কাছে আসার সাহসী গল্প

আপনার চেয়ে আপন যে জন – সিজন ১ । কাছে আসার সাহসী গল্প

আপনার চেয়ে আপন যে জন – কাছে আসার সাহসী গল্প: রাহুল আহমেদ গোবরে পিছলে পরে গেছে! দেশের বিশিষ্ট ইয়ং বিজনেস ম্যান রাহুল আহমেদ! আর তাকে গোসলের জন্য একটা মেয়ের রুমে গিয়ে ধরনা দিতে হয়েছে! চমৎকার এই গল্পটি পড়ুন আর আনলিমিটেড মজা নিন।

পর্ব ১

আজ নুসরাতর বাসররাত। বাসররাত হচ্ছে তার বাবার বাড়িতে। প্রতিটা মেয়ের মত নুসরাতও স্বপ্ন দেখেছিল তার স্বামীর সাথে প্রথম রাত সে শশুড় বাড়িতে কাটাবে। কিন্তু সকালের সামান্য একটা ভুলে আজ তার বর পালটে গেছে। যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তার বদলে বিয়ে উপলক্ষে দাওয়াত খেতে আসা তার বাবার বন্ধুর ছেলে রাহুল আহমেদ এর সাথেই বিয়েটা হয়েছে।

সকালের ঘটনা মনে পরে গেল নুসরাতের।

খুব ভোরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই সামনে রাহুলকে দেখতে পেয়ে চমকে গেল নুসরাত।

_ কি ব্যাপার, আপনি এত ভোরে আমার রুমে কড়া নাড়ছেন কেন?

_ আসলে জগিং শেষে ফেরার পথে গোবরে পা পিছলে পরে গিয়ে দেখোনা কি অবস্থা হয়েছে।

_ এটা কি আমাকে দেখাতে এসেছেন? (মুচকি হেসে)

_ ডোন্ট লাফ নুসরাত। (রেগে)

_ ওকে ওকে। আর হাসবো না। আপনি যান গোসল করে নিন। আমি আরেকটু ঘুমাবো। (হাসি চেপে)
বলেই দরজা লাগাতে গিয়ে বাধা পেল নুসরাত।

_ কি ব্যাপার, দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

_ আমি তোমার ওয়াশরুমে গোসল দিবো, তাই।

_ বাইরে তো আরো দুইটা ওয়াশরুম আছে। সেখানে যান।

_ দুইটাই বুকড হয়ে আছে। এই জন্যেই গ্রামে আসতে ইচ্ছে করে না আমার। বাথরুম করতে গেলেও সিরিয়াল ধরতে হয়।

_ ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন মিঃরাহুল, আমাদের বাড়িতে ২টা এটাচড ওয়াশরুম এবং ২টা কমন ওয়াশরুম আছে।

_ এইজন্যেই তো তোমার রুমে এসেছি। কমন দুইটা বুকড আর অন্য টা কোন রুমে আমি জানি না। ভাবলাম, তুমি এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে। তোমার তো এটাচড হবেই।

কথাটা বলেই নুসরাত কে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো রাহুল।

_ আপনি দরজা কেন লাগাচ্ছেন? আজব তো?

_ তুমি ঘুমাও। আমি গোসল শেষে চলে যাবো। আজ তো তোমার বিয়ে। দরজা খুলে ঘুমালে যে কেউ তুমি জেগে আছো ভেবে রুমে এসে তোমাকে ডিস্টার্ব করবে। সারাদিন অনেক ক্লান্তি তে কাটবে তোমার।

_ হ্যাঁ, এই কথাটা ঠিকই বলেছেন আপনি। তাহলে চলে যাওয়ার আগে দরজাটা ভাল করে চাপিয়ে দিয়ে যাবেন। আমাকে ডাকবেন না প্লিজ।

কথাটা বলেই নুসরাত ঘুমিয়ে গেল। আর রাহুল ইচ্ছেমত গায়ে সাবান ডলে ডলে গোসল করছে। আর ভাবছে,

রাহুল আহমেদ গোবরে পিছলে পরে গেছে! দেশের বিশিষ্ট ইয়ং বিজনেস ম্যান রাহুল আহমেদ! আর তাকে গোসলের জন্য একটা মেয়ের রুমে গিয়ে ধরনা দিতে হয়েছে! ভাবা যায় এগ্লা! এই সব হয়েছে বাবার জন্য। কিনা কি তার ছোটবেলার বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। সেখানে আসতেই হবে। এত করে বললাম বাবাকে যে আমার খুব ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে আমি যেতে পারবো না। তিনি আমার কথা গ্রাহ্যই করলেন না!

বেশ অনেকক্ষণ ধরেই গোসল দিচ্ছে রাহুল। শরীর থেকে গোবরের গন্ধ যেন যাচ্ছেই না।

আধ ঘন্টা পরে নুসরাতর রুমে আবার কড়া নাড়ার আওয়াজ হলো। নুসরাত উঠে দরজা খুলে দিতেই পাশের বাড়ির এক দাদী, চাচি সহ কয়েকজন মাঝ বয়সী মহিলা হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পরলো। ঠিক সেই সময় রাহুল গোসল শেষে খালি গায়ে ট্রাউজার পরে বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। রাহুলকে দেখে রুমের ভিতরে থাকা মহিলাদের মাঝে একটা চাপা গুঞ্জন উঠলো। আর সেই গুঞ্জনে ঘি ঢেলে দিলো তাদের পরবর্তী কথোপকথন।

_ থ্যাংকস নুসরাত। তুমি সুযোগ না দিলে আজ খুব খারাপ পরিস্থিতি তে পরতাম আমি।

_ ইউ ওয়েলকাম। বাট আপনি এখনো যাননি! এত সময় লাগে একটা ছেলের গোসল করতে!

_ যা পরিস্থিতি হয়েছিল আমার। বুঝলাই তো। এতক্ষণ গোসল না দিয়ে উপায় ছিলো না।

গোবরে পা পিছলে পরে যাওয়ার কথাটা ইচ্ছে করেই তুলেনি রাহুল। কারন সে হাসির পাত্র হতে চায় না।

রাহুল চলে যেতেই নুসরাত রুমে উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

_ তোমরা এত সকালে এসে আমাকে ঘুম থেকে কেন তুললে? বিয়ে হতে তো আমার আরো কিছু সময় দেরি আছে। আমার এখনো ঘুম ই ঠিক মত ছাড়েনি।

প্রতিবেশী দাদি টিপ্পনী কেটে বললো,
_ সারারাত না ঘুমাইলে তো ঘুম ছাড়বোই না। কি কও তোমরা। সবার উদ্দেশ্যে কথাটা বলতেই সবাই একযোগে সায় দিল দাদির কথায়।
সবাই কেমন আড়চোখে নুসরাতর দিকে তাকিয়ে আছে।

সেটা দেখে নুসরাত নিজেই জিজ্ঞেস করলো,

_ কি ব্যাপার বলতো চাচী তোমাদের? এভাবে আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছো কেন তোমরা? আমি তোমাদের নুসরাতই গো।
কথাটা বলে চাচীর গলা জড়িয়ে ধরতেই চাচী নুসরাতর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

_ তোর এই অপবিত্র হাত দিয়ে ছুঁয়ে আমাকেও অপবিত্র করে দিস না নুসরাত।

কথাটা বলেই রুম থেকে সবাই বেরিয়ে গেল। নুসরাত কিছুতেই মেলাতে পারছে না কেন তাকে অপবিত্র বলে চলে গেল চাচী। আর রাতে তো আমার ভালই ঘুম হয়েছে। তাহলে দাদী কেন বললো আমার সারারাত ঘুম হয়নি? আজব পাব্লিক মাইরি সব।

কথাটা বলেই আবার ঘুমিয়ে গেল নুসরাত।


পর্ব ২

একটু পরেই নুসরাতর রুমে তার মা ঢুকলো। নুসরাত ঘুমে ছিল। হঠাৎ করেই নুসরাত কে তার মা বিছানা থেকে টেনে নামাতে লাগলো।

_ মা কি হয়েছে। এভাবে টানাটানি করছো কেন আমাকে? আমি ঘুমাচ্ছিলাম তো। (চোখ ডলতে ডলতে)

_ বাইরে সবাই কি বলাবলি করছে নুসরাত? (রেগে)

_ বাইরে সবাই কি বলাবলি করছে সেটা আমি ঘরের ভেতর থেকে কিভাবে বলবো মা? তুমি বাইরে ছিলে তুমি জানো।

_ রাহুল নাকি আজ সারারাত তোর রুমে রাত কাটিয়েছে?

_ মা তুমি কি বলছো এসব!

_ আমি বলছি না নুসরাত। বাইরে সবাই বলছে।

_ মা! তুমি তোমার মেয়ে কে চেনো না? বিশ্বাস করো না আমাকে?

_ আমি তোকে বিশ্বাস করছি। কিন্তু যারা সকালে তোর রুমে রাহুলকে ওইভাবে দেখেছে তারা কি বিশ্বাস করে বাইরে গেছে সে ধারনা আছে তোর?

_ কি বলেছে ওরা?

_ ওরা সবার কাছে বলছে আজ সারারাত নাকি রাহুল তোর সাথে রাত কাটিয়েছে। তোদের মধ্যে নাকি সম্পর্ক আছে। তোর বাবা কথাটা শুনে খুব ভেঙে পরেছে নুসরাত। তুই তো জানিস তোর বাবা তার মান সম্মান নিয়ে কতটা স্ট্রিক্ট। সে কোন ভাবেই মেনে নেবে না। (কেঁদে কেঁদে)

নুসরাত ভোরের সব কথা খুলে বললো তার মাকে।

_ মা এখন তুমি বলো এখানে আমার দোষ কোথায়?

_ রাহুল রুমে ঢোকার পর তুই কেন ঘুমিয়ে গেলি? কেন বাইরে বের হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলিনা যতক্ষণ না রাহুল ওয়াশরুম থেকে বের হয়?

_ মা উনি আমার কাছে হেল্পলেস হয়েই এসেছিলেন। আমি উনাকে হেল্প করেছি যাস্ট। উনার তো কোন খারাপ ইন্টেনশন ছিলো না। তাহলে আমি কেন শুধু শুধু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো? এত নেগেটিভ মাইন্ডে নেওয়ার কি আছে?

_ এটা শহর না নুসরাত। এটা একটা গ্রাম। আর সেখানে যদি একটা মেয়ের সাথে বাইরের কোন ছেলে কে অত ভোরে বন্ধ দরজার ভেতরে দেখে তাহলে মানুষ নেগেটিভ ভাবে নেবে এটাই স্বাভাবিক।

_ কিন্তু আমরা তো কোন খারাপ কাজ করিনি মা!

_ তোরা কিছু করিস নি। আমি সেটা বিশ্বাস করি। কিন্তু গ্রামের মানুষ কে, বিয়েতে আসা সব আত্মীয়স্বজন কে আমি কিভাবে বিশ্বাস করাবো?

_ বিশ্বাস করানোর কি আছে জোর করে? তারা আমাকে ছোটবেলা থেকেই দেখছে। আমার নামে কোনদিন কোন খারাপ রিপোর্ট পায় নি তারা। আর আজ এই সিম্পল বিষয় নিয়ে উনারা আমাকে খারাপ ভাববে না মা। তুমি টেনশন করো না। চলো বাইরে চলো।

মা কে নিয়ে বাইরে বের হলো নুসরাত। বাইরে বের হয়েই তার চোখ কপালে উঠে গেল। পুরো গ্রামের লোক জড়ো হয়ে আছে মনে হচ্ছে। রাহুল আর তার বাবা কেও দেখা গেলো। উনারা বুঝতে চেষ্টা করছে বিয়ে বাড়িতে হচ্ছেটা কি।

নুসরাত কে বাইরে বের হতে দেখেই তার বাবা ঠাস করে গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো।
নুসরাত চড় খেয়ে নিচে পরে যেতেই রাহুল ওকে ধরে তুললো।

_ আংকেল কি করছেন? আজ ওর বিয়ে। আর আপনি ওকে এভাবে থাপ্পড় দিতে পারলেন?

পাশ থেকেই কেউ একজন বলে উঠলো”আরে দেখো সবাই, নুসরাত রে ওর বাপে মারছে জন্যে তার নাগরের গায়ে লাগছে।”
আরেকজন বলে উঠলো”লাগবোই তো, সারারাত রঙ্গলিলা করছে এখন তো টান লাগবোই। হ্যারে নুসরাত, আর কত জনের সাথে রঙ্গলিলা করছোস? তাদের কেউ তরে বিয়া করবো না নাকি? তাই বাড়ির পছন্দে বিয়া করতে রাজি হইছোস।”

_ কি বলছেন কি এসব আপনারা? আপনাদের মেন্টালিটি এতটা লো? (চিৎকার করে বলছে রাহুল নুসরাত কে ধরে রেখে)

রাহুলের হাত থেকে নুসরাত কে ছাড়িয়ে নিয়ে নুসরাতর বাবা আবারও নুসরাত থাপ্পড় মারতে শুরু করলেন। আর বলতে লাগলেন,

_ তুই এতদিন যা চেয়েছিস তাই দিয়েছি তোকে। শুধু বলেছিলাম আমার সম্মানহানি হয় সেরকম কোন কাজ তুই করবি না। কিন্তু আজ তুই কি করলি? পুরো গ্রামের সামনে আমার মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস। আমি ভাবতেও পারিনি আমার মেয়ে হয়ে তুই এতটা নোংরা কাজ করবি। আজ তোকে আমার মেয়ে পরিচয় দিতে ঘৃণা হচ্ছে।

_ বাবা বিশ্বাস করো আমি কোন খারাপ কাজ করিনি। দয়া করে আমার কথাটা বিশ্বাস করো। (কাঁদতে কাঁদতে)

_ এতগুলো মানুষ আজ নিজের চোখে দেখেছে ভোরে রাহুল কে তোর রুম থেকে বের হতে। তুই কিছু করিস নি সেটা আমি বললেই কি ওরা বিশ্বাস করবে? কি হলো বল করবে বিশ্বাস কেউ? (নুসরাত কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে)

_ বাবা তুমি অন্তত আমাকে ভুল বুঝো না, প্লিজ বাবা। (কেঁদে)

_ আপনারা কোন বিষয় নিয়ে নুসরাত কে এভাবে হিউমিলিয়েট করছেন? সকালে আমি ওর রুমে গোসল দিয়েছি এটা নিয়ে?
রাহুল সকালের ঘটনা খুলে বললো বাড়িতে উপস্থিত সবার সামনে। নুসরাতর সম্মান বাঁচাতে এখন আর নিজের লজ্জা নিয়ে ভাবলে চলবে না। (মনে মনে ভাবলো রাহুল)

কথাটা শুনে ভীরের মধ্যে থেকে একটা চাপা গুঞ্জন উঠলো,
“নুসরাতর সম্মান বাঁচাতে এখন ছেলেটা শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে। আসলে শহরের নামিদামি মানুষ তো। গ্রামের মেয়েকে কিছু সময় ভোগ করা যায়। কিন্তু তাকে বিয়ে করা যায় না।”

_ আপনাদের সাহস কি করে হয় এত নিচ কথা বলার? আপনাদের নামে আমি মানহানির মামলা করবো (প্রচণ্ড রেগে গিয়ে)

“নিজের মান সম্মানের বড়াই আর কইরেন না। এতবড় একটা কাহিনী ঘটানের পরেও মিয়া কেমনে মুখ দিয়া কথা বাইর হয় আপনার?”

রাহুল রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাবে এমন সময় নুসরাতর বাবার ফোন টা বেজে উঠলো। হঠাৎ উনি ফোন ফেলে দিয়ে ধপ করে নিচে বসে পরলেন। নুসরাতর মা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন,

_ ছেলের বাড়ি থেকে ফোন এসেছিলো। তারা বলেছে আমার নুসরাত নাকি দুশ্চরিত্র। আর এরকম দুশ্চরিত্র মেয়ের সাথে তারা ছেলে বিয়ে করাবেন না।

_ কিন্তু তাদের কানে এই খবর টা গেল কিভাবে?

“এসব কথা তো বাতাসের আগে আগে থাকে। আর তারা তো ঠিকই বলছে। জাইনা শুইনা এরকম মেয়ের সাথে কেউই ছেলে বিয়া দিবো না।”

এতক্ষন একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিলেন রাহুলের বাবা। হঠাৎ তিনি এগিয়ে এসে নুসরাতর বাবাকে বললেন,

_ আমার রাহুল বিয়ে করবে নুসরাত কে। তোমরা বিয়ের আয়োজন করো। আমার আপত্তি নেই নুসরাত কে আমার পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে….

_ বাবা তুমি এসব কি বলছো? নুসরাত কে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আর আমি ওকে বিয়ে করলে সবাই যেটা ধরে নিয়েছে সেটাকে সত্যি ভাববে।

ঘটনা টার সাথে যেহেতু তুমি জড়িয়ে আছো তাহলে তোমাকে তো এই বিয়ে করতেই হবে। নাহলে লোকে আরও অনেক বাজে কথা শোনাবে নুসরাত কে। মেয়েটা সুইসাইড এটেমট করতে পারে। নুসরাতর সম্মান আর জীবন এই দুইটাই এখন তোমার হাতে। আর আমি ওর বাবাকে কথা দিয়েছি। সো তুমি এই বিয়ে করছো।


পার্ট ৩

বিছানায় বউ সেজে বসে বসে সকালের ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবছে নুসরাত। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে তার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো। রাহুল কে দেখে আবার ভাবনার জগতে ডুব দিলো সে।

_ মিঃরাহুল এত বড়লোক মানুষ! উনি কি সামান্য স্কুল মাস্টার এর মেয়েকে মেনে নিবেন নিজের বউ হিসেবে? উনি তো শুধুমাত্র উনার বাবার কথায় আমাকে বিয়ে করলেন।

রাহুল রুমে ঢুকেছে অনেক্ষন হলো। মনের ভিতর অস্থিরতা নিয়ে পায়চারী করে যাচ্ছে রুমের ভিতর। হঠাৎ নুসরাত বিছানা থেকে নেমে এসে রাহুলের সামনে দাঁড়ালো।

_ কিছু বলবে নুসরাত?

হুট করে রাহুলকে সালাম করতে বসলো নুসরাত। ঘটনার আকস্মিকতায় রাহুল খানিকটা চমকে গেল।
মেয়েটা কি আমাকে হাসবেন্ড ভাবতে শুরু করেছে? কিন্তু আমিতো কখনোই ওকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না। এই গ্রাম, গ্রামের মানুষ এদের থেকে বাঁচাতেই তো আমি ওকে বাবার কথায় বিয়ে করেছি। সেটা তো ও নিজেও জানে।

রাহুলঃ এটা তুমি কি করলে নুসরাত! এসবের তো কোন প্রয়োজন ছিলো না। সেটা আমরা দুজনেই জানি

_ ছিলো। বর চেঞ্জ হলেই তো আর দাদী_ নানী দের নিয়ম চেঞ্জ হয় না।

_ হোয়াট! তুমি এখনো সেই দাদী_ নানী দের কথা বলে যাচ্ছো যাদের জন্য তোমার আজ এই অবস্থা! তোমার একটুও রাগ হচ্ছে না তাদের উপর?

_ রাগ করে কি লাভ বলতে পারেন? যদি আল্লাহ্ আমার ভাগ্যে এটা লিখে রাখে। আমার তাদের উপর কোন রাগ নেই বিশ্বাস করুন। আমার জন্য বাবা মা কে অপমানিত হতে হয়েছে। আপনার জীবন, আপনার ইচ্ছা, অনিচ্ছা কোন কিছুর মূল্যায়ন না করে আমার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। খারাপ লাগাটা আমার এখানেই।

_ তোমার নিজের সাথে যেটা হয়েছে তার জন্য তুমি তাদের কোন দোষ দিচ্ছো না? আর শুধু তুমি নিজেকে দোষী ভাবছো কেন? দোষী তো আমিও।

_ ওই যে বললাম। আমার ভাগ্যে ছিলো। যাই হোক, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইবো নাকি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না। ক্যান ইউ হেল্প মি?

_ তুমি ঠিক আছো তো নুসরাত?

_ কেন বলুনতো?

_ না কিছুনা। তুমি শাড়ি চেঞ্জ করে ঘুমিয়ে পড়ো।

_ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আপনাকে?

_ হ্যাঁ বলো

_ আপনি অন্য কারো কাছে কমিটেড। আর তার জন্যই আমাকে বিয়ে করতে চাননি। আর স্ত্রী হিসেবে মানতেও প্রবলেম হচ্ছে, তাইনা?

_ তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল নুসরাত। আমি কারো কাছে কমিটেড নই। তাই বলে তোমাকে যে স্ত্রী এর অধিকার দিবো সেটা ভাবাও ভুল। আর হ্যাঁ, আমি শুধু তোমার সম্মান বাঁচাতেই বিয়েটা করেছি। তুমি খুব ভাল একটা মেয়ে নুসরাত। আমার জন্য তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।

_ আপনি এভাবে কেন ভাবছেন। আমাদের ভাগ্যে এটাই ছিলো।

_ আমার সাথে তোমার ভাগ্য জড়িয়ে তোমার জীবনটা আমি নষ্ট হতে দিবো না। বিড়বিড় করে কথাটা বললো রাহুল।

_ যা বলার স্পষ্ট করে বলুন মিঃ রাহুল।

_ কিছু না। তুমি ঘুমিয়ে পড়। আজ বৃষ্টি না থাকলে তোমাকে নিয়ে চলে যেতাম আমি। এখন সকালের অপেক্ষা।

শাড়ি চেঞ্জ করে এসে লাইট অফ করে নুসরাত শুয়ে পরলো। বেশকিছু সময় পার হওয়ার পরেও যখন পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভূত হলো না নুসরাতর, তখন সে পাশ ফিরে দেখলো রাহুল চেয়ারে বসে আছে।

_ ঘুমাবেন না আপনি? অনেক রাত হলো তো?

_ এই বাড়িতে আমার ঘুম আসবে না নুসরাত। তুমি ঘুমিয়ে পড়। চেয়ারে হেলান দিয়ে কথাটা বললো রাহুল।

আর কথা বাড়ালো না দুজন। নুসরাত শুয়ে শুয়ে ভাবলো।

_ সত্যিই তো। যে বাড়িতে আমাকে নিয়ে লোকটার বিনা অপরাধে এত অপমান সহ্য করতে হলো সেখানে তার ঘুম না আসাটাই স্বাভাবিক। বাই দা ওয়ে, তাহলে তো আমারও ঘুমানো ঠিক না। অপমান তো আমারও হয়েছে বিনা কারণে!

ভাবামাত্র শোয়া থেকে উঠে বসলো নুসরাত। রাহুল নুসরাতর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

_ কি ব্যপার! তুমি ঘুমানো বাদ দিয়ে উঠে বসলে কেন?

_ দেখুন মিঃরাহুল, অকারণে অপমানিত আপনিও হয়েছেন আর আমিও। তাহলে আপনি না ঘুমালে আমারও তো ঘুমানো উচিৎ নয়, তাইনা?

_ কি আবোলতাবোল কথা বলছো তুমি? আর ইউ গোয়িং টু ম্যাড!

_ আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। আমিও ঘুমাবো না।

_ আমি তোমাকে একবারের জন্যেও বলেছি অপমানে আমার ঘুম আসছে না?

_ সেটা বলেন নি ঠিকই। কিন্তু কারন তো এই একটাই।

_ তুমি ঘুমাও প্লিজ। আমার আসলে এরকম পরিবেশে ঘুম আসে না। তাই জেগে আছি।

_ হতে পারে আপনার কথাই ঠিক বলে নুসরাত শুয়ে পরলো।

আমার তোমার টেনশন এ ঘুম আসছে না নুসরাত। কিভাবে বোঝাই তোমাকে। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিন ই তোমকে ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু আমার যে কাউকে ভালবাসা বারণ। আমি নিজের সাথে কোন মেয়ের সম্পর্ক তৈরি করে তার জীবনটা শেষ করে দিতে পারি না। তোমার নিজের জীবনটা আমার জন্য এলোমেলো হয়ে গেলো। কথাগুলো ভাবতেই চোখ ভিজে গেল রাহুলের।


পর্ব ৪

সারারাত ঝুম বৃষ্টি শেষে স্নিগ্ধ ভোরে আজানের ধ্বনি ভেসে এলো রাহুলের কানে। চোখ মেলে নুসরাতর দিকে তাকাতেই দেখলো শরীর কুঁকড়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। তাড়াহুড়ো করে উঠে গিয়ে কপালে হাত রাখলো রাহুল।

_ নাহ্, জ্বর তো নেই? এভাবে শুয়ে আছে কেন? তাহলে কি মেয়েটা ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না? পাগলী মেয়ে। সামান্য বৃষ্টি নেমে ঠান্ডা পরেছে সেটাই সহ্য করতে পারছে না। মুচকি হেসে কাঁথা টেনে দিলো রাহুল নুসরাতর শরীরে।

ভোরের আলো ফুটতেই নুসরাতর ঘুম ভেঙে গেল। রাহুলকে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখেই উঠে গেল তার কাছে।

_ মিঃরাহুল শুনছেন?

_ হুম শুনছি। বলো

_ আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি। বেশি সকাল হওয়ার আগেই আমরা চলে যাবো এখান থেকে। আপনিও রেডি হয়ে নিন।

_ চলে তো যাবোই। বাট তুমি এত তাড়াহুড়া কেন করছো? তোমাদের বাড়ির সবাই উঠুক। সবাইকে বলে তারপর যাই।
চোখ মেলে নুসরাতর দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো রাহুল।

_ এটা গ্রাম মিঃরাহুল। কালকের অপমানের জের আজ পর্যন্ত টেনে এনে এখানকার লোকেরা আপনাকে আবারো অপমান করবে।

_ তাতে তোমার কি? আমিতো তোমাকে বলেই দিয়েছি যে আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই এবং হবেও না।

_ আপনার অপমানের কারণ টা যদি আমি কেন্দ্রিক না হত তাহলে হয়তো আমার এত ভাবার দরকার ছিলো না।
আর কার সাথে কার সম্পর্ক তৈরি হবে সেটাতো উপরওয়ালা আর সময়ই ঠিক করবে। আপনি আমি না।

নুসরাতর এমন স্ট্রেট ফরওয়ার্ড কথায় রাহুল কি বলবে সেটা বুঝতে না পেরে কথা ঘুরিয়ে বললো,

_ আমরা তো আদতেও কোন অপরাধ করিনি। যার জন্য চোরের মত আমাদের পালিয়ে যেতে হবে। তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। কাউকে না বলে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি না আমি।

_ টপিক চেঞ্জ করছেন মিঃ রাহুল?

_ কিসের টপিক!

_ এই যে, আপনার আমার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কথা উঠলো একটু আগে।

_ আমার ভাললাগছে না নুসরাত। প্লিজ তুমি এখন যাও আমার সামনে থেকে।

নুসরাত কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে রাহুলকে ডাকলো। হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে ইশারায় ওয়াশরুমে যেতে বললো। ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে আয়নায় চোখ পরতেই নুসরাত দেখলো রাহুল তোয়ালে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

_ কি হলো মিঃরাহুল! এখনো দাঁড়িয়ে কেন?

_ আমার ব্রাশ অন্যরুমে। নিয়ে আসছি আমি। কথাটা বলেই রাহুল দরজা খুলতে গেল।

_ একটা মিনিট দাঁড়ান।
ড্রয়ার খুলে একটা ব্রাশ এনে রাহুলের হাতে ধরিয়ে দিল নুসরাত। এবার ওয়াশরুমে যান। মুচকি হেসে বললো,

_ একটা কথা বলার ছিলো তোমাকে।

_ হ্যাঁ বলুন।

_ তোমার কি এই বিয়েতে মত ছিলো না? আমার কথা বলছি না। যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো তার কথা বলছি।

_ বাবা চেয়েছিলো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও না করিনি। কারো সাথে তো কমিটেড ছিলাম না। তাই না করার প্রয়োজন পরেনি। আর আপনার সাথেতো এক্সিডেন্টালি বিয়েটা হয়েছে।

_ যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তাকে কতদিন ধরে চেনো? দেখা করা বা ফোনে কথা এগুলো তো হয়েছেই তাইনা?

_ এগুলো কিছুই হয়নি। আমি তাকে চিনিনা বললেই চলে। গত সপ্তাহে এসে দেখে গেছে। আর এই সপ্তাহে বিয়ের ডেট ফিক্সড করেছিলো।

_ লাইক সিরিয়াসলি নুসরাত! এই যুগের মেয়ে হয়ে তুমি হবু বরের সাথে দেখা করা, ফোনে কথা বলা কিছুই হয়নি তোমার?

_ না হয়নি। কারণ বাবা চায়নি। বাবা এগুলো পছন্দ করে না। আমি আমার বাবার চাওয়া পাওয়া কে সম্মান করি।
জানালার গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে রাহুলের কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে নুসরাত।

_ এখনো বলবে তুমি তোমার বাবা কে সম্মান করো? যে বাবা নিজের সম্মানের জন্য মেয়ের উপর আনা মিথ্যা অপবাদ মেনে নিয়ে এক গ্রাম লোকের সামনে মেয়ে কে থাপ্পড় এর উপর থাপ্পড় মারতে পারে, তার চাওয়া পাওয়ার মুল্যের কথা এখনো ভাবো তুমি?
নুসরাত কে এক ঝটকায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে কথাগুলো বললো রাহুল।

_ মিঃরাহুল, বাবা বাবাই হয়। মেয়েকে শাসন করলেও সে বাবা আর ভালবাসলেও বাবা। এত বছর যদি তার ভালবাসা নিতে পারি তাহলে তার সম্মান বাঁচাতে আমার উপর মিথ্যা অপবাদের শাসন টা কেন মানতে পারবো না বলতে পারেন? আমার বাবার একটা সম্মান ছিলো এই গ্রামে। যেটা আজ আমার জন্য ধুলোয় মিশে গেছে।

_ কিন্তু সেটা তো মিথ্যা। এত ভালবাসে তোমার বাবা তোমাকে, আর এই মিথ্যা অপবাদ টা সে কিভাবে বিশ্বাস করলো আর কিভাবেই বা মেনে নিতে পারলো?

_ আপনাকে কে বলেছে আমার বাবা এটা বিশ্বাস করেছে? আমার বাবা যদি আপনার সাথে আমাকে এক বিছানায় ঘুমাতেও দেখতো তবুও বিশ্বাস করতো না যে তার মেয়ের চরিত্রে দোষ আছে।

_ তাহলে গ্রামের এত লোকের সামনে তোমাকে মারলো কিভাবে?

_ মিঃ রাহুল, বাবা আমাকে কেন এত মেরেছে আর কেন এত কথা শুনিয়েছে জানেন? কারণ বাবা চায়নি আমাকে আর আপনাকে নিয়ে গ্রামের দশ জন লোক আড়ালে দশ কথা বলুক। একজন বাবা আর যাই হোক না কেন মেয়ে সম্পর্কে বাইরের কারো থেকে খারাপ কথা শুনতে রাজি নয়।
রাহুলের চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বললো নুসরাত।

রাহুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নুসরাতর দিকে। বাবা মেয়ের বন্ডিং এত স্ট্রং! এত অপমানিত হলো, এত মার খেলো কাল মেয়েটা বাবার কাছে। আর আজ এই মেয়েই কিনা বাবা সম্পর্কে একটা বাজে কথা শুনতে নারাজ!

_ কি ভাবছেন মিঃ রাহুল?

_ ভাবছি এরকম একটা সিচুয়েশনে তুমি এতটা স্ট্রংলি নরমাল বিহ্যাভ কিভাবে করছো। গ্রাম হিসেবে তো যেটা সবাই ধরে নিয়েছে সেটা খুবই লজ্জাকর।

_ আমার বাবা আমাকে একটা কথা বলতো জানেন? বাবা বলতো বিধাতা তোমার ভাগ্যে যেটা লিখে রেখেছে সেটা ঘটবেই। আর তুমি যত তারাতারি সেটা মেনে নিতে পারবে তত তারাতারি তোমার লাইফ নরমাল ভাবে লিড করতে পারবে।

পাঠক আপনাদের জন্যই আমরা প্রতিনিয়ত লিখে থাকি। আপনাদের আনন্দ দেয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ। তাই এই পর্বের “কাছে আসার সাহসী গল্প” টি আপনাদের কেমন লাগলো পড়া শেষে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে।

আর যেখানে আমার উপর আমার বাবা মায়ের বিশ্বাস আছে সেখানে অন্য লোকে কি ভাবলো সেটা আমি খুব একটা গুরুত্ব দেই না। আমার বাবা মা আর উপরওয়ালা জানে আমি কেমন।
বলছি এখনো কি ব্রাশ নিয়ে দাঁড়িয়েই থাকবেন?

কথাটা শুনে রাহুলের ধ্যান ভঙ্গ হলো। কোন কথা না বলে ঘুরে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটছে আর ভাবছে।

যতটা সহজে ওকে আমার লাইফ থেকে আলাদা করবো ভেবেছিলাম। ব্যাপারটা এত সহজে মিটবে না।


পর্ব ৫

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে রাহুল দেখলো নুসরাত একদম রেডি হয়ে বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে।

_ কি ব্যাপার বলতো তোমার? এত যলদি তৈরি হয়ে বসে আছো?

_ যেতে যখন হবেই তখন দেরি করে লাভ কি বলুন।

_ হ্যাঁ সেটা ঠিক। কিন্তু তোমার ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে এই বাড়ি ছেড়ে তুমি যত তারাতারি পারো চলে যেতে চাও।

_ বাহ্! আপনার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি। আমি ঠিক সেটাই চাই।

_ তোমার পরিবার ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে না নুসরাত! অবাক হয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো রাহুল।

_ আমার পরিবার ছেড়ে গিয়ে থাকতে যতটা না কষ্ট হবে, তার থেকে দ্বিগুণ কষ্ট হবে এখন পরিবারের সাথে থাকলে।

_ হুম বুঝলাম।

_ তো চলুন, বাইরে নাটকের মঞ্চে যাওয়া যাক।

_ মানে?

_ বের হলেই বুঝতে পারবেন। চলুন।

_ কিন্তু আমি কি পরে বাইরে যাবো? জামা কাপড় তো সব ওই রুমে।

_ জ্বী না। সব এই রুমে এবং আপনার হাতের ডানেই আছে।

_ আমার ট্রাভেল ব্যাগ এখানে কে আনলো?

_ আমি আর আপনার বাবা ছাড়া আপাতত আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী আর এ বাড়িতে নেই। আপনার বাবা সকাল সকাল তো আর ছেলের জামা কাপড় দিতে আসবে না। তাই আমিই এনেছি।

_ তুমি এনেছো সেটা ডিরেক্ট বললেই হয়। এতো প্যাঁচানোর কি আছে বুঝলাম না।

_ অত বুঝে লাভ নেই। এখন চলুন তো।

দুজনে একসাথে রুম থেকে বের হতেই দেখলো বাইরে আত্মীয়স্বজন সহ বেশ কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। রাহুল ঘুরে নুসরাতর দিকে তাকালো।

_ এরা আজকে আবার এখানে কেন নুসরাত?

_ আপনাকে বলেছিলাম না, দেখুন আবার সবাই এসেছে দলবেঁধে কথা শোনাতে। ফিসফিস করে বললো নুসরাত।

বের করছি কথা শোনানো। দাঁড়াও।

_ এখানে নুসরাতর ফ্যামিলি আর আত্মীয়স্বজন যারা আছেন তারা এক সাইডে চলে যান প্লিজ। আর পাড়া প্রতিবেশী সহ বাইরের লোক এক সাইডে চলে যান। (সবার উদ্দেশ্যে কথাটা বললো রাহুল)

কেউ নড়ছে না। উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে গেছে রাহুলের কথা শুনে। নুসরাতর বাবা, মা আর রাহুলের বাবাও অবাক হয়ে গেছে। সেটা দেখে রাহুল আবারো বললো,

_ কি হলো, কথাটা তো বাংলাতেই বলেছি আমি। তারপরেও নড়ছেন না কেন কেউ?

এবার সবাই গুটি গুটি পায়ে আলাদা ভাবে জড়ো হতে লাগলো। তারপর রাহুল প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

_ আপনারা এত সকালে এই বাড়িতে কি করছেন? আপনাদের কোন কাজ নেই বাড়িতে, রান্নাবাড়া নেই? নাকি অন্যের বাড়িতে কি ঘটছে সেটা খেয়েই পেট ভরে যায় আপনাদের? একটা মেয়েকে বিনা কারণে কাল এত অপদস্থ করেছেন। তারপর সকাল হতে না হতেই তারই বাড়িতে এসে হাজির হয়েছেন। মিনিমাম লজ্জা বলতে আপনাদের কিছু নেই দেখছি।

কথাগুলো শুনে সবাই বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। হঠাৎ নুসরাত আস্তে করে রাহুলের কানে কানে বললো,

_ কি বলছেন এগুলো মিঃ রাহুল! উনারা বয়সে আমাদের বড়। এভাবে অসম্মান না করলেও পারতেন আপনি।

_ নিজের সম্মান ধরে রাখার দায়িত্ব আগে নিজের পালন করতে হয় নুসরাত। তারপর অন্যরা সম্মান দিলো কিনা সেই প্রসঙ্গ আসে। এখন চুপ থাকো।

তারপর আত্মীয়স্বজন দের উদ্দেশ্য করে বললো রাহুল।

_ আচ্ছা, প্রতিবেশীদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। আপনারা তো নুসরাতর কাছের মানুষ। সেই ছোটবেলা থেকেই ওকে দেখছেন। আপনারা কেউ একজন বলুন আপনাদের নুসরাত সম্পর্কে, ওর অতীতে কোন ব্যাড রিপোর্ট আছে?

কেউ কোন কথা বলছে না দেখে রাহুল আবারো বলা শুরু করলো,

_ তারমানে নেই? তাহলে কাল কি ঘটেছিলো সেটা অন্তত আপনাদের নুসরাতর কাছে শোনা উচিৎ ছিলো? কিন্তু আপনারা সেটা করেন নি। আপনারা কি করেছেন! কেউ একজন ঢোলে বারি দিলো আর আপনারাও নাচতে শুরু করে দিলেন। এই কিনা আপনারা ওর কাছের মানুষ! আমার আর কিছু বলার নেই। আপনাদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে স্যরি।

সবাই চুপ করে আছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে রাহুলের কান্ড দেখছিল রাহুলের বাবা আর নুসরাতর বাবা, মা। নুসরাতর বাবা এগিয়ে এলো রাহুলের কাছে। একটু আড়ালে নিয়ে রাহুল কে বললো,

_ আমি জানিনা বাবা আমার মেয়ের ভাগ্যে কি আছে। আমার মেয়েটা কে আমি এতগুলো বছর আগলে রেখেছিলাম। কেউ কোন কথা শোনানোর সুযোগ পায়নি। কিন্তু কাল এতগুলো মানুষ আমার মেয়েকে কথা শোনানোর সুযোগ পেয়েছিল। আমি সেটা মানতে না পেরে মেয়ের গায়ে হাত তুলেছি। আমি জানি আমার মেয়ের আমার উপর কোন রাগ নেই। কিন্তু ওকে মারার পর থেকে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমার মেয়েটা না জানি কত ব্যাথা পেয়েছে।

রাহুলকে ধরে কাঁদতে লাগলো। রাহুল কি বলে স্বান্তনা দিবে। সে নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। রাহুল ভাবছে,

_ কি দিয়ে তৈরি এই বাবা মেয়ে! এদের ফ্যামিলি শিক্ষাকে স্যালুট করতে হয়।
আংকেল আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে আমাদের পরিবারে ভাল থাকবে।

সকালের নাস্তা শেষে সবার থেকে বিদায় নিয়ে রাহুলদের বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলো সবাই। নুসরাত তার বাবার থেকে বিদায় নিয়ে একটু সামনে এগিয়ে যেতেই রাহুল মজা করে সিরিয়াস মুডে নুসরাত কে বললো,

_ তুমি বলেছিলে তোমার বাবা তোমাকে অনেক ভালবাসে। অথচ তুমি দেখ, তুমি চলে যাচ্ছো আর তোমার বাবার চোখে এক ফোঁটা জল নেই।

_ মিঃরাহুল, একটু ভাল করে খেয়াল করে দেখুন। আমার বাবার চোখের কোনের জল সূর্যের আলোতে চিকচিক করছে।

_ তুমি তো দেখোনি? তাহলে কিভাবে বুঝলে?
বেশ অবাক হয়েই কথাটা বললো রাহুল।

_ এটাই বাবা মেয়ের সম্পর্ক।

রাহুলদের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এলো। এসি করা গাড়িতে বসে বসে একটা কথা ভেবেই ঘামছে নুসরাত। আর সেটা হলো, রাহুলের মা ব্যাপারটা কে কোন চোখে দেখবে। তিনি হয়তো তার ছেলের জন্য অন্য কোন মেয়ে ঠিক করে রেখেছেন।


পর্ব ৬

রাহুলদের গাড়ি এসে থামলো খুব সুন্দর একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে। রাহুল গাড়ি থেকে নেমে নুসরাতর পাশে এসে দাঁড়ালো। অন্য পাশে রাহুলের বাবা। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলো নুসরাত। হঠাৎ রাহুল বলে উঠলো,

_ বাইরে টা দেখা শেষ হলে চলো ভিতর টা দেখা যাক।

_ আপনারা এভাবে আমার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? (অবাক হয়ে)

_ তুমি যদি হারিয়ে যাও। তাই তোমাকে আমি আর বাবা প্রটেক্ট করছি। (মুচকি হেসে কথা টা বললো রাহুল)

রাহুল আর তার বাবা দুজনেই হাসছে।

_ আংকেল! আপনিও উনার কথায় হাসছেন? (মন খারাপ করে কথাটা বললো নুসরাত)

_ আচ্ছা মা আর হাসবো না। তবে একটা কথা বলি। আমাকে আর আংকেল ডেকো না। বাবা বলে ডেকো।

_ কেনো? তোমাকে ও বাবা কেন বলবে?
বেশ রিয়াক্ট করেই কথাটা বলে ফেললো রাহুল।

_ আমার একমাত্র পুত্রবধূ তো আমাকে বাবা বলেই ডাকবে। এতে তুই এরকম রিয়াক্ট কেন করছিস?

_ রিয়াক্ট করছি কারণ….

_ কি কারণ মিঃরাহুল? ক্লিয়ার করে বলুন। কেন আমি আমার শশুড় কে বাবা বলে ডাকতে পারবো না?

_ আমরা কি বাড়ির সামনে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি ভিতরে যাবো।
নুসরাতর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথাটা বললো রাহুল।

বাসার কলিংবেলের আওয়াজ শুনে নিচে নেমে এলেন রাহুলের মা। দরজা খুলে দিতেই রাহুল তড়িঘড়ি করে উপরের রুমে চলে গেলো। ছেলের চলে যাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন তিনি। আজ অনেকদিন পর ছেলেকে তিনি দেখতে পেরেছেন। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রাহুলের মায়ের। হঠাৎ রাহুলের বাবা বলে উঠলো,

_ শুধু ছেলেকে দেখলেই হবে। যার জন্য ছেলেকে দেখতে পেরেছো তাকে দেখবে না রাহুলের মা?

রাহুলের বাবার কথায় রাহুলের মা সম্বিৎ ফিরে পেল। তিনি ঘুরে নুসরাতর দিকে তাকালেন। নুসরাত কিছুই বুঝতে পারছে না। নুসরাতর মাথায় শুধু রাহুলের বাবার কথাই ঘুরছে। নুসরাত ভাবছে।

_ বাবা কেন বললেন যার জন্য”ছেলে কে দেখতে পেরেছে”? এই কথার মানে কি? মিঃরাহুল কি উনার বাবা মা এর সাথে থাকে না? বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হয়েও তিনি আলাদা কেন থাকেন?
রাহুলের মায়ের ডাকে নুসরাতর ধ্যান ভঙ্গ হলো।

_ তুমি নুসরাত? আমার রাহুলের বউ?

_ মহিলা বেশ খুশি হয়েছেন মনে হচ্ছে! কিন্তু যেভাবে বিয়েটা হয়েছে এতে এত খুশি হওয়ার তো কিছু নেই। উনি কি সব কিছু জানেন তাহলে? কে বলেছে, মিঃরাহুল নাকি উনার বাবা? কথাগুলো ভেবেই রাহুলের বাবার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তে তাকালো নুসরাত।

_ আমিই সব বলেছি রাহুলের মাকে। তুমি কিচ্ছু ভেবো না মা।

নুসরাত রাহুলের মাকে সালাম করলো। রাহুলের মা নুসরাত কে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বাসার ভিতরে নিয়ে আসলেন। উপরে রাহুলের রুমটা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললেন তিনি। আর কাজের লোককে বললেন নুসরাতর ব্যাগ রাহুলের রুমে দিয়ে আসতে।

রাহুল মাত্র ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসেছে। হুট করে নুসরাত রুমে ঢুকলো।

_ কারো রুমে ঢুকতে গেলে নক করতে হয়। জানো না তুমি?

_ নুসরাত রাহুলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো, অবশ্যই জানি। তবে সেটা অন্যকারো রুমে, নিজের হাসবেন্ডের রুমে না। আর আজ থেকে এই রুম আপনার একার না। আমারও….

_ হ্যাঁ হ্যাঁ তোমারই রুম এটা। তুমিই থাকবে এখন থেকে এখানে। বেশ রেগে কথাটা বললো রাহুল।

_ তুমিই থাকবে কথার মানে কি? আপনি কি অন্যঘরে থাকবেন নাকি!

_ সেটা আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই।

নুসরাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রাহুলের দিকে। সামান্য রুমে নক করে ঢুকিনি জন্য এরকম ব্যবহার করছেন উনি?

_ কি হলো? তাকিয়ে আছো কেন? যাও ফ্রেশ হতে।

নুসরাত আর কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে গেল। এদিকে রাহুলের বাবা ফ্রেশ হয়ে এসে নিজের স্ত্রী কে আনমনে বসে থাকতে দেখে বললেন,

_ জানো রাহুলের মা, আমি ভাবতেও পারিনি রাহুল আমার কথায় গ্রামে যাবে বিয়েতে। যখন ফোনে যেতে বললাম তখন তো রাজিই হলো না। অথচ দেখো, যার বিয়ের দাওয়াতে গেলো এক্সিডেন্টালি সেই এখন ওর স্ত্রী।

_ মেয়েটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ। নাহলে দেখো, বাড়ি ছেড়ে অন্য ফ্ল্যাটে থাকা ছেলেটা আজ বাড়ি ফিরেছে। আমাদের সাথে এতদিন দেখাও করেনি রাহুল। যে মাকে না দেখলে ছেলেটার পুরো দিনটাই মাটি হয়ে যেত সেই ছেলে কিনা আজ দুমাস হলো আলাদা ফ্ল্যাটে থাকছে। কি হয়েছে ওর রাহুলের বাবা? আজ এতদিন পর আমাকে দেখলো, অথচ মা বলে একটা ডাক পর্যন্ত দিলো না আমাকে। ভাল করে দেখার সুযোগটা ও দিলো না। আমিতো আর কিছু ভাবতে পারি না।

রাহুলের মা কেঁদে ফেললো। একমাত্র ছেলে কে আবার তিনি কাছে ফিরে পেয়েছে। আনন্দ, বেদনায় মিশ্রিত অশ্রুজল বিসর্জন দিয়ে তিনি রাহুলের বাবার বুকে মাথা রাখলেন। রাহুলের বাবা চুপ করে স্ত্রী এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। স্বান্তনা দেবার ভাষা তার জানা নেই। ছেলে কেন হুট করে আলাদা ফ্ল্যাটে চলে গেল আর কেনই বা তাদের কারো সাথে যোগাযোগ রাখছে না সে কারণ টা যে তারও অজানা।


পর্ব ৭

রাত নয়টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ডিনার টেবিলে রাহুলের জন্য ওয়েট করে আছে রাহুলের বাবা, মা। নুসরাত রাহুলকে ডাকতে এসেছে রুমে। কিন্তু রাহুল নুসরাত কে ডিরেক্ট বলে দিয়েছে সে ডিনার করবে না। নুসরাত দরজার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রাহুলের মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলাচ্ছে।

রাহুল নুসরাতর কান্ড দেখে নিজের উপর চোখ বুলিয়ে নিলো। এভাবে কেন দেখছে মেয়েটা? সব কিছু তো ঠিক ই আছে। এই মেয়ের তাকানো তে এত অস্বস্তি হচ্ছে কেন আমার। ওকে কি জিজ্ঞেস করবো নাকি কি দেখে এভাবে?

চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে রাহুল জিজ্ঞেস করেই ফেললো

_ ওইভাবে তাকিয়ে কি দেখো? বললাম তো আমি খাবো না।

_ বাব্বাহ্! এভাবে কি দেখছি সেটা জানার জন্য দেখি মনটা আনচান করছে আপনার মিঃরাহুল!

_ মোটেও না। তোমার এভাবে তাকানো তে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। তাই বলেছি….

_ আমার তাকানো তেই যার এত অস্বস্তি, আমার হার্টবিট শুনতে পেলে না জানি তার কি অবস্থা হবে।

_ হোয়াট ডু ইউ মিন? তুমি কি তোমার বুকে আমার মাথা রাখার কথা বললে?

_ ওয়াও!”অ”বললেই আপনার অজগর মনে হয়, তাইনা?

_ এখানে অজগর কই থেকে আসলো আমি বুঝলাম না?

মেয়েটার কি মাথা খারাপ নাকি! গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সেটার কিছুই কি এই মেয়ের উপর প্রভাব ফেলেনি? আশ্চর্য! (মনে মনে)

_ আপনি সব বয়সের মানুষ দের জিজ্ঞাসা করে দেখবেন। ম্যাক্সিমাম মানুষ অতে অজগর ই বলবে। কারণ এটা কমন।
ঠিক তেমনি আমি যেহেতু আপনার বউ, সেহেতু হার্টবিট শোনার কথা বললে আমার বুকে মাথা রাখার কথাটাই আপনার আগে মনে হবে। এটাও কমন।

_ এই ধরনের উদ্ভট যুক্তি কই পাও তুমি?

_ আমি উদ্ভট যুক্তি দিচ্ছি না। দেখুন, হার্টবিট শোনার কথা বলতেই আপনি আমার বুকে মাথা রেখে শোনার কথা বললেন। অথচ আপনার একবারও মনে হলো না স্টেথোস্কোপ দিয়েও হার্টবিট শোনা যায়।

_ ইয়া আল্লাহ্‌! আমাকে বাঁচাও। কোন কুক্ষনে যে কথাটা বলতে গেছিলাম আমি।
অন্যদিকে ঘুরে বিড়বিড় করে বলতেই নুসরাত সামনে এসে দাঁড়ালো।

_ বিড়বিড় করে কি বলছেন জনাব? জোরেশোরে বলুন, আমিও শুনে ধন্য হই।

_ এই মেয়ে…..তোমাকে না বলেছি আমি খাবো না। চলে না গিয়ে আমার কথার পিছনে পরে আছো কেন?

_ আমি আপনার কথার আগেও নাই পরেও নাই। নিচে বাবা, মা আপনার জন্য না খেয়ে বসে আছে। আপনি না খেলে কেউ খাবে না। সো চলুন।

_ তুমিতো আছোই। উনাদের জোর করে খাওয়াতে পারছো না?

_ না পারছি না। কারণ ছেলের জায়গা ছেলের বউ নিতে পারে না। যে বাবা মা ছেলে না খেলে খাবে না বলে, তাদের ছেলের বউ কিভাবে খাওয়াবে? যেখানে ছেলে বাড়িতে উপস্থিত?

_ তুমি সেই কখন থেকে নিজেকে আমার বউ আমার বউ বলে আসছো। আমি তো তোমাকে কালই বলেছি, তোমাকে আমি স্ত্রী এর মর্যাদা দিতে পারবো না কখনো।

_ আপনি মানুন আর না মানুন। আপনার বাবা মা আমাকে ছেলের বউ হিসেবে মানে। যেভাবেই হোক আপনি আমার বর হয়েছেন। তাই আমিও আপনাকে স্বামী হিসেবে মানি।

_ রাহুল চুপ হয়ে গেল। এর সাথে শুধু কথায় কথা বাড়বে। এর চেয়ে নিচে গিয়ে খেয়ে আসা ভালো। ধুর (মনে মনে)

এই যে চলুন।

_ হ্যাঁ চলুন চলুন।
এত কথার ফায়দা তো হয়েছে। উনি সবার সাথে খেতে রাজি হয়েছেন। যেতে যেতে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলেই হেসে দিলো নুসরাত। যেটা রাহুলের নজর এড়ালো না।

_ এখন তো নিজেই বিড়বিড় করছো।

_ আপনার থেকেই তো শিখলাম একটু আগে।
কথাটা বলেই চোখ মেরে নিচে চলে গেল নুসরাত।

_ মেয়েটা সত্যি বড় অদ্ভুত। এত সহজে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সব কিছু ভুলে কি সুন্দর আগামীর পথচলা কে সহজ করে তুলছে। সবাই যদি ওর মত হতো তাহলে কষ্ট কারো জীবনে চিরস্থায়ী হতো না।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাহুল নিচে নামছে। আর ওইদিকে চোখেজল নিয়ে ছেলের নিজের কাছে আসার দিকে তাকিয়ে আছে রাহুলের মা। আজ তার ছেলে তার সামনে থাকবে। তার সামনে বসে খাবে এতদিন পরে। কথাগুলো ভেবেই রাহুলের মা ডুকরে কেঁদে উঠলো। নুসরাত তার শাশুড়ির চোখের পানি মুছে দিল। যদিও সে জানে না কেন তিনি কাঁদছেন।

রাহুল কোনদিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে টেবিলের দিকে আসছে। একটু আগে যদি সে দেখতো তার মা কান্না করছে, তাহলে হয়তো এই বাড়িতে রাত কাটানো তো দূরের কথা খাবার টাও সে খেতো না।

রাত প্রায় ১২টা বাজতে চলেছে। নুসরাত আর রাহুল ডিনার শেষে উপরে নিজেদের রুমে এসেছে। যদিও রাহুল অন্য রুমে শুতে চেয়েছিলো। কিন্তু বাবা মায়ের জন্য আর পারেনি সেটা।

নুসরাত ডিনার শেষ করে এসে নিজের কাপড় গুছিয়ে রাখার জন্য আলমারি খুললো। রাহুল বারান্দা থেকে রুমে আসতেই আলমারি খোলা দেখেই বললো,

_ আমার আলমারি খোলা কেনো? কে খুলেছে এইটা?

_ আপনি কি চোখে কম দেখেন? দেখতে পাচ্ছেন না কে খুলেছে? আজব লোক!

_ তুমি আমার আলমারি খুলে কি করছো?

_ দেখছি।

_ কি দেখছো?

_ ফুটবল, বাস্কেটবল, ভলিবল বা ক্রিকেট বল কোনটা পাওয়া যায়।

_ হোয়াট! আমার আলমারি তে এগুলো কেন থাকবে? আমি কি প্লেয়ার নাকি!

_ তাহলে আমি আপনার আলমারি খুলে কি করতে পারি? আমার কাপড় তো রাখতে হবে নাকি। হাওয়ায় তো আর ভেসে থাকবে না এগুলো।

_ এই তুমি কোন কথা প্যাঁচ ছাড়া বলতে পারো না, তাইনা?

_ না পারি না। এবার সরুন, আমাকে কাজ করতে দিন।

রাহুল সোফায় বসে ফোন ঘাটছে আর মাঝে মাঝে আড়চোখে নুসরাত কে দেখছে। নুসরাত নিজেও খেয়াল করলো সেটা। নুসরাত হাতের কাজ শেষ করে টুপ করে লাইট অফ করে দিলো।

_ কি হলো এটা?

_ লাইট অফ হলো।

_ সেটাতো দেখতেই পাচ্ছি। তুমি দেখছো না আমি সোফায় বসে আছি।

_ আপনি কি রাতকানা নাকি? বিছানায় শুতে শুতে কথাটা বললো নুসরাত।

_ মানে? আমিতো এখন অফিসের কাজও করতে পারি।

_ করতে পারেন না।

_ হোয়াট? আমি কি করবো না করবো সেটা কি তুমি ঠিক করে দিবা?

_ অন্য ক্ষেত্রে করবো কিনা জানি না। বাট আমার ঘুমের ক্ষেত্রে তো মাস্ট করবো। ইচ্ছে হলে ঘুমিয়ে পরুন। আর না হলে দয়া করে মুখটা চুপ রাখুন। আমি ঘুমাবো।

ঘুমাও। আর কোন কথা শুনতে পারবে না কাল থেকে। সবাই নিজেদের মত স্বাধীন থেকো। আমার জন্য তোমাদের কারো কোন ক্ষতি হোক সেটা আমি চাইনা। আমার বাবা, মা আর তুমি যে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ নুসরাত। তোমাদের ভালবাসি বলেই তোমাদের থেকে আমার দূরে থাকতে হবে। রাহুলের চোখ জোড়া ভিজে গেল কথাগুলো ভেবে


পর্ব ৮

খুব ভোরে সোফা থেকে উঠে নুসরাতর পাশে গিয়ে বসলো রাহুল। সারারাত সোফায় বসেই কাটিয়েছে সে। নুসরাতর পাশে গিয়ে বসে অনেক্ষন ধরেই তাকিয়ে আছে নুসরাতর মুখের দিকে।

_ কি আশ্চর্য একটা মেয়ে! দুঃখ, কষ্ট ভুলে নতুন করে সব কিছু শুরু করার কি সুন্দর চেষ্টা তার! মানুষ কে আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে।
আর আমার? আমার তো আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আপন করে নিতে পারি না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নুসরাতর কপালে পরে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে দিলো রাহুল। নুসরাতর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু পারছে না। দোটানায় পরে গেল সে। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেও হার মেনে নিয়ে শেষমেশ নুসরাতর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।

নুসরাত ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠলো। আর সেটা দেখে রাহুল লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।

_ উফফফ! আর একটু হলেই মেয়েটা জেগে যাচ্ছিলো। আর জেগে গেলেই তো আমার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে ছেড়ে দিতো। মুখে তো কিছুই আটকায় না এর।

অন্ধকার থাকতে থাকতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরলো রাহুল নিজের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে।

ভোরের আলো ফোটার কিছুক্ষণ পর নুসরাতর ঘুম ভাঙলো। চোখ বন্ধ করে পাশে হাত রাখতেই জায়গাটা ফাকা পেল।

_ তারমানে মিঃ রাহুল আজও বিছানায় ঘুমান নি। সোফায় ঘুমিয়েছে। এই লোকটা নিজেকে কি ভাবেন আমি বুঝি না।

চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে রাহুল সোফাতেও নেই। ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেখানেও নেই। রাহুল বারান্দায় আছে ভেবে নুসরাত ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসেও যখন রাহুল কে রুমে পেল না তখন সে ডাকতে লাগলো

_ মিঃ রাহুল, আর কতক্ষন বারান্দায় থাকবেন? রুমে আসুন।

উনি বারান্দায় এতক্ষন কি করছে। (চুল চিরুনি করছে আর ভাবছে নুসরাত)
বেশ কিছু সময় পার হওয়ার পরেও যখন রাহুল রুমে এল তখন নুসরাত গেল বারান্দায়।

_ মিঃ রাহুল আপনি…ওমা! উনিতো এখানে নেই। তাহলে নিশ্চয় নিচে বাবা মায়ের সাথে আছে। আমি শুধু শুধু বক বক করে যাচ্ছি।

নুসরাত নিচে নেমে সোজা কিচেনে চলে গেলো। ওখানে রাহুলের মা রান্না করছে।

_ এত সকালে উঠলে কেন। রাহুল টা মনে হয় এখনো ঘুমিয়ে আছে। (মিষ্টি হেসে কথাটা বললো রাহুলের মা)

_ উনি তো আমার আগেই উঠে গেছে মা। বাবার সাথে বসে গল্প করছে বোধহয়।

রাহুলের মা আর কোন কথা না বলে সোজা ড্রইংরুমে চলে গেল। পিছু পিছু নুসরাতও গেল। রাহুলের বাবা বসে বসে পেপার পরছিলেন। সেখানে রাহুল কে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো।

_ রাহুলের বাবা, রাহুল কোথায়?

_ রাহুল কোথায় মানে? দেখো এখনো ঘুমাচ্ছে মনে হয়। পেপার থেকে মুখ তুলে বললেন রাহুলের বাবা।

_ বাবা উনি আমার আগেই উঠেছেন। উনাকে রুমে না দেখে ভেবেছিলাম নিচে আপনার সাথে বোধহয় গল্প করছে।

রাহুলের মা ধপ করে সোফায় বসে কান্নাকাটি শুরু করলেন। রাহুলের বাবা স্বান্তনা দিচ্ছেন নিজের স্ত্রী কে।

_ আমি ভেবেছিলাম বিয়ে যেহেতু করেছে তাহলে আমার রাহুল আমাদের সাথেই থাকবে। কিন্তু আমার ছেলেটা তো আবারো চলে গেল রাহুলের বাবা। নতুন বউকে এখন কি বলবো আমি। কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বললো রাহুলের মা।

পাঠক আপনাদের জন্যই আমরা প্রতিনিয়ত লিখে থাকি। আপনাদের আনন্দ দেয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ। তাই এই পর্বের “কাছে আসার সাহসী গল্প” টি আপনাদের কেমন লাগলো পড়া শেষে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।

_ মা, কি বলছেন এসব। উনি হয়তো জগিং করতে গেছেন। দেখবেন একটু পরেই ফিরে আসবে। আপনি কাঁদবেন না প্লিজ।

নুসরাত শাশুড়ি কে কথাগুলো বললো ঠিকই। কিন্তু ওর নিজেরও কেন জানি মনে হচ্ছে রাহুল বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। অন্তত এই বাড়িতে আসার পর থেকেই সবার ব্যবহারে মনে হয়েছে উনি এই বাড়িতে থাকেন না।

_ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো বাবা।

_ বলো বউমা

_ উনি কি আপনাদের সাথে এই বাড়িতে থাকেন না?

রাহুলের বাবা চুপ করে আছেন। কিভাবে বলবে সে, তার একমাত্র ছেলে তাদের সাথে থাকে না। আর কেন থাকে না সেটাও তার অজানা।

_ কি হলো বাবা, বলুন?

_ রাহুল এই বাড়িতে থাকে না বউমা। আর কেন থাকে না সেটাও জানি না। আগে থাকতো। কিন্তু গত দুইমাস ওর কি হয়েছে আমি জানিনা।

_ কিছু মনে করবেন না বাবা, উনার কি আগে কারো সাথে কোন রিলেশন ছিলো? মানে উনি কাউকে ভালবাসতেন? আর উনার কোন ফ্রেন্ডস নেই?

বাবা, কথাগুলো আমি মা কেই জিজ্ঞেস করতাম। কিন্তু উনার এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত মনের অবস্থা এখন নেই। তাই আপনাকেই বলছি। আমার জানাটা খুব দরকার বাবা। প্লিজ বলুন।

_ আমার ছেলেটা কখনোই কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতো না। ৪বছর আগে রাহুলকে আমরা লন্ডন পাঠাই পড়াশোনার জন্য। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার ৩মাস আগে ও আমাদের ফোন করে জানায় ওর সাথে একটা মেয়ের খুব ভালো ফ্রেন্ডশিপ হয়েছে। আর দেশে ফেরার পরে ওরা বিয়ে করতে চায়। আমরা সব সময়ের জন্যই আমাদের ছেলের সিদ্ধান্ত কে সমর্থন করেছি। কেন করবো না, রাহুলের সিদ্ধান্ত সব সময়ই আমাদের জন্য সুফল বয়ে এনেছে। ৩মাস পরে ছেলে একেবারে বাড়ি ফিরে আসবে, ছেলের বিয়ে হবে এই সব কিছু নিয়ে আমি আর রাহুলের মা খুব এক্সাইটেড ছিলাম। আমরা রাহুলের বাড়ি ফেরার দিন গুনছিলাম। ওর ফাইনাল এক্সামের সময় হঠাৎ করে আমার হার্ট এ্যাটাক হয়। সময়মত হসপিটালাইযড করার জন্য মেজর কোন ইনজুরি হয়নি। আর ছেলের পরীক্ষা চলছিল জন্য তোমার শাশুড়ি ওকে কিছু জানায় নি।

আর এক্সাম নিয়ে রাহুল নিজেও খুব বিজি ছিলো। কথা খুব কম হতো ওর সাথে আমাদের। এক্সাম শেষে বাড়ি ফিরবে এমন সময় ভিসা জটিলতায় পড়ে আমার ছেলেটা। বাড়িতে ফোন দিয়ে জানায় ১৫ দিন পর ফ্লাইটে উঠবে। চলে আসার আগে বিদেশে ফ্রেন্ড দের সাথে আরো কিছুদিন আনন্দ করে থাকতে পারবে ভেবে আমরাও খুশি হয়েছিলাম। হঠাৎ রাহুলের ফোন একদিন বন্ধ পাই আমরা। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায় তবুও ছেলের ফোন বন্ধ পেয়ে দুশ্চিন্তায় পরে যাই আমরা। পরেরদিন সন্ধ্যায় রাহুলের ফোন আসে। রাহুল জানায় ফ্রেন্ডস রা মিলে পিকনিক করতে গিয়ে কার এক্সিডেন্টে সেই মেয়েটাই শুধু মারা যায় যাকে ও বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছিল।

আমার ছেলেটা খুব ভেঙে পরেছিল বউমা। অনেক বুঝিয়ে ওকে আমরা বাড়ি ফিরিয়ে আনি। ও কিছুতেই আসতে চাইছিলো না। ও বাড়ি ফিরে আসার এক সপ্তাহ পরেই আমার আবারো হার্ট এ্যাটাক হয়। হসপিটালে নেওয়ার পর ডক্টর রাহুল কে জানায় আমার হার্টে দুইটা ব্লক আছে। সার্জারি করতে হবে। রাহুল ওর মায়ের সাথে খুব রাগারাগি করেছিলো সেদিন। তাকে এতবড় একটা এক্সিডেন্টের খবর কেন জানায়নি তার জন্য। তারপর আমাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে বাসায় নিয়ে আসা হলো। আমি যখন প্রায় অনেকটা সুস্থ, ঠিক তারপরে একদিন সকালে রাহুল জানালো সে আর এই বাড়িতে থাকবে না। আলাদা ফ্ল্যাটে থাকবে। আমরা সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমরা অনুমতি দিয়েছিলাম। এতে যদি ছেলে ভাল থাকে তবে তাই হোক। আমরা এখনো সেই কষ্ট বুকে চেপে এখনো ছেলের স্ব ইচ্ছায় ফিরে আসার অপেক্ষা করছি।

কিন্তু ওর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ টা আমাদের আজও অজানা বউমা।

রাহুলের বাবা আজ কাঁদছে। অঝোরে কাঁদছে। ছেলেরা নাকি খুব বেশি কষ্ট না হলে কাঁদে না। আজ রাহুলের বাবার কষ্ট ঠুকরে বের হয়ে আসছে ভিতর থেকে। রাহুলের মা নিজের স্বামী কে স্বান্তনা দিচ্ছে। নুসরাত মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে। রাহুলকে সে বাড়ি ফিরিয়ে আনবে। যেভাবেই হোক। কিন্ত তারজন্য তাকে রাহুলের সাথে থাকতে হবে। এবং জানতে হবে কেন উনি এই মানুষ দুজনকে এত কষ্ট দিচ্ছে।


পর্ব ৯

পরেরদিন সকালবেলা লাগেজ গুছিয়ে রেডি হয়ে নিচে নামতে নামতে ৭টা বেজে গেল নুসরাতর। নিচে লাগেজ রেখে নুসরাত সোজা কিচেনে চলে গেল।

_ কি ব্যাপার বউমা! তুমি সকাল সকাল এরকম রেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছো? অবাক হয়ে নুসরাত কে জিজ্ঞেস করলেন রাহুলের মা।

_ আপনার ছেলের ফ্ল্যাটে যাচ্ছি মা। আজ থেকে আমি ওখানেই থাকবো।

নুসরাতর এরকম স্ট্রেট কথাতে রাহুলের মা একটা ধাক্কা খেল। তবে তেমন কিছুই বললো না।

_ চলে যেতে চাইলে আর বাধা দিবো কেন বলো। ছেলেকেই ধরে রাখতে পারলাম না নিজের কাছে। আর তুমি তো তার বউ।
যাইহোক, তুমি তো রাহুলের ফ্ল্যাট চেনো না। যাবে কিভাবে?

_ ড্রাইভার চাচাতো চেনে তাই না মা?

_ ও হ্যাঁ, উনি চেনে। তুমি তাহলে উনার সাথেই যাও।

রাহুলের বাবা ড্রইংরুমে বসে নিউজপেপার হাতে নিতেই লাগেজের দিকে চোখ গেল। সোফায় বসতে বসতে বললেন

_ রাহুলের মা, চা দিয়ে যাও। আর লাগেজ কেন এখানে? কেউ এসেছে নাকি যাচ্ছে?

নুসরাত হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে তার শশুরের কাছে গেল।

_ বাবা, আপনার চা।

_ দাও বউমা।

চা হাতে নিয়ে মুখ তুলে চাইলেন রাহুলের বাবা।
রেডি হয়ে আছো যে? তারমানে লাগেজটা তোমার? কোথাও যাচ্ছো নাকি?

_ নুসরাত তোমার ছেলের ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকবে। তোমার ছেলের সাথে।
রাহুলের মা বসতে বসতে বললো,

_ বাহ্, তাহলে তো ভালই হলো। ছেলেটা একা একা থাকে। বউমা থাকলে একজন সঙ্গী পাবে। কিন্তু রাহুল কি সেটা জানে?

_ কে জানাবে বলো। তোমার ছেলেতো মোবাইল নাম্বার, ল্যান্ডফোন নাম্বার সব চেঞ্জ করেছে।

_ তাহলে উপায় কি? নুসরাত বাসা চিনবে কিভাবে?

_ বউমা নিজেই উপায় বের করেছে। ড্রাইভার ভাই তো বাসা চেনে। সেই নিয়ে যাবে বউমা কে।
নুসরাতর দিকে তাকিয়ে বললো রাহুলের মা আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো বউমা। ওর যেন কোন কষ্ট না হয়।

নুসরাতর হাত ধরে কথাটা বলেই কেঁদে দিলো রাহুলের মা। নুসরাত তাকে জড়িয়ে ধরলো।

_ আপনি কোন চিন্তা করবেন না মা। আমি আপনার ছেলের সম্পূর্ণ খেয়াল রাখবো। আর আপনারাও নিজেদের খেয়াল রাখবেন কিন্তু। একদম অনিয়ম করবেন না।
দেখি, এত কাঁদলে আমি কিভাবে যাবো আপনাদের ছেড়ে বলুন তো! আর কান্নাকাটি নয় মা প্লিজ।
শাশুড়ির চোখ মুছে দিল নুসরাত।

_ আচ্ছা আর কাঁদবো না। ওখানে গিয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখবি তো মা। বল?

_ আমি চেষ্টা করবো মা। আপনার ছেলে যদি না চায় তাহলে একটু মুশকিল হয়ে যাবে। তবে আমি চেষ্টার কোন ত্রুটি করবো না।
আমি এখন আসি মা। দোয়া করবেন।
রাহুলের বাবা, মা কে সালাম করে গাড়িতে উঠে বসলো নুসরাত।

রাহুলের ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নুসরাতর পাক্কা দুই ঘন্টা সময় লাগলো। বাসার ড্রাইভার রাহুলের ফ্ল্যাটের সামনে নুসরাতর লাগেজ রেখে চলে গেল।
নুসরাত রাহুলের ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজালো। বেলের শব্দ শুনে রাহুলের ঘুম ভেঙে গেল।

_ কে এলো এই অসময়? শুক্রবারে যে একটু শান্তিতে ঘুমাবো সেই উপায়ও নেই। নিশ্চয় খালা এসেছে। বলেছিলাম ১১ টার পরে এসো। ধুর।

ঘুম ঘুম চোখেই মেইনডোর খুলে দিল রাহুল। দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই নুসরাতর হাসি মুখ দেখতে পেলো সে।
রাহুল নিজের চোখ কচলাচ্ছে বার বার।

_ গুড মর্নিং মিঃরাহুল। আপনি যা দেখছেন সেটাই ঠিক। আমি নুসরাতই স্বয়ং উপস্থিত। আপনার সেবায় আমি এখন থেকে সদা প্রস্তুত থাকবো

_ তুমি সাতসকালে আমার ফ্ল্যাটে কি করছো?

_ কি আর করবো বলুন। আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারছিলাম না। তাই চলে এলাম। রুমের ভিতরে ঢুকে গেল নুসরাত।

নুসরাতর কথায় রাহুলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কি বলে এই মেয়ে?

_ এমনভাবে তাকিয়েছেন, চোখ দুটো না তাদের স্থান ত্যাগ করে। সোফায় বসতে বসতে বললো নুসরাত।

_ মানে?

মানে আবার কি, এভাবে এত বড় বড় করে তাকালে চোখ তো আর স্বস্থানে থাকবে না। ঠিকরে বেরিয়ে আসবে।

_ ও মাই গুডনেস! এক হাত মাথায় আর আরেক হাত কোমড়ে রেখে বলে উঠলো রাহুল।

_ মাথা ব্যাথা নাকি কোমড় ব্যাথা মিঃরাহুল? ম্যাসাজ করে দিবো?

_ তুমি দয়া করে আমার বাসা থেকে চলে যাও। প্লিজ!

_ যাবো বলে তো আসিনি আমি।

_ তুমি এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য কি চাও বলো? তুমি যেটা চাও আমি সেটাই দিবো।

_ আপনি আপনার বাবা মায়ের সাথে একসাথে থাকুন। তাহলেই আমি যাবো।

_ ইম্পসিবল! আমি কখনোই তাদের সাথে থাকবো না। ইভেন তোমার সাথেও না। আর তুমি যদি চলে না যাও তাহলে আমিই যাচ্ছি।
রাহুল ঘুরে চলে যেতে নিলেই নুসরাত রাহুলের হাত টেনে ধরে।

_ তুমি আমার হাত ধরেছো কোন সাহসে!

_ আমি আপনার অর্ধাঙ্গিনী। আপনার হাত কেন, আপনার সব জায়গায় স্পর্শ করার অধিকার আমার আছে।

_ আমি সেই অধিকার দেইনি তোমায়।

_ কিছু অধিকার আপনা থেকেই তৈরি হয়ে যায় মিঃ রাহুল। দেবার অপেক্ষা রাখে না।

_ কাকে কখন কি অধিকার দিতে হয় সেটা এখন তোমার থেকে শিখতে হবে আমার?

এক ঝটকায় রাহুলের হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে রাহুলের গলা জড়িয়ে ধরলো নুসরাত। দুহাতে গলা জড়িয়ে রাহুলের নাকে নাক ঘষলো সে। গলা জড়িয়েই বললো

_ শিখতে হবে বৈকি! অনেক কিছুই শেখার বাকি আছে আপনার মিঃ রাহুল।
মুচকি হেসে ফিসফিস করে কথাটা বললো নুসরাত।

রাহুলের হার্টবিট বেড়ে গেছে তো তখনই, যখন নুসরাত তার হাত ধরেছিলো। কিন্তু এখন ভাবছে হার্টবিট মিস না হয়ে যায়! এই মেয়েটা ধরেছে তো ধরেছেই। আর ছেড়ে দেওয়ার নামই নিচ্ছে না!

চলবে

আপনার চেয়ে আপন যে জন
লেখিকাঃ বর্ণিলা বহ্নি

আরো পড়ুনঃ আপনার চেয়ে আপন যে জন – সিজন 2 । কাছে আসার অসমাপ্ত গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *