তবুও তোমাকেই চাই (শেষ খণ্ড) – ভালোবাসার আবেগের গল্প

তবুও তোমাকেই চাই (শেষ খণ্ড) – ভালোবাসার আবেগের গল্প: তোহার প্রেগন্যান্সির যখন সাড়ে সাতমাস চলে তখন তোহার রেজাল্ট বের হয়। নির্ণয় সেইদিন ঢাকায় আসে। নির্ণয় অনলাইনেই তোহার রেজাল্ট বের করে। তোহার রেজাল্ট দেখে নির্ণয় হা হয়ে যায়।


পর্ব ০৯

নির্ণয় সন্ধ্যাবেলা তোহাকে ফোন না করেই মন খারাপ করে বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে নির্ণয় চুপচাপ সোফায় বসে। তোহা ওর ঘরে বই পড়ছে৷ মেহের ড্রইংরুমে এসে দেখে নির্ণয় বসে আছে। মেহের নির্ণয়কে এক গ্লাস পানি দেয়।
~ ভাবি ভাইয়া এসেছে। (মেহের)

মেহেরের কথা শুনে তোহা বই বন্ধ করে ড্রইংরুমে আসে। নির্ণয়ের পা থেকে মোজা খুলতে খুলতে তোহা বলে,
~ আজ ফোন দিলেন না যে! মন খারাপ?
~ হুম।
~ কিছু কি হয়েছে?

~ হয়েছে তো বটেই। আব্বু আসেনাই?
~ হ্যা আব্বু তো ঘরে। আসো আব্বু আম্মুর ঘরে।
নির্ণয় উঠে গিয়ে নক করে আব্বু আম্মুর ঘরে ঢুকে। তোহা আর মেহের ও পিছু পিছু যায়।

~ তুমি চেইঞ্জ করনি নির্ণয়? (আব্বু)
~ না আব্বু তোমাদের একটা কথা বলার ছিল।
~ হ্যা বলো।

~ আব্বু আমার রাজশাহী পোস্টিং হয়েছে। চারদিন পরই সেখানে চলে যেতে হবে আমাকে। (মন খারাপ করে কথাটা বলল নির্ণয়)
~ কিহ? মানেটা কি? আপনি একা সেখানে থাকবেন? (তোহা)
~ তো আর কি করব? তুমিও তো এখানে এডমিশন নিয়ে নিয়েছো। আর কাকে নিয়ে যাব আমি?

~ কি বলছিস তুই ভাইয়া? তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি? (মেহের)
~ সরকারি চাকরি এমনি! তোরা সবাই একসাথে থাকবি আর তুই তোহার সাথে ঘুমাবি।

তোর ঘর ফাঁকাই থাকবে। তোরা দুজন মিলে বাবা মা কে দেখে রাখবি। যখন যেই প্রবলেমেই পরিস না কেন আমায় জানাতে ভুলবি না! এই কথাগুলো আমি সবাইকে বলছি। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।

নির্ণয় যাওয়ার পর তোহা শ্বশুর শ্বাশুড়ির সামনেই কেঁদে দেয়। মেহের তোহার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,
~ ভাইয়ার কাছে যাও। কাঁদছো কেনো হ্যা?
~ আমি আসছি একটু। (তোহা)

তোহা কান্না করতে করতেই ঘরে যায়। নির্ণয় শার্ট খুলে টাওয়েল হাতে নিয়েছে এমন সময় গিয়ে তোহা নির্ণয়কে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়।

~ তোহা তুমি কাঁদছো কেনো? তোহা। (নির্ণয়)
~ আপনি সত্যি আমাকে এখানে রেখে চলে যাবেন? (তোহা)
~ তো কি করব? এছাড়া কি আমার কিছু করার আছে তোহা?
~ আপনি ওখানে একা থাকলে আপনাকে দেখবে কে? কে খাওয়াবে আপনাকে? আপনার খেয়াল কে রাখবে?

তোহা এসব বলে ইচ্ছেমতো কাঁদছে আর নির্ণয় তোহাকে জড়িয়ে ধরে ভাবছে,

~ এই মেয়ে এত কেন ভাবে আমাকে নিয়ে? এখন কি আমাকেও কাঁদাবে নাকি?

~ আপনি প্লিজ যাইয়েন না। আমাকেও নিয়ে যান না? (তোহা)
~ তুমি কি বোকা?

ইউ আর আ মেডিকেল স্টুডেন্ট তোহা। তুমি জানো তোমায় নিয়ে আমার কত স্বপ্ন? তোমার মতো ট্যালেন্টেড বউ কতজন পায়? কতজনের বউ মেডিকেলে পড়তে পারে? তুমি একজন সাক্সেসফুল ডক্টর হবা তোহা। সামান্য আবেগে নিজের এত বড় ক্ষতি করনা।

~ আমি এখানে একা একা কাকে নিয়ে থাকব আজব তো! আমার পড়াশোনা, এতকিছু করা এসব তো স্রেফ আপনার জন্য। আপনি না থাকলে আমার পড়ে কি লাভ? চাইনা আমার এমন পড়াশোনা। আমি পড়বনা মেডিকেলে।

আমি আপনার সাথে যাব। (কেঁদে কেঁদে তোহা)
~ তুমি এখানেই থাকবা আর মেডিকেলেই পড়বা। প্রতিদিন পড়াশোনা করবা। আর দিনশেষে অর্ধেক রাত আমার সাথে ফোনে কথা বলবা। এভাবেই চলতে হবে তোহা তোমায়। তোমাকে যে ডক্টর হতেই হবে।
তোহা আর কিছু বলেনা। ওর চিন্তা শুধু একটাই যে নির্ণয় খাবে কি? থাকবে কোথায়? ওকে দেখে রাখবে কে?

চারদিন তোহা হাসেনি, কথা বলেনি কারো সাথে ঠিক করে। রাতে নির্ণয়কে জড়িয়ে ধরেছে কেঁদেছে শুধু। একটা একটা করে দিন যাচ্ছে আর তোহার বুকের একপাশ একটু একটু করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। নির্ণয়ের যাওয়ার দিন তোহা সারাদিন কেঁদেছে।

নির্ণয় ও তোহাকে থামাতে পারেনি। তোহা নিজের বিছানার উপর উঁবু হয়ে শুয়ে কাঁদছে আর নির্ণয়ের আম্মুও ঘরে এসেছে। নির্ণয় ওর আম্মুকে বলছে,
~ কি শুরু করেছে মা ও? চারটাদিন ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। ও এভাবে কাঁদলে আমি যাব কিভাবে? থামতে বলো ওকে।

~ তোহা মা উঠো। ও তো বিকেলে বেরিয়ে যাবে। তুমি কাঁদলে যাবে কিভাবে ও? ও তো আমাদের কথা দিয়েছে প্রতি সপ্তাহে এখানে আসবে। এভাবে কেঁদো না তুমি।

(নির্ণয়ের আম্মু)
~ আম্মু আসা না আসা বড় কথা নয়। ওনাকে কে দেখবে ওখানে? কি খাবে? থাকবে কোথায়? (তোহা)
নির্ণয়ের আম্মু নির্ণয়কে কানে কানে বলে,

~ এই পাগলকে আমি কি বলি বল তো! আমি মা হয়েও এতকিছু ভাবছিনা আর ও কেঁদে কেঁদে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ওকে একটু সময় দে। তোহা তোর জন্য কিছু খাবার রান্না করেছে আমি সেগুলো প্যাক করছি। বকিস না যেন ওকে। আর হ্যা প্রমিস করেছিস যে প্রতি সপ্তাহে আসবি। (নির্ণয়ের আম্মু)
~ আসব।

মা চলে যাওয়ার পর নির্ণয় তোহাকে শোওয়া থেকে উঠায়। তোহার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
~ কি অবস্থা করেছো নিজের? চোখ মুখ তো এক হয়ে গেছে ফুলে! প্লিজ ময়নাপাখি কেঁদো না।

আমি বলছি তো আমি প্রতিদিন তোমার সাথে কথা বলব, আর ঠিকমতো খাব আর আমি তো অলরেডি একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া সেখানে এডভান্স করে দিছি। তাহলে এত চিন্তা কেন করছো তুমি? সেখানে গেলে একটা বুয়া খুঁজে নিব। তাহলেই তো হয়ে গেলো। (নির্ণয়)

~ কিচ্ছু হয়ে গেলো না। আপনি ভালো থাকবেন তো? (তোহা)
~ সেইটা কি তুমি জানো না আমি ভালো থাকব কি না?

বাট আমি তোমায় কথা দিচ্ছি প্রতি সপ্তাহে আমি আসব এসে তোমায় ঘুরতে নিয়ে যাব, তোমায় সময় দিব। আমি তো দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি না তোহা। আমি শুধু এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাচ্ছি। মাত্র ৫/৬ ঘণ্টার রাস্তা।

আর তুমি মেডিকেল থেকে ছুটি পেলেই তোমায় নিয়ে যাব। পাঁচটা বছরই তো। তুমি ইন্টার্নি কমপ্লিট করে ফেললে আর চিন্তা কি? কেটে যাবে এই পাঁচ বছর হ্যালায় ফ্যালায়ই। তুমি আর কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমি যেতে পারবনা তোহা।

~ আচ্ছা আমি কাঁদলাম না। আপনি রেডি হবেন তো? জামা কাপড় আয়রন করে রেখেছি ওয়াড্রবের উপরে। পরে নিয়েন। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।

তোহা উঠে চোখ মুছে চলে যায় রান্নাঘরে। আম্মুকে হাতে হাতে সাহায্য করে তোহা। নির্ণয় ও মন খারাপ করে রেডি হচ্ছে। রেডি হওয়া শেষে তোহা নির্ণয়ের জামাকাপড় এর ট্রলিতে কিছু খাবার ভালো করে প্যাক করে ঢুকিয়ে দেয়।

~ ওখানে গিয়ে রাতে এগুলো দিয়েই ডিনার করবেন। একটু গরম করে নিয়েন কষ্ট করে আর যা যা লাগে…….
তোহা কথা শেষ করার আগেই তোহার হাত টান দিয়ে নির্ণয় তোহাকে ওর কাছে নিয়ে আসে।

তোহা কাঁদছেনা কিন্তু চোখ দিয়ে পানি পরছে।
~ তুমি আবারো কাঁদছো? হাসবানা একটু? (নির্ণয়)
~ আমি কাঁদছিনা। চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেলে আমি কি করব? চোখ উপ্রে ফেলব? (তোহা)

~ না। কেঁদো না প্লিজ। আমি পাঁচদিন পরেই এখানে আসছি৷ তুমি ঠিকমতো পড়াশুনা কর, আব্বু আম্মুকে দেখো, মেহেরকে দেখে রেখো আর নিজের কেয়ার করো। চুলে শ্যাম্পুর পর তেল দিও। এখন আমি থাকবনা তাই জোর করে দিয়ে দিতে পারবনা কিন্তু। তোমার তো স্বভাব খারাপ রাতে বিনুনি করলে পরেরদিন সকালে চুল আঁচড়াও না।

এখন তো প্রতিদিন মেডিকেলে যেতে হবে সো চুল আঁচড়িয়ো। আর টাইম নিয়ে গোসল করনা, ঠান্ডা লেগে যাবে। নামাজের কথা বললাম না কারণ আমি না বললেও তুমি ওই কাজটা করবে। (তোহার চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে নির্ণয়)
~ সব করব।

~ অফকোর্স ময়নাপাখি। (তোহার কপালে চুমু দিয়ে নির্ণয়) কেঁদো না তুমি আর হ্যা?

~ আচ্ছা কাঁদবনা। নামাজ পড়বেন ঠিকমতো।
~ আচ্ছা।

নির্ণয় বেরিয়ে যাওয়ার আগে নির্ণয়ের আব্বু নির্ণয়কে অনেকদিন পর জড়িয়ে ধরে। নির্ণয় খুশি হয়ে যায় তখন। আগের কেয়ারলেস নির্ণয় এখন বউসহ সবার কেয়ার করছে।

প্রতিটা বাবা বোধহয় এমন একটা ছেলেরই আশা করে থাকে সব সময়! তোহা নির্ণয়কে হাসিমুখে বিদায় জানায়। নির্ণয়ের বাবা নির্ণয়কে বাস স্ট্যান্ডে ছাড়তে যাচ্ছে। নির্ণয় যাওয়ার পর তোহা ঘরের কাজ সেড়ে নেয় তাও তা মুখ ভাড় করে।

মেহের তোহাকে কাজ করতে নিষেধ করেছে কিন্তু তোহা ইচ্ছে করেই করছে যাতে আর চোখ দিয়ে পানি না আসে।
কয়েকঘণ্টা পর নির্ণয় তোহাকে ফোন করে। তোহা ফোন রিসিভ করার পর নির্ণয় বলে,
~ এখনো কাঁদছো?

~ না। পড়তে বসেছি। আপনি রাস্তায়?
~ হ্যা। কিছুক্ষণ পর পৌঁছে যাব। বই ভিজাচ্ছো না তো? (নির্ণয়)
~ ভিজেছে আবার শুকিয়ে ফেলেছি ফ্যানের নিচে দিয়ে। (অল্প হেসে তোহা)

~ হাহাহাহা। একটু হলেও কতদিন পর হাসলা বলো তো? (নির্ণয়)
~ হাসি না আসলে আমি কি করব? মুখে কসটেপ মেরে হাসবো?
~ এই না। এত সুন্দর ঠোঁটগুলো নষ্ট হয়ে যাবে পরে আমি কোথায় কিস করব?

~ হইছে! চলে গেছে আবার বলে কিস করবে! (বই বন্ধ করে তোহা)
~ আসব তো নাকি? একেবারে তো যাইনাই। ডিনার করছো?
~ না। আপনি গিয়ে আগে করবেন এরপর আমি করব।

দূরে গেলে কি হবে? ভালবাসা তো কমে যায়নি। (নখ খুঁটতে খুঁটতে তোহা)
~ এত ভালবাসা কই রাখব আমি? (হেসে নির্ণয়)
~ একটা ব্যাগ বানিয়ে দিবনে, ওইখানেই রাইখেন।


পর্ব ১০

নির্ণয় তোহার সাথে কথা বলতে বলতে ওর ভাড়া করা ফ্ল্যাটে উঠলো। তিনতলায় এক রুমের একটা ফ্ল্যাট সাথে বিশাল ভ্যালকনি আর ভ্যালকনির পাশে অসংখ্য গাছ।

নির্ণয়ের বাসাটা পছন্দ হয়ে যায়। নির্ণয় ঘরে ঢুকে ঘর দেখার পর তোহাকে বলে,
~ ফ্রেশ হয়ে কল করছি। তুমি ডিনার করে আসো৷ আমি এখনি খেয়ে নিচ্ছি।

~ খান আপনি। আর গোসল করে মাথা ঠিক করে মুছবেন। সাদা টাওয়েলটা ইউজ করবেন গোসল করে। (তোহা)
~ আচ্ছা। তুমি খেতে যাও।
~ যাই।

তোহা নির্ণয়ের ফোন কেটে বই খাতা গুছিয়ে রেখে খাবার খেতে যায়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে তোহা ঘুমানোর জন্য শুয়ে পরে পাশে মেহের। তোহা একা ঘুমাতে ভয় পায় তাই মেহের তোহার সাথে ঘুমিয়েছে।

নির্ণয় আবার ফোন দেওয়ার পর তোহা উঠে সোফার উপর বসে কথা বলে। মেহের ওর বয়ফ্রেন্ড এর সাথে তখন চ্যাটিং করছিলো। কথা বলা শেষে নির্ণয় ও ঘুমিয়ে যায় আর তোহাও বিছানায় এসে শুয়ে পরে।

তিনদিন পর,
নির্ণয় অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে তোহাকে ফোন করে। তোহা তখন শ্বাশুড়িকে ওষুধ খাওয়াচ্ছিলো।

~ আসসালামু আলাইকুম। (ফোন রিসিভ করে তোহা)
~ ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি করতেছো?

~ আম্মুকে ওষুধ দিয়ে আসলাম৷ আপনি কখন আসলেন?
~ আধা ঘণ্টা আগে।
~ বুয়া রান্না করে দিয়ে গেছিলো?
~ হ্যা।

~ খাইছেন?
~ হ্যা। তুমি?
~ না খাব। শুনেন
~ হুম বলো।

~ আমি একটু কুমিল্লা যেতে চাইছি। অনেকদিন আব্বু আম্মুকে দেখিনা।
~ তোমার ক্লাস?

~ কলেজ ছুটি তিনদিনের জন্য৷
~ তাহলে যাও। আব্বুকে বলে দিবনে। আব্বু দিয়া আসবে।
~ আচ্ছা। কাল যাব তাহলে।
~ বই নিয়ে যেয়ো।

তোহা পরেরদিন শ্বশুরের সাথে নিজ বাসায় গেলো। প্রায় ছয়মাস পর তোহা বাবা মাকে দেখছে। বাবা মা ও খুব খুশি মেয়ে এসেছে বলে। কলেজ ছুটির তিনদিন তোহা বাবার বাসাতেই কাটালো। এইদিকে প্রতিদিন নির্ণয়ের সাথে তোহার ফোনে কথা হয়ই। তোহার বাবা এসে তোহাকে আবার ঢাকা দিয়ে যায়। সেইদিন নির্ণয়ের ঢাকায় আসার কথা। ওইদিন ছিল বৃহস্পতিবার।

দুপুরে তোহা বাসায় এসে ঘর গুছিয়ে রাখে। নির্ণয় রাতে আসবে। আগামীকাল শুক্রবার তোহার কলেজ অফ। ভালই হয়েছে আসুক সে। সন্ধ্যায় কাজ সেড়ে তোহা গোসল করে নির্ণয়কে কল করে।
~ কই আপনি? (তোহা)
~ বাসে।

~ অফিস তো আজকে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছে না?
~ হ্যা। বৃহস্পতিবার তাড়াতাড়িই ছুটি হয়।
~ সাবধানে আইসেন।

~ সাতটা দিন তোমার থেকে দূরে ছিলাম।
~ সাত বছর তো আর না। (মুখ বাঁকিয়ে তোহা)
~ ওইটা হইলেই মনে হয় তুমি খুশি হইতা তাইনা?
~ মাথা আপনার। ফোন রাখেন। আমি এখন রান্না করব।
~ কি রান্না করবা?

~ বাসমতি চালের পোলাও আর চিকেন।
~ ও আচ্ছা আমার জন্য আমার প্রিয় ডিশ? (নির্ণয়)
~ না আমি খাব।

~ তুমি আসলা কখন?
~ দুপুরে।
~ বাবা চলে গেছে?

~ হ্যা লাঞ্চ করেই বেরিয়ে গেছে। আম্মু আবার একা থাকবে তো তাই। এই রাখছি আমি। এখনো আমার রান্না করা বাকি। বাই। সাবধানে আইসেন।

তোহা তাড়াহুড়ো করে ফোন কেটে রান্না বসায়। মেহের তোহাকে সাহায্য করছে কাটাকুটি করে দিয়ে। ননদ ভাবি মিলে সব রান্না শেষ করে ফেলে। সেইদিন কেউ আর ডিনার করেনি নির্ণয়ের সাথে করবে বলে। রাত এগারোটায় নির্ণয় বাসায় আসে।

তোহা তখন সোফার উপর পায়ের উপর পা তুলে বই পড়ছিলো। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মেহের দরজা খুলে দেয় আর তোহা পিছু ফিরে দেখতে যাবে কে ঠিক তখনি নির্ণয় তোহাকে দেখে হেসে দেয়।
~ এভাবে কেউ পড়ে? (তোহাকে প্রশ্ন করে নির্ণয়)
~ আপনি!

তোহা বই সোফার উপর রেখেই নির্ণয়ের সামনে যায়। নির্ণয়কে ধরতে যেতেই নির্ণয় তোহাকে আটকায়।

~ এই না ধরবানা। শার্টে প্রচুর ধুলা লেগে আছে। সরো। আমি আগে গোসল করব। (নির্ণয়)

~ হু যান। (তোহা নির্ণয়কে সাইড দিয়ে)
~ আম্মু আব্বু তোমাদের সাথে পরে কথা বলছি। আসতেছি।

নির্ণয় খাবার প্যাকেটগুলো ডায়নিং এ রেখে নিজের ঘরে চলে যায়। তোহাও যায় নির্ণয়ের পিছু পিছু। নির্ণয় তোহার টাওয়েল নিয়েই বাথরুমে ঢুকে যায়। নির্ণয়ের অর্ধেক জামাকাপড় ই এখানে আছে কিন্তু টাওয়েল নেই একটাও। তাই তোহার টাওয়েল নিয়েই নির্ণয় গোসল করতে চলে গেলো। তোহা সবার জন্য খাবার বাড়ছিলো তখন নির্ণয়ের আব্বু সবার আগে টেবিলে বসে।

~ আব্বু আপনি আজকে ডাকার আগেই চলে এলেন? (তোহা)
~ ছেলের সাথে কতদিন পরে খাব তাই লোভ সামলাতে না পেরে চলে এসেছি। আর পোলাও এর ঘ্রাণে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। (তোহার শ্বশুর)

~ হাহাহা আব্বু ভাইয়া খুশি হয়ে যাবে বুঝছো। (মেহের)
~ নির্ণয় এখনো গোসল করে! (নির্ণয়ের আম্মু)
~ দাঁড়াও আম্মু আমি দেখছি। (মেহের)
~ দেখতে হবেনা। আমি চলে আসছি। (মেহেরের মাথায় টোকা মেরে নির্ণয়)

~ তুই মানুষ হবিনা ভাইয়া? আবার মারলি আমারে? (মেহের)
~ ভালও তো বাসি না? (মেহেরকে সাইড হাগ করে নির্ণয়)
~ আমিও তোকে অনেক ভালবাসি। আয় আমার সাথে বস।
~ চল।

তোহা সবাইকে খেতে দিয়ে ও দাঁড়িয়ে ছিল। নির্ণয় বলে,
~ তুমি বসছো না কেনো? আর যা যা লাগে আমরা নিয়ে নিব।
~ হ্যা তোহা বসো তুমি। (তোহার শ্বাশুড়ি)
~ আচ্ছা মা।

নির্ণয়ের সাথে মেহের বসা আর তোহা নির্ণয়ের উলটা পাশে বসে আছে। তোহা আস্তে আস্তে খাচ্ছে আর নির্ণয় দেখছে।
খাওয়া শেষ করতে করতে রাত বারোটার বেশি বেজে যায়। খাওয়া শেষে মেহের তোহাকে বলে,

~ যাও ঘরে যাও। আমি এসব গুছিয়ে রাখছি। ভাইয়া একা আছে ঘরে।
~ এতদিন থাকছেনা একা? আর কিছুক্ষণ থাকুক। আমি এগুলো করেই যাচ্ছি। তোমায় করতে হবেনা। (তোহা)
~ যাহ। তুই আমার ভাইয়ার কাছে যা। ধাক্কা মারব কিন্তু এখন। (মেহের)
~ আবার আমায় তুই বলছে!
~ এখন আরো বলব না গেলে।

~ আচ্ছা ভাই যাচ্ছি। তুমি এগুলো ঠিক করে রেখো।
~ হ্যা রাখব। যাও তুমি। (মেহের)
তোহা মেহেরের কথায় ঘরে চলে আসে। নির্ণয় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রাস্তার আলো দেখছিলো।
~ ওই? (তোহা)

~ কি হইছে? এইভাবে ডাকো কেন? (নির্ণয়)
~ এর চেয়ে ভালভাবে ডাকতে জানিনা। আপনি আপনার বোনের সামনে আমায় আজকে অপমান করছেন। (দরজা বন্ধ করে তোহা)
~ বাট হাও?

~ বাট হাও! জানেন না আপনি? একটু ধরতে গিয়েছিলাম বললেন কেন যে শার্টে ধুলা?

~ ওইটা তো সত্যি ছিল তাই। (তোহাকে কাছে টেনে নির্ণয়)
~ এহ ছাড়েন। এক সপ্তাহ দূরে ছিলেন না? এখন আবার ধরতে আসছেন!

~ শখে ছিলাম তো দূরে তাইনা?
~ এখন আর আপনি ধরলে আমি কাঁপাকাঁপি করিনা হুহ। আমি বড় হয়ে গেছি। (তোহা নির্ণয়ের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে নির্ণয়ের গলা জড়িয়ে ধরে)
~ বাব্বাহ! আমি করাবো কাঁপা~ কাঁপি? (তোহার চুল ঠিক করে দিয়ে নির্ণয়)
~ হ্যা করান পারলে৷
~ আচ্ছা?

~ কি আচ্ছা আবার?
তোহার ওড়না সরিয়ে দিয়ে নির্ণয় তোহার চুল খুলে দেয়।
~ ওই এসব কি হ্যা? (তোহা)

~ ওই এসব কি হ্যা? (নির্ণয় তোহার কাছে গিয়ে)
~ আমার কথার রিপিট কেন করছেন? (তোহা)
~ আই লাভ ইউ! (তোহার কানের কাছে গিয়ে নির্ণয়)
~ তো আমি কি করব?

আমি তো ভালবাসিনা।
~ তোমায় বাসতে বলছে কে? জানো হৃদি….
~ হৃদিইই? আবার কিসের হৃদি? (নির্ণয়কে খাটে ফেলে তোহা নির্ণয়ের গেঞ্জির নেক ধরে)

~ বলতে যাচ্ছিলাম হৃদি আর কি। কি জানি বলতে যাচ্ছিলাম মনে নেই। (নির্ণয়)

~ আবার কাহিনী করছেন? হৃদি আবার আপনাকে কল করেছে তাইনা? আপনি আমায় এইটা বলেন নাই। ছিহ আমাকেও মিথ্যে বলেন? (তোহা)

~ আরে ধুর কই হৃদি আমায় কল করেছে জাস্ট তোমার এটেনশন ড্র করার জন্য বলেছি। (তোহার কপালে চুমু দিয়ে নির্ণয়)
~ এটেনশন ড্র করার জন্য হৃদির নামটাই নিতে হলো? (মন খারাপ করে তোহা)

~ আচ্ছা বাদ দাও তো। আই মিসড ইউ ব্যাডলি ট্রাস্ট মি। তোমার কলেজে ভ্যাকেশন শুরু হলেই আমি সত্যি তোমায় নিয়ে যাব।
~ আমিও মিস করেছি অনেক কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় ভুল মেডিক্যালে ভর্তি হওয়া। (নির্ণয়ের হাতের উপর শুয়ে তোহা)
~ আবার একই প্যাচাল!

~ থাক আর এই প্যাচাল পারবনা।
~ মা আমায় ফোন করে কি বলে জানো? (হেসে নির্ণয়)
~ কি?

~ আমরা কেনো বাচ্চা নেইনা? তোমার বয়স কম সেইটা মানা যায় কিন্তু আমার বয়স তো কম না। আম্মু আমায় বলছে দেরি করে বেবি নিলে বেবি পরে আমাকে দাদু বলে ডাকবে। (হাসতে হাসতে নির্ণয়)
~ এই কথা কি আমি ভাবিনাই? আমার না হয় উনিশ বছর কিন্তু আপনার তো আটাশ।

~ কিন্তু কি করার আছে? তোমার পড়াশোনা হ্যাম্পার হবে। আর আমি সেইটা চাইনা। (তোহার হাত ধরে নির্ণয়)
~ কিন্তু মা ভুল কিছু বলেনি। ভেবে দেইখেন।
~ ভাবতে তো হবেই।


পর্ব ১১

নির্ণয় আর তোহা কথা বলছিলো হঠাৎ নির্ণয় বলে,
~ তোহা?
~ হ্যা বলেন।

~ তুমি ভালমতো চইলো। আর আব্বু আম্মু কিছু বললে তর্ক করনা।
~ এসব আপনাকে আমি বুঝাতে বলছি? এত খারাপ ভাবেন কেনো আপনি আমাকে?

~ খারাপ কই ভাবলাম?
~ খারাপই তো ভাবলেন। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?
~ হ্যা কর।

~ আমাদের দূরত্ব কি ভালবাসা বাড়িয়েছে না কমিয়েছে?
~ অফকোর্স বাড়িয়েছে। কমবেনা তো এই ভালবাসা।
~ আপনি কমাবেন না কখনো ঠিক আছে?

নির্ণয় জবাব দেওয়ার আগেই হঠাৎ নির্ণয়ের ফোন বেজে উঠলো। নির্ণয় তোহাকে বুকে রেখেই ফোন রিসিভ করলো।
~ হ্যালো কে বলছেন?

~ নির্ণয় আমি উজ্জ্বল বলছিলাম। আমি সরি তোমায় এত রাতে বিরক্ত করলাম বলে!

~ উজ্জ্বল! মানে হৃদির হাজব্যান্ড? (নির্ণয়)
~ হ্যা।
~ এত রাতে! কিছু হয়েছে ভাইয়া? (নির্ণয়)

~ সমস্যা তো বিয়ের পর থেকে লেগেই আছে। আমি আর পারছিনা হৃদির সাথে সংসার করতে। না ও আমার কেয়ার করছে আর না নিজের! জানো নির্ণয় আজ অবধি আমাদের মধ্যে হাজব্যান্ড ওয়াইফের সম্পর্কটাই তৈরি হয়নাই শুধুমাত্র হৃদি চায়নি বলে। ও স্রেফ একটা কথাই বলে নির্ণয় আমার সব, আমি ওকে ভালবাসি। (উজ্জ্বল)

~ ভাইয়া আপনাদের ব্যক্তিগত সমস্যা আমায় বলছেন! আমি এর কি সলভ দিব? আমি আপনাকে আগেও বলেছিলাম হৃদির বিষয়টা এক তরফা।

এক তরফা কিছু হয়না আর আমি মেরিড। প্রায় তিন বছর হলো আমি বিয়ে করেছি। আমি তো খুব সুখে আছি। এখন ও যদি ওর জীবনে সুখি থাকতে না পারে তার দায় তো কোনোভাবেই আমার না ভাইয়া। (নির্ণয়)

~ আমি সবটা বুঝেছি। লাস্টবার একটা ট্রাই আমি করতে চাই। তুমি কি আমায় হেল্প করবে নির্ণয়? (উজ্জ্বল)
~ কি হেল্প ভাইয়া?

~ তুমি কি একবার হৃদিকে সরাসরি বুঝাবে? ওকে একটু বুঝিয়ে বলবে সবটা? সাথে আমিও থাকব সমস্যা নেই।

~ এ হয় না ভাইয়া। আমি আর ওর সাথে দেখা করতে চাইনা।
~ প্লিজ নির্ণয়। আমার অবস্থাটা তুমি একটু বুঝো। আমি কতটা হেল্পলেস হয়ে তোমায় কল করেছি তাও এত রাতে! আমি একটু আগে অফিস থেকে বাসায় এসেছি। এসে দেখি ও শুয়ে আছে। ভাবলাম চকলেট দেই ওকে।

যেই একটু ধরতে গেলাম ওমনি রিএক্ট করা শুরু করলো। শ্বশুর শ্বাশুড়িকে বলেও কোনো লাভ হচ্ছেনা। এভাবে চলতে থাকলে আমার সংসারটা ভেঙে যাবে। (উজ্জ্বল)
~ ভাইয়া আমি ভাবছি। কাল জানাবো আপনাকে ঠিক আছে?
~ আচ্ছা জানাইয়ো ভাই প্লিজ।

নির্ণয় ফোন কেটে দিলো। তোহা জিজ্ঞেস করলো,
~ কি বলল উনি?

নির্ণয় তোহাকে সব বলার পর তোহা বলল,
~ যদি উনি মনে করে আপনি হৃদির সাথে কথা বললে হৃদি ভাল হয়ে যাবে তো আপনার বলা উচিৎ। ওই বেচারাও তো হেল্পলেস।
~ তবে কি কাল পরশু যাব?

~ শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তো আপনি আছেন ই। শনিবার সকালে দেখা কইরেন। এখন অনেক রাত হয়েছে। ঘুম পেয়েছে আমার। ঘুমাবো।
~ ধ্যাৎ! কিসের ঘুম?

~ কিসের ঘুম কি আবার? ঘুমাবনা? রাত হয়নাই?
~ এই মেয়ে এত বেশি কথা কেন বলে! (নির্ণয়)
~ আচ্ছা বললাম না।

ভোরবেলা,
তোহা ভোরে ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে নির্ণয়কে ধাক্কাচ্ছে।
~ আযান দিবে এখন উঠেন। গোসল করে নামাজ পড়বেন।
~ আমার প্রচুর ঘুম পেয়েছে তোহা, আমি এখন ঘুমাবো। প্লিজ ডেকো না।

~ আহা নামাজটা পড়ে ঘুমান। সমস্যা কি? কেউ তো আর ডাকতে যাচ্ছেনা তখন। উঠেন এখন।

~ এই মেয়েটা এত খারাপ না! ধুর।
নির্ণয় বিরক্ত হয়ে উঠে যায়। তোহাকে বলে,
~ এসো।

~ কই যাব?
~ আমার সাথে গোসল করবা, এইটা তোমার শাস্তি।
~ জীবনেও না। একবার করে শিক্ষা হয়ে গেছে৷ যান আপনি। তাড়াতাড়ি।

~ আমি তো একা যাবনা।
~ আমিও যাবনা।
~ নামাজ ও পড়বনা।
~ যান আসতেছি। (দাঁত মুখ খিচিয়ে তোহা)
~ আচ্ছা আসো।

তোহা বিরক্ত হয়ে নির্ণয় আর ওর জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে যায়। তোহা নির্ণয়ের সাথে গোসল করতে চায়না কারণ নির্ণয় ওকে একবার চুলে শ্যাম্পু করিয়ে দিচ্ছিলো। তোহা একটু নড়েছে বলে নির্ণয় ঠাস করে ওর গালে থাপ্পর মেরে দেয়। এই জিনিসটা তোহার আজীবন মনে থাকবে।

দুজন গোসল করে একসাথে নামাজ পড়লো। নামাজ পড়েই নির্ণয় শুয়ে পরে আর তোহা কুরআন শরীফ পড়ে ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। রুটি আর ভাজি রেডি করে তোহা মেহেরকে ডাকে।

মেহের উঠে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে। সকাল নয়টায় সবাই ব্রেকফাস্ট করে আর নির্ণয় তখনো ঘুমায়।
~ নির্ণয় এখনো ঘুমাচ্ছে তাইনা? (নির্ণয়ের আম্মু)
~ হ্যা আম্মু।

~ বাজারে যেতে হবে তো। কাকে পাঠাবো?
~ আব্বু যাবেনা?

~ না। ওনার কি নাকি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। বেরিয়ে যাবে এখনি।
~ তাহলে আর কি আপনার ছেলেকে ডাকি দাঁড়ান।
~ রেগে যাবে দেইখো!

~ রাগাবো নে! দাঁড়ান আম্মু আমি আসছি।
তোহা ঘরে গিয়ে দেখে নির্ণয়ের মাথা তোহার বালিশে আর পা খাটের শেষ মাথায়।

পুরো খাট জুড়ে শুয়ে আছে ও। তোহা নির্ণয়ের পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে যাতে নির্ণয় হেসেই ঘুম থেকে উঠে। ওর ঘুম ভাঙালে ও রেগে যায় তাই। নির্ণয় পায়ে সুড়সুড়ি পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে। নির্ণয় তোহাকে সামনে দেখেই কি ধমক!

~ কি সমস্যা? সকালে না নামাজ পড়লাম। আবার ডাকছো কেন? (রেগে গিয়ে নির্ণয়)


পর্ব ১২

নির্ণয় বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা এসেছিলো। ওর অফিস ছুটি শুক্র আর শনি দুইদিন। শুক্রবার ও ঘুমের ডিস্টার্ব হলে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে যায় তার উপর তোহা এসে বাজারে যাওয়ার জন্য ডাকছে।

তোহা নির্ণয়কে ডাক দেওয়ার সাথে সাথে নির্ণয় এমন লুক দিলো যেন মনে হলো এখনি তোহাকে খেয়ে ফেলবে। তোহা বেচারি ভয় পেয়ে গেলো। তোহা নির্ণয়কে কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিয়ে বলে,
~ থাক স্বামী আপনি ঘুমান। আমি যাই।

বুকে থুথু দিয়ে তোহা ড্রইংরুমে এসে আম্মুকে বলে,
~ আম্মু অসম্ভব। আপনার ছেলেকে আমি ডাকতে পারবনা। আপনি দারোয়ানকে ফোন করেন। ও এসে বাজার করে দিয়ে যাবে।
~ যাবে? (

তোহার শ্বাশুড়ি)
~ একশ টাকা বেশি দিয়ে দিয়েন তাহলে যাবে।
~ দাঁড়াও আমি দেখছি। তুমি লিস্ট কর কি কি লাগবে আর কতটুকু লাগবে।
~ আচ্ছা আম্মু।

তোহা লিস্ট রেডি করে দারোয়ানকে বাজারে পাঠায়। নির্ণয় এগারোটার সময় ঘুম থেকে উঠে উজ্জ্বলকে ফোন করে আজকে বিকেলেই দেখা করতে বলে। উজ্জ্বল রাজি হয়ে যায়। নির্ণয় ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখতে বসে।
~ জুম্মা আজকে মনে আছে? (তোহা)
~ হ্যা আছে।

~ তো এখান টিভি দেখতে বসলেন যে!
~ দেড়টায় নামাজ। এখন বাজে সাড়ে বারোটা। এত আগে গিয়ে কি করব?
~ করেন যা ইচ্ছা।

~ আমার সাদা পাঞ্জাবিটা আয়রন কর।
~ আয়রন করে রেখেছি।

তোহা নির্ণয়ের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে গেলো। আর নির্ণয় পা ছড়িয়ে টিভি দেখছে। মেহের ওর নিজের কাজে ব্যস্ত। একটা বিশে নির্ণয় পাঞ্জাবি পড়ে জায়নামাজ হাতে নিয়ে মসজিদে চলে যায়। নামাজ পড়ে এসে নির্ণয় বাবা, মা, বোন সবার সাথে দুপুরে খেয়ে ঘরে চলে যায়। তোহাকে নির্ণয় বলে,
~ বিকেলে একটু বের হব তোমায় নিয়ে।
~ কোথায় যাবেন?

~ হৃদি আর ওর হাজব্যান্ড এর সাথে দেখা করতে।
~ শুধু আপনাকে না ডাকলো!
~ তাতে কি? আমার বউ ও যাবে।
~ আচ্ছা যাবনে।

হৃদি জানেনা যে নির্ণয় আসবে ওর সাথে কথা বলতে। উজ্জ্বল ও আর হৃদিকে জানায়নি। শুধু বলেছে আমরা একটু বাইরে যাব বিকেলে। হৃদির ও একটু বাইরের বাতাসের প্রয়োজন। তাই হৃদি কোনো প্রকার তর্ক ছাড়াই রাজি হয়ে যায়।

বিকেলে,
নির্ণয় কালো পাঞ্জাবি পরলো আর চুলগুলো ঠিক করে আঁচড়ালো। তোহা কালো বোরকা আর হাত মোজা, পা মোজা পরে রেডি। কাঁধে একটা ভ্যানিটিব্যাগ ঝুলিয়ে তোহা নির্ণয়ের হাত ধরে বেরিয়ে যায়।

নির্ণয়ের বাবা মা জানে ওরা ঘুরতে যাচ্ছে। নির্ণয় একটা রিক্সা নিয়ে মোহাম্মদপুরের একটা পার্কে যায়। পার্কের রেস্টুরেন্টে বসে হৃদি আর উজ্জ্বল নির্ণয়ের জন্য ওয়েট করছিলো। নির্ণয়কে আসতে দেখে হৃদি দাঁড়িয়ে যায়।

~ হৃদি বসো। অবাক হওয়ার কিছুই নেই। (উজ্জ্বল)
~ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। (হ্যান্ডশ্যাক করে নির্ণয়)
~ ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো আছো?
~ হ্যা অনেক ভাল আছি।

শি ইজ মাই ওয়াইফ। (নির্ণয়)
~ আসসালামু আলাইকুম ভাবি। (উজ্জ্বল)
তোহা মনে মনে সালামের উত্তর নিলো আর হৃদির দিকে তাঁকিয়ে হৃদিকে দেখছিলো। হৃদি দেখতে যথেষ্ট সুন্দরি। থ্রি পিস পরে চুলগুলো ছেড়ে এখানে এসেছে। নির্ণয়ের পাশে তোহা বসলো। হৃদি হাত মোঁচড়াচ্ছিলো তখন।

~ ও এখানে কি করছে উজ্জ্বল? তুমি ডেকেছো? (হৃদি)
~ হ্যা। তুমি শান্ত হয়ে বসো। (উজ্জ্বল)
~ আচ্ছা হৃদি তোমার সমস্যাটা কি?

তুমি এখনো নাকি নির্ণয় নির্ণয় কর? কিন্তু কেনো? এখন তো তোমারো একটা সংসার হয়েছে আর আমার তো হয়েছে সেই কবেই। এইসব আবেগের মূল্য কি এখন কেউ দিবে?

বিশ্বাস কর হৃদি আমি তোহাকে নিয়ে খুব ভালো আছি। তুমি কেনো পারছো না ভাইয়াকে নিয়ে ভালো থাকতে?

(নির্ণয়)
নির্ণয় কথা বলছিলো তখন তোহার পার্টস টা নিচে পরে যায়। তোহা নিচু হয়ে পার্টসটা উঠাতে যায় তখন নির্ণয় টেবিলের সাইডে হাত রাখে যাতে তোহা মাথায় ব্যাথা না পায়। হৃদি সেইটা মন দিয়ে খেয়াল করলো আর মনে মনে হাসলো।

~ হ্যা আমি জানি তুমি খুব সুখে আছো আর থাকবাও। নিজের সুখ কি এখন বেশি হয়ে গেছে যে বিলাতে আসছো? (হৃদি)
~ না হৃদি। আমি ওত দয়ালু না যে সুখ বিলাবো।

শুধু এইটা বলছি যে নিজের সুখটা নিজে ছিনিয়ে নাও। ভাইয়া খুব ভালো মানুষ হৃদি। ভালো মানুষ বলেই হয়ত তোমাকে এখনো ওনার কাছে রেখেছে। কোনো হাজব্যান্ড এসব মানেনা হৃদি, ভাইয়া মেনেছে।

কন্টিনিউয়াসলি ট্রাই করে যাচ্ছে তোমাকে সুখি করার। এই মানুষটার কি দোষ? উনি কেন শাস্তি পাবে? শোনো হৃদি অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে তুমি। অনার্স, মাস্টার্স ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে শেষ করেছো। কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাই এই সামান্য প্র‍্যাক্টিক্যাল সেন্সটা কেনো নেই তোমার? (নির্ণয়)

~ তুমি কি তোমার বউয়ের সামনে আমায় অপমান করছো নির্ণয়? (হৃদি)
~ না। যার মান নেই তাকে অপমান কিভাবে করব আমি? মান থাকলে এসব কথা আমায় শুনতে হতো যে তুমি আমার নাম জপো সারাক্ষণ? হতো শুনতে? (নির্ণয়)

~ প্লিজ, রেগে কেনো যাচ্ছেন? শান্ত ভাষায় বলেন। (তোহা)
~ জানো হৃদি বিয়ের আগে আমার মনে হতো আমি তোমায় ভালবাসি। কিন্তু তোমার ছ্যাচড়ামি আর ফালতামোর জন্য তোমার সাথে বন্ধুত্ত্বটাও শেষ হয়ে গেলো।

তোমার অবস্থাটা এমন যে নিজেও সুখি থাকবনা আর কাউকে সুখে থাকতেও দিবনা। তুমি তো এমন ছিলে না হৃদি? আমার বিয়ের পর হঠাৎ তোমার কি হলো? নিজের বোধ বুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলেছো তুমি? (নির্ণয়)

~ এখন কি আমার ব্যক্তিগত জীবনেও তোমার হস্তক্ষেপ করা লাগলো নির্ণয়? (হৃদি)

~ তুমি জানো না আমি কেমন? যেচে আমি কাউকে সাজেশন দিতে যাইনা। তোমার জীবনেও ইন্টারফেয়ার করতাম না কিন্তু তোমার হাজব্যান্ড বললো বলে আসা। আচ্ছা হৃদি… বাই দা ওয়ে কিছু অর্ডার করি? (নির্ণয়)

~ আমি করে দিয়েছি নির্ণয়। এক্ষুণি খাবার দিয়ে যাবে। (উজ্জ্বল)
~ তাহলে তো হলই।

~ আচ্ছা তোহা তুমি কি এখনো পড়াশোনা করছো? (হৃদি)
~ হুম। (তোহা)
~ কিসে পড়ছো?
~ মেডিক্যালে!

~ বেসরকারি? (অবাক হয়ে হৃদি)
~ জ্বি না। সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে।
~ খুব ভালো তো। অল দ্যা বেস্ট।
~ থ্যাংক ইউ।

~ যাইহোক নির্ণয় আমাকে বোঝানোর কিছুই নেই। আমি যথেষ্ট ম্যাচিউরড, সব বুঝি। আর এতটুকু খেয়াল রাখব যাতে তুমি আমার জীবনে জড়িয়ে না যাও। (হৃদি)
~ তাহলে তো খুবই ভালো হয় হৃদি। নিজের ভালো নিজে বুঝে গেছো তুমি। (নির্ণয়)

~ হ্যা তা অনেক আগে থেকেই বুঝি।
ওরা টুকটাক কথা বলছিলো আর খাচ্ছিলো। উজ্জ্বল অনেক করে বিল দিতে চাইলেও নির্ণয় দিতে দিলো না।

নির্ণয় ছেলেটা কারো কাছ থেকেই কোনো প্রকার ঋণে থাকতে চায়না। তোহা কিছু খেলো না কারণ খেতে গেলে ওকে নিকাব খুলা লাগবে যা উজ্জ্বলের সামনে সম্ভব না। তাই নির্ণয় বাসার জন্য আর তোহার জন্য খাবার নিয়ে নিলো। অনেকক্ষণ আড্ডার পর নির্ণয় শেষে একটা কথাই বলে যায় যে,

~ নিজের মানুষকে নিজের করে নিও হৃদি। কখনো হারাতে দিওনা। যে মানুষটা তোমার এত অন্যায় মেনে নিয়ে তোমার পাশে এখনো আছে সেই মানুষটাকে আর কষ্ট দিওনা। এমন ভালবাসা সবাই পায়না। আসছি।

নির্ণয় পার্কটা ঘুরে সন্ধ্যার পর খাবার নিয়ে বাসায় চলে আসে। তোহা বাসায় এসে নির্ণয়কে বলে,

~ হৃদি আপু যথেষ্ট সুন্দরি। ওনাকেই বিয়ে করলে ভালো করতেন। যদি তা~ ই করতেন তাহলে আজ আর এই দিন দেখা লাগতো না।


পর্ব ১৩

নির্ণয় তোহার কথা শুনে তোহার দিকে তাঁকালো। পাঞ্জাবির দুইটা বোতাম খোলার পর নির্ণয় হাত সরিয়ে তোহার সামনে গেলো।
~ আমি কি একবারো বলেছি আমি তোমার সাথে সুখে নেই তোহা?
~ তা বলেন নি।

কিন্তু দেখুন হৃদি আপু আপনাকে এখনো পাগলের মতো ভালবাসে। আমি তো আপনাকে হৃদি আপুর মতো ভালবাসতে পারিনাই এখনো। তাই বললাম আর কি!

~ শাট আপ। কে বলছে পারো নাই? (তোহাকে জড়িয়ে ধরে নির্ণয়)
~ পারিই তো নাই। নাহলে আমার সামনে কি করে অন্য মেয়ে আপনাকে ভালবাসার কথা বলতে পারে? (নির্ণয়ের বুকে মাথা রেখে তোহা)

~ ওর কথা বাদ দাও তো। ওর মতো ভালো মেয়ে হঠাৎ এমন হয়ে যাবে আমি ভাবিনাই। ওকে যা বলার আমি বলে এসেছি। এখন ওর সিদ্ধান্ত ও কি করবে? ওর কথা আর বলবা না। যাইহোক আমার জন্য একটু চা করে নিয়ে এসো।
~ যাচ্ছি।

তোহা যাওয়ার পর নির্ণয় বসে বসে ভাবছে এখন বোধহয় একটা বেবির ভাবনা ভাবা উচিৎ। নির্ণয়ের বয়স তো বেড়েই যাচ্ছে কিন্তু তোহার পড়াশোনা নির্ণয়কে আটকে দিচ্ছে বারবার। নির্ণয় তোহার কথা ভেবেই বাচ্চা কাচ্চার সিদ্ধান্তে আসতে পারছেনা। তোহা এসে নির্ণয়কে চা দিলো।

~ কাল বিকেলেই তো চলে যাবেন না? (তোহা)
~ হ্যা।
~ কি খাবেন রাতে
? বলেন রান্না করি।
~ তোমার যা ইচ্ছা রাঁধো। আর এই দুইদিন দেখলাম তো একটুও পড়তে বসলানা।

~ আপনি চলে গেলে আবার পড়তে বসব। সমস্যা কই? তখন পুষিয়ে নিব।

~ আচ্ছা নিও। কিন্তু পড়াশোনায় হ্যালা করনা। তোমার ক্যারিয়ার আগে।

~ আপনি তো আছেন ই ওই ক্যারিয়ার নিয়া। কখনো কি বলছেন তোহা তুমি তোমার চুলের দিকে তাঁকিয়ে দেখো কি অবস্থা হয়েছে? বলেছেন? (নির্ণয়কে ধমক দিয়ে তোহা)
~ কম বলেছি কিন্তু একেবারেই যে বলিনি তা না।

~ সেইটাই। কাল এসেছেন আপনি অথচ এখনো অবধি আমার চুল বেঁধে দিলেন না। কেনো? আমার প্রতি কোনো মায়া নাই আর কেয়ার কি শুধু ওই ক্যারিয়ারের প্রতিই?

~ ধ্যাৎ। চিরুনি নাও চুল আঁচড়িয়ে দেই।
তোহা নির্ণয়ের হাতে চিরুনি দিয়ে বলে,
~ এই নিন।
~ বসো আমার সামনে।

নির্ণয় তোহার চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলো আর তখনি মেহের ঘরে আসে।
~ এহ নিজে বসে বসে জামাইয়ের আদর খাচ্ছে। (মেহের)
~ থাপ্রাবো ধরে। কি বলছস এসব হ্যা? (নির্ণয়)
~ ভাব নিস না তুই ভাইয়া। ভাইয়া একটা কথা বলি শোন।
~ বল।
~ আগে বল মারবিনা?

~ মারার মতো কাজ করলে তো মারবই। বল কি?
~ আমি একজনকে ভালবাসি ভাইয়া। আমার সিনিয়র ও।
~ কিহ? (মেহেরের দিকে তাঁকিয়ে নির্ণয়) কবে থেকে?
~ এইত কয়েক মাস হলো।

ভাবিকে আমি সব বলেছি।
~ ভুল করেছিস। এসব ভুলে যা। ওই ছেলের সাথে কনটাক্ট করতে যেন না শুনি। আর তোহা তুমিও তো আমায় বললানা!
~ এই ভাইয়া কি বলছিস তুই? ভুলে যায় কিভাবে? আমি তনয়কে অনেক ভালবাসি।

~ লজ্জা করতেছেনা তোর? আবার আমার কাছে ভালবাসার কথা বলছিস তুই! (রেগে গিয়ে নির্ণয়)
~ রেগে যাচ্ছিস কেনো ভাইয়া?

~ আমি আব্বু আম্মুকে এসব জানানোর আগে সেখান থেকে সরে আয়। নয়ত বিশ্বাস কর আমি ওর ভার্সিটিতে গিয়ে ওকে মেরে আসব। (নির্ণয়)

~ ভাইয়া এমন কেন করছিস তুই? তুই ওর সাথে অন্তত একবার কথা তো বল। এরপর ডিসিশন নিস।
~ এই যা তো। তুই আমার সামনে থেকে যা। আর তোর ফোন আর ল্যাপটপ আমার কাছে দিয়ে যা।
~ কেনো?

~ যাতে ওই ছেলের ভূত মাথা থেকে নামে।
~ আমি দিয়ে যাবনা তোকে ওইসব।
~ দিতে তো হবেই। আমি তনয়কে দেখব তো। (নির্ণয়)
~ কিহ!

(অবাক হয়ে মেহের)
~ কাল আসতে বল ওকে বাসায়। আমি কাল আছি। কালকে লাঞ্চে আসতে বল। আব্বু আম্মু আমরা দেখি। এরপর না হয় ডিসিশনে আসা যাবে কি করব না করব।

~ লাভ ইউ ভাইয়া। চকলেট খাবি?
~ কিটক্যাট। (নির্ণয়)
~ দাঁড়া নিয়ে আসছি।

মেহের দৌড়ে ঘরে গিয়ে দুইটা কিটক্যাট নিয়ে এলো। নির্ণয়ের হাতে দিয়ে বলে,
~ এইটা আগাম ঘুষ। বাবা~ মাকে ম্যানেজ করার পর আরো পাবি। আর ভাবি ভাইয়াকে বলে দিও আমার একটা ভাতিজি চাই ই চাই।
~ হপ।

(হেসে তোহা)
~ এইবার তো তুই মার খাবিই।
নির্ণয় সত্যি সত্যি মেহেরকে ধরে মারতে শুরু করে। শেষে মেহের নির্ণয়কে জড়িয়ে ধরে বলে,
~ থাম। শোন ভাইয়া।
~ কি?
~ তনয়ের না মা নেই। আর ওর বাবা ওকে একদম ই ভালবাসেনা। তাই ও বিয়ের পর বউ নিয়ে একদম একা থাকতে চায়।
~ সেইটা তো তনয়ের ব্যাপার বোন। আমরা শুধু দেখব তনয় তোকে সুখে রাখতে পারবে কি না! এইটুকুই। (নির্ণয়)
~ থ্যাংক ইউ।

মেহের ওর ঘরে চলে যাওয়ার পর নির্ণয় বলে,
~ বিশ্বাস ছিল আমার বোন স্বয়ংবরা হবেনা কিন্তু হয়ে গেলো। এখন দেখা যাক।
~ দেখাদেখির কি আছে?

বোন একটা ভুল করে ফেলেছে। ছেলের ফ্যামিলি দেখে কোনো লাভ নাই। ওদের যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে দিন। এমনিতেই ও মস্ত বড় গুনাহ করে ফেলেছে। এখন আর দেরি করবেন না। এইটা জানার পর আমি কিছু বলিনি কারণ বলবে ভাবি ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। ভেবেছি আমিই বলব আপনাকে কিন্তু আজ ও বলে দিয়েছে ভালই করেছে। আর আমার মনে হয় ছেলেটা ভালই। দেখতেও ভদ্র।

~ আসুক কাল, দেখি। তুমি ডিনার রেডি কর যাও।
~ যাই।

নির্ণয় ভাবছে এত আগে বোনের বিয়ে দিবে? কিন্তু তোহা যা বলেছে ভুল কিছু বলেনি।

পরেরদিন দুপুরবেলা,
নির্ণয় আগে থেকেই মা বাবাকে জানিয়েছে আজকে বাসায় গেস্ট আসবে। কিন্তু বলেনি এক্সেক্টলি কে আসতেছে। নির্ণয় পাঞ্জাবি পরে রেডি আর তোহাও রান্নাবান্না শেষ করে ননদকে বলল ভালো একটা জামা পরতে।

তোহা তনয়ের সামনে যাবেনা। তাই তনয় আসার পর তোহা ঘরেই বসে রইলো। তনয় বেচারা লজ্জায় আধমরা হয়ে গেছে। নির্ণয় তনয়কে রিলাক্স করার জন্য বলল,
~ জাস্ট কুল! বেশি নার্ভাস হয়ে যাচ্ছো কেনো? মনে কর এইটা তোমারই বাসা।

~ না ভাইয়া আসলে ফার্স্ট টাইম তো। (ঘাম মুছে তনয়)
~ কোন ইয়ারে পড়ছো?

~ ভাইয়া অনার্স শেষ। মাস্টার্স করছি।
~ এইটা তো খুব ভালো। কোন ভার্সিটি থেকে অনার্স করলা?
~ ঢাকা ইউনিভার্সিটি, প্রানীবিদ্যার উপর। এখন সেখানেই মাস্টার্স করছি।

~ বাহ! খুবই ভালো। আর আব্বু আম্মু তোমাদের তো বলা হয়নি ও কে! ও তনয়। আমাদের মেহেরের পছন্দের ছেলে। দুজন দুজনকে ভালবাসে। এইটুকু পরিচয়ে হবে তো? (হেসে নির্ণয়)
~ হাহাহা তাই নাকি? আগে বলবি তো তুই! অবশ্য আমি এইরকম কিছু একটা ভেবেছিলাম। (নির্ণয়ের আব্বু)

~ এখন তুমি আর আম্মু কথা বলো। আমি মেহেরকে বলি লাঞ্চ সার্ভ করতে।

নির্ণয় হেসে সেখান থেকে উঠে যায়। নির্ণয়ের বাবা মায়ের পছন্দ হয়ে যায় ছেলেকে। ছেলে স্মার্ট, ভদ্র, দাঁড়ি রাখে আর প্রচন্ড লজ্জা পায়। নির্ণয়ের আম্মু মেহেরকে এসে বলে,
~ মা একে পাইলা কিভাবে? জানাও নি তো আমাদের।
~ আম্মু! (হেসে মেহের)

~ থাক আম্মু বেচারিকে আর খোঁচা দিওনা। এখন যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নাও যে কি করবা!
~ এই ছেলেকে রিজেক্ট করার প্রশ্নই আসেনা। আর ও তো বলল বউ নিয়ে আলাদা থাকতে চায়।

সমস্যা কি আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে। আমার ছেলে মেয়েকে নিয়ে একসাথেই থাকব আমি। তনয়ের বাবার সাথে কথা বলব আমরা। (নির্ণয়ের আম্মু)
নির্ণয়ের আম্মু এইটুকু বলেই চলে যায়। মেহের খুশিতে নির্ণয়ের গাল ধরে চুমু দিয়ে দেয়।

~ এই ছ্যামড়ি এখানে আমার বউ চুমু দেয়। তুই দিলি কেন? দাঁত ব্রাশ করিস? ছিহ! (নির্ণয়)
~ এই একদম লেইকফুল করবিনা। তুই আমার সোনা ভাই না? তোকে আমি যা খুশি করব।

~ হ এখন বিয়ের প্রিপারেশন নে। লাঞ্চ সার্ভ করবি আয়।
~ যা আমি আসতেছি।

মেহেরের খুশির শেষ নেই। মেহের খুশিমনে লাঞ্চ সার্ভ করছে। তনয়কে খাবার দেওয়ার সময় তনয়ের ঘড়ির সাথে মেহেরের লম্বা চুল আটকে যায়। মেহের বাবা মা আর ভাইয়ের সামনে অপ্রস্তুত সিচুয়েশনে পড়ে যায়। তনয় মেহেরের চুল ছাড়িয়ে দেয়। নির্ণয় তনয়ের দিকে তাঁকিয়ে হাসছে।


পর্ব ১৪

তনয়কে মেহেরের স্বামী হিসেবে সবারই পছন্দ হয়ে যায়। তনয় যাওয়ার পর তোহা শ্বশুর শ্বাশুড়িকে বলেছে যত দ্রুত সম্ভব তনয় আর মেহেরের বিয়ে দিয়ে দিতে। মেহেরের ভুলটা যেন আর এগিয়ে যেতে না দেওয়া হয়। তনয়ের বাবা দুইদিন পরই তনয়কে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে মেহেরের বাসায় আসে।

তনয়ের বাবার মেহেরকে পছন্দ হয়। আলাদা থাকা নিয়ে কথা উঠলে তনয়ের বাবা বলে,
~ ছেলে আমার যেভাবে সুখে থাকতে চায় থাকবে। এতে আমার কোনো বাঁধা নেই। ও যদি ভাবে বউকে নিয়ে আলাদা থাকলে সুখি হবে তবে হবে।

তনয়ের বর্তমান আম্মুও এসব নিয়ে কথা বলবেনা।
~ তাহলে তো খুবই ভালো। আর তনয় নাকি দুই মাসের মধ্যে চাকরি পেয়ে যাবে। তো ভাই আমরা চাইছিনা দেরি করতে। এই শুক্রবার ঘরোয়াভাবে ওদের কাবিনটা করে নিতে চাই। তনয় আমাদের এখানে আসা যাওয়া করবে সমস্যা নেই। চাইলে ও এখানেই থাকতে পারে। (মেহেরের আব্বু)

~ না আংকেল। আমি এখানে থাকবনা। ঘর জামাইয়ের কোনো অযুহাত ও নেই এখানে। নির্ণয় ভাইয়ার বউ মানে ভাবি যথেষ্ট পর্দাশীন। ভাবিকে আমি এখনো দেখিনি। উনি আমার সামনে আসতে চায়না।

আর আমি এখানে থাকলে ওনার অনেক সমস্যা হবে তাছাড়া আমারো কোনো ইন্টারেস্ট নেই শ্বশুর বাড়িতে পার্মানেন্টলি থাকার। আমি চাকরি পেলেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিব। মেহেরকে নিয়ে ওখানেই থাকব। (তনয়)

~ এইটা তুমি খারাপ বলনি। ছেলের বউয়ের সুবিধাটাও দেখতে হয়। তুমি যথেষ্ট বুঝদার। (মেহেরের বাবা)
~ নির্ণয় ভাইয়া কি চলে গেছে? (তনয়)
~ হ্যা। শনিবারই চলে গেছে ও।

সামনেই আমি মেহেরকে একটা কথা বলছি আর সেইটা হলো আমি চেষ্টা করি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার। মাঝে মাঝে পড়া হয়না।

কিন্তু বিয়ের পর মেহেরকেও তোহা ভাবির মতো হয়ে যেতে হবে। এতে আশা করি তোমার পড়াশোনার ক্ষতি হবেনা মেহের? আর এইটা আলটিমেটাম ও ধরে নিতে পারো। (তনয়)
~ আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট।

নানান রকম কথাবার্তার পর তনয় আর তনয়ের বাবা চলে যায়। তনয় যাওয়ার পর মেহেরের মা হাসছে আর তোহাকে বলছে,
~ এমন ঠোঁট কাটা ছেলে আমি দেখিনি বিশ্বাস কর তোহা। আমাদের সামনে কিভাবে মেহেরকে বলল তোহা ভাবির মতো হয়ে যেতে হবে। হাহাহা

~ তনয় ভাইয়া একদম ঠিক কথা বলেছে আম্মু। বিয়ের আগে মেয়ের বে পর্দার কারণে মা বাবার গুনাহ হয় আর বিয়ের পরে হয় স্বামীর। এতে মেহের ও ভালো থাকবে দেইখেন আপনি। (তোহা)
~ একদম ঠিক বলছো তুমি। আমিই পারিনি আসলে আমার ছেলে মেয়ে দুইটাকে মানুষের মতো মানুষ করতে।

~ আচ্ছা আম্মু এসব কথা এখন থাক। শুক্রবার না বিয়ে? মেহেরের জন্য কেনাকাটা করবেন না? আর তো মাত্র দুইটাদিন হাতে আছে! (তোহা)

~ নির্ণয়কে আগে বলি ও যাতে ছুটি নিয়ে আসে। ওকে ছাড়া কিছুই হবেনা দেইখো তুমি।

আপনার ছেলে কি আসবে? (তোহা)
~ না আসলে মেহেরের বিয়ে হবে কিভাবে? দাঁড়াও একটা ফোন করি।
নির্ণয়ের আম্মু নির্ণয়কে ফোন দিয়ে বলে,
~ কোথায় তুই?

~ অফিসে আম্মু। কেনো?
~ লাঞ্চ করেছিস?

~ হ্যা খেয়েছি। মেহেরকে না আজকে পাকাপাকি ভাবে দেখতে আসার কথা? এসেছিলো?

~ হ্যা এসেছিলো। আর এই শুক্রবার বিয়ে।
~ কিহ! আজ মঙ্গলবার। মানে আর দুইদিন পর? (খুশি হয়ে নির্ণয়)
~ হ্যা। তুই মিনিমাম দশ দিনের ছুটি নিয়ে বাসায় আয়। আগামীকাল ই চলে আয়। শপিং করতে হবে।

~ এতদিন কি ছুটি দিবে? দেখি চেষ্টা করে।
~ চেষ্টা না। আসতেই হবে দশদিনের ছুটিতে। তোর একমাত্র বোনের বিয়ে। সব তো তোকেই করা লাগবে।

~ আচ্ছা মা আমি যদি পারি তো আজকে রাতেই আসব তবে শিউর না আসব কি না।
~ অফিসে বসের সাথে কথা বল।
~ আচ্ছা দাঁড়াও।

নির্ণয় ফোন কেটে এপ্লিকেশন লিখে। অফিস ছুটি হওয়ার এক ঘন্টা আগে নির্ণয় এপ্লিকেশন সাবমিট করে বসের কাছে। বস নির্ণয়কে ডেকে পাঠায়।

~ মিস্টার নির্ণয় আপনি তো এই দুই বছরে একবারো ছুটি চান নি। আপনার পূর্বের রেকর্ড তাই বলে। (বস)
~ হ্যা স্যার প্রয়োজন পরেনি তাই চাইনি।

~ বারোদিনের ছুটি মঞ্জুর আপনার! বোনের বিয়ে ভালভাবে এঞ্জয় করে আসেন। (এপ্লিকেশনটা নির্ণয়ের হাতে দিয়ে)
~ থ্যাংক ইউ স্যার। আজকে তাহলে আমি এখন বেরিয়ে যাচ্ছি স্যার? (হেসে নির্ণয়)
~ হ্যা যান। স্টে সেইফ। (বস)

সব পেপারস কলিগের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে নির্ণয় বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পরে। নির্ণয় কাউকে বলেনি যে ও শিউর আজকেই আসছে। তোহার শ্বাশুড়ি তোহাকে বলল নির্ণয় আজ আসতেও পারে আবার না ও আসতে পারে।

তোহা ধরেই নিয়েছে ও আজ আসবেনা। রাতে খেয়ে দেয়ে তোহা পড়তে বসে। মেহের তোহার পাশে বসে আনন্দে হাসছে।
~ ননদিনী খুশি কেনো এত?

~ সিরিয়াসলি ভাবি আর দুইদিন পর আমার বিয়ে?
~ এহ! তর সইছেনা? (বই অফ করে তোহা)
~ একদম ই না। তনয় আমার হাজব্যান্ড হবে? আমি ভাবতেই পারছিনা ভাবি! আমি বউ সাজব? ও মাই গড!

~ হাহাহা। হ্যা তুমি বউ সাজবা আর সেইটা তনয় ভাইয়ার বউ। (তোহা)
~ ভাবি! তুমি পড়। আমি ঘুমাই।
~ পড়বানা?
~ কিসের পড়া? দুইদিন পর আমার বিয়ে!
~ তাইলে ঘুমাও। (হেসে তোহা)

রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত তোহা কলেজের পড়া পড়ে শেষ করে। তোহা ঘুমানোর আগে নির্ণয়কে ফোন করে। মেহের পাশে ঘুমিয়ে আছে।

~ হ্যা তোহা বলো। (নির্ণয়)
~ ডিনার করেছেন আপনি?
~ করেছি, তুমি খেয়েছো?

~ হ্যা আমিও খাইছি। ঘুমাচ্ছিলেন?
~ হ্যা। (তোহাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে নির্ণয় মিথ্যে বলল) তুমি ঘুমাওনি?

~ ঘুমাবো এখন।
~ রাত জেগো না শুয়ে পরো।
~ আচ্ছা আল্লাহ হাফেজ।

তোহা শুয়ে পরার দশ মিনিট পরই বেল বাজলো। তোহা উঠে গেলো দরজা খুলতে আর ভাবছে এত রাতে কে এলো? কলিংবেলের আওয়াজ শুনে তোহার শ্বশুর ও উঠে আসে।
~ কে এলো এত রাতে তোহা?

~ জানিনা বাবা। আপনি দেখেন। আমি ঘরে যাই।
~ আচ্ছা যাও।

তোহা ঘরে এসে দরজা চাপিয়ে দেয় আর দরজা খুলে নির্ণয়ের বাবা দেখে নির্ণয় এসেছে!

~ তুই এত রাতে? (খুশি হয়ে নির্ণয়ের আব্বু)
~ আস্তে আব্বু। কেউ জানেনা এসেছি। তুমি ভালো আছো?
~ হ্যা একদম।

~ তুমি ঘুমাতে যাও, আমি ঘরে যাই।
~ যা। সকালে সবার সাথে কথা বলিস।
~ আচ্ছা।

নির্ণয় দরজা আস্তে আস্তে খুলে উঁকি দিয়ে দেখে তোহা আর মেহের একসাথে ঘুমাচ্ছে। মেহের দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে আর মেহের জানালার পাশে। নির্ণয় পেছন থেকে গিয়ে তোহার পিঠে হাত বুলাচ্ছে আর মুখ টিপে হাসছে। পিঠে পরিচিত ছোঁয়া পাওয়ার পরেও তোহা ভড়কে যায় আর চিৎকার করে বলে উঠে,
~ কে?

তোহার চিৎকারে মেহেরের ঘুম ভেঙে যায়। মেহের ঘুম থেকে উঠে হাসছে আর তোহা নির্ণয়কে দেখে হাতি কা কা করার মতো অবাক।
~ ওই আপনি? একটু আগে না বললেন ঘুমাচ্ছেন?
~ হ্যা রিক্সায় ঘুমাচ্ছিলাম।

আর ওই ফকিন্নি তুই এই ঘরে কি করিস? তোর না বিয়ে? এখনি ডাবল থাকার প্র‍্যাক্টিস করছিস? (নির্ণয়)
~ আজকে তো আমি এই ঘর থেকে সরবই না। তুই গিয়ে আমার ঘরে ঘুমা যা। আমি ভাবির সাথেই ঘুমাবো। (মেহের)
~ লাত্থি দিব। (নির্ণয়)

~ কি লাত্থি দিবি হ্যা? শনিবার না গেলি? তিনদিনেই বউকে প্রয়োজন হয়ে গেলো?
~ তোহা চিরুনিটা দাও তো!

(নির্ণয়)
~ চিরুনি দিয়ে মার, লাঠি দিয়ে মার আই ডোন্ট কেয়ার। আমি আজকে এ ঘর থেকে যাবনা। ইভেন আমার বিয়ের দিন পর্যন্ত আমি ভাবির সাথেই ঘুমাবো। (মেহের)
~ হাহাহাহা। (তোহা)

~ এই তোহা চুপ। আর তুই কি বললি পেঁচিমুখি? তুই আমার বউয়ের সাথে কেনো ঘুমাবি? (রেগে গিয়ে নির্ণয়)
~ এই যা তো ভাগ। ভাবি আসো আমরা শুয়ে পরি। তোর জামাকাপড় নিয়ে ড্রইংরুমের বাথরুমে যা।

~ আমি আমার বউকে ছাড়া ঘুমাবো না। তুই তোর ঘরে যা। নাইলে শুক্রবার রাতে টের পাবি তুই। (নির্ণয়)
~ দেখবনে কি টের পাওয়াস। যাবি নাকি চিরুনি মারব? (ভুরু উঁচু করে মেহের)

মেহেরের যন্ত্রণায় নির্ণয় জামাকাপড় নিয়ে মেহেরের ঘরে চলে যায় ঘুমাতে। মেহের তোহাকে বলে,
~ ভাইয়ার কাছে যেন যেতে না দেখি। তাইলে তোমার পা কেটে দিব দেইখো।

~ বেচারা কষ্ট পাবে। যেতে দাও মেহের! (তোহা)
~ চুপ। আমার বিয়ের দিন পর্যন্ত একসাথে থাকা যাবেনা। ঘুমাও এখন আর ঘুম না আসলে সেডিল খাও।
~ যাহ। গুড নাইট।
~ গুড নাইট।

মেহের সত্যি সত্যি মঙ্গলবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত তোহা আর নির্ণয়কে একসাথে থাকতে দেয়নি। তিনজন মিলে জমিয়ে বিয়ের শপিং করেছে এই দুইদিন।

নির্ণয়ের আম্মু মেহের আর তোহাকে সমান সমান জিনিস কিনে দিয়েছে বিয় উপলক্ষ্যে। মেহের হাজার বার না করলেও তিনি শুনেন নাই। শুধু বলেছেন মেয়ে আমার এই দুইটাই।
বিয়ের দিন সকাল থেকে তোহা ব্যস্ত মেহেরকে সাজাতে আর নির্ণয় ব্যস্ত বিয়ের সাজ সরঞ্জাম নিয়ে।

ঘরোয়া বিয়ে হলেও দায়িত্ব একদমই কম না। মেহেরের বাবা খাবার দাবারের দিকটা দেখছে আর মেহেরের আম্মুও খুব ব্যস্ত। বিয়ের দিন তোহা লাল পাড়ের সোনালি রঙের একটা শাড়ি পরেছে আর চুলে খোপা করেছে আর গা ভর্তি গহনা। সাজার দরকার সেজেছে কিন্তু ও কারো সামনে যাবেনা।

দুপুর তিনটায় তনয় আর মেহেরের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর নির্ণয় সবাইকে খাবার সার্ভ করছে আর তনয়ের হাতে একটা প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বলে,
~ আমার বোন সারাদিন কিছু খায়নি কিন্তু হ্যা? খাইয়ে দিও ওকে। (নির্ণয়)

~ তুইও না! (হেসে মেহের)
~ আজকে রাতে দেখিস তুই। তিনরাত আমার বউকে আমার থেকে আলাদা রেখেছিস।

আজকে বুঝবি ঠেলার নাম বাবাজি। (মেহেরের সামনে গিয়ে নির্ণয়)
~ পারলে বুঝিয়ে দেখাইস। (মেহের)
~ ওকেহ মাই বেহেন।

রাতের বেলা তনয়ের বাবা মা আর বাকি যারা এসেছিলো তারা চলে যায়। তনয় ও চলে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু নির্ণয় যেতে দেয়নি। শেষে বাধ্য হয়ে তনয় থেকে যায়।
রাত একটায়,

নির্ণয় ননস্টপ তনয়ের সাথে গল্প করেই যাচ্ছে এইদিকে তনয়ের মন বউ বউ করছে। নির্ণয় বুঝতে পারলেও তনয়কে ছাড়ছেনা ইচ্ছে করেই। নির্ণয় বলে,

~ আজকে তুমি আমার সাথে ঘুমাবে হ্যা?
~ এ! কি ভাইয়া? (তনয় পারেনা কেঁদে দেয়)
~ কেনো কোনো সমস্যা? (হাসি কন্ট্রোল করে নির্ণয়)
~ না ভাইয়া একদম না। আমি আওঅঅনার সাথেই ঘুমাবো।
~ দ্যাটস লাইক আ গুড বয়।

~ এই নির্ণয় জামাইকে ছাড়ছিস না কেনো? অনেক রাত হয়েছে তো। (নির্ণয়ের আম্মু)
~ না আম্মু আজ তো তনয় আমার সাথে ঘুমাবে।
~ হপ। তুই এইদিকে আয়। (হাসি চেপে রেখে নির্ণয়ের আম্মু)
~ না আম্মু কোনো আসা আসি নাই। তোমার মেয়েরে একটা চরম শিক্ষা দিব আমি। তুমি আমাদের মাঝে একদম ঢুকবেনা। তুমি ঘুমাও যাও।

(নির্ণয়)
~ এই অন্যদিন মজা করিস। বাবু আজ ছেড়ে দে। (ইশারায় নির্ণয়ের আম্মু)

~ যাও না কেন তুমি? (চোখ রাঙিয়ে নির্ণয়)
~ মারব কিন্তু এখন। তোহাকে তোর ঘরে নিয়ে আয় যা। তনয়কে ছাড়। (নির্ণয়ের আম্মু)
~ তুমি আবারো কথা বলছো!
~ আচ্ছা আর বলছিনা।

যা খুশি কর।
নির্ণয়ের আম্মু চলে যাওয়ার পর নির্ণয় তনয়কে বলে,
~ যাও ঘুমাও। ওইযে আমার বিছানা।
~ আচ্ছা ভাইয়া।

~ বেচারা! (মনে মনে নির্ণয়)
দুই ঘন্টা পর নির্ণয় মেহেরের ঘরে গিয়ে দেখে ননদ ভাবি গল্প করছে। নির্ণয়কে দেখে মেহের জিজ্ঞেস করে,
~ ভাইয়া তনয় কই?
~ ঘুমায়।
~ মানে? (মেহের)

~ মানে স্লিপ করে, হইছে? (নির্ণয়)
~ তুই ঘুমাবি কোথায়?
~ যেথায় আমার বউ ঘুমাবে।
~ তোর বউ তো আমার সাথে ঘুমাবে।

~ আজকে তোর মাইর একটাও মাটিতে পরবনা কইলাম চুন্নি। মাফ করে দিলাম তোরে। যা তোর বর রে যাইয়া জাগা। আর এই ঘর ছাড়। ঘুমে ধরছে আমার। (হামি দিয়ে নির্ণয়)
~ এই ঘর তো আমার।
(মেহের)
~ আজকে আমার ঘর তোর আর তোর ঘর আমার। ঠিক আছে?
~ ঘুমা। আমি যাই। (মেহের)

~ যান মহারানী। (সরে গিয়ে নির্ণয়)
মেহের ঘরে গিয়ে লাইট জ্বালাতেই দেখে নির্ণয়ের ঘর আর খাট ফুল দিয়ে সাজানো আর তনয় ঘুমাচ্ছে। তখনি নির্ণয় আর তোহা এসে বলে,

~ সারপ্রাইজ! যাহ মাফ করে দিলাম তোরে। তোর ওই ঘুম প্রিয় বরটাকে জাগা এখন। গুড নাইট। (নির্ণয়)
~ লাভ ইউ ভাইয়া।
~ তিন রাত আলাদা রাখছোস! (মুখ বাঁকিয়ে নির্ণয়)
~ আর রাখবনা।

(হেসে মেহের)
~ যা এখন ঘুমা নাইলে যা খুশি কর। হায়ায়া! আমার আবার ঘুম পাইছে। তোহা চলো। (হাই তুলে নির্ণয়)
~ হারামি। (মেহের)


পর্ব ১৫

নির্ণয় তোহাকে নিয়ে ঘুমাতে চলে যায়। মেহের তনয়কে পানি দিয়ে ঘুম থেকে উঠায়। ঘুম থেকে উঠে চারপাশ সাজানো দেখে তনয় চমকে যায়।

~ এইসব কে আর কখন করলো?(তনয়)
~ কে আবার? আমার ভাইয়া। এখনো কি ঘুমাবা?
~ ধ্যাৎ! (হেসে তনয়)

বিয়ের পর তনয় এই বাড়িতে খুব কমই যাতায়াত করে কারণ ও তোহার প্রাইভেসি নষ্ট করতে চায়না।

বারোদিন ছুটি পেয়ে নির্ণয় ও তোহাকে নিয়ে ভালই ঘুরাঘুরি করলো। তনয় চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত মেহের নিজের বাসাতেই থাকবে।
তিন বছর পর,

নির্ণয় আগের নিয়মেই ঢাকা থেকে রাজশাহী যাতায়াত করে আর বছরে দুইবার তোহাকে নিজের কাছে নিয়ে যায়। তোহা ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। পড়াশোনার প্রেসার হাজারগুণ এখন।

নির্ণয়ের মা অনেকটাই নরম হয়ে গেছে আর নির্ণয়ের বাবা চাকরি ছেড়ে বাসায় বসে সময় কাটায়। এক বৃহস্পতিবার বিকেলে নির্ণয় মন খারাপ করে বাড়ি এলো। তোহা পড়ছিলো তখন।

নির্ণয়ের চোখ মুখ কালো দেখে তোহা পড়া বন্ধ করে নির্ণয়ের কাছে যায়। নির্ণয় তোহার হাত চেপে ধরে পাগলের মতো জিজ্ঞেস করে,
~ তোহা তুমি আমায় কি সুখ দিয়েছো জীবনে?

নির্ণয়ের প্রশ্ন শুনে তোহা নির্বাক হয়ে যায় আর ফ্যালফ্যাল করে তাঁকিয়ে থাকে নির্ণয়ের দিকে।
~ কি বলছেন আপনি? আপনি আমার সাথে সুখি নন? (অবাক হয়ে তোহা)
~ তুমি বলো কি সুখ পেয়েছি?

~ আমি আপনাকে কি সুখ দিতে ব্যর্থ হয়েছি আপনি সেইটা বলেন?
~ মন মতো না আমার তুমি। আমার কত ফ্যান্টাসি ছিল বউকে নিয়ে জানো? আমি বউকে নিয়ে ঘুরব। আমার বউ শাড়ি পরবে, সাজবে আর আমরা একসাথে ঘুরব।

এইরকম কত শত ফ্যান্টাসি ছিল আমার। এইসব কি আমি পূরণ করতে পেরেছি তোহা? বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর হলো কিন্তু আজ অবধি তুমি কি আমায় একটা বেবি দিয়েছো? দাওনি।

কতদিন থেকেছো আমার সাথে? হাতে গুনা দুই/চারদিন। তোহা আমি তোমায় নিয়ে সুখি না। একদম ই সুখি না।
নির্ণয়ের কথা শুনে তোহা শুধু চমকাচ্ছেই। তোহা নির্ণয়ের হাত ছেড়ে দেয়। নির্ণয় খাটের উপর বসে।

খাটে বসে নির্ণয় কাঁদছে। তোহা নির্ণয়ের চোখের পানি মুছে দিতে গেলে নির্ণয় তোহার হাত সরিয়ে দেয়। তোহার চোখ দিয়ে তখন অটোমেটিক পানি চলে এলো। তোহা চোখের পানি ফেলতে ফেলতেই নির্ণয়কে জিজ্ঞেস করলো,
~ আপনার কি খুব মন খারাপ?

~ একটুও মন খারাপ না। তোহা তুমি গিয়ে মেহেরের সাথে ঘুমাও আজকে। আমি একা থাকব।

~ আপনার জন্য রেঁধে রেখেছিলাম। খাবেন না?
~ কিছুই করবনা শুধু ঘুমাবো
যাও তুমি।

~ আমি শুই আপনার পাশে?
~ একদম না।

নির্ণয়ের কথা শুনে তোহা কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মেহেরের ঘরে গিয়ে তোহা আস্তে করে মেহেরের পাশে শুয়ে পরে। মেহের তখন ঘুমাচ্ছিলো। সারারাত তোহা কেঁদেছে আর ভেবেছে হলো টা কি নির্ণয়ের? আর নির্ণয় তোহা যাওয়ার পর পরই ঘুমিয়ে যায়।

পরেরদিন সকালবেলাও নির্ণয় যা তা ব্যবহার করে তোহার সাথে। তোহা সকালে নির্ণয়কে চা দেওয়ার পর মিষ্টি হয়নি বলে নির্ণয় চা টা ফেলে দেয় আর তোহাকে যথেষ্ট ধমকায়।

তোহার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি আর মেহের তিনজনেই যথেষ্ট অবাক। এই পাঁচ বছরে নির্ণয় তোহার সাথে গলা উঁচু করেও কথা বলেনি আজ সে ধমকাচ্ছে! নির্ণয়ের বাবা নির্ণয়কে বলে,

~ কি হলো বাবা? তুই তোহাকে ধমকাচ্ছিস কেনো?
~ ধমকাবো না? চা বানাতে জানেনা যেহেতু তবে যায় কেনো বানাতে? (বিরক্ত হয়ে নির্ণয়)

~ সরি। আমি আরেক কাপ চা করে আনছি আপনার জন্য! (তোহা)
~ কোনো দরকার নেই। আম্মু আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
~ এখন কোথায় যাবেন? নাস্তা করবেন না? (তোহা)
~ না করবনা।

যেই তোহার বানানো চা নির্ণয় আনন্দ করে খায় আজ সে চিনি কম বলে এত খারাপ ব্যবহার করলো নির্ণয়ের সাথে? সকালে তোহা কিছু না খেয়েই দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করে সবাইকে দুপুরের খাবার বেড়ে দিলো। নির্ণয় তখনো বাড়ি ফেরেনি। তোহা না খেয়ে নির্ণয়ের জন্য অপেক্ষা করছে ডায়নিং টেবিলে বসে। সেই আসা নির্ণয় বিকেলে আসে।

নির্ণয় আসার পর তোহা বলে,
~ লাঞ্চ করবেন। হাত মুখ ধুয়ে আসুন।
~ আমি খেয়ে এসেছি।
~ কোথা থেকে?
~ ফ্রেন্ড এর বাসা থেকে।
~ ওহ।

নির্ণয় আর একটাবারো তোহাকে জিজ্ঞেস করলো না তোহা খেয়েছে কি না! সব খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে দেয় তোহা। সারাদিনে ও কিছুই খায়নি। নির্ণয়ের সামনে যেতেও ভয় করছে তোহার। তবুও গেলো।
~ আপনার কি কিছু হয়েছে?
~ না। ঘুমাবো। কথা বলবানা একদম। (নির্ণয়)
~ আচ্ছা ঘুমান।

তোহা জানালার ধারে গিয়ে বসে আর নির্ণয় আসলেই ঘুমিয়ে যায়। যেই নির্ণয় তোহাকে ছাড়া কিছু বুঝতো না আজ সে তোহাকে ইগনোর করছে? কিন্তু আসল কারণটা কি শুধুই ফ্যান্টাসি পূরণের অভাব?
সারাদিন নির্ণয় একটা কথাও বলেনি তোহার সাথে শুধু ঘুমিয়েছে। রাতে তোহা সুন্দর করে সেজে নির্ণয়ের পছন্দের নীল রঙের শাড়ি পরে নির্ণয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়।

~ চলেন রাস্তা থেকে একটু ঘুরে আসি। (তোহা)
~ না যাবনা আমি কোথাও। তুমি এভাবে সেজেছো কেনো তাও এত রাতে? (নির্ণয়)

~ আপনার ফ্যান্টাসি গুলো পূরণ করতে। চলুন বাইরে যাই।
~ না আমি যাবনা।
~ তাহলে কি চান আপনি? একটা বাচ্চা তো? সমস্যা নেই। আপনি বাবা হবেন খুব তাড়াতাড়িই।

নির্ণয় হাসলো। নির্ণয়ের এই তাচ্ছিল্যের হাসিতেও তোহা কিছুই মনে করলোনা। তোহা চোখের পানি মুছে নির্নয়কে জড়িয়ে ধরে বলে,
~ প্লিজ আমায় এইভাবে দূরে সরিয়ে রাখবেন না।

আমার তো কষ্ট হয়। গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে আপনি আমায় কষ্টই দিচ্ছেন। কি করেছি আমি? আজ শুক্রবার। কত খাবার রান্না করেছিলাম আপনার জন্য কিন্তু আপনি খেলেনই না। এমন কেনো করছেন? আমি কি ভুল করেছি কোনো?

~ তোহা ছাড়ো আমায়। তুমি কয়েকদিন বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। আমি এখানে আছি কয়েকদিন। আমি জাস্ট একা থাকতে চাই। আমি তোমায় গাড়িতে উঠিয়ে দিবনে তুমি কালই চলে যেয়ো। ঘুমাও এখন। শুভ রাত্রি।

নির্ণয়ের কথা শুনে তোহা এইবার শুধু অবাকই হয়নি, তোহা দাঁড়ানো থেকে বসে পরেছে। কি বলছে ও এসব?


পর্ব ১৬

নির্ণয়ের কথা শুনে তোহা বারবার অবাক হচ্ছে। কি বলছে এসব নির্ণয়? ও ওর তোহাকে ছাড়া থাকতে চায়? সারারাত তোহা কেঁদেছে আর নির্ণয় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। ইদানীং নির্ণয় খুব বেশি ঘুমাচ্ছে। ও এমনই। ডিপ্রেজড থাকলে ও ঘুমায় বেশি।

কিন্তু কি নিয়ে ও ডিপ্রেজড সেইটাই বলছেনা বারবার জিজ্ঞেস করার পরেও। পরেরদিন তনয় মেহেরকে নিতে বাসায় আসে। মেহের এই বাড়িতে ক’দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। মেহের এখন আগাগোড়া তোহার মতো হয়ে গেছে। সংসারী, ম্যাচিউরড, ধার্মিক সব দিক থেকে।

এক্ষেত্রে সবটা ভূমিকা তনয়েরই। তনয় বাসায় এসে দেখলো কোনো একটা ঝামেলা হচ্ছে। নির্ণয়কে সবাই ধমকাচ্ছে এমনকি মেহের ও। মেহের তো কেঁদেই দিয়েছে এর কারণ তোহা ভোরে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।

শুধু কালো রঙের একটা বোরকা আর হিজাব পরেই বেরিয়েছে। বইখাতা, জামাকাপড়, গয়নাগাটি যেভাবে ছিল সেভাবেই আছে। দুপুরে নির্ণয়ের বাবা তোহার বাপের বাড়ি ফোন দিয়ে জানে তোহা সেখানেই আছে। এরপর সবাই নিশ্চিন্ত হয় আর নির্ণয়কে বকাবকি শুরু করে। নির্ণয় চুপচাপ বসে সব শুনছে।

তনয় বিকেলে মেহেরকে নিয়ে যেতে চাইলে মেহের যাবেনা বলে জানায়। তোহার জন্য মেহেরের মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। আর মাত্র বিশ দিন পর তোহার সেকেন্ড সেমিস্টার আর এই সময় নির্ণয়ের এমন আচরণ একদমই বেমানান।

বার কথা শুনে নির্ণয় চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে বসলো। বাধ্য হয়ে তনয় সেদিন শ্বশুর বাড়িতেই থেকে গেলো আর নির্ণয় রাজশাহী না গিয়ে কয়েকদিনের ছুটিতে বাসাতেই বসে আছে। কোথায় যেন একটা অদ্ভূত শূন্য লাগছে নির্ণয়ের।

কিন্তু ওর কাছে জাগতিক চাওয়াটাই এখন বড় তার একমাত্র কারণ হৃদি। হৃদিকে কখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লক করেনি নির্ণয়। হৃদি হাজারবার নির্ণয়কে টেক্সট করেছে কিন্তু নির্ণয়ই রিপ্লাই করেনি। হৃদি এখন বরকে নিয়ে নেপাল সেটেল হয়ে গেছে।

দুজনের হাসিখুশি কাপল পিক দেখেই নির্ণয়ের অবচেতন মনে একটা ধারণা হয়েছে যে ওর বউটাই আনরোমান্টিক!

ম্যাচিউরড নির্ণয়ের মনে এইসব ফালতু চিন্তা ভাবনা আসতে পারে এইটা তোহা ভেবেও দেখেনি।

একটু একটু করে এই চিন্তাগুলো নির্ণয়ের মনে একদম যন্ত্রনার সৃষ্টি করেছে যার ফল তোহার সাথে রাগারাগি, তোহার সাথে থাকতে না চাওয়া।
সময় যেতে যেতে পাঁচদিন চলে গেলো।

এর মাঝে নির্ণয় একদমই তোহার সাথে যোগাযোগ করেনি। ওর যে একটা রোমান্টিক বউ চাই! সাতদিনের মাথায় নির্ণয় রাজশাহী চলে গেলো। তোহা শুধুই কাঁদছে। ঠিকমতো খাচ্ছেনা, ঘুমাচ্ছেনা সারাক্ষণ শুধু নির্ণয়ের কথাই ভাবছে। নির্ণয় অফিসে জয়েন করে।

লাঞ্চের সময় তোহাকে ফোন করতে গিয়েও নির্ণয় ফোন করেনা। কয়েকদিন বাদে তোহার পরীক্ষা সেইটা নির্ণয় খুব ভালো করেই জানে তারপরেও ও তোহাকে কোনো কল করছেনা। তোহাও নির্ণয়কে আর ফোন করেনি।

টানা বারোদিন দুজন দুজনের সাথে কোনো যোগাযোগ ই করেনি। বারোদিন পর হঠাৎ ফেইসবুকিং করতে করতে নির্ণয়ের মনে হয় তোহাকে ফোন দেওয়া উচিৎ।

ভাবনাটাকে সত্যি করে তোহাকে ফোন করলো নির্ণয়। কিন্তু প্রথমবার তোহা ফোন ধরতে পারেনি। পরেরবার রিং হওয়ার পর তোহা ফোন রিসিভ করে। তোহার জ্বর প্রচন্ড। তোহা হ্যালো বলার পর নির্ণয় জিজ্ঞেস করে,
~ অসুস্থ তুমি?
~ না।
~ মনে তো হয় অসুস্থ।

~ কি মনে করে এতদিন পর কল করলেন?
~ তোমার না তিন/চারদিন বাদে পরীক্ষা? ঢাকা আসবানা?
~ দিবনা পরীক্ষা।
~ কেনো?

~ লাগবেনা পরীক্ষা দেওয়া। আমার একটা বাচ্চা চাই, স্বামীর যোগ্য বউ হতে চাই। দ্যাটস ইট। (ভাঙা গলায় তোহা)
~ জ্বর তোমার?

~ না, আমি একদম ঠিক আছি আমি।
~ ঢাকা ব্যাক করবা কবে?
~ জানিনা।

~ আমি না এখন আর নামাজ পড়িনা, খাওয়ার আগে কেউ কল করেও বলেনা “খেয়ে নিয়েন”, কারো সাথে এখন কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যাইনা।

~ সরি। আমি সুখি করতে পারিনাই আপনাকে। যদি পারতাম তবে আমাকে একদম মুছে ফেলতেন না। যেদিন আপনি আমায় ছুঁয়েছিলেন সেইদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন নামাজ কখনো ছাড়বেন না, যত বাজে নেশা ছিল সব ছেড়ে দিয়েছিলেন।

আর আজ আপনি আবারো নিজের আগের রুপে ফিরে গেলেন। আমি আর আপনাকে কোনো কিছুতেই জোর করবনা। আমার অধিকার নেই এখন। কারণ আমি আপনাকে সুখিই করতে পারিনি।

~ তোমায় কিছু প্রশ্ন করি উত্তর দাও তো।
~ জ্বি বলেন।

~ তোমার কি এই পাঁচবছরে মনে হয়নি আমাদের সংসারটা অপূর্ণ? এরেঞ্জ মেরেজ হলেও আমার বা তোমার কি একে অপরের প্রতি কোনো চাওয়া থাকতে পারেনা?

~ ভুল চাওয়া থাকাটা বরাবরই ভুল। আপনি চান আমি শাড়ি পরে আপনার সাথে ঘুরি। আচ্ছা আপনি বলুন তো আমি যে বোরকা, জিলবাব পরে আপনার সাথে বের হই এতে কি কেউ আপনাকে বা আমাকে টিজ করে? তাঁকিয়ে থাকে আমার দিকে? (তোহা)
~ না।

~ আর যখন একটা মেয়ে ওর বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে যাচ্ছে তাই ভাবে ঘুরে বেড়ায় তখন সবার নজর ওর দিকে থাকে। আর আপনি তো নিজেই বলেন এরা অসভ্য। শাড়ি পরলে নারীদের আবেদনময়ী লাগে।

আপনি কি চান আপনার বউকে সবাই দেখুক,আলতু ফালতু কমেন্ট করুক আর সেই গুনাহ আপনার ভাগে পড়ুক? নিশ্চই চাইবেন না।

কেউ আমার দিকে তাঁকিয়ে খারাপ ইঙ্গিত করলেও নিশ্চই আপনি তাকে ছেড়ে দিবেন না কিন্তু দোষটা কার? দোষ আমার কারণ আমি নিজেকেই নিজে সস্তা বানিয়ে ফেলেছি। আপনার যদি এতই ইচ্ছে ছিল কেন আমাকে বললেন না তোহা শাড়ি পড়?

একটু সাজো? বলতেন আমাকে। আর আপনি এইসবই কেন দেখলেন? পাঁচটা বছরে আমার কষ্টগুলো আপনার চোখে পরলো না? মেডিক্যালের পড়াশুনা, সাংসারিক কাজ, শ্বশুর শ্বাশুড়ির দেখাশোনা চাট্টিখানি কথা? এর বদলে আমি কি পেয়েছি? দিয়েছেন আমাকে বেতন বা বোনাস কিছু?

কই আমি তো অভিযোগ করিনাই কারণ আমি জানি এই সংসারটা আমার। আর আপনার বর্তমান ধারণা হলো বিয়ে আমি করেছি ঠিকই কিন্তু আমার বউ সবার। (একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলো তোহা)

তোহার কথা শুনে নির্ণয় অনেক জোরেই তোহাকে ধমক দিলো। তোহা থেমে গেলো। তোহাকে থামিয়ে নির্ণয় তোহাকে বলল,
~ আজ বৃহস্পতিবার। রাত নয়টা বেজে গেছে অলরেডি। আমি কুমিল্লা আসছি।

~ না। আপনি কেনো আসবেন? দরকার কি? যে সুখি করতে পারবে আপনাকে তাকে বিয়ে করবেন।

তোহার বকবক না শুনে নির্ণয় ফোন কেটে দিলো কারণ ও জানে তোহা প্রচুর অসুস্থ আর অভিমানী। নির্ণয় না গেলে এই অভিমান ভাঙবেনা আর ভাঙার কথাও নয়। নির্ণয় এত বড় গাধামিটা শুধু শুধু করলো এই কয়েকটা দিন! হৃদিকে ফেইসবুক থেকে ব্লক করে নির্ণয় রেডি হতে শুরু করে।

আর কয়েকটা দিন পর তোহার পরীক্ষা। এতদিন এত ভালো রেজাল্ট করে শেষে কিনা খারাপ করবে! এইটা নির্ণয় মেনে নিতে পারছেনা। তাই ও ভালবাসার টানে হোক বা তোহার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই হোক কুমিল্লা যাচ্ছে।
চলবে

কারো ভুল বুঝার আগেই বলছি👇
মাঝে মাঝে আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও কিছু সাধারণ ভুলকে অসাধারণ ব্লান্ডার বানিয়ে ফেলি। সাইকোলোজি বলে মানুষের মন চেইঞ্জেবল। সাইকোলজি এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিলেও সংসার জীবনে এর প্রভাব মারাত্মক।

আজ আমি যাকে পছন্দ করে ঘরে আনলাম তার সামান্য খুঁত ধরে তাকে বের করে দিতে আমার সময় লাগবেনা। মনের ব্যাপার এইটা সম্পূর্ণ। ম্যাচিউরিটির সাথে মনের কোনো ব্যাসিক মিল নাই। ম্যাচিউরিটি আছে বলে আমি ভুল করবনা এইটা ভাবাই সবচেয়ে বড় ভুল। যা নির্ণয় করেছে।

পর্ব ১৭

তোহা নির্ণয়ের ফোন কাটার পর চুপচাপ বসে কাঁদছে আর বলছে,
~ বারোদিন পর মনে পড়েছে আমার কথা! কিন্তু কেনো? দরকার তো ছিল না আমার কথা মনে করার।

আমি তো ওনার যোগ্যই না। ওনাকে সুখিও করতে পারিনাই। তবে কেনো আসছে। লাগবেনা ওনার আসা!

মায়ের কোলে শুয়ে তোহা কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই তোহা ঘুমিয়ে যায়। তোহার মা তোহার মাথার নিচে বালিশ দিয়ে জামাই আসার জন্য রাতে জেগে থাকে। ভোর চারটায় নির্ণয় বাসায় ঢুকে। তোহার আম্মু তখন ঘুমে ঢুলছিলো। দরজা খুলে উনি জামাইকে খেতে দেয়। নির্ণয় বলে,

~ আমার ক্ষুধা নেই আম্মা। আপনার মেয়ে কই?
~ কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে।

~ আচ্ছা আম্মা আমি ওর ঘরে যাচ্ছি আর আপনাকে এতক্ষণ জাগিয়ে রাখলাম তার জন্য সরি।

~ না না বাবা ঠিক আছে। তুমি হাতমুখ ধুয়ে যাও তাহলে।
~ আচ্ছা।

গেলো। কুঁকড়ে ঘুমাচ্ছে তোহা। নির্ণয় গালে হাত দিয়ে দেখে তোহার গাল ভেজা। তোহার শরীর কাঁথা দিয়ে ঢেকে দেয় নির্ণয় এরপর নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে তোহার পাশে শুয়ে পরে। নির্ণয় যা কথা বলার কাল তোহার সাথে বলে ওকে কালই ঢাকা নিয়ে যাবে। রবিবার থেকে পরীক্ষা তোহার। প্রিপারেশন নেওয়ার ও তো একটা ব্যাপার আছে।

সকালে তোহা ঘুম থেকে উঠে দেখে পাশে নির্ণয় ঘুমিয়ে আছে। তোহা নির্ণয়কে না ডেকেই উঠে যায়। সকাল নয়টায় নির্ণয় ঘুম থেকে উঠে দেখে ডায়নিং এ বসে তোহা পেঁয়াজ কাটছে আর সমানে কাঁদছে।
~ চোখের পানিটা কি পেঁয়াজের জন্য নাকি মন ভাঙার জন্য?

(নির্ণয়)
তোহা কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত ছুরি চালাচ্ছে পেঁয়াজগুলোর উপর। দেখে মনে হচ্ছেনা পেঁয়াজ না, তোহা নিজের মনটাই কাটছে। নির্ণয় একটা চেয়ার টান দিয়ে তোহার পাশে বসলো আর তখন তোহা উঠে রান্নাঘরে চলে গেলো। তোহা রান্না করছে আর নির্ণয় ডায়নিং এ বসে দেখছে।

~ তোহা আমায় একটু পানি দাও। (নির্ণয়)
তোহা নির্ণয়ের কথা শুনেও শুনছেনা ভাবে আছে। তোহা নির্ণয়কে পানি দেয়নি বলে তোহার মা বলে,

~ এই তুই জামাইকে পানি দিলিনা?
~ না আম্মু। যার যারটা সে সে নিয়ে খাক। (তোহা)
পরে তোহার মা নির্ণয়কে পানি দিলো। বিকাল পর্যন্ত তোহা একদম ই নির্ণয়ের সাথে কথা বলল না।

বিকালে তোহা একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলো তখন নির্ণয় গিয়ে দাঁড়ালো তোহার সামনে। তোহা সেখান থেকে চলে আসতে চাইলে নির্ণয় দরজাতে হাত দিলো। তোহা দাঁড়িয়ে গেলো।

~ তুমি আমার সাথে কথা বলবেনা? (নির্ণয়)
~ আপনার চোখের বালির সাথে কিসের কথা আবার? কোনো কথা আছে কি আমার সাথে আপনার?

(তোহা)
~ তোহা আমি মস্ত বড় ভুল করেছি। আমি সেইটা শুধরেও নিয়েছি।
~ তো আমি কি করব? আপনার কথা কি আপনি ফিরিয়ে নিতে পারবেন?

~ তোহা ওই কথাগুলো আমি কেনো বলেছি আমি জানিনা। আমার ব্রেইন আসলেই ওয়াশ হয়ে গিয়েছিলো যখন দেখলাম হৃদি সুখে আছে আর ওরা সত্যিই সুখে আছে।

~ অন্যের সুখ দেখে আপনার হিংসা হচ্ছিলো তাইনা? তাই নিজেকে অসুখি ভাবতে শুরু করলেন? ঠিক আছে সমস্যা নেই তো। আপনার সুখের জন্যই আমি আপনার সাথে কথা বলছিনা। সুখে থাকুন আপনি। রাস্তা ছাড়ুন।

(তোহা)
~ তোহা আমার ভালো লাগছেনা তোমার এই চুপচাপ থাকা। আমি তোমায় চঞ্চল তোহা নামেই চিনি। আজকে আমি তোমাকে চিনছিই না। (নির্ণয়)
~ সমস্যা নেই।

~ তোহা বাড়ি চলো। তোমার এক্সাম রবিবার।

~ আমি এক্সাম দিবনা। তাছাড়া যেই বাড়িতে যেতে বলছেন সেই বাড়িতে আমি কিসের পরিচয়ে যাব? (তোহা)
~ এতদিন কি পরিচয়ে থেকেছো তোহা? আমার বউ তুমি। ওই বাড়ির বউয়ের পরিচয়ে থাকবে তুমি।

~ না। যার স্বামী তাকে অস্বীকার করে তার আবার কিসের পরিচয়? ছাড়ুন আমার হাত আর যেতে দিন।

~ তোহা যা কিছু হয়ে যাক তবুও তোমাকেই চাই আমি। তুমি ছাড়া আমার জীবন পুরোটাই অগোছালো। সেই প্রথম দিন থেকে এই অগোছালো ছেলেটাকে তুমি এমনভাবে গুছিয়েছো যে এখন একটা কাজ এইদিক ওইদিক হলে বড্ড খারাপ লাগে। আমি ঠিক করে নামাজ পড়িনি, আমি খাইনাই ঠিক করে। আমার কেয়ার করতে করতে তুমি আমায় বাচ্চা বানিয়ে ফেলেছো।

পাঁচ বছর ধরে আমি আমার জামাকাপড় ধুইনা, এক গ্লাস পানি ঢেলে খাইনা সবই তো তোমার জন্য। চাওয়ার আগে সবকিছু তুমি আমায় রেডি করে দিয়েছো। আর আমি কি না তোমায় অযোগ্য বলেছি। আমিই তোমার অযোগ্য তোহা।

তোমার মতো করে আমি তোমার কেয়ার কখনো করিনাই। আসলেই তো পাঁচটা বছর তুমি আমাদের ফ্রি সার্ভিস দিয়েছো বিনিময়ে কিছুই পাওনি। তোহা আমি তোমার গাঁ ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করছি কখনো তোমায় আর এইভাবে কষ্ট দিবনা। আমার ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দাও প্লিজ।

বাসায় চলো। (নির্ণয়)
~ আচ্ছা শো অফ করে কি মজা আছে? আমরা মানসিক ভাবে ভালো থাকলেই তো হলো। আমাদের ভালবাসা অন্যের কাছে প্রচার করে কি ফায়দা হবে আপনার? অন্যকে হিংসে করাবেন? দরকার কি? যার যার সুখ তার তার কাছে।

ভালবাসা প্রচার করার জিনিস না, অনুভব করার জিনিস। এইসব ভুল আসলেই মনকে ক্ষত বিক্ষত করে দেয়।
~ আই এম সরি তোহা। (তোহার হাত ধরে নির্ণয়)
~ চলেন বাসায় যাব। (হেসে তোহা)
~ সত্যি?

~ হ্যা তবে একটা শর্ত আছে।
~ কি?

নির্ণয়ের কানে কানে তোহা কিছু একটা বলল যা শুনার পর নির্ণয় হাসলো আর তোহা মাথা নিচু করে লজ্জা পাচ্ছে।
~ তাই হবে। এখন চলো। রেডি হও।
~ যাচ্ছি।
~ আর শোনো। (তোহার কোমড় ধরে সামনে এনে)
~ কি?

~ আই লাভ ইউ। (তোহার চুল সরিয়ে নির্ণয়)
~ আই লাভ ইউ থাউজ্যান্ড মোর। (নির্ণয়কে জড়িয়ে ধরে তোহা)
~ এখন একটুও রাগ করে নেই তো।

~ অনেক রাগ করে আছি। এই রাগ কমবেনা।
~ আর কিভাবে কমাবো বলো?

~ ওইযে ওয়ে তো বললাম ই।
~ আচ্ছা তাই হবে। রেডি হও এখন। দেরি হয়ে যাবে পরে। (তোহার কপালে চুমু দিয়ে নির্ণয়)

তোহা রেডি হতে চলে যাওয়ার পর নির্ণয় গ্রিলে হাত দিয়ে ভাবছে,
~ আমি চরম ভুল করে ফেলেছি।

ভালবাসাটা তো আসলেই শো অফ করার জিনিস না। হৃদির ছবিগুলো দেখে এক মুহুর্তের জন্য আমি হিপনোটাইজড হয়ে তোহার সাথে কি অন্যায় না করেছি! হৃদিটা আসলেই আমার জীবনের বড় অভিশাপ।

ওর জন্য কত ঝড় বয়ে গেলো আমার জীবনে। থ্যাংক ইউ আল্লাহ তোহাকে আমার বা পাঁজর দিয়ে সৃষ্টি করেছো এজন্য।

আজ থেকে এক ওয়াক্ত নামাজ ও কাযা করবনা ইনশাআল্লাহ। একদম ভালো হয়ে যাব দেখো তুমি।

রাত আটটায় নির্ণয় তোহাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। এতদিন পর বউমাকে দেখে নির্ণয়ের আম্মু খুশি হয়ে যায়। তোহাকে বুকে নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন উনি। তোহা কন্টিনিউয়াসলি বাবা মায়ের খোঁজ খবর নিয়েছে এতদিন। নির্ণয়ের উপর ও আর রাগ করে থাকতে পারেনি নির্ণয়ের বাবা মা।

পর্ব ১৮

বাসায় এসে তোহা বাবা মায়ের সাথে সমানে কথা বলেই যাচ্ছে। মেহের তনয়ের সাথে তনয়ের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকে এখন।

সপ্তাহে একবার তনয় না আসলেও মেহের বাবার বাসায় চলে আসে। দুইদিন পর তোহার পরীক্ষা শুরু। রাতে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করেই তোহা পড়তে বসে। নির্ণয় তোহার পড়া নিচ্ছে আর তোহাকে বারবার কফি বানিয়ে দিচ্ছে যাতে তোহা ঘুমিয়ে না পড়ে।

নির্ণয় তোহার প্রথম এক্সামের দিন তোহাকে কলেজে দিয়ে রাজশাহী চলে যাবে। শুক্রবার রাত আর শনিবার সারাদিন আর রাত তোহা না ঘুমিয়ে শুধু বইয়ের ভেতরেই নিজের চোখ মুখ রেখেছিলো। রবিবার সকাল সাড়ে আটটায় নির্ণয় রেডি হচ্ছে আর তোহাকে বলছে,
~ তুমি কি রেডি?
~ হ্যা।

~ নিকাব পড়বানা?
~ না। (হুদাই বলল তোহা কারণ তোহা মরে গেলেও নিকাব ছাড়া বের হবেনা)

~ থাপ্পর দিব। নিকাব পড়। আর এত টাইট বোরকা পরেছো কেনো তুমি? যাও এই বোরকাটা পালটে আসো। কালো যে বোরকাটা আছে ওইটা পরে আসো। এই বোরকার পিঠের ভাঁজ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
~ যাক। আপনারই তো ভালো। আপনি তো এমনি চান। (মজা করে তোহা)

~ কালো বোরকাটা পর, খুলো এইটা। (ধমক দিয়ে নির্ণয়)
~ হ্যা খুলছি। আমার এপ্রোণ আর আইকার্ড বের করেন। ড্রয়ারে আছে।

~ হ্যা করছি তুমি পালটে এসো। আর চোখ থেকে কাজল মুছো। বাইরে যাওয়ার আগে কাজল পরেছো কেনো তুমি? (নির্ণয়)
~ আজকে পরিনি। কাল পরেছিলাম, উঠেনি এখনো।
~ ধুয়ে আসো যাও।

~ আচ্ছা।
নির্ণয় চুল আঁচড়ে তোহার আইকার্ড আর এপ্রোন বের করলো। এপ্রোন বের করতে গিয়ে এপ্রোন এর পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ পরে গেলো ফ্লোরে।

নির্ণয় ড্রয়ার বন্ধ করে কাগজটা তুলে খুলল। ভেতরের লেখাগুলো পড়ে নির্ণয়ের মাথায় রক্ত উঠে গেছে। নির্ণয়ের হাতের রগগুলো ফুলে গেছে রাগে। নির্ণয়কে এমন দেখে তোহা জিজ্ঞেস করে,
~ কি হয়েছে আপনার? প্রেসার বেড়ে গেছে? বসেন আমি পানি এনে দেই। (তোহা)

তোহা পানি আনতে পা বাড়াতেই নির্ণয় তোহার হাতের কবজি নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরে। তোহার ঘড়িটার ডিসপ্লে ভেঙে গেছে চাপ সইতে না পেরে।

~ কি করছেন আপনি? হাতটা কেটে গেছে আমার। প্লিজ ছাড়ুন।
~ এইটা কি তোহা? (তোহার দিকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে নির্ণয়)
তোহা কাগজটা এক হাতে ধরেই পড়তে শুরু করলো। কাগজটায় লিখা ছিল,
“তোহা,
আমি সাদমান। ওইযে চশমা পড়া ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটাই আমি। আমি দেখেছি আমি যখন ক্লাসে ডক্টরদের সাথে কনসাল্ট করি তুমি হা করে চেয়ে থাকো। কখনো তোমার মুখ দেখিনি কিন্তু তোমার ওই কাজলরাঙা চোখ দেখেই বুঝে গিয়েছি তুমি দেখতে কেমন হতে পারো! তুমি ক্লাসে পড়া বললে আমি তোমার কন্ঠের প্রেমে পরে যাই বারবার। তোমার হাতের লেখাগুলো মুক্তোর মতো।

এত সুন্দর করে লিখো কি করে তুমি? আমি জানিনা তোমার রিলেশন আছে কি নাই। তবে তুমি জেনে রেখো সাদমান নামের কোনো এক ছেলে তোমায় প্রচন্ডভাবে ভালবাসে। তোমার এটিটিউডে বাচ্চামো একটা ভাব আছে। ভালই হলো আমাদের বাচ্চা আর তুমি দুজনেই বাচ্চামো করবা আর আমি দেখব আর হাসব। তোমার উত্তরটা আমায় জানিয়ো”

চিঠিটা পড়ে তোহা সোজা নির্ণয়ের চোখের দিকে তাঁকায় আর বলে,
~ ট্রাস্ট মি আমি এসবের কিছুই জানিনা। সাদমান ছেলেটা ক্লাসের টপার। ব্যাস এইটুকুই চিনি আমি। কখনো কথাও বলিনি আমি ওর সাথে।

~ জাস্ট শাট আপ তোহা। তুমি মেরিড এইটা ওই ছেলে জানেনা? এইরকম একটা চিঠি তোমার এপ্রোনের পকেটে আর তুমি বলছো জানো না? কিভাবে সম্ভব এইটা? (চেঁচিয়ে নির্ণয়)
~ আস্তে কথা বলেন। আমি আসলেই জানিনা এইটা আমার এপ্রোনের পকেটে কিভাবে আসলো।

~ গুড! ভেরি গুড! তোমার আর পড়াশোনার দরকার নাই তো। আমি তোমায় পড়তে পাঠিয়েছিলাম এইসব করার জন্য না তোহা।

~ এখন আপনি শেষ মুহুর্তে এসে আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিলে আমার কিছু বলার নাই কারণ আমি আপনার টাকাতেই পড়ি। আর আল্লাহর নাম নিয়ে বলছি আমি এসবের কিছুই জানিনা।
~ চলো কলেজে বাকিটা আমি দেখছি।

তোহার বাম হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে নির্ণয় তোহাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ভাগ্যিস তোহার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আজ বাসায় ছিল না নয়ত নির্ণয়কে মেরেই ফেলতো তোহার সাথে খারাপ ব্যবহারের জন্য। নির্ণয়ের রাগ একটুও কমেনি শুধু পরীক্ষার দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে নির্ণয় তোহাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

কলেজে গিয়ে নির্ণয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি চেয়েছিলো কলেজ প্রিমিসিসে ঢুকতে দেওয়ার জন্য কিন্তু অনুমতি ছিলনা। এইজন্য নির্ণয় ভেবেছে পরীক্ষা শেষেই সাদমানের সাথে কথা বলবে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তোহা কাটা হাতটা দেখতে দেখতে বেরিয়ে আসে আর একটা ছেলে এসে তোহার পথ অবরোধ করে। নির্ণয় সেইটা দেখছে।
~ হেই তোহা।

~ এক্সকিউজমি সাইড দিন আপনি। আপনার মতো ছেলে যে এতটা বেয়াদব হতে পারে তা আমার জানা ছিলনা। (অন্য দিকে তাঁকিয়ে তোহা)
~ কি করেছি আমি? (সাদমান)

~ আমাকে লাভ লেটার দেওয়ার আগে আমার রিলেশন স্ট্যাটাসটা জানা উচিৎ ছিল আপনার। আমি মেরিড। আর কিছুদিন বাদেই আমার পাঁচ বছর মেরিজ এনিভার্সারি পূরণ হবে।

আজ আপনার জন্য আমাএ হাজব্যান্ড আমায় ভুল বুঝলো। আপনি কিভাবে আমার এপ্রোনের পকেটে লাভ লেটার ঢুকালেন বলেন তো?
~ প্র‍্যাক্টিকাল ক্লাসে। তুমি টের পাওনাই। আই এম সরি তোহা। আমি সত্যিই জানতাম না তুমি মেরিড।

ভাইয়াকে বলো আমায় যেন মাফ করে দেয় আর এতে তোমার কোনো দোষ নাই। (সাদমান)
~ এতক্ষণ পর্যন্ত ইচ্ছে করছিলো ঠাস ঠাস করে তোমার গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দেই। এখন আর দিবনা। কিন্তু শেষের বাক্যটা কি ছিল? (নির্ণয়)
~ কে আপনি?

(সাদমান)
~ নির্ণয়, তোহার হাজব্যান্ড।
~ ভাইয়া আই এম সরি। আমি ওকে নিয়ে অনেক দূর ভেবে ফেলেছিলাম তাই।

এই যুগে ওর মতন মেয়ে দেখাই যায়না। ইউনিক ও। তাই ভালো লেগে গিয়েছিলো। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আপনারা। আমি প্রতিজ্ঞা করছি ভাইয়া আর কখনো আমি তোহাকে বিরক্ত করবনা। আসছি।

আসসালামু আলাইকুম। (সাদমান)
সাদমান যাওয়ার পর নির্ণয় তোহাকে নিয়ে বাসায় না গিয়ে রিক্সা নিয়ে একটা ফ্লোটিং রেস্টুরেন্টে যায়। রেস্টুরেন্টে বসে নির্ণয় তোহাকে বলে,
~ পরীক্ষা ভালো দিছো জানিই। আর সকালের জন্য সরি।
~ সরি বলতে এখানে এসেছেন?

তোহা)
~ না। অনেকদিন ধরে বাইরে খাইনা তাই নিয়ে এসেছি।
~ আপনি একটা একটা করে ভুল করেই যাবেন আর আমি সেগুলো হজম করে নিব?

~ তবে কি করতে চাও বলো?
~ শুধু দেখতে চাই জীবনের বড় ভুলটা কবে করেন!
~ কি ভুল?

~ আমাকে তালাক দেওয়ার ভুল।
~ শাট আপ তোহা। ফালতু কথা বলো না। কি খাবা?
~ যা খাওয়ান।

দুপুরে লাঞ্চ সেড়ে নির্ণয় আর তোহা বাসায় আসে। নির্ণয় ভেবেছিলো দুপুরে রাজশাহী ব্যাক করবে। কিন্তু আজ যাবেনা। নির্ণয়ের বাবা মা মেহেরের বাসায় বেড়াতে গেছে তনয়ের অনুরোধে। এত্ত বড় সুযোগ কিভাবে হাতছাড়া করে নির্ণয়? বাসায় ফিরে নির্ণয় তোহাকে চায়ের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ছয় ঘন্টা ঘুম পাড়িয়ে রাখে।

তোহার নেক্সট এক্সাম আবার তিনদিন পর তাই ঝামেলা হবেনা কোনো। তোহাকে কোলে নিয়ে নির্ণয় মেহেরের ঘরে শুইয়ে রেখে আসে আর দরজা চাপিয়ে ওর নিজের ঘর সাজায় বাসরের জন্য।

ওদের প্রথম বাসরটা নষ্ট হয়েছিলো নির্ণয়ের জন্যই। আজ নির্ণয়ই সেকেন্ড বাসর সাজাচ্ছে নিজের জন্য।
ছয় ঘন্টা পর তোহার ঘুমের ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এরপর তোহা ঘুম থেকে উঠে পরে।

নিজেকে খুব ভারী ভারী লাগছে তোহার! উঠে বসার সময় তোহা দেখে ওর শরীরে এলোমেলো করে শাড়ি পরানো, মুখ সুন্দর করে সাজানো আর গহনাও পরা। তোহা শাড়ির কুচি ধরে দাঁড়িয়ে যায় আর মেহেরের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
~ ওই আপনি কই? খুলুন দরজা? এগুলো কি করেছেন আপনি? (তোহা)

~ পরে খুলব। তুমি শাড়িটা ঠিক করে পড়ে আসো। ঘুমের মধ্যে শাড়িটা ঠিক করে পড়াতে পারিনি আমি।
~ খুলবেন না আপনি?

~ আগে শাড়ি পরে আসো।
~ আচ্ছা যাচ্ছি।

মেহেরের ঘর থেকে তোহা ঠিক করে শাড়িটা পরে আসে। এরপর নির্ণয় দরজা খুলে তোহার উপর গোলাপের পাঁপড়ি ছেটায়।
~ কি এইসব? (হেসে তোহা)
~ একটা ছোট্ট সারপ্রাইজ।

~ দেখি সরেন। আল্লাহ! এইটা কি করেছেন আপনি? বাসর সাজিয়েছেন কার জন্য? (তোহা)
~ আমার জন্য।

~ থাকেন আপনি আপনার সাজানো বাসরে। আমি আবার গিয়ে ঘুমাই।
তোহা সত্যি সত্যি বেরিয়ে যেতে নেয় তখন নির্ণয় তোহার হাত ধরে বলে,
~ পাঁচ বছর আগের বাসর এখন হবে। কোনো নড়ানড়ি চলবেনা। (নির্ণয়)

~ আচ্ছা আপনি কি এখন আমায় লজ্জায় ফেলে দিতে চাইছেন? কাল যদি বাবা মা এসে এসব দেখে তখন তারা কি ভাববে? ছিহ! (তোহা)
~ দেখবেনা। তোমার ইচ্ছা আজ পূরণ হবে। (তোহার কোমড় জড়িয়ে ধরে নির্ণয়)
~ কি ইচ্ছে?

নির্ণয় তোহার কানের সামনে গিয়ে ইচ্ছের কথাটা বলাতে তোহা সোজা নির্ণয়ের নাকে একটা চাপড় মেরে দিলো।
~ আপনি মানুষ হবেন না? (তোহা)

~ নাহ। মানুষ হয়ে কি লাভ যখন অমানুষ হয়ে এত কিছু পাই? (তোহাকে বিছানায় ফেলে নির্ণয়)
~ আউচ! আমি ঘুমাবো। আমি এ ঘরে থাকবই না।
~ ঘুমাতে যেতে দিব? ছয় ঘন্টা ঘুমাইছো।
হয়নাই?
~ না হয়নাই। আপনিই বোধহয় একমাত্র স্বামী যে বউকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এইসব করেছেন।

~ তো কি এখন ইতিহাসে আমার নাম হিরাক্ষরে লিখা হবে? (নির্ণয়)
~ যাহ। উঠেন আপনি এখন।

~ আমি কেনো এখন তুমিও নড়বে চড়বেনা!
~ ছিহ। শ্বাশুড়ি মা কি ভাববে আল্লাহ জানে!

~ পাপ তো করছিনা আর তুমিও তো গার্লফ্রেন্ড না। নিজের বউ। এতে ভাবাভাবির কি আছে? সবাই জানে বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী এসব করেই।
~ ওই খারাপের লিডার। এসব কোনসব? (চোখ পাঁকিয়ে তোহা)
~ দেখাচ্ছি দাঁড়াও।
~ নায়ায়ায়ায়া!

সাড়ে তিনমাস পর,
তোহা দুই মাসের অন্তসত্ত্বা। আর এখন ওর মেডিক্যালের ফাইনাল এক্সাম চলছে। তোহার আম্মু তোহার সাথে এসে থাকছে কারণ তোহার শ্বাশুড়ি একা একা সব সামলাতে পারছেনা।

মেয়েকে নিয়ে মেডিক্যালে দৌড়াদৌড়ি সব তোহার আম্মু করছে আর শ্বাশুড়ি সংসারটা সামলাচ্ছে আর ওইদিকে একা একা রাজশাহীতে নির্ণয় চিন্তা করছে।
~ তোহা বেরিয়েছো? (নির্ণয় ফোন করে)
~ না। এইত বের হব উইথিন ফাইভ মিনিটস।

~ সাবধানে বের হবা আর শুনো বাসে করে একদম ই যাবানা। সিএনজি নিয়ে যাবা। আম্মা কই?
~ আম্মু আমাকে খাওয়াচ্ছে।

~ কিহ? এখন? তোমার না সকাল আটটায় খাবার খাওয়ার কথা? তোহা তুমি না একজন ভাবি ডক্টর? ডক্টর হয়ে তুমি নিজেই অনিয়ম করছো?

~ আমি ভাবি হার্ট সার্জেন্ট, গাইনোকোলজিস্ট নই স্যার। তাই আমি জানিনা প্রেগন্যান্ট হলে কি কি করতে হয়। (হেসে তোহা)
~ আজব। এসব আমি জানি আর তুমি জানো না?
~ আপনি হয়ত আগে মা হয়েছেন তাই জানেন। আমি তো এই প্রথম তাই জানিনা। (হাসি আটকে তোহা)

~ হাজব্যান্ডকে কেউ এসব বলে তোহা? (হেসে তোহার আম্মু)
~ উনি বলতে পারলেও আমিও বলব আম্মু। আমি কি গাইনোকোলজিস্ট তুমিই বলো? এই শুনেন আমি যাই। আপনার সাথে বকবক করার টাইম নাই আমার।
~ লাভ ইউ। সাবধানে যেয়ো।
~ জ্বি রাখি।

ফোন রেখে তোহা শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে কথা বলে বেরিয়ে যায়।


পর্ব ১৯

তোহা মেডিকেলের শেষ সেমিস্টার দিচ্ছে প্রেগন্যান্ট অবস্থায়। নির্ণয় এই সময়টা তোহার সাথে থাকতে পারছেনা বলে খুবই আপসেট। তোহার আম্মু তোহার পুরো খেয়াল রাখছে। উনি তোহাকে নিয়ে যা দৌড় ঝাঁপ করার সব করছে।

দুই মাস লাগিয়ে তোহার পরীক্ষা শেষ হয়। তখন তোহা চার মাসের গর্ভবতী। পরীক্ষা শেষে রেজাল্টের টেনশনে তোহা প্রায়ই মনমরা থাকতো আর মোনাজাতে কান্না করতো।

নির্ণয় তোহাকে হাজারবার নিষেধ করেছে রেজাল্ট নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে। তবুও তোহা শুনছেনা। এইদিকে নির্ণয়ের কাজের প্রেসার এত যে বৃহস্পতিবার বাসায় আসতে পারছেনা। ফোনে ফোনে যা কেয়ার করার সেইটাই করছে নির্ণয়।

তোহার প্রেগন্যান্সির যখন সাড়ে সাতমাস চলে তখন তোহার রেজাল্ট বের হয়। নির্ণয় সেইদিন ঢাকায় আসে। নির্ণয় অনলাইনেই তোহার রেজাল্ট বের করে। তোহার রেজাল্ট দেখে নির্ণয় হা হয়ে যায়। তোহা বারবার নির্ণয়কে জিজ্ঞেস করছে,
~ রেজাল্ট কি? বলেন না প্লিজ।

~ এইটা আমি তোমার কাছ থেকে আশা করিনি তোহা। এত কষ্ট করে তুমি পড়েছো আর এই রেজাল্ট! সিরিয়াসলি?
~ আমার রোল আসেনি?

(তোহা কেঁদে দেয়)
~ আরে বোকা সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওলজিস্ট ডিপার্টমেন্টে তুমি সেকেন্ড হয়েছো। তোমার রোল সেকেন্ডে। অভিনন্দন তোমায়। (

তোহার দিকে তাঁকিয়ে নির্ণয়)
~ সত্যি? (ল্যাপটপটা তোহা নিজের দিকে ঘুরিয়ে)
~ হ্যা নিজেই দেখো। আম্মু, আব্বু মিষ্টি কই? আমি কাল যে মিষ্টি গুলো এনেছিলাম সেগুলো দাও।

(চিল্লিয়ে নির্ণয়)
~ শুধু মিষ্টি তে কি হবে? গ্র‍্যান্ড সেলিব্রেশন চাই ভাইয়া! ট্রিট দে এখন তুই। (মেহের)

~ আমিও আছি ভাইয়া ভুলে যেয়ো না। (ড্রইংরুম থেকে তনয়)
তোহা এত ভালো রেজাল্ট করার পরেও কাঁদছে। তোহার আম্মু তোহাকে জড়িয়ে ধরে হাসছে। নির্ণয় ও তোহার কান্না দেখে হাসছে।
~ এই ফাজিল কাঁদছো কেনো?

~ আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা এত ভালো রেজাল্ট করব। কিভাবে কি লিখেছি আমি নিজেই জানিনা।

(তোহা)
~ কিন্তু করেছো তো! এই নাও এখন মিষ্টি খাও। হা কর। (নির্ণয় তোহাকে বলল)
~ আমি আইসক্রিম খাব।

(তোহা)
~ জানতাম তুমি এই কথাটাই বলবা তাই তনয়কে দিয়ে চল্লিশটা কোণ আইসক্রিম আমি আনিয়েই রেখেছি। এই নাও বাক্স। কত খাবা খাও। (মেহের)
~ এই না। আইসক্রিম খাওয়া যাবেনা। তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে পরে আমার সোনাটার ও ক্ষতি হবে। এই হারামি তোরে এই আকাম করতে কে বলছে?

(নির্ণয়)
~ ভাইয়া তুই চুপ কর। ভাবি তুমি একটা খাও। কিছুই হবেনা। (মেহের)
~ আমি তো খাবই। তোমার ভাইয়ার কথা শুনে কে? (তোহা)
~ খাও কিন্তু ঠান্ডা লাগলে খবর আছে। (নির্ণয়)
~ লাগবেনা।

সেদিন নির্ণয় আর তনয় মিলে একা রান্নাঘরে কাচ্চি রান্না করছে নিজেদের দায়িত্বে।

মেহেরকেও রান্নাঘরে ঢুকতে দিচ্ছেনা তনয় আর নির্ণয়। নির্ণয়ের মা আর শ্বাশুড়ি তোহাকে নিয়েই মেতে আছে। বিকেলে নানা ধরণের জিনিস নিয়ে তোহার বাবা তোহাকে অভিনন্দন জানাতে হাজির। তোহার মা বলে,
~ মেয়েদের প্রথম সন্তান বাবার বাড়িতে হয় সাধারণত। আমি চাই তোহাকে আগামীকাল কুমিল্লা নিয়ে যাব।

~ আম্মা ও তো জার্নি করতে পারবেনা এই অবস্থায়। শরীরটা যথেষ্ট ভারী ওর। (নির্ণয়)

~ সমস্যা নেই। কারে করে যাব আমরা। ওর জন্য ওর বাবা প্রাইভেট কার ভাড়া করেছে। (নির্ণয়ের শ্বাশুড়ি)

~ আচ্ছা আপনারা যখন চাইছেন তাহলে আমিও যাব সাথে। এরপর ওখান থেকে আমি রাজশাহী চলে যাব।

~ তাহলে তো খুবই ভালো হয়। আগামীকাল তাহলে আমরা চলে যাব। তোমার মাকে আমি বলেছি। ওনারা রাজি।
~ আচ্ছা আম্মা সমস্যা নাই।

আর তোহা তুমি গিয়ে রেস্ট কর। অনেক আনন্দ করেছো। আর আমি তোমায় হাজারবার বলেছি টাইলসের উপর এভাবে বারবার হাঁটাচলা করবানা। চুপচাপ খাটে বসে থাকবা। (নির্ণয়)
~ এত বসে থাকে কিভাবে মানুষ?

চিন্তা করবেন না আপনি। মেহেরকে দিয়ে তো হাজারবার ফ্লোর মুছান যাতে পানি না থাকে আর আমি পরে না যাই। এরপরেও পরে যাব ভাবেন কি করে?
~ এক্সিডেন্ট এর উপর কারো হাত পা থাকেনা বুঝছো। এখন ঘরে চলো। আমি নিয়ে যাচ্ছি।
~ চলেন।

রাতে নির্ণয় তোহার পাশে ঘুমায় না কারণ তোহাকে জড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যাস ওর আছে। ঘুমের মধ্যে যদি ও ভুলেও তোহার উপর হাত পা উঠিয়ে দেয় তবে মারাত্মক বিপদ হয়ে যাবে। তাই নির্ণয় ফ্লোরে ঘুমায় আর তোহা খাটের উপর একা ঘুমায়।

পরেরদিন নির্ণয় তোহাকে কুমিল্লা দিয়ে বিকেলেই রাজশাহী চলে যায়। নির্ণয় ডিসাইড করে নিয়েছে তোহার বেবি হওয়ার পর তোহাকে নিয়ে ও রাজশাহীই থাকবে।
দেড় মাস পর,

তোহার ডেলিভারির তারিখ পরলো এমন দিনে যেদিন নির্ণয়ের কোনোভাবেই সম্ভব না ঢাকা আসা। কুমিল্লার একটা প্রাইভেট হাসপাতালে তোহাকে ভর্তি করানো হয়েছে। নির্ণয় মিনিটে চৌদ্দবার ফোন করছে শ্বশুরকে তোহার অবস্থা জানার জন্য।

তোহার শ্বশুর শ্বাশুড়ি, মেহের, তনয় কুমিল্লা আসছে তোহাকে আর নবজাতককে দেখতে। নরমাল ডেলিভারিতে তোহার আর নির্ণয়ের একটা ছেলে হয়। ততক্ষণে সবাই হাসপাতালে চলে আসে আর নির্ণয় ওখানে বসেই হাঁসফাঁস করছে। তোহা সম্পূর্ণ সুস্থ আর বাচ্চাও খুব ভালো আছে।

নির্ণয় কখনো তোহার আল্ট্রা করে বেবি ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা জানতে চায়নি কারণ বেবি জন্মের আগে লিঙ্গ জানা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ তাছাড়া নির্ণয় ছেলে হবে না মেয়ে হবে এই নিয়ে সাসপেন্সে থাকতেই পছন্দ করতো সবসময়।

তোহার ডেলিভারির পর ডাক্তার পার্মিশন দেয় ফেমিলি মেম্বারদের ভেতরে ঢুকতে আর তোহার ছেলেটা তোহার শ্বাশুড়ি মায়ের কোলে। তনয় নির্ণয়কে ভিডিও কল করে ফোনটা মেহেরের হাতে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ইতিহাসে তনয়ই একমাত্র যে এতবছর পরেও ভাবির চেহারা দেখেনি।

নির্ণয় বাচ্চা আর তোহাকে সুস্থ দেখে খুশি হয়ে যায়। মেহের ফোনটা তোহার সামনে ধরে আছে আর তোহার শ্বাশুড়ি বাবুকে তোহার কোলে দিয়ে দেয়। মা, বাচ্চা দুইজনকে একসাথে দেখে নির্ণয় হেসে দেয়। তোহাও হাসে।
~ আপনি বাবা হয়ে গেছেন। দেখেছেন ও কত সুন্দর দেখতে হয়েছে? (তোহা)

~ হ্যা মায়ের মতই সুন্দর হয়েছে। আমি জাস্ট নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিনা। বসের বাচ্চা বস ও এখানে নেই তাই আমি আটকে গেলাম। তুমি ঠিক আছো তো? (নির্ণয়)

~ একদম। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে চলে আসেন। উই আর ওয়েটিং ফর ইউ। (তোহা)

তোহা নির্ণয় কথা বলছে আর মেহের হাসছে। তোহার আর নির্ণয়ের মা কথা বলছে।

~ দেখছেন বেয়াইন এই দুইজন দুইজনকে ছাড়া একদম কিচ্ছু বুঝেনা। আমার ছেলেটাও হয়েছে। মা, বউ, বোন সবাইকে ঠিক করে আগলে রেখেছে। কখনো কারো জন্য কাউকে কষ্ট দেয়নি। সেই তোহার কিশোরী বয়স থেকে তোহা আমার ছেলের বউ।

বিশ্বাস করুন কখনো এদের ঝগড়াঝাটি আমি শুনিনি। নির্ণয় যা বলেছে তোহা সব শুনেছে আর নির্ণয় ও তোহার সব কথা শুনে চলতো। আমার ওষুধ শেষ হয়ে গেলে তোহা নির্ণয়কে হাজারবার ফোন করে আনতে বলতো অথচ কখনো দেখিনি নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নির্ণয়কে দুইবার বলতে।

আপনার মেয়ে সত্যিই খুব লক্ষ্মী জানেন? (তোহার শ্বাশুড়ি)
~ নির্ণয়ের মতো জামাই হয়না। ও আমার মেয়েকে অনেক ভালবাসে। ছেলে মেয়ের সুখই তো সব বাবা মায়ের কাম্য। দোয়া করি ওরা আজীবন এইভাবে সুখে থাক। (তোহার মা)
~ ঠিকই বলছেন।

তোহা নির্ণয়ের সাথে কথা শেষ করে বাবুকে মেহেরের কোলে দেয়। লাল গোলাপি বর্ণের ছোট্ট ছোট্ট হাত পা ওয়ালা বাচ্চাটা এতই ছোট যে তোহার মনে হচ্ছে ওকে ধরলেই হাতের ফাঁক দিয়ে পরে যাবে।

পর্ব ২০ (অন্তিম)

বাবুকে নার্সের কাছে দিয়ে তোহা একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে। নির্ণয় মেহেরকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে তোহা কি করছে। তোহা তখন ঘুমের দেশে।

তিনদিন পর নির্ণয় কুমিল্লা এসে তোহাকে বাবার বাড়ি নিয়ে যায়। তোহার মা জানিয়ে দিয়েছেন বাবুর ছয়/সাত মাস বয়স না হওয়া অবধি তোহা এখানেই থাকবে। নির্ণয় আর কি বলবে!

তোহাও চায় মায়ের সাথে ক’টাদিন থাকবে কারণ ও নাকি পরে বাবুকে সামলাতে পারবেনা। কষ্ট হলেও নির্ণয় রাজি হয়ে যায় তোহাকে কুমিল্লা রাখতে। ছেলে আর ছেলের মায়ের সাথে দুইদিন থেকে নির্ণয় আবার রাজশাহী চলে যায়। এইবার ছেলের মায়ের সাথে নির্ণয় রোমান্স করতে পারেনি বলে নির্ণয়ের কষ্টের শেষ নেই।

নির্ণয়ের এসব কথা শুনে তোহা হাসে। একদিন রাতে নির্ণয় ভিডিওকলে বাবুকে বলে,
~ বাবা তোমার জন্য আমি তোমার মায়ের থেকে প্রায় এক বছর ধরে দূরে আছি। তুমি বড় হয়ে যাও তাড়াতাড়ি।

নির্ণয়ের কথা শুনে তোহা হাসে। বাবুর যখন দুইমাস তখন তোহা একটু সুস্থ হওয়ার পর পরই ইন্টার্নি করে। বাবুকে রেখে তোহা ঢাকা থেকে কুমিল্লা আসা যাওয়া করে ইন্টার্নি করে। এতে তোহার খুব কষ্ট হয় কিন্তু পড়তে যে ওকে হবেই।
এসব শুনে নির্ণয় বলে,

~ বাবুকে রেখে কোথাও যাবানা তুমি তোহা! অনেক হয়েছে। এতদিন নিজের অবহেলা করেছো। সাদাফের কোনো অবহেলা করনা এখন। দরকার হলে রাজশাহী ট্রান্সফার হয়ে এসে ইন্টার্নি কর। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের পাশেই তো থাকি আমি।

~ বাবুকে এখানে আম্মু দেখছে। ওখানে গেলে কে দেখবে? তখন আরো সমস্যায় পরে যাব।

~ এইজন্য তুমি সপ্তাহে চারদিন ঢাকায় আসা যাওয়া করে পড়বা? তোমার দুইমাস আগে ডেলিভারি হয়েছে তোহা! ভুলে গেছো?
~ না ভুলিনাই। তাছাড়া দুই ঘন্টার ব্যাপার। আমার কষ্ট হয়না আর সাদাফ ও অযত্নে থাকেনা। চিন্তা করবেন না আপনি। আর আমি খুব শীঘ্রই আপনার কাছে চলে যাব।

নির্ণয়কে বুঝানোর পর নির্ণয় বাধ্য হয়ে বুঝে। তাছাড়া কথা তো সত্যিই। এতদিন এত কষ্ট করে পড়াশোনা করার পর যদি ডক্টর হিসেবে প্র‍্যাক্টিস না করতে পারে তবে মূল্য কই রইলো এত কষ্টের? এইটা ভেবেই নির্ণয় আরো আগে রাজি হয়ে যায়।
তিন বছর পর,

সাদাফ এখন হাঁটতে শিখে গেছে। তোহাও এখন ডক্টর তোহা হয়ে গেছে। রাজশাহীর একটা নামিদামি প্রাইভেট মেডিক্যালের কার্ডিওলজিস্ট ডিপার্টমেন্ট হেড তোহা। তোহা শুধুমাত্র মহিলাদেরই চিকিৎসা করে।

ইমার্জেন্সিতে যদি পুরুষদের দেখতে হয় তবে খুব বাধ্য হয়েই তোহা নিজেকে ঢেকে সেই রোগীকে দেখে। সাদাফ আম্মুর সাথে মেডিক্যালে এসে আম্মুর সাথেই ঘুরে। আর নির্ণয় অফিসে বসে বসে মা ছেলের খবর রাখে।

ফ্রান্সের একটা হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তোহার ইনভাইট এসেছিলো কিন্তু তোহা দেশের বাইরে একদমই যাবেনা। যা করার ও দেশে থেকেই করবে।

তোহার মা, বাবা এখন নির্ণয়ের কেনা ফ্ল্যাটে থাকে। ঢাকায় তোহার নামে নির্ণয় একটা বড় ফ্ল্যাট কিনেছে। ওই ফ্ল্যাটেই এখন সবাই থাকে শুধু নির্ণয় বাদে। তনয় আর মেহের ও দেড় বছর বয়সী কন্যা সন্তানের পিতা মাতা হয়ে গেছে। নির্ণয়ের মা অসুস্থ থাকে প্রায় সময়। নির্ণয়ের বাবা নির্ণয়ের আম্মুকে দেখে। বয়স তো দুজনেরই হয়েছে।

প্রতিদিন বিকেলে হাসপাতাল থেকে এসে তোহা জামাকাপড় পালটে রান্না বসায়। রান্না বসাতে বসাতে নির্ণয় ও এসে পরে আর নির্ণয় তখন সাদাফেকে নিয়ে খেলে আর তোহা নিশ্চিন্তে রান্না করে।

একদিন বিকেলে তোহা রান্না করছিলো তখন নির্ণয় দরজায় বেল বাজালো। দরজা খুলে দিয়েই তোহা দৌড়ে রান্নাঘরে চলে এলো।

কারণ মশলা টা পুড়ে যাবে বেশি দেরি হলে। নির্ণয় দরজা বন্ধ করে তোহাকে জড়িয়ে ধরে। সাদাফ ফ্লোরে বসে খেলছিলো।
~ কি ব্যাপার? জীবনেও তো এই কাজ করলেন না। আজ এভাবে জড়িয়ে ধরলেন যে?

~ আজকে থেকে ধরব। এতদিন এই আইডিয়াটা আমার মাথায় আসেনাই তো।

~ হাহাহা। সাদাফের কাছে যান। দেখেন ও পানি ফেলে দিলো কি না! যা ফাইজলামি করে ও! (তোহা খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে)
~ করবেনা? তোমারই তো ছেলে।

আব্বু কই তুমি?
~ আব্বু কই তুমি বললেন আর ও চলে আসলো, নাকি? যান আপনি। আমি চা দিচ্ছি।
~ চা না। শরবত দাও।

~ ফ্রিজে শরবত করা আছে। একটু নিয়ে খান না। হাত খালি নেই দেখছেন তো?
~ আচ্ছা নিয়ে নিচ্ছি। তুমি রান্না কর।

নির্ণয় ফ্রিজ থেকে শরবতের গ্লাস বের করে সাদাফের সাথে গিয়ে ফ্লোরে বসলো। সাদাফ নির্ণয়কে দেখে নির্ণয়ের কোলে গিয়ে বসলো আর নির্ণয়ের চুল টেনে বলল,
~ আব্বু এতা কি?

~ শরবত। তুমি চিনো না বাবা?
~ হ্যা। আমি খাব। (সাদাফ)

~ হ্যা আব্বু তোমার জন্যই তো এনেছি। কিন্তু এইটা তো ঠান্ডা। তুমি খাবা কি করে? একটু গরম হয়ে নিক। দাঁড়াও আমি মাইক্রোওভেন থেকে শরবতটা গরম করে আনি।

(নির্ণয় সাদাফের কপালে চুমু দিয়ে)
~ আল্লাহ কি বলেন এসব? (হেসে তোহা) মাইক্রোওভেনে কেউ শরবত গরম করে? হায়রে! সাদাফ এই নাও তোমার দুধ। একটানে খেয়ে নিবে। একদম যেন নিচে না পরে।
~ আচ্ছা। (সাদাফ)

তোহা সোফায় বসে আর নির্ণয় তোহার পায়ের উপর মাথা রেখে বসে আছে। তোহা নির্ণয়ের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে আর সাদাফ দুধের গ্লাস খালি করছে।

~ শার্টটা কি খুলবেন না? এইটা কি ধরণের স্বভাব হ্যা? (তোহা)
~ খুলে দাও।

~ হ্যা জানি তো এইটাই বলবেন। দাঁড়ান আর ঘরে চলেন। সাদাফ দুধ শেষ করে গ্লাসটা রেখে দিবা। আর পানির ফিল্টার একদম ধরবানা! (তোহা)
~ আচ্ছা।

তোহা নির্ণয়কে নিয়ে ঘরে গেলো। নির্ণয়ের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে তোহা বলে,

~ কোনটা না রেখেছি? (তোহার কাঁধে হাত রেখে নির্ণয়)
~ আসলে আমার খুব ইচ্ছে মক্কায় যাওয়ার।

সাদাফ তো যথেষ্ট বড় হয়েছে। আর আমাদের যথেষ্ট অর্থ ও আছে এখন। বাবা, মা, আমি, আপনি আর আব্বু, আম্মু ছয়জন মিলে গিয়ে হজ্জ্ব করে আসি চলেন। (তোহা)

~ এইটা তোমায় বলা লাগবেনা। আমি অলরেডি তোমার জন্য এইটা সারপ্রাইজ রেখেছি। এখন যখন বললা তাই বলে দিলাম।
~ অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

(নির্ণয়কে জড়িয়ে ধরে তোহা)
~ ইনশাআল্লাহ আমরা হজ্জ্বে এইবারই যাব। আমার সব কাগজপত্র বানানো শেষ। কিন্তু আমি একটা বিষয় চিন্তা করছি। (নির্ণয়)
~ কি?

~ নাহ থাক। বললে আবার অসভ্য বলবা।
~ আপনি আসলেই অসভ্য। আমি বুঝিনা ভেবেছেন? হচ্ছে আপনার আজকে!

তোহা ঘর পরিষ্কার করার ঝাড়ু নিয়ে নির্ণয়কে মারতে উদ্যত হয় আর নির্ণয় তখন বলে,

~ আচ্ছা ভাই আর বলবনা। ঝাড়ু নামাও। ডাক্তার মানুষ প্রাণ বাঁচায় আর তুমি আমার প্রাণ কেড়ে নিচ্ছো?

এইটা অনুচিত ডক্টর তোহা।
~ আবার আপনি আমায় ডক্টর তোহা বলছেন? (রেগে গিয়ে তোহা)
~ আচ্ছা চাকরানি তোহাই বলব। হইছে? ডক্টর তোহা বলবনা আর।
~ এইবার তো আপনি শেষ।

তোহা নির্ণয়কে ঝাড়ু পেটা করে ঘর থেকে বের করে। সাদাফ ফ্লোরে পানি ঢেলে রেখেছিলো। নির্ণয় পিছলা খেয়ে পরে যায় আর তোহা নির্ণয়কে ধরতে গিয়ে নিজেও পরে যায়। দুজন পানিতে গড়াগড়ি করে আর সাদাফ মজা পেয়ে ও নিজেও গড়াগড়ি শুরু করে দেয়।

ওরা গড়াগড়ি করুক আমি এই ফাঁকে কিছু কথা বলি। এই গল্পটা আমি গতানুগতিক রোমান্টিক করিনি। চটি গল্প লিখার অভ্যাস আমার নেই আর লিখতেও চাইনা।

তবুও এই গল্পটার সাড়া অনেক ছিল। অনেকে ফ্র‍্যাঙ্কলি রিকুয়েষ্ট করে আমায় দিয়ে এই গল্পটা লিখিয়েছে এইজন্য আমি সবার প্রতি গ্রেটফুল। আর এদের গল্প এখানেই শেষ। ধন্যবাদ সবাইকে।

লেখনী ~ নীলিমা জাবিন তানমনা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “তবুও তোমাকেই চাই (শেষ খণ্ড) – ভালোবাসার আবেগের গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – তবুও তোমাকেই চাই (১ম খণ্ড) – আবেগের ভালোবাসার গল্প

2 thoughts on “তবুও তোমাকেই চাই (শেষ খণ্ড) – ভালোবাসার আবেগের গল্প”

  1. Really khub valo chilo storyta. sadharonoto onno story golute onek bhul pai kintu atate kono bhul pai nai. Sadharonoto sobai banan vul Kore. Onek somoy name vul hoi kintu akhane seta chokhe porenai . Onek valo laglo pore.

    1. Thanks a lot. We provide all parts together. So you will be happy to read. Stay with us and get more fun.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *