In the depths of love – ভালবাসার গভীরতায়

In the depths of love – ভালবাসার গভীরতায়: রাই এর হাতটা ধরে সামনে আনতেই রাই হাতটা সরিয়ে নিলো। আবির হালকা রেগে রাই এর দিকে তাকালো। রাই চোখ সরিয়ে নিলো। আবির জোর করে ওর হাতটা টেনে ধরলো। আর মলম নিয়ে লাগিয়ে দিতে লাগলো।


পর্ব ১

আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে মানি না। আর না মানতে পারবো। বলে বিছানার চাদর খামচে ধরলাম। সাথে সাথেই উনি আলতো ভাবে আমার ঠোঁটদুটো নিজের ঠোঁটের মাঝে নিলেন। চমকে উঠে বিছানার চাদর খামচে ধরেছি।

এক সেকেন্ড পরেই উনি আমার ঠোঁট ছেড়ে আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। হৃদপিন্ডটা রীতিমত বুলেট ট্রেন এর মত ছুটছে।
নিজের সিক্ত মাতাল গলায় বললেন কি বললে?
এমনভাবে বললেন যেনো শুনতেই পান নি। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম আ’ আমি আপনাকে। স্বামী হিসেবে মানি না

সাথে সাথে আবারো উনি আমার ঠোঁট নিজের ঠোঁটের দখলে নিয়ে নিলেন। তবে এবার আলতো ভেবে নয় একটু জোর করেই….
আমি ডান হাত দিয়ে তাকে দূরে ঠেলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাভ নেই। যথারীতি আবারো আমার ঠোঁট ছেড়ে আমার মুখ বরাবর এসে শান্ত কণ্ঠে বললেন আবার বলো

আমি কোনোকিছু বলার ভাষাটাই হারিয়ে ফেলেছি। কি বলবো.. বললে ও কি লাভ। উনি তো শুনছেন না।
আপনি কিন্তু….. বলতে না বলতেই আবারো একই কাজ। আমার ঠোঁট নিজের দখলে নিয়ে নিলেন। তবে এবার আলতো করে কামড় বসালেন। নিজেকে ছাড়িয়ে বললাম দেখুন আপনি…

কিন্তু আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ উনি দিলেন না। আমার মুখ নিজের বা হাতে চেপে ধরে গলায় মুখ গুজে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।
আমি ছাড়া পাওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু যতই হোক একটা ছেলের শক্তির কাছে মেয়েরা কখনোই পেরে ওঠে না। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। উনি খুব ভালো করেই জানেন আমি ওনাকে ভালোবাসি না। সম্ভব ও না। তবুও কেনো আমার সাথে এমন করছেন।

কিছুক্ষন পর আর কোনো উপায় না পেয়ে আমি এমনিতেই শান্ত হয়ে গেলাম। উনি ধীরে ধীরে নিজের মুখ তুলে নিলেন। আর আমার মুখের ঠিক সামনে নিয়ে এলেন। বা হাতটা সরিয়ে আমার ঠোঁট দুটোকে আলতো আঙ্গুল ছুঁয়ে যাচ্ছেন আর নাক দিয়ে আমার গাল ঘষতে লাগলেন।

ওনাকে এতো কাছে আমি সহ্য করতে পারছি না কেনো আমায় বিয়ে করলেন? খুব কি দরকার ছিল?
উনি আমার গালে আলতো করে চুমু দিলেন আর ফিসফিস করে বললেন কাওকে চিরতরে কষ্ট দেওয়ার মুক্ষোম রাস্তাটাই হলো নিজের কাছে বন্দী রাখা। আর এই সমাজে তার সবথেকে সহজ উপায় বিয়ে
বলে ঠোঁট থেকে আঙ্গুল সরিয়ে গেল ঘষতে লাগলেন।

কেনো? আমি আপনার কোন ক্ষতিটা করেছি? কিসের কষ্ট দিতে চান আর? এর থেকে বেশি আর কি কষ্ট দেবেন আমায়?
উনি মুচকি হাসলেন সময়ের সাথে সাথে কষ্টের ধরণ ও কারণ দুটোই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
বলে আবারো আমাকে টেনে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
দয়া করে ছাড়ুন আমাকে। আমি আপনাকে…..

আমার কথা শেষ করার আগেই আমার মুখ একহাতে চেপে ধরলেন উনি ও রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন
তুমি কি কোনোভাবে আমার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছো? আমি কি গুন্ডা নাকি ধর্ষক? কোনটা? খুব শখ দয়া নেওয়ার! ওকে…

বলেই উনি রীতিমত আমার ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। এই মুহূর্তে আমার উপরে ভালোবাসা নয় তবে আমার বলা একটি বাক্যের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের এই একটাই পথ ওনার কাছে। ব্যাথায় আমার চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে। আস্তে আস্তে উনি আমার শাড়ীর আঁচলটা ফেলে কুচিগুলো খুলতে লাগলেন।

শত ধাক্কা দিয়েও তাকে একচুলও নড়াতে পারলাম না, উল্টো আমার প্রতিটা আঘাতের জন্য ওনার অত্যাচার তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
কষ্টে চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম, আর কোনো উপায় নেই আমার…

গালে কিছু একটার স্পর্শ অনুভব হলো। এমনিতেই রাতে তেমন ঘুমোতে পারিনি, চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্তিভাব নিয়ে চোখ ডলতে ডলতে তাকালাম।

আমার পাশেই উনি আমার দিকে কাত হয়ে একহাত দিয়ে আমার গালে স্লাইড করে যাচ্ছেন। চোখ চড়কগাছ এ পরিণত হলো আমার। আচমকা সরে যেতে গেলাম, কিন্তু লাভ হলো না। উল্টো আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলেন উনি…আর রহস্যময়ী এক হাসি ওনার ঠোঁট ছুঁয়েই রয়েছে।

গতরাতের কথা মনে পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলাম তার ওপর থেকে।
উনি স্বাভাবিক গলায় বললেন মানুষ ৩ কারণে চোখে চোখ মেলাতে পারে না। হয় লজ্জা নয় ভয় আর নয়তো…

ঘৃণা আমি দৃঢ় কণ্ঠে প্রকাশ করলাম।
উনি আমার কথা তুচ্ছ করে হেসে গলায় মুখ গুজলেন মানুষ ঘৃণার ভাগটাও সহজে কাওকে দেয় না। আমি তো তাহলে ভাগ্যবান [[ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন]] – তোমার ঘৃণাই সই।
একটা আলতো ভাবে গলায় কামড় দিয়ে উনি তার হাতের বাঁধন আলগা করে দিলেন। আমি গায়ের চাদর জড়িয়ে তার থেকে দূরে সরে উঠে বসলাম।

উনি দুহাত মাথার নিচে দিয়ে আরাম করার মত ভাবে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমি আর কিছু না বলে খাট ছেড়ে উঠতে গেলাম। কিন্তু কপাল আমার ষোলো আনা খারাপ।
পা নামাতে গিয়েই শরীরের ব্যথার কারণে আর এগোতে পারছি না।

আড়চোখে তাকিয়ে দেখি উনি এখনো ওভাবেই শুয়ে আছেন। কোনো হেলদোল নেই।
খুব কষ্ট নিজেকে শান্ত করে আস্তে আস্তে উঠে দাড়ালাম। একপা দুপা সামনে দিতে গিয়েই আবারো পড়ে যেতে গেলাম। সাথে সাথেই খাট ধরে একটু ঠেক দিলাম। শরীরে অসহ্য ব্যাথা। হাটতে অনেকটাই কষ্ট হচ্ছে। আর ওদিকে উনি একটু সাহায্য টুকুও করছেন না।

আবারো হাঁটার জন্য পা বাড়ালাম পেছন থেকে মৃদু অনুরোধের সুর ভেসে এলো রাই….
থেমে গেলাম। উনি বললেন আজ একটা হলদে রঙের শাড়ি পরবে?
কথাটা যতই শুনতে মধুর হোক বা মোহময়ী হোক না কেনো, এখন তার এই ছোট্ট অনুরোধটি ও রাখার মত মানসিকতা আমার মাঝে নেই।

কিছু না বলে আস্তে আস্তে বাথরুমে ঢুকে গেলাম।
ঝর্না ছেড়ে অঝোরে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছি।
কেনো হটাৎ করেই জিবনটা এমনভাবে ঘুরে গেলো! কয়েকটাদিন আগেও তো সব ঠিকঠাক ছিলো। শুধু এই একটা মানুষের জন্যই আমার জীবনের চিত্রটাই বিষাদ হয়ে গেল। এই একটা লোকই চার চারটে জীবনের ছবি ঘুরিয়ে রেখে দিলেন।

কিছুক্ষন পরে বড়ো টাওয়েল পেঁচিয়ে দরজা হালকা খুলে বাহিরে একটু উঁকি দিলাম। ঘর পুরোই ফাঁকা। উনি কি নেই তাহলে? একপা একপা বেরিয়ে পুরো ঘরে চোখ বুলোলাম। নাহ নেই।
যাক ভালো…..

তাকিয়ে দেখি খাটের ওপরে একটা হলদে রঙের শাড়ি বের করে রাখা। দেখে ঠাণ্ডা মাথাটায় ও আগুন জ্বলে উঠলো। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম পরবো না ওটা

এগিয়ে আমার সুটকেস খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু আশ্চর্য। সুটকেসটা নেই। আমার সব কাপড়চোপড় তো ওটাতেই ছিলো। তাহলে?
মা কি কাল বিদায়ের সময় সুটকেস দিতে ভুলে গেলেন? আরে ধুর এখানেই তো ছিলো। কালকেই তো দেখলাম….. এ কেমন কথা বিয়ের পরেরদিন নাকি কাপড় খুঁজে পাচ্ছি না। হলো কিছু!

সরঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সুটকেস এট হদিস মিলল না। নির্ঘাত উনিই সরিয়েছেন। হ্যাঁ., যাতে আমি এই শাড়িটা পরি।
ভাবি…… ভাবি….. দরজা খোলো আর কতক্ষন? ভাইয়া তো এসে গিয়েছে এখন সবাই তোমার অপেক্ষা করছে। কই তুমি?

হ্যাঁ…. হ্যাঁ সুমি…. আসছি। তোমরা, আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি। বলেই তাড়াতাড়ি শাড়িটা নিয়েই বাথরুমে ঢুকে গেলাম। উপায় নেই।
একেই বলে ঝড় আসলে সবদিকই অন্ধকার।


পর্ব ২

হলুদ শাড়ি পরে ভেজা চুলগুলো কোনমতে আঁচড়ে আয়নায় দিকে তাকিয়ে আছি। কেনো? কারণ এই আয়নার ভেতরের দৃশ্যমান প্রতিবিম্বটাকে আজ আমার শেষ করে দিতে মন চাচ্ছে। তাকাতেও ঘৃণা হচ্ছে।

আজ আমি একজনের স্ত্রী। ইচ্ছেতেই হোক বা অনিচ্ছায়। কিন্তু হ্যাঁ (আয়নায় নিজের চেহারার উপরে হাত রেখে) আমি তার স্ত্রী। তার প্রতিটি স্পর্শের সাক্ষী এই আমিই। স্বামী হিসেবে নিজের সম্পূর্ণ অধিকার টুকু সে নিয়েছে।

এটাই কি স্বাভাবিক নয় রাই? তুচ্ছ হাসি বেরিয়ে এলো।
দরজায় ধাক্কার শব্দে হুশ ফিরে এলো। আবারো ডাকতে এসেছে বোধহয়।

এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। সুমি কোমরে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে এইযে ভাবি, আর কতক্ষন শুনি? সাজগোজ করতে করতে কি দিন পার করে দেবে নাকি?

জোরপূর্বক হেসে তাকালাম আসলে….. আমি আসছিলাম।
আর আসা লাগবে না চলো এবার বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
ড্রইং রুমে এসে আমি থেমে গেলাম।
কারণ আমার শ্বশুর…. অর্থাৎ জনাব

রেজোয়ান আহমেদ খুশিতে হৈ হুল্লোর করছেন। ড্রইং রুম ভর্তি অনেকগুলো মানুষ। যাদের মধ্যে ৩–৪ জনকে আমি চিনি। তারা সম্পর্কে আমার চাচী শাশুড়ি, চাচা শ্বশুর, আর বাদবাকি এরকমই অনেকে আছেন। আমার শ্বশুর লোকটা খুবই ভালো মনের বলা চলে। এক কথায় তাকে বাবা বলে সম্বোধন করাটাও ভুল হবে না।

উনি হাসিখুশি মুখে জোরে জোরেই বলছেন আরে কাশেম ভাই তুমি কেনো কিছু খাচ্ছ না? নাও মিষ্টিমুখ করো….. ভাবি আপনারাও নেন। আম্মা….[অর্থাৎ আপনার দাদী শাশুড়ি] আম্মা আপনি এইভাবে কেনো বসে আছেন।
বলছেন আর হাতে হাতে মিষ্টি ভর্তি পিরিচগুলো সোফার সামনের টেবিলে রাখছেন। ওখানে যতগুলো লোকজন উপস্থিত থাকুক না কেনো তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই মুখে হাসির ছিটেফোটাও নেই। শুধু কিছু কিছু মানুষকে আমি একটু খুশি দেখছি।

তার মধ্যে আমার এই ননদ সুমি, (আমার স্বামীর ফুফাতো বোন) আর দু একজন আছেন।
আর বাদবাকি আমার শাশুড়ি, দাদী শাশুড়ি, চাচা শ্বশুরের পরিবার এনারা কেউই এই বিয়েতে খুশি নন।
যথারীতি আমিও নই।

এই ভাবি, কি ভাবছো চলো? বলে সুমি আমাকে হাতের কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো।
আমি মাথা নেড়ে এগোতে যাবো কেউ তখনি আমার ডান হাতটা ধরে টান দিল আর পেছন দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।

এই ভাইয়া কোথায় নিয়ে যাস ভাবিকে এই? পেছন থেকে সুমি ডাকছে।
তাকিয়ে দেখি উনি আমাকে টেনে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।
আমাকে আমাদের ঘরে এনে হাত ধরে সোজা আয়নার সামনে দাড় করালেন উনি। আর এসে সোজা পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে আয়নায় আমার চোখের দিকে তাকালেন। আমি পুরোই অবাক।
কি করছেন কি? ছাড়ুন।

ওনার হেলদোল নেই। ওই একভাবেই আয়নায় আমার দিকেই তাকিয়ে আছে আর আমার ডান কাঁধে তার থুতনি রাখা, মুখে অনুসন্ধানী ভাব। কি দেখছেন এতো নিখুঁত পর্যবেক্ষণ দিয়ে?
শুনতে পান নি? ছাড়ুন।

বলে বিরক্তি নিয়ে তার প্রতিবিম্বের দিকে তাকালাম। নীল রঙের একটা পাঞ্জাবি, কিছু চুল কপালে এসে লেপ্টে আছে, তার শান্ত মন্থর দৃষ্টি খুব অন্যরকমের। চোখ দুটো কিছু একটা বলছে এমন। আচমকা একটা লজ্জা কাজ করলো। উনি এতো কাছে আবার এভাবে তাকিয়ে, তাই চোখ নামিয়ে নিলাম।

লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলে? (বলে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো) কিন্তু তুমি তো আবার ঘৃণা করো… তো?
অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। উনি বাক হেসে হাতের বাধন আলগা করে দিলেন আর আমাকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে দাড় করালেন। আমি মাথা নিচু করেই তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছি। উনি ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে একজোড়া ছোটো সাদা পাথরের ঝুমকো বের করে হাতে নিলেন [ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছি]

একটা ঝুমকো নিয়ে আমার গালে হাত স্লাইড করে কানের কাছে গেলেন আর ঝুমকোটা পরিয়ে দিতে লাগলেন।
পেছন থেকে কিছু চুল সামনে এনে আচড়ে দিলেন, হাতে দুটো স্বর্ণের বালা (যেটা তাদের বংশপরম্পরায় বউ দের দেওয়া হয়) সেটা পরিয়ে দিলেন।

অবশেষে ড্রেসিং টেবিলের উপরে একটা স্বর্ণের আংটি রাখা ছিল। এনগেজমেন্ট রিং বলা চলে। উনিই পরিয়ে দিয়েছিলেন।
গতকাল রাগের বশে খুলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। সেটাই উনি এনেছেন বোধহয়, আমার বা হাত ধরে অনামিকা আঙ্গুলি তে আস্তে আস্তে পরিয়ে দিলেন। তার দিকে তাকালাম।

উনি আংটির দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন নিজের পরিচয়কে ফেলে কি আদৌ বাঁচা সম্ভব?
মুখ তুলে আমার দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করলেন এটা তোমার পরিচয়। যেখানেই যাও না কেনো যাই করো না কেনো….. এখন থেকে তুমি শুধুমাত্রই এই পরিচয়ের অধীন। ঠিক না?

কথাটা সোজা বুকে গিয়ে বিধলো। চোখ সরিয়ে নিলাম। অসহ্য লাগছে। এটাকেই বোধহয় কষ্ট বলে। এমন চিনচিনে ব্যাথা মস্তিষ্কে হচ্ছে যা বলার মত নয়।
উনি টেবিল থেকে কাজলটা হাতে নিয়ে আমার দিকে একপলক তাকালেন। তারপর বাকা হেসে কজলটা রেখে দিলেন আর আমার হাত ধরে বললেন কাজল দিয়ে চোখের রাগটুকু ঢাকতে চাই না।

তোমার চোখের ওই রাগটুকুই কাজলের কাজ করে দেবে। বলে শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটার মতো করে দিলেন। আর হাত ধরে আবারো বাহিরে নিয়ে যেতে লাগলেন।
ড্রইং রুমে এসে আমরা দুজনেই উপস্থিত। সবাই গল্প করছিলেন। আমি গিয়ে সবাইকেই ভদ্রতার খাতিরে সালাম দিলাম। সুমি আর তার পরিবার বেশ ভালোই জানেন আমাকে। বাবা (আমার শ্বশুর) উঠে দাড়ালেন মা আয় এখানে।

এখানে বসে পড়। সবাই দেখ তোর অপেক্ষাতেই ছিলো।

আমার চাচী শাশুড়ি বলে উঠলেন কীরে আবির বাড়িতে বউ এনে কি ভদ্রতা ও ভুলে গিয়েছিস? হাত ছাড়
আবির রাই এর হাত আরো শক্ত করে ধরলো আর নির্ভীক কণ্ঠে বলে উঠলো ভদ্রতা ভুলি নি বিযায় তোমরা আজ এখানে উপস্থিত আছো…… আর (রাই এর দিকে তাকিয়ে) হাত ছাড়ার সময় এলে। ছেড়েই দিবো….

রাই অবাক চোখে আবিরের কথা শুনছিল। এই কথাটার মানে কি হতে পারে? এমন কথা কেনো বললো….
দাদী বলে উঠলেন সব কথার জবাব যে দিতেই হবে সেটা কেনো মনে করো দাদুভাই?

এখন ওকে বসতে দাও…..
আবির আর কথা বাড়ালো না। আমি গিয়ে একটা সোফায় বসে পড়লাম।
চাচা বলে উঠলেন

রেজোয়ান, তোর কোনো কথায় তো আমি কখনো অমত করি নি…. তাহলে আজ তুই কিভাবে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়েও নিলি আর আমরাই জানলাম না?

বাবা মুচকি হেসে উঠলেন কাশেম ভাই…. আমি হয়ত সিদ্ধান্তটা খুব দ্রুত নিয়ে ফেলেছি, কিন্তু ভুল নেই নি সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
চাচী বিরক্তিভরা মুখে বললেন ভাই আপনি তো সব জানেনই তবুও কিভাবে আবিরের সাথে এই মেয়ের বিয়ে দিলেন বলেন তো.!

আমার শাশুড়িও তাল মিলিয়ে ইজে রেগেই বললেন জিজ্ঞেস করো…. আর দেখো উত্তর পাও কিনা। আমার মতামতের প্রয়োজন বোধ এ বাড়িতে কেউই করে না।

রাই এই অপমানগুলো একটুও সহ্য করতে পারছে না। মাথা নিচু করে শুধুই একটা ভদ্রতা পালন করছে রাই। এনারা যদি কোনো সম্পর্কের মধ্যে না পড়ত তাহলে রাই এতক্ষনে এনাদের মুখের উপর জবাব দিয়ে দিত। কিন্তু সেটা সম্ভব না। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো।

তখনি একজন খুব ব্যস্ততার সাথে বাহিরে যাচ্ছিলো দেখে চাচা ডাকলেন এই নিয়াস কোথায় যাচ্ছিস দাড়া…… বড়ো ভাইয়ের কীর্তিকলাপ তো দেখে যা
আমি। এই নিশান কে বলতে না দিয়ে বাবা বললেন বসো এখানে
নিশান বিরক্তিভাব নিয়ে ঠিক রাই এর সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়লো।

আবির বাবার পাশেই দাড়ানো ছিলো। একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে আবির বলে উঠলো
এখানে কোনো ভাস্কর্যের প্রদর্শনী চলছে না। আর আপনারা কোনো বিচারক নন….. যে যা ইচ্ছে মন্তব্য করে যাচ্ছেন বলতে বলতে আবির রাই এর দিকে এগিয়ে গেলো আর ওর পাশেই বসে পড়লো।

ও এখন আবির চৌধুরীর স্ত্রী……রাই চৌধুরী…… বলে সবার দিকেই একটু কড়া চোখেই তাঁকালো আবির।
আবিরের কথা শুনে নিশান মাথা তুলে আবির এর দিকে আর রাই এর দিকে তাকালো।

বাবা পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠলেন তোমরা একটু বাড়াবাড়িই করছো এখন। আর রাই কে দোষা বন্ধ করো…..
বলে উনি একটা চামচে মিষ্টি তুলে রাই এর দিকে ধরলেন নে মা….

রাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিষ্টি টুকু খেয়ে নিল। গলা দিয়ে কিছু নামছে না।
সবাই কিছু না কিছু একটা খোটা আমাকে দিয়েই যাচ্ছে। অথচ আমি কি কিছু করেছি? আমার দোষটা কোথায় ছিল? চোখ ভিজে এসেছে। খুব কষ্ট চোখের পানি আটকে বসে রইলাম।

বিকেলের দিকে মা আর চাচীর একটা কথা কানে এলো। চাচী মা কে বলছিলেন তোমাকে এজন্যই আগেই বলেছিলাম আমার মেয়েটার সাথে আবিরের বিয়ে দিয়ে দাও। তুমি শুনলে না। এখন ছেলে যে মোচড় টা দিলো সহ্য করতে পারবে তো..
মা জবাবে বললেন ভাবি বিশ্বাস করো আমি কখনোই ভাবি নি এমনটা হবে। আমার রক্ত আমাকেই এমনভাবে ঠকালো……

সারাদিন সেভাবেই চলে গেলো। রাতে বারান্দায় বসে আছি। ঘরে যাবার ইচ্ছে নেই। ওই খাটে আমি শুতে চাই না। যেখানে উনি আছেন। যাবো না।
আজ সারাদিনে সকলে যতগুলো কথা শুনিয়েছেন তার একটাও ভুলতে পারছি না। চোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম সেগুলো।

শুধুমাত্র নীলা (চাচী শাশুড়ির একমাত্র মেয়ে) এর সাথে ওনার বিয়ে হয় নি বলে চাচী আমাকে এইভাবে বললো! আমি কি করেছি!বলে হাঁটুতে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলাম।

হটাৎ কেউ আমাকে ধরে থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুললো। দেখি আবির তাকিয়ে আছে। উনি আমার চোখের পানি আলতো করে মুছে দিলেন। আমি সাথে সাথে ওনার থেকে একহাত দূরে সরে গেলাম।
হাতদুটো গুটিয়ে আবির আমার পাশেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লো আর শূন্যে চোখ রেখে বললো কিছু স্বার্থপর মানুষের অযৌক্তিক কথায় কান্না করার মত মেয়ে, অন্তত আমি তোমাকে ভাবি নি……

তবুও তো কথাগুলো একমাত্র আমাকেই শুনতে হচ্ছে।. কাঁদো গলায় জবাব দিলাম।
উনি চোখজোড়া বন্ধ করে বললেন একমাত্র তোমাকেই!তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে যেখানে তোমার আমার নামটাই এখন এক সেখানে কথাগুলো একমাত্র তোমাকেই শুনতে হলো এমনটা ভাবার কারণ?

চাই না আপনার নাম। চাই না এই পরিচয়, যেখানে আজীবন শুধু আমাকে সহ্যই করে যেতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে আবির রাই এর বা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। আর ওর ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটের ভাজে নিয়ে নিলো।

ক্রমেই যেনো তা কামড়ে পরিণত হচ্ছে। রাই আবিরকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে গেলো। কিন্তু উল্টো নিজের ব্যথার পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়িয়ে নিলো।
রাই এর কোমরে হাত দিয়ে ওকে আরো কাছে টেনে নিল।

কিছুক্ষন পর রাই এর ঠোঁট ছেড়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গেলো আবির
এই নাম, এই পরিচয় আর এই (কোমরে হাত দিয়ে চেপে ধরে) আমিকে নিয়েই তোমাকে সারাটি জীবন বাঁচতে হবে……আর এই আমিটা তোমার সাথে এমনভাবেই মিশে গেছে যে (গালে গভীরভাবে চুমু এঁকে) তোমার থেকে আসা গন্ধটুকু তেও এই আমিটাকে তুমি খুঁজে পাবে…..

বলে উঠে আমাকে সোজা একটানে দাড় করিয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলো। অন্ধকার ঘরটায় আমি মোটামুটি অন্ধের মতই হেঁটে যাচ্ছি। ঘরে ঢুকেই আমাকে খাটের উপর ফেলে উনি আমার পাশে শুয়ে পড়লেন বারান্দায় থাকার থেকে বেশি কষ্ট বোধহয় আমার পাশে থাকার তাইনা হলদেটিয়া?

বলে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেন উনি। আমি ছোটাছুটি করার চেষ্টাও করছি দেখুন আপনি সবসময় এই ধরনের বাড়াবাড়ি করছেন। আমি কিছু বলছি না মানে এই না যে…..
হলুদ শাড়িতে খুব মানায় তোমায়, হলদেটিয়া উনি স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন।

হলদেটিয়া! শুনে বুকটা কেঁপে উঠলো। আমি……
আমার মুখ শক্ত করে চেপে ধরলেন আর বাকা হেসে বললেন
ইনজয় দিস হেল। রাই…. বলে আমার ঠোঁট নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলেন আর শাড়ির আঁচল শক্ত করে চেপে ধরলেন।


পর্ব ৩

মাঝরাতে ঘুম ভেংগে গেল….. একটু নড়ব যে সেই জায়গাটুকু ও নেই। আবির আমাকে এভাবেই জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। কি কপাল আমার, এতো ভালোবাসা পেয়েও আমি তা চাইছি না। অথচ অন্য কেউ হলে হয়তো সব ভুলে আবিরকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো।

কিন্তু আমিই হয়তো পারবো না….. জানিনা… ঠিক ১ টো মাস আগে তো জিবনটা অন্যরকমই ছিলো। রাই চোখ বন্ধ করে চলে গেলো নিজের সেই দিনগুলোয়, একটু অনুসন্ধান করতে, ঠিক কেনো তার এসব সইতে হচ্ছে….

এই রাই….. রাই….. কোথায় তুই কতক্ষন লাগবে আর?
উফফ চেঁচিয়ে তো কান ঝালাপালা করে দিচ্ছ একদম মা….. তুমি এমন কেনো? বলতে বলতে বেরিয়ে এলো রাই……

মহারানী আমার…. আপনার জন্য বাস বসে থাকবে না….. চলেন
বলে মিসেস সাবিনা সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন…… রাই ও নিজের ব্যাগটা নিয়ে নামছে।
নিচে নেমে তো বাবার ও ঝাড়া ঝাড়ি শুরু বাসের মধ্যে তোর মেকআপ এর দিকে কে তাকাবে শুনি? এতো সময় লাগে নিচে নামতে?

রাই মুখ ফুলিয়ে রইলো। ছোটো ভাই তামিম বললো আপু তুই একটু বেশিই করিস…..
আমি মোটেও সাজগোজ করি নি
তো দেরি হয় কেনো তোর? মা চেচিয়ে উঠলো।

এখন এনাদের কিভাবে বলবে রাই যে ও রেডি হয়ে এসে দেখে ওর জামাই মেহেদীর দাগ। গত শুক্রবারে মেহেদী লাগাতে গিয়ে লেগেছিল। মা জানেনা। তাই আবারো জমা বদলাতে হলো। কিছুনা, এখন আমাকে না বকে চলো তো।
বলে রাই হাঁটা শুরু করলো। ওনারা আর কিছু বললেন না। ভালো। মেইন রোডে এসে কিছুক্ষন দাড়ানোর পরই গাড়ি পেলাম একটা।

কতদিন পর গ্রামে যাচ্ছি নিজেও ভুলে গেছি। ৩ ঘণ্টার মধ্যেই বাড়িতে থাকবো আমরা।
তবে এইবার বাড়িতে যাওয়ার কারণ শুধু ছুটি কাটানো নয়। বরং আমার খালাতো বোনের বিয়ে তাই যাওয়া হচ্ছে। বাসের মধ্যে ছোটো ভাইয়ের সাথে খুনসুটি করতে করতে অবশেষে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে এসে পৌঁছলাম। অর্থাৎ বড়ো খালামনির বাড়িতে।

বাস থেকে নেমে আশপাশটা দেখতে লাগলাম। সেই অপরূপ গ্রামবাংলা।
তামিম গিয়ে পাশের ছোটো বরই গাছ থেকে পাতা ছিড়তে লাগলো।
মা বললো কতদিন পরে আসলাম

বাবা জবাব দিলো আমিই তো চিনতে পারছি না, প্রায় ৪ বছর পরে এলাম এই গ্রামে
মা বললো হ্যা…. চেনাই যাচ্ছে না। এই রাই… তামিম তোরা আমাদের সাথেই থাকিস। পরে দেখা গেলো হারিয়েই গেলি….

মায়ের কথায় বাবা হো হো করে হেঁসে উঠল। আমি আর তামিম বাকা চোখে তাকালাম নাইস জোক
আমি দুহাত প্রসারিত করে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করার চেষ্টায় ব্যস্ত।একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিলাম এই ঘাস, পাতার গন্ধ পেতে…. কিন্তু ২ সেকেন্ড পরই নাকে একটা বাজে গন্ধ এলো। চোখ মুখ খিচে তাকালাম। সামনে তাকিয়ে দেখি গরুর গোবর পড়ে আছে….. মোটামুটি আমার এহেন কাণ্ডে বাবা, মা আর তামিম গগণবিদারি হাসি হেসে উঠলো…..।

মেজাজটা কোন গাছের চূড়োয় যে উপনীত হলো কি আর বলবো…..
আরো নে গন্ধ বলে তামিম ভেংচি কাটে…..
আমিও তাই করি। বাবা মা আমাদের থামিয়ে একটা ভ্যান ঠিক করলো। এখান থেকে ১০ মিনিটের পথ ভ্যানে
যাবো…..

বাড়ির বড়ো স্টিলের দরজার সামনে এসে পৌঁছলাম। ভ্যান থেকে নেমেই তামিম দৌড়ে ভেতরে চলে গেল আর খালামণিকে ডাকতে লাগলো।
খালামণি আর আবার খালাতো বন সুরাইয়া বেরিয়ে এলো। আমি গিয়ে সুরাইয়া কে জড়িয়ে ধরলাম। কেমন আছিস সুরাইয়া?
ভালো, তুই কেমন আছিস…?

আপু কেমন আছো বলে মা খালামনির দিকে এগিয়ে গেলো।
খালামণি আমাকে জড়িয়ে ধরলো নে সবাই বাড়ির ভেতরে চল। বাহিরে কতক্ষন দাড়াবি?
অনেক ক্ষুধা লাগছে খালামণি বলে তামিম পেটে হাত ডলতে লাগলো।

চল দুষ্ট বলে খালামণি ওর কান ধরে নিয়ে যেতে লাগলো।
বাড়ির ভেতরে গিয়ে সব আত্মীয়র সাথে কুশল বিনিময় করে নিলাম।
নানুর সাথে গিয়ে আড্ডা জমিয়ে দিলাম আমি। আমার নানুর সাথে আমার কলিজা কলিজা সম্পর্ক। কতদিন পর সবাইকে দেখলাম।

সন্ধ্যায় সব মহিলা দল খাটে বসে গল্প করছে। গল্পের মূল বিষয় সুরাইয়ার বিয়ে, পাত্র খুজছে।
বিভিন্ন পাত্রের ছবি দেখছে সবাই আর এক এক রকমের মন্তব্য ছড়াচ্ছে।
এই ছেলের চোখ ভাল না বললো এক খালা।

সুরাইয়া বলল এইজন্য তোমার মেয়ের কপালে এমন শাশুড়ি জুটেছে
খালা বলে উঠলো বাপ তোর কপালে তো ভালো বর জুটুক
আমার মা বললো আচ্ছা এই ছেলেটা কেমন আপু?

খালামণি দেখে বললো আরে এই ছেলেটাকে কিন্তু আমার খুবই পছন্দ আছে….
তাকিয়ে দেখলাম সুরাইয়া চুপ করে আছে। ওকে ধাক্কা দিয়ে বললাম কীরে লজ্জা পাচ্ছিস নাকি?
উপস্থিত সবাই হেসে দিল।

খালামণি বললেন এই ছেলের পরিবার আসবে আগামী পরশু দিন। ছেলের বাপের ব্যবসা সামলায় আর ভালো শিক্ষিত…. দেখতেও খারাপ না। পরিবার বেশি বড়ো না। ঢাকায় থাকে। আর এইতো ওদের গ্রামের বাড়িতেও ভালো একটা বাড়ি আছে। সব মিলিয়ে তো আমার ভালই লাগলো

মা একটু মশকরা করে বললো আগে পাত্রীকে তো জিজ্ঞেস কর কেমন লাগলো
সবাই সুরাইয়ার দিকে তাকালো। সুরাইয়া লজ্জায় আর কিছুই বললো না।
সেরাতের মতো হাসাহাসি করে ভাই বোনদের সাথেই কাটিয়ে দিলাম।

দুদিন পরে বিকেলের দিকে হাতে ঘড়িটা পরছি আর সিড়ি দিয়ে নেমে উঠানে এসেছি মাত্রই, দেখি যতসব আয়োজন চলছে। আজ পাত্রপক্ষ আসার কথা ছিল দুপুরে। কিন্তু কি যেনো একটা সমস্যার জন্য তাদের নাকি আসতে দেরি হবে। তাই ভাবলাম ততক্ষণ একটু নদীর পাড় দিয়ে ঘুরে আসি…… সুরাইয়া তো শাড়ি পরে সং সেজে বসে আছে।

আমি আবার পুতুল সেজে বসতে পারবো না।
উঠানে আসতে পারলাম না মা শুরু হয়ে গেল কই যাচ্ছিস তুই? এখনি পাত্রপক্ষ আসবে যা সুরাইয়ার কাছে গিয়ে বস।

হ্যাঁ হ্যা যাচ্ছি বলে পেছনে দুপা গিয়ে যেই দেখলাম মা অন্য কাজে হাত দিচ্ছে, এক দৌড়।
বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড় পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় এসে পড়লাম। সাথে আমার চেলাপেলা যত বোনরা ছিলো
সেগুলোকেও নিয়ে নিলাম। সবাই একসাথে হৈ চৈ করতে করতে নদীর পাড় এ গেলাম। প্রায় ১ ঘণ্টার মতো ঐখানেই ঘুরলাম ফিরলাম আর ছবি তুললাম। তখনি এক বোন বলে উঠলো এই রাই….. বাড়ি যাবি না? পাত্ররা মনেহয় এসে গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ঘড়িটা দেখি।
১ ঘণ্টা পার! চল চল বাড়ি চল

বলে সব উঠে দাড়ালাম। নদীর থেকে পা হাত ধুয়ে নিলাম। এতক্ষনে মাটি ধুলোবালি ছিটেছে……
হাটতে হাটতে বাড়ির ঠিক সামনে আসতেই কিছু হৈচৈ এর মতন অনেক শব্দ শুনতে পেলাম। যেনো অনেক মানুষ একসাথে কথা বলছে।

গিয়ে দেখি আমাদের কাকী চাচিরা কথা বলছে। বাড়িতে ঢুকতে প্রথমে একটা টিনের ঘর পড়ে, এটায় এক চাচীরা থাকেন। আর তারপরেই আমার খালামনির দোতলা বাড়ি।
ওহ এনারা কথা বলছে ভেবে স্বস্তি পেলাম। ছেলেরা আসেনি তবে….

যাক বাকি বোনেরা যে যার মতো চলে গেলো… আমি নিশ্চিন্ত মনে হেলতে দুলতে আমাদের বাড়ির কাছে এসে গেলাম। আশেপাশে কিছুই খেয়াল করি নি। আমার আবার অভভ্যাস আছে, মাঝে মধ্যে ছিটি বাজাই…..
তো আমি বাঁশি বাজাতে বাজাতে হেলতে দুলতে সোজা সুরাইয়া যে রুমে ছিলো সেই রুমে ঢুকে গেলাম। হাতে ফোন ছিলো, আমি ফেসবুক দেখছিলাম আর হাঁটছিলাম।

অতঃপর রুমে ঢুকে ছিটি বাজাতে বাজাতে যেই উপরে তাকাই আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে……
কতগুলো মানুষ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। পাশে তাকিয়ে দেখি মা, আর খালামণিও আছে।
ভেবাচেকা খেয়ে মুখ থেকে জোরেই বাঁশির আওয়াজ বেরিয়ে এলো।

সাথে সাথে নিজেকে সামলে মুখ বন্ধ করে নিলাম। মাথায় এলো লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার আগে এখন থেকে কেটে পড়তে হবে। সেভাবেই পেছনে ঘুরে দিলাম দৌড়… ৪ কদম যেতেই কেউ ডেকে উঠলো।

এই দাড়াও দাড়াও…… থমকে গেলাম। চেহারাটা যে কি বলবো আমি কি যে বানিয়ে ফেলেছি। শালা পালাতেও দিলো না। মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে আস্তে আস্তে ঘুরে দাড়ালাম।

খাটের উপরে বসে আছে একটা লোক। পোশাকে খুব সম্ভ্রান্ত ধরনেরই মনে হলো। (বড়লোক বড়োলোক)
তিনি বললেন এখানে আসো….

আমি কোনমতে হেসে এগিয়ে গিয়ে তাদের সালাম দেই। সবাই উত্তর নিলো। লোকটি বলল তুমি?
খালামণি বলে ওঠে হেহে। ও পাত্রীর খালাতো বোন….

লোকটি ও ও বলে মাথা নাড়লো…. পাত্রী! আমি অবাক….
আমি খাটের যে প্রান্তে দাড়ানো ঠিক সেখানেই একজন বসে। মাথায় ঘোমটা। আমি ডানে ঘুরে ঘোমটার সামনে মুখ এনে তাকিয়ে দেখি সুরাইয়া ওপস…. বলে সোজা হয়ে দাড়ালাম। মানে পাত্রপক্ষ এনারাই…

হ্যাঁ…. আমি ওর বোন বললাম।
সাথে সাথে লোকটির পাশে চেয়ারে বসা এক ছেলে হেসে উঠে দাড়িয়ে পড়লো আরে…. বেয়াইন সাহেবা…. বলে আমার দিকে দুবাহু প্রসারিত করে এগিয়ে আসতে গেলো।

ঘটনা দেখে তো আমি আকাশ থেকে পড়লাম তার দিকে হাত তাক করে দুকোদম পিছিয়ে গেলাম আরে আরে
বেঁয়াইন কি ভয় পায় নাকি? বললো ছেলেটি।

এমন ষাঁড়ের মতো চেঁচালে সবাই ভোট পাবে আস্তে করে বললাম।
বাকিরা সবাই অবাক। সেই লোকটি বলে উঠলো নিশান।
ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে ফিরল। আর দুষ্টু হাসি হেসে পিছিয়ে গিয়ে নিজের জায়গাতেই বসে পড়লো।

মা একটু হাসলো ভাই। আপনারা নেন না। কেউ কিছু খাচ্ছেন ই না।
তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম খাটের উপরে ৪ জন বসা…. দুটো মাঝ বয়সি লোক আর ৩ য় জন সয়ং পাত্র…. (দেখতে কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম) আর তারপর আমার বোন।

আর ঘরে মা খালা, আর আরো অনেকে আছেন। খালু নেই। উনি পুলিশের চাকরি করেন। তাই ছুটি করতে পারেন নি। তাই আমরাই পাত্র দেখবো।
খাটের সেই লোকটি বলল তোমার নাম কি?

আমি স্বাভাবিক স্বরে বলি রাই….
ভালো ভালো…. আমি হলাম রেজোয়ান হোসেন…. আর এই হলো পাত্র (ছেলের দিকে হাত তুলে) আর ইনি পাত্রের বাবা (২ য় লোকটাকে দেখিয়ে)
আমি সৌজন্য হাসি হাসলাম।

উনি আবারো বলে উঠলেন আমি পাত্রের আঙ্কেল হই…. আর এই হলো আমার ছোটো ছেলে নিশান…..আর বড়ো ছেলে আবির….
আমি তার কথা মতই সবার দিকে তাকিয়ে নিশান এর দিকে তাকালাম। ছেলেটা কেমন শয়তানি হাসি দিয়ে রেখেছে।
আর যখন উনি বললেন আবির…. আমি পাশে থাকা ছেলেটার দিকে তাকাই।

আর একপলক এর জন্য আটকে যাই….. বেশ লম্বা দেখতে… সুঠাম দেহ…. জিম করে দেখলেই বলে দেওয়া যায়। একটা লাল টিশার্ট আর কালো জ্যাকেট পরা…. চুলগুলো মারাত্মক সুন্দর ভাবে ডান চোখের সামনে এসে পড়েছে। চেহারায় একটা অন্যই রকম আভা ফুটে আছে।

সে ও আমার দিকে তাকালো। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নেই।
খালামণি আর পাত্রের বাবা বিভিন্ন কথা বার্তা বলেছেন। আর রেজোয়ান আঙ্কেল ফাঁকে ফাঁকে আমাকে দু একটা প্রশ্ন করছে। তার উত্তর দিচ্ছি।

পাত্রের বাবা বলে উঠলেন ভাবি… আসতে তো দেরি হতো না…. তবে বন্ধুকে ফেলে আসতে চাই নি…. (পাশে রেজোয়ান হোসেনের কাঁধে হাত রেখে) রেজোয়ান আর আবির গতরাতেই দেশে ফিরে আসার কথা ছিল। আসতে পারেনি। আজ আসলো। ওদের নিয়েই আসতে চেয়েছিলাম তাই আজ দেরি হয়ে গেলো
আমি আবার একটু বেশিই কৌতূহলী আঙ্কেল আপনারা দেশের বাহিরে থাকেন?

উনি বললেন না। ব্যবসার কাজে আমরা দুজনে একটু বাহিরে গেছিলাম। আমার ছেলেই মূলত সামলায় সব ব্যবসার কাজ…..
ওহ। কোন দেশ? আবারো প্রশ্ন করলাম।
এদিকে মা চোখ গরম করে তাকালো।

আঙ্কেল হেসে উঠলেন এইতো প্যারিসে ছিলাম।
ওহ…. আমার খুবই প্রিয় একটা জায়গা প্যারিস খুশি হয়ে গেলাম আমি
তাই নাকি.?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

এবার তো আঙ্কেল একে একে প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন আমিও উত্তর দিচ্ছি। কিছুক্ষন পর পাত্রের বাবা কাশি দিয়ে উঠলেন তো….. ভাবি… পাত্রী আর পাত্র আলাদা গিয়ে কথা বলুক নাকি!
খালামণি বললেন হ্যাঁ হ্যা ভাই…. সুরাইয়া। যাও…. মিহিরকে নিয়ে যাও….
সুরাইয়া মাথা নেড়ে খাট ছেড়ে উঠে দাড়ালো।

তাকিয়ে দেখি পাত্র খুব হাসি মুখে আছে। আমি সুরাইয়াকে একটু টেনে কানে কানে বললাম আমিও আসি?
ও একটা থাপ্পড় দিয়ে চলে গেলো ভেতরের ঘরে…… আমি হাসছি।
কিছুক্ষন পর তাকিয়ে দেখি নিশান আমার দিকেই তাকিয়ে আছে…..
আবিরের দিকে তাকালাম।

দেখি উনি একটা ভাব নিয়ে নিজের রণ টিপছে।
ভাই একটা জায়গায় আসছিস… ফোন না দেখলে কি হয় না নাকি? ম্যানার নাই মনে মনে ভাবলাম…
তবে যাই বলো, ছেলেটা ক্রাশ খাওয়ার মতই…… ভেবে মনে মনে হেসে দিলাম।


পর্ব ৪

কিছুক্ষন পরে পাত্র পাত্রী ফিরে আসে। খালামণি গিয়ে সুরাইয়াকে জিজ্ঞেস করে ওর পছন্দ হয়েছে কিনা। আর এদিকে পাত্র কেও তার বাবা জিজ্ঞেস করে।
রাই অতি আগ্রহের সাথে দেখছিল, দেখে দুজনেই হ্যাঁ বলেছে।

সবাই খুশি হয়ে একে অপরকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। দুপক্ষ মিলে বিয়ের তারিখ ও ফিক্স করে ফেললো।
রাই মিহিরের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বললো কি দুলাভাই। সেকেন্ডের ঘরেই হ্যাঁ করে দিলেন। এতো পছন্দ হয়েছে!

ভেবেছিলাম ভাইয়া খুব শান্তশিষ্ট। কিন্তু আমাকে পিছে ফেলে উনি বললেন আরে শালি সাহেবা। আপনার জন্যই তো তাড়াতাড়ি হ্যাঁ বললাম। শীঘ্রই আবারো দেখা করতে হবে না? বলে মিটিমিটি হাসলেন।
রাই হাসতে হাসতে সেখান থেকে সরে এলো। সবাই এখন সবাইকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছে। রাই গিয়ে মিহিরকে মিষ্টি খাইয়ে দিলো।

এই ফাঁকে নিশান এসে রাই এর মুখের সামনে মিষ্টি ধরলো। রাই মাথা নেড়ে না করে দিল। বাকিরা অতটা লক্ষ্য করেনি নিশান আর রাই কে।
নিশান রাই এর ঠিক মুখের সামনে এসে দাড়ালো নতুন সম্পর্কের শুরু। মিষ্টিমুখ দিয়েই হোক? খুব আস্তে করে বলল। রাই ব্যতীত কেউই শুনতে পায়নি।

রাই এর চোখ ডিম এর মত বড়ো বড়ো হয়ে গেল।
নিশান একগাল হেসে জোরেই বলে উঠলো আরে এখন তো আমরা বেয়াই বেয়াইন….. মিষ্টিমুখ করেন….। (সবার অগোচরে বাকা হেসে তাকালো) বোঝেননি?

বলে রাই এর মুখে মিষ্টি ঠেলে দিল।
না চাইতেও রাইকে খেতেই হলো।
বাকি সবাই হাসাহাসি করছে। কেউ নিশ্চই বোঝেনি নিশান কি বুঝিয়েছে কিন্তু, রাই ঠিকই বুঝেছে।

জবাব দেওয়া ফরজ। তাই এই ও শয়তানি হাসি হেসে একটা আস্ত কালোজাম চামচ দিয়ে নিয়ে নিশান এর সামনে ধরলো। নিশান হা করতেই রাই দ্বিগুণ জোরে ওর মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলো ঠিক বলেছেন… বেয়াই …
নিশান আর রাই যেনো চোখে চোখেই এক অদৃশ্য যুদ্ধের ঘোষণা করে দিল। ঠিক ইঁদুর বিড়াল এর মত। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে দুজনই দুজনকে সুযোগ পেলেই পেরেসান করবে।

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই হাত মুছে উঠে যাচ্ছে… কিন্তু রাই দেখলো আবির কিছুই খেলো না।শুধু দুটো মিষ্টিই খেয়েছে।
ভাব। যতসব… বড়লোকের ছেলে হলে যা হয় আরকি… মনে মনে ভাবছে আর আবিরের দিকে কটু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাই।

হটাৎ করেই আবির রাই এর দিকে তাকালো…. আচমকাই রাই ভয় পেয়ে গেল, যদি ওর চেহারার ভঙ্গি দেখে আবির কিছু ভাবে! একটা শুকনো ঢোক গিলে নিলো রাই… তখনি আবির উঠে দাড়ালো।

আর রাই এর দিকে এগোতে লাগলো।
রাই এর পরাণ যায় যায় অবস্থা…. এদিকে কেনো আসছে? ‘ কপাল থেকে ঘাম ছোটার উপক্রম।

ক্রমেই আবির রাই এর দিকে এগোচ্ছে আর রাই ভয়ে কাচুমাচু হয়ে যাচ্ছে।
আবির যখন রাই এর খুব কাছে তখন রাই ভয়েই চোখ বন্ধ করে দিল…. আল্লাহ আল্লাহ এইবার বাঁচিয়ে নাও। জীবনেও কিছু বলবনা কাওকে…. প্লিজ প্লিজ প্লিজ

পরক্ষণেই রাই এর নাম ধরে ডাক পড়লো এই রাই…. চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে কেনো আছিস?
রাই ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখে সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে….. কিন্তু আবির নেই। কাছেও নেই, আশপাশেও নেই।
রাই তাড়াতাড়ি আশপাশে তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তার ঠিক পেছনে যে দরজা সেদিকে তাকালো…..

দেখে আবির বাহিরের বেসিনের কাছে…… হাত ধুচ্ছে।
এটা দেখে রাই একটা বড়ো করে শ্বাস ফেলে প্রশান্তির হাসি দিয়ে সামনে তাকালো।

কিন্তু হাসি আর স্থায়ী হলো না। কারণ বাকিরা সবাই ওর দিকে প্রশ্নকতো চোখে তাকিয়ে…..
অা…… কি কিছুনা বলে ও মাথা নাড়লো….
ওর খালা ওর দিকে একটা তোয়ালে ছুরে দিলো আবিরকে দিয়ে দে… বলে।

রাই মাথা নেড়ে ঘুরে তাকালো আবির হাত ঝাড়তে ঝাড়তে আসছে। ও দরজার কাছে আসতেই রাই তোয়ালেটা এগিয়ে দিল। কিন্তু আবির ওকে এমনভাবে এড়িয়ে গেল যেনো রাই অদৃশ্য কিছু। যেনো ও দেখলোই না রাই কে। আর রাই কে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়ে নিজের যথাস্থানে বসে গেলো।
রাই মূর্তির মতো দাড়িয়ে হা করে রইলো। ইগনোর অস্ফুট স্বরে বলল রাই। এতো বড়ো কলিজা…. আমাকে ইগনোর! আশ্চর্য

রাই ঘুরে তাকালো আবিরের দিকে। সে তার বাবার সাথে কথা বলছে আর মায়ের হাত থেকে নেওয়া তোয়ালে তে হাত মুছছে। রাই তো খাড়ার উপর অপমানিত। ব্যাটা তোরে ভালো ভেবেছিলাম, ভদ্র ভেবেছিলাম, এখন তো দেখি তোর থেকে নিশান লাখ গুন ভালো। মনে মনে গাবাচ্ছে রাই।

পাশ থেকে কে যেন রাইকে আস্তে ডাকলো। রাই নিশানের দিকে তাকাতেই নিশান হেসে তোয়ালে টা চাইলো….. যেহেতু এই মুহূর্তে রাই রাই না জ্বলন্ত আগুন হয়ে গেছে তাই রাগে তোয়ালেটা ছুড়ে দরজার পাশের টেবিলে ফেলে রেগেমেগে হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
নিশান তো অবাক….. কিহল!
পেছনে আবির বিষয়টা খানিকটা লক্ষ্য করলো….

বাহিরে এসে রাই উঠোন জুড়ে ঘুরঘুর করছে আর বকবক করে যাচ্ছে নিজের সাথেই ব্যাটা খাটাশ….. ক্রাশ যাক ধান ক্ষেতে। এতো ভাব কিসের তোর!তোর দেখিস বিয়ে হবে না… বউ আদর করবে না। তোর এই খাটাশপানাই তোরে উচিত শিক্ষা দিবে….. তোর কপালে বউ নাই বকবক করছে আর একটা আমগাছের চারপাশে গোলগোল ঘুরছে রাই।

তখনি এক বোন এলো রাই এর।
রাই….
ওর হেলদোল নেই। নিজের মতই ঘুরছে।
এই রাই?

রাই দেখছেই না। মেয়েটি রাই এর পিছুপিছু হাঁটা শুরু করলো এই রাই কীরে এভাবে ঘুরছিস কেনো?
মণি মণি মণি আমার রাগে গা পিত্তি জ্বলছে

মণি একটু মজা করলো কেনো তুই কি ডাল এর জাগায় কয়লা খেয়েছিস?
রাই হাটতে হাটতে থেমে গিয়ে রাগান্বিত চোখে তাকালো মণির দিকে। মণি চুপ করে গেলো। আবারো রাই ঘোরা শুরু করলো।

আচ্ছা কি হয়েছে বলবি তো।
বলে লাভ নেই। অপমান…. অপমান করেছে আমাকে।
কে!!!!!!মণি অবাক
রাই হাটতে হাটতে মাঝপথে থেমে গেলো ফলে মণি ও যেহেতু হাঁটছিলো ওর পিছ পিছ তাই দুজনের ধাক্কা লেগে গেলো।

আবারো রাই মণির দিকে রেগে তাকালো। মণি বেচারি কিছু না জেনেও ভয় পেয়ে গেল।
অবশেষে পাত্র পক্ষের যাবার সময় হয়ে গেল। রাই মুখ চোখ ফুলিয়ে দাড়িয়ে আছে।
বড়রা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।

মিহির ভাইয়াকে গোমরা মুখ করেই বিদায় জানালো রাই।
সুরাইয়া দুর থেকে দাড়িয়ে দেখছে। আর মিহির সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে শুধু ইশারায় ওকে কাছে এসে দাড়াতে বলছে। কিন্তু সুরাইয়া তা করছে না।

রাই সেটা লক্ষ্য করলো কিন্তু তবুও ওর এখন মজা করার মুড নেই।
নিশান ধির পায়ে এগিয়ে এলো রাইয়ের কাছে। এসে ওর কানের সামনে ফিসফিস করে বললো খুব শীঘ্রই তাহলে দেখা হচ্ছে। কি বলেন বেয়াইন?
রাই এমনিতেই রেগে তার উপর মশকরা?
আপনার সাথে দেখা করার জন্য কেউ বসে নেই।

উহু…. বসে কেনো থাকবে… দাড়িয়ে থাকবে তাও আমার আপ্যায়ন করার জন্য বলে বাকা চোখে তাকালো।
হুম…. গোবরের মালা নিয়ে দাড়িয়ে থাকবো। আইসেন…… বলে ভেংচি করলো রাই।

দেখাই যাক নাহোয় বলে রাই এর ডানহাত আলতো করে ছুঁইয়ে দিয়ে চলে গেলো গাড়ির দিকে। রাই প্রথম টের না পেলেও পরে বুঝতে পারলো।
ততক্ষণে নিশান গাড়িতে গিয়ে উঠে পড়েছে।

গাড়ির পেছনে রেজোয়ান আঙ্কেল, মিহির ভাই ও তার বাবা। আর সামনের ড্রাইভিং করবে আবির আর পাশে নিশান।
রেজোয়ান সাহেব হঠাৎই সবার সামনেই রাইয়ের মাকে বলে উঠলেন আপা। আপনার মেয়েটা সত্যিই খুবই ভালো….. আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এমন একটা ব্যাটার বউ পেলে তো ,

সাথে সাথেই মিহিরের বাবা কেশে উঠলেন মানুষ অতিরিক্ত ই মজা করে। খালামণি অবাক হয়ে হেসে উঠলেন।
আর রাইয়ের মা জোরপূর্বক হেসে বললেন মেয়ে তো একটা যাচ্ছেই। তো আর কিসের কথা তাইনা ভাই বলে কোনমতে কথা এড়ালেন……

মণি হেসে উঠে রাইকে শুনিয়ে বললো কবুল কবুল কবুল
রাই ওকে হাতে চিমটি দিলো। মণি ঠোঁট চেপে হাসছে।

অবশেষে সবাই গাড়িতে উঠতে লাগলো। আবির ও প্রস্তুতি নিয়ে গাড়িতে বসবে তখনি ওই রাস্তা দিয়েই কতগুলো ছোটো বাচ্চা ছেলেরা খেলতে খেলতে যাচ্ছিলো… ওদের হাতে মনেহয় রং এর পানি ছিলো। ওরা একজন আরেকজনকে রং মারতে গিয়ে সোজা খানিকটা রং এসে আবিরের বুকের ডানদিকে কাঁধ জুড়ে লেগে গেলো আর ওর হাতে ও লেগে গেলো।

বেচারা রেগে উঠে কিছু বলতে গেলো কিন্তু তার আগেই ছেলেগুলো এক ছুটে দৌড় চাচা মাফ কইরেন বলতে বলতে সব ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে গেলো।

ওদের কান্ড দেখে সবাই একে তো অবাক + রেগে গেছে। এদিকে রাই আবিরের ওপর রেগে নিশ্চই ছিলো। কিন্তু চাচা শব্দটা শুনে রাই এর হাসি চলে এলো। কিছুতেই আটকাতে পারছিল না।
রাইয়ের মা বলতে গেলো বাবা, তুমি রাগ করো না ওরা সব বাচ্চা……

পুরোটা শেষ ও করতে পারলো না পেছন থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল রাই। হো হো করে হেসে ওর জান ওষ্ঠাগত।
খালামণি, মা, মণি সবাই রাই এর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু বেচারি হাসিটা থামাতেই পারছে না।
গাড়ির ভেতর থেকে রেজোয়ান আঙ্কেল বেরিয়ে এসে বলতে লাগলেন কাজের কাজ হয়েছে। সব সময় মুড নিয়ে থাকিস, ওই বাচ্চারাই তোর মুড উড়িয়ে দিয়ে গেছে বলে উনিও হাসতে লাগলেন।
বাবা কঠোর কণ্ঠে আবির বললো।

রাই কোনমতে নিজের হাসিটা দমিয়ে সোজা হয়ে দাড়াল। তবুও মুখে হাসি।
খালামণি বললেন বাবা রাগ করো না। এক কাজ করো ভেতরে গিয়ে পরিষ্কার করে এসো
আবির বলতে গেলো না, ঠিকাছে মুখে চরম বিরক্তি।
রেজোয়ান সাহেব বললো কিসের না… যা গিয়ে হাত আর শার্ট পরিষ্কার করে আয়। নইলে আবার গাড়িতে রং লেগে যাবে

নিশান বলে উঠলো বাবা!!!! তোমার গাড়ি দামী বাকি ভাইয়া দামী?
রেজোয়ান সাহেব ঠাট্টা করে বললেন অবশ্যই গাড়ি….
সবাই হেসে উঠলো। রাই আরো জোড়ে হেসে উঠলো। আবির রাগী দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে। রাইয়ের মা বললেন তুমি বাদ দাও আবির। যাও গিয়ে ধুয়ে এসো

রেজোয়ান সাহেব বললেন হ্যাঁ যা…. রাই মা….. ওকে একটু নিয়ে যাও তো একটু সাহায্য করো
খালা আর মা একসাথে আমার দিকে তাকালো। আমি তো না চাইতেও হাসছি। নিষেধ করার আর উপায় নেই। আবির হেঁটে আসতে লাগলো। আমিও হাত মুখে চেপে পিছন পিছন গেলাম।
মিটিমিটি হাসছি আর ভাবছি বেশ হয়েছে….. ভাব? তোমার ভাব একেবারে ঘুচিয়ে দিয়েছে

তাকে নিয়ে বাসার ভেতরের বেসিনের সামনে দাঁড়ালাম। উনি হাত বাড়িয়ে বেসিন এর কল ধরতে গেলেন
এক মিনিট বলে তাকে থামালাম। আর আমিই কল ছেড়ে দিলাম। নইলে রং লেগে গেলে পরিষ্কার কে করতে যাবে….। উনি ভাব দেখিয়ে একহাত দিয়ে পানি নিয়ে টিশার্ট এর দিকটা মুছতে গেলেন কিন্তু ভাগ্য ভাগ্য….. রং কমবে কি উল্টো তার হাতে থাকা রং আরো লেগে গেল টিশার্ট এ। জ্যাকেট টা গাড়িতেই খুলে ফেলেছিলেন তাই এ যাত্রায় সেটা বেঁচে গেলো।

আমি ফিক করে একটু হেসে উঠি। উনি একটা শ্বাস ছাড়লেন।
রাই তাকে থামিয়ে বললো আমি হেল্প করছি….. বলে হাতে সাবান মেখে আবিরের দুহাত ধরে সাবান লাগিয়ে দিতে লাগলো রাই।

আবির এখনও চোখ মুখ কুচকে রাই এর দিকেই তাকিয়ে আছে।রাই খুব হাসিখুশি স্বভাবের। ওর মুখে একটা চিলতে হাদি সর্বদাই বিরাজমান। আবির সেই হাসিটাকেই কতক্ষন দেখলো। যেহেতু রাই ওর খুবই কাছে তাই খুব ভালো ভাবেই পর্যবেক্ষণ করলো আবির। আবিরের হাতদুটো ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে দিল রাই।

তারপর হাতে পানি নিয়ে টিশার্ট এর বুকের দিকটায় রং মুছে দিতে গেলো। একটু একটু করে পানি দিয়ে উঠাচ্ছে, আর রাই কিছুটা ইতস্তত ও করছে। বারবার আবিরকে স্পর্শ করাটা ওর একটু অসস্তিকর মনে হচ্ছে। তবুও দিচ্ছে।

বারবারই একটা অজ্ঞাত মেয়ের স্পর্শ আবিরের ঠিক অতটাও ভালো লাগছে না। কিন্তু ও নিষেধ ও করছে না।
আর রাই ও ভুলেই গেছে যে এখন তো আবিরের হাত পরিষ্কার। এখন আর ওর আবিরের দাগ পরিষ্কার করতে হবেনা। ও নিজের কাজে অব্যাহত।

শার্ট এর রঙ পুরোপুরি তো যায় নি তবে কোনমতে যা উঠেছে আরকি।
রাই হাত ধুয়ে আবিরের দিকে একপলক তাকালো। দেখে ওর টিশার্ট এর কলার থেকে একটু উপরে গলায় এক দুটো ছিটে লেগে আছে।

স্বাভাবিক ভাবেই রাই চট জলদি গলায় হাত দিয়ে মুছে দিতে গেলো,
মুহূর্তেই বাঘের থাবার মতো আবির রাই এর হাত ধরে ফেললো।
আচমকাই রাই বিস্মিত হয়ে আবিরের দিকে তাকায়। আবির খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রাই এর দিকে তাকিয়ে একটু একটু করে ওর দিকে এগোতে লাগলো।

তাই বিস্ফোরিত চোখে আবিরের দিকে তাকালো। কিন্তু আবির ভাবলেশহীন ভাবে রাই এর দিকে এগোচ্ছে, আর রাই পিছতে পিছোতে
একপর্যায়ে দেওয়ালের সাথে ঠেকে গেল।
কি কি হচ্ছে কি! হাত ছা ছাড়েন

আবির ততই এগোচ্ছে। একপর্যায়ে রাই এর মুখের সামনে এসে ও থেমে গেলো এতই যখন ভয়, তো হাসছে কেনো?
এই প্রথম আবির রাই এর সাথে কথা বললো। রাই অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবে তাকিয়ে রইলো। আবিরের কন্ঠটা শুনতে একদম কোনো রেডিও আরজে এর মতন শুনাচ্ছে। খুবই আকর্ষক।..
ভয়! আপনাকে! আমার বয়েই গেছে বলে রাই মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

তাই? বলে একটু একটু করে রাই এর দিকে এগোতে লাগলো। রাই আবারো বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে সাথে সাথেই ওর বুকে হাত দিয়ে ওকে আটকালো কি অসভ্যতা এসব? দূরে যান

বলে ঠেলে সরে যেতে গেলো। কিন্তু উল্টো আবিরের ওর হাত আরো জোরে চেপে ধরলো রাই ব্যথায় আহ্…… বলে উঠলো।
আবির তীব্র চোখে রাইয়ের নুইয়ে যাওয়া চেহারাটা দেখে এক চিলতে পরিমাণ হেসে রাই এর মুখের সামনে এসে পড়া চুলগুলোর দিকে লক্ষ্য করে ফুঁ দিল।

একদিকে ব্যাথা লাগছিলো হাতে অন্যদিকে আবিরের এমন কাজে রাই কষ্টমাখা চেহারায় আবিরের চেহারার দিকে তাকালো।
কি যেনো একটা মনে করে আবির আগের মত নিজের ভাব নিয়ে এক ঝটকায় রাই এর হাত ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়াল।

নিজের অবাঞ্ছিত হাসি নিয়ে আমার থেকে দূরেই থাকবে। বলে ঘুরে দাড়ালো আবির।
রাই রেগে গিয়ে জবাব দিলো আপনার কাছে আসার না কারো সখ নেই। আর আমার দূরে থাকা লাগবে না। দেখা যাবে নিজেই আমার পিছন পিছন আসছেন

আবির বাকা হেসে ঘুরে তাচ্ছিল্য চোখে রাই এর দিকে তাকালো তোমার পেছনে? হাহা….. কোনদিক থেকে তো দেখে কোহিনুর মনে হচ্ছে না বলে এক ভ্রু উঁচু করলো আবির।
রাই আরো ক্ষেপে গেল কোহিনুর ও সবার কপালে থাকে না……

হুহ সবাইকে নিশান ভেবে বসে থেকো না জিন্স এর পকেটে বাম হাত ঢুকিয়ে…।
রাই থ মেরে গেলো কি বলতে চান… নিশান আমার পিছনে ঘুরঘুর…
ওকে শেষ করতে দিলো না নিজেই যখন বলছো….

শাট আপ….. বলে চিৎকার করে উঠলো রাই।
আর যাইহোক, আবির কখনো নিজের সামনে কারো গলা উচু আওয়াজ শুনতে পারে না। গিয়ে রাই এর মুখ চেপে ধরলো তোমার ধমক শোনার জন্য নিশ্চই আসি নি

রাই ওর হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো আপনার মত নিচ চিন্তা ধারার মানুষ শুধু পারে অন্যদের কষ্ট দিতে। নিজের ভাই সম্পর্কে এমন মন্তব্য করতেও আপনার খারাপ লাগলো না। ছি….. আপনার সাথে যার ভাগ্যের রেখা মিলেছে সে জাস্ট কষ্টেই কাটাবে…… মুখ পোড়া মানুষ
বলে রাই হনহন করে সে স্থান ত্যাগ করলো। আবির এর হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল।


পর্ব ৫

ভেজা সিক্ত চোখদুটো খুলে তাকালো রাই। তবে এই অডন্ধকরে চোখ খোলা না খোলা একই কথা। আবির এখনও ওকে জড়িয়েই শুয়ে আছে। সেই প্রথম দেখার ঘটনা মনে করে রাই এর খারাপ লাগার পরিমাণটা আরো বেড়ে গেলো।

আস্তে করে নিজের উপর থেকে আবিরের হাতটা সরিয়ে দিলো রাই। আর ওর থেকে দূরে সরে গেলো।
এই মুহূর্তে আবির জেগে থাকলে নিশ্চই ওর হাতটা সরানোর সুযোগটা রাই পেত না। বদলে আবির আরো ক্রুর ভাবে ওকে নিজের কাছে টেনে নিত।

উঠে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসলো রাই। আর নিজের মাথাটা দুহাতে চেপে ধরলো। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। আর না দুচোখে ঘুম আসছে।
মাথায় কি ব্যাথা করছে নাকি?

রাই চমকে ওঠে। আ আপনি ঘু ঘুমান নি?
আবির রাই এর ডান হাত ধরে নিজের কাছে এনে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে মাথায় বিলি কাটতে লাগলো…… হাতটা তো সরিয়ে দিলে। ঘুমটা আর কিভাবে হয় বলো?
রাই অসস্তিতে চোখ বুজে নিলো আপনার মনে হয় আপনার সাথে সংসার করলেই আমি আপনার হয়ে গেলাম? সব এতই সহজ?

আবির হালকা হাসে আলাদা ভাবে তোমাকে নিজের নামে লেখার কোনো প্রয়োজনই নেই আমার।
রাই বুঝলো না বিষয়টা একটু অবাক হলো। মানে!
আবির তৎক্ষণাৎ কিছু বললো না।বিলি কাটতে লাগলো। রাই এর কানে অনবরত আবিরের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দটা আসছে।

তুমি কখনো নিজের শরীরের একটা অঙ্গ কে আলাদাভাবে বাহির থেকে এনে জোড়া দিতে পারবে?
রাই কপাল কুঁচকে ভাবতে থাকলো কি বলছে এসব। কিন্তু রাই এর মন চাচ্ছে না এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে।
চুপ করে রইলো।

হুম? আবির পুনরায় প্রশ্ন করলো।
রাই বিরক্তি সুরে বলল কিসব বলছেন। নিজের শরীরের অঙ্গকে বাহির থেকে কিভাবে আনা যায়! যেখানে সেটা ইতোমধ্যেই আপনারই। আপনার কাছেই আছে।

আবিরের হাত দুটো থেমে গেলো। মাথা থেকে হাত সরিয়ে আবির রাই এর গেল রাখলো তুমিও তার ব্যতিক্রম ছিলে না। শুরু থেকেই আমারই ছিলে।
রাই স্তব্ধ হয়ে গেল। আবির পুনরায় ওর মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলো। আবিরের কথা ভাবতে ভাবতেই কখন যে রাই ঘুমিয়ে গেছে সে জানেনা।

সখি, ভালোবাসা কি এতই সোজা? এই দেখো না নিজেকেই…মানতেই পারছো না।
আর এই দেখো আমাকে…… ছাড়তেই পারছি না।

আবির শুন্যেই কথাগুলো ছড়িয়ে দিল। যদিও এর প্রত্যুত্তর দেওয়ার মানুষটি আপাতত গভীর ঘুমে। অপেক্ষা করাটাও নাটকীয়।
একফোঁটা শান্তির ঘুমের আশায় চোখদুটোর পাতা এক করে দিল আবির। একা একা কথা বলে নিজেকে পাগল প্রমাণিত করার ইচ্ছেটা ওর নেই।

সকালে অনেক শব্দ কানে আসায় ঘুম ভেংগে গেল রাই এর। তৃপ্তির ঘুমটুকু বিসর্জন দিয়ে ঘুমে লেগে আসা চোখ দুটো পিটপিট করে খুললো। আবিরও শব্দের জন্য চোখ মুখ কুঁচকে ঘুম থেকে জেগে গেলো।
কি হচ্ছে কি! বলে রাই চোখ ডলতে লাগলো।
আবির এখনও রাই কে জড়িয়েই রেখেছে। আমার বিয়ে লেগেছে বলে আবির রাই এর চুলে মুখ গুজে আবারো ঘুমোতে গেলো।

রাই আড়চোখে তাকালো তিনদিন আগে বিয়ে হইসে আবার বলে বিয়ে লাগছে। পেট ভরে না নাকি!
আবির ওভাবেই বললো না। মন ভরে না। বাড়ির মানুষ ও জানে আমার বউ আমাকে পছন্দ করে না। তাই আমার আবার নিয়ে দেবে

রাই মুখ বাঁকিয়ে বললো লাভ নেই। বউ পাল্টালেই কি কপাল ঘুরবে নাকি? যেখানে ছেলে নিজেই ঘাড় ত্যাড়া।
আবির চুলের মধ্য থেকেই মুখ তুলে বললো আমি ঘাড় ত্যাড়া!
আর নয়তো কি? চোখ ছোটো ছোট করে নিলো রাই যেটা নিজে বোঝেন সেটাই ঠিক। আর বাকি মানুষেরা তো ফিডার খায়।

আবির রাই এর কোমর ধরে ওকে নিজের দিকে ঘুরালো….আমি খুব নিখুঁতভাবে চিন্তা ভাবনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেই। তোমাদের মেয়েদের মতো না বুঝে চিল্লাই না
রাই প্রথমে রাগতে গেলেও মুহূর্তেই শান্ত হয়ে বাকা ঠোঁটে হাসলো আমি যদি চিল্লানো শুরু করি আপনি এখানে টিকতে পারবেন?

আবির আড়চোখে তাকালো সকাল সকাল তোমার শালিকের মত গলা শোনার সত্যিই ইচ্ছে নেই।
আমি শালিক! জোরেই চেঁচিয়ে উঠলো রাই। সামনাসামনি থাকায়

আবির চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো। উফফ, সোজা বাজ পড়লো কানে
রাই বাকা চোখে তাকালো। একটা দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় এলো। রাই আবিরের কানের সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
সাথে সাথে আবির ওকে ছেড়ে কান চেপে ধরলো।

এই ফাঁকে রাই হেসে দিয়ে উঠতে গেলেই আবির ওর হাত টেনে আবারো নিজের উপর ফেলে দিল।
তোমাকে টিয়া বলে ডাকি শালিক না
রাই হেসে ওঠে তো এখন থেকে শালিক বলে ডাকবেন বলে আবারো চিৎকার দিতে গেলেই আবির ওর মুখ চেপে ধরলো ভালো টা ভালো লাগে না…… মানুষের স্বভাব

রাই উম উম করে আওয়াজ করতে লাগল। আবির চোখে দুষ্টু হাসি নিয়ে রাই এর দিকে তাকালো ইউ নো হোয়াট?
রাই ভ্রু উঁচু করে কি জিজ্ঞেস করলো।
আবির ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে বাকা হেসে বলল তোমার মুখ বন্ধ করার উপায় আমার জানা আছে। কিন্তু এই বাসিমুখে সেটা এপ্লাই করতে চাচ্ছি না

রাই ১ সেকেন্ড বোকার মতো তাকিয়ে থাকলো।
ছি। কি আপনি হ্যাঁ! পিচাশ বলে রাই উঠতে গেলে আবির ওকে ধরে বালিশে শুইয়ে ওর উপরে উঠে গেলো কিহ্! পিচাশ?

রাই মাথা নাড়লো হুম
বুঝাচ্ছি পিচাশ কি জিনিস বলে আবির মুখ এগিয়ে নিতেই রাই মাথা ঘুরিয়ে নিল। আর আবির রাই এর থুতনিতে একটা কামড় বসিয়ে দিল।

আহ্…. রাক্ষস বলে নিজের থুতনিতে হাত দিল রাই।
তুমি…… আবিরের কিছু বলার আগেই দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
দুজনেই চমকে তাকালো দরজার দিকে।

রাই…… রাই দরজা খোলো….
নীলা! রাই এর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। আবির কি যেনো একটা ভেবে রাই এর দিকে তাকালো। ছাড়ুন… দরজা খুলতে হবে বলে রাই উঠতে গেলেই আবির ওকে জড়িয়ে ধরলো।

এই রাই…. মরে গেছো নাকি? দরজা খোলো… এই রাই নীলা রেগে বারবার দরজা ধাক্কাচ্ছে।
আরে কি হয়েছে কি আপনার? ছাড়ুন….. বলছে রাই…..
আবির চুপ করে মিটিমিটি হাসছে।
আরে হাসছেন কেনো?

এই রাই, দরজা খোলো না কেনো? নীলা অনবরত চেঁচিয়ে যাচ্ছে।
দেখুন আপনি এবার বাড়াবাড়ি করছেন কিন্তু রাই পুরো ঘাবড়ে গেছে। নীলা কি মনে করবে আর যদি বাকিদের গিয়ে রাই এর নামে বিচার দেয় তো?
আবির এবার জোরেই বলে উঠলো রাই….. উফফ…. রাই ছাড়ো… ছাড়ো
রাই বেয়াকুব বনে গেলো। থ মেরে আবিরের দিকে তাকিয়ে রইলো।

নীলা এটাশুনেই চমকে গেলো কি করছে রাই ওর সাথে? এই রাই রাই… দরজা খোলো
আবির আবারো নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে ওঠে রাই…. প্লিজ ছাড়ো… দেখো এসব কেনো করছো? আমি কি করেছি তোমার? রাই স্বাভাবিক হয়ে কিছু বলতে গেলেই আবির ওর মুখ চেপে ধরলো। রাই….. আমার ব্যাথা লাগছে তো নাকি। আমার মুখটা এতো শক্ত করে কেনো ধরেছো?

নীলা পুরো আকাশ থেকে খেজুর গাছে পড়লো। আমার আবিরের সাথে ও কি করছে! (চোখের সামনে ভেসে উঠল ওদের একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্ত) নীলা মাথা ঝাড়া দিলো না…. রাই…..
আবির শব্দ ছাড়া হেসে উঠলো রাই দেখো এভাবে ছুচ্ছো কেনো? রাই প্লিজ, না না চুলগুলো ধরো না… দেখো হাতটা ছাড়ো না

রাই এর চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল উম উম করে ও হাত পা ছোড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আবির নিজের নাটক চালিয়েই যাচ্ছে।
রাই দেখো। রা…… বলে আবির চুপ করে গেলো আর দরজার দিকে তাকালো। রাই বিস্ময়ের চরম সীমায়। ও নিজেও দরজার দিকে তাকালো।

নীলার কলিজায় ছ্যাৎ করে উঠলো। আবির…… আবির তোমার কি হয়েছে? ও কি তোমাকে কিছু করেছে নাকি? আবির বলে দরজা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো নীলা। আবির চট করে খাট থেকে লাফ দিয়ে উঠে দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালো। রাই তো ঘটনাক্রমে মূর্তি হয়ে গেছে।

আবির নিজের টিশার্ট টা খুলে হাতে নিলো আর রাই এর দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিল।
আ…. ডাকতে গিয়েই দরজাটা খুলে গেলো….. নীলা হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো আবির!
নীলার চোখে যেনো কেউ বিষ ঢেলে দিয়েছে। আবির ঠোঁটে হাত দিয়ে রাই এর দিক থেকে মাত্রই মুখ ঘুরিয়ে নীলার দিকে তাকালো আরে তুই!স্বাভাবিক স্বরেই বললো।

নীলা আবিরের উন্মুক্ত শরীর আর অগোছালো চুল, ঠোঁটে হাত দেখে তো ওখানেই ফিট। মুখ ঘুরিয়ে খাটের দিকে তাকিয়ে দেখে রাই উঠে বসছে… নীলার চোখ উটপাখির ডিমে পরিণত হলো। রাই দ্রুত উঠেই নিজের শাড়ির আঁচল ঠিক করে উঠে আবিরের পাশে এসে দাড়ালো নীলা….

নীলা কাঁদো কাঁদো মুখে দুজনের দিকে তাকালো। আবির কিছু যেনো বোঝেই নি এমন ভঙ্গিতে বলল ভ্যাবলার মত তাকিয়ে আছিস কেন? কি হয়েছে?

নীলা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল ওই….
আবির হাই তুলে রাই এর পেছনে গিয়ে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখলো তুই জানিস না, স্বামী স্ত্রীর…. একান্ত ব্যক্তিগত সময়টাকে ব্যক্তিগত থাকতে দেওয়া উচিত?
নীলা এবার প্রায় কেঁদেই ফেললো আমি…. (নাক টেনে) আমি… কাকী বলেছে তোমাদের ৯ টার মধ্যে বাহিরে আসতে।

পারবো না…. দেরি হবে…. তুই যা বলে আবির একটা ভাব নিলো।
রাই চেষ্টা করছে কিছু বলার কিন্তু ততবারই আবিরের কথা শুনে ও নিজেই কোমায় চলে যাচ্ছে।
না না নীলা রাই বলতে গেলো.

তার আগেই নীলা হাত উঁচু করে ওকে থামিয়ে দিল বাহিরে চলে আয়
বলে ও হুরহূর করে বেরিয়ে গেলো।
রাই চরম লজ্জা এর রাগে আবিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো কি করলেন এগুলো আপনি?

কি করলাম? কেনো কিছু জানেই না।
এসব কি নাটক ছিল বলে ওর হাতে ধাক্কা দিল রাই।
দেখো যে কাজটা তোমার করা উচিত ছিল সেটাই করলাম। এখন কাওকে না কাওকে তো একটু এগোতে হয়ই। ভাবলেশহীন ভাবে বললো।

আপনি…… রাই চরম ভাবে বিরক্ত। ধুর বলে ঘুরে দাড়ালো। আবির ওর দিকে না তাকিয়েই বাথরুমের দিকে এগোতে গেলেই রাই পেছন থেকে ওর হাত থেমে ধরলো কোথায় যাচ্ছেন…. দাড়ান এখানে… আমি যাবো বলে রাই আবিরকে ঠেলে সরিয়ে নিজে বাথরুমে ঢুকে গেলো।
আবির হাসিমাখা চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

কোনো মেয়ের কারণে যে আবির চৌধুরী হাসতেও পারে…. সত্যিই অবিশ্বাস্য
কথাটা কানে আসতেই আবির ঘুরে দরজার ধিকে তাকালো। নীলা রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে।
আবির প্রশ্নক্ত চোখে তাকালো।

তুমি আবির চৌধুরী….. জীবনে কখনো মেয়েদের পাত্তাই দিতে দেখলাম না। তোমার মতে মেয়েরা শুধুই স্বার্থপর আর টাকার লোভী হয়। আমাকে পর্যন্ত কখনো কাছে আসতে দাও নি….

আবির ওর কথার কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখলো না। টিশার্টটা হাতে নিতে নিতে বলল সোজা কথা বল
নীলা ধেয়ে এসে আবিরের হাত ধরলো রাই কি করছিল তোমার সাথে হ্যাঁ? ও কেনো তোমার কাছে এলো

মুহূর্তে আবিরের মুখভঙ্গি বদলে গেলো। নীলার হাতটা ঝটকায় সরিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা দিলো আবির। নীলা ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো।
রাই নিজের স্বামীর সাথে কি করছিল সেটা জেনে তোর কি কাজ? স্ত্রী নিজের স্বামীর সাথে থাকবে না তো কি বাহিরের তোর মত নষ্টারা থাকবে?

নীলা খুব কষ্টে বললো আবির… কি বলছো?
রাই তোর ভাবি….. (মুখ চোখ শক্ত হয়ে এলো) সম্পর্ক, বয়স, মানসিকতা সব দিক থেকেই তোর বড়ো….. ওকে নাম ধরে ডাকার সাহসটুকু যেনো দ্বিতীয় বার না হয়। বলে সর্ব শক্তি দিয়ে নীলাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল আবির।

নীলা একপলক ক্রোধান্বিত নজরে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো।
বাহিরে নিশান এর সাথে একটা ধাক্কা লাগলেও নীলা সোজা হেটে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। নিশান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।


পর্ব ৬

তৈরি হয়ে দুজনে বাহিরে ড্রইং রুমে এসে দাড়ালো। আজও আবির এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য এলো না। রাই এর হাত ধরে নিয়ে এসেছে। রাই একটা সোনালী পাড়ের লাল শাড়ি পরেছে। আর আবির ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি।

সবাই যে যার মতো কাজ করছে। একটু পরেই আবিরদের অন্য আত্মীয়রা আসবে। বাড়ির বড়ো বউকে দেখতে।
ওদের দুজনকে একসাথে দেখে নীলার গা জ্বলে যাচ্ছে। নীলার মা আবারো বললো নাও…. কিছু বললেই লোক বলবে বেশি কথা বলি। কিন্তু মানুষ নিজের কাজটাও চেয়ে দেখেনা।

আবির রাই কে নিয়ে সোফায় বসিয়ে নিজের চাচীর দিকে ঘুরল কথাটা কোনোভাবে কি তুমি আমাকে বললে?
উনি মুখ বিকৃত করলেন। আবিরের মা বলে উঠলেন না বাবা, তোমাকে কি বলা যায় নাকি? তুমি তো সব অসাধ্য সাধন করে বসে আছো বলতে বলতে টেবিলের উপরে পায়েসের বাটি রাখলেন।
ওর চাচী তাল মিলিয়ে বললেন অসম্ভব কে সম্ভব করেছে

আবির বাকা ঠোঁটে এক ভ্রু উঁচু করে বললো এক্সাক্টলি। বড়মা। (ওর চাচীকে) এখন বড়ো আব্বু তো এত সুন্দর করে হাত ধরে বা যদি বলি তোমার সাথে এইসব অসাধ্য সাধন করেন না। তো সেই ঘাটতি টা তো কাওকে না কাওকে পূরণ করতেই হবে। তাই ভাবলাম নিজেই যোগদান করি….. কি বলো?

আবির এর কথা শুনে ওর মা আর বড়মায়ের চোখ তুঙ্গে উঠে গেলো।
আবির…..
চৌধুরী….. গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো আবির তার বড়মা কে। তোমাদের মহিলাদের সমস্যা একটাই, তোমরা স্টার জলসার সো কল্ড শ্বাশুড়ি সাজতে চাও……

শুনে রাই অজান্তেই হেসে ওঠে। কিন্তু সে হাসিতে আওয়াজের অভাবে কেউ শুনতে পেলো না। নীলা অবাক হয়ে শুধু আবিরকে দেখেই যাচ্ছে।
আবির বললো কিন্তু এই চক্করে যে নিজেদের পরিচয়টাই ভুলে যাও সেটা কি ঠিক? বড়ো…. মা.?

আবিরের মা বলে উঠলেন তুই একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছিস আবির…. তোর …
হুম… আছে। মাথা, মন, মস্তিষ্ক সবই ঠিকাছে বলে আবির পা উঠিয়ে এগোতেই যাচ্ছিলো রাই উঠে দাড়িয়ে আবিরের হাত ধরে ফেললো আর বললো শুধু শুধু কেনো তিলকে তাল করছেন?

আবির ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো ইচ্ছে নেই। তবে কিছু কথার জবাব দেওয়া ফরজ
ততক্ষণে নিশান হাতের ঘড়ি পড়তে পরতে বের হয়েছে মাত্র, রাই কে আবিরের হাত ধরতে দেখে নিশান এক সেকেন্ডের জন্য তাকিয়ে রইলো।

এসব কথা ছাড়ুন…. প্লিজ, (নিম্নমাত্রার কণ্ঠে বলল) নিজের গুরুজনদের সাথে কেনো যেচে পড়ে লাগছেন।
আবির আর কথা বাড়ালো না। নিজের মা, চাচীর দিকে একপলক তাকিয়ে, ঘুরে এসে রাই এর পাশে বসে পড়লো।

নিশান পলক ফেলে, নিজেকে নিজেই কিছু একটা বললো বিড়বিড় করে আর কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো। রাই, আবিরের মা, বড়মা সকলেই বিষয়টা লক্ষ্য করলো। কিন্তু আবির সেদিকে নজর দিল না।
রান্নাঘর থেকে আবিরের ফুফু বেরিয়ে এলেন আপা সুমি কোথায়?
আবিরের মা জবাব দিলেন ও তো ছাদে গেছে, আঁচার দিয়েছিলাম। সেটাও রোদে দিতে
ওহ…… রাই

রাই দাড়িয়ে পড়লো যেনো স্কুল এর প্রেজেন্ট দিতে এসেছে জ্বী ফুপ্পি
মহিলা একগাল হেসে রাই কে নিজের কাছে ডাকলেন এখানে এসো মা
রাই একপলক আবিরের দিকে তাকিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে গেলো।

দেখো…. বিয়ের পর বিভিন্ন ঝায় ঝামেলা থাকলেও, আজ প্রথম আমাদের আত্মীয়, গুরুজনেরা আসবেন তোমাকে দেখতে, যতই হোক। বাড়ির বড়ো বউ তুমি….
আবির বিড়বিড় করে হেসে বললো মনে তো হয় না….
ফুপি বললেন তো তোমাকে কিছু একটা রান্না করে তো তাদের খাওয়াতেই হবে কি বলো?
রাই মুচকি হেসে মাথা নাড়লো….

তো এখন তুমি ছোটো খাটো কোনো আইটেম রান্না করে ফেলো, যেনো কেউ এটা না বলতে পারে, বউ পায়ের উপর পা তুলে খাচ্ছে বলে উনি আদরে রাই এর মাথায় হাত রাখলেন।
পেছন থেকে বিদ্রুপ করে নীলা বলে উঠলো আদৌ রান্না জানে কিনা জিজ্ঞেস তো করে নাও…… দেখা যাবে পোড়া মাংস, আর শক্ত ভাত খেতে হলো

ওর কথা শুনে রাই একটু মন খারাপ করলো। কিন্তু আবির কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। এটা দেখে রাই এর মন আরো খারাপ হয়ে গেলো।
ফুপি বললেন যাই রাধুক, অন্তত রাঁধবে তো। তোর মত বসে নেই ও… কি রাই?

রাই জোরপূর্বক হেসে বলল আমি করছি। কি রাঁধবো এটুকু বলেই হবে।
ফুপি খুশি হয়ে গেলেন আসো….
দুজনে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। নীলা রেগে ওই জায়গা থেকে নিজে ঘরে চলে গেল। আর আবিরের মা চাচী ও অন্যান্য কাজে চলে গেলো।

আবিরের মা যেতে যেতে বললো দেখা যাক কি রেঁধে আনে
চাচীও সায় দিল সেটাই
আবির ডানে রান্নাঘরের ভেতরে রাই এর দিকে তাকালো সব কথার উত্তর মুখে নয়, মাঝে মাঝে কাজের মাধ্যমে দিতে হয় হলদেটিয়া

ফুপির থেকে সব বুঝে নিয়ে শাড়ির আঁচলটা ঘুরিয়ে কোমরে গুজে নিলো রাই। বেশি কিছু না, তবে মুরগির কোরমা রান্না করতে হবে ওকে। মিসেস কামাল (আবিরের ফুপি) সব প্রয়োজনীয় মসলা, মাংস এনে রাই কে দিয়ে দিলো।
রাই চুল গুলোকে একটা খোঁপা করে বেঁধে কাজ শুরু করলো ফুপি, আপনি গিয়ে বসুন আমি করছি
তুমি একা কিভাবে পারবে?

আমি রান্না মোটামুটি পারি। মা কে দেখতাম, তো ওভাবেই টুকটাক শেখা
তাই নাকি (উনি খুশি হলেন) তাহলে ঠিকাছে। করো….. কিছু লাগল ডাক দিও আমি বাহিরেই আছি।
রাই মাথা নাড়লো। উনি হেসে বেরিয়ে গেলেন।

এই মুহূর্তে সোফায় শুধু আবির বসে। বাকিরা নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত।
রাই একে একে মাংস নিয়ে মসলা মাখিয়ে কড়াইতে ছেড়ে দিয়েছে।
আস্তে আস্তে সব কাজই করছে রাই। কিন্তু ওর একটু অসুবিধে হচ্ছে শাড়ির জন্য। শাড়ি পরে কাজ করা সত্যিই ঝামেলার।

এদিকে আবির বারবার কোনো না কোনোভাবে চোখ ঘুরিয়ে সেই রাই কেই দেখছে। একবার রাই এর খোঁপা করা চুলগুলো দেখছে। তো একবার ওর রান্নার হাত পর্যবেক্ষণ করছে।

রাই এর খবর নেই যে কে ওকে দেখছে। বা কেউ কি তাকিয়ে আছে কিনা। ও নিজের মতই কাজ করেই যাচ্ছে।
আর আবির ও নিজের কাজ করেই যাচ্ছে। মানে রাই কে একটু পরপর দেখা। তবে আর কি? এই প্রথম রাই কে রান্না করতে দেখছে। দেখতে তো হবেই।

এদিকে সুমি মাত্রই ছাদ থেকে ফিরলো, আর দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখে ম্যাগাজিন হাতে আবির ডান দিকে তাকিয়ে আছে….. সুমিও সেদিকে তাকালো। দেখে হেসে কেশে উঠলো সুমি তো ভাইয়া….
আবিরের ধ্যান ভাঙলো। আবির সুমির দিকে তাকালো _
তুই ম্যাগাজিন কি সো অফ করার জন্য হাতে রাখছিস? তোর নজর তো ম্যাগাজিনে নাই*

আবির চোখ টিপটিপ করে সুমির দিকে তাকালো আর ম্যাগাজিনের দিকে মাথা ঘোরালো ম্যাগাজিনে তোর নাম এসে গিয়েছিল তো তাই আরকি চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম। বলে আবির একটা পাতা উল্টে ম্যাগাজিনে মুখ গুজলো। সুমি মুখ ফুলিয়ে নিলো ভাবি ও ভাবি, দেখো কেউ তোমায় ডাকছে….. বলে সুমি এক দৌড়।

আবির চোখ রাঙাবে তার সুযোগ ও পেলো না, এর মধ্যেই হাত এর পানি ঝাড়া দিয়ে রাই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
কেউ ডাকেনি তোমায়….. বলে আবির একটু কেমন যেনো করলো। রাই চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো ধুর, আপনার জন্য আসছি নাকি আমি…বলে রাই ফ্রিজের দিকে গেলো আর ফুপি কে ও ডাক দিল। মিসেস কামাল এসে দাড়ালেন
ফুপি, ফ্রিজে কি নারকেলের দুধ আছে?

উনি ফ্রিজ খুলে চেক করলেন আহহা, ওটা তো নেইই। ওটা ছাড়া কিভাবে রান্না হবে! আমি তো খেয়ালই করিনি।
রাই ফ্রিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো এক প্যাকেট মিল্কভিটা রাখা। রাই মুচকি হেসে ওটাই বের করে নিল সমস্যা নেই হয়ে যাবে

প্যাকেটের দুধে কি ভালো রান্না হবে?
রাই আশ্বস্ত করে বললো চিন্তা করেন কেনো. আমি আছিনা? বলে ও হেসে চলে গেলো রান্নাঘরে।
আবির ওর ফুপির দিকে তাকালো।
তুই কি পেঁচার মতো চেয়ে আছিস? যা বাইরে যা হেঁটে আয়। ঘরের কাজ করতে দে। যা বলে উনি চলে গেলেন।

রান্না শেষ। রাই সব খবর টেবিলে গুছিয়ে রেখে হাত মুখ ধুতে চলে গেলো। সবাই তখন মেহমানদের অপেক্ষায়।
বেল বেজে উঠলো সুমি যা দরজা খোল
দরজা খুলতেই রেজোয়ান সাহেব, সুমির বাবা, নীলার বাবা আর অন্যান্য অনেক আত্মীয়রা এসে ভেতরে ঢুকলেন। সবাই সবার সাথে কুশল বিনিময় করে নিলো।

কিগো, তোমাদের বউ কোথায়? এক মহিলা বললেন। আবিরের মা বললেন তোমরা সবাই মাত্রই এলে। বসো, আগে। হাতমুখ ধুয়ে আসো খাবার বাড়ছি, এমনিতেই দুপুর হয়ে গেছে

সবাই সেভাবেই কথায় কথায় হাত মুখ ধুয়ে এসে জড়ো হলো ডাইনিং টেবিলে।
রাই হাত মুখ মুছে, একটু চুল আচড়ে নিজেকে দেখে নিল ঠিকঠাক আছে কিনা। পেছন থেকে আবির এসে দাড়ালো। রাই ঘুরে চলে যেতে গেলেই আবির ওকে ধরে আয়নার সামনে দাঁড় করায়।
আপনার এই ফালতু কাজের জন্য সময় নেই ছাড়ুন

আবির ভাবলেশহীন ভাবে বললোতোমাকে ধরে রাখার সখ আমার নেই।
ও, এখন তো আমাকে ভূতে ধরে রেখেছে রাই তাকালো।
তোমার যে গুণ! ভূতে হার্ট অ্যাটাক করবে না? ঠাট্টা স্বরে
কোন গুণ?

আমি কাছে আসলেই যে আর্তনাদের নাটক শুরু করো সেটা…… গম্ভীর গলায় বলে আবির রাই কে ছেড়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে নিজের ঘড়িটা নিয়ে পরতে পরতে ঘর থেকে বাহিরে চলে গেলো।
রাই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। কথার অর্থটা বুঝতে ওর বেশি অসুবিধে হলোনা।

টেবিলে বসে প্রায় সবাইই রেজোয়ান সাহেবের কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। বউ কই। আসেনা কেনো। আবিরকে ও প্রশ্ন করছে। তবে আবির কারো কোথায় কোনো উত্তর দিচ্ছে না।তাতে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই জানেই যে আবির কোন মেজাজের ছেলে।

আবিরের এক আণ্টি বলে উঠলেন সাবিনা, (আবিরের মা) তোর ছেলের যে মেজাজ, ওর যে বিয়ে হয়েছে, আর ওকে যে কেউ বিয়ে করেছে এটাই তো বিশ্বাস হচ্ছে না।
রেজোয়ান সাহেব হেসে উঠলেন আরে আপা, এক্কেবারে খাঁটি কথা বললেন , আমি তো ভেবেছিলাম আমার এই ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ব্যাটা কাজ, পড়ালেখা ছাড়া কিছুই বোঝে না

একেবারেই নিরামিষ বলে হেসে উঠলো হৃদয় (আবিরের কাজিন)।
অন্য একজন আবিরের দাদী কে বললেন আম্মা, আপনার নাতবউ কেমন লেগেছে?
আবিরের আরো কয়েকটা কাজিন ও জিজ্ঞেস করলো। দাদী মুখ গোমরা করে নিলেন মাত্রই তো কয়দিন হলো। আস্তে আস্তে বোঝা যাবে আমার নাতি, হিরে এনেছে না কয়লা বেছেছে

সবেমাত্র রাই সেখানে এলো। এসেই দাদীর এমন মন্তব্যে ওর পা থমকে গেলো।
রেজোয়ান সাহেবের নজর পড়লো ওর দিকে আরে এইতো রাই।
রাই হুশে এসে তাড়াতাড়ি মাথায় অঞ্চল টেনে এগিয়ে সবাইকে সালাম দিল। আবিরের দুটো কাজিন বোন উঠে রাই কে জড়িয়ে ধরলো। কেমন আছো ভাবি?

রাই উজ্জ্বল মুখে জবাব দিল।
রেজোয়ান সাহেব রাই কে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তার মধ্যে হৃদয় আবার কিছুক্ষন রাই এর দিকে তাকিয়ে ছিল। যেটা আবিরের চোখ এড়ায় নি।

আণ্টি, নিশান কোথায়? হৃদয় বললো।
সাবিনা জবাব দিলেন ও তো ওর ঘরে। একটু আগেই ফিরেছে

রাই একে একে সবাইকেই খাবার বেড়ে দিলেন। এনাদের মধ্যে যারা রাই কে পছন্দ করত না যেমন দাদী, সাবিনা, আবিরের বড়মা। এনারা রাই এর রান্না করা খাবার নিলেন না।
ওদিকে সবাই রাই এর রান্নার ভালোই প্রশংসা করলো। আবির চুপ করেই আছে। হৃদয় তো পারেনা রাই কে গোল্ড মেডেল দিয়ে দিক।

তবে এত ও বিশেষ কিছুই ছিলনা। শুধু কোরমাই তো ছিলো। রাই ভেবে পায় না।
দাদী বলে উঠলেন নিশান বাবা তো কিছু খায় নি।

সাবিনা মুখ ঘুরিয়ে বললেন ও ঘর থেকে বেরোবে না বলেছে
দাদী একটু চিন্তিত স্বরে বললেন এভাবে তো হয় না। রাই……
রাই সোজা হয়ে দাড়াল জ্বী

খাবার বেড়ে নিয়ে যাও নিশান এর জন্য। ওকে ঘরে খাবার দিয়ে এসো বলে উনি খাবার খেতে লাগলেন।
কথাটা শুনে রাই চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। মন কোনোভাবেই চাচ্ছে না যেতে, কিন্তু নিষেধ ও করতে পারছে না। রাই আবিরের দিকে তাকালো। আবিরের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। না চাইতেও প্লেটে খাবার বেড়ে রাই নিয়ে গেলো নিশান এর ঘরে।

পেছনে হৃদয় রাই এর দিকে তাকিয়ে রইলো।
নিশান দাড়িয়ে ছিলো, তখনি রাই এর প্রবেশ। রাই কিছু না বলে খবরটা টেবিলে রেখে ঘুরে দাড়ালো
খবরটা নিয়ে যাও। আমি খাবো না

রাই উত্তরে বললো আমি আনিনি, দাদী পাঠিয়েছেন
এটা শুনে নিশান আরো চটে গেলো বললাম তো নিয়ে যাও।
রাই কিছুক্ষন চুপ রইলো খাবারটা যদি আমি নিয়ে যাই তবে বাড়ির লোকেরা কি বলবে নিশ্চই জানো। তাই খেয়ে নাও

নিশান গিয়ে রাই এর হাত চেপে ধরলো তুমি কি সত্যিই এতই বদলে গেছো? সবই কি মেনে নিয়েছো?
নিশান তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি কে…. হাত ছাড়ো শান্ত দৃষ্টিতে
নিশান নিজের প্রশ্নের উত্তর এভাবে পাবে বলে আশা করেনি। আপনাআপনিই ওর হাতটা আলগা হয়ে এলো। রাই তীব্র যন্ত্রণার চোখে নিশান এর দিকে তাকালো

যেই মুহুর্তে তোমার আমার পাশে থাকার কথা ছিল, তখনই তো ছিলেনা। এখন কত্থেকে এতো কষ্টের ভান্ডার একত্রিত করেছো?
নিশানের কাছে এর কোনো জবাব নেই। রাই মুখ ঘুরিয়ে প্রস্থান করলো।

খাওয়া শেষে সবাই গল্প করছে। গল্পের কেন্দ্রবিন্দু রাই। রাই কে সবাই ঘিরে রেখেছে। আর একেকজন একেকটা উপহার হাতে তুলে দিচ্ছে রাই এর।

আবির দুর থেকে দেখছে সব কিছু।
অবশেষে এক বোন এসে রাইয়ের হাতে একটা ছোটো খাটো চকোলেটের ঝুড়ি ধরিয়ে দিল ভাবি, জানি তুমিও আমার মতই চকোলেট প্রিয়, নাও নাও, সব তোমার

সবাই হেসে উঠলো।
রাই ঝুরিটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
এই ঝুড়িটা দেখেও ওর অতীত চোখের সামনে ভেসে উঠলো।

সুরাইয়ার গায়ে হলুদে জমিয়ে মজা করেছে সবাই। বিশেষ করে রাই। নাচগান, আড্ডা সবই জমজমাট ছিলো।
আগামীকাল পাত্রদের বাড়ি থেকে নাকি কিছু ডালা পাঠাবে। মিহির ভাইয়ার অনুরোধে পাঠানো হচ্ছে।
সুরাইয়ার হলো কপাল বুঝলা খালামণি। বিয়ের জন্য নাকি আলাদাভাবে সব পাঠাচ্ছে ভাইয়ারা বলে রাই হাসছে।
কেনো তোর হিংসা হচ্ছে নাকি? সুরাইয়া ঘরে এলো।

উম আপাতত না। তবে ভাইয়া যদি তার একমাত্র শালীকে কিছু না দেয় তাহলে নিশ্চই ভাইয়া আস্ত থাকবে না বলে রাই নাক এ আঙ্গুল ঘষলো।
ওরে আমার পালোয়ান বলে রাই এর মা ভ্রু উঁচু করলেন।

ওভাবেই হাসাহাসি করে রাত পার।

পরেরদিন বিকেলে পাত্রদের বাড়ি থেকে তিনজন এলো। রাই মাত্রই বাহির থেকে এসেছে। বাড়িতে ঢুকে দেখে নিশান সহ আরো ২ জন বসে আছে সোফায়। দেখেই রাই এর মাথা এমনিতেই বিগরে গেলো।
রাই বাহিরে বেরিয়ে গেলো ধুর এই ছেলের চেহারাই দেখতে মন চায় না
বলতে বলতে রাই বাড়ির পেছনের একটা গাছের নিচে গিয়ে বসলো।

হটাৎ পেছন থেকে কেউ ওর কানে কিছু একটা ধরলো। সাথে সাথে ও চমকে লাফিয়ে উঠলো। দেখে নিশান গলা ফাটিয়ে হাসছে।
রাই দেখে ওর হাতে একটা লম্বা ঘাসের মত কিছু। এজন্য কানে অমন সুড়সুড়ি লেগেছিল।
অটিস্টিক

কি বললে? নিশান এগিয়ে গেলো।
বললাম বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার খুব সুন্দর উদাহরণ আপনি মহাশয় বলে রাই ঢং করলো
ওহ, থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু…. বলে নিশান ও ঢং করলো। তো আমাকে দেখে পালালে কেনো? তুমি হরিণ নাকি আমি বাঘ?

শেয়াল দেখলে বাচ্চারা ভয় পায়। স্বাভাবিক দাঁত বের করে বললো রাই।
নিশান কপাল সংকুচিত করে একপা একপা রাই এর দিকে এগোলো। রাই সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে।
নিশান রাই এর খুব কাছে এসে বলে ওঠে এমন বাচ্চাকে তো মন চায়….. খেয়ে ফেলি বলে বাকা হাসলো নিশান।
রাই মনে মনে বললো দাঁত ভেঙে দিবো। ঢং

গাগালি করছো নাকি? তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে নিশান বলে।
বাহ বুঝলেন কিভাবে? রাই এর চোখ চকচক করে ওঠে।
নিশান কিছুক্ষন বাকা চোখে তাকালো। রাই ঠোঁট চেপে হেসে বাচ্চা বাচ্চা ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইলো।
থাক অবুঝদের সাথে তর্ক করে লাভ নেই বলে নিশান।
প্রতিবন্ধীরা কথা ও বলতে পারে? বলে ঠাট্টা করে রাই।

সবাইকে নিজের মত কেনো ভাব তোমরা মেয়েরা বলবে? নিশান কোমরে একহাত রাখে।
রাই হাত ভাজ করে ভাব নেয় সরি আমরা মেয়েরা অযথা তর্কাতর্কি করিনা
দেখাই যাচ্ছে বাকা চোখে তাকিয়ে

আপনার চোখ ও আছে! রাই বলে ওঠে।
নির্ঘাত তোমার ব্রেনে সমস্যা নিশান বলে।
হুম…. ভাইরাস সামনে থাকলে যা হয় আরকি…… বলে রাই ঠোঁট হ

চেপে হাসলো। কারণ নিশান রীতিমত ওর সাথে তর্ক করে হাঁপিয়ে উঠেছে। বেচারা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে।
পারবেন না পারবেন না, গার্লস পাওয়ার ইউ নো? ‘ রাই নিজের কাঁধেই চাপড় দিলো।
নিশান কিছু না বলে ওর দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে এক দৃষ্টিতে তাকালো। রাই একটু অসস্তিতে পড়ে গেল। দূরে যান
নিশান বাকা ঠোঁটে বলে শেষ গার্লস পাওয়ার?

আব বা…. রাই কিছু বলবে তখনি রাই এর একহাত ধরে সামনে এনে নিশান একটা রঙিন প্যাকেটে মোড়ানো ডালা ওর হাতে ধরিয়ে দিল। রাই তাকিয়ে দেখে ওটায় চুড়ি দেখা যাচ্ছে। এটা!
এই সাজে সেজো কেমন? বলে নিশান রাই এর চোখে গভীর দৃষ্টিপাত করে ধীরে ধীরে সেখান থেকে হেঁটে চলে গেলো।

রাই ডালা টা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে রইলো।
রাতে রাই ওই ডালাটা খুব একান্ত ভাবে নিজের ঘরে খুলতে লাগলো।

লাল রঙের খুব সুন্দর চুড়ি, আরো দু ডজন অন্য রঙের ছিলো। একটা পেন্ডেন্ট যার সাথে চিরকুট ছিলো (সবসময় গলায় পরে রেখো) আর একটা কাজল ব্যাস।
উপহারগুলো দেখে রাই এর মুখে নিজ থেকেই একটা হাসির উদয় হলো। ও বেশ খানিকক্ষণ জিনিসগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো।


পর্ব ৭

রাই প্রায় অনেক্ষন ধরেই ওই ছোট্ট একটা চিরকুট বারবার পড়ছিল, আর নিশান এর বলা একটা কথাই ওর মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল
এই সাজে সেজো
মনে পড়তেই কেমন অদ্ভুত অনুভব হতে থাকে। যখনই মনে পড়ে।

নিশান এর পাঠানো পেন্ডেন্ট টা খুবই সুন্দর লেগেছে ওর। সাথে সাথেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওটা গলায় পরে নিল।
মিস্টার নিশান, আপনার জন্য না তবে লকেটটা খুব সুন্দর তাই পরেছি বলে খিলখিল করে হাসতে লাগলো রাই।
রাই তখনি সুরাইয়ার গলায় ডাক পড়লো আসি বলে রাই ওরনাটা গলায় পেঁচিয়ে লকেটটাকে ঢেকে নিলো।

পাত্রের বাড়ির পাঠানো জিনিসপত্র খোলা হচ্ছে।সবাই গোল হয়ে বসেছে। রাই গিয়ে সুরাইয়ার পাশে বসে পড়লো।
কিরে এতো দেরি কেনো হয় তোর? সুরাইয়া জিজ্ঞেস করলো।
মেকআপ করছিলাম বলে দাঁত বের করলো রাই।

সুরাইয়া দুটো বড়ো বড়ো ডালা খুলে সব বের করতে লাগলো। বড়ো একটা লাল লেহেঙ্গা, কসমেটিকস থেকে শুরু করে সবই আছে। আর বাড়ির বড়দের জন্য শাড়ি, পাঞ্জাবি দিয়েছে। সবার জন্যই যা যা দিয়েছে তার প্যাকেটের ওপরে নাম লেখা।

কাপড় যা দিয়েছে মিহিররা সবার খুবই পছন্দ হয়েছে।
লেহেঙ্গা টা কিন্তু খুবই সুন্দর বললো রাই।সবাই সায় দিল।
কিন্তু রাই খুঁজছে অন্যকিছু এই আমার নামে কিছু পাঠায় নি নাকি?

সবাই তাকালো। নাহ। রাই এর নামের তো কোনো কিছুই নেই। এটা দেখে রাই বাচ্চাদের মত অভিমান করলো এটা কোনো কথা! ভাইয়া আমার জন্য কিছু পাঠালো না?
রাই এর মা বললেন ঠিক করেছে। জামা কাপড় তো কম আনোনি
রাই পুরো দমে কান্না করার অবস্থায় মা….. ( ইমোশনাল ভাব নিয়ে) নিজের টা পেয়ে মেয়ে কে ভুলে গেলে! ইয়া আল্লাহ

সুরাইয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আরো একটা ডালা রয়েছে এই থাম তুই। দেখ এইটায় কি আছে? বলে ডালা টা সামনে নিয়ে খুলতে লাগলো।
রাই হতাশ ভঙ্গিমায় বলল থাক, তোদের জন্যই ভাইয়া ভাবে। আমি। আর কে….. বলে শিনচেন এর মত মুখ ফুলিয়ে নিলো।
সুরাইয়া পাশ থেকে ওর মাথায় থাপ্পড় দিলো এই নে ড্রামেবাজ। তোর ডালা

কিহ! খুশিতে চেঁচিয়ে ওঠে রাই দেখি ডালা টা হাতে নিয়ে কাপড়টা বের করে। সবাই একসাথে বলে ওঠে বাহ…… সুন্দর তো কিন্তু রাই এর চোখ মুখ কুচকে ওঠে এগুলো কি! এগুলো আবার কেউ কাওকে দেয়!

রাই তাকিয়ে দেখে একটা ধূসর রঙের সিম্পল লং ফ্রক। কিন্তু টপ টায় খুব সুন্দর পাথরের কাজ করা, আর সাথে খুব সুন্দর একটা প্রিন্টের ওরনা। মোট মিলিয়ে অসাধারণ বলা চলে কারণ রং যাই হোক ড্রেসটা চোখ লাগানো। এজন্য সবাই ওয়াও বলে ওঠে। কিন্তু রাই এর এটা বিশেষ পছন্দ হয় নি। তার কারণ এটার রং।

ড্রেস সুন্দর তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এর রঙ! মানে বিয়ের দিন কি আমি এই সাদা কালো সাজে সাজবো নাকি! আশ্চর্য বলে রাই ড্রেস টা রেখে দিল। রাই এর মা ওর খালার দিকে তাকালো। রাই এর খালা বললো মা, রাগ করিস না। ড্রেস টা তো সুন্দরই। ওরা হয়ত রং এর বিষয়টা মাথায় নেয় নি।

হ্যাঁ, আর তোর যদি ভালো না লাগে তাহলে পড়িস না। ড্রেস তো তুই ও এনেছিস বললো ওর মা।
রাই মাথা নাড়লো হুম…… জিনিসগুলো হাত দিয়ে নেড়ে দেখতে লাগলো। একটা ফ্রক, সিলভার রঙের চুড়ি (খুবই সুন্দর), আর কিছুই না। রাই মুখ ফুলিয়ে ওখান থেকে উঠে চলে গেলো নিজের ঘরে।

এই ভাবি…. সুমির ডাকে ভাবনার জগৎ ছেড়ে বাস্তবে ফিরলো রাই। কিহলো?
রাই মুচকি হেসে মাথা নাড়লো কিছুনা

দাদী গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন বড়রা কিছু দিলে, গিয়ে সালাম করতে হয়।
রাই অবুঝের মতো তাকালো। পায়ে ধরে সালাম করবে? কেমন যেনো লাগলো রাই এর কথাটা। রাই মাথা নাড়িয়ে উঠতে গেলেই ওর ফুপি বলে ওঠে আম্মা, ওসব পুরনো দিনের রীতি। এখনকার সময় ওগুলো আর হয় নাকি। বাদ দাও।

রাই যাও এগুলো ঘরে রেখে আসো। আর এতক্ষণ তো সবাই আড্ডা দিলেই। এবার একটু আরাম করো গিয়ে।
রেজোয়ান সাহেব বললেন হ্যাঁ সেটাই, ভাই… আপনারা গিয়ে আরাম করুন অনেকদিন পর এসেছেন মেহমানদের উদ্দেশ্যে বললেন।
হ্যাঁ, আপনারা যান। আমরা সবাই ভাবির সাথে থাকবো। বললো সুমি। সাথে আবিরের বাকি কাজিনরাও সায় দিল।
মিসেস কামাল বললেন না, আর যা কথা সব সন্ধ্যায়। এখন গিয়ে সবাই রেস্ট নাও। ওঠো ওঠো

বলতে দেরি, দাদী, সাবিনা, আর আবিরের চাচীর ওখান থেকে উঠতে দেরি হলো না। তারা এতটাই অপছন্দ করেন রাই কে। রাই তাদের দেখে একটু মন খারাপই করলো। উপস্থিত সকলেই বিষয়টা ভালো চোখে দেখলো না। ওনাদের ওঠার সাথে সাথেই আবির ও উঠে দাড়ালো রাই, ঘরে আসো….. কাজ আছে বলে আবির হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেল।
মিসেস সাবিনা যেনো ছেলের আচরণে ক্ষুব্ধ হলেন। রাই কোনমতে জোরপূর্বক হেসে আস্তে করে উঠে চলে গেলো।

বিয়ের দিন চলে এসেছে। সবেমাত্র রাই গোসল সেরে বের হয়েছে। ইতোমধ্যেই বাড়িতে ধুমধাম, হইহুল্লোড় চলছেই। বাড়ির পুরুষেরা সব বাহিরের আয়োজনে ব্যস্ত। পাশের মাঠেই বড়ো করে স্টেজ সাজানো হয়েছে, আর রান্নাবান্না ও হচ্ছে।

পোলাও এর গন্ধে আর টেকা যাচ্ছেনা বাড়িতে বলে রাই চুল ঝাড়তে লাগলো। বাহিরে কাজিনরা ডাকাডাকি করছে ওর হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে। রাই জানালা খুলে একপলক বাহিরে তাকালো।

বাহ কি সুন্দর, সবাইই ভাইয়ার দেওয়া শাড়ি পরেছে। ভাবছে আর তাকিয়ে আছে। অবশ্য ওর মা ওকে বুঝিয়ে গেছে মন খারাপ না করতে। ওর জন্য পাঠানো ড্রেসটা হাতে নিলো রাই। হাজার হোক একটা মানুষ এত সুন্দর করে পাঠিয়েছে, না পরলে তো তার খারাপ লাগতেই পারে। ভেবে রাই ড্রেসটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো।

বরযাত্রী সেই অনেক আগেই এসে পড়েছে। এর মধ্যে নিশান এর চোখ জোড়া খুঁজছে অন্য কাওকে। সবাই খুব আনন্দে মেতে উঠেছে। স্তেজটা এমনভাবে সাজানো, যে দুপাশে বর কনে কে রেখে মাঝে একটা চওড়া লাল পর্দার মত দেওয়া। যেমনটা সিনেমায় দেখায়। পর্দার এপারে ওপরে দুইজন। তবে দেখা যাচ্ছে। মিহির বারবারই সুরাইয়া কে দেখছে। আর সেই নিয়ে দুপক্ষের হাসাহাসি।

অবশেষে সময় এলো নাচ দেখানোর। এর ঠিক সামনেই আরো একটা স্টেজ সাজানো হয়েছে। সেখানেই সাউন্ড সিস্টেম রাখা। নিশান এমন এক পরিস্থিতিতে যে কারো সামনে থেকে সরতেও পারছে না। আবার রাই কেও খুঁজে পাচ্ছেনা। ও কি অনুষ্ঠানে আসবেনা নাকি!

তখনি চারদিক মাতিয়ে গান বেজে উঠলো আর রঙিন আলোর কেন্দ্রবিন্দু হলো একটা মেয়ে।
মুখের সামনে হাত থাকায় প্রথমে কেউ ধরতে পারেনি। গানের তালে তালে সে নাচতে শুরুকরলো
ওহে শ্যাম তোমারে আমি নয়নে নয়নে রাখিব অন্য কেউরে না আমি চাইতে দিবো….

ওহে শ্যাম তোমারে আমি নয়নে নয়নে রাখিব অন্য কেউরে না আমি চাইতে দিবো…. সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠলো। স্টেজ এ রাই নাচছে।
পরনে সেই লং ফ্রক। গর্যেস সাজ, হাতে নিশান এর দেওয়া চুরিগুলোর একডজন, আর গলায় সেই পেন্ডেন্ত।

দুপাট্টা এককাঁধে নিয়েছে। আর চুলগুলো খোলা। খুবই অসাধারণ লাগছে রাই কে। সবাই অবাক + ওর কাজিনরা তো সেই চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। তখনি সুরাইয়ার এক ভাই স্টেজ এ উঠলো
বাগিচার ফুল তুমি তুলিয়া আনিয়াছি আমি
মালা গেঁথে গলায় পরিব
অন্য কেউরেনা আমি চাইতে দিবো…. ওহে শ্যাম….

রাই এর সোহম (যে ছেলেটা ওর সাথে নাচ করছে) খুব সুন্দর করে তালে তাল মিলিয়ে নাচ করছে। এদিকে নিশান তো পুরোই অবাক ওর উপস্থিতির পদ্ধতি দেখে।
এবার নিশান স্টেজ থেকে নেমে অপরদিকে রাই এর স্টেজ ই খুব ভাব নিয়ে উঠলো। আর সোহম সরে গেলো। সবাই ইচ্ছামত তালি দিচ্ছে।
রাই মাথা নাড়িয়ে ওকে ইশারায় চ্যালেঞ্জ করলো নাচার। নিশান ও বাকা হেসে শুরু হয়ে গেলো
সুবাস মিশিয়া থাকে পাপড়ির ভাজে ভাজে……

তেমন তুমি আছো মিশে আমার দেহের মাঝে।(রাই)
সুবাস মিশিয়া থাকে পাপড়ির ভাজে ভাজে……

তেমন তুমি আছো মিশে আমার দেহের মাঝে…(নিশান)
সাত রাজার ধন তুমি….. খুঁজিয়া পাইয়াছি আমি,
মনের মনে কোঠায় রাখিব
অন্য কেউরে না আমি চাইতে দিবো

নিশান আর রাই একসাথে মুখোমুখি এসে দাড়ালো ঠিক গানের মতো
ওহে শ্যাম তোমারে আমি নয়নে নয়নে রাখিব……
অন্য কেউরে না আমি চাইতে দিবো…
ওহে শ্যাম…

দুজনের নাচ শেষ হলো। নিশান রাই এর দিকে হেসে তাকিয়ে আছে। রাই মুখ ভেংচি দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গেলো।
স্টেজ থেকে নেমে আসার পর অন্যান্য ভাই বোনেরা নাচ করছে। আর রাই ঘুরে ঘুরে সব জায়গাতেই দেখছে। সবাই যে যার মতো বিজি। ওদিকে নিশান ও স্টেজে নাচানাচি করছে। হুহ পুরো ক্যাঙ্গারুর মত লাফাচ্ছে বলে নিজেই হাসতে লাগলো রাই….
তাকিয়ে দেখে একটা চেয়ার ফাঁকা আছে। রাই গিয়ে চেয়ারটায় বসলো আর ফোন দিয়ে ওদের ভিডিও রেকর্ড করতে লাগলো।

হটাৎ রাই এর চোখে পড়লো একটা অজ্ঞাত ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রাই ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষন একটু আড়চোখে তাকিয়ে ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করলো। হুম ছেলেটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। রাই এর অসস্তি হচ্ছে। ও ভাবলো এখান থেকে সরে অন্য জায়গায় যাবে।

তাই ও উঠে অন্য একপাশে গিয়ে বসলো।
কিন্তু মহাবিপদ ছেলেটা দেখি ওর পাশেই এসে চেয়ারে বসে গেলো।
রাই এর মেজাজটা পুরোই বিগড়ে গেলো।

যতই সময় যাচ্ছে ততই ছেলেটা যেনো ওর দিকে আরো লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
রাই অসস্তির জন্য সেখান থেকেও উঠে গেলো। দাড়াও বুঝাচ্ছি বলে রাই এবার হাঁটা শুরু করলো। এবারে ছেলেটাও ওর পিছু পিছু হাটতে লাগলো।
রাই এইটা লক্ষ্য করে দ্রুত হাটতে লাগল। সেম ছেলেটাও ওর পিছনেই।

হাটতে হাটতে একপর্যায়ে রাই থেমে যায়। আর ছেলেটা আচমকা থেমে যাওয়ার জন্য প্রায় রাই এর সাথে ধাক্কা লাগতে গেলেই রাই পেছনে ঘুরে ছেলেটার পাঞ্জাবির কলার ধরে সামনে এনে মাটিতে ফেলে দেয়।
তাল সামলাতে না পেরে ছেলেটা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
কি সমস্যা হ্যা? রাই কোমরে হাত বাঁধলো।

ছেলেটা রেগে ওঠে কি,? কে আপনি? আমাকে এভাবে ফেললেন কেনো?
আমি ফেলেছি? তোর তো মাথায় ফাটিয়ে ফেলবো…. বলে রাই পাশে ফেলে রাখা একটা লাঠি উঠাতে গেলেই রাই এর বাবা এসে ওকে ধরে ফেলে। গান বাজনা বন্ধ হয়ে যায়।
রাই কি করছিস তুই!

বাবা, এই ছেলেটা অনেক্ষন যাবৎ আমাকে ফলো করছে। দেখছি যেখানেই যাই সেখানেই আসে। বলে রাই ছেলেটার দিকে অগ্নিদৃষ্টে তাকায়। ততক্ষণে ছেলেটার মা, বাবা উপস্থিত।
এই মেয়ে তুমি আমার ছেলের গায়ে হাত দিচ্ছ কেনো? বলে মহিলা কটমট করে তাকালো
ছেলে তো স্বয়ং কৃষ্ণচূড়া? টোকা দেওয়া যাবেনা? বলে রাই ও ক্ষেপে গেল।
রাই চুপ কর….

কি চুপ করবো খালামণি? ছেলেটাকে তোমরা কিছু বলবে না? ওকে জিজ্ঞেস করুন না ও কি করছিল.?
রাই এর কথা শুনে ছেলেটার বাবা ছেলেটাকে ধরলো ও কী ঠিক বলছে?
ছেলেটা বোধহয় একটু ভয় পেলো
বাবা….. না। আমি

সজোরে একটা চড় পড়লো ছেলের মুখে এই দিন দেখার জন্য তোকে বড়ো করেছি? লোকটি আবারো হাত তুলতে গেলে রেজোয়ান সাহেব এসে তাকে ধরে ফেলেন।
বুঝিয়ে সুঝিয়ে সে মামলা ওখানেই রফাঁদফা করা হয়। তবে রাই শেষে বলে ওঠে এই বাড়ির ত্রিসীমানায় যেনো না দেখি…… বলে তুড়ি মেরে রাই ওয়ার্নিং দিয়ে দেয়।

নিশান মনে মনে বেশ অবাক ও খুশি দুটোই হয়। পুরোই গুন্ডি বলে নিশান হেসে দেয়।
পুরো অনুষ্ঠানটা খুবই ভালো করে সম্পন্ন হলো। এই মুহূর্তে কাজী সাহেব সুরাইয়া আর মিহির এর বিয়ে পড়াচ্ছেন। সুরাইয়া কে কবুল বলতে বলা হলো। ও কিছুক্ষন চুপ থেকে কবুল বললো। সবাই খুশি হয়ে গেলো।
রাই হেসে ওই কথাটাই রিপিট করলো

কবুল বলে রাই পর্দা ভেদ করে মিহির এর দিকে না তাকিয়ে সোজা নিশান এর দিকে চোখ চলে গেল। নিশান দুষ্টু হেসে নিজেও শব্দহীন ভঙ্গিতে বলল কবুল
রাই এর চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেলো। ও সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো। ভালো হইসে তিনবার বলি নি ভেবে হাফ ছাড়লো রাই।

এভাবেই বর কনে তিনবার করে কবুল বলে একে অন্যকে জীবনসঙ্গী বানিয়ে নিলো।
সুরাইয়া কান্না শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যেই। কিছুক্ষণের মাঝেই ওর বিদায় হবে।
রাই কিছু একটা কাজের জন্য বাড়ির ভেতরে গিয়ে দোতলায় উঠেছিল।
কাজ সেরে ও দোতলার ঘর থেকে নামার জন্য পা বাড়াবে ঠিক তখনই পেছনে দরজা লাগানোর শব্দ এলো।
ও চমকে পেছনে ঘুরে তাকায়….

কেউ একজন গাঢ় চকলেট কালার পাঞ্জাবি পরে আছে। মুখ দরজার দিকে। দরজা লাগলো মাত্রই
কে? কে আপনি! রাই ভয় পেয়ে গেল।
লোকটি ঘাড় বেঁকিয়ে ঘুরে দাড়ালো আর একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করল রাই এর দিকে।যাকে দেখে ঘৃণায় রাই এর মুখভঙ্গি বদলে গেলো আপনি এখানে কি করছেন?

আবির কিছু বললো না। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তবে আজ ওর চেহারায় কোনো হাসির রেখা নেই।
কিহলো? দরজা খুলুন….. বলে রাই পিছতে লাগলো
কারণ আবির ওর দিকে এগোচ্ছে।

আপনি….. দরজা খুলুন ততক্ষণে রাই দেওয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকেছে।
আবির ওর সামনে এসে ঠিক ওর দুপাশে দুটো হাত দিয়ে ঘিরে দাড়ালো।
রাই বরফের ন্যায় জমে গেছে। লোকটা কি মতলবে এসেছে!
আবির আস্তে আস্তে রাই এর দিকে মুখ এগোতে লাগলো। রাই নড়তেও পারছেনা। ওর হাতপা এমনভাবেই জমে এসেছে, ভয়ে ও চোখ বন্ধ করে নিলো।

মুহূর্তেই একটা গরম শ্বাস ওর মুখে আছড়ে পড়ল কি মনে করছ আমি কি বাহিরের ওই ছেলেটা নাকি?
রাই তাকিয়ে গেলো। ওর মাথায় ঢুকলো না কি বললো আবির।

আবির আবারো বললো বাহিরে তো ছেলের মাথাই ফাটিয়ে দিচ্ছিলে। কি শেষ সব?
আবিরের কথায় রাই একটা ঢোক গিলে নিলো। রাই হৃদপিণ্ড মিনিটে ১০০ এর উপরে চলে গেলো।
আবির অদ্ভুত গলায় বলল নাচটা ভালো ছিল…… তার থেকে ভালো ছিল তোমার চেহারার চমক। একদম চম্বুকের মতো
রাই এর কপাল সংকুচিত হয়ে যায় কি বলছেন এগুলো!

হুম….. (রাই কে আপাদমস্তক একবার দেখে) হট লাগছিলো। সব দিক থেকেই…… উম….. হুম চেহারাটা যথেষ্ট বাজে লাগছে….. যাইহোক…. তবে (ওর কাছে এসে) নাচের মাধ্যমে তুমি ছেলেদের নিশ্চই পুরোদমে আকর্ষণ করতে পেরেছ। কথাটা এমনভাবে বললো যেনো এর মধ্যে রাই কে কি পরিমাণে অপমান করা হচ্ছে বোঝা যায়।
চুপ করেন….. অসভ্য……ওকে থামিয়ে দিল আবির

আ আ….. অসভ্য কেনো! সেই তো লাগছিলো। শুধু….. বিকৃত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওরনা টা না নিলেও পারতে…
শাট আপ ওর কথা শুনে রাই থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত তুললো, কিন্তু আবির ওর হাতটা ধরে ফেললো। আর আবিরের মুখে হিংস্রতা ফুটে উঠলো।

হাত ছাড়ুন….. আবির ওর হাত এতই শক্ত করে ধরেছে যে হাতের কাচের চুড়ি গুলো একটা একটা করে ভাঙতে লাগলো ভালো লাগেনি? কমপ্লিমেন্ট টা?
ঘৃণা করি। আপনি এমনই, বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ….. ছি

আবির আরো জোরে ওর হাত চেপে ধরলো কেনো! আমি বিকৃত মস্তিষ্কের!কিন্তু স্টেজ এ তো ঠিক এই একই মানষিকতার কিছু ছেলের মাঝে নাচানাচি করছিলে….. যারা তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল তারাও তো এইভাবেই তাকিয়ে ছিল…. রাগান্বিত স্বরে তাহলে আমি কি দোষ করলাম?

আহ্…. ছাড়ুন। আপনার কথামত কি আমি চলবো নাকি?
আবির বাকা হাসলো আমার কথামত যদি নাই চলতে চাও। তো এই ড্রেস কেনো পরেছ?
রাই ব্যথায় কাতরাচ্ছে মানে!

আবির কিছু বললো না, চুপ করে তাকিয়ে রইলো। পরমুহূর্তেই রাই বুঝতে পারলো আবির কি বোঝাচ্ছে
মানে এই ড্রেস…. আপনি দিয়েছেন?

আবির শয়তানি হাসি হেসে রাই কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।
আমার প্রতি তোমার ঘৃণার উপহার ছিলো এটা…..হুম, হট লাগছে। . আবিরের তীব্র কঠোর দৃষ্টি রাই কে ভেতর থেকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে।

রাই হাতের ব্যাথা উপেক্ষা করে ওরনা টা ঠিককরে দু কাঁধে দিলো।
আবির আরকিছু বললোনা। সজোরে দরজা খুলে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো।

দরজা লাগানোর শব্দে ধ্যান ভাঙলো রাই এর। সেদিনের আবিরের হিংস্রতা দেখে রাই সত্যিই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আবির এসে খাটে বসে পড়লো। রাই সেদিনের কথা ভাবছে আর আবিরের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে।
আবির তাকিয়ে দেখলো রাই অভাবে তাকিয়ে…… ও চোখ ছোটো ছোটো করে বললো

এই নজরটা দেখলে মনে চায় খেয়ে ফেলি।
রাই চোখ ফিরিয়ে নিলো। আবির বাকা ঠোঁটে হাসে আমার ব্যাপারে এত গভীর চিন্তা করার কিছুই নেই।
রাই চমকে উঠে ওর দিকে তাকায়।

সহজ জিনিসকে জটলা পাকানোর সহজ উপায়ই হলো খুব বেশিই চিন্তা করো। আর এই অভ্যাসটা মানুষের অত্যন্ত প্রিয়। তুমিও সেই একই ধারণার
কথাগুলো রাই এর বোধগম্যতার খুবই উর্ধ্বে। আবির আর সেদিকে তাকালোনা। উঠে বেলকনিতে চলে গেলো।


পর্ব ৮

আবির বর্তমানে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে। চোখ যে মনের কথার প্রতিফলন ঘটায়, কথাটার সত্যতা বোঝা যায় তোমার দিকে তাকালে রাই….. রাই এর চোখে আবির যতবারই তাকিয়েছে ও শুধু নিজের জন্য ঘৃণাই দেখেছে। তবে তাতে আবিরের কোনো অসুবিধে নেই। কিছু মানুষ ভুলকে নিয়েই বাঁচতে শুরু করে, ভেবে যে সেই ঠিক। তবে পয়সার একটা নয় দুটো পিঠ থাকে……

রাই আয়নার সামনে দাড়িয়ে কানের দুলগুলো খুলছে, চোখে পড়লো কাজলটা। ঠিক এই একই কাজল নিশান ও ওকে দিয়েছিল।

_____অতীতে
রাই আয়নার সামনে দাড়িয়ে কাজল লাগাচ্ছে। নিশান এর দেওয়া। তখনি ওর মা ঘরে এলো এই রাই…. শোন
রাই ঘুরে দাড়ালো।
কাল কিন্তু তুই আর মায়োই যাচ্ছিস মিহিরদের বাড়িতে….

না আমি যাবনা…. বলে রাই জানালার সামনে গিয়ে দাড়ালো।
ওর মা অবাক হলো যাবিনা মানে? কেনো? এতদিন তো লাফালাফি করছিলি যাবি যাবি….
মা… বললাম তো যাবো না। তুমি যাও এখন….. বলে রাই মুখ ফিরিয়ে নিলো।
আরে….

মা, যাও তো…. বলে রাই বিরক্তিসহকারে বাহিরে বেরিয়ে গেলো। ওর মা বেশ অবাকই হলেন মেয়ের কথায়।
রাই ছাদে বসে আছে। বাড়ির সকলে নিচে উঠানে কথা বলছে। একটা রীতি আছে, যে বাড়ির বড়ো একজন মেয়ের বিয়ের পর তার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কিছুদিন থেকে আসে। দেখার জন্য যে মেয়ে সুখে আছে কিনা। ঠিক সেজন্যই আগামীকাল সুরাইয়ার দাদী যাচ্ছেন সেবাড়ি। সাথে রাই এরও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু….

গতকাল আবির যা করেছে। তার পরে নিশ্চই আমি ওই বাড়িতে গিয়ে ওর মুখ দেখতে চাইনা। রাই নিজের ডান হাতের দিকে তাকালো। গতকাল চুড়ি ভাঙার কারণে হাতে কেটে কেটে গেছে। ওর মা জিজ্ঞেস করেছিল, ও বলেছে দরজার সাথে ধাক্কা লেগে হাতের চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল। তাই কেউ কিছু সন্দেহ করেনি।

পরদিন…
আমি যাচ্ছিনা…. যতই যে জোর করুক আমি যাবনা বলে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে রাই।
কেনো দাদুভাই? আমার সাথে যেতে কি তোমার অসুবিধে আছে নাকি? বললো দাদী।

রাই মলিন স্বরে বলল না দাদু…. সেটা না। এমনিতেই যাবনা। ভালো লাগছেনা
তাহলে যেতে সমস্যা কি? যা। এমনিতেও এতো বছর পর গ্রামে এসেছিস, ঘুরবিনা একটু? বললো রাই এর খালা।
না আমি যাবনা। মা বল কিছু….
রাই এর মা কিছু বলবে তার আগেই গাড়ির হর্নের শব্দ কানে এলো সবার। খালু বললেন হয়তো ও বাড়ি থেকে লোক এসে গেছে। বলে উনি বাহিরে বেরোলেন। রাই এর মা বললো আপু, থাক ও যখন যেতে চাচ্ছে না তখন দরকার নেই।
তখন ঘরে এলো ওর খালু, সাথে নিশান। রাই অবাক হলো।

আরে বাবা তুমি….. আমরা তো ভেবেছিলাম…. খালামণি কিছু বলবে তার আগেই নিশান হেসে জবাব দিলো হ্যাঁ আণ্টি, অন্য লোকের আসার কথা ছিল, কিন্তু বাবা আর আবির ভাইয়া ঢাকায় গিয়েছে…. তাই অন্য আরও কিছু কর্মচারীও ওনাদের সাথেই গিয়েছে। বাড়িতে তেমন কেউ নেই বিধায় আমাকে পাঠিয়েছে
ওহ, আচ্ছা হ্যাঁ ভালো কথা। বসো বসো রাই এর মা বললো।

রাই মনে মনে ভাবছে এই রে….. আবির নেই! তাহলে তো যাওয়াই যায়। কিন্তু না করে ফেলেছি যে…. কি করি!রাই অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে নিশান এর দিকে। নিশান বুঝলো না রাই এভাবে কেনো তাকিয়ে। তো আণ্টি, আপনাদের প্যাকিং হয়ে গেলে আমরা তাহলে বেরোই এখন?

খালা জবাবে বললেন আরে হ্যাঁ বাবা, আম্মা তো রেডি আছেই। কিন্তু রাই কে বলছি যেতে ও যেতে চাইছেনা….
নিশান চমকে গেলো ( মনে মনে ভাবলো) রাই ও যাবে! আমি তো ভেবেছিলাম ওকে এমনই দেখার সুযোগ পাবো। এতো মেঘ না চাইতেই জল।

কেনো আণ্টি…. ( রাই এর দিকে তাকিয়ে) ও যাবেনা কেনো? ‘
রাই এর মা জবাব দিল আরে কি যে বলি। ওর কখন যে কি মন চায়।

নিশান রাই এর দিকে তাকালো। বেচারি রাই। এখন ওর মনে চাইলেও ও যেতে পারছেনা। কষ্ট কই রাখবে…
বেয়াইন, আপনি কেনো যাবেন না? বললো নিশান।
রাই বলতে গেলেই ওর মা বললো থাক ও যখন যেতে চাইছে না…..
আমি যাবো….

সবাই চমকে তাকালো রাই এর দিকে। ওর মা বললো তুইই তো বলি যাবিনা? আবার এখন?
হ্যাঁ হ্যাঁ….( ততলাচ্ছে) বলেছিলাম। তবে, মাইন্ড চেঞ্জ এখন আমি যাবো…. বলেই রাই উঠে দাড়ালো আমি ব্যাগ গুছিয়ে আসছি দাড়াও..

বলে রাই দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
নিশান হা করে তাকিয়ে আছে। খালামণি বললেন ওর যে মাঝে মাঝে কি হয়!
দাদী বললেন সে তোমরা বুঝবেনা,। বলে উনি পান চিবোতে লাগলেন। নিশান দাদীর দিকে তাকালো।
খালু বললেন কি বুঝবো না আমরা মা?

উনি হেসে জবাব দিলেন বাচ্চাদের মন, তোরা বুঝবিনা। তোরা তো হয়েছিস আমার থেকেও বুড়ো। বলে উনি হাসতে লাগলেন। নিশান একটু জোরপূর্বক হাসলো আসলেই বাচ্চা বিড়বিড় করলো।

আচ্ছা সাবধানে যাস বলে রাই এর দাদীকে বিদায় জানালো সবাই। নিশান গিয়ে আগেই সামনের দরজা খুলে রাই কে ইশারা করলো বসার জন্য। আর দাদীকে পেছনে বসিয়ে দিল। রাই ও কিছু না বলে সামনে বসে পড়লো।
কিছুক্ষন চলার পর নিশান খেয়াল করলো দাদী ঘুমিয়ে পড়েছেন। রাই জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে।
আসতে চাচ্ছিলে না কেনো?

রাই ওর দিকে মাথা ঘুরালো, এমনিতেই…..
তাহলে আসতে রাজি হলে যে!
রাই চোখ সরিয়ে নিলো। কিছু বললো না। নিশান মুচকি হেসে সামনে তাকালো।
ভাবছিলাম আমিও কালকে ঢাকায় চলে যাই,

নিশানের কথায় পট করেই রাই প্রতিক্রিয়া করে বসে কেনো? নিশান বাকা চোখে তাকালো। রাই একটা ভাব নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো আ, হ্যাঁ তো… যান। আপনাকে কে আটকে রেখেছে?
তুমি….
রাই শিহরিত হয়ে উঠল। নিশান কথা ঘুরিয়ে নিলো চলে গেলে তো আর তোমার সাথে প্রেম করা হবেনা। তাই ভাবলাম কাজটা সেরেই নেই

আপনার সাথে প্রেম করার জন্য মানুষ বসে আছে রাই হেসে উঠলো।
ঠিক তা না। তবে প্রেমে পড়তে কতক্ষন?
নিজেকে হিরো আলম ভাবেন নাকি?
নিশান তাকালো আমি কারো সাথে নিজেকে তুলনা করিনা। আমি নিশান চৌধুরী, দাটস ইট

রাই ও ঢং করে বললো নিশান চৌধুরী
নিশান চোখ ছোটো ছোটো করে নিলো ওকে বেট?
কিসের? ‘
তুমি আমার প্রেমে পড়বে
খেয়ে কাজ নেই আমার? রাই জানালার বাহিরে তাকালো।

না, তুমি যেহেতু এতই আমাকে দামই দেও না। তো বেট? দেখা যাক। যে কয়দিন তোমরা ওই বাড়িতে থাকবে ব্যাস ততদিনে যদি পটাতে পারি তো ওকে। নইলে নাই। জাস্ট একটা সিম্পল বিষয়
পটাতে তো আপনি এমনিও পারবেন না। আর এসব গেম খেলার নূন্যতম ইচ্ছে আমার নেই।
ভয় পাও নাকি?
আপনাকে? হাহ অসম্ভব

তাহলে বেট? বলে হাতটা আগে বাড়ালো নিশান।
যদি হেরে যান?
তুমি যা বলবে তাই…..আর যদি জিতি? নিশান বললো
ওকে বেট…. বলে রাই জানালার বাহিরে তাকালো আবারো। নিশান বাড়ানো হাতটা ফিরিয়ে নিলো উত্তর দিলে না যে?

রাই চুপ করে রইলো। নিশান জোরেই বললো দেখি কতক্ষন চুপ থাকো….
রাই মিটিমিটি হাসলো।
প্রায় সন্ধ্যার আগে আগেই পৌঁছলো তারা মিহিরের বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকতেই সুরাইয়া এসে জড়িয়ে ধরলো। কীরে কেমন আছিস?
ভালো।

রাই গিয়ে একে একে বাড়ির সকলের সাথেই কুশল বিনিময় করে নিলো।
পাশাপাশি ও একটু লক্ষ ও করলো যে আবির আছে কিনা….. নাহ। আবির নেই। মানে ওরা ঢাকায় চলে গেছে। শান্তি।
রাতে খাবার শেষে রাই , নিশান মিহির সুরাইয়া, আরো দু একটা কাজিন, সবাই ছাদে বসে গল্প করছিলো। ঠাণ্ডা শীতল বাতাস, সাথে আড্ডা, মোট মিলিয়ে পরিবেশটা সেই হয়ে উঠেছে। সবাই মিলে ট্রুথ & ডেয়ার খেলছিল। এক পর্যায়ে রাই এর পালা এলো…..

আমি প্রশ্ন করবো…. বলে মিহির হাত তুললো।
ভাইয়া আপনার প্রশ্ন ভালো না লাগলেও কিন্তু উত্তর দিবনা বললো রাই।
সে তো আপনাকে এমনিও দিতে হবে শালীকা….. তো আপনার কি কোনো ভালোবাসার মানুষ আছে শালী সাহেবা?
রাই বাচ্চাদের মত হেসে দিলো বলবোনা…..
আরে, কেনো? বলতে তো হবেই….

মিহিরের সাথে তাল মিলিয়ে সবাই একই কথা বললো। কিন্তু রাই হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে নিশান একটু ভারী গলায় জিজ্ঞেস করলো বলো…. কে সে…. সবাই তো জিজ্ঞেস করছে
রাই চোখ ফিরিয়ে হেসে দিল আরে কেউ না। কেউ থাকলে তো বলেই দিতাম

নিশান কিছুটা হতাশ হলো। ও হইতো ভেবেছিল রাই….. কিন্তু রাই বললো না।
পরক্ষণেই বোতল ঘুরে নিশান এর দিকে গেলো। রাই উত্তেজিত হয়ে পড়ে আমি, আমি প্রশ্ন করবো
নিশান বলে ওকে
জিবনে কয়টা প্রেম করেছেন? বলে রাই হেসে উঠলো।

নিশান কিছুক্ষন রাই এর দিকে তাকিয়ে রইলো প্রেম নয় তবে, টাইমপাস করেছি
সুরাইয়া বলে কয়টা?
নিশান কিছুটা শান্ত গলায় বলে হবে কিছু। গুনিনি কখনো
মিহির হেসে বলে ওঠে আরে ওকে কি জিজ্ঞাসা করো। আমি বলছি, ও। তো ডজন খানেক এর সাথে অলরেডি ব্রেকআপ করে বসে আছে

সবাই শুনে হাসতে লাগলো। নিশান কিছু বললোনা।
এদিকে রাই এর মুখে তেমন হাসি নেই। জোরপূর্বক যেটুকু হাসছে আরকি। নিশান সেটা ভালো করেই বুঝতে পারলো ওর চেহারা দেখে।

যাইহোক খেলার সময় হটাৎ রাই বললো ভাইয়া, আপনারাই খেলেন। আমি খুব ক্লান্ত। ঘুমাবো…
। ওহ, হ্যা এমনিতেও রাত হয়েছে অনেক। চলো সব বলে মিহির ও উঠে দাড়ালো।
সিড়ি দিয়ে নামার সময় রাই সুরাইয়া কে বললো বাকি ঘটনা কালকে শুনবো সুরাইয়া লজ্জায় লাল হয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। রাই হেসে উঠলো।

সবাইকে বিদায় জানিয়ে রাই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াবে কেউ পেছন থেকে বললো মিথ্যে বললে কেনো?
কোনটা মিথ্যে? ঘুরে দেখে নিশান।
ঐযে…. কাওকে ভালোবাসো কিনা
আমি সত্যিই বলেছি।

নিশান সন্দিহান গলায় বলল একটাও না?
সবাইকে নিজের মত কেনো ভাবেন? বলে রাই ঘুরে হাটতে গেলো।
নিশান আসলেই ভেবেছিল হইতো রাই কোনো রিলেশনে আছে। ও গিয়ে রাই এর ডান হাত টেনে ধরলো।সঙ্গে সঙ্গেই রাই আহ্…. করে উঠলো।

নিশান ওর হাত ছেড়ে দিল। দেখে রাই নিজের ডানহাত ধরে ব্যথায় কাতরাচ্ছে….. কি হয়েছে তোমার? বলে রাই এর হাত টেনে হাতাটা তুলে উপরে করলো। রাই এর প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে।
তোমার হাত কিভাবে কাটলো?
রাই কিছু বললো না ছাড়ুন…. আমি ঘরে যাবো….

এখানে আসো…. বলে নিশান ওকে নিয়ে রাই এর ঘরে ঢুকে দরজাটা হালকা চাপিয়ে দিলো। কেউ দেখলে সমস্যা হবে। রাই এর ঘরের টেবিলের নিচে একটা ফার্স্ট এইড বক্স আছে ঐটা নিয়ে নিশান রাই এর পাশে বসে পড়লো আর হাতে মলম লাগিয়ে দিতে লাগলো।

দেখেন আপনাকে এখানে কেউ দেখলে সমস্যা করবে। আপনি যান প্লিজ
নিশান এর হেলদোল নেই। চুপ থাকো…আর বলো কেটেছে কিভাবে?

আ, এমনিতেই।
হোয়াট? হয় তুমি পাগল নয় বাকিদের পাগল ভেবে রেখেছ
রাই এর কিছু বললো না। চুপ করে গেলো।নিশান আস্তে আস্তে বললো তোমার কি বিষয়টা খারাপ লেগেছে?
রাই চোখ তুলে তাকায়। কোনটা?

নিশান একটু ইতস্তত করে বলে আমার রিলেশন এর ব্যাপারে
রাই এর মুখ আবারো শুকিয়ে গেলো আমার কেনো খারাপ লাগবে? আপনার জীবন আপনার ইচ্ছে। ১০০ টা প্রেম করেন তাতে আমার কি?

নিশান মলম লাগানো শেষে রাই এর দিকে তাকিয়ে রইলো নাহ কিছুনা….. বলে উঠে দাড়ালো ঘুমাও…..
রাই ও উঠে দাড়ায়। নিশান পেছনে দুপা গিয়ে আবারো রাই এর কাছে এসে দাড়ায়…..
কি? রাই জিজ্ঞেস করলো।

নিশান রাই এর আরো কিছুটা কাছে গিয়ে ওর মাথায় একটা চুমু দেয়। আর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাই ওর কাজে প্রচুর অবাক। তবে রাই খুশি হয় নি ছেলেটা এইসব ফ্লার্ট করেই মেয়ে পটায় ভেবে রাই একটা শ্বাস ফেলে শুতে চলে গেলো।
__ বর্তমানে।

রাই ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো। বাকিটা রাই ভাবতে চায়না। আয়নার থেকে চোখ সরিয়ে ব্যালকনিতে তাকালো। আবির এখনও ওখানেই দাড়িয়ে।বাহিরে আবারো সুমি রাই কে ডাক দিল। রাই আবিরের দিকে আর মন না দিয়ে বাহিরে চলে গেলো।

বারান্দায় আবির আকাশের দিকে তাকিয়ে পুরনো সেই দিনগুলোর কথা ভাবছে, যখন রাই কে ওর সহ্যই হতো না। এমনিতেও মেয়েদের আবির সহ্য করতে পারতো না, তার উপরে রাই তো ওকে প্রথমদিন ই এমনভাবে কথা শোনালো। সেটা ও কিভাবে সহ্য করতো?

এজন্যই ও বিয়ের দিন রাই কে উচ্ছৃঙ্খল বলে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে ওকে ড্রেস পাঠানোর কারণ কিছুই ছিল না। আবির শুধু চাইছিল ওর দেওয়া জিনিসটাই যেনো রাই ব্যবহার করে। কেননা রাই তো ওকে ঘৃণা করতো। তাই একটা ছোট্ট শোধ নিলো।
কিন্তু এরপরেই তো সব উলোট পালোট হয়ে গেলো
__ অতীতে

সেদিন রাতে যখন নিশান রাই কে মলম লাগিয়ে দিচ্ছিল তখনি আবির সেখানে উপস্থিত ছিল। আসলে ওইদিন যে কাজের জন্য আবির আর রেজোয়ান সাহেব ঢাকায় গিয়েছিল সেই কাজটা ক্যানসেল হয়ে যাওয়ায় রেজোয়ান সাহেবের জোরাজুরিতে আবির আর উনি আবারো বাড়িতে ফিরে আসে। রাত অনেক হয়ে যাওয়ায় তারা কাওকে ডিস্টার্ব করেনি। আর নিজের ঘরে যাওয়ার সময় আবির ওদের দেখে ফেলে।

সামনে নিশান রাই এর খুবই কাছে বসে ওর হাতে কিছু একটা দিচ্ছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। আবিরের তেমন মাথা ব্যাথাও ছিলনা বিষয়টা নিয়ে। ও ফিরেই যাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই আবির দেখে নিশান গিয়ে রাই এর মাথায় চুমু দিল, কিন্তু রাই কিছুই বললো না। এটাই আবিরের মাথা গরম হয়ে গেলো খুব সখ, ছেলেদের কাছে আসার? আবিরের হাত শক্ত হয়ে এলো।

রাতে রাই ঘুমাচ্ছিল। হটাৎ ওর মনে হলো ওর মুখে খুব গরম হওয়া আছড়ে পড়ল। রাই টিপটিপ করে চোখ খুলে ভয়ে চিৎকার দিতে গেলেই কেউ ওর মুখ চেপে ধরলো।
উম উম
গতকালকের কথা কি ভুলে গেছো নাকি? ‘

কন্ঠটা রাই এর মধ্যে শীতল স্রোত বইয়ে দেয়, আবির! রাই এর ছটফটানি থেমে যায়…… আবির হালকা হাসে স্মৃতিশতি ভালো…. তাহলে কালকের কথা কিভাবে ভুলে গেলে?
রাই আবিরের হাতটা টেনে সরিয়ে দিলো আপনি এখানে কি করছেন?
আবির জবাব দিলো না।

রাই উঠতে গেলে ওকে উঠতেও দিলো না সমস্যা কি আপনার?
নিশান এর প্রতি এতই টান? এখানে চলে এলে
রাই রেগে গেলো। আজেবাজে কথা বন্ধ করেন
আবির ওর ডানহাত এর ক্ষত এর জায়গায় শক্ত করে চেপে ধরলো যদি এতটুকুও লজ্জা থাকতো এখানে আসতেই না
আহ্ ছাড়ুন ব্যাথা করছে…..

রাই যতই ব্যথায় আর্তনাদ করছে আবির ততই শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরছে। রাই চিৎকার ও করতে পারছেনা।
ব্যথায় ওর অবস্থা খারাপ রাই ওর বাম হাতটা আবিরের কাঁধের নিচে বুকের দিকে রাখলো, ওর এতই ব্যথা করছে প্লিজ ছাড়ুন, আপনাকে কেউ এইভাবে দেখলে না আপনি বাঁচবেন, না আমি। প্লিজ
রাই এর স্বরে প্রচণ্ড এক ভয় আর কষ্ট দুটোই অনুভব করা যাচ্ছে।

আবিরের হাত আলগা হয়ে এলো। রাই নিজের হাতটা ছড়িয়ে চেপে ধরলো আহ্….. অনেক ব্যাথা করছে ওর। আবির ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
কেনো আমার সাথে এমন করেন আপনি! কেনো? বলে রাই কাঁদতে লাগলো।

বর্তমানে…..

রাই এর সেই কথার উত্তরে আবির বললো খুব শীঘ্রই জানতে পেরে যাবে….. বলে আকাশের দিকে তাকালো আবির।


পর্ব ৯

অতীতে _
সেদিন রাতে আবির আর চোখ বুঝতে পারেনি।
বারবারই ওর কানে রাই এর আর্তনাদের স্বর ভেসে আসছে।

মেয়েটা অতিমাত্রার চালাক। ওকে বিশ্বাস করাটাই বোকামি। ভেবে আবির নিজের চোখদুটো বন্ধ করে খাটে হেলান দিলো।
আমরা এমন এক জগতের বাসিন্দা, যেখানে আপন বলতে কেউই নেই। যা আছে সব স্বার্থ।

পরদিন সকালে খুব বেলা করেই রাই এর ঘুম ভাঙ্গে। তবে ঘুম ভাঙার সাথে সাথে গত রাতের তীব্র ব্যথাটাও যেনো জেগে উঠেছে। আবারো ব্যাথা করছে হাতে।

রাই কিছুক্ষন হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো আবির এমন কেনো!
ও কি কোনো মানসিক রোগী নাকি!
যাইহোক বিছানা ছেড়ে উঠে মুখ হাত ধুয়ে হাতে মলম লাগিয়ে রাই বাহিরে বেরিয়ে গেলো।
সুরাইয়া রান্নাঘরে কাজ করছে। রাইগিয়ে ওর পাশে মোড়ায় বসে পড়লো।

কিরে এতো দেরিতে ঘুম থেকে উঠলি যে? ‘
রাই স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলো ওই, আরকি…. গতকাল জার্নি করে আর রাতে অতদেরি করে জেগে সমস্যা হয়েছে। তাই ঘুম ভেঙে নি

সুরাইয়া হাতের টুকিটাকি কাজ করছে।রাই বললো দে আমি হেল্প করি
আরে না তুই কেনো করবি?
আরে দে তো…. এতো ফর্মালিটির কি আছে?

রাই এর জোরাজুরিতে শেষে সুরাইয়া বাধ্য হয়ে ওকে মটরশুঁটির খোসা ছাড়িয়ে দিতে বলে।
রাইও কাজ করছে আর মনে মনে গভীর চিন্তায় ব্যস্ত। সুরাইয়া একটু জোরেই বললো কীরে প্রেমে পড়েছিস নাকি? এতো কিসের চিন্তা তোর?

রাই মুচকি হাসলো না তেমন না। আচ্ছা, শোন
হুম?
তোদের এবাড়িতে কি কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ বা এমন কিছু আছে নাকি?
সুরাইয়া বেশ অবাক হলো। এটা কেমন প্রশ্ন?
বল না?

না, এমন কেউ তো নেই, কিন্তু কেনো বলবি তো?
উম না এমনিতেই। তোর ননদগুলা যে দাজ্জাল। তাই বললাম
সুরাইয়া হেসে ওঠে তুই ও না। তাও ভালো যে ওরা আপন ননদ না. মিহিরের ভাই বোন নেই
হুম, সেটাই।
আজ শুক্রবার।
বাড়ির সব পুরুষেরা নামায থেকে মাত্র ফিরছে। আবির মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে আসছিল, হঠাৎই ওর মুখে পানির ঝাপটা পড়লো। ও মুখ চোখ খিচে বন্ধ করলো উহুম….কে
বলতেই এবার সজোরে ওর মুখে চুলের ঝাপটা লাগলো। আবির দুকদম পিছিয়ে গেলো। চোখ থেকে পানি হাত দিয়ে মুছে ও আস্তে আস্তে তাকালো, দেখে রাই বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে।

পেছনে নিশান ও ছিলো। নিশান টোকন দেখলো যে রাই উঠানে দাড়িয়ে চুল ঝাড়ছে, ঠিক তখনই আবির সামনে এসে যাওয়ায় চুলের বাড়িটা আবিরের মুখে লাগে। আর রাই পেছনে ঘুরে আবিরকে দেখে থ মেরে যায়।

এদিকে রাই এর মধ্যে হঠাৎই আতঙ্ক গ্রাস করে। সাথে সাথে রাই মুখে হাত চেপে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। আবির শান্ত দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। পেছনে নিশান একটু অন্য নজরেই তাকিয়ে ছিল। কেননা আবির রাই এর নিশান এর মাঝে এই মুহূর্তে আবির দাড়িয়ে। নিশান এর সেটা সহ্য হলো না।
রাই ভেতরে ঢুকে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।

শুনেছিলাম, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়। কিন্তু ভাই এখন তো দুপুর। ক্যামনে কি!
বিকেলে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে, তখনি রাই মিহিরকে উদ্দেশ্য করে বলল ভাইয়া….. আপনাদের এখানে নদী নেই আশপাশে?
মিহির বললো ঘুরতে যাবা?
বাহ, কি সুন্দর। ভাইয়া মনে কথা কিভাবে বোঝেন আপনি? রাই বললো।

মিহির হেসে উঠলো তোমার আর আমার মন কি আলাদা নাকি শালী সাহেবা?
সুরাইয়া কড়া নজর তাকালো মিহিরের দিকে। মিহির চুপ করে গেলো। এটা দেখে উপস্থিত সবাই হাসতে লাগলো।
আচ্ছা, তো চলো যাই। নিশান যা আবিরকে ও ডেকে আন…. বলে মিহির উঠে দাড়ালো।
রাই এর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল উনিও আসবে নাকি! না না মনে মনে ভাবছে রাই।

নিশান একটু আমতা আমতা করে বলল ভাইয়া, মনে হয় না যাবে। জানোই তো ভাইয়া কেমন
মিহির মাথা নাড়লো যাবে না যাবে পরের বিষয়। আগে তো বলতে হবে? যা বলে আয়। গেলে যাবে না গেলে নাই
রাই, একটা শুকনো ঢোক গিলে নিলো ‘ ইয়া আল্লাহ, উনি যেনো না আসে। উনি আসলে আমি যাবনা… মনে মনে বললো।

সুরাইয়ার নজর গেলো রাই এর শুকনো মুখের দিকে। তবে ও কিছু বললো না। কিছুক্ষন পর নিশান ফিরে এলো। এদিকে রাই মনে মনে দোয়া পড়ছে যেনো আবির না আসে। হলো ও তাই।
ভাইয়া যাবেনা বললো বলে নিশান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।

সাথে সাথেই রাই লাফিয়ে ওঠে ইয়ে
সবাই ওর দিকে তাকায়। ও থতমত খেয়ে গেল আ মানে ইয়ে আমরা নদীর পাড়ে যাবো, হাহা আমি রেডি হয়ে আসি বলে লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে নিজের ঘরে চলে গেল।

মিহির অবাক হলো। নিশান ও।
যাইহোক, সকলে মিলে বের হলো নদীর তীরে ঘোরার উদ্দেশ্যে।
অবশেষে নদীর পাড়ে পৌঁছে গেলো ওরা সবাই।

সবাই গল্প করছে আর হাঁটছে। এমন সময় নিশান পেছন থেকে রাই এর জুতো পাড়িয়ে ধরে ফলে রাই হাঁটতে গিয়ে পড়ে যেতে যায়। নিশান সাথে সাথে ওকে ধরে ফেলে।
বেয়াইনের কি চোখ অকালেই গেছে নাকি? বলে নিশান হাসতে হাসতে সামনে সবার সাথে হাটতে থাকে।
দাড়াও দেখাচ্ছি বলে রাই এগিয়ে গিয়ে একই কাজ করে নিশান এর জুতো শক্ত করে পাড়া দিয়ে ধরে। কিন্তু এইবারে নিশান তাল সামলাতে না পেরে সোজা মাটিতে পড়ে যায়। এদিকে সবাই যে যার মতো হাঁটছিলো কেউ রাই কে খেয়াল করে নি তাই রাই দ্রুত সুরাইয়ার পেছনে গিয়ে দাড়ায়।

মিহির বলে ওঠে কীরে দিনে দুপুরে পড়ে যাওয়ার সখ হলো নাকি?
রাই বললো ভাইয়া আমার মনে হয় সে মাটি পরিষ্কার করছিল….
সুরাইয়া বলে দেবর মশাই ঝাড়ু এনে দেই?
সবাই ফিক করে হেসে দিল। নিশান প্রতিশোধ এর নজরে তাকিয়ে রইলো। এদিকে রাই সবার আড়ালে ওকে ভেংচি কাটলো।

রাতে খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে, নিশান রাই এর ঠিক বিপরীতে বসেছে। তখনি রাই এর পায়ে কেমন একটা লাগলো। রাই নিচু হয়ে দেখে নিশান ওর পায়ের ওপর আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করছে। রাই উপরে মুখ তুলেই রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। নিশান ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে খাবার খেতে লাগলো।

তখনি আবির এলো, আবির ডাইনিং রুমে ঢুকেই প্রথমে। ওর চোখ গেলো নিশান এর দিকে।
আবির দেখলো নিশান মিটিমিটি হাসছে। ও কপাল কুচকে নিশানের চোখ বরাবর তাকায়। দেখে রাই রাগান্বিত চোখে কিছু ইশারা করছে।

আবির ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সুরাইয়া ওকে দেখে বললো ভাইয়া আসেন, আপনার অপেক্ষাই ছিলো। বলে সুরাইয়া প্লেট নিয়ে ওকে খাবার বেড়ে দিতে লাগলো।

আবির নিশান এর দিকে স্থির দৃষ্টিতে রেখে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লো। মিহির জিজ্ঞেস করলো কীরে কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
আবির গম্ভীর গলায় বলে ওঠে নিশান……

নিশান চমকে উঠে নিজের পা সরিয়ে নেয়। রাই হাফ ছাড়লো।
নিশান এর সম্পর্কেই বাবার সাথে কথা হচ্ছিল বললো আবির।
নিশান তাকালো আমাকে নিয়ে!
তোর তো সামনে বছর যাওয়ার কথা….

রাই বললো কোথায়?
আবির রাই এর দিকে চোখ ফেরালো। রাই নিজের চোখ নামিয়ে নিলো।
মিহির বললো আরে, ওর তো বিজনেস নিয়ে পড়ার জন্য বিদেশে যাওয়ার কথা চলছে। তো ডিসিশন নিয়েছিস তোরা?

আবির চোখ নামিয়ে নিলো নির্ভর করে, নিশান কি চায় তার ওপর…..’
রাই এটা শুনে নিশানের দিকে তাকালো। নিশান একটু চিন্তায় পড়ে গেল। দুজনেই চুপ করে গেলো কেমন একটা। বাকিরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলো।
আবির ও নিশ্চুপ ভঙ্গিতে খাবার খেতে লাগলো।

এরপরে দুদিন কেটে গেলো। এই দুদিন রাই এর নিশান এর মধ্যে বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়ে গেল। দুজনই খুব দুষ্টুমি করে, একে অন্যকে জ্বালাতন করে। আবার ওদের ভাব ও বেড়েছে। বিষয়গুলো দুটো মানুষের চোখে পড়লো। এক সুরাইয়া, দ্বিতীয় আবির।

যখনই রাই এর দিকে তাকানো যায়, তখনি রাই কে নিশান এর সাথেই বেশিরভাগ দেখা যায়। নিশান ও কেমন শুধুই রাই এর সাথেই সারাদিনের হাসি ঠাট্টা।

এক রাতে রাই শুয়ে ছিল। হটাৎ ওর দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। ও চমকে ওঠে কে?
বলে ও দরজার কাছে যেতেই কেউ আস্তে করে ডাকে আমি দরজা খোলো।
আপনি?
নিশান ঘরে ঢুকে আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়, হুম
রাই ভ্রু কুঁচকে তাকালো আপনি এতো রাতে?

নিশান মুচকি হাসলো উম ভাবলাম তোমাকে একটু জ্বালিয়ে যাই কি বলো? বলতে বলতে ও খাটে গিয়ে বসলো কিছুদিন পরে তো এমনিতেই চলেই যাবে….. তাই
বের হন এখন থেকে, এতো রাতে ওকে পুরোটা বলতেও দিলো না নিশান ওর একহাত ধরে টেনে খাটে ওর পাশে বসিয়ে দিল হবো না, কি করবে?

রাই ঘাবড়ে গেল দেখেন, দূরে যান। এভাবে হাত ধরার মানে কি?
দূরে? বলে নিশান রাই এর আরো একটু কাছে গেলো। রাই নিজের হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে যেতে গেলো, কিন্তু নিশান আবারো ওর হাত ধরে ফেলে এতো দূরে যাওয়ার সখ?
রাই নিশ্চুপ।

কিহলো বলো?
আপনি বিদেশে চলে যাবেন?
নিশান একটা শ্বাস ফেলে রাই এর মুখ নিজের হাতের ভাজে নিলো সেটা এখনো ডিসাইড হয়নি। বলা যাচ্ছেনা
ওহ…. মলিন স্বরে।

কেনো মন খারাপ হচ্ছে নাকি?
আমার, কেনো মন খারাপ হবে?
নিশান ফিসফিস করে বললো প্রেমে পড়ে গেছো মনে হচ্ছে?

রাই কেপে উঠলো। নিশান বিজয়ের হাসি হাসলো মনে তো তাই হচ্ছে।
রাই মাথা নাড়লো না, আপনি হাত ছাড়েন আর যান এখন…
নিশান চোখের পলকেই রাই কে জড়িয়ে ধরলো রাই……
নিজের ঘাড়ে গরম নিশ্বাস আর এই ঠাণ্ডা শীতল পরিবেশের মধ্যে রাই এর হৃদপিন্ডের গতিটাই যেনো ক্রমশ বেড়ে উঠছে নিশান…. ছাড়ুন…..

তুমি করে বলো……
রাই এরমাথা ঘোরার উপক্রম নিশান, আপনি যান এখন থেকে কেউ দেখলে…
তুমি করে বলো আগে।
নিশান ছাড়ো….. রাই এর ঠোঁট কাপছে।

নিশান খুশিতে পুলকিত হলো। রাই কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
রাই এর বুকে যেনো কেউ আরো জোরে জোরে হাতুড়ি পেটাতে লাগলো। নিশান…
রাই, আই লাভ ইউ।
রাই এর মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো। নিশানের কোথায় ওর শরীরের লোম দাড়িয়ে গেলো।
অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল ওর মধ্যদিয়ে।

রাই, উত্তর দেবে না?
রাই পুরো ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। কি বলবে ও জানেনা। দুদিনের পরিচয়েই কি ভালোবাসা হয়ে যায়? কিন্তু ছেলেটাকে যে ও খুব পছন্দ করে।

নিশান সামনে এসে ওর মুখে আলতো করে হাত রাখলো রাই বলো।
এমন এক মুহূর্তে নির্ঘাত যে কারোরই মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। হ্যাঁ বলাটাও সহজ না। আবার না বলতেও মন সায় দেয় না।
রাই বলো।
রাই নিশ্চুপ রইলো।

বিশ্বাস করো খুব খুব ভালোবাসি তোমাকে একবার বলো ভালোবাসি। একবার……
রাই কাপা কাপা গলায় বলল। নিশান…
বলো, একবার…..রাই

খুব স্বাভাবিক। কেউই পারে না এমন সময়ে নিজের ইমোশন ধরে রাখতে। রাই ও পারেনি। রাই নিশান কে জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়লো। নিশান যেনো হাতে চাঁদ পেল। খুশিতে রাই কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আই লাভ ইউ।
জানিনা, ভুল কিনা। তবে, বলেই দিলাম মনে মনে ভাবলো রাই।

এদিকে দরজার বাহিরেই দাড়িয়ে একটা ছেলে কণ্ঠ আর একটা মেয়েলি গলা শুনে চমকে উঠেছেন মিহিরের বাবা। কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে না পারলেও এটুকু বুঝেছি যে সেঘরে রাই এর সাথে একটা ছেলেও উপস্থিত ছিল।
মিহিরের বাবার এই বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটু লাগলো। উনি রেগেমেগে সেখান থেকে চলে গেলেন।
কিছুক্ষন পরে নিশান রাই এর সাথে গল্প করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

রাই যেনো খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেল। আজ এই প্রথম ও ভালোবাসা জিনিসটাকে উপলব্ধি করছে। ওর এতই ভালো লাগছে যে খুশিতে আর সারারাত ঘুম হবে বলে ওর মনে হয়না।

পরদিন সকাল থেকেই নিশান আর রাই এর চেহারায় এক অন্য ধরনেরই হাসি। দুজনের চোখাচোখি সুরাইয়া দেখেও একটু ইগনোর করলো।

বিকেলে মিহির বললো আচ্ছা সবাই মিলে চলো আমরা নদীর ওইপারে আমার এক চাচার বাড়ি আছে। বেড়ায় আসি। চলো
না নদীর ঐপার যাবনা সুরাইয়া বললো।
কেনো? চল না যাই। রাই বললো।

নিশান ও তাল মেলায়।
মিহির বললো আমরা যাচ্ছি, সবাই রেডি হও, আর সুরাইয়া তুমি কিছু বলোই না। আর আবিরকে ও ডাক দাও
এই কয়দিন আবির তেমন একটা রাই কে জ্বালাতন করেনি, তাই রাই এর ভয় কিছুটা কেটে গেছে।
রাই তেমন কিছু মনে করলনা।

আবির তখনি বাহিরে যাচ্ছিলো। এমন সময় মিহির ওকে ডেকে উঠলো এই আবির দাড়া
আবির ফোন করো সাথে কথা বলছিল। তখনি মিহিরের ডাকে ও দাড়িয়ে পড়লো।
এই রেডি হ আমরা বেরোবো…..
আমি যাবনা বলে আবির আবারো ফোনে কথা বলতে গেলো। মিহির গিয়ে ওর ফোন নিয়ে নিলো তুই যাচ্ছিস, রেডি হ তারপরই ফোন পাবি

বলে মিহির আবিরের ফোনটা নিয়ে চলে গেলো।
আবিরের মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো।

যাক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবিরকে ও নিয়ে গেলো মিহির।

মিহির, সুরাইয়া, আবির, নিশান আর রাই নৌকায় উঠেছে স্রোত বায়ে বয়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা বাতাস, রোদের তীব্রতা সব মিলিয়ে সোনালী বিকেল। সবাই নৌকায় আড্ডা দিতে দিতেই যাচ্ছিলো এমন সময়, নিশান এর সাথে রাই এর কিছু কথা নিয়ে দুষ্টুমি হওয়ার সময় নিশানের হাতের সাথে ধাক্কা লেগে রাই পানিতে পড়ে গেলো।

রাই… বলে নিশান চিৎকার দিয়ে উঠলো। সাথে সাথে আরো একজন নদীতে ঠিক একই জায়গায় ঝাঁপ দিলো।
রাই….. বলে সুরাইয়া ও চিৎকার করে উঠলো। মিহির ওকে ধরে ফেললো সুরাইয়া….. দাড়াও….

রাই…… ওখানে নিশান ঝাপ দিতে গেলেই মিহির ওর হাত ধরে আটকে ফেলে। আবির কিন্তু গিয়েছে। তোর আলাদা ভাবে যাওয়ার দরকার নেই। বলে আবির নদীর চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো কোনদিকে দুজনকে দেখা যাচ্ছেনা।
এদিকে সুরাইয়া আর নিশান দুজনেই চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া আমি যাই ছাড়

মিহির কড়া গলায় নিশান কে বললো চুপ, এটা কি রাস্তা নাকি গেলেই খুঁজে পাবি? বলে মাঝিকে নৌকা তীরের কাছে নিয়ে যেতে বললো মিহির।
__ ওদিকে
পানিতে ডোবার সাথে সাথেই স্রোতের টেনে রাই নৌকার পাশ কাটিয়ে বামে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু হাতে ওর একটা টান লাগলো।

স্রোতের বেগ এতই বেশি ছিল যে নৌকা থেকে প্রায় অনেক দূরেই চলে এলো রাই। শ্বাস আটকে আসার উপক্রম। পানিতে হাতপা ছুড়ছে এমন সময় ওকে টেনে কেউ পানির স্তরের উপরে নিয়ে এলো।
প্রাণ যাওয়ার দোর গোড়া থেকে যেনো ফিরে এলো রাই। সামনের মানুষটিকে শক্ত করে ধরে শ্বাস টেনে ফুসফুসকে সতেজ করার চেষ্টা।

কিছুক্ষন এভাবে চলার পরই, রাই একটু শান্ত হয়। ধীরে ধীরে ও মানুষটির সামনে মুখ এনে দেখে আবির। আবির একহাতে ওকে ধরে রেখেছে অন্যহাতে কোনমতে সাঁতরে পাড়ের দিকে যাচ্ছে।
আ, আপনি?

আবির এর মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। অন্য কাওকে আশা করছিলে? নাকি মরার প্ল্যান করছিলে?
মানে কি? বলে রাই সরে যেতে গেলেই আবারো চুবুনি খায়, আর সাথে সাথে আবিরের হাত জড়িয়ে ধরে।
আবির প্রায় নিজের গলা সমান পানিতে এসে দাড়িয়ে রাই কে শক্ত করে ধরে। কিন্তু রাই এর এইখানে ঠাই নেই। সাঁতার ও জানেনা। তাই ও আবিরের হাত ধরেই রেখেছে।

এতো শক্ত করে ধরার কি আছে? ছাড়ুন
আবির নিজের হাতের বাঁধন হালকা আলগা করতেই রাই ডুবে যেতে যায় আর ওকে আবারো জড়িয়ে ধরে।
আবির ওকে নিজের থেকে একটু সরিয়ে নেয়, ছেড়ে দেই নাকি?
‘ না, না

কিন্তু তুমি হইতো চাও না আমি তোমাকে ধরে রাখি?
হুম….. আনমনেই বলে ফেলে রাই। আবির আবারো হাতের বাঁধন আলগা করে দিতেই রাই লাফিয়ে ওঠে না না, মানে… প্লিজ উপরে চলেন, আমি সাঁতার জানিনা।
আবির বাকা চোখে তাকায় ঝাঁপ দিতে তো জানো

আমি কি সাধে লাফ দিছি? আপনার ভাই ই তো….
আমার ভাই? নাকি তোমার…… বাকিটা এমনভাবে ইঙ্গিত করলো আবির যে রাই ইতস্তত বোধ করলো। চুপ করে গেলো রাই।

আবির নিজের কঠোর চেহারা বজিয়েই রাই ঘুরিয়ে পানির যেখানে ঠাই আছে সেখানে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ফলে রাই আবারো নাকানি চুবানি খেলো।
আবির ওকে ছেড়ে পানি থেকে উঠতে লাগলো।
কিছুক্ষন পরে রাই ও আস্তে আস্তে বালুর মধ্যে পা রেখে রেখে উপরে উঠে এলো।
আপনি একটু বেশিই করছেন বলে রাই চেঁচিয়ে ওঠে।

আবির নিজের চুলগুলোর মধ্যে হাত বুলিয়ে পানি ঝাঁড়ছিল তখনি রাই এর এমন কথায় ও ভ্রু কুচকে তাকালো হুম?
রাই একটু দমে গেলো আপনি….(কিছুটা ভেবে ) আপনি অভাবে কেনো ফেলে দিলেন?
ভেসে যেতে দেইনি এটাই তোমার ভাগ্য
বলে আবির আশপাশে তাকাতে লাগল।

কেউই নেই। আর না কোনো নৌকা আছে।
একজন থেকে ওরা যে ঘাট থেকে নৌকা নিয়েছিল সেই ঘাট ও খুব দূরে দেখাই যাচ্ছে।
এখন কিভাবে ফিরবো? রাই নিজের ওরনা চিপড়ে নিলো।

আবির নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে রাই এর দিকে তাকালো তোমাকে নৌকা ওয়ালার কাছে বন্দক রেখে বলবো আমাকে ওইপারে দিয়ে আসতে গম্ভীর গলায় বলে আবির এগোতে লাগলো।
কিঃ! রাই আকাশ থেকে টুপ করে পড়লো। এই ছেলে কি এমন করবে নাকি! রাই পুরো ভয় পেঁয়ে গেলো।
ওদিকে আবির তীর ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।


পর্ব ১০

উল্লুক এর ঘরে উল্লুক। ভাললাগেনা ধুর রাই এর কান্না চলে আসছে।
ওদিকে আবির কিছুকদম গিয়েই বুঝলো রাই ওর পাশে নেই। আবির ঘুরে তাকালো, রাই মাথা নিচু করে ভাবছে। আবির এবার ওকে পিঞ্চ করেই বললো তোমাকে বন্ধক নিবে, এমন ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন মানুষ আছে বলে মনে হয় না।
রাই চমকে উঠে আবিরের দিকে তাকালো।

হুতুম পেঁচার ডাক শুনে মরতে চাইলে থাকো….
বলে আবির আবারো হাটতে শুরু করলো। রাই ভয় পেয়ে গেল। দৌড়ে আবিরের পিছু পিছু হাটতে শুরু করল। সন্ধ্যা প্রায় হতে চলেছে। রাতে একটা থাকার বেবস্থা করতে হবে।

‘ আমরা কোথায় যাচ্ছি? বাচ্চাদের মত করে বললো রাই।
জানিনা ছোট্ট করে বললো আবির।
আরে জানিনা মানে! রাত হতে যাচ্ছে আমরা কি করবো এখন?

রাই দৌড়ে আবিরের সামনে গিয়ে দাড়ায়।
আবির এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। তখনি রাই ওর সামনে এসে দাড়াতেই ও থেমে গিয়ে রাই এর দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে। জাম রাঙা থ্রিপিস, ভেজা চুল, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট আর এই দিগন্ত বিস্তৃত গোধূলি আলোয় খুব অপূর্ব লাগছে রাই কে দেখতে।
আবির একদৃষ্টে ওর চোখের দিকে তাকালো। আবির ওর কোমর ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে সিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো

কি করতে চাও?
রাই একটু লজ্জায় পড়ে গেলো। ও দ্রুত আবিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আবির ওকে ছেড়ে আশেপাশে তাকালো রাতে কোথাও থাকতে হবে…… বলে ও হাটতে শুরু করলো।

রাই এবারে কিছু বললো না, চুপচাপ ওর পেছনে পেছনে হাটতে লাগলো।
এমনিতেই জিম করা বডি, সাদা শার্ট আর ব্লু জিন্স পরে আছে আবির। তার ওপরে ভেজা শরীরে শার্টটা পুরো লেপ্টে আছে শরীরে, চোখ গেলেই আগে ওর জিম করা বডি টাই সবার চোখে পড়বে।
রাই বারবার লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।

কিছুদূর হাঁটার পর রাই হাফিয়ে উঠলো। তার ওপরে ঠাণ্ডা বাতাস, শীতের পরিমাণ ও বেড়েই চলেছে।
আর কতদূর! রাই দাড়িয়ে পড়লো।
আবির ও দাড়িয়ে গেলো আর আপনি বলেন বাড়ি ফিরবেন? রাতে আর ফেরা যাবেনা যা মনে হচ্ছে
রাই বলে উঠলো কেনো!

আবির যেনো প্রশ্ন শুনে বিরক্তই হলো তোমাকে এখনও ভ্যাম্পায়ারদের হতে ধরানো বাকি তাই বলে আবির হাটতে লাগলো। এদিকে মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। রাই এর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো কি বলে কি এই ছেলে! আল্লাহ বাঁচাও

রাই এই অন্ধকারে গিয়ে আবিরের ঠিক পেছনে দাড়িয়ে গেলো। আবির একটু আশপাশে তাকিয়ে একটা বাড়ির মতো দেখলো। আর রাই এর হাত ধরে বাড়িটার দিকে এগোতে লাগলো। একে তো অন্ধকার, তার উপরে ঝোপ ঝাড়, দুজনে কি রেখে কি ধরছে, গাছ না কাটা ঠিক জানেনা। এমন করতে করতেই ওরা বাড়িটার উঠানে এসে দাড়ালো। দুটো টিনের ঘর। ভেতর থেকে হারিকেনের আলো আসছে বোঝা যাচ্ছে। একটার দরজা খোলাই ছিল। আবির গিয়ে সেই দরজার সামনে দাড়ালো

কেউ আছেন?
কে?
একটু সাহায্য লাগতো। কেউ কি একটু বাহিরে আসবেন…..

ভেতরে বসে থাকা একটা বৃদ্ধ মহিলা হারিকেনটা হাতে নিয়ে বের হলেন কে রে?
আবির একটু হেসে উত্তর দিল দাদী, আমরা একটু বিপদে পড়েছি তাই একটু সাহায্য লাগতো
ভেতর থেকে অন্য একটা ছেলের কণ্ঠ কানে এলো কে আইছে দাদী?
ছেলেটা বেরিয়ে আসতেই আবির কে দেখে দাড়িয়ে পড়লো কে আপনি?

আবির একটু মিয়িয়ে যাওয়া গলায় বললো আসলে আমরা একটু বিপদে পড়ে গেছি। দক্ষিণ পাড়া থাকি। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো ভ্যান পাবোনা আবার সন্ধ্যা ও হয়ে গেছে, হাতের ফোন টাকা কোনোটাই নেই। আজকে রাতে যদি একটু থাকতে দিতেন, কাল ভোরেই চলে যাবো

বৃদ্ধা বলে ওঠলেন না না, ওসব অপরিচিতদের থাকতে দেওয়া যাবেনা। যাও তোমরা অন্য কোনো জায়গায় যাও
ছেলেটি বলল আচ্ছা দাদী দাড়াও আমি কথা কচ্ছি তো…. তো ভাই আপনারা কি বিপদে পড়ছেন ইকটু কলি ভালো হয় বোঝেনই তো

আবির একপলক রাই এর দিকে তাকিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো হুম একে একে সব ঘটনা বলার পর ছেলেটা একটু হইতো বিশ্বাস করলো। বৃদ্ধা তখনও মানতে নারাজ।

বৃদ্ধা বললেন তোমরা কি জামাই বউ নাকি? তা না হইলে যাও, আমরা এরকম অবিহত মাইনষেরে রাখতাম না
আবির একটু থেমে গেলো। রাই তো চককেই উঠলো বিবাহিত! না না মনে মনে ভাবছে।
আবির একটু কৃত্রিম হাসি মুখে টেনে নিলো হ্যাঁ। আমরা ওই আরকি, বিবাহিত
ছেলেটা ওর দাদীকে বললো দাদী অহন কি তোমার সমস্যা আছে?
রাই এর মাথা ভন ভন করে ঘুরছে। বলে কী! বিবাহিত!

বৃদ্ধা কিছুটা ভেবে বললো আচ্ছা, থাকো। কিন্তু সকালেই চইলা যাবা….
বলে উনি ঘরে ঢুকে গেলেন। ছেলেটা মলিন গলায় বলল আসেন ভাই। ভাবি আপনিও আসেন
কিন্তু রাই এর পা দুটো বরফের মতো জমে গেছে। ওর তো এগোতেই মনে চাচ্ছেনা। আবির বিষয়টা বুঝতে পারলো। আবির নিচে নেমে রাই এর হাত ধরলো চলো…..
ছেলেটা হেসে ঘরে ঢুকে গেলো। আর রাই অবুঝের মতো আবিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে টা কি?
( ফাইজলামি হইতাসে)

যাইহোক দুজনে ঘরে যেতেই ছেলেটা একটা গামছা, একটা সাদা কাপড় আর একটা লুঙ্গি এনে আবিরের হাতে দিলো আমরা গরীব মানুষ। ভাই যেহেতু আপনারা ভিজা গেছেন কাপড় পাল্টায় নেন। নইলে ঠাণ্ডা লাগবো।
এতেই হবে। ধন্যবাদ আবির বললো।

ছেলেটা বেরিয়ে গেলো। রাই আগেই গামছা টা হাতে নিলো আর মাথা মুছতে লাগলো।
আবির একটানে ওর থেকে গামছা টা নিয়ে লুঙ্গি হাতে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল ৫ মিনিট, চেঞ্জ করে নাও। আমি এসে যেনো এভাবেই না দেখি বলে ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

রাই তো রেগে শেষ। এগুলো কোন ধরনের ব্যবহার!শুধু আজ বিপদে পড়েছে বলেই। নইলে আবিরকে ও তো….. যাইহোক, রাই দ্রুত কাপড় বদলে নিলো। ভরসা নেই। ৫ মিনিটেই যদি চলে আসে।
যাইহোক শাড়ি রাই পরতে পারে। তাই দ্রুত শাড়িটা পরে নিলো রাই আর কাপড়গুলো পাশের দড়িতে বাঁধিয়ে দিলো।
কিছুক্ষন পরে কেউ একজন ঘরে ঢুকলো। রাই চমকে উঠলো কে?
কিন্তু ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, লোকটি আর কেউ না আবির। শুধু লুঙ্গিটা পরে আছে। রাই খিল খিল করে হেসে দিল পুরাই মফিজ

আবির একটু মুখ ঘুরিয়ে নিল। এদিকে রাই হেসেই যাচ্ছে। যতই হোক আবিরের মতো একজনকে লুঙ্গিতে দেখাটাও ভাগ্যের বিষয়। রাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি করার মত অবস্থা। আবির গিয়ে চুপচাপ খাটে বসে পড়লো। ওদিকে ওই ছেলে আর ওর দাদী পাশের যে আরেকটা ঘর আছে সেই ঘরে চলে গেছে। মোট কথা এঘরে আমরা একা।
আবির নিজের ফোনটা নিয়ে খুলে খুলে দেখতে লাগলো। কিন্তু উপায় নেই, ফোনের আনাচে কানাচে পানি ভরপুর।
ইউসলেস বলে আবির ফোনটা রেখে দিল।

কাল সকালে আবার কিভাবে যাবো? রাই জিজ্ঞেস করলো।
হেঁটে
কিঃ!!!!!!! ওর কিঞ্চিৎ চিৎকারে আবির কান দিলনা।
হেঁটে হেঁটে এতদূর যাবো পাগল নাকি! রাই এর কথা শুনে মনে হচ্ছে ওর জন্য কেউ প্রাইভেট প্ল ঠিক করে রেখেছে। এমনিতেই এই দিকে তেমন মানুষজন নেই। ভ্যান রিকশা তো বাদই দেই তাই হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায়?

তোমাকে যেতেই হবে এমন তো না। হাটতে না পারলে যাবেনা বলে আবির হারিকেনটা নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। রাই থ মেরে আছে। লোকটা এমন কেনো! সব সময় একটা বাকা উত্তর। মুখে হাসি তো বাদই দিলাম, ভাবটাই বেশি… রাই মুখ ঘুরিয়ে নিল।
কিন্তু বিপত্তি হলো এক জায়গায়। এই খাটে শুধু দুটো মোটা কাঁথা বিছানো আর শক্ত দুটো বালিশ ছাড়া কিছুই নেই। ফলে পিঠে খুব বাধছে।

রাই বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। কিন্তু শুতেও পারছেনা। অবশ্যই অভ্যাস নেই। এদিকে আবির ঘুমিয়ে গেছে নাকি জেগে আছে বুঝাও মুশকিল। অন্ধকারে শুধু একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে আর কিছুই না।
আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন? রাই ডাকলো।
কিন্তু আবির কিছু বললোনা।

ঘুমিয়ে গেছে! এদিকে আমি যে ঘুমাতে পারবোনা? ওটার কি! বিড়বিড় করছে রাই। তখনি ওর হাতে হ্যাঁচকা টান পড়লো। সাথে সাথে গিয়ে পড়লো আবিরের বুকে।
আবির ওর মাথায় হাত রাখলো ঘুমাও

রাই ভিষন অবাক….. আবির ঘুমোয় নি। আর বুঝলো কিকোরে!
যাক আপাতত ক্লান্তিতে রাই কিছুই বলতে চাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।
আবির এখনও জেগে। ওর চোখে ভেসে উঠলো আজকে সকালের একটা দৃশ্য।
(সকালে)

আবির মাত্রই ঘুম থেকে উঠে বের হয়েছে পাশেই নিশান এর ঘর। ঘরের সামনে দিয়ে আসার সময় আবির নিশান এর গলা শুনতে পেলো। যদিও ইচ্ছে ছিলো না, তবুও কৌতূহল বশতই আবির একটু দাড়িয়ে পড়লো। আর নিশান এর কথাগুলো শুনতে লাগলো। যেটা শোনার জন্য হইতো ও প্রস্তুত ছিলো না।
এখন__
সকালের সেই দৃশ্য চোখে ভাসতেই আবির চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। আর রাই এর মাথায় হালকা করে একটা চুমু দিল।

সকালে ঘুম থেকে উঠে রাই আবিষ্কার করলো আবির ওর পাশে নেই। রাই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। তবে কি উনি আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন? মানে আমি একা এই অচেনা জায়গায় হারিয়ে গেছি? আল্লাহ।
রাই ভয়ে থরথর করে কাপছে। স্বাভাবিক। এমন একটা পরিস্থিতিতে যেকোনো স্বাভাবিক মানুষই ভয় পেয়ে যাবে। রাই কাপা কাপা পায়ে খাট থেকে নেমে মাত্রই বের হবে তখনি সামনে আবির এসে দাড়ালো। আবিরকে দেখেই রাই এক ছুটে ঝাপটে ধরলো আপনি চলে যেনো গিয়েছিলেন?

ওর কণ্ঠে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আবির ওকে ছাড়িয়ে দাড় করতে গেলেও রাই ওকে ছাড়লো না। শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে আপনি কেনো গিয়েছিলেন। জানেন আমি কত ভয় পেয়ে গেছি? আপনি আপনি আমাকে ফেলে কিভাবে যেতে পারেন? রাই কান্না করে দিয়েছে।
আবির অবাক। ও এতো ভয় পেয়ে গেছে! আবির তো এমনিতেই জমা কাপড় বদলাতে গিয়েছিল। এখন তো ওদের বেরোতে হবে।

রাই…..
আপনি খুব খারাপ। খুব খারাপ।শুরু থেকেই আমার সাথে এমন করেন। কি সমস্যা আপনার? আমার সাথেই কেনো? রাই এর আপাতত ভয়ের কারণে কি বলছে না বলছে জানেনা।
তোমার সাথে করতে হবে বলেই এমন করি। আর আমি কেমন? সে তো তুমি বলেই দিচ্ছ……

আবিরের কথা শেষ হলেও রাই এর হাতপা এখনও ঈষৎ কাপছে। আবির এখনও ওকে জড়িয়ে নেয়নি।
কিছুক্ষন পর একটু শান্তি হয়ে নাক টানতে টানতে সরে দাড়াল। আবির এর ভাব পরিবর্তন হলোনা।
রেডি হও, বেরোতে হবে বলে আবির বাহিরে বেরিয়ে গেলো।
মুখ পোড়া বলে ভেংচি কাটলো রাই। নাহলে আর কি? এমন নিরামিষ মুখ বোজা মানুষ আর দুটো হয়না। রাই কাপড় বদলে নিলো।

বাহিরে বেরিয়ে দেখে আবির ছেলেটার হাতে কতগুলো টাকা গুজে দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে। বৃদ্ধা বাহিরে গেছে। ছেলেটা নিতে না চাইলেও জোড়াজোরি করেই টাকাটা দিলো আবির। এরপর দুজনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
রাই এর মাথায় একটাই কথা ঘুরছে টাকাটা কোথা থেকে এলো? কালকে তো ছিলনা। আর যদি ওনার কাছে টাকা থেকেই থাকে তো গতকাল আমরা বাড়ি কেনো ফিরি নি?
রাই আমতা আমতা করে বলল একটা কথা বলি?
আবির হাঁটছে আর হুম বললো।

আ…. আপনার কাছে টাকা কিভাবে এলো? মানে কালকে তো।
আবির বাকা চোখে তাকালো তোমরা মেয়েরা কী আজীবনই বুদ্ধি হাঁটুতে নিয়ে ঘুরবে?
সবসময় একটা বাকা উত্তর বলে রাই মুখ ফুলিয়ে নিলো।

আমার কাছে টাকা ছিল। কিন্তু আপনার মেহেরবানী, টাকাগুলো ভিজে গেছিলো। রাতে সেগুলো শুকাতে রেখেছিলাম। সেখান থেকেই দিয়েছি আবির হাঁটছে আর আশপাশে দেখছে।
রাই আবারো লজ্জায় পড়ে গেলো।
তাইতো…… ইশ ভাবলো রাই।

ভাইয়া অনেক হয়েছে, আর কত? গতকাল থেকেই তুমি আটকিয়ে রেখেছ….. আমি যাচ্ছি ওদের খুঁজতে
বলে নিশান উঠে দাড়ালো।
কোথায় খুঁজবি? ওরা কি এক জায়গায় থাকবে নাকি? নিশ্চই আবির এত্তো বোকা না যে পানির মধ্যেই রাত কাটিয়ে দেবে

সুরাইয়া বললো আপনি এতো সিওর কিভাবে হন যে ওদের কোনো ক্ষতি হয় নি। নদীর গভীরতা বোঝেন?
মিহির গিয়ে সুরাইয়া র হাত চেপে ধরে নরম স্বরে বলল আমি জানি, আবির এতো অবুঝ নয়। আর আবির সাঁতার জানে, যদি রাই কে ও পেয়ে যায় তাহলে আর ভয় নেই

সুরাইয়ার মুখের চিন্তা এখনও সরেনি। সম্ভব ও না। যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা না ফিরবে ততক্ষণ কারো শান্তি নেই। এবাড়িতে সবারই চিন্তায় খারাপ অবস্থা। এখনও রাই এর মা বাবাকে বিষয়টা বলার সাহস পায়নি কেউ। মিহিরের বাবা চিন্তায় চিন্তায় পায়চারি করছে। যদিও তাদের খুঁজতে যেতে চেয়েছিল সবাই। কিন্তু মিহির কাওকে যেতে দেয়নি।

নিশান এর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। ও চেঁচিয়ে উঠলো ব্যাস আমি যাচ্ছি বলে ও বেরোতে যাবে তখনি দরজা দিয়ে খোড়াতে খোড়াতে প্রবেশ করলো আবির, সাথে রাই। রাই আবিরকে ধরে ধরে নিয়ে আসছিলো।
ওদের দেখেই সুরাইয়া ছুটে গেলো রাই

রাই আবিরকে দাড় করিয়ে দিল। সুরাইয়া ওকে জড়িয়ে ধরলো তুই ঠিক আছিস?
মিহির ওর বাবা সবাই এগিয়ে আবিরকে ধরলো তুই ঠিক আছিস? কি হয়েছে?
আবির খাটে বসে বললো হ্যাঁ ঠিকাছি

নিশান দূরেই দাড়িয়ে ছিলো। সবার সামনে তো আর ওর কাছে যেতে পারবেনা।
কিন্তু অবাক কান্ড, রাই নিশানের দিকে একপলক তাকিয়ে আবিরের কাছে চলে গেলো। নিশান এতই বিস্মিত হলো যে বোঝার উপায় নেই, রাই এর আবার কি হলো!

রাই গিয়ে মিহিরকে বললো ভাইয়া, ওনার পায়ে প্রচুর আঘাত পেয়েছে আসার পথে। ডাক্তার ডাকুন
মিহির চেঁচিয়ে উঠলো আর এই তুই বলছিস ঠিক আছিস? বলে মিহির হেঁটে বাইরে চলে গেলো ডাক্তারকে ফোন করতে।
মিহির…. আরে ডাক্তার ডাকার প্রয়োজন নেই। আমি ঠিকাছি।

মিহিরের বাবা বললো কোথায় ছিলে তোমরা দুজন? জানো কত চিন্তা হচ্ছিলো?
রাতে ফেরার মতো অবস্থা ছিলনা তাই একবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম বলে পা টা চেপে ধরলো আবির।
মিহিরের বাবা যদিও চিন্তিত ছিলেন কিন্তু এই মুহূর্তে তার ভীষণ রাগ হচ্ছে রাই এর ওপর এই মেয়েটার জন্যই এতকিছু। রেজোয়ান জানলে কি হতো! একটা চরিত্রহীন মেয়ে ভাবতে ভাবতে কিছুনা বলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আবির আস্তে আসতে উঠে দাড়ালো আমি ঘরে যাবো বলে আগাতে গিয়েই ও পড়ে যেতে গেলো। নিশান এগিয়ে ধরতে গিয়ে থেমে গেলো। কারণ সুরাইয়া আর রাই দুজনেই ওকে ধরে ফেলেছে। চলুন বলে ওরা আবিরকে ওর ঘরে নিয়ে গেল।

এদিকে নিশান এর মনে হচ্ছে যেনো ও অদৃশ্য। ওকে কেউ দেখতেই পায়নি। বিশেষ করে রাই। কিন্তু ওর মাথায় আসছেনা ও কি করেছে? রাই কেনো ওকে ইগনোর করছে।

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ডাক্তার এসে গেলেন আর আবিরকে দেখে গেলেন। পুরো রাস্তা দুজনে হেঁটে এসেছে বিধায় দুজনেরই পায়ের অবস্থা খারাপ। রাই নিজের ঘরেই আরাম করছে। আবির ও। এদিকে নিশান লুকিয়ে রাই এর ঘরে ঢুকে দরজা টা লাগিয়ে দিল। আর ওর পাশে গিয়ে বসল। রাই প্রায় তন্দ্রায় ছিলো রাই বুঝতে পারেনি। হটাৎ নিজের হাতে কিছু স্পর্শ অনুভব করে ও চমকে ওঠে। নিশান কে দেখে যেনো ওর বিস্ময় সাথে রাগ দুটোই বেড়ে যায়।
তুমি এখানে?

রাই….. কাল থেকে এই পর্যন্ত কত চিন্তা করেছি জানো বলে ও রাই কে জড়িয়ে ধরতে গেলেই রাই ওকে ঠেলে সরিয়ে দিলো।নিশান বেশ অবাক রাই

কি হ্যাঁ? কথায় কথায় জড়িয়ে ধরতে হবে এটা কেমন কথা? তোমার নিজের কোনো সেল্ফ রেসপেক্ট না থাকলেও আমার আছে
রাই এর মুখে এমন নিন্দামুলোক কথায় নিশান যেনো বেশ হতভম্ব কি বলছো এসব?
কেনো ভুল কিছু বলেছি?

রাই, তোমার কি হয়েছে? বলে ও হাত বাড়ালেই রাই আবারো ওর হাত সরিয়ে দিলো বলেছি তো দূরে থাকো। সহজ ভাষা বোঝো না নাকি?
নিশান এর ধৈর্য শেষ ও খপ করে রাই এর হাত চেপে ধরলো একরাতেই কি এমন হলো যে তুমি আমাকেই এভাবে বলছো? কি হ্যা?
ছাড়ো। ( হাত ছাড়িয়ে) তোমার চিন্তা ধারা কত নিচু নিজেই দেখো। গতকাল আমার নদীতে পড়া থেকেশুরু করে এই অবধি আমাকে খুঁজতে গিয়েছিলে? কেমন আছি না আছি কোথায় আছি বেঁচে না মরে গিয়েছ দেখতে?
নিশান এর রাগ একটু কমে এলো আমি যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু

যাও নি। এটাই কথা। যখন আমি পড়ে যাই তখনও তুমি না আবির ঝাঁপ দিয়েছিল। কেনো? তোমার ভাবতেই এতো সময় কেনো লাগলো যে তুমি আমাকে বাঁচাবে? কেনো তুমি ছিলে না সে জায়গায়?

নিশান একটু সময় নিল। সত্যিই তো, ওরই তো সেখানে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ও তো মিহিরের কথা শুনেই ক্ষ্যান্ত ছিলো। কিন্তু মিহির শুধুই একটা অজুহাত। মূলত নিশান যায়নি এটাই একটা সত্য।

তখন তাৎক্ষণিক ভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। সরি। কিন্তু তুমি এভাবে বলো না….. নিশান ওর একটা হাত নিজের হাতের ভাজে নিলো।
রাই তবুও নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল যাও এখন। আমি খুব ক্লান্ত। যাও। পরে কথা হবে বলে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পরলো রাই।

নিশান স্তব্ধ। কি বলবে জানেনা। ও চুপচাপ বেইয়ে গেলো ঘর থেকে।
মিহির ঘরে ছিল তখনি ওর বাবা ঘরে ঢুকলো মিহির
পেছনে ঘুরে বাবাকে দেখে মিহির জবাব দিলো জ্বী আব্বা
সুরাইয়া ঘরে নেই নিশ্চিত হয়ে উনি বললেন আগামীকাল রাই কে ফেরত দিয়ে আসার বেবস্থা করো। সাথে আমিও যাবো ওই বাড়িতে।

মিহির বাবার কথায় অনেকটা অবাক। কিন্তু নিষেধ করার ও কোনো কারণ নেই আচ্ছা আব্বা, কিন্তু
ওকে বলতে না দিয়েই ওর বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
মিহির অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো।


পর্ব ১১

পরদিন রাই কে ফেরত দিতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিহির তার বাবাকে কিছুটা বুঝিয়ে সুঝিয়ে সময়টা আরো তিনদিন বাড়িয়ে নিলো।
বাবা, রাই আমাদের মেহমান। যতই হোক একটা নির্দিষ্ট সময় এর আগে নিজেরাই ওকে দিয়ে আসলে আমাদের সম্মান কোথায় থাকবে? ব্যাপারটা তো বোঝোই?

বলে মিহির ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ওর বাবা যদিও মেয়েটাকে দেখতে পারেন না। তবুও কোনো অযথা কাজ করতে ইচ্ছুক নন।
বেড়ে গেলো আরো তিনটে দিন। রাই থাকছে।
সুরাইয়া শোনো…

সুরাইয়া এগিয়ে গেলো স্বামীর কথা শুনতে হ্যাঁ বলেন
মিহির এর চোখ মুখ কুচকে এলো। সুরাইয়ার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের পায়ের উপর বসিয়ে ওর দিকে তাকালো সবসময় আপনি করে কেনো বলো? আমি কি অপরিচিত কেউ নাকি?
আরে, কি করছেন কি? কেউ আসলে তো দেখে ফেলবে

দেখুক…..( সুরাইয়ার মুখের সামনের চুলগুলো পেছনে সরিয়ে) দেখলে কি? বউ কে ধরে রেখেছি বাইরের কাওকে না। পার্মানেন্ট লাইসেন্স আছে
সুরাইয়া হেসে উঠলো আমি কি কোনো যন্ত্রপাতি নাকি? লাইসেন্স আছে
রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করা কি মনে করো? মুখটা ওর দিকে এগোতে গেলেই সুরাইয়া আটকে দিল ওয়েইট, কিছু একটা বলছিলেন সেটা বলেন

উহু, তুমি করে বললে বলবো মিহির ওর গলায় মুখ গুজল। সুরাইয়া লজ্জায় শেষ আচ্ছা, আচ্ছা তো…. বলো কি বলতে
মিহির মুচকি হেসে উঠলো হুম, আমার রাতে ফিরতে দেরি হবে। একটা কাজে যাচ্ছি। তো সবকিছু সামলে নেবে তো?
এমনভাবে বলছেন ( মিহির চোখ গরম করে তাকালো ) মানে বলছো যেনো এই পুরো বাড়িতে আমি একা।
উম, না সেটা অবশ্য না। আসলে….

ওকে ইতস্তত করতে দেখে সুরাইয়া জিজ্ঞেস করলো কিছু কি বলবে? বলো না
মিহির কিছুটা ভেবে সুরাইয়ার এক হাতের আঙ্গুলের ভাজে নিজের আঙ্গুল গুজে দিলো দেখো। বিষয়টাকে তুমি বেশি কিছু ভেবো না। আমি চাচ্ছিলাম তুমি একটু রাই কে দেখে রাখো।

সুরাইয়ার মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো আ….
দেখো রাগ করো না। তবে আমি ওর ভালোর জন্যই ভাবছি। তুমি একটু দেখো ও যেনো নিশান এর সাথে বেশি না মেলামেশা করে। বোঝই তো
সুরাইয়ার খারাপ লাগলেও ও মাথা নেড়ে বললো হুম। জানি…. তুমি ঠিকই বলছো…… আমি…..

মিহির জানে যে নিজের বোন সম্পর্কে এসব শুনতে নিশ্চই কেউ আগ্রহী না। দেখো। আমি কথাগুলো রাই কে উদ্দেশ্য করে বলছি না। নিশান আবির এরা আমার ভাই। অনেক আগে থেকে এদের চিনি। কে কতটুকু ভালো সেটাও বুঝি। আর অবশ্যই নিশান এমন কোনো মহাপুরুষ না যার সাথে সারাক্ষণ দুষ্টুমি আড্ডা করতেই হবে। ওর সাথে রাই যেনো কম মিশে

সুরাইয়া মুচকি হেসে মিহিরের গালে হাত রাখলো হুম, আমি বুঝি। তুমি খারাপটা চাও না। আমি দেখবো ওকে চিন্তা করো না
প্রিয়জনের এতটুকু আশ্বাসই যথেষ্ট হয় বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার জন্য।
মিহির জড়িয়ে নিলো তার প্রিয়তমা কে……

প্রায় পুরোটা রাত রাই এর ঘুম হয় নি। ওর মাথায় সব জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে। এদিকে নিশানের সাথেও ও কিছুটা খারাপ ব্যবহারই করে ফেলেছে। কিন্তু সেদিন আবির না থাকলে ওর মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। ডুবে যাওয়া থেকে শুরু করে বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত যতই বাকা কথা বলুক, আবির যে ওকে ছেড়ে যায়নি এটাই অনেক।

ও তো এমনই ঘাড় ত্যাড়া। তবে তাও তো কোনদিকে সাহায্যের কমতি রাখেনি। চাইলে তো আমাকে জঙ্গলে ও ফেলে আসতেই পারতো। বা রাতে তো আমি ছিলাম ই ওর কাছে।ও চোখ বুঝে নিল রাই। কতই ও ভাবতে চাইছে না ততই যেনো ওর মাথায় সেদিনের কথাই বারবার এসে হাজির হচ্ছে।

না না। আমি ভাববো না। ধুর। ( কিছু একটা ওর মাথায় এলো ) আচ্ছা গিয়ে একবার দেখি নিশান কি করছে বলে রাই উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে।
এদিকে আবির এর চোখেও তেমন ঘুম ছিলোনা। সারারাতই ও কিছু গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলো। কি সে চিন্তা তা বোঝার উপায় নেই। চাপা স্বভাবের মানুষ। তার ওপরে খুব চিন্তুক ধরনের।সবকিছুই খুব সুক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করে।

আবিরের চোখে ভেসে উঠলো রাই এর সেই কাঁপা কাঁপা ঠোঁট, সকালের সেই ভয়ার্ত মুখ, আর ওর স্পর্শ। যেটা না চাইতেও আবিরের মস্তিষ্কে একটা প্রভাব ফেলছেই।

সেদিন সকালে রাই এর অভাবে জড়িয়ে ধরা কোথায় চলে গিয়েছিলেন আপনি? আমি কত্ত ভয় পেয়ে গেছিলাম সত্যিই কথাটায় এতো আতঙ্ক লুকিয়ে ছিল বলার বাহিরে। মেয়েটা সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু…
আবির নিজের মাথাটা দুহাতে চেপে ধরলো।

নাহ, ওকে বিশ্বাস করা যাবেনা। কোনোভাবে যদি নিশান। নাহ…..
আবিরের মাথায় চিনচিনে ব্যথার উদয় হলো। হাতের সামনে একটা খালি গ্লাস ছিলো। আবির রাগের বশে গ্লাসটা ধরে সজোরে ফেলে দিল সামনে।

ওদিকে রাই মাত্রই আবিরের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল নিশানের ঘরে তখনি কাঁচ ভাঙার শব্দে ও চমকে উঠলো। কিহলো! রাই দরজাটা হালকা খুলে ভেতরে দেখার চেষ্টা করলো। তাকিয়ে দেখে ভেতরে আবির খাটের ওপরে মাথা চেপে বসে আছে। আর দরজার সামনে নিচে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে আছে।

হটাৎ কি হলো! ভাবছে রাই ভেতরে যাবো? দরজা খুলতে গেলেই রাই থেমে গেলো।
নাহ এভাবে যাওয়া উচিত না। ভেবে রাই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতরে আবির কেমন যেনো ছটফট করছে। কিন্তু কেনো?

ভেতরে আবিরের মাথায় দুটো বিষয়ে একপ্রকার যুদ্ধ চলছে। যেমন নিজেকে দমাতে পারছে না, ঠিক তেমনই নিজেকে এগোতে ও পারছেনা। আবির একটা বালিশ নিয়ে সামনে ছুড়ে ফেলতে গেলো কিন্তু বালিশটা গিয়ে ওর নিজের পায়েই লাগলো। যে পায়ে ব্যথা ছিল। আহহহহ আবির ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো।

রাই এর চোখে ভেসে উঠলো গতকালের কথা। যখন আবির রাই কে ধরে একটা ঢাল থেকে উঠাচ্ছিল তখনি মাটির একটা বড়ো শুকনো চাকা এসে আবিরের পায়ের ওপরে পড়ে যায়। আর তখনই আবির মারাত্মকভাবে ব্যাথা পায়।
দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠতেই রাই দরজা খুলে ফেললো। আর কাঁচগুলো ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে ভেতরে ঢুকে গেলো
কি করছেন এগুলো! আপনার পায়ে তো ব্যাথা বলে ও আবিরের পায়ের কাছে গিয়ে দাড়ালো।

হটাৎ রাই এর আগমনে আবির থ মেরে তাকিয়ে রইলো। কিছু একটা দেখছে ও রাই এর মাঝে।
রাই পা থেকে বালিশটা সরিয়ে নিয়ে পাশে রাখলো।
বেশি ব্যাথা করছে নাকি?
আবির নিশ্চুপ।

রাই ওর পা দেখে যাচ্ছে। পা প্রায় কালসিটে হয়ে গেছে। সত্যিই ছেলেটা অনেক ব্যাথা পেয়েছে।
এখন থেকে যাও।
রাই অবাক চোখে তাকালো হুম?
এখন থেকে বের হও কঠোর গলায়
আপনি…..

বের হও… আবিরের এমন রাগান্বিত কণ্ঠের সাথে পরিচিত হলেও আজ রাই এর মনে হচ্ছে আবির রাই কে খুব ঘৃণার সহিত বলছে একথা। রাই আর কিছু বলল না। আস্তে করে উঠে দাড়ালো।
আবির স্থির দৃষ্টিতে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে।
রাই আর কিছু বলল না বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

বাহিরে নিশান ও মাত্রই রুম থেকে বের হয়েছে তখনি আবিরের ঘর থেকে রাই কে বের হতে দেখে ও থেমে গেলো রাই…. কিন্তু রাই ওদিকে মনোযোগ দিলনা সোজা নিশানকে ইগনোর করে ওর পাশ দিয়ে চলে গেলো।

ঘটনাক্রমে নিশান এবার বেশ অবাক সাথে বিরক্ত ও হলো। কি এমন হলো যে রাই আবিরের ঘরে গেলো! নিশান নিজেই আবিরের ঘরের দিকে গিয়ে দেখে দরজার সামনে গ্লাসের ভাঙ্গা টুকরো। ওদিকে আবির বসে আছে। নিশান কিছুর তোয়াক্কা করলো না, ঘরে ঢুকে গেলো ও
রাই কেনো এসেছিল এখানে?

আবির ওর দিকে তাকালো না। এতে যেনো নিশান আরো কিছুটা রেগে গেলো আমি কিছু জিগ্গেস করছি
তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই সোজা উত্তর।
তুই বাধ্য….. রাই কেনো এসেছিল?
যে এসেছিল তাকেই জিজ্ঞেস কর

তুই এখন বেশি করছিস ভাইয়া
তো দাড়িয়ে কেনো আছিস? যা এখান থেকে….. আবিরের মুখ শক্ত হয়ে এলো।
নিশান কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মুখ ঘুরিয়ে নিশান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

রাই সোজা রান্নাঘরে চলে গেলো। সুরাইয়া র শাশুড়ি ও ওখানেই ছিলেন। রাই নিজেকে স্বাভাবিক করেই ভেতরে গেলো।
আরে রাই। কিছু লাগবে তোমার মা? ভদ্রমহিলা বললেন।
না না আণ্টি এমনিতেই এলাম, বলে রাই সুরাইয়ার সাথে গিয়ে দাড়ালো। কিছুক্ষন উনি সুরাইয়া কে কাজ বুঝিয়ে দিলেন তারপর রান্নাঘর থেকে চলে গেলেন। সুরাইয়া লক্ষ্য করলো রাই এর চেহারায় কোনো হাসি নেই। কেমন একটা গুমুট ভাব।

কিরে কি হয়েছে?
রাই মাথা ঝাঁকাল কিছুনা
তবুও কেমন যেনো। সুরাইয়া বেশ খানিকক্ষণ খেয়াল করলো ব্যাপারটা। তারপর হাতের কাজ রেখে রাই কে ধরে নিজের সামনে দাড় করলো

শোন রাই ( সে তাকালো) তোকে কিছু কথা বলতে চাই
হ্যা বল
দ্যাখ কিছু জিনিস এমন থাকে যেগুলো আকার ইঙ্গিতেই বুঝে নেওয়া ভালো। তো আমার কথা ভালো করে শোন
রাই একটু চিন্তায় পড়ে গেল। ও কি এমন বলবে? সুরাইয়া মনে মনে সমস্ত কথা গুছিয়ে নিলো।

দ্যাখ, মানুষকে বাহির থেকে দেখে কখনোই বোঝা সম্ভব না সে কেমন। কাজেই আমাদের সকলেরই উচিত আগে সেই মানুষটাকে সম্পূর্ণ জেনে নেওয়া তারপর গিয়ে তার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব বা যাই বলি সম্পর্কে যাওয়া। প্রত্যেক হাসির পেছনে যেমন কষ্ট লুকোনো সম্ভব, তেমনি প্রত্যেক সুন্দরের মাঝে কুৎসিত ও লুকিয়ে থাকতে পারে।
কোনোকিছু তোর ভালো লাগলো আর হুট করেই তুই সেটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেলি বিষয়টা কেমন?

এতক্ষণ সুরাইয়া যা যা বললো এর এক ইঞ্চিও যদি রাই এর মাথায় ঢোকে তুই কি বলতে চাচ্ছিস? একটু খুলে বলবি?
সুরাইয়া ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেললো আচ্ছা। দেখ তোর আর নিশানের মেলামেশা কিন্তু চক্ষুকটু ধরনের। তোর কি মনে হয় না একটা অপরিচিত যতই আমার দেবর হোক সে তো তোর কাছে অপরিচিত। সেক্ষেত্রে ওর সাথে কোন কথা বলা। কিছুটা দুরত্ব বোজিয়ে রাখা?

রাই এর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। মুহূর্তেই যেনো মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো কে কেনো বলছিস এটা?
কেনো বলছি সেটা তো তুই জানিস ই। আলাদা করে আর বলতে চাই না। তবে, নিশান কে যতটা ভালো দেখা যাচ্ছে, আসলে কিন্তু ও এতটাও সুবিধার না। আমি তো এবাড়ির বউ। আমি জানি কোন মানুষটা কেমন।

রাই আমতা আমতা করে বলল কেমন কেমন ভালো না ও?
সুরাইয়া ওর মাথায় হাত রাখলো সেটা জেনে তোর কাজ নেই। আর এমনিতেও তোর কাজ তুই ওর থেকে দূরে থাকবি ব্যাস।
রাই ওর কথায় মাথা নাড়লো। কিন্তু মুখে একটা চিন্তার রেখা রয়েই গেছে।

প্রেম ভালোবাসা এসবে কখনো কোনো বাঁধা নেই আমাদের জীবনে। কিন্তু বিষয়টা গিয়ে দাড়ায় সঠিক জীবনসাথী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে। আবেগ এক জিনিস আর ভালোবাসা আরেক। আবেগ কে ভালোবাসা বলে চালিয়ে দেওয়া মানে নিজেকে নিজেই ঠকানো। সাথে আরো একটা জীবন নষ্ট করা।

আবেগী মানুষ মুহূর্তেই একটা মোহে পড়ে যায় যে সে হইতো প্রেমে পড়েছে। অন্যদিকে ভালোবাসায় মানুষ কখনো বুঝতেই পারেনা সে ভালোবেসে ফেলেছে। মানুষের ব্যবহার দেখেই সহজেই বোঝা যায় ও ভালোবাসে নাকি শুধু ছুঁচকো একটা ধারণা নিয়ে বসে আছে। তাই নিজেকেই সাবধান হতে হয়। বলে সারাইয়া ঘুরে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।

রাই এর মাথায় টাস করে উঠলো। ও তো ঠিক কথাই বলছে। ভুল তো কিছু বলেনি। কিন্তু ও কি কোনোভাবে আমার কথা জেনে গেছে! ভাবতে ভাবতে রাই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
সুরাইয়া পেছনে তাকিয়ে রইলো।

সেদিনের মত আর সারাদিনেও রাই নিশানের সাথে কোনপ্রকার কথা বলেনি। কেননা রাই এর মনে কেমন একটা সন্দেহ বাসা বেঁধে নিলো যে আসলেই কি ও নিশানকে হ্যাঁ বলে ভুল করেছে? ও কি একটু তাড়াতাড়িই বলে ফেলেছে কথাটা। যদিও দুদিনের পরিচয়ে ভালোলাগাকে রাই ভালোবাসা বলে চালিয়ে দিলেও বাস্তবে তো এত সহজ না।

নিশান বারংবার চেষ্টা করেছে রাই এর সাথে কথা বলার। কিন্তু রাই সেই সুযোগটা দেয় নি। রাতে মিহির প্রায় ১০ টটার দিকে ফিরলো। তখন সুরাইয়া আবিরকে খাবার দিতে গিয়েছিল। পাশে রেজোয়ান সাহেব ও বসে। উনি একটু আগেই এলেন এবাড়ি। মিহির ফিরেই আবিরের ঘরে চলে গেল। ওদিকে রাই বসে টিভি দেখছিল।

রেজোয়ান সাহেব ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন তা পায়ে এমন আঘাত কিভাবে পেলি?
আবির কিছু বলবে তার আগেই মিহির বলে ওঠে কিছুনা আঙ্কেল।ওই সিড়িতে নামতে গিয়ে…..
আবির চেয়ে রইলো এটা কোনো উত্তর ছিল! মনে মনে ভাবছে। এদিকে সুরাইয়া মিহিরকে খোঁচা দিল এই বয়সে আবার সিড়ি থেকে নামতে গিয়ে এমন হয় নাকি!কি বলো এসব?

রেজোয়ান সাহেব হেসে উঠলেন হবেই তো, সারাদিন ওই ফোনের মধ্যে ঢুকে কাজ করতে থাকলে তো এটাই হবে। বলে উনি হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন। যাক ব্যাপারটা জানলে উনি কষ্ট পেতে পারেন তাই মিহির বললো না।
একে একে দুদিন এভাবেই হাসি ঠাট্টায় চলে গেলো। তবে রাই এখনও নিশান এর সাথে বেশি একটা কথা বলেনি। যাও বলেছে তাও খুব অল্প। কিন্তু রাই আবিরকে পর্যবেক্ষণ করেছে।

ছেলেটা প্রায় পুরোটা দিনই ফোন নিতেই থাকে, নয়তো বাবার কাজে সাহায্য করবে, নয়ত চুপচাপ থাকবে। অযথা বকবক করা ওর স্বভাবে নেই। রাই যদিও আবির কে অপছন্দই করে, তবুও আবিরের সোজা সাপটা কথা বলার স্বভাবের জন্য ওকে ভালোই লাগে। তবে বেশি ভালো লাগে রেজোয়ান আঙ্কেল কে। লোকটি বেশ মজার মানুষ। যেমন মিশুক তেমন নরম মনের। দেখে মনেই হবেনা যে ওনার মত মানুষের ছেলে আবির।
যাইহোক

অবশেষে দিন এলো রাই আর দাদীর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার। সাথে রেজোয়ান সাহেব, মিহির ওর বাবা আর নিশান ও যাচ্ছে। রেজোয়ান সাহেব যাচ্ছেন বেড়ানোর জন্য। মিশুক মানুষ, হওয়া বদল করতে বেশি পছন্দ করেন। আর নিশানের কথা নাই বলি।

কিন্তু মিহিরের ভয় অন্যদিকে। ওর বাবা কেনো যাচ্ছে সেটা আঁচ করতে পারছেনা মিহির। কিন্তু বুঝতে পারছে যে ওর বাবা রাই কে একটু ও পছন্দ করেনা।

বিদায়ের বেলায় সবার থেকেই বিদায় নিল রাই। শুধু একজনই বাদ ছিলো।
কথার ফাঁকে সুরাইয়া বললেন আবির ভাই কে বলবি না? যা বলে আয়
রাই মুচকি হেসে মাথা নাড়লো।
ভেতরে আবির ফোন কিছু কাজ করছে আর হাতে কিছু কাগজ। রাই আস্তে করে ভেতরে গেলো আর একটু গলা ঝেড়ে নিলো।

আবির এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল। তবে বুঝতে পারলো রাই এসেছে। তাই ও উপরে তাকালোনা।
কি মানুষ। মুখ পোড়া কোথাকার কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। কিভাবে শুরু করবে? ভেবে রাই নরম স্বরে বলল
আমি আর দাদু এখন চলে যাচ্ছি।

আবিরের হেলদোল নেই। রাই বিরক্ত হলো। আবার অপমান বোধ ও করলো। তো এজন্য বিদায় জানাতে এসেছিলাম……
আবির এবার ফোনটা রেখে রাই এর দিকে তাকালো, তো এরপর আর দেখা হচ্ছেনা?

রাই মাথা নাড়লো না। এরপর আমরা ঢাকায় চলে যাবো। তো আর্কবে দেখা হবে বলা যায়না
আবির মাথা নামিয়ে আবারো ফোনটা হাতে নিলো ঠিকাছে, বিয়েতে দাওয়াত দিও।
কিহ……! রাই এর বিরক্তির সীমা যেনো এখানেই শেষ হলো।

এটা কেমন কথা,? চলে যাচ্ছি আর একটা বাই ও ঠিক মত বললো না। এমন কেনো এই লোকটা? রাই রেগে গেলো হ্যাঁ বিয়েতে দাওয়াত দিব, সাথে করে বিরিয়ানী নিয়ে আইসেন নিজের টা নিজেই খেয়ে জাইয়েন বলে রাই হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

পেছনে আবিরের মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
বাহিরে এসে রাই মুখ ফুলিয়ে নিলো। সুরাইয়া কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো তবে কিছু বললোনা। জানেই যে আবির নিশ্চই কিছু বাকা কথাই বলেছে। অবশেষে বিদায়ের বেলা।
গাড়িতে উঠে বসেছে সবাই।

এদিকে মিহির একটু আড়ালে গিয়ে সুরাইয়ার কপালে গভীরভাবে একটা চুমু একে দিল থাকো। আসি তবে
রাই তাকিয়ে রইলো বাড়ির দিকে। কিসের আশায়!হয়তো কোনো একজনের আশায়। যে অন্তত গেটের সামনে এসে দাড়াবে। কিন্তু বাস্তব আর কল্পনা দুটো খুব ভিন্ন।
তাই তেমন কিছুই হলো না।
গাড়ি স্টার্ট করে এর সর্বোচ্চ গতিতে চলতে শুরু করল। পেছনে রয়ে গেলো সেই মানুষগুলো।


পর্ব ১২

প্রায় দুপুরের দিকেই বাড়িতে পৌঁছে গেলো সবাই। রাই এর মা খালা, খালু, বাবা সবাই মিহিরদের খুব সুন্দর করে আপ্যায়ন করেছে। নিশান এখনও শুধু রাই কে দেখেই যাচ্ছে। তবে কথা বলতে পারছেনা।
রাই বাড়িতে গিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল।
এদিকে রেজোয়ান সাহেব মিহিরের বাবা বাড়ির বড়োদের সাথে কথা বলছে। যাক তখনকার মত তেমন কিছুই হলো না।

রাই এর মনটা বেশ খারাপ। কেনো তার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। তবে একটা কথাই ওর মাথায় ঘুরছে, গতকাল সুরাইয়া যেগুলো বললো সেটা। আর এদিকে নিশান ও ওকে একা থাকতেই দিচ্ছে না। সুযোগ পেলেই কথা বলতে আসছে। এতে রাই খুবই বিরক্ত।
এদিকে আবির একদৃষ্টিতে জানালার
বাহিরে তাকিয়ে আছে। তখনি ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো। ওপাশ থেকে কেউ কিছু একটা বললো।
আর যদি খবরটা ভুল হয়?

শুনে আবির ফোনটা রেখে দিল। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

বিকেলে রাই ভাবলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসবে। ঘরে থাকতে ভালো লাগছেনা। যেই ভাবা সেই কাজ। বেরিয়ে পড়লো বাকি বোনদের নিয়ে।
বাহিরে অবশ্য উঠানে সবাই ছিলো। বিধায় মিহির এর বাবা ও দেখলো রাই কে বের হয়ে যেতে।

প্রায় ১ ঘণ্টা যাবৎ রাই আর মণি হাঁটাহাঁটি করেছে বাহিরে। আসরের আযান দেবে দেবে, এমন সময়েই ওরা বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এলো।
এই রাই ওই গাড়িটা কার? মণির কথায় রাই সামনে তাকালো। দেখে যে গাড়িতে ওরা সকালে এসেছে ঠিক তার পাশেই একটা কালো গাড়ি দাড়িয়ে। আমি কি জানি?

কেউ আসলো নাকি বাড়িতে? চল তো বলে মণী রাই এর হাত ধরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলো।
বাড়িতে ঢুকতেই সবার আগে চোখে পড়লো বাড়ির সব মুরব্বিরা সহ ছোটো রাও উঠানে গম্ভীর মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। যেনো খুব চিন্তিত, এতটাই চিন্তিত সকলে যে মাটির নিচে তাকিয়ে কিছু ভাবছেন। অপরদিকে এই চিন্তার সাগরের মাঝে দুটো মানুষের মুখভঙ্গি ভিন্ন।

এক রেজোয়ান সাহেব। যিনি খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছেন। দ্বিতীয় মিহিরের বাবা, যার মুখে একটা রাগ রাগ ভাব বিরাজমান।
রাই আর মণি এগিয়ে গেলো। অন্য মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে সকলে সেদিকে তাকালো, অর্থাৎ রাই এর দিকে। সাথে সাথে যেনো সকলের চিন্তিত চেহারার অবসান ঘটিয়ে সেখানে একটা প্রশ্নমাখা প্রতিক্রিয়ার উদয় হলো। অন্তত রাই এর তো সেটাই মনে হচ্ছে।

মিহিরের বাবা বললেন নিন, এবার তো মেয়েও উপস্থিত, এবার বলেন
রাই অবুঝের মতো তাকালো, কি হচ্ছে তা বোঝার জন্য।
রাই কে দেখে ওর মা এগিয়ে এলেন।

চোখে মুখে অদ্ভুত এক বিস্ময় নিয়ে, কিন্তু এসে যা বললেন এর জন্য রাই মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
তোর বিয়ে হবে, আগামী পরশু। এখন থেকে তোর বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ
রাই কথাটাকে নিছকই মজা হিসেবেই দেখলো মা, কি বলছো কি আমার….
মজা মনে হচ্ছে? মায়ের মুখের এমন কঠিন শব্দচ্চরণ যেনো রাই এর মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে গেল কি বলছো এসব!

কেনো তুই তো এটাই চাইতি…. তো যখন তোর মনের আশা পূরণ হচ্ছেই তখন তোর সমস্যা কি?
রাই এর মাথা থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে মা….. কি হয়েছে তোমার কিসব বলছো তুমি? আর আমি কেনো নিয়ে করতে যাবো?

চুপ কর ( চেঁচিয়ে উঠলেন।) তোর বিয়ে হচ্ছে, তাও পরশুর মধ্যেই। মাথায় থাকে যেনো।
রাই এবার আর নিতে পারলো না খালামণি মা কি বলছে এসব? আর তোমরা এমনভাবে কেনো দাড়িয়ে আছো? কি হয়েছে বলবে তো?

এনারা কি বলবে আর? বলার মুখ কি তুমি রেখেছো? বলে উঠলেন মিহিরের বাবা।
আহ্ বাবা মিহিরকে থামিয়ে দিল তার বাবা তুই চুপ কর। সত্যিটা তো আজ হোক কাল হোক সবার জানতেই হবে। তাহলে চুপ করে কেনো থাকবো? ‘

রেজোয়ান সাহেব অনেক থামিয়ে দিলেন দেখ তুই একটু শান্ত হো……
চুপ কর। তোর নিজের পেটের সন্তান ও তো একই কাজ করেছে। বলে উনি উঠে দাড়ালেন।

রাই এর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। রাই পাশে তাকিয়ে দেখে ওর বাবা একদম নিশ্চুপ বসে আছে। ওর খালা এসে বললো এসব করার আগে একবার হলেও তো বলতেই পারতি, আমরা কি কখনো তোর খারাপ চেয়েছি? বলেই দেখতি, বিষয়টা আমরাই ঠিক করে নিতাম
রাই এর মাথা ছিড়ে যাচ্ছে কি বলছো তোমরা সবাই? অন্তত খুলে বলো কোন বিষয়ে তোমরা আমার উপরে এতো ক্ষিপ্ত?

রেজোয়ান সাহেব এগিয়ে এলেন মামনি, আমি যদিও খুশি কিন্তু ব্যাপারটা এমনভাবে না হলেই পারতো….. তুমি আমার ছেলেকে পছন্দ করো ভালো কথা একবার গুরুজনদের বলতে। তারা তো তোমাকে নিশ্চই সঠিক পরামর্শটাই দিত।

রাই দুপা পিছিয়ে গেলো। ওর মাথায় সোজা আকাশ ভেঙে পড়লো। নিশান এর কথা এনারা কিভাবে জানলেন? নাহ নিশান বলেছে নাকি? নিশান কেনো বলতে যাবে!কিন্তু তাহলে কিভাবে জানলো? অসম্ভব।

মিহিরের বাবা বলে উঠলেন দেখো দেখো সবাই। এই মেয়ের মুখ দেখো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ও আসাই করেনি যে আমরা জানবো

রাই স্তব্ধ হয়ে গেল। কি থেকে কি বলবে ও জানেনা। মণি সাহস করে কিছু বলতেও পারছেনা। কিন্তু কিছুই ওর ও মাথায় আসছে না। খালু বললেন ছি, তোকে সুরাইয়াকে দেখে আসার জন্য পাঠিয়েছিলাম আমরা আর তুই…..

রাই এর চোখ ভিজে এলো। একেই কি বলে বাবা মায়ের অসম্মান করা? তাদের এক একটা কথা গায়ে লোহার গরম সিক ধরার থেকেও কষ্টের। এর চাইতে যন্ত্রণার কিছুই হতে পারেনা। রাই কষ্টে মাথা নিচু করে নিলো। ওর কিছুই বলার নেই। যদিও এখন ও নিশান কে এড়িয়ে চলে, কিন্তু একটা সময়ে তো দুজন সম্পর্কে ছিলই। হোক ক্ষণিকের জন্য।
এখন মাথা ঝুঁকিতে কি হবে? যখন রাতে একা ঘরে একটা পরপুরুষের সাথে ছিলেন তখন মনে পড়ে নি এসব?
বলে হুংকার করে উঠলেন মিহিরের বাবা।

বাবা…. মিহিরকে মোটামুটি দামই দিচ্ছেনা কেউ। ও কিছু বলতে গিয়েও বারবার থেমে যাচ্ছে বা যেতে হচ্ছে।
রেজোয়ান সাহেব গিয়ে বন্ধুকে ধরলেন চুপ কর। অনেক হয়েছে

রাই এর মা কষ্টে চোখ বন্ধ করে নিলেন। এবারে রাই যেনো ভেতর থেকে আরো ভেঙে গেলো। ঠিকই তো, রাতে একটা পরপুরুষের সাথে ছিলাম আমি, ছি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো রাই। বলার কিছু নেই। যা সত্য তা সবার সামনেই এসেছে।

রেজোয়ান সাহেব বললেন মা, দেখো যতই তুমি একজনকে ভালোবাসো বা পছন্দই করো কিন্তু মানুষের মাঝে একটা মিনিমাম লিমিটেশন থাকা উচিত। যতই তুমি কাওকে চেনোনা কেনো।

রাই এর চোখ থেকে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। কষ্টে বুকটা ফেটে আসছে। অথচ আজ কেউ নেই ওকে একটু সামলানোর। রেজোয়ান সাহেব আরো বলেন
তুমি যখন আবিরকে পছন্দ করতেই তখন আমাকে বললেই পারতে, যদি বাবা মা না মানত আমি মানিয়ে নিতাম। কিন্তু তোমরা দুজন এটা কি করলে?

রাই কি কানে ভুল শুনলো? আবির! আবির কে কিভাবে? না ও তো নিশান কে। রাই মুখ তুলে অস্ফুট স্বরে বলল আবির!
খালামণি বললেন তুই আর আবির যখন একে অন্যকে পছন্দ করিস, বললেই পারতি অন্তত আজ এক বাহিরের মানুষের মুখে তোর নামের এসব কথা শুনতে হতো না।

রাই এর গলা আটকে এসেছে ও দ্রুত মাথা নাড়লো না…… না
মিহিরের বাবা ক্রোধান্বিত নজরে তাকালেন দেখো দেখো এত সাহস এই মেয়ের বড়ো ছেলেকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে আবার ছোটো ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে তাও কিনা না না করছে। ছি

রাই এর মা কেঁদে উঠলেন। ওর বাবা উঠে ওখান থেকে চলে গেলো। ওনার এসব কথা সহ্যই হচ্ছেনা।
রাই একের পর এক এসব মিথ্যে অপবাদ সহ্য করতেই পারছেনা আমি আবিরকে ভালোবাসি না। না ওর কান্নার বেগ বেড়ে গেলো।

আবিরকে ত ও সত্যিই ভালোবাসে না। তাহলে সবাই আবিরের কথা কিভাবে পেলো? !
চরিত্রহীনা। না জানে কার কার সাথে কি কি করেছে
মিহিরের বাবার এই কথাটায় সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। রাই এর মা সজোরে ওর গেল চড় বসিয়ে দিলেন এটাও আজ আমায় শুনতে হলো

রাই তাল সামলাতে না পেরে পেছনে পড়ে যেতে গেলেই কেউ ওকে ধরে ফেললো। রাই এর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। ও অস্রুমাখা চোখ নিয়ে উপরে তাকালো। আবির দাড়িয়ে।

আবির ওকে ধরে ওর ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। পেছন থেকে ওর মা বললো আগামী তিনদিন পরেই তোর আবিরের সাথে বিয়ে হয়ে যাবে। এটাই তো চাইছিলি নে, হয়ে যাবে
রাই ঘুরে মায়ের কাছে গেলো মা, আমি সত্যিই আবিরকে ভালোবাসি না। মা বিশ্বাস করো অন্তত এটুকু বিশ্বাস করো

ওর মা ওকে দূরে সরিয়ে দিল। রাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তোমরা সবাই একটা ( গলা জড়িয়ে ধরলো) কেনো কেনো…… বিশ্বাস করো আমি… না ও পুরো কথাটাও শেষ করতে পারছে না। ওর মাথাটা ঘুরছে।
পেছন থেকে আবির বলে উঠলো রাই কেনো শুধু শুধু লুকোনোর চেষ্টা করছো? এখন সবাই জানে, আর সবাই মেনে ও নিয়েছে।

রাই রেগে ওর দিকে তেড়ে গেলো আপনি আপনিই সবাই কে বলেছেন না। যে আমাদের। ওর শার্টের কলার চেপে ধরলো রাই।
আবির সবার চোখের আড়ালে রাই এর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো হ্যাঁ আমিই বলেছি….. কথাটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে আবির কত বড়ো গেম খেলেছে। রাই এর চোখ বিস্ফোরিত হলো।

আবির নিজের চেহারার বাকা হাসি সরিয়ে সবার দিকে তাকালো হুম, রাই আমি বলে দিয়েছি যে সেদিন রাতে তোমার ঘরে আমিই ছিলাম। শুধুই তোমাকে একটু দেখতে গিয়েছিলাম। আর কিছুইনা। কিন্তু তুমি আমাকে চলে যেতে বলেছিলে। আমিই যাইনি। কথাগুলো মিহিরের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল আবির।

মিহিরের বাবা চোখ সরিয়ে নিলেন। আবির ওর মা কে উদ্দেশ্য করে বললো এখানে তোমার কোনো দোষই ছিলনা। তবে ভুল সময়ে, ভুল মানুষটা আমাদের আআওয়াজ শুনে ফেলে বিধায় এমন ধারণার উৎপত্তি
রাই এর মা বলে উঠলেন ওর দোষ নেই? ও যে তখন তোমাকে নিজের কাছে আসতে দিয়েছে এর থেকে বড়ো আর কি চাও?

রাই এর হাত আলগা হয়ে এলো। অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকালো। সবাই কি সুন্দর কতগুলো ভুল ধারণা নিয়ে ব্যস্ত। অথচ কেউ ওকে একবারও জিজ্ঞেস করলো না যে ও কি করেছে ওর মুখ থেকে বলুক।
আবির এর বিপক্ষে কিছু বললো না। থাক। কিছু কথার উত্তর না দেওয়াই ভালো। রাই আবিরের কলার ছেড়ে দিল। পাশে তখনি নিশান এসে দাড়ালো। রাই নিশানের দিকে শূন্য চোখে তাকালো।

নিশান কিছু বলতে গিয়েও যেনো থেমে গেলো। কেনো? সেটা রাই বুঝলো না। রাই এর চোখ চিৎকার করে বলছে নিশান তুমি বলে দাও এরা যা ভাবছে সেটা ভুল। আমি তো তোমাকে পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু এরা কেনো বলছে আবিরের কথা? কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে হলেও নিশান চুপ।
এদিকে নিশানের মনে চলছে এক অন্যরকম ঝড়। না পারছে কিছু বলতে না পারছে রাই এর এমন অবস্থা দেখতে। ও যে বাধ্য।

এদিকে রাই বুঝে গেছে নিশান এর মতলব। ও চুপ করে আছে। মানে ওর মনে কোনো ভালোবাসাই নেই। রাই
আরো একটা ধাক্কা খেল। কিন্তু এবারে আর কিছু বলার সাহস ওর মধ্যে অবশিষ্ট নেই। এদিকে সবাই একের পর এক কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। উপদেশ দিচ্ছে। অথচ যে কাজটা ও করেই নি সেটার জন্য ওকে এত কথা শুনতে হচ্ছে।

রেজোয়ান সাহেব বললেন আচ্ছা তোমরা সবাই এসব ভুলে যাও। দেখো ওরা ছোটো। এতকিছু বোঝে নি। হয়তো ভেবেছিল আমরা মানব না তাই বলেনি। এখন সব বাদ থাক। আমরা ওদের বিয়ে দিয়ে দিলেই তো সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে

মিহিরের বাবা খোটা মেরে বললেন হ্যা এখন তো এটাই করতে হবে। তাছাড়া উপায় নেই। না জানে পরে কি করে বসে। বলে উনি চলে গেলেন। নিশান মাথা ঝুঁকিয়ে নিল। যদিও বলতে চাচ্ছে অনেক কিছু। কিন্তু কিছু একটার জন্য ও থেমে যাচ্ছে বারবার।

রাই এর মা ওখান থেকে চলে গেলেন।
রাই এর পা কাঁপছে। দাড়িয়ে থাকা দায়। মাথাটা এমনভাবে ঘুরছে যে ও আর না পেরে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো আমি এটা করিনি। তোমরা ভুল ভাবছো বিড়বিড় করতে লাগলো।

উপস্থিত সকলেই আর কথা বাড়ালো না। ওখান থেকে চলে গেলো। শুধু দাড়িয়ে রইলো আবির, নিশান এর রাই। মণির এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। মণি এগিয়ে রাই কে ধরতে গেলেই রাই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ওর আর কিছুই মনে নেই।

টিপটিপ করে চোখ খুললো রাই। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা করছে।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ও নিজের ঘরেই শুয়ে আছে। পাশে তাকিয়ে দেখলো মণি ওর হাত ধরে বসে আছে। আর কেউই নেই। বিকেলের কথা মনে পরতেই রাই এর চোখে আবারো পানি চলে এলো। মণি ওর হাতটা চেপে ধরলো উঠেছিস

রাই আস্তে আস্তে করে উঠে মণি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আর হো হো করে কেঁদে উঠলো।
কাঁদিস না। ওকে স্বান্তনা দেওয়ার যতই চেষ্টা করুক মণি কিন্তু পারলনা। ও কেঁদেই যাচ্ছে। দ্যাখ কাঁদিস না। দাড়া আমি কাকী কে ( রাই এর মা ) ডেকে আনি।
রাই ওর হাত ধরে থামিয়ে দিল। নাহ….. কোন মুখে কথা বলবো?

মণি অবাক হলো দাড়া মানে তোর রিলেশন ছিলো আবিরের সাথে?
রাই কেঁদে উঠলো না। ( মাথা নারছে) না
তো?
আমি নিশানকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু।
কিন্তু?

কিন্তু, পরে আমি বুঝতে পারি ও ভালো না। তাই ওকে। বলে ও কেঁদে উঠলো
মণি ওকে জড়িয়ে নিলো তারমানে কি ভাইয়ার বাবা ( মিহিরের বাবা) মিথ্যে বলেছেন?
আমি জানিনা। উনি হয়ত ভুল দেখেছেন
মণি কিছুটা ভাবলো। তারপর বললো জানিস আবির ভাইয়ের সাথে তোর বিয়ে কেনো হচ্ছে?

রাই একটু কান্না থামলো। তবে এখনও গলা জড়িয়ে রয়েছে। মণি বললো যতটুকু শুনেছি আমরা বিকেলে বের হওয়ার পর নাকি মিহির ভাইয়ার বাবা সবাইকে তোর নামে এসব বলেছে। প্রথমে তো কেউই বিশ্বাস করেনি। কিন্তু পরে নাকি আবির ভাইয়া এসে সবাইকে বলেছে যে তোদের মধ্যে সম্পর্ক আছে।

ছিল না, আছে। আর সবাইকে অনুরোধ করে যেনো ওর সাথেই তোর বিয়েটা হয়। ফলে সবাই বিশ্বাস করেছে
রাই মাথা নেড়ে বললো না। ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই
কিন্তু কথা হলো ভাইয়া এটা কেনো বললো!

তখনি দরজা টা খুলে গেলো। দুজনে তাকিয়ে দেখে আবির ভেতরে আসছে। মণি দাড়িয়ে পড়লো। রাই চোখ মুছে নিল। আবির ভেতরে এসে বললো ঠিক আধা ঘণ্টা পরে নিচের সবাইকে এঘরে পাঠিয়ে দিবে
মণি মাথা নাড়লো। আর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রাই খাটে গুটি শুটি করে বসে গেলো। আবির একপা একপা এগোতে লাগলো।

যান এখান থেকে। যান
কিন্তু আবির থামছে না।

রাইয়ের সামনে এসে বসলো ও। রাই ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। আবির ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। রাই ঘৃণার সহিত বললো কেনো করলেন এমন? কেনো বললেন সবাইকে এমন মিথ্যে? আমার সাথে এসব গেম কেনো খেলছেন? কেনো করলেন এমন?
রাই প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়েছে।

এমন সময় আবির প্রচণ্ড রেগে রাই এর মুখ হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো আর খাটের সাথে ওকে চেপে ধরলো
কেনো করেছি? প্রশ্নটা তো আমার করা উচিত তোমাকে……

রাই ব্যথায় মুখ ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু আবির ছাড়ছে না। আবির বলতে লাগলো
অবাক হচ্ছো? আমিও অবাক হয়েছিলাম। জানো খুব অবাক হয়েছিলাম। যখন আঙ্কেল ( মিহিরের বাবা) এর মুখে শুনলাম যে রাতে তোমার ঘরে কোনো ছেলে ছিল। নিশ্চই সেটা নিশান ই ছিলো? কি ঠিক না?

রাই এর অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আবির ও এই মুহূর্তে প্রচুর রেগে আছে যা বলার মত নয়। আবির ওর মুখটা ছেড়ে হাত চেপে ধরলো
বলো। ওহ কি বলবে? বলার মুখ থাকলে তো…
রাই কাঁদছে।

একটা ছেলে তখনি একটা মেয়ের কাছে আসতে পারে যখন মেয়েটা চায়। এর আগে তাকে মেরে ফেললেও সেই মেয়ে কোনো ছেলেকে কাছে আসতে দেয়না।

যে নারী নিজেকে কুনজরের হাতে নিজেই সোপে দেয় তার কোনো আত্মসম্মান থাকেনা। সে শুধুই একটা নষ্টা হোয়েই রয়ে যায়। নারীর আত্মসম্মান তার গৌরব। বিক্রি করার জিনিস নয়। দেহ বিলিয়ে দেওয়া যদি ভালোবাসা হতো তাহলে এই বিশ্বের প্রত্যেক নষ্টা ভালোবাসার দৃষ্টান্ত কায়েম করতো।

রাই ভেতর থেকে পুরো শেষ হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এটাও তাকে শুনতে হলো। তবে কথাগুলো তো সত্যিই। আবির রাই কে ছেড়ে দিল। আর বড়ো বড়ো নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো। সত্যিই এই প্রথম আবির এতটা রেগেছে। আর রাগবে নাই বা কেনো। যেটা ওর শুনতে হয়েছে সেটা তো এত ভালো কথা ছিল না।

রাই কাঁদতে কাঁদতে মাথা ঝুঁকিয়ে নিল। ওর চারপাশ অন্ধকার লাগছে। সত্যিই ও বিরাট একটা ভুল করে বসেছে। অনেক বড়ো। এভাবে ওর কাওকে কাছে আসতে দেওয়া উচিত হয় নি। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে আবিরের বুকের ওপর মাথা এলিয়ে দিয়েছে ও জানেনা।

আমি, বুঝতে পারিনি…..( কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে) আমি…..
রাই কে থামিয়ে দিল আবির। ওর মাথায় হাত রেখে বলল

হোক সে আমার ভাই। কিন্তু তোমার তো কিছু হয়না…… কখনো কখনো মানুষ কখনো নিজের গ্যারান্টি দিতে পারেনা, সেখানে অন্য একজন তো দূরের কথা। হোক সে নিজেরই রক্ত। আর কারো না। কিন্তু মেয়েদের এটা বোঝা উচিত। কেনো এই ছোট্ট একটা কথা তোমার মাথায় ছিলনা?

রাই অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে। বলা হয় কাঁদলে মন হালকা হয় কিন্তু এখন তো ক্রমশই মন মস্তিষ্ক ভারী হয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই নিজেকে হাল্কা করতে পারছেই না।
আবির তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো অবশ্য তোমার বয়স এমন, এই বয়সে যুক্তির থেকে আবেগটাই বেশি কাজ করে। কিন্তু সত্যিই কি আবেগের জোর এতই বেশি?

রাই অশ্রু সিক্ত চোখে তাকালো। আবির নিজের থেকে রাই কে সরিয়ে নিলো। রাই ভেজা ভেজা কণ্ঠে বললো কেনো আপনি বিয়ে করতে চাচ্ছেন? কেনো?
আবির হালকা হাসলো আমি খুবই খারাপ। আমার সাথে যার ভাগ্যের রেখা মিলেছে সে অনেক কষ্ট থাকবে। বলে আবির রাই এর মুখের ঠিক সামনে এগিয়ে গেলো আর কঠোর গলায় বলল ওয়েলকাম, টু মাই হেল….. মিসেস চৌধুরী

রাই এর বুকটা ধক করে উঠলো। মুহূর্তেই যেনো চোখের সামনে অধার ছেয়ে গেলো। নিজের বলা কথাটা যে এভাবে ঘুরে ওর কাছেই আসবে হয়তো সেটা ও ভাবে নি।
আবির নিজের আগের কঠিন চোখ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। পেছনে একটা শূন্য অনুভূিত সম্পন্ন মানুষ তার শুকিয়ে যাওয়া চোখে তাকিয়ে রইলো।

__বর্তমানে
সেদিনের আবিরের সেই কথাটা মাথায় আসতেই রাই চমকে চোখ দুটো খুলে ফেললো। সেদিনের মত ভয়াবহ আবিরকে রাই আর কখনোই দেখে নি। পাশে ঘুরে দেখে আবির রাই কে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে আছে।
সত্যিই খুব অবাক লাগে, একটা মানুষ কিভাবে এত রহস্যময়ী হতে পারে? কিভাবে?

আজও বুঝলাম না, আপনি আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন, নাকি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য…… আজও বুঝিনি বিড়বিড় করে বললো রাই।
সামনে আবিরের ঘুমে বিভোর মুখটা।


পর্ব ১৩

বর্তমানে __
সকালে ঘুম থেকে উঠে আবির দেখলো রাই ঘরে নেই। হয়তো বাহিরে গেছে। আবির ঘুমু ঘুমই চোখে উঠে বসলো। আর বিছানার দিকে তাকালো। আর ওর ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠল।

সারাদিন এ যতই রাগ অভিমান থাকুক, দিন শেষে যে রাই কে আবির নিজের পাশে এইখানেই পায় এতেই ও খুশি। বিয়েটা যে এভাবে হয়েছিলো সেটা ভাবতেই অবাক লাগে। বিয়ের দিনেও রাই কতই না কান্নাকাটি করেছিল যে ও বিয়ে করতে চায়না। কিন্তু অবশেষে বিয়েটা হলোই। ঢাকায় আসার সময়ও রাই একই কাহিনী করেছিল। যাইহোক, এখন আর ওসব ভাবার দিন নেই।

রাই বাহিরে রান্নাঘরে, নিজের শাশুড়ি কে সাহায্য করছে। আর পাশে দাড়িয়ে ওর চাচী শ্বাশুড়ি শুধু মেয়ের খুদ বের করতেই ব্যস্ত। যদিও ফুপি বিভিন্ন ভাবে রাই এর প্রশংসা করছে কিন্তু এতে ওনাদের কোনো কিছুই যায় আসে না। তবে রাই ও শিখে গেছে মানিয়ে নেওয়া। চোখ কান বুজে কাজ করছে।
তখনি বাইরে থেকে ডাক এলো নিশান এর মা, খাবার দাও, বাইরে যাবো

এইতো….. উনি রাই কে খাবারের প্লেট ধরিয়ে দিলেন যাও নিশান কে দিয়ে আসো
রাই যদিও যেতে চাচ্ছে না, তবুও না করার উপায় নেই। চুপ করে প্লেট নাইট গিয়ে টেবিলে নিশানের সামনে দিলো। নিশান রাই এর দিকে তাকালো। রাই চোখ সরিয়ে নিলো। তখনি রেজোয়ান সাহেব এলেন গুড মর্নিং মামনি…..
রাই মুচকি হাসলো গুড মর্নিং…..

তো আজ কি নাস্তা করা হচ্ছে?
পেছন থেকে ফুপি বলে উঠলেন এইতো, আলুর দম আর পরোটা….. বলে একে একে খাবার এনে টেবিলে রাখলেন।
রাই শাশুড়ি ও বেরিয়ে এলেন এসে বললেন নাও, খাবার বেড়ে দাও আর গিয়ে আম্মা ( আবিরের দাদী) কে ডেকে নিয়ে আসো…..

রাই মাথা নাড়লো। আর চলে গেলো দাদীর ঘরে। এদিকে আবির তৈরি হচ্ছে। রাই দাদীকে খেতে আসতে বলেনিজের ঘরে গেলো ওর চুলগুলো খুলে গেছে, তাই ঠিক করতে। ও ঘরে ঢুকতেই দেখে আবির মাত্র শার্ট পরছে….. রাই চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জায়? আবির তা দেখে একটু বাঁকা হাসলো। রাই চুল ঠিক করে যেই বেরোতে যাবে তখনি আবির পেছন থেকে ওর হাত টেনে ধরলো
দাড়াও।

রাই থেমে গেলো। আস্তে আস্তে পেছনে ঘুরে তাকালো। আবির একটা ভাব নিয়ে বললো এখানে আসো….
কেনো?
সবসময় প্রশ্ন বলে আবিরই এগিয়ে গেলো ওর কাছে। আবিরকে আসতে দেখে রাই দুপা পেছবে কি আবির তা হতে দিলনা খেয়ে ফেলবো না…… বলে আবির ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রাই একটা ঢোক গিলে নিলো তো….
বোতাম গুলো লাগিয়ে দাও।

জনাব এমনভাবে বললো যেন উনি কোনো রাজ্যের রাজা, আর রাই কে অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে রেখেছে।
হাত নেই? নাকি বলবেন চোখ নেই? রাই বললো।

জবাবে আবির কিছুই বললো না, শুধু রাই কে চিরচেনা উপায়ে ভয় দিলো। মানে ওই আরকি নিজের মুখ এগোতে গেলেই রাই ওকে থামিয়ে দেয় হ্যাঁ দিচ্ছি তো। আগেই এতো লাফান কেনো…. রাই মুখ ফুলিয়ে নিলো।
আবির ঠোঁট চেপে হাসছে। বেচারি। সহজেই হার স্বীকার করে নেয়। বিষয়টা খুবই বিব্রতকর, এভাবে আবিরের সামনে দাড়ানো আর। নাহয় না বলি।

রাই কোনোভাবে নিজের চোখ দুটো শুধুই শার্ট এর ওপরে রাখল আর বোতামগুলো একে একে লাগিয়ে দিতে লাগলো।
কিন্তু ছেলেদের চিরচেনা স্বভাব। এতকাছে প্রেয়সিকে পেলে আর নিজের ভাবনায় নিয়ন্ত্রণ থাকেনা।
সেটাই হলো। রাই বোতামগুলো লাগিয়ে সরে আসতে গেলো কিন্তু আবির দিলনা। আবির ওকে জড়িয়ে ধরবে তার আগেই রাই ওকে সজোরে ধাক্কা দিলো।

ঘটনাচক্রে আবির এতটাই অবাক ও রাই এর দিকে তাকালো। কিন্তু সবথেকে বড়ো সত্য এটাই যে রাই এর চোখে এখনও শুধু ঘৃণাটাই বিদ্যমান। ও আবিরের দিকে রেগে তাকিয়ে আছে

সবসময় কেনো কাছে আসতে হবে? জানেন না আমি আপনাকে কতটা ঘৃণা করি? আপনার প্রত্যেকটা ছোয়া আমার জন্য জ্বলন্ত অঙ্গার। বলে রাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
পেছনে আবির নিরাশ্বাশ হয়ে তাকিয়ে রইলো।

বাহিরে আসতেই ওর শাশুড়ি শুরু হয়ে গেলেন একজনকে ডাকতে পাঠিয়েছিলাম মানে কি নিজেই হারিয়ে যাবে নাকি?

ফুপি থামিয়ে দিলেন আহ্ ভাবি। রাই আসো….. খাবার বেড়ে দাও….
রাই এগিয়ে গেলো। খাবার বেড়ে প্রথমে দাদী কে তারপর বাবা আর আস্তে আস্তে সবাই কেই খাবার বেড়ে দিলো।
এদিকে তখনি আবির ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ছেলের এমন বেগ দেখে মা ডাক দিল কীরে এতো তাড়াহুড়োয় কোথায় যাচ্ছিস?

আবির দাড়িয়ে গেলো তারপর মায়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিলো বাবা আমিও আজ থেকে আবারো অফিস জয়েন করছি।
রেজোয়ান সাহেব খাবার টুকু ও খেতে পারলো না এর আগেই আবিরের কথায় উনি বিষম খেলো কিহ্হঃ!! আজ থেকে মানে কি?

আবির এর মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ মানে কি আরও ভেঙে বলতে হবে?
ফুপি বললেন আরে তুই এভাবে কেনো বলছিস বাবা? আর এখন থেকে কেনো যাবি?

রেজোয়ান সাহেব ও বললেন ‘ ও বললেই হলো নাকি? বিয়ের এক মাসের আগে কাজে যেতে দিচ্ছি না
রাই আবিরের দিকে তাকাতেই আবির চোখ সরিয়ে নিলো। এবার আবিরের মা বলে উঠলেন হুম, দেখো গিয়ে এই মেয়েই হয়তো আমার ছেলের মাথা খেয়েছে। আমার ছেলেটা দেখো কত রেগে আছে…

ওর চাচীও তাল মিলিয়ে উঠলেন হ্যাঁ দেখো তো ছেলের চেহারা…..
রাই এর কষ্ট আরো বেড়ে যাচ্ছে। ও আবিরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

এদিকে
আবিরের এই কথাগুলো সহ্য হচ্ছেনা। ও রেগে কিছু না বলেই বাসা থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলো।
পেছনে সবাই ডেকে উঠলো আবির…..
রাই ওর যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো। আর নিশান রাই এর দিকে।

আবির এতটাই রেগে যে কারো কোনো তোয়াক্কাই করছে না। অফিসে ঢুকেই বড়ো বড়ো কদম গেলে নিজের কেবিনের দিকে চলে গেলো। অফিসের স্টাফ এতটাই বিস্মিত যে বলার বাহিরে। কয়েকজন তো বলেই উঠলো স্যার তো ১ মাসের আগে আসবেন না বলে দিয়েছিলেন রেজোয়ান স্যার। তাহলে আজ হটাৎ?

আরেকজন বলল তোরা স্যারের চেহারা দেখেছিস? এতো হাইপার।
হুম….. না জানে কাকে ঝেড়ে ফেলে। এই কাজে যা সব

সবাই যার যার কাজে গেলো।
কিছুক্ষন পরেই ভেতর থেকে আবিরের ডাক এলো স্টাফ দের জন্য। একেকজন ভয়ে ভয়ে নিজের ফাইল গুলো নিয়ে যেতে লাগলো।

আর আবির ইচ্ছেমত সবার ওপরে রাগ ঝেড়ে দিলো। যদিও ও এটা করতো না। কিন্তু একই সকালের রাগটা রয়ে গেছে আবার স্টাফরা একজন ও নিজেদের কাজগুলো ঠিকমতো করেনি। ফলে আবির এর রাগ তুঙ্গে উঠে গেলো।
ভেতর থেকে আবিরের ঝারাঝড়ি শুনে তো স্টাফরা ভিয়েই শেষ।

আমি যাবনা বাবা, এই রিয়া আমার ফাইল দিয়ে আসিস বলেই মেয়েটা দৌড়। রিয়া আবার আরেকজন কে ধরলো এই সৌরভ তুই ফাইলগুলো দিয়ে আসিস বলে সে ও দৌড়।
এই এই আমি।! তার আগেই বাকিরাও নিজেদের ফাইল সৌরভের উপরে ছুটে ফেললো ভাই, দিয়ে আসিস একটু

তুই যা বলে সব দৌড় এদিকে সৌরভ বেচারার কান্না চলে আসবে এমন আমাকে তোরা এভাবে ছেড়ে…..
সৌরভ….. ভেতর থেকে আবিরের ডাক…… সৌরভ তো শেষ

এদিকে রেজোয়ান সাহেব মাত্র বের হবেন অফিসের জন্য। কিন্তু তার আগে উনি বৌমার ঘরে গেলেন আর দরজায় টোকা দিলেন মে আই কাম ইন?

রাই ঘুরে তাকায় আরে, বাবা আসেন না।
হাহা, না এখন তো আসার আগে একবার জিজ্ঞেস করতেই হয় কি বলো?
না, তবে আপনি চাইলে করতেই পারেন মুচকি হাসে রাই।

রেজোয়ান সাহেব হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখেন একটা কথা সত্যি করে বলবে মা?
‘জ্বী বলেন?
মা, আসলে দেখো কিছু মনে করো না। তবে।
রাই শোনার জন্য তাকিয়ে আছে।

দেখো আমি জানি তোমার হয়তো অনেকটা অমতেই এই বিয়ে করতে হয়েছে।
রাই এর মুখ মলিন হয়ে এলো।
তবে, হয়েছে তো। জানিনা আবির যেটা বলেছে সেটা সত্যি ছিলো কিনা। কিন্তু মা আমি তো তোকে এবাড়িতে আনতে চেয়েছিলাম যে কারণে আমি নিষেধ করি নি। কিন্তু এখন তো তোরা একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ই গেছিস।

বাবা, আপনি কি অন্য কিছু বলতে চাচ্ছেন?
রেজোয়ান সাহেব মলিন হাসলেন আবিরের সাথে কি তোর ঝগড়া হয়েছে?
রাই মাথা নাড়লো না

যাক না হলেই ভালো। কিন্তু আসলে আমার ছেলেটা একটু এমনই, জেদী। তবে কখনো জেদের বশে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয় নি। হয়তো ও কখনো কখনো ছোটো বিষয়েও রেগে যেতে পারে, কিন্তু দেখবি তুই ওকে ভালো করে বুঝলে ও বুঝে যাবে….

রাই মাথা নিচু করে রইলো। রেজোয়ান সাহেব আর কিছু বললেন না। ওকে বিদায় জানিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু রাই নিজের ভাবনার জগতেই রয়ে গেলো।

তুই এভাবে না খেয়েই চলে কেনো এলি?
আবির বাবার কথায় ততটা কানে নিলো না, নিজের মতই কাজ করছে ল্যাপটপে। ওর বাবা গিয়ে ল্যাপটপটা বন্ধু করে দিলেন আমার দিকে তাকা
আবির বিরক্তি নিয়ে তাকালো। উনি জিজ্ঞেস করলেন দেখ, তোর এই বাসার রাগের প্রভাব এখানে পড়ছে। স্টাফরা তো প্রায় ভোটই শেষ….

আবির দাড়িয়ে টেবিলে হাত দিয়ে বাড়ি মারলো দোষ আমার না ওদের। এক সপ্তাহ অফিসে নেই বলে কাজের কি অবস্থা দেখো। বলে কতগুলো ফাইল বাবার সামনে দিলো আবির।
রেজোয়ান সাহেব ছেলের দিকে হতাশ চোখে তাকালেন মাই সন্ তোমার এখন একটু রেস্ট নেওয়া উচিত। এসব কাজ রাখো। এসেছি ভালো কথা বসে থাকো।

লাগলে ইউটিউব খোলো আর ফানি ভিডিও দেখো। এসব আমার কাজ আমাকে দাও…. ( বলে ফাইলগুলো তুলে নিলেন ) চিল বলে রেজোয়ান সাহেব কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেলেন।
আবির চোখ দুটো বন্ধ করে চেয়ারে বসে পড়লো।

নীলা, ওর মা আর আবিরের মা তিনজন বৈঠকে বসেছে।
নীলার মা বললো দেখো আমি এখনও বলছি, ছেলেকে বুঝি সুঝিয়ে ডিভোর্স টা করিয়ে দাও। আমি তাও আমার মেয়েকে দিতে রাজি আছি। কিন্তু ওই মেয়ে রাই, ও কি কোনো বউ হলো নাকি। এই পরিবারের কেউই ওকে পছন্দ করেনা। আম্মা তো আরো না

নীলা রেজ জ্বলছে কিন্তু যার করার কথা না সেই তো পছন্দ করে। আবির….. ও কিভাবে এরকম একটা মেয়ের প্রেমে পড়ল বলো। না আছে ক্লাস, না আমাদের লেভেলের।

আর মা…..( মায়ের দিকে তাকিয়ে ন্যাকা সুরে) আমি কি ওর থেকে কম সুন্দরী? ইনফ্যাক্ট ও আমার সামনে কিছুই না তবুও কেনো আবির ওকেই বিয়ে করলো?
আবিরের মা বলে উঠলেন বিয়ে করেছে কি আর সাধে? ওই ওর বাবা আর মিহির এর বাবা এরা মিলেই আমার ছেলের মাথা খেয়েছে।

নীলা মাথা নেড়ে বললো না ছোটমা। তোমার ছেলেকে কেউই বোঝায় নি। উল্টো ওই নাকিসবাইকে বুঝিয়ে বিয়ে করেছে
আবিরের মা মানতে নারাজ অসম্ভব। আমার ছেলে এতও বোকা না, যে নিজের পায়ে নিজেই কোড়াল
মারবে। আমি মানি না

(বি: দ্র: এই হলো বাঙালি শ্বাশুড়ি। ওনার ছেলে ধোয়া নিমপাতা আর বৌমা ব্যাঙের ছাতা….)
নীলার মা বললেন থাক, এখন কে কি করেছে বাদ দাও। ওই মেয়েকে বিদায় করো তো।
এদিকে দাদী সবেমাত্রইই ওদের ঘরে পা রাখলো আর এই কথা কানে আসতেই উনি বললেন কি বলছো এসব তোমরা?

দুই বউ দাড়িয়ে পড়লেন আম্মা, আপনি
দাদী ভেতরে এলো এসব কি শুনছি বড়ো বউ?

চাচী বলে উঠলেন আ, হ্যাঁ আম্মা ওই আমরা রাই কে নিয়ে….
আবিরের মা নির্ভয়েই বললেন। আম্মা.. আমরা রাই কে নিয়েই কথা বলছিলাম।
দাদী বললেন কথা বলছিলে? নাকি তাড়ানোর ফন্দি আটছিলে?

দাদু ( নীলা উঠে এলো) তুমিও তো রাই কে পছন্দ করো না। তাহলে সমস্যা কোথায়?
দাদী একটু কঠোর গলায় বললেন আমি পছন্দ করিনা তার কারণ আলাদা। আবির নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। একটাবার আমাকে ও বলেনি। তো অমন নাত বউ আমি মানি কিভাবে?

কিন্তু তাই বলে একজনের সংসারে আগুন লাগানোর কাজ আমার বা তোমার কারোরই না। আবির যদি নিজের বউকে নিজের টাকায় পালতে পারে তাহলে তোমার আমার কি?
ওনারা তিনজনই মাথা ঝুঁকিয়ে নিলেন।
আশা করি এ নিয়ে আর কোনো আলোচনা হবেনা বলে দাদী সেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

রাত প্রায় ১১ টা।
রেজোয়ান সাহেব বাসায় এসে গেছেন রাত ৯ টায়। কিন্তু এখনও আবির আসেনি। ফুপি জিজ্ঞেস করলো ভাই আবির কখন আসবে?

আসেনি এখনও? রেজোয়ান সাহেব অবাক হয়ে ফোন হাতে নিলেন বলেছিলো তো ১০ টার মধ্যেই এসে যাবে উনি ফোন করছেন কিন্তু আবির ফোন তুলছে না। এদিকে রাই ঘরে বসে আছে। নিজেও ফুপির কোথায় দু তিনবার ফোন করেছিলো। কিন্তু আবির ফোন ধরে নি।

তখনি দরজায় বেল বেজে উঠলো। রাই বাহিরে গিয়ে দেখে আবির এসেছে। আবিরের মা জিজ্ঞেস করল এতো দেরি করলি যে?
কাজ ছিল সংক্ষিপ্ত উত্তর। আবির এগোতে গেলেই ফুপি বললেন রাই খাবার বেড়ে গেলো আবিরের জন্য রাই এগোবে তার আগেই আবির ভারী কণ্ঠে বললো আমি খেয়েই এসেছি। এখন আর খাবো না বলে ও সোজা ঘরে চলে গেলো। সবাই রাই এর দিকে তাকালো।

রাই কি করবে বুঝতে পারলো না।
ঘরে গিয়ে দেখে আবির মুখ হাত ধুয়ে বের হলো মাত্র।
আপনি কি সত্যিই খেয়ে এসেছেন?

আবির রাই এর দিকে তাকালো না হ্যাঁ। ভাবলাম তোমাকে আর এক্সট্রা কষ্ট না দেই। বাহির থেকেই খেয়ে আসি
রাই খুব ভালই বুঝতে পারছে আবির কতটা অভিমান করেছে। কিন্তু কী বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না এখানে কষ্টের তো কিছুই নেই
আবির হাতের টাওয়েল টা রেখে ঘুরে রাই এর দিকে এগোলো, রাই দুপা পিছিয়ে গেলো। আবির থেমে বললো ওই দুপা পিছিয়ে শুধু শুধু পা কে কেনো কষ্ট দেবে? তার থেকে ভালো আমিই পিছিয়ে যাই ওর গম্ভীর গলা আর কথাগুলো এতই কঠিন যে রাই আর কিছু বলার ভাষাই হারিয়ে ফেললো।

বেরিয়ে এসে টেবিলের খাবারগুলো গুছিয়ে রেখে দিতে লাগলো রাই। ফুপি এসে বললেন কীরে ও খাবেনা?
না। খেয়ে এসেছেন
ওহ, তো তুই খেয়ে নে
রাই এর হাত থেকে গেলো। মাথা নেড়ে বললো তুমি ঘুমাতে যাও। আমি খেয়ে নিব
সত্যিই তো?
হুম….
ফুপি মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলেন।

তবে রাই এর আর একা একা খেতে মন চাইলো না। আগে তো সবসময়ই বাবা মায়ের সাথে একসাথেই খেঁয়েছে। এখন কি আর একা গলার নিচে ভাত যাবে? খাবারগুলো ফ্রীজ এ তুলে, রাই চলে গেলো ঘরে।
আবির খাটে বসে ফোন চালাচ্ছে। রাই আজ কেনো যেনো শাড়ি পরে আর ঘুমাতে চাচ্ছেনা, গিয়ে আলমারি থেকে একটা থ্রিপিস বের করে নিল। আর চলে গেলো পাল্টাতে।

বাহিরে এসে দেখে আবির সেই আগের মতই ফোন চালাচ্ছে। তবে আজ আর রাই এর দিকে তাকালো না। রাই যদিও খুশি, যে ভালো হয়েছে ওর টর্চার সহ্য করা লাগবে না। কিন্তু কোথায় যেন একটা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। যাইহোক রাই গিয়ে চুল আঁচড়ে নিলো। কিন্তু এখনও আবির তাকায় নি। রাই গিয়ে লাইট অফ করে দিল। সাথে আবির ও ফোনটা রেখে হাই তুলে শুয়ে পড়লো।

আশ্চর্য…. এতো রাগ! রাই গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। কিন্তু আজ আর আবির ওকে কাছে টেনে নিল না। বরং মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিক ফিরে শুয়ে আছে।

রাই মনে মনে ভাবছে এর আগেও তো এভাবে বলেছি। কই তখন তো দূরে যায়নি। আজব মানুষ
কিন্তু আবির সত্যিই আজ আর রাই এর দিকে ঘুরল না। যাইহোক রাই ঘুমিয়ে গেলো। রাতে রাই এর ঘুম হালকা ভেঙেছিল। ওর মনে হচ্ছিল ওর হাতপা নাড়তে পারছেনা। তবে ঘুমের মধ্যে আর কি বুঝবে? সপ্ন ভেবে ও ঘুমিয়ে গেলো।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে আবির বারান্দায় ফোন কথা বলছে। রাই উঠে গিয়ে যতটুকু শুনলো তাতে মনেহলো অফিসের কাজের কথা বলছে। যাক রাই ফ্রেশ হয়ে চলে গেলো বাইরে।
নাস্তার টেবিলে সবাই খাবার খাচ্ছে। আজও আবির বেরিয়ে যেতে গিয়েছিল। কিন্তু রেজোয়ান সাহেব দিলেন না। ফলে সবাই একসাথেই আছে।

রেজোয়ান সাহেব একটু অ্যাটেনশন নিয়ে বলে উঠলেন আচ্ছা, এখন যেহেতু আবির আবারো কাজে লেগে গেছে তো আর কি? আমাদের একটা ডিল এর ডেট দেওয়া হয়েছে আগামী সপ্তাহের সোমবার। আজ এমনিতেই বুধবার। যেতেও হবে কক্সবাজারে। তো চলো বেটা আজই নাহয় বেরিয়ে পড়ি…..

কথা শুনেই আবির কেশে উঠলো। রেজোয়ান সাহেব ছেলেকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিল। রাই তো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। এদিকে সুমি আর ফুপি মুখ টিপে হাসছে। আবির বিস্ময় নিয়ে বললো আজই?

হ্যাঁ কেনো কোনো সমস্যা আছে নাকি? এমনিতেই তো তুমি এত স্পিডের সাথে কাজে নেমেই গেছো তো?
ফুপি বললেন হ্যাঁ ভাই একদম ঠিক। বউ রেখে কাজ। যাও এবার,

সুমি বললো ঠিক। যা গিয়ে নোনাজলে ডুব দিয়ে আয়। তাতে যদি বুদ্ধি খোলে
নিশান নিজের মতই খাচ্ছে।
রাই তো অবাক। উনি চলে যাবে! এটা কেমন কথা? মানে ঠিকাছে যাবে, কিন্তু এখনি! কিন্তু ওকে রাই যাচ্ছে যাক না মনে মনে বিড়বিড় করছে।

তো আজই যাই। কাল আবার জ্যাম হবে অনেক রাস্তায়। এয়ারপোর্ট পৌঁছতেই জান বের হয়ে যাবে। যাও খেয়েই রেডি হয়ে নাও
আবির আর রাই একে অন্যের দিকে তাকালো। আবির রাই এর চেহারা দেখে কি বুঝলো জানিনা, তবে ও নিজেও রাজি হয়ে গেলো ঠিকাছে। ফ্লাইট কখন?
এইতো ১ টায়

আবির মাথা নাড়লো। এদিকে রাই তো এখনও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। এটা কেমন কথা ভাই? হোয়াট?
আর রেজোয়ান সাহেব মনে মনে পৈশাচিক হাসি দিলেন চলো বাবা চলো। তোমার রাগ ছোটাচ্ছি। একেবারে সুদে আসলে তোমাকেও বুঝিয়ে দিব বউ কি জিনিস, আর আমার মেয়েকে ও ( রাই) বুঝিয়ে দিব স্বামী কি জিনিস।

ঘোড়ার ডিম দুটোই জেদী। এখনও দেখো তাকিয়েই আছে। অথচ বলছে না বাবা যাবনা। ধুর
আবির ঘরে সুটকেস এ কাপড় নিচ্ছে, আর রাই সোফায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রাই হেল্প করতে গিয়েছিল কিন্তু আবির তো আবির ই। দিলো না। এখন তো রাই শুধু তাকিয়েই আছে

এবাড়িতে এক আপনিই তো আছেন যে সবসময়ই আমার সাপোর্টে থাকেন। এখন আবার আপনি চলে গেলে আমি কি করবো? মানে ঠিকাছে পছন্দ করিনা। কিন্তু ওই নীলার চাইতে তো ভালই আছেন। ধুর, যান তো যান।

এক সপ্তাহের জন্য আপনার ক্যাচক্যাচ থেকে মুক্তি। আহ….’ একদিকে যেমন মন খারাপ এর কথা তেমনি আবার নিজেকে সান্তনা দেওয়ার কথাও বলছে রাই। তবে নিজের মনে।
কিন্তু এমন না আবির কিছু বুঝতে পারছেনা। আবির আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে যে রাই উসখুস করছে কিছু বলার জন্য কিন্তু বলতে পারছেনা। তাই আবির ও চুপ করে আছে।

রাই ও উঠে দাড়ালো। কিন্তু বলতে আর পারলো না।
আবির ব্যাগ রেখে একটা শার্ট বের করে নিলো, এদিকে রাই একটু একটু করে পায়চারি করছে। বলবে কি বলবে না? বলবে কি না?

আ আবির তাকালো না। রাই চুপ করে গেলো।
কিন্তু কতক্ষন? আবারো রাই আমতা আমতা করলো কতদিনের জন্য যাবেন এক্সাকটলি?
আবির শার্ট পরতে পরতে বললো বাবা জানে

রাই আবারো দমে গেলো।
আবির আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করছে। রাই আবারো বললো
তো…. আপনি যাচ্ছেন?

আবির কপাল কুঁচকে আয়নার মাধ্যমেই রাই এর দিকে তাকালো।
রাই থতমত খেয়ে গেল এমনি… বললাম রাই ঘুরে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে।

দুপুর ১ টা।
সবাই ড্রইং রুমে জড়ো হয়েছে। রেজোয়ান সাহেব দাড়িয়ে। আবির আসছে না। রাই ও দাড়িয়ে। শেষে আবির ব্যাগ নিয়ে এলো। সবাইকেই বিদায় জানাচ্ছে কথা বলছে, কিন্তু রাই এর দিকে একবারও তাকালো না আবির। রাই পাশেই ছিল। আবির বললো আচ্ছা চল দেরি হয়ে যাবে
রেজোয়ান সাহেব ও জানেন ছেলের কাজ। হ্যাঁ চল

বেচারি মেয়েটার দিকে একবার তাকালোনা পর্যন্ত। রাই এর মুখ ছোট্ট হয়ে গেলো। যতই হোক, লোক দেখানোর নামে হলেও তো একটা বাই বলা উচিত ছিল রাই কে। কিন্তু ও!!!
এতো রাগ!লাগবে না আপনার বাই। রাই মুখ ফুলিয়ে ঘরে চলে গেল।

ওদিকে গাড়িতে বসে আবির অনেক্ষন ধরে লুকিং মিরোর দিয়ে নিজের ঘরের বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইলো।
কিন্তু রাই আর বারান্দায় এলোনা।
গাড়িটাও চলতে শুরু করল।
এদিকে রাই গাড়ির স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ শুনলেও দাঁতে দাঁত চেপে ঘরেই বসে রইলো। হুহহ।


পর্ব ১৪

আবির গিয়েছে প্রায় এখন ৮ ঘণ্টা হতে চললো। এখনও একটা ফোন ও করেনি। রাই এর কাছে করেনি ঠিকাছে, কিন্তু আল্লাহর বান্দা অন্তত নিজের মায়ের কাছে তো একটা ফোন করতেই পারিস। এমনকি রেজোয়ান সাহেব নিজেও এখনও ফোন করেননি।
রাই এর মেজাজটা অনেকটাই খারাপ এই মুহূর্তে। সকাল থেকেই খারাপ। কিন্তু বাপ বেটার এমন কাজে সত্যিই রাগ বাড়ছে বলি কমছে না।

হ্যাঁ তোরা পৌঁছে গিয়েছিস? বাহির থেকে ভেসে এলো শাশুড়ি মায়ের গলা। রাই এর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। একলাফে দরজা পার করে বাহিরে উকি দিল। মা কথা বলছে ফোনে হ্যাঁ ঠিকাছে। তোরা তাহলে ভালোয় ভালোয় পৌঁছেই গেছিস, যাক। তাহলে দুইজনে ভালো করে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমাও। আচ্ছা রাখছি

যাক ভালো ভালোয় পৌঁছে গেছে রাই ঘরে ঢুকে গেলো। তখনি ওর ফোন বেজে উঠলো। রাই কেনো যেনো খুশি হয়ে দৌড়ে গেলো ফোন ধরতে।
হ্যালো…..
হ্যাঁ রাই মা।

বাবা…. মুখটা নেতিয়ে পড়লো
রেজোয়ান সাহেব মনে মনে হাসলেন আর আবিরকে শুনিয়ে জোরেই বললেন হ্যাঁ মা, ভালো ভাবেই পৌঁছে গেছি। চিন্তা করিস না। আচ্ছা

রাই মুচকি হাসলো ভালো হয়েছে। আপনারা কেউ ফোন দিলেন না তাই ভাবছিলাম……
রেজোয়ান আবারো আবির কে শুনিয়ে বললেন কি, কি বললে? আবিরের সাথে কথা বলবে.?
রাই অবাক ও কখন এটা বললো?

ওদিকে আবির মুখ তুলেই হাত বাড়িয়ে দিল ফোনটা নেওয়ার জন্য। তখনি রেজোয়ান সাহেব বলে উঠলেন ওহ, কি বললে? আবির তোমাকে ফোন করেনি তাই রেগে আছো? আচ্ছা
আবির এর মুখ শুকিয়ে গেলো। হাতটা গুটিয়ে নিলো ও।
আচ্ছা রাখি….

হ্যা হ্যালো…. রাই কে কিছু বলতেও দিলনা তার আগেই ফোন কেটে দিল রেজোয়ান সাহেব।
একদিকে আবির অন্যদিকে রাই। দুজনেই সমান আকারে হতাশ। দুজনেই ভাবলো একজন অন্যজনকে ফোন দিবে। কিন্তু ফোনটা আর হাতে নেওয়া হলো না।

করবো না ফোন। মা কে ফোন করতে পারে, বউ কে পারে বা। মুখ পোড়া হূহ বিড়বিড় করতে করতে রাই বিছানায় চলে গেলো।
আবির কিছুক্ষন ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু প্রেয়সি আর বার্তা পাঠালো না বা যোগাযোগ ও করলো না। কি আর করার? নিজেও শুয়ে পড়লো।

পাশ ফিরতেই রাই এর মনে পড়ে গেলো আবিরের কথা, থাকলে এখন জড়িয়ে ধরতো…. আর ছাড়তে বললেও ছাড়ত না….. ভেবে রাই আলতো হাতে বিছানায় হাত বুলায়।

ওদিকে আবির এর চোখের সামনে ভাসলো রাই এর হাতপা ছোড়াছুড়ি। যখনই কাছে টেনে নেবে তখনি দূরে যেতে চাইবে। আবির নিজের বুকের ওপরে একটা হাত রাখলো। নিজের হলদেটিয়া কে তো এখানেই রাখে প্রতি রাতে। জায়গাটা আজ শূন্য মনে হচ্ছে।
দুরত্ব যদি সত্যিই এতো শক্তিশালী হতো তাহলে এতদূরে থেকে দুটো মন একই কথা ভাবতে পারতো না। কখনোই না।

পরদিন রাই ঘরে কাজ করছিল ঠিক এমন সময় নিশান ওর ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল। রাই ভেবেছে হয়তো সুমি এসেছে। তাই ও দরজার দিকে আর তাকালো না।
সুমি, দেখেছো পানি এসেছে কিনা? এখনও তো রান্নাটা শেষ হয় নি।

তবে ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। রাই হাতের কাপড়গুলো আলমারিতে রেখে ঘুরে তাকালো সুমি….. কিন্তু সেখানে নিশান কে দেখে রাই ভরকে গেল। তুমি? !

নিশান আস্তে আস্তে রাই এর দিকে এগিয়ে এলো। রাই হাত উঠিয়ে ওকে থামিয়ে দিল দাড়াও….. এভাবে একজনের ঘরে ঢোকা বা দরজা লাগানো কোনোটাই কি তোমার কাছে সম্মান জনক নাকি? বের হও এখন থেকে

রাই! অতিবিস্ময়ের সাথে নিশান বললো তুমি এভাবে বলছো? !
তোমার কি কোনো সন্দেহ আছে তাতে?
রাই অন্তত আমাকে কিছু বলার সুযোগটা তো দাও

রাই পিছিয়ে গেলো এগোবে না। আর তোমার কথা শুনবো? সিরিয়াসলি? শুনতেই তো চেয়েছিলাম, সুযোগটা তো দিয়েই ছিলাম। কই সেদিন তো কিছুই বললে না। উল্টো এমনভাব করে দাড়িয়ে ছিল যেনো তুমি আমাকে চেনোই না।

নিশান এর কাছে এর জবাব নেই, এমনটা রাই এর ধারণা। কিন্তু নিশান প্রতিবাদী কণ্ঠ এগিয়ে এলো তুমি যেটা ভাবছো সেটা সম্পূর্ণ ভুল। সেদিন তোমার সামনে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল সবই আংশিক ছিলো। কিন্তু এর পুরোটা তোমার দেখা হয় নি।
ওহ প্লিজ। দেখো সেদিন কি হয়েছে না হয়েছে তাতে আমার এখন কিছুই আসে যায়না। সুতরাং সে প্রসঙ্গ বাদ।
রাই…..

রাই না ভাবি…. ভুলে যেও না সম্পর্কে আমি তোমার বড়ো এখন। অতীত ভুলে চলতে শুরু করো। তখন আর এত কষ্ট থাকবেনা বলে রাই চলে যেতে গেলো কিন্তু নিশান ওর হাতটা চেপে ধরলো

রাই তুমি সবটা না জেনে যেতে পারোনা।
নিশান ছাড়ো….
রাই…..
সজোরে ওর গালে চড় বসিয়ে দিল রাই। হাতটা থরথর করে কাপছে। চোখে একরাশ ঘৃণার প্রতিফলন, ঠোঁটে কঠোর বাণী

বাংলা বোঝো না? আমি এখন তোমার সম্পর্কে বড়ো। তাই নিজের মনমতো আমাকে ডাকবে না। তোমার স্পর্শ আমি ঘৃণা করি। ঠিক এই স্পর্শটাই আজ আমার জীবনের এমন একটা মোড়ে এনে ফেলেছে। দ্বিতীয়বার এই স্পর্শ নিয়ে কি নরকে ঠাই করাতে চাও?

নিশান এর চোখ লাল হয়ে এলো রাই এর দুবাহু চেপে ধরে খরখর গলায় বলল ঘৃণা! তাই না? কই বিয়ের আগ পর্যন্ত তো আমার স্পর্শে তোমার সমস্যা হতো না, এখন হটাৎ ঘৃণা কোথা থেকে এলো? সেদিন রাতেও তো…..
চুপ করো….. সেদিন রাতে কি হয়েছিল হ্যা কি হয়েছিল? লিট্রালি কিছুই হয় নি। আমার কাছে তুমি এসেছিলে আমি তোমাকে ডাকি নি। আর কিছু মিথ্যে আবেগী কথা বলেছিলে…… আর কি?

নিশান শয়তানি ভঙ্গিতে বলল হ্যাঁ কিছুই হয় নি। তো? তো কি? মানুষ তো জানেনা সেটা আমি ছিলাম। যদি জেনে যায়? তখন তো আর তোমার কথা বা আমার কথায় কেউ কান দেবে না। তারা নিজেরাই বাকি সব মনগড়া কাহিনী গড়ে নিবে….. ঠিক যেমন মিহির ভাইয়ার বাবা করেছিল। হুহ। মূর্খ মানুষ।

রাই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিশান কে ধাক্কা দিলো হ্যাঁ মূর্খ ছিলেন উনি। কিছু না জেনেই এতকিছু করেছেন। তবে উনি যেটা দেখেছিলেন সেটা সত্যিই ছিলো। কিন্তু তাতে আমার এখন আর কিছু আসে যায়না। মানুষের বিশ্বাস দিয়ে আমার আর কাজ নেই। যার বিশ্বাস করার সে যদি আমাকে বিশ্বাস করে এতদূর নিয়ে আসতে পারে, বাকি জীবনটা ও পারবে…

নিশান অগ্নিদৃষ্টি তে তাকালো, অহংকার! বাহ। তা ভাই তো দেখছি ভালই জাদু জানে। কিন্তু যদি ওর এই বিশ্বাসে ফাটল ধরে যায়?
রাই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সম্ভব তোমার মত তোমার ভাই ও যদি স্বার্থপর হয় তাহলে সবই সম্ভব। কিন্তু কি জানো তো? এখনও এমন লক্ষণ আমি তার মধ্যে পাইনি।

কতটা সহজে বলে দিলে এতটাও সহজ না। যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে গিয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করো সেদিন ও কেনো এসেছিল তোমাদের বাড়িতে। আর আমিই বা কেনো সেদিন জবাব দিতে পারিনি। ও নিজেই সব বলে দিবে। আর যদি না বলে ( রাই কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে) তাহলে বুঝে নিও তোমার অহংকার আর থাকলো না
বলে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো নিশান।

রাই মুখ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লো।চোখ দুটো বন্ধ করতেই গড়িয়ে পড়তে লাগলো লোনাপানি। সাথে সাথে ভেসে এলো মাগরিবের আযানের ধ্বনি।
আল্লাহু আকবার

আল্লাহু আকবার
ভুল করেছিলাম। এক মুহূর্তের আবেগের জন্য নিজের জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হচ্ছে। কিন্তু সেটা শুধুই একটা ভুল ছিল। আর কিছুনা। সবসময় কেনো মেয়ে বলে আমার দিকেই আঙ্গুল তোলা হবে? কেনো? আমি কতটুকু ভুল করেছি? .
কষ্টে গলা আটকে আসছে।

কই নিশান কে তো এতকিছু সহ্য করতে হলো না। তাহলে শুধু আমিই কেনো? হ্যাঁ, সুরাইয়াই ঠিক বলেছিলো। ঠিক ছিল ওর কথা। ঠিক। কাঁদতে কাঁদতে হাটুতে মুখ গুজে নিলো রাই।
তখনি রাই এর ফোনটা বেজে উঠলো। ধীরে ধীরে হাঁটু থেকে মুখ তুলে খাটের উপর থেকে ফোনটা হতে নিলো। চোখের পানিতে একাকার দৃষ্টি। কে ফোন করেছে দেখেও নি রাই।
হ্যা হ্যালো…..

বুকটা কেঁপে উঠলো আবিরেরর রাই…. কি হয়েছে? কাঁদছ কেনো?
রাই হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরলো না….. ( নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করে) কিছু হয় নি।
আবিরের চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো কি হয়েছে সেটা বলো? কেউ কিছু বলেছে?
উহু….. রাই কথাও বলতে পারছে না।

রাই… মিথ্যে বলবে না। কি লুকাচ্ছো? আবিরের বিষয়টা একদমই সুবিধের মনে হচ্ছেনা। রাই এখন কেনো কান্না করবে? হয় ওকে কেউ কিছু বলেছে নয়তো অন্য বিষয়।

কিছুনা ( ক্ষীণ কণ্ঠে) আপনি। আপনি ঠিক আছেন?
রাই….. আবিরের কথা শেষ হবে তার আগেই রেজোয়ান সাহেব ফোনটা নিয়ে নিলেন আরে মা। কি খবর তোমার? সব ঠিকঠাক? কি করছো?

রাই এর পক্ষে আর কথা বলা কোনোমতেই সম্ভব ছিলনা। ও ফোনটা কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
হ্যালো হ্যালো রাই…. কি হলো বলতো? রেজোয়ান সাহেব ফোনটা ছেলেকে দিলেন।

আবিরের মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ। নিশ্চই কিছু হয়েছে। নয়তো সারাদিন খবর না নেওয়ার পর এখন ফোন করায় রাই এর রেগে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ও তো।. কি হতে পারে?

রাতে রাই শুয়ে আছে বিছানায়। যদিও চোখে ঘুম নেই মন চাচ্ছে ছুটে মায়ের কোলে গিয়ে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাই। কিন্তু সেটাও সম্ভব না। সন্ধ্যার পরে আর আবিরকে ফোন দেইনি সে। তবে মনে চাচ্ছিলো ফোন দিয়ে কথা বলতে। কিন্তু আবির হয়তো কাজে ব্যস্ত।

এদিকে আবির মাত্রই কাজ শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। তবে মনে আসলো রাই কে একবার ফোন দিতে। দেবে কিনা সেটাই বিষয়। দেওয়া উচিত। জানতে তো হবে ওর কি হয়েছে? যেই ভাবা সেই কাজ। ফোনটা হাতে নিয়ে কল করবে ওমন সময় বাবার গলা

আবির…. এই আবির। দরজা খোল
আবির বেশ চটে গেলো।খাট থেকে নেমে লম্বা কদম ফেলে দরজা টার কাছে গিয়ে দাড়ালো। কিন্তু বাবা এখনও ডেকেই যাচ্ছে। দরজাটা খুলে সোজা বাবার ওপর হামলা

চেচামেচি করে কি হোটেলে লোক জড়ো করতে চাও নাকি? কি হয়েছে?
রেজোয়ান সাহেব ভ্যাবলা হেসে ঘরে ঢুকে গেলেন কি করছিলি?
আবির দরজা লাগিয়ে দিল শুয়ে ছিলাম

ওহ। পড়ে পড়ে ঘুমাতেই এসেছ মনে হচ্ছে?
আরে….
থাক আর বলতে হবেনা। নাও এই ফাইলগুলো চেক করো। আর বলো ঠিকাছে কিনা? বলে উনি বিছানায় বসে পড়লেন। আবির আর কথা বাড়ালো না। হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে চেক করতে লাগলো।

এদিকে রেজোয়ান সাহেব এর পাশেই আবিরের ফোনটা পড়ে ছিল। উনি ফোনটা জাস্ট আড়াল করে পকেটে ঢুকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বসে রইলেন। যেনো কিছুই হয় নি।
আবির ফাইল দেখতে দেখতে বললো বাসায় ফোন করেছিলে?
কেনো বলো তো?
বাবার এমন বোকা কথায় আবির হা করে তাকালো এর জন্য কারণ লাগবে তোমার?

রেজোয়ান সাহেব আমতা আমতা করে বললেন না, সেটা না। তবে। কারণ ছাড়া শুধু শুধু তোমার মায়ের বকবকানি শুনে কি করবো? তাই আর ফোন করিনি। তা তুই রাই কে ফোন করেছিলি?
নাহ আবির যেনো কথাটা এড়িয়েই যাচ্ছে। বাবা আবারো বললেন কেনো? করবি না? ফোন করে বল কি করছিস ও খেয়েছে কিনা
সময় হলে করবো। আর হ্যাঁ ফাইল ঠিকাছে আর তোমার……

আবিরেরকথা ফুরোবে তার অপেক্ষাও করলেননা রেজোয়ান সাহেব সোজা উঠে দাড়ালেন ঠিকাছে হ্যাঁ তাহলে ওকে বেটা গুড নাইট। ঘুমাও আর আমাকেও ঘুমাতে দাও….. বলতে বলতে আবিরের হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে রেজোয়ান সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
এদিকে বাবার এমন অদ্ভুত ব্যবহারে আবির বেশ অবাক।

রেজোয়ান সাহেব বেরিয়ে নিজের রুমে এসে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন বাছাধন। ফোন করবেনা বলছো? তাহলে তো আর ফোনের দরকার নেই। আমার কাছেই নাহয় থাক ফোনটা আজ রাত

আজ শুক্রবার।
বাড়িতে মোটামুটি সবাই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করছে। রাই শুধু শুনছে। সবাই প্ল্যান করলো ধানমন্ডি লেকে যাবে। একটু হাটাহাটি করে, সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্ট থেকে খেঁয়ে তারপর বাসায় আসবে। যথারীতি সবাই বলাবলি করছে। ফুপি জিজ্ঞেস করলো
রাই যাও তাহলে রেডি হও।

সুমি বললো ভাবি কি পরবে আজ?
আমি, আসলে আমি ভাবছিলাম
হ্যা বলো ফুপি এগিয়ে এলেন
রাই মাথা নিচু করে নিলো ফুপি। আসলে অনেকদিন বাবা মা কে দেখা হয়না। তাই যদি একটু ঘুরে আসতাম বাসা থেকে

ওমা, সেটা আবার বলতে হবে নাকি। যাবে তো। এমনিও তো যেতেই হবে। কিন্তু যেহেতু আবির নেই তাই একা আর যেতে হবেনা। আবির আসলে দুজন একসাথে ঘুরে এসো কেমন?
রাই খুশি হয়ে মাথা নাড়লো।
তো এখন যাও রেডি হয়ে নাও,

ফুপি আমার যেতে মন চাইছে না
থাক না ফুপি যেতে চাচ্ছে না তো জোর কেনো করছো? বললো নীলা।

চুপ কর ( নীলাকে থামিয়ে) কেনো যাবেনা? সবাই যাচ্ছে তুমিও যাবে। যাও তৈরি হয়ে নাও ফুপি বললেন
মানুষের কত ভীমরতি আবিরের মা বললেন।
রাই আর কথা বাড়ালো না ওকে

এদিকে রেজোয়ান সাহেব ছেলের ঘরে ঢুকে চমকে গেলেন একি অবস্থা তোর!
উস্কোখুস্কো চুল, চোখ লাল হয়ে গেছে যেনো কতরাত ঘুমোয়নি, চিন্তিত মুখ, পুরো ঘর ওলোট পালোট, ছেলের এই অবস্থায় রেজোয়ান সাহেব তো অবাক। আবির মুখ চোখ ঘুচিয়ে রেখেছে।
‘ কি হয়েছে আবির?

আবির শুষ্ক গলায় বলল কিছুনা। গতরাত থেকেই আমার ফোনটা খুঁজে পাচ্ছিনা। সারারাত খুঁজেও আমি কত্থাও পেলাম না। উফফ। মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে
জনাব রেজোয়ান বুঝলেন তারই কারসাজির ফল খোজ। দ্যাখ দ্যাখ কোথাও হবে।

কোত্থাও নেই। সব জায়গায় খুঁজেছি। নেই। নেই তো নেই বলে রেগে বিছানার একটা বালিশ ফ্লোরে ছুড়ে ফেললো আবির। রেজোয়ান সাহেব এখন ভাবছেন কিভাবে ফোনটা রাখবে। ছেলে তো পর্দার একটু কোণ ও বাদ রাখেনি।
রেজোয়ান সাহেব পুরো ঘর জুড়ে হাঁটছেন, আর চিন্তা করছেন ফোনটা কোথায় রাখা যাবে?
আবির
আবির বাবার দিকে তাকালো।

তুই খাটের তশক উঠিয়ে দেখেছিস?
আবির অবাক। মাথা নাড়লো।
আরে তো ঐটাই দেখ। ওঠ ওঠ রেজোয়ান সাহেব হাফ ছাড়লেন।

ছেলেকে উঠিয়ে এমন ভঙ্গি করলেন যেনো উনি সত্যি সত্যিই খুঁজছেন। অবশেষে তশকের তলা থেকে ফোনটা বের করে রীতিমত বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠলেন পেয়েছি এইতো পেয়েছি।
আবির হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলো থ্যাংক গড
খুঁজলেই পেয়ে যেতে. হাহাহাহা

কিন্তু বাবার আগমনে ফোনের এমন উদয়, আবিরের তো খটকা লাগছে। সন্দিহান চোখে বাবার দিকে তাকালো।
রেজোয়ান সাহেব একটু বোকা বোকা হাসি দিলেন বুঝলো নাকি! ভেবে উনি তাড়াহুড়ো করে উঠলেন চল চল, মিটিং আছে চল। কি তুই একটা ফোন নিয়ে এতকিছু ধুর বলতে বলতে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আবির বাবার যাওয়ার পানে একবার, আর ফোনের দিকে একবার তাকাল।

সারাদিন ভালোই ঘোরাঘুরি করেছে সবাই। তবে রাই নিশানের থেকে একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব রেখেই চলেছে।
শেষে সবাই একটা রেস্টুরেন্টে এলো।

খাবার খাওয়ার সময় নীলা চালাকি করে সবার ছবি তোলার ছলে নিশান আর রাই এর ছবি তুলে নিলো। যদিও তারা আলাদাই বসেছে কিন্তু নীলার অ্যাঙ্গেল থেকে তাকালে দুজনকে পাশাপাশিই মনে হয়। সেই সুযোগে নীলার এমন শয়তানি বুদ্ধি।

পরদিন আবিরের কাছে খবরটা প্রথমে এলো যে ওরা যে ডিলের জন্য এখানে এসেছিল সেই ডিলাররা ডিল ক্যানসেল করে নিয়েছে। আবির গেলো তার বাবার রুমে বাবা….
রেজোয়ান সাহেব সিরিয়াস একটা মুখ করে বললেন আবির, কাজের চাপ দেখে মনে হচ্ছে এ সপ্তাহে আর ফেরা হচ্ছেনা।
কিন্তু ডিল তো ক্যানসেল হয়ে গেছে

হ্যা তো।( আনমনেই বলছিলেন তখনি মাথায় এলো ) কিহ্হ ডি ডিল ক্যানসেল মানে কি? কে কে বললো?
হ্যাঁ মাত্রই তাদের কাছ থেকে খবর এসেছে…..( আবির সন্দিহান চোখে তাকিয়ে) তো এখন তো ডিল ক্যানসেল। তাহলে ফেরা যাক বাড়িতে?
ফিরবো! ( হতাশ কণ্ঠে)

আবির সত্যি এবার খুবই অবাক। বাবার এমন ভঙ্গিমা যেনো ওর সন্দেহই বাড়াচ্ছে আর কিছুনা।
কেনো? এখানে সেটেল হওয়ার প্ল্যান আছে নাকি?

রেজোয়ান সাহেব অসহায় গলায় বললেন সে সখ আর পূরণ হলো। তোমার মায়ের কৃপায় সেটা আর সম্ভব না
আবির বাকা চোখে তাকালো আমি টিকিট বুক করছি। রেডি হও বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
রেজোয়ান সাহেবের মাথায় হাত কোথায় ভাবলাম একটু সবক শেখাবো তা তো হলোই না উল্টো ডিল টাও ক্যানসেল……


পর্ব ১৫

বিমানবন্দরে দাড়িয়ে চেকিং করাচ্ছে আবির আর রেজোয়ান সাহেব। সন্ধ্যা প্রায়। এদিকে রেজোয়ান সাহেবের মুখ বেশ ভার। কেনো? তা বোঝা আবিরের পক্ষে শক্ত।

কি? মাকে খুব বেশিই মিস করছো নাকি? আবির উপহাস করে বললো।
ছেলের কথায় রেজোয়ান সাহেব রেগে গেলেন তা কিভাবে বুঝলে বাবা?

আবির টিকিট নিয়ে বাবার দিকে ঘর ঘুরালো তোমার চেহারার উন্নতি দেখে হেঁটে চলে গেলো।
বুঝবান ছেলে আমার ফুঁসতে ফুঁসতে গেলো রেজোয়ান সাহেব।
প্লেন ছেড়ে দেবে এখনি। রেজোয়ান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন বাড়িতে খবর দিতেই ভুলে গেছি। তুই বলেছিস?
আবির মাথা নাড়লো আর ঠাট্টা করে বললো কি দরকার? তোমাকে দেখে নাহয় মা একটু মিনি শক খেলো…. ইটস গুড

রেজোয়ান সাহেব বাকা চোখে তাকালেন নিজের মাছ ঢাকতে আমার শাক ব্যবহার করছো? করো করো বিড়বিড় করলেন
এই বয়সেই যদি বিড়বিড় করো তো ভবিষ্যৎ তো পড়েই আছে ফোনের দিকে তাকিয়ে।
রেজোয়ান সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন বোঝে কিভাবে এইটাই আজ পর্যন্ত ধরতে পারলাম না মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলেন।

এদিকে রাই আনমনেই বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে ও বেখেয়ালি ভাবে নিজের সাথেই কথা বলে যাচ্ছে
উনি এমনভাবে পরিবর্তন হচ্ছেন! সত্যিই অদ্ভুত। আগে তো প্রায় সারাদিনই আমার আশপাশেই থাকতেন। কিছু হোক না হোক, এখন! একটা ফোন ও করেন না।

তখনি পেছন থেকে কেউ আচমকাই রাই কে জড়িয়ে ধরে কাঁধে একটা গভীর চুমু দিল সবসময় আমিই কেনো এগোবো? নিজেও তো ফোন করতেই পারো। অন্যের ওপর এতো নির্ভরশীল কেনো থাকো?
রাই চমকে উঠে ঘুরে তাকালো কেহ।

আবিরকে দেখে যেনো রাই এর বিশ্বাসই হলো না। রাই একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো আবিরের দিকে।
আবির কি একটা ভাবলো। ভেবে রাই এর থেকে একপা সরে গেলো

ওহ, সরি তোমাকে টাচ করা যাবেনা বলে আবির ঘুরে যেতে নেবে রাই পেছন থেকে আবিরের হাত টেনে ওর বুকের সাথে লেপ্টে গেলো।
আবির বাকা হেসে রাই কে নিজের থেকে সরিয়ে নিলো। রাই এতই খুশি যে কিছু বলতেও পারলনা।
তুমি তো ডিসটেন্স পছন্দ করো…..

রাই এর চেহারা মলিন হয়ে এলো আপনি, তো আরো এক সপ্তাহ পরে আসবেন বলেছিলেন
আবির বারান্দা থেকে ঘরে এলোহ্যা, পরে ভাবলাম অনেকদিন যাবত কারো কড়া গলা শুনি না। একটু শুনে আসি।
রাই মনে মনে হাসলো। আর ওর কাপড় বের করে খাটে রাখলো ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি খাবার দেই
নাহ। পেট ভরা। বেজায় খাটতে হবে না

রাই এর ভালো লাগলো না কথাটা আপনার একার জন্য তো আর রাজভোগ বানাতে হবেনা তাই সমস্যা নেই। ফ্রেশ হয়ে নিন বলে রাই বেরিয়ে গেলো। বাহিরে এসে তো রাই এর খুশি দেখে কে। লোকটি ফিরে এসেছে। এর থেকে খুশির কি হতে পারে।

বাবাকে গিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো তারপর দুজনের জন্য খাবার গরম করতে চলে গেলো রাই। বাকিরা অনেক আগেই খেঁয়ে নিয়েছে। তখনি রান্নাঘরে ঢুকলো নিশান।
এখানে কী করছো? রেগে গেলো রাই।

তোমার কথামত চলতে হবে এমনটা তো না নিশান জবাব দিলো।
না হবেনা। কিন্তু আমার থেকে দুরুত্ব বজীয়ে চলবে বলে রাই ঘুরে খাবারে মনোযোগ দিলো।

নিশান প্যান্টের পকেটে দুহাত দিয়ে রাই এর কানের কাছে মুখ এনে বললো তো ভালই হলো। যাও এখন ভাই কেইজিজ্ঞেশ করে দেখো সেদিন কি হয়েছিলো….
রাই এর বুক ধক করে উঠল। নিশান ওখান থেকে হেলেদুলে চলে গেলো।

বাবার খাবার তার ঘরে দিয়ে এসে, রাই আবিরের খাবারটা ঘরে নিয়ে গেল। আবির সোফায় বসে ছিল। রাই গিয়ে সোফার সামনের ছোট্ট টেবিলে খাবার এর প্লেট রেখে দিল। আর তখনই আবির রাই এর বা হাত ধরে ওকে টেনে নিজের পায়ের ওপর বসিয়ে দিল আর সন্দিহান চোখে তাকালো সেদিন কাঁদছিলে কেনো?
রাই কোনকথা বললো না। উল্টো মাথা নিচু করে নিলো।

কেউ কিছু বলেছে?
রাই মাথা নাড়লো। দরকার কি শুধু শুধু এই কথা বলে আবারো অশান্তি করার। আবির শেষবারের মতো বললো তাহলে কিছু লাগবে?

রাই পুনরায় মাথা নেড়ে না করলো। আবির বেশ ভালই বুঝতে পারছে যে রাই কিছু লুকাচ্ছে। কিন্তু বেশি জোরাজুরি আবার আবিরের পছন্দ না।
খাইয়ে দাও

রাই অবাক চোখে তাকালো। আবির প্লেট টা সামনে এনে বললো খাইয়ে দাও…
আশ্চর্যজনক ভাবে আবির লক্ষ্য করছে রাই এখন আর আগের মতো ওর ওপর রাগছে ও না। আবার দূরেও ঠেলে দিচ্ছে না। আবারো প্লেট এগিয়ে দিল, রাই নিয়েও নিলো। আবির ভাবছে এটা কি সত্যি স্বপ্ন!
এক লোকমা ভাত নিয়ে আবিরের মুখের সামনে ধরলো রাই।

আবির নিজের চিন্তায় মশগুল ছিলো বিধায় দেখেই নি। রাই বলে উঠলো কিহলো? নেন
চিন্তার জগৎ ছেড়ে আবির খাবার খেয়ে নিল। রাই ও নিজের মতো করে খাইয়ে দিচ্ছে। হটাৎ খাবার মুখে নিতে গিয়ে আবির আলতো ভাবে রাই এর হাত কামড়ে ধরলো। তবে আলতো ভাবে। রাই দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। কিন্তু কিছু বললো না। শুধু মনে মনে হেসে উঠলো।

একই কান্ড এখন যতবারই খাবার দিচ্ছে রাই ততবারই তার আঙ্গুল একটু একটু করে কামড়ে ধরছে। এদিকে রাই খাওয়ানো ছেড়ে দিলে নির্ঘাত এই ছেলে নিজে খাবে না, আবার উদ্ভট পাগলামি ও করছে। তবে এতে রাই এর বিশেষ সমস্যা হচ্ছেনা।
খাবার আমার হাতে। আমার হাত নয়। রাই এর এই কথায় আবির এবারে একটু জোরেই কামড়ে ধরলো আহ্…… আরে এমন কেনো করছেন

আবির ভাব নিয়ে বললো আমি তো খাবারই খাচ্ছি। মাঝে তুমি তোমার হাত নিয়ে এলে কামড় তো খাবেই।
রাই হেসে ওঠে তাই? এককাজ করি চামচ নিয়ে আসি….. বলে রাই উঠতে গেলে আবির উঠতে দিলো না প্লেটের দিকে দেখেছেন?

রাই কপাল কুঁচকে প্লেটের দিকে তাকালো। আর এক লোকমার মতো খাবার আছে। এর জন্য আলাদা ভাবে চামচ? ধুর রাই খাইয়ে দিল। কিন্তু এইবারে আবির সত্যিই খুব জোরেই কামড়েছে। রাই হাতটা ছড়িয়ে নিলো রাক্ষস
আবির ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে তাকালো পানি?

রাই চোখ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো পানিও আমাকে খাইয়ে দিতে হবে
আবির কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো। রাই একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে গ্লাসটা হাতে নিলো। শেষে কিনা বাচ্চাদের মত খাইয়ে দিতে হচ্ছে! বাবা দেখলে নির্ঘাত আবিরের কান ঝালাপালা করে দিতেন।

রাই হাত ধুয়ে হাত মোছার জন্য উঠতে যাবে আবির ওকে টেনে নিয়ে গলায় মুখ গুজল। আবির…
এই প্রথম আবিরের সামনে ওর নামে ডাকলো রাই, আবির গলায় গভীর এক চুমু দিয়ে ওকে আঁকড়ে ধরলো। কিন্তু আশ্চর্য এইবারে ও রাই বিদ্রোহ করলো না। যে কারণে আবির ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রাই হাত উঠিয়ে আবিরের কাঁধে রাখবে তখনি দরজায় ডাক পড়লো ভাইয়া

দুজনে চমকে উঠলো। আবির রাই কে ছেড়ে সরে গেলো। দুজনেরই হৃদস্পন্দন এত্ত দ্রুতবেগে ছুটছে বলার মত নয়। আবির নিজের চুলগুলো ঠিক করে নিল, আর উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।

সামনে নিশান দাড়িয়ে। নিশান হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে আবিরকে জড়িয়ে ধরলো ভাইয়া কতদিন পরে আসলি এর আমার সাথে দেখা ও করলি না। বলে রাই এর দিকে তাকালো।
রাই এর মুহূর্তেই বিরক্ত লেগে গেলো। রাই সোফা থেকে উঠে দাড়ালো আর প্লেট আর গ্লাস নিয়ে ওদের পাস করে বেরিয়ে গেলো।

আবির বিষয়টা লক্ষ্য করলো। আর নিশানের সাথে কথা বলে নিলো। যদিও নিশান তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই বলতে আসেনি। তবে শুধুই আবির আর রাই কে দুর করার একটা কাজ ছিল।
এদিকে রাই অপেক্ষা করছে ঠিক কখন নিশান ঘর থেকে বের হবে। তখন সে ঘরে যাবে। নিশানের বলা কথা মাথায় আসলো রাই এর আবিরকে জিজ্ঞেস করো সেদিন কি ঘটেছিল

রাই দৃঢ় কণ্ঠে বলল করবো না। জিজ্ঞেস করবো না। তোমার মত ঠকবাজের কথা আর কি জিজ্ঞেস করবো?
কিছুক্ষন পর নিশান ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই রাই ঘরে ঢুকলো। রাই এর মনে সন্দেহ যদি নিশান উল্টো পাল্টা কিছু বলে গিয়ে থাকে।

কিন্তু তেমন কিছুই না। আবির স্বাভাবিক ভাবেই। খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ল খুবই ক্লান্ত। ঘুমাবো
রাই মাথা নাড়লো হুম লাইট নিভিয়ে আবিরের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল রাই।

কিন্তু রাই এর ঘুম আর এলো না। কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করতে করতে শেষে গিয়ে উঠেই বসলো। এদিকে জনাব আবির কে দেখে মনে হচ্ছে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। রাই কিছুক্ষন ওকা উকি করে দেখার চেষ্টা করলো সত্যিই কি সে ঘুমিয়ে গিয়েছে কিনা।

কিন্তু আচমকাই রাই এর হাতে হ্যাঁচকা টান পড়লো। গিয়ে সোজা আবিরের উপরে। আবির ওকে ঘুরিয়ে নিজের ডানে নিয়ে এলো আর মুখটা চেপে ধরে উচু করে ফিসফিস করলো কিছু লাগবে?
রাই মাথা নাড়লো।

তাহলে উকি দিচ্ছিলে কেনো?
রাই ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো
আমি তো তাই দেখলাম

রাই চুপ। আবির ওকে জড়িয়ে নিলো
সবসময় আমিই কেনো ইয়া আল্লাহ…… আমার ওপরেই কেনো এতো অত্যাচার
আবিরের কথায় রাই ঠোঁট চিপে হাসলো। যাক ঘুমটা এবারে নিশ্চিন্তেই ভালোই হবে। রাই ওর বুকে মাথা রেখে শান্তির নিশ্বাস ফেললো।

পরদিন আর আবির অফিসে গেলো না। রেজোয়ান সাহেব যেতে দিলেন না। তবে খাবার টেবিলে যা কান্ড হলো সেটা আর বলার মত না।
সবাই খাবার খাচ্ছে। রাই আর ফুপি খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। তখনি সুমি একটু গলা খাকারি দিয়ে বললো
মামা, এগুলো কি তুমি ঠিক করছো?

উপস্থিত সকলে সুমির দিকে তাকালো। রেজোয়ান সাহেব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি করলাম?
সুমি বললো এইযে, তুমি যে আবির ভাই কে শুধুই কাজে যেতে দিচ্ছ এখনও তো ওদের বিয়ের একটা মাস ও হলো না। কেনো শুধু শুধু মধুর মধ্যে ঘি ঢেলে দিচ্ছে বলো তো? কথাটা এমনভাবে বললো যেনো ভারী অন্যায় হয়ে যাচ্ছে।
রেজোয়ান সাহেব ছেলের দিকে বাঁকা চোখে তাকালেন আমি কি আর মধুর মধ্যে ঘি দিচ্ছি? ছেলে আমার, নিরামিষ। আমি কি করবো?

এইসব কথা উপস্থিত রাই আবিরের বিপক্ষে অর্থাৎ শাশুড়ি, চাচী, নীলা, নিশান এদের কারোরই ভালো লাগছে না। দাদী অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। সুমি, রেজোয়ান সাহেব, ফুপি, সুমির বাবা সকলে আবার একই দলে। আবির তেমন প্রতিক্রিয়া করছে না। রাই ও তাই।

ফুপি বললেন এদিকে এতদিন হয়ে গেল এত ঝামেলা যাচ্ছে যে রাই যে একটু বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে সেটাও হচ্ছে না। ভাই…..

রেজোয়ান সাহেব বলে উঠলেন বুঝেছি। আর বলা লাগবে না। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আর যেতে হবেনা কোথাও আবির পরশুই রাই কে নিয়ে চলে যাস।

আবির মাথা নাড়লো। এদিকে রাই আবিরকে খাবার দিচ্ছে তখনি সুমি বললো হ্যাঁ হ্যাঁ যাও আর তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, এরপর তো আরেকটা ট্রিপ বাকি। আফটার অল এতো কাজ বাকি
নীলা চেচিয়ে উঠলো আরেকটা ট্রিপ মানে?

ফুপি বললেন আরে আস্তে আস্তে। এতো হাইপার কেনো হচ্ছো নীলা?
রেজোয়ান সাহেব তো আমার কান গেলো রে। গলা তো না পুরো তবলা

চাচী ক্ষেপে গেলেন রেজোয়ান ভাই। তুমি কিন্তু বেশিই বলছো এবার
সুমি সবাইকে থামিয়ে দিল। রাই তো অবাক। কোন কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। সুমি বললো আরে ওদের ট্রিপ নিয়ে তোমরা কেনো ঝগড়া করছো?

আবিরের মা গম্ভীর গলায় বললেন আর কিসের ট্রিপ?
হানিমুন…. বললো সুমি।
সাথে সাথে নীলা চাচী, আবিরের মা, নিশান সবার মুখ হা হয়ে গেল আর একটুর জন্য সকলের মুখের ভাত নিচে পড়ে নি। রেজোয়ান সাহেব নরম সুরে বললেন মধুচন্দ্রিমা

এদিকে রাই আর আবির তো থ। এরা কি সত্যিই পাগল হলো নাকি? হানিমুন ওদের আর প্ল্যানিং চলছে পাবলিকলি! রাই পুরোই লজ্জা পেয়ে গেল।
আবিরের মা স্বামীর হতে চিমটি কেটে বললেন তুমি কোথায় ভেসে যাচ্ছো হ্যা?
রেজোয়ান সাহেব হেসে বউ এর দিকে মুখ নিয়ে ফিসফিস করলেন আমাদের সময়ে
মহিলা খাড়ার উপর শকড।

এদিকে নীলার তো হা ক্রমশ বড়ই হচ্ছে। ওর সামনেই ওর আবির কিনা রাই এর সাথে ছি ছি…
নিশানের মুখ চোখ শক্ত হয়ে এলো।

আবির একটু কেশে উঠলো। সবাই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায়। রেজোয়ান সাহেব বললেন তাহলে আর কি? পরশুই চলে যাবি শ্বশুরবাড়ি।
সুমি চোখ টিপ দিয়ে বললো এরপর…..
রাই এর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। বেচারি।

এদিকে সারাদিন রাই লক্ষ্য করলো নীলা আবিরের পিছু পিছু ঘুরছে। কেনো কে জানে,? দেখে তো মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়। কিন্তু আবির ওকে এমনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে যে অন্য কেউ হলে তার খুব ইগোতে লাগতো। কিন্তু নীলা তো নীলা।
ও পণ করে রেখেছে আজ ও আবিরের সাথে কথা বলেই ছাড়বে।

আবির ও নাছোড়বান্দা। একটু পরপরই ও রাই কে কোনো না কোনো বাহানায় কাছে ডাকছে। কখনো পানি দিতে বলছে কখনো খাবার কখনো এমনিতেই।
নীলা এতে বেশ রেগে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই আবিরকে হাতের নাগালে পাচ্ছে না।

দুদিন পর আবির রাই কে নিয়ে ওর বাবার বাড়িতে রওনা দিলো। অবশ্য এই দুদিন নীলা, বা রাই কেউই আবিরকে তেমন একটা কাছে পায়নি। নীলা তো পায়ই নি আর রাই এর আর কি বলবো। আবির এই দুদিন অফিসের কাজের জন্যই সকালে বেরিয়ে রাতে দেরিতে ফিরত।
আজ যাচ্ছে ওরা। সবাইকে বিদায় জানিয়ে দুজনে গাড়িতে চড়ে বসলো। অবশ্য নীলা সর্বস্ব চেষ্টা করেছে দুজনকে না যেতে দেওয়ার কিন্তু সে গুড়ে বালি।

অবশেষে রাই এর বাড়িতে ওরা পৌঁছে গেলো। রাই খুশিতে ছুটে গেলো তাদের ফ্ল্যাটের দিকে।
বেল বাজাতেই রাই এর মা দরজা খুললেন। মেয়ে সোজা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো আম্মু।
মায়ের চোখেও জল কেমন আছিস মা?

তামিম এসে রাই কে জড়িয়ে ধরলো। রাই এর বাবা ও এলেন।
আবির কুশল বিনিময় করে নিলো।
দুজনেই অতঃপর বাড়িতে ঢুকে সোফায় বসলো।


পর্ব ১৬

মা, তোমরা তো আমাকে ভুলেই গিয়েছো। একটা ফোন ও করো না বলে রাই মুখ ফুলিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে গেলো কিন্তু ওর বাবা ওকে এড়িয়ে গেলো। মেয়েকে কোথায় বুকে টেনে নিবেন, সেখানে উনি মেয়ের সাথে তেমন একটা কথাই বলছেন না।

রাই এর চোখে মুহূর্তেই পানি আসার উপক্রম। বাড়িয়ে দেওয়া দুহাত গুটিয়ে নিয়ে রাই মাথানিচু করে নিজের ঘরে চলে গেল। ব্যাপারটা আবিরের মস্তিষ্কে আঘাত করলো।

তবে কি ওর কর্মের ফল এখন রাই কে এভাবে দিতে হবে! ওর বাবা ও ওর সাথে কথা বলতে চাচ্ছেনা?
আবির অনুতাপে মাথা ঝুঁকিয়ে নিল। রাই এর মা ওর বাবাকে কিছু একটা ইশারা করলো, কিন্তু উনি সেদিকে তাকালেন না, আমি বাহির থেকে আসছি। তুমি রান্না সেরে নাও

বলে উনি বেরিয়ে গেলেন। তামিম এর খুবই খারাপ লাগলো। ও দৌড়ে বোনের রুমের দিকে গেলো।
আবির আর রাই এর মা সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
আপু….

রাই ভাবনায় বিভোর ছিলো, হটাৎ ওর ডাকে ঘুরে তাকালো।
আপু তুই চলে এলি কেনো! চল বাহিরে চল।
উহু। মমম যা তুই

ঠিকই আছেন। বাবা তার জায়গায় ঠিকই আছে। আমি থাকলে আমিও এটাই করতাম।
তামিম মন খারাপ করে দাড়িয়ে রইলো। রাই এর চোখে পানি নেই। বরং ওর চোখ যেনো এখন মরুভূমি তে পরিণত হয়েছে। আর কত? একটা মানুষ ঠিক কতটা আর কাঁদতে পারে? এরপর চোখের জল ও যে লুকিয়ে পড়ে।

যা বাহিরে যা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি বলে রাই বাথরুমে ঢুকে গেলো।
তামিম বোনের শুকনো মুখটা দেখেও যে কিছুই করতে পারলো না।
ঠিক তার পেছনেই আবির দাড়িয়ে সবটা দেখছিল।

নীলা রাগে পুরো ঘরজুড়ে পায়চারি করছে। ওর কোনোকিছুই ভালো লাগছে না। স্বাভাবিক। শুধু ভেবেই যাচ্ছে যে কিভাবে রাই আর আবির কে আলাদা করবে। কিন্তু যত ভাবছে ততই যেনো মাথা ধরে আসছে। সম্ভব না এতো ভাবা।
তোমাদের যদি আমি আলাদা না করেছি, আমিও নীলা না

রাই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। চোখের সামনে এখন তার নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত ছেড়ে যাওয়া ঘরটা।

যেতে তো একদিন হতই। তবে ঠিক এভাবে নিশ্চই যেতে চাইনি। বলে ঘরটায় ঘুরতে লাগলো রাই। সখের ড্রেসিং টেবিল, দেওয়ালে ঝুলানো কাগজের ফুল, প্রজাপতি। কত শখ করে নিজের ঘরটাকে নিজে সাজিয়েছিল। সবই আজ ওর থেকে শতগুণ দূরে।
অকর্মার ঢেঁকি
রাই এর ধ্যান ভাঙলো। চেয়ে দেখে আবির ঘরে ঢুকলো মানে!

আবির এক ভ্রু উঁচু করে বললো ওদিকে তোমার মা একা কাজ করে চলেছে, আর তুমি এখানে ঘর দেখতে ব্যস্ত?
রাই ভুলেই গিয়েছিল ঠিক তো…. মা বলে রাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
মা, কি করছো?
কি করবো আর? দেখছিস না? তুই এখানে কেনো আসলি?

রাই এগিয়ে মাকে সাহায্য করতে লাগলো তোমার করা লাগবে না ছাড়ো।আমি করছি
মেয়ের কথায় উনি বেশ অবাক তুই করবি মানে? তুই কি রাঁধতে জানিস নাকি
রাই মুচকি হেসে উঠলো শিখে গিয়েছি…… করতে করতে শেখা হয়ে যায়

ওর মা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মা রে, তুই খুশি আছিস তো ও বাড়িতে?
রাই এর চোখ ভিজে এলো। মা কে জড়িয়ে নিলো সে হ্যা মা। অনেক ভালো আছি। জানো সবচেয়ে ভালো বিষয় কি?

ওর মা তাকালো।রাই বললো তোমার জামাই যে সবসময় আমার পাশে থাকে। কখনো অন্যদের মত আমার দিকে আঙুল তোলে না। বা (অন্যমনস্ক হয়ে) মুখ ও ঘুরিয়ে নেয়না

উনি বুঝতে পারলেন মেয়ের অভিমান হয়েছে বাবার ওপর আচ্ছা বাদ দে যা তুই বস আমি খাবার নিয়ে আসছি
রাই জেদ করলেও ওর মা ওকে কোনো কাজই করতে দিলনা। দুপুরের দিকে রাই এর বাবা ফিরে এলেন। সাথে কত রকমের বাজার আর মিষ্টি। কোনোটারই কমতি নেই। তবে এবারে আর রাই এগিয়ে গেলো না। জানেই যে তার বাবা আর তাকে পছন্দ করেননা।

আবির তামিমের সাথে গল্প করছে।
এদিকে রাই এর বাবা ওর মায়ের কাছে গিয়ে একটা বক্স ধরিয়ে দিল নাও
এটা কি?
উনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন আইস্ক্রিম বলে উনি চলে গেলেন।

ওর মায়ের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মেয়ের জন্য আইস্ক্রিম আনতে ভোলেন নি তবে। উনি গিয়ে রাই কে ডেকে বক্স টা ধরিয়ে দিলেন। রাই বক্সের ভেতরে আইস্ক্রিম দেখে খুশিতে একাকার। এখনও মনে পড়ে সেদিনের কথা, যখন বাবা বাজার থেকে ফিরলে বা বাহির থেকে ফিরলেই মেয়ের একটাই আবদার থাকতো আইস্ক্রিম কই? আর উনি এক বক্স করে আইস্ক্রিম এনে মেয়েকে খুশি করিয়ে দিতেন। তার বাবা সত্যিই বদলায় নি। শুধু একটু আঘাত পেয়েছেন।

রাই বক্সটা ফ্রিজে রেখে বাবার ঘরে চলে গেল। আবির আর তাদের ডিস্টার্ব করলো না।
কিছুক্ষন পর বাবা মেয়ে হাসিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
তোমার কি রান্না হয়েছে নাকি হোটেলে চলে যাবো?
মা, কি করছো এতক্ষণ যাবৎ?

আগেও তারা এভাবেই রাই এর মায়ের মাথা নস্ট করে দিত। আজ সেই একই দৃশ্য দেখে তামিম আর ওর মা সত্যিই ভীষণ খুশি। এখন তো দেখা যাচ্ছে আবিরের থেকে রাই আর ওর বাবার খোশগল্প চলছে। পুরো বাড়িসুদ্ধ কেপে উঠছে দুজনের হাসির শব্দে। আবির নিঃশব্দে তাকিয়ে দেখছে এই দৃশ্য।

রাতে সবার সাথে আড্ডা দিয়ে তারপরে আবির আর রাই ঘুমোতে গেলো। কিন্তু অর্ধেক রাতে আবিরের ফোনটা বেজে উঠলো। ঘুম ঘুম চোখে দুজনে বিরক্ত হয়ে তাকালো কে ফোন করছে দেখেন না
আবির উল্টো রাই কে জড়িয়ে নিয়ে বললো তোমার ফোন বাজছে।

আরে ধুর। ঘুমাচ্ছেন নাকি বেহুঁশ আপনি? ফোন আপনার বাজছে। আমাকে বলছেন কেনো?
আবির সত্যিই ভীষণ বিরক্ত। এই মাঝরাতে কে তাকে এবারে ডিস্টার্ব করছে। আবির অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা হাতে নিলো
হ্যালো…..
ওপাশে নিশ্চুপ।

আবির আবারো হ্যালো হ্যালো করলো কিন্তু লাভ নেই।ওপাশে শুধুই টুংটাং কিসের যেনো একটা শব্দ হচ্ছে। কিন্তু কেউ কথা বলছে না। আবির ফোনটা কেটে রেখে দিল। কিন্তু শুতে যাবে ঠিক তখনই আবারো ফোনটা বেজে উঠলো। রাই ঘুরে আবিরের দিকে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো ফোনটা ধরছেন না কেনো!
হুম….(কল রিসিভ করে) হ্যালো কে?

আবারো একই নিরবতা। কেউ কি ঠাট্টা করছে নাকি আবির জানেনা। ফোনটা কেটে দিয়ে এবারে সাইলেন্ট করে দিল। আর সোজা প্রেয়সীকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু রাই আবারো জিজ্ঞেস করলো কে ছিলো?

আবির একটুও কথা বলার মুডে নেই। সোজা একটা মুখ বন্ধ করা উত্তর দিয়ে দিলো তোমার ছোট্ট একটা সতীন। যাও গিয়ে গল্প করে আসো
রাই ফিক করে হেসে উঠলো আপনাকে সহ্য করার মত দ্বিতীয় কেউ ও আছে এই দুনিয়ায়! বাহ। সত্যিই তার সাথে কথা বলা লাগে

আবির চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো খুব শখ সতীন পালার?
তবে আরকি? দুজনে মিলে ফন্দি করে আপনার ব্যাংক ব্যালেন্স শূন্য করে দিবো। ভালো হবেনা?
আবির মুচকি হেসে চোখ বুঝে নিল আগে বলবে না, তুমি তোমার মেকআপ এর কথা বলছো

রাই বাকা চোখে আবিরের হাতে একটা চিমটি কাটে চুপ করেন
ছিলাম তো। থাকতে তো দাওনা..
এভাবেই খুনসুটি করতে করতে দুজনে ঘুমিয়ে গেলো।

এভাবেই ৩ দিন কেটে যায় রাই দের বাড়িতে। ৩ দিন পরেই আবির আর রাই বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায়। বিকেলে বাড়ি যেতেই রাই কে ঘিরে ধরে ফুপি আর সুমি। আর সে যে কি গল্প জুড়ে দিল দুজনে।

রাই খুবই ফুরফুরে মেজাজে আছে এখন। এই তিনদিন ওর খুব ভালো কেটেছে। আবির যাইহোক খুব খুশি এতে।
আবির ঘরে মাত্রই প্রবেশ করলো ওমনি ওর ফোন একটা কল এলো।
ফোনটা বের করে দেখে সেদিন রাতে যে নম্বরে কল এসেছিল, ঠিক সেই নম্বরটা। কিন্তু একই কান্ড ফোন ধরলে কেউ কথা বলেনা। আবির বেশ বিরক্ত এই ফোন কলের জন্য।

কিন্তু একটু চিন্তাও হতে লাগলো, কেননা গত ৩ দিন যাবত এই কলটা ওকে অনেক ডিস্টার্ব করছে। কে ফোন করছে এটাও জানা যাচ্ছেনা।
আবির কিছুটা ভেবে একজনকে ফোন করলো
হ্যালো…

ওপাশ থেকে হাসিমুখে উত্তর এলো কি খবর ভাই আপনার? অনেক দিন পরে যে মনে করলেন?
আবির মাথা নেড়ে বললো হ্যাঁ, আচ্ছা শোন একটা কাজ আছে
হুকুম করেনছেলেটা চেয়ারে বসা থেকে দাড়িয়ে পড়লো।

একটা নম্বর পাঠাচ্ছি, খবর বের কর
আবিরের কোথায় গাম্ভীর্যতা দেখে ছেলেটা সিরিয়াস হয়ে গেলো জ্বী ভাই। আপনি পাঠিয়ে দেন
আবির ফোনটা রেখে দিল।

পরদিন যেকোনো এক কাজেই আবির একটু বেরিয়েছিল। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরবে ঠিক তখনই ওর মাথায় এলো ছেলেটাকে (গতকাল যাকে নম্বর দিলো) একটা ফোন করে আসতে বলবে। দেখা যাক কি খবর পেয়েছে।

যেই ভাবা সেই কাজ। আবির আজ গাড়ি নিয়ে বেরোয় নি। বাইক এ ছিলো। বাইকটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে নেমে দাড়ালো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফোন দিচ্ছে, কিন্তু ছেলেটা ফোন তুলছে না। আবির আবারো ট্রাই করলো। ফাঁকা রাস্তা প্রায় বেখেয়ালি ভাবেই আবির দাড়িয়ে ছিলো। হটাৎ গাড়ির টায়ারের একটা ঘোসঘস শব্দ কানে এলো।

এতক্ষণ পরে আবিরের হুশ এলো আর ও ফোন হাতেই পেছনে ফিরবে তখনি কোত্থেকে একটা কালো রঙের গাড়ি এসে সজোরে আবিরের বাইকে ধাক্কা দিলো।
ভাগ্যক্রমে আবির বেঁচে গেলো কারণ আবির বাইকের মাথার দিকে দাড়িয়ে ছিল।

আর গাড়িটা কোনোভাবে বাইকের পেছনে ধাক্কা দিলো ফলে আবির সরে যেতেই বাইকটা সজোরে রাস্তায় ছিটকে পড়ল। এদিকে আবির অবাক হয়ে গেলো। আর ওদিকে গাড়ির দিকে দৌড়ে যেতে লাগলো। কেননা আবির ভাবছে হয়তো গাড়িটা কোনোভাবে ব্রেকফেল করে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ভেতরে ড্রাইভার এর কিছু হইনি তো?

এই ভাবনা থেকেই আবির দৌড় দিল গাড়ির দিকে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে গাড়িটা উল্টো এবার উচ্চশব্দে আবিরের দিকেই এগোতে লাগলো।
আচমকাই এমন ঘটনায় আবির কি করবে ভেবে না পেয়ে নিজে বাঁচার জন্যই পায়ের গতি কমিয়ে ঘুরে ফুটপাতের উপরে একলাফে উঠে গেলো। গাড়িটা ফুল স্পিডে থাকায় সজোরে ধাক্কা খেল ফুটপাতের ঢালাই এর সাথে।

ফুটপাতের ধালাইটা প্রায় দুহাত সমান উঁচু ছিলো। যেকারনে গাড়িটা উল্টো নিজেই আছড়ে পড়ে। গাড়িটার সামনে প্রায় দুমরে মুচড়ে গেছে। দেখে মনে হয়না চলবে। আবির সন্দিহান চোখে আবারো গাড়ির দিকে দৌড় দিল, কিন্তু এবারে ভেতরে থাকা ব্যক্তিটি গাড়ি স্টার্ট করে সোজা একটানে আবিরকে ক্রস করে চলে গেলো।
ওই…… আবির হাফাতে হাফাতে রাস্তায় দাড়িয়ে পড়লো। আশেপাশের লোক জড়ো হওয়া শুরু হয়েছে মাত্রই।
আরে ভাই আপনি ঠিক আছেন?

ভাই কিছু হইছে আপনার?
লোকেরা কি উরাধুরা গাড়ি চালায় আজকাল
মনে তো হইতাছিল মার্ডার কইরা দিব

নেশাখোর ছিলো মনেহয়
মানুষের এসব বিভিন্ন কথার মাঝে রাস্তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা মানুষটা ছিলো আবির। আর ওর মাথায় শুধু একটাই প্রশ্ন আসছিল
কে ছিলো এটা?

বাইকের এমন মুমূর্ষু অবস্থা নিয়ে বাড়ি ফিরতে আবিরের বেশ ঝামেলা পোহাতে হলো। অবশেষে ঠেলে ঠুলে কোনমতে বাইক নিয়ে বাড়ি পৌঁছেই গেলো সে। ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ঢুকতেই প্রায় রাত ৮ টা বাজে।

রাই সহ সবাই ড্রইং রুমেই ছিলো। ওকে দেখেই সুমি বললো কীরে ভাই কই ছিলি এতক্ষণ? সকালে বলেছিলি বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসবি। এখানে রাত হয়ে গেছে তো।
আবির আর মুখে এক অদ্ভুত চিন্তার ছাপ। সে কথা বাড়ালো না রাই, ঘরে আসো বলে হেঁটে সোজা নিজের ঘরে চলে গেল।

দাদী রাই কে বললো দেখো তো আমার দাদুভাই কে এমন কেনো দেখাচ্ছে?
রাই মাথা নেড়ে সোফা ছেড়ে উঠে ঘরের দিকে গেলো।
ঘরে গিয়ে দেখে আবির বাথরুমে।
২ মিনিট পর একটা সাদা টিশার্ট এর কালো ট্রাউজার পরে বের হলো সে। রাই এগিয়ে গেলো আপনাকে এমন কেনো দেখাচ্ছে?

আবির হেঁটে খাটে গিয়ে বসলো। তখনি রাই এর চোখ গেলো আবিরের বা হাতের তালুর দিকে। কেমন লাল দেখলো।
হাতে কি হয়েছে আপনার? বলে রাই হাতটা তুলে ধরলো আরে কেটে গেছে কিভাবে!রাই উত্তেজিত হয়ে পরল বলছেন না কেনো কি হয়েছে হাত কিভাবে কেটেছে?
আবির রাই কে আগে শান্ত করলো কিছু হয় নি তুমি শান্ত হও।

কি কিছু হয় নি? হাত কেটে গেছে বলছেন কিছু হইনি। ওয়েইট আমি। মাকে ডেকে আনি বলে রাই যেতে গেলে আবির ওকে পেছন থেকে টেনে ধরে বললাম তো কিছু হইনি। কেনো তাদের টেনশন দিতে যাচ্ছো?
কিন্তু…. রাই দৌড়ে গিয়ে আলমারি থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে এলো। হাত দিন হাতটা টেনে নিয়ে তুলোয় স্যাভলন মিশিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে লাগলো।
আপনি কি বলবেন কি হয়েছে?

আবির কিছুক্ষন চিন্তা করলো। তারপর কিছুটা সত্যিই কিছুটা মিথ্যে মিলে বানিয়ে রাই কে শুধু এটাই বললো যে ওর বাইক অ্যাকসিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গেছে। তবে পুরো ঘটনাটা বললো না। কেননা রাই এর মাধ্যমে অন্যরা জেনে গেলে বেজায় হাঙ্গামা হতে পারে। আর আবিরের মা চাচী তো আছেনই। শুধু শুধু তিল কে তাল করে দিবেন।
দেখো এটা শুধুই একটা ছোট্ট।
ছোট্ট!’ রাই রেগে গেলো

কি হতো যদি সত্যি মারাত্মক কিছু হয়ে যেতো তবে? তখন কি করতেন?
হয় তো নি আবির হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকালো।
আরে, কিন্তু….
চুপ আর কথা না। এটা নিয়ে আর ভাবতে হবেনা।
কিন্তু….

হলদেটিয়া…… আবিরের মাতাল কণ্ঠে রাই একটু কেপে উঠলো আর তাড়াহুড়ো করে বললো আচ্ছা আপনি বসেন, আমি খাবার গরম করছি বলে উঠে চলে গেলো।
রাই রান্নাঘরে এসে ভাবতে লাগলো আবির আর তার বিয়ের ঠিক আগের রাতের কথা
অতীতে সেই রাতে__

রাই কোনোভাবেই বিয়েতে রাজি না।বারবারই মা বাবা দুজনকেই বোঝাচ্ছে, কিন্তু ওনারা সত্যিই নিরুপায় ছিলো। বাড়িতে মিহিরের বাবা ঘটনাটা এমনভাবে রটাচ্ছিলেন এদিকে গ্রামবাসীরা ও প্রায় জেনেই গিয়েছিল। এখন মানুষের বলাবলি। কি আর করার। সবাই বিয়েতে রাজি। এদিকে নিশান ও কাওকে কিছুই বলছে না।

রাই অবশ্য নিশান কে অনেকভাবে বলার চেষ্টা করেছে সবাইকে সত্যিটা বলে দিতে। বা এই বিয়ে আটকাতে। কিন্তু নিশানের সাথে সরাসরি ও কথা বলতেই পারেনি। সবসময়ই রাই কে কেউ না কেউ নজরে রাখতো। কিন্তু রাই এটাও বুঝে গিয়েছিল যে নিশান এর যদি সত্যিই কিছু করার ইচ্ছে থাকতো ও সেদিনই কিছু একটা করতো। কিন্তু সে তা করেনি।
রাত প্রায় ৮ টা বাজতে যাবে, রাই নিজের ফোনটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। তখন অবশ্য এক কাজিন ছিলো তার পাশে।

রাই এর ফোনে তখনি একটা মেসেজ এলো কীরে দোস্ত কেমন আছিস?
রাই মেসেঞ্জার ওপেন করে দেখে পুরনো এক বান্ধবীর মেসেজ। রাই একটু খুশি হলো এইতো ভালো কেমন আছিস তুই?
ভালো…. মেয়েটার নাম নাফিসা।

নাফিসার সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে রাই জানতে পারলো নাফিসা আজ রাত ৯ টার বাস করে ঢাকা ফিরছে। মূলত নাফিসার গ্রামের বাড়ি রাই দের গ্রামের বাড়ি থেকে ২ ঘণ্টার দূরত্বে। আর রাই দের গ্রামের বাড়ি পার করেই মূল সড়কে উঠতে হয় দেন ঐখান থেকে ঢাকায় আসে বাস।
নাফিসা জিজ্ঞেস করলো তো কোথায় আছিস তুই? ‘

এইতো গ্রামে…. রাই জবাব দিল।
ওপাশ থেকে মেসেজ এলো ইশ দোস্ত আগে বলতি তাহলে তোদের বাড়িতে চলে আসতাম। এখন তো সম্ভব ও না
হুম তখনি রাই এর মাথায় কি যেনো একটা বুদ্ধি খেলতে লাগলো। ফট করেই মেসেজ করলো আচ্ছা দোস্ত তুই ঢাকা ফিরছিস তো?

টুং করে শব্দ হলো হ্যাঁ
গ্রেট, (রাই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো ) দোস্ত এই নিড এ হেল্প
হ্যাঁ বল না

রাই দ্রুত মেসেজ করলো দোস্ত শোন তোদের বাস ঠিক আমাদের এই গ্রামের রাস্তা দিয়েই যাবে তাইনা?
কিছুক্ষন পর মেসেজ এলো হ্যাঁ
মাথাচর(রাস্তার নাম) এর রাস্তা দিয়েই তো যাবে?
হ্যাঁ…. কিন্তু কেনো….

রাই এর দুচোখে যেনো আশার আলো ভেসে উঠলো দোস্ত তাহলে শোন। তুই গাড়িতে উঠবি ঠিক ৯ টায়। আর তোর এইখানে আসতে সময় লাগবে ২ ঘণ্টা মানে ১১ টা।
হ্যাঁ, কিন্তু রাই বলবি তো কি হেল্প?

বেশ এক মিনিট সময় নিয়ে একটা লম্বা চওড়া মেসেজ করলো রাই শোন। তুই যখন। মাথাচর এর রাস্তায় আসবি তখন নিশ্চই এই গ্রামের কেউ না কেউ নামবে। (কারণ ওই রাস্তার পাশেই ফাঁকা একটু জায়গায় বাস থেমে যাত্রী ওঠা নামা করে। ) তো যখন যাত্রীরা নামবে তখন তুই কোনো একভাবে বাসের কন্ডাক্টর কে বলবি একটু ওয়েইট করতে।
নাফিসার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব কিন্তু কেনো?
কারণ আমি যাবো তোর সাথে

কিঃ!!!!! নাফিসা অবাক।
হ্যাঁ বেশি কথা বলিস না। আমি যা বলছি শোন। বাকিটা বাসে উঠে তোকে বুঝিয়ে বলবো। তো বাস পৌঁছলে আমাকে যদি ঐ রাস্তায় না দেখিস তো কন্ডাকটর কে একটু থামতে বলিস, চিন্তা নেই তোদের বাস আসার আগেই আমি ঐখানে উপস্থিত থাকবো। আর আমাকে নিয়েই যাবি তুই। বেশি না ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেই হবে। বাকিটা আমি জানি

নাফিসা বুঝতে পারছে না কি বলছে রাই। তবে ও শুধু ওকে বললো আচ্ছা। তুই রেডি থাকিস। আর ১১ টার আগেই ওখানে পৌঁছে যাস।
ওকে বেবি লাভ ইউ বলে কথার ইতি টানলো রাই। এই সুযোগ কোনোভাবেই হাত ছাড়া করা যাবেনা। যেকোরেই হোক ওকে এই বিপদ থেকে বেরোতে হলে এই সুযোগটা কাজে লাগাতেই হবে।

রাত ৯ টার মধ্যেই সবাই খাওয়া দাওয়া করে নিলো। গ্রাম বলে কথা। তার উপরে আগামীকাল বিয়ে। আবিরের পরিবারের কেউই এটা জানেনা। শুধু আবির, নিশান, রেজোয়ান সাহেব ই উপস্থিত। তারা তিনজন আপাতত রাই দের বাড়ি অর্থাৎ সুরাইয়ার বাড়িতেই রয়েছেন। মিহিরের বাড়ি যাননি। মিহির সকালেই নিজের বাড়ি গেছে। আগামীকাল সুরাইয়া কে নিয়ে আসবে বলে।

যাইহোক খাবার টেবিলে সবাই লক্ষ্য করলো যে রাই আধা ঘন্টা আগেও রেগে ছিলো, ওর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। কিন্তু তাতে কারো মাথা ব্যাথা নেই।
সন্দেহটা একজনেরই হচ্ছে। বলা লাগবে নাকি তার নাম?
আবির।

আবির খাবার খাচ্ছে আর রাই কে দেখছে। কেননা রাই খাওয়ার মাঝেই কেমন মুচকি হাসছে। কেনো!না হাসিতে সমস্যা নেই। কিন্তু যে আজ সকালেও কান্না করছিল বিয়ে করবে না, বেলা ঘুরতেই এমন কি হলো? রাই অন্যদিনের থেকে দ্রুত খাবার খেয়ে উঠে পড়লো। সকলেই দেখলো, তবে কি অতটা গুরুত্ব দিলনা।

রাই এর উঠে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবির।
রাত প্রায় ১০ টা। সবাইই ঘুমিয়ে গিয়েছে বলা চলে। পুরো বাড়িতে পিনপতন নিরবতা। ওর পাশে একটা কাজিন ঘুমিয়ে আছে। তবে ওর ঘুম পাতলা না। ফলে বলা চলে কোয়ালার ন্যায় ঘুমোচ্ছে।

যাইহোক রাই আস্তে করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। আর চাদরের নিচে দুটো বালিশ ঢুকিয়ে দিয়ে নেমে ধীরে ধীরে আলনার উপর থেকে নিজের সাইড ব্যাগটা হাতে নিলো।
ওর কাছে কিছু টাকা আর নিজের বাসার এক্সট্রা চাবি আছে। এটাই সম্বল। আগে এখন থেকে বেরোতে হবে, ঢাকা পৌঁছে নিজের বাড়ি যাবে। তারপরের টা পরের বিষয়।

রাই ব্যাগটা নিয়ে আর জুতোজোড়া হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো রুমের বাহিরে।
এবার পুরো বাড়ি পার করে রাস্তায় বেরোতে হবে। কাজটা শক্ত। কারণ বাড়িতে মূল দরজা খুললে অনেক জোরে আওয়াজ হওয়ার সম্ভাবনা। যেহেতু নিরবতা চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। তাই ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজার কাছে গেলো রাই।

বুকটা রীতিমত ফেটেই যাবে এতই হৃদস্পন্দনের বেগ। ধীরে ধীরে ছিটকানি খুলতে লাগলো রাই। আশেপাশে অন্ধকার বাদে আর কিছুই নেই।
বেশ যুদ্ধ করে অবশেষে ছিটকিনি খুলে গেলো।

আস্তে করে আধা হাত সমান দরজা ফাঁকা করে রাই বেরিয়ে পড়লো। উঠান ও ফাঁকা। কেউ নেই। চাঁদের আলোয় সব স্পষ্ট।
জুতো হাতেই রাই সোজা এক দৌড় দিল বাহিরে কাচা রাস্তার দিকে। রাস্তায় পৌঁছে গেলে আর ভয় নেই। বাকিটা ও আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবে বাসের থামার কাছে কাছে।

আল্লাহর রহমতে বাড়ির উঠোন পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় ও এসে পড়লো রাই। এবার আর তাকে পায় কে? জুতো জোড়া পা বাবাজিকে দান করে ছুটে এক দৌড় লাগালো।
আশপাশ ঝিঝিপোকা জোনাকি পোকা দিয়ে ভরপুর। গাছপালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলও রাস্তা ভরে যাচ্ছে, তার উপর দিয়ে রাই শুধুই দৌড়াচ্ছে।

অবশেষে এখন ৫ মিনিটের পথ বাকি। ঘড়িতে ১০:৪০। হাফিয়ে উঠলো রাই। এখন একটু আরাম করে করেই হাঁটবে। গ্রামের রাস্তা। কেউই নেই। রাত ১০:৪০।অনেক রাত।
রাই আস্তে আস্তে হাটতে লাগলো। আজ যেনো তার মনে কোনো ভয় নেই। শুধু আছে একটা সুপ্ত আশার আলো। যার সামনে এই রাত বিরাতে বের হওয়ার ভয়টাও হার মানছে। আজ জেকরেই হোক রাই কে ঢাকা যেতেই হবে।

হাটতে হাটতে অবশেষে সে ঠিক ওই রাস্তায় এসে পৌঁছল। এখনও ১৫ মিনিট বাকি। নাফিসা কে একটা ফোন করলো
কতদূর তোরা?
এইতো আর ২০ মিনিটের মধ্যেই এসে যাবো। ভাঙ্গা রস্তা বুঝিস তো

হ্যাঁ আমি এসে গিয়েছি। চিন্তা করিস না বলে রাই ফোন রেখে দিল।
এখন শুধু অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু কিন্তু কিন্তু। এতই কি সোজা? এই নিস্তব্ধ রাতে দুপাশের ধান ক্ষেত, গাছপালা, পোকার ডাক তার মাঝে একা রাই।
মানুষ সাহসী হয় ঠিকই। কিন্তু কতক্ষন? ঠিক তাই। এবার রাই এর মনে ও ভয় একটু একটু করে উকি দিতে লাগলো।
তাই বিভিন্ন ক্যাটাগরির ভয়।

ভুত, জ্বীন, নিশির ডাক, হুতুম পেঁচা, বিশেষ করে কোনো খারাপ লোকের পাল্লায় পড়ার ভয়। রাই মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়তে লাগলো। কেননা সত্যিই একা মেয়ে এইভাবে এইখানে! একটা মারাত্মক বিষয়।
যেকারনে রাই ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে

আর একটু পর পরই গগন কাপিয়ে ডেকে উঠছে পেঁচার দল। রাই ভয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠলো।
কিন্তু হায়, ওর চিৎকার শোনার মত এক নির্জীব উপাদান গুলো ছাড়া কেউই নেই।
এখনও বাস এসে পৌঁছয়নি। রাই মনে প্রাণে চুম্বকের মতো বাস কে টেনে নিজের দিকে আসতে বলছে কিন্তু তা নিতান্তই অবাস্তব।

তখনি রাই অনুভব করলো তার পেছনে শুকনো পাতার মড়মড় শব্দে চমকে উঠলো রাই। পেছনে ঘুরবে ঠিক তখনই বাসের হর্ণ কানে এলো। পুলকিত নয়নে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলো বাস এসে পড়েছে। বাস টা থেমে ও গেলো নিজের যথাস্থানে।

রাই খুশি হয়ে যেই পা বাড়াতে গেলো ওমনি কেউ ওর মুখ টিপে ধরলো পেছন থেকে আর ওকে চেপে ধরে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।

উম্ম উম্ম রাই পা ছুঁড়ছে। কিন্তু লাভ নেই।
ওদিকে নাফিসা বারবার জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে। কিন্তু রাই নেই। আসছে ও না। প্রায় যাত্রী নেমে গিয়েছে। বাস ছাড়বে ছাড়বে। এদিকে বলতে ও পারছে না। একটা ভয় মনে। অবশেষে বাস হর্ণ বাজিয়ে আবারো নিজ গন্তব্যের দিকে ধেয়ে চললো। নাফিসা ফোন বের করে কল দিচ্ছে। রাই এর ফোন বেজেই যাচ্ছে কিন্তু ফোনটা তুলতে পারছে না।

অবশেষে রাই এর চোখের সামনে দিয়েই ওর শেষ আলোর আশাটুকু ও চলে গেলো।
কিন্তু এইবারে তো রাই এর মন মস্তিষ্ক জুড়ে ছেয়ে গেলো একরাশ আতঙ্ক। এমন আতঙ্ক যা বলার মত না।
সত্যিই কি কোনো অসৎ মানুষের হাতে পড়ে গেলো রাই!

কিছুক্ষন ওভাবেই রাই কে টেনে পেছনে নিয়ে একটা বড়ো কাঠাল গাছ পড়ে রাস্তায় সেই গাছের সাথে ধাক্কা দিলো অজ্ঞাত লোকটি।
রাই চেঁচিয়ে উঠলো আহ্…. কে… কে আপনি?

কিন্তু ওর মুখটা আবারো চেপে ধরে কেউ ওর অনেক কাছে এসে পড়লো। উন, উহু। রাই চেষ্টা করছে ব্যক্তিটিকে নিজের থেকে সরিয়ে নিতে কিন্তু পারছেনা।
লোকটি প্রায় রাই এর গলায় মুখ গুজতে যাবে, কিন্তু রাই কোনো উপায়ও করতে পারছেনা। তার শক্তির সাথে এভাবে পারা সম্ভব না।

ভয় আর আতঙ্কে রাই এর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
ঠিক তখনই হাতটা আলগা হয়ে গেল। লোকটা ওকে ঠেলে সরিয়ে দুপা পিছিয়ে দাড়ালো।

রাই লম্বা লম্বা শ্বাস টানছে। ওর যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে। ভাঙ্গা গলায় বললো কে?
কিন্তু জবাব নেই। বেশ খানিকক্ষণ পরে রাই স্বাভাবিক হলো। মাথার ঘাম মুছে সে লোকটির দিকে এবার স্পষ্ট ভাবে তাকালো, আর চাঁদের আলোয় যতটুকু বোঝা গেলো, সে আবির।

রাই এর পায়ের তলার মাটি সরে গেল। এই কনকনে ঠাণ্ডা পরিবেশেও গলাটা শুকিয়ে কাঠ। আ, আ আপনি
আবির ওর কাছে এসে হাত চেপে ধরলো আর শক্ত গলায় বললো এখন…… যদি। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকতো…. তবে কি তুমি খুশি হতে?
রাই ভয়ে কেঁপে উঠলো। ঠোঁটদুটো অনবরত কাপছে। কি বলবে সে জানেনা।

আবির চিৎকার দিয়ে উঠলো জবাব দাও ড্যাম ইট…. বলে ওর মাথার কাছ ঘেঁষে গাছের উপরে একটা ঘুসি মারলো।
রাই এর প্রাণ যায়যায় অবস্থা। বাকশূণ্য হয়ে গেছে ও। আবিরের চেহারা যতটুকু বোঝা যাচ্ছে শুধু রাগ, আগুনের মতো টগবগ করছে।
রাই চুপ করেই রইলো।

কি প্রমাণ করতে চাচ্ছো তুমি হ্যাঁ কি? যে আমি তোমার ওপর কোনো অমানবিক অত্যাচার করছি? নাকি তুমি (আবারো গাছে একটা ঘুসি মেরে) কোনো জেল পলাতক আসামী? নাকি আমি কোনো সিরিয়াল কিলার?
আ, আ মি……
চুপ বলে আবির দূরে সরে গেলো।

রাই খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো আপনি, আপনি যে….. যে আমাকে জোর করে বিয়ে করছেন এটা কি….. এটা কি ঠিক? একটা ঢোক গিলে নিলো।
আবির ক্ষিপ্র হয়ে রাই কে পেছন থেকে টেনে নিজের মুখোমুখি দাড় করালো সেটা যদি তুমি বুঝতে তাহলে এভাবে পালাতে না ইউ…
হাত মুঠি করে আবির নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো।

রাই আর কিচ্ছু বললো না। ওর হাতপা কাপছে। আবির নিজেকে শান্ত করার জন্য পিছিয়ে গিয়ে একহাতে মাথা চেপে ধরে নিচের ঠোঁট কামড়ে দাড়িয়ে রইলো।
চারপাশের প্রকৃতি আবারো নিস্তব্ধ।
রাই ও চুপ করেই দাড়িয়ে। এরই মাঝে পেছন থেকে আরো এক দুটো ভ্যান যাওয়ার শব্দ ও এলো কানে। কিন্তু তাতে আর কি?

বেশ খানিকক্ষণ পরে আবির নিজেকে একটু শান্ত করলো আর ফিরে এসে রাই এর বা হাত ধরলো। রাই ওর দিকে তাকালো। আবির সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। অর্থাৎ বাড়ির দিকে।

দুপা যেতেই রাই একটু থেমে গেলো। কিন্তু আবির নিজের মুখের কঠোর ভাব নিয়ে রাই এর দিকে তাকাতেই রাই ভয় পেয়ে গেল। আর কিছু না বলে আবিরের সাথেই হাটতে লাগলো।
আবির চুপচাপ ওর হাত ধরেই হাঁটছে। হাটতে হাটতে একসময় দেখলো সামনে থেকে দু তিনজন ছেলেরা আড্ডা দিতে দিতে আসছিল।

তখনি ছেলেগুলো মোবাইলের ফ্ল্যাশ দিলো রাই এর দিকে। এমনিতেই রাই ভীত ছিলো আর ওই ছেলেদের দেখে ওর মনে অজানা আতঙ্ক গ্রাস করলো। ছেলেগুলো যত কাছে আসছে রাই ততই আবিরের দিকে সরে যাচ্ছে।
এক পর্যায়ে রাই ভয়ে নিজেই আবিরের হাত জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু ততক্ষণে ছেলেরা চলে গেছে।

যখন ভয় করা উচিত ছিল তখন কোথায় ছিলে?
রাই হাতটা ছেড়ে দিল। তবে আবির বা হাত ধরেই আছে। কি ভেবে যে আবির বললো কে জানে আবির হঠাৎই শান্ত গলায় বলে উঠলো
আমিও কিন্তু ছেলে। প্লাস আমরা অবিবাহিত

রাই এর পা বরফ না পুরো পাথরের মত জমে গেলো। আবির দাড়িয়ে পড়লো। রাই এর কপাল বেয়ে যেনো ঘাম ঝরছে। আবির বুঝতে পারলো।
তবে এখন মুড নেই বলে রাই এর হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। রাই না পারতেই হাঁটছে।

সারাপথে আর তেমন কথা হয় নি। তবে এক পর্যায়ে আবির রাই এর দিকে একটু গভীরভাবে তাকিয়েছিল।
হলুদ রঙের উজ্জ্বল এক কুর্তি পরে ছিল রাই। চাঁদের আলোয় এতো সুন্দর উজ্জ্বল লাগছিলো যেনো ওর পাশে থেকে নূর ছড়াচ্ছে। আবির শীতল কণ্ঠে বললো হলদেটিয়া
রাই চমকে তাকালো।

আর কিছু না।
হেঁটে হেঁটে প্রায় ৪৫ মিনিট পরে বাড়ি পৌঁছলো দুজনে। সদর দরজা তখনও খোলা। কেউ জেগে নেই এটাই অনেক। আবির রাই কে দরজার সামনে দাড় করিয়ে বললো নিশ্চই এই কাজ দ্বিতীয় বার হচ্ছেনা? (রাই চুপ) ঘুমোতে যাও।
রাই মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢুকতে গেলো তখনি পেছন থেকে আবিরের ডাক হলদে টিয়া

রাই থমকে দাড়ালো। পেছনে ঘুরে দেখে আবির গভিরদৃষ্টে তাকিয়ে। একটানে রাই কে বুকে মিশিয়ে নিলো। আর কপালে একটা চুমু একে দিল।
বর্তমানে_____

এই ছিলো সূচনা। হলদে টিয়া ডাকার। আবিরের মুখে এই ডাকটা প্রতিবারই এক অদ্ভুত ভালোলাগার তৈরি করে রাই এর মাঝে। মুচকি হেসে দিল রাই।
ওদিকে আবিরের ফোন টুং করে একটা মেসেজ এলো। ফোনটা হাতে নিয়ে আবির বিস্মিত….


পর্ব ১৭

রাতে অবশ্য রাই লক্ষ্য করেছে আবির কি যেনো একটা ভাবছে।
যেনো কত যুগের চিন্তা সব একসাথে মাথায় এসে চেপেছে।
আপনি এত কি চিন্তা করছেন?
হু? হুঁ? আবির এর ধ্যান ভাঙলো।
রাই খাটে গিয়ে বসলো শুনতে ও পান নি! কি এত ভাবছেন?

আবির রাই কে জড়িয়ে খাটে হেলান দিলো ভাবছি।
কি?
আবিরের নিশ্বাস ফেলার শব্দ রাই এর কানে প্রতিফলিত হচ্ছে। বারবার। বাতাসটা এসে ওর ডান গালের কাছ ঘেঁষে যাচ্ছে।
মনে করো যদি আজ আমার কিছু হয়ে যায় তো?

রাই স্তব্ধ হয়ে গেল মানে!
হুম। এখন আজীবন তো আমি থাকবো না।
তারমানে কি আপনি এই কথা বলবেন? রাই এর হাত জমে এসেছে।

নিজেকে তো বিলিয়েই দিয়েছি, এখন কেউ যদি কুড়িয়ে না নেয় তবে অস্তিত্ব বিলীন হতে কত সময় লাগবে বলো?
রাই এর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। আবির কি ওকে আবারো সেই প্রশ্ন টাই করবে? এই প্রশ্নের উত্তর যে রাই এখন দিতে চাচ্ছে না।
ঘুমোয়বলে আবির শুয়ে পড়লো। রাই ও। তবে রাই এর মস্তিষ্কে একটাই কথা ভেসে বেড়াচ্ছে, ঠিক আবিরের একটু আগে বলা কথাটা।

পরদিন সন্ধ্যায় আবির রেজোয়ান সাহেব আর দাদী সোফায় বসে ছিল। বাকিরা যে যার মতই কাজ করছে।
তখনি আবিরের ফোন একটা মেসেজ এলো। আবির স্বাভাবিক ভাবেই নিজের ফোনটা হাতে নিলো।
রীতিমত চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো আবিরের। কেনো যেনো? আবিরের মা বিষয়টা প্রথমে লক্ষ্য করলো
কি হয়েছে আবির তোর?
কিছুনা।
তাহলে ওমন কেনো দেখাচ্ছে?

আমি একটু বাইরে যাচ্ছি ফিরতে সময় লাগতেও পারে আবার না ও লাগতে পারে। হলদে…… (তখনি সবাই আবিরের দিকে তাকাতেই আবির নিজেকে সামলে নেয় ) রাই চিন্তা করো না
রাই কিছু বলবে তার আগেই আবির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো।

কি হচ্ছে টা কি গতকাল থেকে! আবির এমন করছে কেন? মনের মধ্যে নানান কথা ঘুরছে রাই এর।
কিছুক্ষন পরেই আবিরকে কোনো এক ভবনের ছাদের মধ্যে ঢুকতে দেখা গেলো।

ছাদের স্টিলের দরজা খুলতেই ক্যাচ…… করে একটা শব্দ হলো। আবির এর মুখ দেখে বোঝা দায় ও রেগে আছে নাকি কি……
ছাদে ঢুকতেই কেউ পেছন থেকে এসে আবির কে জড়িয়ে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে আবির তাকে পেছন থেকে টেনে সামনে এনে দাড় করালো।

এসবের মানে কি?
কি আবির? তুমি জানো না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি? তুমি..
চুপ আবিরের ধমকে নীলা ভয় পেয়ে গেল।

একটা কালো রঙের জর্জেটের শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ, সাজ, চুলগুলো কালার করা
সত্যিই নীলাকে দেখে আবিরের মনে শুধু একটাই কথা এলো উচ্ছৃঙ্খলতা র সীমা পার করে গেছে এই মেয়ে। এর থেকে বাজে আর কি হতে পারে?
তুই এখানে কেনো?

নীলা হাত বাড়িয়ে দিতে গেলেই আবির ওর হাত সরিয়ে দেয়।
গতকাল তো এখানেই আসতে বলেছিলাম তখন কেনো এলে না?
ঠিক কোন কারণে আসতে বলেছিলি?
নীলা হেসে আবিরের কাছে গেলো ঠিক যেকারনে আজ আসতে বলেছি

আবির ওর থেকে দূরে পিছিয়ে গেলো গতকালের মতে আমি ১২ টার মধ্যে না আসলে নাকি তুই আত্মহত্যা করবি…. বলতে বলতে আবির এগিয়ে ছাদের রেলিং এর ধারে গিয়ে নিচে তাকালো কই তোর ডেডবডি ত দেখছি না
আবির!!!! নীলার বিস্মিত গলা
নীলা এগিয়ে গেলো আবির বিশ্বাস করো আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি অনেক….. বলে আবিরের বা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল।

বিশ্বাস করো, তুমি কেনো এভাবে আমার ভালোবাসার অবমাননা করো? যেনো প্রত্যেকবার আমাকে এভাবে ঠকাচ্ছো? গ্রামে যাওয়ার আগেও আণ্টি আপনাদের বিয়ের কথা বলেছিল। কই তখন তো তুমি নিষেধ করো নি। তবে হুট করে এই সস্তা মেয়েকে কেনো?
বাতাসে বিকট একটু শব্দ ঢেউ খেলে গেলো। চারপাশ পুরো থমকে গেলো।

নীলা নিচু হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে, বা গালে হাত। সত্যিই কি আবির ওকে এতো জোরেই চড় মারলো!
সস্তা! আবিরের ডান হাত কাপছে। কিছুটা রাগে কিছুটা ব্যথায়। আবিরের পায়ের জুতোর ঠক ঠক শব্দ ক্রমশ নীলার দিকে এগিয়ে গেলো। নীলা মাথা তুলে তাকালো, মুখে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসে লাল হয়ে উঠেছে চেহারা। যেনো এখনও চামড়া ফেটে রক্ত ঝরবে।
একে টাকার লোভ।
দ্বিতীয় বিলাসিতা

এরপর তোর দুশ্চরিত্র,
এতগুলো গুণ তোর মধ্যে প্রতিফলিত হয় যে নিজেকে তোর সামনে যৎসামান্য মনে হয়।
নীলা ভাঙ্গা গলায় বললো চরিত্রহীন? ঠিক কি দেখে বললে?

আবির চৌধুরী যে অযথা কিছু বলেনা (নীলার মুখ চেপে ধরে) সেটা তোর থেকে ভালো কে জানে?
নীলা ব্যথায় কুকড়ে যাচ্ছে। আবির ওকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল। সাথে নীলার শাড়ির আঁচলটা সরে গেলো। আবির ঘৃণায় চোখটা সরিয়ে নিলো।
কোনো প্রমাণ ছাড়া তুমি এভাবে বলতে পারোনা

আবির গিয়ে রেলিংএর সাথে হেলান দিয়ে একপা তুলে দুহাত জিন্সের পকেটে দিলো গত মাসের ১৫ তারিখ। এক মেয়ে ঠিক তোর মতই, আর এক ছেলে ঠিক।.

নীলা আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। ওর ভয়ার্ত চেহারাই নাকি ইতিহাস উগলে দিচ্ছে।
ঠিক নিশানের মতো, ওয়ারির এক নামি ফাইভস্টার হোটেলের বাহিরে দেখতে পাওয়া গেছে বলে কিছু সিসিটিভির মতামত

নীলা দৌড়ে আবিরের কাছে গেলো বিশ্বাস করো আবির। আমি, আমি কিছুই করিনি
আবির ওকে আবারো দূরে ধাক্কা দিলো আমি তো বলি নি তুই কিছু করেছিস।
নীলা থেমে গেলো। কিন্তু ওর চোখ দুটো চিৎকার করছে। আবির, আমি কিছুই করিনি। সব ওই ওই নিশানের দোষ নিশান….

আবির ওর একহাত চেপে ধরলো তোর এই বিষাক্ত রূপে এখন যদি আমি কিছু করতাম, ঠিক আগামীকাল এই একই কথা বলতি, সব আবিরের দোষ…..
আবির…..
তুইই তো নারী। উচ্ছৃঙ্খল পোশাকে ঘুরবে, বেগানা পুরুষদের কাছে ডাকবে…. অথচ তোমায় ছুয়ে দেখলে সব দোষ পুরুষের?

আবির আমি রো পুরোটাই তোমার.. তুমি চাইলে।
হুম…. তুই খুব দামী। নিজেকে উৎস্বর্গ করছিস….. আর বাকিরা সস্তা…… বলে আবির বেরিয়ে আসতে লাগল।
তুমি এখান থেকে গেলে আমার লাশ দেখবে আবিরপেছন থেকে নীলার কণ্ঠ ভেসে এলো।

আবির এর মাথায় অগ্নেয়োগীরি টগবগ করছে। পেছনে ঘুরে দেখে নীলা রেলিং এর ধারে দাড়িয়ে এটা বলছে। আবির ওর দিকে এগোলো।নীলা এখনও ভয় পেয়ে আছে দেখো তুমি কিন্তু এভাবে এগোলে আমি, আমি লাফ দিব
কিন্তু আবির নিজের মতই এগিয়ে যেতে লাগলো। নীলা তাকিয়ে রইলো। আবির গিয়ে সোজা নীলাকে ধাক্কা দিয়ে আবির…. ওর একহাত ধরে ফেললো।

আবির, আবির হাত ছাড়বে না
আবির এক নজরে তাকিয়ে আছে।
আবির, প্লিজ আমাকে ওঠাও আবির….
তোর স্বপ্নটা নাহয় পূরণ করে দেই
নাহ। নাহ

আবির ওকে তুলে মুখ চেপে ধরলো কাক কখনো ময়ুরপালক লাগিয়ে ময়ূর হয়ে যায়না। মানুষ এমনই স্বভাবের দাশ মুখ ঠেলে নীলা কে ফেলে দিয়ে আবির ছাদ থেকে চলে গেলো।
নীলা রুক্ষ চোখে তাকিয়ে রইলো।

এবারে ঘটলো আরেক ঘটনা। আবির গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরছিল। মাত্রই ট্রাফিক এ আটকা পড়েছে। সিগন্যাল লাল।
গ্রীন সিগন্যাল পড়তেই আবির ফুল স্পিডে গাড়ি স্টার্ট করল।

কিন্তু অবাক বিষয় , একটা কালো গাড়ি বারবারই আবিরের গাড়িকে ওভারটেক করতে লাগলো। কিন্তু আবির এখন কোনো ঝগড়া ফাসাদের মুডে নেই।
কিন্তু আবারো গাড়িটা ঘুরে সেই আবিরের গাড়ির পেছনেই এসে গেলো। লুকিং মিরর এ দেখা গেলো গাড়িটার ভেতরে কেউ একজন কালো পোশাকে বসা। যতটুকু বোঝা যায়।

কিন্তু আবির যে পথেই বাক নিচ্ছে গাড়িটাও সেদিকেই যাচ্ছে। বেশ কয়েকবার একই ঘটনা দেখে আবির এর মনে একটু সন্দেহ উঁকি দিলো।
আবির খুব দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছে।কিন্তু আশ্চর্য ওই গাড়িটাও একই কাজ করছে।
কি একটা মাথায় এলো, আবির সামনের এক ট্রাফিক পুলিশের সামনে খুব কষে ব্রেক করলো নিজের গাড়িটা।

পেছনের লোকটা হয়তো বোঝেই নি এমনটা হবে। তাই পেছনের গাড়িটা তাল সামলাতে না পেরে ঠিক আবিরের গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আর দাড়াল না। ট্র্যাফিক পুলিশ বাঁশি বাজাতে লাগলো। কিন্তু গাড়িটা আর থামলো না। আবির সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইলো।

রাতে ১০ টার দিকে আবির বাসায় ফিরলো। তবে তার এই আগমন এমনই ভয়ংকর ছিলো যা বলার বাহিরে।
সবাই খাবার টেবিলেই বসে ছিল। আবিরের আসার অপেক্ষা।
আবির দরজা খুলে (জুতাটাও খুললো না) ভেতরে ঢুকে সোজা ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোলো। রাই অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে তাকালো। রেজোয়ান সাহেব হা করে আছেন।

ব্লু শার্ট, জিন্স, চুলগুলো এলোমেলো, বুকের উপরে দুটো বোতাম খোলা, স্লিভ গুলো কনুই এর উপরে আবির এসে সোজা ডান হাত এগিয়ে নীলার বাবা (ওর চাচা) এর সামনে রাখা কাচের প্লেটটা তুলে ফেলে দিল। কাঁচ ভাঙার শব্দ সবাই অবাক হয়ে গেলো।

কি করছো আবির?চাচী চেঁচিয়ে উঠলেই আবির তার সামনের প্লেট ও ধরে ছুড়ে ফেলে দিলেন।
পাশেই নিশান ও ছিলো ভাই….
চুপ….. বলে ওর সামনের প্লেট গ্লাস যা ছিল সব ঠেলে ফেলে দিল। আর হাতে তুড়ি মেরে চাচা চাচীর দিকে ইঙ্গিত করলো আউট। গেট আউট
আবির…. ওর মা দাড়িয়ে পড়লো…

তোমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি….. আবির নিজের ডান হাতের স্লিভ কনুই থেকে সামান্য উপরে তুললো অনেক বেড়ানো হয়েছে…. এরপর আবার নাতি নাতনীদের দেখতে আসবে তোমরা। এই মুহূর্তে বের হও
আবির, কি বলছিস এসব? কাশেম মিয়া এগিয়ে গেলেন।

একবারের বেশি বলবনা। রাত মাত্র ১০ টা, এখন ও যাওয়া সম্ভব।
রেজোয়ান সাহেব তো মাঝে মাঝে যেনো বিশ্বাসই করতে পারেননা যে আবির নাকি তারই ছেলে। সত্যিই অবাস্তব মনে হয়। উনি তো শুধু ছেলের কান্ড দেখে মজা নেন। তবে আজ ওকে সত্যিই ভয়ংকর লাগছে।

এমনকি আবিরের মা ও কিছু বলতে পারছেন না। ফুপি এগিয়ে গেলো আবির…..
কেউ একটা কথাও বলবেনা। আমি কতক্ষন কথা বলবো ওর চিৎকার শুনে আর কারো সাহস ও হলো না।
তো, ব্যাগ গুলো ও কি আমিই এনে দিবো? দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
চাচা বললেন রেজোয়ান, তোমার ছেলে কিন্তু এবার বেশিই করছে

রেজোয়ান সাহেব নির্বাক তাকিয়ে রইলেন।
চাচী রেগে বললেন ভদ্রতা সব লোপ পেয়েছে। তোমার ছেলে কিন্তু বাড়াবাড়ি করছে। যেতে হলে চলেই যাবো। এভাবে বলার কি আছে?
আবিরের মা চুপ করে আছেন। ওর চাচী পুনরায় বললো এরকম জানলে জিবনে মেয়ের বিয়ে এবাড়ি ঠিক করতাম না

আবির কাচের ডাইনিং টেবিলের উপর একটা ঘুষি দিলো অভদ্রতা এখনও করিনি। আর মেয়ে!হুহ ওকে কেউ কিনতে যায়নি। আপনারা বেচতে এসেছিলেন
রেজোয়ান সাহেব যেনো এবার হার্ট অ্যাটাক করবেন আল্লাহ, আল্লাহ এ কি আমার ছেলে রে? আমার তো মনে হয় না বিড়বিড় করে। সুমি একটু ঝুঁকে মামার কানে বলল আমারও মনে হয় না মামু

রেজোয়ান সাহেব অসহায় চোখে সুমির দিকে তাকালো। সুমি চোখ দিয়ে শান্তনা দিলো।
চাচী হুংকার দিয়ে উঠলেন দেখো রেজোয়ান দেখো তোমার ছেলে এখন কি বলছে দেখো।

আবির এবার চাচার দিকে দুপা এগোলেন এর থেকে বেশি এক্সপ্লেইন আমি করিনা।
রেজোয়ান সাহেবের তো ঘাম ছুটছে আস্তে করে সুমিকে ডাকলেন এই সুমি, সুমি। মা রে একটু বাতাস কর বাতাস। আমি তো শেষ। এ কি আমার ছেলে?

সুমি ওরনা র কোণা দিয়ে মামাকে বাতাস দিচ্ছে তোমার ছেলে মনে হয় বাইরে থেকে ঝগড়া করে এসেছে….
তার জন্য এরকম করবে!
হাফ মেন্টাল সুমি বড়ো বড়ো চোখে তাকালো।

একদিকে রেজোয়ান সাহেবের বাচ্চামো, অন্যদিকে আবিরের এই রূপ, মোটামুটি রাই এর মাথা ঘুরছে। রাই এগিয়ে গিয়ে আবিরের সামনে দাড়ালো আর ভয়ে ভয়ে বললো
আপনি…..
এখান থেকে যাও, শক্ত গলায় বললো আবির। নিজেকে অনেক নিয়ন্ত্রণ করে রাই কে যেতে বললো। কিন্তু রাই ভয় পেলেও গেলো না

শুনুন তো, এমন কেনো করছেন?
আবির এবার রাই এর দিকে ঘুরে ধমক দিয়ে উঠলো ঘরে যাও…. তোমাকে যেতে বলেছি…..
রাই এর বুকটা কেপে উঠলো। ওর প্রাণপাখি যায় যায় অবস্থা। আবির এই দ্বিতীয় বার ওর ওপরে চেঁচালো। সেই রাতে, আর এখন।

রাই এর এত্ত খারাপ লাগছে। আবিরের কঠোর মুখটা দেখে রাই পিছিয়ে গেলো। আর সোজা নিজের ঘরে চলে গেল।
এদিকে বাহিরে সবাই চেঁচামেচি করলেও শেষে আবিরের শুধু একটা কথাই কানে এলো আমি যেনো ঘর থেকে বের হলে আপনাদের একজনকে ও না দেখি

বলে আবির নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। বাকিরা সবাই হতভম্ব। এমন একটা কথা আবির কেনো কিভাবে বললো কে জানে? তবে চাচী কিছু একটা আন্দাজ করলেন। আর নীলার বাবাকে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।
বাকিরা বাহিরেই দাড়িয়ে। সুমি গলা নামিয়ে মামাকে বললো আইস ব্যাগ এনে দেই মামু…?
রেজোয়ান সাহেব তো ছেলের রাগ দেখে আর তর্কেই গেলেননা। কি ছেলে রে মাইরি! সাক্ষাৎ হিটলার।

নিশান চিন্তায় পড়ে গেল। আবির হটাৎ এমন ব্যবহার কেনো করলো? আশ্চর্যের ই বিষয়। কেননা আবির এমন ছেলে যে কখনো পরিবারে এত বেশি সময় ও দেইনি, বা, কারোর প্রতি তার কোনো আগ্রহ ও ছিলনা। সোজা সাপটা রেজোয়ান সাহেব এর বিজনেস দেখে, অফিস সামলায় আর দিনশেষে এসে ঘুমিয়ে যায়। ঠিক এমনটাই ছিলো ও।
কিন্তু হটাৎ এতো এতো পরিবর্তন।
আবিরের মা বলে উঠলেন ওই মেয়েটাই আমার ছেলের মাথা খেয়েছে। নইলে আমার ছেলে জীবনেও ওর গুরুজনদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি

রেজোয়ান সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন হ্যাঁ ছেলে হাসলেও দোষ, কাঁদলেও দোষ, বসলেও দোষ, উঠলেও দোষ, হা…… (থেমে গেলেন ) বাথরুমে গেলেও দোষ। সবাই চোখ গোল গোল করে তাকালো
যত দোষ ওই দুদিনে আসা মেয়ে টার যত্তসব বলে রেজোয়ান সাহেব ও প্রস্থান করলেন।

সুমি হাতের ওরনা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল, মা শোনো – আজ কি সবাই ক্লোজ আপ দিয়ে দাঁত মাজতে ভুলে গেছে নাকি? এরকম বিকর্ষণ কেনো করতাসে?
ফুপি সুমির হাতে থাপ্পড় দিলেন চুপ
সুমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো।

রাই এর খুব অভিমান হলো। এভাবে বলার কি ছিল। তাও সবার সামনে। ওর খুবই খারাপ লেগেছে। আবিরের কিছু সমস্যা থাকলে বলতো। কিন্তু এরকম ভাবে রাগলো ও। হাহ কথাই বলবনা।
তখনি আওয়াজ এলো দরজা খোলার। রাই বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলো। উঁকি দিয়ে দেখলো আবির ঘরে ঢুকে একটু হাঁটাহাঁটি করলো। তারপর টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো।

হাহ কি সুন্দর। এসে একবার ডাকলো ও না। আদৌ এই ঘরে আছি না মরে গেছি জানেই না। ধুর ধুর কিছুক্ষন পর আবির বেরিয়ে এলো। রাই ভাবলো হয়তো এবার রাই কে খুঁজবে। কিন্তু রাই এর ভাবনায় এক চিমটি গুড় ঢেলে আবির গিয়ে নিজের ল্যাপটপটা বের করলো। আর সোফার উপরে বসে গেলো।
রাই এটা দেখে তো

করো কাজ। যতক্ষণ মন চায়।
রাই বারান্দাতেই দাড়িয়ে রইলো।
এদিকে আবিরণযোগ সহকারে কিছু কাজ করছে। কি করছে তাতে রাই এর কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু আজ আবির ওকে না ডাকলে ও এখন থেকে বেরোবে না এটা শিওর।

ওদিকে জনাব নিজের মতই কাজকরেই যাচ্ছেন। বেটা অন্তত এটুকু তো খেয়াল কর এই ঘরে আর কেউ আছে কিনা।
সেকেন্ড যায়, মিনিট যায় আবিরের ভাবের উন্নতি নেই। নিজের মতই খুব গম্ভীর মুখে কিছু কাজ করছে।
এদিকে রাই দাড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত। কখন আসবে ও।
রাই এর মেজাজ এতই খারাপ হচ্ছে যে কি বলবে।

ঐযে বলে না রাগের থেকেও ভয়ংকর হলো অভিমান। রাগ তো সময়ের সাথে সাথে কমেই যায়। কিন্তু অভিমান এমন, যে সময় এর সাথে সাথে এর ভরটা শুধুই বাড়ে। মানুষ রাগের মোকাবেলা করতে পারলেও অভিমান খুবই উর্ধ্বে। সহজে পেরে ওঠা যায়না। তাই যত দ্রুত সম্ভব অভিমান কাটিয়ে ফেলা উচিত হয়।

কিন্তু এদিকে একজন অভিমান করে বসে তো আরেকজন যেনো জানেই না। একটা পর্যায়ে তো রাই ব্যাস হাফিয়েই গেলো। লাগবে না কারো আসার আমি নিজেই চলে যাচ্ছি মুখ গোমরা করে রাই ঘরের দিকে পা বাড়ালো। তখনও আবির মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। কিন্তু কি এমন জরুরি কাজ কে রাই কে ও দেখছে না।

রাই জোরেজোরে পা ফেলে হেঁটে খাটের ওপরে গিয়ে বসলো। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।
কিছুক্ষন পর, আবির সোফায় একটু হেলান দিলো। যেনো মানুষ যেভাবে একটানা কাজ করে ক্লান্তি দুর করার জন্য করে। ঠিক তেমনই।

রাই চোখ সরিয়ে নিলো।
আবির শান্ত নজরে রাই এর দিকে তাকালো। আর ল্যাপটপটা বন্ধ করে নিলো। উঠে হাটতে হাটতে গিয়ে রাই এর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।

রাই অবাক। তবে মুখ দিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছে না।রাই মুখ ঘুরিয়ে নিল। আবির চোখ বুজে রাই এর একটা হাত টেনে নিজের চুলের মধ্য গুজে দিল। তবুও রাই কোনো সাড়া দিলনা। চুপ করেই রইলো। আবির ও চোখ বুজে চুপ করে রইলো।
বেশ খানিকক্ষণ এভাবে চলে গেলো।

অভিমান, আবদার, বায়না এসবই একটা মানুষ ঠিক তার কাছেই করে যে ওই মানুষটার খুব কাছের কেউ হয়…
রাই আবিরের দিকে তাকালো। আবির চোখ খুলে রাই এর দিকে তাকালো আমার থেকে তো কষ্ট ছাড়া কিছুই পাও না। তবে কেনো এই অভিমান? আবির উঠে বসে রাই এর মুখোমুখি বসলো আমি তো তোমার জন্য শুধুই একটা অভিশাপ। নয় কি?

রাই অবাক হলো। ছেলেটা সবসময় ওকে নিজের কথার জালে কি সুন্দর ফাঁসিয়ে নেয়…..তবে ওর কথাটা গায়ে বিধলো। এমনকরে বলা লাগলো ওর! সত্যিই কি অন্যকিছু ছিলনা বলার জন্য? রাই তাকিয়ে রইলো।
তোমরা খুব সহজেই আবেগে ভেসে যাও। কিন্তু এই আবেগের জন্যই বাছবিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেল
রাই মুখ ঘুরিয়ে নিল আপনি তখন ওভাবে না চেঁচালেও পারতেন।

আবির বাকা হেসে শুয়ে পড়লো সাথে রাই কে ও টেনে বুকে নিলো ঐযে, তোমার কষ্ট দেওয়ার সমস্ত ভার নিয়েছিলাম।
রাই জানে এইকথাটা ওর জন্যই ছিল। সত্যিই এর বিপক্ষে আর কোনো কথা বলতে পারেনা রাই। বলতে ঠিকই চায়। কিন্তু পারেনা। কিছু একটা পিছুটান, যেটা ওকে আবিরের কথার প্রত্যুত্তর দিতে দেয়না।


পর্ব ১৮

এতো অপমান আর অসম্মানিত হওয়ার পর কার এমন মুখ যে থেকে যাবে!নীলার বাবা মা ভোরের দিকেই সব কাপড় চোপড় গোজগাছ করে চলে গেছেন। অবশ্য আবিরের মা আটকাতে চেয়েছিল কিন্তু পারেননি। রেজোয়ান সাহেব তখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন।

ওনারা দুইজন পায়ের তলার মাটি কাপাতে কাপাতে বেরিয়ে গেলেন। অবশ্য দাদী থাকলে বোধহয় থামাতেন। কিন্তু উনিও আপাতত বাড়িতে নেই। কদিন আগে গিয়েছেন বোনবাড়ি বেড়াতে।

উফফ, আমার ছেলেটা যে দিন দিন শুধু জঘন্য হচ্ছে আর কিছুই না। মুখ ভার করে আবিরের মা ঘরে চলে গেল।
নীলার বাবা মায়ের এমন চেঁচামেচি তে রাই এর ঘুমটা প্রায় ভেঙেই গেলো। একটু এপাশ ওপাশ করতেই বুঝতে পারলো, পাশে আবির নেই। চোখ মুখ ছোটো করে হালকা উঠে তাকালো। খাটে তো নেই। তাহলে?

বাথরুমে হয়তো ভেবে রাই আবারো ঘুমে লুটিয়ে পড়লো।
ঘুম ভাঙ্গলো প্রায় ৮ টার কাছাকাছি সময়। এবারে রাই আরো আশ্চর্য হলো। আবির এখনও বিছানায় নেই। রাই বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেলো বাথরুমের দিকে। দরজায় আলতো ভাবে হাত রাখতেই দরজাখুলে গেলো ভেতরেও নেই!

রাই পেছন ঘুরে দেখে ঘরের দরজা খোলা (ভিড়িয়ে রাখা)। রাই শাড়ির আঁচল ঠিক করে একটু বাহিরে গেলো। সবাই ঘুমাচ্ছে। এই মুহূর্তে এক ফুপি ছাড়া কেউই ৯ টার আগে ঘুম থেকে ওঠেন না। আর ফুপি বাহিরেই দাড়ানো ফুপি
আরে, তুই! কীরে ঘুম থেকে মাত্র উঠলি?
রাই মাথা নাড়লো হুম। উনি কোথায়?

ফুপি বুঝলেন না কিনি?
উনি…..
আরে কে সে?
রাই একটু আমতা আমতা করে বলল আবির…
ফুপি হোহো করে হেসে উঠলেন নাম নিতে লজ্জা করে নাকি?
না, তবে।

ও তো সকালেই বেরিয়ে গেছে। নামাজ পড়তে উঠেছিলাম তখনি আমাকে বলে গেলো বাইরে কাজ আছে আর তোকে যেনো বিরক্ত না করি। তাই তোকে ডাকি নি

ওহ, রাই চিন্তায় পড়ে গেলো এতো সকালে কি কাজ!
আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে আসি বলে রাই চলে গেলো।
আবির দাড়িয়ে আছে নিজের গাড়ির পাশে। বারবার হাতের কালো ঘড়িটা দেখছে। কার অপেক্ষা?
ব্রো….. কেউ ডাকলো। আবির তাকিয়ে হাত উচু করলো।

এতো দেরি করলি যে? আবির জিজ্ঞেস করলো ছেলেটাকে।
ছেলেটা হেসে মাথা চুলকায়। আবির চোখের হলদেকালো সানগ্লাসটা খুলে জিজ্ঞেস করে সেদিন যে নম্বর দিলাম, কি আসলো খবরে?

ছেলেটা এদিক ওদিক তাকালো ভাই, অন্য জায়গায় যাওয়া যাক?
আবির আন্দাজ করতে পারলো ওঠ গাড়িতে উঠে আবির হাই স্পিডে গাড়ি চালাতে শুরু করলো।
রাই রান্নার কাজে ব্যস্ত। তখন সুমি ডাকলো ভাবি…
হ্যাঁ বলো সুমি রাই তরকারি রাধছিল, সুমি গিয়ে আহ্লাদী সুরে বললো ভাবি জানো তো আগামী পরশু কি?
মস্তিষ্কের চাকা ঘুরিয়ে রাই ভাবনায় খুঁজতে লাগলো আগামী পরশু কি? কি মনে?

কি মনে?
সুমি অবাক হলো আরে বাবা পরশু তো একটা স্পেশাল দিন। জানােনা?
রাই আবারো মস্তিষ্কের ক্যালেন্ডার খুলে খোঁজার চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুতেই কোনো বিশেষ দিন বলে ওর জানা নেই।

জানিনা, তুমি বলো পরশু কি?
সুমি একটু মুখ ভার করলো যাহ, তুমি জানোই না। থাক তোমাকে বলবই না বলে সুমি রান্নাঘর থেকে চলে গেলো।
আরে সুমি…. কিন্তু কে শোনে কার কথা। সুমি ও চলেই গেলো।

আবির আর সৌরভ (ছেলেটা কে খবর দিতে এসেছে) একটা রেস্টুরেন্ট এ বসে আছে। সৌরভ খুবই গম্ভীর মুখে কিছু একটা ভাবছে।
রাজভোগ সামনে আনলে মুখ খুলবি নাকি?
আবিরের কথায় সৌরভ চিন্তা ছেড়ে তাকালো হাহ, না ভাই। তবে ভাবছি আপনি যদি….
বলে ফেল….

সৌরভ জানে আবির অযথা রাগার পাত্র নয়। বেশিরভাগই দুটো কথাই শোনায়। তাও যদি সৌরভ কোনো কাজের খবর না আনে। আজও একই অবস্থা, সৌরভ কোনো খবরই আনতে পারেনি ভাই, কোনো খবর নেই আসলে
আবির এর মুখটা আর কি বলবো…. ইউ সেড নো ইনফো?

সৌরভ মাথা নিচু করে রাখল। এই দ্বিতীয় বারের মতো সৌরভ বেকার হয়ে গেলো। ভাবছিল আবির কিছু বলবে। কিন্তু আবির উল্টো বিড়বিড় করতে করতে মাথা নামিয়ে নিলো নো, ইনফো!!
সৌরভ ভাল করে লক্ষ্য করলো আবির কিছু একটা ভাবছে।
ভাই…

গাড়ির যে নম্বরপ্লেট এর নম্বর দিলাম সেটা?
দ্রুততার সহিত জবাব দিলো ভাই হ্যাঁ এটার খবর আছে। এই যে গাড়িটা আপনাকে ফলো করছিল এইটা আসলে একটা খোয়া যাওয়া গাড়ি। বেশ কয়েক মাস আগে নাকি এক ভদ্রলোক গাড়িটা পার্ক করে বাড়িতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন গাড়িটা উধাও। সিকুরিটি ওদিকে আবার অন্য কীর্তিতে ব্যস্ত ছিল। গাড়ির আওয়াজ শুনেও না শোনার ভান

সিসি ক্যামেরা?
নেই। সেবাড়ির আশপাশে সিসিটিভি নেই
মাস্টারপ্ল্যান বলে আবির অন্যমনস্ক হয়ে চেয়ারে হেলান দিলো।

সৌরভ ও ভাবছে ঠিক কি হচ্ছে! ব্যবসায়িক কাজে শত্রুতা চৌধুরী বাড়ির সাথে বরাবরই অনেক কোম্পানির ই আছে। তবে মার্ডার করার মত এত কাপুরুষতার বাহক তেমন কেউ নেই। অবশ্য বলা যায়না কোথা দিয়ে কে হুট করে শত্রুতা নামক খেলনা হাতে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কিন্তু সত্যি বলতে সৌরভ ক্রস চেক করেছে। কিন্তু বিজনেস এর সাথে জড়িত কাউকেই পায়নি। ওদিকে আবির যে কখনো সোজা পথে চিন্তা করেনা সেটাও সৌরভ জানে।

বলাই বাহুল্য, আবিরের ব্যবসা জগতের সাথে জড়ানোর পরপরই সৌরভের আগমন। আবিরের ডানহাত। ফলে আবিরকে এটুকু চেনে সে। আবার আবিরও জানে যে সৌরভ কোন পর্যায়ের গোয়েন্দাগিরি পারে।

হাড়ির খবর কিভাবে বের করতে হয় তা ওকে শিখিয়ে দেওয়া লাগেনা। যখন ও কোনো খবর আনতে পারেনি, নির্ঘাত কেউ এমনই ভাবে আবিরের পেছনে লেগেছে যার চিহ্ন টুকুর প্রতিও দয়া করেনি। নো ক্লু।

আঁধারে হাঁটো….. বিড়বির করলো আবির। সৌরভ হূ!বলে জিজ্ঞেস করলো।
তাহলে আর কি? চলো বের হওয়া যাক বলে আবির উঠে দাড়ালো।
ভাই কিছু খাবেন না?

হুম, খাবো। গাড়ি ওয়ালাকে পাই। দেন একসাথে খাবো বলে আবির হাতের সানগ্লাস টা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। সৌরভ ও পেছনে উঠে এলো।
কিন্তু ভাগ্যের হটাৎ আগমন ভুলে গেলে নাকি?

রেস্টুরেন্টের গেট দিয়ে বাহিরে গিয়ে ডানে ঘুরে হাটতে গেলেই কোত্থেকে কি একটা এসে আবিরের মাথায় সজোরে আঘাত করলো। আচমকা হামলায় আবির দুপা পিছিয়ে গেলো।
পেছনে সৌরভ ও ছিলো। সৌরভ দেখলো একটা কালো হুডি পরে মাস্ক লাগানো লোক একটা বড়ো চওড়া লোহার পাত দিয়ে সজোরে আবিরকে আঘাত করলো।

ওই…. চেচিয়ে সৌরভ ছুটে গেলো লোকটার দিকে ততক্ষণে লোকটা ও সোজা দৌড়। আবির নিজেকে সামলে সামনে তাকালো। ওই হুডি ওয়ালা লোকটা সেই কালো গাড়িতে উঠে চলে গেলো। সৌরভ তাকে ধরবে তার আগেই লোকটা চলে গেলো। সৌরভ দৌড়ে পেছনে এলো
ভাই আপনি ঠিক আছেন?
আবির মাথা নাড়লো।

রাই সেই সকাল থেকে অপেক্ষাই করছে আবির আর আসছেনা। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। এদিকে আবিরের মা সমানে শুধু রাই এর নামে ক্যান ক্যান করছে। কিন্তু রাই এর সয়ে গেছে। কিছু করার নেই, যার যেমন চিন্তা। সে রাই কে পছন্দ করেনা এতে রাই এর আলাদা করে দোষ নেই। বরং রাই যদি নিশান কে ও বিয়ে করত তখনও উনি একই ব্যবহার করতেন। কেননা উনি এই ধরনের নিজ ইচ্ছায় বিয়েরই বিপক্ষে।

যাইহোক এদিকে সুমি ও মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। কি যে বলবে রাই। সে তো আসলেও জানেনা যে পরশু কি?
তখনি সুমি ইয়া বড় বড় কদম ফেলে ঘরে প্রবেশ করলো। রাই তো বেশ অবাক।
তো মহারানীর রাগ কমেছে?

সুমি এক ঝটকায় বসে পড়লো নাহ
তাহলে?
তবুও ভাবলাম তোমাকে বলে একটু ধন্য করে দিয়ে যাই। পরে জানতে পারলে তো হাউমাউ করে কাঁদবে।
সুমির বাকা কথায় রাই এর প্রচণ্ড হাসি পেলো। তা বলেন শুনি

সুমি কিছুটা সময় ভাবলো তারপর অনতিবিলম্বে বলে উঠল পরশুদিন ভাইয়ার জন্মদিন
রাই স্বাভাবিক ভাবেই ভাবলো হইতো নিশানের কথা বলছে সুমি ওহ….
সুমি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল ওহ? শুধু ওহ?
রাই বুঝলো না হ্যাঁ তো?

সুমির মাথায় বাড়ি আরে, আবির ভাইয়ের জন্মদিন, আবির ভাইয়ের
ওহ, (বলে মাথা ঘুরাবে তখনি) কিহ.!!!!!! ওনার…
সুমি কোমরে হাত বেঁধে তাকালো জ্বী, আপনার ওনার জন্মদিন
রাই এর মুখে হাসি ফুটে উঠলো গ্রেট। ওহ মাই গড… আমি জানতামই না
তো এখন ট্রিট দাও

জন্মদিন কী আমার যে আমি ট্রিট দিবো? রাই উঠে দাড়ালো।
আজ্ঞে না, আপনার প্রিয়তম এর
বলে সুমি চোখ টিপ দিলো।
রাই হেসে উঠলো তোমার ভাইয়া আসলে বলো।
এর মানে কি ভাবি?
কি!

তুমি কি ভাইয়াকে আজই সব বলে দেওয়ার প্ল্যান করছো নাকি?
রাই চিন্তায় পড়ে গেল। সুমি উঠে রাই এর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বললো আরে পরশু তো ভাইয়া কে সারপ্রাইজ দিতে হবে। এটাও তোমাকে বলে দিবো নাকি?
রাই মাথা নাড়লো। সুমি হতাশ। এটা মেয়ে নাকি বাচ্চা। সব বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে। তখনি দরজায় বেল বাজলো দাড়াও আমি যাই বলে সুমি এগিয়ে গেলো।

পেছনে রাই ও গেলো।
দরজার বাহিরে আবির দাড়িয়ে। ওকে দেখেই সবাই হামলে পড়লো
কীরে আবির তোর মাথায় ব্যান্ডেজ কেনো? ফুপি এগোলো। এটা শুনে ওর মা ও দৌড়ে এলো ব্যান্ডেজ! কিসের ব্যান্ডেজ? কি হয়েছে? এই আবির

আবির আস্তে আসতে ঘরে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দিল। চারদিকে সবাই ঘিরে ধরেছে। রাই গিয়ে একগ্লাস সরবত করে আনলো আপনার কি হয়েছে?

আবির রেমণকিচুই বললো না শুধু বলল ও ঠিক আছে। রেজোয়ান সাহেব অফিসে। নইলে নিশ্চই ছেলেকে ঠাটিয়ে জিজ্ঞেস করতো এই অবস্থা কেনো!

আবির কিছুক্ষন সোফায় বসে, উঠে ঘরে গেলো। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে শুধু প্রশ্নই জাগবে। রাই ও চলে গেলো।
।আবির গিয়ে বিছানায় ঢলে পড়লো। রাই ঘরে ঢুকে দরজা টা লাগিয়ে দিল আপনি কি খুলে বলবেন ঠিক কি হচ্ছে আপনার সাথে?

আবির আলতো চোখে তাকালো। রাই গিয়ে আবিরের পাশে বসলো কালকে থেকে আর আপনি বাইরে যাবেন না।
আবির হেসে উঠলো তুমি কষ্ট করে শ্বাস কেনো নাও? ছেড়ে দাও শ্বাস নেওয়া নাকি?
রাই বিরক্ত হলো আপনি ইদানিং নিশ্চই কোনো একটা সমস্যায় পড়েছেন। আমাকে বলছেন না। আর যতদিন ওই সমস্যা খুলে না বলবেন, ততদিন আপনি ঘর থেকে বেরোতে পারবেন না। ফাইনাল। আর আমার এই কথা সবাই রাখতে বাধ্য।

কোনো সমস্যা না। শুধু সিম্পল অ্যাকসিডেন্ট
সব অ্যাকসিডেন্ট কি আপনার সাথে ডিল করে এসেছে নাকি। যত্তসব। বলে রাই উঠে গেলো।
এদিকে নীলা বসে বসে ভাবছে। গতকাল যে অপমান ওর সহ্য করতে হলো বিশেষ করে ওর বাবা মায়ের। এর প্রতিশোধ ও কিভাবে নিবে?

হাতের ফোনটা অন করে গ্যালারিতে গেলো। ছবি দুটো নিশান আর রাই এর। যেটা সেদিন তুলেছিল। কিন্তু এই ছবি দুটো আর দেখানো হলো না আবিরকে। নীলা ভেবেছিলো আবিরকে ছবিগুলো দেখিয়ে হাত করবে। কিন্তু তার আগেই আবির রেগে সেখান থেকে চলে গেলো। আর ছবিগুলো এখন পাঠানোটা বোকামি ছাড়া কিছুই না। কারণ আবির এসবে আর বিশ্বাস করবেনা।

রেগে উঠে নিলা ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিল।
নিশান এর আজ বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেছে। ইদানিং নিশান বাহিরে বাহিরেই বেশি থাকে। ফলে বাসার সবাই তেমন চিন্তা না করলে ও রাই এর মাথায় একটা চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। রাই শুধু খাবারটা দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

আবির আজ ও ল্যাপটপ নিয়ে কি একটা কাজে ব্যস্ত। দেখতে ও দেয়না। যাইহোক তাতে রাই এর মাথা ব্যথা নেই। তবে রাই এর সমস্যা এক জায়গাতেই যে আবির এই অবস্থা নিয়ে কেনো কাজ করবে।

আপনি এই অবস্থায় কেনো কাজ করছেন?
শেষ হয়ে গেলে বলে দিবো বলে আবির ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় চলে গেলো।
রাই এদিকে ভাবছে আবিরের জন্মদিনে ঠিক কি করা যায়?

আবিরদের, বাড়ির ঠিক সামনেই রাস্তায় সেই অজ্ঞাত হুডি পরা লোকটা দাড়িয়ে আছে। একদৃষ্টে আবিরের ঘরের ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে সে। ঘরের এনার্জি বাল্ব এর আলোর কিঞ্চিৎ পরিমাণ বারান্দায় পড়েছে। লোকটি সেদিকে তাকিয়ে থেকে নিজের পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করলো।
তখনি আবিরের ফোন এ আবারো একটা মেসেজের শব্দ এলো।
আবির একটু সন্দিহান চোখে ফোনের দিকে তাকালো।


পর্ব ১৯

আবির ফোনটা হাতে নিলো।
কিন্তু দেখতে যাবে তার আগেই রাই ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো।
এতো কিসের কাজ আপনার?
রাই ফোনটা দাও

দিবনা। একহাতে ল্যাপটপ আরেকহাত এ ফোন, আর পুরো পরিবার?
আবির ল্যাপটপটা পাশে রাখল আর রাই কে ধরে নিজের পায়ের উপরে বসালো কাজ আছে বলেই করছি
রাই হতাশ চোখে তাকালো এখনও কিন্তু বলেননি এই আঘাত গুলো কোথা থেকে পাচ্ছেন?
আবির চুপ করে তাকিয়ে রইল।

এমন কিছু কি আছে যেটা আমাকে জানানো যাবেনা?
আবির হালকা হেসে বলল সব কি তোমার বোধগম্য?
তাই বলে আপনি এরকম হুটহাট অ্যাকসিডেন্ট করিয়ে আসবেন নাকি?

আমিও সেটাই ভাবছি….. বলে আবির রাই কে সোফায় বসিয়ে দিয়ে আবারো ল্যাপটপটা হাতে নিলো। রাই সত্যিই বিরক্ত বেশিই হেয়ালি করেন আপনি
ল্যাপটপে চোখ রেখেই ও বললো এতদিন আমার সাথে থেকেও ধরতে পারলে না কি বলি কি করি?
রাই দাড়িয়ে পড়লো না বুঝিনা। কারণ আপনি বুঝতেই দেন না বলে রাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

আবির আর সেদিকে মনোযোগ দিলনা। এই মুহূর্তে ওর কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ফোনের ব্যাপারে ভুলেই গেলো।
বাহিরে লোকটির মেসেজের উত্তর না আসায় রাগে সে ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে এক নজরে বারান্দার দিকেই তাকিয়ে রইলো।
রাতে কাজ শেষ করতে করতে প্রায় দুটো। রাই ততক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে। বেচারি এতো করে বললো কাজ বন্ধ করে ঘুমোতে কিন্তু কে শোনে কার কথা।

ল্যাপটপটা রেখে আবিরের উঠে খাটের পাশে গেলো। ঘুমোলে প্রত্যেক মানুষকেই দেখতে কতটা নিষ্পাপ লাগে। মনেহয় মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেহারার দিকেই তাকিয়ে থাকি।
আবির গিয়ে বিছানায় রাই কে পেছন থেকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো।

এক গোছা চুলের মাতাল করা সুবাস। যদিও বা এটা চুলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য না, তবুও এই মুহূর্তে এই গুনে গুনান্বিত চুলগুলো আবিরকে পাগল করার মত যথেষ্ট। আলতো করে চুলে মুখ গুজে ঘ্রাণ নিতে নিতে কখন যে ঘোরে চলে গেছে, আবির জানেনা….. ক্রমশ নিজের ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে দিতে লাগলো রাই এর উন্মুক্ত কাঁধে, গলায়। গভীর ঘুমে বিভোর রাই, হয়তো অনুভব করতে ব্যার্থ।

দোষ তো আমার নয়,
নয়নজোড়া যে তোমায় খোঁজে।
তুমি এতই দূরে,

যেনো এক পৃথিবী পার করেও
পাইনা কাছে।
কাছে থেকেও দূরে।
তবুও কী সব দোষ আমার?
বিরবিড় করতে করতে নিজের প্রেয়সী কে আরো নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আবির।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই রাই দেখলো আবির ওকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। মুচকি হেসে আবিরের এলোমেলো চুলের মধ্যে বাম হাতটা গুজে দিলো। আর কপাল থেকে সরিয়ে দিতে লাগলো। এইকয়দিনে চুলগুলো অনেকটাই লম্বা হয়েছে। চোখ ঢেকে যাওয়ার মত অবস্থা। কিন্তু দেখতে সুন্দর ই লাগে। মুখে হালকা দাড়ি, ঘুমন্ত চেহারা। আকৃষ্ট করতে যথেষ্ট।

কিন্তু কপালের ব্যান্ডেজটা, যেনো এই সৌন্দর্য আরো সহস্র গুন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

কি যে মাথায় এলো, রাই মুখটা এগিয়ে আবিরের কপালে একটা চুমু দিল। মহাশয় তো ঘুমোচ্ছে। নাহলে নিশ্চই রাই এত কাছে নিজে যায়না।
কিন্তু ওতো ভালো ও লাগলো না। জাস্ট একটা কিস! আবিরের গালে হাত রেখে স্লাইড করলো। আস্তে করে বাম গালে একটা চুমু দিয়ে সরে এলো।

নট ব্যাড। বাট পারফেক্ট ছিলনা
রাই চমকে ওঠে। তাকিয়ে দেখে আবির চোখ খুলে টিপটিপ করে তাকাচ্ছে। রাই উঠে বসলো আপনি জেগে!
আবির একটা হাই তুললো জাগিয়ে বলছো জেগে!

রাই লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। ইশ। কি বলবে এখন? রাই উঠতে যাবে, নীল রঙের শাড়ির আঁচলটা টান খেলো পেছন থেকে। থমকে গেলো ও। ধীরে ধীরে ঘুরে দেখে আবির ধরে রেখেছে। আঁচলটা ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো রাই কে আবির। রাই চোখ নামিয়ে নিলো।
ঘুম ভাঙলে জরিমানা দেবেনা?
রাই মাথা নাড়লো ছাড়ুন। এমনিতেই…… দেরি হয়ে গেছে

আমারও ধরে রাখার মতো টাইম নেই।ঘুম উড়ে যাওয়ার আগে জরিমানা দিয়ে যাও। আরেক ঘুম বাকি।
কিসের জরিমানা?
বোঝানো লাগবে? বলে আবির রাই কে কাছে টেনে নিবে, তার আগেই বাহিরে খুব জোরে কাচ ভাঙার শব্দ হলো….

আবির রাই দুজনেই চমকে উঠলো।
কি হলো! রাই উঠে চুল ঠিক করে বাহিরে বেরিয়ে গেলো। পেছনে আবির ও। সবাই ঘুমোচ্ছিল। কিন্তু এই শব্দে মোটামুটি সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে। ফুপি ভয়ার্ত স্বরে বলল এই কি ভেঙেছে?
রাই এগিয়ে গেলো সেটাই তো জিজ্ঞেস করতাম

কিসের আওয়াজ ছিলো এটা আবিরের মা উঠে গেছেন। রেজোয়ান সাহেব আবার বেঘোরে ঘুমোনো মানুষ। নাক ডেকে জমিয়ে ঘুম দিচ্ছেন। ওনার আবার ঘুমের তালে এসব হুশ থাকেনা।
আবির এগিয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো। টেবিলের কোনোকিছু ভাঙেনি। অন্য কোথাও ও কিছুই ভাঙেনি। তবে?
সামনে ড্রইং রুমে এগিয়ে গিয়ে আবির এর পা আটকে গেলো। রাই দেখছিল। কি হয়েছে?

সবাই আবিরের দিকে এগোলো। এটা কে করলো!ফুপি বললেন
সবাই দেখলো, ড্রইং রুমের জানালার কাচগুলো ভেঙে অর্ধেকটা সোফায় অর্ধেকটা মাটিতে পড়ে আছে। কিন্তু কাচ কিভাবে ভাঙলো!
আবির একপা এগিয়ে গিয়ে মাটির কাচগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো।

রাই এর মনে ভয় ঢুকে গেলো। এটা কে বা কেনো করলো!
আবির কাঁচগুলো দেখে একটু পেছনে ঘুরে এদিক ওদিক তাকালো। সাথে বাকিরাও তাকালো।
নিচে ফ্লোরে একটা মাঝারি আকারের পাথর পড়ে আছে। আবির এর মাথায় একটা অন্য ই চিন্তা গ্রাস করলো।
আরে এসব কে কি করছে! আবিরের মা এগিয়ে গেলো। পাথর ফেলে কি মজা নেওয়া হচ্ছে নাকি?
কার ভাই খেয়ে দেয়ে কাজ নেই?

সুমি এগিয়ে বললো নিশ্চই ওই পাশের বিল্ডিং এর পুঁচকে গুলো এসব করেছে। এমনিও তো ওরা বেআদব
হতে পারে। আচ্ছা যা তোরা আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি বলে ফুপি এগোলেন।

রাই বললো ফুপি ফ্লোরের গুলো পরিষ্কার করে ফেলা যাবে কিন্তু সোফার গুলো তো সম্ভব না। ওটা তো সোফার পিলো বদলাতে হবে
হুম, সেটাই।

আবির কিছুক্ষন চিন্তামগ্ন থেকে নিজের ঘরে চলে গেল।
বিকেলে আবির বাহিরে গিয়েছিল। আবিরের মা রেজোয়ান সাহেবকে যে সে কি ঝাড়লেন বলার মত না। যেনো মরার মত ঘুম তার। এতো কেউ দুনিয়াদারি ছেড়ে ঘুম কিভাবে ঘুমায়! সেই কষ্টে রেজোয়ান সাহেবের দুপুরের খাওয়াটা ও ভালো হলোনা।

এদিকে সুমি রাই কে নিয়ে বেরিয়েছে। আগামীকাল আবিরের জন্মদিন। এখন সবকিছুর আয়োজন তো করতেই হবে। মার্কেটে গিয়ে সে ইচ্ছেমত কেনাকাটা করলো সুমি।
ফাঁক বুঝে রাই আবিরের জন্য একটা ঘড়ি কিনে নিলো।

আবিরকে দেখা গেলো একটা প্রাইভেট ব্যাংক থেকে বেরোলো। ফোনটা হাতে নিয়ে কাওকে ফোন করলো কোথায় তুই?
ভাই আমি তো বাসায়, কেনো ভাই? সৌরভ নড়েচড়ে বসলো।
একটা অ্যাড্রেস দিচ্ছি, কুইক খবর লাগা।

জ্বী ভাই

আবির ফোনটা রেখে দিল। আর সৌরভ কে একটা অ্যাড্রেস সেন্ড করলো। তুই যা, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়ছি বলে আবির নিজের কালো সানগ্লাস চোখে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলো। পেছনে কতগুলো ওয়ার্কার কানাঘুষা করছে ছেলেটা কিউট ছিলনা?
হ্যাঁ কি হ্যান্ডসাম?

কালো জ্যাকেট, হোয়াইট টিশার্ট, চুলগুলো দেখেছিস?
আরেক মেয়ে বলে উঠলো আরে, দেখলেই বোঝা যায় খুব আপার ক্লাসের

এইসবই চলছিল। এর মধ্য থেকে দু একটা অবশ্য আবিরের কানেও এসেছে। তবে আবির উল্টো একটা তুচ্ছ হাসি দিয়ে গাড়িতে বসে গেলো
যার বর তার খবর নাই,
পাড়া পড়শীর ঘুম নাই

গাড়ি স্টার্ট দিলো। বা হাতে সানগ্লাসটা খুলে পাশের সিটে রেখে দিল।
মাত্রই সৌরভের সাথে সেই অ্যাড্রেসে পৌঁছেছে আবির। সৌরভ খবর নিয়েছে।
ভাই বিশেষ কিছু এইখানেও নেই

মনে হচ্ছে (একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ) বিয়ের বয়স হয়েছে তোর। বিয়ে ছাড়া ব্রেইন কাজ করছেনা?
সৌরভ একটু লজ্জা পেলো ভাই বিশ্বাস করেন, একটা কাজের খবর যদি পাই। এইবারের আপনার এই কেসগুলো সত্যিই জটিল।

প্রমোশন ও চাও, বিনা খাটুনিতে?
বলে আবির সিড়িতে উঠছিলো হঠাৎই একটা লোকের সাথে ধাক্কা লেগে গেলো। সরি বলে আবির চলে গেলো। লোকটা মাথা নিচু করে হাঁটা ধরলো। লোকটা প্রায় নিচে চলে গিয়েছে। আবির ও দোতলায় পৌঁছেছে।
ভাই, এই বাড়িতে কি কাজ আপনার?

আছে, ওই লোকটা…… সাথে সাথে আবিরের মাথায় কি একটা খেলে উঠলো সৌরভ ওই লোকটা….
সৌরভ এদিক ওদিক তাকালো কোন লোকটা?

আবির ওকে ধাক্কা দিয়ে ১০ সিড়ি নিচে নেমে গেলো। দূরে তাকিয়ে দেখে একটু আগের সেই ধাক্কা খাওয়া লোকটা দ্রুতবেগে দৌড়াচ্ছে। আবির ও এক ছুট লাগলো।
ভাই… সৌরভ ও পেছনে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলো।

এদিকে রোড ক্রস করে লোকটা অলরেডি অন্য একটা গলিতে ঢুকে গেছে। আবির ও প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। এই সেই লোকটা যাকে ও খুঁজে চলেছে।
আজ সত্যিই একবার হাতে আসুক।
সৌরভ পড়ে গেলো রাস্তার জ্যামে। গাড়ি একটার পর একটা এসেইচলেছে।
আবির দৌড়ে যতক্ষণে ওপরের গল্লিতে পৌঁছলো ততক্ষণে লোকটা গায়েব। পুরো হওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আবির রেগে পাশের একটা দেওয়ালে ঘুসি মারলো ড্যাম।

ভাই….. পেয়েছেন?
আবির মাথা নাড়লো। সৌরভ আশপাশের দু চারটে বাড়ির সিড়ি চেক করলো। নেই। চিনতেই দেরি হয়ে গেল।
রাই আর সুমি বাড়িতে ফিরেছে সবেমাত্র।

সব কেনাকাটা হয়ে গেছে। আগামীকাল রাত ১২ টায় আবির সারপ্রাইজটা পাবে। সবাই জানে ব্যাপারটা যে আয়োজন করা হচ্ছে, শুধু আবির বাদে। বাসায় ফিরেই রাই দেখেছিল নিশান কেমন করে যেনো ঘুমোচ্ছে।

ওর ঘরের দরজা হালকা খোলা। যেনো খুব ক্লান্ত। অবশ্য সারাদিন কি করে কই থাকে, কেউই তার খবর নেইনা। অথবা নিশান খবর দেয়না। তাতে এই মুহূর্তে রাই এর কিছুই যায় আসেনা।
ও যদি এতই ভালো হতো, তাহলে এমন গুন্ডাদের মতো অবস্থা না করে বাবার কাজে হাত দিত। বলে মুখ ঘুরিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় রাই।

ততক্ষণে আবার আবিরের মাথার ব্যান্ডেজের মধ্য থেকে অল্প অল্প রক্ত বের হতে শুরু করে দিয়েছে।
ভাই, আপনার তো আবারো রক্ত পড়ছে বলে
সৌরভ এগিয়ে গেলো।

এতো দৌড়াদৌড়ি করলে এমনটা হবেই
স্বাভাবিক বলে আবির গাড়ির দিকে ফিরল।
ভাই আপনি বাড়িতে যান, এদিকে অনেক সিসিটিভি আছে। আমি বাকিটা দেখছি।
না….

ভাই আপনার কথা শুনবো না। আপনি বাড়িতে যান। আমি বললাম। তো আমি দেখে নিব। এই অবস্থায় আপনি বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে পারবেন না। পরে আরেক ঝামেলা হবে

সৌরভের অনেক জোরাজুরিতে অবশেষে আবির বাড়ি ফিরতে বাধ্য হলো। যদিও জানে সৌরভ গাফিলতি করবেনা। কিন্তু লোকটা এতো চতুর যে হাতের কাছ দিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য।
এই মুহূর্তে আবির রাই এর সামনে বসা। রাই এর তো মেজাজ তুঙ্গে। রেগে রেগে আবিরের মাথার ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে।

যতই বলি এসব করবেন না, আমার কথা কে শোনে? যার যা ইচ্ছা তাই করে এবাড়িতে
আবির চুপ করে শুনছে।
রক্তই যদি বের হলো ব্যান্ডেজের কি মূল্য রয়ে গেলো? আপনি কি এমন করছিলেন যে এইটা হতেই হলো?
আবির নিজের হলদেটিয়ার কোমর জড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রাই নিজের মতই ব্যান্ডেজ করেই যাচ্ছে, আর বকবক করছে।

আমার কোনো মূল্যই নেই।
নিজেই নিজেকে মূল্যহীন বললে মানুষ কী বলবে?
সেই একই স্বভাব। এই ছেলের বাকা কথা আর শেষ হওয়ার না।

আমি বলছি কম আপনি প্রমাণ করছেন বেশি বলে রাই সরে গেলো।
রাতে রাই আর বাকিরা মিলে অলরেডি সব প্ল্যানিং করে নিয়েছে। আগামীকাল কিভাবে কি হবে সেসব। আবির আপাতত রেজোয়ান সাহেবের সাথে কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

পরদিন সকাল থেকেই আয়োজন শুরু হয়েছে। আবির রেজোয়ান সাহেবের সাথে অফিসে গিয়েছে। নিশানের খবর কেউই জানেনা। এস ইউসুয়াল। যাইহোক সবাই আবিরের পছন্দের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত। কেক তৈরি হচ্ছে বাড়িতেই। সুমি আর রাই মিলে কেক তৈরি করছে।

এভাবেই হাসি ঠাট্টায় দিন পার হয়ে গেলো।
রাত ৯ টায় মাত্রই সবাই কাজ শেষ করে নিজের নিজের ঘরে যাবে, তখনি রেজোয়ান সাহেব আর আবির ফিরে এলো।

রেজোয়ান সাহেব ঘরে ঢুকেই খাবারের সুস্বাদু ঘ্রাণ নাকে টেনে বললেন আরে বাহ, মনে হচ্ছে ভালো কিছু রান্না হয়েছে?
আবির ও পেছনে সবেমাত্র ঘরে ঢুকলো। ফুপি বললেন হ্যাঁ হয়েছে মানে? ভাবি তোমার জন্য রাজভোগ সাজিয়েছে সবাই হেসে উঠলো।
এইযে একটা কথা বললি তুই। নির্ঘাত ঘাপলা আছে।

আবিরের মা এগিয়ে গেলো এই কি ঘাপলা হ্যাঁ? রেগে গেলেন।
মানে এই কথাটা মানতে আমি নারাজ। তুমি নিশ্চই নিজের ছেলেদের জন্যই রান্না করেছো
মহিলা কিছু জবাব দিবে তার আগেই আবিরের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন কানে নিতেই আবিরের মুখ ভাব বদলে গেলো।
ফোন কেটে ও ঘুরে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
এই আবির সবাই ডাকলো। রাই ব্যাপক অবাক। এদিকে আবির তাড়াহুড়ো করে সিড়ি থেকে নেমে নিচে চলে গেলো।

কিহলো ওর? সুমি বললো। রেজোয়ান সাহেব তেমন পাত্তা দিলেননা চিন্তা করো না, ও চলে আসবে। চলো তো
রাই এরই মাঝে আবিরের ফোন একটা মেসেজ দিয়ে দিলো রাত ১২ টার মধ্যে ছাদে চলে এসেন। প্লিজ
ওদিকে আবিরের ফোন মেসেজ এসেছে, ও একপলক দেখেই ফোনটা রেখে গাড়ি স্টার্ট করল।
এদিকে রাত প্রায় ১২ টা বাজতে গেলো। আবিরের দেখা নেই।

সবাই ছাদে দাড়িয়ে। খুব সুন্দর করে বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে ছাদটা। সবকিছু ঠিকঠাক। শুধু আবির ই নেই। রাই একটা লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরেছে। সাথে হালকা সাজ। যেহেতু উনি বেশি সাজগোজ পছন্দ করেন না। ফলে রাই ও এখন অতটা সাজে না।

কিন্তু একে একে সেকেন্ড মিনিট ঘণ্টা চলে যাচ্ছে আবিরের দেখা নেই। সবাই ক্লান্ত। এখন রাত ১ টা। আবির নেই। সবাই অনবরত কল করেই যাচ্ছে। কিন্তু ওর কোনো রেসপন্স নেই। সবাই সত্যিই এবার রেগে যাচ্ছে। এমনটা কেউ করে!
কি হলো ছেলেটার?

কি জানি। ফোনটা ও ধরছে না।
ভাইয়ার যদি কাজ থাকে তো বলেই যেত।
অফিসের কাজ তো আজ আর নেই। থাকলেও কি ও রাত পার করবে?
বুঝি না, কি ছেলে পেটে ধরলাম। এক চুলও যদি বুঝি ওকে।

সবাই নিজের মধ্যেই কথা বকে যাচ্ছে। আর রাই এর দৃষ্টি দুরেরর ওই এলইডি আলোয় আলোকিত রাস্তার দিকে। যদি আবির আসে।
আচ্ছা এখানে এভাবে দাড়িয়ে থেকে আর লাভ নেই। ও আসলে নাহয় আমরাও আসবো চলো বাসায় ফুপি উঠে দাড়ালো।
বাকিরা ও বসা থেকে উঠে দাড়ালো।

হ্যাঁ চলো।
রাই বললো আপনারা যান। আমি নাহয় একটু পরেই আসি। দেখি উনি যদি আসে।
না না এই রাতে ছাদে থাকা লাগবেনা। চলো ও আসলে আবার আসবো আবিরের মা বললেন।
মা দেখি না। যদি চলে আসেন। একটু পরেই আমিও চলে আসবো। কিন্…..

আহা, থাক থাকতে দাও। রাই ওই হদচ্ছড়া আসলে আমাদের ডেকো বললেন রেজোয়ান সাহেব।
সুমি থাকতে চাইলেও ফুপি দিলেন না। ওদের প্রাইভেট টাইম ও তো দরকার। তাই সবাই একে একে ছাদ থেকে নেমে গেলো।
পেছনে রয়ে গেলো রাই।

একে একে সময় পার হয়ে গেলো। কিন্তু তখনো আবিরের দেখা নেই। রাই চেয়ারে বসে, আছে। আর অপেক্ষা করছে।
আজকে ভেবেছিলাম খুব সুন্দর করে আপনাকে কিছু কথা বলবো। যেগুলো এর আগে বলা হয় নি। আপনিই তো সেই কথা গুলো শোনার জন্য এত টর্চার করেছেন। আর আজ যখন আমি প্রস্তুত (হাতের গিফট বক্সের দিকে তাকিয়ে) তখন আপনিই নেই।

আঁধারে ছাওয়া কালো আকাশটাই ও আজ চাঁদের দেখা নেই। ছাদের হলদে বাতির আলোয় যতটুকু স্পষ্ট, সেটুকুতেই রাই চোখ বুলিয়ে নিলো। কত সুন্দর করে সাজানো এই জায়গাটা।
যেমন সাজ, তেমন সময়। তবুও আপনিই নেই। কখন আসবেন?

আচ্ছা (বাচ্চাদের মত করে) আপনি কি শুনতে চান না আমি… নাহ আর বলবো না, আসুন আগে তারপর ইচ্ছেমত বকবো। তারপরে যদি আপনি ক্ষমা টমা চান তারপর ভেবে দেখবো……
রাই এর চোখ ঘুমে আচ্ছন্ন। একটু একটু করে রাই টেবিলের ওপর মাথাটা নুইয়ে দিলো। চোখজোড়া সত্যিই লেগে আসছে। কি করবে ও জানেনা। আবির কেনো আসছে না।

বক্সের মধ্য থেকে ঘড়ির কাটার টিকটিক আওয়াজ ও এই নিস্তব্ধতায় স্পষ্ট কানে আসছে। মস্তিষ্ক জেগে থাকতে চাইলেও শরীর আর এই ক্লান্তির ভার সইতে পারলো না।
চোখজোড়া শুধু লেগে এলো।

রাত ২ টা। আবির এখনও যদিও বাড়ি পৌঁছয় নি। তবে ছাদে কেউ একজন অগোছালো পা ফেলে উঠে এলো। তার চোখ গুলো জ্বলজ্বল করছে। আশেপাশের এই সাজ এই আনন্দ তার একটুও সহ্য হলো না। তার থেকে বেশি তার চোখে কাটার মত বিধলো একটাই দৃশ্য।

লাল শাড়িতে একদম নববধূ বেশে ওই চেয়ারটায় বসে টেবিলে মাথা রেখে অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়া রাই। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী উলোট পালোট করে দেক। একপা একপা করে সে রাই এর দিকে এগোতে লাগলো। আজকে কিছু একটা খুব বড়ো অঘটন ঘটবে। প্রকৃতি তার সাক্ষী। আশেপাশে হালকা বাতাসে যেনো এই বার্তাই ভেসে বেড়াচ্ছে, যা শোনার মত সক্ষমতায় রাই নেই।


পর্ব ২০

রাই…. একটা কণ্ঠস্বর কনে এলো। ইতোমধ্যেই ঘুম ভেংগে গিয়েছে রাই। এর কন্ঠটা শুনে মনে হলো খুব পরিচিত স্বর। রাই এর মাথায় প্রথমেই আবিরের কথা এলো। রাই মনে মনেই খুশি হয়ে গেল।

ওদিকে…

ভেতরে কেবিনে শুয়ে আছে সৌরভ। ডক্টর চেকআপ শেষে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই আবির এগিয়ে গেলো ডক্টর পেশেন্ট এর কী অবস্থা?
বেশি গভীরভাবে আঘাত পায়নি, বলে বেঁচে গেছে। খুব ভারী লোহার রড ধরনের কিছু দিয়েই মাথায় আঘাত করা হয়েছে।

এখন কি দেখা করা সম্ভব?
উম, জ্ঞান ফিরলেই পারবেন। তবে স্ট্রেস দেওয়া যাবেনা
জ্বী। থ্যাংক ইউ ডক্টর ডক্টর চলে গেলেন।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর নার্স ও বেরিয়ে এলেন পেশেন্ট এর বাড়ির লোক কে? আবির এগিয়ে গেলো।
হ্যাঁ, দেখা করতে পারবেন তবে কিছুক্ষণের জন্য
আবির সম্মতি দিলো।
ভেতরে গিয়ে দেখে সৌরভ চোখ বন্ধ করে আছে। কারো আসার শব্দে ও চোখ খুলে তাকালো। অস্ফুট স্বরে বলল ভাই….

আবির গিয়ে পাশে বসলো আমাকে তো একটা ফোন করা যেত নাকি? তোর কিছু হলে আমি?
সৌরভ কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।
আবির ও চুপ রইলো।

(আসলে তখন সন্ধ্যায় যখন আবির বাসায় ধকে তখনি একটা লোকের কল আসে, লোকটা বলে একজন রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। তাকে হাসপাতালে পৌঁছনো হয়েছে। তার ফোন থেকে প্রথম নম্বর নাকি আবিরের ছিলো।তাই ওটায় ফোন করেছে। এজন্য আবির তাড়াহুড়োয় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়)
সরি ভাই….. অস্ফুট স্বরে।
ঠিক কি হয়েছিল?

সৌরভ একটা নিশ্বাস ফেললো ভাই, গতকালকের ওই লোকটার আস্তানা খুঁজে পেয়েছিলাম। তাই, (একটু থেমে ) তাই, ভাবলাম যে সময় নষ্ট না করে আগে ওকে গিয়ে ধরি। তারপর, আপনার কাছে। কিন্তু।………… ঐখানে পৌঁছনোর পর, ও কোনোভাবে টের পায়। ধরতে গিয়ে হাতাহাতি হয়। আর শেষে রাস্তার পাশের একটা লোহার পাইপ পড়ে ছিল। ঐটা…
আবির হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিল লোকটা কে?

এখনও পরিচয় পাইনি। শুধু, ওকে খুঁজে পেয়েছিলাম সিসিটিভি, দিয়ে
আবির একটু গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো। গণিতবিদদের মতো করে কতগুলো হিসাব মিটিয়ে সৌরভের দিকে তাকালো রেস্ট কর। সুস্থ হওয়া পর্যন্ত আর উঠতে হবেনা।

সৌরভ আর কিছু বললো না। ওর মাথার ব্যথাটা যেনো বেড়ে যাচ্ছে।
আবির কেবিন থেকে বেরিয়ে নার্সকে বলে গেলো।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আবির একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে এখন রাত ২ টা। তখনি ফোনের মেসেজটার দিকে আবারো নজর গেলো। রাই এর মেসেজটা। আবির প্রায় ভুলেই গিয়েছিল….. কিন্তু ছাদে কেনো? যাইহোক সেদিকে আবিরের মাথা ব্যাথা নেই। গাড়িতে উঠে আবির গাড়ি স্টার্ট করলো।

বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে আবিরের প্রায় আধ ঘন্টা লেগে গেলো।
ফ্ল্যাটে না ঢুকে আবির সরাসরি ছাদের দিকে গেলো। অবশ্য মেসেজে ১২ টার কথা উল্লেখ থাকলেও, একবার দেখে আসতে চায় রাই আছে কিনা। না থাকলে তো ভালো। বাসায় চলে যাবে।

কিন্তু আশ্চর্য বিষয় যে ছাদ থেকে একটা শব্দ একাধারে ভেসে আসছে। আর ১০ টা সিড়ি পার করেই ছাদ। কিন্তু কিসের শব্দ! যত সিড়ি উপরে উঠছে, ততই যেনো আবিরের কানে শব্দটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
যেনো কারো কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আবির এর খটকা লাগলো। সোজা দৌড়ে উপরে উঠে গেলো।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আবির থমকে গেলো।

ঠিক তার সামনে মাটিতে বসে আছে রাই। লাল শাড়িতে। কিন্তু বাকি চারিদিকের অবস্থা দেখে আবিরের বিস্ময়ের শেষ রইলো না। চারদিকের অবস্থা খারাপ। মনে হচ্ছে ছাদে বেলুন আর অন্যান্য কিছু দিয়ে সাজানো হয়েছিল যেগুলো কেউ ছিড়ে মাটিতে ফেলেছে, সবকিছু উলোট পালোট। একটা টেবিল ও উল্টে পড়ে আছে। কিন্তু এরই মধ্যে আবিরের চোখ গেলো রাই এর হাতের দিকে। আবির দৌড়ে গেলো রাই……

তোমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে কেনো? রাই,? আবির দেখলো মেঝেতে ভাঙ্গা কাছের চুড়ি পড়ে আছে। আর রাই এর হাতেও সেই একই কাচের চুড়ি। রাই শুধু কান্না করছে। ওর চোখের কাজল ও কান্নার জন্য লেপ্টে গেছে, চুলগুলো এলোমেলো। আবিরের বুকে যেনো কেউ হাজার টনের পাথর চাপা দিচ্ছে ক্রমশ। এতটা ব্যাথা করছে।

রাই।.
রাই আবিরের দিকে ভালো করে তাকালো দুর হন আমার থেকে বলে আবিরকে ঠেলে সরিয়ে দিলো রাই। উঠে দাড়ালো। আবির অবাক।
রাই…..!

আমার নাম নিজের মুখে আনবেন না কান্নার জন্য ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বললো রাই। আমার….. কাছেও… আসবেন না
আবির উঠে দাড়ালো কিন্তু কি হয়েছে তোমার? আবির এগিয়ে গেলেই রাই পিছিয়ে গেলো আর নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চিৎকার করলো বলেছিনা….. দু দূরে থ থাকুন…. বলেছিনা
দেখো সব কথা পরে। তোমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে …

রাই আবারো চেঁচিয়ে উঠলো আপনার দেখা লাগবে না….. এখন থেকে চলে যান
আবির স্পষ্ট বুঝতে পারলো এই রাগটা কোনো অভিমান নয়। বা রাই ওর দেরিতে আসার জন্য রেগে নেই। অন্য কোনো কিছু হয়েছে…. আবির বিস্ময় চোখে তাকিয়ে রইলো।

রাই একহাতে মাথা চেপে ধরে নিজের কান্না থামানোর প্রচুর চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। ওর কান্নার বেগ শুধু বেড়েই চলেছে।
ও হটাৎ আবিরের দিকে তাকালো। আবির সত্যিই জানেনা ওর কি করা উচিৎ।
রাই একপা একপা করে আবিরের দিকে এগোলো। আর গিয়ে ওর শার্ট এর কলার চেপে ধরলো কেনো করলেন আমার সাথে এমন?

আমি…
কেনো করলেন? কিসের প্রতিশোধ চান? আমি আপনার কোন ক্ষতিটা করেছি? বলে রাই গর্জে উঠলো।
আবির যেনো একের পর এক শক খাচ্ছে কি করেছি আমি?

রাই রেগে গেলো তবে তুচ্ছ হেসে বললো ওহ, হ্যাঁ জানেনই তো না কি করেছেন। কিভাবে জানবেন? আপনি তো স্বীকার ই করেন না। জানবেন কি?
আবির রাই এর দুবাহু ধরলো স্পষ্ট করে বলো কি বলতে চাচ্ছো?

রাই কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। তারপর কান্নাজড়িত গলায় বলল আমাদের বিয়েটা ঠিক কি আবির?
আবির এর চোখ মুখ সংকুচিত হয়ে এলো এই কথার অর্থ ওর মস্তিষ্কে ধারণ হচ্ছেনা মানে?
বোঝেন না? বলে রাই ওর হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো আপনার এই মিথ্যে ভালোবাসা, কতগুলো বানানো কথা আমার আর জাস্ট সহ্য হচ্ছেনা।
বানানো!

হ্যাঁ বানানো। সব মিথ্যে। সব। আমি বুঝি না আপনারা ছেলেরা আমাকে কি পেয়েছেন? কি আমি? ননীর পুতুল? এতই সস্তা যে যখন যে ধাঁচে ফেলবেন তার মধ্যেই আমাকে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে? আপনাদের দুই ভাই এর মিথ্যে কিছু কথার জালে পড়ে আজ আমি শেষ। আমার আমিই আজ শেষ। কেনো আমার সাথে এই মিথ্যে খেলাগুলো খেললেন?

আবিরের রক্ত গরম হয়ে আসছে। এসব কি উল্টোপাল্টা বলছে রাই। ও চেঁচিয়ে উঠলো রাই,।
হ্যাঁ এক্সাক্টলী। এখন চিল্লাবেন। এটা ছাড়া কোনো উপায় আপনার জানা আছে কি?
রাই তুমি কি সোজাভাবে বলবে কি হয়েছে?

রাই নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে কি হয়েছে? সত্যিটা জেনে গেছি… আর কি হবে? (চোখ মুখ কঠিন হয়ে এলো রাই এর) নিশান আমাকে সবটা বলে দিয়েছে, সেদিন ঠিক কি হয়েছিল
আবির মুহূর্তেই থমকে গেলো। নিশান বলে দিয়েছে মানে! অর্থাৎ সেদিন সুরাইয়াদের বাড়িতে যা হয়েছে সেটাই বলে দিয়েছে?

রাই বাকা হাসলো কিহলো? মিস্টার চৌধুরী….. এখন কথা নেই কেনো?
আবির আর কিছু বললো না। ও শুধু রাই এর কথা শোনার জন্য তাকিয়ে রইলো। পিনপতন নিরবতা ভেঙে রাই আবারো বলতে শুরু করলো

কেনো এরকম একটা আঘাত আমাকেই সইতে হলো বলবেন? আমি তো শুধুই একজনকে চেয়েছিলাম মাত্র। হ্যাঁ এখন চাই না। কিন্তু একটা সময় তো আমি নিশান কে চেয়েছিলাম। ওকে পছন্দ করতাম। ভালোবাসার কথা নাই বলি। কিন্তু আপনি সেটুকু ও কেড়ে নিয়েছিলেন।
ঠিকাছে মেনে নিলাম।

আপনার কিছু বানানো কথার জন্য সেদিন আমার বাবা মা আমাকে। (চোখ বুজে নিলো রাই ) তাও মেনে নিলাম।
আপনাকে বিয়ে করতে হয়েছে? যেখানে আপনাকে আমি কখনো চিন্তাই করিনি। মেনে নিলাম।
এবাড়িতে আসলাম, একে একে আপনার পরিবারের প্রত্যেকে আমাকে যতটুকু কথা শুনিয়েছে যা অসম্মান করেছে
তাও মেনে নিলাম।

আপনার সব অত্যাচার, (আবির ভ্রু কুঁচকে তাকালো, রাই জোর দিয়ে বললো) হ্যাঁ অত্যাচার সেটাও মেনেই নিলাম।
অবশেষে, সব ভুলে সব সব কিছু ভুলে আপনাকেও মেনেই নিচ্ছিলাম….. হ্যাঁ নিচ্ছিলাম। কিন্তু গেস হোয়াট?

আজ এসে আমি জানতে পারলাম আপনি, আপনার ভালোবাসা, আপনার কেয়ারিং, আপনার সবটুকু শুধুই একটা মিথ্যে। একটা সাজানো সুন্দর মিথ্যে। এটুকু বলে রাই থামলো। আবিরের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। কিন্তু আবির শুনতে চায় রাই ঠিক কেনো এসব বলছে। রাই আবারো বলতে শুরু করলো
আজ এসে নাকি জানলাম যে আপনিই আমাকে আর নিশানকে একটা মিথ্যে খেলায় ফাঁসিয়ে নিয়েছিলেন। আপনিই।

সেদিন যখন মিহির ভাইয়ের বাবা এতসব বলছিল তখন নাকি নিশান ছিলো সেখানে। নিশান হয়ত বলতেই যাচ্ছিলো যে আসলে ওর আর আমার। যাইহোক। ঠিক সেই মুহূর্তে আপনি ওখানে গিয়ে উপস্থিত হন। আর কথা ঘুরিয়ে দেন। আর নিজের মিথ্যে সাজান।

নিশান কিছু বলবে তার আগেই আপনি ওকে অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে আমার (ঘৃণায় মাথা নাড়লো) আমার নামে হুমকি দেন যে নিশান কিছু বললেই আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন? ছি…..
আবির এর হাত আলগা হয়ে এলো। ও রাই এর মুখ থেকে অন্ততপক্ষে একথা আশা করেনি।

আর এই একটা কারণেই নিশান কিচ্ছু বলতে পারেনি?কিছুনা। রাই একহাতে চোখের পানি মুছে নিল হ্যা যদিও নিশান এর সাথে আমার সব সম্পর্কই একটা ঘৃণার বিষয় ছিল আমিও মানছি। ওকে তো সেদিনই মন থেকে মিটিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু… কিন্তু এই শূন্য মনে পুনরায় সতেজতা ফিরিয়ে এভাবে ভেঙে ফেললেন? আজ যদি আপনি আমার জীবনে এই মোড়টা না ঘুরতেন হ্যাঁ নিশান কে পেতাম না তবে অন্তত এই মিথ্যে জগতের বাসিন্দা তো হতে হতো না।

শেষ পর্যন্ত, আমার আমিটুকুও তো সেরাতে আপনি দখল করে নিয়েছেন। আর কি বাকি? আর কি?
কেনো করলেন এটা? শুধুই একটা প্রতিশোধের জন্য? শুধুই নিজের ভাইকে সহ্য করতে পারেন না তাই? নাকি নিজের লালসার জন্য?

আবির সজোরে রাই এর গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। রাই কিছুটা সরে গেলো। অঝোরে ওর চোখ থেকে পানি পড়ছে। এই আবির ই কি সে? আজ পর্যন্ত তো ওর গায়ে হাত তোলে নি।তবে আজ?
রাই সোজা হয়ে দাড়াল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল এখন, তো…… এটাও সইতেই হবে। হুম…… সয়ে নিবো।

অন্তত একটা বার বলে দেখতেন। আপনার। পায়ে পড়ে… খো ক্ষমা চেয়ে….. নিতাম
সাথে সাথে রাই এর আরেক গালে একটা চড় পড়লো। আবির নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চড় দিয়েছে। সত্যিই কি এই কথাগুলো ওর শোনার কথা ছিল? এই ধরনের বিষাক্ত কথা ওর সহ্যসীমার বাইরে।
পর যদি আপনাকে খুন করে যায় তাও আপনি সইতে পারবেন। কিন্তু আপনজন যখন অবিশ্বাস করে সেটা কিভাবে সইবেন?

রাই এর মাথাটা ঘুরছে। একেই এতক্ষণ কান্না, তারপর এই অবস্থা। ওর আর সহ্য হলো না। রাই আবিরকে ধাক্কা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছাদ ছেড়ে নিচে চলে গেলো।
আবির রাগের মাথায় দেওয়ালে দুটো ঘুষি দিলো। ওর মাথা কাজ করছে না। দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কিছু একটা ভাবলো।

আবিরের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। ও ঘুরেই দ্রুতবেগে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো।
গাড়িতে উঠেই সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালানো শুরু করলো। আর শুধু রাই এর কথাগুলোই কানে বাজছিল।
আবিরের চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা দৃশ্য _
অতীতে…..

সেদিন মিহিরের বাড়িতে আবির নিশান এর ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, তখনি ওর কানে কিছু কথা ভেসে এলো।
আবির অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভালো করে শোনার জন্য নিশানের ঘরের দিকে তাকালো। ভেতরে নিশান দাড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছিল।
কিসের টাকা? তুমি তো এখনও আমার কাজটাই শেষ করনি। আবার কিসের টাকা?

ওহ হ্যালো…… তোমাকে আমি আরো ২ মাস আগেই বলেছিলাম, আবির ভাই এর কাছে যাওয়ার মিথ্যে নাটক করো। আর সেই ছবিগুলো ফাঁস করে দাও। তুমি এখনও…. মানে এখনও পর্যন্ত এই কাজটাই করতে পারোনি। আবার টাকা! রেগে গেলো নিশান।
আবির চরম অবাক। নিশান কাকে বলছে এটা? নিশান আবারো বললো কখনো যেনো আমাকে ফোন করতে না দেখি বলে ফোন কেটে দিল। আর খাটে বসে পড়লো।

এর আগের বারও ওই মেয়েটা এই কাজটা করতে পারেনি। আর এইবারের এইটা তো শুরুই করেনি। উফফ….. আবির ভাই কে কোনোভাবেই সরানো যাচ্ছে না ব্যবসা থেকে। কোনোভাবেই না

আবির এর সব এ টু জেড সব ক্লিয়ার হয়ে গেল। ওর আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ১ বছর আগেও একটা মেয়ে ওর নামে মিথ্যে গুজব ছড়িয়েছিলো।

ওর চরিত্রহীন হওয়ার। কিন্তু সেবারের মেয়ে টাকে আবির খুব ভালোমতই শিক্ষা দিয়েছিল নিজের মিথ্যে বলার। আর তখন থেকেই আবিরের কোনো মেয়েকে সহ্য হইনা। এবারেও নিশান একই কাজ করছিল! এটা জেনে যতটা না ধাক্কা লেগেছে তার থেকে বেশি আবিরের ঘৃণা হচ্ছে নিশানের মতো ভাই পেঁয়ে।
_বর্তমানে
আবির গাড়ি চালাচ্ছে।

এই একটা কারণেই তোমাকেও (রাই কে) আমার শুরুতে সহ্য হতো না। ভাবতাম সব মেয়েরাই এমন খারাপ। কিন্তু……
গাড়িটা ডান দিকে মোচড় দিলো।

নিশান যে কতগুলো মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে সেটা আবির এর মিহির বাদে কেউ জানেনা। ওর স্বভাব ব্যবহার আবিরের এতটাই পরিচিত যে রীতিমত ওকে না পছন্দ করার অনেক কারণ আছে সবার। যার জন্য এই কথাটা নিশানের মুখে জানার পরই আবিরের একটা ধারণা বদলে যায়, যে রাই ও আবিরের মতই।
নিশান একটা বারে, মদের নেশায় মক্ত। পুরো বারে শুধু বড়লকদের নেশাখোর ছেলেমেয়েরা।

কার গায়ের ওপরে কে পড়ছে। কে কোনদিকে যাচ্ছে কোনো খেয়াল নেই। নিশান একগ্লাস মদ সাবার করে যেই না পেছনে ঘুরতে গেলো কেউ ওর গালে সজোরে চড় মারলো। আর ওর টিশার্ট এর কলার চেপে ধরে টেনে নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারলো। নিশান কিছু বুঝবে তার আগেই ওকে বেধরে কেউ মারতে লাগলো। বারের গান বাজনা বন্ধ হয়ে গেলো। সবাই নিজের দৃষ্টি এই দৃশ্যে কেন্দ্রীভূত করলো।

একটা পর্যায়ে গিয়ে নিশান নিজেকে বাঁচিয়ে ঢুলতে ঢুলতে একদিকে চেপে চিৎকার করে উঠলো কেহ.? কে
আবির দাড়িয়ে। চোখে মুখে এমন হিংস্রতা, এমন এক আগুন যা সহজেই কাওকে ঝলসে দিতে পারে। এই মুহূর্তে ওর পথে কেউ আসা মানেই প্রাণ হারানো। নিশান ঢুলতে ঢুলতে বললো ভাই….. তুই!

আবির এক ছুটে গিয়ে আবারো নিশানকে টেনে মারতে যাবে নিশান ভয় পেয়ে গেল ভাই ভাই ভাই….. মারবি না প্লিজ প্লিজ। আবির ওকে ধরে আবারো মাটিতে ছুড়ে ফেললো।
নিশান মুখ থুবড়ে পড়ল ভাই…… বলবি তো কি হয়েছে?

মুখে বলে যদি নিজের মধ্যকার আগুন মেটানো যেত সেটা আবির আগেই করে নিত। কিন্তু তা সম্ভব না।
ভাই….. বলবি?
আবির আস্তে আস্তে গিয়ে নিশানের পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।

গলাটা চেপে ধরে ক্রোধান্বিত স্বরে বলল
কাপুরুষ শব্দটা ও তোর সাথে যায়না। নিকৃষ্টের সীমাটুকুতেও নেই তুই।
নিশানের দম আটকে আসছে ওহ তাই নাকি ব্রো? আমি?

বলে আবিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কাশতে কাশতে উঠে দাড়ালো নিশান। সাথে আবির ও। নিশান গর্জন করে উঠলো
নিকৃষ্ট! হাহ, ভাইয়ের প্রেমিকার সাথে ঘর আমি বাধি নি। আর না মিথ্যে ষড়যন্ত্র করে কাওকে হাতিয়ে নিয়েছি। আর না অন্য কারো লাভ ওয়ান্স কে নিজের সম্পত্তির মত করে আত্মসাৎ করেছি….. তাহলে?
আবির এর রাগ তুঙ্গে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা মনে এখন ধ্বংস।

আবির গিয়ে নিশানের গলা চেপে ধরে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা দিলো।
অগণিত মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করা, নিজের ভাইয়ের ফিয়নসে এর সাথে অবৈধ সম্পর্ক, ভাই কে ক্যারেকটারলেস বানানোর চেষ্টা। একবার না, তার ওপর (গলা আরো শক্ত করে চেপে) রাই এর ওপরে নজর।

নিশান কোনোভাবে ধাক্কা দিয়ে আবিরকে নিজের থেকে সরিয়ে নিলো হ্যাঁ….. ছি ছিলাম খারাপ। এইসব করেছি। করতে চেয়েছি। রাই এর দিকেও নজর দিয়েছি। হ্যাঁ আমি খারাপ।

কিন্তু কি জানিস তো…… জীবনের এই প্রথম নিশান। এই প্লেবয় নিশান চৌধুরী কারো প্রেমে পাগল হয়েছিল, অজান্তেই। কিন্তু হয়েছি। আমি রাই কে শুরু থেকেই ভালবাসতাম। বুঝতেই যেটুকু দেরি হয়ে গেছে।
আবির তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল ভালোবাসা!

হ্যাঁ ভালোবাসি গর্জে উঠল নিশান প্রচণ্ড ভালোবাসি। ওকে হারানোর পর বুঝেছি আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। সেদিন শুধু মাত্র তোর ম্যানিপুলেশন এর জন্যই আমি কাওকে বলতে পারিনি আমি ওকে কতটা ভালোবাসি।
দুজনের মনে ভেসে উঠলো সেদিনকার ঘটনা

মিহিরের বাবা সবাইকে রাই এর নামে যা ইচ্ছে তাই বলছে। পুরনো ধারণার মানুষ। স্বাভাবিক উনি বিষয়টা উল্টোভাবে নিয়েছেন। না বুঝেই। কিন্তু যেটা ঘটেছে সেটাকেও অস্বীকার করা যায়না। নিশানের এসব কথা সহ্য হচ্ছিল না। যদিও ও রাই কে ভালোবাসে না বলে ওর ধারণা। কিন্তু কথাগুলো ওর নিজেরই বিচ্ছিরি লাগছে।
ওদিকে আবির মিহিরদের বাড়িতে নিজের ঘরে বসে ছিল। তখনি সৌরভের ফোন এলো।
হ্যালো ভাই…..

হুম, বল
ভাই….. আসলে….
কথা বলার পাসপোর্ট লাগবে তোর?
হেহ না ভাই। আসলে খবরটা….

…… আবির শোনার অপেক্ষায়
সৌরভ খুব দ্বিধাবোধ নিয়েই বললো হ্যা ভাই। আমি ক্রস চেক করেছি। সেদিন হোটেলে নিশানের সাথে নীলা ও ছিলো। ওদের ছবি সবাই কনফার্ম করেছে

আবির এর হাতে আর কিছুই থাকলো না। বাকা হাসলো আর যদি খবরটা ভুল হয়?
আমার গলা আপনার গুলি
আবির ফোনটা কেটে দিলো। এইবারে আর আবির মস্তিষ্কের কথায় মনকে হারতে দিতে চায়না। ও বেরিয়ে গেলো সুরাইয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে।

ওদিকে নিশান যখন কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই বাড়ির বাইরে গাড়ির হর্ণ।
সবাই জানালা ভেদ করে বাহিরে তাকালো। আবির গাড়ি থেকে বেরিয়ে এই বাড়ির দিকেই আসছে। সবাই মোটামুটি অবাক ছিলো।

আবির ভেতরে এসে এই অবস্থা দেখে সত্যিই অবাক ছিলো। ও তো ভেবেছিল নিশানকে এনে শাস্তি দিবে, কিন্তু যখন মিহিরের বাবার মুখে সেই রাতের কথা শুনলো। তখন আবিরের মাথাটা জাস্ট হ্যাং হয়ে গেল। ও খুব কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করেছিল সেদিন। আর কোনো প্রস্তুতি বাদেই রাই এর সাথে নিজের সম্পর্কের কথা বলে ফেলেছিল।

আর নিশান কে টেনে অন্যত্রে নিয়ে গিয়েছিল তোর বিদেশ যাওয়ার ভিসা রেডি। আগামী তিনমাসের মধ্যেই যাবি
কিন্তু ভাই।

রাই এর সাথে তোর কি হয়েছে না হয়েছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। আর তোর নিজের সপ্ন, বিদেশ যাওয়া ইত্যাদির মাঝে নিশ্চই তৃতীয় কেউ নেই বলে বাবা জানে। আশা করি সুযোগের সদ্যব্যবহার তোর জানা আছে।

নিশান সেই মুহূর্তে অনেকটাই বিভ্রমে পড়ে যায়। হ্যাঁ আউট অফ কান্ট্রি ওর সপ্ন, কিন্তু রাই কে ও ও নিজে ভালোবাসে না। সেক্ষেত্রে তো ওর এই সম্পর্কে চিন্তা করার কিছুই নেই। তাহলে? তবুও নিশানের মনে একটা খচখচ রয়েই যাচ্ছে।
আবির সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো, ওদিকে রাই ততক্ষণে এসে গিয়েছে। আর বাহিরের হট্টগোলে নিশান ও বেরিয়ে গেলো।
___বর্তমানে

নিশান এর চোখে পানি আমার অজান্তেই আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছি। শুধু তোর জন্য। নাহলে আজ রাই আমার কাছে থাকতো। হ্যা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছি, আমি কাকে হারিয়েছি। শুধু তোর কথার জালে। হ্যা আমার ভুল স্বীকার করে আমি ক্ষমা চাইতাম কিন্তু সেই সুযোগটুকু ও শেষমেষ আমার রইলো না।

হেহ…. আর কি? কি বলছিলি তোর ফিয়ন্সে? ওর থেকে চরিত্রহীন এই দুনিয়ায় কেউ নেই। আমি ওকে অফার করিনি…. ও নিজেই এসেছিল। হ্যা নিজেই। তবে ওর মতো মেয়ের গায়ে হাত দিতেও আমার ঘিন্না হয়। ব্রো ব্রো, যতই রিলেশন করিনা কেনো জীবনে কেউ বলতে পারবে না ওদের সাথে রাত পার করেছি।

আর তোর টা! হেসে উঠলো নিশান ওর থেকে মার্কামারা বোকা আর দ্বিতীয় কেউ নেই। রুমে ঢুকে নেশাপানি করেই ফিট….. (আবারো হাসলো নিশান। অট্টহাসিতে) ওকে ছুবে এই নিশান? হেহ…. আমার লেভেল এ পড়ে ওর মতো মেয়ে!

আবির এর রাগ কমে নি এক শতাংশ। এইসব বেকার কথায় আবিরের কিচ্ছু যায় আসেনা এতই ভালো তুই? তাহলে নিজের পাপ নিজ মুখে স্বীকার করতে কোথায় বাঁধলো?

নিশান রেগে তাকালো বাঁধবে না? তুই আমাকে রাই এর কাছ থেকে দুর করেছিস। তুই… আর কেউ না। তো নে, তোর সুখের সংসার….. ওহ সরি রাই তো তোকে শুরু থেকেই ঘৃণাই করতো। এখন নাহয় আরেকটু বেড়ে গেলো সে মাত্রা…..

আবির নিজের জিন্সের পকেটে দুহাত গুজে নিশানের কাছে এগোলো। ওর ঠিক মুখ বরাবর দাড়ালো আবির
ঘৃণা থেকে ভালোবাসা… পথটার মতো অসম্ভব আর কোনো কিছুই হতে পারে না।
তুই ওর পছন্দ কেও নিজের করতে পারিস নি।

আমি ওর ঘৃণাটুকু কেও নিজের নামে করে নিয়েছি।
ভালোবাসা লাগবে না।

কিন্তু ওর গায়ে লেখা প্রতিটি স্পর্শে এই ঘৃণা নামক আবিরেরই অস্তিত্ব, খুঁজে পাবি। (কণ্ঠস্বর নিচু করে) বারংবার
নিশান এর যেনো অস্তিত্বটাই মিটে গেলো। বিলুপ্ত হয়ে গেলো ওর ভালোবাসার অনুভূতি। এর থেকে জঘন্য কেউ মৃত্যুকেও বলবে না।


পর্ব ২১

রাই মুখ চেপে ধরে কান্না করছে। হায় যদি তখন নিশানের জায়গায় আবির থাকতো, তাহলে হয়ত এই মুহূর্তটা অন্যরকমই হতো। দুজনের দুরত্বটা কতটা কমে যেত।
কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস। দুরত্ব টা উল্টো আরো বেড়ে গেলো।

তখন ছাদে নিশানকে দেখে রাই ভরকে গেলেও নিশান যে কথাগুলো বলে তা শোনার জন্য রাই কেনো কোনো মেয়েই প্রস্তুত হতে পারেনা।

চুড়ির কাচে কেটে যাওয়া হাতটার দিকে তাকালো রাই নিজেই নিজেকে কষ্ট দিলি, এখন যন্ত্রণাটাও সইছে না! চোখের পানি যেনো থামছেই না। ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল।

তখনি ঘরের বাতি জ্বলে উঠলো। ঘরের এককোণে জড়সড় হয়ে বসা রাই অবাক হয়ে গেল। অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে দেখে আবির বাতি জ্বালিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল।

রাই চোখ মোছার চেষ্টা করলো, কিন্তু যে হাত অশ্রুজলে ভিজে, সে হাত কি অশ্রু মুছতে পারে?
আবিরের মুখে কোনো ভঙ্গিমা নেই। সাদা সিধে মুখ, কোনদিকে না তাকিয়ে আবির সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলো। রাই তখনি হাঁটুতে মুখ গুজে।

কিছুক্ষন পর আবির ভেজা চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো। পরনে একটা ট্রাউজার, আর কিছুই না। বাইরে এসে দেখলো রাই তখনও মাটিতে বসে। আবির টাওয়েল টা রেখে রাই এর দিকে এগিয়ে গেলো। আর এক হাঁটু ভাজ করে ওর সামনে বসলো।
কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার হিচকি উঠে গেছে। আবির ওর বাহু ধরে টেনে উঠিয়ে দাড় করলো। রাই এর মধ্যে এটুকুও শক্তি নেই, যে নিজেকে ছাড়িয়ে নিবে।

আবির ওকে নিয়ে টেনে বাথরুমে নিয়ে গেল, আর বেসিনে দুহাতের কাটা জায়গা সুন্দর করে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিলো। তারপর ওর মুখ চোখ ও সুন্দর করে মুছিয়ে দিল পানি দিয়ে। যদিও রাই একবার সরে আসতে গিয়েছিল। কিন্তু আবিরের জন্য আর পারেনি।

রাই কে বাহিরে নিয়ে খাটে বসিয়ে মুখ চোখ মুছে দিলো আবির। রাই আর আবিরের দিকে তাকাচ্ছে না। আবির গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। রাই এর পায়ের সামনে ফ্লোরে বসলো আবির।

রাই এর হাতটা ধরে সামনে আনতেই রাই হাতটা সরিয়ে নিলো। আবির হালকা রেগে রাই এর দিকে তাকালো। রাই চোখ সরিয়ে নিলো। আবির জোর করে ওর হাতটা টেনে ধরলো। আর মলম নিয়ে লাগিয়ে দিতে লাগলো।

রাই উসখুস করছে। কিন্তু তাতে আবিরের কিছুই আসে যায়না।

কাজ শেষে আবির চোখ তুলে রাই এর দিকে তাকালো, কতক্ষন কাঁদবে আর?
রাই হিচকী তুলতে তুলতে বললো কাজটা। করার।. আগে…. ভাবতেন
আবির হতাশ কণ্ঠে বললো একটা পয়সার কয়টা পিঠ?

রাই নির্দ্বিধায় উত্তর দিল আপনি কি নিশান কে।আমাদের মাঝ। থেকে। সরান। নি?
আবির দুপলক তাকিয়ে রইলো হুম…
আমি….. তো…. বিয়েতে….. রাজি…. ছিলাম…. না, তবুও… তো বিয়ে করেছেন?
হুম….

তাহলে…(ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায়) আর। কোনটা বাদ রইলো?
আবির এর ঠোঁটদ্বয় কিঞ্চিৎ প্রসারিত হলো। রাই এর হাতদুটো নিজের হাতের ভাজে নিলো তুমি যেটা জানো সেটা সত্যি……(রাই অসহায় চোখে তাকালো ) তবে সেটা আংশিক
পুরোটা কি?

সন্দেহের শুরুটাই যখন তুমি করেছো। শেষটাও তোমারই দায়িত্বে পড়ে
রাই তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল কোনো শেষ নেই এর। এটাই সত্যি
আবির ওর হাত ছেড়ে উঠে দাড়ালো জেনে নাও…
রাই তাকিয়ে রইলো।

আবিরের চোখ গেলো রাই এর গালের দিকে। দুই গাল লাল হয়ে আছে। রংটা লজ্জার হলে, বোধহয় আবির ই বেশি খুশি হতো। কিন্তু তার সুযোগ নেই। আলতো হাতে রাই এর এক গালে হাত রাখলো।
রাই এর মধ্যে দিয়ে এক চিলতে শিহরণ বয়ে গেল। নিজের হাতটা উঠিয়ে আবিরের হাতটা সরিয়ে দিলো সহ্য হয় না আপনার এই স্পর্শ। সহ্য হয় না

আবির তাকিয়ে রইলো। এই কথাটা এর আগেও আবির শুনেছে। কিন্তু তখন এক ফোঁটাও কষ্ট ওর হয়নি কিন্তু আজ…… আবির ওর হাত ধরে উঠিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো, আর ওর ঠোঁটদুটো নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো। রাই এর চোখ আবারো ভিজে এলো।

ওর ঠোঁটে কামড় দিয়ে আবির ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে নিলো
আমাকে সহ্য করার কিছুই নেই। হয় মেনে নিবে, নয় মানিয়ে নিবে…
বলে রাই কে নিয়ে বিছানায় শুয়ে নিজের বুকে টেনে নিল।


পর্ব ২২

খাবার টেবিলে, সকলেই নাস্তা করছে। রেজোয়ান সাহেব বললেন কীরে আবির? গত রাতে কখন ফিরেছিস?
এইতো, ২ টায়

কেনো এতো দেরি হলো কেনো?
ফুপি বলে উঠলেন।

রুটির টুকরো মুখে পুরে আবির বললো কিছু কাজ ছিল
তা শুনি কি এমন কাজ? যে নিজের জন্মদিন ভুলে গেলি তুই ভাইয়া সুমি বললো।

আবিরের মুখের খাবার আটকে গেলো। গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে সুমির দিকে তাকালো জন্মদিন!
রাই রান্নাঘর থেকে ভাজির বাটি এনে টেবিলে রাখলো। সুমি ঢং করে বললো লাগে জানেই না…..
আবির অবুঝের মতো বাবার দিকে তাকালো। ছেলের ওমন চাহনিতে রেজোয়ান সাহেব নীজেও বিরক্ত
এমন করে তাকাচ্ছিস যেনো জানিস না
আবির ঘুরে ফুপির দিকে তাকালো। উনি বললেন আরে ভাই, ওর কি মনে ছিল নাকি? ভুলে গিয়েছিল বলেই তো সারপ্রাইজ দিতে পারলাম

সুমি মুখ বাঁকিয়ে বললো দিতে আর পারলাম কই? উনি তো রাত ২ টায় আসছে। নির্ঘাত ভাবি ও ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আমরা কত প্ল্যান করে এতো আরেঞ্জমেন্ট করলাম, দাম রইলো না
ওর কথায় আবির অবাক। ওর জন্মদিন ছিল কাল! ছাদে যা সাজানো ছিল সব ওর জন্য! চোখদুটো রাই এর দিকে চলে গেলো। রাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। চোখে আফসোসের ছাপ রাই এর। কি লাভ হল এতসব করে? দিনশেষে আবারো একটা ভুলবোঝাবুঝি।

রেজোয়ান সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বললেন তো কি প্ল্যান করলি তোরা?
কেউই বুঝলো না আসলে উনি কি বলতে চাচ্ছেন? ভাই কি বলছো ঠিক করে বলো….
আবির, রাই, তোরা যে যাবি একটা জায়গায় তো কিছু কি ঠিকঠাক করেছিস? কিছু ভেবেছিস?
যাবো মানে! রাই জিজ্ঞেস করলো।

আরে, ভুলে গেলে ভাবি?
রেজোয়ান সাহেব সুমি কে থামিয়ে বললো আরে, ঐখানে যাবেনা?
রাই ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ঐখানে কোন খানে?
আবির রেজোয়ান সাহেব এর দিকে তাকালো। উনি এবার একটু স্পষ্টভাষী হতে চাইলেন মানে তোমাদের হানিমুনে।

সভা শুদ্ধ থুক্কু টেবিল শুদ্ধ মানুষজন সব হা করে তাকালো। রেজোয়ান সাহেব তো।
আবিরের মা অনেক চিমটি করতে বললেন তোমার কথা বার্তার ধরন কী হ্যাঁ বলো তো।
আব আ বা আরে, আরে এটাই তো বাস্তবতা (আরেকটা রুটি নিয়ে) এখন হানিমুনে যাবে তো এতে এতো ঢং করার কী আছে? সোজা সাপটা কথা। কোথায় যাবি তোরা ডিসাইড কর। তারপর গিয়ে ঘুরে আয় আর বাড়িটা একটু ফাঁকা কর

আবির খেতে খেতে বললো কেনো ফুটবল খেলতে নাকি?
রেজোয়ান সাহেব বাকা চোখে তাকালেন না একটা ডুপ্লিকেট নাসা বানাবো, ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তোলাও আবশ্যক
আবির মাথা নাড়লোওহ

আরে কি ওহ? চেচিয়ে উঠলেন রেজোয়ান সাহেব যেটা বলছিলাম সেটা কর। রাই মা….
।রাই কিছু না শুনেই মাথা নিচু করে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। রেজোয়ান সাহেব মুখ ঘুরলেন বাবা আবির….. আবির পানির গ্লাস রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের দিকে চলে গেলো।

রেজোয়ান সাহেব হতাশ কণ্ঠে বললেন মা সুমি…..
সুমি চোখ মুখ কুচকে বললো মামু, আমার কিন্তু বিয়ে হয় নি
রেজোয়ান সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন তার স্ত্রী তার দিকে রেগে তাকিয়ে আছে। বেচারা। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলেন।

বিকেলে নিশান বাড়ি ফিরলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেমন নেশাখোর ধরনের অবস্হা। ঢুলতে ঢুলতে ঘরে গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল। ড্রইং রুমে সুমি আর রাইছিল। সুমি বললো কি হচ্ছে এই ছেলের কে জানে। আগে তো এমন ছিল না। সবসময় ই ফুরফুরে মেজাজের থাকতো।এখন দেখো। মনে হচ্ছে নেশা করে আসছে
রাই সবজি কাটছিল সবসময় বাহির থেকে দেখেই সব বোঝা যায়না…

সুমি ঘুরে তাকালো সেটা ঠিক। তবে। কিছু সময় অবস্থা দেখে আন্দাজ করা সম্ভব,
রাই সুমির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো।
রাই….. ভেতর থেকে আবিরের গলা ভেসে এলো।

যাও যাও, জনাব ডাকছেন বলে পিনচ করলো সুমি। রাই হেসে মাথা দুলাতে দুলাতে চলে গেলো।
ঘরে যেতেই আবির রাই এর ফোন রাই এর সামনে ধরলো।কেউ কল দিচ্ছে
রাই ফোনটা হাতে নিয়ে কানে ধরলো হ্যালো কে?

কীরে রাই, কি খবর তোর? সেইদিন যে রাইতে আসবি বললি এর তো খবর নেই…. ঠিক আছিস তো?
আরে নাফিস…… রাই এর চোখ গেলো আবিরের দিকে, খুব মনোযোগ সহকারে আবির তাকিয়ে আছে। রাই দমে গেল। একটু গেম খেলাই যায় হ্যাঁ নাফিস…. বল কি খবর?

দোস্ত আমি মেয়ে, বলে নাফিসা একটু এমন করলো।

রাই হেসে হেসে বললো হ্যাঁ ওই একই বলে হাটতে লাগলো।
ওই মাইয়া একই মানে? কি কস একই? তুই…..
আচ্ছা আচ্ছা দোস্ত বাদ দে….. সরি তোকে বিয়েতে ইনভাইট করতে পারিনি বলে রাই খাটের পাশে গেলো।
বিয়ে? !!!!!! নাফিসা অবাক।
হ্যাঁ…. বিয়ে বললো রাই।

আবিরের কেনো যেনো মনে হলো কথাটায় হতাশার চরম সীমানা পার করা হয়েছে।
কবে করলি?
এইতো। বুঝে নে, আমি বুঝি দোস্ত বুঝি তোকে ইনভাইট করিনি। আসলে কাউকেই করিনি। ইন ফ্যাক্ট আমাকে ইনভাইট (আবিরের দিকে তাকিয়ে) করতে দেওয়া হয়নি

ওহ আচ্ছা থাক। তো ভাইয়া কেমন রে?
রাই চেঁচিয়ে উঠলো আরে ঐটাই তো কপাল বইন ঐটাই তো কপাল। আমিও বুঝিনা মানুষ এমন কেনো? এতো কিসের লুকোনো…..

দোস্ত আর ইউ ওকে? নাফিসার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে কথাগুলো।
হ্যাঁ….( ড্রামা করে) আই অ্যাম ওকে
তো এগুলো কি বলছিস?
আরে হ্যাঁ নাফিস আই নো….. কিন্তু কী করবো বল, যার কপাল খারাপ তার সবই খারাপ……

দোস্ত তোর মাথা নস্ট হয়ে গেছে, রিলাক্স, আমরা পরে কথা বলি বলে নাফিসা ফোন কেটে দিল।
রাই তো হ্যালো… নাফিস…. কীরে রাগ করলি নাকি? আচ্ছা শোন আমরা একদিন মিট করবো বুঝলি? হ্যাঁ রাখি আজ

রাই ও ফোনটা রেখে আফসোসের সুর ধরলো হায়রে বন্ধু আমার…..
এতক্ষণ আবির সবই শুনছিল, তবে এবারে ঘুরে তাকালো। রাই ফোনটা নিয়েই বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

সাথে সাথে আবির ওকে টেনে শক্ত করে ধরলো। আর ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো
আরে কি করছেন কি? ফোন দেন
কিন্তু রাই ধরতেও পারলো না। আবির ওই নম্বর টাতেই ফোন করলো। আর লাউড স্পিকারে রাখলো, ফোনটা দিন বলছি। আবির….

তখনি ফোনটা নাফিসা ধরে উঠলো কীরে তোর মাথা কি পুরাই শেষ? বললাম না পরে কথা হবে। যা রেস্ট নে
রাই থ মেরে গেলো। আবির চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো। আর কলটা কেটে ফোনটা খাটে ফেলে দিল।
রাই চোখ টিপটিপ করে আমতা আমতা করে বলল আ, হ্যা তো? ঐটা, ঐটা নাফিসের বোন ছিল
আবির এক ভ্রু উঁচু করলো। অর্থাৎ রেয়ালি?

রাই মুখটা ঘুরিয়ে নিল।
তো চলো তোমাকে তোমার বন্ধুর কাছে দিয়ে আসি, হায়রে বন্ধু তোমার…..
আবিরের খোটায় যদিও রাই এর গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করছে ও।
ছাড়ুন

আবির বললো ধরে কোথায় রাখলাম?
রাই তাকিয়ে দেখে আবির অনেক আগেই ওকে ছেড়ে দিয়েছে শুধু সাথে দাড়িয়েই আছে। রাই দ্রুত দূরে সরে সোজা ঘরের বাইরে চলে গেলো।
সব বিপদ সব আমার ঘাড়েই ধুর ভাললাগেনা নিজেকেই বকতে বকতে রাই বাইরে চলে গেলো।

পরদিন একই অবস্থা। বাড়ির সবাই উঠে পড়ে লেগেছে রাই আর আবিরের হানিমুন যাওয়া নিয়ে। যেনো মধুচন্দ্রিমা ওদের না ওনাদের। আবির বরাবরের মতই ইগনোর করে গেলো। অবশ্য আবিরের মায়ের তাতে মাথা ব্যথা নেই। বৌমাকে একপ্রকার কিঞ্চিৎ মেনেই নিয়েছেন বলা চলে। রাই নিজেও তেমন সাড়া শব্দ দিচ্ছেনা।

রাই হেঁটে মাত্রই নিশানের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তখনি হাতে হ্যাঁচকা টানে রাই ভেতরে চলে গেল।
তাকিয়ে দেখে নিশান দরজা লাগিয়ে ওর দিকে ঘুরে দাড়ালো।
কি অসভ্যতা এসব নিশান?

রাই এগোতে গেলেই নিশান উল্টো পথ আটকে দাড়ালো রাই দাড়াও…..
আর কি বলার আছে তোমার?
রাই শোনো, তুমি তো জানোই আমি তোমাকে….

রাই হাত উচিয়ে ওকে থামিয়ে দিল তোমার এইসব কথা শুনতে আমি আসিনি…..
নিশান ওকে ইগনোর করে বললো দেখো রাই, আমি সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসি…..
নিশান…..

রাই…. দেখো আমি তো তোমাকে সব সত্যিই বলেছিলাম। তাহলে এখনও কেনো তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ? রাই….
নিশান চুপ করো।

রাই দেখো, তুমি চাইলে আমি এখনও তোমাকে মেনে নিবো…. জাস্ট একবার……
চুপ করো (ধমক দিয়ে বললো রাই) লজ্জা করেনা এসব বলতে? আর কী বললে? মেনে নিবে? কেনো ভিক্ষা দিচ্ছ? আমাকে দানবাক্স মনে হচ্ছে? কি?
নিশান এগিয়ে গেলো রাই আমি ওভাবে বলিনি…. শোনো

চুপ করো। কি মনে হয় তোমার? আমি কি? হ্যাঁ,
একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো…. হ্যাঁ তুমি সত্যিটা বলেছো ভালো কথা। ধন্যবাদ। কিন্তু তার মানে এই না আমার বিবাহিত জীবন বিচ্ছেদ করে আমি তোমার সাথে চলে যাবো….. জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে মানুষের একবারই হয়।

আর যে আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে ছিল তাকেই আমি পেয়েছি। এতে আমার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। কি মনে হয় তোমার? আমি এই বিয়ে এখনও মেনে নেই নী? প্লিজ গো অন। আমার স্বামী ভালো হোক, খারাপ হোক আমি তারই। মাঝে যেই আসুক। এই পবিত্র বন্ধন থেকে এট লিস্ট আমি বের হচ্ছি না
রাই….. ভাই তো সব মিথ্যে…..

দেখো, কোনটা মিথ্যে কোনটা সত্যি আমি জানিনা। তবে এটুকু বোঝার সক্ষমতা আমার আছে বা আমি বুঝি অন্তত বিশ্বাসঘাতকতা আমার সাথে যায়না।তোমার থেকে ভালো এটা কেউ জানেনা….. সো সরি। দরজা থেকে সরে দাঁড়াও….

বলে রাই নিশান কে সরিয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে গেলো।
নিশান নিথর হয়ে তাকিয়ে রইল।

আজ শুক্রবার। পবিত্র জুম্মার নামাজের পর রেজোয়ান সাহেব আবির বাসায় এলো। মাত্রই সোফায় বসেছে, তখনি নিশান বাসায় ঢুকলো। কারো দিকে না তাকিয়েই নিজের ঘরে চলে গেল।
রেজোয়ান সাহেব নিজের ছোটো ছেলেকে নিয়ে প্রচন্ড চিন্তায় আছেন। কেননা ইদানিং ওর ব্যবহার আচার যে হারে পরিবর্তন হচ্ছে যে কেউই সন্দেহ করবে।

যাইহোক দুপুরে খাবার টেবিলে অবশ্য সবাই খুব হাসি মজা করলেও নিশান ছিলো খুবই শান্ত। কিছুক্ষন পরপর রাই এর দিকে তাকিয়েছে বটে। তবে সেই চাহনিতে কোনো খারাপ অনুভূতি ছিলনা। খাবার শেষে আবির একটু ঘরে গেলো। বাকিরা বাহিরেই ছিলো।

নিশান তখনি নিজের সাথে একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বাইরে এলো। সবাই অবাক। ওর মা বললো কীরে, তুই কোথাও যাচ্ছিস নাকি?

নিশান সবার সামনে দাড়ালো। পরনে টিশার্ট প্যান্ট আর একটা লম্বা ব্রাউন কোট। ব্যাগটা রেখে বাবার সামনে গিয়ে দাড়ালো নিশান।
কীরে তোর কি ট্রিপ আছে নাকি?

ছেলে বাবার কথার তেমন প্রতিক্রিয়া করলো না। শুধু কোটের পকেট থেকে কিছু একটা বের করলো। সবাই তাকিয়ে দেখে পাসপোর্ট।
ওর মা দাড়িয়ে গেলো এই, এইটা কেনো? কোথায় যাচ্ছিস তুই?

রাই সন্দিহান চোখে তাকিয়ে। নিশান ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল।
বাবা আমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি।
মানে! সবাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে। ফুপি উঠে দাড়ালো কীরে কি বলছিস তুই এসব? বলা নেই কওয়া নেই। এগুলো কি?
সুমির বুকটা ধ্বক করে উঠলো। সুমির হাতটা কেমন কেনো কাপছে তুমি, তুমি কি মজা করছো নাকি?

নিশান মাথা নাড়লো আমার পাসপোর্টের নতুন ভিসা করে এনেছি। আজই ফ্লাইট। চিন্তা করো না, স্টুডেন্ট অত খারাপ আমি না। কাজ পেয়ে যাবো
ওর মা রেগে গেলেন নিশান এইসব মজা আমার একটু ও ভালো লাগছে না। এসব কি বলছিস?
মা আমি সত্যিই বলছি

নিশান, ব্যাগ রেখে যাও ঘরে যাও। আর এই ব্যাপারে পরে কথা হবে রেজোয়ান সাহেবের কড়া গলা উপেক্ষা করেই নিশান বললো বাবা, এমনিতেও তো দুই একমাস পরেই আমার যাওয়ার কথা ছিলই

হ্যাঁ কিন্তু আজকের কথা ছিল না এভাবে হুট করে। রেজোয়ান সাহেব বললেন।
রাই রীতিমত বাকরুদ্ধ। মাথা কাজ করছেনা। নিশান কি সত্যিই চলে যাচ্ছে? কিন্তু কেনো? মানে এইভাবে হটাৎ! তবে কি…… কারণটা রাই অনেকখানি আন্দাজ করতে পারলো।

না, তোমার এসব কথা শুনছি না যাও ঘরে যাও ওর মা বললো।
কিন্তু নিশানের ভাবমূর্তির পরিবর্তন নেই। নিশান দ্দৃঢ় কণ্ঠে বললো দেখো একটু পরেই আমার ফ্লাইট। তাই আমাকে যেতেই হচ্ছে। শেষ বিদায়টা নাহয়……

ওর মা ওকে ইচ্ছেমত চড় মারতে লাগলেন কি বলছিস এসব? তোর মাথা ঠিকাছে?
নিশান হেসে মায়ের হাতদুটো আটকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো মা, তোমার ঠিক এই মারটাই খুব মিস করবো।

আর চিন্তা করোনা। আমি কি সবসময়ের জন্যই যাচ্ছি নাকি? বলে মাকে ছেড়ে ফুপির কাছে গেলো ফুপি….
উনি জড়িয়ে নিলেন বাবা, এখনই এভাবে? কেনো? কোনো সমস্যায় পরেছিস?
নিশান মাথা নাড়লো উহু
সুমির কাছে গিয়ে মাথায় একটা গাটটা দিয়ে বললো ভালো থাকিস

সুমি স্তব্ধ হয়ে আছে। কেনো যেনো ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পাথরের মত জমে গেছে। ও কিচ্ছুটি বলতে পারলো না।
নিশান ঘুরে ব্যাগটা হতে নিলো। সবাই অনেক কিছুই বলেছে কিন্তু ও শুনলো না। ওর মা পুরো কান্নাই করে দিয়েছে।
রাই এর দিকে এখনও তাকায়নি নিশান। হটাৎ কি মনে করে ব্যাগটা নিচে রেখে ঘুরে দাড়ালো। উদ্দেশ্য? সোজা আবিরের ঘর।
আবির মাত্রই বের হবে তখনি নিশান ঘরে এলো। আবির দাড়িয়ে পড়লো। নিশান ঘরে ঢুকে দরজা টা একটু চাপিয়ে দিলো আর ভাই এর দিকে তাকালো বাই বলবি না?

আবির সন্দিহান চোখে তাকিয়ে ঠিক কি কারণে?
নিশান মুচকি হাসলো চলে যাচ্ছি।
আবির অবাক হয়ে তাকালো।

অস্ট্রেলিয়া বলে নিশান একটা শ্বাস টেনে বুকটা কে হালকা করে নিলো।
আবির তেমন কিছু ভাবলো না কতদিনের ট্রিপ?
হয়তো আজীবন…..

এইবারে নিশানের কোথায় আবির একটু গম্ভীর হলো। নিশান জানে ওর ভাই যেচে জিজ্ঞেস করবে না কেনো। ব্যাপার না।
উহু, রেগে বা জেদ করে যাচ্ছিনা। কিন্তু, এইখানে থাকার মতো ও কারণ নেই।
আবির একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো।

রাই কে তো নিয়েই নিলি। উহু উন ফ্যাক্ট ও তো এখন তোরই। আশা করি খুশি আছিস। থাকবি…
তবে কি বলতো? তুই রাই কে কিন্তু আমার জন্যই পেয়েছিস হ্যা? (নিশান নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসার চেষ্টা করলো) আমি না থাকলে বোধহয় পেতি না। না না অহংকার করছি না। শুধু নিজের স্মৃতি ধরে রাখার একটা কারণ দিয়ে যাচ্ছি।

সত্যিই খুব বোকা ছিলাম। দিন থাকতে মূল্য দেইনি। তবে….( কষ্টে চোখের পানি আটকে) তুই এই ভুলটা করিস না। আর হ্যাঁ আমি…. আমি অনেক দূরে চলে যাওয়ার পরে নাহয় রাই কে আমার সত্যিটা বলে দিস… তোকে যেনো ও ভুল না বোঝে। কিন্তু (নিশানের কথা আটকে এলো) আমাকে ও। যেনো….. ঘৃণা…. না করে
আবির অনুভূতি শূন্য হয়ে গেলো।

নিশান যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়িয়ে আবারো আবিরের দিকে তাকালো
মাঝ খানটায় তুই এসেছিলি ভাই। আমি না। তবে ফিরিয়ে দিতেও বলবো না। রইলো নাহয় তোর হয়ে। যার শুরুটায় আমি ছিলাম।

নিশান বেরিয়ে গেলো। আবির স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো।
চৌকাঠ পেরিয়ে ও যেনো পিছুটান টা ছাড়তে পারছেনা নিশান। মায়ের ডাক বারবার ওকে থামিয়ে দিচ্ছে।

সবাই এতবোঝালো তবুও কিছুই বুঝলো না নিশান। ওর কথা ওকে যেতেই হবে। রাই অবশ্য আটকাতে চাইছিল। কিন্তু বিবেকের সাথে আত্মসম্মানের লড়াইয়ে নিজের আত্মসম্মান কেই বেছে নিলো মনটা।
শেষবারের মতো নিশান রাই এর দিকে তাকালো। তবে এই চাহনির ভাষা এক নিশান বাদে কেউ জানবে না।
ভালো থেকো…… শুধু এটুকুই বললো চোখ দুটো।

নিশান ঘুরে দাড়িয়ে সব পিছুটান উপেক্ষা করে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাটতে শুরু করলো। সে জানে পেছনে এতগুলো মানুষের মাঝে একজোড়া চোখ তার দিকেই তাকিয়ে। তবে ঘুরে দেখার সময়টা আর রইলো না।

সুমি নিজের ঘরে মাটির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। শূন্য চোখে তাকিয়ে। কেনো? সেটা নাহয় না বলাই থাক। কিছু কিছু কথা বলে বোঝানো দুঃসাধ্য। সেক্ষেত্রে অনুভূতিই শুধু দৃশ্যমান। যদিও তা সবার বোঝার উর্ধে।
আবির একবুক উত্তেজনা নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে। কিসের উত্তেজনা? সে জানেনা।

তবে কি সত্যিই একটা ভুল করে বসেছে আবির? তৃতীয় ব্যক্তিটা সে ছিল নির্দ্বিধায় সে স্বীকার করে। কিন্তু বিষয়টা কি সত্যিই তিন তিনটে জীবনের মূল্য হয়ে দাড়ালো? কানে বাজলো নিশানের বলা শেষ কথাটা তুই রাই কে কিন্তু আমার জন্যই পেয়েছিস……
কথাটা কি বিবেক বিবেচনায় সত্যিই ভুল!

রাই নিশানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে। নিশান কি সত্যিই এতই খারাপ? নাকি শুধু একটা সহানুভূতি কাজ করছে ওর জন্য? দ্বিতীয় সুযোগটা যে সত্যিই দেওয়ার মত সুযোগ ছিল না। হায় ভাগ্য।
জনমানবহীন একটা ফাঁকা রাস্তায় নিশান দাড়িয়ে।

হেঁটে যাওয়ার শক্তিটুকুও নেই।
পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করলো, হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ফোন অন করতেই ওয়ালপেপার এ রাই এর হাসি মাখা মুখের একটা ছবি। নিশান ফোনটা হাতে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।

আজকের রান্না টা সত্যিই ভালো ছিল। (ভেসে উঠলো দুপুরের দৃশ্য) লাল শাড়ীটা হয়ত অন্য কারো জন্যই পড়েছিলে। কিন্তু দেখে দারুণ লাগছিলো। ঠিক এই হাসিটাই দেখতে চেয়েছিলাম (ফোনের দিকে তাকিয়ে) হয়ত আমার সাথে।

হ্যাঁ আমি দেরি করেই বুঝেছি, কিন্তু চেয়েছিলাম তো… চলে যাচ্ছি। চিন্তা করো না দূরেই থাকবো। তবে তোমার স্মৃতিতে যদি কখনো চলে আসি তবে আমার দোষ দিও না। এতে আমার নিশ্চই কোনো হাত থাকবে না।
নিশান এর হাতদুটো মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আকাশের পানে চেয়ে কষ্ট ঝরিয়ে দিতে চিৎকার করলো নিশান রাই…… চোখ দুটো অবাধে জল ছেড়ে দিল।

আজ বুকে চাপা হাজারটা কষ্ট শেষ করে দিতে চাচ্ছে নিশান। হ্যাঁ ও স্বার্থপর হয়েছে, খারাপ ও হয়েছে। কিন্তু পরিশেষে এটাও সত্য যে ও নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছে। হোক সেটা দেরিতেই বোঝা। কিন্তু ওর এক চিলতে পরিমাণ কষ্ট ও আমাদের বোঝার বাইরে।

ফোনটা পড়ে রইলো শুকনো মাটির উপরে। নিশান উঠে দাড়ালো মাথা নিচু করে। পা বাড়ালো নিজের গন্তব্যের দিকে। পেছনে রয়ে গেলো স্মৃতিটা পড়ে।

ঐ দেখ চলে যাচ্ছে নিশান। মৃতের মতো পা ফেলে ফেলে। পায়ের তলার শুকনো পাতাগুলো কি কিছু বলে? শূন্য জমিন, মেঘা আসমান…
পেছনে ফেলে একঝাঁক,
পিছুটান।


পর্ব ২৩ (অন্তিম)

আবির বাহিরে যাচ্ছিলো এমন সময় রেজোয়ান সাহেবের ডাক এই আবির…..
আবির দাড়িয়ে গেলো হ্যাঁ বাবা বলো
আম্মা, তো অনেকদিন হলো ওবাড়ি গিয়েছেন। আজ ফোন করেছিল তাকে নিয়ে আসতে বলেছে। তো তুই যাবি। কেমন?

আবির না করতে চাচ্ছিলো। কিন্তু ওর মা বললেন হ্যাঁ যাও। আম্মা কে নিয়ে আসো। আর রাই কে ও নিয়ে যাও। ঘুরে আসো দুজনেই।
রেজোয়ান সাহেব সম্মতি দিলেন হ্যাঁ যাও।

আবির আর না করতে পারলো না। একপ্রকার বাধ্য হয়েই যেতে হলো। সাথে রাই ও যাচ্ছে। রাই এর না করার উপায় আর রইলো কই? যেহেতু আবিরের মা বাবা দুজনেই আদেশ দিয়েই দিয়েছেন। তাই রাই ও সাথে যাচ্ছে।

এই কয়দিনে যদিও রাই আবিরের সাথে তেমন একটা কথা বলেনি। অভিমানটা বেশ ছিলো, কিন্তু আবির খুব সুন্দর করেই সবসময় ওকে সামলে নিয়েছে।কিন্তু হ্যাঁ যতদিন না রাই চাইবে আবির কোনো ভুল বোঝাবুঝি মিটাবে না।
গাড়িতে দুজনই চুপ করে বসে আছে। আজ রাই এর খুব ইচ্ছে করছে আবিরের সাথে কথা বলতে। একটু না খুব বেশিই। অনেক্ষন যাবতই রাই এর উসখুস করা দেখছে আবির। তবে কিছু বললো না।

আর থাকতে না পেরে রাই কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে গেলো ঠিক তখনই চোখের পলকে আবির গাড়ি বামে মোড়ে ঘুরিয়ে দ্রুত চালাতে লাগলো। আচমকা এমনটা রাই আশা করেনি।
কি করছেন আপনি?

আবির নিজের মতো করেই গাড়ি চালাচ্ছে। রাই এদিকে ভয় পেয়ে গেলো আরে, কি করছেন এটা? এভাবে কেনো গাড়ি চালাচ্ছেন?
হটাৎ কিছু বিস্ফোরণের মতো শব্দ কানে এলো। রাই ভয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠলো। আর গাড়িটা কেমন এদিকওদিক যেতে লাগলো।
আবির…..

আবির রাই এর একহাত শক্ত করে ধরে গাড়ির ব্রেক চাপলো। গাড়িটা সোজা গিয়ে একটা কনস্ট্রাকশন সাইট এর উচু করে রাখা বালুর স্তূপের সাথে ধাক্কা খেল।
বের হও….

আবির রাই কে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
আরে, গাড়ির পেছনের চাকা পাংচার হয়ে আছে। এজন্যই গাড়ি অভাবে নিয়ন্ত্রণ হারায়।
পেছনে আওয়াজ এলো অন্য একটা বাইক এর আসার। আবির আর রাই দুজনেই সেদিকে তাকালো। আবির রাই কে পেছনে ঠেলে দিল

আমি যতক্ষণ নিচে না আসবো ততক্ষণ লুকিয়ে থাকবে বুঝলে…..
রাই কিছু বলবে তার আগেই কোনো কথা। না একদম চুপ। যাও বলে আবির যে বিল্ডিং এর কনস্ট্রাকশন হচ্ছিল সেই বিল্ডিং এর দিকে দৌড় দিল।

আবির…..রাই চিৎকার করে উঠলো। পেছনে তখনি সেই বাইক এর উপরে দেখা গেলো একটা ছেলেকে। বয়স আবিরের মতই হবে। ছেলেটা বাইক সজোরে ব্রেক করে ফেলে আবিরের যাওয়ার দিকেই দৌড় দিল। রাই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। আশেপাশে ও কেউ নেই। কনস্ট্রাকশন বোধহয় আজ বন্ধ। রাই কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা।

আবির গাড়িতে থাকাকালীন ই দেখেছে লোকটাকে ওকে ফলো করতে। হটাৎ এমন উদয়! যাইহোক আবির এখন ছাদের দিকে যাচ্ছে। আজ ব্যাস সামনাসামনি কথা হবে।

ছাদে আসতেই পেছন থেকে ছেলেটা ধাক্কা দিয়ে আবিরকে ফেলে দিল। আবির গিয়ে মাটিতে পড়ল। পেছনে ফিরতেই দেখে ছেলেটা আবিরের উপর হামলা করবে তখনি আবির সরে গেলো। ছেলেটা মাটিতে পড়ে যায়।

রাই কাপা কাপা গলায় রেজোয়ান সাহেব কে সবটা বললো। ওদিকে রেজোয়ান সাহেব পুলিশকে খবর দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রাই নিচ থেকে উপরে তাকিয়ে আছে। আবিরকে কোনোভাবেই দেখা যাচ্ছেনা। ও কি যাবে কি না ও জানেনা। কি করবে ও!

মারামারির এক পর্যায়ে আবির ছেলেটাকে পেছন থেকে শক্ত করে ধরলো।
নিশান ছাড় আমাকে….. ছাড় ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠলো।
আবির অবাক হলো নিশান!

ছেলেটা ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকালো হয় আজকে তুই বাঁচবি নইলে আমি নিশান…. বলে দৌড়ে আবিরের দিকে ছুটলো। আবির সরে গিয়ে ওকে আগের তুলনায় আরো শক্ত করে ধরলো কে নিশান? আমি নিশান না….
চুপ কর, ছাড় আমাকে
আমি নিশান না। আমি আবির

ছেলেটা এক মুহূর্তের জন্য একটু স্থির হলো। পরক্ষণে আবারো ছোটাছুটি শুরু করলো নিশান ছাড় বলছি। তুই
আবির ওকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিল বলছি তো আমি নিশান না। আমি আবির……
ছেলেটা উঠে দাড়ালো আমি মানি না….. বলে আবারো তেড়ে আসতে গেলেই আবির আবারো ওকে আছড়ে ফেলে আমি নিশান না আমি আবির…. ওর বড়ো ভাই। ওর সাথে তোমার কি?

ছেলেটা হাফাতে হাঁফাতে দাড়িয়ে পড়লো নিশান। না?
নাহ…. আমি আবির। ওর বড়ো ভাই…. তুমি কে?
ছেলেটার মুখ রেজ ফেটে গেলো শিট… নিশান কই?
আগে বলো তুমি কে?

সেটা আপনার জানা লাগবে না…..
আবির দুপা এগোলো এতদিন ধরে মারার জন্য পেছনে পড়ে আছো আর আমার জানতে হবেনা?
আমি……( রাগ দমিয়ে) নিশান কে খুঁজছিলাম। ‘
কেনো
মারবো বলে

আবির এগিয়ে গিয়ে ওর গলা চেপে ধরলো কেনো মারবে ওকে? কে তুমি?
ছাড়ো ছাড়ো বলছি…. আবির ছেড়ে দিতেই ছেলেটা কেশে উঠলো।
বলো….. আবির রেগে আছে।
ছেলেটা লম্বা লম্বা শ্বাস টানতে লাগলো ও আমার অনেক বড়ো ক্ষতি করেছে। অনেক…..
যেমন?

আমি স্বর্ণার ভাই।
আবির এর মুখে বিস্ময় খেলে গেলো। কেননা স্বর্ণা সেই মেয়েটা যে ২ বছর আগে আবিরের নামে চরিত্রহীন এর গুজব ছড়িয়েছিল আরো কত কি নিশানের কথায়। আর আবির ওর বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশন নিয়েছিল।
স্বর্ণার ভাই!

হুম….. ওই নিশানের জন্য আমার বোনটা এখন জেলে বসে আছে।
আবির এগিয়ে গেলো তুমি কি জানো তোমার বোন কি করেছিল?
জানিনা। আর না ও বলেছে। কিন্তু ও এটুকু বলেছে নিশানের জন্যই ওর এই অবস্থা। আমার বোনের কোনো দোষ নেই। বিনা দোষে…

আবির ওকে থামিয়ে দিল যাকে নির্দোষ বলছো, সব থেকে বেশি সেই দোষী ছিলো…..
ছেলেটা চমকে উঠলো হোয়াট? কি বলতে চান?

রাই এর বাবার আসার অপেক্ষা করতে পারলো না। ও ছুটে বিল্ডিং এর ভেতরে চলে গেল। ৭ তোলা বিল্ডিং। রাই প্রতি তলায় উঠে উঠে আবিরকে ডাকছে কিন্তু সাড়া নেই। হটাৎ আওয়াজ এলো ছাদের দিকে থেকে রাই সেদিকে উঠে গেলো।
ছেলেটা মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ওর নিজেরই বিশ্বাসহচ্ছে না যে ওর বোন ই আসলে এই কাজ করেছিল।

আবির গম্ভীর স্বরে বলল যখন ঘরের মানুষই ঠিক না থাকে, বাইরের মানুষকে ঠিক করে কি হবে?
ছেলেটা ওর দিকে তাকালো। আবির গম্ভীর ভাব ধরে রেখেই বললো তোমার বোন কে যদি বের করতে বলো, আমি ব্যবস্থা নিবো। কিন্তু আমার মনে হয় না সে সত্যি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।

ছেলেটা মাথা নাড়লো নাহ….. ওকে ছাড়াতে হবেনা। নাহ। ওর শাস্তি ওকে পেতে হবে।
কিন্তু তুমিও তো একই বলতে গেলে আরো জঘন্য পথে যাচ্ছিলে
ছেলেটার চোখ ছলছল করে উঠলো ভাই, নিজের ভাই বোনের দুঃখ কি সত্যিই দেখা সম্ভব? যখন বিষয়টা এই পর্যায়ে যাবে?

আবির ওর কাঁধে হাত রাখলো কিন্তু যথাযথ কারণটা জেনে কাজ করা উচিত।
হুম, ভাই…. ছেলেটা আবিরের পা ধরতে গেলো….. আবির আটকে দিলো আরে
ভাই আমাকে মাফ করেন.। আমি আর কখনও….

আবির…. পেছনে রাই এসে দাড়িয়েছে মাত্রই। ছেলেটা ভয় পেয়ে আবিরের দিকে তাকালো। আবির রাই এর দিকে তাকিয়ে আছে।
আবির…… প্লিজ আপনি ওকে কিছু করবেন না…… রাই এর হাত পা কাপছে। ছেলেটা আবিরের দিকে তাকালো। তখনি নিচে কেমন পুলিশের গাড়ির আওয়াজ এলো। আবির আর ছেলেটা দুজনেই চমকে উঠলো।

আবির ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো। কে কি করলো রাই জানেনা। ছেলেটা নিজের হুডি ক্যাপ টা টেনে মাথায় দিয়েই দৌড় দিল। রাই কে সরিয়ে ও সিড়ি দিয়ে নেমে গেলো।
এই…… রাই চিৎকার করতে গেলেই আবির এসে রাই কে টেনে ধরলো রাই…..
আবির লোকটা পাকিয়ে গেল
রাই…..

আবির, লোকটা…..
আবির শান্ত কণ্ঠে বললো হলদেটিয়া। রাই এর মুখ নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে।
রাই একটু শান্ত হলো। কতদিন পর আবিরের মুখে। রাই কান্না করে আবিরকে জড়িয়ে ধরলো
আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।খুব……

আবির ওকে জড়িয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলো।
আমাকে মাফ করে দাও। সরি। আমি সত্যি তোমাকে হারাতে চাই না আবির। সত্যিই। আমি ভেবেছিলাম লোকটা তোমাকে (ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো রাই)
কিচ্ছু হয়নি

আবির বিশ্বাস করো আমি অনেক চাই তোমাকে হ্যাঁ। আমি খুব খারাপ ব্যবহার করেছি। কিন্তু। আমার কি দোষ বলো? আমিও তো….
আবির রাই কে নিজের সামনে নিতে কপালে কপাল ঠেকালো রাই, তুমি যেটা করেছো সেটা স্বাভাবিক ছিলো। হ্যাঁ, তবে একটু কষ্ট দিয়েছ.. বটে

রাই কাঁদতে কাঁদতেই আবিরের ডানহাতটা নিজের দুহাতে পুরে নিলো। আলতো করে হাতটাতে চুমু দিয়ে নিজের ডান চোখে একবার বাম চোখে একবার ছুঁইয়ে নিলো। অশ্রুসিক্ত চোখে আবিরের দিকে তাকালো রাই আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, আবির অনেক হারাতে চাইনা। যেটা হয়েছে সেটা ভুল ছিল। কিন্তু আমার বর্তমান আর ভবিষ্যত্ দুটোই তুমি প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।

বহু প্রতীক্ষিত এই কথাটুকু আজ আবিরের বিশ্বাসের বাইরে। ও কিছুক্ষন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো।
সরি….. আমি এই ভুল বোঝাবুঝি তে থাকতে চাইনা প্লিজ। যেটা হয়ে গেছে সেটা বদলানো যাবে না। আমি জানিনা কে ভুল কে ঠিক। কিন্তু তুমি তো এখন আমার অস্তিত্বে মিশে আছো। কিভাবে ভুলে যাবো বলো?
আবির মুচকি হেসে রাই কে জড়িয়ে ধরলো। রাই হেসে উঠলো সরি মুখ পোড়া…
মাফ করলাম, হলদে টিয়া…..

দুজনেই হেসে উঠলো। আবিরের মুখে এক অদ্ভুত তৃপ্ততার হাসি আজ। এর থেকে ভালো কিছুই হতে পারেনা। আকাশের পানে তাকিয়ে হটাৎ আবিরের চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো

আমি অনেক দূরে চলে যাওয়ার পরে নাহয় রাই কে আমার সত্যিটা বলে দিস… তোকে যেনো ও ভুল না বোঝে। কিন্তু (নিশানের কথা আটকে এলো) আমাকে ও। যেনো ঘৃণা না করে
মাঝ খানটায় তুই এসেছিলি আমি না……

আবিরের মুখ খানা মলিন হয়ে এলো। থাক না কি দরকার নিশানের অতীত টেনে এনে রাই কে জানানো?

কিছু কথা নাহয় আড়ালেই রয়ে যাক। হোক না সে খারাপ। কিন্তু কি দরকার তাকে তারই ভালোবাসার সামনে টেনে নিকৃষ্ট এর কাতারে ফেলার? ও তো অতীতটা ফেলে চলে গেছে বহুদূরে। থাক না বাকিটা ইতিহাসে গচ্ছিত, কোনো গহীন কোণে। কিন্তু কোনো এক জায়গায় একটা আফসোস রয়েই যাবে
সত্যিই কি আমি তৃতীয় ব্যক্তিটি ছিলাম? ভুলটা কি আমারই তৈরি ছিলো!
কে জানে?

খোলা জানালার পাশে বসে শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজছে সুমি। কি সেটা তার অগোচর। তবে আজ বুকটা সত্যিই খুব ভারী হয়ে আছে, খুব মন চাচ্ছে মানুষটাকে চিৎকার করে কিছু অগোছালো মনের কথা বলে দিতে। আর কতদিন এই কথাগুলো জমিয়ে রাখবে সে মন কারাগারে? ছাড়া কি পাবেনা এরা? হাতে থাকা কালো ডাইরির পাতা উল্টে তাকালো সুমি। প্রত্যেকটা পাতায় তার প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে লেখা ছোট্ট ছোট্ট দুটো লাইন।

এক পাতায় লেখা ১২ আগস্ট। তুমি আজ হলদে রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়েছিলে হিমু বলবো না। উহু তুমি ছন্নছাড়া পথিক নও। তবে রাজপুত্র বলবো, যার রাজকুমারী এইখানেই বসে এই মুহূর্তে এই কথাগুলো লিখছে।

সুমির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। অপর পাতা উল্টে নিলো সে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, বুঝলে? এই হলো তোমার স্বভাব, ছোট্ট থেকে দেখেছি মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করো। আজও আমাদের কাজিনদের সাথে গোলাপ নিয়ে কতই হাসি মজা করলে….. কই আমার সাথে করলে কি হতো? একটা গোলাপ ই তো। নাহয় দিলে আমায়। মন চায়না বুঝি?
সুমির মুখ খানা মলিন হয়ে এলো।

পরের পাতা একটা উল্টোলো
১৬ মার্চ, লাল রংটায় নিজেকে লেপ্টে এই যে আমাদের বাড়িতে এলে, প্রথমে তো ভেবেছিলাম রেগে আছো নাকি? আরে ঐযে, লাল যে রাগের প্রতীক। কিন্তু কই তুমি তো উল্টো হাসিমজায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে।

২ জুন, মাংসটা কিন্তু আমিই রান্না করেছিলাম। তুমি হয়ত ভেবেছ মায়ের রান্না। কিন্তু কই বুঝতেই পারলে না যে অজান্তেই আমার এতো প্রশংসা করে গেলে।

সুমি একসাথে অনেকগুলো পাতা উল্টোলো। সাদা পাতা, হাতের কাছের লাল কলমটা আঁকড়ে ধরলো ওর ডান হাতটা। অনেকদিন পর মন চাচ্ছে আজ ও কিছু লিখব। লিখতে চায়। কতদিন আর পুরনো লেখাগুলো পড়বে?
৬ জুলাই….
আজ আমার জন্মদিন…
ভাগ্যিস তুমি নেই এখানে। নইলে পচা ডিম মারতে। (চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি কাগজে পড়লো)

তুমি নেই আজ এক সপ্তাহ। সেই যে গেলে না ফোন…. না বার্তা। কি হ্যাঁ? আন্টির কথা মনে পড়েনা? আঙ্কেল? আবির ভাই? আম্মু? আচ্ছা ঠিকাছে আমার কথা? (সুমির চোখ ভিজে এলো। চোখে ঝাপসা হয়ে গেলো সব)
কিভাবে মনে পড়বে? ওখানে ইংরেজি ম্যাডামদের পটিয়েছ হয়তো? হুম আমিও কি বোকা! তোমাকে তো কখনো বলাই হয়ে উঠলো না। কিভাবে জানবে বলো?

লিখাটা রেখে সুমি কান্না করে দিল। চোখের পানিতে পুরো কাগজটা ভিজে গেছে। লাল কলমটা ও যেনো আজ নিজের কলি বিসর্জন দিয়ে সন্তুষ্ট নয়। কেননা আজ যে কারো মিষ্টি মনের কথা নয়, অথচ একরাশ দুঃখের বোঝা তাকে টানতে হচ্ছে।

চোখটা আলতো মুছে কাগজটার দিকে তাকালো সুমি।
একটানে ছিড়ে ফেললো এই কাগজটা দুমরে মুচড়ে কাগজটা জানালার বাইরে ফেলে দিল।

বেঞ্চে বসে শূন্যে তাকিয়ে ছিল নিশান। হটাৎ মাথায় কিছু একটা টোকা লাগলো।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কতগুলো বাচ্চারা কাগজের বল নিয়ে খেলছে। তার একটা নিশানের পায়ের কাছে পড়ে।
রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল। পার্কে বসে নিশান একমনে কিছু ভাবছিল। তখনি কাগজটা ওর মাথায় লাগলো।

নিশান সামনের দিকে তাকালো। আজ এতদিন পর হটাৎ বাড়ির কথা মনে পড়ছে। কিন্তু নিশান যে সব ছেড়ে চলে এসেছে, চিরতরের জন্য। ওর চোখে ভেসে উঠলো রাই এর হাসিমাখা চেহারাটা। মুখে এক কিঞ্চিৎ হাসি এলো।
কিন্তু হায়, সেই শেষ স্মৃতিটা ও (ফোনটা) যে নিশান মিটিয়ে এসেছে। এখন যা আছে সব শুধুই ওর স্মৃতিতেই আবদ্ধ। এর বাইরে আর কিছুই যে ওর শেষ নেই….

একে একে নিজের পুরনো সুখের স্মৃতিগুলো মনে করলো নিশান। আর মুখে এক তৃপ্তির হাসি নিয়ে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাড়ালো। পকেটে দুহাত দিয়ে মাথাটা ঝুঁকিয়ে হাটতে শুরু করলো। কোথায়? যেদিকে দুচোখ যায়। এখন তো এই তার জীবন। আর এতেই নিশান খুশি।

যেদিন ফিরবে সেদিন নাহয় মনের সুপ্ত অনুভূতিগুলো বিছিয়ে দিবো তোমার পথে। জানবে, কতটা ভালোবাসি……
তোমারই অপেক্ষায়
নিশান

লাল কলমটা শব্দ করে টেবিলে পড়ে গেলো। পেছনে উঠে নির্জীব পায়ে হেঁটে চলে গেলো সে।
জানালার বাতাসের দমকা হাওয়ায় ডাইরির পাতাগুলো উল্টে গেল। পেছনে একটা সুর বইতে থাকলো
খোলা জানালায় দক্ষিণের বাতাসে,
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে

কখন তুমি এসে হেসে বলে দাও
আছি তোমার ও পাশে

বহুদূর পথ, ভীষণ আঁকাবাঁকা
চলতে ভীষণ ভয়
তুমি এসে বলে দাও আছি পাশে
করোনা কিছুতেই ভয়।

কখনো ভাবিনি চলে যাবে তুমি আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে
কখনো ভাবিনি ফিরে আসবেনা
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে

অনেক পথের পথিক আমি
ক্লান্তি সর্বশেষ
তোমার পথের ঠিকানা খুঁজে
আমি আজ অবশেষে

তুমি আমার প্রথম ও শেষ
জীবনের ভালোবাসা
তোমার মাঝে তাইতো আমার জীবনের শত আশা
কখনো ভাবিনি চলে যাবে তুমি

আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে
কখনো ভাবিনি ফিরে আসবেনা
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।

লেখা – মিজুকি ওরা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “In the depths of love – ভালবাসার গভীরতায়” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – আমার আছে জল – ব্যর্থ প্রেমের ছোট গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *