হে দুঃখি চোখ – না পাওয়ার কিছু কথা

হে দুঃখি চোখ – না পাওয়ার কিছু কথা: আব্বার চোখ থেকে টুপ করে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। তারপর আব্বা এক হাতের পিঠ দিয়ে তার চোখের জল মুছে নিয়ে আম্মার কাছ থেকে পা ছাড়িয়ে ঘরে ফিরলেন।


১ম পর্ব

এই নিয়ে নবম বারের মতো আমার বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে। এই বিয়েটা অবশ্য হয়েই গিয়েছিল!ছেলের মা এসে আংটি পড়াতে আমার আঙুল ধরেছে পর্যন্ত। আর ঠিক তখন বরের ছোট মামা ডাকলেন তার বোনকে। মানে আমার হবু শাশুড়িকে।
আপা?

বরের মা তাকালেন।
বরের মামা বললেন, একটু এদিকে আসো আপা। কথা আছে।
বরের মা বললেন, আহা!আংটি টা পরিয়েই আসি। তুই একটু ওয়েট কর।

বরের মামা তখন বললেন, জরুরি কাজ। আংটি পরানোর আগেই আসতে হবে তোমার।
বরের মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, দাঁড়াও মা। আমি একটু শুনে আসি কী বলে ও কেমন!

আমি মুচকি হাসলাম। আর দাঁড়িয়ে রইলাম আমার হবু শাশুড়ির জন্য। তিনি আবার আসবেন আর আমার অনামিকায় চকচকে সোনালী আংটি পরিয়ে দিবেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমার হবু মামা শ্বশুরের কথা শুনতে গিয়ে আমার হবু শাশুড়ি আর আমার কাছে ফিরে এলেন না আংটি পরাতে। তিনি বারান্দায় ডেকে নিলেন বাবাকে। তারপর বললেন, ভাইসাব, বিয়েটা হবে না।

আব্বা মুখ মলিন করে বললেন, এ কী বলছেন আপনি? কেন হবে না?
বরের মা বললেন, এর আগে আপনার মেয়ের আটবার বিয়ে ভেঙেছে। বিয়ে ভাঙা মেয়েকে আমি আমার পুত্রবধূ করবো না।

এই কথা শুনে আমার বাবা সঙ্গে সঙ্গে বারান্দায় পিলার ধরে বসে গেলেন। আর আমার সৎ মা এসে আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে গেলেন উঠোনে।
তারপর আমায় মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন, পুড়া কপালী, তোর লাইগা আমার মাইয়াডারেও বিয়া দিতে পারতাম না আমি। তোর তো জীবনেও বিয়া হইবো না। পিছনে আমার মাইয়াডারও হইবো না।

বড়
বইনের বিয়া না হইলে ছোড বইনের হইবো কেমনে?
আব্বা তখন আম্মাকে বললেন, রাখো তো। আমার মা মরা দুঃখী মেয়ে। এরে তুমি কতো বকো?

আব্বার মুখ থেকে এমন কথা শুনে আম্মা আব্বাকে ধমকে উঠলেন।
আহ্লাদী বাপ। একটা কলঙ্ক জন্ম দিছে। আপনার এই মাইয়ারে লইয়া আপনি এই বাড়ি থাইকা বাইর হইয়া যান কইলাম। আপনার মাইয়ার লাইগা আমার মাইয়ার সুন্দর জীবন আমি নষ্ট হইতে দিতাম না।

আব্বা তখন চুপ মেরে গেলেন। যেন কোন উত্তর তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না আর।

রাতে সবাই প্লেট টেনে নিয়ে খেতে বসেছে। আমিও গিয়ে সবার সাথে প্লেট টেনে নিয়ে বসে পড়লাম। কিন্তু আম্মা সবার প্লেটে ভাত বেড়ে দিলেও আমার প্লেটে দিলেন না। আব্বা বললেন, এ কী, বিথীর প্লেটে ভাত দিলা না যে?

আম্মা তখন গমগমে গলায় বললেন, হের কপালে এই বাড়ির ভাত উইঠা গেছে। এরে আমি ভাত দিবো না। কতো করে আপনেরে কইছিলাম যে আমার ভাতিজার মতন এমন ছেলে মিলানো বহুত কঠিন। শুনলেন না। ছেলের রাগ বেশি এইটা আপনার সমস্যা!রাগ এই পৃথিবীর কোন পুরুষের না আছে! লক্ষ্মী ছেলের কাছে আপনে মেয়ের বিয়া দিবেন। দেখি লক্ষী ছেলে আপনের কই মিলে!

মিলবে না এটা আমিও জানি। আমার সৎ মা চান তিনি আমাকে তার ভাইয়ের ছেলে হাসানের জন্য তার ঘরের বউ করে নিতে। কিন্তু হাসান সম্পর্কে আব্বা খুব ভালো করেই জানেন যে হাসানের শুধু রাগই বেশি না তার চরিত্রও খারাপ। শত শত মেয়ের সাথে সে প্রতারণা করেছে। তাছাড়া ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে সে খুন রাহাজানিও করে। এই জন্যই আব্বা না করে দিলেন।

কিন্তু আমার সৎ মা আব্বার এই না বলা খুব সহজে মেনে নিতে পারেননি। এই জন্য তিনি আমার জন্য বিয়ের কোন আলাপ এলেই খুব কুট কৌশলে বরপক্ষের লোকদের কানে তিনি এই কথা বলে দেন যে আমার নাকি চরিত্রে সমস্যা। অনেক ছেলের সাথে আমার শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে। কী অসভ‍্য ব‍্যাপার!

আব্বা এর জন্য আম্মাকে বকতেও পারেন না। বেশি বকাঝকা করলে আম্মা আব্বাকে হুমকি দিয়ে বলেন, একটা কল দিলে আপনার মাইয়ার কী হইবো জানেন?
আব্বা থরথর করে কেঁপে উঠে বলেন, কী হবে?

আম্মা বলেন, ইজ্জত যাইবো। আমার ভাতিজার হাতে ইজ্জত যাইবো!
আব্বা তখন চুপ হয়ে যান।

আম্মা তবুও বলেন, হাসান গত পড়শুও একটা মাডার করছে। চেয়ারম্যানের পোলারে। হের সাথে লাগতে গেলে হে কাউরে ছাড়ে না। ফুপারেও ছাড় দিবো না।

কথাটা শুনে ভয়ে আব্বার মুখ কেমন শুকিয়ে যায়। তাই তিনি শীর্ণ মুখে ফ‍্যাল ফ‍্যাল করে আমার দিকে তাকান। আমার তখন খুব কান্না পেয়ে যায়। তাই আমি ওখান থেকে উঠে চলে যাই বারান্দার দিকে। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদতে থাকি।

আব্বা বাড়া ভাত রেখে হাত ধুয়ে উঠে পড়েন। তারপর তিনি ঘর থেকে চুপচাপ বের হয়ে চলে যান বাইরে। আব্বা বাইরে চলে গেলে আম্মা আসেন আমার কাছে। এসে ধমক দিয়ে বলেন, কপাল যদি ভালা রাখতে চাস তাইলে বিয়াডাত রাজি হইয়া যা। নাইলে তোর জীবনডা বরবাদ কইরা দিবো কইলাম।

আমার তখন রাগ পেয়ে যায় খুব। রাগে আমি জোর গলায় বলে উঠি, পৃথিবীতে মনে হয় তোমার মতন খারাপ মহিলা আর একটাও নাই!

কথাটা শুনে আম্মা খুব রেগে যান। আর তার চোখ আগুন করে মুহূর্তে আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দেন। তারপর আমার চুল ধরে টেনে ফেলে দেন মেঝেতে। আমি—-


২য় পর্ব

আমি ব‍্যাথায় কুঁকড়ে উঠে কেঁদে উঠি। তারপর আম্মা এসে আমার গলা চেপে ধরেন। আমি তখন কান্নাভেজা গলায় বলি, আম্মা, আমার কষ্ট হচ্ছে খুব!

আম্মা শুনেন না। তিনি চেপে ধরে রাখেন অনেক্ষণ আমার গলা। তারপর যখন দেখেন আমার চোখ উল্টে আসছে তখন ছেড়ে দেন। আমি ক্লান্ত হয়ে বারান্দার দেয়ালের উপর হেলে পড়ি। আমার চোখ থেকে টপটপ করে জল নামতে থাকে।

আম্মা তখন বলেন, তোর বাপের কাছে যদি কস তোরে আমি মারছি তাইলে কিন্তুক তোরে জানে মাইরা ফেলাইয়াম।

যদি ভালা থাকতে চাস তাইলে রাইতে শুইয়া শুইয়া চিন্তা ভাবনা কইরা দেখ যে সারা জনম কী ভিক্ষুকের মতন ঘুইরা ঘুইরা খাইবি না রাজ রানীর মতন খাইবি। তুই যদি বিয়াতে রাজি হস তাইলে হাসান তোরে রাজ রানী কইরা রাখবো। আর নাইলে তোর হাত পাও ভাইঙ্গা দিয়া ঘর থাইকা বাইর কইরা দিবো আমি। হেরপর রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা কইরা খাইবি।

আমার মুখ দিয়ে কান্নার জন্য তখন আর কোন কথা আসে না। আমি বারান্দায় বসে থেকে একমনে শুধু কাঁদতেই থাকি। আর মনে মনে বলি, মা মাগো, তুমি মরে গিয়ে আমায় কেমন বিপদে ফেলে গেলে। তুমি চলে যাওয়ার সময় আমায় কেন নিয়ে গেলে না!

রাত বাড়তে থাকে। আব্বা ঘরে ফিরে না। আমিও বারান্দায় বসে থাকি। আম্মা নিতুকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। আমাকে একটি বারের জন্যও বলে না যে তুই ঘরে আয়। এসে শুয়ে পড়।

বারান্দায় বসে থেকে আমার চোখ লেগেই আসছিলো। হঠাৎ আব্বা এসে আমার মাথায় আলতো স্পর্শ করায় আমি জেগে উঠি। আব্বা তখন কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, তোর মা তোরে এখানে রেখে দরজা বন্ধ করে দিছে?

আমি চুপ করে থাকি।
আব্বা তখন বলেন, বল। কথা বল।
আমি তখন কেঁদে উঠি ফুঁপিয়ে। কাঁদতে কাঁদতে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে বলি, আব্বাগো, আমার আর ভালো লাগে না এইখানে। আম্মা খালি মারে। হুমকি দেয়। না জানি কখন কী করে বসে! তুমি আমারে এইখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাও আব্বা।

আব্বা আমার মাথার আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, মা, মারে, আমি তোর ভালোর জন্য নতুন বিয়ে করলাম। ভাবছিলাম মা হারা মেয়ে আমার মা পাইবো। কিন্তু এটা কী আগে জানতাম রে মা, ঘরে আমি যারে আনতেছি সে মা না, সে একটা ডাইনি!

আব্বার গলা ধরে আসে। চোখে পানি এসে যায়। তিনি তার এক হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছেন। আমি তার বুকের ভেতর একটা ছোট্ট পাখির ছানার মতো কাঁপতে থাকি। আর চোখের জলে ভাসিয়ে ফেলি আব্বার পাঞ্জাবি।

আব্বা দরজায় কড়া নাড়েন। কিন্তু আম্মা দরজা খুলেন না। আব্বা এবার ডাকতে থাকেন। আম্মাকে ডাকেন। আম্মা দরজা খুলে দেয় না। সাড়াও দেয় না। আব্বা এবার নিতুকে ডাকলেন। নিতু বললো, আসতেছি আব্বা।

কিন্তু আম্মা নিতুকে এমন ধমক দিলেন! ধমক দিয়ে বললেন, খবরদার। বাপ বোনের প্রতি অত দরদ দেখানো ভালা না। আইজ থাইকা আমি যা কইয়াম তাই হইবো। এরা বারান্দাত থাকবো। ওইখানে ঘুমাইবো।

আব্বা তখন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দরজায় গিয়ে লাথি মারেন তার শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে। দরজাটা তখন প্রচন্ড রকম কেঁপে উঠে। আর দ্বিতীয় লাথির সময় দরাম করে ভেঙে যায় দরজার খিল। তারপর আপনা আপনি খুলে যায় দরজা।

আব্বা এবার দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে আম্মার কাছে যান। আর আম্মাকে খাট থেকে একটানে নামিয়ে এনে চুল ধরে টেনে বের করেন ঘর থেকে। তারপর বারান্দা থেকে এক ধাক্কায় উঠোনে ফেলে দিয়ে বলেন, যাহ। এই বাড়ি থাইকা তুই এবার বাইর হইয়া যা।

আম্মা উঠোনে ধুলোবালির উপর থেকে উঠে শাড়িতে লেগে থাকা ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করতে করতে বলেন, ভালা হইছেনা কইলাম কামডা। কমজাতের বাচ্চা, তুই জানস না কার শইল‍্যে হাত তুলছস। তোর হাত যদি আমি না ভাঙ্গাই তাইলে আমি এক বাপের পয়দা না!

আব্বা তখন ঘৃণা মেশা একদলা থুথু উঠোনে ফেলে দিয়ে বললেন, যা যা, দেখা যাইবো তুই কই বাপের পয়দা।

আম্মা তখন উঠোনে থেকেই নিতুকে ডাকলেন, নিতু আয়। এই বাড়ি যতদিন আমার দখলে না আসবো ততদিন আমি এই বাড়িত ফিরতাম না।
আব্বা বললেন, নিতু আমার মেয়ে। সে তোর সাথে যাবে না।

নিতুরও সম্ভবত যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আম্মা তার দিকে এমন চোখে তাকালেন যে নিতু ভয়ের ছুটেই আম্মার পেছনে পথ ধরলো।

যাওয়ার সময় বাড়ির দেউঠি পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আম্মা একবার পেছনে তাকালো। তারপর চিৎকার করে বলে গেলো, বুইড়া, তুই আর তোর মাইয়ারে দুঃখের সাগরে ভাসাইতে না পারলে আমি এক বাপের পয়দা না।
আব্বা—


৩য় পর্ব

আমার সৎ মা যে বিষধর জাতের সাপ সেটা আগে থেকেই আমি জানতাম। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই তো তার হাতের মার খেয়ে খেয়ে বড় হয়েছি।

কিন্তু তিনি আমায় এমন ভাবে মারতেন যেন আব্বা কোন ভাবেই টের না পান। তাই আমি তখন খুব লুকিয়ে চুরিয়ে কাঁদতাম। যেন আব্বা কোন ভাবেই বুঝতে না পারেন যে আমি কাঁদছি।

ক্লাস টুয়ে পড়ার সময় একদিন আম্মার সাথে আমি গোসল করছিলাম পুকুর ঘাটে বসে থেকে। আম্মা তখন বললেন, বিথী, ব‍্যাঙের মতন লাফ দিয়া দিঘির মাঝখানে পড়তে পারবি?
আমি তখন খুব ভীতু টাইপের ছিলাম। তাই বললাম, না গো আমি পারবো না।

এই কথা বলার পর আম্মা বললো, শোন, তোরে ব‍্যাঙ হইয়া যে দিঘিত লাফ দিতে কইছি সাবধান এইটা তোর বাপের কাছে কইছ না। কইলে কিন্তুক তোরে জবাই দিয়া দিবাম।
আমি তখন ভয়ে ভয়ে বললাম, বলবো না আম্মা। কারোর কাছে বলবো না। তবুও তুমি আমারে জবাই দিও না

সেই ছোট্ট বেলায় আম্মার এই কথাটার কারণ বুঝতে না পারলেও এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি কেন সেদিন আম্মা আমায় পুকুরে ব‍্যাঙের মতন ঝাঁপ দেয়ার জন্য বলেছিলো!
যেই মা কোন কারণ ছাড়াই সেই ছোট্ট বেলায় কৌশলে আমায় মেরে ফেলার চেষ্টা করতে পারে সেই মা এখন তো আরো ভয়ানক কিছু করেই ছাড়বে!

বিকেল বেলা বারান্দায় আব্বার পাশে বসে থেকে আমি বললাম, আব্বা, আমার কেমন জানি ভয় হচ্ছে। সত‍্যি সত্যি ভয় হচ্ছে। আব্বা, আম্মা যদি তার ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে আসে আমাদের বাড়িতে। তখন কী হবে আমাদের?

আব্বা খানিক সময় চুপ হয়ে রইলেন। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, মারে, সারা জীবনে একটা মিথ্যা কথা বলি নাই, কারোর একটা টাকা মাইরা খাই নাই। কারোর কাঁচা আলপথে পা দেই নাই।

আমি জেনে বুঝে কাউকে কথায়ও আঘাত দেই নাই। আমি যেহেতু কারোর কোন ক্ষতি করি নাই তাইলে আমার ক্ষতি কেমনে মাইনা নিবো আল্লাহ? আমি আল্লাহর উপর ভরসা রাখি। নিজে আল্লাহ পাকই তো বলছেন, যে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে তারে তিনি ঠকান না। তাইলে আমি ঠকবো কেনো?

আব্বার মুখের কথাগুলো শুনে আমার মনের ভেতর দিয়ে হিম শীতল বাতাস বয়ে যায়। অদ্ভুত আনন্দে আমি আব্বার মুখের দিকে তাকাই। কী সুন্দর এবং পবিত্র মুখ।

এই মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়, পৃথিবীতে বাবারা হলো সন্তানের জন্য ছায়াদানকারী বৃক্ষ। যার বাবা এই দুনিয়ায় বেঁচে নাই সেই কেবল জানে রোদ-ঝড়ের কবল থেকে একা বাঁচার কী কষ্ট!

তিনদিন পর রাতের বেলা হঠাৎ আম্মা ফোন দিলেন। আব্বা ফোন ধরলেন না। কিন্তু বারবার যখন ফোন দিচ্ছেন তখন ধরে বললেন, কী হয়ছে? ফোন দেও কেন? তুমি না আমারে দুঃখের সাগরে ভাসাইতে আসবা!কই ?

দিন তো তিনটা চলে গেল এখনও আসলা না তো?
আম্মা ও পাশ থেকে হঠাৎ করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কান্নার জন্য কোন কথা বলতে পারছে না। আব্বা অস্থির হয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, কী হইলো কাঁদতেছো কেন?
কথা কও!

আম্মা কথা বললো না। কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে দিলো।
তারপর আব্বা আবার ফোন দিলেন। কিন্তু সেই ফোন বন্ধ। বারবার চেষ্টা করেও আম্মার ফোনে কল দিতে পারলেন না।

আব্বা তখন চিন্তায় কেমন অস্থির হয়ে উঠলেন।
আমি বললাম, কী হইছে আব্বা? কী হইছে?
আব্বা তখন কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, আমার কেমন ভয় লাগতেছে রে বিথী! বিরাট ভয় লাগতেছে!


৪র্থ পর্ব (অন্তিম)

আব্বা ঠিক করেছিলেন নিতুর মামার বাড়ি যাবেন। তিনি চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন না জানি কী বিপদ হলো ওদের!নয়তো কাঁদবে কেন ফোন করে আম্মা। আর কথা না বলে ফোনের সুইচ ই বা কেন বন্ধ করে দিলো!

কিন্তু আব্বার আর যাওয়ার প্রয়োজন হলো না। পরদিন দুপুর বেলা আম্মা নিজেই ফিরে এলেন। কিন্তু তিনি এলেন একা। নিতু আসেনি।

তার চোখ মুখ কেমন ফোলা ফোলা। চেহারা মলিন হয়ে আছে। আম্মা ঘরের বারান্দায় পা রেখেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। আর ডাকলেন আমাকে। বললেন, বিথী, মারে মা তুই কই? আয়, একটুক এইদিকে আয়!

আমি দৌড়ে গেলাম আম্মার কাছে। কাছে গিয়ে দেখি তিনি কাঁদছেন। তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আম্মা আমাকে দেখেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তারপর আমার কাছে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে ফেললেন।

আমার যতটুকু মনে আছে বোঝ হওয়ার পর আম্মাকে কোনদিন আমায় জড়িয়ে ধরতে দেখিনি। এমনকি আদর করে এভাবে ডাকতেও দেখিনি কোনদিন। কিন্তু আজ আমায় তিনি জড়িয়ে ধরলেন।

আম্মা আমায় জড়িয়ে ধরে কান্নামাখা গলায় বললেন, বিথীরে বিথী, ও মা বিথী, আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে রে মা!
আমি অবাক হয়ে বললাম, কী হয়েছে?

আর এদিক ওদিক তাকিয়ে নিতুকে না পেয়ে বললাম, নিতু কোথায়?
আম্মা তখন আরো জোরে জোরে কেঁদে উঠে বললেন, নিতু নাই মা। নিতুরে জোর কইরা নিয়া পালাইছে হাসান!

আমি আরো বেশি অবাক হয়ে বললাম, মানে?
হ মা। আমি বিরাট বড় ভুল কইরা ফেলাইছিলাম মা। তোর সব্বোনাশ করতে গিয়া আমার নিজের সব্বোনাশ আমি করে ফেলাইছি রে মা।

আমার খুব অস্থির অস্থির লাগছে। কেন জানি গলা বেয়ে কান্না আসছে। আমি অনেক কষ্টে কান্না লুকিয়ে রেখে বললাম, আম্মা, নিতুকে নিয়ে ও এখন কোথায় আছে?

জানি না রে মা জানি না। হাসানের আগে থাইকাই আমার মাইয়ার প্রতি লোভ আছিলো। আমি ভাবছিলাম হের সাথে যদি তোর বিয়া দিতাম পারি তাইলে আর হে আমার মাইয়ার দিকে নজর দিবো না। কিন্তু কাজ হইলো না রে মা।

রাগে বাড়িত গিয়া হাসানরে কইলাম হে যেন তোর ইজ্জত মারে। কিন্তু হারামজাদা আমার নিজের ইজ্জতই মাইরা দিছে রে মা। আমি ভুল কইরা ফেলাইছি মা। আরেকজনের লাইগা গর্ত করলে সেইখানে নিজের পা-ই আগে পড়ে রে মা। নিজের পা-ই আগে পড়ে!

আম্মার কথাগুলো শুনে আমি বড়ো অবাক হলাম। আর ভাবলাম কী অসম্ভব ধুরন্ধর মহিলা তিনি। কী ভয়ংকর চতুর! কিন্তু এইসব কিছু করে কী লাভ হলো তার? এই যে মানুষ অন‍্যকে ঠকিয়ে সব সময় নিজে জিতে যেতে চায় কিন্তু সে কী এভাবে আদৌ জিতে যেতে পারে?

কিছুতেই পারে না। সে হেরে যায়। সৃষ্টিকর্তা তাকে জিতে যেতে দেন না। আপাত দৃষ্টিতে আমরা হয়তোবা দেখি সে জিতে গেছে। তাকে নিয়ে তার সামনে আমরা দু চারটা প্রশংসা বাক্যও বলি। কিন্তু বাস্তবে তো সে হেরেই যায়!

আমি বললাম, নিতুকে কী উদ্ধার করার কোন ব‍্যাবস্থা নাই?
আম্মা বললেন, নারে মা নাই। কী জানি কই গেছে এরে নিয়া হাসান!
তারপর আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো আম্মা। আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। সান্ত্বনা দিলাম। তবুও তার কান্না কোন ভাবেই থামলো না।

আব্বা বাজার থেকে ঘরে ফিরলেন সন্ধ্যা বেলায়।
আব্বা উঠোনে পা রাখতেই ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আব্বার কাছে গেলেন আম্মা। তারপর একেবারে আব্বার পায়ের কাছে বসে আব্বার পা ধরে কাঁদতে লাগলো আম্মা। আব্বা বললেন, কী ব‍্যাপার? কী হইছে?

আম্মা সবকিছু ভেঙে ভেঙে বললো।
আব্বা তখন বললেন, আমি আগেই বলছিলাম নিতুরে রাইখা যাওয়ার জন্য। তুমি মুখের জোরে, তোমার ভাতিজার পাওয়ারের জোরে নিয়া গেলা! আমার মাইয়াটারে নিয়া এর জীবনটা নষ্ট করে দিলা!

আব্বার চোখ থেকে টুপ করে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। তারপর আব্বা এক হাতের পিঠ দিয়ে তার চোখের জল মুছে নিয়ে আম্মার কাছ থেকে পা ছাড়িয়ে ঘরে ফিরলেন। ঘরে ফিরে বাজারের ব‍্যাগটা রেখে বারান্দায় এসে একটা চেয়ারের উপর বসলেন।

তারপর আম্মাকে বললেন, তোর পাপ আমার মেয়েটাকে গ্রাস করে ফেলছে। সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার! তুই একটা খুনি! তুই একটা দুশ্চরিত্রা মহিলা। তোর হিংসা, তোর হৃদয়হীনতা আমার মেয়েটাকে আজ ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে।

যা তুই এক্ষুনি এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যা!
আম্মা তখন কেমন বেকুব বনে গেলেন। তারপর ধীর স্থির ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় মাথায় হাত চাপড়ে শুধু এই কথাই বলতে লাগলেন, আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে! আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে!

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গেলাম আম্মাকে ফেরাতে। কিন্তু আম্মাকে আটকে রাখা গেলো না কিছুতেই। তিনি হাত চাপড়াতে চাপড়াতে, আমার সব্বোনাশ হয়ে গেল রে আমার সব্বোনাশ হয়ে গেল! এই কথা বলে বলে চলে গেলেন কোথায় যেন!

চার বছর পর,

আমার বিয়ে হয়েছে। বর খুব লক্ষ্মী!নয় নয়বার বিয়ে ভাঙার পর আব্বা যখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে আমার বুঝি আর বিয়েই হবে না! চিরদিন আব্বার গলার কাঁটা হয়ে ঝুলে থাকতে হবে আমার!

কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু। দশমবারের বেলা আর বিয়ে ভাঙলো না। বর তার মাকে নিয়ে এসে সরাসরি আমায় পছন্দ করলেন। তারপর এর দুদিন পরই বিয়ে পড়ানো হলো। এখন আমার এক মেয়ে। মেয়ের বয়স দুই। মেয়েও তার বাবার মতন খুব লক্ষ্মী!

আব্বা এখন আমার কাছেই থাকেন। সব মিলিয়ে এখন আমি অনেক সুখি। কিন্তু একটা গোপন দুঃখও আছে আমার। দুঃখটা হলো আমার সৎ মা এবং ছোট বোন নিতুর জন্য। হাসান নিতুকে নিয়ে পালানোর মাস খানেক পরেই সে বাড়িতে চলে এলেও নিতু তার সাথে এলো না। আম্মা গিয়ে তার কাছে বললেন, নিতু কই আমার?

হাসান বললো, নিতু কই এটা কী করে আমি জানবো? আমি কী নিতু কে নিয়ে কোথাও গিয়েছিলাম নাকি?

এরপর আম্মা পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় প্রভাব থাকার কারণে হাসানের নামে কোন কেসই লিখেনি পুলিশ। আব্বা নিজেও চেষ্টা করেছিলেন পুলিশের কাছে গিয়ে। কিন্তু পুলিশ জানালো, প্রমাণ ছাড়া কিছুই করা যাবে না। তাছাড়া হাসান সাহেবের মতো এমন সমাজ সেবকের নামে অপবাদ রটানোর জন্য আপনার নামে সে যদি মানহানির মামলা করে তখন কিন্তু আপনার নিজেরই বিপদ হবে!

আব্বার পিঠ তখন আপনা আপনিই দেয়ালে ঠেকে গেল। তাই তিনি এ নিয়ে আর খুব একটা বাড়াবাড়ি করতে পারলেন না।

আর আম্মা ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ঘোর পাগল বণে গেলো। কিছুদিন তিনি বাজারে বাজারে ঘুরাফেরা করলেও এক সময় পুরোপুরি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো। আমি এখনও নিতুকে মনে মনে খুঁজে বেড়াই। খুঁজি আম্মাকেও। বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে রাস্তার দু পাশে তাকাই এই আশায় যে যদি হঠাৎ করে চোখের সামনে আম্মা কিংবা আমার বোনটি পড়ে যায়!

কিন্তু দুঃখজনক হলো দুজনের কাউকেই কোনদিন এক পলকের জন্যও চোখের সামনে পাইনা আমি!

লেখা – অনন্য শফিক

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “হে দুঃখি চোখ – না পাওয়ার কিছু কথা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – মেঘের পালক – একটি কষ্টের প্রেমের গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *