সাঁঝের বেলার রাঙা গোধূলি (১ম খণ্ড) – Ekta bhalobasar golpo story

সাঁঝের বেলার রাঙা গোধূলি – Ekta bhalobasar golpo story: হিমান্তের কপালে ভাঁজ পড়ে সারার কথা শুনে। সারাকে আদর আহ্লাদ করে বেরিয়ে আসে। ভার্সিটির জন্য বেরোবে সে। দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে হিমান্ত। পাশেই রান্নাঘর। এক পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়।


পর্ব ০১

আধো আলো আধো অন্ধকার পিচ রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে পংক্তি। জনাকীর্ণ চারপাশ থেকে এশার আজানের প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে। প্রতিদিন এসময়টাতেই বাড়ি ফেরে সে। আগে সাথে বান্ধবী মনিরা থাকলেও এখন পংক্তি একাই ফেরে। একা হাঁটতে বড় অস্বস্তি লাগে এতো মানুষের ভীরে। এ কারনেই হাঁটার গতি বাড়ায় পংক্তি।

মিরপুর ১৩ নম্বরের এই সরু রাস্তার চারপাশে অগনিত মানুষের ভীর। ফুটপাতে নানা সামগ্রী নিয়ে বসেছে খুচরা ব্যবসায়ীরা। চারপাশে কতো মানুষ!কেউ সবজির খুচরা বাজার থেকে সবজি কিনছে, কেউ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী মাছ দেখছে কেনার জন্য, কেউবা নিত্যপ্রয়োজনীয় টুকিটাকি ঘর গৃহস্থালির জিনিসপত্র কিনছে।

পংক্তি এসব দেখতে দেখতেই এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর এগোতেই দুটো স্টল। স্টলের ভ্যানের কাঁচে বড় বড় অক্ষরে লেখা চটপটি এবং ফুসকা। আর পাশের টাই হালিম। পংক্তি চট করে চোখ সরিয়ে নেয়। এই খাবারগুলো পংক্তিকে খুব টানে। কিন্তু তার সাধ্য নেই এসব খাওয়ার। গার্মেন্টসের হেলপার হিসেবে সে মাত্র ৮হাজার টাকা বেতন পায়।

আবার এক বাসায় কাজও করে। যা পায় তার সবটাই তাকে মামীর হাতে তুলে দিতে হয়। মামি হাত খরচ বাবদ দুইশ টাকা ধরিয়ে বাকিটা তার গোপন কৌটায় বন্দি করে ফেলে। দু’শ টাকা হলেও সেটা পংক্তির কাছে অনেক ছিল। কিন্তু সেটাও তার কাছে থাকে না। দিন দুই যেতেই মামি মোলায়েম স্বরে ওটা কায়দা করে বাগিয়ে নেয়।

প্রথমবার সরল মনেই দু’শ টাকা থেকে ২০ টাকার চটপটি খেয়েছিল পংক্তি। মামি যখন সেটা জানলো অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিল। সেই থেকে শিক্ষা হয়েছে ওর। এখন আর সে ঐ দু’শ টাকা খরচ করে না৷ রেখে দেয় মামি চাইলেই চুপচাপ দিয়ে আসে। তখন যেই খুশিটা মামির চোখে মুখে ফোটে তাতেই শান্তি পায় পংক্তি।

মামির মন পাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেও কিছুতেই সে মামির মনে জায়গা করতে পারে না। বরং মনে হয় মামির চক্ষুশূল সে। এসব ভাবতে ভাবতে স্টল গুলো থেকে অনেক দূর চলে এসেছে পংক্তি। ঘার ঘুরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে চোখ ছলছল করে উঠলো ওর। মনিরা সাথে নেই দেখেই এতো আবেগী কথা মনে আসছে। মনিরা ইদানিং নাইট শিফটও করছে। পংক্তিকেও বলেছিল ওর সাথে নাইট শিফট করতে তাতে আরও কিছু পয়সা আসবে।

কথাটা বলে পরক্ষনেই গলা ঝাঁঝিয়ে ওঠে মনিরার। বলে,
“তোর নাইট শিফট করেও লাভ কী? সব তো ঐ হাড়ে বজ্জাত মামিই নিয়ে নেবে। তার চেয়ে এই ভালো। রাতে ঘুমটা তো হবে শান্তিতে।”

পংক্তি তেমন বাকপটু নয়। সে বেশিরভাগ সময়ই চুপ থাকে। মনিরার কথায় মনে মনে শুধু হাসে বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই যে রাতে শান্তির ঘুমের কথা বললো। সে’কথা শুনে মনে মনে বেজায় হাসি পেল। পংক্তি অতিরিক্ত কষ্টগুলো হাসির আড়ালে ঢাকতে চায়। এটাও তেমন হাসি। যেন নিজেকে নিজে তাচ্ছিল্য করা।

তা নয়ত কী! দেড় রুমের টিনশেড বাসা ভাড়ায় থাকে ওরা। মামা, মামী ছোট রুমটায় থাকে। বড় রুমটায় পংক্তি, পংক্তির মামাতো ছোট বোন মিলি আর পংক্তির চেয়ে চার বছরের বড় মামাতো ভাই মাহিন থাকে। মাহিন চৌকিতে শোয় আর পংক্তি ও মিলি নিচে বিছানা পেতে থাকে।

তাতে সমস্যা নেই পংক্তির। কিন্তু ইদানিং মাহিন ভাইয়ের নজর ওর কাছে ভালো লাগছে না। তিনদিন আগে ঘুমের ঘোরে পংক্তির মনে হয়েছিল কেউ ওর বুকে হাত দিয়েছিল। পংক্তি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। অন্ধকার রুমে তখন শুধু মাহিনই জেগে ছিল। ওকে বসতে দেখে বিশ্রীভাবে হেঁসেছিল মাহিন। পংক্তির এখন রাতে ভয় করে।

ঘুম হয় না ঠিক মতো। তাকে আবার না মামাতো ভাইয়ের লালসার মুখোমুখি হতে হয়। গতবার তো মামা তার পক্ষ নিয়ে বড় ছেলে মুহিবকে আলাদা করে দিল। কিন্তু এবার কী হবে? দোষ তো ওরই দেখবে সবাই। মুহিব ভাইকে নিয়ে এখনও সুযোগ পেলে অনেক কথা শোনায় মামি। ভাবিও দু’চোখে পংক্তিকে সহ্য করতে পারে না এখন আর।

এরা সুযোগের অপেক্ষায় আছে পংক্তিকে এক হাত নেবে বলে। এসব আনমনা হয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎই কিছুর সাথে পা বেঁধে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয় পংক্তি। পিচ ঢালা পথ ছেড়ে সে কখন এই ঘিঞ্জি এলাকার উঁচু নিচু ভাঙা পথে নেমেছে খেয়ালই নেই। এই রাস্তাটা এবড়োথেবড়ো। নতুন বসতি তাই রাস্তা তেমন মেরামত করা হয় নি। আগে হয়তো বস্তি ছিল। কিছুটা গ্রাম্য পরিবেশের ছোঁয়াও আছে এদিকটায়।

একটু দূরে দূরে হেডলাইটের আলোয় সাবধানে খোয়া ফেলা রাস্তা পার হয়ে সামনের কাঁচা রাস্তা ধরে তারপর আবার ভাঙা বিল্ডিংয়ের উচ্ছিষ্ট ফেলা সংকুল পথ। বৃষ্টি হলে হাঁটুর উপর অব্দি পানি হয় এই রাস্তায়। তখন গা ঘিনঘিন করে পংক্তির। সমস্ত এলাকার মানুষের পরিত্যক্ত ময়লা আবর্জনা সব ঐ পাশের নালা দিয়েই কালাপানির পুকুরে পড়ে। বৃষ্টিবাদলে সব পানি এক হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে তখন গোসল ছাড়া উপায় থাকে না পংক্তির।

আজ অবশ্য বৃষ্টি হয়নি তবে গরম খুব পড়েছে। বোরকার নিচে সুতি জামাটা ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে। পংক্তি দ্রুত পা চালায় এ অন্ধকার পথটায়৷। এখানে যেই অন্ধকার তাতে মাঝে মাঝে পংক্তির প্রচন্ড রকমের ভয় হয়। কেউ হুট করে পথ আগলে টেনে নিয়ে গেলেও কাকপক্ষী জানবে না। তবে এসব সবটায় পংক্তির মনের ভয়। আজ একবছর সে এ রাস্তায় চলাচল করছে। আলহামদুলিল্লাহ কিছুই ঘটে নি। হয়তো ভবিষ্যতেও ঘটবে না। তবে অসহায় মন কু ডাকবেই।

পংক্তি সরু গলির পথ ধরে বাড়ি ফেরে। লম্বা লম্বি টিনসেড বাসা। এ পাশে চারটা পরিবার ও পাশে চারটা পরিবার। মাঝে রান্না ঘর,বাথরুমে চলাচলের জন্য সামান্য পথ। বাড়িওয়ালা থাকে না। ডানপাশের প্রথম ঘরটা যার তিনিই বাড়িওয়ালার অবর্তমানে দেখাশোনা করেন৷ বড়ই চাড়াল ধাঁচের লোক কেয়ারটেকার। বাম পাশে তিননম্বর ঘরটাতে পংক্তির মামা ভাড়া থাকে। পংক্তি চটি জোড়া খুলে ভেতরে ঢুকলো। ঘরে মিলি ছাড়া আর কেউ নেই।

মিলিটা মুখের উপর বই রেখে ঘুমাচ্ছে। পংক্তি দ্রুত বোরখা ছেড়ে না জিরিয়েই গামছা খুঁজে ঘর ছেড়ে বাইরে এলো। এই বাসাটাতে রান্না ঘর, বাথরুম বাইরে। বাম পাশের চারটা ভাড়াটের জন্য ২টো বাথরুম আবার ডান পাশেরও তেমন। চুলার ব্যবস্থাও একই রকম। পংক্তি গামছা নিয়ে রান্নাঘরে সামনে আসতেই থেমে গেল।

রান্না ঘরের পাশ দিয়েই টয়লেটে যাওয়ার রাস্তা। এখানেই হতাশ, বিষন্ন মুখে দাঁড়িয়ে রইল। পংক্তির ভাগ্য আজও খারাপ। গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার শরীর। অসহ্য লাগছে। ভেবেছিল গোসল করে একটু স্বস্তি পাওয়া যাবে কিন্তু তা হয়তো এতো তাড়াতাড়ি হবে না। আগে থেকেই কেউ একজন টয়লেটে ঢুকে আছে। পংক্তি নিশ্চিত এটা লাবন্যের মা। তিনি ইচ্ছা করে এ সময় ঢুকেছেন।

পংক্তির মামির সাথে ঝগড়ায় পেরে ওঠে নি সেই ক্ষোভ পংক্তিকে নাজেহাল করে উসুল করছে। এমনই করেন উনি। কিন্তু পংক্তি কোনো সময় দু’কথা বলে না তাকে। চুপচাপ পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। এখান থেকে সরলে হয়তো গোসলই করা হবে না ওর।

সামনের ঘরের শিউলি ভাবি খাবার গরম করতে এসে দেখে পংক্তি ঘর্মাক্ত শরীরে, মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শিউলির খুব মায়া হয় মেয়েটার উপর। একটা মানুষ কতোটা আঘাত পেলে এতোটা ঠান্ডা মেরে যায় শিউলির জানা নেই। তবে পংক্তির এই নিশ্চুপতা দেখলে কিছুটা আঁচ করা যায় ওর দুঃখের গভীরতা।

এই গভীরতা আঁচ করাও সহজ ব্যাপার নয়। যারা পংক্তির মনের শুদ্ধতা জানে তারাই কেবলমাত্র আঁচ করতে জানে। বাকিদের চোখেও পড়ে না এই মেয়েটার দুঃখ দুর্দশা। শিউলি তরকারির চুলায় আঁচ বাড়িয়ে এগিয়ে আসে শিউলির কাছে।
“কী রে আজও দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে?”

পংক্তি জবাব দেয় না। নত মুখে শান্ত চোখে দাঁড়িয়ে থাকে। শিউলি ওর হাতটা ধরে বলে,
“চল আমাদের টয়লেটে গোসল করে নিবি। তোকে বলেছি না যেটা খালি পাবি ঢুকে যাবি। তারপর যা হয় আমি দেখবোনে।”
“না ভাবি। শুধু শুধু ঝগড়া ফ্যাসাদের দরকার নেই। মামি রাগ করবে।”

“তোর মামিই তো এসব করাচ্ছে। আমার কী মনে হয় জানিস পংক্তি? তোর মামি ইচ্ছে করে লাবন্যের মায়ের সাথে ঝগড়া করে যেন লাবন্যের মা সেই ঝাল তোর উপরে মেটায়। আমার তো এও সন্দেহ হয় এরা দু’জনই না বুদ্ধি করে তোরে কষ্ট দেয়।”

“কী যে বলো তুমি ভাবি! এসব তোমার ভুল ধারণা। মামি এতোটাও খারাপ না।”
“বেকুব তুই। সে যে কী কিসিমের মানুষ তোর এই সরল মস্তিষ্কে ঢুকবে না। মুহিব ভাইয়ের অপমানের শোধ নেয় এসব করে। ওরা সুযোগে আছে তোরে ইকরাম কাকার কাছে ছোট করার জন্য।”
পংক্তি জানে শিউলি ভাবি যা বলছে সেটা শতভাগ সঠিক তবুও পংক্তি একগাল হেঁসে দিল।

যেন সবই ভাবির ভুল ধারণা। শিউলির মেজাজ চটে যায় পংক্তির মাত্রাতিরিক্ত সরলতা দেখে। মেয়েটা বোঝালেও বোঝে না। ভাবি জানে না পংক্তি সব বুঝেও না বুঝতে বাধ্য হয়। যে অন্যের গলগ্রহে থাকছে তার আবার বোধশক্তির কী প্রয়োজন! তাদের তো সব হাসি মুখে মেনে নেওয়া শিখতে হয়। নয়তো মাথার উপর নিরাপদ আশ্রয় টুকুও খোয়াতে হবে। পংক্তির তিনকুলে মামা ছাড়া আর কেইবা আছে?

মামার ছায়া মাথার উপর থেকে সরলে পংক্তির মরা ছাড়া উপায় থাকবে না। সতেরো বছর বয়সের পূর্ণ যৌবন তার। আশেপাশে কুকুর শকুন ওঁৎ পেতে আছে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য। মামা আছে বলেই বাঁচা। পংক্তিকে নির্লিপ্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিউলি রাগ করে চলে যায় ঘরে। পংক্তির দাঁড়ানোর ১৫ মিনিট পর লাবন্যের মা মুখ ঝামটে বের হয়।

পংক্তির মধ্যে কোনো ভাবোদয় হয় না তা দেখে। গামছা, কাপড় রেখে পংক্তি ড্রামে ধরে রাখা থেকে পানি থেকে একবালতি পানি নিল। এর বেশি নেওয়ার অনুমতি মামি দেয় নি। অথচ রাত জেগে পংক্তিকেই পানি ধরে রাখতে হয়। কিন্তু ভাগের বেলায় কম টুকুই তার জোটে। এসবে এখন আর পংক্তির তেমন আক্ষেপ নেই।

সব গা সয়ে গেছে। পংক্তি গোসল করে দেহ মনে শান্তি পায়। ভেজা কাপড় সামনের তারের উপর মেলে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ঘরে ঢোকে। ঘরে ঢুকতেই মিলি ওর দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালো। তারপর জোরে জোরে শব্দ করে পড়তে লাগলো “দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য”মূল ভাব হলো,, “মিলি বাকিটা না পড়েই থেমে গেল। উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখলো মা আশেপাশে আছে কিনা!না নেই।

তারমানে সে এই মুহূর্তে নিজেকে বিপদমুক্ত পেল। তবুও সাবধানতা গলায় নিয়ে স্বল্প স্বরে বললো,
“আপা! ও আপা!”
পংক্তি ভেজা চুল বালিশে এলিয়ে সবেমাত্র দু’চোখ বন্ধ করেছিল। গোসল করে তার ক্লান্ত দেহটার আকুতি রাখতেই শুয়েছিল সে। মিলির গলার আওয়াজে চোখ খুলে তাকাল।
“কিছু বলবি?”

“আপা জানিস মা কই গেছে?”
“না তো।”
“মনে হয় মুহিব ভাইয়ের বাসায় গেছে। আপা তুই খেয়ে আগে আগে শুয়ে পড় নয়তো আজও এসে বকবে মা তোকে।”
“আরে না! তেমন কিছুই হবে না। তুই পড়। মামি ফিরলেই খাবো।”

“আপা তুই এমন কেন? এ যাবত একদিনও এমন হইছে যে মা রাতে মুহিব ভাইয়ের বাসা থেকে এসে তোরে বকে নাই। সেদিন তো চড়ও খেলি। যা না আপা।”
“মিলি বিরক্ত করিস না তো। চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে পড়। নাইনে উঠেছিস এখন পড়ায় হেলাফেলা করিস না বোন।” পংক্তি আবার চোখ বুজলো। মিলি মুখ কালো করে আপার মুখের দিকে চেয়ে রইল।

পংক্তিকে মিলি বরাবরই আপন বোনসম ভাবে। পংক্তির প্রতি মায়ের বিরূপ আচরণ মিলিকে কষ্ট দেয়। সবাই কেন পংক্তির সাথে এমন করে? পংক্তি আপা অনাথ বলে? মিলির চোখ ছলছল করে কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে থাকা পংক্তির মলিন মুখটা দেখে। মিলি আবার পড়ায় মনোযোগ দিতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। মা এসে কী শুরু করবে সেসব ভাবতেই মিলির চিন্তা হতে লাগলো।

তারউপর আজ বাবার নাইট ডিউটি। রাতে ফিরবে না বাবা। বই সামনে খুলে মিলি এসব ভাবছিল তখনই ঘরে মাহিন ঢুকলো। ঘরে ঢুকতেই মাহিনের চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। দৃষ্টির সামনে প্রিয়তমা শুয়ে আছে। মাহিন ভালোমতো দেখতেও পারলো না পংক্তিকে।

মিলি ওর দিকে তাকাতে দেখে চোখ সরিয়ে নিল মাহিন। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে মাহিন নিজের বিছানায় বসলো। ওর চঞ্চল দৃষ্টি জোড়া বার বার পংক্তির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু মিলির জন্য সেই চঞ্চলতায় ব্যাঘাত ঘটছে। মাহিন গম্ভীরমুখে মিলিকে লক্ষ্য করে বললো,
“মা কইরে?”

“কই আবার! মুহিব ভাইয়ের বাসায় গেছে।”
“যা তো চট করে মা’কে ডেকে নিয়ে আয়।”
“আমি তো পড়ছি ভাইয়া। তাছাড়া মা একটু পরই চলে আসবে। এখন ডাকতে গেলে বকবে আমাকে।”

মাহিন ভাই আর পংক্তিকে একা রেখে মিলি কিছুতেই যেতে যাচ্ছে না। পংক্তি আপার সাথে মুহিব ভাইয়ের নোংরা আচরণ মিলিকে এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। ভাইদের প্রতি এখন ওর আর বিশ্বাস নেই। মিলির এমন জবাব শুনে মাহিন রেগে গেল,
“কী ছাই পড়িস সে’কি আর জানি না! জিএসসিতে তো টেনেটুনে পাশ করলি আবার আমাকে পড়া দেখাচ্ছিস। যা বলছি।”

মাহিনের ঘরে ঢোকার পরপরই পংক্তি গায়ে কাপড় ঠিক করে শুয়ে ছিল। মাহিন মিলির উপর রাগ করছে শুনে উঠে বসলো। ঠান্ডা গলায় বললো,
“ভাইয়া ও পড়ুক আমি যাচ্ছি।” পংক্তি উঠতেই মাহিন বলে উঠলো,
“তোকে কে যেতে বলেছে? তুই গেলে আরেক কান্ড ঘটে যাবে। সব জেনে বুঝেও যেতে চাচ্ছিস কোন সাহসে?”মাহিনের কড়া কথায় পংক্তি চুপ মেরে বসে রইল। মাহিন সবার অলক্ষ্যে মুচকি হেঁসে আবার মুখ কঠিন করে।

মিলির সামনে দাঁড়িয়ে ধমকাতে লাগলো। নিরুপায় মিলি ভাইয়ের হাতে চড় খেয়ে শেষমেশ যেতে বাধ্য হলো।
মিলির যাওয়ার পর ঘরটাকে কেমন বিপদসঙ্কুল মনে হচ্ছে পংক্তির। ভয় করছে একা মাহিনের সাথে থাকতে এ ঘরে। মাহিন ওর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকায় অস্বস্তি কাজ করছে ভেতরে ভেতরে। মনে সাহস সঞ্চার করে পংক্তি উঠে দাঁড়াতে গেলে হঠাৎই মাহিন হাত ধরে মুখোমুখি বসে ওর।

পংক্তির বুকের ভেতর অজানা শঙ্কায় ঢিপঢিপ করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। শরীর কাঁপছে জ্বরের রোগীর মতো। মাহিন কিন্তু হাত ছাড়ে নি। পংক্তির ভয় পাওয়া নিষিদ্ধ আনন্দ দিচ্ছে মাহিনকে। পংক্তির শ্যামলা মুখটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে সে ভয়ে। মাহিন অন্য হাত দিয়ে পংক্তির নাকের ঘাম মুছে ঝুঁকে আসে। মাহিনকে কাছে আসতে দেখে পংক্তির সমস্ত শরীর অসাড় হতে লাগলো। দু’আঙুলের দুরত্বে পংক্তি আর মাহিনের ঠোঁট।

পংক্তি ঢোক গিলে চোখ, শ্বাস বন্ধ করে। ভেতরে প্রবল শক্তি সঞ্চার করে মাহিনের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। উঠে দাঁড়ায় কাঁপতে কাঁপতে। অস্ফুট স্বরে বলে,
“মাহিন ভাই! “
মাহিন প্রত্যাখ্যাত হয়ে রেগে যায়। চোখ লাল করে পংক্তির চুলের মুঠি ধরে টেনে বিছানায় ফেলে দেয়। দু’হাত বিছানায় চেঁপে ধরে।

ধমকের সুরে বলে,
“মাহিন ভাই কী হ্যাঁ! বল মাহিন। পংক্তিরে তোরে আমি ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।” মাহিন ধমক দিয়ে কথা শুরু করলেও শেষ করে কাতরতা দিয়ে। মাহিনের কথা শুনে ভয়ে দু’চোখ বিস্ফোরিত পংক্তির।
“এসব কী বলছেন আপনি মাহিন ভাই? আল্লাহর দোহায় লাগে ছাড়েন।” পংক্তি কাঁদতে থাকে। মাহিন পংক্তির মুখ চেঁপে ধরে।

“হুশশ! শব্দ করবি না। তোকে সেই কবে থেকে পছন্দ করি আমি জানিস না তুই। অনেক সাহস লেগেছে তোর কাছে আসতে। আমার ভালোবাসা গ্রহন কর পংক্তি। একটা চাকরি হলেই তোকে বিয়ে করবো কথা দিচ্ছি। তোর সব কষ্ট দূর করে দেব ভালোবেসে। ভালোবাসবি বল?”

পংক্তি চাপা মুখেই গোঙাতে লাগলো। মাহিন কান খাঁড়া করে কারো পদধ্বনি শুনতে পেয়ে দ্রুত নিজের বিছানায় গিয়ে বসে। পংক্তিকে চোখ রাঙায় স্বাভাবিক হতে। মৃদু স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“শোন কাল পর্যন্ত তোকে ভাবতে সময় দিলাম। কাল রাত্রেই আমার জবাব চাই। আর শোন এসব কাওকে জানালে পরিণতি কী হবে তা তো জানিসই।”

মাহিনের ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি। বিছানায় গা এলিয়ে পংক্তির দিকে আড়ে ঠাড়ে চায় সে। মিলির গলার আওয়াজ শোনামাত্রই পংক্তি দ্রুত ওড়না ঠিক করে উল্টো দিকে শুয়ে পড়ে। এখনও কাঁপছে ও। জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে। ভয় আতঙ্ক আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছে পংক্তিকে। মনে হচ্ছে এখনই আত্মহত্যা করে নিজেকে শেষ করে দেই।

এতো ভয়, ভীতি, লাঞ্ছনার মাঝে বাঁচার চাইতে মরে যাওয়া শতগুনে ভালো। কিন্তু সেটা শুধু পংক্তি ভাবতেই পারবে। মরা বুঝি ওর আর হবে না। মরতেও যে সাহসের দরকার পড়ে। যে মাহিন, মুহিবকে সে আপন ভাই জ্ঞান করেছে তারাই ওর দিকে অন্য নজরে তাকালো। পংক্তি আগেই সন্দেহ করেছিল এমন কিছু হবে।

সে লক্ষ্য করেছিল মাহিন নানা ছুতায় পংক্তির আশেপাশে ঘুরঘুর করে। সুযোগ পেলে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। হাত ছোঁয়। একটা মেয়ে আর কিছু বুঝুক আর না বুঝুক খারাপ আর ভালো স্পর্শ সে খুব সহজেই বুঝতে পারে। মুহিব ভাইয়ের ঘটনার পর তো সব পুরুষকেই ওর মুহিব মনে হয়। তাদের চোখে শুধু লালসাই পরিস্ফুটিত হতো। পংক্তির শরীর গরম হয়ে উঠেছে। হয়তো ভেঙেচুরে জ্বর আসবে। দুঃশ্চিতায় মাথা ভনভন করছে।

আজ রাতে আর খাওয়া হলো না পংক্তির। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা তবুও সে খেতে পারলো না। উল্টো বমি করে নিথর মেরে শুয়ে রইল বিছানায়। মামি যাও একটু চিৎকার চিচাঁমেঁচি করছিল মাহিনের ধমকে চুপ করে গেল। রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে পংক্তির। ব্যথায় মাথার পেছনটা মনে হয় ছিঁড়ে যাচ্ছে। নিরবে অশ্রুবিসর্জিত করতে লাগলো।

বালিশে মুখ ঠেসে কাঁদছে পংক্তি। মামি এসব জানলে পংক্তিকে বের করে দেবে ঘর থেকে। মাহিন ভাইকে এতোকষ্ট করে লেখাপড়া শেখাচ্ছে পংক্তির মতো অনাথকে বউ মানবে বলে? কোনোদিন না! পংক্তি তো সব বোঝে। মাহিন ভাই কেন বোঝে না? এসবের দায়ভার তো সবটা পংক্তির উপর পড়বে। তখন কোথায় গিয়ে ঠাঁই হবে পংক্তির? মাহিন কী তখন এমনি করে বলবে ভালোবাসি! পংক্তি আর ভাবতে পারে না। চোখের সামনে ঘোর অমানিশা নেমে আসে।


পর্ব ০২

“মনিরা তোকে পংক্তি খুঁজছে।”
“কোথায় ও”
“ঐ তো মেশিনের কাছেই দাঁড়ানো।”

“যা আমি আসছি।” সহকর্মী নিশি কে বিদায় দিয়ে মনিরা ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। চোখ মুখ ধুয়ে ঘুরতেই হুট করে কোথা থেকে এসে সুমন কোমর জড়িয়ে ধরে। মনিরাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে গলায়, ঘাড়ে,ঠোঁটে চুমুর বর্ষণ শুরু করে। জামার গলার ভেতর হাত ঢুকাতেই মনিরা সিটকে সরে আসে।

“রাতে যা করছ হয় নাই। এখনও এসব করা লাগবো?”
“এমন করস কেন? এইগুলারেই তো ভালোবাসা কয়। তোরে আমি কতো ভালোবাসি তুই বুঝোস না ছেরি?”মনিরার বাঁধা উপেক্ষা করে আবার জাপটে ধরে সুমন। নির্জন কাপড়ের ভান্ডারের ঘরটায় টেনে নিয়ে যায়। বেশখানিক্ষন পর মনিরা ওড়না ঠিক করতে করতে বের হয়। পেছনে সুমন।
“বিয়া কবে করবা?”

“আরে পাগল হইছোস কেন? দিন কী ফুরাই গেল? সময় হইলেই সব হইবো। এহন যা কাম কর গিয়া।” একপ্রকার তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ধমকে চলে গেল সুমন। মনিরার ইচ্ছা করছে এখনই গিয়ে পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিতে।
“শালা বাইঞ্চ*। খাওনের সময় জিহ্বা লকলকাইতে আহে। খাওন শেষ হইলে দূর দূর করে। আরে মনিরা রে কোন কুক্ষনে এই কুত্তারে মন দিছিলি?”মনিরা কপাল চাপড়ে বিরবির করতে করতে কর্মস্থানে গিয়ে বসে। অদূরে পংক্তি বসেছিল। মনিরাকে দেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে।

“কী রে আমারে বলে খুঁজতাছিলি? বিষয় কী? বিয়ের দাওয়াত দিবি নাকি?”কথাটা শেষ করেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মনিরা। ওর দেখাদেখি আশপাশের সহকর্মীরাও হাসছে। মনিরার হাসি থেমে গেল পংক্তির শুকনো বিবর্ণ মুখশ্রী দেখে। আবহাওয়া বিদরা যেমন আকাশের রঙ বদল দেখে পূর্বাভাস আন্দাজ করতে দক্ষ। মনিরাও বান্ধবীর মুখ চোখ দেখলে বুঝে যায় ওর মনের খবর। ভ্রুকুটি করে পংক্তির নত মুখে চেয়ে নরম স্বরে বলে,
“কী সমস্যা?”

পংক্তি এই প্রশ্নের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল এতোক্ষণ। মনিরা প্রশ্ন শেষ করার সাথে সাথে মনিরাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। খুব চেষ্টা করে কান্না ঠেলে রোধ করার কিন্তু আজ আর পারলো না পংক্তি। অসুস্থ, দূর্বল শরীরের কাছে তাকে হার মানতে হলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল মনিরার গলা জড়িয়ে।

“কী রে তোর গায়ে তো হাবিয়ার আগুন। ইয়া মাবুদ! এই পংক্তি সোজা হ।” পংক্তিকে সামনে এনে বসায়। আশেপাশের সবাই পংক্তির দিকে কৌতূহল চোখে তাকিয়ে আছে। ফিসফিসানিও শুরু হলো তাদের মধ্যে। তা দেখে মনিরা সতর্কতার সাথে পংক্তিকে উঠিয়ে নিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে বসে।
“এবার বল! গায়ে জ্বর এলো কী করে? গতকালও তো সাইবেরিয়া ছিলি আজ সাহারা মরুভূমি হওয়ার কারন কী? বাসায় কিছু হয়েছে? মামি মেরেছে?”

পংক্তি না সূচক মাথা নাড়ায়। মনিরা বিরক্ত হয় পংক্তির নিরবতা দেখে। এদিকে পেটে ক্ষুধাও লেগেছে মনিরার। তাই আগে খাবারের অর্ডার দিল। খাবার আসতে আসতে মনিরা চুপচাপ পংক্তিকে পর্যবেক্ষণ করছে। মনিরা জানে পংক্তি মুখ ফুটে কিচ্ছু বলবে না৷ সবটা আগে মনিরাকে আন্দাজ করতে হবে তারপর সে বিস্ময় চোখে দুদন্ড মনিরাকে দেখে চোখের বারিধারা বইয়ে বলতে থাকবে অব্যক্ত কথা।

মনিরা গভীর মনোযোগ দিয়ে পংক্তিকে দেখে যাচ্ছে। হঠাৎ ওর চোখটা পংক্তির হাতের কব্জিতে গিয়ে আটকালো। সেখানে কিছুটা রক্তজমাট বাঁধার মতো লালচে বর্ণ হয়ে আছে। মনিরা বুঝে গেছে। সাথে সাথে মেজাজ চড়িয়ে বলে,
“শালার সব পুরুষই মাদার*। তোর মাহিন ভাইটাও ওমন অজাত হয়ে গেল? সব শালা মুখোশ পড়া শয়তান।

দেহ খাওয়ার ধান্দা। আমি সব জানতাম। আমার কথা তো শুনবি না। এতো করে বললাম চলে আয় আমার সাথে থাকবি। না তুই আসবি না। মামা রাগ করে। এখন কী করবে তোর মামা? কুকুর বেড়ালের সাথে থাকা যায় কিন্তু চরিত্রহীন পুরুষের সাথে কখনোই থাকা যায় না পংক্তি। ওদের নজরে বিষ,হাতে বিষ,দাঁতে বিষ সর্বশরীরে বিষ থাকে। চরিত্রহীন পুরুষ কখনোই জীবের তালিকার না ওরা নিকৃষ্টতর পর্যায়ের জন্তু।

তোর মতো মেয়ে দেখলে তো আরও,,,
“মাহিন ভাই নাকি ভালোবাসে আমাকে। বিয়ে করতে চায়?”পংক্তির চোখে বিস্ময় কেটে ভয় জেঁকে বসেছে। মনিরার মুখের দিকে করুন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। পংক্তির কথা শুনে মনিরা বড়সড় রকমের ধাক্কাই খেল মনে মনে। ধাক্কাটা সামলাতে মৃদু হাসলো। ততক্ষণে খাবার ওদের টেবিলে। মনিরা রুটি ছিরে আলুভাজি তাতে পুরে পংক্তির মুখের সামনে ধরলো।

“খা!”
পংক্তি হা না কিছুই বললো না। জ্বর শরীরে খেতে ইচ্ছা করছে না তবুও মনিরার হাত থেকে খেয়ে নিল। মনিরা গম্ভীরমুখে পানি এগিয়ে দিল সাথে ব্যাগ থেকে বের করে দিল একটা প্যারাসিটামল এইচ প্লাস। পংক্তি তিক্ত মুখেই জোর করে গিললো ওষুধ টা। মনিরা এবার নিজে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। খাওয়া শেষ হতেই হাত মুছতে মুছতে বললো,
“মাহিন বলেছে তোকে বিয়ে করবে?”

“হ্যাঁ! পংক্তি গতরাতের সব কথা খুলে বললো। মনিরা আরও কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলো। তারপর ঠোঁটের কোনা প্রসারিত করে বললো,
“হ্যাঁ বলে দে।”
“হ্যাঁ বলে দেব! পাগল তুই? মামিকে জানিস না?”

“জানি তো? দ্যাখ পংক্তি তোর মামা বয়স্ক মানুষ। কখন কী হয় বলা যায় না। তোর মামার কিছু হলে তোর কী গতি হবে ভেবেছিস কখনো?”
“আমি কী করবো তাহলে? আমার ভীষণ ভয় করছে রে মনি।” পংক্তির কন্ঠস্বরে ভয় আর অসহায়ত্ব।

“মাহিনের সাথে সম্পর্কে রাজি হয়ে যা। সাথে একটু চালাকও হ। দেহ মন সব দিয়ে বশ করে ফেল ওকে। তারপর দেখবি তোকে ছাড়া দুনিয়া কেমন আন্ধার দেহে ঐ। ছেলের কথার উপর তোর মামি মোমেনা বেগম কোনোদিন টু শব্দ করতে পারবে না। আর বাদবাকি বকবক করা। সেটা কোন শ্বাশুড়ি করে না বল। বাঙ্গালী শ্বাশুড়িদের কাছে বউ হলো চক্ষুশূল।”

“আমি পারবো না রে। আমার ভয় করে।”
“বাল! পারবা ডা কী? তুই কী চাস মাহিনও মুহিবের মতো একা ঘরে পেয়ে তোরে জাপটে ধরুক? তারপর পাড়া মহল্লায় সেটা জানাজানি হোক? তোর মামা এবার সইতে পারবে এসব? সবাই তোর দিকেই আঙুল ধরবে। সবচেয়ে বড় কথা মাহিন শিক্ষিত পোলা। তারে একবার বশ করতে পারলেই তোর লাইফ চকাচক। আর কতো মাইনষের বান্দীগিরী করে থাকবি? নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে।” মনিরার কন্ঠস্বরে একরাশ ক্ষোভ।

“পরে যদি মাহিন ভাই প্রত্যাখ্যান করে তখন কী হবে বল? তাছাড়া বিয়ের আগে এসব হারাম। তোকে আমি নিষেধ করি সেই আমিই যদি এসব করি আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবে না কোনোদিন। নিজের কাছে নিজেই তো ছোট হয়ে যাবো”পংক্তির মুখটা ছোট হয়ে গেল। নত মুখে মাথা ধরে বসে আছে।
“তাহলে থাক পর্দানশীন নিরীহ জীব হয়ে। আমার কী? তোমার জীবন তুমি বোঝো।”

মনিরা রাগে গম্ভীর হয়ে রইল। পংক্তি নিঃশ্চুপ। মাথার পেছনে ব্যথাটা আমার চাড়া দিয়ে উঠেছে। বমি বমি লাগছে। সোজা বসে থাকতে পারলো না পংক্তি। মাথা টেবিলের উপর রেখে বসে রইলো। সহসায় মনিরার খারাপ লাগলো পংক্তির মলিন মুখ দেখে। পাশে সরে এসে বান্ধবীর মাথার হিজাবের উপর হাত রেখে বললো।

“শোন পংক্তি। আমার মতো তোকে হতে বলছি না তবে মাহিনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিস না। একটা অবলম্বন তোর দরকার রে। সেই অবলম্বন মাহিন হলে ক্ষতি কী। আচ্ছা তুই ওকে আজ গিয়ে বল সাত দিন দূরত্ব রেখে ভালোবাসতে। তারপর যদি সুবিধা মনে করিস সম্পর্ক রাখিস নয়তো মানা করে দিবি। বুঝেছিস না কী বলতে চাচ্ছি!”

“হুমম। ভেবে দেখি।” দূর্বল গলায় ওভাবেই মাথা ঠেঁকিয়ে জবাব দিল পংক্তি।
“তুই তো ঠিকমতো বসতেই পারছিস না। কাজ করবি কীভাবে। চল আজ ছুটি নেই।”
“না থাক। বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না।”

“আরে বাসায় যাওয়া লাগবে না আজ আমার বাসায় চল। এই শরীরে তোকে ঐ বাসায় পাঠাবো না। ওঠ! ওঠ।”
পংক্তির নিষেধ স্বত্বেও মনিরা জোর করে টেনে তুললো ওকে। হাত ধরে নিয়ে সুপারভাইজারের কেবিনে সামনে দাঁড়ালো। পংক্তির অসহ্য লাগে সুপারভাইজারকে।

কেমন লোলুপ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায় লোকটা। দেখতে গা রি রি করে ওঠে। হিজাবের মুখোশ ভালো করে উঠিয়ে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো পংক্তি। মনিরা এগিয়ে গেল সুপারভাইজারের একদম কাছে। সুপারভাইজারের মুখের দিকে ঝুঁকে বললো,
“ও স্যার! স্যার গো?”

“কী দরকার?”
“ছুটি লাগবো স্যার।”
“ছুটি দিতে পারবো না। আজ এমডি আসবে। কাজ স্লো দেখলে সমস্যা আছে।”

“দুইজনের জন্য কী আর কাজ আটকে থাকবে স্যার। দেন না স্যার একদিনের ছুটি। পংক্তির শরীরটা ভালো না স্যার। ঐ দেখেন দেয়াল ধরে দাঁড়ায় আছে। উল্টো পাল্টা কিছুই হইলে তখন কিন্তু আপনিই ফাঁসবেন।”
“ভয় দেখাস ছেরি তুই আমারে। জানিস এই গার্মেন্টসের মালিক আমার ফুপাশ্বশুড়।” মধ্য বয়স্ক সুপারভাইজার আজিজুল ইসলাম চটে যায়। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে গেলে মনিরা আজিজুলের পা জড়িয়ে ধরে।

“ও স্যার মাফ করে দেন স্যার। আমি ওমনে কথাটা কই নাই স্যার। আপনি যে এই অফিসের উঁচু পর্যায়ের লোক তা আমরা সবাই জানি স্যার। মাফ কইরা দেন স্যার।” ,
“পা ছাড়! যার ছুটি তারে বল আমাকে এসে বলতে।”

“স্যার ওর গায়ে অনেক জ্বর। কথা বলতে গেলে পেট উগলায়া বমি আইতাছে। শেষে আপনার গায়ে বমি কইরা দিলে কী একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে যাইব।”
“জ্বর নাকি?”
“হ স্যার। মেলা জ্বর।”
“দেখি এই পংক্তি এদিক আয়। দেখি কতো জ্বর তোর গায়ে?”

আজিজুলের ডাক শুনেও নড়ে না পংক্তি। ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘৃণা হচ্ছে লোকটার দিকে তাকাতে। হাত পা শক্ত করে একই ভাবে দাড়িয়ে আছে পংক্তি। এদিকে আজিজুলের হাত ইশপিশ করছে পংক্তির কচি নরম শরীর ছোঁয়ার জন্য। জ্বরের অসিলায় হাত, কপাল ছুঁয়ে এক ফাঁকে অন্য জায়গায় হাত দেওয়ার চান্স নেবে সে।

ভাবতেই চোখ দুটো পৈশাচিক আনন্দে লকলক করে। পংক্তির উপর অনেক দিন থেকেই নজর আজিজুলের। এই মেয়ের মধ্যে কিছুতো আছে যা এই গার্মেন্টসের অন্য মেয়ে কর্মীদের মধ্যে নেই। বোরখার আড়ালে আঁটসাঁট দেহ গড়ন, ভরা যৌবন, ডাগর ডাগর দুটো ভীরু চোখ। ভাবতেই রিরংসা জেগে ওঠে। আজিজুলের লোলুপ দৃষ্টির সীমানায় কড়াঘাত করে পিয়ন এসে দাঁড়ায়। হড়বড়িয়ে বলে,
“স্যার, এমডি স্যার আইছে।”

কথাটা শোনামাত্রই আজিজুল সটান হয়ে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। সকল নিষিদ্ধ চেতনা মুহূর্তে গায়েব হতে বাধ্য হয়। মোটা ফ্রেমের চশমাটা কাঁপা হাতে পড়ে নিয়ে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে আজিজুল। পিয়নকে তাড়া দিয়ে বলে,
“যাও আমি আসছি।” আজিজুল টেনে গুঁজে শার্টের ইন ঠিক করে বের হতে উদ্যত হয়। তখনই মনিরা সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

“যামু স্যার! “
“না! শুনলি না এমডি আসছে।”
“এমডি তো আর আমাগো কাজ দেহে না। দেহেন আপনি। দেন না স্যার ছুটি। ও একা যাইতে পারবো না আমারেও যাইত হইবো।?
“আরে কী মুসিবত! যা যা! পথ ছাড়।”

“স্যার এইজন্যই বলি আপনে মানুষ ভালা।” আজিজুল মনিরার কথায় কর্ণপাত না করে দ্রুত বের হয়ে গেল। মনিরা মুখ ঝামটে বিরবির করে সেদিক তাকিয়ে,
“ভালো না ছাই। আস্তো শয়তান, লম্পট একটা।” পংক্তি চল। পংক্তি এতোক্ষন দাঁড়িয়ে আরও দূর্বল বোধ করছিল। তবুও মনের জোরে মনিরার কাঁধে হাত রেখে এগোতে লাগলো। কিছুদূর গিয়েই মনিরা থামলো।

খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর চোখ মুখ। পংক্তিকে পাশের বেঞ্চিটায় বসিয়ে কী যেন দেখতে লাগলো দারুন উচ্ছ্বাস নিয়ে। পংক্তি দূর্বল শরীরেই কষ্টে শিষ্টে ঘাড় টা কাত করে দেখতে চাইলো মনিরার এতো খুশির কারন কী? ঘার কাত করে সামনে তাকাতেই পংক্তি বুঝলো মনিরার হঠাৎ খুশি হওয়ার কারন এই গার্মেন্টসের এমডি শেহরাজ সিদ্দিকী হিমান্ত। ত্রিশের কোঠায় পা দেওয়া সুদর্শন, সুপুরুষ হিমান্ত।

পঁচিশের পর বয়স যেন তার কাছে পরাজিত হয়ে থেমে আছে। সিদ্দিকী গার্মেন্টসের সকল কর্মচারী তটস্থ থাকে তার ভয়ে। তবে মেয়েরা তটস্থ কম মুগ্ধ হয় বেশি। এই যেমন মনিরাই। হিমান্ত সিদ্দিকীর কঠিন চেহারার আড়ালের মুখের হাসি ভাগ্যবানরাই দেখেছে হয়তো। পংক্তি যতোবার দেখেছে কঠিন মুখাবয়বেই দেখেছে হিমান্তকে। পংক্তির দৃঢ় বিশ্বাস লোকটা নিজেও হয়তো দ্বিধান্বিত হবে শেষ কবে হেঁসেছিল ভাবতে গেলে।

পংক্তি, মনিরা আড়ালে দাঁড়িয়ে নেভী ব্লু বিজনেস ক্যাজুয়াল ড্রেসে সানগ্লাস পরিহিত হিমান্তকে অফিসে ঢুকতে দেখলো। লোকটা এদিক ওদিক তাকায় না। সোজা চলে। এদিক ওদিক তাকালে দেখতে পেত মনিরার মতো মেয়েরা তার একটু খানি চাহনীর জন্য হাপিত্যেশ করে মরছে। হিমান্ত চলে যেতেই মনিরা পেছন ফিরে পংক্তির দিকে তাকালো। মনিরার সাথে চোখাচোখি হতেই পংক্তি কপাল চাপড়ায়। মনিরা বোকার মতো দাঁত বের করে হেঁসে দিল তা দেখে।

পংক্তিকে নিয়ে নিজের একরুমের ভাড়া বাসায় এসেছে মনিরা। পংক্তি এর আগেও দু’একবার এখানে এসেছে। পাঁচ তলা ফ্লাটের তিনতলায় সাবলেট হিসেবে মনিরা বাসাটা ভাড়া নিয়েছে। তবে মনিরা একা থাকে না মাঝেসাঝে গার্মেন্টসের টেকনিশিয়ান সুমনও এসে থাকে। এ ফ্লাটে যারা মনিরাকে চেনে তারা জানে মনিরা আর সুমন স্বামী স্ত্রী। আসলে তা নয়। পংক্তি সুমনকে একদম পছন্দ করে না।

লোকটা যেন কেমন! বিয়ে ছাড়া একটা মেয়ের সাথে দিনের পর দিন অবৈধ সম্পর্ক করা লোক আর যা হোক পংক্তির চোখে ভালো নয়। মনিরার মতো অসহায় মেয়েদের সর্বনাশ করাই এদের লক্ষ্য। পংক্তি কতো বোঝায় মনিরাকে। কিন্তু কাজ হয় না তাতে। সুমনকে নাকি সে ভালোবাসে। এযুগে ভালোবাসলে নাকি এসব সাধারণ বিষয়। তাছাড়া মনিরার দৃঢ় বিশ্বাস সুমনই ওর স্বামী হবে।

সেই বিশ্বাসেই একসাথে থাকা। এই বাসা ভাড়ার সবটাই সুমন দেয়। একারনেই এই বাসায় আসতে রুচিতে বাঁধে পংক্তির। কিন্তু বান্ধবী কষ্ট পাবে ভেবে মন্দলাগার বহিঃপ্রকাশ করে না। মনিরার সবকিছু ভালো লাগলেও ওর এই অধঃপতন পংক্তির মোটেও ভালো লাগে না। তবে সে না চাইতেও বান্ধবীর এই স্বভাব মেনে নিয়েছে। কারন এর পেছনের কাহিনি তো সবটাই জানা পংক্তির। বিছানায় হাঁটু ভাঁজ করে কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে পংক্তি। মাহিনকে কী জবাব দেবে সেটাই ভাবছে আবার।

“ওঠ! এই শরবত টুকু খা ভালো লাগবে। চুলায় মাংস বসিয়ে দিয়ে এসেছি। কব্জি ডুবিয়ে খাবো আজ দু’জন।” পংক্তি আসাতে মনিরা যে কতো খুশি হয়েছে তার ওর হৃদয় নিংড়ানো হাসিতেই প্রকাশ পাচ্ছে। পংক্তি শরবত খেতে চায় না। মনিরা জোর করে বসিয়ে খাইয়ে দেয় পংক্তিকে। মনিরা বাসায় আসার পর থেকেই হিমান্ত সিদ্দিকীর গুনকীর্তন করে যাচ্ছে। হিমান্ত স্যার এমন,ওমন। তাকে কোন কোর্টে বেশি ভালো লেগেছে। তার বা’ঠোঁটের উপরের বড় তিলটাতে তাকে আরও আকর্ষণীয় লাগে এমন নান কথার ঝুঁড়ি নিয়ে বসে। পংক্তি মনে মনে হাসলো মনিরার বকবক শুনে।

“আজ তো তোর ঘুমও হবে না দেখছি?”পংক্তির দূর্বল কন্ঠে মৃদু কৌতুক। মনিরা বেশ বুঝেছে পংক্তির ইঙ্গিত। মনিরা স্মিত হেঁসে জবাব দেয় ,
“ঘুম ছাড়া কী তাকে ধরার সাধ্য আছে আমাদের বল?”

“তাহলে তো তোর এটাও বোঝার কথা দৃষ্টি আমাদের ততদূর উঠানো উচিত যতদূর উঠালে ঘার ব্যথা না করে। মনিরা আমরা গরিব মানুষ। বড়লোকদের দিকে তাকিয়ে চোখ ধাঁধালে পেট ভরবে না। উল্টো মনটাই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।”

“শুরু হয়ে গেল তোর লেকচার। আরে বাবা আমি কী এসব বুঝিনা ভেবেছিস? সব বুঝি। তবে হিমান্ত স্যার আমার ক্রাশ। শুধু আমার কেন গার্মেন্টসের সব মেয়েদেরই।”

“ভুল বললি। সব মেয়েদের না।”
“ওহ! সরি আমি তো তোর মতো পর্দানশীল যৈবতীর কথা ভুলেই গেছিলাম। তুই আসলেই একটা নিরামিষ। হিমান্ত! আহ নামটা শুনলেই কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। তুই কেমনে তার উপর ক্রাশ না খেয়ে থাকস মাথায় ধরে না আমার। আমি তো দিনে একশবার ক্রাশ খাই।”

“বলেছি না আমি আমার দৃষ্টির সীমবদ্ধতার বাইরে তাকাই না। যা পাওয়ার বা দেখার যোগ্যতা আমার নেই তা আমি বর্জন করি।”
“মহান তুই। মহান যৈবতি।”
“সর ফাজিল জানি একটা। কী ভাষা বলিস।”

“পংক্তিরে মাঝে মাঝে মন পোড়ানো ভালো। হিমান্তের মতো শুদ্ধ পুরুষের জন্য মন পুড়লেও শান্তি লাগে। সব পুরুষ যে এক নয় তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হিমান্ত স্যার। এমনিতে কী সে মেয়েদের চোখে হিরো! হিরো হতে গেলে যোগ্যতা লাগে যৈবতি কন্যা।”
“হুম সেটা হয়তো সত্যি। এমডি স্যার শুনেছি ভালো লোক। তবে এতোই যদি ভালো হয় তাহলে তার ডিভোর্স কেন হলো?”

“তোকে কে বলেছে ডিভোর্স হলেই মানুষ খারাপ হয়? হের বউই মনে হয় শয়তান আছিল।”
“আন্দাজে কতোকিছুই বলা যায় মনি। দূর থেকে সবই ভালো লাগে। কাছে গেলেই শুদ্ধি অশুদ্ধি হয়ে যায়। বড়লোক পুরুষদের চরিত্র শুনেছি আরও খারাপ হয়। নিশ্চয়ই লোকটার মধ্যে খারাপ কিছু আছে। নয়তো বউ চলে গেল কেন?”

“হইছে এবার থাম। কিছু মানুষকে দেখলেই বলা যায় সে কেমন! তার জন্য দূরে কিংবা কাছে কোনো বিষয় না। আর একটা কথা বলবি না তুই হিমান্ত স্যারকে নিয়ে। চুপ করে শুয়ে থাক।” মনিরা বেশ চটে গেছে পংক্তির উপর। রাগ করে রান্নাঘরে চলে যায় মনিরা। বান্ধবীর ক্রাশ পাগলামি দেখে পংক্তি মুচকি হেঁসে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। ততক্ষণে ঘুরেফিরে মাথায় আবার মাহিনের কথাগুলো এসে ভীর করেছে


পর্ব ০৩

নিঃসঙ্গ হেঁটে চলেছে পংক্তি। আশেপাশের পথচারীদের মাঝে ঘরে ফেরার তাড়া। ঘিঞ্জি রাস্তা ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে পংক্তি। উন্মুক্ত চোখজোড়া দিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে একপলক আকাশের গম্ভীরতা দেখে নিল। পরিবেশটা গুমোট বেঁধে আছে। নিজের গম্ভিরতা সকলকে জানানোর প্রয়াসেই একটু পর পর গুড় গুড় শব্দ করছে আকাশ।

হয়তো বড় কোনো ঝড় হওয়ার অশনি সংকেত কিংবা এসব কিছুই হবে না দু’ফোঁটা জল ঝরিয়ে আকাশ আবার গম্ভীর হয়ে যাবে। পংক্তি চাইছে আজ ঝড় উঠুক। উথাল পাথাল করে তুলুক সব। উড়িয়ে নিয়ে যাক সকল জরা,ব্যাধি। তার মাঝে পংক্তি নিজের সকল দুঃখ কষ্ট বিলিয়ে দেবে। নিজের ভেতরের চাপা ক্ষোভ, যন্ত্রনাগুলোকে সে আর ধরে রাখতে পারছে না।

পথচারী সকলে বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করলেও পংক্তির আজ তাড়াহুড়ো করতে ইচ্ছা করছে না। ওর মন বলছে “ভিজি না আজ দুদন্ড। হোক না হৃদয় প্রশান্ত। বাঁচা মরার সংঘর্ষের এক ফাঁকে উৎফুল্ল হোক চিত্ত।” গুড় গুড় শব্দ ক্রমশ বিকট গর্জনে রূপ নিল। আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। গুমোটের খোলস পাল্টে প্রচন্ড বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দে মুখরিত হলো চারপাশ।

পংক্তির বুক ঢিপঢিপ করলেও সে সাহস সঞ্চিত করলো কী এক খুশির তাড়নায়। সবাই যেখানে ছুটোছুটি করে এগোচ্ছে পংক্তি সেখানে নির্লিপ্ত। ওকে এভাবে হাঁটতে দেখে পেছন থেকে কেউ একজন বললো,
“আপা জোরে পা চালান। ভিজে যাবেন তো?”লোকটা কথাটা বলে ক্ষণকাল অপেক্ষা করার সময় পেল না।

পংক্তিরও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রবল বাতাস ঠেলে ছন্দহীন গতিতে সে হেঁটে চলছে। যেন কোন নির্জন,জনমানবশূন্য গ্রহে তার বাস। সে যেন এভাবেই চলেছে, ফিরেছে এতোটা কাল। পংক্তি আধা পাকা রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তায় পা দিতেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো। প্রচন্ড বাতাস আর জীমূতমন্দ্রের কারনে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিছিন্ন হলো। আশেপাশের সবটায় ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে। এই অন্ধকার কিয়ৎক্ষণ পংক্তির চলার পথ রুদ্ধ করলেও শেষমেশ সরে দাঁড়ালো। পংক্তির চোখের সামনের অন্ধকার অস্পষ্ট আলোয় পরিণত হয়।

সেই ক্ষীণ আলো ধরে এগোয় পংক্তি। উঁচু নিচু পথ চলতে চলতে এক খোলা মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। আশ পাশের বাড়ি থেকে যতসামান্য চার্জার বাতি কিংবা মোমের আলো ছিটকে আসছে। তবে সেটা এই অব্দি আসতে আসতেই আরও ক্ষীণ হয়ে গেল। পংক্তি নেকাব সরিয়ে মুখ হা করলো। দু’হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি বিলাসী হতে চাইলো চোখ বন্ধ করে। সহসায় বিকট শব্দ করে অদূরেই একটা বাজ পড়লো। চোখের সামনে আগুনের মতো শিখা জ্বলে উঠলো। পংক্তি আতঙ্কিত চোখে এদিক ওদিক তাকানোর অবকাশ পেল না। ছুটতে লাগলো প্রাণপণে।

মৃত্যুকে এতো নিকটে দেখে ওর সকল স্বাদ আহ্লাদ উবে গেল। সেখানে জেঁকে বসলো একরাশ ভয় আর আতঙ্ক। এতো জলদি পংক্তি মরতে চায় না। মৃত্যুকে এতো সামনে দেখলে যে কারোই পরকাল নিয়ে চিন্তা হবে। পংক্তিরও হলো। সে ঝড় বৃষ্টি ঠেলে ছুটে চলছে। তাকে বাঁচতে হবে। মরার পরের সুখের জন্য বাঁচতে হবে। গলির দোকানের সামনের কোলাহলে পংক্তির হুশ ফিরলো। সবাই কেমন কৌতূহলী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

পংক্তির ভেতরে অস্বস্তি বেড়ে যায়। কোনোমতে সেখান থেকে বাড়ির সামনে এসে থামে। এক লহমায় আপাদমস্তক নিজেকে একবার দেখে নেয়। যাচ্ছে তাই অবস্থা ওর। একটু আগে কী ঘটেছিল তার কূলকিনারা করতে পারে না। এমনটা পংক্তির সাথে মাঝে মাঝেই হয়। সব বাঁধা ভুলে সে মুক্ত বিহঙ্গী হতে পা বাড়ায় ক্ষনিকবাদেই তার ভেতর আবার মৃত্যু ভীতি কাজ করে। এই দ্বৈত সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পংক্তিই হয় শেষমেশ।

আজও যেমন চটি হারিয়ে চলে এসেছে। পা’টাও হয়তো কেটেছে। ব্যথা সেটাই জানা দিচ্ছে। কাঁধের ব্যাগ সহ নিজেও কাকভেজা হয়ে ফিরলো। এই জড় পদার্থের জীবনটা হঠাৎই কেন এমন জীবন্ত হতে চাই পংক্তির জানা নেই। এবারও গতবারগুলোর মতো মনে মনে সংকল্প করে আর এমন করবে না সে। করবে না কথাটা সত্যি করবে না হবে কিনা পংক্তির জানা নেই। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মামির বকার শোনার জন্য প্রস্তুত হয়ে পংক্তি গেট ঠেলে বাড়ির ভেতর ঢোকে। রাত মনে হয় ভালোই হয়েছে।

তারউপর বিদ্যুৎ না থাকায় সবাই শুয়ে পড়েছে হয়তো। তবে কারো ঘরে চার্জারের আলো, আবার কারো ঘরে মোমের আলো এখনও দেখা যাচ্ছে। পংক্তির মামার ঘরের সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভেতর থেকে সাড়াশব্দ নেই। মামার হয়তো আজও নাইট ডিউটি। যেদিন মামা ঘরে থাকে না সেদিন ঘরটায় নিরবতা নেমে আসে। মাহিন ভাইয়ের সামনে মামি তেমন চিৎকার করতে সাহস পায় না।

করলেও বেশিক্ষণ সেটা স্থায়ী হতে পারে না মাহিন ভাইয়ের ধমকে। দাঁত কিড়মিড় করে তখন শুয়ে পড়ে মামি। মিলি হয়তো বই মুখের উপর নিয়ে বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে। এই মিলিকে যদি আলাদিনের চেরাগের জিন বলতো “বলুন কী ইচ্ছা আপনার?”মিলি এক সেকেন্ড সময় ব্যয় না করে অকপটে হাসতে হাসতে বলে দিত”ঘুমাতে চাই,চব্বিশঘণ্টা ননস্টপ ঘুমাতে চাই।” এতো কষ্টের মাঝেও হাসি পেল মিলির ঘুমকাতুরে বাতিক মনে করে।

পংক্তি দরজায় নক করতে যাবে তখনই একটা হাত ওর মুখ চেপে টেনে টয়লেটের সরু চলার পথে নিয়ে আসলো। পংক্তি আপ্রাণ চেষ্টা করছে চিৎকার করতে কিন্তু পারছে না। মুখ থেকে গোঙানি ছাড়া কিছুই বের হচ্ছে না। ভয়ে শক্ত হয়ে গেছে পংক্তির দেহ।

“ইচ্ছে করে দেরি করেছিস তাই না?”গ্যাসলাইটের আলো হঠাৎই পংক্তির সম্মুখে জ্বলে উঠলো। সেই অল্প আলোয় যার মুখটা পংক্তির অতি নিকটে সে হচ্ছে মাহিন। রাগে মুখ লাল হয়ে আছে। চোয়ালের হাড় গুলো ফুলে ফুলে উঠছে মাহিনের। ভয়ে পংক্তি এতোক্ষন কাঁদছিল। মাহিনকে দেখে থেমে গেল ওর কান্না। বুক, হাত,পা সব কাঁপছে মাহিনকে এতো কাছে দেখে।

পংক্তির অশ্রুসিক্ত ভীরু নয়নে মাহিনের চক্ষুদ্বয় কিছুসময়ের জন্য বিবশ হয়ে গেল। পংক্তির ভেজা মুখটা গ্যাসলাইটের স্বল্প আলোয় বুঝি আরও আকর্ষণীয় লাগছে। মাহিনকে খুব টানছে ঐ সিক্ত ওষ্ঠদ্বয়। মাহিন পংক্তির ঠোঁটের দিকে ঝুঁকতেই পংক্তি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মাহিনের ঘোর কাটে সঙ্গে সঙ্গে। রাগটা আগের চেয়ে বেড়ে যায়। পংক্তির চোয়াল শক্ত করে ধরে নিজের শরীরের ভার সম্পূর্ণ পংক্তির উপর ছেড়ে দেয়। শিহরিত হয় পংক্তির দেহ। দু’হাতে ঠেলে সরাতে চাই মাহিনকে।

“ছাড়ুন আমাকে মাহিন ভাইয়া!”
“হুশশ!”মাহিনের নিঃশ্বাস এসে পংক্তির মুখের উপর পড়ে। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে বুকের উপর দু’হাত লম্বা করে মাহিনের শরীরকে বাঁধা দেয়। মাহিন দাঁতে দাঁত পিষে ফিসফিস করে বলে,
“এমন কেন করছিস তুই? আমি কী খুব খারাপ? আমাকে ভালোবাসিস এ’কথা বলতে তোর এতো অনিহা।”
“আমাকে যেতে দিন আল্লাহর দোহায় লাগে। কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

“তাহলে বল আমাকে ভালোবাসিস! বল! “
পংক্তি কী করবে ভেবে পাচ্ছে না! মাহিনের চোখের চাহনি এই মুহূর্তে মারাত্মক কিছুর সংকেত জানাচ্ছে। মুখ দিয়েও বিশ্রী গন্ধ আসছে। পংক্তি নিশ্চিত মাহিন আজও নেশা করেছে। মাহিনকে থামাতে হলে কিছু তো করতে হবে। নয়তো অঘটন ঘটে যাবে। তাতে ক্ষতি পংক্তিরই।

যুগে যুগে ধর্ষিত,লাঞ্ছিত, শ্লীলতাহানির স্বীকার মেয়েদেরই হতে হয়েছে। আবার সাথে অপবাদ টাও নিতে হয়েছে পুরুষ উষ্কানির। এসব ভাবনা ভেদ করে মনিরার কথা তখন মনে পড়লো। পংক্তি কালক্ষেপণ করার সময় পেল না।

এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললো,
“হ্যাঁ ভালোবাসি।” কথাটা বলেই নিঃশ্বাস রুখে বন্ধ চোখে অশ্রু ফেললো। মাহিন এখন কী করবে পংক্তির জানা নেই। কথাটা বলে সে আদৌ ঠিক করলো না ভুল সেটাও জানা নেই। শুধু মাথায় আসছে”একটা অবলম্বন লাগবে। সেটা মাহিন হলে ক্ষতি কী? মাহিন হলে ক্ষতি কী? যায় করি বিয়ে তো ওর সাথেই হবে। তখন সব বৈধের খাতায় যোগ হবে।”

পংক্তিকে অবাক করে মাহিন সরে দাঁড়াল। ঢুলুঢুলু চোখে হাত নাড়িয়ে বললো,
“যা ঘরে যা। গামছা টা নিয়ে আয়।” কথাটা শেষ করে ধাড়াম করে টয়লেটের দরজা বন্ধ করে দিল। ভেতর থেকে ঝুপঝাপ পানির আওয়াজ আসছে। পংক্তির স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগলো। টয়লেটের দরজায় একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে পংক্তি।

বিড়বিড় করে বলছে,
“তাহলে কী মাহিন ভাই সত্যি আমাকে ভালোবাসে। তার মনে খারাপ কিছু নেই।” পংক্তি ভেতর নতুন অনুভূতি জন্ম নিল। সে মাহিনের বউ হবে কথাটা ভাবনায় আসতেই লজ্জাবতী গাছের ন্যায় লজ্জায় নেতিয়ে গেল। তার জীবনেও সুখ আসবে। ছোট্ট ঘর, ভালোবাসা আর ঢাল হয়ে আগলে রাখা স্বামী সবই তার হবে। পংক্তির চোখ দুটো খুশিতে ছলছল করলো। হুট করে হাঁচি দিয়ে বসলো পংক্তি।

“কী রে এখনও দাঁড়িয়ে আছিস? যা গামছা নিয়ে আয়। তোর কাপড়ও নিয়ে আসিস। আমি বের হলে তুই তাড়াতাড়ি ভিজে কাপড় ছেড়ে নিস। মনে তো হচ্ছে ঠান্ডা লাগিয়ে নিয়েছিস। যা!”ভেতর থেকে মাহিন ফিসফিস করে ধমকের সুরে বলে গেল। পংক্তি লজ্জায় দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে গিয়ে গামছা আর কাপড় নিয়ে আবার ফিরে এলো। টয়লেটের দরজা কিছুটা ফাঁক করে হাত বাড়িয়ে গামছা চাইল মাহিন। পংক্তি এগিয়ে দিতে গেলেই মাহিন হাত ধরে ফেলে। পংক্তির ভয় করে। এদিক ওদিক তাকায় অন্ধকারে। পংক্তির হাত ছাড়ানোর চেষ্টা দেখে মনে মনে হাসলো মাহিন।

“এতো ভয় পাস কেন রে তুই? প্রেম করবো একটু রোমাঞ্চ করবো না তাই কী হয়? ভয় নেই কিছুই করবো না এখন।” মাহিন হাসলো। হাতটা ছেড়ে গামছা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। পংক্তি হাতটা বুকে চেঁপে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল নত মস্তকে। মাহিন বের হতেই পংক্তি টয়লেটে ঢুকে পড়লো। গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে ভাবনায় ডুবলো।

তার জীবন এভাবে মোড় নেবে সে ভেবেও দেখেনি কোনোদিন। মাহিনকে সে ভালোবাসে এ’কথা ভুল। পংক্তির সতেরো বছর বয়সে প্রেমের ফুল ফোঁটে নি। মাহিনকে বলা ভালোবাসিতে ছিল না কোন আবেগ। সে’কি পারবে এই সম্পর্ক টেকাতে! পরক্ষনেই হাসলো পংক্তি। গরিবদের জীবনে এসব ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। একটা আশ্রয় হলেই হলো। নিরাপদ আশ্রয়। যেটা সে মাহিনকে ভালোবাসি বলায় পাবে। তারপর তো ভালোবাসা এমনিতেই হয়ে যাবে পংক্তির।

পর্ব ০৪

রাতে ঘুম আসছে না পংক্তির। এপাশ ওপাশ করছে শুধু। অতিরিক্ত ভাবনা চিন্তার কারনে তার মাথা ব্যথাটা প্রচন্ড রূপ নিল। ফলস্রুতিতে জ্বরটাও হুহু করে গেল বেড়ে। তার সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে কাশি। গতকাল স্বাধীন হয়ে আনন্দ উপলব্ধি করতে গিয়েই কাশি নামক নতুন রোগ পেয়েছে। এজন্যই প্রতিটি মানুষকে বিধাতার নিয়মের বাইরে যেতে নেই। গেলেই বিপদ। পংক্তির ধারণা ওর কপাল ওর মা’য়ের মতোই হবে। জলে ভাসা কচুরিপানার মতো। যার নির্দিষ্ট কোনো স্থান থাকে না। পংক্তি মা’য়ের মুখ দেখেনি জন্মের পর।

জন্ম দিয়েই তিনি মুক্তি পেয়েছেন লাঞ্ছনা, বঞ্চনার জীবন থেকে। পংক্তি যখন একটু একটু বুঝতে শিখল তখন জানলো ওর মা কাওকে ভালোবেসে স্বর্বস্ব লুটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিনিময়ে অপমান,কলঙ্ক ছাড়া কিছুই মেলে নি মায়ের কপালে। সেই থেকে পংক্তি প্রতিজ্ঞা করেছে জীবনে কোনোদিন প্রেম করবে না। কোনো পুরুষকে বিশ্বাসও করবে না। ভাগ্য এমনই খেলা খেললো। তাই হলো ওর সাথে।

পংক্তি জীবনে একের পর এক পুরুষ দেখলো যারা লোলুপ হায়েনার মতো শুধু ওকে খুবলে খেতে চাইতো। ছোট বেলার পণ এখন ক্রমশ বিশ্বাসে পরিণত হলো। ঘৃণা ধরে গেল পুরুষজাতির উপর। এতিম পংক্তি ভাই বলে যাকে শ্রদ্ধা করলো সেও নোংরা ভাবে পংক্তিকে চাইলো। আদরের হাতটা ধীরে ধীরে লালসার হাতে পরিনত হলো। স্কুলের শিক্ষক, গার্মেন্টসের সুপারভাইজার, দারোয়ান সবার নজরে একই পৈশাচিকতা।

এমন কেন সবাই? ক্ষণকালের রিরংসার জন্য কেন তারা পংক্তিদের ভোগের চোখে দেখে। শারীরিক চাহিদার কী এতোই শক্তি যার কাছে মানবতা, মায়া- মমতা সবটা পরাজিত হয়। আচ্ছা মাহিনও কী তেমন ভাবে? না! না! এসব পংক্তির ভ্রান্তি। মাহিন শিক্ষিত ছেলে। সে নিশ্চয়ই ভালো খারাপের তুলনা বোঝে। অবশ্যই বোঝে। তাইতো ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছে। পংক্তির শুকনো ঠোঁটের কোনে ম্লান হাসি।

সে যে করেই হোক মাহিনকে ভালোবাসবে। অন্য সবার মতো ভাববে না মাহিনকে। পংক্তির চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে মাথা ব্যথায়। কুঁকড়ে শুয়ে আছে মাথা চেঁপে। সকল ভাবনা চিন্তা থেকে সরে আসে সে। নয়তো মাথা ব্যথায় আজ বুঝি তার মরন সুনিশ্চিত।

গতরাতের মাথা ব্যথার কারনে আজ ঘুমটা দেরিতে ভাঙলো পংক্তির। আজ আর কাজে যেতে হবে না ভেবে দেরিতে ওঠা নিয়ে দুঃশ্চিতার ঘুচলো। মনিরা গতকাল পংক্তির শারীরিক অসুস্থতা দেখে বলেছে সে ছুটি করিয়ে নেবে ওর। পংক্তির আজ কাজে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পংক্তির এই দুঃখের জীবনে একটুখানি সুখ যদি কেউ দিয়েছে তবে সে মনিরা। ক্লাস সিক্স অব্দি পংক্তির ক্লাসমেট ছিল মনিরা।

তারপর সে কোথায় গিয়েছিল, কী হয়েছিল পংক্তি জানতো না। এমনিতেও ক্লাসে কারো সাথে তেমন কথা বলতো না পংক্তি। চাপা স্বভাবের এই মেয়ের সাথেও কেউ বন্ধুত্ব করতে আসতো না সেঁধে। একদিন স্কুল থেকে ফিরতে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে গেল মনিরার সাথে। পংক্তি চিনতে পারে নি। মনিরাই ছুটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে। পংক্তির খুব অস্বস্তি হচ্ছিল যেটা মনিরা বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে দিল।

সেই থেকে প্রায় কথা হতো,দেখা হতো মনিরার সাথে। পংক্তি লক্ষ্য করেছিল মনিরা বয়স অপেক্ষা বেশিই বড় হয়ে গেছে। ওর দেহ গঠন, চলন,কথা বলার ভঙ্গি সবটাতেই পূর্ণাঙ্গ রমণীর ছাপ। অনেক বদলে গেছে মনিরা। এখন কথায় কথায় শব্দ করে হাসে। গায়ের ওড়নাটাও ঠিক করে পড়ে না। কয়েকবার পান,সিগারেটও খেতে দেখেছে সে মনিরাকে। পংক্তির ভয় হয় এসব দেখে। সে ইচ্ছা করে মনিরাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু সেটা কিছুদিনের। একদিন কী কাজে মনিরা শিউলি ভাবির বাসায় এসেছিল।

তখনই তার চোখে পংক্তির দুর্দশার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিজের মতো আরেকটা জীবন নষ্ট হোক তা হয়তো মনিরা চায় নি সেদিন। তখন থেকেই পংক্তিকে আগলে রাখা তার। মনিরার যদি সাধ্য থাকতো তবে সে পংক্তির পড়ালেখা কোনোদিন থামাতো না বলে পংক্তির ধারণা। পংক্তি মা পায় নি কিন্তু তার রূপে একটা বোন পেয়েছে। আর সে হলো মনিরা। যে ছায়া হয়ে কর্মস্থলে সর্বদা নিরাপত্তা দেয়। সকল বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।

ক্লাস নাইনের পর স্কুলের গন্ডি আর পেরুতে পারে নি পংক্তি। মামির অসহনীয় খোটা,অত্যাচার তাকে বাধ্য করেছে স্কুল ছেড়ে কর্মী হতে। এখনও তাকে খোটা শুনতে হয় তবে সেটা সহনীয়। মনিরাকে ওর মামা মামি পছন্দ করে না। খারাপ,বাজারি মেয়ে বলে। পংক্তিকে নিষেধ করেছে মনিরার সাথে চলতে। পংক্তি সেসব কানে তোলে না।

পংক্তির চোখে মনিরা বিশুদ্ধ। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মনিরা যা করছে তাতে সবার চোখ টাটাই। কই কেউ তো এগিয়ে আসে না সুন্দর, সুস্থ জীবনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। মনিরাদের খারাপ পথে ঠেলে দিয়ে যারা নীতিকথা ঝাড়ে তারাই আবার অন্ধকারে মনিরাদের হাত টেনে ধরে রেট জিজ্ঞেস করে।

সব বয়সী মেয়েদের বক্ষ,নিতম্বের ওঠানামা দেখে ভেতরের পশুকে জাগায়। পংক্তির মানুষ চেনা শেষ। তবে মুখোশ পড়া মানুষ চিনতে সে এখনও অপরিপক্ব। ঘৃনাভরা মনে এসব ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে উঠে প্রথমে যার মুখটা চোখে পড়লো সে মাহিন। উপুড় হয়ে কী শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। মুহূর্তে সকল ঘৃণা মন থেকে মুছে গেল। গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই পংক্তির ভেতর জড়তা সৃষ্টি হলো। চোখ সরিয়ে নিল তৎক্ষণাৎ।

অসুস্থ শরীরে সকালে উঠেই প্রথম সে রুটি বেলে। ১০ টার মতো রুটি, আলু ভাজি, ডিম ভাজি,চা সবটা সে রেডি করে গোসল সেড়ে নেয়। অল্প করে একটা রুটি পানিতে ভিজিয়ে মনিরার কিনে দেওয়া ওষুধ টা ব্যাগ থেকে বের করে খেয়ে নিল। এরমধ্যে মিলি, মাহিন উঠলো জেগে। মামি উঠে চলে গেল দু’বাড়ি পরেই বড় ছেলের বাসায়।

সকালে, বিকেলে,রাতে নাতিকে না দেখলে মজিলার ভালো লাগে না। যাওয়ার সময় দুটো রুটি আর ডিমভাজিও নিল নাতির জন্য। মিলি গোসলে গেছে। একটু পর ওর কোচিং। তারপর সেখান থেকেই স্কুলে যাবে। পংক্তি আর মাহিন শুধু ঘরে এখন। জ্বরে দূর্বল শরীরটাকে টেনেটুনে দাঁড় করালো। দুই ঘরের বিছানা গুছিয়ে,ঝাড়ু দিল।

এলোমেলো কাপড়, চোপড় ভাঁজ করছিল। আচমকা মাহিন এসে কোমর জড়িয়ে এলোপাথাড়ি চুমু দিতে লাগলো। পংক্তি ভয়ে আৎকে উঠলো মাহিনের স্পর্শে। নড়বে সে শক্তিটুকুও খুইয়ে বসেছে মাহিনের জোরের কাছে। মাহিন পংক্তির শক্ত হয়ে যাওয়া শরীরটা ছেড়ে বিছানায় বসলো। পংক্তি ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো তখনও। বালিশে মাথা দিয়ে পংক্তির দিকে চেয়ে রইল মাহিন। চোখে এখনও ঘুমের রেশ। ঠোঁটের কোনে হাসি।

পংক্তিকে স্ট্যাচুর মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চাপা স্বরে বললো,
“কী রে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গায়ে ওড়না দে। ভালোবাসার অধিকারেই ছুঁয়েছি। সহজ ভাবে নিতে শেখ।”
পংক্তির ইচ্ছা করছিল চিৎকার করে বলতে,
“এমন ভালোবাসার আমার দরকার নেই। আপনার ছোঁয়ায় শুধু ভয় জাগে ভালোবাসা জন্মে না।

“পংক্তির ঠোঁট ভেদ করে একটা শব্দও বের হলো না। এই ঠোঁট একটু আগে মাহিন ছুঁয়েছে। ঠোঁট শক্ত করে দাঁত পিষতে লাগলো। পংক্তির মন চাইলো সর্বশরীর নিয়ে চিতায় উঠে যেত। নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে। কিন্তু পারলো না। একরাশ ঘৃণা মনে নিয়ে ওড়নাটা তুলে গায়ে দিল। দ্রুত চলে আসলো মামার রুমে। চোখ ফেটে জল গড়াচ্ছে পংক্তির।

মিলি স্কুলে যাওয়ার পরপরই মাহিনও বের হয়ে গেল। যেতে যেতে পংক্তির নির্লিপ্ত মুখ দেখে মাহিনের কপাল কুঞ্চিত হয়। সকালের ঘটনা পংক্তি সহজ ভাবে নেয় নি সেটা মাহিন ভালোমতোই বুঝে গেছে এতোক্ষণ। আর তাতেই যেন মেজাজ চড়ে গেল ওর। এই মেয়েকে ও এতোটা ভালোবাসে তা মাহিন নিজেও জানতো না। যেদিন ওর বন্ধু পংক্তির নামে লাভ লেটার দিল ওর হাতে সেদিনই প্রথম বুঝেছিল।

পংক্তির নামের রসালো প্রেমপত্র পায়ে পিষে ছিঁড়ে ছিল মাহিন। হঠাৎই বুকে জ্বালা ধরে গেছিল পংক্তির মুখটা মনে করে। দশ বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট করেছে পংক্তির জন্য। এই একটা চিঠি তাকে বুঝিয়েছিল পংক্তিকে সে বোন নয় প্রেমিকার জায়গা দিয়েছে। এই অনুভূতিতে ছন্দপতন হলো মাহিনের জীবনে। এরপর থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিল সে। পংক্তিকে দেখলেই ওর সবটা এলোমেলো হয়ে যেত। আগের মতো করে কথা বলতে পারতো না।

পংক্তি স্কুল ছেড়ে গার্মেন্টস গেল। মাহিন তখন সবেমাত্র অনার্স ভর্তি হয়েছে। পংক্তিকে নিয়ে সংসার পাতার মতো সাধ্য বা সাহস ওর ছিল না। মা’কে ভালো করেই জানে মাহিন। তিনি মরে যাবেন তবুও পংক্তিকে মানবেন না। মাহিনের সবদিকেই অথৈ জল। সম্মুখে পংক্তি তবুও তাকে বলতে পারতো না তোকে ভালোবাসি রে। মাহিনের হয়তো বলা হতো না যদি না মুহিব কান্ডটা ঘটাতো।

মাহিনের ক্ষমতা থাকলে সেদিনই ভাইকে টুকরো টুকরো করে শেয়াল কুকুরকে ভক্ষণ করাতো। পংক্তির গায়ে মাহিন ছাড়া অন্য কেউ হাত দেবে তা মাহিন জীবিত অবস্থায় কোনোদিন সহ্য করবে না। পংক্তি শুধু তার। একান্তই তার। মুহিবকে সে শাস্তি দিতে না পারুক সম্পর্ক ছেদ করেছে। বাবাকে প্রেশার দিয়ে কৌশলে আলাদা করে দিয়েছে এতেই মাহিন কিছুটা হলেও সন্তুষ্ট। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মাহিন সিগারেট ধরালো। চাকরীর পেপার নিয়ে বসলো চায়ের টঙের বেঞ্চিটায়।

“মাহিন ভাই, সুখবর আছে জলদি আহো।”
পাশের কম্পিউটারের দোকান থেকে জহির চিৎকার করে ডাকলো মাহিনকে। মাহিন সিগারেটে দুটো টান দিয়ে পায়ে পিষে কম্পিউটারের দোকানে ঢুকলো। চেয়ার টেনে উদাসীন চোখে বসতেই জহির লাফিয়ে সামনে এলো,
“সানার মিষ্টি, কাচ্চি সব খাওয়াতে হবে বুঝলা তো?”

“কোন খুশিতে? মজা নিও না সকাল সকাল। মেজাজ এমনিতেও খারাপ।”
মাহিনের কাঠখোট্টা জবাবে জহির দমলো না। উল্টো ছুটে আবার ফিরে এলো। হাতে একটা খাম। মাহিনের সামনে ধরতেই মাহিন সচকিত হয়ে উঠলো। এই মুহূর্তে তার কেঁদে দিতে ইচ্ছা করছে। বাচ্চা শিশুর মতো হাওমাও করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পুরুষ বলে সে পারলো না কাঁদতে। তবে তার চোখ দুটো ছলছল হয়ে উঠলো। চট করে খামটা খুলে চোখ বুলালো। মাহিন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ওর সরকারি জব হয়েছে।

তাও আবার চিটাগং কাস্টমসে। একটা সরকারি চাকরীর জন্য দিন রাত এক করে পড়েছে মাহিন। নানা জায়গায় পরীক্ষা দিয়েছে। অবশেষে সোনার হরিন আজ সত্যি মাহিনের হাতে। মাহিন নির্বাক হয়ে শুধু কাগজটা দেখছে। এটা কোনো সাধারণ কাগজ নয়। মাহিনের স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি। পংক্তিকে আপন করে পাওয়ার মাধ্যমে। মাহিন ক্ষণকাল দাঁড়াল না আর সেখানে। জহিরকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি খাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেড়িয়ে এলো।

পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করলো। টিউশনি থেকে পাওয়া পনেরো শত বায়ান্ন টাকা আছে এই মুহূর্তে। মাহিন কিছু না ভেবে সেটা নিয়েই চললো মিষ্টির দোকানে। সেখান থেকে যাবে মাংসের দোকানে। পংক্তির জ্বর সে তো এসব খেতে পারবে না। একা ওকে সবার সামনে কিছু দেওয়াও যাবে না। কিছুটা মন খারাপ করে শুধু মিষ্টি আর মাংস নিয়েই বাড়ি ফিরলো।

ইকরাম তালুকদার ছেলের সরকারি চাকরি হয়েছে শুনে খুশিতে কেঁদেই ফেললেন। মজিলা কাঁদলো ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। সামনে তাদের সুদিন আসছে দেখে খুশির সীমা রইলো না। মিলি এখনই ভাইয়ের কাছে এটা ওটা বায়না ধরছে। সবার হাসি কান্নার মাঝেও মাহিনের চোখ দুটো বার বার পংক্তিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পংক্তি একবার শুধু ঘরে এসে মাংস গুলো নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেছে।

মাহিনের দিকে ফিরেও তাকা নি। মজিলা মিষ্টি নিয়ে বড় ছেলের বাসায় গেল। ইকরাম নাইট ডিউটি করায় বিছানায় শুয়ে পড়ল। বড় ক্লান্ত তার শরীর। ইদানিং বুকেও ব্যথা করে তার। কাল একবার ডাক্তার দেখাবে বলে ভাবলো। আবার ভাবলো না থাক। ছেলেটার চাকরী হয়েছে নতুন জায়গায় যাবে। কিছু টাকা দেওয়া লাগবে তো। এসব ভাবনা চিন্তা নিয়েই ঘুমিয়ে গেল ইকরাম। নাক ডাকার শব্দ হলো একটু পর।

মাহিন ঘরে বসে কখন থেকে পংক্তির জন্য অপেক্ষা করছে। এতোবড় খুশির সংবাদ শোনার পর পংক্তির অনূভূতি জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে মাহিনের। মাহিনের মন ধৈর্য মানছে না। মনে মনে ভেবে নিয়েছে বছর খানিকের মধ্যেই সে পংক্তিকে বিয়ে করবে। বাবা মা রাজি না হলে না হবে তাতে মাহিনের কিছু আসে যায় না। এসব ভাবনার অবসান ঘটলো পংক্তিকে দেখে। পংক্তি ওড়না মাথায় ঘরে ঢুকে কী যেন খুঁজছিল! চোখের সামনে পংক্তিকে পেয়ে মাহিন এক মিনিটও দেরি করলো না পংক্তিকে নিজের বুকে টেনে আনতে।

“এতো লজ্জা পাস কেন আমার কাছে আসলে! পরশু তো চলে যাবো তখন খারাপ লাগবে না। মিস করবি না আমাকে? তোকে আমি খুব মিস করবো রে পংক্তি।” কথাটা শেষ করে পংক্তির গলায় মুখ ডুবালো মাহিন।
“মাহিন ভাই ছাড়েন! মামা পাশের রুমে।”

মাহিনের কপালের রগ ফুলে উঠলো পংক্তির শীতল ব্যবহারে। সকালের রাগটাও যোগ হলো সাথে। পংক্তির দুবাহু সজোরে চেঁপে ধরে মুখোমুখি দাঁড় করালো। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো পংক্তি তবুও চোখে তুলে তাকালো না। মাহিনের জোরে জোরে ফেলা শ্বাস প্রশ্বাস তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে মাহিন কতোটা রেগে আছে। মাহিন কিছু বলতে চেয়েও বললো না। বিছানার উপর পংক্তিকে ছুড়ে মেরে হনহন করে বাইরে বের হয়ে গেল।

একে তো জ্বর তার উপর মাহিনের দেওয়া ব্যথায় পংক্তির চোখের জল বেরিয়ে আসলো। বাহুদুটো ব্যথায় টনটন করছে। পংক্তি কী করবে ভেবে পায় না। মাহিনের ছোঁয়াকে সে স্বাভাবিক ভাবে নিতেই পারছে না। ভয় করে ওর। অনেক ভয়। সুখের লোভ করতে গিয়ে না মা’য়ের মতো হতে হয় তাকে। সে মাহিন কে কী করে বোঝাবে মনের কথা? মাহিন কী বুঝবে পংক্তির সমস্যা।

পুরুষ মানুষ যা সহজে বলতে, করতে পারে একটা মেয়ে তা পারে না। তাকে এক পা ফেলতেও হাজারটা চিন্তা করতে হয়। মাহিন যখন তখন তাকে বুকে টানে,স্পর্শ করে এসব পংক্তি সহজ ভাবে নিতে পারছে না। পংক্তির চোখে এসব হারাম। পংক্তি নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায়। চোখ মুখ ঠিক করে রান্নাঘরে ছোটে।

রাত করে ফিরলো মাহিন। পংক্তি না ঘুমালেও বিছানায় শুয়ে রইলো চোখ বন্ধ করে। পংক্তির শরীরটা এখন কিছুটা ভালো। তবে মন ভালো নেই। মাহিন গম্ভীরমুখে বসে রইল অর্ধেক রাত। পংক্তি সব টের পেল তবে সাহসে কুলালো না মাহিনের মুখোমুখি হতে। মাহিন একসময় শুয়ে পড়লো। ঘুমালো কিনা বুঝলো না পংক্তি। অনেক ভাবনা চিন্তা করতে করতে পংক্তিও একসময় ঘুমিয়ে গেল। পরদিন সকালে মামির মাতমে ঘুম ভাঙলো সবার। রাতে কিছুই বোঝে নি মজিলা। সকালে স্বামীর গায়ে হাত লাগতেই চমকে ওঠে সে। ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে ইকরামের শরীর।

স্বামীকে হারিয়ে মাতম করতে করতে মূর্ছা গেলেন তিনি। পংক্তি, মিলিও কাঁদতে কাঁদতে বাকরুদ্ধ। পিতাকে হারিয়ে শোকে মূহ্যমানহয়ে মাহিন নিরবে চোখের জল ফেলছে বিছানায় বসে। মুহিব, মুহিবের বউও ছুটে এসেছে খবর শুনে। পরিবারের বটগাছ সমতূল্য মানুষটার হঠাৎ মৃত্যুতে সবার মাঝেই বিষাদের ছায়া।

পর্ব ০৫

চারপাশে সন্ধ্যার রেশ কেটে আঁধার নেমে এসেছে। পাখিরা ফিরছে আপন নীড়ে। কেউ কেউ আবার আপন ঘরে ফিরছে। সবেমাত্র মানিকগঞ্জ এসে পৌঁছেছে পংক্তিরা। শিবচরের লোকেরা ভীর করেছে তালুকদার বাড়ি, মরহুম ইকরাম তালুকদারের লাশ দেখার জন্য। কয়েকজন নানা কথায় ওদের স্বান্তনা দিচ্ছে।

পংক্তির শরীর খুবই খারাপ। তবুও সে শক্ত হয়ে আছে। মনিরার কথায় ঠিক হলো। ওর মামা চলে গেল। এখন কী হবে ওর? মামা ছাড়া এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কে আছে পংক্তিকে আগলে রাখার? মনিরা! সে আর ক’দিন দেখবে? সুমনকে ছেড়ে তো আর পংক্তিকে নিয়ে থাকবে না? পংক্তির মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। ঝাপসা হতে হতেও সম্মুখ কিছুটা স্পষ্ট হলো শেষমেশ। রাত দশটায় মামার লাশের দাফন কার্য সম্পন্ন হলো। কেউ কিছুটি মুখে দেয় নি।

অভুক্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে সবাই। ও ঘর থেকে মামির বিরতি দিয়ে কান্নার শব্দ পাচ্ছে পংক্তি। মামার কথা মনে করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছে পংক্তি। অনিশ্চিত ভবিষ্যত ওর সামনে। রাতটা ওর দুশ্চিন্তায় কাটলো। পরদিন সব ঠিকঠাক করে পংক্তি,মিলিকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে শিবচর ছাড়লো মাহিন। মাহিনকে কাল চিটাগং যেতে হবে। সে ইচ্ছা করলে দু’টো দিন ছুটি করিয়ে নিতে পারতো কিন্তু নিল না। এখানে মাহিনের একদন্ড থাকতে ইচ্ছা করছে না। মাহিনের তাড়াতেই মজিলা মিলি ও পংক্তিকে পাঠিয়ে দিল।

মজিলা,মুহিব,মহিবের বউ স্বপ্না থেকে গেল গ্রামে। তারা পরে আসবে ঢাকা। মিলি, পংক্তি পাশাপাশি বসে আছে বাসে। মাহিন সামনের সিটটায়। পংক্তি লক্ষ্য করছে মাহিন কেমন যেন হয়ে গেছে। পংক্তির দিকে আগের মতো তাকাচ্ছে না। কথা বলছে না। পংক্তির খারাপ লাগলো মাহিনের পরিবর্তনে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল ওদের। কাপড় পাল্টে কই যেন বেরিয়ে গেল মাহিন। মিলিও কাঁদছে শুয়ে। পংক্তি ওদের মতো গা এলিয়ে দিতে পারলো না। শোক করে বসে থাকলে চলবে না ওর। কাপড় ছেড়ে ভাত বসালো চুলায় পংক্তি।

ফ্রিজে রেখে যাওয়া তরকারি বের করে গরম করলো। রান্না শেষ হলে মিলিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে মাহিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো সে। মাহিন ফিরলো রাত একটার পর। বাসার সবাই তখন ঘুমিয়ে গেছে। পংক্তিও ঝিমিয়ে পড়েছিল। দরজায় নক হতেই সচকিত হয়ে বসলো পংক্তি। দরজা খুলে একপাশে দাঁড়াতেই মাহিন ঘরে ঢুকলো।

ঘরে ঢোকার আগে অবশ্য একবার সুক্ষ্ম চোখে পংক্তিকে পর্যবেক্ষণ করে নিল সে। দরজা লাগিয়ে মাহিনের সামনে দাঁড়ালো পংক্তি। নত মুখে নরম গলায় শুধালো,
“খাবার দেব?”

মাহিন জবাব দিল না। চুপচাপ লুঙ্গিটা পড়ে নিল। পংক্তিকে পাশ কাটিয়ে বাবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। পংক্তির মোটেও ভালো লাগলো না মাহিনের এমন নিরবতা। কী এমন করেছে যার জন্য এমন করছে সে? পংক্তি কপট রাগে বিছানায় গা এলালো। মনে মনে পণ করলো বলবে না সে কথা মাহিনের সাথে। মাহিনকে আজ অন্য সবার মতো ভাবতে বাধ্য হলো পংক্তি। নিজের উপর রাগ হচ্ছে। কেন ঐদিন মাহিনকে ভালোবাসি বলতে গেল।

মিথ্যা মিথ্যি বললেও তো বলেছিল। মাহিন সেটার মূল্যও দিল না। না দিক। পংক্তির কাওকে প্রয়োজন নেই। যা আছে কপালে সে সয়ে নেবে। নানা কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ওর কান্না পেল। বালিশ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদলো পংক্তি।

“পংক্তি খাবার দিয়ে যা এ ঘরে।” মাহিনের বিষন্ন গলার আওয়াজে পংক্তি সহসায় কান্না বন্ধ করে উঠে বসলো। সকল অভিমান মনে পুষে চুপ করে রইল। মাহিন বিরতি দিয়ে আবার ডাকলো। এবার কিছুটা রেগেই বললো,
“কী রে ঘুমিয়ে গেছিস? খিদে পেয়েছে তো? পংক্তি! এই পংক্তি খাবার দিয়ে যা।”

শেষের কথাটায় আবেগ মেশানো ছিল। পংক্তি আজ আর সে আবেগ উপেক্ষা করতে পারলো না। দ্রুত উঠে খাবারগুলো নিয়ে মাহিনের সামনে দিয়ে নত মুখে খাটের এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। মাহিন একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ সরালো। প্লেটে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করলো কিন্তু খেল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিষন্ন চোখ দুটো তুলে পংক্তিকে দেখলো।

কঠিন গলায় বললো,
“কোন অন্যায়ের শাস্তি দিচ্ছিস তুই আমাকে? তোকে ভালোবাসার!”
পংক্তি মুখ তুলে চাইলো না। জবাবও দিল না মাহিনের কথার। মাহিন উঠে দাঁড়াল। পংক্তির কাছে এসে পংক্তিকে জাপটে ধরলো শক্ত করে।
“আমাকে ফেরাস না পংক্তি। খুব ভালোবাসি তোকে। তোর এই নিরবতা আমাকে তিলে তিলে মারছে কেন বুঝিস না তুই? আমার তোকে প্রয়োজন পংক্তি।”

মাহিনের কান্নামিশ্রিত চাপা স্বর পংক্তিকে এলোমেলো করে তুললো। নিজের অজান্তেই সে মাহিনে কাছে ধরা দিল। ডুকরে কেঁদে উঠলো মাহিনের বুকে মাথা রেখে। এভাবেই কিছু সময় একে অপরের বাহুবন্ধে আবদ্ধ ছিল ওরা। ঘনিষ্ঠ হতে হতেও কী এক বাঁধায় পংক্তি নিজেকে গুটিয়ে নিল। মাহিন জোর করতে পারতো কিন্তু করলো না।

দুজনে দুজনকে আরেকটু সময় দিল। মাহিন পংক্তির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,”ছুটিতে এসে কিন্তু বাঁধা মানবো না।” পংক্তি লজ্জায় মুখ লুকালো মাহিনের বুকে। মাহিন হেঁসে দু’হাতে জড়িয়ে বুকে টেনে নিল পংক্তিকে। মাহিনের ভালোবাসায় ডুবে পংক্তি একমুহূর্তের জন্য সকল কষ্ট ভুলে বসলো। মনে হতে লাগলো কতো চেনা, কতো আপন মাহিন ওর। অযথায় এতো বোকামি করলো এতোদিন।

পংক্তির সকল জড়তা কাটে মাহিনের বুকে মাথা রেখে। মাহিন যদি আরেকবার বলতো সে আজ পংক্তিকে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাছে চায় পংক্তি হয়তো বাঁধা দিত না। সে যে মাহিনকে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে এই সময়টুকুতেই। পংক্তি ছলছল চোখে দু’হাতে মাহিনের গলা জড়িয়ে বললো,
“আমাকে ঠকাবে না তো?

আমার বিশ্বাসে কোনোদিন আঘাত করবে না তো? জানো আমার না খুব ভয় হয়।”
“কোনোদিন না! ওয়াদা করলাম আমি তোর আছি তোরই থাকবো। আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই।”
পংক্তির খুশি যেন আর ধরে না। একবার সে নিজেই চাইলো এতোবড় প্রাপ্তিতে নিজেই নিজেকে মাহিনের পায়ে সঁপে দিক। পরক্ষনেই লজ্জায় নেতিয়ে গেল। প্রেমে পড়লে মানুষ নির্লজ্জ হয় তা আজ বুঝলো পংক্তি। পংক্তিকে লজ্জিত হতে দেখে নিঃশব্দে হাসলো মাহিন। পংক্তি লাজুক হেঁসে ওর বুকে ধাক্কা দিয়ে উঠতে গেলে মাহিন হাত টেনে ধরে।

মাহিন বললো,
“খাইয়ে দিবি না। আজকের রাত অনেক বিশেষ আমার জন্য। তোর হাতের খাবার খেয়ে আরও বিশেষ হোক রাতটা আমার। চিটাগং গিয়েও যেন এরাতের কথা মনে করে নিজেকে স্বান্তনা দিতে পারি। খাইয়ে দে।”
পংক্তি নিজে হাতে খাবার তুলে খাইয়ে দিল মাহিনকে। মাহিনের মাথাটা কোলে রেখে ঘুম পাড়ালো। সারারাত ওর ঘোরের মধ্যে কাটলো। দু’চোখে স্বপ্ন বুনতে থাকলো ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে। এই রাত দীর্ঘ হোক মনে মনে সেই কামনা করতে লাগলো পংক্তি।

তিনদিন গত হয়েছে মাহিন চিটাগং গেছে। যাওয়ার পর থেকে পংক্তির সাথে যোগাযোগ নেই মাহিনের। কীভাবে থাকবে, পংক্তির কী মোবাইল আছে? বাসার সবাই মাহিনের সাথে কখন কথা বলে জানে না পংক্তি। রাতে ফিরলে মামি ওকে এটা ওটা কাজ দিয়ে ব্যস্ত করে তোলে। পংক্তির মন কাঁদে মাহিনের সাথে একটু কথা বলার জন্য। সুযোগ পেলে মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করে। মাহিন নামটা খুঁজতে থাকে। কিন্তু পায় না। অবাক হয় পংক্তি।

নিজের অসহায়ত্বের উপর নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানায়। ইদানিং মামির ব্যবহার আরও খারাপ হয়েছে। সহ্যই করতে পারছে না পংক্তিকে। প্রতিদিন দোষ খোঁজে পংক্তিকে মারার জন্য। এতো কষ্টের মাঝেও পংক্তি মাহিনের ফিরে আসার প্রহর গুনতে লাগলো। একসপ্তাহ, দু’সপ্তাহ এভাবে একমাস কেটে গেল। পংক্তির অপেক্ষার অবসান হয় না। তবুও পংক্তির মনোবল ভাঙে না। মাহিনের উপর ওর অগাধ বিশ্বাস।

মাহিন তাকে কথা দিয়েছে ফিরে এসে পংক্তিকে আপন করবে। পংক্তি চুলায় দুধ চড়িয়ে সাত পাঁচ ভাবনায় ডুবেছিল। আচমকা চুলে টান পড়ায় চাপা আর্তনাদ করে উঠলো সে। মজিলা পংক্তিকে ভাবার সময় না দিয়েই চুল টেনে দু’চারটা চড় গালে বসিয়ে দিল। পংক্তি হকচকিয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে নিজেকে সামলে নেবে সে সুযোগটুকুও পেল না। মজিলা গরম দুধের পাতিলে পংক্তির হাতটা ডুবিয়ে দিল। আকাশ ভাঙা আর্তনাদ করে উঠলো পংক্তি। চোখের সামনে ধোঁয়াসা হয়ে গেল সব।

যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেকে আবিষ্কার করলো শিউলি ভাবির ঘরে। পংক্তিকে জাগতে দেখে শিউলি এগিয়ে এলো। বিমর্ষ মুখে পংক্তির মাথায় হাত রাখলো। বললো,
“বলেছিলাম না! ওরা তোকে বাঁচতে দেবে না। ওরা মনে মনে কুবুদ্ধি আঁটছে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দেবার জন্য। তুই কোথাও চলে যা পংক্তি।”
“কই যাবো ভাবি? আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।”

পংক্তির চোখে জল। হাতটা মরিচের মতো জ্বলছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে ও। শিউলির কিছুতেই ওর দুরবস্থা সহ্য হলো না। ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলো,
“তবে গলায় রশি দে। মরে যা। এরা এমনিতেও তোকে বাঁচিয়ে রাখবে না রে পংক্তি।” শিউলি মুখে আঁচল গুঁজে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। পংক্তির স্থির দৃষ্টি অবিরাম অশ্রু ধারায় সিক্ত হলো।

বিড়বিড় করে আকুতি ভরা কন্ঠে বলতে লাগলো,
“তুমি কোথায় মাহিন? আমি যে আর পারছি না। কবে আসবে তুমি তোমার পংক্তির কাছে।”
রাতে মিলি এসে জোর করে পংক্তিকে ঘরে নিয়ে গেল। আজকাল সবাই কেমন বদলে গেছে। মিলিটাও আগের মতো ভালো করে কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যায়। মানুষ এতো তাড়াতাড়ি বদলায় কেন? কেন এমন অচেনা হয়ে যায়? পংক্তির চোখে জল নেই। শুধু বুক ভরা চাপা বেদনা।

ইদানিং চিন্তায় রাতের ঘুমও হারাম হয়েছে ওর। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো হাতের পোড়া স্থানে পানি জমে ফুলে উঠেছে। ব্যথায় টনটন করছে হাতটা। তবুও কারও নূন্যতম দয়া মায়া হলো না পংক্তির উপর। স্বার্থ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। সাথে তারা মানুষ থেকে নিষ্ঠুর পশুতে পরিনত হয়। যার জলজ্যান্ত উদাহরণ মজিলার পরিবার। পংক্তি পোড়া হাতে কাজ করতে গিয়ে হাত ছিলে ফেলে। পোড়া মাংসের দগদগে ঘা দেখে পংক্তিরই ভয় করছে।

তবুও সেই হাতে কাজ সাড়লো সে। একফাঁকে ঘরে নিয়ে পংক্তির ক্ষত হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিল শিউলি। সেটা দেখামাত্রই অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিল মজিলা। ভয়ে দ্রুত ঘরে চলে আসে পংক্তি। সকালের নাস্তা খাওয়া হলো না ওর। দেরি হয়ে গেছে আজ। বোরখা পড়তে পারলো না পোড়া হাতের কারনে। কোনোমতে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে এলো। রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চললো দ্রুত পায়ে। তবুও একঘন্টা লেট পৌঁছালো পংক্তি।

ভাগ্য ওর এতোই খারাপ আজ গার্মেন্টস ঢুকতেই সুপারভাইজারের মুখোমুখি হতে হলো। আজ প্রথম বেআব্রু পংক্তিকে দেখলো সুপারভাইজার। ক্ষনিকের জন্য মনে হলো এ তো কোহিনূর হিরা রে আজিজুল। ওর ছোঁয়ায় তোর দেহবদন ধন্য হবে। আজিজুলের লোভী চোখ দুটো লিকলিক করতে লাগলো পংক্তির রূপ দেখে। পংক্তি আড়চোখে একবার আজিজুলের চোখের ভাষা টের পেয়ে সরে দাঁড়াল। ভয়ে গা কাটা দিলো পংক্তির।

সালাম দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রুখে দিল আজিজুল। মোলায়েম স্বরে ঝুঁকে এসে বললো,
“গত মাস থেকে তোর অনিয়ম দেখছি। আজ আবার দেরি করে এসেছিস। খুব সমস্যা চলছে বুঝি?”
“তেমন কিছু না স্যার। আর এমনটা হবে না।”

পংক্তি দু’কদম সরতে গিয়েও আজিজুলের হাতের বাঁধার কারনে সরতে পারলো না। হাত পা অবশ হওয়ার উপক্রম পংক্তির। চঞ্চল চোখে মনিরাকে এদিক ওদিক খুঁজছে সে। আজিজুল ব্যাপারখানা বুঝে মিটমিট করে হাসতে লাগলো। কাঁধে হাত রেখে নির্ভয় দিয়ে বললো,
“আমি কী বাঘ না ভাল্লুক বল তো?

এতো ভয় কেন পাস আমাকে তুই?”আজিজুল বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল পংক্তির দিকে। পংক্তি একচুল নড়ার সাহস পাচ্ছে না ভয়ে। ভয় ওকে আড়ষ্ট করে তুললো। আজিজুল শক্ত করে ওর কাঁধটা ধরে রেখেছে। পংক্তি এদিক ওদিক মানুষ খুঁজতে লাগলো ভীরু চঞ্চল চোখে। সেদিক খেয়াল করে আজিজুল পংক্তির পোড়া হাতটা টেনে ধরতেই পংক্তি ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল। আলগা দরদ দেখিয়ে বললো,
“আহা রে! কতখানি পুড়েছে। কেমনে হাত পুড়ালি?”

“ভাতের ফ্যান পড়ে পুড়ে গেছে। ‘ পংক্তি ভয়ে ভয়ে হাত ছাড়িয়ে আবারো ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে নিল। চলে যেতে পা বাড়াতেই আজিজুল আচমকা জাপটে ধরে নির্জন কক্ষে নিয়ে এলো পংক্তিকে। পংক্তি মনে মনে যে ভয় পেয়েছিল তাই হলো। ভয়ে চোখ দু’টো বিস্ফোরিত হলো পংক্তির। ব্যথা হাতে চাপ লাগাতে এমনিতেই সে চিৎকার দিয়ে উঠলো। তৎক্ষণাৎ মুখ চেপে ধরলো সুপারভাইজার।

“কাঁদছিস কেন? তোর সব দুঃখ কষ্ট দূর করে দেব। রাণী বানিয়ে রাখবো চিৎকার করিস না। আয় কাছে আয়।” পংক্তি প্রাণপণ চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আধখানা হয়ে গেছে। অসহায় দু’চোখে কাকুতি মিনতি করছে তবুও পশুটা ছাড়ছে না ওকে। কাপড়ের স্তুপে উপর ফেলে হাত বেঁধে মুখে কাপড় গুঁজে দিল। লালসার চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আজিজুলের।

দাঁড়িয়ে বেল্ট খুলতে লাগলো সে দ্রুততার সাথে। পংক্তির চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে চোখের জলে। সাহায্যের জন্য সৃষ্টি কর্তাকে স্মরণ করছে মনে মনে। আজ বুঝি ওর সব শেষ হয়ে যাবে। মাহিনকে কী জবাব দেবে! না পংক্তি কিছু কর! কিছু কর!পংক্তির অন্তর আত্মা চিৎকার করে সাহস দিতে লাগলো। আজিজুল ঝুঁকতেই পংক্তি সর্বশক্তি দিয়ে আজিজুলের পেটে লাথি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

কোনোদিক না তাকিয়ে ছুটতে থাকে দিশাহীন। চোখে মুখে ভয় আর আতঙ্ক ওর। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। আচমকা কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যায় পংক্তি। পোড়া হাতটা থেতলে যায় তাতে। কাপড় গোঁজা মুখেই ভয়ে চোখ খিঁচে ব্যথায় গোঙাতে থাকে।

“রিলাক্স! ভয় পেয়ো না।” পংক্তির মুখ থেকে কাপড়টা সরিয়ে দু’হাতের বাঁধন খুলে দেয় গম্ভীর কন্ঠস্বরের পুরুষটি। একটা মিষ্টি গন্ধ এসে নাকে লাগে পংক্তির। হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলছে তাতে। পংক্তির হাতের ক্ষতের মাত্রা দেখে ইশ করে উঠলো মানুষটা। ম্যানেজার বলে কড়া শব্দে ফার্স্ট এইড বক্স আনতে পাঠালো। ভয়ে ভয়ে হিচকি টানতে টানতে চোখ মেললো পংক্তি। এক হাঁটুতে ভর দিয়ে মুখোমুখি বসা মানুষটাকে দেখে পংক্তির মনে সাহস সঞ্চার হয়। অশ্রু ঝরা চোখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে পংক্তি। উৎসুক চোখে কপাল কুঁচকে পংক্তির দিকে তাকিয়ে আছে শেহরাজ সিদ্দিকী হিমান্ত।

“কী হয়েছে তোমার?”কোমল কন্ঠে পংক্তিকে প্রশ্ন করলো হিমান্ত। পংক্তি যেন একমুহূর্তের জন্য সব ভুলে গেল মানুষটার চোখের গভীরতায়। হিমান্ত অস্বস্তিবোধ করছে মেয়েটাকে এভাবে দেখে। চোখ নামিয়ে নিজের গায়ের কোর্টটা দিয়ে ঢেকে দিল পংক্তির ওড়না ছাড়া বক্ষ। বারকয়েক ডেকে সাড়া না পেয়ে ইতস্তত করে শেষমেষ পংক্তির বাহুধরে ঝাঁকুনি দিল। সাথে সাথেই হিমান্তের বুকের উপর ঢলে পড়লো পংক্তির অচেতন দেহটা।

পংক্তির মাথা বুকে পড়তেই চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে রইল হিমান্ত। নিজেকে সামলে নিল সাথে সাথে হিমান্ত। চোখ খুলে পংক্তির অশ্রুসিক্ত মলিন মুখটা দেখে অস্থির হলো হিমান্তের হৃদয়। নিজ হাতে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিল। পংক্তির ক্ষত হাতটার দিকে চোয়াল শক্ত করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে।

পর্ব ০৬

আজ বহুবছর পরে কোনো নারীর কান্না ভীষণ ভাবে পীড়িত করছে হিমান্তকে। নারীলোক মাত্রই কারনে অকারণে কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই মেয়ের কান্না হিমান্ত স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না? কেন সে’কথা ভাবতে চাচ্ছে না সে এখন। জ্ঞান ফেরার পর একটিবারও পংক্তি হিমান্তের মুখের দিকে চাইলো না। হিমান্ত নিজ হাতে যখন ওর ক্ষতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিল তখনও চোখ তুলে চাইলো না সে।

মেয়েটির বড় বড় নেত্র পল্লবের নিচের চঞ্চল চোখদুটো বার বার হিমান্তকে ওর আতঙ্কিত মনের ইঙ্গিত করছিল। মেয়েটাকে নিয়ে এতো ভাবতে যাওয়ায় নিজের মনকে শক্ত করে শাসালো হিমান্ত। তার জীবনে নারীকে নিয়ে এমন ভাবনার প্রবেশাধিকার নিষেধ। হ্যাঁ নিষেধ। হিমান্ত নিজের চেয়ারটায় গিয়ে বসলো।

কী মনে করে মেয়েটার দিকে আরেকবার তাকালো সে। বান্ধবীর কাঁধে মাথা রেখে হিচকি টেনে টেনে কাঁদছে মেয়েটা। ভয় তার চোখে মুখে। হাত পা স্থির নয় ওর। হিমান্ত চোয়াল শক্ত করে একদৃষ্টিতে ওকে দেখছে। রাগমিশ্রিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো হিমান্ত,
“কে ছিল?”

পংক্তি জবাব দিতে পারলো না। ওর কন্ঠনালী স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। ভয়ে মনিরার হাতটা শক্ত করে ধরে কাঁদছে। হিমান্ত দ্বিতীয়বার আর প্রশ্ন করলো না। কল করে ম্যানেজারকে ডেকে আনলো। পংক্তিকে যেখানে পাওয়া গেছে তার আশেপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখাতে বললো। ম্যানেজারের শরীর দরদর করে ঘামছে। আজ যে এমডি রেগে আছে তা তার মুখ দেখলে যে কেউ আন্দাজ করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা যার কারনে রেগে আছে তাকে আজ আধমরা করেই ছাড়বেন এমডি।

রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে সিসিটিভির ফুটেজ দেখাতে লাগলো ম্যানেজার মাসুদ। সিসি ফুটেজে যা দেখলো তাতে যেন মেজাজ সাত আসমানে চড়ে গেল ম্যানেজারেরই। এমডির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো আসন্ন ঝড়ের আলমত স্পষ্ট সেখানে। আজ পাঁচ বছর ধরে এই গার্মেন্টসের ম্যানেজার পদে আছেন মাসুদ আহমেদ। এমডি হিমান্তের রাগ সম্পর্কে তিনি ভালোই জানেন। সুপারভাইজারের নীচ কাজ দেখার পরও যে নিরব হয়ে আছেন এটাতেই বড় ভয় করছে ম্যানেজারের।” আজ আজিজুল শেষ তুমি।” বিড়বিড় করে ম্যানেজার বললো।

ম্যানেজারকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমক দিয়ে বলে উঠলো হিমান্ত,
“এখনো দাঁড়িয়ে কেন আপনি? গিয়ে জানোয়ারটার ঘাড় ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসুন।”
“জি স্যার! জি জি!”দ্রুত পা চালিয়ে দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল হিমান্তের ডাকে।
“ম্যানেজার সাহেব! ওর ঘাড় ধরে যদি না এনেছেন? তবে আপনার ঘাড় ধরে এখান থেকে চিরদিনের জন্য বের করে দেব আমি।”

এমডির চোখ পাকানো রুক্ষ স্বরের হুমকিতে ম্যানেজার ঘাবড়ে যায়। নত মুখে জড়ানো কন্ঠে জবাব দেয়
“আপনি যেভাবে বলেছেন সেভাবে হবে স্যার।”
হিমান্ত কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইশারায় যেতে বলার সাথে সাথে ম্যানেজার একপ্রকার ছুটে বেরিয়ে যায়। পংক্তি, মনিরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ভয়ে। পংক্তি আস্তে আস্তে বলে,
“মনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল। আমার ভয় করছে মনি।”

“ভয় করছে করুক। চুপ করে বসে থাক। হারামির পুতের সাহস কত্তবড়? ওর পুরুষাঙ্গ কেটে চিল কাউয়ারে খাওয়াই দিমু। নাম জিগাচ্ছি সেটাও তো কইতাছোস না। এতো ভয় কেন তোর ভিতরে?”মনিরার রাগের সামনে পংক্তি টু শব্দও করতে পারলো না।

তবে ওর মোটেও ভালো লাগছে না এখানে বসে থাকতে। ভয় আর আতঙ্কে অস্থির হয়ে নির্বাক বসে নাক টানছে পংক্তি। ইতিমধ্যে ম্যানেজার ঘাড় ধরে টানতে টানতে আজিজুলকে নিয়ে হাজির হলো। আজিজুলের দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিঃ বলে তিরস্কার করলো সে। আজিজুল ঢুকেই পংক্তি আর মনিরার দিকে অসহায় চোখে তাকালো। পংক্তি ভয়ে মুখটা আরও নুয়ে নিল। জড়সড় হয়ে বসলো মনিরার কাছে।

ভীষণ রকম আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরেছে এমুহূর্তে। মনিরা মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসতে চাইলো আজিজুলের দিকে। হিমান্ত তর্জনী নাড়িয়ে বসার ইশারা করতেই রাগ চেঁপে বসে রইলো মনিরা। বিড়বিড় করে আজিজুলের নামে উৎসর্গ করলো পৃথিবীর কুখ্যাত অশ্রাব্য ভাষা। হিমান্তকে তীক্ষ্ণ চোখে এগিয়ে আসতে দেখে আজিজুল ভীতু স্বরে বললো,
“দেখো হিমান্ত আমার ভুল হয়েছে।

এই সামান্য দোষের জন্য, এদের মতো ছোটলোকদের সামনে নিজের আত্মীয়কে তুমি অপমান করতে পারো না।”
“ম্যানেজার সাহেব,আপনার বেল্ট টা কী চামড়ার?”
উপস্থিত সবাই অবাক হিমান্তের এহেন কথা শুনে। আজিজুল কিছু ভাবতে লাগলো। তার ভয় এখনও কাটছে না। হিমান্ত তাকে ছাড়বে না এটা সে অনেকাংশেই নিশ্চিত। তবুও আত্মীয়তার দোহায় দিয়ে যদি বাঁচা যায়! একটা ক্ষীণ আশা মনে জাগে আজিজুলের। পাপের অনুশোচনা তার বিন্দুমাত্র নেই।

ফাঁক ফোঁকর খুঁজতে লাগলো হিমান্তের হাত থেকে বাঁচার। এদিকে প্রশ্নে জবাব না দিয়ে ম্যানেজারকে ভ্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে জোরে করেই ধমক দিল হিমান্ত। ম্যানেজার আমতা আমতা করে জবাব দিল,
“জি স্যার, পিওর লেদারের বেল্ট।”

“দেখি খোলেন তো একটু। ওকে ছেড়ে এদিকে আসেন।” ম্যানেজার লজ্জা পেল মেয়ে দুটোর সামনে বেল্ট খুলতে বলায়। নত মুখে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হিমান্ত তাড়া দিল।
“লজ্জা পাচ্ছেন কেন ওদের দেখে? আজিজুলের মতো হতে পারলেন না! মেয়ে মানুষ দেখলে ওর তো পুরুষাঙ্গ স্ট্রং হয়ে যায়। যেখানে সেখানে কুকুরের মতো হামলে পড়ে। আর আপনি মিয়া লজ্জায় মরে যাচ্ছেন। খুলুন তো বেল্ট।”

বাধ্য কর্মচারীর মতো বেচারা ম্যানেজার শরমে মরে যায় যায় অবস্থায় বেল্ট খুলে হিমান্তের হাতে দিল। আজিজুলের পিলে চমকে উঠলো হিমান্তের হাতে চামড়ার বেল্ট দেখে। আতঙ্কিত চোখে বড় বড় ঢোক গিলতে লাগলো সে। সে যেন বুঝে গেছে তার সাথে কী হতে চলছে। হিমান্ত গভীর মনোযোগ দিয়ে বেল্টার আগা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল। ঠোঁটের কোনে এক ফালি হাসির ঝিলিক দিয়ে ম্যানেজারকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“মজবুত তো বেল্টটা? গ্যারান্টি ট্যারান্টি দিয়েছে কিছু?”

“ফুটপাত থেকে কিনেছি স্যার! খুবই সুলভ মূল্যের তবে টেকসই আছে।”
“তাই নাকি? ব্যবহার করে দেখবো কতোটা টেকসই আপনার বেল্ট?”
“মানে! ম্যানেজার মানে কথাটা সম্পূর্ণও করতে পারলো না শিকারী নেকড়ের মতো হুঙ্কার ছেড়ে আজিজুলের উপর শপাং শপাং করে বেল্ট মারতে লাগলো হিমান্ত। আজিজুল ও মাগো! বাবা গো বলে গগনবিদারী আর্তচিৎকারে ফেঁটে পড়লো। মনিরা পংক্তি ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো একে অপরকে শক্ত করে ধরে।

ম্যানেজার বিস্ফোরিত চোখে থমমত খেয়ে এককোনায় সরে দাঁড়ালো। তিনজনই হিমান্তের এই রূপ দেখে বাকরূদ্ধ। তিনতলার সবার মাঝে মুহূর্তে নিরবতা নেমে আসলো। শুধু দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো আজিজুলের আর্তনাদ।

আজিজুল কে বেল্ট দিয়ে পেটাতে পেটাতে গর্জন করে উঠলো হিমান্ত,
“ছোটলোক ওরা! তুই কী? নরকের কীট!দু’মুঠো ভাতের জন্য এখানে কাজ করতে আসে। মা,বোনের নজরে না দেখে জড়িয়ে ধরিস? রেপ করতে চাস! কর তো? ঐ তো দাঁড়িয়ে আছে। যা টেনে আন? আন! বাস্টার্ড তোর জনমের লালসা আজ আমি মিটিয়ে দেব। ম্যানেজার সিজার নিয়ে আসেন।”

“হিমান্ত তোমার পায়ে পড়ি। ও পংক্তি। তুমি আমার মা। তোমার পায়ে পড়ি মাগো!আমাকে বাঁচাও।”
হিমান্তের পা জড়িয়ে ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদে আজিজুল। হিমান্ত থামে মা। সে মেরেই যায়। মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে আজিজুলের আর্তনাদ থেমে যায় একসময়। ম্যানেজার রিকুয়েষ্ট করে হিমান্তকে শান্ত করে।

আজিজুলের সাদা শার্ট ছিড়ে শক্তে লাল হয়ে গেছে। চশমা ভেঙে তিন টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে ফ্লোরে। হিমান্তের রাগ এখনও শিরায় শিরায় টান দিচ্ছে। নিজের রাগের উপর নিয়ন্ত্রন আনলো সে। হাজার হোক মামাতো বোনের স্বামী। বোনকে তো বিধবা করতে পারবে না। তবে এই শিক্ষার পরেও না শুধরালে হিমান্ত অবশ্যই মেরে ফেলবে আজিজুলকে। হিমান্তের চোখে এমন জানোয়ারদের বেঁচে থাকার কোনো হক নেই।

ম্যানেজার দ্রুত আজিজুলকে এম্বুলেন্সে উঠিয়ে হসপিটালে পাঠায়। হিমান্ত ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে পংক্তি, মনিরাকে বসতে বলে। কোল্ড কফি হাতে ফিরে আসে এমডির কক্ষে ম্যানেজার মাসুদ আহমেদ। হিমান্ত কফিতে দু’চুমুক দিয়ে শান্ত হয়ে বসে। মনিরাকে লক্ষ্য করে গম্ভীরগলায় বলে,
“ও যতোদিন সুস্থ না হচ্ছে ওর ছুটি। নিয়ে যাও।”

মনিরা পংক্তিকে নিয়ে এমডির কক্ষের বাইরে আসতেই পংক্তি ওকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দেয়। ভেঙে পড়ে একেবারেই পংক্তি। মনিরা পংক্তিকে ধরে ক্যান্টিনে নিয়ে বসায়। হালকা নাস্তা অর্ডার করে পংক্তিকে স্বান্তনা দিতে লাগলো। পংক্তি ভীষণ ভয় পেয়েছে। আজিজুল যা করেছে সে ভয় সাথে আজিজুলের মর্মান্তিক অবস্থার হতে দেখে ভয়ে পংক্তির হৃদপিণ্ড একফোঁটা হয়ে গেছে।

হিমান্তের রাগী রূপ মনে করতেই বুকের পাশে ধ্বক করে ওঠে। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে এখনও। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড ভাবে ঘামছে সে। মনিরা পংক্তিকে সাহস দিতে লাগলো। গার্মেন্টস জুড়ে কানাঘুষো হচ্ছে পংক্তিকে নিয়ে। এসব কথা বাতাসের আগে ছড়িয়ে যায়। আজিজুল যা করেছে সবটা এখন গার্মেন্টসের সবার মুখে মুখে। অনেকেই পংক্তিকে দোষাচ্ছে সত্য মিথ্যার মিশ্রিত গুজব শুনে।

সেসব শুনতে পেয়ে পংক্তি আরও ভেঙে পড়েছে। মনিরা পংক্তিকে সাহস দিল। বুঝিয়ে বললো ভেঙে না পড়তে। কিছু লোকের কাজই তিলকে তাল করা। পংক্তিকে এদের কথা শুনে ভেঙে পড়লে চলবে না। পংক্তির ভয় যেন কিছুতেই কাটলো না। মনিরা কী ভেবে উঠে দাঁড়ালো। পংক্তিকে বললো,
“তুই একটু বস আমি আসছি।”
“প্লিজ যাস না। ভয় করছে আমার।”

“কোনো ভয় নেই। আমি যাবো আর আসবো। একটু বস। ভয় নেই কোনো। মনে সাহস রাখ।”
পংক্তি ভীতু মনে মাথায় ওড়না টেনে বসে রইল। আশপাশ থেকে নানারকমের ফিসুড়ফাসুড় আসছে। সবটা তার সাথে সুপারভাইজারকে জড়িয়ে। এরা সবাই জানে সুপারভাইজারের চরিত্র ভালো না তবুও পংক্তির দোষ দিচ্ছে। পাশের এক মহিলা একটু জোরেই মুখ বেঁকিয়ে বললো,
“এক হাতে তালি বাজে না বুঝছো।

বান্ধবীটা তো পুরুষ ধরা গোছের মেয়েলোক। এটাও মিনমিনে চেহারা নিয়ে তলে তলে আকাম করে। দুটোই এক। গার্মেন্টসের সব পোলাগো মাথা নষ্ট করে আবার বিচার দিয়ে মাইর খাওয়ায় হু।”
পংক্তি বাকরুদ্ধ হয়ে যায় মহিলার কথা শুনে। মরে যেতে ইচ্ছা করছে ওর। কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করে বলছে,
“আল্লাহ মরণ দাও আমার। মরণ দাও।”

বেশকিছুক্ষণ পর মনিরা ফিরলো। সেও নাকি ছুটি নিয়ে এসেছে। পংক্তিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ওষুধ কিনে তারপর ফিরলো মনিরা। পংক্তির মামিদের কিছু জানানো হলো না। মনিরা নিষেধ করেছে। পংক্তিও বললো না কারন দোষ সব ঘুরেফিরে ওর ঘাড়েই পড়বে। দু’দিন পংক্তি কেটে গেল। এক হাতে যতোটুকু পেরেছে কাজ করেছে সে। বসে বসে তাকে মামি খাওয়াবে না সেটা দিনে একশ বার শুনিয়েছে। মনিরা রোজ বিকেলে এসে খোঁজ নিয়ে যায়।

এদিকে পংক্তি যে বাসায় কাজ করতো সেটা ছিল পংক্তির মামির দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ার। বড় ভালো মনের মানুষ তিনি। পংক্তির কষ্ট বোঝেন। পংক্তি কাজে না যাওয়ায় তিনি চিন্তিত হয়ে আজ খবর নিতে এসেছেন৷ এসে পংক্তির এমন দুরবস্থা দেখে মজিলাকে খুব ধমকেছে। জোর করে সাথে করে নিয়ে আসে পংক্তিকে। নিজের ছেলে মেয়ে সব বিদেশ থাকায় বিধবা রেহানা একা এতোবড় বাড়ি থাকেন।

মজিলাকে কতোকরে বলেছে পংক্তিকে দিয়ে দিতে। কিন্তু রাজি হয় নি মজিলা। এই মেয়েকে দুচোখে সহ্য করতে পারে না আবার ছাড়তেও চাই না কেন বোঝে না রেহানা। পংক্তির উপর বড় মায়া জন্মেছে রেহানার। কোনোভাবে নিজের কাছে সারাজীবনের জন্য এনে রাখতে পারলে শান্তি পেতেন তিনি। পংক্তিকে একসপ্তাহ নিজের কাছে এনে রেখেছে। এই একসপ্তাহে পংক্তির হাতের ক্ষতটা প্রায় সেড়ে শুকিয়ে গেছে। তবুও নিয়মিত ওষুধ খেতে হচ্ছে তাকে। ওষুধ পত্র সবটা মনিরা নিয়ে আসে।

এমডি নিজে নাকি মনিরার কাছে ওর খোঁজখবর নেয়। খরচপাতিও দেয় ওষুধের জন্য। পংক্তি মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার মহানুভবতার কারনে। বিকেলে ওষুধ খেয়ে একটু ঘুমিয়ে গিয়েছিল পংক্তি। বাইরে মামির গলার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ওর। কানখাড়া করে যা শুনলো তা শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। পংক্তির বিয়ে ঠিক করেছে মামি। কিন্তু কার সাথে? মাহিনের সাথে নয়তো?

মামির আনন্দে গলে গলে বলা কথাটা শুনে পংক্তির মনে একরাশ আতঙ্ক বাসা বাঁধে। মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনে সে নিশ্চিত হয় তার হবু বর মাহিন নয় অন্য কেউ। পংক্তির বুক ভরা আশা আকাঙ্ক্ষা এক নিমেষে চুরমার হয়ে যায়। শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে নিরবে কাঁদতে থাকে সে। মাহিনকে মনে মনে স্মরণ করছে পংক্তি। এই অবেলায় মাহিন কী ফিরবে তার কাছে?

পর্ব ০৭

পংক্তির হলুদ শাড়ি ভিজে গায়ে লেপ্টে গেছে। ঘন বরষার জলে শরীর থেকে একটু একটু করে ধুয়ে যাচ্ছে হলুদবাটা। মুশলধারায় বৃষ্টি নামলো। সবাই ছুটে ঘরে ঢুকলেও পংক্তি ঠাঁই বসে রইল বাড়ির মাঝখানটায়। এতোক্ষনের জমানো কষ্ট এখন নোনাজল হয়ে দু’চোখ বেয়ে গড়াচ্ছে। থমথমে মুখে পিটপিট করে আকাশে দিকে চাইলো পংক্তি। ধূসর আকাশ ফুঁড়ে টিপটিপ জল পড়ছে ওর মুখে, চোখে। বেশিক্ষণ তাকানো যাচ্ছে না সেদিকে।

তবুও পংক্তি জোর চেষ্টা করলো ঐ আকাশটাকে দেখতে চেয়ে।” “আমি কান্না লুকাবো কোথায়? আমার অশ্রু থামাবো কী দিয়ে? এই ভাবনায় দিশাহারা হতেই তুমি এলে আকাশ ভেঙে। ওগো বৃষ্টি তুমি এলে।” কথাগুলো অনুচ্চারিত রয়ে গেল। পংক্তির দুঃখ জমা দু’ঠোঁট ভেদ করে বিকট শব্দে কান্নার রোল উঠলো। পুরো বাড়ির লোকেরা হতবাক। বিস্ময় চোখে শুধু কাঁদতে দেখছে পংক্তিকে। পংক্তির জন্মের পর থেকে তারা পংক্তিকে চেনে জানে। এ মেয়ে চাপা প্রকৃতির। হাসির আড়ালে কান্না ঢাকে। লোক সম্মুখে দুঃখ উন্মোচন করে না।

আজ সেই মেয়ে কাঁদছে। উন্মাদিনীর মতো কাঁদছে। শিউলি, মিলি সহ আরো দুজন মহিলা ছুটে এলো পংক্তিকে উঠাতে। তারাও কাঁদছে পংক্তির সাথে। পংক্তিকে একচুল নড়াতে পারছে না তারা। এই জীবনের সব কষ্ট বুঝি আজ শরীরে ধারণ করেছে পংক্তি। পাতলা শরীর নয়তো এতো ভারী কী করে হয়? টেনেটুনে ভেজা শরীরেই ঘরে নিয়ে শুয়ে দেওয়া হয়। শরীর ছেড়ে দিয়েছে পংক্তি। এখন আর শব্দ করে কাঁদছে না।

শিউলি নিজ হাতে কাপড় বদলে গা হাত পা মুছে দেয়। বাইরে ঝড় উঠেছে প্রচন্ড বেগে। শিউলি পংক্তির চুল গুলো গামছায় মুছে বালিশের উপর ছড়িয়ে দিল। সোজা হয়ে শুয়ে আছে পংক্তি। যেন কাঠের পুতুল। যার চলন বলন শক্তি নেই। চোখের তারা স্থির। মাঝে মাঝে সে চোখের কোনা বেয়ে জল এঁকেবেকে গড়িয়ে বালিশে পড়ছে। একটা মানুষ কতোটা কষ্ট নিতে পারে! পংক্তি এই টুকু জীবনে হয়তো তার চেয়ে বেশিই নিয়েছে। সুখ তো পেলই না উল্টো চরিত্রহীনার দাগ কপালে লাগিয়ে দিল আপনজনেরা। ভালোবাসবে না ভেবেও যাকে ভালোবাসলো সে প্রত্যাখ্যান করলো। মুখ ফিরিয়ে নিল ঘৃণায়। পংক্তির সহ্য ক্ষমতা কমে গেছে। সে নিজের কষ্টের ভারে বাকরুদ্ধ আজ।

তুমুল ঝড় মাথায় করে বাড়ি ফিরলো মাহিন। ঘরে ঢুকেই পংক্তির অবস্থা দেখে বিব্রতবোধ করলো। চলিষ্ণু হতেই শিউলি চোখে মুখে কাঠিন্য এনে মাহিনের সম্মুখে দাঁড়াল।
“অঙ্গার শতধৌতেন মলিনত্বং ন মুঞ্চতা। একটা প্রবাদ এটা। অর্থ জানো কী?”

“আমার কোনো প্রয়োজন নেই এসবের অর্থ জানার।” মাহিন তিক্ষ্ম স্বরে পাল্টা জবাব দিল শিউলিকে। শিউলি বিদ্রুপ করে বললো,
“এখন আর প্রয়োজন পড়বে কেন? এখন তো তুমি বাবু মশায় বনে গেছো। তোমার সকল প্রয়োজন তো গিয়ে ঠেকেছে বড়লোকের আধুনিকা মেয়ের কাছে।”
“ভাবি আপনি চুপ করলে আমি খুশি হবো। নিজের চরকায় তেল দেন। আমার পার্সোনাল মেটারে ইন্টারফেয়ার করা বন্ধ করলেই ভালো হতে আপনার জন্য।” মাহিন জোর গলায় বিরক্ত হয়ে বললো কথাটা। শিউলি লজ্জা পেল তাতে।

যেতে যেতে বলে গেল,
“এই পিতৃমাতৃ হীন মেয়েটাকে নিয়ে তোমরা যা করলে তার শাস্তি একদিন ঠিক পাবে। মনে রেখো উপরে একজন আছেন। যার কেউ নেই তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। তার ঘরে দেরিতে বিচার হলেও সঠিক বিচারই হয়।”
কেউ যথার্থই বলেছি চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়। গত মাস খানেকের মধ্যে মাহিনেরও তেমন হয়েছে। সে ভুলে গেছে পংক্তির প্রতি তার সকল অনুভূতিদের।

ভুলে গেছে এই মেয়েকে একসময় পাগলের মতো চাইতো সে। টাকার মোহ মানুষকে সব ভুলিয়ে দেয়। মাহিনের মতো লোক টাকায় আবেগ বেঁচে তখন। মাহিন দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছে। সামান্য একটা ঈদের শার্টের জন্য তাকে কতো কাঁদতে হতো। কতো কিছুই চেয়ে সে পায় নি দরিদ্র পিতার নিকট থেকে। বেচারা তার বাপ। একটা ফ্যাক্টরির নাইট গার্ড ছিল।

সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থে মাহিনদের ছয় সদস্যের পরিবারটা বড়ই কষ্টে দিনাতিপাত করতো। মুহিব খারাপ সংগতে পড়ে পড়াশোনায় বেশিদূর না এগোলেও মাহিন অদম্য ইচ্ছাশক্তি ধারণ করে পড়েছে। ছেঁড়া বই,ছেঁড়া ব্যাগ, ছেঁড়া জুতা। যেটা ওর মা মানুষের বাসায় কাজ করে চেয়ে নিয়ে আসতো। চাকরীতে ঢোকা অব্দি তার ভেতরের লোভটাকে সে চিনতে পারে নি। কিন্তু যখনই চিটাগঙের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ের সাথে তার বন্ধুত্ব হলো।

ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারলো তার জীবনের লক্ষ্য পংক্তি নয় টুম্পা। পংক্তির প্রতি তার যে আবেগ সেটা ক্ষণস্থায়ী,স্রেফ একটা মোহ। যেটা টুম্পার সাথে মিশে মাহিন বুঝতে পেরেছে। পংক্তিকে সে ধোঁকা দেয় নি। শুধু ভালোবাসিই বলেছিল ব্যস। এটাকে ধোঁকা দেওয়া বলে না। সঠিকসময়ে নিজেকে ভুল পথ থেকে সরিয়ে আনতে পেরে আনন্দিত সে। তারউপর পংক্তির নামে যেসব বদনাম শুনেছে তার পর পংক্তিকে ভালোবাসা বোকামিই বলা যায়। মাহিনের সামনে এখন উজ্জ্বল ভবিষ্যত। এসব পংক্তি ফংক্তির জন্য সেটা সে নষ্ট করবে না।

একরাশ বিরক্ত চোখে পংক্তি জড় পদার্থের মতো শুয়ে থাকা দেহটার দিকে তাকায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাঁসে। মনে মনে ভাবে,
“টুম্পার সামান্য নখেরও যোগ্য নয় ও।”
মুখে বলে,
“মা, কখন বিদায় করবে ওকে? মানসম্মান তো রাখলো না কিছুই। আজ ওর জন্য দু’টাকার স্কুল মাস্টারের বউয়ের বকবক শুনতে হলো আমাকে।”

ও’ঘরে বসে পংক্তির জন্য আসা বিয়ের গহনা নেড়েচেড়ে দেখছিল মিলি,স্বপ্না ও মজিলা। মিলি ছাড়া বাকি দুজনের মুখ নিরস হয়ে গেল মাহিনের রাগী গলায় বলা কথাগুলো শুনে। মজিলার লোভী চকচকে চোখ দুটো তখনও ফিরে ফিরে গহনাগুলো দেখছিল। তার মন বললো, “গলায় দিতে পারলে কেমন দেখাতো আমাকে?”মজিলা এই কেমন এর জবাব জানতে স্বপ্না মিলিকে তাড়া দিল মাহিনকে ও বাড়ি নিয়ে যেতে। স্বপ্না যেতে চাইছে না।

মজিলা ঠিক জানে স্বপ্নার না যাওয়ার কারন। সে এখান থেকে কিছু একটা বাগাবে। সেই মতলব ওর চোখে মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মজিলা। বউটার হাতটানের ব্যামো আছে সেটা মজিলা ভালো করেই জানে। কিন্তু এখন এসব করতে সে দেবে না। তাহলে বরপক্ষের নজরে চলে আসবে বিষয়টা। এই সকল গহনার থেকে মজিলা একটা গহনা সরাবে সবার অলক্ষ্যে। তার জন্য সবগুলোকে আগে ও বাড়ি পাঠাতে হবে। মজিলা চেহারায় রাগ রাগ ভাব নিয়ে আসলো।

উঁচু গলায় বললো,
“বউ, যাও মাহিনকে তোমাগো বাড়ি নিয়া যাও। দেখছোই পোলা আমার ওরে সহ্য করতে পারছে না। বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত ওরে ঐখানেই রাইখো। এ বাড়ি আসনের কাম নাই ততক্ষণে।”
“আম্মা বাইরে ঝড় হচ্ছে তো। একটু পরে যাই।”

“বেশি কথা কইয়ো না। ঝড় হচ্ছে তো কী হইছে? এই তো দু’পা দিলেই তোমার ঘর। আবার মুহিব টা একা একা মেহমান গো খানাপিনার কী আয়োজন করছে কে জানে? সন্ধ্যা হইলেই সবাই চলে আইবো। যাও গিয়ে হাত লাগাও গিয়া। মিলি তুই যা। আলমারি থেকে চাদর আর বালিশের কভার নিয়ে যা। ভালো করে ঘর সাজা যা!যা।” মজিলা মাহিনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওদের সাথে স্বপ্নাদের বাসায় পাঠায়। স্বপ্নার হুতাশ মুখটা দেখার মতো ছিল তখন।

যেতে যেতে শ্বাশুড়িকে মনে মনে বড়সড় গালি দিল। স্বপ্নারা যে বাসায় ভাড়া থাকে সেখানে দুটো রুম খালি পড়ে আছে। মজিলা,মুহিবের অনুরোধে বাড়িওয়ালা সেখানে পংক্তির বিয়ের আয়োজনের অনুমতি দিয়েছে। মজিলা লাভে আছে। তার সবকিছুতেই এখন লাভ। মাহিন এখন মোটা বেতন পায় মাস গেলে। ধীরে ধীরে নাকি আরও বাড়বে। এ লাইনে উপরি টাকারও অভাব নাই।

মজিলা দাঁত বের করে হাসতেই যাচ্ছিল কী পংক্তির বিষন্ন মুখটা সামনে এলো। মরা মানুষের মতো শুয়ে আছে কেমন? মজিলার হিংসা হচ্ছে পংক্তির ভাগ্য দেখে। হানিফ সিদ্দিকীর বয়স কতো হবে? মজিলার আন্দাজে ষাটের কাছাকাছি হবে হয়তো! বড়লোক মানুষের সঠিক বয়স ঠাহর করা মুশকিল। ষাটের বেশিও হতে পারে তবুও মজিলা ধরে নিল ওটাই। নিজে সেঁধে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। যৌতুক তো নেবেনই না উল্টো মুহিবের চাকরী দেবেন বলে আশ্বস্ত করে গেছেন। বিয়ে খরচ পাতির জন্য লাখ খানেক টাকাও দিয়েছেন মজিলার হাতে।

গহনা,শাড়ি, সাজ সজ্জার সামগ্রিও পাঠিয়েছেন। মজিলা বেশিরভাগটাই মেরে দেওয়ার মতলবে আছে। মজিলার আজ আফসোস হচ্ছে। পংক্তি কোটিপতির ঘরের বউ হবে। হোক বা বুড়ো লোকটা তবুও তো সম্পদশালী। পংক্তিকে সোনার পালঙ্কে রাখবে। পংক্তির আসন্ন সুখ কল্পনা করে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরে মজিলা।

নিজের গরিবী কপালকে ধিক্কার দিতে দিতে গহনা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কী পেয়েছে এই জীবনে? কিছুই না। হতদরিদ্র স্বামীর অল্প বেতনে দু’বেলা পেট পুরেই খেতে পারতো না আবার স্বপ্ন দেখবে। বিয়ের আগে মজিলার দু’চোখে মেলা স্বপ্ন ছিল। সব ভেঙেচুরে খান খান হয়েছে ইকরাম তালুকদারের মতো নাইট গার্ডকে বিয়ে করে। ভাগ্যের উপর চরম অভিমান হলো মজিলার। হানিফ সিদ্দিকীর পাঠানো শাড়ি, গহনা নেড়েচেড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।

পর্ব ০৮

চারিপাশে হিন্দী গানের ধুমধাড়াক্কা আওয়াজ। লাল নীল বাতির জমকালো আলোর বিচ্ছুরন। নানা বয়সীদের পদচারণায় মুখরিত বিয়েবাড়ি পরিবেশ। স্টেজে বর কনের ফটোসুট চলছে। অনেকে আগ্রহ ভরে সেটা দেখছে আবার অনেকে নিজের অত্যাধুনিক যন্ত্র যেটাকে কিনা টাচ ফোন বলে সেটা দিয়ে সেলফি তুলতে ব্যস্ত।

বিয়ে বাড়ি মানেই ভুঁড়িভোজের আসর। সেটাও চলছে এক কোনে। হিমান্তের এই বিচিত্রা দেখার ইতি ঘটলো এক তরুণীর সুকন্ঠি স্বরে। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে সোজা দাঁড়াতে সমস্যা হচ্ছিল হিমান্তের। তাইতো দেয়ালের কোন ঘেঁষে দাড়িয়ে ছিল এককোনে। হাতে মদের গ্লাস। মেয়েটির কন্ঠ শোনামাত্রই ঘুরে দাঁড়ালো সে।

“ইয়েস মিস,হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ? যদিও হেল্প করার মতো অবস্থায় আমি এখন নেই। সি!”এক নাগারে কথা গুলো বলে হাত মেলে নিজের অবস্থা বোঝাতে চাইলো হিমান্ত। তাতেই ঘটলো বিপত্তি। নেশায় টালমাটাল হয়ে পড়ে যাচ্ছিল ভাগ্যিস মেয়েটা দু’হাতে জড়িয়ে নিল তাকে। সত্তর কেজির হিমান্তকে ওভাবে ধরে রাখতে সাতচল্লিশ কেজির ওজনের মেয়েটার ভীষণ রকম বেগ পেতে হচ্ছিল।

বেচারী বহুকষ্টে হিমান্তকে আবার দেয়াল ধরাতে সক্ষম হলো। যদিও হিমান্তও মেয়েটির অনাকাঙ্ক্ষিত জড়িয়ে ধরা থেকে নিস্কৃতি পেতে নিজেও নিজেকে মেয়েটির থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু নেশা তাকে এতোটাই দূর্বল করে দিয়েছিল যে নিজের ভর নিজের কাছেই পাহাড় সম লাগলো।

“সরি মিস!”হিমান্ত ঢুলুঢুলু চোখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির কাছে। হিমান্তের এমন নেশাগ্রস্ততা দূর থেকে সহজে কেউ আন্দাজ করতে পারবে না। বেচারী মেয়েটিও পারে নি। হিমান্তকে অনেক্ষণ যাবত সে নটিস করছিল। বেশ মনে ধরেছিল হিমান্তকে ওর। যাকে এই যুগে আদর করে সবাই বলে ক্রাশ। এমন সুদর্শন পুরুষকে দেখে উঠতি বয়সী যুবতিরা ক্রাশ নামক আবেগ খায়। মেয়েটিও তাই খেলো।

বিয়ে বাড়ির খাবার তার মুখে তাই আর রুচলো না ঠিক। কতো আশা আর সাহস বুকে নিয়ে এসেছিল একটু কুশলাদি জিজ্ঞেস করবে তারপর একটু হাসবে পরস্পরকে দেখে আর তারপর সেলফি। শেষে সৌজন্যের খাতিরে ফেসবুক কিংবা মোবাইল নাম্বার টা নেওয়ায় যেত। এখন তো ওর সকল আশায় জল ঢেলে গেল। একটু হতাশ হলেও পরক্ষনে নিজেকে বুঝ দিলো। এমনটা এ যুগে হয়ই। মদ,সিগারেট আম বাত এখনকার যুগে। বলা যেতে পারে যুগসই ট্রেন্ড। স্মার্ট ছেলেদের ক্ষেত্রে এসব চলে। তরুণীটির শুকনো মুখখানি সহসায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

লাজুক হাসিতে ঠোঁট সরু করলো। নত মুখে বললো,
“আমার নাম ইরা। পুরো নাম আরশিয়া মাহজাবীন ইরা।”
মেয়েটির কথা শুনে নেশায় আচ্ছন্ন হিমান্তের কপালে ভাঁজ পড়লো। ভ্রু উর্ধমুখী করে বললো,
“এক্সকিউজ মি! আমাকে কিছু বললেন?”

“মানে! না মানে।” হিমান্তের কঠিন চোখে তাকানো দৃষ্টি দেখে তরুণীর ক্রাশ বদহজম হয়ে গেল। বেচারী দারুন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়েছে। এখন পালিয়ে বাঁচলেই বড় বাঁচা বাঁচে সে। হিমান্ত বেশ বুঝেছে মেয়েটির অবস্থা। সে মুচকি হেঁসে চেয়ার টেনে বসে। বলে,
“থ্যাংকস আমাকে হেল্প করার জন্য। বাট সরি টু ছে আমি আপনাকে এমুহূর্তে কোনো হেল্প করতে পারবো না।

সো প্লীজ গেট লষ্ট।” হিমান্ত কথাগুলো উচ্চস্বরেই এবং রূঢ় ভাষায় বলছিল যার কারনে মেয়েটি যারপরনাই অপমানিত বোধ করলো। আশেপাশে দু’একজন তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। মেয়েটির চোখে জল চলে এলো তা দেখে। দ্রুত কান্না লুকিয়ে ছুটে চলে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে। হিমান্তের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুঁঠে উঠলো মেয়েটির যাওয়ার পথে চেয়ে।

“মেয়েটাকে এভাবে ইনসাল্ট না করলেও পারতে।”
পরিচিত মেয়েলী কন্ঠস্বর শোনামাত্রই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল হিমান্তের। চাহনি কঠিন করে তুললো। কোনো জবাব না দিয়ে সামনে মদের বোতল থেকে আরেক প্যাগ নিতেই যাচ্ছিল কী পরিচিত কন্ঠস্বরের মেয়েটি টেনে নিয়ে নিল গ্লাসটা।

“হাও ডেয়ার ইউ! গিভ মি দ্যা গ্লাস।”
“দেব না গ্লাস কী করবে? দোষ আমি করেছি শাস্তি আমাকে দাও। নিজেকে কেন তিলে তিলে শেষ করছো? কেন?”

হিমান্ত রুক্ষ মুখে অদ্ভুত হাসি হাসলো। গ্লাস টা টেনে নিয়ে গটগট করে গলায় ঢাললো মদটুকু। টেবিলের উপর কপাল ঠেঁকিয়ে বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“তোমার কী ধারণা তোমাকে এখনও ভালোবাসি আমি? তোমার অস্তিত্ব ধারণ করে আছি? নেভার।”
“মিথ্যা! মিথ্যা! সবটা মিথ্যা কথা। যদি ভালোই না বাসো এখনও তবে এসব কেন করছো? কেন নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছো বলো?”

হিমান্ত রাগে চিৎকার করে দাঁড়াতে গিয়ে টেবিল চেয়ার সহ নিচে পড়ে গেল। উপস্থিত সবাই বিস্ময় চোখে হিমান্তের দিকে তাকালো। এতোক্ষনের বাজা গান বাজনা, মানুষের কথাবার্তা সব একনিমেষেই বন্ধ হয়ে গেল। সবার দৃষ্টি এখন হিমান্ত এবং পাশে দাঁড়ানো বিজনেসম্যান আলভী আহমেদের স্ত্রী আহনার দিকে স্থির। অদূরেই দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করছিল আলভী আহমেদ। সেও বিব্রতবোধ করলো এসবে দেখে।

বেয়ারাকে ইশারা করে উপস্থিত সবাইকে অন্যপাশে পাঠিয়ে দিল। আহনা আহমেদ হিমান্তকে উঠতে সাহায্য করতে গেলে ধমক দিয়ে বলে হিমান্ত,
“ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ মি। জাস্ট লিভ মি এলোং। কেন বার বার সামনে আসেন আপনি? আর কী চাই? বলুন?

স্ট্রে এওয়ে ফ্রম মি। স্ট্রে!”
আলভী ইশরায় বেয়ারাদের আদেশ করতেই তারা গিয়ে হিমান্তকে উঠিয়ে চেয়ারে বসায়। যার বিয়ে অর্থাৎ বর সে হিমান্তের দিকে এগোতে গেলে আলভী বাঁধা দেয়। বর অর্থাৎ রাহাত আলভীর বাঁধা পেয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আহনা বিমর্ষ মুখে কিছু বলার জন্য এগিয়ে গেলে তর্জনী নিজের ঠোঁটে চেঁপে চুপ করতে বলে হিমান্ত। কিছুক্ষণ থেমে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে হিমান্ত কর্কশভাবে বলে,
“তোমাকে আমি এখন আর ভালোবাসি না। প্রমাণ চাও?

তবে এই দেখো! রোজ বোতলের পর বোতল মদ,প্যাকেটের পর প্যাকেট নিকোটিনের ধোঁয়া সবটা নিয়ম করে নিচ্ছি। জ্বালিয়ে অঙ্গার করে দিচ্ছি এই হৃদয়টাকে, যেটায় একদিন তুমি ছিলে। আমি তোমাকে ভুলে গেছি। হ্যাঁ! হ্যাঁ ভুলে গেছি। প্রমাণ চাও? তবে হৃদয় ছিঁড়ে দেখো সেখানে তুমি আর নেই। কিছুই নেই। শুধু ছাই হওয়া একদলা মৃতপ্রায় হৃৎপিন্ড নামক মাংসদলা আছে। মিসেস আলভী আহমেদ নেক্সট টাইম আমার সম্মুখে আসবেন না প্লীজ। মৃতপ্রায় মানুষের চারপাশে শুধু মরা মরা গন্ধ ভাসে। আপনার গায়ে লেগে যায় যদি?

সর্বনাশ হয়ে যাবে! গেট লষ্ট!”
আহনা কাঁদতে থাকে হিমান্তের কথা শুনে। পড়ে গিয়ে কাচের গ্লাসের ভাঙা টুকরোতে লেগে হাতটা কেটে গেছে হিমান্তের। আহনা হাতটা ধরতে গেলে রক্তচক্ষু হয়ে তাকায় হিমান্ত। আহনার সাহসে কুলায় না আর কিছু বলার।

হিমান্ত ডিজে বয়কে ঠোঁটের ইশরায় বলে,
“লেট ইট রেন ওভার মি।” সাথে সাথেই নিস্তব্ধতা ভেঙে গানের টিউন বাজে। হিমান্ত ঝুঁকে বসে মাথা পা নাড়াতে থাকে তার তালে তালে। গান চলে হিমান্তও সেই সাথে গায়

Girl my body don’t lie, I’m outta my mind
Let it rain over me, I’m rising so high
Out of my mind, so let it rain over me
Ay ay ay, ay ay ay let it rain over me
Ay ay ay, ay ay ay let it rain over me

নেশা মাত্রা ছাড়া হয়ে গিয়েছিল হিমান্তের। নিজের মধ্যে নেই সে এখন। বেয়ারাদের কাঁধে হাত রেখে লাফাতে থাকে হাত মাথা নাড়াতে নাড়াতে। হিমান্তের বন্ধুদের চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল তখন। তারা হিমান্তের রাগ সম্পর্কে পূর্ব অবহিত। হিমান্ত এখন যা করছে রাগ নিবারনের জন্যই করছে। লাফালাফির এক পর্যায়ে হিমান্ত বমি করে দেয়। পুরো শার্ট, কোর্ট নষ্ট হয় তাতে। দূর্বল হয়ে লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে।

রাহাত, আলভী বেয়ারাদের সাহায্যে হিমান্তকে একটা রুমে নিয়ে কাপড় পাল্টে শুয়ে দেয়। আলভী আহনার দিকে তাকিয়ে রেগে যায়। আহনার হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে যায়। ওদের বন্ধুরাও ওদের পিছু নেয়। সবার চোখে মুখে উৎকন্ঠা। হিমান্তের ঘুম ভাঙে মোবাইলের শব্দে। বেসুরো ভাবে ওটা শব্দ করেই যাচ্ছে। হিমান্ত দু’বার স্ক্রিন না দেখেই কল কাট করলো। ফের বেজে উঠলো। একবার, দু’বার ননস্টপ বেজেই চলছে।

দেয়াল ঘড়িতে রাত ৮ঃ৪০ এর কাটা ছুঁই ছুঁই। কাজী চলে এসেছে ইতিমধ্যে। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামছে। সাথে দমকা বাতাস। অনুন্নত এলাকা বলে একটু পর পরই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। বড় চার্জার বাতির ব্যবস্থা করতে গিয়েই দেরি হচ্ছে বিয়ে পড়াতে। মুহিব ও আজিজুল ইসলাম কোথা থেকে যেন বড় একটা চার্জার বাতি নিয়ে আসলেন।

সম্ভবত কিনে এনেছেন। হানিফ সিদ্দিকীর ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে গেছে। অসহ্য লাগছে এখানে বসে থাকতে। সেই কবে এমন গরম গায়ে লাগিয়েছিলেন ঠিক মনে করতে পারলেন না তিনি। একটা ছেলে তাকে হাত পাখা দিয়ে থেমে থেমে বাতাস করে যাচ্ছে। সৌজন্যের খাতিরে তিনি কয়েকবার বলেওছেন লাগবে না। তবুও ছেলেটা বাতাস করে যাচ্ছে। আশেপাশে অজানা অচেনা লোকদের দিকে তাকাতেই তিনি গুড ফিল করছেন না।

সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। বেশিরভাগের চাহনীতে স্পষ্ট বিদ্রুপ পরিলক্ষিত। আজিজুলকে সামনে দেখে হাত ইশরায় কাছে ডাকলেন হানিফ সিদ্দিকী। আজিজুল দাঁত বের করে হাসলো। এই আজিজুলের হাসি সিদ্দিকী সাহেব মোটেও পছন্দ করেন না। আজিজুলের চেহারাটাই শয়তান শয়তান ভাব আছে। হাসিও তেমন অশুভ,বিশ্রী। তবুও তিনি আজিজুল কে স্নেহ করেন। ছেলেটা তার সব কথা শোনে। সম্মান করে।

যা তার নিজের ছেলের কাছে তিনি কোনোদিনই পান নি। এতো এতো সম্পদ অথচ কোনো ভবিষ্যৎ ওয়ারিশ থাকবে না। একমাত্র সন্তান হিমান্তও যে হারে নেশা পানি ধরেছে তার ভবিষ্যতও সিদ্দিকী সাহেব ভালো দেখছেন না। ছেলের উপর চরম ক্ষোভ দেখিয়ে বিয়েটা করছেন তিনি। নয়ত এ বয়সে এসে বিয়ে করতে চাওয়া বড়ই লজ্জার বিষয়। আজিজুল জোড়াজুড়ি করলো নয়তো তিনি কোনোদিনই রাজি হতেন না।

কপালের ঘাম মুছে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন হানিফ সিদ্দিকী। আজিজুল সামনে বসে বোকার মতো হেঁসে বললো,
“কাজী এসে পড়েছে ফুপাজান। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। আমি গিয়ে আরেকবার দেখে আসি ফুপা জান?”

“যাও!”ছেলের কথা মনে পড়তেই সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল সিদ্দিকী সাহেবের। কী জন্যে আজিজুলকে ডেকেছিলেন সেটাও ভুলে গেলেন। মেজাজটাই বিগড়ে গেছে বরং এখন।
অবশেষে বিয়ের কার্যক্রম শুরু হলো। কাজী এসে নাম,ধাম, দেনমোহর সব নিয়ে আলোচনা শুরু করলো।

আলোচনা শেষে সেগুলো টুকে নিলেন রেজিস্টার খাতায়। সবেমাত্র বিসমিল্লাহ বলে শুরুই করবে তখনই হন্তদন্ত পায়ে ঘরে ঢুকলো হিমান্ত। অচেনা অজানা ব্যক্তির আগমনে হকচকিয়ে গেল পংক্তির বাড়ির লোক। পরে তারা বরের আত্মীয় ভেবে চুপ করে রইলো। হিমান্তের অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনে সিদ্দিকী সাহেব বিব্রতবোধ করলেন।

এতোবড় ছেলের সামনে বাপ হয়ে বর সেজে বসে থাকতে তার লজ্জা করছে, অস্বস্তি লাগছে। শরীর আগের থেকে বেশীমাত্রায় ঘামছে। পরক্ষনেই একটা চিন্তা তাকে গ্রাস করলো। এই বিয়ের কথা তার শ্যালকের স্ত্রী আকলিমা, আজিজুল আর সিদ্দিকী সাহেব নিজে ছাড়া কেউ জানে না। তিনি সবাইকে হুঁশিয়ারি করে দিয়েছিলেন আর যেই জানুক কিন্তু হিমান্ত যেন বিয়ের আগে এ’কথা না জানে। তিনি চাইছিলেন হিমান্ত এ খবর না জানুক।

কিন্তু এখন দেখছেন জেনেই গেছে সে। তার চরম পর্যায়ের অস্বস্তি হচ্ছে হিমান্তের সামনে এভাবে বসে থাকতে। আজিজুলের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখলেন ভয়ে চুপসে আছে আজিজুল। হিমান্ত বাবার দিকে একবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়েই যে রুমে মেয়ে বসা সে রুমে ঢুকে গেল। সিদ্দিকী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না। পংক্তির বাড়ির লোক সিদ্দিকী সাহেবের রক্তাভ মুখটার দিকে তাকিয়ে কিছু আন্দাজ করতে লাগলো। এরমধ্যে হিমান্ত রুম থেকে বের হয়ে এলো।

তার পেছনে নত মুখে দাঁড়ানো নববধূ সাঁজে পংক্তি। সিদ্দিকী সাহেব বিস্ময়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালেন ওদের দিকে ৷ হিমান্ত পংক্তির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখনই মাহিন সামনে পথ আগলে দাঁড়ালো। রীতিমতো হুঙ্কার দিয়ে উঠলো,
“কে আপনি? পংক্তিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

“সেটার জবাব আমি আপনাকে দিতে বাধ্য নই। বাই দ্যা ওয়ে হু আর ইউ?”মাহিনকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে তাচ্ছিল্য করে ঘর ছেড়ে দরজার সামনে এলো হিমান্ত। দমকা হাওয়ার সাথে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ভিজে একাকার হিমান্ত। মাহিন নির্লিপ্ত হেঁটে যাওয়া পংক্তির দিকে তাকিয়ে চুপসে গেল। বিড়বিড় করে বললো,
“ওহ! তাহলে ঘটনা সব সত্যি! চরিত্রহীনা। মাহিনের চোখের চাহনী ঘৃণায় ভরে উঠলো। ততক্ষণে ভীর ঠেলে ভেতর থেকে ছুটে এলো মজিলা।

গলা ঝাঁঝিয়ে বললো,
“দাঁড়ান। বলা নেই কওয়া নেই আমাগো মেয়ে নিয়া যাইতাছেন? ভালোই ভালোই হাত ছাড়েন ওর।”
“না ছাড়লে কী করবেন? শুনুন সে একটু আগ পর্যন্ত আপনাদের মেয়ে ছিল এখন আর নেই। আমাগো মেয়ে কথাটা উচ্চারণ করতে লজ্জা হলো না আপনার? নন আঠারো প্লাস মেয়েকে বাপের বয়সী লোকের সাথে বিয়ে দিতে যাচ্ছেন আবার আমাগো মেয়ের অধিকার দেখাতে আসছেন?

আরেকবার যদি এই মেয়ের আশেপাশে আপনাদের একটাকে দেখছি আই ওয়ার্ন ইভরিওয়ান সবকটাকে ধরে জেলের ভাত খাওয়াবো।” হিমান্তের রক্তচক্ষু আর তেজি গলার হুমকিতে সব ভয় পেয়ে যায়। হিমান্ত একবার শুধু বাবার দিকে আরেকবার আজিজুলের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়। তারপর পংক্তিকে টানতে টানতে নিয়ে বসায় গাড়িতে। উপস্থিত সবাই সব দেখেও নিরব দর্শক হতে বাধ্য হলো।

হিমান্তের হুমকির সামনে তাদের কারও সাহস হলো না কিছু বলার। মাহিন পংক্তির অনুভূতি শূন্য নির্লিপ্ত ভাব দেখে রাগে ফেঁটে পড়লো। এক মিনিট আর সে এখানে দাঁড়াল না। সবাই যখন ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে তখন মজিলার চোখ পড়লো পংক্তির পাশের সিটে বসা মনিরার দিকে। সব বোঝা হয়ে গেল মজিলার।

তার বাড়া ভাতে ছাই যে মনিরা দিয়েছে তাতে আর একবিন্দু সন্দেহ রইলো না মজিলার। তিনি সেদিকে তেড়ে যেই না যাবেন ওমনি গাড়ি ছুটে বেরিয়ে গেল গলি থেকে। মজিলা হায়! হায় একি সর্বনাশ হলো মাতমে বৃষ্টি কাঁদার মধ্যে বসে পড়লেন। সিদ্দিকী সাহেব অপমানে মুখটা একটুখানি করে আজিজুলকে সাথে নিয়ে দ্রুত কেটে পড়লেন সেখান থেকে।

পর্ব ০৯

অবিরাম বর্ষায় পিচঢালা রাস্তার উপর পানি জমছে। সম্পূর্ণ পানি গড়িয়ে সরে যাওয়ার আগেই দ্রুতগতির গাড়ির চাকার আঘাতে ছিঁটকে পড়ছে রাস্তার দু’ধারে। শাঁ শাঁ করে গাড়ি ছুটছে। কতো রকমের যান্ত্রিক যানবাহন। বাস,কার, ট্যাক্সি, সিএনজি মাঝে সাঝে দু’একটা রিকসাও দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির শব্দের সাথে গাড়ির হর্নের শব্দ মিলেমিশে তৈরি করছে অদ্ভুত শব্দের অনুরণ।

হেডলাইটের অনুজ্জ্বল আলোয় বর্ষাঘন রাস্তাটা বিষাদগ্রস্হ লাগছে এই মূহুর্তে। পংক্তি গাড়ির দরজার বন্ধ কাচে মাথা ঠেকিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছে। ঘন বর্ষায় পৃথিবী যেমন পবিত্র, শান্ত হয় পংক্তিও চাই এমন করে কেঁদে সেই সুখ অনুভব করতে। আকাশের মতো প্রাণ খুলে কাঁদতে চায় পংক্তি। ঝমঝমিয়ে চোখ দিয়ে নোনাজলের বৃষ্টি গড়িয়ে মনটা শান্ত, স্নিগ্ধ করতে চায় সে। কিন্তু সে সুযোগ তো তার কপালে নেই। পংক্তির আজ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে ওর কপালে সুখ নেই শান্তি নেই। স্বর্ণলতা সে। যার আঁকড়ে ধরার কিছুমাত্র আর অবশিষ্ট নেই এখন।

আগে যাও মাথার উপর এক টুকরো ছাঁদ ছিল আজ থেকে সেটাও রইলো না। এই জনবহুল পৃথিবীতে একা নিঃস্ব পংক্তি। গন্তব্যহীন পথচারী। ঠিকানাবিহীন এক মানবী। দীর্ঘশ্বাস ঠেকাতে দাঁত কামড়ে চোখ বন্ধ করলো পংক্তি। পংক্তির পাশে বসা মনিরা বেশ চিন্তিত। মনিরার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটলো হিমান্তের গম্ভীর গলার স্বরের আওয়াজে।

“কোথায় নামাবো তোমাদের?”কথাটা জিজ্ঞেস করেই লুকিং গ্লাসে তাকাই হিমান্ত। পেছনে বসা মনিরার চঞ্চল চোখ আর অনিচ্ছাকৃত হাসি দেখে হিমান্তের স্বাভাবিক মুখটা রাগে কঠিন হয়ে যায়। কিছু তো গোলমাল আছে সে আগেই বুঝেছিল। এবার সেটা কিছুটা ক্লিয়ার হচ্ছে। হিমান্ত রাগ লুকিয়ে আবার প্রশ্ন করলো,

“হ্যালো! কোথায় নামাবো তোমাদের?”

“স্যার মানে!”

“মানে মানে বন্ধ করে কথা ক্লীয়ার করো। তোমার ঘ্যানঘ্যান শোনার সময় নেই আমার। কাঁচা ঘুম থেকে তুলে এনেছ? মনে আছে কী কী বলেছিলে?”হিমান্ত চোখ রাঙাতেই মনিরা নাকে কাঁদতে শুরু করলো।

“স্যার আমি তো বাসায় চলে যাবো। কিন্তু?”

“নো কিন্তু পরন্তু? সামনে মার্কেটটার সামনে নামিয়ে দেব তারপর তোমাদের পথ তোমরা দেখবে আমার পথ আমি। ওকে।”

“প্লীজ স্যার। এমনটা করবেন না। আমার থাকা নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করবো না কিন্তু?”

“আবার কিন্তু? একবারে কথা ক্লীয়ার করো। ফাস্ট ফাস্ট।” হিমান্ত চরম পর্যায়ের বিরক্তি প্রকাশ করে।

“স্যার! আমার ফ্রেন্ডটার একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিননা প্লীজ স্যার।” মনিরার এমন আকুল আবেদন শুনে হিমান্ত তব্দা খেয়ে যায়। দ্রুত ব্রেক কষে গাড়ি সাইড করে। অত্যাশ্চর্য হয়ে পেছনে ঘুরে বলে,

“আরে সর্বনাশ! আচ্ছা তোমরা সব মেয়েরাই কী এমন? নাম্বার ওয়ান পল্টিবাজ!”

“স্যার সরি বাট!”মনিরার চোখের কোনে জল চিকচিক করে।

“আবার বাট ফাট! এই মেয়ে তুমি কী বলেছিলে মোবাইলে মনে আছে তোমার? ওকে আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। বলেছিলে স্যার আপনার জন্য আমার বান্ধবীকে আজিজুল ষড়যন্ত্র করে একটা বুইড়া ব্যাটার সাথে বিয়ে দিচ্ছে। সেই বুইড়া ব্যাটাটা যে আমার বাবা তা কিন্তু বলো নাই। প্রথম পল্টি তুমি চালাকি করেছ আমার সাথে। দ্বিতীয় টা হলো আমাকে সরাসরি ব্লেম করেছ আমার কারনে শুধুমাত্র আমার কারনেই তোমার বান্ধবীর এই দশা হতে যাচ্ছিল।

সে মরে গেলে আমার ব্লা হবে ব্লা হবে ইটিসি। তৃতীয় পল্টি তুমি এখন মারলে। কী কথা হয়েছিল আমাদের দুজনের? আমি তোমার বান্ধবীকে সহি সালামত উদ্ধার করে এনে তোমার হাতে নিরাপদে তুলে দেব তাই তো? কিন্তু এখন তুমি এই মেয়ের অর্থাৎ তোমার বান্ধবীর দায়িত্ব আমার ঘাড়ে দিতে চাচ্ছ! ডু ইউ থিংক আ’ম এন এ্যাস?”হিমান্ত চড়া গলায় ধমক দিল মনিরাকে। তাতে মনিরা পংক্তি দু’জনেই ভয়ে কেঁপে উঠলো। পংক্তি মনিরার হাত চেপে ধরেছে। মনিরা পংক্তিকে সাহস দিল ওর হাতে হাত রেখে। হিমান্ত রাগী চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করছে।

মেজাজ চরম খারাপ হচ্ছে এখন এদের দুজনকে কাঁদতে দেখে। মুখ ঘুরিয়ে কপালে হাত রেখে সিটে হেলান দিয়ে বসলো হিমান্ত। তিনজনেই চুপ হয়ে গেল। পংক্তি অসহায় চোখে মনিরাকে নেমে যেতে ইশারা করলো। মনিরার চোখ দিয়ে তৎক্ষণাৎ অশ্রু ঝরে পড়লো। পংক্তির দিক থেকে নজর সরিয়ে হিমান্তের সিটের দিকে তাকিয়ে রইল।

“স্যার প্লীজ স্যার। আপনি ছাড়া এখন আর কেউ নেই আমাদের পাশে। ওর কথা তো সব বলেছি আপনাকে। প্লীজ স্যার ওকে সাহায্য করুন। আপনার পায়ে পড়ি স্যার। ওর একটা ব্যবস্থা করে দিন।” মনিরা কান্নায় ভেঙে পড়লো। হিমান্ত এসব দেখে পড়েছে বেকায়দা অবস্থায়। বাড়িতে এই মেয়েকে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাহলে সাহায্য কী করে করবে?

“কী মুসিবত শালার! মানুষের উপকার করেও দেখি শান্তি নাই। বিশেষ করে মেয়ে মানুষের। মেয়েমানুষ মাত্রই উটকো ঝামেলা। তোমার বান্ধবী তুমি বোঝো কী করবে! আমি এসবের মধ্যে নাই। কথা শেষ।” হিমান্ত ধমক দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করতে গেলে মনিরা ঝুঁকে ওর পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। পংক্তির লজ্জা করছে। মনিরার জন্য কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছা করছে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে জীবন দিয়ে দিতে। ওর জন্য মনিরা লোকটার পায়ে পড়ে কাঁদছে। অসহায়ের মতো পংক্তি নিঃশব্দে কাঁদছে এ দৃশ্য দেখে।

হিমান্তের মন নরম হয় মনিরার কান্নাকাটিতে। মনিরাকে ধমক দিয়ে চুপ করে বসতে বলে সিটে। মনিরা নাক টানতে টানতে চুপ করে যায়। হিমান্ত বেশ কিছু সময় ধরে ভাবতে থাকে। ভাবনা শেষ হতেই মোবাইল বের করে বন্ধু রাহাতকে কল করে। হিমান্তের নেশা তখনও কিছুটা অবশিষ্ট। যার কারনে সে অনেক কথাই ঠিকমতো মনে করতে পারছে না। এই যেমন ঘন্টাখানেক আগেই রাহাতের বিয়ে হয়েছে। সেই হিসেবে রাহাতের আজ বাসর রাত।

হিমান্ত সেটা বেমালুম ভুলে বসে আছে। মোবাইলের ও পাশ থেকে রিফাত যখন তাকে কথাটা মনে করিয়ে দিল তখনই তার মনে পড়লো। হিমান্ত বিব্রত বোধ করলো বিষয়টা বুঝতে পেরে। কল কাট করতেই যাচ্ছিল কিন্তু রাহাতের কথা তখনও শেষ হয় নি। রাহাত হিমান্তের মোবাইল করার মূল উদ্দেশ্যে শুনতে নাছোড়বান্দা।

একপর্যায়ে হিমান্ত তাকে সবটা খুলে বলে। দীর্ঘক্ষণ দু’জনে চুপ করে যায় মোবাইলের দু’পাশে। হিমান্ত সরি বলে কল কাট করে দেয়। লুকিং গ্লাসে পেছনে বসা অসহায় মেয়েদুটোকে দেখে ওর মায়া হচ্ছে এই মুহূর্তে। যাকে হাত ধরে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনেছে সেই মেয়েটির দিকে তাকালো হিমান্ত। স্থির চোখে সাইড গ্লাস বাইরে তাকিয়ে আছে। কী মনে করে হঠাৎই বলে বসলো,

“গ্লাস খুলতে পারো সমস্যা নাই।”

মেয়েটি একবারটির জন্যেও ওর দিকে তাকালো না। উল্টো সহজ ভঙ্গি ছেড়ে জড়সড় হয়ে বসে রইল নত মুখে। হিমান্ত নিজেকে নিজে বকলো। কী দরকার ওর মেয়েটাকে এসব বলার! এই মেয়েদুটোর কারনেই ও আজ ঝামেলায় পড়েছে। এই ঝামেলা অল্পতেই শেষ হলে সমস্যা ছিল না। হিমান্তের বদ্ধমূল ধারণা আজ বাবার সাথে বহুদিন পর ওর ঝামেলা হবে এ’নিয়ে। নেশার ঘোর এখনও পুরোপুরি না কাটায় মাথা টনটন করে ব্যথা করছে।

অস্থির লাগছে ভেতরে ভেতরে চিন্তায়। একে তো বাইরে ঝড় বৃষ্টি তারউপর মেয়েটাকে আশ্রয় কোথায় দেবে সে চিন্তা। এতোকিছু ভেবে একসময় হিমান্ত সিদ্ধান্ত নিলো উত্তরার খালি ফ্লাটে রেখে আসবে। সেই মনেই গাড়ি স্টার্ট করছিল কী এরমধ্যে রাহাত কল করলো। রাহাত জানালো মেয়েটির থাকার ব্যবস্থা সে তাদের গেষ্ট রুমে করে দেবে। তবে বেশিদিন তাকে রাখা রাহাতের পক্ষে সম্ভব নয়। তাতে তার বাড়ির লোক সন্দেহ করতে পারে।

হিমান্ত চিন্তা করলো এতো রাতে একা ফ্লাটে রেখে আসা ঠিক হবে না মেয়েটাকে। তারচেয়ে থাকুক দু’একদিন রাহাতের বাসায় পরে একটা ব্যবস্থা ঠিক করে দেবে সে। অবশেষে হিমান্তের চিন্তা কিছুটা লাঘব হলো রাহাতের আশ্বাসে।

পংক্তি ও মনিরাকে হিমান্ত রাহাতের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল। যেতে যেতে সোজাসাপ্টা বলে দিল জাস্ট সাতদিন এর মধ্যেই ব্যবস্থা করে নিতে হবে মনিরা এবং পংক্তিকে। কথাটা বলেই হিমান্ত চলে গেল। পংক্তি শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে। মনিরা পংক্তিকে স্বান্তনা দেয়। পরিস্থিতি বোঝায়। পংক্তি বুঝতে চায় না। তার এক কথা এখানে সে থাকবে না। তাছাড়া এমডি স্যারের কথা তার আত্মসম্মানে লেগেছে। ঠিকই তো বলেছে এমডি স্যার।

কেন ওরা বার বার স্যারকে ডিস্টার্ব করছে? সে তো এদের চেনা জানা না, সাধারণ এমপ্লয়ি ছাড়া। মনিরা অনেক বুঝিয়ে পংক্তিকে এ বাড়ি রেখে যায়। একজন কাজের লোক এসে গেস্ট রুমে নিয়ে যায় পংক্তিকে। কিছু কাপড় আর খাবার দিয়ে কাজের লোক চলে যায় সেখান থেকে। পংক্তি ভেজা শরীরেই ফ্লোরে বসে কাঁদে।

তার অনিশ্চিত ভবিষ্যত তাকে ভাবিত করে। মনিরার চিন্তা তাকে কষ্ট দেয়। চোখের সামনে অন্ধকার আর অন্ধকার। এছাড়া যেন আর কিছুই সে দেখছে না। মাহিনকে ভালোবাসায় তার জন্য কাল হলো। কেন যে নিজের পণ ভাঙলো? কেন আজ তাকে মাহিনের দৃষ্টির আড়াল হতে ঘর ছাড়তে হলো? এসব ভেবে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে পংক্তি।

রাত ১ঃ৩৬ বাজে। গাড়ি পার্ক করে হিমান্ত কপাল টিপতে টিপতে বাড়িতে ঢোকে। এখন একটা লম্বা ঘুম দরকার ওর। ড্রইং রুমে ঢুকতেই হিমান্ত লক্ষ্য করে কাউচে গম্ভীরমুখে বসে আছে তার বাবা, মামা,মামি,কাজিন এবং কাজিনের হাজবেন্ড আজিজুল। হিমান্তকে দেখামাত্রই আজিজুলের মুখের রঙ পাল্টে ভয়ার্ত হয়ে যায়। হিমান্ত নরমাল ভঙ্গিতেই পাশ কেটে সিঁড়িতে দু’পা ফেলতেই সিদ্দিকী সাহেব গর্জন করে ওঠেন। শ্যালকের স্ত্রী আকলিমার নাম ধরে বলেন,

“আকলিমা প্রশ্ন করো জনাবকে আর কতোটা আমাকে হেয় করলে তার মন ভরবে।”

হিমান্ত স্থির দাঁড়িয়ে যায় বাবার কথা শুনে। বাবার সাথে ছোটবেলা থেকেই কম কথা বলতো হিমান্ত। বাবা ছেলের সেই সম্পর্ক আরও খারাপ হয় গত পাঁচ বছরে। কেউ কারো সাথে কথাও বলে না এখন সরাসরি। হিমান্ত কখনোই বাবার কোনো কাজে ইন্টারফেয়ার করে না। আজ করে ফেলেছে। সে ভাবে এরজন্যই হয়তো এতোটা রেগে আছে সিদ্দিকী সাহেব। হিমান্ত ঘুরে দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে এগিয়ে আসে সিদ্দিকী সাহেবের দিকে। হিমান্ত চোখের চোখ রাখতেই সিদ্দিকী সাহেব ঘাবড়ে যান। তিনি চোখ সরিয়ে নেন। হিমান্ত বাঁকা হেসে ছোট্ট করে বলে,

“সরি সিদ্দিকী সাহেব।”

বিয়ের আসরের অনাকাঙ্খিত ঘটনায় সিদ্দিকী সাহেব অপমানিতবোধ করেছেন। বাসায় এসে সেই রাগে ক্ষোভে দু’গ্লাস হুইস্কি গিলেছেন। আজিজুলকে আজ প্রথমবার খুব ধমকেছেন তিনি। অভিমানে ভেবেছিলেন কিছুই বলবেন না ছেলেকে কিন্তু সবাই তাকে উস্কাতে লাগলো হিমান্তের বিরুদ্ধে।

হিমান্ত উচ্ছন্নে যাচ্ছে বাবা হিসেবে সিদ্দিকী সাহেবের উচিত তাকে শাসন করা, তার চিকিৎসা করানো এমন নানা কথায় সিদ্দিকী সাহেবের মেজাজ একসময় খুবই বিগড়ে গেল। সেই সাথে সিদ্দিকী সাহেবের মোটেও পছন্দ হলো না হিমান্তের সরি বলার স্টাইল। ছেলে তাকে বাবা বলার স্থানে আর সবার মতো সিদ্দিকী সাহেব বলে এটাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন তিনি। এতোদিনের চাপা ক্ষোভ সব মাথায় জেঁকে বসলো। আগের চেয়ে দ্বিগুন রেগে গেলেন। বললেন,

“সরি ফর হোয়াট? আজ আমাকে বলো হিমান্ত কতো কিছুর জন্য সরি বলবে তুমি? প্রতিনিয়ত আমাকে অপদস্থ করার জন্য? মানুষের সম্মুখে আমাকে ছোট করার জন্য? নাকি আমাকে নির্বংশ হতে বাধ্য করতে পারার খুশিতে? বলো আমি শুনতে চাই?”

“ব্যস! একদম চুপ করুন। আপনার সাথে কোনো কথা বলার রুচি আমার আগেও ছিল না এখনও নেই সিদ্দিকী সাহেব। দয়া করে মুখটা বন্ধ করুন। হুইস্কি আর শ্যালকের স্ত্রী আপনার মাথা পুরোটাই নষ্ট করে দিয়েছে। আপনাকে কিছু বলাই বৃথা।” হিমান্ত তর্জনী উঁচিয়ে সিদ্দিকী সাহেবের কথার পাল্টা জবাব দিল দ্বিগুন তেজে।

সিদ্দিকী সাহেবও দমবার পাত্র নন। সন্তান হয়ে হিমান্ত তাকের তর্জনী দেখায় এতো সাহস ওর? আকলিমার নাম এভাবে নেওয়ায় আকমিলা কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে চলে যায়। মঞ্জুর ছাড়া বাকিরাও তার পিছু পিছু মুখ কালো করে চলে যায় ভেতরে। এসব দেখে রাগে ফুঁসে উঠলেন ছেলের উপর সিদ্দিকী সাহেব। রাগের তার জ্ঞান লোপ পেয়ে বসলো। যা মুখে আসলো তাই বলতে লাগলেন নেশার ঘোরে।

“আমার খাও আমার পড়ো আবার আমাকে আঙ্গুল দেখাও? এতো সাহস তোমার! কোন সাহসে ঐ মেয়েকে টেনে নিয়ে গেলে তুমি? একটা মেয়ের যা চাহিদা তা কী পূরণ করার ক্ষমতা তোমার আছে? তুমি ভুলে যাও কেন তুমি একজন অক্ষম পুরুষ হিমান্ত। আমার বংশ আমি তোমার আসায় নির্বংশ হতে দিতে পারি না। তোমার যে যোগ্যতা নেই সেটা এখনও আমার আছে। আমি আবার বিয়ে করবো। ওয়ারিশ বানাবো। আমার পথে বাঁধা হতে পারো না তুমি?”

হিমান্ত অপমানে, লজ্জায় দীর্ঘক্ষণ কোনো কথাই বললো না। আহনার পর আজ নিজের বাবা সিদ্দিকী সাহেবও তাকে অক্ষম পুরুষ বলে আঘাত দিল। হিমান্ত নিজের বেঁচে থাকাকে অভিশাপ দিতে লাগলো। সিদ্দিকী সাহেব ওকে এতোবড় কথা বলতে পারে ওর যেন বিশ্বাস ই হলো না। কর্ণপর্দায় আঘাত করছে কথাগুলো। হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। হিমান্তের কঠিন দৃষ্টি ভেদ করে আজ বহুদিন পর জল গড়ালো কয়েক ফোটা। বাবার অলক্ষ্যে সেটা মুছে ঘুরে দাঁড়ালো হিমান্ত। দীর্ঘশ্বাস টেনে চোয়াল শক্ত করে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,

“তো ঠিক আছে। যা খুশি করুন। আজ এই মুহুর্ত থেকে আপনার সকল কিছু আমি ত্যাগ করলাম। না আপনাকে আমার প্রয়োজন না আপনার আত্মীয়দের আর না আপনার সম্পদ। একটা কেন একশ টা বিয়ে করুন তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই শুধু ঐ মেয়ে থেকে দূরে থাকবেন। চলি।” হিমান্ত সামনের রুমটাই ঢুকে গেল দ্রুত পায়ে হেঁটে। সিদ্দিকী সাহেব রক্ত শূন্য চোখে ধপ করে বসে পড়লেন সোফায়। মঞ্জুর সিদ্দিকী সাহেবের কাঁধে হাত রাখলেন। বিমর্ষ মুখে বললেন,

“এভাবে না বললেও পারতেন দুলাভাই। আপনি তো জানেনই হিমান্তের রাগ। তাকে এখন পায়ে ধরেও এ’বাড়ি রাখা যাবে না। এমন কথা কেন বললেন আপনি? সন্তান হয় ও আপনার। ওর দূর্বল জায়গায়, কষ্টের জায়গায় আঘাত দিয়ে ঠিক করেন নি দুলাভাই। ও ঠিকই চলে যাবে দেখবেন। যদি পারেন আটকান। এখনও সময় আছে।”

“চলে যাক সে। তার মতো সন্তানের কোনো প্রয়োজন নেই আমার। অপমান আর লজ্জা ছাড়া কি দিয়েছে সে আমাকে? কেউ আটকাবে না তাকে। চলে যাক সে চলে যাক। এই বাপ ছাড়া দুনিয়া কতো কঠিন বাইরে দুইদিন থেকে বুঝে আসুক।”

মঞ্জুরের হাতটা কাঁধ থেকে ঝটকা মেরে সরিয়ে দূর্বল পায়ে উপরে উঠে যান সিদ্দিকী সাহেব। ছেলেকে ওসব বলে শান্তি পাচ্ছেন না তিনি। বুকের ভেতর অসহনীয় ব্যথা অনুভব করছেন। হিমান্তকে কাছে পাবার যে ক্ষীণ আশা ছিল আজ রাগের বশবর্তী হয়ে সেটাও শেষ করে দিলেন তিনি। মাথা ভার হয়ে আসছে। চোখের সম্মুখে ঝাপসা হতে লাগলো সিদ্দিকী সাহেবের।

পর্ব ১০

দেহে গরম অনুভূত হওয়ায় সারা নড়েচড়ে উঠলো। হাত পা ছড়িয়ে শুতে না পারায় বিরক্তির রেশ কপালে তুলে আবার ঘুমে তলিয়ে গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারলো না। অস্বস্তি হচ্ছে এভাবে শুয়ে থাকতে। গরমে গলা, ঘার ভিজে গেছে। গা ভিজলে রাগ ওঠে সারার। গরমকাল তার মোটেও পছন্দ না। সামান্যতে গা ঘামার মতো বিদঘুটে জিনিসটার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। এখন যেমন হচ্ছে।

মুখ, চোখে প্রচন্ড বিরক্তি এনে পিটপিট করে গোল গোল চোখে তাকাল সারা। চোখ খুলতে আবছাভাবে মামার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভর্তি থুতনিটা চোখে পড়লো। ঘুম ঘুম চোখে ভাবতে লাগলো এতোসকালে মামা তার বিছানায় কী করে? এমন তো ঘটে নি আগে কখনও। সারা মামার ঘামে ভেজা বুকের শার্টের উপর থেকে মাথা তোলে। ছোট্ট দু’হাত মুঠোবন্ধি করে চোখ ডলতে ডলতে অস্ফুটে স্বরে প্রশ্ন করে,
“মামা! “
“হুমম।”

হিমান্ত ছোট্ট করে জবাব দিয়ে সারাকে সোজা করে কোলে বসায়। মুখোমুখি বসিয়ে দু’হাতে সারার এলোমেলো চুলগুলো গুছাতে থাকে। সারা গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকায় মামার দিকে। কেমন মলিন আর উদাস লাগছে মামাকে আজ। মুখে কাঠিন্য ভাব নেই। চোখ দুটো ফোলা আর লাল। সারারও এমন হয় যখন সে আকি নানুর বকায় কাঁদে।
“মামা তুমি কেঁদেছ কেন? নানাভাই বকেছে আবার? তোমার বুকে কষ্ট হচ্ছে মামা?”সারার গোলাপী ফর্সা গালটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। মামার বুকে খুব সাবধানে ওর ছোট্ট হাতটা রাখলো। তারপর আবার প্রশ্ন করলো,
“কোথায় ব্যথা করছে মামা? আমাকে বলো আমি ডলে দেই।”

“কোথাও ব্যথা করছে না মা। আমি ঠিক আছি। তুমি ঘুমাবে আরও?”সারা না সূচক মাথা নাড়ায়। হিমান্ত ভাগ্নির কপালে চুমু দিয়ে পাশে বসিয়ে এক চিলতে ম্লান হাসি দিলো। মুখ ঘুরিয়ে নিল দ্রুত। দাঁত কামড়ে চোয়াল শক্ত করলো কষ্ট ঠেলতে। হিমান্তের বুকের বা’পাশে সত্যি ব্যথা করছে। সাথে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সারাকে নিয়ে তো বাড়ি থেকে এক কাপড়ে নেমে এলো। কিন্তু এখন কী হবে? কোথায় যাবে এই বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে?

হিমান্তের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। তবুও সারার সামনে চেহারায় স্বাভাবিকতা ধরে রাখে সে। সারা বিস্ময় চোখে রাস্তার ছুটে চলা গাড়ি গুলোকে দেখছে। সূর্য এখনও উদয় হয় নি। দূরে আজানের পবিত্র ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ওরা দু’জন নির্জন যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে। মামার ও’পাশে সারার টেডি বেয়ার ব্যাগ আর বারবিডলটা। ওটা দেখামাত্রই সারার চেহারা বিবর্ন হয়ে গেল। মামার দিকে মুখ তুলে চাইলো সে।

আস্তে আস্তে বললো,
“আমরা কী বাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছি মামা?”সারার গলার স্বরে বলে দিচ্ছে সে শংঙ্কিত। হিমান্ত কোনো জবাব দিল না। ঝুঁকে হাঁটুতে কনুই ভর করে দু’হাতে মুখ ঢেকে নিল। এই বাচ্চা মেয়েকে কী জবাব দেবে সে? হিমান্তের চোখ ভিজে আসে। সারার মুখের দিকে তাকানোর শক্তি তার নেই। সারা মাত্র ৪বছরের একটা মেয়েশিশু তবুও সে অনেক কিছু বোঝে। কারন মেয়েশিশু মাত্রই দায়িত্বশীল হয়ে জন্মায়।

তাদের না চাইতেও আপনজনের খুশির জন্য সব বুঝতে হয়, মানতে হয়। এটাই নারীধর্ম। মাতৃহীনা মেয়েটি জন্মের পর থেকেই মা,বাবা সব কিছু এই মামাকেই জেনেছে। মামাই তার সব। সে মামার খুব কাছে থেকেছে বিধায় মামার অনেক না বলা কথায় বুঝে নিতে পারে। (আরও একটা কারন আছে যেটা পাঠক পরে জানতে পারবে) এই যেমন এখন বুঝে গেল। তার মামা বিপদে আছে। সারার ছোট্ট হাতের সাপোর্ট দরকার। সারা বেঞ্চিটায় উঠে দাঁড়ালো। মামার দিকে এগিয়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে।

“তাহলে এখন অনেক মজা হবে তাই না মামা? আমরা সারাদিন শুধু ঘুরবো,তুমি আমার পাশে পাশে থাকবে। আকি নানু,পঁচা আঙ্কেল, আন্টিও আমাকে আর ভয় দেখাবে না, বকবে না তাই না মামা? আমি খুব খুশি জানো মামা।” হিমান্তের দুশ্চিন্তায় ভাটা পড়লো সারার কথা শুনে। আশ্চর্য হয়ে ঘুরে তাকালো ওর দিকে। দু’হাতে বন্দী করে বুকে মাঝে লুকিয়ে নিল সারাকে।

ধড়া গলায় বললো,
“কে বলে আমার মা মরে গেছে? তুই তো আমার মা। আমার শক্তি, সাহসের উৎস।”
ভোর ফুরিয়ে সকালের সূর্য উদয় হতেই রায়হান হাজির হলো এমইএস যাত্রী ছাউনির সামনে। রায়হান সালাম দিয়ে বললো,
“ভাইয়া বাসা ভাড়া পেয়ে গেছি। আমাদের বাড়ির চার বাড়ি পরের ফ্লাটটা। চারতলায় দেড় রুমের বাসা।

ভেতরে রান্নাঘর,বাথরুমের ব্যবস্থা আছে। মাসিক ভাড়া সব দিয়ে হয়তো দশ হাজার পড়বে। ঘরের ফার্নিচারের ব্যবস্থাও আমার বন্ধুরা ম্যানেজ করছে। দু’এক ঘন্টার মধ্যে সব রেডি হয়ে যাবে। চলেন এখন যাওয়া যাক।” কথাগুনো এক নিঃশ্বাসে বলে থামলো রায়হান। কোমরে হাত রেখে নুয়ে শ্বাস ফেলছে সে। গত ৩/৪ ঘন্টার মধ্যে তার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে সেটা তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। হিমান্ত উঠে দাড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রায়হানকে।

“তোকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা আমার নেই রায়হান, তবে ভাই হিসেবে তুই বেস্ট।”
“ভাই! এভাবে বললে কিন্তু পর পর লাগে। তুমি আমার আপন চাচাতো ভাই না? বাবা চাচায় যা হোক আমরা তো ভাই ভাই। তুমি আমার জন্য কী সেটা আমি বোঝাতে পারবো না। আর হ্যাঁ শেষ কথাটা কিন্তু তুমি কপি করছ? ওটা আমার ডায়লগ। এবং তোমার জন্য বরাদ্দ ঐ লাইনটা কারন ভাই হিসেবে তুমিই বেস্ট।” রায়হান হিমান্তের সামনে দাঁড়িয়ে গাল ফুলিয়ে বলে। হিমান্ত ছোটো করে হাসি দিয়ে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে কাঁধে হাত রাখে।

“ভাই স্টাইল নষ্ট করে দিলা তো? এই সারা বল তো এখন কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?”এলোমেলো চুলগুলো সহ ঝুঁকে দাঁড়ায় সারার দিকে। সারা ভাবনার ভঙ্গি ধরে, তারপর বলে
“লাল বান্দরের মতো। হি! হি! হি!”খিলখিল করে হেসে জিহ্বা দেখিয়ে ছুটে মামার পেছনে লুকিয়ে পড়ে।

“দেখলে ভাইয়া!”রায়হান ঠোঁট উল্টে হিমান্তের দিকে মুখ গোমড়া করে তাকায়। হিমান্ত সারার দিকে চোখ বড় করে রায়হানের মাথা ধরে কাছে আনে। নিজ হাতে ওর চুল ঠিক করে বলে,
“অনেক দুষ্টুমি করেছিস এবার চল! আচ্ছা ঘড়ি কি বিক্রি করেছিস?”

“ভাইয়া তোমার ঘড়ি তো ইম্পর্টেড। লাক্সারি ব্রান্ডের। সেকেন্ড হ্যান্ড হিসেবে বেঁচতে গেলেও তো কমপক্ষে চার লাখ টাকা নেব। ওমন কাস্টমার বাংলাদেশে এভেইলেবেল না। তবুও আমার এক বন্ধুকে বলেছি সে তার এক আঙ্কেলকে রাজি করিয়েছে। তিনি নাকি তিনের বেশি দিতেই পারবেন না।”
“ইটস ওকে। ওতেই হবে। বেঁচে দে। টাকাগুলো আমার ইমিডিয়েটলি দরকার।”

“আচ্ছা! “
রায়হান একটা সিএনজি থামায়। তিনজনে সিএনজিতে উঠে বসে। হিমান্ত বহুদিন পর সিএনজিতে উঠলো। সারা এই প্রথম। সারার একদম ভালো লাগছে না তবুও সে ভালো লাগার ভান করছে মামার খুশির জন্য। এতো কম বয়সী একটা মেয়েশিশুর মধ্যে এই গুনটি কি করে এলো তা ব্যাখ্যা করা মুশকিল। তবে পরিস্থিতি মানুষের মানসিকতা দ্রুত পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। সারার বেলায়ও হয়তো তেমন হয়েছে।

সে অন্য বাচ্চা শিশুর মতো অযথা জেদ করছে না, ভয় পেলেও প্রকাশ করছে না। হিমান্তের দৃষ্টি এড়ায় নি অবশ্য বিষয়টা। সে মাঝে মাঝে ভাগ্নির মলিন মুখটা দেখছে। হিমান্ত ইচ্ছা করলে সারাকে রেখে আসতে পারতো কিন্তু সেটা অনুচিত এবং ভুল কাজ হতো। ও বাড়ির লোক একটাও সুবিধার নয়। হিমান্তকে তার বাবার সম্পদ থেকে বেদখল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা ওরা করেছে। আজ তাতে সফলও হয়েছে তারা। সিদ্দিকী সাহেব সারাকে ততোটা পছন্দ করেন না। মেয়ের মৃত্যু জন্য দায়ী করেন নাতনিকে। দেখলেই ধমক দিয়ে ওঠেন।

সারা হিমান্তের অনুপস্থিতিতে একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকে সর্বক্ষণ ও বাড়িতে। হিমান্তের পরের টার্গেট সারায় আকলিমা মামির চোখে। সারাকে এটা সেটা করে ঠিক ক্ষতি করতো আকলিমা মামি। হিমান্তের দৃঢ় বিশ্বাস এটা। আকলিমা মহিলাটা রহস্যময়ী। উপরে যতোটা মমতা দেখান ভেতরটায় তার চেয়ে হাজারগুন কপটতা ধারণ করেন। মুনাফিকের সবকটা লক্ষণ আকলিমার মধ্যে আছে। শুধু কী আকলিমা! তার ভাতিজা যে কিনা এখন জামাতা হয়েছে তার ভেতরও আছে। তার ছেলে মেয়ে দুটো আগে ভালো ছিল।

হিমান্তকে সমীহ করতো। এখন করে না। কেন করে না হিমান্ত জানে তবে সে এ’কথা কাওকে বলতে পারে না। অনেক চেষ্টা করেছিল রাহাতকে বলবে। কিন্তু পারে নি। মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হয়। বমি উগলে আসে। মাথায় তখন আর সেসব কথার রেশটুকুও থাকে না। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্ট এড়াতে সে আর কাওকে বলে না ওসব। সিএনজি এসে থামলো ভাড়া নেওয়া ফ্লাটটার অদূরে। বড় গলি পেরুলেই পাঁচ তলার ফ্লাটটা।

আশেপাশে আরও ফ্লাট আছে। এই ফ্লাটের সামনে একটা প্রকান্ড আম গাছ দাঁড়ানো। হিমান্ত এক নজর চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। উন্নত আবাসিক এলাকা। গেট পেরিয়ে রায়হান ওদের নিয়ে বাড়িওয়ালার বাসায় ঢুকলো। বাড়িওয়ালা বেশ অমায়িক লোক। জিনিসপত্র না আসা পর্যন্ত হিমান্তকে তার বাসায় থাকার জন্য অনুরোধ করলো।

আহানা সকাল থেকেই লক্ষ্য করছে আলভী গম্ভীর হয়ে আছে। কোনো কথার সঠিক জবাব সে দিচ্ছে না। যেন একপ্রকার এড়িয়ে চলতে চাইছে সে। মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে রুমে আসলো আহানা। আলভী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধার চেষ্টা করছে কিন্তু বার বারই ব্যর্থ হচ্ছে সে। আহানা মুচকি হেঁসে আলভীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সহসায় আলভীর মুখটা কালো হয়ে গেল। চোখ সরিয়ে নিল আহানার উপর থেকে। আহানা বিষয়টা বুঝেও না বোঝার ভান করে। নিজ হাতে আলভীর টাই বাঁধায় মনোযোগ দিল আহানা।

“কী হয়েছে আলভী? ঠিক করে কথা বলছ না আমার সাথে তুমি।”
“কিছু না। হয়ে গেছে আমি চলি।” আহানা পথ আগলে দাঁড়ালো। বিমর্ষ মুখে বললো,
“এমন কেন করছ তুমি? কি করেছি বলো?”

“তুমি সব জানো। তবুও কেন বার বার জিজ্ঞেস করো? আলভী হঠাৎ বাজ পড়ার মতো গর্জে উঠলো।
“না জানি না আমি। তুমি বলো। তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই আমি।” আলভী ক্ষিপ্ত মেজাজে আহানার বাহুজোড়া চেঁপে ধরলো। বললো,
“কী শুনতে চাও হ্যাঁ! আমার আর হিমান্তের বন্ধুত্ব নষ্ট করেছ সেটা শুনতে চাচ্ছো? নাকি বন্ধু হয়ে বন্ধুর বউয়ের সাথে পরকিয়া করেছি সেটা শুনতে চাচ্ছো? বলো কী শুনতে চাচ্ছো তুমি?

“আলভী!”আহানা অবাক চোখে অশ্রুফেলে। আলভী আহানার বাহু ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। নিজের চুল মুঠ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“পাঁচ টা বছর আহানা! পাঁচ টা বছর। আমি এখনও হিমান্তের চোখে চোখ রাখতে পারি না। ওর সামনে দাঁড়াতে লজ্জা করে আমার। নিজের উপর ঘৃণা হয় যখন হিমান্তকে নেশায় বুঁদ হতে দেখি। আমাদের হিমান্ত কী এমন ছিল বলো? তোমার আমার জন্য আজ ওর এই অবস্থা। কেন এমন করলে তুমি আমার আর হিমান্তের সাথে?”

আলভী চিৎকার করে চোয়াল চেঁপে ধরে আহানার। আলভীর চক্ষু রক্তবর্ণ। আহানা ব্যথায় গোঙাতে থাকে। সহ্য করতে না পেরে আলভীকে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে ওঠে,
“তো কী করতাম তুমিই বলো? আমি মা হতে চেয়েছি। বিয়ের তিন বছরেও যখন আমার সন্তান হলো না সবাই আমাকে বন্ধ্যা, বাঞ্জ আরও কতো কী বললো! তুমি তো শোনো নি তাই বুঝবেও না আমার কষ্ট।

কতো ডাক্তার দেখালাম, টেস্ট করালাম। সবাই বললো সমস্যা আমার নয়। হিমান্তের রিপোর্টও পজেটিভ তবে কিছু ডাক্তার বললো সমস্যা যদি থাকে তবে হিমান্তের ভেতর। আমি তবুও হিমান্তকে ছাড়তে চাইনি। আমি শুধু মা হতে চেয়েছি। হিমান্তকে আমি কতোটা ভালোবাসি তা শুধু আমিই জানি আলভী। কিন্তু কী করবো বলো? একজন স্ত্রী হেরে গেল একজন মায়ের কাছে।”

“হেরে গেল? ভুল বললে আহানা ঐ স্ত্রী নিজেই নিজের লোভে হেরেছে। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য কাপল পাবা যাদের সন্তান হয় না। তাই বলে তারা কী ভালোবাসার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তোমার মতো? না। তুমি কোনোদিনই হিমান্তকে ভালোবাসো নি। আহানা নিজেকে ছাড়া কাওকে ভালোবাসতে শেখেই নি। স্বার্থপর তুমি আহানা। প্রচন্ড স্বার্থপর। মাঝে মাঝে তোমাকে দেখলে আমার ঘৃণা হয়।” আলভী ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বিছানার উপর আহানাকে। আহানা নত মুখে বিছানায় বসে কাঁদছে। সে জানে হিমান্তের সাথে সে ধোঁকাবাজি করেছে।

একারনে আলভীও তাকে বিশ্বাস করে না। আজ সেটা মুখেও প্রকাশ করলো আলভী। ভালোই করেছে আহানা এটারই যোগ্য। আহানা উপুড় হয়ে চাদর খামচে কাঁদে। আলভী স্থির কঠিন মুখে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে দ্রুত চলে গেল ঘর ছেড়ে। আহানার কান্নার শব্দ সাথে সাথে বেড়ে গেল।

দুপুরের পরপরই মনিরা পংক্তির খোঁজ নিতে রাহাতের বাড়িতে আসে। একজন কাজের লোক পংক্তি যে রুমে থাকে সেখানে নিয়ে গেল মনিরাকে। গিয়ে দেখলো পংক্তি বিবর্ণ মুখে বিধ্বস্ত চেহারায় বসে আছে। মনিরাকে দেখামাত্রই শুকনো হাসি দিল। মনিরা পংক্তির মাথাটা কাঁধে রাখলো। জিজ্ঞেস করলো খাওয়া দাওয়া করেছে কিনা। পংক্তি হু বলে জবাব দিল।

“পংক্তি! “
“হু!”
“তোকে আজ আমি এমন কিছু কথা বলবো যা কাওকে বলিনি। শুনবি?”মনিরার বিষন্ন গলার স্বরে পংক্তি ব্যথা খুঁজে পেলো। সে থমথমে মুখে মাথা নাড়াল।
“হ্যাঁ শুনবো।”

মনিরা নিজের বিভৎস অতীত বলতে লাগলো একে একে। ( মনিরার অতীত পরে জানানো হবে)। সব শুনে পংক্তির মনে হলো মনিরা তার চেয়েও বড় হতভাগী। পংক্তির চেয়ে হাজারগুন কষ্ট বেশি তার। মনিরার কষ্টের কাছে নিজের কষ্ট নগন্য মনে হলো। অশ্রুসজল চোখে মনিরাকে জড়িয়ে ধরলো পংক্তি। মনিরা কাঁদলো না তার মুখটা শক্ত হয়ে আছে। বেশকিছু সময় পর হেঁসে পংক্তিকে সাহসী হওয়ার পরামর্শ দিল।

নিষেধ করলো এভাবে ভেঙে না পড়তে। বিকেল পর্যন্ত সে পংক্তির সাথে ছিল। যাওয়ার সময় বলে গেছে কাল আসতে পারবে না পরশু কিংবা তারপরের দিন সে আসবে। দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করলো কারন অতিদ্রুতই পংক্তির থাকার ব্যবস্থা সে করে ফেলবে। মনিরাকে যেতে দেখে এ বাড়ির ড্রাইভার কিছু ভাবতে থাকলো। তখনই তার মনে পড়লো মনিরাকে সে তার বন্ধু সুমনের সাথে দেখেছে। সুমন তাকে মনিরা সম্পর্কে নানা বাজে কথা বলেছে। ড্রাইভার মনিরার যাওয়ার পথে তাকিয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে,
“এই ছেমরি এইখানে কী করে?”

“কেন চেনো নি তারে? ওর এক বান্ধবী রাহাত স্যারের অতিথি। কাল রাতে আইছে। মজার ব্যাপার কী জানো? মাইয়্যা ডা বিয়ার সাজে ছিল। খুব কানতাছিল। এইহানে থাকতেই চাইছিল না।” দারোয়ানের ঠোঁটে আপত্তিকর হাসি। ড্রাইভারও হাসে। ড্রাইভার দারোয়ানকে জানায় যেই মেয়ে এইমাত্র গেল সে মেয়ে খারাপ চরিত্রের। আরোও নানা খারাপ কথা বলে মনিরা সম্পর্কে ড্রাইভার।

ক্রমেই তারা মনিরা,পংক্তি এবং রাহাতকে নিয়ে অশ্লীল রসীকতায় মেতে ওঠে। ঘটনাচক্রে ঠিক সেইসময় ব্যালকনিতে দাঁড়ানো রাহাতের স্ত্রী অর্নি সেসব শুনে ফেলে। অর্নি রাহাতের ব্যাপারে মারাত্মক পোজেসিভ। রাহাত যে এমন একটা কাজ করেছে একটিবারও তাকে জানায় নি।

অর্নির ভেতর সন্দেহের বীজ দানাবাঁধে। ওর বার বারই মনে হচ্ছে রাহাত তাকে ধোঁকা দিচ্ছে না তো? নানা অশুভ চিন্তা এসে ভর করলো অর্নির ভেতরে। কিছুতেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না সে। রাগে ক্ষোভে শরীর জ্বলছে অর্নির।

পর্ব ১১

চারদিনের মাথায় পংক্তির জায়গা গেষ্টরুম থেকে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে হয়েছে। তাতে পংক্তির আক্ষেপ নেই তবে কষ্ট এতোটুকুই অর্নি ম্যাডাম তাকে দু’চোখে সহ্য করতে পারে না। কেন পারে না সেটা পংক্তি বোঝে। এই উপলব্ধিটাই তাকে লজ্জা দেয়। অর্নি বলামাত্রই পংক্তি তার সকল কাজ করে দেয় তবুও সে পংক্তির ভুল ধরবেই। আজও অপমান করেছে চায়ে চিনি বেশি হয়েছে এই দোষ ধরে। পংক্তি জানে সে বেশি দেয়নি।

এ বাসার সবাই সেটা জানে তবুও তারা কিছুই বলবে না। এমপির মেয়ে বলে অর্নিকে সবাই ভয় পায়। রাহাতের বাবা মাও কিছু বলার সাহস পায় না। পংক্তির জন্য দিনের পর দিন রাহাতকে কটুকথা শুনতে হচ্ছে। যা পংক্তির কাছে কষ্টের। নিজের সুখের জন্য অন্যকে যন্ত্রণা পংক্তি দিতে চায় না। পংক্তি চলে যেতে চেয়েছে রাহাত স্যার যেতে দেয় নি। তিনি পংক্তিকে বলেছেন হিমান্ত স্যার না বলা অব্দি পংক্তিকে এক পাও কোথাও যেতে দেবেন না তিনি।

হিমান্তের সাথে সিদ্দিকী সাহেবের পিএ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। শেষে বিরক্ত হয়ে হিমান্ত তাকে মোবাইলে সাফ জানিয়েছে ফারদার তাকে যেন ডিস্টার্ব না করা হয়। হিমান্ত মরে যাবে তবুও সে ও’বাড়ি আর পা দেবে না। ছেলের এমন কথা শুনে সিদ্দিকী সাহেব গো ধরে বসে গেছেন, তিনিও আর যোগাযোগ করবেন না। বাপ বেটা দীর্ঘদিনের রাগ,অভিমান বুকে পুষে আলাদা হয়ে গেল। এখন তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

বাপ বেটার এই মুখ দেখাদেখি বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে আকলিমা। সেটা সিদ্দিকী সাহেবের ধারণার বাইরে। সিদ্দিকী সাহেবের ধারণা আকলিমার মতো সহজ,সরল, পরহেজগার রমনী দু’টো হয় না। বিপত্নীক সিদ্দিকী সাহেবকে ভাতৃসম্মানে আগলে রেখেছে এতোটাকাল সে। সিদ্দিকী সাহেব কৃতজ্ঞ আকলিমার কাছে। তার সন্তানদের ছোট থেকে বড় করেছে আকলিমা অথচ হিমান্ত মামিকে দু’চক্ষে সহ্য করতে পারে না। হিমান্তের এই আচরণ গুলোই সিদ্দিকী সাহেবের মেজাজ বিগড়াতে যথেষ্ট।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে চাকরী বাজার মোটেও সুলভ নয়। সেখানে শেকড় ছাড়া হিমান্তের অবস্থা আরও করুন হতে পারতো, কিন্তু আল্লাহর কৃপায় তেমনটা হলো না। এক বন্ধুর সহযোগিতায় হিমান্ত একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী লেকচারার পদে চাকরী পেল। নেক্সট মান্থ থেকে হিমান্তের জয়েন। বেতন যা পাবে হিমান্তের আপাতত চলে যাবে। তবে এ’কদিন তাকে পক্সি ক্লাস করাতে হবে। এখানে থেকেই ধীরে ধীরে সে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে জব খুঁজবে। যেখানে স্থায়ী হওয়া যায়৷ এজন্য অবশ্য সময় লাগবে।

আর ততোদিন এই জবটাই তার সম্বল। এই হঠাৎ মধ্যবিত্ত লাইফ লিডিংএ অনেকদিক থেকেই সমস্যা হচ্ছে হিমান্তের। যেহেতু সে একজন এডিক্টেড পার্সোন সেহেতু মদ সময় মতো পেটে না গেলে হাইপার হয়ে ওঠে শরীর। এদিকে জব আওয়ারে সারাকে রেখে যেতে হয় রায়হানদের বাসায়। রায়হানের ভাতিজাটা বড্ড দুষ্টু। সারাকে দু’দিন খামচি দিয়েছে। বেচারি ভয় পেয়েছে খুব। সারার জন্য বাসায় গভর্নেসের ব্যবস্থা করাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রায়হানকে অবশ্য বলা হয়েছে। রায়হান খোঁজ নিচ্ছে। হিমান্তের শরীর ভালো যাচ্ছে না এসব কারনে। অতিরিক্ত স্ট্রেস নেওয়ায় মাথা ব্যথা বাড়ে। স্ট্রেস কমাতে এবং নেশার উদ্রেক হতেই হিমান্ত মদ পান করতে বাধ্য হয়। রাতে নেশা করে পড়ে থাকায় সারার সমস্যা হয়। সে রাতে বাথরুম করতে উঠতে ভয় পায় একা একা। হিমান্ত তখন নেশায় বেহুশ পড়ে থাকে বিছানায়।

হিমান্তকে জাগাতে না পেরে ভয় পেয়ে মাঝরাতে কাঁদে মেয়েটা মামা! মামা করে। ইউরিন আটকে রাখতে না পেরে বিছানা নষ্ট করে ফেলে সারা। সকালে উঠে হিমান্তকে সেসব পরিষ্কার করতে হয়। এসব কিছুর খারাপ প্রভাব পড়ছে মেয়েটার উপর। কেমন নেতিয়ে গেছে এ ক’দিনেই সারা। হিমান্ত ভেবে পাচ্ছে না এই মুহূর্তে কী করা উচিত? নিজের আত্মসম্মান ছোট করে সারার জন্য ও বাড়ি ফিরে যাবে? নাকি এখানেই থেকে যাবে?

দ্বিধান্বিত হিমান্ত। অফিস শেষ করে রায়হানকে কল করে। রায়হান সারাকে নিচে নিয়ে আসে। গভর্নেসের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই রায়হান জানায় সে খোঁজ নিচ্ছে। রায়হানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফেরে হিমান্ত, সারা।

বাসায় প্রবেশ করতেই সারা মামাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদে। ভয়ে মুখ লাল হয়ে আছে ওর। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,
“মামা! ঐ বাসায় আমি আর যাবো না। আরহাম শুধু মারে আমাকে। আজ আমার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। গলায় খামচি মেরেছে। আমার ভয় করে। তুমি আমাকে সাথে করে নিও যেও মামা।”

হিমান্তের খারাপ লাগে। সারাকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। সারার চোখ মুছে বুকে জড়িয়ে নেয়। সারার চোখের জল হৃদয়বিদীর্ণ করছে হিমান্তের। কী করবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎই পংক্তির কথা স্মরণে আসে। সে মেয়েটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। অসহায় মেয়েটার একটা খোঁজও নেয় নি ভেবে নিজেকে ধিক্কার দেয়। দ্রুত মোবাইলটা বের করে মনিরাকে কল করে। মনিরার মোবাইল বন্ধ। হিমান্ত হতাশ হয়। পরক্ষনেই রাহাতের কথা মনে পড়ে।

সঙ্গে সঙ্গে কল করে বন্ধুকে। রাহাত তাকে জানায় পংক্তি এখনও ওর বাসায় আছে তবে! হিমান্তের কপাল কুঞ্চিত হয় রাহাতের তবে শব্দটা শুনে। সে রাহাতকে জোর করে সবটা বলার জন্য। রাহাত হিমান্তকে জানায় অর্নি পংক্তি এবং রাহাতকে নিয়ে সন্দেহ করে। এ কারনেই পংক্তির উপর নানা টর্চার করছে। বেচারী চুপচাপ সব সহ্য করছে। চলে যেতে চেয়েছিল রাহাত যেতে দেয় নি। হিমান্তের মন খারাপ হয় মেয়েটার কথাগুলো শুনে।

অপরাধবোধ জাগে নিজের ভেতর। সে তখনই সারাকে কোলে নিয়ে রাহাতের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তার মাথায় তখন একটা ভাবনায় কাজ করছে সারার জন্য মেয়েটাকে তার প্রয়োজন। আর মেয়েটার একটা নিরাপদ আশ্রয় প্রয়োজন যেটা হিমান্ত তাকে দেবে। হিমান্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়৷ সারার কপালে চুমু দিয়ে মুচকি হাসে।

সারার মন খারাপ তাই সে চুপচাপ মামার কোলে বসে আছে। মন ভালো থাকলে জিজ্ঞেস করতো মামা কোথাই যাচ্ছি,কেন যাচ্ছি? কিন্তু এখন সেসব প্রশ্ন করছে না। হিমান্ত ভাগ্নির মলিন মুখটা দেখে বিমর্ষ হয়। সদ্য ফোটা হাসিটুকু ম্লান হয়ে গেল। তবে মনে মনে একটু আশা রাখে খুব শীঘ্রই সারা আবার হাসবে। হিমান্ত ভাগ্নির সকল কষ্ট দূর করে হাসি এনে দেবে।

পংক্তিকে নিতে হিমান্ত রাহাতের বাসায় আসে। সে বাইরে থেকে নিয়ে যেতে পারতো তবে অর্নির ভুল ভাঙানোটা জরুরী। পংক্তির তৈরি হয়ে আসার অপেক্ষা করছে হিমান্ত, সারা। রাহাত গেছে পংক্তিকে সে’কথা জানাতে। অর্নি বাইরে থেকে বাসায় ফিরে হিমান্তকে বসার ঘরে দেখে সে’কি আনন্দিত। চোখে মুখে খুশির উচ্ছাস নিয়ে হিমান্তের সামনে গিয়ে বসে,
“আসসালামু ওয়ালাইকুম হিমান্ত ভাইয়া। কেমন আছেন ভাইয়া?

সারা বেবি কেমন আছ?
সারা জবাব দেয় না। মুখ নামিয়ে মামার বুক জড়িয়ে বসে থাকে। হিমান্ত এক চিলতে হাসি দিয়ে জবাব দেয়
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“জ্বী ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ। কোনো কাজে এসেছেন ভাইয়া? না মানে আসেন না তো এখন তাই বললাম আরকি?”

“ইটস ওকে। এতো ফর্মাল হচ্ছো কেন অর্নি। আমাদের সম্পর্ক কী ফর্মাল?”
“না মানে।”
“আচ্ছা ইতস্তত করার প্রয়োজন নাই। বি ইজি।”

অর্নি, হিমান্তের কথা বলার মাঝে পংক্তি ব্যাগ নিয়ে উপস্থিত হয়। হিমান্ত ওকে দেখে দাঁড়িয়ে যায় সারাকে কোলে নিয়ে। সারার ঘুমঘুম লাগছে। মামার গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখে। হিমান্ত পংক্তির নত মুখটা এক নজর দেখলো। মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না ওড়নার ঘোমটার কারনে। হিমান্ত অর্নির বিস্মিত চেহারা লক্ষ্য করে বললো,
“রাহাতের সাথে ঝামেলা করো না আর। ওকে আমিই রেখে গিয়েছিলাম।

মেয়েটা অসহায় থাকার জায়গা ছিল না এজন্য কিছুদিনের জন্য এখানে রেখে গিয়েছিলাম। তবে আজ থেকে তার থাকার জায়গা হয়েছে। সেখানেই থাকবে এখন থেকে ও। চলি?”অর্নির চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। লজ্জিত হয়েছে সে হিমান্তের কথা শুনে। সৌজন্যে দেখানোর জন্য জোর করে হাসলো। হিমান্ত অর্নিকে গুড উইশ দিয়ে, পংক্তিকে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে আসতে বললো। রাহাতের সাথে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল হিমান্ত।

ততক্ষণে সারা মামার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। পংক্তি একে একে সবার কাছে থেকে বিদায় নিলো। রাহাতের মা পংক্তিকে দোয়া করে দিল। মেয়েটাকে তার মনে ধরেছিল খুব। মেয়েটার চলে যাওয়ায় খারাপ লাগছে তার।

পংক্তি রাহাতের বাবা, মাকে সালাম করে অর্নি সামনে এসে বললো,
“আমার কারনে আপনি কষ্ট পেয়েছেন তার জন্য ক্ষমা করে দেবেন আমাকে। রাহাত স্যারের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি ভালো মানুষ। আমি জীবনে অনেক পুরুষ দেখেছি রাহাত স্যার তাদের চেয়ে অনেক ভালো। আমাকে ছোট বোন বলেছেন তিনি। আমি তার উপকার কোনোদিন ভুলবো না। আপনিও ভালো। আপনার উপর কোনো রাগ নেই আমার। চলি ম্যাডাম।”

অর্নির মুখটা সোজা রইলো তবে থমথমে। পংক্তি যাওয়া মাত্রই তার চোখে জল এলো। নিজের ভুলগুলো উপলব্ধি করলো অর্নি। সিএনজি ভাড়া করে হিমান্ত সোজা বাসায় চলে এলো পংক্তিকে নিয়ে। পথে সে পংক্তিকে নিজের অবস্থার কথা সব খুলে বলেছে। পংক্তির আপত্তি আছে কিনা এখানে থাকতে জিজ্ঞেস করলে পংক্তি মাথা নাড়িয়ে না বলে। হিমান্ত খুশি হয় পংক্তির জবাব শুনে। সে রাহাতের কাছে মেয়েটা সম্পর্ক অনেক কথায় শুনেছে।

সব শুনে পংক্তিকে সারার জন্য উপযুক্ত গভর্নেস,ন্যানি মনে করে সে। তবে সমস্যা হচ্ছে বেড একটা। রুম অবশ্য দুটো। এই মুহূর্তে আরেকটা বেড জোগার করা মুশকিল। তাছাড়া হিমান্তের মদ্যপানের সময়ও হয়ে গেছে। কী করবে ভাবছিল। সারাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পংক্তিকে ডাক দিল। পংক্তি এসে নত মুখে দাঁড়াল একপাশে।

হিমান্ত বললো,
“তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। আমি জানি না কথাটা শুনে তোমার সিদ্ধান্ত কী হবে? তবুও বলতে হবে। কারন আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে। শোনো আমি একজন মদ্যপায়ী ব্যক্তি। মদ ছাড়া একটা দিনও আমার চলে না। ইদানিং সারার জন্য দিনে না পান করলেও রাতে পান করতেই হয়। নয়তো শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ভয় নেই নেশা করে আমি এ’রুমে আসবো না। ও’রুমেই দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকবো।

তুমি এ’রুমে সারার সাথে থেকো। ওর রাতে বাথরুমের চাপ আসে। আমাকে না দেখে ভয় পেলে তুমি একটু সামলে নিও। পারবে না?”

পংক্তি মাথা নাড়ায় সে পারবে। হিমান্ত সারার কপালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উঠে পাশের রুমে আসে। রুমটায় বিছানোর মতো কিছুই নেই। জানালা খুলতেই হু হু করে বাতাস এসে ঢোকে। অল্প আলো এসে পড়েছে রুমটায়। রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের সামনে আসতেই মনে পড়ে রাতে কেউ খায় নি ওরা। হিমান্ত আবার সারা, পংক্তির রুমে আসে। পংক্তি তখন সারার পাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে নত মুখে।

হিমান্ত একপলক ওকে দেখে ওয়াশরুমে গিয়ে কাপড় পাল্টে বের হয়। কালো শটস আর এ্যাশ কালার টিশার্ট পড়েছে হিমান্ত। সারার মাথায় হাত বুলিয়ে পংক্তিকে বলে,
“তুমি কী কথা বলতে পারো? কথা বলতে পারলে তোমার নামটা বলো? বেনামে ডাকাটা অস্বস্তিকর।”
“পংক্তি! “আস্তে করে জবাব দেয় পংক্তি। হিমান্ত মুচকি হাসে।

“পংক্তি নাইচ নেইম। তোমার কী খিদে পেয়েছে পংক্তি? খিদে পেলে একটু কষ্ট করে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে, গরম করে খেয়ে নিও।”
হিমান্ত উঠে দরজার কাছে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায়। বলে,
“আমাকে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই পংক্তি। আমি বাঘও না ভাল্লুক ও না। নিশ্চিন্তে থাকতে পারো তোমার ক্ষতি করবো না আমি। গুড নাইট।”

হিমান্ত পাশের রুমের দরজা বন্ধ করে ময়লা ফ্লোরের উপর বসে। পরিস্থিতি তাকে মখমলের গালিচা থেকে ময়লা ফ্লোরে নামিয়ে এনেছে। তবুও এটা সম্মানের,শান্তির। হিমান্তের নেশার উদ্রেক হয়েছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে মদ পান করতে না পেরে। দ্রুত ছিপি খুলে গলায় ঢালে মদ। একসময় নেশায় বুঁদ হয়ে বিড়বিড় করতে করতে ফ্লোরে বেহুশ হয়ে পড়ে হিমান্ত।

টিকটিক ঘড়ির কাঁটা চলছে। রাত পৌনে তিনটে। পংক্তির ঘুম আসছে না। খারাপ লাগছে। হিমান্ত স্যার তাকে বলেছে ব্যক্তিগত ঝামেলার কারনে পরিবার ছাড়া আলাদা থাকছে সে। কিন্তু পংক্তির ধারণা পংক্তির কারনেই হিমান্ত স্যারের এই অবস্থা। সেদিন পংক্তির বিয়ে না আটকালে আজ হয়তো স্যারের সাথে এমন হতো না।

আর এই বাচ্চা মেয়েটাকেও কষ্ট করতে হতো না। সব দোষ পংক্তি নিজের উপর নেয়। নিজেকে অভিশপ্ত মনে করে। সেই যে গেল তারপর থেকে মনিরারও কোনো খোঁজ নাই। পংক্তির চিন্তা হয় মনিরার জন্য। পংক্তি সবার দুর্দশার জন্য নিজেকে দায়ী করে নিরবে কাঁদে। পংক্তির কান্না থামে সারার কথা শুনে।

“মামা ওয়াশরুমে যাবো। ও মামা!”পংক্তি লক্ষ্য করে সারা কথাগুলো চোখ বন্ধ করেই বলছে। পংক্তি চোখ মুছে হাসার চেষ্টা করে। সারার মাথায় হাত রেখে বলে,
“চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।” পংক্তির গলা শুনে সারা চমকে চোখ খোলে। পংক্তি লাইট অন করে এসে সারাকে বসিয়ে কোলের মধ্যে নেয়। সারার অনেকক্ষণ কপাল কুঞ্চিত করে তাকিয়ে হঠাৎ হেঁসে দেয়। বলে,
“আমি তোমাকে চিনেছি। তুমি পংক্তি আন্টি। আজ থেকে আমাদের সাথে থাকবে তাই না?”
“হুমম। কী করে চিনলে?”পংক্তি হেসে জবাব দেয়।

“মামা রাহাত মামার সাথে যখন মোবাইলে কথা বলছিল আমি সব শুনেছি।” কথাটা শেষ করেই সারার হাসি নিভে যায়। পেট চেঁপে চোখ মুখ খিচে বলে,
“ওয়াশরুমে নিয়ে চলো আন্টি।” পংক্তি দ্রুত সারাকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দু’জনে বিছানায় বসে। সারা তখনও পংক্তির কোলে বসে আছে। পংক্তি সারার চুলগুলো বিলি কাটতে কাটতে বলে,
“ভয় করছে তোমার সারা?”

“না! তবে খিদে পেয়েছে। আমি খেতে চাইলে তুমি কী রাগ করবে আন্টি?”
“না তো! তোমার যখন যা ইচ্ছা হবে আমাকে বলবে। বলবে তো?”
“যদি তুমি না মারো তাহলে বলবো।”

“এতো মিষ্টি একটা পরিকে কী কেউ মারে? আমি তো তোমাকে অনেক আদর করবো। এতো এতো এত্তো!”পংক্তির কথা শুনে সারা হেঁসে দেয়। পংক্তিও হাসে। বাচ্চা মেয়েটার ভেতর থেকে ভয়টা কাটাতে পেরে পংক্তির ভালো লাগে। সারাকে বসিয়ে ফ্রিজে রাখা বিরিয়ানীর প্যাকেট বের করে। সেটা গরম করে সারাকে নিজ হাতে খাওয়াতে থাকে। সারা দু’গাল খেয়ে আর খেতে চায় না।

পংক্তি অনেক বুঝালে সারা মুখ গোমড়া করে বলে,
“প্রতিদিন এগুলা খেতে ভালো লাগে না আন্টি। অন্যকিছু খাবো। ফ্রাইড রাইস আর চিকেন।” সারার মলিন মুখ সহসাই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পংক্তি সারার গালে চুমু দিয়ে বলে,
“আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি বসো আমি ঝটপট রান্না করে আনছি।”

পংক্তি ফ্রিজ খুলে চিকেন,সবজি বের করে। দ্রুত হাতে ফ্রাইড রাইস আর চিকেন বানানোতে লেগে যায়। সারা বারবিডল বুকে জড়িয়ে বিছানা ছেড়ে রান্নাঘরে এসে পংক্তির ওড়না ধরে দাঁড়ায়। পংক্তি হাসতেই সারাও হাসে। পংক্তি হাত ধুয়ে ক্লিপ দিয়ে সারার চুলগুলো বেঁধে পাশের চেয়াটায় বসায়। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে পংক্তি এটা সেটা বলে সারাকে হাসাতে থাকে। রান্না শেষ করতে করতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে ওর। সারার চোখ তখন ঘুমঘুম।

সারাকে কোলে বসিয়ে সারা যতোটুকু খেতে পারে খাওয়ায়। সারা ঘুমিয়ে যায় পংক্তির কোলে। ঘুমন্ত সারাকে বিছানায় শুইয়ে পংক্তি রান্নাঘর পরিষ্কার করে। বাথরুমে হিমান্তের পড়ে থাকা কাপড় ধুয়ে ব্যালকনিতে শুকাতে দেয়। এতোক্ষনে পংক্তির শরীরে ক্লান্তি নেমে এসেছে। রুমে এসে মশারী টানায়। সারাকে বুকে নিয়ে বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম নেমে আসে ওর দু’চোখে।

পর্ব ১২

এখন বাজে সকাল পৌনে নয়টা। ঠিক এগারোটায় হিমান্তের ক্লাস আছে। নেশায় ভার ভার মাথাটা দু’হাতে শক্ত করে চেঁপে ধরে বসলো হিমান্ত। শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যথা করছে। ধনীদুলাল হিমান্ত খালি ফ্লোরে কোনোদিনই ঘুমায় নি। ভাগ্যের পরিহাসে গত রাতে ফ্লোরে ঘুমাতে হলো যার কারনে ব্যথা টনটন করছে রগেরগে। হিমান্ত নেশা করুক যাই করুক ঘুম আটটার আগেই ভাগে। এই অভ্যাসটায় লাভই হয়েছে ওর নয়তো চাকুরী করে খাওয়া হতো না আর। বড় কষ্ট শিষ্টে দরজা খুলে বাইরে এলো সে।

ঘুম থেকে আগে ওটার অভ্যাস থাকলেও নেশার রেশ মাথায় থাকে আরও বেশকিছু সময়। সেটা কাটাতে একগ্লাস লেবু পানি দরকার ওর। তার আগে গোসলটা সাড়তে হবে। হিমান্ত ভুলেই গিয়েছিল পংক্তির কথা। দরজা খুলে ঢুলুঢুলু চোখে ফ্রিজের কাছে দাঁড়ালো। লেবু বের করে ঘুরতেই ঘুমন্ত পংক্তির মুখখানি দেখে চোখ কুঁচকালো হিমান্ত। এলোমেলো পায়ে এসে দাঁড়ালো পংক্তির শিওরে। পংক্তি মুখের উপর ঝুঁকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। ঠিক তখনই পংক্তির থুতনির তিলটা উপর চোখ আটকে গেল। আনমনে হেঁসে উঠলো।

পুরুষালী গলার হাসির শব্দ পেয়ে চমকে চোখ মেললো পংক্তি। হিমান্তকে ওভাবে ঝুঁকে দাঁড়াতে দেখে ভয়ে ওড়না ঠিক করে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো বিছানার এককোনে। বুক ঢিপঢিপ করছে ভয়ে। হাত পা কাঁপছে। হিমান্ত নেশার রেশে তখনও হাসছিল। মাতাল হাসি। চোখ খোলা রেখেছে বড় কষ্টে। হাসতে হাসতে পংক্তির মুখোমুখি এসে বসলো হিমান্ত। পংক্তি ভীরু নয়নে সেদিকে তাকাচ্ছিল বার বার। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে পংক্তির। ওড়নাটা মাথায় দেবে সেই উপায়ও নেই। লজ্জা, ভয় আড়ষ্ট করে তুলেছে পংক্তিকে। হিমান্তের মুখটা হঠাৎই বিমর্ষ হয়ে গেল।

চট করে উঠে দাঁড়ালো। গুনগুন করতে করতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। উদ্দেশ্যে লেবুপানি বানানো। হিমান্ত যেতেই পংক্তি দীর্ঘ করে শ্বাস প্রশ্বাস নিলো। তখনই ঝনঝন করে কিছু পড়ার আওয়াজ এলো রান্নাঘর থেকে। নেশার ঘোরে হিমান্তের কিছু হলো নাকি সে ভয়ে ছুটে এলো পংক্তি। পাতিল পড়ে ছিল ফ্লোরে। হিমান্ত নেশায় দূর্বল হাতে সেটা উঠাতে গিয়ে লেবু ফেলে দিল। বেচারা কোনটা উঠাবে সেটা নিয়ে কনফিউজড।

পংক্তিকে দেখামাত্রই বিষন্ন মুখে বললো,
“সব পড়ে গেল। লেবুপানি খাবো সেটাও পড়ে গেল। ভার্সিটিতে যাবো দেরি হয়ে যাবে।”
পংক্তি অবাক চোখে চেয়ে রইল হিমান্তের মলিন মুখটার দিকে। কেমন বাচ্চা বাচ্চা মুখটা করে রাখছে ঠিক যেন সারা। অন্য সময়ের মতো কাঠিন্য কিংবা গম্ভীরতার ছাপ নেই ও মুখে। বড্ড মায়াভরা মুখখানি। পংক্তির এখন আর ভয় করছে না হিমান্তকে দেখে। এগিয়ে গিয়ে প্লেট উঠিয়ে লেবুটা হাতে নিল। হিমান্ত চুপচাপ ওকে দেখে যাচ্ছিল।

পংক্তি গ্লাস নিতে নিতে বললো,
“আপনি চেয়ারটায় বসুন আমি লেবুপানি তৈরি করে দিচ্ছি।”
হিমান্ত কোনো শব্দ ছাড়াই চেয়ারটায় গিয়ে বসলো। ওর সম্পূর্ণ দৃষ্টি পংক্তির মুখের দিকে। পংক্তির ওড়নাটা বার বার হিমান্তের দৃষ্টির মাঝে এসে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। বিরক্তে কপালে ভাঁজ পড়লো হিমান্তের। হিমান্ত চোখ সরিয়ে নিলো। পেটের মধ্যে পাক মারছে। বমি আসছে।

পংক্তির দেওয়া লেবুপানি অর্ধেকটা খেতেই হরহর করে বমি করে দিল রান্নাঘরে। গতকাল রাতে কিছু না খাওয়ায় বমি করতেও কষ্ট হচ্ছিল। পংক্তির খুব খারাপ লাগছিল হিমান্তের কষ্ট দেখে। গ্লাস ভর্তি পানি এগিয়ে দিতেই হিমান্ত ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আবারও বমি করলো। হিমান্তের চোখে আগের মতো কাঠিন্য দেখে পংক্তি কাঁপা স্বরে বললো,
“পানিটুকু খেয়ে নিন ভালো লাগবে।”

হিমান্ত চুপচাপ ওর হাত থেকে পানি নিয়ে বেসিনে গিয়ে দাঁড়ালো। কুলি করে কিছুটা পানি খেয়ে আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ মুডে বেরিয়ে এসে দেখলো পংক্তি ফ্লোর পরিষ্কার করেছে। হিমান্তের খারাপ লাগলো ফ্লোর নষ্ট করে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে। তখন নেশার ঘোরে পংক্তিকে ওভাবে ঝুঁকে দেখা,হাসা হিমান্তের অস্বস্তির কারন হয়ে দাঁড়ালো। ঘুমন্ত পংক্তিকে দেখে ওর মায়ের কথা মনে পড়েছিল।

মায়ের সাথে বসে মধুবালার মুভি দেখার স্মৃতি জেগেছিল কারন পংক্তির মুখটা মধুবালার মতো। মেয়েটার গায়ের রঙটা একটু ময়লা তবে চেহারাটা মায়াবী। ক্ষনিকের জন্য হিমান্ত অতীতে চলে গিয়েছিল। মায়ের মৃত চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিল তখন হিমান্ত। পংক্তি একমনে কাজ করছে। পংক্তির পেছনে দাঁড়িয়ে কিছু বলবে বলবে করেও বলতে পারছে না হিমান্ত। কথা বলতে সংকোচ কাজ করছে। অনেকক্ষন এমন করে নিজেকে সামলে গলা ঝাড়লো। হিমান্ত গলা ঝাড়তেই পংক্তি সোজা হয়ে দাঁড়ালো নত মুখে। ভয় পেয়েছে হিমান্তের আচমকা গলা ঝাড়ার আওয়াজে। দু’জনেই মুখোমুখি দাঁড়ানো।

পংক্তি চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না আর হিমান্তে সংকোচে দৃষ্টি এদিক সেদিক করছে। হিমান্ত কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললো,
“সরি আমার জন্য সকাল সকাল কষ্ট হলো তোমার।”
“না না! এ আর কী কষ্ট? আপনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন। আপনার এবং সারার দেখাশোনা করা আমার দায়িত্ব।” কথাগুলো খুবই ধীরে ধীরে বললো পংক্তি। হিমাম্ত সৌজন্যের হাসি টেনে বললো,
“ধন্যবাদ। তবে তোমার উপর আমার কোনো কাজের প্রেশার নেই। শুধু সারাকে দেখে রাখলেই চলবে।”

“আমার দায়িত্ব আমার কাছে প্রেশার না। আমি সবটাই করবো। আমার কোনো সমস্যা হবে না।”
“ওকে।” হিমান্ত ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার পংক্তির দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“তখনের ব্যবহারে কী ভয় পেয়েছ?”

পংক্তি মাথা নাড়ালো সে ভয় পায় নি। যদিও তারা দু’জনই সত্যিটা জানে। হিমান্ত রুমে যেতে উদ্যত হলে পংক্তি সভয়ে বললো,
“আপনার নাস্তা দেব?”
“এখন নাস্তা তৈরি করতে গেলে লেট হয়ে যাবে। আমি বরং বাইরে খেয়ে নেব।”

“নাস্তা তৈরি আছে। আপনি বসুন আমি গরম করে আনছি।”
হিমান্ত কিছুটা অবাক হলেও স্বাভাবিক মুখে বললো,
“ঠিক আছে।”

পংক্তি ফ্রাইড রাইস আর চিকেন ফ্রাই গরম করে হিমান্তের সামনে দিল। হিমান্ত শুধু রাইসটুকুই খেল। চিকেন খেল না। এলার্জির সমস্যা আসে হিমান্তের। এলার্জি জাতীয় খাবার খাওয়া নিষেধ। অবশ্য এসব সে পংক্তিকে বললো না। খাওয়া শেষ হলে পংক্তিকে ডেকে হাজার পাঁচেক টাকা ধরিয়ে দিল। বললো রায়হান নামে ওর এক কাজিন আছে।

ঘন্টা খানেক বাদেই সে আসবে। আসলে পংক্তি যেন, প্রয়োজনীয় জিনিসের লিষ্ট তৈরি করে দিয়ে দেয়। ঘুমন্ত সারার কপালে চুমু দিয়ে চলে যায় হিমান্ত। হিমান্ত যেতেই পুরো ঘরটা ঘুরে দেখে পংক্তি। গতকাল রাতে হিমান্ত যে ঘরে ছিল সে’ঘরে ঢুকে মন খারাপ হয়ে যায় ওর। এতো বড়লোক মানুষ অথচ খালি ফ্লোরে ঘুমিয়েছিল। তখনই পংক্তির মনে পড়লো খাওয়ার সময় সোজা হয়ে বসতে কষ্ট হচ্ছিল হিমান্তের। ঘাড় টা কেমন করে রেখেছিল।

বোধহয় ব্যথা করছিল। পংক্তির মনে মায়া জন্মালো লোকটার জন্য। সাথে শ্রদ্ধাবোধও। সারা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সম্পূর্ণ ঘরটা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করলো। সব কিছু গুছিয়ে নিতেই সারা উঠে পড়লো। মলিন মুখে গুটিশুটি মেরে বসেছিল বিছানায়। পংক্তিকে দেখামাত্রই ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে রইলো ফোলা চোখে। পংক্তি দিনের আলোয় ভালো করে দেখলো মেয়েটাকে। বাদামী চোখ আর কটা চুল সারার। বরফ সাদা গায়ের রঙে স্বর্গীয় বাচ্চার মতো দেখতে। পংক্তি মুচকি হাসতেই নত চোখে বসে রইলো সারা। সারার পাশে বসে টেনে কোলে বসালো পংক্তি।

দু’হাতে সারার পিঠ ছাড়ানো চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো,
“তুমি ভয় পাচ্ছ?”
সারা মাথা নাড়ালো সে ভয় পাচ্ছে। পংক্তি দু’হাতে সারার মাথাটা বুকে নিয়ে গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“আমি কী অনেক ভয়ংকর দেখতে সারা?”

“না”সারা মাথা তুলে পংক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল। পংক্তি সারার তুলতুলে ফর্সা গালে চুমু দিয়ে বললো,
“তাহলে তুমি আমাকে ভয় পাও কেন? আমি কিন্তু কষ্ট পেয়েছি এ’কথা শুনে।”

সারা অবাক চোখে তাকালো পংক্তির মুখপানে। কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে নিঃশব্দে পংক্তির গলা জড়িয়ে মাথা রাখলো পংক্তির কাঁধে। সারাকে দাঁত ব্রাশ করিয়ে নাস্তা খাইয়ে সারার কোঁকড়া চুলগুলো যত্নের সাথে আচরে বেঁধে দিল। সারা একদম চুপচাপ বসে আছে বারবিডলটা নিয়ে। পংক্তির সাথে এখনও সে স্বাভাবিক হতে পারছে না।

এইটুকু বয়সে মানুষের অনেক রূপ দেখেছে সে। পংক্তির আদরেও তাই বিশ্বাস আসছে না হয়তো। ভয়ে ভয়ে চুপচাপ বসে আছে। পংক্তি সব বুঝতে পারে কারন সেও একদিন এমন ছিল। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাতর কিন্তু প্রকাশে ছিল ভয়ার্ত। সারার অব্যক্ত অনুভূতিরা তাই হয়তো প্রবল ভাবে নাড়া দিতে সক্ষম পংক্তিকে। পংক্তি এটা সেটা বলে সারার সাথে সম্পর্ক সহজ করতে লাগলো। সারা একটু হাসে আবার ভয়ে গুটিয়ে যায়। এসব দেখে সহজেই পংক্তি সারার মানসিক অবস্থার আন্দাজ করতে পারে। বেলা ১২ টার পরপরই রায়হান এলো।

পংক্তিকে সূক্ষ্ম চোখে দেখে সালাম দিয়ে সারার পাশে গিয়ে বসলো। সারা সেখানে বেশিক্ষণ ছিল না। বিষন্ন মুখে গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘরে পংক্তির পাশে এসে দাঁড়ালো নিঃশব্দে। পংক্তি এক চিলতে হেঁসে কোলে নিয়ে বসলো। দুটো চাদর, কাঁচা বাজার, গৃহস্থালি নানা জিনিসের লম্বা একটা ফর্দ তৈরি করে রায়হানের হাতে তুলে দিলো। ফর্দটা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রায়হান।

বলে,
“আল্লাহ গো, ভাবি এত্তোবড় লিষ্ট দিলেন?”ভাবি শব্দটা উচ্চারণ করে তৎক্ষণাৎ জিহ্বা কাটলো সে। পংক্তি অস্বস্তিকর মুহূর্ত এড়াতে দ্রুত রান্নাঘরে চলে আসে। ভাবি ডাকটা শোনামাত্রই লজ্জা লাগলো তার। রায়হান সদর দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে আসলো। উঁকি দিল রান্নাঘরে। গলা ঝেড়ে অনুতপ্ত স্বরে বললো,
“আপনি কী রাগ করেছেন?”

পংক্তি মাথা নাড়ায় সে রাগ করেনি। যা শুনে রায়হান যেন হাফ ছাড়ে। হেঁসে গদগদ হয়ে এগিয়ে এসে বলে,
“থ্যাংকস। নামটা জানতে পারি কি?”
“পংক্তি “
“ওয়াও। পংক্তি অর্থ কী জানেন?”

“চরন, লাইন।” পংক্তি নিচুস্বরে জবাব দিলো। রায়হানের সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা হলো ওর। রায়হান ফ্রেন্ডলি গোছের ছেলে। পংক্তিকে কেন যেন ওর ভালো লাগলো। পংক্তির বয়স জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলো ওর থেকে তিন বছরের ছোট পংক্তি। ব্যস আর কে পায় রায়হানকে! একমিনিটের জন্য উঁকি দিয়ে একঘন্টা ননস্টপ নিজের নাড়ি নক্ষত্রের গল্প শুনালো পংক্তিকে। পংক্তির জীবনে এমন মজার মানুষ দ্বিতীয়টি সে দেখে নি। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না যেমন পংক্তি।

আর এর সম্পূর্ণ অপজিট পার্সোন হলো রায়হান। এই একঘন্টার পরিচয়ে নিজের গার্লফ্রেন্ড, ফ্রেন্ড সম্পর্কে সব অকপটে বলে দিলো সে। কেন এতো কিছু বললো সেটাও বললো। পংক্তিকে তার নাকি অনেক পছন্দ হয়েছে। পংক্তি কেন জিজ্ঞেস করে নি। সে পুরোটা সময়ই হা না জবাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু রায়হান নিজেই তার জবাবে বলেছে সে জানে না তবে পংক্তিকে দেখে মনে হয়েছে সে তাকে সব বলতে পারে। ভাবি বা বোন ভেবে নিয়েছে প্রথম সাক্ষাতেই। ভাবি শব্দটা পংক্তিকে আবার লজ্জায় ফেলে।

পংক্তির লাজুক মুখ দেখে হো হো করে হেসে ওঠে রায়হান। এই ছেলেটার সবকিছু কেমন উদ্ভট তবে খারাপ নয়। রায়হানের কথা বলার ধরন,ব্যবহারে পংক্তি মুগ্ধ হয়। রায়হানের ব্যবহার হঠাৎই তার ভেতর শূন্যতা তৈরি হয়। ভাতৃস্নেহের শূন্যতা। রায়হান বুঝেছিল কিনা কে জানে? যাওয়ার সময় বলে গেল তুমি আমাকে রায়হান ভাই বলে ডাকবে। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে বিনাসংকোচে বলে দেবে আমাকে। পংক্তি ঘার নাড়ি হ্যাঁ বললেও সে জানে এমনটা সে কোনোদিন বলবে না। রায়হান থাকাকালীন সারাও কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।

সে এখন অল্প স্বল্প কথা বলছে পংক্তির সাথে। সব কিছু নিয়ে রায়হান ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসলো। পংক্তি তাকে হিমান্তের রুমের জন্য একটা তোশক আর বালিশ আনতে বলেছিল। আর দু’টো শিতল পাটি। সবই এনেছে রায়হান। রায়হান, পংক্তি, সারা তিনজনে মিলে হিমান্তের রুম গুছিয়ে পরিপাটি করলো। রায়হান বোন পাতিয়ে বোনের হাতের রান্না খেয়ে তবেই গেল। সারাকে গোসল করিয়ে দুপুরের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়ালো পংক্তি। আনমনেই ভাবতে বসলো তার জীবনের মোড় কোথা থেকে কোথায় এসে থেমেছে। যারা আপন ছিল আজ তারা পর। আর যাদের পংক্তি চিনতোও না তারা আজ ওর পাশে। এমন জীবনের কথা কী সে কোনোদিন চিন্তা করেছে?

যেখানে তার স্বামী সংসারের স্বপ্ন ছিল সেখানে আজ সে অন্যের সন্তানের, অন্যের ঘরের কাজের লোক। হায়রে নিয়তি! পংক্তির বুকটা শূন্যতায় হাহাকার করে উঠে।
সন্ধ্যার আগে আগেই হিমান্ত ফিরলো। সারার হাসিমুখ দেখামাত্রই সকল ক্লান্তি দূরে হয়ে গেল হিমান্তের। এই তো সে চেয়েছিল। সারার ঠোঁটে অনাবিল হাসি। শিশুসুলভ প্রাণখোলা হাসি। ভয় আর বিষন্নতার ছাপ নেই। ভাগ্নিকে কোলে করে বিছানায় গিয়ে বসলো হিমান্ত। পংক্তি রান্নাঘরে ব্যস্ত তখন। সারা সারাদিনের সব কথা বললো মামাকে।

পংক্তির প্রশংসায় সে থামলোই না। হিমান্ত মুচকি হাসলো ভাগ্নির কথা শুনে। ভার্সিটিতে বসে বসে পংক্তিকে রাখার সিদ্ধান্তে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছিল। ভাগ্নির হাসিমুখ দেখে ও মেয়েটার সম্পর্কে সারার কথাগুলো শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল হিমান্ত। কাল রায়হানেরও মতামত শুনবে। সারা মামাকে টেনে হিমান্তের রুমে আনতেই হিমান্ত অবাক। গতকালও যে রুমটা প্রাণহীন,অন্ধকার ছিল আজ যেন আলোয় আলোয় ভরে উঠেছে। যথার্থ রুম মনে হচ্ছে।

সবকিছু পরিপাটি। ফ্লোরের এককোনে বিছানা পাতা। ব্রাউন কালার পর্দা, একই রঙের মশারী আর সবচেয়ে বড়কথা রুমটা পরিষ্কার পরিছন্ন। একটা ছোট্ট টেবিল ফ্যানও রেখেয়েছে। হিমান্ত মনে মনে খুশি হয় মেয়েটার কাজে। কারন সে নিজের রুমের জিনিসপত্রের কথা রায়হানকে বলতে ভুলে গিয়েছিল। রাতে শীতল পাটি বিছিয়ে সারা এবং হিমান্তকে খাবার দেয় পংক্তি। আগের মতো দামি ডায়নিং টেবিলে পঞ্চব্যঞ্জনের সমাহার না থাকলেও তৃপ্তি আর শান্তি আছে আজ। যা ঐ পঞ্চব্যঞ্জনেও ছিল না।

বাসায় আসার আগেও সে নিজেকে জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক ভাবছিল কিন্তু এখন তার সাহস বৃদ্ধি পেল। মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই এবার সে জয়ী হবে সম্মানের সাথে বাঁচার লড়াইয়ে। সবটায় এই মেয়ের জন্য। বার বার মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিতে হিমান্তের ভালো লাগলো না। সে নর্মাল বিহেভ করলো। মেয়েটার প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস তার এখনও হয়ে ওঠে নি। তবে সন্দেহের মতো অন্যায়ও করতে চাচ্ছে না। রায়হানকে বিষয়টা বুঝতে না দিয়ে শুধু বলেছে মাঝেমধ্যে এসে দেখে যেতে হিমান্তের অনুপস্থিতিতে। পংক্তি সম্পর্কে সকল কথায় বলেছে হিমান্ত রায়হানকে।

সবটা শুনে রায়হান বলেছে সে খেয়াল রাখবে। কিছুসময় সারার সাথে সময় কাটিয়ে নিজের রুমে চলে এলো হিমান্ত। এসে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। দেয়ালের এককোনে মদের গ্লাস, বোতল সাজানো। হিমান্তের আজ কেন যেন ঐ অপবিত্র জিনিসটায় হাত দিতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা হচ্ছে নিজের ভার্সিটি লাইফে ফিরে যাওয়ার। যখন তার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল বই। দিন রাত সে বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতো।

শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, সফোক্লিসের ইডিপাস, চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্ট, ডেভিট কপারফিল্ড, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ সহ দেশ বিদেশের নানা ঔপন্যাসিকে বই ছিল তার সময় কাটানোর মাধ্যম। সে সময়টাকে আজ খুব মিস করছে হিমান্ত। কতোই না নির্ভেজাল ছিল তার একাকিত্বটা। নিজের ভাগ্যকে দুষলো আহানার মতো মেয়ের প্রেমে পড়ার দোষে। মা বোনকে হারিয়ে সে নিজের মধ্যেই বেঁচে ছিল। আহানার প্রেমে পড়ে সেটাও হারিয়ে ফেলেছে। জীবন্ত লাশ সে আজ।

যার হাসি, কান্না সব অর্থ হীন এখন। এসব ভাবতেই বিষাদ আর হতাশা ঘিরে ধরলো হিমান্তকে। হাত বাড়ালো নিজের ধ্বংসের দিকে। যতোক্ষণ অতীত স্মৃতি মস্তিষ্ক থেকে ধোঁয়াশা না হলো মদ গলায় ঢেলেই গেল। বিড়বিড় করে বললো,
“মৃত্যু আর কতো দূর তুমি? এ বাঁচা পাহাড়সম যন্ত্রণাদায়ক আমার জন্যে। নিয়ে যাও, মুক্তি দাও। মা! মাগো কই তুমি?”মমতাময়ী মায়ের মুখখানি অস্পষ্ট রূপে সামনে দেখলো। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো বিছানার উপর।

পর্ব ১৩

হিমান্ত জাগার আগে পংক্তি উঠে নাস্তা, লেবু পানি তৈরি করে। সেগুলো ছোট্ট টেবিলটায় সাজিয়ে আবার গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে পংক্তি। হিমান্ত প্রতিদিনকার মতো মাথা ধরে উঠে বসে। গতকালের শরীর ব্যথায় রাতে জ্বর এসেছিল বোধহয়। দূর্বল লাগছে হিমান্তের শরীর। আজ আর পংক্তি নামক মানবীকে ভোলে নি মস্তিষ্ক। বিছানায় শুয়ে থাকা পংক্তি ও সারার মুখটা একপলক দেখে ফ্রিজের দিকে এগোয়। পংক্তি ঘুমায় নি।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। হিমান্তকে এগোতে দেখে গতকাল সকালের কথা মনে পড়তেই চট করে উঠে বসে। পংক্তিকে ওভাবে উঠে বসতে দেখে হিমান্ত থমকে দাঁড়ায়। পংক্তির নত মুখের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলে,
“ভয় পেয়েছ?”

পংক্তি মাথা নাড়ায় সে ভয় পায় নি। যদিও সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। হিমান্তের উপস্থিতিই থাকে ভয় পাইয়ে দেয়। পুরুষ জাতটাকে তার বড্ড ভয়। অচেনা অজানা হিমান্তকে তো আরও বেশি ভয় পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনো এক অজানা কারন বশত হিমান্তকে খুব বেশি ভয় না পেলেও ভয় পায়। হিমান্তের সামনে দাঁড়ালে হাত পা, গলা কাঁপে। কথা জড়িয়ে যায়। এখনও তেমনটা হচ্ছে। হিমান্ত ওর মুখের দিকে দূর্বল চোখের পাতা মেলে কপাল কুঁচকে তাকায়। পংক্তিকে হাত মুচরাতে দেখে হিমান্ত আবার প্রশ্ন করে,
“অনেক ভয় পেয়েছ? পানি খাবে?”

পংক্তি মাথা আরেকবার নাড়ানোর আগেই হিমান্ত ঘুরে দাঁড়ায়। টেবিলের উপর ঢেকে রাখা লেবু পানির গ্লাসটা পংক্তির দিকে বাড়িয়ে দেয়। সস্নেহে বলে,
“পানিটা খেয়ে নাও। ভয় নেই হুমম।” পংক্তি বোকার মতো তাকিয়ে রয় হিমান্তের ধরে রাখা গ্লাসটা দিকে। চঞ্চল চোখের তারায় একবার গ্লাসের দিকে তো একবার নিজের হাতের দিকে তাকায়। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে ভাঙা ভাঙা শব্দে বলে,
“আমি ভয় পাই নি।

এই লেবু পানিটুকু আমি আপনার জন্য বানিয়েছিলাম।” কথাটা বলেই রুদ্ধশ্বাসে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। হিমান্তের জবাবের প্রত্যাশা না করে পাশ কাটিয়ে রুম ছেড়ে বাইরে চলে আসে। হিমান্ত তখনও চোখে কৌতূহল ধরে রেখেছে। পংক্তি বেরুতেই হিমান্ত গ্লাসের দিকে তাকায়। তারপর আবার দরজার দিকে। ঠোঁটটা একপাশে প্রসস্থ করে ঢকঢক করে পানিটুকু পান করে। বমির উদ্রেক হতেই ওয়াশরুমে চলে আসে। অনেকক্ষণ শাওয়ার নিয়ে তোয়ালে জড়িয়ে রুমে ঢোকে।

গতকাল দুপুরে ঘুমানোয় সারার আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভাঙলেও ঘুমের রেশ এখনও ওর চোখে মুখে। পংক্তির বুকে মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছে কোলে। হিমান্তকে নগ্ন গায়ে একটুকরো তোয়ালে পেঁচিয়ে রুমে ঢুকতে দেখে পংক্তির গলা শুকিয়ে আসে। দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়। পংক্তির উপস্থিতিতে হিমান্তের ভেতর কোনো ভাবান্তর নেই। সারার সাথে কথা বলতে বলতে আলমারি খুলে কাপড় বের করলো সে। কাপড় নিয়ে চলে যাবে তখনই সারা বায়না ধরলো তাকে কোলে নিতে হবে।

পংক্তি চমকে তাকালো সারার দিকে। সারা পংক্তির কোলে বসে হিমান্তের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে আছে।
হিমান্তর দৃষ্টি গিয়ে থামলো পংক্তির নত মুখে। বড় করে ঘোমটা টেনে বসে আছে সারাকে কোলে নিয়ে। দৃষ্টি সরিয়ে হিমান্ত এগোতেই পংক্তির হৃদপিণ্ডটার গতি বেড়ে গেল। রুদ্ধশ্বাসে কাঁপা হাতে চুপচাপ বসে রইলো পংক্তি। হিমান্ত যতো এগোচ্ছে পংক্তি ততোই অস্বস্তি অনুভব করছে। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। চোখ তুলে তাকাতেই হিমান্ত পংক্তির চার চোখ এক হয়। দু’জনই দৃষ্টি সরিয়ে নিল চট করে। পংক্তি লজ্জায় মুখ আরও নামিয়ে নিল। হিমান্ত ভাবলেশহীন।

“মামা কাপড় বদলে আসি আগে?”
সারার মাথায় হাত রেখে স্নেহভরা স্বরে বলে হিমান্ত। সারা মানে না। সে যাবেই যাবে কোলে। হিমান্ত নিরুপায় হয়ে পংক্তি দিকে ঝুঁকে সারাকে কোলে নেয়। হিমান্তের ভেজা চুলের কয়েক ফোঁটা পানি পংক্তির নাকে পড়ে। তাতেই শিরশির করে ওঠে পংক্তির তনুমন। পুরুষালী ভেজা গায়ের সুবাসে মৌ মৌ করে রুমটা। পংক্তির হৃদয়ে কাঁপন ধরায় সে সুবাস।

সারাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসে হিমান্ত। সম্পূর্ণ রুমটা গোছানো। মদের পড়ে থাকা খালি বোতল, গ্লাস কিছুই নেই। সারাকে বিছানায় বসিয়ে গায়ে আকাশী রঙের শার্ট জড়িয়ে নেয়। বিছানায় বসে পংক্তিকে নিয়ে চিন্তা করে। সারাক্ষণ কী এক আতঙ্কের ছাপ মেয়েটার অবয়বে! কিন্তু কেন? ছোটবেলা থেকে মামির হাতে অত্যাচারিত হয়েছে বলে! হিমান্তকে ভাবুক হতে দেখে সারা কাছে এসে প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে মামা?”

“কিছু না মা। আচ্ছা মা একটা কথা জিজ্ঞেস করি সত্যি সত্যি বলবে হুমম?”
“করো!”হিমান্ত সারাকে বুকে জড়িয়ে চুলে বিলি কাটে। সারা মামার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে প্রশ্ন শোনার জন্য। হিমান্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে বলে,
“তোমার পংক্তি আন্টি কেমন? আদর করে তোমাকে?”

“তোমাকে কাল বললাম না? অনেক আদর করে তো। আমাকে ব্রাশ করিয়ে দেয়,খাইয়ে দেয়, গোসল করিয়ে দেয়,ঘুম পাড়িয়ে দেয় আবার গল্প, কবিতাও শিখায়। কবিতা শুনবে মামা?”
হিমান্ত মেকি হাসে। মেয়েটাকে নিয়ে এতো ভাবনা তার জন্য অনুচিত মনে করে। মন,মস্তিষ্ককে কড়া করে শাসায় ফের এমন ভাবনা না ভাবতে। ভাগ্নির মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
“শোনাও।”

“তাই তাই মামা বাড়ি যায়।
তাই তাই মামা বাড়ি যায়
মামা বাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই।
তাই তাই মামা বাড়ি যায়।
মামি দিল দুধভাত দুয়ারে বসে খায়।

তাই তাই মামাবাড়ি যায়।
তাই তাই মামাবাড়ি যায়
মামার সাথে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে যায়।” হাত নাড়িয়ে সুরে সুরে ছড়া কাটছিল সারা। পাশের রুমের বিছানা গোছাতে গোছাতে পংক্তি মুচকি হেঁসে শুনছিল সারার ছড়া কাটা। সারা ছড়া কাটা থামিয়ে এসে মামার গলা জড়িয়ে ধরলো।

“ও মামা তুমি আমাকে নিয়ে মাছ ধরতে যাও নি কেন?”
“তাই তো? আমি তো অন্যায় করে ফেলেছি আমার মায়ের সাথে।” সারার গাল ফুলানো দেখে হিমান্ত মুচকি হাসে। আজকাল হিমান্ত হাসছে। আগে এতো হাসতো না সে। সারার সাথে কথা বললে অনিচ্ছায় হাসতে হতো কিন্তু এখন সত্যি মন থেকে হেঁসেছে। বুকটাতে আগের মতো গুমোট ভাব নেই।

ও বাড়ি ছেড়ে বসার পর, বিশেষ করে পংক্তি নামের মেয়েটা সারার এবং এ’ঘরের দায়িত্ব নেওয়ায় হিমান্ত হালকা অনুভব করছে। সারার ছড়া কাটা অঙ্গ ভঙ্গি তাকে হাসিয়েছে। মুগ্ধ করেছে। আগে যা সারার মন রক্ষার্থে করতো আজ মন থেকে করেছে। মামাকে নিশ্চুপ দেখে সারা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
“আমাকে নিয়ে যাবে না মামা। ও মামা।”

“নেব মা। মামা ছুটি পেলেই তোমাকে মাছ ধরতে নিয়ে যাবে। তারপর অনেক মাছ ধরবে মামা আর সারা ঠিক আছে?”

“পংক্তি আন্টি যাবে না?”সারার মুখে মেঘের ছায়া দেখে হিমান্ত অবাক হয়। পংক্তি মেয়েটা সারাকে কতোটা আদর করে হিমান্ত বুঝে নিয়েছে। হিমান্তের চিন্তা দূর হয় সারাকে নিয়ে। সাথে সাথে অজান্তেই ভরসা তৈরি হয় পংক্তির উপর। সারার মাথায় হাত রেখে বলে,
“অবশ্যই যাবে।” মামার নির্ভেজাল হাসিমুখে বলা কথা শুনে সারা খুশি হয়। হিমান্তের গালে চুমু দিয়ে ছুটে আসে পংক্তির কাছে।

“আন্টি জানো মামা বলেছে আমরা মাছ ধরতে যাবো।”
“তাই।”
“হ্যাঁ। তুমি আমি আর মামা। তাই তাই মামা বাড়ি যায়,,।

সারা ছড়া কাটতে থাকে বিছানায় নেচে নেচে। সারার শিশুমন এখন নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে। পংক্তির আদর আহ্লাদ তাকে তার চঞ্চল শৈশব ফিরিয়ে দিয়েছে। মামার অবর্তমানে পংক্তিই তার সকল আবদার পূরণ করে।

পংক্তির মমতার আঁচলে একটু একটু স্বাভাবিক হচ্ছে সারা। হিমান্ত রেডি হয়ে খেতে বসে। পংক্তি আগেভাগে টেবিলে সব সাজিয়ে রান্নাঘরে চলে এসেছে। সারা মামার হাতে খেতে খেতে পংক্তির শোনানো ছড়া,গল্প সব বলতে লাগলো। হিমান্ত মনোযোগ দিয়ে শোনে।

খাওয়া শেষ করে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বেরোয়। দরজার কাছে গিয়ে থেমে যায়। কিছু ভেবে ইতস্ততা কাটিয়ে পংক্তির নাম ধরে ডাকে। পংক্তি হয়তো এমনটা আশা করছিল না। হঠাৎ এভাবে নাম ধরে ডাকায় ঘাবড়ে যায় সে। হিমান্ত নরম গলায় আরেকবার ডাকতেই হন্তদন্ত হয়ে নত মুখে ছুটে আসে।

“জি!”
“তোমার কিছু লাগবে?”
পংক্তি মাথা নাড়ায় লাগবে না। হিমান্ত চোখ মুখ কঠিন করে বলে,
“আমি দেখতে কী পিশাচ দানব টাইপ?”

হিমান্তের ধমকের সুরে বলা কথায় পংক্তি ভয় পায়। কথা জড়িয়ে যায়। জবাব দেবে কিন্তু কী জবাব দেবে ভেবে পায় না। নিঃশব্দে মাথা নাড়াতেই হিমান্ত আবার ধমক দেয়।
“এতো মাথা নাড়ালে ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে যাবে। আশ্চর্য খালি মাথা নাড়ায়। এই মেয়ে কথা বলতে কষ্ট হয় তোমার?”
“জি না”পংক্তির গলার স্বরে স্পষ্ট ভয়ের আভাস পেয়ে হিমান্ত রাগ দমায়।

মেয়েটার উপর অযথা রাগ করায় অনুতপ্ত হয়। স্বর নরম করে বলে,
“আচ্ছা সরি। বাট কিছু জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়াবে না। মাথা নাড়িয়ে জবাব দেওয়া মারাত্মক বদ অভ্যাস। এবার থেকে মুখে জবাব দেবে ওকে?”

পংক্তি ভুলবশত আবার মাথা নাড়ায়। জিহ্বা কামড়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে দ্রুত। ভীরু মনে আমতা আমতা করে বলে,
“জি আচ্ছা।

“পংক্তির বোকামী দেখে কপাল চাপড়ে “আশ্চর্য”বলে বেরিয়ে যায় হিমান্ত। পংক্তি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। কান্না পাচ্ছে এমন বোকামীর জন্য। কিন্তু কী আর করবে? সে তো এমনিই। সবাইকেই ভয় পায়। হিমান্ত স্যারের গম্ভীরগলা শুনলে তো কথায় নেই। পংক্তিকে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সারা কোমর জড়িয়ে ধরে। মুখ উঁচু করে আদুরে গলায় বলে,
“তোমাকে বকেছে মামা?”

“না তো।” নিজেকে সামলে নেয় পংক্তি। সারার হাত ধরে রুমে আসে। পংক্তির চোখের পাতা ভেজা দেখে সারা তাকিয়ে থাকে।

জোর গলায় বলে,
“তুমি মিথ্যা বলছ। মামা নিশ্চয়ই বকেছে তোমায়। এই যে কেঁদেছ।” পংক্তির ভেজা চোখের পাপড়ি ছুঁয়ে বিষন্ন হয় সারার মুখ। পংক্তির কষ্ট, চিন্তা নিমেষে দূর হয়ে যায় মেয়েটার মায়ায়। একদিনেই কেমন আপন হয়ে গেছে ওরা দু’জন। আত্মার আত্মীয়। পংক্তিকে চিন্তা মগ্ন হতে দেখে সারা বলে,
“মামা আসুক আমি বকে দেব। তবুও তুমি কেঁদো না।”

“ইয়া আল্লাহ। মা আমার,সোনা আমার খবরদার মামাকে কিছু বলিস না।”
“কেন বকবো না। একশ এক বার বকবো।”

“তুমি আমার আম্মা,খালাম্মা সব লাগো সারা মা। প্লীজ মামাকে কিছু বলো না। তাহলে কিন্তু আমি আরও কাঁদবো।”
“না! না তুমি কাঁদবে না। আমি মামাকে বকবো না।”
“প্রমিস!”
“প্রমিস।”

পংক্তি খুশি হয়ে সারাকে আদর করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। হিমান্তের সামনে এসব বলা মানেই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়া। তারউপর তার সামনে মাথা নাড়ানোতে নিষেধাজ্ঞা। পংক্তির তো অভ্যাস মুখে জবাব না দিয়ে মাথা নাড়িয়ে জবাব দেওয়া। এতো সহজে অভ্যাস কী যায়! পংক্তি সভয়ে বিড়বিড় করে,
“পংক্তি অভ্যাস বদলে ফেল। মাথা নাড়ানো মারাত্মক বদঅভ্যাস। কে বলেছে?

দ্যা গ্রেট হিমান্ত সিদ্দিকী বলেছে।”
পংক্তি জানে না তার দ্যা গ্রেট হিমান্ত সিদ্দিকীর ভাগ্নি মামাকে বকবে বলে মনস্থির করে আছে। প্রমিস শব্দের মহত্ত্ব সারার মতো শিশুবাচ্চা কতোক্ষনই বা মনে রাখবে আর।

পর্ব ১৪

সিদ্দিকী সাহেবের প্রপিতামহ হানিফ সিদ্দিকী ছিলেন ইংরেজ আমলের জমিদার। প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর সিদ্দিকী সাহেবের দাদাজান জমিদারি লাভ করেন।

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও জমিদারদের ঠাট বাট কমে নি। পূর্ব পুরুষের রক্ত যে তাদের শিরায় শিরায় বহমান। ইংরেজদের বাতিলে কী তা এতোসহজে যায়! নিজস্ব এলাকায় তাদের প্রভাব আগের মতোই বজায় থাকে। সিদ্দিকী সাহেবের পিতা আসাদউল্লাহ সিদ্দিকী ছিলেন মার্জিত,শান্ত স্বভাবের মানুষ।

বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার। সমাজের উঁচু নিচু ভেদাভেদ তার পছন্দ ছিল না। জমিদারি ভাবও দেখাতে পছন্দ করতেন না তিনি। একারনেই হানিফ সিদ্দিকীর দাদার অসন্তোষ তার উপর প্রকাশ পায়। পুত্র আসাদউল্লাহ্কে নানা সময় এ নিয়ে নসিয়ত দিতেন। বলতেন,
“জমিদারি প্রথা গেছে তো কী হয়েছে মর্যাদা তো আর যায় নি। পূর্ব পুরুষের মান রক্ষার্থে তোমার উচিত তাদের পদাঙ্ক অনুসরন করা।”

আসাদউল্লাহ পিতার সামনাসামনি দ্বিমত করতেন না। তবে মনে মনে এসব বংশ গড়িমার পক্ষপাতী মোটেও ছিলেন না তিনি। দ্বিতীয় হানিফ সিদ্দিকী অর্থাৎ হিমান্তের বাবার জন্মের সময় তার দাদাজান এতোইটাই খুশি হয়েছিলেন যে, পিতার নামে নাতির নাম রাখেন হানিফ সিদ্দিকী। হানিফ সিদ্দিকীর দাদাজান পিতার ছবি নাতির মধ্যে দেখতে চেয়েছিল বোধহয়। কিন্তু হলো উল্টো।

হানিফ সিদ্দিকী দাদাজানের অতি আদরে উচ্ছন্নে গেলেন। তার ছোট ভাই আরিফ সিদ্দিকী পিতার মতো নম্র স্বভাবের হলেও হানিফ সিদ্দিকী হলেন উগ্র, বদমেজাজি, শরাবি। যুবক বয়সে যখন তার সমবয়সীরা স্কুলে পাঠ পড়ে তখন হানিফ সিদ্দিকী বাইজির নাচ দেখেন। এদিকে শিকারে গিয়ে হানিফ সিদ্দিকীর দাদা এবং পিতা সর্পদংশনে মৃত্যুবরণ করেন।

সিদ্দিকী মহলের ভীত নড়বড়ে হয়ে যায় তাদের আকস্মিক মৃত্যুতে। অনন্যোপায় হয়ে হানিফ সিদ্দিকীর মাতা হুমায়রা অন্দর থেকে বাহিরে আসেন। হুমায়রা তখনও স্বামীশোক কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। বয়সই বা কতো ছিল! ঊনত্রিশ মাত্র। তার শ্বশুর মশাই নারীশিক্ষার খেলাপ হলেও স্বামী আসাউল্লাহ তাকে ঘরে শিক্ষা দিয়েছিলেন। স্বামীর কল্যাণে ইংরেজিও শিখেছিলেন তিনি। জমিদারি অনেক শিক্ষায় স্বামীদ্বারা প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

হুমায়রা সিদ্দিকী কোনোদিন ভাবেনও নি এমন দুর্যোগ তার জীবনে নামতে পারে। এতো জমিজমা, সম্পত্তি কী করে সামলাবেন ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না৷ তারউপর বড়ছেলে হানিফের বিপথে গমন তাকে আরও চিন্তিত করলো। বাধ্য হয়ে দু’ছেলেকে বিলেত পাঠিয়ে দিলেন। ঝড় ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করে নিজেকে বেগম সাহেবা রূপে তৈরি করলেন।

স্বামী, শ্বশুরের রেখে যাওয়া সহায় সম্পদের দেখভাল করলেন। কেটে গেল ৮ বছর। হানিফ সিদ্দিকী ব্যারিস্টারি শেষ করে চলে এসেছে। হুমায়রা সিদ্দিকী লক্ষ্য করলেন ছেলে তার যতসামান্যই বদলেছে। ছেলের চারিত্রিক উন্নতি মোটেও হয়নি। হুমায়রা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সবাই পরামর্শ দিল বিয়ে দিতে। ঘরে বউ আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হুমায়রা তাই করলেন।

দূরসম্পর্কের ভাই ও নিজের কোম্পানির
ক্লার্কের মেয়ে হিমাকে তার পছন্দ হলো। কালক্ষেপণ না করে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন তিনি। বিয়ে হলো হিমা এবং হানিফ সিদ্দিকীর। সুন্দরী ও পতিপ্রাণা স্ত্রী পেয়ে হানিফ সিদ্দিকী বদ অভ্যাস ছাড়তে লাগলেন। হুমায়রা ভাবলেন ছেলে বুঝি তার শুধরে গেছে। দেখতে দেখতে হিমান্তের জন্ম হলো। ছেলের মুখ দেখে হানিফ সিদ্দিকীর সত্যিই পরিবর্তন হলো। মদও ছাড়তে লাগলেন তিনি। হুমায়রা পুত্রবধূর উপর সন্তুষ্ট হলেন৷ হিমান্তের মা হিমা ছিল মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। স্বামীই তার সব ছিল।

স্বামীর সকল আবদার তার মাথার উপর। স্বামী শ্বাশুড়িকে সন্তুষ্ট রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাই তিনি করতেন। স্বামীর হা তে হা স্বামীর না তে না এই ছিল তার জীবনের মূল। স্বামীও তাকে ভালোবেসেছিল কিন্তু তাতে ভাটা পড়লো মেয়ে সামিরা গর্ভে আসতেই। হিমা ভেবেছিলেন তিনি গর্ভবতী ভেবে হয়তো স্বামী দূরত্ব বজায় রাখছেন, তেমন কথা বলছেন না,ঠিকমতো বাড়িও ফিরছেন না।

হিমার ধারণা মিথ্যা হলো সামিরার জন্মের পর। সিদ্দিকী সাহেব নিত্যদিন মদ্যপ হয়ে বাড়ি ফিরতে লাগলেন। হিমা স্বামীকে সমীহ করতেন সাথে ভয়ও পেতেন। স্বামীর কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করার সাহস কিংবা স্পর্ধা তার ছিল না। কিন্তু স্বামীর এহেন পরিবর্তন তাকে কষ্ট দিলো তবুও তিনি তার চেহারায় সেসবের ছাপ পড়তে দিলেন না।

স্বামীকে ভালোবেসে আগলে রাখতে চাইলেন। বিধিবাম! কোনোভাবেই স্বামীকে আগের রূপে আর পাওয়া হলো না হিমার। উল্টো স্বামী এখন তাকে সহ্য করতে পারেন না। একদিন এসে বললেন হিমাকে তিনি তালাক দেবেন। হিমা সিদ্দিকী সাহেবকে প্রশ্ন করেন নি। স্বামী বিচ্ছেদের শঙ্কায় শোকে এতোটাই মূহ্যমানহয়ে যান যে নিরবতা তার সর্বাঙ্গ জুড়ে বসে। সিদ্দিকী সাহেব হিমার এই নির্লিপ্তা মেনে নেননি। সেই প্রথমবার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছিলেন তিনি।

ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিনত হলো সেটা। হিমান্তের বয়স তখন সবেমাত্র দশ। সে দেখেছে তার হাস্যোজ্জ্বল মায়ের মুখটা দিনদিন ফ্যাকাশে হয়ে যেতে। পিতার অত্যাচারে ক্ষত বিক্ষত মায়ের থমথমে মুখ হিমান্তের রূহ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিত। সিদ্দিকী সাহেব মায়ের নিষেধে হিমাকে তালাক না দিলেও আরেকটা বিয়ে করলেন। তৎকালীন সিনেমার এক উঠতি নায়িকাকে বউ করে ঘরে এনে তুললেন। হিমান্তের মায়ের জায়গা হলো অন্য কক্ষে।

হুমায়রা ছেলের অধঃপতন কিছুতেই সহ্য করতে পারলেন না। ছেলেকে হাজার বলেও যখন লাভ হলো না তখন তার সব রাগ গিয়ে পড়লো হিমার উপর। পুত্রবধূকে তিনি দোষাতে লাগলেন। যদিও তিনি জানতেন দোষ বিন্দুমাত্র হিমার নয়। পুত্রবধূর বাকরুদ্ধ হয়ে থাকাও শঙ্কিত করলো হুমায়রাকে। একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে আশায় দেখেও না দেখার ভান করলেন হিমার কষ্ট। হিমা চোখের সামনে স্বামীকে অন্যের বাহুবন্ধনে দেখে রক্তশূন্য মানুষে পরিনত হতে লাগলো।

স্বামী শ্বাশুড়ির দেওয়া আঘাত তাকে এতোই কষ্ট দিল যা তিনি সহ্য করতে পারলেন না। শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। কথা বন্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে খাওয়া। মায়ের শিওরে বসে বসে কাঁদতো হিমান্ত। মায়ের আদর পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতো তার শিশুমন। তার মা জননী পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো বিছানায় শুয়ে চেয়ে থাকতো স্থির চোখের দৃষ্টি মেলে। হিমান্তের কান্নাজড়িত আম্মি ডাকের জবাব হিমা আর দিল না কোনোদিন।

পতিপ্রাণা হিমা স্বামীর অবহেলা,নির্যাতনে শোকে দুঃখে পরপারে পাড়ি জমালো। একা হয়ে গেল হিমান্ত। মায়ের মমতার আঁচল হারিয়ে চঞ্চলতা ভুলে শান্ত হয়ে গেল সে। মৃত মায়ের ব্যবহৃত জিনিসে একটু আদর, মমতা খুঁজে বেড়াত ছোট্ট হিমান্ত।

মায়ের অকাল মৃত্যু হিমান্তের শিশুমন মেনে নিতে পারে নি। আর তাই পিতা পুত্রের সহজ সম্পর্কের মাঝে অভিমানের দেয়াল উঠলো। সিদ্দিকী সাহেব কোনোভাবেই প্রিয়পুত্রকে আর আগের মতো পেলেন না। হুমায়রা সিদ্দিকীও ভেঙে পড়লেন। পুত্রবধূর এমন মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ি করলেন তিনি।

রাগে ক্ষোভে সিদ্দিকী সাহেবের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। নাতি নাতনী দুটোকে বড় করতে লাগলেন নিজ ছায়ায়। সিদ্দিকী সাহেবের সাথে দ্বিতীয় স্ত্রীর মনোমালিন্য শুরু হয়। একপর্যায়ে তালাকও হলো তাদের। নানাভাবে অপদস্থের স্বীকার হতে হলো তাকে। সিদ্দিকী সাহেবের কাছে সম্পর্কের মূল্য ছিল না। দ্বিতীয় স্ত্রীর দেওয়া আঘাত তাকে ভেতর থেকে জাগরিত করলো। তিনি সম্পর্কের মানে বুঝলেন কিন্তু তাতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিদ্দিকী সাহেব অনুতপ্ত হলেন৷ হিমার কবরে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।

কোনো কিছু করে যদি হিমাকে ফিরে পাওয়া যেত সিদ্দিকী সাহেব তখন হয়তো তাই করতেন। প্রথম স্ত্রীর প্রতি করা সকল অন্যায় সিদ্দিকী সাহেবকে মর্মপীড়ায় পীড়িত করলো। বাকি জীবনে তিনি আর শান্তি পাননি। হিমাকে তিনি আজও ভুলতে পারেন নি। হিমাই ছিল তার প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা যেটা হিমাকে হারিয়ই তিনি বুঝেছেন। স্ত্রীর মৃত্যু সন্তান হিমান্তকে তার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।

হিমান্ত আব্বা বলে ডাকতো না সিদ্দিকী সাহেবকে। কী এক অসম যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ছিলেন তিনিই জানেন। তার কষ্ট লাঘব হয় পুনরায় হিমান্তের আব্বা ডাকে। হিমান্ত কলেজ শেষ করে তখন ভার্সিটিতে যায়। একদিন হঠাৎই এসে হাসিমুখে বললো,
“আব্বা আমি একজনকে ভালোবাসি। তাকেই বিয়ে করতে চাই।”

হিমান্তের আব্বাডাকে সিদ্দিকী সাহেব ঐদিন আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। সন্তানকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কেঁদেছিলেন। হিমান্ত তার সাথে পুরোপুরি সহজ না হলেও টুকটাক কথাবার্তা হতে লাগলো দু’জনের মধ্যে। তাতেই সিদ্দিকী সাহেবের শান্তি। সিদ্দিকী সাহেব কোনো কিছু যাচাই বাছাই করলেন না। ছেলের পছন্দ করা মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেন। এই বিয়েতে তার মা হুমায়রা নাখোশ ছিল।

মেয়ে তার পছন্দ ছিল না। তবুও হিমান্তের খুশির জন্য তারা সবাই বিয়েতে মত দিলেন। সব ঠিকঠাক চললো। বিয়ের পরপরই আহানাকে নিয়ে হিমান্ত সুইটজারল্যান্ডে হানিমুনে গেল। ধীরে ধীরে সবাই পছন্দ করলো আহানাকে। হিমান্তের খুশি আবার ফিরে এলো। সিদ্দিকী মহল সুখ শান্তিতে ভরে উঠলো। এরমধ্যে একটা দূর্ঘটনায় নিঃস্ব হয়ে হিমান্তের মামা মঞ্জুর সপরিবারে এসে সিদ্দিকী মহলে উঠলেন।

সিদ্দিকী সাহেব কোম্পানির ম্যানেজার পদে চাকরি দিলেন শ্যালক মঞ্জুরকে। হিমান্তও পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার ব্যবসায়ে সাহায্যের হাত বাড়াল। হিমান্তের বিয়ের তিন বছর যেতে না যেতেই সেই বিভৎস দিন আবার ফিরে এলো। বিধাতা যেন উপযুক্ত শাস্তি বেছে নিলেন সিদ্দিকী সাহেবের জন্য। হিমার সাথে যা করেছিলেন তিনি। আহানাও তার ছেলের সাথে তাই করলো।

সিদ্দিকী সাহেব চোখের সামনে দেখলেন নিজের পাপের পরিনাম। প্রাণপ্রিয় সন্তান হিমান্ত মায়ের স্থানে আর সিদ্দিকী সাহেবের স্থানে যেন আহানা। সন্তান জন্মদানে অক্ষম অপবাদে হিমান্তের সাথে প্রতিদিন ঝগড়া শুরু করলো সে।

হিমান্ত প্রথমে কথা কাটাকাটি করলেও একসময় নিরব শ্রোতা হয়ে যায়। আহানার সকল কথার অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে। হিমান্তের জীবন দুর্বিষহ করে তুললো আহানা। হিমান্ত নিজের দোষ খুঁজে না পেলেও আহানা পেত। তাদের মাঝে দূরত্ব তৈরি হলো। বিছানা আলাদা হলো।

সিদ্দিকী সাহেবের মা এসব সহ্য করতে পারলেন না। নাতির নত মুখ তাকে কষ্ট দিল। উত্তপ্ত হতে লাগলো সিদ্দিকী মহলের পরিবেশ। ছোট ভাই আরিফের সাথে ব্যবসায়ীক বিবাদে জড়ালেন। আরিফ পরিবার সহ সিদ্দিকী মহল ত্যাগ করলো। যার ধাক্কা এবার আর নিতে পারলেন না হুমায়রা সিদ্দিকী। ব্রেন স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হলেন তিনি। দিনদিন সবকিছু এলোমেলো হতে লাগলো। আহানা এরমধ্যে ঘটিয়ে ফেললো আরেক নোংরা ঘটনা।

হিমান্তের এক বন্ধুর সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুললো। অশান্তি চরম পর্যায়ে সিদ্দিকী পরিবারে। হিমান্ত নিজ চোখে বন্ধু ও স্ত্রীকে এক বিছানায় দেখে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। তার তখনকার অন্তর্জ্বালা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আহানার সাথে হিমান্তের তালাক হলো। ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে লাগলো হিমান্ত। নেশা করা শুরু করলো সে।

দুই দুইবার আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। বাধ্য হয়ে কিছুকাল রিহার্বে পাঠাতে হলো তাকে। ইতিমধ্যে সিদ্দিকী সাহেবে মায়েরও মৃত্যু হলো। সিদ্দিকী সাহেব পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন এবার। সন্তানের ভাগ্য তার পাপেই এমন হলো ভাবলেন তিনি। সেই চিন্তায় মাইনর অ্যাটার্ক হলো তার। সেই সময় তার পরিবারের হাল ধরেছে আকলিমা।

হিমান্ত, সামিরাকে আগলে রেখেছে সে। হিমান্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলো তবে মন থেকে সে তখনও অসুস্থ। দিনরাত নেশা করা তার অভ্যাসে পরিণত হলো। সবার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হলো তার। নিজের দর্পন দেখতে লাগলেন সিদ্দিকী সাহেব। মায়ের কষ্ট আজ হারে হারে উপলব্ধি করছেন তিনি।

স্বামী, সন্তান হিসেবে তিনি ব্যর্থ এবার বুঝি পিতা হিসেবেও ব্যর্থতার গ্লানি নিতে হলো তাকে। সিদ্দিকী সাহেবের প্রায়শ্চিত্ত বুঝি তখনও হয়নি। তাইতো মেয়ে সামিরা তাকে না বলেই পালিয়ে বিয়ে করলো এক অস্ট্রেলিয়ানকে। সিদ্দিকী সাহেব অনেক খোঁজ করেও মেয়ের হদিস পেলেন না। হিমান্তও খুঁজলো বোনকে। অবশেষে পেল তবে মৃত।

সারাকে জন্ম দিয়ে সামিরা দুনিয়া ছেড়েছিল ততোদিনে। সারার বয়স তখন তিনমাস। হিমান্ত সারাকে কোলে নিয়ে পিতৃত্বের স্বাদ পায়। এই অবুঝ শিশুটা তার মৃতপ্রায় জীবনের হয়ে দাঁড়ায় এক মাত্র অবলম্বন। অ্যালান সারার দায়িত্ব নিতে গড়িমসি করছিল। বোনকে হারিয়ে হিমান্ত শোকার্ত। অ্যালানকে মেরে ফেলতে ইচ্ছা হয়েছিল সেসময় তার।

সারার মুখ চেয়ে সে এমনটা করে নি। দুঃখভারাক্রান্ত মনে হিমান্ত শুধু তাকে বলেছে,
“সন্তান কী অমূল্য সম্পদ যেদিন উপলব্ধি করতে পারবে সেদিন এসো মেয়েকে দেখতে। তার আগে তোমার ছায়াও যদি দেখেছি আ’ল কিল ইউ।”

সারাকে মেনে নিলেন না সিদ্দিকী সাহেব। সামিরার মৃত্যুর কারন হিসেবে সারার অস্তিত্ব সহ্য করতে পারতেন না তিনি। হিমান্তের সাথে এ নিয়ে তার বাকবিতণ্ড হয়। সেই থেকে আবার কথা বলা বন্ধ হয় তার আর হিমান্তের। এতোদিন যাও দু’চোখের সামনে ছিলেন আজ সেটাও নেই।

পাপ বাপকেও ছাড়ে না। সব তার পাপের শাস্তি। স্ত্রী, পিতা,মাতাকে তিনি যেভাবে কষ্ট দিয়েছেন সব কষ্ট আজ দু’সন্তানের বিচ্ছেদে পাচ্ছেন। তিনি ব্যর্থ জীবনের জরায় ক্লান্ত, অবসন্ন। হিমান্তকে ছাড়া আজ একসপ্তাহ পাড় করলেন তিনি। হিমান্তের অনুপস্থিতি সিদ্দিকী সাহেবের অন্তর বেদনায় জর্জরিত করছে।

রাতের ঘুমটাও বুঝি ত্যাগ করেছে তাকে। হুইস্কি গলায় ঢেলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সিদ্দিকী সাহেব। জীবনকে আমরা যা দেব জীবন তাই সুদে আসলে ফিরিয়ে দেয়। সিদ্দিকী সাহেবকেও দিয়েছে। একবুক যন্ত্রনা, হতাশা আর একাকীত্ব। তার জীবনে যদি হিমা থাকতো তবে আজ এমন হতো না বোধহয়। নিজের ভুলে এবং প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মরণে কাঁদলেন তিনি।

হিমাকে দেওয়া কষ্ট তিনি দ্বিগুণ হারে পেয়েছেন। সন্তানের সুখ দেখার জন্য মরিয়া হয়ে আছেন তিনি। মৃত্যু কালে ছেলের মুখে প্রানবন্ত হাসি দেখে যেতে পারলেই তার জীবন সার্থক। সেটা কী সম্ভব! বুকের বা’পাশ শক্ত করে ধরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন আবার সিদ্দিকী সাহেব। কষ্টের ভারে বুকটা ভারী হয়ে আসছে। ইজি চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে মৃত স্ত্রীকে স্মরণ করতে লাগলেন।

সূর্যের কড়া রোদ স্তিমিত হয়ে আসছে। মিরপুরের ফুটপাত ধরে হাঁটছে সে। মাথা ঝিমঝিম করছে হিমান্তের। শিক্ষকতা পেশা মোটেও সহজ নয়। এ পেশায় নতুন সে। অনেক বিষয়েই বুঝতে হচ্ছে, জানতে হচ্ছে। সমস্যাও আছে কিছু। তবুও এগিয়ে চলতে হবে সব সমস্যা, বাঁধা টপকে। হিমান্তের দৃঢ় বিশ্বাস সে পারবে। পারতেই হবে তাকে। সিদ্দিকী সাহেবের নাম ছাড়া সে সচ্ছল ভাবে বেঁচে দেখাবে।

সামনে কাপড়ের শোরুম দেখে দ্রুত পা বাড়াল সেদিকে। পংক্তি রাতের রান্না বসিয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে সারাকে গল্প শোনাচ্ছে। শিশুসুলভ চঞ্চলতা ফিরে এসেছে সারার মাঝে। সে এখন অনেক দুষ্টুমি করে পংক্তির মমতার ছায়ায়। পংক্তির হাসি পায় সেসব দেখে। সন্ধ্যার আজান পর পরই রান্না শেষ হয়। পংক্তি সারাকে নিয়ে অজু করে নামাজে বসে।

নামাজ শেষে সারা ব্যালকনিতে দাঁড়ায় মামার অপেক্ষায়। দূর থেকে মামাকে আসতে দেখে চিৎকার করে ডাকে। হিমান্ত নিচ থেকে হাত নাড়িয়ে ইশারা করে নিচে নামতে। পংক্তিকে বলে সারা ছুটে নিচে নামে। সারাকে কোলে নিয়ে হিমান্ত ঘরে আসে। সারা কিন্তু এরমধ্যেই মামাকে সব বলে দিয়েছে সব। হিমান্তের খারাপ লাগে মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে শুনে।

হিমান্ত কাপড় ছেড়ে বিছানায় বসে। সারা মামার বুকের উপর বসে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
“তুমি সরি বলবে না?”
হিমান্ত কপাল কুঁচকায়। বলে,
“কেন?”

“বা রে! পংক্তি আন্টিকে যে বকেছ ভুলে গেছ? এক্ষুণি সরি বলবে তুমি। আন্টি,আন্টি!”সারা চিৎকার করে পংক্তিকে ডাকে। পংক্তি পারে না ফ্লোর ভেদ করে লুকিয়ে পড়তে। এই মেয়ে সব বলে দিছে। এখন কী হবে? লজ্জায় পংক্তির মুখ রক্তাভ হয়ে ওঠে। এদিকে সারা পংক্তির সাড়া শব্দ না পেয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে মামার বুকে। হিমান্ত সারার পাগলামি দেখে মুচকি হাসে। পংক্তির নাম ধরে ডাকে হিমান্ত।

সারার ডাক উপেক্ষা করতে পারলেও হিমান্তের ডাক উপেক্ষা করতে পারে না পংক্তি। ভীরু পায়ে চুপচাপ এসে হিমান্তের রুমে দরজায় দাঁড়ায়। হিমান্ত সারার কান্না থামাতে ব্যর্থ হয়ে বলে,
“সারাকে কোলে নাও ধরো। কী মেয়ে কথায় কথায় কাঁদে।

ছিঁচকাদুনী একটা।” পংক্তি সারাকে কোলে নেয়। হিমান্ত সারা,পংক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সারার নাক টেনে দুষ্টুমি করে। পংক্তি নত মুখে জড়সড় দাঁড়িয়ে ছিল অস্বস্তি নিয়ে। হিমান্ত পংক্তিকে উদ্দেশ্য করে শীতল কন্ঠে বলে,
“শুনলাম কেঁদেছ নাকি?

কষ্ট পেয়েছ আমার কথায়? আসলে তুমি সবসময় এভাবে ভয়ে ভয়ে থাকো যেটা আমার ভালো লাগে না। তাই একটু বেশিই রাগ করেছি বোধহয় সকালে। আ’ম সরি।”
পংক্তি লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে আছে। খারাপ লাগছে মানুষটার অনুতপ্তে। কষ্ট কেন পেল সে সেই আক্ষেপে মরে যেতে ইচ্ছা করছে পংক্তির।

পংক্তিকে নিরব দেখে হিমান্ত মলিন মুখে আবার বললো,
“রাগ করেছ? কথা বলবে না? দেখো তুমি কথা না বললে সারা কিন্তু আমার ১২টা বাজিয়ে ছাড়বে। ভ্যাঁ ভ্যাঁ কিন্তু একটুও থামবে না ওর। ছিঁচকাদুনি বুড়ি একটা!”মুচকি হেঁসে হিমান্ত সারার নাক টানতেই হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে থাকে পংক্তির কোলে। পংক্তিও মুচকি হাসে। হিমান্ত সেটা দেখে ফেলে।

এক হাত বুকে রেখে বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“যাক হাসলে তাহলে। বড় বাঁচা বাঁচালে আমায়। এই ছিচকাদুনী থাম! দেখ তোর পংক্তি আন্টি হাসছে। তার মানে তোর আন্টি ক্ষমা করেছ আমাকে।”

হিমান্ত গাল টেনে দেয় সারার। সারা চট করে কান্না থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পংক্তির লজ্জায় নত মুখের হাসির দেখে। ভেজা চোখে সারা ফিক করে হেঁসে পংক্তির গলা জড়িয়ে ধরে। সারার ওমন হাসি দেখে হিমান্ত হোঁ হোঁ করে হেঁসে সারাকে কোলে টেনে নেয়। পংক্তি বিমুগ্ধ নয়নে হিমান্তের হাসি দেখে।

এতো সুন্দর হাসি কেউ হাসতে পারে পংক্তির জানা ছিল না। ঘোর লেগে যায় পংক্তির চোখে। লজ্জা শরম ফেলে হাঁ করে চেয়ে থাকে হিমান্তের মুখের দিকে। নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে,
“থাকতো যদি রঙ তুলি! এঁকে রাখতাম ঐ হাসি।
হাসিতে হৃদয় দোলে, হাসিতে হৃদয় দোলে। ও মানুষ এমন হৃদয়হরণীয়া হাসি তুমি কোথায় পেলে গো কোথায় পেলে?”

নিজের বলা কথা শুনে পংক্তি লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে। হিমান্তের চক্ষুগোচর হওয়ার আগেই ছুটে চলে আসে রুম থেকে। নিজেকে শাসায় কেন এমন বললো সে। পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা তাকে ঘিরে ধরলো সেই মূহূর্তে।

পর্ব ১৫

রাত্রির দ্বিপ্রহর। মাথার উপরের ফ্যান ঘোরার শব্দটা কানে লাগছে খুব। ঘুম আসছে না কিছুতেই। এমন অদ্ভুত অনুভূতি আগে কখনও হয় নি পংক্তির। কী নাম দেওয়া যায় অনুভূতিটার? সাময়িক আবেগ! নাকি প্রথম প্রেমানুভূতি! হিমান্তের প্রতি তার মনে ভিন্ন আবেগ কাজ করছে। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে মানুষটার হাসি দেখার পর।

“আমি কি তার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি? না,না, ছিঃ ছিঃ! এ কেমন কথা? এসব যে ভাবাও পাপ আমার জন্য।” দ্বিধান্বিত স্বগতোক্তি শেষে পংক্তি ঘুমন্ত সারার দিকে কাত হলো। মনে হচ্ছে সারার মুখচ্ছবিতেও হিমান্তের ছাপ স্পষ্ট। ঠোঁটের কোনে লাজুক হাসি ভেসে উঠলো পংক্তির। পরক্ষনেই বললো,”একি অশোভন ভাবনা তার! কেন এমন বেহায়াপনা করছে মন?

উফ!”পংক্তি উল্টো কাত হলো আবার। বালিশের কোনার দিকে মুখ ঠেঁসে দমবন্ধ রইলো কিছুসময়। বেশিক্ষণ দমবন্ধ করে রাখতে পারলো না সে। দমবন্ধ করলেই কী আর হিমান্ত নামের অনুভূতি বন্ধ হবে? বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো পংক্তি। সারার দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল আবার। টেবিলে উপরে রাখা পানির জগটা থেকে গ্লাস ভর্তি করলো পানিতে।

এক নিঃশ্বাসে পান করে নিল সেটা। ভারী নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে। বৃদ্ধাঙ্গলি দিয়ে ফ্লোর ঘষছে। একটিবার মানুষটার মুখ দেখার সাধ জাগ্রত হচ্ছে এই মুহুর্তে। দরজার বাইরে কাতর চোখে তাকিয়ে হঠাৎই মাথা নুইয়ে বললো,
“ছিঃ তুই এতো বেহায়া হচ্ছিস কেন রে আজ! লাজ লজ্জার মাথা খেয়েছিস হুমম। কই তুই আর কই সে। নিজের জায়গা কেন ভুলে যাচ্ছিস? সে তোকে দয়া করে আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রিতের এমন ভাবনা মানায় না পংক্তি।” পংক্তির মনটা বিষাদের কালো মেঘে ঘিরে ধরলো। চোখ দুটো ছলছল।

মাহিনের দেওয়া শিক্ষার পরও কেন তার মন হিমান্তের জন্য কাতর তার জবাব পংক্তির জানা নেই। হঠাৎ করেই যেন ভালোলাগা তৈরি হলো হিমান্তের প্রতি। ভালোলাগা, ভালোবাসারা বুঝি এমনই। পংক্তি টেবিলের এককোনে রাখা শপিং ব্যাগটার দিকে এগিয়ে গেল। দু’টো থ্রি পিছ এনে দিয়েছে হিমান্ত আজ পংক্তিকে। একটা মেরুন রঙের অন্যটা কচি সবুজ পাতা রঙের। আগে পংক্তির জীবনে রঙের কোনো গুরুত্ব ছিল না।

পছন্দের রঙ বলতেও স্পেসিফিক কোনো কিছু মনে আসতো না তার। তবে আজ মনে আসছে। যখন হিমান্ত তাকে ডেকে এই দুটো থ্রি পিছ দিয়েছিল। সংশয় মনে বলেছিল,
“তোমার পছন্দ হবে কিনা জানি না। আসলে এর আগে কখনও কোনো মেয়ের জন্য শপিং করি নি। এই ফার্স্ট। রঙ দুটো আমার পছন্দের। মনে হলো তোমাকে বেশ মানাবে।

পছন্দ না হলে তোমার পছন্দের রঙ বলে দিও এনে দিব তেমনটা।” ড্রেস দু’টো হাতে নিয়ে পংক্তির চোখে জল এসে গিয়েছিল। পংক্তির অভ্যাস সে কারনে অকারনেই কাঁদে। তবে তখন সে আনন্দে কেঁদেছিল। আনমনেই বলেছিল,
“আমার সকল পছন্দ আজ থেকে আপনাকে ঘিরে।

আপনি, আপনার সকল কিছুই আমার পছন্দ। আজ থেকে এই দু’টো রঙ আমারও পছন্দের।” ঘোর কাটতেই মুখে বললো,
“পছন্দ হয়েছে।” হিমান্ত ভ্রুকুটি করে কিছুক্ষণ ওর নত দৃষ্টির মুখে তাকিয়ে ছিল। কী ভাবছিল কে জানে?

তবে পংক্তির ভাবনা জুড়ে তো সেই ছিল। কাপড় দু’টোতে হাত বুলিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল পংক্তি। তখনই কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করলো। ভয়নক কিছুর অস্তিত্ব টের পেল তার ৬ষ্ট ইন্দ্রিয়। ঘড়ির দিকে তাকালো সাড়ে তিনটে বাজে। পংক্তির গলা অকারণেই শুকিয়ে আসছে। ভয় ভয় পাচ্ছে সে। হঠাৎ এমন হওয়ায় ঘাবরে গেল কিছুটা।

দ্রুত বিছানায় এসে সারাকে বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো। তখনই মনে হলো রুমে কেউ হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক টেবিলের কোনে গিয়ে থেমেছে। পংক্তি সর্বশক্তি দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো। মন বলছে চোখ মেললেই ভয়ংকর চেহারার অশরীরী তাকে আক্রমণ করে বসবে। পংক্তির শরীর অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে লাগলো, ঘাম হচ্ছে। মনকে শান্ত করে দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে একসময় ঘুম নেমে আসলো ওর চোখে।

আজ ছুটির দিন হওয়া স্বত্বেও নাস্তা সেড়ে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল হিমান্ত। পংক্তির এখনও সাহস কিংবা অধিকারবোধ জাগে নি যার দরুন সে হিমান্তকে প্রশ্ন করবে এসব বিষয়ে। হাজারো চিন্তা ভাবনা মাথায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। সারা কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করলো,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি আন্টি?”
“বাড়িওয়ালার বাসায়। চলো।”

সারা পংক্তির হাত ধরে লাফাতে লাফাতে নিচে নামলো। দোতলার পুরোটা নিয়েই বাড়িওয়ালারা থাকে। দরজার পাশের কলিংবেল টিপতেই ভেতর থেকে দরজা খোলা হলো। কাজের মেয়ে গোছের একটা মহিলা আঞ্চলিক টোনে জিজ্ঞেস করলো,
“কারে চায়?”মহিলার কথার ধারালো সুরে পংক্তি গলার স্বর কাপলো। তবুও হাসি মুখে জবাব দিল,
“বাড়িওয়ালি আন্টি আছে?”
“হ! আপনে কে?”

“আমরা তিনতলা থাকি। হিমান্ত ভাইয়ার কাজিন আমি। আন্টি নাকি কাপড় বানাতে পারে তাই আসলাম।”
“আল্লাহ গো! আপনে হিমান্ত বাবাজির বইন। আহেন আহেন। আগে কইবেন না।” পংক্তির হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে আসলো কাজের মহিলা। পংক্তি কিঞ্চিৎ বিস্মিত মহিলার হঠাৎ পরিবর্তনে। তার চেয়েও বেশি বিরক্ত হিমান্তের বইন কথাটা শুনে। বসার ঘরে এনে বসতে দিয়ে সারাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“এইডা কে? হিমান্ত বাবাজির ভাগ্নি তাই না?”
“জ্বি!”
“মাশাল্লাহ। কত্ত সুন্দর। ঠিক মামার মতোই। আপনেরা বসেন আমি আপারে ডাইক্যা আনতাছি।” হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রস্থান করলো বাড়িওয়ালার কাজের মহিলা। পংক্তি কালো মুখে বসে আছে। হিমান্ত তাকে বেরোনোর আগে বলে গেছে এখানে আসতে। বাড়িওয়ালির সেলাই মেশিন আছে। তিনিই নাকি হিমান্তকে বলেছেন, প্রয়োজনীয় কাপড় সেলাইয়ের দরকার হলে তার কাছে আসতে।

পংক্তির এতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা তখন দেখা দিল যখন হিমান্ত তাকে সতর্ক করে বলে দিয়েছে; এখানে এসে যেন কাজিন পরিচয় দেয় পংক্তি। কোনোমতেই যেন সত্যিটা না বলে। পংক্তি তার কেউ না এ’কথা জানলে নানা জন নানা কথা রটাতে পারে। যার রিস্ক হিমান্ত নিতে পারবে না। পংক্তিকে তার প্রয়োজন সারার জন্য।

পংক্তিরও একটা নিরাপদ আশ্রয় প্রয়োজন যেটা সে এখানে পাবে। হিমান্তের সকল কথা পংক্তি নত মুখে মেনে নিয়েছিল। হিমান্তের বলা কথা শুনে পংক্তির ভেতর হিমান্তের জন্য অঙ্কুরিত প্রেমানুভূতি মাথা ভেঙে পড়েছে। মাথা ভেঙে পড়লেও তার রেশ পংক্তির হৃদয় জুড়ে। হিমান্ত চোখে আঙুল দিয়ে সত্যিটা বোঝানোর পরও তার মন মানছে না। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে হঠাৎ হঠাৎ পংক্তি মনে।

পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমের মতো সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথম যৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মত সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়। ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বাড়িওয়ালি মহিলা পংক্তিকে খুবই আদর করলো।

হিমান্ত সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করলেন তিনি। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানতে চেয়েও হতাশ হলেন। পংক্তি হিমান্ত সম্পর্কে কিছুই বললো না। হিমান্ত সম্পর্কে পংক্তির এই নির্লিপ্ততা বাড়িওয়ালিকে কেন যেন আনন্দ দিল। আনন্দের চোটে বলেই বসলেন।

তার মেয়ে নাকি হিমান্তের ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। হিমান্ত স্যার বলতে নাকি পাগল তার মেয়ে। পংক্তি এতোক্ষনে বাড়িওয়ালির সমাদরের কারন উপলব্ধি করলো। এই উপলব্ধি তার হৃদয় যন্ত্রণা বাড়িয়ে তুললো ভীষণ ভাবে।

কাপড়ের মাপ দিয়ে কোনোমতে বেরিয়ে আসলো সারাকে নিয়ে। বাড়িওয়ালির মেয়েও বাসায় নেই এদিকে হিমান্তও নেই। চিন্তা হতে লাগলো পংক্তির। পাওয়ার আগেই বুঝি সব হারিয়ে ফেললো সে। এই ভাবনায় কান্না চলে আসে পংক্তির। দাঁত চেঁপে আটকে রেখেছে কোনোক্রমে সেটা। উপরে এসে বাসার লক খুলবে ঠিক সে’সময় সামনের বাসার প্রতিবেশী পিছু ডাকলো।

পংক্তির মন ভালো না থাকলেও হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময়ে করলো সে। বয়স বেশি না প্রতিবেশীনির। পংক্তিকে একপ্রকার টেনে নিজের বাসায় নিয়ে এলো। কথায় কথায় পংক্তি জানতে পারলো বছর দুয়েক হলো মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। স্বামী সরকারী জব করে।

পংক্তির বয়স জেনে মেয়েটা সহাস্যে বললো,
“এমা! তুমি তো দেখি আমার চেয়ে অনেক ছোট। আমি কিন্তু ভাই তুমিই বলবো তোমাকে।”
“জ্বি। বলুন সমস্যা নেই।” মেয়েটা আবার হাসলো। বললো,
“তাহলে তুমি আমাকে সোনিয়া আপা বলে ডেকো কেমন?”

“আচ্ছা।” সোনিয়া পংক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে পংক্তি হিমান্তের বলে দেওয়া কথাটাই শুনিয়ে দেয়। পংক্তির বাবা মা নেই জেনে হা হুতাশ করলো সোনিয়া। মায়া জাগলো পংক্তির উপর। পংক্তি সোনিয়া গল্প করছিল সে’সময় সোনিয়ার বোনের পাঁচ বছরের মেয়েটা এসে হাজির।

মেয়েটাকে কাছে টেনে বললো,
“ও আমার বোনের মেয়ে। উপর তলায় থাকে ওরা। আপু, দুলাভাই দু’জনই জব করে। সারাদিন আমি একা থাকি তাই ওকে আমার কাছে রেখে যায়। আজ আপু দুলাভাইয়ের ছুটি ছিল তাই ও দেরিতে আসলো।”

কথাটা শেষ করেই ভাগ্নিকে চুমু দিল সোনিয়া। সে দৃশ্য দেখে সারা পংক্তির গা ঘেঁষতেই পংক্তি হাসলো। কোলে তুলে নিয়ে আদরের চুমু দিলে সারা আনন্দিত হয়। সোনিয়া খেয়াল করলো বিষয়টা। সারাকে লক্ষ্য করে আদুরে গলায় বললো সোনিয়া,
“তোমার নাম কী আম্মু?

সারা পংক্তির বুকে মুখ লুকিয়ে রইল লজ্জায়। পংক্তি মৃদু হেসে সারাকে সাহস দিয়ে বললো
“আন্টিকে নাম বলো মা।” সারা বোধহয় কিছুটা সাহস পেল। আস্তে করে বললো,
“সাবারিয়া সিদ্দিকী সারা।”
“বাহ! মিষ্টি নাম তো। তোমার পরিচয় দাও আম্মু।” ভাগ্নিকে লক্ষ্য করে বললো সোনিয়া। সোনিয়ার ভাগ্নির চটপট করে জবাব দিল,
“মুনতাহশা মিরা।”

মিরা এবং সারার বন্ধুত্ব করিয়ে দিল সোনিয়া। মিরা হাসলেও সারা গুটিয়ে রইল। বেলা বাড়তেই পংক্তি উঠে দাঁড়ায়। আবার আসবে বলে বাসার দরজা কাছে চলে আসে। মিরা কিন্তু ততক্ষণে নিজের সকল খেলনার সাথে সারাকে পরিচয় করিয়ে দিল। সারা চুপচাপ বসে বসে দেখলো সব। পংক্তির ডাকামাত্রই ছুটে গেল বাইরে। সোনিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুমে ঢুকলো ওরা।

মিরার মন খারাপ হলো সারার চলে যাওয়ায়। সোনিয়া ভাগ্নির মলিন মুখ দেখে হাসলো কিছুক্ষণ। কোলে বসিয়ে বুঝালো সারাকে কী করে বন্ধু বানাবে সে। মিরা মনোযোগ দিয়ে শুনলো খালামনির কথা। সহসায় মলিন মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মিরার।

সোনিয়ার ব্যবহার পংক্তির ভালো লেগেছে। শিউলি ভাবির সাথে কোথায় যেন একটু মিল আছে। মন কখন কাকে আপন করে নেয় মনের মালিক নিজেও জানে না। রান্নাসহ ঘরের সকল কাজ শেষে ওরা দু’জন গোসল সেড়ে বেরুতেই হিমান্ত হাজির। এক গাট্টি বই নিয়ে এসেছে নীলক্ষেত থেকে সে।

পংক্তির মনে স্বস্তি এলো কথাটা শুনে। ঘরের ফ্লোরের এককোনে বই গুলো সাজিয়ে রাখলো নিজ হাতে হিমান্ত। তারপর গেল গোসলে। গোসল শেষে ঘরে এসে পংক্তিকে ডাকলো হিমান্ত। পংক্তি এমন ভাবে ছুটে এলো যেন হিমান্তের ডাকের অপেক্ষা ছিল সে এতোক্ষন। দরজার কোনে দাঁড়িয়ে কাঁপা স্বরে জবাব দিল,
“জ্বি!”
“দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? এদিকে আসো কথা আছে।”

হিমান্ত যখন এমন করে পংক্তিকে ডাকে পংক্তির হৃদয় আলোড়িত হয়। কর্ণদ্বয় ভেদ করে সেই গলার স্বর মধুর সুর মূর্ছনায় মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় প্রকম্পিত করে। কী এক অনুভূতি! সহজে যা ব্যক্ত করা যায় না। পংক্তি ভীরু চোখের পাতা তুলে তাকাল হিমান্তের দিকে। অগোছালো ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে কপালে। সেটাতে আঙুল চালিয়ে সাইড করলো হিমান্ত।

পংক্তি চোখ ধীরে ধীরে হিমান্তের বড় বড় চোখ তারপর সরু নাক ছেড়ে ঠোঁটে গিয়ে থামলো। ঠোঁটের একসাইড কামড়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে হিমান্ত। পংক্তির তৃষ্ণা পাচ্ছে। দৃষ্টি অনড় ঐ দাঁত ও ঠোঁটের সংযোগস্থলে। পংক্তির ঘোর কাটলো হিমান্তের গলার আওয়াজে,
“পংক্তি এটা দেখো তো।”

হিমান্তের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় মিইয়ে যায় পংক্তি। দুনিয়ার সমস্ত লজ্জা এসে ভর করে ওর উপর। হিমান্ত হাত বাড়িয়ে ধরে রেখেছে একটা খাম। পংক্তির সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। জড়তায় হাত পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবনায় ডুব দিয়েছে সে।

পংক্তিকে অন্যমনস্ক দেখে হিমান্ত ঈষৎ রেগে বলে,
“কই নাও।” পংক্তি চমকে ওঠে। আবার চোখাচোখি হয় দুজনের। পংক্তি দৃষ্টি না সরালেও হিমান্ত সরিয়ে নেয়। হিমান্তের চোখের দৃষ্টিতে কিছুটা বিরক্তি ভাব পরিলক্ষিত। পংক্তি মন খারাপ করে তা দেখে। হাত বাড়িয়ে খামটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।

“কোথায় যাচ্ছ? এখানে বসে দেখো। বসো এখানে।”
“না বসবো না। আমার দিকে তাকালে তো বিরক্তি লাগে, রাগ লাগে আপনার। আপনি একাই বসে থাকেন।” পংক্তিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভারি গলায় বলে হিমান্ত,
“কী হলো?”

“কিছু না। বসছি।” অভিমানি মনে একটু দূরুত্বে হিমান্তের পাশে জবুথবু হয়ে বসে খামটা খোলে পংক্তি। ভেতরে যা ছিল তা দেখে বিস্ময়ে তার চোখ ছানাবড়া। স্কুলের ভর্তি ফরম। সকল ভয়,লজ্জা,জড়তা ভুলে হিমান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে রয় পংক্তি। আনন্দে চোখের কোনে জল চিকচিক করে ওর।

হিমান্ত ফিরে তাকায় না। বই নিয়ে ব্যস্ত সে। এদিকে তাকানোর ফুরসত তার নেই। অথচ সে যদি একবার তাকাতো তা হলে দেখতে পেত কারো দৃষ্টি জুড়ে তার প্রতিচ্ছবি। প্রেমিকরুপে, ভরসার মানুষরুপে কারো হৃদয় গহিনে তার পঁট খোদাই করা হচ্ছে একটু একটু করে।

পর্ব ১৬

পংক্তির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে হিমান্ত পাশ ফিরে তাকায়। পংক্তির দৃষ্টিজুড়ে তখনও হিমান্ত। ওকে এভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে হিমান্তের কপাল কুঞ্চিত হয়।

পংক্তির দু’চোখের ভাষা বুঝতে হিমান্তের বেশি সময় লাগলো না। পংক্তির দৃষ্টির মায়াজালে সেও নিজেকে কিছুসময় ঐ দৃষ্টিতে আবদ্ধ রাখলো। হঠাৎ কী ভেবে দৃষ্টি সরিয়ে চোয়াল শক্ত করে তুললো সে। গম্ভীর গলায় বললো,
“দেখেছ?”

“হু!”
“পংক্তি! “কিছুটা ধমকের সুরে ডাক দিতেই পংক্তি চমকে ওঠে। ঘোর কাটতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে মাথা নুয়ে ফেলে। হিমান্ত উঠে দাঁড়ায়। কিছুটা রাগ মিশ্রিত স্বরে বলে,
“দেখলে দেখো নয়তো ওঠ। বোকার মতো বসে থাকার মানে কী? সামান্য পরিমাণও কমনসেন্স নাই তোমার। এতো কেয়ারলেস কেন তুমি?”

আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে হিমান্ত। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কাঁপা হাতে সিগারেট ধরায়। অস্থির লাগছে হিমান্তের। বুকের বা’পাশ ভার ভার অনুভব করছে সে। সব কিছু পুনরায় স্বাভাবিক করতে এই নিকোটিনের ধোঁয়ায় এখন সম্বল। নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়ায় সবকিছু আড়াল করার চেষ্টা করলো হিমান্ত।

পংক্তি মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আগের পংক্তিকে কেউ বকলে পংক্তি কষ্ট পেত, কাঁদতো কিন্তু হিমান্তের বকায় এই পংক্তি অভিমান করেছে। পংক্তি আজকাল নিজের মধ্যেই নেই আর। সব এলোমেলো হয়ে গেছে রাগী লোকটার প্রেমে পড়ে। মনের আকাশ তার ভালোবাসার সাত রঙে রঙিন এখন।

তাতে আবার মাঝে মাঝে অভিমানের কালো মেঘ জমে। হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টিও হয়। তবে শেষমেশ ভালোবাসার রঙধনুতে পুনরায় রাঙিয়ে তোলে তনুমন। পংক্তি ভর্তি ফরমের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বলে,
“কী রাগ বাব্বাহ! সামান্য কারনে এতোগুলো কথা শুনিয়ে গেল। সব দোষ তো তারই। তাকে দেখতে গিয়েই না সব ভুলে গেছি।”

পরক্ষনেই মুচকি হেঁসে গুনগুন করে,
“আমার একলা আকাশ
থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে।

আমার দিনগুলো সব
রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে “
লজ্জায় হাতের কাগজগুলোয় মুখ ঢেকে মিটিমিটি হাসে পংক্তি।

বিকেলের দিকে শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে জন কিটসের ওড টু এ নাইটিঙ্গেল কবিতা পড়ছিল হিমান্ত। দরজায় নক হতেই মুখের সামনে থেকে বই টা সরিয়ে নিল। গম্ভীর গলায় বললো,
“ভেতরে এসো।” গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলো পংক্তি।

হাতে তখনকার খামটা। হিমান্ত বইয়ে চোখ রেখে তীর্যক স্বরে প্রশ্ন করলো,
“ভাবনা চিন্তা শেষ তোমার? শেষ না হলে একেবারে শেষ করে তারপর আসো।”
“আপনাকে নিয়ে ভাবনা তো আমার ইহকালেও শেষ হবে না। দুয়া করবো যেন পরকালেও শেষ না হয়।”

মুখে বললো,
“সরি!”
হিমান্ত কিছুক্ষণ মনোযোগী রইল বইয়ের পাতায়। পংক্তিও নিরবে দাঁড়িয়ে আড়েঠারে মানুষটাকে দেখছে। রুম জুড়ে নিরবতা। ক্ষনিক সময় বাদে হিমান্ত শব্দ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে বসলো। খোলা বইটা পাশে উল্টে রেখে ভর দিয়ে বসলো দু’হাটুতে। সামনে আসা চুলগুলোকে ব্যাকব্রাশ করতে করতে বললো,
“সবটা দেখেছ? ভুল ত্রুটি আছে কোথাও?”
“না!”
“গুড।

খামটা দাও আমাকে।” হিমান্ত হাত বাড়াতেই পংক্তি খামটা দিয়ে দেয়। হিমান্ত খামের ভেতরের কাগজ গুলো বের করে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল। পংক্তি যেতে উদ্যত হলে হিমান্ত ছোট্ট করে বলে,
“দাঁড়াও! “পংক্তি কৌতূহলে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো হিমান্ত নিজের মোবাইলে কারো নাম্বার ডায়াল করছে। তারপর পংক্তির দিকে না তাকিয়েই বললো,
“নাও মনিরার সাথে কথা বলো।

“মনিরার নাম শুনে পংক্তি খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। চট করে মোবাইলটা হাত থেকে নিয়ে কানে লাগিয়ে বললো,
“হ্যালো মনিরা!”
“ঐ পাগলি মেয়ে, কলটা তো ধরতে দাও আগে ওকে।

“গম্ভীরতা ম্লান করে ঠোঁটের কোনে হাসি ফোঁটে হিমান্তের। পংক্তি নিজের বোকামিতে লজ্জায় দৌড়ে বেরিয়ে আসে হিমান্তের রুম থেকে। রিং যাচ্ছে তখনও। পংক্তি জিহ্বা কামড়ে অন্ধকার ব্যালকনিতে গিয়ে দেয়াল ঠেঁসে দাঁড়ায়। হিমান্তের কন্ঠে পাগলি মেয়ে কথাটা পংক্তির হৃদয় প্রশান্ত করে। সাথে মুচকি হাসি বোনাস ছিল সেই প্রশান্তি দীর্ঘ করতে। বেশকিছুক্ষন রিং হওয়ার পর মনিরা রিসিভ করে।

“আসসালামু ওয়ালাইকুম স্যার।”
“তোর স্যার না,আমি পংক্তি।”
“পংক্তি তুই। কেমন আছিস বইন?”

“তোর সাথে একটুও কথা নাই যা। পরশুদিন আসবি বলে সেই যে গেলি তারপর আর দেখা নাই। পরশুদিন তরশু,বরশু টরশু দিন হয়ে গেছে। আমি তো তোর কেউ না তাই খোঁজ নিয়ে কী হবে আর?”
“আল্লাহ রে! আরে থাম বইন। তোর মুখে তো খই ফুটছে রে। ব্যাপার কি? পংক্তিই নাকি তুই?
“দ্যাখ মনিরা মজা করবি না বলে দিলাম। তোর উপর অনেক রেগে আছি আমি।”

মনিরা পংক্তির রাগ ভাঙানোর মিশনে নামে। সে জানায় তার কিছু সমস্যা হয়েছিল। যেকারনে সে নির্দিষ্ট দিনে আসতে পারে নি। পংক্তি মনিরার সমস্যার কথা জানতে চাইলে মনিরা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। পংক্তির মনে খটকা লাগে। বার কয়েক জিজ্ঞেস করেও সদুত্তর পায় না সে। মনিরা এটা সেটা বলে পংক্তির মাথা থেকে প্রসঙ্গটা আড়াল করে। হিমান্তের প্রতি তার দূর্বলতার কথা পংক্তি মনিরাকে জানায় না। তবে আর সব কথায় সে বলে।

সারার সাথে কথা বলিয়ে দেয়। আরও নানা বিষয়ে কথা হয় ওদের। মনিরা জানায় ভর্তির যাবতীয় কাগজপত্র সেই যোগাড় করে দিয়েছে। মনিরা এও বলে পংক্তির অভিভাবকত্ব সে হিমান্তকে দিয়েছে। পংক্তিকে এখন থেকে তার কথামতোই চলতে হবে। মনিরার অগাধ বিশ্বাস হিমান্তের উপর। পংক্তির মধ্যেও সে সেটা তৈরি করতে চায়।

যদিও মনিরার অজানা ইতোমধ্যেই হিমান্তের উপর শুধু অগাধ বিশ্বাস নয় অগাধ ভালোবাসাও সৃষ্টি হয়েছে তার বান্ধবীর মনে।
খুব শীঘ্রই মনিরা এখানে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা শেষ করে। পংক্তির মন প্রেমের দোলায় দুলছে। হিমান্তের প্রশংসা করে মনিরা সে দোলার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। পংক্তি মোবাইল ফেরত দিতে গিয়ে সারার কথা ভাবে। সে স্কুলে ভর্তি হলে সারার কী হবে? সারার জন্যই তো তাকে রাখা হয়েছে।

পংক্তিকে ভাবুক মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হিমান্ত চোখ তুলে তাকায়। আজকাল পংক্তি আগের মতো বড় করে ঘোমটা দেয় না। যার কারনে চেহারা স্পষ্ট বোঝা যায়। হিমান্তের কন্ঠ প্রায় রোধ হয়ে আসে যতোবার পংক্তির থুতনির নিচের তিলটা চোখ পড়ে।

দৃষ্টিতে মাদকতা বিরাজ করে তখন। পংক্তির চোখে চোখ পড়তেই হালকা কেঁশে দৃষ্টি ফেরায়। ভরাট গলায় বলে,
“কিছু বলবে?”
“না মানে! আমি স্কুলে গেলে সারাকে কে দেখবে?”

“যে স্কুলে তুমি ভর্তি হবে সেখানের এক টিচার আমার ক্লাসমেট ছিল। তার ছোট মেয়ে সারার বয়সী। স্কুলের পাশেই বাসা ওদের। একজন কাজের লোক আছে ওর মেয়েটাকে দেখাশোনার জন্য। তোমার ক্লাসের টাইমে সারা সেখানেই থাকবে।” কথাগুলো হিমান্ত বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো। পংক্তি নিচু স্বরে দ্বিধান্বিত হয়ে বলে,
“কিন্তু! “
“কোনো কিন্তু নেই। যাও এখন। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে রাতের আগে আর আসবে না এ’ঘরে।”

পংক্তি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হিমান্তের দিকে তাকায়। হিমান্ত ততোক্ষণে বইয়ে পাতায় মুখ ডুবিয়েছে। দু’কদম এগিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে হিমান্তের বইয়ে ঢাকা আধো মুখখানি দেখে মনে মনে বললো পংক্তি,
“কোন সাগরে ডুব দিলি রে, গভীর কতোখানি?

মরবি নাকি ভাসবি প্রেমে, কেবল জানে অন্তর্যামী।”

পর্ব ১৭

সদ্য স্নান সেরে রুমে এলো পংক্তি। শাড়ির কুঁচি ঠিক করে, আঁচলটা দুপাট্টা করে কাঁধে নিল। ভেজা চুলের জলের ফোঁটায় গ্রীবাদেশে মুক্তোর দানার মতো জল জমে আছে। বড়ই আকর্ষণীয় লাগছে এই মুহূর্তে পংক্তিকে। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই পেছনের মানুষটার সাথে শুভদৃষ্টি হলো তার। মানুষটার চোখের, ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসির আভাস। পংক্তি নাক কুঁচকে জিহ্বা ভেঙাতেই মানুষটা দ্রুততার সাথে কোমর জড়িয়ে ধরলো।

নিগূঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে নিল পংক্তিকে। মানুষটার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কানে এসে লাগছে। স্থির,নিশ্চল পংক্তি। মানুষটার স্পর্শের মোহমুগ্ধতায় জমে গেছে সে। পংক্তির গ্রীবাসুন্দর থেকে ক্রমশ মানুষটার ওষ্ঠদ্বয় পংক্তির কর্ণলতিকায় গিয়ে থামলো।

সেই গম্ভীর গলায়, গুছানো শব্দে বললো,
“ভালোবাসি প্রিয়া,বড্ড বেশিই ভালোবাসি তোমায়।” দু’চোখ বন্ধ করে মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করছে পংক্তি।

মানুষটা ভালোবাসার সব মধু মিশিয়ে ওর নাম উচ্চারণ করলো,
“পংক্তি! “
“হু!”
“চোখ খোলো।”

“না! লজ্জা লাগে।”
“খোলা না।”
“না! অনেক লজ্জা লাগে আপনার চোখের দিকে তাকালে।”

“পংক্তি আন্টি! আন্টি, কি হয়েছে তোমার? ও আন্টি!”সারা ঘুমন্ত পংক্তিকে ধাক্কাতে শুরু করলো। পংক্তি ঘুমের ঘোরেই লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে বিড়বিড় করতে করতে। সারা ভয় পেয়ে কান্না জুড়ে বসে।

জোরে জোরে ধাক্কাতে শুরু করে পংক্তিকে। পংক্তির স্বপ্ন ভঙ্গ হয় সারার কান্নার শব্দে। চোখ মেলেই হতভম্ব সে। হায় রে কপাল! সে এতোক্ষন স্বপ্ন দেখছিল। লজ্জায় দাঁত কামড়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে। সারা অশ্রু ভেজা চোখে তখনও হা করে চেয়ে আছে।

পংক্তি সারাকে টেনে বুকের মধ্যে নিয়ে নিজের কপাল চাপড়ায়। সারা নাক টানতে টানতে বলে,
“আন্টি কী হয়েছে তোমার? এমন করলে কেন তুমি?”
“কিছু না মা। আন্টি দুষ্টুমি করছিল তোমার সাথে। তুমি ভয় পেয়েছ মা?”পংক্তি তোতলায় কথাটা বলে। নার্ভাস ফিল করছে সে। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে।

কী দেখলো স্বপ্নে! ভাবতেই যেন তনুমনে বসন্তের পবন ছুঁয়ে দিয়ে গেল। শিহরণ জাগলো দেহে। সারার ওয়াশরুমের চাপ ধরায় সে জেগে উঠেছিল শেষরাতে। পংক্তি সারাকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুম করিয়ে আনে। আজ রাতে চেষ্টা করেও ঘুম হলো না পংক্তির। সারারাত কর্ণপর্দায় অনুরণিত হলো,”ভালোবাসি প্রিয়া,বড্ড বেশিই ভালোবাসি! কথিত আছে মানুষের অবচেতন মন সর্বক্ষন যা চিন্তা করে তাই স্বপ্ন দেখে।

পংক্তি বিনাবাক্য মেনে নেবে, সে এই ৮ মাসের প্রতি ঘন্টায়,প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিটে হিমান্তের ভালোবাসার জন্য চাতকী হয়ে আছে। হিমান্ত পংক্তির মধ্যেকার সম্পর্ক বদলেছে। একে অন্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে দু’জন। হিমান্তের কেয়ারে পংক্তি মাঝে মাঝে নিজের অতীতই ভুলে বশে। পংক্তির A-Z সকল প্রয়োজন জানামাত্রই পূরণ করে হিমান্ত।

১৮ বছরের আগে পংক্তির জীবনে যতো অসম্পূর্নতা ছিল সব যেন এই আটমাসে পূর্নতা পেয়েছে। শুধু আর একটা অপূর্ণতা। হিমান্তের মহীয়সী, সহধর্মিণী হওয়ার সাধ পংক্তি গত আটমাস ধরে মনে লালন করে আসছে। হিমান্তের সামনে আজও তার কন্ঠ স্বর কাঁপে। নয়তো কবেই বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে দিতো,
“সতেরো বসন্ত গত হয়েছে।

কী অপূর্ণতায় না ছিল তাতে! অবশেষে আপনি এলেন মনের দুয়ারে। ফাগুন হাওয়ায় দুলে দুলে এলেন। সতেরো বসন্তের পলাশ,কৃষ্ণচূড়া, শিমুল, কাঁঠালচাপা সবটা নিয়ে এলেন। শাঁখে শাঁখে কোকিলের কুহু গান। আপনার বুকে বাসর আজ আমার। কবিগুরুর গানে ছন্দময় সে বাসর।
মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে।

মধুর মলয়-সমীরে মধুর মিলন রটাতে॥”
পংক্তি যতোবার ভেবেছে বলবে ততোবারই কিছু না কিছু নিয়ে হিমান্ত তাকে ধমকেছে। এই লোকটার এতো রাগ কেন! কেন! তার রাগ দেখে পংক্তির সাহস উবে যায়। সকল কথা কন্ঠনালিতেই রুদ্ধ হয় তখন।

আজকাল হিমান্ত নেশা করা কমিয়ে দিয়েছে। এজন্য সে নিয়মিত ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে। তার এখন অনেক দায়িত্ব। তাকে নেশা করে পড়ে থাকলে আর চলবে না। পংক্তি নামাজ পড়ে সকালের নাস্তা তৈরি করে। হিমান্ত রেডি হয়ে আসার আগেই নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে চলে আসে রান্নাঘরে। রাতে যে স্বপ্ন দেখেছে তারপর মানুষটার সম্মুখীন সে কিছুতেই হতে পারবে না। যদি বুঝে যায় কিছু?

পংক্তির মনে হিমান্তকে হারিয়ে ফেলার ভয় জন্মে। এই ভয়টার কারনেও সে নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রেখেছে। হিমান্ত নাস্তা খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। সারা ততোক্ষণে জেগে গেছে। মামার কোলে উঠে পংক্তির গতরাতের আচরনের কথা বলে দেয় সে।

হিমান্তের কপালে ভাঁজ পড়ে সারার কথা শুনে। সারাকে আদর আহ্লাদ করে বেরিয়ে আসে। ভার্সিটির জন্য বেরোবে সে। দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে হিমান্ত। পাশেই রান্নাঘর। এক পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। ভারী স্বরে ডাকে,
“পংক্তি!
“জ্বি!”পংক্তি চকিত চেহারায় ছুটে এসে দরজার কোন ঘেষে দাঁড়ায়।

দৃষ্টি তার ফ্লোরে নিবদ্ধ। মন চাইছে মানুষটার চোখে চোখ রেখে তাকাতে কিন্তু পারছে না। সাহস নেই পংক্তির। হিমান্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল দীর্ঘক্ষণ। পংক্তির বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। এতোক্ষন হয়ে গেল অথচ কিছুই বলছে না। বিষয় কী? পংক্তি ভাবিত হয়। চোখ তুলে তাকাতে গেলেই হিমান্তের প্রশ্নে সাহস হারায়। হিমান্ত বলে,
“সারা বললো রাতে নাকি কী হয়েছিল তোমার?”

“এই সারা সব বলে দেয়। আল্লাহ জানে কী কী বলেছে? এখন কী জবাব দিব আমি? তাকে নিয়ে রোমান্টিক স্বপ্ন দেখেছি সেটা বলবো? মেরে রোদে শুকিয়ে ছাতু বানিয়ে খেয়ে ফেলবে নগদে। আল্লাহ আমি কী বলবো!”
“কী হলো? অসুস্থ তুমি? ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?

“না! না! কিচ্ছু হয় নি। স্বপ্ন দেখেছিলাম তো তাই।” পংক্তি নিচু স্বরে চোখ খিঁচে ধীরে ধীরে জবাব দিল।
“ওহ! কিছু আনতে হবে আসার সময়?”

“মাছ ফুরিয়ে গেছে। সাথে কিছু কাঁচা সবজিও আনতে হবে।”
“আচ্ছা নিয়ে আসবো। চলি।” চলি বলেও দাঁড়িয়ে রইল হিমান্ত। পংক্তি হিমান্তের পায়ের পলিশ করা চকচকে জুতা আর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। দু’হাত পকেটে ঢুকানো। পংক্তি ভেবেছিল আরও হয়তো কিছু বলবে। কিন্তু কিছুই বলেনি৷ মিনিট দুয়েক পর প্রস্থান করে হিমান্ত। পংক্তির খুব ইচ্ছা হয় মানুষটা যখন এভাবে অকারনেই ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তখন তার মুখটা দেখা।

কী ভাবছে সেটা বোঝা। কিন্তু চেষ্টা করেও তাকাতে পারে না সে’সময়। বাই চান্স যদিওবা সাহস করে সামান্য একটু চোখ তুলতে চায় আচমকা ধমক দিয়ে বসে হিমান্ত। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ধমকটা পড়ে পংক্তির উপর। ব্যস পংক্তির সাহস ফুসস। চোখ তোলা তো দূরের কথা চোখ বন্ধ করতে হয় ভয়ে।

হিমান্ত বেরোনোর পরপরই পংক্তি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে হিমান্ত। হালকা পিঙ্ক কালার শার্টে মারাত্মক লাগছে হিমান্তকে। তারউপর যখন সে হাটতে হাঁটতে ঘাড় ঝুঁকে চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করছে উফ! পংক্তির যেন দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। যতোক্ষণ চোখের আড়াল না হলো হিমান্ত, পংক্তি একচুলও নড়ে না ব্যালকনি থেকে। সেই সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত আর দেখা হবে না মানুষটাকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনটা হালকা করে নিল পংক্তি।

স্কুল ড্রেসের রঙের এপ্রোন সাথে হিজাব পড়ে রেডি পংক্তি। সারা আজও যাবে না সাদিয়া ম্যাডামের বাসায়। সোনিয়া আপার সাথে পংক্তিদের সম্পর্ক এখন পরিবারের মতো। পংক্তির আপা ডাকে সোনিয়া সত্যিই নিজেকে ওর আপা ভেবে নিয়েছে। পংক্তিদের সকল সুবিধা অসুবিধার খেয়াল সে রাখে। সারা আর মিরাকে আলাদা চোখে দেখে না। এদিকে মিরার সাথেও পাক্কা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে সারার।

দিনের বেশিরভাগ সময়ই তার মিরার সঙ্গ চায়। আজও মিরার সাথে খেলবে সে। ব্যাগ গুছিয়ে সারাকে সোনিয়ার তত্বাবধানে রেখে স্কুলের পথে রওনা হলো পংক্তি। হেঁটে গেলে বিশ মিনিটের পথ। সামনে অটোস্ট্যান্ড থেকে অটোতে উঠলো সে। হিমান্তের কড়া নির্দেশ অটো ছাড়া যাওয়া যাবে না। পংক্তির কী সাধ্য সে হিমান্তের নির্দেশ অমান্য করে! অটোতে বসে কিছুদূর এগোতেই মনিরাকে দেখলো। রিকশা করে উল্টোদিকে যাচ্ছে সে।

পংক্তি ডাকবে তার আগেই অটো অনেক দূর চলে এসেছে। মনিরা আজকাল আর তেমন আসে না পংক্তির সাথে দেখা করতে। পরশুদিনও কল করেছিল পংক্তি, ব্যস্ততা দেখিয়ে রেখে দিয়েছিল মনিরা। ইদানিং মিনিটের পর মিনিট কল করেও মনিরার সাথে কথা বলতে পারে না পংক্তি। মনিরা যেন কেমন পর পর আচরণ করে। পংক্তির চোখদুটো ছলছল করছে।

পংক্তির জীবনে হিমান্ত,মনিরা আর সারা ছাড়া কেইবা আছে? পংক্তি ভেবে নিয়েছে আজ বাসায় গিয়েই আবার কল করবে। কতোক্ষন রিসিভ না করবে দেখবে সে। মনিরার সমস্যা কী সেটা জেনেই ছাড়বে আজ। আপন মানুষগুলোকে সে হারাতে চায় না। কোনোমতেই না। ভাড়া মিটিয়ে পংক্তি স্কুলে ঢুকলো।

“ঐ গোলাপী!”ডাকটা শুনে দাঁতে দাঁত পিষে দাঁড়ালো পংক্তি। পংক্তিদের স্কুলের পাশেই কলেজ। ছেলেটা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। গত চারমাস ধরে পংক্তির আসা যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকে।

ইদানিং আবার উপরোক্ত নামেও ডাকা শুরু করেছে। বিরক্ত লাগে পংক্তির। একবার ভেবেছিল হিমান্তকে বলবে এ ব্যাপারে পরমূহুর্তে সে ইচ্ছার ত্যাগ দিয়েছে। পংক্তির স্কুলফ্রেন্ড মিতু বলেছে”বাদ দে। আর তো কটা দিন। এসএসসি দিয়ে স্কুল থেকে চলেই যাওয়া লাগবে শুধু শুধু ঝামেলা পাকানোর দরকার নেই”পংক্তি সে’মতেই ছেলেটাকে এড়িয়ে চলে।

তবুও পিছু ছাড়ছে না ছেলেটা। নেহাতই পংক্তি ভীতু গোছের মেয়ে বলে বেঁচে গেল। নয়তো ঠাটিয়ে চড় বসাতো ছেলেটার গালে। পংক্তি যখন মনে মনে ক্ষিপ্ত হচ্ছিল তখনই সামনে এসে দাঁড়ালো মৌসুম। হাত বাড়িয়েই প্রতিদিনের মতো শাহরুখ খান স্টাইলে বললো,
“মৌসুম চৌধুরী। নাম তো শুনেইছ?”

কথাটা বলে ঝুঁকতেই পংক্তি পাশ কেটে সামনে এগোয়। মাথা উঁচু করে পংক্তিকে সামনে না দেখে পেছন ফিরে তাকায় মৌসুম। গতচারমাস ধরে মেয়েটার পিছে লেগে আছে। ভাও ই দিচ্ছে না মেয়েটাকে ওকে। ইদানিং একই নিয়মে একই ডায়লগ দিচ্ছে তবুও একটা কথা বলে না। মৌসুম চৌধুরীর নামে যেখানে স্কুল কলেজের মেয়েরা হুলস্থূল করে ফেলে। সেখানে এই মেয়ে নির্বাক। পংক্তিকে পাবার আকাঙ্খা যেন আরও তীব্র হয়ে উঠলো মৌসুমের ভেতর। কত মেয়েকে সে পটিয়েছে, প্রেম করে মন উঠে গেলে ব্রেকাপও করেছে।

ঐ মেয়েদের ক্যাটাগরি না এই মেয়ে সেটা এতোদিনে বোঝা হয়ে গেছে মৌসুমের। সেই ভিন্নতার কারনেই যেন মেয়েটার ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পংক্তির যাওয়ার পানে তৃষ্ণিত পথিকের মতো চেয়ে রয় মৌসুম। তার চোখের তারায় তারায় শুধু পংক্তির প্রতিমূর্তি।

পর্ব ১৮

স্কুল জীবনের বেস্ট স্মৃতিময় সময়টুকু নবম-দশম শ্রেণীতে থাকাকালীন। পংক্তি কয়েকমাস গত হলে নবম শ্রেনীতে ভর্তি হয়। সবার সাথে মিশতে তার সময় লাগে। তবে আগের মতো সে নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে না। ক্লাসমেটদের সাথে প্রয়োজনে কথা বলে, মিতু নামী মেয়েটার সাথে বন্ধুত্বও হয়েছে। জীবন রঙ বদলায়। কখনো মেঘে ঢেকে ধূসর তো কখনো সাতরঙা রংধনুর ছটায় রঙিন।

পংক্তির আকাশে রংধনু উঠেছে। হিমান্ত নামক রংধনু। ক্লাসরুমে বসে জানালার বাইরের মেঘলা আকাশ দেখছে সে। পৃথিবী কতো রূপ বৈচিত্র্যময়! কতো সৌন্দর্য্য এর আনাচে কানাচে! এই মেঘলা আকাশকে এর আগে এতো সুন্দর লাগে নি পংক্তির। দু’হাত গাল ঠেকিয়ে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে সে। দেখতে দেখতে অঝোর ধারায় বর্ষা নামল। পংক্তির মনের ময়ূরী নাচছে বর্ষার ঝিরিঝিরি শব্দে।

“এই মেঘ মল্লারে উন্মনা উতলা
হোক তব প্রেমের মধুর সূচনা।

টুপটাপ বরিষনে থেকে থেকে বিজলীর অভিমানী গর্জনে।
চলো তুমি আমি মিশে যায় ভালোবাসার গহীনে।

তোমার ছোঁয়া লেগে থাক সর্ব অঙ্গে মোর
হয়ে ঠিক ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে হিমেল পবন।”

পংক্তির ঘোর কাটলো ফিন্যান্স স্যারের আগমনে। ক্লাস শুরু হলো। অনেক কষ্টে পড়ায় মনোযোগ দিল সে। ফিন্যান্স সহজে পংক্তির মাথায় ঢোকে না। তবে হিমান্ত বুঝালে পানির মতো সহজ মনে হয়। পংক্তির আলাদা কোনো টিউটর নেই। স্কুল শেষে সোজা বাসায় যাবে।

ফ্রেশ হয়ে সকালে রান্না করা খাবার গরম করে পড়তে বসে যাবে। মাঝে মাঝে সারার সাথে খুনশুটি অবশ্যম্ভাবী। হিমান্ত রাতে এসে ফ্রেশ হয়েই পংক্তির পড়া দেখবে। রুটিন মাফিক প্রতিটি পড়া কমপ্লিট করেই তবে ছুটি পংক্তির। যেহেতু পংক্তি এখন ক্লাস টেনে সুতরাং পড়ার চাপ খুব। হিমান্ত বলে দিয়েছে একবেলা রান্না করে তিনবেলা খেতে হবে। রান্নার পেছনে সময় নষ্ট করা মোটেও চলবে না।

পংক্তি সে’মতেই সকালে নাস্তা বানিয়ে, তরকারী রান্না করে ঠান্ডা করে ফ্রিজে রাখে। রাতে শুধু ভাতটা চড়াবে। সেটাও মাঝে মধ্যে হিমান্ত করে। দুপুরে কেউ বাসায় থাকে না সুতরাং দুপুরের খাবার নিয়ে চিন্তা নেই। পংক্তি টিফিন বানিয়ে সারার জন্য রেখে আসে নিজেও নিয়ে আসে। এভাবে চলছে পংক্তির সাজানো গোছানো জীবন। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে দৈনন্দিন চিন্তা ভাবনা করতে করতে লাস্ট পিরিয়ডে চলছে।

কৃষি শিক্ষা ক্লাস হচ্ছে এখন। পংক্তি এই ক্লাসে রিলাক্সড ফিল করে। কৃষি স্যারটা দারুন অমায়িক আর মজার। দ্রুত পড়া দিয়ে মিতুর সাথে গল্প করতে বসে। মুখটা ভার করে মিতুকে বললো,
“শোন না! ঐ ছেলেটা আজও পিছু নিয়েছিল।”

“ইসস! তোর কপাল একখান পংক্তি। মৌসুম চৌধুরী তোর প্রেমে পড়েছে। চাট্টিখানি কথা বল তো?”
“দ্যাখ মজা করিস না। আমি কী উনাকে বলবো?”
“আজব মেয়ে তুই তো! তোর উনাকে এসব ব্যাপারে কেন টানছিস? কিছু হইলেই উনাকে বলবো, উনাকে বলবো! নিজের বলে কী কিছু আছে তোর? বুদ্ধি নাই তোর? তুই বলতে পারিস না মৌসুমকে কিছু?”

“আমার ভয় করে।” পংক্তির কথা শুনে মিতু কপাল চাপড়ায়। কৃষি স্যার সেটা দেখে ফেলায় জিহ্বা কামড়ে সরি বলে চুপ করার ভান ধরে। পংক্তির মুখে তখনও চিন্তার ছাপ। মিতু ঠোঁট না নাড়িয়ে চাপা স্বরে বলে,
“ভয় কে জয় করতে হবে। আজ ছুটির সময় এর একটা বিহিত করেই ছাড়বো আমি। হয় তুই ওর সাথে কথা বলবি নয় ঠাঁটিয়ে চড় দিবি।” পংক্তি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালে মিতু খিস্তি দিয়ে ওঠে।

তা দেখে ফিক করে হেঁসে ওঠে পংক্তি। কৃষি স্যার এবার দু’টোকেই চোখ গরম দিয়ে সাবধান করে। পংক্তি মিতু চোখাচোখি করে মুখ টিপে হেঁসে দেয়।
ক্লাস শেষে পংক্তি, মিতু একসাথে বের হয়। যাওয়ার সময় কিছুটা পথ দু’জন হাঁটে। তারপর যে যার বাসার দিকে যায়। কলেজের মাঠের পাশের রাস্তা ধরে হাঁটছিল ওরা।

মিতুর চোখজোড়া মৌসুমকে খুঁজছে। কিছুদূর এগোতেই সামনে মৌসুমকে ফ্রেন্ড সহ দাঁড়াতে দেখে মুচকি হেঁসে পংক্তিকে গুতা দেয়। সাদা শার্ট, নেভিব্লু প্যান্টে ৫ ফুট ১০ ইঞ্চির মৌসুমকে হিরো লাগছিল। ঠোঁটে মোহনীয় মুচকি হাসি। পংক্তিকে দেখেই হাসিটা আরও প্রশস্ত হলো।

পংক্তি নজর সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। ওরা মৌসুমের পাশ কাটতেই মৌসুমের বন্ধুরা গান গেয়ে উঠলো,
“ও বন্ধু লাল গোলাপী কই গেলা রে। এসো এসো বুকে রাখিবো ধরে।”
পংক্তির ইচ্ছা হচ্ছে জুতা খুলে ইচ্ছামতো পিটাতে বদ গুলাকে। পংক্তির এই অব্যক্ত ইচ্ছা মৌসুম পূরণ করে দিল।

কিল,গুষি,লাথি দিয়ে বিদায় করলো সবকটাকে। ওর বন্ধুরা হতভম্ব মৌসুমের আচরণে। যেতে যেতে কষ্টভরা মুখে পিছু ফিরে সেটায় বুঝালো তারা। এর আগে মৌসুমের টার্গেট করা বহু মেয়েদের লক্ষ্য করে এর চাইতেও খারাপ ইঙ্গিতের গান গেয়েছে। অথচ আজ মৌসুম তাদের এভাবে অপমান করলো! বন্ধুদের মেরে মৌসুমও খুশি হয় নি। খারাপ লাগছে ওর। কিন্তু পংক্তিকে নিয়ে এমন গান সহ্য করতে পারে নি মৌসুম। রাগ উঠে গিয়েছিল মাথায়। ব্যথা পাওয়া হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে এলো।

নত মুখে বললো,
“ওদের পক্ষ থেকে আমি সরি। প্লিজ কিছু মনে করো না।”

পংক্তি মৌসুমের কথায় জবাব না দিয়ে হাঁটা ধরে। মেজাজটায় খারাপ হয়ে গেছে ওর। মিতু মৌসুমের মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে পংক্তিকে বলে,
“ছেলেটার সাথে একটু কথা বললে কী হয়? তাকিয়ে দ্যাখ একবার কেঁদে দেবে ভাব। চল না!”
“না আমি যাব না। তোর দরদ লাগলে তুই যা।”

“তুই তো এমন না পংক্তি তবে মৌসুমের নাম শুনলে এমন কেন করিস?”
“জানি না তবে ওকে আমার পছন্দ না।”
মিতু পংক্তির হাত টেনে ধরে।
“আজ ওর সাথে কথা বলবি তুই। সরাসরি বলে দে তুই ওকে পছন্দ করিস না। চল।”

“মিতু প্লিজ! ছাড়!”
“না চল।” মিতু টানতে টানতে মৌসুমের সামনে নিয়ে আসে পংক্তিকে। পংক্তিকে খোঁচায় কথা বলার জন্য। মৌসুম বিস্মিত পংক্তিকে সামনে পেয়ে। মলিন মুখটা সহসায় হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পুনরায় বলে,
“আ’ম সরি।”

পংক্তিকে ধাক্কাতেই পংক্তি মিতুর উপর ক্ষিপ্ত হয়। সামনে মৌসুম জবাবের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। নিরুপায় পংক্তি কঠিন স্বরে বলতে গিয়েও কাঁপা স্বরে জবাব দেয়,
“ঠিক আছে।” পংক্তি জোর করে হাত ছাড়িয়ে চলে আসতে চাইলে মৌসুম বলে,
“এতোটাও খারাপ নই আমি। বন্ধুত্ব করায় যায়। প্লিজ!”
পংক্তি কী বলবে ভেবে পায় না। কাওকে মুখের উপর কিছু বলাটাতেও সে পারদর্শী না। মিতু আনন্দে বিগলিত হয়ে পংক্তির আগেই জবাব দেয়।

“অবশ্যই। অবশ্যই।” পংক্তি না চাইতেও মিতুর সাথে সম্মতি জানায়। মৌসুম ছেলেটার কথাবার্তা খারাপ লাগে না পংক্তির। মিনিট পাঁচেক ওরা কথা বলে। পংক্তি দেরি হচ্ছে বলে বিদায় নিয়ে চলে আসে। মিতু,মৌসুম তখনও গল্পে মশগুল। ওদের বাসা এক এলাকায় হওয়ায় ওরা দু’জন একসাথে সেদিকে যায়।

সারা ঘুমিয়ে গিয়েছে। পংক্তি সোনিয়া আপার বাসা থেকে ঘুমন্ত সারাকে কোলে করে বাসায় ঢোকে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ঘর গুছাতে গুছাতে সন্ধ্যার আজান পড়ে গেল। হিমান্ত আসার সময় হয়ে গেছে। সারাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ফ্রেশ করে। হালকা নাস্তা খাইয়ে দু’জনে পড়তে বসে। বই সামনে নিয়ে ঠোঁট উল্টে বসে আছে সারা। পড়তে বসলে সে প্রতিদিনই এই কাজ করে। পংক্তি ঠোঁট টিপে হেঁসে গম্ভীর স্বরে বলে,
“কিরে পড়ছিস না কেন? পড়!”

“ভাল্লাগে না। খিদে পেয়েছে।”
“এই মাত্র তো খেলি। এই পৃষ্ঠা পড় তারপর তোর ছুটি”
“অনেক খিদে পেয়েছে আমার। দেখো কেমন শুকিয়ে ন্যাতাভ্যাতা হয়ে গেছে পেটটা।” পেটের উপর থেকে গেঞ্জিটা সরিয়ে মুখ ফুলিয়ে দেখায়।

“ন্যাতাভ্যাতা আবার কী? মাঝে মাঝে কিসব বলিস তুই। সব মাথার উপর দিয়ে যায়।”
“আমি খিদেতে অজ্ঞান হয়ে যাবো। আমার মাথা ঘুরছে। আন্টি মরে গেলাম। ছুটি দাও।”
সারাকে এমন করতে দেখলে পংক্তির পেট ফেটে হাসি পায়। এখনও পাচ্ছে। হাসতে গিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে সেটাকে দমালো। মুখটা কঠিন করে সারার দিকে ফিরে বললো,
“অনেক খিদে পেয়েছে?”

“এত্তোওও।” দু’হাত মেলে জবাব দেয় সারা।
“তোকে এক শর্তে খেতে দেব। তার আগে বল তোকে আমি তিনটে আপেল দিলাম। তুই তোর মামাকে সেখান থেকে দিলি দুটো। তাহলে মোট কয়টা থাকলো তোর কাছে?”

সারা পড়েছে মহা মুসিবতে। পড়বে না বলে খিদের বাহানা করেছে, এখন তো অংক ধরে বসলো পংক্তি আন্টি ওকে। যেই লাউ সেই কদু। কী করবে ভাবতে ভাবতে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। তৎক্ষনাৎ হেঁসে ফটাফট জবাব দিল,
“একটাও না।”

পংক্তি অবাক হয়ে বললো,
“একটাও না মানে? তুই পারিস নি। তোর ছুটিও হবে না। খেতেও দেব না।”
“আমি পেরেছি।” দৃঢ়তার সাথে জবাব দেয় সারা।

“কেমনে? বুঝা তো আমাকে।”
“দেখো তুমি যে’কটা আপেল দিয়েছ সেগুলো তো আমি খেয়েই নেব তাই না? আমার পেটে তো এখন অনেক খিদে তাই মামাকে আমি আজ দিব না। সব খেয়ে ফেললে তো একটাও থাকে না। তাই উত্তর একটাও না।”

“এ্যাআআ!”
“আমার ছুটি রে রে। আমি মিরার সাথে গিয়ে খেলব এখন।” পংক্তি বোকা বনে হাঁ হয়ে আছে। কি চমৎকার সমাধান দিয়ে চলে গেল সারা! পংক্তি পিছু ডাকবে তার আগেই সারা পগার পার। সারা যেতেই শব্দ করে হেঁসে উঠলো পংক্তি।

লেখা – তানিশ শেখ

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “সাঁঝের বেলার রাঙা গোধূলি – Ekta bhalobasar golpo story” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – সাঁঝের বেলার রাঙা গোধূলি (শেষ খণ্ড) – Ekta bhalobasar golpo story

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *