হঠাৎ তুমি এলে (শেষ খণ্ড) – First love story bangla

হঠাৎ তুমি এলে (শেষ খণ্ড) – First love story bangla: নিঃসঙ্গতা একটা স্বার্থপরতা। তুলির চোখে আমাকে যে খুঁজে পাও বিশ্বাস করো অরন্য এটাই ভালোবাসা। তুলিকে নিয়ে সারাজীবন একসাথে থাকলেও তুলির চোখে তুমি আমাকেই দেখতে পারবে।


পর্ব ১৯

কারণ তোরা বলল,
~ আমি বিদেশে আসার আগের পনেরদিন তোর ব্যাপার টা নিয়ে ভেবে সব ঠিক করে রেখে এসেছিলাম। জানতে পারি তোকে যে ডাক্তার দেখানো হয় উনি করোনিক ভিলাস সেমপ্লিং টেস্ট করে।
এরকম টেস্টের নাম জীবনেও শোনি নি। তাই অবাক হয়ে তোরাকে জিজ্ঞেস করলাম
~ এটা কিসের টেস্ট তোরা? এ টেস্টের নাম আগে কখনও শুনি নি।

~ এটা হলো এমন একটা টেস্ট যে টেস্ট চার, পাঁচ মাসের গর্ভ অবস্থায় করলে বুঝা যায় যে বাচ্চা ছেলে নাকি মেয়ে। আর মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এ টেস্ট করানো হয়। তারপর মেয়ে বাচ্চা শনাক্ত হলে যারা প্রথম বাচ্চা মেয়ে চাই না তাদেরটা গর্ভপাত করে ফেলে দেওয়া হয়। এই যে আমরা নাইন লিখা নিয়ে একটা কনফিউশানে ছিলাম না? ঐ নাইন লিখাটারও কারণ উদঘাটন করতে পেরেছি।

আমি অস্থির হয়ে বললাম,
~ কিভাবে?

তোরা আমাকে শাত্ত্বণা দিয়ে বলল,
~ আরে অস্থিরতা কমা আগে।

আমি নিজেকে স্থির করে বললাম
~ এবার বল।

~ শুন প্রথমেই আমার সন্দেহ হয়েছিল এটা ভেবে যে তোকে আশে পাশের ডাক্তার রেখে কেন এত দূরে ডাক্তার দেখানো হচ্ছে। তোকে যে ডাক্তার দেখানো হচ্ছে এর আগের দুইটা রিপোর্ট ও ঐ ডাক্তারের ছিল। তাই ডাক্তারের ব্যাপারে গভীর ভাবে খুঁজ নিলাম জানতে পারলাম যারা মেয়ে বাচ্চা চাই না তারা এ টেস্ট করে শনাক্ত করে যে, বাচ্চা ছেলে হবে নাকি মেয়ে। যদি মেয়ে হয় তাহলে সেটা গর্ভপাতের মাধ্যমে নষ্ট করে ফেলে। আর এ কাজটা করা একদম বেআইনি তাই এ কাজটা করা হয় একদম গোপনে।

আমার প্রমাণের দরকার ছিল তাই আমার পরিচিত এক ভাইয়াকে পাঠলাম ঐ ডাক্তারের কাছে উনার স্ত্রী এর সদ্য পাঁচ মাসে পড়েছিল। উনি ভাবীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল
~ আপনি কি ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে এটা বলতে পারবেন? আমার প্রথম বাচ্চা ছেলে হোক এটা চাই। মেয়ে বাচ্চা আমি চাই না। যা টাকা লাগে দিব আমি। আমাকে একটু সাহায্য করুন।

মহিলা আমার ভাইকে আস্তে করে বলল,
~ এত জোরে জোরে বলছেন কেন? কেউ জানলে সমস্যা। আমি এখানে এসব কাজ করি না। আমার একটা নিজস্ব মেটারনিটি ক্লিনিক আছে কালকে সকালে আপনার স্ত্রী কে নিয়ে ঐখানে আসবেন। আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।

এ বলে মহিলাটা ঠিকানা দিল। আমার ভাই ঠিকানাটা নিয়ে পরদিন ঐ ক্লিনিকে গেল। সেখানে যাওয়ার পর ভাবীর টেস্ট করল এবং ভাবীর রিপোর্টে সিক্স লিখে দিল। ভাইয়া সিক্স লিখা দেখে জিজ্ঞেস করল
~এটা কি? এটা দিয়ে কি বুঝাচ্ছে আমি তো কিছুই বুঝছি না, আমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে।

সাথে সাথে উনি বলল,
~ শুনুন সিক্স টা দেখতে ইংরেজি কোন অক্ষরের মত সেটা আগে বলুন।
আমার ভাই ভেবে উত্তর দিল~
~ বি অক্ষরের মত।
~ বি মানে বয়। আপনার ছেলে সন্তান হবে। যান এবার মিষ্টি খান গিয়ে বাসায়।

ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে এসে আমাকে পুরো ঘটনা বলল। আমি তখন তুর্জের আগের স্ত্রী দের রিপোর্ট দেখে ভেবে দেখলাম নাইন অক্ষরটা ইংরেজি জি অক্ষরের মতো। তার অর্থ দাঁড়ায় জি মানে গার্ল। মানে মেয়ে বাচ্চা।
আমি বিস্মিত হয়ে তোরাকে জিজ্ঞেস করলাম~
~ কিন্তু এ ছেলে বাচ্চা আর মেয়ে বাচ্চা দিয়ে কি হবে?

~ তুই কি বোকা নাকি নিরা। তুর্জ আর তুর্জের মা চাই তাদের প্রথম সন্তান ছেলে হোক যার কারণে এসব টেস্ট করাচ্ছে। যদি শনাক্ত করতে পারে যে বাচ্চাটা মেয়ে বাচ্চা, তাহলে গর্ভপাত করিয়ে ফেলে। তবে এখানেও একটা কিন্তু থাকে।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
~ কি কিন্তু থাকে?

~ কিন্তু টা হচ্ছে গর্ভপাত করালে সব স্ত্রী দের মরার কথা না। আমার কাছে মনে হচ্ছে তোকে যেভাবে ভয় দেখানো হচ্ছে সেভাবে ভয় দেখিয়ে আগেই সবাইকে হতাশ করে ফেলে। প্রথম স্ত্রী এর মৃত্যু গর্ভপাতের এর কারণেই হয়। আর শুনেছি দ্বিতীয় স্ত্রী এর মৃত্যু এক্সিডেন্টে হয়েছে। আমার তো মনে হচ্ছে ওরাই এক্সিডেন্টটা করিয়েছে।

আমি তোরাকে থামিয়ে বললাম,
~ আর যাই করুক ওরা মানুষ মারতে পারে এটা বিশ্বাস হচ্ছে না তোরা।
~ পুরো ঘটনা আর প্রমাণ দেখলে তোরও একই কথা মনে হবে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
~ বল কি?

~ প্রথম স্ত্রী এর মৃত্যু হয়েছে গর্ভপাতের সময়। তবে প্রথম স্ত্রী এর নামে জীবন বীমা করা ছিল আর তার মৃত্যুর পর তারা মোটা অঙ্কের টাকা পায়। যেহুত তুর্জ তার স্ত্রী দের সাথে ভালো ব্যবহার করত তাই মেয়ে পক্ষের পরিবারের কেউ কোন অভিযোগ করতে পারে নি। আমার যা মনে হয় সেটা তোকে খুলে বলি তাহলে,
তুর্জের কাজ হচ্ছে অসহায় মেয়েগুলোকে খুঁজে বিয়ে করা। আর বিয়ের ব্যপারটা সে আর তার মা এমনভাবে এগিয়ে নিয়ে যায় কেউ তুর্জের পরিবারের খুঁজ নেওয়ার সুযোগ তেমন পায় না। তার উপর প্রথম স্ত্রী এর নামে জীবন বীমা করে।

তাকে জোর পূর্বক গর্ভপাত করানো হয়। আর এর আগের সময়টাতে তাকে বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখিয়ে হতাশ করে দেওয়া হয়। যার কারণে এরকম গর্ভপাতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে তুর্জের প্রথম স্ত্রী এর ক্ষেত্রে ও তাই হয়। বলা যায় পরোক্ষভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ফলে তার প্রথম স্ত্রী এর মৃত্যু ঘটে। আর তারা জীবন বীমার সত্তর লাখ টাকা পায়। সে কারণে প্রথম স্ত্রী এর মৃত্যুর পর তুর্জের পরিবারের আর্থিক অবস্থা হুট করে ভালো হয়ে যায়।

তারপর শুরু হয় তুর্জদের নতুন খেলা। দ্বিতীয় বউ এর নামে একটা ছোট খাট বীমা করে কারণ জানে বারবার জীমন বীমা করলে ধরা খাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। আর দ্বিতীয় বউকে এক্সিডেন্টের নাটক করে মেরে ফেলে। এর পিছনেও একটা পরোক্ষ কারণ হল দ্বিতীয় স্ত্রী এর পেটে মেয়ে বাচ্চা ছিল। তারা চাইত তুর্জের প্রথম বাচ্চা ছেলে হোক। বলা যায় মানসিক বিকার গ্রস্ত মানুষ ওরা।

তৃতীয় জনকে কিভাবে মেরেছে সেটা ধোঁয়াশায় আছে। বাড়িটাকে অভিশপ্ত প্রমাণ করে যাতে আশেপাশের কেউ তাদের সন্দেহ করতে না পারে। ঐ যে তোর গুষ্টিতে কার কয় সন্তান কে বড় কে ছোট কেন জিজ্ঞাস করেছিল জানিস?
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম~
~ কেন?

~ তাদের হয়ত ধারণা ছিল তোর আত্নীয়দের সবার যদি প্রথম বাচ্চা ছেলে হয় তাহলে তোরও হওয়ার সম্ভবনা বেশি। আর খেয়াল করে দেখ তোদের আত্নীয়দের সবার প্রথম বাচ্চা ছেলে। তার উপর অসহায় মেয়ে বিয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে সেসব মেয়েদের বিয়ের ব্যপারে পরিবাররা চিন্তিত থাকে বেশি আর তখন তুর্জের মত এমন ছেলে পেলে যে কেউ তেমন খুঁজ না নিয়েই বিয়ে দিয়ে দিবে। যেমনটা তোর বাবা, মা ও করেছে।
এখন তোর ও পাঁচমাস হবে কিছুদিনের মধ্যে আমার তো মনে হয় তোর সাথে এমন কিছু ঘটতে পারে। আমাকে একটু সবসময় খুঁজ খবর দিস। বাকি ব্যবস্থা আমি করতেছি। হাতে সবটা প্রমাণ আসুক।

তোরার কথাগুলো কোন অযৌক্তিক কথা ছিল না। সবকিছু শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ধুম করে কেঁদে ফেললাম। তোরা আমার কান্না শুনে বলল,
~ নিরা এখন ভেঙ্গে পড়ার সময় না। মানুষের জীবনে অনেক কিছুই ঘটে তাই বলে নিজেকে এভাবে ভেঙ্গে মুচড়ে দিলে হবে বল? নিজের ধৈর্য বাড়া। আল্লাহকে ডাক। অবশ্যই আমরা সঠিক পথ পাব যেটা আমাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর।

তোরার কথা শুনে নিজের মধ্যে একটু শক্তি সঞ্চয় হলো। সত্যিই তো নিজেকে শক্ত করতে হবে। তা না হলে তুর্জ আর তুর্জের মা বারবার বিভিন্ন মেয়েকে ঠকাবে। অসহায়ত্বটাকে দুর্বলতা ভেবে ঘায়েল করবে। নিজের জীবনের সবটা দিয়ে হলেও এর শেষটা দেখে ছাড়ব। নিজেকে শক্ত করে তোরাকে বলিষ্ঠ গলায় জাবাব দিলাম~
~ তুই যা বলবি তাই হবে। আমাকে কি করতে হবে বলিস।
~ শুন তোকে কবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলত?

~ বলেছিল দেড় মাস পর যেন যাই। মানে আর পনেরদিন পর ডাক্তার দেখানোর তারিখ।
~ তাহলে তোর শ্বাশুড়ি নিশ্চিত প্রতিবারের মত এবারও নিজে গিয়ে সিরিয়াল দিয়ে আসবে।
~ হ্যাঁ তাই করবে মনে হয়।

~ তাহলে একটা কাজ করবি যখন বাসা পুরো খালি থাকে। ঐ যে চাবি বানিয়ে দিয়েছিলাম ঐটা কি তোর সাথে আছে?
~ হ্যাঁ আমি যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিলাম।
~ ঐ চাবিটা দিয়ে তোর শ্বাশুড়ির রুমে গিয়ে লকার খুলে দেখবি কোন কাগজ পত্র আছে কি না। ঠিক আছে?
~ আচ্ছা ঠিক আছে।

তোরার সাথে কথা শেষ করার পর একবার এসব ভেবে হতাশ হচ্ছিলাম আবার নিজেকে শক্ত করছিলাম। সত্যি বলতে কি
“মানুষ আর অমানুষ গুলারে চিনা যায় না। কারণ তাদের দেখতে একই রকম লাগে”
এত সুন্দর সম্পর্কের ও যে একটা ঘৃনিত অংশ আছে সেটা তুর্জ আর তুর্জের মাকে না দেখলে জানতাম না। ঠিক এ মুহুর্তে কেউ একজন মনে হয় ঐ পুতুলটা আমার উপর আবার ছুরে মারল।

আমি ভয় পেয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে পুতুলটাকে ধরে ফেললাম। খেয়াল করলাম পলিথিনের মধ্যে লাল রঙ কেউ গুলিয়ে পুতুলের পেটে বেঁধে রেখেছে। তার মানে ঐদিনেও এরকম রঙ বাঁধা ছিল আর আমি পুতুলটাকে নীচে ঢিল মারতেই ঐ রঙ এর পলিথিনটা ফেটে রঙ বের হচ্ছিল আর আমি রক্ত ভেবে চিল্লানি দিয়েছিলাম। কতটা হিংস্রভাবে আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে ভাবতেও ঘৃনা লাগছে। আম্মুকে ডাক দিলাম। আম্মু এসে বলল
~ কি হয়েছে বউমা।

আম্মু আমার হাতে পুতুলটা দেখে অবাক হয়েও নিজেকে সামলে নিল। সামলে নিয়ে পুনরায় বলল,
~ কি হয়েছে বউ মা। এমন করছো কেন?
~ দেখুন আম্মু কে জানি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য এমন পুতুল ছুরে মেরেছে। পেটে আবার রঙও বেঁধে দিয়েছে।
তবে বুঝতে পারলাম ঐ মহিলা অনেক বড় অভিনেত্রী। ঐ মহিলা জাবাবে বলল,
~ আমি তো তোমার হাতে কিছুই দেখিছি না। কি বলছো এগুলা?

বুঝতে পারলাম উনি এ নাটকেই বহাল রাখবে নিজেকে। আমি পুতুলটা হাত থেকে ফেলে নানীমার রুমে চলে গেলাম। একটু নজর আম্মুর দিকে রাখলাম। খেয়াল করলাম খানিকক্ষণ পর আম্মু পুতুলটা নিয়ে চলে গেল।

বুঝতে আর বাকি রইল না কত বড় নাটক উনি করতে পারে। তোরা না থাকলে আমিও এগুলো বের করতে পারতাম না। তোরার কথা মনে হতেই চাবির কথা মনে হল। দৌঁড়ে আমার রুমে গেলাম। যে জায়গায় চাবি রেখেছিলাম খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু চাবিটা ঐখানে পেলাম না। বেশ চিন্তা হল এটা ভেবে চাবিগুলো গেল কোথায়? কিন্তু আমি আমার ব্যাগেই চাবিগুলো রেখেছিলাম। সাথে সাথে তোরাকে কল সবটা বললাম। তোরা আমার কথা শুনে চমকে গিয়ে বলল,
~ অন্য কোথাও রেখেছিস কি না দেখ। মনে হয় অন্য কোথাও রেখেছিস।

~ নাহ তোরা আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি ঐখানেই রেখেছিলাম। কিন্তু পাচ্ছি না কেন? কে নিল চাবি?

~~ শুন নিরা আমার মনে হয় ওরা হয়ত জানতে পেরে গিয়েছে তুই সবটা জেনে গিয়েছিস। চাবিটা ওরাই সরিয়েছে আর তোকে বুঝতে দেয় নি। তুই ও একদম স্বাভাবিক ভাবে থাক। যাতে ওরা এটা ভাবতে না পারে যে চাবিটা তুই বানিয়েছিস। ওরা আরও শক্তিশালী পরিকল্পনা করবে। তোকে আরও সাবধান থাকতে হবে। নিজের সবটা দিয়ে লড়াই করতে হবে। পনের দিন পর ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার কি বলে আমাকে সবটা বলিস। ঠিক আছে।

আমি অসহায় গলায় তোরাকে জাবাব দিলাম~
~~ আচ্ছা ঠিক আছে।

এরপর কল কেটে দিলাম। অনাকাঙ্ক্ষিত যন্ত্রনার মধ্যে পনেরদিন পার করলাম। পনের দিন পর তুর্জ আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার আমাকে দেখে বলল
~ রোগীর একটু সমস্যা আছে একটা টেস্ট করাতে হবে।
তুর্জ জাবাব দিল~
~ যা টেস্ট করানোর দরকার করুন আপনি। টাকা যা লাগে আমি দিব।

এটা বলার পর ডাক্তার মহিলাটা আমাকে টেস্ট করাতে নিয়ে গেল। আমার বেশ ভয় লাগছিল টেস্ট করতে। কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না। তাই অনেক সাহস করেই টেস্ট টা করলাম। কিছুক্ষণ পর রিপোর্ট দিল। রিপোর্ট পাওয়ার পর আমাকে চেম্বার থেকে বের করে বাইরে বসিয়ে তুর্জ একা ডাক্তারের সাথে কথা বলল। কথা শেষে আমাকে আবার নিয়ে গেল চেম্বারে। তারপর ডাক্তার মহিলাটা আমাকে বলল,
~ আপনার একটু সমস্যা আছে পনের দিন পর আসবেন আবার।

আমি আর তুর্জ ডাক্তারকে বিদায় জানিয়ে বাসায় ফিরলাম। এক ফাঁকে আমার রিপোর্টটা ছবি তুলে তোরাকে পাঠালাম। তোরা আমার রিপোর্ট দেখে বলল
~ তোর মেয়ে বাচ্চা হবে। দেখ নাইন লিখা। আমার যতদূর মনে হয় পনেরদিন পর তোকে গর্ভপাত করাতে নিয়ে যাবে। এর মধ্যে তুই আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করবি না। ওদেরকে হাতে নাতে হাসপাতালে ধরতে হবে। আমি আমার আগের অফিসের সাথে কথা বলে রেখেছি। তারা বাকি কাজ করবে। তোর একটা কাজেই আমার সাথে যোগাযোগ বহাল রাখা।

তোরার কথা শুনে মনে মনে বেশ ভয় পেলেও নিজেকে নিজে শাত্ত্বণা দিয়ে শক্ত করতে লাগলাম। সত্যিই তো এ লড়াইয়ে আমাকে জিততে হবে, না হয় অনেক মেয়ের প্রাণ যাবে।
কিন্তু দশদিন পর তাদের সব মুখোশ আমার সামনে উন্মোচন হয়ে গেল। মানুষ এতটা জঘন্য হতে পারে জানা ছিল না। এতটা ভালো মানুষের রুপ অমানুষগুলো ধরতে পারে তা চিন্তার বাইরে ছিল। ভয়ংকর একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম আমি।


পর্ব ২০

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে খেয়াল করলাম তুর্জ ওয়াশরুমে। তাই ভাবলাম একটু তোরাকে কল দেওয়া যাক। এই ভেবে মোবাইলটা হাতে নিতে চাইলাম। কিন্তু বিছানার কোথাও মোবাইল পেলাম না। কিন্তু আমি তো মোবাইল বালিশের পাশেই রেখেছিলাম। সমস্ত ঘর খুঁজা শুরু করলাম। কিন্তু কোথাও মোবাইলটা পেলাম না। বেশ ঘাবড়ে গেলাম মোবাইলটা না পেয়ে। কারণ মোবাইলটা না পেলে তোরার সাথে যোগাযোগ করতে পারব না। হুট করে তুর্জের মোবাইলটা সামনে পেয়ে আমার মোবাইলে একটা কল করলাম। খেয়াল করলাম কলটা তুর্জের আলমিরার ড্রয়ার থেকে বাজতেছে। আমি আলমিরা খুলে ড্রয়ার খুলতে চাইলাম লক্ষ্য করলাম ড্রয়ারটা লক করা। সেই মুহুর্তে খেয়াল করলাম তুর্জ ওয়াশ রুম থেকে বের হয়েছে। তুর্জকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম~
~ আমার মোবাইলটা এই ড্রয়ারের ভিতর গেল কিভাবে?
তুর্জ আমার দিকে তাকিয়ে দায়সাড়াভাবে বলল,
~ আমি কিছু না জানি না। মা কে গিয়ে জিজ্ঞেস করো।
তুর্জের কথাটা শুনে কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বললাম,
~ আমার মোবাইল তোমার ড্রয়ারে রাখা আর তুমি দায়সাড়া ভাবে বলছো তুমি কিছু জানো না আর আম্মুকে জিজ্ঞেস করতে। ড্রয়ারের চাবি দাও মোবাইল বের করব।

~ চাবি দিতে পারব না মায়ের নিষেধ আছে। মোবাইল লাগলে মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নাও।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
~ আম্মু আমার মোবাইল নিয়ে কি করবে?

তুর্জ গা ছাড়া একটা ভাব নিল। ভাবটা এমন ধরল যে যা হচ্ছে তার ব্যপারে তুর্জ জানেই না কিছু। গা ছাড়া একটা ভাব নিয়ে বলল,
~ আমি কিছু জানি না। যা বলার মাকে গিয়ে বলো।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম তুর্জকে বলে কোন লাভ হবে না। তাই আম্মুকে জিজ্ঞেস করতে রুম থেকে বের হতে নিব ঠিক এমন সময় দেখলাম আম্মু আমার রুমে ঢুকছে। রুমে ঢুকেই বলতেছে~
~ এখানে এত কথা কিসের?

~ দেখুন না আম্মু আমার মোবাইলটা তুর্জ লক করে রেখেছে আমাকে দিচ্ছে না।
আম্মু মুখটাকে গম্ভীর করে বলল,
~ মোবাইল আমি লক করে রেখেছি।

~ কিন্তু কেন?
তিনি কোন উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
~ তুমি মোবাইল দিয়ে কি করবে শুনি?

~ দরকার ছিল একটু।
~ কি দরকার? তোরার সাথে কথা বলে আমাদের কিভাবে ফাঁসানো যায় সে ব্যবস্থা করবে তাই তো?

আমি আম্মুর কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না। তার মানে ওরা সবটা জেনে গিয়েছে। এখন কি করব বুঝতে পারছিলাম না। নিজেকে একটু স্থির করে বললাম,
~ নাহ মানে আম্মু,
এবার ঐ মহিলার আসল রুপটা বের হয়ে গেল।
“চেনা মুখের আদলে অনেক অচেনা রূপ থাকে। সময়ের পরিক্রমায় তা প্রকাশিত হয়।”

আম্মু আমাকে বলল,
~ তুমি নিজেকে খুব চালাক মনে করো তাই না? পেটে নিয়ে রেখেছ তো একটা মেয়ে বাচ্চা। তার উপর তোরার সাথে কথা বলে আমাদের ফাঁসাতে চাচ্ছ? সবটা তো জেনেই গিয়েছ আর লুকিয়ে লাভ কি? তোমাকে অনেক আগে থেকেই নজরে রেখেছিলাম। তোমার ব্যাগে লকারগুলোর দ্বিতীয় চাবি দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম তুমি তুর্জের তৃতীয় স্ত্রী এর মত অধিক পাকনা মেয়ে।
~ তার মানে তুর্জ এর আগে তিনটা বিয়ে করেছে তাই তো?

~ হ্যাঁ তিনটা বিয়ে করেছে। জেনে গিয়েছ যেহুত সবটা বলে দেই। না হয় বেশি পাকনামি করবে। পাকনামির ফল আগের স্ত্রী দের সাথে কেমন হয়েছিল একটু জেনে রাখা ভালো। শুনো তুর্জের প্রথম স্ত্রী এর পেটে ছেলে বাচ্চায় ছিল তবে তার নামে বীমা করে রেখেছিলাম তাই ইচ্ছা করেই গর্ভপাত করাই। কিন্তু ঐ সময়ও মেয়েটা মরে নি। পরে ডাক্তারকে হাত করে চিকিৎসা বন্ধ করে দেই। ফলে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। বিনিময়ে আমরা পাই সত্তর লাখ টাকা।

সেখান থেকে ডাক্তারকে দেই দশ লাখ টাকা। তারপর শুরু হয় মা আর ছেলের বিয়ে বিয়ে খেলা। তুর্জকে দ্বিতীয় বিয়ে করায়। সে মেয়ের পেটে ছিল মেয়ে বাচ্চা। ঐ মেয়েকে মারার কোন ইচ্ছা ছিল না। তবে মেয়েটা মেয়ে বাচ্চা নষ্ট করতে চাচ্ছিল না। কথায় কথায় পুলিশের হুমকি দিত। তাই বু্দ্ধি করিয়ে এক্সিডেন্ট করিয়ে মেরে ফেলি। যদিও আমার ছেলেটার একটু কষ্ট হয়েছে। কারণ নাটকটা সাজাতে আমার ছেলেটার পা ইচ্ছা করে ভাঙ্গতে হয়েছে।

মহিলার এ কথা টা শুনে চমকে গেলাম। কতটা হিংস্র হলে এভাবে নাটক সাজায় আর নিজের ছেলের পা, মা ভেঙ্গে নাটকের বাস্তবতার রুপ দেয় সেটা ওদের দেখে বুঝলাম। এর মধ্যেই মহিলা পুনরায় বলল,
~ তৃতীয় বিয়ে করালাম ঐ মেয়েকেও মারার কোন শখ ছিল না। ইচ্ছা ছিল মেয়ে বাচ্চা নষ্ট করে দিব তারপর আবার বাচ্চা নিতে বলব। কারণ আমার বংশে প্রথম বাচ্চা ছেলে হোক এটা চাই। কিন্তু ঐ মেয়েটা তোমার মত বেশ পাকনামি করে ফেলেছিল। সমস্ত বিষয় ঘেটে বের করে ফেলেছিল। তাই ওকে ফাঁপা ইনজেকশন পুশ করে মেরে ফেলেছি। সবাই তো ভেবেছে হার্ট এটাক করে মরে গিয়েছে। আর এ বাড়িটা তো অভিশপ্ত বাড়ি।

এই বলে মহিলাটা একটা অট্ট হাসি দিল। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
~ আমি তেমন কিছুই করব না। আমার বাচ্চাটাকে খুন করবেন না। আপনিও আপনার মায়ের প্রথম মেয়ে সন্তান। আপনার মা তো আপনাকে খুন করে নি। মেয়ে হোক ছেলে হোক সন্তান তো আল্লাহর দান। এভাবে একটা বাচ্চার প্রাণ দুনিয়ায় আসার আগেই নষ্ট করে দিবেন না।

~ আমার বংশে ছেলে বাচ্চায় লাগবে। আর মেয়ে হলে তো তোমার মত কালো হবে। অভিশাপ বয়ে আনবে। চিন্তা করো না বউমা এবার আমাদের কথা শুনে মেয়েটাকে নষ্ট করো। সব ঠিক হয়ে যাবে। পরের বার একটা ছেলে সন্তানেই হবে দেখো।
আমার বাচ্চা আমি নষ্ট করব এটা ভেবেই আমি আঁৎকে উঠে তুর্জকে বললাম,
~ দেখো আম্মু কি বলতেছে। তোমরা যা অন্যায় করেছ আমি সবটা গোপন রাখব তোমরা আমার মেয়েকে মেরে ফেল না। মাকে বুঝাও একটু।

তুর্জ আমার দিকে রাগী চোখমুখ নিয়ে তাকিয়ে বলল,
~ মা যা বলেছে তাই হবে, এ বংশে ছেলে সন্তানেই আসবে প্রথম।
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
~ আমার মায়ের সাথেও কি কথা বলতে দিবে না তোমরা।

পাশ থেকে মহিলটা বলে উঠল~
~ তোমার মাকে বলে রেখেছি তোমাকে ডাক্তার বিশ্রাম দিয়েছে, পাঁচদিন কথা বলতে পারবে না। সুতরাং তোমার মায়ের সাথে কথা বলার দরকার নাই। যা কথা বলার গর্ভপাতের পর বলবে।
এবলে মা চলে গেল। মা চলে যাওয়ার পর তুর্জকে অনেক মানানোর চেষ্টা করলাম। তুর্জ কিছুতেই মানল না। বরং অফিসে চলে গেল। এদিকে তোরা বলেছিল তার সাথে যোগাযোগ যেন করি সবসময়। কিন্তু সেটাও করতে পারছি না।

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তোরার সাথে যোগাযোগ করা। কিভাবে কথা বলব তোরার সাথে। কোন উপায় পাচ্ছিলাম না। কতবার তুর্জের ফোনটা লুকিয়ে কথা বলতে চাইলাম কিন্তু ফোন লক করা ছিল। আমাকে ওরা শারিরীক কোন যন্ত্রণা দেয় নি তবে মানসিক ভাবে পুরো মেরে ফেলেছে। আমার আত্ন চিৎকার শুনার মত কেউ নেই। নীরবে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আরও পাঁচটা দিন পার করলাম। তোরার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারলাম না।

আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপদের সম্মুখীন হচ্ছি। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও নিজের সন্তানকে বলি দিতে হবে। হয়ত আমার প্রাণটাকেও বলি দিয়ে দিবে তারা। এতটা অসহায় আগে কখনও লাগে নি। কিছুক্ষণ পর আমাকে নিয়ে যাবে ডাক্তারের কাছে। আমি কি সব আটকাতে পারব নাকি পারব না। জীবনের শেষ অধ্যায় হয়ত এটা। আজকেই হয়ত আমার ডায়রি লিখার শেষ দিন। আর কোনদিন হয়ত ডায়রিটা লিখতে পারব না। লিখতে খুব হাত কাঁপছে। একটু পরেই হয়ত আমার জীবনের ইতি ঘটবে।

তুলি এ লিখাটা পড়ার পর কয়েক পৃষ্ঠা উল্টাল কিন্তু পরবর্তী লিখা আর পেল না। তুলি ভাবতে লাগল তাহলে কি নিরার সেদিন মৃত্যু হয়েছিল। অরন্যকে জিজ্ঞেস করলে হয়ত জানা যাবে। পরে কি হয়েছিল জানার জন্য তুলির মন ছটফট করতে লাগল। তুলি ডায়রিটা রেখে রান্না ঘরে গিয়ে অরন্যকে দেখে একটু থমকে গেল। কি এক মায়া যেন অরন্যের মুখে মেখে আছে।

এ মায়ায় যেন বারবার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। তুলি নিজেকে সামলে নিল কারণ অরন্য বিবাহিত তার মায়ায় পড়লে চলবে না। তুলির মনে শুধু একটা প্রশ্ন অরন্যের বউ কোথায়? অপরদিকে নিরার কি হয়েছিল সেটা জানার জন্যও ছটফট করছিল। তুলি সরাসরি রান্না ঘরে ঢুকে গেল। অরন্যকে তুলিকে দেখে বলল,
~ থাক আর সাহায্য করতে হবে না। বানানো তো শেষ। এখন এত ক্রেডিট নিতে হবে না।
তুলি রাগী কন্ঠে বলল,
~ আমি আপনাকে সাহায্য করতে আসি নি। আমি ডায়রিটা পুরো পড়েছি।

~ অহ! পড়ে ফেলেছেন, তাহলে আর কি চান?
~ তারপর নিরার কি হয়েছে বলবেন? নিরা কি বেঁচে আছে নাকি ঐ অপরাধীরা নিরাকে মেরে ফেলেছে।

অরন্য তুলির কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল
~ এ কফির মগটা ধরুন তো একটু। আমি দুটা একসাথে ধরতে পারছি না। অনেক গরম তো তাই।
তুলি রাগী চোখে অরন্যের দিকে তাকিয়ে কফির মগটা হাতে নিয়ে বলল,
~ আপনি বলেন না তারপর নিরার কি হয়েছিল?

অরন্য পুনরায় তুলির কথা পাত্তা না দিয়ে কফিতে এক চুমুক দিয়ে বলল,
~ একটু মিষ্টি কম হয়েছে। আপনি মিষ্টি কম খান নাকি বেশি খান।
অরন্যের কথা শুনে তুলির শরীরটা রাগে গিজগিজ করতে লাগল। রাগে কফির মগটা রান্না ঘরে রেখে চলে আসল। অরন্য কফির মগটা নিয়ে তুলির পিছন পিছন গেল আর বলতে লাগল
~ আরে কফিটা নিয়ে যান।

তুলি কোন কথা না শুনে রুমে চলে আসল। অরন্য কফির মগটা হাতে নিয়ে তুলির কাছে গিয়ে বলল,
~ কফিটা খান সমস্ত ঘটনা খুলে বলছি।

তুলি অরন্যের কথায় কফিতে একটা চুমুক দিল। কফিতে চুমুক দেওয়ার পর লোভনীয় স্বাদে কফির মগে যেন হাবুডুবু খেতে লাগল। নিজের লোভনীয় চেহারা অরন্যের কাছে অগোচর করে অরন্যেকে বলল,
~ এবার বলুন তারপর নিরার সাথে কি হয়েছিল। আর নিরা কি বেঁচে আছে নাকি মরে গিয়েছে?

অরন্য তুলির অস্থিরতা খেয়াল করল। অস্থিরতা দেখে অরন্য বলল,
~ নিরার মত দেখা যাচ্ছে আপনিও বেশ অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। এত অস্থির হলে চলবে?
অরন্যের কথা শুনে তুলির শরীরে রাগের তীব্রতা বাড়তে লাগল। নিজের রাগকে নিবারণ করে বলল,
~ আমি স্থির আছি এবার বলুন।

অরন্য তুলির দিকে তাকিয়ে আবার চোখটা নীচে নামিয়ে ফেলল। কারণ তুলির দিকে তাকালে তুলির চোখ দুটো দেখলে অরন্যের অদ্ভুত অনুভূতি হয়। আর ঐ চোখে ভালো করে তাকালে অরন্য যে আবেগের সাগরে ডুবে যাবে সেটা অরন্য বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে। তাই অরন্য নিজেকে সংযত করে তুলিকে বলল,
~ আপনার সাথে যেখানে দেখা, প্রতদিনের মত আমিও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দাঁড়িয়ে আকাশটাকে উপভোগ করতে ছিলাম। রাত তখন এগারটা বাজে। ঠিক এ সময় নিরা নামের মেয়েটা আপনার মতই আসে ব্রিজের উপর। মেয়েটা অবশ্য আপনার মত মার্ডার করে আসে নি।

এ বিষয়টা নিয়েও অরন্য বেশ মজা করছে দেখে তুলি রাগে অরন্যের দিকে তাকাল। অরন্য তুলির রাগী চোখ দেখে বলল,
~ আরে এত রাগ করছেন কেন? আমি তো কথাটা আমি মজা করে বলছি। তাহলে শুনুন
তখন নিরা আমার দিকে তাকিয়ে ওর ডায়রিটা আমার দিকে বাড়িয়ে বলল,
~ আমাকে একটু এ ঠিকানায় পৌঁছে দিন।

আমার অনেক বিপদ। আমি বাসায় পৌঁছাতে না পারলে আমাকে আমার শ্বাশুড়ি এবং স্বামী মেরে ফেলবে। আমি অনেক দূর থেকে পালিয়ে এসেছি। আপনি একটু দয়া করুন। এ বলে নিরা অজ্ঞান হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব? মনে হল আজকে উনার জায়গায় আমার বোন বা আমার প্রিয় সহধর্মিণী থাকলে আমি তাদের সাহায্য না করে থাকতে পারতাম না। আমি উনাকে নিয়ে আমি যে হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় আছি ঐ হাসপাতালের এক বিশেষ কেবিনে ভর্তি করালাম।

এক তো নিরা গর্ভবতী ছিল তার উপর নিরার প্রেসার ছিল অনেক কম। নিরাকে ট্রিটমেন্ট দিতে লাগলাম। কেবিনের একটা চেয়ারে বসলাম। ডায়রিটা হাতে নিয়ে পড়ব কিনা চিন্তা করতে লাগলাম। অনেক ভেবে ডায়রিটা পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর ডায়রিটা খুলে পড়তে লাগলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ডায়রিটা পড়া শেষ হল। ডায়রিটা পড়ে ভাবলাম মেয়েটা কতটা অসহায়। এত ভালোবাসার পর এমন একটা ধাক্কা খাবে কে জানত। আমি নিরার জ্ঞান ফিরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সারা রাত পার হয়ে গেল কোন সাড়াশব্দ ছিল না। নিরার ডায়রিতে শুধু বাসার ঠিকানা দেওয়া ছিল কোন মোবাইল নম্বর দেওয়া ছিল না। তাই ঐ সময় কারও সাথে যোগাযোগ করার উপায় পেলাম না। সকাল সাতটায় নিরা বাঁচাও বলে চিল্লানি দিয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম নিরা এখনও ঐ ট্রমায় আছে।

আমি নিরার কাছে গিয়ে বললাম,
~ বিনা অনুমতিতে আপনার ডায়রি পড়ার জন্য দুঃখিত। আপনি চিন্তা করবেন না এখানে আপনাকে কেউ কিছু করবে না। আমি একজন ডাক্তার আর আপনি এ হাসপাতালে বেশ নিরাপদে আছেন। আমাকে বলুন আপনি এবার কি করতে চান। আমি কি কোন আইনি ব্যাবস্থা নিব?
নিরা আমার কথা শুনে একটু স্বস্তি পেয়ে বলল,
~ আপনার মোবাইলটা একটু আমাকে দিবেন।

আমি নিরার দিকে আমার মোবাইল টা এগিয়ে দিলাম। নিরা আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে বলল একটু ডাটা অন করে দিবেন। আমি একটু আমার মেসেন্জারে ঢুকব। আমি মোবাইলটা নিয়ে ডাটা অন করে দিলাম। নিরা তার মেসেন্জারে ঢুকল। নিরা মেসন্জারে ঢুকে আশ্চর্য হল এটা দেখে যে তোরাকে অনেকগুলো মেসেজ এ পর্যন্ত করা হয়েছে যা নিরা করেই নি। নিরা খুব ভালো করে বুঝতে পারল এসব মেসেজ তুর্জ করেছে।

তুর্জ এসব মেসেজ করে তোরার কাছ থেকে সব তথ্য কৌশলে জেনে নিয়েছি। যখনেই তোরা কল দিয়ে কথা বলতে বলেছে তখনেই তোরাকে মেসেজ দেওয়া হয়েছে যে বসায় সমস্যা যা বলার মেসেজে বল। আর সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় এটা যে তোরাকে মেসেজ করে একটা ঠিকানা দিয়ে বলা হল আগের রিপোর্টের কাগজগুলো যেন ঐ ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়। আর তোরাও তাই করবে বলল। নিরা মেসেজগুলে জোরে জোরে পড়ে ভয়ে ঘামতে লাগল। আমি নিরাকে একটু সাহস জুগিয়ে বললাম,
~ আপনি আপনার বান্ধবীকে কল দিন। আপনার বান্ধবীত অনলাইনে আছে।

নিরা নিজেকে সামলে তোরাকে কল দিল। ওপাশ থেকে তোরা কল দিয়ে বলল
~ কি রে কল ধরছিলি না আমি তো চিন্তায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুই কোথায় এখন?
নিরা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
~ আমার হয়ে ওরা এতদিন মেসেজ দিয়েছে তোকে। তুই কি কাগজ গুলো পাঠিয়ে দিয়েছিস। ঐ কাগজগুলো প্রমাণ ছিল।

তোরা নিরার কথা শুনে চমকে গেল। তোরা নিজেও চিন্তা করতে পারে নি যে এমন কিছু হচ্ছে। কারণ তারা এমন ভাবে মেসেজ করেছে যে বুঝার কোন উপায় ছিল না। তোরা কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে বলল,
~ কাগজের কথা পরে ভাবা যাবে। তুই এখন কেমন আছিস সেটা আগে বল। এখন কোথায় আছিস আর মোবইল কোথায় পেয়েছিস।

নিরা তোরাকে সবটা ঘটনা খুলে বলল। তোরা সবটা শুনে নিরাকে প্রথমে বলল,
~ আগে তোর পাসওয়ার্ড বদলে ফেল। যাতে করে তোর আইডিতে যেন ঢুকতে না পারে। পাসওয়ার্ড বদলিয়ে আমাকে আবার কল দে।
নিরা ফোনটা কেটে ফেসবুকে ঢুকে পাসওয়ার্ড বদল করে তোরাকে পুনরায় কল দিল।
(কমেন্ট ব্লক খেয়েছি তাই সবাই গল্প পড়ে কমেন্ট করে যাবেন। )


পর্ব ২১

তোরা পুনরায় কল ধরে নিরাকে আস্বস্থ করে বলল,
~ নিরা তুই চিন্তা করিস না। আমি কাগজগুলোর কপি করে পাঠিয়েছিলাম। মূলকপি আমার কাছেই আছে। এখন যা বলি শুন। তোর বাবা মাকে হয়ত তারা কল দিয়েছে অথবা তারা ঐখানে আছে। তাই এখন তোর পরিবারের কাউকে কল দিস না। আমি আমার আগের অফিসের একজনকে বলেছি, তাদেরকে আগেই হাতে যে প্রমাণ ছিল তা পাঠিয়েছি। আমি এখন তাদের কল দিব। বাকিটা তারা ব্যবস্থা করবে। তোর পাশে থাকা ভদ্রলোকটাকে একটু ফোনটা দে। আমি উনার সাথে কথা বলতে চাই।

নিরা আমাকে ফোনটা ধরিয়ে দিল। ওপাশ থেকে তোরা বলল,
~ ভাইয়া আমি আপনাকে চিনি না তবে আপনি নিরার জন্য যা করেছেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। যদি অভয় দেন একটা কথা বলতে চাই।
~ হ্যাঁ বলুন কি বলতে চান। কোন ভয় পাওয়ার দরকার নেই, নির্ভয়ে বলুন।

~ আপনাকে একটু মামলা করতে হবে নিরার হয়ে। ঐ অপরাধীগুলোকে শাস্তি দিতে হবে। পারবেন না ভাইয়া এটুকু সাহায্য করতে।
আমি খুশি মনে বললাম,
~ এ আর কেমন কাজ অবশ্যই পারব। এটুকু করতে পারলে আমি আরও খুশি হব।

তারপর নিরাকে নিয়ে থানায় গেলাম। থানায় গিয়ে তুর্জ আর তুর্জের মায়ের নামে একটা মামলা করলাম। তোরার আগের অফিসের লোকগুলার সাহায্যে তুর্জ আর তুর্জের পরিবারের বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ দাঁড় করালাম। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গেল সাথে ঐ ডাক্তার মহিলাকেও। তুর্জের নানীমা এসবে জড়িত ছিল না তাই তুর্জের নানীমাকে একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করলাম।

তুলি অবাক হয়ে বলল,
~ এখন নিরা কোথায় আছে? বাবা মায়ের সাথে আছে? আর ঘটনাটা তিনবছর আগের তার মানে এখন নিরার মেয়ের হয়ত আড়াই বছর। বলুন না কোথায় আছে ওরা।
অরন্য তুলির অস্থিরতা দেখে বলল চলুন এক জায়গায় নিয়ে যাই আপনাকে। তুলি অবাক হয়ে বলল,
~ কোথায় নিয়ে যাবেন?

~ সাথে ছুরিটা নিয়ে নিবেন তো, অন্য কোথাও নিয়ে গেলে ছুরি দিয়ে মেরে দিবেন। একটা মার্ডার তো করেছেনেই। খুব শখ জাগতেছে খুনের আসামীর সাথে একটু ঘুরতে। খোলা আকাশের নীচে একটু গল্প করতে। বহুদিনের শখ বলতে পারেন।

তুলি অরন্যের কথায় ক্ষেপে গিয়ে বলল,
~ আমি কোথাও যাব না। আপনি সব বিষয় নিয়ে কেন মজা করুন বলুন তো।
~ বিশ্বাস করতে পারলে চলুন। এত ক্ষেপে যান কেন কথায় কথায়?

তুলি শান্ত গলায় বলল,
~ আমি এভাবে বের হলে তো অনেকে আমাকে চিনে ফেলবে। পুলিশ আমাকে দেখলে ধরে নিয়ে যাবে। তার উপর ঐ শয়তান মহিলার আর নিলয়ের লোকজন আশেপাশে আছে।
অরন্য কিছুক্ষণ ভেবে সেখান থেকে উঠে অন্য একটা রুমে গিয়ে আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে আসল হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে। ব্যাগটা তুলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
~ এই নিন।

~ এ ব্যাগে কি? এ ব্যাগ দিয়ে আমি কি করব?
~ খুললেই বুঝবেন। আগে খুলে দেখুন। না খুলেই এত প্রশ্ন করছেন কেন? বোম রাখে নি ব্যাগে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
কথাখানা বলেই অরন্য ঐ রুম থেকে প্রস্থান নিল। অরন্য বের হওয়ার পর তুলি ব্যাগ টা খুলে দেখল একটা বোরকা। তাই তুলি দেড়ি না করেই বোরকাটা পড়ে নিকাব পড়ে নিল। নিকাব পড়ার পর রুম থেকে বের হয়ে বলল,
~ চলুন এবার বাইরে যাওয়া যাক। কোথায় না নিয়ে যাবেন বললেন।

অরন্য তুলিকে দেখে একটু খামখেয়ালে হাসি দিয়ে বলল,
~ আপনার ছুরিটা নিয়েছেন তো। না হয় তো আপনাকে কি থেকে কি করে বসি। তখন তো বিপদে পড়ে যাবেন। আপনার ছুরিটা কোথায় দেখতেছি না যে।
তুলি বিরক্ত গলায় জাবাব দিল~
~ সেটা আপনাকে দেখতে হবে না। এতকিছু না দেখলেও চলবে। এবার চলুন।

তুলি আর অরন্য বের হয়েএকটা রিকশা ভাড়া করে দুজন উঠল। তুলির বেশ ফুরফুরা লাগছে বাইরে বের হতে পেরে। কতদিন এ বাহিরটা দেখা হয় নি তুলির। খোলা আকাশের নীচে রিকশা চড়া হয় নি। তুলির মনটা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আকাশের দিকে বারবার চোখ যাচ্ছিল আর মনে হচ্ছিল এ খোলা আকাশে ডানা মেলে উড়তে পারলে হয়ত অনেক ভালো লাগত। এতটা ভালো লাগছে তুলির যা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। অজান্তেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এর মধ্যেই রিকশাটা থেমে গেল একটা গেইটের সামনে। অরন্য রিকশা থকে নেমে তুলিকে বলল,
~ কি ব্যপার উপরে তাকিয়ে কি দেখছেন?

তুলি আবার নিজের মধ্যে ফিরে আসল। অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলে~
~ নাহ কিছু না। আমরা কি চলে এসেছি।
~ হ্যাঁঁ চলে এসেছি নামুন।

তুলি রিকশা থেকে নামল। নামার পর অরন্য গেইটটা খুলে ভিতরে ঢুকল। তুলি গেইটের ভিতরে ঢুকে প্রথমে একটা ছোট মাঠ খেয়াল করল। মাঠের কিছু বিস্তৃতি পর কতগুলো ছোট ছোট বাড়ি দেখল। অরন্য তুলিকে নিয়ে সেই বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। একটু হাঁটার পরেই অরন্য তুলিকে নিয়ে একটা ঘরের সামনে গিয়ে দরজা নক করতেই একটা মেয়ে বের হয়ে আসল। মেয়েটাকে তুলির আর চিনতে বাকি রইল না এ মেয়েটাই নিরা। নিরা অরন্যকে দেখে বলল,
~ আরে আজকে এ সময় যে? চেম্বার নেই?
~ হ্যাঁ ঠিক ধরেছিস চেম্বার নেই।

নিরা অরন্যকে বাইরে একটা চেয়ার বের করে দিল। ঠিক এ সময় তুলিকে দেখে বলল,
~ এ কে অরন্য। এ ও কি থাকবে নাকি এখানে।
~ নাহ ও এ আশ্রমটা দেখতে এসেছে। মেহমান বলতে পারিস।
~ অহ! তাই বলো।

এটা বলার পর পরই তুলি লক্ষ্য করল একটা বাচ্চা মেয়ে নিরাকে মা মা বলে ডাকছে। অরন্য বাচ্চা মেয়েটাকে দেখেই পকেট থেকে চকলেট বের করে দিল। তুলি আশ্চর্য হল এটা ভেবে যে অরন্য কখন মেয়েটার জন্য চকলেট নিল টেরেই পেল না। নিরা তুলির দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তোমাকে তো চেয়ার দিতে ভুলে গিয়েছি। কতক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছ মনে কিছু নিও না।

তুলি একটা হাসি দিয়ে বলল,
~ আরে না মনে কিছু কেন নিব? তোমাকে দেখেই অনেক ভালো লাগছে।
পাশ থেকে অরন্য নিরাকে আঁটকে দিয়ে বলল
~ আরে চেয়ার আনতে হবে না। ওকে নিয়ে একটু ঐ পুকুর পাড়ে বসব।

পুকুর পাড় আছে শুনে তুলির মনটা খুশিতে আনচান করতে লাগল। অরন্য চেয়ার থেকে উঠে তুলির দিকে তাকিয়ে বলল চলুন একটু পুকুর পাড়ে যাওয়া যাক। তুলি পুকুর পাড়ে যাওয়ার আগে বাচ্চা মেয়েটার দিকে একটু তাকাল। তাকিয়ে দেখল মেয়েটা অসম্ভব সুন্দরি হয়েছে। অথচ নিরার শ্বাশুড়ি এ বাচ্চাটাকে বলেছিল পৃথিবীতে আনতে দিবে না। তার উপর বলেছিল কালো জন্ম নিবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার লিলাখেলা ভিন্ন তিনি বাচ্চাটাকে অসম্ভ সুন্দর করে গড়েছেন। তুলি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তোমার নাম কি?

বাচ্চাটা আধু আধু কন্ঠে বলল,
~ পরী।
তুলি পরীকে একটু জড়িয়ে ধরে একটা চুমু একে দিয়ে অরন্যকে বলল,
~ চলুন যাই।
অরন্য তুলিকে নিয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসল। তুলি তখন অরন্যকে জিজ্ঞেস করল,
~ এটা কিসের আশ্রম। আর নিরা কি তার বাবা মায়ের সাথে থাকে না।

অরন্য পুনরায় ঘটনা বলা শুরু করল,
~ সেদিন নিরার দরকার ছিল একটা সঠিক সাপোর্টের। আমি আর তোরা চিন্তা করে দেখলাম নিরা যদি তার বাবা মায়ের কাছে থাকে তবুও সে অবহেলিত হবে। কারণ পরিবার ও মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট সময় পর ভুঝা মনে করে। নিরাকে বললাম কিছুদিন বাবার বাসায় থেকে একটা ভালো চাকুরি পেলে আলাদা বাসা নেওয়ার জন্য।

কিন্তু এ সমাজ গায়ের রঙ টাকেই বেশি প্রাধান্য দেয় যোগ্যতার থেকে। ফলে নিরার ভালো চাকুরি হল না। আমি আর তোরা নিরাকে ব্যবস্যার ব্যবস্থা করে দিলাম। নিরা খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে হওয়ার দরুণ একবছরেই ব্যবস্যাটা বেশ ভালো করে দাঁড় করে ফেলে। এর মধ্যে নিরার মেয়ে পরীর জন্ম হয়।

নিরা কঠোর পরিশ্রমে তিন বছরে ব্যবস্যাটাকে একদম দাঁড় করিয়ে সফল ব্যবসায়ী হয়। এখন নিরার এ ব্যবস্যা থেকে মাসে ৮০~৯০ হাজার টাকা রোজগার হয়। আস্তে আস্তে অরন্য থেকে হয়ে গেলাম নিরার বড় ভাই। নিরা আমাকে নিরার বড় ভাই মনে করে আমিও নিরাকে ছোট বোনের মত দেখি। নিরার ব্যবস্যা যখন ভালোর দিকে তখন মনে হল আমার একটা খোলা জায়গা পড়ে আছে সে জায়গায় এসব অবহেলিত মেয়েদের জন্য আশ্রম দিলে তো ভালোই হয়। নিরাকে বলার পর নিরা বলল,
~মেয়েদের দেখাশুনার দায়িত্ব আমি নিব। নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করব।

আমিও আর দ্বিতীয়বার না ভেবে আশ্রমটা করেই ফেললাম। নিরা এখানে থাকা শুরু করল। ব্যবস্যার অর্ধেক টাকা এখানে ব্যয় করে। নিরার বান্ধবী তোরাও মাসে মাসে কিছু টাকা এসব সুবিধা বঞ্চিত মেয়েদের জন্য পাঠায়। শুরু হয় আমাদের পথ চলা।
তারপর অরন্য বলল একটু এদিকে আসুন। এবলে অরন্য তুলির হাত ধরে টান দিয়েও ছেড়ে দিয়ে বলল,
~ দুঃখিত। হাতটা অনিচ্ছাকৃতভাবে ধরে ফেলেছি।

তুলি অরন্যের ছোঁয়া পেয়ে এক ভালোবাসার অতল সাগড়ে ডুবে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
~ সমস্যা নেই। ঠিক আছে চলুন। কোথায় না নিয়ে যাবেন।
এরপর অরন্য তুলিকে নিয়ে একটা মেয়ের কাছে গেল। মেয়েটা দেখতে পরীর মত সুন্দর বললেও ভুল হবে বলতে হবে পরীর থেকেও সুন্দর। এত সুন্দর মেয়ের ঠাঁই এ আশ্রমে এটা দেখে তুলি বলল,
~ এ কে?

~ এ সাবিহা। বয়স সতের। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তবে হয়ত মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এত সুন্দর মেয়ে এখানে কেন? নিরার গায়ের রঙ হয়ত কালো তাই হয়ত তার জীবনে এত ঝামেলা হয়েছে কিন্তু এ মেয়ে তো ফর্সা তাই বলে সে কি এ সমাজের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে? নাহ পায় নি এসমাজ তাকেও অসহ্য যন্ত্রণা দিয়েছে। সুন্দর হয়ে জন্ম নিয়েছে এটাই তার অপরাধ। সত্যি বলতে মেয়েদের সবকিছুতেই অপরাধ খুঁজে বেড়ায় এ সমাজ। মেয়েটার জীবনে ঘটে যায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

মেয়েটা সন্ধ্যায় একদিন বাসায় ফিরছিল। চার পাঁচটা বখাটে ছেলে ধরে ধর্ষণ করে। ধর্ষিত হওয়ার পর মান সম্মানের হানি ঘটবে তাই মেয়েটার বাবা মা কোন মামলা করে নি। হায়রে সমাজ এখানে নাকি ধর্ষিত হলে মান যায় আর যারা ধর্ষণ করে তাদের মান যায় না। মেয়েটার মনের ব্যথা কেউ বুঝে নি। কয়েকদিন পর মেয়েটার পেটে বাচ্চা আসে। মেয়েটা বুঝতেই পারে নি। যখন বুঝতে পেরেছে তখন অনেক দেড়ি হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চাটা নষ্ট করার মত কোন উপায় ছিলনা। মেয়েটার পড়ালেখা বন্ধ করে ঘর বন্দি করে রেখে দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে মেয়েটার বাচ্চা হয়। তবে সেটা সঠিক চিকিৎসার অভাবে মারা যায়।

কারণ তারা ডাক্তারের কাছে নিয়েই যাই নি মেয়েটাকে, তথাকথিত মান সম্মান যাবে বলে। বাচ্চাটাকে হয়ত কোন এক ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল। তখন হয়ত সবাই বাচ্চাটাকে দেখে মনের অজান্তেই মেয়েটাকেই গালি দিয়েছিল। এ সমাজে কেউ বলে না, কেমন বাবা নিজের বাচ্চাকে এভাবে ফেলে দিয়েছে।

এ সমাজ শুধু বলতে জানে কেমন মা নিজের বাচ্চাকে এভাবে ফেলে রেখেছে। কিছুদিন পরে মেয়েটার ভাই বিয়ে করে। মেয়েটার ভাই বিয়ের পর মেয়েটার বাবা, মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় আর মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সেদিন মেয়েটা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আমার কাছে আসল। আমি তখন টং দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল~
~ ভাইয়া একটু খাবার দিন। সকালে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। থাকার জায়গা নেই সারাদিন কিছু খায় নি।

মেয়েটার মুখটা দেখে কলিজাটা ফেটে গিয়েছিল। তখন মেয়েটার বয়স ছিল ষোল। মেয়েটাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? মেয়েটা তার জীবনের ঘটনা গুলো খুলে বলল। মেয়েটার ঘটনার শুনে বুকটা কেঁপে গিয়েছিল। আর বলে উঠেছিল~
“হে সমাজ তোমার কি কখনও টনক নড়বে না”

কারণ যখন মেয়েটাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল তখন মেয়েটার বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর ছিল। এ অল্প বয়সে কত কষ্টটাই না সহ্য করেছে। আমি নিরাকে কল দিলাম। নিরা ঐখানে গিয়ে মেয়েটাকে আশ্রমে নিয়ে আসল। এক বছর যাবৎ মেয়েটা এখানে থাকে।

এখানে মেয়েটা বসে নেই। পড়াশুনা করছে পাশাপাশি সুতার কাজ করে নিজের খরচটা নিজেই জুগিয়ে নিচ্ছে। আর ঐসব নরপশুর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের বিষয়টা পুলিশ দেখছে। তবে ন্যায় বিচার নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দিহান রয়েছে।

তারপর অরন্য পাশে থাকা আরেকটা মেয়েকে দেখিয়ে বলল। ওর নাম তাহিরা বয়স পঁচিশ। বিয়ে হয় বিশ বছর বয়সে। বিয়ের তিন বছর পর একটা বাচ্চাও হয়। বেশ সুখেই ছিল। কিন্তু সে সুখ বেশিদিন টিকে নি ওর কপালে। স্বামী পরকিয়া করে ডিভোর্স দিয়ে দেই। বাপের বাড়িতে গ্রহণ করে নি। তাই ঠাঁই পেয়েছে আমার এ আশ্রমে। তবে সে এখন তার নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে বেশ ভালো হস্ত শিল্প পাড়ে মেয়েটা।

আশে পাশে তাকান দেখেন অনেক মেয়েই আছে তারা অবহেলিত হয়ে এখানে এসেছে। তবে তারা কেউই বসে নেই। তারা ঠিকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমি বলব~
“হে নারী তুমি অন্যায়কে প্রশ্রয় দিও না। অন্যায়ের রসাতলে নিজেকে গুটিয়ে ফেল না। তুমি ঘুরে দাঁড়াও। তোমার মাঝে রয়েছে অসংখ্য প্রতিভা সেটা শুধু প্রকাশ কর। রুখে দাড়াঁও আপন শক্তিতে। সমাজ তোমাকে বদলে দিবে না বরং সমাজকে তুমি বদলে দাও। তোমার সুপ্ত প্রতিভা গুলোকে জাগিয়ে তুল। নিজের পায়ে দাঁড়াও। কারণ তুমি নারী, তুমিই মা, তুমিই মেয়ে, তুমিই অর্ধাঙ্গিনী।

এ বলে অরন্য একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে মাঠের ঘাসের উপর বসল। তুলিও অরন্যের কথা শুনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মনের ভিতর এক অদ্ভূত সাহস পেল। আশেপাশের মেয়েগুলোকে দেখেও এক অদ্ভুত শান্তি পেল মনে। অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আপনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন নিঃসন্দেহে সেটা অনেক ভালো উদ্যোগ। তবে একটা বিষয় আমার কাছে এখনও ধোঁয়াশায় আছে। বিষয়টা কি একটু খুলে বলবেন।
অরন্য মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
~ বলে ফেলুন শুনি। পেটে কথা চেপে রাখলে বদহজম হবে।

~ আমি কি জানতে পারি আপনার স্ত্রী রুপা কোথায়? আর এ উদ্যোগটা নেওয়ার পিছনে কি কোন কারণ আছে।
আকাশপানে তাকিয়ে অরন্য বলল,
~সত্যিই কি জানতে

~ জানার জন্যই তো বললম
তাহলে শোনোন
~ আমি তখন মেডিকেলে ইন্টার্নি করছিলাম। পড়ালেখায় বেশ মনোযোগী ছিলাম। কোন মেয়ের দিকে তকাতাম না। প্রেম ভালোবাসায় মোটেও বিশ্বাসী ছিলাম না। মনে হত এসব পাগলের কান্ড কাহিনী। পড়াশোনার বাইরে কোন কিছু ভাবতেই পারতাম না। নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখতাম বইয়ের গন্ডিতে। বেশ ভালোই কাটছিল আমার দিনকাল।

আমি একটা বাসা ভাড়া নিয়ে মেডিকেলের কাছেই থাকতাম। কেন জানি না হলের খাবার গলা দিয়ে নামত না। তাই আলাদা বাসা ভাড়া করে নিজেই কোনরকমে রান্না করে খেতাম। একদিন বাসা থেকে বের হয়ে একটা বিষয় লক্ষ্য করে বেশ অবাক হলাম।


পর্ব ২২

লক্ষ্য করলাম একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একা একা কি যেন বিড় বিড় করছে। এমন ভাবে বিড়বিড় করছে মনে হচ্ছে কারও সাথে কথা বলছে। মেয়েটা যে আহামরি সুন্দর ছিল তা না। তবে মেয়েটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগছিল। আশ্চর্যের একটা বিষয় হল মেয়েটা খালি পায়ে ছিল আর হলুদ রঙ এর থ্রি পিস পড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটাকে খালি পায়ে দেখে বেশ অবাক হলাম। একটা মেয়ে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে তার উপর পরিপাটি কাপর~চোপর পড়া, তাই বিষয়টা কেমন জানি অদ্ভুত লাগছিল।

কোন মেয়েকে দেখে আমার কখনও অনুভূতি জাগে নি তবে সে মেয়োটাকে দেখে মনের ভিতর বেশ একটা অনুভূতি জাগল। তাই আস্তে করে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠিক এ মুহুুর্তে একটা চোরের আগমন ঘটল। আগে দেখতাম বাংলা সিনেমাতে নায়ক নায়িকার পাশে দাঁড়ালে নায়িকার ব্যাগ চুরে চুরি করে নিত। আর নায়িকা চিল্লানি দিতে থাকত তারপর নায়ক ব্যাগটা উদ্ধার করে নায়িকা কে দিত। অতঃপর তাদের মধ্যে প্রেম হয়ে যেত।

এখন দেখি বাস্তবেও চুরের আগমণ ঘটেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এটা ছিল যে চুরটা মেয়েটার ব্যাগটা নিয়ে দৌঁড় দিলেও মেয়েটা তেমন কোন কিছুই করে নি। আমি মেয়েটাকে দেখে বোকা বনে গেলাম। কারণ এ মেয়েটার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে এতক্ষণে চোর চোর বলে চিল্লানি দিত। কিন্তু মেয়েটা বেশ শান্ত হয়েই দাঁড়িয়ে আছে ঠিক যেমনটা ব্যাগ চুরির আগে দাঁড়িয়ে ছিল। একটু সাহস করে মেয়েটার কাছে গেলাম। কাছে গিয়ে বললাম,
~ আপনার ব্যাগে কি কিছু ছিল না!
~ ব্যাগে তিন হাজার টাকা, দুইটা বই, একটা খাতা, আর আমার মোবাইলটা ছিল।

মেয়েটার জবাব শুনে আরও আশ্চর্য হলাম। এতকিছু থাকার পর মেয়েটা কিছুই করল না। মেয়েটার তো এতক্ষণে চিল্লানি দিয়ে রাস্তা উজাড় করার দরকার ছিল। অথচ মেয়েটা একটু হতাশও হল না।
একটু ভয় ও হচ্ছিল মেয়েটাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে। কারণ ঐভাবে কোন মেয়ের সাথে আগে কখনও কথা বলে নি তো তাই। তবুও পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম~
~ আপনার এতগুলো জিনিস চুরে নিল আপনার কি কোন মায়া লাগছে না?

মেয়েটা একটা মুচকি হাসি দিয়ে হাঁটা শুরু করল। কোন পাত্তায় দিল না আমার কথায়। আমারও বেশ রহস্যময় একটা চরিত্র মনে হল। তাই মেয়েটার পিছন নিলাম। মোটকথা মেয়েটার পিছন নিয়ে মেয়েটাকে এক প্রকার বিরক্তই করছিলাম। খেয়াল করলাম মেয়েটার মুখে তেমন কোন বিরক্তরে ছাপ নেই। মনে মনে ভাবলাম এ কি আজব মেয়ে নাকি। অনেক বকবকানির পর মেয়েটা যা উত্তর দিল তা শুনে আমি একদম হতবাক। এত পাগল মেয়েও হয় জানা ছিল না। কারণ মেয়েটা উত্তরে বলল,

~ আমি লেডি হিমু আর লেডি হিমুদের এমন সামান্য বিষয়ে হতাশ হলে চলবে না। চুরির পর আটকালেই কি চোরকে ধরতে পারতাম? নাহ ধরতে পারতাম না। শুধু শুধু সময় নষ্ট হত। হতাশ হলেই বা কি ব্যাগ তো ফিরে পাব না। আর বাকি রইল এত বিরক্ত করছেন তবে কেন বিরক্ত হচ্ছি না। তাহলে শুনুন লেডি হিমুরা এত স্বাভাবিক বিষয়ে বিরক্ত হয় না।

মেয়েটার কথাগুলো শুনে হাসিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা আমার। আমি হাসি সামলাতে না পেরেই বেশ জোরেই হাসি দিলাম। মেয়েটা আমার হাসি দেখে আশ্চর্য না হয়েই হাঁটা শুরু করল। আমি তখন মনে মনে ভাবলাম হুম লেডি হিমুদের এমন হাসিতে আশ্চর্য হওয়া বারণ। এদিকে ঘঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ দেড়ি হয়ে গিয়েছে। তাই দেড়ি না করেই মেডিকেলে যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম।

কেন জানি না শত কাজের মাঝেও মেয়েটার মুখটা ভেসে আসছিল। কেন জানি মেয়েটাকে দেখার জন্য মনটা আকুল হয়ে যাচ্ছিল। আমার মত ছেলের একটা মেয়েকে এভাবে ভালো লেগে যাবে কখনও বিশ্বাস করতে পারতাম না। মনে হচ্ছিল এ এক অন্যরকম আমি। সারাদিন মেডিকেলে থেকে কাজ শেষে বাসায় যাওয়ার পর ও মেয়েটার মুখ অদ্ভুত ভাবে চোখে ভাসতেছিল। কোনকাজেই যেন মন বসছিল না। পড়াশোনায়ও মন দিতে পারছিলাম না। ঐদিকে বিসিএস এর রেজাল্ট টা এখনও ঝুলে আছে। সারারাত পার করলাম এভাবে। পরদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়েই সে মেয়েটাকে আবার দেখলাম। দৌঁড়ে গেলাম মেয়েটার পাশে।

খেয়াল করলাম আজকে মেয়েটা বেশ স্বাভাবিক ভাবে বের হয়েছে। মেয়েটার স্বাভাবিক ড্রেসআপ দেখে একটু আশ্চর্য হলাম। মেয়েটাকে একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম~
~ এই যে লেডি হিমু, আজকে যে জুতা পড়ে বের হলেন কারণ কি? হিমুরা তো খালি পায়ে হাঁটে। আপনার পায়ে জুতা কেন? মেয়েটা আমার দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়ে বলল,
~ আপনার কোন সমস্যা?

আমি এবার মেয়েটার চোখ দুটো খেয়াল করলাম অসম্ভব মায়া মাখা চোখ। কিসের সাথে তুলনা করলে ভালো হবে জানি না। তবে মেয়েটার চোখ গুলো আমার কাছে কেন জানি না গরুর চোখের মত বড় বড় আর টানা টানা মনে হয়েছে। গরুর চোখে যেমন কাজল কালো রেখা থাকে তেমনি মেয়েটার চোখেও রয়েছে কাজলের ছটা। এর চেয়ে ভালো উপমা আমার কাছে জানা নেই। আমি মেয়েটার চোখ দুটো দেখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাহস দেখালাম না। কারণ কখন যে আবেগে ডুবে যায় বলা যায় না। তাই আমার চোখ দুটো নীচে নামিয়ে ফেললাম কিছুক্ষণের জন্য। তারপর নিজেকে সামলিয়ে পুনরায় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ আমার তো কোন সমস্যা নেই। তবে কালকে এক বেশে দেখলাম আর আজকে আরেক বেশে তাই মনে প্রশ্ন জাগল আর কি।

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ সময় আছে আপনার কাছে।
একটা অপরিচিত মেয়ে সময় জিজ্ঞেস করছে ব্যপারটা নিয়ে একটু চমকে গেলাম। চমকে গিয়েও নিজের চেহারায় সেটার প্রতিচ্ছবি আনলাম না। খুব ভদ্রভাবে মেয়েটাকে বললাম
~ নাহ মানে আমার তো হাসপাতালে ডিউটি আছে। কিজন্য বলুন তো?

মেয়েটা সোজা সাপটা বলল,
~ নাহ আমার আজকে ক্লাস করতে ইচ্ছা করছে না। তাই ভাবলাম আপনার সময় থাকলে আপনার সাথে আড্ডা দিব এক কাপ চা খাব আর আপনার সাথে পরিচিত হব। দেখে বেশ ভদ্র লাগছে। তাই আর কি।

মেয়েটার কথা শুনে মেয়েটাকে একটু পাগল পাগল মনে হচ্ছিল। কারণ একটা অপরিচিত ছেলের সাথে স্বাভাবিক কোন মেয়ে চা খেতে চাইবে না। তবুও মেয়েটার সাথে এক কাপ চা খাওয়ার সুযোগটা নষ্ট করতে মন চাইল না।
আমি মেয়েটাকে আমতা আমতা করে বললাম,
~ সত্যি বলতে আমার মেডিকেলটা সামনেই। আপনি চাইলে হাঁটতে হাঁটতে মেডিকেলে যেতে পারি। ঐখানে ক্যান্টিনে না হয় এক কাপ চা খাওয়া যাবে। তাহলে আমার ডিউটি তে যেতে দেড়ি হবে না।

মেয়েটা আমার কথা শুনে খানিকক্ষ ভাবার পর বলল,
~ চলুন যাওয়া যাক।
মেয়েটাকে নিয়ে মেডিকেলের পথে রওনা দিলাম। মেয়েটার সাথে সেদিনে প্রথম রাস্তায় হাঁটলাম পাশাপাশি। এ প্রথম কোন মেয়ের সাথে আমি এভাবে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা হুট করে জিজ্ঞেস করল
~ হাসপাতালে কিসের ডিউটি করেন?

~ আমি ইন্টার্ন ডাক্তার তো। রোগী দেখা বলতে পারেন।
~ অহ! আপনি ডাক্তার। বাহ! ভালোই হল কখনও কোন অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতে পারব।

এ বলে মেয়েটা একটা হাসি দিল। এই প্রথম কোন মেয়ের হাসি দেখে আমার মনে হল হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। খেয়াল করলাম মেয়েটার সামনের দাঁত দুখানা একটু বড়। বড় দাঁতওয়ালা মেয়ের হাসি যে সুন্দর হতে পারে ঐ মেয়েটাকে না দেখলে বুঝতাম না। আমি মেয়েটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা আমার নীরবতা দেখে আমার দিকে তাকাল। সাথে সাথে আমি আমার চোখটা নামিয়ে ফেললাম।

অল্প কিছুক্ষণ হাঁটার পর মেডিকেলের সামনে চলে আসলাম। মেয়েটাকে নিয়ে ক্যান্টিনে বসলাম। মামাকে দুই কাপ রঙ চা দিতে বললাম সাথে আদা দিয়ে। মামা চা নিয়ে আসল। চা টা হাতে নিলাম। এবার ও মেয়েটার একটা বিষয় লক্ষ্য করে বেশ অবাক হলাম। কারণ মেয়েটা কাপের থেকে চা পিরিজে ঢেলে খাচ্ছিল। বেশ শব্দ ও হচ্ছিল। শব্দ করে চা খেতে খেতে বলল,
~ এভাবে চা খাওয়ার মজাই আলাদা। একটু খেয়ে দেখেন না।

বেশ দুটানায় পড়ে গেলাম এভাবে চা খাব কিনা এটা ভেবে। মানুষ এভাবে চা খেতে দেখলে কি ভাববে সেটাও ভাবতে লাগলাম। তবে কেন জানি না ঐভাবে চা খাওয়ার লোভটাও সামলাতে পারছিলাম না। বেশ দুটানায় পড়েও একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে মেয়েটার মত চা খেতে লাগলাম। যদিও মেয়েটার মত এত শব্দ করে চা খায় নি তবে বেশ তৃপ্তি নিয়ে চা খেয়েছিলাম। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনে হল এখন তো মেয়েটার পরিচয় নেওয়া হল না। তাই চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বললাম,
~ আপনার নামটা কিন্তু জানা হল না।

~ রুপা। মোমতাহিনা সায়রা রূপা।
আমি হাসতে হাসতে বললাম
~ তার মানে হিমুর রুপা।
মেয়টা মুখ ভার করে বলল,
~ ঐ কথা আর বলবেন না। ঐ কথা বললেই গা শিউরে উঠে। হিমুর নাম আর নিবেন না।

~ কিন্তু কেন? গতকালের চরিত্র টা বেশ ভালো লেগেছে আমার। সত্যিই তো হিমু আছে সুতরাং লেডি হিমু থাকা দরকার। তবে গা শিউরে উঠে কেন?

রুপা প্রশ্নটা শুনে মুখটা গুমরা করে বলল,
~ কালকে যাওয়ার পর প্রথমেই বাবার সম্মুখীন হই। বাবা আমার এ অবস্থা আর খালি হাতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
~ কি রে তোর জুতা কোথায়? তুই কি বের হয়ে আর জুতা পড়িস নি? আর খালি হাতে কোথায় গিয়েছিলি? ব্যাগ কোথায় তোর।

আমি বাবার কথায় পাত্তা দিলাম না তেমন, কারণ লেডি হিমুদের সব কথায় পাত্তা দিলে হবে না। বাবা বারংবার প্রশ্ন করতেছে আমি কোন কথার জাবাব না দিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম। বাবা আর তেমন প্রশ্ন করল না। বিকেল বেলা খেয়াল করলাম কতজন লোক এসেছে। আমি তেমন পাত্তা না দিয়েই ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলাম।

বাবা আসলো আমার কাছে, আমার কাছে এসে বলল,
~ তোরা মা থাকলে কথাগুলো হয়ত তোর মা বলত। কিন্তু তোর মা তো আর নেই তাই আমিই বলছি। শুন মা তুই তো বড় হয়েছিস। তাই তোর জন্য একটা পাত্র দেখেছি। তারা আজকে দেখতে এসেছে। একটু তৈরী হয়ে বের হ।

বাবার কথায় আশ্চর্য হলাম না। কারণ হিমুদের আশ্চর্য হতে হয় না। বাবা বিয়ের কথা বলায় রাজি হলাম না। কারন হিমুরা বিয়ে করে না। বিয়ে করব না বলে শত চেষ্টা করেও বাবা আমাকে পাত্র পক্ষের সামনে নিয়ে যেতে পারল না। অগত্যা পাত্র পক্ষকে বিদায় দিতে হল।

বিদায় দেওয়ার পর আমি বেশ খুশি হলাম। কারণ লেডি হিমু হিসেবে নিজেকে বেশ প্রতিষ্ঠিত মনে হয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল রাতে। সারাদিন তেমন কিছু খাই নি রাতে ক্ষুধায় পেট টা চুচু করছিল। আমার বাসায় আমি আর বাবা থাকায় বাবায় রান্না করে আমার জন্য। রাতে খেতে গিয়ে দেখলাম খাওয়ার মত কিছু নেই। বাবাকে বললাম খাবার কোথায়। বাবা উত্তর দিল~
~ লেডি হিমুদের না খেলেও চলে।

প্রয়োজনীয় সব কাজ ববাই করে দেয়। তাই সব কিছু করা না দেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম আমার এ কাজটা করলে না যে। বাবা উত্তরে বলল,
~লেডি হিমুদের অন্য কারও সাহায্য লাগে না।

যখনেই যা জিজ্ঞেস করছিলাম শুধু বলছিল লেডি হিমুদের কারও সাহায্য নিতে হয় না। সারা রাত না খেয়ে বেশ শিক্ষা হয়েছে। তার উপর সব কাজ একা করেছি। তার উপর সব চুরে নিয়ে গিয়েছে। মোবাইল কিনার টাকা চেয়েছি দিল না উত্তরে বলল লেডি হিমুদের মোবাইলের দরকার হয় না। অনেক কষ্টে মোবাইল কিনার জন্য রাজি করালাম তবে বিনিময়ে এক ঘন্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শর্তারোপ করল। মোবাইল এর জন্য এটুকু করতে বাধ্য হলাম। হিমু হওয়ার শখ মিটে গিয়েছে পুরো। তাই লেডি হিমু হওয়ার চিন্তা ছেড়ে দিয়েছি। আমি রুপা চিরিত্রেই ভালো আছি।

আমি রুপার কথা শুনে একটা হাসি দিলাম। মেয়েটা সত্যিই আজব চরিত্রের। পাগলামির একটা বৈশিষ্ট্য রুপার মধ্যে আছে তা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। হাসতে হাসতে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম অনেক টা সময় পার করে ফেলেছি এখন উঠতে মন না চাইলেও উঠে ডিউটিতে যেতে হবে। তবে রুপার ঠিকানা টা নিয়ে নেওয়া দরকার। তাই রুপাকে বললাম,
~ আপনার বাসা যেন কোথায়? আর এখন কি সাথে মোবাইল নেই। নাহ মানে আমার ডিউটি আছে তো উঠতে হবে। পরে যেন আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারি তাই ঠিকানা চাওয়া।

লক্ষ্য করলাম রূপা চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বলল,
~ সি ব্লকের ছয় নম্বর বাসাটা। আতিক সাহেবের বাসা বললে চিনবে সবাই। আতিক সাহেব আমার বাবা। আর আপাতত তো নম্বর নেই। কারণ মোবাইল তো চুরে নিয়ে গিয়েছে। তবে আজকে মোবাইল কিনার পর সিমটা তুলব। আগের নম্বরটা দিয়ে যাই। যোগাযোগ করলে ঐ নম্বরে কল করবেন ঠিক আছে? রাতে হয়ত সিমটা খুলা পাবেন।
আমি মথায় হাত চুলকাতে চুলকাতে বললাম,
~ আচ্ছা ঠিক আছে।

রুপার নম্বরটা নিয়ে মামাকে চায়ের টাকা দিতে গেলাম। চায়ের টাকা দিতে গিয়েও মেয়েটার এক অদ্ভুত বিষয় দেখে পুনরায় অবাক হলাম। কারণ আমি মামাকে দশ টাকার নোট এগিয়ে দিলাম চায়ের বিল দেওয়ার জন্য। মামা বিল টা রেখে দিল। কিন্তু মেয়েটা তার ব্যাগ থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে আমাকে দিয়ে বলল,
~ এই যে আমার বিল টা।

~ বিল কেন দিচ্ছেন। আমি তো দিয়ে দিয়েছি বিল। আপনার আর বিল দেওয়া লাগবে না।
~ আমি কেন আপনার টাকায় চা খাব। আমি আপনার সাথে গল্প করেছি তার মানে এই না আপনার টাকায় চা খেতে হবে। আমি আমার চা আমার টাকাতেই খাব। আমি সহজে কারও কাছ থেকে কোনকিছু নিই না।

এ বলে রূপা রাগী চোখে নিয়ে আমার দিকে তাকাল। রূপার চোখের চাহুনিতে বেশ ভয় পেয়ে রুপার হাত থেকে পাঁচ টাকায় কয়েন নিয়ে ক্যান্টিন থেকে বের হলাম। উদ্দেশ্য ডিউটিতে যাওয়া। রুপার কাছে বিদায় নিয়ে মেডিকেলে ঢুকে গেলাম। এর মধ্যের আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আবরার আমাকে চেপে ধরে বলল,
~ কি রে জীবনে তো কোন মেয়ের দিকে তাকাইতে দেখলাম না। ঐ মেয়ে কে ছিল রে?

আমি ভ্রুটা কুঁচকে বললাম,
~ এত ভালো চিনি না আজকেই কথায় হয়েছে। এর আগে গতকাল দেখছিলাম।
আবরার আমার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষণ হা করে রইল। তার প্রধান কারণ হল আমি কোন মেয়ের সাথে মিশতাম না। তাই দুই দিনের পরিচয়ে একটা মেয়েকে নিয়ে চা খাব সেটা ও বিশ্বাস করতে পারছে না।

আবরারের অবস্থা দেখে বললাম,
~ কিরে এভাবে হা করে আছিস কেন? মুখে মাছি ঢুকবে।

আমার কথায় আবরারের হুঁশ ফিরে। বলার সাথে সাথে মুখটা বন্ধ করে বলল
~ তুই একটা মেয়েকে দুইদিনের পরিচয়ে চা খেতে নিয়ে এসেছিস এটা তো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। এটা শুনার পর হা হয়ে থাকাটা কি অস্বাভাবিক কিছু?
আমি আবরারের দিকে তাকিয়ে তার পিঠে একটা চাপর দিয়ে বললাম,
~ বাদ দে চল। মানুষের জীবনে কখন কোন দিকে মোর নেয় বলা যায় না।

অবরার এক বিন্দু হেসে বলল,
~ তা একদম ঠিক বলেছিস। চল এবার ডিউটিতে চল। এমনিতেও আজকে একটু দেড়ি করে ফেলেছি।
তারপর দুজন ডিউটিতে গেলাম। আর ডিউটিতে মন দিলাম। শত ব্যস্ততার মাঝেও রূপার চা খাওয়ার শব্দটা যেন কিছুক্ষণ পর পর মাথায় বাজত আর অদ্ভুত এক অনুভূতির শিহরণ দিত।

সারাদিন ডিউটি করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরার জন্য মেডিকেল থেকে বের হলাম। তবে হেঁটে ফিরতে মোটেও ভালো লাগছিল না। তাই পনের টাকা দিয়ে একটা রিকশা ভাড়া করলাম। রিকশা নিয়ে বাসার সামনে গেলাম। রিকশাওয়ালা মামাকে টাকা দিতে গিয়ে দুইটা দশ টাকার নোট দিলাম। রিকশাওয়ালা মামা বলল,
~ মামা ভাংতি দেন। আমার কাছে পাঁচ টাকা খুচরো নেই।

আমি সারা মানিব্যাগ ঘেটে কোন খুচরো পেলাম না। রুপার পাঁচ টাকার কয়েনটা শুধু পেলাম। তবুও মামাকে বললাম,
~ মামা একটু আশেপাশে দেখেন ভাংতি পান কিনা।

মামা আমার হাতে থাকা পাঁচ টাকার কয়েনটা দেখে বলল
~ আপনার হাতেই তো পাঁচ টাকার কয়েন আছে ঐটা দিয়ে দশ টাকা একটা ফিরিয়ে নেন।
কিন্তু আমার মন কয়েনটা দিতে মোটেও সায় দিল না। তাই মামাকে বললাম,
~ থাক আর পাঁচ টাকা দিতে হবে না। পাঁচ টাকা রেখে দিন।

পাঁচ টাকা বেশি পেয়ে মামা হাসতে হাসতে বলল আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘ দিন বাঁচিয়ে রাখুক। এ বলে চলে গেল।
“এসব মানুষগুলোকে খুব অল্প দিয়েই খুশি করা যায়। অল্প পাঁচ টাকা আমাদের কাছে খুব বেশি কিছু না হলেও এ মামার কাছে অনেক কিছু। তাদেরকে উচ্চশ্রেণির মানুষের মত খুব বেশি কিছু দিতে হয় না। অপরদিকে উচ্চ শ্রেণীর মানুষগুলোকে অনেক কিছু দেওয়ার পর ও এরা খুশি হয় না সহজে। আর এদের মত নিম্নবিত্ত মানুষ গুলোকে অল্প কিছুই দিলে তারা যে খুশির হাসিটা দেয় সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য।”

বাসায় ফিরে ভাত বসিয়ে ভাবলাম রূপার দেওয়া নম্বরটায় কল দেওয়া যাক একটু। যে ভাবনা সে কাজ। রুপাকে কল দিলাম। কল দেওয়ার পর লক্ষ্য করলাম কলটা ঢুকেছে। তার মানে নতুন মোবাইল কিনেছে। প্রথম দুইবার কল ধরে নি। তৃতীয়বার কল দেওয়ার পর ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসল। বুঝতে আর বাকি রইল না এটা রুপার কন্ঠ। রুপা বলল
~ হ্যালো কে?

~ আমি অরন্য।
রুপা শক্ত গলায় বলল,
~ অরন্য কে? চিনতে পারলাম না। আর কত হাবিজাবি পরিচয়ে কল দিবি।

আমি কিছুটা অবাক হলাম রুপা আমাকে তুই করে জাবাব দিল তাই। আমার বেশ রাগ হল কথাটা শুনে। কারণ সকালে চা খেল আর এখনেই আমাকে চিনতে পারছে না তার উপর তুইতোকারি করছে। তবুও নিজের রাগটা নিবারণ করে বললাম,
~ ঐ যে সকালে চা খেয়েছিলাম একসাথে মনে আছে? আপনি আমাকে আপনার মোবাইল নম্বরটা দিলেন। ভুলে গিয়েছেন নাকি?

এবার রুপা একটা হাসি দিল। রুপার হাসিটার এক অসম্ভব সুন্দর শব্দ পেলাম। মুহুর্তেই মন ছুয়ে গেল। রুপা হাসি দিয়ে বলল,
~ অহ! কি যে করি না আমি। আপনার সাথে এত কথা বললাম সকালে আর আপনার নামটাই জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। এজন্যই আমি চিনতে পারছিলাম না। মনে কিছু নিবেন না। আমি তো ভেবেছিলাম সৌরভ। তাই এত রাগ রাগ গলায় কথায় বলছিলাম। ছেলেটা বিভিন্ন নাম্বার দিয়ে কল দেয় তো তাই।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
~ এ সৌরভটা আবার কে? যার জন্য আমি বকা খেলাম।

মেয়েটা গলাটা একটু নীচু করে বলল,
~ মহা বেয়াদব একটা ছেলে। আমাকে পছন্দ করে। পাত্তা দেই না তাই বিভিন্ন নম্বর থেকে কল দেয়।
~ তা ছেলেটা কি করে?

~পড়াশুনা করে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে। সব দিক দিয়ে ঠিকেই আছে তবে আমার ভালো লাগে না। কেন জানি না দেখলেই গা জ্বলে খুব। তা আপনার কি অবস্থা।
~ হ্যাঁ ভালো। আপনার বাসায় কে কে থাকে?
~মবাবা আর আমি।
~ আপনার মা কোথায় থাকে?

~ মা মারা গিয়েছে আমার যখন বয়স ছয় ছিল। তারপর আর বাবা বিয়ে করে নি। আমি আর বাবায় একসাথে থাকি।
রূপার কথা শুনে বেশ খারাপ লাগল। তাই রূপাকে শাত্ত্বণা দিয়ে বললাম,
~ আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য। আপনার কষ্টটা বাড়িয়ে দিলাম এমন প্রশ্ন করে। এজন্য দুঃখিত আমি। মনে কিছু নিবেন না।

রুপা একটা হাসি দিয়ে বলল,
~ আরে ধুর কি যে বলেন না। মনে কিছু কেন নিব? তা আপনার বসায় কে কে আছে?
~ আমরা এক ভাই এক বোন। বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। লন্ডন থাকে। আর বাবা, মা বেশ কিছুদিন আগে চলে গিয়েছেন উপরে। ধানমন্ডি বাসা আছে দুইটা ভাড়া দিয়ে রাখি। আর এখানে মেডিকেলের পাশেই একটা বাসা ভাড়া করে থাকি।

মেয়েটা আমার কথা শুনে ধীর গলায় বলল,
~ আপনি আমার থেকেও অভাগা। বাবা, মা কেউ নেই।

আমি এক চিলতে হাসি দিয়ে বললাম,
~ আমি বাবা মায়ের আদর পেয়ে বড় হয়েছি। দুই বছর আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে দুজনেই মারা গিয়েছে। ঐযে বললাম না আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। হয়ত এতেও ভালো কিছু রয়েছে। তা আপনি কিসে পড়েন?

~ ন্যাশনাল ভার্সিটিতে অনার্স করতেছি পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে।
~ ওহ আচ্ছা খুব ভালো
এক, কথা, দুই কথায় অনেক কথা হতে লাগল। কথা বলতে বলতে অনেকক্ষণ পর একটা গন্ধ নাকে ভেসে আসল।


পর্ব ২৩

গন্ধটাকে পাত্তা না দিয়ে রুপার সাথে কথা বলতে লাগলাম। অল্প সময় পর গন্ধটা আরও তীব্র হলো। কিসের গন্ধ বুঝতে না পেরে রূপাকে বললাম
~ আপনি কি একটু লাইনে থাকবেন। কিসের একটা গন্ধ আসতেছে একটু দেখব।
~ আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি দেখুন আমি লাইনেই আছি।

আমি গন্ধটার দিকে এগুতে লাগলাম৷ খেয়াল করলাম গন্ধটা রান্না ঘর থেকে আসতেছে। তাই দেড়ি না করেই রান্না ঘরে গেলাম। রান্না ঘরে গিয়ে আমার মাথায় হাত পড়ল। কারণ রুপার সাথে কথা বলতে বলতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম চুলায় ভাত বসিয়েছি। এজন্য ভাত পুড়ে পুড়া গন্ধ বের হচ্ছিল। তখন কি করব বুঝতে না পেরে তাড়তাড়ি চুলা বন্ধ করে রুপাকে বললাম,
~ সত্যি বলতে কি, একটা আকাম করে ফেলেছি।

খেয়াল করলাম ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ আসছে না। বুঝতে পারলাম রূপা কলটা আগেই কেটে দিয়েছে। তাই রুপাকে পুনরায় কল দিলাম। রূপা কলটা ধরে বলল,
~ কিসের গন্ধ ছিল বের করতে পেরেছেন কি? আপনি কথা বলছিলেন না তাই ভাবলাম ফোনে টাকা নষ্ট করে লাভ কি। তাই কেটে দিয়েছিলাম। মনে কষ্ট নিবেন না।

ভাত পুড়ে যাওয়ায় মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। কারণ এখন নতুন করে ভাত রান্না করে খাওয়ার মত রুচি বা শক্তি আমার নাই। আমি কষ্টভরা গলায় বললাম,
~ নাহ, মনে কষ্ট নিই নি। আমি ভাত বসিয়েছিলাম তো কিন্তু আপনার সাথে কথা বলতে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই কখন যে ভাত পুড়ে গিয়েছে খেয়ালেই করে নি। গন্ধটা ভাত পুড়ার ছিল।

~ হায় আল্লাহ্ কি বলেন! এখন খাবেন কি? তাহলে আবার ভাত রান্না করুন।
~ এখন নতুন করে ভাত রান্না করে খাওয়ার রুচি নেই। রান্না করা বহুৎ ঝামেলা। আর ঝামেলা করতে পারব না। একেবারে কালকে সকালে খাব। (হতাশা গলায়)
~ তাহলে আর কি করবেন। না খেয়েই থাকুন।

~ হ্যাঁ তাই তো করতে হবে। (অসহায় গলায়)
রূপা হুট করে বলে বসল~
~ এখন রাত নয়টা বাজে। একটা কাজ করুন আমার বাসার সামনে একটু আসুন। আমি বাইরে বের হয়ে আপনাকে নিয়ে একটু ঘুরতে যাব নে। তখন না হয় বাইরে থেকে কিছু খেয়ে নিবেন।

এত রাতে অকারণে যদিও এর আগে কখনও বের হই নি তবে রূপার কথা ফেলে দেওয়ার মত কোন উপায় ছিল না। তাই রূপাকে বললাম,
~ আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি তৈরী হয়ে বিশ মিনিটের মধ্যেই আসছি।
~ আচ্ছা ঠিক আছে।

কলটা কেটে তৈরী হতে নিয়ে বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলাম কিভাবে গেলে ভালো হবে এটা ভেবে। বেশ চিন্তা করে নিজেকে পরিপাটি করে বের হলাম গন্তব্য রূপার বাসা। রূপার বাসার সামনে গিয়ে রূপাকে কল দেওয়ার আগেই একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। রূপার বাসায় কুকুর আছে রূপাতো বলে নি। অপরদিকে আমি কুকুরকে অনেক ভয় পাই। কোন গতি না পেয়ে রূপাকে কল দিলাম। কল দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,
~ আপনার বাসায় যে কুকুর আছে বললেন না তো। কুকুরের দৌঁড়ানি খাব না তো?

রূপা এক গাল হাসি দিয়ে বলল,
~ কি যে বলেন না। এ কুকুর আপনাকে কিছুই করবে না। এটা আমাদের পোষা কুকুর।
~ কিছু করবে না মানে? যে হারে ঘেউ ঘেউ করতেছে মনে হচ্ছে তো এখনেই কামড় দিয়ে বসবে। কুকুরের কামড় কিন্তু অনেক মারাত্মক।
~ ভালো করে দেখুন কুকুরটা বাঁধা। আপনাকে কিছুই করতে পারবে না। আপনাকে আমি জানালা দিয়ে দেখতে পারতেছি। আপনি একটু ডান দিকে এসে উপরের দিকে তাকান।

কুকুরটাকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম সত্যিই কুকুরটা বাঁধা। কুকুরটাকে বাঁধা দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এবং দেড়ি না করেই রূপার কথা মত ডানদিকে এসে উপরের দিকে তাকালাম। রূপা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
~ এই যে আমি দেখতে পারছেন? একটা দঁড়ি দিয়ে ব্যাগ ফেলব একটু ব্যাগটা ধরবেন ঠিক আছে।

আমি বুঝতে পারছিলাম না রূপা ঠিক কি করতে চাচ্ছে। রূপার মাঝে যে একটা পাগলামির অভ্যাস আছে সেটা বেশ ভালো বুঝতে পেরেছিলাম। তাই এতশত না ভেবে জানালার নীচে দাঁড়ালাম। তারপর উপর থেকে খেয়াল করলাম একটা ব্যাগ নীচের দিকে পড়ছে। আমি দঁড়ি থেকে ব্যাগটা খুলে রূপাকে কল দিয়ে বললাম,
~ ব্যাগাটা দঁড়ি থেকে খুলেছি। দঁড়িটা উপরে তুলে ফেলুন এবার। কিন্তু এ ব্যাগে কি? আপনি কি নীচে নামবেন না।

রূপা কথাটা একটু টান দিয়ে বলল,
~ মাথা খারাপ আপনার? এত রাতে বের হব? বাবা জানলে হাড় ভাঙ্গবে আমার। সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে বের হওয়া নিষেধ। আপনি এবার চলে যান।
রূপার কথা শুনে হালকা অভিমান জমল মনে। ও বের হবে বলেই আমি তখন বের হয়েছিলাম তা না হলে বের হতাম না। অভিমানী গলায় বললাম,
~ তাহলে আসতে বললেন কেন? আমি তো শুধু আপনার সাথে দেখা করব বলে বের হয়েছিলাম।

রূপা একটা অট্ট হাসি দিয়ে বলল,
~ আপনার মনে হয় বেশ রাগ হচ্ছে। রাগ হওয়ার মত কিছু হয় নি। ব্যাগটা দেওয়ার জন্যই আসতে বলেছিলাম।

অমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম~
~ এ ব্যাগে কি আছে? বলা যাবে কি?
~ আছে কিছু একটা। আপনি বাসায় গিয়ে ব্যাগটা খুলে দেখুন কি আছে। বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না।

আমি মন ভাঙ্গা নিয়ে বাসায় গেলাম। মনে মনে একটু রাগ ও হল রূপার উপর। ভাবতে লাগলাম একটা অপরিচিত মেয়ের জন্য আমার এত রাগ অভিমান আসছে কেন? রাগ অভিমান তো তাদের জন্য আসে যারা অনেক পরিচিত এবং আপন হয়। অথচ এ মেয়েটার সাথে পরিচয় মাত্র দুইদিনের তাহলে এত রাগ অভিমান মায়া কেন কাজ করছে। এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় গেলাম। বাসায় গিয়ে ব্যাগটা খুলে বিস্মিত হয়ে গেলাম।

এ মেয়েটার মধ্যে পাগলামির গুণ আছে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু মায়াও আছে সেটা বুঝতে পারিনি। ব্যাগে দুইটা বাটি ছিল এক বাটিতে চিংড়ি মাছের তরকারি ছিল আরেক বাটিতে ভাত। একটা অপরিচিত মেয়ে আমার জন্য এমন করেছে ব্যাপারটা বেশ আনন্দদয়ক লাগল। সত্যিই মেয়েটার মাঝে অদ্ভুত ভালোলাগার একটা বিষয় আছে।

হাতে বাটিটা নিয়েই রূপাকে কল দিলাম। রূপা কলটা ধরে বলল,
~ বাটিতে কি আছে দেখেছেন? এজন্যই আসতে বলেছিলাম। আমার জন্য আপনার ভাত পুড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাতে না খেয়ে থাকলে মোটেও ভালো লাগত না। তাই বাসায় যা ছিল তাই দিলাম।
~ আরে কি যে বলেন না আপনার জন্য কেন নষ্ট হবে। এতকিছু না করলেও পারতেন। রাতে না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে আমার।
~ আরে ইয়ার এটা তেমন কিছু না। খেয়ে নিন।

রূপার আরে ইয়ার কথাটার সাথে সেদিন প্রথম পরিচিত হই। এটা তার চিরাচায়িত ডায়লগ ছিল। সেদিন রূপার হাতের রান্না খেয়ে দ্বিতীয়বারের মত রূপার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। সেদিনের পর থেকে রূপার সাথে আমার পথচলা শুরু। তবে রূপার কিছু অদ্ভুত পাগলামি ছিল। সবসময় সে কোন না কোন পাগলামি করত।

যদিও তার পাগলামিগুলো আমার বেশ ভালো লাগত। কারণ তার পাগলামির মাঝেও অন্যরকম ভালোবাসা লুকিয়ে থাকত। রূপা খুব মিশুক ছিল অল্প দিনের মধ্যে সে খুব আপন করে নিল আমাকে। নিজের অজান্তেই তাকে আমি অনেক ভালোবেসে ফেললাম। এক বছরের একটা সম্পর্কটাকে মনে হয়েছিল একশ বছরের একটা সম্পর্ক। এর মধ্যে আমি ডাক্তার হয়ে বের হয়ে গেলাম। সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে চলে আসলো।

রূপার পাগলামির দিকগুলো তাহলে বলি আপনাকে। একদিন রূপা রাত তিনটায় শীতের কনকনে রাতে ফোন দিয়ে বলল,
~ আরে ইয়ার আমার তোমাকে অনেক দেখতে মন চাচ্ছে তুমি একটু আসো তো। একদম ভালো লাগছে না।

আমি রূপার এমন আবদার শুনে মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম রাত তিনটা বাজে। এসময় বাইরে বের হতে বলছে কেন? মনে মনে ভাবলাম রূপার কি কোন কিছু হয়েছে। আমার মধ্যে নিমিষেই অস্থিরতা চলে আসলো। অস্থির হয়ে বললাম,
~ তোমার কি কিছু হয়েছে? এত রাতে আসতে বলতেছ যে। কোন ঝামেলায় পড়েছ নাকি?

~ আরে ইয়ার কিছু হয় নি। তোমাকে দেখতে মন চাচ্ছে। তাই আসতে বলতেছি। একটু আসো। একটু দেখা হলেই চলে যেও।
ঘুম ঘুম গলায় বললাম,
~ রূপা এত রাতে আসতে পারব না। কত ঠান্ডা বাইরে। ঘুমাও তুমি সাকালে দেখা হবে।

কিন্তু কে শুনে কার কথা। একরোখা ছিল অনেক, তার একরোখামিতে কখনও পেরে উঠতাম না। সেই রাতেই বের হয়ে গেলাম রূপার বাসার সামনে যাওয়ার জন্য। কনকনে শীতের রাতে রূপার বাসার সামনে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কল দিলাম রূপাকে। চার, পাঁচবার কল দেওয়ার পর রূপা ঘুম ঘুম গলায় বলল,
~ অরন্য আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। এখন কম্বলের নীচে থেকে বের হতে মন চাচ্ছে না তুমি চলে যাও। তার উপর এত শীতে বের হয়ে জানালার পাশে আসতে পারব না। কষ্ট করে এসেছ এতেই খুশি। যাও গিয়ে ঘুমাও।
মেজাজটা চড়ে গেল খুব, বকতে যাব এর মধ্যেই ফোনটা কেটে বন্ধ করে ফেলল।

রাগ নিয়ে বাসায় গেলাম। মনে মনে ভাবলাম কালকে এর জন্য বকব। এসব ভেবে আবার ঘুমালাম। সকাল বেলা কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল। ঘঁড়ির কাটায় খেয়াল করলাম ছয় টা ত্রিশ বাজে। এত সকালে আমার বাসায় কে আসবে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঘুমঘুম চোখ নিয়ে দরজা খুলে বেশ অবাক হলাম।

কারণ দেখলাম দরজার সামনে রূপা দাঁড়ানো। রূপাকে দেখেই রূপার প্রতি থাকা সব অভিমান চলে গিয়েছিল। কারণ রূপার ঐ চোখে তাকিয়ে যেন সবকিছু বেমালুম ভুলে যাওয়া যায়। রূপা এ প্রথম এ বাসায় এসেছে। না জানি দারোয়ানকে কি বলে ঢুকেছে। রূপার পাগলামির উপর আমার একদম ভরসা নেই। রূপা আমার দিকে তেড়ে এসে বলল,
~ আরে ইয়ার এখনও এত ঘুম কিসের? উঠো। সাড়ে ছয়টা বাজে। এত সকাল পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ কেন।

আমি মুখে হাই তুলতে তুলতে বললাম,
~ শীতের সকালে এটাকে এত সকাল বলে না। আবার মাথায় কি ভূত চাপল একদম বাসায় চলে আসলে যে। এত সকাল সকাল আসলে কি করে?

রূপা আমার মাথার চুল টেনে ধরে বলল,
~ এত কিছু তোমাকে জানতে হবে না। আমার কাছে সব কাজেই সহজ। আমি সব পারি। এবার উঠো। ঘরে কি কি আছে বলো রান্না করে নাস্তা করব।
~ তা না হয় রান্না করলে সমস্যা নেই। তবে এখানে এত সকালে আসলে যে তোমার বাবা কিছু বলবে না?

(এরপর রূপা যা বলল তা শুনে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। সত্যিই মেয়েটা বড্ড পাগল)
~ বাবাকে রাতে দুধের গ্লাসে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছি। চিন্তা করো না মরবে না।

একদম অল্প পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ দিয়েছি। শুধু কড়া ঘুম হবে। সকাল দশটার আগে ঘুম ভাঙ্গবে না বাবার। তখন আমাকে না দেখলেও সমস্যা নেই, কারণ তখন আমি কলেজে যাওয়ার জন্য বের হই। আর বাসায় অটো লক আছে। আমি লক করে আসি একটা চাবি আমার কাছে আরেকটা চাবি বাবার কাছে থাকে। কোন সমস্যা হবে না।

আমি মথায় হাত দিয়ে বললাম
~ তোমার কি পাগলামি অভ্যাস যাবে না। এমন করার কি কোন দরকার ছিল। নিজের বাবাকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছ লুকিয়ে। কি যে করো না তুমি। তোমাকে নিয়ে আর পারতেছি না। কবে এসব পাগলামি যাবে তোমার।

রূপা আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
~ ব্যাগে করে কফি আর গুড়ো দুধ নিয়ে এসেছি। আমি কফি বানিয়ে দিচ্ছি। আমার কফি খেলে তোমার সব ঘুম চলে যাবে, দেখবে একদম চাঙ্গা হয়ে গিয়েছ।
~ থাক রূপা আর পাগলামি করতে হবে না। তুমি ঐ চেয়ারটাই বসে বিশ্রাম করো আর আমি একটু ঘুমাই। বেশ ঠান্ডা পড়েছে, শীত শীত লাগছে অনেক। এ বলে আমি একটু এগিয়ে যেতে নিলাম।

রূপা আমার গেন্জি টেনে ধরে বলল,
~ আরে ইয়ার কোথায় যাচ্ছ। আমি এত কষ্ট করে দেখা করতে আসলাম তোমার সাথে কফি খাব বলে আর তুমি চলে যাচ্ছ। একদম যাবে না এখানে বসো।
আমি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম রূপা যে একরোখা আমাকে যেতে দিবে না। তাই ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে বসলাম রূপার পাশে। রূপা বকবক করে যাচ্ছিল আর কফি বানাচ্ছিল। তখন ওর চাঞ্চলতা দেখে আমার চোখ থেকে নিমিষেই ঘুম চলে গেল।

রূপার দিকে তাকিয়ে রূপার কথায় মনোযোগ দিলাম রূপা তখন কফি বানানোর রেসিপিটা শিখিয়েছিল। ঐ যে আপনাকে বানিয়ে খাওয়ালাম আজকে, সেটা রূপার কাছ থেকেই শিখা। সেদিন রূপা রেসিপিটা বলতেছিল আর তার দিকে আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। রূপা সমপরিমাণ কফি, চিনি আর পানি নিয়ে বলল,
~ এবার এটাকে ঘুটতে হবে।

এই বলে কাটা চামচ দিয়ে ঘুটতে লাগল আর মুখের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল। আমি রূপার অঙ্গভঙ্গি দেখে ভিতরে ভিতরে হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছিলাম। রূপার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কোন যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেমেছে। এত হাসি পাওয়ার পরও নিজেকে বেশ দমিয়ে রাখলাম। কারণ ভুলক্রমে হেসে দিলে রূপার যে রাগ আর পাগলামির স্বভাব আমার বারোটা বাজাবে। তাই নিজের হাসি দমিয়ে রূপাকে দেখতে লাগলাম। এর মধ্যে রূপা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নাড়ানো বন্ধ করল।

খেয়াল করলাম মিশ্রণ গুলো ফোমের মত হয়েছে। তারপর গরম পানিতে পরিমাণমত গুড়ো দুধ নিয়ে ফোমটা ঢেলে দিয়ে মিশিয়ে নিল। আর আমার দিকে বাড়িয়ে দিল খেতে। খাওয়ার পর বেশ ভালোই লেগেছিল। তার উপর যে যুদ্ধ করে বানিয়েছে ভালো না হলেও ভালো বলাটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেল। তবে কফিটা সত্যিই অসাধারণ হয়েছিল। সেই যে কফির রেসিপিটা শিখেছিলাম আজও ভুলে নি।

রূপার কথা অণুযায়ী সত্যি সত্যি কফিটা খাওয়ার পর ঘুম চোখ থেকে পুরোপুরি উড়ে গেল। কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে বললাম,
~ সত্যিই রূপা তোমার কফিতে যাদু আছে। কফিটা খাওয়ার পর শরীরটা একদম চাঙ্গা হয়ে গিয়েছে।

~ আরে ইয়ার বলেছিলাম না একদম চাঙ্গা হয়ে যাবে। আচ্ছা আর কি খাওয়া যাই বলতো। তোমার ঘরে কি কি আছে।
~ এখানেই আছে সব। এর বাইরে কিছু নেই। ব্যাচেলর মানুষ কোনরকমে রান্না করে খাই আর কি।

রূপা ভালো করে খেয়াল করে হাতে আলু নিয়ে বলল,
~ আলু পুড়া খাবে। অনেক মজা। একবার খেলে এর স্বাদ জীবনে ভুলবে না।

~ আলু পুড়া কি? এরকম তরকারির নাম তো আগে শুনি নি। (বিস্ময়ের সুরে)
~ দাড়াঁও দেখাচ্ছি। গ্রামে গেলে ঐখানে মাটির চুলায় গরম ছাই এর মধ্যে পুড়িয়ে খেতাম, শহরে তো আর মাটির চুলা নেই। তাই গ্যাসের চুলাতে পুড়িয়ে খাই। বেশ মজা লাগে। এই যে গ্যাসের আঁচটা কমিয়ে এবার আলুগুলো দিয়ে দিব। এ হালকা আঁচে আলুগুলো সিদ্ধ হয়ে যাবে।

এ বলে রূপা একটার পর একটা কথা বলতে লাগল। রূপার কথাগুলো শুনে বেশ মজা পেতাম। কারণ সে দুনিয়ার সবচেয়ে বেরসিক কথাটাকেও সবচেয়ে রসিকভাবে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে উপস্থাপন করত। আর কতক্ষণ পর পর হি হি করে হাসি দিয়ে উঠত। আমার দিক থেকে কথা হোক আর না হোক ও আপন মনে কথা বলে যেত। আমি শুধু ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতাম। কথার ফাঁকে গ্যাসের চুলাটা নিভিয়ে বলল,
~ আলুপুড়া হয়ে গিয়েছে। দাঁড়াও আমি তুলে আলুর খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছি।

এ বলে আলুটা তুলে খোসা ছাড়ানোর শেষে আমাকে দিল। আমি গরম গরম মুখে নিলাম। সত্যি বলতে এটার স্বাদ ছিল অসাধারণ।
রূপার হাতের রান্না অনেক মজা ছিল। যা রান্না করত তাই হাত চেটে খাওয়ার মত ছিল। কিন্তু রূপার বিশেষ চা খেয়ে আমার বারোটা বেজে যেত।

রিলেশনের সাতমাস পার করার পর রূপা তার বাবার সাথে আমাকে বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। রূপার বাবার সাথে বেশ ভালোই ভাব জমে গিয়েছিল। প্রতিদিন একবার যেতে বলত। আমিও সময় পেলেই ছুটে যেতাম। তবে সেখাইনেই ঘটে বড় বিপত্তি। প্রতিদিন রূপার স্পেশাল চা খেয়ে আমার যাই যাই অবস্থা। অপরদিকে রূপার রাগের কাছে হার মেনে আমাকে এসব স্পেশাল চা প্রতিদিন হজম করতে হত। না পারতাম বলতে না পারতাম খেতে। তাহলে কয়েকটা স্পেশাল চায়ের বর্ণনা বলেই ফেলি।

সেদিন রূপার বাসায় প্রথম গিয়েছিলাম ওর বাবার সাথে পরিচিত হতে। দরজা খুলেই আঙ্কেলকে প্রথম দেখে সালাম দিলাম। আঙ্কেল সালাম গ্রহণ করে বসতে বললেন। আমিও বাধ্য ছেলের মত বসে পড়লাম। তারপর আঙ্কেল আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করল। আমি বাধ্য ছেলের মত সবকিছুর জবাব দিলাম। অতঃপর আঙ্কেলের আমাকে বেশ ভালো লেগে গেল। সেই খুশিতে আমার প্রিয়তমা রূপা আমার জন্য একটা স্পেশাল চা বানিয়ে আনল।

আমি চা টা খেয়ে কি করব বুঝতে পারছিলাম না। মনে মনে ভাবছিলাম চায়ের স্বাদাটা এমন কেন? চায়ে কি এমন দিল যে আমার গলা এমন জ্বলে গেল। আঙ্কেলের সামনে তেমন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না। অসহায় দৃষ্টিতে রূপার দিকে তাকালম। রূপা আমাকে ইশারা দিল চা টা যেন পুরো খাই। কিন্তু এ চা আমি কিভাবে খাব বুঝতে পারছিলাম না।

কিন্তু এ চা না খেলে পাগলিটা আবার ক্ষেপে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে চা টা খেলাম। সেদিন চা টা খেয়ে বাসায় ফিরার পর আমার পেটের বারোটা বাজল। কোনরমে ঔষধ সেবন করে পেটটাকে বারোটা বাজার হাত থেকে রক্ষা করলাম। অতঃপর রূপাকে কল দিলাম। রূপা কল ধরার সাথে সাথে বলে উঠল~
~ আরে ইয়ার আমার চা টা কেমন হয়েছিল বলো তো। তোমার জন্য একদম স্পেশাল রেসিপি প্রয়োগ করে বানিয়েছি।

~ ভালো হয়েছে। কিন্তু তুমি চা তে কি দিয়েছিলে? চা টা একটু অন্যরকম স্বাদের মনে হয়েছিল।
রপা হাসতে হাসতে যা বলল তা শুনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কেউ চা এ এমন কিছু দেয় জানা ছিল না। আমার মাথা কিছুক্ষণ এর জন্য স্থির হয়ে গিয়েছিল রূপার কথা শুনে।

তার উপর নাম দিয়েছে স্পেশাল রেসিপি। কারণ রূপা বলল,
~ শুনো আজকে তোমাকে মরিচের চা বানিয়ে দিয়েছি। মরিচের গুড়ো আর কাঁচা মরিচ হালকা বেটে দিয়েছিলাম ভালো হয় নি চা টা। ভেবেছি তোমাকে এরকম স্পেশাল চা আরও বানিয়ে খাওয়াব আর তুমি আমাকে কেমন হয় বলবে। যদি রিভিউ ভালো পাই তাহলে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফেলব। আর নাম দিব রূপার রান্নাবান্না। কেমন হবে বলো তো।

আমি অসহায় হয়ে ভিতরে ভিতরে বলে উঠলাম তোমার দিল কি দয়া হয় না। এমন চা খাইয়ে আমাকে মারার প্ল্যান করতেছ নাকি। তবুও মনের কথাটা মনে রেখে মুখে একটা হাসি দিয়ে অসহায় গলায় বললাম,
~ তুমি বানিয়েছ তো অনেক মজা হয়েছে। তোমার স্পেশাল চা বলে কথা। তোমার ইউটিউব চ্যানেল একদিনেই ফেমাস হয়ে যাবে এমন চায়ের রেসিপি পেয়ে। রূপার রান্নাবান্না বলে কথা।

এটুকু প্রশংসা না করলে ঝড় বয়ে যেত আমার উপর। কারণ রূপার মাথায় কখন কি চড়ে বসে আর কিসে রেগে বসে বুঝা যায় না। তবে কেন জানি না, এ পাগলিটার এগুলোর জন্যই ওকে বেশি স্পেশাল মনে হয়। কেন জানি না পাগলিটার পাগলামিগুলো আমার ভীষণ ভালো লাগত। বলা যায় একটা মিষ্টি যন্ত্রণা।

তবে স্পেশাল চায়ের কাহিনী আরও কিছুদিন বহাল ছিল। সেদিন দ্বিতীয় বারের জন্য রূপার বাসায় গিয়েছিলাম তার বাবার সাথে দেখা করতে। সত্যি বলতে তার বাবার সাথে দেখা করাটা মুখ্য বিষয় ছিল না। মুখ্য বিষয় ছিল রূপাকে একটু ভালোভাবে দেখা। রূপার বাসায় গিয়ে রূপার বাবার সাথে কথা বলতে লাগলাম। এক পর্যায়ে রূপার স্পেশাল চা হাজির হল। রূপার এ চায়ের রঙটা জানি কেমন ছিল। ভয়ে ভয়ে রূপার দিকে তাকালাম। রূপা আমার চাহুনি দেখে বলল,
~ অরন্য চা টা খেয়ে নাও পুরো।

আমি অসহায় গলায় বললাম
~ আঙ্কেলকে এক কাপ চা দাও।
~ বাবা দুধ চা ছাড়া অন্য চা খায় না। আর বাবা একটু আগে চা খেয়েছে। এটা শুধু তোমার জন্য স্পেশাল করে বানিয়েছি। খাও। (রাগী গলায়)
আমি মনে মনে ভাবলাম আল্লাহ্ই জানে কি স্পেশাল চা আমাকে দিয়েছে। ভয়ে ভয়ে স্পেশাল চা মুখে দেওয়ার পর চায়ের স্বাদের বাহারে আমার গলা থেকে মাথা পর্যন্ত ঝিম ধরে গেল।

পর্ব ২৪

কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলাম। কারণ চা টা এত তেঁতো ছিল যে মুখে বর্ণণা করার মত কোন শব্দ পাচ্ছি না এখন। আমি তো আমার শত্রুকেও কোনদিন এ চা খাওয়াব না। কারণ এ চা খেলে তেঁতোর চুটে যে কেউ অক্কা পাবে। ঝিম ধরে মনে মনে ভাবতে লাগলাম কোন ক্লাসে জানি পড়েছিলাম
“তিতুমীর তেঁতো ঔষধ খেত অনেক আনন্দ করে।”

আজকে তিতুমীর যদি বেঁচে থাকত আর এ চা খেত তাহলে সেও ওয়াক করে ফেলে দিত। আমার ঝিম ধরে বসে থাকা দেখে আঙ্কেল বলল
~ কি হয়েছে বাবা? কোন সমস্যা?
~ নাহ আঙ্কেল এমনিতে।

~ আচ্ছা তুমি চা খাও। আমি একটু রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিই। চা খাওয়া শেষ হলে চলে যাওয়ার সময় আমাকে বলে যেও। আমার মাথাটা কেমন জানি ব্যাথা করছে।

আমি আঙ্কেলকে আমার বুকের ব্যথা কি করে বুঝায়। আঙ্কেল চলে গেলে এ চা রূপা আমাকে পুরোটা খাওয়াবে। মনে মনে বলতেছিলাম দয়াকরে যাবেন না। কিন্তু আমাকে তো ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে। তাই নিজেকে সামলিয়ে মুখে একবিন্দু মিথ্যা হাসি এনে বললাম,
~ আচ্ছা আঙ্কেল যান। একটু বিশ্রাম নিলেই মাথা ব্যথা কমে যাবে। আর যদি না কমে তাহলে একটা নাপা ট্যাবলেট খেতে পারেন।

~ নাহ বাবা ট্যাবলেট লাগবে না। সারাদিন অনেক কাজ করেছি তো একটু বিশ্রাম নিলেই চলে যাবে।
বলেই আঙ্কেল চলে গেল। আর এদিকে রূপা এসে আমার সন্মুখে বসল। খুব অসহায় লাগছিল তখন। চাতক পাখির মত অসহায় চিত্তে রূপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললাম,
~ আজকে শরীরটা ভালো লাগছে না। এ চা টা আজকে খেতে পারছি না। কিছু মনে করো না। কষ্ট করে বানিয়েছ এতেই আমি খুশি।
~ কেন খাবে না শুনি? আমি এত কষ্ট করে তোমার জন্য কালোজিরা দিয়ে স্পেশাল চা বানিয়েছি তুমি না খেলে হবে নাকি? এখনি খাও। এ চা খেলে একদম মন মেজাজ ফুরফুরা হয়ে যাবে। না খেলে খবর আছে।

এ বলে রূপা আমার দিকে তেড়ে আসার উপক্রম। চা তেঁতো হওয়ার কারণটাও বুঝলাম এখন। কালোজিরার স্পেশাল চা। বাপ জনমেও এমন চায়ের রেসিপি শুনে নি। আমি চুপ হয়ে বসে রূপাকে সামাল দেওয়ার জন্য চা টা নিয়ে নাক চেপে এক চুমুকে পুরোটা সাবাড় করে ফেললাম। খাওয়ার পর মনে হচ্ছিল চোখটা বেশ ঝাপসা লাগছে। মাথাটাও বেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। উপরে পাখার দিকে তাকিয়ে মনে হল পাখাটা উল্টো ঘুরছে।

সেই সাথে কেমন জানি হেঁচকি আসছে। তবে হেঁচকিটা গলাতেই আটকে রইল। ঝাপসা চোখে রূপার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রূপা হাসছে। রূপার হাসিটা দেখে মনে স্বস্তি পেলাম। তার মানে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই ঘটছে না। এর মধ্যে কি যে হল জানি না। হুট করে চোখ মেলে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিজেই চমকে গেলাম। খেয়াল করলাম রাত আটটা বাজে। অথচ আমার রূপার বাসা থেকে বিদায় নেওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা ছয়টায়। দুই ঘন্টা কি করে পার করলাম ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেলাম। এর মধ্যেই আমার প্রিয়তমা রূপার আগমণ।

রূপা এসে বলল,
~ অরন্য ঘুম কেমন হয়েছে তোমার। বলেছিলাম না চা টা খেলে একদম ঠিক হয়ে যাবে। চা টা খেয়েছ বলেই ফ্রেশ একটা ঘুম দিতে পেরেছ। তোমার তো একদম সাড়া শব্দ ছিল না। কতবার ডেকেছি তোমাকে। এত ভালো ঘুম হয় এ চা টা খেলে বুঝতে পারি নি। এখন একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফেলি কি বলো?
রূপার কথা শুনে বুঝতে পারলাম যে রূপার স্পেশাল চা টা খেয়ে আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

আর আমার প্রিয়তমা ভেবেছিল আমি আরাম পেয়ে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি। হায়রে এ কোন উভয় সংকটে পড়লাম। একদিকে রূপার চা অন্যদিকে রূপা। নিজের কষ্ট বুকে চেপে রূপাকে হাসি মুখে বললাম
~~~হ্যাঁঁ এবার চাইলেই তুমি একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলতে পার। অনেক ভালো হবে। যাদের ঘুম হয় না তারা তোমার স্পেশাল চা খেয়ে ঘুমাতে পারবে।
রূপা একটু হাসি দিয়ে নীচে তাকাল। বুঝায় যাচ্ছিল প্রশংসা শুনে বেশ লজ্জা পাচ্ছিল।

“মেয়েদের একটা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট হচ্ছে তাদেরকে যদি কেউ প্রশংসা করে তাহলে তারা সেটা সহজে বিশ্বাস করে নেয় হোক সেটা সত্যি অথবা মিথ্যা। মেয়েদের পটানোর একটা বড় অস্ত্র হচ্ছে প্রশংসা। তবে মাত্রা অতিরিক্ত প্রশংসা মেয়েদের হজম হয় না।”

রূপার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। একটু প্রশংসা পেয়ে একদম লজ্জায় লাল হয়ে গেল রূপা।
“মেয়েদের লজ্জা মাখা মুখটা দেখতে অনেকটা ফুটন্ত গোপালের মত। মেয়েদের চেহারায় তার সৌন্দর্য তখনেই ফুটে উঠে যখন মেয়েরা লজ্জা পায়। লজ্জা মেয়েদের দেয় এক অদ্ভূত সৌন্দর্যের ছোঁয়া।”

রূপার দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রূপার লজ্জা মাখা মুখটা অবলোকন করলাম। অতঃপর মনে মনে ভাবলাম এখনেই উত্তম সময় রূপার স্পেশাল চা পুনরায় খাওয়ার আগে কেটে পড়া। যে ভাবনা সে কাজ। রূপাকে বললাম,
~ রূপা আমি এবার গেলাম। অনেক সময় পার করে ফেলেছি। এখন বাসায় গিয়ে কাজ করতে হবে। কালকে সকালে আবার ডিউটি আছে।

আসার জন্য বের হতে নিলে রূপা হাতে দুইটা বাটি দিয়ে বলল,
~ এখন আর গিয়ে কষ্ট করে রান্না করে খেতে হবে না। টিফিন বাটিতে খাবার দিয়ে দিয়েছি। খেয়ে নিও।
রূপার এ বিষয় টা আমার খুব ভালো লাগে। কি করে জানি রূপা সব বুঝে ফেলে।

“মেয়েরা এক মায়ার চাঁদর। সে তার মায়ার চাঁদরে সব আগলে রাখতে পারে। মায়া দিয়ে সে বিশ্ব জয় করতে পারে। নরীর মায়ার কাছে সবকিছু পরাজিত হতে বাধ্য।”
রূপার শত পাগলামির মধ্যেও আমাকে সে তার মায়ার চাঁদরে জড়িয়ে রাখে। সব ভুলে গেলেও আমার কখন কি লাগবে সে ঠিকেই বুঝে যেত। আমি টিফিন বাটিটা নিয়ে রূপার বাসা থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমার বাসায় আসলাম। বাসায় এসে বাটি দুটো খুলার পর খাবারের গন্ধে মনটা ভরে গেল। রূপার হাতের রান্নার স্বাদেই আলাদা।

রূপার স্পেশাল চা ব্যতীত রূপার হাতের রান্না যে কেউ চেটেপুটে খাবে। আমি বাটিতে খেয়াল করলাম গরুর মাংসের ভুনা করে দিয়েছে। খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে বাটিটা খুলেই সাথে সাথে খেতে বসে পড়লাম। খাওয়ার সময় রূপা কল দিয়ে বলল,
~ আরে ইয়ার তোমাকে তো আমি স্পেশাল আরেকটা চা বানিয়ে বোতলে করে রেখেছিলাম দিতে ভুলে গিয়েছি।

রূপার স্পেশাল চায়ের কথা শুনে আমার খাবার গলায় আটকে উঠল। ভাত মনে হয় খাদ্য নালি দিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পথ ভুলক্রমে শ্বাস নালিতে চলে গিয়েছে। নাকে মুখে দিয়ে ভাত বের হওয়ার অবস্থা হল। ফলে আমি জোরে জোরে কাশি দিতে লাগলাম। রূপা কাশির শব্দ পেয়ে বলল,
~ অরন্য পানি খাও তাড়াতাড়ি। এভাবে মুখে ভাত নিয়ে কেউ কথা বলে নাকি। খাবার টা শেষ করে কলটা ধরবে তো, কি যে করো না। এখনেই পানি খাও।

আমি পানি খেয়ে একটা দম নিলাম। মনে মনে ভাবলাম ভালোই হয়েছে ভুলে গিয়েছে। না হয় ভিডিও কল দিয়ে আমাকে খেতে বলত। যে পাগল মেয়ে। মনে মনে একটু খুশি হলাম যে রূপা চা টা দিতে ভুলে গিয়েছে। রূপাকে এখন শাত্ত্বণা দেওয়া দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গিয়েছে। রূপাকে শাত্ত্বণা দিয়ে বললাম,
~ রূপা থাক না তোমার স্পেশাল চা আর দিতে হবে না। তুমি যে আমার জন্য খাবার দিয়েছ এটাই অনেক। আজকে না হয় ঐ স্পেশাল চা টা তুমিই খেয়ে নাও।

বুঝতেই পারছিলাম রূপার মনটা খুব খারাপ সে চা টা না দিতে পেরে। তাই ভারী গলায় মন খারাপ করে বলল,
~ কি যে বলো না তুমি তোমার জন্য বানিয়েছি। এ চা কি আমার গলা দিয়ে নামবে। আমি চা টা রেখে দিচ্ছি তুমি কালকে আসলে খেতে দিব। না হয় তোমার বাসায় সকালে নিয়ে আসব।

কালকে আবার স্পেশাল চা খেতে হবে সেটা শুনেই আমার গলায় আবার ভাত আটকাল। আবার কাশি দিতে দিতে বললাম
~ এখন রাখি খাওয়া শেষ করে কল দিব।

কালকে আবার রূপার স্পেশাল চা খেতে হবে এটা ভেবেই কান্না পচ্ছিল। তবুও নিজেকে সামলে খাওয়া শেষে রূপার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমিয়ে গেলাম। সাকালে উঠে নাস্তা তৈরী করে খেয়ে বের হয়ে গেলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্য। ভাগ্য ভালো রূপা তার স্পেশাল চা নিয়ে আসে নি। মনে মনে শুকরিয়া করতে করতে হাসপাতালে গেলাম। ডিউটি করতে লাগলাম মাঝে মাঝে রূপার সাথে কথা সব মিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিল দিনটা।

এর মধ্যে বিসিএস রেজাল্ট দিল আমি বিসিএসে টিকেও গেলাম। রূপাকে প্রথম খবরটা দিলাম। রূপা খবরটা পেয়েই বলল,
~ তোমাকে আজকে আমি স্পেশাল চা খাওয়াব৷ কাজ শেষ করে বাসার মোরে এসে আমাকে কল দিও। আমি চা সাথে নিয়ে আসব আর সরাসরি তোমার বাসায় যাব।
স্পেশাল চায়ের কথা শুনে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল।

সে সময় আমি সবে মাত্র পানি মুখে দিয়েছিলাম। তাই পানিটা স্পেশাল চায়ের কথা শুনে নাকে মুুখে দিয়ে বের হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এখনেই বেঁহুশ হব আমি। কিন্তু সে সুযোগ দিল না আমার প্রিয়তমা রূপা। রূপার সুরেলা কন্ঠে বলতে লাগল
~ আরে ইয়ার কথা বলছো না কেন? কখন থেকে হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছি। কথা তো বলো। কি হয়েছে অরন্য?

আমি বেঁহুশ হওয়ার উপক্রম থেকে নিজেকে হুঁশে এনে বললাম
~ নাহ রূপা তেমন কিছু হয় নি। তোমার স্পেশাল চা খাওয়াবে তো সেটা নিয়েই ভাবছিলাম।
~ কি ভাবছিলি শুনি?

~ ঐ যে তোমার চা কত মজা। তুমি ইউটিউব চ্যানেল খুললে একদিনেই ফেমাস হয়ে যাবা তখন আমার কি হবে এসব ভাবছিলাম। তখন যদি আমাকে ভুলে যাও।
~ কি যে বলো না। তবে আজকের চা টা খেলে তুমি সত্যিই বুঝবা আমি কত ভালো চা বানাই।

রূপার কথা শুনে মনে মনে ভাবতে লাগলাম সে তো আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। ইউটিউব চ্যানেল খুললে আর ফেমাস হওয়া লাগবে না ভাইরাল হবা আর কি। আস্তে আস্তে এসব বিড়বিড় করতে লাগলাম। এমন সময় রূপা চেঁচিয়ে উঠল
~ সমস্যা কি অরন্য কতক্ষণ পরপর একদম চুপ হয়ে যাচ্ছ। কথা বলছো না কেন?

রূপার চেঁচামেঁচিতে হতচকিয়ে নিজেকে স্থির করে বললাম,
~ আচ্ছা সন্ধ্যায় আমি মোরে আসব। আগেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমি কল দিলে এস।
~ আচ্ছা এখন রাখি। আমি আমার স্পেশাল চা টা বানাই আগে।

আমি অসহায় গলায় বললাম আচ্ছা। এ মুহূর্তে আবরার এসে আমার পিঠে একটা চাপর দিয়ে বলল,
~ কি রে ট্রিট কোথায়? তোর রেজাল্ট দেওয়ার পর তোকে খুঁজে পাওয়ায় যাচ্ছে না। ইদানিং অনেক ব্যস্ত মনে হয়। আমাকে তো একদম ভুলে গিয়েছিস। ঐ মেয়েটাকে নিয়ে বেশ ঘুরাফেরা হচ্ছে। ব্যপার কি শুনি।

~ মেয়েটাকে ভীষণ ভালো লাগে।
~ এখন তো চাকুরি পেয়ে ফেলেছিস এখন না হয় বিয়েটা করে ফেল। কথা বলা লাগলে বলিস। তোর তো কোন অভিভাবক দেশে নেই। আমার বাবা, মা না হয় তোর অভিভাবক হয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেল।

আমি আবরারের এমন কথা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। কারণ যে আমি মেয়েদেরকে তেমন দেখতে পারতাম না সে আমি আজকে একটা মেয়েকে এত ভালোবাসি ভাবলেই যেন নিজেকে অচেনা লাগে। আবরারের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম,
~ আমি রূপার সাথে কথা বলে তোকে জানাব। আর ট্রিট না হয় একবার বিয়েতেই দিব।

~ ট্রিট ফাঁকি দিলে কিন্তু বিয়ে হবে না
এ বলে আবরার হাসতে হাসতে ডিউটিতে চলে গেল। এদিকে আমি সবকাজ শেষ করে সন্ধ্যার দিকে রূপার বাসার মোরে গিয়ে রূপাকে কল দিলাম। কল দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপা হাজির। রূপার হাতে একটা বোতল দেখেই বুঝতে পারছিলাম এটা রূপার স্পেশাল চা। রূপা এসেই আমাকে কানে একটা আকস্মিক চিৎকার দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল। আমি তার আকস্মিক চিৎকারে বাধ্য ছেলের মত ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বললাম,
~ ওরে আল্লাহ্ কি করো। অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

এ মিথ্যা ভয় পাওয়ার পিছনে একটা সরল কারণ ছিল রূপার হাসি। এ কথাটা বলার পর রূপা একটা অট্ট হাসি দিবে আর আমি সেটা অবলোকন করব এটাই আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল। ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে। রূপা আমার কথা শুনে একটা হাসি দিল আর আমি সে হাসিটা দৃষ্টিপাত করছিলাম। খানিকক্ষণ হেসে রূপা আমার চোখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
~ আরে ইয়ার এভাবে তাকিয়ে আছ যে কোথায় হারিয়ে গেলে।

আমি রূপার তুড়ির আওয়াজ শুনে বাস্তবে ফিরলাম রূপার হাসির সাথে সাথে যেন আমি সবসময় স্বপ্নের রাজ্যে চলে যাই। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। বাস্তবে ফিরে এসে রূপাকে বললাম,
~ নাহ ঐরকম কিছু না। তবে তোমাকে তো তোমার বাবা সন্ধ্যার পর বের হতে দেয় না। আজকে বের হলে কিভাবে?

রূপা আমার হাতে একটা চিমটি কেটে বলল
~ ঘুমের ঔষধ আছে কি জন্য? বিকেলের চা এ একটা কড়া ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছি। আজকে রাতে আর উঠতে পারবে না। চলো এবার তোমার বাসায় চলো।
এ পাগলিটাকে যে কবে মানুষ হবে কে জানে। অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করে বসে। আমি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে রূপার দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ চলেন মহারানী এবার চলেন। কবে যে মানুষ হবে আর পাগলামি কমাবে আল্লাহ্ মালুম।

রূপা আমার পাশ থেকে আমার সম্মুখ বরাবর এসে আমার চোখে চোখ রেখে বলল,
~ কেন আমার পাগলামি কি তোমার ভালো লাগে না?

রূপার দিকে তাকালে কেন জানি না আমার সকল বিরক্তি চলে যায়। কেন জানি না আমি ওর চোখে ভালোবাসার ছন্দ খুঁজে পাই।
“ট্রেনের বগি যেমন একটার সাথে আরেকটা সংযুক্ত হয়ে ঝিকঝিক করে ছন্দাকারে যেতে থাকে। তেমনি রূপার চোখের দিকে তাকালে আমার ভালোবাসার ট্রেনটা ঝিকঝিক করে চলতে থাকে”।

রূপার চোখের মায়া কাটিয়ে উঠা অনেক কঠিন।
” মেয়েরা যে মায়াবতী হয় সেটা তাদের চোখের প্রমাণ দেয়।”

রূপার চোখের দিকে তাকিয়ে রূপার প্রতি কোন অভিযোগ আসলো না। রূপাকে শান্ত গলায় বললাম,
~ পাগলিটার এ পাগলামিগুলোই তো আমার বেশ ভালো লাগে।

রূপা একটু হাসি দিয়ে আমার সম্মুখ থেকে সরে পুনরায় পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
~ এজন্যই তো আমি এত পাগলামি করি।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাসায় চলে আসি। রূপা বাসায় এসেই তার স্পেশাল চা আমাকে দিয়ে বলল,
~ নাও এবার এটা খাও।

রূপার স্পেশাল চায়ের কাপটা দেখেই আমার কেন জানি গা গুলাতে লাগল বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল তবুও নিজেকে সামলিয়ে রূপার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে ভয়ে ভয়ে চায়ে চুমুক দিলাম। চায়ে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে চমকে গেলাম। এত মজার চা আমি কখনও খেয়েছি বলে মনে হয় না। চায়ে চুমুক দিয়ে রূপার দিকে তাকালাম। রূপা একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,
~ এবার বলো আমার ইউটিউব চ্যানেল খুললে কেমন হবে। আমি কেমন চা বানায় বলো।

আমি বুঝতে পারছিলাম রূপা আমার সাথে চা নিয়ে একটা মজা করেছে। রূপার অভ্যাসেই এমন মজা করা। আমি বেশ শান্ত গলায় রূপাকে বললাম,
~ তার মানে তুমি আমার সাথে মজা করেছ? এটা করা কি ঠিক হয়েছে। কি বিদঘুটে স্বাদের চা তুমি খাইয়েছো আমাকে তোমার কোন ধারণা আছে।
রূপা আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বলল,
~ ইচ্ছা করেই এমন চা বানিয়েছিলাম।

এটা শুনার পর আমি একটা বালিশ নিয়ে রূপার দিকে তেড়ে গেলাম আর রূপা দৌঁড় দিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। বেলকনি তে গিয়ে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হয় বাইরের আকাশটা রূপার ভালো লেগে গিয়েছে। না হয় এমন দৌঁড়ে গিয়ে চুপ হয়ে থাকার মেয়ে রূপা না। বাইরে থেকে বাতাসে রূপার খোলা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। আমি বালিশটা হাত থেকে ফেলে রূপার দিকে এগিয়ে গেলাম। খেয়াল করলাম রূপা বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে থেকে হালকা বৃষ্টিফোঁটা বেলকনির গ্রিল দিয়ে আসছে। আমি রূপার কাছে গিয়ে রূপার হাত দুটোর উপর হালকা হাত দিতেই রূপা আমার বুকে মাথা এলিয়ে দিল। আমি রূপা
~ কি দেখছো ঐ আকাশের দিকে।

রূপা তার মাথাটা আমার বুকে এদিক ওদিক হেলাতে হেলাতে বলল,
~ আকাশটা অনেক সুন্দর লাগছে না?

সত্যি বলতে
“আকাশের বিশালতা অনুভব করা অনেক কঠিন ব্যপার। কিন্তু আকাশের দিকে তাকালেই এর গভীরতায় নিমিষেই হরিয়ে যাওয়া যায়। জানো অরন্য ভালোবাসাটাও ঠিক একরমেই। ভালোবাসাটা শব্দটা চারটা অক্ষরের হলেও এর বিস্তৃতি অনেক। ভালোবাসার বিস্তৃতিটা একবার উপলব্ধি করতে পারলে খুব সহজেই ভালোবাসার গভীরে ডুবে যাওয়া যায়।”

রূপার হাতটা শক্ত করে গ্রিলে চেপে ধরে বললাম,
~ আজকে কি কবি হয়ে গেলে নাকি এত সুন্দর করে ছন্দাকারে কথা বলছো যে।

রূপা আমার হাতে স্পর্শ পেয়ে আমার বুকে তারা মাথাটা আরও চেপে ধরে বলল,
~ অরন্য একটা কথা বলব।
~ হ্যাঁ বলো কি বলতে চাও। অনুমতি নেওয়ার কি আছে?

~ চলো এখন বিয়ে করে ফলি। আমার লুকিয়ে বিয়ে করার খুব ইচ্ছা। লুকিয়ে বাবাকে ফাঁকি দিয়ে সংসার করার অনেক ইচ্ছা।
রূপার আকস্মিক এমন বিয়ের কথা শুনে একটু চমকে গিয়ে বললাম,
~ ধুর পাগলি কি যে বলো না। লুকিয়ে কেন বিয়ে করতে হবে। তুমি চাইলে আমি আবরারের বাবা মা কে আমার অভিভাবক হিসেবে তোমার বাবার কাছে কালকেই পাঠাব।

~ আমার ভীষণ ইচ্ছা লুকিয়ে বিয়ে করার চলো না এখন বিয়ে করে ফেলি।
~ রাত আট টা বাজে এখন কিভাবে বিয়ে করব। কালকে সকালে করি?
~ তোমার বন্ধু আবরারকে বলো কাজী অফিসে আসতে। আর আমি আমার একটা ছেলে বন্ধু আছে ওকে বলতেছি। ওরা সাক্ষী হবে তারপর তুমি আর আমি বিয়ে করে ফেলব।

রূপার একরোখামি যখন উঠেছে তখন সেটা বিয়ে না করার আগ পর্যন্ত নামবে না বেশ ভলোই বুঝতে পারছিলাম। রূপার কথা মতই আবরারকে আসতে বললাম। আবরার অবশ্য রূপার সম্পর্কে ভালোই জানে। রূপা কেমন স্বভাবের সেটাও জানে। তাই এরকম আকস্মিক বিয়েতে আবরার তেমন চমকায় নি। দুজন সাক্ষী নিয়ে কাজী অফিসে গেলাম।

অবশেষে রূপা আর আমি রাত নয়টায় বিয়ে করে আবরার আর রূপার বন্ধুকে বিদায় দিয়ে আমার বাসায় আসলাম। ভালোবাসার মানুষটাকে সারাজীবনের জন্য এক বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলাম। এ ছিল আমাদের প্রেমিক~প্রেমিকা থেকে স্বামী ~স্ত্রী হওয়ার গল্প।

তারপর শুরু হয় আমাদের নতুন গল্প। সেদিন রাতে রূপা আর আমি বেলকনিতে অনেক সময় কাটিয়েছি। অদ্ভুত সুন্দর মায়া ভরা একটা রাত ছিল। চারদিকে ধমকা বাতাস বইতেছিল। আর রুপা আমার বুকে তার মাথা হেলিয়ে আকাশটার বিশালতায় মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আমি রূপার কপালটা আমার কাছে এনে একটু ভালোবাসার স্পর্শ একে দিলাম। নিমিষেই রূপা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। রূপা ঠিকেই বলেছিল ভালোবাসটা উপলব্ধি করলে সত্যিই এর গভীরে হারিয়ে যাওয়া যায়।

আমিও কিছুক্ষণের মধ্যে রূপার ভালোবাসার গভীরতায় ডুবে গেলাম। রূপার সাথে একদম মিশে গেলাম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস গুলো যেন ভালোবাসার সাক্ষী দিচ্ছিল। কখন যে ভালোবাসার চাঁদরে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। সকালে রূপার ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম থেকে রূপাকে অদ্ভুত বেশে দেখে চমকে গেলাম। সত্যিই বুঝি না এ মেয়ের মনে কি চলে।

পর্ব ২৫

খেয়াল করলাম রূপা আমার শার্ট কেটে কিরকম জানি অদ্ভুত একটা জামা বানিয়ে পড়ে আছে। জামার ডিজাইনটা কিভাবে বর্ণণা করলে সেটা সঠিক ভাবে উপস্থাপন হবে তা বুঝতে পারছি না। রূপার এরকম তাজ্জব জামা দেখে যতটা না চমকে গিয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি হাতাশ হয়েছিলাম রূপা আমার পনেরশ টাকা দিয়ে কেনা নতুন শার্ট টা কেটে ফেলেছে। রূপাকে দেখে হতাশ হয়ে বললাম,
~~~আমার শার্টের এ দশা করলে কেন? বেচারা শার্টটাকেও তোমার অত্যাচার থেকে রেহাই দিলে না?

রূপা আমার কথায় রাগ হয়ে গাল ফুলিয়ে বসে রইল। মেয়েটার এ এক বাজে অভ্যাস কিছু বললেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। যতক্ষণ না ওর প্রশংসা করব ততক্ষণ এ গাল ফুলানো বহাল থাকবে। রূপার গাল ফুলানো দেখে আস্তে করে রূপাকে ধরে বললাম,
~~~আরে পাগলি তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। শুধু শুধু গাল ফুলিয়ে বসে আছ কেন?
কথাটা বলার সাথে সাথে রূপার গালে একটা হাসি ফুটে উঠল।

“মেয়েরা একটা আবেগের খনি। যখন কেউ একটু ভালোবাসা ছুয়ে দেয় তখন সে খনি বিগলিতে হয়ে হাসি হয়ে মুখে ভেসে উঠে।”
রূপার হাসিমাখা মুখটা দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ঠিক তখন রূপা আমার সামনে হাত দিয়ে তুড়ি বাজাতে বাজাতে বলল,
~ আরে ইয়ার এভাবে কি দেখছো। আমাকে এখনেই যেতে হবে। না হয় বাবা ঘুম থেকে উঠে আমাকে না দেখলে ঝামেলা করবে।

এবলে রূপা তড়িগড়ি করে ঝড়ের বেগে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কাপড় পাল্টে চলে গেল। রূপা চলে যাওয়ার পর রেখে যাওয়া ছেড়া শার্টটা হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। বাসায় গিয়ে আমাকে কল দিয়ে বলল,
~ অরন্য ঐ বাসাটা পাল্টাও এবার। একটা কাজ করো এখন তো তোমার হাসপাতালে যাওয়া লাগে না। চাকুরিতে জয়েনের আগে তোমার বাসায় উঠে পরো।
রূপার কথা শুনে মনে হল যে, সত্যিই এটা করা দরকার।

এতে করে রূপাকে নিয়ে কোন ঝামেলা হবে না। আর এ বাসায় যেকোন সময় রূপাকে নিয়ে ঝামেলা হওয়ার সম্ভবনা আছে। তাই রূপার কথা মতই কেয়েকদিন পর বর্তমানে যে বাসায় থাকি সে বাসাটাতেই রূপাকে নিয়ে উঠেছিলাম। রূপা প্রথম দিন উঠেই যা যা লাগবে সবকিছুর একটা তালিকা করল। রূপার তালিকা দেখে আমি হতবাক। এত বড় তালিকা করেছে কি বলব। আমি তালিকা দেখে রূপাকে বললাম,
~ এতকিছু আনতে হবে নাকি। অল্পকিছু হলে হয় না।

~ যা আনতে বলেছি কালকের মধ্যে তাই অানবে। বাসা অর্ধেক গুছানো শেষ, বাকিটা কালকে গুছাব। এখন আমি আমার বাসায় যাব। আজকে বাবা রান্না করবে না। তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে রান্না করতে হবে। না হয় বাবাকে না খেয়ে থাকতে হবে।

এবলে রূপা বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আর আমি রূপার লম্বা তালিকাটা হাতে নিয়ে ধপাশ করে শুয়ে পড়লাম। এতকিছু যে কখন নিয়ে আসব জানি না। আজকে সারাদিন চলে যাবে এসব আনতে আনতে। তার উপর কালকে যদি এসে দেখে ঠিকঠাক মত সব আনতে পারে নি তাহলে রূপার মাথার ব্যাঁমোটা বাড়বে। আমি নিজেকে একটু শান্ত করে বাজারে গেলাম।

তালিকা অণুযায়ী সব কিনে আনলাম। সারাদিন কেটে গেল আমার এসব কিনে আনতে আনতে। রাতে এসেই হালকা কিছু খেয়ে রূপার সাথে অল্প কথা বলে ঘুমিয়ে গেলাম। সারারাত কড়া একটা ঘুম হল। সকালে কলিং বেল এর আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙ্গল। ঘুমঘুম চোখে ঘঁড়ির কাটায় তাকিয়ে দেখলাম সকাল নয়টা বাজে। আমি হুড়মুড়িয়ে উঠলাম কারণ এসময় শুধু আমার প্রিয়তমা রূপারেই আগমন ঘটবে। আর আমাকে এভাবে ঘুমাতে দেখলে তার মুখের থেকে কয়েকখানা ভুলভাল ইংলিশ বকা শুনতে হবে।

একটা কথাতো বলায় হল না। (রূপা ছাত্রী হিসেবে মোটেও ভালো ছিল না। ভালো একটা বিষয় নিয়ে পড়লেও পড়াশোনায় মন ছিল না। কোনরকমে পাশ করে অনার্স তৃতীয় বর্ষে উঠেছে। আর ইংলিশে বেশ কাঁচা। প্রায় সময় ইংলিশ বানান ভুল করত এবং যখন আমার সাথে ইংলিশে কথা বলত তখন হাজার টা ভুলভাল ইংলিশ বলত। আমি ভুলভাল ইংলিশ শুনে একটু হাসলেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকত। তবে তার ইংলিশ বলাটা আমার কাছে বেশ লোভনীয় বিনোদন মনে হত। শত মন খারাপ হলেও তার ইংলিশের বাহার শুনে আমার মন ভালো হয়ে যেত আর হেসে লুটোপুটি খেতাম। তাই আমি এ অধ্যায়ের নাম দিয়েছি লোভনীয় রঙ্গমঞ্চ। )

যাইহোক কাহিনীতে আসি। ঘুমটাকে কোনরকম নিবারণ করে দরজাটা খুলতেই আমার প্রিয়তমার মিষ্টি কথা ভেসে আসল। প্রিয়তমা দরজায় একহাত দিয়ে হেলান দিয়ে বলল
~ কি ব্যপার চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছিলে। এত দেড়ি হল কেন দরজা খুলতে শুনি।
এ বলে চোখ দিয়ে ইশারা করতে লাগল। আমি রূপার হাতটা টান দিয়ে রুমে এনে বললাম,
~ হয়েছে এখন আর তোমাকে শাসন করতে হবে না। দেখো সব আনা হয়েছে নাকি। না হয় আবার আনতে যাব।

রূপা খুব ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
~ আপাতত বাজারে থেকে সবজি আর মাছ আনো। সকালের নাস্তা তো খাও নি। বাইরে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিও। এরমধ্যে আমি বসাটা গুছাতে থাকি। তোমার বাজার আনা হলে একসাথে রান্না করব। তারপর খানদানি ভোজন পর্ব সাড়ব।

~ সবজি আর মাছ দিয়ে খানদানি ভোজন করবে? আমি তো জানতাম গরু আর খাসি দিয়ে মানুষ খানদানি ভোজন করে। (হাসতে হাসতে)
~ তোমাকে এত কিছু ভাবতে হবে না। যাও তো তাড়াতাড়ি যাও। রূপার সবজি আর মাছেই হল খানদানি ভোজন। রূপার হাতে রান্না কি খারাপ নাকি। খুলব নাকি একটা ইউটিউব চ্যানেল। নাম দিব রূপার রান্নাবান্না। (ভ্রূটা কুঁচকে)
~ এসব বাদ দিয়ে এবার পড়ায় মন দাও। না পড়লে হবে নাকি।

পড়ার কথা শুনলেই রূপার মাথা গরম হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। রেগে গিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
~ বাজার আনতে বলেছি বাজার আনো। আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না। আসছে বিদ্যাসাগর।
রূপার গর্জন শুনে তাড়াতাড়ি বাজার করতে গেলাম।

বাজার থেকে অনেক ক্লান্ত হয়ে ফিরে দরজায় নক করলাম। রূপা পাকা বিশ মিনিট পর দরজা খুলল। শরীরটা রাগে গিজগিজ করছিল তবুও রাগটাকে সামাল দিয়ে রূপাকে জিজ্ঞেস করলাম
~ কোথায় ছিলে এতক্ষণ।

~ কাজ করছিলাম।
~ দরজাটা খুলেও ও কাজ করতে পারতে।
~ দরজা খুলতে আসলে ঐ কাজটায় মনোযোগ চলে যেত।

আমি রাগরাগ গলায় রূপাকে বললাম,
~ এবার বাজারগুলো ঘরে নিয়ে আমাকে উদ্ধার করো। মাছের ব্যাগ টা ধরে দাঁড়াও একটু।

এ বলে মাছের ব্যাগটা রূপার হাতে দিয়ে বাজারগুলো দরজার সামনে রেখে রুমে এসে সোফায় শুয়ে পড়লাম। খানিকক্ষণ পর খেয়াল করলাম রূপা মাছের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়েই আছে। রূপার দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ কি ব্যাপার রূপা এখনও মাছের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো যে।
~ তুমিই তো বলেছিলে মাছের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। কই ঘরে আসতে তো বলো নি। আমি তো তোমার কাথায় শুনছিলাম।

খুব ভালো বুঝে গিয়েছিলাম। রূপা বাকি বাজারগুলো আমাকে দিয়েই আনাবে। তাই রূপার কাছে গিয়ে, বাকি বাজার গুলো দরজার সামনে থেকে ঘরে ঢুকিয়ে রূপাকে বললাম,
~ এবার মাছের ব্যাগটা নিয়ে ঘরে এসে আমাকে উদ্ধার করো। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আজকে আর রান্না করতে হবে না।

~ হুহ আসছি তো। তোমার কথা শুনলেও দোষ, না শুনলেও বলো কথা শুনি না। আমি তো উভয় সংকটে পড়েছি। এদিকে গেলেও দোষ ওদিকে গেলেও দোষ।
রূপাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
~ হয়েছে আর কথা বলতে হবে না। এখন কথা বলতে গেলে বোম ফাটবে। আমাকে কি করতে হবে বলেন মহারাণী।

এবলে রূপাকে টেনে আমার কাছে নিয়ে আসলাম। রূপা আমার থুতুনিটা টেনে বলল,
~ এখন কিছুই করা লাগবে না। শুধু বসে বসে টেলিভিশন দেখেন। আমি রান্না করে নিয়ে আসতেছি। রান্না শেষ হলে না হয় আসতে বলব। আমাকে এবার যেতে দিন।

আমি রূপাকে ছেড়ে দিলাম। এবার আমার নজর গেল ঘরের দিকে। রূপা অল্পক্ষণের মধ্যে অনেক পরিপাটি করে গুছিয়ে ফেলেছে। রূপার সবদিক একদম স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকলেও। পড়ালেখার দিকটা অর্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ। বেচারিকে পড়ার কথা বললেও রেগে যায়। তাকে যদি বুঝানো হয় পড়ালেখা ছাড়া দুনিয়াতে কিছু সম্ভব না ঠিক তখনি রূপা বিভিন্ন নামিদামি মানুষের উদাহরণ দিবে যারা না পড়ে অনেক বড় কিছু হয়েছে। রূপার সাথে চাপায় কখনও পারা যায় না। মেয়েটার এ দিকটা ব্যতীত সব দিকগুলোই ঠিক ছিল।

রূপার মাথায় কি যে চলে কে জানে। আমার একসময় ইচ্ছা ছিল যে একটা ক্যারিয়ার ভালো ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করার। কারণ আমার কাছে সবসময় যোগ্যতাটা অনেক বড় কিছু ছিল। কিন্তু উপর আল্লাহর ইচ্ছা মনে হয় ভিন্ন ছিল। তাই হয়ত আমার জীবনে রূপার আগমন হয়েছে।
“সত্যি বলতে মন থেকে কাউকে চাইলে কখনও আল্লাহ আলাদা করেন না। বরং চাওয়ার মধ্যে যদি ঘাপলা থাকে তাহলেই আল্লাহ বিভিন্ন অজুহাতে আলাদা করে দেন। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে যখন চাইতে হয় তখন সৎভাবে হালাল নিয়্যাতে চাইতে হয়।”

রূপাকে নিয়ে মাঝে মাঝে আবরার বলত~
~ অরন্য দেখ রূপা ননমেডিকেল তার উপর ন্যাশনালে পড়ে। ওর সাথে তোর মিলবে বলে মনে হয় না। কিছু করার আগে ভেবে করিস।
কিন্তু রূপার সাথে মিশে মনে হয়েছে। ওর সাথে ছাড়া আর কারও সাথে আমার মিলার কথা না। একমাত্র ওর সাথেই আমার সবচেয়ে বেশি মিলে।

ও যেভাবে আমাকে যত্ন নেয় অন্য কেউ পারবে বলে মনে হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষকে যোগ্য করে তুলে সমাজের জন্য কিন্তু মানবিকতা সেটা নিজেকেই গড়ে তুলতে হয়। আর রূপার মধ্যে সেটার কমতি ছিল না। তাই নন মেডিকেল হলেও রূপার সাথে চলতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না
“কখনও প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা দিয়ে কাউকে বিচার করা উচিত না যে সে কেমন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জরুরি তার চেয়ে বেশি জরুরি একজন যোগ্য মানুষ হওয়া। যোগ্যতা অর্জন করা আর যোগ্য মানুষ হওয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ।”

এর মধ্যেই রান্নার একটা সুন্দর সুঘ্রাণ নাকে আসল। আমি এর সুঘ্রাণ আহরণ করার লোভটা সামলাতে পারলাম না। দৌঁড়ে গেলাম রান্না ঘরে। রান্না ঘরের দরজার সামনে যেতেই রূপার দিকে চোখ গেল। রূপার একটা অভ্যাস বলব নাকি বদ অভ্যাস বুঝে উঠতে পারছি না। অভ্যাসেই বলা যাক।

রূপার একটা অভ্যাস সব কাজেই ছটফটিয়ে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে করবে। তাকে কাজ করতে দেখলে মনে হয় সবচেয়ে কষ্টকর কাজটাও অতি সহজ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে রূপার কাছে গেলাম। রূপার কাছে গিয়ে রূপাকে সিনেমার নায়কের মত পিছন থেকে যখনেই ধরতে যাব ঠিক এ মুহুর্তে রূপা বলে উঠল~
~ আরে আরে ধরতে আসবে না। যাও তো যাও। এখানে এসে এখন ঢঙ করতে হবে না।

আহারে আমার হিরো সাজা আর হল না যে ঝাড়ি খেয়েছি তার পর হিরো সাজতে গেলে কপালে মাইর জুটবে। তাই রান্না ঘর থেকে চলে আসলাম। খানিকক্ষণ পর রূপা গোসল করে আমার কাছে এসে তার চুলগুলো পাখার নীচে রেখে শুকাচ্ছিল। রূপার চুল থেকে এক অদ্ভুত সুবাস আসছিল। আমি রূপার কাছে গিয়ে চুলের সুবাস আহরণ করতে করতে বললাম,
~ তোমার চুলের সুঘ্রাণ সত্যিই লোভনীয়।
~ ডাব শ্যাম্পুট সুঘ্রাণ এটা।

আমি একটু হেসে রূপাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
~ সে যাইহোক একটা কথা কি বলব?
রূপা আমার উপর গা এলিয়ে দিলে বলল,
~ কি বলতে চাও।

আমি রূপার ঘাড়ে চুমু দিয়ে বললাম,
~ তোমাকে খুব ভালোবাসি।

~ আমিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।
ভালোবাসা, খুঁনসুটি, ঝগড়া সব মিলিয়ে আমাদের জীবন বেশ ভালোই চলছিল। বিবাহিত হয়েও দুজন থাকতাম ব্যাচেলরের মত। সবাই জানত আমরা সিনগেল কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ছিলাম পুরোপুরিভাবে মিনগেল। বলা যায় বিবাহিত ব্যাচেলর। বিবাহিত তার উপর ব্যাচেলর দুইটা পরস্পর বিপরীতার্থক শব্দ হলেও বেশ সুখেই ছিলাম আমরা। এভাবে কেটে গেল আরও তিনটা মাস।

রূপাকে বারবার বলছিলাম এবার আঙ্কেল কে বলে তোমাকে তুলে আনি। কিন্তু কেন জানি রূপা ঐ সময়টাতে একদম পাল্টে গিয়েছিল। আগের মত তেমন কথা বলত না। সবসময় চুপ হয়ে থাকত। কিছু জিজ্ঞেস করলেও কোন জবাব দিত না। আগের মত বাসায় আসত না। কল দিলেও ঠিক করে ধরত না। রূপার এরকম আচরণ আমাকে বেশ কষ্টও দিচ্ছিল। এরকম চুপ হয়ে যাওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না।

সব নিয়ে একদিন রাতে রূপাকে কল দিলাম। কল দেওয়ার পর রূপাকে জিজ্ঞেস করলাম~
~ কি হয়েছে রূপা তুমি এত চুপ হয়ে গেলে যে। কথা বলো না ঠিক করে। কল দিলে ধরতে চাও না। সারাক্ষণ কিসের মধ্যে ডুবে থাকো। তুমি কি জানো না তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি। তোমার এ ব্যবহার গুলো আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। নাকি আবার লেডি হিমু হতে চাচ্ছ। কিছুতো বলবা। তুমি কি জানো তোমার এসব পাগলামিতে আমি বিরক্ত। আমাকে রেহাই দাও।

কিন্তু রূপা আমার কথা শুনে তেমন কোন পাত্তা না দিয়ে কল টা কেটে মোবাইলটা বন্ধ করে ফেলল। তখন রাত একটা বাজে। ঠিক এসময় খেয়াল করলাম আবরার কল দিয়েছে। আবরারের কল ধরার সাথে সাথে আবরার বলল,
~ অরন্য তুই ঠিক আছিস তো।

~ কি হয়েছে? আমার কি হবে? আমি তো ঠিকেই আছি।
তারপর আবরার যা বলল আর আমি যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আবরার বলল,
~ দোস্ত রূপার একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। একটু দেখ আমি তোকে লিংক পাঠাচ্ছি।

আমি প্রথমে ভেবেছিলাম রূপা কোন রেসিপির ভিডিও হয়ত দিয়েছে আর সেটা নিয়ে হয়ত অনেকে মজা করছে তাই রূপাও এ বিষয়ের জন্য চুপচাপ হয়ে আছে। এ ভেবে যখন ভিডিওতে ক্লিক করলাম তখন তা দেখে আমি চমকে গেলাম। রূপার অর্ধ উলঙ্গ গোসলের ভিডিও আমার সামনে। খেয়াল করলাম ভিডিওটার ভিউ হয়ে গিয়েছে অনেক। কতশত নোংরা কমেন্ট। রূপার উপর চরম রাগ হল। রূপাকে কল দিলাম। খেয়াল করলাম রূপা মোবাইল অন করেছে। অনেকক্ষণ কল দেওয়ার পর রূপা কলটা ধরার সাথে সাথে বললাম,

~ ছিঃ এত নোংরা একটা ভিডিও করতে লজ্জা লাগল না তোমার। কতটা নোংরা হয়ে গিয়েছ চিন্তা করতে পারছো। এজন্যই তো আমাকে ভালো লাগে না তাই না। তোমার তো একজন দিয়ে হবে না। নোংরামি করতে এত মজা লাগে তাই না। কি করেছিলাম আমি? কোনকিছুর অভাব তোমাকে দেই নি তবুও এভাবে কষ্ট দিতে পারলে।
~ অরন্য ভিডিওটা আমি করে নি।

রূপা আরও কিছু বলতে যাবে এ মুহুর্তে রূপার কথা আটকে দিয়ে বললাম,
~তোমার গোসলখানায় আরেকজন ভিডিও করেছে এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলতেছ। লজ্জা হওয়া উচিত। এ মুখ দেখানোর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
তারপর আরও কিছু বলতে নিব খেয়াল করলাম মোবাইলটা বন্ধ। দশ মিনিট মোবাইলে কল দিলাম। প্রতিবারেই বন্ধ পেলাম। রূপার বাবাকে কল দিলাম বললাম রূপাকে দিতে। আঙ্কেল অবাক হয়ে বলল,
~ রূপা ঘরে নেই।

আমি কথাটা শুনার সাথে সাথে রূপার বাসায় গেলাম। আঙ্কেল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। কোন কথা বলছে না। আমি সারা বাড়ি খুঁজেও রূপাকে পেলাম না। রূপার টেবিলের উপর রূপার লাল মোলাটের ডায়রিটা পেলাম। ডায়রিটায় কাঁপা কাঁপা করে লিখা ছিল~
প্রিয় অরন্য, “আমার ভালোবাসার ইচ্ছেডানা”

তুমি না জিজ্ঞেস করেছিলে আমার কি হয়েছে? আমি এত চুপচাপ কেন। কারণটা তোমার সামনে ইতিমধ্যে চলে এসেছে।
কিন্তু জানো সবচেয়ে বেশি কষ্ট কখন পেয়েছি যখন তুমি অন্য সবার মত আমাকে ভুল বুঝেছিলে। সত্যিই ভিডিওটা আমি করি নি। ভিডিওটা সৌরভ কৌশলে ধারণ করেছিল। কারণ আমি ওকে মোটেও পাত্তা দিতাম না। সে রাগটা আমার উপর তুলল।

আমাকে ভাইরাল করে দিল। আর গালিগুলো আমার কপালেই জুটল। ভিডিও করার পর বিভিন্নভাবে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করত। আমি যেন তার সাথে শারিরীক সম্পর্কে রজি হই নাহয় আমাকে ভাইরাল করে দিবে।

আমি কিন্তু রাজি হয় নি অরন্য। আমি বিষয়টা কাউকে বলতে পারছিলাম না। তুমিও আমার উপর রেগে শুধু বকাবকি করতে তাই তোমাকে আরও বলতে পারে নি। অপরদিকে সৌরভ অনেক বলেও যখন কোন পাত্তা পাচ্ছিল না তখন এ কাজ টা করেছে। তবে দোষী আর অপরাধী আমিই হলাম। অপরাধ টা কি আমার ছিল? সবাই যে কমেন্ট বক্সে আমাকে গালাগাল দিচ্ছে কতটা অপরাধী আমি ছিলাম। ভাইরাল করতে পারাটা সবার মাথায় বসে গিয়েছে। কেউ এর আড়ালের দৃশ্যগুলো দেখে না।

নিজের এ মুখটা দেখাতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। তাই লোকালয়ের থেকে আড়ালে গিয়ে নিষ্ঠুর পৃথিবীতে থেকে বিদায় নিলাম।
ইতি তোমার লেডি হিমু
রূপা।

আমি চিঠিটা পড়েই দৌঁড়ে বের হয়ে গেলাম রূপাকে খুঁজতে। সারারাত খুঁজলাম পেলাম না। আর যখন পেলাম তখন
এ বলেই অরন্য অনেক কাঁদতে লাগল। তুলি অরন্যকে ধরে বলল
~ তারপর কি হয়েছে বলুন। কাঁদবেন না দয়াকরে।
অরন্যের কান্না দেখে তুলির চোখটাও ছলছল করতেছিল। তবে তুলি তার চোখের জলটাকে আড়াল করে অরন্যকে শাত্ত্বণা দিতে লাগল।

পর্ব ২৬

অরন্য নিজেকে সামলিয়ে বলল,
~ তখন সকাল আট টা বাজে। ভিডিওটা এর মধ্যে পুরোপুরি ভাইরাল হয়ে যায়। আমি পুলিশের সাহায্য নিলাম। পুলিশ খু্ঁজ লাগাল।
কেটে গেল আরও তিন ঘন্টা। তিন ঘন্টা পর পুলিশ আমাকে কল করে বলল,
~ অরন্য সাহেব আপনি একটু থানায় আসেন তো।

আমি তারাহুরা করে থানায় গেলাম। গিয়ে নিজের প্রিয়তমার মৃতদেহটা দেখলাম। আমার চিনতে মোটেও ভুল হয় নি এ আমার রূপা। আমার পাগলি টা। যে নাকি সারাদিন বকবক করেই যেত আমাকে দেখলে লাফিয়ে উঠত সে ঐদিন আমাকে দেখে বলছে না আরে ইয়ার আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন? পুলিশ শুধু বলেছিল এটাই কি রূপা। আমি পুলিশের কথার জাবাব না দিয়ে রূপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। পুলিশের বুঝতে বাকি রইল না এটাই আমার পাগলি টা।

রূপাকে ধরে বলতে লাগলাম~
~ আমাকে তো একটু বুঝাতে পারতে, বলতে পারতে। আমার থেকে দূরে সরে কেন গেলে? আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকব একটাবারও ভাবলে না। সারাদিন এত বকবক করতে এত কথা বলতে একটাবারও আমাকে ভরসা করে সমস্ত কিছু বলতে পারলে না। শেষমেষ আমিই তোমাকে ভুল বুঝলাম। আমার সাথে অভিমান করার কি দরকার ছিল রূপা। আমি যে তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না।

পুলিশ রূপার থেকে আমাকে আলাদা করতে পারছিল না। এক প্রকার জোর করেই পুলিশ রূপার মৃতদেহটা আমার কাছ থেকে আলাদা করে নিয়ে গেল। একটু পর সবাই জানল বিষয় টা আবরার এসে আমাকে অনেক শাত্ত্বণা দিল। কিন্তু আমার মন তো মানছিল না। রূপাকে ছাড়া কিভাবে থাকব আমি এটা ভেবেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। রূপার বাবা রূপার মৃত্যুর খবর শুনে পুরোপুরি কোমায় চলে গিয়েছিল আর কিছুদিন পরেই রূপার বাবার মৃত্যু ঘটে। কারণ রূপার বাবার একমাত্র অবলম্বন ছিল রূপা। রূপাকে হারিয়ে সে শোকটা আর কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

রূপার ময়না তদন্ত করা হল। ময়নাতদন্ত শেষে যখন একটা বিষয় জানানো হল তখন আমার কলিজা ভেদ করে একটা কষ্টের তীর বিদেছিল সেটা এখন মাঝে মাঝে যন্ত্রণা দেয়। কারণ পুলিশ বলেছিল রূপার গর্ভে দুই মাসের বাচ্চা ছিল। আমার বুঝতে বাকি ছিল না এটা আমার বাচ্চায় ছিল। এক তো রূপাকে হারানোর কষ্ট তার উপর যোগ হল সন্তান হারানোর কষ্ট। পুলিশকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। সব প্রমাণ দিলাম। সৌরভের শাস্তি ও হল।

রূপা দ্বিতীয় বার ভাইরাল হল তবে এখন রূপাকে কেউ বকে নি। আগের ভিডিওতে যারা রূপাকে গালাগাল দিচ্ছিল হাস্যকর ব্যপার হলেও সত্যি যে পরের ভিডিওতে তারাই রূপাকে শ্রেষ্ঠ নারীর খেতাব দিচ্ছে। মানুষ পারেও। ভাইরালের জগতে এসে আমরা আমাদের হিতাহিতজ্ঞান টুকু হারিয়ে ফেলি।

কোন কিছু যাচাই না করেই যা ইচ্ছা বলতে থাকি। সেদিন আমার ও একটা ভুল ছিল আমি রূপার সমস্ত কথা না শুনেই রূপার সাথে বাজে ব্যবহার করেছি। রূপাকে বুঝার চেষ্টা করে নি। সেদিন যদি রূপাকে একটু সাহস, বিশ্বাস, আর সাপোর্ট করতাম তাহলে আর আজকে আমার অনাগত সন্তান আর প্রিয়তমা রূপাকে হারাতে হত না।

এই যে জামা বোরকা এগুলো সব রূপার জন্য কিনি। রূপাকে তো পড়াতে পারব না তাই মাঝে মাঝে অসহায় মানুষগুলোকে দেই। রূপার শোকটা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল। আবরার অনেক সাহায্য করেছিল।

তবে রূপাকে হারানোর যন্ত্রণা টা সবসময় কুড়ে কুড়ে খেত। ঐ যে ব্রিজটা যেখানে প্রতিরাতে দৌঁড়ে চলে যাই সেখান থেকেই ঝাপ দিয়ে আমার রূপা আকাশে চলে গিয়েছিল। কেন জানি না সেখানে গেলে রূপার শেষ নিঃশ্বাস টা শুনতে পাই। কেন জানি না তার সাথে সেখানে মন ভরে কথা বলতে পারি। এভাবেই সেখানে দাঁড়িয়ে একদিন রূপার সাথে কথা বলছিলাম তখন নিরার আগমন হয়। নিরাকে সেদিন প্রথম দেখেই রূপার মুখটা ভেসে এসেছিল।

সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই নিরার দিকে। এর পর পরই মনে হয়েছিল, অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ালে কেমন হয়। তাদের একটু সাহস দিলে তো মন্দ হয় না। কারণ আমি চাই না আর কোন মেয়ে সাপোর্ট না পেয়ে এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাক। তারপর এ আশ্রমটা খুলা। এ আশ্রমে অনেক অসহায় নারীরা থাকে। কিন্তু তাদের গুণের অন্ত নেই। সেটা তো কতক্ষণ আগে আপনাকে দেখালামেই।

এ বলে অরন্য চুপ হয়ে গেল। তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল
“সব পুরুষ এক না সব পুরুষ নারীকে নিয়ে খেলে না। কিছু পুরুষ নারীকে এতটাই ভালোবাসে সেটা তুলনা করার মত কোন বস্তু পাওয়া যায় না। সেই কিছু পুরুষেই হয়ত বাবা হয় যোগ্য স্বামী হয়।”

যেমন নিলয় আর তুর্জ পুরুষ আর অপরদিকে অরন্য একজন পুরুষ। দুদলের মধ্যে তফাৎ অনেক। এক দল নারীকে নিয়ে খেলে ফেলে দেয় আরেকদল ফেলে দেওয়া নারীকে কুড়িয়ে এনে সম্মানের জায়গা তৈরী করে দেয়। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ হয়ে বসে রইল। চারদিকে তখন পিনপনা নীরবতা।

হুট করে তুলি তার ব্যাগে রাখা ছুরিটা ছুরে ফেলে দিল। ছুরিটা ফেলতে দেখে অরন্য খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলল,
~ কি ব্যাপার ছুরিটা ফেলে দিলেন যে? আমি যদি আপনাকে কিছু করে বসি তখন কি করবেন?
তুলি আকাশের তাকিয়ে বলল
~ এ ছুরিটার আর দরকার পড়বে না। চলুন যাই।

~ কোথায় যাবেন?
~ নিয়ে গেলেই তো বুঝবেন। এত কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন?

~ কোথায় যাবেন বললে ভালো হয়। আর নিরা তো এখন না খাইয়ে যেতে দিবে না।
~ পুলিশের কাছে যাব।
~ কিন্তু আপনি তো পুলিশ ভয় পান।

তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে আর্দ্র গলায় বলল
~ হ্যাঁ ভয় পেতাম। কিন্তু এখন আর পাই না। অপরাধ তো আমি করি নি। আমি কেন ভয় পাব? এখানে কত অসহায় নারীরা নিজের জীবন পাল্টেছে। আমার থেকেও অসহায় যারা তারাও নিজের জীবনকে বদলাতে পেরেছে। আমি কেন পারব না? আর অপরাধীরা ঘুরে বেড়াবে আর আমি অপরাধ না করে লুকিয়ে থাকব সেটা তো হয় না। ঐসব নরপশুর হাত থেকে তো আরও অনেক মেয়েকে রক্ষা করতে হবে। আপনি ঠিকেই বলেছেন

“আমি নারী আমি সব পারি। কারণ আমি মা, আমি মেয়ে, আমি অর্ধাঙ্গিনী “
অরন্য একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল
~ এজন্যই আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আপনাকে এখানে না আনলে আপনার মনের পরিবর্তন হত না। সমাজ আপনাকে কখনও বদলে দিবে না। বরং সমাজকে আপনার বদলে দিতে হবে। এ সমাজ নারীদের মর্যাদা দিবে না। বরং মর্যাদা নিজের তৈরী করে নিতে হবে।

তুলি দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল। সত্যিই তো তুলি কেন এত ভয় পাচ্ছিল। তুলি তো কোন দোষ করে নি। এই অসহায় নির্বাক সমাজ তুলির মত অনেক নারীকেই শিখিয়েছে চুপ করে সহ্য করতে। তুলি মনে মনে ভাবছে আমরা নিজেরাই তো নারীদের সম্মান দিতে পারছি না। নিজেরাই তো পুরুষদের সুযোগ করে দিচ্ছি অন্যায় করার। কিন্তু কেন? এর উত্তর হয়ত কেউ দিতে পারবে না। নিজের অস্তিত্ব কেন বিলীন করে দিচ্ছি। তুলির মনের সাহসের মাত্রা বাড়ল। তুলি অরন্যের দিকে আবার তাকিয়ে বলল,

~ পুলিশের কাছে কখন যাব সেটা বলেন। লড়াই করতে আমি প্রস্তুত। আর আমার বাবা মায়ের নম্বর দিচ্ছি আপনি একটু কথা বলুন।
~ আমার তো মনে হয় আপনি বললেই ভালো হয়। আপনার বাবা, মা আপনি ভালো জানেন কিভাবে বললে ভালো হবে। আপাতত পুলিশের কাছে যাই ঘটনা খুলে বলি তারপর দেখি উনারা কি বলে। যদিও দেশের আইন ব্যবস্থা ভালো না তবুও এছাড়া উপায় নেই।

~ আপনি যা বলেন তাই হবে। আচ্ছা
এ বলে তুলি অরন্যের দিকে তাকাল। অরন্য ও তুলির দিকে তাকিয়ে রইল। অরন্যের চোখে তুলি যেন এক ভালোবাসার বর্শা দেখতে পাচ্ছে। নিমিষেই তুলির মন বলে উঠছে অরন্য আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু মুখ দিয়ে সেটা বের হচ্ছে না। একেই হয়ত বলে মন ফাটে তো মুখ ফাটে না। অরন্যের চোখে ভরসার একটা ছাদ দেখতে পাচ্ছে। তুলির খুব ইচ্ছা করছে সে ছাদের আরশ তলে যেতে। কিন্তু কিভাবে যাবে সে উপায় যেন তুলির অন্তরায়।

অপরদিকে অরন্য যখন তুলির দিকে তাকিয়েছিল। রূপার সে চেনা চাহুনিটা বারবার মুখের সামনে ভেসে আসছিল। মনে হচ্ছিল অবিকল রূপার মত কেউ অরন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। দুটো আলাদা মানুষের চোখের চাহুনিতে এত মিল কি করে হয় অরন্য সেটা ভেবে পাচ্ছে না। কেন জানি না ঐ চোখপানে অরন্যের তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালোই লাগছে। আর রূপার কথাটা কানে বাজছে। ঐ যে রূপা বলেছিল

“আকাশের বিশালতা অণুভব করা অনেক কঠিন ব্যপার। কিন্তু আকাশের দিকে তাকালেই এর গভীরতায় নিমিষেই হরিয়ে যাওয়া যায়। জানো অরন্য ভালোবাসাটাও ঠিক একরমেই। ভালোবাসাটা শব্দটা চারটা অক্ষরের হলেও এর বিস্তৃতি অনেক। ভালোবাসার বিস্তৃতিতা একবার উপলব্ধি করতে পারলে খুব সহজেই ভালোবাসার গভীরে ডুবে যাওয়া যায়।”

দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। স্তব্ধ নীরবতা বিরাজ করছে। দুজনেই দুজনকে কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু কিসের বাঁধা যেন সবকিছু আটকে দিচ্ছে। হঠাৎ পরীর মিষ্টি কন্ঠে দুজন চমকে উঠে চোখ নীচে নামিয়ে ফেলে। পরী অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ মামা, মামা আম্মু ডাততেছে।

পরীর অস্পষ্ট কথাগুলো শুনে অরন্য পরীকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
~ চল যাই মামা।

এবলে তুলির দিকে তাকিয়ে বলল
~ ছুরিটা ফেলে দিয়ে লাভ কি। ছুরিটা না হয় সাথে নিয়েই নিন। বাসায় না হয় সাজিয়ে রাখব। বিখ্যাত ছুরি বলে কথা।
খামখেয়ালি কথা শুনে তুলি রেগে অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ সবসময় এত প্যাঁচাল কেন পারেন বলেন তো। নিরা খেতে ডেকেছে খেতে চলুন এবার।

অরন্য মুখ ভরে একটা হসি দিয়ে পরীকে কোলে নিয়ে হাঁটতে লাগল। তুলিও হাঁটতে থাকল। নিরার ঘরে ডুকেই অরন্য আর তুলি দেখল নিরা সব রান্না করে রেখেছে। তুলি নিরার দিকে তাকিয়ে বলল
~ তুমি এত কিছু এত অল্প সময়ে রান্না কিভবে করলে?

পাশ থেকে অরন্য বলল,
~ ও তো আর আপনার মত খাই আর ঘুমাই না আর ছুরি নিয়ে বাহাদুরি করে না।

তুলি চোখ গুলো বড় বড় করে অরন্যের দিকে তাকাতেই নিরা বলে উঠল~
~ আরে তুলি রাগ করো না। অরন্য সবসময় এমন মজা করে। তুমিও না। ওর কথায় রাগ করো না।
~ আরে কি যে বলো তুমি, রাগ কেন করব? তোমার রান্না দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। এখনেই দাও খাব। খুব ক্ষুধা লাগছে। সকালে শুধু এক মগ কফি খেয়েছিলাম।

নিরা হাসতে হাসতে বলল
~ কেন? নাস্তা কর নি কেন?

~ অরন্য রান্না করে নি।
অরন্য পাশ থেকে বলে উঠল~
~ নিজের নাস্তা নিজে রান্না করে খেলে কি পাপ হয় নাকি। মানুষের আশায় বসে থাকেন কেন?

নিরা এক গাল হেসে বলল
~ হয়েছে ভাইয়া। তোমাদের ঝগড়া না হয় বাসায় গিয়ে করো। এখন চুপচাপ খেতে বসো।

এরপর তুলি আর অরন্য খেতে বসল। তুলি নিরার কাছে বিদায় নিতে গেলে নিরা তুলিকে ডেকে বলল,
~ একটা কথা বললে কি রাগ করবে?
তুলি একটু হেসে বলল,
~ রাগ কেন করব?

~ অরন্যকে একটু মানুষ করো। আর কত একা থাকবে। পারলে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়ে করে ফেল। কেন জানি না অরন্য যখন তোমাকে নিয়ে এসেছে তখন মনে হয়েছিল অরন্যের মনে তোমার জন্য একটা জায়গায় তৈরী হয়েছে। মানুষটা সবার জন্য ভাবতে ভাবতে নিজের জন্য ভাবতে ভুলে গিয়েছে।

নিরার কথাটা শুনে তুলি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তুলি বেশ ভালোই বুঝতে পরেছিল যে এ দুইমাসে সে অরন্যকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছে। অরন্যকে বলতে না পারলেও মনে মনে সেটা বারবার অনুভব করেছে। তুলি নিরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ আমি চেষ্টা করব। আমার জন্য শুধু দোআ করো।
~ সে তো সবসময় করব।

তুলি আর নিরাকে এমন অবস্থায় দেখে অরন্য একটা কাশি দিয়ে বলল,
~ এই যে আপনার কি হয়েছে? যাবেন না নাকি।
~ হ্যাঁ যাব তো চলুন।

তুলি নিরার কাছে বিদায় নিয়ে নিরার বাচ্চাটাকে একটু আদর করে চলে আসল অরন্যের সাথে। অরন্য তুলিকে নিয়ে আশ্রম থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিল। রিকশায় উঠে অরন্য তুলিকে বলল
~ আমার মনে হয় আজকে পুলিশের কাছে না গিয়ে আগে একটা উকিলের সাথে কথা বলি। আমার পরিচিত একজন মহিলা উকিল আছে যিনি সবসময় এসব অবহেলিত মেয়েদের নিয়ে কাজ করে। তার কাছে সমস্ত বিষয়টা খুলে বলে তারপর কি করলে ভালো হবে সেটা জেনে বাকিটা করব কি বলুন?
~ আপনার যা ভালো মনে হয় তাই করুন।

অরন্য তুলির দিকে তাকিয়ে দেখল তুলি বেশ শান্ত হয়ে বসে আছে। তুলির শান্ত চেহারা উপর পড়ন্ত বিকেলের রোদটা পড়েছে। গতিয়মান রিকশার সাথে সাথে তুলির মুখের উপর পড়ন্ত রোদটাও যেন ছন্দকার তরঙ্গাকারে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাহস হল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই মাথাটা নীচে নামিয়ে ফেলল। ইতিমধ্যে রিকশাওয়ালা মামাও রিকশার গতি ধীর করে ব্রেক চেপেছে। ব্রেক চেপে রিকশার থেকে নেমে অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ মামা ভাড়াটা দিন।

অরন্য আর তুলি রিকশা থেকে নামল। নামার পর অরন্য ত্রিশ টাকা দিল। ত্রিশ টাকা পেয়ে রিকশাওয়ালা মামা বললেন
~ পাঁচ টাকা খুচরো দেন। আমার কাছে কোন খুচরো নেই।

অরন্য মানিব্যাগ খুঁজে মামাকে বলল,
~ পাঁচ টাকা নাই মামা যা দিয়েছি নিয়ে যান। পাঁচ টাকা দিতে হবে না।

মামা একটা হাসি দিয়ে চলে গেল। পাশ থেকে তুলি বলল,
~ব্যাগে তো পাঁচ টাকা ছিল দিলেন না কেন।

অরন্য মানিব্যাগটা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল
~ এটা আমার প্রিয়তমা রূপার দেওয়া প্রথম কয়েন টা। এটা দেয়া যাবে না।

তুলি কথাটা শুনে মনে মনে ভাবছে একটা মেয়ে কতটা ভাগ্যবান হলে এমন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিল। এসব ভেবে অরন্যের দিকে তাকিয়েই রইল। অরন্য তুলিকে ডেকে বলল
~ কি হল চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন। উকিলের কাছে চলে এসেছি চলুন যাই।

তুলি চোখটা নামিয়ে বলল
~ নাহ কিছু না, চলুন।

দুজন উকিলের কাছে গেল। তুলি প্রথমেই খেয়াল করল একটা সুন্দর মেয়ে পরিপাটি হয়ে বসে আছে। অরন্যকে দেখেই হালকা হেসে বলল
~ কেমন আছেন অরন্য সাহেব?
~ হ্যাঁ ভালো আছি।

~ অনেক দিন পর আসা হল।
~ দরকার ছাড়া তো আসা হয় না। দরকারেই জ্বালাই আপনাকে।
~ হিহিহি কি যে বলুন না। এটাকে জ্বালানো বললে বলব যে, এরকম জ্বালানো আরও পেতে চাই। তা বলুন এখন কি নিয়ে লড়তে হবে।

অরন্য পাশে থাকা তুলিকে দেখিয়ে বলল,
~ এ তুলি। এর কথায় আপনাকে মেসেজে ডিটেইলস বলেছিলাম সকাল দিকে। কি হয়েছে সমস্ত ঘটনা আজকে সকালে জানার পরেই মেসেজ দিয়েছিলাম আপনাকে। এখন সেটারেই ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি। আর তুলি এ হচ্ছে মিসেস অধরা তোমার মামলা টা নিয়ে লড়বে। অনেক ভালো একজন উকিল।

অধরা একটু হেসে বলল
~ শুধু শুধু এত প্রশংসা না করলেও চলবে। যাইহোক আমি তুলির ব্যপার টা ভেবেছি। আমার মনে হয় প্রথমে তুলির উচিত নিলয়কে ডিভোর্স দেওয়া তারপর তুলির জামিনের ব্যবস্থা করব। জামিনের ব্যবস্থা হওয়ার পর পরই তুলি পুলিশের কাছে গিয়ে সমস্ত কিছু বলবে। আমার মনে হয় না এতে ওকে কোন শাস্তি দেওয়া হবে। তবে আইন হাতে তুলে নেওয়ার জন্য সাময়িক শাস্তি দিতে পারে তবে আমি সেটাও মওকুফ করার ব্যবস্থা করে দিব। আমি কাগজ পত্র প্রস্তুত করে রাখব পরশুর মধ্যে। পরশু গিয়ে তুলি সব বলবে পুলিশকে।

অরন্য আরও কিছুক্ষণ কথা বলে অধরাকে বিদায় জানিয়ে তুলিকে নিয়ে বাইরে আসল। এসে পুনরায় রিকশা করল। রিকশাতে উঠে অরন্য তুলিকে বলল
~ এ উকিলেরও একটা মজার কাহিনী আছে শুনবেন।

তুলি উৎসুক হয়ে বলল
~ হ্যাঁ বলেন শুনি।

পর্ব ২৭

তাহলে শুনোন~
~ শুনলে এখান থেকেও আপনি অনেক শিক্ষা নিতে পারবেন। বুঝতে পারবেন নারীরা ইচ্ছা করলেই পারে লড়াই করে নিজেদের জায়গায় তৈরী করতে। এতে শুধু দরকার নারীদের বলিষ্ঠ মনোবল।

অধরা যখন অধরার মায়ের পেটে ছিল তখন উনার বাবা চেয়েছিল যে উনার একজন ছেলে সন্তান হোক। কিন্তু সেদিন অধরার জন্ম হয়। অধরার জন্মের পর অধরার বাবা মোটেও খুশি ছিল না। অধরাকে নিয়ে অধরার মায়ের সাথে ভালোই ঝগড়া হত। অথচ এ সমাজ জানে না যে,
“মেয়ে হওয়ার জন্য মেয়েরা দায়ী না পরোক্ষভাবে ছেলেরা দায়ী।”
যাইহোক বছর ঘুরতেই অধরার মা আবার গর্ভবতী হয়।

আর অধরার মায়ের কোলে একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়। অধরার বাবা সেদিন অনেক খুশি হয়েছিল। সেদিন থেকেই শুরু হয় বৈষম্যের। অধরা মেয়ে হওয়ার দরুণ অধরাকে সবসময় সবকিছু থেকে বঞ্চিত করত। অধরার পরিবার কিন্তু যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিল।
সময়ের পরিক্রমায় দুজনেরেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় হয় কিন্তু অধরার বাবা তার ভাইকে ভলো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় আর তাকে ভর্তি করায় বাড়ির পাশের একটা স্কুলে। কোনরকমে প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পার হয়।

এবার হাইস্কুলে ভর্তির পালা। অধরা চাচ্ছিল বাড়ি থেকে একটু দূরে ভালো একটা হাই স্কুলে ভর্তি হতে, কিন্তু ঐ হাই স্কুলে ভ্যানে যেতে আসতে ভাড়া লাগবে, এজন্য অধরাকে ভর্তি করাতে অধরার বাবা নাকোচ করল। তবুও অধরা জিদ করে ভর্তি হল। তবে ভর্তির টাকাটাও জোগাড় করেছে নিজের মায়ের ব্যাগের থেকে টাকা চুরি করে। সেদিন টাকা চুরির জন্য অধরার মা অধরাকে বেদরম মার মেরেছে। ভর্তির পর অধরা হেঁটেই যেত স্কুলে আর অধরার ভাই যেত ভ্যানে করে।

অধরার জন্য অধরার বাবার মাসে তিনশ টাকা বাড়তি নষ্ট করাটা বেশি মনে হচ্ছিল। অথচ অধরার ভাই এর ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। দিন যায় মাস যায় অধরার মনে হয় একটা প্রাইভেট পড়া দরকার কিন্তু সে টাকা অধরার ছিল না। কারও কাছে হাত পাতার মত অবস্থা ছিল না। কারণ অধরার বাবার যথেষ্ঠ টাকা ছিল। কারও কাছে হাত পাতলে তার বাবার মানসম্মান ক্ষুন্ন হবে তাই চাইত না। এভাবেই পড়তে পড়তে এসএসসি তে গোল্ডেন পায়। সেদিন অধরার বাবা অধরার প্রতি একটু যত্নবান হলেও সেটা টিকে নি বেশিদিন।

অধরার বাবা চাইত অধরা বিয়ে করে ফেলুক। কিন্তু অধরার স্বপ্ন ছিল বড়। তাই সে বিয়েতে রাজি হত না। আর এটা নিয়েই অধরার বাবা আর অধরার মধ্যে ঝগড়া হত। বিনিময়ে মাইর খেত।

অধরার বাবা কোনভাবেই অধরাকে কলেজে ভর্তি করাবে না
তবুও অধরা নিজের জিদটাকে বহাল রেখেছে। নিজের স্বপ্নটাকে নষ্ট হতে দেয় নি। নিজের অস্তিত্বটাকে বিলীন হতে দেয় নি। অধরার মামার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলেজে ভর্তি হল। তবে বইপত্র পেতনা পড়ার জন্য। কোনরকমে বান্ধবীদের কাছ থেকে লিখে আনত। কলেজের লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়ত। বিপত্তি ঘটে পরীক্ষার সময়। তখন অধরার বাবা একটা অযোগ্য পাত্র নিয়ে আসে বিয়ে দেওয়ার জন্য।

অধরা কি করবে বুঝতে না পেরে সেদিনেই লুকিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় মামার বাড়ি। অধরার মামা অবশ্য অধরাকে সাহায্য করত অনেক। সেখান থকে কোন রকমে পরীক্ষাগুলো দেয়। পরীক্ষার পর নিজের বিবেকেই বাঁধল এ বাড়িতে আর কতদিন? তাই চলে গেল নিজের বাড়িতে। বাড়িতে যাওয়ার পর যা হওয়ার কথা ছিল তাই হল। কপালে জুটল বেদরম পিটুনি।

তারপর অধরার মনে হল একটা কোচিং করার দরকার ভার্সিটিতে এডমিশন টেস্টের জন্য। কিন্তু সে সুযোগ ও পায় নি। তাই ঘরে বসেই প্রস্তুতি নিতে থাকল। কিছুদিন পরেই রেজাল্ট দিল। অধরা গোল্ডেন এ প্লাস পেল। সেদিন অধরার বাবা অধরার সাথে একটু ভালোভাবে কথা বলেছিল। অধরাকে পড়াতে রাজি হয়েছিল। তবে অধরার বাবা চেয়েছিল অধরা বাড়ির কাছে ন্যাশনালে পড়ুক। কিন্তু অধরার স্বপ্ন ছিল আরও বড়। সে চাইত সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। অনেক যুদ্ধ করে মায়ের কাছে কান্না কাটি করে ফরম ফিল আপের জন্য।

মা কি করবে বুঝতে না পেরে নিজের নাকে পড়া ফুলটা অধরাকে দিল। অধরার সেদিন মায়ের নাকের ফুলটা নিতে বুক কাঁপতেছিল কিন্তু করার কিচ্ছু ছিল না কারণ তার স্বপ্ন পূরণ করতে এটুকু স্বার্থপর হতে হবে। অধরা নিজেকে সামলে নাকফুলট বিক্রি করে ফরম ফিল আপ করে। এবার পরীক্ষার সময় বিপত্তি ঘটল ঢাকা যাওয়ার টাকা কি করে জোগাড় করবে। চিন্তা করে পাচ্ছিল না কি করবে। অবশেষে বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে ঢাকায় এসে এডমিশন টেস্ট দেয় আর চান্স পায়।

এরপর অধরার বাবা একদম পাল্টে যায়। নিজের মেয়ের সুনাম যখন মানুষের মুখে শুনল তখন অধরাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইল।
এক পর্যায়ে জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে আজকের এ পর্যায়ে এসেছে। আর এখন তার বাবার চোখের মনি অধরা। সেদিনের পর থেকে অধরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমাজে সুবিধা বঞ্চিত নারীদের জন্য কাজ করবে। আর এখন তাই করছে। যে অধরাকে তারা ভুঝা ভেবেছিল সে অধরায় আজকে তার বাবা মায়ের একমাত্র আশার খনি। একমাত্র আশ্রয়স্থল।

আচ্ছা একবার ভাবুন তো অধরা যদি এ সমাজের কাছে পরাজয় মেনে নিত তাহলে কি সে পর্যায়ে আসতে পারত? কতটা সংগ্রাম আর কষ্ট করে পড়েছেন চিন্তা করতে পারছেন কি? তবুও এ সমাজের কাছে মাথা নত করে নি। নিজেকে গড়ে তুলেছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

নারীরা চাইলেই সংগ্রাম করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। তাই শোষিত নারীদের নিয়েই আমাদের এ আয়োজন এ আশ্রম। এ আশ্রমের প্রতিটা মেয়ের কাছ থেকে একটা একটা শিক্ষা নিতে পারবে। নিজের মনকে শক্ত করতে পারবে। সংগ্রাম করতে পারবে। আমি চাই এ আশ্রমে একসময় শতাধিক মানুষ হোক তবে তারা যেন শোষিত হয়ে না আসে। তারা যেন আসে সমাজটাকে এগিয়ে নিতে।

অরন্য কথাগুলো বলে থেমে গেল। তুলি অরন্যের কথা গুলো শুনে ভাবতে লাগল প্রতিটা নারীর যদি এ যুদ্ধ করার সাহস থাকত তাহলে হয়ত সত্যিই সমাজটা বদলে যেত। তাহলে হয়ত নারীরা শোষিত হত না। বরং নারীর হাতের ছোঁয়ায় সমাজটা বদলে যেত। সত্যিই তো কত নারীই সংগ্রাম করে নিজের অবস্থান করেছে। সেখানে কিছু কিছু নারী কেন নিজেদের পিছিয়ে রাখছে। তুলির মনে অদ্ভুত একটা আত্নবিশ্বাসের সঞ্চার হল। কেন জানি না আজকে তুলির বিশ্ব জয় করতে ইচ্ছে করছে। কেন জানি না ইচ্ছা করছে অনেক লড়াই করে নিজের স্থানটা তৈরী করতে।

তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ সমাজ পরিবর্তনে আপনার মত কিছু মানুষ ও দরকার যারা নারীদের সঠিক মূল্যায়ন করে।
~ বাসায় চলে এসেছি। রিকশা থেকে নামবেন না? (একটু হেসে)
~ হ্যাঁ নামছি।

অরন্য আর তুলি রিকশা থেকে নেমে বাসায় গেল। বাসায় গিয়ে তুলি কতক্ষণ চুপ হয়ে বসে রইল। এর মধ্যেই আকাশে মেঘের গর্জন দিতে লাগল। এসময় টা কেমন জানি অদ্ভুত, এই গা ফাটিয়ে রোদ্দুর উঠছে আবার গর্জন দিয়ে মেঘ নামছে। মেঘের গর্জন শুনে তুলির ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। এসময়টাতে তুলি আম কুড়াতো। শিলা কুড়াতো। বৃষ্টিতে ভিজে নিজেকে শীতল করত। কত মধুর সময়টাই না ছিল। আজকে খুব ভিজতে মন চাচ্ছে তুলির।

মেঘ, বৃষ্টির খেলায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে মন চাচ্ছে তুলির। বেলকনিতে গিয়ে বাইরে হাত দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরার একটা প্রতিযোগিতায় নামল। অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভুতি জাগছে তুলির মনে। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা হাত দিয়ে ধরে ভিতরে এনে মুখে লাগাচ্ছে। এক শীতল পরশ যেন তুলিকে আরও শীতল করে তুলছে। তুলির মুখে অজানা এক হাসি লুটোপুটি খাচ্ছে।

ঠিক এসময় অরন্য তুলির রূমে আসল। তুলিকে বরান্দায় এ অবস্থায় দেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তুলির চোখে মুখের আবছা হাসিটা দেখে অরন্যের মনটা কেন জানি শীতল হচ্ছিল। কেন জানি না এক অদ্ভুত ভালোবাসার পরশ পাচ্ছিল। তুলিকে দেখলেই কেন জানি না অরন্যের মনে হয় এটা রূপা।

কারণ দুটো মানুষ আলাদা হলেও এদের চোখ, হাসির মধ্যে অপূর্ব মিল খুঁজে পায় অরন্য। তুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করলেও অরন্য তুলির থেকে চোখটা সরিয়ে ফেলল। কারণ অরন্য কখনও রূপার জায়গা কাউকে দিতে পারবে না। তুলিকে না ডেকেই অরন্য চলে নিতে নিল।

ঠিক এসময় তুলি পিছন ফিরে দেখল অরন্য রূম থেকে প্রস্থান নিচ্ছে। অরন্যকে দেখে তুলির ভিতর এক অদ্ভুত ভালোবাসা জেগে উঠল। কেন জানি না তুলির মন চাচ্ছে অরন্যকে ধরে চিৎকার করে ভালোবাসি বলতে। বুঝতে পারছে না তুলি কি করতে যাচ্ছে। নিজের আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে। তুলি অরন্যকে পিছন থেকে ডাক দিল~
~ এই যে শুনোন।

তুলির ডাকে অরন্য পিছন ফিরে তাকাতেই বৃষ্টির ফোঁটায় তুলির ভেজা আর্দ্র চুলগুলো দেখে চোখটা নীচে নামিয়ে ফেলল। কারণ এ চুল দেখলে অরন্য তার আবেগ সামলাতে পারবে না। তুলি অরন্যকে দেখে দৌঁড়ে অরন্যের কাছে গিয়েও থেমে গেল। অরন্যের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে বলল,
~ চলুন বৃষ্টিতে ভিজি। বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ইচ্ছা করছে।

অরন্য তুলির কথাটা ফেলতে পারল না। তুলিকে নিয়ে ছাদে চলে গেল। তুলি বাচ্চাদের মত দৌঁড়ে ভিজতে লাগল। অরন্য শুধু তুলির দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। টানা এক ঘন্টা তুলি বৃষ্টিতে ভিজার পর কাঁপতে কাঁপতে অরন্যকে বলল
~ বৃষ্টি থেমে গিয়েছে চলুন ঘরে যাই। প্রচন্ড শীত করছে।

অরন্য তুলিকে নিয়ে রূমে আসলো। তুলি রূমে এসেই কাপড়টা পাল্টে নিল। কাপড় পাল্টে চুল মুছতে মুছতেই তুলি কয়েকটা হাঁচি দিল। তুলি বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল তুলির ইতিমধ্যেই ঠান্ডা লেগে গিয়েছে। ছোটবেলা থেকে তুলির একটা বদঅভ্যাস একটু বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর চলে আসে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না। নিমিষেই গা টা গরম হতে লাগল। তুলি কোনরকমে মাথাটা মুছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।

সাঁঝের সময় এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অরন্য তুলিকে কয়েকবার ডেকে বলল,
~ কি ব্যাপার এ অসময়ে শুয়ে আছেন যে।

তুলির কোন শব্দ পেল না। অরন্য ভাবল তুলি হয়ত ঘুমাচ্ছে। কিন্তু খানিকক্ষণ পর। তুলির একটু আওয়াজ শুনে তুলির কাছে এসে দেখল। তুলি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে আর কাঁপছে। তুলির মাথাটা অরন্য ধরে খেয়াল করল জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় হাত ধরতেই তুলি অরন্যের হাতটা টেনে বুকের কাছে নিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখল। আর বলতে লাগল~
~ অরন্য একটা কথা বলব আপনাকে?

অরন্য হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলে তুলি আরও জোরে হাতটাকে ধরে রাখল। অরন্য তুলির কানের কাছে গিয়ে হালকা করে বলল
~ কি করছেন কি? হাতটা একটু ছাড়ুন।
~ বলুন না একটা কথা বলব কি না?
~ হাতটা ছেড়ে কথা বলুন।

~ নাহ হাত ছাড়ব না।
অরন্য বেশ মুশকিলে পড়ে গেল কি করবে এটা ভেবে। অরন্য যতবারেরই হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে ততবারেই তুলি হাতটাকে শক্ত করে ধরছে। তাই হাতটা ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা না করে তুলিকে জিজ্ঞেস করল
~ কি বলতে চান বলুন?

~ আমি আপনাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। প্রচন্ড রকমের ভালোবাসি আপনাকে। আপনাকে যতবারেই দেখছি ততবারেই নিজের মনের অজান্তে ভালোবাসার মানুষটাকে খুঁজে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমার স্বপ্নের পুরুষটাকে খুঁজে পেয়েছি।

তুলির এমন কথায় অরন্য একটু বিস্মিত হয়ে গেল। তুলির প্রতি অরন্যেরও একটা তীব্র টান কাজ করল। তুলির কথার জবাবে অরন্যের বেশ ইচ্ছা করছে বলতে যে, তুলি আমিও তোমায় ভালোবাসি। কিন্তু কেন জানি না অরন্যের মনে হচ্ছে এতে তার প্রাণপ্রিয় প্রিয়তমা রূপাকে ঠকানো হবে। তাই তুলিকে বলল,
~ জ্বরের ঘোরে কি আবোল তাবোল বলছেন। আমি ঔষধ দিচ্ছি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।

তুলি অরন্যের হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলল
~ সত্যিই আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।

অরন্য তুলির হাত থেকে নিজের হাতটা বেশ জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে পাশের রূমে চলে গেল।

তারপর তৈরী হয়ে ব্রিজের কাছে চলে গেল। প্রতিদিন ব্রিজের কাছে রাত এগারোটায় গেলেও আজকে অরন্য রাত আট টায় ব্রিজটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মনে মনে রূপার সাথে কথা বলতে লাগল। কল্পনায় থাকা রূপা বলল,
~ কি ব্যাপার অরন্য আজকে এত তাড়াতাড়ি আসলে যে।

~ ঘরে একদম মন টিকছে না। জানো রূপা আমার বাসায় একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছিলাম। এখান থেকেই তার সাথে পরিচয়। ওর চোখের দিকে তাকালে কেন জানি না তোমাকে দেখতে পাই। কেন এমন হয় বলতো? দুটো আলাদা মানুষের চোখের চাহুনিতে এত মিল কি করে হয় বলতে পারবে?
~ আমি যদি ঐ মেয়ের চোখ দুটোতে থাকি তুমি কি ঐ মেয়ের চোখ দুটোতে তাকিয়ে আমার সাথে কথা বলতে পারবে না?

~ কেন পারব না রূপা, অবশ্যই পারব। কেন জানি না ও তাকালে মনে হয় তুমি তাকিয়ে আছ। জানো রূপা মেয়েটা আজকে অদ্ভুত রকমের পাগলামি করেছে। আমাকে নাকি ভালোবাসে।
~ তুমি বাসো না? তোমার মন কি বলে?

অরন্য এবার কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। কারণ অরন্যেরও তুলির প্রতি একটা মায়া জন্মে গিয়েছে। অরন্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
~ আমি যা বলব সেটা শুনলে কি তুমি কষ্ট পাবে?
~ আরে বোকা কষ্ট কেন পাব?

~ নাহ মানে তুলিকে দেখলে আমার কেন জানি অদ্ভুত ভাবে তোমাকে মনে পড়ে। ওর দিকে তাকালে তোমার চোখ দুটো ভেসে উঠে। তোমার আরে ইয়ার কথাটা কানে বাজতে থাকে। মনে হয় একটা ভিন্ন চেহারার অবিকল একটা মানুষেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এমন কেন মনে হয় জানি না। কিন্তু তোমার জায়গায় তাকে ঠাঁই দিয়ে তোমাকে কষ্ট দিতে পারব না।

কল্পিত রূপা অরন্যের পাশে এসে দাঁড়াল। অরন্যের হাতটা ধরে বলল,
~ আমার তো মনে হয় তুমি এতদিন আমাকে বেশি কষ্ট দিয়েছ।
~ কিভাবে কষ্ট দিলাম তোমাকে। রূপা আমি কখনও তোমার জায়গাটা অন্য কাউকে দেই নি। তোমাকে আমার মনের ভিতর ধারণ করে রেখেছি সবসময়।

কল্পিত রূপা এক রাশ হেসে বলল,
~ আরে ইয়ার তুমিও না। ঠিক এ জায়গায়টাতেই তুমি খুব বড় ভুল করেছ। তোমার এ নিঃসঙ্গ জীবন আমাকে আরও কষ্ট দিচ্ছে। আমাকে আরও অপরাধী করে তুলছে। তোমাকে এভাবে একদম ভালো লাগে না আমার। আমি চাই তুমি নতুন করে জীবন শুরু করো। আমার মত করে কাউকে ভালোবাস।

সংসার করো। অরন্য এ একাকীত্ব কোন সমাধান না। একা থাকলেই যে তুমি আমাকে ভালোবাসবে তা না। বরং তুমি আরেকটা মেয়ের জীবন সুন্দর করে রাঙ্গিয়ে দিয়েও আমাকে ভালোবাসতে পার। ভালোবাসা মানে এই না তুমি সারাজীবন নিঃসঙ্গতার গ্লানি বয়ে বেড়াবে। ভালোবাসা তো সেটা যেটা
“হাজারো মানুষের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে। যার অস্তিত্ব মনের মনিকোঠায় মিশে থাকবে। যাকে ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না শুধু অনুভব করা যাবে।”

নিঃসঙ্গতা একটা স্বার্থপরতা। তুলির চোখে আমাকে যে খুঁজে পাও বিশ্বাস করো অরন্য এটাই ভালোবাসা। তুলিকে নিয়ে সারাজীবন একসাথে থাকলেও তুলির চোখে তুমি আমাকেই দেখতে পারবে। আমাকে হারাবে না অরন্য। আমি যে তোমার অস্তিত্বে মিশে আছি। সেখান থেকে কেউ সরাতে পারবে না। তবে তোমার এ নিঃসঙ্গতা আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। আমি তো চাই তুমি নিজেকে ভালো রাখো। কিন্তু এ নিঃসঙ্গতা তোমাকে কুড়ে কুড়ে খেলে আমার ভালো লাগবে না। অরন্য যাও তুলির কাছে ফিরে যাও। তার নয়ন জোড়ায় আমাকে খুঁজে নাও। তোমার অস্তিত্বে থাকা রূপাকে আর কষ্ট দিও না।

এ বলে কল্পনার রূপা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বেশ কয়েকবার অরন্য রূপা, রূপা বলে ডাকল কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। অরন্যের মাথায় তখন একটা কথা বাজতে লাগল যাও অরন্য তুলির চোখে আমাকে খুঁজে নাও।

অরন্যের তুলির কথা মনে হতেই বাসায় ছুটে গিয়ে তুলিকে দেখে অরন্য চমকে গেল। বুকের ভেতরটা দুমরে মুচরে গেল। তুলিকেও হারিয়ে ফেলবে এটা ভেবেই বুকের ভেতরটায় কষ্টের তীর যেন ছেদ করল।

পর্ব ২৮

কারণ অরন্য খেয়াল করল তুলি নীচে পড়ে আছে। অরন্য দৌঁড়ে গিয়ে তুলির পাশে গেল। গিয়ে খেয়াল করল তুলির শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তাই তুলিকে কোলে নিয়ে খাটে তুলল। এর মধ্যে তুলি টের পেল কেউ একজন তাকে ধরেছে সে ভালোই বুঝতে পেরেছিল এটা অরন্য। তুলি চোখ মেলে তাকাতে পারছে না।

জ্বরের তীব্রতা এতই ছিল যে তুলির হুঁশ তেমন ছিল না। অরন্য তুলির মাথায় জল পট্টি দিতে লাগল। তুলিকে কোনরকমে মুখে তুলে একটা ঔষধ খাওয়ালো। অরন্য সারারাত তুলির মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে কখন যে তুলির পাশে ঘুমিয়ে গেল টেরেই পেল না।

ভোর চারটায় তুলির হুঁশ ফিরল। তুলি চোখ খুলে দেখল অরন্য তুলির পাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। তুলির মাথায় জলপট্টি দেওয়া। তুলির বুঝতে বাকি রইল না অরন্য তুলির মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে ঘুমিয়ে গিয়েছে। তুলি নিজেকে সামলে একটু উঠতে নিল। এমন সময় অরন্যের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠতেই তুলি বলে ফেলল
~ আমার জন্য আপনি সারারাত কষ্ট করেছেন।

অরন্য মুচকি হেসে বলল
~ রাতে যে আবোল, তাবোল করেছেন সেটা কি সত্যি ছিল নাকি জ্বরের ঘোরে করেছেন?

তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল
~ অরন্য আমি
আরও কিছু বলতে নিবে এমন সময় অরন্য তুলির মুখটা আটকে দিয়ে বলল,
~ আমি কি কিছু বলব?
~ কি বলতে চান?

অরন্য তুলির হাতটা শক্ত করে ধরে তুলির চোখে চোখ রেখে বলল
~ তোমার ঐ চোখে কেন জানি না রূপাকে খুঁজে পাই। কেন জানি না তোমার মাঝে রূপার অস্তিত্ব টের পাই। কেন জানি না বারবার তোমার মাঝে রূপাকে হারিয়েও ফিরে পাই। তোমার চাহুনির মায়ায় যেন রূপার প্রতিচ্ছবি আটকে আছে। আমার হারিয়া যাওয়া রূপা কি হবে? আমার হারিয়ে যাওয়ার রূপাকে তোমার মাঝে ফিরে পেতে চাই।

তুলির বিশ্বাসেই হচ্ছিল না যে অরন্য তুলিকে এভাবে বলছে। নিমিষেই তুলির চোখে ভালোবাসার অশ্রু বিন্দু জমে গেল। অরেকটু ভালোবাসা পেলেই হয়ত সে অশ্রু বিন্দুটা বৃষ্টি হয়ে নেমে যাবে। তুলি প্রতিক্ষায় আছে কখন অরন্য ভালোবেসে বুকে টেনে নিবে আর তুলি তার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুবিন্দু বৃষ্টি হয়ে নামাবে।
খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না তুলির। খানিকক্ষণের মধ্যেই অরন্য তুলিকে জড়িয়ে ধরল। আর তুলির চোখের জল শ্রাবণের মেঘের মত ঝরতে লাগল। অরন্যকে চেপে ধরে বলল,

~ জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তখন তোমার সাথে দেখা। নিজের হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্বটাকে আবার ফিরে পেলাম। বাঁচার একটা আশা খুঁজে পেলাম। আমি যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসি, বলতে চেয়েও আটকে গিয়েছি বারবার। কখন যে জ্বরের ঘোরে বলে ফেলেছি খেয়ালেই করে নি। আমি তো ভালোবাসার চাতক পাখি হয়ে তোমার ভালোবসা পাবার জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিলাম। কাউকে যে এত অল্প সময়ে আপন করা যায় সেটা তোমাকে না দেখলে জানতাম না। বড্ড ভালোবাসি তোমায়।

অরন্য তুলিকে আরও শক্ত করে ধরল। সম্বোধনটাও যে আপনি থেকে তুমিতে কিভাবে চলে আসল তাদের বুঝার অন্তরায় রয়ে গেল। এর মধ্যেই সকালের সূর্যটা লাল হয়ে আকাশে উঠতে লাগল। ক্রমশেই আধার গুচিয়ে চারদিক আলোকিত হতে লাগল। অরন্য তুলির কাছ থেকে তুলির পরিবারের নম্বর নিয়ে কল দিয়ে তুলিকে বলল কথা বলতে। তুলি হ্যালো বলতেই তুলির মা তুলির কন্ঠ শুনে কেঁদে দিয়ে বলল,

~ মারে কোথায় ছিলি এতদিন? আমাদের উপর এত কিসের রাগ যে একটা কল ও করিস নি। আগের বাসায় কত খুঁজ নিয়েছি পেলাম না। নিলয় কেমন আছে?
নিলয়ের কথা বলতেই তুলি কেঁদে দিয়ে মাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। তুলি ভেবেছিল তার মা হয়ত তাকে বলবে যে এরকম কাজ করলে এরকমেই হবে। বাবা মাকে না বলে কিছু করলে এর ফল এমনেই হয়।

কিন্তু না তুলির মা উল্টা তুলিকে সাহস দিল তুলির পাশে দাঁড়াল। তুলির বুকটা তখন আরও ফেটে গেল। তুলি ভাবল বিয়ের রাতে যদি তুলি, তুলির মাকে সবটা বলতে পারত তাহলে হয়ত আজকের এ দিনটা দেখতে হত না। অপরদিকে তুলি এটা ভেবেও খুশি হচ্ছে যে যদি তার জীবনে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় না ঘটত তাহলে এত, এত মেয়ের সংগ্রাম করে টিকে থাকার লড়াইটা দেখতে পারত না। আর অরন্যের মত এমন মানুষকে কাছে পেত না। মায়ের সাথে কথা বলা শেষে কলটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইল তুলি।

খানিকক্ষণ পর অরন্য তুলির বাবা, মাকে কল দিয়ে সবকিছু বুঝাল। আর বলল কালকে তুলি থানায় গিয়ে সব বলবে তারাও যেন সেখানে থাকে। তারপর কথাশেষে কলটা কেটে দিল।

সারাটাদিন একে অপরকে আরও কাছ থেকে আগলে নিল। পরদিন মিস অধরা কল দিয়ে অরন্যকে বলল,
~ অরন্য সাহেব তুলিকে নিয়ে থানায় আসুন।

অরন্য তুলিকে নিয়ে থানায় গেল। তুলির বাবা, মা ও সেদিন থানায় গেল। একবছর পর বাবা, মাকে দেখে তুলি দৌঁড়ে গিয়ে তাদের ঝাপটে ধরে কাঁদতে লাগল।
অরন্য তুলিকে সামলে থানার ভেতর নিয়ে গেল। তুলি সমস্ত ঘটনা পুলিশকে খুলে বলল। পুলিশ বিষয়টা তদন্ত করে। ঐ মৃত ব্যক্তির কল লিস্ট থেকে নিলয় আর ঐ মহিলার নম্বর ট্র্যাক করে নিলয় আর ঐ মহিলাকে আটক করল।

ঐখান থেকে আরও অনেক অসহায় মেয়েকে উদ্ধার করা হয়। আর ঐসব মেয়েদের ঠাঁই হয় অরন্যের গড়া আশ্রমে। নিলয় আর খবিশ মহিলার শাস্তির ব্যবস্থা করা হল। এর মধ্যে নিলয়ের সাথে তুলির ডিভোর্স করানো হয়। আইন হাতে তোলে নেওয়ার জন্য তুলির যে শাস্তি হওয়ার কথা ছিল সেটা সার্বিক দিক বিবেচনা করে তুলির শাস্তি মওকুফ করে দেওয়া হয়।

তুলির পরিবারের সাথে কথা বলে, অরন্য আর তুলির বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় তিনমাস পর তাদের ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয়। আশ্রম থেকে তুলির জন্য অনেক উপহার পাঠায় সবাই। আর নিরাও বিয়েতে উপস্থিত ছিল।

তারপর বাবা মাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে করে নতুন গন্তব্যে যাচ্ছে তুলি, নতুন জীবন শুরু করতে। তুলি মনে মনে ভাবতে লাগল, আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্য। এতসব ঘটনা না ঘটলে আজকে তুলি অরন্যের মত বীরপুরুষ পেত না।

এসব ভেবেই তুলির চোখে আনন্দের অশ্রুবিন্দু জমা হল হালকা। মাঝপথে নিরা নেমে গেল। কারণ নিরাকে আশ্রমে যেতে হবে। তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবতে লাগল। আকাশটা রক্তবর্ণ হয়ে লাল হল। নিমিষেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামল। ব্যাস্ত শহরের রাস্তার দুপাশে সোডিয়াম বাতি জ্বলে উঠল। অরন্য তুলিকে নিয়ে বিয়ের রাতে বাসায় না গিয়ে সেই ব্রিজের কাছে গেল। ব্রিজের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। ব্রিজের উপর দিয়ে তখন জোনাকি পোকার মত হেডলাইড জ্বালিয়ে গাড়ি চলতে লাগল।

“ব্যস্ত শহরে গাড়ির হেড লাইডগুলো দেখতে অনেকটা জোনাকি পোকার মতো। এ জ্বলে এ নিভে। বলা যায় হরেক রঙয়ের জোনাকি পোকা। এ ব্যস্ত শহরের রাতটাও যেন দিনের মত প্রাণচঞ্চল।”

তুলি অরন্যের হাতটা চেপে ধরে বলে~
~ রূপাকে মনে পড়ছে বেশি? তাই কি এখানে এসেছ যে?

~ নাহ তুলি, রূপাকে খু্ঁজতে আর প্রতিদিন এখানে আসতে হবে না। কারণ আমার রূপা তো তোমার চোখে ডুবে আছে। এখানে তোমার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল তাই এখানে আসলাম। ভাবলাম এখানে কয়েক ঘন্টা কাটাব। বৃষ্টিত এখন পড়ছে না তাই উড়তে থাকা ধূলিগুলোকে না হয় ধরার চেষ্টা করব।

অরন্যের কথা শুনে তুলি ভাবতে লাগল এ দুনিয়ার প্রতিটা ছেলে যদি অরন্য হত তাহলে মেয়েদের এত কষ্ট হত না। প্রতিটা মেয়েই চাই এরকম একজন পুরুষ তার স্বপ্ন পূরণের সাথী হোক। তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আমার স্বপ্ন পূরণের সাথী হবে?

~ সারা জীবনের সাথী হব। তোমাকে আবার ভর্তি করাব। পড়া শুরু করবে। জীবনটাকে এখানে থামিয়ে দিলে হবে না। নিজের অবস্থান গড়ে তুলবে। প্রতিটা মেয়েরেই উচিত নিজের অবস্থা গড়ে তোলা। তোমাকেও আরও সামনে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবে জীবনটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র সে যুদ্ধক্ষেত্রে সবসময় জিতার চেষ্টা করবে। তাহলেই জীবনে উন্নতি করতে পারবে।

অরন্যের এ কথাগুলো তুলিকে যেন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। তিনটা ঘন্টা ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে বাসায় গেল অরন্য আর তুলি। বাসায় গিয়েই তুলি বেলকনিতে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। পূর্ণিমার চাঁদটা আজকে তার সমস্ত বিস্তৃতি নিয়ে উঠেছে। অপলক দৃষ্টিতে চাঁদের সৌন্দর্য অবলোকন করছে তুলি।
ঠিক কিছুক্ষণ পর অরন্য হাতে কফি নিয়ে তুলির দিকে বাড়িয়ে বলল
~ আজকেই শেষ বারের মত বানিয়ে খাওয়াচ্ছি। এরপর আর বানিয়ে খাওয়াব না। এরপর থেকে এ দায়িত্বগুলো তোমাকে নিতে হবে।

তুলি চট করে কফির মগটা হাতে নিয়ে বলল,
~ আরে ইয়ার কি যে বলো না। এক কাপ কফিই তো। এখন থেকে তোমাকে তুলির স্পেশাল কফি খাওয়াব।

তুলি রূপার পুরোপুরি কপি করাতে অরন্য তুলির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু হেসে বলল,
~ থাক আর স্পেশাল কফি খাওয়াতে হবে না।
কথাটা বলার সাথে সাথে দুজনেই জোরে অট্ট হাসি দিয়ে উঠল।

এভাবেই সুখে শান্তিতে কেটে গেল দুইটা বছর। এর মধ্যে তুলি আর অরন্যের কোল জোরে আসল একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। আজকে দুবছর পর সে ব্রিজটার সামনে এসে দাঁড়াল তুলি আর অরন্য। এ দু বছরে ব্যস্ততার কারণে এখানে আসতে পারে নি দুজনের কেউ। অরন্য আর তুলি পাশাপাশি দাঁড়াল যখন তখন সূর্যটা ডুবতে লাগল।

কিছুক্ষণ এর মধ্যেই হালকা অন্ধকার হল। সোডিয়াম বাতিগুলোও আগের নিয়মে জ্বলে উঠল। সে সাথে গাড়ির হেডলাইট গুলোও জোনাকি পোকার মত গতিয়মান হতে লাগল। ঠিক তখনেই অরন্য বলল,
~ এখানেই তো দুবছর আগে ঝাঁপ দিতে এসেছিলে। আজকে একটু ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছা জাগছে না।
~ একদম না।
~ কেন?

তুলি উৎসুক চোখে অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল
~ যখন জীবনের গতি হারিয়ে একদম হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। নিজের অস্তিত্বকে বিশাদময় করেছিলাম। তখন নিজের চলার গতি আবার ফিরে পেয়েছি। নিজের অস্তিত্ব আবার খুঁজে পেয়েছি। কারণ আমার জীবনে
“হঠাৎ তুমি এলে”।

এ গল্পটা থেকে আমি যেদিকগুলো তুলে ধরতে চেয়েছি নীচে দেওয়া হলো-

১) নিলয় আর তুলির ঘটনা থেকে বুঝাতে চেয়েছি যে ফেসবুকের অল্প পরিচয়ে কাউকে বিশ্বাস করা উচিত না। জীবনে যাই হোক বাবা মাকে আগে জানানো উচিত।
২) নিরা আর তুর্জের ঘটনা থেকে বুঝাতে চেয়েছি যে নিজের অপূর্ণতাকে দুর্বলতা ভাবা উচিত না। বিয়ে খুব সেন্সসিটিভ বিষয় সেটা ভালো করে খুঁজ নিয়ে দেওয়া উচিত।

৩) রূপা আর অরন্যের কাহিনি থেকে বুঝাতে চেয়েছি যে কোনোকিছু পেলেই আমরা যাচাই না করেই ভাইরালে মেতে উঠি তবে সেটা একদম ঠিক না। এতে কারও জীবন চলে যেতে পারে।
৪) অধরার কাহিনী থেকে বুঝাতে চেয়েছি যে মেয়ে মানুষ মানেই নিজের পরিবার থেকে শুরু করে সবজায়গায় বৈষম্য। তাই নিজের অবস্থানটা নিজেকেই বদলাতে হবে।

৫) সব শেষে তুলি আর অরন্যের কাহিনি থেকে বুঝাতে চেয়েছি জীবনে অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় আমাদের সবটা কাটিয়ে উঠতে হবে তাহলে আধার গুঁচিয়ে আলোর মুখ দেখব।

এটা একটা রোমান্টিক গল্প হলেও এ গল্পটায় আমি নারীদের অবস্থান তুলে ধরেছি যাতে করে নারীরা একটু সাহসী হয়ে উঠতে পারে। সবাইকে ধন্যবাদ গল্পটা পড়ার জন্য। কেমন লেগেছে জানাবেন। আবার দেখা হবে নতুন কোনো কাহিনি/নতুন কোনো গল্প নিয়ে।

লেখিকা: শারমিন আঁচল নিপা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “হঠাৎ তুমি এলে – First love story bangla” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – হঠাৎ তুমি এলে (১ম খণ্ড) – First love story bangla

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *