ছলনাময়ী ভালোবাসার গল্প

ছলনাময়ী ভালোবাসার গল্প – ধোঁকা ও ভ্রম | Sad Love Story

ছলনাময়ী ভালোবাসার গল্প – ধোঁকা ও ভ্রম: মানুষ তার এক জীবনে যতগুলো ধোঁকা খায় তার মধ্যে বেশিরভাগ ভালবেসে বা মিথ্যে প্রেমের ফাঁদে পড়ে। এমনি এক ছলনাময়ী ভীষণ কষ্টের ভালবাসার গল্প আজ আপনাদের আমাদের লেখিকা আফ্রিনা সাথি শোনাবে। চলুন তবে শুরু করা যাক বিশ্বাসের গোড়ায় বিষ ঢালার গল্প।

আহনাফের ছলনাময় ভালবাসা

গতকাল রাতে কার সাথে ফিসফিস করে কথা বলছিলে?

তোমার মাথাটা দিনদিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, নুসরাত। বাচ্চা ছাড়া কি কেউ বাঁচেনা? অনেক হয়েছে এবার একটু স্বাভাবিক হও।

আহনাফের কথায় আমার মাথাটা কেমন করে! সত্যিই কি আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। কয়েকদিন আগে আমি রান্না করছিলাম। আহনাফের ফোনটা বেজেই চলেছে। বিরক্ত হয়ে রুমে যেয়ে দেখি আহনাফ ওয়াশরুমে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি ওর বান্ধবী রাইসার কল। আমি মোবাইলটা রেখে আবার রান্নাঘরে চলে এলাম। বুঝতে পারছিলাম আহনাফ ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছে। রাতে যখন জিজ্ঞেস করলাম, রাইসার সাথে এত কি কথা? ও খুব বিরক্ত হল। আমাকে বলল ও ওর বন্ধু জয়নালের সাথে কথা বলছিল। আমাকে কল লিস্ট ও দেখালো। মোবাইলে তন্ন তন্ন করে খুজেও রাইসার মিসড কল গুলো পেলাম না। সত্যি আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। সত্যিই কি আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি?

আহনাফের আচরণে কোন অসংগতি নেই। ও আমাকে অনেক ভালোবাসে। এই যে বিয়ের এত বছর পর ও আমাদের কোন বাচ্চাকাচ্চা হল না তাতেও আহনাফ কখনো কিছু বলেনি। আমি জানি একটা বাচ্চার জন্যা ওর মধ্যেও হাহাকার আছে। কিন্তু ও সেটা আমার জন্যে চেপে রাখে। কিন্তু তারপর ও আমি কেন মাঝেমাঝেই ভুলভাল দেখি। এই ত ২/৩ দিন আগে ও অফিস থেকে বাসায় ফিরে সার্টটা খুলে ওয়াশরুমে গেল। আমি সার্টটা সরিয়ে রাখতে গিয়ে স্পষ্ট দেখলাম ওতে লিপিস্টিকের দাগ বসে আছে। আহনাফ বের হলে ওকে বলতেই হেসে উড়িয়ে দিল।

তোমার সত্যি মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, নুসরাত। এই দেখো শার্টটা।

আহনাফ শার্টটা আমার সামনে ধরলে আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওখানে কোনই দাগ নেই। আমার মাথা ঘুরতে আরম্ভ করল। আহনাফ তখনি ওষুধ এনে আমাকে দিল। ওষুধটা খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে গেলাম।

নুসরাতের মানসিক রোগ

সেদিন আহনাফের আসতে দেরি হচ্ছিল। তাই বসে টিভি দেখছিলাম। কলিংবেলের শব্দে উঠে গেলাম। দরজা খুলতেই দেখি আহনাফ ওর বান্ধবীকে জরিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মাথা ঘুরছিল। কি করব বুঝতে পারছিনা। ইচ্ছা করছিল চড় দিয়ে মেয়েটাকে বাসা থেকে বের করে দেই। হঠাৎ আহনাফের কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম। দরজাটা ধরে দাড়িয়ে আছ কেন?

আহনাফের গলা শুনে মনে হল ও নেশা করেছে। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আহনাফ আমার গালে কষে একটা থাপ্পর দিল। আমি ঠাস করে পড়ে গেলাম। সাথে সাথে জ্ঞান হারালাম। কলিংবেলের শব্দে আমার জ্ঞান ফিরল। উঠে দেখলাম আমি সোফায় টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দরজা খুলতেই আহনাফ আমার দিকে হেসে একটা ফুলের তোড়া এগিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সত্যি বলতে ভূলেই গিয়েছিলাম আমার জন্মদিনের কথা।

সত্যি আমি কিছু বুঝতে পারছিনা এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? আমি কি তাহলে পাগল হয়ে যাচ্ছি?

নুসরাতর কথা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.তাহির।

আমার মনে হয় আপনি বাচ্চা নিয়ে অনেক বেশি ভাবেন। আর তা থেকেই আপনার মনে নানা ধরনের নেতিবাচক ভাবনা আসছে। আর এই নেতিবাচক ভাবনাগুলো আপনার অবচেতন মনে একটা ছাপ ফেলে যাচ্ছে। আর তাই ভাবনাগুলোকে আপনি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছেন। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। এগুলো খেতে থাকেন। আর সেই সাথে নিজেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখুন। ৭ দিন পর আমার সাথে দেখা করবেন।

ডা. তাহিরের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে নুসরাত আহনাফের অফিসে গেল।

নুসরাতকে দেখে আহনাফ ভীষণ খুশি হল। অফিস ছেড়ে ওকে নিয়ে ঘুরল অনেকক্ষণ।

নুসরাত নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছে। ঘুমও হচ্ছে ঠিকমত। তবুও আবোল তাবোল দেখা বন্ধ হচ্ছেনা। ইদানিং নুসরাতকে রুমের মধ্যে বন্ধ করে আহনাফ অফিসে যায়। শেষমেষ উপায় না পেয়ে নুসরাত তার বাবা মাকে খবর দেয়। উনারা এসে নুসরাতকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে।

রাইসার মিথ্যে ভালবাসা

২ বছর পর…

রাইসাঃ আহনাফ দেখোত আবিদ কোথায়?

রাইসার ডাকে আহনাফ ল্যাপটপ থেকে মুখ সরিয়ে আবিদকে এদিক ওদিক খুজতে লাগল। একটু পরেই দেখল আবিদ টেবিলের নিচে বসে আছে।

রাইসাঃ আমি বেরোলাম তুমি আবিদকে দেখো।

আহনাফ তাকিয়ে দেখে রাইসা সেজেগুজে কোথায় যেন বের হচ্ছে?

আহনাফঃ তুমি এই সময় কোথায় যাচ্ছ, রাইসা? গতকালও এই সময় বেরোলে?

রাইসাঃ আহনাফ তোমার মাথাটা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি ত গতকাল তোমাকে নিয়ে ব্যাংকে গেলাম।

আহনাফের মাথাটা কেমন করে ওঠে। ইদানিং কি সব ঘটছে ওর সাথে! মনে হয়, রাইসা মাঝরাতে কার সাথে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। ওর নড়াচড়া টের পেলেই কথা বন্ধ হয়ে যায়। আহনাফ লাইট জ্বালিয়ে দেখে রাইসা অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

আহনাফের মানসিক রোগ ও শাস্তি

আহনাফের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ওর সন্দেহ দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। সেদিন ও স্পষ্ট শুনল রাইসা কাকে মোবাইলে বলছে, আবিদ নাকি আহনাফের ছেলে না। আহনাফের মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। কিন্তু পরে রাইসাকে জিজ্ঞেস করতেই ও কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলে। শেষমেষ অনেক বুঝিয়ে রাইসা আহনাফকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যায়।

ডা.তাহির চেম্বারে আজ বিরস মুখে বসে আছে। সিরায়াল দেয়া দুটো রুগি আজ আসেনি। প্রতিদিন উনি ৫ জনের বেশি রুগি দেখেনা। আগে জানলে আরো দুজন রুগির সিরিয়াল রাখতে পারত। বিরক্ত হয়ে যখন সেক্রেটারিকে ডাকতে, যাবে তখনি রাইসা আর আহনাফ ঢুকল। আহনাফকে খুব উদ্ভ্রান্তের মত লাগছে। ডা.তাহির রাইসাকে পাশের রুমে বসতে বলে আহনাফের সাথে একা কথা বললেন।

ডা.তাহির মনোযোগ দিয়ে আহনাফের সব কথা শোনে। আমার মনে হয় আপনার প্রথম স্ত্রীর কিছু ঘটনা আপনার অবচেতন মনে ছাপ ফেলেছে। যার জন্যে আপনার সাথেও এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। ওগুলো খেতে থাকুন। ৭ দিন পর আবার দেখা করবেন।

আহনাফ আর রাইসা বাড়িতে ফিরে যায়। আহনাফ নিয়ম করে ডাক্তারের দেয়া ওষুধ খেতে থাকে। ২ দিন বেশ ভালোই থাকে। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে ওর পাগলামি শুরু হয়। শেষমেষ কোন উপায় না পেয়ে ওকেও মানসিক হাসপাতালে রেখে আসতে হয়।

রাইসার ভ্রম ও পাপের শাস্তি

রাইসা আর তাহির ড্রয়িংরুমে বসে আছে। রাইসা খুশিতে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। আবিদকে কোলে নিয়ে তাহিরর কাছে দিল। নাও তোমার ছেলেকে। এতদিন কত কষ্ট করে তোমার সাথে দেখা করেছি। কিন্তু আর না। এখন থেকে আমরা তিনজন একসাথে থাকব। কত কষ্ট করে নুসরাতকে আহনাফের জীবন থেকে সরিয়েছি। আবার আহনাফকে সরাতেও কম কষ্ট করতে হয়নি। অবশ্য তুমি পাশে ছিলে বলেই সব সম্ভব হয়েছে। এই বাড়ি, আহনাফের সব সস্পত্তি এখন আমাদের। আহনাফকে হাসপাতালে পাঠানোর আগে সব ওর থেকে লিখে নিয়েছি।

তাহির রাইসার মুখোমুখি গিয়ে বসল। দলিলটা কোথায় রেখেছ?

রাইসা আলমারি থেকে দলিলটা বের করে দিল। আহনাফ ওর সব সম্পত্তি রাইসাকে লিখে দিয়েছে।

তাহির মিটিমিটি হাসছে। কফির কাপটা রাইসার হাতে তুলে দিয়ে ও পুরো বাড়িটা ঘুরেঘুরে দেখছে। রাইসা জানেনা তাহিরর পরবর্তী টার্গেট ও নিজেই।

কলিংবেল বেজে উঠল। তাহির দরজা খুলে দেখল নুসরাত দাঁড়িয়ে আছে। নুসরাত এর হাতটা ধরে ওকে ভিতরে নিয়ে এলো। রাইসা তাকিয়ে নুসরাতকে দেখে চমকে উঠল।

একি নুসরাত এখানে? রাইসার মাথাটা ঘুরছে।

তাহির আবিদকে নিয়ে নুসরাত এর হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। রাইসার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল, তুমিও তো আহনাফের মত আচরণ করছ, রাইসা? নুসরাত এখানে কিভাবে আসবে? ওতো এখন মানুসিক হাসপাতালে। রাইসা চোখ কচলে আবার তাকায়। তাহির ঠিকই বলেছে, কোথাও নুসরাত নেই।

গল্প: ভ্রম
লেখা: আফরিনা সাথী

আরো পড়ুন- সত্যিকারের ভালোবাসা বোঝার নিনজা টেকনিক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *