শ্রাবনের বর্ষা – ভালোবাসার গল্প ছবি (১ম খণ্ড)

শ্রাবনের বর্ষা – ভালোবাসার গল্প ছবি: “বর্ষা ছাড়া শ্রাবণ এর অস্তিত্ব অচল। শ্রাবণের কেবল বর্ষাকেই চাই।” অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে রয়েছে শ্রাবণ। কিন্তু দিদিভাই আসছে না। অল্প সময়ের মধ্যে বর্ষা এলো।


পর্ব ১

২১শে শ্রাবণ। কয়েকদিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। মাঠ-ঘাট, পুকুর, বিল সব জলে পরিপূর্ণ। অবিরাম বর্ষণে গ্রামের মানুষের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার ঘটেছে। খড়ের ছাউনি দিয়ে সাজানো ছোট্ট একটা কূঠি। তার মধ্যে ছেঁড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছে পূজারিণী। ভীষণ দুঃখী একটা মেয়ে। তার মন এতটা বিষাদে ভরে গেছে, যে ছাউনির ফাঁকা অংশ থেকে মাথায় পড়া জলের ফোঁটা টের করতে পারছে না। ঘরটা ভীষণ অন্ধকার। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া ভাঙ্গা জানালাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। জানালায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে, এক অদ্ভুত শব্দ সৃষ্টি করে‌ ভেতরে প্রবেশ করছে মৃদু শীতল বাতাস।

মেদিনীপুরে, জেলে পরিবারে জন্ম পূজারিণীর। খুব দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন একজন গায়িকা হবে। পড়াশুনা তেমন ভালো পারে না পূজারিণী। গানই তার প্রাণ তার জীবন। অনিমেষ বাবু মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। তিনি গত দুমাস ধরে গানের স্কুল এ টাকা জমা দিতে পারেননি। গানের টিচার সাফ জানিয়ে দিয়েছে, পূজারিণী যেন সেখানে আর না যায়। ব্যর্থতা স্বীকার করে সেদিন ফিরে এসেছিল পূজারিণী।

দরিদ্র হয়ে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাটা যেনো তার ছিল অপরাধ। তারপর থেকেই আনমনা হয়ে যায় সে। একদিকে নিজের স্বপ্ন শেষ হয়ে যেতে বসেছে। অন্যদিকে, এই বৃষ্টি ভরা মরশুমে বাড়ি ফেরেনি বাবা। তিনদিন ধরে মাছ ধরতে সমুদ্রে গেছে। সমস্ত ট্রলার ফিরে এলেও, অনিমেষ বাবুদের ট্রলার এখনো ফিরে আসেনি। চোখ মিছামিছি বন্ধ করে পড়ে রয়েছে পূজারিণী। ঘুম আসতে চাইছে না। বাস্তবটা ভেবে সে বারবার কেঁপে উঠছে। বর্ণালী দেবী নিজের শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

তিনিও ভীষণ চিন্তিত। ঝড়ের মধ্যেও বাড়িতে ফেরেনি উনার স্বামী। পূজারিণীর পাশে বসে তিনি বুঝতে পারলেন, ঘরের মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটা পরছে। তাড়াতাড়ি করে পূজারিণীকে ডাকতে লাগলেন। মায়ের ডাক শুনেও পূজারিণী ইচ্ছে করে পড়ে রইল। তার কিছুই ভালো লাগছে না। কিন্তু মায়ের বারবার বকবকানিতে শেষমেষ উঠে পরল। পূজারিণী একটু রাগান্বিত ভাব প্রকাশ করে বলল, “ভালো লাগেনা! সামান্য খড় দিয়ে ঘরটাও ঠিক করতে পারো না তোমরা”।

মেয়ের কথা কান না দিয়ে বিছানা গুটিয়ে ফেলেন বর্ণালী দেবী। খাটের ওপর পড়তে থাকা বৃষ্টির ফোঁটায়, একটা ছোট্ট বাটি এনে রাখলে। যাতে জল গড়িয়ে অন্যদিকে যেতে না পারে, ওই বাটির মধ্যে জমতে থাকে। মায়ের কান্ড কারখানা দেখে পূজারিণী আবার বলল, “আর কতদিন এইভাবে চালাবে মা!”বর্ণালী দেবী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভগবান যতদিন না আমাদের দিকে তাকায়, ততদিন আমাদের এইভাবে চলতে হবে।”

_ “ভগবান আমাদের দিকে কোনদিনও তাকাবে না। আমরা সারা জীবন এমনই থেকে যাব।”
_ “ভগবান কখনো কারো জীবনে শুধু দুঃখ লিখে থাকে না। এক টুকরো হলেও সুখ লেখে।”
মা যুক্তি_ তর্ক দিয়ে তাকে ঠিক হারিয়ে দেবে। তাই পূজারিণী বাইরে বেরিয়ে আসছিল বৃষ্টি উপভোগ করার জন্য। তখনই পেছন থেকে মা ডেকে বলে, “দোকানে গিয়ে একবার কাকুকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর তো, তোর বাবা কখন ফিরবে?”পূজারিণী মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখ পেঁচিয়ে বলল, “এমনিতে সমুদ্রে থাকলে কল যায় না। আজ আবার বৃষ্টি হচ্ছে, কল কি করে যাবে শুনি?”

_ “একবার ফোন করলে অসুবিধা কোথায়?”
_ “সব সময় লোকের বাড়িতে গিয়ে কল করতে ভালো লাগে না। কতবার বলেছি একটা ফোন কিনতে। কিন্তু সেটাও তোমরা আনো নি।”
মা আরো কিছু বলছিল, কিন্তু পূজারিণী শুনেনি। বাবার জন্য তার মনটা কেমন হচ্ছিল। মনটা বারবার ছটফট করে উঠছিল বাবার জন্য। বাবাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। অথচ কদিন হলো বাবাকে দেখেনি। উনি কোথায় আছে? কি করছে? কিছুই জানেনা সে। অজানা একটা ভয়ে সে বেরিয়ে পরলো ছাতা মাথায় নিয়ে।

ঝমঝম করে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির সাথে মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়ায় ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম। চারিদিকে থই থই জল। পূজারিণীর যতটা না রাগ হচ্ছিলো নিজের পরিবারের ওপর, তার চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছিল প্রশাসনের ওপর। সে নিজের চোখে দেখেছে, ভোটের সময় কত নেতা_ নেত্রীকে তাদের বাড়িতে আসতে। অথচ আজ দুর্যোগের দিনে তাদের কেউ একবারের জন্য খোঁজ নেয়নি।

দুরন্ত ঢেউ কিংবা ঝড়_ ঝঞ্ঝায় এখানকার জেলেরা বসে থাকে না; হাত গুটিয়ে। মাছ ধরার জন্য বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলে প্রতিদিনই ভাষায় জীবিকার তরী। সাগরে অগভীর অংশে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ফেলা জাল, ওরা টেনে তুলে মাছের জো বুঝে। ওদের বড় জাল প্রস্থ কয়েকহাত হলেও দৈর্ঘ্যে হাজার হাত। লম্বা জাল টানতে জেলে লাগে অনেক, গায়ের জোর লাগে বেশ। মাছ ধরা যেন যুদ্ধ। জেলেরা যোদ্ধা আর জাল ওদের যুদ্ধাস্ত্র। টেনে তোলা জালে মেলে সাগরের হরেক রকম মাছ।

ওরা জালের দড়ি কোমরের সাথে পেঁচিয়ে টানে। সামনে থাকা আরও জেলে হাত দিয়ে জাল টানে। মাছ ধরার কাজটা কষ্ট হলেও শিকার এর মজাটা আছে পুরোপুরি। সেই জন্য গলায় ওদের খুশির গান থাকে সব সময়। এ যেন সাগরের সাথে পাঞ্জা কষে জীবিকার রসল তুলে আনা। কিন্তু হতাশা হয় তখনই, যখন এত কষ্ট করে জাল তোলার পরও মাছ থাকে না।

ট্রলার একবার বেরিয়ে গেলে সমুদ্রে থাকে প্রায় সাত থেকে আট দিন‌ বা আরো বেশি। এই কদিন জেলেদের খাবার এবং ট্রলার চালানোর জন্য তেল যথেষ্ট প্রয়োজন। একবার ট্রলার বের হলে তা খরচ হয় প্রায় দুই থেকে তিন লাখ টাকা। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যে কোন সময় তাদের প্রাণ নিয়ে নিতে পারে। মৃত্যুর সাথে লড়াই করে তারা মাছ ধরে। কিন্তু প্রায় সময় তারা হতাশা হয়ে ফিরে আসে। মাছের তেমন একটা দেখা পায় না। ব্যয় অনেক হয়ে গেছিল, কিন্তু তখন একটাও মাছ শিকার হয়নি।

দুর্যোগের খবর শুনেও অনিমেষ বাবুদের ট্রলার ঘুরে আনেনি। নগর ফেলে সমুদ্রে থেকে যায়। তাদের বিশ্বাস ছিল, ঝড় হয়তো ততটা বিশাল আকার ধারণ করবে না। পরক্ষণে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ তাদের বাধ্য করে মোহনায় ফিরে আসতে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ তাদের ট্রলারকে বারবার এদিক ওদিক করে নিয়ে গেছে। এক সময় তারা বেঁচে থাকার আশা টা ছেড়ে দিয়েছিল। তবু শেষমেশ অনেক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে মোহনায় ফিরে এসেছে।

নতুন জীবন ফিরে পাওয়ায়, মুখে একটা ছোট্টো হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন অনিমেষ বাবু। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি আসতে পূজারিণীকে দেখে একটু আশ্চর্য হন। এই বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা কি করছে? অনিমেষ বাবু আবার একবার হেসে ওঠে। নিশ্চয়ই তাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। একটা জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে পূজারিণীকে ডাকলেন তিনি। পূজারিণী ঘুরে দেখল, বাবা রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে। তার স্থির চোখ সম্পূর্ণভাবে পূজারিনির ওপর নিমজ্জিত। পূজারিণী নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না।

বাবাকে দেখামাত্র বুকটা আনন্দে ভরে উঠলো। চোখের জল বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু বৃষ্টির জলে তা মলিন। ছাতা ফেলে দিয়ে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। অনিমেষ বাবু একটা ছেঁড়া পোশাক পরে রয়েছেন, কাদা আর বালিতে ভর্তি। শরীর থেকে আঁশটে গন্ধ বেরিয়ে আসছে। কিন্তু পূজারিণী এসব কিছুই পাচ্ছে না, তার নাকে কেবল বাবা বাবা একটা সুগন্ধী ভেসে আসছে। বাবার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল পূজারিণী। অনিমেষ বাবু মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। কিছুক্ষণ স্থির অবস্থায় থাকার পর অনিমেষ বাবু বললেন, “বোকা মেয়ে! কান্না করছিস কেন? পূজারিণী কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

“কোথায় ছিলে এতদিন? এই বৃষ্টির মধ্যে মাছ ধরতে না গেলে হয় না!”
_ “আমরা এতে অভ্যস্ত। আমাদের কিচ্ছু হবে না। গোটা ভিজে গেছিস। মা এবার জোর বকুনি দেবে…”
অনিমেষ বাবু ব্যাগ থেকে একটা গামছা বের করল। গামছাও অনেক ভিজে রয়েছে। ভিজে গামছা দিয়ে মেয়ের মাথা মুছে দিল। তারপর ছাতা মাথায় দিয়ে, সমুদ্রে মাছ ধরার কৌশল এর অভিজ্ঞতা মেয়ের সাথে শেয়ার করতে করতে হাঁটতে শুরু করল। পূজারিণী একটা হাত বাবার আর একটা হাতকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে।

বাড়ি ফিরতেই মা কথা শোনাতে লাগলো পূজারিণীকে। বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যায়। সকালে একবার ভিজেছে আবার এখন একবার। পোশাকও খুব বেশি নেই। বাড়িতে ব্যবহার করার জন্য মাএ দুটি পোশাক রয়েছে তার। যা ইতিমধ্যে ব্যবহার করে ফেলেছে সে। প্রথমে বাক্স থেকে একটা নতুন পোশাক পরার জন্য আবদার করে পূজারিণী। কিন্তু মা ‘না’ বলে। কাল ‘বাইশে শ্রাবণ’। স্কুলে ফাংশনে গান গাইবে। সেখানে নতুন পোশাক পরে যাওয়া শ্রেয় বলে মনে করে বর্ণালী দেবী। মায়ের একটা পুরনো শাড়ি পরে নিল সে। মনের মধ্যে ভীষণ রাগ। নতুন পোশাক পরলে এমন কী হয়ে যেত? কাল না হয় আবার সেই পোশাক পরে স্কুলে গান গাইতো। মায়ের সবকিছুতে বাধা। মায়েরা হয়তো এমনই হয়।

ইতিমধ্যে অনিমেষ বাবু আর বর্ণালী দেবী বাদানুবাদে জড়িয়ে গেছে। পূজারিণী ইলিশ মাছ খেতে ভীষণ পছন্দ করে। কিন্তু অভাবের কারণে তা কখনো হয়ে উঠে না। নিজের হাতে কত ইলিশ মাছ নাড়াচাড়া করে, কিন্তু তা কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই অনিমেষ বাবুর। গরীব হলে বোঝা যায়, জীবনটা কত অদ্ভুত! কত ছোট ছোট ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তাদের। বাড়ি ফেরার সময় 200 টাকা দিয়ে একটা ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে আসেন তিনি। তাই নিয়ে বাদানুবাদ। বাইরে বৃষ্টি পড়তে না পড়তেই ঘরের ভেতরে বৃষ্টি পড়ছে, মেয়েকে গানের স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে, এগুলো দেখাশুনা না করেই তিনি 200 টাকার মাছ কিনে নিয়ে এসেছেন। অনিমেষ বাবু এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

তিনি জানেন, বাড়ি ফিরলে স্ত্রী কথা শোনাবে। তাই তিনি চুপচাপ বসে রয়েছেন, মাঝে মধ্যে দু’একটা কথা বলছে। পূজারিণী বাবার মাথায় সরষের তেল মাখিয়ে দিতে লাগল। তখনো মা ঝগরা করে চলেছে। বাবা_ মেয়ে চোখাচোখি হতেই দুজন হেসে ওঠে। তাদের হাসি দেখে আরো বেশি ক্ষেপে যায় বর্ণালী দেবী। বর্ণালী দেবীকে শান্ত করার জন্য অনিমেষ বাবু স্নান করতে বেরিয়ে যায়। কিন্তু বর্ণালী দেবী চুপ হলেন না। আবার নতুন একটা ঝামেলা শুরু করলো।

বর্ষার দিনে উনুনে জল উঠে রয়েছে। শুকনো ডাল আর পাতা গুলো ভিজে গেছে। সহজে আগুন ধরছে না, ধোঁয়া সৃষ্টি করছে। বিরক্ত হয়ে সমস্ত রাগ অনিমেষ বাবুর ওপর উগরে দিচ্ছেন বর্ণালী দেবী। মায়ের বারবার বকবকানি তে পূজারিণী একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “সব সময় ঝগড়া করতে তোমায় ভালো লাগে! একটু মানিয়ে নিতে পারো না।” তিনি বারবার উনুনে ‘ফুঁ’ দিতে লাগলেন। অনেকবার ‘ফুঁ’ দেওয়ার পর আগুন জ্বলে উঠলো। বর্ণালী দেবী এবার পূজারিনির দিকে তাকিয়ে বলল, “সব সময় মেয়েদেরকে মানিয়ে নিতে হবে কেন? ছেলেরাও তো পারে মানিয়ে নিতে। আমিও অনেক বড় পরিবারে জন্মে ছিলাম। কখনো উনুনের পাশে যেতে দেয়নি আমার বাবা_ মা। আর আজ… আর কত মানিয়ে চলব।”

_ “শুধু কি তুমি মানিয়ে নিচ্ছো! বাবাও কত মানিয়ে নিয়ে নিচ্ছে। আমাদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য নিজের প্রাণ এর সাথে লড়াই করে মাছ ধরছে। আমাদের জন্য আর কি করতে বাকি আছে বাবার?”
_ “হ্যাঁ, বাবার প্রতি তো দরদ উথলে উঠবে। আর আমি যে সারাদিন বাড়িতে কাজ করে মরছি সেদিকে লক্ষ নেই। বিয়েটা হোক, তারপর বুঝবি মেয়ে হওয়ার যন্ত্রণাটা কত!

মার সাথে কখনো পেরে ওঠেনি পূজারিণী। আজও পারবে না। তাই কথা না বাড়িয়ে ভেতর থেকে উলে গোনা আসন আনতে চলে গেল। সে নিজের হাতে আসনগুলো গুনেছে। উনুনের পাশে ছোট্ট একটা জায়গায় রয়েছে। সেখানে বসেই তারা খায়। পূজারিণী তিনটি আসন সেখানে বিছিয়ে দিল। অল্প সময়ের মধ্যে বাবা চলে এলেন। তিনজন বসে খাচ্ছে। কারুর মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ অনিমেষ বাবু পূজারিণী মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “চিন্তা করিস না মা! আমি নিজে গিয়ে দিদিমনির পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো।

তোকে আবার ভর্তি নেওয়ার জন্য।”বাবার কথা শুনে গলায় ভাত লেগে গেল পূজারিণী। তাড়াতাড়ি জল খেয়ে বলল, “আমার জন্য তোমাকে ছোট হতে হবে না। আমি গান শিখতে চাই না। গান শেখার জন্য অনেক ইন্সট্রুমেন্ট এর প্রয়োজন। যেগুলো আমাদের সামর্থের বাইরে। হয়তো কখনো কিনতেও পারবো না। আমরা এমনি ভালো আছি। আমি গান শিখতে চাই না বাবা!”কথাগুলো বলে পূজারিণী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বাবা পূজারিনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে”।
_ “কিছু ঠিক হবে না। আমি গান শিখতে চাই না। আমি শুধু তোমাদের কাছে থাকতে চাই।”

_ “কিন্তু তোর স্বপ্ন!”
পূজারিণী একটু হেসে বলল, “বাবা মার হাতে হাত রেখে বড় হওয়া, বাবা মার সেবা সুস্থতা করার চাইতে, আর বড় স্বপ্ন কিছুই হতে পারে না। আমার এটুকু হলেই হবে।”ছোটবেলা থেকে দেখা স্বপ্নগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। শুধুমাত্র দারিদ্রতার কারণে। ছোটবেলা থেকে কত স্বপ্ন ছিল, সে একজন গায়িকা হবে। বাবা মার জন্য একটা পাকা বাড়ি বানিয়ে দেবে। বাড়ির সামনে বাগান তৈরি করবে। সেখানে বসে তিনজন রাতের পর রাত গল্প করবে। যা আজ কাকতালীয়। চ্যাম্পিয়ন সত্তা অনেকের মধ্যে থাকে। কেউ কাজে লাগিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। কেউ নিজের চ্যাম্পিয়ন সত্তাকে নিজেই হারিয়ে ফেলে। আবার কেউ বাস্তবতার কাছে হেরে যায়।


পর্ব ২

অনেক আগেই ঘড়ির কাঁটা রাত নয়টা পূর্ণ করে ফেলেছে। বিকেলের পর থেকে বৃষ্টি কমতে শুরু করে এবং সন্ধ্যের পর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এখন রাতের আকাশে গোটাকয়েক তারার অবতরণ ঘটেছে। কয়েকদিন ধরে অবিরাম বর্ষণ এর জন্য, মৃদু ঠান্ডা আবরণ সরে যায় নি। মাঝেমধ্যে দমকা হাওয়া হচ্ছে তবে আগের তুলনায় অনেক কম। কয়েকদিন বৃষ্টিতে বন্দি থাকা কলকাতাবাসী বেরিয়ে পড়েছে একটু ঘুরে দেখার জন্য। অবিরাম বর্ষণ শহরবাসীকে বন্দি করে রাখলেও, বর্ষা চৌধুরীকে বন্দী করতে পারে নি।

চৌধুরী পরিবারের একমাত্র ভিত বর্ষা চৌধুরী। ছোটবেলায় বাবা মারা যায়। তখন মা কোন ভাবে সংসার দেখে নেয়। কিন্তু পরে সমস্ত দায়িত্ব পড়ে বর্ষা চৌধুরীর উপর। এক দিকে বৃদ্ধ মা অন্যদিকে প্রতিবন্ধী দাদা। সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে উঠে বর্ষা। এত বর্ষণের মধ্যেও সে ছুটি নেয় নি, রেগুলার উপস্থিত থাকলে অফিস ‌থেকে বোনাস পাওয়া যায়। বোনাসের লোভে কখনোই অফিস অফ করেনি সে।

হুইল চেয়ারের উপর বসে রয়েছে হেরে যাওয়া এক চরিত্র শ্রাবণ চৌধুরী। ফর্সা, ছিপছিপে গড়ন বিশিষ্ট শরীর। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। কতটা লম্বা তা বলা প্রায় অসম্ভব। ছোটবেলা থেকেই উঠে দাঁড়াতে পারে নি। ভগবান দুটো পা দিলেও সেই পায়ে কোন শক্তি নেই। মাথায় চুল যেমন স্পর্শ কাতরহীন এবং শক্তিহীন, তেমনি তার পা দুটো শক্তিহীন। খুব লাজুক ছেলে। লাজুকতার জন্য তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে ভালো গান গাইতে পারতো শ্রাবণ, কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার নিজেই শেষ করেছে।

প্রতিবন্ধকতাকে দূরে ঠেলে এগিয়ে যেতে পারে নি। যেখানে মানুষ প্রতিবন্ধকতাকে দূরে ঠেলে হিমালয় জয় করছে, সেখানে শ্রাবণ হুইলচেয়ারে বসে গান গাইতে সংকোচন বোধ করে। স্কুলে বেশি দূর পড়াও হয়ে ওঠেনি। বন্ধুদের অপমান লাঞ্ছনার শিকার হয়ে একসময় পড়াশোনাও বন্ধ করে দেয়। অপমানকে ভীষণ ভয় পায় শ্রাবণ চৌধুরী। অপমান সহ্য করতে পারে না। বাড়িতে বসে একজন গায়ক তৈরি করার স্বপ্ন দেখতে থাকে সে। তার মাধ্যমেই সে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। তার ছাত্র ইন্টারন্যাশনাল গায়ক হবে; অনেক সম্মান অর্জন করবে। কিন্তু সেই ছাত্র এখনো খুঁজে পায়নি শ্রাবণ চৌধুরী। শ্রাবণ কোনো প্রফেশনাল গায়ক নয়। তার কাছে নেই কোনো অ্যাওয়ার্ড।

কোন বড় স্টেজ সোও করে নি। বাবা বড় গায়ক ছিল তা বলে ছেলে যে বড় গায়ক হবে তার কোনো কথা নেই। তাই কোন পিতা_ মাতাও শ্রাবণের কাছে নিজের ছেলেকে গান শিখতে চায় নি। অনেক গানের স্কুলে শিক্ষকতা করার জন্য এপ্লাই করে শ্রাবণ, কিন্তু তাকে সুযোগ দেয় নি। অথচ শ্রাবণ চৌধুরী একজন গানের শিক্ষকের মত সমস্ত যোগ্যতার অধিকারী। তার বাবা তাকে সমস্ত গান শিখিয়েছে। গানের তাল, গিটার, হারমোনিয়াম, সবকিছুই শিখিয়েছে তার বাবা। শুধুমাত্র বড় বড় এ্যাওয়ার্ড হাতছাড়া হয়েছে। নিজের নাম বড় করে উঠতে পারেনি, তাই আজ অবহেলিত সে।

দিন ছাড়া রাত্রি অসম্ভব। তেমনি বর্ষা ছাড়া শ্রাবণ অসম্ভব। দাদার স্বপ্ন পূরণের জন্য বর্ষা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। নিজেই অনেক ছাত্র এনে দিয়েছিল। কিন্তু এক থেকে দু মাস গান শেখাতে না শেখাতে তাদের বিদায় করে দিয়েছে শ্রাবণ। যার ইচ্ছে শক্তি নেই তাকে জোর করে হয়তো গান মুখস্ত করে নেওয়া যায়, কিন্তু গান শেখানো যায় না। তার প্রমাণ শ্রাবণ চৌধুরী নিজেই। নিজের ইচ্ছেশক্তি না থাকার জন্য সে বড় গায়ক হয়ে উঠতে পারেনি।

অভাবের টান থাকলেও ছেলেদেরকে গান শেখাতে চাই নি। শুধুমাত্র টাকার জন্য কখনোই কাজ করেনি শ্রাবণ চৌধুরী, আর ভবিষ্যতেও করবে না। জোর করে কখনো কোন কিছু শেখা যায় না, ভবিষ্যতেও যাবে না। কোন কিছু শিখতে চাইলে তার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি থাকা উচিত। এইগুলোর একটাও ছিল না ওই ছেলেগুলোর মধ্যে।
পুরো বাড়িটা আজ বেলুন দিয়ে সাজিয়েছে শ্রাবণ আর অনন্যা দেবী। শুধুমাত্র একুশে শ্রাবণ, চৌধুরী পরিবার আনন্দের ভরে ওঠে।

অনন্যা দেবীর যমজ সন্তান শ্রাবণ_ বর্ষার জন্মদিন। দুজনের বয়স 25 প্লাস। তবুও কেউ বিয়ে করে নি। শ্রাবণ অনেকবার বর্ষাকে বিয়ে করার কথা বলেছে। কিন্তু বর্ষা কখনো রাজি হয়নি। বর্ষা বলে, “বর্ষাকে কেবল শ্রাবণ মাসে মানায়। এই বর্ষার কখনো শ্রাবনকে ছেড়ে যাবে না। শ্রাবণ যতদিন থাকবে ততদিন বর্ষাও থাকবে। শ্রাবণ বর্ষার একে অপরের পরিপূরক।”বর্ষার এই কথা শুনে শ্রাবণ হাসি ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না। বর্ষাও শ্রাবনকে অনেকবার বিয়ের কথা বলেছে। কিন্তু শ্রাবণও উল্টে বলে,

“বর্ষা ছাড়া শ্রাবণ এর অস্তিত্ব অচল। শ্রাবণের কেবল বর্ষাকেই চাই।” অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে রয়েছে শ্রাবণ। কিন্তু দিদিভাই আসছে না। অল্প সময়ের মধ্যে বর্ষা এলো। মা গিয়ে দরজা খুলতেই বর্ষা তাড়াতাড়ি বলল, “দাদা ভাই রেগে রয়েছে তাই না! কত দেরি হয়ে গেল।”মা ধীর গলায় বলল, “আজকের দিনেও তোকে অফিসে যেতে হয়! কতবার বললাম আজকে অন্তত থেকে যা! শুনলি কই।”

_ “ও মা! তুমি বোঝনা কেন বলতো? সব বুঝেও না বোঝার ভান করছ।”
_ “আমাকে বুঝিয়ে কিচ্ছু হবে না দাদাকে বোঝাবি যা।”অনন্যা দেবী মেয়ের দুটো গাল টিপে বললেন।
বর্ষা চতুর্দিক দেখতে লাগলো। দরজার কাছাকাছি কেউ নেই। হাতে থাকা অফিসে ব্যাগ মাকে দিয়ে বলল, “তুমি ব্যাগটা রেখে দাও। আমি পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকছি।”
_ “আচ্ছা, তাড়াতাড়ি তৈরি হয় আসিস, শ্রাবণ কিন্তু ভীষণ রেগে রয়েছে”।

বর্ষা হন হন করে নিজের রুমে চলে গেল। শ্রাবণের চোখে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ নয়। সে ঠিক বুঝতে পেরে গিয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যে বর্ষা একটা গোলাপী রঙের শাড়ি পড়ে বেরিয়ে এল। হুইল চেয়ার এর কাছে এসে শ্রাবনকে জড়িয়ে ধরে তাড়াতাড়ি বলে ফেলল, “সরি রে।”শ্রাবণ বর্ষার দুটো হাত সরিয়ে দিল। ভীষণ রেগে রয়েছে সে। সব সময় বর্ষা দেরি করে। সবকিছুতেই তার লেট। দাদার রাগ কি করে ভাঙাতে হয় বর্ষা তা জানে। সে আবার শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরে গালে চুম্বন করল। একটা চুম্বনে শ্রাবণের রাগ নিমিষে উধাও হয়ে গেল। তবুও রাগান্বিত ভাবে বলল, “আজকের দিনেও তুই লেট করে আসলি। আজকে অফিস না গেলে হতো না!”

_ “অফিসে কত কাজ থাকে, একদিন বন্ধ করলে সেগুলো সব জমা হয়ে থাকবে। পরের দিন তো আমাকে আবার ওইগুলো করতে হবে।”
_ “সারাটা জীবন অফিস অফিস করে কাটিয়ে দেয়। এরপর থেকে অফিসেই থেকে যাবি বাড়িতে আর আসতে হবে না।”
বর্ষা আর কথা বাড়ালো না। দোষ নিজেরই। অন্তত আজকের দিনে বাড়িতে থেকে যাওয়া তার উচিত ছিল। কিন্তু সেটা করেনি। অফিস অফ করলে বিপদ যে আরও বেড়ে যেত। শ্রাবণকে বোঝাতে পারছে না একদিন অফিস বন্ধ করলে তাদের দু’মুঠো ভাত যোগানোর ক্ষমতাও হারিয়ে যাবে। বাড়িতে সেই একমাত্র উপার্জনকারী।

নিজের মনের মধ্যে ক্ষতবিক্ষত লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে বলল, “এইভাবে আমার সাথে ঝগড়া করবি; না কেক কাটবি। মা তো খিদে ছটফট করছে।” শ্রাবণ হো হো করে হেসে উঠলো। বর্ষার কথা ততটা খেয়াল করলেন না অন্যান্যা দেবী। কিছুক্ষণ ভেবে বুঝতে পারলেন সমস্ত দোষ এখন তার উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বর্ষা। অনন্যা দেবী তাড়াহুড়ো করে বললেন, “নিজের খিদে পেয়েছে সেটা বলতে পারছিস না। মায়ের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিস। আমার খিদে পায়নি।

আমি না খেয়ে সারারাত থাকতে পারবো।”বর্ষা এবার একটু বিরক্ত বোধ করল। তবুও দুজনকে বুঝতে দিল না। সারাদিন অফিসে এত কাজ তারপর বাড়িতে এসে ঘ্যানঘ্যানানি কারই বা ভালো লাগে! তবে বর্ষার বেশ লাগে। শুধুমাত্র শ্রাবনকে ঠান্ডা করার জন্য কথাগুলো বলেছিল। আর এখন মা রেগে যেতে বসেছে। মায়ের রাগ ভাঙ্গাতে বেশি সময় নিল না বর্ষা।

কিছুক্ষণ পর আলো ঝলমল করে উঠল চৌধুরী বাড়ি। পুরো বাড়ি অনন্যা দেবী সাজিয়েছে। শ্রাবণ শুধুমাত্র হেল্প করেছে। বর্ষা কখনো ভাবতে পারেনি, তার দাদা আর মা তাকে এত বড় একটা সারপ্রাইজ দেবে। পুরো বাড়ি রঙিন আলো আর বেলুনে ভর্তি করে দিয়েছে। বর্ষার আনন্দে চোখে জল চলে এলো। শ্রাবনের কোন বন্ধু বান্ধব নেই। সব সময় বাড়িতে থাকে মা আর দিদিভাই তার বন্ধু। বর্ষা অফিসে কয়েকজন কর্মচারী সঙ্গে বেশ আলাপ রয়েছে। তবে অবসর টাইম শ্রাবণের সাথে কাটায়।

তাই তারও তেমন কোন বন্ধু বান্ধব নেই। বাড়ির অথিতি কেবল তারা তিনজনই। একটা ছুরি দুজন ধরে আলতো করে কেক কাটলো। একটা ছুরি দিয়ে দুজন একসাথে কেক কাটতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল কারণ, শ্রাবণ উঠে দাঁড়াতে পারে না আর বর্সাও অনেক লম্বা। বর্ষা ইচ্ছে করে শ্রাবণের মত বসে পড়ল। এবার দুজন দুজনের দিকে তাকিয়েই ফিক করে হেসে উঠলো। তারপর কেক কাটলো। আর নিজেরাই নিজেদেরকে ‘হ্যাপি বার্থডে’ বলে উইস করল সাথে অনন্যা দেবীও।

বর্ষা কেকের কিছু অংশ নিয়ে শ্রাবনকে মাখিয়ে দিলো তারপর তার মাকেও। শ্রাবণ কিছুক্ষনের জন্য ভুলে গেল সে প্রতিবন্ধী। বারবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। ছুটে গিয়ে বর্ষাকে কেক মাখিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছে না। বর্ষার চোখ স্থির হয়ে গেল শ্রাবণের উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা দেখে। কয়েক মুহূর্তের আনন্দ মুহূর্তের মধ্যে হতাশায় ভরে উঠলো। শ্রাবণের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। উঠে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা তাকে ভীষণ আঘাত দিয়েছে।

মায়ের গালে থেকেও টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। বর্ষা নিজেকে কোনরকম সামলে শ্রাবনকে জড়িয়ে ধরল। তারপর পিঠে হাত চাপড়ে বলল, “কাঁদিস না দাদাভাই!ভগবান সবার জন্য সব কিছু দেয় না। তোকে অনেক কিছু দিয়েছে তাই হয়তো দুটো পা কেড়ে নিয়েছে।”বর্ষা কথাগুলো বলে নিজেই কেঁদে উঠলো। তবে শ্রাবনকে কিছুতেই বুঝতে দিল না। বর্ষা ভেঙ্গে পড়লে শ্রাবণ আরো বেশি ভেঙ্গে পড়বে। শ্রাবণের মনের জোর কেবল বর্ষায় বাড়াতে পারে। সেখানে বর্ষার ভেঙ্গে পড়া বোকাইমি ছাড়া অন্য কিছু নয়। শ্রাবণ চোখের জল মুছে বলল, “আমি তো কাঁদছি না…..”

শ্রাবণ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই, অনন্যা দেবী একটা গিটার নিয়ে এসে ছেলেকে দিলেন। একটা রোমান্টিক গান গাওয়ার জন্য। তিনি জানেন, তার ছেলেকে কেবল গানই সুখে রাখতে পারে। শ্রাবণের সুখের সাথে গান জড়িয়ে রয়েছে। শ্রাবণ বর্ষাকে সরিয়ে দিল। হাসিমুখে বলল, “তুমি এই বয়সে রোমান্টিক গান শুনবে?”মাও একটু হেসে বললেন, “কেন আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি? রোমান্টিক গান শুনতে পারবো না।

_ “হ্যাঁ নিশ্চয়ই পারবে, তুমি তো এখন ইয়াং।” শ্রাবণ খিল খিল করে হেসে উঠল। বর্ষাও মায়ের কথাকে সমর্থন করে বলল, “”হ্যাঁ দাদা ভাই! এই বৃষ্টির দিনে তোকে একটা রোমান্টিক গান গাইতে হবে।”মা আর বর্ষায় তার জীবনে সবকিছু। তাদের সামান্য আবদার শ্রাবণের কাছে কিছু না। একটু ভেবে চিন্তে বলল, “আমি গান গাইতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে”!
_ শর্ত?

_ হ্যাঁ।
_ কি শর্ত? বল শুনি।
_ আমার সাথে সাথে তোদেরকেও গান গাইতে হবে।
_ ওওও এই ব্যাপার। তুই শুরু কর। আমরাও শুরু করব।
শ্রাবণ গিটার নিয়ে একটা রোমান্টিক গান ধরল,

“সানি সা_ সা_ সা_ রে গা_ পা পানি
সা_ রে_ গামা পানি
সা_ রে_ গামা পানি, প্রেমের কাহানী।
রিমঝিম এই ধারাতে, চায় মন হারাতে।
রিমঝিম এই ধারাতে, চাই মন হারাতে।

এই ভালোবাসাতে, আমাকে ফাঁসাতে।
এলো মেঘচে, এলো ঘিরে বৃষ্টি সুরে সুরে সোনায় রাগিনী
মনে স্বপ্ন এলোমেলো, এ কি শুরু হলো প্রেমের কাহিনী।

এলো মেঘচে, এলো ঘিরে বৃষ্টি সুরে সুরে সোনায় রাগিণী
মনে স্বপ্ন এলোমেলো, এ কি শুরু হলো প্রেমের কাহিনী।
রিমঝিম এই ধারাতে, চায় মন হারাতে।
রিমঝিম এই ধারাতে, চাই মন হারাতে।

আগে কত বৃষ্টি যে, দেখেছি শ্রাবণে
জাগেনি তো এতো আশা ভালোবাসা এ মনে।
ওও আগে কত বৃষ্টি যে, দেখেছি শ্রাবণে
জাগেনি তো এতো আশা ভালোবাসা এ মনে।

সেই বৃষ্টি ভেজা পায়ে, সামনে এলে হায় ঠোঁটে কামিনী
আজ ভিজতে ভালো লাগে, শূন্য মনে জাগে প্রেমের কাহিনী।
রিমঝিম এই ধারাতে, চায় মন হারাতে।
রিমঝিম এই ধারাতে, চায় মন হারাতে।

শ্রাবণের বুকে প্রেম কবিতা যে লিখে যায়
হৃদয়ের মরুপথে জলছবি থেকে যায়…


ব্রেকিং নিউজ…

“গুড মর্নিং! ফের রাতে শহরের বুকে আবার একটি খুন। এই নিয়ে 12 বছরে মোট 15 জন খুন হলেন। 12 বছর ধরে তদন্ত চললেও এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনিন পুলিশ। বিরোধীরা সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়েছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবার সরকারের বিরুদ্ধে।”
নিউজ শুনে কলকাতা পুলিশ মোটেও আশ্চর্য হননি।

12 বছর ধরে তারা তদন্ত করে আসছে কিন্তু কোন কূলকিনারা খুঁজে পায়নি। বারবার তারা কেসটা ক্লোজ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ঠিক তখনই আবার নতুন একটা খুন ঘটে। 5_ 6 বছর আগে একদিনে দুটো খুন হয়। তখনই পুলিশ নড়েচড়ে বসে ছিল, কিন্তু কোনো সমাধান করতে পারেনি। এবার সিবিআই তদন্তের দিকে কেসটা চলে যাচ্ছে। নিজেদের সম্মান বাঁচাতে উঠে_ পড়ে লাগলো কলকাতা পুলিশ। এই কেস দেখাশোনার জন্য একটা বিশেষ পুলিশ কমিশন গঠন করা হলো।

কেসটাকে স্বাভাবিক নেওয়া যায় নি কারণ, প্রতিটা খুন একজন মানুষ করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কেন খুন করছে? খুন করে তার লাভ কি? সেটাও জানা নেই। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য খুন করছেন না, এটা পুরোপুরি নিশ্চিত কলকাতা পুলিশ। কেউ প্রতিশোধ নিতে চাইলে দু’বছরের মধ্যে সবাইকে খুন করে ফেলত। আজ 12 বছর ধরে খুন করত না। প্রতিটা খুণ পেটে ছুরি চালিয়ে করেছে। আবার তিনজনকেই বিষ দিয়ে মেরেছে। প্রতিশোধ নিতে চাইলে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করতে পারতো, কিন্তু সেটা করেনি। স্বাভাবিক ভাবে হত্যা

করেছে। যারা খুন হয়েছে তারা প্রত্যেকে সাধারণ মানুষ। তাদের বিরুদ্ধে কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। তাদের মধ্যে চারজন মহিলা রয়েছে এবং দুজন মহিলা ইয়াং বয়সি। বিশেষ কমিশনের হেড অভিজিত বাবুর সাথে দেখা করার জন্য ভিড় জমিয়েছে মিডিয়ার লোক। তাদের একটাই প্রশ্ন, কেস কত দূর এগোল? কি অদ্ভুত এই মিডিয়ার লোক। কয়েক মুহুর্ত আগে কমিশন গঠন হলো। আর এখনই জানতে চাইছে কেস কতদূর এগিয়েছে। অভিজিত বাবু চিন্তিত।

গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছেন। কেস যে মোটেও সুবিধাজনক নয় সেটা তিনি অনুমান করতে পেরেছেন। এমন সময় একজন কনস্টেবল এসে অভিজিত বাবু কে বললেন, “স্যার মিডিয়ার লোক প্রচুর ঝামেলা করছে, আমি গিয়ে বলে দেবো আমরা 24 ঘণ্টার মধ্যে আসামিকে গ্রেপ্তার করে নেব।”অভিজিত বাবু একটু হেসে বললেন, “পাগল দেখেছেন?”
_ “হ্যাঁ”।

_ “তার সাথে আপনার কোন পার্থক্য নেই”। আজ 12 বছর ধরে যারা এর সমাধান করতে পারলো না, আর আমরা 24 ঘন্টায় তা করে ফেলব! মুখে যা আসছে তাই বলে ফেলছেন।”
কনস্টেবল মাথা নিচু করলেন। তিনি একবারও ভেবে দেখেননি। কেসটা যতটা সহজ ভাবছেন ততটা সহজ মোটেও নয়। এমন সময় আর একজন কনস্টেবল অভিজিত বাবুর রুমে প্রবেশ করলেন। তার হাতে একগুচ্ছ ফরেনসিক ল্যাব এর রিপোর্ট রয়েছে। তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, “স্যার! এই কেসে আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে।”
_ কিসের মিল এর কথা বলছেন?

_ স্যার! প্রতিটা খুন একজন করে বেড়াচ্ছে।
অভিজিত বাবু ভীষণ চটে গেলেন। এই আবাল দের নিয়ে তাকে কেসের অনুসন্ধান করতে হবে। যাদের মধ্যে নূন্যতম জ্ঞান নেই। তিনি রাগান্বিত ভাবে বললেন, “একজন মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে বলে এত বছর ধরে কেস চলছে, না হলে অনেক আগেই কেস ক্লোজ….”অভিজিত বাবুর মুখে কথা আটকে কনস্টেবল আবার বলল, “স্যার! প্রতিটা খুণ একজন মেয়ে করছে।”
_ “মেয়ে”!

_ “হ্যাঁ স্যার। ফরেনসিক ল্যাব পরীক্ষা তাই বলছে। শুধু তাই নয়, 12 বছর আগে মেয়েটি শিশু ছিল। শিশু অবস্থা থেকে খুন করছে সে। প্রতিটা খুনের ধরন এবং ছুরির আঘাতের জোর তাই বলছে।”

অভিজিত বাবু টেবিল চাপড়ে বলে উঠলেন, “হোয়াট”! কনস্টেবল আর কিছু বলল না। বেশ অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ। মিনিট দশেকের পর, প্রথম কনস্টেবল মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। তার হাসি দেখে অভিজিত বাবু ভীষণ রাগ করলেন। নিজের রাখ সামলে বললেন, “এমন অবস্থায় তোমার হাসি পাচ্ছে?”
_ “মাফ করবেন স্যার। একটা কথা বলতে পারি?”

মানুষ যখন সব জায়গাতে হেরে যায়। স্বার্থপরতায় ভুগতে থাকে। কি করবে কিছু খুঁজে পায় না। তখন একজন সাধারণ মানুষের কথাও তার কাছে বাণী মনে হয়। অভিজিত বাবু কনস্টেবল এর কথা শুনতে চাইলেন। তিনি নরম গলায় বলল, “হ্যাঁ বল।”
_ “প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জীর”বাইশে শ্রাবণ”মুভি দেখেছেন?”

_ “হ্যাঁ দেখেছি। কিন্তু ওই মুভির সাথে এই কেসের….
_ “প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জী রাতে খুন করে বেড়াতো আবার সকালে ওই কিসের তদন্ত করত।”
অভিজিত বাবু রাগে হাঁপাতে লাগলেন। এতক্ষণে তিনি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। ইচ্ছে করছিল কনস্টেবলকে গালে দুটো চড় দিতে। কিন্তু পারছে না। নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল, “তুমি কি বোঝাতে চাইছো? এই খুনগুলো আমি করে বেড়াচ্ছি?”

_ “আপনি কেন করবেন? আমার ওই রকম মনে হল তাই বললাম।”


পর্ব ৩

বর্ষা গাড়ি ড্রাইভিং করছে। পেছনের সিটে জানালা খুলে বসে রয়েছে শ্রাবণ। সকাল থেকে আর বৃষ্টির দেখা নেই। বিকেলের মৃদু বাতাস, শ্রাবণের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। আদিত্য চৌধুরী একজন বড় গায়ক ছিলেন। হাসিতে ভরা ছিল চৌধুরী পরিবার। উনা মৃত্যুর পর পুরো পরিবার ভেঙ্গে পড়ে। অনন্যা দেবী কোন ভাবে টেনেটুনে সংসার চালাতে থাকেন। একদিকে শ্রাবণ অসুস্থতা অন্যদিকে সংসার, একসাথে দু দিক সামলাতে হিমশিম খেয়ে উঠেন অনন্যা দেবী।

আদিত্য চৌধুরী একটার পর একটা দামি ইন্সট্রুমেন্ট বিক্রি হয়ে যেতে থাকে। একসময় গাড়ি বাড়ি সবই বিক্রি হয়ে যায়। শেষ হয়ে যায় ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স। তাদের উঠোনে চলে আসে দারিদ্রতা। শ্রাবণ পাবলিক প্লেসে যাতাযাত করার জন্য উপযুক্ত ছিল না। ওর কথা ভেবেই অনন্যা দেবী স্বামীর একটা গাড়ি রেখে দেন। ওটা পুরনো হয়ে গেলেও বর্ষা তাকে বেশ যত্ন করে রেখেছে। বাইরে থেকে পুরোপুরি গাড়ি লাগলেও ভেতরে কিন্তু তা মোটেও নয়। ভেতরে শ্রাবণের বসার জন্য উপযুক্ত জায়গা করা হয়েছে।

অবসর সময়ে বর্ষা শ্রাবনকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সারাদিন ঘরের মধ্যে বন্দি থাকতে ভালো লাগে না। খোলা আকাশের নীচে থেকে শ্রাবনকে ঘুরিয়ে আনে বর্ষা। শ্রাবণকে বিছানায় তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া সবই করে বর্ষা। যদিও শ্রাবণ এখন নিজেই অনেক কাজ করতে পারে। একই কাজ বারবার করে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রতিবন্ধকতাকে দূরে ঠেলে এগুতে শিখে গেছে।

বাইশে শ্রাবণ, অফিস হাফ ডে। তাই আজ গ্রামে যাচ্ছে তারা। ছোটবেলা থেকে গ্রাম দেখার ইচ্ছে হলেও তা পূরণ হয়নি। বর্ষা ছোটবেলায় বাবার সাথে অনেকবার গ্রামে গেলেও শ্রাবণের গ্রামে যাওয়া হয়নি। তাই আজ শ্রাবণকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। খোলা বাতাস অনুভব করতে করতে তারা দুজন মেদিনীপুর চলেছে। ভ্রমণ জমিয়ে রাখার জন্য মাঝেমধ্যে শ্রাবণের গলার মিষ্টি সুর, আর মাটির কাপে চা যথেষ্ট‌। দুজন আড্ডা আর গল্পের মাধ্যমে গ্রামে পৌঁছলো।

একটা ছোট্ট ব্রিজ পার হওয়ার পর থেকে শহর যেন হঠাৎ করে হারিয়ে গেল। বড় বড় বিল্ডিং, চওড়া রাস্তা বিলীন হয়ে গেল। তারপর থেকেই শুধু সবুজ আর সবুজ। কিছুদুর যাওয়ার পর আবার একটা ব্রিজ পরল। ব্রিজের ওপর অনেক বস্ত্রহীন মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখান থেকে কেউ জাল ফেলেছে, আবার কেউ জালে কত মাছ উঠল তা দেখছে। বর্ষা গাড়ি দাঁড় করালো। দুজনই জানালা দিয়ে মুখ বের করে সেই অপরূপ দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে চাইলো। নদী বেশ ফুলে_ ফেঁপে রয়েছে।

নদীর পানি গুলো বলছে আমায় ছুঁয়ে দেখো। নদীর জলের কলতান অন্যদিকে পাখি গুঞ্জন, ছোট ছোট শিশুদের ছুটে বেড়ানো সব মিলিয়ে এক অপরূপ পরিবেশ। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর আবার চলতে শুরু করলো। গ্রামের মধ্যে কিছুটা আধুনিক পাকা রাস্তা, গাড়ি ঢুকতে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে বাঁক ঘুরতে বেশ সমস্যা হচ্ছিল। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর শ্রাবণের কানে ভেসে আসে একটা সুস্পষ্ট রবীন্দ্র সংগীত। তখনো সন্ধে হয়নি।

সূর্য পশ্চিম আকাশে লাল আভা সৃষ্টি করেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা মিলিয়ে যাবে। শ্রাবণ তাড়াতাড়ি বর্ষাকে গাড়ি থামাতে বলে। বর্ষা গাড়ি থামিয়ে বলল, “কি হলো! এখানে থামতে বললি কেন?”শ্রাবণ মুখে হাত দিয়ে বুঝিয়ে দিলো বর্ষাকে চুপ থাকার জন্য। বর্ষার চুপ হয়ে রইল। কিছুই বুঝতে পারলো না। অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতা থাকার পর বর্ষা আবার হাত নাড়িয়ে জানতে চাইলো, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ কি? শ্রাবণ ইশারায় বুঝিয়ে দিল তাকে গান শোনার জন্য।

আজব! এতক্ষণ ধরে কথা বলছিল, হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেল কেন? নিজেও কথা বলছে না, আবার বর্ষাকে ও কথা বলতে দিচ্ছে না। বর্ষা কান খাড়া করে গান শুনতে লাগল। কিছুক্ষণ শোনার পর বিরক্ত হয়ে বলল, “সম্ভবত স্কুলে ফাংশন হচ্ছে। গ্রামের স্কুলের ফাংশন গুলো বিকেলে কিংবা সন্ধের দিকে হয়। সেখানেই একজন রবীন্দ্র সংগীত গাইছে।”গান শোনাতে ব্যাঘাত ঘটায় শ্রাবণ একটু রেগে বলল, “সেটা আমি জানি। তুই ভালো করে শোন দিলে বুঝতে পারবি।

“বর্ষা আবার কিছুক্ষণ গান শোনার পর বলল, “ও ওই কথা বলছিস.. গান একজন মেয়ে গাইছে। শ্রাবণ আর কিছু বলল না। আবার গাড়ি চালাতে বলল। বর্ষাও তার কোন উত্তর না দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।

হয়তো এখানেই শ্রাবণ আর বর্ষার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। চ্যাম্পিয়ন তৈরি করা যায় না। চ্যাম্পিয়ন জন্ম নেয়। তবে চ্যাম্পিয়নকে চেনার জন্য একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োজন। সেটাও সবার মধ্যে থাকে না। শ্রাবণের মধ্যে সেটা আছে। তাই সে বুঝতে পেরে গেছিল ওই মেয়ের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন সত্তা লুকিয়ে রয়েছে। মেয়েটা যদি তার চ্যাম্পিয়ন সত্তাকে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে একদিন বড় গায়িকা হবে সে। শ্রাবণ সেটাই বর্ষাকে বুঝাতে চাইছিল।

কিন্তু বর্ষা বুঝতে পারেনি অর্থাৎ তার মধ্যে চ্যাম্পিয়ন চেনার অক্ষমতা রয়েছে।
বিলে জমে থাকা জলে শালুকের লুকোচুরি। নীল আকাশে পাখির ওড়াউড়ি। শেষ বিকেলের সূর্য রশ্মি চিনিয়ে দেয় অপরূপ গ্রামকে। বিলের মধ্যে খুব অযত্নে ফুটে থাকা কচুরিপানার সৌন্দর্যের প্রাচুর্যতা গ্রামকে ভরিয়ে দেয়। গাড়ির গতি খুব মন্থর। গ্রামের সৌন্দর্য আরো বেশি তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অবিরাম বর্ষণে সদ্য রোপন করা, ধানের চারা গাছ গুলোর আগা একটু একটু করে দেখা যাচ্ছে। তারাও আজ ভীষণ ক্লান্ত মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছে।

হয়তো পরেরদিন সূর্যালোক তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দেবে। জমিতে কিছু মানুষ নষ্ট হয়ে যাওয়া চারা গাছ গুলো আবার নতুন করে রোপন করছে। বাবা মাকে একটু সাহায্য করার জন্য শিশুরা এক জমি থেকে অন্য জমিতে চারা গাছ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বর্ষা একটু থেমে থেমে বললো, “আমরা তো হারিয়ে যেতে পারি গ্রামের মধ্যে! ফেরার সময় রাস্তা খুঁজে পাবো না। এখান থেকেই ফিরে যাওয়া আমাদের বেটার হবে বলে মনে হচ্ছে।

“গ্রামের এমন অপরূপ সৌন্দর্য ছেড়ে শহরের কোলাহল জীবনে ফিরে যেতে মন চাইছিছে না শ্রাবণের। তবুও কর্মের টানে তাকে ফিরে যেতে হবে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, “গ্রামের কিছুই তো দেখলাম না, আর এখনই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবি?”
_ “তাহলে কাউকে একজন বল, আমাদেরকে গ্রামটা ঘুরে দেখানোর জন্য। না হলে তো হারিয়ে যাব।”

_ “মানুষের কি কোন কাজ কর্ম নেই, আমাদেরকে নিয়ে গ্রাম ঘুরে দেখাবে!”
_ “এটা গ্রাম। গ্রামের মানুষ আমাদের মত অতটা ব্যস্ত নয়। একবার বলে তো দেখ তাদের ব্যবহার দেখে আশ্চর্য হবি।”
_ “আচ্ছা ঠিক আছে।”

বর্ষা একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামাল। লোক গুলো বড় গাড়ি দেখে মোটেও আশ্চর্য হয়নি। মাঝেমধ্যে এমন গাড়ি তাদের গ্রামে প্রবেশ করে। শ্রাবণ আশেপাশে দেখল চায়ের দোকানে প্রাপ্তবয়স্ক কয়েকজন মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। দোকানদার একজন মহিলা উনি চা বানাচ্ছেন, পাশে আর একজন বিভিন্ন ধরনের চপ বানাচ্ছেন। শ্রাবণ জানালা দিয়ে মুখ বের করে ডাকলেন ‘কাকু মণি’ বলে। শ্রাবণের কথা শুনে বর্ষা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। শ্রাবণ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “কি হলো! হাসছিস কেন?”বর্ষা মুখের মধ্যে কথা আটকে রাখতে পারল না।

সে হাসিমুখে বলল, “কাকু আবার মনি…”বর্ষা কথা গুলো বলেই আবার হাসতে শুরু করলো। শ্রাবণ কিছু বলল না। ভাবতে লাগলো, লোকটা আবার তাঁর কথায় খারাপ কিছু না ভেবে বসে। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। বয়স্ক মানুষ জনের মধ্যে একজন গাড়ির কাছে আসলেন। কাছে আসতেই শ্রাবণ তাকে সব বুঝিয়ে বলল। লোকটি পুরো ফর্শা শরীর পুড়ে তামাটে হয়ে রয়েছে। কঠোরতা থেকে চোখ দুটো তীক্ষ্ণ ভাবে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মাথায় লাল চুল।

সম্ভবত উনি সমুদ্রের মাছ ধরতে যায়। নোনা হওয়ায় এমন অবস্থা উনার। কি অদ্ভুত ওই লোকটি! শ্রাবণের একটা কথাতেই রাজি হয়ে গেল। কোন ব্যস্ততা অজুহাত দেখালো না। লোকটিকে যে ‘কাকুমণি’ বলেছিল সেটাতেও কিছু মনে করেনিন। বর্ষার পাশের সিটে গিয়ে বসলো বয়স্ক লোকটি। অল্প সময়ে বেশ ভাব জমে গেল;তাদের মধ্যে। লোকটি প্রথমে বড্ড আশ্চর্য হয়। শহরের মানুষ নাকি গ্রাম ঘুরে দেখতে এসেছে।

ধুলোবালি কাদা মাখতে এসেছে গ্রামে। এটা কি সম্ভব? হয়তো কিছু কিছু মানুষের কাছে এটা অসম্ভব নয়। কয়েকটা কথাবার্তার মধ্যে তাদের পরিচয় হয়ে যায়। লোকটির নাম অনিমেষ, এই গ্রামেই তার বাড়ি। তবে শ্রাবণ আর বর্ষার পরিচয় শুনে লোকটির ব্যাপক ভাবে উৎফুল্লিত হয়ে ওঠে। ভাবতে পারেননি, তিনি আদিত্য চৌধুরীর ছেলে মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যে আদিত্য চৌধুরী কয়েক বছর আগে তাদের গ্রামে স্টেজ শো করতে এসেছিল। সেই বছর কত মানুষ উনাকে দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছিল। অথচ আজ উনাকে সবাই ভুলে গেছে। হয়তো এটাই পৃথিবীর নিয়ম। যখন টাকা গাড়ি_ বাড়ি পাওয়ার থাকবে তখন তাকে সবাই সম্মান_ খ্যাতি দেবে।

ওইগুলো ফুরিয়ে গেলে সেই মানুষটিও ফুরিয়ে যাবে। তাদের করুণ পরিণতির কথা শুনে অনিমেষ বাবু চোখে জল চলে আসে। তিনি কিছুতেই শ্রাবণ আর বর্ষাকে বাড়ি ফিরে যেতে দিলেন না। উনার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। প্রথমের দিকে তারা রাজি না হলেও অনিমেষ বাবুর বারবার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। গুরুজন হয়ে বারবার অনুরোধ করছেন আর তারা ফেলে দেবে। বর্ষার সাথে অনিমেষ বাবুর বেশ ভাব জমে। তবে শ্রাবণের চোখ শুধু গ্রামের দিকে। মন ভরে সে গ্রামের সৌন্দর্য অনুভব করছে। বর্ষা আর অনিমেষ বাবুর কথায় আদৌ কান দিল না সে।

দুচোখ ভরে গ্রাম দেখছে শ্রাবণ। রাস্তার খুব কাছাকাছি গ্রামের ছোট ছোট মেঠো বাড়ি রয়েছে। গ্রামের কৃষকদের কঠোর শ্রম তবে দিনের শেষে ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি; আগামীর স্বপ্ন। গ্রামে রয়েছে বড় বড় পুকুর। কেউ আবার মাছ ধরছে ছিপ ফেলে। বয়স্কদের আড্ডা। বিশ্বকর্মা আর দুর্গা প্রতিমার কাজ চলছে। গ্রামের শিশুদের ভাবনাহীন বৈচিত্র বড্ড আপন। পাশাপাশি দুটো গাছে শাড়ি বেঁধে দিয়ে দোলনা তৈরি করেছে। আর শাড়ির মাঝখানে একজন বসে রয়েছে।

আর একজন দোলাচ্ছে এবং দোলানোর হিসাবে ঠিক রাখছে। পরেরবার তাকে ঠিক ততোবারই দোলাতে হবে। বড্ড বিচিত্র এই শিশু সমাজ!গরুর বিশাল পাল নিয়ে রাখাল ছুটে চলেছে। বড্ড বিরক্ত রাখাল। গরু গুলো বারবার এদিক ওদিক ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে। গরু গুলো বাড়ি ফিরতে চাইছে না। আরও কিছুক্ষণ মাঠে থাকতে চাইছে। বাংলা গ্রামের রয়েছে নিজস্ব ঢং। বাড়ির উঠোনে বসে বাড়ির নারীরা উকুন দেখছে। কেউ বা কাজে ব্যস্ত, কেউ আবার বাড়ির সামনে মাদুর পেতে পড়তে বসেছে। ঝুঁকে ঝুঁকে পড়া মুখস্ত করছে সে। মানুষগুলো যেন একে অপরের পরম আত্মীয়। শ্রাবণ কখনো ভাবতে পারেনি, গ্রামের মধ্যে এখনো ওই পৌরনিকতা রয়ে গেছে।

এখনো বাড়ির সামনে বাচ্চারা ঝুঁকে ঝুঁকে পড়া মুখস্ত করছে। শ্রাবণের মনে জেগে উঠছিল ছোটবেলার স্মৃতি। শহরে বড় হলেও গ্রামের শিশুদের মত ঝুঁকে ঝুঁকে পড়া মুখস্ত করা অভ্যাস ছিল তার।
অনিমেষ বাবুর দেখানো পথ অনুসরণ করতে লাগলো বর্ষা। গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একসময় তারা একটা কূঠির সামনে এসে পৌঁছল। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা বাঁশ ঝাড়ের নিচে গাড়ি পার্কিং করল। মেন রাস্তা থেকে অনিমেষ বাবুর বাড়ির দূরত্ব সামান্য। বৃষ্টি হওয়ায় ওই রাস্তাটা কাদা হয়ে রয়েছে। পায়ে যাতে কাদা না লাগে তার জন্য অপরূপ বৈচিত্র সৃষ্টি করেছেন। কিছুটা দূরত্ব বরাবর ইট রেখেছেন। তার ওপরে পা মাড়িয়ে অনায়াসেই যাওয়া যায়।

কিন্তু শ্রাবণের পক্ষে তা সম্ভব নয়। কাদামাড়িয়ে তাকে যেতে হবে। বর্ষা হুইল চেয়ার পেছনে ধরে এগিয়ে নিয়ে গেল বাড়ির দিকে। কূঠি এর কাছাকাছি আসতেই লক্ষ পরল গৃহপালিত পশু। বাড়ির উঠোনে তুলসী মন্দির, ধানের গোলা। বাড়ির উঠোনে লাউ কুমড়ো গাছ, সেগুলো আবার চাল বিয়ে পুরো ছাউনিতে ভরে গেছে। বাড়ির চারপাশে রয়েছে অনেক রকমের ফুল গাছ। অনিমেষ বাবুর মতন একটা বড় মন রয়েছে বর্ণালী দেবীর ও। অপরিচিত দুজন মানুষকে দেখে, তিনি মোটেও দ্বিধা বোধ করলেন না।

অথিতি আপ্যায়নের যাতে কোনো ত্রুটি না থাকে তার ব্যবস্থা করলেন। তিনি প্রথমে দুই গ্লাস পালো শরবত নিয়ে এসে তাদেরকে দিলেন। গরিবের অতিথি আপ্যায়ন, বাড়ির সৌন্দর্য তাদের বুক ভরিয়ে দিচ্ছে। বর্ষা খুব তাড়াতাড়ি মানুষকে আপন করে নিতে পারে যেটা শ্রাবণ পারে না। বর্ষা আর বর্ণালী দেবী খোশগল্পে মেতে উঠলেন। শ্রাবণ চুপচাপ বসে তাদেরকে দেখছে। মেঠো বাড়ির দেওয়াল আলপনা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। হয়তো এই বাড়িতে কোন অল্প বয়সী নারী রয়েছে। নারীর হাতে আলপনা বেশ মানায়। তারাই পারে এমন সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে।

একটা সাদা বস্তা বিছিয়ে দিলেন বর্ণালী দেবী। তার উপর শিল নাড়া দিয়ে চাল গুঁড়ো করতে লাগলেন। আজ পিঠে হবে। স্থির চোখে তাকিয়ে রয়েছে শ্রাবণ আর বর্ষা। বড্ড অদ্ভুত গ্রামের মানুষ! এত চাল শিল নাড়া দিয়ে গুঁড়ো করবে। বেশ অনেকক্ষণ দেখার পর বর্ষা হাসিমুখে বলল, “আমায় দিন। আমিও আপনার সাথে চাল গুঁড়ো করব।”
_ “পারবেন না। বড্ড শক্ত এই কাজ।” বর্ণালী দেবী বর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল। বর্ষা আবার বলল,

_ “চেষ্টা তো করতে পারি….”শ্রাবণ আর চুপ থাকতে পারলো না। বর্ষার সাথে মজা করতে লাগলো। বর্ষা ঠিক পারবে, সে এমন কোন কাজ নেই যে পারবে না। এমনকি পিঠেও বানিয়ে দিতে পারবে। 10 থেকে 15 রকমের পিঠে বানাতে পারে বর্ষা। বর্ণালী দেবী হি হি করে লাগলেন ভাই বোনের খুনসুটি দেখে। উনার ভাইও ছোট বেলায় উনার সাথে কত মজা করত। কিন্তু আজ কতগুলো বছর হয়ে গেছে তাদের একবারের জন্য দেখা হয়নি। কাজের ব্যস্ততায় তারা আজ পৃথক। বিয়ের আগে পর্যন্ত ভাইবোনের সম্পর্কটা বেশ মধুর থাকে। তারপরেই পাড়তে থাকে দূরত্ব। শুধু থেকে যায় মনের টান।

বর্ণালী দেবীর একটা শাড়ি বর্ষা পড়ে নিল। একটা জামা পরে তো সব সময় থাকা যায় না। আবার সেই পোশাক পরে কাল কলকাতায় ফিরতে হবে। শাড়ি পরা অবস্থায় বেশ সুন্দর লাগছিল বর্ষাকে। চাল গুঁড়ো করতে পারছে না তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় পুকুরে কারোর পা ধোয়া শব্দ শ্রাবণের কানে ভেসে আসে। শ্রাবণ ঘুরে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্ধকারে তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পূজারিণী নাচতে নাচতে ঘরের মধ্যে আসছিল, হঠাৎ বাড়ির মধ্যে অপরিচিত দুজনকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। মাথা নিচু করে রুমের মধ্যে যাচ্ছিল, তখনই বর্ণালী দেবী তাকে ডেকে শ্রাবণ আর বর্ষার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পূজারিণী দুজনকে প্রণাম করে। বর্ষা পূজারিণী সাথে বেশ ভাব জমিয়ে নিল। কিন্তু শ্রাবণ অন্য কিছু দেখছে। মেয়েটা চোখের মধ্যে কিছু একটা লুকিয়ে রয়েছে।

একটি বীজ যতক্ষণ না আলো_ বাতাস_ জল পাচ্ছে ততক্ষণ সে অঙ্কুরিত হতে পারে না। সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। তেমনি পূজারিনির মধ্যে কিছু একটা সুপ্ত অবস্থায় লুকিয়ে আছে। নির্দিষ্ট পরিবেশে এর অভাবে তা বেরিয়ে আসতে পারছে না। শ্রাবণ বেশ ভালো করে তা বুঝতে পারছে। তার গলার স্বর শ্রাবণ যেন কোথায় শুনেছে। কিন্তু ঠিক কোথায় শুনেছে তা বুঝে উঠতে পারছে না। বেশ অনেকক্ষণ এমনভাবে বসে থাকার পর বর্ণালী দেবী মেয়েকে বললেন, “দেখ না! ওই বাবুটা ততক্ষণ থেকে একটা জায়গায় বসে রয়েছে। তুই ওকে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে যায়।”

‘আচ্ছা’বলে পূজারিণী শ্রাবণের কাছে আসলো। হুইল চেয়ার ধরে রুমের মধ্যে নিয়ে গেল।”আপনি কখনো একা যেতে পারেন না?”রুমের মধ্যে যেতে যেতে পূজারিণী জিজ্ঞেস করল শ্রাবনকে। শ্রাবণ একটা ঢোক গিলে বলল, “হ্যাঁ পারি, দুই হাতে চাকা ঘুরিয়ে এগিয়ে যেতে পারি”।
_ “আপনার খুব কষ্ট হয়, তাই না!”

_ “কই নাতো, ছোটবেলা থেকে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি।”
_ “ওওও।”
খুব ধীর গলায় কথা বলছিল দুজনই। কিছুক্ষন নিস্তব্ধতা। মেয়েটির গলার স্বর বড্ড সুন্দর সেটা শ্রাবণ অনুমান করতে পারছে। মেয়েটা বেশ নম্র_ ভদ্র। বড়দেরকে কিভাবে শ্রদ্ধা ভক্তি করতে হয় তা সে ভালো করেই জানে। তবে মেয়েটার চুল বেশ অগোছালো, তা থেকে বেরিয়ে আসছে একটা দারুণ সুগন্ধি। বাড়ির মধ্যে শ্রাবণ প্রবেশ করতেই চোখ কপালে উঠলো। বাইরে থেকে বাড়িটা যত সুন্দর মনে হচ্ছিলো ভেতর আরো অনেকে বেশি সুন্দর। ভেতরে দুটো মোটা রামায়ণ, মহাভারত বই রয়েছে। পাশেই রয়েছে অগুনতি বই। শ্রাবণ বই গুলো দেখে বলল, “এত বই কে পরে শুনি!”

_ “বইগুলো সব আমারই, ক্লাস ওয়ান থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত বই খাতা রেখে দিয়েছি। একটাও বিক্রি করিনি। আমি মনে করি, নিজের পড়ার বই বিক্রি করা অনুচিত। সেটাকে গুছিয়ে রেখে দেওয়াই ভালো। কারুর প্রয়োজন হলে তাকে বইগুলো দিই পরে আবার ঠিক ফিরিয়ে নিয়ে আসি।

মেয়েটার শুধু গলার স্বর নয় কথাগুলোও বেশ সুন্দর। বেশ মন দিয়ে শ্রাবণ মেয়েটির কথা শুনল। কিছু সময়ের পর মেয়েটা আবার বলল, “আপনি আমাকে গান শিখাবেন? আমার না ছোটবেলা থেকে গান শেখার বড্ড ইচ্ছে আছে। কিন্তু দারিদ্রতা….”মেয়েটি আর কোন কথা বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। শ্রাবণ ভীষণ আশ্চর্য হয়। শ্রাবণ এতদিন ধরে দেখে এসেছে, বাবা_ মা জোর করে ছেলে মেয়েদেরকে কিছু শেখাতে চায়। কিন্তু এই মেয়েটা নিজে থেকে শিখতে চাইছে। তার মধ্যে যে একটা ক্ষিধে রয়েছে সেটা শ্রাবণ অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল।

জোর করে হয়তো কোন কিছু শেখা যায়। কিন্তু শিখে যাওয়া জিনিস বেশি দিন নিজের আয়ত্তে থাকে না। নিজের জেদের বশে যদি কোন কিছু শিখতে পারি তাহলে সে শিক্ষা আজীবন থেকে যায়। শ্রাবণ এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইলো। সে হাসিমুখে বলল, “আমি তোমাকে গান শেখাবো, যদি তুমি আমাকে একটু সাহায্য করো।”
_ “সাহায্য!”
_ _ “হ্যাঁ, আমি একটা মেয়েকে খুঁজছি। আর সেই মেয়ে পাশের স্কুলে পড়ে। সম্ভবত তুমিও ওই স্কুলে পড়ো।”

_ “একটা মেয়েকে খুঁজতে আপনি এতদূর ছুটে এসেছেন? এত ভালবাসেন মেয়েটাকে?”
শ্রাবণ একটু লজ্জা পেয়ে গেল। মেয়েটা এখন অনেক ছোট তাই এইসব উদ্ভাব কথাবার্তা বলছে। শ্রাবণ মাথা নিচু করে বলল, “না না, আমি ওকে কখনো দেখিনি।”
_ “সে কি! না দেখে এত ভালোবেসে ফেললেন!”

_ “আজব! ওই মেয়েটার শুধু গান শুনেছি আমি। ওর মধ্যে একটা আলাদা জিনিস লুকিয়ে রয়েছে। ওটাকে কাজে লাগাতে হবে। দিলেই একদিন বড় গায়িকা হতে পারবে সে।”
_ “সরি! আমি না বুঝতে পারিনি। মেয়েটি কি গান গাইছিল বলুন, আমি চিনতে পারি কি না দেখছি।
শ্রাবণ একটু ভাবতে লাগলো। মেয়েটির গান স্পষ্ট ভাবে মনে রয়েছে তার। তবে মেয়েটির নাম ঠিক মনে করতে পারছে না।

বর্ষার জন্যই নামটা স্পষ্ট করে শুনতে পারেনি। শ্রাবণ তাড়াহুড়ো করে বলল, “দোল দোল দুলুনি রাঙ্গা মাথার চিরুনি এনে দেবো হাট থেকে…….”শ্রাবণের গানের নাম বলা শেষ হতে না হতেই পূজারিণী হি হি করে হেসে উঠলো। আর হাসি কিছুতেই থামছে না। শ্রাবণ অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ হাসার পর একটা হাত কোমরে আর একটা হাত বুকে রেখে পূজারিণী বলল, “ওই মেয়েটা তো আমি।”

_ “হোয়াট!”
_ “আপনি মেয়েটার নাম শুনেননি?”
_ “হ্যাঁ শুনেছিলাম, ‘প’ দিয়ে কিছু একটা নাম হবে।”

পূজারিণী আবার হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল, ‘পূজারিণী!’শ্রাবণে স্মৃতিতে এবার নামটি ভেসে উঠলো। এই নামটাই সে শুনেছিল। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে খুঁজে পেয়ে যাবে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। ‘পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি’ বলে চিৎকার করে উঠল শ্রাবণ। শ্রাবণের চিৎকার শুনে পূজারিণী তাড়াতাড়ি মুখ চেপে ধরল। বেশ কোমল, শীতল হাত পূজারিণী। কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে শ্রাবণ চুপ হয়ে গেল। শ্রাবনের চোখ স্থির হয়ে গেল পূজারিণী মায়াবী মুখখানা দেখে।”এইভাবে চিৎকার করবেন না, সবাই কি ভাববে..”পূজারিণী বলল।

শ্রাবণ একটু লজ্জা পেয়ে গেল। এভাবে চিৎকার করা তার উচিত হয়নি। পূজারিণী আবার বলল, “আপনি কি পেয়ে গেছেন?”
_ “স্বপ্ন”
_ “স্বপ্ন দেখা যায়। তাকে আপনি কিভাবে পেলেন?”
_ “এখন বুঝতে পারবে না। কিন্তু একদিন তুমি নিজে এসে আমাকে বলবে তুমি তোমার স্বপ্ন পেয়ে গেছো?”
_ “আপনি কি সব কথা বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

_ “তোমার না বুঝলেও চলবে। তুমি আমার সাথে শহরে যাবে? তোমাকে আমি গান শেখাবো। অনেক বড় গায়িকা বানাবো। অনেক সম্মান পাবে। অনেক মেডেল পাবে।”
পূজারিণী ধপ করে খাটের উপর বসে পড়ল। তার কাছে সবই স্বপ্ন লাগছে। কাল যে স্বপ্নটা ভেঙে গেছিলো আজ সেই স্বপ্নটা পূরণ হতে চলেছে। সে নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। কিছুক্ষন নিস্তব্ধতা থাকার পর বলল, “না, আমি গান শিখতে চাই না। আমি আমার বাবা_ মার কাছে থাকতে চাই। আমাদের সামর্থ্য নেই গান শেখার মত।”

_ “তোমার সমস্ত দায়িত্ব আমি নেব। তোমার কোন অসুবিধা হবে না। তোমার পরিবার থেকে একটি টাকাও দিতে হবে না।”
_ “কিন্তু তুমি নিজেই তো প্রতিবন্ধী। কোন কাজ কর না, অন্যের উপর নির্ভরশীল। তাহলে কি করে আমার দেখাশোনা করবে। হাসিমুখে আমার দায়িত্ব নিতে চাইছেন?”
‘প্রতিবন্ধী’এই একটা কথাই যেন শ্রাবণ চৌধুরী চিরশত্রু। একটা কথাই তার সমস্ত স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে। প্রতিবন্ধকতার জন্য তাকে কম লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় নি। আর এখনও হতে হলো। তবুও পূজারিনীর ওপর নিশ্চুপ থাকলো। কেবল পূজারিণী পারে তার স্বপ্ন পূরণ করতে। সে হাসিমুখে বলল, “আমাকে বিশ্বাস করতে হবে না।

শ্রাবনের জন্য বর্ষা সবকিছু করতে পারে। তুমি আমার দিদিভাইকে বিশ্বাস করো। তোমার সমস্ত দায়িত্ব আমার দিদিভাই নেবে।”পূজারিণী ভাবতে লাগলো। একে বিশ্বাস করতে পারছে না অন্যদিকে নিজের স্বপ্নকে তাড়িয়েও দিতে পারছে না। এত বড় একটা সুযোগ সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য যদি একটু স্বার্থপর হতে হয়, তবে সে স্বার্থপরই হবে। তাকে যদি অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তাও সে করবে।

কিন্তু বাবা_ মা, তাদেরকে তো ছাড়তে পারবে না। পূজারিণী আবার ধীর কন্ঠে বলল, “কিন্তু বাবা! বাবাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। ‘বাবা বাবা গন্ধ’ না পেলে আমি মরে যাব।”শ্রাবণ আবার একবার আশ্চর্য হল। ‘বাবা বাবা গন্ধ’ এটা আবার কোন গন্ধের মধ্যে পড়ে? শ্রাবণ একটু হেসে বলল, “‘বাবা বাবা গন্ধ’মানে?”
_ “আমি যখন বাবার কাছে থাকি তখন একটা গন্ধ পাই। সেটা কেবল বাবার কাছ থেকেই আসে। যারা বাবাকে ভীষণ ভালবাসে তারাই কেবল ওই গন্ধটা পায়। বাবার শরীরের গন্ধ অন্য সব ফুলের গন্ধ কেও হার মানিয়ে দেয়। সেই গন্ধে লুকিয়ে থাকে বাবার কঠোর পরিশ্রম। মেয়ের প্রতি ভালোবাসা।


_ “আমি তো এতোক্ষণ ধরে তোমার বাবার সাথে এলাম। কই কোন গন্ধ তো পেলাম না।”
_ “সব গন্ধ নাকে ভেসে আসে না। কিছু গন্ধ অনুভবে ভেসে আসে। আমিও বাবা বাবা গন্ধটা নাকে পাই না। অনুভব করি।”
_ “এইতো তোমার কথার মধ্যেই উত্তর রয়েছে। তুমি শহরে থেকেও তোমার ‘বাবা বাবা গন্ধ’ অনুভব করবে।”

বেশ অনেকক্ষণ ধরে পূজারিণীকে বোঝালো শ্রাবণ। অবশেষে পূজারিণী তাদের সাথে যেতে রাজি হলো। এবার শুধু পূজারিনির বাবা_ মাকে বোঝাতে হবে। বেশ অনেকক্ষণ রুমের মধ্যে থাকার পর পূজারিণী হঠাৎ করে বলল, “আপনার ঘাড় না খুব সুন্দর!”শ্রাবণ নিশ্চুপ হয়ে নিজের ঘাড়ে হাত বুলাতে লাগল। শ্রাবণকে নিশ্চুপ দেখে পূজারিণী বলল, “কি হলো আপনি চুপ করে গেলেন।”

_ “এমনি, এতদিন ধরে মানুষের চুল, ঠোঁট, চোখের প্রশংসা শুনে এসেছি। কিন্তু আজ প্রথমবার কাউকে দেখলাম ঘাড়ের প্রশংসা করতে।”


পর্ব ৪

শ্রাবণের মন আজ বড্ড উৎফুল্লিত। সে তার স্বপ্ন পেয়ে গেছে। পূজারিণীকে নিয়ে ফিরছে শহরে। অনেক কষ্টে অনিমেষ বাবুকে রাজি করিয়েছেন। প্রথমের দিকে পুরোপুরিভাবে না বললেও পরের মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি রাজি হন। যদিও তিনি শ্রাবণের চাইতে বর্ষাকে বেশি বিশ্বাস করেছেন। বর্ষা উনাদের কথা দিয়েছেন, প্রতিমাসে পূজারিণীকে গ্রাম থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাবেন।

দ্রুতবেগে গাড়ি ছুটে চলেছে কলকাতার দিকে। গাড়ির গতি মত বর্ষার মনও আজ খুব দ্রুত এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। বর্ষা সামনে থেকে খুশি হলেও ভেতরে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। সে চায় তার দাদার স্বপ্ন পূরণ হোক। তা বলে একটা মেয়েকে তার বাড়িতে রাখবে সেটা চায়নি। তিনজনের দুবেলা ভাত জোগাড় করতে রীতিমতো বেগ পেতে হয় তাকে। তার ওপর আরও একজনকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে শ্রাবণ। তার ভরণ_ পোষণের দায়িত্বও শ্রাবণের। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিস হল, শ্রাবণ মাসের শেষে এক টাকাও রোজগার করে না। তাদের পরিবার আবার একটা বড় আর্থিক সমস্যায় পড়বে। বর্ষা ‘না’ বলতে পারে নি। শ্রাবণই তার কাছে সব। তার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত সে। তাকে আরো বেশি পরিশ্রম করতে হবে। যে যত বেশি পরিশ্রম করবে, সে তত তাড়াতাড়ি সাফল্য পাবে।

ফুরফুরে বাতাসে শ্রাবণের মুখ থেকে গান বেরিয়ে এল। গুনগুন করে গান গাইছে। পাশে পূজারিণী বসে রয়েছে। তার তীক্ষ্ণ চোখ শ্রাবণের ঘাড়ের ওপর নিক্ষেপ করে রয়েছে। শ্রাবণ খেয়াল করতেই পূজারিণী চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। বেশ অনেকবার এমন হওয়ার পর শ্রাবণ বলল, “কি ব্যাপার! আমাকে এইভাবে বারবার দেখছেন কেন?”
_ “আপনার ঘাড়টা খুব সুন্দর।”খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো পূজারিণী। তার কথা শুনে শ্রাবণ অবাক হওয়ার ভান করে। মুখ পেঁচিয়ে বলে, “আজব! তুমি আবার শুরু করেছো।”

_ “না, সত্যি বলছি আপনার ঘাড় খুব সুন্দর।”
_ “অনেক হয়েছে, এমনভাবে তাকিয়ে থাকবে না। লোক খারাপ ভাববে।”
পূজারিনির কথা শুনে বর্ষাও মিটমিট করে হাসতে লাগলো। সেও কখনো মানুষের ঘড়ের প্রশংসা শুনেনি। যতই শহরের দিকে এগোতে থাকে শ্রাবণ_ বর্ষার মধ্যে কথা ততই বাড়তে থাকে। গাড়ির মধ্যেও তাদের খুনসুঁটি চলছে।

জানালার পাশে বসে পূজারিণী শুধু ভাই_ বোনের ভালোবাসার বন্ধন এর ছন্দ দেখছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য তারা ভুলে গেল পাশে পূজারিণী রয়েছে। পূজারিণী অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু শ্রাবণ পাত্তা দিল না। বর্ষার কাছে থাকলে সবকিছুই ভুলে যায় শ্রাবণ। তার দিদিভাই তার কাছেই সব। একা একা বসে পূজারিণী বড্ড বোরিং বোধ করছে। শেষমেষ সে শ্রাবনকে ‘দাদা ভাই’ বলে ডাকলো।

‘দাদাভাই’এই একটা শব্দ শুধুমাত্র বর্ষার বলার অধিকার রয়েছে অন্য কারোর নেই। শ্রাবনকে অন্য কেউ এই নামে ডাকলে ভীষণ রেগে যায়। পূজারিণী উপর রাগ করলেও প্রকাশ করল না। তাকে বুঝিয়ে বলল, দ্বিতীয়বার যেন এই নামে না ডাকে। পূজারিণী মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে জানতে চাইলে, তাকে কি বলে ডাকবে?
_ “ভাই বলে ডাকবে।”শ্রাবণ বলল।

_ “আপনি আমার চাইতে কত বড়, আপনাকে আমি ভাই বলে কিভাবে ডাকতে পারি।”
_ “তাহলে নাম ধরে ডাকো। ভুলেও দাদাভাই বলো না।”
কোথায় এসে পড়ল। যেখানে বয়সে বড় মানুষকে দাদাভাইও বলা যাবে না।

আজব ফ্যামিলিতে যাচ্ছে পূজারিণী। তার জন্য কি অপেক্ষা করে রয়েছে, সেটা একমাত্র ভগবানই জানে। তবে শ্রাবণ বর্ষা ভালবাসা দেখে মুগ্ধ সে। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করল, প্রত্যেক ভাই বোনের সম্পর্ক সারা জীবন যেন এভাবেই থাকে। অল্প সময় চুপ থেকে পূজারিণী বলল, “আপনি ততক্ষণ থেকে আমাকে আজব আজব বলে যাচ্ছেন, কিন্তু এখন আপনাদেরকে আমার আজব লাগছে।”শ্রাবণ ভারী মুখখানা পূজারিণী দিকে ঘোরালো। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “কেন?”

_ “আপনি বর্ষাকে বলছেন দিদি ভাই, আবার বর্ষা আপনাকে বলছেন দাদা ভাই। অল্প সময় যেতে না যেতে আবার তুই তে তা করে কথা বলছেন। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।”পূজারিণী কথা শুনে দুজনেই হেসে উঠলো। তাদের হাসি দেখে পূজারিণী ভীষণ রাগ করলো। প্রত্যেক কথায় তাদের হাসতে হয়। এমন কোনো হাসির কথা বলেনি। যদি কোন ভুল করেছিল তা বুঝিয়ে বলতে পারতো, হাসার কি দরকার ছিল? শহরের মানুষগুলো হয়তো এমনই।

মানুষের ভুল না ধরিয়ে দিয়ে ভুলকে নিয়ে ট্রল করতে থাকে। পূজারিণী ভারী মুখ শ্রাবনকে ভাবিয়ে দিল। পূজারিণীকে এভাবে কষ্ট দেওয়া উচিত হয়নি। পূজারিণী পাশ ঘেষে বসে ডাকতে লাগল। জানালার দিকে মুখ করে রয়েছে পূজারিণী, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পেয়ে গেছে। সামান্য হাসিতে এত কষ্ট পাবে সেটা ভাবতে পারেনি শ্রাবণ। খুব ইমোশনাল মেয়ে। শ্রাবণ পূজারিনির চোখ থেকে জল মুছে দিয়ে সরি চাইল। শ্রাবণের আদর_ যত্ন পেয়ে পূজারিণী কান্না থামল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, “এভাবে আর হাসবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়। ভুলটা ধরিয়ে দিবেন মেনে নেব। কিন্তু অন্যের বিদ্রুপ আমি মোটেও সহ্য করতে পারি না।”

_ “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ওইভাবে আর হাসবো না। আসলে আমরা দুজন জমজ ভাইবোন। তাই একে অপরকে দিদিভাই দাদাভাই বলি।”
_ “সিরিয়াসলি।”পূজারিণী প্রাথমিক আঘাত সামলাতে সামলাতে বলল।
_ “হ্যাঁ”

_ “পুরো ঘটি।”
পূজারিণী কথা শুনে শ্রাবণ অবাক হলো। সে কি বলল, আর পূজারিণী কি উত্তর দিলো। শ্রাবণ বিব্রত মুখে বলল, “ঘটি! মানে কি?”পূজারিণী একগাল হাসি দিয়ে বলল, “কিছু না”। বলেই আবার হাসতে লাগল।

গাড়ি একসময় গ্রাম ছেড়ে পুরোপুরি শহরে ঢুকে পড়ল। শহরের বড় বড় বিল্ডিং পূজারিনির চোখকে গাড়ির মধ্যে আটকে রাখতে পারল না। জানালা দিয়ে শহরের বড় বড় বিল্ডিং, চওড়া রাস্তা দেখতে লাগলো। শহরের মেয়েদের দেখে হতভম্ব সে। কত ছোট ছোট মেয়ে একা ঘুরে বেড়াচ্ছে, একা গাড়িতে উঠে স্কুল, কলেজের চলে যাচ্ছে। অথচ সে আজ পর্যন্ত বাবাকে ছাড়া কোথাও বের হয়নি। গ্রামের হাটের বেশি দূরে সে কখনোই যায়নি।

কখনো গাড়ি দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে, আর বিপরীত দিকে গাড়িগুলো পিঁপড়ের মতো সারিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সেগুলো দেখে খুব মজা পাচ্ছে পূজারিণী। কখনো রাস্তায় চলা মেয়েদের মত নিজের চুল গুলো ঠিকঠাক করছে আবার চুল বাঁধার চেষ্টা করছে। পূজারিণীকে দেখে শ্রাবণ মিটমিট করে হাসতে লাগলো। এক সময় বলেই ফেললো, পূজারিণীও তাদের মতন হতে বেশি সময় লাগবে না। পূজারিণী ব্যাপকভাবে খুশি হলো শ্রাবণের মুখে অনেক প্রশংসা শুনে। শ্রাবণ নিজেই পূজারিণীকে শহরের রাস্তা গুলো চিনিয়ে দিতে লাগল। শহরের কোন দিক থেকে গেলে কোথায় উঠবে সবই বুঝিয়ে দিচ্ছে শ্রাবণ।

কিন্তু পূজারিণী কিছুই বুঝেছে না। তবুও শ্রাবণের কথা মন দিয়ে শুনছে। শ্রাবনের প্রতিটা বাক্য তার কাছে কবিতার মত লাগছে। কত সুন্দর কথা বলে মানুষটি। কথার মাধুর্যতা তাকে মুগ্ধ করল। বারবার ইচ্ছে করলো শ্রাবণের কথা শোনার জন্য। শ্রাবণ কথা বলা বন্ধ করার সাথে সাথে সে বলল, “আচ্ছা, আমি কাল থেকে কি স্টেজ শো করবো?”নিতান্ত হাসির কথা বলল পূজারিণী। যে কেউ এই কথা শুনলে হেসে উঠবে। শ্রাবণেরও হাসি পাচ্ছে কিন্তু আটকে রাখল। এখনো গানের ‘গ’ শিখেনি অথচ স্টেজ শো করার স্বপ্ন দেখছে। তবে পূজারী এই ইচ্ছা কে বুকের মধ্যে আগুনের মতন চালিয়ে দিতে হবে।

তবেই সে সাফল্য পাবে। এই নেশা তাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। শ্রাবণ বোঝালো, তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে, অনেক স্ট্রাগল করতে হবে, প্র্যাকটিস করতে হবে, নতুন নতুন গানের তাল শিখতে হবে, সঙ্গীত চর্চা করতে হবে, বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতে হবে তবেই সে একজন প্রকৃত গায়িকা হয়ে উঠবে। পূজারিণী মাথানিচু করে বললাম, “কিন্তু সবাই যে বলে আমি ভালো গান করতে পারি। তাড়াতাড়ি বড়ো জায়গায় যেতে পারবো। তারা কি মিথ্যে বলে?”

_ “ওরা মিথ্যে বলে না। তোমার মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। কিন্তু শুধু প্রতিভা থাকলে হয় না। তাকে কাজে লাগাতে হয়, তাকে ব্যবহার করতে হয়। তাদের সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে মাঝ পথে হারিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি উঁচুতে উঠে গেলে সেখান থেকে পড়তে বেশি সময় লাগবে না।”
শ্রাবণের কথা, পূজারিণী গভীর ভাবে ভাবতে লাগলো। আমতা আমতা করে কিছুটা হলেও শ্রাবণের কথা বুঝতে পেরেছে। তবুও মনের সংকোচন দূর করতে পারছে না। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। সে আমার নম্রভাবে বলল, “আমি না আত্মবিশ্বাস পাচ্ছি না, নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না।”

_ “আত্মবিশ্বাস তুমি তখন পাবে, যখন তুমি অন্যের কথা নয় নিজের মনের কথা শুনবে। আমার কথা না শুনে তুমি তোমার মনের কথা শোনো। সে কি বলছে তা বোঝার চেষ্টা করো।” শ্রাবণ পূজারিণী মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল। তারপর অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতা। শহরে ঢুকে পড়ার পর থেকে বর্ষা কোন কথা বলছে না। শহরে গাড়ি_ ঘোড়া খুব বেশি, মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সে। গাড়ির মধ্যে তার জীবন শ্রাবণ রয়েছে। অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতা পর পূজারিণী জানতে চাইল সে জয়ী হতে পারবে কি না?

_ “জয়ী তারা হয় না, যারা শক্তিশালী। জয়ী তারাই হয়, যারা ভাবে সে জয়ী হবে।”হাসিমুখে উত্তর দিলাম শ্রাবণ। শ্রাবণের প্রতিটি বাক্য পূজারিনির কাছে মধুময়। সেও শ্রাবণের সাথে খুশির হাসি হাসতে লাগলো।
শহরে বেশ নির্জন জায়গায় শ্রাবণের বাড়ি। আশেপাশে বাড়ির সংখ্যা খুবই কম। পাশে একটা ছোট্ট মন্দির রয়েছে। বাড়ির মানুষ গুলোর মত বাড়ীটাও বেশ সুন্দর। বাড়ির চারিদিকে ফুলে ভর্তি বাগান রয়েছে। শহরের মানুষও তাহলে গাছ ভালোবাসে। গাছকে সবাই ভালবাসে তবে গ্রামের মানুষরা একটু বেশিই বাসে।

পূজারিণী প্রথমে ভেবেছিলো শ্রাবণের মা নিশ্চয়ই রাগী হবে। উনার স্বামী কত বড় গায়ক। হয়তো তার সাথে কথা বলতে চাইবে না। কিন্তু বাড়িতে এসে তার ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটলো। অনন্যা দেবী খুব মিষ্টি একটা মানুষ। একটা অপরিচিত মেয়েকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আপন করে নিলেন। বাড়িতে প্রবেশ করতেই তিনি পূজারিণীকে ‘বৌমা’ বলে ডাকলে। পূজারিণী বুঝতে পারল না, তাকে বৌমা বলছে কেন?তবে উনার মুখে বৌমা ডাক বেশ সুন্দর।

শ্রাবণ আর বর্ষা মায়ের কান্ড দেখে হাসতে হাসতে রুমে চলে গেল। কিন্তু বেচারা পূজারিণী অনন্যা দেবী খপ্পরে পড়ে গেল। তিনি গোটা বাড়ি ঘুরে দেখাচ্ছেন পূজারিণীকে। বকবক করেই যাচ্ছেন। এতদুর জার্নি করার অভ্যাস পূজারিনির নেই। ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছিল, আবার অনন্যা দেবীকে বলতেও পারছিল না। তিনি বোঝার চেষ্টাও করছে না। তিনি পুরো ইতিহাস বই খুলে বসেছেন, সেই বই প্রতিটা বাক্যে শ্রাবণ আর বর্ষাকে ব্যবহার করছে।

শ্রাবণ বর্ষার এটা খেতে ভালোবাসে, ওখানে যেতে ভালোবাসে, সেখানে যায় না, ওটা করে না, এটা করে না…. পূজারিণী একসময় বলে ফেলল, উনাকে একটু জল খেয়ে আবার বলতে। কিন্তু উনি শুনলেন না। জল পরে খাবে আগে কথাগুলো শেষ করে নিক।

কয়েক বছর আগে উনার সাথে দেখা করাটাই ছিল মানুষের স্বপ্ন। কিন্তু আজ সে উনার বাড়িতে থাকবে। এর চাইতে বড় স্বপ্ন হতে পারে না। এটাই পৃথিবীর নিয়ম!আজ উপরে আছো কিন্তু নিচে নামতে বেশি সময় লাগবে না। উপরে শুধু তোমার থাকার অধিকার নেই অন্যের রয়েছে। স্কুলে প্রথম থেকে লাস্ট হওয়া কিংবা লাস্ট থেকে ফার্স্ট হওয়া খুবই সহজ। কিন্তু ফার্স্ট আসন ধরে রাখা বড্ড কঠিন।

বর্ষার অফিসে দেরি হয়ে গেছিল। খুব তাড়াহুড়ো করছে সে। শ্রাবণ কিছুটা হলেও হেল্প করার চেষ্টা করছে। শ্রাবণ ফাইলগুলো গুছিয়ে দিয়েছিল, সেইসময় হাঁপাতে হাঁপাতে পূজারিণী প্রবেশ করল। তাকে হাঁপাতে দেখে বর্ষা কাছে গিয়ে বলল, “কি হয়েছে? তুমি এইভাবে হাঁপাচ্ছ কেন?”

_ “আপনার মা!”পূজারিণী হাঁপাতে হাঁপাতে বললো। বর্ষা এক গ্লাস জল নিয়ে তাকে দিল। তারপর জানতে চাইল তার মা কি করেছেন। পূজারিণী নিমিষে জল শেষ করে দিল। তবুও তার তৃষ্ণা মিটলো না। সে বলল, “আপনার মা কি সব আজব কথা বলছেন। কথা বলুক তাতে আমার অসুবিধা নেই। কিন্তু উনি একনাগাড়ে বলে যাচ্ছেন একবারের জন্যও থামছেন না। কতবার বললাম জল খেতে সেটাও খাচ্ছেন না। প্রতিটা বাক্যে আপনার দুজনের নাম ব্যবহার করছে। আমার মাথাটা গনগন করছে।”বর্ষা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে হাসতে লাগলো। ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিল সে। তাদের হাসি দেখে পূজারিণী আবার বলল, “আপনারা হাসছেন!

_ “কিছু মনে করো না। আসলে আমার মা এমনই। কোন বিবাহযোগ্য মেয়েকে আমাদের বাড়িতে আনলে উনি নিজের বউ মা ভাবতে থাকেন। দাদাভাইয়ের বয়স হয়েছে তাকে কতবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মা। কিন্তু দাদা ভাই রাজি হয় নি। মাও কখনো বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করেনি, দাদা কোনো কাজ করে না, তার দুটো পা নেই, তাকে কেন একটা মেয়ে বিয়ে করতে চাইবে? একটার পর একটা রিজেক্ট হয়ে যাবে তার ভয়ে দাদা ভাই বিয়েতে কখনই রাজি হয়নি। মা সব বুঝেও না বোঝার ভান করে।”

পূজারিণী চুপ হয়ে রইল। শ্রাবণ নিজে হাতে হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে পূজারিনির কাছে আসলো। তার চোখে চোখ রেখে বলল, “মা’র হয়ে আমি সরি চেয়ে নিচ্ছি। মায়ের কথায় কিছু মনে করো না। এর আগেও বর্ষার দুজন অফিসের কর্মচারী এসেছিল উনাদের সাথে এমনই করেছেন। ওরা অনেক রেগে গেছিল আশা করি তুমি তা করবে না।”
_ “না না, আমি কিছু মনে করিনি। উনি খুব সহজেই অচেনা মানুষকে আপন করে নিতে পারেন। আমরা গ্রামের মানুষেরাও অতটা তাড়াতাড়ি কাউকে আপন করতে পারি না।”

_ “আচ্ছা আমি আসছি। তোরা সাবধানে থাকিস।”বর্ষা ব্যাগ তুলে নিয়ে বলল। তারপর শ্রাবণের কাছে এসে গালে একটা চুম্বন করল। শ্রাবণ বর্ষার গালে একটা চুম্বন দিয়ে বলল, “সাবধানে যাস!”বর্ষার রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখনই কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে এলো। তারপর পূজারিণী গালে একটা চুম্বন করে বলল, “আজ থেকে তুইও আমার বোন! সাবধানে থাকিস!”পূজারিণী চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এলো। তাকে কেউ বোন বলে ডাকছে। এত তাড়াতাড়ি এই বাড়িতে, সে সবার কাছে আপন হয়ে উঠবে কখনো ভাবে নি।

শুধু কি আপন হয়ে উঠেছে, বাবা মার অভাব বুঝতেও দিচ্ছে না। কয়েক মুহূর্তে সে যা ভালোবাসা পেয়েছে সেই ভালবাসার বন্ধন ছেড়ে তার মন যেতে চাইছে না। বর্ষা পূজারিণী চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “বোকা মেয়ে! কান্না করছিস কেন? আমার গালে চুম্বন দিবি না!”পূজারিণী কোনো কথা বলতে পারল না। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আবার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠছে। তারপর আলতো করে বর্ষার গালে চুম্বন করল।

শ্রাবণ পূজারিণীকে তার বাবার রুমে নিয়ে এলো। অনেক দিনের পর আদিত্য চৌধুরীর রুম খোলা হল। বাবা মারা যাওয়ার পর এই রুমে তেমন কেউ প্রবেশ করে না। মাঝেমধ্যে শ্রাবণ আসে। বাবার ইন্সট্রুমেন্ট গুলো ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে। মাঝেমধ্যে গান ধরে। অনেক নামিদামি ইন্সট্রুমেন্ট ছিল আজ সেগুলো হারিয়ে গেছে। গোটাকয়েক মাত্র ইন্সট্রুমেন্ট রয়েছে। শ্রাবণ প্রতিটা ইন্সট্রুমেন্ট এর নাম এবং তাদের কাজ পূজারিণীকে বোঝালো। পূজারিণী গিটার আর হারমোনিয়াম ছাড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। শ্রাবণ একে একে সেলো, দোতারা, রবাব, একোস্টিক গিটার, বেস গিটার বাজিয়ে শোনালো। তবে সেতার বাজাতে পারলো না শ্রাবণ। পূজারিণী শুধু হাঁ করে দেখছে। সে এক সময় বলল, “আমাকেও কি এগুলো বাজাতে শিখতে হবে?”
_ “অবশ্যই।”

_ “আমিতো গায়িকা হতে চাই, এগুলো শিখে আমি কি করবো?”
_ “গীত, বাদ্য ও নৃত্য সমষ্টিকে সংগীত বলে। এগুলো প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা কলা। অর্থাৎ শুধু গীত শিখলে হবে না তার সাথে সাথে বাদ্য এবং নিত্য সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি।

পূজারিণী ঠিক বুঝতে পারছে না তবুও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। শ্রাবণ আবার একটু থেমে বলল,
“আজ থেকে তুমি এই রুমে থাকবে। তোমার কোন অসুবিধা হবে নাতো।”
_ “আমি একা এই রুমে থাকবো!”
_ “হ্যাঁ।”

_ “একা থাকতে আমি পারবো না। আমি ভীষণ ভয় পাই। আমি বর্ষার কাছে থাকবো।”
_ “তা তো হবে না। বর্ষা শুধু শ্রাবণ এর জন্য। সে কখনোই আমাকে ছেড়ে তোমার কাছে থাকতে চাইবে না। তাছাড়া আমার বাথরুমে যেতে, বিছানায় উঠতে বড্ড অসুবিধা হয়। তার সাহায্য ছাড়া আমি অচল। তুমি চাইলেও সে তোমার কাছে আসবে না।”
_ “তাহলে আমি তোমার মায়ের কাছে থাকবো”।
_ “কিন্তু মায়ের বকবকানি!”

পূজারিণী একটু হেসে বলল, “সেটা আমি ঠিক মানিয়ে নেব।”


পর্ব ৫

শহরে আসার পর পূজারিণীর চঞ্চলতা এবং প্রাণোচ্ছল কোথায় হারিয়ে গেল। বেশিরভাগ সময় চুপচাপ বসে থাকে। তবে বর্ষার সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়েছে। কেবল তার সাথেই প্রাণ খুলে কথা বলতে পারে। শ্রাবনকে একটু ভয় পায় সে। শ্রাবণ কেমন একটা মানুষ! প্রতিটা কথায় রাগ করে। অথচ মা আর বর্ষার সাথে কত শান্তভাবে কথা বলে। শিক্ষক আর ছাত্রীর মধ্যে ভালোবাসার পাশাপাশি ভয়টাও ভীষন জরুরী। ছাত্রীর কর্তব্য শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। হয়তো সেই জন্যই শ্রাবণ তার উপর রাগান্বিত থাকে।

প্রায় তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর শ্রাবণ আর পূজারিণীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিল বর্ষা। পূজারিণীকে আজ গানের স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে এসেছে শ্রাবণ। স্কুলের পথ দিয়েই বর্ষার অফিস তাই তাদেরকে ড্রপ করে দিল সে। গাড়ির ভেতরে থেকেই বর্ষা বলল, “সাবধানে বাড়ি ফিরিস। পূজারিণী তুমি কিছুতেই দাদাভাইর হুইল চেয়ার ছাড়বে না, কেমন।”পূজারিণী মাথা নাড়লো। বর্ষা আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “আজ আমার ফিরতে একটু দেরি হবে, চিন্তা করে থাকবি না।”পূজারিণী গাড়ির জানালার কাছে গেল। তারপর বর্ষাকে মৃদু কন্ঠে বলল, “কেন? আজকে অফিসে কিছু আছে?”

_ “না রে পাগলি। আজ থেকে আমাকে দাদার পাশাপাশি আমার একটা বোনের দায়িত্ব নিতে হবে। তার ভরণপোষণ তার স্কুলের খরচ সব আমার উপর। তাকে যে বড় গায়িকা হতে হবে। তাইতো আজ থেকে আমি অফিসে ওভার ডিউটি করব।”বর্ষা পূজারিণীর কাঁধে হাত রেখে বলল। পূজারিণী দুটো চোখ ছল ছল করে উঠেছে। কান্না করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এত জনের সামনে পারছে না। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে সে বলল, “তোমরা আমার জন্য এত কিছু করছ কেন? তোমাদের এমনিতেই কষ্ট, আমাকে নিয়ে এসে তোমাদের কষ্ট আরো বাড়িয়ে ফেলেছো কেন?”

_ “কষ্ট নয়, এটাতো আনন্দ। ওই আনন্দটা তুই বুঝতে পারবি না। তবে তোকে এমনি_ এমনি গান শিখাচ্ছি না। তুই যখন বড় গায়িকা হয়ে যাবি, তখন আমার সমস্ত টাকা শোধ করে দিবি।”কথাগুলো বলে বর্ষা হেসে উঠলো। পূজারিণীও চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া দুফোঁটা জল মুছে ফেলল। সে হাসিমুখে বলল, “তোমাদের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না…”
_ “আচ্ছা অনেক হয়েছে। এবার স্কুলে…..

বর্ষাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো পূজারিণী। সামনে দুজন সিকুরিটি গার্ড রয়েছে। তারপরে লম্বা রাস্তা পেরিয়ে গানের স্কুল। গানের আবার স্কুল হয়, এটা ভেবেই প্রথমে আশ্চর্য হয়েছিল পূজারিণী। তার কল্পনার বাইরে ছিল গানের জন্য আলাদা করে স্কুল রয়েছে। তখনই সে আরো বেশি আশ্চর্য হয়েছিল শ্রাবণের কথা শুনে, গানের শুধু স্কুল নয় মিউজিক কলেজও রয়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, সঙ্গীত এর বিভিন্ন ভাগ নিয়ে বিভিন্ন স্কুল রয়েছে। শুধুমাত্র রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে আলাদা স্কুল রয়েছে।

রবীন্দ্র সংগীতকে নিয়ে গবেষণা হয়। এই কথাগুলো সেদিন মানতে হয় পূজারিণীকে। যা আজ নিজের চোখে দেখছে সে। পূজারিণী এখন বুঝতে পারছে সংগীত শেখা অত সহজ নয়। তাইতো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে সংগীত শেখে, কিন্তু শিল্পী হয়ে ওঠে মাত্র চার থেকে পাঁচজন। পূজারিণী হুইলচেয়ার পেছনে ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শ্রাবনকে। বর্ষার এনে দেওয়া চুরিদার সে পরে রয়েছে। কয়েকদিন আগেই বর্ষা তার জন্য অনেকগুলো চুরিদার নিয়ে আসে।

পূজারিণী বড়ো হয়েছে তার ফ্রক পরা মানায় না। সেদিন কত খুশি হয়েছিল পূজারিণী। নতুন পোশাক পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল। দুই বোনের সম্পর্ক মানেই যে রক্তের সম্পর্ক হতে হবে, সেটা সেদিন ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছিল বর্ষা। রক্তের চাইতেও বড় সম্পর্ক হল মনের সম্পর্ক। বর্ষাকে তার বড্ড আপন মনে হয়। কলকাতায় সবচেয়ে বড় গানের স্কুল। স্কুলের প্রিন্সিপাল শ্রাবণের ছোটবেলার বন্ধু অনির্বাণ।

পূজারিণীকে এখানে নিয়ে এসেছে যাতে তার কোনো অসুবিধা না হয়। স্কুলের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখল, একটা রুমের সামনে স্পষ্ট ভাবে লেখা রয়েছে ‘প্রিন্সিপাল রুম’। দুজনই রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রুমের মধ্যে কার সাথে কথা বলছেন অনির্বাণ। শ্রাবনকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ওই লোকটিকে বাইরে যেতে বলল, আর শ্রাবণকে কাছে ডেকে নিল। প্রবেশ করতেই অনির্বাণ দু’কাপ চা নিয়ে আশার আদেশ দিলেন।। শ্রাবণ তাড়াতাড়ি বলল, “না থাক, আমি চা খাব না।”
_ “কি বলছিস ভাই। এত দিনের পর দেখা হল আমাদের, আর সামান্য চা খাওয়াতে পারব না।”

অনির্বাণের আচরণ দেখে শ্রাবণ হতবাক। কয়েক বছর আগে শিক্ষকতার জন্য অ্যাপ্লিকেশন করেছিল শ্রাবণ। কিন্তু অনির্বাণ নিজেই না করে দিয়েছিল। আর আজ তার আতিথিয়তায় মুগ্ধ শ্রাবণ। এতক্ষণে অনির্বাণ পূজারিণীকে লক্ষ্য করলো। তাকে পাশে থাকার চেয়ারে বসতে বলল। তারপর জানতে চাইল তাদের আসার উদ্দেশ্য। শ্রাবণ পূজারিণী কাছ থেকে একটা ফর্ম নিয়ে অনির্বাণকে দিয়ে বলল, “পূজারিণীকে ভর্তি করে নিতে”। অনির্বাণ একবার পূজারিনীর দিকে আবার একবার শ্রাবণের দিকে তাকালো। তার চোখ বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। এক সময় চোখ স্থির করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তুই এখনও গান নিয়ে পড়ে আছিস।

কতবার বলেছি তোর বাবার মধ্যে প্রতিভা ছিল তোর মধ্যে নেই। তুই পারবি না গান করতে। তাছাড়া তোর দুটো পা নেই এই অবস্থায় ওই মেয়েটাকে গান শেখাবি।”পুরো ঘর নিস্তব্ধ। কেউ কোনো কথা বলছে না। শ্রাবণের বুকটা কেমন করে উঠছে। যেখানেই যায় সেখানেই প্রতিবন্ধীকতার অপমান সহ্য করতে হয়। সে মুখ উঁচু করে বলল, “গান আমি শিখবো না। মেয়েটা শিখবে, তাকে ভর্তি নিতে অসুবিধা কোথায়?”

_ “অসুবিধা অনেক আছে। প্রথমত, আমাদের ভর্তি প্রক্রিয়া অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুন করে কাউকে ভর্তি নিচ্ছি না। এক বছর অপেক্ষা করে থাকতে হবে। তাছাড়া আমাদের স্কুলে ফিসও অনেক বেশি। প্রতি মাসে এক তারিখের মধ্যে জমা দিতে হবে যেটা তোর পক্ষে সম্ভব নয়।”

_ “ভাই, একটু বোঝার চেষ্টা কর। আমি মেয়েটাকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছি। তার বাবা_ মাকে কথা দিয়েছি। আর এখানে নিয়ে এসে তাকে এক বছর অপেক্ষা করে রাখবো।”
শ্রাবণের কথা শুনে অনির্বাণ হাসতে লাগল। তার হাসাটাই স্বাভাবিক। তার কাছে কেউ বারবার হাত জোড় করে সাহায্য চাইছে, অনির্বাণের মতন মানুষ তাতেই খুশি হওয়ার কথা। কিছুক্ষণ হাসার পর বলল, “গ্রামের মেয়ে গ্রামের মতন থাকতে দে। কেন মিছে মিছি গায়িকা বানানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছিস ওকে।

স্কুলের দু’চারটা ফাংশনে গান করাই তাদের জন্য যথেষ্ট। তারপর বিয়ে দিয়ে দে সুখে শান্তিতে সংসার করুক।”অনির্বাণ এর ওপর ভীষন রাগ হল শ্রাবণের। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোলে রাখলো। কেবল অনির্বাণই তাকে সাহায্য করতে পারে। সেখানে তার উপর রাগ দেখালে চলবে না। পূজারিণী কোন কথা বলছে না। সে চুপচাপ বসে দুজনের কথা শুনছে আর অপমান সহ্য করেছে। শ্রাবণ বারবার অনুরোধ করলো অনির্বাণকে। কিন্তু অনির্বাণের পাষাণ হৃদয়কে গলাতে পারল না।

তবে একটা সুযোগ দিল। পূজারিণীকে এক্সাম দিতে হবে। এক্সামে যদি পাস করে তাহলে তাকে ভর্তি করে নেবে। কিন্তু শ্রাবণ এতে খুশি হলো না। সে জানে পূজারিণী কিছুতেই পাস করতে পারবে না। তার কন্ঠস্বর ভালো কিন্তু সংগীত সম্পর্কে তার জ্ঞান নগণ্য। আর এজন্যই অনির্বাণ ইচ্ছে করে এক্সাম এর কথা বলেছে। কণ্ঠস্বর ভাল না এটা বলতেও বেশি সময় নেবে না অনির্বাণ, সেটা ভালই বুঝতে পারছে শ্রাবণ। কিছুক্ষন নিস্তব্ধতা থেকে শ্রাবণ বলল, “সব জায়গাতেই তোদের রাজনীতি। এখানে রাজনীতি না করলে হয় না?”
_ “কোথায় রাজনীতি করলাম?

স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট রুলস এবং গাইডলাইনস রয়েছে। সেটা আমাদের পালন করতে হয়। তুমি কি করে বুঝবি। তুই তো কখনো স্কুলের মুখ দেখিস নি।”
_ “আমি হয়তো কখনো স্কুলের মুখ দেখিনি, তবে স্কুলের কোনটা গাইডলাইনস কোনটা রাজনীতি সেটা আমি ভালো করে জানি। আমি নিতান্ত 18 বছরের যুবক নই।
_ “আচ্ছা ঠিক আছে এখন আসতে পারিস। আমার অনেক কাজ আছে।”

শ্রাবণ পূজারিণীকে ইশারা করে বললো ফিরে যাওয়ার জন্য। পূজারিণী উঠে হুইল চেয়ার ধরল। ফিরে যাচ্ছিল, তখনই শ্রাবণ অনির্বাণ এর দিকে তাকিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলল, “আজ আমি ফিরে যাচ্ছি। তবে তোকে একটা কথা দিয়ে গেলাম, আজ যাকে ভর্তি নিলি না একদিন তার ছোট্ট একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবি।”হো হো করে হেসে উঠল অনির্বাণ। সেও দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বললো, “তাহলে তিন বছর পর বাংলার একটা নতুন সংগীত শিল্পী জন্মাবে।”
_ “সেটা তো সময় বলবে।”

তীক্ষ্ণ রোদ তাদের গায়ে এসে পড়ছে। রোদের সচ্ছলতার মতো পরিষ্কার তাদের মন গুলো আজ বিষাদে ভরে উঠেছে। সমাজে প্রভাবশালী মানুষের চাপে আজ কত প্রতিভাযুক্ত মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র তাদের স্বার্থের জন্য কত মানুষের স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে।

সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর শ্রাবণ পূজারিণীকে টোটো করে চলে যেতে বলে। তিন কিলোমিটার হেঁটে যেতে কষ্ট হবে পূজারিণীর। শ্রাবণ হুইলচেয়ার গড়িয়ে গড়িয়ে ঠিক পৌঁছে যাবে। কিন্তু পূজারিণী যায়নি। শ্রাবনকে একা ছাড়তে চায় না। তাই তারা দুজনে একসাথে বাড়ি ফিরছে ফুটপাতের ওপর দিয়ে। শ্রাবণ হুইল চেয়ারের উপর বসে রয়েছে তাই তার কষ্ট না হলেও পূজারিণী পুরো ঘেমে গেছে।

_ “আচ্ছা আমাকে ওরা ভর্তি নিল না কেন?”পূজারিণী ধীরকন্ঠে শ্রাবনকে জিজ্ঞেস করল।
_ “কি জানি! ভেবেছিলাম তোমার লড়াইটা একটু সহজ করে দেব। কিন্তু তা হলো না। তোমাকে অনেক কষ্ট করতে হবে।”
_ “এখন আমার কি করনীয়?”

_ “তোমাকে এক্সাম দিতে হবে। কালকে তুমি এক্সাম দেবে।”
_ “কিন্তু আমি পাশ করতে পারব না।”
_ “সব সময় নেগেটিভ মাইন্ড নিয়ে ঘোরো কেন? কিছু না করার চাইতে, করে হেরে যাওয়াই ভালো।”শ্রাবণ গম্ভীর কণ্ঠে বলল। শ্রাবণের কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা দেখে পূজারিণী আর কিছু বলল না। শ্রাবণ আবার রেগে গেছে তার ওপর। অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতা থাকার পর পূজারিণী বলল, “আচ্ছা, আপনিতো বলেছিলেন আপনি নিজেই আমাকে গান শেখাবে। তাহলে স্কুলের কি প্রয়োজন আছে।”

শ্রাবণ কিছু বলল না। সে কিছু একটা ভাবছে। ভাবতে ভাবতে এক সময় বলল, “তুমি অরিজিৎ সিং এর নাম শুনেছো?”পূজারিণী মাথা নাড়িয়ে”হ্যাঁ” বলল।
_ “জানেন, অরিজিৎ সিং কে গান শেখানোর জন্য তিনজন গুরু ছিলেন। রাজেন্দ্র প্রসাদ হাজারী যিনি ক্লাসিকাল মিউজিক শেখাতেন। ধীরেন্দ্র প্রসাদ হাজারী যিনি তবলা বাজানো শেখা দেন। বীরেন্দ্র প্রসাদ হাজারী যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন।

তা সত্ত্বেও তিনি মিউজিক স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। সেখানে গান গেয়েছেন। কেন করেছিলেন? তারমধ্যে শেখার একটা আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহী উনাকে আজ এত বড় একটা জায়গায় নিয়ে গেছে। শিক্ষা কখনোই কেউ কোনদিন কেড়ে নিতে পারবে না। যতই পড়বে ততই তোমার জ্ঞানের পরিধি বাড়বে।”

একটা ছোট্ট রুম। তাতে কিছুটা দূরত্ব বরাবর রয়েছে দুটো খাট, শ্রাবণ আর একটা বর্ষার। একটা রুমে দুইজন থাকে। রুমটা বেশ সাজানো গোছানো। রুমের মধ্যে রয়েছে একটা দারুন স্মেল। রুমে একটা জায়গায় অনেকগুলো কাপ রয়েছে, সেগুলো সবই বর্ষার আর শ্রাবণের। তবে কোনটা কার আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। সবগুলি মিশিয়ে রেখেছে। শ্রাবণ আর বর্ষা দুজন আলাদা মানুষ কিন্তু প্রাণ একটি। পূজারিণী ধীর পায়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে দেখলো, কেউ নেই ভেতরে। সে চারিদিকে ঘুরপাক খেয়ে দেখছে।

আলমারির ভিতরে কত বই রয়েছে। তার ইচ্ছে করলো বইগুলো নিয়ে একটু খুলে দেখতে। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে নেওয়া উচিত নয়। সেখান থেকে চলে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। বারবার নিজেকে দেখছে সে চকচক করা আয়নায়। আবার হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। দেখতে অনেক মিষ্টি। শুধু একটু যত্ন নিতে হবে। কিন্তু কিভাবে যত্ন নেবে?
_ “এই যে ম্যাডাম, একা একা ওভাবে হাসছো কেন?”হাসির সুরে বলল বর্ষা। কিছুক্ষণ আগে সে রুমে প্রবেশ করেছে। প্রথমে পূজারিণীকে রুমের মধ্যে দেখে একটু আশ্চর্য হয়। পরে তা আবার বিলীন হয়ে যায়। হঠাৎ বর্ষার গলা শুনে ঘাবড়ে যায় পূজারিণী। আমতা আমতা করে বলে, “কই কিছু না তো।”

_ “দাদাভাইকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
_ “উনি তো‌ কাকিমার কাছে ছিল।”

_ _ “ওও। ‘পূজারিণীকে রুমের মধ্যে থাকতে বলে বাথরুমে প্রবেশ করল বর্ষা। ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখল পূজারিণী ঠিক একই ভাবে বসে রয়েছে। তাকে বারবার লক্ষ করছে। তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণ, সে ঠিক বুঝতে পারল না। বর্ষা তার কাছে গিয়ে বসলো। বলল, “আমাকে কিছু বলবে?”মাথা নেড়ে ‘না’ বলল পূজারিণী। অল্প সময়ের পর পূজারিণী বলল, “আচ্ছা বর্ষা দিদি, তোমরা সব সময় কত সুন্দর গুছিয়ে থাকো, কিন্তু আমি থাকতে পারি না কেন?”বর্ষা মৃদু হাসলো।

তারপর দুটো হাত তার গালে বোলিয়ে বলল, “নিজেকে সুন্দর আর গুছিয়ে রাখার জন্য প্রথমে নিজেকে ভীষণ ভালোবাসতে হবে, আর অন্যের সাথে নিজের তুলনা করা যাবে না। তবেই সুন্দর হওয়া যায়।”
_ “ধুর, কি যে বলো। নিজেকে আবার নিজেই কিভাবে ভালোবাসবো!”

_ “ভালোবাসা যায়। নিজেকে নিজে ভালো না বাসলে সে জীবন অর্থহীন। নিজেকে কোনদিন ভালো না বাসলে অন্য কেউ তোমাকে কোনদিনও ভালোবাসবে না।”পূজারিণী একটু একটু করে বর্ষার কথা ভেতর থেকে ভাবতে লাগলো। কথার মধ্যে অনেক গভীরতা রয়েছে। সেই গভীরতা পৌঁছতে হবে পূজারিণীকে। বর্ষা নিজের সাজুগুজু করার সরঞ্জাম নিয়ে, পূজারিণীকে সাজাতে লাগলো। প্রথমে বেশ পরিপাটি করে পূজারিণী মাথা চিরুনি দেয়। বেশ সুন্দর খোঁপা করে চুল বাঁধে। পূজারিণী চুপটি করে বসে রয়েছে।

কোন কথা বলছে না। মুখে ক্রিম মাখিয়ে দেয়.. লোশন দিয়ে দেয়। সবশেষে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে দেয়। আয়নার সামনে যেতে পূজারিণী নিজেই নিজেকে চিনতে পারল না। কত সুন্দর লাগছে তাকে। সে বর্ষাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। বর্ষা তার পিঠে হাত চাপড়ে বলল, “আজ থেকে এগুলো শুধু আমার নয় তোমারও। তুমি যখন খুশি এগুলো নিয়ে সাজুগুজু করবে। নিজে যদি গুছিয়ে না থাকো তাহলে কিন্তু মার খাবে বলে দিলাম।”পূজারিণী মিটমিট করে হাসছে। বর্ষার প্রতি তার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ক্রমশ বাড়তে লাগলো।

আরো বেশ কয়েকটা দিন কেটে যায়। শহরের একটা ছোট্ট মিউজিক স্কুলে পড়াশুনা শুরু করেছে পূজারিণী। আগের স্কুলে এক্সাম দিয়েছিল কিন্তু সেখানে পাস করে উঠতে পারে নি। সেটা পূজারিণীর প্রথম ব্যর্থতা। তারপর বর্ষা নিজে গিয়ে একটা ছোট্ট স্কুলে ভর্তি করে দেয়। ব্যস্ত হয়ে পড়ে পূজারিণী। প্রথমের দিকে সংগীত শিক্ষার জন্য ভীষন আগ্রহ দেখালেও পরে অজুহাত দেখাতে শুরু করে। গান গায়তে বললে অনায়াসে গান গিয়ে ফেলে।

কিন্তু খেয়াল, ধুন, লঘু সংগীত, শাস্ত্রীয় সংগীত, পড়ক, মাত্রা, একক, স্বর প্রভৃতি সম্পর্কে বোঝালে কিংবা লিখতে বললে, পূজারিণী বিভিন্ন অজুহাত দেখাতে থাকে। মাথা যন্ত্রণা করছে, বাথরুমে যাবে, আজ না কাল এইসব বলে পালানোর চেষ্টা করে। তবে শ্রাবণ ভীশন কড়া। পড়ানোর সময় সে আলাদা মানুষ হয়ে যায়। চোখেমুখে রাগ ফুটে ওঠে। কাজের প্রতি দায়িত্বশীল থাকা ভালো। যেটা শ্রাবণের ভীষন রয়েছে। সরু একটা লাঠি রেখেছে। পূজারিণী অজুহাত দেখালে পিঠ চাপড়ে বসে যায়।

পূজারিণীকে মারতে দ্বিধা বোধ করে না শ্রাবণ। একদিন মার খেয়ে ভীষণ কান্না করেছিল পূজারিণী, কিন্তু শ্রাবণ শুনেনি। তার চোখের জল দেখে আরো বেশি পিটিয়েছিল। পড়ানোর ক্ষেত্রে কোন ছাড় নেই। বর্ষাও বাধা দিতে আসে না। শিক্ষার জন্য যেমন ভালোবাসা প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন হলে মার খাওয়াটাও স্বাভাবিক। ভালোবাসার পাশাপাশি ভয়ও প্রয়োজন।

আজকাল পূজারিনীর অপছন্দের মানুষ হয়ে উঠেছে শ্রাবণ। শ্রাবনকে একদম সহ্য করতে পারে না। কেমন একটা মানুষ। সবসময় পড়াশোনা। গানের বাইরে যেন অন্য জগৎ নেই। শ্রাবণ সবসময় বলে, “2_ 1 ঘণ্টা পরিশ্রম করে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না। চ্যাম্পিয়ন হতে হলে কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে হয়। যে এইগুলো করতে পারবে, কেবল সেই চ্যাম্পিয়ন হবে অন্য কেউ নয়। যদি ভুলেও হয়ে যায় তবে সেটাও কয়েক দিনের জন্য। যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে থাকতে হলে কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন”। পূজারিণীর যন্ত্রণা, রাগ সব শ্রাবণকে ঘিরে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে শ্রাবণকে পেটাতে কিন্তু পারে না।

আজও শ্রাবণ বসে তার খাতায় কিছু একটা লিখে যাচ্ছে। পূজারিণী সামনে বসে ভয়ে কাঁপছে। পড়ানোর সময় শ্রাবনকে আরো বেশি ভয় পেতে থাকে। এই বুঝি তার পিঠে আবার একটা লাঠি ঘা পরল। খাতায় কিছু একটা লিখে পূজারিনীর দিকে বাড়িয়ে দিল। আর সেটা স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করতে বলল। সংগীতের শুদ্ধ স্বর সাতটি, কোমল স্বর পাঁচটি, মোট 12 টি। যথা: সা রে (ঋ) গা (জ্ঞ) মা (ক্ষ) পা ধা (দ) নি (ণ)।

শ্রাবণ তাকে বলল, “প্রথমে সা রে গা মা পা না নি বলতে। এবং নি শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবার শেষ থেকে প্রথমে দিকে বলতে বলল।” পূজারিণী অনায়াসেই করে ফেলল। এর আগে সেটা অনেকবার করেছে। তাই কোনো অসুবিধা হলো না। বেশ অনেকক্ষণ ধরে এই ভাবে গান শেখাতে লাগলো তাকে। শেষ মুহূর্তে শ্রাবণ তাকে একটা কাগজ দিয়ে বলল, গানটা গাওয়ার জন্য। পূজারিণী অনায়াসে কাগজটা নিয়ে গান গাইতে শুরু করল,

“এই শ্রাবণের ভরা মরশুমে
রিমঝিম বৃষ্টিতে কত কথা…”

দুলাইন গাইতে না গাইতে তাকে থামিয়ে দিল শ্রাবণ। এভাবে গান গাওয়া যায় না। অন্যভাবে গাইতে হবে। এই শ্রাবণে, এটা খুব ধীর গলায় হবে। ভরা মৌসুমে হালকা স্বর বাড়তে থাকবে। রিমঝিম বৃষ্টিতে কত কথা, এটা আবার মৃদুস্বরে হবে এবং গলার রেস দীর্ঘক্ষন থাকবে। বেশ অনেকবার বোঝানোর পর পূজারিণী বুঝতে পারল। এবং গান ধরল,
“এই শ্রাবণের ভরা মরশুমে
রিমঝিম বৃষ্টিতে কত কথা
শোনাতে চাই তোমায় গোপনে।

চারিদিকে থই থই জল
তারই মাঝে আমার এই গান
ভরিয়ে দেবে তোমার ওই হৃদয়।
জানি তুমি আছো কাছাকাছি
তবু কেন এত লুকোচুরি….।”


পর্ব ৬

বেশ কয়েকটা মাস কেটে যায়। কিন্তু পূজারিনী গানের ইম্প্রুভ করতে পারেনি। অনেকেই দাবি করে পূজারিণী ভালো গান গাইতে পারে। শ্রাবণ তা উড়িয়ে দেয়। সে এখনো গানের ‘গ’ শিখতে পারেনি। পূজারিণী ভীষণ রাগ হয়। সবাই তার গানের কত প্রশংসা করে, কিন্তু শ্রাবণ প্রশংসা তো দূরের কথা সে…

পূজারিণী এখন একটা নির্দিষ্ট রুটিনে আবদ্ধ হয়ে গেছে। রোজ সকালে উঠে রেওয়াজ করে। রেওয়াজ করার জন্য ধুলোবালি বা ডাস্ট যেন না থাকে। এয়ার যেন ফলিয়েট না হয়। গলাকে কখনো প্রেসার করা যাবে না। যে স্কেলের মধ্যে গলা কম্ফোর্টেবল সেই স্কেলের মধ্যে গান গাইতে হবে। কিন্তু পূজারিণী তা শোনে না। যখন যা খুশি তাই করে বেড়ায়। তার প্রতিটা কাজে শ্রাবণ কিছু না কিছু নিয়ম লাগিয়ে রেখেছে। রেওয়াজ করাও নিয়ম। সেটা সে মানতে পারেনি। ভীষণ রাগ হয়। মাঝেমধ্যে শ্রাবণকে গালি দেয়।

তার রেগে যাওয়া, গালি দেওয়ার বহু কারণ রয়েছে। পূজারিণী 18 বছর বয়সী যুবতী, এই বয়সে তার ওপর এত কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি শ্রাবণের। উচ্চারণ স্পষ্ট হওয়া সত্বেও তাকে ব্যায়াম করতে হয়। পূজারিণী কতবার বলেছে, তার মুখে জড়তা নেই এবং উচ্চারণ স্পষ্ট। কিন্তু শ্রাবণ বুঝেও বোঝে না। পূজারিণী যখন নতুন নতুন গান শিখবে বিশেষ করে হিন্দি গান, তখন তার মধ্যে উচ্চারণের অস্পষ্টতা সৃষ্টি হবে। অস্পষ্টতা দূরীকরণের জন্য প্রথম থেকেই ব্যায়াম করতে হবে।

কিন্তু ব্যায়াম একটা নয়!পূজারিণী প্রতিদিনের রুটিনে সকালে তিন তিনটা ব্যায়াম লাগিয়ে রেখেছে শ্রাবণ। প্রথমত, মুখে হাওয়া ভরে পাঁচ সেকেন্ড রেখে ধীরে ধীরে বার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জিভকে মুখের ভেতর একবার ক্লক ওয়াইজ, আর একবার এন্টি ক্লক ওয়াইজ ঘোরাতে হবে। তৃতীয়ত, জিভকে প্রথমে সোজা করে পাততে হবে, তারপর জিভের আগাকে উল্টোভাবে ঘোরাতে হবে, তারপর একটা ঢোক গিলতে হবে। এমনভাবে প্রত্যেকটি ব্যায়াম তিন বার করতে হবে। তারপর শুরু হয় রেওয়াজ করা আর শ্রাবণের ঘ্যানঘ্যানানি। যতই ভালো করুক না কেন, শ্রাবণ ঠিক বলবে ভালো হয়নি। তার দ্বারা কিছুই হবে না। আরো বেশি প্রাক্টিস করতে হবে, আরো বেশি রেওয়াজ করতে হবে।

আবার কখনো পিঠে পরে লাঠির ঘা। সফলতার জন্য কেবল পরিশ্রমের দরকার। কঠোর পরিশ্রম ছাড়া সফলতা কল্পনারও বাইরে। যে মানুষ সময় থাকতে ঘাম ঝরাবে না, ভবিষ্যতে সে চোখের জল ঝরাবে। শুধু এখানেই শেষ নয়। রেওয়াজ শেষ করার পর তাকে দোকানে যেতে হয়। বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। বর্ষা একা সংসার সামলাতে পারেনি। সে একটা বইয়ের স্টল খুলে। বইয়ের পাশাপাশি জেরক্স, বিভিন্ন প্রিন্টও করে। দোকানের দায়িত্ব পুরোপুরি শ্রাবণ নেয়।

কিন্তু উপরে উঠে বই কেড়ে নেওয়া, কিংবা দাঁড়িয়ে জেরক্স করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাকে সাহায্য করার জন্যে পূজারিণীকে দোকানে থাকতে হয়। সেও এখন অনেক কিছু শিখে গেছে। জেরক্স করতে পারে, কম্পিউটার চালাতে পারে। পাশাপাশি তাকে রুম ঝাঁট দিতে হয়, ধুপ লাগায়, দরজা_ জানালা খুলে এবং বন্ধ করে। কাস্টমার এসে মে বই গুলো এলোমেলো করে দিয়ে যায়, সেগুলো আবার সব সাজিয়ে রাখতে হয় তাকে।

রোজ সকালে বর্ষা দুজনকে গাড়ি করে দোকানের সামনে ছেড়ে দিয়ে, নিজে অফিসে যায়। যেদিন পূজারিনীর স্কুল থাকে সেদিন তাকে স্কুলে ছেড়ে দেয়। স্কুল ছুটি হওয়ার পর সমস্ত ছেলে মেয়ের মত সে বাড়ি ফিরে যেতে পারে না। তাকে দোকানে আসতে হয়। স্কুল থেকে দোকানের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। সেই দূরত্বে যাতাযাত করার জন্য সামান্য টোটো ভাড়াও নেই। হেঁটে হেঁটে দোকানে আসতে হয়। দোকানে এসে সামান্য ফ্রেশ হওয়া মতন টাইম থাকে না। রাজ্যের কাজ জমা হয়ে থাকে। রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় দুজনকে গাড়িতে তুলে নেয় বর্ষা। বাড়িতে এসে সবার একটু বিশ্রাম থাকলেও পূজারিণীর নেই। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার পর তাকে জোর করে গান শেখায় না শ্রাবণ।

জোর করে গলায় পেশার দেওয়া বোকামি। কিন্তু বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পীদের জীবনী পড়তে হয় পূজারিণীকে। সেখানেও ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ নেই। ভুলক্রমে ঘুমিয়ে পড়লে পিঠে পড়ে যাবে লাঠির ঘা। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিলে বোঝা যায় জীবনটা কতটা কঠিন। সূর্যের আলোর মত সচ্ছল জীবন যাপন করত গ্রামে। কিন্তু শহরে এসে তার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। হাসিখুশি হৃদয় হারিয়ে গেছে। বেঁচে থাকার লড়াই কতটা কঠিন হতে পারে, পূজারিণী এখন হাড়ে হাড়ে টের করতে পারছে।

তার সমস্ত যন্ত্রণা, রাগ, অভিমান, ঘৃণা শ্রাবনকে ঘিরে। শ্রাবণই তার জীবনে যন্ত্রণা নিয়ে এসেছে। শ্রাবনের আরেক নাম যেন যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা পূজারিণী মধ্যে একটা ক্ষিদে তৈরি করে দিয়েছে। এই ক্ষিদে পূজারিণীকে সাফল্য এনে দেবে। শ্রাবণের দায়িত্ববোধ, কঠোরতা পূজারিণীকে অনেক বড় জায়গায় নিয়ে যাবে। পূজারিণী এখন বুঝতে না পারলেও পরে ঠিক বুঝতে পারবে। শ্রাবণ কেবল তাকে পথ দেখাচ্ছে, সেই আঁকাবাঁকা পথে পূজারিণী যাবে; শ্রাবণ নয়।

আজ পূজারিণীর স্কুল নেই। সারাদিন দোকানে থাকতে হবে। শ্রাবণের কাছে আজকাল থাকতে একটু বেশি পছন্দ করে পূজারিণী। তার বকুনিও আজকাল আশীর্বাদ মনে হয়। মানুষটি রাগী হলেও ভীষণ ভালবাসে তাকে। সেটা সে জানে। তাকে কষ্ট, যন্ত্রণা ইচ্ছে করে দেয় নি, জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দিয়েছে। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যন্ত্রনা, কষ্ট দুটো জিনিস খুবই প্রয়োজনীয়। এই দুটো জিনিস ছাড়া সফলতা প্রায় অসম্ভব।

প্রথম দু’সপ্তাহে ‘বুক স্টলে’একজনও খরিদ্দার আসেনি। তারপর থেকেই এক দুজন করে আসতে থাকে। এখন বেশ অনেক লোকজন আসে। ভালো একটা লাভ হয়। শ্রাবণ কম্পিউটারের কাছে বসে পূজারিণীকে ডাকলো। পূজারিণী সমস্ত বই গুছিয়ে দিয়ে শ্রাবণের কাছে আসলো।
_ “গিটার বাজাতে পারো।”বেস প্রাণখোলা মুখে শ্রাবণ বলল। পড়ানোর সময় যে গাম্ভীর্য থাকে সেটা নেই। পূজারিণী অস্বাভাবিকভাবে বলল, “না, আমি শুধু হারমোনিয়াম বাজাতে পারি।”

_ “শিখিয়ে দিচ্ছি তোমাকে, একটু অপেক্ষা করো।”
_ “আচ্ছা ঠিক আছে।”

শ্রাবণ কম্পিউটারটা অফ করল। পূজারিণী স্বাভাবিকভাবে নিল, শ্রাবণ নিশ্চয়ই এখানে তাকে গিটার বাজানো শিখাবে না। এখন দোকানে খরিদ্দার নেই কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে চলে আসবে। তাই সে শিখতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু সে শ্রাবণ চৌধুরী। তার কাছে শিক্ষার জন্য সবকিছুই অনুকুল পরিবেশ। প্রতিকূল বলে কোন কথা নেই।

শ্রাবণ গিটার কোলে তুলে নিল। পূজারিণীকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার গিটার বাজানোর কৌশল লক্ষ করতে বলল। পূজারিণী ভারী আশ্চর্য। এখানেও তাকে পড়াতে শুরু করেছে। না তাকিয়ে উপায়ও নেই, এত জনের সামনে মারতে শ্রাবণের হাত কাঁপে না। স্থির চোখে শ্রাবণ এর দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকলো। শ্রাবণ গিটার নিয়ে বলতে শুরু করল।

গিটার বাজানোর জন্য প্রথমে জানতে হবে গিটারে পরিচিতি। গিটার সাধারণত তিন ধরনের হয় একোস্টিক গিটার, হাওয়াই গিটার, ইলেকট্রিক গিটার। শ্রাবণ যেটা ধরে আছে ওটা একোস্টিক গিটার। গিটারের চওড়ায় অংশ সব সময় পায়ের উপরে রেখে ডান হাতের মাসল দিয়ে ধরতে হবে। গিটারের সবচেয়ে উপরের অংশকে হেড বলা হয়। তার পাশে যে সুরু অংশ থাকে সেগুলো কে টিউনিক বলা হয়। টিউনিক সুর তৈরি করে। তারপর হলদে রংয়ের যে অংশ দেখা যাচ্ছে, ওকে বলা হয় ওপেন নাট।

তারপর তামার পাত গুলোকে বলা হয় ফ্রেট। এক একটা গিটারের 5 থেকে 24 টা ফ্রেট থাকে। এটাকে আবার ফ্রেট বোর্ডও বলা হয়। তার মধ্যে যে চিহ্ন গুলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ওই গুলোকে পোস্টিং মার্ক বা ফ্রেটমার্ক বলা হয়। ১, ২, ৩ নাম্বারে রয়েছে একটি পোস্টিং মার্ক তারপর আবার ৫ নম্বরে… চওড়া অংশে যে গোল অংশ আছে ওটাকে বলা হয় সাউন্ড হল। ওইখান থেকে শব্দ প্রতিধ্বনি’ হয়। তারপর থেকে নপ বা বাটন। গিটার বাজানোর জন্য সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল ছটি স্ট্রিং।

নিচ থেকে ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬ তার থাকে। প্রত্যেকটি তারে আলাদা আলাদা নাম রয়েছে, 6_ e, 5_ a, 4_ d, 3_ g, 2_ b, 1_ e. শ্রাবণ বৃদ্ধাঙ্গুলি 6 নম্বর তারের উপর রাখল এবং কনিষ্ঠা বডির উপর রাখল। তারপর তর্জনী তিন নম্বর, মধ্যমা দু’নম্বর এবং অনামিকা এক নম্বর তারের উপর রাখল। তারপর খুব সূক্ষ্মভাবে স্পর্শ করল। ছ নম্বর তার থেকে ডাউন স্ট্রোক শুরু করলো। ৬_ ৫_ ৪=ডাউন স্ট্রোক। ৩_ ২_ ১=আপস্ট্রোক

। এইভাবে কুড়ি বার করে সুর সৃষ্টি করলো। শ্রাবণ গিটার তুলে রাখলো কিন্তু পূজারিণী তখনও দেখে চলেছে। সে যে কিছু বুঝেনি সেটা ভালোভাবে বুঝতে পারছে শ্রাবণ। তাকে নাড়িয়ে বলল, “কি হলো! ওই ভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কিছু বুঝতে পেরেছ?”পূজারিণী মাথা নাড়িয়ে না বলল। স্বাভাবিক ব্যাপার! একদিনে কেউ শিখতে পারবে না। শ্রাবণ আবার বলল, “ধীরে ধীরে শিখে যাবে। এটা লেসন ওয়ান। আরো অনেকগুলো লেসন রয়েছে গিটার বাজানোর জন্য।”

_ “আমি বাড়ি যাব।”নির্বিধায় পূজারিণী বলে ফেলল। হঠাৎ এমন প্রশ্নে এমন উত্তর শুনে শ্রাবণ একটু ঘাবড়ে গেল। তবে কি তার কঠোরতা সহ্য করতে পারছে না পূজারিণী? সে তার মাথায় হাত রেখে বলল, “কেন? এখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে?”
_ “এই গানের এত নিয়ম আমি মনে রাখতে পারব না। আমাকে মিছে মিছি গান শেখাচ্ছ। আমার দ্বারা এগুলো হবে না। আপনার একটা কথাও আমি বুঝতে পারিনি। আপনার স্বপ্ন অন্য কাউকে দিয়ে পূরণ করান আমি পারবো না।”

_ “এইভাবে ভেঙ্গে পড়লে হবে না। নিজের মনের মধ্যে জোর খাটাও। আরো অনেক পরিশ্রম করতে হবে, আরো অনেক ব্যর্থতা আসবে। ব্যর্থতার জন্য প্রস্তুত হও। 99 বার ব্যর্থ হওয়ার পর একবার সফলতা আসবে।”গড় গড় করে বলে গেল শ্রাবণ। পূজারিণী চুপটি করে বসে রয়েছে। কিছুক্ষন নিস্তব্ধতা থাকার পর বলল, “সত্যি করে বলুন তো, গিটার বাজানোর জন্য এত নিয়ম আছে, না আপনি ইচ্ছে করে আমাকে দিয়ে এগুলো করাচ্ছেন?”
_ “অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি! আমি ইচ্ছে করে নিয়ম তৈরি করতে যাব কেন? এগুলো প্রথম থেকেই রয়েছে।”

_ “সত্যি।”
_ “হ্যাঁ।”
একইভাবে কিছুক্ষণ কথা চলে তাদের মধ্যে। তারপর যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি অভিজিৎ বাবুর মুখ ঘামিয়ে দিয়ছে। তিনি খুব ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসছেন দোকানের দিকে। হাতে একটা ডায়েরী কপালে ধরে সূর্য রশ্মিকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। তিনি হন হন করে দোকানের মধ্যে প্রবেশ করলেন। কয়েকটা কাগজ দিয়ে তাড়াতাড়ি জেরক্স করে দিতে বললেন শ্রাবনকে। নিচে বসে জেরক্স করার কোন সিস্টেম নেই।

তাই পূজারিণীকে জেরক্স করতে বলে। পূজারিণী জেরক্স করছে, আর অভিজিৎ বাবুর চোখ জোড়া মিটমিট করে শ্রাবণকে দেখছে। চোখের মধ্যে একটা অপ্রতিভ ভাব। তিনি যেন শ্রাবনকে এর আগে অনেকবার দেখেছেন। খুব পরিচিত লাগছে। অভিজিৎ বাবু বড়ো হাঁ করে অনেকখানি বাতাস মুখে ভরে নিয়ে বলল, “ইউ আরে শ্রাবণ চৌধুরী, রাইট!”একজন পুলিশ অফিসারের মুখে নিজের নাম শুনে ঘাবড়ে গেল শ্রাবণ। পূজারিণীও হকচকিয়ে দুজনকে দেখতে লাগলো।

শহরে তার তেমন কোন পরিচিত মানুষ নেই। যে কয়েকজন ছিল তারা সময়ের সাথে সাথে ভুলে গেছে। এই মায়াবী পৃথিবীতে সবাই সাময়ের বন্ধু। সেটা সময় হলে বুঝতে পারবেন।
_ “হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনতে পারলাম না।”শ্রাবণ খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল।

_ “নতুন একটা কেসের জন্য আমি এই শহরে এসেছি। তার চাইতে আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়, আপনার বাবা আদিত্য চৌধুরীর একজন বড় ভক্ত। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তোমার বাবাকে একবার দেখার জন্য কত ছুটে বেড়িয়েছে। টিভিতে কত দেখেছি। কিন্তু উনার মধ্যে এমন কি হলো, যে উনাকে ডিপ্রেশন ঘিরে ধরল।

ডিপ্রেশনে ভুগে উনি চলে গেলেন।”অভিজিৎ বাবুর চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। আস্তে আস্তে একটা কান্না তার সারা শরীর ঝাঁকাতে শুরু করলো। শ্রাবণ অভিজিৎ বাবুর পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ” ইন্সপেক্টর হয়ে এত ইমোশনাল হলে চলবে কি করে।”ইন্সপেক্টর চোখের জল মুছে বলল, “জানি না, কেন দুঃখের কথা শুনলে আমার চোখে জল চলে আসে। আমি দুঃখ যন্ত্রণা এগুলো কখনো সহ্য করতে পারি না। আজকে তোমার সাথে পরিচয় হয়ে আমার খুব ভালো লাগলো। দুটো পা নেই তবুও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছো। আমাদের দেশে হাজার হাজার মানুষ রয়েছে যারা শুধু অজুহাত দেখিয়ে নিজের দায়িত্ববোধ থেকে সরে দাঁড়ায়। আর তার নাম দেয় বেকারত্ব।”

_ “জীবন হেরে যাওয়ার জন্য নয়। হেরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর নামই জীবন।”
এতক্ষণে পূজারিণী জেরক্স শেষ করে ফেলেছে। সে জেরক্স গুলো অভিজিৎ বাবুকে দিয়ে নিজের কাজে মগ্ন হলো। অভিজিত বাবু জেরক্স নিয়ে পূজারিণীকে আপাদমস্তক দেখে বললেন, “মেয়েটা কে?”
_ “গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছি। হেব্বি ট্যালেন্টেড। ঠিক মতন কাজে লাগাতে পারলে একদিন বড় গায়িকা হতে পারবে।”
_ “সিরিয়াসলি! তুমি ওকে গান শেখাচ্ছো!”

_ “হ্যাঁ।”
_ “তাহলে আমরা একটা নতুন সঙ্গীতশিল্পী পাচ্ছি।”
_ “সেটা আমি কি করে বলব। যে গান শিখছে ওকে জিজ্ঞেস করো।”

_ “যখন কোন বড় শিল্পী তৈরি হয় তখন তার পেছনে একজনের হাত থাকে, যাকে আমরা ‘গুরু’ বলি। কিন্তু ওই মানুষটির যতটুকু সম্মান পাওয়ার কথা বাস্তবে তার চাইতে অনেক কম সম্মানও পায় না। যখন কোন সিনেমা তৈরি হয় তখন সেই সিনেমার সমস্ত ক্রেডিট দেওয়া হয় নায়ক নায়িকাকে। কিন্তু বাস্তবে কি তারা সমস্ত ক্রেডিট পাওয়ার যোগ্য? একটা সিনেমা তৈরির জন্য রাইটার, পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, ভিডিও এডিটিং উনাদের সমান ক্রেডিট দেওয়া উচিত। কিন্তু দেওয়া হয় না। উনাদেরকে কেউ মনে রাখতেও চায় না।”
_ “এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম।”শ্রাবণ একটু হেসে বলল।

_ _ “এই নিয়ম বদলাতে হবে….”
আরও কিছু সময় দুজনের মধ্যে বেশ কথা হলো। পূজারিণী চেয়ারের উপর বসে দুজনকে আপন মনে দেখছে। খিদে তার পেটে ইন্দুর লাফাতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু বলতে পারছে না। ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। অভিজিৎ বাবু চলে যাওয়ার পর, পূজারিণী শ্রাবণের পাশে এসে দাঁড়াল। হাত দিয়ে ওড়না গোল করছে, মুখে বিড়বিড় করছে, মাথা চুলকাচ্ছে, চুল ছিঁড়ছে, কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছে না পেটের খিদের কথা। শ্রাবণ তাকে দেখে থমকে গেল। অবাক করার মত একটা মেয়ে। কখন কি করে সে নিজেও জানে না। চুপ করে তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু বলছে না। শ্রাবন তীক্ষ্ণ চোখের সুবাসের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “কিছু বলবে?”

_ “হ্যাঁ”।
_ “বল, ওই ভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
_ “না, মানে… আসলে আমার প্রচুর খিদে পেয়েছে।”
শ্রাবণ ভীষণ কষ্ট পেল। একটা মেয়েকে সারাদিন ধরে খাটিয়ে নিচ্ছে অথচ তার খিদের কথা একবারের জন্য ভাবেনি। আর মেয়েটাও বড্ড অদ্ভুত। অন্যের খিদে সে কি করে জানবে। সে দেবতা নয় মানুষ! মানুষের খিদে পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর জন্য লজ্জা পাওয়ার কি দরকার! শ্রাবণ কোন কথা বলল না। সে ড্রয়ার থেকে 30 টাকা বের করে পূজারিণীকে দিল, দু প্লেট ঘুগনি আর ব্র্যাট নিয়ে আসার জন্য। টাকা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে গেল পূজারিণী। মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে।

শ্রাবণ পেছন থেকে ডেকে বলল, “সাবধানে যাবে, আর দয়া করে মাথাটা উঁচু করো, কেউ ধাক্কা মেরে দেবে তো।”পূজারিণী মাথা নাড়িয়ে চলতে শুরু করল। দোকানে বসে পূজারিনীর দিকে লক্ষ্য করতে থাকলো শ্রাবণ। বেশ অনেকক্ষণ পর পূজারিণী আবার ফিরে আসলো। কিন্তু আগের মতন তার মুখে হাসি নেই। চোখের জল চিকচিক করে উঠেছে। তাকে দেখে হতভম্ব শ্রাবণ। একটু আগেই ঠিক ছিল, দোকানে কি এমন তার সাথে ঘটে গেল?

শ্রাবণ হুইলচেয়ার তার কাছে গড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বলল, “কি হয়েছে? কেউ কিছু তোমাকে বলেছে?”পূজারিণী কিছু বলল না। ‘কিছু না’বলে জোরে জোরে কেঁদে উঠলো। দুটো প্লেট টেবিলের উপর রাখতে গিয়ে একটা প্লেট মেঝেতে ফেলে দিলো। তার কান্নার রেস আরো ভয়ানক আকার ধারণ করল। শ্রাবণও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে আবার রাগ হচ্ছে। মেয়েটি নিজের যন্ত্রণা সব সময় বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে একা একা কান্না করে। তার কষ্ট কাউকে বুঝতে দেয় না। শ্রাবণ এবার রাগান্বিত স্বরে বলল,

“কি হয়েছে, আমি কতবার ধরে জানতে চাইছি?”পূজারিণী পড়ে যাওয়া খাবার গুলো তুলে নিচ্ছিল। শ্রাবণের গম্ভীর স্বর শুনে তার শরীর কেঁপে উঠল। শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল, “দোকানের কয়েকটা ছেলে খুব খারাপ খারাপ কথা বলছিল আমার নামে।”
_ “কিন্তু কেন? তুমি ওদের কিছু বলেছিলে?”

_ “না, আমি শুধু হাত দেখিয়ে ওটা দাও, আর এটা দাও এমনভাবে কথা বলেছিলাম। গ্রামে আমরা এমন ভাবেই কথা বলতাম। আর ওরা আমার কথা শুনে….”
শ্রাবণ বুঝতে পেরে গেল তার সাথে কি হয়েছে। শহরের মানুষগুলো একটু স্মার্ট ভাবে কথা বলে। সবার সামনে নিজেকে স্মার্ট প্রমাণিত করে। আর সেখানে পূজারিণী পুরো গাইয়া। গ্রামের ভাষায় কথা বলেছে। শ্রাবণ পূজারিণী চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, “সবার জীবনে অপমান, লাঞ্ছনা আসে এগুলো মেনে নিতে হয়। সব সময় ইমোশনাল হলে চলে না। তুমি খাবার খেয়ে নাও।”

_ “আমারটা তো পড়ে গেছে। আমি খাব না। আপনি খেয়ে নিন?”
_ “বললাম না তোমাকে খেয়ে নিতে!”শ্রাবণ বড় বড় চোখ করে বলল। পূজারিণী কোন কথা না বলে চুপচাপ খেতে শুরু করল। শ্রাবনের ইচ্ছে করছিল তাকে খাইয়ে দিতে। কিন্তু খাইয়ে দিলো না। এতে শ্রাবণের প্রতি পূজারিণী ভয় অটুট থাকবে। পূজারিনীর মায়ায় আবদ্ধ হতে চায় না শ্রাবণ। ভয়, দারিদ্রতা, অপমান_ লাঞ্ছনা, অবহেলা, এগুলোই সাফল্য চাবিকাঠি। এগুলো সবকটাই রয়েছে পূজারিনির মধ্যে। শ্রাবণ আবার হুইলচেয়ার গড়িয়ে পূজারিণী কাছে গিয়ে বলল, “তুমি অভিজিৎ বাবুর কথা শুনেছ?”মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল পূজারিণী।

_ “উনার কথামতো তুমি বড়ো গায়িকা হলে আমাকে ভুলে যাবে না তো।”
_ “এইসব কথা আমি কখনো কল্পনায়ও ভাবি না। আপনাদের আমি কখনো ভুলতে পারবো না।”
_ “ওই সব কথা সবাই বলে। কিন্তু যখন নিজের মধ্যে সম্মান খ্যাতি চলে আসবে তখন আপনা আপনি এই মানুষটাকে ভূলে যাবে।”
_ “আমি ভুলবো না, কথা দিলাম।”

_ “আচ্ছা, সেটা সময় বলে দেবে, তুমি আমাদের ভুলবে কি ভুলবে না?যখন তুমি সাফল্যের উঁচু জায়গায় পৌঁছে যাবে। তখন যারা বলবে এখানে এলে কি করে? হাসি মুখে একবার বলে দিও ‘দারিদ্রতা'”


পর্ব ৭

শহরে একের পর এক খুন যেমন ভয়ের সঞ্চার ঘটিয়েছিল শহরবাসীর মধ্যে, তেমনি ঘুম ছুটে গিয়েছিল পুলিশের ও। কেসটি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। নিজেদের সম্মানের টানাপড়ায় চলে এসেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অফিসে চলে এসেছেন অভিজিৎ ব্যানার্জি। পুরনো খবর কাগজ, ফাইল ঘেঁটে দেখছেন। অতীত ছাড়া ভবিষ্যৎ অসম্পূর্ণ। অতীতের প্রতিটা স্মৃতি ভবিষ্যতের ভবিষ্যৎ।

ঠান্ডা মাথায় কাজ করছেন তিনি, কিন্তু এখনও একজন কনস্টেবল আসেনি। অভিজিৎ বাবুর জানা মতে, প্রথমে কনস্টেবল অফিসে আসে তারপরেই উনার আসার কথা কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও এই ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র রাগ করেন না। সবার সাথে বন্ধুত্বের মতন মিশে থাকেন। কিছুক্ষণ পর কনস্টেবল অভিক আঁকাবাঁকা পথে রুমে প্রবেশ করল। অভিক চরিত্রটা বড্ড অদ্ভুত। সব সময় নেশায় ডুবে থাকে। অভিজিৎ বাবু কিছুতেই জানতে পারেননি, তার নেশায় ডুবে থাকার কারণ কি?

জোর করে রহস্য বের করে নেওয়ার সাহস কারোর হয়নি। তিনি কখনই এই ব্যাপারে কথা বলেন না। তবে মদ খেয়ে মাতলামি করতে চোখে পরেনি। আজ একটু বেশি ক্লান্ত লাগছে অভিককে। প্রতিদিন এসে তিনি প্রথমে অভিজিৎ বাবুকে গুড মর্নিং জানায় কিন্তু আজ জানালেন না। এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দিয়ে অভিজিৎ বাবু বললেন, “কতবার বলেছি তোমাকে মদ খেতে না। তাও তুমি শুনছো না কেন? সকাল সকাল মদ না খেলে তোমার হয় না।

“ঘটঘট করে জল পান করে ফেলল অভিক। তারপর অভিজিৎ বাবুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “স্যার, আপনি আমাকে এত ভালবাসেন কেন? মদ খেয়ে অফিসে আসার সত্ত্বেও আপনি আমাকে বের করে দেন নি। ভালোবেসে আগলে রাখছেন।”
_ “আমি তোমাকে ভালোবাসি না, তোমার পরিবারকে ভালোবাসি। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে বের করতে পারি না।

একবার ভেবে দেখেছো, তোমার চাকরি চলে গেলে, তোমার ছেলে_ মেয়ে, বৃদ্ধ বাবা_ মা স্ত্রীকে কি খাওয়াবে?”কথাগুলো বলে অভিজিৎ বাবু আবার নিজের কাজে লেগে পড়লেন। কিছু একটা খুঁজছেন তিনি। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ লক্ষ্য করলেন অভিক কান্না করছে। চোখ থেকে টপটপ করে জল নিজের প্যান্টে পরছে। কান্নার কারণ অভিক কিছুতেই বলবে না। প্রতিটা মানুষের যন্ত্রণা আলাদা। কেউ অভাবে যন্ত্রণা পায়, কেউ স্বভাবে, কেউ পায় ভালোবাসায়।

কিন্তু অভিকের সব কিছুই রয়েছে। তবে তার যন্ত্রণাটা কোথায়? তিনি আবার অভিকের কাছে গিয়ে বললেন, “তুমি কখনো মন্দির, মসজিদ, গির্জায় গেছো?”অভিক মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। অভিজিৎ বাবু আবার জানতে চাইলেন, তিনি ওইখানেই কখনো মদ খেয়ে প্রবেশ করেছেন কিনা! চেয়ার থেকে উঠে পড়ে কর্কশ স্বরে অভিক বলল, “ওখানে ভগবান থাকেন, আল্লাহ থাকেন, যীশু খ্রীষ্ট থাকেন, সেখানে আমি মদ খেয়ে কিভাবে প্রবেশ করব?”

_ “যদি আপনি নেশা করে মন্দির, মসজিদ, গির্জায় যেতে পারেন না, তাহলে বাড়িতে কী করে আসেন? সেখানে তো আপনার গভধাত্রী মা থাকেন। আপনার ভালবাসার সন্তান_ সন্ততি থাকে। আপনার শুভাকাঙ্খী স্ত্রী থাকে। আপনার স্ত্রী সব সময় শাঁখা সিঁদুর পরে থাকেন। তিনি বিশ্বাস করেন, শাঁখা সিঁদুর তোমাকে রক্ষা করছে। কি করে তুমি তাদেরকে অপমান করো?”

অভিক মাথা নত করে রইলো। কিছু বলতে পারছে না। অভিজিৎ বাবুর প্রত্যেকটি খাঁটি কথা তার অন্তরে কাঁটার মতো বিঁধলো। তিনি সবই বোঝেন কিন্তু নিজের মনকে বোঝাতে পারেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “যন্ত্রণা স্যার, যন্ত্রণা! তা আপনি বুঝবেন না।”
_ “যন্ত্রণা শুধু তোমার মধ্যে নেই। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যন্ত্রণা রয়েছে।

তার মানে এই নয়, যন্ত্রণার সমাধান কেবল মদই করতে পারে। যন্ত্রণা দূরীকরণের জন্য, বড় বড় দাড়ি করে নিলাম, মদ খেলাম ব্যস দিলে যন্ত্রণা চলে যাবে!কখনোই যাবে না। যন্ত্রণা দূর করার জন্য প্রথমে নিজেকে বাঁচাতে হবে, নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে। যন্ত্রণার বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে।”

অভিজিৎ বাবু নিজের কাজ ছেড়ে অভিককে বোঝাতে লাগলেন। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে উৎপল প্রবেশ করল। সে অভিকের সহকর্মী। একটু বেশি রোমান্টিক। 25 বছর বয়সী যুবক বিয়ে করেনি। তাই মেয়ের প্রতি একটা ঝোঁক বেশি। তাকে ঘামতে দেখে অভিজিৎ বাবু এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দিলেন। যেখানে সবাই অভিজিৎ বাবুকে দেখা শোনার কথা, সেখানে অভিজিৎ বাবু সবাইকে দেখাশোনা করছে। এতে বিন্দুমাত্র কষ্ট বোধ করে না অভিজিৎ বাবু। বরং ভালই লাগে সবাই একই সাথে মিলেমিশে থাকতে।

তিনি কখনো নিজেকে বড় অফিসার মনে করেন না। উনার এই বিশেষ গুণ সারা রাজ্যে সুনাম বয়ে বেড়াচ্ছে। কপালে জুটেছে রাজ্য থেকে বিশেষ কয়েকটি অ্যাওয়ার্ড। তাইতো সরকার নির্বিধায় উনার উপর ভরসা করে এই কেসের দায়িত্ব দিয়েছেন।
_ “ঘড়ির কাঁটা দেখেছো উৎপল?”একগাল হেসে অভিজিৎ বাবু বললেন।

_ “হ্যাঁ স্যার, পৌনে দশটা।”
_ “অফিসের টাইম 9:00 আর তুমি এসেছো পৌনে দশটায়। তাও আবার উচ্চস্বরে কথা বলছ।”
_ “সরি স্যার, এমনটা আর হবে না।”

_ “একটা বাক্য রোজ রোজ শুনতে ভালো লাগে না। নতুন নতুন বাক্য ব্যবহার করো। নতুন অজুহাত তৈরি করো, একটা অজুহাত আর কতদিন চালাবে?”
_ “সত্যি বলছি আর দেরী হবে না। আমাকে আর 30 মিনিট টাইম দিন।
_ “এমনিতেই দেরি করে এসেছো। তার ওপর আরও 30 মিনিট টাইম চাইছো!”

_ “প্লিজ স্যার, আজকের জন্য অন্তত….
অভিজিৎ বাবুর সাদাসিধে মন উৎপলের কথায় রাজি হয়ে গেলেন। উৎপল তাড়াতাড়ি একটা পুঁটলি খুলে ফেলল। পুঁটলি মধ্যে নোংরা আবর্জনা আর পাতায় ভর্তি। অভিজিৎ আর অভিক কিছুই বুঝতে পারলো না। শুধু উৎপলের ওপর দৃষ্টি নিমজ্জিত করল। উৎপল খুব আগ্রহের সাথে সেই আবর্জনার মধ্যে কিছু খুঁজে চলেছে। কিন্তু পাচ্ছে না, তাই বারবার ইতস্তত হয়ে পড়ছে আর একাই রেগে উঠছে। কোন উপায় না দেখে অভিজিৎ বাবু তাকে সাহায্য করল। ওই নোংরা মধ্যে একটা পাতায় নাম্বার রয়েছে।

যেটা উৎপলের ভীষণ প্রয়োজন। ওই নাম্বার তাকে নতুন দিশা দেখাবে। অভিজিৎ বাবু ভাবলেন, নাম্বারটা সম্ভবত উৎপলের ভীষণ দরকার। তাই তিনিও অধীর আগ্রহে আবর্জনার মধ্যে খুঁজতে লাগলেন সেই বিশেষ পাতাটিকে। আধঘন্টা মত খুঁজেও কোন নাম্বার পেলেন না। হতাশা হয়ে ছেড়ে দিলো উৎপল। কিন্তু অভিজিৎ বাবু ছাড়লেন না। তিনি খুঁজে চলেছেন। একসময় অভিক বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “আচ্ছা উৎপল, ওই নাম্বারটা কার সেটা কি জানতে পারি আমরা?”

_ “রোজ অফিসে আসার সময় বাসস্ট্যান্ডে একটা মেয়ের সাথে দেখা হতো। আমি ওকে দেখতাম সেও আমাকে দেখতো। এইভাবে প্রায় তিন মাস চলছে। কিন্তু কেউ কাউকে কিছু বলতে পারি নি। আজ হঠাৎ সে বাসে উঠে যায়। আমি তাকিয়ে রয়েছি। আর হঠাৎ সে একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে কিছুক্ষণ নিজের কাছে রাখার পর আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়। আমি নিশ্চিত ওখানে সে নিজের নাম্বার লিখেছিল। কিন্তু পাতাটা উড়ে উড়ে অনেক পাতার মাঝে পড়ে। আমি ওখানে খুঁজে না পেয়ে সমস্ত পাতা ভরে নিয়ে এসেছি।”

গড় গড় করে বলে গেল উৎপল। গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকলো অভিক। এটা মানুষ না অন্য কেউ। ভাবনার গভীরে ডুবে গেল অভিক। হাসবে না কান্না করবে কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।। অভিজিৎ বাবুর রাগটা ভীষন বেড়ে বেড়ে গেচ্ছে। এত কাজ বাকি রেখে উৎপল এতক্ষণ তাদেরকে দিয়ে একটা মেয়ের নাম্বার খোঁজিয়েছে। আর যেটা পুরো বাস্তবতার সাথে কোন মিল নেই। মেয়েটা আদৌ নাম্বার দিয়েছিল না অন্যকিছু করেছিল সেটাও জানা নেই। উৎপল কী জন্য প্রতিদিন দেরি করে আসতো অভিজিৎ বাবুর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। একটা মেয়ের জন্য সে নিজের পেশাকে এইভাবে অবহেলা করেছে। কেবল ভালোবাসাই পারে সবকিছু থেকে বের করে নিতে।

সবকিছুকে দূরে ঠেলে কাছে কেবল ভালোবাসাই ডেকে নিতে পারে। যেটা উৎপল এর ক্ষেত্রে ঘটেছে। ভীষণ রাগ হলেও দেখাতে পারলেন না তিনি। বেচারা এত কিছুর পরেও নাম্বারটা খুঁজে পায়নি। অভিজিৎ বাবু উৎপলের কাঁধে হাত চাপড়ে বলল, “এমন লাভ স্টরি সিনেমায় হয়, বাস্তবে নয়। মেয়েটাকে ভুলে যাওয়া তোমার জীবনে বেটার হবে বলে আমার মনে হয়।”

_ “স্যার, অনেক লাভ স্টোরি সিনেমা লাভ স্টোরি কেও হার মানায়। আর আমার বুকটা কোন সিলেট নয় যে কারোর নাম একবার লিখে মুছে ফেলব।”
_ “উৎপল! কি সব অদ্ভুত কথাবার্তা বলছো? ওই সব কথা 16_ 17 বছর ছেলেদের মুখে মানায়। তোমার মুখে নয়। তাছাড়া ওই মেয়েটার সাথে তুমি কখনো কথা বলোনি, চেননা, জানোনা আর ভালোবাসা হয়ে গেল।”

_ “ভালোবাসায় কোন পরিচিতি লাগে না। শুধু মানুষটা থাকলে হলো।”
এমন সময় বেশ দ্রুত বেগে প্রবেশ করল দুর্গা। তিনি অভিজিৎ বাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট। তার চাইতেও ওর একটা বড় পরিচয় আছে, সে অভিজিৎ বাবুর গার্লফ্রেন্ড। উনাদের রিলেশনশিপ প্রায় তিন বছর। একই স্কুল, কলেজে পড়াশোনা করেছেন।

প্রথমে বন্ধুত্ব তারপর প্রেম। তাই তাদের সম্পর্কটা খুব গভীর। এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারেন না। দুর্গা বেশ লম্বা, গঠনমূলক শরীর। অতি রূপবতীও বলা যায়। পুলিশের পোশাকে একটু বেশি ভালো লাগে দুর্গাকে। উনার বয়স চব্বিশ_ পঁচিশ হবে। তবে বিয়েটা করেননি। সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকেন। তবে অফিসে অভিজিৎ বাবু দুর্গাকে কখনো গার্লফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় দেয় না। সে তার কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই কাজকে বেশি প্রাধান্য দেয়। দুর্গাকে দেখে উৎপল হাসির ছলে বলল, “স্যার আপনার গার্লফ্রেন্ড চলে এসেছে। উনিও কিন্তু আজ দেরি করে এসেছে। উনাকেও আজ বকতে হবে কিন্তু!”

_ “উৎপল! লিমিট ক্রস করে যাচ্ছ। এটা অফিস উনি তোমার সিনিয়ার তাকে সম্মান দেওয়া তোমার উচিত। আর দুর্গা অনেক আগেই এসেছে। আমি ওকে কয়েকটা রিপোর্ট আনতে পাঠিয়ে ছিলাম।”বেশ গম্ভীর স্বরে কথাগুলো বললেন অভিজিৎ বাবু। দুর্গা উৎপলের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে লাগলো। ইশারা করে বুঝিয়ে দিল আমার স্বামী বলে কথা। স্ত্রীকে কিছু বললে স্বামী তো একটু রাগ করবে। এখনো বিয়ে করেনি অথচ স্বামী_ স্ত্রী ভাবতে শুরু করেছেন। কিছুক্ষণ আগে তিনি নিজেই প্রেম সম্পর্কে বেশ ভালোই জ্ঞান দিলেন আর এখন ……

_ “সরি স্যার!”মাথা নিচু করে উৎপল বলল।
_ “ওকে, দ্বিতীয়বার যেন এমন না হয়।”দ্রুতবেগে দুর্গার কাছে যেতে যেতে কথাগুলো বলল অভিজিৎ বাবু। সামনাসামনি দুজন চেয়ারে বসলো। পাশে অভিক দাঁড়িয়ে থাকলো আর উৎপল পাতাগুলোর কাছেই থাকলো। দুর্গা টেবিলের সামনে অনেকগুলো ফাইল ফেলে উচ্চ কণ্ঠে বলল, “স্যার, একটি আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে!”
_ “মিল!”

_ “হ্যাঁ স্যার! যারা খুন হয়েছে তারা প্রত্যেকেই খুন হওয়ার এক মাসের মধ্যে শহরে কোথাও না কোথাও রোড ক্রস করেছে।”
_ “রোড ক্রস আমরা সবাই করি। তাতে মিল তুমি কোথায় পেলে?”
_ “রুলসের বাইরে গিয়ে ওরা রোড ক্রস করেছে….

দুর্গার কথা শেষ হতে না হতেই অভিক ধীর গলায় বলল, “এর মানে ওরা সিগনাল মানে নি, তাইতো দুর্গা?”
_ “অভিক, ওকে কথা শেষ করতে দাও।”অভিজিৎ বাবু বললেন। অভিক চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

দুর্গা একটা ঢোক গিলে বলল, “স্যার শহরে অনেক লং রাস্তা রয়েছে। যেগুলো এক সাইড দিয়ে শুধু গাড়ি যাচ্ছে আবার এক সাইড দিয়ে শুধু গাড়ি আসছে। কিন্তু মাঝখানে কোন বেড় দেওয়া নেই। ছোট কিংবা মাঝারি পাথর দিয়ে দুটো রাস্তাকে পৃথক করে রেখেছে। আর তারা ব্যস্ততার কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে পাথরগুলোকে সরিয়ে রাস্তা ক্রস করেছে। রাস্তা ক্রস করার পর তারা পাথরগুলোকে পূর্বের অবস্থায় রাখেনি। মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়ে গেছে।

কোন দায়িত্বশীল মানুষ কিংবা সিভিক পুলিশ নিজের দায়িত্বে যদি পাথরগুলো পূর্বের অবস্থায় রেখে দেয় তো ভালো, আর না হলে পাথরগুলো মাঝ রাস্তায় পড়ে থাকে। তার ফল ভুগতে হয় সাধারণ মানুষকে। একের পর এক অ্যাক্সিডেন্ট করতে থাকে।”দুর্গা কথাগুলো বলে জল খেলে। সবাই চুপচাপ। অভিক বলল, “তারমানে অ্যাক্সিডেন্ট গুলোর সাথে খুনির কিছু সম্পর্ক রয়েছে।”

_ “না অভিক! একটা কথা আছে অতি চালাকি করতে গেলে ফাঁদে পড়তে হবে। খুনিও অতি চালাকি করতে গিয়ে ফাঁদে পড়ে গেছে। ওই রোড ক্রসিং এর সাথে খুনের কোন যোগ নেই।”কথাগুলো বলে অভিজিৎ বাবু চুপ হয়ে রইলেন। কিছু একটা ভেবে অভিক বলল, “স্যার, খুনি কিভাবে ফাঁদে পড়ল? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!”
_ “সব বুঝতে পারবে। একটু অপেক্ষা করো।”তিনি আবার একটু থেমে দুর্গাকে বললেন, “দুর্গা, তুমি কম্পিউটার ঘেঁটে দেখতো 12 বছর আগে এমন ভাবে কেউ এক্সিডেন্টে মারা গেছে কিনা!”

_ “কিন্তু 12 বছরের আগের রেকর্ডগুলো কি কম্পিউটারে আদৌ রয়েছে।”
_ “কিছু না কিছু অবশ্যই থাকবে। আমিও পুরনো ফাইল ঘেঁটে দেখছি। কিছু তো অবশ্যই বের হবে।”
দুর্গা সাথে সাথে কম্পিউটারের কাছে গিয়ে বসলো। অভিক আর অভিজিৎ বাবু দুজনই পুরনো ফাইল ঘাঁটতে শুরু করলো। প্রতিটা প্রাণই দামি। একটি প্রাণের বিনিময়ে অন্য কিছু হতে পারে না।

কিন্তু কেসটা যদি পুরো ঘেঁটে দেখা যায়, তাহলে সময় অনুযায়ী খুন খুব কম হয়েছে। বারো বছরে পনেরোটি। তারই ভিত্তিতে অভিজিৎ বাবু ভেবে নিয়েছেন, রোড ক্রসিং এর সাথে খুনির কোন সংযোগ নেই। খুনি জানতো পুলিশ প্রথমে খুন হয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে একটা মিল খুঁজে বেড়াবে। খুনি ইচ্ছে করে প্রত্যেকটি খুন হয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে একটা মিল রেখে দিয়ে গেছে।

আর পুলিশ ওই মিলকে কেন্দ্র করে তদন্ত শুরু করবে। কেশ পুরো অন্যদিকে ঘুরিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তার সাথে কোন সম্পর্ক নেই। পুলিশকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছে। এইজন্য খুনি যতক্ষণ যায় না মিল খুঁজে পাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত খুন করেনি। তাই এতদিন ধরে মাত্র বারো জনকে খুন করেছে। না হলে খুন এর পরিমাণ দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুন হয়ে যেত। প্রায় ঘন্টা খানেক খোঁজার পর দুর্গা হাল ছেড়ে দিল। এমন অ্যাক্সিডেন্টে কেউ মারা যায়নি। অভিজিৎ বাবুও হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখনই অভিক ‘স্যার স্যার’ বলে চিৎকার করে উঠলো। অভিজিৎ বাবু খুব আগ্রহের সাথে বলল, “কিছু পেয়েছ অভিক?”

_ “বারো বছরের আগে এই ভাবে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে নি। কিন্তু তার আরো দুবছর আগে বিখ্যাত গায়ক আদিত্য চৌধুরীর ছেলে শ্রাবণ চৌধুরীর অ্যাক্সিডেন্ট হয়;ঠিক এমন ভাবে।”
_ “হোয়াট?”উচ্চ স্বরে চিৎকার করে উঠলেন অভিজিৎ বাবু।

_ “কিন্তু শ্রাবণ চৌধুরী তো জন্মগত প্রতিবন্ধী। উনার আবার কী করে এক্সিডেন্ট হল?”দুর্গা গলায় জোর দিয়ে বললো। অভিজিৎ বাবু চেয়ার থেকে উঠে মাথা চুলকাতে লাগলেন। এদিকে উৎপল এখনো সেই পাতা গুলোর মধ্যে নাম্বার খুঁজে চলেছে। তাকে দেখে অভিজিৎ বাবু অবাক হয়। অদ্ভুত মানুষ! এখনো নাম্বার খুঁজে চলেছে। ওর দিকে মনোযোগ না দিয়ে কেস নিয়ে ভাবতে থাকল। স্মৃতিতে জেগে উঠল শ্রাবণ চৌধুরীর অতীত।

তিনি খুব ভালোভাবে মনে করতে পারছেন, ছোটবেলায় শ্রাবণ চৌধুরীকে হাঁটতে দেখেছেন বাবার সাথে। অর্থাৎ সে জন্মগত প্রতিবন্ধী ছিল না। এই এক্সিডেন্টে দুটো পা চলে যায়। অভিক অভিজিৎ বাবুর কাছে গিয়ে বললেন, “আমি যতটুকু জানি, শ্রাবণ চৌধুরীর ওই অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে বিশাল একটা শোরগোল পড়ে গেছিলো শহরে। কিন্তু লাভ হয়নি। পাথরগুলো কে সরিয়ে ছিল পুলিশ তা খুঁজে বার করতে পারেনি। দীর্ঘদিন কেস চলার পর আপনাআপনি কেসটা বন্ধ করে দিতে হয়।”

_ “স্যার, শ্রাবণ চৌধুরী অতীতের সাথে এই কেসের কিছু না কিছু জড়িয়ে আছে। আমাদের শ্রাবণ চৌধুরী অতীতটাকে ভাল করে জানতে হবে।”দুর্গা বলল।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অভিজিৎ বাবু শ্রাবণ চৌধুরীর অতীত বলতে শুরু করলেন………

একসময় শহরের বড় গায়ক ছিলেন আদিত্য চৌধুরী। উনার নাম, সম্মান, খ্যাতি, বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। টলিউড ছেড়ে বলিউডেও গান গাওয়ার সুযোগ পান। বলিউডের ছোট্ট টেলিকাস্ট অভিনেত্রী অন্নপূর্ণা দেবীকে বিয়ে করেন মাত্র 22 বছর বয়সে। দু’বছরের সংসারে তাদের কোলে ছোট্ট এক সন্তান আসে সন্ধ্যা। সন্ধ্যাকে জন্ম দেওয়ার পর অন্নপূর্ণা দেবী চিরকালের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।

অন্নপূর্ণা দেবী মারা যাওয়ার পর অনেকেই আদিত্য চৌধুরীকে বিয়ে করতে বলেন। কিন্তু তিনি সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বিয়ে করেননি। সৎ মায়েরা নাকি, সৎ ছেলে মেয়েদের চোখে দেখেন না। কিন্তু সন্ধ্যা বড় হতেই আবদার করে বসে মায়ের জন্য। তার মাকে চাই।

মা ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারত না। সব সময় কান্না করতো। কোন উপায় না পেয়ে শেষমেষ, আদিত্য চৌধুরী অনন্যা দেবীকে বিয়ে করেন। অনন্যা দেবী কিছুতেই বুঝতে দিতেন না তিনি তার সৎ মা। ভালোবাসা, আদরে আগলে রেখেছিলেন সন্ধ্যা চৌধুরীকে। আদিত্য চৌধুরীও ছোট্ট একটা সংসার পেয়ে খুশি হয়েছিল। নিজের মেয়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। কয়েক বছর পর তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় যমজ সন্তান, শ্রাবণ বর্ষা।

সেদিন কত খুশি হয়েছিল তাদের পরিবার। নিজের সন্তান জন্ম নেওয়ার পরও তিনি সন্ধ্যাকে কোনভাবে অবহেলা করেনি। সন্ধ্যা জানতে পেরে গেছিল অনন্যা দেবী ওর সৎ মা। কিন্তু কখনো সৎ মা ভাবেনি সে। নিজের মা ভেবেছে সব সময়। হাসিখুশিতে তাদের পরিবার ভোরে উঠে। আনন্দ, উচ্ছাস মধ্যে দিন কাটাতে থাকে। তিন সন্তানকে নিয়ে অনন্যা দেবী কত গর্ব করতেন। সন্ধ্যা সবসময় শ্রাবণ আর বর্ষাকে কোলে নিয়ে ঘুরতো। তাদেরকে সবসময় হাসিয়ে রাখতো। কষ্ট কি জিনিস অনন্যা দেবীর পাশাপাশি তাদেরকে সন্ধ্যাও বুঝতে দিত না। অল্প বয়সে সন্ধ্যাকে এত দায়িত্বশীল দেখে ভারী আশ্চর্য হত অনন্যা দেবী। তার প্রতি ভালোবাসা আরো বাড়তে শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে শ্রাবণ বর্ষাও বড় হতে থাকে।


পর্ব ৮

“আমার নাম লিখলি কেন? আমি তো কথা বলিনি।”খুব ধীর কন্ঠে শ্রাবণ অনির্বাণকে বলল।
_ “তুই জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়েছিস সেই জন্য নাম লিখেছি।”অনির্বাণ প্রতুত্তর করল।
_ “নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য নাম লিখলে….

শ্রাবণের বলতে থাকা কথা আটকে অনির্বাণ চোখ পাকিয়ে কর্কশ স্বরে বলল, “মনিটরের উপর কথা বলছিস! তোর নামের পাশে স্টার চিহ্ন বসিয়ে দিলাম, এবার থেকে তুই দাগি ক্রিমিনাল।”শ্রাবণ আবার অনির্বাণকে আটকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সে যত বার আটকানোর চেষ্টা করে অনির্বাণ ততগুলো স্টার তার নামের পাশে বসিয়ে দিতে থাকে। শেষমেষ বেকায়দা হয়ে ছেড়ে দিল। মেয়েদের মধ্যে বর্ষা প্রতিবাদ করল শ্রাবন’এর নাম লেখাতে। কিন্তু অনির্বাণ তারও নাম লিখে রাখলো।

ক্লাস ফাইভ এর স্টুডেন্ট তারা। অনির্বাণ ক্লাসের মনিটর। ক্লাসের মনিটরের ব্যাপারে বেশি না বলাই ভালো। ওরা যে কতটা শয়তান হতে পারে সেটা হাড়ে হাড়ে সবাই জানে। সামান্য নিঃশ্বাস নেওয়া সে শ্রাবণের নাম লিখে ফেলেছে। ক্লাসে স্যার প্রথমে প্রবেশ করতেই নামের লিস্ট চাইল। অনির্বাণ স্যারের দিকে নামের লিস্ট বাড়িয়ে দিল। স্যার সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবণ আর বর্ষাকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়। শ্রাবণ স্বাভাবিক থাকলেও বর্ষা স্বাভাবিক থাকতে পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। একটু ইমোশনাল টাইপের মেয়ে সে। পুরো ক্লাস বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকল তারা।

সবাই তাদের কে দেখছে। নিজের ক্লাসমেট থেকে শুরু করে উঁচু ক্লাসমেট সবাই। শ্রাবণ এর প্রতিশোধ নিতে চাইল। সে খুব দুষ্টু টাইপের ছেলে। এত সহজে ছাড়বে না। স্কুল ছুটি হওয়ার পর শ্রাবণ সবকিছু বলে সন্ধ্যাকে। সন্ধ্যাও ওই স্কুলের স্টুডেন্ট। তবে সে তাদের চাইতে উঁচু ক্লাসে পড়ে। সন্ধ্যা শ্রাবণের চাইতে আরো বেশি দুষ্টু। দুষ্টুমি করে কাকে কিভাবে ফাঁদে ফেলতে হয় সেটা সে খুব ভালোভাবে জানে। অনির্বাণকে একটা চকলেট দিয়ে তাড়াতাড়ি পটিয়ে ফেলল সন্ধ্যা।

গ্রীষ্মকাল। বিকেল তিনটে হওয়া সত্বেও সূর্য প্রখরভাবে কিরণ দিচ্ছে। শহরের উপরে বাতাসের আশা করাটাও বৃথা। গরমে তারা ঘেমে রয়েছে। পাশেই একটা আম গাছ রয়েছে। সেখান থেকে আম পেরে দিতে হবে অনির্বাণকে। হাসিখুশিতে চারজন ফিরছে। কিন্তু অনির্বাণ আদৌ জানে না সন্ধ্যা তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেছে। ক্লাসের ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে সে। ক্লাসে পড়াশোনা না করলে সবাই শাস্তি পায়। আলাদা করে প্রতিশোধ নেওয়ার কোনো মানে হয়। কিছু দূর হাঁটার পর তারা পাঁচিল টপকে একজনের বাড়িতে প্রবেশ করল। বর্ষা ভীষণ ভয় করল। সে যেতে চাইলো না, প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। সন্ধ্যা অনির্বাণকে গাছে তুলে দিয়েছে।

তারপর তিন থেকে চারটা আম সন্ধ্যাকে দেওয়ার সাথে সাথেই, সন্ধ্যা নিচে পড়ে থাকা পাথরগুলো তার দিকে ছুটতে লাগলো। শ্রাবণও সন্ধ্যার হাতে হাত লাগালো। গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেওয়ার মতো। বেকায়দায় পড়ে গেল অনির্বাণ। গাছ থেকে নেমে কিছুতেই ছুটে পালিয়ে যেতে পারছে না। আবার তাদের দিকে কিছু ছুঁড়তে ও পারছে না। শ্রাবণ আর সন্ধ্যার ছোঁড়া পাথরগুলোর আঘাত সহ্য করতে লাগলো সে। বর্ষাও প্রাচীরের বাইরে থেকে বেশ মজা নিচ্ছে।

সেও বাইরে থেকে পাথর ছুঁড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পাথর ছোড়ার পর সন্ধ্যা অট্টহাসি দিয়ে বলল, “কিরে কেমন লাগছে? আমার ভাই বোনের নাম আর লিখবি?”অনির্বাণ কাকুতি_ মিনতি করে বলল, সে আর কখনোই শ্রাবণ বর্ষার নাম লিখবে না। তাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু সন্ধ্যার ছাড়লো না। বেশ মজা পাচ্ছিল। তাদের অট্টহাসি এবং অনির্বাণের কান্না শুনে বাড়ির কেউ একজন বেরিয়ে এলো।

তিনি এসে জানতে চাইলেন, সেখানে ঠিক কী ঘটেছে? সন্ধ্যা সাথে সাথে উত্তর দিলো অনির্বাণ আম চুরি করছে। তাই তারা চিৎকার করে তাদের বাড়ির লোককে ডাকছিল। যথেষ্ট উচ্চ এবং ভদ্র পরিবারে জন্ম সন্ধ্যার। তার বাবার নামও তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই লোকটি’ও অল্প কথাতেই সন্ধ্যার কথা বিশ্বাস করে নিল এবং তাদেরকে কিছু বলল না। সব দোষ না করেও দোষ পড়ল অনির্বাণের উপর।

হাসি খুশিতে তারা আবার বাড়ির পথে ফিরল। বর্ষা খুশির তর সইতে পারছে না। সে চায়, তার দিদিভাই দাদাভাই গিয়ে আবার তাকে মারুক। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। বর্ষা খুব শান্ত টাইপের মেয়ে। কারো সাথে মিশতে চায় না। শ্রাবণ সন্ধ্যার চাইতে একটু বেশি আদরে বড় হয়েছে সে। বাবা মায়ের ভালোবাসা কখনো ভাগ করা যায় না। তবুও বর্ষা ভাবে তার বাবা মা তাকে একটু বেশি ভালোবাসে। যদিও এতে সন্ধ্যা আর শ্রাবণের একবিন্দুও কষ্ট অনুভব করে না। বাড়ির ছোট ছেলে কিংবা মেয়ে একটু বেশি আদরে বড় হয় এটাই স্বাভাবিক।
এটাই পৃথিবীর নিয়ম। এখনো বর্ষাকে খাইয়ে দিতে হয়। খাবার টেবিলে বসে খুব শান্তভাবে খেয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যা আর শ্রাবণ।

তারা মাকে ভীষণ ভয় পায়। অনন্যা দেবীও খুব রাগী। ছেলে_ মেয়ে ভুল করলেই পিঠে লাঠির ঘা ফেলতে ভুল করেন না। বর্ষাকে অনন্যা দেবী খাইয়ে দিচ্ছেন। একদিকে শ্রাবন, সন্ধ্যার চুপ থাকা অন্যদিকে বর্ষার হাসি দেখে কিছু একটা টের করছিলেন অনন্যা দেবী। তবে বুঝতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ হাসার পর বর্ষা তার মাকে বলল, “জানো মা আজ কি হয়েছে?”সন্ধ্যা ইশারায় করে বর্ষাকে বলতে বারণ করল। কিন্তু বর্ষা শুনবে না। অনন্যা দেবী আবার জানতে চাইলেন।

বর্ষা ভেজা একটা হাসি দিয়ে বলল, “আজ দিদি আর দাদা একজনকে গাছে তুলে দিয়ে প্রচুর পাথর ছুঁড়ছে। তারপর ওই ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি।”বলেই হা হা করে হেসে উঠল বর্ষা। দুষ্ট শুধু শ্রাবণ আর সন্ধার ছিল না; বর্ষাও ছিল। কিন্তু এখন সে কেটে পড়ার চেষ্টা করছে। বর্ষার কথা শুনে অনন্যার দেবী রাগে গনগন করে উঠলেন। চোখের মণিকোঠা বীভৎস আকার ধারণ করল। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে শ্রাবণ আর সন্ধ্যা। তার মা কতটা ভয়ানক হতে পারে তারা ভালোভাবে জানে।

তারা মাথা নিচু করে রয়েছে। খেতেও পারছে না। খাওয়া শেষ হওয়ার পরই অনন্যা দেবী একটা সরু কঞ্চি নিয়ে খুব পেটালো দুজনকে। এমন মার তারা অনেকবার খেয়েছে। কতবার বলেছে তাদের বদমায়েশি করতে না, কিন্তু তারা কখনও শুনে না। দুজন ভুলেও বর্ষার নাম একবারও বলল না। বাবা মার মত তারাও বর্ষাকে ভীষণ ভালোবাসে। আদরের বোনকে কখনো কষ্ট পেতে দেবে না। বর্ষার হাসিতে হাসতে চাই ছিল।

শ্রাবণ বর্ষা ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশে সন্ধ্যা শুধু চোখ বুজে পড়ে রয়েছে। তার ঘুম কিছুতেই আসছে না। পা দুটো যন্ত্রণায় ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। একবার শুয়ে পড়ে আবার একবার উঠে পায়ে হাত বোলাতে থাকে। তার মা এমন কেন? খুব ভালোবাসেন তিনি। আবার খুব মারেনও। খুব শাসনে রেখেছেন তাদেরকে। আর পাঁচ দশটা ছেলেমেয়ে যে ভাবে জীবন যাপন করে, তারা তেমন জীবন যাপন করতে পারে না। সন্ধ্যা যথেষ্ট বড় হয়েছে অথচ এখনও তাকে একা কোথাও ছাড়েননি।

একা বন্ধু_ বান্ধবীদের বাড়িতে যেতে দেয় না। কোথাও যেতে চাইলে অনন্যা দেবী নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যান। কিন্তু ভুলেও পুরো স্বাধীনতা দেননি। তাই সন্ধ্যার মাঝে মাঝে মায়ের উপর ভীষণ রাগ হয়। আবার মাঝে মাঝে ভাবে তার মা তার কাছে সব। তার অস্তিত্ব কেবল তার মা। তার ভালোর জন্যই মা শাসন করে। তবে অনন্যা দেবী খুব চিন্তিত সন্ধ্যাকে নিয়ে। সন্ধ্যা মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পায়। কারোর মৃত্যু দেখলে সে কেমন একটা হয়ে যায়। শত ঠান্ডা থাকলেও তার শরীর থেকে ঘাম ঝরতে থাকে। গোটা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। তাই বাড়িতে টিভি প্রায় সময় বন্ধ থাকে। টিভিতে মৃত্যু কিংবা এক্সিডেন্ট দেখলে সন্ধ্যা কেঁপে উঠে। তাকে সামলানো মুশকিল হয়।

_ “কিরে এখনো ঘুমাসনি”?
মায়ের কন্ঠ শুনে সন্ধ্যা ঘুমানোর ভান করল। কিন্তু মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ নয়। মা যেমন সন্তানের বাহ্যিক কষ্ট দেখতে পায় তেমনি অন্তরের মধ্যে কি চলছে সেটাও দেখতে পান। হয়তো এটা কেবল মা দেখতে পায়, অন্য কেউ নয়। তিনি ঠিক বুঝতে পেরে গেলেন সন্ধ্যা কান্না করছিল। অনন্যা দেবী কাছে গিয়ে বসলেন। সন্ধ্যার মাথা নিজের কোলে রেখে বললেন, “খুব কষ্ট পাচ্ছিস তাই না! কতবার বলেছি কারো সাথে বদমায়েশি করতে না। আমার কথা শুনিস না কেন?”

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর মায়ের কোলে লুকানো মুখ থেকে মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো।
_ “অনির্বাণ আমার ভাই বোনকে ইচ্ছে করে স্যারের কাছ থেকে মার খাইয়েছে। আর আমি তাকে ছেড়ে দেবো।”
সন্ধ্যার কথা শুনে অনন্যা দেবী হেসে উঠলেন। সন্ধ্যার ঘুমানোর ভান করাটা ব্যর্থ হয়ে গেছে। সেটা হয়তো এখনো সন্ধ্যা বুঝতে পারেনি। তাকে বুঝতে দিলোও না। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, “এর জন্য স্যারকে বলতে পারতিস। নিজেদের মধ্যে মারপিট করা একদম উচিত হয়নি।”

_ “আচ্ছা, পরের বার থেকে এমন আর হবে না।”
_ “এই কথা কবার বললি।”
_ “16 বার।”আবার মা_ মেয়ে দুজনেই হেসে উঠলো। অনন্যা দেবী ব্যথা কমানোর মলম নিয়ে এসে সন্ধ্যার পায়ে লাগাতে লাগলো। মায়ের সেবা যত্ন মলম এর চাইতে বেশি কাজ করছে। সন্ধ্যার আপনাআপনি চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল পড়ে গেল। মায়েরা আসলে এমনই। প্রথমেই বকবে, মারবে পরে আবার অফুরন্ত ভালোবাসবে। তিনি সন্ধ্যাকে ছাড়িয়ে শ্রাবনকে মলম লাগাতে যাচ্ছিল। তখনই সন্ধ্যা মায়ের হাত টেনে নিয়ে বলল, “ওকে অনেক আগেই আমি মলম লাগিয়ে দিয়েছি।”

মলম টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আবার কাছে এসে বসলেন।
_ “ভাইকে মলম লাগিয়ে দিয়েছিস, আর নিজে লাগাতে পারলি না? ওদের এত ভালোবাসিস কেন?”
_ “ওরা যে আমার প্রাণ। আমার জীবন। ওরা ছাড়া আমি শূন্য।”

_ “এই বয়সে এত দায়িত্ব নিতে হবে না হুম। ঘুমিয়ে পড়, আমি ঘুম পাড়িয়ে যাচ্ছি।”
অনন্যা দেবী সন্ধ্যার মাথায় হাত বোলাতে থাকলো। মায়ের মমতা ভালবাসা সন্ধ্যা ঘুমের দেশে চলে গেল। ঘুম ঘুম চোখে বলল, “আচ্ছা মা, মানুষ মারা যায় কেন?”সন্ধ্যা এমন প্রশ্ন অনেকবার করেছে। তাই তিনি একটুও আশ্চর্য হলেন না। ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিলেন, জন্ম_ মৃত্যু এগুলো সবই ভগবানের উপর নির্ভর। প্রত্যেক সাম্রাজ্যের যেমন উত্থান ঘটে তেমনই পতন ঘটে। মানুষ কেও জন্ম নিলে মরতে হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।

কিন্তু এই নিয়ম সন্ধ্যা মানতে পারে না। যদি মানুষের মৃত্যু হবে তাহলে তাকে কেন জন্ম দিল ভগবান। বেশ অনেকক্ষণ ধরে মা_ মেয়ের যুক্তি_ তক্কো চলল। শেষমেষ অনন্যা দেবী বললেন, “তবে আমার তিন সন্তানের কখনো মৃত্যু হবে না তারা অমর থাকবে?”সন্ধ্যা আগ্রহের সাথে জানতে চাইল কিভাবে মানুষ অমর থাকতে পারবে? অনন্যা দেবী আবার হাসিমুখে বললেন, “মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু মানুষের কাজ চিরস্থায়ী।

মানুষের কাছে কখনো বিলীন হয়ে যায় না। সে তার কাজের মাধ্যমে অমর হয়ে থাকে।”মায়ের কথা শুনে অতুল ভাবনায় হারিয়ে গেল সন্ধ্যা। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সেও অমর হয়ে থাকবে। কিছুতেই মারা যাবে না। মৃত্যুর পর সব যেন অন্ধকার। সেই অন্ধকার সে কখনো দেখতে চায় না। এমন সময় গাড়ির শব্দ তাদের কানে ভেসে আসে। নিশ্চয়ই বাবা ফিরে এসেছে। অনন্যা দেবী মেয়েকে রেখে চলে যেতে চাইলেন।

কিন্তু যেতে পারলেন না। কেন যেতে পারলেন না সেটা তিনি নিজেও জানেন না। সন্ধ্যার করুন দৃষ্টি কিছু একটা বলতে চাইছিল। তিনি এক গাল হেসে মেয়েকে বললেন, “পেট ভরে নি তো?”সন্ধ্যা মাথা নাড়ালো তারপর বলল, “আমিও বাবার সাথে আবার খেতে চাই। আমাকে খাইয়ে দেবে বর্ষার মতো?”
_ “আচ্ছা”

_ “আমাকে কোলে নিয়ে চলো।”
_ “এত বড় একটা মেয়েকে কি করে কোলে নেবো?”
_ “নিয়ে চল না।”অনন্যা দেবী কিছু বলার আগেই সন্ধ্যা মায়ের কোলে উঠে পড়ল। কোনভাবে টলমলে তাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন সন্ধ্যা আবার বলল, “আমি তো তোমার সৎ মেয়ে, তবুও এত ভালবাসো কেন আমায়?”

_ “আমি তো কখনো সৎ মেয়ে ভাবি নি। হয়তো নয় মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করি নি। কিন্তু তিল তিল করে বড় করেছি।”কথাগুলো বলে অনন্যা দেবী কেঁদে উঠলেন। সন্ধ্যা মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে গালে চুম্বন করল। মাও ফিরিয়ে দিলেন চুম্বন।

হাসি খুশির মধ্যে তাদের দিন বয়ে চলে। সুখের পাশাপাশি দুঃখও মাঝে মাঝে আসতো। এমন আরো অনেক ঘটনা ঘটায় বর্ষা। কিন্তু সমস্ত দোষ হয় শ্রাবণ এবং সন্ধ্যার। আদিত্য বাবু নিজেই সন্ধ্যা এবং শ্রাবনকে গান শেখাতেন। বর্ষার গানের প্রতি কোন ইন্টারেস্ট ছিল না।

তাই তিনিও বর্ষাকে গান শেখান নি। বর্ষার নতুন জামা এবং খাবার খুব পছন্দ করত। তাই ছোটবেলায় বর্ষা একটু বেশি মোটা ছিল। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান কিংবা জন্মদিন হলে শ্রাবণ এবং সন্ধায় গানের কোন ইন্সট্রুমেন্টের উপহার পেতো, আর বর্ষা পেত নতুন পোশাক। নতুন পোশাক পেলেই সে সবকিছু ভুলে যেত। একজন মানুষ সব কাজ কখনোই পারে না। সেটা তাদের ক্ষেত্রেও ঘটে। বর্ষা গান না পারলেও খুব মেধাবী স্টুডেন্ট ছিল। অন্যদিকে সন্ধ্যা এবং শ্রাবণ পড়াশুনা বিন্দুমাত্রও পারত না।

তবুও মায়ের শাসনে জোর করে পড়তে বসতো রোজ। কাজের ব্যস্ততায় আদিত্য বাবু দেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছেন। মাঝেমধ্যে সাথী হোতো অনন্যা দেবী এবং বর্ষা। কিন্তু শ্রাবণ আর সন্ধ্যা উনাদের সাথে যেতেন না। বাড়িতে থাকতেই বেশি পছন্দ করত।

“স্যার, আমি গান গাইতে পারব না?”গলা বসে গেছে এমন ভান করে প্রিন্সিপাল স্যারকে বলল সন্ধ্যা।

সন্ধ্যার যুক্তিহীন কথায় প্রিন্সিপাল স্যার ঘাবড়ে গেলেন। একদিনের পরই স্কুলের ফাংশন, আর এখনই সন্ধ্যা গান গাইতে চাইছে না। কত নতুন গেস্ট ইনভাইট করা হয়েছে অনুষ্ঠানে। এই গানের অনুষ্ঠানে জাজ ছিলেন আদিত্য চৌধুরী। কিন্তু মেয়ে গান গাওয়া, তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আর এখন মেয়েই গান গাইতে চাইছে না। স্কুলের মধ্যে সন্ধ্যার গলায় যে কণ্ঠস্বর রয়েছে সেই কণ্ঠস্বর অন্য কারোর নেই।

তাকে ছাড়া স্কুলের অনুষ্ঠান করাটাও অসম্ভব। প্রিন্সিপাল স্যার উচ্চ কণ্ঠে বলল, “এমন আজব কথা বলছ কেন? একদিনের পর অনুষ্ঠান সেটা মাথায় আছে তো?”
_ “স্যার আপনিও একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমার গলা বসে গেছে। আমি কি করে গান গাইবো?”কথাগুলো বলে খ্যাক করে কেশে উঠল সন্ধ্যা। তার কন্ঠস্বর দেখে স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়; গলা বসে গেছে। স্যার বেশি জোর করলেন না।

গান তো আর জোর করে গাইয়ে নেওয়া যায় না। তিনি একটু ভেবে বললেন, ” স্কুলের মধ্যে এমন কারোর সাথে পরিচয় আছে, ভালো গান করে।”সন্ধ্যার প্ল্যান মাফিক কাজ করতে শুরু করলো। তার গলা কিছুতেই বসে যায়নি। সে চাইছিল তার ভাইকে একটা গান গাওয়ার সুযোগ করে দিতে। অল্প বয়সে তার অনেক নামডাক হয়ে গেছিল। কিন্তু শ্রাবণ ভালো গান গেয়ে একটাও সুযোগ পায়নি। ভাইয়ের জন্য এইটুকু ত্যাগ তার কাছে কিছু নয়। সে তাড়াতাড়ি বলল, “স্যার, আপনি আমার ভাইকে দিয়ে গান গাওয়ান। ও খুব ভালো গান গাইতে পারে।”

_ “আমরা ভেবে দেখছি। তোমার ভাইকে এখানে নিয়ে আসো।”
শ্রাবণ আদিত্য চৌধুরীর ছেলে ছিল। প্রিন্সিপাল স্যার নির্বিধায় শ্রাবনকে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেয়। উপস্থিত ছাত্র_ ছাত্রী, গেস্ট থেকে শুরু করে অভিভাবক/অভিভাবিকা সবাইকে উপহার দেয় একটি মনমুগ্ধকর কণ্ঠস্বর।

“মাগো আমার মা আমি তোমারি খোকা
তুমি আমার জননী ভগবান, তুমি মা
মায়ের আঁচল, মায়ের স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ
মায়ের আঁচল, মায়ের স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ
তোমার চরনে আমার জীবন।

মাগো আমার মা আমি তোমারি খোকা
তুমি আমার জননী ভগবান, তুমি মা
খোকার ঘুমের পাড়া জুড়োলো, বর্গী আসে না
মা যে তাকে আগলে রাখে, বুকের মাঝে তার
মায়ের গল্প মায়ের ছোঁয়া, চাঁদ মামা টি দিয়ে যায়….”

করতালিতে ফেটে পড়েছিল সবাই। বাহবা দিয়েছিল স্যার। আনন্দে চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যার। তার ভাইও উঠে আসছে সংগীত জগতে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, একসময় দুজন মিলে গোটা দেশে দাপিয়ে বেড়াবে সঙ্গীত নিয়ে। সেবার গানের প্রথম হতে পারেনি শ্রাবণ। কিন্তু তৃতীয় হয়েছিল। গানের অ্যাওয়ার্ড নিয়ে ছুটে এসে বর্ষাকে দিয়েছিল। বর্ষা অনেক খুশি হয়। এরপর আরো অনেক গান গাওয়ার সুযোগ পায় সন্ধ্যা। কখনো নিজে গান গায় আবার কখনো শ্রাবনকে সুযোগ করে দেয়। দুজনই যত অ্যাওয়ার্ড পেতো সব গুলো বর্ষাকে দিয়ে দিত। দুজনের পুরো পৃথিবীর বর্ষাকে ঘিরে ছিল। বর্ষার হাসিতে হাসতে ভালোবাসে। তিন ভাইবোনের এমন ভালোবাসায় বারবার মুগ্ধ হত চৌধুরী পরিবার। শহরের মানুষও তারিফ করত তিন ভাই বোনের ভালোবাসা নিয়ে।

আদিত্য চৌধুরী গর্ব করতেন নিজের সন্তানদের নিয়ে। কিন্তু এত ভালোবাসা, সুখ কি তাদের কপালে সইবে?ভগবান তো কখনো কারো জন্য শুধু সুখ ভালোবাসা লেখেননি। তিনি কপালে কষ্টও লিখেন।


পর্ব ৯

কেউ একজন বলেছিলেন, ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’। বর্তমানই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। বর্তমান যেভাবে কাটাবেন ভবিষ্যৎ ঠিক তেমনি হবে। মানুষের জীবনে নানা সমস্যা, নানা বিষন্নতা আসে। থাকে দায়িত্ববোধ এবং কর্তব্য। কেউ এগুলো সৎ নিষ্ঠার সাথে পালন করে। কেউ বেছে নেয় অসৎ পদ, আবার কেউ উদাসীনতা। নিজে সচ্ছল এবং আনন্দময় ভাবে জীবন কাটানোর জন্য গর্ত খুঁড়ে ফেলে। আর সেই গর্তে অন্যকে ফেলতে চায়। কিন্তু কখনো ভেবে দেখে না সেই গর্তে তার পাও পিছলে পড়তে পারে। নিজের ভুলের মাশুল নিজেকেই দিতে হবে।

সকাল থেকে চৌধুরী পরিবার আনন্দে মুখরিত। অনেক দিনের পর আদিত্য চৌধুরী বলিউডে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। দুপুরে উনাকে মুম্বাই যেতে হবে। সঙ্গে যাবেন অনন্যা দেবী। তিনি সকাল থেকে পূজা_ অর্চনায় ব্যস্ত। আদিত্য যেন আরো অনেক অনেক গান গাওয়ার সুযোগ পান বলিউডে। বাবা মা চলে যাওয়ার পর শ্রাবন সন্ধ্যা প্ল্যান করে রেখেছে, তারাও আজ একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসবে।

বর্ষা প্রথমে বাবা মার সাথে যেতে চায়। কিন্তু পরে সন্ধ্যা তাকে বলে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা। বাবা_ মার সাথে গেলে শুধু শুধু বসে থাকতে হবে। আর এখানে থাকলে তাকে অনেক জায়গায় ঘুরে দেখাবে আর বিরিয়ানি খাওয়াবে। বিরিয়ানির লোভে বর্ষাও থেকে যেতে রাজি হয়। দুপুরে তিন সন্তানদের নিয়ে খেতে বসেছিলেন আদিত্য চৌধুরী। অনন্যা দেবী একটু ব্যস্ত থাকায় বর্ষাকে নিজের হাতে খেতে হচ্ছে।

কিছুক্ষণ খাওয়ার পর অনন্যা দেবী তাড়াহুড়ো করে এসে আদিত্য চৌধুরীকে বললেন, বাড়িতে টাকা নেই। মাত্র কয়েক শ’ টাকা পড়ে রয়েছে। সেই টাকা দিয়ে মুম্বাই যাওয়া সম্ভব নয়। আদিত্য চৌধুরী ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার কথা। অন্যদিকে ফ্লাইট এর সময় হয়ে গেছে। আবার ব্যাংকে যথেষ্ট লাইনও দিতে হবে। আদিত্য চৌধুরী খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই অনন্যা দেবী বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

তিনি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন, আর যাওয়ার সময় আদিত্য চৌধুরী তাকে তুলে নেবেন গাড়িতে। হন হন করে বেরিয়ে গেল অনন্যা দেবী। ছেলেমেয়েদের খাইয়ে গুছিয়ে দিলেন আদিত্য চৌধুরী। হাত নাড়িয়ে সন্তানদের বিদায় জানালেন। তারা যেন বাড়ি থেকে বের না হয়। সাবধানে থাকে। পরেরদিন সকালেই ফিরে আসবেন। বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর অনন্যা দেবীর কল পান আদিত্য চৌধুরীর।
_ “আর কতক্ষণ সময় লাগবে?”অনন্যা দেবী বেশ রাগান্বিত স্বরে বলল।
_ “এইতো 15 মিনিট..”

_ “আরো 15 মিনিট! আমি রোদে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো। তাড়াতাড়ি আসো আমি এত সব বুঝি না।”অনন্যা দেবীর কথাতে তিনি একটু বিপাকে পড়লেন। তাদের মতো উচ্চ বংশ পরিবারের স্ত্রী রোদের মধ্যে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে, সেটা কি পরিবারের ক্ষেত্রে শোভা পায়? পায় না। তিনি যে রাস্তায় যাচ্ছেন আবার কিছুক্ষনের পর উল্টো দিক দিয়ে সেই রাস্তায় ফিরে আসতে হবে। শুধুমাত্র সিগন্যালের জন্য এত দূর যেতে হয়।

তার ধমনীর রক্তে জেগে ওঠে এক বর্বর মানসিকতা। তিনি গাড়ি থেকে নেমে দুটো রাস্তাকে পৃথক করা পাথরগুলিকে সরাতে লাগলেন। পাথর সরিয়ে উল্টো রাস্তায় চলে গেলেন। কিন্তু একবারের জন্যও সেই পাথরগুলোকে পূর্বের অবস্থায় রাখলেন না। মাঝ রাস্তায় পড়ে থাকলো পাথরগুলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পাথরগুলোকে দেখলেন তিনি। ইচ্ছে হচ্ছিল পাথরগুলোকে পূর্বের অবস্থায় রেখে দিতে। কিন্তু রাখলেন না।

এই সামান্য পাথর তেমন বড় একটা এক্সিডেন্ট হবে না। তাছাড়া তার পরিবারে এখন কেউ বের হবে না। কোন সিভিক পুলিশ দেখলে তা সরিয়ে দেবে। তিনি দ্রুত গাড়ি চালিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন আর রাস্তায় পড়ে থাকলো পাথর। সমাজের দায়িত্বশীল একজন মানুষ হয়েও মূর্খের মতন কাজ করলেন। হয়তো এই জন্য কিছু কিছু মানুষ বলে, শিক্ষিত মানুষের চাইতে মূর্খের দাম অনেক বেশি। এত তাড়াতাড়ি আদিত্যর আগমন অনন্যা দেবীকে ভাবিয়ে তুলল। উনার স্বামী রং রোডে আসেনিন তো? মনের সংকোচন দূর করার জন্য স্বামীকে বললেন, “আপনি এত তাড়াতাড়ি কি করে এলেন?”অনন্যাকে সত্যি কথা বলা যাবে না।

বললে, তিনি আবার এখনই বলবে পাথরগুলো সরিয়ে আসতে। একদিকে দেরি হয়ে যাবে, অন্যদিকে মান সম্মান বলে কিছু থাকবে না। তিনি মিথ্যা কথা বললেন। দুপুরে রাস্তা ফাঁকা ছিল তাই দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছেন। অনন্যাও ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক নিল। তার স্বামী আর যাই হোক মূর্খের মতো কাজ করবে না। সমাজে দায়িত্বশীল লোক সে।
বাবা_ মা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন ভাইবোন স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শহর বুকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। বাবা_ মার সাবধানতা নিমিষে উড়িয়ে দিল। বাড়িতে কাজের মাসি তাদের বাধা দিল। কিন্তু তারা শুনেনি। কাজের মাসির জন্য বিরিয়ানি নিয়ে আসবে, এই বলে কাজের মাসিকে ভুলিয়ে দিল সন্ধ্যা। বিরিয়ানির প্রতি লোভ সবার। তিনি প্রথমে না না বললেও পরে রাজি হয়ে যান। বেশ ধীর গতিতে স্কুটি চালাচ্ছে সন্ধ্যা। পরপর বসে রয়েছে বর্ষা আর শ্রাবণ।

কিন্তু শ্রাবণ আর বর্ষা ধীর গতিতে বাইক চালানো মেনে নিতে পারছে না। তারা বারবার সন্ধ্যাকে রিকোয়েস্ট করছে জোরে বাইক চালানোর জন্য। সন্ধ্যা কিছুটা বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু খুব বেশি স্পিড নয়। তার জীবনের চাইতেও বেশি দামি ছিল শ্রাবণ আর বর্ষার জীবন। দুপুরের কড়া রোদ সঙ্গে হালকা গরম বাতাস তাদেরকে একটু ক্লান্ত করে। তবে আনন্দে ওই ক্লান্ত অনুভব করতে পারল না। পরপর দুটো লরি যাচ্ছে, তাদেরকে ওভারটেক করার চেষ্টা করলো সন্ধ্যা।

গাড়ির স্পিড আরো কিছুটা বাড়িয়ে দিল। কিন্তু ওভারটেক করতে পারলো না। মাঝ রাস্তায় পড়ে থাকা পাথর গুলোতে ধাক্কা মারে। তিনজনই ছিটকে পড়ে রাস্তায়। দ্রুতগতিতে আসা লরি শ্রাবণের পায়ের উপর দিয়ে, এবং সন্ধ্যার বুকের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। দ্রুতগতিতে গাড়ি কাদা রাস্তার উপর দিয়ে চলে গেলে যেভাবে কাদা এবং কাদামাখা জল ছিটকে পড়ে, ঠিক সেভাবেই সন্ধ্যার দেহের প্রতিটি অঙ্গ_ প্রত্যঙ্গ বীভৎসভাবে ছিটকে পড়ে।

মুহুর্তের মধ্যে মৃত্যু ঘটে সন্ধ্যা। এক বিন্দু পর্যন্ত কান্না করার সময় পায়নি সে। ভাবতেই পারেনি তার মৃত্যু ঘটবে। তার মৃত্যু হল কিনা সে নিজেও হয়তো জানে না। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে শ্রাবণ। আর বর্ষা মাঝ রাস্তায় পড়ে থেকে এই মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী থাকে। আর দেহে একটুও আঘাত লাগেনি। কিছু জায়গায় চামড়া উঠে গেছে আর মাথাটা ফেটে যায়।

সেদিন, ভরা দুপুরে বর্ষা চিৎকার করে কত মানুষকে ডেকেছিল। কিন্তু কেউ আসি নি। তারপর কখন কারা তাদেরকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল ছিল, তারা জানে না। নিজের কর্মের ফল নিজেকে দিতে হয়েছিল। আদিত্য চৌধুরী ছোট্ট একটা ভুল তাদের পরিবারের আদরের বড় মেয়েকে কেড়ে নেয়। শ্রাবণ চৌধুরীর চলে যায় দুটো পা। শেষ হয় তার স্বপ্ন। তারপর শুরু হয় কেস কাচারি। কিন্তু পুলিশ কখনও খুঁজে বের করতে পারেনি পাথরগুলোর কে সরিয়ে ছিল। আদিত্য চৌধুরী নিজেও আত্মসংবরণ করেনি। তিনি জানতেন তিনি আত্মসংবরণ করলে নিজের মান সম্মান থাকবে না। তার স্ত্রী তাকে খুন করে ফেলবে।

বর্ষা আর শ্রাবণের কাছে সারাজীবনের জন্য খারাপ হয়ে থাকবে। ভুগতে থাকেন ডিপ্রেশনে। একসময় তিনি নিজেই গান ছেড়ে দেন। এক্সিডেন্ট দু_ বছরের মধ্যে মারা যান আদিত্য চৌধুরী। সংসারের নেমে আসে দারিদ্রতা। ভেঙে পড়ে চৌধুরী পরিবার। চৌধুরী পরিবারে চারিদিকে বেড়া দেওয়া হয় দুঃখ যন্ত্রণা দিয়ে। হাসিখুশি পরিবারটি মুহূর্তের মধ্যে কোথায় বিলীন হয়ে যায়। যতদিন বাড়তে থাকে ততই শহরের মানুষ জনের কাছ থেকে হারিয়ে যেতে থাকে চৌধুরী পরিবারের ঐতিহ্য। সাথে সাথে হারিয়ে যায় আদিত্য চৌধুরীর সুনাম।

সূর্যি মামা যেন শুধুমাত্র অভিজিৎ বাবুর অফিসের উপরে উঠেছে। তার তীক্ষ্ণ এবং স্বচ্ছল রশ্মি সবাইকে অস্থির করে তুলেছে। চারিদিকে একটা মৃদু কণ্ঠস্বর এবং নীরবতা। শ্রাবণের গোপন অতীত তাদের চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে। বেশ অনেকক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে অভিক বলল, “স্যার, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন?”
_ “কোন জিনিসের কথা বলছো?”

_ “সন্ধ্যা মৃত্যুকে ভয় পেত। আর তারই অল্প বয়সে মৃত্যু হল আবার বীভৎস ভাবে। শ্রাবণ ভালো গান গাইতে পারতো কিন্তু তার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। বর্ষা সবার আদরের বড় হয়েছিল। নতুন পোশাক খাবার তার পছন্দ। কিন্তু আজ পরিবারের সামান্য সুখ শান্তির জন্য নিজেই সবকিছু ত্যাগ করেছে। মানুষ যা চায় তা কখনো পায় না কেন?”
অভিকের যুক্তিপূর্ণ কথায় সবাই চুপ হয়ে গেল। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। মানুষ যা চায় তা কখনো পায় না।

তাই আজকাল খুব কম মানুষই সুখী হয়। যে মানুষ জীবনে যত কম চাইবে সে মানুষ ততই সুখী হবে। নিজের চাওয়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন নিজেকে হারিয়ে ফেলবে সেটা সে নিজেই বুঝতে পারে না। অভিক চোখের জল মুছে আবার বলল, “স্যার, আমি একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত এই খুন গুলো বর্ষা করছে। সন্ধ্যার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিচ্ছে।”অভিজিৎ বাবুর ও তাই মনে হল। সন্ধ্যার বীভৎস মৃত্যু সে নিজের চোখের সামনে দেখেছে। শ্রাবনকে যন্ত্রণা পেতে পেতে কোমায় চলে যেতে দেখেছে।

সেদিন যদি ওই মানুষটা পাথর না সরাত, তাহলে ওদের কিছুতেই এমন দুর্ঘটনায় পড়তে হতো না। সমাজে এমন দায়িত্বহীন মানুষের জন্য বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। এমন দায়িত্বহীন মানুষ শুধুমাত্র যে একবার পাথর সরাবে তার কোন কথা নেই। তারা বারবার পাথর সরাতে পারে। তার করুণ পরিণতি একবার চৌধুরী পরিবার পেয়েছে, পরে অন্য কোন পরিবার পেতে পারে। শহরের এমন আবর্জনা নতুন জিনিসকে পচিয়ে দেওয়ার আগেই সেই আবর্জনাকে সরিয়ে ফেলছে বর্ষা।

সবাই বর্ষাকে খুনি হিসেবে ধরে কেস এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু সেখানে দুর্গা বাধা দিল। সে বলল, বর্ষা কিছুতেই খুন করতে পারে না। শেষবার খুন হয়েছে 21 শে শ্রাবণ। ঐদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোন টোটো পায়নি দুর্গা। বর্ষার বাড়ির পাশ দিয়ে দুর্গার বাড়ির রাস্তা। রাস্তার মাঝখানে দুর্গাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বর্ষা নিজের গাড়িতে তুলে নেয়। দুজনে কথা বলতে বলতে বাড়ি ফেরে সেদিন। আবার ঐদিন শ্রাবণ বর্ষার জন্মদিন ছিল। বর্ষার বাড়ি থেকে খুনের জায়গা দূরত্ব 8 কিলোমিটার। অল্প সময়ের মধ্যে বর্ষা কিভাবে খুন করতে পারে? বাড়ি থেকে ওইখানটায় যেতে এবং সুযোগ বুঝে খুন করার একটা ন্যূনতম সময়ের প্রয়োজন। যেটা বর্ষার ছিল না।

তাছাড়া সে একটা মেয়ে। তার খুন করতে একটু বেশি সময় লাগবে। অভিকের যুক্তিপূর্ণ কথা দুর্গার পাল্টা যুক্তিপূর্ণ কথায় হেরে গেল। পাথর সরানোর পরের দিন কেউ খুন হয়েছে, আবার কেউ পাথর সরানোর এক মাসের পর খুন হয়েছে। বর্ষা চাইলে ওকে পরে খুন করতে পারত। ঐদিন কিছুতেই খুন করত না। জন্মদিনের মতন একটা পবিত্র দিনে কিছুতেই হাত রক্তাক্ত করতো না। তাছাড়া বর্ষার এমন আচরণ দেখে বোঝা যায়, সে এমন কাজ করতে পারে না। তাহলে খুন কে করছে? আসল খুনি কে? নীরবতা কাটিয়ে দুর্গা বলল, “আমার মনে হয় খুনগুলো সন্ধ্যাই করছে। সে কোনোভাবে বেঁচে গেছে। একসময় মৃত্যুকে ভয় পেত আর এখন মৃত্যু নিয়ে খেলা করছে।”

_ “তাই হবে হয়তো।”অভিজিৎ বাবু মৃদু গলায় বলল।
_ “না স্যার, সন্ধ্যা কিছুতেই খুন করতে পারে না। আমি একশো পার্সেন্ট নিশ্চিত।” উৎপল কথাগুলো বলতে বলতে স্যারের কাছে আসলো। তাকে দেখে সবার মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল। বেচারা এতক্ষণ ধরে একটা মেয়ের নাম্বার খুঁজে বেড়িয়েছি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, কিন্তু নাম্বারটা আর পেলো না। তার জন্য একটু মায়া প্রকাশ করল সবাই। দুর্গা একটু ঠাট্টা প্রকাশ করে বলল, “কি উৎপল! নাম্বার পেলেন? দুপুর হয়ে গেল…”দুপুর কথাটি শুনে একটু কেমন হয়ে গেল উৎপল।

দুপুর হলেই সে একটা মালাই খাবে। যতই ঠান্ডা থাকুক তার মালাই চাই। এখনো বাচ্চা থেকে গেছে উৎপল। অফিসে এটা সবাই জানে। উৎপল বলল, “আমি আগে মালাই খেয়ে আসি। তারপর বলছি।”উৎপল কাউকে অগ্রাহ্য না করে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। অভিক ছুটে গিয়ে উৎপলকে জড়িয়ে ধরে। অপ্রতিভ হবে কানে ফিসফিস করে বলে, “উৎপল কি হচ্ছে কি? স্যার আছে, সেটা খেয়াল করেছো?”

_ “অভিক বাবু, আপনি তো জানেন আমি দুপুরে মালাই খাই।”
_ “আরে ভাই, একটু তো ওয়েট করে যাও। তারপর তোমাকে একটা নয় আমি দশটা মালাই খাওয়াবো।”
_ “প্রমিস।”

_ “প্রমিস।”
অভিক উৎপলকে বুঝিয়ে স্যারের কাছে নিয়ে আসলো। পাশে থাকা দুটো চেয়ারে দুজন বসলো। অভিজিৎ বাবু কর্কশ স্বরে বললেন, “তুমি তো কোন কথাই শোনো নি। তারপরও কিভাবে বলছো সন্ধ্যা এই খুন করতে পারে না।”অভিজিৎ বাবুর কথা শুনে উৎপল হাসতে লাগল। অভিজিৎ বাবু বিরক্ত বোধ করলেন।

একজন সিনিয়র অফিসারের সামনে সিরিয়াস কথার সময় হাসা মানায় না। সেটা কি জানে না উৎপল। তিনি ইচ্ছে করলেই উৎপলের চাকরি খেয়ে নিতে পারেন। উৎপল একগাল হেসে বলল, “এটা খুব সাধারন ব্যাপার। যে মেয়ের এমন বীভৎসভাবে মৃত্যু হয়, সে কী করে বাঁচতে পারে? তাছাড়া, শ্রাবণ যখন ক্লাস ফাইভে পরে তখন তার এক্সিডেন্ট হয়। ক্লাস ফাইভের বাচ্চার বয়স দশ থেকে এগারো বছর মধ্যে হবে। তখন শ্রাবণের বয়স যদি এগারো ছিল, তাহলে সন্ধ্যার বয়স নিশ্চয়ই পনেরো থেকে ষোল মধ্যে ছিল।

অ্যাক্সিডেন্টের দু’বছর পর খুন শুরু হয়েছে। সেখানটায় সন্ধ্যার বয়স আঠারো থেকে উনিশের মধ্যে হবে। ফরেনসিক ল্যাব পরীক্ষা অনুযায়ী খুনি শিশু থেকে খুন করছে। কোন উনিশ বছর বয়সী যুবতীকে কি শিশু বলা যায়?” উৎপলের কথা শেষ হতেই অভিজিৎ বাবু টেবিল চাপড়ে উঠলেন। নিজেদের যুক্তি বারবার নিজেদের কাছে হেরে যাচ্ছিল। এমন যুক্তি নিয়ে কোর্টে চাজশিট কিছুতেই দাখিল করা যাবে না। এই খুনগুলো তাহলে কে করছে? কি তার উদ্দেশ্য? বেশ অনেকক্ষণ ধরে সবাই ভাবতে লাগলো। ভাবার পর অভিজিৎ বাবু দুর্গাকে বললেন, “এখন আমাদের দুটো কাজ তাড়াতাড়ি করতে হবে। প্রথমত, কোর্টে চার্জশিট দাখিল করতে হবে। দ্বিতীয়ত, …..”

অভিজিৎ বাবুর কথা আটকে উৎপল বলল, “দ্বিতীয়ত, আমাকে মালাই কিনে দিতে হবে।”রাগে ঘন ঘন করতে লাগল অভিজিৎ বাবু। উৎপল কখনোই সিরিয়াস হবে না। অভিক আর দুর্গা মিটমিট করে হাসছে। আজকাল উৎপল কাউকেই ভয় করছে না। তবে তার একটা ভালো গুণ রয়েছে। এত কাজের মধ্যেও সবাইকে হাসিয়ে রাখতে পারে। সে একটু চুপ থেকে স্যার কে আবার বলল, “আপনার ফোন টা দিন না!”
_ “কেন?”

_ “একটা মেয়েকে ফোন করবো?”
_ “নিজের ফোনে করতে পারছ না? স্যারের কাছ থেকে চাইছো?”
_ “প্লিজ স্যার! আমার ফোনে ব্যালেন্স শেষ।”
_ “কোন মেয়েকে ফোন করবে? সেটা আগে বল?”

_ “সকালে বললাম না, একটা মেয়ে পাতায় নাম্বার লিখে ছুঁড়ে দিয়েছিল আমার দিকে…..”
অতল ভাবনায় হারিয়ে গেল উৎপল। সবাই বিশ্বাস করতে পারছে না উৎপল শেষমেষ নাম্বারটা খুঁজে পেয়েছে। আর মেয়েটাও ওই পাতায় নাম্বার লিখেছিল। অনেকক্ষণ আগেই উৎপল নাম্বারটা পেয়ে গেছে। সেখানে বসে শুধু অভিজিৎ বাবুর কথা শুনছিলেন। বেশ রোমান্টিক একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল। কাজে আর মন বসতে চাইল না। অভিজিৎ বাবু ফোন নিয়ে উৎপলকে দিল। উৎপল সঙ্গে সঙ্গে ফোন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।

মুখে এক অদ্ভুত হাসি। এক অদ্ভুত অনুভূতি। যে অনুভূতির নাম নেই। তাকে দেখে সবাই মিটমিট করে হেসে উঠলো। অভিজিৎ বাবুর ঠোঁটের কোণে ও ফুটে উঠল হাসি। যাইহোক ছেলেটার পরিশ্রম অন্তত বৃথা যায়নি। কিছুক্ষণ উৎপলকে দেখার পর অভিজিৎ বাবু দুর্গাকে আবার বলল, “কালকে দুটো কাজ তাড়াতাড়ি করে ফেলবে। কোন দুটো কাজের কথা বলছি মনে আছে তো?”দুর্গা মাথা নাড়িয়ে বলল, “ইয়েস স্যার। প্রথমত কোটে চার্জশিট দাখিল করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মালাই……”
মুখ ফসকে বলে ফেলল দুর্গা। সে পুরোটা উৎপলের কথায় মগ্ন ছিল। অভিজিৎ বাবু দ্বিতীয়বার রেগে গিয়ে বলল, “তুমিও!”

_ “না একচুয়ালি…”
_ “বুঝেছি, আর বলতে হবে না। উৎপলের সাথে থাকতে থাকতে সবাই উৎপল হয়ে যাচ্ছে। আমিও একদিন উৎপল হয়ে যাব।”


পর্ব ১০

হেমন্তের পৌঢ়ত্বের পর আসে জড়গ্রস্ত শীতের বার্ধক্য। আবহমান গ্রামবাংলার অন্যান্য সকাল থেকে শীতের সকাল আলাদা। প্রকৃতির পালাবদলে শীত আসে রিক্ততা আর শুষ্কতা নিয়ে। ফসলহীন মাঠ, ঝরা পাতা প্রকৃতি যেন বৈরাগীর বসন পরেছে। শীতের সকাল আসে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। কোমল সূর্যরশ্মিতে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু গুলো মুক্তোর মত ঝলমল করে। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ শিশিরের ঝরে পড়ার শব্দ, আর পাখির কলরব আন্দোলিত করে গ্রামের জীবনকে।

কর্মমুখী মানুষ শিশিরভেজা মেঠো পথে পা রাখে। জীবিকার প্রয়োজনে হাড় কাঁপানো শীত পরোয়া করে না ওরা। কুয়াশা ভেদ করে ছুটে চলে যে যার কাজে। অনিমেষ বাবু বিড়ির ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে কাজে চলেছেন। কাঁধে রয়েছে জাল, আর কোমরে বেঁধে রেখেছেন মাছ রাখার ছোট্ট ঝুড়ি।
কতটা বেলা হল বোঝার উপায় নেই। বেলা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে, কেননা সূর্যের দেখা নেই। কুয়াশা বারবার সূর্যকে আড়াল করছে। শীতের আগমনের সাথে সাথে বনভূমিতে শুরু হয় হাহাকার , মালতীলতা হয় পত্র শূন্য। খেজুর গাছের আগায় ঝুলছে খেজুর রসের ছোট্ট হাঁড়ি।

সূর্যের মিটিমিটি আলো দেওয়ার আগে গাছিরা বেরিয়ে পড়ে রস সংগ্রহে। ক্ষেতের পর ক্ষেত থাকে সরষে ফুল। ফুলের উপর উঠে চলা রঙিন প্রজাপতি কিংবা মৌমাছিদের মেলা মন হরণ করে। শীত মানে সরষে ফুলের হলুদ বন্যা। শীতের দাপট থামাতে পারে না পাখির চঞ্চলতা। কৃষকের মত কৃষক_ বধূ গৃহস্থলীর কাজে লিপ্ত হয়। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় পুকুরের জল স্পর্শ করে বাসন মাজে। গৃহপালিত পশুর জন্যও আছে শীতের পোশাক। জল কমে যাওয়ায় খাল_ বিল, জলাশয়ে জাল ফেলতে ব্যস্ত জেলেরা।

অনিমেষ বাবুর আগমনে নদীর পাশে বসে থাকা বেশ কয়েকটা সাদা বক উড়ে চলে গেল। চারিদিকে কুয়াশাচ্ছন্ন তার মধ্যে আরও পাঁচ ছ’জন জেলে মাছ ধরছেন। তাদের নৌকাযান ভেঙ্গে দিয়েছে নদীর নীরবতা। নদী থেকে উঠছে হালকা ধোঁয়া। পুব আকাশে সূর্যের স্নিগ্ধ শোভন রশ্মি নদীতে এসে পড়েছে। সূর্যরশ্মি আর নদীর জল মিশে একাকার। নিয়েছে নতুন এক রঙিন আভা।
“দরিয়ায় আইলো তুফান

দরিয়ায় আইলো তুফান
আয় কে যাবি রে
ভেসে ভেসে যাব চলে মদিনা নগরে”
মনের সুখে গান গেয়ে একের পর এক জাল ফেলছেন অনিমেষ বাবু। উপস্থিত আরও জেলেদের ও মধুর কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসে আসছে। কেউ জীবিকার প্রয়োজনে আবার কেউ বাড়ির দুমুঠো অন্নের জন্য মাছ ধরছেন। সাধারণত এখানকার জেলেরা শীতকালে ট্রলার করে মাছ ধরে না। ধরলেও খুব সামান্য। প্রতিবার জাল ফেলে মাছ ধরে খুব সামান্য। তবুও একের পর জাল ফেলতে দ্বিধা বোধ করে না। কখনো জেলে একা মাছ ধরতে আসেন আবার কখনো আসেন জেলের বউ।

বাড়িতে থাকা জেলের ছোট্ট ছেলে কিংবা মেয়েও মাঝেমধ্যে আসে। ঠান্ডার মধ্যে তারাও হাত লাগায় বাবার কাজে। কোন কাজ না পারলেও মুগ্ধ হয় বাবার পাশে থাকতে পেরে। অনিমেষ বাবুর চোখের সামনে বারবার পূজারিনীর মুখশ্রী ভেসে উঠছে। সেও তার বাবার সাথে কতবার এসেছে। বাবাকে কত ভালোবাসত। আজ কয়েকটা মাস হয়ে গেল দেখা হয়নি। বুকটা বার বার ধুকপুক করে ওঠে অনিমেষ বাবুর। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা চোখের জল।

এটা কোন স্বপ্ন? যা পূরণের জন্য বাবার থেকে দূরে থাকতে হবে! স্বপ্ন পূরণ না করলে হয় না! স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে বাড়ির প্রিয়জন যে দূরে চলে যায়। স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে, মানুষ কখন নিজেকে হারিয়ে ফেলে সেটা বুঝতে পারে না। স্বপ্ন পূরণ করা কি ভীষন জরুরী? টাকা, গাড়ি_ বাড়ি এগুলো ছাড়া কি জীবন অসম্পূর্ণ? নানা প্রশ্ন আঁকিঝুকি দেয় অনিমেষ বাবুর মাথায়। আবার নিজেই চোখের জল মুছে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। তার মেয়ে অনেক বড় গায়িকা হবে। অনেক নামডাক হবে। সবাই তাকে চিনবে। অনিমেষ বাবু এমন সব কথা ভাবছেন, হঠাৎ নদীর মাঝখান থেকে কেউ উচ্চ স্বরে বলল, “ওহে অনিমেষ! কত মাছ পড়ল?

“কণ্ঠস্বর খুব পরিষ্কার এবং তীক্ষ্ণ। বিপরীত মানুষটি অনিমেষ বাবুর প্রতিবেশী। তিনিও উনার মতো মাছ ধরে বেড়ান। জীবিকার প্রয়োজনে তিনিও জীবিকার তরী ভাসান নদীতে। অনিমেষ বাবুও উচ্চস্বরে উত্তর দিলেন, বেশ কয়েকটা মাছ পড়েছে। অনিমেষ বাবুর উত্তর পাওয়ার পর তিনি আবার একইভাবে উচ্চ স্বরে বললেন, “তা মায়াটার খবর কি? সে কি বড় গায়িকা হয়ে গেছে?”কথাটা মোটেও ভালো লাগলো না অনিমেষ বাবুর। লোকটি ইচ্ছে করে বিদ্রূপ করল।

অল্প দিনে কেউ গায়িকা হয়ে যেতে পারে? তাকেও সময় দেওয়া উচিত। তাকে তৈরি হতে হবে। অনিমেষ বাবু যোগ্য জবাব দিলেন। তিনি বললেন, “হয়নি , তবে দুদিনের মধ্যে বিশ্বসেরা গায়িকা হয়ে যাবে? চিন্তা করো না তোমায় মিঠাই খাওয়াবো ঠিক।”যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর। উনি ইচ্ছে করেই অনিমেষ বাবুকে কথা শুনিয়েছিলেন, কিন্তু ভাবতে পারেননি অনিমেষ উল্টে তাকে কথা শুনিয়ে দেবে। কিছুক্ষন নিস্তব্ধতা থাকার পর লোকটি আবার বলল, “কি লাভ ভাই, মাইয়া মানুষকে এত কিছু শিখিয়ে? ওই তো কটা দিনের পর সেই হাড়ি, বাসন মাজতে হব? বিয়ের বয়স হয়ছি বিয়ে দেই দও। মাইয়া মানুষ… একটু বুঝো অনিমেষ…।

_ “না না, আমোর মাইয়া একদিন বড় গায়িকা হব। এই গ্রামর মুখ উজ্জ্বল করিব। তাকু আমে অনেক পড়িবা, অনেক লিখিবা।”
অনিমেষ বাবুর কথা শুনে লোকটি হাসতে লাগল। বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর সখ গেল না। তিনি কর্কশ স্বরে বললেন, “কেঠি কি তুমে পড়ুচ, সব খরচ তো চৌধুরী পরিবার দেয়। আমোর যদি এমন একটা চৌধুরী পরিবার রইতা, তাহলে আমোর ঘরো মাইয়াও গায়কা হেয়তা।”

বুক চিনচিন করে উঠলো অনিমেষ বাবুর। কোন কথা আর বলতে পারল না। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতন আঘাত পেলেন তিনি। সত্যি কি তাই। তার মেয়ের মধ্যে কিছু নেই। চৌধুরী পরিবার জন্য তার মেয়ে গায়িকা হতে পারছে। হ্যাঁ, চৌধুরী পরিবারের অনেক অবদান আছে। হয়তো ওরা না থাকলে তার মেয়ে কখনো গায়িকা হওয়ার স্বপ্নটাই দেখতে পারত না। কিন্তু তার মেয়ের মধ্যেও কিছু আছে। তাইতো শ্রাবণ অন্য মেয়েকে না নিয়ে, তার মেয়েকে নিয়েছিল। গ্রামের মানুষের এই কটুকথা পূজারিনীর কোনো ক্ষতি করবে না তো? তার স্বপ্নের বাধা হবে না তো? নাকি স্বপ্ন পূরণ হয়েও, পূরণ হবে না! থেকে যাবে কোন চিরন্তন কালো দাগ।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল সূর্য রশ্মি কুয়াশাকে বিলীন করতে থাকলো। কমতে থাকল শীতের দাপট। কিছু ছেলে ব্যাট হাতে নেমে পড়ল মাঠে। আবার কেউ ঘুড়ি নিয়ে ছুটে বেড়ালো বিলে। কেউ আবার দা হাতে আপন_ মনে ধান কাটছে। বৃদ্ধ_ বৃদ্ধারা রোদ পোহাতে ব্যস্ত। তাদের সঙ্গী হয়েছে কোন ছোট্ট শিশু। মেতে উঠেছেন গল্পে গল্পে সোনালী অতীতে। কেউ আবার বাড়ির ভেতরে কনকনে ঠাণ্ডা দূর করার জন্য, পান্তা কিংবা মুড়ি নিয়ে বসেছে বাড়ির উঠোনে। আবার কেউ পুকুর পারে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা স্নান করে স্কুলে যেতে হবে।

গরম জলে স্নানের কথা বললেই মায়ের হাতে শুনতে হবে জোর বকুনি। মায়েরা ঠান্ডায় সন্তানদের ভুলেও মারেন না। ঠান্ডায় একটু মারলে নাকি গায়ে ভীষণ ব্যথা অনুভূতি হয়। শহর থেকে একটা গাড়ি দ্রুত বেগে ছুটে আসছে গ্রামের দিকে। মধ্যিখানে রয়েছে পূজারিণী আর বর্ষা। অনেকদিন ধরে পূজারিণী নিজের গ্রামে আসতে চাইছিল। ব্যস্ততার কারণে তা হয়ে উঠতে পারেনি। বেশ কয়েক দিন অফিসে ছুটি থাকায়, তারা বেরিয়ে পড়েছে গ্রামের উদ্দেশ্যে। তবে শ্রাবণ আসে নি। পূজারিণী অনেক জোর করে ছিল আসার জন্য, কিন্তু সে শুনেনি।

যদিও পূজারিণী মনে মনে অনেক খুশি হয়েছে শ্রাবণের না আসাতে। অন্তত কয়দিনের জন্য সে বিশ্রাম পাবে। না হলে এখানেও পড়াশুনা করতে হতো। বিশ্বাস নেই বাবা_ মার সামনেও পেটাতে পারে। পড়াশুনা পূজারিনীর ভালো লাগে না তা কিছুতেই বোঝে না শ্রাবণ। ওকে নিয়ে গিয়েছিল গান শেখাতে কিন্তু এখন শেখাচ্ছে পড়াশোনা। গান না শিখিয়ে পড়াশোনা শেখাবে, আগে থেকে জানলে কিছুতেই যেত না পূজারিণী।

বাড়িতে কোন কাজ করতো না, অথচ সেখানে কত কাজ করে। বলতে গেলে পুরো দোকানের দায়িত্ব পূজারিনীর উপর। মাঝেমধ্যে বাড়িতে কিছু কাজও করতে হয়। এসব কিছুই ভালো লাগে না পূজারিণীর। বলতেও পারে না। সব মুখ বুজে সহ্য করছে। কি আর করা যায়? সে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। তাই তার লড়াই একটু কঠিন। ওই কঠিন পাথরকে ভাঙতে পারলে, আপন বেগে ঝর্ণার জল বেরিয়ে আসবে।

কিন্তু এই পাথরটাকে ভাঙ্গা বড্ড কষ্ট। সে আদৌও ভাঙতে পারবে কিনা জানে না। তবুও চেষ্টা করছে। চেষ্টাই একমাত্র শব্দ যেটা সমস্ত ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ করতে পারে। এতক্ষণে পূজারিণী একটা জিনিস লক্ষ্য করলো, বর্ষার হাতে বড় ফোন আর নেই। কয়েকদিন আগেই সে দেখেছে বর্ষাকে বড় ফোন ব্যবহার করতে। কিন্তু আজ একটা কিপ্যাড ফোন ব্যবহার করছে। কিন্তু কেন? পূজারিণী কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।

বর্ষা শ্রাবণের সাথে কথা বলছে। মাত্র দুই ঘন্টা হয়েছে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। আর এর মধ্যেই বর্ষা শ্রাবনকে তিনবার কল করেছে। এটাই হয়তো শ্রাবণের প্রতি বর্ষার টান। বর্ষাও জোর করে শ্রাবণ কে নিয়ে আসতে চায়নি। শহরের চাইতে গ্রামের ঠান্ডা ভীষণ। শ্রাবণ ঠান্ডা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। তাই তার আসা হয়নি। বর্ষা ফোন রাখার সাথে সাথে পূজারিণী জিজ্ঞেস করল, “বর্ষা দিদি, তোমার বড় ফোনটা কোথায় গেল?”পূজারিণীর আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে বর্ষা একটু হতভম্ব হলো। বর্ষা তার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “ওটা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই ছোট ফোন কিনে নিলাম।”

_ “কেন? আবার একটা বড় ফোন নিতে পারতে।”
_ “আসলে, আমি তো তেমন ফোন ব্যবহার করি না। বড় ফোন নিয়ে কি করবো মিছেমিছি?”
পূজারিণী আরো কিছু কথা বলছিল, কিন্তু বর্ষা শুনল না। গ্রামীণ ভাঙ্গাচুরা রাস্তা। সাবধানে ড্রাইভিং করতে লাগলো। বর্ষাও কিছুতেই বোঝাতে পারে না তাদের জন্যই ওকে এত কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে। তার বড় মোবাইল আদৌ ভেঙে যায় নি। সে ফোনটা বিক্রি করে দিয়েছে।

সেই টাকায় নিজে একটা ছোট্ট ফোন কিনেছে সাথে পূজারিণীকেও কিনে দিয়েছে। শীতের ভালো পোশাক ছিল না পূজারিনীর। সবাই স্কুলে নতুন নতুন সোয়েটার পরে যেত। সেখানে পূজারিণী প্রতিদিন একটা সোয়েটার পরতো। তাই তাকে একটা চাদর কিনে দিয়েছে। একটা ফোন থেকে তিনটে জিনিস হয়ে গেল। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে?সেই চাদর মুড়ি দিয়ে এখন বসে রয়েছে পূজারিণী। বেশ সুন্দর লাগছে তাকে। অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশি কিউট লাগছে পূজারিণীকে। চাদর জড়িয়ে বসে থাকার অভ্যাস যে তার ছোটবেলা থেকে রয়েছে, সেটাও তার চাদর পরার কৌশল দেখে বোঝা যায়।

_ “তোমার ঘাড়ও শ্রাবণের মতন খুব সুন্দর।”আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে বর্ষা একটু হতবাক হয়ে। এই মেয়ের ঘাড় ছাড়া আর কোন সৌন্দর্য যেন চোখে পড়ে না। সব সময় ঘাড়ের প্রশংসা করতে থাকে। ঘাড়ের মধ্যে এমন কি রয়েছে? কে জানে। বর্ষা ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলে, “দেহে তো আরো অনেক অঙ্গ_ প্রত্যঙ্গ রয়েছে, তাদের প্রশংসা না করে তুমি সবসময় ঘাড়ের প্রশংসা করো কেন?”

_ “তোমাদের ঘাড়টা সুন্দর। তাই প্রশংসা করি।”
সত্যিই অদ্ভুত মেয়ে। ঘাড় আবার সুন্দর হয়। তবে পূজারিনীর কাছে অসম্ভব কিছু না। যাইহোক একঘেয়েমি থেকে নতুন কিছু তৈরি করতে পেরেছে। সবাই সব সময় চুল, চোখ, মুখের প্রশংসা করে। সে না হয় ঘাড়ের প্রশংসা করল।

বাড়ির সামনে পৌঁছতেই বর্ণালী দেবীর চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল। কতদিন হল মেয়েকে দেখেনি, ভালবাসেনি, আদর করেনি, জড়িয়ে কান্না করতে পারেনি। পূজারিণী গাড়ি থেকে নেমে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পরলো। কান্নায় চোখের জল ভাসিয়ে দিল। বর্ণালী দেবীর চোখ থেকেও টপটপ করে জল পড়লো। কয়েক মুহূর্তের জন্য দুজন ভুলে গেল তাদের সাথে আরও একজন রয়েছে। বর্ষা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনকে দেখছে। কটা মাস মাকে দেখতে না পেয়ে কতটা আকুল হয়ে গেছে পূজারিণী।

বিয়ের পর কি করে মাকে ছাড়া পূজারিণী থাকবে? আদৌ থাকতে পারবে তো? কিছুক্ষণ কান্না করার পর বর্ণালী দেবী পূজারিণীকে ছাড়িয়ে বলল, “আর কান্না করতে হবে না, ওই দিদি ভাই তো একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছে! ওনাকে বাড়িতে নিয়ে আয়।”

_ “একটু জড়িয়ে থাকতে দাও না। কতদিন হলো তোমার গায়ের গন্ধ পায়নি। কি মিষ্টি তোমার গায়ের গন্ধ।”
_ “কি আজেবাজে বকছিস সব। গায়ের গন্ধ আবার মিষ্টি হয়।”
_ “হ্যাঁ হয়। তুমি বুঝবে না।

_ “আমি বুঝতেও চাই না। বাড়ির ভেতরে চল‌।”
বর্ষা মিটমিট করে হাসতে লাগলো। তারপর দুজনকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসলেন। আগের বার রাতে বাড়িতে এসেছিল তাই তেমন করে বাড়িটাকে ভালোভাবে দেখা হয়নি। বর্ষা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাড়ি দেখতে লাগল। আগের বারের তুলনায় এবার একটু বেশি ভালো লাগছে। গতবারে কেমন একটা ভিজে ভাব ছিল, এবার সেটা নেই। তবে ঘরের ভেতর ভীষণ ঠান্ডা। মাটির দেওয়ালে আলপনা গুলো আবছা হয়ে গেছে। কয়েকমাস বাড়িতে পূজারিনীর অনুপস্থিত ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। মা_ মেয়ে দু’জনই খোশগল্পে মেতে উঠলো।

অনিমেষ বাবু বাড়িতে নেই। উনি মাছ ধরতে নদীতে গেছেন। বর্ষা বসে শুধু দেখছে। মনটাও বারবার ব্যাকুল হচ্ছে শ্রাবণের জন্য। গ্রামে নিয়ে এলে মনে হয় ভালোই হত। একা ছেড়ে আসা উচিত হয়নি। মা আছে তবুও মনটা কেমন হচ্ছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। শ্রাবণ বর্ষাকে ছাড়া থাকতে পারে না, আর বর্ষা তাকে ছেড়ে গ্রামে চলে আসলো তিন দিনের জন্য। এমন সব কথা ভাবছে হঠাৎ পূজারিনীর একটা কথায় বর্ষার ঘোর কাটল। পূজারিণীর খিদে পেয়েছে। সে মাকে খাবার বাড়তে বলল।

পূজারিণী যাইহোক খেয়ে নেবে, কিন্তু বর্ষা সে কি এই গ্রামের খাবার খেতে পারবে। গ্রামে পান্তা, মুড়ি, শাকসবজি এগুলোই তাদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু শহরের খাবার তো পুরো ভিন্ন। বর্ণালী দেবী খুব ধীর কণ্ঠে পূজারিণীকে বলে বাজার থেকে চাওমিন নিয়ে আসার জন্য। তাদের মধ্যিখানে হওয়া কথা গুলো, বর্ষার থেকে আড়াল করতে চাইল। কিন্তু বর্ষা ঠিক বুঝতে পেরে গেল। সেও খুব সাধারণ মেয়ে। গ্রামের খাবার খাওয়া অভ্যাস হয়তো নেই কিন্তু পারবে। গ্রামের মানুষ যদি দীর্ঘদিন ধরে ওই খাবার খায়, তাহলে বর্ষা কেন পারবে না? পূজারিণী বর্ষার কাছে গিয়ে বলল, “আমাদের খাবার তোমার মুখে রুচি আসবে না। তুমি পারবে না?”

_ “পারবো বলছি না। তুমি গ্রামে বড় হয়ে শহরের খাবার খেতে পারো, তাহলে কেন আমরা শহরে বড় হয়ে গ্রামের খাবার খেতে পারব না?”
পূজারিণী আর কিছু বলল না। বর্ণালী দেবীও জোর করলেন না। তিনি দুটো থালায় পান্তা নিয়ে এলেন সাথে বেগুন মাখা। মাটিতে বিছানো দুটো আসনে দুজন বসলো। এরই মধ্যে অনিমেষ বাবু চলে এলেন। পূজারিণী ইচ্ছে করছিল বাবার কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু খাওয়ার থালা ছেড়ে উঠলো না।

সেখানে বসেই গল্প করতে লাগল। দুজনেই পান্তা খাচ্ছে তবে বর্ষার একটু কেমন লাগছে। টক টক ভাব। তবুও খাচ্ছে মনের আনন্দে। মাঝেমধ্যে সেও অনিমেষ বাবুর সাথে গল্প করছে। অনেক গল্প করার পর অনিমেষ বাবু হঠাৎ একটা বেমূলক প্রশ্ন করে বসলেন।
_ “তোমরা বাড়ি ফিরবে কবে?”

যদিও গ্রামের মানুষের কাছে এই প্রশ্ন স্বাভাবিক। তারা অনেক সময় এমন কথা বলে ফেলে। তার মানে যে তাদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছে তা নয়। আসলে ভালবাসার মানুষকে অল্পদিনে ছাড়তে চায় না। অনেকদিন রেখে দিতে চায়। হয়তো ভালোমন্দ খাওয়াতে পারবেন না কিন্তু বাড়িতে রেখে দিতে চায়। তাই তারা এমন অমূলক কথা বলে। বর্ষার একটু খারাপ লাগলো ওই কথাতে। নিজেকে সামলে বলল, “কালই চলে যাব।”
পূজারিণী মুখটা পাংশু মত হয়ে গেল। আজ এসে কাল ফিরে যেতে চাইছে। কত আশা ছিল অন্তত কদিনের জন্য শ্রাবণের হাত থেকে রেহাই পাবে। কিন্তু সব আশায় জল ঢালল বর্ষা।

_ “একদিন থেকে বাড়ি ফিরে যাব।”মৃদু হেসে অনিমেষ বাবু বললো।
_ “জোর করবেন না। পরেরবার এলে অনেক দিন থাকবো। আসলে দাদাভাই একা আছে। আমার কিছু ভালো লাগছে না”
সূর্যের রশ্মি পশ্চিম আকাশকে লাল আভায় ভরে দিয়েছে। পাখিদের কলরব ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। তারাও বাসায় ফিরতে ব্যস্ত। পূজারিণী আর বর্ষা গ্রামের রাস্তায় হেঁটে চলেছে। দুজনই গায়ের চাদর মুড়ি দিয়ে রেখেছে। ভীষণ ঠাণ্ডা। নানা ধরনের গ্রামের সৌন্দর্য বর্ষাকে মুগ্ধ করছে। তার উপর রয়েছে পূজারিণীর অপরূপ ভাবে গ্রামের সৌন্দর্য বর্ণনা। চারিদিকে গাছগাছালিতে ভর্তি, তবে প্রায় গাছের পাতা নেই সব পাতায় ঝরে পড়েছে। শুকনো পাতার উপর ছুটে চলেছে ছোট ছোট শিশুরা।

আবার কোন কোন মহিলা সেই পাতাগুলো গোটাতে ব্যস্ত বাড়ির জ্বালানির জন্য। চাষীরা ধান কাটতে ব্যস্ত। কিছু কিছু চাষী ধানের বোঝা মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। এই কাজে বাচ্চারাও লিপ্ত হয়েছে। তারাও মাথায় ধানের বোঝা নিয়ে যাচ্ছে; তবে খুব সামান্য। মাঝে মধ্যে অনেকেই এসে পূজারিণী সাথে কথা বলছে। পূজারিণীও গল্প করতে বেশ ভালোই পারে। বর্ষা তখন শুধু দেখে মাঝে মধ্যে দু’একটা কথা বলে। পূজারিণী অন্য মানুষ গুলোর সাথে কি কথা বলছে, বর্ষা তা ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না।

মেদিনীপুরে গ্রামীণ ভাষা এবং শহরে ভাষার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তাই হয়ত এমন হচ্ছে। তবে পূজারিণীকে দেখেছে খুব স্পষ্ট ভাবে প্রচলিত বাংলা কথা বলতে। অন্যান্য মানুষগুলো যখন বর্ষার সাথে কথা বলে তখন তারাও চেষ্টা করে প্রচলিত বাংলা কথা বলার, কিন্তু তারা গুলিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা একটা ব্রিজের উপরে গিয়ে বসলো। ব্রিজটা খুব ছোট্ট। নদীর জল নেই বললে চলে। শীতকালে পুরো শুকিয়ে রয়েছে। নদীকে দেখেও মায়া হচ্ছে বর্ষার।

এদিক ওদিক তাকিয়ে বেড়াচ্ছে বর্ষা। এমন সময় পূজারিণী সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “আচ্ছা, তোমার মা রোজ একটা ফটোয় মালা পরান। আমি অনেকবার জানতে চেয়েছি ওই মেয়েটা কে কিন্তু তোমার মা কিছুই বলেনি। বারবার কথা এড়িয়ে গেছেন। ওই মেয়েটা কে? আমি কি জানতে পারি।”মুহূর্তের মধ্যে পুরনো অতীত বুকের মধ্যে ঝাঁকিয়ে উঠলো বর্ষার। চূর্ণ_ বিচূর্ণ হয়ে গেল। কথা বলার ক্ষমতা নেই। চোখ দুটো ছল ছলে উঠেছে। হঠাৎ বর্ষার মধ্যে এমন পরিবর্তন দেখে পূজারিণীও কেমন একটা হয়ে গেল। ওই মেয়েটা কে? যাকে দেখে সবাই কান্না করে? কথা এড়িয়ে যায়। পূজারিণী একবুক সাহস নিয়ে আমতা আমতা করে বলল, “বলো না, কে ওই মেয়ে? তোমরা সবাই ওকে আড়াল করছ কেন?
_ “উনি আমার দিদিভাই …..”

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বর্ষা। তার চোখের জল মুছে দিয়ে পূজারিণী জানতে চাইল তাদের ছোট্ট বেলার অতীত। বর্ষা আজ না বলল না। সে সংক্ষেপে তাদের ছোট্টবেলার অতীত বলল।


পর্ব ১১

দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে বর্ণালী দেবী। কিছুই ভালো লাগছে না। শুধু চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে। মনটা বারবার ব্যাকুল হয়ে উঠছে মেয়ের জন্য। কিছুক্ষণ আগে তারা চৌধুরী পরিবারে ফিরে গেছে। ফেরার সময় পূজারিণী কতনা কান্না করলো। একটু বেশি ইমোশনাল টাইপের মেয়ে পূজারিণী। কিছুতেই ওই বাড়িতে যেতে চাইছিল না। বাবা_ মাকে ছাড়া তার থাকতে ভীষণ কষ্ট হয়। সে কথা কাউকে বোঝাতে পারে না। তার পাশে বসে বিড়ি ফুঁকছেন অনিমেষ বাবু।

মেয়ে মানে কি এমন!প্রথমে নিজের ঘরকে আলো করে রাখবে, পরে সেই ঘর অন্ধকার করে দিয়ে অন্য ঘরকে আলো ভরিয়ে দেবে। পূজারিণী আজ পড়াশোনার জন্য বাইরে গেছে। কিন্তু এক সময় তাকে বিয়ে দিতে হবে। এই গ্রাম ছেড়ে দূরে চলে যাবে সে। চাইলেও জোর করে আটকানো যাবে না। পৃথিবীর নিয়ম এত নিষ্ঠুর কেন? সবসময় মেয়েদেরকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ছেলেরাও তো পারে ত্যাগ স্বীকার করতে। শুধুমাত্র বৃদ্ধ অবস্থায় সুখে কাটানোর জন্য কি প্রত্যেকটা পরিবার পুত্র সন্তান কামনা করে? নানা প্রশ্ন আঁকিঝুকি খাচ্ছে বর্ণালী দেবীর মাথায়। বেলা বাড়তে থাকে কিন্তু তাদের অবস্থান পরিবর্তন হলো না।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বর্ণালী দেবী একসময় চোখের জল মুছে খুব মৃদু কন্ঠে বলল, “শুনছেন।”
_ “বল।”এতক্ষণে অনিমেষ বাবু বেশ কয়েকটা বিড়ি শেষ করে ফেলেছেন। বিড়ির শেষ অংশটুকু আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। তারাও যেন কিছু একটা ইশারা করছে। বিড়ি জ্বলতে জ্বলতে নিজেকে শেষ করে ফেলেছে। জ্বলন্ত অবস্থায় প্রত্যেকটা মুহূর্তে অনিমেষ বাবুকে খুশি রেখেছে।

বিড়ির শেষ অংশটুকু উনার আর প্রয়োজন নেই তাই ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। অনিমেষ বাবুর জীবনটাও খানিকটা বিড়ির মতো। তিনিও যৌবন অবস্থায় নিজেকে শেষ করে, সবাইকে সুখের আঙিনায় আটকে রেখেছেন। কিন্তু বৃদ্ধ অবস্থায় তাকেও বিড়ির মতো কেউ ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তবে এমনটা হবে না, বিশ্বাস করে অনিমেষ বাবু।
_ “আমরা বৃদ্ধ অবস্থায় কার কাছে থাকবো? আমাদের তো কোনো পুত্র সন্তান নেই! কে আমাদের দেখাশোনা করবে?”খুব স্বাভাবিক এবং দৃঢ় স্বরে বললেন বর্ণালী দেবী।

আজকের দিনে এমন প্রশ্ন খুব নিতান্তই শোনা যায় না। আধুনিকতার সাথে সাথে মানুষ নিজের ভালো নিজে বুঝতে শিখে গেছে। তবে গ্রামের মানুষের মধ্যে এই প্রশ্ন বারবার উঠে আসে। বর্ণালী দেবীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অনিমেষ বাবু। তার মনের মধ্যেও এই প্রশ্ন অনেকবার জেগে উঠেছে।

কখনো পাত্তা দেয়নি। তিনিও খুব স্বাভাবিকভাবে বর্ণালী দেবীকে বোঝালেন। তাঁরা তার মেয়ের কাছে গিয়ে থাকবে। শুধুমাত্র বৃদ্ধ অবস্থায় ছেলেরা যে বাবা_ মার দায়িত্ব নেবে তা নয়। মেয়েরাও পারে বাবা_ মার দায়িত্ব নিতে। ছেলের সাথে সাথে মেয়েদেরও কর্তব্য বাবা_ মার দেখাশোনা করা। মেয়ে মানে, বিয়ে করার পর নিজের বাড়িকে পরের বাড়ি করে দিয়, অন্যের বাড়ি আপন হয়ে গেল, তা নয়। মেয়ে মানে, দুই হাত দিয়ে চারপাশকে আগলে রাখা।

মেয়ে মানে, একজন পুরুষের মতো সমান অধিকার। তারাও কোনো কাজে পিছিয়ে নয়। অনিমেষ বাবুর কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হয় বর্ণালী দেবী। তবুও মনের সংকোচন দূর করতে পারলেন না। একটা খটকা লেগে রইল।

রেস্টুরেন্টে পাশাপাশি বসে রয়েছে অভিজিৎ বাবু আর দুর্গা। ওই পুরনো কেস ছাড়া হাতে নতুন কোনো কেস নেই। অফিসে হাফ ডে করে চলে এসেছেন তারা। দুজনই খোশগল্পে মেতে রয়েছে। এখন ওইখানে আসার কথা উৎপলের। সে আজ তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে উনাদের পরিচয় করিয়ে দেবেন। কয়েকদিন আগেই উৎপলের নতুন গার্লফ্রেন্ড হয়েছে। তারপর থেকেই উৎপলের মধ্যে এক অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন। প্রেমে পড়লে সবাই পরিবর্তন হয়ে যায়। কিন্তু উৎপল মাত্রা অতিরিক্ত। অফিসে এখন আদৌ কাজ করে না।

দু’দিন অন্তর অফিস ছুটি নেয়। আজ হাফ ডে অফিস করার পর সবাই এক সাথে মিট করার কথা ছিল। কিন্তু উৎপল আজ অফিসে আসে নি। একটা বিশেষ কাজের জন্য অভিক অফিস থেকে বাড়ি ফিরে গেছে। তারা আজ একই সাথে অনেকদিন ধরে কাজ করে আসছে। একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যার নাম বন্ধুত্ব। বন্ধুর জন্য কাজকে সামান্য ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেওয়া খুবই নিতান্ত ব্যাপার। তাদের প্রত্যেকের বয়স প্রায় সমান। শুধুমাত্র অভিকের বয়স 30_ 31 হবে। বন্ধুত্ব কখনো বয়স মানে না।

তারই উদাহরণ অভিক। অফিসে কখনো কখনো কাজের ক্ষেত্রে অভিজিৎ বাবু অভিক কে ‘অভিক’ বলে ডাকেন। না হলে প্রায় সময় তিনি উনাকে যোগ্য সন্মান দেন। অনেক দিনের পর একসাথে প্রেমের গল্প করছেন অভিজিৎ বাবু আজ দুর্গা। তাদের প্রেমের গল্প একটু না হতেই দুর্গা প্রথমে বিয়ের কথা বলতে শুরু করে। আর অভিজিৎ বাবু বিয়েতে রাজি নন। তিনি মস্ত বড় একটা অফিসার হলেও বাড়িতে রয়েছে অন্ধ_ কুসংস্কার। বাড়িতে ছোট মেয়ে থাকতে ছেলের বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না।

লজ্জায় বাড়িতে কিছুই বলতে পারেননি তিনি। মাকে ও ভীষণ ভয় পায় অভিজিৎ বাবু। তাদের সম্পর্কের কথা বাড়িতে এখনো জানায়নি। এমন কথা শুনে প্রত্যেক মেয়ের মত দুর্গাও মুখটা গম্ভীর করে বসে রইল। কিছুই ভালো লাগছে না। একটা ভালোবাসা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন দুজন দুজনকে বিয়ে করে। কিন্তু তাদের বিয়ে মনে হয় আর হবে না। বলতে বলতে তারা পঁচিশের গণ্ডি পার করে ফেলেছেন‌। বাড়িতে বিয়ের জন্য বারবার জোর করছেন দুর্গাকে। পঁচিশ বছর বয়সে খুব কমই অবিবাহিত মেয়ে রয়েছে। সে আর কিছুতেই বাবা_ মাকে আটকে রাখতে পারছে না। বাবা_ মা প্রায় ধরে নিয়েছেন দুর্গা একটা ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছে।

না হলে কোন ছেলে কেন বিয়ে করতে চাইবে না? এত বছর রিলেশনশিপে থাকা সত্ত্বেও! দুর্গার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে অভিজিৎ। একসময় দুর্গা অভিজিৎ পকেট থেকে ফোন বের করে নিল। তারপর বলল,
_ “মায়ের নাম্বার বলুন? আপনাকে কিছু বলতে হবে না আমি বলছি?”

_ “না মানে, আমি আজ সবকিছুই বলবো। এখন মাকে কিছু বলতে হবে না। উনি রাগ করতে পারেন।”কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল অভিজিৎ বাবু। একজনকে বড় অফিসার কে কাঁপতে দেখে বেশ ভালই লাগছিল দুর্গা। তবে সে ভালোভাবে জানে অভিজিৎ কিছুতেই বলবে না।

সে আবার ধমক দিয়ে বলল, “বলছি না নাম্বার দিতে!”যতই মস্ত বড় অফিসার হন না কেন, গার্লফ্রেন্ডের কাছে বেশিরভাগ ছেলেই একটু ভীতু হয়। অভিজিৎ বাবু একটু ভয় পেয়ে গেলেন। উনাকে ভয় পেতে দেখে দুর্গার বেশ হাসি পাচ্ছিল। তবে লুকিয়ে রাখলো। অভিজিৎ এর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কল করল দুর্গা। বারবার কল করছে কিন্তু বিজি। দুর্গার একটু সন্দেহ জাগলো। নিশ্চয়ই নাম্বার ভুল দিয়েছে। আবার নাম্বার সেভ করাও আছে ‘মা’ বলে। তাই সন্দেহটা দূর হলো।

_ “ফোন তো বিজি বলছে। এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছেন উনি?”
_ “প্রেম করছে মনে হয়!”এমন প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো দুর্গা। তার মা এই বয়সে প্রেম করছে। কোথা শুনতে ভুল হলো না তো। না সঠিক শুনেছে। সে আবার বলল, “হোয়াট? তোমার মা এই বয়সে প্রেম করছে?”
_ “না না, আমার মা নয়;বোন।”

_ “সিরিয়াসলি! ঋতু প্রেম করছে?”
_ “তাই তো মনে হচ্ছে। বেশ কয়েকদিন ধরে আমি লক্ষ করেছি সারাদিন ফোনে কার সাথে কথা বলতে। যখন জিজ্ঞেস করি, তখন বান্ধবী বলে কথা এড়িয়ে যায়। কিন্তু আমি বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারি কোনটা বান্ধবী, কোনটা প্রেমিক।”

মিটমিট করে হাসতে লাগলো দুর্গা। হবু ননদও প্রেমে পড়ে গেল। এর আগে অনেকবার তার সাথে কথা বলেছে দুর্গা। মিষ্টি একটা মেয়ে। খুব শান্ত বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। একটু কথা বলে চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু এখন ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলছে। বেস্ট ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। প্রেমে পড়লে সবাই এমন হয়। বোরিং মানুষটাও খুব ইন্টারেস্টিং হয়ে ওঠে। ঋতুর ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। তবে দুর্গার রাগ হচ্ছিল অভিজিৎ এর উপর। বোন কত বড় হয়েছে অথচ এখনো ফোন কিনে দেয়নি। একটু রেগে অভিজিৎ কে বলল, “তুমি বোনকে একটা মোবাইল কিনে দিতে পারছ না! এখনও সে বাড়ির ফোন ব্যবহার করে। তুমি দাদা না গাধা!”
_ “সে এখন অনেক ছোট। মোবাইল ব্যবহার করা অনুচিত।”

_ “কলেজে পড়াশোনা করে আর তোমার কাছে ছোট লাগছে। এই বয়সে ফোন খুবই দরকার। বিশেষ করে কলেজে পড়াশোনার জন্য।”
_ “হ্যাঁ, এই বয়সে ফোন খুবই প্রয়োজন। তবে বেশির ভাগ ছেলে মেয়ে ফোন প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করে। আমি ভালোভাবে জানি তাদের মধ্যে একজন আমার বোনও হবে। প্রথমে তারা ফোনকে ব্যবহার করবে, কিন্তু কিছুদিন পর ফোন তাদেরকে ব্যবহার করতে শুরু করবে।

“কিছুক্ষণ থেমে রইল অভিজিৎ বাবু। গালে হাত দিয়ে কথা শুনছে দুর্গা। আবার বলতে শুরু করলেন তিনি, “আমি চাইলে বড় ফোন ব্যবহার করতে পারতাম কিন্তু করিনি। কিপ্যাড ফোন ব্যবহার করছি। শুধুমাত্র আমার বোনের ভালোর জন্য। আমি বোনকে কিছু একটা ভালো জিনিস দেখে দিলাম তারপর বললাম তাকে ব্যবহার করতেন না। সে কি শুনবে? শুনবে না, বরং তার প্রতি আরও ইন্টারেস্ট বেড়ে যাবে। কারণ আমরা প্রত্যেকে নতুন কিছু শিখতে চাই।

ওই জিনিসটার মধ্যে এমন কিছু নতুন জিনিস রয়েছে, যার জন্য দাদা তার কাছ থেকে আড়াল করছে। যেমন ভাবে হোক সেটা ঠিক খুঁজে বার করবে। অনেক সময় বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে, আর আমরা বাড়িতে লাউডস্পিকারে টিভি চালিয়ে দেখতে থাকি। আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চোখ রাঙ্গিয়ে বলি পড়াশোনা করতে। আর না করলে, তাদের দোষ হয়। কারণ তারা পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল না। ওদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে আমরা বেরিয়ে যেতে চাই। কিন্তু বাস্তবে তাদের দোষ থাকে না, দোষ থাকে আমাদের। ছোটদের সামান্য ভালোর জন্য আমরা সামান্য টিভি দেখা ত্যাগ করতে পারি না। জানো, আজকালকার বেশির ভাগ ছেলে মেয়ে ফোনে চার্জ শেষ হয়ে গেলে ডিপ্রেশন ফিল করে। নিজেকে একা মনে করে। এবার তুমি বলল মোবাইল তারা চালায়? না মোবাইল তাদেরকে চালায়?”

একনাগাড়ে কথা বলায় গলা শুকিয়ে গেল অভিজিৎ বাবুর। আরো কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু পারলেন না। তিনি চুপচাপ বসে রয়েছেন। দুর্গা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে আশাবাদী অভিজিৎ আরো কিছু শোনাবে। তাকে ‘ক’ বলেছিল ছিল, আর সে পুরো কলকাতার ইতিহাস শুনিয়ে দিল। যাইহোক, কথাগুলো মোটেও মন্দ নয়। বাস্তব জীবনে এমনই ঘটে। অভিজিৎ কে কোনো কথা বলতে না দেখে দুর্গা বলল, “এবার অন্তত একবার উৎপলকে ফোন করো। আসবে নাকি জিজ্ঞেস করো? না হলে আমি চললাম।”

অভিজিৎ উৎপল কে বারবার কল করতে লাগলো। কিন্তু না, সেও বিজি। আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল। যাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে তারাই কল ধরছে না। অন্তত একবারের জন্য কল রিসিভ করে আনসার তো দিতে পারে। না হলে একটা এসএমএস করতে পারে। কিন্তু কিছুই করছে না। এত ব্যস্ত ফোনে। একসময় দুজন বিরক্ত হয়ে উঠে চলে যাচ্ছিল। তখনই লক্ষ্য করে উৎপল ফোনে কথা বলতে বলতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা আবার চেয়ারে বসে পড়লো। উৎপল পাশে এসে বসল।

কিন্তু আগের মতো কোনো কথা বলল না। ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে। একবার মুখটা পেঁচিয়ে নিচ্ছে, ঠোঁটের কোণে বারবার হাসি, মাথা চুলকায়, নিজের জামার কলার মুখে নিয়ে চিবুচ্ছে, মাথা চুলকে চুলকে চুলগুলো পুরো এলোমেলো করে ফেলছে, মাঝে মধ্যে দাঁড়িয়ে চুলকাতে লাগলো। অভিজিৎ দুর্গা দুজনের গালে হাত দিয়ে বসে স্থির চোখে উৎপলকে লক্ষ করছে। প্রেমের সবাই পড়ে, কিন্তু উৎপলের মতো এমন মারাত্মকভাবে পড়ে না। বেশ খানিকক্ষণ উৎপল ওদেরকে পাত্তা দিলো না। অভিজিৎ বাবু বড্ড বিরক্ত বোধ করছিল সাথে দুর্গাও। তবে বিরক্তটা উৎপলের হাসিখুশি মন দেখে কর্পূরের মত উবে গেল। অনেকক্ষণ একইভাবে থাকার পরও অভিজিৎ উৎপলকে বলল,

“ভাই, এবার তো অন্তত ফোনটা রাখ। আমাদের সাথে একটু কথা বল।”অভিজিৎ বাবুর কোন কথাই গ্রাহ্য করল না উৎপল। অনেকক্ষণ কথা বলার পর ফোন রেখে বললো, “এই মেয়ের দাদা গুলো এমন হয় কেন বলতো? পাক্কা শয়তান।”
_ “মেয়ের দাদা আবার এখানে কি করলো?ওই ভদ্র মানুষকে তুমি গালি দিচ্ছো কেন?”গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলল অভিজিৎ বাবু।

উৎপল মুখ ভ্যাংচিয়ে বললো, “ভদ্র মানুষ, রাজ্যের একটা শয়তান। জানেন, এতদিন পর্যন্ত বোনকে একটা ফোন কিনে দেয়নি। আবার উনি নাকি একজন পুলিশ অফিসার। একবার বিয়েটা হতে দিন, তারপর দেখিয়ে দেবো তুমি কত বড় পুলিশ অফিসার।”উচ্চস্বরে কথা বলছে উৎপল। কিন্তু দুর্গা কোথাও একটা মিল খুঁজে পাচ্ছে উৎপলের গার্লফ্রেন্ড আর অভিজিৎ বাবুর বোনের সাথে। অভিজিৎ আর উৎপল অনেকক্ষণ কথা বলল। বেশ অনেকক্ষণ কথা বলার পর উৎপল উঠে গিয়ে একটা মেয়েকে নিয়ে আসলো।

মেয়েকে দেখে দুজই অবাক। মেয়ে আর কেউ না, সে ঋতু। বেশ লম্বা, ফর্সা চেহারা, লাজুক মুখশ্রী। সেও প্রস্তুত ছিল না এখানে এসে দাদার সঙ্গে দেখা হবে। নিজেও দাদার নামে বেশ কয়েকটা খারাপ কথা বলে দিয়েছে। শুধুমাত্র ভালোবাসার খাতিরে। কিন্তু বর্তমান যে কত ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাবতে পারছে না সে। মুখ নিচু করে রয়েছে। আর উৎপল তখনও মেয়ের দাদাকে গালি দিয়ে যাচ্ছে। দূর্গা কিছুতেই হাসি থামিয়ে রাখতে পারছে না। একসময় হো হো করে হেসে উঠলো।


শহরে আসার পর আবার নিয়মিত রুটিনে আবদ্ধ হয় পূজারিণী। ধরাবাঁধা একঘেয়েমি জীবন যাপন করতে শুরু করে। সকাল থেকে রাত প্রায় প্রতি সময় শ্রাবণ তার কাছে থাকে। দীর্ঘদিন তার সাথে থাকার পর ভয় কিছুটা হলেও কমে গেছে। মানুষটা ভালো শুধুমাত্র তার ভালোর জন্য সে কড়া হয়েছে। আসনের উপর বসে রয়েছে পূজারিণী পাশে সেতার। বারবার সেতার বাজানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।

শ্রাবণ রেগে ফোঁস ফোঁস করছে। বারবার দেখানো সত্ত্বেও পূজারিণী কিছুতেই পারছে না। পারবেই বা কি করে? তার মনোযোগ একদম এদিকে নেই। মন অন্য কোথায় হারিয়ে রয়েছে। শেষমেষ শ্রাবণ ব্যর্থ হয়ে ওকে ছেড়ে দিল। আজ আর জোর করা ঠিক হবে না। তবে পূজারিনীর উপর রাগ ভীষণ ভাবে বেড়ে গেল। পূজারিণী ইচ্ছাকৃতভাবে এইসব করছে।

_ “ডাইরিটা দাও?কি লিখেছ একবার দেখি?”গম্ভীর স্বরে শ্রাবণ পূজারিণীকে বলল।
_ “আমি নিজের লেখা নিজে বুঝতে পারি না আপনি কি করে বুঝবেন!”পূজারিণী এমন কথা শ্রাবণ ভালোভাবে নেবে না সেটা হয়তো সে বুঝতে পারেনি। শ্রাবণের রাগ দ্বিগুন বেড়ে গেল। নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে, পাশে থাকা সরু কঞ্চি নিয়ে পূজারিনীর হাতে বেশ কয়েকটা ঘা মারলো। খুব ভয়ানক ভাবে হাতে আঘাত সৃষ্টি হল। শীতের মধ্যে যন্ত্রনা ভয়ঙ্কর ভাবে অনুভব হল কিন্তু শ্রাবণ সেদিকে কোন খেয়াল করল না।

সে পূজারিণী ডায়েরি নিয়ে একের পর এক পাতা দেখতে শুরু করলো। পূজারিণী ঠিকই বলেছে সে নিজের লেখা নিজেই বুঝতে পারে না অন্য কেউ কি করে বুঝবে। পাতার একটা অক্ষরও ঠিকঠাক লিখেনি সে। এতগুলো দিন ধরে তাকে পড়ানো সবটাই ব্যর্থ।
বর্ষার খাটের উপর চুপচাপ বসে রয়েছে পূজারিণী। পাশেই বর্ষা অফিসের কাগজপত্র নিয়ে কি সব করছে।

পূজারিণী বারবার দেখছে তার হাতে আঘাত করা অংশটি। ওই অংশটি বেশ ফুলে উঠেছে এবং রক্ত জমা হয়ে রয়েছে। খুব ব্যথাও অনুভব হচ্ছে। বর্ষার চোখে সে ফাঁকি দিতে পারল না। ঠিক বুঝতে পেরে গেল। প্রথমে দেখাতে না চাইলেও বর্ষা জোর করে দেখলো। বেশ কয়েকটা কঞ্চির ঘা হাতে পড়েছে। সেই অংশ নিদারুণভাবে ফুলে রয়েছে। বর্ষাকে পুরো ঘটনা বলতে হলো না সে বুঝতে পেরে গেল কি হয়েছে। মলম নিয়ে পূজারিণীকে লাগিয়ে দিল।

বর্ষার স্নেহ যত্নে পূজারিণী মুগ্ধ হলো। তার কোলে মাথা রেখে বলল, “তোমরা কত ভালো! কিন্তু শ্রাবণ দাদা তোমাদের মত একটুকরোও নয়। উনি তোমাদের সাথে কত ভালো ব্যবহার করেন কিন্তু আমার সাথে সব সময় রাগান্বিত। যেন আমি উনার কাছ থেকে কিছু একটা কেড়ে নিয়েছি, তাই তিনি প্রতিশোধ নিচ্ছেন।”পূজারিনী কথাগুলো বর্ষাকে বেশ আঘাত করলো। তার দাদাই প্রাণ, আর ওই দাদার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলবে সে কি মেনে নিতে পারবে?

পারবে না। তবে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে পারবে। তার দাদা ভালো, মন্দ মোটেও নয়। কিছু ভালোর জন্য কিছু খারাপ মেনে নেওয়া বাধ্যতামূলক। পূজারিণীকে ও নিজের ভালোর জন্য শ্রাবণের খারাপ ব্যবহার মেনে নিতে হবে। একগাল হেসে বর্ষা বলল, “একটা গল্প শুনবি?”
_ “গল্প”
_ “আমি তো অনেক বড় হয়ে গেছি। এই বয়সে কেউ গল্প শুনে। গল্প ছোটদের জন্য বেস্ট।”
_ “বড় হয়েছিস তাতে কি? গল্প শুনাতে কোন বয়স থাকে না।”

পূজারিণী অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বর্ষা গল্প বলতে শুরু করল, “একবার এক বিয়েবাড়িতে বরের ছোটবেলার শিক্ষক উপস্থিত ছিল। বর তখন অনেক ধনী, অনেক বড় এক ব্যবসায়ী। বর তাঁর ছোটবেলার শিক্ষকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল তাকে চিনতে পারছে কি না। শিক্ষক না বলল। বর শিক্ষকে বলল, ‘স্যার আপনার মনে আছে স্কুলে একবার একটা পেন চুরি হয়ে গেছিল। তার জন্য আপনি সবাইকে চোখ বন্ধ করে দিয়ে একসাথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর প্রত্যেকের পকেট সার্চ করতে লাগলেন। আমার ভীষণ ভয় করছিল। কারণ পেন আমার পকেটের মধ্যে ছিল। এই বুঝি আপনি পেনটা আমার পকেট থেকে পাবেন আর সবাইকে বলে দিবেন।

স্কুলে আমার নামে বদনাম হবে। সবাই আমাকে চোর বলবে। কিন্তু কি অদ্ভুত! আপনি আমার পকেট সার্চ করলেন, পেন পেলেন কিন্তু কাউকে কিছু বললেন না। যার পেন হারিয়ে গেছিলো তাকে ফিরিয়ে দিলেন। ভেবেছিলাম পরে হয়তো আমাকে ডেকে কিছু বলবেন কিন্তু না, আপনি কিছুই বলেন নি। ‘ শিক্ষক হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার ওই ঘটনাটা খুব মনে আছে। তবে পেন কে চুরি করেছিল তা আমি জানি না।

কারণ তোমাদের মতো আমিও নিজের চোখটি বন্ধ করে রেখেছিলাম। আসলে আমি জানতে চাইছিলাম না, পেন আসলে কে চুরি করেছে? আমি যদি জানতে পারতাম তাহলে তার প্রতি একটা ঘৃণার সৃষ্টি হয়ে যেত। ‘শিক্ষকের কথা শুনে বর চুপচাপ হয়ে গেল। মুখের ভাষাই হারিয়ে গেছিল। আজ সে অত বড় বিজনেসম্যান হয়তো সেই স্যারের জন্যই হয়েছে।”

বর্ষার গল্প বলা শেষ হতেই দুজনেই চুপ হয়ে গেল। বর্ষা জানতে চাইল পূজারিণী কিছু বুঝতে পেরেছে কি না! পূজারিণী মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। বর্ষা ড্রয়ার থেকে একটা ডায়েরী এনে পূজারিণীকে দিল। ডাইরি এদিক_ ওদিক উল্টে দেখতে লাগলো। ডাইরির মধ্যে প্রত্যেকটি অক্ষর শ্রাবণের। সে নিজে হাতে লিখে পূজারিণী কে দিয়েছে। পূজারিণী খুশি আর সইতে পারছে না। কিছুক্ষণ আগে যে মানুষটি তাকে মেরে ছিল সামান্য অক্ষরের জন্য।

এখন সেই মানুষটি নিজের হাতে সবকিছু লিখে দিয়েছি। শিক্ষক আসলে এমনই হয়। যত বড় বড় সাকসেসফুল মানুষ রয়েছে প্রত্যেকে পেছনে নিজের বাবা_ মা আর ছোটবেলার শিক্ষকের হাত থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেক সাকসেসফুল মানুষই বড় হয়ে ছোটবেলার শিক্ষককে ভুলে যায়। আবার অনেকে তো বাবা_ মাকেও ভুলে যায়।


পর্ব ১২

দু’বছর পর…

হুইলচেয়ার বারবার এদিক ওদিক গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে শ্রাবণ। দুচোখে ভরে উঠেছে ক্লান্ত আর অপেক্ষা। আজ সবচাইতে জনপ্রিয় রিয়ালিটি সো তে সিলেক্ট হওয়া নাম প্রকাশিত হবে। শ্রাবণের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রকাশিত নামের প্রথমে দিকেই থাকবে পূজারিণী। এই দু বছরে সে নিজে হাতে তাকে তৈরি করেছে। সে কেমন গান গাইতে পারে তা কেবল শ্রাবণই জানে। কোনো শিল্পীকে অন্য শিল্পীর সঙ্গে তুলনা করা সঠিক নয়। প্রত্যেক শিল্পী নিজের জায়গা নিজেই সঠিক। তবুও শ্রাবণ জানে বর্তমানে অন্যান্য গায়িকার তুলনায় পূজারিণী গলা অনেক ভালো। তার হাত ধরে নতুন একটা সঙ্গীতের জগত সৃষ্টি হবে, সে আগে থেকে জানতো। এখন তাকে তৈরি করাও শেষ।

এবার শুধু পূজারিণীকে এগিয়ে যেতে হবে। নিজের ভালো নিজেকে বুঝে নিতে হবে। এখন আর পড়ার জন্য শ্রাবণকে বলতে হয় না। সে নিজেই পড়তে বসে যায়। নিজেই প্র্যাকটিস করে। প্রয়োজন হলে নিজেই গিয়ে শ্রাবণের কাছে সাহায্য চায়। মাঝে মাঝে ধন্যবাদ দেয় শ্রাবনকে। সেদিনের কঞ্চির ঘা গুলো আজ আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেদিন যদি কঞ্চির ঘা গুলো পিঠে পড়তো না তাহলে, আজ হয়তো এখানে পৌঁছাতে পারতো না পূজারিণী।

এখন পূজারিণী মনে করে তার অনেক কিছু শিখতে বাকি। অনেক কিছুই অজানা রয়েছে। এক সময় নিজে ভাবতো সে সবকিছু জানে কিন্তু এখন তার পুরো বিপরীত। নিজেই শ্রাবনকে বলে বই কিনে দিতে পড়ার জন্য। শ্রাবণ যথাসাধ্য চেষ্টা করে পূজারিনীর সব দায়িত্ব পালন করতে। এই দু বছরে পূজারিণী বেশ কয়েকটা জায়গায় গান গেয়েছে। নিজের নাম উপরের দিকে নিয়ে গেছে। ব্যর্থতা না আসলে সাফল্য সম্ভব নয়। আগে ব্যর্থতার মুখ দেখো তারপর সফলতার মুখ দেখবে।

ব্যর্থতা ছাড়া সাফল্য অসম্ভব। পূজারিণীকে ও ব্যর্থতা ঘিরে ধরলো। কিন্তু এই ব্যর্থতার যেন ব্যর্থতার নয়। ইচ্ছে করে হারিয়ে দেওয়া। প্রকাশিত নামে প্রথমের দিকে তো দূরের কথা পুরো লিস্টে কোথাও পূজারিনীর নাম নেই। এটাই নিতান্ত রাজনীতি কিংবা সমাজে উচ্চপদে নিমজ্জিত মানুষের স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো কথা বলা যায় না। যে মানুষ ভালো গান গাইতে পারে তার নাম নেই। অথচ যারা গান গাইতে ঠিকঠাক পারে না তাদের নাম প্রথমের দিকে রয়েছে।

এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি? শুধুমাত্র টাকা দিয়ে হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ এভাবে নষ্ট করা যায় না। তারা যেন বুঝেও বুঝে না। রাগে গোঁ গোঁ শব্দ করছে শ্রাবণ। রাগের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে সেটা ভালোভাবে বুঝতে পারছে পূজারিণী। এতক্ষণ সোফায় বসে ছিল পূজারিণী কিন্তু আর বসতে পারল না। বুকের ভেতর যন্ত্রণা শেষ করে দিচ্ছিল। তার চাইতেও বেশি পোড়াছিলো শ্রাবনকে। নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না। তাঁকে সান্ত্বনা কিছুটা হলেও পূজারিণী দিতে পারবে। কিন্তু কতটা পারবে তা জানে না। ব্যর্থ ভাবে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করল।

_ “পারবি না! পারবি না! এভাবে কখনো কোন শিল্পীকে আটকানো যায়নি। আজও আটকানো যাবে না।”চিৎকার করে শ্রাবণ নিজেই নিজেকে কথাগুলো বলছে। পূজারিণী আবার সোফায় বসে পড়ল। সত্যি কি তার মধ্যে কিছু রয়েছে? শ্রাবন কি সঠিক কথা বলছে? তার মধ্যে সম্ভবত কিছুই নেই। শ্রাবণ ভুল বুঝেছে। তাইতো বারবার তার নাম সব জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলে সবাই। আমার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে শুরু করে পূজারিণী। তখন রাগে ফোঁপাচ্ছে শ্রাবণ।

কিছু একটা ভেবে শ্রাবণ দ্রুত গতিতে হুইলচেয়ার গড়িয়ে পূজারিনীর কাছে আসলো। তারপর উচ্চ স্বরে বলল, “তোমাকে একবার অনির্বাণ রশিদ দিয়েছিল। ওই রশিদ তোমার কাছে আছে?”পূজারিণী ভাবতে থাকলো পুরনো দিনের কথা। খুব ভালোভাবে মনে আছে ওই রশিদের কথা। কিন্তু এত দিনে তা কি আদৌ আছে? শ্রাবন যে ভাবে রেগে রয়েছে তাতে না বলা ঠিক হবে না। পূজারিণী মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।

_ “এক্ষুনি ওই রশিদ আমার কাছে নিয়ে আসো।”
মহা বিপদে পড়ল পূজারিণী। প্রায় আড়াই বছরের আগের কাগজ তার কাছে থাকবে কি করে? আর সেটা কোনো দামি কাগজ ছিল না। সামান্য একটা কাগজ। তার কাছে কাগজ রেখে কোনো লাভ নেই। পূজারিণী আমতা আমতা করে বলল, “কিন্তু ওই কাগজ এতদিন আমার কাছে কি করে থাকবে? সম্ভবত হারিয়ে গেছে……”

_ _ “চুপ! কোন কথা শুনতে চাইনা। ওই রশিদ আমার এখনি চাই। তুমি গিয়ে খোঁজো।”শ্রাবণের উচ্চস্বর পূজারিণীর কন্ঠ শুকিয়ে দিল। সে আবার আগের মতো ভয় পেতে শুরু করেছে। শ্রাবনকে এর আগে কখনো এতটা উত্তেজিত এবং ভয়ঙ্কর হতে দেখেনি। এই প্রথম দেখছে সে। এই অবস্থায় তাকে সান্তনা দিতে পারে কেবল বর্ষা। কিন্তু বর্ষা কয়েক ঘণ্টার আগে অফিসে চলে গেছে। পূজারিণী ছুট্টে চলে গেল রুমে। পুরনো কাগজ খুঁজতে থাকলো।

ছেলের ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এলো অনন্যা দেবী। তিনিও ছেলের এমন রূপ কখনো দেখেননি। কিন্তু মাকে দেখে শ্রাবণের ভয়ঙ্কর রূপ কোথায় হারিয়ে গেল। সমুদ্রের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে যেমন জল হু হু করে বেরিয়ে আসে, তেমনি শ্রাবণের চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসছে। মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহসও তার নেই। সে যে প্রতিবন্ধী। উঠে দাঁড়াতে পারে না। শুধু মায়ের দিকে দু হাত বাড়িয়ে রাখলো। শ্রাবণ বরাবরই কঠোর এবং গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ।

যে মানুষ এত যন্ত্রণা পাওয়ার পরেও কান্না করে নি, সে আজ কান্না করছে। এটা কি কল্পনা করা যায়। বুকের ভেতর নিশ্চয়ই ভয়ংকর আঘাত পেয়েছে। ভয়ংকর আঘাত ছাড়া শ্রাবনকে কেউ কখনো কান্না করাতে পারে না। অনন্যা দেবী ছুটে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। শ্রাবণ তখনো কান্না করে চলেছে। কান্না করতে করতে বলল, “মা আমি হেরে গেলাম। তোমার ছেলে একটা লুজার। পারলাম না স্বপ্ন পূরণ করতে। স্বপ্নে শুধু দেখেই গেলাম…”আর কথা বলতে পারলো না শ্রাবণ। অনন্যা দেবী প্রাণভরে ছেলেকে সান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু শ্রাবণ শুনছে না। কি করে শুনবে? জীবনের এত ব্যর্থতা কেউ কখনো হয়ত মেনে নিতে পারেনি।

ব্যর্থতারও লিমিট থাকা দরকার। সেটা যেন আজ ক্রস করে গেছে। পূজারিণী অনেক কাগজ নেড়েচেড়ে দেখার পর, রশিদ টা শেষ পর্যন্ত পেল। রশিদ পিয়ে শ্রাবণ সেখান থাকা একটা নাম্বারে বারবার কল করতে শুরু করলো। কিন্তু পূজারিণী শ্রাবনকে দেখছে। শ্রাবণের দুচোখের জল আরো বেশি সৌন্দর্য করে তুলেছে। ছেলেরা কান্না করলে একটু বেশিই কিউট লাগে। তাই হয়তো কেউ কেউ বলে, ছেলেদের কান্না করতে নেই। পূজারিণী মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে।

একটা মানুষ তখনই কাঁদে যখন সে জীবনে ব্যর্থ হয় অথবা প্রিয় মানুষ হারিয়ে যায়। তাহলে শ্রাবণ কান্না করছে কেন?সে তো ব্যর্থ হয়নি। ব্যর্থ হয়েছে পূজারিণী। তবে শ্রাবণ কি পূজারিণীকে ভালোবাসে?তাই ভালোবাসার মানুষের ব্যর্থতা মেনে নিতে পারছে না। এত কষ্টের মধ্যেও পূজারিনির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। ওই মানুষটা যদি তাকে ভালোবাসে তাহলে মন্দ হয় না। উনাকে বেশ ভালই লাগে পূজারিনীর। আর যাই হোক অন্তত খাঁটি ভালোবাসা কাকে বলে সেটা সে জানতে পরবে।

এতদিন এই বাড়িতে থাকার পর, এখান থেকে যাওয়ার ইচ্ছা টাও দমে গেছে। দশ_ বারো বার কল করার পর বিপরীত দিক থেকে কল ধরল অনির্বাণ। তার কণ্ঠস্বরে অট্টহাসি এবং বিদ্রুপ। তার ভয়ংকর অট্টহাসি বুঝিয়ে দেয়, ইচ্ছে করে পূজারিণীর নাম সরিয়েছে সে। রিয়্যালিটি শোতে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছে অনির্বাণ।

_ “কি বন্ধু! তোমার ওই মেয়ে নাকি সংগীতশিল্পী হবে। সাধারণ একটা রিয়েলিটি শোতে নিজের নাম তুলতে পারল না। আর সে হবে সংগীতশিল্পী? সঙ্গীতশিল্পীর মানে বোঝো?”খুব স্পষ্ট ভাবে অনির্বাণের কণ্ঠস্বর তিনজনের কানে ভেসে আসলো। শ্রাবনের চোখ থেকে আবার জল গড়িয়ে পরলো। তবে পূজারিণী নিজেকে শক্ত করতে থাকলো। অনির্বাণের কথাগুলো সে মন থেকে নিল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল এর যোগ্য জবাব একদিন ঠিক দেবে। ছেলেকে এইভাবে অপমান করতে দেখে অনন্যা দেবী চুপচাপ বসে পড়লেন।

তিনি কিছু বলতে পারছেন না। শ্রাবনকে বললেও শুনবে না। শ্রাবণ তখনো আকুতি_ মিনতি করে বলল, “প্লিজ ভাই, এমন করিস না। আমি জানি তোরা ইচ্ছে করে পূজারিনীর নাম সরিয়ে দিয়েছিস। চাইলে আবার নাম যোগ করতে পারবি। এমন করিস না। ওকে অনেক কষ্ট করে তৈরি করেছি। এইভাবে শেষ হতে দিস না। ওকে নিজের হাত দিয়ে মেরেছে, দিনের_ পর_ দিন দোকানে গরুর মতো খাটিয়েছি। আজ সে যদি ব্যর্থ হয়ে যায় তাহলে আমার কিচ্ছু হবে না। কিন্তু মেয়েটা বড্ড কষ্ট পাবে। এত লড়াইয়ের পর কে হেরে যেতে চায় বল? ওর বাবা_ মার সামনে আমি কখনো মুখ দেখাতে পারবো না।”শ্রাবণের আকুতি_ মিনতি ভালই লাগলো অনির্বাণের। খুব মজা পাচ্ছে সে। এমনটাই চাইছিল।

কিছুক্ষণ ঠাট্টা করার পর অনির্বাণ বলল, “শ্রাবণ, আমি ইচ্ছে করে নাম সরিয়ে ফেলব কেন? আমিও সমাজে একজন দায়িত্বশীল মানুষ। সমাজে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিভাশীল মানুষগুলোকে উচ্চপদে নিয়ে আসাই আমার কর্তব্য। ও গান পারে না। তার আরো শেখা প্রয়োজন। তুই তাকে আরো ভালো করে গান শেখা। সামনে বছর হয়তো চান্স পেতে পারে।”

পূজারিণী সোফায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। তাকে যে এইভাবে অবহেলার শিকার হতে হবে সে কখনো ভাবেনি। সে নিজেও জানে অনেক ভালো গান গায়। সবচাইতে বড় কথা হলো, যাদের নাম সিলেক্ট হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই গানের অনেক অনেক কিছুই অজানা। সেখানে পূজারিণী খুব পারদর্শী। পূজারিনীর আরো বেশি কষ্ট হচ্ছিল শ্রাবণের আকুতি_ মিনতিতে। একটা মানুষ কতটা নিচে নিভে গেছে শুধুমাত্র পরের একটা মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য।

এমন মানুষ আজ খুবই বিরল। কিন্তু এত আকুতি_ মিনতি অনির্বাণের পাষাণ হৃদয় গলাতে পারল না। শ্রাবণ বুঝতে পারল অনির্বাণ আকুতি_ মিনতিতে কমবে না। যে যেমন মানুষ তার জন্য তেমন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। শ্রাবণ তার যোগ্য জবাব দিল। সে উচ্চ স্বরে বলল, “আমি শ্রাবণ চৌধুরী, হার নয় আমার জীবনসঙ্গী। ঘুরে দাঁড়াতে জানি বস।”

_ “আচ্ছা জোকস শুনিয়ে দিলে আমায়।”
_ “কোনটা জোকস কোনটা বাণী বলবে তা সময় খানি।”
অনির্বাণ আর শ্রাবণ বেশ খানিকটা জোকস নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। পূজারিণী বেশ হাসি পাচ্ছিল শ্রাবণের জোকস গুলো শুনে। সব সময় অভদ্র ভাষায় নয়, কখনো কখনো ভদ্র ভাষায়ও খুব ভালোভাবে গালি দেওয়া যায়। সেটাই করছিল শ্রাবণ।

সম্পর্ক এমন হওয়া উচিত, অনেক বছর পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হলে বলবে, কিরে তোরা আজও একসাথে আছিস? তাদের খাঁটি বন্ধুত্ব সম্পর্ক আজও অটুট। অভিজিৎ বাবু প্রথমের দিকে উৎপলকে মেনে না নিলেও পরে মেনে নিয়েছে। তাকে মেনে নেওয়াতে কোন অসুবিধা ছিলো না। কিন্তু উৎপল উনার নামে বলা খারাপ কথাগুলো প্রথমে মেনে নিতে পারেনি। আপাতত ভাবে এখন তারা সবাই একসাথে রয়েছে। এই দু বছরে নতুন কোন খুনের ঘটনা ঘটেনি। কেস আবার চাপা পড়তে চলেছে।

_ “আচ্ছা স্যার একটা কথা বলুন তো! ওরা সারাদিন কোন বিষয় নিয়ে এত কথা বলে?”অভিজিৎ এর কানে ফিসফিস করে বলল অভিক। অভিকের কথা শুনে অভিজিৎ মৃদু হাসলো। প্রেম করার জন্য আবার কি কথা বলবে, সেটা কি ভাবতে হয়। হাজার হাজার কথা জমে থাকে। বরং প্রেম করার পর কথা বলার সময় পায় না অনেক প্রেমিক_ প্রেমিকা। অভিজিৎ বাবু একটু মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “আপনি কখনো প্রেম করেছেন?”

_ ‘না।”
_ “তাহলে করুন একবার।”
_ “এই বয়সে প্রেম করবো? তোমার কাকিমা জানলে আমার আস্ত রাখবে না।”
_ “আমি কাকিমার সাথেই প্রেম করতে বলছি। অন্য কারোর সাথে নয়।”
_ “কি যে বলেন স্যার, কিছুই বুঝতে পারছি না। বউয়ের সাথে আবার প্রেম করবো কিভাবে?”

_ “বউয়ের সাথেও প্রেম করাও যায় অভিক বাবু। প্রেমের অনেক ধাপ, অনেক ভাগ রয়েছে। সেগুলো জানলে প্রেম বউয়ের সাথেও হয়।”
অভিক আরো কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু হলো না। এরপরে যে ডান্স করবে, সে আর কেউ নয়; সে দুর্গা। মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট ওর নাম ঘোষণা হল। কলকাতা পুলিশের বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রক্ষায় একটা ছোট্ট আয়োজন। এখানে প্রায় সবাই উপস্থিত রয়েছে। অভিজিৎ বাবু নিজের বোনকে ও অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছিলেন।

কিন্তু তিনি জানতেন না, তার বোন এখানে এসেও উৎপলে সাথে কথা জুড়ে দেবে। উৎপল আর ঋতু পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে গল্প করছে। অনুষ্ঠান যে আদৌ দেখছে না তাদের ঠোঁটের কোনে হাসি তাই বলছে। দুর্গা ছোটবেলা থেকে নাচ শিখেছে। তার পেশা যদি পুলিশ হয়, তাহলে তার নেশা নাচ। ভালো নাচ করতে পারে। সুযোগ পেলে কখনো হাতছাড়া করে না। আজ সে নাচে পার্টিসিপেট করেছে। দু’চোখ ভরে দেখছে অভিজিৎ বাবু। দুর্গার নাচ দেখে অভিজিৎ বাবুর সমস্ত স্বপ্ন বুকে এসে উঁকি দিচ্ছে।

আনন্দের সীমানা হারিয়ে গেছে। দুর্গার নাচ যতটা না মুগ্ধ করেছে তার চাইতে বেশি মুগ্ধ করেছে তার রূপ। একজন প্রকৃত প্রেমিক পারে তার প্রেমিকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আর সবাইতো শারীরিক সৌন্দর্যই নজর দেবে। অপরূপ সুন্দরী সে। অভিজিৎ বাবুর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা দেখে অভিক খিল্লি করে বলল, “কি স্যার! আপনিও দেখছি আপনার বোনের মতো হয়ে গেলেন। কটা মাসের পর তো বিয়ে করবেন, এত দেখার কি আছে?”অভিজিৎ শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্লাসিকাল ডান্স, কথাটার মধ্যেই পবিত্রতা রয়েছে…”

_ “স্যার, আমিও যদি দুর্গার মতো ক্লাসিকাল ডান্স করি তাহলে আমার মধ্যেও আপনি পবিত্রতা খুঁজে পাবেন।”মুখ পেঁচিয়ে কথাগুলো বলল অভিক।
_ “অভিক, তুমি না সত্যি।”

দুর্গার নাচ করার পর আবার তাদের কাছে ফিরে আসলো। আরো বেশ খানিকক্ষণ অনুষ্ঠান চলল। অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তে অভিজিৎ বাবুকে একটি ছোট্ট পুরস্কার পুরস্কৃত করা হলো। এবং উনাকে কিছু বলার জন্য আমন্ত্রণ করলেন স্টেজে। এতক্ষণে ঋতু আর উৎপলের হুশ ফিরল। অভিজিৎ বাবু কখনো ভাবতে পারেনি, উনাকে অনুষ্ঠানে উনার মূল্যবান বক্তব্য সবার সামনে তুলে ধরতে বলবেন। তিনি খুশিমনে হাঁটতে শুরু করল। উনার বন্ধুরা ও খুশি। অভিজিৎ বাবু সবাইকে শ্রদ্ধা ভক্তি নিবেদন করে বলতে শুরু করলেন।

“এখানে উপস্থিত শুধু কলকাতা পুলিশ নেই, রয়েছে সাধারণ মানুষ। তাদের উদ্দেশে কয়েকটা কথা বলতে চাই। শহরে কোথাও কোন ক্রাইম হলে আমরা সবার প্রথম পুলিশের ওপর তার দায় চাপিয়ে দি। ভাবতে থাকেন ক্রাইমের জন্য দায়ী পুলিশ। পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে ক্রাইম নির্মূল করতে। হ্যাঁ সত্যি এর জন্য দায়ী পুলিশ। অনেক পুলিশ রয়েছে যারা টাকার জন্য শুধুমাত্র কাজ করে। তার পাশাপাশি রয়েছে অনেক ভালো পুলিশ। কিন্তু তার পাশাপাশি সামান্য হলেও আপনারাও দায়ী।

আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ছোট্ট ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। আমার বয়স তখন খুব কম। বাবা_ মার সাথে ছত্রিশগড় গেছি। তখন বহু মানুষ বর্ণবৈষম্যের শিকার হতো। আমি বাসে বসে জানালার পাশ দিয়ে দেখছি। একজন ভদ্র মানুষ, সাধারণ এক বাঙালি কুলিকে লাথি মেরে ফেলে দিতে। হয়তো কুলির দোষ থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তাকে ওই ভাবে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া কি উচিত ছিল?”

সমস্ত দর্শক হই হই করে উঠলো। তারা ‘না’ বলে চিৎকার করলো। তাদের কণ্ঠস্বর থামতেই অভিজিৎ বাবু আবার বলতে লাগলেন, “কিন্তু কেউ আসেনি। সবাই দাঁড়িয়ে বরং মজা নিচ্ছিল। তারা কুলিকে দেখে হাসাহাসি করছে। সবচাইতে অবাক করার বিষয় কি ছিলেন জানেন, সেখানে অনেক বাঙালি দাঁড়িয়েছিল। আমার কানে স্পষ্ট ভাবে বাংলা ভাষা ভেসে আসতে শুনেছি। কিন্তু কেউ একবারের জন্য প্রতিবাদ করেনি। সবাই পুলিশকে ডাকতে শুরু করে। আমাদের কাছে প্রতিদিন ছোটখাটো অনেক কেস আসে।

কিন্তু তার মধ্যে অনেক কেস থাকে যেগুলো কোনো মাথামুণ্ডু থাকে না। হয়তো ছোট্ট একটা সরি বলে নিলে ওই কেসের সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু আপনারা করেন না। নিজেদের ইগো দেখান। আর পুলিশ তার পেছনে ছুটতে থাকে গাড়ি নিয়ে , একবার আসামির বাড়িতে, একবার কোর্টে। এর সমস্ত খরচ কখনো আমরা দি না। খরচ বহন করে সরকার। একবার ভেবে দেখুন তো সরকার কোথা থেকে টাকা পাবে? আপনাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আপনাদের পেছনে খরচ করে। সরকার আপনাদেরকে যতটা দিচ্ছে, ভাববেন সরকার আপনাদের কাছ থেকে ঠিক ততটা নিচ্ছে।”

অভিজিৎ বাবুর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর কান ঝাঁজালো হাতের তালি পরল।

পরপর আরো দুটো রিয়েলিটি শো তে নাম ক্যানসিল হয়ে যায় পূজারিণী। শ্রাবণ এখন পুরোটা ভেঙে পড়েছে। আনমনা হয়ে উঠেছে। যে মানুষ একসময় দুপুরে পূজারিণীকে খাওয়ার কথা বলতো। আজ সে না খেয়ে বসে রয়েছে। শ্রাবণ নামে মাত্রই দোকানে এসেছে। কোন কাজ করছে না। সমস্ত কাজই পূজারিণী করছে।

দুপুরের দিকে দোকানে খরিদ্দার প্রায় নেই বললেই চলে। পূজারিণী ঘুগনি আর পাউরুটি শ্রাবণের সামনে রেখে বলল, “খেয়ে নিন আপনি? না খেলে তো শরীর খারাপ করবে।”শ্রাবণ কোন কথা বলল না। আনমনা হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। পূজারিণী বারবার বলার পর শ্রাবণ খুব মৃদুভাবে বলল, “আমার কিছু ভালো লাগছে না। তুমি খেয়ে নাও।” পূজারিণী আর জোর করলো না। এইসময় শ্রাবনকে একা থাকতে দেওয়াই ভাল হবে।

একা থাকলে মনটা অনেক ফ্রেশ হয়ে যাবে। সেও খেলো না। গুছিয়ে রেখে দিল। তারপর শ্রাবণের উল্টো দিকে বসে উনাকে লক্ষ করতে লাগলো। মানুটার শরীর ক’দিনে কতটা ভেঙ্গে গেছে। এতটা দুর্বল হতে কখনো দেখেনি সে। যে মানুষ প্রতিবন্ধক হওয়া সত্ত্বেও নিজের ত্বকের সব সময় যত্ন নিত। নিজেকে গুছিয়ে রাখতো। আজ সে এলোমেলো। নিজেকে ছন্নছাড়া করে ফেলেছে। মৃদু বাতাস শ্রাবণের চুল গুলো উড়িয়ে দিল। হাসলে শ্রাবনকে বেশ লাগে।

কিন্তু গোমড়া মুখে আদৌ ভালো লাগছে না। পূজারিণী মাথায় নানা ধরনের ভাবনা জেগে উঠলো। আচ্ছা, এই মানুষটাকে যদি ভালোবাসি তাহলে কি অসুবিধা হবে? যদি ওকে বিয়ে করে, সংসার করি তাহলে কি মানুষটা তা মেনে নেবে না! নাকি উনি আমাকে আদৌ পছন্দ করে না? পছন্দ না করার মতো, কোন কারন কি আছে? শ্রাবণের কি কখনো ইচ্ছে করে না, বিয়ে হবে, ছেলে মেয়ে হবে, সংসার হবে। না কী ইচ্ছে থাকলেও সেগুলোকূ দমিয়ে রেখেছে।

ইচ্ছে গুলোকে নিজের হাতে শেষ করছে।
“আচ্ছা বর্ষা দিদি, তুমি কাউকে ভালবাসো না?”পূজারিণী মুখে এমন কথা শুনে বর্ষা আঁতকে উঠলো। এমন প্রশ্ন আজ পর্যন্ত তাকে কেউ করার সাহস পায়নি। পেলেও কেউ কখনো বলেনি। রোজ বিকেলে তারা দুজন বাড়ির ছাদে গিয়ে বসে। নানা ধরনের গল্প শোনায়। পূজারিণী শোনায় গ্রামের গল্প, আর বর্ষা শোনায় শহরের গল্প। একটু বিশমিত সুরে বর্ষা বলল, “হঠাৎ, এমন প্রশ্ন!”

_ “না এমনি বললাম। জাস্ট জানতে ইচ্ছে করলো।”পূজারিণী হাসিমুখে বলল। বর্ষা পূজারিণী দুটো গাল টিপে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ ভালোবাসি! একজনকে ভীষণ ভালোবাসি।”
_ “সিরিয়াসলি!”খুব আগ্রহের সাথে বলল পূজারিণী। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল ছেলেটার নাম কী? তাকে দেখেছে কিনা সে। সে কেমন দেখতে? এতসব প্রশ্ন শুনে বর্ষা একটু হেসে উঠলো। তারপর খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “সে আর কেউ নয়, সে হচ্ছে শ্রাবণ চৌধুরী।”

পূজারিণী সমস্ত আশা_ আকাঙ্ক্ষা জল ঢেলে দিলো বর্ষা। দাদাকে তো সবাই ভালবাসবে। এটা আবার এমন কী নতুন কথা। কি জানতে চাইল আর বর্ষা কি জানালো। পূজারিণী একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “ধ্যাত, শ্রাবণ তো তোমার দাদা। আমি বলছি প্রেমিক প্রেমিকার কথা।”পূজারিণীর কথাগুলো শুনতে বেশ ভালই লাগছিল বর্ষার। তবে বেশি পাত্তা না দেওয়াই ভালো। প্রেমিক প্রেমিকা নিয়ে বর্ষা কখনো ভাবে না। আর ভবিষ্যতেও ভাববে না। সে এক গাল হেসে বলল, “সবটা দিয়ে নিঃস্ব হয়ে ভালোবাসে যে জন, তারচেয়ে বড় আছে কি ভালোবাসার উদাহরণ। সেটা প্রেমিক_ প্রেমিকা হোক কিংবা ভাই বোন হোক; সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।


পর্ব ১৩

পূজারিণীর গ্রামে খুশির বন্যা বইছে। তাদের গ্রামের মেয়ে জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো তে গান গাইতে চলেছে। আনন্দ কৌতুহল দ্বিগুণ হয়েছে। কখনো ভাবতে পারেনি তাদের গ্রামের মেয়ে এত বড় একটা জায়গায় পৌঁছাবে। তাদের কটু কথার যোগ্য জবাব একা একা পেয়ে যাবে। বর্ণালী দেবী আর অনিমেষ বাবু জীবনের সবচাইতে খুশির দিন আজ। সবারই চোখ টিভির সামনে। পূজারিণীর ধৈর্য শক্তি এবং শ্রাবণের আপ্রাণ চেষ্টা তাদেরকে আজ এই জায়গায় উপনীত করেছে।

একটা বছর ধরে তারা অপেক্ষা করেছে। ব্যর্থতা স্বীকার করে গ্রামে ফিরে আসেনি। সাফল্য একটা ছোট্ট শব্দ। লেখাও খুব সহজ। কিন্তু তাকে অর্জন করা বড্ড কঠিন। সেই কঠিন কাজ সহজ করতে চলেছে পূজারিণী। জীবনে কোন কালো মেঘ তাকে আটকে রাখতে পারেনি। তাকে বারবার ব্যর্থতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে কিন্তু তাকে মেনে নেয় নি। ব্যর্থতা ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। জীবনে বারবার ব্যর্থতা আসবে। ব্যর্থতাকে ভয় পেলে হবে না।

সেখান থেকে পালিয়ে গেলেও চলবে না। তাকে প্রতিহত করতে শিখতে হবে। তবেই জীবনে সাফল্য আসবে। আর যে মানুষ ব্যর্থতা স্বীকার করে নেবে, তার হয়তো জীবন থাকবে কিন্তু জীবনের মধ্যে সে থাকবে না। আজ সাফল্য এসেছে বলে কাল ব্যর্থতা যে আসবে না তা ভাবা ভুল। ব্যর্থতা আবার আসবে। তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
এই একটা বছরে শ্রাবণ পূজারিণীকে নতুন কোন গানের অনুষ্ঠানে নামায়নি। অনেক শর্টফিল্ম এবং অ্যালবাম সং এ পূজারিণীকে গান গাওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করে। পূজারিণী রাজি থাকলেও শ্রাবণ না বলে দিত। শ্রাবণ চাইছিল, যারা পূজারিণী নাম সরিয়ে দিয়েছিল তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে।

তাদেরকে দেখিয়ে দিতে তাদের চেয়েও কোন অংশে কম নয় সে। সেও পারে তার প্রতিভাকে সবার সামনে তুলে ধরতে। কারোর দয়ায় সে বড় হয়নি। নিজে খেটে, নিজে রোজগার করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করছে। তার স্বপ্ন কেউ পূরণ করে দেয় নি। নিজের স্বপ্ন নিজে পূরণ করার স্বাদ সম্পূর্ণ আলাদা। আর এই এক বছরে পূজারিণী সম্পূর্ণভাবে শ্রাবণের প্রেমে পড়ে গেছে। কিন্তু বলতে পারিনি। যতই হোক শ্রাবণ তার শিক্ষক।

কি করে বলবে তাকে ভালোবাসে? এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারে না। মানুষটা তার পাশে বসে থাকা একটা স্বপ্নের মত। প্রতিবন্ধী হওয়া সত্বেও কত কিছু জানে সে। তবে পূজারিণী তার ভালবাসাকে হারিয়ে যেতে দেবে না। যে মানুষটা কে ভালোবেসেছে একবার হলেও ওকে বলা উচিত। রিজেক্ট করে দিলে হাসিমুখে তার জীবন থেকে সরে যাবে। কিন্তু না বলে কখনো যাবে না সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, সে যখন একজন বড় সংগীতশিল্পী হবে তখন শ্রাবনকে বিয়ের কথা বলবে।

তখন নিশ্চয়ই শ্রাবণ না বলতে পারবে না। এই আশায় বেঁচে আছে সে। শ্রাবণের মায়ায় আরো বেশি করে আবদ্ধ হতে হবে। শ্রাবণকে তিনটা বছর নয় তিন হাজার বছর কাছে লাগবে ‌
টিভির সামনে বসে রয়েছে অনন্যা দেবী এবং শ্রাবণ। অনেক আগে পূজারিণীকে নিয়ে প্রোগ্রামে বেরিয়ে গেছে বর্ষা। শ্রাবণের দুটো চোখ ছল ছল করে ওঠেছে। কথা বলার ক্ষমতা যেন লোপ পেয়েছে, এই ঘটনার আকস্মিকতায়। তার সৃষ্টি আজ সবার সামনে প্রকাশিত হতে চলেছে।

একজন শিল্পীর সৃষ্টি যখন সবার সামনে প্রকাশিত হয় তার চাইতে শিল্পীর সুখের, আর কিছু মনে হয় নেই। প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার অনেক আগেই শ্রাবণের চোখে জল চলে এসেছে। এটা দুঃখের জল নয় এটা আনন্দের জল। পরিশ্রম বৃথা যায়নি। সেই আদিকাল থেকে কোন মানুষের পরিশ্রম বৃথা যায়নি আজও তা যাবে না। অনন্যা দেবীরও দুটো চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে। তিনিও ভীষণ খুশি। শ্রাবণের পাশে বসে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

সময়ের অপেক্ষা শেষ হল। অবশেষে টিভির মুখে ভেসে উঠলো পূজারিনীর মুখ। পরনে হলুদ রংয়ের চুরিদার। ছেড়ে রাখা বড়ো বড়ো চুলগুলো বাতাসে বারবার এলোমেলো হয়ে উঠছে। আনন্দ মধ্যেও কিছুটা ভয় পেয়ে রয়েছে তা স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে। সে সেই গ্রামের পূজারিণী, যে স্বপ্ন দেখেছিল গায়িকা হবে। আজ তা পূর্ণ হতে চলেছে। ভাগ্যিস সেদিন স্বপ্নটা ছেড়ে চলে যায় নি। চলে গেলে হয়তো আজ এই দিনটা দেখতে হতো না।

স্টেজের মধ্যে উঠেও পূজারিণী কাকে একটা খুঁজতে লাগলো। হ্যাঁ, শ্রাবণকে খুঁজছে। শ্রাবণই তার জীবনের মন্ত্র। তার ছায়া। উনি যদি এখানে থাকত তাহলে তার আরও বেশি ভালো লাগতো। ভয় পেত না। সাহসের সাথে এগিয়ে যেত। এত বড় বড় মানুষের সামনে সেও বসে হাত তালি দিয়ে বলতো সাব্বাস পূজারিণী!সাব্বাস! শ্রাবণ একটা বট গাছের মত আর সেই বটগাছের নিচে বসে থাকার ছোট্ট এক পথিক পূজারিণী।

শ্রাবণ ছাড়া পূজারিনির কোন অস্তিত্ব নেই। আজ এতদূর আসার পেছনে যদি কোনো মানুষের অবদান থাকে সেটা শুধু একজনের; শ্রাবণ চৌধুরী। জানে না, সে রিয়্যালিটি শো তে প্রথম হবে না দ্বিতীয় হবে। তবু এত দূরে পৌঁছেছে এটাই তার কাছে অনেক। একটা সময় পূজারিনীর গলা থেকে ভেসে আসলো সুমধুর কন্ঠের স্বর।
“ওহ! বান্ধবী, তোর হাতের লাল চুড়ি
আমার কানে বাজছে সুরকলি।

নগ্ন পায়ে ছুটে তোর চলা নূপুরের ধ্বনি
করছে আমায় পাগল বারংবার।
এই বুঝি তুই আছিস আমায় কাছাকাছি
তবু কেন বুঝিস না আমি তোকে ভালোবাসি।

রোজ বিকেলে আমার কোলে বসিয়ে
শোনাবো তোকে আমার কল্পনার গল্পতে।
ওহ! বান্ধবী, তোর হাতে লাল চুড়ি
আমার কানে বাজছে সুরকলি।

তোর হাতে হাত রেখে হাঁটবো আমি সারা বিকেলে
তোর পিঠে হেলান দিয়ে বসবো সারা সন্ধ্যাতে
শুনবো আমি তোর মুখে দুজনের প্রেমের কাহিনী।

ওহ! বান্ধবী, তোর লাজুক মুখে টিপ টিপ হাসি
আমায় ছুটে যেতে ইচ্ছে করে তোরই কাছাকাছি।
জানি তুইও বাসিস আমায় ভালো
মাঝখানের ছোট্ট ব্যবধান করছে এলোমেলো।

ওহ! বান্ধবী, আর দেরি নয়
এবার বলবো আমি তোমায় ভালোবাসি।
ওহ! বান্ধবী, তোর হাতের লাল চুড়ি
আমার কানে বাজতে সুরকলি।”

পূজারিণী গান গোটা বাংলার মানুষকে মুগ্ধ করল। শ্রাবণ জানতো পূজারিণী সাফল্য পাবে। কিন্তু এত কম সময়ে এত বড় সাফল্য সে ভাবতে পারে নি। বিশেষ করে গ্রামে গঞ্জে পূজারিণী নাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। দ্বিতীয় রাউন্ডের জন্য পূজারিণী সিলেক্ট হল। সামনের সপ্তাহের দ্বিতীয় রাউন্ড হবে। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে শ্রাবণ যেন কোথায় একটা ফিকে হতে শুরু করল। পূজারিণী সাফল্য পেছনে যে মানুষের অবদান রয়েছে। সে হারিয়ে যেতে বসেছে। শ্রাবণের এতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি।

সে কেবল পথ দেখিয়েছে আর ঐ পথে পূজারিণী গেছে। সে ভাঙ্গাচুরা পথ অতিক্রম করেনি, করেছে পূজারিণী। শ্রাবনের চাইতে পূজারিণী বেশি ক্রেডিট পাওয়া জরুরি। আর সে সেটাই পাচ্ছে। চৌধুরী পরিবার আবার আগের মত হয়ে উঠল। তাদের পরিবার ফিরে পেল আনন্দ_উচ্ছ্বাস। সন্ধ্যা মারা যাওয়ার পর এমন আনন্দ উচ্ছ্বাস কখনো হয়নি। পূজারিণীর জন্য আবার ফিরে পেল তাদের পরিবার আনন্দের মুহূর্ত।

পূজারিণী তো আনন্দে তর সইছে না। সারাদিন ফোনে বাবা মার, বান্ধবীদের সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত। কত অজানা কথা তাদের সাথে শেয়ার করছে। কত নতুন অনুভূতি জন্ম নিয়েছে, নিয়েছে কত নতুন অভিজ্ঞতা। সব শেয়ার করছে তার বাবা_ মার সাথে। সমস্ত রাউন্ড শেষ হওয়ার পর পূজারিণী গ্রামের বাড়ি যাবে। আর সঙ্গে করে পুরো চৌধুরী পরিবারকে নিয়ে যাবে। যার জন্য আজ তার সাফল্য। ওই পরিবার না থাকলে সে কখনো সাফল হতে পারত না। শুধু শ্রাবণ নয় তার সাফল্যের পেছনে রয়েছে বর্ষা। বর্ষা ও ওর জন্য অনেক কিছু করেছে। যা কখনো তার ঋণ শোধ করা যাবে না।

“ও মন পাখি, আয় না চলে আমার কাছাকাছি
আমি বসে আছি তোরই অপেক্ষায়
ও মন পাখি, আয় না চলে আমার স্বপ্ন হয়ে
সাজাবো তোকে রঙিন বেলুন দিয়ে।

কতশত মনের আশা
জেগে উঠেছে আজ ভালোবাসায়।
ছোট্ট একটা ঘর, সাজাবো কত রঙের বহর
তোকে নিয়ে যাব আমি নিরুদ্দেশে।
ও মন পাখি, আয় না চলে আমার কাছাকাছি
কত গল্প শোনাতে আছে বাকি।

আমি হতে চাই তোর, তুই কবে হবি আমার বল
ও নীল আকাশের পরী, তোকে ছাড়া শূন্য মানবী আমি।
ও মন পাখি, আয়না চলে আমার কাছাকাছি
আমি বসে আছি তোরই অপেক্ষায়….”

অবশেষে দ্বিতীয় রাউন্ড শেষ হলো। এখানেও উত্তীর্ণ হয়ে গেল পূজারিণী। পর পর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ , পঞ্চম সমস্ত রাউন্ডে পূর্ণ করল পূজারিণী। ফাইনাল রাউন্ডের জন্য মোট পনেরো জন সিলেক্ট হলো। এরমধ্যে পূজারিনীর প্রতিদ্বন্দী তেমন কেউ নেই বললে চলে। তবে দুজন দেবারতী এবং অঙ্কুশ খুব ভালো গান গেয়ে উঠে এসেছে। তাদের প্রতিভা আছে সেটা মানতেই হবে। সেটা শ্রাবণ নিজেও স্বীকার করেছে। সামনে রবিবার ফাইনাল রাউন্ড। পূজারিণীর প্র্যাকটিস দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল শ্রাবণ।

তবে তাকে তৃতীয় থেকে নীচে যে কেউ নামাতে পারবে না, সেটা খুব ভালোভাবে জানে শ্রাবণ। তবে লক্ষ প্রথম হওয়া। শ্রাবণ কথা দিল, ফাইনাল রাউন্ডে নিজে সেখানে উপস্থিত থাকবে।
বিকেলের অন্তিম সূর্যরশ্মি ক্লান্ত হয়ে পশ্চিমাকাশে বিলীন হতে চলেছে। সূর্যের শেষ রশ্মি জ্বলজ্বল করছে। সাথে রয়েছে শরৎ এর মৃদু ঠান্ডা বাতাস। বাতাসেও পুজো পুজো গন্ধ বইছে। কয়েকদিন পরই মহালয়া। শরৎ এর মধুর বাতাস গায়ে মেখে নিতে শহরে হাঁটতে বেরিয়েছে দুই ভাইবোন।

প্রথমে অভিজিৎ বাবু একা আসতে চাইছিল, কিন্তু বেরোনোর সময়ে ঋতু জোর করে তাকে নিয়ে আসার জন্য। বোনের রিকুয়েস্ট ফেলতে পারেননি। বোনকে নিয়ে বেরিয়ে পরে। কিছুটা হাঁটার পর তাদের সাথে যোগ হয় দুর্গা। দুর্গা প্রথমে ঋতুকে দেখে ঘাবড়ে যায়। অভিজিৎ বাবু দুর্গাকে ইশারা করে বুঝিয়ে বলে, সামলে নিতে নিজেকে। আসলে অভিজিৎ বাবু বেরিয়েছিল দুর্গার সাথে দেখা করতে। শেষ বিকেলে দুজন দুজনের পিঠে হেলান দিয়ে বসে, কিছু মধুর গল্প বলতে চাইছিল।

একই প্লেটে দুজন ফুচকা খেতে চাইছিল। দুজন হাতে হাত ধরে গোটা শহর ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু সমস্ত আশা নিমিষে শেষ করেছে ঋতু। যদিও সে জানতো না, দাদা দুর্গার সাথে দেখা করতে বেরিয়েছে। জানলে নিশ্চয়ই জেদ করত না আসার জন্য। দুর্গাও অজুহাত দেখিয়ে বলে, সেও তাদের মতো শহরে ঘুরতে বেরিয়ে ছিল, আর হঠাৎ তাদের সাথে দেখা হয়ে যায়। ঋতু আনমনা ভাবে কিছু ভাবছে, আর দুর্গা অভিজিৎ বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা করতে করতে তাদের মধ্যেও রিয়ালিটি শোর প্রসঙ্গ চলে আসে।

সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের মধ্যে এই কয়টা মাসে রিয়েলিটি শোর কথা ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। বিশেষ করে পূজারিণী এবং অঙ্কুশের গলার স্বর নজর কেড়েছে দুই বাংলার মানুষের। দুর্গার দাবি এই রিয়েলিটি শো তে প্রথম হবে অঙ্কুশ, আর অভিজিৎ এর দাবি এবারে প্রথম হবে পূজারিণী। দুজনের মধ্যে এই নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। দুজনের দাবিতে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে।

এমন সময় পেছন থেকে ঋতু এসে বলল, “আমার মনে হয় দুজনের মধ্যে কেউই প্রথম হবে না।”হঠাৎ ঋতুর মুখে এমন কথা শুনে দুজনেই রেগে যায়। কারণ বর্তমানে দুর্গার ফেভারেট সিঙ্গার হয়ে উঠেছে অঙ্কুশ আর অভিজিৎ এর পূজারিণী। তাদের ফেভারিট সিঙ্গার প্রথম হতে পারবে না এটা নিয়ে খারাপ লাগছে। অভিজিৎ বাবু একটু কর্কশ স্বরে বলল, “তাহলে কে প্রথম হবে?”

_ “দেবারতী।”
দেবারতীর নাম শুনে দুজনেই হেসে উঠলো। কোথায় অঙ্কুশ, পূজারিণী আর কোথায় দেবারতী? দুজনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। তবে ঋতুর কথা মোটেও নিন্দনীয় নয়। তার কথাতেও যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। সেই যুক্তি শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হল দুজন। এই রিয়েলিটি শোর মালিক ভরত সেনগুপ্ত। আর তারই মেয়ে দেবারতী সেনগুপ্ত। নিজের মেয়ে থাকতে অন্য কাউকে প্রথম হতে দেবে বলে, তার মনে হয় না।

যে কোনভাবেই হোক ওদের নাম ঠিক সরিয়ে ফেলবে। বর্তমানে প্রায় রিয়্যালিটি শোতে এমন ঘটনাই ঘটে। আসল প্রতিভা মানুষকে সরিয়ে নকল মানুষকে প্রথম করা হয়। সেটা যে পূজারিণী কিংবা অঙ্কুশের সাথে ঘটবে না তার কোন মানে নেই। দুর্গা ঋতুর কথা মেনে নিতে পারল না। সে বলল, “সমস্ত মানুষ খারাপ নয়। আজও কিছু মানুষ ভালো আছে। আমার বিশ্বাস, উনি এত বড় একটা রিয়েলিটি শোতে এমন নোংরামি করবে না। উনি যোগ্য শিল্পীকে সম্মানিত করবেন।”
_ ” সেটাতো সময় বলবে।”

অবশেষে রবিবার চলে আসলো। চৌধুরী পরিবার সকাল সকালেই পূজার আয়োজন করল। পুজোর একটাই উদ্দেশ্য ছিল পূজারিণী যেন প্রথম হতে পারে। তার স্বপ্ন সত্যি করতে পারে। এই কয়েকদিন শ্রাবণ পূজারিণীকে ভালোভাবে আগলে রেখেছে। এমনকি দোকানে পর্যন্ত যেতেও দেয়নি। কারো সাথে ভালোভাবে কথা বলতে দেয়নি। এতে গলার কন্ডিশন নষ্ট হতে পারে। রিয়েলিটি শোতে পূজারিণী যদি একবার প্রথম হতে পারে, তাহলে তাকে আর পিছনে ঘুরে তাকাতে হবে না। এগিয়ে যাবে বহু দূরে। নির্দিষ্ট সময়ে তারা পৌঁছে গেল। তবে শ্রাবনকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিল না।

প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম বাঁধা। বর্ষা প্রথম থেকে এসেছে তাছাড়া একজন সঙ্গীতশিল্পী সাথে একজন আসতেই পারে। সেই হিসেব অনুযায়ী বর্ষা আর পূজারিণী প্রবেশ করল। শ্রাবণ বাইরে বসে থাকল হুইলচেয়ারে। এর কোনো প্রতিবাদ করেনি কারণ প্রত্যেকটি প্রোগ্রামের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। আর সেই নিয়ম আগে থেকেই তারা জানিয়ে দিয়েছিল। সেখানে প্রতিবাদ করা বৃথা। পূজারিণী যখন ভেতরে প্রবেশ করছিল তখন একবার ঘুরে দেখে শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইশারা করে বললো ‘বেস্ট অফ লাক’। পূজারিণী হাত নাড়িয়ে টা টা করল।

পূজারিণী অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর ভেতরে কী ঘটেছে সবই‌ অজানা শ্রাবণের। একসময় শ্রাবণের নিজের লেখা গান তার কানে ভেসে আসলো। ভেসে আসলো পূজারিণীর আরো কয়েকটা গান।

“এই শ্রাবণে ভরা মরসুমে
রিমঝিম বৃষ্টিতে কত কথা
শোনাতে চাই তোমায় গোপনে
চারিদিকে থই থই জল
তারি মাঝে আমার এই গান
ভরিয়ে দেবে তোমার ওই হৃদয়
জানি তুমি আছো কাছাকাছি
তবু কেন এত লুকোচুরি….”

আপন_ মনে পূজারিনীর গান শুনছিল শ্রাবণ। হঠাৎ তার কাঁধে কেউ হাত চাপড়ে তাকে ডাকে। শ্রাবণ মুখখানা পাংশু করে পেছন ঘুরলো। চেনা মুখ অভিজিৎ বাবু। সাথে আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার। অভিজিৎ শ্রাবনকে দেখে মুখের হাসি ফুটে উঠল। শ্রাবণের বুঝতে অসুবিধা হয়নি অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে ওখানে। তাছাড়া এখানে উপস্থিত রয়েছে ভরত সেনগুপ্ত। তাই পুলিশ একটু বেশি রয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ অভিজিৎ বাবু আর শ্রাবণ এর মধ্যে কথা চলল। প্রায় তিরিশ মিনিট পর ধবধবে সাদা পোশাক পরিহিত একজন ভদ্র মানুষ স্টেজে আসলেন। উনি ভরত সেনগুপ্ত।

মাথায় ছোট ছোট চুল উপরের দিকে ছাঁটা। চাপ দাড়ি বেশ বড় করে রেখেছেন। বয়স হলেও বোঝার উপায় নেই। রিয়েলিটি শোর মালিকের পাশাপাশি তিনি নিজেও একজন সংগীতশিল্পী। প্রথমে তিনি সবাইকে সম্মান এবং শ্রদ্ধা জানিয়ে, নাম ঘোষণা করতে থাকলেন। শ্রাবণের চোখে ঘৃণা এবং আক্রোশে ভরে উঠলো। স্প্রিংয়ের মত ছিটকে উঠলেন অভিজিৎ বাবু। প্রথম অঙ্কুশ কিংবা পূজারিণী হয়নি, হয়েছে দেবারতী। এমনকি পাঁচ পর্যন্ত কোথাও নাম নেই অঙ্কুশ আর পূজারিণী। ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে অঙ্কুশ এবং সপ্তম স্থানে রয়েছে পূজারিণী।


পর্ব ১৪

পূজারিণী মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে, মুখে ভাবান্তর নেই। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ঘনঘন হাঁপাচ্ছে। না চাইতেও অজান্তে চোখে জল এসে গেছে। সে আজও ব্যর্থ। বর্ষার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বর্ষার কাছে কোনো ভাষা নেই। অস্পষ্টে কাতরে উঠলো। কাঁধে উত্তেজিত আঙ্গুলগুলো চেপে বসে রইল। বর্ষা খুব মৃদু স্বরে বলল, “কাঁদিস না সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এবার পারিসনি তো কি হয়েছে। পরেরবার নিশ্চয়ই পারবি।

“বর্ষার কণ্ঠস্বর তাকে আরো বেশি আঘাত করলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কান্নার বেগ যতই বাড়ছে আশেপাশের লোকগুলি দুজনের দিকে বারবার তাকিয়ে দেখছে। কেউ আবার সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ প্রশংসাও করছে। পূজারিণী যথেষ্ট ভালো গান গেয়েছে। অন্তত তার প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে থাকা আবশ্যক। নোংরামি করে তাকে সরিয়েছে। পূজারিণী কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “আমি পারলাম না শ্রাবনের স্বপ্ন পূরণ করতে। কত আশা নিয়ে উনি আমাকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন, আর আমি উনার একটা কথাও রাখতে পারিনি। আমি একজন ব্যর্থ মানুষ।”পূজারিণীকে এইভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেওয়া যাবে না।

তাকে শক্ত হতে হবে। বুঝতে হবে বারবার ব্যর্থ পর সফলতা আসে। একদিনে কখনো সফলতা আসা সম্ভব নয়। যে মানুষ যত ব্যর্থ হবে সে ততো বেশি শিখতে পারবে। পূজারিণীকে নিজের গা থেকে সরিয়ে হাসিমুখে বলল, “জানিস, অরিজিৎ সিং একটা রিয়্যালিটি শোতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেবার উনি ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে। আর ওই বছর যিনি ফার্স্ট হয়েছিল তার কথা এখন কেউ মনে রেখেছে? রাখেনি। কে ফাস্ট হয়েছিল আজ তার নাম সবার অজানা। কিন্তু অরিজিৎ সিং এখন কোথায় রয়েছে সেটা সবারই জানা। রিয়ালিটি শো আসলে কিছু নয়। নিজেকে পপুলার করা একটি অংশ মাত্র। ধৈর্য ধর দেখবি পারবি।

পারবি সফলতা আনতে।”পূজারিণী চুপচাপ রইল। বর্ষা পূজারিণীর দু চোখ বেয়ে আসা জল মুছতে থাকলো। পাগলি মেয়ে! সব সময় কান্না করতে হয়। কান্না করা মানে সবাই দুর্বল ভেবে নেয়। আর দুর্বল মানুষকে সবাই সব সময় আঘাত করতে ভালবাসে। বরং কষ্ট পেলেও বিপরীত মানুষকে কখনো বুঝতে দেওয়া উচিত নয়। বুকের মধ্যে শত কষ্ট লুকিয়ে রেখে, হাসি নিয়ে ফিরে আসা উচিত। এতে ওই মানুষটি বুঝতে পারবে, সে এত সহজে ভাঙ্গার মানুষ নয়। পৃথিবীর অভ্যন্তরের জমে থাকা লাভা কেবল ভূপৃষ্ঠের দুর্বল অংশ দিয়ে বের হয়, শক্ত অংশ দিয়ে নয়।

শ্রাবণ এখনো বাইরে বসে রয়েছে। আজ তার চোখের জল নেই। আগুনের মত দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে। তার চেহারা খুব ভয়ানক হয়ে উঠেছে। দুই চোখে ঘৃণা আর আক্রোশ। সেই সময় সে লক্ষ্য করে মিডিয়াকে। বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভরত সেনগুপ্ত, আর মিডিয়া নানা ধরনের কোশ্চেন করছে। খুব সূক্ষ্মভাবে উত্তর দিচ্ছেন তিনি। ন্যায় নীতির কথা বলছেন। উনার কাজ নাকি, প্রতিভাশীল নতুন শিল্পীদের সবার সামনে তুলে ধরা। সে দরিদ্র হোক কিংবা বড় বাড়ির সন্তান, সেটা ওদের কাছে ম্যাটার করে না। একজন শিল্পীর জন্য তারা সবকিছু করতে পারে। প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্যও। কিন্তু মিডিয়ার লোক উনাকে চেপে ধরল।

“বেশির ভাগ মানুষের দাবি, প্রথম পাঁচের মধ্যে অঙ্কুশ এবং পূজারিণী থাকার কথা কিন্তু তাদের নাম বাতিল কেন?”মিডিয়ার পাল্টা প্রশ্নে ভরত সেনগুপ্ত কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন। তখনই একটি ঘটনা ঘটে গেল। এত ভিড়ের মধ্যে শ্রাবণ নিজের পায়ের জুতো খুলে ভরত সেনগুপ্তর দিকে ছুঁড়ে মারলেন। জুতো পুরো ভারত সেনগুপ্তের মুখে গিয়ে পড়ে, আর পুরোটাই মিডিয়ার ক্যামেরায় চলে আসে।

তারপর চিৎকার করে বলতে লাগল, “পারবি না, এই ভাবে আটকে রাখতে পারবি না……” মুহুর্তের মধ্যে তুমুল হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। এত ভিড়ের মধ্যে শ্রাবণের কণ্ঠস্বর আর শোনা গেল না। ভরত সেনগুপ্ত রেগে আগুন। পরেরদিন খবরের কাগজে তার ছবি কিভাবে বেরোবে, সে ঠিকই বুঝতে পারছে। সামান্য একটা প্রোগ্রামে নিজের অর্জন করার সম্মান এইভাবে শেষ হতে দেবে না। ইচ্ছে করছিল, শ্রাবণের দুটো কলার ধরে গোটা দশেক থাপ্পড় লাগিয়ে দিতে।

কিন্তু পারছেন না। সামনে মিডিয়া রয়েছে। এতে নিজেরই সম্মান হানি ঘটবে। তিনি উত্তেজনায় হাত নেড়ে বকের মত গলা লম্বা করে পুলিশকে ডাকলেন। অভিজিৎ বাবু শ্রাবনকে সামলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। যতই হোক সে তার নিজের বন্ধু। শেষমেষ অভিজিৎ শ্রাবণের গালে থাপ্পড় মারে। কিছুটা হলেও শান্ত হয় শ্রাবণ। তাকে গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল। তখনই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। শ্রাবণের পায়ে থাকা আরেকটি জুতো ভরতের দিকে ছুঁড়ে মারে। এই দৃশ্য দেখে দুর্গা না হেসে পারে না। গ্রেফতার করলেও সে মনে মনে অনেক খুশি হয়েছে। ছেলেটার সাহস আছে মানতেই হবে। শ্রাবণের অন্যায় হয়তো তেমন কিছু নয়। কিন্তু ক্ষমতা ফলিয়ে তাকে শাস্তি দেবে, এটা নিশ্চিত দুর্গা।

পরেরদিন খবরের কাগজে র মূল বিষয়বস্তু হয়ে উঠল রিয়েলিটি শো। সাথে ভারত সেনগুপ্তর লজ্জাজনক অপমান। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই আঙ্গুল তুলে শ্রাবনের দিকে। সামান্য একটা প্রোগ্রাম নিয়ে এমন আচরণ করা তার মোটেও ঠিক হয় নি। শ্রাবণের যদি জাজদের প্রতি বিশ্বাস নেই, তাহলে কেন সে নিজের ছাত্রীকে ঐ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করিয়েছিল? কেউ তাকে জোর করেনি। বরং নিজেই জোর করেছিল। তারা যা ঠিক করে দিয়েছেন তা মানতে বাধ্য প্রত্যেকে, এবং সবাই মেনেও নিয়েছে।

তাহলে শ্রাবণের মানতে অসুবিধা কোথায়? প্রত্যেকের যুক্তির কাছে হারিয়ে যায় শ্রাবণের যুক্তি। শ্রাবণের এক মাস জেল হয়। বর্ষা অনেক চেষ্টা করেছিল শ্রাবনকে ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু পারেনি। অভিজিৎ বাবু, তিনিও তার কর্তব্যের প্রতি সচেতন থাকলেন। শ্রাবনের জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা করে দেননি। প্রত্যেক আসামিকে যেমন ভাবে থাকতে হয়, শ্রাবনকেও ঠিক একই ভাবে থাকতে হলো। রোজ বর্ষা দুবেলা শ্রাবনকে দেখতে আসতে থাকলো। তাতে অভিজিৎ বাবু না করতে পারেননি। নিয়ম মানা দরকার। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়মের চাইতে মনুষ্যত্ব দেখানো উচিত। এমন কোনো নিয়ম কখনো রক্ষা করা উচিত নয়, যেখানে মানুষের মধ্যে মানুষের দূরত্ব বেড়ে যায়।

হঠাৎই একদিন পূজারিণী ব্যাগ_ পত্র গুছিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য উদ্যত হল। তার এখানে আর ভালো লাগে না। তার মধ্যে কোন প্রতিভা নেই। শ্রাবণ চিনতে ভুল করেছে। না হলে অন্তত এতদিনে একটা ভালো জায়গায় পৌঁছে যেত। তার জন্যই শ্রাবনকে জেলে যেতে হয়েছে। শ্রাবণের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে সে। গ্রামে ফিরে যেতে চায়। তার সোনার গ্রামকে আপন করতে চায়। তাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে বর্ষা বুঝতে পেরে যায়, তার মধ্যে এখন কি চলছে। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল।
_ “ব্যাগপত্র রেখে খেতে আয়।”বর্ষা স্বাভাবিকভাবে বলল।

_ “আমি বাড়ি যাব। আমাকে ছেড়ে দিয়ে আসুন। আমার আর এখানে ভালো লাগছে না।”বর্ষা এবার পূজারিণীর কাছে গিয়ে বসলো। তারপর তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। এগিয়ে যেতে হবে। তোর বাবা মাকে কথা দিয়েছিলাম, তোকে বড়ো গায়িকা বানাবো। যতদিন না তুই বড় গায়িকা হচ্ছিস ততদিন গ্রামের বাড়ি যাবি না।”
_ “কিন্তু বাবা মা বারবার জানতে চায়। আমি তাদেরকে কি উত্তর দেব? বলব এত কিছুর পরও আমি ব্যর্থ হয়েছি। উনারা গ্রামের মানুষ, ব্যর্থ সাফল্য ততটা বোঝে না। তারা মেনে নিতে পারবে না।”কাঁদো কাঁদো গলায় পূজারিণী বলল। বর্ষা তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল , তুই ব্যর্থ হয়েছিস।

আরো অনেক বার ব্যর্থ হবি। তারপর সফলতা আসবে। সফল হতেই হবে। নাহলে পৃথিবীর নিয়ম বদলে যাবে। মানুষের পরিশ্রম কখনো বৃথা যায়নি, আজও যাবে না। পূজারিণী কিছুক্ষণ ভাবতে লাগল বর্ষার কথা। অনেক ভেবেচিন্তে সে বলল, “কিন্তু আমার জন্য শ্রাবনকে জেলে যেতে হলো। আমার খুব খারাপ লাগছে। তোমার ভাই বোনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটলো, শুধু আমার জন্য। দোষ না করেও উনি আজ বন্দী।”
_ “খারাপ আমারও লাগছে। দাদাভাইকে ছাড়া আমি কখনো একা থাকিনি। আজ থাকছি। বুকের মধ্যে কত যন্ত্রণা হচ্ছে তা বুঝিয়ে বলতে পারব না। সে অন্যায় করেছে অন্যায়ের শাস্তি পেতেই হবে।”
_ “অন্যায়!”

_ “হ্যাঁ, অন্যায় করেছে। কোন গুরুজন মানুষকে জুতো ছুঁড়ে দেওয়া ভদ্রতা দেখায় না। তাতে তার কাপুরুষকতা পরিচয় পাওয়া যায়। আমার বাবা সবসময় বলতো নিজের রাগ কন্ট্রোলে রাখতে। রাগ না দেখিয়ে খুব শান্তভাবে সমস্যার সমাধান করতে। আমি বাবার কথা রাখতে পারলেও দাদাভাই পারেনি।”
_ “কিন্তু!”

_ “কোন কিন্তু নয়। রাগ কখনো মানুষকে উপরের দিকে নিয়ে যায় না, নিচের দিকে ঠেলে দেয়। আমার বাবা_ মা সব সময় একটা গল্প বলতো..”
পূজারিণী কৌতূহল বেড়ে গেল। বর্ষা আজকাল খুব ভালো গল্প বলে শোনায়। সে গল্প শুনতে চাইলো। পূজারিণীর মাথায় হাত বোলিয়ে গল্প শোনালো বর্ষা। তবে একটা শর্তে। দ্বিতীয়বার যেনো, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা না ভাবে।

একবার একটা সাপ এক দোকানে প্রবেশ করে। দোকানের মধ্যে একটা কোদাল ছিল। সাপটি কোদালের ধারালো অংশে আঘাত করে। আর সাপ ভীষণ ভাবে আঘাত পায়, এবং কোদালের উপর ক্ষেপে ওঠে। সে প্রতিশোধ নিতে চায়। দ্বিতীয়বারের মতো কোদালের ধারালো অংশে আঘাত আনে। এতে সাপের আরো বেশি আঘাত লাগে। সমস্ত দাঁত ভেঙ্গে যায়। তখন নিজের রাগ কন্ট্রোল করে রাখতে পারল না সে‌। রাগ আরো বেড়ে যায়। সে কোদালের ধারালো অংশে নিজেকে পেঁচিয়ে ধরে কোদালকে শাস্তি দিতে চাইল। আর সে মারা যায়। যদি রাগ কন্ট্রোল করতে পারতো তাহলে মারা যেত না। মানুষ পশু পাখি সবার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। যে যত বেশি নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারবে সে তত বেশি সুরক্ষিত থাকবে। রাগ, অহংকার হল মানুষের পতনের কারণ।

শরৎকাল। শরৎ মানে, গোধূলি আকাশের রং এর খেলা। শরৎ মানে, অভিমানী মেঘের খেলা। জানালা খুললে দূরের আকাশে লাল রংয়ের হাতছানি। বিশাল আকাশের নিচে অকারণ পুলকে মন ছুঁয়ে মেঘের সাথে ভাবনাহীন লুকোচুরি। ইট পাথর যান্ত্রিক জীবনে আছে হাজারো ব্যস্ততা। তারপরও শহরের কোলাহল এড়িয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা কঠিন নয়। শরৎ এর মৃদু বাতাস গায়ে মেখে নিতে অনন্যা দেবী নিজের ছেলেকে নিয়ে বেরিয়েছেন।

প্রায়ই অনেক বছর পর তিনি বেরিয়েছেন। প্রায় পনেরো বছর আগে তিনি এমনভাবে তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে রোজ বিকেলে ঘুরতে বের হতেন। কিন্তু সময় বদলে গেছে। বদলে গেছে তাদের জীবনযাপন। শ্রাবণের মন ভীষণ খারাপ। মন যতই খারাপ হোক, প্রকৃতির সান্নিধ্যে সবাইকে উজাড় করে দেয়। তাইতো তিনি শ্রাবনকে নিয়ে বেরিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে ঘুরতে।

বাড়িতে পূজারিণী আর বর্ষা রয়েছে। পূজারিণী এখন নিজেকে অনেকটাই স্বাভাবিক করে নিয়েছে। নিজের ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে এখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে একটা মৃদু শব্দ করছে সে। তাকে শব্দ করতে দেখে বর্ষা বলল, “কি হল তোর? ওইভাবে শব্দ করছিস কেন?”পূজারিণী বালিশ থেকে মুখ তুললো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে রয়েছে। মুখ একটু বীভৎস টাইপের দেখাচ্ছে। একগাল হেসে বলল, “আমি শব্দ করছি না। আমি কান্না করছি।”

_ “ভালো, কিন্তু এইভাবে কেউ কান্না করে।”ভালো করে কান্না কর।”হাসিমুখে বর্ষা বলল। তারপর বিছানা ঠিক করতে থাকলো। পূজারিণী বর্ষার উপর রাগ করলো। সে কান্না করছে, আর তাকে না সামলে বর্ষা হাসছে। সে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি কান্না করছি, আর তুমি কিছু বলবে না। তুমি ওই ভাবে হাসবে?”বর্ষা এবার তার কাছে গিয়ে বসলো। তারপর বলল, “এইভাবে তো কেউ কান্না করে না। কান্না করলে তার চোখ থেকে জল পড়বে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে না তুই কান্না করছিস।”
_ “আমি কান্না করছি।”গম্ভীর কণ্ঠে বলল পূজারিণী।

_ “আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, এবার বল কান্না করছিস কেন?”
_ “আমি সমস্ত মেয়ের মত খারাপ হয়ে গেলাম বর্ষা দিদি। আমিও প্রেমে পড়ে গেছি।”কাঁদো কাঁদো গলায় বলল পূজারিণী। তবে তার মুখের অবস্থা দেখে বোঝা যায় না, সে আদৌ কান্না করছে। বরং ভীষণ আন্দোলিত এবং প্রফুল্ল সে। পূজারিণীর প্রেমে পড়া শুনে বর্ষার চমকে উঠলো।
_ “কী? সিরিয়াসলি?”আচমকাই হাসিমুখে বলে উঠলো বর্ষা।

_ “বাহ! এটা তো খুশির খবর। তাহলে কান্না করছিস কেন? আর ওই লাকী মানুষটা কে?”
_ “সত্যিই এটা খুশির খবর তো!”বিস্ময় প্রকাশ করে পূজারিণী বলল।
_ “হ্যাঁ রে বাবা। আগে বল তো ওই লাকী মানুষটা কে?”

_ “শ্রাবণ চৌধুরী।”দ্বিতীয়বারের মতো আশ্চর্য হল বর্ষা। তার সম্পূর্ণ ভাবনার বাইরে কথা বলল পূজারিণী। কখনো ভাবতে পারেনি তার দাদার প্রেমে কেউ পড়বে। আবার পূজারিনীর মতো একটা মেয়ে। যার ভবিষ্যতে ক্যারিয়ার উজ্জ্বল_ চকচকে। অবশেষে তাহলে তার দাদার একটা গতি হবে। এতদিন সে শ্রাবণের দায়িত্ব নিয়ে এসেছে। এবার দুই হাতে পূজারিণীকে দায়িত্ব নিতে হবে। আনন্দে চোখে জল চলে এলো। এলোমেলো কন্ঠে বলল, “সত্যি, তুই দাদাকে ভালবাসিস?”

_ “হ্যাঁ সত্যি!”বর্ষা ফোনটা তুলে নিল শ্রাবণকে কল করে সুখবর দেওয়ার জন্য। তখনই পূজারিণী তার কাছ থেকে মোবাইল ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “থাক তোমাকে বলতে হবে না। আমার নিজের মনের ফিলিংস নিজেই বলবো।”বর্ষা ভীষণ অবাক হলো। বয়সে ছোট হলে কি হবে, পূজারিণীর প্রেমের অভিজ্ঞতা বেশ ভালোই রয়েছে। নিজের মনের ফিলিংস নিজের মতো করে কেউ কখনো কাউকে বলতে পারবে না। তাই নিজে বলাটাই বেটার। এতে বিপরীত মানুষ যতই খারাপ ভাবুক না কেন, তাতে কোন অসুবিধা নেই। নিজের ফিলিংস কেবল নিজের কাছেই ফিলিংস লাগে, অন্যের কাছে তো গল্প হয়ে যায়।

“আচ্ছা একটা কথা অন্তত বল?”
বর্ষা খুব ধীর কন্ঠে পূজারিণীকে বলল। পূজারিণী জানতে চাইল কোন কথা?সে শ্রাবণের কি দেখে ভালবাসলো। সবচাইতে বড় কথা সে একজন প্রতিবন্ধী। এর আগে অনেক মেয়ে দেখানো হয়েছিল, কিন্তু সবাই রিজেক্ট করে দিয়েছে। আর সেখানে পূজারিনীর মতো এত অপরূপ মেয়ে, যার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। সেই প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে শ্রাবনকে। এটা কি সম্ভব? কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে সবই সম্ভব। বয়স, রূপ, ধর্ম এগুলো কোন কিছুই পাত্তা পায় না ভালোবাসার ক্ষেত্রে।

ভালোবাসা থেকে পৃথিবীর বৃহত্তম কোন শক্তি নেই। যতদিন ভালোবাসা আছে ততদিন মানব সভ্যতার কোন চিন্তা নেই। পূজারিণী একগাল হেসে বলল, “এ পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে। যাদের সাধারণেও অসাধারণ লাগে। আর সেই অসাধারণ মানুষটি হলো শ্রাবণ।”
বর্ষা হাঁ হয়ে শুধু পূজারিণীকে দেখছে। প্রেমে পড়লে মানুষ কবি, সাহিত্যিক হয়ে ওঠে।

পূজারিণী ও তাই হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কত হবে তার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে। কিন্তু পূজারিণী পরবর্তী কথা বর্ষার একদম পছন্দ হলো না। ওই কথার জন্য সে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। পূজারিণী জানতে চাইছিল, বর্ষার কোনো মনের মানুষ আছে কিনা? সে কবে বিয়ে করবে? তার উত্তরে বর্ষা বলল, তার একজনই মানুষ রয়েছে। আর ওকে বহু বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওকে তার ভীষণ প্রয়োজন। পূজারিণী আরও কিছু জানতে চাইছিল। কিন্তু বর্ষা বলল না। সে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পূজারিণী কিছুই বুঝতে পারলো না। বর্ষাকে যখনই প্রেম কিংবা বিয়ের কথা বলে। সে বারবার কথা এড়িয়ে যায়। কিন্তু কেনো?


পর্ব ১৫

রাত অনেক। কিছুতেই ঘুম আসছে না পূজারিণীর। বারবার ছটফট করে এপাশ ওপাশ ঘুরছে। শ্রাবণের মায়ায় আবদ্ধ সে। ইচ্ছে করছে তাকে একবার দেখতে। কিন্তু সম্ভব নয়। শ্রাবণের মুখখানা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। খুব মায়াবী একটা মুখ। শ্রাবণের কাছে একটা জাদু রয়েছে। সেই জাদু অতি সহজে বস করেছে পূজারিণীকে। আবার পূজারিনীর মাথায় আলফাল চিন্তাও ঘুরছে। শ্রাবনকে কি করে প্রপোজ করবে সে? সে যদি না বলে দেয়।

তাহলে কি হবে? তার সামনে আর যেতে পারবে না। তাকে গান শিখাতে নিয়ে এসেছিল। আর এখন ভালোবাসার কথা বলবে। সেটা কি সম্ভব? যদি সে রাগ করে। কথা বলা বন্ধ করে দেয়। থাক, প্রপোজ করার দরকার নেই। অন্তত প্রতিদিন তো দেখতে পাচ্ছে মানুষটিকে। পূজারিণীর ছটপটানিতে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল অনন্যা দেবীর। ভারী আশ্চর্য হলেন। এত রাত পর্যন্ত পূজারিণী জেগে রয়েছে! তিনি পূজারিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

এতে পূজারিণী ও চমকে উঠলো। তাহলে উনিও ঘুমানি! উনিও কি তার মতো প্রেমে পরল? ভেবে নিজেই হেসে উঠলো। আবার নিজের কপাল চাপড়ায়। কি সব আজেবাজে কথা ভাবছে। এই বয়সে উনি প্রেম করতে যাবে কেন। অন্য কোনো কারণ আছে হয়তো। কি বলে প্রথম কথা বলা শুরু করবে পূজারিণী ভাবতে পারছে না, তখনই অনন্যা দেবী ধীর কন্ঠে বললেন, “এখনো ঘুমোসনি?”পূজারিণী আমতা আমতা করতে লাগলো। কি উত্তর দেবে সে। উত্তর না পেয়ে অনন্যা দেবী আবার বললেন, “শরীর খারাপ করছে? গা তো গরম নেই!”

_ “আমার কিচ্ছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। আপনাকে আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, আপনি সঠিক উত্তর দেবেন?”এত রাতে পূজারিণী কি কথা জানতে চাইছে। উনাদের পরিবারে এমন কোনো গোপন কথা তো নেই। তাছাড়া সন্ধ্যার কোথাও ওকে সব জানিয়েছে। তার পরেও কি কথা জানতে চাইছে। একটু আশ্চর্য হলেও তা প্রকাশ করল না পূজারিনীর সামনে। হাসিমুখে পূজারিণীর কথা শুনতে চাইল।

_ “আপনি কখনো প্রেম করেছেন।”পূজারিণী কথা শুনে তিনি বাকরুদ্ধ হলেন। এই মেয়ের লজ্জা বলে কিছু নেই দেখছি। উনি উনার মায়ের সমবয়সি। মাকে জিজ্ঞেস করছে ছোটবেলায় প্রেম করেছে কিনা! আবার মাঝরাতে। খুব হাসিও পাচ্ছে। উনাকে হাসতে দেখে পূজারিণী বিরক্ত বোধ করলো। সে অনন্যা দেবীকে জড়িয়ে ধরে আবার বলল, “বলো না, প্রেম করেছ কিনা?”অনন্যা দেবী কি বলবেন খুঁজে পেলেন না।

এমনভাবে উনাকে সম্ভবত কেউ কখনও ভালবাসেনি। এমনভাবে সন্ধ্যা ভালোবেসেছিল, অনেক কথা জানতে জোর করতো। কিন্তু ভগবান তাকেই কেড়ে নিয়েছে। নিজের স্বামী থেকে শুরু করে ছেলে মেয়ে কখনোই মায়ের ভালো_ মন্দ জানতে চাইনি। মায়ের ছোটবেলা কেমন ছিল, তা একবারের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে নি। সবার চরিত্র সমান নয়। তাই হয়তো ওরা কখনোই জানতে চাইনি মায়ের ছোটবেলা। এতে অনন্যা দেবী খুব একটা কষ্ট পায়নি।

কারণ, ছেলেমেয়েরা মায়ের ছোটবেলার খোঁজ না নিলেও আদর_ যত্ন, ভালোবাসার কমতি ছিল না। তিনিও পূজারিণীর শরীরের ওপর একটা হাত রেখে হাসিমুখে বলল, “না, আমার জীবনে কোন প্রেম ছিল না। আমি কলেজে পড়াশুনা করতাম। তখনই বাবা একদিন বলে আমার বিয়ের কথা। খুব ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সমাজে দশটা মেয়ের চাইতে আমি পৃথক হব। কিন্তু বাবার মুখের উপর না বলতে পারিনি।

কিন্তু পরক্ষণে আরো বেশি অবাক হই, যখন জানতে পারি আমার সাথে যার বিয়ে হচ্ছে উনি আগে বিয়ে করেছেন, একটা মেয়েও আছে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। অনেক কেঁদেছিলাম। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারিনি। একসময় আমার বিয়ে হয়ে গেল। ভেবেছিলাম, আমার জীবনটা সেখানেই শেষ। অন্যর মেয়েকে বড় করতে হবে আমায়। ভালোবাসা মনে হয় আমার জীবনে নেই। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে উনি বড় গায়ক।

বাড়িতেও খুব কম থাকেন। কিন্তু এই বাড়িতে এসে আমার সমস্ত ভাবনার বদল ঘটলো। মনের মতন একটা মানুষ পেলাম। আদিত্য বাবু সব সময় বাড়ির বাইরে থাকতেন। একটু ভালোবাসার জন্য কত আবদার করতাম উনার কাছে। কিন্তু উনি সব সময় কাজের ব্যস্ততা দেখাতেন। তবে অভাব কি জিনিস কখনো বুঝতে দেয়নি। সারাদিন সন্ধ্যার সঙ্গে খেলাধুলা করে কাটিয়ে দিতাম। একসময় অপছন্দের মানুষগুলো পছন্দের হয়ে উঠল।

দুজনকে মন থেকে মেনে নিলাম। তারা হয়ে উঠল আমার আপন। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন সইল না। ভগবান আমার কাছ থেকে দু’জনকেই কেড়ে নিলেন।”কথাগুলো বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অনন্যা দেবী। পূজারিণী উনাকে সান্ত্বনা দিলেন। তারপর বলল, “ছাড়ুন তো। ওরা তো চলে গেছেন। মন খারাপ করে আর কি হবে! তারা তো আর ফিরে আসবেন না।”

_ “তবুও নিজের মেয়ে, স্বামী তো। খুব কষ্ট হয়।”
_ “আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর আমি আপনার বাড়িতে রয়েছি। কিন্তু কখনো দেখলাম না আপনাকে বাপের বাড়ি যেতে। উনাদের সাথে আপনার কিছু প্রবলেম রয়েছে বুঝি!”
অনন্যা দেবী হাসতে লাগল। তিনি এবার উঠে বসলেন। সাথে পূজারিণীও ওঠে বসলো। তারপর তিনি বললেন, “উনাদের সাথে আমার কোন ঝগড়া নেই। এক্সিডেন্টের পর শ্রাবণ প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। ওর দেখাশোনা করতে হয়।

একদিকে সংসারের হাল অন্যদিকে দুটো ছেলে মেয়ের দেখাশোনা করতে করতে কখন যে তাদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। সবাই বলে দূরত্ব ভালো জিনিস। দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না। দূরত্ব খুব খারাপ জিনিস। কে বলেছে দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়? দূরত্ব খারাপ জিনিস! মায়া কমিয়ে দেয়, ভালোবাসা কমিয়ে দেয়!যা বাকি থাকে তা হলো ফর্মালিটি!দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একসময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।”

উনি আর কিছু বললেন না। পূজারিণীকে ঘুমিয়ে পড়তে বলল। পূজারিণী শুয়ে পড়লো। সে খুব ভালোভাবে অনুভব করতে পারছে অনন্যা দেবী কান্না করছে। মেয়েদের জীবন কি আসলে এমন? সব সময় মানিয়ে নিতে হয়। সারাদিন হাসিখুশিতে থাকা মানুষটির ভিতরে কি চলছে কেউ কখনও ভেবে দেখেনি। উনার বুকের ভেতর পুড়ে ছারখার হয়ে রয়েছে। সে যদি এতগুলো প্রশ্ন না করত। তাহলে কখনোই জানতে পারত না উনার মনের কষ্ট।

আজীবন চাপা পড়ে থাকতো। নিজের কষ্টের কথা অন্যের সাথে শেয়ার করে নিজেকেও একটু হালকা মনে করলেন অনন্যা দেবী। কিছুক্ষণ পর তিনি আবার বললেন, “তুই এমন করিস না। যদি কাউকে ভালোবেসে থাকিস, তাহলে বলিস। নিজের ভালো নিজে বুঝে নিবি। অন্যের জন্য নিজেকে কখনো বিলিয়ে দিবি না। যতটুকু বিলিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন শুধু ওইটুকু দিবি।”পূজারিণী চুপচাপ। মন খুলে অনন্যা দেবী কথা শুনছে। একসময় সে বলল,

“আমাকে আপনার বাড়িতে রেখে দিন না সারা জীবন। এই বাড়ি ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি আপনার পুত্রবধূ হয়ে থেকে যাব।”মেঘ হীন আকাশে বাজ পড়ার মতো, অনন্যা দেবীর বুকটা কেঁপে উঠল। কী সব কথা বলছে পূজারিণী। উনি অনেকবার পূজারিণীকে পুত্রবধূর করার কথা ভেবেছেন। কিন্তু সাহস কুলায়নি তাকে বলার জন্য। সে ভবিষ্যতে একজন বড়ো গায়িকা। আজ ওই মেয়ে নিজে থেকে বলছে। সেটা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারছেন না। তিনি একটু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “সিরিয়াসলি! তুই শ্রাবনকে বিয়ে করতে চাস?”

_ “হ্যাঁ, ওকে আমি কতটা ভালোবাসি জানি না। তবে উনাকে না দেখে থাকতে পারি না। উনার শাসন আমার এখন ভালবাসায় পরিনত হয়েছে। তারপরে বর্ষার মতো ননদ আপনার মতন শাশুড়ি কে ছাড়তে চায় বলুন তো?”
অনন্যা দেবী হি হি করে হেসে উঠলেন।

অদ্ভুত মেয়ে! এখনো বিয়ে হয়নি। তাছাড়া শ্রাবণ রাজি কিনা তাও জানা নেই। আর সে শাশুড়ি ননদ ভাবতে শুরু করে দিয়েছে।
_ “আচ্ছা, আমি শ্রাবণের সাথে কালকে কথা বলে দেখব। যে কোনভাবেই হোক ওকে রাজি করাব দেখিস। একবার রাজি হয়ে যাক। দু’মাসের মধ্যেই তোদের বিয়ে দিয়ে দেব।”
_ “দুর!”একটু বিরক্ত প্রকাশ করে বলল পূজারিণী।

_ “কি হলো?”
_ “দুমাস কেন? দু’সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করে দিন না। জানেন, আমার সমস্ত বান্ধবীরা বিয়ে করে ফেলেছে। আর একা থাকতে ভালো লাগছে না। কত স্বপ্ন আমার। বিয়ে হবে, ছেলে হবে স্বামীকে নিয়ে ঘুরবো। একুশ বছর হয়ে গেল। আর কতদিন একা থাকবো?দিন দিন বয়স বেড়ে যাচ্ছে সে দিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে তাইনা।”
পূজারিণী মুখে সেই ভরাক্রান্ত আর নেই। মুখে ফুটে উঠেছে হাসির ঝলকানি।

সে খুব আনন্দিত এবং প্রফুল্ল। কল্পনায় যে কত স্বপ্ন দেখছে তা ভাবাটাই একটা কল্পনা। অনন্যা দেবীর ও খুব হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা বড্ড চঞ্চল আর মিষ্টি। কোন কথা গোপন রাখতে পারে না। আর এই বয়সে একটু আধটু এমন হয়। তিনি হাসিমুখে বললেন, “আমি তোর মায়ের সমবয়সী সম্পর্কে মাও হয়ে যাব কদিন পর। আর তুই একটুও লজ্জা পাচ্ছিস না। কি সব কথা বলে যাচ্ছিস?”

_ “মায়ের কাছে লজ্জা আবার কি? একটা মেয়ের ভালো বন্ধু কেবল একজন মাই হতে পারে। জানেন, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম। তখন সবার ভাই বোনকে দেখে আমার খুব কষ্ট হতো। ইচ্ছে হত আমারও যদি একটা ছোট্ট ভাই কিংবা বোন থাকতো, তাহলে মন্দ হতো না। বারবার কান্না করতাম। মাকে জিজ্ঞেস করতাম আমার ভাই কিংবা বোন হবে কবে? মা সবসময় কথা এড়িয়ে যেত। কিন্তু বেশিদিন যায় নি। মা একদিন আমাদের সব বুঝিয়ে বলল। উনাদের কিছু শারীরিক সমস্যার জন্য আর কখনো সন্তান নেওয়া সম্ভব নয়। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু আনন্দও হয়েছিল, মাকে ভালো বন্ধু হিসেবে পিয়ে।”

_ “কষ্ট পেতে হবে না। বর্ষার মতো একটা দিদিভাই পাচ্ছিস। এবার খুশিতো।”
_ “হ্যাঁ, ভীষণ খুশি।”পূজারিণী অনন্যা দেবীর গালে ছোট্ট একটা চুমু দিল। তারপর উনাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আর তোমার মত মিষ্টি একটা শাশুড়ি পিয়েছি। ও শাশুড়ি! শাশুড়ি গো।” কথাগুলো বলে পূজারিণী খিলখিল করে হেসে উঠলো সাথে অনন্যা দেবীও।

অবশেষে কপাল খুলে গেল পূজারিনীর। বাংলার বিখ্যাত ডিরেক্টার অন্তিম সেনগুপ্ত, তার একটা ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিলেন পূজারিণীকে। পূজারিণী সহ চৌধুরী পরিবার খুব খুশি। বর্ষা পূজারিণীকে স্টুডিওতে নিয়ে গেল। গান গাইলো এবং নির্দিষ্ট সময়ে গান রিলিজ করলো। পূজারিণী প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো সারা বাংলা। অনেকে পূজারিনীর অটোগ্রাফ নিতে শুরু করলো। নিজের স্বাক্ষর একদিনে অটোগ্রাফে পরিণত হবে সেটা কখনো ভাবেনি সে। সবকিছু সম্ভব হয়েছে শ্রাবণ এর জন্য।

শ্রাবণ একটা পৃথিবীত। আর সেই পৃথিবীতকে কখনো হারাতে চায় না পূজারিণী। যদিও তার ভালোবাসার কথা এখনো বলে উঠতে পারেনি। ভালোবাসা এখনো একতরফা রয়েছে। তবে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, একদিন ঠিক বলবে। অনন্যা দেবী শ্রাবনকে সবকিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু পূজারিণী বলতে দেয়নি। নিজের মনের কথা নিজেই জানাবে। নতুন ছবিতে গান গাওয়ার পরও পূজারিণীর মধ্যে কোন পরিবর্তন হলো না। তাকে আগের মতো এখনো দোকানে যেতে হয়।

ছোটখাটো গায়িকা হয়ে উঠেছে কিন্তু দারিদ্রতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যদিও দোকানে যেতে দ্বিধাবোধ করে না পূজারিণী। নিজেকে বড় কিছু ভাবে না। তার এই বিশেষ গুণ অনেক দূরে নিয়ে যাবে। আজকাল অনেক মানুষই সাকসেসফুল হওয়ার পর তারা ভুলে যায়, সে কোথা থেকে উঠে এসেছে। যেখান থেকে উঠে এসেছে, ধনী হয়ে যাওয়ার পর ওই সব মানুষকে ছোট করতে আজকাল কেউ দ্বিধাবোধ করে না। পূজারিণী মধ্যেও সেই ঘৃণা আসতে পারে। তাই শ্রাবণ তাকে এখনো বোঝায়। কতটুকু বোঝাতে পারে জানে না সে। পূজারিণী যথেষ্ট বড় হয়েছে। নিজের লাইফ_ স্টাইল নিজেই বিবেচনা করবে।

“এই কাগজ গুলো প্রিন্ট করে দিন একটু তাড়াতাড়ি।”বিপরীত মানুষটার কাছ থেকে কাগজ নিয়ে প্রিন্ট করতে শুরু করলো শ্রাবণ। এক বারের জন্যও চোখ মেলে দেখল না বিপরীত মানুষটি কে। দুর্গা কাগজ প্রিন্ট করতে দিয়ে দোকানের ভেতরে প্রবেশ করল। এক দুটো বই উল্টে পাল্টে দেখতে শুরু করলো। কাউকে কিছু না বলে দোকানে প্রবেশ করাটা অন্যায়। বই উল্টানোর শব্দ পেয়ে শ্রাবণের এবার হুশ ফিরল। সে তাকিয়ে দেখল দুর্গা গোটাকয়েক বই উল্টে পাল্টে দেখছে। অন্য কেউ হলে হয়তো কিছু বলতো। দুর্গাকে দেখে কিছু বলল না। দুর্গা তারই সমবয়সি। জেলে থাকাকালীন দুর্গা তাকে অনেক সাহায্য করেছে।

দুর্গা না থাকলে কারাগারে থাকা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত। দুচোখ মেলে শ্রাবণ দুর্গাকে দেখতে থাকলো। খুব মায়াবী চোখের অধিকারী দুর্গা। স্বাভাবিক পোশাকের থেকে পুলিশের পোশাকে দুর্গাকে বেশি সুন্দর দেখায়। এবং একটু বেশি স্মার্ট লাগে। প্রিন্ট করার পরও নিজের কাছে কিছুক্ষণ কাগজ রেখে দিল। দুচোখ ভরে দুর্গাকে দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। আরো অনেকক্ষণ দুর্গা থাকলে মন্দ হয় না। অবশেষে দুর্গা তার কাছে এসে কাগজ নিল।

শ্রাবণ কাগজের মূল্য নিতে চাইল না। কিন্তু দুর্গা মূল্য না দিয়ে ফিরবে না। বিজনেসের ক্ষেত্রে কোন বন্ধুর ছাড় নেই। বিজনেস ইজ বিজনেস। অবশেষে শ্রাবণ টাকা নিল। দুর্গা ফিরে যাচ্ছিল, তখনই কারোর একটা অনুপস্থিতি সে টের করতে পারল। একগাল হেসে বলল, “পূজারিণী কী আর দোকানে আসে না? না আসারই কথা। মেয়েটার যথেষ্ট নাম হয়ে গেছে। একজন গায়িকা দোকানের কর্মচারী হবে। সেটা মনে হয় তার ক্ষেত্রে মানায় না।”‘দুর্গার কথা শুনে শ্রাবণ হেসে উঠলো। নিজেই প্রশ্ন করল আবার নিজেই উত্তর দিল। শ্রাবণ বলল, “তেমন কিছু নয়। কয়েকদিন আগেই দোকানে এসেছে সে। ওর শরীরটা তেমন ভালো নেই। তাই আজ অনুপস্থিত।”

_ “ওও আচ্ছা। “বলে দুর্গা বেরিয়ে যাচ্ছিল। তখনই শ্রাবণ পেছন থেকে ডাকে। দোকানে থাকতে তার ভালো লাগছে না। একা কখনও থাকেনি। একাকীত্ব বোধ করছে। বর্ষার আসতে সন্ধে হয়ে যাবে। এতক্ষণ শ্রাবণের অপেক্ষা করতে ভাল লাগবে না। সে দুর্গাকে রাস্তা পার করে দেওয়ার জন্য বলল। বিপরীত সাইডে গিয়ে অনায়াসে ফুটপাতের ওপর দিয়ে হুইল চেয়ার গড়িয়ে গড়িয়ে বাড়ি চলে যেতে পারবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রাবণ দোকান বন্ধ করে দিল।

আর ওই সময় দুর্গা অপেক্ষা করল এবং শ্রাবনকে কিছুটা সাহায্য করল দোকান গোছানোর ক্ষেত্রে। শ্রাবনের কথামতো দুর্গা শ্রাবণের হুইলচেয়ার ধরে রাস্তা পার করে দিল। তারপর শ্রাবণ দুর্গাকে একটা ‘থ্যাঙ্কস’ জানিয়ে হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চলতে শুরু করল। দুটো চোখ রাঙ্গিয়ে দুর্গার দেখতে থাকলো। আবার আফসোসও হলো। মানুষটির সঙ্গে গেলে ভালো হতো। সে আর দেরি করলো না। পেছন থেকে শ্রাবনকে ডাকলো। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে যেতে দুর্গা ছুটে তার কাছে গেল। দুর্গাকে ছুটে আসতে দেখে ভারী আশ্চর্য হল শ্রাবণ। তারপর বলল, “কি হলো? আপনি এভাবে দৌড়ে এলেন কেন?”

_ “তেমন কিছু না। আপনি একা যেতে পারবেন? আগে এইভাবে একা কখনো গেছেন?”
_ “না, যায় নি। তবে যেতে পারবো।”
_ “আসলে আমার বাড়ির রাস্তা আপনার বাড়ির সামনে দিয়ে। বাড়িতে কিছু দরকারি কাজের জন্য দুপুরে ফিরে যাচ্ছি। চলো একসঙ্গে ফিরি।”
_ “কিন্তু আপনি এতটা রাস্তা হেঁটে যাবেন কেন? আমি একা যেতে পারব। আপনি ট্যাক্সি করে চলে যান। আমাকে রাস্তা পার করে দিয়েছেন এইটুকু অনেক।”কথাগুলো বলল শ্রাবণ।

_ “আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার যদি অসুবিধা থাকে আমার সাথে যেতে। তাহলে একা যান। জোর করব না।”শ্রাবণ আর না বলল না। দুর্গা তো তার সমবয়সী। একটু গল্প করে একসঙ্গে গেলে অসুবিধা কোথায়? অবশেষে দুর্গা শ্রাবণের হুইলচেয়ার ধরল। এগিয়ে যেতে থাকলো বাড়ির পথে। বেশ অনেকটা দূর যাওয়ার পর দুর্গা দুটো মালাই নিল। দুজন মালাই খাচ্ছে। দুজন দুজনের দিকে তাকাচ্ছে আর হেসে উঠছে। একটা আলাদা অনুভুতি একটা নতুন স্বাধীনতা।

শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালই লাগছে দুর্গা। এভাবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মন্দ হবে না। তবে অভিজিৎ বাবু দেখলে মন্দ হতে পারে। অভিজিৎ এর কথা ভেবে দুর্গা হেসে উঠলো। উনি এমন অবস্থায় দেখলে কি যে রিয়াক্ট করতেন, কেবল ভগবানই জানে। দুর্গা অজান্তেই হো হো করে হেসে উঠলো। শ্রাবণ জানতে চাইল তার হাসির কারণ কি? কিন্তু দুর্গা বলল না। গল্প করতে করতে তারা আবার এগিয়ে গেল বাড়ির পথে।

চলবে

লেখাঃ শুভজিৎ জানা (রাজা)

পাঠক আপনাদের জন্যই আমরা প্রতিনিয়ত লিখে থাকি। আপনাদের আনন্দ দেয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ। তাই এই পর্বের “শ্রাবণের বর্ষা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো পড়া শেষে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।

আরো পড়ুন – শ্রাবণের বর্ষা – ২য় খণ্ড

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *