পাহাড়ে মেঘের ছায়া (১ম খণ্ড) -Valobasar Golpo 2021

পাহাড়ে মেঘের ছায়া – Valobasar Golpo 2021: আকাশের হাত ছেড়ে বৃষ্টি দৌড়ে গিয়ে মেঘকে জড়িয়ে ধরলো! মেঘও অবাক ও খুশি হয়ে বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরেছে! এদিকে আকাশ আর মেঘের পাশে দাড়িয়ে থাকা নাফিসা কিছুই বুঝতে পারছে না, শুধু হতবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে! বৃষ্টি মেঘকে ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে তাকে ইচ্ছে মতো মারতে লাগলো। তারপর…..


পর্ব- ১

ভোর চার টায়, জুতোজোড়া হাতে নিয়ে, রাতে গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা কাধে নিয়ে নিশব্দে হেটে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মেঘ। গেইটের বাইরে এসে ব্যাগটা গেইটের সিকে ঝুলিয়ে কেডস শো পড়ে নিলো। তারপর ব্যাগটা নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাসা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সিএনজি স্টেশনে চলে এলো। সকাল সকাল দৌড়ানোর ফলে ব্যায়ামটাও হলো আর মনটাও একদম ফ্রেশ হয়ে গেল।

একটা সিএনজি রিজার্ভ করে বাস স্টেশনে চলে এলো। সেখান থেকে টিকেট কেটে, দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে বাসে উঠে রওনা দিলো সিলেটের উদ্দেশ্যে।
মেঘ মাস্টার্স কমপ্লিট করে বছর খানেক হলো বাবার সাথে ব্যাবসায়ে হাত লাগিয়েছে। অনার্সের ছাত্র থাকাকালীন ই বাবার সাথে কন্টাক্ট করা প্রতি বছর কোথাও না কোথাও মাসব্যাপী ট্রিপে যাবে। আজ বন্ধুবান্ধব ছাড়া একাই রওনা দিয়েছে। বাসায় বাবা ছাড়া কেউ জানে না। অবশ্য বাবাও জানে না যে আজ যাবে।

ছোট বোন বৃষ্টি এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আর দু সপ্তাহের মতো আছে তার রেজাল্ট প্রকাশিত হবে। ভাইয়াকে প্রতি বছর ট্রিপে যেতে দেখে হিংসা হয় তার। তাই সেও বলেছে এবছর মেঘের সাথে ট্রিপে যাবে। রায়হান চৌধুরী মেয়ের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়েছে, যদি বৃষ্টি জিপিএ- ৫ পেয়ে পাস করে তাহলে যেতে দিবে মেঘের সাথে। বৃষ্টি এখন রেজাল্টের অপেক্ষায়ই আছে। কিন্তু এদিকে মেঘ বৃষ্টিকে সাথে নিতে রাজি নয়। জানেই কিছুদিন পর রেজাল্ট দিবে। তাই বৃষ্টি যেন তাকে না দেখতে পায়, সেজন্য চুপিচুপি পালিয়ে বেরিয়ে এসেছে বাসা থেকে।

মেঘ প্রকৃতির প্রেমিক। সবসময় প্রকৃতির লীলাভূমি, সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো সুযোগ খুজেই ট্রিপে জয়েন করে। আর তা যদি হয়, অরন্য, পর্বত শৃঙ্গ, জলধারা, সৈকত তাহলে তো কথাই নেই ! তাকে আর আটকায় কে!

উঁচুনিচু, সমতল বিভিন্ন পথ পেরিয়ে পৌছেছে সিলেটের হবিগঞ্জে। ভ্রমনকারীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত কোন এক রিসোর্টে উঠেছে মেঘ। ছোটখাটো এক রুম ভাড়া করে নিয়েছে। বাথরুমে গোসল সেড়ে হালকা নাস্তা করে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। রাতে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারেনি। তাছাড়া এতোটা সময় বাসে ভ্রমণ করে শরীর ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাই শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের জগতে তলিয়ে গেল।

বিকেলের দিকে ঘুম ভেঙেছে তার। খুব ভালো একটা ঘুম হওয়াতে শরীরটা একদম ফ্রেশ লাগছে। দেহে একটা আকাশী রঙের টিশার্ট জড়িয়ে ওয়ালেট আর ফোনটা সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ঘুরে দেখার জন্য। রিসোর্টের রেস্টুরেন্টে না গিয়ে একটু এগিয়ে চা বাগানের পাশে মাচায় তোলা ছোটখাটো হোটেলটায় লাঞ্চ সেড়ে নিলো। তারপর উঁচুনিচু জমিতে চাষ করা চা বাগান ঘুরে বেড়ালো। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে এলে রমনীগণকে দেখা যায় চা পাতা তোলার জন্য লাইন ধরে মাঠে নেমেছে। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এলে বাড়ি ফিরে যায় তারা। রমনীদিগের লাইন ধরে হাটা, চা পাতা তোলা, উঁচুনিচু চা বাগান, সূর্যাস্তসহ বিভিন্ন রমমের দৃশ্য ক্যামেরা বন্ধী করে সূর্যাস্তের পর রিসোর্টে ফিরে এলো মেঘ।

পরপর দুদিন কাটালো হবিগঞ্জে। তারপর এসে ভিড়লো সিলেটের জাফলং এ। অপরূপ সৌন্দর্য্যের মায়া মিশে আছে জাফলং। উঁচুনিচু ও অরণ্যে আচ্ছাদিত পাহাড়! গিরিপথ বেয়ে নেমে চলেছে জলধারা অর্থাৎ ঝর্ণা! ঝর্ণার পানিতে গোসল সেরে নিয়েছে মেঘ। সেখানে ঘুরাফেরার পর শ্রীমঙ্গলের একটা হোটেলে উঠলো। রাত, ভোর, দুপুর কাটিয়ে বিকেল তিন টার দিকে একটা পাহাড়ে উঠলো। বড়সড় পাহাড়টা বেশি উঁচু না হওয়ায় উপরিভাগটা সমতল। এদিকটায় চাকমাদের বসবাস। বিভিন্ন লোক মাঠে মেষ চড়াচ্ছে।

পাহাড়ের উপরিভাগে উঠতেই বাচ্চাদের একসাথে জড়ো গলার আওয়াজ শুনতে পেলো মেঘ। সামনে এগিয়ে দেখলো দশবারো জন বাচ্চাকে একটা মেয়ে পড়াচ্ছে! বাচ্চারা গলা ফাটিয়ে মেয়েটিকে অনুসরণ করে পড়ে যাচ্ছে। মনমুগ্ধকর একটা দৃশ্য! খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের উপর ছোট খাটো একটা স্কুল। শিক্ষক হিসেবে আঠারো-বিশ বছরের এক মেয়ে আর শিক্ষার্থী হিসেবে পাচ-সাত বছরের বাচ্চারা। এমন একটা দৃশ্য ক্যামেরা বন্ধী না করলেই নয়! মেঘ একটু দূর থেকেই ছবি তুলে কাছে এগিয়ে গেলো। মেয়েটিকে দেখে মেঘ একটু আশ্চর্য হলো। মেয়েটির চেহারা দেখে কোনো না কোনো দিক থেকে মনে হচ্ছে সে ঢাকার মেয়ে, আবার কোনো দিক থেকে মনে হচ্ছে সে পাহাড়ি কন্যা! অর্থাৎ সম্পূর্ণ ঢাকাইয়াদের মতোও না, আবার পাহাড়িয়াদের মতোও না! মেয়েটি কয়েকবার তাকিয়েছিলো মেঘের দিকে কিন্তু কোন কথা বা জিজ্ঞাসা করে নি। মেঘও কিছু বলেনি।

একটু পর বাচ্চাদের ছুটি হলে বাচ্চারা লাইন ধরে আগে চলেছে আর তার পিছন পিছন মেয়েটি যাচ্ছে। মেঘ পর্যাবেক্ষন করে দেখলো লম্বাটে মেয়েটার পড়নে সালোয়ার কামিজ। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, ঘনকালো লম্বা চুল। চুলগুলো খোলা, আর মাঝামাঝিতে ছোট একটা কাটা আটকে রেখেছে। পেছন থেকে দেখতেও খোলা চুলে দারুণ দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। ইচ্ছে করছিলো ছবি তুলতে, কিন্তু এভাবে ছবি তোলাটা অন্যায় হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছেটা সংযত রেখে পকেটে হাত দিয়ে মুচকি হেসে দাড়িয়ে আছে মেঘ। আরো কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে সন্ধ্যার দিকে পথের এক চায়ের দোকানে ঢুকলো। চা বিক্রি করছে এক মহিলা। দোকানের পেছনের দিকে একটু উচুতে মাচা পাতানো কাঠের ঘর।

দোকানীদেরই হবে হয়তো। চা অর্ডার করতেই ছোট ছেলেটি ছোট একটি মাটির পাত্রে চা এনে দিলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মেঘের সম্পূর্ণ শরীর শিহরিত হয়ে উঠলো। এই প্রথম তার মাঝে এমন শিহরণ জেগে উঠেছে! চায়ের দোকানের ছেলেটি এমন সাহেবি বেশের মেঘকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। সাত-আট বছরের ছেলেটিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘ জিজ্ঞেস করলো,

  • নাম কি তোমার?
  • বিধু চাকমা।
  • দোকান তোমাদের নিজেদের?
  • (দোকানীকে দেখিয়ে) উনি তোমার কি হয়?
  • মা।
  • এই বাড়িটাও তোমাদের?
  • হ। কইত্তে আইছেন?
  • ঢাকা থেকে।
    দোকানী ছেলেটিকে ডাকলে ছেলেটি চলে গেলো। আস্তে আস্তে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে আর দোকানে লোকদের ভির জমছে। যে ই আসছে, মেঘের দিকে একটু ঘুরেফিরে বারবার তাকাচ্ছে। মেঘ চা শেষ করে টাকা দিয়ে হোটেলে ফিরে এলো।

দুতিনদিন যাবত মেঘকে বাসায় দেখছে না বৃষ্টি। মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলে মা বললো জানে না। বাবার কাছে জিজ্ঞেস করলে বাবাও একই উত্তর দিলে বৃষ্টি ক্ষেপে গেলো। কারণ মা না জানতে পারে, কিন্তু বাবা ঠিক জানে মেঘ কোথায় আছে। পরিবারের সব সদস্যকে খুব ভালো করেই জানা আছে তার।

  • সত্যি করে বলো ভাইয়া কোথায়।
  • জানি না তো আমি। কি করে বলি বলতো!
  • আর কেউ না জানলেও তুমি ঠিক জানো। তারাতারি বলো।
  • বলে যায়নি তো আমার কাছে।
  • ভাইয়া আমাকে রেখে ট্রিপে গেছে না?
  • সত্যি বলছি, যাওয়ার সময় আমার কাছে কিছু বলে যায়নি।
  • যাওয়ার সময় বলে যায়নি ঠিক আছে, কিন্তু আগে তো ঠিকই বলেছে। কি বলেনি?

এবার কি জবাব দিবে রায়হান চৌধুরী! মেয়ের কাছে যে ধরা পড়ে গেছে! আমতা আমতা করে বললো,

  • না মানে বলেছিলো এ সপ্তাহে কোথাও যাবে, তাই আমার বিজনেস যেন আ
  • হয়েছে হয়েছে, আর বলতে হবে না। সব বুঝে গেছি আমি।যেতে দিলে কেন তুমি! বলেছি না আমার রেজাল্টের পর যেতে! এজন্যই তো কয়েকবার ফোন করার পর রিসিভও করে না!

বৃষ্টি কান্না শুরু করে দিলো। মিসেস মোহিনী চৌধুরী ধমক দিয়ে বললো,

  • এখানে কান্না করার কি আছে! ছেলে মানুষ ঘুরাফেরা করবেই। ওর সাথে তোর জোড়া কিসের! মেয়েদের এতো দূর ঘুরাফেরা করা ভালো না!
  • তুমি চুপ করো। ছেলের পক্ষ তো টানবেই। মেয়ে বলে জন্মেছি বলে হাত পা গুছিয়ে ঘরে বসে থাকবো?
  • কি আযব মেয়ে! আমি কি সেটা বলেছি! তোকে কি ঘর থেকে বের হতে দেই না! ঘুরতে যেতে দেই না! আমি শুধু বললাম, দূরদূরান্তে মেয়েদের যাওয়া ভালো না। কোন বিপদ হলে ছেলেরা যতটা মোকাবেলা করতে পারবে মেয়েরা তা পারবে না।
  • তোমার জ্ঞান তোমার কাছেই রাখো। (বাবাকে) কোথায় গেছে, বলো তারাতাড়ি। না হলে আমি সব ভেঙে ফেলবো।
  • সে কি বলে যায় কখনো, কোথায় যবে! ফিরে এসে না গল্প বলে কোথায় গেছে, কি কি করেছে!
  • ফোন দাও এখন। ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো কোথায় গেছে!
  • আচ্ছা আচ্ছা, ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবো কোথায় গেছে। তারপর আমার বৃষ্টি মা কে জানাবো, ওকে?
  • জিজ্ঞেস করবো না, এখন করবে।
    বৃষ্টি নিজেই বাবার ফোন হাতে নিয়ে মেঘের নম্বরে ডায়াল করলো। লাউড স্পিকারে রেখে বাবাকে বললো কথা বলতে। মেঘ রিসিভ করে বললো,
  • হ্যাঁ, বাবা বলো।
  • কোথায় আছিস, তুই?
  • আছি বাংলাদেশের কোন এক কোণে।
    বৃষ্টি হুট করে বলে উঠলো,
  • ভালোয় ভালোয় বল কোথায় আছিস, না হলে এই বাড়িতে ঢুকতে পারবি না!
  • বাবা তুমি এই চামচিকার সামনে কল করেছো!
  • খবরদার, চামচিকা বলবি না। তুই চামচিকা, তোর চোদ্দগুষ্টি চামচিকা।
  • হ্যাঁ আমার চোদ্দগুষ্টির মধ্যে তুইও আছিস। এই কদিন পর না তোর রেজাল্ট দিবে, কোথায় আল্লাহর নাম নিবি! তা না করে মানুষের সাথে ঝগড়া করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিস!
  • কোথায় আছো, বলবা না!
  • এইতো লাইনে এসেছিস! আমি তো আমাদের ছাদের চিলেকোঠার ঘরে আছি। কয়দিন ধরে না খেয়ে আছি। বোন আয়, কিছু খাবার দিয়ে যা।
    কথাটা বলে মেঘ হা হা করে হেসে উঠলো সাথে তার বাবা মা ও। আর বৃষ্টি রেগে চিৎকার করে বললো,
  • উফফ! বাবা বলে না কেন তোমার ছেলে কোথায় আছে!
    এবার রায়হান চৌধুরী আবার জিজ্ঞেস করলো,
  • মেঘ তুই কোথায় আছিস?
  • সিলেট।
    মিসেস চৌধুরী এসে ফোন নিয়ে নিলো,
  • হয়েছে তো এবার জানা!
    বৃষ্টি নাকমুখ ফুলিয়ে চলে গেলো। মেঘের সাথে তার বাবা-মা কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিলো।

পর্ব – ২

সকাল থেকেই আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। নাস্তা করে চা বাগানের দিকে হাটতে লাগলো মেঘ। পাহাড়ি মেয়েরা চা পাতা তুলছে। মেঘ তাদের মধ্যে একটা মেয়েকে দেখে চমকে উঠলো। এই মেয়েটিকেই তো দেখেছে কাল পাহাড়ে বাচ্চাদের পড়াচ্ছিলো! কিন্তু আজ দেখতে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। কাল তার পড়নে সালোয়ার কামিজ ছিলো কিন্তু আজ পুরো চাকমা মেয়েদের মতো মনে হচ্ছে। পড়নে স্কার্ট, খোপা করা চুল, পিঠে চা পাতা রাখার জন্য বেতের ঝুড়ি। পাহাড়ি কন্যাকে ভিন্ন কাজে ভিন্ন সাজে সাজতে দেখে খুবই ভালো লাগছে মেঘের কাছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু হলে মেয়েগুলো বাড়ি ফেরার জন্য ছুটতে লাগলো। মেঘ ভিজতে ভিজতে হোটেলে ফিরে এলো।

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা বৃষ্টি হলো। বিকেলে মাধবপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে এই হোটেল ছেড়ে দিলো মেঘ। ব্যাগ কাধে নিয়ে হেটে যাওয়ার সময় পথের ধারে গাছপালায় আচ্ছন্ন উঁচু পাহাড়টা দেখে মনে হলো এই পাহাড়ে একবার ঘুরে যাওয়া যাক। বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা একদম ঝকঝকে হয়ে আছে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ি রাস্তা পিচ্ছিল থাকে তাই স্যান্ডেল পড়ে নিলো মেঘ। খুব সাবধানে পাহাড়ের চুড়ায় উঠলো।

বিভিন্ন গাছপালা আছে এখানে। দেখতে দেখতে আর একটু এগিয়ে দেখলো এই পাহাড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অন্য একটা পাহাড়ে ঝর্ণা বয়ে চলেছে। ওই পাহাড়ের উচ্চতা আরো অনেক বেশি। কেন জানি মনে হচ্ছে এটা হামহাম ঝর্ণা! এতো সুন্দর একটা দৃশ্য এখানে না এলে দেখতেই পারতো না মেঘ! নিচের দিকটায় তাকিয়ে দেখলো পাহাড়ের অর্ধেকটা থেকে শুরু হয়ে নিচের সম্পূর্ণ সমতল ভূমিতে চা চাষ করা! নিচের দিকে তাকাতেই হঠাৎ করে মাথাটা ঘুরে উঠলো মেঘের।
তারপর আর কিছু মনে নেই তার!

চোখ খুলতেই দেখতে পেলো সে এক কাঠের ঘরে শুয়ে আছে। চারিদিকের বেড়া কাঠের আর টিনের চালা। আশেপাশে কাউকে দেখছে না। শোয়া থেকে উঠতে চেষ্টা করতেই মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো মেঘ। মাথাটা তার ভারী ভারী লাগছে! তাই আর উঠলো না। বা হাতটা নাড়াতে পেরেছে কিন্তু ডান হাতটা নাড়াতে গিয়ে ব্যাথা অনুভব করলো। কি হয়েছে তার সাথে, ভেবে পাচ্ছে না! অত:পর পা দুটো নাড়িয়ে দেখলো ঠিক আছে কি না! নাহ! পায়েও হালকা ব্যাথা আছে! তবে আঘাতটা বোধহয় ডান হাত আর মাথায় বেশি লেগেছে। সে তো পাহাড়ে উঠেছিল! ঝর্ণা দেখছিলো! নিচের দিকে তাকিয়ে চা বাগান দেখেছিলো! তারপর! তারপর কি হয়েছিলো! আর ভাবতে পারছে না!

হঠাৎ দরজা ফাক করে এক মধ্যবয়সী মহিলা প্রবেশ করলো ঘরে। মেঘকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে দ্রুত পায়ে হেটে খাটের ধারে এসে বসলো। মেঘকে জিজ্ঞেস করলো,

  • ঠিক আছো তুমি, বাবা?

মেঘ জবাব না দিয়ে মহিলার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। মহিলাকে দেখতে পুরো ঢাকাইয়াদের মতো মনে হচ্ছে। কথাও ঠিক তেমনই স্পষ্ট! পড়নেও সুতি শাড়ি, স্বাভাবিকভাবে মেয়েরা যেমনটা পড়ে থাকে ঠিক তেমন! মেঘকে এভাবে তাকাতে দেখে মহিলাটি আবার জিজ্ঞেস করলো,

  • কেমন লাগছে এখন?

মেঘ মনে মনে বললো, “আর ভালোলাগা! হাত পা মাথা সব গেছে! ” তবুও মুখে অস্ফুট স্বরে জবাব দিলো,

  • ভালো। আমি এখানে কিভাবে?
  • পাহাড়ের গোড়ায় চা বাগানে পড়ে ছিলে। প্রায় এক দিন পর আজ তোমার জ্ঞান ফিরেছে। এমন অবস্থা কিভাবে হলো?
  • পাহাড়ের গোড়ায়! আমি তো পাহাড়ের চূড়ায় ছিলাম!!
  • তাহলে কি চূড়া থেকে পড়ে গেছো! নাফিসাও এটাই সন্দেহ করেছিলো।
  • কে?
  • নাফিসা। আমার মেয়ে। সে ই কাল বিকেলে চা পাতা তুলতে গিয়ে তোমাকে চা বাগানে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে এসে আমাকে নিয়ে যায়। তারপর দুজন লোকের সাহায্যে তোমাকে এখানে নিয়ে আসি। ডাক্তার ডেকে ওষুধ করাই। আল্লাহর রহমতে প্রাণ আছে তোমার সাথে।
  • আমার ব্যাগ ছিলো সাথে, পেয়েছেন কি?
  • হ্যাঁ, ব্যাগ, ফোন সবই সযত্নে আছে। তুমি বিশ্রাম নাও। আমি আসছি।
    মেঘ মনে মনে বলে নিলো, আল্লাহ! এতো উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে বেচে গেলাম কিভাবে! সবই তোমার রহমত!

মহিলাটি চলে যাওয়ার পরক্ষণে মনে হলো উনি আল্লাহর রহমতের কথা বলেছেন! তার মানে তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের। কিন্তু শ্রীমঙ্গলে তো চাকমাদের বসবাস! আর চাকমারা হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী! যদিও উনাকে দেখে চাকমা মনে হয় না! এরকম বিভিন্ন কথা ঘুরপাক খাচ্ছে মেঘের মাথায়! ঘরের ভেতরে থেকে দিন না রাত বুঝতেও পারছে না! ছোট একটা জানালা আছে তা ও বন্ধ! এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখলো মাঝামাঝিতে ছোট খাটটা পাতানো। কাঠের একটা সুকেচ আছে। পাশেই একটা বুকশেলফ আর ২টা বেতের চেয়ার। বাসায় কি ব্যাপারটা জানানো দরকার! না থাক! শুধু শুধু টেনশন করবে। আর কোথাও বেড়াতেও যেতে দিবে না।

একটু পর মহিলাটি এলো হাতে একটি বাটি নিয়ে। খাটের পাশে রাখা টুলের উপর বাটি টা রেখে মেঘের পাশে বসলো।

  • সোজা হয়ে বসতে পারবে?
    মেঘ চেষ্টা করে পারলো না উঠতে। মহিলাটি তাকে ধরে একটু তুলে পেছনে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বসালো। মেঘের হাত দুটো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো।
  • হাত নাড়াচাড়া করতে পারো?
  • ডান হাতে অনেক ব্যাথা।
  • চিন্তা করো না। ডাক্তার বলেছে হালকা একটু মচকে গেছে। একটু যত্ন নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। বাসা কোথায় তোমার?
  • ঢাকা।
  • এখানে বেড়াতে এসেছো?
  • হ্যাঁ।
  • সাথে কেউ আসেনি?
  • না।
  • বাসায় খবর দিলে ওরা নিতে আসবে না?
  • বাসায় জানাতে চাচ্ছি না। শুধু শুধু টেনশন করবে। কতোদিন লাগবে সুস্থ হতে? ডাক্তার এমন কিছু বলে নি?
  • না, ডাক্তার তো তোমাকে ঠিকমতো চেকাপ ও করতে পারেনি সেন্স না থাকায়! একটু পর আসবে ডাক্তার।
  • আন্টি এখন সকাল না বিকাল?
    মহিলাটি মৃদু হেসে জবাব দিলো,
  • বিকাল। এই দেখো, তোমার নামটাই তো জানা হলো না। নাম কি তোমার?
  • মেঘ। মেঘ চৌধুরী।
  • বাহ! পাহাড়ে মেঘের ছায়া!

আন্টির কথা শুনে মেঘও মৃদু হাসলো। বুঝাই যাচ্ছে বড়ই রসিক আন্টি! কথাবার্তা শুনেও মনে হচ্ছে যথেষ্ট শিক্ষিত। বাটিটা হাতে নিয়ে আন্টি বললো,

  • তোমার জন্য স্যুপ এনেছি। ডান হাতে তো ব্যাথা! নিজ হাতে খাবে কিভাবে! আমি খায়িয়ে দিবো?
    মেঘ উত্তরে শুধু একটা হাসি দিলো। আন্টিও হেসে খায়িয়ে দিচ্ছেন। আন্টিকে দেখে পুরো তার মায়ের মতো দেখাচ্ছে। কথাবার্তা, আচারব্যবহার সবকিছুতেই যেন মিল আছে! শুধু চেহারাটার মিল নেই। একটু পর ডাক্তার এলো সাথে একটা মেয়ে। মেয়েটাকে দেখে মেঘ অবাক! এটা তো সেই মেয়েটাই! ডাক্তার এসে চেকাপ করার পর বললো,
  • কয়েকদিন রেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।

মেঘ জিজ্ঞেস করলো,

  • কতোদিন লাগবে?
    ডাক্তার উত্তরে বললো,
  • তা সঠিক বলতে পারছি না। তবে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে।
    ডাক্তার মেয়েটির হাতে কিছু ওষুধ দিয়ে বললো,
  • নাফিসা, ওষুধগুলো ঠিকমতো দিয়ো। আর কাটা জা

য়গায় ওয়েনমেন্ট লাগিয়ে দিয়ো। হাতের আর পায়ের ফোলা জায়গায় কয়েকদিন ঠান্ডা জলপট্টি দিয়ো। চার পাচ দিন পর এসে আমি মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দিয়ে যাবো।

  • আচ্ছা।
    মেঘ এবার নিশ্চিত হলো, এটাই আন্টির মেয়ে নাফিসা! রাতে আন্টি এসে খায়িয়ে দিয়ে গেলো। তারপর নাফিসাকে ডেকে দিলেন ওষুধ দেওয়ার জন্য। নাফিসা এসে আন্টিকে বুঝিয়ে দিলো কোনটা কিভাবে কখন দিতে হবে। ওষুধ দেওয়ার পর আন্টি হাতে আর পায়ের ফোলা জায়গায় ঠান্ডা জলপট্টি দিলেন। মেঘ ইতস্তত বোধ করে বললো,
  • আমি আপনাদেরকে বিপদে ফেলে দিলাম।
  • না, ঠিক আছে।
  • আন্টি, সুস্থ হওয়ার ক টা দিন আপনাদের এখানে থাকলে অসুবিধা হবে?
  • সুস্থ হওয়ার আগে তোমাকে যেতে দিচ্ছে কে? পরিবারকে জানাও নি , এখন তোমার দেখবাল করবে কে, শুনি?
    মেঘ আর কিছু বললো না। সকালে চোখে সূর্যের আলো পড়লে ঘুম ভাঙলো মেঘের। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা ছোট জানালাটা খুলে দিয়েছে। মেঘকে উদ্দেশ্য করে নাফিসা বললো,
  • উঠুন। বেলা অনেক হয়েছে। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিন। ওষুধ খেতে হবে।
    নাফিসা ছোট বালতিতে করে পানি এনে দিলো মেঘের কাছে। মেঘ উঠতে পারছে না শোয়া থেকে। নাফিসা উঠতে সাহায্য করলো। আন্টি এসে খায়িয়ে দিয়ে গেলো। নাফিসা ওষুধ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। একটু পর তারাহুরো করে এ রুমে এসে সুকেচের ড্রয়ার থেকে কিছু নিয়ে আবার বেরিয়ে গেলো। মেঘ লক্ষ্য করলো নাফিসার পড়নে ছিলো স্কার্ট। হয়তো চা পাতা তুলতে যাবে এখন।

এভাবে কেটে গেলো এক সপ্তাহ। এর মাঝে ডাক্তার এসে মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দিয়ে গেছে। নাফিসা আর আন্টির সেবায় মেঘ এখন অনেকটা সুস্থ। কাটাছেঁড়া জায়গাগুলো শুকিয়ে গেছে। হাত পায়ের ব্যাথা আগের চেয়ে অনেকটা কমে গেছে। কারো সাহায্য ছাড়া একা একা হাটাহাটিও করতে পারে মেঘ। তবে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়ায় আন্টি বেশিক্ষণ হাটতে দেয় না মেঘকে। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর থাকতে হয়, আর ঘরের সামনে ছোট উঠোনে একটু হাটে। মাঝে মাঝে পাশের বাসার লোকজনও দেখতে আসতো।


পর্ব – ৩

প্রথম দেখাতেই নাফিসাকে ভালো লেগেছিলো। এক্সিডেন্টের পর চোখের সামনে বারবার দেখতে দেখতে পাহাড়ি কন্যার প্রেমে পড়ে গেছে মেঘ! বারবার এটা সেটা জিজ্ঞেস করে কথা বলার সুযোগ খোঁজে মেঘ। কিন্তু পাহাড়ি কন্যার মন যে পাথরের মত শক্ত। প্রয়োজন ছাড়া সহজে কথা ফুটে না মেয়েটির মুখে। আন্টি সবসময় হাসিমুখে কথা বলে কিন্তু নাফিসা একদম চুপচাপ স্বভাবের। ঘরের ভেতরে একা একা সারাদিন কাটে মেঘের। এতোদিন এখানে থেকে লক্ষ্য করলো, নাফিসা আর তার মা ছাড়া কেউ এ বাড়িতে থাকে না!

নাফিসার কি কোন ভাইবোন নেই! তার বাবাও কি নেই! খাটে বসে ভাবতে ভাবতে চোখ পড়লো বুকশেলফে রাখা কয়েকটি উপন্যাসের বইয়ের উপর। মেঘ শেলফের কাছে এগিয়ে গেলো। হাজার বছর ধরে, লালসালু, বড়দিদি, ছোটদিদি, পথের পাচালী এই পাচটি উপন্যাসের বই রাখা আছে একসাথে। তার পাশে আছে দুটি কবিতার বই মেঘনাদ বধ কাব্য ও স্বাধীনতা। “পাহাড়ি কন্যা, তুমি তো দেখছি সাহিত্যে মগ্ন!” ভাবতেই মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মেঘ পথের পাচালী উপন্যাসের বইটি হাতে নিয়ে আবার খাটের দিকে এগিয়ে এলো। এ বইয়ের একটা অংশ পড়েছিলো, বাকিটা পড়া হয়নি। আধশোয়া অবস্থায় বসে বইটি পড়তে লাগলো। কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবার নিয়ে আন্টি রুমে প্রবেশ করলো।

  • বই পড়ছো?
  • হুম।
  • খাবারটা আগে খেয়ে নাও। ওষুধ খেতে হবে।
  • আন্টি কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?
  • হুম, করো।
  • আপনার পরিবারে আর কোন সদস্য নেই?
  • না। আমি আর আমার মেয়েই আমার পরিবার। আর কেউ নেই।
  • আন্টি আপনাদের দেখেই বুঝা যায় এ অঞ্চলের না। আপনাদের স্থানীয় বাসা কোথায়?
  • এটাই আমাদের স্থানীয় বাসা। খাবারটা খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও।

কথাটা বলে আন্টি সেখানে আর অপেক্ষা করলো না। আন্টি বেরিয়ে গেলে মেঘ বুঝতে পারলো উনি এ নিয়ে আর কোন কথা বলতে চাচ্ছে না। এটা তাদের স্থানীয় বাসা না, তা মেঘ খুব ভালো করেই বুঝে গেছে। এর পিছনে কোন না কোন রহস্য আছে যার জন্য তিনি এরিয়ে চলে গেছেন! যাক, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তার ঘাটাঘাটি না করলেও চলবে। বিপদে আশ্রয় দিয়ে এমনিতেই অনেক সাহায্য করেছে, যার জন্য মেঘ তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। মেঘ হাত ধুয়ে খাবার খেয়ে ওষুধ নিয়েছে।

ওয়ালেট হাতে নিয়ে দেখলো পর্যাপ্ত টাকা নেই। থাকবেই কিভাবে! ওষুধে কি আর কম টাকা খরচ হয়েছে! হবিগঞ্জে, শ্রীমঙ্গলে ঘুরেই তো টাকা কমে গিয়েছিলো! ভেবেছিলো, মাধবপুর যাওয়ার পর ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিবে,তা আর হলো কোথায়! তারউপর, ফ্রীতে এখানে থাকছে, খাবার পাচ্ছে! আবার প্রথমদিকে নাফিসাও ওষুধের খরচ দিয়েছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নাফিসাকে তার টাকাটা ফেরত দিতে হবে। এই ভেবে নিলো মেঘ।

একটু পর নাফিসা বাসায় এসেই “আম্মি আম্মি” বলে বাইরে থেকে জোরে ডাকতে শুরু করলো। হয়তো আম্মির রুমে আম্মিকে পায়নি তাই গলা ছেড়ে ডাকতে লাগলো। কোন সাড়া না পেয়ে মেঘ যে রুমে আছে সে রুমে এলো। দেখলো মেঘ একা বসে আছে। মেঘ দেখলো ক্লান্ত নাফিসার মুখে অস্পষ্ট হাসির ঝিলিক। অন্যকেউ হয়তো এ হাসিটা বুঝতে পারতো না কিন্তু মেঘ বুঝতে পেরেছে। মেঘ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,

  • আম্মি কোথায়?
  • এতো খুশি কেন?
  • কোথায়!
  • তোমার চেহারায় খুশি দেখছি আমি।
  • আম্মিকে দেখেছেন?
  • একটু আগে এসেছিলো। এখন কোথায়, তা জানা নেই।
    নাফিসা আবার বেরিয়ে যাচ্ছিলো, টুলের উপর চোখ পড়তেই দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে মেঘকে কিছুক্ষণ আগে খাবার দিয়ে যাওয়া থালাবাটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
    অন্যদিন পাশে থেকেও নাফিসার গলার আওয়াজ শোনা যায় না। অথচ আজ জোর গলায় আম্মিকে ডাকছে, হুট করেই ঘরে এসে মেঘের সাথে কথা বলেছে! এর পিছনে কারণ তো নিশ্চয়ই আছে! কিন্তু সেটা কি!

একটু পর নাফিসার আম্মি এলে উনার কাছে জানতে পারলো নাফিসা এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। আজ এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে! নাফিসা তাহলে বৃষ্টির সমবয়সী! তাহলে তো বৃষ্টির ও রেজাল্ট দিয়েছে। কি হয়েছে রেজাল্ট, কে জানে! মেঘ ফোন হাতে নিয়ে বাবার নম্বরে ডায়াল করলো। বাবার সাথে কথা বলে জানতে পারলো, বৃষ্টি গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। বৃষ্টির সাথেও কথা বলতে চেয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি রেগে আছে তাই মেঘের সাথে কথা বলবে না। মেঘ টিশার্ট চেঞ্জ করে অফ হোয়াইট শার্টটি পড়ে বিকেলে বের হলো বাসা থেকে। আন্টি না করেছিলেন কিন্তু মেঘ বললো বেশি দূর যাবে না। আশেপাশের মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করে ব্যাংকের ঠিকানা নিলো এবং ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে নিলো। বাজার থেকে পাচ কেজি মিষ্টি ও এক কেজি সন্দেশ নিয়ে বাসায় ফিরলো মেঘ। হাতে মিষ্টি দেখে আন্টি জিজ্ঞেস করলো,

  • এসব কি!
  • কেন, মিষ্টি।
  • তা তো দেখছি ই। কিন্তু এতো মিষ্টি কেন?
  • আমাদের ওদিকে তো পরীক্ষায় পাস করলে মিষ্টি খাওয়ানো হয়। এদিকে কি হয় না?
  • হ্যাঁ। কিন্তু এতো মিষ্টি নিয়ে এলে কেন?
  • নাফিসা জিপিএ-৫ পেয়েছে না, তাই।
    মেঘের ও মায়ের কথা শুনে নাফিসা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো,
  • আপনাকে কে বলেছে আমার জন্য মিষ্টি আনতে?
  • তোমার জন্য না তো, পাড়াপ্রতিবেশির জন্য।
  • উদ্দেশ্যটা তো আমিই না?
  • হ্যাঁ।
  • সেটাই বলছি, আপনি এনেছেন কেন?
  • আন্টি ধরুন তো। মিষ্টির সাথে সন্দেশ আছে। ওটা শুধু আপনাদের জন্য। আমার ছোট বোন গোল্ডেন পেয়েছে তাই সন্দেশ টা আমার বোনের উদ্দেশ্যে।
  • তাই নাকি! আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই তো।

মেঘ নাফিসার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে এলো। বইটা নিয়ে আবার পড়ছিলো, এমন সময় নাফিসা এলো রুমে। মেঘ একবার নাফিসার দিকে তাকিয়ে আবার বই পড়ায় মনযোগ দিলো। নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,

  • মিষ্টি আনতে কত টাকা খরচ হয়েছে?
    নাফিসার কথা শুনে ব্রু কুচকে তাকালো মেঘ। তারপর বললো,
  • কেন?
  • উল্টো প্রশ্ন করছেন কেন! জানতে চেয়েছি উত্তর দিবেন।
  • কারণ না বললে উত্তর দিবো না।
  • আমি আপনার টাকা ফেরত দিবো। এবার বলুন!
  • এসব কি বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, নাফিসা? সামান্য মিষ্টি এনেছি, তা নিয়ে কি শুরু করেছো!
  • মিষ্টি আমিও কিনতে পারি। সুতরাং, আপনার কেনার কোন প্রয়োজন ছিলো না। বলুন কত টাকা খরচ হয়েছে?
  • পাহাড়ের নিচ থেকে উদ্ধার করে আমার সেবাযত্ন সহ ডাক্তারী ওষুধ করাতে কত খরচ হয়েছে, বলো।
  • কেন?
  • কেন, আবার? আমি তোমার টাকা ফেরত দিবো তাই!
  • আমি কাউকে দেয়া কিছু ফেরত নেই না। নিজেকে গুছিয়ে চলতে শিখে গেছি অনেক আগেই।
  • তুমি কাউকে দেয়া কিছু ফেরত নেও না, তাহলে এটা ভাবলে কিভাবে যে আমি মিষ্টি আনার টাকা ফেরত নিবো! যাই হোক, তুমি যা চাইছো তা ই হবে। তুমি আমার টাকা ফেরত দিবে আমিও তোমার টাকা ফেরত দিবো। বলো বলো কত খরচ করেছো! আমার এতোদিনের থাকা, খাওয়ার হিসেব সহ বলবে।
    বলো

নাফিসা আর একমুহূর্তও দাড়ালো না। রেগেমেগে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর নাফিসা প্লেটে করে ৪টা মিষ্টি নিয়ে আবার মেঘের কাছে এলো। কিছু না বলে প্লেট টুলের উপর রেখে চলে যাচ্ছিলো এমন সময় মেঘ বললো,

  • এসব কি! এখানে রেখে যাচ্ছো কেন?
    নাফিসা দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে প্লেট টা হাতে নিয়ে মেঘের সামনে ধরে বললো,
  • আমি পরীক্ষায় পাস করেছি, সে জন্য মিষ্টি এনেছি। নিন ধরুন।
  • তুমি খেয়েছো?
  • না, আমি খাবো না। আপনিই খান। বেশি করে খান।
    মেঘ নাফিসাকে কিছু না বলে আন্টিকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। নাফিসা তার কর্মকাণ্ড দেখে অবাক! আন্টি ডাক শুনে রুমে প্রবেশ করলে মেঘ বললো,
  • আন্টি নাফিসা মিষ্টি খেয়েছে?
  • না। বলেছি খেতে। কিন্তু খাবে না।
  • তাহলে একটা মিষ্টিও কাউকে দিবেন না।
  • তাহলে কি করবো এগুলো?
  • যেখানে আছে, সেখানেই থাকুক।
  • সে কি! ঘরে রেখে দিলে পচে যাবে তো!
  • পচুক। তা ও দিবেন না। যার উদ্দেশ্যে মিষ্টি আনা, সে ই যদি না খায় তাহলে আর অন্যের খাওয়ার প্রয়োজন কি?
    মেঘের কথা শুনে নাফিসা অবাক! এতোগুলো মিষ্টি এনে এখন বলছে কাউকে না দিয়ে ঘরে রেখে পচাতে! সে তার মা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
  • আম্মি, আমি মিষ্টি খাবো। যাও তুমি কাকে দিবে, দিয়ে এসো।

মেঘ নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,

  • খাবে তুমি?
  • হ্যাঁ বলেছি তো! এবার ধরুন।
    মেঘ নাফিসার হাত থেকে প্লেট নিয়ে তার সামনে ধরে বললো,
  • নাও, তাহলে খাও।
  • বলেছি তো খাবো। বিশ্বাস হয় না!
  • না হয় না। এখন খাও, আমার সামনে, আন্টির সামনে।
    নাফিসা একটা মিষ্টি থেকে একটু ভেঙে নিয়ে মুখে দিলো। নাফিসার মা মৃদু হাসলো মেঘ তার জিদ্দি মেয়েকে মানাতে পারায়। অল্প নেওয়াতে মেঘ বললো,
  • মাত্র এতোটুকু!
    এবার নাফিসা রেগে তার মা কে বললো,
  • আম্মি, তুমি কিছু বলবা!
  • মেঘ, নাফিসা মিষ্টি খেতে পছন্দ করে না। এতোটুকুই অনেক তার জন্য।
    মেঘ বিড়বিড় করে বললো,
  • এজন্যই তো কারো সাথে মিষ্টি করে কথাও বলতে পারে না!
  • কিছু বলেছো?
  • না, নিন আপনিও ধরুন।
  • তুমি খাও। আমি খেয়ে নিবো।
  • না, আমার সামনে নিন।
    আন্টি একটা মিষ্টি তুলে নিলে মেঘও একটা তুলে মুখে দিলো। তারপর প্লেট আন্টির কাছে দিয়ে দিলো।
  • সে কি! আর খাবে না?
  • না আন্টি। একটাই যথেষ্ট।

পর্ব – ৪

সেদিনের পর বৃষ্টি তার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলে রেখেছে, রেজাল্টের পর তারা সিলেট বেড়াতে যাবে। তারা কমপক্ষে এক সপ্তাহ থাকবে সেখানে। কয়েকজন যেতে রাজি হয়েছে। তাদের মধ্যে ছেলেদের তো কোন সমস্যা নেই কিন্তু মেয়ে ফ্রেন্ডের বাসা থেকে এতোদূর যেতে দিবে না! এমনকি বৃষ্টিকেও সিলেটের জন্য ছাড়বে না তার বাবা মা এটা খুব ভালো করেই জানা আছে। তাই তারা পরিকল্পনা করে নিলো, বাসায় বলবে কুমিল্লা যাবে সাত দিনের জন্য।

বৃষ্টির রেজাল্টে তার বাবা মা অনেক খুশি। বেড়াতে যেতে দিতেও রাজি, কিন্তু কুমিল্লা যাবে সাত দিনের জন্য! এটা তাদের কাছে আপত্তিকর বিষয়!

  • বৃষ্টি, সাত দিনের জন্য কুমিল্লা গিয়ে কি করবি শুনি! কুমিল্লা এক দিনেই ঘুরে আসা যায়।
  • মা, তুমি কোন দিন আমার মতে একমত হয়েছো! সবসময় তোমার ছেলের পক্ষ টেনেছো। তোমার একটাই কথা, আমি যেন সারাদিন ঘরে বসে থাকি! তাই তো!
  • তোকে কিছু বুঝানোই দায়!
  • তোমার বুঝ তোমার কাছেই রাখো! আমাকে বুঝাতে হবে না। বাবা, তুমি কি যেতে দিবে না?
  • তোর মা তো ঠিকই বলেছে। কুমিল্লা তো একদিনেই ঘুরে আসা যায়। শুধু শুধু সাতদিন কাটানো কি প্রয়োজন! এক এক দিন এক এক জায়গায় বেড়াতে যা।
  • না, আমি একদিন ঘুরবো না। বলেছো আমি জিপিএ-৫ পেলে ভাইয়ার সাথে ট্রিপে যেতে দিবে। এদিকে তোমার ছেলে আগেই পালিয়ে গেছে! এখন আমি গোল্ডেন পেয়ে পাস করে কুমিল্লায় যেতে চাচ্ছি, তাও আপত্তি জানাচ্ছো!
  • আপত্তি জানাচ্ছি না। আমি শুধু
  • আমি কোন কথা শুনবো না। ক্লিয়ার বলো যেতে দিবে কিনা?
  • আচ্ছা যা।
  • কালকেই যাবো। দশ হাজার টাকা রেডি করো।
  • দশ হাজার! এতো টাকা লাগবে কুমিল্লা যেতে!
  • সাত দিনের থাকা খাওয়া কি তোমার বাবা ঠিক করে রেখেছে আমার জন্য!
    মেয়ের কথা শুনে রায়হান চৌধুরী হোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন,
  • এতো টাকা ক্যাশ রাখলে চুরিও তো হতে পারে।
  • আচ্ছা, পাচ হাজার দাও। আর বাকিটা যখন দরকার হবে, বিকাশে পাঠিয়ে দিবা।
    রায়হান চৌধুরী বরাবরই রসিক মানুষ! তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
  • মোহিনী, তোমার ছেলে সিলেট বাড়াচ্ছে, মেয়ে কুমিল্লা বেড়াবে আমরা আর বাসায় বসে থাকবো কেন! চলো কোথাও হানিমুনে যাই!
    বৃষ্টি খিলখিল করে হেসে উঠলো, আর মোহিনী চৌধুরী জবাব দিলো,
  • আহ! বুইড়া বেটার শখ কতো! চলো তাহলে যাই। বাড়িটা আমি মাথায় নেই আর তোমার ব্যবসায় তুমি মাথায় নাও। এগুলো আবার থেকে যাবে কেন!
    বৃষ্টি ও রায়হান চৌধুরী মোহিনীর কথা শুনে একজোটে হাসলো।
    পরেরদিন পরিকল্পনা মোতাবেক দুজন ছেলে বন্ধু আর বৃষ্টিসহ তিনজন মেয়ে বাসায় ম্যানেজ করে রাজি করাতে পেরেছে। তারপরদিন ভোরে তারা পাচজন ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। বাসে বসে সবাই মিলে গুগলে সার্চ করে সিলেটের ম্যাপ দেখে নিয়েছে। কোথায় কোথায় ঘুরবে তাও ঠিক করে নিয়েছে।

পথ ভুলে গেলে লোকেদের কাছে জিজ্ঞেস করলেই গন্তব্যে পৌছাতে পারবে সেই ধারনাও করে নিয়েছে। দুপুরের আগেই তারা মৌলভীবাজার শহরে এসেছে। বৃষ্টির খুব আনন্দ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে মেঘকে এখনই ফোন করে জানাতে সেও এখন সিলেটে আছে। কিন্তু মেঘকে জানাতে গেলে বাসায় জেনে যাবে আর তার বাসায় জেনে গেলে ফ্রেন্ডের বাসায়ও জেনে যাবে! তাই মেঘের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো। বাসায় ফিরে একবারেই জানাবে মেঘকে।

মৌলভীবাজারের একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেড়ে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করেছে তারা। যদিও এতোক্ষণ ভ্রমণের পর রেস্ট নেওয়াটা প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু তারা আজই শ্রীমঙ্গল যাবে, আর সেখানেই একটা রিসোর্টে উঠবে। অত:পর মৌলভীবাজার থেকে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সন্ধ্যায় তারা শ্রীমঙ্গল পৌছেছে। সিলেটেও ঢাকার মতো জ্যাম! শ্রীমঙ্গলে একটা রিসোর্টে এসে দুটো রুম ভাড়া করেছে। রিসোর্টের রুম গুলো একদম ছোট ছোট। যা বৃষ্টির পছন্দ হয়নি! ছেলে দুটো এক রুমে আর মেয়ে তিনজন এক রুমে। ডিনার করে তারা নিজেদের রুমে ঘুমাতে চলে এলো। ছোট বিছানায় দুজন আঁটলেও তিনজনের জন্য কষ্টকর। তাও কিছুই করার নেই, কষ্ট করে তিনজনই এক বিছানায় শুয়ে পড়লো। সারাদিন ভ্রমণ করে ক্লান্ত আবার তাদের ইচ্ছে খুব সকালে উঠে চা বাগান ঘুরবে, তাই রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে, চা বিস্কুট নাস্তা করে চা বাগানে ছুটে চললো পাচ জন। বন্ধুবান্ধব যেখানে একসাথে হয় সেখানেই মজা লেগে থাকে। চা বাগানেও তাদের দুষ্টুমির শেষ নেই। চা বাগানে কাউকে রানী, কাউকে চাকরানি বানিয়ে ফটোশুট করে নিলো। সবারই বাসায় টুকটাক কথা হয়। দুপুরে গোসল করে লাঞ্চ সেড়ে মাধবপুর লেক দেখে কলাবনের দিকে অগ্রসর হলো। চা বাগান, লাউয়াছড়া পেরিয়ে কলাবনে ঘুরে নিলো। তারপর সন্ধ্যার দিকে রিসোর্টে ফিরে এলো।

গতকালই পরিকল্পনা করে রেখেছে আজ তারা জাফলং ঘুরবে এবং গোয়াইন নদীতে গোসল করবে। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা চলে গেলো সেখান। ঘুরাঘুরি শেষে খাসিয়াপল্লীঘাটে গোসল করতে চলে এসেছে সবাই। এখানেই ঘটলো এক বিপত্তি! বন্ধুবান্ধব ইচ্ছে মতো ঝাপাঝাপি করেছে পানিতে নেমে। প্রায় একঘন্টা ঝাপাঝাপির পর পানি থেকে উঠে আর বৃষ্টিকে দেখছে না বাকি চারজন! আশেপাশে তাকিয়ে অন্য কয়েকজনকে দেখতে পেয়েছে, কিন্তু বৃষ্টিকে দেখতে পাচ্ছে না। সবাই ভয়ে আতঙ্কিত! বৃষ্টি কোথায় গেলো! সে তো সাতার জানে! পানিতে ডোবার সম্ভাবনা তো কম! যথাসম্ভব নিজেরা স্থলে, পানিতে খোজাখুজি করছে। একপর্যায়ে তারা একপ্রকার চিৎকার শুরু করেছে।

আশেপাশের লোকজন তাদের চিৎকার শুনে বিষয়টি জেনেছে তাদের কাছে। তারাও যথাসম্ভব খোঁজেছে। অবশেষে না পেয়ে পুলিশকে জানাতে বললো। পুলিশকে জানাতে সেখানকার লোকজন সাহায্য করলো।

রেজাল্টের পর আরো চারদিন পার হয়ে গেছে মেঘ নাফিসাদের বাসায় আছে। বিকেলে মেঘ আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে খাটে। ঘরের ভেতর থেকেই শুনতে পেল কেউ একজন নাফিসা আর তার মায়ের সাথে কথা বলছে। অন্যকথা বলতে বলতে হুট করেই বলে উঠলো,

  • অই ফোয়া কিতা অনো বালা অইসে নানি! আর খইদিন থাকবাই ইবা ! পাক্কা টাল অই বইসে! যাইত কি নামও নের না!
    আরো কিছু কথা বলে মহিলাটি চলে গেলো। কিন্তু এর প্রতুত্তরে নাফিসা কিংবা তার মা কিছু বলেনি। এর আগেও মেঘকে দেখতে এসে এ ধরনের অনেক কথা বলেছে অনেকে। যা মেঘ নিজেই শুনতে পেয়েছে। না আর থাকা যাবে না। আজ বা কালের মধ্যেই বাসা ছেড়ে কোন রিসোর্টে উঠবে মেঘ। এতোদিন এখানে পড়েছিলো দুটো কারণে। একে তো সে অসুস্থ অন্যদিকে পাহাড়ি কন্যার মায়া! একটু পর নাফিসা ঘরে ঢুকেই মেঘকে জিজ্ঞেস করলো,
  • কবে যাবেন এখান থেকে?

মেঘ সবকিছু বুঝতে পেরেও বললো,

  • কেন?
  • যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দিন। কবে যাবেন?
  • এখানে থাকতেই ভালো লাগছে। তাই ভাবছি যাবো না।
  • আপনার ভাবনা মোতাবেক সব চলবে নাকি! এটা আপনার বাবা দাদার বাড়ি না যে দিনের পর দিন পড়ে থাকবেন এখানে!
  • এটা আমার বাবা দাদার বাড়ি হতে যাবে কেন! এটা তো তোমার বাবা দাদার বাড়ি। বাড়িটা ভালো লেগেছে তাই পড়ে আছি এখানে।
  • চুপ! একদম চুপ! আর একটা কথাও বলবেন না। বিপদে পড়েছিলেন তাই ঠাই দিয়েছি। তারমানে এই নয় যে দিনের পর দিন এখানে থেকে যাবেন। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন। সুতরাং এখন, এই মুহূর্তে আপনার আসবাবপত্র নিয়ে বিদায় হবেন। বেরিয়ে যান বলছি।

মেয়ের চড়া গলা শুনে তার মা এ ঘরে প্রবেশ করলো।

  • নাফিসা, মেহমানের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানা নেই তোর! এমন বাজে ব্যাবহার করছিস কেন!
  • আম্মি, চুপ থাকো তুমি। কে মেহমান! কিসের মেহমান! রাস্তা থেকে তুলে এনে ঠাই দিয়েছি, সেবা করে সুস্থ করে তুলেছি। একজন মানুষ হিসেবে অন্যের যতটুকু সেবা করার তার চেয়েও অনেক বেশি করেছি। আর কতো ভালো ব্যবহার করতে বলছো তুমি! চলে যেতে বলো এখন। আর এক মুহুর্তও যেন এ বাড়িতে না থাকে।
    নাফিসা হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। নাফিসার আম্মি মলিন সুরে বললো,
  • বাবা ওর কথায় কিছু মনে করো না। আসলে লোকদের মুখের কথা শুনে ও বাজে ব্যবহার করছে। আমার মেয়েটা এমন না।
  • না, আন্টি ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করি নি। আপনাদের মতো এমন দয়ালু মানুষ পৃথিবীতে খোঁজে পাওয়া দুষ্কর! এতোদিন এখানে থেকে নাফিসাকে একটু হলেও চিনেছি আমি। আর এভাবে কারো বাসায় পড়ে থাকলে লোকজন যা তা বলবেই। আমি চলে যাচ্ছি।
    মেঘ ব্যাগ গোছাতে লাগলে আন্টি বললো,
  • এখনি চলে যাবে! আজ থেকে যাও। কাল কোন একটা ব্যাবস্থা করো।
  • না, আন্টি। এখনি যাবো। আর ভাববেন না আমি রাগ করেছি। আমিও আগে থেকেই ভাবছিলাম চলে যাবো। আপনারা যেটুকু করেছেন আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
    মেঘ ব্যাগ গুছিয়ে আন্টির কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে নাফিসার রুমটা একবার ভালোভাবে দেখে নিলো যেখানে মেঘ এতোদিন থেকেছিলো। আর মনে মনে বললো,
  • আজ আবার তোমার রুম ফিরে পাবে নাফিসা।

উঠোনের একপাশে চালতা গাছটার নিচে ছোট বেঞ্চিতে বসে ছিলো নাফিসা। মেঘ তার কাছে গিয়ে বললো,

  • আমাকে আশ্রয় দিয়েই তুমি সবচেয়ে বড় ভুল করেছো। চলে যাচ্ছি আমি। কোন দাবি থাকলে বলো। শোধ করার চেষ্টা করবো।
  • কিসের দাবি?
  • যেমন, এখানে থেকেছি, খেয়েছি, আমার সেবাযত্ন করেছো এসবের কোন দাবি থাকলে বলো।
  • এখান থেকে চলে গিয়ে উদ্ধার করুন। আর কোন দাবি নেই।
    মেঘ মুচকি হেসে বললো,
  • আচ্ছা, ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ।

মেঘ চলে গেলো বাসা থেকে। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রোকসানা নামক সেই মধ্যবয়সী মহিলাটা দরজায় হেলান দিয়ে ভাবছে ছেলেটা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু মেয়েকেও তো দোষ দেয়া যাচ্ছে না। সে ও তো লোকমুখে কথা শুনেই এমন ব্যবহার করেছে! ছেলেটা ভালোভাবে যেন বাড়ি ফিরতে পারে এই দোয়া করে তিনি খুব বড় একটা নিশ্বাস ছাড়লো। সন্ধ্যার পর নিজের রুমে এলো নাফিসা। রুমটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

প্রায় দু’সপ্তাহের মতো এই রুমটা অন্যের দখলে ছিল! কাপড়চোপড়, ওষুধপত্র এলোমেলো ভাবে থাকতো, নাফিসা চা বাগান থেকে এসে সব গুছিয়ে রাখতো। বিকেলে বাসায় ফিরে দেখতো তার বই মাথার পাশে রেখেই লোকটা ঘুমিয়ে পড়তো আর নাফিসা তা তুলে বুকশেলফে রেখে দিতো। ঠিকসময়ে খাবার এনে দিতো, ওষুধ হাতে তুলে দিতো, হাত পায়ে জলপট্টি লাগিয়ে দিতো! আজ সব কাজের ছুটি দিয়ে গেছে লোকটা।

নাফিসাদের বাসা ছেড়ে মেঘ ইকো রিসোর্টে উঠেছে। বাড়ি ছেড়েছে তো কি হয়েছে! এখান থেকে যাবে না সে। পাহাড়ি কন্যার মায়ায় যে পড়ে গেছে অনেক আগেই! ব্যাগটা ফ্লোরে ঢিল মেরে চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো মেঘ। হাতদুটো মাথার নিচে রেখে বললো,

  • যদি ঢাকা ফিরতেই হয়, তাহলে তোমাকে সাথে নিয়েই ফিরবো, মেঘা! পাহাড়ি কন্যা তুমি এই মেঘের মেঘা।

পর্ব – ৫

চোখ খুলে তাকাতেই বৃষ্টি দেখতে পেল তার উপর বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে! পাতার ফাকে টুকরো টুকরো আকারে বিশাল আকাশটাকে দেখা যাচ্ছে। চোখটা একটু ঘোরাতেই দেখলো তার সামনে আজব মানুষ! বৃষ্টি লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। দুজন লোক বিকট শব্দ করে তার দিকে একটু এগিয়ে এলো! বৃষ্টির গলা শুকিয়ে গেছে! এ তো জংলী! আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে জঙ্গলের ভেতর! একটু দূরে আরো পাচজন জংলী দাড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।

অদ্ভুত সাজে সজ্জিত দুজন মানুষ তার দিকে আরেকটু এগিয়ে আসতেই বৃষ্টি ভয় পেয়ে খুব জোরে চিৎকার দিলো। বৃষ্টিকে ভয় পেতে দেখে দুজনই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! এ তো মেয়েলি কন্ঠ! একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা পাচজন দৌড়ে এলো চিৎকার শুনে। বাকি দুজনকে হাসতে দেখে একজন পুরুষ কন্ঠ তাদেরকে ধমক দিলো। সাথে সাথে সব নিরব হয়ে গেল!

  • এতোক্ষণ পর একটা মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে তার সেবা না করে তোরা এভাবে ভয় দেখাতে শুরু করেছিস! মানুষ এভাবে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়, সে খেয়াল কি আছে তোদের! সবজায়গায় ফাজলামো না করলে চলে না!
    বৃষ্টি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে লোকটির কথা শুনে যাচ্ছে আর ভাবছে, ” জংলী আবার এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে! জানা ছিলো না!” লোকটা বৃষ্টির কাছে এসে বসতেই বৃষ্টি ভয় পেয়ে আরেকটু পিছিয়ে গেলো। ভয় কাটাতে লোকটা বললো,
  • ভয় পেয়ো না। আমরা তোমার কোন ক্ষতি করবো না। আর আমরা জংলীও না। তোমার মতোই সাধারণ মানুষ। নাম কি তোমার?
  • বৃষ্টি।
  • বাসা কোথায়?
  • ঢাঢাকা।
  • ঢাকা হলে এখানে কি করছো?
  • আমি কোথায়?
  • তুমি এখন সিলেটে। এ জায়গার নাম বিছানাকান্দি। লেকের ধারে পড়ে থকতে দেখি তোমাকে। সেখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসি জংগলের মাঝে। ঢাকা থেকে সিলেটে কিভাবে এলে?
  • বাসে।
  • সেটা জিজ্ঞেস করিনি। সিলেট কেন এসেছো, আর কার সাথে এসেছো?
  • বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসেছি।
  • বন্ধুরা কোথায়?
  • জানি না। আমি তো তাদের সাথে খাসিয়াপল্লী ঘাটে গোসল করছিলাম! তারপর আর কিছু জানি না!
  • খাসিয়াপল্লীঘাট থেকে বিছানাকান্দি চলে এসেছো!
    তাদের মধ্যে অন্য একজন বললো,
  • গোসল করতে গিয়ে ফাঁদে পড়ে স্রোতে ভেসে এসেছে বোধহয়!
    বৃষ্টি এতোক্ষণ কাপা কাপা কন্ঠে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো। তার শরীরে এখনো ভেজা কাপড়! দুপুর পেরিয়ে বিকেলের শেষের দিকে, এখনো ভেজা কাপড় গায়ে! কন্ঠে তো কম্পন ধরবেই! সাথে শরীরও কাপছে, লোকটা তাদের মধ্যে একজনকে বললো,
  • সিমি, তোর কাপড়চোপড় দিয়ে হেল্প কর। ঠান্ডা লাগছে বোধহয়!
  • আচ্ছা, চলো আমার সাথে।

বৃষ্টি ঘুরেফিরে এক এক বার এক এক জনের দিকে তাকাচ্ছে। সবাই জংলী বেশে অদ্ভুত সাজে সেজে আছে। অথচ বলছে তারা জংলী না, স্বাভাবিক মানুষ!
মেয়েটি বৃষ্টির কাছে এসে তাকে ধরে দাড় করালো। বৃষ্টি ঠিকমতো হাটতেও পারছে না! পুরো শরীর কাপছে তার। আস্তে আস্তে হেটে তাদের সাথে জংগলের আরো গহীনে এলো। জায়গা টা একটু ফাকা! বড় বড় তিনটা তাবু টানানো! মেয়েটি বৃষ্টিকে একটা তাবুতে নিয়ে এলো। লং কটি আর জিন্সের প্যান্ট দিলো বৃষ্টিকে পড়ার জন্য।

প্যান্ট একটু লম্বা হওয়ায় বৃষ্টির পায়ের গোড়ালিতে নেমে গেছে। সে ফোল্ড করে ছোট করে নিলো। কাপড় চেঞ্জ করে নিলে পাতলা একটা কম্বল এগিয়ে দিলো মেয়েটি। বৃষ্টি কম্বল মুড়ে তাবুতেই বসে রইলো। মেয়েটি এতোক্ষণে তার লতাপাতার অদ্ভুত পোশাক ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাক পড়ে নিলো। মেয়েটি খুব সুন্দর। বৃষ্টির মতোই ফর্সা, তার চেয়ে একটু লম্বাও হবে। বয়সেও বড় দেখাচ্ছে। তাই বৃষ্টি আপু বলেই সম্মোধন করে বললো,

  • আপু তোমার নাম?

মেয়েটি একবার বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গায়ে লোশন মাখতে মাখতে জবাব দিলো,

  • সিমি রওনাক।
  • বাসা কোথায় তোমার?
  • আমরা সবাই ঢাকা থেকে এসেছি।

অন্য একটি মেয়ে এসে বাইরে যাওয়ার জন্য ডেকে গেলো। বৃষ্টি কম্বল মুড়েই সিমির সাথে তাবুর বাইরে বেরিয়ে এলো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। বৃষ্টি সবার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সবাই জংলী পোশাক ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাকে আছে। এরা মোট সাতজন। তিনজন মেয়ে আর চারজন ছেলে! সবার চেহারা মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর! সকলেই যথেষ্ট স্মার্ট! কিন্তু এরা জংলী পোশাক পড়েছিলো কেন, বুঝতে পারছে না সে।

দুজন ছেলে এসে তিন তাবুর মাঝে ফাঁকা জায়গায় কিছু শুকনো পাতা রেখে তার চারিদিকে কয়েকটি লাঠি দাড় করালো এবং লাঠির মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো। পরিবেশ টা খুব ভালো লাগছে বৃষ্টির কাছে তাই মৃদু হাসলো বৃষ্টি! ছেলেগুলোর দিকে আবার তাকিয়ে সে ভাবছে একটু আগে কোন ছেলেটি তার সাথে কথা বলেছিলো! আগুনের পাশে বসে লাঠিগুলো একটু নেড়েচেড়ে ঠিক করছিলো একটি ছেলে। মাথা ভর্তি সিল্কি চুল, চুলের ঝিকিমিকির সাথে চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে, আগুনের আলোতে চেহারাটা উজ্জ্বল আলোকিত হয়ে আছে। বৃষ্টি একেই সন্দেহ করলো, যে তার সাথে একটু আগে কথা বলেছিলো। ছেলেটি লাঠি ঠিক করে বৃষ্টির দিকে এগিয়ে এলো,

  • এখানকার পথ চেনা আছে তোমার?
  • না।
  • বন্ধুদের ফোন নম্বর মুখস্ত আছে? থাকলে কল করে বলে দাও। তারাও তো তোমাকে না পেয়ে টেনশন করছে।
    ছেলেটির কথা শুনে এবার বৃষ্টি নিশ্চিত এই ছেলেই তার সাথে কথা বলেছিলো তখন। আর বন্ধুদের কথা তো এই মুহুর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিলো! অত:পর ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো,
  • আপনার কাছে ফোন আছে?
    ছেলেটি তার ফোন বৃষ্টিকে দিয়ে বললো,
  • কোথায় আছে তারা, সেটাও জিজ্ঞেস করে নিও। কাল সম্ভব হলে এগিয়ে দিয়ে আসবো।
  • আচ্ছা।

ছেলেটি অন্য একটা ছেলেকে “রওনক ” নাম ধরে ঢেকে কিছু একটা বললো। নামটা শুনে বৃষ্টি একটু অবাক হলো। একটু আগে সিমি নামের মেয়েটা বলেছিলো তার নাম সিমি রওনক! তাহলে কি এদের দুজনের মধ্যে কানেকশন আছে নাকি! বৃষ্টি তার বান্ধবী রূপার কাছে কল করলো। তারা বৃষ্টির কথা শুনতে পেয়ে প্রান ফিরে পেয়েছে। পুলিশের সাথেও কথা বলেছে বৃষ্টি। আর সে সবাইকে নিশ্চিত করলো সে সম্পূর্ণ ঠিক আছে। আর কাল তাদের কাছে ফিরে আসবে। ব্যাপারটা এতোদূর পৌছে যাবে ভাবতে পারেনি সে। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে বিষয়টি তার বাবা-মাকে জানানো হয়নি! তাহলে এতোক্ষণে এলাহি কান্ড ঘটে যেত! বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছে বন্ধুদের সাথে। তারপর কল কেটে ছেলেটির ফোন তার কাছে ফিরিয়ে দিলো। ফোন হাতে নিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো,

  • কোথায় আছে তারা, জেনেছো?
    বৃষ্টি নিজের জিভে কামড় দিলো। কথা বলতে বলতে তো এটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি! আমতা আমতা করে বললো,
  • না, মানে ভুলে গেছি জিজ্ঞেস করতে। সমস্যা নেই, পরে জিজ্ঞেস করে নিব।
  • ওকে।
  • ভাইয়া, আপনার নাম কি?
  • নাম জেনে কি করবে? কিভাবে নিজের গন্তব্যে পৌছাবে সেটা ভাবো।
    ছেলেটি নিজের কাজে লেগে গেলো। বৃষ্টি অবাক! কেউ নাম জানতে চাইলেও এমন ভাব দেখায়! এতোক্ষণ তো ভালোই ব্যাবহার করছিলো! তাবুর একপাশে দুজন ছেলে পাথর দ্বারা চুলো বানিয়ে তার উপর পাতিল বসিয়েছে। অন্যদিকে, সিমি আর সাথের মেয়ে দুটো মাদুরে বসে মটরশুঁটি বাছতে লাগলো। বৃষ্টি তাদের কাছে গিয়ে বসে মটরশুঁটি বাছতে লাগলো। অন্যদুজনের মধ্যে এক মেয়ে বললো,
  • এতোটা নিশ্চিন্তে আছো কিভাবে! এখন যদি আমরা তোমাকে মেরে ফেলি!
    বৃষ্টি হেসে জবাব দিলো,
  • মেরে ফেললে মরে যাবো। এখন আর ভয় পাই না। তখন শুধু অদ্ভুত বেশে দেখেছিলাম তাই ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সত্যিই বুঝি তোমরা জংলী।
    তিনজনই হাসলো তার কথা শুনে। অন্য একজন বললো,
  • বাবাহ! সাহস আছে দেখছি।
  • হুম, আছে একটু। কিন্তু তোমরা জংলী সেজেছো কেন?
  • আমরা বন্ধুরা প্রায়ই বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে থাকি। এবার আমাদের প্লান ছিল জংগলে এসে জংলী সেজে শর্ট ফিল্ম বানানোর। যেই ভাবা সেই কাজ।
  • ওয়াও! একদমই আলাদা পরিকল্পনা ! কতোটুকু হয়েছে?
  • তিনদিন হলো এসেছি। আরো সপ্তাহের মতো লাগবে।
  • তারপর ঢাকা ফিরে যাবে?
  • হ্যাঁ। তবে এখানে কিন্তু সত্যিই জংলী আছে।
  • তাই নাকি! আমার দেখার খুব ইচ্ছা।
  • ভুল করেও ইচ্ছে মেটাতে যেও না। তাদের হাতে ধরা পড়লে আর ফিরে আসতে পারবা না! তারা মানুষ হয়ে মানুষকে খেয়ে ফেলে।
  • ওফফ! ভয়ংকর! তোমরা কি স্টুডেন্ট?
  • হ্যাঁ। আমরা সবাই মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
  • কোন ভার্সিটি?
  • জাহাঙ্গীরনগর।
  • ওহহ! ভালো। আচ্ছা আপু, ওই ভাইয়াটার নাম কি?
    তিনজনই বৃষ্টির দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো! বৃষ্টি এভাবে তাকানোর কারণ খুজে পাচ্ছে না। সিমি বলে উঠলো,
  • কেন! প্রেমে পড়ে গেছো নাকি?
    এমন প্রশ্নে বৃষ্টি হকচকিয়ে গেল। তারপর বললো,
  • কি বলছো এসব! আমি শুধু নাম জানতে চাইলাম। কারণ, ভাইয়াকে নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। নাম তো বললোই না, কেমন যেন এক্সট্রা ভাব দেখিয়ে চলে গেলো!
    এবার তিনজনই হেসে উঠলো। তাদের হাসি দেখে একটা ছেলে এগিয়ে সে বললো,
  • এতো হাসছিস কেন?

উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ছেলেটি মুঠ ভর্তি মটরশুঁটি নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো। সবাই বুঝতে পেরেছে ফাজিলটা মটরশুঁটি নেয়ার জন্যই এসেছে। তাই আপুরা রিজভী নাম ধরে বকাঝকা করতে লাগলো। সিমি বৃষ্টিকে বললো,

  • ওর নাম আকাশ। এমনিতে মেয়েদের সাথে কমই কথা বলে। প্রেমে টেমে পড়ো না আবার। আগেই বলে দিচ্ছি, সফল হবে না।
    আবারো তিনজন হেসে উঠলো, আর বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকালো।

পর্ব – ৬

বিকেলে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য সেই ছোট পাহাড়ে এলো নাফিসা। গোল হয়ে বসে বাচ্চারা খেলা করছিলো। নাফিসাকে দেখতেই বাচ্চারা সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেলো। শুধু একজনই বসে ছিলো, সেটা বড় বাচ্চা মেঘ! নাফিসা তাকে দেখে অবাক হলো! সে কি ঢাকা ফিরে যায়নি কাল! আজ বিকেল হয়ে গেছে এখনো শ্রীমঙ্গলে আছে! এখন আবার কার বাসায় উঠেছে! বাচ্চাদের বসতে বলে মেঘকে জিজ্ঞেস করলো,

  • আপনি এখানে কেন?
  • কেন কোথায় থাকার কথা ছিলো?
  • কোথায় থাকার কথা ছিলো তা আমি জানি না। কিন্তু আপনি এই বাচ্চাদের মাঝে কেন?
  • এসেছি বাচ্চাদের সাথে খেলতে আর বাচ্চাদের টিচারের কাছে কিছু শিখতে।
  • উঠুন, উঠুন বলছি।

মেঘ বসা থেকে উঠে দাড়ালো,

  • আচ্ছা, উঠলাম। এবার বলুন ম্যাডাম।
  • চলে যান এখান থেকে। এই পাহাড় থেকে নেমে যান।
  • বাড়িটা আপনাদের ছিলো কিন্তু পাহাড়টা নিশ্চয়ই আপনাদের না! সুতরাং আমি এখানে থাকতেই পারি।
  • আমি এখানে যতক্ষণ আছি, ততক্ষণের জন্য আপনি থাকতে পারবেন না।
  • কেন আমি তো তোমাকে বিরক্ত করছি না!
  • আপনার সাথে কথা বলে আমার সময় নষ্ট হচ্ছে। দয়া করে যান এখান থেকে।
  • ওকে, পড়াও।

মেঘ নেমে এলো পাহাড় থেকে। পাহাড়ের রাস্তায় কিছুক্ষণ হাটাহাটি করলো, কিছুক্ষণ পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসে বাচ্চাদের পড়া শুনলো। একটুপর যখন লাইন ধরে বাচ্চাদের পাহাড় থেকে নামতে দেখলো, তখন মেঘ দৌড়ে পাহাড়ে উঠে এলো। নাফিসার পথ আটকে দাড়াতেই নাফিসা বললো,

  • আপনি এখনো যাননি?
  • না।
  • আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন কেন? সরে দাড়ান।
  • সরে দাড়ালে পথ আটকাবো কিভাবে?
  • কি চাইছেন আপনি?
  • তোমাকে।
  • মানে!
  • মানে, তোমার সাথে একটু সময় কাটাতে চাইছি। ওদিকটায় চলো, দুজন বসে একটু গল্প করি।
  • গল্প করার মতো সময় আমার হাতে নেই। আমি আপনার মতো বসে বসে খাই না। উপার্জন করলেই হাড়িতে ভাত আসে।
  • এজন্যই তো তোমাকে এতো পছন্দ করি। তবে এটা তোমাকে কে বললো যে আমি বসে বসে খাই!
  • কাউকে বলতে হবে কেন! আমি কি নিজ চোখে দেখছি না। কাজকর্ম থাকলে কি আর এখানে থেকে থেকে অন্যের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতেন?
  • একটু সময় নিয়ে গল্প করতে চাচ্ছি, তার জন্য কতো কথা শুনিয়ে যাচ্ছো!

নাফিসা মেঘকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে নেমে এলো। মেঘ পাহাড়ের উপর থেকেই বললো,

  • গল্প করার সময় আমি ঠিক খুঁজে নিবো, মেঘা। দেখে নিও তুমি
    পথের ধারে চায়ের দোকানে ঢুকে এক কাপ চা নিলো মেঘ। সিলেটে আসার পর এই মাটির কাপে চা মেঘের মাঝে নতুন অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। জ্বিভে স্বাদ স্পর্শ করতেই সর্বাঙ্গে এক অজানা শিহরণ বয়ে যায় এবং ফুরফুরে করে দেয় মন! তাই সুযোগ পেলেই এক কাপ চা নিয়ে মুহূর্তটা উপভোগ করে মেঘ। চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে রিসোর্টের দিকে যাওয়ার পথে দেখলো চা পাতা তোলার জন্য দলবেঁধে মেয়েগুলো চা বাগানে নামছে। হঠাৎ মনে হলো, নাফিসাও তো সকাল বিকাল দুবার চা পাতা তুলতে আসে! মেঘ পথ চলা থামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো তার মেঘার জন্য। একটু পর অন্য এক দলে নাফিসাকে দেখতে পেল। নাফিসা বাগানে চা পাতা তুলতে লাগলে মেঘও নেমে এলো তাদের সাথে। মেয়েগুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে, আর নাফিসার প্রচুর রাগ হচ্ছে এভাবে পিছু নিচ্ছে বলে। মেয়েগুলো না থাকলে এখন দু’চারটা কথা শুনিয়ে দিতো। তাদের সামনে কিছু বলতে গেলে সমস্যায় পড়তে হবে তাই চুপচাপ চা পাতা তুলে যাচ্ছে। মেঘ নাফিসার লাইনে এসে কয়েকটি পাতা ছিড়ে নাফিসার পিঠের ঝুড়িতে রাখলো। নাফিসা বিরক্তি নিয়ে বললো,
  • এসব কি হচ্ছে! পাতাগুলো এভাবে নষ্ট করছেন কেন?
  • কেন, নষ্ট হয়ে গেছে? তোমাদের দেখে আমারও ইচ্ছে হলো তুলতে, তাই তুলছিলাম।
  • হ্যাঁ নষ্ট হয়ে গেছে। বের হন এখান থেকে!
  • আশ্চর্য! আমি পাতা তুলতে এসেছি। কোথায় শিখিয়ে দিবে, তা না করে তাড়িয়ে দিচ্ছো!
  • হ্যাঁ তাড়িয়ে দিচ্ছি। আপনি থাকায় আমার অসুবিধা হচ্ছে।
    মেঘ চলে এলো সেখান থেকে। এই মেয়ের মন যে পাথরের মতো শক্ত, তা অনেক আগেই বুঝে গেছে!

সকালে ঘুম থেকে উঠে মেঘ হোটেলে নাস্তা করে নিয়েছে। তারপর চা বাগানের দিকে হাটতে লাগলো। নাফিসা চা পাতা তুলতে এলে আজও তার সাথে নেমে গেলো বাগানে। পাতা তুলে নাফিসার ঝুড়িতে রাখতেই নাফিসা চোখ রাঙিয়ে মেঘের দিকে তাকালো। মেঘ এভাবে তাকাতে দেখে বললো,

  • হচ্ছে না যখন শিখিয়ে দাও না! বেড়াতে এসেছি যখন কিছু না শিখলে কি সার্থক হবে!

নাফিসার দলের মেয়েগুলো একটু পর পর তাকাচ্ছে আর হাসছে। তারাও বুঝে গেছে ছেলেটি নাফিসার পেছনে পড়েছে! তাদের মধ্যে একজন বললো,

  • নাফিসা, দে না শিখিয়ে।
    এবার নাফিসা দেখিয়ে দিলো, কিভাবে তুলতে হয়। মেঘ চুপচাপ তাকে অনুসরণ করে কিছু পাতা তুলে নাফিসার ঝুড়ি ভর্তি করে দিলো। চলে যাওয়ার সময় মেঘ পেছন থেকে বললো,
  • মেঘা, পাহাড়ে আজ একটু আগে আসবে?

মেয়েগুলো সবাই হা করে আছে। নাফিসা পেছনে ফিরে মেঘের কাছে এসে বললো,

  • এই নামটা কালও পাহাড় থেকে নামার সময় শুনেছি। কে মেঘা?
  • তুমি মেঘা।
  • আমি মেঘা না। আমি নাফিসা। নূর নাফিসা।
  • হ্যাঁ, সবার কাছে তুমি নূর নাফিসা হতে পারো। কিন্তু শুধু আমার জন্য মেঘা। তুমি এই মেঘের মেঘা।
  • আর কখনো মেঘা বলে ডাকবেন না। আর আমি পাহাড়ে আগে আসবো না, আপনাকে যেন পাহাড়ে না দেখি।
    নাফিসা আবার সামনে এগিয়ে গেলো। এক মেয়ে নাফিসাকে বললো,
  • অন্নেক হ্যান্ডসাম রে নাফিসা! মানাইছে তোর ধারে! তুই মাইনা যা!
    বাকি মেয়েগুলো মিটিমিটি হাসছে আর নাফিসা রাগী দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়েছে! মেঘও মেয়েটির কথা শুনে মুচকি হেসে পেছন থেকে বললো,
  • মেঘা, ওর মতো সবাই বলবে তুমি আমি একে অপরের জন্য পারফেক্ট!

দুপুরে মেঘ হামহাম ঝর্ণাতে এলো। সেদিন পাহাড় থেকে বুঝা যাচ্ছিলো খুব কাছে ঝর্ণাটি। হয়তো তিন চার মিনিটের পথ হবে। আজ এসে দেখলো বিশ মিনিটেরও অধিক সময় লেগেছে! অনেক লোক আছে এখানে। চাকমাসহ, ঢাকাইয়াও দেখা যাচ্ছে। বেড়াতে এসেছে বোধহয়! তাদের সাথে নেমে মেঘও অনেক্ক্ষণ ঝাপাঝাপি করলো ঝর্ণার পানিতে। তবে এটা বুঝতে পারছে বন্ধুরা এলে গোসলে আরও বেশি মজা হতো! বিকেলে নাফিসার আগেই পাহাড়ে এসে খোলা আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে আছে মেঘ। একটু পর দু একজন করে বাচ্চারা আসতে লাগলো। সবার কাছে বসার জন্য আলাদা আলাদা ছোট মাদুর আছে। মাদুর পেতে বাচ্চারা বসে পড়লো।

কয়েকজন এসে গতকালের মতো খেলার জন্য মেঘকে টানতে লাগলো। মেঘ উঠে একজনের কাছ থেকে খাতা নিয়ে যোগবিয়োগ খেলা খেলে তাদের কৌশলে যোগ আর বিয়োগ শিখিয়ে দিলো। তারপর জাতীয় সংগীতের তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন গেয়ে শেখাল। গতকাল প্রথম দুই লাইন শিখিয়েছিলো। এবার চার লাইন একসাথে বাচ্চাদের গাইতে বললে বাচ্চারা শিখিয়ে দেওয়া সুর টেনে গাইতে লাগলো। নাফিসা পাহাড়ে উঠার সময় বাচ্চাদের সুরেলা কন্ঠ শুনে অবাক হলো। দ্রুত গতিতে পাহাড়ে উঠে এসে দেখলো মেঘ দাড়িয়ে আছে আর বাচ্চারা সংগীত গাইছে! দেখে নাফিসা খুব খুশি হলেও তা বাইরে প্রকাশ করলো না। মেঘ নাফিসাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বাচ্চাদের থামতে বললো। নাফিসার কাছে এসে বললো,

  • মেঘা, কথা দিচ্ছি বিরক্ত করবো না। থাকতে পারবো তো এখানে কিছুক্ষণ ?
  • থাকুন।

মেঘ খুশি হয়ে এক পাশে এসে ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে উড়ন্ত ঘাষ ফড়িং এর সাথে দৃষ্টিতে খেলতে লাগলো আর রঙিন স্বপ্ন গুলো সাজাতে লাগলো। যদি থাকতো শত রঙের প্রজাপতির ডানা, তাহলে আজ ভুবনে থেকে দৃষ্টিতে নয়! উড়ে উড়ে সঙ্গ দিতো তাদের আর জমিয়ে দিতো রঙিন খেলামেলা! দৃষ্টির সম্মুখে আকাশে ভেসে যাচ্ছে সাদাকালো মেঘ। অন্যদিকে কানে তার মধুর সুর হয়ে ভেসে আসছে বাচ্চাদের পড়া। জমিনে শুয়ে থাকা মেঘ খুব গভীর ভাবে অনুভব করছে মুহুর্তটাকে!

একটু পর বাচ্চাদের সুর বন্ধ হয়ে গেল। মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো বাচ্চারা লাইন ধরে নেমে যাচ্ছে আর তার মেঘা তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে! নাফিসা এসে মেঘের কাছে বসে দূরে থাকা উচ্চ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে মেঘ স্বপ্ন দেখছে নাকি বুঝতে পারছে না! চোখের পাতা কয়েকবার বন্ধ করলো আর খুললো। তারপর উঠে বসলো, এ তো সত্যিই তার মেঘা তার পাশে বসে আছে! মেঘ জিজ্ঞেস করলো,

  • চা পাতা তুলতে যাবে না আজ?

নাফিসা পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই জবাব দিলো,

  • হ্যাঁ, যাবো। বেড়াতে এসেছেন, আর কত থাকবেন? ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন না কেন?
  • পাহাড়ি কন্যার মায়া যে ছাড়ে না আমায়!
  • এভাবে পিছু নিচ্ছেন কেন আমার?
  • ভালোবাসি, তাই।

নাফিসা এবার মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,

  • ভালোবাসার জন্য আর কাউকে চোখে পড়লো না? আমাকে কেন এভাবে বিরক্ত করে যাচ্ছেন?
  • প্রথম দেখেই তোমাকে ভালো লেগেছে। আর সেবাযত্ন করে তো আমার হৃদ মাঝারেই বসে গেছো যেটা অন্যকারো পক্ষে সম্ভব হয়নি! তাছাড়া আগেই তো বলেছি, আমাকে আশ্রয় দিয়ে তুমি সবচেয়ে বড় ভুল করেছো। এখন যে আমি তোমার ভালোবাসার জন্যই পাগল হয়ে আছি!
  • ভালোবাসা পাথর চাপা দিয়ে ঢাকা ফিরে যান।
  • ঢাকা ফিরতে হলে মেঘাকে সাথে নিয়েই ফিরবো।
  • এসব পাগলামি পাহাড়ে মানায় না।
  • তুমি চাইলেই মেনে যাবে।
  • তাহলে জেনে রাখুন আমি চাইবো না কখনো সেটা।
    নাফিসা উঠে চলে গেলো। মেঘ শুধু মেঘার যাওয়ার পানে চেয়ে মুচকি হাসলো।

পর্ব – ৭

নতুন পরিবেশে রাতটা খুব আনন্দের সাথে কাটিয়ে দিলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে তাবুর বাইরে এসে দেখলো সূর্য উদয় হয়েছে হয়তো কয়েক মিনিট আগে। দুহাত মেলে আড়মোড়া ভাঙল বৃষ্টি। জংগলে এই প্রথম রাত কাটালো সে। গাছপালায় আচ্ছন্ন একটা জায়গায় তিনটা তাবু টানানো, নির্জন জংগল, পাখিদের কিচিরমিচির কলোরব, পাতার ফাকে ফাকে নতুন লাল সূর্যের আলো এসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে! এর চেয়ে সুন্দর পরিবেশ আর কি হতে পারে!

না, বৃষ্টির মতে এর চেয়ে সুন্দর পরিবেশ আর নেই! এতোক্ষণ মনে হচ্ছিলো সবার আগে বুঝি তারই ঘুম ভেঙেছে! এখন দেখছে তার আগেও সেই আকাশ নামের ছেলেটার ঘুম ভেঙেছে! কিন্তু ছেলেটা গাছের ডালে ঝুলছে কেন! বৃষ্টি আর একবার হাত মেলে আড়মোড়া ভেঙে সামনে এগিয়ে গেলো। আকাশ তাকে দেখেছে ঠিকই কিন্তু কিছু বললো না। তাই বৃষ্টিই জিজ্ঞেস করলো,

  • এই যে মিস্টার, সকাল সকাল আপনি গাছের ডালে ঝুলছেন কেন?

আকাশ কোনো জবাব দিলো না। তাই বৃষ্টি আবার বললো,

  • ডাল ভাঙার চেষ্টা করছেন নাকি! শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই! এই ডালটা যথেষ্ট মোটা। আর কাচা ডাল এমনিতেই সহজে ভাঙে না। নেমে পড়ুন, নেমে পড়ুন
    আকাশ ঝুলন্ত অবস্থায় থেকেই জবাব দিলো,
  • অন্যের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার জন্যই কি মেয়ে জাতের সৃষ্টি হয়েছে?
  • মানে!
    ডাল ছেড়ে দিয়ে আকাশ নিচে নেমে পড়লো।
  • ধ্যাত! কোন একটা কাজে শান্তি নেই। কেউ না কেউ এসে বাধা দিবেই! মানে টা বুঝো না! কোন কাজ করতে দেখলেই তোমরা এটা সেটা বলে কাজে বাধা দাও!
  • আমি আবার আপনার কোন কাজে বাধা দিলাম! আমি তো যেটা সত্য সেটাই বলছিলাম!
  • কে বললো তোমাকে, আমি ডাল ভাঙার চেষ্টা করছি? কাচা ডাল ভেঙে আমি কি করবো?
  • তাহলে ঝুলছিলেন কেন?
  • ব্যায়াম করছিলাম, ব্যায়াম বুঝো? ইয়োগা!
  • হয়েছে হয়েছে, বাংলা বলাতেই বুঝতে পেরেছি। ইংরেজি বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটা আবার কোন ধরনের ব্যায়াম! আগে তো কখনো দেখিনি!
  • রিং ধরে ব্যায়াম করতে দেখেছো কখনো? এটা আর ওটা সেইম কাজ!
  • তাই নাকি! ওটা তো লম্বা হতে কাজে লাগে! আপনি তো এমনিতেই অনেক লম্বা! এই দেখুন, আমার চেয়েও কতো লম্বা!
    কথা বলতে বলতে বৃষ্টি একেবারে আকাশের গা ঘেঁষে দাড়ালো উচ্চতা মাপার জন্য। আকাশ তা দেখে হাসতে লাগলো! বৃষ্টি মুগ্ধ হয়ে আকাশের হাসি দেখছে! ছেলেদের হাসলে এতো সুন্দর লাগে, আগে জানা ছিলো না তার! আকাশ হাসতে হাসতে বললো,
  • তুমি কি লম্বা নাকি! তোমার সাথে আমার উচ্চতা মাপতে এসেছো যে!
  • আমি লম্বা না!
  • উচ্চতা কতো তোমার? ছয় ফিট? নাকি সাত ফিট?
  • হুহ্! মেয়েরা এতো লম্বা হয় নাকি! আমি পাচ ফিট তিন ইঞ্চি !
  • মেয়েরা এতো লম্বা হয় না, সেটা মাথায় আছে। আর আমি যে ছেলে, সেটা মাথায় নেই!
  • ওফ্ফ! সরি!
  • তবে এটা ঠিক বলেছো, আমি এমনিতেই লম্বা। আমার এই ব্যায়ামের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তোমার প্রয়োজন আছে! সুতরাং তুমি ঝুলতে থাকো, পরে আমার সাথে উচ্চতা মাপতে এসো।
    আকাশ কথাটা বলে তাবুর দিকে পা বাড়ালো। বৃষ্টি বিড়বিড় করতে করতে বললো,
  • আহ! লম্বা হয়েছে বলে কি ভাব! যেন আর মানুষ লম্বা হতে পারে না! আমিও লম্বা হয়ে দেখিয়ে দিবো আপনাকে। প্রয়োজনে আজ সারাদিন ঝুলে থাকবো এই গাছের ডালে!
    বৃষ্টি আর সময় নষ্ট না করে গাছ বাইতে লাগলো। ডালটা বেশি উচুতে না। আর একটু আধটু গাছ বাইতে জানে বৃষ্টি। আকাশ তাবুর কাছাকাছি গিয়ে আবার পেছনে তাকালো একবার। বৃষ্টিকে গাছে উঠতে দেখে অবাক হয়ে আছে! এতো বড় মেয়ে গাছ বাইছে! পাগল নাকি! আকাশ তারাতাড়ি গাছের কাছে গেলো। বৃষ্টি এতোক্ষণে ডাল পর্যন্ত উঠে গেছে! আকাশ নিচ থেকে বলতে লাগলো,
  • এই মেয়ে! পাগল হয়ে গেছো নাকি! গাছে উঠেছো কেন! নামো!
  • এতোক্ষণ তো মেয়ে জাতের দোষ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এখন কি ছেলে জাতের দোষ দেখতে পাচ্ছেন না! আপনিও তো আমার কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন!
  • আমি কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি করছি না। গাছে উঠেছো কেন? গাছে তোমার কি কাজ?
  • লম্বা হওয়ার জন্য ব্যায়াম করবো আমি।
  • আরে পড়ে গেলে হাড়গোড় ভেঙ্গে যাবে। নামো বলছি!
  • না, নামবো না।
  • তুমি এমনিতেই লম্বা। আর লম্বা হতে হবে না। নেমে আসো।
  • না, আজ ব্যায়াম করেই নামবো। এরপর আর লম্বা হওয়া নিয়ে খোটা দিতে পারবে না।
    আকাশ আর কোন কথা বললো না। চুপচাপ দাড়িয়ে আছে বৃষ্টির কান্ড দেখার জন্য! খুব বড় গলায় তো কথাগুলো বলেছে বৃষ্টি। জেদ করে গাছের ডাল পর্যন্তও উঠে এসেছে! কিন্তু এবার ঝুলবে কিভাবে! সেই সাহস যে আর হচ্ছে না! হাত একটু একটু এগিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ মচকে পড়েই গেলো। ভয় পেয়ে এতো জোরে চিৎকার দিলো, পুরো জংগলে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হলো আর তাবুতে থাকা সবার ঘুম ভেঙে গেলো। তারা তারাহুরো করে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। সবার চোখ গুলোর আকৃতি দ্বিগুণ বড় হয়ে গেছে, আর মুখটা হা হয়ে আছে! বৃষ্টি তো গাছ থেকে পড়ে গেছে! কিন্তু ব্যাথা পায়নি কেন! চোখ খুলে বৃষ্টি নিজেকে আকাশের কোলে আবিষ্কার করলো! রিজভী এগিয়ে এসে বললো,
  • কি দেখছি রে আমি! সবসময় দেখেছি, বৃষ্টি আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে! কিন্তু আজ দেখি বৃষ্টি আকাশ থেকে আকাশেরই কোলে পড়ে!
    আকাশ আর বৃষ্টি ছাড়া সবাই হো হো করে হেসে উঠলো! আকাশ বৃষ্টিকে কোল থেকে নামিয়ে দাড় করালো। অভ্র পেছন থেকে রিজভীর মাথায় ঠুসি দিয়ে বললো,
  • চোখ তোর অন্ধ বাছা! এ নহে বৃষ্টিপাত! এ-তো প্রেমের আলোকপাত! এ যে প্রেম বর্ষন!

সবাই অভ্রের কবিতা শুনে আবার হেসে উঠলো। বৃষ্টিও খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,

  • ও রে বাবা! কবি নাকি! খুব সুন্দর কবিতা বানান দেখছি! নামটা কি কবি মহাশয়ের, বলেন তো শুনি ?
    অভ্রের কাধে হাত রেখে রিজভী বললো,
  • এ যে মোদের অভ্র কবি! হা হা হা!
    বৃষ্টিও খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আকাশ বৃষ্টির কান্ড আর বন্ধুদের মস্করা দেখে রেগে চলে গেলো তাবুতে। ঝুমুর নামের মেয়েটা বৃষ্টির কাছে এগিয়ে এসে বললো,
  • সকাল সকাল এ কোন মহাপ্রলয় ঘটলো! বলবেন কি?
  • মানে?
  • মানে তুমি আকাশের কোলে উঠতে গেলে কেন? আর এতো জোরে চিৎকার করে জংগল কাপালেই বা কেন?
  • ছি ছি! কি বলো আপু! আমি আকাশের কোলে উঠি নি! ও ই আমাকে কোলে নিয়েছে!
    সবাই অবাক বৃষ্টির কথা শুনে! সিমি এগিয়ে এসে বললো,
  • তাই নাকি! কেন হটাৎ আকাশ তোমাকে কোলে নিতে গেলো!
  • আমি গাছে উঠেছিলাম ব্যায়াম করার জন্য। সেখান থেকে পড়ে যেতেই আকাশ ধরে ফেললো!
    রিজভী হাসতে হাসতে বললো,
  • তুমি গাছে উঠতে পারো? আবার উঠে দেখাও তো আমাদের!
  • এবার পড়ে গেলে ধরবে কে?
  • কেন! আমি আছি, রওনক আছে! না সরি, রওনক না! আমি আছি, আমাদের কবি মহাশয় আছে! আমরা ধরবো!
  • না থাক, আপনারা না ধরতে পারলে আমি শেষ! এতো রিস্ক নিতে যাবো না!
    সকলে হাসতে হাসতে তাবুতে চলে গেলো।

বৃষ্টি সিমির সাথে বাইরেই হাটতে লাগলো আর নিম গাছের কচি ডাল দিয়ে ব্রাশ করতে লাগলো।

  • আপু একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
  • হুম, করো।
  • রওনক ভাইয়া কি তোমার কোন কিছু হয়? ফ্রেন্ড ছাড়া।
  • আমার হাসব্যান্ড।
  • সত্যিইইইইই!
  • হাসব্যান্ড মিথ্যা হয়!
  • জানো, আমিতো প্রথমেই সন্দেহ করেছিলাম!
  • সন্দেহ করার কি আছে! সবার কাছেই ক্লিয়ার!
  • না, মানে আমি তো আর জানতাম না! যখন শুনলাম ওই ভাইয়ার নাম রওনক, তখন মনে হয়েছে তুমি বলেছো তোমার নাম, সিমি রওনক! তখনই বুঝতে পেরেছি নিশ্চই তোমাদের কানেকশন আছে! তা লাভ ম্যারেজ নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ?
  • সমবয়সী হলে আবার এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়!
  • ফ্যামিলি এতো সহজে মেনে নিলো?
  • মেনে নেয় নি। মানিয়ে নিয়েছি।
  • ওহ! কাল তুমি আমাদের তাবুতে থাকোনি কেন? ভাইয়ার সাথে ঘুমিয়েছো?
    এবার সিমি এক হাত কোমড়ে রেখে বৃষ্টির দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। বৃষ্টি দাতে দাত চেপে বললো,
  • সরি, সরি! আর জিজ্ঞেস করবো না!
  • এতো কথা বলতে পারো তুমি! ভাবতেও পারিনি!
  • আচ্ছা, অন্য একটা বিষয় জানবো। আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না।
  • না, আর একটা কথাও না।
  • প্লিজ আপু, একটা।
  • একটাও না। যাও আমার কাছ থেকে।
  • প্লিজ আপু, আজ তো চলেই যাবো। আর তো দেখাও হবে না! প্লিজ এটাই লাস্ট।
  • ওকে।
  • কাল তুমি আমাকে এটা বলেছিলে কেন, আকাশের প্রেমে পড়লে সফল হতে পারবো না!
  • এই তুমি প্রেমে পড়ে গেছো?
  • দূর আমি কি জানতে চাইছি আর তুমি কি বলছো!
  • হা হা হা! আকাশ একটু অন্যরকম ছেলে। গোমড়ামুখো! হাসতেও জানে না, কাদতেও জানে না! শুধু রাগটাই দেখাতে জানে। তাকে দেখে কতো মেয়ে প্রেমে পড়েছে হিসেব নেই। কমবেশি সবাই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। কোন মেয়ে তার বাড়ি পর্যন্ত চলে গেছে, কোন মেয়ে তার জন্য তার সামনে হাত কেটে ফেলেছে। কিন্তু আকাশের মন গলাতে পারেনি! পাষাণ একটা! আমাদের সাথে খাটো মেয়েটা আছে না, অথৈ! সেও প্রেমে পড়েছিলো, তার পাগলামি দেখে আকাশ তাকে শেষ পর্যন্ত ফ্রেন্ড বানিয়ে ছেড়েছে! আল্লাহ জানে এর কপালে কোন মেয়ে জুটবে! যেই মেয়ে ওর ঘরে বউ হয়ে আসবে, তিনদিনও টিকবে না! গ্যারান্টি!
  • এমন কেন, লোকটা?
  • কি জানি! মেয়েদের তেমন একটা পাত্তা দেয় না। শুধু আমরা যারা ফ্রেন্ড আছি, তাদের সাথে প্রয়োজন ভেদে টুকটাক কথা বলে।
    সিমির ব্রাশ করা হয়ে এলে তাবুর দিকে চলে গেলো। বৃষ্টি এখানেই দাড়িয়ে আছে। আর নিজের সাথে নিজেই বিড়বিড় করে কথা বলে যাচ্ছে।
  • তোমার বলা কথাগুলো মিললো না গো আপু! আকাশ হাসতে জানে! আমি আজ দেখেছি তাকে হাসতে। সেই হাসিতে আমি প্রেমে পড়ে গেছি লোকটার! সে কথাও বলতে জানে, আমার সাথে সে কিছুক্ষণ আগে চাপা ছেড়েছে! আজ তো বলেছে আমাকে দিয়ে আসবে! না আমি যাবো না! আমি এখানেই থাকবো, আকাশের কাছাকাছি! তার উপর এমন একটা পরিবেশ, ইচ্ছে করছে সারাজীবন কাটিয়ে দেই এখানে! ওফ্ফ! অসম্ভব ভালোলাগা! কিন্তু এরা কি আমাকে সাথে রাখবে! কি করা যায়!

পর্ব – ৮

বৃষ্টি সিমির কাছে গিয়ে বান্ধবীকে কল করার জন্য মোবাইল চাইলো। সিমি তার ফোন বৃষ্টিকে দিলে বৃষ্টি তাবু থেকে কিছুটা দূরে এসে রূপার কাছে কল করলো।

  • হ্যালো, রূপা?
  • হ্যাঁ বৃষ্টি, বল। কখন আসবি তুই? তোর জন্য কোথাও ঘুরাও হচ্ছে না!
  • আমি আসবো না।
  • কিইইইই!
  • হ্যাঁ, আমি আসবো না। তোরা তোদের মতো করে ঘুরে ঢাকা ফিরে যা। আমি এখানেই আছি কয়েকজন আপু ভাইয়ার সাথে। ওদের সাথেই ঢাকা ফিরে যাবো।
  • পাগল হয়ে গেছিস! এমনিতেই বাসায় মিথ্যে বলে এসেছি! আবার তুই বলছিস তোকে রেখে ঢাকা ফিরে যাবো! কাল রাতেও আংকেল তোর ফোনে কল করেছে। আমি রিসিভ করে মিথ্যে বলেছি, যে তুই ঘুমিয়ে আছিস। আবার ফোন দিলে কি বলবো!
  • গুড! ভেরি গুড! তুই এক কাজ কর, আমার ফোনটা অফ করে দে। আর বাবাকে যা বলার আমি কল করে বলে দিবো। আর শুন, তোরা নিজেদের মতো ঘুরেফিরে ঢাকায় ফিরে যা। আমার ব্যাগটাও নিয়ে যাবি। আমি ঢাকা ফিরে তোর কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে নিবো। তুই সবার আগে এখন আমার ফোনটা অফ কর। রাখি এখন। আল্লাহ হাফেজ।
    বৃষ্টি কল কেটে তার বাবার নম্বরে ডায়াল করলো। রিসিভ হতেই বললো,
  • বাবা, কেমন আছো?
  • আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?
  • আমিও আলহামদুলিল্লাহ। মা ভালো আছে?
  • হ্যাঁ। এটা কার নম্বর?
  • এটা এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে নিয়ে কল করেছি। আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে। ভাবছি ঢাকা ফিরেই ঠিক করবো। তুমি আবার বারবার কল করো না এটাতে। তাহলে ওরা বিরক্ত হতে পারে।
  • তাহলে কথা বলবো কিভাবে? কবে আসবে তুমি?
  • আমার ফিরতে দেড়ি হবে। আরো একসপ্তাহের মতো থাকবো। আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে স্ট্রং! পরিবেশটা ভালো লাগছে তাই আরো কিছুদিন থাকবো। না করবা না প্লিজ। আর আমি মাঝে মাঝে তোমাকে ফ্রেন্ডের ফোন থেকে কল করবো।
  • আচ্ছা। ভালো থাকিস।
  • ওকে, আল্লাহ হাফেজ।
    কল কেটে বৃষ্টি প্রশান্তির হাসি দিলো। যাক, সবটা ম্যানেজ করা হয়ে গেছে। এবার এদিকটা ম্যানেজ করতে হবে। নাস্তা করা শেষে আকাশ বৃষ্টিকে জানালো, আজ তাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে পারবে না। আবহাওয়াটা খুব সুন্দর। তাই তার জন্য এখন ফিল্মের কাজটা মিস করতে পারবে না। বৃষ্টি যেন আর একটা দিন কষ্ট করে তাদের সাথে থাকে আর তার ফ্রেন্ডদের যেন কল করে জানিয়ে দেয় কাল ফিরবে তাদের কাছে! বৃষ্টি তো সেই খুশি! সে তো এটাই চাচ্ছিলো কোনভাবে যেন তাদের সাথে থাকতে পারে। যাক, সুযোগটা পেয়েই গেলো! দুপুর পর্যন্ত তাদের সাথে শর্ট ফিল্ম দেখলো। ভালোই অভিনয় করতে পারে এক এক জন। এখন সবাই গোসল করতে যাবে। বাকিটা বিকেলে করবে। সবাই জংলী পোশাকে আছে। বৃষ্টির কাছে দেখতে খুবই ভালো লাগছে। তাবু থেকে একটা বড় পাতিল আর একটা কলস নিয়ে তারা জংগল থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। কলস দেখে সিমিকে জিজ্ঞেস করলো,
  • আপু, এটা নিচ্ছো কেন?
  • পানি আনবো।
  • পানি দিয়ে কি করবে?
  • কাল থেকে কি পানি না খেয়ে আছো?
  • ওহ! তবে লেকের পানি খেয়েছি?
  • বোকা মেয়ে! পাহাড়ি অঞ্চল, ঝর্ণার অভাব! ঝর্ণার বিশুদ্ধ পানি খেয়েছিলে।
    বৃষ্টি তাদের সাথে জংগল থেকে বেরিয়ে বিছানাকান্দি ঝর্ণার ধারে এলো। খুব সুন্দর জায়গা! ছোট বড় পাথরে ভরপুর! উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসছে ঝর্ণা! ঝর্ণার পানি পাথরের উপর আছড়ে পড়ছে! ছেলেগুলো ঝাপাঝাপি করে ঝর্ণার ধারে লেকের পানিতে নেমে গেলো। মেয়েরাও কোমড় পানিতে নেমেছে বৃষ্টি খুব সাবধানে পাথরের উপর দাড়িয়ে অল্প পানিতে নেমেই গোসল করেছে। গোসল শেষে পানি থেকে উঠে একদিকে ছেলেরা, একদিকে মেয়েরা গাছের আড়ালে এসে কাপড়চোপড় পাল্টে নিলো। ভেজা কাপড়চোপড় ধুয়ে শুকনো পাথরের উপর মেলে দিলো শুকানোর জন্য।

অত:পর আকাশ কলস নিয়ে ঝর্ণার দিকে যেতে লাগলো পানি নেয়ার জন্য। সাথে রওনক আর রিজভী বড় পাতিল হাতে নিয়ে পাতিল বাজাতে বাজাতে আকাশের সাথে যাচ্ছে। অভ্রসহ মেয়েরা দাড়িয়ে আছে একপাশে। বৃষ্টির ইচ্ছে করছে সেই সমান্তরালভাবে নেমে আসা ঝর্ণার ধারে যেতে। যেই ভাবা সেই কাজ! বৃষ্টি প্যান্ট ফোল্ড করে, ওড়না টা গলায় পেচিয়ে ঝুলন্ত মাথা ছোট করে নিলো। তারপর পাথরের উপর দিয়ে হেটে হেটে চলে গেলো তাদের পিছু। অথৈ ডাকছিলো বৃষ্টিকে কিন্তু সেদিকে কান দিলো না বৃষ্টি। ডুবন্ত শ্যাওলাজমা পাথরে খুব সাবধানে পা ফেলে তাদের কাছে চলে গেলো। আকাশ ঝর্ণার নিচে কলস ধরে রেখেছে পানি নেয়ার জন্য আর বড় পাতিলটা নিচে রাখা হয়েছে। কলস ভরে পাতিলে ঢালা হচ্ছে। বৃষ্টি বললো,

  • এই পানিতে কোন ময়লা নেই?
    রিজভী বললো,
  • হ্যাঁ, উড়ন্ত পক্ষীর গু আছে! হা হা হা!
    -ছি! কি বাজে লোক!
    বৃষ্টিকে দেখে রওনক বললো,
  • তুমি এখানে এসেছো কেন শুধু শুধু?
    বৃষ্টি উৎফুল্ল হয়ে জবাব দিলো,
  • খাড়া ঝর্ণায় হাত ভেজাবো বলে।
    বৃষ্টির অদ্ভুত ইচ্ছের কথা শুনে পেছনে ফিরে একবার বৃষ্টির দিকে তাকালো আকাশ। রিজভী হেসে বললো,
  • হাত ভেজাতে গিয়ে যদি এই ফাদে পড়ো, তোমার চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
    পানি নেওয়া শেষ হলে রওনক আর রিজভী পাতিল ধরে নিয়ে আসতে লাগলো। আকাশ কলস হাতে নিতেই বৃষ্টি বললো,
  • প্লিজ, এখানে হাত ভেজাবো। ঝর্ণা স্পর্শ করবো একবার।
  • করো, না করেছে কে! একবার বাচিয়েছি বলে বারবার বাচাতে যাবো এটা ভেবে ভুল করো না।
    কথাটা বলে আকাশ চলে আসছিলো বৃষ্টি তারাহুরো করে আকাশের সামনে লাফ দিয়ে পথ আটকাতে গেলে পানি ছিটে আকাশ আর বৃষ্টি দুজনেই হালকা ভিজে যায়! আকাশ রাগী দৃষ্টিতে তাকালো বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টি আহ্লাদী সুরে আবার বললো,
  • প্লিজ একটু ধরুন না আমাকে। একটু স্পর্শ করবো ঝর্ণা।

আকাশ কলস পাশে অন্য পাথরের উপর রেখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

  • এসো।
    বৃষ্টি খুশি হয়ে আকাশের হাত ধরে সামনে গেলো। অসমতল জায়গায় আকাশ খুব সাবধানে দাড়িয়ে বৃষ্টিকে ধরে রইলো। বৃষ্টি উৎফুল্ল হয়ে এক হাতে আকাশকে ধরে রেখে অন্য হাতে ঝর্ণা স্পর্শ করলো। অন্যরকম এক ভালো লাগা! আকাশ বৃষ্টির আনন্দ দেখে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো। বৃষ্টি আকাশকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঝর্ণা হতে হাত নামিয়ে আকশেরও একটা হাত টেনে নিয়ে আবার ঝর্ণা স্পর্শ করলো! আকাশ আরো গভীরভাবে বৃষ্টির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বৃষ্টি আকাশের চোখে পলকহীন তাকিয়ে আছে! এ দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়! দুজনের দৃষ্টি নিরবে কথা বলে যাচ্ছে! বৃষ্টি মুহুর্তটা গভীরভাবে অনুভব করছিলো! আকাশ আচমকা হাত সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকালো। এ কোথায় ভেসে যাচ্ছিলো সে! এ মেয়েটা তার মাঝে কেমন যেন অনুভূতি সৃষ্টি করে দিচ্ছিলো! সে বৃষ্টিকে সরিয়ে এনে কলস হাতে নিয়ে চলে এলো। বৃষ্টিও তার পিছু পিছু চলে এলো আর বন্ধুবান্ধব তো আছেই তাদের নিয়ে ঠাট্টা করার জন্য! বিকেলটাও খুব মজা করে তাদের সাথে কাটালো বৃষ্টি! যখনই সুযোগ পাচ্ছে আকাশের সাথে কথা বলছে, অভ্র আর রিজভীর সাথে মিলে একটু একটু দুষ্টুমি করছে! মানুষগুলো সত্যিই অন্যরকম!

মেঘা পাহাড় থেকে চলে যাওয়ার পর মেঘ আবার ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে রইলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ আর উড়ন্ত ঘাস ফড়িংয়ের সাথে খেলা করেই সময়টা পার করে দিলো। সূর্য ডুবে অন্ধকার হয়ে আসছে, মেঘ উঠে পাহাড় থেকে নেমে গেলো। রিসোর্টের পথের ধারে হাটতে লাগলো। চা বাগানে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চলে গেছে হয়তো সবাই। টংয়ের উপর বসানো মুদি দোকানে এলো মেঘ। মাটির কাপে এক কাপ চা না খেলেই নয়।

এখানে আসার পর এটা রোজকার অভ্যাস হয়ে গেছে। বড়দের আড্ডায় কিছুক্ষণ বসে ছিলো। তাদের কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা সম্পূর্ণ ভিন্ন! এক এক বিষয় নিয়ে এক একজন, এক এক কথা বলে যাচ্ছে। হঠাৎ কোন দূর মসজিদ থেকে আযানের শব্দ ভেসে এলো। এখানে আসার পর মেঘ মসজিদ দেখেনি কিন্তু নাফিসার বাসায় থাকাকালেও কয়েকবার দূর থেকে আযানের শব্দ শুনতে পেয়েছিলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো সাড়ে সাতটা বাজে। ইশার আযান দিয়েছে।

বাসায় থাকলে নামাজ তেমন মিস হয় না। কিন্তু সিলেট আসার পর সেই যে হবিগঞ্জে নামাজ পড়েছিলো আর পড়া হয়নি। তারপর তো এক্সিডেন্টই হলো। যাক আজ নামাজ পড়বে তাই দোকান থেকে বেরিয়ে রিসোর্টে ফিরে এলো। সেখানেই নামাজ আদায় করে নিলো। রেস্টুরেন্টে ডিনার করে বাবা মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। বৃষ্টির খবর নিয়ে জানতে পারলো তারা কুমিল্লা গেছে বেড়াতে। বেশি রাত জেগে না থেকে ঘুমিয়ে পড়লো মেঘ।


পর্ব – ৯

সকালে বাজার করার জন্য নাফিসা বাজারের দিকে যাচ্ছিলো। হঠাৎ দেখলো শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ইকো রিসোর্ট থেকে মেঘ বেরিয়ে আসছে। তার মানে সে এখানে উঠেছে! কারো বাড়িতে যায়নি!
মেঘও নাফিসাকে দেখে থেমে গেলো। মুচকি একটা হাসি দিয়ে নাফিসার কাছে এসে পাশাপাশি হাটতে লাগলো।

  • এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো?
  • আপনাকে জানাতে বাধ্য নই।
  • আচ্ছা, জানাতে হবে না। সাথে গেলেই দেখতে পাবো।
  • সাথে যেতে পারবেন না। বাজারে যাচ্ছি আমি।
  • বাজারে কেন?
  • বাজারে কেন যায় সেটা জানেন না! খাবার খেতে জানেন? খাবারটা তৈরি করতে অনেক উপকরণের প্রয়োজন হয়। আর সেগুলো বাজার থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। আমিও সেজন্যই যাচ্ছি।
  • অনেক ভালো বুঝাতে পারো তুমি। শিক্ষিকা হলে মানাবে দারুণ। ভবিষ্যৎ নিয়ে কি প্ল্যান আছে?
  • এতো কথা বলেন কেন আপনি? আর আমার সাথে সাথে কেন আসছেন?
  • আমিও তো বাজারে যাবো, তাইতো একসাথে যাচ্ছি।
  • আপনি কেন যাবেন?
  • কেন আবার! বাজার করতে!
  • রান্না করে খান আপনি?
  • না, তোমার সাথে বাজার করবো।
  • সরে দাড়ান। সরে দাড়ান! যেখানে ইচ্ছে যান। কিন্তু আমার সাথে আসবেন না আপনি।

নাফিসা দ্রুত পায়ে হেটে যাচ্ছে, মেঘও হেসে তার সাথে সমান তালে যাচ্ছে। বিরক্ত লাগছে নাফিসার, তবুও কিছু বললো না। বললেই কি হবে! শুনবে না একটা কথাও! বাজারের পাশেই মেঘ মসজিদ দেখতে পেল। নাফিসা নিজের ইচ্ছে মতো বাজার করেই যাচ্ছে। মেঘ সাথে সাথে ঘুরছে। বাজারে বেশিরভাগ বিক্রেতাই মহিলা। এই অঞ্চলে কর্মস্থলে পুরুষদের চেয়ে মহিলা ই বেশি দেখা যায়। তাদের ভাষা বাংলা হলেও একটু অন্যরকম। মেঘ লক্ষ্য করলো, নাফিসা বিক্রেতাদের সাথে তাদের ভাষায়ই কথা বলছে।

কিন্তু মেঘের সাথে ও তার মায়ের সাথে স্বাভাবিক ভাষায় কথা বলে। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে অন্ধকার হয়ে আসছে। বৃষ্টি হতে পারে, তাই নাফিসা তারাতাড়ি বাজার করা শেষ করলো। বাজার করার পুরোটা সময়ই মেঘ নাফিসার সাথে সাথে ঘুরলো।
বাজার থেকে বেরিয়ে বাসার দিকে রওনা দিতেই পথে নামলো বৃষ্টি। কোনো আবাস না দিয়েই একাধারে ঝপাঝপ বৃষ্টি নেমে গেলো। নাফিসা দৌড়ে একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় চলে এলো সাথে মেঘও।

  • ওফ! এতো সকাল সকাল বৃষ্টি!
  • মেঘলা দিনে ছাতা নিয়ে বের হবে না! এখন বাসায় যাবে কিভাবে?
  • আপনি সাথে না এলে হয়তো এখন বৃষ্টি শুরু হতো না!
  • মানে! আমার সাথে বৃষ্টির কি কানেকশন!
  • মেঘ থেকেই তো বৃষ্টির সৃষ্টি হয়! মাটিতে মেঘকে হাটতে দেখে আকাশের মেঘের হিংসে হয়েছে তাই বাসায় যাওয়ার সময়টুকুও দিলো না!
    নাফিসার কথা শুনে মেঘ হাহাহোহো করে হেসে উঠলো।
  • দারুণ বলেছো! কিন্তু বৃষ্টি তো কুমিল্লায়! এখানে এসে পড়লো কেন হঠাৎ!
  • মানে?
  • আকাশের বৃষ্টি না, আমার বোনের কথা বলছিলাম। ওর নামও বৃষ্টি। মেঘের প্রতি হিংসুটে!
  • হুহ! কি অদ্ভুত নাম! ভাইয়ের নাম মেঘ! বোনের নাম বৃষ্টি! আপনার বাবার নাম কি আকাশ আর মায়ের নাম কি ভূমি নাকি?
  • হা হা হা হলে পারফেক্ট হতো। কিন্তু আফসোস! উনাদের বাবা মা সেটা রাখেনি! আমার বাবার নাম রায়হান চৌধুরী আর মায়ের নাম মোহিনী চৌধুরী।
  • মোহিনী নামটা খুব সুন্দর।
  • আচ্ছা! আর মেঘা নামটা?

নাফিসা আর কোন জবাব দিলো না। দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো। বৃষ্টি থামার বদলে যেন আরও বেড়ে চলেছে! মেঘের কাছে বৃষ্টিটা খুব ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে ভিজতে! না, শুধু শুধু ইচ্ছে দমিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না! পকেট থেকে ফোন আর ওয়ালেট বের করে নাফিসার সামনে ধরলো। নাফিসা কিছু না বুঝতে পেরে মেঘের দিকে তাকালো।
মেঘ হেসে বললো,

  • এগুলো রাখবে একটু তোমার কাছে?
  • কেন?
  • একটা কাজ আছে, কাজটা শেষ হলে ফেরত নিয়ে নিবো।
  • সরি, আমি রাখতে পারবো না।
  • বৃষ্টিতে ভিজবো আমি। এগুলো ভিজলে নষ্ট হয়ে যাবে।
  • এখন আপনি বৃষ্টিতে ভিজবেন!
  • হুম। মুহুর্তটা ভালো লাগছে খুব। সুতরাং অবহেলা করার মানে হয় না! ইচ্ছেমতো উপভোগ করাটাই শ্রেয়!
    মেঘ কথাগুলো চমৎকার বলে! নাফিসা মেঘের সময়টা আর নষ্ট না করে ফোন আর ওয়ালেট হাতে নিয়ে নিলো। মেঘ প্যান্ট ফোল্ড করে দোকানের বারান্দা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো আর বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। চোখের পাতা বন্ধ করে আকাশ পানে মুখ করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলো মেঘ। এদিকে এখন না আছে কোন যানবাহন আর না আছে কোন লোকজন! অন্যরকম এক ভালো লাগা! অন্যরকম এক অনুভূতি! নাফিসা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো বৃষ্টিতে ভেজা মেঘকে। অজান্তেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মেঘ নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা তার দিকেই তাকিয়ে আছে! মেঘ দুহাত মেলে হাতে বৃষ্টির পানি জমা করলো। অত:পর দু’হাতের পানি নাফিসার দিকে ছুড়ে মেরে হেসে বললো,
  • ভিজতে ইচ্ছে হলে চলে এসো।

মেঘ তাকে এভাবে পানি ছিটিয়ে দিবে নাফিসা ভাবতেও পারেনি! মেঘকে ভিজতে দেখে তারও ইচ্ছে হচ্ছিলো বৃষ্টিতে ভেজার। কিন্তু হাতে বাজারের ব্যাগ আর মেঘের ফোন ও ওয়ালেট থাকায় মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে উত্তরে মেঘকে “না” জানালো। মেঘ আবার বললো,

  • ব্যাগের জন্য আসতে পারছো না? ফোন আর ওয়ালেট তোমার বাজারের ব্যাগে রেখে ব্যাগটা শাটারের সাথে ঘেঁষে মাটিতে রেখে আসো।

নাফিসা মেঘের বলা কথাটা মনে করলো, ” মুহুর্তটা ভালো লাগছে খুব। সুতরাং অবহেলা করার মানে হয় না! ইচ্ছেমতো উপভোগ করাটাই শ্রেয়!” এক মিনিট পর তাই করলো সে। বারান্দা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলো ভেজার জন্য। মেঘ রাস্তায় জমা পানির সাথে খেলা করছে। নাফিসা আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বুজে ঝুমঝুম বৃষ্টি উপভোগ করছে আর দুহাত মেলে হাতে বৃষ্টির পানি জমা করছে। মেঘ মুগ্ধ হয়ে নাফিসার দিকে তাকিয়ে আছে! সাথে আছে মন ভোলানো মুচকি হাসি! নাফিসা চোখ খুলে মেঘের দিকে তাকাতেই সেই হাসিটা দেখতে পেল। চোখ খুলে তাকাতে দেখে মেঘ তার মুখে পানি ছিটিয়ে দিলো।

নাফিসাও মেঘকে পানি ছিটিয়ে দিলো, আবার মেঘ দিলো আবার নাফিসাও দিলো। এভাবে চার পাচ বার ছিটানোর পর মেঘ আবার দিতে গেলে থেমে গেলো। পানি ছিটাতে ছিটাতে নিজেদের অজান্তেই তারা একে অপরের কাছে চলে এসেছে! মেঘ তার হাতের পানি নাফিসার মাথায় দিলো আর তা কপাল, নাকমুখ বেয়ে সারা অঙ্গ স্পর্শ করে মাটিতে পড়লো! মেঘ আলতো করে দু’হাতে তার মেঘার মুখখানা স্পর্শ করলো। নাফিসা মেঘের দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে। মেঘ তার ঠোঁট জোড়া এগিয়ে তার মেঘার কপালে আলতো করে চুমু একে দিলো। সাথে সাথে মেঘার সমস্ত শরীরে এক তরঙ্গের সৃষ্টি হলো।

এ কেমন স্পর্শ! এ কেমন অনুভূতি! এই প্রথম কেউ তাকে এক ভিন্ন অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়েছে! মেঘা শিউরে ওঠে দু’হাতে মেঘের শার্ট খামচে ধরলো! মেঘ দু’হাতে মেঘার মাথা ধরে কপালের সাথে কপাল আর নাকের সাথে নাক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে বৃষ্টির পানি দুজনের মাথা স্পর্শ করে টুপটাপ মাটিতে পড়ছে। দুজনের ভেতরটা উথালপাতাল হয়ে আছে। মেঘ এভাবেই দুতিনমিনিট দাড়িয়ে থেকে মাতাল সুরে বললো,

  • ভালোবাসি। ভালোবাসি মেঘা। খুব ভালোবাসি মেঘা।

নাফিসা মেঘের শার্ট ছেড়ে মেঘকে ছাড়িয়ে মেঘ থেকে একটু দূরে সরে গেলো। এতোক্ষণ সে কোথায় ছিলো তার নিজেরও জানা নেই। তবে এটা খুব ভালো জানা আছে, এই মানুষটা তাকে অন্য একটা জগতে নিয়ে গেছে। নাফিসা আবার বারান্দায় চলে এলো, সাথে মেঘও। বৃষ্টি আগের চেয়ে একটু কমেছে, কিন্তু শেষ হয়নি। সকাল সকাল বৃষ্টিতে ভিজেছে আবার হালকা বাতাস বইছে। যার ফলে দুজনেরই ঠান্ডা লাগছে। মেঘ নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলো ঠান্ডায় হাত দুটো গুটিয়ে নিচ্ছে। তাই অন্যদিকে তাকিয়ে নাফিসাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

  • ওড়না চিপে পানি ঝরিয়ে গায়ে দাও। ঠান্ডা কম লাগবে।
    নাফিসা মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেঘ উল্টোদিকে ঘুরে দাড়িয়ে আছে। আশেপাশে একটু তাকিয়ে বারান্দার এক কোনে এসে ওড়না থেকে পানি ঝরিয়ে আবার গায়ে দিলো। আবার এসে মেঘের পাশে দাড়ালো। মেঘ একবার তাকালো নাফিসার দিকে, আবার বৃষ্টি দেখতে লাগলো। হঠাৎ কিছু একটা দেখে মেঘ দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। এভাবে হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়ায় নাফিসা একটু অবাক হলো। বারান্দার একটু কিনারার এসে দেখলো একটা অটোরিকশা! আর মেঘ সেই রিক্সার কাছেই গেছে। মেঘ রিকশা সাথে নিয়ে এলো দোকানের কাছে।
  • মেঘা, এটায় উঠে যাও।
  • না, আপনি যান এটায়।
  • আমি অটোতে যাবো না। এইটুকু পথ এক দৌড়েই যেতে পারবো। উঠে পড়ো তারাতাড়ি বৃষ্টির মধ্যে অটো পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া বৃষ্টি শেষ হতেও অনেক দেড়ি।
    মেঘ বাজারের ব্যাগ অটোতে তুলে দিলো। নাফিসাও উঠে পড়লো।
  • আপনিও চলুন।
  • না, আমি বৃষ্টিতে হাটতে হাটতে ভিজবো। তুমি যাও।
    অটো চলতে লাগলে মেঘও হাটতে লাগলো। নাফিসা একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলো মেঘ রাস্তায় জমে থাকা বৃষ্টির পানির সাথে খেলা করছে আর হাটছে। মুচকি একটা হাসি দিয়ে আবার সামনে তাকালো। বাসায় ফিরে মনে হলো বাজারের ব্যাগে তো মেঘের ফোন আর ওয়ালেট আছে! ওফ্ফ! একটুও খেয়াল ছিলো না! তাছাড়া মেঘ তো হেটে আসছিলো, এগুলো সাথে থাকলে ভিজেই যেতো! যাক, বিকেলে পাহাড়ে এলে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে।

নাফিসা বাজারের ব্যাগ থেকে ফোন আর ওয়ালেট বের করে লুকিয়ে রাখলো। ভিজে আসার কারণে আম্মির কাছে বকা শুনতে হলো। এদিকে রিসোর্টে ফিরে মেঘেরও মনে হলো ফোন আর ওয়ালেট মেঘার কাছে রয়ে গেছে। যাক, পরে নেয়া যাবে। আর কেউ কল করলে মেঘা রিসিভ না করলেই হয়।


পর্ব – ১০

কলেজ অফ থাকলে বাসায় ঘুম ভাঙে নয়টা, দশটায়! কিন্তু এই জঙ্গলে বৃষ্টির ঘুম ভাঙে খুব সকালে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে। এখানে প্রতিদিনই সে ভোরের নতুন লাল সূর্য দেখতে পায় আর মিষ্টি রোদ গায়ে মাখে। এখানে সারাজীবন থাকলেও তৃপ্তি মিটবে না তার। এই পরিবেশের সবকিছুই ভালো লাগছে তার কাছে। শুধু মাত্র একটা জিনিস ছাড়া! সেটা হলো টয়লেট! থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু টয়লেটটা নিয়ে যত্তসব সমস্যা! জঙলে খোলামেলা টয়লেট আবার যেখানে ছেলেমেয়ে একসাথে আছে! ছি! ছি! ছি! যদিও তাবুর দু’পাশে পাতলা চট দ্বারা আবদ্ধ দুইটা টয়লেট। একটা ছেলেদের জন্য আরেকটা মেয়েদের জন্য।

তবুও একটু অস্বস্তিকর! বৃষ্টি তাবু থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে হাটতে লাগলো। আজ আকাশকে গাছের ডালে ঝুলতে দেখছে না। আকাশ উঠেনি নাকি! একটু সামনে যেতেই দেখলো, আকাশ আর রিজভী আসছে। রিজভীর মুখ নড়ছে খুব আর আকাশ চুপচাপ। হাতে কিছু একটা আছে তাদের। বৃষ্টি হেটে তাদের দিকে এগিয়ে গেলো। রিজভী বৃষ্টিকে দেখে বললো,

  • এতো সকালে ঘুম ভাঙে কেন বৃষ্টির! প্রতিদিনই কি আকাশের কোলে উঠতে মন চায়?
  • মন চাওয়ার কি আছে! আকাশের কোল থেকেই তো বৃষ্টি ঝরে। হিহিহি
  • হাহা অভ্র কবির কথাই তো সত্য হয়ে যাচ্ছে দেখছি!
    আকাশ রেগে তাকালো রিজভীর দিকে। তারপর রিজভীর হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে হনহন করে চলে গেলো তাবুর দিকে। রিজভী আর বৃষ্টি দৃঢ় পায়ে হেটে তাবুর দিকে যাচ্ছে। প্যাকেট দেখে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো,
  • প্যাকেটে কি আছে?
  • প্যাকেটে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ব্যাঙ আছে।
  • ব্যাঙ! ব্যাঙ দিয়ে কি করবেন?
  • রান্না করে খাওয়াবো তোমাকে। হা হা হা
  • ওয়াক! থু! ছি! সবসময় এমন বাজে কথা বলেন কেন! এসব খান আপনি!
  • এখন থু থু ফেলছো, রান্না করলে আবার খাওয়ার জন্য দৌড়ে এসো না।
  • আমি ব্যাঙ খাই না। সাত দিন না খেয়ে থাকতে রাজি তবুও ব্যাঙ খেতে রাজি না।
  • তার মানে সাত দিনের পর আট দিনের মাথায় ব্যাঙ খেতে রাজি আছো! হা হা হা
  • ছি! আপনি অনেক বাজে লোক। অনেক খারাপ লোক। আপনি, আপনি গোবরে পোকা।
    রিজভী হাহাহোহো করে হাসতে হাসতে তাবুতে চলে এলো। সামনে পড়লো ঝুমুর। রিজভীকে হাসতে দেখে বললো,
  • কিরে! এমনভাবে হাসছিস কেন!
  • আমাদের পিচ্ছি মেহমান বৃষ্টি ব্যাঙ খেতে চাইছে। সাথে মসলা স্বরূপ গোবরে পোকা দিতে বলছে। ব্যাঙ তো পাওয়া যাবে কিন্তু গোবরে পোকা কোথায় পাই, বলতো।
    রিজভীর কথা শুনে ঝুমুরও সকাল সকাল হা হা করে হাসতে লাগলো। বৃষ্টি রেগে ফেটে যাচ্ছে!
  • আপু দেখোতো রিজভী ভাইয়া কি বলছে আমাকে! এমনিতে ক্ষুধায় পেটে গুড়ুম গুড়ুম ডাক পরছে তার উপর ভাইয়া এসব বাজে বাজে কথা শোনাচ্ছে! এখন তো বমি আসছে আমার!
  • বমি এলে রিজভীর উপর বমি করে দিবে। ব্যাস, সমান সমান।
    এবার বৃষ্টি হাসতে লাগলো। অভ্র তাবু থেকে বেরিয়ে বললো,
  • বাছা রিজভী, তোর কি নিতুর সাথে ব্রেকাপ হয়েছে! এমন ভাবে এই পিচ্চি মেয়েটার পেছনে পড়লি কেন রে!
  • হায়! হায়! এতো বড় কথা! সইতে পারছি না আমি, কবিগুরু! আপনি জানেন না, পিচ্চি মেয়েটা বিশাল আকাশের পেছনে পড়ে আছে। হা হা হা! ভালো কথা মনে করছস দোস্ত, নিতুর সাথে ব্রেকাপ না হলেও আজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাল বলে দিছে আজ সকালে যেন কল করে তার ঘুম ভাঙাই!

ঝুমুর আর অভ্র হাসতে লাগলো। রিজভী দৌড়ে তাবুতে চলে গেলো। পিছু পিছু অভ্রও। বৃষ্টি কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো,

  • নিতু কে?
    ঝুমুর জবাব দিলো,
  • রিজভীর গার্লফ্রেন্ড।
  • অহ আচ্ছা। এমন লোকের গার্লফ্রেন্ড কেমন হবে আপু! যে ছেলে এমন বাজে কথা বলে!
    ঝুমুর হেসে জবাব দিলো,
  • এসব তো বলে আমাদের হাসানোর জন্য। গার্লফ্রেন্ড এর সাথে কি আর এসব বলে! তখন ঠিকই প্রেমালাপ করে।
    আকাশ তাবু থেকে বেরিয়ে ঝুমুরকে ডেকে প্যাকেটটা দিলো। বৃষ্টিও গেলো সাথে। প্যাকেট খুলে দেখলো চারটা ব্রয়লার মুরগী! আর রিজভী এটাকে ব্যাঙ বলেছে!
    একটু পর মুরগী কেটে রোস্ট রান্না করছিলো। আকাশ আর রওনক খুব ভালো রান্না করতে পারে। বৃষ্টি এখানে আসার পর থেকে দেখছে সব রান্না ছেলেগুলোই করছে। মেয়েরা শুধু কেটেকুটে দিচ্ছে। রিজভী জোকস শুনায় আর অভ্র কবিতা। আর বাকি সবাই শ্রোতা! আকাশটা মেঘলা হয়ে আসছে। তাই তারা তারাতাড়ি রান্নার আয়োজন করলো।

পাথর দিয়ে দুইটা চুলা বানিয়ে রান্না বসিয়েছে। ভাত রান্না শেষ রোস্ট রান্না প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় এক ফোটা দু ফোটা করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। বাকি আসবাবপত্র সবাই দ্রুত তাবুতে রাখছে। রিজভী ছাতা এনে চুলার উপর রেখে দাড়িয়েছে। বাকিরা আকাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো বৃষ্টি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা! রিজভী ছাতা ধরে দাড়িয়ে বৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

  • আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারলে না তুমি বৃষ্টি ! অসময়ে তোমার আসা লাগবে!
  • আমি আবার কি করলাম!
  • এই যে, ঝপাঝপ বৃষ্টি হয়ে আমার ছাতার উপর পড়ছো। রান্নাটাও শেষ করতে দিচ্ছো না!
    বৃষ্টি এবার বুঝতে পারলো তার নাম বৃষ্টি হওয়ায় তাকে কথা শোনাচ্ছ। তাই হি হি হি করে হেসে উঠলো। তাদের রান্না শেষ। যার যার খাবার নিয়ে তারা নিজেদের তাবুতে চলে গেছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি তীব্র গতিতে ঝরতে লাগলো। খাওয়া শেষ করে কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ তাবু ফাক করে বসে বসে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি তাবুর ফাকে দেখলো আকাশ বেরিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজবে হয়তো! বৃষ্টির ইচ্ছে করছে এখন ভিজতে। না, শুধু শুধু ইচ্ছে দমিয়ে রাখার কোন মানে হয় না। জুতা খুলে বৃষ্টিও বেরিয়ে গেলো। আকাশ তাবু থেকে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে। বৃষ্টিও দৌড়ে আকাশের দিকে গেলো। খালি পায়ে দৌড়াতে ভালোই লাগছে! আকাশ বৃষ্টিকে দেখে বললো,
  • তুমি এখানে এসেছো কেন?
  • আপনি এসেছেন কেন?
  • আমি গোসল করতে এসেছি।
  • আমিও গোসল করবো।
  • তো আমার সাথে আসছো কেন?
  • ইচ্ছে হলো তাই।

আকাশ আর কিছু না বলে সামনে তাকাতেই কিছু একটা দেখে হঠাৎ থেমে গেলো। বৃষ্টিও আকাশের দৃষ্টিকে অবলম্বন করে তাকিয়ে থেমে গেলো। তাদের থেকে কিছুটা দূরে রওনক আর সিমি একসাথে ভিজছে। রোমান্টিক দৃশ্য! সিমি দুহাত মেলে আকাশপানে মুখ করে তাকিয়ে আছে। আর রওনক সিমির হাতগুলো স্পর্শ করে সিমির মতোই আকাশপানে তাকিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সিমির মাথা ঠেকে আছে রওনকের বুকে! দৃশ্যটা দেখতেই বৃষ্টির মাঝে আনন্দের ঢেউ খেলে উঠলো। হয়তো এরাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দম্পতি!

আকাশ আর সামনে না এগিয়ে তাবুর দিকে ফিরে আসতে চাইলে বৃষ্টি তার হাত ধরে বাধা দিলো। আকাশ তার দিকে তাকাতেই বৃষ্টি বললো,

  • যাবেন না প্লিজ। আমারও ইচ্ছে করছে আপনার সাথে ভেজার। প্লিজ
    বৃষ্টির দৃষ্টি অন্যরকম! আকাশকে কেমন যেন মায়ায় ফেলে দেয়। আকাশ এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার সামনে হাটতে লাগলো। বৃষ্টি দৌড়ে আকাশের সামনে দাড়িয়ে পথ আটকালো। আর একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
  • আপনাকে মানানোর জন্য এখন কি পায়ে ধরতে হবে?
    আকাশ ব্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে বললো,
  • এসব কি হচ্ছে শুনি!
    বৃষ্টি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
  • আজ তো চলেই যাবো। একটা ইচ্ছে পূরণ করুন। আমরা ওদিকে না গিয়ে এদিকটায় হাটবো। প্লিজ!
    আকাশ বৃষ্টির কথামতো তার বলা সেদিকেই আস্তে আস্তে হাটতে লাগলো। বৃষ্টি খুশি হয়ে আকাশের পাশাপাশি হাটতে লাগলো। আলতো আলতো করে স্পর্শ করে আকাশের একটা হাত ধরে ফেললো। হাত ধরায় আকাশ হাতের দিকে তাকিয়ে আবার বৃষ্টির মুখের দিকে তাকালো। আকাশ তাকিয়েছে এটা বুঝতে পেরেও বৃষ্টি সামনে তাকিয়ে হেটে চলেছে। আকাশ হাত ছুটিয়ে নিতে চাইলে বৃষ্টি আরও শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
  • প্লিজ, বেশিক্ষণ হাটবো না তো। কয়েক মিনিট।
    আকাশ আবার সামনে হাটতে লাগলো। বৃষ্টি দেখতে পেল সামনে কিছু বনফুল! বৃষ্টি আকাশের হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে সেখানে চলে গেলো। পেছন থেকে আকাশ চেচিয়ে বললো,
  • সাবধানে! এই ফুলে কাটা আছে।
    বৃষ্টি আকাশের কথামতো সাবধানে সেখানে গেলো। আকাশও পিছু পিছু গেলো। সাদা ও গোলাপি রঙের ফুটে থাকা ফুলগুলো দেখতে অনেকটা জবা ফুলের মতো। কিন্তু জবা ফুল না। এই ফুলের আকৃতি আরো বড়। বৃষ্টির পানিতে ভেজায় ফুলগুলোকে আরো বেশি আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। ফুলে হাত দিতে গেলেই বৃষ্টির হাতে কাটা ফুটলো।
  • ওফ্ফ!
  • বেলেছিলাম না এই ফুলে কাটা আছে!
  • নিবো কিভাবে?
  • নিতে হবে কেন! দেখে সন্তুষ্ট হওনি!
  • নিয়ে দিবেন একটা?
  • আমি পারবো না। কাটার আঘাত পাওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই।
  • আঘাত পাবেন না। চেষ্টা তো করুন একবার।
  • আমার হাত কি লোহা নাকি যে আমার হাতে কাটা ফুটবে না!
  • আপনার হাত লোহার চেয়েও বেশি কঠিন।
  • হোয়াট! লোহার চেয়েও কঠিন!
  • তা নয়তো কি! কতোক্ষন আমি হাত ধরে হাটলাম একবারের জন্যও হাতের মুঠোয় আমার হাতটা ধরেননি! দেন না একটা ফুল ছিড়ে। ছেলেরা গার্লফ্রেন্ড এর জন্য কতকিছু করে আর আপনি কাটার ভয়ে একটা ফুল ছিড়ে দিচ্ছেন না!
  • এই মেয়ে, কি যা তা বলছো! তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড হলে কবে!
  • ধরে নিন আজ থেকেই।
  • এসব আলতু ফালতু কথা বলা বন্ধ করো। আর আমার পিছু নেওয়াও বন্ধ করো।
  • এখন কি ফুল ছিড়ে দিবেন কি না? না দিলে কিন্তু চিৎকার করবো
  • চিৎকার করলে কি হবে?
  • চিৎকার করলে আপনি বিরক্ত হবেন, আর খুব দ্রুত আমাকে ফুল ছিড়ে দিবেন।
  • দিবো না।
  • আসলেই একটা পাষাণ!
    বৃষ্টি আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুজতে লাগলো। আকাশ জিজ্ঞেস করলো,
  • কি খুজো?
  • মোটা একটা লাঠি খুজি, আপনার মাথা ফাটানোর জন্য।

আকাশ হাহাহোহো করে হেসে উঠলো। বৃষ্টি আকাশের হাসি দেখে নিজেও মুচকি হাসলো। এই ছেলের হাসি দেখলে সে বারবার প্রেমে পড়ে। ছেলে মানুষ এতো সুন্দর হাসে কিভাবে! আশেপাশে তাকিয়ে সে সেগুন গাছের পাতা পেল। দুইটা পাতা একসাথে নিয়ে ফুল ছিড়তে লাগলো। দুইটা ফুল ছিড়তে পেরেছে। একটা সাদা একটা গোলাপি। বাকি গুলো ঝোপের ভেতরের দিকে। হাত এতোটা লম্বা না। যাক, দুটা পেয়েই সে খুশি। আকাশ তার ফুল নেয়ার কৌশল দেখে মৃদু হাসলো। বুদ্ধি আছে মেয়েটার। বৃষ্টি কমে গেছে।

এখন ঝিরিঝিরি পড়ছে। তারা ভিজতে ভিজতে আবার তাবুতে ফিরে এলো। অভ্র অন্য তাবু থেকে তাদের একসাথে দেখে কিছু একটা বলতে চাইছিলো তার আগেই আকাশ কানে আঙুল ঢুকিয়ে তারাতাড়ি তাবুতে চলে গেলো। বৃষ্টি তার কান্ড দেখে হাসলো। সেও বুঝতে পেরেছে অভ্র এখন তাদের দুজনকে নিয়ে তার কবিতা শুনাতো তাই আকাশ কানে আঙুল দিয়েছে। বৃষ্টিও হাসতে হাসতে তাদের তাবুতে চলে গেলো।


পর্ব – ১১

প্রায় বিকেলের প্রথম ভাগে সেই বৃষ্টি থামলো। আজ ছুটির দিন হওয়ায় বাচ্চাদের পড়াও নেই, চা পাতা তোলার কাজও নেই। তবুও নাফিসাকে বিকেলে পাহাড়ে আসতে হলো মেঘের ফোন আর ওয়ালেট ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। অনেক্ক্ষণ যাবত এখানে বসে আছে কিন্তু মেঘ আজ আসছে না! আসছে না কেন আজ পাহাড়ে! সে কি আগে থেকেই জানতো নাকি যে আজ বাচ্চাদের পড়া নেই! না এলে ফোন আর ওয়ালেট ফিরিয়ে দিবে কিভাবে! ইকো রিসোর্টে যেতে হবে নাকি তাকে! আর একটু অপেক্ষা করবে নাফিসা, তাই ঘাষের উপর বসে রইলো। আর পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই ভোর বেলায় সূর্যের দেখা পেয়েছিলো আর এখন অস্ত যাওয়ার সময় আবার দেখা পেল। একটু পর মনে হলো পাশে এসে কেউ বসলো। নাফিসা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই মেঘকে দেখতে পেল।

  • আপনার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম! আজ এতো দেড়ি করে এলেন যে!
  • ইদানিং আমাকে খুব বেশি মিস করো মনে হচ্ছে! ক’দিন পর তো দেখা না পেলে পাগলই হয়ে যাবে!
  • সবসময় দু চার লাইন বেশি বুঝেন কেন! আপনার দেখা পাওয়ার জন্য না, ফোন আর ওয়ালেট ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম।

নাফিসা ফোন আর ওয়ালেট মেঘের সামনে ধরলে মেঘ তা হাতে নিলো। ফোনটা তাদের থেকে কিছুটা সামনে ঘাসের উপর রাখলো আর ওয়ালেট পকেটে রাখতে রাখতে বললো,

  • এখন যা ই বলো না কেন, একদিন আমার কথাও সত্য বলে প্রমাণিত হবে মেডাম। তাছাড়া আমি এখানে ঠিক সময়েই এসেছি। এতোক্ষণ লুকিয়ে ছিলাম তোমাকে একটু অপেক্ষা করানোর জন্য।
  • মানুষ কতোটা নির্বোধ, ভাবা যায়! শুধু শুধু অপেক্ষা করালেন কেন আমাকে! আমার যে আরো কাজ থাকতে পারে সেটা সম্পর্কে একটু ভেবেছেন!
  • শুধু শুধু অপেক্ষা করাই নি।
  • তাহলে কেন করিয়েছেন?
  • তোমার সাথে সূর্যাস্ত দেখার জন্য অপেক্ষা করিয়েছি।
  • এসব ফালতু কাজে অযথা সময় নষ্ট করতে আমি পারবো না।
    নাফিসা চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালো। মেঘও দ্রুত উঠে নাফিসার হাত ধরে টেনে এক ঝটকায় তার কাছে এনে পূর্ব দিকে ঘুরিয়ে পেছন থেকে দু’হাতে সম্পূর্ণ বন্দী করে ফেললো। নাফিসা ভাবতেও পারেনি মেঘ তার সাথে এমনটা করবে! তার কাছ থেকে ছুটা তো দূরের কথা, একটা হাতও মুক্ত করতে পারছে না! খুব বিরক্ত লাগছে সাথে ভয়ও হচ্ছে। মেঘ কি সেইসব বাজে ছেলে! মেঘ কি এখন তার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবে! এমনটা তো ভাবেনি কখনো মেঘকে নিয়ে! ভয়ার্ত ও কান্না জড়িত কণ্ঠে নাফিসা বললো,
  • কি করছেন এসব! ছাড়ুন বলছি। ছাড়ুন আমাকে!
  • আমার ইচ্ছে পূরণ না করা পর্যন্ত ছাড়বো না মিস মেঘা। সবসময় এতো কাজ আর কাজ নিয়ে পড়ে থাকো কেন! মনে কি একটু আবেগ, ইচ্ছে, ভালোলাগা আর ভালোবাসা নেই! এতো সুন্দর মুহুর্তগুলোকে উপেক্ষা করো কেন!
  • না নেই। ছাড়ুন, না হলে আমি চিৎকার করবো।
  • ওফ্ফ! সময় তো তুমিই নষ্ট করছো! পূর্বাকাশে তাকাও একটু।
  • কেন তাকা

পূর্বাকাশে তাকিয়ে সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই নাফিসার দৃষ্টি আটকে গেল এক মনোরম দৃশ্যে! খুব সুন্দর রংধনু ভেসে আছে নীল পূর্বাকাশে! নাফিসার চোখ দুটো ছলছল করছে। মুখে যতই বলুক এসব আলতু ফালতু কাজ! সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, রংধনু, বৃষ্টি এসব কার না ভালো লাগে! নাফিসা ছোটাছুটির চেষ্টা বাদ দিয়ে খুব শান্ত হয়ে পলকহীন রংধনুর দিকে তাকিয়ে আছে। অচেনা, অজানা এই মানুষটা বিনা স্বার্থে তাকে এতো সারপ্রাইজ দিয়ে যায় কেন!

একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য! নাফিসাকে শান্ত থাকতে দেখে মেঘ তার মাথাটা একটু নিচু করে নাফিসার কাধে থুতনি রেখে সেও পলকহীন রংধনুর দিকে তাকিয়ে আছে। নাফিসা একটু কেপে উঠলো! তাও রংধনু থেকে চোখ সরায়নি। মেঘকে এখন একটুও বিরক্ত লাগছে না তার কাছে। বরং খুব ভালো লাগছে। কারো বাহুডোরে বন্দী হয়ে রংধনু দেখাতে যে এতো আনন্দ, এতো ভালোলাগা মিশে আছে তা জানা ছিলো না। এই প্রথম এমন অনুভূতির সৃষ্টি হলো তার মাঝে! সকালে বৃষ্টিতে ভেজার সময়ও মেঘ তাকে এক ভিন্ন জগৎ থেকে ঘুরিয়ে এনেছে। আবার এখনও আরেকটা জগতে রংধনুর সৌন্দর্য উপভোগ করাচ্ছে।

রংধনুর রঙ আস্তে আস্তে আবছা হয়ে বিলীন হয়ে গেছে। কতোক্ষন তারা এভাবে ছিলো কারোরই জানা নেই। শুধু এটা জানে পুরোটা সময় তারা একে অপরের সাথে মিশে এভাবেই দাড়িয়ে ছিলো। রংধনু আর খুঁজে না পাওয়া গেলে এভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় থেকেই মেঘ তার মাথা সোজা করে মেঘাকে সাথে নিয়ে পশ্চিম দিকে ঘুরে দাড়ালো। নাফিসা পশ্চিমাকাশে তাকালে মেঘ আবার কাধে থুতনি রাখলো। এতোক্ষণে সূর্য এক চতুর্থাংশ ডুবে গেছে।বাকিটাও নিরবে দাড়িয়ে দেখতে লাগলো দুজনেই। মেঘ নাফিসার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো,

  • মনে ভালোবাসার অনুভূতি কখন সৃষ্টি হয়েছিলো জানিনা। তবে প্রিয় মানুষকে সাথে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবো, এভাবে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, রংধনু দেখবো, সেই স্বপ্ন অনেক আগে থেকেই বুনে রেখেছি আমি। আজ তুমি পূর্ণ করে দিলে আমার স্বপ্ন, মেঘা। এখন শুধু সূর্যোদয় দেখাটা বাকি। ইনশাআল্লাহ, সেটাও সুযোগ বুঝে পূরণ করে নিবো তোমায় নিয়ে।
    কথাগুলো শেষ করে মেঘ কেমন যেন হয়ে উঠেছে! মেঘ সেভাবে দাড়িয়েই নাফিসার কান থেকে ঘাড়ে নাকমুখ ঘষছে আর একের পর এক ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে যাচ্ছে! নাফিসা এ কোন জগতে ভাসছে তার নিজেরও জানা নেই! মেঘের প্রত্যেকটা স্পর্শ কাপিয়ে তুলছে তাকে। স্পর্শগুলো যেন মেঘের ভালোবাসার জানান দিয়ে যাচ্ছে! একের পর এক নতুন অনুভূতির জন্ম দিয়ে যাচ্ছে মেঘ! নতুন স্বপ্ন দিয়ে সাজাচ্ছে তাকে! এতোকিছুর সূচনা কিভাবে করতে পারে সে! সকালে বৃষ্টিতে ভিজিয়েছে, এখন রংধনু আবার সূর্যাস্ত! একদিনেই পরপর তিনটা জগতে ঘুরে বেড়িয়েছে! একি সত্যি নাকি স্বপ্ন! সূর্য সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। নাফিসার কেমন যেন লাগছে। মেঘের উপর রাগও দেখাতে পারছে না, মেঘকে ঠেলে দূরেও সরাতে পারছে না। স্থীর হয়ে গেছে সে। অনেক চেষ্টা পর মুখ থেকে কিছু শব্দ বের হয়ে এলো নাফিসার,
  • এএসব ঠিক না, মেঘ। এসব পাপ!

এতোক্ষণে মেঘের খেয়াল হলো সে কি করছিলো! সে তো তার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে কোনো অধিকার ছাড়া আস্তে আস্তে কাছে চলে যাচ্ছিলো!
মেঘ নাফিসাকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে সরে দাড়ালো। নাফিসা চোখের পাতা বন্ধ করে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে ও ছাড়াতে লাগলো। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। ঘাসের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে পকেটে রাখলো মেঘ। স্বাভাবিক হয়ে নাফিসাকে বললো,

  • বাসায় যাবে না? চলো

নাফিসা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। আবছা অন্ধকারে হাত ধরে উঁচুনিচু পথ বেয়ে পাহাড় থেকে নেমে এলো দুজন। রাস্তার দিকে এগিয়ে আসতেই চার পাচ জন লোক পড়লো সামনে। নাফিসা একটু ঘাবড়ে গেলো কিন্তু মেঘ কোন প্রতিক্রিয়া করলো না। লোকগুলো তাদের দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো কিন্তু কিছু বললো না। নাফিসা তারাতাড়ি রাস্তায় হাটতে শুরু করলো। মেঘও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাটছে।

  • আরে আস্তে হাটো। এতো তাড়া কিসের!
  • বাসায় যেতে হবে।
  • বাসায় তো যাবেই।
    মেঘ হুট করেই নাফিসার একটা হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলো। নাফিসা তার দিকে তাকাতেই মেঘ বললো,
  • এক কাপ চা খাবে আমার সাথে? এই টংয়ের দোকানে মাটির কাপে এক কাপ চা খাবো। দোকান এখন ফাকা আছে। আমরা ভেতরে যাবো না। বাইরে বেঞ্চিতে বসে খাবো। মাত্র এক কাপ!

মেঘ উত্তরের আশায় দৃষ্টিতে আকুল আবেদন নিয়ে তাকিয়ে আছে। এ কেমন আবদার! যতই দূরে যেতে চেষ্টা করছে ততই কাছে টেনে নিচ্ছে! সারাদিন যে একের পর এক ভিন্ন জগৎ দেখিয়েছে তার একটা আবদার তো রাখাই যায়! নাফিসা পেছনে তাকিয়ে দেখলো লোকগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। তাই মেঘকে উদ্দেশ্য করে বললো,

  • চলুন।

মেঘ তার উত্তরে খুব খুশি হলো। তাই উৎফুল্ল হয়ে বললো,

  • তুমি বেঞ্চিতে বসো আমি চা নিয়ে আসছি।
    মেঘ দোকানে এসে দুকাপ চা অর্ডার করলো। নাফিসা এসে বেঞ্চিতে বসলো। চা খাওয়া শেষ হলে আর এক মুহূর্তও দেড়ি করবে না কোন কারণে। সোজা বাসায় যাবে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আম্মি নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। মেঘ দুকাপ চা এনে নাফিসার পাশে বসলো। নাফিসার হাতে এক কাপ দিয়ে অন্যটায় খুব গভীর অনুভূতি নিয়ে এক চুমুক দিলো। এমনিতেই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আর আজ তো প্রিয় জনের সাথে বসায় এই চায়ের প্রেমেই পড়ে গেছে!

নাফিসা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আর আড়চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে মেঘের চা খাওয়ার নমুনা দেখছে। ভালোই লাগছে মেঘের সাথে বসে চা খেতে।
চা শেষ করে টাকা দিয়ে আবার নাফিসার সাথে হাটতে লাগলো।

  • আপনি এদিকে আসছেন কেন? রিসোর্টের রাস্তা ওদিকে।
  • জানি আমি। তোমাকে বাসার পাশে পৌছে দিয়ে রিসোর্টে যাবো।

অন্ধকারে সরু পাকা রাস্তায় প্রিয় মানুষের সাথে পথ চলাটাও প্রেমের এক মুগ্ধকর অনুভুতির সারা দেয়। মুহুর্তটা শিহরিত করে তুলছে মেঘকে। বাসার প্রায় কাছাকাছি এসে পড়লে মেঘ আচমকা নাফিসাকে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। খুব শক্ত করে বাহুডোরে বন্দী করে ফেলে। ইচ্ছে করছে সারাজীবন এভাবে রেখে দিতে।

  • তোমায় দেখার পর থেকে প্রত্যেকটা মুহুর্ত তোমাকে মিস করি মেঘা। ইচ্ছে করে সারাজীবন এভাবে আগলে রাখতে।

এতোক্ষণ ভালো লাগলেও এখন নাফিসার কাছে খুব বিরক্ত লাগছে। মাঝে মাঝে এসব কি কাণ্ড ঘটায় মেঘ! এসব একদমই ভালো লাগে না তার কাছে। এমনভাবে চেপে ধরেছে, তার শক্তির কাছে পেরে উঠছে না নাফিসা। তার চোখে পানি এসে ভীড় জমিয়েছে। একমিনিট পর মেঘই তাকে ছেড়ে দিয়ে কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো,

  • যাও, বাসায় যাও।

নাফিসা হঠাৎ বড় বড় চোখ করে তাকালো। এ দৃষ্টি তো মেঘের দিকে নয়! মেঘ নাফিসার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে পেছনে তাকিয়ে দেখলো ওই লোকগুলো! যাদের পাহাড় থেকে নামার সময় দেখেছিলো! লোকগুলো হঠাৎ করেই মেঘ আর নাফিসাকে ধরে নিয়ে নাফিসার বাসার দিকে অগ্রসর হলো। মেঘ কিছু না বুঝতে পেরে বারবার বলছিলো তাদেরকে এভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন কেন! কিন্তু তারা কোন জবাব দিলো না!


পর্ব – ১২

দুপুরের শেষ দিকে অর্থাৎ বিকেলের শুরুতে বৃষ্টির সমাপ্তি ঘটলো। পুরোটা সময় আজ তাবুতেই কাটাতে হয়েছে সবাইকে। বৃষ্টি শেষে ভেজা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে তাবু থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। আকাশ বৃষ্টির কাছে এলো।

  • তোমার ফ্রেন্ডরা কোথায় আছে?
  • কেন?
  • কেন আবার! তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবো।
  • জানি না আমি, তারা কোথায় আছে!
  • জানো না মানে! কল করে জানোনি?
  • ফোন নেই আমার কাছে।
  • এখানে অন্যদের সবার কাছেই ছিলো। আর আমার কাছেও চাইতে পারতে! এই নাও, ফোন করো।
    বৃষ্টির তো এখান থেকে যেতেই ইচ্ছে করছে না! এই আকাশ আবার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলো! এখন কি করা যায়!
    তার ফোন তো অফ করা, তাই বৃষ্টি তার নিজের নম্বরে ডায়াল করলো। বারবার বলছে সংযোগ দেয়া সম্ভব না।
  • ফোন বন্ধ।
  • অন্য জনের কাছে দাও।
  • আর কারো নম্বর জানা নেই।
  • তোমার নিজের ফোনে দাও। সেটা তো তোমার ফ্রেন্ডের কাছেই।
  • সেদিন কথা বলে আমারটা অফ করে দিতে বলেছিলাম। বাবা-মা যাতে কিছু না জানতে পারে।
  • হোয়াট! এখন যাবে কিভাবে!
  • আপনাদের সাথে থাকবো। আর তারা হয়তো ঢাকা ফিরে গেছে। আজ আমাদের ঢাকা ফেরার কথা ছিলো।
  • এই মতলবে আছো তাহলে! ফ্রী তে থাকা খাওয়া পাচ্ছো, বেশ আরামে আছো, তাই যেতে চাচ্ছো না।
  • কি মানুষরে বাবা! খায়িয়ে আবার খোটা দেন! হিসাব করে রাখেন, ঢাকায় ফিরে পরিশোধ করে দিবো।
  • তুমি এখানে থাকতে পারবে না। বাবার নম্বর তো জানা আছে, বাবাকে বলো এসে নিয়ে যেতে।
  • কেন! আমার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
  • কিন্তু আমাদের হচ্ছে।
  • আপনার সাথে থাকি নাকি! যে আপনার অসুবিধা হচ্ছে! অথৈ আপু, ঝুমুর আপু তোমাদের কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে আমার সাথে থাকতে?
    বাকি যারা কথা শুনছে তারা কোন উত্তর না দিয়ে মিটিমিটি হাসছে। বৃষ্টি আবার বললো,
  • দেখেছেন, ওদের কোন সমস্যা হচ্ছে না।
  • ওদের সমস্যা না হলেও তুমি থাকতে পারবে না।
    রিজভী বলে উঠলো,
  • থাক না আকাশ। গার্লফ্রেন্ড কে কেউ এভাবে তাড়িয়ে দেয়!
    সবাই হাহাহোহো করে হেসে উঠলো। আকাশ রেগে তাকালো রিজভীর দিকে।
  • আর একবার এসব উল্টাপাল্টা কিছু বললে আমি তোদের সাথে এক মুহুর্তের জন্যও থাকবো না।
    সবাই চুপ হয়ে গেল। আকাশ বৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
  • তুমি তোমার বন্ধুদের কাছে কিভাবে যাবে তা তুমিই জানো। কিন্তু এটা ক্লিয়ার, আমাদের সাথে থাকতে পারবে না।
    আকাশ চলে গেলো সেখান থেকে। বৃষ্টি ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে বললো,
  • উউহ! আমাদের সাথে থাকতে পারবে না! যেন তার মাথায় চড়ে বসে আছি যে, আমাকে সহ্য হচ্ছে না! ইডিয়ট একটা!
    একটু পর তারা সবাই একসাথে জংগল থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের দিকে ঘুরতে এলো। মাঝারি আকৃতির পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পূর্বাকাশে খুব সুন্দর রংধনু দেখে সবাই আনন্দিত হলো। বৃষ্টি খুশিতে লাফানো শুরু করেছে। লাফানোর ফলে অসমতল পাহাড়ে উঁচুনিচুতে পা পিছলে পড়ে যেতে নিলে পাশে থাকা আকাশের টিশার্ট ধরে ফেললো। আকাশ বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টিও মন খারাপ করে আবার তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে দাড়ালো। রংধনুর জন্য আকাশটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। সবাই যার যার ফোনে রংধনুর সাথে ছবি তোলায় ব্যস্ত! আকাশও রংধনুর ছবি তুলছে। বৃষ্টির কাছে ফোন না থাকায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ছবি তুলতে পারছে না। সে পাহাড়ের একপাশে এসে বসে পড়লো এবং দু’পায়ের হাটু ঝাপটে ধরে রংধনুর দিকে তাকিয়ে রইলো। মনটা খারাপ থাকলেও রংধনুর দিকে তাকিয়ে মন ভালো হয়ে গেছে। তাই মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে রংধনুর সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো বৃষ্টি। একটু পর বৃষ্টির কাছে এসে অভ্র বসে পড়লো।
  • মন খারাপ নাকি বৃষ্টি! সবাই তো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তুমি এখানে বসে আছো কেন?
  • রংধনু নিয়ে একটা কবিতা শুনান দেখি, কবি ভাই!
  • হা হা হা! এখন উপভোগ করার সময়। আগে উপভোগ করি পরে কবিতা বানাবো।
  • চেষ্টা করলে অনেক বড় কবি হতে পারবেন।
  • থাক! প্রতিযোগী হয়ে উঠলে বড় বড় কবিরা আবার আমার প্রতি রেগে যাবে।
  • হিহিহি
  • রংধনু তো মিশে গেলো । চলো, তাবুতে ফিরে যাবো।
  • আচ্ছা।
    সূর্যাস্তের সময় তারা তাবুতে ফিরে এসেছে। বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশটা খুব ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। মুরগির রোস্ট রান্না করা আছে সেটা দিয়েই রাতের খাবার হয়ে যাবে। কুড়িয়ে রাখা শুকনো পাতার সাহায্যে এখন শুধু ভাত রান্না বসিয়েছে। তাবুর মাঝখানে জ্বালিয়ে রাখা আগুনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই বসে আছে। অথৈ বলে উঠলো,
  • রিজভী একটা গান শুনা।
  • টাকা দে।
  • ঘুষখোর কোথাকার! ঘুষ খাইলে তোর গলায় পেটেসহ সর্বাঙ্গে সমস্যা দেখা দিবে।
  • এমন বদ দোয়া দিলে গান কেন! গানের গা ও শুনতে পাবি না।
  • যা, শুনবো না তোর গান। তোর গান নিতুকেই শুনা। আকাশ আর রওনক গেয়ে শোনা।
    আকাশ জবাব দিলো,
  • মুড নাই!
    রওনক বললো,
  • সবসময় আমাদের গান শুনতে ইচ্ছে করে কেন! তোরা গেয়ে শোনা আজ।
    অথৈ বিরক্তি নিয়ে বললো,
  • বাবারে বাবা! এক এক জনের কি দাপট! মনে হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গায়ক!
    সিমি বললো,
  • শুধু শুধু কেন বলতে যাস তাদের! আমাদের সামনে গান গাইলে তাদের প্যাস্টিজে লাগবে। আরেক কুখ্যাত কবি! সারাক্ষণ ভাবনায় বিলীন থাকে!
  • দোস্ত বিরক্ত করিস না তো! একটা লাইন মেলাতে পারছিনা এমনিতেই!
    আজ বৃষ্টি অনেক চুপচাপ! সিমি বৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
  • বৃষ্টি গান গাইতে পারো না?
  • গান কে না গাইতে পারে আপু! কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে! কিন্তু গান সবাই গাইতে পারে।
  • বাহ! এখন তুমি কিভাবে গাও? প্রকাশ্যে নাকি গোপনে?
  • আমি পরিস্থিতির স্বীকার।
  • আচ্ছা, তাহলে এখন বললে গেয়ে শুনাবে?
  • কি ধরনের গান শুনতে চাও?
  • সেটা তুমিই ডিসাইড করে নাও, আমাদের কি ধরনের গান শুনাতে চাও!
    বৃষ্টি গান গাইতে শুরু করলো,

তোর মন পাড়ায়
থাকতে দে আমায়
আমি চুপটি করে দেখবো
আর ডাকবো ইশারায়

তুই চাইলে বল
আমার সঙ্গে চল
ওই উদাস পুরের বৃষ্টিতে
আজ ভিজবো দুজনায়
অভিমানী মন আমার
চায় তোকে বারেবার

তাই বলি আয় রে ছুটে আয়
তোর মন পারায়,থাকতে দে আমায়
আমি চুপটি করে দেখবো
আর ডাকবো ইশারায়!

সম্পূর্ণ গান বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে গাইছে। এখানে উপস্থিত সবাই বিষয়টি লক্ষ্য করেছে। আকাশও বুঝতে পেরেছে তাই গানের মাঝখানেই উঠে অন্ধকারে অন্য পাশে চলে গেছে। বৃষ্টির গান শেষ হলে সবাই তার কণ্ঠের প্রশংসা করলো। সবাই মুগ্ধ! সিমি বলে উঠলো,

  • বাহ! খুব সুন্দর গাও তুমি। আমার মনে হচ্ছিলো কোন আর্টিস্ট এর গাওয়া গান শুনছিলাম!
  • বেশি বললে আবার গলে যাবো!

সবাই একসাথে হেসে উঠলো। সিমি হেসে আবার বললো,

  • বেশি বলছি না। সত্যিই অসাধারণ গেয়েছো তুমি। প্রোগ্রামে পার্টিসিপ্যান্ট করো নিশ্চয়ই?
  • আগে করতাম। ছোট বেলায় গানের ক্লাসে ভর্তি করিয়েছে বাবা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন প্রোগ্রামে পার্টিসিপ্যান্ট করেছি। এরপর বাবা-মা নিষেধ করায় আর কোথাও পার্টিসিপ্যান্ট করিনি।
  • নিষেধ কেন করলো?
  • গান গাওয়া ভালো না। বাবা মা আগে সাপোর্ট করেছে কিন্তু একটু ধার্মিক হওয়ার পর নিষেধ করেছে। ভালো না যেহেতু তাই সেদিকে অগ্রসর না হওয়াটাই ভালো।
  • অহ, আচ্ছা!
    ঝুমুর রিজভীকে বললো,
  • দেখলি তো বয়সে ছোট মেয়েটা কত সুন্দর গেয়েছে! আর তোদের গান এর ধারে কাছেও ঘেষবে না! তোরা শুধু ছাগলের মতো ভ্যা ভ্যা ই করতে পারছ!
  • ভ্যা ভ্যা আমরা করি না তুই করছ, এই যে প্রমাণ দিছোস।
  • হিহিহি আমাকে বলতে গিয়ে তো তুইও করলি!
    এভাবে তারা দলবেঁধে একে অপরের সাথে ঝগড়া লেগে গেলো। কেউ হাসছে, কেউ মুখে বুলি ছুড়ছে! বৃষ্টি তাদের মাঝ থেকে উঠে অন্ধকারের দিকে চলে গেলো, যেদিকে আকাশ গিয়েছে। আগুনের আলোর আড়ালে এসে পূর্নিমার দেখা পেল বৃষ্টি! গাছের পাতার ফাকে টুকরো টুকরো ভাবে আকাশটা দেখা যাচ্ছে। সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে আর চারিদিকে চাদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আশেপাশে একটু চোখ বুলিয়ে অল্প আলোতে আকাশকে দেখতে পেল বৃষ্টি। আকাশ একটা গাছে হেলান দিয়ে চাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি দৃঢ় পায়ে আকাশের কাছে এসে দাড়ালো।
  • এভাবে এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন?
  • তোমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে না নিশ্চয়ই!
  • হুম, হবে না।
  • এখানে এসেছো কেন?
  • আপনার সাথে সময় কাটাতে।
  • আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে।
  • যদি না থাকি!
  • বাবার আদুরে মেয়ে মনে হচ্ছে! সুতরাং জেদটা বাবার কাছেই দেখিয়ো। বাইরের কাউকে দেখিয়ো না। অনেক বিপদের সম্মুখীন হবে।
  • এতো ভাবেন আমাকে নিয়ে!

এই মুহুর্তে বৃষ্টিকে পাগল মনে হচ্ছে আকাশের কাছে। আকাশ বুঝাতে চাইছে একটা আর মেয়েটা বুঝ নিচ্ছে আরেকটা! তাই আর কিছু না বলে আবার আকাশ পানে চেয়ে আছে। আর বৃষ্টি তাকিয়ে আছে গাছে হেলান দেয়া আকাশের দিকে। চাদের মৃদু আলোয় এই আকাশকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। এই ছেলেটার সবকিছু এতো ভালো লাগে কেন তার কাছে! ভেবে পায় না বৃষ্টি! নামটাও কেমন মিলে গেছে, আকাশ আর বৃষ্টি! ভাবতেই মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো বৃষ্টির। আকাশ চাদের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছে বৃষ্টি পলকহীন তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাই বললো,

  • এভাবে তাকাবে না আমার দিকে।
  • কেন? তাকালে কি হবে?
  • অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে।
  • যেমন?
  • যেমন প্রেম হয়ে যেতে পারে।
  • সমস্যা কোথায়?
  • আমার এসব পছন্দ না।
  • যদি বলি, ইতিমধ্যে প্রেম হয়ে গেছে!
    আকাশ হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো,
  • কি বলেছো?
  • প্রথম দিন থেকেই একটু একটু করে আমি প্রেমে পড়ে গেছি তোমার।
    আকাশ আর কিছু না বলে খুব জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো বৃষ্টির গালে। টাল সামলাতে না পেরে বৃষ্টি স্থির জায়গা থেকে কিছুটা পিছিয়ে গেলো আর গালে থাপ্পড় পড়ার সাথে সাথে মুখ থেকে একটি শব্দ বের হলো,
  • ভালোবাসি!

পর্ব – ১৩

আকাশ রেগে বললো,

  • আর একবার এমন কিছু বললে খুন করে ফেলবো।
    বিন্দু মাত্র ভয় না পেয়ে, অশ্রু ভেজা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি বললো,
  • তবুও বলবো, ভালোবাসি তোমাকে।

আকাশ বুঝতে পারছে না বৃষ্টি কেন এমন করছে! যদি সেটা আবেগ হয় তাহলে তার আবেগ কাটাতে হবে। এদিকে বৃষ্টির জেদ একবার যেহেতু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে, এই পাষাণের মন গলিয়েই ছাড়বে! সেও দেখতে চায় কিভাবে আকাশ সবাইকে অবহেলা করতে পারে! বৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে আকাশ বললো,

  • বৃষ্টি, থেমে যাও। এসব তোমার আবেগ। ভালোবেসো না আমাকে। আমি কখনো ভালোবাসতে পারবো না কাউকে।
  • কেন পারবে না? কখনো বিয়ে করবে না? সন্যাসী হয়ে থাকবে? মানুষ একা বাস করতে পারে না আকাশ। জানিনা কীজন্য তুমি এমন হয়ে আছো। কিন্তু এই একঘেয়েমি বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসো।
  • বৃষ্টি, আর কিছু বলো না প্লিজ। আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না। তোমার জীবন নিয়ে নিতেও আমি দ্বিধাবোধ করবো না। দয়া করে আমাকে উল্টাপাল্টা কিছু করতে বাধ্য করো না।
  • আমিও দেখতে চাই তুমি কি করতে পারো। বারবার বলবো, আমি ভালোবাসি তোমাকে, আকাশ।
    আকাশ আচমকা বৃষ্টির চুলের মুঠি ধরে একদম তার মুখের কাছে এনে বললো,
  • শুধু শুধু আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছিস কেন? বলেছি না আমি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। ভালোবাসার মানে তুই বুঝিস কিছু? ভালোবাসা কাকে বলে জানা আছে তোর?
  • আমি তোমাকে বুঝি, তোমাকে জানি আর তোমাকেই চাই। আর কিছু বুঝতে ও জানতে চাই না। তুমি থাকলেই হবে আমার কাছে।

বৃষ্টি আকাশের চোখে তাকিয়ে কথা বলছে আর তার চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে। আকাশের চোখও রাগে লাল হয়ে গেছে। আকাশ বৃষ্টিকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে চলে গেলো তাবুর দিকে। বৃষ্টি সোজা হয়ে গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে মাটিতেই বসে রইলো। দু’পায়ের হাটু জড়িয়ে ধরে চাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাথে তার চোখে অশ্রুর ঝর্ণা বইছে। আজ প্রথম তার সাথে এমন হলো! কারো মন পরীক্ষা করতে গিয়ে তাকে আঘাত পেতে হলো!

এদিকে আকাশকে হনহনিয়ে তাবুর দিকে যেতে দেখে সবার মুখ চুপ হয়ে গেছে। ওর আবার কি হলো হঠাৎ! কেউই বুঝতে পারছে না কিছু। বৃষ্টিই বা কোথায়! সিমি জোর গলায় বৃষ্টিকে ডাকতে লাগলো। সিমির ডাকে বৃষ্টির ধ্যান ভাংলো। সে চোখমুখ ওড়না দিয়ে মুছে যথেষ্ট স্বাভাবিক হয়ে তাবুর দিকে গেলো। আগুনের আলোতে বৃষ্টির মুখটাও মলিন দেখাচ্ছে। সিমি জিজ্ঞেস করলো,

  • কি হয়েছে, বৃষ্টি?
  • কই! কিছু না আপু।
  • এদিকে আসো।
  • না আপু। আমার একটু খারাপ লাগছে। আমি ঘুমাবো।
  • আচ্ছা, খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাও।
  • খেতে ইচ্ছে করছে না।

সিমি বারবার খেয়ে যাওয়ার জন্য বলছিলো কিন্তু বৃষ্টি তাবুতে চলে গেলো। একপাশে এসে কাথাটা টেনে গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো বৃষ্টি। একটু পর আকাশ বেরিয়ে এলো তাদের তাবু থেকে। এখানে সবাইকে দেখলো বৃষ্টিকে ছাড়া। বৃষ্টি কি এখনো সেখানে আছে! আকাশ আবার সেই গাছের কাছে গেলো। বৃষ্টিকে না পেয়ে বন্ধুদের কাছে জিজ্ঞেস করলো,

  • বৃষ্টি কোথায়?
    ঝুমুর ঠাট্টা করে বললো,
  • হঠাৎ বৃষ্টিকে খুজছিস! ব্যাপারটা কি!
  • বেশি কথা না বলে যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দে।
  • হুহ্! তাবুতে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।
  • খাওয়ার জন্য ডেকে আয়।
  • খাবে না বলে দিয়েছে।
  • আরেকবার ডেকে আয়।

আকাশের কথায় ঝুমুর এসে আবার ডেকে গেলো। বৃষ্টি ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে, ঝুমুরের ডাকে আর কোন সাড়া দিলো না। ঝুমুর ফিরে এসে বললো ঘুমিয়ে পড়েছে। সিমি জিজ্ঞেস করেছিলো কি হয়েছে তাদের মাঝে। আকাশ বলেছে কিছুই হয়নি। তাদের মাঝে আবার কি হবে! আকাশও অল্প খাবার খেয়ে উঠে চলে গেলো। বাকিরা খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লো। লুকিয়ে লুকিয়ে কেদে বৃষ্টি সারারাত পার করে দিলো। খুব কষ্ট লেগেছে তার। তার বাবা-মা ও আজ পর্যন্ত তার উপর হাত তুলেনি! আকাশ তার গায়ে হাত তুলেছে সেজন্য একটুও কষ্ট লাগতো না, যদি আকাশ তাকে একটু বুঝতে চেষ্টা করতো! মানুষ এতোটা পাষাণ কিভাবে হতে পারে!

লোকগুলো নাফিসা আর মেঘকে নিয়ে নাফিসাদের বাসায় এলো। উঠুনে থেকে নাফিসার আম্মিকে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করলো। নাফিসার আম্মি রোকসানা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। নাফিসা আর মেঘকে দেখে তিনি অবাক হলেন। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছেন না। লোকগুলো আশেপাশের লোকজনকেও ডেকে আনলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়িতে এলাকার মেম্বারসহ লোকেদের ভীড় জমে গেছে। এসব দেখে রোকসানা জিজ্ঞেস করলেন,

  • কি হয়েছে? আপনারা কি শুরু করেছেন এসব!
  • শুরু আমরা করছি! আমাগো এলাকায় আইয়া পড়ছো! অসহায় বইলা থাকার জায়গা দিছি। এহন নিজের হুড়িরে দিয়া নোংরামি শুরু করছো!
  • কি বলছেন এসব!
  • এতোদিন ধইরা এই পোলারে বাড়িত রাখছো! কে জানে আর কি কি ঘটাইছো মা বেটি মিলা! যেই আশেপাশের লোক মন্দ বলা শুরু করছে বাড়ি থেইক্কা বাইর কইরা এহন দিন নাই রাইত নাই পাহাড়ে, রাস্তাঘাটে নোংরামি করায়! আইজ একটু আগে পাহাড় থেইক্কা নামছে। আমাগো দেইখা তারাতাড়ি দৌড়াইয়া আইছে আবার আন্ধাইরে মাঝ রাস্তায় জড়াজড়ি শুরু করছে! এতোদিন থাকছো থাকছোই! এহন এই এলাকা ছাড়ো। না হয় চুনকালি মাখাইয়া জলে ভাসায় দিমু।

নানান লোকের মুখে নানান কথা! কারটা রেখে কারটা শুনবে, মনে যে হানছে তীব্র ব্যাথা! রোকসানার বিশ্বাস হচ্ছে না এসব। কি যা তা বলে যাচ্ছে। তার মেয়ে এমন না। আর এই ছেলেটাকেও খারাপ ভাবেনি সে। কিন্তু এখন লোকেদের মুখ কিভাবে বন্ধ করবে! নাফিসা নিরবে কান্না করেই যাচ্ছে। আর মেঘ অনেক কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু তাকে কিছুই বলার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সব বিবেচনা করে এলাকার মেম্বার বললেন, হয় এই মুহূর্তে মেঘ নাফিসাকে বিয়ে করে তার পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিবে।

আর না হয় চুনকালি মেখে তাদের এলাকা থেকে তাড়া করবে। রোকসানা স্তব্ধ হয়ে গেছে। নাফিসাও কান্না করেই যাচ্ছে। মেঘের মনে অন্যরকম এক ভয় কাজ করছে। অচেনা অজানা লোকজন, কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার হাতে নেই এখন! সে তার জন্য তাদের এতো বড় সর্বনাশ হতে দিবে না। প্রয়োজনে এখন বিয়ে করবে সে। তাই রোকসানার পায়ের কাছে বসে পড়লো।

  • আন্টি আমি নাফিসাকে বিয়ে করতে চাই। আন্টি, নাফিসাকে আমার হাতে তুলে দিবেন? কথা দিচ্ছি, বিন্দুমাত্র আচ লাগতে দিবো না তার উপর। কেউ আঙুল তুলে কথা বলতে পারবে না তার সাথে। আন্টি, আপনি অনুমতি দিবেন কি?

রোকসানা আঁচলে মুখ চেপে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। এতোগুলো লোক দাড়িয়ে তামাশা দেখছে। ভাবতেও পারেনি তার জীবনে এমন সময়ও আসবে! খুব কঠিন গলায় তিনি বললেন,

  • মেঘ যদি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজে নেয়, তাহলে নাফিসার সাথে মেঘের এখন বিয়ে হবে।
  • আমি সমস্ত দায়িত্ব নিবো।
    মেঘ পায়ের কাছ থেকে উঠে দাড়ালো। নাফিসা দৌড়ে এসে তার মায়ের সামনে দাড়িয়ে বললো,
  • আম্মি, কি বলছো এসব! আম্মি আমি এই ছেলেকে বিয়ে করবো না।
    রোকসানা সাথে সাথে নাফিসার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
  • তাহলে গিয়েছিলি কেন নোংরামি করতে! রাত ক’টা বাজে তুই বাড়ির বাইরে কেন! আর একটা কথাও বলবি না। আজ এখন তোর বিয়ে হবে মেঘের সাথে।
    নাফিসা স্তব্ধ হয়ে গেছে। মায়ের মুখ থেকে এসব শুনবে ভাবতে পারেনি সে! মেম্বার পাশের গ্রাম থেকে কাজী এনে নাফিসা আর মেঘের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। আর পাড়ার লোকজন যেন তাদের নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু না বলে সেজন্য সবাইকে সতর্ক করে দিলেন। মেঘকেও সচেতন করে দিলেন যাতে পালিয়ে না যায়। দায়িত্ব যখন নিয়েছে, তা যেন ঠিকঠাকভাবে পালন করে। লোকজন চলে গেলো। এ বাড়িতে এখন দুজন ব্যাক্তি আছে। রোকসানা আর নাফিসা । পুরো বাড়ি স্তব্ধ হয়ে আছে। শুধু বাইরে ঝিঝি পোকার ডাক শুনা যাচ্ছে। অতিরিক্ত কোন শব্দ নেই। নাফিসা তার আম্মির রুমে এসে খাটে শুয়ে কান্না করে যাচ্ছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনটাকে খুবই ভালো লাগছিলো তার কাছে। মনে হচ্ছিলো তার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আজকের দিনটা তার জন্য অলক্ষুণে। কি থেকে কি হয়ে গেলো সবটা ভাবনার বাইরে। বিয়ে পড়ানোর পর মেঘকে মেম্বার সাথে নিয়ে গেছে তার জন্মপরিচয় নেয়ার জন্য। মেঘ মেম্বারের কাছে পরিচয় দিয়েছে। আর অনুরোধ করে এটাও বলে দিয়েছে তার পরিবারকে যেন এখন কিছু না জানায়। হঠাৎ করে জানলে তার পরিবার মানবে না, তাই সে সুযোগ বুঝে সবটা জানাতে চায়। মেম্বারের সাথে কথা বলে মেঘ বুঝতে পেরেছে তিনি একজন ভদ্র ও জ্ঞানী লোক। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখলো বারান্দায় খুটির সাথে হেলান দিয়ে রোকসানা বসে আছে। মেঘ কাছে এসে হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। রোকসানা বললো,
  • ঘরে যাও।
  • আন্টি, আমি কিছু কথা বলতে চাই। একটু শুনুন প্লিজ। সবটা লোকেদের ভুল ছিলো। বিপদে আপনারা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সেজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আপনি আমার মায়ের মতো। আজ মা পাশে থাকলেও আমি মাকে কথাগুলো বলতাম। এ বাড়িতে আসার আগেই পাহাড়ে, চা বাগানে নাফিসাকে আমি দেখেছি। প্রথম দেখার পরই তাকে ভালো লাগে খুব। তবুও আমি এক ধাপও এগিয়ে যাইনি তার কাছে। সেদিন শ্রীমঙ্গল ছেড়ে চলেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু দেখুন ভাগ্যের কি পরিহাস!পাহাড় থেকে পড়ে আপনাদের বাসায় উঠতে হলো! এখানে আসার পর আমি নাফিসার প্রতি আরো দুর্বল হয়ে গেছি। এখান থেকে যাওয়ার পরও নিষেধ করা সত্ত্বেও নাফিসার সাথে পাহাড়ে, চা বাগানে দেখা করতাম। ভেবেছি কয়েকদিন পর ঢাকা ফিরে বাবা-মা কে বলবো আপনাদের বাসায় আসতে। আর আপনার সম্মতিতে নাফিসাকে আমাদের বাসার বউ করে নিতে। কিন্তু ঘটেছে অন্যকিছু! নাফিসা ইচ্ছে করে যায়নি আজ। সকালে বাজার থেকে নাফিসার সাথে ফেরার পথে বৃষ্টি নামলে আমার ফোন আর ওয়ালেট বাজারের ব্যাগে রাখি। আমি ভিজে রিসোর্টে ফিরে আসি। কিন্তু ওগুলো নিতে মনে ছিলো না। বিকেলে এগুলো ফেরত দিতেই নাফিসা পাহাড়ে যায়। সেখান থেকে নেমে টংয়ের দোকানে এক কাপ চা খেতে অনুরোধ করি। চা খেতে খেতেই দেড়ি হয়ে যায়। তাই নাফিসাকে এগিয়ে দিতে এ পথে আসি। আর ওই লোকগুলো যে আমাদের ফলো করে যাচ্ছে তা বুঝতে পারিনি। দয়া করে তাদের মতো আপনি ভুল বুঝবেন না আমাদের। ঘটনা এতোদূর এসে পৌছাবে ভাবতে পারিনি। ক্ষমা করা যায় না আমাকে?
  • ক্ষমা কিভাবে করবো, অপরাধ করোনি তো! ভালোবাসা অপরাধ না। তবে ভালোবাসার নাটক করা অপরাধ। খুব বড় অপরাধ, যার ক্ষমা হয় না। আমার মেয়ের সাথে অন্তত ভালোবাসার নাটকটা করো না। লোকের সামনে তো বলেছো দায়িত্ব নিবে, এখন কি পিছু হাটতে চাইছো?
  • কি বলছেন এসব! আমি পিছু হাটার জন্য দায়িত্ব নেই নি। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করবো। আপনি কি আমাকে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নিয়েছেন?
    দুজনের চোখেই পানি। রোকসানা মৃদু হেসে বললেন,
  • আমার মেয়েটা খুব কঠিন। খুব জ্বালাতন করবে তোমায়। পারবে সামলাতে?
    মেঘও মৃদু হেসে বললো,
  • মায়েদের দোয়া থাকলে সন্তানের পক্ষে অবশ্যই সম্ভব।
  • হাতমুখ ধুয়ে ঘরে যাও।

পর্ব – ১৪

  • হাতমুখ ধুয়ে ঘরে যাও।
    মেঘ উঠে বাইরে থেকে হাতমুখ ধুয়ে নাফিসার রুমে এলো। কিন্তু নাফিসাকে দেখতে পেল না। রোকসানা এসে খাবার দিয়ে গেলো। মেঘ খেয়ে শার্টটা খুলে ফেললো। ঘেমে ভিজে গেছে! এখন পড়নে তার সাদা সেন্টু গেঞ্জি আর প্যান্ট। তার জামাকাপড় রিসোর্টেই রয়ে গেছে। ধীর গতিতে ফ্যানটা ছেড়ে ছোট জানালার পাশে দাড়িয়ে রইলো।
    রোকসানা নিজের রুমে এসে নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
  • উঠে খেয়ে নে।
  • খাবো না আমি।
  • আর কখনো থাপ্পড় দিবো না, আমার আম্মিকে। উঠো।
  • না।
  • নাফিসা! না খেলে কিন্তু আমিও খাবো না। ক্ষুধা লেগেছে আমার অনেক। তারাতাড়ি উঠো।

নাফিসা উঠে তার আম্মিকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাদতে লাগলো। তার আম্মি অনেক বুঝিয়ে শান্ত করলেন। মেয়েকে খায়িয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলেন। নাফিসা এসে আবার আম্মির বিছানায় শুয়ে পড়লো।

  • নাফিসা, তোমার রুমে যাও।
  • এখানেই থাকবো আমি।
  • তোমার বিয়ে হয়েছে এটা মেনে নিতে হবে। যাও, জামাই একা আছে। ছেলেটা খুব ভালো তার উপর সে তোমার স্বামী। অমান্য করো না তাকে।
  • আম্মি, প্লিজ। ওই লোককে কিছুতেই মানবো না আমি। ওই লোকের জন্য আজ আমার জীবনে সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে।
  • কিছু উল্টাপাল্টা হয়নি। সব ঠিক আছে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। মেয়ে বড় হবে, তার বিয়ে হবে। ওই রুমে যেতে বলেছি। যাও!
    মায়ের কড়া কন্ঠ শুনে রাগ করে হনহনিয়ে তার নিজের রুমে চলে এলো। মেঘ জানালার পাশে দাড়িয়ে ফোনে কিছু করছে। নাফিসা এসে কড়া কন্ঠে বললো,
  • আপনি এখানে আছেন কেন? হোটেলে ফিরে যান।

নাফিসার কথা শুনে মেঘ ব্রু কুচকে পেছনে তাকালো। নাফিসার কথায় রাগ স্পষ্ট, চেহারায়ও রাগ ভেসে আছে। মেঘ নাফিসার দিকে আসতে আসতে স্বাভাবিকভাবে বললো,

  • হোটেলে ফিরে যাবো? আচ্ছা চলো, হোটেলে ফিরে যাবো।
  • আমি কেন যাবো! আপনাকে যেতে বলেছি।
  • আমি গেলে তো তুমিও যাবে। তোমাকে একা ফেলে যাবো নাকি! যতই হোক তুমি আমার একমাত্র স্ত্রী। তোমার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে না!
  • না! নেই কোনো
    মেঘ হঠাৎ নাফিসার মুখ চেপে ধরে বললো,
  • আস্তে কথা বলো। ভুলে যেও না পাশের রুমে আম্মি আছে। আমি তোমার কাছেই আছি। সুতরাং আস্তে বললেই শুনতে পাবো।
  • না। নেই কোনো দায়িত্ব। মুক্তি দিয়ে দিলাম আমি আপনাকে। আমি আপনার স্ত্রীও নই। মানি না এই বিয়ে, আর না মানি আপনাকে।
  • তুমি না মানলেও আমি মানি। তাছাড়া আমি তোমার কাছে মুক্তি চাই নি।
  • আপনি কি যাবেন! নাকি আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবো?

মেঘ দরজার কাছে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। নাফিসার কাছে এসে আবার বললো,

  • আমিও যাবো না আর তুমিও যাবে না। দুজনেই একসাথে থাকবো। চুপচাপ গিয়ে ঘুমাও। আর ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে আম্মিকে ডাকবো এখন। নাফিসা রেগে ঘরের কোনা থেকে মাদুরটা নিয়ে খাটের পাশে মাটিতে বিছিয়ে দিলো। আলমারি খুলে একটা বালিশ আর একটা কাথা বের করে ঢিল দিয়ে মাদুরের উপর ফেললো। মেঘ এসব দেখে বললো,
  • মাটিতে শুতে হবে না। আমার সাথে খাটে শুয়ে পড়ো।
    নাফিসা খাটে উঠে মাঝামাঝিতে শুয়ে পড়লো আর বললো,
  • আমি মাটিতে শুতে যাবো কেন! আপনার জন্য এসব। চুপচাপ শুয়ে পড়ুন।
  • হোয়াট! আমার জন্য মানে! নতুন জামাইয়ের জন্য পারলে সোনার পালঙ্কের ব্যবস্থা করে আর তুমি নিজে খাটে শুয়ে আমাকে বলছো মাটিতে শুতে!
  • ইচ্ছে হলে শুয়ে পড়ুন না হয় চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যান। আমার ঘুমে ডিস্টার্ব করবেন না।
    মেঘ বালিশ আর কাথা উঠিয়ে খাটের পাশে এসে বললো,
  • একপাশে চাপো। আমিও খাটেই ঘুমাবো।
    নাফিসা চোখ বুজে আছে। কোন জবাবও দিচ্ছে না, একপাশে চেপেও যাচ্ছে না। মেঘ কোন জবাব না পেয়ে হাতে থাকা কাথা আর বালিশ মাদুরের উপর ফেলে দিলো। খাটে নাফিসার বালিশে মাথা রেখে একপাশে অল্প জায়গাতেই নাফিসাকে ঝাপটে ধরে শুয়ে পড়লো। এমন কাণ্ডে নাফিসা হকচকিয়ে গেল! চোখ খুলেই মেঘের মুখটা তার মুখের কাছাকাছি দেখলো আর মেঘের এক হাত তার পেটের উপর! মেঘ মুচকি হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
  • আসলে আমিই বোকা! তুমি অনেক বুদ্ধিমতী! আমি বুঝতেই পারিনি তুমি কি ইঙ্গিত করছো! স্বামী-স্ত্রীর আবার আলাদা কাথা বালিশ লাগে নাকি! একটাই তো যথেষ্ট!
  • সরুন

নাফিসা বিরক্তি নিয়ে শোয়া থেকে উঠতে গেলে মেঘ নাফিসাকে বিছানায় চেপে ধরলো। নাফিসা মেঘকে ধাক্কা দিতে চাইলে মেঘ তার উপর উঠে দু’হাতে নাফিসার দুহাত বিছানায় চেপে ধরলো।

  • আজ তো আমাদের বাসর রাত! ঝগড়া করে স্পেশাল রাতটাকে শেষ করে দিও না। ঝগড়া কাল সকালে করবো। ওকে! এখন একটু কাছাকাছি আসো।
  • আহ! ছাড়বেন আমাকে? নাকি আমি চিৎকার করবো?
  • বোকা মেয়ে! বাসর রাতে চিৎকার করে কেউ! আম্মি কি ভাববে! আশেপাশের সবাই কি ভাববে! ছি! ছি!
    নাফিসা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেঘ তার মেঘার ঠোঁটে ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দিলো। নাফিসা আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছোটার জন্য। কিন্তু মেঘের শক্তির কাছে পেরে উঠছে না! মেঘ আরও শক্ত করে নাফিসার হাতদুটো বিছানায় চেপে ধরলো। নাফিসার শরীরের সবটুকু শক্তি যেন আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মেঘ ঠোঁট ছেড়ে দিলে দুজনেই হাপাতে লাগলো। নাফিসার চোখের কোটরে পানি এসে ভীড় জমিয়েছে। মেঘকে সরাতে নাফিসা সজোরে এক লাথি দিলো। হাত আটকাতে পেরেছে কিন্তু পা তো আর আটকে রাখেনি! মেঘ টাল সামলাতে না পেরে বিছানা থেকে মাটিতে মাদুরের উপর পড়ে গেলো। কাত হয়ে পড়ায় একপাশে হাতে আর কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে! মেঘ পড়ে যেতেই নাফিসা শোয়া থেকে দ্রুত উঠে বসলো। মেঘও মাদুরে বসে খাটে নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
  • ওফ! কি কপাল আমার! বাসর রাতে বউয়ের মেজাজ ঠান্ডা করতে গিয়ে লাথি খাই! এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন! হয়েছে তো! পুরো খাট একা পেয়েছো। এবার শান্তিতে আরাম করে ঘুমাও।

মেঘ কাথা টেনে বালিশে মাথা রেখে উল্টো হয়ে মাদুরে শুয়ে পড়লো। নাফিসা মুখ গোমড়া করে খাটেই বসে আছে। শুতেও ভয় পাচ্ছে। মেঘ এসে যদি আবার তার উপর হামলা করে! মেঘ মাথাটা একটু উঠিয়ে নাফিসাকে বসে থাকতে দেখে বললো,

  • বসে আছো কেন! ঘুমাবে না? নাকি এখন আবার আমার সাথে মাদুরে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে! চাইলে আসতে পারো, নিষেধ করবো না।
  • আমি ঘুমালে আপনি আবার উপরে আসবেন না তো!
  • আল্লাহ! কোথায় রেখেছো আমাকে! বউ নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিলাম আর বউ হলো এমন!
    নাফিসাকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃদুস্বরে বললো,
  • আসবো না আমি উপরে। ঘুমাও।

ভয়ে ভয়ে নাফিসা শুয়ে পড়লে মেঘও শুয়ে পড়লো। আর নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,

  • ভয় না লাগলে লাইটটা অফ করে দিও মেঘা। আলোতে আমার ঘুম আসে না।
  • আমার ভয় লাগে।

মেঘ কাথা টেনে নাকমুখ ঢেকে শুয়ে পড়লো। নাফিসাও অনেক্ষন সজাগ থেকে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।

সারারাত ঘুমাতে পারেনি বৃষ্টি। আপুদের পাশে শুয়ে নিশব্দে কেদেছে শুধু। ভোরে পাখিদের কিচিরমিচির শুনে তাবু থেকে বেরিয়েছে। একটা রাত নির্ঘুমে কাটালো সে। বাইরে একটু একটু আলো ফুটতে শুরু করেছে। সূর্য এখনো উঠেনি। কাল বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশটা এখনো খুব ঠান্ডা হয়ে আছে। ঠান্ডা লাগছে একটু একটু। মনে হচ্ছে শীতের দিন টেনে আনবে এই আবহাওয়া। ওড়নাটা ছড়িয়ে গায়ে নিয়ে হাত গুটিসুটি মেরে হাটছে বৃষ্টি।

আর কাল রাতের কথা ভেবে এখনো বিরতি নিয়ে এক ফোটা দু ফোটা করে পানি পড়ছে চোখ থেকে। একটু পর আকাশ বেরিয়ে এলো তাবু থেকে। দু’হাত মেলে আড়মোড়া ভেঙে সামনে এগোতে গেলেই তাবু থেকে দূরে কাউকে হাটতে দেখা গেলো। এখানে আসার পর আজ পর্যন্ত কেউ তার আগে উঠেনি। আরেকটু সামনে গেলেই বুঝতে পারলো এটা বৃষ্টি। মেয়েটার একটা ভালো অভ্যাস লক্ষ্য করেছে আকাশ।

এখানে তার পরে যদি কারো ঘুম ভাঙে সেটা বৃষ্টি। কিন্তু আজ তারও আগে উঠেছে বৃষ্টি। আকাশ দৌড়ে ব্যায়াম করতে করতেই বৃষ্টির দিকে এগিয়ে গেলো। বৃষ্টি কারো পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে পেছনে ফিরে তাকালো। বৃষ্টির চেহারাটা দেখে আকাশ থমকে দাড়ালো! বৃষ্টির চোখে পানি! চোখ কেমন যেন গর্তে চলে গেছে। নির্ঘুম চোখ বুঝাই যাচ্ছে! কাল রাতের ঘটনা মনে করে আকাশের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। থাপ্পড় দেয়ায় গালে আঙুলের ছাপগুলো এখনো স্পষ্ট, যা নীল বর্ণ ধারণ করেছে। বৃষ্টি আকাশকে দেখে আবার উল্টো দিকে ঘুরে দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিলো। আবার আগের ন্যায় হাটতে লাগলো। আকাশ এসে তার সামনে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

  • কাদছো কেন তুমি?

বৃষ্টি কোন জবাব না দিয়ে ঘুরে উল্টো দিকে পা বাড়ালো। আকাশ হাত ধরে টেনে তার দিকে ঘুরালো।

  • কিছু জিজ্ঞেস করছি, শুনতে পাচ্ছো না? কাদছো কেন?
    বৃষ্টি জবাব না দিয়ে হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলো। আকাশ হাত আরও চেপে ধরে বললো,
  • ঘুমাও নি রাতে?
    বৃষ্টি উচ্চস্বরে জবাব দিলো,
  • না ঘুমাইনি, রাতে। আমি ঘুমাই বা না ঘুমাই আপনার কি তাতে? আপনার তো নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা করছি না। হাত ছাড়ুন আমার।
    আকাশ হাত না ছেড়ে আরো শক্ত করে চেপে ধরে টানতে টানতে জঙ্গলের বাইরের দিকে নিয়ে এলো বৃষ্টিকে। হাত ছেড়ে দিয়ে আকাশ দেখলো বৃষ্টির হাত লাল হয়ে গেছে। চেপে ধরায় ব্যাথা পেয়েছে নিশ্চয়ই কিন্তু একবারও বলেনি সে ব্যাথা পাচ্ছে। আকাশ মলিন সুরে বললো,
  • সরি জোরে হাত চেপে ধরার জন্য। কাল রাতে থাপ্পড় দেয়ার জন্যও সরি। আমি তোমাকে বারবার ওয়ার্নিং দিয়ে যাচ্ছিলাম তুমি তবুও শুননি। তাই রেগে এমন বিহেভ করেছি। আমি তোমাকে আগেও বলেছি এখনো বলছি। দেখো বৃষ্টি, আমি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না কখনো। আমার এসব প্রেমটেম একদমই ভালো লাগে না। আমি ইউনিক লাইফ এনজয় করা পছন্দ করি। কারো খেয়াল রাখা, মন রক্ষা করা এসব আমার দ্বারা সম্ভব না। আমি আশেপাশের লোকজনকে দেখে আমার সিদ্ধান্তে অটুট হয়েছি। এমন অনেক সিচুয়েশন এসেছে আমার লাইফে। কেউ হাত কেটে ফেলেছে, কেউ পুলিশের ভয় দেখিয়েছে কেউ ফাজলামো করার চেষ্টা করেছে। আমি বারবার নিষেধ করা সত্যেও আমাকেই কেন পছন্দ করে আমি বুঝি না। প্লিজ তুমিও তোমার পাগলামো বন্ধ করো। বয়স তোমার অল্প। ক্যারিয়ার গড়ার বয়স মাত্র শুরু। নিজের লক্ষ্য বাস্তবায়িত কর। আমিও আমার নিজের মতো করে সাজাতে চাই আমার লাইফটাকে। এসব লাইফ পার্টনার জাস্ট বোরিং লাগে আমার।
  • আকাশ তুমি ভুলে যাও কেন তুমিও একটা মানুষ! মানুষ একা থাকতে পারেনা কখনো। তার জীবনে সঙ্গী প্রয়োজন। তুমি যেই ইউনিক লাইফ এনজয় করতে চাইছো সেটা একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। আমাকে না বুঝিয়ে একবার নিজেকে বুঝাও। একটু ভালো করে ভেবে দেখো তোমার নিজের ভাবনায় সম্পূর্ণ ভুল খুজে পাবে তুমি। একা কয়দিন কাটাতে পারবে তুমি? আজ অসুস্থ হয়ে পড়লে পাশে তোমার কাউকে লাগবে না? আজ কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কাউকে জানাতে হবে না, সেটা ভুল না সঠিক! কোন কাজে অগ্রসর হতে হলে কারো সাপোর্টের প্রয়োজন হবে না? তোমার পরিবার নেই? তারা কি তোমার কাছে কিছু প্রত্যাশা করছে না? তারা কি তোমাকে সংসারে ঠেলে দিতে চাইবে না একসময়? কয়দিন এভাবে সবার বিপরীতে যুদ্ধ করে যাবে? প্রকৃতি কি তোমার নিয়মে চলবে? তুমি হয়তো ভাবছো তুমি সঠিক, এককভাবে চলে মহৎ হয়ে যাবে সবার কাছে। তুমি কি জানো এভাবে বোকা হয়ে যাচ্ছো তুমি। একসময় ভেবে আফসোস করবে নিজের জীবনটাকে নিয়ে। খুব আফসোস করবে।
    হঠাৎ করেই বৃষ্টি আকাশকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বললো,
  • আকাশ, সিদ্ধান্ত বদলাও। ভালোবাসি তোমাকে। মানুষের মাঝে ভালোবাসা এতো তারাতাড়ি ধরা দেয় না। কিন্তু আমার এমন হয়েছে কেন আমি নিজেও জানিনা। অনেক ভালোবাসি তোমাকে। সেই প্রথম দিন থেকেই তোমার সবকিছু ভালো লাগে আমার। প্রথমদিনই জংলী বেশে লুকিয়ে থাকা তোমার কথা, তোমার সুর আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশ্বাস করো, তুমিই প্রথম ব্যক্তি যে আমাকে এতো জোরে থাপ্পড় দিয়েছে। আমার বাবা-মাও কখনো আমার গায়ে হাত তুলেনি। আমার ভাইয়া বেত নিয়ে দুষ্টুমি করে মাঝে মাঝে মেরেছে কিন্তু এতো জোরে মারেনি কখনো। কাল সারারাত আমি কান্না করেছি। বিশ্বাস করো, এক মিনিটের জন্যও ঘুমাইনি। আমার একটুও কষ্ট নেই, তুমি শুধু আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করো । আমি সেই কষ্ট চিরতরে ভুলে যাবো। আকাশ প্লিজ। আকাশ

পর্ব – ১৫

বৃষ্টি কান্না করতে করতে বলছে কথাগুলো। এদিকে আকাশ পাথরের মুর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। হাতটা উঠিয়ে বৃষ্টিকে সান্ত্বনা পর্যন্ত দিচ্ছে না! বৃষ্টি তাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। আকাশের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে আকাশের বুকে দুতিনটা ধাক্কা দিয়ে বললো,

  • পাষাণ হয়ে গেছো তুমি? কোন অনুভূতি নেই তোমার মাঝে? তুমি কি মানুষ না পাথর!
    বৃষ্টি দৌড়ে জঙ্গলের দিকে যেতে নিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো। চোখ পড়লো অর্ধ উদিত লাল সূর্যের দিকে! সে দৌড়ে আবার আকাশের কাছে চলে এলো।
  • তিন মিনিট তোমার গা ঘেঁষে দাড়াবো, সরাবা না প্লিজ!

বৃষ্টি আকাশের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে আকাশের দুইটা হাত তার পেটের উপর আনলো। গভীর অনুভূতি নিয়ে বৃষ্টি আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে সূর্যোদয় দেখলো! মুহুর্তটা খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করলো সে। আকাশ তাকে স্বেচ্ছায় কাছে টেনে দাড়ালে হয়তো সেটা আরও গভীর হতো!
সূর্যোদয় দেখতে তার তিনমিনিট লেগেছে নাকি আরও বেশি সময় লেগেছে তার জানা নেই! সূর্যোদয় দেখে বৃষ্টি আকাশকে ছেড়ে আবার দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর চলে গেলো। আকাশ সূর্যের দিকে তাকিয়েই আছে। মেয়েটা অনেক কথা জানে! যতবারই তার কাছে আসে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির জন্ম দিয়ে যায়! এমন কেন সে! বড়সড় এক নিশ্বাস ফেলে আকাশও তাবুর উদ্দেশ্যে যেতে লাগলো।

রওনক আর অভ্রের হাতে বাজার আনিয়ে সবাই মিলে সকালের নাস্তা তৈরি করে ফেললো। এর মাঝে বৃষ্টির চেহারা দেখে তাকে জিজ্ঞেস করেছে তার কি হয়েছে। কিন্তু সে নিজের কষ্টটা লুকিয়ে বিদ্রুপস্বরূপ উত্তরে বলেছে তাকে ভুতে ধরেছে। সবাই এ নিয়ে নানান উপহাস শুরু করেছে শুধু আকাশ ছাড়া। আকাশ শুধু এটাই লক্ষ্য করছে বৃষ্টি তার কষ্ট লুকিয়ে সবার সাথে নিজেকে নিয়েই মজা করছে! খাওয়ার সময় বৃষ্টি এলো না তাদের কাছে। তার ভালো লাগছে না এই বলে সে অন্যদিকে হাটতে লাগলো। সবারই একটু খারাপ লাগছে। মেয়েটি কাল রাতেও খায়নি এখনও খাচ্ছে না। কিছু হয়েছে তা সবাই বুঝতে পারছে। সিমির কথায় সবাই খাওয়া শেষ করে নিলো। বৃষ্টি হাটতে হাটতে সেই গাছের নিচে এসে বসলো, যেখানে আকাশ ডালে ঝুলেছিলো।

খাওয়া শেষ করে সিমি বৃষ্টির জন্য প্লেটে খাবার নিলো। আকাশ দুইটা মুরগির রোস্ট তুলে দিলো প্লেটে। সিমি তার দিকে তাকাতেই আকাশ বললো,

  • কাল রাতেরটা সহ দিলাম।
    সিমি হেসে প্লেট নিয়ে বৃষ্টির কাছে এলো। পিছু পিছু রিজভীও দৌড়ে এলো। সিমি বৃষ্টির কাছে এসে গাছের শিকড়ে বসলো।
  • না খেয়ে চলে এলে কেন! খেয়ে নাও।
  • খাবো না আপু। ভালো লাগছে না।
  • রাতেও খাওনি, এজন্যই ভালো লাগছে না। তারাতাড়ি খেয়ে নাও। না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
  • আপু জোর করো না প্লিজ। এমনিতেই বমি বমি লাগছে।
  • খালি পেটে আছো বলেই বমি বমি লাগছে।
    হঠাৎ রিজভী বলে উঠলো,
  • ওমা! বমি বমি লাগছে! পেটের ভেতর কি আছে গো?
  • পেটের ভেতর নাড়িভুড়ি আর মলমূত্র আছে।
  • তা তো আমাদেরও আছে, কই আমাদের তো বমি বমি লাগছে না! তাছাড়া আর কি আছে তোমার পেটে?
    সিমি রেগে বললো,
  • তুই যাবি এখান থেকে!
    বৃষ্টি রিজভীকে জবাব দিলো,
  • আমার পেটে বমিও আছে। এজন্যই বমি বমি লাগছে।
    বৃষ্টির উত্তর শুনে রিজভী হাহাহোহো করে হাসতে হাসতে চলে গেলো। সিমি আরও কয়েকবার বললো কিন্তু বৃষ্টিকে রাজি করাতে পারলো না। সিমি প্লেট নিয়ে তাবুর দিকে চলে গেলো। সিমিকে প্লেট নিয়ে ফিরে আসতে দেখে আকাশ সিমির হাত থেকে প্লেট নিয়ে বৃষ্টির কাছে এলো। গাছের শিকরে বসে বললো,
  • খাচ্ছো না কেন?
  • আপনার কি?
  • আমার কিছুনা। খেয়ে নাও। তোমার জন্য খাবার বেশি রান্না করেছি এখন নষ্ট করা যাবে না।
  • খাবো না আমি। কে বলেছে বেশি করে রান্না করতে! এমনিতেই তো আপনাদের খাবার অনেক খেয়ে ফেলেছি। আর অতিরিক্ত কোন খাবার আমার জন্য রান্না করতে হবে না।
  • এই ব্যাপার! খাবার তো বাচালে, কিন্তু এখনো এখানে আছো কেন? থাকার জায়গা বাচাবে না?
  • হ্যাঁ, থাকবোও না। চলে যাবো।
  • কোথায় যাবে?
  • যেদিকে দু চোখ যায়।
  • কখন যাবে?
    বৃষ্টি অশ্রুসিক্ত নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
  • এখনই চলে যাচ্ছি।
    কথাটা বলে বৃষ্টি উঠতে গেলে আকাশ আবার হাত টেনে বসিয়ে দিলো।
  • এতো জেদ কেন? চুপচাপ বসো।

আকাশ এখনো একহাত ধরে আছে। বৃষ্টি অন্যদিকে ফিরে চোখের পানি মুছছে।

  • বৃষ্টি, এদিকে তাকাও। তাকাতে বলছি! দেখো কেউ কিন্তু একটার বেশি রোস্ট খায়নি। তোমার প্লেটে কিন্তু দুইটা।
  • বলেছি আমি দুইটা দিতে?
  • কাল রাতে খাওনি তাই দিয়েছি। তারাতাড়ি খাও। না হলে আবার সবগুলো আমার পেটে চলে যাবে।
  • খাবো না।
  • তুমি কি জানো আমাদের রান্না কতো মজা হয়?
  • না জানি না। আর জানতেও চাইনা। সরুন, আমি চলে যাবো।
  • মাইর দিবো কিন্তু এখন।
  • দিন, এটা আর নতুন কি! অলরেডি তো দিয়েছেনই।
    ছলছল চোখে বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো। কথাটা শুনে আকাশের ভেতরে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো। শাসনস্বরূপ বললেও এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। গায়ে হাত না তুললেও পারতো সে! সবটা একপাশে ফেলে আকাশ বললো,
  • বাঘ আর শেয়ালের গল্প শোনালে খাবে?
    বৃষ্টিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে আকাশ আবার বললো,
  • তাহলে রূপকথার গল্প শুনাবো?
  • আমাকে কি বাচ্চা মনে হয়?
  • মনে হয় না, এখন মনে হচ্ছে। তোমাকে যতক্ষণ ধরে বলছি, এতোক্ষণে বাচ্চাদের খাওয়া শেষ হয়ে যেত!
    বৃষ্টি কান্নার মাঝেও হেসে উঠলো।
  • বাচ্চাদের খুব ভালো সামলাতে পারেন দেখছি। ভবিষ্যতে আপনার এতোগুলা বাচ্চাকাচ্চা হোক।
  • আচ্ছা, ভবিষ্যৎ আসুক আগে। এখন তো খাও।
  • ভালো লাগছে না। খাবো না।
  • আমি যদি পারতাম, “ভালো লাগে না” শব্দগুলোকে চিরদিনের জন্য ধংস করে দিতাম। মাছ ধরতে পারো?
    হঠাৎ এমন প্রশ্নে বৃষ্টি চমকে উঠলো। উৎফুল্ল হয়ে জবাব দিলো,
  • ছোট বেলায় ধরেছিলাম একবার!
  • পাহাড়ের গোড়ায় বসে মাছ ধরেছো কখনো?
  • পাহাড়ের গোড়ায় মাছ!
  • হুম। মাছ ধরতে যাবো একটু পর। রওনক সেই ব্যবস্থাই করছে। খাওয়া হলে সাথে যেতে পারবে। না হলে যেতে পারবে না।
    বৃষ্টি গ্লাসটা নিয়ে হাত ধুয়ে নিলো। প্লেট হাতে নিয়ে খেতে লাগলো। আকাশ মনে মনে বললো, “এই পদ্ধতি রেখে শুধু শুধু এতোক্ষণ কষ্ট করে যাচ্ছি! আগে জানলে তো মাছ ধরার কথাটাই আগে বলতাম!”

নিজের সাথে কথা বলে মৃদু হাসলো আকাশ। খালি পেটে তৈলাক্ত খাবার কেমন যেন শরীর ঝাকা মেরেছে বৃষ্টির! আকাশ বুঝতে পেরে বললো,

  • ঝাল খেতে পারো?
  • হুম, মোটামুটি।
  • সিদ্ধ মরিচে কামড় দিয়ে খাও।
  • আমার দিকে কেউ তাকিয়ে থাকলে খেতে পারি না।

আকাশ মুচকি হেসে উঠে যেতে নিলে বৃষ্টি আবার বললো,

  • আমি দুইটা রোস্টও খেতে পারবো না।
  • রিজভীকে ডাকবো?
  • কেন, আপনি খেতে জানেন না?
  • আমি দু প্লেট ভাত খেয়েছি!
  • তাই বলে এইটা খাওয়ার জায়গা নেই পেটে!
  • ওকে, তারাতাড়ি শেষ করো।
    আকাশ একটা রোস্ট নিয়ে খেতে খেতে তাবুর দিকে গেলো। সিমি এসে গানের সুরে বললো,
  • কি জাদু করেছো বলোনা? তোমার রানী সহজেই মেনে গেলো কিভাবে বুঝলাম না!
  • শাট আপ!
  • হিহিহি! কি বলেছিস? যে সহজে মেনে গেছে।
  • সহজে! এ তো বাচ্চাদের চেয়েও খারাপ। অবশেষে মাছ ধরার কথা বলে প্লেট হাতে দিয়েছি।
  • সাথে আবার রোস্টও ফ্রী! মেয়েটি কিন্তু অনেক ভালো আকাশ। তোর সাথে মন্দ হয় না। ভেবে দেখ!
  • সিমি, স্টপ!
  • পাষাণ, হার্টলেস!

সিমি চলে গেলো। আকাশের মুখ নাড়াচাড়া দেখে রিজভী দৌড়ে এসে রোস্ট নিয়ে পালালো। অবশ্য আকাশই বেশিরভাগ শেষ করেছে, শেষটুকু রিজভী নিয়েছে। বৃষ্টি আকাশের বলা কৌশল প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ খাবার শেষ করে তাবুতে এলো।


পর্ব – ১৬

মেঘার ডাকে ঘুম ভাঙলো মেঘের। চোখ খুলে তাকাতেই দেখলো মেঘা তার পাশে দাড়িয়ে তাকে ডাকছে।

  • সকাল হয়েছে, উঠুন। আমি ঘর ঝাড়ু দিয়ে গুছাবো।

মেঘা ডেকে চলে যাচ্ছিলো। পায়ের কাছে যেতেই মেঘ সুযোগ বুঝে আচমকা তার সামনে পা বাড়ালো এবং মেঘা হোচট খেয়ে মেঘের উপর পড়লো। মেঘ মুচকি হেসে তাকালো, মেঘা চোখ বন্ধ করে আছে। এক হাতে মেঘার পিঠে ধরে অন্য হাতে মেঘার বাধা চুল খুলে দিলো। চুল এসে মেঘের সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সে চুলের ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত! সকাল সকাল মেঘার চুলের ঘ্রাণে মাতাল হয়ে উঠছে! মেঘা তড়িঘড়ি করে উঠতে গেলে মেঘ আরও চেপে ধরলো তার সাথে। সামনে আসা চুল কানের পেছনে গুজে দিয়ে বললো,

  • সকাল বেলা এভাবে ডেকে কেউ বরের ঘুম ভাঙ্গায়? তার উপর বিয়ের পর আজ আমাদের প্রথম সকাল! মিষ্টি করে ডাকতে হয় বরকে। চুলে বিলি কেটে, মুখে উষ্ণ ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে, প্রেম প্রেম দুষ্টুমি মেখে ডাকতে হয়।

নাফিসা রেগে উঠতে গেলে মেঘ তার মাথাটা টেনে কাছে এনে ঠোঁটে উষ্ণ ঠোঁটের আলতো ছোয়া দিয়ে প্রথম সকালটাকে মিষ্টি বানিয়ে দিলো। নাকে নাক ঠেকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ছেড়ে দিলো। নাফিসা উঠে ঠোঁট মুছতে মুছতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। মেঘ হেসে উঠে বসলো। হাত মুখ ধুয়ে ফোন আর ওয়ালেট নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাজারের উদ্দেশ্যে। বাজার করে রিসোর্টে এলো। তার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রিসোর্টের ভাড়া পরিশোধ করে রিসোর্ট ছেড়ে দিলো। কাপড়চোপড়ের ব্যাগ আর বাজারের ব্যাগ সাথে নিয়ে নাফিসার বাড়িতে এলো। আম্মিকে ডেকে হাতে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিলে রোকসানা বললো,

  • এতো বাজার কেন এনেছো? শাকসবজি সব আছে ঘরে।
  • এটা আমার দায়িত্ব, আম্মি। বিয়ের পরদিন নাকি নতুন জামাইকে বাজার করতে হয়, তাই আমিও করলাম।
  • কিন্তু এখন প্রয়োজন ছিলো না। মাছ মাংস এনেছো, ফ্রিজ নেই যে এসব সংরক্ষণ করে রাখবো!
  • অল্পই এনেছি। রান্না করে ফেলুন। আর সবজিগুলো এমনিতেই রাখা যাবে।
    নাফিসা ঘর থেকে বেরিয়ে বললো,
  • এসব কি শুরু করেছেন? আপনাকে না চলে যেতে বলেছি। আপনি তো দেখছি কাপড়চোপড় নিয়ে হাজির হয়েছেন! এখানে থাকতে পারবেন না৷ বাজারের ব্যাগসহ এই মুহূর্তে বের হন বাড়ি থেকে।
  • নাফিসা, এভাবে কথা বলছিস কেন? চুপ থাক। এখন ও তোর স্বামী, এটা মানতে হবে।
  • মানি না আমি। চলে যেতে বলো। না হলে আমি চলে যাবো।
  • ভালো কথা বলতে শিখে গেছিস! সম্মান শব্দটাকে ভুলে যাচ্ছিস!
  • আম্মি তুমি জানো না এ লোকটা এসে আমাদের কি ক্ষতি করেছে! তার হয়ে কথা বলছো কিভাবে তুমি!
  • একদম চুপ। কোনো ক্ষতি করেনি ও। বরং সম্মান বাচিয়েছে। এটা তোর ভাগ্য, ভাগ্যকে মেনে নিতে হবে। মেঘ, তুমি ঘরে যাও।

নাফিসা রেগে মায়ের রুমে চলে গেলো। অসহ্য লাগছে তাঁর। মায়ের রুমে বসে কান্না করছে নাফিসা। রোকসানা রান্না বসিয়েছেন। মেঘ নাফিসার রুমে এসে তার ব্যাগটা চেয়ারে রাখলো। বিছানাপত্র সব গুছিয়েই রেখেছে নাফিসা। চোখের পানি মুছে নাফিসা তার রুমে এলো। আলমারি খুলে স্কার্ট হাতে নিলো। মেঘ নাফিসাকে আটকালো।

  • কোথায় যাচ্ছো? কোন কাজ করবে না তুমি আজ থেকে। সব দায়িত্ব আমার উপর।
  • সরে দাড়ান। আপনি বাধা দেয়ার কে?
  • মেঘা, জেদ করো না। তোমাকে কোন কাজ করতে হবে না। প্রয়োজন হলে আমি করবো।
  • কি চাইছেন কি আপনি? আমার সাজানো জীবনটাকে তো ধংস করে দিয়েছেন! জোর করে বিয়ে করেছেন, জোর করে আমার বাসায় উঠেছেন। এখন আবার আমার কাজ বন্ধ করে ঘরে বন্দী করে রাখতে চাইছেন? আমি কি পুতুল, যে আমাকে যেভাবে নাচাবেন আমি সেভাবেই নাচবো? সারাজীবন কি অন্যের বাধ্য হয়ে চলবো? এজন্যই কি আমি পৃথিবীতে এসেছি? আমার কোনো স্বাধীনতা নেই?
  • তুমি যা ভাবছো তা নয়। আমি তোমাকে পরাধীন করতে চাইছি না। শুধু উপার্জন করতে নিষেধ করেছি। আমি এখন তোমার হাসব্যান্ড। আমি থাকতে তুমি কেন উপার্জন করতে নামবে? আমার উপর ভরসা রাখো। ইনশাআল্লাহ সবটা সামলে নিবো।
  • ভরসা! পুরুষ মানুষের উপর কোন ভরসা নেই আমার। বিশ্বাস করিনা আমি পুরুষদের। মানি না আপনাকে হাসব্যান্ড। আমার কোন কাজে বাধা দিতে আসবেন না বলে দিলাম। পারলে মুক্তি দিয়ে এখান থেকে চলে যান।

নাফিসা বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। স্কার্ট পড়ে না খেয়েই চা বাগানে চলে গেলো। আম্মি বারবার বলার পরও খায়নি। চা বাগানের কাজ করে বাসায় আসেনি। এই রোদের মধ্যে সেই পাহাড়ে এসে বসে বসে কান্না করছে। হঠাৎ কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাকালো। মেঘ এসে তার পাশে বসেছে।

  • এখানে বসে কান্না করছো কেন? রাগ তো আমার উপর, শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো কেন?
  • আমার কোন ব্যাপারে আপনি কথা বলবেন না। চলে যান এখান থেকে। আপনাকে সহ্য হয় না আমার।
  • এমন কেন করছো? বিয়ে তো একসময় করতেই। কোন একসময় তোমার জীবনে কি কেউ আসতো না। তাহলে সেখানে আমাকে মেনে নিতে পারছো না কেন?
  • না, আসতো না কেউ। আপনাকেও মেনে নিতে পারবো না।
  • একা একা জীবন কাটানো যায়?

নাফিসা আর কিছু বললো না।

  • বাসায় চলো।
  • যাবো না।
  • আম্মি কিন্তু সকাল থেকে না খেয়ে আছে তোমার জন্য। আম্মিকে কেন কষ্ট দিয়ে যাচ্ছো!

নাফিসা অবাক হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো মেঘের দিকে। এতো বেলা হয়ে গেছে, তার আম্মি তার জন্য না খেয়ে আছে! তাহলে তো ওষুধও খায়নি ! চোখের পানি মুছে নাফিসা তারাতাড়ি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মেঘ হেসে সেখানেই বসে রইলো।
নাফিসা বাসায় ফিরে আম্মিকে ডাকতে ডাকতে ঘরে প্রবেশ করলো।

  • এখনো খাওনি কেন?
  • তুইও তো খাসনি!
  • তোমার ওষুধ খেতে হবে জানো না!
  • তুই যে না খেয়ে কাজ করতে গিয়েছিস জানিস না?
  • অনেক কথা বলো তুমি। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি, খাবার দাও। দুপুর হয়ে গেছে এখনো নাস্তা করার খবর নেই!
    নাফিসা হাতমুখ ধুয়ে এলো। আম্মি খাবার বেড়ে বসে আছে।
  • মেঘ কোথায়?
  • জানিনা।
  • জানিস না মানে! তাহলে তুই জানলি কিভাবে আমি না খেয়ে আছি!
  • উনিই বলেছে। এখন কোথায় জানিনা। কথা না বলে খাও তো এবার।
  • মেঘও কিন্তু নাস্তা না করেই তোকে খুজতে বেরিয়ে গেছে।
    নাফিসা একটু অবাক হয়ে আম্মির দিকে তাকালো। তারপর কড়া কন্ঠে বললো,
  • আমি কি বলে গেছি কাউকে, আমাকে খুজতে যেতে!
  • বারবার তোকে একটা কথাই বুঝাতে চাইছি বুঝতে পারছিস না কেন তুই! বিয়েটা যেভাবেই হোক, এখন তো মেনে নিতে হবে, নাফিসা। ছেলেটারই বা কি দোষ! তাছাড়া ওর দোষ থাকলে তোরও দোষ আছে। ছেলেটা অনেক ভালো। খুব যত্ন নিবে তোর।
  • হ্যাঁ, প্রথম প্রথম সবাই ভালো হয়। পরে গিয়ে দোষ বের হয়ে আসে।
  • আল্লাহ, একটু বুদ্ধিশুদ্ধি দাও এ মেয়ের মাথায়। পরে যদি দোষ বের হয়ে আসে তাহলে ভেবে নিবি এটা তোর ভাগ্যে লিখা ছিলো।
  • আমি কি এখন না খেয়ে চলে যাবো?
  • না।
  • তাহলে, তুমি খাচ্ছো না কেন?
  • মেঘ আসুক।
  • আমি তোমার জন্যই খেতে বসেছি।
  • আমরা খাইনি বলেই মেঘ খায়নি।
  • ওষুধ খেতে হবে তোমার। তারাতাড়ি খাও। আমি খাওয়া শেষ করে মেঘকে ডেকে আনবো।
    মেয়ের কথায় খেয়ে নিলো রোকসানা। নাফিসা খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে গেলো মেঘকে ডাকতে।
  • সবসময় পিছু পিছু ঘুরে, আজ আবার ঢং দেখিয়ে বসে ছিলো কেন! অসহ্য!
    পথে একা একাই বিড়বিড় করতে করতে নাফিসা পাহাড়ে এলো। কিন্তু এখানে কেউ নেই। মেঘ কোথায় গেলো!
  • এখানেই তো এসেছিলো! এখন আবার কোথায় হারিয়ে গেছে! এখানে আসার পর থেকে ঝামেলার উপর ঝামেলা বাধিয়ে যাচ্ছে লোকটা! এখন আবার কোথায় খুজি!
    নাফিসা পাহাড় থেকে নেমে এলো। রাস্তায় আশেপাশে দোকানপাটেও দেখতে পেল না। একবার ভেবে আবার ইকো রিসোর্টে এলো। ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো আজ সকালে সে রিসোর্ট ছেড়ে দিয়েছে। ক্লান্তি আর বিরক্তি নিয়ে বাসায় ফিরে এলো।
  • এসেছে তোমার মেঘ?
  • না। তুই না খুজতে গেলি?
  • পাই নি।
  • পাসনি মানে! কোথায় গেলো ছেলেটা। চলে যায়নি তো কোনোদিকে! নিশ্চয়ই তুই কিছু বলেছিস!
  • আমি বলতে আর নতুন কি! আগেও তো বলেছি। গিয়েছে চলে? আর চলে গেলে ভালোই হয়।
  • এতো কথা না বলে খুঁজে নিয়ে আয়।
  • আযব কথাবার্তা বলো। এমন বিহেভ করছো যেন আমি পর আর সে আপন! না খুঁজেই কি এসেছি! এখন না পেলে আমি কি আকাশ থেকে নামিয়ে আনবো মেঘকে!
    “চাইলে নামিয়ে আনতে পারো আকাশ থেকে মেঘকে। আকাশের মেঘও ছোয়া যায়।”
    হঠাৎ মেঘের গলা শুনে উঠুনের দিকে তাকালো মা মেয়ে। দরজার সামনে দাড়িয়েই কথা বলছিলো তারা। মেঘকে দেখে বেরিয়ে এলো রোকসানা। পিছু পিছু নাফিসাও। মেঘের পোশাকআশাকসহ সে সম্পূর্ণ ভেজা। হাতে পাতায় মোড়ানো কিছু দেখা যাচ্ছে। নাফিসা উঠুনে এসে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ তো পুরো পরিষ্কার! সিলেট অঞ্চল জুড়েও হয়তো বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু মেঘ ভেজা কেন!
  • আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখো! বৃষ্টি হয়নি আজ।
    নাফিসা রাগী দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকালো আর রোকসানা হেসে বললো,
  • তোমার এ অবস্থা কেন? কোথায় গিয়েছো?
  • হামহাম ঝর্ণায় গোসল করে এলাম।

নাফিসার দিকে মোড়ানো পাতাটা এগিয়ে দিয়ে,

  • নাও ধরো।
    নাফিসা কিছু না বুঝে তাকালো মেঘের দিকে।
  • তাকিয়ে আছো কেন! ধরো, এখানে ফোন আর ওয়ালেট আছে। এটা ঘরে নিয়ে যাও আর আমার জামা নিয়ে আসো ব্যাগ থেকে।

নাফিসার দাত কিড়মিড় করছে! মা পাশে থাকায় কিছু না বলে পাতা ফেলে ফোন আর ওয়ালেট হাতে নিয়ে ঘরে এলো। হাতের চাপ লেগে ফোনের স্ক্রিনটা জ্বেলে উঠলো। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই খুব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখতে পেল নাফিসা! আম্মি দ্রুত জামা নিয়ে যাওয়ার জন্য বললে ফোন রেখে ব্যাগ খুললো। সামনে যা পেয়েছে তা থেকেই একটা টিশার্ট আর একটা প্যান্ট নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

  • আবার কোথায় গেছে?
  • বাথরুমে গেছে। দিয়ে আয়।
  • আমি পারবো না। তুমি যাও।
  • জামাইয়ের সামনে আমি যাবো! ছি, মেয়ের আন্দাজ দেখলে অবাক লাগে।
    নাফিসা বোকা হয়ে গেল তার মায়ের কথায়। অবশেষে তাকেই যেতে হলো। দরজার সামনে গিয়ে ডাকলো,
  • এই নিন আপনার জামাকাপড়।
  • ভেতরে রেখে যাও।
  • ছি, লজ্জা করে না বাথরুমে আরেকজনকে ডাকতে!
  • তোমার কি মনে হয়, আমি তোমার মতো জামাকাপড় খুলে গোসল করি!
  • আপনাকে কে বললো আমি জামাকাপড় খুলে গোসল করি!
  • তোমার কথার স্টাইলই বলে দিয়েছে।

মেঘের মুখে এরকম কথা শুনবে ভাবেনি নাফিসা। এখন তার নিজেরই লজ্জা লাগছে খুব! কি হচ্ছে আজ তার সাথে! যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই বোকার মতো লজ্জা পাচ্ছে! নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে আবার বললো,

  • তাহলে আপনি নিতে পারছেন না কেন!
  • আমার হাতে সাবান।

দরজা ঠেলে নাফিসা ভেতরে ঢুকলো। মেঘ শার্ট খুলে ফেলেছে। সারা শরীরে সাবান লেগে আছে। নাফিসার কেমন যেন লাগছে তাকে দেখে। তারাতাড়ি করে কাপড় রেখে বেরিয়ে যেতে নিলে মেঘ তাকে বাথরুমের দেয়ালে আটকে ধরলো।

  • তোমাদের বাথরুমটা আমার পছন্দ হয়েছে। চার দেয়াল আছে কিন্তু ছাদ নেই। লাইট লাগবে না! দিনের বেলা সূর্যের আলো, রাতের বেলা চাদের আলো। আর আমাবস্যায় ভুতের ভয়! হাহাহা!
  • ছাড়ুন!
  • তুমি এতো তারাতাড়ি আমার পছন্দ জেনে গেছো! বেছে বেছে লাল টিশার্টটা ই এনেছো!
    নাফিসা আমতা আমতা করে বললো,
  • আমি বেছে বেছে আনিনি। সামনে যা ছিলো তাই নিয়ে এসেছি।
  • সামনে তো তোয়ালেও ছিলো। কোথায় সেটা? গোসলে এলে তোয়ালে লাগে, জানোনা সেটা?
    নাফিসা থতমত খেয়ে গেলো। কি হয়েছে আজ তার! সব কাজ এমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন! এদিকে মেঘ আরো কাছে চলে এসেছে।
  • ককি করছেন! সরুন।
  • গোসল করেছো?
  • না।
  • তাহলে আর কি, একসাথেই করি চলো।
    মেঘ দুষ্টুমি হাসি দিয়ে কথাটা বলে তার গালটা মেঘার গালে ঘষে সাবানের ফেনা লাগিয়ে দিলো।
  • ককরবো না আমি এখন।
    মেঘ নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলো তার চোখে পানি। তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
  • বিনা কারণেই চোখে হামহাম ঝর্ণা বয়ে যায়! যাও, তোয়ালে নিয়ে আসো।
    নাফিসা সেখান থেকে বেরিয়ে গালের ফেনা আর চোখের পানি মুছতে মুছতে ঘরে চলে এলো। তোয়ালে নিয়ে আবার ছোট ছোট কদমে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। দরজার বাইরে থেকে বললো,
  • হাত ধুয়ে আপনার তোয়ালে নিন।
    মেঘ দরজা ফাঁক করে হাত বাড়িয়ে নাফিসার হাতসহ তোয়ালে ধরে বললো,
  • ভয় পাচ্ছো? এখনো তো তোমাকে ভেতরে নিতে ব্যাপার না। এক টান পড়লে নিজেই চলে আসবে।
    নাফিসা ভয়ার্ত চোখে তাকালে মেঘ হাত ছেড়ে তোয়ালে নিয়ে হাসতে হাসতে ভেতরে দরজা লাগিয়ে দিলো। গোসল সেড়ে ঘরে এলো মেঘ। নাফিসা খাটের কোনায় বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো।
  • মেঘা, বৃষ্টির সময় কি বাথরুমে ছাতা নিয়ে যাও?
    মেঘের কথায় নাফিসা ঘুরে তাকালো। তোয়ালে টা ঢিল মেরে খাটে ফেলে মেঘ আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল ঝাড়ছে। লাল টিশার্টে, ভেজা চুলে মেঘকে দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। অনেক স্মার্ট সে। কথাবার্তা, চলাফেরা, গঠন সবদিক থেকেই স্মার্ট। ফর্সা গায়ে লাল রংটা মানিয়েছে বেশ। সুন্দরের পূজারী মেয়েরা মুহুর্তেই প্রেমে পড়ে যাবে। নাফিসা কোন উত্তর না দিয়ে তোয়ালেটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। বাইরে তোয়ালে নেড়ে মায়ের রুমে এলো। মা তার হাতে মেঘের জন্য খাবার ধরিয়ে দিলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাবার নিয়ে রুমে আসতে হলো।
  • খেয়েছো তুমি?
  • কেন? না খেলে খাবেন না?
    মেঘ তার হাত ধরে টান দিয়ে খাটে বসিয়ে দিলো।
  • না খেলে জোর করে খাওয়াবো এখন।
  • আমি খেয়েছি।
  • পালানোর জন্য বলছো?
  • আম্মিকে জিজ্ঞেস করুন।
    মেঘ হাত ছেড়ে দিয়ে খেতে খেতে বললো,
  • আমার জামাকাপড় এখনো আলমারিতে রাখোনি কেন?
  • নিজের বাসায় ফিরে যান।
  • আচ্ছা, তোমার ব্যাগ গুছিয়ে নাও দ্রুত। আজকেই ঢাকা ফিরবো।
  • কিহ! আমি কেন যাবো!
  • বউ রেখে আমি একা যাবো নাকি!
  • আমি আপনার বউ না।
  • খেতে বসেছি, বেশি কথা বলো না। জামাকাপড় আলমারিতে রাখো।
    নাফিসা রুম থেকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মেঘ ধমকের সুরে বললো,
  • কানে কথা যায়নি? এক পা বাড়ালে পা ভেঙে ফেলবো। জামাকাপড় রাখো!
    হটাৎ ধমকে উঠায় নাফিসা ভয়ে একটু কেপে উঠেছে। দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে ব্যাগ থেকে কাপড়চোপড় নামিয়ে গুছিয়ে আলমারিতে রাখছে সে।

পর্ব – ১৭

সকালে নাস্তা করার পর তারা তাদের জংলী বেশে শুটিং করতে লেগেছে। সরাসরি শুটিং দেখতে ভালোই লাগছে বৃষ্টির। অন্যরকম জগতের মতো লাগছে সবকিছু। শুটিং দেখে মনে হচ্ছে এসব জংলীদের বাস্তবিক জীবন! পোশাকটাও দারুণ!

দুপুর পর্যন্ত তাদের শুটিং চললো। সকালে বানানো বসি নিয়ে তারা ঝর্ণার ধারে চলে এলো। প্রথমে সবাই গোসল করে নিলো। কাপড়চোপড় রোদে শুকাতে দিয়ে মেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে গাছের নিচে বসে। আর ছেলেগুলো বসি হাতে নিয়ে পৃথক পৃথক জায়গায় পাথরের উপর বসে পড়লো মাছ ধরতে। বৃষ্টি মেয়েগুলোর কাছেই বসে আছে কিন্তু মন তার ছেলেদের মাছ ধরার দিকে। অভ্র রওনককে উদ্দেশ্য করে বললো,

  • রওনক, তোর বসিতে মাছ না উঠলে সিমি মাছ খেতে পারবে না বলে দিলাম।
    এদিক থেকে সিমি জবাব দিলো,
  • তাহলে, তোর বসির মাছ কে খাবে? তোর বউ তো আসেনি!
  • আমার বসির মাছ সিমি বাদে সবাই খেতে পারবে। রওনক মাছ না পেলে তোর খাওয়া বন্ধ!
    রওনক জবাব দিলো,
  • ব্যাটা, চাপা না ছেড়ে আগে মাছ ধরে দেখা।

বৃষ্টি তাদের কথোপকথন শুনে আনন্দ পাচ্ছে। সিমিকে জিজ্ঞেস করলো,

  • আপু, কবি ভাইয়ার বউ আছে?
  • হ্যাঁ, কবি ভাই পিচ্চিকালেই বিয়ে সেরেছে।
  • বউ কি এখনো পিচ্চি?
  • বউ ডাক্তারি পড়ছে।
  • ওয়াও! দারুণ তো! হাসব্যান্ড কবি আর ওয়াইফ ডাক্তার!
    বৃষ্টিসহ মেয়েরা সবাই হেসে উঠলো। অথৈ বৃষ্টিকে বললো,
  • তুমি কোন গ্রুপ থেকে এইচএসসি দিয়েছো?
  • সাইন্স গ্রুপ থেকে।
  • লক্ষ্য কি ডাক্তার নাকি!
  • হুম, বাবামায়ের ইচ্ছে সেটাই।
  • তোমার ইচ্ছে?
  • আমার ইচ্ছে বাবা-মা কে ঘিরেই।
  • ভালোই, পূরণ হোক বাবামায়ের ইচ্ছে!
  • আমিন।
    তারা নিজেরা আবার গল্প করতে লাগলো। ওদিকে রওনক এর কন্ঠ শুনা গেলো,
  • চুপচাপ থাকা আকাশের না হয় স্বভাব, কিন্তু রিজভীর কি হলো! রিজভী এখন চুপচাপ কেন! কিরে তোর বাকশক্তি হারিয়ে গেছে নাকি শ্রবণশক্তি হারিয়ে গেছে!
    অভ্র বলে উঠলো,
  • বিরক্ত করিস না তো। বেচারা নিতুর সাথে ঝগড়া লেগেছে হয়তো!
  • হাহাহা! ছেকা খেলে কবিতা লিখা শিখে নিস অভ্রের কাছে!
  • অই ব্যাটা, আমি কি ছেকা খেয়ে কবিতা লিখছি রে?
  • তোর কবিতা লেখার রহস্য খুজতে গেলে আমাকে বিজ্ঞানী হতে হবে। আমি অজ্ঞান টজ্ঞান হতে পারবো না বাপু!
    অভ্র ও রওনকের কথা শুনে বৃষ্টি এখান থেকেই হিহিহি করে হেসে উঠলো। হঠাৎ করেই রিজভী চিৎকার করে উঠলো! অনেকে ভয়ও পেয়ে গেছে তার চিতকারে! অভ্রের হাত থেকে তো বসিই পড়ে গেছে!
  • ওই পাইছিরে, মাছ পাইছি! দেখ কত্তবড় মাছ পাইছি!
    রওনক বললো,
  • এনাকোন্ডা কোথাকার! আমি তো ভাবছি তোর পায়ের নিচে পাথর ফেটে বিস্ফোরণ ঘটেছে!
    অভ্র বললো,
  • দেখ, কাট্টার জন্য আমার বসি পড়ে গেছে!
    রিজভী আনন্দে লাফিয়ে বললো,
  • তোরা তো এসবই ভাববি! একটা মাছ ধরতে পারছোস কেউ! আমি এজন্যই এতোক্ষণ চুপ ছিলাম। কখন থেকে চেষ্টা করছি এটা ধরার জন্য। তোদেরকে চুপ থাকতেও বলতে পারিনি এটা চলে যাবে বলে! উম্মাহ!
    ঝুমুর চেচিয়ে বললো,
  • কিরে রিজভী, এটা কি নিতুর জন্য পাঠাবি? নিতুর কাছে যেতে যেতে তো কাটাসহ পচে যাবে!
  • দূর! তোর নিতুর নিমকুচি করি। নিজের পেট বাচাই আগে, পরে নিতুর খবর!
    সবাই হেসে উঠলো। অথৈ বললো,
  • নিতু জানলে, ঢাকা থেকেই তোকে জুতাপেটা করবে।
  • দূর হো, কথা বলিস না। দেখ আরও কতো মাছ ধরি। বলদ গুলায় তো এখনো মাছের চেহারাও দেখে নাই! মাছও মানুষ চিনে!
    রিজভী আবার বসে পড়লো মাছ ধরতে। বৃষ্টি আর বসে না থেকে তার প্যান্ট ফোল্ড করে পানির উপর থাকা পাথরের উপর দিয়ে হেটে হেটে আকাশের কাছে চলে এলো। আকাশ যেই পাথরে বসে আছে তার সাথে লাগানো পাথরেই বৃষ্টি বসলো আকাশের কাছাকাছি। আকাশ তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনযোগ দিলো। বৃষ্টি বললো,
  • গরম লাগে না, রোদে বসে আছেন!
  • বাতাস তোমার গায়ে লাগছে না!
  • হ্যাঁ লাগছে, তবে রোদের তাপও আছে মোটামুটি। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি অনেক মাছ ধরতে পারেন, কিন্তু রিজভী ভাইয়াই তো সবার চেয়ে এগিয়ে!
    আকাশ কিছু না বলে তার মাছ রাখার পাত্রটা এপাশ থেকে বৃষ্টির কাছে দিলো। বৃষ্টি পাত্রে তাকিয়ে হা করে আছে! একবার পাত্রের মধ্যে তাকাচ্ছে আর একবার আকাশের দিকে! এতো মাছ ধরে ফেলেছে, অথচ একবার টুশব্দও করেনি! আর ওদিকে রিজভী একটা ধরেই লাফাচ্ছে! বৃষ্টি চিৎকার করে কিছু বলতে যাবে, তখনই আকাশ তাকে থামিয়ে দিলো।
  • হুশশশ! একদম চুপ!

বৃষ্টি ফিসফিস করে বললো,

  • আপনি কি ভুত! এইটুকু সময়ে এতো মাছ ধরে ফেলেছেন আর ওরা কেউ ধরতে পারেনি!
    আকাশ তাকে ভয় দেখানোর জন্য চোখ বড় করে “ভাও!” শব্দ করলো। বৃষ্টি একটু হলেও ভয় পেয়ে পেছনে হেলে পাথর থেকে পড়ে যাচ্ছিল। আকাশ হাসতে হাসতে তার হাত ধরে আবার সোজা করে বসালো। বৃষ্টিও আকাশের হাসি দেখে হাসছে আর মুগ্ধ হয়ে তার হাসি দেখছে। আকাশ বললো,
  • এটা টেকনিক!
  • আপনার হাসি অনেক সুন্দর!
  • বকবক করলে মাছ আসবে না। ওরা এতোক্ষণ বকবক করায়ই মাছ পায়নি। এখন আমিও পাচ্ছি না।
  • ওহ! সরি, আমি চুপ!
    বৃষ্টি পাত্রে রাখা মাছ নিয়ে খেলা করে উঠে গেলো। পাথরের উপর দিয়ে হেটে হেটে অভ্রের কাছে গেলো। তার পাত্র খালি! বৃষ্টি কতগুলো নুড়ি তুলে দিলো পাত্রে। অভ্র তাকাতেই বৃষ্টি খিলখিল করে হেসে বললো,
  • ভাইয়া কবিতা না শুনালে মাছ আসবে না!
  • ঠিক বলছো, দাড়াও কবিতা বানাই!
  • আপনি বানাতে থাকুন, আমি যাই।
    বৃষ্টি হাসতে হাসতে রওনক এর দিকে এলো। মাছ না দেখতে পেয়ে তার পাত্রেও নুড়ি তুলে দিয়ে হাসতে লাগলো। রওনক মেজাজ খারাপ করে পাত্র উল্টে নুড়ি ফেলে দিলো। বৃষ্টি বললো,
  • মাছ না ধরতে পারলে পাথর দিয়েই পাত্র ভরে নিন!
  • মজা নেও মাছ পাইনা বলে!
  • এক কাজ করুন, সিমি আপুকে ডেকে নিন সাথে। মাছ হুরহুর করে চলে আসবে!
  • আইডিয়াটা মন্দ না, মাছ না পেলেও বকা খাওয়া থেকে বেচে যাবো।
    রওনক সিমিকে ডাকতে লাগলো আর বৃষ্টি হাসতে হাসতে রিজভীর কাছে গেলো। রিজভী খুব মনযোগ দিয়ে মাছ ধরছে আর তার পাত্রে একটা মাছ লাফাচ্ছে। বৃষ্টিকে দেখে ফিসফিস করে বললো,
  • কথা বলো না, মাছ চলে যাবে!
  • ওকে।
  • দেখেছো, আমি চ্যাম্পিয়ন মাছ ধরায়!
  • হুম, আপনাকে সেকেন্ড পুরষ্কার দেওয়া উচিত।
  • সেকেন্ড কেন! চ্যাম্পিয়নকে ফার্স্ট দিতে হয় বোকা মেয়ে!
  • আকাশের পাত্রটা একবার দেখে আসুন।
  • কেন?
  • নিজে গিয়েই দেখুন।
  • বসিটা ধরো একটু।

বৃষ্টির হাতে বসি ধরিয়ে দিয়ে রিজভী আকাশের কাছে চলে গেলো। পাত্রে মাছ দেখে জোর গলায় বলতে লাগলো আকাশের মাছের কথা, আর আকাশকে ভন্ড বলে বকতে লাগলো। সবাই অবাক হয়ে আকাশের মাছ দেখতে চলে এলো। হাটে হাড়ি ভেঙে দেওয়া আকাশকে তার দিকে রেগে তাকাতে দেখে বৃষ্টি হঠাৎ চিৎকার করে বললো,

  • রিজভী ভাইয়া, বড় মাছ! বড় মাছ! আপনার বসি নিয়ে পালাচ্ছে!
    রিজভী পানি দিয়েই দৌড়ে চলে গেলো। বৃষ্টি তাকে বোকা বানাতে পেরে হাসতে হাসতে আবার আকাশের কাছে চলে এলো। সবাই আবার মাছ ধরতে নিজের জায়গায় ফিরে গেলো। বৃষ্টি আকাশের পাশে বসে বললো,
  • সরি!
  • মাছ ধরবে?
    বৃষ্টি উৎফুল্ল হয়ে মাথা নাড়ালো। আকাশ জায়গা মতো বসি পেতে বৃষ্টির হাতে ধরালো। দুতিনটা মাছ ধরেছে বৃষ্টি। এতেই অনেক খুশি হয়েছে সে। আকাশ তার আনন্দ দেখে মৃদু হেসেছে ! বৃষ্টি আকাশের হাতে বসি ধরিয়ে আকাশের কাধে মাথা রেখে বললো,
  • থ্যাংক ইউ সো মাচ, আকাশ! লাইফে ডিফারেন্ট কিছু অনুভব করলাম তোমার জন্য! পাহাড়ের গোড়ায় মাছ! ওফ্ফ! ভাবতেই অবাক লাগছে!
  • বৃষ্টি সোজা হও।
  • প্লিজ একটু থাকি। কথা বলবো না কোনো।

আকাশ আর কিছু বললো না। কমবেশি মাছ ধরে সবাই তাবুতে ফিরে এলো। অভ্রের পাত্র খালিই আছে। হয়তো তার কবিতা মাছ পছন্দ করেনি!
লাঞ্চ সেড়ে আবার তাদের শুটিং চললো। বিকেলে মাছ রান্নার আয়োজন করলো তারা। সবাই ই গল্পগুজব করছে, আবার গান গাইছে কেউ। আকাশও বৃষ্টির সাথে হাসিখুশি ব্যবহার করছে! আনন্দের মাঝে রান্নাটা শেষ করলো তারা। খাওয়াদাওয়ার পর আড্ডা দেয়ার সময় আকাশ তাদের মাঝ থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে তার কাজ সারতে তাবু থেকে অনেকটা দূরে চলে গেলো। একটু পর বৃষ্টিও বেরিয়ে গেলো। কাছে গিয়ে শুনতে পেল আকাশ ফোনে কথা বলছে,

  • সুইটহার্ট, আর ক’টা দিন অপেক্ষা করো। আমি অতি শীঘ্রই ঢাকা ফিরবো। এতো টেনশন করো কেন! আমি ঠিক আছি। কাজটা শেষ হলেই তোমার কাছে ফিরবো জান। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করো। চেহারার যদি বাজে হাল দেখি, আমি কিন্তু তোমার খবর নিয়ে ছাড়বো। ওকে গুড নাইট, লাভ ইউ।
    আকাশ পেছনে ফিরতেই বৃষ্টিকে দেখতে পেল। চাদের আলোয় বৃষ্টির চোখের পানি চিকচিক করছে।
  • তুমি এখানে এসেছো কেন?
  • কার সাথে কথা বলছিলে, আকাশ?
  • তুমি জেনে কি করবে! যাও তাদের কাছে আড্ডা দাও।
  • আমি তোমাকে ভালোবাসি, বুঝতে পারছো না! তুমি তো বলেছিলে কাউকে ভালোবাসবে না কখনো! তাহলে এভাবে কার সাথে কথা বলছিলে? কেউ কি আছে তোমার জীবনে?
  • হ্যাঁ আছে। আমার বউ আছে। আর এজন্যই বলেছি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। এবার দয়া করে বুঝতে চেষ্টা করো আর আমার পিছু ছাড়ো।

বৃষ্টির ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। সে কি শুনলো এসব! আকাশের জীবনেও কেউ অাছে! আকাশ তাবুতে চলে গেলো আর বৃষ্টি এখানেই গাছের শিকরে বসে পড়লো। কান্না করছে খুব! প্রথমবার এভাবে কাউকে চেয়ে এখন নিজের দোষে ধোকা খেয়েছে সে! সবসময় ভিন্ন কিছুতে সে আকর্ষিত হয়! আকাশ ভিন্ন মন মানসিকতার ছেলে বিধায় তার প্রতি বৃষ্টি আকর্ষিত হয়ে গেছে! যদিও প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলো তাকে পটানো যায় কিনা সেটা পরীক্ষা করতে। কিন্তু এখন সে পটাতে নয়, মন থেকেই চাইছে আকাশকে। আকাশের ব্যক্তিত্ব তাকে মুগ্ধ করেছে! কিন্তু হঠাৎ করে এটা কি শুনলো সে!

একটু পর সিমি এলো তার কাছে। তাকে কান্না করতে দেখে বললো,

  • কি হয়েছে তোমার! কান্না করছো কেন? আকাশ কিছু বলেছে?
  • হ্যাঁ বলেছে আপু! অনেক কিছু বলেছে! তোমরা আগে বলনি কেন ওর বউ আছে! আমাকে এভাবে বোকা বানালে কেন!
  • বউ! কি বলছো তুমি! আকাশের বউ নেই।
  • আছে আপু। সে নিজে বলেছে। আর আমি তাকে ফোনে কথা বলতেও শুনেছি। সুইটহার্ট, জান বলে নিশ্চয়ই অন্যকারো সাথে কথা বলবে না!
    সিমি মুচকি হেসে বললো,
  • বোকা মেয়ে, ওটা ওর দাদুর সাথে কথা বলেছে।
  • দাদু!
  • হ্যাঁ, দাদুকে বউ বলেই ডাকে। দাদু অসুস্থ। আকাশ খুব যত্ন নেয় দাদুর। এখন কাজের লোকের কাছে দায়িত্ব দিয়ে এখানে এসেছে। আর এজন্যই শুটিং তারাতাড়ি শেষ করে ঢাকা ফিরতে চাইছে।
  • আকাশের বাবা-মা নেই?
  • আছে। দু’জনেই বিজনেস ম্যান। তাদের নিজেদের কাজে ব্যাস্ত। ছোট থেকে আকাশ তার দাদুর কাছেই মা-বাবার যত্ন পেয়েছে। এমনিতে কোনোকিছুরই অভাব রাখে না তারা, কিন্তু পরিবারকে সময় দিতে পারেনা। এজন্যই আকাশ এমন হয়ে গেছে। বাবা-মা কে দেখে এখন তার সংসার জীবন ভালো লাগে না। যদি সংসারে সময় দিতে না ই পারে তাহলে সংসার গড়ার কি প্রয়োজন!
    বৃষ্টি চোখের পানি মুছে বললো,
  • আপু তুমি সব জেনে সত্যি বলছো তো?
    সিমি মুচকি হেসে বললো,
  • খুব ভালোবাসো না আকাশকে! খুব কষ্ট হয় তোমার জন্য। এতো চেষ্টা করে যদি ব্যর্থ হয়ে যাও! এই পাষানের জন্য শুধু শুধু নিজে কষ্ট পেয়ো না। আকাশ বুঝতে পারছে না কত লক্ষি একটা মেয়েকে অবহেলা করছে!
  • আমি আরো চেষ্টা করবো আপু।
  • আল্লাহর রহমতে সফল হও এই দোয়াই করি। কিন্তু ব্যর্থ হলে উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করো না। তাহলে সেটা বোকামি হবে।
    বৃষ্টি মৃদু হেসে সিমির সাথে তাবুর দিকে ফিরে এলো। সিমির সাথে যেতে যেতে বৃষ্টি মনে মনে বললো,
  • আমার সাথে মস্করা! দাড়াও দেখাচ্ছি তোমাকে। খুব মজা পাও না আমাকে কাদিয়ে! আমি তোমার পিছু ছাড়ছি না বাপু!
    আকাশকে অভ্রের পাশে বসে থাকতে দেখলো বৃষ্টি। চোখের পানি ভালোভাবে মুছে আকাশের কাছে এলো।
  • আপনার ফোনে ব্যালেন্স আছে? কল করবো আমি।

আকাশ বৃষ্টির চোখেমুখে তাকিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে দিলো। বৃষ্টি তাবুর পেছনে চলে এলো কিন্তু তাদের দৃষ্টির বাইরে না। বৃষ্টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছুক্ষণ আগে কল করা নম্বরে ডায়াল করলো। রিসিভ হতেই বৃদ্ধা কন্ঠ শুনতে পেল বৃষ্টি। তাহলে সিমির কথাই ঠিক! সালাম দিয়ে বৃষ্টি তার পরিচয় দিয়ে কথা বলতে লাগলো। কথায় ভাব জমাতে বৃষ্টি ওস্তাদ! এক প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য প্রসঙ্গে যেতে যেতে সহজেই আকাশের দাদুর সাথে ভাব জমিয়ে নিয়েছে। আকাশকে সে কতটা পছন্দ করে তা আর বলা বাকি রাখেনি।

দাদুর সাথে কথা বলে বৃষ্টিও আনন্দ পেয়েছে। খুব মজার মানুষ বুঝাই যাচ্ছে। আকাশ বৃষ্টির সাথে কেমন আচরণ করে সেটাও জানিয়েছে দাদুকে, আর দাদুর সাপোর্ট চেয়েছে। বৃষ্টি তাবুর পাশে বসে থাকা লোকদের কন্ঠ শুনতে পেলেও তারা বৃষ্টির কথা শুনতে পায়নি। কারণ বৃষ্টি স্বভাবতই ধীর গলায় কথা বলে। কথা বলা শেষে আকাশের কাছে ফোন দিয়ে এলো। তারপর আবার তাদের সাথে আড্ডা দিতে বসলো। আকাশ কললিস্টে চেক করে কোন নম্বর পেল না। কথা বলে কেটে দিয়েছে ভেবে ফোন রেখে দিলো।


পর্ব – ১৮

যোহরের নামাজ পড়ে দুপুরটা ঘুমিয়েই কাটালো মেঘ। বিকেলে নাফিসার আগেই পাহাড়ে এসে বাচ্চাদের জাতীয় সংগীতের পরের লাইন গাইলো। হঠাৎ করেই দুইটা খরগোশের ছানা লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড়ে উঠে গেলো। বাচ্চারাসহ মেঘও অবাক হলো! খরগোশ এলো কোথা থেকে! মেঘ এগিয়ে যেতেই একটি ছানা লাফিয়ে মেঘের কাছে চলে এলো। মেঘ সেটাকে হাতে নিলো। খুব সুন্দর দেখতে। বাচ্চারা কেউ কেউ নিচে থাকা ছানাটা ধরার চেষ্টা করছে আবার কেউ মেঘের হাতেরটা নেয়ার চেষ্টা করছে।

ইতোমধ্যে আরও একটা ছানা উঠে এসেছে! ব্যাপারটা বুঝার জন্য মেঘ পাহাড়ের কিনারায় এলো। নিচের দিকে তাকাতেই দেখলো রাস্তায় একটা ভ্যান গাড়ি দাঁড়ানো। গাড়ির উপর যে খাচাটা আছে সেখান থেকে লাফিয়ে খরগোশের ছানা নামছে! পাহাড়ে আরও দু একটা উঠে আসছে! মেঘ বাচ্চাদের দুষ্টুমি করতে নিষেধ করে খরগোশের ছানাটা হাতে নিয়েই নিচে এলো। ভ্যানগাড়ি ওয়ালা লোকটি খাচায় করে ছানাগুলো খামারের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। উঁচু নিচু রাস্তার ঝাকায় খাচার বাধন খুলে যাওয়ায় খরগোশের ছানা লাফিয়ে নামা শুরু করে। অনেকগুলো নেমে গেছে। একা হওয়ায় এখন না পারছে খাচার বাধন সামলাতে আর না পারছে ছানাগুলোকে ধরে রাখতে!

ঘটনা শুনে মেঘ লোকটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। প্রথমে খাচাটা ভালোভাবে বেধে নিচের ছানাগুলো লোকটির সাথে উঠালো খাচায়। তারপর দৌড়ে পাহাড়ে উঠে এলো। এখানে পাচ ছয়টা উঠে গেছে। বাচ্চাদের সাহায্যে দৌড়ে ধরছে ছানাগুলোকে। নাফিসা পাহাড়ে এসে দেখলো মেঘ খরগোশের পেছনে দৌড়াচ্ছে। বাচ্চাদের সাথে তাকেও বাচ্চা মনে হচ্ছে। খুবই ভালো লাগছে দৃশ্যটা! মেঘ একে একে সবগুলো ধরে লোকটির হাতে তুলে দিলো। শেষেরটা হাতে নিয়ে নাফিসার সামনে হঠাৎ করে ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে ধরলো। নাফিসা পিছিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু ভয় পায়নি। মেঘ বললো,

  • মেঘা, ছানাগুলো সুন্দর না?
  • আল্লাহর সৃষ্টি সবই সুন্দর। যার টা তার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসুন।

মেঘ হেসে নিচে নেমে এলো। নাফিসা বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য বসালো। একটু পর মেঘ আবার উপরে এলো কিন্তু হাতে দুইটা খরগোশের ছানা!
বাচ্চারা উঠে আসতে চাইলে নাফিসা ধমক দিয়ে আবার বসালো। মেঘই তাদের কাছে এগিয়ে গেলো। বাচ্চাদের উদ্দেশ্য করে বললো,

  • আগে পড়া শেষ করো, তারপর আমরা খরগোশের ছানা নিয়ে খেলবো।
    বাচ্চারা রাজি হয়ে গেলো। নাফিসা বললো,
  • আপনি এগুলো ফেরত দেননি!
  • হ্যাঁ দিয়েছিতো! বেছে বেছে আবার পাচ’শ টাকায় দুইটা কিনে এনেছি।
  • পাচ’শ টাকায়!
  • হুম, এটা পাইকারি দামে। অন্যকেউ হলে হয়তো দিতো না। আমি হেল্প করায় আমাকেও হেল্প করেছে!

মেঘ একপাশে চলে এসে ছানা দুটোকে নিয়ে খেলছে আর নরম ঘাস ছিড়ে খাওয়াচ্ছে। বাচ্চারা পড়ছে ঠিকই কিন্তু মন তাদের সেই খরগোশ ছানার দিকে! নাফিসারও একই অবস্থা, বাচ্চাদের পড়াচ্ছে আর একটু পর পর খরগোশ ছানার দিকে তাকাচ্ছে। পড়া শেষ হলে বাচ্চারা মেঘের সাথে খেলতে চলে এলো। নাফিসা শাসনস্বরূপ বললো তাদের বাসায় যেতে, না হলে মায়েরা চিন্তা করবে। বাচ্চাদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা বইখাতা একপাশে রেখে খরগোশ নিয়ে খেলা করছে। মেঘ নাফিসাকেও ডাকলো কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নাফিসা নেমে গেলো পাহাড় থেকে। চা বাগানে যেতে হবে তাকে।

প্রায় বিশ মিনিটের মতো তারা খেলা করেছে। বাচ্চাদের নামিয়ে মেঘ ছানা দুটো নিয়ে বাসায় ফিরলো। নাফিসা আসরের নামাজ আদায় করছে। মেঘ আম্মির কাছে ছানা দুটো দিয়ে নিজেও ওযু করে নিলো নামাজের জন্য। এতোক্ষণে নাফিসার নামাজ শেষ। মেঘ নামাজ পড়তে পড়তে নাফিসা চা বাগানের জন্য বেরিয়ে গেছে। খরগোশ ছানা দুটোকে আম্মি সযত্নে ঘরের এক কোনে খাচার মতো বেড়া দিয়ে রাখলেন। মেঘ চা বাগানে চলে এলো। নাফিসার কাছে এসে পাতা তুলে ঝুড়িতে রাখছে। নাফিসার বিরক্ত লাগছে আর এদিকে মেয়েগুলো মেঘকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। কমবেশি সবাই জানে গতকাল মেঘ নাফিসার বিয়ে হয়েছে। নাফিসা বিরক্তি দৃষ্টিতে তাকাতেই মেঘ বললো,

  • এভাবে তাকাও কেন! ভয় পাই তো আমি! আমি তুলে দিলে তোমার কাজ তারাতাড়ি শেষ হবে।

মেঘের কথা শুনে একজোটে মেয়েগুলো হেসে উঠলো। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলো,

  • নাফিসা, পরশু আইছ। গান উৎসব আছে বটবৃক্ষের তলায়। ভাইয়া, আইসেন!
    বাহ! শুরুতেই একটা দাওয়াত পেয়ে গেলো। নাফিসা কিছু বললো না, কিন্তু মেঘ আনন্দিত! সে বন্ধুদের সাথে বিজু উৎসবে একবার উপস্থিত হয়েছিলো তাছাড়া আর উপজাতিদের কোন প্রোগ্রামে যায়নি।

মেঘ চা পাতা তুলে দেওয়ায় নাফিসার ঝুড়ি তারাতাড়ি ভরে গেছে। নাফিসাকে সাথে নিয়েই সন্ধ্যায় মেঘ বাড়ি ফিরেছে। সাথে কিছু নরম ঘাস তুলে এনেছে। নাফিসা মায়ের রুমের কোনায় খরগোশ ছানাদের দেখলো। পোশাক পাল্টে মা কে রান্নার কাজে সাহায্য করলো। রান্না শেষে হাতমুখ ধুয়ে খরগোশ ছানাদের ঘাস খাওয়ালো। মেঘের জন্য খাবার নিয়ে রুমে যেতেই দেখলো মেঘ জানালার পাশে দাড়িয়ে লাউড স্পিকারে রেখে ফোনে কথা বলছে।

  • বাবা, তোমার কক্সবাজারের প্ল্যান ক্যান্সেল করে দাও।
  • কেন! ওটা আবার তোর কি ক্ষতি করলো।
  • আমার ক্ষতি করেনি। ওটা তুমি ট্রান্সফার করে সিলেট নিয়ে আসো। এখানে সেটা বেশি ভালো হবে। পরিবেশটা অন্যরকম আরও বেশি আকৃষ্ট করবে মানুষদের।
  • সেখানে কি তোর বাপ জমি ঠিক করে রেখেছে?
  • আমার বাপ সম্মতি দিলেই আমি ঠিক করে ফেলবো। খুঁজে খুঁজে ইউনিক প্লেস বের করবো। আগে বলো কক্সবাজার প্ল্যান ক্যান্সেল করবে।
  • না, ওটাই ফিক্সড।
  • আমি কিন্তু সেখানে উঁকিও দিবো না। শতভাগ সিলেট সাপোর্টার।
  • তাহলে আর কি, তোকে বাদ দিয়ে বৃষ্টিকে দিয়ে দিবো ওটা।
  • হাহাহা তারপর আবার আমার জন্য আরেকটা করবা। আর আমি সিলেটই বেছে নিবো। ভেবে দেখো, সেখানে করলে আমি নিবো না। আর বৃষ্টিকে যদি আমি সিলেটের কথা বলি, ওকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে যাই তাহলে কিন্তু কক্সবাজার তোমাকেই থাকতে হবে। এর চেয়ে কি ভালো নয়, টাকা বাচিয়ে একটাতেই দুই ভাইবোনকে ফিক্সড করে দাও!
  • কিভাবে?
  • থাকার জন্য ফ্লোরটা ফ্ল্যাট সিস্টেম হবে। বাকিটা তোমার কাজের। তারাতাড়ি রাজি হয়ে যাও। বৃষ্টিকে জানালে কিন্তু এখনি সিলেট আসতে চাইবে।
  • তোরা ভাইবোন সবসময় আমার কাজে প্যাচ লাগিয়ে রাখোছ।
  • প্যাচের কি হলো, ওটা তো তুমি ক্রয় করোনি। দেখে রেখেছো শুধু। তো ছেড়ে দিলে ক্ষতি কি?
  • ওটা ছেড়ে যদি সিলেট ঠিক না হয়!
  • সিলেট ঠিক হলেই ওটা ছাড়বে।
  • ওকে আগে দেখ। ওরা কিন্তু তারাতাড়ি করতে চাইছে।
  • ওকে।
  • বাসায় ফিরবি কবে?
  • ইনশাআল্লাহ, সিলেটের প্ল্যান কমপ্লিট করেই ফিরবো।
  • বাহ! একজন কুমিল্লা ছেড়ে আসতে চায় না আরেকজন সিলেট!
  • বৃষ্টি এখনো ফিরেনি!
  • না। বেড়ানো শেষ হয়নি, আরও থাকবে। এক কাজ কর, শশুর বাড়ি খুঁজে ফেল আমরা এসে বিয়ে দিয়ে দেই একজনকে কুমিল্লা আর একজন সিলেট! তারপর সারাজীবন সেখানেই থাক।
    মেঘ মাথা চুলকে বললো,
  • দাও, দিলে তো ভালোই হয়!

ছেলের উত্তর শুনে রায়হান চৌধুরী হাহাহোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর কল কেটে দিলেন। নাফিসা একে একে খাবারের বাটি এনে রেখেছে আর মেঘের কথা শুনছিলো।যদিও কিছু বুঝতে পারেনি তাদের প্ল্যানের কথা কিন্তু বাবা ছেলের সম্পর্কটা কেমন বন্ধুত্বের সেটা বুঝে গেছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমানোর জন্য বিছানা ঠিক করতে লাগলো নাফিসা। মেঘ চেয়ারে বসে অনলাইনে সিলেটের ম্যাপ দেখছে। নাফিসাকে দেখলো আলমারি থেকে মশারি বের করছে। মনে হলো কাল রাতের কথা, মাথা যতটুকু কাথার বাইরে ছিলো মশা কামড়ে খেয়েছে মেঘকে। মশারি ছিলো অথচ তাকে দেয়নি কাল! নাফিসা নিচে মাদুর পেতে একটা বালিশ আর একটা কাথা রাখলো।

মেঘ কিছু বললো না। নাফিসা মশারিও টানিয়ে দিলো। একটু পর নাফিসা খাটে এসে শুয়ে পড়লো। মেঘ বাইরে এসে ফ্রেশ হয়ে আবার রুমে এলো। কোন অতিরিক্ত শব্দ ছাড়াই খাটে উঠে কাথাটা টেনে সরালো। এক কাথায় দুজনকে ঢেকে মেঘ নাফিসার বালিশে শুয়ে পড়লো। নাফিসা দ্রুত উঠার চেষ্টা করতেই মেঘ দু’হাতে তাকে ঝাপটে ধরে পা দুটোও নিজের দুপা দিয়ে আঁকড়ে ধরে শুয়ে আছে। নাফিসা তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই মেঘ ধমক দিয়ে বললো,

  • চুপচাপ শুয়ে থাকো। কি ভেবেছো তুমি, কাল নিচে শুয়েছি বলে প্রতিদিনই শুবো! আজ হাতের পাশাপাশি তোমার পা-ও আটকানো। একদম নড়াচড়া করার চেষ্টা করবে না।
    নাফিসা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ছুটার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। মেঘ আবার বললো,
  • এখন কিন্তু মাইর লাগাবো। চোখের পানি দেখালেও কোন লাভ হবে না আজ।
    নাফিসা মেঘের গায়ে টিশার্টের উপর দিয়ে খামচিও লাগাচ্ছে। নাফিসার মুখে কান্নার পাশাপাশি ভয়ের ছাপও স্পষ্ট। মেঘ মুচকি হেসে ঠোঁটে আর চোখের পাতায় আলতো করে চুমু দিয়ে বললো,
  • তুমি আমার শক্তির কাছে পারবে না। শুধু শুধু নিজের শক্তি খরচ করছো কেন! আমি তোমার সাথে কিছুই করবো না। চুপচাপ ঘুমাও।
    মেঘ নাফিসার মাথাটা বুকে টেনে হাত পা আটকে রেখেই চোখ বুজে রইলো। নাফিসা তারপরও চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে একসময় শান্ত হয়ে গেল। মেঘ যখন বুঝতে পারলো নাফিসা ঘুমিয়ে পড়েছে তখন খুব বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে নাফিসার মাথায় চুমু দিয়ে সে ও ঘুমিয়ে পড়লো।
    নাফিসার আজকের সকালটা শুরু হলো মেঘের বুকে! চোখ খুলার আগে কানে বেজে উঠলো ঢিপঢিপ শব্দ! এ যেন এক মাতোয়ারা গানের সুর তুলেছে! নাকে এসে লাগছে মিষ্টি গন্ধ! যার ঘ্রাণ সারাদিন নিলেও তৃপ্তি মিটবে না! কিসের গন্ধ হতে পারে এটা!

চোখ খুলে তাকালো নাফিসা। চোখের সামনে লাল কাপড় দেখতে পেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝতে পারলো এটা মেঘের টিশার্ট আর সে মেঘের বুকে পড়ে আছে! ঢিপঢিপ শব্দটা মেঘের হৃদস্পন্দনের যেটা তরঙ্গ সঞ্চার করছে! মিষ্টি ঘ্রাণটা মেঘের শরীরে লেগে থাকা ঘ্রাণ যেটা অতৃপ্তি আনতে বাধ্য! মানুষের শরীরের গন্ধ এমন হয় কিভাবে! এটা তো অসহ্যকর হওয়ার কথা!

একটু নড়াচড়া করার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলো মেঘ তাকে বাহুডোরে বেধে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে! আজ সেই প্রথম রাত, যেখানে অজানা এক মানুষের বুকে কাটাতে হয়েছে তাকে! ভাগ্যে কি এটাই লেখা ছিলো! না, সবটা ভাগ্য বলে মেনে নেওয়া যাবে না! সবকিছু মেনে নিতে হলে বারবার ধোকা খেতে হবে!
নাফিসা মেঘের বুক থেকে মাথা সরিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মেঘকে জোরে ধাক্কাতে লাগলো। মেঘ কপাল ব্রু কুচকে ঘুমঘুম চোখে তাকালো। নাফিসা তার মুখে তাকিয়ে আবার থেমে গেলো! কেউ কপাল ব্রু কুচকে তাকালে এতো সুন্দর লাগে সেটা তার জানা ছিলো না! কেউ ঘুমঘুম চোখে তাকালে দেখতে এতোটা মায়াবী দেখায় সেটা আজ প্রথম দেখলো!

মেঘ ঘুমঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

  • নড়াচড়া করছো কেন, কি হয়েছে?
    এই কন্ঠ যেন মধুর হয়ে নাফিসার কানে পৌছাল! মেঘ থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
  • উঠবো আমি।
    মেঘ আরো কাছে এসে বললো,
  • কোথায় উঠবে?
  • ঘুম থেকে উঠবো আমি।
  • এখনো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলছো!
    নিজেকে বোকা পরিচয় দিয়ে এখন নিজের উপরই খুব রাগ হচ্ছে! কি হয়েছে তার! কি বলতে কি বলছে সে! এবার খুব ভেবে জবাব দিলো,
  • সকাল হয়ে গেছে, শোয়া থেকে উঠবো আমি। ছাড়ুন!
  • সারাক্ষণ শুধু ছাড়ুন আর ছাড়ুন! কখনো বলেছো একটু কাছে আসুন!
    নাফিসা আর কিছু না বলে ছোটার জন্য জোরাজুরি শুরু করলো। মেঘ মুচকি হেসে নাফিসার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বললো,
  • হ্যাভ এ সুইট মর্নিং, মিসেস মেঘা চৌধুরী!

মুচকি হাসি মুখে নিয়ে মেঘ নাফিসার আগেই বিছানা থেকে নেমে গেলো। সূর্যোদয় হয়নি এখনো, মসজিদ এখান থেকে মোটামুটি অনেক দূর! মেঘ জায়নামাজ চেয়ে ঘরেই নামাজ আদায় করলো। মেঘের পর একই জায়নামাজে নাফিসা নামাজ আদায় করলো। মেঘ ঘরেই বসে ছিলো। নাফিসার নামাজ শেষ হতেই বললো,

  • প্রভাতি চাদর পড়বে?

নাফিসা একটু অবাক হয়ে তাকালো! কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্নের উত্তর দিলো না! জায়নামাজ রেখে বিছানা গুছাতে লাগলো। মেঘ উত্তর না পেয়ে বললো,

  • কেমন মানুষ তুমি! না বুঝলেও তো প্রশ্ন করবা! প্রভাতি চাদর বলতে সকালের মিষ্টি বাতাস গায়ে মাখবে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করেছি। চলো প্রভাতি চাদর পড়ে নির্জন পথে হাটবো দুজন।
  • হাত ছাড়ুন, কোথাও যাবো না আমি।

নাফিসা তার নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো! মেঘ হতাশ হয়ে বসে রইলো! মেঘের কথাগুলো গভীরভাবে আকৃষ্ট করে নাফিসাকে! কিন্তু কোথাও এক বাধার কারণে সে গভীরতা থেকে বেরিয়ে আসে! সেটাও মেঘ বুঝতে পারে, কিন্তু তার কারণটা সে বুঝতে পারছে না! এমন কেন করে সে!
মেঘ একাই বেরিয়ে গেলো। একটু পর বাড়ি ফিরলো সাথে বাশ নিয়ে। আম্মির কাছ থেকে দা আর রশি নিয়ে কাজে লেগে গেলো। উঠুনের এক কোনে বসে মাত্র দু’ঘন্টায় বাশ আর রশি ব্যবহার করে মাঝারি আকৃতির একটা খাচা বানিয়ে ফেললো। নাফিসা কাজের ফাকে ফাকে বারবার মেঘের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছিলো মেঘ কি করছে! খাচাটা দেখে বুঝতে পারলো খরগোশ ছানার জন্য এই ব্যবস্থা! তবে খাচাটা খুব সুন্দর হয়েছে, এতে পাচ ছয়টা খরগোশ ছানাও রাখা যাবে!

শহুরে মানুষ এতোটা সুশৃঙ্খল কর্মঠ হবে সেটা নাফিসার কল্পনার বাইরে ছিলো! রোকসানা এগিয়ে এসে খাচা দেখে প্রশংসা করলেন আর খাচার তলায় একটা প্লাস্টিকের মোটা কাগজ সাথে পাটের চট বিছিয়ে দিলেন। ছানা দুটো থাকতে আরাম পাবে।
সকালের নাস্তা করার পর নাফিসা চা বাগানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মেঘ ঘরে এসে দেখলো নাফিসা আয়নার সামনে দাড়িয়ে খোপা করছে। মেঘ এগিয়ে এসে তার দুহাতে আচমকা নাফিসার কোমড় জড়িয়ে ধরলো! নিশব্দে ঘটনা সংগঠিত হওয়ায় নাফিসা কেপে উঠলো! নাফিসা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই মেঘ খোপার নিচে উন্মুক্ত ঘাড়ে চুমু একে দিলো! মেঘের স্পর্শে নাফিসা শিউরে ওঠে খোপা ছেড়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো! সে যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে! মেঘ কানের কাছে মুখ এনে বললো,

  • আজ ফিরতে দেড়ি হবে আমার, পারলে খরগোশ ছানাদের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ।

মেঘ তাকে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। নাফিসা মনে মনে বলে দিয়েছে “আল্লাহ হাফেজ”। মানুষটা এমন কেন! দূরে সরিয়ে দিতে চাইলে জোর করেই আরও কাছে চলে আসে! হঠাৎ করে এসে মনে ভিন্ন অনুভূতি সৃষ্টি করে আবার হঠাৎ করেই চলে যায়!


পর্ব – ১৯

প্রতিদিনের মতো আজ সকালেও ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টি তাবুর আশেপাশে হাটাহাটি করছে। কিন্তু আজ সবাই খুব তাড়াতাড়ি জেগে গেছে। হয়তো কাল রাতে তারাতাড়ি ঘুমানোর ফলেই জেগে গেছে আজ। সকালটা ভালোভাবেই কাটালো তাদের সাথে কিন্তু আকাশের সাথে কথা বলেনি বৃষ্টি।
খাওয়ার সময়ও অল্প খেয়ে উঠে পড়লো। সবাই যেন টুকটাক গোছগাছ শুরু করেছে। চলে যাবে নাকি! বৃষ্টি সিমির কাছেই গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

  • আপু, তোমাদের শুটিং কি শেষ? তোমরা কি চলে যাবে নাকি?
  • আরে না। আরও দু তিনদিন লাগবে।
  • তাহলে গোছগাছ করছে যে সবাই!
  • অপ্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে রাখছে। ঝামেলা কম থাকাই ভালো।
  • হুম।

বেলা প্রায় অনেকটাই পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ সকাল কেটে দুপুর এসে পড়েছে। বৃষ্টি গাছের শিকরে বসে মাটিতে আঁকিবুঁকি করছে। আকাশ এসে পাশে বসলো। বৃষ্টি দেখেও না দেখার ভান করে নিজের কাজ করতে লাগলো।

  • এগুলো কি আকছো?
  • মার্ডার প্যাটার্ন আকছি।
  • মানে?
  • আপনাকে আগে মারবো নাকি আপনার বউকে আগে মারবো সেই নকশা আঁকছি!
    বৃষ্টির কথা শুনে আকাশ হাহাহোহো করে হেসে উঠলো। আর যাই হোক, বৃষ্টি আকাশের হাসি দেখা মিস করে না।
  • আমাকে খুন করতে সহজ হবে তোমার। আমি কাছে আছি আর আমার বউ তো অনেক দূরে! যেতে যেতে অনেক সময় লাগবে।
    বৃষ্টি তার দিকে তাকালো শুধু কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া জানালো না! আকাশ একটা কাঠি নিয়ে মাটিতে খাচার মতো কিছু একে বললো,
  • দেখোতো এই প্যাটার্নটা বুঝতে পারছো কিনা!
  • কি এটা?
  • এটা কারাগার। আমাকে অথবা আমার বউকে খুন করার আগেই তুমি কারাগারে বন্দী হয়ে যাবে।
  • হুহ্! বাচ্চাকাচ্চা আছে নাকি আপনার?
  • কেন! বাচ্চাদেরও মেরে ফেলবে নাকি!
  • না, বাচ্চাদের আমি ভালোবাসি খুব। তারা নিষ্পাপ!
  • বাহ! দরদী খুনী!
  • বেশি কথা না বলে যেটা প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দিন।
  • হুম, আছে।
  • ছেলে না মেয়ে?
  • ছেলে ও মেয়ে।
  • দুইজন?
  • হুম।
  • ছেলেমেয়ে কি বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আর বাবাকে সময় দেয় না?
    আকাশ অবাক দৃষ্টিতে তাকালো! কারণ সে যেটা উদ্দেশ্য করে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টি সেটা সহজেই ধরে ফেলেছে! এটা কিভাবে সম্ভব! বৃষ্টি আড়চোখে তাকিয়ে আবার বললো,
  • বউ কি অসুস্থ? দেখাশোনার মানুষ নেই তার কাছে!
  • কে বলেছে তোমাকে এসব?
  • কেন, সঠিক বলে দিয়েছি নাকি!
  • সিমি বলেছে না? এক মিনিট! তার মানে দাদু তোমার কথা বলছিলো সকালে! তুমি দাদুকে বলেছো আমি বিয়ে করেছি আর তুমি আমার বউ!
  • আমি এসব কিছু বলিনি।
  • তাহলে দাদু নাতবউয়ের সাথে কথা বলতে চাইলো কেন!
  • আমি কি জানি!
  • আমি তো ভেবেছিলাম দাদু দুষ্টুমি করছিলো! এদিকে তুমি খিচুড়ি পাকিয়ে রেখেছো!
  • উল্টাপাল্টা বলবেন না। আমি দাদুর সাথে কথা বলেছি ঠিকই কিন্তু কারো সম্পর্কে মিথ্যে বানিয়ে কিছু বলিনি। আমি আমার কথা বলেছি শুধু, আপনার তরফে কিছু বলিনি।
  • ফোন নম্বর কোথায় পেলে?
  • আপনার ফোন থেকেই তো কল করলাম।
  • আমার ফোন থেকে! কখন?
  • কাল রাতে।
  • তুমি তাহলে দাদুর সাথে কথা বলার জন্য ফোন নিয়েছো! বুঝলে কিভাবে এটা দাদুর নম্বর! আমি তো কোন নাম দিয়ে সেইভ করিনি!
  • বউয়ের সাথে প্রেমালাপ করছিলেন রাতে তাই ডায়াল লিস্টের প্রথম নম্বরে ডায়াল করে দেখেছি সেটা কোন বউ!
    আকাশ নিরবে তাকিয়ে থাকলো বৃষ্টির দিকে। মেয়েটির উপর রাগও হচ্ছে আবার বুদ্ধির প্রশংসাও করছে মনে মনে। বৃষ্টি আবার মাটিতে আঁকিবুঁকি করছে।
  • ঘুরতে যাবে?

বৃষ্টি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আকাশের দিকে। আকাশ আবার বললো,

  • যাবে না?
  • কোথায়?
  • বললেই চিনবে নাকি! চলো
  • যাবো না।
  • শুধু তুমি আর আমি যাবো। আর একবার জিজ্ঞেস করবো। যাবে?
    আকাশের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগটা কেন শুধু শুধু মিস করতে যাবে! মুচকি হেসে হাত ঝেড়ে বৃষ্টি উঠে দাড়ালো।
  • চলুন।
  • এই বেশে না। তোমার ড্রেস পড়ে এসো। আমি জঙ্গলে ঘুরবো না, অন্যদিকে যাবো।
  • ওকে।

বৃষ্টি তাবুতে চলে গেলো। সিমির জামাটা পাল্টে নিজের জামা পড়ে নিলো। বাইরে বের হতেই সিমি বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরলো। বৃষ্টি অবাক হয়ে বললো,

  • কি হলো আপু?
    সিমি মুচকি হেসে বললো,
  • কিছু না।
    আকাশের সাথে সামনে হাটতে লাগলে পেছন থেকে রিজভী বললো,
  • বায়, বায়, ঝড়বৃষ্টি। আশা করি, আবার দেখা হবে।

বৃষ্টি পেছনে তাকিয়ে হেসে কিছু না বলে আবার আকাশের সাথে হাটতে লাগলো। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আকাশ তাকে একটা পাহাড় ঘুরিয়ে, লেকের পাড় ঘুরিয়ে অটোতে উঠলো। আকাশের সাথে ঘুরতে ভালোই লাগছে বৃষ্টির। গাড়িতে থেকেও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে একটা রিসোর্টের সামনে থামলো। রিসোর্ট দেখে বৃষ্টি একটু অবাক হলো। এটাতে তো সে তার বন্ধুদের সাথে উঠেছিলো!

  • নামো।
  • এখানে?
  • হ্যাঁ।
    আকাশ গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া দিচ্ছে, বৃষ্টিও নেমে পড়লো। রিসোর্টের গেইট দেখিয়ে আকাশ বললো,
  • ভেতরে চলো।
  • রিসোর্টে কেন?
  • সারাদিন কি এভাবেই ঘুরবো! একটু রেস্ট নেওয়া প্রয়োজন নয় কি? আমার ক্ষুধাও লেগেছে।

বৃষ্টি মুচকি হেসে নির্ভয়ে রিসোর্টে যেতে লাগলো। কারণ, তার বন্ধুদের আরও দুএকদিন আগেই ঢাকা ফেরার কথা। সে নিশ্চিত, তারা ঢাকা পৌছে গেছে।
আকাশ বৃষ্টিকে একটা রুমের সামনে এনে কলিং বেল বাজালো। কেউ দরজা খুলতেই বৃষ্টি অবাক! তার বন্ধুরা এখানে! তারা এখনো ঢাকা ফিরেনি! আর আকাশই তাকে এখানে নিয়ে এলো কিভাবে! সে কি তাদের চিনে! চোখে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে! আকাশ হয়তো তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরেছে! তাই বললো,

  • দাড়িয়ে আছো কেন! ভেতরে যাও। আজ তাদের ট্রেন ছিলো, আমি ফোন করে বলাতে তোমার জন্য তারা ট্রেন মিস করেছে। আগামীকাল সকালের ট্রেনে একসাথে ঢাকা ফিরে যাবে।

বৃষ্টির চোখ ছলছল করছে। এই বুঝি অশ্রু গড়িয়ে পড়বে! এখানে রেখে যাওয়ার জন্য তাকে মিথ্যে বলে এনেছে! সিমি আপু এজন্যই তাকে জড়িয়ে ধরেছিলো! রিজভী ভাইয়া এজন্যই এভাবে বিদায় জানাচ্ছিলো! বৃষ্টি মনের ভেতর খুব কষ্ট নিয়ে একটা প্রশ্ন করলো,

  • তুমি তাদের ফোন নম্বর কোথায় পেলে?
  • তুমি তো আর নম্বর দিতে না, তাই অনেক কষ্টে আমার কললিস্ট খুজে বের করেছি। জঙ্গলে প্রথমদিন যে নম্বরে তুমি কল করেছিলে সেটাই খুঁজে বের করেছি। ভেতরে যাও। আল্লাহ হাফেজ।
    বৃষ্টি আকাশের হাত ধরে আকাশকে থামিয়ে দিলো,
  • আকাশ, আমি যাবো তোমার সাথে।
  • পাগলামো করো না, বৃষ্টি। ভেতরে যাও।
  • না, আমি তোমার সাথে যাবো।

আকাশকে রেখেই বৃষ্টি সিড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছিলো, আকাশ হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে এলো। খটে বসে বললো,

  • কি শুরু করেছো এসব!
  • কিছুই না।
  • বাচ্চাদের আচরণ ছেড়ে নিজের অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করো। আর আলতু ফালতু বিষয়ে সময় নষ্ট না করে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবো।
  • আমি বর্তমান নিয়ে ভাবি। কেননা, বর্তমানকে ঘিরেই ভবিষ্যৎ।
    আকাশ উঠে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। এদিকে তার বন্ধুবান্ধব আকাশকে নিয়ে নানান প্রশ্ন করে যাচ্ছে! বৃষ্টি শুধু একটাই উত্তর দিলো, “তোরা চিনবি না!” চোখে মুখে পানি দিয়ে আকাশ রুমে এসে বৃষ্টির বন্ধুর উদ্দেশ্যে বললো,
  • খাবারের ব্যবস্থা আছে?
  • নিচে যেতে হবে ভাই।
  • যাবে একটু আমার সাথে?
  • চলুন।
    বৃষ্টি বসা থেকে উঠে বললো,
  • আমিও যাবো।
  • আশ্চর্য! খাবার আনতেও এখন তোমাকে সাথে নিতে হবে!
    আকাশ একটু কড়া কন্ঠে বলায় বৃষ্টি চুপ হয়ে গেলো। আকাশ আর বৃষ্টির এক বন্ধু বেরিয়ে গেলো। বৃষ্টি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রুমে এলো। একটু পর বৃষ্টির বন্ধু একা এলো, আকাশ সাথে নেই!
  • আকাশ কোথায়?
  • আকাশ উপরে।
  • ফাজলামো রাখ। তোর সাথে যিনি গেছেন তিনি কোথায়?
  • চলে গেছে। তুই নাকি দুপুরে খাসনি, তাই খাবার কিনে দিয়ে গেছে।
  • ওফ্ফ! শীট!

বৃষ্টি দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিলো, তার বন্ধুরা বললো,

  • আরে তুই কোথায় যাচ্ছিস! খাবার কে খাবে?
  • খাবার তোরা খা ইচ্ছে মতো। রূপা, আমার ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলি না? কোথায়?
  • ব্যাগ দিয়ে কি করবি! কোথাও যাবি না তুই।
  • কথা কম বল। ব্যাগ দে আমার।
  • বৃষ্টি, একসাথে এসেছি আর কাল সকালে একসাথে ঢাকা ফিরবো। কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
  • ব্যাগ দিতে বলেছি!
    বৃষ্টি রেগে ধমক দেয়ায় রূপা ব্যাগ দেখিয়ে দিলো। বৃষ্টি ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। যেতে যেতে বললো,
  • আমার জন্য আর অপেক্ষা করবি না। তোরা যথাসময়ে ঢাকা ফিরে যা।

বৃষ্টি রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে আকাশকে দেখতে পেল না! কান্না করতে ইচ্ছে করছে তার! মানুষটা এতো খারাপ কেন! ছোট বাচ্চার মতো বোকা বানিয়ে চলে গেলো। যাক সে চলে, আসার সময় পথ চিনে ফেলেছে। সুতরাং একাই যাবে! এখন তার কাছে কাপড়চোপড়, টাকা, ফোন সবই আছে। কিন্তু গাড়ি যে পাচ্ছে না! হাটতে হাটতে একসময় সে গাড়ি পেয়ে গেলো এবং সেই পথে রওনা দিলো, যে পথে আকাশ তাকে নিয়ে এসেছে! যেতে যেতে একসময় জঙ্গলের পাশে চলে এলো। বিকেল হয়ে গেছে।

সূর্য প্রায় অস্ত যাওয়ার পথে! যতই সাহস দেখাক না কেন, মনের ভেতর ভয় আকুপাকু করছে! তবুও সে একা একা জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করছে। তাবুর জায়গায় চলে এসে বৃষ্টি থমকে গেলো! এখানে তাবুটাবু কিছুই নেই! তারা কোথায় গেছে! এখানেই তো ছিলো তারা, সেটা তার স্পষ্ট মনে আছে! এজন্যই কি সকাল থেকে গোছগাছ করছিলো তারা! একবারও বলেনি কেন এখান থেকে চলে যাবে! খুব ভয় লাগছে বৃষ্টির! নির্জন এই জঙ্গলে একা সে! পাখিদের কিচিরমিচির অন্যদিন মধুর মনে হলেও আজ এই নির্জন জঙ্গলে সেটা ভয়ানক মনে হচ্ছে!

এদিকে সিমিরা সবাই মৌলভীবাজার এসে এক রিসোর্ট ভাড়া করেছে। আকাশ বৃষ্টিকে সেখানে রেখে সোজা মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। তাদের ভাড়া করা রিসোর্টের প্রায় কাছাকাছি পৌছতেই আকাশের ফোনটা বেজে উঠলো। বৃষ্টির বান্ধবী রূপা কল করেছে!

  • হ্যালো?
  • হ্যালো, ভাইয়া বৃষ্টির ফোনটা চালু রাখতে বলুন। ওর সাথে কথা বলবো।
  • মানে!
  • বৃষ্টির ফোনটা অফ আছে, ওকে অন করতে বলুন। আর না হয় আপনি ফোনটা ওর কাছে দিন।
  • কি বলছো! আমি তো চলে এসেছি। বৃষ্টিকে না তোমাদের কাছে রেখে এলাম!
  • মানে! বৃষ্টি আপনার সাথে নেই!
  • আমার সাথে হবে কেন!
  • ও তো আপনার পিছু পিছু বেরিয়ে গেছে!
  • হোয়াট! কখন?
  • আপনি যাওয়ার পাচ মিনিটের মধ্যেই।
  • আমি তো সাথে সাথেই চলে এসেছি! ওর সাথে তো দেখা হয়নি!
  • তাহলে কোথায় সে! সে তো আমাদের কাছে নেই!
  • আমি এসেছি প্রায় বিশ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে আর এখন জানাচ্ছো আমাকে, বৃষ্টি আমার পিছু পিছু বেরিয়ে গেছে!
  • আমি তো ভেবেছি আপনার সাথে চলে গেছে, তাই আর ইনফর্ম করিনি! এখন কি হবে ভাইয়া!
  • ফোন রাখো। দেখছি আমি।

“এই মেয়েকে নিয়ে আর পারলাম না! ওফ্ফ! এখন কোথায় খুজি আমি! জঙ্গলের দিকে চলে যায়নি তো আবার! আল্লাহ তুমিই জানো কোন পরিস্থিতিতে আছে!”
আকাশ গাড়ি থেকে নেমে আবার অন্য গাড়িতে বিছানাকান্দির দিকে রওনা দিলো।

বৃষ্টি জঙ্গল থেকে তারাতাড়ি বের হয়ে আসছিলো। হঠাৎই তার সামনে দুজন লোক এসে তাকে ঘিরে ধরলো! হাতে তীর আকৃতির লম্বা যন্ত্র! হঠাৎ করে সামনে আসায় বৃষ্টি খুব ভয় পেয়েছে! পরক্ষনে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো লোক দুটোর গায়ে জংলী পোশাক, যেমনটা আকাশদের গায়ে ছিলো। কিন্তু এরা তাদের মধ্যে কেউ না, তা খুব ভালো করেই চিনতে পারছে বৃষ্টি। এদের দেখতে আরও বেশি ভয়ানক লাগছে! তবে বৃষ্টি তাদের সাজসজ্জা দেখে মনে মনে প্রশংসা করলো, আকাশদের চেয়ে বেশি সুন্দর হবে তাদের শুটিং! এরা তাদের মতোই আরেক দল হবে। আকাশরা তো ঢাকা থেকে এসেছিলো, কিন্তু এই দল কোথা থেকে এসেছে! প্রথমে অনেক ভয় পেলেও এখন আগের চেয়ে কিছুটা কমে গেছে। জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে ভয়ে ভয়ে বৃষ্টি বললো,

  • আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?
    লোক দুটো কেমন যেন বানরের মতো শব্দ করে বৃষ্টির কাছে চলে এলো। অদ্ভুত শব্দ করে বৃষ্টিকে সামনে হাটতে ইশারা করছে! বৃষ্টি ভয়ে এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে! বৃষ্টি যাচ্ছে না বলে তাদের মধ্যে একজন তীরের মাথা দিয়ে খোচা দিলো বৃষ্টিকে।
  • আহ! খোচান কেন!
    তারা আরও বিকট শব্দ করে ইশারা করতেই বৃষ্টি তাদের দেখানো পথে হাটতে লাগলো।

পর্ব – ২০

মেঘ সকালে নাস্তার পর বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে , বিকেল হয়ে গেছে তবুও ফিরেনি! আজ সকালে চা বাগানে এসে নাফিসাকে বিরক্তও করেনি! দুপুরে আম্মি জিজ্ঞেস করেছিলো ” মেঘ দুপুরের খাবার খেতে বাসায় আসছে না কেন? কোথায় গেছে?” নাফিসা উত্তরে বলেছে সে জানে না। আম্মি এসে নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলো কল করতে। কিন্তু কল করবে কিভাবে! মেঘের ফোন নম্বরও তো জানা নেই তার! আম্মি রেগে কিছুক্ষণ বকাঝকা করলো!

এখন বিকেলে বাচ্চাদের পড়াতে এসেও বাচ্চারা মেঘের কথা জিজ্ঞেস করছে। মেঘ আজ তাদের সঙ্গীত শিখাতে আসেনি, আবার কাল বলে গিয়েছিল খরগোশ নিয়ে খেলা করবে। না এসেছে মেঘ আর না এনেছে খরগোশ! বাচ্চারা বারবার মেঘের কথা জিজ্ঞেস করতে করতে নাফিসাকে বিরক্ত বানিয়ে ফেলছে! কোনমতো পড়া শেষ করলো নাফিসা। বাচ্চারা তার পিছু পিছু বাড়িতে চলে এলো খরগোশ ছানাদের সাথে খেলার জন্য। খাচা বাইরেই রাখা ছিলো, বাচ্চারা মুঠো করে ঘাস নিয়ে খরগোশ ছানাকে খাওয়াচ্ছে। নাফিসা আসরের নামাজ পড়ে চা বাগানের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় বাচ্চাদের তাড়িয়ে দিলো নিজ বাসায় যাওয়ার জন্য।

চা বাগানে আসতেই তার সঙ্গীরা জিজ্ঞেস করছে মেঘের কথা! সারাদিন মেঘের কথা শুনতে শুনতে কান তব্ধ লেগে যাচ্ছে! তারা আবারও বলে দিলো কাল বিকেলে মেঘকে সাথে নিয়ে যেন বটবৃক্ষের তলায় তাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে যায়। নাফিসা চা পাতা তুলে বাসায় আসার পথে পাহাড়ের কাছ থেকে কিছু নরম ঘাস তুলে নিয়ে এলো খরগোশ ছানার জন্য। বাসায় এসে দেখলো মেঘ এখনো আসেনি। মায়ের সাথে রান্নার কাজে হেল্প করতে লাগলো।
সন্ধ্যায় মেঘ বাসায় ফিরলো হাতে কতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে। সে এসেই দেখতে পেল নাফিসা দরজার সামনে বসে খরগোশ ছানাদের মুখে ঘাস তুলে দিচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে সারাদিন ভালোই যত্ন নিয়েছে হয়তো! মেঘকে আসতে দেখে দরজার কাছ থেকে উঠে দাড়ালো নাফিসা। মেঘ ভেতরে এসে বললো,

  • ভালোই তো যত্ন নিচ্ছো দেখছি! শুধু আমার বেলায় অবহেলা!
    নাফিসা কিছু না বলে খরগোশ ছানার খাচা নিয়ে আম্মির রুমে চলে গেলো। মেঘ শপিং ব্যাগ গুলো খাটের একপাশে রেখে ফোন আর ঘড়ি টেবিলে রাখলো। আলমারি খুলে জামাকাপড় নিয়ে নাফিসাকে ডাকলো।
  • মেঘা
    দুবার ডাক দেয়ার পর নাফিসা এলো।
  • কি?
  • গোসল করবো।
  • তো আমি কি করবো!
  • বাথরুম ফাঁকা আছে কিনা দেখে এসো।
  • হ্যাঁ, ফাঁকা ই আছে। যান!
    মেঘ মুচকি হেসে বললো,
  • ওকে, জান। নাও ধরো এগুলো। আর চলো আমার সাথে।
  • আমি আপনার জামাকাপড় নিয়ে কেন যাবো!
  • তাহলে তোমার জামাকাপড় নিয়ে আসো, একসাথে গোসল করি!
    নাফিসা বিরক্তি নিয়ে মেঘের হাতে তার জামাকাপড় দিয়ে দিলো।
  • আমার এতো গোসলের শখ হয়নি, ধরুন আপনার জামাকাপড়। আর নিজে নিয়ে যান।
  • আশ্চর্য মেয়ে তুমি! এখন আমি একা একা বাথরুমে যাবো আর আম্মি যদি না জেনে সেখানে চলে যায় তাহলে ভাবতে পারছো কিছু! আমিও লজ্জা পাবো আর আম্মিও কতটা লজ্জিত হবে!

মেঘ ভুল বলেনি কথাটা! তারই বুঝতে এলোমেলো হয়েছে! তাই নাফিসা মেঘের জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে এলো। পিছু পিছু মেঘও। নাফিসা জামাকাপড় রেখে বের হতে নিলে মেঘ আটকালো। দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বললো,

  • চলো একসাথে গোসল করি!
    নাফিসা মেঘকে ঠেলে সরিয়ে বাইরে এসে দাড়িয়ে রইলো। মেঘ গোসল করে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো।
  • জামাকাপড় ধুয়ে দাও। অনেক তো নিজের কাজ নিজে করেছি। এখন তো বউ আছে, এখন না হয় আমি একটু আরামে কাটাই!
    মেঘ কথাটা বলে চলে এলো। নাফিসার প্রচুর রাগ হচ্ছে! না ইচ্ছে করছে এসব ধুয়ে দিতে আর না পারছে এগুলো রেখে চলে যেতে! কি সুন্দর অধিকার ফলাচ্ছে এখানে থেকে থেকে! দিনরাত তাকে জ্বালানো যেন তার পেশা হয়ে গেছে! নাফিসা রাগে ফাটছে আর জামাকাপড় ধুয়ে দিতে দিতে মেঘকে মনে মনে হাজার বার বকে যাচ্ছে! শরীরের সব রাগ যেন জামা-কাপড়ের উপর ঝেড়ে ফেলছে! জামাকাপড়ের মতো মেঘকে আছড়াতে পারলে এখন শান্তি লাগতো তার মনে!

কাপড়চোপড় ধুয়ে নাফিসা আম্মির রুমে চলে এলো। আজ সে খাবার নিয়ে যায়নি মেঘের জন্য। বাধ্য হয়ে আম্মিই গেছে খাবারের প্লেট ও বাটি নিয়ে।

  • মেঘ, কোথায় ছিলে সারাদিন? দুপুরে খাওয়াও হয়নি তোমার!
  • আম্মি, সিলেটেই কয়েকটা জায়গা ঘুরেছি। বাবা রিসোর্ট স্থাপন করবে সেটার জন্যই কিছু জায়গা দেখেছিলাম। আর দুপুরে খেয়ে নিয়েছি রেস্তোরায়।
  • অহ! তোমার ফোন নম্বরটা দিও তো। টেনশন করছিলাম কোথায় গেছো, কিছু বলেও যাওনি!
  • টেনশনের কি আছে। আমি মেঘার কাছে বলে গিয়েছিলাম ফিরতে দেড়ি হবে।
  • কার কাছে?
    মেঘ বিন্দু পরিমাণ লজ্জা পেয়ে বললো,
  • নাফিসার কাছে।
    রোকসানা নিশব্দে হেসে উঠলো। তারপর বললো,
  • চমৎকার একটা নাম দিয়েছো। মেঘা, নামটা খুব সুন্দর! বাসায় কিছু জানিয়েছো বিয়ের কথা?
  • না আম্মি, আমাকে সুযোগ বুঝে সেখানে গিয়ে জানাতে হবে। এখানে থেকে এমন কিছু জানালে বাবা-মা কষ্ট পাবেন! একমাত্র ছেলে আমি, আমাকে নিয়ে এমন কিছু তাদের কল্পনার বাইরে।
    রোকসানা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
  • হুম, সেটা তো হবেই।
  • আপনি চিন্তা করবেন না। বাবা-মাকে আমি শীঘ্রই জানাবো সবটা। আর নাফিসাকে ফেলে আমি যাবো না। আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন আম্মি।
    রোকসানা মৃদু হেসে বললো,
  • এখন, খেয়ে নাও তুমি।
    মেঘ একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
  • আম্মি এটা নিয়ে যান। আপনার জন্য এনেছি, দেখুন পছন্দ হয় কি-না!
  • এটা কি?
  • শাড়ি।
  • শাড়ি এনেছো কেন শুধু শুধু! এটার কোন প্রয়োজন ছিলো না! অযথা টাকা নষ্ট!
  • এটা কোনো কথা হলো! এটাও তো আমার একটা পরিবার! আমি কি পরিবারের জন্য কিছু করতে পারবো না!
  • আমি সেটা বলিনি মেঘ! ঠিক আছে, দাও। এবার তুমি খেয়ে নাও, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
  • হুম।
    রোকসানা খাবার দিয়ে চলে গেলেন। নাফিসা আম্মির সাথে বসেই খেয়েছে। আম্মি খাওয়ার মাঝেও নানান বানী নাফিসার কানে দিলেন মেঘের সাথে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। যদিও শুনতে ভালো লাগছে না, তবুও নাফিসা তা চুপচাপ হজম করে নিলো। রাত হয় আর তার মনে ভয় বাড়তে থাকে! মেঘের কাছে যেতে ইচ্ছে করে না একটুও! কিন্তু আম্মির জন্য কিছু বলতেও পারে না! ঘুমানোর সময় হয়ে এলে নাফিসা ভয়ে ভয়ে ওই রুমে গেলো। মেঘ খাটে শুয়ে আছে মোবাইল নিয়ে! নাফিসাকে দেখতেই উঠে বসলো সে।
  • মেঘা, এদিকে আসো।

নাফিসা তার কথায় কান না দিয়ে ঘরের কোনা থেকে মাদুরটা নিয়ে মাটিতে বিছিয়ে দিলো। মেঘ উঠে এসে নাফিসাকে টেনে খাটে বসালো। হাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে বললো,

  • দুইটা শাড়ি এনেছি তোমার জন্য। দেখো পছন্দ হয় কিনা!
  • আমি বলেছি কাউকে আমার জন্য শাড়ি আনতে?
  • সবকিছু তোমাকে বলতে হবে! আর তুমি তো কিছুই বলোনা আমাকে, তাই নিজের ইচ্ছাতেই নিয়ে এলাম।
  • আপনার ইচ্ছাতে এনেছেন আপনিই পড়েন। আমি শাড়ি পড়ি না।
  • পড় না তো কি হয়েছে, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে পড়বে।
  • পড়বো না আমি।
  • আলমারিতে তুলে রাখো।
  • পড়বো না যখন রাখবো কেন আলমারিতে।
  • এতো কথা বলো কেন! পড়বেও এখন আলমারিতে তুলেও রাখবে। রাখো!
    মেঘ ধমক দেয়ায় নাফিসা মুখ গোমড়া করে শপিং ব্যাগ গুলো সব আলমারিতে রাখলো। একসাথে সব রাখতে দেখে মেঘ বললো,
  • আমার ড্রেস গুলো ব্যাগ থেকে নামিয়ে রাখো।

মেঘের কথামতো সব করছে ঠিকই কিন্তু তার কাজে জেদ স্পষ্ট! চোখে হালকা পানিও উঁকি দিচ্ছে! কেউ তার সাথে ধমক দিয়ে কথা বললে তার খুব খারাপ লাগে! আর মেঘ এটা বুঝে গেছে। কিন্তু তাকে কথা শুনাতে হলে এভাবেই বলতে হবে। এছাড়া আর উপায় খুঁজে পাচ্ছে না মেঘ! নাফিসা জামা আলমারিতে রেখে কাথা আর মশারী বের করে নিচে বিছানা ঠিক করতে লাগলো। মেঘ বললো,

  • শুধু শুধু নিচে বিছানা করে লাভ নেই! আমি তোমার সাথে খাটেই ঘুমাবো।

নাফিসা কোনো প্রতিক্রিয়া না করে বিছানা ঠিক করে নিজেই নিচে শুয়ে পড়লো। মেঘ তো অবাক! আজ তাকে না বলে সে নিজেই নিচে শুয়ে পড়েছে! মেঘও কম কিসে! সেও খাট থেকে নেমে নাফিসার সাথে মাদুরে শুয়ে পড়লো! নাফিসা তাকে ধাক্কাতে লাগলো আর এক প্রকার কান্নাই শুরু করলো!

  • ছাড়ুন, খাটে দিয়েছি তো আপনাকে। সেখানে ঘুমান।
  • তুমি যেখানে, আমি সেখানে। সে কি জানো না!
    মেঘ মুচকি হেসে গানের সুরে বললো কথাটা। এদিকে নাফিসার চোখে পানি! নাফিসা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য তার সাথে জোড়াজুড়ি করেই যাচ্ছে! মেঘ কাথাসহ মুড়ে নাফিসাকে কোলে তুলে খাটে ফেলে দিলো। নাফিসা উঠতে চেষ্টা করতেই মেঘ তাকে নিয়ে এক বালিশে এক কাথার নিচে শুয়ে পড়লো। কপালে একটা চুমু দিয়ে মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বললো,
  • চুপচাপ ঘুমাও। নড়াচড়া করবে না একদম। তাহলে কিন্তু মাইর লাগাবো!

নাফিসার হাত পা সব মেঘ দ্বারা আটকানো! বাধ্য হয়ে তার বুকেই মিশে থাকতে হলো। আবার সেই মিষ্টি গন্ধটা পাচ্ছে মেঘের শরীর থেকে! এ তো এক অজানা ভালো লাগা! এই গন্ধটা নাফিসাকে শান্ত হতে বাধ্য করছে!

সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো খোলা আকাশের নিচে! সে কি এখনো ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে বুঝতে পারছে না! ঘুম ভাঙলে তো আকাশমুখী ঘরের চালা দেখতে পাবে! কিন্তু আকাশ দেখছে কেন! চালা কোথায় গেছে!
ঝটপট উঠে বসলো নাফিসা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে কোন এক পাহাড়ে ঘাসের উপর শুয়ে আছে! তার গায়ে পাতলা কাথাটা আছে! মেঘ মাথার নিচে দুহাত রেখে তার পাশেই শুয়ে আছে! মেঘ শুয়ে থেকেই মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে!

  • ঘুম ভেঙেছে তাহলে!
  • আমি এখানে কিভাবে?

মেঘ উঠে বসে বললো,

  • মেঘা, তোমার ঘুম অনেক গভীর। বাসা থেকে এপর্যন্ত নিয়ে এসেছি তবুও তোমার ঘুম ভাঙেনি! যদিও তোমাকে কোলে নিয়ে খুব সাবধানে হেটেছি যাতে ঘুম না ভাঙে! তবে ভয় একটা ছিলো, কোন লোকের সামনে পড়লে না জানি কি হতো! ভাগ্যিস এই ভোর বেলা কারো নজরে পড়িনি!
  • মানে! আপনি আমাকে বাসা থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন!
  • হুম।
  • কেন এনেছেন এখানে?
  • বলেছিলাম না, তোমাকে নিয়ে সূর্যোদয় দেখবো! এজন্যই এনেছি। এমনিতে বললে তো আসতে না, তাই এই কৌশল অবলম্বন করতে হলো।
  • এমন আযব মানুষও বসবাস করে দুনিয়ায়, জানা ছিলো না! যত্তসব!
    নাফিসা কাথা মুড়ে হাতে নিয়ে উঠতে গেলে মেঘ তাকে এক টানে আবার বসিয়ে দিলো। তার দুপায়ের মাঝে বসিয়ে পা দিয়ে আটকে ধরলো। হাত থেকে কাথাটা নিয়ে চাদর ন্যায় দুজনকে একসাথে জড়িয়ে নিলো কাথার ভেতর। পেছনে বসে নাফিসার কাধে থুতনি রেখে কানের কাছে মুখ এনে বললো,
  • এতো কষ্ট করে এতোটা পথ নিয়ে এলাম, উদ্দেশ্য সফল না হতেই এভাবে যেতে দেই কিভাবে! হুম? পূর্বাকাশে তাকাও মেঘা, আকাশ লাল হয়ে গেছে। সূর্য এখনই উদয় হবে।
    দুতিন মিনিটের মধ্যেই সূর্যের দেখা পেল! নাফিসা প্রথমে ছোটার জন্য ছটফট করলেও এখন স্থির হয়ে মেঘের বাহুডোরে বন্দী হয়ে বসে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজন সূর্যের দিকে! লাল সূর্য একটু একটু করে সম্পূর্ণ দেখা দিলো তাদের! নতুন আলো ছড়িয়ে আলোকিত করে দিলো এ ভুবন! সূর্যোদয় দেখার মাঝে এতো আনন্দ, এতো ভালো লাগা আছে সেটা এই প্রথম অনুভব করলো নাফিসা! সাথে কানে ভেসে আসছে ঝর্ণার শব্দ! কাধে পড়ছে মেঘের গরম নিশ্বাস! অতি ভালো লাগায় চোখে অশ্রু ঝরছে তার!

মেঘ নিজের ইচ্ছে পূরণ করতে পেরে খুবই আনন্দিত। এ তো তার বহুদিনের ইচ্ছে, প্রিয় মানুষকে সাথে নিয়ে সূর্যোদয় দেখবে! আজ তার পূর্নতা পেল! নতুন লাল সূর্য উপরে উঠে গেলে মেঘ নতুন নেশায় মগ্ন হয়েছে! একদিকে সূর্যোদয়, অন্যদিকে পাথরের উপর আছড়ে পড়া ঝর্ণার পানির শব্দ আর পাখিদের কলোরব! এতো ভালো লাগছে কেন মুহূর্তটা! দুজনকেই শিহরিত করে তুলছে! নাফিসার কাধ থেকে চুল সরিয়ে কাধে ঠোঁট ছুয়ে দিলো মেঘ। নাফিসা চোখ বন্ধ করে ফেললো এবং সাথে সাথে মেঘের জামা খামচে ধরলো! মেঘ চুলের মাঝে মুখ লুকিয়ে বললো,

  • ভালোবাসি মেঘা, খুব ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়!
    আরও কয়েক মিনিট তারা এভাবে বসে থেকে একসময় নাফিসা চোখ মুছে উঠে পড়লো। কাথা রেখেই ছোট ছোট কদম ফেলে হাটতে লাগলো। এই পাহাড় তাদের বাসা থেকে দূরে না! কিন্তু এদিকে বেশি আসে না নাফিসা। বাচ্চাদের পড়ায় বলে শুধু ওই ছোট পাহাড়ে যায়। মেঘ উঠে কাথা ভাজ করে হাতে নিয়ে নিলো। দ্রুত পায়ে নাফিসার কাছে গিয়ে হাত ধরে তাকে হামহাম ঝর্ণার পাশে নিয়ে গেলো। নাফিসা কোনো কথা না বলে মেঘ যেদিকে নিয়ে গেছে সেদিকে চুপচাপ গিয়েছে তার সাথে।

এখানে এসে মেঘ কাথাটা একটা ডালে ঝুলিয়ে রাখলো! টিশার্ট খুলেও কাথার সাথে রাখলো। এতো সকালে কোন লোকজন দেখা যাচ্ছে না এখানে! পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে আর ঝর্ণার পানি আছড়ে পড়ছে টিলা, পাথরের উপর! নাফিসা পাথরের উপর দাড়িয়ে শুধু দেখছে। মেঘ কি এখন এখানে গোসল করবে! প্যান্ট ফোল্ড করে মেঘ পানিতে পা রেখে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো নাফিসার দিকে।

  • এসো গোসল করবো একসাথে।

নাফিসা চোখ বড় বড় মেঘের দিকে তাকালো! এতো সকালে গোসল! তাও এই ঝর্ণার পানিতে! কাপড়চোপড়ও তো আনেনি, গোসল করলে বাড়ি ফিরবে কিভাবে সেটা কি এই ছেলের মাথায় ঢুকেনি! একটা মেয়ে এতোটা পথ ভেজা কাপড়ে যাবে কিভাবে সেটা কি মাথাচাড়া দিচ্ছে না এই মানুষটার!

  • কি চিন্তা করছো এতো? লোকজন নেই তো এখানে। এসো
  • না আমি এখন গোসল করবো না।
  • গোসল তো তোমাকে করতেই হবে এখন আমার সাথে!
    নাফিসা সেখান থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও পারলো না! মেঘ তাকে টেনে পানিতে নামিয়ে দিয়েছে!
  • হচ্ছে কি এসব! বলেছিলাম না আমি গোসল করবো না!
  • হুশশ!
    মেঘ তাকে নিয়ে খাড়া ঝর্ণার নিচে দাড়ালো। নাফিসা তবুও ভিজতে চাইছে না! মেঘ নাফিসার ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে নিয়ে খাড়া ঝর্ণার নিচে মাথা রাখলো! কয়েক সেকেন্ড থেকে মাথা সরিয়ে নিলো। নাফিসার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো! এটা কি ছিলো সে কিছুই অনুমান করতে পারছে না! মাথা ভনভন করছে! খাড়া ঝর্ণার পানি মাথায় আছড়ে পড়া, তারউপর মুখ বন্ধ করে পানির নিচে জোর করে এতোক্ষণ আটকে রাখা! একটুর জন্য মনে হচ্ছিলো এই বুঝি দম আটকে মরে যাচ্ছে! এসব কোন মানুষের কাজ! মানুষ কতটা জঘন্য হলে এমন কাজ করতে পারে! নাফিসা এখনো ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না আর এদিকে মেঘের মুখে মুচকি হাসি। মেঘ নাফিসার কোমড় ধরে আছে, নাফিসা যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে! মেঘ তাকে তার বুকে ফেলে বললো,
  • ঘনঘন শ্বাস না নিয়ে, ধীরে ধীরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ো।
    মেঘের কথা মতো নাফিসা সেটাই করলো। এখন নিজের কাছে একটু হালকা মনে হচ্ছে। যখন বুঝতে পারলো নাফিসা স্বাভাবিক হয়ে গেছে তখন মেঘ তাকে নিয়ে গলা পানিতে নেমে গোসল করলো। কয়েকটি ডুব দিয়ে পানি থেকে উঠে এলো। নাফিসা ওড়না জড়িয়ে কাপছে। পুরো শরীর ভেজা, এখন বাসায় যাবে কিভাবে! রেগে মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,
  • বলেছিলাম গোসল করবো না, এখন ভেজা কাপড়ে বাসায় ফিরবো কিভাবে?
    মেঘ প্রতুত্তরে মুচকি হেসে ডাল থেকে কাথা নিয়ে চাদর ন্যায় নাফিসার গায়ে জড়িয়ে দিলো। এতে নাফিসার সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে গেছে! মেঘ বললো,
  • কোন ইচ্ছা জাগলে সেটা অপূর্ণ রাখতে নেই। পরবর্তীতে আফসোস করবে। আমি সবটা ভেবেই তোমাকে পানিতে নামিয়েছি। রাস্তায় বেশি মানুষ থাকবে না, এভাবে বাসায় যেতে পারবে। চলো।
    মেঘ টিশার্ট গায়ে দিয়ে নাফিসাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো।

পর্ব – ২০

মেঘ সকালে নাস্তার পর বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে , বিকেল হয়ে গেছে তবুও ফিরেনি! আজ সকালে চা বাগানে এসে নাফিসাকে বিরক্তও করেনি! দুপুরে আম্মি জিজ্ঞেস করেছিলো ” মেঘ দুপুরের খাবার খেতে বাসায় আসছে না কেন? কোথায় গেছে?” নাফিসা উত্তরে বলেছে সে জানে না। আম্মি এসে নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলো কল করতে। কিন্তু কল করবে কিভাবে! মেঘের ফোন নম্বরও তো জানা নেই তার! আম্মি রেগে কিছুক্ষণ বকাঝকা করলো! এখন বিকেলে বাচ্চাদের পড়াতে এসেও বাচ্চারা মেঘের কথা জিজ্ঞেস করছে। মেঘ আজ তাদের সঙ্গীত শিখাতে আসেনি, আবার কাল বলে গিয়েছিল খরগোশ নিয়ে খেলা করবে।

না এসেছে মেঘ আর না এনেছে খরগোশ! বাচ্চারা বারবার মেঘের কথা জিজ্ঞেস করতে করতে নাফিসাকে বিরক্ত বানিয়ে ফেলছে! কোনমতো পড়া শেষ করলো নাফিসা। বাচ্চারা তার পিছু পিছু বাড়িতে চলে এলো খরগোশ ছানাদের সাথে খেলার জন্য। খাচা বাইরেই রাখা ছিলো, বাচ্চারা মুঠো করে ঘাস নিয়ে খরগোশ ছানাকে খাওয়াচ্ছে। নাফিসা আসরের নামাজ পড়ে চা বাগানের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় বাচ্চাদের তাড়িয়ে দিলো নিজ বাসায় যাওয়ার জন্য।

চা বাগানে আসতেই তার সঙ্গীরা জিজ্ঞেস করছে মেঘের কথা! সারাদিন মেঘের কথা শুনতে শুনতে কান তব্ধ লেগে যাচ্ছে! তারা আবারও বলে দিলো কাল বিকেলে মেঘকে সাথে নিয়ে যেন বটবৃক্ষের তলায় তাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে যায়। নাফিসা চা পাতা তুলে বাসায় আসার পথে পাহাড়ের কাছ থেকে কিছু নরম ঘাস তুলে নিয়ে এলো খরগোশ ছানার জন্য। বাসায় এসে দেখলো মেঘ এখনো আসেনি। মায়ের সাথে রান্নার কাজে হেল্প করতে লাগলো।

সন্ধ্যায় মেঘ বাসায় ফিরলো হাতে কতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে। সে এসেই দেখতে পেল নাফিসা দরজার সামনে বসে খরগোশ ছানাদের মুখে ঘাস তুলে দিচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে সারাদিন ভালোই যত্ন নিয়েছে হয়তো! মেঘকে আসতে দেখে দরজার কাছ থেকে উঠে দাড়ালো নাফিসা। মেঘ ভেতরে এসে বললো,

  • ভালোই তো যত্ন নিচ্ছো দেখছি! শুধু আমার বেলায় অবহেলা!
    নাফিসা কিছু না বলে খরগোশ ছানার খাচা নিয়ে আম্মির রুমে চলে গেলো। মেঘ শপিং ব্যাগ গুলো খাটের একপাশে রেখে ফোন আর ঘড়ি টেবিলে রাখলো। আলমারি খুলে জামাকাপড় নিয়ে নাফিসাকে ডাকলো।
  • মেঘা

দুবার ডাক দেয়ার পর নাফিসা এলো।

  • কি?
  • গোসল করবো।
  • তো আমি কি করবো!
  • বাথরুম ফাঁকা আছে কিনা দেখে এসো।
  • হ্যাঁ, ফাঁকা ই আছে। যান!

মেঘ মুচকি হেসে বললো,

  • ওকে, জান। নাও ধরো এগুলো। আর চলো আমার সাথে।
  • আমি আপনার জামাকাপড় নিয়ে কেন যাবো!
  • তাহলে তোমার জামাকাপড় নিয়ে আসো, একসাথে গোসল করি!
    নাফিসা বিরক্তি নিয়ে মেঘের হাতে তার জামাকাপড় দিয়ে দিলো।
  • আমার এতো গোসলের শখ হয়নি, ধরুন আপনার জামাকাপড়। আর নিজে নিয়ে যান।
  • আশ্চর্য মেয়ে তুমি! এখন আমি একা একা বাথরুমে যাবো আর আম্মি যদি না জেনে সেখানে চলে যায় তাহলে ভাবতে পারছো কিছু! আমিও লজ্জা পাবো আর আম্মিও কতটা লজ্জিত হবে!
    মেঘ ভুল বলেনি কথাটা! তারই বুঝতে এলোমেলো হয়েছে! তাই নাফিসা মেঘের জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে এলো। পিছু পিছু মেঘও। নাফিসা জামাকাপড় রেখে বের হতে নিলে মেঘ আটকালো। দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বললো,
  • চলো একসাথে গোসল করি!
    নাফিসা মেঘকে ঠেলে সরিয়ে বাইরে এসে দাড়িয়ে রইলো। মেঘ গোসল করে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো।
  • জামাকাপড় ধুয়ে দাও। অনেক তো নিজের কাজ নিজে করেছি। এখন তো বউ আছে, এখন না হয় আমি একটু আরামে কাটাই!

মেঘ কথাটা বলে চলে এলো। নাফিসার প্রচুর রাগ হচ্ছে! না ইচ্ছে করছে এসব ধুয়ে দিতে আর না পারছে এগুলো রেখে চলে যেতে! কি সুন্দর অধিকার ফলাচ্ছে এখানে থেকে থেকে! দিনরাত তাকে জ্বালানো যেন তার পেশা হয়ে গেছে! নাফিসা রাগে ফাটছে আর জামাকাপড় ধুয়ে দিতে দিতে মেঘকে মনে মনে হাজার বার বকে যাচ্ছে! শরীরের সব রাগ যেন জামা-কাপড়ের উপর ঝেড়ে ফেলছে! জামাকাপড়ের মতো মেঘকে আছড়াতে পারলে এখন শান্তি লাগতো তার মনে!
কাপড়চোপড় ধুয়ে নাফিসা আম্মির রুমে চলে এলো। আজ সে খাবার নিয়ে যায়নি মেঘের জন্য। বাধ্য হয়ে আম্মিই গেছে খাবারের প্লেট ও বাটি নিয়ে।

  • মেঘ, কোথায় ছিলে সারাদিন? দুপুরে খাওয়াও হয়নি তোমার!
  • আম্মি, সিলেটেই কয়েকটা জায়গা ঘুরেছি। বাবা রিসোর্ট স্থাপন করবে সেটার জন্যই কিছু জায়গা দেখেছিলাম। আর দুপুরে খেয়ে নিয়েছি রেস্তোরায়।
  • অহ! তোমার ফোন নম্বরটা দিও তো। টেনশন করছিলাম কোথায় গেছো, কিছু বলেও যাওনি!
  • টেনশনের কি আছে। আমি মেঘার কাছে বলে গিয়েছিলাম ফিরতে দেড়ি হবে।
  • কার কাছে?
    মেঘ বিন্দু পরিমাণ লজ্জা পেয়ে বললো,
  • নাফিসার কাছে।
    রোকসানা নিশব্দে হেসে উঠলো। তারপর বললো,
  • চমৎকার একটা নাম দিয়েছো। মেঘা, নামটা খুব সুন্দর! বাসায় কিছু জানিয়েছো বিয়ের কথা?
  • না আম্মি, আমাকে সুযোগ বুঝে সেখানে গিয়ে জানাতে হবে। এখানে থেকে এমন কিছু জানালে বাবা-মা কষ্ট পাবেন! একমাত্র ছেলে আমি, আমাকে নিয়ে এমন কিছু তাদের কল্পনার বাইরে।

রোকসানা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

  • হুম, সেটা তো হবেই।
  • আপনি চিন্তা করবেন না। বাবা-মাকে আমি শীঘ্রই জানাবো সবটা। আর নাফিসাকে ফেলে আমি যাবো না। আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন আম্মি।
    রোকসানা মৃদু হেসে বললো,
  • এখন, খেয়ে নাও তুমি।
    মেঘ একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
  • আম্মি এটা নিয়ে যান। আপনার জন্য এনেছি, দেখুন পছন্দ হয় কি-না!
  • এটা কি?
  • শাড়ি।
  • শাড়ি এনেছো কেন শুধু শুধু! এটার কোন প্রয়োজন ছিলো না! অযথা টাকা নষ্ট!
  • এটা কোনো কথা হলো! এটাও তো আমার একটা পরিবার! আমি কি পরিবারের জন্য কিছু করতে পারবো না!
  • আমি সেটা বলিনি মেঘ! ঠিক আছে, দাও। এবার তুমি খেয়ে নাও, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
  • হুম।

রোকসানা খাবার দিয়ে চলে গেলেন। নাফিসা আম্মির সাথে বসেই খেয়েছে। আম্মি খাওয়ার মাঝেও নানান বানী নাফিসার কানে দিলেন মেঘের সাথে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। যদিও শুনতে ভালো লাগছে না, তবুও নাফিসা তা চুপচাপ হজম করে নিলো। রাত হয় আর তার মনে ভয় বাড়তে থাকে! মেঘের কাছে যেতে ইচ্ছে করে না একটুও! কিন্তু আম্মির জন্য কিছু বলতেও পারে না! ঘুমানোর সময় হয়ে এলে নাফিসা ভয়ে ভয়ে ওই রুমে গেলো। মেঘ খাটে শুয়ে আছে মোবাইল নিয়ে! নাফিসাকে দেখতেই উঠে বসলো সে।

  • মেঘা, এদিকে আসো।

নাফিসা তার কথায় কান না দিয়ে ঘরের কোনা থেকে মাদুরটা নিয়ে মাটিতে বিছিয়ে দিলো। মেঘ উঠে এসে নাফিসাকে টেনে খাটে বসালো। হাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে বললো,

  • দুইটা শাড়ি এনেছি তোমার জন্য। দেখো পছন্দ হয় কিনা!
  • আমি বলেছি কাউকে আমার জন্য শাড়ি আনতে?
  • সবকিছু তোমাকে বলতে হবে! আর তুমি তো কিছুই বলোনা আমাকে, তাই নিজের ইচ্ছাতেই নিয়ে এলাম।
  • আপনার ইচ্ছাতে এনেছেন আপনিই পড়েন। আমি শাড়ি পড়ি না।
  • পড় না তো কি হয়েছে, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে পড়বে।
  • পড়বো না আমি।
  • আলমারিতে তুলে রাখো।
  • পড়বো না যখন রাখবো কেন আলমারিতে।
  • এতো কথা বলো কেন! পড়বেও এখন আলমারিতে তুলেও রাখবে। রাখো!
    মেঘ ধমক দেয়ায় নাফিসা মুখ গোমড়া করে শপিং ব্যাগ গুলো সব আলমারিতে রাখলো। একসাথে সব রাখতে দেখে মেঘ বললো,
  • আমার ড্রেস গুলো ব্যাগ থেকে নামিয়ে রাখো।

মেঘের কথামতো সব করছে ঠিকই কিন্তু তার কাজে জেদ স্পষ্ট! চোখে হালকা পানিও উঁকি দিচ্ছে! কেউ তার সাথে ধমক দিয়ে কথা বললে তার খুব খারাপ লাগে! আর মেঘ এটা বুঝে গেছে। কিন্তু তাকে কথা শুনাতে হলে এভাবেই বলতে হবে। এছাড়া আর উপায় খুঁজে পাচ্ছে না মেঘ! নাফিসা জামা আলমারিতে রেখে কাথা আর মশারী বের করে নিচে বিছানা ঠিক করতে লাগলো। মেঘ বললো,

  • শুধু শুধু নিচে বিছানা করে লাভ নেই! আমি তোমার সাথে খাটেই ঘুমাবো।
    নাফিসা কোনো প্রতিক্রিয়া না করে বিছানা ঠিক করে নিজেই নিচে শুয়ে পড়লো। মেঘ তো অবাক! আজ তাকে না বলে সে নিজেই নিচে শুয়ে পড়েছে! মেঘও কম কিসে! সেও খাট থেকে নেমে নাফিসার সাথে মাদুরে শুয়ে পড়লো! নাফিসা তাকে ধাক্কাতে লাগলো আর এক প্রকার কান্নাই শুরু করলো!
  • ছাড়ুন, খাটে দিয়েছি তো আপনাকে। সেখানে ঘুমান।
  • তুমি যেখানে, আমি সেখানে। সে কি জানো না!
    মেঘ মুচকি হেসে গানের সুরে বললো কথাটা। এদিকে নাফিসার চোখে পানি! নাফিসা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য তার সাথে জোড়াজুড়ি করেই যাচ্ছে! মেঘ কাথাসহ মুড়ে নাফিসাকে কোলে তুলে খাটে ফেলে দিলো। নাফিসা উঠতে চেষ্টা করতেই মেঘ তাকে নিয়ে এক বালিশে এক কাথার নিচে শুয়ে পড়লো। কপালে একটা চুমু দিয়ে মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে বললো,
  • চুপচাপ ঘুমাও। নড়াচড়া করবে না একদম। তাহলে কিন্তু মাইর লাগাবো!
    নাফিসার হাত পা সব মেঘ দ্বারা আটকানো! বাধ্য হয়ে তার বুকেই মিশে থাকতে হলো। আবার সেই মিষ্টি গন্ধটা পাচ্ছে মেঘের শরীর থেকে! এ তো এক অজানা ভালো লাগা! এই গন্ধটা নাফিসাকে শান্ত হতে বাধ্য করছে!
    সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো খোলা আকাশের নিচে! সে কি এখনো ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে বুঝতে পারছে না! ঘুম ভাঙলে তো আকাশমুখী ঘরের চালা দেখতে পাবে! কিন্তু আকাশ দেখছে কেন! চালা কোথায় গেছে!

ঝটপট উঠে বসলো নাফিসা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে কোন এক পাহাড়ে ঘাসের উপর শুয়ে আছে! তার গায়ে পাতলা কাথাটা আছে! মেঘ মাথার নিচে দুহাত রেখে তার পাশেই শুয়ে আছে! মেঘ শুয়ে থেকেই মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে!

  • ঘুম ভেঙেছে তাহলে!
  • আমি এখানে কিভাবে?

মেঘ উঠে বসে বললো,

  • মেঘা, তোমার ঘুম অনেক গভীর। বাসা থেকে এপর্যন্ত নিয়ে এসেছি তবুও তোমার ঘুম ভাঙেনি! যদিও তোমাকে কোলে নিয়ে খুব সাবধানে হেটেছি যাতে ঘুম না ভাঙে! তবে ভয় একটা ছিলো, কোন লোকের সামনে পড়লে না জানি কি হতো! ভাগ্যিস এই ভোর বেলা কারো নজরে পড়িনি!
  • মানে! আপনি আমাকে বাসা থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন!
  • হুম।
  • কেন এনেছেন এখানে?
  • বলেছিলাম না, তোমাকে নিয়ে সূর্যোদয় দেখবো! এজন্যই এনেছি। এমনিতে বললে তো আসতে না, তাই এই কৌশল অবলম্বন করতে হলো।
  • এমন আযব মানুষও বসবাস করে দুনিয়ায়, জানা ছিলো না! যত্তসব!
    নাফিসা কাথা মুড়ে হাতে নিয়ে উঠতে গেলে মেঘ তাকে এক টানে আবার বসিয়ে দিলো। তার দুপায়ের মাঝে বসিয়ে পা দিয়ে আটকে ধরলো। হাত থেকে কাথাটা নিয়ে চাদর ন্যায় দুজনকে একসাথে জড়িয়ে নিলো কাথার ভেতর। পেছনে বসে নাফিসার কাধে থুতনি রেখে কানের কাছে মুখ এনে বললো,
  • এতো কষ্ট করে এতোটা পথ নিয়ে এলাম, উদ্দেশ্য সফল না হতেই এভাবে যেতে দেই কিভাবে! হুম? পূর্বাকাশে তাকাও মেঘা, আকাশ লাল হয়ে গেছে। সূর্য এখনই উদয় হবে।
    দুতিন মিনিটের মধ্যেই সূর্যের দেখা পেল! নাফিসা প্রথমে ছোটার জন্য ছটফট করলেও এখন স্থির হয়ে মেঘের বাহুডোরে বন্দী হয়ে বসে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজন সূর্যের দিকে! লাল সূর্য একটু একটু করে সম্পূর্ণ দেখা দিলো তাদের! নতুন আলো ছড়িয়ে আলোকিত করে দিলো এ ভুবন! সূর্যোদয় দেখার মাঝে এতো আনন্দ, এতো ভালো লাগা আছে সেটা এই প্রথম অনুভব করলো নাফিসা! সাথে কানে ভেসে আসছে ঝর্ণার শব্দ! কাধে পড়ছে মেঘের গরম নিশ্বাস! অতি ভালো লাগায় চোখে অশ্রু ঝরছে তার!

মেঘ নিজের ইচ্ছে পূরণ করতে পেরে খুবই আনন্দিত। এ তো তার বহুদিনের ইচ্ছে, প্রিয় মানুষকে সাথে নিয়ে সূর্যোদয় দেখবে! আজ তার পূর্নতা পেল! নতুন লাল সূর্য উপরে উঠে গেলে মেঘ নতুন নেশায় মগ্ন হয়েছে! একদিকে সূর্যোদয়, অন্যদিকে পাথরের উপর আছড়ে পড়া ঝর্ণার পানির শব্দ আর পাখিদের কলোরব! এতো ভালো লাগছে কেন মুহূর্তটা! দুজনকেই শিহরিত করে তুলছে! নাফিসার কাধ থেকে চুল সরিয়ে কাধে ঠোঁট ছুয়ে দিলো মেঘ। নাফিসা চোখ বন্ধ করে ফেললো এবং সাথে সাথে মেঘের জামা খামচে ধরলো! মেঘ চুলের মাঝে মুখ লুকিয়ে বললো,

  • ভালোবাসি মেঘা, খুব ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়!
    আরও কয়েক মিনিট তারা এভাবে বসে থেকে একসময় নাফিসা চোখ মুছে উঠে পড়লো। কাথা রেখেই ছোট ছোট কদম ফেলে হাটতে লাগলো। এই পাহাড় তাদের বাসা থেকে দূরে না! কিন্তু এদিকে বেশি আসে না নাফিসা। বাচ্চাদের পড়ায় বলে শুধু ওই ছোট পাহাড়ে যায়। মেঘ উঠে কাথা ভাজ করে হাতে নিয়ে নিলো। দ্রুত পায়ে নাফিসার কাছে গিয়ে হাত ধরে তাকে হামহাম ঝর্ণার পাশে নিয়ে গেলো। নাফিসা কোনো কথা না বলে মেঘ যেদিকে নিয়ে গেছে সেদিকে চুপচাপ গিয়েছে তার সাথে।

এখানে এসে মেঘ কাথাটা একটা ডালে ঝুলিয়ে রাখলো! টিশার্ট খুলেও কাথার সাথে রাখলো। এতো সকালে কোন লোকজন দেখা যাচ্ছে না এখানে! পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে আর ঝর্ণার পানি আছড়ে পড়ছে টিলা, পাথরের উপর! নাফিসা পাথরের উপর দাড়িয়ে শুধু দেখছে। মেঘ কি এখন এখানে গোসল করবে! প্যান্ট ফোল্ড করে মেঘ পানিতে পা রেখে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো নাফিসার দিকে।

  • এসো গোসল করবো একসাথে।
    নাফিসা চোখ বড় বড় মেঘের দিকে তাকালো! এতো সকালে গোসল! তাও এই ঝর্ণার পানিতে! কাপড়চোপড়ও তো আনেনি, গোসল করলে বাড়ি ফিরবে কিভাবে সেটা কি এই ছেলের মাথায় ঢুকেনি! একটা মেয়ে এতোটা পথ ভেজা কাপড়ে যাবে কিভাবে সেটা কি মাথাচাড়া দিচ্ছে না এই মানুষটার!
  • কি চিন্তা করছো এতো? লোকজন নেই তো এখানে। এসো
  • না আমি এখন গোসল করবো না।
  • গোসল তো তোমাকে করতেই হবে এখন আমার সাথে!
    নাফিসা সেখান থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও পারলো না! মেঘ তাকে টেনে পানিতে নামিয়ে দিয়েছে!
  • হচ্ছে কি এসব! বলেছিলাম না আমি গোসল করবো না!
  • হুশশ!

মেঘ তাকে নিয়ে খাড়া ঝর্ণার নিচে দাড়ালো। নাফিসা তবুও ভিজতে চাইছে না! মেঘ নাফিসার ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে নিয়ে খাড়া ঝর্ণার নিচে মাথা রাখলো! কয়েক সেকেন্ড থেকে মাথা সরিয়ে নিলো। নাফিসার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো! এটা কি ছিলো সে কিছুই অনুমান করতে পারছে না! মাথা ভনভন করছে! খাড়া ঝর্ণার পানি মাথায় আছড়ে পড়া, তারউপর মুখ বন্ধ করে পানির নিচে জোর করে এতোক্ষণ আটকে রাখা! একটুর জন্য মনে হচ্ছিলো এই বুঝি দম আটকে মরে যাচ্ছে! এসব কোন মানুষের কাজ! মানুষ কতটা জঘন্য হলে এমন কাজ করতে পারে! নাফিসা এখনো ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে না আর এদিকে মেঘের মুখে মুচকি হাসি। মেঘ নাফিসার কোমড় ধরে আছে, নাফিসা যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে! মেঘ তাকে তার বুকে ফেলে বললো,

  • ঘনঘন শ্বাস না নিয়ে, ধীরে ধীরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ো।
    মেঘের কথা মতো নাফিসা সেটাই করলো। এখন নিজের কাছে একটু হালকা মনে হচ্ছে। যখন বুঝতে পারলো নাফিসা স্বাভাবিক হয়ে গেছে তখন মেঘ তাকে নিয়ে গলা পানিতে নেমে গোসল করলো। কয়েকটি ডুব দিয়ে পানি থেকে উঠে এলো। নাফিসা ওড়না জড়িয়ে কাপছে। পুরো শরীর ভেজা, এখন বাসায় যাবে কিভাবে! রেগে মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,
  • বলেছিলাম গোসল করবো না, এখন ভেজা কাপড়ে বাসায় ফিরবো কিভাবে?
    মেঘ প্রতুত্তরে মুচকি হেসে ডাল থেকে কাথা নিয়ে চাদর ন্যায় নাফিসার গায়ে জড়িয়ে দিলো। এতে নাফিসার সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে গেছে! মেঘ বললো,
  • কোন ইচ্ছা জাগলে সেটা অপূর্ণ রাখতে নেই। পরবর্তীতে আফসোস করবে। আমি সবটা ভেবেই তোমাকে পানিতে নামিয়েছি। রাস্তায় বেশি মানুষ থাকবে না, এভাবে বাসায় যেতে পারবে। চলো।

মেঘ টিশার্ট গায়ে দিয়ে নাফিসাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো।


পর্ব – ২১

জংলী বেশে সজ্জিত অদ্ভুত লোক দুটো বৃষ্টিকে ধরে জঙ্গলের আরো গহীনে নিয়ে এলো! যদিও সে ভাবছে এরা ছদ্মবেশী তবুও বৃষ্টির খুব ভয় লাগছে! তারা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না! তাকে একটা বড় গাছের পাশে আনলো। দেখতে অনেকটা বট গাছের মতো, কিন্তু বট গাছ নয়! এখানে তাদের দলের আরও অনেকে আছে সবাইকে দেখতেই কেমন ভয়ানক মনে হচ্ছে। বৃষ্টিকে দেখে সবার ন
জর এখন বৃষ্টির দিকে! এভাবে তাকাতে দেখে বৃষ্টির খুব ভয় লাগছে! আরো দুজন এগিয়ে এসে বৃষ্টিকে নিয়ে একটা গাছের সাথে মোটা লতা দিয়ে বেধে ফেললো!

  • একি! বাধছেন কেন আমাকে! আমি কি করেছি! আরে!

বৃষ্টি এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে কিন্তু কোন জবাব পাচ্ছে না! লোকগুলো নিজেদের মধ্যে অন্যরকম ভাষায় কথা বলছে যার আগামাথা বৃষ্টি কিছুই বুঝতে পারছে না! এরা কোন দেশের মানুষ! কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে ওদের বসবাসের ধরন দেখে বৃষ্টি মনে মনে প্রশংসা করলো। এদের শুটিং একদম পারফেক্ট! কিন্তু তাকে বেধে রেখেছে কেন, সেটাই তার মাথায় ঢুকছে না! কেউ কেউ তার দিকে তাকিয়ে হেসে যাচ্ছে! বৃষ্টির ভয় লাগছে খুব! সূর্য ডুবে অন্ধকার হয়ে গেছে! তারা লাঠির সাহায্যে মশালে আগুন ধরিয়ে আলোকিত করেছে জঙ্গল! একটু পর দেখলো দুজন কাধে করে কি যেন এনেছে! দেখতে শেয়ালের মতো দেখাচ্ছে! রক্ত পড়ছে টুপটাপ!

কিছুক্ষণের মধ্যে তারা এটার চামড়া ছাড়িয়ে আগুনের উপর ঝুলিয়ে পোড়া দিতে শুরু করলো! বৃষ্টির এদিকে ভয়াবহ অবস্থা! এতোক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে এরা কোন শুটিং করতে আসেনি! এরা আসল জংলী! জীবনে কখনো জংলীর হাতে ধরা পড়বে ভাবতে পারেনি সে! ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে! এই প্রানীটার মতো কি তাকেও পুড়িয়ে খাবে এখন! ভাবতেই তার শরীরের সকল লোম দাড়িয়ে গেলো!

এদিকে আকাশ সোজা স্থানীয় থানায় এসেছে পুলিশের সাহায্য নেওয়ার জন্য। এই থানার দারোগা তার এক বন্ধুর বড় ভাই অর্থাৎ সে ও ভাই ডাকে। আর এই দারোগার সাথে পরিচয় বলেই এই জঙ্গলে থেকে শুটিংয়ের প্রস্তুতি নিয়েছিলো। যথাসম্ভব তারা তাদের শুটিং শেষও করতে পেরেছে। গতকাল জংলীরা এদিকে আসছে সেই আভাস দারোগাই দিয়েছিলো তাদের। আর সেজন্যই তারা আজ সব গুছিয়ে এখান থেকে চলে গেছে। কিন্তু এই বৃষ্টি মেয়েটা আবার সেই প্যাচে ফেললো! দারোগার কাছে সবটা ক্লিয়ার বলে সাহায্য চাইলো। আকাশকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখে তাই তারা রিস্ক নিতে রাজি হয়েছে। কয়েকজন পুলিশ নিয়ে তারা প্রস্তুত হয়েই জঙ্গলের দিকে গেলো।

এদিকে জংলীরা ঢাক ঢোল পিটিয়ে নাচছে আর রান্নার আয়োজন করছে! তা দেখে বৃষ্টির কলিজা শুকিয়ে গেছে আর কিছু না ভেবে সে মৃত্যুর সময় গুনতে লাগলো! এই বুঝি তাকে পুড়ে ছিড়ে খাবে জংলীগুলো! কেউ তো জানতেও পারবে না কিছু! ব্যাগ তার পিঠেই আছে আর ফোন ব্যাগে। কিন্তু কাউকে কিছু জানানোর সুযোগ নেই! হঠাৎই পুলিশ আসতে দেখে সে অবাক হলো! পুলিশ বন্দুক হাতে প্রস্তুত হয়ে এসেছে! আর পুলিশদের দেখে জংলীরা সাথে সাথে ধনুক নিয়ে প্রস্তুত!

জংলী পুলিশের যুদ্ধ হবে নাকি এখন! বৃষ্টি, কি হবে তা দেখার অপেক্ষায় রইলো। পুলিশ বারবার তার দিকেই তাকাচ্ছে। ইশারা বিশারায় জংলীদের কিছু বুঝিয়ে একটা বাক্স এগিয়ে দিলো। জংলীদের মধ্যে সরদার জংলীটা বাক্সটার ভেতরে দেখে অন্যজনকে কিছু ইশারা করলো আর অই ব্যক্তি এসে বৃষ্টিকে ছেড়ে দিলো। পুলিশ ডাকতেই বৃষ্টি তাদের কাছে চলে গেলো। খুব সাবধানে বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে তারা জঙ্গল থেকে বের হচ্ছে। বৃষ্টি এদিকে নানান প্রশ্ন করে যাচ্ছে পুলিশকে। বকবক করতে দেখে দারোগা তাকে ধমক দিলো। তারপর বৃষ্টি আর কোন কথা বলেনি, চুপচাপ তাদের সাথে যেতে লাগলো। আর মনে মনে বললো, ” বাহ! পুলিশ গুলো কতো ভালো! জংলীর হাত থেকে আমাকে বাচিয়েছে! আর যাই হোক, জংলীরা তো আর আমাকে খেতে পারবে না!”

খুশি মনে বৃষ্টি তাদের সাথে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গাড়ি চলাচলের রাস্তায় এসে থমকে গেলো! আরও দুজন পুলিশের সাথে পুলিশের গাড়ির সামনে পকেটে হাত দিয়ে আকাশ দাড়িয়ে আছে! এবার তার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার! আকাশই তাহলে পাঠিয়েছে পুলিশদের! কিন্তু আকাশ ই বা জানলো কিভাবে সে জঙ্গলে! এটাই ভাবছে বৃষ্টি। আকাশের সামনে এসে পুলিশ বললো,

  • জঙ্গলের আশপাশ ছেড়ে চলে যাও। আর ঘুরতেও এসো না এদিকে। দিনের বেলা ঘুরাফেরাও এখানে বিপদ।
  • ওকে, ভাইয়া। ধন্যবাদ।
  • হুম, যাও। গাড়িতে উঠো, স্টেশনের কাছে নামিয়ে দেই। সেখান থেকে অটোর সাহায্যেও চলে যেতে পারবে।
    পুলিশের গাড়িতে উঠলে তারা স্টেশনের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে সেখানে দুজনেই চুপচাপ দাড়িয়ে আছে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। আকাশের তো চোখের পলকই পড়ছে না আর বৃষ্টি তার দৃষ্টি বুঝতে পারছে না। কিন্তু সেও তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশ তাকে মিথ্যে বলে চলে আসায় রাগ, অভিমান, কষ্ট এক হয়ে তার চোখে অশ্রু হয়ে দেখা দিচ্ছে! এই বুঝি গড়িয়ে পড়বে!
আকাশের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে বৃষ্টি জঙ্গলের দিকে অর্থাৎ এই মাত্র যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে হাটা ধরলো। আকাশ এগিয়ে পেছন থেকে তার হাত ধরে টেনে সামনে ঘুড়িয়ে সাথে সাথে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো বৃষ্টির গালে! বৃষ্টি এক হাতে গাল স্পর্শ করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে!

  • সাহস কি করে হয় একা একা চলে আসার! এই জঙ্গলে ঢুকারই এতো সাহস আসে কোথা থেকে! এইটুকু শরীরে এতো জেদ এতো আবেগ কেন!
    বৃষ্টি আচমকা আকাশকে জড়িয়ে ধরলো। কাদতে কাদতে বললো,
  • জানি না। জানি না আমি কিছু! এসেছো কেন তুমি! ভালোবাসো না তো আমাকে। বাচালে কেন? খেয়ে ফেলতো জংলীরা আমাকে। মরে যেতাম আমি। তোমার তো কোনো ক্ষতি হতো না। পাঠালে কেন পুলিশদের? কেন এসেছো?
    রাস্তায় দাড়িয়ে বৃষ্টি আকাশকে জড়িয়ে ধরে কেদে চলেছে। আকাশ হাত উঠিয়ে শান্তনা পর্যন্ত দিচ্ছে না! পাথরের মতো দাড়িয়ে আছে! বৃষ্টি আকাশের শার্ট খামচে ধরে হু হু করে কান্না করতে করতে আবার বলতে লাগলো ,
  • এতো পাষাণ কেন তুমি! একটুও বুঝো না আমাকে? এই ভালোবাসি তো। জানো, তুমি মিথ্যে বলে আমাকে রেখে এসেছো আমার খুব কষ্ট লেগেছে। জঙ্গলে এসেও আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। ওই লোকগুলোকে দেখে আরও বেশি ভয় পেয়েছি যখন জানতে পেরেছি তারা আসল জংলী! ভেবেছিলাম আজকেই বুঝি আমার জীবনের শেষ দিন! বাবামায়ের কথা খুব মনে পড়ছিলো। তোমার কথাও বারবার মনে পড়ছিলো! ওরা আমাকে বেধে রেখেছিলো। ভেবেছি শেষ মুহুর্তে নিজের খবরটা পর্যন্ত কাউকে দিতে পারবো না। বাবামায়ের জন্য অনেক কষ্ট লেগেছে আমার। আমাকে না পেলে পাগল হয়ে যেতো বাবা-মা, ভাইয়া। ওরা খুব ভালোবাসে আমাকে। তুমি তো আমাকে একটুও ভালোবাসো না। তবুও আমি তোমাকে ভালোবাসি, আকাশ!
    বৃষ্টি কথা বলতে বলতে কান্না করেই যাচ্ছে। আকাশ এবার দুহাত উঠিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

আকাশ এক হাতে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে পকেট থেকে ফোন বের করে রূপার কাছে কল করে বললো,

  • রূপা, বৃষ্টিকে পেয়েছি। ও ভালো আছে। তোমরা কাল সকালের ট্রেনে অথবা বাসে ঢাকা ফিরে যেও। আমি বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে ফিরবো।
  • ওকে ভাইয়া। ওর সাথে একটু কথা বলতে পারবো?
  • ভয় পেয়ে বৃষ্টি নোনা পানিতে গোসল করছে। এখন কি সে তোমার সাথে কথা বলবে!
    রূপা কিছু বুঝতে না পারলেও বৃষ্টি বুঝতে পেরে হেসে উঠলো। আকাশের উপর হেলে থাকা অবস্থায়ই হাতটা বাড়িয়ে মোবাইটা হাতে নিয়ে বললো,
  • রূপা, পরে তোকে কল করে কথা বলবো। এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বায়
    বৃষ্টি কল কেটে নিজেই ফোন আকাশের প্যান্টের পকেটে রাখলো। আকাশ এবার বললো,
  • মনে হচ্ছে আমরা বিয়ের পর এখন আমাদের বেডরুমে অবস্থান করছি। তাই না?

বৃষ্টি লজ্জা পেয়ে ঝটপট আকাশকে ছেড়ে দিলো। তার খেয়ালই ছিলো না তারা এখন রাস্তার পাশে দাঁড়ানো! চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো।

  • কোথায় যাবো এখন? সিমি আপুরা কোথায় আছে?
  • মৌলভীবাজার। চলো।

বৃষ্টি মুখটা মলিন করে বললো,

  • ক্ষুধা লেগেছে খুব। সকালে যে খেয়েছি আর খাইনি সারাদিন।
  • খাবার কিনে দিয়ে এসেছিলাম না! খাও নি কেন?
  • রেখে এসেছো কেন আমাকে!
  • আমার কাছে টাকা কম। মৌলভীবাজার যেতে পারবো কিনা সন্দেহ! ডেবিট কার্ড রিজভীর কাছে দিয়েছিলাম। আর নিতে মনে ছিলো না। তোমার কাছে টাকা থাকলে চলো রেস্টুরেন্টে।
  • চলো।

দুজন হেটে হেটে স্টেশন থেকে একটু এগিয়ে এসে একটা রেস্টুরেন্টে এলো। খাবার অর্ডার করে খেয়ে নিলো। আকাশ খাবে না বললেও বৃষ্টি তার জন্য খাবার অর্ডার করেছে। যার ফলে তাকেও খেতে হয়েছে। খাওয়া শেষে ব্যাগ নেড়েচেড়ে বৃষ্টি বললো,

  • আমার পার্স কোথায়!
  • মানে!
  • পার্স পাচ্ছি না কেন! টাকা দিবো কিভাবে!
  • হোয়াট! পেট ভরে খেয়ে এখন এই কথা! টাকা দিবো কিভাবে এখন! আমি যে বললাম আমার কাছে টাকা নেই, তুমি আগে ব্যাগ চেক করে নিবে না!
  • আমি কি জানতাম নাকি! সমস্যা কি, তোমার কাছে যা আছে সেটা দিয়ে দাও।
  • এটা দিলে মৌলভীবাজার যাবো কিভাবে!
  • এখন খেয়ে ফেলেছি, টাকা না দিয়ে কি যেতে পারবো!
    রেস্টুরেন্টের লোক বিল উঠাতে এলে আকাশ সেই টাকাই দিয়ে দিলো। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে হাটতে লাগলো আর এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। বৃষ্টি বললো,
  • এভাবে কি দেখো?
  • কোনো কথা বলবা না। চুপচাপ থাকো। সবসময় একটা না একটা বিপদে ফেলে রাখো!
    বৃষ্টি মুখ গোমড়া করে রাস্তা পাড় হয়ে ওপাশে চলে গেলো। আকাশের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো। এতো টেনশনে ফেলে এখন আবার রাগ দেখানো হচ্ছে! ইচ্ছে মতো মাইর দিতে পারলে এখন শান্তি লাগতো! বৃষ্টি হনহন করে রাস্তার বিপরীত দিকে হাটতে লাগলে আকাশও ওপাশে চলে গেলো। আকাশকে তার দিকে আসতে দেখে বৃষ্টি আরও জোরে জোরে কদম ফেলতে লাগলো। আকাশও জোরে জোরে কদম ফেলছে। এক পর্যায়ে একটা দৌড় দিয়ে বৃষ্টি একটা রিসোর্টের ভেতর ঢুকে পড়লো।

আকাশ রেগে আগুন! চেনা নেই জানা নেই, হুট করেই এদিক সেদিক চলে যাচ্ছে! আকাশও দৌড়ে রিসোর্টে ঢুকলো। বৃষ্টি তাকে পিছু পিছু আসতে দেখে মুচকি হাসলো। সে ৯৯% নিশ্চিত ছিলো আকাশ তাকে একা ছাড়বে না। সে আসবেই তার সাথে। বৃষ্টি একেবারে রিসিপশনের পাশে এসে দাড়িয়েছে। আকাশ জিজ্ঞেস করলো,

  • এখানে এসেছো কেন?
    বৃষ্টি তার জবাব না দিয়ে রিসিপশনের ছেলেটিকে বললো,
  • এক্সিউজমি, আপনাদের রিসোর্টে কোন রুম ফাঁকা আছে? এক রাতের জন্য নিবো।
  • হ্যাঁ, ম্যাম। আছে।
    আকাশ বললো,
  • পাগল হয়ে গেছো তুমি!
    বৃষ্টি তার কথার প্রতুত্তর না দিয়ে লোকটির সাথে কথা বলে একটা রুম নিয়ে নিলো। টাকাও এডভান্স করে দিলো। আকাশ টাকা দেখে তার দিকে রেগে তাকালো! সে টাকা রেখে বলেছে তার কাছে টাকা নেই! বৃষ্টি রুমের চাবি নিয়ে আকাশের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ছো মেরে দৌড় দিলো। আর আকাশকে তার সাথে যেতে বললো। আকাশ ডাকলেও শুনলো না সে। নিরুপায় হয়ে তাকেই যেতে হলো। রুমে একটা বেড আছে আর তিন শেডের একটা সোফা আছে। আকাশ ধপাস করে সোফায় বসে পড়লো।
  • টাকা আছে তখন দাও নি কেন?
  • আজ এখানে থাকবো। কাল আশেপাশের জায়গা ঘুরবো তোমার সাথে, এজন্যই।
  • আসলে তুমি একটা পাগল! বেশি আদর দিয়ে তোমার বাবা-মা পাবনা পাঠাতে চেয়েছে তোমাকে।
    বৃষ্টি হিহি করে হেসে জবাব দিলো,
  • আর দেখো, বাসায় না জানিয়ে আমি সিলেট এসে পড়েছি! জীবনে ভাবতেও পারিনি জংলী দেখবো! আজ সেটাও দেখেছি!
    আকাশ লক্ষ্য করলো বৃষ্টির ভয় সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেছে।
  • টাকা দাও।
  • কেন?
  • আমি রুম ভাড়া করবো।
  • এক রাত থাকবো এর জন্য দুইটা রুম ভাড়া করতে হবে! শেষ সম্বল আর কিছু টাকা আছে, সেগুলো অযথা নষ্ট করবো না।
  • মানে কি! আমি এখানে থাকবো!
  • সমস্যা কি!
  • থাকবো না আমি। আমার টাকা আমাকে ফেরত দাও। তোমার জন্য আমার সব টাকা শেষ হয়েছে।
  • আমার জন্য মানে! তুমি আমার জন্য টাকা শেষ করলে কিভাবে?
  • জংলীরা কি তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছে!
  • ওহ! পুলিশ ওদের কিছু দিয়েছিলো। বাক্সে কি ছিলো?
  • পুলিশ কিছু দেয়নি। পুলিশের কথায় আমি কিনে দিয়েছি। বাক্সে মুরগী ছিলো। এই মুরগী কিনেই আমার টাকা শেষ!
  • ভালোবাসো আমাকে?
  • না।
  • তাহলে একা একা ছুটে এলে কেন আমাকে বাচাতে? আবার এতো টাকাও খরচ করলে!
  • লাগবে না তোমার টাকা, আমার ফোন দাও। বিকাশ থেকে টাকা উঠাবো।
    বৃষ্টি দরজা লাগিয়ে ফোন সহ ওয়াশরুমে যেতে যেতে বললো,
  • বেশি কথা বললে, ফোন এখন টয়লেটে ফেলে দিবো। আলাদা ব্যবস্থা করে দিবো, এখানেই থাকবে।

বৃষ্টি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলে আকাশ গেলো। বিছানার মাঝামাঝিতে কোল বালিশ রেখে বৃষ্টি একপাশে শুয়ে পড়লো। আকাশ ঘেমে যাওয়ায় শার্ট খুলে ফেললো। পড়নে তার সাদা সেন্টু গেঞ্জি! খাটে না শুয়ে সে সোফায় শুয়ে পড়লো। বৃষ্টির রাগ হলো এটা দেখে। এক রুমে থাকতে পারছে অথচ বিছানায় না! বিছানা তো আলাদা করে দিয়েছেই! হুহ্ ঢং! নিজেরা ঠিক থাকলেই তো সব ঠিক! ঠান্ডা লাগছে একটু একটু। রাত বাড়লে তো ঠান্ডা আরও বাড়বে! একটা পাতলা কম্বলে দুজন দুজায়গায় কিভাবে সম্ভব! বৃষ্টি উঠে গিয়ে কম্বলটা আকাশের গায়ে দিলো।

  • এটা এনেছো কেন? লাগবে না আমার, নিয়ে যাও।
  • আমি তো দেখতে পাচ্ছি লাগবে। তুমি এটা নাও, আমি বিছানার চাদর উঠিয়েই গায়ে দিতে পারবো।
    আকাশ আর কিছু বললো না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। বৃষ্টি এখানে দাড়িয়েই দেখছে তাকে। অর্ধেক শরীর ঢাকা তার। সাদা গেঞ্জি তে দারুণ লাগছে তাকে! লোভ সামলাতে না পেরে খুব দ্রুত কম্বল সরিয়ে আকাশের বুকে মাথা রেখে কম্বলের নিচে শুয়ে পড়লো। আকাশ হকচকিয়ে গেল!
  • এটা কি হচ্ছে! বৃষ্টি, উঠো!
  • উহুম!
  • উঠতে বলছি!
  • থাকি না একটু। এমন করো কেন!
  • আমি কিন্তু এখন রুম থেকে বেরিয়ে যাবো!
  • প্লিজ আকাশ। পাচ মিনিট থাকি৷ ওকে!
  • এক মিনিটও না। বেডে যাও।
  • মাত্র পাচ মিনিট। প্লিজ প্লিজ প্লিজ!
    আকাশ আর কিছু বললো না, শুধু ঘড়ির কাটা গুনতে লাগলো। আর বৃষ্টি চুপটি মেরে আকাশের বুকে কান পেতে তার হৃদস্পন্দন শুনতে লাগলো! এ তো এক অজানা অনুভূতি! এতো ভালো লাগছে কেন! এদিকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আকাশ ঘুমিয়ে পড়েছে। আকাশের বুকে, কম্বলের নিচে প্রচন্ড আরামে বৃষ্টিও ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে!

পর্ব – ২২

আজকের নতুন সকালটা খুবই আনন্দময় লাগছে বৃষ্টির কাছে। চোখ খুলেই সে আকাশকে দেখেছে। হাত পা সবকিছু তার দখলে নিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে আকাশ! আকাশকে খুব কাছ থেকে দেখছে বৃষ্টি। কপালে ভাজ ফেলে, মুখে সিরিয়াস ভাব এনে ঘুমায় সে। হাসিখুশির ছিটাফোঁটা নেই! বৃষ্টি মনে মনে ব্যাঙ্গ করে বললো, “হুহ্! ইউনিক লাইফ এনজয় করবে! করাচ্ছি তোমাকে ইউনিক লাইফ এনজয়! বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বোকা লোক! সমাজবিহীন মানব, একা থাকবে বললেই হলো!”

সারারাত এক কম্বলের নিচে সরু সোফায় দুজন ব্যাক্তি থেকেছে! বৃষ্টি লক্ষ্য করলো রাতে সে আকাশের উপর শুয়েছিলো, কিন্তু এখন সে আকাশের হাতে মাথা রেখে বুকের সাথে মিশে সোফায় শুয়ে আছে। পাতলা কম্বল দিয়ে আকাশ তাকে একেবারে আগলে রেখেছে।
একটু পরেই আকাশের ঘুম ভাঙলো। বৃষ্টিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলো! পরক্ষনেই মনে হলো বৃষ্টি পাচ মিনিটের কথা বলে সারারাত কাটিয়েছে তার সাথে! চোখমুখ কুচকে বললো,

  • শেষ হয়নি তোমার পাচ মিনিট?
    বৃষ্টি মুচকি হেসে জবাব দিলো,
  • না।
  • সারারাত কেটে গেছে এখনো পাচ মিনিট শেষ হয়নি! উঠো!
    আকাশ ধমক দেয়ায় বৃষ্টি বিড়বিড় করে বললো,
  • হুহ্! সারারাত আমাকে কোলবালিশ ন্যায় ব্যাবহার করেছে, প্রয়োজন শেষ এখন আবার দুর্ব্যবহার করছে!
    আকাশ খেয়াল করে দেখলো সত্যিই সে বৃষ্টির উপর হাত পা তুলে কোলবালিশ ন্যায় রেখে শুয়ে আছে! সাথে সাথে হাতপা সরিয়ে নিলো। হঠাৎ তাকে ছেড়ে দেয়ায় বৃষ্টি সোফা থেকে পড়ে যেতে নিলো আর খপ করে আকাশের গেঞ্জি ধরে ঝুলে রইলো।
  • কি করছো! পড়ে যাচ্ছি তো, ধরো!
  • আমার কি! গেঞ্জি ছাড়ো।
  • আশ্চর্য! আমি পড়ে যাচ্ছি তো!
    আকাশ খপ করে বৃষ্টিকে দু’হাতে ধরে তার উপরে তুলে সে বৃষ্টির নিচে পড়ে রইলো! এবার মৃদু স্বরে বললো,
  • উঠো।

বৃষ্টি মুচকি হেসে কম্বল সরিয়ে উঠে পড়লো। ফ্রেশ হয়ে তারা সকালেই রিসোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করে নিলো। বিল বৃষ্টিই দিলো। আকাশ মৌলভীবাজার যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করতে গেলেও বৃষ্টি বাধা দিয়ে জোর করে তাকে এ অঞ্চল ঘুরানোর জন্য রাজি করালো। দুপুরের দিকে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সেখানে চা বাগান ঘুরেছে, কলাবন ঘুরেছে, পানবন ঘুরেছে। হামহাম ঝর্ণার ধারে ঘুরেছে।

সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরেছে। ভালোই লাগছে আকাশের সাথে ঘুরাফেরা করতে! দুপুরে টংয়ে পাতানো হোটেলে লাঞ্চ করেছে। পাহাড়ি অঞ্চলের খাবারের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন! বিকেল হয়ে গেছে। পান বনের ভেতর দিয়ে হাটার সময় কোন শব্দ পেয়ে বৃষ্টি চমকে উঠলো! ঢাকঢোলের শব্দ ভেসে আসছে! আকাশকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

  • আকাশ, এটা কিসের শব্দ? এখানেও কি জংলী আছে?
  • এই ছোট ছোট বনে জংলীরা ঘুরে না। উপজাতিদের কোন প্রোগ্রাম হবে হয়তো।
  • চলো না যাই
  • সারাদিন ঘুরে এখন আবার প্রোগ্রামে! চুপচাপ চলো, না হয় আমি চলে যাই তুমি থাকো।
  • ওকে যাও, আমি দেখবোই সেখানে কি হচ্ছে!

বৃষ্টি আর অপেক্ষা না করে শব্দের অনুসন্ধানে সেদিকে দৌড় দিলো। তার বিশ্বাস আকাশ তাকে ফেলে যাবে না। একা ছেড়ে যাওয়ার হলে কাল তাকে খুজতে আসতো না! আকাশ না চাইতেও বৃষ্টির পিছু পিছু সেখানে গেলো। দেখলো বটবৃক্ষের নিচে গান, যাত্রাপালা আর মেলা বসেছে! উপজাতিদের কোন উৎসব আর দেখেনি বৃষ্টি! উল্লাসিত হয়ে সে আকাশের সাথে হাটছে। হাটতে হাটতে একসময় থমকে দাড়ালো সে! তার দৃষ্টিকে লক্ষ্য করে আকাশও তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে কারো দিকে তাকিয়ে আছে! সামনে একটা ছেলে তার সাথে একটা মেয়ে দাঁড়ানো! ছেলেটাও তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে! বৃষ্টির চেহারায় রাগ অভিমান স্পষ্ট!

আকাশের হাত ছেড়ে বৃষ্টি দৌড়ে গিয়ে মেঘকে জড়িয়ে ধরলো! মেঘও অবাক ও খুশি হয়ে বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরেছে! এদিকে আকাশ আর মেঘের পাশে দাড়িয়ে থাকা নাফিসা কিছুই বুঝতে পারছে না, শুধু হতবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে! বৃষ্টি মেঘকে ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে তাকে ইচ্ছে মতো মারতে লাগলো। বৃষ্টির মুখে হাসি আর চোখে কান্না! এদিকে মেঘ হাসতে হাসতে তাকে থামানোর চেষ্টা করছে!

  • শয়তান, ইতর, বান্দর! তুই আমাকে রেখে পালিয়ে এলি কেন! বলেছিলাম না এবার আমাকে সাথে নিয়ে ট্যুরে যেতে!
  • আরে থাম থাম, তুই এখানে কিভাবে?
  • তুমি এখানে কিভাবে?
  • আমি তো জানিয়েছিই সিলেট এসেছি। কিন্তু তুই না কুমিল্লা ছিলি!
  • তুমি সিলেট ঘুরবা আর আমি কুমিল্লা গিয়ে ঘোড়ার ঘাস কাটবো! বাবা এতোদূর আসতে দিতো না, তাই মিথ্যে বলেছি।
  • সাহস কতো বড়! কার সাথে এসেছিস?
  • ফ্রেন্ডদের সাথে।
  • দাড়া এক্ষুনি বাবাকে জানাচ্ছি।
  • মেরে ফেলবো একদম! ও কে? গার্লফ্রেন্ড নাকি?
  • তোর ভাবি।
  • হোয়াট! তুমি বিয়ে করে ফেলছো!
  • হুম।
  • ভাইয়া, সিরিয়াসলি!
  • হুম।
  • কবে?
  • গতসপ্তাহে।
  • ওএমজি! বাবা মা জানে?
  • না। বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে, বাবা মা কে জানাই নি এখনো। ঢাকা ফিরে জানাতে হবে।
  • এক্সিডেন্টলি মানে!
  • লম্বা ঘটনা। পরে বলি। মেঘা, ও আমার ছোট বোন বৃষ্টি চৌধুরী।
  • আসসালামু আলাইকুম ভাবি।
    নাফিসা এতোক্ষণ শুধু তাদের কথা শুনছিলো। এখন বৃষ্টি সালাম দেওয়ায় জবাব দিলো,
  • ওয়ালাইকুম আসসালাম।
  • তোমার নাম তো ভালোই মিলেছে ভাইয়ার সাথে! মেঘ আর মেঘা!
    মেঘ হালকা কেশে জবাব দিলো,
  • এহেম, এটা আমার দেওয়া নাম। ওর নাম, নূর নাফিসা।
  • ওরে বাবা! নতুন নামও দিয়ে দিছো! তবে নূর নাফিসা নামটাই কিন্তু বেশি সুন্দর! যাইহোক ভাবি কিন্তু মাশাল্লাহ অনেক সুন্দরী! স্থানীয়?
  • হুম।
  • ওয়াও! একটু একটু পাহাড়ি মনে হয়, আবার একটু একটু ঢাকাইয়া! যাইহোক, বছরে বছরে বেড়াতে আসতে পারবো!
    বৃষ্টি কথা বলে নিজেই হাসতে লাগলো। মেঘ বললো,
  • ঢাকা ফিরবি কবে?
  • অতি শীঘ্রই।
  • কোথায় উঠেছিস?
  • ভাসমান!
  • মানে?
  • মানে অনেক কিছু! আজ এখানে তো কাল ওখানে। আগে পরিচয় হও, ও হচ্ছে!
    বৃষ্টি পেছনে ফিরে দেখলো আকাশ নেই!
  • এ কি! আকাশ কোথায় গেলো!
  • আকাশ কে?
  • এখন আমার সাথে একটা ছেলে দাড়িয়ে ছিলো না? ও কোথায় গেছে?
  • ও তো এই মাত্র চলে গেলো।
  • ওফ্ফ শীট! কোন দিকে গেছে?
  • এদিকে। ছেলেটি কে?
  • ভাইয়া, পরে বলবো সব। আমি যাই এখন। পরে কল করবো তোমাকে!
    বৃষ্টি দৌড়ে ছুট দিলো। মেঘ পেছন থেকে বললো,
  • বৃষ্টি, বিয়ের কথা বাবা মা কে বলিস না কিছু। আমি ঢাকা ফিরে বলবো।
  • ওকে, আমি সিলেট এসেছি সেটাও জেনো না জানে।
  • ওকে!
    বৃষ্টি দৌড়ে মেলা থেকে বেরিয়ে এলো। মেঘের বলা কথা অনুযায়ী সে পান বনের দিকে এসে দেখলো আকাশকে অনেকটা দূরে দেখা যাচ্ছে! সে চেচিয়ে আকাশকে ডেকে দৌড় দিলো। আকাশ পেছনে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি সোজা দৌড়ে আসছে! সে চমকে গেলো! সে যেদিকে দৌড়ে আসছে, এখানে তো বড় ফাদ আছে! না জানি পড়ে যায়! আকাশ সেখান থেকেই বৃষ্টিকে থামতে বলছে কিন্তু বৃষ্টি না থেমে সোজা দৌড় দিচ্ছে! হঠাৎ করেই সে ফাদে পড়ে গেলো!

এদিকে মাটি ধসে পড়ে বড় ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে! বন পাতালতায় আচ্ছাদিত হওয়ায় দূর থেকে তেমন একটা দেখা যায় না! আর বৃষ্টিতো নিচে না তাকিয়ে সোজা দৌড়ে আসছিলো, সে দেখবে কিভাবে!
বৃষ্টিকে পড়ে যেতে দেখে আকাশ ভয় পেয়ে চিৎকার করে দৌড়ে এলো! এসে দেখলো বৃষ্টি মোটা গাছটার শিকড় ধরে ঝুলে আছে! নিচে পড়লে এখান থেকে উদ্ধার করা দায়! নিচে পানি জমে ময়লা পড়ে স্তুপ হয়ে আছে। কতটুকু গর্ত কে জানে! আকাশকে আসতে দেখে বৃষ্টি অশ্রুসিক্ত নয়নে তার দিকে তাকিয়ে শিকড় ধরে ঝুলে আছে। একটা পায়ে মাটি আঁকড়ে ধরেছে। আকাশ বসে নিচু হয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

  • হাত ধরো আমার। সাবধানে উঠার চেষ্টা করো।

বৃষ্টি তার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,

  • ভালোবাসো আমাকে?
  • বৃষ্টি, ফাজলামো করার সময় না। হাত বাড়াও।
  • মরে গেলে তোমার কি! তুমি তো আরও বাচো। তোমার পিছু পিছু কেউ ঘুরবে না, তোমাকে কেউ আর বিরক্ত করবে না!
  • বৃষ্টি, পড়ে যাবে। হাত বাড়াও।

বৃষ্টি আকাশের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চুপচাপ আগের ন্যায় ঝুলে আছে। তার শরীর কাপছে আকাশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এদিকে সে নিজেও কিছু করতে পারছে না! এই মেয়ে তো তার কথা শুনছে না একটুও! এবার মায়াবী কন্ঠে বললো,

  • এই পাগলী, ভালোবাসি তো হাত বাড়িয়ে দে!
    বৃষ্টি মুগ্ধ হয়ে তাকালো! আকাশ আবার বললো,
  • ভালো না বাসলে কি তোকে নিয়ে সারাদিন এভাবে ঘুরে বেড়াই! ভালোবাসি তো। উঠে আয় আমার কাছে!
    বৃষ্টির মনে উৎফুল্লতা জেগে উঠলো। সে খুব সাবধানে পায়ে মাটিতে ভর দিয়ে একটু উপরে উঠে আকাশের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। আকাশ হাত শক্ত করে ধরে খুব সাবধানে বৃষ্টিকে টেনে উপরে তুললো। হাত ধরে দুতিন কদম এগিয়ে বৃষ্টিকে সজোরে একটা থাপ্পড় মারলো! বৃষ্টি গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে! আকাশ চিৎকার করে বলছে,
  • মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর! এখন নিচে পড়ে গেলে কি হতো! কিভাবে উদ্ধার করতাম আমি! এই তোর পরিবার না তোকে খুব ভালোবাসে! তাদের কথা তোর মাথায় আসেনি! পড়ে মরে যাওয়ার কথা চিন্তা করলি কিভাবে! কিসের প্রেম নিয়ে পাগল হয়ে আছিস!

বৃষ্টি কাদো কাদো গলায় বললো,

  • লাইফে এতো জোরে তিনটা থাপ্পড় খেয়েছি! প্রথমটা তুমি দিয়েছো জঙ্গলে। দ্বিতীয়টাও তুমি দিয়েছো রাস্তায়! এখন তৃতীয়টাও তুমি দিয়েছো এই পান বনে! তবুও তোমাকে ভালোবাসি!
    আকাশ কষ্টের মাঝে মুখে হাসি ফুটিয়ে এক টানে বৃষ্টিকে তার সাথে মিশিয়ে নিলো! মাথায় চুমু দিয়ে বললো,
  • ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি! বিশ্বাস হয়েছে?

বৃষ্টি অতি সুখে কান্না করে যাচ্ছে আকাশকে জড়িয়ে ধরে। আকাশও খুব শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে তাকে! আজ বৃষ্টির সার্থকতা প্রকাশ পেয়েছে। আকাশ মুখ ফুটে বলেছে তাকে! আকাশের বুকে মুখ লুকিয়ে বৃষ্টি বললো,

  • জানি আমি, তুমি আমাকে ভালোবাসো। তা না হলে কি আর জঙ্গলে আমাকে জোর করে খেতে বাধ্য করো, আমাকে মাছ ধরতে দাও, এভাবে একা ছুটে আসো আমাকে খুজতে, নিজের টাকা খরচ করে জংলীদের কাছ থেকে আমাকে উদ্ধার করো! এভাবে আমার জোড়াজুড়িতে সারাদিন ঘুরে বেড়াও!
  • জানো যখন এতো পাগলামি করো কেন?
  • তুমি প্রকাশ করো না বলে!
  • হয়েছে তো এবার, চলো।
  • না হয়নি। চলে এলে কেন তুমি আমাকে ফেলে? ও আমার ভাইয়া ছিলো!
  • ভাইয়া ভাবির কাছেই তো দিয়ে এসেছিলাম। তো ফিরে এলে কেন!
  • আমি তো ভাইয়ার সাথে আসিনি!
  • আমার সাথেও তো আসোনি।
  • এসেছি ফ্রেন্ডের সাথে, তোমার সাথে যাবো। কতদিন থাকবে?
  • কালকেই চলে যাচ্ছি, চলো।
  • আমার পা ব্যাথা করছে, একটু জিড়িয়ে নেই।
  • সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, এখন সময় নষ্ট করা যাবে না। ওইদিকে রাস্তা, গাড়িতে উঠে যাবো।

পায়ে ব্যাথা নিয়েই আকাশের হাত ধরে হাটতে লাগলো! পান বন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে পড়েছে কিন্তু গাড়ি পাচ্ছে না! হাটার গতি আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। ফাকা রাস্তা, দু একটা বাস যাচ্ছে কিন্তু সিগনাল দিলেও থামছে না! এই জুতা পড়ে আর হাটতে পারছে না তাই জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিলো বৃষ্টি। পড়নে প্যান্ট আর কটি, গলায় পেচানো ওড়না, কাধে ব্যাগ হাতে জুতা। ভালোই লাগছে দেখতে। আকাশ তার দিকে তাকিয়ে তাকে দাড়াতে বললো। সে একটু এগিয়ে গিয়ে বৃষ্টির ছবি তুলে নিলো। বৃষ্টি আকাশের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে দৌড়ে তাকে তাড়া করলো! আকাশও দৌড়ে যাচ্ছে! বৃষ্টি হঠাৎ করেই রাস্তায় বসে পড়লো, আর হাটতে পারছে না! আকাশ পেছনে ফিরে বসে থাকতে দেখে তার কাছে এলো।

  • কি হলো?
  • আর পারছি না। পা ব্যাথা করছে খুব। এখানেই দাড়িয়ে অপেক্ষা করো।
  • গাড়ি কম আসছে, দেখছো না!
  • তাহলে দাড়াও, একটু জিড়িয়ে নেই।
    হঠাৎ করেই আকাশ তাকে কোলে তুলে নিলো। বৃষ্টি চরম অবাক! হা করে তাকিয়ে আছে আকাশের মুখের দিকে!
  • এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? এভাবে তাকালে আমি হাটতে পারবো না।

বৃষ্টি লজ্জা পেয়ে এক হাতে গলা জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ লুকিয়ে রেখেছে। আকাশ তাকে নিয়ে হেটে যাচ্ছে! অনেকটা পথ এসে থেমে গেলো,

  • নামো এবার। আর পারবো না।
  • কেন, আমি না এইটুকু একটা মেয়ে! এতটুকুতেই হাপিয়ে গেলে!
  • পাচ কেজি আর দশ কেজি তো না!
    বৃষ্টি হিহি করে হেসে বললো,
  • নামাও।
    আকাশ তাকে নামিয়ে বললো,
  • জুতা পায়ে দাও। না হয় কাটা ফুটবে আবার!
    বৃষ্টি তার কথায় জুতা পড়ে নিলো। একটা অটো আসছে দেখে সিগনাল দিলো কিন্তু অটোতে জায়গা নেই! ড্রাইভার তাদের বলে গেলো এখানে গাড়ি পাবে না, সামনে স্টেশন আছে সেখান থেকে গাড়ি নিতে। তারা হাটতে হাটতে স্টেশন থেকেই গাড়িতে উঠলো।

পর্ব – ২৩

চাকমা সম্প্রদায়ের যাত্রাপালা অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেয়ে নাফিসার সাথে উপস্থিত হয়েছে মেঘ। খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ভালোই লেগেছে। ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন রেসেপি আর ভিন্ন অনুভূতি! খুব উপভোগ করেছে মেঘ। নাফিসাকে নিয়ে মেলায় ঘুরার সময়ই বৃষ্টির সাথে দেখা হয়েছিল তার। বৃষ্টি চলে যাওয়ার পর নাফিসাকে নিয়ে চুরির দোকানে এলো। মেঘ জোর করায় অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নাফিসাকে মেঘের সঙ্গ দিতে হচ্ছে! একমুঠো লাল চুড়ি নিয়ে নাফিসার হাতে পড়াতে গেলে নাফিসা হাত মুঠ করে রাখলো।

  • আমি চুড়ি পড়বো না।

মেঘ তার হাতে জোরে চাপ দিতেই সে মুঠো ছেড়ে দিলো। আর মেঘ চুড়িগুলো পড়িয়ে দিলো।

  • খুললে খবর আছে তোমার!
    মেঘ দোকানীকে টাকা দিয়ে নাফিসার হাত ধরে আবার হাটতে লাগলো। জিজ্ঞেস করেছিলো আরও কিছু কিনবে কিনা, কিন্তু নাফিসার মুখ থেকে তো কোনো কথাই বের হয় না! মেঘ নিজের ইচ্ছাতেই মেলায় উঠা কিছু খাবার কিনে নিলো। নাফিসাকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছে মেঘ। প্রতিদিনের মতো আজও নাফিসাকে মেঘ দ্বারা আবদ্ধ হয়েই ঘুমাতে হয়েছে। আর যাইহোক, পুরুষ মানুষের শক্তির কাছে কি আর পারা যায়!

সকালে ঘরের সামনে উঠুনে বসে আম্মি মেঘের এনে দেওয়া মুরগীর লোম ছাড়াচ্ছিলো। নাফিসা পাশেই বসে পেয়াজ কেটে দিচ্ছে আর মেঘ ঘরে বসে বাবার সাথে ফোনে কথা বলছে। কয়েকটি জায়গা ঘুরে সে দেখেছে। বাবাকে ছবি পাঠিয়েছে। বাবা জানিয়েছে তিনি কাল সিলেট আসবে দেখতে। মেঘ বাবাকে বলে দিলো আসার সময় সাথে যেন ল্যাপটপটা নিয়ে আসে। বাবার সাথে কথা বলা শেষ হতেই নাফিসার আনন্দিত চিৎকার শুনিতে পেল মেঘ। নাফিসা “খালামনি” বলে চিৎকার করে দৌড় দিলো। মেঘ দেখলো কোন এক চাকমা মহিলা এসেছে আর নাফিসা আনন্দিত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে! পড়নে শাড়ি, যথেষ্ট স্মার্ট। বয়সে আম্মির মতোই হবে।

  • আদাব, খালামনি। কেমন আছো?
  • ভালো, আমার নাফিসা মনিটা কেমন আছে?
  • আলহামদুলিল্লাহ, তোমাকে দেখার পর এখন খুব ভালো।
    মেঘ দ্বিধায় পড়ে গেলো! নাফিসা ডাকলো খালামনি আবার বললো আদাব! এটা কেমন! কে উনি!
    মহিলাটি এগিয়ে আসতেই আম্মি বললো,
  • কেমন আছিস দিপা।
  • এইতো ভালো। তুই কেমন আছিস?
  • আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। দিয়াকে নিয়ে এলি না কেন?
  • দিয়া পৃথার বাসায় গেছে দুদিন হলো। বাসায় আর একা একা ভালো লাগছে না তাই ইচ্ছে হলো নাফিসার কাছে চলে আসি।
  • খুব ভালো করেছো। খালামনি আজ থাকবে তুমি।
  • আমার স্কুলে কে যাবে!
  • হেড টিচার তুমি। দুএকদিন ইচ্ছে করলেই মিস দিতে পারো।
    দরজার দিকে তাকিয়ে মেঘকে দেখে ডাকলেন রোকসানা।
  • মেঘ এসো এদিকে। এ হচ্ছে আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড দিপা চাকমা।
  • আদাব, খালামনি।
  • আদাব। কেমন আছো?
  • আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?
  • ভালো। চেনো নাকি আমাকে? খালামনি সম্মোধন করলে যে?
  • এই মাত্র চিনলাম, নাফিসা খালামনি ডাকায় আমিও ডেকেছি।
    দিপা হেসে বললো,
  • ওহ আচ্ছা! রোকসানার কাছে শুনেছি আমি তোমার কথা। দেখে তো আরও বেশি ভালো লাগলো। কি নাফিসা, তোমার সমস্যা কোথায়? মেঘ তো যথেষ্ট স্মার্ট, সুসজ্জিত, মার্জিত! তোমার সাথে দারুণ মানিয়েছে!

রোকসানা জবাব দিলো,

  • বুঝিয়ে যা একটু, আমি বুঝাতে বুঝাতে ক্লান্ত!
    নাফিসা মেঘের দিকে তাকালো একবার পরক্ষনে বললো,
  • খালামনি, ঘরে চলোতো। আগে বিশ্রাম নাও। কতোদিন দেখি না তোমায়, ঝুড়ি ভর্তি গল্প জমা আছে। চলো চলো
    নাফিসা টেনে দিপা খালামনিকে ঘরে নিয়ে গেলো। এদিকে মেঘ আম্মিকে বললো,
  • আম্মি, বাবা সিলেট আসবে কাল। বাবা যতদিন থাকবে আমি রিসোর্টে উঠবো। আর সুযোগ বুঝে বাবাকে বিয়ের কথাটা বলার চেষ্টা করবো।
  • হঠাৎ সিলেট কেন?
  • রিসোর্টে স্থাপনের জন্য ভালো একটা প্লেস খুজছিলাম। এ দুদিন ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বাবাও দেখতে আসবেন। পছন্দ হলেই কাজ শুরু করবে।
  • ওহ আচ্ছা। যা ভালো মনে করো তা ই করো।
  • কিছু লাগলে বলুন, আমি বাজারের দিকে যাবো।
  • না, কিছু লাগবে না।
    মেঘ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো এদিকে রোকসানা রান্না বসিয়েছে। নাফিসা তো খালামনিকে পেয়ে ভীষণ খুশি! মায়ের কাজে হেল্প করছে আর খালামনির সাথে গল্প করছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে মেঘের কথা বুঝাচ্ছেন খালামনি, আর বারবার নাফিসা প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথা বলছে। নাস্তা করে নাফিসা চা বাগানে যাওয়ার সময় খালামনিকে বারবার থেকে যেতে বলেছে।
    মেঘ একটু দেড়ি করেই বাসায় ফিরেছে। রোকসানা দিপার সাথে উঠুনের একপাশে চালতা গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসে কথা বলছিলো। মেঘকে আসতে দেখে দিপা বললো,
  • মেঘ, তোমার সাথে ঘুরতে যাবো। সময় হবে তোমার?

মেঘ একটু বিব্রত হলো! খালামনি তার সাথে ঘুরতে যাবে! তবুও হেসে বললো,

  • কোথায় যাবেন?
  • এদিকেই আশেপাশের অঞ্চল। নিয়ে যাবে না?
  • অবশ্যই। কখন যাবেন বলুন?
  • নাস্তা করেছো?
  • না।
  • আগে তুমি নাস্তা করো। তারপরই বের হবো।
    রোকসানা ঘরে চলে এলো মেঘকে খাবার দিতে। আর দিপা বেঞ্চিতেই বসে আছে। রোকসানার মুখটা দেখে কেমন যেন লাগছে মেঘের কাছে। কেদেছে বোধহয়! বান্ধবীকে কাছে পেয়ে মনের সুখ দুঃখ প্রকাশ করেছে হয়তো! মেঘের খাওয়া শেষ হতেই দিপা চাকমা মেঘের সাথে বের হচ্ছিলো। রোকসানা দিপার হাত ধরে মাথা নাড়িয়ে কিছু ইশারা করছিলো। দিপা বললো,
  • প্লিজ রোকসানা বাধা দিস না আমাকে। পরিবারের সদস্য হওয়া সত্তে সবটা জানা দরকার তার।
    মেঘ তাদের আলাপন কিছুই বুঝতে পারেনি। দিপা রোকসানাকে উপেক্ষা করে মেঘকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। দিপা হাটতে হাটতে মেঘের সাথে কথা বলছে।
  • তোমরা তো মনে হয় এক ভাই এক বোন। তাই না?
  • হ্যাঁ।
  • বাবা মা আছেন। তাই না?
  • হ্যাঁ।
  • জিজ্ঞেস করবে না আমি জানি কিভাবে?
  • নিশ্চয়ই আম্মি বলেছে।
    দিপা মৃদু হাসলো।
  • হুম, ধরতে পেরেছো তাহলে। মাস্টার্স কমপ্লিট তোমার?
  • হ্যাঁ।
  • বর্তমানে কি বেকার?
  • না, বাবার সাথে ব্যবসায়ে যুক্ত হয়েছি এক বছরের মতো হলো।
  • ওহ! আচ্ছা। তুমি এতোদিন ধরে এখানে পড়ে আছো এতে ক্ষতি হচ্ছে না সেদিকে?
  • বাবা সামলাচ্ছেন। কন্টাক্ট করা আছে বাবার সাথে, বারো মাসের একমাস আমার ছুটি থাকবে। অর্থাৎ প্রতিবছর লাং টাইম ট্যুরে যাবো। আর এখানেও সেই উদ্দেশ্যে আসা।
  • ট্যুর উদ্দেশ্যে এসে বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো তাই না!
  • এটা হয়তো ভাগ্যে ছিলো। তবে সম্পূর্ণটা ভাগ্যের দোষ না। আমার ইচ্ছেও ছিলো যদিও ধরনটা ভিন্ন হয়েছে।
  • জানাও নি কেন বাসায়?
  • সুযোগ হয়ে উঠছে না। হঠাৎ করে এমন কিছু শুনলে বাবা মা কষ্ট পাবে। কোন ইচ্ছার ত্রুটি রাখেনি তারা আমাদের দুই ভাইবোনের। আর আমাকে নিয়ে এমন কিছু তাদের কল্পনার বাইরে! ঢাকা ফিরে আমাকে সবটা খুলে বলতে হবে।
  • আমি কিছু কিছু জেনেছি কিন্তু সবটা আমার ক্লিয়ার না। নাফিসার সাথে তোমার পরিচয় কিভাবে?
  • এখানে বেড়াতে এসেই তাকে দেখেছি আমি। পাহাড়ে বাচ্চাদের পড়াচ্ছিলো। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু!
  • বাহ! প্রথম দেখা পাহাড়ে! এ তো দেখছি পাহাড়ে মেঘের ছায়া! আর সেখান থেকে একেবারে প্রেমের সূচনা!
  • হুম।

মেঘ মৃদু হাসলো। তারা কথা বলতে বলতে চা বাগানের পাশের রাস্তায় এসে পড়েছে। মেঘ রাস্তায় থেকে নাফিসাকে দেখালো। নাফিসাও একপর্যায়ে তাদের দেখতে পেয়েছে কিন্তু তারা দূরে থাকায় কথা বলতে পারেনি। তারা কথা বলতে বলতে আবার হাটতে লাগলো। দিপা চাকমা সেই পাহাড়ে যেতে চাইলে মেঘ নিয়ে এলো। এতোক্ষণে তিনি মেঘের কাছে মেঘ আর নাফিসার পরিচয়ের শুরু থেকে শেষ সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে নিয়েছেন। পাহাড়ে উঠে মেঘকে বললো,

  • তুমি অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারো। ভালো লেগেছে তোমার সাথে গল্প করে। আমি তোমার সাথে কেন ঘুরতে এলাম জানো তুমি?
  • জানি না, তবে অনুমান করতে পেরেছি কিছুটা। আপনি বোধহয় কিছু বলবেন আমাকে।
  • হুম, কিছু না। অনেক কিছু বলবো তোমাকে। আগে বলো, নাফিসাকে সবসময় আগলে রাখতে পারবে তো তুমি?
  • আপনি সম্পূর্ণ ঘটনা জেনেও হয়তো বুঝতে পারেননি নাফিসা এখনো আমার সাথে ফ্রী না। সে আমাকে মেনে নিতে রাজি না। এককথায় আমাকে বিরক্তিকর মনে করে সে। কেন এমন করে সেটা আমি জানি না। তবুও আমি বলবো, আমার জীবনের শেষ পর্যন্ত আমি তাকে মানানোর চেষ্টা করবো। চিন্তা শুধু একটাই, বাবা মা কে বুঝাতে পারবো কিনা কে জানে!
  • তুমি অনেক বুদ্ধিমান। নাফিসা কেন এমন করে আমি সেটাই জানাতে এসেছি তোমাকে। আমি একটা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। আমার স্কুল চালু থাকা সত্ত্বেও আমি তোমার সাথে কথা বলার জন্যই এসেছি। নাফিসা ও তার মা দুজনেই ঢাকার বাসিন্দা।
  • সেটা তাদের চেহারা দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি।
  • হুম তার কারণটা এবার জানো

পর্ব – ২৪

  • হুম তার কারণটা এবার জানো। ওরা যে বাসায় থাকছে ওটা আমার বাসা মানে আমার বাবার বাড়ি। বাবার চাকরির বদলিতে আমার পরিবার ঢাকা থাকতেন আর হাই স্কুল থেকে রোকসানা আমার ফ্রেন্ড। কলেজ পর্যন্ত পড়েছি একসাথে এরপর রোকসানা আর পড়েনি। নাফিসার বাবা আছে ঢাকাতেই। নাফিসার বাবার নাম সৈকত মির্জা। তার বাবা মায়ের লাভ ম্যারেজ। রোকসানার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার কিছুদিন আগেই পালিয়ে বিয়ে করেছে তারা। যার ফলে রোকসানাকে তার পরিবার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সৈকত তাকে নিজ বাসায় না নিয়ে ভাড়াটে বাসায় রেখেছে। বলেছিলো পরিবারকে ম্যানেজ করে বাসায় নিবে। একসময় সে জানায় পরিবার তাদের মেনে নিবে না তাই তাদেরকে ভাড়াটে বাসায়ই থাকতে হবে। রোকসানা এতে রাজি হয়েছে। সৈকত নিজ দায়িত্বে তাকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু রোকসানা আর ভার্সিটিতে ভর্তি হয়নি।

বিয়ের প্রথম বছরই তাদের কোলে নাফিসা এসেছে। নাফিসার নামটা তার বাবাই রেখেছে। মির্জা নূর নাফিসা। খুব আদর করতো মেয়েকে। আমি আমার শিক্ষাজীবন ঢাকাতেই শেষ করেছি। সেখানেই ভাড়াটে বাসায় থাকতাম আমিও। সেটা তাদের বাসা থেকে একটু দূরে ছিলো। দিনকাল তাদের ভালোই চলছিলো। সৈকত একটা কোম্পানিতে চাকরি করতো কিন্তু বেতন নাকি অল্প পেতো! এই অল্প উপার্জনে তাদের সুখের সংসার চলতো। মাঝে মাঝে সে তার নিজ বাড়িতে থাকতো আবার মাঝে মাঝে রোকসানার কাছে।

এভাবে আট বছর কেটে যায়। পাচ বছর বয়সে নাফিসাকে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করা হয়। সাত বছর বয়সে যখন ক্লাস টু তে পড়ে নাফিসা, হঠাৎ করেই সৈকতের এ বাড়িতে আসা বন্ধ হয়ে যায়! রোকসানা কল করে তাকে পায়না! সে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে! তার বাসা সে চিনতো, বড়লোকের ছেলেই সে। যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার দুদিন পরই নাফিসাকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে সে তার বাড়িতে যায়। বাড়ির গেইটে নক করতেই এক মহিলা বেরিয়ে আসে। বয়স তার চেয়ে বড়জোর চার পাচ বছর বেশি হবে! মহিলাটি বলে,

  • কে আপনি? কাকে খুজছেন?
  • জ্বি, এটা কি সৈকত মির্জার বাড়ি?
  • হ্যাঁ।
  • তিনি কি বাসায় আছেন?
  • উনি বাবার সাথে একটু হসপিটালে গেছে।
  • হসপিটালে কেন?
  • চারদিন আগে তার একটা এক্সিডেন্ট হয়। পায়ে একটু আঘাত পেয়েছে ওটারই ট্রিটমেন্ট করাতে গেছে। আপনি উনাকে খুজছেন কেন?
  • একটু দরকার ছিলো।
  • তাহলে ভেতরে এসে বসুন। এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে।
  • আপনি কে হন উনার?
  • আমি উনার স্ত্রী।
    কথাটা শুনে রোকসানার মনে হচ্ছে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে! সে নিজেকে শক্ত করে বললো,
  • উনি বিয়ে করেছেন কবে?
  • জ্বি, আমাদের বিয়ে হয়েছে তেরো বছর চলছে।

ঠিক তখনই স্কুলের ড্রেস পড়া এক মেয়ে এসে ঢুকলো রোকসানার পাশ দিয়ে আর সেই মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

  • মা, বাবা আর দাদু কি এখনো আসেনি?
  • না এসে পড়বে। যাও তুমি, ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হও। আপা আপনি আসুন ভেতরে।
    রোকসানা জিজ্ঞেস করলো,
    -ও কি আপনার মেয়ে?
  • জ্বি।
  • ছেলেমেয়ে কয়জন আপনার?
  • আল্লাহ একজন মেয়েই রেখেছে আমার ভাগ্যে। একি! আপনার মেয়ের চোখে পানি কেন? কি হয়েছে মামনি তোমার?
    রোকসানা মহিলাটির কথায় নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা গাল ফুলিয়ে চোখে পানি নিয়ে রেগে আছে! সেও আর ভেতরে না গিয়ে সেখান থেকে নাফিসাকে নিয়ে চলে এলো। বাসায় ফিরে রোকসানা নিজের কষ্ট চাপা রেখে নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
  • কি হয়েছে মা? তুমি রেগে আছো কেন?
  • আম্মি, আব্বুর বউ না ওই আন্টিটা? আব্বু আরেকটা বিয়ে করেছে না? আব্বু আমাকে রেখে ওই আপুটাকে চকলেট কিনে দিয়েছে না?
    এইটুকু মেয়ে এতোকিছু বুঝে গেছে আর সেই কষ্টে চোখে পানি এনেছে সেটা দেখে রোকসানা নিজের কষ্ট চাপা রাখতে পারেনি!

রোকসানা মেয়েকে জড়িয়ে সেদিন হাউমাউ করে কেদেছে! সেদিন বিকেলেই সে নাফিসাকে নিয়ে আমার বাসায় এসেছে আমাকে সবটা বলে অনেক কেদেছে আমার কাছে! কোন আশ্রয়স্থল নেই তার! আমি তাকে শান্তনা দিয়ে সৈকত সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখি সত্যিই সে বিয়ে করেছে। ঘরে বউ রেখেই সে রোকসানাকে বিয়ে করেছে। আমি একজন বান্ধবী না, তাকে আমার বোনের মতো দেখেছি। সেও আমার সাথে বোনের সম্পর্ক গড়েছিলো। সৈকতের সাথে সরাসরি কথা বলতে চেয়েছিলাম আমি কিন্তু রোকসানা সেটা হতে দেয়নি। সে এই প্রতারকের নাম মুছে ফেলতে চেয়েছে নিজের জীবন থেকে। সে চেয়েছে নাফিসাকে এতিমখানায় দিয়ে নিজের জীবন শেষ করে দিবে। আমি তাকে বুঝিয়ে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি।

বিপদের সময় যদি পাশে না দাড়াতে পারি তাহলে কিসের বোন আর কিসের বন্ধু হলাম! এখানে এসে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি তারপর থেকে সে জীবিকা নির্বাহের পথ ধরে। আমার ভাইয়া ঢাকাতেই থাকে আর আমি আমার শশুর বাড়ি। এই বাড়িতে এখন রোকসানা থাকে আর তার আপন বলতে এখন সে আমাকেই মানে। বলেছিলাম তাকে বিয়ে করতে কিন্তু সে তার মেয়েকে নিয়েই বাচতে চেয়েছে, চা বাগানে কাজ করে নতুন সংসার বেধেছে। এসএসসি পরীক্ষার পর থেকে গত দুবছর যাবত মাকে অব্যাহতি দিয়ে নাফিসা নিজে সংসারের হাল ধরেছে। নাফিসা তার বাবার প্রতারণা দেখে কোন পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করে না আর তাই সে তোমার সাথেও এমন করে।

আর ঢাকার মানুষতো একদমই দেখতে পারে না! তোমাদের বিয়ের দিনের ঘটনা আমি সেদিন রাতেই শুনেছি কিন্তু সিলেট না থাকায় আসতে পারিনি। মানুষ সবাই সবার জীবন নিয়ে ব্যস্ত! আমি ওদিকে সব ফেলে রেখে সময় করে ছুটে এসেছি তোমাকে জানানোর জন্য। রোকসানা বারবার নিষেধ করছিলো কিন্তু আমার মনে হয়েছে সবটা তুমি না জানলে নাফিসাকে মানাতে পারবে না। তোমার ভেতর আমি চেষ্টা দেখেছি। তোমার কাছে সবটা বলে এখন নিজেকে হালকা লাগছে আমার। পারবে তুমি মেয়েটার জীবন রাঙিয়ে দিতে?

  • আমি তো সেই প্রথম থেকেই চেষ্টা করছি এখন সবটা জেনে আমার রাস্তা ক্লিয়ার। ইনশাআল্লাহ আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবো। কিন্তু নাফিসার চেহারা একটু একটু চাকমাদের মতো দেখায় কেন?

দিপা মুচকি হেসে বললো,

  • পরিবেশের কারণে এমনটা হয়ে থাকে। সে তো ছোট থেকেই এ অঞ্চলে আছে, তাই স্থানীয়দের মতো অনেকটা।
  • অহ! কিন্তু আম্মি জানাতে চায়নি কেন আমাকে?
  • নিজেদের বিষয়ে অন্যকাউকে জানাতে ইচ্ছুক নয় তাই চাপা রাখতে চেয়েছে। অনুরোধ একটাই, ধোকা দিয়ো না নাফিসাকে।
  • আরে কি বলছেন! আপনি আমার বড়, অনুরোধ করবেন কেন! আপনি সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন। আমি কোনোভাবে তাকে ধোকার সম্মুখীন হতে দিবো না। পাহাড় থেকে নেমে অন্যদিকটায় ঘুরবেন?
  • না, চলো বাসায় ফিরে যাই।
    মেঘ দিপা চাকমার সাথে বাসায় ফিরে এলো। বিকেলে দিপা চাকমা চলে যেতে চাইলে নাফিসাও তার সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলো। নাফিসার মা নিষেধ করলো কিন্তু দিপা চাকমা বললো,
  • চুপ থাক তুই। অনেকদিন হলো মেয়েটা আমার সাথে থাকে না। যাবে সে আমার সাথে।
  • দিপা কি বলছিস তুই! মেঘ এখানে আর সে বেড়াতে যাবে!
  • সমস্যা কি? মেঘও তো সাথে যাবে।
    মুহূর্তেই নাফিসার মুখ মলিন হয়ে গেছে! সে তো মেঘ থেকে বাচতেই এখান থেকে পালাতে চাইছে! এখন মেঘও তার সাথে যাবে! নাফিসার মলিন মুখ দেখে মেঘ মুচকি হেসে বললো,
  • খালামনি আমি যাবো না। আমার কিছু কাজ আছে। নাফিসা যেতে চাইলে আপনি নাফিসাকে নিয়ে যান।
  • সে কি কথা! নতুন বউ একা একা ঘুরবে কেন! তুমিও যাবে সাথে।
  • না, কাজটা একটু ইম্পর্ট্যান্ট। যেতে পারছি না।
  • আচ্ছা তাহলে নাফিসা দ্রুত তৈরি হয়ে নাও।
    মেঘ যাবে না তাই, নাফিসা খুশি মনে জামাকাপড় গুছিয়ে খালামনির সাথে চলে গেলো।

বৃষ্টি আকাশের সাথে মৌলভীবাজার চলে এলো। সিমি আপুর সাথে দেখা হতেই উৎফুল্ল হয়ে জড়িয়ে ধরলো আপুও অনেক খুশি হয়েছে বৃষ্টিকে দেখে! রিজভী বলে উঠলো,

  • ঝড়বৃষ্টি যেতে না যেতেই এতো তারাতাড়ি চলে এলো!
  • কথা বলবেন না আমার সাথে! আপনারা সবাই খুব খারাপ! সবাই জানতেন আমাকে মিথ্যে বলে রেখে আসবে অথচ কেউ একবারও বলেননি!
    সিমি বললো,
  • আমি তো বলতে চেয়েছিলাম, আকাশের জন্য পারিনি!
  • না বলে ভালোই করেছো!
  • কেন?
  • তা না হলে কি আর জংলী দেখতে পারতাম!
    ঝুমুর হাসতে হাসতে বললো,
  • জংলী তো আগেই দেখেছো, জংলীর সাথে থেকেছও।
    আকাশ জবাব দিলো,
  • এই জংলী না, জঙ্গলের প্রকৃত জংলী দেখে এসেছে!
    সবাই চমকে একসাথে বলে উঠলো,
  • হোয়াট!
  • হ্যাঁ, কাল ফ্রেন্ডের কাছে দিয়ে আসতে পারিনি। সেখান থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের ভেতর চলে গেছে আর আটকা পড়েছে জংলীদের হাতে। পুলিশ দিয়ে মুরগী পাঠিয়ে ফিরিয়ে এনেছি। আরেকটু দেড়ি করলে হয়তো জংলীদের পেটে খুজতে হতো!

সবাই অবাকের শীর্ষ পর্যায়! তারা এক একজন এক এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বৃষ্টিকে ক্লান্ত বানিয়ে ফেলছে!
কিছুক্ষণ পর সবাই একসাথে ডিনার করলো। সিমি বৃষ্টিকে নিয়ে ছাদে চলে এলো।

  • বৃষ্টি, সত্যি করে বলোতো কি হয়েছে? তুমি আজ এতো খুশি কেনো? আকাশও দেখলাম ভালো বিহেভ করছে তোমার সাথে!
  • বুঝতে পারোনি কিছু?
  • উহুম!
  • আই এম সাক্সেস ফুল! আকাশ আজ আমার প্রতি তার লুকানো ভালোবাসা প্রকাশ করে দিয়েছে!
    বৃষ্টির কথা শুনে সিমি হা করে আছে আর বৃষ্টি মিটিমিটি হাসছে!
  • সত্যি! হাউ দিস পসিবল!
  • আকাশকে জিজ্ঞেস করো, বিশ্বাস হয়ে যাবে।
  • আমি কিন্তু অনেক এক্সাইটেড!
  • হিহিহি আমিও!
  • কাল রাতে থেকেছো কোথায়?

সেখানকার রিসোর্টে একটা রুম নিয়েছিলাম।

  • একটা রুম! আকাশ কোথায় থেকেছে?
    সিমিকে উৎফুল্ল হতে দেখে বৃষ্টি কথায় আরও মধু মাখিয়ে বললো,
  • এক রুমে এক সোফায় এক কম্বলের নিচে দুজন থেকেছি।
  • কি বলছো তুমি এসব! আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি! না, তুমি পাগল! এ টু জেড বলো।
    বৃষ্টি সব ঘটনা বললে, সিমি অবাক হয়ে আছে!
  • এক দিনেই এতোকিছু!!! শেষ পর্যন্ত এই পিচ্চিটাই জিতে গেলো!
  • আচ্ছা অথৈ আপুর কি একটুও হিংসে হচ্ছে না?
  • উমম! মে বি না।
  • কেন?
  • এই মেয়ে, সবার লাইফেই কেউ না কেউ আছে। অথৈ কি এখনো আকাশের জন্য বসে আছে নাকি! তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
  • ওহ!

পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,

  • আরও কিছু বাকি আছে বলার?
    দুজনেই পেছনে ফিরে দেখে আকাশ! বৃষ্টি জ্বিভ কেটে তাকিয়ে আছে! আর সিমি হেসে তাদের নিয়ে মস্করা শুরু করেছে। আকাশ বৃষ্টির দিকে নিজের ফোন এগিয়ে দিতেই বৃষ্টি বললো,
  • আমি কি করবো?
  • দাদু কথা বলবে।
  • দাদুকেও সবটা বলে দেই?
    আকাশ বিরক্তি দৃষ্টিতে তাকালো আর বৃষ্টি হিহি করে হেসে ফোন নিয়ে দাদুর সাথে কথা বলতে লাগলো।

পর্ব – ২৫

বাকিরাও সবাই এসে গেছে ছাদে। অনেক্ক্ষণ যাবত আড্ডা দিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো। বৃষ্টি নামছে না দেখে আকাশ আবার তার কাছে এলো।

  • দাড়িয়ে আছো কেন?
  • ভালো লাগছে এখানে থাকতে।
  • ঠান্ডা লাগছে না?
  • হুম, একটু একটু। তবুও ভালো লাগছে।

বৃষ্টি পা ঝুলিয়ে রেলিংয়ে উঠে বসে পড়লো। তার দেখাদেখি আকাশও পাশে বসলো।

  • বৃষ্টি তুমি কি বুঝতে পারছো, আমাকে নিয়ে তোমার মনে যেটা আছে সেটা শুধু মাত্র আবেগ। কয়দিন গেলেই দেখবে আর ভালো লাগছে না। আমরা লাইফ নিয়ে খেলতে জানি না কিন্তু লাইফ আমাদের নিয়ে খেলা করে। এই ভালো লাগে এই খারাপ লাগে! কিন্তু চোখের সামনে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও তা আমাদের চোখে পড়ে না। আমরা সেটার পেছনেই দৌড়াতে থাকি। তার চেয়ে ভালো নয় কি ভেবে আগে থেকেই সে পথ থেকে সরে যাই?
  • কি বুঝাতে চাইছো তুমি? আমার এই অনুভূতি কি তোমার কাছে শুধুই আবেগ মনে হচ্ছে? আর কিছু খুজে পাচ্ছো না তুমি আমার মাঝে? এটা কি তোমার মাথায় একটুও হানা দিচ্ছে না, তোমাদের সাথে তো আরও অনেক ছেলে ছিলো তবুও তোমার প্রতিই আমার নজর পড়েছে কেন? কই তাদের প্রতি তো আমার কোনো ফিলিংস নেই! তুমি যে একটা পাষাণ সেটা জেনেও আমি এখনো তোমাকেই চাই। এতোটা হার্ট করো কেন আমাকে? বলো ওকে আমাকে তোমার ভালোবাসতে হবে না,

তোমার জীবনে অন্য কাউকে আনো যাকে নিয়ে তুমি ভালো থাকবে। খুব তো ভালো জ্ঞান দিতে পারো অন্যকে, আর তোমার মাথায় এটা ঢুকছে না একটা মানুষ কোন পরিবেশে বসবাস করে? আজ তোমার বন্ধুবান্ধব সাথে আছে তাই তোমার এই জীবনটা ভালো লাগছে। কদিন পর তো তারাও নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কি পারবে তখন এভাবে বাচতে? ভেবে দেখো না, আজ এখানে যদি তুমি একা থাকতে এতোটা এনজয় করতে পারতে একা একা? বোরিং লাগতো না? জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটিতে নাকি পড়ে, হুহ্! প্রিন্সিপাল কেন যে এই ব্যক্কলকে ভার্সিটিতে রাখছে এখনো!

রাগে বৃষ্টির গা ঝিমঝিম করছে! অন্যদিকে তাকিয়ে সে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। বিরক্ত লাগছে পাশে বসে থাকা স্টুপিডটাকে, তার চিন্তা ধারণা সব বিরক্ত লাগছে। আর এদিকে আকাশ একটু চেপে বৃষ্টির গা ঘেঁষে বসে পেছন দিক দিয়ে বৃষ্টির ওপাশে রেলিংয়ে হাত রাখলো। হঠাৎ করেই আকাশ গান ধরলো,

নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি তোমায় ভালোবাসি

তুমি আমার প্রানপাখি, মৃগনয়না তোমার আঁখি
তাই পলকে পলকে শুধু তোমাকেই আগলে রাখি।
তোমায় ভেবে ভেবে কেটে যায় সাজের বেলা
নীলাম্বরে জমেছে দেখো লাখো তারার মেলা!
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি তোমাকেই ভালোবাসি

ঝিকিমিকি জ্বলছে দেখো, কত শত জোনাকির আলো!
অনুরাগে অভিমানে, অশ্রুপাতে লাগে কি আর ভালো।
ভালোবাসা কি, তা যদি তুমি জানো,
অভিমান ভেঙে বলছি তো এবার শুনো!
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি
লাখো স্বপ্ন, লাখো ইচ্ছে

বুনেছি যত, সবই তোমায় ঘিরে।
ছোটবড় সব ভ্রান্তি নিয়ে
কভু হারিয়ে যাবো, আবারও আসবো ফিরে।
কারণ শুধু একটাই ওগো প্রেয়সী!
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি যে এই তোমাকেই ভালোবাসি

  • রাইটার, সুরকার, গীতিকার সবটাই আমি নিজে। কেমন হয়েছে?
    বৃষ্টি জবাব না দিয়ে শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার মুখে তাকিয়ে আছে। আকাশ মুচকি হেসে নেমে পড়লো রেলিং থেকে। একটা হাত বাড়িয়ে দিলো বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টি তার হাত ধরে নেমে দাড়ালো। তার চোখে এখনো পানি। অশ্রু কমার বদলে আরও বেশি ঝরছে! সে আচমকা আকাশকে জড়িয়ে ধরে বললো,
  • ভালোবাসি আকাশ। খুব ভালোবাসি।

আকাশও তাকে বেধেছে বাহুডোরে। বৃষ্টি আকাশের বুকে মাথা রেখে পরম আবেশে চোখ বুজে আছে। কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই আকাশ বললো,

  • রাত বেড়ে গেছে অনেক, চলো ঘুমাবে।
  • আজকের রাতটাও তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবো।

আকাশ স্তব্ধ তার কথা শুনে! এই এক সমস্যা! মেয়েটাকে একটু আস্কারা দিলে একেবারে মাথায় চড়ে বসে! এতো বুদ্ধিমতী অথচ ন্যূনতম বোধটুকু কি তার মাঝে নেই! বিয়ের আগে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কিভাবে একসাথে রাত কাটাতে পারে! আকাশ এ নিয়ে কিছু না বলে বৃষ্টিকে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে এলো। ঝুমুরদের রুমের সামনে এসে বৃষ্টিকে যেতে বললো। বৃষ্টি বললো,

  • প্লিজ আকাশ, কাল তো চলেই যাবো। একটা রিকুয়েষ্ট রাখো।
  • ভেতরে যাও।
  • প্লিজ, চলো আজ রাতটা ছাদেই কাটিয়ে দেই।
    আকাশ দরজা ঠেলে নিজেই বৃষ্টিকে রুমের ভেতর ঠেলে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিলো। ভোরে এসে খুলে দিয়ে গেছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সবাই নাস্তা করতে এলো। আকাশ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলো চোখমুখ কেমন যেন দেখাচ্ছে! জঙ্গলে যেদিন থাপ্পড় দিয়েছিলো তার পরদিন এমনটা দেখাচ্ছিলো তাকে! সে কেদেছে কাল রাতে! বৃষ্টি মুখ ফুলিয়ে রেখেছে! কথা বলছে না কারো সাথে তেমন! আকাশের সাথে তো একেবারেই না! অল্প খাবার খেয়ে সে উঠে পড়েছে। বাকিরা খাওয়াদাওয়া শেষ করে একটু বাইরে হাটার জন্য বের হলো। চা বাগান ঘুরে একটু পর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। চা বাগানে আসতেই আকাশ বৃষ্টিকে টেনে এক পাশে নিয়ে গেলো। বৃষ্টি চুপচাপই আছে, ভালো মন্দ কিছুই জিজ্ঞেস করছে না! আকাশ বললো,

  • এমন মুখ ফুলিয়ে আছো কেন? রাতে ঘুমাও নি?
    বৃষ্টি কোনো জবাব দিচ্ছে না। আকাশ আবার বললো,
  • আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি কানে কথা যাচ্ছে না? ঘুমাও নি কেন রাতে?

বৃষ্টি আকাশের হাত ছাড়িয়ে আবার তাদের কাছে চলে গেলো। রিসোর্টে ফিরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ট্রেনের টিকেট কেটেছে তারা। এগারোটায় তাদের যাত্রা শুরু হলো। ট্রেনে উঠে বৃষ্টির খুব আনন্দ লাগছে। কিন্তু প্রকাশ করছে না। একটা কেবিন বুক করেছে তারা। আটজন হওয়ায় কেবিন এমনিতেই ফুলফিল! ঝুমুর অথৈ একসাথে, অভ্র রিজভী একসাথে বসে পড়েছে। বৃষ্টি জানালার দিকে বসেছে। সিমি আর রওনক তো একসাথে বসবে তাহলে কি আকাশ তার সাথে বসবে! আকাশ যেন না বসতে পারে তাই বৃষ্টি সিমিকে ডেকে বললো তার পাশে বসতে। সিমি এসে বসা মত্রই আকাশ এসে বললো,

  • এই তুই এই সিটে কি করছ? তোর জামাই একা একা বসে বিরহের গান গাইছে। যা ওইদিকে।

রওনক বিপরীত সিটে বসে হাসছে। আর সিমি জবাব দিলো,

  • এইটা বললেই পারিস, তুই তোর গার্লফ্রেন্ড এর সাথে বসবি।
  • জানিস যেহেতু বসলি কেন?
  • হুহ্, যাচ্ছি।

বৃষ্টি কিছু বলতে পারলো না। সিমি উঠে গেলো আর আকাশ পাশে বসে পড়লো। বৃষ্টি একদম জানালার পাশে গা ঘেঁষে বসে আছে। আকাশও তার দিকে চেপে বসলো। বৃষ্টি রেগে তাকিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আকাশ তাকে বিরক্ত করতে পেরে মুচকি হাসলো। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। বৃষ্টি একদম চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছে। গলার আওয়াজ বলতে অভ্র, রিজভী আর অথৈয়ের গলাই শুনা যাচ্ছে। তারা দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে। বৃষ্টিকে এমন মুডঅফে দেখতে ভালো লাগছে না আকাশের কাছে। তারউপর সে বৃষ্টির চোখে ঘুম দেখতে পাচ্ছে। একটা হাত বৃষ্টির পেছনে রাখলো সে। বৃষ্টি তার স্পর্শে কেপে উঠেছে। খুব দ্রুত জানালা থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছে! আকাশ তার দিকে তাকায়নি, সে অন্যহাতে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন ভাব করছে যেন কিছুই হয়নি!

বৃষ্টি তাদের বিপরীত সিটে বসে থাকা সিমি আর রওনকের দিকে তাকিয়ে দেখলো দুজন এক হেডফোন কানে দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছে। সিমি রওনকের কাধে মাথা রেখেছে। খুব সুখী দম্পতি মনে হচ্ছে তাদের। এদিকে তার পিঠে আকাশ হাতের আঙুল নাড়াচ্ছে! বৃষ্টির অসস্তিকর লাগছে। সে হাত সরিয়ে দিতে চাইলে আকাশ আরও চেপে ধরলো। বৃষ্টি তারদিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,

  • হচ্ছে কি এসব! হাত সরান।
  • কোথায় কি হচ্ছে? দেখি!
    আকাশ তাকে একহাতে একেবারে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। বৃষ্টি লজ্জা পেয়ে বললো,
  • আশ্চর্য! এখানে সবাই আছে। দেখলে কি ভাববে!
  • কি ভাববে?

আকাশ হঠাৎ এমন শুরু করেছে কেন বৃষ্টির মাথায় কিছুই ঢুকছে না! উপায় না পেয়ে সে আকাশের কাধেই মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

  • এমন করছো কেন! এসব আলগা পিরিতি দেখাতে হবে না।
  • তুমি না দেখলেই তো হয়।
    এই ছেলের মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে! বৃষ্টি কোনোভাবেই তাকে ছাড়াতে পারছে না। আকাশ বৃষ্টির দিকে একটু মোচড় দিয়ে বসলো যার ফলে বৃষ্টি কাধে আরও ভালো করে মাথা রাখতে পেরেছে। কিছুক্ষণ এভাবে কাধে মুখ লুকানো অবস্থায়ই বৃষ্টি ঘুমিয়ে পড়েছে। আকাশ তাকে ঘুমানোর সুযোগ করে দেয়ার জন্যই এতোক্ষণ তার সাথে এমন করছিলো। সিটে হেলান দিয়ে এক হাতে বৃষ্টিকে ধরে সে বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। আর এদিকে বৃষ্টি ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। গলা থেকে ওড়নাটা নামিয়ে আকাশ বৃষ্টির উপর ছড়িয়ে দিয়েছে বাতাস কম লাগার জন্য।

দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তারা ঢাকা এসেছে। কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছাকাছি আসতেই আকাশের ডাকে বৃষ্টির ঘুম ভাঙলো। রাতে একটুও ঘুমায়নি, যার ফলে এখন সারাটা রাস্তা এভাবে ঘুমিয়েই ছিলো সে। চোখ খুলে তাকাতে দেখে আকাশ বললো,

  • উঠো এবার চলে এসেছি তো।
  • কোথায় চলে এসেছি?
  • ঢাকায়।
  • কিহ! এতো তারাতাড়ি?

অভ্র বৃষ্টির জোর গলা শুনে বললো,

  • এতোটা সময় বৃষ্টির তারাতাড়ি মনে হচ্ছে? তুমি টিকেট কেটে আবার সিলেট যাও।
    সবাই হাহা করে হাসতে লাগলো। বৃষ্টি হাই তুলে দেখলো তার উপর তার ওড়না ছড়ানো! সে ঝটপট সোজা হয়ে ওড়না ঠিক করে নিলো। বিকেল পাচটার দিকে তারা কমলাপুর পৌছেছে। ট্রেন থেকে নেমে আকাশ বললো,
  • এখন কি এগিয়েও দিয়ে আসতে হবে?
  • না আমিই যেতে পারবো।
  • চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে এখনো ঘুম কাটেনি! রাস্তায় আবার ঘুমিয়ে পড়বে না তো?
  • তাহলে এগিয়ে দিয়ে আসো।
    রওনক বললো,
  • আরে যা যা, শশুর বাড়ি থেকে ঘুরে আয়।
    সবাই হাহা করে হাসতে লাগলো আকাশ বিরক্তি নিয়ে রওনকের দিকে তাকালো। রিজভীর কাছে নিজের ব্যাগ ধরিয়ে দিলো। রিজভী বললো,
  • ভালোই তো কামলা পাইছোস আমারে!
  • হুম, বৃষ্টি চলো।
    আকাশ বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে বৃষ্টির বাড়ির দিকে রওনা দিলো। রিক্সায় বসে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো,
  • তোমাদের হাড়িপাতিল যে ছিলো ওসব কোথায়?
  • হাড়িপাতিল নিয়ে সিলেট থেকে ঢাকা আসবো! ওগুলো বেচে দিয়েছি সেখানেই।
  • ওহ! আমি তো ভেবেছি জংলীরা বুঝি রেখে দিয়েছে!

বৃষ্টি হিহি করে হাসতে লাগলো। আকাশ নিরব। বৃষ্টি বাসার সামনে নেমে গেলে বললো,

  • এটা তোমার বাসা তো? ঘুমের ঘোরে আবার অন্যদের বাসায় চলে যেও না।
    বৃষ্টি মুচকি হেসে বললো,
  • ভেতরে চলো, বাবা মায়ের সাথে দেখা করে যাও।
  • না। যাও।
  • আল্লাহ হাফেজ।
  • আল্লাহ হাফেজ।
    বৃষ্টি গেইটের ভেতর ঢুকে কিছুটা পথ এগিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো। আকাশ রিকশা নিয়ে এখনো গেইটের সামনেই আছে। বৃষ্টি আবার ফিরে এসে বললো,
  • কি ব্যাপার? যাচ্ছো না কেন? বাসায় আসবে?
  • না, তুমি বাসায় যাও নাকি আবার সেদিনের মতো সাথে সাথে বেরিয়ে অন্যদিকে চলে যাও সেটা দেখার জন্যই বসে আছি।

বৃষ্টি হেসে এবার এক দৌড়ে তাদের মেইন দরজার সামনে এসে দাড়িয়ে কলিং বেল বাজালো। তার মা এসে দরজা খুলে দিলে সে মাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মাকেসহ ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে মায়ের দৃষ্টির অগোচরে আকাশকে হাত নেড়ে টাটা জানিয়ে দরজা বন্ধ করলো। এবার বিশ্বাস করে আকাশ নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

এতোদিন বাইরে কাটিয়েছে তাই বাসায় এসে মায়ের বকা শুনতে হলো। আবার জানতে পারলো বাবা কাল মেঘের কাছে সিলেট যাবে জমি দেখার জন্য। বৃষ্টি মনে মনে বললো, ভাগ্যিস সে আজ চলে এসেছে! না হয় বাবার সাথে কোনোভাবে দেখা হলে বাবা জেনে যেতো সে মিথ্যে বলে সিলেট গিয়েছে!


পর্ব – ২৬

নাফিসা খালামনির সাথে তাদের বাসায় চলে গেলো। তাদের বাসা শ্রীমঙ্গলেরই এক প্রান্তে। পরেরদিন মেঘের বাবা এসেছে। সকালেই মেঘ কিছু জামাকাপড় নিয়ে ইকো রিসোর্টে উঠেছে। দুপুরের দিকে বাবা সরাসরি সেখানেই এসেছে। রিসোর্টের রেস্তোরাঁয় বাবার সাথে লাঞ্চ শেষ করে বের হলো তার পছন্দের জায়গাগুলো দেখানোর জন্য। বাবাকে নিয়ে পাহাড়ের ধারে জলাশয়ের পাশ দিয়ে হাটার সময় কোন মেয়ের খিলখিল হাসির শব্দ পেয়ে সে সামনে তাকিয়ে দেখলো বাচ্চারা খেলছে কিন্তু শব্দটা তাদের দিক থেকে আসেনি!

মেঘ ডান পাশে তাকিয়ে দেখলো দুটো মেয়ে বসে আছে ঢালুর দিকে! নাফিসাকে চিনতে তার একটুও সময় লাগেনি! তাহলে সে এখানে বেড়াতে এসেছে! খালামনির বাসা তাহলে এখানে আশেপাশে কোথাও। হাসিটা নিশ্চয়ই নাফিসার না, পাশের মেয়েটার। নাফিসা ঘাসের উপর বসে হেসে হেসে মেয়েটার সাথে কথা বলছে। মেঘ মুচকি হেসে আবার বাবার সাথে কথা বলতে বলতে জলাশয়ের অন্যপাশে গিয়ে বাবাকে জায়গাটা দেখাতে লাগলো। বাবা ঘুরে ঘুরে দেখলো। পছন্দ হয়েছে বোধহয়!

সেদিক থেকে আবার পেছনের দিকে আসতে নিলে নাফিসা আর মেয়েটির সামনাসামনি হয়ে গেছে! নাফিসা মেঘকে এখানে দেখে হতবাক! আর মেঘের মুখে মুচকি হাসি। মেঘ বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

  • বাবা, চা বাগানের ওই জমিটা দেখবে না? ওটা আরও বেশি ভালো মনে হয়েছে আমার কাছে।
  • চলো, তাহলে সেদিকেই যাই। তারপর সিদ্ধান্ত!
  • হুম, চলো।

মেঘ ইচ্ছে করেই নাফিসাকে জানানোর জন্য বাবার সাথে কথা বলছিলো। নাফিসা ওড়না মাথায় দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ মেঘকে একবার দেখছে আবার তার বাবার দিকে তাকাচ্ছিলো। মনে মনে ভয় ছিলো, না জানি মেঘ তাকে ডেকে বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়! কিন্তু সে ভয়টা বাস্তবায়িত হয়নি। মেঘ তার বাবাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। মেঘ একটু এগিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেঘকে তাকাতে দেখে নাফিসা সাথের মেয়েটিকে নিয়ে বিপরীত পথে তাড়াতাড়ি হাটতে লাগলো।

বাবাকে সাথে নিয়ে বেশ কিছু জায়গা ঘুরে দেখেছে মেঘ। এর মধ্যে বড় বড় পাহাড় গুলোর পাশে সমতল জায়গাটাই তাদের বাবা ছেলের পছন্দ হয়েছে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ, এখান থেকে শ্রীমঙ্গলের অপরূপ দৃশ্য খুব সুন্দর উপভোগ করতে পারবে! দুদিকে চা বাগান আছে, একদিকে পানবন আর একদিকে হ্রদ! এটাই পারফেক্ট মনে হচ্ছে, এদিকে প্রতিযোগীর অবস্থান নেই!

বাবা তিনদিন এখানে থেকে জমিটা কিনে নিলেন। মেঘ খুব খুশি হয়েছে বাবা সিলেট জমি কেনায়। এবার মেঘের কাজ শুরু! বাবাকে ট্রেনে উঠিয়ে সে রিসোর্টে এলো। তার ল্যাপটপ আর কাপড়চোপড় নিয়ে সে রিসোর্ট ছেড়ে নাফিসাদের বাসায় এলো। নাফিসা আরও একদিন আগে এসেছে বাসায়। খরগোশ ছানা দুটো আম্মি স্বযত্নেই রেখেছে। আম্মির সাথে দেখা হতেই আম্মি বললো,

  • তোমার বাবা চলে গেছে?
  • হ্যাঁ, আম্মি। আজ সকালেই ট্রেন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছি।
  • ওহ আচ্ছা। বিয়ের কথা বলতে পেরেছো কিছু?
  • না আম্মি, চেষ্টা করেছি কিন্তু বলার সুযোগ পাইনি! নিজেই বিব্রতবোধ করেছি!
  • ঘরে যাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
  • না আম্মি, নাস্তা করেছি আমি। নাফিসা কবে ফিরবে?
  • এসেছে তো গতকাল। এখন চা বাগানে আছে।
  • ওহ, আচ্ছা।

নাফিসা চা বাগান থেকে ফিরে এসে দেখলো মেঘ গোসল করছে বাথরুমে। খাটে রাখা কাপড়চোপড় সে আলমারিতে গুছিয়ে রাখলো। হঠাৎ চোখ পড়লো টেবিলে রাখা মেঘের ফোনের উপর। সেদিন একটা চমৎকার দৃশ্য তার চোখে পড়েছিলো, কিন্তু ভালো করে দেখতে পারেনি। আজ সুযোগ আছে দেখার। সে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিন জ্বালালো।

কিন্তু সেই দৃশ্যটা পেল না! ওয়ালপেপারেই তো ছিলো! নাফিসা টাচ করে স্ক্রিন লক খুললো। এবার সেটা ভেসে উঠেছে! এটা তো সেই দৃশ্য যেদিন তারা পাহাড়ে দাড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখেছিলো! খুব চমৎকার একটা মুহূর্ত ছিলো। ছবিটা সূর্য সহ তাদের একপাশ থেকে তোলা হয়েছে। মেঘ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি রেখে দাড়িয়ে আছে। দুজনেই সুর্যাস্ত দেখছে! আবছা অন্ধকারে অস্তগামী লাল সূর্য সহ তাদের ছবি দেখে নাফিসার মাঝে সেই অনুভূতিটা হানা দিলো। খুব গভীরভাবে অনুভব করতে পেরেছিলো মূহুর্তটা! অজান্তেই নাফিসার মুখে হাসি ফুটে উঠলো!

মেঘ ঘরে এসে ছবি দেখে তাকে হাসতে দেখে বললো,

  • মুহূর্তটা আরেকবার উপভোগ করলে কেমন হয়, মেঘা?
    হঠাৎ মেঘের কন্ঠ শুনে চমকে উঠে দ্রুত ফোন রেখে দিলো নাফিসা। মেঘ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
  • আমার সবকিছু তোমারই। যখন ইচ্ছে ব্যাবহার করতে পারো।
  • কোন প্রয়োজন নেই আমার।
  • প্রয়োজন হলেই নিবে। মেঘা, আকাশে ভাসমান মেঘ ছুয়েছো কখনো?
  • না।
  • আমার ইচ্ছে তোমাকে নিয়ে মেঘের দেশে ঘুরে আসার।
  • আমার কোন ইচ্ছে নেই।
  • তুমি একদম নিরামিষ! কখনো নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করো না এমনকি অন্যের ইচ্ছাতেও বাধা দাও! ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে নেই। যখন যা ইচ্ছে হবে ভাবার মতো হলে দুতিন বার ভেবে ঝটপট পূরণ করে ফেলবে। তা না হলে কোনো কিছুতেই এক্সপারিয়েন্স আসবে না! শুধু বই পড়ে জ্ঞানী হওয়া যায় না, প্রকৃতির মুখোমুখি হতে হয়। জীবন অতি ক্ষুদ্র, সময়টাকে অবহেলা করে কাটানো সবচেয়ে বড় বোকামি। অবহেলা না করে উপভোগ করতে শেখো, বোরিং জিনিসটা চিরতরে মুছে যাবে।

মেঘের কথাগুলো প্রকটভাবে মুগ্ধ করে নাফিসাকে! এই মানুষটা এতো কথা জানে কিভাবে! এতো সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথা বলে কিভাবে! এসব অদ্ভুত অনুভূতি মিশ্রিত কথা শুনলে যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে! সে ও কি প্রেমে পড়ে গেছে! মেঘকে তো শুরু থেকেই তার ভালো লাগে, ইচ্ছে করে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে।

না, নিজেকে কারো মায়ায় জড়াতে পারবে না সে। মায়া খুব খারাপ জিনিস! বিশ্বাস ভেঙে দেয়। কাউকে এতোটা বিশ্বাস করবে না সে!
পরক্ষণে নাফিসা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বিকেলে বাচ্চারা ছুটে এসেছে খরগোশের সাথে খেলা করতে। উঠুনে ছেড়ে দৌড়াদৌড়ি করে আধমরা বানিয়ে ফেলেছে ছানা দুটোকে! নাফিসা ধমকে তাদের বাসায় পাঠিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ সেবা করেছে ছানা দুটোর। অনেক ভালো লাগে খরগোশ ছানাদের। প্রতিদিন সে তাদের গোসল খাওয়াদাওয়ার যত্ন নিচ্ছে। তার অনুপস্থিতিতে আম্মি করে তাদের সেবা।

সন্ধ্যা থেকে মেঘ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। জমি কেনার কাজ তো শেষ, সে গত দুদিন থেকেই লেগে পড়েছিলো রিসোর্টের নকশার কাজে! এটা শুধু একটা রিসোর্টই হবে না, এটা তাদের বসবাস যোগ্য একটা বাড়িও হবে।

নাফিসা এসে রাতের খাবার দিয়ে গেলো। ভাতের প্লেট রেখে তরকারির বাটি নিয়ে এসেও দেখলো মেঘ খুব মনযোগ দিয়ে কাজ করছে। খাবার এনেছে তা দেখেও নি! সংকেত দেওয়ার জন্য নাফিসা বললো,

  • খাবার খেয়ে নিন। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
    মেঘ ল্যাপটপে তাকিয়েই বললো,
  • তুমি খেয়েছো?
  • না, খাবো।
  • বসো তাহলে, একসাথে খাই।
  • না, এখানে আপনার খাবার এনেছি খেয়ে নিন।
  • একজনের খাবারই দুজন ভাগ করে খাবো।

নাফিসা আর একমুহূর্তও দাড়িয়ে না থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। মেঘ ল্যাপটপে তাকিয়েই মুচকি হাসলো।
নাফিসা খেয়ে ঘুমানোর জন্য এসেও দেখলো মেঘ কাজ করছে। খাবার যেভাবে রেখে গেছে এখনো সেভাবেই আছে।

  • আপনি খাননি কেন এখনো?
  • তুমি তো আমার সাথে খেলে না তাই!
  • এখন কি খাবেন না?
  • তুমি কি বলো? খাবো নাকি খাবো না?
  • খাওয়ার জন্য কি দিয়ে যাইনি!

মেঘ ল্যাপটপে তাকিয়ে মুচকি হেসে জবাব দিলো,

  • কাজটা শেষ করে, তারপর খাবো।
    নাফিসা গিয়ে চেয়ারে বসলো। সে ঘুমাবে, এদিকে মেঘকে খাট থেকে নামতেও বলতে পারছে না! পাচ দশ মিনিটের মতো বসে থেকে সে মাদুর বিছাতে লাগলো। মেঘ ল্যাপটপ রেখে খাট থেকে নামতে নামতে বললো,
  • মেঝেতে বিছানা করছো কেন? কতক্ষণ টিকবে সেটা?
  • খাট আপনি একা দখল করে নিলে ঘুমাবো কিভাবে!
  • এতো তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো কেন তোমরা! আমরা ঘুমাতে ঘুমাতে এগারোটা বারোটা বেজে যায়!

নাফিসা কোন জবাব দিলো না। মেঘ হাত ধুয়ে খাওয়া শুরু করলো, নাফিসা মাদুর তুলে বিছানার একপাশে এসে শুয়ে পড়লো। মেঘ খাওয়া শেষ করে প্লেট গুলো টেবিলের একপাশে রেখে রুমেই একটু হাটাহাটি করলো। নাফিসা উঠে বাইরে গেলো সাথে প্লেটও রেখে এলো। আবার এসে শুতেই মেঘ এসে পাশে হাতে মাথা ভর দিয়ে শুয়ে পড়লো। নাফিসা বিপরীত মুখী ঘুরে থাকায় মেঘ তার দিকে ঘুরাতে চেষ্টা করলো। পরপর দুবার চেষ্টা করার পরও নাফিসা মানছে না তাই সে নিজের অর্ধেক ভাড় ছেড়ে দিয়ে তার উপরে উঠে পড়লো। দুহাতে নাফিসার দুহাত আটকে ধরলো। নাফিসা ভয়ার্ত চোখে তাকালো তার দিকে! মেঘ বললো,

  • এতো দেমাক কেন তোমার? এইটুকু শরীরে এতো জেদ কেন? আমাকে কি একটুও ভালো লাগে না? কেন মানতে পারছো না আমাকে? সবাই কি তোমার বাবার মতো?
    নাফিসা তার বাবার কথা শুনে বড় বড় চোখ করে তাকালো মেঘের দিকে! সে তার বাবা সম্পর্কে জানে কিভাবে! আম্মি কি বলে দিয়েছে! মেঘ আবার বললো,
  • মেঘা তুমি যে জেদ নিয়ে আছো সেটা বোকামি ছাড়া কিছুই না! তোমার বাবার জন্য তুমি সবাইকে অবহেলা করছো। পাপ যদি একজন করে তার শাস্তি সবাই কেন পাবে!
  • কে বলেছে আমার বাবার কথা? আমার কোন বাবা নেই, আমি আর আমার আম্মিই আমাদের পৃথিবী।
  • বাবা ছাড়া তো আর তুমি পৃথিবীতে আসোনি!
  • আর একটা কথাও বলবেন না। ছাড়ুন আমাকে।
  • উহুম, শুনতে হবে তোমাকে। মানতে হবে বাস্তবতাকে। এভাবে জীবন চলে না। একজন প্রতারণা করেছে বলে সবাই প্রতারক না। সবাইকে তোমার বাবার মতো মনে করো কেন! আশেপাশে তাকিয়ে দেখো তাদের সংসার কি টিকছে না? তারা কি সুখে নেই? তোমার বাবা বিশ্বাস নিয়ে খেলা করেছে তাই বলে তুমি সকল পুরুষজাতিকে নিন্দা করবে! আমরা নতুন সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়েছি মেঘা, এটা মানতে পারছো না কেন! শুধু মাত্র সেই মানুষটার কারনে? একজনের কারনে তুমি নিজের জীবনটাকে অবহেলা করে যাবে!

আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছো শুধু সেই লোকটার কারনে! তোমার চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি কষ্ট পেয়েছে আম্মি, কোথায়! তিনি তো এমন না, তিনি তো ঠিকই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চাচ্ছে। শুধু মাত্র তোমার জন্য সেটা পারছে না। উনি বুঝ দিলে তুমি মাথায় নাও না! মেঘা আমাদের চেয়ে সবসময়ই বেশি বুঝে বাবা মা। আমরা কাজ করি জেদ আর আবেগ নিয়ে কিন্তু বাবা-মা কাজ করে সবদিক বিবেচনা করে। আম্মি তো তোমার জন্যই বেচে আছে, তোমাকে আগলে রেখে দিন কাটাচ্ছে সেখানে তুমি যদি আম্মির পরামর্শ গ্রহণ করতে না পারো তাহলে কেমন মেয়ে হলে তুমি! আম্মিও চায় আমাদের সম্পর্ক অটুট থাকুক।

  • আমি চাই না। শুনতে পেরেছেন, আমি চাই না। মানবো না কখনো আপনাকে। আগেও বলেছি এখনো বলছি। কিসের আশায় পড়ে আছেন এখানে? চলে যাচ্ছেন না কেন! কিসের আশায় পড়ে আছেন!
  • জানো না তুমি কিসের আশায় পড়ে আছি!
  • ওহ হ্যাঁ! আমি আপনার ওয়াইফ! আমার উপর পুরুষত্ব ফলাবেন তার পরে না যাবেন! আমার দেহটা ভোগ করার জন্যই তো পড়ে আছেন তাই না?
    মেঘ স্তব্ধ হয়ে গেছে! এতো চেষ্টার পর এই ফলাফল! সে কি এতোটাই অবুঝ! এটা কি বললো মেঘা! সে কি ভালোবাসার মর্ম বুঝে না! মেঘের মধ্যে কি সে ভালোবাসার কোন দিক দেখেনি! মেঘের চোখ লাল হয়ে আসছে, বুকের ভেতর আঘাত হেনেছে নাফিসার কথা! হাতের বাধন হালকা হয়ে গেছে!
    নাফিসা একটা হাত ছুটিয়ে তার গায়ের ওড়না সরিয়ে দিলো। চোখে পানি নিয়ে জেদি কন্ঠে বললো,
  • নিন আমি প্রস্তুত। নিজের তৃপ্তি মিটিয়ে আমাকে মুক্ত করে চলে যান।

মেঘের পুরো শরীর রাগে কাপছে! তাকে নিয়ে এমন কিছু ভাবলো কিভাবে সে! এতো ভালোবেসেছে তাকে আর এই তার পরিনয়! মেঘ এক হাতে নাফিসার মুখ চেপে ধরে গলার নিচে বাম পাশে খুব জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিলো! নাফিসা চিৎকারও দিতে পারছে না মুখ চেপে রাখায়, শুধু অশ্রু ঝরছে আর যন্ত্রণায় ছটফট করছে ! মেঘ কামড় ছেড়ে দিলে নাফিসা দেখলো, মেঘের চোখে পানি টলমল করছে, মুখে রক্ত লেগে আছে! মেঘ মুখ ছেড়ে দিয়ে বুকের বামপাশে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলতে লাগলো,

  • তোর দেহ ভোগ করতে নয়, এখানে যেই ছোট্ট হৃদয়টা আছে না সেটা দখল করার জন্য পড়ে আছি। সেখানে একটু জায়গা পাওয়ার জন্য সেই প্রথম থেকে তোর পিছু পিছু ঘুরে বেড়াচ্ছি! এতো দেমাক কিসের তোর? এতোটাই নিচ মনে হয় আমাকে? ভালোবাসা বুঝলি না! আফসোস করবি জীবনে, খুব আফসোস করবি দেখে নিস। আমি চলে গেলেই তো তুই খুশি, যা তোর খুশিতেই আমার খুশি। চলে যাবো আমি।

মেঘ তার উপর থেকে উঠে পড়লো। চোখের পানি মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে! নাফিসা দ্রুত উঠে বসলো! দাতের আঘাত যে খুব বিষাক্ত! ব্যাথা করছে খুব! রক্তও ঝরছে প্রচুর! সে তার ওড়না হাতে নিয়ে এক কোনা দিয়ে বুকে চেপে রাখলো। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করতে কিন্তু পারছে না! সহ্যও হচ্ছে না এই ব্যাথা! জগ থেকে পানি নিয়ে ওড়নার একপাশ ভিজিয়ে ক্ষত জায়গায় চেপে ধরে রাখলো!
বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর নাফিসা দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। এসময় কোথায় চলে গেলো মেঘ! এসব না বললেও পারতো সে!

মেঘের কথাগুলো তার কানে বেজে চলেছে। সে নিজেও তো জানে মেঘ তাকে কতটা ভালোবাসে! মেঘের হাত বাচার জন্য খালামনির বাসায় গেলেও সেখানে সে মেঘকে মিস করেছে! ঘুমাতে গিয়ে মেঘের অভাব বুঝতে পেরেছে! মেঘকে নিয়ে তার মনে যে অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে সেটা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে সে! তাহলে এভাবে কষ্ট দিলো কেন আজ! ঠিকই তো, তাকে ভোগ করার হলে আরও আগেই সে তা করতে পারতো। এমন অনেক সুযোগ ছিলো তার! কি বলতে কি বলে ফেলেছে তা ভাবতেই নাফিসার খুব কষ্ট হচ্ছে! মেঘকে কেন অবহেলা করছে, তার তো কোন দোষ নেই! যে মানুষটা তাকে প্রতিনিয়ত ভিন্ন জগতের জানান দিচ্ছে তাকে সে কিভাবে কষ্ট দিতে পারলো!

এমন একটা মানুষকে কষ্ট দিয়ে এখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে নাফিসার! সে তো তার স্বামী, এটা একদমই ঠিক হয়নি। ক্ষমা চাইতে হবে তার কাছে। কোথায় গেছে এখন, কোথায় খুজতে যাবে তাকে! আবার এদিকে কামড়ের যন্ত্রণা! কোন কিছু ভেবে না পেয়ে দরজা চাপিয়ে ঘরেই চোখের পাতা খুলে শুয়ে আছে মেঘের অপেক্ষায় আর বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে নোনা জলে!


পর্ব – ২৭

মেঘের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন তার চোখ লেগে এসেছে বুঝতেই পারেনি নাফিসা! হঠাৎ কারো স্পর্শ অনুভব করতে পেরে চোখ খুলে তাকালো সে। দেখলো মেঘ তার পাশে বসে ওড়না সরিয়ে কামড়ের জায়গা তুলো দিয়ে পরিষ্কার করছে। মেঘের চোখে তাকিয়ে দেখলো ভেজা চোখ লাল হয়ে আছে! তুলা দিয়ে পরিষ্কার করে সেখানে মলম লাগিয়ে দিলো মেঘ। ডিসপেনসারি থেকে তুলা, মলম আর টেবলেট নিয়ে এসেছে। নাফিসা ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো বারোটা বাজতে চলেছে!

প্রায় তিন ঘন্টা বাইরে ছিলো মেঘ! মলম লাগাতেই ক্ষত জায়গায় জ্বালা করতে লাগলো! নাফিসা চোখের পানি ফেলছে আর মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ ব্যান্ডেজ করে দিলো। একটা টেবলেট নিয়ে নাফিসার হাতে দিলো আর পানির গ্লাস পাশে এগিয়ে দিলো। এতোক্ষণ সময়ে নাফিসা মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মেঘ একবারের জন্যও তাকায়নি তার দিকে! নাফিসা উঠে বসে টেবলেট খেয়ে নিলো। মেঘ মাদুরটা মাটিতে বিছিয়ে কাথা আর বালিশ মাদুরে ফেলে মশারি টানাতে লাগলো। নাফিসা মৃদু স্বরে বললো,

  • খাটে এসে শুয়ে পড়ুন।

মেঘ তার কথায় পাত্তা না দিয়ে মশারি টানিয়ে নিচে শুয়ে পড়লো। নাফিসা বুঝতেই পারছে খুব রেগে আছে তার উপর। একদমই উচিত হয়নি মেঘকে উল্টাপাল্টা কথা বলার! কিন্তু এখন রাগ ভাঙাবে কিভাবে! পরক্ষণে মেঘের করা দুষ্টুমির কথা মনে হতেই নাফিসা খাট থেকে নেমে মাদুরে মেঘের পাশে শুয়ে পড়লো। মেঘ একটু সরে গেলে নাফিসাও চেপে গেলো তার দিকে। মেঘ এবার মাদুর থেকে উঠে খাটে চলে এলো। নাফিসা মুচকি হেসে কাথাটা ভালো করে জড়িয়ে মাদুরেই শুয়ে রইলো।

সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে খাটে আবিষ্কার করলো নাফিসা! সে তো মাদুরে শুয়ে ছিলো, খাটে এলো কিভাবে! মেঘ এনেছে নিশ্চয়ই। আশেপাশে তাকিয়ে মেঘকে দেখতে পেলো না। মাটিতে করা বিছানাও নেই, সব গুছানো! মেঘই করেছে নিশ্চয়ই! কিন্তু সে কোথায় গেছে! নাফিসা উঠে খাটের বিছানা গুছিয়ে নিলো। নামাজ পড়ে আম্মির সাথে রান্নার কাজে সাহায্য করলো। খরগোশ ছানাদের ঘাস খাওয়ালো। নাস্তা রেডি করে ফেলেছে মেঘ একবারের জন্যও বাসায় আসেনি! আম্মি জিজ্ঞেস করলো,

  • নাফিসা মেঘ কোথায়? সকাল থেকে দেখছি না যে!
  • জানি না তো। আমিও সকাল থেকে দেখছি না। আমার কাছে বলে যায়নি।
  • সকাল সকাল কোথায় বেরিয়ে গেলো! মোবাইলটা নিয়ে আয় তো!
    নাফিসা মোবাইল নিয়ে এলে আম্মি মেঘের নম্বরে ডায়াল করলো। মেঘের ফোন বন্ধ!
  • ফোন তো বন্ধ! তুই চা বাগানে যাবি না?
  • হ্যাঁ।
  • তাহলে যাচ্ছিস না কেন?
  • হ্যাঁ যাচ্ছি।

নাফিসা খেয়ে চা বাগানে যাওয়ার জন্য রেডি হলো। সে খাওয়ার সময় আম্মিকেও খায়িয়ে ওষুধ খায়িয়েছে। কাল রাতের ঘটনা ভাবতে ভাবতে নাফিসা চা বাগানে চলে এলো। চোখ যেন আশেপাশে মেঘকেই খুজে বেড়াচ্ছে। চা বাগান থেকে এসেও শুনলো মেঘ এখনো বাসায় আসেনি! ফোনও বন্ধ! আম্মি টেনশন করছে আর নাফিসার মনে ভয় হানা দিচ্ছে! মেঘ কি তার উপর খুব অভিমান করেছে! মেঘ কি তার কথায় কষ্ট পেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেলো! সে কি ঢাকা ফিরে গেছে নাকি অন্যকোথাও! তার আবার কোনো বিপদ হয়নি তো! নানান কথা চিন্তা করতে করতে বিকেল হয়ে গেছে! সে দ্রুত পাহাড়ে বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য বেরিয়ে পড়লো। মেঘ তো পাহাড়ে আসে,

এখানে নিশ্চয়ই তাকে পেয়ে যাবে। বাচ্চাদের পড়াতেও ভালো লাগছে না। মন শুধু মেঘের অপেক্ষায় আছে! সকাল থেকে বিকেল পেরিয়ে যাচ্ছে এখনো মেঘের দেখা মিললো না! রিসোর্টে, বাজারের দিকেও খুঁজেছে নাফিসা। আজ বিকেলে চা বাগানেও যায়নি সে। মেঘের অভাব হারে হারে টের পাচ্ছে! সে ও যে মেঘকে ভালোবেসে ফেলেছে তা আজ স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে! একবার কাছে পেলে তো অভিমান ভাঙ্গার চেষ্টা করতো। কোথায় গেছে মেঘ, আসছে না কেন তার কাছে! জামাকাপড় তো সবই এখানে আছে!

মেঘ কি সত্যি সত্যিই চলে গেছে তার কথায়! এই অপূর্ব মানুষটাকে এতো কাছে পেয়েও কি সে হারিয়ে ফেললো! ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে, চোখেও অশ্রু ঝরছে! রুমে একা বসে বসে কান্না করছে নাফিসা! মাগরিবের নামাজটা আদায় করেছে। মোনাজাতে থেকেই মেঘের কন্ঠ শুনতে পেল! আলহামদুলিল্লাহ বলে মোনাজাত শেষ করলো। দরজার কাছে এসে শুনতে পেল,

  • কোথায় গিয়েছিলে মেঘ?
  • একটা কাজে বেরিয়েছিলাম আম্মি। সেখান থেকে রেলস্টেশনে গেলাম টিকেট কাটতে। কাল ঢাকা যাবো।
  • ওহ, আচ্ছা। ফোন বন্ধ কেন তোমার? দিনকাল ভালো না, এদিকে চিন্তায় ছিলাম। একবার জানাবে না!
  • আম্মি ফোনে চার্জ না থাকায় বন্ধ ছিলো। সরি, খুব সকালে বের হওয়ার কারণে বলে যেতে পারিনি।
  • ঠিক আছে। হাতমুখ ধুয়ে এবার বিশ্রাম নাও। চোখ মুখ কেমন হয়ে আছে!
    মেঘ নাফিসাকে টপকিয়ে ঘরে ঢুকলো। নাফিসা নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
  • গোসল করবেন এখন?

মেঘ কোনো জবাব দিলো না। মোবাইল চার্জে লাগিয়ে নিজের হাতে জামাকাপড় আর তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেলো! মেঘের অবহেলা নাফিসার সহ্য হচ্ছে না, সারাদিন বাইরে থেকে এখন একটুও কথা বললো না তার সাথে! কিভাবে একা একা চলে গেলো গোসল করতে! আজ কি তার লজ্জা লাগছে না! নাফিসা স্বেচ্ছায় বাথরুমের সামনে এসে দাড়িয়ে রইলো। মেঘ গোসল করে নিজের জামাকাপড় নিজেই ধুয়ে বেরিয়েছে! আজ নাফিসার জন্য কাজ ফেলে রাখেনি! মনটা খারাপ করে নাফিসা মেঘের পিছু পিছু ঘরে এলো। মেঘ ব্যাগে জামাকাপড় গুছানো শুরু করেছে! সে কি সত্যিই চলে যাবে! না, এটা হতে পারে না! যেতে দিবে না তাকে। সে যে তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, ভালোবাসে তাকে। বউকে ফেলে রেখে কেন যাবে সে! দায়িত্ব নিয়েছিলো না, সেই দায়ে তাকে আটকে রাখবে।

নাফিসা খাবার নিয়ে এলো মেঘের জন্য। মেঘ হাত ধুয়ে খেতে বসলে নাফিসা তার নিজের প্লেটও এখানে নিয়ে এলো। আজ মেঘের সাথে খাবে। মেঘ কিছু বললো না। নিজের খাওয়াতে মনযোগ দিয়েছে। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে নাফিসা বাটি থেকে তরকারি নিয়েছে কিন্তু মাছ নেয়নি। কাল থেকে এখন পর্যন্ত নাফিসার মুখের দিকেও তাকায়নি। তবে এটা আন্দাজ করতে পেরেছে নাফিসা ওড়না ছড়িয়ে গলায় ফেলে রেখেছে বেন্ডেজের জন্য। চুপচাপ খাওয়া শেষ হলে নাফিসা থালাবাটি রেখে এলো। মেঘ ল্যাপটপও ব্যাগে তুলে রাখলো। নাফিসা খাটের পাশে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

  • কাল কি আপনি সত্যিই চলে যাবেন?

মেঘ তার কথায় উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নাফিসার খুব খারাপ লাগছে। মেঘ তাকে এতোটা অবহেলা করে কিভাবে ! একবার কথা বলছে না, তার দিকে তাকাচ্ছেও না! ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও দিচ্ছে না!

নাফিসা মুখ চেপে ধরে কান্না করছে! মেঘকে সে কিছুতেই যেতে দিবে না! মেঘকে আটকানোর জন্য এই রাতটাই আছে তার কাছে। সে চোখের পানি মুছে ইশার আযানের পরপরই নামাজ আদায় করলো। মেঘের জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। ব্যাগ থেকে জামাকাপড় সব আলমারিতে তুলে রাখলো। হঠাৎ চোখ পড়লো প্যাকেটের উপর। মেঘ তাকে শাড়ি এনে দিয়েছিলো! মেঘের এনে দেওয়া শাড়ি থেকে একটা শাড়ি হাতে নিলো। লাল রঙ তো মেঘের পছন্দ, তাই সে লাল শাড়িটাই হাতে নিয়েছে। এটা পড়বে সে এখন।

দরজা লাগিয়ে শাড়ি পড়া শুরু করলো। মেঘ এসে দরজা ধাক্কাতেই দেখলো ভেতর থেকে বন্ধ! টোকা দিয়ে নক করলো দুইবার কোনো সাড়া নেই। নাফিসা বুঝতে পেরেছে মেঘ এসেছে কিন্তু তার শাড়ি পড়া শেষ হয়নি তাই খুলছে না! মেঘ বিরক্তিসহিত দাতে দাত চেপে বললো,

  • আজকের রাতটাও কি ঘরে জায়গা হবে না?
  • আসছি।

যদি আবার রাগ করে চলে যায়! তাই নাফিসা অর্ধেক শাড়ি পড়েই দরজা খুলে দিয়ে দ্রুত আবার ঘরের এক কোনে এসে শাড়ির কুচি ঠিক করতে লাগলো! মেঘ দরজা ঠেলে ঘরে পা রাখতেই নাফিসাকে লজ্জিত অবস্থায় দেখে আবার দরজা চাপিয়ে বাইরে চলে এলো। নাফিসা যথাসম্ভব দ্রুত শাড়ি পড়া শেষ করলো। মেঘকে দেখতে না পেয়ে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলো। মেঘ পকেটে দুহাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে উঠুনে দাড়িয়ে আছে। নাফিসাকে দরজা খুলতে দেখে মেঘ ভেতরে প্রবেশ করলো। তার দিকে তেমনভাবে না তাকালেও মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে শাড়িতে তার মেঘাকে কেমন লাগছে। কিন্তু মাথা তুলে তাকালো না সে! ল্যাপটপ টেবিলে নামানো দেখে কাপড়ের ব্যাগ খুজতে লাগলো। আলমারি খুললে নাফিসা এসে আলমারি লাগিয়ে দিলো আর আলমারিতে পিঠ ঠেকিয়ে মেঘের সামনে এসে দাড়ালো। মেঘ পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলে নাফিসা তার শার্টের কলার টেনে ধরে বললো,

  • এমন করছেন কেন আপনি? আমাকে দেখছেন না কেন? কথা বলছেন না কেন আমার সাথে! সরি ওসব বলার জন্য!
    মেঘ হাত ছুটাতে ছুটাতে অন্যদিকে তাকিয়েই বললো,
  • শাড়ি পড়ে যাতে আমার সামনে কেউ না আসে!
    মেঘ তাকে ছাড়িয়ে জগ থেকে ঢেলে পানি খাচ্ছে। নাফিসা তার সামনে এসে দাড়িয়ে বললো,
  • একশো বার আসবো।

মেঘ খাটে উঠে একপাশে শুয়ে পড়লো। নাফিসাও উঠে মেঘের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। মেঘ তার হাত সরাতে চাইলে আর শক্ত করে শার্ট আঁকড়ে ধরলো নাফিসা ! অপরাধী কন্ঠে বিড়বিড় করে বললো,

  • সরি বলেছি তো। প্লিজ ক্ষমা করে দিন।

নাফিসা হাত বাড়িয়ে মেঘের শার্টের প্রথম দুইটা বোতাম খুলে উন্মুক্ত বুকে হাত রাখলো। মেঘ বুঝতে পারছে না হঠাৎ কি হয়ে গেছে তার মেঘার! গম্ভীর সুরে বললো,

  • কেউ যেন আমাকে টাচ না করে।
  • হাজার বার টাচ করবো। আপনার কি! টাচ করলে কি করবেন আপনি?
  • মেরে ফেলবো একেবারে!
  • ফেলুন, মেরে ফেললে মরে যাবো।
    মেঘ আর রাগ নিয়ে থাকতে পারলো না! মুখে হাসি ফুটিয়ে হঠাৎ করেই পেছনে ঘুরে মেঘার উপর আধশোয়া অবস্থায় থেকে বললো,
  • মেরে ফেলবো?

নাফিসা মেঘের মুখে হাসি দেখে সেও মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে বললো,

  • মেরে ফেলুন।
  • রক্ষা পাবে না কিন্তু!
  • বাধা দিবো না।
    মেঘ শাড়ির আঁচল সরিয়ে কামড়ের জায়গা দেখে বললো,
  • এখনো খুব ব্যাথা পাও?
  • উহুম!
    অত:পর স্বেচ্ছায় নাফিসা বাধ্য করেছে মেঘকে, ভালোবাসা আজ পূর্ণভাবে পাওয়ার জন্য! এ ছাড়া আর কোনো উপায় দেখেনি তার মানুষটাকে আটকে রাখার!
    আজকের সকালটা খুবই সুন্দর! ঘুম ভাঙতে দেড়ি হয়েছে, নাফিসা নিজেকে আবিষ্কার করেছে তার প্রিয় মেঘের উন্মুক্ত বুকে! আষ্টেপৃষ্টে আগলে রেখেছে মেঘ তাকে! এক আঙুল নেড়ে মেঘের বুকের লোমের সাথে খেলা করছে মিসেস মেঘা চৌধুরী।
  • ঘুম ভেঙে গেছে মেঘা?

মেঘের ঘুমঘুম কন্ঠ শুনতে তার কাছে খুব মধুর লাগছে! লোকটা কতটা পাজি, একটুও বুঝতে দেয়নি সে এতোক্ষণ সজাগ ছিলো! মেঘা তো জানতো মেঘ এখনো ঘুমাচ্ছে, সে তো আর তার মুখের দিকে তাকায়নি! লজ্জা পেয়ে মেঘা মেঘের বুকের লোমের মাঝে নাক ডুবালো! মাতাল সুরে জবাব দিলো ,

  • হুম। আপনি কি আজ সত্যিই চলে যাবেন?
    মেঘ শরীর কাপিয়ে নিশব্দে হেসে বললো,
  • সেজন্য কাল রাতে কাছে এসেছো তুমি?
    নাফিসা কোন জবাব দিলো না। চুপচাপ তার বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। মেঘ আবার বলতে লাগলো,
  • তুমিই তো বলেছো চলে যেতে। শুধু শুধু আর থাকবো কেন! ট্রেনের টিকেটও কেটে ফেলেছি। ভালোবাসো না তো, অযথা থেকে লাভ কি!
  • এখনো প্রমাণ দিতে হবে ভালোবাসার! যাবেন না আপনি। আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবেন না আপনি! বিয়ে করে দায়িত্ব নিয়েছেন না, এক মুহুর্তের জন্যও ছেড়ে যেতে পারবেন না!

মেঘ মৃদু হেসে নাফিসাকে টেনে বালিশে তুললো। নাফিসার চোখের পানি মুছে দিয়ে চোখের কোনায় চুমু দিয়ে বললো,

  • তাও ভালোবাসিস স্বীকার করবি না?
    নাফিসা মেঘের কপালে ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে বললো,
  • স্বীকার করেই তো কাছে এসেছি।
  • ওরে আমার দুষ্টিরে!
  • দেখি, ছাড়ুন। বেলা হয়ে গেছে অনেক। আম্মির সাথে রান্নার কাজে হেল্প করতে হবে।
  • আমার মা কিন্তু বাবাকে তুমি করে বলে।
  • চেষ্টা করবো আমিও।
  • রান্না কি তুমি করবে?
  • কি খাবেন, বলুন।
  • আমার বিরিয়ানি খুব পছন্দের।
  • ওকে, আমি রান্না করে খাওয়াবো।
  • মুরগির মাংস আছে?
  • হুম।
  • ফ্রিজ নেই, রাখছো কোথায়?
  • পাশের বাসায়।
  • ওকে। যাও।
  • আপনি না উঠলে যাবো কিভাবে!
  • আরেকটু থাকো।
    মেয়েকে শাড়ি পড়ে ঘর থেকে বের হতে দেখে রোকসানার চোখ জ্বলজ্বল করছে! খুব সুখী মনে হচ্ছে তার মেয়েকে! মেয়ে কি তাহলে মেঘকে মেনে নিতে পেরেছে! মেয়ের সুখ দেখার প্রত্যাশাই তো করছিলো সে। এখন নিশ্চিন্তে বাকি জীবন পাড় করে দিতে পারবে। যেভাবেই হোক, তার মেয়ের জন্য মেঘের মতো ছেলেকেই পাঠিয়ে দিয়েছেন উপরওয়ালা!

আম্মিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাফিসা লজ্জা পেয়েছে। তবু্ও স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলো,

  • এভাবে তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে! দেখোনি নাকি কখনো?
  • দেখেছি তো। আজ আবার নতুন করে দেখছি রূপবতীকে! মেঘ এনে দিয়েছে শাড়ি?
    নাফিসা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জবাব দিলো।

পর্ব – ২৮

মেঘের আজ সকালের নাস্তা মেঘার হাতের বিরিয়ানি। নাফিসা তার সাথে বসেই নাস্তা করেছে। সবকিছু গুছিয়ে চা বাগানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেঘ তাকে প্রস্তুত হতে দেখে হাত ধরে বাধা দিলো,

  • বাচ্চাদের পড়াও সমস্যা নেই, চা বাগানের কাজ করতে যেও না। আমি দায়িত্ব নিয়েছি তো, ভরসা রাখো আমার উপর।
  • আজ যাই, হিসেব নিকেশ মিটিয়ে কাল থেকে আর যাবো না।
  • ওকে, যাও।
  • আপনি কি চলে যাবেন?
    মেঘ ফোনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
  • তুমি কি চাও?

আশ্চর্য! সে কি জানে না কি চায়! নাফিসা এমন উত্তর আশা করেনি। ভেবেছিলো মেঘ সরাসরি “না” জবাব দিবে! মেঘ ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখ মলিন করে নাফিসা মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে! ফোন পকেটে রেখে মেঘ নাফিসাকে কাছে টেনে দাড় করিয়ে দুহাত নাফিসার কাধে রেখে বললো,

  • এমন গাল ফুলিয়ে আছো কেন! কেমন যেনো দেখাচ্ছে তোমাকে! একেবারে বারবি ডল!
    নাফিসা হাত সরিয়ে দিয়ে চলে যেতে নিলে মেঘ তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
  • টাকা দিয়ে টিকেট কাটলাম, টাকা গুলো জলে ভেসে যাবে না?
  • যাক জলে।
  • বাবা-মাকে তোমার কথা জানাতে হবে না?
  • ফোনে জানিয়ে দিন।
  • এভাবে বললে তো উনারা কষ্ট পাবে!
  • আপনার বাবা না এসেছিলো, তখন বললেন না কেন?
  • আমার বাবা তোমার কি হয়?
    নাফিসা সামনাসামনি লজ্জা পেলো! এটা বলা উচিত হয়নি! মেঘ কি কষ্ট পেয়েছে! কয়েক সেকেন্ড নিজের সাথেই কথা বলে নাফিসা নিচু স্বরে আবার বললো,
  • বাবা না এসেছিলো, তখন বললেন না কেন?
  • চেষ্টা করেছিলাম, সাহস পাইনি!
  • যদি উনারা মেনে না নেয়!
  • যদি টা না হয় পরেই ভাবি। আগে যাই বাসায়।
  • না, যাবেন না।
  • তুমি চা বাগানে যাবে না?
  • আগে বলুন, আপনি যাবেন না।
    মেঘ নাফিসার কপালে ঠোঁট ছুয়ে বললো,
  • আচ্ছা যাবো না। যাও, আর আজই হিসেব নিকেশ মিটিয়ে কাজ ছেড়ে দিবে।
  • আচ্ছা।

নাফিসা চা বাগানে চলে গেলো। মেঘ বাসায় বসে তার কাজ কমপ্লিট করেছে। খুব শীঘ্রই রিসোর্টের কাজ শুরু করবে। তার প্লানিং আপাতত কমপ্লিট। সারাদিন ঘরে বসে কাজ করে বিকেলে নাফিসার সাথেই পাহাড়ে এসেছে বাচ্চাদের পড়াতে। সাথে খরগোশ ছানাদেরও এনেছে। বাচ্চাদের ছুটি হলে নাফিসাসহ কিছুক্ষণ খেলা করেছে। বাচ্চারা চলে গেলে নাফিসা মেঘের পাশে এসে কাধে মাথা রেখে বসেছে। খরগোশ ছানা পাশেই দৌড়াদৌড়ি করছে। মেঘ বললো,

  • এখানে বসলে যে?
  • আজ সূর্যাস্ত দেখবো।
  • চা বাগানে যাবে না?
  • উহুম! কাজ শেষ আর যাবো না।
  • মেঘা, আজকে আবার লোকগুলো আমাদের ধরে নিয়ে আরেকবার বিয়ে দিলে ভালো হবে না?
    নাফিসা কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকালো মেঘের দিকে! এভাবে তাকাতে দেখে মেঘ হেসে আবার বললো,
  • আরেকবার বিয়ে হবে, আরেকবার নতুন বউ পাবো, আরেকবার বাসর হবে! আহ! ভাবতে পারছো! এবার সবকিছু কতটা আনন্দের সাথে এনজয় করতে পারবো!
    নাফিসা মেঘকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,
  • খুব খারাপ লোক আপনি! আপনি একটা!
  • কি?
  • ইদুর!
    মেঘ হাহাহোহো করে হেসে বসা থেকে দাড়িয়ে বললো,
  • তাহলে তুমি ইঁদুরের বউ! আই মিন, মিসেস রেট!
  • ছি!

নাফিসা খরগোশ ছানাদের ধরতে যাচ্ছিলো মেঘ তাকে টেনে দাড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি রেখে বললো,

  • কোথায় যাচ্ছো এখনি! সূর্যাস্ত দেখবে না!
  • খুব ভালো ফটোগ্রাফার আপনি! সেদিনের ছবিটা অনেক সুন্দর ছিলো।
  • কিন্তু আমি ফটোগ্রাফার তো না! প্রকৃতির সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দী করা আমার শুধুমাত্র শখ!
  • এটা কি হলো!
  • কি?
  • আমার দিকে না, আকাশে তাকান।
    মেঘ আকাশে তাকিয়ে দেখলো সূর্যাস্তের আগেই কালো মেঘের ছায়ায় সূর্য ঢেকে গেছে!
  • সূর্যাস্ত আর দেখা হবে না! সব আপনার দোষ!
  • আমার দোষ কেন! আমি কি করলাম!
  • তাহলে কার দোষ বলুন?
  • অবশ্যই কালো মেঘের দোষ।
  • কালো হোক আর ধলো হোক! দোষ তো মেঘেরই, তাই না?
    এবার মেঘ বুঝতে পেরে হেসে উঠলো! তার নামকে ইঙ্গিত করেই কথা বলছে নাফিসা! তাই নাফিসার ঘাড়ে নাকমুখ ডুবিয়ে বললো,
  • এতো দুষ্ট তুমি, ধারণার বাইরে! আমি তো ভেবেছিলাম আনরোমান্টিক, মনমরা মেয়ে তুমি! নিজেকে প্রস্তুতও করে ফেলেছিলাম এই ভেবে, তোমাকে স্বাভাবিক জীবন উপভোগ করার দিকে নিয়ে যেতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হবে!
  • বাসায় যাবেন না?
  • আর কতো বলবে আপনি আপনি! একটুও তো চেষ্টা করছো না!
    নাফিসা কিছু না বলে খরগোশ ছানা কোলে নিতে গেলো। মেঘও একটা ছানা কোলে তুলে নিয়ে বললো,
  • এক কাপ চায়ে চুমুক দেয়ার সময় হবে?
  • খরগোশ ছানা নিয়ে সম্ভব না! অন্যদিন ভাবলে কি সমস্যা হবে?
  • তোমার ইচ্ছে, চলো।

দুজনেই খরগোশ ছানা কোলে নিয়ে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে হাটছে। হঠাৎ মেঘ বললো,

  • মেঘা, মনে কর তুমি যেমন আছো তেমনই! আমি যেমন আছি তেমনই!
  • এটা আবার কেমন কথা!
  • আরে আগে শুনো। মনে কর তুমি যেমন আছো তেমনই! আমি যেমন আছি তেমনই! আর খরগোশ ছানা দুটো বেবি মানে মানুষের বাচ্চা। এই মুহূর্তে আমাদের দেখে কেমন লাগছে জানো? এই মুহূর্তে আমাদের মনে হচ্ছে একটা পরিবার রাস্তায় হাটছে। আমি বাবা, তুমি মা, আর দুজনের কাছে দুইটা একইরকম বেবি! দেট’স মিন, আমাদের টুইন বেবি!
    নাফিসা তারাতাড়ি তার হাতের ছানাটা মেঘের হাতে ধরিয়ে দিলো।
  • আরে! কি হলো!
  • আপনি বাবা সাথে দুইটা টুইন খরগোশ বেবি! আমি নাই!

নাফিসা হাসতে হাসতে রাস্তার বিপরীত পাশে চলে গেলো। মেঘ মুখটা মলিন করে একটু থেমে আবার হাটতে হাটতে খরগোশদের উদ্দেশ্য করে বললো,

  • বাচ্চাদের ও বাচ্চাদের বাবাকে একা পথে রেখে বাচ্চাদের মা চলে গেছে! বাহ! ভালোই তো! যাক, কিছুই বলবো না আমি।
    নাফিসা আবার রাস্তার এপাশে অর্থাৎ মেঘের কাছে চলে এসে পাশাপাশি হাটতে হাটতে বললো,
  • আপনি কেমন লোক! খরগোশ ছানাদের মানুষের বাচ্চা বানিয়ে দিয়েছেন!
  • আমি তো জাস্ট এক্সাম্পল দিচ্ছিলাম!

নাফিসা এবার মেঘের হাত থেকে একটা ছানা নিতে গেলে মেঘ দিতে চায়নি। কিন্তু নাফিসা জোর করেই নিয়ে মেঘের পাশাপাশি হাটতে লাগলো।

  • মেঘা, আমাদের যদি প্রথম টুইন বেবি হয়! খুব ভালো হবে না? বেড়াতে যাওয়ার সময় কারো কোলই খালি থাকবে না! একজন তোমার কোলে আর একজন আমার কোলে থাকবে!

নাফিসা এক কানে আঙুল দিয়ে বললো,

  • চুপ! চুপ! একদম চুপ! বড্ড বেশি কথা বলতে পারেন!
    মেঘ হাহাহোহো করে হেসে বললো,
  • এক কান ধরলেই কি, অন্য কান যে খোলা!
  • আপাতত সেটা বন্ধ করতে পারছি না। এখন আপনার মুখ বন্ধ করলেই হয়!
  • তুমি তো দেখছি আমাকেও তোমার মতো বোবা বানিয়ে ছাড়বে! আমি তো বেশি বেশি কথা বলে তোমাকে একটু চতুর বানানোর চেষ্টা করছি। এতো চুপচাপ থাকা যাবে না।
  • প্রসঙ্গ পাল্টান।

মেঘ নাফিসার আরও কাছ ঘেঁষে বললো,

  • এতো লজ্জা পেলে কিভাবে! একদিন না একদিন তো এমন জীবনের মুখোমুখি হতেই হবে। তখন কোথায় পালাবে মিসেস? বাচ্চারা তো ডেকে ডেকে বাহানা দিয়ে ঠিকই খুজে বের করে ফেলবে!

নাফিসা আর কোনো প্রতুত্তর করলো না। জঘন্য লোক! থামতে বললে কথা আরও বাড়িয়ে দেয়! তার চেয়ে প্রতুত্তর না করাই ভালো।
নাফিসাকে লজ্জা পেতে দেখে মেঘ প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথা বলতে বলতে বাসায় ফিরে এলো। রাতে নাফিসা তার খাবারসহ মেঘের জন্য খাবার নিয়ে এলো। নাফিসা তরকারি নিয়েছে কিন্তু আজও মাছ নেয়নি! মেঘ নিজের হাতে নাফিসার প্লেটে মাছ তুলে দিলো। নাফিসা তাকাতেই মেঘ বললো,

  • মাছ খাও না কেন? সবটুকু শেষ করবে।
    নাফিসা কিছু না বলে, ভাত নাড়াচাড়া করলো। তারপর বললো,
  • ওই রুমে গিয়ে খাই?
    মেঘ তার দিকে তাকিয়ে মুখটা মলিন করে ফেললো! আবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললো,
  • যেখানে খুশি যাও। না করেছে কে? আমি কি তোমাকে আমার সাথে বসে খেতে বলেছি নাকি!
  • রাগ করছো কেন! মাছের কাটা বেছে খেতে পারি না আমি। আম্মি বেছে দেয়। তাই বলছিলাম!
    মেঘ অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো! মুচকি হেসে বললো,
  • আমি বেছে দিবো?
  • আপনি খাবেন কখন!
  • আবার আপনি! এই মাত্র না তুমি করে বললে!
  • কখন! মনে নেই।
    মেঘ মাছের কাটা বেছে দিতে দিতে বললো,
  • আরেকবার আপনি বলে দেখো, এরপর আমি স্পেশালভাবে মনে করিয়ে দিবো। এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লেগেছে! একটা দোষ তো পেলাম যেটা দিয়ে তোমাকে খোটা দিতে পারবো! আবার নিজেই সে কাজ করে দিবো। আর কি পারো না, বলো আমাকে?
  • চেষ্টা করেছি পারিনি এমন কোন কাজ নেই। আর থাকলেই সেটা বলবো নাকি! খোটা শুনতে কে চায়!
    মেঘ মুচকি হেসে বললো,
  • আচ্ছা! তাহলে কাটা বেছে খেতে পারো না কেন?
  • গলায় কাটা ফুটেছে কয়েকবার৷ তাই মাছ খেতেই ভয় পাই।
  • তোমার সব ভয় গুলোকে আমি জয় করে নিবো মেঘা।
  • খেয়ে কোথাও যাবে না। পাহাড়ি অঞ্চলে রাতে ঘুরাফেরা ভালো না।
  • যথা আজ্ঞে, মহারানী। তবে তোমাকে গল্প করতে হবে। আমি তো সারাদিনই চেষ্টা করলাম। এবার দেখি, কতটা বাড়াতে পেরেছি তোমার কথা বলার স্পীড। বৃষ্টি থাকলে ভালো হতো। একদিনেই তোমাকে বাচাল বানিয়ে ফেলতো।
  • সিলেটই তো ছিলো বৃষ্টি। আমাদের এখানে থাকলেই পারতো।
  • আমাকেই তো তাড়িয়ে দিচ্ছিলে তুমি, বৃষ্টিকে জায়গা দিতে?
    নাফিসা মুখ মলিন করে ফেললে মেঘ আবার হাসানোর চেষ্টা করলো। টুকটাক গল্প করতে করতে দুজনেই খাওয়া শেষ করলো।
    সকালে নাস্তা করার পর মেঘ কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। তাই নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
  • কোথাও যাচ্ছেন নাকি?

মেঘ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে নাফিসার কাছে এসে দাড়ালো। ঠোঁটের কোনায় দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে একটা হাত নাফিসার কোমড়ে রেখে কাছে টেনে বললো,

  • কি বলেছো? আরেকবার বলো।
    মেঘের স্পর্শে কেপে উঠে নাফিসা আমতা আমতা করে বললো,
  • কোথাও যাচ্ছো?
  • এটা বলোনি তো! আগে যেটা বলেছো সেটাই বলো।
  • আমি তো এটাই বললাম!
    মেঘ কানের কাছে মুখ এনে কানে আলতো করে কামড় দিয়ে বললো,
  • খুব চালাক, হুম? পানিশমেন্ট পরে পাবে, কাজে বের হচ্ছি। দুপুরের দিকে ফিরবো। আজ শাড়ি পড়বে, পাহাড়ি অঞ্চল ঘুরবো তোমায় নিয়ে। আসি, আল্লাহ হাফেজ।
  • আল্লাহ হাফেজ।

লেখা – নূর নাফিসা

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “পাহাড়ে মেঘের ছায়া – Valobasar Golpo 2021” টি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ুন – পাহাড়ে মেঘের ছায়া (২য় খণ্ড) – Premer Golpo 2021

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *