বাসর ঘরের ইতিকথা – Basor Raat Love Story

যেই পাত্রপক্ষের পরিবার ভরা রেস্টুরেন্টে দেখতে এসে আমাকে অপমান করে নিজের বড় ছেলের পাত্রী হিসেবে অযোগ্য বলে রিজেক্ট করে দিয়েছিলেন আজকে ভাগ্যক্রমে তারদের পরিবারেরই ছোট ছেলের বউ আমি। এই জিনিসটা আমি কোনো দিনও চাইনি না আমি ভেবেছিলাম ও। ইরাদের মা বাবা তারাই এটা আমার জানা ছিলো না, জানা থাকবেই বা কি করে? কখনো ইরাদের পরিবার নিয়ে আমি বা আমার পরিবার নিয়ে ইরাদের কথা হয়নি।

৩ ঘন্টা আগেও সব ঠিকঠাক ছিলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব এলোমেলো হয়ে গেছে,, এই সময় গুলো যেন আমার জন্য বিষের মতন কাটছে, যদি সময়টা পেছনে নিয়ে ৩ ঘন্টা আগের থেকে মনে করতে যাই তাহলে সেই সময়টা এমন ছিলো-
ইরাদ আর আমি আমার রুমে ছিলাম তখন কে যেন এসে দরজায় কড়া নাড়ে,
আমি ভেতর থেকে তাকে বললাম রুমে প্রবেশ করতে, দেখি সম্পা এসছে তার মুখে হাসি আর বললো,

  • সরি সরি সরি আমি চাচ্ছিলাম একটু দেখতে যে তুই ভাইয়াকে ভালোবাসিস কতটুকু তাই বলিনাই পাত্র ভাইয়া নিজেই। আর ওই লোকটা ভাইয়ার অফিসের ম্যানেজার। কারণ যেই সময় তুই চা নাস্তা নিয়ে আসছিলি তখন ভাইয়া ছাদে গেসিলেন একান্তে তার বড় ভাইকে ফোন করার জন্য তোদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে,, উনি যাতে সবটা ম্যানেজ করে দেন এই কথা গুলো বিস্তারিত আলাপ করতে আর এমন সময়ই উনার ম্যানেজার আসে আর তুই ভেবেছিলি ওই লোকটা কি না পাত্র।
    আমি পুরোই বোকা হয়ে গেলাম আর লজ্জাও লাগছিলো ইরাদের সামনে, আমি সম্পাকে চোখের ইশারা দিয়ে মানা করলাম এগুলো বলতে কিন্তজ ও বলেই যাচ্ছিলো,,
    তখন সম্পা কপাল কুচকে ইরাদকে জিজ্ঞেস করে
  • কিন্তু ভাইয়া তুর্য স্যারের কেসটা তো বুঝলাম না কাহিনি কি?
  • ওকে বলছি,
    আমি ওদের দেখছি আর ভাবছি কতশত জিনিস মাথায় রেখে দিসে দুই জন মিলে আর আমি নতুন নতুন রহস্য জানতে পারছি এখন সব শুনে,
    ইরাদ বলতে শুরু করলো,
  • যেদিন প্রথম তোমাদের ভার্সিটি যাই সেদিনই রুহির কথা বলি তুর্যকে, ও বললো মেয়েটা অনেক চুপচাপ আর ভালো, আরো প্রশংসা করলো। আমার কথায় তুর্য বুঝতে পেরেছিলো রুহিকে আমি পছন্দ করি।
    আর সে রাতেই রুহির পরিবার ও তুর্যর পরিবার দেখা করেন আর এমনতেও, তুর্য তনিমা আপুকে ভালোবাসে ও তো রুহিকে বিয়ে করবে না কিন্তু রুহির যেন অন্য কোথাও বিয়ে ফিক্স না হয় এইজন্য তখন ও বলে মেয়ে পছন্দ হয়েছে।
    আর পরে ওর আপুর বিয়ের সময় আংকেল আন্টিকে সবটা খুলে বলে এরপর তো ওর ও বিয়ে হয়ে গেলো।
  • যাক ভাইয়া বাচা গেলো ভাইয়া, সব ভালো যার শেষ ভালো তার।
  • হ্যাঁ এখন শুধু মা বাবা যেন আমাদের মেনে নেয় এটাই চাচ্ছি।
  • আর যদি না মেনে নেয়? আমি করুন চোখে জিজ্ঞেস করলাম ইরাদকে, আমার চোখ মুখ একদম শুকিয়ে গেছে
    ইরাদ আমার কাছে এসে গালে হাত দিয়ে বলে,
  • ভাইয়া আমাকে সাপোর্ট করবে আর আমরা দু জন মিলে মা বাবাকে মানিয়ে নিবো ইনশাআল্লাহ। তুমি ভয় পেও না।
    বিদায়ের মুহুর্ত ঘনিয়ে এলো, কান্না করলাম মামা মামি তামিম কে রেখে যেতে কষ্ট হচ্ছিলো তবুও যেতে তো হবেই। আমাদের সাথে মোহিত ভাই আর সম্পা গেলো আমার শ্বশুর বাড়িতে। আমরা যাওয়ার পরে গেইট খুলে দিলো আমার ভাশুর অর্থাৎ ইরাদের বড় ভাই। তাকে দেখে আমি ভুত দেখার মতন অবাক হই কারন তিনি অন্য কেউ নন বরং আমাকে ৯বম বার রিজেক্ট করা পাত্র ছিলেন যার মা আমাকে অকথ্য ভাষায় অপমান করেছিলেন আর সে চুপচাপ বসে বাধ্য বাচ্চার মতন শুনছিলেন, আমাকে অপমান করার কারণ একটাই ছিলো আমার মা বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আর আমার মতন মেয়ে ইরাদের মা তার ত্রিসীমানায় দেখতে চান না। সব গুলো কথা আমার কানে বারবার বারি খাচ্ছিলো,,
    আমি যেমন অবাক হয়েছি ঠিক তেমনি অবাক ইরাদের বড় ভাই ইফাদ ও হয়েছেন,
    আমাকে দেখে সে জিজ্ঞেস করলো,
  • ইরাদ উনি তোর ওয়াইফ?
  • হ্যাঁ ভাইয়া, কিন্তু তুমি এত অবাক কেন?
  • আগে থেকে উনাকে চিনি তাই
  • কিভাবে?
  • মা বাবা একটা মেয়ে দেখতে গিয়ে কথা কাটাকাটি হলো না তুই বাংলাদেশে ফেরার আগের দিন?
  • হ্যাঁ বলেছিলা
  • মেয়েটা উনিই ছিলো
  • শিট
    সম্পা আর মোহিত ভাইয়া ও বোকা হয়ে গেলো এই কাহিনি দেখে। আমি তাদেরকে চলে যেতে বললাম জোর করে কারণ আমি জানি আমার শ্বাশুড়ি এখন অন্য রকম ব্যাবহার করবে আর সম্পা এসব দেখলে একটা না একটা উত্তর করে ফেলবে তখন আবার সমস্যা হয়ে যাবে। তারা যাওয়ার পরেই আল্লাহার নাম নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করালাম,,
    আমাকে দেখে ইরাদের মা চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলেন আরও নোংরা কথা বলা শুরু করলেন। আমি নাকি ইচ্ছে করে উনার ভোলাভালা ছেলেকে আয়ত্ত করে বিয়ে করেছি। আমার আর আমার পরিবারের মিলে এসব প্ল্যান ছিলো আমি চুপচাপ এক কোণায় দাড়িয়ে কথা গুলো শুনছিলাম মাথা নিচু করে।
    ইরাদ অনেক চেষ্টা করে তাকে মানানোর কিন্তু সে মানতে চায় না একটা সময় সে উঠে এসে আমাকে টানতে টানতে গেইটের বাইরে বেড় করে দিতে চাইলেন তখন ইফাদ ভাই আর ইরাদ এসে তাকে থামালেন। অনেক বুঝানোর পরে সে বললেন, ইরাদকে সে মাফ করে দিবে যদি আমাকে যেভাবে নিয়ে আসছে সেভাবেই বাড়িতে দিয়ে আসে। আমার খুব ভয় হচ্ছিলো তখন, কিন্তু ইরাদ আমাকে ছাড়ে নি ও বলেছে ওর শেষ কথা আমাকে ছাড়বে না। তখন ওর মা আমাদের বাসা থেকে বেড় করে দেন রাতের বেলায়ই। খুব খারাপ লাগছিলো তবে ইরাদের বাবা কোনো খারাপ কথা বলেনি আমাদের আর বলেন কোনো দিন কোনো সম্পর্ক রাখবে না আমাদের সাথে। আমি ভয়ে ইরাদের হাতটা শক্ত করে ধরি৷ ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ভয় পেয়ো না একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
    এরপর সে রাতে আমরা একটা হোটেলে উঠি,, তারপরের দিনই ইরাদ একটা বাসার ব্যাবস্থা করে আর এদিকে সম্পা মামা মামিকে সে রাতের কথা খুলে বলেন। মামা প্রথমে আমাকে ছাড়িয়ে আনতে চেয়েছিলেন কিন্তু মামি বলেন ইরাদের মত ছেলে হয় না ও আমার ঠিকি খেয়াল রাখবে তাই তাকে যেন কষ্ট না দিই। আমাদের সব কিছু গোছগাছ করতে করতে ৩ মাস লেগে গেলো এই কয়দিনে ইফাদ ভাইয়ার আর আমার শ্বশুরের সাপোর্টে ইরাদের নতুন ব্যাবসা আমাদের ঘর গোছানো সব কিছু হয়ে গেলো। ইরাদের বাবা আমাদের মেনে না নিলেও আমার অতীতের মধ্যে যে আমার কোনো হাত নেই সেইটুকু বুঝতে পারছিলেন আর তাই সে আমাকে ছোটো করেনি। শুধু আমার শ্বাশুড়িই আমাদেরকে একদম মানবেন না দেখে সড়িয়ে দিয়েছিলেন তাদের থেকে। ইরাদ এখন দ্বায়িত্ব নিয়েছে পুরো একটা সংসারের, আমাদের ছোটো খাটো একটা সংসারের।
    এত কিছুর মাঝে আমার আর ইরাদের মধ্যে একটা ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও হয়ে গেলো।
    এখন বলতে পারি আমার ভালোবাসার মানুষ আমার স্বামীই আমার বেস্টফ্রেন্ড। তবে এতদিনে আমাদের বাসর হয়নি।
    আজকে ইরাদের ব্যাবসার প্রথম পেমেন্ট এসছে, তার যেন এক বিশাল চিন্তা নেমে গেছে মাথা থেকে আলহামদুলিল্লাহ সব কাজ এখন রানিং
    এদিকে বিয়ের ৯৯ দিন শেষ হয়ে ১০০ তে পা দিবে আর ইরাদের জন্মদিন ও বটে।
    সে রাতে বাড়ি ফেরাএ আগেই আমি সুন্দর করে কেক বানিয়েছি আমাদের রুমটায় হালকা মোম দিয়ে সাজিয়েছি,, একদম ছিমছাম করে,,
    রজনীগন্ধা এনে রেখেছি ফুলদানিতে
    বেলীফুলের কিছু মালা ও ড্রেসিং টেবিলের ওপরে এনে রেখেছি।
    আমি গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম একটা বেগুনি রঙের জামা পরলাম,,
    ইরাদ বাসায় ফিরলো রাত ১১টায়। অনেক খুশি লাগছে ওকে দেখতে। এসেই আমাকে প্রতিদিনের মত কপালে একটা চুমু দিলো।
  • আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি
  • না দাড়াও
    আমি টেবিলে সব খাবার দিয়ে রেখেছি খেয়ে একবারে যাও
    রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে ১১ঃ৩০টা বেজে গেলো
  • এখন আমি গোসল করে আসি তুমি শুয়ে পরো,
  • এই না বাথরুমে না
    আমার কথায় ইরাদ হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলো
  • কেন?
  • না মানে আমাদের বাথরুমে গিজার নষ্ট।
  • আমিতো ঠান্ডা পানিতেই গোসল করি সমস্যা নেই
  • পানিও নাই
  • আচ্ছা আমি দেখছি
  • না না অন্য বাথরুমে যাও
  • আচ্ছা
    -কাপড় নিয়ে আসি
    -ওই রুমের বাথরুমে যাও ওখানে কাপড় দিয়ে আসছি।
    ইরাদ বাথরুমে যাওয়ার পর আমি যেন হাফ ছেড়ে বাচলাম,,
    এরপর আমাদের রুমে এসে নিজে সুন্দর একটা জর্জেটের সেই লাল শাড়িটা পরে নিলাম যেটা পরে তুর্য স্যারের মা বাবার সাথে দেখা হয়েছিলো,,
    ইরাদই সেটা সম্পার মাধ্যমে মামির কাছে দিয়েছিলো আমি সেটা কিছুদিন আগে জানতে পারি। আমাকে সামনাসামনি এই শাড়িটা পরা ও দেখে নি তাই আজকে ওর মন মত করেই সাজলাম চুল গুলো খুলে দিলাম গালে হালকা ব্লাশঅন দিলাম চোখে মাশকারা আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। বেশ দেখাচ্ছে আমাকে। এর সাথে লজ্জাও লাগছে।
    ঠিক ১২টায় ইরাদ রুমে প্রবেশ করতেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বলি
  • হ্যাপি বার্থডে মাই ডিয়ার হাসব্যান্ড, আই লাভ ইউ
    এই প্রথম আমি ইরাদের কাছে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করলাম।
    ও আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো,
  • আই লাভ ইউ টু। তোমার মনে ছিলো আজকে আমার বার্থডে?
  • হুম ইফাদ ভাইয়া গত মাসেই বলেছিলেন, রুমের ডেকোরেশন টা পছন্দ হয়েছে আপনার?
  • হ্যাঁ অনেক,,
  • আসেন তাহলে কেক কাটি
    কেক কাটার পরে ইরাদ আমাকে বললো
    -এদিকে আসেন
    এরপর ঘুরিয়ে তার কোলে বসালো আমি বললাম,
  • জ্বি বলুন
  • আপনার জন্য একটা গিফট আছে
  • আপনিই তো আমার সবচেয়ে বড় গিফট, আর কিছু লাগবে না
  • আমার লাগবে
    এই বলে ইরাদ আমাকে একজোড়া চুরি বালা পরিয়ে দিলো হাতে। এগুলো তার দাদুর বালা দুই নাতি বউদের জন্য দুই জোড়া রেখে গেছেন। এগুলো আমার শ্বশুর নাকি আজকে এস্ব দিয়ে গেছেন। কথা গুলো শুনে চোখ ভিজে গেলো।
  • জানো রুহি? বাবা বলেছেন আমাদের মেনে নিবে একটা কাজ করলে
  • কি কাজ? বলেন আমি এখনি করছি
  • তাদের সহসাই খুশির খবর দিতে পারি তাহলেই মেনে নিবে
  • কোন খুশির খবর দিবো?কিভাবে দিবো?
  • আসো শিখিয়ে দেই
    এই বলেই ইরাদ আমার ঠোঁট জোড়া ওর দখলে নিয়ে নিলো। আমি একদম হকচকিয়ে উঠি, আমার সারা শরীরে এক প্রকার কম্পন তৈরি হয়ে গেলো, ইরাদ আলতো থেকে ধীরে ধীরে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো, কিছুক্ষন পরে ঠোঁট জোড়া ছেড়ে কানের কাছে এসে বললো,
  • একটা বাবু হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসছে,,লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম, ওকে ছেড়ে উঠে যেতে চাইলেই আমাকে ইরাদ কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। কপালে গালে শরীরের প্রতিটা অঙতে তার ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে,,
    আজকে একজন মেয়ে থেকে পূর্ণাঙ্গ নারীতে পরিণত হচ্ছে আমার ভালোবাসার মানুষের স্পর্শে। তার প্রতিটা ছোয়া আমার সর্বাঙ্গে এক নতুন আমাকে আবিষ্কার করছে। ভালোবাসায় ডুবে যাচ্ছি। এক নতুন জগতে।

অহংকার পতনের মূল, কাউকে যদি আপনি তাচ্ছিল্য করেন,, কটাক্ষ করেন তা আপনার কাছেই ফিরে আসবে কোনো না কোনো ভাবে। রুহিকে যে অপমান ইরাদের মা দিয়েছিলেন ভাগ্য ক্রমে সে তারই প্রিয় পুত্রের বউ হয়ে গেছে। কোনো মানুষ কে আপনার ভালো নাই লাগতে পারে কিন্তু তার জন্য সেই মানুষটার সাথে আপনি দুর্ব্যবহার করতে পারেন না, তার মন ভেঙে দিতে পারেন না। কারণ আপনার আমার আমাদের যাই আবস্থান আছে বর্তমানে তা সম্পুর্ণটাই আল্লাহর দেওয়া। সবাই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন আর আমার জন্য বেশি বেশি দুয়া করবেন কিছুদিন পর ইনশাআল্লাহ নতুন কোনো গল্প নিয়ে ফিরবো আপনাদের মাঝে তত দিন আমার সাথেই থাকবেন। অনেক ভালোবাসা আর দোয়া রইলো সবার জন্য)

বাসর ঘরের ইতিকথা
Yasira Abisha

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *