যোদ্ধা – রহস্যময় রুপকথার গল্প

যোদ্ধা – রূপকথার গল্প: প্রজারা বিরক্ত হয়ে ওঠে। প্রতিবাদ করে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। রুদ্র নারায়ণ গড়ে প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা। অবশেষে কি হলো জানতে পুরো গল্পটি পড়ুন।


পর্ব ১

“জয় রুদ্র নারায়ণের গড়ের জয়”
“জয় রুদ্র নারায়ণ গড়ের রাজা কেশো নারায়ণের জয়”
প্রজারা চিৎকার করে জয়ের ধ্বনি দিচ্ছে, রাজা কেশো নারায়ণের নামে। যুদ্ধ সজ্জায় প্রস্তুতি নিচ্ছে কেশো নারায়ন। বীরমতে মেতে উঠেছেন তিনি। যুদ্ধের বাজনা বেজে উঠেছে। হাতিরা গর্জন করছে। পাঁচ লক্ষ সৈন্য বাহিনী ওঙ্কার ধ্বনি দিচ্ছে। রেশম বস্ত্রে রাজকীয় রাজপতাকা আকাশে উড়ছে। সবমিলিয়ে চারিদিকে এক বীরচিত পরিবেশ। সেখানে যুদ্ধ সাজে সবাই সজ্জিত হয়ে উঠছে।

রুদ্র নারায়ণ গড়, এক বিশাল প্রাসাদ। প্রাসাদের চূড়া যেন আকাশ ছুঁয়েছে। সামনে এক বিশাল ফুলের বাগান। চারিদিকে সৈনিক দিয়ে ঘেরা। ভিতরে একটা মাছি প্রবেশ করার বিন্দুমাত্র জায়গাও নেই। প্রাসাদটি এত সুন্দর, কিন্তু কেমন যেন নিষ্প্রাণ। আধো অন্ধকার। সূর্যের আলো পৌঁছায় না ভেতরে। সেই অন্ধকার হঠাৎ নেমে এসেছে।
চারিদিকে সৈন্যদল জয়ধ্বনি দিচ্ছে।

মাঝখানে রয়েছে দ্রুতগতি সম্পন্ন একটি শ্বেত অশ্ব। সে বারবার ” কু–হু–হ””করে সামনের দুটো পা উপরে তুলছে। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত সে। প্রাসাদের ভেতর থেকে ধনুকের টংকার বেজে ওঠার সাথে সাথে যুদ্ধ ঘোষণা হল। ধনুকে টংকার এত জোরালো, রুদ্র নারায়ণ গড় সহ পুরো পৃথিবীত কেঁপে উঠলো।
এমন সময় দোতালার দক্ষিণ দিকের একটা বারান্দার দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এল এক ঝলক নরম আলো।

সেই আলোর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসছেন রাজকুমার কেশো নারায়ন। যেমন চাপার মত গায়ের রং, তেমনি মেঘের মতো লম্বা চুল। তেমনই চোখ, তেমনই নাক, তেমনি মুখ। মাথায় রাজযোটক। হাতে ধারালো তরোয়াল। এত সুন্দর! এত সুন্দর রাজপুত্র মনে হয় সারা পৃথিবীতে নেই। সুন্দর্য মনের সাথে কোন মিল নেই। পাষাণ একটা হৃদয় রয়েছে তার। তিনি জনসমক্ষে এসে, নিজের ডান হাত বারবার বুকে চাপড়ে চিৎকার করে বললেন,

  • আমি যোদ্ধা। আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। আজ থেকে প্রতিটি রাজ্য আমার পায়ের তলায় থাকবে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী একটাই নাম হবে, রুদ্র নারায়ণগড়। আর সেই রাজ্যের রাজা হবো আমি কেশো নারায়ন। আমার এই আগ্রাসনের সামনে যে আসবে, সে প্রাণ ভিক্ষা করার সময় পর্যন্ত পাবেনা। ধড় থেকে মুন্ডু নামিয়ে দিব।
    কেশো নারায়ণ জনসমক্ষে বাম হাতে তরোয়াল তুলে রাখে। ডানহাতে তরোয়াল এর ধারালো অংশে হাত মুঠো করে রাখেন। হাত থেকে লাল রক্তরেখা গড়িয়ে পড়ে তরোয়াল এর শেষ অংশ পর্যন্ত। সেই হাত নিয়ে তিনি কপালে দাগ কেটে হুঙ্কার দেন,
  • আমি যোদ্ধা আ-আ-আ-আ-আ-আ
    বারবার নিজের বুকে হাত চাপড়ে হুংকার দিচ্ছেন,
  • আমি যোদ্ধা, আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বীর।
    সাথে সাথে পজাসহ সৈনিকরা জয়ধ্বনী দিতে থাকেন,
    “জয় রুদ্র নারায়ণগড় এর জয়”
    “জয় রুদ্রনগর এর রাজা কেশো নারায়ণের জয়”

এক লাফে তিনি শ্বেত অশ্বর পিঠে উঠে বসেলেন।অশ্ব সামনের দুটো পা উপরে তুলে “কু- হু-হু”করে, আলোর গতিতে দৌড়াতে লাগল। কেশো নারায়ণ অশ্ব পিঠে বসে, দুটো হাত শূন্যে মেলে ধরলো। একটা হাতে রাজকুমারী পার্বতীর দেওয়া আর প্রিয় “কণিকা” তরোয়াল। যেটার সাহায্যে এক নিমিষে হাজার সৈনিকে শেষ করে দিতে পারে। অন্য হাতে অশ্বর কেসকে ধরে তীব্র গতিতে ছুটছেন,পাশের রাজ্য অমৃতনগরীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে।তার পেছনে পাঁচ লক্ষ সৈন্য বাহিনী।

যে কোন রাজ্য কে বধ করার জন্য কেশো নারায়নই একাই যথেষ্ট। তার ওপর পাঁচ লক্ষ সৈন্য বাহিনী। বিশ্বের সমস্ত শক্তিশালী রাজ্যের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ইতিমধ্যে বিনাযুদ্ধে অনেক রাজ্য আত্মসংবরণ করেছে।
যদিও রুদ্র নারানগড় এর একটা দুর্বলতা রয়েছে। ভৌগলিক কারণবশত রুদ্র নারায়ণ গড়ে চারিদিকে নদী অবস্থিত। তাই যুদ্ধের জন্য বেশিরভাগ সময় জাহাজের উপর নির্ভর করতে হয়। তবুও পিছুপা ঘটেনি কেশো নারায়ণ।

গত ৫ বছর আগে রুদ্র নারায়ণ গড় বলে কোন রাজ্য ছিল না। সেই অংশটা অমৃতনগরীর অন্তর্গত ছিল। অমৃত নগরীর রাজা বিজয়, এখান থেকে তেমন কোন রাজ্য কোষ পেতেন না। বরং প্রজাদের পেছনে অনেক বেশি খরচ হতো। দুর্গম নদী পথ পেরিয়ে রাজ্য কোষ আদায় করাও সম্ভব নয়।

প্রজারা বিরক্ত হয়ে ওঠে। প্রতিবাদ করে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। রুদ্র নারায়ণ গড়ে প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা করে, রাজকুমারী পার্বতী এবং রাজকুমার কেশো নারায়ণ। কিন্তু রাজা বিজয় বিনাযুদ্ধে রাজকুমারী পার্বতীকে এই রাজ্য দান করেন। কারণ যুদ্ধের জন্য যা অর্থ ব্যয় হবে, তারা সিকি মাত্রও রুদ্র নারায়ণগড় থেকে পাওয়া যাবে না। স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় রুদ্র নারায়ণ গড়। রাজকুমারী পার্বতী কেশো নারায়ণকে অস্ত্রশিক্ষা দান করেন। এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বানায়।

পরবর্তীতে রাজকুমারী পার্বতী চেষ্টাই পাশের কয়েকটা রাজ্য দখল করে, রুদ্র নারায়ণ গড়ে মানচিত্র বদলায়। রুদ্র নারায়ন গড়ে সীমানা বিশাল হতে থাকে। কেশো নারায়ণকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পার্বতী কে রাজকুমারী পদে নিযুক্ত করা হয়। যদিও তারা বিয়ে করেননি। কেশো নারায়ণের সাহস এবং বিক্রমের কারণে আশেপাশে রাজ্যগুলোর ঘুম কেড়ে নেয়। সম্পদে ঐশ্বর্য পরিপূর্ণ হয় রুদ্র নারায়ণগড়।

এত ক্ষমতাধর হয়েও কেশো নারায়ন ছিল ভীষণ দয়ালু। তার আদর্শ ছিল “তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত সমাজ দেব”। যেটা অসম্ভব সেটা তিনি করে দেখাতেন। রাজ্য মানুষের প্রতি তার ছিল অসীম ভালোবাসা। প্রজাদের সুখ দুখ, আনন্দ-বেদনা নিয়েই তিনি সারাক্ষণ ভাবতেন। ফলে রাজ্যের মানুষরা ছিল খুব সুখী। কোন কিছুর অভাব ছিল না তাদের। তারাও তাদের রাজাকে প্রানের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। মাত্র 21 বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে বসেন। তার শাসন প্রণালী অল্পদিনের প্রজাদের মন জয় করে নেয়।

হলে কি হবে! এত শক্তি যে রাজা, এত সম্পদে পরিপূর্ণ যার ভান্ডার। এত বিশাল আর মহৎ যার মন। সেই মনের গভীরের কোনে ছিল এক নিদারুণ বেদনা। দারুন অসুখী ছিলেন কেশো নারায়ণ। সব থেকেও তার যেন কিছুই নেই। তিনি যেন ভীষণ একা। সারাদিন আনমনা হয়ে থাকতেন।
এত সম্পদে পরিপূর্ণ রাজ্যকে, বারবার বিদেশেরা আক্রমণ করে। কিন্তু সব চেষ্টার ধুলোয় মিশিয়ে দিতেন কেশো নারায়ণ। তিনি একাই শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তেন।

রাজকুমারী পার্বতীও যুদ্ধক্ষেত্রে যেতেন না, কারণ তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গেলে কেশো নারায়ণের ব্যর্থতা ধরা পড়ে যাবে। কেশো নারায়ণ যে সময়ে দশজনকে সৈনকে বোধ করবে। ঠিক সেই সময়ের মধ্যে পার্বতী 25 জন সেনাকে বোধ করতে সক্ষম। অর্থাৎ বিশ্বের ইতিহাসে সেরা যোদ্ধা হিসেবে নাম থাকবে রাজকুমারী পার্বতী। তিনি কেশো নারায়ণের পথে বাধা হতে চাননি।তিনি চেয়েছিলেন কেশো নারায়ণকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বানাতে। এবং বানিয়েও ছিলেন। কিন্তু কোনদিন ভাবেনি কেশো নারায়ণ রুদ্র নারায়ণ গড়ে আদর্শ সাম্য, মৈত্রী, ভালোবাসা ভুলে গিয়ে জাতীয়তাবাদ, আগ্রাসন নীতি গ্রহণ করবেন।

হঠাৎ এক বছরের মধ্যে কোথা থেকে কি হয়ে গেল। কর্পূর এর মত রাজকুমারী পার্বতী উবে গেলেন। কেশো নারায়ণ আগ্রাসন নীতি গ্রহণ করলেন। প্রজারা মটেও এই নীতি মেনে নিতে পারেননি। তবুও মুখ বুঝে সহ্য করছে। রাজার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। তারা যুদ্ধ চাই না শান্তি চায়। একথা তারা রাজাকে বোঝাতে পারে না। যার ভয়ে গোটা বিশ্ব কম্পিত, জড়োসড়ো। তাকে কি করে প্রজারা বোঝাবেন। কেশো নারায়ণ এখন একটা নীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন, যার মাথা উঁচু হয়ে উঠেছে, তার মাথাটা কেটে ফেলে দাও।

মূলত চারটিটি কারণে কেশো নারায়ণের শত্রুরা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারত না। প্রথমত, তার বীর, পৃথিবীর সমস্ত বীর কে হার মানায়। ১০০০ হাজার জন সৈনিকের সামনে একা বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারে। কখনো পায়ের নিচে, কখন শূন্যেউঠে সৈনিকদের ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেয়। দ্বিতীয়ত, তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সাহায্যে বিপরীত দলের যুদ্ধকৌশল বুঝে নাওয়া। তৃতীয়ত, পৌড়ানীতি, প্রথমে শত্রুদলকে বাধা না দিয়ে রাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করতে দিতেন।

রাজ্যে থাকা-খাওয়ার পানিও সবগুলিতেই বিষ মিশে দিয়ে, শত্রুদলকে দুর্বল করে তুলতেন। এরপরে রুদ্র বাহিনী চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে শত্রু দলকে ধ্বংস করে দিতেন। চতুর্থ, তিনি কোন সেনাপতি রাখতেন না, বিশ্বাসঘাতকতার কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে যেতেন এবং সামনে থেকে প্রতিনিধি করতেন।
কিন্তু অমৃত নগরীতে পৌঁছে তিনি একটু বিপাকে পড়লেন। তার যুদ্ধকৌশল যেন তাকে ফেরত দিচ্ছে। কোন সৈনদল তাদের প্রতিহত করতে আসছে না।

তাহলে কি আর্তসর্ম্পন করলো রাজা বিজয়? সেটা মোটেও সম্ভব নয়! বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র অমৃত নগরী। তারা ভয় আত্মসমর্পণ করবে। প্রতি আঘাত আনবে না। এটা কখনোই সম্ভব নয়।
কেশো নারায়ন অগ্নি তীর নিয়ে অমৃত রাজপথ দিকে ছুড়ে দিলেন। রাজপতাকা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। সাথে সাথে পেছন থেকে কয়েক লক্ষ তীর তাদের দিকে ছুটে এলো। অল্প সময়ের মধ্যে এত তীরের আগমন তারা সামলে উঠতে পারল না।

মাটিতে লুটিয়ে পরল হাজার হাজার কেশো নারায়ণের সৈনিকের দল। তবুও দ্বিধা বোধ করলেন না কেশো নারায়ন। তিনি বুক ফুলিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার ধারণা, তিনি একাই অমৃত নগর এর জন্য যথেষ্ট। রাজা বিজয় হুংকার দিয়ে বললেন,

  • এখনো সময় আছে কেশো নারায়ন, সমস্ত সৈন্য নিয়ে তুমি রাজ্যে ফিরে যাও। তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হতে পারো, কিন্তু সামরিক শক্তি থেকে অনেক পিছিয়ে। তোমাকে প্রাণভিক্ষা দিচ্ছি, যে কজন সৈন্যবাহিনী বেঁচে আছে তাদের নিয়েই রাজ্যে ফিরে যাও।

কেশো নারায়ণ হুংকার দিয়ে বলল,

  • আমি যোদ্ধা। তোমাকেও সময় দিচ্ছি তুমি আত্মসংবরণ করো। আমি একাই অমৃত নগর এর সমস্ত সৈনিকের জন্য যথেষ্ট।
  • কেশো নারায়ন, রক্ত দেখেছো রক্তের নদী দেখনি।
  • রাজা বিজয়, রক্তের নদী দেখেছ সাগর দেখনি।
    সঙ্গে সঙ্গে রুদ্র নারায়ণ গড়ের সৈন্যদল তীর ছুড়লেন। প্রতিঘাত করলেন বিপরীত দলের সৈনিকরা। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ।কেশো নারায়ন দুই হাতে দুটো তরোয়াল নিয়ে সৈনিকদের টুকরো টুকরো করতে লাগলেন। ক্রমশই রাজপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। কোন সৈনিকই তার সামনে দাঁড়াতে পারছে না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে, রাজপ্রাসাদের ভেতরে থাকা সমস্ত সৈনিককে দু টুকরো করে দিলেন কেশো নারায়ন।

রাজপ্রাসাদের মধ্যে প্রায় সবাই ভয়ে জড়সড়। ঘরের একটা কোনে লুকিয়ে রয়েছে রাজা বিজয়ের পত্নি, রানি রূপমতি এবং পুত্রবধূ এবং পুত্রবধূর সাত বছরের কন্যা। রানী হয়ে লুকিয়ে থাকা রানীর শোভা পায় না। এটা লজ্জাজনক ঘটনা। রানী যদি লুকিয়ে থাকে তাহলে প্রজারা কার ভরসায় বেঁচে থাকবে। নিজের বিবেকে বাধলো রুপমতীর। তিনি বীরের মতো তরোয়াল নিয়ে কেশো নারায়ণ কে প্রতিহত করলেন। কেশো নারায়ণ একটু দুর্বল হলেন রানীর মায়াবী চোখে।

তিনি কেশো নারায়ণের আসল মা। যদিও দুজনই জানে না তারা মা ছেলে। কিন্তু কেশো নারায়ণের কাছে রানী টিকে থাকতে পারলেন না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে রানীর ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দিলেন কেশো নারায়ন। নিজের মাকে হত্যা করলেন। যদিও তিনি জানেন না রূপবতী তার আসল মা। এই দৃশ্য দেখে পুত্রবধু সহ তার সাত বছরের কন্যা কেঁদে উঠলেন।কী নিশংস ভাবে হত্যা রূপবতী কে? একজন নারীকে হত্যা করতে একটুও হাত কাঁপলো না কেশো নারায়ণের।

তাদের গোটা শরীর থর থর করে কাঁপছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। ভয়ে চোখ, মুখ, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। এবার কেশো নারায়ণ সাত বছরের শিশুর দিকে এগোতে লাগলেন। তার মা চিৎকার করে বলতে লাগল,
ওকে ছেড়ে দাও, আমাকে হত্যা করো। সে একটা শিশু। নিষ্পাপ শিশুকে মেরে তোমার কি লাভ। পবিত্র শিশুকে হত্যা করে পাপের বোঝা বাড়িয়ো না। দয়া করে ওকে ছেড়ে দাও।
কিন্তু কেশো নারায়ণের প্রাসান হৃদয় তামনলো না। সে শিশুটিকে হত্যা করল। তার মা কান্না থামিয়ে চিৎকার করে করে বললেন,

  • তুমি মানুষ নও, মানুষ বেশি তুমি এক হিংস্র পশু, তুমি একটা জানোয়ার, একটা নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করতেও তোমার হাত আটকালো না। এই তুমি রাজা। তোমার আসল পরিচয়। তুমি নাকি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা।যোদ্ধা যেমন সমস্ত মানুষকে হত্যা করে, তেমনি সমস্ত মানুষের দায়িত্ব নিজের হাতে নেয়।তোমার রাজযোটক তোমাকে ঘৃণা করবে।
  • তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা নও, তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ…

কিছু বলার আগেই, কেশো নারায়ণ এক কোপে মুন্ডু সরিয়ে ফেলেন। মুহুর্তের মধ্যে গোটা রাজপ্রাসাদ লাল রঙে ভরে গেল। চারিদিকে শুধু লাশ আর রক্তে লাল। কেশো নারায়ণ সেই রক্তে মাখা মেঝেতে বসে পড়লেন। এটা তিনি কি করলেন? এতগুলো নিষ্পাপ নারীকে হত্যা করলেন? রাজকুমারী পার্বতীর একটাও আদর্শ মানলেন না। সব ভুলে গেল। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। যোদ্ধাকে কাঁদতে নেই। উঠে দাঁড়াতে হয়। যেখানে দাঁড়ালেই মৃত্যু ঘটে রক্তের বন্যা বয়ে।

সেখানে দাঁড়ানোটাই বৃথা। তার কানে তীরের মতন রাজকুমারী পার্বতীর একটা কথা ভেসে আসছিল,”এমন জীবন গঠন করিবে তুমি, মরিলেও কাঁদিবে জগত জননী”। আর এটা তিনি কি করলেন, তিনি মারা গেলে কান্না তো দূরের কথা, কেউ হয়তো পড়াতেও নিয়ে যাবেন না। কুকুর, শিয়াল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে।

পর্ব ২

আত্ম গ্লানিতে ডুবে যাচ্ছিল কেশো নারায়ণ। তিনি রাজকুমারী পার্বতীর একটা কথা রাখেননি। তিনি একের পর এক হত্যা করে চলেছে। কিন্তু কে এই কেশো নারায়ণ? তার বংশের পরিচয় কি? তা সবারই অজানা। রক্তমাখা দেহ নিয়ে তিনি রাজপ্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এলেন। তখন রুদ্রগড়ের সৈন্যরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা কিছুতেই অমৃতনগর সৈন্যদলের সাথে পেরে উঠতে পারছে না।

তিনি আবার দুটো হাতে তলোয়ার নিয়ে বুক ফুলে সৈন্যদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার তরোয়াল ধরা মানে আবার নতুন করে হত্যালীলা শুরু। ইতিমধ্যে তার শরীরে তিন চারটে তির লেগে রয়েছে। তবুও তিনি থামলেন না। কখনো নীচে দিয়ে কখনো শুন্যে উঠে সৈন্যদের বোধ করতে লাগলেন। তিনি একটা তীর ছুড়লে, সেখান থেকে হাজারটা তীর বেরিয়ে যায়। তিনি এত বীভৎসভাবে, কম সময় সৈন্যদের হত্যা করছিল, দেখে মনে হচ্ছিল কেউ ছুরি দিয়ে আলু কাটছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অমৃতনগর রক্তে লাল হয়ে গেল।

আকাশে এক ঝাক শকুনি ঘুরছে। দেহ গুলির ভক্ষণ এর উদ্দেশ্যে। রাজা বিজয় হতভাগ্য হলেন, তার স্বপ্নের রাজ্যকে এক নিমিষে শেষ করে দিল কেশো নারায়ণ। অমৃত নগরী হয়ে গেল শ্মশান পুরি। বিজয়ের চোখের কোনে জল চিকচিক করে উঠেছে। তিনি জানেন না কেশো নারায়ণ উনার নিজের সন্তান। রাজা বিজয় কেশো নারায়ণের কাছে মাথানত করলেন। তার পায়ের কাছে তরোয়াল ফেলে দিয়ে বসে বললেন,

  • তোমার মত বীর এ ত্রিভুবনে নেই। তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। আমিও অমৃত নগরী রাজা বিজয়, তোমার কাছে আত্মসংবরণ করছি। অমৃত নগরী আজ থেকে তোমার। আমাকে দয়া করে প্রাণ ভিক্ষা দাও।
    কেশো নারায়ণ উচ্চ স্বরে বললেন,
  • কিন্তু আপনি ভুল করেছেন। আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন। তার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। আমার আগ্রাসনের সামনে যে আসবে তার ধড় থেকে আমি মুন্ডু নামিয়ে দিব। তোমার বেলাও তার ব্যতিক্রম হবে না মহারাজা বিজয়।
  • কিন্তু আমিতো আত্মসম্মোহর করলা। ক্ষমা চাইলাম। প্রয়োজন হলে সারাজীবন তোমার দাস হয়ে কাটিয়ে দেবো। দয়া করে আমাকে প্রাণে মেরো না।
  • আমার অভিধানে “ক্ষমা”শব্দটি নেই মহারাজা। মাথা উচু হলে তা আমি নামিয়ে দিই।
    রাজা বিজয় প্রচন্ডভাবে ভেঙে পড়লেন। চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এলো। তবুও তিনি এক বীরের মতো বললেন,
  • তবে তাই হোক কেশো নারায়ণ। তুমি আমাকে হত্যা করো। তবে মনে রেখো, একদিন তোমার সামনে আরও এক শক্তিশালী যোদ্ধা আসবে। তোমার সামনে দাঁড়াবে। তোমাকে বোধ করবে। তুমি ক্ষমা চাওয়ার সময়টাও পাবে না।
  • তুমি ভুলে যাচ্ছ মহারাজা। আমাকে অস্ত্রশিক্ষা রানী পার্বতী দিয়েছি। উনি শুভ শক্তির প্রতীক। আমিও শুভ শক্তির প্রতীক। একজন যোদ্ধা থাকতে পৃথিবীতে অপর যোদ্ধা জন্মাতে পারে না। আমি যাকে অস্ত্রশিক্ষা দান করব, পরবর্তীতে সে হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা।

কেশো নারায়ণ বলেই তীব্রগতিতে তরোয়াল ধারালো অংশ দিয়ে রাজা বিজয়ের গলায় বসালেন। ধড় থেকে মুন্ডু প্রায় অনেকটা দূরে গিয়ে পড়ল। ভারতের শক্তিশালী রাজ্য অমৃতনগর পরাজিত হওয়ার পর। অনেক রাজ্য যুদ্ধ করতে রাজি হল না। বিনা যুদ্ধে আত্মসম্বরণ করতে লাগলেন। আর রাজা কেশো নারায়ণের লোভ ক্রমশই বাড়তে লাগলো। একের পর এক রাজ্যকে বোধ করে চলেছেন তিনি।

দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত ছোট্ট একটি রাজ্য সুন্দরগড়। অনেক প্রাচীন রাজ্য। আয়তনের দিক দিয়ে খুবই ছোট। অপূর্ব সৌন্দর্য পরিপূর্ণ এই রাজ্য।রাজ্যের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল রাজকুমারী আলোর সৌন্দর্য। যেখানে সত্য ধর্ম এবং সদাচার পালন করা হতো। উপরে ছিল এক পর্বত।সেখানে নানা সুন্দর এবং সুগন্ধি ফুল ফলের উদ্যান তৈরি করেছিল রানী আলো। এবং অনোন্য বহুমূল্য রত্ন সজ্জিত এক প্রাসাদে আলো থাকতেন। পিতা অগ্নিদেবের একমাত্র সুতা আলো। ছোটবেলা থেকেই মহারানী মারা যান। অগ্নিদেব নিজে হাতে আলোকে বড় করে তুলেন।

মাত্র 18 বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে বসেন। তিনি কোনো অন্যায় সহ্য করতেন না।অন্যায় যে করবে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেন না। সুন্দরগড় তখনকার দিনে একমাত্র রাজ্য। যেখানে পুরুষদের মতো নারীদের সমান ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার ছিল। নারীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। প্রজারা স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটাতে। কোন অভাব ছিল না। সেখানে মানুষ সুখে শান্তিতে নির্বিঘ্নে বসবাস করত। তাদের কোন ভয় ছিল না। সকলেই ধর্ম মেনে চলত এবং সবসময় সরদার করত। অর্থাৎ নৈতিক আদর্শ উচ্চতা সেই নগরীকে অলৌকিক মহিমা দিয়েছিল।

প্রতিদিনের মত আজও রাজকুমারী আলো আর তার সাতজন সখি স্নানের উদ্দেশ্যে সরোবরে গেলেন। চারিদিকে পাহাড়ঘেরা উপত্যকার মাঝে ছিল অপূর্ব সুন্দর এক সরোবর। স্বর্গ লজ্জা পায় এমন সুন্দর পরিবেশ দেখে। চারিদিকে শীতল জল। পুরো সরোবর পদ্মফুলে ভর্তি। সরোবরে নামে রাজকুমারী, কি অপূর্ব রূপ। যেমন তার চোখের রেস, তেমনই তার ক্রোধ। তেমনি তার চাওনি।

প্রথম সখি তার রূপে মোহিত হয়ে বলল,

  • তোমার রুপ স্বর্গের দেবদেবীকে হার মানায় রাজকুমারী। রূপবান রাজকুমার কবে আসবে, তা নিয়ে আমি ভীষণ চিন্তিত।
    প্রথম সখির কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। রাজকুমারীকে নিয়ে তারা খানিকক্ষণ মশকরা করল। তবে আলো সমস্ত সখির মনোভাব দূর করে বললেন,
  • আমি কোন রাজকুমারকে বিয়ে করব না। সাধারণ কোনো কৃষককে বিয়ে করবো। যে শুধু আমায় ভালবাসবে। পুরো রাজ্য চালনা করবে। আমার চাইনা কোন রূপবান পুরুষ। চাই কালো কুচকুচে হৃদয়-মন সুপুরুষ। যার নয়নে থাকবে শুধু মায়া। আর সেই মায়ায় আমি হারিয়ে যাব।

সখীরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রাজকুমার চাই না। চাই একজন সুপুরুষ কৃষক। এটা কেমন কথা রাজকুমারী? সুন্দরগড়ের রাজকুমারী সে। রাজকুমারী হয়ে কি কৃষককে বিয়ে করবে। এটাকি প্রজাদের কাছে শোভা পাবে। কৃষককে কি কেউ ভয় পাবে। রাজা হতে গেলে যুদ্ধবিদ্যা জানার প্রয়োজন। কৃষক নিশ্চয়ই অস্ত্রবিদ্যা পেরে উঠতে পারবেন না। সখীরা রাজকুমারীকে অনেক কথাই বললেন। রাজকুমারী মনের মধ্যে একটা ছবি এঁকে একা একা হাসতে লাগল।

সেই সময় একটা সু-মধুর বাঁশির সুর তাদের কানে ভেসে এলো। বাঁশিতে বেজে ওঠা সুর যেন স্বর্গীয় সব সুর। দূর থেকে রাজকুমারী সহ সব সখিরা তা শুনে অবাক হয়। এ সুর তো সুন্দরগড়ে পাখিদেরও অজানা। তারা মুগ্ধ হয়ে শুনে। কিন্তু সুরকার থাকে আড়ালে। তাকে কেউ দেখতে পায়না।সেই সুরের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক নিদারুণ বেদনা।

অসহ্য যন্ত্রণা যেন তিনি ভুগছেন। কষ্টের মধ্যে কাটছে তার দিন। রাজকুমারী আলো ধীরে ধীরে সরোবর থেকে উঠতে লাগলেন। গায়ে থাকা কাপড় শরীরে লেপ্টে বসে রয়েছে। শরীর থেকে জল ঝরে ঝরে পড়ছে। চন্দনের মতন উজ্জ্বল তার গায়ের রং। তার রূপ এত সুন্দর যে, কেউ দিনের পর দিন একই জায়গায় বসে তার রুপ আহরণ করবে। স্নানের পর তার রূপ যেন আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে। তিনি নগ্নপায়ে মেঠোপথে আগন্তুক সুরের দিকে এগুতে লাগলো। তা দেখে সখীরা আশ্চর্য হয়ে রাজকুমারীকে আটকে বলল,

  • কোথায় যাচ্ছ রাজকুমারী?
  • ওই সুরকার কে খুঁজতে।
  • এই অবস্থায়! তোমার শরীর এখনো ভেজা। এটা রাজকুমারের শোভা পায় না।
  • না সখি আমায় আটকায় না। আমি এই রাজ্যের রাজকুমারী। সবার সুখ-দুখে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছি। কিন্তু ঐ সুরকার কে যার মনে এত বেদনা জমে রয়েছে, তা জানতে হবে। মনের বেদনা দূর করতে হবে।
  • রাজকুমারী, সে সুরকার বেশি কোন বৈরীদল ও হতে পারে। তোমার কাছে এখন কোন অস্ত্র নেই। আমাদের রাজ প্রাসাদে ফিরে যাওয়াই উত্তম।
  • আমি রাজকুমারী আলো। বৈরীদলকে ভয় পাইনা। আমি বিনা অস্ত্রেও যুদ্ধে পারদর্শী।

রাজকুমারী কোন কথা না শুনে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। পিছনে পিছনে সখীরাও গেল। সখিরা বড্ড ভালোবাসে রাজকুমারীকে। তাই রাজকুমারীকে একা ছাড়তে পারল না। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর তারা লক্ষ্য করলো। একজন রাখাল গাছে পিঠ ঠেকিয়ে বসে, এক করুণ সুরে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। রাখাল কে দেখে সখীরা একে অপরের দিকে তাকালো। রাজকুমারী রাখালের কাছে বসতে, রাখাল বাশির সুর থামিয়ে দিল। একটু বিব্রত হয়ে রাজকুমারী দিকে তাকিয়ে বলল,

  • কে তুমি নারী? ভেজা শরীরের জঙ্গলে প্রবেশ করেছ। চলে যাও। এখানে অনেক বিপদ আঁচ পেতে বসে রয়েছে।
  • আমি রাজকুমারী আলো। বিপদকে ভয় পাইনা।
    রাখাল মাথা নত করে বললেন,
  • মার্জনা করবেন রাজকুমারী। আমি বুঝতে পারিনি। আপনি রাজকুমারী আলো।
  • কিন্তু আপনার কিসের এত বেদনা।মা আপনি বাসির সুরে মধ্যে প্রকাশ করছেন। আমার রাজ্যে সবাই সুখী দেখতে চাই, কিন্তু আপনি….
  • আমার কোনো কষ্ট দুঃখ নেই।
  • তাহলে…

রাখাল দাড়িয়ে বলল,

  • আমাদের সবার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। কেশো নারায়ণ বিশ্বজয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। একের পর এক রাজ্য তার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ছে। ধুলোর মতো মিলিয়ে যাচ্ছে কোথায়। কয়েক মাসের মধ্যে উনি আমাদের রাজ্যকে আক্রমণ করবেন। নিমিষে শেষ করে দিবেন আমাদের রাজ্য কে। উনার অভিধানের ক্ষমা শব্দটি নেই। উনি বাচ্চা থেকে নারী কাউকে ছাড়ে না।সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। উনার হাত থেকে আমাদেরকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

রাজকুমারী আলো একটুও ভয় পেলেন না কেশো নারায়ণ কে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে বললেন,

  • আমি রাজকুমারী আলো। যতদিন আমার শরীরে প্রাণ আছে। ততদিন আমার রাজ্যে কোন প্রজার কিছু হতে দেব না। শত্রু দলের বিরুদ্ধে আমি রুখে দাঁড়াবো।
    রাখাল হেসে বললেন,
  • আপনি জানেন না রাজকুমারী, কেশো নারায়ণ বিশ্বের সেরা যোদ্ধা। উনার মত বীর ত্রিভুবনে একটাও নেই। উনি একাই লক্ষ লক্ষ সৈন্য কে বধ করতে সক্ষম।
    আলো একটু আশ্চর্য হলো। কে এই কেশো নারায়ন? যার ভয়ে গোটা বিশ্ব কাঁপছে? তার আসল পরিচয় কী? উনি যদি বিশ্বের সেরা যোদ্ধা হয়, তাহলে কেন নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করে। একজন যোদ্ধার শিশুদেরকে বাঁচানো তার কর্তব্য। নারীদের প্রাণ রক্ষা করা তার আদর্শ। আর তিনি ওদেরই হত্যা করে চলেছে।মনে মনে কেশো নারায়ণের প্রতি তার কৌতূহল বেড়ে গেল। তাকে দেখার ইচ্ছা মনের মধ্যে জাগলো। তবুও রাজকুমারী হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
  • উনি যত বড়ই যোদ্ধা হোক। আমার রাজ্যে রক্ত ঝরতে দেবনা। আমি উনাকে বদ করব। কোন ক্ষুদ্র জিনিসকে ক্ষুদ্র জিনিস দিয়ে সহজে ভাঙ্গা যায় না। ক্ষুদ্র জিনিসকে ভাঙতে হলে কোনো বৃহৎ জিনিসের প্রয়োজন। তেমনি বৃহৎ জিনিসকে ভাঙতে গেল কোন বৃহৎ জিনিস নয় ক্ষুদ্র জিনিস প্রয়োজন। তেমনি এই বীরকে কোন বীর হত্যা করতে পারবে না। কোন সাধারণ মানুষই হত্যা করবে। আর সেই সাধারণ মানুষ হবো আমি, রাজকুমারী আলো।

কিছু শব্দার্থঃ

সুতা- কন্যা
বৈরীদল- শত্রু দল
সখি- বন্ধু
ভৈরবে- ভয়ংকরভাবে
ভগবতী- দেবী
রত্নাকর–রত্নের খনি

পর্ব ৩

ক্লান্ত,বৃদ্ধ রাজা অগ্নিদেব সিংহাসনে বসে রয়েছেন। তিনি খুবই চিন্তিত।রাজ্যের কোনো রাজকুমার নেই এটার চিন্তা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল অগ্নিদেবকে। পরবর্তী রাজ্যের দায়িত্ব কে নিবেন। কিছু একটা ব্যাপার ভাবতে ভাবতে সেনাপতি রাজ দরবারে প্রবেশ করলেন। তিনি বুকে হাত দিয়ে রাজা মশাই কে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বললেন

  • মহারাজ মার্জনা করিবেন।আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, কেশো নারায়ণ যেভাবে একের পর এক রাজ্য জয় করে চলেছে, অতি শিগগিরই তিনি আমাদের রাজ্য আক্রমণ করবেন।আমার মনে হয়, আমাদের এখন থেকে আত্মসংবরণ করা উচিত।

মহারাজা নিশ্চুপ। তিনি কিছুই বলছেন না।তিনি ভালোভাবে জানেন কেশো নারায়ণের সাথে তার সৈন্যদল পেরে উঠতে পারবে না। তবুও বিনা যুদ্ধে তিনি হার মানতে চান না। আবার পুরনো অতীতের কথা মনে পড়লে, শরীর শিরশির করে ওঠে। কিন্তু কেশো নারায়ণ পুরনো অতীত জানলেও ওদের ছাড়বে না। ওর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা মানে মৃত্যুই একমাত্র পথ। তবুও প্রজাদের সুরক্ষার কথা ভেবে এখানে যুদ্ধ ঘোষণা করায় উচিত। কিন্তু মহারাজা কি আদৌ করবেন? মহামন্ত্রী তিনিও মহারাজকে যথাযোগ্য শ্রদ্ধা জানিয়ে বললেন,

  • হে মহারাজ, আমি সেনাপতির কথায় সমত পোষণ করছি। আমাদের আত্মসম্বরণ করাই একমাত্র পথ।এতে কিছু না হলে অন্তত কয়েকটা প্রাণ রক্ষা পাবে।
    বেশ খানিকক্ষণ রাজদরবার নিশ্চুপ হয়ে রইল। মহামন্ত্রী থেকে শুরু করে সেনাপতি সবাই নিজেদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পিনপতন একটা শব্দও নেই। মহারাজার বার্তায়, তাদের প্রাণ নির্ভর। অগ্নিদেব সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
  • তবে তাই হোক, কেশো নারায়ণকে আমাদের আত্মসংবরণ এর পত্র পাঠাও।
    মহারাজের এই বার্তায় রাজপ্রাসাদের মধ্যে একটা খুশির আলো ভরে গেল। সবাই আনন্দে আত্মহারা হলো। সেনাপতি থেকে মহামন্ত্রী সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। মহারাজ আবার সিংহাসনে বসে পড়লেন। নিজের কর্তব্য লাগছে। তিনি রাজা হয়ে বিনাযুদ্ধে রাজ্য ছেড়ে দিলেন। প্রজাদের কথা একবারও ভাবলেন না। কি নিষ্ঠুর এই মহারাজ? নিজের আত্মসম্মান বোধ বলতে কিছুই নেই।ঠিক সেই সময় রাজকুমারী আলো প্রবেশ করল।তিনি উচ্চ কণ্ঠে বললেন,
  • পিতা এ কী নিধান তোমার?

অগ্নিদেব চুপ করে বসে রয়েছেন। কিছু বলছেন না। আলো আবার বলল,

  • পিতা এটা হতে পারে না, বিনা যুদ্ধে আমরা রাজ্য ছেড়ে দেবো না। আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করবো।
    সেনাপতি মশাই বললেন,
  • আপনি জানেন না কেশো নারায়নকে। উনি বিশ্বের সেরা বীর। যে কোন রাজ্যকে তিনি একা হাতে শেষ করে দিতে সক্ষম। আমরা উনার বিরুদ্ধে কিভাবে যুদ্ধ করব।
  • চুপ করো সেনাপতিমশাই। আপনি যদি রাজ্যের সেনাপতি হয়ে, ভীতু হন। তাহলে রাজ্যের মানুষ কার ভরসায় বাঁচবে? তুমি সেনাপতি পদে নিযুক্ত হয়েছে। সেনাপতির মানে বুঝেন আপনি? বোঝেন না,বুঝলে এই কথা বলতেন না।তোমার উচিত রাজ্যের জন্য প্রাণ দান করা।তুমি না করে প্রাণের ভয়ে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। এটা তোমার শোভা পায় না সেনাপতিমশাই।
  • মার্জনা করবেন রাজকুমারী, আপনি যুদ্ধে যেতে পারেন আমি যুদ্ধে যাবো না। প্রয়োজন হলে আমি সেনাপতি ত্যাগ করব। আপনার প্রাণের ভয় না থাকতে পারে, আমার প্রাণের ভয়ে রয়েছে। বাড়িতে ছোট ছোট শিশু রয়েছে।
  • সেনাপতি মশাই!
  • হ্যাঁ রাজকুমারী! আমি চাইনা সেনাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করতে।
    এদিকে মহামন্ত্রী তিনি বলে উঠলেন,
  • শুধু সেনাপতি নয়, আমিও মহামন্ত্রীর আসন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবো। তবে ওই মানব জ্ঞানহীন কেশো নারায়ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবো না। উনি শুধু রাজ্য জয় করেন না, সঙ্গে সঙ্গে নিশংসভাবে বাচ্চা শিশু, নারীদের হত্যা করতে কোন দ্বিধাবোধ করেন না।
    এবার মহারাজা মুখ খুললেন। তিনি উচ্চ কণ্ঠে বললেন,
  • সেনাপতি মশাই! মহামন্ত্রী! আপনাদের আসল রূপ তাহলে এটাই। আপনার কী করে তাহলে রাজ্যের মানুষের দায়িত্ব নিবেন? আমি ভেবেছিলাম পরবর্তী রাজ্যের ভার দিব সেনাপতি মশাইকে। কিন্তু তুমি তো ভীতু কাপুরুষ। তোমাকে বন্দি করা উচিত।
    সিংহাসন ত্যাগ করে তিনি নীচের দিকে নামতে নামতে বললেন,
  • আমি যুদ্ধে যাবো। বিনা যুদ্ধে আমরা এক ইঞ্চিও অংশ ছাড়তে রাজি নই। এতে যদি প্রাণ যায় রক্তের বন্যা বয়ে তবে তাই হোক।
    রাজকুমারী আলো উচ্চ কণ্ঠে বললেন,
  • না পিতা, যুদ্ধে আমি যাব।
  • তা হয় না আলো। কেশো নারায়ণ এর সাথে যুদ্ধ করা মানে মৃত্যু অনিবার্য। আমি আমার মৃত্যু জেনেই যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছি। তুমি যেওনা। তোমার বয়স অল্প।
    রাজকুমারী আলো পিতার পায়ের কাছে মাথা নত করলেন, তার ডান হাত বুকে রেখে বললেন,
    “থাকিতে দাস, যদি যাও রণে তুমি,

এ কলঙ্ক, পিতা ঘুষিবে জগতে”
(সংগৃহীত)
অগ্নিদেব কন্যাকে হাত দিয়ে তুলে দিলেন। ভীষণ ক্লান্ত অগ্নিদেব। চোখে জল গড়িয়ে এলো।তার পিতাকে ভেঙে পড়তে দেখে তিনি বললেন,

  • পিতা,চোখে অশ্রু কেন? রাজার চোখে অশ্রু কি শোভা পায়?
    অগ্নিদেব চোখের জল মুছে বললেন,
  • না কন্যা, তবে আমি এক কন্যাকে হারিয়ে আর এক কন্যাকে হারাতে চাইনা।
    রাজসভা পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল। এতদিন সুন্দর গড়ের মানুষ জেনে এসেছে, অগ্নিদেবের একটি মাত্র কন্যা সেটা হল আলো। কোন কন্যার কথা তিনি বলছেন। এবার আলোর চোখের কোনে জল চিকচিক করে উঠলো। আশ্চর্য হয়ে তার পিতাকে বললেন,
  • কোন কন্যা পিতা? যেটা তুমি সবার কাছে লুকিয়ে রেখেছো।

ক্লান্ত, ভয়ে জর্জরিত মহারাজ তার দিকে তাকিয়ে বললেন,

  • আমার জ্যৈষ্ঠ কন্যা পার্বতী। কেশো নারায়নকে যিনি অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন সে আর কেউ নয়, সে আমার জ্যৈষ্ঠ কন্যা রাজকুমারী পার্বতী।
    পুরো রাজসভায় নীরবতা বিরাজ করছে। সবারই কল্পনার বাইরে রাজকুমারী পার্বতী আসলে অগ্নিদেবের কন্যা। যার জন্য আজ গোটা বিশ্ব কম্পিত। ভয়ে তটস্থ।

(যোদ্ধা নামের এই রুপকথার গল্পটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানাতে আমাদের কমেন্ট করুন।)

আজ থেকে 25 বছর আগে, সুন্দরগড়ে রাজ ঠাকুর তিনি ভাগ্য নির্ধারণ করে বলে দেন,অগ্নিদেব আর মহারানীর মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান কন্যা হবে।তাই প্রথম সন্তান কন্যা হওয়ায় অগ্নিদেব বড় চিন্তিত হয়ে গেলেন। তিনি জানেন এরপর তার যে সন্তান হবে সে কন্যা। পরবর্তীতে রাজ্যের রাজা কে হবে? তিনি অসুখে দ্বিধায় ভুগতে থাকলেন। তখন তার মাথায় একটা কুসংস্কার খেলে গেল।তিনি কুসংস্কারের একটি চরম অধ্যায়ের সৃষ্টি করলেন।তিনি রাজকুমারী পার্বতীকে একটা নদীতে মান্দাস করে ভাসিয়ে দেন।

ভাবলেন, হয়তো রাজকুমারী কোথাও গিয়ে না কোথাও ঘাটে লাগবে। আর তারা ঠিক তাকে বাঁচিয়ে নিবে।প্রজাদের কথা ভেবে তিনি নিজের সন্তানকে এইভাবে বিলিয়ে দিলেন। মহারাজা নিজেই সেই মান্দাস এর উপর নজর রাখলে। যে ভাগ্যের পরিহাস এর জন্য, কন্যাকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্য কিন্তু পরিবর্তন হলো না।উনি ভেবেছিলেন দ্বিতীয় সন্তান কন্যা হওয়ার পর, তৃতীয় সন্তান পুত্র হইবে। কিন্তু তা হলোনা।তৃতীয় সন্তান জন্ম দেওয়ার আগেই মহারানী মারা যায়।

মহারাজ অগ্নিদেব তখন আরো দ্বিধা, যন্ত্রণায় ভুগতে থাকেন। নিজের পাপ নিজেকে তাড়িয়ে বেড়ায়। রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। একটা নিষ্পাপ শিশুর সাথে তিনি কি করলেন। তাকে দেখে রাতের চাঁদ নিজের মুখ লুকায়। নিজের সন্তানকে নিজের জলে ভাসিয়ে দিলেন। তিনি চাইলেন তার সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু তখন সব শেষ।
মান্দাস ভাসতে ভাসতে রুপ নগরীতে পৌঁছায়। যার বর্তমান নাম রুদ্র নারায়ণগড়।

তখন রুদ্র নারানগড় এর রাজা বিক্রম ছিলেন খুব সহজ সরল মানুষ। প্রজাদের পাশে সবসময় থাকতেন। ন্যায়-অন্যায় সত্য ধর্ম এবং সদাচার পালন করা হতো। তবে তিনি এবং মহারানী খুবই চিন্তিত ছিলেন। তাদের মধ্যে কোন সন্তান ছিল না। তারা সব সময় নদীর পাশে এসে ঘুরে বেড়াতেন। নিজেদের সুখ-দুখ নিয়ে আলোচনা করতেন। বারবার মহারানী বিক্রমকে বলতেন আমাকে “একটা সন্তান দিন”। কিন্তু ব্যর্থ মহারাজ বিক্রম তা কখনোই পূরণ করতে পারেননি। এমনই একদিন সেই মান্দাস নদীর ঘাটে ভেসে ওঠে। মহারানী উদ্বেলিত হয়ে দেখেন। এক সুন্দর ফুটফুটে কন্যা সন্তান। মহারানী তাকে তুলে নেন। রাজা বিক্রম অনেক বাধা দেয় তবুও তিনি কোনো কথা শুনেননি,

রূপবতী কন্যা এলে
সাগর জলে ভেসে।
না জানি হায় এতটা কাল
ছিলে যে কোন দেশে
এলে সাগর
জলে ভেসে।
এলে সাগর
জলে ভেসে।
এলে আমার
মনের দেশে।
তোমায় দেখে মুগ্ধ চোখে
স্বপ্ন নামে হাজার।
প্রথমদেখে হিয়ার মাঝে
লাগলো দোলা আমার।
তোমায় দেখে মুগ্ধ চোখে
স্বপ্ন নামে হাজার।
প্রথম দেখেই হিয়ার মাঝে
লাগলো দোলা আমার।
রূপবতী কন্যা এলে
সাগর জলে ভেসে।
না জানি হায় এতোটা কাল
ছিলে যে কোন দেশে।

রাজা বিক্রম এবং মহারানী, কন্যার নাম দেন রাজকুমারী পার্বতী। খুব অল্প বয়সে রাজকুমারী পার্বতী অস্ত্রশিক্ষা পারদর্শী হয়ে ওঠে। প্রজাদের সবাইকে তিনি বলেন রাজকুমারী পার্বতী নিজের সন্তান। আর অগ্নিদেব তিনি একটু আশ্বস্ত হন। তার কন্যা হয়তো পিতার কাছে বড় হতে পারেনি। তবে সে এক পিতাকে ছেড়ে আরেকটি পিতা কে পেয়েছে। তিনি চাইলেন না রাজকুমারী পার্বতীর আসল পরিচয় দিতে। এতে রাজকুমারী আরো বেশি কষ্ট পাবে। একে সে নিজের পিতাকে ছেড়ে থাকতে চাইবে না।

আবার রাজা বিক্রম এবং মহারানী কে ছাড়া আসতেও চাইবে না। রাজকুমারী পার্বতী এক অজানার কারণে সব সময় নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াতেন। খেলাধুলা থেকে সবকিছুই তিনি নদীর পাড়ে করতেন।তাকে পাহারা দেওয়ার জন্য অনেক সেনাবাহিনীর মোতায়েন থাকত দূর থেকে। যেটা রাজকুমারী পার্বতী টের করতে পারতেন না। রাজপ্রাসাদের থাকতে মন চাইতো না। রাজপরিবারের রক্ত তার গায়ে বয়ে ছিল। তাই তিনি বারবার যুদ্ধ করতে চাইতেন। রাজা বিক্রম তিনি নিজে কন্যাকে যুদ্ধবিদ্যা সেখান।দিনের-পর-দিন রাজকুমারী পার্বতী যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে।

রাজকুমারীর বয়স যখন 12 বছর তখনই ঘটলো আর এক চরম ঘটনা। তখন অমৃত নগরীর আগ্রাসন নীতিতে রূপনগর (রুদ্র নারায়ণ গড়) তটস্থ। অমৃত নগরের রাজা বিজয়ের দুই সন্তান ছিল। প্রথম সন্তান রাজকুমার পৃথ্বীজিৎ। এবং দ্বিতীয় সন্তান কেশো নারায়ন। কেশো নারায়ণের যখন বয়স 5 বছর। তখনই অমৃত নগরী এবং রূপনগর (রুদ্র নারায়ণ গড়) মধ্যে তীব্র যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে প্রায় দুই দলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তবে অমৃতনগর যতটা ক্ষতি হয়েছিল তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রূপনগর (রুদ্র নারায়ণ গড়)। রুদ্র নারায়ণ গড়ের সৈন্যরা ওদের সাথে যুদ্ধে পেরে উঠতে পারেনি। ওরা পরাজিত স্বীকার করে।

রূপকথার গল্প আগেকার দিনের ভাষা এখনকার দিনের ভাষার মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। সেই ভাষা আমি ঠিক করতে গিয়ে অনেক জায়গায় গুলিয়ে ফেলেছি। কখনো এখানকার ভাষা আবার কখনো আগেকার দিনে ভাষার যোগ করে ফেলেছি। প্লিজ মাফ করবেন। আমার চোখে সেগুলো ধরা পড়লে পরবর্তী সময় এডিট করে দিব।আপনাদের চোখের সামনে ধরা পড়লে কমেন্টে সেই ভুলগুলি ধরিয়ে দিবে।


পর্ব ৪

রূপনগরে (রুদ্র নারায়ণগড়) এবং অমৃত নগর এর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বাঁধে। অমৃত নগরী শক্তিশালী রাষ্ট্র হলেও রূপনগরে পরাস্ত করতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। রূপনগরে পাল্টা জবাব দিতে থাকে অমৃত নগরীকে। কিন্তু খুব কম সৈন্যসামন্ত পেরে উঠতে পারে নি অমৃত নগরীকে পরাস্ত করতে। যত বেলা বাড়তে থাকে ততই রূপনারানের সৈনদল ধ্বংসের পরিণত হয়।আরো ভেঙে পরে রূপনগরের সৈন, যখন রাজা বিক্রম মারা যান। এখানে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। পুরো রূপনগরে অমৃতনগর দখলে চলে আসে। চলে নির্মম হত্যালীলা। এই হত্যালীলা বাচ্চা থেকে শিশু কাউকে ছাড় দেয়নি রাজা বিজয়।

রূপনগরের মহারানী নিজেকে বাঁচাতে তিনি অমৃত নগরীর ছোট রাজকুমার কেশো নারায়ণের সামনে তরোয়াল ধরে রাখে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, তার গায়ে কিংবা রাজকুমারী পার্বতীর গায়ে যদি একটু আঘাত লাগে, তাহলে তিনি ছোট্ট কেশো নারায়ন কে হত্যা করবেন। তখন মহারাজা বিজয় বাধ্য হয়ে উনাদেরকে ছেড়ে দেন। কিন্তু মহারানী মহারাজকে বিশ্বাস করতে পারেন না। তিনি ছোট্ট কেশো নারায়ন এবং বেঁচে থাকা কয়েকজন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সমুদ্রপথে নিজের রাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তার পেছনে পেছনে অমৃতনগর সৈন্য-সামন্ত ধাওয়া করে। মাঝ সমুদ্রে শুরু হয় প্রবল ঝড়। ঝড়ে নিস্তেজ হয়ে যায় অমৃত নগরী এবং রূপনগরীর সৈন্যদল।

মহারানী নিশ্চিত তার প্রাণ কেউ রক্ষা করতে পারবেন না। তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। তিনি ছোট্ট কেশো নারায়নের দিকে তাকালেন। সে তো এখন ঘুমাচ্ছে। মহারানীর বিবেকে লাগলো। তার জন্য এই ছোট্ট শিশুটি মারা যাবে। তাদের মধ্যে শত্রুতা, ওই বাচ্চা ছেলেটিকে পোহাতে হবে। অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করতে হবে। শত্রু দলের ছেলে হতে পারে, কিন্তু নিষ্পাপ শিশুকে হত্যার মুখে ঠেলে দেওয়া মত জঘন্য পাপ তিনি করতে পারেন না। একটা ছোট্ট মান্দাসে, তিনি কেশো নারায়ণকে ভাসিয়ে দেন।

এবং নিজে মৃত্যুবরণ করেন। সমুদ্র ঝড়ের পর ধরে নেওয়া হয় রূপনগরের মহারানী এবং অমৃতনগর ছোট্ট রাজকুমার মারা গেছে। শোকের ছায়া নেমে এসেছে অমৃতনগর মধ্যে। মহারানী রূপমতী খুব ভেঙ্গে পড়ে ছোট্ট সন্তানকে হারিয়ে। উনি প্রতিজ্ঞা করেন রূপনগরের রাজকুমারী পার্বতী কে হত্যা করে উনি কেশো নারায়ণের হত্যার প্রতিশোধ নেবেন।পরের দিনই রূপনগরে রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে অমৃতনগর সৈন্যবাহিনী। শুরু করে চরম হত্যালীলা। রাজকুমারী পার্বতীর বয়স তখন ১২ বছর। তিনি কিছুই জানেন না। তবে একটা কথা বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি যদি রাজকুমারীর বেশে থাকেন তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য।

তিনি রাজকুমারীর পোশাক-আশাক ছেড়ে দিয়ে সাধারণ পোশাক পরিহার করে। অমৃত নগরীর সৈনদল রাজকুমারী পার্বতীকে না পিয়ে আরও চরমভাবে হত্যা শুরু করে। তাও রাজকুমারী পার্বতীকে খুঁজে পাননি।একদিন হত্যালীলা পর অমৃতনগর সৈন্যদল ফিরে যায় এবং কিছু সৈন রাজপ্রাসাদে থেকে যায়।সেনাপতি মশাইকে রুপ নগরের দায়িত্ব দেন রাজা বিজয়।

দুদিন ধরে পেটে একমুঠো ভাত না পড়ায় ভেঙ্গে পড়ে রাজকুমারী পার্বতী। তিনি চিৎকার করে করে খাওয়ার চাইতে থাকেন। কিন্তু কেউ দেয়নি। এদিক ওদিক সে ছুটে বেড়ায়, খাবার খুঁজতে। সে নদীর পাশে গিয়ে জল তুলে পান করতে থাকে। অন্তত কিছু সময়ের জন্য বেঁচে থাকতে পারবেন।জল পান করে তিনি কয়েক মুহুর্তের জন্য নদীর পাড়েই ঘুমিয়ে পড়েন। সমুদ্র তখন ভয়ঙ্করভাবে গর্জন করছে। তীব্র ঢেউ নদীর পাড়ে আছাড় খাচ্ছে। ভেঙ্গে চুরমার করে দিচ্ছে নদীর পাড়।

সেই সাথে ভেঙে যাচ্ছে রাজকুমারী পার্বতীর হৃদয়। হঠাৎ কোনো শিশু তীক্ষ্ণ কান্নার রাজকুমারীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। এই নদীর পারে শিশুর কান্না। তা কি সম্ভব? কোন কিছুই অসম্ভব নয়।রাজকুমারী ব্যাকুল হয়ে ওঠে সেই শিশুটিকে দেখার জন্য।রাজকুমারী উঠে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগে সেই শিশুটিকে। কে এই শিশু? যে তীক্ষ্ণ ভাবে শুধু কান্না করে চলেছে।তিনি লক্ষ্য করেন নদীতে একটি ছোট্ট মান্দাস ভাসছে, আর সেখান থেকেই ভেসে আসছে তীক্ষ্ণ কান্নার সুর।

সে অনেক কষ্টে সেই মান্দাসকে নদীর পাড়ে আনে। মান্দাস দেখেই তিনি বড়ই আশ্চর্য বোধ করে। ওই মান্দাসের ভেতর রয়েছে এক ছোট্ট শিশু। তখনো শিশুটি তীব্র আর্তনাদ করে কেঁদে চলেছে। পার্বতীর মন আর বাঁধলো না, সে ছোট্ট শিশুটিকে কোলে তুলে নিল। তখনো কান্না করে চলেছে। দেখে মনে হয় শিশুটিও তার মতন দুদিন ধরে কোন খাওয়ার ভক্ষণ করে নি। খিদার চোটে তার তীব্র কান্না। কিন্তু শিশুটিকে কী খেতে দেবেন রাজকুমারী? নিজে এই আজ দুই দিন না খেয়ে রয়েছে। তার উপর একটা বাচ্চা শিশু। সে পারলোনা বাচ্চা শিশুর কান্না দেখতে। তাকে কোলে করে গ্রামে উদ্দেশ্যে চলল।

গ্রামে গিয়ে সে একের পর এক কুঠির দরজায় টোকা দিতে লাগলেন। কিন্তু কেউ খুললো না। যার দরজা খোলা ছিল সে আবার বন্ধ করে দিল। একজন ভদ্রমহিলা বাড়ির সামনে বসে থাকতে দেখে রাজকুমারী পার্বতী তাকে বললেন,

  • আমাকে দুমুঠো ভাত দিন না। ওই শিশুটি কাঁদছে। তাকে খেতে না দিলে মারা যাবে। দয়া করে ভাত দিন দুমুঠো।

কিন্তু ভদ্র মহিলার পাষাণ হৃদয় ওই শিশুটির কথায় মন গলল না। তিনি রাজকুমারীকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন,

  • যা এখান থেকে ভাগ। আমরা নিজেরা খেতে পারিনা তোকে কি করে খেতে দিব।
    রাজকুমারী আবার উঠে ভাত চাইলো। তার জন্য নয় ছোট্ট শিশুটির জন্য। কিন্তু তাদের পাষাণহৃদয় সে গলাতে পারলো না।রাজকুমারী আরো কিছুদূর গিয়ে তিনি আবার একজনকে ভাত চাইলেন,
  • দিন না, আমাকে এক মুঠো ভাত। শিশুটা ভীষণ কান্না করছে। না খেতে পারলে মারা যাবে। দয়া করে ওকে কিছু খেতে দিন। দয়া করে এক মুঠো ভাত দিন।
    রাজকুমারী পার্বতী লোকটির পায়ে ধরে বসে পড়লেন এবং চিৎকার করে করে এক মুঠো ভাত চাইলে। কিন্তু লোকটি ভাত দিল না। তিনি রাজকুমারী পার্বতী থেকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন,
  • তোদের পিতা মাতা কেমন রে? যদি সন্তানদের খাওয়াতে পারবে না তাহলে জন্ম দিয়েছিল কেন? আমার একটা নয় দুটো।
    এমন বিদ্রূপ কথাতেও রাজকুমারী পার্বতী সরে আসলো না। সে জানে,দুমুঠো ভাত না পেলে ছোট্ট শিশুটি মারা যাবে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করলো দুমুঠো ভাত সংগ্রহের জন্য। গ্রামের প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতে সে ভাত চাইল। কিন্তু কেউ এক মুঠো ভাত দিল না। রাজকুমারী হৃদয় হাহাকারে উঠেছে। এটাই কি তাদের রাজ্য। এই রাজ্যের তিনি রাজকুমারী। হয়তো তার পরিচয়টা গোপনে রয়েছে। গ্রামের মানুষেরা যে আদর্শ বড় হয়েছে তার বিন্দুমাত্র পরিচয় রাজকুমারী দেখতে পেলেন না। সবাই স্বার্থপর! স্বার্থপর! কেউ দুমুঠো অন্ন দিল না। তীব্র এক কষ্টকর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে হবে রাজকুমারী পার্বতী এবং কেশো নারায়নকে। তবুও রাজকুমারী পার্বতী শেষ চেষ্টা করলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন সে রাজকুমারী পার্বতী, সে বেঁচে থাকতে ওই ছোট্ট শিশুটির কিছু ক্ষতি হতে দিবেন না। তিনি শেষমেষ আর এক বাড়িতে গিয়ে দুমুঠো ভাত চাইল। চাষী তার দিকে তাকিয়ে বলল,
  • আমি তোমাকে ভাত দেব, কিন্তু তার বিনিময়ে তুমি কি দিবে?
    রাজকুমারী পার্বতী মুখে একটু হলেও হাসি ফুটে উঠল। সে চাষীর দিকে তাকিয়ে বলল,
  • আমার কাছে তো কিছু নেই। আমি আপনাকে কি দিব। দয়া করে ওই শিশুটির প্রাণ বাঁচান। ওই শিশু দুমুঠো ভাত না পেলে যে মারা যাবে।
  • তোকে ভাত দিতে পারি। যদি তুই আমার একটা কাজ করতে রাজি হোস?
  • কি কাজ বল। আমি সব কাজ করতে রাজি আছি।
  • তুই আমার গুরু গুলোর জন্য এক আঁটি ঘাস নিয়ে আয়। তবেই তোকে আমি ভাত দিব। না হলে এখান থেকে চলে যা।
    পার্বতী আর সময় নষ্ট করল না। শিশুটিকে নিয়ে ঘাস সংগ্রহ করতে লাগলো। সে একটা নিরাময় জায়গায় শিশুটিকে শুইয়ে দিল। তখনো কান্না থামেনি শিশুটি। পার্বতী বারবার রাজকুমার কে বলছে “কান্দিস না! কান্দিস না! একটু অপেক্ষা কর, দেখবি আমি ঠিক ভাত সংগ্রহ করতে পারব। তুই একটু চুপ করে থাক”। কিন্তু রাজকুমারীর কোন কথা শুনলো না শিশুটি। খিদূর চোটে তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। রাজকুমারী ঘাস কাটতে লাগল। ঘাস কাটার অভিজ্ঞতা তার কখনোই নেই। প্রাসাদের মধ্যে বড় হয়েছে। তার পেছনে সবসময় দাস-দাসীরা ছিল। আর আজ তিনি ঘাস কাটছেন। ভাগ্য যে চাকার মতো ঘুরে। কখন কার দিকে থাকবে তা বোঝা বড়ই মুশকিল। ভাগ্যের পরিহাসে আজ তারা সব হারিয়েছে।তিনি নিজেই ছোট্ট শিশু,তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে ভগবান আবার আর এক ছোট্ট শিশুকে। দুদিন হল পিতা-মাতাকে হারিয়েছে। সেই কষ্ট ভুলতে না ভুলতে আবার এক কষ্ট এসে উপস্থিত। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছিল। তবুও তিনি কোনো বাধা মানলেন না। এক আঁটি ঘাস নিয়ে কৃষকের কুটীর-দ্বারে উপস্থিত হল। এক আঁটি ঘাস এর বিনিময় দুমুঠো ভাত নিয়ে এলো। কিন্তু শিশুটিকে ভাত খাওয়াতে গিয়ে তিনি বড়ই মুশকিলে পরল। শিশুটি কিছুতেই ভাত খেতে চাইছে না। তবুও জোর করে এক মুঠো ভাত খাওয়ালো। শিশুটি অনেক ছোট। ভাত খাওয়ার তিনি মোটেও অভ্যস্ত নয়। এখন তার মাতৃদুগ্ধ পান করা উচিত। কিন্তু সেটা তো মোটেও সম্ভব নয়। তখনই রাজকুমারী পার্বতী লক্ষ্য করে তার হাতে দুটো সোনার বালা। তিনি শিশুটিকে নিয়ে আবার সেই চাষীর কুঠিরে গেলে।রাজকুমারীকে দ্বিতীয়বারের মতো দেখে চাষী বিরক্ত হয়ে বলল,
  • আবার এসেছো কি জন্য?

রাজকুমারী পার্বতী করুন দৃষ্টিতে চাষীর দিকে তাকিয়ে রইল। সে দয়ালু সুরে বলল,

  • আমাকে এক ঘটি দুধ দিন না।
  • অ্য..অ্য.. দুধ দিন না। দুধের দাম কত তুই জানিস। দুধ হবে না, যা ভাগ।
    রাজকুমারী এবার চাষীর পা ধরে ফেললেন। নিজের সোনার বালা খুলে ফেলে চাষীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।তিনি বারবার করুণা করে বললেন,
  • এই নাও আমার সোনার বালা। এবার আমাকে এক ঘটি দুধ দাও।

সোনার বালা দেখে চাষী চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে কিছুতেই ওই সোনার বালা হাতছাড়া করতে চাইল না। তবে তাঁর লোভ আরও বেশি বাড়লো।অসহায় রাজকুমারীকে বাগে পিয়ে তিনি সব চুষে নিতে চাইলে।সে রাজকুমারীকে বলল,

  • আমায় দুটো বালা দাও, তবেই আমি দুধ দেব।

রাজকুমারী আর কোন কথা বলল না। সে সাথে সাথে তার দুটো বালা খুলে চাষীকে দিল। চাষী সঙ্গে সঙ্গে এক ঘটি দুধ দিলেন। চাষী সোনার বালা পেয়ে বেজায় খুশি, তিনি নাচতে নাচতে কুটীর-দ্বারে প্রবেশ করলেন। আর রাজকুমারী দুধ নিয়ে এসে ছোট্ট শিশুটিকে পান করলেন। অবশিষ্ট দুধ এবং ভাত নিজে খেয়ে কয়েক মুহুর্তের জন্য প্রাণ বাঁচালো। এবারে বাচ্চা শিশুটি কান্না থামিয়েছে। শিশুটি কান্না থামিয়ে প্রশ্ন করল,

  • আমার মা কই? আমি মায়ের কাছে যাব।

বড় অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে রাজকুমারী বিব্রত হলেন। তিনি কোথায় পাবেন তার মাকে। এই যুদ্ধে হয়তো তার মা নিহত হয়েছে। এই শিশুটি হয়ত তার মতই মাতৃ পিতৃহারা। পিতা-মাতা মারা যাওয়ার সময় হয়তো এই শিশুটিকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কোনোক্রমে সে পেয়ে যান। পার্বতী শিশুটিকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করে। তাকে বলে, তার মা কাজে গেছে ফিরতে কয়েকদিন সময় লাগবে। তার পরেও শিশুটি কাঁদলেও রাজকুমারী তাকে সামলে নেয়।

(যোদ্ধা নামের এই রুপকথার গল্প টি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানাতে আমাদের কমেন্ট করুন।)

জঙ্গলের পথে রাজকুমারী রাজকুমারকে কোলে করে হাঁটতে থাকে। নিজেই ছোট তার উপর একটা ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে হাঁটতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। পা পাথরে বারবার আঘাত পেয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। ঝর ঝর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তবুও শিশুটিকে ফেলে দেয় নি। এখন বাসা খুঁজতে হবে। থাকার একটা জায়গা খুঁজতে হবে। কিন্তু কোথায় পাবে সেই জায়গা?

কিছুদুর যাওয়ার পর রাজকুমারী একটা পুরনো মন্দির দেখতে পেল। তিনি ভাবলেন এই মন্দিরে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আছে। কেউ না থাকলেও পুজো দিতে নিশ্চয়ই কেউ আসবেন। এই শিশুটিকে যদি এখানে রেখে দেওয়া যায়। তাহলে ঠিক কেউ না কেউ একে মানুষ করাতে পারবে। না হলে এখানে তো পুরোহিত মশাই রয়েছে। তিনি শিশুটিকে ঠিক বাঁচিয়ে নিবেন।সে শিশুটিকে মন্দিরে বসিয়ে দিল। তারপর সোজা পথে রাজকুমারী বেরিয়ে যেতে লাগলো। তখনই শিশুটি আবার চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। কাঁদো কাঁদো গলায় শিশুটি বলল,

  • জিও না আমায় ছেড়ে। আমি যে একা। আমার ভীষণ ভয় করছে। দয়া করে তোমার সাথে আমাকেও নিয়ে চলো।
    রাজকুমারী পার্বতী পেছনে তাকাতে পারলেন না। বড্ড মায়া হচ্ছিল ওই শিশুটির উপর। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার থাকতেও পারছে না। ছেলেটিকে তার কাছে রাখলে কি খেতে দেবে? কিভাবে বড় করবে সেই শিশুটিকে। তিনিই বা কিভাবে বড় হবে? নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল রাজকুমারীর মাথায়?

তখনই তার মাথায় একটা ভাবনা এল, এই জঙ্গলে তো অনেক জন্তু-জানোয়ার আছে। তারা যদি একটা রাতের মধ্যেই ওই শিশুটিকে আক্রমণ করে। তাহলে শিশুটির প্রাণ কে বাঁচাবে? না এটা তিনি করতে পারেন না। যতই তিনি ছোট হোক। তিনি রাজ্যের রাজকুমারী। তিনি রাজার কন্যা। তার ধমনীতে রাজবংশের রক্ত জেগে উঠলো। তাকে একা ছেড়ে যেতে পারেনা। সেই ছোট্ট শিশুটিকে আবার কোলে তুলে নেয়। কাঁদো কাঁদো গলায় রাজকুমারী শিশুটিকে বলে,

  • আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। যতদিন না তোর সঠিক ঠিকানা পাচ্ছি, ততদিন আমি তোকে কাছে রাখবো। আমি তোকেই বড় করব।
    রাজকুমারী মন্দিরটিকে দেখে আরো বেশি অবাক হলেন। এই মন্দিরটা যে অনেক পুরনো। দীর্ঘ 50 বছর মনে হয় এই মন্দিরে কেউ প্রবেশ করেনি। এখানে পুজো পাট সব বন্ধ। এটা তিনি কী করতে যাচ্ছিলেন? তিনি যদি এই শিশুটাকে এখানে ফেলে রেখে যেতেন। তাহলে শিশুটা বাঁচতে পারতো না। কষ্ট পেতে পেতে এক সময় মারা যেত।
    রাজকুমারী রাজকুমারের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
  • তোমার নাম কি?
    শিশুটি কোন উত্তর দিল না। সে তখনো তার নাম আয়ত্ত করতে পারেনি। রাজকুমারী তাকে একের পর এক,তার রাজ্যের নাম, পিতা মাতার নাম জিজ্ঞেস করলেন? কিন্তু শিশুটি কোন উত্তর দিতে পারল না। রাজকুমারী বুঝতে পারলেন, শিশুটি অনেক ছোট। এখন এত প্রশ্ন না করাই ভালো। রাজকুমারী মন্দিরের দিকে তাকালেন, নারায়ণের মন্দির। নারায়ণ ঠাকুর কে দেখে তিনি শিশুটির নাম দিলেন কেশো নারায়ন।

পর্ব ৫

রাত্রির কালো পর্দা সরিয়ে একটি রৌদ্রদীপ্ত দিনকে উপহারস্বরুপ শ্যামা ধরিত্রীর হাতে তুলে দেয় যে, সে উষা-তপনের দ্রুতি, অরুণ রমণী। ঊষার আবির্ভাব রাত্রি বিদায় ও দিনের শুভসূচনা সন্ধিক্ষণ। তার পিছনে পিছনে চলে সূর্য দেব আবির্ভাব, আবির্ভূত হন উদয়াচলে। সূচিত হয় প্রভাত। প্রবাদে আছে শব্দ জাগরণের স্নিগ্ধ প্রশান্তি। আছে শুভ্র শুচিতা, আছে অরুণ অরুণ এর সোনা হাসিতে উজ্জ্বল কর্মচঞ্চল প্রাণের অবলীলা। সকালের হিম শীতল বায়ু আঘাত হানলো রাজকুমার কেশো নারায়ণ এবং রাজকুমারী পার্বতী গায়ে।

তারা মন্দিরের সামনে পাশাপাশি দুজন ঘুমিয়ে রয়েছে। গায়ে বসন এলোমেলো। চুল গুলো মুখের উপর পড়ে রয়েছে।চারিদিকে নিঝুম নিস্তব্ধতা।এক চরম ঘুম দিচ্ছে তারা। তারা কোনোভাবেই রাতটা কাটিয়ে ফেলেছে।পাখির গানে প্রথমে কেশো নারায়ন উঠে পরল। উঠে তিনি কান্না শুরু করে দিলেন। কেশো নারায়ণের কান্নায় রাজকুমারী পার্বতীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি উঠে রাজকুমারকে কোলে নিয়ে বললেন,

  • কান্দিস না সোনা। এইতো আমি তোর কাছে রয়েছে।

কিন্তু কেশো নারায়ণ শুনল না। তার কান্নার জোর বেড়ে গেল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

  • আমার খিদে পেয়েছে আমাকে কিছু খেতে দাও।
    খাওয়ার কথা শুনতে রাজকুমারী চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরলো। কোথা থেকে পাবে খাওয়ার? দু’মুঠো অন্নের জন্য কালকের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিটা রাজকুমারী চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে। এই রুদ্র নারায়ণগড়ের কারোর দয়া মায়া বলতে কিছু নেই। কেউ তাদের খেতে দেবে না। নিজের খাবার নিজেকে সংগ্রহ করতে হবে। অনেক বুঝিয়ে কেশো নারায়ণকে শান্ত করলেন।

রাজকুমারী মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। এই জঙ্গলে নিশ্চয়ই অনেক ফল গাছ রয়েছে। সেখান থেকে ফল সংগ্রহ করে তারা খাদ্য গ্রহণ করতে পারবে।সেই আশায় তিনি রাজকুমারকে কোলে নিয়ে জঙ্গলে উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।, জঙ্গল টা ভালো করে ঘোরার জন্য। জঙ্গলের কিছুটা যাওয়ার পর একটা ছোট্ট নদী দেখতে পেল। তার তীর বরাবর রয়েছে সবুজ ঘাসে ঢাকা মনোরম সমতল তৃণভূমি। বনের আরো ভেতরের দিকে যেতেই, চোখে পড়ল তরমুজ জাতীয় ফল এবং আঙ্গুরের গাছ। আঙ্গুরগুলি সবই পাকা এবং রসালো। আরো খানিকটা যাওয়ার পর প্রচুর সংখ্যক কোকো, কমলালেবু ও নানা ধরনের লেবু জাতীয় গাছ চোখে পড়ল।রাজকুমারী অনেক ঘুরে সেই সব ফল সংরক্ষণ করলেন। তারপর মন্দিরে ফিরে এলে।

মন্দিরে ফিরে এসে রাজকুমারী নিজে ফল খেলে, এবং এর রাজকুমারকে কিছু ফল এবং ফলের রস খাওয়ালেন। ফলের রস খাওয়ার পর রাজকুমারের শরীর একটু তেজ বাড়লো। খুব সুন্দর দেখতে একটি ফুটফুটে ছেলে। চন্দনের মতন তার গায়ের রং উজ্জল। চোখে ভীষণ মায়া। যেন কোন রাজ্যের ছোট্ট রাজকুমার। তিনি এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতে লাগলেন। রাজকুমারী ঝামেলায় পরল। জঙ্গলের মধ্যে কত জন্তু-জানোয়ার রয়েছে তার ঠিক নেই। তার ওপর রাজকুমারের বাচ্চা সুলভ মনোভাব।

রাজকুমার তো বাচ্চা, বাচ্চা সুলভ মনোভাব দেখাবে না তা কি হয়? রাজকুমার বারবার রাজকুমারীকে খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কিন্তু রাজকুমারী বারবার তা প্রত্যাখান করছে। তার কিছুই ভালো লাগছে না।হয়তো রাজকুমার এখন কিছু বুঝতে পারছেনা, কিন্তু রাজকুমারী একটু বড় হয়েছে,সে জানে তার সামনে বাস্তবটা কত বড় কঠিন হতে চলেছে। 1 বছর ২ দু’বছর নয়। তাদের বড় হতে 15 বছর লেগে যাবে।এই 15 বছরে তাদের বেঁচে থাকার লড়াই টা এত সহজ হবে না।

জঙ্গলে শুধু বন্য জন্তু-জানোয়ার নেই, আছে জলদস্যুদের ডেরা। যেকোনো মুহূর্তে তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। অল্প বয়সেও রাজকুমারী অস্ত্র শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিল, কিন্তু অস্ত্র না থাকলে তিনি কী নিয়ে যুদ্ধ করবেন? তবুও তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন কেশো নারায়ণের কোন ক্ষতি হতে দেবেন না। ওকে মানুষ করে তুলবে মানুষের মতন।

অনুকূল পরিবেশ,যথাযথ শিক্ষা ও পরিচর্যা পেলে নিজের চেহারা ঘুমিয়ে থাকা শক্তি সম্ভাবনা অঙ্কুরিত হয়ে পত্র-পল্লবে শাখা-প্রশাখা নিজেকে মেলে ধরে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে একটা গাছ।তেমনি প্রতিটি শিশু পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠার জন্য সব রকমের সুযোগ-সুবিধা একান্ত দরকার। দুঃখের বিষয়, কেশো নারায়ণ এবং পার্বতীর জন্য তা ছিল না।
রাজকুমারী রাজকুমারকে একটি নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে, মন্দিরের দরজাটি ভেঙে ফেললেন। তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন।

অনেক পুরনো মন্দির ধুলোই বালিতে ভর্তি। তবে মন্দিরের পুজো অর্চনার জন্য বেশ কিছু জিনিস সেখানে পড়ে রয়েছে। যদিও সেগুলো অনেক পুরনো, তবে অক্ষত। তিনি ভাল করে মন্দির পরিষ্কার করতে লাগলেন। রাজকুমার একা একাই খেলে চলেছে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। কাজের ব্যস্ততার মাঝেও রাজকুমারী তাকে দেখে হাসছে। আবার কখনো তার সঙ্গে খেলায় তাল মিলাচ্ছে। রাজকুমারীর বড্ড ইচ্ছে করে খেলতে, কিন্তু পারে না। তার উপর যে এখন অনেক দায়িত্ব। রাজকুমারকে বড় করে তুলতে হবে। মন্দিরটা ভালোভাবে পরিষ্কার করার পর কিছু মোটা দড়ি, কিছু তরোয়াল এবং কয়েকটা পুরনো কাপড় পাওয়া গেল।

এইগুলো নিয়েই এখন তাদের বেঁচে থাকতে হবে। দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। নিরাপদ জায়গায় থাকার জন্য তিনি কয়েকটি গাছের ডাল কেটে আনলেন। সংগৃহীত কাছ থেকে খুঁটি তৈরি করলেন। খুঁটিগুলো মন্দিরের সামনে একটা একটা করে পুঁতে দিলেন। তারপর মোটা দড়ি দিয়ে চারপাশ বেড়া দেওয়ার মতন করে খুঁটি গুলোকে বাঁধলেন। যাতে বাইরের বন্য জন্তু-জানোয়ার সহজে আক্রমন করতে না পারে। এবার তারা বাইরের জগত থেকে পুরোপুরি সুরক্ষিত।

বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র প্রয়োজন। এই তিনটি মূল উপকরণ বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। তাদের কাছে, বস্ত্র, বাসস্থান খাদ্য থাকলেও, খাদ্যের সমস্যা টা কখনো মেটানো সম্ভব নয়। সারাদিন তারা নিশ্চয়ই ফল খেয়ে কাটাতে পারবে না। তাদের ভাতের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তাদের কিছু বস্ত্র খোঁজ করতে হবে। একই বস্ত্র পরিহার করে সারা বছর কাটানো সম্ভব নয়। এর একটা উপায় বার করতে হবে!

দু’মুঠো ভাতের জন্য রাজকুমারীর একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। তিনি রাজকুমারকে নিয়ে আবার জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করলেন। সাথে নিলেন একটা তরোয়াল। যেকোনো মুহূর্তেই বন্য জন্তু-জানোয়ার আক্রমণ করতে পারে। তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। জঙ্গলে প্রবেশ করে রাজকুমারী শুকনো ডালপালা সংগ্রহ করতে লাগলো। তা দেখে রাজকুমারী আশ্চর্য হল। শুকনো ডালপালা দিয়ে রাজকুমারী কি করতে চাইছে? রাজকুমার রাজকুমারী কে বলল,

  • আপনি এই শুকনো ডালপালা নিয়ে কী করবেন?
    রাজকুমারী রাজকুমার এর কাছে আসলেন। তার দুটো গালে হাত দিয়ে রাজকুমারী নরম গলায় বলল,
  • এই শুকনো কাঠ গুলো আমরা কুমোরকে বিক্রি করব। কুমোররের হাঁড়ি কলসি পোড়ানোর জন্য কাঠের দরকার হয়। আমরা এই কাঠ বেচে দু’মুঠো অন্ন সংগ্রহ করবো।
    রাজকুমার বেজায় খুশি হলো। তিনি আনন্দের রাজকুমারীকে বলল,
  • ভাতের সাথে নিশ্চয়ই ডাল,মাছ, মাংস দেবে।
    রাজকুমারী হেসে বললেন,
  • না সোনা, এত কিছু দেবেনা। আমাদের শুধু ভাত আর ডাল দেবে।
    রাজকুমারের মনটা ভেঙ্গে গেল। তবুও তিনি বললেন,
  • কেন দাস-দাসীরা তো আছে। তারা আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসবে। তারাই আমাদের খাবার তৈরি করে দেবে। তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। চলো আমরা ফিরে যাই।
    রাজকুমারী ভারী অবাক হলো ‘দাস-দাসী’ কথাটা শুনে। তিনি ভাবলেন এই শিশুটি কোন সাধারণ মানুষ নয়। তিনিও কোন রাজ্যের রাজকুমার। না হলে তিনি কি করে জানবেন দাস-দাসীর কথা। রাজকুমারকে লুকিয়ে রাখতে হবে। তার বাবা-মা যদি বেঁচে থাকে। মা-বাবা যদি কোনদিন জানতে পারে রাজকুমার এখানে থেকে বড় হচ্ছে। তাহলে তাকে নিয়ে চলে যাবে। রাজকুমারী একা হয়ে যাবে। সেই মায়াবী শিশুকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। এই দুটো দিনে শিশুটি পার্বতীর কত আপন হয়ে উঠেছে। তাকে নিয়েই সে বাঁচতে চায়।অনেক বড় যোদ্ধা বানাবে সে,কেশো নারায়ণকে। নিজেই শিশুটাকে অস্ত্রশিক্ষা দান করবে। তাকে দিয়েই তার হেরে যাওয়া বাবার প্রতিশোধ নিবে। রূপনগরে আবার আগের মতন হয়ে উঠবে। রুপ নগরের রাজা হবেই কেশো নারায়ণ আর রাজকুমারী পার্বতী। মনে মনে শপথ গ্রহণ করলেন রাজকুমারী পার্বতী। তবুও রাজকুমারী পার্বতী নরম গলায় বলল,
  • না রাজকুমার। এখানে কোন দাস-দাসী নেই। এখন থেকে আমাদের একাই চলতে হবে।
    রাজকুমার মাথা নেড়ে বলল,
  • বুঝেছি, মার সাথে সমস্ত দাস-দাসীরা নিশ্চয়ই চলে গেছে। তাই এখন আমাদের সব কাজ করতে হবে। মা ফিরে এলে আমরা আর কোনো কাজ করব না।
    রাজকুমারী হেসে বললেন,
  • হ্যাঁ রাজকুমার। ততদিন তুমি আমার সাথে থাকবে। আমার সব কথা শুনে চলবে প্রতিজ্ঞা করো।
  • আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যতদিন না আমার মা-বাবা ফিরে আসবে, ততদিন আমি আপনার সমস্ত কথা শুনে চলবো।
    জঙ্গলে অনেকক্ষণ কাঠ সংরক্ষণ পর রাজকুমারী সেগুলো কুমোর কে বিক্রি করে দুমুঠো অন্ন সংগ্রহ করল। কিন্তু কুমোর শুধু ভাত দিল। ডাল দিল না। রাজকুমার কে পাশে বসিয়ে রাজকুমারী খাওয়াতে লাগলেন। কিন্তু রাজকুমার কিছুতেই খেতে চাইছেন না।
  • আমি এই ভাত খাব না। আমাকে ডাল এনে দাও। আমাকে মাছ এনে দাও। আমি খালি ভাত খেতে পারব না।
    রাজকুমারী বড্ড ঝামেলায় পড়লেন। এই শিশুকে তিনি কি করে বোঝাবে, এর থেকে আর ভালো খাবার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। এইভাবে তাদের জীবনযাপন করতে হবে। তিনি রাজকুমারে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
  • দয়া করে খেয়ে নাও। আমি রাতে তোমার জন্য ডাল আর ভাতের ব্যবস্থা করে দেব। কথা দিচ্ছি। এবার খেয়ে নাও।
    দুজনের চোখ থেকে খাবারের থালায় টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছিল। তাদের মা শিখিয়েছিল খেতে বসে, খাবারের থালায় চোখের জল ফেলতে নেই। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে দিয়েছি। বেঁচে থাকাটাই এখন যন্ত্রণাদায়,কষ্ট হয়ে উঠেছে। তবুও ঘুরে দাঁড়ানোর টাই জীবন। সেটাই করছে রাজকুমারী পার্বতী। তিনি রাজকুমারের চোখের জল মুছে দিলেন। রাজকুমারও রাজকুমারীর চোখের জল মুছে দিল। রাজকুমার বলল,
  • ঠিক আছে, রাতে কিন্তু আমি ডাল আর ভাত চাই। না হলে আমি খাব না। আমি এখান থেকে চলে যাব।
    রাজকুমারী রাজকুমারের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। এই শিশুটা জানে না এখান থেকে চলে গেলে তার বাঁচার উপায় নেই। তার মৃত্যু অনিবার্য। ছেলে মানুষ জানে না বলে ফেলেছে। তাকে কাছে নিয়ে বলল,
  • আচ্ছা ঠিক আছে, এখন চুপটি করে খেয়ে নাও তো।
    সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর,পড়ন্ত দুপুরে রাজকুমারী ঘুমিয়ে পড়েছিল ভাঙা মন্দিরের ভেতরে। তার কোলের উপর মাথা দিয়ে রাজকুমারও ঘুমিয়ে পড়েছে। সূর্য তখন মাথার উপর। চারিদিক গনগন করে রোদের প্রকোপ। এই গভীর জঙ্গলে বাতাস যেমন একা-নিঃসঙ্গ, তেমনি রাজকুমার এবং রাজকুমারী ছিল একা এবং নিঃসঙ্গ। পার্বতী বেশ খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে গেছিল। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে পড়ার পর, রাজকুমারী যখন ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, রাজকুমার তার পাশে নেই। তার মুখ মুহূর্তের মধ্যে হতাশায় ভরে উঠলো। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে রাজকুমারকে খুঁজতে লাগলেন। তিনি বারবার উচ্চকণ্ঠে রাজকুমার কে ডাকছে,
  • রাজকুমার কোথায় তুমি? দয়া করে সারা দাও! আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি! দয়া করে এমন করো না রাজকুমার।
    রাজকুমার এর কোন শব্দ নেই। সে জঙ্গলের কিছু দূরে একটা ঘোড়ার শাবক পেয়েছে। ছোট্ট একটা শাবক ঠিকঠাক হাঁটতে পারছে না তার কাছেই বসে রয়েছে। এদিকে রাজকুমারী চিৎকার করে করে,রাজকুমারকে ডেকে চলেছে। হঠাৎ রাজকুমারের কানে রাজকুমারী গলার স্বর ভেসে এলো। তখন রাজকুমার ও চিৎকার করে বলল,
  • আমি উত্তরের দিকে রয়েছে রাজকুমারী। আমাকে নিয়ে যাও। আমি রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিনা। জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে।

রাজকুমারীর চোখ থেকে তখন জল গড়িয়ে পড়ছে। কি করে রাজকুমার জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল, সে ভেবেই পাচ্ছে না। রাজকুমারী ও চিৎকার করে বলল,

  • তুমি সেখানেই থাকো। আমি আসছি। আর তুমি জোরে জোরে চিৎকার করো,যাতে আমি শুনতে পেয়ে তোমার দিকে এগিয়ে যেতে পারি।
    রাজকুমারী কথামতো রাজকুমার জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন,”রাজকুমারী”বলে। সুরের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলেন রাজকুমারী।

এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি রাজকুমারকে খুঁজে পেয়ে গেলে। রাজকুমার কে পেয়ে তিনি কেঁদে অস্থির। তাকে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করে করে রাজকুমারী কাঁদতে লাগল। রাজকুমারীর কান্না দেখে রাজকুমার ও কেঁদে উঠলো। পার্বতী একটু অবাক হয়ে বললো,

  • তুমি কাঁদছো কেন?
  • আপনি কাঁদছেন তাই আমারও চোখ থেকে জল পড়ে যাচ্ছে।
    রাজকুমারী মাথা নাড়িয়ে বলল,
  • তুমি আর কাঁদবে না। তোমার চোখে আমি কখনো জল দেখতে চাই না। আর কখনো আমাকে না বলে একা বেরোবে না।
    রাজকুমার মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানাল। তারপর সে দূরে হাত বাড়িয়ে দেখালো একটা ঘোড়ার শাবক পড়ে রয়েছে।সাদা ধবধবে একটি ঘোড়ার শাবক ঘাসের উপর পড়ে রয়েছে। রোগা দুর্বল তার চেহারা। মনে হয়,সেও তার মা-বাবাকে হারিয়ে একা ক্লান্ত। রাজকুমারী ঘোড়ার শাবক এর কাছে গিয়ে বলল,
  • একে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবি?
    রাজকুমারের আনন্দে আর ধরে রাখতে পারছেনা। তিনি আনন্দে বিচলিত হয়ে উঠলেন। আর রাজকুমারীকে হ্যাঁ সম্মতি জানাল।তারপর তারা দুজন সেই ঘোড়ার শাবকটিকে নিয়ে মন্দিরে ফিরে এলেন……
    ভীষন কৌতুহল হল রাজকুমারী। রাজকুমারের প্রতি তার আরও তীব্র মমতা তৈরি হলো

সে সারাক্ষণ রাজকুমারের সাথে থাকে। তারর সাথে গল্প করে। তার জন্য বন থেকে ফুল কুঁড়িয়ে আনে। শেষে ফুল দিয়ে রাজকুমারী মালা গাঁথে। এমনি করে দিন যায়। রাজকুমারকে পিয়ে রাজকুমারী যেন সব দুঃখ ভুলে গেল। রাজকুমারও যেন ভীষণ খুশি। কেশো নারায়ন এবার রাজকুমারীকে পার্বতী বলে ডাকতে শুরু করলো। কষ্টের মধ্যেও তারা ছোট্ট ছোট্ট আনন্দ খুঁজে নিয়ে দিন কাটাতে লাগলো।

আর এভাবে চলতে লাগলো তাদের সুখের সংসার।

লেখাঃ শুভজিৎ জানা (রাজা)

-সমাপ্ত-

পাঠক আপনাদের জন্যই আমরা প্রতিনিয়ত লিখে থাকি। আপনাদের আনন্দ দেয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ। তাই এই পর্বের “যোদ্ধা নামের রুপকথার গল্প” টি আপনাদের কেমন লাগলো পড়া শেষে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।

আরও পড়ুন – তুমি আমার ভালোবাসা – ভালোবাসার গল্প কথা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *