত্যুর কারণ ছিল ছাদ থেকে পা পিছলে পড়ে যাওয়া। সবাই সেটাই জানত, অবাক ব্যাপার হচ্ছে বাবা তখনো বুঝেনি এটা মেহরাবের কাজ।
কৌতুহলটা ক্রমশ বেড়ে গেল।

পরের পৃষ্ঠায় লেখা আছেঃ
” আজ আমি জেনে গেছি কে আমার গোপন শত্রু! জেনে খুশি হচ্ছিনা, বরং নিজেকে ঘৃণা হচ্ছে। এতটা নিচে কেউ নামতে পারে তার লোভের জন্য।

সব জেনেও চুপ করে আছি আমার মুশুমার নিরাপত্তার কথা ভেবে।”
এইবার সত্যিই আমার মেহরাবের প্রতি সন্দেহ হচ্ছে। চাচ্চুও বলেছিল ও আমাকে পাওয়ার জন্য ই এমন করেছিল। কিন্তু বাবা নিজেকে কেন ঘৃণা করবে?

এই তারিখটায় আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম, সেদিনের লেখাঃ
” মুশুকে আমি পালাতে বলেছি, কারণ আমি বুঝে গেছি এরপরে ওর উপর ই আক্রমণ করবে। জানিনা, মুশু কতটা ভাল থাকবে? কিন্তু জানোয়ারটার হাত থেকে তো বাচবে। ওই জানোয়ারটা আজ নিজের রুপটা আমাকে দেখিয়ে দিল।

সারারাত আমার উপর নির্যাতন করেছে মুশুকে কোথায় পাঠিয়েছি জানার জন্য।
তবু আমি মুখ খুলিনি, আর খুলব ও না।”

শেষ পাতায় আরেকটা কথা লেখা ছিল যেটা আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে,
” শত্রু বাহিরের হলে তাকে শেষ করা যায়,
কিন্তু শত্রু তো বাহিরের নয় ঘরের
আমার নিজের রক্তের
তাকে নিঃশেষ করার উপায় টুকুও আমার জানা নেই
ও বলেছে আজ আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে এখান থেকে। জানিনা আর বেচে ফিরব কিনা! আল্লাহ আমার মুশুমা কে তুমি হেফাজতে রেখো।

আমার শেষ আর্তনাদ”
আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেছি। এতটাই শক হলাম যে ডায়েরীটা আমার হাত থেকে পড়ে গেল। তার মানে শত্রু আর কেউ নয়। আমার বাবার কলিজার টুকরা আর আমার প্রিয় চাচ্চু। চাচ্চু আমাকে এতগুলো মিথ্যে অনায়াসে বুঝিয়ে দিল, আমার মেহরাবকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল।

পুরো রহস্যটা আমার সামনে না এলেও কিছুটা আমি বুঝে গেছি। এখন আমি কি করব? আমার সত্যিই মাথা কাজ করছে না। এক্ষুনি চাচ্চু যদি জানে তার আসল রুপ আমার সামনে চলে এসেছে তাহলে আমাকেও মারতে দুইবার ভাববেনা। যার পক্ষে নিজের ভাইকে শেষ করা সম্ভব, আমার ক্ষতি করা কোনো ব্যাপার না। আমার কিছু হলে আমার সন্তানটাও যে শেষ হয়ে যাবে।

না এখন চুপ থাকব, আমার মেহরাব কোথায় সেটা আগে খুজে বের করতে হবে।
আমার মন বলছে ওকে চাচা কোথাও বন্দি করে রেখেছে।

এমনসময় চাচ্চু দরজা ধাক্কাল, “মা মুশু, দরজাটা খোল মা!”
এই মা ডাকটা তার শুনতে বড্ড ঘৃণা হচ্ছে। ডায়েরীটা লুকিয়ে ফেলে দরজাটা খুললাম। চাচ্চু ভিতরে এসে আমার রুমের চারপাশটা একবার দেখে নিল।

~ কিরে মা, দরজা খুলতে এত দেরী হল যে?
~ চাচ্চু, শুয়ে ছিলাম উঠতে কষ্ট হচ্ছিল।

~ হুম, তোর চাচীর কাছে তো শুনলি তোর পেটে ওই বদজ্বীনের বাচ্চা আছে। এই বাচ্চা জন্ম দেওয়াটা পাপ হবে মুশু। পেটে শত্রু পুষে লাভ নেই। আমি বলছি কি, বাচ্চাটা তুই নষ্ট করে ফেল।
খুনির সন্তান জন্ম দেওয়ার কোনো ঠ্যাকা নেই তোর।

শুনে কলিজার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, এই কথা তো চাচ্চুর মুখেই মানায়। এত নিষ্ঠুরতা এই নূরানী, ভদ্র চেহারার পিছনে থাকতে পারে বাবার লেখা গুলো না পড়লে জানতাম না। কিন্তু এখন এসব প্রকাশ করলে চলবেনা। আমাকে ধীরেসুস্থে কাজ করতে হবে।

এই বাচ্চাটা আমি কিছুতেই মারতে দিবনা, এটা আমাদের পবিত্র ভালোবাসার বন্ধন। কিছু একটা করে চাচ্চুর হিংস্রতার হাত থেকে ওকে বাচাতেই হবে।
~ কিরে মা, চুপ করে কি এত ভাবছিস?

পর্ব ১৭

আমি ভয়ে ঢক গিলে নিলাম। হিংস্র হাতটা এইবার আমার সন্তানের উপর এসে পড়ছে। চাচ্চুকে এখন কিছু বুঝতে দিলে চলবেনা। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
~ চাচ্চু আমি যতটুকু জানি এ্যাবরোশনের সময় ও নেই এখন।

এখন যদি বাচ্চা নষ্ট করি, তাহলে আমারো ক্ষতি হবে। চাচ্চু শুনে কিছুটা হতাশ হল। তারপরো বড়জোর মুখে হাসি ফুটিয়ে চলে গেল। আমার ব্যাপারটা খটকা লাগল। আমিও চাচ্চুর পিছু নিলাম। উনি সোজা রান্নাঘরে চাচীমার কাছে গেলন।

আমি দরজার আড়ালে লুকিয়ে আড়ি পাতলাম। কিছু থালাবাসন নিচে পড়ার শব্দ শুনলাম। নিশ্চয়ই রাগে চাচ্চু সেগুলো ফেলে দিয়েছেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
~ এই মেয়েটাকেই শেষ করতে পারছিনা। তার উপর এসে জুটল তার সন্তান। ঝামেলা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, আর সহ্য হচ্ছেনা।

ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ওকে গলা টিপে দুটোই একসাথে শেষ করি। গ্রামের সবাই জেনে গেছে মেয়েটা আমার কাছে। ওর সন্দেহজনক কিছু হলে গ্রামের লোকেরা আমাকে ই সন্দেহ করে বসবে। ইদানিং গ্রামে কিছু গোয়েন্দা বাড়ছে।
~ আপনি শান্ত হন।

~ কিসের শান্ত হব? যতক্ষণ না শত্রু শেষ করতে পারছি ততক্ষণ আমি শান্তি পাচ্ছিনা সালেহা। বাপ-বেটির কাহিনী শেষ ই হচ্ছেনা। এত কষ্ট করে বাপটাকে সরালাম, মেয়েটা এসে হাজির। এত কিছু করলাম মেয়েটাকে মারার জন্য, কিছুতেই কিছু হলনা। উলটো আরেকটা জ্বীনের বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরছে।

ভেবেছি বিয়ের নাম করে পাচারকারীদের হাতে তুলে দিয়ে বিদায় করব ঝামেলা ছাড়া। সেটাও আর হল না।
এভাবে একের পর এক প্ল্যান নষ্ট হচ্ছে আমার। আর সহ্য হচ্ছেনা, এবার একটা কিছু করতেই হবে। ও আর ওর সন্তানকে টুকরো টুকরো করে তবেই থামব আমি।

শুনে আমার হাত-পা কাপাকাপির পর্যায়ে চলে গেল। আমার সন্তানের কি হবে?
হাত দিয়ে পেট চেপে ধরলাম, আমি বেচে থাকতে আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি হতে দিবনা। মেহরাব তুমি কোথায়? প্লীজ আমার কাছে ফিরে এসো। তোমার বউ আর সন্তানের পাশে এসে দাড়াও। চাচ্চুর কাছ থেকে আমাকে নিয়ে যাও।

সারারাত ঘুম হলোনা, কেবল ছটফট করতে লাগলাম। আমাকে যে মেহরাবকে খুজে বের করতে হবে? আর চাচ্চুর মুখোশ সবার সামনে খুলে দিয়ে তার উপযুক্ত শাস্তি তাকে দিতেই হবে।
ডায়েরীটা হাতে নিলাম। তখন অতটা ভাল করে ঘাটাঘাটি করতে পারিনি, এখন একটু চেক করে দেখি কোনো নতুন ক্লু পাই কিনা? কিন্তু কিছুই পেলামনা।

এদিকে শরীরটাও আর টলছেনা। পেটের ভিতর টা ভীষণ ভারী ভারী লাগছে, ক্লান্তিটাও অনেক বেশী। আমার তো ২মাস ও শেষ হলনা। এর মধ্যে এটা এত ভারী লাগার তো কথা নয়। তবে কি সত্যি আমার ভিতরে মেহরাবের মতই কেউ একজন বেড়ে উঠছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? কিন্তু যেখানে আমার সাথে মেহরাবের বিয়ে হতে পারে সেখানে আমার গর্ভে জ্বীন জন্ম নেওয়া কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। সবই আল্লাহর অশেষ রহমত, তার ইচ্ছেতেই সব হয়।
আল্লাহ তুমি আমার সহায় হও।

বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে এসে দাড়ালাম। মেহরাব এর কথা বড্ড মনে পড়ছে, এই সংবাদে না জানি কত খুশি হত সে। কিন্তু আমার মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মেহরাব সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও কেন সেদিন চুপ ছিল? ও তো আমায় সবটা বলতে পারত। আর চাচ্চু ই বা মেহরাবের ব্যাপারে এত কিছু কি করে জানে? তবে কি চাচ্চু মেহরাবকে আগে থেকেই চিনত!
চাচ্চু সবাইকে মেরে ফেলল কেন?

কি স্বার্থ আছে চাচ্চুর! বাবা তো তাকে অনেক বেশী স্নেহ করতেন! আর উনি বাবাকে চোখে বেধেই বা কোথায় নিয়ে গেলেন!
এত প্রশ্নের জট পেকে আছে, কিন্তু কোনোটার ই উত্তর আমি পাচ্ছিনা।

এমন সময় খেয়াল করলাম একটা কালো ছায়া এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এইদিক ওদিক উকি মারছে। এত রাতে কে ওখানে উকিঝুকি মারছে। চাচার ঘরের দরজাটা খুলে গেল তখনি। চাচা বের হয়ে এসে বারান্দার আড়ালের কোণে চলে গেলেন তার সাথে ওই ছায়াটাও।

আমি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। এখানে তো চাচ্চু নেই। তবে চাচ্চু কোথায় গেল? ঘরের দরজা তো এখনো খোলা তার মানে চাচ্চু ঘরে ঢুকেনি। বাড়ীর গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা হাট করে খোলা।

চাচ্চু এত রাতে বেরিয়েছে তার মানে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। দেরী না করে আমিও বাড়ী থেকে বের হলাম। একটু হাটার পর দেখি চাচ্চু দ্রুত পা চালিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমিও অনেকটা দূরত্ব রেখে চাচ্চুকে ফলো করছি। চাচ্চু মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে এই দিক ওই দিক তাকিয়ে দেখছেন।

কিছুটা হাটার পর আমাদের গ্রামের নির্জন জঙ্গলে ঢুকে গেলেন। আমি জঙ্গলের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম ঢুকব কিনা! শুনেছি এই জঙ্গলটা বেশ ভয়ানক। আমাদের গ্রামের কেউ তো ভুলেও এই জঙ্গলে পা রাখেনা। আমিও এর ধারে কাছে আসিনি কখনো।

এত কিছু ভাবলে চলবেনা, এক্ষুনি চাচ্চুর পিছু নিতে হবে। অতি সাবধানে পা ফেলে চাচ্চুর পিছু পিছু হাটছি। চাচ্চু এসে জঙ্গলের পুরোনো বাড়ীটার সামনে এসে দাড়ালেন। এমন একটা জঙ্গলের পুরোনো বাড়ী আছে আমি কখনোই শুনিনি। কিন্তু চাচ্চুর এখানে কি কাজ থাকতে পারে?

চাচ্চু তাড়াতাড়ি বাড়ীটার ভিতরে ঢুকে গেলেন। আবছা অন্ধকারে আমার চলতে কষ্ট হচ্ছে, আজ চাঁদ ভালো করে জ্যোৎস্না দিচ্ছে বলে এখনো দেখে দেখে হাটতে পারছি। শরীরটা আর সত্যিই টলছেনা।

বাড়ীর দরজায় ঢুকব এমন সময় দেখি একটা বিশালকৃতির সাপ ফণা তুলে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আল্লাহর নাম জপ করছি মনে মনে। সাপটা আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর এসে আমার শরীর পেচিয়ে আমার পেট পেচিয়ে ধরে রাখল।

আমি বুঝতে পারছিনা আসলে কি হচ্ছে! চোখ বুঝে আল্লাহর নাম নিচ্ছি। একটু পরে সাপট আমাকে ছেড়ে জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের মাঝে হারিয়ে গেল।
শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে।

আর দেরী না করে বাড়ীর ভিতরে ঢুকলাম। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেবল উপরের একটা ঘর থেকে সামান্য আলোর ছটা আসছে, চাচ্চু নিশ্চয়ই ওখানেই আছে। উপরে উঠতে গিয়ে ছোচট খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও বাচলাম। আমার কেমন গা ছমছম করছে।

একটা বাসি পচা গন্ধ নাকে আসছে, তাতে আমার বমি হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তাড়াতাড়ি ওড়না টা নাকে দিয়ে সেই ঘরের সামনে এসে দাড়ালাম। দেয়ালে দেখলাম ছায়াটা ভাসছে, নিশ্চয়ই এইদিকেই আসছে। মোটা থামের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম দেরী না করে। ছায়াটা ঢুকার সাথে সাথে ঘর থেকে কথা আর হাসির আওয়াজ আসতে লাগল।

আমি আবারো উকি মেরে দেখলাম, যা দেখলাম তা দেখে আমার পুরো শরীর উত্তেজনায় ঠান্ডা হয়ে এল। চেয়ারে দুজন লোককে বেধে রাখা হয়েছে আধমরা করে। মুখটা নিচে ঝুলে আছে তাই বুঝতে পারছিনা ওরা কে! তার উপর কালো কাপড় দিয়ে মুখ বাধা। চাচ্চু গিয়ে ওদের কাপড় টা টেনে নিল। একি এ তো আমার বাবা আর মেহরাব।

ছুটে যেতে যাচ্ছিলাম কিন্তু নিজেকে আটকালাম। এটা উপযুক্ত সময় নয়। কালো ছায়াবেশী কালো চাদরে ঢাকা মানুষটা তার চাদর খুলে ফেলল। মুখটা এখনো দেখতে পাচ্ছিনা। এখন নিশ্চিত হচ্ছি এসব জঘন্য কাজে চাচ্চুর সহযোগী কেউ ছিল। চাচ্চুর ঘরের কোণ থেকে পানির বালতি টা এনে বাবার গায়ে ঢেলে দিলেন। বাবা চমকে মুখ তুলে তাকালেন।

চাচ্চু হেসে হেসে বলল,
~ কিরে ভাই, তর কষ্ট হচ্ছে? আহারে শুধু তোর নয়, চেয়ে দেখ তোর জামাইটার ও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তোদের কে আর বাচিয়ে রাখা যাচ্ছেনা, তোরা তো নাছোড়বান্দা, কিছুতেই আমার কথা মানবিনা। এখন উপরেই যেতে হবে তোদের।

ওই ছায়াবেশী মেহরাবের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর আঙ্গুলে জোরে কামড় দেয়। মেহরাব চিৎকার করে উঠে মূহুর্তে। ওর চিৎকার শুনে আমার বুকটা ধড়ফড় করছে। ছায়াবেশী এইবার এইদিকে ফিরে চাচ্চুকে কিছু একটা ইশারা দিতে লাগল। চাচ্চু মশালে আগুন জ্বালিয়ে বাবা আর মেহরাবের সামনে ধরল। তখনি ছায়াবেশীর চেহারা আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল।
নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিনা আমি, এ আমি কাকে দেখলাম?

পর্ব১৮

এ তো মেহরাবের প্রেমিকা উম্মে। ওর মত ভালো মেয়ে কিনা চাচ্চুর সাথে মিলে মেহরাবের ক্ষতি করতে চাচ্ছে। কিন্তু কেন এমন করছে ও? ও তো আমার জন্য মেহরাবকে ছেড়ে দিয়েছিল, এখন কি সেই প্রতিশোধ নিতে এসেছে। উম্মে মুখ থেকে কালো ধোয়াজাতীয় কিছু একটা চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে লাগল।

ধোয়াটা আমাকে ঘিরে ধরতেই মাথা ঘুরিয়ে উঠল হঠাৎ। পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে নিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা আর, নিজেকে সামলাতে গিয়ে রুমের দরজা নাড়িয়ে দিলাম। শব্দ শুনে উম্মে আগুনরাঙ্গা চোখে পিছনে তাকাল।

এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল দরজার দিকে, আমি তখনো দরজার পিছনে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি। এইবার নিশ্চিত ধরা পড়ে যাব, য়খন নিজেকে, বাবাকে কিংবা মেহরাবকেও উদ্ধার করতে পারবনা। আল্লাহ তুমি রহম করো। এমন সময় মোটা দড়িজাতীয় কিছু একটা আমাকে পেচিয়ে ধরে একটানে জঙ্গলের বাহিরে নিয়ে চলে এল।

বাহিরে এসে দেখি সেই বিশালকৃতির সাপ তার লেজ দিয়ে পেচিয়ে শূন্যে তুলে রেখেছে আমাকে। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম, এই সাপটা কি আমাকে খেয়ে নিবে নাকি ছোবল মারবে?

সাপটা আমাকে আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে দিল। অতঃপর এক মানুষের রুপ নিয়ে দেখা দিল। যদিও মুখসহ সারাশরীর কালো চাদরে মুড়ে রেখেছে। তবুও বুঝতে পারলাম এটা একটা মেয়ে। কিন্তু সাপ কি করে মেয়ে হল? মেয়েটা আমাকে বলল,
~ ভাবছো তো আমি কে?

~ হ্যাঁ, আপনি কে? আমাকে এভাবে কেন টেনে আনলেন!
~ ভয় পেয়োনা মুশায়রা। আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী, একজন জ্বীন আমি। আমি চাইনি তোমার শত্রুরা তোমার আর তোমার সন্তানকে মেরে ফেলুক। আর একটু হলে তুমি ধরা পড়ে যাচ্ছিলে তাই আমি সাপের রুপ নিয়ে তোমাকে টেনে নিয়ে আসলাম।

~ অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু আমার নিজের জীবনের চেয়ে আমার বাবা আর স্বামীকে উদ্ধার করাটা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

~ তোমার কি মনে হয় তুমি ওদের সাথে পারতে? ওরা যদি তোমার সন্তানকে মেরে ফেলত! তুমি ভুলে যেও না, তোমার গর্ভে যে আছে সে কোনো সাধারণ মানুষ্য সন্তান নয়, সে জ্বীন বংশ উদ্ভুত।

সে ই হবে জ্বীন জগতের পরবর্তী সরদার। ভীষণ শক্তিশালী হবে সে, সে ই রক্ষা করবে তার জ্বীনজগত কে। রক্ষা করবে জ্বীনি তলোয়ারকে।
আমি তার কথা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে আমার গর্ভে যে আছে, তা পুরো জ্বীনজাতির কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমার উপর গুরুদায়িত্ব পড়েছে তাকে খেয়াল রাখার।

মেয়েটি কাছে এগিয়ে এসে আমার পেটের উপর হাত রেখে বলল,
~ তাকে রক্ষা করা আর দেখে রাখার দায়িত্ব এখন তোমার। সবসময় সাবধানে পা ফেলবে, তোমার শত্রুরা তোমাকে ছেড়ে দিবেনা। যেকোনো সময় তোমার উপর আক্রমণ করতে পারে। আমি তোমাকে নিরাপদে জঙ্গলটা পার করে দিলাম, তুমি এক্ষুনি বাড়ী ফিরে যাও। আল্লাহ হাফেজ।

বলেই মেয়েটি উধাও হয়ে গেল, বুঝলাম না কে এই শুভাকাঙ্ক্ষী। আল্লাহর নাম নিয়ে বাড়ীতে ফিরে শুয়ে পড়লাম। সময় যত যাচ্ছে আমার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। কি ভাবে আমি ওদের কাছ থেকে আমার আপনজন দেরকে রক্ষা করব।

একটু পরে বুঝতে পারলাম চাচ্চু ফিরেছে, ততক্ষণে সকাল হয়ে এসেছে।
আমার শরীরটা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি আর বাচবই না। কিন্তু আমার যে এখনো বড় দায়িত্ব গুলো বাকি আছে। সেগুলো শেষ না করে গেলে আমি মরেও শান্তি পাবনা।
চাচ্চু সারাদিনে আমার সাথে তেমন কথা বলেনি। তবে আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়েছিল আমার দিকে, মনে হচ্ছিল সেই চোখজোড়া থেকে রাগ ঠিকরে পড়ছে।

বাড়ীর উঠোনে বসে বসে ভাবছিলাম কি করা যায়!
নিজেকে খুব নিয়ন্ত্রণ করছি, আমার তো ইচ্ছে করছে এক্ষুনি সেই বাড়ীতে ছুটে যাই আর ওদেরকে মুক্ত করে আনি। কিন্তু তাড়াহুড়োর কোনো কিছুরই ফল ভাল হয়নি। খুব ভেবেচিন্তে করতে হবে, চাচ্চু অনেক বেশী চালাক। তিনি যদি কিছু টের পেয়ে যায় তবে এক্ষুনি আমাকে শেষ করে দিবে।

কতটা চালাক হলে তার খেলায় একটা জ্বীনকে সামিল করতে পারে! তিনি কি টের পেয়েছিল একসময় তার পথের কাটা হবে একটা জ্বীন মানে আমার মেহরাব। এসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে ক্লিয়ার না। কাল রাতে মেয়েটাকেও এসব জিজ্ঞেস করতে পারিনি।

এমনসময় দেখি হোসাইন পাগলা গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে। ও তো সেইদিন দীঘির পাড়ে আমাকে কিছু বলেছিল, পরবর্তী তে তার কথা গুলো সত্যতা আমি পেয়েছিলাম। এ সংকট মূহুর্তে সে কি আবারো আমাকে কিছু ইঙ্গিত করতে চায়। তাড়াতাড়ি গিয়ে গেইট খুলে বের হলাম। পাগলাটা আমাকে একটা তাবিজ হাত ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা শুধু একটা কাজেই ব্যবহার করতে পারবি। তোর কাছে যেটা বেশী দরকারি মনে হবে, সেটায় ব্যবহার করবি।

আমি তাবিজটা হাতে নিলাম। সে ড্যাবড্যাব করে আমার পেটের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সে আসছে, খেয়াল রাখিস। বলে নাচতে নাচতে চলে গেল নিজের পথে। আমি তাবিজটা গলায় বেধে নিলাম।
নিজের রুমে পা রাখতে একটা বড় শক খেলাম। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আমার। চাচ্চু আমার ঘরে ঢুকেছে, অন্যদিকে তাকিয়ে কিছু একটা করছে। আমি ধীরপায়ে ঢুকে বললাম, চাচ্চু তুমি এখানে?

চাচ্চু আমার দিকে ফিরে তাকালেন। তার হাতে বাবার সেই ডায়েরীটা। চমকে উঠলাম, চাচ্চু সব বুঝে গেছে। আমি যে তার সত্যি বুঝে গেছি সেটা চাচ্চু ধরে ফেলেছে। সেটা বুঝে নেওয়ার জন্য চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করলাম,
~ তোমার হাতে ওটা কি চাচ্চু?

~ তোর ঘরে এটা ছিল আর তুই জানিসনা এটা কি?
ভয়ে ঢক গিলে বললাম, আমি তো বাবার ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়েছিলাম। এনে রেখেছিলাম বাবার শেষ স্মৃতি হিসাবে। পড়ে দেখব বলে আর মনে ছিলনা।

চাচ্চু এটা নিয়ে বলল, এটা আমার কাছে থাক। এখন এসব না পড়াই ভাল, বাচ্চার খেয়াল রাখ বরং।
আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম, চাচ্চু তাহলে কিচ্ছু বুঝেনি। চাচ্চু ডায়েরীটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। খাটের উপর এসে বসতেই পোড়া পোড়া গন্ধ পেলাম। চাচ্চুর ঘরে উকি দিয়ে দেখি চাচ্চু ডায়েরীটা জ্বালিয়ে ফেলেছেন। এভাবে কি নিজের পাপ ঢাকতে পারবে চাচ্চু? আল্লাহ তোমার জন্য উপযুক্ত শাস্তি ঠিকিই বরাদ্দ করে রেখেছেন। তোমার পাপ তোমাকে কখনোই মুক্তি দিবেনা।

সন্ধ্যায় রান্নাঘরে চাচীমার সাথে টুকটাক কাজ করছিলাম। চাচীমা সবি জানে সেটা আমি বুঝি। কিন্তু চাচ্চুর ভয়ে কিছু করতে পারলনা, চাচীমার উপর আমার কোনো ঘৃণা কাজ করছেনা। চাচীমার মত মানুষ কখনোই চাচ্চুর এসব কাজ সমর্থন করবেনা সেটা আমি জানি, নিজের স্বামীকে ভয় পেয়ে চুপ করে আছে।

কাজ করতে করতে চাচীমা হাতের কব্জিতে বড় একটা গর্ত দেখলাম। মনে হল কেউ সেখান থেকে কেটে মাংস উঠিয়ে নিয়েছে। কেপে উঠলাম দেখে, এতদিন চাচীমা আচলের তলায় এটা লুকিয়ে রেখেছে।
আমি চাচীমার হাত টা ধরে বললাম, তোমার এটা কি করে হল?

~ ও কিছুনা, সামান্য চোট লেগেছিল।
~ চোট এমনই লাগল যে এক টুকরো মাংস ই উঠে গেল।
চাচীমা মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাদতে লাগলেন।

~ চাচীমা আমি সব জেনে গেছি। চাচীমা আমার মুখ চেপে ধরে বলল,
~ চুপ, এসব একদম বলবিনা। তোর চাচচু জানলে তোকে বাচতে দিবেনা কোনোমতেই। মুশু আমি তোর মা হিসেবে চাই তুই আর তোর বাচ্চা জীবিত থাক। হাত জোড় করে বলছি এসব কথা বলিসনা।

অই শয়তানটা আমার চোখের সামনে একে একে সবাইকে মেরে ফেলেছে। আমি বাধা দিয়ে গিয়েছি বলে আমার এই অবস্থা করেছে। আমি চাইনা তোর কোনো ক্ষতি করুক ওই পাষন্ডটা। আমি চাচীমাকে জড়িয়ে ধরলাম।

এমনসময় চাচ্চু রান্নাঘরে ঢুকে চাচীমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে টেনেহেচড়ে নিয়ে যেতে চাইল। চাচীমা ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল,
~ ওকে ছেড়ে দিন আপনি। এমন কাজ করবেন না, আল্লাহ নারাজ হবে। ও যে একটা নিষ্পাপ শিশু ধারণ করে আছে।

~ ওই তুই চুপ, তুই ই আমার আসল শত্রু। ওকে বাচাতে এসেছিস, দেখ তোকে কে বাচায়।
আমাকে সরিয়ে চাচ্চু চাচীমার মুঠি ধরে ফেলে। টেনে টেনে চুলার কাছে এনে, আগুন বাড়িয়ে দিয়ে, চুলায় চাচিমার মাথা ঢুকিয়ে দেয়। দাউদাউ আগুনে পুড়িয়ে যাচ্ছে চাচীমার মাথা।কি নৃশংসতা! চাচীমার আর্তনাদ আমাকে স্পর্শ করে গেল। সহ্য করতে পারছিলামনা আর! অবশ হয়ে এলো সব

পর্ব১৯ & শেষ পর্ব

আস্তে আস্তে চোখ খুললাম আমি। মাথাটা এখনো ধরে আছে, আমার হাত চেয়ারের সাথে বাধা। চারিদিকে অন্ধকার, বুঝতে পারছিনা কোথায় আছি। ঘন ঘন শিয়ালের ডাক আসছে চারপাশ থেকে। এমন ডাক তো সেদিন জঙ্গলে এসে শুনেছিলাম, তবে কি চাচ্চু আমাকে পোড়াবাড়ীতেই নিয়ে এসেছে।

হাত নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, এত শক্ত করে বেধে রেখেছে যে নাড়াতেই পারছিনা। এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম, তাকিয়ে দেখলাম চাচ্চু কয়েকটা মশাল এনে জ্বালিয়ে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে একটা ভয়ংকর হাসি দিল,
~ কিরে মা, কষ্ট হচ্ছে খুব?

~ আমাকে বেধে রেখেছো কেন? খুলে দাও।
~ এত উতলা হসনা মা, তোকে ছেড়ে দিব। শান্তিতে উপরে চলে যাবি।
বলে আবার বেরিয়ে গেল চাচ্চু। একটু পরে এসে বাবা আর মেহরাবকে ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকাল। ওরা অবশের মত মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে, দুজনের শরীর ই রক্তে মাখা।

আমি চিৎকার করে উঠলাম, বাবা!
বাবা আমার দিকে কাতরচোখে তাকালেন। তারপর হাত জোড় করে চাচ্চুকে বললেন, ভাই, আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দে। ও তো তোর কোনো ক্ষতি করেনি। আমাকে মেরে ফেল কিন্তু আমার মেয়েকে ছেড়ে দে। চাচ্চু হাসতে হাসতে বলল,
~ ছেড়ে তো দিব।

তুই, তোর মেয়ে আর মেয়ের জামাই সবাইকে একসাথে ছেড়ে দিব কিন্তু তোরা মরার পর। ক্ষতি তোর মেয়ে করেনি, তুই করেছিস। তার ফল তো সবাই পাবে ভাই। চাচ্চুর পিছনে এসে উম্মে এসে দাড়াল। মেহরাব তখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে।

কপাল বেয়ে রক্ত বের হচ্ছে, আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। উম্মে এসে হেসে বলল, আহারে, আমার প্রেমিক দেখি খুব কষ্ট পাচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বললাম, তুমি এত নীচ সেটা জানা ছিলনা! ঘৃণা হচ্ছে তোমাকে দেখে। নিজের ভালোবাসাকে কেউ এভাবে আঘাত করতে পারে?

উম্মে আমার গাল জোরে চেপে ধরে বলল,
~ আমি নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারি। নিজের বোনকে যেখানে মারতে পারি, সেখানে বোনের প্রেমিক আর কি। সব পারি আমি।

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, বুঝতে পারলামনা ওর কথাটা। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ একটু পরে তো মরেই যাবি, তোর কৌতুহলটা মিটিয়ে নিই। সব রহস্য বলি তোকে। নাহলে তো শান্তিতে মরতে পারবিনা।

উম্মে শূণ্যে বসে গেল, যেন মনে হল সে চেয়ারে বসে পড়ল। চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলল, মোল্লা সাহেব আপনিই শুরু করেন। চাচ্চু বাবার পাশে বসে বলল, আমার চেয়ে তুই বেশী জনপ্রিয় ছিলি সবার কাছে, তোর কথায় পুরো গ্রাম চলত।

আর আমি তোর চামচাগিরি করেই কাটাতাম, এমনকি বাবা মারা যাওয়ার আগে তোকে যোগ্য মনে করে সব সম্পত্তি তোর নামে লিখে দেয়। ছোটছেলে হিসেবে কিছু পাইনি, তুইও আমাকে চামচার মত পাশে পাশে রাখতি। আমার না খুব রাগ হত, কিন্তু চুপচাপ সব সহ্য করতে হত।

কারণ আমার কাছে তো কিছুই নেই, আমি কিছু করলে তুই আমার মাথার উপর থেকে ছাদটা নিয়ে নিতি।
বাবা বিস্ফোরিতচোখে তাকিয়ে বলল, তোকে তো আমি খুব ভালোবাসতাম ভাই। আমার কাছে চাইলে কি আমি তোকে দিতাম?

~ আমার পথের কাটা তো ছিলি তুই। তোকে না সরালে সম্পত্তি, গ্রামের মোড়ল হতে পারতামনা আমি। তাই আমি চিন্তা করে ফেললাম যে করেই হোক তোকে আমি সরিয়ে ফেলব।

কাজটা আমি আগেই করতে পারতাম, একাই করতে পারতাম। কিন্তু করলে সন্দেহ টা আমার উপর ই করত সবাই। তাই আমি জ্বীন ডাকা শুরু করি। একটা বদজ্বীন ও নিয়ে আসি তোদের মারার জন্য এক এক করে। উম্মে হেসে বলল, বদজ্বীন টা আমার অধীনে ছিল। ওর থেকেই মোল্লাসাহেবের প্ল্যান টা জানতে পারি আমি।

আমি ভাবলাম এর থেকে যদি আমার প্ল্যানটা এক করতে পারি, তবে আমার স্বার্থ আরো সহজে হাসিল হবে। আমি দেখা করি মোল্লাসাহেবের সাথে। আমার উদ্দেশ্য ছিল মেহরাবকে জ্বীনজগত থেকে সরানো, জ্বীনরাজ্য আমার আয়ত্বে আনা। তলোয়ারটা নিজের করে নেওয়া। তুই যখন পালিয়ে গিয়েছিলি তার আগেই মেহরাবকে বুঝিয়েছিলাম এই মেয়েটা তোমার মারতে হবে।

ও তো কিছুতেই রাজি হচ্ছিলনা, খুব কষ্ট হয়েছিল রাজি করাতে। আমি ভেবেছি ও যদি তোকে মারে তবে নিরীহ মানুষ হত্যার অপরাধে ও জ্বীনজগত থেকে বহিষ্কৃত হবে। আর আমারো রাস্তা পুরাই পরিষ্কার। কিন্তু ও কি করল? তোর প্রেমে পড়ে গেল। তোকে আগলে রাখতে শুরু করল
তাতে আমি আপত্তি করিনি। কারণ, ও যতদিন না জ্বীনরাজ্যে না ফিরলে আমার ই ভাল। তোকে বিয়ে করে ও সেখানে রয়ে যাবে।

আমি মেহরাবের দিকে তাকালাম একবার। এতকিছু ছিল এর পিছনে, আমি অকারণেই মেহরাবের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। মেহরাবের এর মধ্যে জ্ঞান ফিরে এল। আস্তে করে উঠে বসে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
উঠে আমার কাছে আসতে চাইতে উম্মে চোখের ইশারায় ওকে দূরে ফেলে দিল ধাক্কা দিয়ে। মেহরাব দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ল।

~ উহু, মেহরাব নড়ার চেষ্টা করোনা। তোমার এখন কোনো শক্তি নেই যে আমার সাথে মোকাবেলা করতে আসবে। তাই আমি যা বলছি চুপচাপ তাই করো। নাহলে তোমার প্রাণপ্রিয় বউ আর তার পেটের সন্তান দুজনেই আমার হাতে মারা পড়বে। মেহরাব অসহায়ের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল
~ উম্মে তুমি পাপের সীমানা অতিক্রম করোনা।

~ সেটা তো আগেই অতিক্রম করে ফেলেছি নিজের যমজ বোন উম্মেকে মেরে ফেলে। আমি তো উম্মে নয় উমাইয়া। আমি চমকে উঠলাম। এত প্যাচ এই কাহিনীতে! উমাইয়া একটু থেমে আবার বলল,
~ কেন মেরেছি জানো? নিজের স্বার্থের পথে ও একটা বাধা ছিল।

আমি ভেবেছিলাম মেহরাবকে কাছে কাছে থেকে সুযোগমত তাকে মেরে তলোয়ার হাতিয়ে নিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে যাব। উম্মের জন্য আমি কখনোই মেহরাবের কাছে ঘেষতে পারতামনা, উম্মে সব জেনে গিয়েছিল। তাই নিজের হাতে নিজের বোনকে শেষ করে দিয়েছি।

আফসোস ছিল একটাই, এত কিছু করেও ওই মেহরাবকে মারতে পারলাম না, ওর থেকে এটা জানতে পারলামনা তলোয়ারটা কোথায় আছে! ও জ্বীনজগত থেকে বাহিরে থাকাকালীন ও জ্বীনরাজ্য আমি আয়ত্বে আনতে পারিনি। ওরা মেহরাবের মৃত্যু ছাড়া অন্য কাউকে রাজ্যে মানবেনা।সব উল্টোপাল্টে গেল, রেগে গিয়ে দাদীমা আর আন্টিকে মেরে ফেললাম। ও আর তোকেও মারতে চেয়েছি, ভাগ্যের জোরে বেচে গেলি বার বার!
কিন্তু এইবার আর নয়, সব গুলো মারব একসাথে।

তাই তো তোর বাবাকেও বাচিয়ে রেখেছি। আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত সাজানো প্ল্যান ছিল ওদের শুধুমাত্র সামান্য পার্থিব সম্পত্তির জন্য। গা ঘিন ঘিন করে উঠল। সম্পত্তির জন্য মানুষগুলো এত নিচে নামতে পারে। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে কেদে দিয়ে বললেন, মুশুমা, কেন এলি এখানে তুই? বাবা হিসাবে আজ কি আমার মেয়ে, নাতিনকে বাচাতে পারবনা!

~ বাবা ভেঙ্গে পড়োনা। আল্লাহ আছেন আমাদের সাথে। এই শয়তানরা কিচ্ছু করতে পারবেনা। কথা শুনে চাচ্চু ক্ষেপে গেল। আমাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে নিল, চুলের মুঠি ধরে বলল, আমি শয়তান? তবে দেখ শয়তান কি কি করতে পারে?

বাবা আর মেহরাব ছুটে আসতে চাইল আমাকে বাচাতে। কিন্তু উমাইয়া ওদেরকে ধরে রেখেছে।
চাচ্চু আমাকে জোরে ধাক্কা দিলেন। সাথে সাথে পড়ে গিয়ে ঘরের এক কোণে থাকা বড় পাথরের সাথে পেটে বাড়ি খেলাম। জান বেরিয়ে যাচ্ছিল আমার মনে হয়, আল্লাহ আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়নি তো। খুব ব্যথা শুরু হল পেটে। আর সহ্য করতে পারছিলামনা। ওরা হাসতে হাসতে বাবা আর মেহরাব উঠিয়ে নিল।

উমাইয়া আমাকে ডেকে বলল,এখন তোর চোখের সামনেই তোর বাবা আর স্বামীকে মেরে ফেলব। মেহরাব ভয় পেয়োনা, তোমাদেরকে বেশি কষ্ট দিয়ে মারবনা। আল্লাহ এখন কি হবে? আমি কি ওদেরকে বাচাতে পারবনা। গলার তাবিজটার দিকে তাকালাম, এটা ব্যবহার করার উপযুক্ত সময় এখন।

খুলে হাতে নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরে বললাম, ওদেরকে রক্ষা করো আল্লাহ। কিন্তু কাজ হচ্ছেনা, ওরা আস্তে আস্তে আঘাত করতে যাচ্ছে। ইয়া আল্লাহ! এখন কি করব?
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মা একজনের জন্য চাও। জামাইকে বাচা তুই। মেহরাব আমাকে মানা করে বলল, না মুশু তুমি বাবাকে বাচাও। এত ভেবোনা, তুমি বাবাকে আগে রক্ষা করো।

আমি কি করব বুঝতে পারছিনা, একদিকে স্বামী আরেকদিকে বাবা। দুইজনেই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এমনসময় চাচ্চু এসে আমার পেটে লাথি মারল। আমি ব্যথায় কঁকিয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। তাবিজটা ছুড়ে গিয়ে বাবার হাত পড়ল। বাবা সেটায় ফু দিয়ে মেহরাবের দিকে ছুড়ে মারলেন। তাবিজটা মেহরাবের গায়ে পড়া মাত্রই উমাইয়া ছিটকে দূরে পড়ে গেল। ভীষণ রেগে ও বাবাকে চেপে ধরল।

চোখের সামনেই আমার বাবাকে দুটুকরো করে দিল মাঝ বরাবর। আমি চিৎকার ও করতে পারছিলামনা, এতটা চোট পেয়েছি লাথিটায়। না পারলাম বাবাকে বাচাতে, না পারলাম নিজের সন্তানকে বাচাতে। আমি পারিনি কিছুই। উমাইয়া আমার দিকে তেড়ে এল, বুঝতে পেরে গেছি এখন আমাকে মারবে ও। চাচ্চু গিয়ে মেহরাবের গালে ঘুষি দিয়ে তাবিজটা কেড়ে নিল, সাথে সাথে মেহরাবকে বেধে উবু করে মাটিতে বসিয়ে দিল।

উমাইয়া তার ভয়ংকর হাসি দিয়ে রক্তাক্ত নখগুলো আমার দিকে তাক করল। এমনসময় আমার সেই কালো চাদর পরিহিতা শুভাকাঙ্ক্ষী এসে সামনে দাড়াল। উমাইয়া অবাক হয়ে থমকে গেল, সাথে আমি আর মেহরাবও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

আজ আমার শুভাকাঙ্ক্ষীর পরনে কালো চাদর নেই, তার নূরানী মুখটা শোভা পাচ্ছে। মেহরাব অবাক হয়ে বলে উঠল, উম্মে!
শুনে আমিও তাকাল হ্যা এটাই তো উম্মে। কিন্তু উমাইয়া তো উম্মেকে মেরে ফেলেছিল। উম্মে হাসি দিয়ে বলল,
~ কিরে বোন ভয় পেলি?

~ তুই তো মরে গেছিস, নিজের হাতে আমি তোকে মেরে ফেলেছি। ফিরে এলি কি করে তুই?
~ মরেও ফিরে এসেছি তোর পাপ শেষ করার জন্য। আজ তোর পাপের খেলা এখানেই শেষ হবে। তোকে আমার সাথে নিয়ে যাব বোন। যাবি তো?

উমাইয়া খুব ভয় পেয়ে গেল। পিছু হটতে হটতে বলল, আমার কাছে আসবিনা উম্মে। আমি কিন্তু তোকে ছাড়বনা।
~ আত্মাকে তুই কিছুই করতে পারবিনা, আমি চাইলে তোকে অনেককিছুই করতে পারব। বলে উম্মে নিজের নখ বের করে নিল। আল্লাহু আকবার বলে উমাইয়ার বুকে ঢুকিয়ে দিলে হার্টটা বের করে আনল।

আমি সহ্য করতে না পেরে চোখ বুজে নিলাম। মেহরাব আমার কাছে ছুটে এল, আস্তে আস্তে আমাকে উঠাল। চাচ্চু উম্মের এমন রুপ দেখে তাড়াতাড়ি করে পালিয়ে গেল। উম্মে ওর পিছু নিতে যাবে আমি ওকে ডাকলাম, উম্মে!
সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চিন্তা করোনা মুশায়রা। তোমাদের বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়নি। সে সম্পূর্ণ সুস্থ আছে।

মেহরাবের দিকে তাকালাম আমি। ওর চোখ থেকে পানি ঝড়ছে। আমারো খুব খারাপ লাগছে, এভাবে এত ভাল মেয়েটাকে মরতে হল।

উম্মে মেহরাবের কাছে এসে বলল, সুখে থাকো তোমরা। আমি খুব খুশি হয়েছি আমার মেহরাবকে দেখার জন্য একজন যোগ্য মানুষ আছে। এখন শান্তিতে বিদায় নিতে পারব।তোমার বাচ্চাটার খেয়াল রেখো।
জ্বীনবংশের ভরসা ও। ভালো থেকো তোমরা। আমি অই শয়তানটাকে শেষ করে নিজের দায়িত্ব শেষ করি। আল্লাহ হাফেজ।

বলেই উধাও হয়ে গেল। মেহরাব আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে এলোপাথাড়ি চুমু খেতে লাগল। “খুব ভালোবাসি বউ!”
~ প্রচন্ড ভালোবাসি মেহরাব।

আমরা এক একটা দিন গুনতে লাগলাম নতুন সদস্যের অপেক্ষায়। আল্লাহর রহমতে আমাদের সংসার সুখে পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
কেবল আমাদের বাচ্চাটা আসার প্রতীক্ষা।

মেহরাব খুব যত্ন করে আমার। মাঝে মাঝে পেটে কান লাগিয়ে বলে, দেখো ও আমাদের নাম উজ্জ্বল করবে। আমার বুকটা ধক করে উঠে, কে জানে সামনে কি অপেক্ষা করে আছে!

লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “জ্বীনবর (সিজন ২) – ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প বলো” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – জ্বীনবর (সিজন ৩) – রোমান্টিক ভূতের গল্প


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *