নিকাহ – bangla romantic biyer golpo from fb

নিকাহ – bangla romantic biyer golpo from fb: আমি ডায়েরীটা উঠিয়ে প্রথম পৃষ্টা উল্টাতেই দেখি ঐ ছেলেটির একটা পাঁচফুট সাইজের ছবি আঠা দিয়ে লাগানো। বুঝতে আর বাকি রইলোনা যে এটা তারই ডায়েরী।


পর্ব ১

লোকাল বাসে উঠতেই দেখি বাস ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে।
বাসে উঠার আগে হেল্পারকে আমতা আমতা করে উপায় না পেয়ে যখন বললাম আমার একটা সিট লাগবেই তখন সে অনায়াসে বলে দিলো’ ভেতরে সিট খালি আছে।
তাকে বিশ্বাস করে বীনাবাক্যে বাসে উঠে পড়াটা একদমই উচিত হয়নি আমার।

আমার পরে আরো সাত থেকে আটজন লোক বাসে উঠলো।
কেউই কাউকে পাত্তা দিচ্ছেনা।

আমি যে একা একটা মেয়ে বাসে দাঁড়িয়ে আছি সবাই দেখছে ঠিকই কিন্তু কেউ সিট ছেড়ে উঠে বলছেনা ‘আপনি বসুন, আমি দাঁড়িয়ে যাচ্ছি’।
সম্পূর্ণ শরীর কালো বোরকায় ঢাকা, এমনকি আমার হাতে পায়েও কালো মৌজা দেখে ভাবছে আমি হয়তো কোনো বৃদ্ধা।

আমার যায়গায় যদি কোনো বেপর্দা মেয়ে বাসে উঠতো তখন হয়তো দেখা যেতো সব ছেলে এমনকি আঙ্কেল বয়সি লোকেরাও নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে বলতো।
ঠেলতে ঠেলতে প্রায় বাসের মাঝখানটায় এসে দাঁড়িয়েছি আমি।

আমার সামনে পেছনে মধ্যবয়স্ক দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে।
একটু পর পর ধাক্কা দিচ্ছে আমাকে।

ধাক্কা দিয়ে আবার আড় চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে, উনাদের কি একটুও লজ্জা লাগছেনা আমার সাথে এমন করতে?
বাসের ভেতরের এমন পরিস্থিতিতে আমার খুব কান্না পাচ্ছে।
কেনো যে আজকে একা আসতে গেলাম।

আব্বুজান বলেছিলেন, আমি একা মাদরাসা পর্যন্ত যেতে পারবো কিনা।
আমি বলেছিলাম-
আব্বুজান প্রতিদিন তো আপনি আমাকে পৌছে দেন এবং নিয়েও আসেন আজকে আপনার প্রয়োজনে বাইরে যেতে হচ্ছে, আমি কি করে আপনাকে আমার সাথে যেতে বলি!
আপনি কাজে যান, আমি ঠিক পৌছে যাবো মাদরাসায়।
তাছাড়া খুব বেশি দূরও তো না।

বাসে করে গেলে খু্ব দ্রুতই পৌছে যাবো।
একা একা মাদরাসা পৌছে তো গিয়েছিলাম ঠিকই, সকাল সকাল তেমন ভীড় ছিলো না।

কিন্তু এই মধ্য দুপুরে বাসে এত মানুষ থাকবে জানলে আমি কোনোদিনই বাসে উঠতাম না।
আমার পাশে একজন যুবক ছেলে বসে আছে।
ফর্শা চামড়ায় কালো চাপ দাড়ি।

মাশাআল্লাহ্ সাদা পাঞ্জাবীতে খুব সুন্দর লাগছে দেখতে উনাকে।
ছিঃ ছিঃ আমি কি ভাবছি, ইয়া আল্লাহ্ ক্ষমা করুন আমাকে।
চোখে চোখে আমি যেনাহ্ করে ফেল্লাম।

কই, ঐ যুবক ছেলেটা তো আমার দিকে একবারও তাকায়নি তবে আমিই কেনো তাকালাম।
ইয়া আল্লাহ্ ক্ষমা করুন আমাকে।

আচ্ছা যুবক ছেলেটার মনে কি আমার জন্য একটুও দয়া হচ্ছেনা?
নাকি আমি যে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি সেটা সে দেখতেই পায়নি কে জানে।

পুরুষ মানুষ নারীদের সাহায্য করবে এটাই তো স্বাভাবিক, তা না করে ছেলেটা কি সুন্দর পাশে বড় ব্যাগ রেখে কি নিষ্ঠুর ভাবে বসে আছে।
ইচ্ছে করছে ছেলেটার কানের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলি- ‘এই যে ছেলে, শুধু সুদর্শন হলেই কি হবে? আপনার পাশে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে মনে মনে সাহায্য চাইছে আপনিকি বুঝতে পারছেন না?’

কেনো জানিনা আমি ছেলেটার কাছ থেকেই সাহায্য আশা করছি।
তবে আমার আশায় গুড়ে বালি।
হাত উঁচু করে ধরবো যে তারও উপায় নেই, আমি তো আর এত লম্বা নই।
উপায় না পেয়ে সিটের মাথায় শক্ত করে ধরে আছি।
প্রায় কান্না করেই দেবো সেই মুহূর্তে যুবক ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো।

আমি ছেলেটির বুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
এত কাছাকাছি কোনো ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো আমি কোনোদিন কল্পনাও করিনি।
ছেলেটার শরীর থেকে খুব সুন্দর ঘ্রাণ আসছে।
জীবনের সব থেকে লজ্জাজনক মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমি।

ছেলেটি উপরের কোনো এক যায়গায় ধরে আমাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো–

  • আপনি আমার সিটে বসুন, আপনার হয়তো দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।

কোনো চিন্তা ভাবনা বা সময় নষ্ট না করেই আমি ধুপ করে বসে পড়লাম।
একটা ধন্যবাদ পর্যন্তও বলিনি, বলব কি করে!
গায়রে মাহরাম পুরুষদের সাথে কথা বলিনি আমি কখনও।

তাছাড়া কণ্ঠেরও তো একটা পর্দা আছে।
আমার কণ্ঠ কেমন সেটা আমি গায়রে মাহরাম পুরুষদের শোনাবো কেনো?
তবে ছেলেটির কণ্ঠ মাশাআল্লাহ্ অনেক সুন্দর।
ছেলেদের কণ্ঠও বুঝি এত সুন্দর হয়?

আচ্ছা সে কি কোনো ভাবে আমার মনের কথা শুনে ফেললো!
ইয়া আল্লাহ্ আমি আবারও ছেলেটার কথা ভাবছি?

কিন্তু না ভেবে উপায় কি, এত বড় উপকার করলেন উনি আমার।
আব্বুজানকে ছাড়া কোনোদিন বাইরে বের হইনি আমি।
ছোট থেকে আমাকে মাদরাসায় দিয়ে আসতেন এবং নিয়েও আসতেন।

ফাজিল ৩য় বর্ষে (অনার্স) পড়াশোনা করছি অথচ এত বড় হয়েও আমার আব্বুজানকে রেখে কোথাও বের হতেই কেমন অস্বস্তি হয়।
ইশশ নেহাত আজকে পরীক্ষার প্রয়োজনীয় কাজে যেতে হলো, নাহয় ফাজিলে তো তেমন ক্লাসই করিনা আমি।
কিছুক্ষণ পরেই বাস আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে লাগলো।

মধ্যবয়স্ক লোকগুলো সবাই নেমে গেলো যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে ধাক্কা দিচ্ছিলো।
আমার অপর পাশের সিট খালি হতেই ছেলেটি সেখানে বসে পড়লো।
আমি আড় চোখে তাকিয়ে আছি ছেলেটির দিকে।

খুব সুন্দর গড়নের ছেলেটি, সাদা পাঞ্জাবী পায়জামাতে মাশাআল্লাহ্ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।
দু’হাত ভাজ করে নির্লিপ্ত ভাবে সামনে তাকিয়ে বসে আছে।
আমার পাশে ছেলেটির বড় ব্যাগ, বোধহয় অনেকদিনের ছুটি কাটিয়ে বাসায় ফিরছে কিংবা কোথাও যাচ্ছে।

আমি না চাইতেও বারবার আমার চোখ ছেলেটির দিকেই যাচ্ছে।
উফফ কি অসহ্যকর, আমি কেনো ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছি?

জুরাইন এসে বাস থামতেই ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো।
কেনো জানিনা আমার হৃদস্পন্দন হুট করেই বেড়ে গেলো।
আচ্ছা এমন কেনো হচ্ছে!

আমি জড়োসড়ো হয়ে কাঁধের ব্যাগ শক্ত করে ধরে আছি।
ছেলেটি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে ব্যাগ উঠিয়ে নিলো।
আস্তে আস্তে চুপচাপ বাস থেকে নেমে গেলো।

ছেলেটি নামতেই বাস আবার পোস্তগোলার পথে রওনা দিলো।
বাস দ্রুত চলে যাওয়ার আগে আমি আরো একবার আড় চোখে জানালা দিয়ে ছেলেটির যাওয়ার পথে তাকালাম।
হাতে ভারি ব্যাগ নিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে কাউকে খুঁজছে হয়তো।
ছেলেটা নেমে যাওয়াতে আমার কেনো খারাপ লাগছে!

এমন কেনো হচ্ছে আমার সাথে, সে চলে গেছে তাতে আমার কি!
আমি কেনো মন খারাপ করে আছি।
ইয়া আল্লাহ্ ক্ষমা করুন আমাকে, আমি যেনো শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বিরত থাকি।
জানালা থেকে চোখ নামিয়ে পাশে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড় হয়ে গেলো।

একি, এটাতো একটা ডায়েরী।
এটা এখানে কেনো পড়ে আছে?

কার ডায়েরী এটা? ছেলেটার নয়তো?
আমি ডায়েরীটা উঠিয়ে প্রথম পৃষ্টা উল্টাতেই দেখি ঐ ছেলেটির একটা পাঁচফুট সাইজের ছবি আঠা দিয়ে লাগানো।
বুঝতে আর বাকি রইলোনা যে এটা তারই ডায়েরী।
ব্যাগ থেকে পড়ে গেছে হয়তো।

কিন্তু আমি এখন এই ডায়েরীটা কি করবো?
এর মালিকে তো ফেলে এসেছি আরো আগে।
বাস পোস্তগোলা চলে এসেছে, আমিও নেমে যাবো এখন।

কিন্তু এই ডায়েরী? আমি কি এটা এখানেই ফেলে যাবো, নাকি আমার সাথে করেই নিয়ে যাবো!
সাতপাঁচ না ভেবেই ডায়েরীটা আমি আমার কাঁধের ব্যাগে ভরে নিলাম।
নিজেকে একটু অপরাধি অপরাধি লাগছে এখন।

তবে যা হচ্ছে তার কোনো কিছুর জন্যই আমি দায়ি নই।
বাসায় পৌছে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে গেলো।
দরজা খুলতেই আমি দেখি…


পর্ব ২

সাতপাঁচ না ভেবেই ডায়েরীটা আমি আমার কাঁধের ব্যাগে ভরে নিলাম।
নিজেকে একটু অপরাধি অপরাধি লাগছে এখন।
তবে যা হচ্ছে তার কোনো কিছুর জন্যই আমি দায়ি নই।

বাসায় পৌছে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে গেলো।
দরজা খুলতেই আমি দেখি আব্বুজান আমার সামনে অস্থির দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি এক পা বাড়াতেই আব্বুজান আমার কাঁধ থেকে ব্যাগ হাতে নিয়ে বললেন–

  • রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়নি তো?

এত দেরি হলো কেনো? আম্মু তুমি জানো কত চিন্তা হচ্ছিলো আমার।
কত খারাপ খারাপ খেয়াল আসছিলো মনে।

তোমাকে একা কখনও কোথাও যেতে…
আহ্হা আব্বুজান আপনি এত চিন্তা করছেন কেনো?
আমার কিছুই হয়নি, এই দেখুন একদম ঠিকাছি আমি।
আর রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ছিলো তাই আসতে দেরি হয়ে গেলো।

তবে খুব অস্বস্তি হয়েছে আজকে।
জানেন আব্বুজান, বাসের লোকগুলো খুব খারাপ।
তবে এটাও সতি, হাজারটা খারাপ মানুষের মধ্যে দুই একজন ভালো মানুষও থাকে।

যখন আমরা বিপদে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই, আল্লাহ্ই তখন তাদেরকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন।
আপনি চিন্তামুক্ত হন আব্বুজান, এখন থেকে প্রতিদিন আপনিই আমাকে নিয়ে যাবেন এবং নিয়েও আসবেন।
আব্বুজান আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন–

  • তোমার নিরাপত্তার জন্য তো আমি সবসময় থাকবোনা আম্মু।
    তবে তোমার নিরাপত্তার জন্য যেনো সবসময় কেউ একজন তোমার পাশে থাকে তার ব্যবস্থা আমি খুব দ্রুতই করে ফেলবো ইনশাআল্লাহ্।
    আব্বুজানের কথার ইশারা বুঝতে পেরে আমি আমার কাঁধের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে আমার রুমে চলে এলাম।

বেশ কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করছি আব্বুজান আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছেন।
এমন কথার মুখোমুখি হতে আমার খুবই লজ্জা লাগে।

আমার ডায়েরীটা পাচ্ছিনা কেনো।
এখানেই তো রেখেছিলাম, গেলো কোথায়!
কোথাও পড়ে গেলো নাতো?
–জাঈন, কি খুঁজছিস তুই?

আম্মু আমার ডায়েরীটা পাচ্ছিনা, এই চেইনেই রেখেছিলাম।
কোথায় গেলো কে জানে।
–তুই তো ছোট খাটো সব জিনিস হারিয়ে ফেলিস।
দেখ কোথাও হারিয়ে বসে আছিস হয়তো।

আম্মু ওটা ছোট খাটো জিনিস না, তোমাকে বোঝাতে পারবো না ডায়েরীটা আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
–আমি এতকিছু বুঝতে চাইনা, দ্রুত নিচে নেমে খেতে আয়।
সেই কখন থেকে তোকে ডাকছি সে খেয়াল কি আছে তোর?
আসছি আম্মু তুমি যাও।

গোসল করে যোহর নামাজ পড়ে বসে আছি।
হুট করেই আমার আজকের বাসের সেই ছেলেটার কথা মনে হলো।
দ্রুত পড়ার টেবিল থেকে ব্যাগের চেইন খুলে ডায়েরীটা বের করলাম।
জাঈন জারিফ, বাহ্ খুব সুন্দর নাম ছেলেটার।

দেখতে যেমন মাশাআল্লাহ, নামও ঠিক তেমন।
ইশশ আবারও আমি ঐ ছেলের প্রশংসা করছি, ইয়া আল্লাহ্ কি হচ্ছে আমার!
প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই তার ছবি।
যাক গে, তার ছবিটা আর দেখবো না আমি।

দেখলেই আমার মনে কেমন কেমন হয়।
তাই একটা মার্কার নিয়ে আমি সম্পূর্ণ ছবিটা কালো করে দিলাম।
সাথে সাথেই আমি আমার বোকামি বুঝতে পারলাম।

এখন কি হবে, তার সাথে যদি কোনোদিন দ্বিতীয়বার দেখা হয় তখন তো আমাকে তার ডায়েরীটা ফিরিয়ে দিতে হবে, তখন আমি কি জবাব দেবো?
সে যদি জিজ্ঞেস করে আমি তার ছবির উপর নিজের এত সুন্দর প্রতিভা কেনো দেখালাম।
তখন আমি কি জবাব দেবো?
ধ্যাৎ, দিয়ে দেবো একটা জবাব।

দেখা হলে এটা যে তাকে ফিরিয়ে দেবো এতেই তার শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
ছবির নিচে নীল কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা–
পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ; ‘তোমরা সুনিপুণ অভিনয় শিল্পী’

-আর আমি “নির্বাক আদর্শ দর্শক”
ছেলেটাকি কোনো কবি সাহিত্যিক নাকি!
নাহ কে জানে হবে হয়তো।
আচ্ছা আমি কি ডায়েরীতে কি লেখা আছে সেটা পড়বো!
কারো ব্যাক্তিগত লেখা পড়া মোটেও ঠিক না।

কিন্তু প্রথম পৃষ্ঠাতে তো কোনো ঠিকানাও লেখা নেই।
মনের খচখচ দূর করতে আমি তার পরের পৃষ্ঠা উল্টোতেই দেখি দরজায় আম্মু দাঁড়িয়ে আছেন।

  • জেরিন, আম্মু খেতে এসো।

তোমার আব্বুজান অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য।
আমি ডায়েরীটা বিছানায় ফেলে রেখে উঠে চলে গেলাম ডাইনিংয়ে।
আমাকে ছাড়া আব্বুজান একটা ভাতও মুখে নিবেন না, তাই আমি চাইলেও কখনও দেরি করতে পারিনা খাবারের ডাক পড়লে।

সকালের দুষ্টু রোদ পর্দাভেদ করে আমার মুখে এসে পড়তেই আমার ঘুম ছুটে পালালো।
ফজর পড়ে ঘুমটা খুব যত্ন করেই আসে।
এলো মেলো চুলগুলো মুখের সামনে এসে পড়ে আছে।
হাত দিয়ে সরিয়ে দিতেও খুব অলসতা লাগছে আমার।

হুট করেই ঐ ছেলেটার ডায়েরীর কথা মনে পড়তেই আমি উফে বসলাম।
কাল রাতে দুই এক পৃষ্ঠা পড়তে না পড়তেই চোখে ঘুম চলে এসেছিলো।
তবে যতটুকু পড়েছি তাতে বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটা পাক্কা সাহিত্যিক হবে।

গোছানো লেখার ধরনই বলে দিচ্ছে এই ছেলে নির্ঘাত প্রেম করে কিংবা প্রেমে পড়েছে।
মনের ছটফটানি দূর করতেই বালিশের পাশে থেকে ডায়েরীটা হাতে নিলাম।
প্রথম দুই পৃষ্ঠা উল্টোতেই একটা লেখায় আমার চোখ আটকে গেলো।

হৃদয়ের লাশকাটা ঘরে চলছে অনুভূতির পোস্টমর্টেম,
ভেসে আসছে মৃত অনুভূতির আধ্যাত্মিক আর্তনাদ।
ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই,

খানিকক্ষণে বেজে উঠলো ও পাড়ার গীর্জার শতবর্ষী ঘন্টা।
মার্বেল আকৃতির চোখ দু’টো জুড়ে,

অনুভূতির অকাল পতনের শোক।
সময়ের কাছে হেরে গিয়ে বেসুরো হয়ে যাচ্ছে ব্যথার সুর।
মনে মস্তিষ্কে চলছে স্রষ্টার সঙ্গে একতরফা কথোপকথন।
স্রষ্টা শুনছেন, শুনছেন কেবল শুনেই যাচ্ছেন,
হয়তো স্রষ্টা চুপটি করে শুনতেই ভালোবাসেন।

আচ্ছা ছেলেটা কি প্রেমে ব্যার্থ হয়েছে নাকি?
না না প্রেমে ব্যার্থ হওয়া ছাড়াও তো মানুষের মনের কত অসুখ থাকে।
কে জানে এই ছেলের মনে কি আছে।

তবে কথাগুলোর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি আমি।
পরের পৃষ্ঠা উল্টাতেই দরজার ওপাশ থেকে আম্মির কণ্ঠ শুনতে পেলাম আমি।
সাথে সাথেই বালিশের নিচে ডায়েরীটা রেখে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলতেই আম্মি এক প্রকার হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে আমাকে বললেন–

  • জেরিন, আম্মু দ্রুত আমার সাথে রান্নাঘরে আসো।

আজকে বাসায় মেহমান আসবে, আমার সাথে একটু হাতে হাতে কাজ করে দেবে তুমি।
দেরি করো না আম্মু, মেহমান একটু পরেই চলে আসবে।
আমাকে কাজের তাগিদ দিয়ে আম্মি চলে গেলেন রান্নাঘরে।
আমিও আর দেরি না করে ফ্রেশ হয়ে আম্মিকে সাহায্য করতে চলে গেলাম।

আম্মি, কে আসবে আজকে?

  • তোমার আব্বুজানের সেই পুরোনো বন্ধু, তোমার জাফর আঙ্কেল।
    অনেকদিন পর দেখা করতে আসবেন।
    শেষবার যখন এসেছিলেন, তখন তুমি ছোট্ট ছিলে।

তাই হয়তো তোমার মনে নেই।
কয়েকমাস হলো দেশে এসেছেন।
ছেলেকে রেখেই এসেছিলেন বালিতে।
পরশু তার ছেলেও দেশে এসেছে, তাই তোমার আঙ্কেল দেখা করতে আসবেন তোমার আব্বুজানের সাথে।
ও আচ্ছা।

পুরো ঘরময় ঈদের আমেজ আমেজ ভাব।
মেহমানই তো আসবেন, এত আয়োজনের কি আছে!
তবে আব্বুজানের বন্ধু বলে কথা, আয়োজন তো হতেই হবে।

সে যাই হোক, রান্নার কাজ শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর হতে চললো।
আম্মি তো বলেছিলেন তারা নাকি একটু পরই চলে আসবেন, অথচ এখনও আসার নামই নেই।
আব্বুজান তাদের চিন্তায় পায়চারি করছেন এ মাথা থেকে ও মাথা।
আব্বুজানকে চিন্তায় ফেলে তারা দিব্যি আস্তে ধীরে রওনা হচ্ছে বোধহয়।

আমি বড় ওড়না নিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে পানির স্প্রে-র বোতলটা হাতে নিয়ে চলে এলাম ছাঁদে।
আব্বুজানকে পেরেশান দেখতে আমার একদমই ভালো লাগে না।

আজকের আকাশটা বেশ পরিষ্কার।
তেমন একটা রোদও নেই এখন, অথচ অন্যদিন এই দুপুর বেলা কড়া রোদের জন্য চোখ মেলে তাকানোই যায়না।
ছাঁদের গাছগুলোও আজ অনেকটা সজিব, রোদ পড়েনি তাই হয়তো।

গোলাপ গাছের পাশে স্প্রে-র বোতলটা রেখে ছাঁদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়াতেই উপর থেকে একটা ছেলেকে ফোনে কথা বলতে বলতে আমাদের বাড়ির দিকে এগোতে দেখলাম।
সামনে তাকাতেই দেখি আমাদের বাড়ির ঠিক সামনেই একটা কালো প্রাইভেট কার দাঁড় করানো।
জাফর আঙ্কেলরা চলে এসেছেন হয়তো।
যাক তবে, আব্বুজানের চিন্তা দূর হলো।

আমিও আর বেশিক্ষণ ছাঁদে থাকবো না।
ফুলগাছগুলিতে একবার পানি স্প্রে করে বোতল হাতে ছাঁদের দরজার কাছে আসতেই শুনতে পেলাম কেউ একজন কথা বলতে বলতে উপরে উঠে আসছে।
এটাতো আমার আব্বুজানের কণ্ঠ না।

কণ্ঠটা খুব না হলেও একটু চেনা চেনা লাগছে, ছেলেটা যে ফোনেই কথা বলছে তা নিশ্চিত।
তবে কি নিচে দেখা ঐ ছেলেটা উপরে উঠে আসছে।
কেনো, তাকে ছাঁদেই কেনো আসতে হবে?

মেহমান হয়ে এসেছে এত ঘুরাঘুরি করার কি আছে?
আমি সামনে তাকাতেই দেখি ছেলেটা….


পর্ব ৩

আমিও আর বেশিক্ষণ ছাঁদে থাকবো না।
ফুলগাছগুলিতে একবার পানি স্প্রে করে বোতল হাতে ছাঁদের দরজার কাছে আসতেই শুনতে পেলাম কেউ একজন কথা বলতে বলতে উপরে উঠে আসছে।
এটাতো আমার আব্বুজানের কণ্ঠ না।

কণ্ঠটা খুব না হলেও একটু চেনা চেনা লাগছে, ছেলেটা যে ফোনেই কথা বলছে তা নিশ্চিত।
তবে কি নিচে দেখা ঐ ছেলেটা উপরে উঠে আসছে।
কেনো, তাকে ছাঁদেই কেনো আসতে হবে?

মেহমান হয়ে এসেছে এত ঘুরাঘুরি করার কি আছে?
আমি সামনে তাকাতেই দেখি ছেলেটা নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এদিকেই আসছে।
এক মুহূর্তের দেখায় চেহারাটাও দেখতে পারিনি।
কিন্তু আমি তাকে কেনো দেখবো?

ধ্যাৎ, বোরকাও তো পড়িনি আমি।
ছেলেটা যদি এদিকে চলে আসে?
আমি তো তখন লজ্জায় মরেই যাবো।

আমি ওড়নাটা ভালোভাবে মুখে বেঁধে নিলাম।
আস্তে আস্তে ছেলেটার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে।
চলে গেলো নাকি, যাক ভালোই হয়েছে।

মাথা বের করে উঁকি দিতেই দেখি ছেলেটা ঐ সাইডের ছাঁদে আমার উল্টো দিকে মুখ করে ফোনে কথা বলছে।
আমি খোলা দরজা পেরিয়ে মাঝখানের ছোট্ট চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে দেখতে লাগলাম।
কেমন চেনা চেনা লাগছে।

মনে হচ্ছে এই কণ্ঠ এই কথার ধরন আমি আগেও কোথাও শুনেছি।
যাক গে, তাকে চিনে আমার লাভ নেই।
আমি অন্যমনস্ক হয়ে সিড়ি ভেঙে নিচে নামার আগেই সিড়ির রেলিংয়ে পা আটকে পড়ে গেলাম।
পড়ে যাওয়াতে একটু শব্দ হয়েছে অবশ্য।

পায়ে প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে।
চোখে পানি এসে পড়েছে আমার।
আব্বুজান এজন্যই আমাকে তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করেন সবসময়।
তাড়াহুড়ো করা নাকি শয়তানের কাজ।

কিন্তু কে শুনে কার কথা।
খোলা দরজা দিয়ে চোখে পানি নিয়েই অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছি ছেলেটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।
আমি দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম।

ছেলেটা আমার কাছে আসার আগেই আমি চোখের পানি মুছে দ্রুত ওরনা ঠিক করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম।
পায়ের পাতায় ভিষন ব্যাথা পেয়েছি।
আম্মি একবার আমার কাছে এসেছিলেন অবশ্য, বরফের কৌটো হাতে দিয়ে ব্যস্ততার দরুন চলে গেলেন।
মনে মনে ঐ ছেলের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছি।

কিন্তু বেশি বকাও দিচ্ছিনা, ছেলের পরিচিত আমার আব্বুজানও তো আছেন।
কিন্তু আজ ঐ ছেলেটার জন্যই আমার এ দশা।
কি দরকার ছিলো তার ছাঁদে এসে ফোনে কথা বলার?
বাড়িতে কি আর কোনো যায়গা ছিলো না?

দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে বিছানায় গিয়ে সটান করে শুয়ে ডায়েরীটা বালিশের নিচ থেকে বের করলাম।
মাঝে মাঝে জীবনটা প্রচন্ড বিষাক্ত লাগে!
বেঁচে থাকতে ইচ্ছে ই করে না!
পালিয়ে যাওয়ার ফন্দি খুঁজে বেড়াই!

খুব একা লাগে কেনো জানি!
অথচ বাসায় সবাই আছে!
সবার সাথেই কথা বলছি, হাসছি কিন্তু যে কথাগুলো আমাকে অশান্তি করছে সেগুলো বলতে পারছি না, কাউকে জড়িয়ে কাঁদতে পারছি না!
এখানে সবাই আছে তবুও যেনো কেউই নেই!

কেনো বাবা, কি এমন দুঃখ উনার!
বেঁচে থাকতে কেনো ইচ্ছে করে না জনাবের?
কথায় আছে বেশি সুখে থাকলে নাকি ভুতে কিলায়, আপনারও বোধহয় সে দষাই হয়েছে।
না হয় এত সুন্দর একটা জীবন রেখে কেনো মরে যেতে ইচ্ছে করবে!

জনাব জাঈন জারিফ, আপনার উচিত এই সুন্দর জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা।
এমনও মানুষ আছে যারা খুবই নিম্ন মানের জীবন কাটাচ্ছে, তারা তো দিব্যি বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
আল্লাহ্ আমাদের প্রতিটা জীবনকেই পরীক্ষায় ফেলেন।
দুঃখ কষ্ট ভয়ের মাধ্যমেই আমাদের পরীক্ষা করেন।

এত দ্রুত হতাশ হলে কি চলবে?
যাক গে, জনাব আপনি যদি বিবাহিত হয়ে থাকেন তাহলে আপনার প্রিয়তমার সাথে সব শেয়ার করুন।
দেখবেন এক ঝটকায় সব মন খারাপ শেষ হয়ে যাবে।
এই না, আপনি কেনো বিবাহিত হতে যাবেন?

কি আশ্চর্য! এই লোক বিবাহিত হলে তাতে আমার কি?
আমার কেনো এত হিংসে হচ্ছে!
ইয়া আল্লাহ্ কি হচ্ছে কি আমার সাথে?

আমি কি তবে, কি যাতা ভাবছি আমি।
ধ্যাৎ এই ডায়েরীটাই আর পড়বো না, বার বার ফেৎনা সৃষ্টি করে দিচ্ছে আমার মনে।
বিকেলে আম্মি আমার রুমে এসে আমার পাশে বিছানায় এসে বসলেন।

আমি তখন আছরের নামাজ শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করছিলাম মাত্র।
কি অদ্ভুত, আম্মি আমাকে বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই আমার কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দিলেন।
খুব বেশি খুশি হলেই কেবল আম্মি এমন করেন।

শেষবার যখন আমি কুরআন খতম দিয়েছিলাম তখন আম্মি আমাকে এভাবে কপালে চুমু এঁকেছিলেন।
এইতো গেলো রমজানের কথা।
হঠাৎ আজ কি এমন হয়ে গেলো মাথায় আসছেনা আমার।
মনের খচখচানি দূর করতেই আমি আম্মিকে বললাম–

আম্মি আপনি কি খুব বেশিই খুশি আজকে?
আমি তো আপনাকে খুশি করার মতো কোনো কাজই করিনি।
উল্টো পায়ে ব্যাথা পেয়ে আপনার কাজ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
জবাবে আম্মি বললেন–

  • কেনো জারিন? খুশি না হলে কি আমার স্নেহের আম্মুটাকে আদর করতে পারবো না?
    তাছাড়া তুমি পায়ে ব্যাথা পেয়ে আমার কাজ বাড়িয়ে দিয়েছো কে বলেছে?
    বরং যেটা হবার সেটাই হয়েছে।
    আমার যেটা দায়িত্ব আমি সেটা করেছি।

তুমিও পায়ে ব্যাথা পেয়ে তোমার গুনাহ্ কিছুটা কমিয়ে নিয়েছো।
এজন্যই সর্বাবস্থায় আমাদের আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
না তেমন কিছুনা। তবে কোনো কারন তো নিশ্চয়ই আছে আম্মি, নাহয় আচমকা আমাকে কেনো আপনি চুমু দিচ্ছেন!
বলুন না আম্মি, কি এমন হয়েছে?

মুচকি হেসে আমার গালে হাত বুলিয়ে আম্মি আমাকে বললেন–

  • তোমার আব্বুজান তোমাকে বলবেন।
    ধৈর্য্য ধরো আম্মু। আজকে আমি অনেক খুশি।
    আমার জেরিনটা অনেক বড় হয়ে গেছে।

আল্লাহ্ আমার এই ভালোবাসাটাকে নেক হায়াত দান করুক, আমিন।
আরো একবার আমার কপালে আদর দিয়ে আম্মি চলে গেলেন রুম থেকে।
আমিও ভাবছি, কি এমন হলো আজকে?

আম্মি এত খুশি খুব কমই হন।
অবশ্যই আব্বুজানের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে।

রাতে দস্তর খানায় বসে সবাই ডিনার শুরু করলাম।
আব্বুজান আমার প্লেটে মাছের মাথাটা তুলে দিলেন।
আব্বুজান সবসময়ই এমন করেন।

মাছের মাথাটা আমার পাতে তুলে দিবেনই দিবেন।
যতোই মানা করি, বলি আব্বুজান আপনি মাছের মাথাটা খান।
আব্বুজান আমার কথা শুনবেন-ই না।

বরং মুখে বিস্তর হাসির রেখা ফুঁটিয়ে তৃপ্তি সহকারে আমাকেই মাছের মাথাটা দিবেন।
আমি চোখ গরম করে আব্বুজানের দিকে তাকাতেই সেই চিরচেনা হাসিটা দিলেন।
আমি আব্বুজানের হাসির উপরে আর কোনো কথাই বলতে পারলাম না।

ঐ হাসিতে কি যে আছে আমি নিজেও জানিনা, মনেহয় যেনো জান্নাতের একটা টুকরো ঐ হাসির মাঝে আল্লাহ্ তায়ালা রেখে দিয়েছেন।
কিন্তু আজ শুধু আমার প্লেটে মাছের মাথাটা দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি।
বরং এক হাতে আমার মাথা আলতো করে ধরে আব্বুজান আমার কপালে চুমু খেলেন।
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি আব্বুজানের দিকে।

আজ হলো কি সবার!
কারন ছাড়াই আমাকে সবাই চুমু খাচ্ছে কেনো?
খাবার শুরু করতেই আব্বুজান আম্মিকে বললেন–

  • আমাদের জেরিন আম্মুটা দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেছে।

ভাবতেও পারছি না আজকে জেরিনের জন্য আমাদের খুশি আরো দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
আমাদের ছোট্ট জেরিনের জন্য একটা রাজপুত্রের খোঁজ পেয়েছি আজকে।
আমি আব্বুজানের কথা শুনে মুখে ভাত রেখেই কাশতে লাগলাম।

খুব সম্ভবত গলায় খাবার আটকে গেছে।
আব্বুজান তড়িঘড়ি করে পানির গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
পানি খেয়ে আমি আব্বুজানের দিকে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইলাম।
আব্বুজান এটা কি বললেন, রাজপুত্রের খোঁজ পেয়েছেন মানে?

আব্বুজান কি বলছেন আপনি?

  • শান্ত হও আম্মু, চোখ মুখ লাল হয়ে আছে তোমার।
    আমি খানিক সময় চুপ করে থেকে আমার প্লেটে হাত দিলাম।
    মুখে ভাত নিতেই আব্বুজান বলতে শুরু করলেন–
  • জেরিন আম্মু, তোমার জাফর আঙ্কেল আমার খু্ব ভালো বন্ধু।
    বলতে গেলে ছোট বেলার বন্ধুই বলা চলে।
    একসাথে আমরা দু’জন থেকেছি খেলেছি।
    আট নয় বছর আগে জাফর পরিবার সহ বালিতে চলে গিয়েছিলো ছেলের পড়াশোনার জন্য।
    পরিবার বলতে, তোমার আন্টি আর তার ছেলে।

আজকে ছেলেটাকে নিয়ে এসেছিলো আমাদের বাসায়।
কথায় কথায় তোমার কথা জিজ্ঞেস করলো।
তারপর এ কথায় সে কথায় তোমাকে জাফরের ছেলের জন্য চেয়ে বসলো।

সেই ছোট্ট বেলায় তোমাকে দেখেছে, এরপর আর দেখেনি তোমাকে।
ছেলেটাও দেখলাম বেশ ভদ্র।
মুখে হাসি ছাড়া কথাই বলেনা, মাশাআল্লাহ্ দেখতে শুনতে খুব ভালো।
পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকরির অপেক্ষায় আছে।

তবে তোমার জাফর আঙ্কেল বলেছেন ছেলেকে ব্যাবসায় নামিয়ে দিবেন।
ছেলেও বললো চাকরি থেকে ব্যাবসায় নাকি তার আগ্রহ বেশি।
রাসূল (সাঃ) ও কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে ব্যবসায়কে শ্রেষ্ঠ বলেছেন।

আমি অবশ্য এখন তোমার জাফর আঙ্কেলকে কিছুই বলিনি, তুমি তোমার মতামত দেবে তারপরই আমি জাফরকে জানাবো।
জারিন আম্মু, আমি কোনোদিনই আমার মতামতকে তোমার উপর চাপিয়ে দেবো না।
তুমি যা বলবে তাই হবে।
তোমার কি কাউকে পছন্দ করা আছে?

যদি থাকে বলতে পারো আমি আজই তোমার জাফর আঙ্কেলকে না করে দেবো।
শেষের কথাটা বলার সময় আব্বুজানের মুখে ব্যর্থতার ছাপ স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে।
আমি আব্বুজান কে কি করে ফিরিয়ে দেবো?

তাছাড়া আমিও তো কাউকে, মানে তেমন কেউই তো নেই আমার জীবনে।
শুধু শুধু আব্বুজানকে হতাশ কি করে হতে দেই।
তবুও মনে কোথাও একটা বাঁধ সাধছে।
চুপচাপ খাবার খাচ্ছি আমি।

আমিও কোনো উত্তর দেইনি, আব্বুজানও আর কিছু জিজ্ঞেস করেন নি।
খাবার শেষ করে নিচুস্বরে আব্বুজান কে বললাম….


পর্ব ৪

চুপচাপ খাবার খাচ্ছি আমি।
আমিও কোনো উত্তর দেইনি, আব্বুজানও আর কিছু জিজ্ঞেস করেন নি।
খাবার শেষ করে নিচুস্বরে আব্বুজান কে বললাম–
আব্বুজান আমার পছন্দের কেউই নেই।

আপনি আমার জন্য যা ভালো মনে করেন তাই করবেন।
এতে আমাকে জিজ্ঞেস করার কিছুই নেই।
আপনি নিশ্চয়ই আমার খারাপ চাইবেন না।

বলেই আমি দ্রুত ডাইনিং থেকে আমার রুমে এসে দরজা আটকে দিলাম।
কেনো জানিনা আমার খুব কান্না পাচ্ছে।
কেনো এমন হচ্ছে জানিনা, তবে হচ্ছে।
না চাইতেও আমি বালিশের নিচ থেকে ডায়েরীটা হাতে নিয়ে বেলকনির গ্রিলের সাথে ঠেশে থাকা চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম।
অন্ধকার রাত, কিছুই দেখা যাচ্ছেনা বাইরে।

ডায়েরীটা আমি বুকে আগলে রেখে চুপচাপ বসে আছি।
কি হচ্ছে আমার সাথে।
না না চোখের পানি পড়ছে না একদমই।
তবে কেনো জানিনা কিছুই ভালো লাগছে না।

বাসের ঘটনার পর ডায়েরীর প্রতিটা অক্ষরের প্রেমে পড়া।
প্রতিটা লেখার প্রতি আসক্ত হয়ে যাওয়া।
আমার জন্য আব্বুজানের পাত্র খোঁজা, আর আজ আমার নিকাহ্ নিয়ে আলোচনা।
সবকিছুই কেমন যেনো খুব দ্রুত ঘটছে আমার সাথে।

বুঝতে পারছি না আমি কি চাইছি।
আচ্ছা আব্বুজান এত তাড়াহুড়ো কেনো করছেন।
আমি তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছিনা না।

অন্তত পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপরই নাহয় আমাকে এসবে ঘাটাতেন।
আব্বুজানেরই বা দোষ কি, বয়সতো আমারও আর কম হয়নি।
একুশ বসন্ত পেরিয়ে এখন বাইশে পা রেখেছি।
আব্বুজানেরও হয়তো আমাকে নিয়ে হাজারো ইচ্ছে আছে, স্বপ্ন আছে।

মোয়াজ্জিনের আযানের মধুর শব্দে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।
আলহামদুলিল্লাহ্ সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ্ তায়ালার, আরো একটি দিন চোখে দেখার সুযোগ পেলাম।
দূর থেকে একটা ডাহুক পাখি ডাকছে বোধহয়।

কি আশ্চর্য, রাতে আমি বেলকনিতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম ভাবতেই অবাক লাগছে।
ডায়েরীটা তখনও আমার বুকে জড়িয়ে আছে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমে গিয়ে ডায়েরীটাকে আলমিরার ভেতরে এক কোনায় রেখে দিলাম।
এই ডায়েরীটাই যত নষ্টের মূল।
খুব রাগ হচ্ছে এখন আমার, কেনো যে সেদিন বাস থেকে কুড়িয়ে এটা আনতে গেলাম কে জানে।
সেখানেই ফেলে আসতাম তাহলেই ভালো হতো।

একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নামাজের জন্য ওযু করতে চলে গেলাম।
নামাজ পড়লেই শান্তি পাবো বোধহয়, এ ছাড়া আর কোনোই উপায় নেই।

আজ বিকেলে নাকি জাফর আঙ্কেল আন্টি আর তার ছেলে আসবেন আমাকে দেখতে।
এখানে দেখার কি আছে?
সেদিনই তো বললো জাফর আঙ্কেল না দেখেই প্রস্তাব রেখেছেন; তবে একদমই না দেখাটা!
জানিনা আমি কিছুই জানিনা।

মন সায় দিচ্ছে না তবে বিবেক বলছে এটাই আমার জন্য সঠিক।
খুব বেশি না হলেও আর এক মাস বাদেই আমার ফাইনাল পরীক্ষা।
এ সময় এসব না হলেই কি হতোনা?

তবুও মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি, নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করবো আমি সে কথা মনে হতেই আমার চিন্তা হচ্ছে।
আচ্ছা আমাকে কি ঐ ছেলেটার সামনে যেতে হবে!
সেদিনের ছাঁদের ছেলেটাই তো, কেনো জানিনা আমার তাকে পছন্দ না।

উহুম কি কারনে এমন অনুভূতি হচ্ছে তাকে নিয়ে তা জানিনা, তবে হচ্ছে।
আন্টির নামটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে, “দোলা” নাম শুনে মনেই হয়না উনার বয়স হয়েছে।
এ বয়সের আন্টিদের বুঝি এত ছোট নাম থাকে?
তাদের তো থাকা উচিত বড় বড় নাম।

যেনো নাম শুনেই বোঝা যায় মধ্যবয়সি কোনো মহিলা হবেন।
প্রায় বিশ মিনিট হতে চললো দোলা আন্টি আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছেন।
এর মাঝে তিন থেকে চারবার অবশ্য আমার গাল সমেত হাত বুলিয়ে চুমু খেয়েছেন।
আগে থেকেই আমি বোরকা পড়ে বসে আছি।

জানতাম তাদের সামনে যেতে হতে পারে।
আমাকে বোরকায় দেখে দোলা আন্টি আম্মিকে বললেন–

  • জারিন কি ঘরেও বোরকা পড়ে থাকে নাকি?

দোলা আন্টির কথা শুনে না হেসে আমি পারলাম না।
ঘরের ভেতর বুঝি কেউ বোরকা পড়ে?
আমার রুমেই বোরকা পড়ে বসে ছিলাম, হুট করে আন্টি এসে আমার সাথে গল্প করা শুরু করে দিলেন।
সেই যে আমাকে দেখে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই।

আম্মি এসে চেয়ার টেনে বসতেই দোলা আন্টি আম্মিকে বললেন–

  • মাশাআল্লাহ্ ভাবি, জারিনকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।
    অবশ্য আমাদের পছন্দই আমার ছেলের পছন্দ, তবুও আশা করছি জারিনকে ওর খুবই ভালো লাগবে।

আল্লাহর অনেক অনেক শুকরিয়া আমার ছেলেটার জন্য এত ধার্মিক এবং ভদ্র একটা মেয়ে খুঁজে পেয়েছি।
আপনার ভাই তো প্রথম থেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন, আমিই বললাম জারিনকে একটু দেখে আসি।

তাই চলে এলাম, ভাবিনি এখানে এসে একটা হুরের দেখা পাবো।
আমরা তো রাজি এবার আপনাদের মতামত দেবার পালা।
জারিন আম্মু তুমি রাজি তো?

দোলা আন্টির প্রশ্নে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।
কি বলব আমি এখন! আমি তো সব আব্বুজানের উপরই ছেড়ে দিয়েছি।
আব্বুজান হ্যাঁ বললে হ্যাঁ, না বললে না।

আগ বাড়িয়ে আমি কোনো জবাব দিলাম না।
চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি, খুব লজ্জা লাগছে এখন।
এভাবে কেউ সরাসরি জিজ্ঞেস করে বুঝি?
আমার কোনো উত্তর না পেয়ে আম্মি এবং দোলা আন্টি হালকা শব্দে হেসে উঠলেন।
আম্মি বললেন–

  • আমাদেরও কোনো আপত্তি নেই, জারিন তো তার আব্বুজানের দিলের টুকরা।
    তার আব্বুজান যা বলবেন জারিন তাতেই হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে যাবে।
    আমাদের উচিত এবার জারিন আর জারিফকে একান্তে একটু কথা বলতে দেয়া।

‘জারিফ’ নাম শুনতেই আমি আম্মির দিকে তাকালাম।
কি বললেন আম্মি, “জারিফ”।
কোন জারিফ? সেই ডায়েরীর মালিকের নামওতো জারিফ ছিলো।
ধ্যাৎ, দুনিয়াতে কি আর কোনো জারিফ নেই নাকি।

বুদ্ধু আমি, একজনকে নিয়ে এত ভাবার কি আছে।
তবে না চাইতেও মনটা আবার খচখচ করতে শুরু করে দিলো।
আম্মিরা চলে যেতেই আমি মুখ ঢেকে নিলাম।

এখনই হয়তো ঐ জারিফ ছেলেটা চলে আসবেন।
খুব অস্থিরতা কাজ করছে আমার মনে।

কখনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি কিনা।
দু’হাত বার বার ঘষছি, এদিক ওদিক তাকিয়ে চিন্তা করছি এখন কি হবে।
আমি কি বলব, কি উত্তর দিবো।
সে কি প্রশ্ন করবে আমাকে?
ওফফো, গলা শুকিয়ে আসছে আমার।

এখন এক গ্লাস পানি খেতে পারলে বোধহয় খুবই ভালো হতো।
না না সে প্রশ্ন করলেও আমি কোনো জবাব দেবো না।
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ না বলে দেবো, সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এক ঝটকায়ই।
কথা বললেই আমার জড়তা কাজ করবে তা নিশ্চিত।

আমার এসব আজগুবি চিন্তা ভাবনার মাঝেই পর্দার ওপাশ থেকে পুরুষালী একটা কণ্ঠ মোলায়েম কন্ঠে সালাম দিলেন।
সালামের জবাব না দিয়েই আমি আতঙ্কে দাঁড়িয়ে গেলাম।
নত দৃষ্টিতে বড় বড় শ্বাস ফেলছি, ভিষন জড়তা কাজ করছে সালামের জবাব দিতে।
তবে সালামের জবাব আমাকে দিতে হবেই।

সালামের জবাব দেয়াটা যে ওয়াজিব।
আমাকে নিরব থাকতে দেখে সে আবার সালাম দিলো।
তাড়াহুড়ো করে ধীর কণ্ঠে জবাব দিলাম।

চোখ খিচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি আলমিরার সাথে ঠেশে।
কি বলবে সে এখন? আমিই বা কি বলব?

আব্বুজান কেনো এই ছেলেটাকে আমার সাথে দেখা করতে বললেন, আব্বুজান তো জানেন আমি কত অস্বস্তিতে পড়ে যাবো।

  • আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেনো, বসুন না।
    আপনি না বসলে তো আমিও বসতে পারছি না।
    ছেলেটার কথায় আমি চোখ খুলে তাকালাম।

তবে দৃষ্টি আমার তার পায়ের পাতায়।
ফর্শা পায়ের অধিকারি সে, মানে ফর্শা চামরার অধিকারি ছেলেটা।
তাকে বসতে না বলে আমি নিজেই টুপ করে বিছানায় বসে গেলাম।

ছেলেটাও আমার থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে বিছানার ঐ কোনায় গিয়ে বসলো।
আড় চোখে তার দূরত্ব কতটা সেটা মেপে যাচ্ছি আমি।
ডান হাত মুঠ করে বিছানার চাদর খামচে ধরে আছি।

শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুতগতিতে চলছে আমার।
চরম অস্বস্তিকর একটা মুহূর্ত যাচ্ছে এখন।
হাত মৌজাটা পড়ে নেয়া উচিত ছিলো, না পড়ে ভুল হয়ে গেছে আমার।

ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিনা দেখতে পাচ্ছিনা, ইচ্ছে করেই তাকাচ্ছিনা তার দিকে।
মূলত তাকানোর সাহসটাই খুঁজে পাচ্ছিনা আমি।

  • আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?
    কি বললো ছেলেটা, ভয় কেনো পাবো তাকে।
    কোনোদিনই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি তাই প্রচুর অস্বস্তি হচ্ছে।

আল্লাহ্ ছাড়া আমি আর কাউকেই ভয় পাইনা।
সে যাই হোক, তাকে আমি কোনো জবাব দিচ্ছিনা।
মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম।
সে বোধহয় মুচকি হাসলো।

  • দেখুন আপনার ব্যাপারে আমার কিছুই জিজ্ঞেস করার নেই।

আমি যা জানার আপনার বায়োডাটা থেকেই জেনে নিয়েছি।
তাছাড়া আব্বু আম্মু যেহেতু আপনাকে পছন্দ করেছেন এর বাইরে আমার আর কিছুই বলার নেই।
আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে আপনি করতে পারেন।
আমি চুপ করে আছি, কি জিজ্ঞেস করবো আমি।

আমিওতো আব্বুজানের কথাতেই রাজি হয়েছি।
আমার কোনো কিছুই বলার নেই।

তবে বলতে ইচ্ছে করছে ‘আপনার কণ্ঠটা আমি কোথাও শুনেছি’।
ধ্যাৎ কি ভাববে আমাকে।
ভাববে হয়তো আমি ছেলেদের কণ্ঠ শোনার জন্য কান খাড়া করে রাখি, ছিঃ।

আচ্ছা আমি কি একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখবো।
না না, এমনিতেই খুব লজ্জা লাগছে তার উপর তার দিকে তাকালে যদি সেও আমার দিকে তাকায়।
যদি দু’জনার চোখাচোখি হয়ে যায়, তখন তো লজ্জায় জ্ঞান হারাবো আমি।

  • তবে কি আপনার আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করার নেই!
    আমি এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ালাম।
    সে কি বুঝলো জানিনা, উঠে দাঁড়িয়ে আমার ঠিক তিন হাত সামনে দাঁড়ালো।

আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম তাড়াহুড়ো করে।
দৃষ্টি আমার তখনও ছেলেটার পায়ের দিকে।
ভাবছে হয়তো আমার তার পায়ের পাতা পছন্দ হয়েছে, হাস্যকর।

আমি যে লজ্জায় তার দিকে তাকাতে পারছিনা সে কথা তাকে কেউ যদি বলে দিতো।

  • তাহলে আজকে আসি, আমার সম্পর্কে যা জানার বিয়ের পরই নাহয় জেনে নিবেন।
    ইনশাআল্লাহ্ তাহলে খুব দ্রুতই মুলাকাত হচ্ছে আমাদের।
    তবে একটু ইচ্ছে ছিলো আপনার কণ্ঠ শোনার।
    যাক গে, বিয়ের পরেই নাহয় আমি শুনে নেবো।

নিজের খেয়াল রাখবেন, আল্লাহ্ হাফেজ।
বলেই উনি যেইনা পেছনে ফিরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন ওমনি আমি….


পর্ব ৫ (শেষ)

তাহলে আজকে আসি, আমার সম্পর্কে যা জানার বিয়ের পরই নাহয় জেনে নিবেন।
ইনশাআল্লাহ্ তাহলে খুব দ্রুতই মুলাকাত হচ্ছে আমাদের।
তবে একটু ইচ্ছে ছিলো আপনার কণ্ঠ শোনার।

যাক গে, বিয়ের পরেই নাহয় আমি শুনে নেবো।
নিজের খেয়াল রাখবেন, আল্লাহ্ হাফেজ।
বলেই উনি যেইনা পেছনে ফিরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন ওমনি আমি তার দিকে তাকালাম।
সেদিনের দেখা ছাঁদের মতোই এক বালতি স্টাইল নিয়ে সামনে হেঁটে চলে যাচ্ছেন।

যাক গে, আার তাতে কি।
আচ্ছা আমার কি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো?

বিয়ের সরঞ্জাম গায়ে মেখে চুপ করে বিছানায় বসে আছি আমি।
আমাকে ঘিরে রেখেছে আমার ছোট ছোট কাজিন আর কিছু প্রিয় বান্ধবীরা।
পুরো বাড়ি আমেজে গম গম করছে।

মানুষের শোরগোলে মনেই হচ্ছেনা এই বাড়ি একটা শান্ত বাড়ি ছিলো এতদিন।
আম্মি তো একটু পর পর আমার রুমে এসে উঁকি মেরে যাচ্ছেন।
বান্ধবীদের মজার শ্লোকের সম্মুখীন হচ্ছি আমি ক্ষনে ক্ষনেই।

ভারি ভারি গহনা আর মেকআপের পেছনে, আমার এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া, আব্বুজান আর আম্মিকে রেখে চলে যাওয়ার কষ্টগুলো ফিঁকে পড়ে গেলেও সম্পূর্ণ ঢেকে যায়নি।
জ্বি হ্যাঁ, আজ আমার নিকাহ্।
জাফর আঙ্কেলের ছেলে জারিফের সাথেই।

সেদিন তারা চলে যাওয়ার পর আব্বুজান আমার কাছে এসে বললেন- তারা নাকি খুব দ্রুতই নিকাহ্ এর কাজ শেষ করতে চাইছেন।
আমতা আমতা করে বললেন পরশুই নিকাহ্ করাতে নিয়ে আসবেন ছেলেকে।
আব্বুজানকে এক রাশ অভিমান নিয়ে যখন বললাম–

আব্বুজান আমি তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছিনা।
তবে কেনো এত তাড়াহুড়ো করছেন।

সামনেই তো আমার পরীক্ষা।
পরীক্ষাটা শেষ করে নিলে হতো না?

তখন আব্বুজানের চেহারাটা মলিন হয়ে গিয়েছিলো।
সেই চেহারা আমার নজর এড়ায়নি।
সাথে সাথেই আমার বুকের ভেতর কেমন কেমন হতে লাগলো।

আব্বুজানকে আমি কি কোনো ভাবে কষ্ট দিয়ে ফেললাম!

আব্বুজান বললেন–

  • তারা বলছিলো তাদের তো কোনো মেয়ে নেই, তাই যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের মেয়েকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে চায়।
    আম্মু আমি না করতে পারিনি, তবে আমি এখনই বলে দিচ্ছি তোমার পরীক্ষার পরই যেনো নিকাহ্ হয়।
    আমি আব্বুজানের হাত আমার দু’হাতের মধ্যে নিয়ে চুমু খেলাম।

আমি জানি আব্বুজানও চান না আমাকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে।
কিন্তু যেটা নিয়ম সেটা নিয়মই।
আব্বুজানও এই নিয়মের বাইরে যেতে পারবেন না।

সম্পর্ক ভালোবাসা মায়া এসবই আল্লাহ্ মানুষের অন্তরে সৃষ্টি করে দেন।
কিছু নিয়ম কানুনও দিয়েছেন, আমাদের উচিত নিয়ম মতোই সব পালন করা।
মানুষজাতীর পক্ষে কখনোই সম্ভব না এসব থেকে দূরে পালানো।
সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখে তার আদেশ মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কর্ম।

আব্বুজানের দিকে শীতল দৃষ্টি রেখে বললাম।
আব্বুজান ক্ষমা করবেন আমাকে।
আপনার কথা অমান্য করতে যাচ্ছিলাম।
আপনাকে মনে কষ্ট নিয়ে এই রুম থেকে আমি যেতে দিতে পারবো না।

আপনি যা চান তাই হবে আব্বুজান।
যখন আপনার মর্জি হবে তখনই আমি নিকাহ্ করবো।
তবুও আপনি আমার প্রতি নাখোশ হবেন না।

আব্বুজান আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমার দু’গালে হাত রেখে কপালে ভালোবাসা এঁকে দিলেন।
উনার চোখে পানির আভাস দেখা দিচ্ছে।
আমি বললাম–

  • দো’য়া করবেন আব্বুজান, ইহকালে যেনো আপনাদেরকে খুশি করে যেতে পারি।
    আব্বুজান কিছুই বললেন না।
    আঝোর ধারায় অশ্রু বিষর্জন দিতে দিতেই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলেন বুকে।

আম্মিও দরজায় দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছে নিলেন।

উনারা নাকি এসে গেছেন।
মানে বর পক্ষ এসে গেছেন।
আমার রুমের পাশেই অবশ্য তাদেরকে বসতে দেয়া হয়েছে।

ছোট ছোট কাজিনরা উঁকি ঝুকি দিয়ে দেখছে।
কেউ কেউ শরবত এগিয়ে দিচ্ছেন।
বৃদ্ধা কয়েকজন এসে আমাকে বার কয়েক দেখে গেলেন।

সব কিছুর মাঝেও আমার আশেপাশে কেমন যেনো গুমোট এক অনূভুতি ঘোরাফেরা করছে।
অস্বস্তি আর লজ্জার মাঝেও কেমন অনূভুতিহীন লাগছে সবকিছু।
পর্দার ওপাশে ছেলে পক্ষের কয়েকজন বসে আছেন, পর্দার এ পাশে আমি বসে আছি।

ইচ্ছে করেই ভারি পর্দা সরিয়ে মোটামুটি হালকা একটা পর্দা টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।
বোরকা নিকাবে এদিকটায় মেয়েরা আবৃত হয়ে চুপচাপ পর্যবেক্ষক করছে।
আম্মি কিছুটা আমার কাছেই বসেছেন অবশ্য।

কাবিননামা নাকি পাঁচ লক্ষ এক টাকা ধার্য হয়েছে।
বাবা এ নিয়ে টু শব্দটিও করলেন না।

আমারও তেমন মাথা ব্যাথা নেই এ নিয়ে।
কিন্তু কাজি হুজুর যখন আমাকে উদ্দেশ্য করে জারিফ আঙ্কেলের নাম নিয়ে তার ছেলে ‘জাঈন জারিফ’ এর নাম উচ্চারণ করে কাবিনের টাকার হিসেবটা বললেন, তখন আমি চোখ বড় বড় করে পর্দার ওপাশে তাকালাম।
‘জাঈন জারিফ’ হ্যাঁ উনিই তো।

সেই বাসের ছেলেটাই তো এটা।
ইয়া আল্লাহ্, এটা কি হচ্ছে আমার সাথে।
তার সাথেই কি আমার নিকাহ্ হচ্ছে?

জাফর আঙ্কেলের ছেলেই কি ইনি।
আমি নিকাবের ভেতর থেকেই হা করে তাকিয়ে আছি তার দিকে, অবশ্য নিকাবের উপরও কারুকাজ করা ভারি লাল দুপাট্টা টা লম্বা করে দেয়া ছিলো।
হালকা সাদা পর্দার এপাশ থেকে তার চেহারাটা আবছা বোঝা যাচ্ছে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে তার চেহারা।

এটা কি কোনো কোইন্সিডেন্স নাকি!
নাহ্ এটা তাকদীর, হ্যাঁ অবশ্যই এটা তাকদীর।

তবে আমার তাকদীর এত সুন্দর আর আশ্চর্য করে আল্লাহ্ তৈরি করবেন ভাবতেও অবাক লাগছে আমার।
পাশ থেকে বান্ধবী ফাতেমা আমাকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো।
হালকা শব্দে হেসে কানের কাছে মুখ এনে বললো–

  • কবুল বলছিস না কেনো জারিন?

বরকে সামনে দেখে খেয়ে ফেলবি নাকি?
নিকাহ্টা করে নে, কবুল বলার পর ইচ্ছে মতো তাকিয়ে থাকিস।
তোর বরকে কেউ নিয়ে যাবে না।
বলেই হাসতে লাগলো সে।

আমাকে মুহূর্তেই কোথা থেকে যেনো ডজন খানেক লজ্জা এসে জাপটে ধরলো।
নিকাবের ভেতর থেকেই মুচকি হাসছি আমি।
এবার গুমোট অনূভুতিগুলো মনেহয় দূরে পালিয়ে গেলো।

চারদিক থেকে লজ্জা আর লজ্জা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
ভাগ্যিস নিকাব পড়ে ছিলাম।
নাহয় আমার লজ্জামাখা মুচকি হাসিটা সবাই দেখে নিতো আর হাসতো।

আম্মির ইশারায় ভরাট কণ্ঠে ‘কবুল’ বলে দিলাম আমি।
চোখে আমার পানির ঢেউ খেলছে।
মন চাইছে চিৎকার করে আম্মিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি।
আম্মি আস্তে করে বললেন, আমি যেনো একদমই না কাঁদি, তাহলে আব্বুজান নাকি খুব কষ্ট পাবেন।

উনিও স্বলজ্জায় ‘কবুল’ বলে দিলেন।
আমার মতো এত সময় অবশ্য নেন নি।
ব্যাস, হয়ে গেলাম আমি শরীয়ত মোতাবেক মিসেস জাঈন জারিফ ওরফে জারিন।

এবার কাজি আঙ্কেল আমার দিকে পর্দার নিচ দিয়ে নিকাহ্ নামাটা এগিয়ে দিলেন।
পাথর খচিত কলমটা হাতে নিয়ে সাইন করার জন্য ঝুকতেই ভারি দুপাট্টাটা সামনে এসে পড়লো।
ফাতেমা উপুর করে ধরতেই আমি কাপা কাপা হাতে সাইন করে দিলাম।

জাফর আঙ্কেল সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচ লক্ষ টাকা আব্বুজানের সামনে তুলে ধরলেন।
বললেন- আমিকে যেনো দিয়ে দেয়া হয়।

চোখের পানি মুছতেই আব্বুজান আমার কপালে লম্বা চুমু খেয়ে আমার হাত শক্ত করে ধরে জাঈনের পাশে লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো গাড়িতে বসিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
আমার হাত শক্ত করে ধরে জাঈনকে বললেন–

  • জাঈন, আমার একমাত্র মেয়েটা এখন তোমার দায়িত্ব।

আমানত বললে ভুল হবে, সে এখন সম্পূর্ণই তোমার।
অনুরোধ করছি আমার মেয়েটাকে কখনও কষ্ট দিও না।
খুব যত্নে আগলে রেখেছি এতদিন, জারিন কষ্ট পেলে আমিও কষ্ট পাবো।
জাঈন বললেন–

  • আঙ্কেল এই যে এখন আপনি জারিনের হাত ধরে আছেন।
    গাড়ি ছাড়লেই ছেড়ে দিবেন, সাথে সাথেই আমি জারিনের হাত ধরবো।
    লজ্জার কথা তবুও মুখ ফুটেই বলছি, সেই হাত আর কখনই ছাড়বো না।

ইনশাআল্লাহ্ জারিনকে কোনো দিন আপনার কাছে আমার নামে নালিশের সুযোগ দেবো না।
আব্বুজান মুচকি হেসে বললেন–

  • বাবা বলা শিখে যাও জাঈন, দো’য়া রইলো তোমাদের জন্য।
    আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তোমাদেরকে নেক হায়াত দান করুন।

গাড়ি ছাড়তেই জাঈন সত্যি সত্যিই আমার হাত শক্ত করে ধরলেন।
এক মুহূর্ত উনার দিকে তাকাতেই দেখি উনি প্রসস্থ হাসি মাখা মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি অবনত করে নিলাম আমি।
ইশশ, উনার চোখে চোখ পড়ে গেলো আমার।

মুখে হাসি রেখেই জাঈন বললেন–

  • কবুল বলার সময় আপনার কণ্ঠ শুনেছিলাম।
    তবে তিন শব্দের ঐ ছোট্ট কথায় আমার মন ভরে নি।

আমি আরো শুনতে চাই আপনার কণ্ঠ।

আমি কোনো কথা বললাম না।
দুপাট্টা টা মাথার উপর রাখা, নিকাব পরে আছি অবশ্য।
আমি যে লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছি সেটা উনি বুঝতে পারছেন কিনা কে জানে।

  • মিসেস জাঈন, জড়তা সব আপনার বাড়িতে রেখে আসলে ভালো ছিলো না?
    ধ্যাৎ কি বলছেন উনি।

সদ্য নিকাহ্ হলো আমার, লজ্জা আর জড়তায় ঘিরে থাকবো আমি এটাই তো নিয়ম।
আচ্ছি উনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?
সেদিনের বাসের কথা উনার কি মনে আছে?
না, কেনো মনে থাকবে।

আমার কাছেই তো সেদিনটা নতুন আর মনে রাখার মতো ছিলো, তার কাছে এটা হয়তো স্বাভাবিক।
আমি উনার হাত থেকে আমার হাত ছাড়াতে চাইলে উনি আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন আমার হাত।

উনি দরজার বাহিরের সব হাসি তামাশা আড্ডা শেষ করে প্রায় বিশ মিনিট পর এলেন।
বাকি সময় অবশ্য উনার রুমে আমার সাথে উনার কাজিনরা বসে গল্প করছিলো।
সেদিনের মতোই নিজের রুমে ঢুকার আগে উনি নমনিয় মিষ্টি কণ্ঠে সালাম দিলেন।

এবার আমি আর জবাব দিতে দেরি করলাম না।
আমার জবাব পেয়ে উনি রুমে ঢুকে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে আমার পাশে এসে বসলেন।
লজ্জায় এখন আমার মাথা কাটা যাবার অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেই কখন থেকে জাঈন আমাকে দেখে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই, পাক্কা দশ মিনিট তো হবেই।

আস্তে আস্তে জাঈন তার দু’হাত আমার গালে রাখলেন।
সঙ্গে সঙ্গেই আমি এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিয়ে চোখ বড় বড় করে বললাম–

এই বরফের মতো ঠান্ডা হাত আপনি আমার গালে কেনো রাখলেন?
জাঈন, উনি বিছানা থেকে উঠে পেট ধরে শব্দ কর হাসছেন।
এমন ভাবে হাসছেন মনে হচ্ছে যেনো বিশ্বজয় করে ফেলেছেন।

এবার আমার দিকে ঠান্ডা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–

  • উঠো।
    আমি লজ্জায় উনার হাত ধরে বিছানা থেকে নামতেই বললেন–
  • ওযু করে আসো জারিন, একসাথে নফল নামাজটা আদায় করে নেই।

তারপর মন ভরে তোমার কণ্ঠস্বর শোনার বাকি আছে আমার।
আমিও আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ওযু করতে চলে গেলাম।

নামাজ পড়ে দো’য়া শেষে জাঈন আমার দিকে ঘুরে বসে আমার হাত আলতো করে ধরলেন।
কেনো জানিনা সব কিছুই আমার কাছে কেমন সারপ্রাইজড লাগছে।
জাঈন আমার দিকে ঝুকে এসে বললেন–

  • মাশাআল্লাহ্ আমার বউটা মেকআপহীন খুবই সুন্দরী।
    বলেই জাঈন আমার কপালে হাত রেখে স্বশব্দে পড়লেন-

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَهَا، وَخَيْرَ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا، وَشَرِّ مَا جَبَلْتَهَا عَلَيْهِ (আবু দাউদ)

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি এর যত কল্যাণ রয়েছে এবং যত কল্যাণ তার স্বভাবে আপনি দিয়েছেন তা চাই। আর এর যত অকল্যাণ রয়েছে এবং যত অকল্যাণ ওর স্বভাব-চরিত্রে আপনি রেখেছেন তা থেকেও আপনার আশ্রয় চাই। ’
পড়েই আমার কপালে চুমু খেয়ে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা আংটির বক্স বের করে খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিলেন।

বাহ্ খুব সুন্দর তো স্বর্ণের আংটিটা।
জাঈন বললেন-

  • যেদিন তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম, সেদিনই আংটিটা নিয়েছি।
    মাপটা অবশ্য অনুমান করেই নিয়েছিলাম।

আমি জাঈনের হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে জায়নাজ থেকে উঠে দাঁড়ালাম।
আমার বাড়ি থেকে আনা লাগেজটার কাছে গিয়ে একটা নীল র্যাপিং প্যাপারে মোড়ানো তার জন্য আমার একমাত্র উপহারটা বের করে জাঈনের কাছে গিয়ে বসে সেটা তার সামনে এগিয়ে দিতেই জাঈন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

মনে মনে আমি খুব হাসছি।
জাঈন তো জানেইনা ভেতরে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে।
সে আস্তে আস্তে র্যাপিং প্যাপারটা খুলতেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে আমাকে বললো–

  • আমার ডায়েরী?
    এটা কোথায় পেলে তুমি?

আমি তো ভাবলাম এটা আমি বালিতেই ফেলে এসেছি।
আমি মুচকি হেসে জাঈনকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা খুলে বললাম।
জাঈন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না এত কিছু হয়ে গেছে, শুধু জাঈন কেনো আমি নিজেওতো কিছুই জানতাম না।
তবে ঐ যে তাকদীর, তাকদীরে বিশ্বাস রাখতে হয়।

জাঈন তার ডায়েরীটা টেবিলে রেখে দু’হাত আমার গালে রেখে আমার কপালে চুমু খেলেন।
আমি আবারও লজ্জায় গুটিয়ে গেলাম।
বললেন–

  • মিসেস জাঈন জারিফ, আপনি তো দেখি আমাদের নিকাহ্ হবার পূর্বেই আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন।
    তবে আমি কিছু শর্তে আপনাকে ভালোবাসতে পারি।
    মুহূর্তেই আমার মুখ কালো হয়ে গেলো।

স্ত্রীকে ভালোবাসতে কি কোনো শর্তের প্রয়োজন লাগে?
কে জানে, তার মতো সাহিত্যিকের বোধহয় লাগে।

আমার কপালে আবার চুমু খেয়ে জাঈন বললেন–

  • আমার প্রথম শর্তঃ বিছানায় শুধু মাত্র একটি বালিশ থাকবে যেটাতে আমি ঘুমাবো, আর তুমি ঘুমাবে আমার বুকে।

আমার দ্বিতীয় শর্তঃ শীত হোক কিংবা গরম, সবসময় দুজনের ৮ টি হাত পা একত্রিত করে ঘুমাবো।
আমার তৃতীয় শর্তঃ তুমি কখনোই আমার আগে ঘুম থেকে উঠতে পারবে না।

সব সময় আমি তোমার আগে ঘুম থেকে উঠে তোমার ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকবো।
আমার চতুর্থ শর্তঃ প্রতি শুক্রবার হাতের সব কাজ বন্ধ রাখবো আর দু’জনে বিকেলে ঘুরতে বের হবো।
দু’হাতের পিঠে চুমু খেয়ে জাঈন বললেন–

  • এই চারটা শর্তে রাজি থাকলেই কেবল আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারি।
    বলো এবার, রাজি?
    আমি আর হাসি দমাতে পারলাম না।

দাঁত বের করে হেসেই চললাম, কি না কি শর্ত ভেবেছিলাম আমি, আর উনি কিনা!
জাঈন আমার হাসির দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলেন।

জাঈনের সেই দৃষ্টিতে নেই কোনো কামুকতা আর না কোনো ভারি চাহিদা।
ঐ দৃষ্টিতে আমি শুধু এক সমুদ্র সমান ভালোবাসাই খুঁজে পেলাম।

ওয়াল্লাহি, তার চোখে আমার জন্য সৃষ্টি হওয়া ভালোবাসা কোনোদিন ফুরিয়ে না যাক সে দো’য়াই মনে মনে চেয়ে নিলাম আমি রবের কাছে।

লেখা – ফাহমিদা ইফ্ফাত ছিদ্দীকা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “নিকাহ – bangla romantic biyer golpo from fb” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – নাট্যকার বান্ধবী – প্রেমের নাটকীয় সম্পর্ক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *