তুমি আমি (১ম খণ্ড) – Valobashar romantic premer golpo bangla

তুমি আমি – Valobashar romantic premer golpo bangla: প্রেম কিছু বলে না। শক্ত হয়ে বসে থাকে। এই লোকটাকে তার একদমই পছন্দ নয়। কেমন বাঁকা ত্যাড়া কথা বলে। প্রেমের এখনো মনে আছে, সকালের মৃত্যুর দিন তাকে কীভাবে হেনস্তা করেছিল।


প্রথম পর্ব

“আফিফ, আমি তোমার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে। একটুর জন্য আসবে, প্লিজ।”

এতটুকু বলে ফোনের লাইনটা কেটে দিল নিশান্তিকা। আফিফ খুবই ঘুম কাতুরে ছেলে। তবে, নিশান্তিকার কথা শুনে সে হতবিহ্বল বসেই রইল কিছুক্ষণ। চোখ দুটি জ্বালা করছে তার।

ঘড়ির কাঁটায় ৮টা ছুঁইছুঁই। গভীর রাতে চোখ বুজেছে আফিফ, সাদা রঙের ল্যাবটব আধ বন্ধ পড়ে আছে বিছানার কোণে। মাথা ঝিম ধরে আছে। দু~ একবার হাই তুলছে। চোখের কোণের জল বলে দিচ্ছে ঘুমটি অপূর্ণ। উষ্কখুষ্ক চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়িয়ে চাড়িয়ে ওঠে দাঁড়াল, আরো একবার মাথা ঝুলিয়ে হাই তুলল।
কালো রঙের টি~ সার্ট হাতে নিয়ে দো~ তালায় এসে দাঁড়াল আফিফ। রেলিং ধরে নিচে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাক করে দেখল নিশান্তিকা সবুজ ঘাসের মাঝে বেঞ্চের কোণে বসে ছিল। বাগানের লাল গোলাপের কলি দেখতে সে মত্ত।

আফিফের দিকে দৃষ্টি পড়তেই নিশান্তিকা হাত নাড়িয়ে হাই জানাল। আফিফ নিচে নেমে এল। নিশান্তিকার পাশে বেঞ্চের অপর কোণে বসে পা দুটি সবুজ দূর্বা ঘাসের শিশির বিন্দু ছুঁয়ে দিল।

“শুভ সকাল নিশান্তিকা।”
“শুভ সকাল।” নিশান্তিকা মিষ্টি হেসে প্রতিউত্তর দিল। আকাশের অদূরে তার দৃষ্টি।
“হঠাৎ এই অকর্মার দ্বারে কি মনে এলে?”

নিশান্তিকা একটু হাসল। টিপটিপ করে আড়চোখে নিশান্তিকার হাসির ঝলক গেঁথে নিল মনে আফিফ।
“জরুরি কিছু কথা বলতে এসেছি।” আফিফের দিকে ঘুরে তাকাল নিশান্তিকা, চোখের দৃষ্টি স্থির।
“সময় বহমান। বলতে থাক, শুনছি আমি।”

“বলব। তোমার চোখ লাল লাল দেখাচ্ছে, নিশ্চয় ঘুম পূর্ণ হয়নি। কফি খাবে?”

নিশান্তিকার মিনুতি সুরের আবদার এড়িয়ে যাওয়ার মত নয়। ভাবলেসহীন ভঙ্গিতে আকাশের পানে চেয়ে বলে ওঠল~
“হুমম খাওয়াই যায়।”

“আচ্ছা, আমি আনছি। ততক্ষণে তুমি একটু হাঁটাহাঁটি করতে পার।”

আফিফ উজ্জ্বল হাসল। নিশান্তিকা ওঠে দাঁড়াল। আফিফ ভাবছে, এই সকাল তার প্রাপ্য ছিল। প্রথমে সুন্দরীর দেখা অতপর হাতের মিষ্টি কফির আবদার, ভাবা যায়!

“নিশান্তিকা, বলছি যে তোমার দরকারি কথা শেষ হলে, তুমি কি চলে যাবে?”
নিশান্তিকা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল~ হ্যাঁ
অাফিফ একটু ভেবে আবার বলল~

“তাহলে বরং চলো আমরা হাঁটি।” আকাশ পানে তাকিয়ে আবারও হাই তুলে আরমোরা ভাঙল আফিফ। অপেক্ষা করছিল নিশান্তিকার উত্তরের।
“আচ্ছা কফি খেয়ে না হয় হাঁটব।”

নিশান্তিকা চোখের আড়ালে চলে গেল। নিশান্তিকা যেখানে বসে ছিল সেদিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইল আফিফ, চোখ দুটির স্থির দৃষ্টি তার। কোনো ভাবনা, ক্লান্তি, অবসাদ নেই।

এদিক~ সেদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে ফিরে হেঁটে এসে সেই বেঞ্চের কোণে বসল। হাতের ছোঁয়া রাখল।
“দাদিমা, সকালটা খুব সুন্দর, নিষ্পাপ, শুভ্র। গোলাপের চারায় কলি এসেছে, দেখেছ?”

আফিফের দাদিমা বাগানের ফুল গাছের পরিচর্যা করছিল। নাতির কথায় মিষ্টি হাসলেন। জলের হ্যান্ডেল রেখে মালিকে বললেন গাছের গোড়ায় মাটি খুড়ে আলগা করে দিতে।

“সকাল, ভোর ৫টায় ফোন দিয়েছিল।” নিশান্তিকা কফির মগ আফিফের দিকে এগিয়ে দিল। কথাটা বলে বেঞ্চের কোণে বসল।

আফিফ কফিতে এক চুমুক দিয়ে ঠায় বসে রইল। এই কফির স্বাদ মুখে রুচছে না তার, চিরচেনা লাগছে। নিশান্তিকার কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না, নিজ থেকে বলল~
“কফিটা তেতো লাগছে, সেই চিরচেনা স্বাদ।”

নিশান্তিকা চোখ টিপটিপ করে আফিফের দিকে তাকাল। ছেলেটি খুব অদ্ভুত ভাবে কথা বলে। রহস্য মিশ্রত চাহনি।
“তুমি বানিয়ে আনছি বলে চললে, আর এটা নিয়ে চলে এলে?” আফিফ কঠিন সুরে কথা বলল। কফিটির মগ বেঞ্চের মাঝে রেখে দিল। এক চুমুকে তৃষ্ণা মিটে গেছে তার।

“আফিফ, আমি আনছি বলে গিয়েছি, বানিয়ে আনছি! কখন বললাম?”

নিশান্তিকা স্বাভাবিক স্বরের কথায় আফিফ একটু আহত হলো, হয়ত সে ভেবে ছিল নিশান্তিকা বলবে~ আচ্ছা, আমি বানিয়ে আনছি। তবুও আফিফ শেষ চেষ্টা করল, ঠোঁটের কাছে আঙুল রেখে বলল~
“আমি কি তবে ভুল শুনেছি!”

নিশান্তিকা প্রতিউত্তরে শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাকালো। আফিফ এবার ক্ষান্ত হলো।
“আচ্ছা চলো হাঁটি।” আফিফ জোর কদমে উঠে দাঁড়াল।

“কফিটা শেষ কর, আর এই চশমাটা পড়ে নেও।”

নিশান্তিকার এগিয়ে দেওয়া চশমাটা পড়ে নিল আফিফ। ভুল বশত ঘাটের বক্সের কোণে রেখে এসেছিল। কফির মগ হাতে নিয়ে বসে পড়ল। কোনোরকম কফিটা গিলে, মগটা এক আছার দিবে। ভেবে নিল আফিফ।

“কম্পিউটার অন করে রেখে এসেছ, পাণ্ডলিপি লেখা শেষ?”
“একটু আছে, উপসংহার। হয়ে যাবে, তুমি পড়বে?”

আফিফ নিশান্তিকার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল।

“হুমম অন্যদিন। চলো হাঁটি।” নিশান্তিকা কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিল।

দুজনে গেট পেরিয়ে পিচঢালা রাস্তায় হাঁটতে লাগল। আফিফ আসার সময় সজোড়ে দূরে আছার মেরেছে মগটা। নিশান্তিকা সামনে তাকিয়েই মুচকি হাসল।
চারিপাশে সকালের ঠাণ্ডা ঝিরিঝিরি হাওয়া। পিচঢালা রাস্তা। দু~ পাশে সারি বাঁধানো মেহগনিবৃক্ষ। শীত শেষে বসন্তের আগমন। লম্বা লম্বা গাছের নতুর কড়ির নরম ছোট ছোট পাতা। রোমাঞ্চকর সুন্দর পরিবেশ, একেবারে ঝকঝকে।

আফিফ টাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে শুভ্র আকাশ পানে তাকিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছিল। খোলা হাওয়ায়, পুব আকাশে সূর্যিমামার হালকা ঝলমলে রোদের শুভ্র উষ্ণতায় মন মাতানো ঘ্রাণ নাক ছুঁয়ে গেল আফিফের। নিশ্চয় এটা নিশান্তিকার খোলা চুলের। ভালোবাসার মাঝে বিরাজমান জীবন নীরবতা। যেখানে লুকিয়ে থাকে অগণিত ভালোবাসা।

বেশ কিছুক্ষণ পর নিশান্তিকা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,
“সকাল, তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, কিছু কথা বলবে শুধু।”
“কী বিষয়ে?”

“আঙ্কেল~ আন্টি প্রেম সম্পর্কে জেনে গিয়েছে। সকালকে চাপ দিয়েছে প্রেমের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে।”
“আমি কী করতে পারি, আই মিন আমরা দুজনে?”
“ওদের বিয়ের বিষয়টা তোমায় হ্যান্ডেল করতে হবে।”
“আমায় কেন?”

“যাতে আন্টিদের দু~ চারটা গুন্ডা এলে, তাদের মেরে তক্তা বানাত পার।”

“সিরিয়াসলি!”দুজনে কিছুক্ষণ হাসল। আফিফ হাসি থামিয়ে মাথায় চুলগুলো হাত দিয়ে ঝাকালো, অতপর বলল,
“আচ্ছা, আমার কি ওদের মাঝে ইনভলব হওযা উচিত হবে?”
“ওরা যেহেতু চাচ্ছে তবে কেন নয়!”

“তোমার কি মতামত?”
নিশান্তিকা রাস্তার কোণে বেঞ্চে বসে পড়ল। আফিফ এখনো আকাশের শূণ্য দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে। নিশান্তিকা মুখ তুলে গালে লাগা চুল গুলো কানে গুজে নিয়ে বলে~

“সকাল, প্রেমকে খুব ভালোবাসে।”


দ্বিতীয় পর্ব

“ভালবাসায় হাত দিতে নেই, তবে ভালবাসা এসে যায়।” আফিফ মুচকি হেসে বেঞ্চের অপর কোণে বসল।

নিশান্তিকা ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইল সেদিকে। ছেলেটির কথায় আগা~ মাথা নেই। কখন কি যে বলে। লেখক মানুষ বলেই হয়ত। লেখকরা একটু প্রেমিক পাগলা টাইপের হয় নিশান্তিকার মতে।

দুজনে নীরবে বসে থাকে। আফিফ দেখছে খোলা হাওয়ায় নিশান্তিকার এলোমেলো চুলে হাওয়া বয়ছে, স্নিগ্ধ, শান্তিময়, মায়াবী চেহারায় সৌন্দর্য ফুটেছে ফুলের মত। এমনি একটি মেয়ের প্রিয়তম বউ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে সে। এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে তার, ভালোবাসার চাদরে আবৃষ্ট করে নিতে।
নিশান্তিকা মাথা তুলে ইশারা করতে আফিফ মুচকি হেসে এগিয়ে এসে নিজের মনের বাসনা প্রকাশ করে বলে,
“নিশান্তিকা, ডাব খাবে? শরীরের ক্ষেত্রে পুষ্টিকর, আরামদায়ক।”

“আজ নয়, অন্যদিন।” নিশান্তিকা লজ্জারাঙা মুখে মাথা নত করে রাখে।

“অন্যদিন কেন?”
“আজ জরুরি কথা বলতে এসেছি।”

“বিষয়টা হাস্যকর। কিছু লুকাচ্ছ তুমি।” আফিফ সহসা বলে ওঠে, এমন মুহূর্ত সে হারাতে চায় না।
“আসলে, টাকা আনিনি। ফ্রী তে নিশ্চয় বিক্রি করবে না।” নিশু ধীরে ধীরে চিপানো সুরে বলে।
আফিফ অবাক হলো নিশান্তিকার কর্মকাণ্ডে। মেয়েটি এত লাজুক, তার জানা ছিল না।
“আচ্ছা, তবে টাকা নাহয় পরে দিয়ে দিও, আপাতত চলো।”

“উঁহু”
“চলো”
আফিফ উঠে দাঁড়িয়ে নিশান্তিকার এক হাত জাপটে ধরে হাটতে থাকল।
“আফিফ!”
“ভদ্রমহিলার মত চুপচাপ চলো।”

নিশান্তিকা এবার কঠিন সুরে চোখ পাকিয়ে বলল,
“আমি ভদ্রমহিলা নই।”

“তবে, ” আফিফ এক চোখ টিপ মেরে বলল। নিশান্তিকা লজ্জিত মুখে নত সুরে বলে,
“ভদ্রমেয়ে।”

আফিফ হেসে দিল প্রতিত্তোরে। নিশান্তিকা লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে মুচকি হাসল।
দুপুরবেলা,

নিশান্তিকা কলেজ ক্যান্টিনে বসে আছে। সবে মাত্র একটি আইসক্রিমের ডিব্বা শেষ করল। প্রেম, আরো একটি এগিয়ে দিল, নিশান্তিকা উজ্জ্বল হেসে ডিব্বাটা নিয়ে নিল। প্রেম, নিশান্তিকার একমাত্র কাজিন। তিন বছরের বড় প্রেম তার থেকে। দুজনের একে সাথে বেড়ে ওঠা।
নিশান্তিকার সামনেই চেয়ারে বসে আছে আফিফ আর দীপ্ত। প্রেমের পাশে বসে আছে শ্রেয়া। প্রেমের ক্লাসমেট।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা ঘিরে রাখল তাদের। শুধু নিশান্তিকা স্পুন নাড়িয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে পা ঝুলিয়ে বসে চুপিচুপি আফিফের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। বিষয়টি দীপ্ত বেশ ভালোভাবে খেয়াল করছে।

তাই দীপ্ত নীরবতা ভেঙে প্রথমে প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা, আমরা এখানে বসে আছি কেন?”

“প্রেমের বিয়ের প্ল্যান সাজাতে।” শ্রেয়া বলল।

দীপ্ত মনে মনে খুব বিরক্ত হলো নিশান্তিকার কর্মকাণ্ডে। আইসক্রিম খাওয়া শেষ হলে না প্ল্যান সাজাবে!এ নিয়ে চারটা শেষ করল। তবুও নাকি পেট ভরছে না। একেই বলে মেয়ের জাত। এদের কারণে যত অখাদ্য~ কুখাদ্যর যত কদোর!
“নিশান্তিকা, প্ল্যান কী?” দীপ্ত মেকি হেসে বলল।

“বলেনি এখনো! বলেছি তো।”

“কী?” সকলে অবাক হয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় তার দিকে। নিশান্তিকা হেসে বলে,
“সকাল, খুব ভোরে বাসা থেকে পালিয়ে কাজির বাসায় যাবে। তোমরা সেখানে উপস্থিত থাকবে। কাজি সাহেব দুজনের বিয়ে দিয়ে দিবেন।”
“এক সেকেন্ড, কাজির বাসায় কেন?” দীপ্ত না বুঝে প্রশ্ন করল নিশান্তিকার কথার মাঝে।
“অত সকালে কোন কাজি সাহেব অফিস খুলবে!”

দীপ্ত মাথা ঝাকায়। ভাবনাগুলো আসলেই গভীর। নিশান্তিকার প্ল্যানে সন্তুষ্ট হয় সে।
“আইডিয়া কার?”শ্রেয়া জানতে চায়। নিশান্তিকা সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“প্রেম, শ্রেয়া আপু, আইডিয়া আফিফ দিয়েছে।”

প্রেম কিছু বলে না। সবার কথা শুনে, মাথা নিচু করে বসে আছে এক কোণে। অসহায় লাগছে তার নিজের প্রতি। সকলের আলোচনা চলতে থাকে।
“কোনভাবে সকালের সাথে যোগাযোগ করা হলো না, আর একবার পরিবারকে মানানো যায় না?”

আফিফের কথায় নিশান্তিকা কিছুক্ষণ ভেবে চেয়ার টেনে বসে বলতে থাকে সকলের উদ্দেশ্যে,
“কোনো সুরাহা হবে না আফিফ। এমন নয় যে চেষ্টা করা হয়নি। একবার নয়, দু দুবার। প্রথমত, তুমি একজন লেখক, আমাদের এই সমাজ, দেশ, মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা~ মা সম্পর্কে তোমার ব্যাসিক জ্ঞান আছে। কোনো বাবা~ মা চায় না প্রেমের বিয়ে হোক, অথবা ভার্সিটির বেস্ট স্টুডেন্ট বেকার ছেলের সাথেও।

দ্বিতীয়ত, ছেলে~ মেয়েদের মন বুঝতে তারা অক্ষম সেজে থাকে। পরিণয়, প্রেম সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকে নিচু মানের। তাদের আমরা বুঝাতে চেয়েছি, সব ভালোবাসা সমান হয় না, কিন্তু তারা বুঝেছে অন্যটা। সেকেন্ড টাইম এই ভুলটা করতে গেলে আমরা বেয়াদব হয়ে যাব। ব্লা ব্লা।

“এক মিনিট, আমি যতদূর জানি ওদের রিলেশন প্রায় তিন বছর। তবে, এতদিন কোন সমস্যা হলো না কেন?”

সকলে প্রেমের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। প্রেমের মনের পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করে। নিশান্তিকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আসলে সমস্যা হয়েছে সকালের ভাইকে নিয়ে। সকালকে ওই ছেলেটা সহ্য করতে পারে না। এমনিতে সৎ ভাই। এতে করে বাবা~ মায়ের কান ভারি করছে।”
“তো ওদের বিয়ে হয়ে গেলেই কী ঝামেলা শেষ?” দীপ্তের প্রশ্ন।

“ঝামেলা একটু হবেই দীপ্তদা। যতটা সহজ ভাবছি ততটা নয়, খুব জটিল।”
“যেমন!” দীপ্ত মনযোগে নিশান্তিকার কথা শুনে।

“সম্ভবত, সকালের সম্পত্তির অধিকার ছেড়ে দিতে হবে। বেচারি মেয়েটা।”
“আমার খুব খারাপ লাগছে, কি জানি, কীভাবে আছে মেয়েটি।” শ্রেয়া মনের আক্ষেপ প্রকাশ করে।
প্রেম বুকের বা~ পাশে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করল। সকালের ভাবনায় নিজেকে কেমন অসহায় অসহ্য ভাব হতে লাগল। এক ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে তার প্রিয়তমের দ্বারে। কিন্তু এখন সে নিরুপায়।

“আমি আর এসব কথা শুনতে চাই না। বাসায় যাব।”

প্রেমের কথায় সকলে চমকে ওঠে। প্রেমের চেহারায় ফুটে উঠেছে বেদনাদায়ক চিহ্ন। চুলগুলো সেদিক দুলছে, ফর্সা মুখটা ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করেছে। চোখ দুটি রক্তিম রঙে ফুটে ওঠেছে। ভয়ংকার ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে প্রেমকে।

প্রেমের কাঁধে হাত রাখে শ্রেয়া। দীপ্ত একটা হাত চেপে ধরে। ভরসা দেখায়।

“নিজেকে শক্ত কর প্রেম। আমরা সবাই আছি তোর সাথে। আমরা জানি যে, তোরা দুজনে কত ভালোবাসিস। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাবিস নাহ্।”
“আচ্ছা, আমাদের এখন ইতি টানা উচিত। শ্রেয়া আপু, প্রেম ভাইয়াকে বাসায় পৌঁছে দিও। আমরা এখন উঠছি।” প্রেমের পরিস্থিতি বুঝে নিশান্তিকা এখানেই ইতি টানে। কথায় কথা বাড়তে, এতে প্রেমের কষ্ট লাগবে, খারাপ দেখাবে।

আফিফ বাদে সকলে ওঠে দাঁড়াল। খুব মনোযোগ দিয়ে প্রেমকে পর্যবেক্ষণ করছে আফিফ। শ্রেয়া পরিবেশ মজাতে প্রেমকে শুনিয়ে হেসে খেলে বলল,
“বাব্বাহ্, বোনের দেখছি সুমতি হয়েছে। প্রেম ভাইয়া, কত মধুর ডাক!”

“শ্রেয়া আপু, সুমতি আমার আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে, ওদের বিয়ের পর যদি বলি, প্রেম শুনো, চলো আইসক্রিম খেতে যাই। তাহলে কি হবে বলত”
“কি হবে” সকলে উচ্চস্বরে বলে ওঠে।

“ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে, প্রেমের বিয়ে দোষের বিয়েতে পরিণত হবে।”

শ্রেয়া হাসতে হাসতে প্রেমের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“বেচারার সংসার হওয়ার আগেই ভেঙে যাবে।”

“শুধু ভেঙে যাবে কি, অকালে মৃত্যুও হতে পারে।”

সকলে মিলে হাসি মজায় মেতে ওঠল। প্রেম মনের দুঃখ কিছুটা ভুলে কিছুক্ষণ হেসে হেসে বলল,
“তারপর ভূত সেজে এসে তোকে জ্বালাব, তোলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। প্রতিদিন থাপ্পড় থেরাপি দিব। বুঝেছিস।”
“যা ভাই এবার বাসায় যা, নিজে থাপ্পড় ধেরাপি থেকে বাঁচতে প্রস্তুতি নিতে হবে তো।”

প্রেম সহ সকলে হাসছে। নিশান্তিকার সাথে ঝগড়া করছে, মন খুলে কথা বলছে। নিশান্তিকার মন ভালো হয়ে গিয়েছে প্রেমের ঠোঁটে হাসি দেখে। মনমরা শরীর নিয়ে বসে থাকতে এমন মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে ভালো লাগছিল তার। সে চায় না, দ্বিতীয় বার প্রেম ভালোবাসা হারানোর কষ্ট ভোগ করুক।


তৃতীয় পর্ব

পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তায় দুটি মানুষ পাশাপাশি হেঁটে চলছে। একটুখানি নীরবতা, লজ্জা, অনুরাগ, অভিমান, দুজনকে এক বাঁধনে আটকে রেখেছে।
নিশান্তিকার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে আফিফ। সোটাম দেহ, ফর্সা, গোলগাল মুখের গঠন। শান্ত ভাব চেহারায় ফুটে উঠেছে। নিশান্তিকার খুব ভালো লাগে আফিফের সহজ সরল শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে।

আচমকা নিশান্তিকা বলে ওঠে,

“শ্রেয়া আপু তোমার দিকে ১১বার তাকিয়েছে।”
আফিফ মুচকি হেসে বলে,
“আমি ক~ বার তাকিয়েছি!”

নিশান্তিকা প্রতিত্তোরে মৃদু হাসে। ঠোঁটের কোণে হাসি রাখে, চোখ মুখে প্রশান্তি ফুটে ওঠে। কারণ, আফিফ সারাক্ষণ নিশান্তিকার ধ্যানে মগ্ন ছিল। আফিফের পার্সোনালিটিতে নিশান্তিকা বরাবর সন্তুষ্ট হয়েছে।

“আজ আকাশ খুব মেঘলা, শহরজুড়ে অন্ধকারে বিষন্ন। বৃষ্টি আসবে না তো!”
নিশান্তিকা আকাশে একবার তাকিয়ে আফিফের দিকে চেয়ে চেয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ভেবে বলে,
“আপনি খুব গম্ভীর চঞ্চল একজন পুরুষ।”

নিশান্তিকার প্রশংসায় আপ্লুত হয়ে আফিফ ধীরে ধীরে হেসে একসময় উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। কপাল কুঁচকে বলে,
“আর? আরো কিছু আছে?”

নিশান্তিকা লজ্জা পেয়ে নত মাথায় না সূচক মাথা নাড়ায়। চুপিচুপি প্রেমের বিষয় ভাবতে থাকে।
“আচ্ছা নিশু, তোমার কি মনে হচ্ছে না আমি তেজপাতা হয়ে যাচ্ছি।”
আচমকা আফিফের এমন ধাঁচের কথায় চমকে ওঠে। সময় নিয়ে বলে,
“অ্যা! বলেন কি?”

“হ্যাঁ, বলছি যে ওদের মাঝে নিজেকে তেজপাতা মনে হচ্ছে। আসলে, আমি গিয়ে কী করব? এটাই ভাবছি যে, শুধু তোমাদের কথা গিলব। আর মেয়েদের নজরে পড়ব।”
আফিফের কথার অর্থ বুঝতে পেরে নিশান্তিকা উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, বলে,
“আসলে হলো, আপনি সাথে থাকলে আমি সাহস পাব।”

“সত্য বলছ?” গলার স্বর নরম করে জিগ্যেসা দৃষ্টিতে তাকায় আফিফ।

“তিন সত্য।” নিশান্তিকা ঠোঁট টিপে হাসি আটকে বলে। আফিফ বুঝতে পেরে দুষ্টুমির ছলে বলে,
“হাহ্, চারপাশে ছেলে থাকলে মেয়েরা নাকি ভয় পায়। কখন কি হয়ে যায়! আর তোমার সাহস বাড়বে।”
“সিরিয়াসলি বলছি, আপনি থাকলে সাহস বাড়বে।”

নিশান্তিকা এবার সিরিয়াস হয়। তবু্ও আফিফ বাঁকা হেসে হাতে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“হুমম তবে, কাছে আসো হাতটা ধরি দেখি কেমন সাহস বাড়ে?”

নিশান্তিকার সিরিয়াস ভাবটা নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে পিচঢালা রাস্তায় বসে পড়ে। আফিফ মাথার চুলগুলো হালকা ঝাঁকিয়ে দিয়ে, টিপটিপ চোখে নিশান্তিকার হাসি গেঁথে নেয় মনে। মেয়েটি এত জোড়ে হাসে যে আফিফের কানে বারবার প্রতিধ্বনি বাজতে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ঐ তো প্রিয়তম হেসে হেসে আমায় ডাকছে, খুব কাছে।

“লেখক সাহেব, আপনার সাথে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব একদিন, দেখে নিয়েন।”

আফিফ ফিক করে হেসে বসে পড়ে। নিশান্তিকার সাথে তাল মিলিয়ে হাসে। খুশিতে মনের মধ্যে আনন্দের ঝড় তোলে।

নিশান্তিকার বাড়ির পথে চলে এসেছে দুজনে। খপ করে নিশান্তিকার হাত চেপে ধরল আফিফ। নিশান্তিকা ভড়কে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। আফিফ চুপসানো গলায় বলে,
“যদি কেউ টেনে নিয়ে যায়।”

হাতের মুঠি শক্ত করে আফিফ। নিশান্তিকা লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারেনা।

গেট পেরিয়ে চলে যায় নিশান্তিকা। আফিফ বিষন্ন মনে চেয়ে চেয়ে দেখে নীড়ে ফিরছে তার প্রিয়তমা। যে নীড়ে তার স্থান নেই।
মেঘ গর্জন করে ঝপাঝপ বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। আফিফের গায়ের শার্ট ক্রমশ ভিজতে থাকে বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায়। প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটায় শরীরে শিহরণ জাগায় আফিফের।

আফসোস বাড়ে। আকাশে তাকিয়ে ভাবে আর একটু আগে কেন বৃষ্টি এলো না। অনুভূতির প্রকাশ ঘটে হৃদয়ে। প্রিয়তমা কি ফিরবে এ পথে।
নিশান্তিকা ছাতা নিয়ে এগিয়ে আসে। আফিফ বৃষ্টির মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে নিশান্তিকার হেঁটে আসা দেখতে থাকে। যেন সে এটাই চাইছিল মনে মনে।
“বৃষ্টির মত তুমিও সময় নিয়ে এলে, ভেজি গেছি একেবারে।”
অপরাধীর ভাবে নিশান্তিকা বলল,
“ভেবেছিলাম তুমি দূরে চলে গেছ।”

“এতটুকু আসতেও সময় নিলে।”

নিশান্তিকা এক কান ধরে ক্ষমা চায়। আফিফ মুচকি হেসে ছাতা টেনে নেয়। ৷ ভিজে চুলগুলো হালকা ঝাঁকি দিয়ে পানি সরিয়ে নেয়।
“সো তুমি যাবে কীভাবে, ভিজে যাবে তো।”

“থাক না, তুমি যেটুকু ভিজেছ, ততটুকুই ভিজব।”
নিশান্তিকা স্নিগ্ধ মুখ পানে চেয়ে থাকে আফিফ। মনে মনে ভাবে বউ সাজলে কত অপরূপ সুন্দরী দেখাবে। এক জায়গায় চোখ আটকে যায় আফিফের, কিছু সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে,
“লকেটটা বাসায় এসে আড়াল করতে ভুলে গেছিলে বুঝি।”

নিশান্তিকা মাথা নত করে রাখে। মুখে আকাশে কালো ঘন মেঘের মত অন্ধকার নেমে আসে।
“একজনকে ওয়াদা দিয়েছি, ভালোবাসা না থাক ওয়াদা এখনো আছে।”

আফিফ আচমকা নিশান্তিকার কোমর জড়িয়ে ধরে। আকস্মিক টানে নিশান্তিকা ভড়কে যায়। চারিদিকে থমথমে পরিবেশ।
“আফিফ কি করছ?”
“হুসস, প্রেম আমাদের দেখছে দাঁড়িয়ে।”

নিশান্তিকা চেয়ে দেখে দেওয়ালের ওপারে গ্রীল ঘেঁষে তাদের দিকে দেখছে।
“তাহলে ধরলে কেন, ছাড়ো।”

নিশান্তিকা ছারানোর চেষ্টা করে। আফিফের কর্মকাণ্ডে রাগ প্রকাশ করে।
“আমি তো তোমার ভালোই করছি?”

আফিফ শক্ত করে ধনে নেয়। অগ্নি চোখে তাকিয়ে থাকে নিশান্তিকা।
“এতে ভালো টা কী?”

“বলছি শুনো, তোমাকে প্রেম আমার সঙ্গে একান্ত দেখলে বুঝবে কোন চক্কর আছে।”
নিশান্তিকা ভাবনায় চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

“এতে করে কি হবে?”

“এতে করে তোমার ভূত ওর মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে। আর জেদের বসে সকালকে বিয়ে করে নিবে।”
“সত্য বলছ?” নিশান্তিকা চুপসে যায়।

“ভরসা রাখ আমার কথায়”

নিশান্তিকা এগিয়ে দু হাত দিয়ে আফিফের গলায় হাত রাখে। কাছাকাছি আগায়। মাথা নেড়ে বলে,
“হুমম, আইডিয়া টি কাজের, তবে সকালের জন্য ওর চোখে জল এসেছে, তুমি দেখলে না।”
“তুমি আসলেই বোকা মেয়ে, ওটা ওর ন্যাকামি ছিল। ড্রামা কিং সাচ্ছে। তোমাকে দেখাচ্ছে।”
নিশান্তিকা চিন্তিত মুখে বলে,
“ও ভুল কিছু করে বসবে না তো?”

“তোমার মত বোকা না সে।”

আফিফের কথার জোর বুঝতে পারেনিশান্তিকা, ঠোঁট ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ আফিফের কথা ভাবে। প্রেমকি তবে সত্যই অভিনয় করছে? শেষ~ মেশ সকালকে বিয়ে করবে তো। অতীতের ভাবনায় ডুবে যায় সে।

সন্ধ্যা নেমে আসছে ক্রমশ। চারিপাশে ঘন অন্ধকার হয়ে আসছে। ঘন মেঘের স্তূপ আকাশে ছেয়ে আছে এখনো। বৃষ্টির গতি বাড়ছে, ঝপাঝপ করে ছাতার উপরে আচরে পরছে। পিচঢালা রাস্তার পানির স্রোত বয়ে চলছে অন্ধকার ড্রেনে। ধূয়ে নিয়ে যাচ্ছে হাজারও পদধূলি। যার ভীতর লুকিয়ে ছিল এক একটি প্রেমের গল্প।
“নিশু, আগামীকাল আমার সঙ্গে যাবে এক জায়গায়।”

নিশান্তিকা মাথা তুলে জিগ্যেস করে,
“কোথায়?”
“বলব কাল, সারাদিন আমরা ঘুরব সেখানে, যাবে?”
“হুমম”

নিশান্তিকা ঘোরের মাঝে মাথা নাড়ে। দুজনেই ঠান্ডায় থরথর কাঁপতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে যায়। প্রেমের কথা সে ভুলেই যায়, সাথে বাড়ি ফেরার কথাও।

সময় যেমন থেমে নেই, তেমনি দুজনের কথার শেষ নেই। নেই কোনো ক্লান্তি, অবসাদ। এভাবেই জনম পার করতে তারা দ্বিধাবোধ করবে না। প্রকৃতির বুকে যেন একজোড়া কপোত~ কপোতী।


চতুর্থ পর্ব

সকালের হাওয়া এখনো ঠাণ্ডা। রাতের বৃষ্টির রেশটা এখনো যায়নি। বড় বড় গাছ~ পালা, মাঠের সবুজ ঘাস, পিচঢালা রাস্তা ভিজে একেবারে ঝকঝকে।

নিশান্তিকা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশ উপভোগ করছিল। রাতের ঘুম বেশ আরামদায়ক হয়েছে। বসন্তকালে বৃষ্টি হওয়া খুব কম দেখেছে সে। দেখলেও মনে নেই। মনে রাখার মত কোন স্মৃতিও নেই। যেখানে স্মৃতি নেই, সে সময় মনে না থাকায় শ্রেয়।

তবে, গত রাতের ছিল। অদ্ভুত সুন্দর কেটেছে। ভাবনাবিহীন শুভ্র সকালের মতই গত রাত পার করেছে নিশান্তিকা।

পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তার অদূরে তার দৃষ্টি। প্রেম কিছু পথশিশুদের নিয়ে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে শিশুদের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। হয়ত কোন মজার গল্প শুনাচ্ছে। প্রেম খুব ভালো গল্প বানাতে পারে। পথশিশুদের হাতে খাবারের প্যাকেট। কারো হাতে বই, খাতা, পেন্সিল। এই কাজটাও প্রেমের করা। এ দৃশ্য প্রতিদিন নিয়ম করে দেখৈ সে। একটি ছেলের হাতে নিশান্তিকার সাদা কালো রঙের ছাতাটাও আছে।
গত রাতে,
সন্ধ্যার পরপর দুজনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, আফিফ দেখতে পেল এক পথশিশু রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। সহসা আফিফ ছেলেটির দিকে ছাতাটি এগিয়ে দিতেই, ছেলেটি ছাতা নিয়ে দৌড়ে চলে গেল। আফিফের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে নিশান্তিকাও।

নিশান্তিকা দেয়ালের ওপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখল, প্রেমের রুমের জানালার থাইগ্লাস বন্ধ। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এদিকে ঝড়ো হাওয়া, ঝুম বৃষ্টি। কাক ভেজা অবস্থায় নিশান্তিকা বাসায় ফিরে এলো। আফিফ তখন খুবই কাঁপছিল, ছেলেটির অল্প ঠাণ্ডার ছোঁয়ায় এলার্জি দেখা যায়।

নিশান্তিকা বেশ কিছুক্ষণ পর রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে রুমের জানালার থাইগ্লাস খুলে দেয়। প্রেম তখনে দাঁড়িয়ে। নিশান্তিকা নিচে নেমে আসে। সকালে গরম গরম খাবার খাওয়া প্রয়োজন। শরীরে এনার্জি আসবে, অন্তত আফিফের জন্য এককাফ গরম কফি বানানো দরকার।

ছ~ বছরের ছেলে নেহাল, কাঁধ থেকে স্কুল ব্যাগ নামিয়ে টেবিলের এক পাশে রেখে বলল,
“গুড মর্নিং আপু, আমার টিফিন রেডি করে দাও। জলদি।”

নিশান্তিকা মিষ্টি হেসে উত্তর দিল,
“মর্নিং সোনা, দু’মিনিট টাইম দাও বাবু।”

“আপু আমি স্কুলে কীভাবে যাব।”

“তোমার ড্রাইভার চাচু চলে এসেছে। তোমায় নিয়ে যাবে।”
“তুমি যাবে না?” নেহাল অভিমানি সুরে বলল।

“হ্যাঁ, যাব। এখন চটজলদি ভদ্রছেলের মত টোস্টটা খেয়ে নাও।” নিশান্তিকা আদুরে গলায় বলে নেহালের গাল টেনে দিল। নেহাল আবেগি স্বরে বলে ওঠল,
“আপু আমি চপস্টিক খাব।”

“আচ্ছা, দুপুরে আমরা রেস্টুরেন্টে খেতে যাব।”

“সত্যি আপু?” নেহাল খুশিতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠল।
“তিন সত্যি।”

নেহাল, নিশান্তিকার প্রাণ। কোন আবদার সে ফেলতে পারে নাহ্। নিশান্তিকা মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে নেহালকে। মনের মাঝে কিছু মিশ্র অনুভূতি নেড়ে ওঠল। মায়েরা এভাবেই সন্তানের যত্ন নেয়। ছোট বেলায় কত না মায়ের কাছে এভাবে আবদার করত। স্মৃতির পাতা মনে পড়তেই চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে।

প্রেম দু~ তালা ভবনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। কলিংবেল চাপতে গিয়েও থেমে দাঁড়াচ্ছে। কিছু কিছু সময় মানুষ অজানা কারণে থেমে যায়। যার কোন উত্তর নেই।

প্রেম কাঁচের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখল, ডাইনিং টেবিলে নেহালকে ইনিয়েবিনিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে নিশান্তিকা। ভাই~ বোনের ভালেবাসার কিছু মুহূর্ত। মন জুড়িয়ে যায় প্রেমের। হাসি মুখে কলিংবেল চাপে, দেয়ালের নেমপ্লেটে তার চোখ থমকে যায় ‘সুখপাখি ভবন’।
প্রেমকে দেখা মাত্রই নেহাল দৌড়ে এসে গলা জরিয়ে বসে। নিশান্তিকা মৃদুস্বরে হেসে প্রেমকে বলে,
“এসো প্রেম, বসো, শুভ সকাল।”

“শুভ সকাল”
প্রেম আসবে ভেবে নিশান্তিকা প্রস্তুতি নিয়েই ছিল, তবে, এসেই যাবে। এতদূর ভাবেনি।
“ব্রেকফাস্ট শেষ?”প্রেম শুকনো হেসে বলল।

“নেহালকে মাত্রই খাওয়াচ্ছি। তুমি কফি খাবে, ঢেলে দেই।”
“হ্যাঁ দেও। আর দুধের গ্লাসটা দাও, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

কফির মগ এগিয়ে দিল নিশান্তিকা, প্রেম পাশে রেখে নেহালকে নিয়ে কথা বলতে থাকল। নিশান্তিকা বলল,
“প্রেম রাতে নেহাল ঘুমাতে পারছিল না। বুকে চেপে রেখে খুব কষ্টে ঘুম পারিয়েছি। নাকের ভিতর পলিপাস বেড়েছে। আজ ডক্টর দেখাতে যাব, তুমি যাবে?”

“আমি একটু ব্যাংকে যাব, টাকা তুলতে হবে। আব্বুদের টাকা পাঠাতে হবে। সময় লাগবে। আমি নাহয় পিক~ আপ করে নিব তোমাদের।”
“হুমম” প্রেমের কথায় নিশান্তিকা মাথা নাড়ায়।

“তুমি গতরাতে ডক্টরকে কল করে ডেকে নিলে না কেন? আমায় বলতে।”

“আসলে, বৃষ্টি ছিল। আচ্ছা, তুমি কফি খাও। নেহাল এসো মেডিসিন নিয়ে আম্মুকে কল দিব। তোমার নিউ টেডিবিয়ার দেখাবে নাহ্।”
“হ্যাঁ দেখাব তো। প্রেম জানু, “
“বলো জানু।”

“আপু আমায় এত্ত বড় টেডিবিয়ার গিফট করেছে।”
“তাই, প্রেম জানুকে দেখাব তো?”
“হ্যাঁ”
“তবে নিয়ে আসো।”

“আপু যাই।” নেহাল দাঁড়িয়ে নিশান্তিকাকে বলে।
“যাও, সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে ওঠবে।”

“ওকে আপু”
প্রেম কফির মগ এগিয়ে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে নিশান্তিকার দিকে তাকাল। ভেবে ভেবে বলল,
“মামুনি গতরাতে আমায় ফোন দিয়েছিল, তোমায় পায়নি তাই।”

“হ্যাঁ, আম্মু বলেছে তোমার কথা। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে।” নিশান্তিকা কাজ করতে করতে উত্তর দিল।
“কি বলল মামুনি।”
“বলল যে সাবধানে থাকতে আর যেন তোমার খেয়াল রাখি।”

প্রেম প্রতি উত্তরে হুমম বলল। নিশান্তিকা সিদ্ধ ডিমটার ওপর বিটলবন ছিটিয়ে দিয়ে, নেহালের টিফিন ব্যাকে ভরে দিল।
“নেহালকে নিয়ে তুমি খুব কনসার্ন থাক।”
নিশান্তিকা উদাস মনে বলে,

“বাবা~ মার অবর্তমানে আমিই ওর সব। নেহাল খুশি থাকলে আমার মাঝে প্রাণ থাকে।”
“হ্যাঁ সে তো দেখতেই পারছি, ডান হাতে মেবি গরম কিছুতে ছ্যাকা লেগেছে।”
নিশান্তিকার ডান হাতের পিটে লাল হয়ে আছে। ছ্যাকটা আসলেই বেশি লেগেছে।
“ও কিছু না। এমনি লাল।”

নিশান্তিকা এরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। প্রেম সহসা বলে ওঠল,
“মেডিসিন লাগিয়ে নিও।”

“কিছু হবে না। আসলে নেহাল কিছু খেতে চায় না। সব সময় বায়না করে। সিদ্ধ ডিমটুকু স্কুলে যেতে যেতে খেয়ে নেয়। মা পাগল ছেলেটা আমার কাছে ভালো আছে এই অনেক।”

নিশান্তিকার কথা মন দিয়ে শুনল প্রেম। মাথা নেড়ে হুমম বলল। প্রেমের অন্যমনস্ক দেখে নিশান্তিকা বলে,
“তুমি ঠিক আছ?”
“হ্যাঁ আছি।”

“কচু আছ।”
ফ্রুটস স্যালাটের প্লেট প্রেমের দিকে এগিয়ে দেয়,
“তোমার জন্য বানিয়েছি, আমি জানি গতরাতেও তুমি কিছু খাওনি।”

প্রেম শুকনো হাসি দেয়। মনে মনে উজ্জীবিত হয়। নিশান্তিকা আবার বলে,
“ঘুম কেমন হয়েছে? সকালের সঙ্গে কথা হয়েছে?”

প্রেমের মুখটা ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে আসে। নিচু স্বরে বলে,
“হুমম হয়েছে। বলব তোমায়।”

নিশান্তিকার হাতটা টেনে নিয়ে মলম লাগিয়ে দেয় প্রেম। হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখে, যেন ছুটে গেলে এখনি হারিয়ে যাবে। নিশান্তিকা চুপটি করে বসে ভাবে, প্রেম কি মলম নিজের কাছে নিয়েই ঘুরে, নাকি ইচ্ছে করেই এনেছে।

পঞ্চম পর্ব

সকালের ঘুম ভেঙেছে খুব ভোরে। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে খুব ভোরে ওঠে বসে সকাল। ঘুম হবেই বা কি করে, ঠিক সময়ে খাওয়া নেই, শরীরের যত্ন নেই, সারাক্ষণ যন্ত্রের মত মন মরা অবস্থায় শুয়ে, বসে থাকে।

গভীর রাতে বুকের ব্যাথায় ছটফট করে, দু চোখ বেয়ে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ে। কেউ দেখেনা সে যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্তটুকু।
ইচ্ছে করে এই ইট~ সিমেন্টর চার দেয়াল ভেঙে বদ্ধ জীবন থেকে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে।

ঘুম ভাঙার পরপর বেশ তৃষ্ণা পেয়েছে সকালের। বিছানা ছেড়ে নেমে জল খেয়ে এসে আবারও ঠাস করে বসে পড়ল। যেন একটি যন্ত্র মানব।

জানালার ছোট ছোট ফুটো দিয়ে ভোরের আলো প্রবেশ করেছে। যার ফলাফল রুমের জায়গায় জায়গায় আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে।
সকাল খুব বিরক্ত হলো, এত অল্প অল্প আলো সে সহ্য করতে পারে না। হয় সম্পূর্ণ আলো থাকবে না হয় সম্পূর্ণ অন্ধকার। কিছুর একটা অভাবে জীবন বিষাক্ত মনে হচ্ছে সকালের।

শেষমেশ রুমের লাইট জ্বালিয়ে নিয়ে, টেবিলে মাথা রেখে বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর উৎফুল্ল হয়ে প্রেমের সাথে কথা বলল। মন হালকা হলো।
কথা শেষে বই নিয়ে বসল। কিছুদিন পরেই এক্সাম ওদের। সকাল ভাবল, অনেকদিন হলো ক্যাম্পাসে যাওয়া হয়নি, আজ সে ক্যাম্পাসে যাবে। প্রাণ খুলে হাসবে। প্রেমের সাথে কথা বলবে, দু~ চোখ ভরে দেখবে। এসব ভাবতেই সকালের মন আনচান আনচান করতে থাকল। হঠাৎ তার মনযোগ ক্ষুণ্ণ হলো বাহিরে কিছু পরে ভাঙার শব্দে।

নিশান্তিকা চুপিচুপি বিছানায় ওঠে বসে। ভেজা চুলগুলো হালকা ঝাঁকি দিয়ে আফিফের মুখের দিকটায় রেখে মাথায় মাথা ঠেকাল। মনে মনে দুষ্টু হাসে।
আফিফ মুখে একপাশ কাধ হয়ে ঘুমিয়ে ছিল। সম্পূর্ণ গায়ে কম্বল চাপানো।

নিশান্তিকা ভেবে ছিল আফিফ ওঠে বসবে, বকা দিবে। কিন্তু অনেক্ষণ হলো, এসবের কিছুই হলো নাহ্। নিশান্তিকা ওঠে বসে। আফিফকে সোজা করে, কম্বল সরিয়ে নেয়। তবুও ছেলের হেলদুল নেই। দুবার হালকা ধাক্কা দেয়। কিছুই হয় না। এখনো সে ঘুমে কাতর।
নিশান্তিকা এবার বিরক্ত হয়। আফিফের ডান হাতে কামর বসিয়ে দেয়।
~ আহ্, নেহাল লাগছে তো।

~ আমি নিশান্তিকা।
~ ওহ্

~ ওহ্! বেশ হয়েছে, লাগছে। এত ঘুম কাতরে কেন তুমি? এখন আমায় কেউ তুলে নিয়ে গেলেও হুসস থাকবে নাহ্।
আফিফ মুচকি হেসে ওঠে বসে।

~ কে নিয়ে যাবে, প্রেম?
নিশান্তিকা আগুন চোখে তাকায়। আফিফ চুপসে গিয়ে আবার শুয়ে পরে।
~ আফিফ!

~ উমম
~ আফিফ লিসেন, দুপুর হতে চলল। খেতে হবে কিছু নাকি
আফিফ মাথা তুলে বলে, মাত্র ৯টা বাজে।
~ তো?
~ দুপুর হলো কই!

~ আফু, ৯টা বাজে, বুঝতে পারছ, ৯টা। ভোর হয় সেই পাঁচটায়।
~ ধুর, আপু ডাকছ কেন? আরেকটু ঘুমাতে দাও।
~ আফিফ, আমি আফু ডেকেছি, আপু নয়।
~ ঐ একই হলো।

নিশান্তিকা বিরক্ত হয়ে দমে গেল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল।

~ আচ্ছা টাইগার শরফের মত এত স্ট্রং টাইশেপস~ বাইশেপস বানালে কীভাবে?
আফিফ মুচকি হেসে বলল,
~ হুহ্ কোথায় টাইগার শরফ আর কেথায় আফিফ মাহিয়াম।

নিশান্তিকা একপ্রকার ফোঁস করে ওঠল,
~ আবার, নিজেকে টাইগারের সাথে তুলনা করছ। ওয়েট দেখাচ্ছি মজা। দাদুননন
আফিফ ধরফরিয়ে ওঠে দাঁড়ায়।

~ দাদু কোথায়? দাদুকে ডাকছ কেন?

আফিফের ভয়ার্ত চেহারা দেখে নিশান্তিকা হেসে কুটিকুটি। নিশান্তিকার হাসির প্রভাবে আফিফ বুঝে গেল, সে এখন নিশান্তিকার বাসায়। এখানে দাদুন কীভাবে আসবে!

~ খুব না খুব হাসি পাচ্ছে। তোমার এই হাসিহাসি মুখখানা দেখার জন্য প্রেমকে ডেকে আনি।
~ যত পারো চেঁচাও, প্রেম আসবে না।

নিশান্তিকা স্বাভাবিক হয়ে যায়। সঙ্গে আফিফও। নেহালকে না দেখতে পেয়ে জিগ্যেস করে,
~ নেহাল কোথায়, নেহাল?
~ বাসায় নেই।

নিশান্তিকা হাসি থামিয়ে আনে। আফিফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
~ প্রেম এসে ওকে স্কুলে নিয়ে গেছে।
~ ওহ্।
আফিফ মাথা ঝুলিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
~ তারমানে নিশান্তিকা, বাড়ি সম্পূর্ণ ফাঁকা।

আফিফের চাহনি দেখে নিশান্তিকা বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়িয়ে, নড়েচড়ে ঘাটের কোনে গিয়ে দাঁড়ায়।
~ বাড়ি ফাঁকা, তো তো কি হয়েছে?
আচমকা আফিফ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।

~ হাউ ফিল ম্যাডাম, বলো বলো, ভয় লাগছে?
~ মোটেই না।

নিশান্তিকা তবুও ভয় পাচ্ছে। তুতলে যাচ্ছে বারংবার। বুকের ভিতর ধুকধুক করছে।
আফিফ আচমকা নিশান্তিকার ভয়ার্ত চেহারা দেখে চুপসে গেল।
~ নিশু, কি হয়েছে। আমি মজা করছিলাম বোকা মেয়ে।

নিশান্তিকা গম্ভীর হয়ে যায়। কঠিন স্বরে বলে,
~ আফিফ, ওয়াশরুমে যাও। আমাদের তারাতাড়ি বের হতে হবে।
আফিফ মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে এগোতে থাকে। নিশান্তিকা দূর থেকে টাওয়াল ছুড়ে মারে। আফিফ হেসে ওঠে।
~ সাওয়ার নিবে নাহ্ একদম।
~ উহু, পাক্কা এক ঘন্টা।

~ তবে রে
আফিফ ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দেয় চটজলদি। ভিতর থেকে চেঁচিয়ে বলে,
~ নিশু, মোবাইল চার্জে বসাও। ফাস্ট।

~ আগে সরি বলো। তারপর ভেবে দেখব।
আফিফ মুচকি হেসে সরি বলে।
ওকে, সরি সরি সরি। পাগলী একটা।

নিশান্তিকা ফুলদানিতে কিছু রজনীগন্ধার গুচ্ছ ফুল রেখে দুষ্টুমি করে চলে যাচ্ছিল। থেমে দাঁড়িয়ে, কিছু একটা ভেবে মোবাইল চার্জে বসায়। চার্জে দিতেই অন মোবাইল হলো, আর ফোন অন হতেই দীপ্তের এসএমএস আসতে লাগল অহরহ।
নিশান্তিকা বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল

ষষ্ঠ পর্ব

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখল আফিফ। এক ঝাপটা পানি দিল মুখে। প্রশান্তি ছুঁয়ে গেল চোখ মুখে। একটু আগের নিশান্তিকার বোকা বোকা চেহারার ভাবটা মনে করে আফিফ মুচকি হাসল। নিশান্তিকাকে তুতলানোর সময় কি বোকাটাই লাগছিল।
রুম থেকে কিছু পরে যাওয়ার আওয়াজ পেল
আফিফ।

দুবার নিশান্তিকা বলে ডেকেও সড়া পেল না। চোখ মুখে প্রশান্তি মেলাতে আরেক বার পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
নিশান্তিকার কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে আফিফ থমকে দাঁড়ালো। আফিফকে দেখা মাত্র নিশান্তিকার গলা পাকিয়ে এলো কান্নায়, হুট করে কেঁদে ওঠে নিশান্তিকা।

আফিফ এগিয়ে এসে নিশান্তিকার বাহুডোর চেপে ধরে,
~ নিশু, এই কান্না করছ কেন? কি হলো, এই বোকা মেয়ে।
নিশান্তিকা কাঁপা হাতে মোবাইল এগিয়ে দিল, ম্যাসেজ অপশনে দীপ্তের নাম দেখে আফিফ হকচকিয়ে গেল। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে মোবাইল বিছানায় ছুড়ে মারল।

~ নিশু, কান্না থামাও বলছি। একদম কাঁদতে না। দীপ্ত এমনি, পাগল ছেলে। ছাড়তো ওর কথা। নিশু প্লিজ। সকালবেলা মুড অফ করছ কিন্তু এবার।

নিশান্তিকা চুপিচুপি একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আফিফের কথার মানে সে কিছুই বুঝছে না। দীপ্তর ম্যাসেজ কি সে দেখেনি। এখনো স্বাভাবিক রিএক্ট করছে!

~ দী দীপ্ত তোমার দাদিমাকে নিয়ে হসপিটালের আছে। দাদিমা রাতে স্টোক করেছে।

নিশান্তিকার কাটা কাটা বাক্যের কথায় আফিফের দম বন্ধ হয়ে আসল। বিছানায় বসে পরল ধপাস করে, হাত থেকে টাওয়াল টা নিচে পরে গেল।

হসপিটালের বারান্দায় গ্রিল ধরে মাথা নীচের দিকে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আফিফ। দীপ্ত করিডোর দিয়ে হেঁটে এসে আফিফের কাঁধে হাত রাখে। এতটুকু সময়ের মাঝে আফিফের মুখ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। যেন সে কত দিনের ক্লান্ত পথিক। মুখে কোনো আনন্দের অনুভূতি চিহ্ন নেই।

আফিফের ভরসার হাত দীপ্ত। ভাই হোক বা বন্ধু হিসেবে, সব সময় পাশে পেয়েছে। আফিফের আপন পরিবার বলতেই যে দীপ্ত আর দাদিমা। আফিফ সোজা দাঁড়িয়ে ক্ষীণ আওয়াজ করল।

~ দীপ্ত!
~ ভয় নেই, দাদিমা এখন আউট অফ ডেঞ্জার।

দীপ্ত সহসা বলে ওঠল। আফিফ মাথা ঝুলিয়ে নিচু স্বরে বলল।

~ খুব ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল দাদিমার হাসি মুখটা দেখতে পাব তো? আমার অনুপস্থিতিতে দাদিমার কিছু হয়ে যেত, তবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না কখনও।

~ দেখ, দাদিমার বয়স হয়েছে, রেস্টের প্রয়োজন। তোকে নিয়ে সব সময় কনসার্ন থাকেন। গত রাতেও এ নিয়ে আলোচনা করেছে।
আফিফ জোরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঘুরে দাঁড়িয়ে গ্রিলে পিঠ ঠৈকায়। দেখতে পায় নিশান্তিকা চুপচাপ করিডোরের এক কোনে বসে আছে।

একজন নার্স এসে জানায় পেসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে, প্রশান্তি হেসে ছলছল চোখে আফিফের দিকে তাকায় নিশান্তিকা। আফিফ মৃদু হেসে ইশারা দেয়, নিশান্তিকা চোখের জল মুছে কেবিন নম্বর ১৩ রুমে ঢুকে।

~ তুই গতরাতে নিশান্তিকার বাসায় কাটিয়েছিস, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারছি না।
দীপ্তের কথায় ক্ষোভ প্রকাশ স্পষ্ট।

দীপ্ত সহসা উঁচু গলায় বলে ওঠে,
~ আমি ওকে নিয়ে কিছুই ভাবছি নাহ্। ভাবছি তুই কতটা বদলে গেছিস। তুই আমার বন্ধু ছিলি? একটি শান্ত শিষ্ট অমিশুক ছেলে একটি মেয়ের বাসায় রাত থাকার সাহস দেখাতে পারে। সে আমার বন্ধু আফিফ নয়।

দীপ্ত খুব বিরক্ত আফিফের কর্মকাণ্ডে। কাছের বন্ধুর বদলে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারে না, দীপ্তও পারছে না। আফিফ বুঝতে পারে দীপ্ত খুব রাগ করেছে। খুব বেশি।

~ সরি দীপ্ত। আমি
আফিফকে থামিয়ে দিয়ে দীপ্ত বলে,
~ তোর মুখে সরি মানায় না আফিফ। তুই ভুল করছিস।

আফিফ মুচকি হেসে দীপ্তের কাঁধে হাত রেখে বলে,
~ পরিস্থিতি আমায় বাধ্য করেছিল দীপ্ত।

দীপ্ত এড়িয়ে যাওয়ার মত বলল,
~ কি বলতে চাস, খোলাখুলি বল।

আফিফ যেন এটাই চাইছিল, একটা সুযোগ। মুচকি হেসে বলে ওঠে,
~ তখন সন্ধ্যা রাত, মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা দুজনে গেটের একট দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ভিজে গেছিলাম প্রায়।
~ বাহ্। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজছিলি।

দীপ্ত ব্যঙ্গ সুরে বলল। আফিফ সহসা বলে ওঠল,
~ নিশু আমায় ছাতা দিতে এসেছিল। আমি আটকে রেখেছিলাম ওকে। সেই সময় বৃষ্টি বেড়ে যায়। হঠাৎ দেখি
আফিফ থেমে দীপ্তের দিকে তাকায়। দীপ্তের চোখ মুখে উদগ্রীব হয়ে আছে।

~ তারপর?
দীপ্ত এবার কথায় মনোযোগ দেয়। আফিফ দীপ্তের আগ্রহ বুঝতে পেরে মনে মনে হেসে বলতে থাকে একের পর এক ঘটনা।

~ হঠাৎ দেখি, দুটি ছেলে গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। খুব সতর্ক সহকারে। হাতে কিছু একটা ছিল। অন্ধকারে বুঝা যাচ্ছিল না।

দীপ্ত চমকে ওঠে। ভয় পায় সহসা। কোন খারাপ কিছু শুনার অপেক্ষার সময় যেমন মানুষ ভয় পায়, ঠিক তেমনি হচ্ছে দীপ্তের মাঝে। আফিফকে নিয়ে সব সময় সে টেনশনে থাকে।

~ কি বলিস, তারপর
~ অদ্ভুত, আমরা এগিয়ে যেতেই ছেলে দুটি অন্ধকারের আড়ালে মিলিয়ে গেল। হয়ত চলে গেছিল।

দীপ্ত শুনে কিছুক্ষণ থেমে বলল,
কিন্তু, তোরা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলি কেন? বৃষ্টি ছিল, বাসায় চলে যেতি।
আফিফ থেমে যায় দীপ্তের কথায়। এখন সে কি বলবে। প্রেমের বিষয় কথাটা কি বলা উচিত হবে।

হায় আল্লাহ, এ কি ভাবছে সে। তার মাঝে কি তবে সত্যি পরিবর্তন এসেছে। নিজের কলিজার টুকরো বন্ধুর থেকে সে কথা লুকাতে চাইছে। কিন্তু এখানে তো যুক্তি আছে। বিষয়টা নিশান্তিকা জড়িত। বিষয়টি আফিফের হলে এত ভাবতে হত না তার।

দীপ্ত আফিফের এক পাশে হালকা ঝাঁকি দিয়ে আবার জিগ্যেস করে। প্রেমের বিষয় বলে দেয় আফিফ। দীপ্তের চোখ মুখে কঠিন ভাব আসে।
তখনি নিশান্তিকা কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে

সপ্তম পর্ব

নিশান্তিকা কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। আফিফ মুচকি হেসে গলার স্বর নীচে নামিয়ে কথা বলে দীপ্তের সাথে। নিশান্তিকা দূরে দাঁড়িয়ে ডাকে,
~ আফিফ
~ হ্যাঁ
~ দাদিমা এখন সুস্থ আছে, তুমি এসো।

~ আসছি।

আফিফ হাতের ইশারায় বলে আসছি। নিশান্তিকা আবার কেবিন নম্বর ১৩ রুমে ঢুকে যায়।
নিশান্তিকা চলে যাওয়ায় দীপ্ত আবার কথায় মনোযোগ দেয়।
~ তারপর, কি হলো?

~ তারপর, নিশান্তিকা কাঁপছিল, ভয়ে নয়তো ঠান্ডায়। আমার চেপে ধরল। তখন আমি কি করে একা ছেড়ে আসতাম, তুই বল।
আফিফ মুখ তুলে দীপ্তের চোখের দিকে তাকায়। দীপ্ত সহসা কিছু বলে না। পরবর্তী অংশ বলতে বলে।

~ বাসা সম্পূর্ণ ফাঁকা। ওকে নিয়ে গেট বন্ধ করে বাসায় গেলাম। নেহাল এসে আকরে ধরল।

বৃষ্টি হচ্ছে বলে, নেহালকে যে দেখাশোনা করত, সেও চলে গেল। রুমে এসে মাথা মুছে ভাবছি, এখন কি করব। ফোনটাও বন্ধ, বৃষ্টির মাঝে আমি বেরিয়ে যাই, তবে মাঝ পথে খোঁজ নিতেও পারব না। ভয় হচ্ছিল, যদি নিশান্তিকা নেহালের কোনো বিপদ হয়!

আফিফের কণ্ঠে উৎকন্ঠা। তবুও দীপ্ত নিজের জায়গায় সচল। কঠিন সুরে বলল,
~ তাই ভেবে থেকে গেলি, হুহ্!

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসে। দীপ্তকে বুঝাতে পারছে না। কি করেই বা পারবে, যদি দীপ্ত না বুঝে। আসলে আমরা সকলে নিজ নিজ জায়গা থেকে সঠিক ভেবে বসে থাকি। অন্যর ভাবনাটা আমাদের সাথে মিলতে চায় না। আফিফ আবার বলে,

~ নিশান্তিকা এসে অনুরোধ কলল, যাতে থেকে যাই। নেহালও ছাড়ছিল না। আর জানিস, আমার মনে হচ্ছে রাতে ঐ দুটি ছেলে ঢিল ছুড়েছে।
দীপ্ত ভ্রু কুঁচকে ওঠল,
~ ঢিল ছুড়েছিল?
~ হ্যাঁ
~ ঔ ছেলে দুটি?
~ হয়ত, অন্ধকারে স্পষ্ট দেখি নি। তবে, ছেলে ছিল।

~ আচ্ছা আমি বিষয়টি দেখছি।
আফিফ মাথা ঝুলিয়ে হাসে। খুশি হয়।

~ তবে, আফিফ, নিশান্তিকার বাবা~ মা এসে যদি এসব জানতে পারে তখন কিন্তু বিষয়টি হাতের বাহিরে চলে যাবে।
~ দীপ্ত, আমি তখন এতকিছু ভাবিনি, ওদের সেইফ করাটাই মাথায় ঘুরছিল।

~ কিন্তু, তুই ভুলে যাচ্ছিস, প্রেম জানে। হয়ত ওই এসব করেছি।

আফিফ মুচকি হেসে ঠাণ্ডা মাথায় দীপ্তকে বুঝায়।

~ দীপ্ত, ভাই আমার, তুই বেশি ভাবছিস। প্রেম এসব কেন করবে, আর কেনই বা বলবে?
~ ভুলে যাস না, প্রেমের সাথে এক সময় ওই মেয়েটার রিলেশন ছিল।

~ একটা সময় ছিল, এখন নেই। নিশান্তিকা খুব সিরিয়াস টাইপের মেয়ে, প্রেমের জীবনে ও আর কোনে দিন ফিরবে না। ট্রাস্ট মি।
দীপ্ত তবুও ভাবে। তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু এসবের মাঝে জড়িয়ে যাচ্ছে। সে মানতে নারাজ।

~ আফিফ আমি সত্যই এত কিছু জানতে চাই না, ভাবতে চাই না। তবে,
~ তবে,
~ তুই নিশান্তিকাকে নিয়ে বেশ সিরিয়াস, সেটা বুঝতে পারছি, ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছিস। বিষয়টি আমায় খুব ভাবাচ্ছে।
দীপ্তের কথার অর্থ আফিফ বুঝতে পারে। বুকে সাহস সঞ্চয় করে সহসা বলে,
~ আমিও সত্যিই জানি না, ভালোবাসা হারালে মানুষ কি ভাবে বাঁচে। তবে নিশান্তিকাকে হারালে আমি মরেই যাব।

দীপ্ত যেন পাথর হয়ে গেছে। নড়ছে না, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে সে আটকে আছে। যে ছেলে নিজের কিসে ভালো বুঝেনা, সে অন্যর জন্য মরার কথা ভাবছে। তার বন্ধুকে সে মরতে দিবে না, কথা বলতে গিয়েও পারল না, গলাটা শুকিয়ে থমকে আছে।
~ আফিফ!

আফিফ অপরাধীর মত মাথা নীচু করে রেখে ধীরে ধীরে বলল,
~ আমি সরি দীপ্ত, তোর কথা মানতে পারিনি, নিশান্তিকাকে আমি সত্যিই খুব ভালোবাসি। মন সায় দিল, এ মানুষটাকে ভালোবাসা যায়, ছিঁড়া যায়, আনন্দের সাথে সময় কাঁটানো যায়, নিশ্চিন্তে পাশে বসিয়ে দূর দিগন্তে পারি দিয়া যায়। যতটা পরিমান ভালোবাসা যায়, আমি ততটাই বেশি ভালোবাসি।
দীপ্ত বাকরুদ্ধ। যে ছেলেটা সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে থাকত, কথা বলতে পছন্দ করত না, অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলতে পারত না, আজ সে ভালোবাসার কথা কত অনায়াসেই বলে দিল।
~ বিয়ে করবি নিশুকে?

আচমকা দীপ্তের মুখে এ কথা শুনে আফিফ চমকে ওঠল। যেন অবিশ্বাস্য। দীপ্ত সহসা উঁচু স্বরে হেসে ওঠে বলে,
~ কি রে বল। লজ্জা পাচ্ছিস, ছোট বেলার মত।
আফিফ মুচকি হেসে মাথা নিচু করে রাখে। লজ্জা পেয়েছে সে।

~ পারলে তো এখনি করে নিতাম। ওর সামনে ভালোবাসি বলতে চাইলেই গলা আটকে আসে।
~ আব্বে, বোকা ছেলে, যখন তখন ভালোবাসার কথা কেউ বলে নাকি।
আফিফ মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে বলে,
~ ভালোবাসি বলব নাহ্।

~ বলবি তো, তবে স্পেশাল থিওরি দিয়ে।
~ থিওরি! সেটা কি।

~ শুন আমি বুঝিয়ে দিব। তুই শুধু প্রস্তুতি নিয়ে বলবি, কবে বলবি। আর শুন, ঔই মেয়েটি যদি তোর ভালোবাসা গ্রহণ না করে, তবে আমি ওখানেই মেরে পুঁতে রাখব। বলে দিলাম।

আফিফ উঁচু স্বরে হেসে ওঠে দীপ্তের পাগলামি দেখে। একটু আগেও যে কিনা শাসন করছিল।
~ হ্যাঁ, ভালোবাসি খুব, বলে দিব।

দুপুর চারটে,
চারটে বেজে গেছে, সকাল এখনো ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে। বারোটা থেকে সে প্রেমের অপেক্ষায় বসে আছে, অথচ প্রেমের আসার খবর নেই। এতদিন পর সে সুযোগ পেয়েছে, বাসা থেকে বেরিয়ে প্রেমকে একনজর দেখার। সময় যেতে থাকল ক্রমশ, বাসায় ফিরলে রাগ ঝারবে সবাই, তবুও বসে আছে প্রেমের অপেক্ষায়।

চারটা বিশে ক্যাম্পাসে এসে গাড়ি থেকে নামল প্রেম। এতক্ষণ তার সাথে নিশান্তিকা আর নেহাল ছিল। হসপিটাল থেকে ওদের পিক~ আপ করে রেস্তোরাঁয় গিয়েছে, এরপর শপিংমল। বাসায় পৌঁছে দেওয়ার সময়ও প্রেম বলেনি নিশান্তিকাকে সকালের সঙ্গে দেখা করবে। কারণ, নিশান্তিকা জানলে তাকে তখনি আসতে হত। যেই সময়টা প্রেম হাতছাড়া করতে চায় নি।

প্রেমকে দেখা মাত্র সকাল দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। দু~ চোখ ভরে নোনাজল গড়িয়ে পরল প্রেমের বুকে।
~ এত লেট করলে কেন? কত কষ্ট হচ্ছিল জানো।
~ সরি, তেমায় আর কষ্ট পেত দিব না।

সকাল মাথা তুলে তাকিয়ে বলল,
~ আমি তোমার কাছে চলে আসব প্রেম।

প্রেম মুচকি হেসে সকালের গালে লাগা জল মুছে দেয়। হাতের শপিং ব্যাগ সকালের হাতে দেয়।
~ এতে কি আছে?
~ দেখো।

ব্যাগে বেনারসি আর কিছু অর্নামেন্টস আছে। সকাল ছলছল চোখে প্রেমের দিকে তাকায়। আবারও জড়িয়ে ধরে শক্ত হাতে।
প্রেম খেয়াল করে সকাল আগপর থেকে শুকিয়ে গেছে। শরীরের যত্ন নেই। চোখ দুটি কোটরের ভিতর চলে গেছে। চোখের নিচে কালি জমেছে, হাত পা মুখ বিবর্ণ কালচে দেখাচ্ছে।
~ সকাল, আমায় একটু সময় দিবে এখনি।

~ এখনি। সকাল ভিজানো গলায় বলল। প্রেম জোর দিয়ে বলল,
~ হ্যাঁ এখনি
~ কিন্তু বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যাবে।
~ আমি তোমায় পৌঁছে দিব।

~ হ্যাঁ, কিন্তু, কোথায় যাব।

~ চলো, আমার বাসায়।
সকাল মাথা নেড়ে প্রেমের সাথে গাড়িতে গিয়ে বসে।

অষ্টম পর্ব

ভোর হয়েছে, পিচঢালা রাস্তায় হালকা কুয়াশার বুকে হিরহির হাওয়া বয়ে চলছে।

ভোর পাঁচটা বাজে। দীপ্ত সবাইকে নিয়ে পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রেম গিয়েছে সকালকে এগিয়ে আনতে। সামনেই কাজির বাসায় যাবে সকলে।

নিশান্তিকা দাদিমার কাছে নেহালকে রেখে এসেছে। আফিফ ঘুমের কারণে ঢলতে ঢলতে নিশান্তিকার হাত ধরে হেঁটে এসেছে এতদূর।
গতকাল রাত ৮টায় দাদিমাকে নিয়ে বাসায় ফিরেছে আফিফ। নিশান্তিকা সেখানেই উপস্থিত ছিল। যাতে খুব ভোরে দুজনে মিলে সকালকে নিয়ে কাজির বাসায় পৌঁছাতে পারে।

গভীর রাত পর্যন্ত দুজনে গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছে। যার ফলাফল আফিফের ঘুম পূর্ণ হয় নি।
~ এই আফিফ, এবার ওঠে দৌড় দে নয়তো
দীপ্তের কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না আফিফ। হাই তুলে চোখ ডলতে ডলতে বলল,
~ ওদের বিয়ের কাজ শেষ? আমরা যাই তবে।

দীপ্ত সহসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকায় আফিফের দিকে। আফিফ মাথা ঝুলিয়ে নিচু স্বরে বিরবির করে। নিশান্তিকার দিকে তাকিয়ে দেখে, সে ঠোঁট টিপেটিপে হাসছে। আফিফ সহসা বোকাসোকা ভাবে চলে যায়।

নিশান্তিকার মন মেজাজ আজ বেশ ফুরফুরে। লাল শাড়ি পরেছে, চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে লিপিস্টিক লাগিয়েছে, দু~ হাতে কাঁচের চুরি। ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা, যদিও সে আফিফের কথায় সেজেগুজে এসেছে। যেন এক শুভ্র নির্মল নিষ্পাপ লাল টকটকে কনে পরী।
নিশান্তিকার হাত চেপে ধরল আফিফ। হাত দিয়ে ইশারায় দেখালো প্রেম সকালকে নিয়ে এগিয়ে আসছে। আফিফ হাত চেপে হাঁটার গতি বাড়ালো।
~ আফিফ, ওরা আসছে। আমায় টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ।

~ নিশু, গতরাতে বলেছিলাম তোমায় একটা জায়গায় নিয়ে যাব, সেখানেই।

দুজনেই কুয়াশার বুকে লুকিয়ে গেল। দীপ্ত প্রাণ খুলে হাসলো। নিশান্তিকা কত সহজেই আফিফের সাথে মেতে আছে। এটা দেখে সে খুশি হয়েছে ভীষণ। বন্ধুর সুখের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে, এ সময় তাকে যে পাশে থাকতেই হতো।

ছোট একটি গার্ডেন বাড়ি। চারপাশে শুধু ফুলের সমাহার। একটি বেঞ্চে আফিফ আর নিশান্তিকা বসে আছে। ফুলের সুবাসের হাওয়া বয়ছে ধীরে ধীরে।
চারপাশে ফুলের টপ, কিছু ফুলের গাছ লাগানো। ফুলের সুবাসে টানে উড়ে এসে কলির ওপর বসেছে উড়ন্ত ভ্রমর। নিশান্তিকার চোখ আটকে যায় রঙ্গন ফুলের ওপর। কি সুন্দর ছোট ছোট পাপড়ি, লাল টকটকে।

নিশান্তিকা এ বাড়িতে আগেও এসেছে। বহুবার এসেছে। প্রথম যেদিন এসেছিল, সেদিন দেখা হয়েছিল
আফিফের সঙ্গে। বেঞ্চে চাদর মুড়িয়ে শুয়ে আছে একটি ছেলে, উষ্কখুষ্ক চুল, বিবর্ণমুখ, বিষেদে ভরপুর দু~ চোখে।

বেঞ্চের সামনেই ছিল একটি কবর। কবরের পাশে ছিল, লাল সাদা রঙের গোলাপ ফুল। গোলাপের পাপড়িগুলো একের পর এক ঝরে পড়ছিল কবরের ওপর। সেদিন জানতে পারে কবরটি আসলে আফিফের মায়ের। প্রায়শই এখানে সে রাত কাটায়।

নিশান্তিকা সেদিনের পর থেকে প্রায় আসা যাওয়া করত। কিন্তু আফিফের দেখা মিলত নাহ্। খুব মায়া হতো আফিফের মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে। যারা ভালোবাসার কাঙাল হয়, তারা অনেক মায়াবী মুখের হয়। শান্ত গঠন, খুব সহজ সরল। আফিফ সেরকমই একটি ছেলে। এক অজানা মায়ার টানে নিশান্তিকা বারবার এখানে আসত।

হঠাৎ একদিন পিচঢালা রাস্তায় দেখা হয় দুজনের। এরপর ক্যাম্পাসে, বইমেলায়, নেহালের স্কুল গেটে। আফিফ বলত, ফুলের টপ দিতে এসেছে, তাই শুনে নিশান্তিকা মনে মনে হাসত। ছোট ছোট কথায় কথায় দুজনের মাঝে গড়ে ওঠে এক গভীর মমতার বন্ধুত।

তুমি আমার বর্ণনাহীন প্রেম প্রেয়সী,
আমার হৃদয়ের অব্যক্ত ভালোবাসা।

তুমি তো লতাবিহঙ্গের মত জড়িয়ে থাকা,
আমার অনুভূতিতে শিহরণ জাগানো আশা।
রজনীগন্ধার মন মাতানো সুবাসের মতো,
আমাকে মোহিত করে তোমার অনুভব।

গোলাপের পাপড়ির আলতো স্পর্শের মতো,
তোমার ছোঁয়ায় আমি যেন ভুলে যাই সব।
ঝিনুকের বুকে লুকিয়ে থাকা মুক্তোর মতো,
তোমার মাঝেই আমি ডুবে যেতে চাই।

আমি যে তোমার চাতক পাখি,
তোমার হৃদয় খাঁচায় দিও গো ঠাঁই।

তোমাতেই আমার ভানার সমাপ্তি হয়,
তুমিই তো আমার কল্পনার পারম্ভীকা।

তোমাকে তোমার চেয়েও বেশি ভালোবাসি,
তুমিই তো আমার ভালোবাসা নিশান্তিকা।
(সিহাব আহমেদ)
নিশান্তিকা অস্থির ভাব প্রকাশ করল। আফিফ হুট করে এত কিছু উপহার দিবে, ভাবতেও পারে নি। বেশ কিছুক্ষণ পর নিশান্তিকা নিচু স্বরে বিরবির করে বলল,
~ কবিতার শব্দগুলো খাপছাড়া হয়ে গেল না, লেখক সাহেব!

আফিফ হেসে নিশান্তিকার হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

~ আমি মানুষটি যে খাপছাড়া, তাই আমার কবিতা গুলোও খাপ বিহীন।
মজার ছলে নিশান্তিকা বলে ওঠে,
~ লাগাম ধরতে দিচ্ছেন না কেন, কাউকে?
~ তোমায় তো বলছি, ধরছ না কেন!

দমে যাওয়ার মেয়ে নিশান্তিকা নয়, সেও জোর কদমে বলে,
~ আপনি তো লেখক মানুষ, হাজারও মেয়ে আপনার প্রেমে দেওয়ানা, একপ্রকার পিছনে লাইন লেগে আছে। একজনকে ধরিয়ে দিন।

~ প্রিয়, তাদের যে তোমার মত দীঘল কালো কেঁশ নেই, নীল হরিণী চোখের মায়া নেই, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ছায়া নেই, খাড়া নাকের ডগায় লাল বিন্দু নেই, আলতা রাঙা পায়ের নূপুরের ঝনঝন শব্দ নেই, কোমল হাতের স্পর্শ নেই, মোলাম গোলাপি ঠোঁটের মুচকি হাসি নেই। ভালোবাসি বলার নরম মিষ্টি সুরের কণ্ঠ নেই। তাদের ভালোবাসি কি করে বলো!

~ ওহ্! আচ্ছা। এতেই আমার ভালোবাসার কারণ। যদি হয়ত বা আমি কুৎসিত হতাম, তখন
নিশান্তিকার অভিমান হয়। তাই সে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। যদিও সে আফিফের প্রশংসায় আপ্লুত হয়েছে।
আফিফ মুচকি হেসে বলে,
~ হুম হয়ত বা তুমি আমার চোখেই পরতে না।

~ সত্যি কি তাই? নিশান্তিকার অভিমান গাঢ় হয়।
~ সত্যি তাই, এটাই বাস্তব।

~ যেদিন আমার বয়স হয়ে যাবে, তখন তো কুঁকড়ানো সাদা চুল হবে, চোখের জ্যোতি কমে যাবে, দৃষ্টির ছায়া হারিয়ে য়াবে, মোলাম ঠোঁটে শুষ্কতা বিরাজ করবে, কণ্ঠে আসবে রুক্ষতা, কোমল হাতের স্পর্শ হবে খসখসে, তখন
~ ততদিনে তোমার ভালোবাসার আঙিনায় আমি ছেয়ে যাব। মধুর তৃষ্ণা মিটে যাবে। শখ আল্লাদ ধীরে ধীরে থেমে যাবে। তোমার কোলে মাথা রেখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার অপেক্ষার প্রহর গুনব।

নিশান্তিকা আজও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখে আফিফের চোখ ~ মুখে। অদ্ভুত এক মায়া, কত সুন্দর ভাবে পাগলামিতে মেতে থাকে প্রেমিক পাগল ছেলেটা। প্রেমিক পাগল না~ হলে এমন ভাবে এ কথা কেউ, কখনো, কোনদিন কাউকে বলেছে? এত ভালোবাসে ছেলেটা তাকে!
সে কি তার ভাগ্যলিখনে লেখা আছে!

আফিফ মুচকি হেসে নিশান্তিকার হাত দুটো বুকের বা পাশে আগলে রেখে বলে,
~ তোমায় এত ভালোবাসি যে প্রথম দিনের চুম্বনটি হুট করেই দিয়েছিলাম সহজেই। ভুলেই গেছিলাম আমার প্রতি মুহূর্তের ভালোবাসার মানুষটিকে বলাই হয়নি, ভালোবাসি। প্রতি মুহূর্তে তোমার অনুভূতি, কেয়ারিং আমায় আগলে রাখতে যে ভুলেই গেছিলাম আমি তোমার কাছে অধিকারের দিক থেকে অপরিচিত। অথচ, তুমি আমার হৃদয় জুড়ে সবটা আছো। আমার ভালোবাসা নিশান্তিকা।

আফিফের অনুভূতি প্রকাশে নিশান্তিকা বাকরুদ্ধ। এতটা প্রশান্তি সে কোনোদিন উপভোগ করে নি। আজ তাদের সম্পর্কের একটি পরিচয় হলো। আফিফের হৃদয়ের ধুকধুক কাঁপনিতে নিশান্তিকার হার্টবিট জোড়ছে ধকধকানি বাড়তে থাকলো। এত লজ্জায় সে কখনোই পড়ে নি।
আফিফ লাল শাড়ির আচল টেনে ঘোমটা দিয়ে দিল নিশান্তিকার মাথায়। নিশান্তিকা লজ্জা পেয়ে নত মাথায় বসে রইল।
~ বাহ্, ঘোমাটায় তোমায় সত্যি নতুন বউ বউ লাগছে।

নিশান্তিকা লজ্জা রাঙা মুখে মুচকি হাসে। গালদুটো রঙ্গন ফুলের মত লাল টকটকে হয়ে যায়।

অষ্টম পর্ব

ভোর হয়েছে, পিচঢালা রাস্তায় হালকা কুয়াশার বুকে হিরহির হাওয়া বয়ে চলছে।

ভোর পাঁচটা বাজে। দীপ্ত সবাইকে নিয়ে পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রেম গিয়েছে সকালকে এগিয়ে আনতে। সামনেই কাজির বাসায় যাবে সকলে।
নিশান্তিকা দাদিমার কাছে নেহালকে রেখে এসেছে। আফিফ ঘুমের কারণে ঢলতে ঢলতে নিশান্তিকার হাত ধরে হেঁটে এসেছে এতদূর।
গতকাল রাত ৮টায় দাদিমাকে নিয়ে বাসায় ফিরেছে আফিফ। নিশান্তিকা সেখানেই উপস্থিত ছিল। যাতে খুব ভোরে দুজনে মিলে সকালকে নিয়ে কাজির বাসায় পৌঁছাতে পারে।

গভীর রাত পর্যন্ত দুজনে গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছে। যার ফলাফল আফিফের ঘুম পূর্ণ হয় নি।
~ এই আফিফ, এবার ওঠে দৌড় দে নয়তো
দীপ্তের কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না আফিফ। হাই তুলে চোখ ডলতে ডলতে বলল,
~ ওদের বিয়ের কাজ শেষ? আমরা যাই তবে।

দীপ্ত সহসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকায় আফিফের দিকে। আফিফ মাথা ঝুলিয়ে নিচু স্বরে বিরবির করে। নিশান্তিকার দিকে তাকিয়ে দেখে, সে ঠোঁট টিপেটিপে হাসছে। আফিফ সহসা বোকাসোকা ভাবে চলে যায়।

নিশান্তিকার মন মেজাজ আজ বেশ ফুরফুরে। লাল শাড়ি পরেছে, চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে লিপিস্টিক লাগিয়েছে, দু~ হাতে কাঁচের চুরি। ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা, যদিও সে আফিফের কথায় সেজেগুজে এসেছে। যেন এক শুভ্র নির্মল নিষ্পাপ লাল টকটকে কনে পরী।

নিশান্তিকার হাত চেপে ধরল আফিফ। হাত দিয়ে ইশারায় দেখালো প্রেম সকালকে নিয়ে এগিয়ে আসছে। আফিফ হাত চেপে হাঁটার গতি বাড়ালো।
~ আফিফ, ওরা আসছে। আমায় টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ।

~ নিশু, গতরাতে বলেছিলাম তোমায় একটা জায়গায় নিয়ে যাব, সেখানেই।

দুজনেই কুয়াশার বুকে লুকিয়ে গেল। দীপ্ত প্রাণ খুলে হাসলো। নিশান্তিকা কত সহজেই আফিফের সাথে মেতে আছে। এটা দেখে সে খুশি হয়েছে ভীষণ। বন্ধুর সুখের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে, এ সময় তাকে যে পাশে থাকতেই হতো।

ছোট একটি গার্ডেন বাড়ি। চারপাশে শুধু ফুলের সমাহার। একটি বেঞ্চে আফিফ আর নিশান্তিকা বসে আছে। ফুলের সুবাসের হাওয়া বয়ছে ধীরে ধীরে।
চারপাশে ফুলের টপ, কিছু ফুলের গাছ লাগানো। ফুলের সুবাসে টানে উড়ে এসে কলির ওপর বসেছে উড়ন্ত ভ্রমর। নিশান্তিকার চোখ আটকে যায় রঙ্গন ফুলের ওপর। কি সুন্দর ছোট ছোট পাপড়ি, লাল টকটকে।

নিশান্তিকা এ বাড়িতে আগেও এসেছে। বহুবার এসেছে। প্রথম যেদিন এসেছিল, সেদিন দেখা হয়েছিল
আফিফের সঙ্গে। বেঞ্চে চাদর মুড়িয়ে শুয়ে আছে একটি ছেলে, উষ্কখুষ্ক চুল, বিবর্ণমুখ, বিষেদে ভরপুর দু~ চোখে।

বেঞ্চের সামনেই ছিল একটি কবর। কবরের পাশে ছিল, লাল সাদা রঙের গোলাপ ফুল। গোলাপের পাপড়িগুলো একের পর এক ঝরে পড়ছিল কবরের ওপর। সেদিন জানতে পারে কবরটি আসলে আফিফের মায়ের। প্রায়শই এখানে সে রাত কাটায়।

নিশান্তিকা সেদিনের পর থেকে প্রায় আসা যাওয়া করত। কিন্তু আফিফের দেখা মিলত নাহ্। খুব মায়া হতো আফিফের মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে। যারা ভালোবাসার কাঙাল হয়, তারা অনেক মায়াবী মুখের হয়। শান্ত গঠন, খুব সহজ সরল। আফিফ সেরকমই একটি ছেলে। এক অজানা মায়ার টানে নিশান্তিকা বারবার এখানে আসত।

হঠাৎ একদিন পিচঢালা রাস্তায় দেখা হয় দুজনের। এরপর ক্যাম্পাসে, বইমেলায়, নেহালের স্কুল গেটে। আফিফ বলত, ফুলের টপ দিতে এসেছে, তাই শুনে নিশান্তিকা মনে মনে হাসত। ছোট ছোট কথায় কথায় দুজনের মাঝে গড়ে ওঠে এক গভীর মমতার বন্ধুত।

তুমি আমার বর্ণনাহীন প্রেম প্রেয়সী,
আমার হৃদয়ের অব্যক্ত ভালোবাসা।

তুমি তো লতাবিহঙ্গের মত জড়িয়ে থাকা,
আমার অনুভূতিতে শিহরণ জাগানো আশা।

রজনীগন্ধার মন মাতানো সুবাসের মতো,
আমাকে মোহিত করে তোমার অনুভব।

গোলাপের পাপড়ির আলতো স্পর্শের মতো,
তোমার ছোঁয়ায় আমি যেন ভুলে যাই সব।
ঝিনুকের বুকে লুকিয়ে থাকা মুক্তোর মতো,
তোমার মাঝেই আমি ডুবে যেতে চাই।

আমি যে তোমার চাতক পাখি,
তোমার হৃদয় খাঁচায় দিও গো ঠাঁই।

তোমাতেই আমার ভানার সমাপ্তি হয়,
তুমিই তো আমার কল্পনার পারম্ভীকা।

তোমাকে তোমার চেয়েও বেশি ভালোবাসি,
তুমিই তো আমার ভালোবাসা নিশান্তিকা।

(সিহাব আহমেদ)
নিশান্তিকা অস্থির ভাব প্রকাশ করল। আফিফ হুট করে এত কিছু উপহার দিবে, ভাবতেও পারে নি। বেশ কিছুক্ষণ পর নিশান্তিকা নিচু স্বরে বিরবির করে বলল,
~ কবিতার শব্দগুলো খাপছাড়া হয়ে গেল না, লেখক সাহেব!

আফিফ হেসে নিশান্তিকার হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
~ আমি মানুষটি যে খাপছাড়া, তাই আমার কবিতা গুলোও খাপ বিহীন।

মজার ছলে নিশান্তিকা বলে ওঠে,
~ লাগাম ধরতে দিচ্ছেন না কেন, কাউকে?

~ তোমায় তো বলছি, ধরছ না কেন!

দমে যাওয়ার মেয়ে নিশান্তিকা নয়, সেও জোর কদমে বলে,
~ আপনি তো লেখক মানুষ, হাজারও মেয়ে আপনার প্রেমে দেওয়ানা, একপ্রকার পিছনে লাইন লেগে আছে। একজনকে ধরিয়ে দিন।
~ প্রিয়, তাদের যে তোমার মত দীঘল কালো কেঁশ নেই, নীল হরিণী চোখের মায়া নেই, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ছায়া নেই, খাড়া নাকের ডগায় লাল বিন্দু নেই, আলতা রাঙা পায়ের নূপুরের ঝনঝন শব্দ নেই, কোমল হাতের স্পর্শ নেই, মোলাম গোলাপি ঠোঁটের মুচকি হাসি নেই। ভালোবাসি বলার নরম মিষ্টি সুরের কণ্ঠ নেই। তাদের ভালোবাসি কি করে বলো!

~ ওহ্! আচ্ছা। এতেই আমার ভালোবাসার কারণ। যদি হয়ত বা আমি কুৎসিত হতাম, তখন
নিশান্তিকার অভিমান হয়। তাই সে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। যদিও সে আফিফের প্রশংসায় আপ্লুত হয়েছে।
আফিফ মুচকি হেসে বলে,
~ হুম হয়ত বা তুমি আমার চোখেই পরতে না।

~ সত্যি কি তাই? নিশান্তিকার অভিমান গাঢ় হয়।

~ সত্যি তাই, এটাই বাস্তব।
~ যেদিন আমার বয়স হয়ে যাবে, তখন তো কুঁকড়ানো সাদা চুল হবে, চোখের জ্যোতি কমে যাবে, দৃষ্টির ছায়া হারিয়ে য়াবে, মোলাম ঠোঁটে শুষ্কতা বিরাজ করবে, কণ্ঠে আসবে রুক্ষতা, কোমল হাতের স্পর্শ হবে খসখসে, তখন

~ ততদিনে তোমার ভালোবাসার আঙিনায় আমি ছেয়ে যাব। মধুর তৃষ্ণা মিটে যাবে। শখ আল্লাদ ধীরে ধীরে থেমে যাবে। তোমার কোলে মাথা রেখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার অপেক্ষার প্রহর গুনব।

নিশান্তিকা আজও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখে আফিফের চোখ ~ মুখে। অদ্ভুত এক মায়া, কত সুন্দর ভাবে পাগলামিতে মেতে থাকে প্রেমিক পাগল ছেলেটা। প্রেমিক পাগল না~ হলে এমন ভাবে এ কথা কেউ, কখনো, কোনদিন কাউকে বলেছে? এত ভালোবাসে ছেলেটা তাকে!
সে কি তার ভাগ্যলিখনে লেখা আছে!

আফিফ মুচকি হেসে নিশান্তিকার হাত দুটো বুকের বা পাশে আগলে রেখে বলে,
~ তোমায় এত ভালোবাসি যে প্রথম দিনের চুম্বনটি হুট করেই দিয়েছিলাম সহজেই। ভুলেই গেছিলাম আমার প্রতি মুহূর্তের ভালোবাসার মানুষটিকে বলাই হয়নি, ভালোবাসি।

প্রতি মুহূর্তে তোমার অনুভূতি, কেয়ারিং আমায় আগলে রাখতে যে ভুলেই গেছিলাম আমি তোমার কাছে অধিকারের দিক থেকে অপরিচিত। অথচ, তুমি আমার হৃদয় জুড়ে সবটা আছো। আমার ভালোবাসা নিশান্তিকা।

আফিফের অনুভূতি প্রকাশে নিশান্তিকা বাকরুদ্ধ। এতটা প্রশান্তি সে কোনোদিন উপভোগ করে নি। আজ তাদের সম্পর্কের একটি পরিচয় হলো। আফিফের হৃদয়ের ধুকধুক কাঁপনিতে নিশান্তিকার হার্টবিট জোড়ছে ধকধকানি বাড়তে থাকলো। এত লজ্জায় সে কখনোই পড়ে নি।

আফিফ লাল শাড়ির আচল টেনে ঘোমটা দিয়ে দিল নিশান্তিকার মাথায়। নিশান্তিকা লজ্জা পেয়ে নত মাথায় বসে রইল।
~ বাহ্, ঘোমাটায় তোমায় সত্যি নতুন বউ বউ লাগছে।

নিশান্তিকা লজ্জা রাঙা মুখে মুচকি হাসে। গালদুটো রঙ্গন ফুলের মত লাল টকটকে হয়ে যায়।

দশম পর্ব

আজ সোমবার, সকাল বেলা, সময় ৮টা।

সকালের মৃত্যুর দুই দিন হয়েছে। সেদিনের সেই মুহূর্ত টুকু মনে পড়লে নিশান্তিকার শরীরে ভয়ংকর শিহরণ জাগে। নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু এত বড় অস্বাভাবিক একটি ঘটনা ঘটে গেল যে, নিশান্তিকার চিন্তা ভাবনা ক্রমশ জট পাকিয়ে আসে।

প্রত্যেকের জীবনে একটি দাগ কেটে গিয়েছে সকালের মৃত্যুতে। এ দাগ কি কোনোদিন মুছবে নাকি আরো ক্ষত~ বিক্ষত করবে! নিশান্তিকা সেটা জানে না। এসব সে ভাবতে চায় না। গত দুদিনের সময় সে মনে রাখতে চায় না।

গত ৭২ ঘন্টায় প্রত্যেকের জীবন পাল্টে গেছে। চাইলেও ভুলা সম্ভব নয়। অথচ এমনটা হওয়ার আশা ছিলনা। বিধাতা তার ভাগ্য নিয়েই কেন এত খেলে। ৷ নিশান্তিকা ভাবতে পারেনা, মাথা ব্যাথায় কুঁকরে ওঠে। বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়িয়ে দোতালায় পৌঁছায়।

বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ায় নিশান্তিকা, চোখের দৃষ্টি তার পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তার শূন্য পথে।
নিশান্তিকার বুকের মাঝে ধুকপুক ধুকপুক করে, শূন্যতায় কেউ আঘাত হানে, চিরচির ব্যাথা অনুভব করে সে।
এমন কোনো সকাল ছিল না, ঐ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পথশিশুদের সঙ্গে প্রেমকে দেখেনি। হাতে থাকতো খাবারের প্যাকেট, আর আদর্শ লিপির বই।
এই নিয়মিত নিয়মটি যেন প্রেমের জীবনের বাধ্য নিয়ম ছিল। আর এ দৃশ্যর প্রতিদিনের সাক্ষী হতো নিশান্তিকা। সকালবেলা চোখ খুলে পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তার চিত্রটি ছিল নিশান্তিকার চোখের একটি অঙ্কিত দৃশ্য। যা কখনো ভুলে যাওয়া দুঃসাধ্য।

আর আজ, এখন যা ধোয়াশা। এমন দৃশ্য তার চোখে আর কোনোদিন পরবে কি! প্রেম সেই আগের মত হেঁটে এসে পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়াবে!
নিশান্তিকা অস্থির হয়ে উত্তর খুঁজে। কে দিবে জীবনের এ উত্তর। বুকের মাঝে খুব বেশি ব্যাথা অনুভব করে সে। উত্তর পায় না। শুধু ভাবে।
আফিফ দরজার কোণে দাঁড়িয়ে দাদিমাকে এক পলক দেখে বিরবির করে ডাকে,
~ দাদিমা

আনোয়ারা বেগম নামাজের চকিতে বসে বসে তসবিহ হাতে গুনছিলেন।
ভোর হয়েছে। পূর্ব আকাশে সূর্য কিরণময় ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। কিছু মুহূর্ত বাদেই হয়ত পৃথিবী রৌদ্রজ্বল হয়ে ওঠবে।
নাতির সুর পেয়ে তিনি চোখ তুলে তাকালেন, কাছে ডাকলেন সহাস্যে।
~ আয়, আমার কাছে আয় ভাই।

বাড়িটা দোতালা, নিচতলায় ডয়িংরুম সহ দুটি বেডরুম। একটি ছোট আকারের রুমে আনোয়ারা বেগম নামাজের ঘর বানিয়েছেন। একপাশে ছোট একটি বিছানা, অন্যপাশে জানালা, জানালা ঘেঁষে নামাজের চকি।

একটি আলমারি, আর দুটি বইয়ের তাক। পূর্ব দিকের এই জানালাটি ভোরের আগে খোলা হয়। আনোয়ারা বেগম চকিতে বসে বসে দিনের আলো ফুটা দেখেন আর তসবিহ গুনেন। এসব তার প্রতিদিনের রুটিন।

দিনের অর্ধেক সময় তার এখানেই কাটে। বাকিটা সময় নিচের গার্ডেনে। এ ভাবেই সময় কাটাতে সে পছন্দ করেন। মাঝে মাঝে বইয়ের তাক দেখে ইসলামিক বই, উপন্যাস, কবিতা পড়েন। বয়স প্রায় ষাট বছর। বেশি চাপ নিতে বা সহ্য করতে পারেন নাহ্।

তবে এর মাঝে নিজের প্রাণপ্রিয় নাতির খেয়াল তিনি ঠিকই রাখেন। এক নজর আড়াল হলেই তিনি ছটফট করে।

~ দাদিমা, তোমার শরীর কেমন আছে? আফিফ হেঁটে এসে আনোয়ারা বেগমের কোল ঘেঁষে বসে, মাথাটা এলিয়ে দেয় কোলের আঁচলে। আফিফের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন আনোয়ারা বেগম, একমাত্র স্নেহের ছায়া তার। তিনি সহাস্যে জবাব দেন।
~ আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। দাদুভাই, তুমি ঠিক নেই, তাই না।

~ নেই দাদিমা, আমি ঠিক নেই। কিছুই ঠিক নেই।
আফিফ অস্থির গলায় জবাব দেয়।
~ দাদুভাই, মনের অস্থিরতা দূর করো। শক্ত হও।

আফিফ আবারও ছটফটিয়ে উঠে অস্থির ভাবে বলে,
~ পারছি না দাদিমা, নিশুর বিধস্ত মুখের চাহনি আমি আর দেখতে পারছি না। আমি পারছি না নিশুর আবদার, আক্ষেপ মেনে নিতে।
আফিফের অসহায় কণ্ঠে আনোয়ারা বেগম কেঁপে ওঠেন, ভয় সংশয় বাড়ে মনে মনে। কি বলে সান্ত্বনা দিবেন তিনি।
~ দাদুভাই, তুমি নিশুকে ফিরিয়ে দিয়েছ গতকাল?

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কান্নায় গলা আটকে আসে। আনোয়ারা বেগমকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। জড়ানো গলায় বলে,
~ উপায় ছিল না দাদিমা।

~ ভুল করলে দাদুভাই, ওর মন খুব নরম, ওর দূর্বল জায়গায় তুমি ভয় পাইয়ে দিছো।
আনোয়ারা বেগম কেঁপে ওঠেন, নিজের মাঝেও অস্থিরতা কাজ করে। আফিফ শক্ত কণ্ঠে বলে,
~ কিন্তু ওকে লড়তে শিখতে হবে।

~ তোমাকে ওর পাশে প্রয়োজন।
আনোয়ারা বেগম আফিফের মুখ দু হাতপর মুঠোয় নিয়ে বলেন। আফিফ সহসা জবাব দেয়।
~ আমি আড়াল থেকে সব সময় ওর পাশে আছি।

আফিফের মাথায হাত বুলিয়ে দেন, ঠোঁটে হাসি এঁকে কথা বলেনআনোয়ারা বেগম। গতকাল নিশান্তিকা এসেছিল, সেই কথোপকথন আফিফের থেকে শুনেন। আফিফকে সান্ত্বনা দেয়, বুঝান। ৷ নিশান্তিকা ভয় পেয়ে তার কাছে ছুটে এসেছে।
~ কিসের ভয় নিশুর!

আফিফের প্রশ্নের উত্তর দেয় আনোয়ারা বেগম।
~ তোমাকে হারানোর ভয় দাদুভাই, তোমাকে। ওর মন খুব নরম, অল্পতেই ভয় পায়। ও ভয় পেয়েছি, যদি তোমায় হারিয়ে ফেলে।
আফিফ অন্যমনস্ক হয়ে বলে,
~ সত্য বলছ দাদিমা।

~ এটাই সত্যি, ও তোমায় ভালোবাসে। যদি হারিয়ে ফেলে সেই ভয়ে ছুটে এসেছে।
~ কিন্তু দাদিমা নিশুর এখন প্রেমের পাশে দাঁড়ানো উচিত। আমি ওকে সেটাই বুঝিয়েছি।
আনোয়ারা বেগম সহসা বলেন,
~ ওর হয়ত সেখানেই ভয়। মেয়েটা দূর্বল প্রকৃতির।

আফিফ ভাবনায় পড়ে যায়। কোনো কথা খুঁজে পায় না মনে, এখন সে কি বলবে। নিশান্তিকা কি সত্যি তার জীবন থেকে এক সময় চলে যাবে! আফিফ ভেবে পায় না। সে কি তবে গতকাল নিশুকে ফিরিয়ে দিয়ে ভুল করেছে! কি এমন চেয়েছিল মেয়েটি, শুধু বুকের বা পাশে সারাক্ষণ ঠাঁই। সব সময় নজরের আলখাল্লায় বন্দী রাখতে।

আফিফের ভাবনা দেখে আনোয়ারা বেগম সহসা হেসে বলেন,
~ সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। সময়ের উপর ছেড়ে দাও। এত ভেবোনা।
আফিফ অন্যমনস্ক হয়েই বিরবির করে বলে,
~ সত্য বলছ, সব ঠিক হয়ে যাবে!

~ দাদিমার কথায় ভরসা আছে তো তোমার।
~ হুমমম

আফিফ মাথা তুলে মাথা নাড়ে। আবার চোখ বুঝে পরম যত্নে দাদিমার কোলে মাথা রেখে বসে। ২৫টা বছর এই কোল তাকে ছায়া দিয়েছে, রক্ষা করেছে৷ মা~ বাবা মমতায় বড় করেছে, ছায়া হয়েছে। আদর যত্নে ভরিয়ে রেখেছে। কোনোদিন বুঝতে দেয়নি সে অনাথ। আসলেই তো, সে অনাথ কীভাবে হয়। যার সাথে এমন মমতাময়ী দাদিমা থাকে, সে কোনোদিন অনাথ হতে পারে না। আফিফ অনাথ নয়। তার সঙ্গে দাদিমা আছে।
নিশান্তিকা রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসে থাকে। প্রেমকে কি বলবে সে।

এগারো পর্ব

নিশান্তিকা রিপোর্ট হাতে নিয়ে নিস্তব্ধত বসে থাকে। প্রেমকে কি বলবে সে? এত প্রসার প্রেম কীভাবেই বা নিবে! নিশান্তিকা ভাবনা চিন্তা শেষ করপ ফাইল ড্রয়ারে রেখে দেয়। সময় হলেই সে প্রেমকে জানাবে, এর আগে নয়।

জানালার পর্দাটা সরিয়ে নেয় নিশান্তিকা। দিনের আলো এসে আলোকিত ভরিয়ে দেয় রুমের ভিতর। থাইগ্লাস এক পাশে খুলে দেয়। এক ফালি রোদ এসে পড়ে ঘরের মেঝেতে। সকালের হাওয়া বয়ে যায় চারপাশে। আহ্, ক্ষণিকের প্রশান্তি।

বিছানায় নেহাল আর প্রেম ঘুমিয়ে ছিল। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে নেহাল ওঠে বসল। দু হাতের মুঠো দিয়ে চোখ ডলে হাই তুলল কয়েকবার। নিশান্তিকাকে দেখা মাত্রই হেসে ওঠে।

~ গুড মর্নিং আপু। আমার আজ খুব ভালো ঘুম হয়েছে।
নেহালকে বুকে জরিয়ে নেয় নিশান্তিকা। সযত্নে আগলে রাখে বাহুডোরে।
~ মর্নিং সোনা। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।
~ এখনি
~ হ্যাঁ, বেলা বাড়ছে।

~ ওকে, এখনি যাচ্ছি। গিভ মি 5মিনিট,
নেহাল মুখে হাত দিয়ে ভেবে মাথা ঝুলিয়ে আবার বলে,
~ নো নো 10মিনিটস।

নিশান্তিকা উচ্চ স্বরে হেসে ওঠে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
~ ওকে, মাই ডিয়ার ভাই।

নেহাল ওয়াশরুমে চলে যায়। দু’জনের কথোপকথনে প্রেম চোখ মেলে তাকালো, তবে ওঠে বসল না। আবার চোখ বুঝে ঘুমানো ভাবে চলে গেল। নিশান্তিকা এগিয়ে এসে প্রেমের পাশে বসল, মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে আর পিঠে হাত রাখল।
~ প্রেম, প্রেম, ওঠে বসো। সোজা হও। প্রেম
প্রেমের জাগানো উপস্থিতি বুঝতে পারে নিশান্তিকা।

~ আহ্ প্রেম। কথা শুনো আমার, অনেক বেলা হয়েছে।

প্রেম সোজা হয়ে টানটান হয়ে শুয়ে থাকে। নিশু প্রেমের কপালে আবার হাত রাখে। সস্তির শ্বাস ছেড়ে বলে,
~ জ্বরটা হয়ত একেবারেই নেই। গতরাতে বুঝেছিলাম, জ্বর কমে আসছে। এখন কেমন লাগছে তোমার?

প্রেম কিছু বলে না। চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। নিশান্তিকা কিছু বলার সাহস পায় না। এ দু~ দিনে সে অনেক কথাই বলেছে, প্রেম কিছু বলেনি, শুধু শুনেছে। মানসিক আঘাতে সে বেশ বিধস্ত হয়েছে। সকালের মৃত্যু তাকে এক গভীর যন্ত্রণার সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। উপরের দিক থেকে দেখা যায়, মানুষ গুলো স্থির, শক্ত। অথচ ভিতর থেকে সকলে এক অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, ভেঙে পরেছে, বিধস্ত হয়েছে বহুবার। সবার আগের পৃথিবীটাই যেন বদলে গেছে। এক নতুন জগতের পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে তারা।

নেহাল এসে নিশুর সামনে দাঁড়ায়। নিশু টাওয়াল দিয়ে নেহালের হাত মুখ মুছে দেয়। নতুন জামা পড়িয়ে দেয়। প্রেম নির্বাক চেয়ে চেয়ে দেখে। নেহাল মাঝে মাঝে নিজের কথা বলে। হাসে, মাথা ঝুলায়। সে এখন এ বাড়িতে খুশি ব্যক্তি। কারণ, প্রেম তার সাথে থাকে। আপু তার পাশে থাকে সব সময়, বাসা থেকে আর বের হয় না।

তাকে স্কুলেও যেতে হয় না। এসবের পিছনে কারণ সে জানতেও চায় না। তার মনে আনন্দ হচ্ছে, এর থেকে বেশি কিছু সে চায় না। জানতে চায় না তার প্রেম জানু হঠাৎ কেন অসুস্থ হয়ে এ বাড়িতে থাকে। আগেরবার জোর করলেও যে থাকতে না, সেটা সে খুশিতে ভুলে যায়।
~ আপু,
~ হুমম
~ আমি আজ নিজেই ব্রাশ করে নিয়েছি।

~ এই তো আমার গুড বয়ের মত কাজ।
~ আমি বড় হয়ে যাচ্ছি বলো আপু।

নিশান্তিকা হেসে ওঠে,
~ হ্যাঁ, আমার ছোট্ট ভাইটা বড় হয়ে ওঠছে দিনে দিনে।
নেহাল আপ্লুত হয়ে হেসে হেসে আবার বলে,

~ আব্বু ~ আম্মু এসে দেখবে, আমি এত্ত বড় হয়ে গেছি। বলো।
নিশান্তিকা, নেহালকে রেডি করা শেষ হলে বলে,

~ হ্যাঁ, তোমায় খুব আদর করবে। এখন নিচে যাও, খাবার রেডি আছে।
~ তুমিও চলো।
~ আমি তোমার প্রেম জানুকে নিয়ে আসছি।

~ ওকে আপু, প্রেম জানুু, তুমি জলদি ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো।

নেহাল নিচে চলে যায়। নিশান্তিকা মনে মনে অনেক কথা ভেবে নিজেকে প্রস্তুতি নিয়ে প্রেমের পাশে বসে।
~ প্রেম ওঠ, ওঠে বসো। ফ্রেশ হয়ে কিছু খেতে হবে তোমাকে।

প্রেম কিছু বলল না। নিশান্তিকা আবার বলল,
~ প্রেম ওঠ, ওঠে বসো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, মেডিসিন নিতে হবে, তার জন্য কিছু খেতে হবে তোমাকে।

প্রেম ওঠে বসে খাটের ওপাশে হেলান দিয়ে নির্বাক চেয়ে দেখে, তবুও কিছু বলে না। নিশান্তিকা এবার বিরক্ত হয়। মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।
একটা মানুষের সামনে কতক্ষণ বসে বসে কথা বলা যায়, যদি সে কথা বলতে আগ্রহ না থাকে। তবুও নিশান্তিকা যথা সম্ভব শান্ত হয়ে বসে বলে,
~ তোমার শরীর কি দূর্বল লাগছে, মাথা যন্ত্রণা করছে না তো, বলো। কি হলো, বলো।

প্রেম কিছু বলল না। নিশান্তিকা এবার চরম বিরক্ত হয়। এসব আর সে নিতে পারছে না। অসুস্থ মানুষ টি যদি না বলে কিসে তার খারাপ লাগছে তাহলে তাকে সুস্থ কীভাবে করবে সে।

নিশান্তিকা ওঠে দাঁড়িয়ে শক্ত হয়ে মুখের উপর বলে দেয়,
~ আর কত জ্বালাবে আমায়, আমি ট্রায়াড ফর ইয়োর কোম্পানি।
প্রেমের মাঝে কোনো পরিবর্তন সে দেখতে পায় না।
~ ধ্যাৎ

নিশান্তিকা চলে যেতে চাইলে প্রেম খপ করে ডান হাত ধরে ফেলে, নিশান্তিকা কিছুটা চমকে ওঠে ঘুরে তাকায়। প্রেম মাথা তুলে বলে,
~ মাত্র আড়াইদিন জ্বালিয়েছি, এর মাঝেই বিরক্ত হয়ে গেলে!

আকষ্মিক প্রেমের রুক্ষ স্বরে এমন কথায় নিশান্তিকা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বিধস্ত মুখের চাহনি, চোখ~ মুখ শুকনো, মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে প্রেমের।

নিশান্তিকা অন্য হাত নিজের কপালে ঠেকায়। প্রেমের হঠাৎ এমন রুপে নিশান্তিকা থমথমে হয়ে যায়। এখন কি বলবে সে, এমন পরিস্থিতি আসবে সে কখনো কল্পনাও করে নি। কি বলে দিল সে? মুখ ফুসকে কথা বলাটি যদি সে ফিরিয়ে নিতে পারত, তাহলে বোধহয় এই পরিস্থিতি থেকে সে মুক্তি পেত।

এত এত টেনশন, পারিপার্শ্বিক ঝামেলা, কিছু কিছু ঘটনা মেনে নেওয়ার চাপের মুখোমুখিতে নিশান্তিকা বিরক্ত হয়ে ওঠছে, মেজাজ সব সময় খিটখিটে হয়ে থাকে। আর সামলে ওঠতে পারছিল না। তবুও এমন ভাবে কথা বলা উচিত হয় নি। উত্তেজনায় মুখ ফুসকে বেরিয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে কোথাও কোনো প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছে না সে। তার এখন একটু প্রশান্তি প্রয়োজন। প্রেম কবে তাকে বুঝবে!

প্রেম হাত চেপে রাখায় নিশান্তিকা খুব ব্যাথা পাচ্ছিল। কথা বলার বাহানা পেয়ে নিশু বলল,
প্রেম, ব্যাথা লাগছে, হাতটা ছাড়ো।

প্রেম একবার হাতের দিকে তাকিয়ে আবার নিশান্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দেয়। নিশান্তিকা সস্তি পেয়ে প্রেমের পাশে বসে মুখটা ফ্যাকাসে নিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে,
~ না আসলে, তুমি কোনো উত্তর দিচ্ছেলে না, তাই বিরক্ত লাগছিল কিছুটা।

প্রেম শুধু শুনে যায় কিছু বলে না। নিশান্তিকা স্বাভাবিক হয়ে মুচকি হেসে বলে,
প্রেম, যা হবার ছিল, হয়ে গেছে। আমাদের এতে কারো হাত নেই। তুমি নিজেকে সামলে নেও। নিজের জন্য হলেও স্বাভাবিক জিবনে ফিরে আসো।
প্রেম গম্ভীর মুখে বলে,

~ হুমমম, আর কিছু বলবে না।
নাহ্। নিশান্তিকা না সূচক মাথা ঝাকায়। এতটুকু সে বলতে পেরেছে সেই ঢেরবেশি।
প্রেম স্বাভাবিক গলায় নিশান্তিকার সাথে আলোচনা করছে।
~ উকিল এসেছিল।

~ হ্যাঁ, গতরাতে। আমার সাথে কথা হয়েছে।
~ তোমায় এত ট্রেস নিতে কে বলেছে। আমায় জানাতে।

~ তুমি এমনিতেই সিক। তাছাড়া বিষয়টি পারিবারিক। সেক্ষেত্রে আমি দায়িত্ব নিতেই পারি।
~ ভুল বললে, বিষয়টা আমার। আমায় জড়িয়ে।

নিশান্তিকা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে,
~ সেটুকু বুঝার ক্ষমতা তোমার নেই।

~ যাইহোক, উকিল কি বলল।
~ সেটা কি এখনি জানতে হবে।

আমি নিশান্তিকাকে থামিয়ে প্রেম বলে,
~ হ্যাঁ তো কখন? আমায় জানতে হবে। আমি এখন সুস্থ আছি। বিষয়টি দেখার সময় হয়েছে।
নিশান্তিকা বিরক্ত সুরে বলে,
~ পুরোপুরি সুস্থ হও। তারপর ভাবা যাবে। এখনি এত চাপ নিতে হবে না।

~ নিশু, আমি এখন সুস্থ, উকিল কি বলল
~ না ঠিক নেই। সম্পূর্ণ সুস্থ হও। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।

প্রেম আর কিছু বলে না। নিশান্তিকাও বলে না। আজ তার ভালো লাগছে, প্রেম স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে এখন। প্রেমের এখন সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া প্রয়োজন, শক্ত হওয়া প্রয়োজন। না~ হলে সকালের মৃত্যুর রহস্য সে সমাধান করতে পারবে না।

প্রেমই তাকে একনাত্র সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু প্রেমকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে, চোখের সামনে সব কিছুই যে ধোয়াশা। নিশান্তিকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবনায় মত্ত ছিল, তখনি নেহাল এসে পিছন থেকে কোমরে হাত রেখে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়। ভয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। নিশান্তিকা হতবিহ্বল দাঁড়িয়ে থাকে, পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করে,
প্রেম বিছানা ছেড়ে এগিয়ে আসে।

লেখনীতে – মেহরুন্নেছা সুরভী

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “তুমি আমি – Valobashar romantic premer golpo” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – তুমি আমি (শেষ খণ্ড) – Valobashar romantic premer golpo bangla

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *