আমার তুমি (সিজন ৩: শেষ খণ্ড) – Romantic premer golpo bd

আমার তুমি (সিজন ৩: শেষ খণ্ড) – Romantic premer golpo bd: তুর্য কিছু বলার আগেই পরী শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। মামা কানে হাত দেয়, তুর্য চোখ বন্ধ করে ফেলে আর সেজান ভয়ে তুর্যর গলা জড়িয়ে ধরে।


পর্ব ১৯

পরী আচমকা হাত ধরায় তুর্য পেছনে ফিরে তাকায়। পরী বলে,
“ভালোবাসা ভুল নয়। কিন্তু ভুল মানুষটাকে ভালোবাসা ভুল। আপনার বুঝা উচিত, আমার সমস্যাটার কারণে আমি জয়কে পর্যন্ত বিয়ে করিনি। আমার এত বছরের ভালোবাসাকেও বিসর্জন দিতে হয়েছে। আমার আপন খালাই যেখানে আমার এই সমস্যাটাকে মেনে নিতে পারেনি। সেখানে আপনার মা সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মানুষ। সে কেন মেনে নেবে আমাকে? হ্যাঁ নিতে পারে। তবে সেটা আপনার জন্য নয়। আপনার ভাই সূর্যর জন্য। আর কারণটা নিশ্চয়ই ভেঙ্গে বলতে হবে না?”

“পরী, তুমি জয়কে বলোইনি তোমার সমস্যাটার কথা। তুমি যদি বলতে তাহলে নিশ্চয়ই জয় এটা ভাবত না যে সে বাবা হতে পারবে নাকি পারবে না। ঐ মুহূর্তে জয়ের ইম্পোর্টেন্স থাকতে তুমি।”
“আমি কী করে বলতাম? কী করে বলতাম আমি? আমি নিরুপায় ছিলাম। আমি অনেকবার চেয়েছিলাম জয়কে অন্তত সত্যিটা জানানোর। ভালোবাসার মানুষটার চোখে কে-ই বা চায় অপরাধী হয়ে থাকতে? আচ্ছা আপনি তো আমায় ভালোবাসেন। আপনি চাইবেন কখনো আমার চোখে ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকতে? চাইবেন না। কারণ কোনো মানুষই এটা চায় না। আমি বাঁধা ছিলাম দুটো জায়গায়। প্রথমত আমি মা হতে পারব না। আর দ্বিতীয়ত খালামনি আগেই মাথার দিব্যি দিয়ে রেখেছিল। খালা শুধু তার দিব্যি দিয়েই ক্ষান্ত হননি।দিয়েছিল জয়ের কসম। এসব পাড় করে জয়কে সত্যিটা জানানোর মতো সাহস আমার হয়ে উঠেনি। আমি জানিও না জয় কখনো এই সত্যিটা জানতে পারবে নাকি। আর জানলেও জয় তখন কী করবে সেটাও আমি জানি না। কিন্তু আমি চাই, জয় কখনো সত্যিটা না জানুক। আমায় ভুল বুঝেই না হয় ও ভালো থাকুক।”
“সত্য কখনো চাপা থাকে না জানো? আজ হোক বা কাল। জয় নিশ্চয়ই সত্যিটা জানতে পারবে।”

“যে সত্যিটা জয় জানে না। সেটা আপনি জানেন। জেনে বুঝে তবুও কেন ভুল পথে পা বাড়াচ্ছেন?”
জয় মুচকি হেসে আরেকটু শক্ত করে পরীর হাতটা চেপে ধরে। তারপর গানের কয়েকটা লাইন বলে।
“অগোছালো দিন রাত বলে যায়,
হাতে রাখা তোর হাত বলে যায়
ভালোবেসে কোনো ভুল করিনি আমি।”

তুর্যর হাত থেকে তাড়াতাড়ি হাতটা সরিয়ে নেয় পরী।
বিকেলের দিক দিয়ে রুমকি, সিয়াম আর শশী পরীকে এসে দেখে যায়। যাওয়ার পথে তুর্য রুমকিকে ডাকে। রুমকি দাঁড়িয়ে বলে,
“আরে তুর্য তুমি এখানে।”
“হুম। কেমন আছেন আপু?”
“এইতো ভালো আছি। কিছু বলবে?”

“পরী আর শপে কাজ করবে না।”
“কাজ করবে না মানে? আমি তো মাত্রই ওর সাথে কথা বললাম। আমাকে তো কিছু বলল না।”
“আসলে আপু আমিই না করে দিলাম। ওর অবস্থা তো এখন জানেনই।”
“আমি তো ওকে এখনই আসতে বলিনি। যতদিন ও সুস্থ না হয় ততদিন ওর ছুটি।”
“পরী সুস্থ হলেও কাজটা করবে না আপু।”

“তুর্য তুমি কি ভেবে বলছ এসব? না মানে কথাটা অন্যভাবে নিয়ো না। জাস্ট কথার প্রেক্ষিতেই বলছি, ওর হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছো। কোনো রাইট আছে কী?”
“ভালোবাসি আপু। ভালোবাসার মানুষটার ভালো, খারাপ দেখব না?”
রুমকি হেসে বলে,

“ওহ আচ্ছা! তাহলে এই ব্যাপার। কিন্তু তুমি ওর পরিবার সম্পর্কে জানো? পরিবারের দায়িত্ব কিন্তু ওর উপরই।”
“সেসব কিছু আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন। আমি সব সামলে নেব।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। দোয়া করি ভালোবাসা যেন পূর্ণতা পায়। পরীকে দেখে রেখো।”
“ইনশাল্লাহ। দোয়া করবেন আপু।”

তিন দিন পর পরীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেয়।
পরী বালিশের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। পরীর চোখ বন্ধ ছিল। দরজার আওয়াজ টের পেতেই চোখ মেলে তাকায় পরী। দরজার দিকে তাকাতেই দেখে সেজান আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখছে। পরী সেজানকে ডাকে।
“বাবু? তুমি ওখানে কেন? কাছে আসো?”

এতবার ডাকার পরও সেজান কাছে আসে না। তুর্য এসে সেজানকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসায়। তখন পরী সেজানকে টেনে কাছে আনে। এই কয়েকদিনে সেজান একদম পরীর কাছে আসেনি। পরীকে ছাড়া যে বাচ্চা কিছু বোঝেই না। সে বাচ্চা পরীর কাছে আসেইনি। কী অদ্ভুত! পরী সেজানের দুহাত ধরে বলে,
“কী হয়েছে? লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলে কেন? এতবার ডাকার পরও আসোনি কেন?”
সেজান বিড়াল ছানার মতো গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। পরী আবার বলে,
“বলো।”

“চাচ্চু বলেতে তোমালে যেন আমি না জ্বালাই। আমি কাতে এতে যদি তোমালে ব্যতা দেই তাই।”
সেজানের কথা শুনে পরী হা হয়ে আছে। এতটুকু বাচ্চা পরী ব্যথা পাবে বলে কাছে আসেনি। পরী সেজানকে বুকের মাঝে নিয়ে তুর্যকে বলে,
“কী বলেছেন আপনি ওকে?”

সেজানের পাশে যে জায়গাটুকু ছিল তুর্য সেখানে শুতে শুতে বলল,
“আমি তেমন কিছুই বলিনি ম্যাম। শুধু বলেছিলাম, তোমার মাম্মির কাছে এখন বেশি যাবে না। দুষ্টুমি করলে ব্যথা পাবে। ও এত গভীরভাবে কথাটা মাথায় কীভাবে নিল কে জানে! তারপর থেকেই শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে তোমায় দেখে। কাছে আসে না।”

পরীর বলার মতো কিছুই নেই। সেজানকে এত্তগুলা চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে। তুর্য হাতের উপর ভর দিয়ে শুয়ে বলে,
“একটুখানি ভাগ আমায় দিলেও তো পারো।”
“হুস।”
“হুস হুস করো কেন? আমি কি হাঁস-মুরগী?”
“আপনি পাগল।”

তুর্য সেজানের গালে চুমু খেয়ে বলে,
“সে তো তোমার জন্যই।”
দরজার আড়াল থেকে তুর্য, পরী আর সেজানের খুনসুটি দেখেন নাহিদা বেগম। অপরিচিত কেউ ওদের দেখলে ভাববে ওরা একটা সুখী পরিবার। তুর্য যে পরীকে খুব ভালোবাসে সেটা তিনি বুঝে ফেলেছেন। কিন্তু পরী কি কখনো ভালোবাসবে তুর্যকে? এ কথা ভাবলেই মনটা কেঁদে উঠে তার।

লন্ডনে আসলেও সূর্যর মনটা পড়ে আছে বাংলাদেশে। তিরার স্মৃতি মুছতে পারছে না। চাইলেই কি আর কাউকে ভুলে থাকা যায়? কোনো না কোনো মন খারাপের রাতে স্মৃতিগুলো ঠিকই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সূর্য লন্ডনে ওর একটা বন্ধুর এপার্টমেন্টে উঠেছে। ব্যালকোনিতে বসে তিরা আর সেজানের ছবি দেখছিল। তখন রুমে আসে ওর বন্ধু শিপন। কাঁধে হাত রেখে বলে,
“কী রে কী করছিস?”
“কিছু না রে। বোস।”

“না বসব না। চল বাহিরে যাব।”
“না রে। ভালো লাগছে না।”
“বাসায় বসে থাকলে ভালো না লাগারই কথা। বাহিরে গেলেই ভালো লাগবে। চল উঠ।”
“আচ্ছা চল। কিন্তু কোথায় যাবি?”
“পার্লারে যাব।”

“দিনদিন ইয়ং হওয়ার আসল রহস্য তাহলে এটাই?”
“একটু রং চং তো মাখতে হয়। বুঝিস না?”
তারপর দু বন্ধু এক সঙ্গে হেসে উঠে।
পার্লারের কাছে গিয়ে সূর্য বলে,
“তুই ভেতরে যা। আমি এখানেই আছি।”
“বাহিরে কী করবি? চল ভেতরে যাই।”
“না। তুই যা।”
“ওকে।”

সূর্য বাহিরে একাই হাঁটাহাঁটি করছে। তখন দেখতে পায় বিদেশি এক ছেলে একটা মেয়েকে খুবই বকছে। মেয়েটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বাংলাদেশি নাকি বিদেশি। মেয়েটা মাথা নিচু করে কাঁদছে। ছেলেটা একসময় চলে যাওয়ার পরও মেয়েটা সেখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সূর্যর একবার ইচ্ছে হলো মেয়েটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে। আবার কী না কী ভাববে তাই আর যাওয়া হচ্ছে না। মেয়েটার চোখ সূর্যর দিকে পড়তেই মেয়েটা উল্টো পথে হাঁটা ধরে। সূর্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। মেয়েটা ব্যাগ থেকে ফোন বের করার সময় একটা কার্ড ব্যাগ থেকে পড়ে যায়। এই সুযোগেই সূর্য এগিয়ে যায়। কার্ডটা তুলে মেয়েটার পেছন পেছন যায় আর ডাকে।
“শুনছেন? এই যে মিস?”
মেয়েটা একবার পিছু তাকিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ফর্সা নাকমুখ লাল হয়ে আছে। সূর্য কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনার ব্যাগ থেকে এটা পড়ে গেছে। আপনি কাঁদছেন কেন? কোনো সমস্যা?”
“না।”

“বাংলাদেশি?”
সামনের ফ্ল্যাট থেকে একটা মেয়ে “অর্পা”
বলে ডাকতেই মেয়েটা বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। সূর্যও আর আগ্রহ দেখিয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে চলে যাওয়া ধরে। তখনই অর্পা ফিরে এসে পেছন থেকে ডাকে,
“শুনুন।”

ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে জয় আর সূচী। সে রাতের পর ধীরে ধীরে দুজনের সম্পর্কই অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। সূচী বলে,
“আপনি কিন্তু এখনো বলেননি।”
“কী বলব?”
“এইযে এতদিন অবহেলা করার কারণ কী? নিশ্চয়ই ছ্যাকা খেয়েছিলেন তাই না?”
জয় মৃদু হাসে। সূচী কপট রেগে বলে,
“হাসছেন কেন?”

“তোমার কথা শুনে।”
“হাসির কী বললাম? ছ্যাকা খাননি তাহলে?”
“না।”
“তাহলে? আপনি কাউকে ভালোবাসতেন না? নাকি আমায় ভালো লাগেনি?”
“একটা ভালোবাসা ছিল আমার জীবনে।”
“ছিল! তাহলে চলে গেল কেন?”

“এই কেনর উত্তর আমি নিজেও জানি না। এখনো অজানা রয়ে গেছে।”
“কখনো জানতে চাননি?”
“সেই সুযোগও দেয়নি।”
“অন্য কাউকে ভালোবেসেছিল?”
“উঁহু।”
“তবে?”

“আমাকেই ভালোবাসতো। কিন্তু আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো রিজন আমায় বলেনি। শুধু বলেছিল আমি যেন তোমায় মেনে নেই। সব অতীত ভুলে তোমায় নিয়ে জীবনটা নতুন করে শুরু করি। অতীত আঁকড়ে ধরে যেন না থাকি।”
“আমার কথা জানে সে?”
“হুম।”
“আপনার জানতে ইচ্ছে করে না সে কেন ছেড়ে চলে গেল?”
“করে। আর আমি অপেক্ষাতে আছি কোনো একদিন নিশ্চয়ই সত্যিটা জানতে পারব।”
“তখন আবার আমায় ছেড়ে দেবেন না তো?”


পর্ব ২০

অফিসের পুরো ফ্লোর জুড়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে সেজান। সেজানের পেছন ছুটে ছুটে পরী হাঁপিয়ে উঠেছে। নিজের ডেস্কে চুপচাপ বসে আছে। সেজান একটু পরপর উঁকি দিয়ে বলছে,
“মাম্মি আমালে ধলো।”

ধরতে গেলেই ছুটে পালাচ্ছে। সাথে খিলখিল করে হাসছে। অফিসের বাকি কর্মচারীরাও হাসছে ওর কাহিনী দেখে।
পরী তুর্যদের অফিসে জয়েন করেছে মাস তিনেক হবে। শপের কাজটা যে তুর্যই না করে দিয়েছে সেটা পরী এখনো জানে না। তার অবশ্য কারণও আছে। তুর্য বিষয়টাকে খুব সুন্দর করে সামলিয়েছে। তুর্যর বাবাকে দিয়ে বলিয়েছে তিনিই জবটা না করে দিয়েছেন। এবং অনেক বুঝিয়ে নিজের অফিসে একটা কাজ দিয়েছে। এখন তুর্য যতটা সময় অফিসে থাকে পরীকে দেখতে পারে।
পরী সেজানকে ধরে তুর্যর কেবিনে নিয়ে যায়। পরীকে দেখে তুর্য ল্যাপটপ বন্ধ করে বলে,
“কিছু বলবে?”
পরী সেজানকে তুর্যর কোলে দিয়ে বলে,
“রাখেন ওকে। এত দুষ্টুমি করতেছে। দিনদিন বেশি পাকা হয়ে যাচ্ছে। কোনো কাজই করতে দিচ্ছে না।”
পরীর কথা শুনে হাসছে তুর্য। বলে,
“এজন্যই তোমায় বলেছিলাম কাজ করার দরকার নেই তোমার। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাও। আর বাকি সময়টা সেজানকে দাও। কিন্তু তুমি তো আমার কথাই শুনছো না। আমি তো তোমার পরিবারের দায়িত্ব নিতেই চেয়েছিলাম।”

পরী টেবিলের উপর দু’হাত রেখে তুর্যর দিকে একটু ঝুঁকে বলে,
“কথায় কথায় আমাকে একদম টাকার গরম দেখাবেন না। আপনি কে হ্যাঁ? কেন নেবেন আমার পরিবারের দায়িত্ব? এখন নিশ্চয়ই বলবেন, আমি তো তোমায় ভালোবাসি পরী। কিন্তু একটা কথা আপনি ভালো করেই জানেন, আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”
তুর্য ঠোঁটে বাঁকা হাসি দিয়ে মুখটা পরীর দিকে এগিয়ে নিয়ে বলে,
“তুমি নিজেও জানো না যে তুমি আমায় ভালোবাসো।”
“ড্যাম ইট।”
পরী হনহন করে তুর্যর কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। তুর্য হাসে। সেজানকে টেবিলের উপর বসিয়ে দুহাত দিয়ে ধরে রাখে। বলে,
“তোর মাম্মির খুব রাগ তাই না রে?”
“আমাল মাম্মি কুব বালো।”

“হুম। তা তো বটেই। তোর মাম্মি আমায় ভালোবাসে না কেন রে?”
“মাম্মি পাপালে কুব বালোবাছে। মাম্মি আমালেও বালোবাছে।”
“আরে ব্যাটা! আমিই তোর পাপা।”
সেজান শরীরটা একটু বেঁকিয়ে বলে,
“এহহহ! তুমি আমাল চাচ্চু।”

তুর্য হেসে সেজানকে আদর করে দেয়। মায়ের তফাৎটা বুঝতে না পারলেও বাবার তফাৎটা সেজান খুব ভালো করেই বোঝে। প্রতিদিন ভিডিও কলে ওর বাবার সাথে কথা বলে। সূর্য যে কীভাবে সেজানকে ছাড়া এতদূরে থাকছে কে জানে! এক ভাই ভালোবাসা হারিয়ে দূরে আছে। আর আরেক ভাই ভালোবেসেও ভালোবাসা পাচ্ছে না।
কিছু ফাইল পরীকে দেখতে দেওয়া হয়েছিল। ঐগুলো কমপ্লিট করে আবারও তুর্যর কেবিনে যায়। ফাইলগুলো টেবিলের উপর রেখে বলে,
“দেখেন তো ঠিক আছে কী-না।”

তুর্য ফাইল চেক করছে তখন পরীর ফোন বেজে উঠে। সূচী ফোন করেছে। প্রথমদিন ছাড়া সূচী পরে আর দু’দিন ফোন দিয়েছিল। এরপর অনেক মাস কেটে গেছে সূচী আর ফোন করেনি। আর পরীও ইচ্ছে করে নিজের ক্ষত না বাড়ানোর জন্য ফোন দেয়নি। পরী ফোন রিসিভ করে বলে,
“হ্যালো।”

“কেমন আছো পরী?”
“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
“আমি তো দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ এখন।”
“কেন?”

সূচী আনন্দে কথাই বলতে পারছে না। কথা গলায় আটকে আছে। খুশিতে হাসি পাচ্ছে। পরী বলে,
“শুনতে পারছো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। দাঁড়াও বলছি।”
কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সূচী চোখ বন্ধ করে বলে,
“আমি প্রেগন্যান্ট!”

পরীর কান থেকে ফোনটা আলগা হয়ে যায়। চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। একটু একটু করে পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে পরী। তুর্য তাড়াতাড়ি উঠে পরীর কাছে আসে। তুর্য কিছু বলতে গেলে পরী থামিয়ে দেয়। পরীর ঠোঁটে হাসি বিস্তৃত। বলে,
“কংরাচুলেশন সূচী। আমি অনেক অনেক খুশি হয়েছি।”
“আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে পরী। তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের একটা পুচকু হবে উফফ।”
“জয়কে জানিয়েছ?”

“জয় তো জানেই। রিপোর্ট আরো এক সপ্তাহ আগেই পেয়েছি। সবাই তো খুশিতে আমায় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই তোমায় জানানো হয়নি। তোমাকে না জানাতে পেরে শান্তিও হচ্ছিল না।”
“এখন থেকে সাবধানে থেকো। নিজের খেয়াল রেখো। আর ঠিকমতো খাবে কেমন? আমি তোমাকে পরে ফোন দেবো। অফিসে আছি এখন।”
“আচ্ছা।”

পরী ফোন কেটে দিয়ে ডুকরে কেঁদে ফেলে। পরী শুধু কষ্টে নয় আনন্দেও কাঁদছে। সূচী প্রেগন্যান্ট মানে জয় সূচীকে মেনে নিয়েছে। জয় ভালো আছে। এর চেয়ে বেশি কিছু তো আর চাওয়ার ছিল না পরীর। তুর্য বলে,
“কী হয়েছে বলবে তো? কে ফোন করেছিল?”
পরী সেজানকে বুকে চেপে ধরে তুর্যকে সব বলে। তুর্য পরীর দু’গালে হাত রেখে বলে,
“তুমি আমার দেখা অন্যতম সাহসী আর শক্ত মনের একটা মেয়ে।”

চারটার দিকে সেজানকে নিয়ে বাড়িতে চলে যায় পরী। ফ্রেশ হয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“মা নিশাত আসেনি স্কুল থেকে?”
“আসছে তো। বাইরে খেলছে মনে হয়।”
“ওহ। দুপুরে খেয়েছিলে? নানু খেয়েছে?”
“সবাই খেয়েছে। তোর মামার কী খবর রে? আর কথা হয়েছিল?”
“দু’দিন আগে হয়েছিল।”
“ওর সেই কবে দেশে আসার কথা। অথচ এখনো এলো না।”

“মামার একটা কাজের জন্যই তো আটকে গেল। বলেছে কাজ মিটে গেলে আসবে।”
“হুম। যা খেয়ে নে।”
সেজানকে নিয়ে পরী খেতে বসেছে তখন তুর্যর মা আসে। টেবিলের উপর একটা বাটি রেখে বলে,
“তোমার মায়ের কাছে শুনলাম তুমি নাকি ভর্তা অনেক পছন্দ করো? তাই নিজের হাতে বানালাম।”
“আপনি আবার কষ্ট করে এসব করতে গেলেন কেন আন্টি?”
তিনি পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“কীসের কষ্ট মা? তুমি আমার যে উপকার করছ এখনো তাতে এসব তো কিছুই না। তোমার জন্য কিছু করতে পারলে আমার ভালো লাগবে। তোমার যদি কখনো কিছু লাগে তুমি নিঃসঙ্কোচে আমায় জানাবে কেমন?”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন বসুন একসাথে খাই।”

“না মা। আমি খেয়ে এসেছি। তোমার মা কোথায়?”
“রুমেই আছে।”
“আচ্ছা।”
সেজান পেছন থেকে ডেকে বলে,
“দাদু দাদু আমিও যাব।”
পরী বলে,
“আগে খাওয়া শেষ হোক।”

“না। আমি আল কাবো না।”
সেজান খেতে না চাইলে পরী আর জোর করে খাওয়ায় না। জোর করে খাওয়ালেই বমি করে দেবে। সেজানের মুখ মুছে দিয়ে তাহমিনা বেগমের কোলে দিয়ে দেন।

নিশাত বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বইখাতা নিয়ে বাহিরে যায়। তখন পরী ডেকে বলে,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“তুর্য ভাইয়ার কাছে।”

“কেন?”
“তুমি জানো না? তুর্য ভাইয়াই তো আমায় পড়ায়। প্রতিদিন রাতেই তো ভাইয়ার কাছে পড়তে যাই। আজ রাতে বন্ধুদের সাথে পিকনিক করব। তাই ভাইয়া বলছে এখন পড়াবে। আমি যাচ্ছি।”
পরী নিশাতের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। নাহিদা বেগম ছাদ থেকে কাপড় এনে দেখে পরী আনমনা হয়ে কিছু ভাবছে। জিজ্ঞেস করেন,
“কী ভাবছিস?”
“কই?”
“আবার বলিস কই? কী ভাবিস বল।”
“কিছু না।”
“তুর্যর কথা ভাবছিস?”

পরী ভ্রু কুঁচকে তাকায় মায়ের দিকে। আসলেই পরী তুর্যর কথা ভাবছিল। মা মৃদু হেসে বলেন,
“আমি তোর মা হই এটা কি ভুলে যাচ্ছিস? মেয়ের মনের কথা বুঝব না?”
“এমন কিছু না মা।”
“হুম বুঝি বুঝি। অবশ্য ভাবার মতোই একটা ছেলে তুর্য। তোর অপারেশনের পর তো তুর্য তোর কম খেয়াল রাখেনি। তোর প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে সবসময় তোর পাশে থেকেছে। সে হিসেবে বলতে গেলে তো আমি তেমন সেবাই করিনি। তুর্যই করতে দেয়নি। শুধু বলেছে, আমাকে বলে দেন কীভাবে কী করতে হবে। তুই জানিস তুর্য অফিস থেকে এসে আমার সাথে রান্না করত। খুঁটিয়ে, খাঁটিয়ে জানতে চাইতো তুই কী পছন্দ করিস। আমার মনে হয় তোর তুর্যকে একবার সুযোগ দেওয়া উচিত।”
“এসব তুমি কী বলছ মা?”

“ভুল কী বললাম? তুই বুকে হাত দিয়ে বলতো তুই তুর্যকে পছন্দ করিস না?”
“আমি মিথ্যা বলব না। হ্যাঁ তুর্যকে আমার ভালো লাগে। আর লাগাটাই কি স্বাভাবিক না বলো? একটা মানুষ যদি প্রতিনিয়ত আঠার মতো পিছে লেগেই থাকে, সারাক্ষণ ভালোবাসি ভালোবাসি বলে, কেয়ার করে তাহলে তাকে ভালোলাগাটা কি স্বাভাবিক না? কিন্তু আমি জেনেশুনে কখনোই তুর্যকে ভালোবাসতে পারব না।”
“কেন পারবি না? জয়ের জন্য? জয় তো দিব্যি সুখে আছে। তবে তুই কেন পারবি না?”
“জয় সুখি হোক এটাই আমি চেয়েছি। কিন্তু জয়ের বিরহে আমি তুর্যকে ফিরিয়ে দিচ্ছি না। এটার কারণ তোমার তো জানার কথা মা।”
“আমি জানি না। কী কারণ আছে শুনি?”

“তুমি তো জানো মা আমি কোনোদিন মা হতে পারব না।”
নাহিদা বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। পলকহীনভাবে পরীকে দেখছে। পরীর বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,
“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস পরী? এসব তুই কী বলছিস?”

“কী বলছি মানে? ছোটবেলায় না আমার একটা অপারেশন হয়েছিল। ডাক্তার নাকি বলেছিল আমি আর মা হতে পারব না?”
“এসব তোকে কে বলেছে? তোর কোনো অপারেশন হয়নি ছোট বেলায়। আর না তোর কোনো সমস্যা ছিল।”
নাহিদা বেগমের কথা শুনে পরীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। মা এসব কী বলছে? আর খালা তাহলে? পরীর মাথা ঘোরাচ্ছে। মা তো মিথ্যা বলবে না। তাহলে খালা যা বলেছিল? সব মিথ্যা ছিল? নাটক ছিল সব? সব প্রশ্নের উত্তর তো খালাকে দিতেই হবে। রুমে গিয়ে পার্সটা নিয়ে বলে,
“আমি এসে তোমাকে সব বলছি মা। তুমি সেজানকে দেখো।”

গাড়িতে বসে আছে পরী। সমস্ত শরীর কাঁপছে। পথও ফুরাতে চাচ্ছে না। পরীর মনে হচ্ছে হেঁটে গেলেও এরচেয়ে কম সময় লাগবে।

জয়ের বাড়ির সামনে এসেও শরীর চলছে না। পা আগাচ্ছে না। রাগে, কষ্টে, জিদ্দে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। বাড়ির ভেতর ঢোকার পর কলিংবেল বাজায়। দরজা খুলে দেয় কাজের লোক। পরী তাকে সরিয়ে ভেতরে ঢোকে। ড্রয়িংরুমে থাকা কাঁচের টি-টেবিলটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে বলে,
“খালা কোথায় তুমি!”

কাঁচ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। পাশে থাকা চেয়ার, সোফা, টাঙানো ছবি সব ছুঁড়ে ফেলে দেয়। খালা আসার আগেই পরী তার রুমে যায়। দরজার মুখেই দেখা হয় দুজনের। পরীর চোখমুখ লাল টকটকে হয়ে আছে। চোখের পাতা ভেজা। ঠোঁট দু’টো অনবরত কাঁপছে। খালা বলেন,

“কী হয়েছে তোর? এভাবে ঘরের দামী দামী জিনিস ভাঙ্গচুর করছিস কেন? এগুলো কেনার টাকা কি তোর মরা বাপ এসে দেবে?”
পরীর পাশেই ওয়ারড্রব ছিল। ওয়ারড্রবের উপর থেকে ফুলদানিটা নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারে ড্রেসিংটেবিলের দিকে। মুহূর্তেই আয়ানাটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। পরী চিৎকার করে বলে,
“এই ফুলদানিটা যদি তোমার মাথায় ফাঁটাতে পারতাম তবেই আমার শান্তি হতো। এই জিনিসপত্রের মতো যদি তোমায় ছুঁড়ে ফেলতে পারতাম তাহলেই আমার শান্তি হতো। কেন করেছিলে আমার সাথে ছলনা? কেন বলেছিলে মিথ্যে? কেন বলেছিলে আমি মা হতে পারব না?”
“তোর মা কি সুস্থ হয়ে গেছে?”

“তুমি কি চেয়েছিলে মা সারাজীবন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকবে। আর আমি সত্যিটা জানতেও পারব না?”
“সত্যিটা যখন জেনেছিস তখন তো আর লুকানোর কিছু নেই। জয়ের থেকে তোকে আলাদা করার জন্য আর কোনো উপায় ছিল না আমার। তুই হলি ফকিন্নি ঘরের মেয়ে। তার উপর বাপও মারা গেছে। তোকে আমার ছেলের বউ করব? পাগল আমি? তার উপর তোকে বিয়ে করলে তোর পুরো পরিবারটাকে আমার ছেলের টানতে হতো। এত কষ্ট করে ছেলে বড় করেছি কি অন্যের পরিবার টানার জন্য? তুই নিজের পরিবার দেখ আর সূচীর পরিবার দেখ। তোদের সাথে আমাদের আত্নীয়তা মানায় না।”

“বাহ্ খালা বাহ্! টাকা-পয়সার লোভে তুমি তোমার ছেলের কথাটাও একটাবার ভাবলে না? টাকার লোভে তুমি অন্ধ হয়ে গেছিলে যে ছেলের ভালোবাসা কেড়ে নিতেও দু’বার ভাবোনি। তুমি তো মা নও। মা নামের কলঙ্ক। কি সুন্দর করে নাটকটা সাজিয়েছিলে তুমি। আমি যদি এই সত্যিটা জয়কে জানাই তাহলে তুমি জয়ের চোখে কতটা নিচে নেমে যাবে জানো তো? আমি যদি বিয়ের পরও জয়কে সব জানাতাম তাহলেও জয় সূচীকে ছাড়তে দু’বার ভাবতো না। কিন্তু আমি সেটা পারিনি। কী করে পারতাম? তোমার কসমের কাছে তো আগেই আটকে ছিলাম। আর তারপর রইল সূচী। একটা মেয়ে হয়ে তো আরেকটা মেয়ের ঘর আমি ভাঙ্গতে পারি না। হ্যাঁ পারতাম। যদি আমি তোমার মতো অমানুষ হতাম। তুমি যেই টাকার জন্য আমাকে আর জয়কে আলাদা করলে সেই টাকা কতদিন থাকবে? এমন না হয় একদিন টাকার জন্যই আমার পায়ে ধরতে হয় তোমার। আল্লাহ্ কখন কী করে তা আমরা কেউ জানিনা। আল্লাহ্-র লীলাখেলা বুঝা দ্বায়। সারাটা জীবন আমি তোমায় ঘৃণা করে যাব। তুমি আমার কাছ থেকে আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছ। আমি তোমায় কোনোদিন ক্ষমা করব না। কোনোদিন না।”

পরী কাঁদতে কাঁদতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। জয়ের মা তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। পরী চলে যাওয়ার পরই দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে জয়। পরী বাড়িতে আসার প্রায় দু’মিনিট পরই জয় বাসায় আসে। বাড়ির এমন বেহাল অবস্থা দেখে চমকে যায়। পরীর কণ্ঠস্বর শুনে মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। এরপর দেয়ালের আড়াল থেকে লুকিয়ে সবটা শুনে।
মায়ের মুখোমুখি হয় এবার জয়। এই চোখে রয়েছে মায়ের প্রতি রাগ, ঘৃণা আর ক্রোধ। জয়কে এভাবে দেখে তিনি থতমত খেয়ে যান। ভয়ে একদম চুপসে যান। তবুও মুখে মিথ্যা হাসি ফুঁটিয়ে জয়ের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“তুই কখন আসলি বাবা?”
জয় ধাক্কা দিয়ে হাত সরিয়ে দেয়। রাগে এতটা জোরেই ধাক্কা দিয়েছিল যে তিনি সোকেশের সাথে বারি খান।

পর্ব ২১

সোকেশের সাথে বারি খাওয়ায় মাথায় চোট পেয়েছেন তিনি। মাথায় হাত দিয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“জয়!”

জয় রেগে বলে,
“জয় কী হ্যাঁ? জয় কী? কেন করলে তুমি আমার সাথে এমন? কেন পরীকে আমার থেকে আলাদা করেছিলে? টাকার জন্য? টাকার এত লোভ তোমার? তুমি আমার কেমন মা? আমার কথাটাও তুমি ভাবলে না। আমি চোখের পানিও তোমার মন গলাতে পারেনি।”
“জয় আমার কথা শোন তুই বাবা।”

“আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। তোমার মুখটাও আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না। তোমাকে মা বলতেও আমার ঘৃণা করছে। তোমাকে খুন করলেও হয়ত আমার রাগ মিটবে না। কিন্তু কী করব বলো? হাজার দোষ করলেও তো তুমি মা। তাই তোমাকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আমি আর এই বাসায় তোমার সাথে থাকছি না। আমি আজই চলে যাব সূচীকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে।”

ছাদের ফ্লোরে বসে অনবরত চিৎকার করে কাঁদছে পরী। খালা কখনো এমন কিছু করতে পারবে এটা পরী স্বপ্নেও ভাবেনি। সবই তো ঠিক ছিল। শুধু টাকাই সব এলোমেলো করে দিলো? টাকার লোভে মানুষ ভালোবাসা কেড়ে নিতেও ভাবে না?

নিশাতকে পড়িয়ে সেই কখন থেকে তুর্য অপেক্ষা করছে পরীর জন্য। পরী আসছে না বিধায় ছাদে চলে যায়। ছাদে গিয়ে পরীকে এভাবে কান্নারত অবস্থায় দেখতে পেয়ে চমকে যায়। পরীর কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে পরী? এভাবে কাঁদছো কেন? প্লিজ বলো আমায় কী হয়েছে। কোনো ছেলে কিছু বলেছে? কোনো ব্যাড কমেন্ট করেছে? প্লিজ বলো।”
কান্নার জন্য পরী কথাই বলতে পারছে না। পরীকে এভাবে কাঁদতে দেখে তুর্য নিজেও ঠিক থাকতে পারছে না। অজানা ভয়ে মনটা কেঁদে উঠছে।
ছাদের ফ্লোরেই পরীর ফোনটা বেজে উঠছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে জয়ের নাম। পরী খেয়ালই করেনি যে ফোন এসেছে। তুর্য ফোনটা নিয়ে পরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“তোমার ফোন। জয় ফোন করেছে।”

ফোন রিসিভ করবে না করবে না ভেবেও ফোনটা রিসিভ করে। পরী কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে জয় কান্নারত কণ্ঠে বলে,
“পরী প্লিজ সিনহা হাসপাতালে চলে আয়। প্লিজ।”
ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছুই আসছে না। এক সময় জয় ফোনটা কেটে দেয়। পরীর কান্না থেমে যায় এবার। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
“সি সি সিনহা হাসপাতালে যাব।”

“হাসপাতালে কেন?”
“জানি না। আমাকে এখনই যেতে হবে।”
পরী তাড়াতাড়ি উঠে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। পেছন পেছন তুর্যও আসে। বাড়ির মেইন গেট পার হয়ে পরী হাঁটতে থাকে। ব্যস্ত হয়ে হাঁটায় ছোট ইটের টুকরোর সাথে হোঁচট খায়। পাশে তুর্য ছিল বলে আর পড়েনি। তুর্য ধরে বলে,
“এভাবে হাঁটতে থাকলে রাত ফুরিয়ে যাবে পৌঁছাতে পৌঁছাতে।”

পরীর হাত ধরে তুর্য বাসে উঠে। সিটে বসেও পর্যন্ত পরীর হাত ছাড়েনি।
হাসপাতালের সামনে পৌঁছে পরী নার্ভাস হয়ে যায়। চিন্তা হচ্ছে খুব। পা-ও আর সামনে আগাচ্ছে না। তুর্য হাতটা একটু শক্ত করে ধরে বলে,
“রিলাক্স! চলো।”
সামনের করিডোর পেরিয়ে পরের করিডোরে যেতেই জয়কে দেখতে পায়। জয় পরীকে দেখে দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। কান্নার পরিমাণ আরো বেড়ে যায় জয়ের। এভাবে জড়িয়ে ধরায় পরীও চমকে যায়। তুর্যর হাত থেকে পরীর হাতটা আস্তে আস্তে আলগা হয়ে যাচ্ছে। তুর্যর চোখটা একটু একটু ঝাপসা হয়ে আসছে। তুর্য দ্রুত চোখ দুটো অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।
জয় কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“আমার মা তোর সাথে যেটা করেছে সেটা খুব অন্যায় করেছে। মায়ের জন্যই আমরা দুজন আলাদা হতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু যাই হয়েছে পরী এতে আমার কোনো হাত নেই। হ্যাঁ, আমি এতদিন তোকে ভুল বুঝেছি ঠিকই। কিন্তু আজ আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে। তুই মাকে আজ যা যা বলেছিস আমি সব শুনেছি। আমি সিদ্ধান্তও নিয়েছি মায়ের থেকে আলাদা হওয়ার। সূচীকে ডাকার আগেই সিঁড়ি থেকে সূচীর চিৎকারের শব্দ পাই। বাহিরে গিয়ে দেখে সিঁড়ি বেয়ে রক্তর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সূচী পেট ধরে কাঁদছে। একটু আগে ডাক্তার জানায় বাচ্চাটাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সূচীরও এখনো জ্ঞান ফেরেনি। মাতৃত্ব নিয়ে মায়ের বলা মিথ্যার শাস্তি এখন সূচী পেল। বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না পরী। এতসব কিছুর মধ্যেও তো একটা চরম সত্যি আছে রে। আমি তো সূচীকে ভালোবেসে ফেলেছি। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় আমি সূচীকে ভালোবাসি।”
তুর্যর দিক থেকে হাতটা পুরোপুরি আলগা হলেও এবার পরী শক্ত করে চেপে ধরে তুর্যর হাত। তুর্যর হাত ধরে রাখা পরীর হাতের দিকে তাকায় তুর্য।

পরীর চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে জয়ের থেকে নিজেকে ছাঁড়িয়ে নেয়। অন্য হাত দিয়ে জয়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“প্রকৃতি তার শাস্তি দিতে ভুলে না জয়। আমি খালার শাস্তি চেয়েছি ঠিকই। কিন্তু কখনোই চাইনি তোমার, সূচীর বা বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হোক। তুমি টেনশন করো না। সূচীর কিছু হবে না দেখো। সুস্থ হয়ে যাবে সূচী।”
টলমল করা চোখে পরীর দিকে তাকিয়ে জয় বলে,
“তুই আমায় ক্ষমা করেছিস তো পরী?”

পরী মৃদু হেসে বলে,
“কিসের ক্ষমার কথা বলছ? তুমি কি সূচীকে ভালোবেসে নিজেকে অপরাধী ভাবছো? ভাবছো তোমার ভালোবাসাকে আমি ঠুনকো ভাবছি? এমন কিছু ভেবো না জয়। আমি জানি তোমার কোনো দোষ নেই। স্বামী-স্ত্রীর একটা পবিত্র সম্পর্ক তোমাদের। তাহলে ভালোবাসাটা অপরাধ হবে কেন? ভালোবাসা হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এইযে তুমি মাত্রই আমায় জড়িয়ে ধরেছিলে। সেটা কিন্তু আমায় ভালোবেসে নয় বরং সূচীকে হারানোর ভয়ে। হয়তো একটা ভরসার বুক বা হাত খুঁজছিলে। এখানে আমি তোমার কোনো দোষ দিচ্ছি না। সূচীর প্রতি এত ভালোবাসা হয়তো এজন্যই এখন অনুভব করছ কারণ সূচীর সিচুয়েশন এখন খারাপ। যদি এমন এক্সিডেন্ট না হতো তাহলে হয়তো আমার জন্য তোমার মনে ভালোবাসা, কষ্ট আবারও জেগে উঠত। সেসব তোমাদের সংসারের জন্য ভালো হতো না। এজন্য শুধু এটাই বলব, আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। নিরাশ হয়ে পড়ো না। আল্লাহ্-র উপর ভরসা রাখো।”
তুর্যর হাত ধরেই যখন পরী আসছিল তখন জয় বলে,
“আমি তোকে কখনো ভুলতে পারব না পরী।”

পরী পেছনে ঘুরে মুচকি হেসে বলে,
“তা তো আমিও তোমায় ভুলতে পারব না জয়। তবে অতীত আঁকড়ে বেঁচে থাকার মতো বোকামিও করব না। অতীত ভেবে নিজের বর্তমান, ভবিষ্যৎ কোনোটাকেই নষ্ট করব না। বাস্তবতার চাপে যখন আমরা পড়ে যাব তখন হয়তো অতীত মনে করার সময়টুকু পাবোও না আমরা। হয়তো বা কখনো অতীত মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ব। ব্যস এতটুকুই। সত্যি আর বাস্তব আমাদের মানতেই হবে না। তোমার জন্য আমার জন্ম হয়নি। আর আমার জন্যও তোমার জন্ম হয়নি। যদি হতো তাহলে নিশ্চয়ই আমরা আলাদা হতাম না। আমার তুমিটা তুমি নও জয়। কিন্তু তোমার তুমি সূচী।”

এরপর আর পিছু ফিরে তাকায়নি পরী।
রাত ১২টা ছুঁই ছুঁই। একটু পর পর মেঘ ডাকছে। হয়তো বৃষ্টি পড়বে। আজ আকাশের কাঁদতে ইচ্ছে করলেও পরীর কান্না পাচ্ছে না। ভালো লাগছে এটা ভেবে, জয় সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে সূচীকে। কোনো পিছুটান থাকবে না আর। জয়ের মুখে সূচীকে ভালোবাসার কথা শুনে পরীর পিছুটানও কমে যায়। এবার নিজের জন্য বাঁচবে। নিজেকে ভালোবেসে বাঁচবে।
ফুটপাত দিয়েই এতক্ষণ হাঁটছিল তুর্য আর পরী। বৃষ্টি পড়া শুরু করায় একটা বটগাছের নিচে দুজনে আশ্রয় নেয়। আশেপাশে কোনো মানুষজন নেই। মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি তড়িৎ বেগে ছুটে চলেছে। বৃষ্টির পানিতে রাস্তাটা বেশ চমৎকার লাগছে। তুর্য হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,
“এখানে দাঁড়ালে কেন?”

“আপনি তো বৃষ্টিতে ভিজতে পারেন না। কোনো গাড়ি থামলেই বাসায় চলে যাবেন।”
“আর তুমি?”
“আমি বৃষ্টিতে ভিজে হেঁটে যাব। পথে কোনো রিক্সা পেলে রিক্সায় উঠে যাব।”
“আমাকে কি তোমার পাগল মনে হয়? এত রাতে আমি তোমায় একা ছেড়ে যাব?”
“আপনার ভালোর জন্যই বলেছি।”
“আমিও ভালোবাসার মানুষটার ভালো চাই। তোমায় ভালোবেসে আমি অসহ্য এই বৃষ্টিকেও সহ্য করতে রাজি আছি। অসহ্য বৃষ্টিকেও ভালোবাসতে রাজি আছি। কারণ তুমি বৃষ্টি ভালোবাসো।”
নিজের হাতের মুঠোয় পরীর হাত নিয়ে বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় হাঁটতে থাকে দুজনে।

পর্ব ২২

দুপাশে গাছ-গাছালি। মাঝখানে রাস্তা। গাছের ডালপালা, পাতা থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে। আকাশ থেকে পড়ছে বড় বড় পানির ফোঁটা। রাতের আকাশ, কালো রাস্তা আর বৃষ্টি সব মিলিয়ে মনের মতো একটা পরিবেশ। রাস্তার ধার ঘেঁষে হেঁটে চলেছে পরী আর তুর্য। এতক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকলেও তুর্যর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। হঠাৎই পরীর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। পরী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় তুর্যর দিকে। তুর্য কোনো কথা না বলে পরী দুহাত নিজের দুহাতে নিয়ে হাঁটতে থাকে। পরী সামনে এগিয়ে হাঁটছে আর তুর্য পিছিয়ে পিছিয়ে হাঁটছে। পরী বলে,
“এভাবে উল্টো হয়ে হাঁটছেন কেন? সামনে ঘুরে হাঁটেন।”
তুর্য মুচকি হেসে গান ধরে,
“রিমঝিম এ ধারাতে,
চায় মন হারাতে।

রিমঝিম এ ধারাতে
চায় মন হারাতে
এই ভালোবাসাতে, আমাকে ভাসাতে!!
এলো মেঘ যে এলো ঘিরে,
বৃষ্টি সুরে সুরে সোনায় রাগিণী।
মনে স্বপ্ন এলোমেলো,
একি শুরু হলো
প্রেমের কাহিনী।

এলো মেঘ যে এলো ঘিরে,
বৃষ্টি সুরে সুরে সোনায় রাগিনী
মনে স্বপ্ন এলোমেলো,
একি শুরু হলো
প্রেমের কাহিনী।
রিমিঝিমি এ ধারাতে, চায় মন হারাতে
রিমঝিম এ ধারাতে, চায় মন হারাতে!!
আগে কত বৃষ্টি যে দেখেছি শ্রাবণে,
জাগেনি তো এতো আশা,,
ভালোবাসা এ মনে।

হো, আগে কত বৃষ্টি যে দেখেছি শ্রাবণে
জাগেনি তো এত আশা,
ভালোবাসা এ মনে।
সে বৃষ্টিভেজা পায়ে, সামনে এলে হায়
ফোঁটে কামেনি!
আজ ভিজতে ভালো লাগে,
শূন্য মনে জাগে
প্রেমের কাহিনী।”

পরী নিষ্পলকভাবে দেখছে তুর্যকে। তুর্যর চোখের গভীরতা অনেক। হয়তো এই চোখেই আছে এক সমুদ্র ভালোবাসা। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে যখন যাচ্ছিল পাশ থেকে এক জোড়া কাপল এসে হাত তালি দিতে দিতে বলে,
“বাহ্ ভাই বাহ্! আপনারা তো দেখছি আমাদের থেকেও বেশি রোমান্টিক।”
ছেলেটা তুর্যকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“দূর থেকেই আপনাদের দেখছিলাম। আপনি বোধ হয় গান গেয়ে শুনাচ্ছিলেন? একটুখানি শুনলাম।”
তুর্য হেসে বলে,
“বুঝেনই তো! কিন্তু আপনাদের তো চিনলাম না।”
“আমি ফাহাদ আর ও আমার ওয়াইফ প্রিয়া। আপনারা?”
“আমি তুর্য। আর ও পরী।”
“স্বামী-স্ত্রী না?”

“জি না। তবে হয়ে যাবে।”
“ওহ আচ্ছা। বুঝেছি বুঝেছি। এত রাতে দুজনে বৃষ্টিবিলাস করছিলেন?”
“ওরকমই।”
“আমরাও তাই করছিলাম। কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?”
“বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম। আপনারা?”
“এই তো পাশেই আমাদের বাড়ি। আজকের রাতটা চাইলে আমাদের বাসায় থাকতে পারেন।”
“জি না ভাই। ধন্যবাদ।”
প্রিয়া হেসে বলে,

“আমরা কোনো চোর ডাকাত নই কিন্তু।”
প্রিয়ার কথা শুনে সবাই হেসে দেয়। বৃষ্টির রাত। কোনো গাড়ির দেখাও মিলছে না। আবার বৃষ্টিতে ভিজলে তুর্য অসুস্থ হয়ে যায়। আর যাই হোক, নিজের জন্য তো আর অন্য কারো ক্ষতি করা যায় না। তাই পরী সবদিক ভেবে রাজি হয়ে যায়। পরী রাজি হওয়ায় তুর্যও আর কিছু বলে না।

পরী ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছে। প্রিয়া একটা তোয়ালে পরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“চুলগুলো পেঁচিয়ে নাও। আর আমার সাথে চলো রুমটা দেখিয়ে দেই।”
“বাড়িতে আর কেউ নেই?”
“না। আমার শ্বশুর-শ্বাশুরী, ননদ গ্রামে গেছে।”

চারজনই চেঞ্জ করে লিভিংরুমে বসে। প্রিয়া সবার জন্য কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এসেছে। সবাইকে কফি দিয়ে প্রিয়া ফাহাদের পাশে বসে। ফাহাদ এক হাত দিয়ে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে। কফির মগে চুমুক দিয়ে ফাহাদ বলে,
“তারপর রিলেশন কতদিনের আপনাদের?”
পরী হালকা হেসে বলে,
“আমাদের কোনো রিলেশন নেই ভাই।”
“সিরিয়াসলি? দেখে তো বোঝাই যায় না।”

“বাহ্যিক দিক দেখে কি আর ভেতরের কিছু আন্দাজ করা যায়?”
“হুম তাও ঠিক।”

তুর্য সোফার উপর দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলে,
“এই মেয়ের মন গলানো খুব কঠিন ভাই। এতদিন ধরে পেছন পেছন ঘুরি। অথচ পাত্তাই দেয় না।”
কথাটা বলেই তুর্য হাঁচি দেয়। একটু পরপর নাক টানছে। ঠান্ডা অলরেডি লেগে গেছে বোঝা যাচ্ছে। তুর্যর কথা শুনে ফাহাদ বলে,
“ভালোবাসা সত্যি হলে এটা কোনো ব্যাপার না ভাই। এইযে প্রিয়াকে দেখছেন, ওকে কিন্তু আমি এত ইজিলি পাইনি। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।”
ফাহাদের কথা শুনে প্রিয়া মিটিমিটি হাসছে। প্রিয়া তুর্যকে বলে,
“ভাইয়া আপনি কি ঘুমাবেন?”

“বৃষ্টিতে ভিজেছি তো। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে।”
“তাহলে আপনি রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
“না। সমস্যা নেই।”
প্রিয়া তুর্যর কথাকে পাত্তা না দিয়ে ফাহাদকে বলে,
“ভাইয়াকে তার রুমটা দেখিয়ে দাও। আমি পরীকে নিয়ে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”

তুর্য আর পরীকে আলাদা রুমে দিয়ে প্রিয়া রুমে চলে যায়। ফাহাদ তুর্যর কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারে জ্বর জ্বর ভাব। তাই ফাহাদ তুর্যর রুমেই থেকে যায়। আর প্রিয়াকে বলে পরীর রুমে থাকতে।
প্রিয়াও বাধ্য মেয়ের মতো পরীর রুমে যায়। পরী তখন ব্যালকোনিতে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।প্রিয়া বলে,
“আরে বৃষ্টির মধ্যে ব্যালকোনিতে কেন? ভিজে যাবে তো।”
পরী মুচকি হেসে বলে,
“সমস্যা হবে না।”
“তুমি রুমে আসো তো।”
প্রিয়া পরীকে টেনে রুমে নিয়ে বিছানায় বসে।

“তোমার কি ঘুম পাচ্ছে পরী?”
“না তো। কেন?”
“অনেক রাত হলো তো। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“তোমার ঘুম পেলে ঘুমাও।”
দুজনের কথা চলাকালীন ফাহাদ দরজায় কড়া নারে। দরজা খুলে দেয় প্রিয়া। ফাহাদ বলে,
“পরীকে নিয়ে তুর্যর রুমে আসো তো। বারবার পরীর নাম বলছে।”
পরী ফাহাদের কথা শুনেই তুর্যর রুমে যায়। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। প্রিয়া একটা বাটিতে পানি আর একটা কাপড় এনে দেয় জলপট্টি দিয়ে দেওয়ার জন্য। পরী চুপচাপ তুর্যকে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। তুর্য পরীর হাত ধরে বলে,

“প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না। আমায় একটা সুযোগ দাও।আমি তোমায় কখনো কষ্ট দেবো না। তোমার সব কষ্ট, অতীত আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দেবো।”
তুর্য এক নাগাড়ে এসব কথা বলেই যাচ্ছে জ্বরের ঘোরে। প্রিয়া ইতস্ততবোধ করে বলে,
“একটা কথা বলি পরী?”
“জি।”
“উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি তোমাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু তুমি এমন ভাবলেশহীন কেন? তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো?”
পরী একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
“জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি কারো মায়ায় জড়াতে চাই না।”

“মানে? কোনো অতীত ছিল?”
পরী একবার ফাহাদের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায়। ফাহাদ সেটা বুঝতে পেরে বলে,
“আচ্ছা আমি বাহিরে যাচ্ছি।”
পরী ফাহাদকে আটকিয়ে বলে,

“না ভাইয়া। সমস্যা নেই।”
তারপর এক পলক তুর্যর দিকে তাকিয়ে সবটা বলে প্রিয়া আর ফাহাদকে। সব শুনে ফাহাদ রাগে ফেঁটে যাচ্ছে। পারে তো এখনই জয়ের মাকে খুন করে ফেলে। কিন্তু অন্যদিকে প্রিয়া খুব শান্ত ও স্বাভাবিক। প্রিয়া পরীর পাশে বসে বলে,
“তোমার অতীত সত্যিই খুব খারাপ পরী। কিন্তু ঠকে যাওয়ার মতো কষ্টকর নয়। তোমার চেয়ে আমার হারানোর প্রাপ্তি কম নয়। কিন্তু এতকিছুর পরও বলব আমি এখন সুখী। জানো সেই সুখের নীড় কে?”
পরী উৎসুক চোখে প্রিয়ার চোখে তাকিয়ে আছে। সত্যিই এই চোখের প্রাপ্তির স্থান অনেক বিশাল। প্রিয়া একটা হাত ফাহাদের দিকে তাক করে বলে,
“আমার এই সুখের নীড় হলো এই মানুষটা। তুমি জয়কে হারিয়েছ ছোট্ট একটা মিথ্যায়। আর আমি ঠকেছি পরী। ভালোবেসে, বিশ্বাস করে ঠকেছি। তখন থেকে ভাবতাম ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। ভালোবাসার মতো সত্যিকারের মানুষ নেই। আমার এই ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দিয়েছে ফাহাদ। ওর ভালোবাসা দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে এখনো সত্যিকারের ভালোবাসা বেঁচে আছে। আমি বলন না যে ভালোবাসা ছাড়া কিছু নেই। বা ভালোবাসতেই হবো।অবশ্যই নিজের জন্য বাঁচো। কিন্তু এই বেঁচে থাকার মধ্যেও তো একটা ভরসার হাত খুব দরকার তাই না? হাজার ক্লান্তি, বিপদ শেষে কেউ একজন শক্ত করে হাতটা ধরে বলুক, আমি আছি। এমনটা চাও না?”
পরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“চাই।”

পর্ব ২৩

প্রিয়া মৃদু হেসে বলে,
“জানো পরী, ভুল মানুষকে ভালোবাসার ফলে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। এখনো আমার বাবার মৃত্যুর জন্য আমার নিজেকে দায়ী মনে হয়। যাকে আমি ভালোবাসতাম সে আমাকে ঠকিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে। শুধুমাত্র এই টাকার লোভেই। আমি কষ্টটা মেনে নিতে পারিনি। গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিলাম। তখন বাবা এটা দেখে সহ্য করতে পারেনি। হার্ট এটাক করে মারা যায়। এখনো চোখের সামনে আমার বাবার মুখটা ভাসে।
তারপর থেকেই আমি পুরোপুরি পাল্টে যাই। হাসিখুশি, চঞ্চল মেয়েটা একদম শান্ত, নিরব হয়ে যায়। গল্পটা হয়তো এখানে শেষ হলেও পারত। কিন্তু হয়নি। এরপর আসলো আমার জীবনে আরো একজন মানুষ। বিয়ের প্রস্তাব আসে আমার জন্য। আমি প্রথমে রাজি না হলেও মায়ের কথা ভেবে রাজি হয়ে যাই।

কিন্তু মন থেকে আমি তখনো তাকে মেনে নিতে পারিনি। আমার মনে ছেলেদের জন্য ছিল অবিশ্বাস আর ভয়। তার একটা অতীত ছিল। সেই অতীতের কথাও আমাকে জানিয়েছিল। আমি যখন তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করি তখন সেও আমাকে ঠকায়। গায়ে হলুদের রাতে আমার পায়ে ধরে কেঁদে বলে সে আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। তার এক্স তার কাছে ফিরে এসেছে। আমি মেনে নিতে পারিনি এটা। কোনো মেয়ের পক্ষে কি এটা সহ্য করা সম্ভব? আমি তাকেও আটকাইনি। ভেঙ্গেচুরে নতুন এক আমি জন্ম নিই। এরপর চলে আসলাম অন্য এলাকায়। সবার সাথে সব যোগাযোগ ছেড়ে পরিবারকে নিয়ে জীবন শুরু করলাম। তখনই ঝড়ের বেগে ভালোবাসার মানুষটি আসে ফাহাদ। যে আমার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। যে আমার হাত ধরে সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে সবাই ঠকবাজ, প্রতারক হয় না। সত্যিকারের ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে।”
পরী অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করে,
“তাদের সাথে তোমার আর যোগাযোগ নেই?”

“না। যেই অতীত একবার পেছনে ফেলে এসেছি সেই অতীত নিজের সাথে জড়িয়ে রাখার মতো বোকাও আমি নই। তবে যার সাথে আমার রিলেশন ছিল তার নাম শিহাব। সংসার সুখের হয়নি। আমার বিয়ের পর একবার দেখা হয়েছিল কক্সবাজারে। তখন সব বলেছিল। বউ অন্য একজনের সাথে পালিয়ে যায়। সবচেয়ে মজার বিষয় কি জানো? ও আমার কাছে একটা সুযোগ চেয়েছিল। আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল। অথচ এই মানুষটাই কিন্তু আমাকে আর্থিক অবস্থার জন্য ছেড়ে গিয়েছিল। তখন আমি তাকে ফাহাদের কথা বলি। আর ধন্যবাদও জানাই এমন প্রতারক আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার জন্য।
আর যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সে মৃন্ময়। ফাহাদের কাজিন। এটা অবশ্য আমি বিয়ের দিন জেনেছিলাম। মৃন্ময় ওর এক্সের কাছে ফিরে গেলেও পরবর্তীতে আমার একাকীত্বে ভুগেছিল। আমায় অনেক খুঁজেছিল। কিন্তু ভুল তো ভুলই। যে ভুল একজনকে ভেঙ্গেচুরে দিতে পারে সে ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না। বিয়ের আগের রাতে এই ঘটনাটা না হয়ে যদি বিয়ের পর হতো? তখনও কিন্তু মৃন্ময় এভাবেই আমাকে ছেড়ে যেত। যার পরিণাম হতো ডিভোর্স। তখন আমার অবস্থাটা কী হতো? ডিভোর্সের পর মৃন্ময় ওর ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসলেও কি কোনো লাভ হতো?
এদের দুজনের কারোরই পথের কাঁটা হইনি আমি। দুজনকেই তাদের সুখের নীড়ে যেতে দিয়েছি। কিন্তু দুজনের আফসোসের কারণ হয়েছি। কারণ ওরা কেউই সত্যিকারের মানুষটাকে চিনতে পারেনি।”
“মানুষ ঠকালে কী হবে! প্রকৃতি কাউকে ঠকায় না। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ ঠিকই নিয়েছে।”
“ঠিক তাই। সত্যিকারের মানুষটাকে চিনতে একদম ভুল করা উচিত নয়। না হলে পরে আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।”
“হুম। ভোর তো প্রায় হতে চলল। ঘুমাবে না?”

“সমস্যা নেই তো।”
“জানি। তোমরা বরং ঘুমিয়ে পড়ো। আমি তুর্যর কাছে আছি।”
প্রিয়া কিছু বলার আগে ফাহাদ বলে,
“আচ্ছা ঠিক আছে।”

ফাহাদ আর প্রিয়া নিজেদের রুমে চলে যায়। প্রিয়া রুমে গিয়ে বলে,
“মেয়েটাকে একা রেখে আমায় নিয়ে আসলে কেন?”
“তুমি কি দিনদিন বোকা হয়ে যাচ্ছো?”
প্রিয়া তেড়ে গিয়ে বলে,
“এই বোকামির কী করেছি?”

ফাহাদ প্রিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুর্য আর পরীকে একা সময় দেওয়ার জন্যই তো চলে আসলাম। এখন তুর্যর জন্য আলাদা কোনো ফিলিংস জন্ম নিতে পারে পরীর। আমরা থাকলে কি আর তা হতো? আর তাছাড়া তোমাকে কি এখন কাছে পেতাম না আসলে।”
প্রিয়া ফাহাদের হাতে একটা চিমটি কেটে বলে,
“ফাজিল।”

সকাল ১০টা নাগাদ প্রিয়া আর ফাহাদকে বিদায় জানিয়ে তুর্য আর পরী চলে আসে। আসার আগে প্রিয়া পরীকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল তুর্যর বিষয়টা ভালো করে ভেবে দেখতে। সারারাত জলপট্টি দেওয়ায় আর ওষুধ খাওয়ায় জ্বর অনেকটা কমে গেছে তুর্যর।
বাসে পাশাপাশি বসে আছে দুজন। তুর্য একদম চুপচাপ হয়ে গেছে জ্বর আসায়। পরী তুর্যর কপালে হাত দিয়ে বলে,
“জ্বর এখনো আছে?”
“সামান্য আছে। চলে যাবে।”
“অযথাই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধালেন।”

“অযথা হতে যাবে কেন? তুমি বৃষ্টি ভালোবাসো তাই আমিও বৃষ্টি ভালোবাসবো।”
“আমার বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস আছে। কিন্তু আপনার নেই।”
“আগে তুমিও তো বৃষ্টিতে ভিজতে পারতে না বলেছিল। তোমার যখন সহ্য হয়ে গেছে তখনও আমারও হয়ে যাবে।”
“প্রচুর ঘাড়ত্যাড়া আপনি।”

“তোমার চেয়ে কমই আছি।”
এরপর দুজনই চুপচাপ। তুর্যর জ্বরের রেশ এখনো কাটেনি বিধায় অল্প সময়েই বাসের সিটে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। একটু পরপর বাসের ঝাঁকুনিতে মাথাটা এদিক-সেদিক হেলে পড়ছে। বার কয়েকবার পরীর কাঁধেও এসে পড়েছে। কিন্তু পরী সরিয়ে দিয়েছে। তুর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে কী ভেবে যেন তুর্য মাথাটা নিজেই কাঁধে এনে রাখে।

অর্পা বাচ্চাদের সাথে কানামাছি খেলছে। আর সূর্য একটা বেঞ্চিতে বসে সেজানের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। অর্পার সাথে দ্বিতীয় বার দেখা হওয়ার পর থেকেই একটা ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
বাচ্চাদের সাথে খেলতে খেলতে হয়রান হয়ে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সূর্যর পাশে এসে বসে। বলে,
“সেজানের সাথে কথা বলছ?”
“হুম। বলবে?”

সূর্য ফোনটা অর্পার দিকে ধরে। অর্পা বলে,
“কেমন আছো সেজান?”
“আমি বালো আতি। তুমি কে?”
“আমি তোমার একটা আন্টি।”
“আন্তি? কোন আন্তি? আমাল পুপি তো তুমি না।”
“না, না। আমি তোমার ফুপি নই। আমি তো অর্পা।”

“অল্পা কে? তোমালে আমি চিনি না।”
সেজানের মুখে নিজের নাম শুনে অর্পা হেসে দেয়। বলে,
“তুমি আমাকে চিনবে না। আমি তোমার বাবার বন্ধু।”
সেজানের সাথে কথা বলতে বলতে হেসে লুটোপুটি খায় অর্পা। কথা বলা শেষে সূর্যকে বলে,
“তোমার ছেলেটা খুব পাকা।”

“হ্যাঁ। প্রচুর দুষ্টু।”
“ওকে ছাড়া থাকো কীভাবে?”
“কিছু যে করার নেই। তিরাকে ভুলতে পারি না।”
“এজন্য এভাবে বাচ্চাটাকে কষ্ট দেবে?”

“নিজেকে যেদিন সম্পূর্ণ সামলাতে পারব সেদিন বাংলাদেশে চলে যাব।”
“এটাই ভালো হবে।”
“তুমি কিন্তু এখনো আমাকে সেই কথাটা বললে না।”
“কোন কথা?”
“ঐযে প্রথমদিন ডাকলে শুনুন বলে। দাঁড়ানোর পর কিছু না বলেই চলে গেলে। এরপর একদিন শপিংমলে দেখা হলো তখন নিজেই কথা বললে। রেস্টুরেন্টে বসলে। অনেক কথাই বললে কিন্তু ঐ ছেলেটা কে ছিল বলোনি।”
“ওহ! ঐ ছেলে আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল।”

“বয়ফ্রেন্ড?”
“হু। বাদ দাও তো এসব। এখন আর রিলেশন নেই।”
“আচ্ছা।”
“এখন আমায় উঠতে হবে। বাসায় যাব।”
“চলো পৌঁছে দেই।”

কয়েকদিনে অফিসের অনেক কাজ জমা হয়ে গেছে। তুর্য অফিসে যায়নি বলে পরীকেও যেতে দেয়নি।চারদিন পর পরী আর তুর্য অফিসে চলে যায়।
নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছিল পরী। তখন তুর্যর পি-এ এসে বলে তুর্যর কেবিনে যেতে।
পরী তুর্যর কেবিনে গিয়ে চমকে যায়। জয় বসে আছে তুর্যর সামনে। পরীকে দেখে জয়ও দাঁড়িয়ে যায়। জয়ের মুখটা আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গেছে। তুর্য বলে,
“জয় তোমাকে কিছু বলতে এসেছে পরী।”
পরী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকায়। জয় বলে,
“কেমন আছিস?”
“ভালো। তুমি কেমন আছো? আর সূচী?”
“সূচী এখন সুস্থ আছে। আমরা বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছি।”
“কেন?”

“মায়ের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখব না। এখানে থাকলে মা কোনো না কোনো ভাবে আমাদের কাছে আসবে। মায়ের ছায়া আর সূচীর উপর পড়ুক তা আমি চাই না। তোর সাথে বোধ হয় যাওয়ার আগে আর কথা হবে না। তাই আজ বলতে আসলাম।”
“ওহ। দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছ আশা করি সব ভেবেচিন্তেই নিয়েছ। সাবধানে যেয়ো। আর সূচীর খেয়াল রেখো। সূচীর পাশে সবসময় সাপোর্ট হয়ে থেকো।”
“থাকব।”

জয় চলে যাওয়ার পরই তুর্য বলে,
“যদি এখন মনমরা হয়ে থাকতে দেখি তাহলে একদম মেরে ফেলব।”
পরী কপাল কুঁচকে তাকায়।
“ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আমি কি ভয় পাই নাকি!”
পরী চলে আসা ধরে তখন তুর্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”

“আমার মনে এত রং নেই ঘুরতে যাওয়ার।”
তুর্য পরীর দিকে একটু ঝুঁকে বলে,
“কিন্তু আমার মনে প্রচুর রং। এই রঙেই রাঙিয়ে দেবো তোমায়। নদীর বিশুদ্ধ বাতাসে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। সো, কোনো বারণ আমি শুনছি না। চলো।”

পর্ব ২৪

তুর্য যখন পরীকে নিয়ে নদীর সামনে গাড়িটি দাঁড় করালো। তখনও পরী নির্বাক। গাড়ি পার্কিং করে পরীকে নিয়ে নদীর কিনাড় ধরে হাঁটছিল। বাতাসে নদীর পানিতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। তুর্য একটা নৌকা ভাড়া করে। পাল তোলা নৌকা।
এমন পরিবেশে না চাইতেও মনটা ভালো হতে বাধ্য। মাঝি আপনমনে পানিতে বৈঠা চালাচ্ছে। তুর্য পরীর দিকে তাকিয়ে আছে। আর পরী পানির মধ্যে পা ডুবিয়ে পা নাড়াচ্ছে। ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি। তুর্য পরীর একটু কাছে এসে বলে,
“সাঁতার পারো?”

পরী ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
“উঁহু।”
“যদি পড়ে যাও?”
“তাহলে মরে যাব।”
তুর্য পরীর এক হাত চেপে ধরে বলে,
“তাহলে আমি আছি কী করতে? আমি থাকতে তোমার কোনো ক্ষতিই হবে না।”
“এত কেয়ার কেন করেন বলেন তো?”
“ভালোবাসি তাই।”

“আমি ভালোবাসি না জেনেও এত ভালোবাসেন?”
“কেউ ভালোবাসলে যে শুধু তাকেই ভালোবাসতে হবে এমন তো কিছু জানতাম না আগে। তাছাড়া আমি তো জানি তুমি মনে মনে কলা খাও।”
“মনে মনে কলা খাই মানে?”
“এইযে মনে মনে ভালোবাসো।”
পরী হাসল। তুর্য বলে,
“ওভাবে হেসো না।”
“হাসলে কী হবে?”

“পানিতে পড়ে যাব।”
“সাঁতার পারেন না?”
“পারি।”
“তাহলে কোনো সমস্যা নেই।”
“তাহলে ঝাঁপ দেই?”
“এই না।”
এবার দুজনেই হেসে ফেলে। পরী এবার নিজের মতো করে হাত দিয়ে পানি ছুঁয়ে দিচ্ছে। তুর্য ফোন চাপছে। পরী মাঝিকে জিজ্ঞেস করে,
“চাচা পানির নিচে কিছু নাই?”

“কী থাকব?”
“আমি ছবিতে দেখেছি। পানির নিচে ভূত থাকে। তাছাড়া ইয়া বড় বড় মাছ থাকে। ওরা যদি পা টেনে ধরে পানির নিচে নিয়ে যায়?”
পরীর কথা শুনে মাঝি খিলখিল করে হেসে দিল। বলল,
“না রে মা। ছবিতে তো কতকিছুই দেহায়। বাস্তবে কী আর হয় নি!”
“যাক বাবা বাঁচলাম! আপনার ছেলে-মেয়ে নাই?”
“আছে। একখান পোলা আর একখান মাইয়া।”

“ওহ।”
গল্প করতে করতেই ওরা নদীর পাড়ে পৌঁছে যায়। তুর্য মাঝিকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ১০০টাকা বকশিস দিল। পরী জিজ্ঞেস করল,
“এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“গেলেই দেখতে পারবে।”

পরী মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে। তুর্য পেছনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী হলো?”
“না বললে আমি যাব না।”
“বললে আরো যাবে না।”
“না বললেও যাব না।”
“আচ্ছা বলছি। বন্ধুর ফ্ল্যাটে যাচ্ছি।”
পরী অবাক হয়ে বলে,
“কেন?”

“ভয় পাচ্ছো নাকি তুমি? আমার কোনো খারাপ মতলব নেই আগেই বলে দিচ্ছি।”
পরী তবুও দাঁড়িয়ে আছে। তুর্য এবার প্রায় হাত ধরেই নিয়ে যায় পরীকে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে কলিংবেল বাজায়। তারপর দুহাত দিয়ে পরীর চোখ আটকে ধরে। কেউ একজন দরজা খোলার পর পরীকে নিয়ে ভেতরে যায়। পরীর চোখ দুটো ছেড়ে দেয়। সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখছে। চোখ ডলে ভালো করে তাকিয়ে দেখে আশেপাশে ইচ্চি-পিচ্চি দিয়ে ভরপুর।
খাটের উপর ছোটছোট বাবুগুলো হাত-পা নাড়িয়ে সমানে খিলখিল করে হাসছে। আর যে বাবুগুলো হাপুড় বাইতে পারে ওরা ফ্লোরে। এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে। কয়েকটা বাবু এগিয়ে এসে পরীর জামা টেনে ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে। পরীর মাথা ঘুরছে। বাবুটাকে কোলে নিয়ে তুর্যর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এসব কী? এত বাচ্চা কাদের?”

“তুমি চাইলে এই বাচ্চাগুলো আমাদের হতে পারে।”
“মানে কী? এত বাচ্চা!”
“তাতে কী? বাচ্চার জন্যই তো তুমি আমায় দূরে সরিয়ে রেখেছ। শুধুমাত্র বাচ্চা হবে না বলেই তো তুমি আমায় ভালোবাসো না। নাও আবার কত বাবু লাগবে।”
“আপনি কোথায় পেলেন এদের?”

“তুমি যখন মাঝি কাকার সাথে ফোনে কথা বলছিলে তখন এক বন্ধুকে ম্যাসেজে বলে সব ব্যবস্থা করেছি।”
পরীর কোলের বাচ্চাটা পরীর উড়না মুখে দিয়ে কামড়াচ্ছে। হঠাৎই বাচ্চাটা কান্না করে উঠে। বোধ হয় ক্ষুধা লেগেছে। তখন পাশের রুম থেকে একজন মহিলা এসে বাচ্চাটাকে নিয়ে যায়। তুর্য পরীর হাত ধরে বলে,
“বাসো না একটু ভালো। দাও না একটা সুযোগ! নিজেদের বাচ্চা যাদের না হয় তারা কী সংসার করছে না? বাচ্চা এডোপ্ট করছে না? আমরাও বাচ্চা এডোপ্ট নেবো। প্লিজ একটু ভালোবাসো।”
পরী তুর্যকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। তুর্য তো এখনো সত্যিটা জানে না যে পরী মা হতে পারবে। তবুও তুর্যর ভালোবাসা কমেনি। পরীর জীবন থেকে সরে যায়নি। বরং আরো বেশি করে ভালোবেসেছে। খারাপ সময়গুলোতে পরীর পাশে থেকেছে। পরীকে চুপ থাকতে দেখে তুর্য বলে,
“কিছু তো বলো!”

পরী মুচকি হেসে বলে,
“এমন পাগলামি যে করে, এত ভালো যে বাসে তাকে ভালো না বেসে থাকা যায়?”
তুর্য ধপাস করে সোফার উপর পড়ে যায়। হাত-পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বলে,
“ওহ মাই গড! এইটা আমি কী শুনলাম। তুমি আমায় ভালোবাসো। আমার এতদিনের স্বপ্ন পূরণ করেছে আল্লাহ্।”
তুর্যর এমন অবস্থা দেখে পরী শব্দ করে হেসে ফেলে।

এয়ারপোর্ট দাঁড়িয়ে আছে সূর্য আর অর্পা। অর্পার বোন আসবে বাংলাদেশ থেকে। তাই রিসিভ করতে এসেছে। সূর্যও ফ্রি ছিল তাই অর্পা সূর্যকেও নিয়ে এসেছে। সূর্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেম খেলছিল। হঠাৎই অর্পা দৌঁড়ে গিয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরে। সূর্য বুঝতে পারে এটা অর্পার বোন। দুবোন কিছুক্ষণ কথা বলে সূর্যর দিকে এগিয়ে আসে। সূর্যকে দেখিয়ে অর্পা বলে,
“এটা আমার বন্ধু সূর্য।
আর সূর্য, এটাই আমার বোন সূচনা। সবাই সূচী বলেই ডাকে। আর ও হচ্ছে সূচীর হাজবেন্ড জয়।”
সূর্য ওদের দুজনের সাথে কুশলবিনিময় করল। জয় বলল,
“আপনাকে কেমন যেন চেনাচেনা লাগে ভাই।”
সূর্য হেসে বলে,
“হয়ত কোথাও দেখেছেন।”

“হুম। হতে পারে।”
অর্পা বলে,
“বাকি কথা বাড়িতে গিয়ে হবে। এখন চলো সবাই।”
বাড়িতে গিয়ে সূচী আর জয় ফ্রেশ হতে যায়। অর্পা সবার জন্য টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। সূর্য জিজ্ঞেস করে,

“সূচী তোমার বড় নাকি ছোট?”
“এমা! তুমি দেখেও বোঝোনি? সূচী আমার ছোট।”
“তাহলে ওর বিয়ে হয়েছে। অথচ তোমার এখনো বিয়ে হয়নি?”
এমন প্রশ্নে অর্পার হাসি মুখটা বিলীন হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“আমার বিয়ে হয়েছিল।”

“বিয়ে হয়েছিল? তাহলে তোমার স্বামী কোথায়? আর তুমি এখানে কেন থাকো?”
“সে অনেক কথা। পরে সময় করে সব বলব।”
“আচ্ছা তোমার হাজবেন্ড কোথায় সেটা বলো।”
“ও বাংলাদেশেই আছে। ডিভোর্স হয়ে গেছে আমাদের।”
“আই সি!”
জয় আর সূচী ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংরুমে আসায় ওরা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে অন্য কথা বলতে শুরু করে। তারপর চারজন মিলে একসাথে খেতে শুরু করে।

পর্ব ২৫

তাহমিনা বেগম ঘুমন্ত সেজানকে তার স্বামীর পাশে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তুর্যর বাবা তখন ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“সেজানকে নিয়ে আসলে যে? পরী কোথায়?”

“মেয়েটা একটু ঘুমিয়েছে। সারাদিন অফিস, বাড়ি আবার সেজানকে সামলানো। সব মিলিয়ে তো কম ঝামেলা যায় মেয়েটার উপর। আজ বন্ধের দিন। একটু ঘুমাচ্ছে।”
“ওহ।”

“সূর্যর সাথে কথা হয়েছিল আর তোমার?”
“না। আজ তো আমাকে আর ফোন দেয়নি।”
“আমি একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম।”
“কী বিষয়?”
“সূর্যর আর পরীর বিষয়।”
“বুঝলাম না।”

“না বোঝার কী আছে? পরীকে সূর্যর বউ করে আনতে চাচ্ছিলাম।”
“তোমার কি মাথা ঠিক আছে তাহমিনা? সূর্য বিবাহিত। একটা বাচ্চাও আছে। তিরা না হয় মারা গেছে। কিন্তু সূর্যর বাচ্চা আছে এটা মানতে হবে তোমাকে। পরী যে সেজানকে নিজের ছেলের মতোই সময় দিচ্ছে এটাই কি আমাদের ভাগ্য নয়?”
“আমি পরীর কথা ভেবেই বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি। তুমি কি জানো পরী কখনো মা হতে পারবে না?”
“কী বলছ এসব?”

“ঠিকই বলছি। যখন আমি শুনেছিলাম কথাটা তখন আমারও খুব খারাপ লেগেছিল। পরে ভেবে দেখলাম আল্লাহ্ হয়তো পরীকে সেজানের জন্যই পাঠিয়েছে।”
“তুমি কি সব জেনে বলছ?”

“অবশ্যই। পরী নিজের মুখে বলেছে।”
“আমি বুঝতে পারছি না কী বলব!”

“তোমার বুঝতে হবে না। আমি তুর্যর সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলব। ওদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা খুব ভালো।তাছাড়া পরী সূর্যর সাথে সুখীই হবে। সেজানও পরীকে সারাজীবনের জন্য মা হিসেবে পাবে।”

বাড়িতে মামা-মামীরা এসেছে আজ তিনদিন হবে। অনেক বছর পর তারা দেশে ফিরেছে। জয়দের বাসায় যাবে বলে পরীকেও নিয়ে যাচ্ছে। পরী না করা সত্ত্বেও শুনেনি। পরে পরী বলেছে সে যাবে কিন্তু বাড়িতে ঢুকবে না। মামা তাতেই রাজি হয়। পরী যখন রেডি হচ্ছিল তখন তুর্য রুমে আসে। খাটের উপর বসে বলে,
“এতো সাজুগুজু করছ কেন?”

পরী হিজাব পরতে পরতে বলে,
“কই এত সাজুগুজু করছি?”
“করছই তো। নতুন জামা-কাপড়, হিজাব পরছো।”
“খালার বাসায় যাচ্ছি।”

তুর্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
“খালার বাসায় যাচ্ছো মানে? এতকিছুর পরও তুমি ঐ বাসায় যাবে?”
“বাড়িতে ঢুকব না। মামাকে বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েই চলে আসব।”
“না। তাও তুমি যাবে না। প্রয়োজনে নিশাতকে পাঠাও।”
“নিশাত তো স্কুলে গেছে।”
“জানি না আমি এতকিছু। তুমি যাবে না মানে যাবে না।”
পরী আর কিছু বলছে না দেখে তুর্য পরীর হাত চেপে ধরে নিজের দিকে ঘুরায়। পরী বলে,
“কী করছ? কেউ দেখে ফেলবে।”

“দেখলে দেখুক। আমি কী বলেছি তুমি শুনেছো তো?”
“হ্যাঁ শুনেছি।”
দরজার পাশ থেকে মামা গলা খাঁকারি দিতেই তুর্য পরীর হাত ছেড়ে দেয়। মামা মিটমিটি হাসতে হাসতে রুমে প্রবেশ করে। তুর্যর পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বলে,
“আমার ভাগ্নীর হাত ধরাধরি হচ্ছে নাকি?”
মামার কথা শুনে তুর্য থতমত খেয়ে যায়।
“না আসলে।”
“থাক, থাক বুঝেছি। সমস্যা নেই তো। আমি কি আগের যুগের মামা নাকি? আমি হচ্ছি ডিজিটাল যুগের মামা। প্রেমে বাঁধা দেবো না।”

মামার কথা শুনে পরী লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। আর তুর্য হাসছে। মামা বলে,
“পরী আর জয়ের সম্পর্কের কথা আমি জানতাম। জয়ের বিয়ের ব্যাপারেও পরী আমায় সব বলেছে। বড় আপা বিয়ের দাওয়াত দেওয়া সত্ত্বেও আমি আসিনি। কিন্তু পরে আপার চক্রান্ত যখন জানলাম তখন আর চুপ থাকতে পারিনি। আপাকে কিছু কথা শোনানোর দরকার। এজন্যই পরীকে নিয়ে যাচ্ছি। চাইলে তুমিও যেতে পারো আমাদের সাথে।”
শেষের কথাটা মামা চোখ মেরেই বলল। তুর্য হেসে বলল,
“আমি তো এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছি যাওয়ার জন্য।”
মামা হেসে বলল,
“ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। তার আগে হাত ধরাধরি বাকি থাকলে শেষ করে নাও।”
কথাটা বলে হাসতে হাসতে মামা রুম থেকে চলে গেল। পরী তুর্যর দিকে তেড়ে গিয়ে কয়েকটা কিল-ঘুষি দিল তুর্যর পিঠে আর বুকে। কপট রেগে বলল,
“বারবার না করা সত্ত্বেও শুনলে না। এখন মামা কী মনে করল?”

তুর্য পরীকে সামনে ঘুরিয়ে কাঁধে থুঁতনি রেখে বলল,
“ভাবুক যা খুশি। মামা তো বুঝেই গেছে আমাদের মধ্যে ইয়ে আছে।”
“ইয়ে কী হ্যাঁ? ইয়ে কী? কোনো ইয়ে টিয়ে নাই। যাও এখনই রুম থেকে বের হও।”
“এভাবে অপমান? বের করে দিচ্ছো তাই না? ঠিক আছে। আমারও একদিন সময় আসবে।”
“তাই নাকি? তো কবে আসবে সেই সময় শুনি? বুড়ো হওয়ার পর?”
“আমায় চ্যালেঞ্জ করছো?”

“চ্যালেঞ্জ করার কী হলো? সত্যিই বলেছি।”
“আমি কালই মাকে আমাদের বিয়ের কথা বলব হুহ।”
তুর্য রেডি হতে চলে গেল। আর পরী হাসছে। পরীর মতো এমন হাজারটা মেয়ে আছে। কিন্তু তুর্যর মতো এমন ছেলে সব পরীর জীবনে আসে না। এটা ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পরী।

জয়দের বাড়ি যাওয়ার আগে বিশাল বড় একটা বাজার আছে। এখানে কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে মাছ-মাংস, ডিম, শুকনো খাবার সবই পাওয়া যায়। বাজারের মাঝখান দিয়েই বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা। রাস্তায় প্রচুর মানুষের ভিড়। এত ভিড় ঢেলে গাড়ি নিয়ে সামনে আগানো মুশকিল। তাই সবাই রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে সামনে এগোয়। সবাইকে পাশ কাঁটিয়ে কাঁটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পরী বাদে মামা-মামী আর তুর্য এগিয়ে গেলেও পরী থেমে যায়। ভিড়ের মাঝেই দেখতে পায় সেই চিরপরিচিত মুখটি।

পরী ভিড় ঢেলে সেদিকেই এগিয়ে যায়। একজন বাবার মতো বয়স্ক লোককে জনসম্মুখে অপমান করা হচ্ছে। আশেপাশের লোকদের কানাকানিতে বুঝতে পারলো লোকটা তাদের থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। কিন্তু এখনো শোধ করতে পারেনি। ঐ বয়স্ক লোকটার মেয়ে প্রতিবাদ করায় কয়েকজন উটকো, বাজে ছেলেরা মেয়েটাকে খারাপ ভাষায় ইভটিজিং করছে। মেয়েটা নীরবে চোখের পানি ফেলছে। আর পাবলিক? তারা চেয়ে চেয়ে মজা দেখছে। অবশ্য তারাই বা বলবে কী? ক্ষমতাবান লোকদের সামনে আমজনতা তুচ্ছ। কিন্তু পরী তো চুপ থাকবে না। ঐ মেয়েটার জায়গায় আজ পরীও থাকতে পারতো।

সবাইকে সরিয়ে পরী মেয়েটার কাছে যায়।যারা মেয়েটাকে ইভটিজিং করছিল তাদের একজনের দিকে নিজের উড়নার এক সাইড হাতে দিয়ে বলে,
“নে এবার আমার উড়না ধরে টান দে। আমাকে ইভটিজিং কর। দেখি তোর বাপের ঘাড়ে কয়টা মাথা।”
পরীর এমন সাহসিকতা দেখে ছেলেগুলো ভড়কে যায়। কিন্তু দমে যায়নি। একটা ছেলে পরীর উড়না ধরে বলে,

“খুব দেমাক দেখছি? প্রতিবাদ করতে আসছিস? জানিস আমরা কার লোক?”
পরী গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ছেলেটার গালে থাপ্পর দেয়। বলে,
“দেখেছিস সাহস? এবার তোর কোন বাপকে ডাকবি ডাক।”
ছেলেটা রেগে পরীর উড়না টান দিতে যাবে তখনই তুর্য আর মামা এগিয়ে আসে। কিন্তু তার আগেই কেউ একজন এগিয়ে এসে ছেলেটার হাত ধরে বলে,
“খবরদার! ওর গায়ে যেন একটা ফুলের টোকাও না লাগে।”

ছেলেটা আর কেউ নয়। সেই পরিচিত মুখ। পরীর বড় ভাই নিহাল। পরী নিহালের দিকে তাকিয়ে হাত তালি দিয়ে বলে,
“বাহ্, বাহ্, বাহ্! আমার গায়ে টোকা পড়লে তোর কী? তোর গায়ে ফোস্কা পড়বে? খুব জ্বলছে নাকি? কোথায় জ্বলছে দেখি তো একটু।”

নিহাল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরই একজন ছেলে পরীর দিকে এগিয়ে আসতে গেলে নিহালের বন্ধু বাঁধা দেয়। ছেলেটা বলে,
“আটকাচ্ছেন কেন ভাই? মেয়েটার সাহস দেখছেন? আমাদের ছেলেদের গায়ে হাত তোলে। আর ভাইকেও কথা শোনাচ্ছে।”
“চুপ থাক। তুই জানিস ঐ মেয়ে কে?”
“কে?”
“নিহালের বোন।”

এবার ছেলেটাও দমে যায়। পরী সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কী হলো? সবাই এখন চুপ হয়ে গেলেন যে? কিছু বলেন আমায়। ইভটিজিং করেন। করবেন না? কেন? আপনাদের এই গুন্ডা বসের বোন বলে?”
নিহালের বন্ধু বলে,
“পরী এসবের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ো না। তুমি বাসায় যাও। আমাদের বস অর্ডার করেছে বলেই নিহাল এখানে তাকে আটকিয়েছে।”

পরী রেগে বলে,
“আমার ইচ্ছে করছে থাপ্রিয়ে আপনার সব কয়টা দাঁত ফেলে দেই। কোন বালের বস আপনাদের? যে বাপের বয়সী একজন লোককে জনসম্মুখে অপমান করতে বলে? তার কি বাপ, ভাই নেই? মা, বোন, বউ, মেয়ে নেই? আজ এই মেয়েটার জায়গায় কি তার আপন কেউ থাকতে পারতো না? এই লোকটার জায়গায় কি তার বাপ, ভাই থাকতে পারত না? আচ্ছা তাদের কথা বাদই দিলাম। আপনাদের মধ্যে যদি কারো বাবা, বোন ওদের জায়গায় থাকতো? পারতেন এই কাজটা করতে?”
সবাই এবার মাথা নিচু করে আছে। কারো কাছেই কোনো উত্তর নেই। পরী এবার নিহালের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোর কাপুরুষ সাঙ্গপাঙ্গদের তো মাথা নিচু হয়ে গেল রে। ওরা তো উত্তর দিতে পারল না। তুই দে। তুই বল। আজ ওদের জায়গায় আমার বাবা আর আমি থাকলে তুই এই কাজগুলোই করতি? বল করতি?”

নিহাল চুপ। পরী বলে,
“উহ হো! কাকে কী জিজ্ঞেস করি আমি। তুই তো এইসবে ওস্তাদ। তোর দ্বারা এসব অসম্ভব কিছু নয়। যে ছেলে বাবার খুনি তার কাছে এসব কিছুই না। হ্যাঁ তুই আমার বাবার খুনী।”
নিহালের চোখ দুটো ছলছল করে উঠে।
“পরী!”

“চুপ। ঐ মুখে আমার নামও নিবি না। তোকে আমি ঘৃণা করি। ভেবেছিলাম বাবার মৃত্যুর পর তুই অনুতপ্ত হবি। এসব পথ থেকে ফিরে আসবি। কিন্তু তুই আসিসনি। কীভাবে করিস তুই এসব কাজ? আজ যদি আমাকে কেউ রাস্তায় সবার সামনে ইভটিজিং করত তাহলে তুই সেটা সহ্য করতে পারতি? নিজের বোনের ক্ষতি সহ্য করতে পারিস না। তাহলে অন্যের বোনের ক্ষতি কীভাবে করিস?
তাদের কাছে তোরা টাকা পাবি ভালো কথা। সময় দে তাদের। হয়তো সঠিক সময়ে দিতে পারেনি। তাই বলে কি সময় বাড়িয়ে দেওয়া যায় না? মানুষ কি সাধে টাকা ধার নেয়? কতটা নিরুপায় হলে নেয় সেটা তো তোর অজানা নয়। গরীব লোকদের উপর আর কত অন্যায় অত্যাচার হবে। জোর যার, মুল্লুক তার এটা কি বন্ধ হবে না? একটু তো শান্তি দে এদের।”

পরীর চোখে পানি চলে এসে পড়েছে। চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে,
“তোকে আর আমার কিছুই বলার নেই। তোকে আমি খুব ঘৃণা করি রে খুব। যদি একদিনের জন্যও আমায় বোন ভেবে থাকিস তাহলে এমন অন্যায়, অত্যাচার আর কারো সাথে করিস না।”
পরী লোকটা আর মেয়েটাকে সেখান থেকে অন্যদিকে নিয়ে যায়। দুজনেই কাঁদছে। লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“এমন একজন ছেলের বোন তুমি মা। তোমায় না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না। একই রক্ত হয়েও দুজনের মধ্যে কত তফাৎ।”

পরী তার হাত ধরে বলে,
“কাঁদবেন না চাচা।”
মেয়েটা পরীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে,
“তুমি আমার সত্যিকারের বোন। ভাগ্য করলে এমন কাউকে বোন হিসেবে পাওয়া যায়।”
পরী মেয়েটার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“কাঁদবে না আর। আমার নাম্বার রাখো। যদি পরবর্তীতে ওরা আর কিছু বলে তাহলে আমাকে ফোন করে জানাবে।”

এরপর তাদেরকে রিক্সা ঠিক করে দিল।
তারপর ওরা গেল খালার বাসার দিকে। মামা আর মামী ভেতরে গেলেও পরী আর তুর্য যায়নি। ওরা হাঁটতে হাঁটতে খেলার মাঠের দিকে যায়। দুজনই চুপচাপ হাঁটছে। তুর্য বলে,
“মামা বলল নিহাল ভাইয়া তোমার ভাই।”
“ছিল।”
“বুঝলাম না।”

“ভাই ছিল সে। নিশাত ছাড়া এখন আর কোনো ভাই নেই আমার।”
“তার উপর তোমার খুব রাগ দেখছি।”
“কেউ তোমার বাবার খুনী হলে তার উপর তোমার রাগ থাকবে না?”
“এই কথাটা তখনও তুমি সবার সামনে বলেছিলে। একটা ছেলে কীভাবে তার বাবার খুনী হতে পারে?”
“প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ভাইয়াই বাবার খুনী।”
“আমায় কি সব বলা যায় না?”

পরী সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলতে শুরু করে,
“আমরা খুব হাসি-খুশি একটা পরিবার ছিলাম। চার ভাই-বোন আর মা-বাবাকে নিয়ে আমাদের ছিল সুখের সংসার। ভাইয়ার পড়াশোনা করতে ভালো লাগতো না বলে এসএসসির পর আর পড়েনি। টুকটাক কাজ করতে শুরু করে। এর কয়েক বছর পর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। আপুর এইচএসসির পর বিয়ে হয়ে যায়। ভাইয়া খারাপ ছেলেদের সাথে মিশেমিশে বিভিন্ন নেশায় জড়িয়ে যায়। এমন কোনো নেশাদ্রব্য নেই যেটা ভাইয়া খায়নি। ঘর থেকে প্রায়ই টাকা নিতো চুরি করে। একসময় যখন আমরা সবাই জেনে গেলাম তখন টাকা লুকিয়ে রাখতাম। আব্বুও আর কোনো টাকা দিতো না।

একদিন ভাইয়া বাসায় খুব ঝামেলা করছিল। বারবার নেশা করার জন্য মায়ের কাছে টাকা চেয়েছিল। মা কেঁদেকেটে ভাইয়াকে বুঝিয়েছিল এসব পথ থেকে সরে আসতে। কিন্তু ভাইয়া কোনো কথাই শোনেনি। আব্বু অফিস থেকে এসে দেখে ভাইয়া খুব চেঁচামেচি করছে মায়ের সাথে। আব্বু ভাইয়াকে বকা দেওয়ায় ঝামেলা আরো বেড়ে যায়। ভাইয়া লাঠি নিয়ে আব্বুকে পিটাতে যায়।”
এতটুকু বলেই পরী থেমে যায়। থমথমা গলায় তুর্যকে বলে,

“ভাবতে পারছো তুর্য, যে ছেলেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে বাবা-মা। সেই ছেলে তার জন্মদাতা পিতাকে লাঠি দিয়ে মারতে যায়? মা যদি না ধরতো তাহলে ভাইয়া ঠিকই আব্বুকে মারতো। ভাইয়া রাগ করে চলে যায় বাড়ি থেকে। চোখের সামনে এত অবনতি আবার আব্বুকে মারতে যাওয়া এইসব কষ্ট মিলিয়ে আব্বু আর সহ্য করতে পারেনি। সারাজীবনের মতো চলে যায় আমাদের ছেড়ে। এখন তুমিই বলো আব্বুর মৃত্যুর জন্য কী ভাইয়া দায়ী নয়?

মৃত্যুর খবর পেয়ে ভাইয়া এসেছিল বাড়িতে। কিন্তু আমি আর মা বাবাকে দেখতে দেইনি। কেন দেবো? ভাইয়াই তো আমার বাবার খুনি। লাশের খাঁটিয়াও নিতে দেইনি। জয়, নিশাত আর পাশের বাড়ির ভাইয়ারা নিয়েছিল। সেই থেকেই ভাইয়াকে আমি ঘৃণা করি। এখনো চোখের সামনে সেই দৃশ্যটা ভাসে। খুব কষ্ট হয় আমার তুর্য।”

পরীর কথা শুনে কখন যে তুর্যর চোখে পানি এসে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। পরীর দুহাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“আমি আছি তো! আর কোনো কষ্ট পেতে দেবো না তোমায়।”
তারপর খুব যত্ন করে পরীর চোখের পানি মুছে দেয়।

পর্ব ২৬

পরীর ডেস্ক আর তুর্যর কেবিন প্রায় মুখোমুখি। থাই গ্লাসের কাঁচ ভেদ করে বেশিরভাগ সময়টা তুর্য পরীকেই দেখে। কখনো কখনো চলার পথে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। পরী লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলে আর তুর্য মিটমিট করে হাসে। প্রয়োজন ছাড়াই তুর্য ওর ডেস্কের সামনে যাওয়া আসা করবে। এর,ওর সাথে কথা বলবে।

পরীর পাশের ডেস্কেই রূপসী একটি মেয়ে কাজ করে। তুর্য পরীকে দেখার জন্যই ওখানে যায়। ঐ মেয়েটির সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে পরীকে দেখে। মেয়েটা তো তুর্যর কথা শুনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। আর এদিকে পরী রাগে ফেঁটে যাচ্ছে। তুর্য ওর কেবিনে চলে যাওয়ার পর প্রায় সাথে সাথেই পরী তুর্যর কেবিনে যায়। পেছন থেকেই জোরে একটা ধাক্কা দেয়। হুট করে পেছন থেকে ধাক্কা খাওয়ায় তুর্য টেবিলের উপর পড়ে যায়। পরীর দিকে তাকিয়ে দেখে রাগে লাল হয়ে আছে। হাতে বেশ ব্যথা পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে। হাতের পিঠ ডলতে ডলতে পরীকে বলে,
“এভাবে ধাক্কা দিলে কেন? ব্যথা পেলাম না?”

পরী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
“ব্যথা পাওয়ার জন্যই ধাক্কা দিছি। আরাম পাওয়ার জন্য নয়।”
“কী করেছি আমি?”
পরী এগিয়ে গিয়ে তুর্যর টাই ধরে বলে,
“আবার বলিস কী করেছি!”

তুর্য পরীর হাত ধরে বলে,
“আস্তে আস্তে। এত জোরে টাই টেনে ধরলে তো ফাঁস লেগেই মরে যাব।”
“মেরেই ফেলব তোকে আমি।”

“আমার অপরাধ কী সেটা তো বলো? তুমি আবার আমাকে তুই তুই করেও কথা বলছো!”
“একশো বার বলব। তাতে তোর কী?”
“আচ্ছা আমার কিছু না। এখন বলো কী করেছি আমি?”
“ঐ মেয়ের সাথে এত ঢলাঢলি কীসের?”
“কোন মেয়ে?”
“ন্যাকা! এখন জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কোন মেয়ে?”

“আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না তুমি কোন মেয়ের কথা বলছো।”
“কতগুলো মেয়ের সাথে ঢলাঢলি করিস রে তুই যে এখন বুঝতেই পারছিস না কার কথা বলছি!”
“নাউজুবিল্লা। এসব কী বলো তুমি? তুমি ছাড়া আমি আর কারো সাথে ঢলাঢলি করি না বিশ্বাস করো।”
পরী চোখ গরম করে তাকাতেই তুর্য থতমত খেয়ে বলে,

“না মানে! ঢলাঢলি বলতে বুঝিয়েছি যে, তুমি ছাড়া আর কোনো মেয়ের কাছে যাই না আমি।”
“তাহলে আমার পাশের ডেস্কে বসা ঐ মেয়ের সাথে তোর এত কীসের আলাপ?”
“ওহ মাই গড! একটু কথা বলেছি আর সেটাকেই তুমি ঢলাঢলি বানিয়ে দিয়েছ? তাছাড়া তোমাকে দেখার ছুঁতোতেই তো আমি ওর সাথে কথা বলেছি।”

“ঘুষি দিয়ে তোর নাক ফাঁটিয়ে দেবো আমি। আমাকে দেখতে গেলে আমার সাথে কথা বলবি। অন্য মেয়েদের সাথে হেসে হেসে এতো কীসের কথা?”
“আচ্ছা স্যরি। এই কান ধরলাম। আর কথা বলব না।”

“তুই আর আমার সাথেই কথা বলিস না।”
“এই এই, না, না!”
পরীর হাত ধরে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“মাফ চাইছি তো! মাফ করে দাও প্লিজ।”
পরী জোরে একটা কামড় বসিয়ে দেয় তুর্যর হাতে। তখন তুর্য বাধ্য হয় পরীকে ছেড়ে দিতে। পরী বলে,
“আর যদি ঢং করতে আসিস কামড় দিয়ে মাংস তুলে ফেলব। আর খবরদার, অন্য কোনো মেয়ের সাথে রংঢং করার একদম চেষ্টা করবি না।”

সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরেও তুর্য পরীদের ফ্ল্যাটে বসে আছে। পরী সেজানকে নিয়ে রুমের ভেতর বসে আছে। রুম ভেতর থেকে লক করা। মামা নিজের রুম থেকে এসে তুর্যকে দেখে বলে,
“আরে তুর্য তুমি? কখন এলে?”
তুর্য নোখ কামড়াতে কামড়াতে বলে,
“অনেকক্ষণ।”

“নোখ কামড়াচ্ছ কেন? কোনো কিছু ভাবছো নাকি টেনশন করছো?”
“না। তেমন কিছু নয়।”
নোখ কামড়াতে কামড়াতে তুর্য বারবার পরীর রুমের দিকে তাকাচ্ছিল। মামা তুর্যর দৃষ্টি লক্ষ করে সেদিকে তাকিয়ে বলে,

“ওহ আচ্ছা! পরীর কাছে যেতে পারছ না?”
“না, না। আমি তো সেজানকে দেখতে এসেছি।”
“তাই নাকি? আচ্ছা আমি সেজানকে নিয়ে আসছি।”
মামা পরীর রুমে দরজায় নক করার কিছুক্ষণ পর পরী দরজা খুলে দেয়। মামার পেছন পেছন তুর্যও এসেছে। মামা বলে,
“পরী সেজানকে দে তো।

তুর্য নিতে এসেছে।”
পরী কোনো কথা না বলে সেজানকে মামার কোলে দেয়। তুর্য দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মামা সেজানকে তুর্যর কোলে দিয়ে বলে,
“এই নাও সেজানকে। মন ভরে দেখো।”

তুর্য তখনও উঁকিঝুঁকি দিতে ব্যস্ত। মামা তুর্যর চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলে,
“একি? চোরের মতো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছো কেন? সেজানকে দেখতে চেয়েছ দিয়েছি। আর কাকে দেখতে চাচ্ছো?”

তুর্য কিছু বলার আগেই পরী শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। মামা কানে হাত দেয়, তুর্য চোখ বন্ধ করে ফেলে আর সেজান ভয়ে তুর্যর গলা জড়িয়ে ধরে।
মামা বলে,
“মিথ্যে বলে নিজেই ঠকলে। আমি তো জানি তুমি পরীকেই দেখতে এসেছ। শুধু শুধু সেজানের কথা বললে।”

“বুঝেছেন যখন তখন এমন করলেন কেন?”
“আমাকে মিথ্যা বলার ফল এটা।”
তুর্য মনেমনে বলে,
“মামা-ভাগ্নী একই রকম।”

তুর্য সেজানকে নিয়ে রুমে চলে যায়। তাহমিনা বেগম তুর্যর রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
“অফিস থেকে এসেই কোথায় গিয়েছিলি?”
“উপরে। কেন?”
“এমনি। তোকে কিছু কথা বলব।”
“বলো।”

“এই কথাগুলো শুধু কথাই নয়।দায়িত্ব বলতে পারিস। দুটো দায়িত্ব দেবো তোকে। পালন করতে হবে।”

তুর্য মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুমি কোনো দায়িত্ব দিলে আমি সেটা পালন করিনি এমনটা কী কখনো হয়েছে?”
“এটা অনেক রিস্কি।”
“তোমার জন্য আমি যেকোনো রিস্ক নিতে রাজি।”
“তুই আমাকে ছুঁয়ে কথা দে।”

“তুমি আমায় অবিশ্বাস করছ নাকি?”
“রিস্কি জেনে পরে যদি তুই দায়িত্ব পালন না করিস? বিশ্বাস নাই। তুই আমাকে ছুঁয়ে কথা দে।”
তুর্য হেসে বলে,

“তোমার বাচ্চামো স্বভাব আর গেল না। আচ্ছা নাও, তোমায় ছুঁয়ে বললাম তুমি যেই দায়িত্ব দেবে আমি তা পালন করব।”
“সূর্য আর পরীর দুজনের বিয়ের জন্য দুজনকে রাজি করাবি।”
মায়ের গলা থেকে তুর্যর হাতটা আলগা হয়ে যায়। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। একটু নড়েচড়ে বলে,
“এসব তুমি কী বলছ মা? ভাইয়ার সাথে পরীর বিয়ে?”
“ভুল কী বললাম?”

“মা, ভাইয়া তিরা ভাবিকে খুব ভালোবাসে এখনো। তিরা ভাবি বেঁচে নেই বলে কি ভাইয়ার ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে?”

“সারাজীবন কি সূর্য একাই কাঁটিয়ে দিবে? আমি এতকিছু জানি না। তুই যেভাবে পারিস সূর্যকে রাজি করাবি। আর হ্যাঁ পরীকেও রাজি করানোর দায়িত্বও তোরই।”
“মা আমি পরীকে”

“আমি জানি না কিছু। কীভাবে পরীকে রাজি করাবি তোর দায়িত্ব। তোর সাথে পরীর একটা ভালো বন্ধুত্ব আছে আমি সেটা জানি। তুই বললে পরী ঠিক রাজি হবে।আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। তুই কিন্তু আমায় কথায় দিয়েছিস।”
“আমার কথাটা শোনো তুমি।”

পাশের রুম থেকে তরী তাহমিনা বেগমকে ডাকে। তিনি তু্র্যকে বলেন,
“আমি আর কিছুই শুনব না এখন। তুই ওদের রাজি করাবি ব্যাস। আমি শুধু ওদের মুখে ‘হ্যাঁ’ শুনতে চাই।”

তিনি চলে যাওয়ার পর তুর্য জোরে দেয়ালে একটা ঘুষি দেয়। সেজানের পায়ের কাছে বিছানায় মাথা রেখে বলে,
“এই দায়িত্ব আমি কীভাবে পালন করব মা! আমি যে পরীকে ভালোবাসি। নিজের ভালোবাসাকে কীভাবে ভাইর হাতে তুলে দেবো? এতটা মহৎ যে আমি নই মা।”

পর্ব ২৭

সকালে পরীর ঘুম ভাঙ্গে কারো হাতের স্পর্শে। চোখ মেলে দেখে সেজান ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে পরীর মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। পরী সেজানকে দেখে হেসে ফেলে। কিন্তু সেজানের ঠোঁটে হাসি নেই। মুখটা খুব মলিন। পরী সেজানকে পেটের উপর বসিয়ে বলে,
“কী হয়েছে আমার বাবুর? মন খারাপ?”
“কিতু হয় নাই।”
“সত্যিই কিছু হয়নি?”

সেজান দুদিকে ঘাড় নাড়ায়। পরী বলে,
“তাহলে মাম্মিকে একটা চুমু দাও তো।”
সেজান একটু ঝুঁকে পরীর গালে চুমু খায়। গালে হাত রেখে বলে,
“মাম্মি তোমালে সবাই বালোবাসে কেন?”
সেজানের মুখে এমন কথা শুনে পরী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সকাল সকাল সেজানের হলো কী? মুখে হাসি নেই। আবার কীসব কথা বলছে!

পরী সেজানকে সোজা করে বসিয়ে বলে,
“কী হয়েছে বাবু? মাম্মিকে সত্যি কথা বলো।”
নাহিদা বেগম তখন রুমে এসে বলেন,
“তুই এখনো শুয়ে আছিস? অফিসে যাবি কখন?”
“সময় আছে তো।”

“কোথায় সময়? দশটা থেকে তোর অফিস। নয়টা বাজে এখন। ফ্রেশ হবি, খাবি, রেডি হবি। কবে করবি সব?”
“নয়টা বেজে গেছে?”
“জি মহারাণী।”

পরী বিছানা ছেড়ে উঠে সেজানকে নাহিদা বেগমের কোলে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। গোসল সেরে, রেডি হয়ে ডাইনিংরুমে এসে বেশ অবাক হয়। প্রতিদিন তুর্য এখানে পরীর জন্য অপেক্ষা করে। অথচ আজ নেই? হয়তো লেট হয়েছে বলে চলে গেছে।নিশাত টেবিলে বসে নাস্তা করছিল। পরী একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,
“তুর্য চলে গেছে?”
“ভাইয়া তো আজ আসেইনি।”
“আসেনি!”

“না।”
পরী আর কিছু না বলে চুপচাপ নাস্তা শেষ করল। সেজানকে আদর করে দিয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেল।
সকাল ১১টা ৪০ মিনিট
এই এতক্ষণে একবারও পরী তুর্যকে দেখেনি। তুর্যও পরীকে কেবিনে ডাকেনি। হয়েছে কী আজ? নাকি আজ আসেইনি তুর্য। হাত দিয়ে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে এসব ভাবছিল। তখন তুর্যর পিএ পরীর ডেস্কের সামনে দিয়ে যায়। পরী তাকে দেখেই ডাক দেয়।
“ম্যাম।”

মেয়েটা পেছনে ঘুরে বলে,
“কিছু বলবে?”
“আজ উনি আসেনি কেন?”
“তুর্য স্যার?”
“হুম।”

“এসেছে তো। স্যার তো তার কেবিনেই আছে। কোনো দরকার?”
“না ম্যাম। কোনো দরকার নেই।”
“ওকে। ওহ ভালো কথা, তোমাকে যে ফাইলগুলো দিয়েছিলাম কমপ্লিট করেছ সেগুলো?”
কাজগুলো কমপ্লিট হলেও পরী মিথ্যা বলে।
“না ম্যাম। একটা ফাইলের কাজ এখনো বাকি। ওটা শেষ হলে আমি স্যারকে গিয়ে দিয়ে আসব।”
“আচ্ছা। তাড়াতাড়ি করো।”

পরী মুচকি হেসে বলে,
“ঠিক আছে।”
পরী ফাইলগুলো কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করার পর মনে মনে বলে,
“কোথায় ও আমার রাগ ভাঙাবে। তা না করে উল্টো রাগ করে বসে আছে? দেখাচ্ছি মজা আজ।”
পরী ফাইলগুলো নিয়ে তুর্যর কেবিনে যায়।

দরজায় নক করতে গিয়েও করে না। আস্তে করে দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে তুর্য জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। পরী আস্তে আস্তে পা ফেলে তুর্যর কাছে যায়। পেছন থেকে তুর্যকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“তুমি তো দেখছি মহা ফাজিল। আমার রাগ না ভাঙিয়ে নিজেই রাগ করে বসে আছো? আমাকে ছাড়াই অফিসে চলে আসলে। অফিসে এসেও দেখা দিলে না।”
তুর্য পরীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে,
“এটা অফিস পরী। হুটহাট এভাবে এসে জড়িয়ে ধরার কোনো মানে হয়? যদি আমার পিএ এসে দেখে ফেলে? কতটা খারাপ ভাববে?”
তুর্যর কথা শুনে পরীর হাসি হাসি মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে যায়। আগে তুর্য নিজেই পরীর কাছে আসতে চাইতো। নানা বাহানায় পরীর হাত ধরত। আজ সেই তুর্যই পরীকে রিজেক্ট করছে? পরমুহূর্তেই পরী হেসে তুর্যর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“বুঝেছি। কাল কথা বলিনি বলে খুব রাগ হয়েছে তাই না?”

তুর্য এবারও পরীকে দূরে সরিয়ে দেয়। বেশ ঠান্ডাভাবেই বলে,
“একটু আগে কী বললাম পরী? তুমি তো আর বাচ্চা নও। বাচ্চাদের মতো বিহেভ বাদ দাও। আর তোমার উপর আমি কোনো রাগও করিনি।”

মুহূর্তেই পরীর চোখ দুটো ছলছল করে উঠে। তা দেখে তুর্যর নিজেরও খুব কষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমার ভালোর জন্যই বলেছি। কেউ দেখে ফেললে তোমাকেই খারাপ বলবে।”
পরী কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
“এর আগে যখন তুমি আমার হাত ধরতে। আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে তখন কেউ বুঝত না? তখন কেউ খারাপ বলত না?

আর এখন সবাই খারাপ বলবে?”
তুর্য পরীর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখন পরীর চোখ দেখে আর বলতে পারে না।
আচমকা পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কাঁদবে না একদম আমার সামনে। আমি তোমায় এভাবে দেখতে পারি না।”
এতক্ষণ পরীর চোখে পানি টলমল করলেও এবার কান্নাই করে ফেলে। মেয়ে মানুষগুলো বোধ হয় এমনই। যতই রাগ-অভিমান হোক, যতই কষ্ট দিক একটু ভালোবেসে কাছে টানলেই কেঁদেকেটে বুক ভাসাবে।

তাহমিনা বেগমের কথা মনে পড়তেই তুর্য পরীকে ছেড়ে দেয়। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“এই চোখে অশ্রু মানায় না। এখন যাও। বাসায় গিয়ে কথা বলব।”

দোটানা কাকে বলে তা এখন তুর্য হারে হারে বুঝতে পারছে। মা তুর্যর কোনো কথাই শুনতে চাচ্ছে না।এদিকে পরীকে হারাতে পারছে না। বিশাল গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে এখন। মাকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছে। এসব কসম খুব বেশি বিরক্ত লাগছে তুর্যর। পরীর অসহায়ত্বের দিকটা এখন অনুভব করতে পারছে। সেজানের কথা ভেবে অনেক কষ্টে নিজেকে শক্ত করে সূর্যকে ফোন দেয়। দুবার রিং হওয়ার পর সূর্য ফোন রিসিভ করে বলে,
“হ্যাঁ বল।”
“কেমন আছিস ভাইয়া?”
“আমি তো ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”
“বেঁচে আছি।”

“মানে কী? তোর গলা এমন কেন? কোনো সমস্যা?”
“না। তোর কাছে কিছু চাইলে তুই দিবি?”

“এভাবে বলার কী আছে? তুই শুধু বল তোর কী চাই? আমি এই দেশ থেকে পাঠাচ্ছি। ফোন লাগবে? নাকি ল্যাপটপ?”
তুর্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“সেজানের জন্য একটা মা লাগবে।”
সূর্য হেসে বলে,
“সেজানের মা তো এখন আছেই। পরী আছে তো।”
“কিন্তু সত্যি তো আর এটা নয়। পরী তো আর সেজানের মা না?”
“কী হয়েছে বল তো? পরীর কি বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
“বিয়ের কথা চলছে।”

“কার সাথে?”
“তোর সাথে।”
“কিহ্! মাথা ঠিক আছে তোর?”
“হুম। এটা মায়ের চাওয়া।”

“মা চাইলেই হলো নাকি? মা জানে না আমি তিরাকে কতটা ভালোবাসি? মায়ের কথা বাদই দিলাম। তুই তো জানিস আমি তিরাকে কতটা ভালোবাসি। এরপরও তুই এই কথাটা কীভাবে বলিস?”
“এখানে আমার কী করার আছে বল? আমি কী করতে পারি?”
কথা বলতে বলতে দুজনের বেশ কথা কাটাকাটি হয়। সূর্য বলে,
“আচ্ছা দেখছি কী করা যায়।”
সূর্য ফোন রাখার পর তুর্য পরীর ফোনে টেক্সট করে,
“ছাদে আসো।”

মোবাইলটা পকেটে রেখে আয়নার সামনে ভালো করে নিজেকে দেখে। চোখ দুটো লাল লাল দেখাচ্ছে। বেসিনে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয়। কিন্তু বুকের দহন বেড়েই চলেছে। বুকের দহন নিজের মধ্যেই আড়াল করে ছাদের দিকে এগোয় তুর্য।

ছাদে গিয়ে দেখে পরী এখনো আসেনি। তাই একা একাই ছাদে হাঁটতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর পরী জোরে জোরে শব্দ করে হাসতে হাসতে ছাদে আসে। তুর্যর কাছে এসে হাসতে হাসতেই তুর্যর উপর গড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পেট ধরেই নিচে বসে পড়ে। আবছা আলোয় পরীকে দেখছে তুর্য। এত সুন্দর হাসিমুখটা বোধ হয় তুর্যর আর দেখা হবে না।

পরী নিজেকে সামলিয়ে বলে,
“নিশাত আর সেজান যে কী করে না! দুটোর কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেছে।”
তুর্য ছোট্ট করে বলল,
“ওহ্।”

“বাদ দাও এসব। হঠাৎ ছাদে ডাকলে যে? দুজনে একসাথে চাঁদ দেখার জন্য?”
“না। কিছু বলার জন্য।”
“বলো।”
তুর্যকে চুপ থাকতে দেখে পরী আবার বলে,
“কী হলো? বলো?”
“বলতে পারছি না।”।
পরী ফিক করে হেসে দেয়।বলে,
“এত লজ্জা পাচ্ছো কেন? বাড়িতে নিশ্চয়ই বিয়ের কথা বলেছ?”
“মা নিজেই বলেছে।”

পরী অবাক হয়ে বলে,
“সত্যিই?”
তুর্য কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“ভাইয়ার সাথে। ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ের কথা বলেছে।”
পরীর মুখটা চুপসে যায়। জিজ্ঞাসু
দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“মশকরা করছো?”
“আমি সিরিয়াস।”

“তোমার কি মাথা ঠিক আছে তুর্য?”
“আমার কিছু করার নেই পরী। আমি মাকে কথা দিয়েছি।”
পরী তুর্যকে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে বলে,
“কথা দিয়েছো মানে কী? এমন কথা তুমি কীভাবে দিতে পারো? তুমি জানো না আমি তোমাকে ভালোবাসি? তুমি মাকে কেন বলোনি আমাদের সম্পর্কের কথা? আমি তোমার ভাইকে কেন বিয়ে করব? বিয়ে করতে হলে তোমাকেই করব।”
“আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।”

“ভেবে বলছ তুমি এইসব? এতদিন তাহলে আমাদের মধ্যে কী ছিল?”
“আমি ভেবেই বলছি। সেজানের দিকটা একবার ভাবো।”

“কী ভাববো? ওহ হো! এতক্ষণে আমি সব পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি। আমি মা হতে পারব না এটা জেনে তুমি এখন তোমার ভাইকে বিয়ে করতে বলছ তাই না? আমার উপর যা ছিল সব মোহ? এখন মোহ কেটে গেছে বলে আমাকে আর ভালো লাগে না? আর বাবা হতে পারবে না এটা নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝে তারপর আজ এসব বলছ। তুমি তো সত্যিটা জানোই না।”
“আমাকে তুমি ভুল বুঝছো পরী। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

“হ্যাঁ ভালোবাসার নমুনা দেখছি তো। কেন করেছিলে এতদিন নাটক?”
“আমায় ভুল বুঝো না প্লিজ।”
“ভুল বোঝার মতো কিছু আছে কী?”
“আমি জানি না কিছু।”
পরীর কষ্ট হচ্ছে, রাগ হচ্ছে। কিন্তু কান্না পাচ্ছে না। সত্যি বলতে তুর্যর সামনে একটুও কাঁদতে ইচ্ছে করছে না। তুর্যকে কিছু বলতেও ইচ্ছে করছে না। পরী চুপচাপ চলে আসা ধরলে তুর্য হাত টেনে ধরে বলে,
“করবে তো ভাইয়াকে বিয়ে?”

পরী রাগে চড় বসিয়ে দেয় তুর্যর গালে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
“এতক্ষণ ঠান্ডা মাথায় কথা বলেছি ভালো লাগেনি? কোন মুখে বলিস তোর ভাইকে বিয়ে করতে? আমাকে নিজের মতো গড়ে নিয়ে এখন বলছিস তোর ভাইকে বিয়ে করতে! বাহ্ রে বাহ্! কী মহৎ তুই। স্বার্থের মহান তুই। নিজের ভাইয়ের বউ হিসেবে সহ্য করতে পারবি তো তুই?”

তুর্য এবার পরীর হাতটা ছেড়ে দেয়। পরী চলে যাওয়ার আগে বলে,
“তোকে যেন আমি আর চোখের সামনে না দেখি। তোকে এখন চোখের বিষই মনে হচ্ছে আমার।”
পরী চলে যাওয়ার পর তুর্যর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা নোনাজল।

পর্ব ২৮

রুমে গিয়ে ভাঙচুর শুরু করে দিয়েছে পরী। রাগে, জিদ্দে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ছে। ভাঙচুর করার শব্দ পেয়ে নাহিদা বেগম পরীর রুমে যান। পরীকে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? ভাঙছিস কেন সব?”

পরীর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে অশ্রুকণা। পরী বলে,
“তুর্যর মা চায় তার ছেলে সূর্যের সাথে আমার বিয়ে দিতে।”
“কী বলিস এসব? সে চাইলেই হলো নাকি? তুর্যর বউ করতে চাইলেও একটা কথা ছিল। সে কোন জ্ঞানে চায় তোকে সূর্যর বউ করতে?”
“জানিনা আমি।”

“দাঁড়া আমি তার সাথে কথা বলব।”
“না। তোমাকে কিছু বলতে হবে না। উনি যদি উনার বড় ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে তাহলে তুমি তাকে কিছু বলবে না। আমি এই বিয়েতে রাজি।”
“তোর মাথাটা গেছে পরী।”

“আমার মাথা ঠিকই আছে।”
নাহিদা বেগম কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যান। এখন যেই পরিমাণ পরী রেগে আছে কিছু বললে তো বুঝবেই না। উল্টো রিয়াক্ট করবে। তাই তিনি কিছু না বলে পরীর রুম থেকে বেরিয়ে যান। মাথা ঠান্ডা হলে সময় নিয়ে বুঝাতে হবে।

তুর্য রুমে গিয়ে দেখে তাহমিনা বেগম ফোনে কারো সাথে রাগারাগি করছে। পাশেই তরী দাঁড়িয়ে আছে। তুর্য তরীকে জিজ্ঞেস করে,
“মা কার সাথে কথা বলছে?”
“ভাইয়ার সাথে।”

তুর্যও আর কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ফোনের ওপাশ থেকে সূর্য কী বলছে তা কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তাহমিনা বেগমের শেষ কথা ছিল,
“ঠিক আছে তুই দেশে আয়। তারপর সামনা-সামনি সব কথা হবে।”
সূর্য ফোন কেটে দেওয়ার পর অর্পা জিজ্ঞেস করে,
“তুমি এত রাগারাগি করছিলে কেন?”
“বাড়ি থেকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে।”

অর্পা যেন একটু আৎকে উঠল। কিন্তু সূর্যকে সেটা বুঝতে না দিয়ে বলল,
“ভালোই তো। তাহলে রাজি হচ্ছো না কেন? তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো?”
“আমি তিরাকে ভালোবাসি।”
অর্পা কিছু না বলে চুপ করে থাকে।

পরেরদিন সকালে অফিসে গিয়ে খুব অবাক হয় তুর্য। পরী তুর্যর আগেই অফিসে এসে পড়েছে। এরচেয়েও অবাক করার বিষয়টি হচ্ছে পরী খুব স্বাভাবিক এবং সবার সাথেই খুব হাসি-খুশিভাবে কথা বলছে। যেখানে তুর্য ভেবেছিল পরী হয়ত আর অফিসেই আসবে না।
তুর্য কেবিনে গিয়ে ওর পিএ কে দিয়ে পরীকে ওর কেবিনে ডেকে পাঠায়।
পরী দরজায় নক করে বলে,
“আসব স্যার?”

তুর্য ছোট করে বলে,
“হুম।”
পরী ভেতরে যাওয়ার পর তুর্য জিজ্ঞেস করে,
“হঠাৎ এত ফর্মালিটি দেখাচ্ছো যে?”

পরী চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলে,
“স্যরি? বুঝলাম না।”
“না বোঝার মতো কিছু বলেছি? আগে তো পারমিশন নিতে না ভেতরে আসার জন্য। এখন পারমিশন নিয়ে ভেতরে আসছো, স্যার ডাকছো। এসব ফর্মালিটি কি তোমার সাথে যায়?”
“ওয়েট, ওয়েট! আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন স্যার এটা অফিস। আমার বাড়ি নয়। আর আপনি আমার বস। সেহেতু আপনার কেবিনে আসার জন্য তো পারমিশন অবশ্যই নিতে হবে।”
“স্টপ ইট পরী! কী আপনি আপনি করছো!”
“বসকে আপনি বলব না তাহলে কী বলব?”
এরমধ্যেে দরজায় তুর্যর পিএ নক করে বলে,
“মে আই কাম ইন স্যার?”

“ইয়েস।”

তুর্যর পিএ ভেতরে আসার পর পরী বলে,
“আর কিছু বলবেন স্যার? না বললে আমি এখন যাই?”
“ঠিক আছে।”

পরী কেবিন থেকে চলে আসে। মনে মনে বলে,
“তুমি তো আমায় চেনো না মিষ্টার। ঘুঘু দেখেছো, ঘুঘুর ফাঁদ তো এখনো দেখোনি।”
দিনের পর দিন এভাবেই কাঁটছে। পরীকে প্রতিদিন দেখে দেখে অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে তুর্য। সূর্যরও দেশে আসার সময় এসে পড়েছে। পরীর এতো পরিবর্তন তুর্য কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। সূর্য দেশে না আসা পর্যন্ত কোনো কথাও উঠছে না এই বিষয়ে।
সকাল ৮:৩০ মিনিট
কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দেয় তুর্য। পরীকে দেখে একটা ধাক্কা খায়। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে নতুন বউ। পরী বলে,
“এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি ভেতরে যাব কীভাবে?”
পরীর কথা শুনে তুর্য সরে দাঁড়ায়। পরী ভেতরে গিয়ে দেখে তাহমিনা বেগম টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। পরীকে দেখে হেসে বলেন,
“আরে মা এতো সকালে তুমি?”

পরী তাকে সালাম করে বলে,
“কেন আসতে পারি না?”
“অবশ্যই পারো মা।”
“কিছু কথা বলতে এসেছিলাম।”
“আগে বলো সকালে নাস্তা করেছ?”
“না।”

“তাহলে বসো নাস্তা করতে করতে কথা বলি।”
পরীও হাসিমুখে বলে,
“আচ্ছা।”
তুর্যর বাবা-মা, তরী, তুর্য আর পরী একসাথে খেতে বসেছে। ব্রেডে বাটার লাগাতে লাগাতে পরী বলে,
“আন্টি আপনি নাকি তুর্যর কাছে বলেছেন আপনার বড় ছেলের বউ করতে চান আমায়?”
“তা বললামই মা।”
“আমি বিয়েতে রাজি।”

পরীর কথা শুনে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে তুর্য। পরী সেটা লক্ষ করে তাহমিনা বেগমকে বললেন,
“উনার নাম্বারটা দিবেন আন্টি? একটু কথা বলতাম আরকি!”
“কেন দেবো না? দাঁড়াও আমার ফোনটা নিয়ে আসি।”
তুর্যর গলা দিয়ে খাবার নামছে না। বুকের ভেতর মোচর দিচ্ছে। বুকটা জ্বালাপোড়া করছে। অন্যদিকে পরী গপাগপ খাচ্ছে। হেসে হেসে ভিডিও কলে সূর্যর সাথে কথা বলছে। তুর্য মনে মনে নিজেকে বোঝাচ্ছে,
“কাম ডাউন তুর্য! এত রেগে যাচ্ছিস কেন? এটাই তো হওয়ার ছিল। তুই তো পরীকে এরজন্যই রাজি করিয়েছিলি। এখন নিজেই সহ্য করতে পারছিস না?”

পায়ের নোখ দিয়ে ফ্লোর খোঁচাচ্ছে আর কাঁটাচামচ দিয়ে টেবিল খোঁচাচ্ছে।
সবার খাওয়া শেষ। যে যার মতো উঠে গেছে। শুধু তুর্য আর পরী আছে। পরী কলে কথা শেষ করে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে যখন আসা ধরে তখনই হাতে টান লাগে। তুর্য পরীর হাত টেনে ধরে রুমের ভেতর নিয়ে দরজা লক করে দেয়। পরী বলে,

“এটা কী হলো? আমাকে রুমে নিয়ে আসলেন কেন? আর দরজাই বা লাগালেন কেন? দুদিন পর যে আপনার ভাবী হবে তাকেই এভাবে রুমে নিয়ে আসতে লজ্জা করে না?”
তুর্য রাগে দেয়ালে একটা ঘুষি মারে। পরী থতমত খেয়ে বলে,
“আপনার দেয়াল ভাঙতে হলে ভাঙেন। কিন্তু আমাকে যেতে দেন।”
তুর্য পরীর গাল চেপে ধরে বলে,

“মেরে ফেলব একদম। ভাইয়ার সাথে হেসে হেসে এতো কীসের কথা তোমার?”
তুর্যর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পরী বলে,
“অদ্ভুত কথা বললেন তো। যার সাথে আমার বিয়ে হবে আমি তার সাথে কথা বলব না? আপনার সমস্যাটা কোথায় আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।”

তুর্য পরীকে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে। পরীর দুহাত বিছানার সাথে চেপে ধরে বলে,
“আমি এই বিয়ে হতে দেবো না। আমি এতো মহান হতে পারব না। শুধু ভাইয়ার সাথে কেন, আমি ছাড়া অন্য কারো সাথে তোমাকে সহ্য করতে পারব না। আমি মাকে সব বলে দেবো। সবাই মানলে মানবে আর না মানলে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাব।”

পরী নিজেকে ছাড়াতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। দাঁত কটমট করে বলে,
“একদম ন্যাকামি করবেন না আমার সাথে। আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইলেই হলো নাকি? বিয়ে করতে হলে আমি সূর্যকেই করব। আপনি যখন যা চাইবেন আমাকে তাই করতে হবে? তখন আপনার মনে হয়েছিল আপনি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন।

আপনার মায়ের কথা রাখা জরুরী তাই আমাকে ফিরিয়ে দিতেও দুবার ভাবেননি। আর এখন যখন আপনার জ্বলছে খুব তখন আমায় ছাড়া থাকতে পারছেন না। বিয়েটাও হতে দেবেন না বলছেন। আপনার কি মনে হয় আমি আপনার সব কথা শুনতে প্রস্তুত? আমার আত্মসম্মানবোধ নেই? আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। আমি আপনাকে বিয়ে করব না।”
তুর্য এক হাত ছেড়ে দিয়ে পরীর গালে থাপ্পড় দিতে যায়। পরী ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। পরীকে অবাক করে দিয়ে পরীর অধরে গভীর চুম্বন এঁকে দেয় তুর্য।

পর্ব ২৯

পরী নিজের সর্বোচ্চ শক্তি খাঁটিয়ে নোখ দিয়ে খামচি দেয় তুর্যকে। ধারালো নোখের খামচি খেয়ে ব্যথায় ছেড়ে দেয় পরীকে। পরী সেই সুযোগে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তুর্য পেছন থেকে হাত চেপে ধরে বলে,
“ভাইয়াকে বিয়ে করার ভূত মাথা থেকে নামিয়ে ফেলো।”
“কেন নামাব? এই ভূত আমার মাথায় ঢোকানোর আগে মনে পড়েনি?”
“আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি।”

“সেটা তো এখন আমার দেখার বিষয় নয়।”
তাহমিনা বেগমের ডাকে তুর্য পরীর হাত ছেড়ে দেয়। নিজেকে ঠিকঠাক করে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায় পরী।

ঠিক দুদিন পর বিয়ের দিন-তারিখ সব ঠিক করা হয়। সূর্য বলেছে এখন বিয়ের জন্য এতো আয়োজন করার দরকার নেই। কিন্তু পরী এটাই বুঝতে পারছে না সূর্য কেন এই বিয়েতে রাজি হয়েছে? এর উত্তর একমাত্র সূর্যই দিতে পারবে। পরী তৎক্ষণাৎ সূর্যকে ফোন দেয়। সাথে সাথেই ফোন রিসিভ করে সূর্য।
“কেমন আছো পরী?”
“সেটা কি আপনার অজানা?”
“এভাবে বলছ কেন?”

“আর কীভাবে বলব তাহলে? আপনার সাথে আমার কী কথা হয়েছিল? আপনি দেশে আসার পর দুজন মিলে বাড়িতে বুঝিয়ে বলব যে আমরা বিয়ে করব না। কিন্তু এখন দেখছি পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছে। রাত পোহালেই নাকি ভোরের ফ্লাইটে আপনি বিয়ে করতে আসছেন। এসবের মানে কী? আমি তো বলেছিলাম আমি অন্য একজনকে খুব ভালোবাসি। আর আপনিও নাকি তিরা ভাবীকে খুব ভালোবাসেন। তাহলে কোথায় গেল আপনার ভালোবাসা? কেন বিয়ে করছেন আমায়?”

এক দমে কথাগুলো বলল পরী। সূর্য খুব ঠান্ডা গলায় বলল,
“আমায় ক্ষমা করো পরী। আমি আসলে বুঝতেই পারছি না তোমার প্রতি আমার অনুভূতিটা কেমন। তবে সেজানের জন্য হলেও তোমাকে আমার প্রয়োজন। এখন না হয় বিয়ে করার জন্য কারণ হিসেবে এটাকেই ধরে নাও। আমাকে হয়ত এখন তোমার স্বার্থপরও মনে হবে। কিন্তু এছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।”

রাগে ফোন কেটে দেয় পরী। কী চেয়েছিল আর কী হচ্ছে।

তুর্য তাহমিনা বেগমের রুমে গিয়ে বলে,
“মা তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
“বল।”
“আমি পরীকে ভালোবাসি।”
তাহমিনা বেগম একদম চমকে উঠলেন। অবাক হয়ে বললেন,
“কী বললি? তুই পরীকে ভালোবাসিস?”

“হ্যাঁ। ভাইয়ার সাথে পরীর বিয়ে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারব না।”
“মাথা ঠিক আছে তোর? রাত পোহালেই সূর্যর সাথে পরীর বিয়ে। আর এখন এসব বলছিস আমায়?”
তুর্য তাহমিনা বেগমের হাত ধরে বলে,
“প্লিজ মা প্লিজ কিছু করো।”
তাহমিনা বেগম নিজের হাত ছাঁড়িয়ে নিয়ে বলেন,
“এমন কোনো বায়না করিস না যেটা আমি রাখতে পারব না।”

তাহমিনা বেগম তুর্যর আর কোনো কথা শোনেনি। তুর্য অনেকবার ফোন দিয়েছে পরীকে। কিন্তু ফোন বন্ধ। ফ্ল্যাটে গিয়েও লাভ হয়নি। পরীর রুম ভেতর থেকে লক করা। সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি তুর্য বা পরী। তুর্যর উপর পরীর রাগের পরিমাণ এখন পাহাড় সমান।
পরেরদিন পার্লার থেকে লোক এসে পরীকে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। সকাল থেকে তুর্যর দেখা পায়নি পরী। সূর্যর ফোনও নাকি বন্ধ পাচ্ছে। বিকেলের দিকে কোথা থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে বাসায় আসে তুর্য। সোজা পরীর রুমে যায়। পরীর হাত ধরে বলে,
“চলো আমরা এক্ষুণী চলে যাব এখান থেকে।”

রাগে তুর্যর হাত ঝেড়ে ফেলে দেয় পরী। রাগ আর কান্নার সংমিশ্রণ ফুঁটে উঠেছে পরীর চেহারায়। হিংস্র বাঘিনী মনে হচ্ছে। পরী চেঁচাতে চেঁচাতে বলে,
“তুই বের হ আমার রুম থেকে। কেন যাব আমি তোর সাথে? তুই তো এটাই চেয়েছিলি।”
তুর্যর পরিবার আর পরীর পরিবারের সবাই এখন পরীদের ফ্ল্যাটে উপস্থিত। পরী তুর্যর শার্টের কলার ধরে যা নয় তাই বলছে কাঁদতে কাঁদতে।

মামা এসে পরীকে টেনে সরায়। পরীর গালে হাত রেখে বলে,
“ঠান্ডা হ পরী। এমন পাগলামী করছিস কেন?”
পরী কোনো উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ পর তাহমিনা বেগমের ফোন বেজে উঠে। সূর্য ফোন করেছে। তাহমিনা বেগম ফোন রিসিভ করে বলেন,
“বল। কতদূর এসেছিস?”
“আমি আসব না মা।”
“আসবি না? কেন? বিয়ের এতো আয়োজন তাহলে?”
“বিয়ে হবে।”

“বিয়ে হবে? কিন্তু কার সাথে?”
“তুর্যর সাথে। পরী তুর্যকে ভালোবাসে। আর তুর্য পরীর থেকেও বেশি ভালোবাসে পরীকে। এজন্য আমি চাই পরীর সাথে তুর্যর বিয়ে হোক।”
তাহমিনা বেগম আর কিছু না বলে ফোন রেখে দেন। ফোন রাখার পর দুই পরিবারকেই সব বললেন। সবাই রাজি হয়। কিন্তু পরীর মাথায় এটা ঢুকছে না যে সূর্য কীভাবে জানলো পরী তুর্যকে ভালোবাসে? পরী তো তুর্যর কথা বলেনি। আর তুর্যও সূর্যকে কিছু বলেনি।
এতকিছুর পরও যে দুজন এক হবে এটাই এখন সবচেয়ে খুশির বিষয়। কিন্তু মাঝখানে একটা বিপত্তি বাঁধলো।

বিয়ে হওয়ার পর যখন তুর্য আর পরীকে এক রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে তখন সেজান তাহমিনা বেগমকে জিজ্ঞেস করেছে,
“মাম্মি কেন চাচ্চুর সাতে তাকবে? মাম্মি তো পাপাল সাতে তাকবে।”
সকলের মনে এতক্ষণ যেই ভয়টা ছিল ঠিক সেটাই হলো। বিয়ের আগেও পরী আর তুর্য বিষয়টা নিয়ে ভেবেছে। সেজানকে কী বলে বোঝাবে! কিন্তু কোনো উত্তর খু্ঁজে পায়নি। আর এখন তো সরাসরি প্রশ্নটা করেই বসল।

তাহমিনা বেগম বললেন,
“দাদুভাই তোমার মাম্মি যখন আকাশে গিয়েছিল তখন মুখ পাল্টে দিয়েছিল না? এখন তোমার মাম্মিকেও পাল্টে দিয়েছে। তোমার মাম্মিকে নিয়ে ওকে দিয়ে গেছে।”
“তাহলে ও আমাল মাম্মি নয়?”
“মাম্মি নয় তো কী? ও তোমাকে মায়ের মতোই ভালোবাসবে। তুমি ওকে মাম্মি বলেই ডাকবে।”
এতসব কথা ছোট্ট সেজানের বোধগম্য হয় না। পরী বলে,
“সেজানকে আমার কোলে দিন।”

পরী সেজানকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে বলে,
“আমি তোমার ছোট মাম্মি। তোমার চাচ্চুর বউ। কিন্তু তুমি আমাকে মাম্মি বলেই ডাকবে কেমন বাবু?”

পরীর কোলে গিয়ে সেজান শান্ত হয়ে যায়। সবাই চলে যাওয়ার পর তুর্য ফ্রেশ হয়ে নেয়। ওয়াশরুম থেকে এসে বলে,
“তুমি ফ্রেশ হবে না?”

পরী চোখ গরম করে বলে,
“আমাকে নিয়ে আপনার এতো ভাবতে হবে না।”
“এখনো রেগে আছো আমার উপর?”
“আমার রাগ নেই।”
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
পরী কোনো কথা না বলে সেজানকে শুইয়ে দিয়ে নিজে ফ্রেশ হয়ে নেয়। রুমে এসে দেখে সাইডে কোলবালিশ দিয়ে সেজানকে শুইয়ে দিয়েছে। মাঝখানে তুর্য। পরী বলে,
“সেজানকে সাইডে দিয়েছেন কেন?”

তুর্য একটু নড়েচড়ে বলে,
“আপনি আপনি করলে আমি কোনো উত্তর দেবো না।”
রাগ কন্ট্রোল করে পরী বলে,
“সেজানকে সাইডে দিয়েছ কেন?”
“দ্যাট’স লাইক অ্যা গুড গার্ল।”

বলে, আবার জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে,
“দ্যাট’স লাই অ্যা গুড ওয়াইফ।”
“ন্যাকামি বাদ দিয়ে যা জিজ্ঞেস করেছি তা বলো।”
“আরে কী বলব? তোমার আমার একটা প্রাইভেসি আছে না? তাই সেজানকে সাইডে দিয়েছি।”
“না। কোনো প্রাইভেসি নেই আমাদের। সেজানকে মাঝে দাও।”
তুর্য উঠে বসে বলে,
“তাহলে আমি কোথায় ঘুমাব?”
“তুমি সাইডে ঘুমাবে। নাহলে ফ্লোর আর সোফা তো খালিই পড়ে আছে। চাইলে সেখানেও শুতে পারো।”

“এহহ! তা হচ্ছে না। আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে তুমি মাঝখানে শোও। আমি এই সাইডে তারপর তুমি আর তারপর সেজান।”
পরী কিছু না বলে কোলবালিশ নিয়ে নিজের আর তুর্যর মাঝখানে দিয়ে সেজানকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল। তুর্য পরীর দিকে কাৎ হয়ে শুয়ে বলল,
“এটা কী হলো?”
পরী তুর্যর দিকে ঘুরে। তুর্যর উপর দিয়েই একটু এগিয়ে টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে দিয়ে বলল,
“যেটা হওয়ার ছিল সেটাই হলো।”

তুর্য কোলবালিশটা ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পরীর উপর এক হাত দেয়। পরী হাত সরিয়ে দিতেই তুর্য শক্ত করে জাপটে ধরে পরীকে। পরী দাঁত কটমট করে বলে,
“এভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছ কেন? আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
হাতের বাঁধনটা হালকা করল তুর্য। হুট করেই পরীর পেটে, কোমড়ে সুরসুরি দেওয়া শুরু করে তুর্য। পরীর রাগ হলেও এখন হাসি ছাড়া আর উপায় নেই। হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ। পরী কোনো রকমে বলল,
“সেজান জেগে যাবে। ছাড়ো।”
তুর্য সুরসুরি দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পরীর গলায় মুখ ডুবিয়ে বলে,
“যাও দিলাম না সুরসুরি। কিন্তু তোমায় ছাড়ছি না। আর ছাড়বোই বা কেন? আমার তুমিটা শুধু আমার হয়েই থাকবে।”
পরী কিছু বলল না কিন্তু মুচকি হাসল। যে হাসিটা তুর্যর দেখা হয়নি অন্ধকারে।

পর্ব ৩০

খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে সূর্য আর অর্পা। এতটা দিন একসাথে কাঁটিয়ে কখন যে সূর্যকে অর্পা ভালোবেসে ফেলেছে সেটা সে নিজেই জানেনা। কিন্তু এই ভালোবাসা এক পাক্ষিক। না কখনো অর্পা সূর্যকে ভালোবাসার কথা বলেছে আর না কখনো বুঝিয়েছে। বলেই বা লাভ কী? সূর্য তো শুধু তিরাতেই মগ্ন। সূর্যকে দেখলেই বোঝা যায় সূর্য কতটা ভালোবাসে তিরাকে। নিরবতা কাটিয়ে অর্পা জিজ্ঞেস করে,
“পরীর বিয়ে কি তাহলে তোমার ভাইয়ের সাথে হয়েছে?”

“হুম।”
“তুমি কী করে জানলে যে তুর্য পরীকে ভালোবাসে?”
সূর্য পাশে থাকা একটা বেঞ্চিতে বসে বলে,
“সেজান বলেছে।”

অর্পা অবাক হয়ে বলে,
“কী? সেজান বলেছে? কিন্তু কীভাবে সম্ভব এটা? অতটুকু একটা বাচ্চা!”
“অবাক আমিও হয়েছিলাম যখন ঐ ছোট্ট সেজানের মুখে শুনি তুর্য পরীকে ভালোবাসার কথা বলেছে।”

অর্পা সূর্যর পাশে বসে আগ্রহ ভরা কণ্ঠে বলে,
“একটু পরিষ্কার করে বলো না সব।”
“তুর্য যখন পরীকে বিয়ের বিষয়ে আমায় বলল। তার পরেরদিনই সেজান আমাকে বলে,
‘পাপা তোমালে একতা কতা বলি? ‘
‘বলো।’

‘চাচ্চু কেন মাম্মিল জন্য কাঁতে(কাঁদে)? মাম্মিও না চাচ্চুল সাতে অনেক ঝগলা কলে। চাচ্চু আমাল পায়েল কাতে শুয়ে কেঁতে কেঁতে বলে আমাল মাম্মিতে নাকি ভালোবাসে।’
আমি তো তখন ওর কথা শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।”
“হায় আল্লাহ্! তারপর? সেজানের পাশে কেউ ছিল না?”
“ছিল। পরীর মামা ছিল। মামার ফোন থেকেই ভিডিও কলে কথা হয়েছিল। পরে আমি মামাকে জিজ্ঞেস করেছি,
‘সেজান এসব কী বলছে মামা? ‘

‘ঠিকই বলছে সূর্য। পরী আর তুর্য দুজনই দুজনকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু তুর্য পরীকে বলেছে তোমায় বিয়ে করার কথা। তোমার মাকে নাকি তুর্য কথা দিয়েছে।’
‘মা বললেই তুর্যর সব শুনতে হবে? মাকে কেন বলে না যে পরীকে ভালোবাসে।’
‘আমিও তো সব জানিনা।’
‘আচ্ছা আমি দেখছি।’

ঐদিন মামার সাথে আর কোনো কথা বলিনি। তার আগে পরীর সাথে আমার কথা হয়েছিল যে, দেশে এসে এই বিষয় নিয়ে সবার সাথে কথা বলব। তখনও আমি জানতাম না ওদের সম্পর্কের কথা। পরী আমার সাথে অনেক হাসাহাসি করেই কথা বলত। আমি স্বাভাবিকভাবেই নিতাম। পরে তরী বলে যে তুর্যকে জ্বালানোর জন্য নাকি বলত। তরীও ওদের সম্পর্কের কথা সব জানতে পারে পরে। তখন মামাকে গিয়ে সব বলে।

মাকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছিল তুর্য যাতে পরী আমাকে বিয়ে করে। এজন্যই তুর্য কিছু করতে পারছিল না। পরে আমি, তরী আর মামা মিলে প্ল্যান করি ওদের সারপ্রাইজ দেবো। আর বিয়েটা ওদের দুজনেরই হবে। আমি মাকে বলি বিয়ের সব ব্যবস্থা করতে। ফোনও বন্ধ করে ফেলি। কারণ আমি জানতাম পরী আমায় ফোন করবে। বিয়ের কিছুক্ষণ আগে আমি মাকে ফোন করে সব বলি। আর তারপর তো তোমার সামনেই সব কথা হলো।”

“এতকিছু হয়ে গেল বুঝতেও পারলাম না! তবে এটা ভেবে ভালো লাগছে দুটো ভালোবাসার মানুষ এক হতে পেরেছে।”

“ওদের দুজনের জন্মই হয়েছিল দুজনের জন্য।”
“হুম।”
“আচ্ছা আজ তোমার কথা বলো তো। ডিভোর্স কেন হয়েছিল?”

অর্পা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
“ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। আমার হাজবেন্ডের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাই আমার বাড়ি থেকে ওকে মেনে নেয়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিই পালিয়ে যাব। করলামও তাই। দুজনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে সংসার শুরু করি। এক বছর ভালোভাবেই যায়। তারপর থেকেই ও পরিবর্তন হতে শুরু করে। অন্য মেয়েদের সাথে মেলামেশা শুরু করে।

এসব নিয়ে কোনো কথা বললেই আমায় মারধর করত। শারীরিক, মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে হতে বিরক্ত আর অতিষ্ঠ হয়ে উঠি আমি। সহ্য করতে পারছিলাম না আর। পরে দুজনের মতামতের ভিত্তিতেই ডিভোর্স হয়। তখন আমার করুণ অবস্থায় বাবা-মা মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারেনি। বাড়িতে চলে আসি। কিন্তু প্রতিবেশীদের কানাঘুষায় টিকতে পারছিলাম না। তাই এখানে চলে আসি।”
“মানুষের জীবন কতো রকমের হয় তাই না?”

“জীবন নয়। বরং আমি মনে করি মানুষই বিভিন্ন রকম হয়। কেউ ভালোবাসার পরও হারায়। আবার কেউ বা ভালোবাসার পর পরিবর্তন হয়। কেউ কেউ আবার সারাজীবন ভালোবেসেই পাশে থাকে।”
“নিয়তি বোঝা অতি সহজ নয়। কিছু জিনিস বোধ হয় কঠিনই ভালো।”
“হুম।”
“বাদ দাও এসব। চলো উঠি।”
সূর্য উঠে কয়েক কদম এগোয়। তখন অর্পা পেছন থেকে বলে,
“সূর্য সারাজীবন আমার পাশে থাকবে তো?”

সূর্য মুচকি হেসে বলে,
“বন্ধু হিসেবে সারাজীবনই পাশে আছি। কিন্তু ভালোবাসার জায়গায় তিরা ব্যতীত আর কাউকে মানতে পারব না। আমি এগোচ্ছি। তুমি আসো।”
অর্পা মনে মনে বলে,
“আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য।”

ব্যালকোনিতে বসে জয়ের কাঁধে মাথা রেখে দূরের আকাশ দেখছে সূচী। আগের ট্রমা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সূচী জয়ের হাত ধরে বলে,
“একটা গল্প শোনাও।”

“কী গল্প শুনবে?”
“জীবনের গল্প শুনতে চাই।”
“আমার জীবনের গল্প শুনবে?”
সূচী মাথা তুলে বলে,
“তোমার জীবনের গল্প?”

জয় হালকা হেসে সূচীর মাথা পূণরায় কাঁধে রেখে বলে,
“হ্যাঁ আমার জীবনের গল্প। রূপকথার মতোই সুন্দর ছিল সে সময়টা। খুব ভালোবাসতাম একজনকে।”
“ভালোবাসতে? কাকে?”
“পরীকে!”
“পরীকে?”

“হ্যাঁ পরীকে।”
“আমি কিছু বুঝতে পারছি না জয়। তুমি তো কখনো আমায় বলোনি এসব। আর পরীও তো কখনো আমায় বলেনি।”
জয় প্রথম থেকে সবটাই খুলে বলে সূচীকে। সব শুনে সূচীর চোখ দিয়ে পানি বের হয়। বুঝতে পারে শ্বাশুরীর পাপের ফল অনাগত বাচ্চাটাকে দিতে হয়েছে। জয় সূচীকে বুকে টেনে বলে,
“কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে আবার।”

সকালে তুর্যর ঘুম ভাঙে পানির ঝাপটায়। এক মুহূর্তের জন্য তুর্য চোখ বুজে অনুভব করেছে পরীর ভেজা চুলের পানি তুর্যর মুখে পড়েছে। কিন্তু চোখ মেলার পর সে ধারণা ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে, পরী একটা তোয়ালে ভিজিয়ে এনেছে। তোয়ালের পানি চিপরিয়ে তুর্যর মুখে ফেলছে। তুর্য সাথে সাথে লাফিয়ে বসে পড়ে। হাত দিয়ে মুখের পানি মুছে বলে,
“সকাল সকাল এটা কী করলে?”

“দেখোনি? আরেকবার করব?”
“ধুর! আনরোমান্টিক একটা বউ। আমি কল্পনা করলাম তোমার চুলের পানি বোধ হয় আমার মুখে এসে পড়েছে। আর চোখ মেলে দেখি সব উল্টা!”
“তোয়ালের পানি যে দিয়েছি এটাই তো তোমার ভাগ্য।”
“ভাগ্য না ছাই।”

“হু ছাই-ই। এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
তুর্য তখনও ঠায় বসে আছে। পরী রুম থেকে বের হওয়ার সময় তুর্য ভালো করে খেয়াল করে পরীকে। ডেকে বলে,
“তুমি অর্ধেক শাড়ি পরে কোথায় যাচ্ছো?”
“মায়ের কাছে।”

“কেন?”
“কেন মানে? দেখছ না আমি শাড়ি পড়তে পারি না। তাই মায়ের কাছে যাচ্ছি।”
“আমি তোমাকে আনরোমান্টিক কি এমনি এমনিই বলি?”
“কী করলাম আবার?”
“আমি থাকতে মায়ের কাছে কেন যাবে?”
“তুমি শাড়ি পরাতে পারো?”

“না পারি না। ইউটিউব আছে কী করতে?”
“ঢং বাদ দাও তো। আসছে ইউটিউব দেখে উনি আমায় শাড়ি পরিয়ে দিবে। এই আমি কি তোমার মতো বেক্কল? ইউটিউব দেখে যদি এতো সহজেই শাড়ি পরা শেখা যেত তাহলে তোমার আগে আমিই শিখতাম।”
“তুমি আমায় বেক্কল বললে? আমি বেক্কল?”
“সাথে গর্দভও তুমি।”

“অপমানের উপর অপমান। মিসেস পরী তুমি এখনো আমায় চিনতে পারোনি। আমি ইউটিউব না দেখেই তোমায় শাড়ি পরিয়ে দেবো। আসো।”

“বড় বড় বয়ান বাদ দিয়ে ফ্রেশ হও যাও। তারপর সেজানকে উঠিয়ে ফ্রেশ করিয়ে দাও।”
তুর্যর আর কোনো কথা না শুনে পরী সোজা নিজেদের ফ্ল্যাটে গেল। মায়ের কাছ থেকে শাড়ি পরে টেবিলে সবার জন্য খাবার সাজালো। সেজান দৌঁড়ে এসে পরীর শাড়ির আঁচল টেনে ধরে। পরী হেসে সেজানকে কোলে নেয়। সেজান পরীর গালে চুমু খেয়ে বলে,
“মাম্মি তোমালে অনেত সুন্দল লাগে।”

পরীও সেজানের গালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার লক্ষী বাবা!”
নাহিদা বেগম বলেন,
“তুর্যকে ডেকে আন। খেতে হবে তো। তোর শ্বশুর-শ্বাশুরী আর তরীকেও ডেকে আনিস”
“আচ্ছা।”

পরী নিচ তলায় গিয়ে সবাইকে খাওয়ার জন্য ডাকে। তরী এসে বলে,
“ভাবী ভাইয়া তোমাকে ডাকছে।”
“আচ্ছা তুমি আব্বু-আম্মুকে নিয়ে উপরে যাও। আমি আসতেছি।”
“আচ্ছা।”

পরী তুর্যর রুমে যাওয়ার সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে দেয় তুর্য। পরী বলে,
“দরজা লাগাচ্ছো কেন?”
তুর্য মিটিমিটি হাসতে হাসতে পরীর দিকে আগায়। পরী আমতা আমতা করে বলে,
“ভিলেনের মতো এভাবে আসছো কেন?”

“বাহ্! এখন আমি ভিলেনও হয়ে গেলাম? তাহলে তো ভিলেনের কাজ করতে হয়।”
“উল্টাপাল্টা কথা বাদ দিয়ে উপরে চলো। সবাই অপেক্ষা করছে।”
কে শোনে কার কথা! তুর্য পরীর কাঁধে হাত দিয়ে শাড়ির সাথে লাগানো সেফটিপিন খুলে। তারপর আঁচল টেনে শাড়িটা খুলে ফেলে। পরী চোখ বড় বড় করে বলে,
“কী করছ?”
“দেখোই না কী করি।”

তুর্য শাড়িটা নিয়ে পূণরায় পরীকে পরিয়ে দেয়। শাড়ি পরানো শেষে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলে,
“দেখো তো এই বেক্কল, গর্দভ ঠিকমতো শাড়ি পরাতে পেরেছে নাকি?”
পরী তুর্যার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“খুব সুন্দর পেরেছে।”

তুর্য পরীর কোমরে চেপে ধরে আরেকটু কাছে এনে বলে,
“স্বামী নামক এই ভিলেন শুধু বস্ত্রহরণ-ই করে না বরং বস্ত্র পরিয়েও দিতে পারে।”
পরী তুর্যর পায়ের উপর পা রেখে একটু উঁচু হয়ে তুর্যর নাকে নাক ঘষে বলে,
“উঁহু, ভিলেন না।”

“তাহলে কী?”
পরী এবার বাম চোখ মেরে গানের কলিটা বলে,
“তুই আমার হিরো, তুই আমার হিরো। বাকি সব জিরো।”
তুর্য হেসে পরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

পর্ব ৩১

নিজের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিচ্ছে পরী। এখন থেকে তুর্যদের বাড়িতেই থাকবে। যদিও পরী প্রথমে আপত্তি করেছিল। কিন্তু তুর্য বলেছে প্রতি বৃহস্পতিবার এই বাড়িতে নিয়ে আসবে। আর শুক্রবার বিকেলে আবার নিয়ে যাবে। নাহিদা বেগমও অনেক বুঝিয়ে, শুনিয়ে রাজি করিয়েছে। তুর্য পরীদের ফ্ল্যাটে এসে নিশাতকে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার আপু কোথায়?”

“আপু তো রুমে।”
“আচ্ছা।”
তুর্য এবার পরীর রুমে যায়। পরী তখন কাপড় গোছাচ্ছিল। তুর্য বলে,
“পরী নিচে চলো।”
“কেন?”
“আগে চলো তো।”

তুর্য এক প্রকার প্রায় পরীর হাত ধরে টেনেই ওদের ফ্ল্যাটে চলে যায়। ড্রয়িংরুমে গিয়ে বেশ অবাক হয় পরী। ওর বড় বোন এসেছে। সাথে নিহালও আছে। আরো বেশি অবাক হয় নিহালের সাথে ঐ মেয়েটাকে দেখে। যেদিন রাস্তায় মেয়েটা ও তার বাবাকে অপমান করেছি নিহাল ও তার লোকজন। পরীর বড় বোন পিংকি এসে পরীকে জড়িয়ে ধরে। পরীর হুশ ফিরে তখন। কতগুলো দিন পর বোনের সাথে দেখা। সেই যে বাবা মরার পর একবার দেখা হয়েছিল আর আজ দেখা হলো। দুজনের চোখেই পানি টলমল করছে। পরী বলে,
“আমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো তোর?”

“রাগ করিস না আমার লক্ষী বোন। আমার শ্বশুরবাড়ির কথা সবই তো জানিস তুই।”
“বাদ দে এসব। দুলাভাই কোথায়? আর পুচকুটা কোথায়?”
“বাবু কান্না করছিল তাই ওকে নিয়ে দোকানে গেছে।”
“ওহ্। ঐ লোকটা কেন এসেছে?”
পিংকি পরীর চোখ লক্ষ করে পেছনে তাকায়। পরী নিহালকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছে। পিংকি বলে,
“পরী আমার কথা শোন। এখানে উল্টাপাল্টা কিছু বলিস না।

“কী কথা শুনব আমি? কেন নিয়ে এসেছিস তাকে?”
নিহাল মাথা নিচু করে বসে আছে। নিহালের পাশে বসে থাকা মেয়েটা নিহালের হাত ধরে পরীর সামনে নিয়ে আসে। মেয়েটা বলে,
“আমায় চিনেছ?”
“হু। কিন্তু তুমি এখানে কেন?”

“পরী সেদিনের ঘটনার পর তোমার ভাই আমার কাছে মাফ চায়। শুধু আমার কাছেই না আমার বাবার কাছেও মাফ চায়। সব খারাপ কাজ ছেড়ে দিয়ে আমায় বিয়ে করতে চায়। তার পরিবর্তনের কারণ শুধু আমিই ছিলাম না বরং তুমিও ছিলে। পরবর্তীতে আমার পরিবার রাজি হলে আমরা বিয়ে করি। তোমার ভাই সবসময় শুধু তোমার কথা বলতো আর কাঁদতো। অনুতপ্ত হতো প্রতিনিয়ত। তোমার ভাইকে কি মাফ করা যায় না?”
পাশের রুম থেকে নাহিদা বেগম এসে বলেন,
“ওকে ক্ষমা করে দে মা।”

“তুমি এখানে? ভাইয়া আগেই তোমার সাথে দেখা করেছে?”
“আমি কী করব বল? আমি তো মা। সন্তান হাজার অন্যায় করলেও মা মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারে না। ও যখন আমার পা ধরে কেঁদে মাফ চাইল তখন আমিও মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারিনি।”
তুর্য পরীর কাঁধ ধরে বলে,

“মানুষ মাত্রই তো ভুল পরী। যে ভুল হয়ে গেছে সেটা তো আর সংশোধন করা সম্ভব না। কিন্তু এখন যখন নিজেকে সে শুধরিয়ে নিয়েছে তখন তোমার উচিত তাকে ক্ষমা করে দেওয়া।”
“কী করে ক্ষমা করব বলো তো? পরবর্তীতে যে এই লোকটা মায়ের সাথেও একই কাজ করবে না তার কী গ্যারান্টি আছে?”

নিহাল মেঝেতে বসে পরীর পা পেঁচিয়ে ধরে বলে,
“আমায় একটা সুযোগ দে না বোন। আমি তোদের জন্য সব ছেড়ে দিয়েছি। আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। আমাকে একটা সুযোগ দে ভালোভাবে বাঁচার। আমি তোদের সবাইকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে চাই বোন।”

পরীর চোখে পানি আসলেও তা মাটিতে পড়তে দেয় না। নিহালকে তুলে বলে,
“মনের ভেতর যে দাগ হয়ে গেছে সেই দাগ তুলে ফেলা কঠিন। তবে আমি তোমাকে একটা সুযোগ দিতে চাই। কিন্তু তুমি যদি একই ভুল আবারও করো কখনো তাহলে সেদিন থেকেই তুমি আমার কাছে মৃত হয়ে যাবে।”
নিহাল চোখের পানি মুছে পরীকে জড়িয়ে ধরে। সবাই এবার কেঁদে ফেলে। নিহাল কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আর কোনো ভুল হবে না রে।”

সব মান-অভিমান শেষ হওয়ার উপলক্ষে মামা সবার খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অনেক সময় পর সবাই একসাথে সময় কাটাচ্ছে। পরিবারের মানুষজন আবার একসাথে হয়েছে। বিকেলের দিকে পরীকে বিদায় দেওয়া হয়। যাওয়ার কালে সবার চোখেই ছিল পানি। নিশাত কেঁদেছে সবচেয়ে বেশি। পরীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছে,
“আপুরে তোরে খুব মিস করব। আমায় ভুলে যাবি না তো?

পরী নিশাতের কপালে চুমু খেয়ে বলেছে,
“না সোনা। আমার কলিজাকে আমি কীভাবে ভুলব? স্কুল থেকে ছুটি পেলেই আমার কাছে চলে আসবি। আর আমি তো প্রতি সপ্তাহে আসবোই।”
পরী মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,
“তুমি কিন্তু একদম চিন্তা করবে না। সময় মতো ওষুধ খাবে। নানুর খেয়াল রাখবে।”
নাহিদা বেগম কেঁদে বলেছেন,
“রাখব মা। তুইও তোর খেয়াল রাখবি। সবার সাথে মিলেমিশে থাকবি।”
পরী নানুকে বলে,
“নানু তুমিও চলো না আমার সাথে।”

নানু পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে,
“নারে নানুভাই। আমি যাইয়া তোর সতীন হইতে পারুম না। আমি গেলে তোর নায়ক পরে তোরে চিনবই না।”

পরী এবার হেসে ফেলে। নানুর হাত জড়িয়ে চুমু খায়। পরী নিহালের উদ্দেশ্যে বলে,
“তোর হাতে আমার পরিবারের দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। বলতে পারিস আমানত। আমানতের খেয়ানত করিস না। সবাইকে ভালোবেসে পাশে থাকিস।”
“থাকব রে পাগলী।”
পরী ওর ভাবীকে বলে,
“তোমার নামটাই তো জানা হলো না।”
“হাসি।”
“তোমার কাছে আমার ভাইর দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। সবসময় ভালোবেসে ওর পাশে থেকো। সকল খারাপ কাজ থেকে ওকে দূরে রেখো। পারবে তো?”
হাসি মৃদু হেসে বলে,
“পারব।”

পরী এবার মামাকে জড়িয়ে ধরে। বলে,
“তোমার জন্যই বোধ হয় তুর্যর আর আমার এক হওয়া হলো মামা। সূর্য আমায় সব বলেছে। সেজান আর তোমার অবদান আমি ভুলব না।”
মামা পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে,
“পাগলী মেয়ে আমার! মেয়ের জন্য এতটুকু করব না তো কার জন্য করব?”
“লাভ ইউ মামু।”
“লাভ ইউ টু মাই ডটার।”

গাড়িতে বসে সবাই অপেক্ষা করছিল। তুর্য সবার সাথে কুশলবিনিময় ও কদমবুসি করে পরীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে। পরী গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে সবাইকে হাত নাড়িয়ে বিদায় দেয়।
গাড়ি চলতে থাকে তার আপনগতিতে। তুর্য শক্ত করে পরীর হাত চেপে ধরে রেখেছে। গাড়ি যখন বাড়ির সামনে থামে তখন পরী অবাক হয়ে যায়। বিশাল আলিশান বাড়ি তুর্যদের। এই বাড়ি রেখে এতটাদিন সবাই ছোট্ট ফ্ল্যাটটাতে থেকেছে। ওদের মন অনেক পরিষ্কার সেটা স্বীকার করতেই হবে। করো মধ্যে বিন্দু পরিমাণ অহংকার নেই। বাড়িতে ঢুকে তাহমিনা বেগম বলেন,
“তুর্য তুই পরীকে রুমে নিয়ে যা। দুজনই ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়। আমি খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।”

তুর্যর রুমে গিয়ে আরেক দফা অবাক হয় পরী। অনেক পরিপাটি করে সাজানো তুর্যর রুম। বিছানার পাশেই রয়েছে গিটার। তুর্য যেই সুন্দর গান গায় তাতে গিটার থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। বরং রাতে গান শোনা যাবে। পরী আগে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে যায়। তাহমিনা বেগম রান্না করছিলেন। পরীকে দেখে বলেন,
“একি তুমি রান্নাঘরে কেন?”
“আমার বারণ আছে রান্নাঘরে আসা?”

“আরে না। সেটা বলিনি। মাত্রই গোসল করলে। এখন রান্নাঘরে আবার ঘেমে যাবে।”
“কোনো সমস্যা নেই। প্রয়োজনে আবার গোসল করব। এখন বলেন কী সাহায্য করব আপনাকে?”
“কোনো সাহায্য করতে হবে না। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখ।”
“তা কী করে হয়? আমি বরং তরকারি কেটে দেই। আপনি রান্না করুন।”
তাহমিনা বেগম হেসে বলেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে। কাল থেকে আর আমাদের রান্না করতে হবে না। এই কয়দিন কেউ বাড়িতে ছিল না বলে কাজের লোকদের ছুটি দিয়েছিলাম। কাল থেকে সবাই আসবে।”
“কিন্তু সকালের রান্নাটা আমি করতে চাই মা। বাড়ির বউ হয়ে রান্না করব না তা কী করে হয়?”
“কে বলল তুমি এই বাড়ির বউ?”

তাহমিনা বেগমের কথা শুনে পরী অবাক হয়ে যায়। এটা কী বলছেন উনি! পরীকে ঘাবড়ে যেতে দেখে উনি শব্দ করে হেসে বলেন,
“তোমাকে দেখতে এখন দারুণ লাগছে।”
হাসি থামিয়ে আবার বলেন,
“তুমি এই বাড়ির বউ না। এই বাড়ির মেয়ে।”

পরী হাফ ছেড়ে বাঁচল। বলল,
“আমি মা হতে পারব না জেনেও আমায় মেনে নিলেন? তাও আবার নিজের মেয়ের মতোই?”
এবার যেন উনার মুখটা একটু মলিন হলো। বলল,
“এখানে তো তোমার কোনো দোষ নেই। কিছু করারও নেই তোমার। যা হওয়ার তা হবেই। তাছাড়া সেজান আছে তো। তুমি তো ওকে মায়ের থেকে কম ভালোবাসো না।”
পরী তরকারি কাটতে কাটতে বলে,
“একটা কথা বলব মা?”
“বলো।”

“আপনরা একটা সত্যি জানেন না এখনো।”
“কী সত্যি?”
“আমি মা হতে পারব।”
তিনি অবাক হয়ে বলেন,
“সত্যি বলছ তুমি?”

“হুম।”
খুশিতে আত্মহারা হয়ে তিনি বলেন,
“আল্লাহ্! এইটা কী শুনালে তুমি আমায়। তুর্য জানে?”
“না। এখনো বলিনি। সময়, সুযোগ বুঝে বলব।”
শ্বাশুরী হেসে বলে,
“বুঝি বুঝি। সারপ্রাইজ দেবে তাই না?”

পরী লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। তিনি বলেন,
“তাহলে সেদিন যে বলেছিলে তুমি মা হতে পারবে না।”
“সব ছিল আমার খালার চক্রান্ত। তিনিই এই মিথ্যাটা রটিয়েছে।”
“মানুষ কত জঘন্য হয় ছিঃ!”

“বাদ দেন মা। তার কথা তুলে আমাদের ভালো মুহূর্তগুলো নষ্ট করতে চাই না।”
রাতে সবাই একসাথে ডিনার করতে বসে। পরী সেজানকে কোলে নিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে। খেতে খেতে তুর্য বলে,

“তোমার আর চাকরী করার দরকার নেই। এখন থেকে নিয়মিত ভার্সিটিতে যাবে। মাস্টার্স কমপ্লিট হওয়ার পর যদি চাকরী করতে চাও তাহলে করতে পারো।”
তুর্যর বাবা বলেন,
“তুর্যর সাথে আমি একমত।”
“কিন্তু বাবা, আমি নিজের একটা পরিচয় করতে চাই।”
তাহমিনা বেগম বলেন,

“সেটা তো মাস্টার্স কমপ্লিট করার পরও করতে পারবে। এখন তোমার পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া উচিত। তুমি আবার ভেবো না আমরা তোমার স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছি। আমরা চাচ্ছি তুমি শক্তপোক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হও। এখন তো তোমার ভাই আছেই তোমার মা আর ভাইকে দেখার জন্য। আর তুর্যও আছে। তুমি যেমন এই বাড়ির মেয়ে। তেমনি তুর্যও ঐ বাড়ির ছেলে। তুর্যরও এখন থেকে দুটো পরিবার আর তোমারও। দুই পরিবারের সমস্যাই তোমরা দেখবে। আমরা আর কত সামলাবো? এখন থেকে সব দায়িত্ব তো তোমাদেরই পালন করতে হবে।”
পরী কী বলবে বুঝতে পারছে না। কখনো যে পরী এতো সুখের দেখা পাবে এটা কল্পনায়ও ভাবেনি। আল্লাহ্-র কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করছে পরী।

রাতে ঘুমানোর সময় সেজানকে নিজের কাছে নিয়ে যায় তাহমিনা বেগম। হয়তো তুর্য আর পরীকে একান্ত সময় দেওয়ার জন্যই। রুমে ঢোকার আগে তরী পথ আটকে বলে,
“টাকা না দিলে ভেতরে ঢুকতে দেবো না।”
তুর্য বলে,
“কীসের টাকা?”
“সেটা ভেতরে গেলেই দেখতে পাবে।”
“কোনো টাকা নাই। যা ভাগ।”
“দেখো না ভাবী, ভাইয়া কেমন কিপ্টামি করে।”

পরী বলে,
“তুমি এমন কিপ্টা হলে কবে থেকে? দেখি ওয়ালেট দাও তাড়াতাড়ি।”
“ওর সাথে সাথে তুমিও বাচ্চা হলে নাকি?”
“কথা না বলে ওয়ালেট দাও।”
তুর্য পরীর হাতে ওয়ালেটটা দেয়। পরী তরীর হাতে ওয়ালেট দিয়ে বলে,
“পুরো ওয়ালেটই তোমার যাও।”
তুর্য বলে,
“আরে কী করছ?”

তরী ওয়ালেট থেকে এক হাজার টাকার তিনটা নোট নিয়ে বলে,
“এত লাগবে না ভাবী। তিন হাজারই অনেক।”
ওয়ালেট তুর্যর হাতে দিয়ে ভেংচি কেটে বলে,
“ভাবীর মতো একটু উদার হতে শেখ।”
তুর্য দৌঁড়ানি দিতেই তরী দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।

পরী আর তুর্য হেসে রুমে ঢুকে। পুরো রুম অন্ধকার। তুর্য বলে,
“পাজিটা রুম অন্ধকার করে তিন হাজার টাকা মেরে দিল।”
তুর্য হাতিয়ে হাতিয়ে রুমের লাইট অন করল। লাইট অন করতেই দুজনের চোখ ছানাবড়া। পুরো খাট ফুল দিয়ে সাজিয়েছে। এতটুকু সময়েই কী সুন্দর করে সাজিয়েছে! ফুলের গন্ধে ঘর ভরে গেছে। তুর্য পেছন থেকে পরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“চলো ফুলসজ্জাটা সেড়ে ফেলি।”

“মুখে ব্রেক নেই?”
“এত ব্রেক কষলে ভালোবাসায় ঘাটতি হবে।”
“হপ।”
“তুমি হপ।”
“একটা কথা বলব।”

“এখন কোনো কথা শুনব না।”
“ভালো কথা।”
“না। কোনো কথাই না।”
তুর্য পরীকে পাঁজাকোলে নিতেই পরী তুর্যর গলা জড়িয়ে ধরে। কানে ফিসফিস করে বলে,
“একটা সত্যি কথা বলি। সম্পূর্ণ কথাটা কাল খুলে বলব। আমি মা হতে পারব।”
শেষের কথা শুনে তুর্য অবাক হয়ে যায়। সেই সাথে খুশিতে চোখ দুটো খুশিতে চিকচিক করে উঠে।
“সত্যি বলছ? আমি বাবা হতে পারব?”
পরী লজ্জামাখা মুখে বলে,
“হুম।”
খুশিতে ভালোবাসার পরশ দেয় পরীর কপালে। ভালোবাসায় মেতে উঠে দুজন।

সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে তুর্য। পরী সেজানকে কোলে নিয়ে রুমে এসে বলে,
“আজ আসবে কখন?”
“কেন আমায় ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়?”

“কচু।”
তুর্য হাসে। সেজানকে চুমু খেয়ে বলে,
“তাড়াতাড়িই ফিরব।”
সেজানের চোখের উপর হাত রেখে পরীর গালে চুমু খেয়ে বলে,
“টাটা।”
পরী তুর্যর কান্ডে হেসে ফেলে।

“আল্লাহ্ হাফেজ।”
সেজানও হাত নাড়িয়ে তুর্যকে টাটা দেয়।

সকালটা কাটাল শ্বাশুরীর সাথে গল্প করতে করতে। তুর্য, শ্বশুর, তরী ওরা বাসায় নেই। গল্প করতে করতেই সেজান আবার ঘুমিয়ে যায়। সেজানকে শুইয়ে দিয়ে এসে কিচেনে যায়। কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুঁজে দুপুরের রান্না বসায়। তাহমিনা বেগম এতবার না করার পরও শোনেনি। মাত্র ভাত বসিয়েছে তখনই ড্রয়িংরুম থেকে শ্বাশুরীর ডাক আসে। পরী তার কাছে যেতেই তিনি বলেন,
“ফ্রেশ হয়ে অফিসে যাও তো।”
“কেন মা? কোনো সমস্যা?”

“না। তুর্য যেতে বলল।”
“ওহহ ঠিক আছে।”
পরী ফ্রেশ হয়ে অফিসে চলে গেল। তুর্যর কেবিনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“হঠাৎ অফিসে আসতে বললে যে?”
তুর্য পরীর কথার উত্তর না দিয়ে পিএকে ডেকে বলে,
“ওয়েটিং রুমে যে অপেক্ষা করছে তাকে ভেতরে পাঠান।”

“ওকে স্যার।”
প্রায় মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একজন মহিলা কান্নারত অবস্থায় ভেতরে ঢোকে। তাকে চিনতে কষ্ট হয় না পরীর। ইনিই জয়ের মা। উনি কাঁদতে কাঁদতে পরীর পা ধরে বলেন,
“আমায় সাহায্য কর মা। তুই ছাড়া আর কেউ নেই আমাকে সাহায্য করার।”
পরীর মনে পড়ে সেইদিনের কথা। পরী বলেছিল এমন না হয় একদিন পরীর পায়ে ধরতে হয় তার। সেইদিন টা যে এত তাড়াতাড়ি আসবে সেটা তো ভাবেনি পরী। পরী জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে?”

তিনি কাঁদতে কাঁদতেই বলেন,
“তোর খালুর কিডনি নষ্ট হওয়ায় বাড়ি বন্ধক রেখেছিলাম। জমি বিক্রি করেও টাকা শোধ করতে পারছি না। জয়ও আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি যে ওর কাছে চাইব। এইদিকে এখনো তোর খালু হাসপাতালে। টাকার অভাবে হাসপাতালের সব বিল পরিশোধ করতে পারিনি।”
“এখন আমি কী করতে পারি?”

“এমনভাবে বলিস না রে মা। আমি অন্যায় করছি জানি। আমায় মাফ করে দে মা। সাহায্য কর আমায়।”

পরী তুর্যর দিকে তাকায়। তুর্য একটা চেক পরীর দিকে এগিয়ে দেয়। পরী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তুর্যর দিকে তাকায়। তুর্য চোখের ইশারায় বলে,
“পরে বলছি।”
পরী বলে,
“তোমাকে তো আমি কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারব না খালা। তবে খালুর উপর আমার কোনো রাগ নেই। তোমাকে সাহায্য করার মতো ক্ষমতাও আমার নেই। তবে আমার জীবনে এমন একজন মানুষকে পেয়েছি যাকে পেয়ে আমি ধন্য। আমি না পারলেও সে তোমায় টাকা দিয়ে সাহায্য করছে।

অথচ এই টাকার জন্যই তুমি কী পরিমাণ নাটকই না করেছিলে! দেখলে তো প্রকৃতি কীভাবে তার প্রতিশোধ নেয়? এই চেকে এক লক্ষ টাকার এমাউন্ট আছে। এটাতে হয়ত তুমি তোমার বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তবে খালুকে হাসপাতাল থেকে আনতে পারবে। অহংকার পতনের মূল এটা তোমার বোঝা উচিত। গরীবরাও মানুষ এটা তোমার বোঝা উচিত। সময় সবার একরকম যায় না এটাও তোমার জানা দরকার। এই চেকটা নিয়ে এখন তুমি আসতে পারো।”
তিনি চেকটা নিয়ে হাত জোড় করে বলেন,
“পারলে মাফ করে দিস আমাকে।”

কাঁদতে কাঁদতেই তুর্যর কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। তুর্য এসে পরীর হাত ধরে হাতের পিঠে চুমু খায়। বলে,
“অতীতকে চিরতরে মুছে ফেলো। চাইলেও হয়ত সব ভুলে যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু চাইলেই ভালো থাকা সম্ভব। তোমাকে নিয়ে আমি ভালো থাকতে চাই পরী।”
পরী তুর্যকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“হয়তো কোনো পূণ্যর ফল হিসেবেই তোমাকে পেয়েছি। ভালোবাসি তোমায়। সারাজীবন এভাবেই ভালোবাসব। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।”
“আমিও ভালোবাসি আমার তুমিকে। পাশে থাকব প্রতিটা সেকেন্ড।”

লেখা – মুন্নি আক্তার প্রিয়া

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “আমার তুমি (সিজন ৩: শেষ খণ্ড) – Romantic premer golpo bd” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – আমার তুমি (সিজন ৩: ১ম খণ্ড) – Romantic premer golpo bd

এই সিরিজের এখানেই পরিসমাপ্তি। ভালো থাকবেন সবাই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *