মাঝপথে – Notun sad love story Bangla

মাঝপথে – Notun Sad love story bangla: সাফওয়ানের বউ হয়ে এসেছে অনি। কোনো প্রকার হই হুল্লোড় সাজ সজ্জা ছাড়া নরমাল ভাবেই। তিহি তার কোলে ঘুমিয়ে আছে। মায়ায় লেপ্টে আছে চেহারা। গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। মনে হচ্ছে আজ কতোদিন পর শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে সে


পর্ব ১

“আমার ডিভোর্স চাই অনি!”
আয়ুশের মুখে চার শব্দের কথা টা শুনে অনিতার হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। আয়ুশ চমকে উঠে নি বরং চোখে মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলেছে। অনিতার শাশুড়ি সেলিনা বেগম রেগে তেড়ে আসেন এবং গর্জে বলে উঠেন,

“ভাঙ্গ ভাঙ্গ সব ভেঙ্গে ফেল। আর তো কিছু করতে পারবি না। এখন নিজের রাগ জেদ সব ঘরের জিনিসপত্রের উপর ই দেখা।”
সেলিনা বেগম চলে গেলেন। অনিতা মাথা তুলে একবার আয়ুশের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত করে বললো,

“আমি ডিভোর্স দিতে পারবো না তোমাকে আয়ুশ!”
কথাটা আয়ুশের শুনতে যতটা না সময় লেগেছিলো তার থেকে অনিতার গালে থাপ্পড় পড়তে বেশী সময় লাগে নি। থাপ্পড় খেয়ে আর নিজেকে সামলাতে পারে নি অনিতা। অপ্রস্তুত ভাবে পড়ে গিয়ে মাথায় ছোট খাটো চোট লেগে যায়। সেই চোট থেকে তরল জাতীয় কিছু চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। অনিতা কাঁপা কাঁপা হাতে

কপালের চোট লাগা অংশে হাত দিয়ে দেখে রক্ত। অসহায় দৃষ্টিতে আয়ুশের দিকে তাকায় সে। এই অসহায়ত্ব অনেক কিছুই জানান দিতে চায় আয়ুশ কে কিন্তু আয়ুশের চোখে চরম বিরক্তির ছাপ অসহায়ত্বের ছিটেফোঁটা ও তার চোখে পড়ছে না। রেগে যায় আয়ুশ।

“আমি আর পারছিনা এতো প্যারা নিতে! এই বাড়িতে তুমি আমার জন্য বিশাল বড় একটা ঝামেলার সৃষ্টি করছো। ভালো থাকতে পর্যন্ত দিচ্ছো না আমাকে? কেন হ্যাঁ? তোমার জন্য আমার মা আর বোনের কাছে কথা শুনতে হচ্ছে এর কারণ টাই মূলত তুমি! মরা বাবা টাকে নিয়ে আর কিছু বললাম না! ঐ একটা

মানুষের ত্যাড়ামির জন্য আমার তোমার মতো গাইয়া একটা মেয়ে কে বিয়ে করতে হয়েছে। আমি এতো কিছু জানিনা এবার আমার মুক্তি চাই ব্যাস। যদি হিতে বিপরীত হয় আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না মনে রেখো তুমি!”

আয়ুশ অনিতার মুখের উপর কথা গুলো বলে বেরিয়ে যায়।
অনিতা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আয়ুশ চলে যেতেই কাজে মেয়ে ময়না দৌড়ে আসে। অনিতার কপালে রক্ত দেখে হকচকিয়ে উঠে বললো,

“ভাবী আফনের কপাল থেইকা তো রক্ত পড়তাছে তাড়াতাড়ি যান ব্যান্ডেজ কইরা নেন!”
ময়নার কথাটা আয়ুশের বোন আদ্রি শুনে বললো,
“ও আচ্ছা আমার ভাইয়ের পাশাপাশি মেয়ে টা তোমাকেও জাদু করেছে তাই না। যত্তসব আজাইরা সিনেমা দেখতে হয় আমাকে!”

ময়না ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। এই বাড়িতে অনিতা ছাড়া বাকি ৩ টা মানুষ ই পিষাচের মতো। আয়ুশের বাবার মরতে দেরি হয়েছে অনিতার উপর অত্যাচার আর সকল অবহেলা অমানবিক কাজ শুরু করতে তাদের দেরি হয় নি। আয়ুশ আর অনিতার বিয়ে টা সাধারণত আয়ুশের বাবার জন্য ই হয়েছিলো। রফিক সাহেব

বড্ড জিদ্দি একটা মানুষ। যা বলেন তাই করে ছাড়েন। এক প্রকার জোড় করেই আয়ুশের সাথে অনিতার বিয়ে হয়। বাড়িতে সবাই রফিক সাহেব কে ভয় পায় তাই দু’বছরে কেউ অনিতা কিছু বলতে পারে নি। অনিতার সুখের সময় ই ছিলো এই দুইটা বছর। অনিতার বাবা নেই। মা আর সাজিদ,মার্জিয়া কে নিয়ে

তাদের পরিবার। সাজিদ চাকরি খুঁজছে কিন্তু মেলে না চাকরি সবই টাকার তৈরি লিলিপুট। মার্জিয়া ইন্টারে পড়ে। টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই তাদের সংসার চলতো। এর মাঝে আয়ুশের সাথে অনিতার বিয়ে হয় রাফিক সাহেব ই চালাতো ওই পরিবার টাকেও। বন্ধু মারা যাওয়ার দুর্দিনে তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানো

তিনি তার কর্তব্য মনে করেছিলেন। আর যথাযথ ভাবে কর্তব্য পালন ও করেছিলেন। আদ্রি ক্ষিপ্ত হয়ে চলে যায়। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ময়না অনিতার দিকে দৃষ্টি ফের বদল করে। অনিতা তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
“তুই তো শুধু বাহিরের ক্ষতটাই দেখলি ভেতরের টা তো কেউ দেখছে না।”

“অমানুষ গুলার কথা কইয়েন না ভাবী। তারা নিজেরাই এমন কাজ করে আফনের সাথে আর আফনে কন ক্ষত দেখবে। ভুইলা যান ভাবী আর চলে যান! এভাবে আফনের কষ্ট দেখলে আমার ও কষ্ট লাগে!”
“কোথায় যাবো আমি বল? আমি কোথাও যেতে পারবো না রে। আমার নিজের যা হবে হোক অন্যদের কথা ভেবেই আমাকে এখানে সব সহ্য করে পরে থাকতে হবে।”

ময়না কিছু বলছে না। তার বলার মতো ও কিছু নেই। অনিতা ভাবতেও পারেনি মাঝপথে এসে তার জীবন টা এভাবে থমকে যাবে। জীবনে চলার পথ টা কখনো কঠিন কখনো বা সহজ। এই চলার পথে একজন সঙ্গী অবশ্যই প্রয়োজন। সেখানে আয়ুশ মাঝপথে-ই তাকে থামিয়ে দিয়েছে বাকি পথ টা অনিতার একাই লড়াই করে এগিয়ে যেতে হবে। এই লড়াইয়ে দু’জন নেই একাই সে।


পর্ব_২

ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে অনিতা। একটু আগেই আয়ুশ তাকে মেরেছে অমানুষের মতো করে। অনিতা ও যে তার মতো একটা মানুষ এটা হয়তো বা তার মনে নেই। আর মনে থেকেই বা কি হবে? অনিতা না থাকলেই তো সে বাঁচে। এতো কিছুর পর ও অনিতা কিছুতেই তাদের পিছু ছাড়ছে না সুপারগ্লু এর মতো লেগে

আছে। আয়ুশ নিজের রাগ যতক্ষণ কমে নি ততক্ষণ পর্যন্ত অনিতা কে মেরেছে। এরপর সে কাছেই একটা ফার্মেসী তে গিয়ে কি যেনো মনে করে ঔষধ নিয়ে আসে।
“নে ঔষধ আর মরে থাকলে তো তোর ওই গুনধর ভাই বোন আমাদের নামে মামলা করে দেবে!”
“গরু মেরে জুতা করতে এসেছো? এতো সহজে আমি মরবো না বুঝেছো! এতো সহজে মরবো না!”

আয়ুশ ঔষধ গুলো অনিতার মুখের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে সিগারেট হাতে নিয়ে কোথাও চলে যায়। সকাল থেকে সেলিনা বেগম আর আদ্রি বাড়িতে নেই। আদ্রির ফুপির বাড়িতে গেছে হুট করেই। আগে থেকে কোনো রকম প্ল্যান ছিলো না তাদের যাওয়ার পিছনে মূল কারণ টা এখনো অবধি অনিতা বুঝতে পারে নি।
অনিতা ব্যথিত শরীর নিয়ে রান্না করার জন্য কিচেনে যায়। ময়না তার পিছন পিছন আসে।

“ভাবী আফনে অসুস্থ আইজকা রান্না আমি করি?”
“না ময়না পরে জানতে পারলে আবার আমাকে মারবে। জানোই তো উনারা একটা খুঁত ও ধরতে পারলে তার জন্য ও আমাকে ভোগাবে!”

ময়না কিছু বললো না। অবশ্য বলে ও যে লাভ নেই যেটা সত্যি সেটাই বলেছে অনিতা। ক্লান্ত শরীরে বিন্দু পরিমান শক্তি নেই কাজ করার তাও অনিতা বহু কষ্টেই করছে। রান্নাবান্না প্রায় শেষের দিকে চুলোয় পানি ফুটাতে দিয়েছে অনিতা। ফুটানো পানি খায় সবাই। অনিতা দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসতেই চোখ লেগে আসে। ঘুমিয়ে পড়ে অনিতা। সেলিনা বেগম আর আদ্রি কাজ সেরে বাড়িরে এসে দেখে অবস্থা

খারাপ। ধোয়া উড়ছে পুরো বাড়ি অন্ধকার করে ফেলছে। কি বিদঘুটে একটা গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। সেলিনা বেগম ধোয়ার সূত্রপাত ধরে রান্না ঘরে দেখে অনিতা ঘুমাচ্ছে। রেগে আগুন হয়ে যান তিনি। চুলোয় পাতিল পুড়ে গেছে আল্লাহ না করুক আর একটু হলেই বড়সড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতো। আগুনে পুড়ে

সব ধ্বংস হয়ে যেতো। সঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছেন সেলিমা বেগম আর আদ্রি। চুলো বন্ধ করে দিয়ে সেলিনা বেগম রেগে চেঁচিয়ে উঠেন। অনিতার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সেলিনা বেগম অনিতার চুল ধরে টেনে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসেন।

“তুই একটা অলক্ষুনে মেয়ে। আমাদের শেষ দেখে তবেই ছাড়বি তাই না? এই জন্যই আগুন লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলি?”
“মা আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি বুঝতে পারিনি! আমার ব্যাথা লাগছে মা ছাড়ুন!”
আদ্রি অনিতার গালে চড় বসিয়ে দেয়। মার বকুনি খেয়ে অপরাধীদের মতো নিচের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে অনিতা। শরীর এতোটাই খারাপ ছিলো যে সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারে নি। এই কাজের জন্য যে মার টা খেয়েছে এর জন্য কোনো খারাপ লাগা কাজ করছে না অনিতার। কারণ

আসলেই এখানে দোষ টা তার ছিলো। এভাবে ঘুমিয়ে পড়া একদম ঠিক হয় নি। রাতে আয়ুশ বাসায় এসে এসব শুনে নির্বাক হয়ে যায়। সবার খাওয়া শেষ হওয়ার পর থালা বাসন সব ধুয়ে রেখে রুমে আসে অনিতা। আয়ুশ এতক্ষন তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। আরো একটা থাপ্পড় পড়ে অনিতার গালে। ভয়ংকর রেগে আছে আয়ুশ।

“কেন ডিভোর্স দিচ্ছিস তুই আমাকে? কেন চলে যাচ্ছিস না এই বাড়ি ছেড়ে? বল আমাকে কবে যাবি তুই কবে মুক্তি পাবো আমরা? আজ তো বাড়ি টাই পুড়িয়ে দিতি থাকতাম কোথায় আমরা? পথে বসানোর ফন্দি এঁটেছিস?”

“আমি ইচ্ছে করে এমন করি নি আয়ুশ!”
“তাহলে কি আমার মা বোন মিথ্যা বলছে? কি চাস তুই এটা বল!”
“দুই বছর পর এখন ডিভোর্স কেন চাচ্ছো তুমি? অপরাধ কোথায় আমার?”

“তোর অপরাধ একটাই তুই আমাকে বিয়ে করেছিস! তুই আমার যোগ্য নয় এটা তুই বুঝিস না?”
“যোগ্যতার কথা বলছো তুমি?”

কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আয়ুশ অনিতা কে জোড় করে রুম থেকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। ময়না আজ নেই তার ঘরটায় গিয়েই শুয়ে পরে অনিতা। কান্না থামছেই না। তার যদি সত্যি সত্যি ডিভোর্স হয়ে যায় মা সাজিদ মার্জিয়া এদের কি হবে? কে দেখবে এদের! ভাবতে পারছে না অমিতা।

মাথা ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এতো কষ্ট আর নিতে পারছে না সে। পৃথিবীতে কি কেবল এই ঘরের মানুষ গুলোই কি এতো নিষ্ঠুর? মানুষ এতো পাষাণ কিভাবে হয়!


পর্ব_৩

সেলিনা বেগম আয়ুশ আর আদ্রি, কোনো মাজার জিয়ারত করতে যাচ্ছে। বাসায় অনিতা একা। ময়না আজ ও নেই শুনেছে ও অসুস্থ এই জন্যই আসে নি। তারা চলে যায়। আনমনে এক দিকে তাকিয়ে আছে অনিতা। ফোনটা লাগাতার বেজেই চলেছে। সাজিদ কল দিচ্ছে কিন্তু অনিতার সেদিকে কোনো ভ্রুঁ ক্ষেপ

নেই। ধ্যান ভেঙ্গে বাস্তবে ফিরে অনিতা। ফোন এখনো বাজছে তাড়াহুড়ো করে কল রিসিভ করে অনিতা। কয়দিন হলো বাড়ি তে কোনো খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। অনিতা দিন দিন নিজের অবনতির আশঙ্কায় কোনো দিকে খেয়াল নেই! সব সময় শুধু মাথায় আজেবাজে চিন্তা ভর করে। সাজিদ হাসছে সেটা স্পষ্ট

বুঝতে পারছে অনিতা। ভাই টার সাথে কথা বলে মন টা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। শত কষ্টের ভিড়ে ও এক টুকরো সুখ মন কে ঘিরে ধরেছে। এই অজস্র কষ্টের ভিড়ে একটু টুকরো সুখের মূল্য আকাশচুম্বী। অনিতা সাজিদ কে একটু ও বুঝতে দিলো না তার কষ্টের জীবন টার সম্পর্কে! সে চাচ্ছে অন্তত তার কষ্টের বিনিময়

হলেও, ভাই বোন আর মায়ের মুখে হাসি টা অটুট থাকুক। সাজিদের সাথে কথা শেষ করে রান্নার কাজে হাত লাগায় অনিতা। মাজার থেকে ফিরতে তো নিশ্চয় দুপুর হয়ে যাবে। খাবার সামনে না পেলে সবাই আবার ঘর মাথায় তুলে ফেলবে! কোনো রকম ঝামেলা চায় না অনিতা। তাই চট জলদি রান্না টা সেরে নেয়।

মন ভালো থাকায় আজ সে নোনতা ইলিশ রান্না করছে। এই ইলিশের অন্য সব ইলিশ মাছের থেকে একটা ইউনিক জিনিস আছে আর সেটি হচ্ছে লবণ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সেলিনা বেগমের অত্যন্ত পছন্দের খাবার। আদ্রি আর আয়ুশের পছন্দ বিরিয়ানি। মোটকথা ৩ জনের ই পছন্দের খাবার রান্না করছে অনিতা আজ। নিশ্চয় সবাই অনেক খুশি হবে! এর বিনিময়ে একটু ভালো ব্যবহার ও যদি অনিতার কপালে জোটে, তাহলে মন্দ হয় না।

অনিতা গোসল সেরে নেয়। অপেক্ষা তাদের ফেরার। কলিংবেল বেজে উঠল। মন জানান দিচ্ছে তারা এসে গেছে। অনিতা যতটা দ্রুত সম্ভব গিয়ে দরজা খুলে দেখলো যাদের ফেরার জন্য সে অপেক্ষা করছিলো তারা নয় বরং অন্য কেউ এসেছে।

“মাহবুব ভাই আপনি!”
“হুম আমি!”
“চা খেতে আসলাম!”
“মানে?”
“এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবলাম আপনার হাতে চা খেয়ে যাই। আপনি, না সেই লেভেলের চা বানান। একটু চা হবে প্লিজ?”

বাসায় কেউ নেই। অনিতার মন কু ডাকছে। অনিতা চুপ করে রইলো। তাই মাহবুব আবার বলে উঠলো,
“কি হলো ভাবী খাওয়াবেন না?”
“না মানে আজ কেউ বাসায় নেই! আপনি বরং অন্য দিন আসুন তখন খাওয়াবো!”
“অন্যদিন?”
“জি!”

“অন্যদিন কিভাবে আসবো? হতে পারে আজ এখানে থেকে ফিরে গেলেই, দেখা যাবে আমি মরে গেলাম? জীবন মরণের তো আর কোনো গ্যারান্টি নেই তাই না? তাছাড়া মৃত মানুষ কি আর চা খেতে পারে বলুন? পরে মরে গিয়ে ও একটা আফসোস থেকে যাবে!”

“তাও আজ হবে না মাহবুব ভাই। আমার শরীর টা তেমন ভালো নেই! চা বানাতে পারবো না। কথা দিচ্ছি আরেক দিন খাওয়াবো!”
মাহবুব নাছোড়বান্দা সে কিছুতেই অনিতার কথা শুনছে না। অনিতা মাহবুব কে বসতে দিয়ে দ্রুত হেটে রান্না ঘরে চলে যায়। মন কেমন করছে! পুরো বাড়িতে সে একা আর একটা অবিবাহিত ছেলে ব্যাপার টা খারাপ দেখাচ্ছে! মাহবুবের মতি গতি ও তেমন একটা ভালো ঠেকছে না। সব সময় কেমন দৃষ্টিতে তাকায়। এই দৃষ্টি তে খারাপ কিছুর ইঙ্গিত পায় অনিতা।

মাহবুব অনিতার পেছনে দাঁড়ানো। অনিতা সেটি টের ও পায় নি। সে এক মনে এক ধ্যানে কাজ করছে। মাহবুব হঠাৎ করেই পেছন থেকে অনিতা কে জাপটে ধরে। এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না অনিতা। ভয়ে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। অনিতা করুণ সুরে বললো,
“এসব কি করছেন মাহবুব ভাই!”

“কি করছি বুঝেন না? নাকি বুঝতে চান না কোনটা?”
মাহবুব থামছে না। অনিতা নিজেকে বহু কষ্টে ছাড়িয়ে নেয়। অতঃপর মাহবুবের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে অমিতা। ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,

“ছিঃ কেমন জানোয়ার আপনি? মানুষ হয়ে জানোয়ারের মতো আচরণ করছেন! এই আপনার স্বভাব?”
মাহবুব ও রেগে গেছে। চড় খাবে ভাবতে পারে নি। চোখ মুখ ভয়ংকর লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
“ভালো ব্যবহার করছি দেখে চড় দিলা? আসো এবার তোমাকে আসল জানোয়ারের রূপ দেখাই!”
একটা পুরুষ মানুষের শক্তির কাছে একটা মেয়ের নিতান্তই নগন্য। একটা হাতির সামনে একটা পিঁপড়া পাঙ্গা নেওয়ার মতো ব্যাপার!

“মাহবুব তোর এই অবস্থা কিভাবে হলো?”
“এখনো বুঝতে পারছো না কিভাবে হলো? অনিতা ভাবী ই আমার এই হাল করেছে!”
“কি!”

অনিতা দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসে আছে। মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। মাহবুবের সাথে হাতাহাতির এক পর্যায়ে অনিতা ফল কাটার ছুরি দিয়ে মাহবুবের হাতে আঘাত করে। এতেও সে দমে নেই বরং আরো ক্ষেপে গেছে ভীষণ। অনিতা হার মানার পাত্রী নয় দেখে মাহবুব অনিতার মাথায় দেওয়ালের সাথে আঘাত করে।

মুহুর্তের মধ্যে মাথা ঝিম ধরে আসে। নিজেকে বাঁচানোর প্রাণ পন চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে অনিতা। নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়ে। মাহবুব এসে অবশ্য দরজা খুলতে বলেছে কিন্তু অনিতা খুলে দেয় নি। দরজা ভেঙ্গে ফেলার ও হুমকি দিয়েছিলো সে, তাতে ও কোনো কাজ হয় নি! কেননা অনিতা

জানতো এই দরজা ভাঙ্গা এতো টাও সহজ কাজ নয়। তাই মাহবুব কিছু করতে না পেরে নিজেই নিজের এমন হাল করে যাতে যে কেউ দেখলে খারাপ কিছুর আশঙ্কা বুঝতে পারে।

সেলিনা বেগম আর আয়ুশ মাহবুবের মুখ থেকে কথাটা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় অনিতার উপর। মাহবুব চলে যায়। দরজার ওপাশে আয়ুশের গলা শুনতে পেয়ে অনিতা যেনো প্রাণ ফিরে ফেলো। এই মুহূর্তে তার কষ্টের

সময়ে আয়ুশ কে মনে করছে একজন ভরসা যোগ্য ব্যক্তি। দরজা খুলেই আয়ুশ কে জাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করে সে। গা ঘিনঘিন করছে আয়ুশের। সে অনিতার হাত ধরে টেনে ড্রয়িংরুমে তার মা আর বোনের সামনে নিয়ে আসে। সেলিনা বেগমের হাতে থাপ্পড় খেয়ে নির্বাক অনিতা।

নষ্ট মেয়ে কথাটি, দুই টা শব্দের হলে ও এর অর্থ বিশাল। এক নারীর চরিত্রে দাগ লাগায় শব্দ দুটো। অনিতা সেই শব্দে খেতাব ভুক্ত হলো কিছুক্ষণ আগেই। মাহবুবের কথা বিশ্বাস করে

জলজ্যান্ত তিন, তিনটা মানুষ অনিতার সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার করবে এটা সে ভাবতে পারে নি। নিজের চরিত্রে দোষ না লাগানোর অসংখ্য চেষ্টা করেও সফল হলো না অনিতা। সে নির্দোষ হয়ে ও আজ সে ব্যর্থ!

আদ্রি ও একটা মেয়ে হয়ে অনিতা কে খারাপ বলার কিছু অংশ ও বাদ রাখে নি। কলঙ্কিত করেছে অনিতা কে। দুটি চোখের ঝরতে থাকা জল বাঁধাহীন ভাবেই ঝরছে। ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায় অনিতা। পেছন ফিরে একবার বাড়ি টাকে দেখে

নিলো। তার সাজানো গোছানো সংসার নষ্ট হয়ে মুহুর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। মাহবুব তার সংসার ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। আর এই নিষ্ঠুর মানুষ গুলো ও সময়ের সৎ ব্যাবহার করার জন্য আগে থেকেই তৈরি হয়ে বসে ছিলো। পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে তারা। অনিতা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”আমি সয়ে গেলাম আল্লাহ যেনো না সয়!”


পর্ব_৪

মাথায় হাজারো আজেবাজে চিন্তা ভর করেছে। কি হবে অনির পরিবারের সবার? কোথায় গিয়ে কার দুয়ারে দাঁড়াবে? আর এখান থেকে যদি অনি বাড়ি তে যায় তাহলে কি জবাব দেবে সবাই কে? সে কী বলে দেবে যে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে? আর বললে ও সবাই জেনেই বা

কেমন রিয়েক্ট করবে? সব চিন্তা ই নেগেটিভ দিক ইঙ্গিত করছে। এতো সব ভাবতে ভাবতে অনির মনেই নেই যে সে মাঝপথে চলে এসেছে। তার সেদিকে কোনো হুস নেই! নিজের ভাবনায় বিভোর সে।

 সাফওয়ান আহমেদ বেখেয়াল বশত গাড়ি সামনের দিকে না তাকিয়েই ড্রাইভ করছে। যখন তাকালো তখন কিছু টা দেরি হয়ে গিয়েছে। সামনে থেকে কোনো মেয়েলী কন্ঠের চিৎকার শুনলো সাফওয়ান। গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে দেখলো একটা মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। 

একবার ভাবলো মরুক বা বাঁচুক তাতে তার কি আসে যায়? এমনিতে এখন মেয়ে দেখলেই কেমন একটা ঘৃণা চলে আসে। সহ্য হয় না একদম! অনির মাথা থেকে রক্ত পড়ছে। সাফওয়ান দ্রুত অনি কে হসপিটালে নিয়ে যায়। বেশি দেরি হলে কোনো খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে এতে সাফওয়ান নিশ্চিত! সে আর যাই হোক কোনো ঝামেলায় পড়তে চায় না।

ডাক্তার বেরিয়ে আসে। সাফওয়ান দাঁড়িয়ে ছিলো ডাক্তার কে দেখে কিছু টা এগিয়ে যায়।
“ডাক্তার সব ঠিক আছে তো?”
“পেশেন্ট আপনার কি হয়?”

“না, আমার কিছু হয় না!” সাফওয়ানের শর্টকাট জবাব। ডাক্তার একটু বিচলিত হন!
“আপাতত সব ঠিক আছে। একটু পর ই জ্ঞান ফিরবে! মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে এমন হয়েছে। ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“ওহ ওকে!”

ডাক্তার কিছু বলতে গিয়েও বললো না। সাফওয়ান ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করে আর এক মুহূর্ত ও না দাঁড়িয়ে চলে যায়। হসপিটালে নিয়ে এসেছে এটাই যথেষ্ট।

মাথা ব্যথা করছে। উঠে বসে অনি। আশে পাশে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলো এটা হসপিটাল। একজন নার্স কে দেখে সে ডেকে জিজ্ঞেস করে কে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে নার্স সব খুলে বলে। বাহিরে কাউকে দেখতে পেলো না অনি।অদিতি অনি কে হসপিটালে

দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে যায়। মাথায় ধবধবে সাদা ব্যান্ডেজ লাগানো। এক অপূর্ব সুন্দর লাগছে অনি কে। অদিতি দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে।
“অনি তোর এই অবস্থা কিভাবে হলো? মাথায় কিভাবে ব্যাথা পেলি?”

অদিতির সাথে অনিতার তার বাসায় এসেছে। অদিতি মা নেই বাবা আর সে ই। অদিতির বাবা বাড়ি নেই। অদিতি অনির সব কথা শুনে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। এরা মানুষ না জানোয়ার! এমন ব্যবহার কিভাবে করতে পারলো!
“নারী নির্যাতনের মামলায় সব কয়টাকে ফাঁসিয়ে দিই চল!”
“না!”
“কোনো টাকা লাগবে না। এই মামলায় খরচ সরকার দেয়। তাছাড়া প্রমাণ ও আছিস তুই নিজেই। একবার আমি দেখতে চাই তাদের অবস্থা টা কেমন হয়!”
“এসব করে আর কি হবে বল? আমি চাই না মা বা সাজিদ এরা কেউ ই আমার এই সব কথা জানুক!”

“মানে কি?”
“আমার একটা জবের ব্যবস্থা করে দে। আমি যেমন ই থাকি আমার ভাই বোন আর মা অন্তত খুশী থাকুক এটাই আমি চাই! জানিস আমি যদি এখন মারা যেতাম মরে ও শান্তি পেতাম না রে! যিনি আমাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে ধন্যবাদ টা তার প্রাপ্য!”

“খবরদার আর মরার কথা বলবি না। জবের ব্যবস্থা নাহয় হলো কিন্তু তোকে যে হসপিটালে নিয়ে এসেছে ওই লোকটা কে?”
“দেখিনি চলে গিয়েছিলো আগেই!”

অদিতির যেখানে জব করে সেখানেই জব পেয়েছে অনি। মাজেদুল ইসলাম অফিসের বস। দুই ছেলে এক মেয়ের বাবা তিনি। দেখতে শুনতে বেশ ভালোই রুচিশীল ভদ্রলোক মনে হলো অনির কাছে। তিনি অদিতির থেকে ও বড় পদে জব দিলেন অনি কে। অনি অবশ্য এটা আশা

করে নি! অদিতি খুশী হয়। মাঝখান দিয়ে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেলো। অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যায় অনি।
মার্জিয়া অনি কে দেখে হতবাক। চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠে। এসেই সোজা জড়িয়ে ধরেছে বোন কে। দুই বোন কে এই অবস্থায় দেখে শাহানা বেগম কেঁদেই দিলেন। সাজিদ

নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। অনি শাহানা বেগমের দিকে এগিয়ে যায়! নিচু হয়ে মায়ের পায়ে ধরে সালাম করে। শাহানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বুকে টেনে নেয়। হুহু করে কান্না করে দেয়।

এই কান্নার কোনো অর্থ নেই। মায়ের মন সন্তানের জন্য সর্বক্ষণ ব্যাকুল হয়ে থাকে। এই ব্যাকুলতার ফল সরূপ চোখের কোন থেকে ঝড়ে পড়া এই অশ্রু ফোঁটা গুলো! তার উপর আজ কতগুলো দিন বাদে অনি কে দেখছে। সাজিদ মা আর বোনের কান্না দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,
“মা তুমি এসব কী শুরু করলে? আপু মাত্র ই তো আসলো আর এখনি কান্না শুরু করছো? প্রতিদিনই তো কান্না করো, আজ অন্তত কান্না টা বন্ধ করো!”
সাজিদের কথায় বুক টা ধ্বক করে উঠে অনির। প্রতিদিন কান্না করে মানে?
“কি বলছিস সাজিদ! মা প্রতিদিন কান্না করে?”

“হ্যাঁ আপু।”
“মা এসব কী শুনছি? কান্না করো তুমি? ঠিক আছে এরপর আমি এই বাড়িতে আর আসবো না!”
“চুপ। তোরা তিন টাই এক জাতের হয়েছিস। তোরা কি বুঝবি এক মায়ের কষ্টের কথা? সন্তান যেখানেই থাকুক সর্বদা চিন্তা হয় বুঝলি!”
অনি শাহানা বেগমের চোখের পানি আলতো করে মুছে দিয়ে বললো,
“এই যে দেখো আজ এসেছি। তাও দুদিনের জন্য আর কান্না করো না!”

শাহানা বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব গভীর ভাবে কিছু দেখলো। মুখ টা কেমন শুকনো, চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে আছে! মন কেমন করে উঠছে। তার মেয়েটা স্বামীর বাড়িতে আদৌ ভালো আছে তো? নাকি ভালো থাকার অভিনয় করছে? মন বলেছে এসব অভিনয় মাত্র ভালো থাকা নয়!
,
সাজিদের পাশে বসে আছে অনি। সাজিদ ছোট বাচ্চাদের মতো অনির কোলে মাথা রেখে গেইম খেলছে। অনি সাজিদ মাথার চুল গুলো টেনে দিচ্ছে। সাজিদ যখন পিচ্চি ছিলো ঠিক এভাবে করেই তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতো অনি। সেই সাজিদ এখন আর ছোট নেই! বড় হয়েছে

ঠিকই কিন্তু অভ্যাস গুলো সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। মার্জিয়া কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারছে না। আজ নিরব কে দেখে নি সে। প্রতিদিন ই মার্জিয়া কে দেখতে ছুটে আসতো নিরব কিন্তু আজ আসে নি। ব্যাপার টা ভাবাচ্ছে মার্জিয়া কে। সে বই বন্ধ করে দিয়ে অনির কাছে চলে যায়। তিন ভাই বোন মিলে গল্প জুড়ে দেয়।

রাতে খাবার সেরে অনি শুয়ে আছে। শরীর বেশ ক্লান্ত। শাহানা বেগমের উপস্থিতি টের পায় অনি। বিছানায় পাশে বসে মেয়ের মাথায় বিলি কেড়ে দিচ্ছেন তিনি। ঘুম চলে আসছে অনির। শাহানা বেগম কতো শত ভেবে অনি কে বলে উঠলো,
“অনি!”

“জি মা!”
“তুই ভালো নেই তাই না?”
মায়ের কথা শুনে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে অনির। ঘুম মুহুর্তেই উবে গেল। অনি আচমকা মায়ের এমন কথা শুনে উঠে বসে মায়ের হাত টি আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নেয়!


পর্ব ৫

মার্জিয়া বই খুলে বসে আছে পড়ায় মনোযোগ নেই এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে অনি। সে গিয়ে মার্জিয়া পাশে বসে।
“কিরে তোর মন খারাপ?”

মার্জিয়া হকচকিয়ে উঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
“নাহ তো আপু!”
“মিথ্যা বলছিস কেন?”
“আরে ধুর মিথ্যা কেন বলবো!”

মার্জিয়া এই প্রসঙ্গ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে পাল্টে দিলো বললো,
“আপু আয়ুশ ভাইয়া ভালো আছে?”
“হুম!”

মার্জিয়া ইগনোর করছে দেখে অনি আর তাকে জোড় করলো না।
“তোর পরীক্ষা কবে?”
“সামনের মাসের ১ তারিখ থেকে শুরু হবে!”
“ফি কত আসে জানাস।”

“হু!”
“তোর চশমা কোথায়?”
“ওই আসলে…
“কী?”
“ভেঙ্গে গেছে!”

“কবে?”
“এইতো কিছু দিন আগে!”
“নিস নি কেন আরেক টা?”
“এতো টাকা কোথায় পাবো?”
“আমি আছি কি করতে?”

“সব ই তো তুই দিস! বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে সব! তোর কাছে আর চাইতে ইচ্ছা করে না রে আপু!”
“বেশি কথা বলিস দেখছি!”
“বেশি কই বললাম! যা‌ বলেছি ঠিক ই তো!”
“ভালো কথা তুই প্রাইভেট পড়িস না?”

মার্জিয়া চুপ করে আছে দেখে কিছু টা আঁচ করতে পারলো অনি।
“টাকার কথা ভাবিস না আমি যতদিন আছি তোদের কোনো সমস্যা হবে না। কাল থেকে প্রাইভেটে যাবি!”
অনি উঠে চলে যেতে নেয় মার্জিয়া পেছন থেকে ডেকে উঠলো,
“আপু!”

“হু!”
“তোর সব টাকা একদিন শোধ করে দিবো!”
“কীভাবে?”
“বড়লোক ছেলে কে বিয়া করে হিহিহি!”
“অন্যের টাকা কেন নিবো? তুই নিজে দিতে পারলে, নিতে পারবো!”
“তুই যে দিস ওটা কি তোর টাকা?”

“এতো দিন আমার টাকা ছিলো না। এখন তো আমার ই!”
নিচু স্বরে অনি কথাটা বিড় বিড় করে বললো। মার্জিয়া বুঝতে পারে নি তাই বলে উঠলো,
“কিরে আপু কিছু বললি?”
“কই না তো!”

অনি ৫০০ টাকা নিয়ে মার্জিয়া কাছে আসে। তার হাতে টাকা গুলো এগিয়ে দিয়ে বললো,
“নতুন একটা চশমা কিনে নিয়ে আসিস।”
মার্জিয়া টাকা টা হাতে নিয়ে ঠায় বসে আছে। সাজিদ অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। জবের জন্য কম ট্রাই করে নি। প্রতিবার ই একটাই ফলাফল। নূন্যতম যোগ্যতা থাকলেও টাকার জন্য জব পাচ্ছে না। দুনিয়া টাই যেনো টাকার উপর নির্ভরশীল। টাকা ছাড়া চলে না।

সব কিছু তে টিকলে ও শেষে ঘোষ চায়। পরিবারের এই দুর্দিনে একটা জব অতি গুরুত্বপূর্ণ যদি হাল টা একটু ধরতে পারে এই আশায়। আশার ফল প্রতিবার ই হতাশায় পরিণত হতে যায়। তাই এবার হাল ছেড়ে দিয়েছে সাজিদ। সাজিদের পাশে এসে দাঁড়ায় অনি। দূরে কৃষ্ণচূড়া

গাছটা টায় ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে। টকটকে লাল ফুল নিচে পড়ে আছে অনেক। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। সাজিদ অনির উপস্থিতি টের পায়।
“কিরে আপু তুই?”
“হুম কি দেখছিস এমন করে?”

“দেখছি না ভাবছি!”
“কী ভাবছিস?”
“জব পেলে হয়তো তোর পাশে দাঁড়াতে পারতাম! তুই তোর ওই পরিবারে সবার কাছে ছোট হয়ে আছিস,শুধু আমাদের জন্য। তুই ছোট হয়ে থাক এটা আমার আর ভালো লাগে না। কিছু একটা করতে চাই আমি!”

“চাইলে সব পাওয়া যায় না। সব পেয়ে গেলে ও আবার না পাওয়ার কিছু থাকে না। আমার কাছে আমার নিজের থেকে ও দামি তুই মার্জিয়া আর মা । সেখানে আমি ছোট হই বা বড় এসব কে বলেছে তোকে? উনারা তো কিছু বলে না তাই না!”

“আমি জানি তে আপু তুই যত যাই বলিস। সব আমাদের শান্তনা দেওয়ার জন্য ছাড়া কিছুই না। আমাদের সুখের কথা তো খুব ভাবিস নিজে সুখে আছিস তো?”
সাজিদের কথায় বুক টা ধ্বক করে উঠলো।অনি নিজেও জানে না সে কেমন আছে!

সাজিদ বেঞ্চিতে বসে আছে। স্পৃহা দৌড়ে এসে হাপাতে থাকে। সাজিদের পাশে বসলো সে। সাজিদ সরু চোখে একবার স্পৃহা কে দেখলো।
“এতো হাঁপাচ্ছিস কেন?”

“তোর জন্যই তো এতো ঝামেলার মধ্যে ও আসলাম।”
“আমি কি আসতে বলেছি?”
“বলিস নি! কিন্তু তুই যে আমার অভ্যাস হয়ে গেছিস এটা বুঝিস না?”
“আমি তোর অভ্যাস হবো কেন?”

“গাঁধা কিচ্ছু বুঝিস না। প্রতিদিন ই তো আগে এখানে আসতি সঙ্গে কে ছিলো মনে নেই?”
“তুই ছিলি!”
“তাহলে এখন এমন ভাব কেন করছিস যেনো কিছুই বুঝিস না! তুই একা আসতি না সঙ্গে আমি ও ছিলাম। সেই অভ্যাস টাই রয়ে গেছে।”

হলুদ জামা পড়ে আছে স্পৃহা। চুল গুলো পিঠের উপর ছেড়ে দেওয়া। স্নিগ্ধ বাতাসে তা উড়ে এসে মুখের উপর আঁছড়ে পড়ছে। চোখে কাজল আর হালকা সাজ স্পৃহার। তাতেই অপূর্ব লাগছে। ইন্দ্রানীর মতো! ইন্দ্রাণী জিনিস টা কি সেটা সাজিদ জানি না! তবে প্রায়শই গল্পে

সাজিদ পড়েছে ইন্দ্রাণীর মতো সুন্দর। তাই সে ধরেই নিয়ে ইন্দ্রাণী খুবই রূপবতী কেউ! চঞ্চল মেয়ে স্পৃহা টকবক করছে। বসে বসে পা দুলাচ্ছে আর হাত। হাতে থাকা হলুদ চুড়ি গুলো একটা আরেক টার সাথে বারি খেয়ে একটা অপূর্ব বিমোহিত শব্দ হচ্ছে। অদ্ভুত ভালো

লাগছে সেই শব্দ। সাজিদ অবাক চোখে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু ও চোখ এদিক ওদিক করছে না। স্পৃহার চোখ সাজিদের উপর পড়তেই সে লজ্জায় পড়ে যায়। সাজিদ তাকে দেখায় মগ্ন তাই স্পৃহা আস্তে করে সাজিদের হাতে চিমটি কাটে। সঙ্গে সঙ্গে সাজিদ আহ বলে শব্দ করে উঠে। স্পৃহা খিলখিল করে হেসে উঠে। সাজিদের কাছে এই হাসি টাও মারাত্মক সুন্দর লাগছে এই মুহূর্তে!


পর্ব ৬

অনি আজ চলে গেছে। অদিতির বাসায় থেকে জব টা করবে সে। তার যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। অদিতি অনি কে আসতে দেখে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।
“কেমন আছিস?”
“ভালো তুই?”

“ভালো! ওখানে সবাই কেমন আছে রে?”
“হুম ভালো আছে!”
“আজ অফিসে যাবি?”
“হুম!”

“ওকে চল রেডি হয়ে নে!”
অনি আর অদিতি রেডি হয়ে অফিসে চলে যায়। মাজেদুল ইসলাম কেমন দৃষ্টি নিয়ে অনি কে দেখছে। অস্বস্তি তে পড়ে যায় অনি। তাও সেটা মুখে প্রকাশ করলো না।
“স্যার…
“হ্যাঁ।”
“কোনো কাজের কথা বলছিলেন!”
“ও হ্যাঁ। R.K গ্রুপের সাথে আমাদের একটা ডিল ফাইনাল করা দরকার। প্রেজেন্টেশন আপনাকেই করতে হবে! কথা হচ্ছে আপনি পারবেন তো?”
“জ্বি স্যার।”

মাজেদুল ইসলাম অনির দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দেয়। অনি সেটা নিয়ে চলে যেতে নিবে মাজেদুল ইসলাম অনি কে ডাকে!
“কিছু বলবেন?”

“আপনার নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে?”
অনি ভাবতে পারে নি তিনি পারসোনাল প্রশ্ন করে বসবে। অনি মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে দ্রুত চলে আসে নিজের কেবিনে। অদিতি অনি পাশের কেবিনেই তাই সে অনি কে দেখে জিঙ্গেস করলো,

“কিরে কি হলো? মুখ অমন অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?”
“কই না তো!”
অনি জোড় পূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে ফাইলের কাগজ পত্র গুলোর দিকে মনোযোগ দেয়।

প্রেজেন্টেশন ভালো ভাবেই করেছে অনি। ডিল টাও ফাইনাল হয়ে গেছে। RK গ্রুপের লোকজন চলে যায়। মাজেদুল ইসলাম অনির দিকে এগিয়ে আসে,
“মিস অনিতা!”
“জি স্যার!”

“লাঞ্চ টাইম শেষ হয়ে যাচ্ছে চলুন কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ করে নি!”
“না স্যার কোনো সমস্যা নেই আমি আর অদিতি একসাথে করে নিবো!”
“ডিল ফাইনাল হওয়ায় আমার তরফ থেকে ট্রিট চলুন। কোনো এক্সকিউজ দেখাবেন না প্লিজ!”

“আমার জন্য অদিতি ওয়েট করছে। তাহলে এক কাজ করি অদিতি কে ও সাথে নি!”
মাজেদুল ইসলাম কিছু বললেন না। ৫ দিন কোনো ভাবে কেটে গেলো। বারান্দায় অনি মুখ ভার করে বসে আছে এটা অদিতি বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। এও বুঝতে পারছে কারণ কি! অদিতি অনির হাতের উপর তার হাত টা রাখে। অনি অদিতির দিকে তাকায়।
“কি ভাবছিস?”

“কোনো দিন যদি মা আর ওরা জানতে পারে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে তখন কি হবে?”
“যা হবার হবে। তোর তো কিছুই করার নাম তাই না! আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে ভরসা রাখ।”

অনি সহমত পোষণ করে। অন্যদিকে সাজিদ জবের জন্য একটা লোকের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলো। কথা শেষ করে ফিরতেই সামনে পড়ে আয়ুশ। আয়ুশ একা নেই সাথে অন্য একটা মেয়ে। মর্ডান ড্রেসআপ। আয়ুশের কনুই চেপে ধরে হাটছে। সাজিদ কে দেখে ও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলো সাজিদ তাদের পেছন থেকে ডাকে!
“ভাইয়া দাঁড়ান!”

আয়ুশ আর ডায়না পিছন ফিরে তাকায়। ডায়না বুঝার চেষ্টা করছে ছেলেটি কি।
“ভাইয়া দেখে ও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলেন যে? কি ব্যাপার বলুন তো!”
“কি ব্যাপার মানে? কোনো ব্যাপার নেই। ইচ্ছা হয় না তোমাদের মতো ছোট লোকদের দেখতে! তাও চোখ যে কখন কোন দিকে যায় বলা যায় না!”

“ছোট লোক আবার কি জিনিস! ছাড়ুন সেসব ইনি কে?”
“আমার স্ত্রী ডায়না!”
“হোয়াট!”

ডায়না বলে উঠলো,,,,
“তুমি কে?”
“আমি সাজিদ। আপু উনি যা বলছে তা ঠিক?”
“হ্যাঁ”
“মজা করছেন তাই না?”
“আরে আজিব মজা করবো কেন?”
“কই আপু তো আমাদের জানায় নি। আপনি যে, দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন!”

“হাহাহা আর আপু! ও নিজেও জানে না তোমাদের কি জানাবে?”
“মানে আমি ঠিক বুঝলাম না!”
আয়ুশ ডিভোর্সের কথা টা জানায় সাজিদ কে। অবাক হয়েছিলো একটু কারণ সে এখন জেনেছে ডিভোর্সের ব্যাপার টা। সাজিদের মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।

মুখে কিছু বলার ভাষা নেই। একটাই চিন্তা মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে তাহলে অনি কোথায় এখন! আয়ুশের কলার চেপে ধরে সাজিদ। ডায়নার সাহায্য নিয়ে আয়ুশ ছাড়া পেয়ে সাজিদ কে শাসিয়ে চলে যায়। সাজিদ রেগে গেছে।

বাসায় চলে যায় সাজিদ। অনি কে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু ফোন টা বাজতে বাজতে কেটে যাচ্ছে। তোলার নাম ই নেই!
“আশ্চর্য ফোন টা তুলছে না কেন!”

সাজিদ উল্টা পাল্টা বিহেব করছে।শাহানা বেগম বুঝতে পারছেন না তার ছেলের হঠাৎ কি হলো! তিনি সাজিদের ঘরে যায়! সাজিদের পাশে বসে,
“সাজিদ?”
“হ্যাঁ মা বলো!”
“তোর কি কিছু হয়েছে?”

“আজব কি হবে আমার? যেভাবে কথা বলছো মনে হচ্ছে কোনো অন্য গ্রহের প্রাণী আমি!”
“এতো রাগছিস কেন? বল আমাকে কি হয়েছে!”
“বললাম তো কিছু হয় নি। যাও এখান থেকে একা থাকতে দাও আমাকে!”

সাজিদ ভীষণ ই রেগে আছে। মার্জিয়া কিছু বলছে না। শাহানা বেগম উঠে চলে যান। তিনি মনে করেছেন জব হয় নি তাই রেগে আছে। এটা নতুন নয়! রাগ ভেঙ্গে গেলে নিজেই সরি বলবে। তাই শাহানা বেগম পর খাটালো না তাকে।

সারাদিন কেটে গেছে। ফোনের কোনো খবর নেই অনির। অফিসের জন্য রেডি হতেই ফোনের কথা মনে পড়ে। ফোন খুঁজে পেয়ে অবাক হয় অনি। ১০০ টা কল অনেক গুলো টেক্সট তাও আবার সাজিদের নাম্বার থেকে।

“কিরে কি হলো তোর আবার?”
“সাজিদ এতো কল কেন দিলো?”
“কল দিয়ে দেখ!”

অনি সাজিদ কে কল করার ট্রাই করে এখন নাম্বার অফ বলছে। টেক্সট গুলো পড়ে ঘামতে থাকে অনি। সে অল্পতেই অনেক বেশি সিরিয়াস। কারো কিছু হলো না তো এই জন্য ভয় পেয়ে যায় সে। দ্রুত ই অদিতি কে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অনি…….


পর্ব ৭

অনি আর অদিতি কে আসতে দেখে চমকে উঠেন শাহানা বেগম। অদিতি সালাম বিনিময় করে। শাহানা বেগম রান্না ঘরে চলে যান। অনি সাজিদ কে খুঁজছে কিন্তু সে নেই। অনি রান্না ঘরে গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়ায়,
“কিরে তুই এখানে এলি যে হঠাৎ করে?”

“কেন আসতে পারি না মা?”[অভিমানী সুরে]
“ধুর পাগলী মেয়ে আমি কি সেটা একবার ও বলছি! ফোন করে আসিস নি তাই জিঙ্গেস করছি।”
“সাজিদ ফোন দিয়েছিলো।”

“সাজিদ?”[আবারো চমকে উঠলো শাহানা বেগম। অনি ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো]
“চমকে উঠলে যে মা? কি হয়েছে বলো তো!”
“সাজিদ কাল থেকেই কেমন উদ্ভট বিহেব করছে। জানিনা কি হয়েছে!”
“জিঙ্গেস করো নি?”

“তা আর বাদ রেখেছি! কিচ্ছু বলে না আমাকে!”
অনি ভাবনায় পড়ে যায়। সাজিদ বাড়িতে আসে। সাজিদ কে দেখতে পেয়ে মার্জিয়া দৌড়ে আসে।
“ভাইয়া আপু এসেছে!”

“কই?”
সাজিদ কে আনন্দিত বা দুঃখিত কিছুই হতে না দেখে মার্জিয়া নিজেই অবাক হয়।
“আমি কি ডেকে আনবো?”
“নাহ আমি যাচ্ছি।”

সাজিদ অনির রুমের দিকে যেতে নেয় অদিতি সামনে পরে। মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বললো,
“ভালো আছেন আপু?”
“হ্যাঁ ভালো। তুমি ভালো আছো?”
“জ্বি আপু ভালোই।”

সাজিদ অনির কাছে যায়। অনি সাজিদ কে দেখে দ্রুত তার কাছে এগিয়ে আসে। সাজিদ এক নজরে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বুঝতে চেষ্টা করছে সে। অনি তার এই দৃষ্টি দেঝে মুচকি হেসে বললো,

“কিরে সাজিদ কই ছিলি এতক্ষন? এতগুলো ফোন দিলি আমি তো ভয় পেয়ে গেছি তাই সোজা চলে এসেছি!”
“কোথা থেকে এসেছিস?”
“মানে?”

“মানে টা আমার থেকে ভালো তুই জানিস আপু!”
অনির বুক টা ধ্বক করে উঠলো। অস্থির লাগছে ভীষণ। তাই তোতলিয়ে জবাব দিলো!
“যেখান থেকে আসার কথা সেখান থেকে এসেছি আর কোথা থেকে আসবো?”
“তোর শশুড় বাড়ি থেকে এসেছিস?”

“হুম!”
“আর কতো মিথ্যা বলবি আমাদের আপু?”
“মিথ্যা আমি? কি বলছিস রে সাজিদ! তুই ঠিক আছিস!”
“আমার কথা ছাড়ো আপু। তুমি বলো নি কেন আমাদের যে তুমি আয়ুশ ভাইয়া কে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছো!”

“কে বলেছে তোকে এসব?”
“আমি কেউ বললে হয়তো বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু যেটা নিজের চোখে দেখে আসলাম সেটা কে তো অবিশ্বাস করতে পারি না তাই না?”
অদিতি রুমে ঢুকে। সঙ্গে মার্জিয়া ও। সাজিদ সব খুলে বলে। না চাইতে ও কান্না করছে ভাই বোন ৩ জন। অদিতি তাদের শান্তনা দেওয়ার জন্য কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। নির্বাক হয়ে

আছে সে ও। সাজিদ অনির মার্জিয়া অদিতি কেউ ই বুঝতে পারে নি শাহানা বেগম তাদের সব কথা দরজার আড়াল থেকে শুনছিলো! সবার কথা শেষ হলে পরিবেশ যখন শুনশান নিরব তখন তিনি ধীরে পায়ে রুমে আসে। শাহানা বেগম কে দেখে আসাড় হয়ে গেছে অনি। তার চোখে পানি। এতোবড় একটা ধাক্কা তিনি সহ্য করতে পারলেন না। হার্ট অ্যাটাক করে বসেন তিনি।

হসপিটালে নিয়ে আসা হয় শাহানা বেগম কে। ডাক্তার বেরিয়ে আসেন।
“আমার মায়ের এখন কি অবস্থা?”
“রোগীর অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল। যত দ্রুত সম্ভব টাকার ব্যবস্থা করুন। নয়তো যেকোনো সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে।”

টাকার অংক টা ডাক্তার সাহেব অনি কে বুঝিয়ে দেয়। সময় খুব কম। এতো দ্রুত এতো টাকা জোগাড় করা কম কথা নয়। সাজিদ তার চাচার কাছে যায়। তিনি ভনিতা করে টাকা দিলেন না। হতাশ হয়ে বসে আছে অনি। মাথা কাজ করছে না। তার জন্য শাহানা বেগমের আজ এই

অবস্থা। নিজের কাছে নিজেই অপরাধী হয়ে গেছে অনি। যেকোনো মূল্যে উনাকে বাঁচাতে হবে নয়তো নিজেই এই পাপ কখনো মোচন হবে। এই অপরাধ বোধ তাকে আজীবন কুড়ে কুড়ে খাবে। অদিতি এসে অনির কাঁধে হাত রাখে।

“বসের সাথে কথা বলে দেখতে পারিস যদি উনি তোকে লোন দেয় তাহলে তুই তোর গ্যালারি থেকে আস্তে আস্তে সব শোধ করে ফেলতে পারবি?”
“জয়েন করেছি মাত্র কয়দিন হলো দিবে উনি টাকা?”

“বিপদে পড়েই তো টাকা চাইছিস। দেখ না আগে কি বলেন উনি! আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।”
শেষ এই একটাই উপায় ছিলো। রুদ্ধশ্বাস ফেলে অদিতি আর অনি খুব দ্রুত অফিসে চলে যায়। মাজেদুল অনি কে ৪ লক্ষ টাকা দিয়ে দেয়। শর্ত হলো এই ঋণ শোধ না করা অবধি কোনো ভাবেই চাকরি ছাড়তে পারবে না। হিতে বিপরীত হলে অনির জন্য মামলা করা হবে। অনি কান্না করে দেয়।

“স্যার আপনার কাছে চির ঋণী হয়ে থাকবো!”
টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অনি। টাকা জোগাড় করে জমা দেওয়া হয় চিকিৎসার জন্য।

৫ দিন পর……….

শাহানা বেগমের অবস্থা এখন একটু ভালো। এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন পরের বার এমন‌ হলে বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই উনাকে সব সময় দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখতে হবে। শাহানা বেগমের পাশে বসে আছে অনিতা। শাহানা বেগমের এক হাত তার হাতের মুঠোয়। শাহানা বেগম কান্না করছেন দেখে ঘাবড়ে যায় অনি। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

“কাঁদবে না মা। আমরা তোমাকে হারাতে পারবো না। বাবা ও নেই তোমাকে হারালে আমরা যাবো কোথায়? আমাদের যে আর কেউ ই থাকবে না!”
শাহানা বেগম চুপ করে আছেন।মুখে কোনো কথা নেই। কান্না ও করছেন না। এই কয়দিন অফিসে যেতে পারে নি অনি। মাজেদুল সব ব্যাপারে তাকে ছাড়া দিচ্ছে দেখে অবশ্য অনির সন্দেহ হয়।

একটা বেঞ্চিতে বসে আছে সাজিদ। চারদিক ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত। পাশেই কয়েক টা কুকুর খাবারের সন্ধান করছে। মাহে মাঝে ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে। পাশেই ট্রেনের রাস্তা। কিছুক্ষণ পরই ট্রেন আসবে। আর নিরব পরিবেশ হয়ে উঠবে কোলাহল পূর্ণ। সাজিদ

লক্ষ্য করলো কেউ একজন দৌড়াচ্ছে। একটা মেয়ে। সোজা এসে ট্রেনের রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে পড়েছে। খোলা চুল গুলো মুখের উপর পড়ে আছে। মুখ টা দেখা যাচ্ছে না। দূর থেকে ট্রেনের হুইসেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। জানান দিচ্ছে তার আগমনি বার্তা।

অদ্ভুত ব্যাপার মেয়েটা নড়ছেই না। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আজব তো সুইসাইড করতে চাচ্ছে নাকি? সাজিদ না চাইতে ও দৌড়ে গেলো। ট্রেন কাছাকাছি চলে এসেছে। মেয়েটির হাত ধরে টেনে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসে সাজিদ। ট্রেন কিছু টা দূর গিয়ে থেমেছে। মেয়েটি ক্ষিপ্ত হয়ে

থাপ্পড় বসিয়ে দেয় সাজিদের গালে। সাজিদ স্টাচুর মতো থাপ্পড় খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাল লাল হয়ে আছে। এতো বড় হয়েছে সাজিদ আজ পর্যন্ত কোনো চড় খায় নি। বন্ধুদের তো দূরের কথা আর এখানে কিনা একটা মেয়ে তাকে থাপ্পড় মারলো।
সাজিদ বুঝতে পারছে না তার এখন কেমন রিঅ্যাকশন করা উচিত। তাই ড্যাব ড্যাব করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। নিশি চেঁচিয়ে বললো,

“কেন বাঁচালে আমায়? দরদ দেখাতে এসেছো এখানে? আমি মরতে চাই মরতে শুনেছো তুমি? অন্য একটা মেয়ে কে বিয়ে তো ঠিকই করেছো এখন আমার কাছে কি চাও হ্যাঁ? “
সাজিদ অবাক হয়ে গেলো। আজব সব কথা শুনে। সাজিদ ধীরে সুস্থে বলে উঠলো,

“আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে ও আমি সেইম কাজ টাই করতাম! আর সুইসাইড করা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম। আমার চোখের সামনে দিয়ে একজন কে কিভাবে মরতে দিই? পাপী তো আমি ও হয়ে যাবো পরে!”

নিশি কন্ঠস্বর শুনে তাকালো সাজিদের চোখে। সে ভেবেছিলো অনিক এসেছে তাকে বাঁচাতে। কিন্তু এটা তো অনিক নয় অন্য কেউ!
“কে আপনি?”

“আমি কে সেটা আপাতত না ই জানলেন।”
“আই এম রিয়েলি সরি আসলে আমি ভেবেছিলাম..
“ইট্স ওকে। নিন পানি খান আর রিলেক্স হয়ে বলুন!”
ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো নিশি। ল্যাম্পপোস্টের নিচে সাজিদের পাশে বসে আছে সে।

চুল গুলো হাত দিয়ে মুখের উপর থেকে সরিয়ে নিলো। সাজিদ এবার নিশির মুখটি দেখতে পেলো। কাজল লেপ্টে আছে। কান্না করেছে নিশ্চয়ই চোখ মুখ ফুলে তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে। দুইজনের মাঝে নিরবতা বিরাজ করছে। নিরবতা কাটিয়ে নিশি বলে উঠলো,

“আমি নিশি। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। অনিক কে খুব ভালোবাসি। ৩ বছরের সম্পর্ক আমাদের। আর আজ সে অন্য একটা মেয়ে কে বিয়ে করে ফেলেছে।”
“সেজন্য সুইসাইডের পথ বেছে নিয়েছেন?”
নিশি চুপ করে আছে।

“কি মনে হচ্ছে আপনার?”
“আমি এর চেয়ে বেশি আর কি ই বা করতাম? ওকে এতোটাই ভালোবাসি যে নিজেকে খুব নিঃস্ব মনে হচ্ছিল। থাকতে পারবো না বাঁচতে পারবো না। দম আটকে মারা যাবো মনে হচ্ছিলো!”
“আপনি মারা গেলে আপনার বাবা মায়ের আহাজারি কে দেখতো? উনাদের চেয়ে আপনার ভালোবাসার মানুষটি কে বড় প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন আপনি? আর যারা কিনা আপনাকে ছোট থেকে একটু একটু করে আজ এতো বড় করেছে তাদের কথা একটা বারের জন্য ও

ভাবলেন না? আচ্ছা আপনি একটা কথা ভাবেন তো যিনি আপনাকে বেঁচে থাকতেই পাত্তা দিলো না সে আপনি মারা গেলে বুঝি আপনার জন্য খুব আফসোস করতো? হাহা ভুল জানেন আপনি! তিনি উল্টো বলতো যে যাক আপদ নিজ থেকে বিদায় হয়েছে। কিন্তু আপনার বাবা

মা উনাদের তো আপনাকে হারানোর কষ্ট টা সারাজীবন থেকে যেতো। উনাদের ভালো থাকা নষ্ট হয়ে যেতো। আপনি একা মরতেন না মেরে ফেলতেন আরো দুইটা কে মানুষ কে। আর তারা আপনার বাবা মা!”
সাজিদ চুপ করে আছে। নিশি ঢুকরে কেঁদে উঠছে। আসলেই সে এসব কিছুই ভাবে নি। নিজেকে বড্ড অপরাধী আর অসহায় মনে হচ্ছে। সত্যি কার ভালোবাসার দাম না দিয়ে এক বেঈমানের জন্য মরতে যাচ্ছিলো সে।

নিশি পাগলের মতো কাঁদছে। সাজিদের এই মুহূর্তে ঠিক কিভাবে তাকে শান্তনা দেওয়া উচিত সে নিজেও বুঝতে পারছে না। সাজিদ তার হাত টি নিশির হাতের উপর রাখে। নিশি চোখ তুলে তাকায়।

“আপনাকে শান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা আমার জানা নেই। তবে আপনি এই যে কাঁদছেন সেটাও বৃথা। আর কাঁদবেন না। যে ভালোবাসার দাম দিতে যানে না তার জন্য একটা কাঁদা ও পাপ।”
নিশি চোখের পানি মুছে ফেলে।
“আর কাঁদবো না আমি!”

“এই তো গুড। আপনার বাবা মাকে একবার মনের চোখ দিতে দেখুন দেখবেন ভালো থাকার অনেক গুলো রাস্তা খুঁজে পাবেন। আসলে কি জানেন জগতে কেউ ই নিঃস্ব নয়। কোথাও না কোথাও স্থান রয়েছে ই। ভালোর পর ই খারাপ। আর খারাপের পর ই ভালো!”
নিশি সহমত পোষণ করলো। সাজিদের ফোন বেজে উঠে। অনি ফোন দিয়েছে। সাজিদ কথা বলে শেষ করে উঠে।

“চলুন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিই। এতোক্ষণে হয়তো আপনার বাবা মা আপনাকে না পেয়ে পাগলের মতো খুঁজছে।”
পুরোটা পথ দুজন মানুষ হেটেই এসেছে। বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় নিশি
“এটাই আমাদের বাড়ি!”

“বাহ বেশ চমৎকার তো!”
“ভেতরে আসুন না!”
“আজ না অন্যদিন। আসলে এখন যেতে হবে আর্জেন্ট!”
“আচ্ছা ঠিক আছে!”

সাজিদ বিদায় নিয়ে চলে যেতে নিবে নিশি ডাক দেয়,
“শুনোন!”
“জি কিছু বলবেন?”
“আপনার নাম টা কি জানতে পারি?”

“সাজিদ!”
কথাটি বলে সাজিদ তার গন্তব্য স্থলে রওয়ানা দেয়। নিশি সাজিদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুটা সময় ওইভাবেই কেটে গেলো। তারপর সে গেট ক্রস করে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।


পর্ব ৯ (অন্তিম)

১ মাস কেটে গেছে। শাহানা বেগম ও বেশ সুস্থ। সাজিদের সাথে নিশির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এদিকে স্পৃহা যে সাজিদ কে ভালোবাসতো সেটা সাজিদ বুঝে উঠতে পারে নি।
গত দুদিন আগে….

~ “কিরে স্পৃহা হঠাৎ এতো তাড়া দিয়ে ডাকলি কেন?”
স্পৃহা সাজিদ কে কিছু না বলে তাকে হুট করে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠে। কেঁদেই চলেছে সে। সাজিদ কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে। স্পৃহা কেঁদে কেঁদে সাজিদের শার্ট ভিজিয়ে ফেলছে। সাজিদ চুপ করেই আছে। আর ভাবছে কি হলো হঠাৎ মেয়েটার। বেশ

কিছুক্ষণ পর স্পৃহা কান্না থামিয়ে স্বাভাবিক হলো।
~ “কিরে এভাবে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?”
~ “সাজিদ আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে!”
~ “মানে?”

~ “কাল বিয়ে!”
~ “ও আচ্ছা অভিনন্দন।”
~ “তুই খুব খুশি হয়েছিস তাই না?”
~ “হুম খুশির খবর খুশি হবো না?”
স্পৃহা আবারো কেঁদে উঠলো।

~ “খুশির একটা খবর আর তুই কাঁদছিস গাঁধি!”
~ “আমি যে তোকে ভালোবাসি সাজিদ!”
স্পৃহা কে নিজের বুক থেকে দু হাতে সরিয়ে দেয় সাজিদ। স্পৃহা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে শুধু দেখছে!

~ “এসব কি বলছিস স্পৃহা মাথা ঠিক আছে?”
~ “হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ঠিকি বলছি। তুই আমার চোখ দেখে বুঝিস না? আমি তো শুনেছি চোখের ভাষায় ভালোবাসা পড়া যায় তুই কেন তা পারিস না?”
~ “এসব কথা আর মুখে ও আনবি না স্পৃহা।”

~ “আমি তোকে ভালোবাসি এটাই আমার শেষ কথা। অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না আমি! আমি তোকেই বিয়ে করবো!”
~ “হাহা কি যে বলিস না তুই। কোন মুখ নিয়ে তোর বাবা মার সামনে দাঁড়াবো? বেকার ছেলের কাছে কেউ তার মেয়ে কে বিয়ে দিবে?

সেদিন স্পৃহা খুব কেঁদেছিলো। সাজিদ শুধু দেখেছিলো তার চোখের সেই করুন আহাজারি কিন্তু করার মতো কিছু ছিলো না। জীবন বড় কঠিন জীবনের মুখোমুখি যে হয় সে ই জীবনের আসল অর্থ টা বুঝতে পারে। স্পৃহা কে সেদিন ই শেষ দেখেছিলো সাজিদ। এর মাঝে আর

দেখেনি। দেখার সুযোগ ছিলো কিন্তু যায় নি ইচ্ছা করেই। আর এই ঐদিনের পর থেকে স্পৃহা কে বড্ড মিস করেছে। তাও জীবনের কারাগারে তার দুটি হাত শক্ত শিকলে বাঁধা পড়ে গেছে। ইচ্ছা আকাশ সমান হলে উপায় গুলো ভাসমান। কোনো নিস্তার নেই এসবের।

মাজেদুল ইসলাম ডেকে পাঠালেন অনি কে। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও মাজেদুল ইসলামের ডেস্কে যায় অনি।
~ “বসুন এখানে!”
~ “জি!”
মাজেদুল ইসলাম নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে অনির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো….

~ “মিস অনিতা আমি আপনাকে যদি এখন বলি আমার সব টাকা শোধ করে দিতে! পারবেন কী তা আপনি?”
~ “অসম্ভব স্যার।”
~ “সম্ভব ই!”
~ “কিভাবে??”

মাজেদুল ইসলামের কথায় সারা শরীর কাঁপুনি দিয়ে রাগ উঠে অনির। একটা মানুষ এতো টা বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কের কিভাবে হয় ছিহ! এক পর্যায়ে মাজেদুল ইসলামের গালে প্রচন্ড জোড়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় অনি। পরিবেশ টা থমথমে হয়ে গেছে। মাজেদুল ইসলাম ও নির্বাক চোখে অনি কে দেখছে। ক্ষিপ্ত হয়ে রেজিকনেশন লেটার মাজেদুল ইসলামের মুখের উপর

ছুড়ে মারে অনি। মাজেদুল ইসলাম ও কম যান না। তার টাকা একদিনের মধ্যে শোধ করতে বলেন নয়তো অনির বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। দুইজন ব্যাক্তির শহস্র কথা সব একটি মানুষ বাহিরে থেকে কান খুলে শুনছে।

চারদিকে অন্ধকার নেমেছে। রাস্তায় হাটছে অনি। কয়েকবার ফোন ও এসেছে কিন্তু তার একটু ও ইচ্ছা নেই ফোন উঠানোর। হাতে কিছু কাগজ সেগুলো রাস্তায় ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। অফিসে অদিতি জানতে চাইলে ও কিছু না বলে অনি বেরিয়ে পড়েছিলো।

আনমনে রাস্তায় হাটছে অনি আর ভাবছে কত শত ভাবনা। হঠাৎ তার কাছাকাছি গাড়ির হর্ন বাজায় সে অপ্রস্তুত ভাবে থাকায় ভয় পেয়ে যায়। ভেবেছিলো এক্সিডেন্ট করে বসবে। কয়েক মিনিট কেটে গেলো। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চোখ খুলে মিটমিট করে তাকালো অনি। সে যা ভেবেছিলো তেমন হয় নি। সব কিছু স্বাভাবিক। গাড়ি থেকে কেউ একজন নেমে আসলো,
~ “আপনাকে আমার সাথে একটু যেতে হবে!”

~ “কোথায়?”
~ “স্যারের বাড়িতে!”
~ “আপনার স্যার কে?”
~ “মিস্টার সাফওয়ান মাহবুব!”

নামটা আজ প্রথম শুনছে অনি। সে ভেবেছিলো মাজেদুল ইসলাম হবে। কিন্তু নাহ তা না অন্য কেউ। অনি ভ্রুঁ কুঁচকে কিছু একটা ভেবে বললো,
~ “উনাকে তো আমি চিনি ই না তাহলে আমি কেন যাবো?”

~ “ভয় নেই ম্যাডাম। চলুন আমার সাথে। গেলে আপনার ই লাভ!”
~ “আমার লাভ বলতে?”
~ “স্যার কোনো কাজের কথা বলবেন আপনার সাথে!”
~ “কাজ আমার সাথে? কি কাজ?”

~ “দেখুন ম্যাডাম সেটা তো আমাকে বলে নি!”
পুরো ব্যাপারটি অদ্ভুত লাগছে। গাড়িতে উঠে বসে অনি। আধঘন্টা পর গাড়িটি একটি বিরাট বড় বাড়ির সামনে থামলো। একটা গার্ড এসে বললো,
~ “ম্যাম চলুন আমার সাথে!”

লোকটার পেছন পেছন হাটছে অনি। দোতলার বারান্দায় গিয়ে পৌঁছায় সে। বারান্দায় লাইট আছে কিন্তু কম আলোয়। একটা লোক কে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট। মুখ সামনের দিকে থাকায় চেহারা দেখে যাচ্ছে না। তিনি সম্ভবত সিগারেট খাচ্ছেন ধোঁয়া উঠছে।
~ “কে আপনি?”

সাফওয়ান পিছন ফিরে তাকায়। সে অবাক হয় নি। অনি তা সুরু দৃষ্টি তে সাফওয়ান কে দেখছে।
~ “বসুন!”
~ “বসতে আসিনি! কি কাজের কথা বলবেন বলুন!”
~ “এতো তাড়া কিসের?”
~ “তাড়া নয় ঘৃণা!”
~ “বুঝেছি!”

~ “আপনি কে আর আমাকে চিনেন কিভাবে?”
~ “পৃথিবীতে সবাই কিন্তু সবাই কে চিনে না! প্রতিদিন দেখা মিলে শত শত অচেনা অপ্রিয় মুখের। সবাই কে চেনার প্রয়োজন নেই। আপনার আর আমার মধ্যে সম্পর্ক হবে গিভ এন্ড টেক এর!”

অনি বুঝলো গম্ভীর লোক।
~ “জি!”
~ “মাজেদুল ইসলাম সাহেবের সব টাকা কালকের মধ্যে শোধ করে দিতে পারবেন না সেটা আমি জানি তবে আপনাকে একটা অফার করতে পারি!”
~ “হোয়াট। আপনারা সব পুরুষ গুলোই এমন। আপনি ও আমার দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাইছেন বাহ মিস্টার বাহ!”

~ “হাহা। আই হেইট অল ওমেন ওকে? সব টা না শুনে আগে থেকেই কথা বলা উচিত নয়!”
~ “কি শুনবো?”
~ “আপনার সব টাকা আমি শিধ করে দিবো এন্ড আপনি যদি এই কব করেন তাহলে আপনার ফ্যামিলির দায়িত্ব আমি নিবো শুধু…
~ “শুধু কি?”

~ “শুধু আপনি আমার মেয়েটা কে দেখাশোনা করবেন। ওর মনে ওর মায়ের জন্য ঘৃণা তৈরি করবেন এটাই আপনার কাজ!”
~ “মানে কি??? আমি একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে এটা করতে পারি?”
~ “টাকার জন্য মানুষ সব পারে ইউ নো দ্যাট?”

~ “মামলা হলে হোক তাও আমি এই নিষ্ঠুর কাজ করতে পারবো না সরি মাফ করবেন আসি!”
~ “আরেক বার ভেবে দেখুন!”
~ “আমি ভেবেই বলছি!”

দোতলা থেকে নিচে আসতেই একটা পিচ্চি মেয়ে এসে অনির কে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। অনি বসে মেয়েটির চোখের পানি মুছে দেয়। কি মিষ্টি চেহারা। কান্না করার ফলে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।

~ “আম্মু তুমি এমন কেন? আমাকে একা করে দিলা কেন? জানো আমার একা থাকতে খুব কষ্ট হয়।”
এতটুকু কথা বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। অনি কে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়। নির্বাক হয়ে আছে মুখে কথা নেই। তিহা ওইভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে। এক হাত জাপটে ধরে আছে অনি কে। অনি ভাবছে তিহা তাকে আম্মু বললো কেন। সাফওয়ান নেমে আসে।
~ -“ছেড়ে দিন ঠিক হয়ে যাবে!”

~ “বেড রুম কোথায়?”
সাফওয়ান হাতের ইশারায় দেখিয়ে দেয়। অনি কোলে করে তিহা কে শুইয়ে দেয়। কেমন একটা মোহো কাজ করছে। মারাত্মক মায়া চেহারায়। অনি চুমু দেয় কপালে। কেন দিলো সে জানেনা। তখন না জেনেই বলেছিলো সে এই পিচ্চির জন্য ঘৃণা তৈরি করতে পারবে না কিন্তু

এখন তো সে একদম পারবেই না কিছুতেই না। ভয়ংকর মায়াময়ী মেয়ে। এর মনে কষ্ট দিলে পাপ লাগবে। সাফওয়ান ড্রয়িংরুমে বসে আছে। অনি আসে সেখানে….
~ “আপনাকে আমার ড্রাইভার পৌঁছে দিবে!”
~ “দরকার নেই!”

~ “কিন্তু আমার দরকার আছে। সসম্মানে এনেছি সসম্মানে পৌঁছে দেওয়া আমি আমার কর্তব্য মনে করি!”
রাত টা আর ঘুম হলো না অনির। কাউকে কিছু বলতে ও পারছে না। কি ই বা বলবে। বলার মতো ও কিছু নেই।

এদিকে সাজিদ মন খারাপ করে থাকায় রিজন জিঙ্গেস করে নিশি। এতোগুলো দিন সাজিদ তার কাছে কোনো রহস্যময় মানব ছিলো আজ সব রহস্য কেটে গেছে। সাজিদ আজ মন খুলে নিশি কে সব বলেছে। এতোদিন নিশির সাজিদের প্রতি আস্তে আস্তে বিশ্বাস জমেছে।

সাজিদ কে একটা জনের জন্য মন খারাপ করতে দেখায় সকালে একটা গুড নিউজ দেবে বলে বিদায় নেয় নিশি। সাজিদ যদি ও কিছু বুঝলো না।

আনমনে ফুটপাথে হাটছে অনি। হঠাৎ করে ময়না সামনে পড়ে। মেয়েটা দেখেই কান্না শুরু করেছে।
~ “ভাবী কই ছিলেন আফনি! আফনারে কতো খুজসি! ওই অমানুষ গুলা শেষমেশ আফনেরে বাইর ই করে দিলো!”

ময়না কান্না থামায়। অনির পাশে হাটছে সে।
~ “ভাবী জানেন আফনেরে বাইর কইরা দিয়া ওরাও ভালো নাই!”
~ “মানে?”

~ “ছোট সাহেব যারে বিয়া করসে ওই মাইয়া আম্মারে বাড়ি থেকে বাইর কইরা বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসছে। সব সম্পত্তি তার নামে করে নিসে শুনছি!”
~ “কিহ!”

~ “হ আর ছোট আফামনি তো কিছু সন্ত্রাসীর হাতে ধর্ষিতা হইয়া আত্মহত্যা করসে!”
হতভম্ব হয়ে আছে অনি। মুখের কথা বলার কোনো ভাষা নেই।
~ “আল্লাহ বিচার করছে ভাবী আল্লাহ বিচার করসে!”

সাজিদ চাকরির কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো। বিশ্বাস হচ্ছে না তার। নিশি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠেছে। নিশি তার বাবার কোম্পানি তে চাকরি দিয়েছে সাজিদ কে।

দুপুরের দিকে মাজেদুল ইসলামের থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে অবাক ই হয় অনি। এতোক্ষণে তো অনেক কিছু হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। সাফওয়ান এসে অনির সামনে গাড়ি থামায়। অনি সুরু চোখে একবার তার দিকে তাকালো।
~ “উঠুন!”

অনি উঠে বসে। একটা নদীর সামনে এসেছে তারা। দুইজনের মাঝে নিরবতা বিরাজ করছে। নিরবতা ভেঙ্গে সাফওয়ান বললো,
~ “আপনি বিস্মিত হচ্ছেন না আজ আপনার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলো না দেখে?”
~ “হ্যাঁ একটু!”

~ “আমি সব টাকা শোধ করে দিয়েছি!”
~ “কেন?”[অবাক হয়ে]
~ “আমার মেয়েটার অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বাবা হয়ে এটা আমি দেখতে পারছি না। আমি চেয়েছিলাম ওর মা হয়ে কেউ আসুক দায়িত্ব নিক। অনেকে রাজি হয়েছিলো

অতটুকুন বাচ্চাটার মনে কষ্ট দিয়ে মায়ের জন্য ঘৃণা তৈরি করতে তারা শুধু আমার টাকার লোভে ছিলো। আপনি তার উল্টো!”
~ “ওও আচ্ছা।”
~ “আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই অনি!”
অনি অবাক হয়ে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে।

~ “কিন্তু আমার কাছে থেকে কখনো স্ত্রীর অধিকার পাবেন না কোনো দিন!”
তিহার মায়ের সব কার্যকলাপ খুলে বলে সাফওয়ান। কেন সে মেয়েদের ঘৃণা করে তাও ও। বাচ্চা একটা মেয়ে কে ছেড়ে যে অন্য ছেলের সাথে পাকাতে পারে সে আর যাই হোক কখনো কারো মা হতে পারে না।

সাফওয়ানের বউ হয়ে এসেছে অনি। কোনো প্রকার হই হুল্লোড় সাজ সজ্জা ছাড়া নরমাল ভাবেই। তিহি তার কোলে ঘুমিয়ে আছে। মায়ায় লেপ্টে আছে চেহারা। গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। মনে হচ্ছে আজ কতোদিন পর শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে সে। অনি আস্তে করে তাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বারান্দায় যায় যেখানে সাফওয়ান দাঁড়ানো। হাতে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি।

অনি ছবি টার দিকে তাকিয়ে টাষ্কিত হয়। হুবহু তার চেহারা। অনি তার মুখে হাত দেয়। সাফওয়ান সেটা লক্ষ্য করে!
~ “আমি ও অবাক হয়েছিলাম আপনাকে দেখে। কারণ আপনি দেখতে মিতার মতো!”
~ “কে উনি?”
~ “বেঈমান টা!”

~ “ও”
~ “এই জন্য ই তিহি আপনাকে ওর আম্মু মনে করেছে। সব সময় এটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতো।”
অনির বুক টা হুহু করে উঠে। বড্ড মায়া বসে গেছে। সাফওয়ান ছবি টি ফ্লোরে আছাড় মেরে ভেঙ্গে অনির সামনে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। অনি ড্যাব ড্যাব করে তার কান্ড দেখছে!
~ “এর কোনো স্থান আর এখানে থাকার প্রয়োজন নেই।”

~ “আমাকে ও কি এভাবে পুড়িয়ে মেরে ফেলবেন?”
সাফওয়ান তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
~ “আমি খারাপ তবে এতো টাও খারাপ নই। আপনি আমার জন্য কেউ নন আমার মেয়ের

জন্য তার মা। আর আমার জীবন আমার মেয়েটা। তিহির মাঝেই আমার প্রাণ পাখি রয়েছে। অন্তত তার জন্য হলেও আমার, কখনো আপনার ক্ষতি করার মতো দুঃসাহস হবে না। বিশ্বাস রাখতে পারেন! বেঈমানি করবো না!”

সাফওয়ান চলে যায়। ক্রুদ্ধ দৃষ্টি চোখে, মুখে রাগ আর একরাশ কষ্টের ছাপ। গম্ভীর লোকটার চোখে মুখে ও কোথাও যেনো হারিয়ে যাওয়া যায় নিমিষেই। অনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তিহি টাকে মাঝপথে ফেলে না দিয়ে বাকি পথ আনন্দে ও মায়ের ভালোবাসার সঙ্গে এগিয়ে দিতে

অনি সাফওয়ান কে বিয়ে করেছে। আর তার পরিবারের সচ্ছলতা ও সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার জন্য ও বটে। মাঝপথে থমকে যাওয়া সব কিছুই আবার সচল হয়ে গেছে শুধু তার জীবন টাই এখনো মাঝপথে আটকে আছে! সে মাঝপথেই দাঁড়িয়ে কারো মুখে হাসি আর

কারো অবহেলায় দিব্ব্যি কাটিয়ে দিতে পারবে। কথায় আছে “ভোগে নয় ত্যাগেই সুখ” তার ত্যাগেই ৪ জন মানুষ সুখী হবে আর তাদের সুখ ই অনির সুখ। অনি আনমনে সাফওয়ানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো…..
ধূমকেতু দেখেছো কখনো?

ধূমকেতুর ন্যায় তুমিও নিভৃতে উদয় হও আমার হৃদয়ও গগনে,
ছোঁয়ার আগেই আবার মিলিয়ে যাও মহাশূন্যে…
যেন এসেছিলে

বাঁকা চাহনিতে প্রেমের ঝড় তুলতে,
তবে তোমাকে দেখার সোভাগ্য আমার হয়েছিলো,
না হয় তোমার স্মৃতিটুকু নিয়েই কাটিয়ে দেবো আরও কিছু রজনী,

আবার আসবে তো নিশিতে?
অপেক্ষায় রইলাম……

লেখা – হিয়া চৌধুরী

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “মাঝপথে – Notun Sad love story bangla” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – অপ্রকাশিত ভালোবাসার গল্প (১ম খণ্ড) – তোমাকে আজও খুজে বেড়াই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *