জীবনের দুঃখের গল্প

ভালোবেসে তোমায় – জীবনের দুঃখের গল্প

ভালোবেসে তোমায় – জীবনের দুঃখের গল্প: জীবন কত অসহায় আর নিষ্ঠুর হতে পারে তা কেবল ভালোবাসার হারা মানুষগুলো বুঝতে পারে, যাদের ভালোবাসার মূল্যায়ন হয় না। চলুন এরকম একটি জীবনের গল্প পড়ি।


পর্ব ১

১৯ বছরের ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে ৪বছরের ভালোবাসার হাত ধরে পালিয়ে এসেছিলাম। তাও আজ থেকে ৫ বছর আগে। ৪ বছরের ভালোবাসা আর ৫ বছরের সংসার মোট ৯ বছর।
৯ বছরের ভালোবাসা, হালকা অভিমান, দুষ্ট-মিষ্টি ঝগড়া আর অনেক খানি তৃপ্তি দিয়ে একটু একটু করে গড়া ভালোবাসাময় সংসার, সেখানে আজ থেকে অন্য কেউ রাজত্ব করবে।
একটা মেয়ের জীবনে এটা মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রনাময়, কিন্তু আমার কোনো অনুভূতিই নেই। নিজের হাতে আমার বর আর তার নতুন জীবনসঙ্গীর রুমটা নিজের মত করে সাজিয়ে দিয়েছি। মেয়েটা তো অনেক আশা নিয়ে এই সংসারে পা রাখতে যাচ্ছে, সেখানে আমার ব্যাবহার করা জিনিসপত্র ব্যাবহার করবে প্রশ্নেই আসে না।

যদিও তার বরটাই এটো, এই ৯বছরে শুধু ওর জীবনে না প্রতিটা পশমের গোড়ায় গোড়ায় আমার অস্তিত্ব মিশে আছে তবে আজ থেকে তার সম্পূর্ন দাবি ছেড়ে দিলাম।
পড়ে থাকতে হবে এই ঘরের কোনো এক কোনায়, আমার যে আর যাওয়ার কোনো জায়গাই নেই।

যেদিন বাবা-মায়ের ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে রাতের অন্ধকারে স্মৃতির হাত ধরে পালিয়ে এসেছি সেদিন থেকে তাদের কাছে আমি মৃত্যু। আর শশুড়-শাশুড়ি তারাও আমাকে মন থেকে মেনে নেয়নি তাই তো বিয়ের প্রথম দিন থেকেই আমাদের নতুন সংসার শুরু হয়।

কলিং বেলের শব্দে ভাবনা থেকে বাস্তবে আসে মায়া, মাথায় ১২ হাত কাপড়ের তের হাত ঘোমটা দিয়ে দরজা খুলে দিল। মন ভরে নিঃশ্বাস নিল আর নতুন বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দোয়া করে দিল।

“যে পূর্নতা আমি দিতে পারিনি সেই পরিপূর্নতা যেন তোমার দ্বারা হয়।”

মুচকি একটা হাসি দিয়ে দরজা থেকে সরে দাড়ালো মায়া।
তার বর নতুন বউয়ের হাত ধরে ভিতরে প্রবেশ করল। কোনো একদিন মায়াও এভাবে হাতটা আকরে ধরে এই বাসায় প্রবেশ করছিল।

তবে সেটা তখন শুধু একটা বাসাই ছিল আর এই মেয়েটা একটা সাজানো-গোছানো সংসারে প্রবেশ করল।
পার্থক্য শুধু এইটুকুই কেই একটা বাসাকে সংসারে পরিনত করছে আর কেউ সেই সংসারে রাজত্ব করবে।

_ আপনারা গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসেন, আমি খাবার রেডি করতেছি।

স্মৃতি একবার মায়ার দিকে আড়চোখে তাকালো, হয়ত ভাবছে মেয়েটা অস্বাভাবিক আচারন করবে, কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে যাবে কিন্তু না মেয়েটা একদম স্বাভাবিক আছে তবে কেমন যেন অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছে।

মায়া ও ফ্যালফ্যাল হয়ে তাকিয়ে আছে স্মৃতির চোখে। মনে মনে বলছে, স্মৃতি শেষ অবধি আমার অনুভূতিটুকুও কেড়ে নিলে।

রুমে প্রবেশ করে আশ্চর্য হয়ে যায় স্মৃতি আর সাথে নতুন বউ। একদম ঝকঝকা নতুন সামগ্রী দিয়ে রুমটা সাজানো, বিছানার চাদর থেকে শুরু করে রুমের প্রতিটা জিনিস।

খাবার রেডি করে ওদেরকে ডাক দিল মায়া, কিছুক্ষনের মধ্যেই রুম থেকে বের হয়ে আসল ওরা। খাবার টেবিলে সব কিছু সাজিয়ে রেখে আড়ালে দাড়িয়ে চোখের জল ঝড়াচ্ছে।

_ কেন কাঁদছিস মায়া? তুই যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলি, তাহলে এভাবে ভেঙে পড়তেছিস ক্যান?
_ ওর পাশে আমি যে কাউকে মেনে নিতে পারি না, আমার দূর্বলতাই তো এই মানুষটা।

_ না তুই কাঁদবি না, একদমই না। পরবর্তী ঝড়ের জন্য নিজেকে তৈরি করে নে।
নিজের অস্তিত্বের সাথে কথা বলে, চোখের পানি মুছে নিল।

ওদের খাওয়া শেষ। আবারও বুকটার ভিতর হাহাকার শুরু হল, যে মানুষটা প্রথম লোকমা আমার মুখে না দিয়ে নিজে মুখে ভাত দিত না। আজ সে একবার জানতেও চাইল না, আমি খেয়েছি কিনা?

কি অদ্ভুদ জীবন!

স্মৃতি আর তার নতুন বউ রুমে ডুকে যখন ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিল, মনে হচ্ছে মায়ার কলিজায় কেউ ছুরি মেরেছে। ছুরিটা এত্তবেশি দাড়ালো যে, পুরো হৃদয়টাই ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে।

একটা বাচ্চাই কি জীবনের সব? আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাটা এতই ঠুকনো ছিল?
আমিও তো বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র সন্তান ছিলাম। তোমার জন্য শুধু তোমার জন্য সেই আদর ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে, তোমার ভালোবাসায় সারা দিয়েছি।

সব থেকেও কেউ ছিল না আমার।
আর আজ সেই তুমিও পর করে দিলে আমার।

তোমার কি একটু কষ্ট হবে না গো, ওই বুকে যখন অন্য কেউ লেপ্টে থাকবে?
তখন কি আমার অস্তিত্ব বিন্দুমাত্র নাড়া দিবে না তোমায়?

এই সংসারে প্রতিটা কানায় কানায় তোমার আমার ভালোবাসা লেপ্টে আছে, সেই ভালোবাসাকে অন্য কেউ মুছে দিয়ে নিজের ভালোবাসার সূচনা করবে।

বড্ড কষ্ট হয়, অনেক বেশি যন্ত্রনা হচ্ছে। তুমি কি একটু অনুভব কর না, আমার অসহনীয় যন্ত্রনা গুলো?

কেউ নতুন ভালোবাসা সৃষ্টিতে ব্যাস্ত আর কেউ বা পুরনো স্মৃতি মনে করে ডুকরে ডুকরে কাঁদে বালিশে মুখ গুজে।
ভালোবেসে বিয়ে করে, ভালোবাসা দিয়েই একটা ভালোবাসাময় সংসার সাজিয়েছে ২জন।

বিয়ের ২বছর পর সেই ভালোবাসার ফসল হিসেবে একটা ছোট্র অস্তিত্ব মায়া পেটে ধারন করে। তখন বুঝি সুখগুলো উপচে উপচে পড়তেছে।

আর সেই সুখগুলোকে বুঝি হিংসে হচ্ছিল তাই তো প্রেগনেন্ট এর ৭ মাসের সময় বাচ্চাটা মিস্ক্যারেজ হয়ে যায়। সেদিন মায়ার চেয়ে স্মৃতি বোধহয় বেশিই কষ্ট পেয়েছিল। ছেলেরা কাঁদতে নেই কিন্তু সেদিন স্মৃতিকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখেছি।

কতটা অনুভূতির থাকলে ছোট্র একটা অস্তিত্বকে এতটা ভালোবেসে ফেলা যায়। তবুও স্মৃতি নিজের কষ্টগুলোকে চেপে রেখে মায়াকে সবসময় সাপোর্ট দিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছে।

এই ৩বছরে আরও ৩বার বাচ্চা মিস্ক্যারেজ হয়ে গেছে।
প্রথম প্রথম স্মৃতি সাপোর্ট করলেও ইদানিং সেও খুব অমনোযোগি মায়ার প্রতি। মায়ার প্রতিটা কাজেই সে বিরক্ত। অনেক ডাক্তার দেখানোর পরও কোনো সমাধানই পাচ্ছে না, তাই তো স্মৃতি আশা ছেড়ে দিয়েছে।

আগের মত আর ভালোবাসা নেই। ভালোবাসাময় সংসারটা যেন একটু ভালোবাসার জন্য হাহাকার করতেছে। যেই মানুষটার বুকে সুয়ে স্বপ্ন বুনে রাত পাড় করত, সেই মানুষটাই এতটাই বদলে গেছে যে সামান্য খেয়ালটুকু রাখে না। অফিস থেকে লেইট করে ফিরে, ঠিকমত কথা বলে না।

মায়া নিজের থেকে কথা বললেও দায়সারা জবাব দেয়।
বাসায় এসেই ম্যাসেজের টুংটাং শব্দে মেতে উঠে স্মৃতি, আর সেই শব্দে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায় মায়া।
ধীরে ধীরে বুঝতে পাড়ল তার প্রয়োজন ফুরিয়ে

আসতেছে।
আর তার সেই ধারনা অনুযায়ী আজ নতুন বউ নিয়ে ফিরল স্মৃতি। হ্যা এর জন্য দায়ী তার অক্ষমতা কারন সে মা হতে পারে না। স্মৃতিকে বাবা হওয়ার সুখটা দিতে সে অক্ষম। কেঁদে কেঁদে সারা রাত কাটিয়ে দিয়েছে, পেটের উপর হাত রাখল।

আজও সে প্রেগনেন্ট, কিন্তু তার কোনো ভরসাই নেই। হয়ত ২-১ মাস পর এটাও মিস্ক্যারেজ হয়ে যাবে।


পর্ব ২

কেঁদে কেঁদে সারা রাত কাটিয়ে দিয়েছে, পেটের উপর হাত রাখল।
আজও সে প্রেগনেন্ট, কিন্তু তার কোনো ভরসাই নেই। হয়ত ২-১ মাস পর এটাও মিস্ক্যারেজ হয়ে যাবে।

ফজরের নামাজ আদায় করে নিল। আল্লাহর কাছে ২হাত তুলল,

_ ইয়া আল্লাহ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হয়েও তাদেরকে নিঃস্ব করে দিয়েছি। তার বিনিময়ে তো আমাকেও বারবার সন্তানহারা করে দিয়েছ।

আমি খুব পাপী গো আল্লাহ, আমি খুব নিঃস্ব। অন্তত এবার এই অসহায়ের প্রতি একটু সদয় হও। আমার পেটের ধন, আমার বুকে এনে দাও।

এই পোড়া মনটায় একটু আশার আলো জ্বেলে দাও। বেঁচে থাকার এই শেষ সুযোগটা কেঁড়ে নিও না।

২হাত তুলে আল্লাহর কাছে অজরে কেঁদে কেঁদে সাহায্য চাইল। আরও কিছু টাইম প্রার্থনায় কাটালো।
বারবার বাচ্চা মিস্ক্যারেজ হয়ে যাওয়া, এটা হয়ত বাবা-মায়ের চোখের জলের প্রতিদান। সন্তান হারানোর কষ্ট আজ তীলে তীলে বুঝতে পারতেছে।

আগে যদি এই যন্ত্রনা সামান্য পরিমান অনুভব করতে পারত, কখনোই বাবা-মায়ের চোখের জলের কারন হত না।

সকালের সূর্যটাও উকি দিচ্ছে, মায়া উঠে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।
আলোতে পরিপূর্ন সূর্যটা চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে শুধু জীবনের আলোটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আশাগুলো নিরাশাময় হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বোধহয় জীবনটা গতি হারিয়ে ফেলতেছে।

কি ছিলাম, কি হলাম আর কি হব?
চারদিকে আলোতে জ্বলমল করতেছে, এতক্ষনের শান্ত নগরিটা ব্যাস্ত হয়ে উঠতেছে। ধীর পায়ে কিচেনে ঢুকে নিজেও ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।

বিয়ের পর থেকে স্মৃতি এমন কোন দিন ছিল না শান্তিতে রান্না করতে দিত।
_ বউ, এই বউ (জড়িয়ে ধরে)

_ সকাল সকাল আবার জ্বালানো শুরু করে দিয়েছ?
_ রেগে যাচ্ছ কেন (নাকের ডগায় চুমো দিয়ে)

_ ছিঃ ছিঃ ঘেমে একাকার হয়ে গেছি, আর ওনি চুমো খাচ্ছে।
_ ভালো লাগে তোর ঘামে ভেজা মুখটা। ঠোঁটের ছোয়ার মুছে দেওয়ার লোভটা সামলাতে পারিনা।
_ সকাল সকাল ন্যাকামি। একদম ডিস্টার্ব করবে না।

_ উহু, নো ন্যাকামি শুধু হেল্প করছি

_ হু হেল্প না ছাই। আমার কাজের ১২টা বাজাচ্ছে।

_ এই একদম বকবক করবে না, তারাতারি রান্না কর অফিসের দেরি হয়ে যাবে।
_ তাইলে ছাড়।
_ উহু এভাবেই।

_ দূর ছাই, যত মসিবত।

এভাবেই প্রতিটা সকালের রান্নায় স্মৃতি হেল্পের নামে জ্বালিয়ে মারত। স্মৃতি পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখত, কখনো বা চুলগুলো ছেড়ে মুখ গুজে দিত।

মায়া মুখে মুখে যতই রাগ দেখাত, কিন্তু অন্তরে ভিন্ন অনুভূতি বয়ে যেত। আর কখনো হয়ত এই মুহূর্তগুলো ফিরে আসবে না। পিছু তাকালেই শুধু অতিত হাতরে বের হয়।

রান্না প্রায়ই শেষ। এখন ওনাদেরকে ডাকা উচিত বাট মেয়েটার নামটাই জানা হল না।
আনমনা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রান্না ঘরে কিছু ভাঙার শব্দে পিছু ফিরে তাকালো মায়া।

কাঁচের বাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, মেয়েটা সেই কাঁচের টুকরো গোছাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।

_ আরে রে করছ কি? হাতে বিধে যাবে তো, সরো তো দেখি আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।
_ সরি, আসলে আমি খেয়াল করিনি।
_ সরি কেন?

তোমার সংসার তুমি ভাঙবে, তুমি তুমি গড়বে। হঠাৎ করে কেউ তো আর পাক্কা ঘরওয়ালী হয়ে আসে না।
_ আমাকে শিখিয়ে দেন, বাকী খাবারগুলো আমি তৈরি করে দেই।

_ তুমি এ বাসায় নতুন, অন্তত কয়েকটাদিন বিশ্রাম কর। তারপর না হয় এসব কাজ-বাজ কইরো।
তোমার বর উঠছে?
_ তোমার বর শব্দটা শুনে মেয়েটা উদ্ভুদভাবে তাকালো।

মায়া খানিকটা হাসল ওর এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে।
_ কি হল যাও ওনাকে উঠিয়ে নিয়ে এসো।
ওহ ভালো কথা, তোমার নামটাইতো জানা হল না।

_ ইফতি
_ তোমার নামের মতই তুমি খুব মিষ্টি।
_ আপু।

_ কিহ, কিছু বলবে?
ভয় পেয় না। আগলে যখন রাখতে পারিনি তখন আর কেড়ে নিব না। তোমার সংসার তুমি বুঝে নাও, তবে কাজের লোক হিসেবে থাকতে দিও।

বুঝোই তো পালিয়ে এসেছি। সো, আর কোনো আশ্রয় নেই। তবুও যদি তোমাদের বিশেষ অসুবিধা হয়, তখন না হয় ঠিকানা খুঁজে নিব। আল্লাহর দুনিয়াতে আর না হোক, সাড়ে ৩হাত জায়গা তো পাব।

ইফতি যতই মায়াকে দেখতেছে ততই যেন অবাকের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
একটা মানুষ কতটা কঠিন হলে এভাবে স্বাভাবিক থাকতে পারে।

স্বামী এমন একটা মূল্যবান ধন, মেয়েরা সব ভাগ দিতে রাজী শুধু স্বামী ছাড়া।
আর সেখানে মায়া যেন অনুভূতিহীন মানবী।

এই এক মাসে অনেকটা খাতির জমিয়ে ফেলছে ইফতির সাথে।
যদিও সেদিনের পর থেকে কখনো স্মৃতির মুখটা দর্শন করেনি।
সর্বদা সতর্ক থাকে, যাতে মৃত্যুর আগে কখনো ওই মানুষটার মুখটা সামনে না পড়ে।

বড্ড ঘৃনা হয়, কতটা নীচ মেন্টালিটির হলে এমন জগন্য কাজ করতে পারে।
আরে তোমায় ভালোবেসেই তো সব ছেড়েছি আর দিনের শেষে তুমিই আমাকে ছেড়ে দিলে।
খুব বেশি বেইমান তুই।

স্মৃতি বাসায় এসে প্রায়ই আড়চোখে মায়াকে খুঁজে বেড়ায়। মাঝে মাঝে ওর মুখটা দেখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু বাসায় থাকলে তো মায়া রুম থেকেই বের হয় না আর খাওয়া দাওয়া তো দূরের কথা।

আর যদি কখনো মুখোমুখি হয়েও যায় তখন ১২হাত কাপড়ের ১৩হাত ঘোমটা টেনে দেয়। এভাবে একটা মানুষ বন্দি থাকলে তো তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলবে তাই সময় পেলেও খুব কম টাইমই বাসায় থাকে স্মৃতি।

তবে মনে মনে শান্তিও পায়। সতিনের সংসারে নাকি ঝামেলা বেঁধেই থাকে কিন্তু সেখানে ইফতি নূন্যতম অভিযোগ তোলে না।

তুলবেই বা কেমনে সেই সুযোগটাই তো পায়না। বিয়ের দিন ভেবে নিয়েছে মায়াকে একটা আলাদা ফ্লার্ট ভাড়া করে দিবে বাট এখন বোধহয় তার আর প্রয়োজন নেই।

খাবারের সময় ইদানিং আড়চোখে মায়াকে খোঁজে স্মৃতি, যেটা ইফতির চোখকে এড়ায় নি।
যদিও মনের ভিতর একটু অশান্তি হয় তবু কিছু বলে না।
তবে হঠাৎ একদিন বলেই ফেলল।

_ আপু আপনি তো আমাদের সাথে বসেই খেতে পারেন

_ কষ্ট হবে না তোমার, তোমার স্বামীর পাশে, তোমার সতিনে বসে খাবার খাইলে?

ইফতি মাথা নিচু করে চলে গেল। আসলেই তো, হ্যা শুধু কষ্ট না বড্ড বেশি তার চেয়েও বেশি কষ্ট হবে। আমি মেনে নিতে পারব না স্মৃতির পাশে কাউকে।

ইফতির এভাবে চলে যাওয়ায় উত্তরটা ভালোভাবেই পেয়ে গেছে মায়া।

হায়রে মেয়ে, তুই সামান্য এইটুকু মেনে নিতে পারবি না আর সেখানে দিব্যি সুখে শান্তিতে আমার স্বামীকে নিয়ে কিভাবে আমার গড়া রাজ্যে রাজত্ব করতেছিস।


পর্ব ৩

হায়রে মেয়ে, তুই সামান্য এইটুকু মেনে নিতে পারবি না আর সেখানে দিব্যি সুখে শান্তিতে আমার স্বামীকে নিয়ে কিভাবে আমার গড়া রাজ্যে রাজত্ব করতেছিস।

সময় তার আপন গতিতে পাড় হয়ে যাচ্ছে।
মায়া প্রেগনেন্ট ৭মাস। খুব দূর্বল হয়ে পড়তেছে। রাতে তো একদম ঘুমাতেই পারে না। রুম থেকে বারান্দা আবার বারান্দা থেকে রুমে পায়চারি করে রাত পাড় করে দেয়।

_ এইইই (বালিশ দিয়ে মাইর দিয়ে)
_ কি হল তিশু পাখি
_ কি হয়নি বল, আমাকে অশান্তিতে রেখে নিজে ঘুমাচ্ছ ক্যান?
_ আমি আর অশান্তি! তাও তোমাকে?

_ তুমি না তো কে হ্যাঁ। আমি প্রেগনেন্ট এর জন্য দায়ী কে হ্যাঁ? খাটাশ লোক একটা।
_ আরেরে তিশুপাখিটা রাগতেছে ক্যান?
_ একদম স্পর্শ করবে না আমায়, তোমার বাবুরা আমাকে ঘুমাত দেয়না ক্যান হ্যাঁ (এলোপাথারি মাইর আর সাথে তো বকা আছেই)।

আমি ঘুমাবো, আমার বুঝি ঘুম পায়না। (কাঁদো কাঁদো হয়ে)

_ কিহ, ওদের এত্তবড় সাহস। আমার তিশুমনিকে জ্বালায়, এদিকে এসো বকে দিচ্ছি। (বুকের সাথে লেপ্টে নিয়ে)
তিশুপাখি।
_ হু

_ বাবুরা বড় হচ্ছে তো তাই তোমাকে জানান দিচ্ছে, মাম্মাম আমরা আসতেছি। আর একটু সহ্য কর পাখিটা, আর কয়টাদিন তো।
_ তাইলে তোমাকে ক্যান জ্বালায় না?

_ বাবুরা তো তার মাম্মামকে বেশি ভালোবাসে তাই মাম্মামকে জ্বালায়। এখন আমার তিশুপাখিটা ঘুমাবে
_ উহু, কোলে নাও
_ এখন! সকালে অফিস আছে তো।
_ গোল্লায় যাক তোমার অফিস। তারাতারি কোলে নাও
_ বাধ্য হয়ে কোলে তুলে নিল নয়তো হরতাল শুরু করবে।

_ আমি না ঘুমানো পর্যন্ত আমাকে কোলে নিয়ে হাটবে, বুঝেছ
_ এ্যাআআআ!
_ এ্যাআআ না হ্যাঁ। তোমার বাবুরা যতক্ষন আমাকে জ্বালাবে ততক্ষন তোমাকে আমি জ্বালাবো।

ফিক করে হেসে উঠল মায়া। মায়ার হাসির শব্দে শাশুড়ি জেগে উঠছে, ,
_ কিরে মা কি হইল, হাসতেছিস ক্যান?

শাশুড়ির কথায় হুস ফিরে পেল মায়া। সে তার অতিত হাতরে বেরাচ্ছিল এতক্ষন। ইশ কতটা যত্নে গড়া ভালোবাসা আজ তা সবই অতিত।
স্মৃতি যদি পাশে থাকত তাইলে আজও এভাবে জ্বালাতো।

চোখ বুঝে ঘুমানোর চেষ্টা করতেছে।
মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড হিমু হচ্ছে। কোন পাপের বিনিময় এমন সন্তানের মা হল কে জানে। হঠাৎ বিয়ে করে নিয়ে আসার জন্য মানতে পারেনি মেয়েটাকে কিন্তু তবুও কখনো তো ছেড়ে দিতে বলেনি। এমন ছেলের মা পরিচয় দিতেও বিবেকে বাধাঁ দেয়।

মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে শাশুড়ি আর মায়ার ২চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়তেছে, কতদিন কারো ভালোবাসার স্পর্শ পায়নি।

_ আটকাতে পারলি না রে মা?
_ যে যেতে চায় তাকে আটকে কয়দিন রাখা যায়।
_ বুঝি না বাপু, তোরা এযুগের হয়েও এমন কাজ কেমনে করলি। একটা বাচ্চা তো এডোপ্ট ও নিতে পারতি।

_ বলছিলাম মা। তবে অক্ষমতা তো আমার, তার তো আর না।
_ কষ্ট হয়না এখানে থাকতে?
_ বড্ড কষ্ট হয়, মা

_ যাবি আমার সাথে?
_ মায়ার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠছে।
যাবেনা মানে একটা আশ্রয়ের অভাবেই তো এখানে পড়ে থাকা।

সকাল থেকে মায়া যাবতীয়, যা যা প্রয়োজন আরকি সব গুছিয়ে নিচ্ছে। বিকেলে রওনা দিবে শাশুড়ির সাথে।
শাশুড়ি নামাজ পড়তেছে, ইফতি সাওয়ার নিচ্ছে আর এদিকে অনাবরত কলিংবেল বেজেই চলছে।

তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে দরজা খুলে দিয়ে, তারাতারি সরে যেতে নিলে কাপড়ের সাথে পা আটকে পড়ে যেতে নিল কেউ একজন ধরে ফেলল।

স্পর্শটা মায়ার খুব ভালোভাবেই চেনা। কিছুক্ষনের জন্য যেন জমে বরফ হয়ে গেল। তার সেই চিরচেনা ২টো হাত তাকে আকরে ধরেছে। যে হাত ২দুটোকে ভরসা করে সব ছেড়ে এসেছিল।

তবে আজ আর সেই স্মেলটা পাচ্ছে না। যে স্মেলটা পাগল করে দিত, দূর থেকে তার উপস্থিতি জানান দিত।
এই স্মেলটার জন্য কতই না পাগলামী করত। রিলেশন চলাকালীন যখন দেখা করত, স্মৃতিকে দেখার সাথে সাথেই জড়িয়ে ধরে বুকে নাক গুজে দিয়ে প্রানভরে স্মেলটা নিঃশ্বাসের সাথে মিশিয়ে নিত শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরায়।

আবার যাবার সময় সেইম কাজটা করত।
একদিন মায়া ফ্রেন্ডদের সাথে শপিং গেল, হঠাৎ তার নাকে তার পাগল করা স্মেলটা এসে লাগল।
সাথে সাথেই স্মৃতিকে ফোন দিল।

_ তিশুপাখি, আমি বিজি আছি। পরে ফোন করছি
_ একদম ফাজলামী করবে না আমার সাথে। তুমি নিউ-মার্কেটে আছ?
_ তোমাকে কে বলল হ্যাঁ?

_ কেউ না, তোমার উপস্থিতি কেউ বলে দিতে হবে ক্যান। তোমার শরীরের স্মেলটা আমি এখানে পেয়েছি।
_ হ্যাঁ, আমার বউটা সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল গো এবার। এই স্মেলটা কি অন্য কারো থাকতে পারে না?

_ না পারে না। আমার হৃদয়ে হৃৎপিন্ডের চাইতেও অনেক গভীরে, রক্ত আর শিরা-উপশিরারও অনেক গহিনে, যে অস্পর্শ অবিনশ্বর রুহ আছে সেই রুহুবিন্দুর সাথে মিশে আছে তোমার স্মেল।

সেই অনুভূতিটা কি মিথ্যা হতে পারে।
_ শপিং মলের আড়ালে দাড়িয়ে কথাগুলো শুনতেছিল স্মৃতি। শুধু শুনতেছিল না প্রানভরে অনুভব করার চেষ্টা করতেছিল কতটা ভালোবাসলে এতটা সিরিয়াস হতে পারে।

মায়া কথাগুলো শেষ করে সামনে তাকানোর সাথে সাথেই থমকে যায়। স্মৃতি ২হাত দুদিকে ছড়িয়ে দাড়িয়ে আছে, মায়া চোখ বুঝে এক দৌড়ে স্মৃতির বুকে জায়গা করে নিল।
হ্যা তার অনুভূতি, অনুভব গুলো ঠুকনো না।

_ এত ভালবাসিস ক্যান পাগলী?
_ যেদিন ব্যাখ্যা করতে পারব সেদিন তুমি আমি ভালোবাসাময় রের্কড গড়ব।

চোখ ২টো ভিজে উঠল মায়ার। স্মৃতি চোখের পানি মুছিয়ে দেওয়ার স্পর্শে হকচকিয়ে উঠল সে। চোখ মেলে তাকিয়ে।
স্মৃতির সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল, চোখগুলো নামিয়ে ফেলল মায়া।
এই দৃষ্টিতে ডুবে গিয়ে আজ খেসারত দিতে হচ্ছে, বড্ড ঘৃনা করে এই দৃষ্টিটাকে আজ।

_ দেখে চলতে পার না?
_ দেখতে দেখতে বড্ড ক্লান্ড এবার না হয়, না দেখেই বাকীটা জীবন পাড় করলাম।
_ যদি পড়ে যেতে

_ বেশি কিছু হলে মরেই যেতাম। সেইটুকুই তো বাকী আছে।

খুব যত্নে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, স্মৃতির দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। স্মৃতি চেয়ে আছে ওর যাওয়ার পানে। কতদিন পর মুখটা দেখছে হিসেব নেই, আর হিসেব করার সময়ই বা কোথায়।

বেশ ভালোই আছে নতুন সঙ্গীকে নিয়ে। তবে বুকের ভিতর হঠাৎ চিনচিনিয়ে ব্যাথা করতে, এই কি সেই মায়া। যার কাজল টানা চোখের জালে আটকে গেছিলাম। আজ আর চোখে কাজল নেই কিন্তু চোখের নিচে কষ্টের কালো ছাপ পড়ে আছে।


পর্ব: ৪

ভালোবাসা দিয়ে গড়া, ভালোবাসাময় পৃথিবীটা আজ ছেড়ে যাবে।
মায়া ফ্লাটের প্রতিটা কানায় কানায় হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে।

আর কখনো ফেরা হবে না তার নিজের হাতে গড়া স্বপ্নের স্বর্গে। স্বর্গটা আজ অন্য কারো দখলে। কি দরকার আর মিছে মিছে হিমু বাড়িয়ে।
হিমু বাড়িয়ে যখন লাভ নেই তখন না হয় হিমু কাটিয়েই নিবে।

_ ইফতি, আসব?
_ জী, আপু। আসেন
_ নাও ভাই, তোমার সবকিছু বুঝে নেও (সংসারের একগোছা চাবি হাতে দিয়ে)

_ থাক না আপনার কাছে
_ এত মূল্যবান জিনিস বহিবার শক্তি বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই। আর তাছাড়া আমি চলে যাচ্ছি, তাই তোমার জিনিস তোমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাই

_ চলে যাচ্ছেন মানে?
_ হ্যাঁ, মা বলছে ওনার কাছে আমি থাকতে পারব। তাই শুধু শুধু তোমাদের সংসারে ঝামেলা নাই বা করলাম। আর তাছাড়া তোমাদের প্রাইভেসিরও প্রয়োজন আছে যদিও এতটা দিন তোমাদের সাথে ছিলাম।

কি করব বল, উদ্দেশ্যহীন পথে তো আর পা বাড়ানো যাবেনা আর এখন যেহেতু একটা ঠিকানার সন্ধান পেয়েছি।
সো, এই সংসার ছাড়া উচিত।

স্মৃতির দেওয়া সকল গহনা মায়ার হাতে তুলে দিল।
যদিও এগুলো আমি ব্যাবহার করছি কিন্তু এগুলো তোমার বরেরই কিনে দেওয়া।
তুমি না হয় ভেঙ্গে নতুন করে গড়ে নিও।

_ বর তো আপনারও, এগুলো আপনার কাছেই রাখা উচিত। আর আপনার গহনা আমি কেন নিব?
_ উচিত, অনুচিত বুঝার মত পরিস্থিতিতে নেই আমি।

সবচেয়ে দামি জিনিসটাই তো নিয়ে নিলে, তার দেওয়া ঠুকনো স্মৃতির বোঝা আমার কাছে নাই রাখলাম।
_ আপনি ওনার কাছেই দিয়ে যাইয়েন।

_ তার মুখ দর্শন করার ইচ্ছা আমার নেই বইন।
আর শোনো তোমার প্রতি হিমু জন্মাই গেছে, অন্তত সপ্তাহে একদিন আমি ফোন দিয়ে জ্বালাব। বিরক্ত হলেও একটু কথা বল।

ভালো থেক। সংসারটা সাবধানে রেখ, তোমার কাছ থেকে যেন কেউ কেড়ে না নেয়।

মায়া রুম থেকে বের হয়ে আসল। ইফতি ওর যাওয়ার পানে চেয়ে আছে, শেষ উক্তিটা কি আমাকে অভিশাপ হিসেবে দিয়ে গেল?

স্মৃতি বিকেল ৪টা বাজে গাড়ি নিয়ে বাসার সামনে আসল। মায়ের জন্য অপেক্ষা করতেছে। খুব কষ্টে বাসার বাহিরে পা রাখল মায়া, এই মুহুর্তে যদি তার রূহটা বের হয়ে যেত তাইলেও বোধহয় এতটা কষ্ট হত না।

বারবার পা টা থমকে যাচ্ছে, ছেড়ে যাচ্ছে সে তার আপন ঠিকানা। ইশ মনে হচ্ছে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখতেছে, এই বুঝি স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। আর তখন মায়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে, স্মৃতি মায়াকে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে আদর করে দিবে।

_ এই পাগলী, কি হল। তুমি জাননা, বড্ড কষ্ট হয় তোমার চোখের জল দেখলে।
এই দেখ, কতটা কাছে আছি তবুও কেন ভয় পাচ্ছ। তিশুপাখি কেঁদ না, সারা জীবন পাশে থাকব।

কিন্তু না সে ঘুমের ঘোরে নেই, সে এখন কঠিন বাস্তবতার মাঝে আছে।
এক বুক আশা, সারাজীবন এক সাথে থাকার শপথ করে স্মৃতির ২হাত আকরে ধরে পা রেখেছিল।
ভেঙে গেছে শপথ আজ, হয়ে গেল জীবনটা গতিহারা।

নীড়ের ঠিকানা তার জন্য না, রাকিব তুলার মত উড়তেছে জীবনটা আদৌ তার বিরতি আছে কিনা।
গেটের সামনে আসার সাথে সাথে স্মৃতির চোখগুলো ছানাবড়া। মায়ার পেট স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা বড়, তাইলে কি মায়া প্রেগনেন্ট। আর ও চলে যাচ্ছে ক্যান, এখানে ওর সমস্যা হচ্ছে কোথায়।

গাড়িতে উঠে মায়া ওর শাশুড়ির পাশে বসল, স্মৃতি মুখোমুখি ভিন্ন সিটে।
মায়া একবারও ওর দিকে তাকালো না, একদম স্বাভাবিক হয়ে বসে আছে।

স্মৃতি কেন যেন ফ্যালফ্যাল হয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ওদেরকে স্টেশনে পৌছে দিয়ে, স্মৃতি বাসার দিকে পা বাড়াল। বুকটা একটু একটু শূন্য লাগতেছে। কিন্তু কেন লাগতেছে তা জানা নেই, তার তো সবই আছে।

শশুড়-শাশুড়ির সাথে দিনগুলো ভালোই যাচ্ছে মায়ার। নিজের মেয়ের মত খেয়াল রাখতেছে তারা। এর মাঝে একবার ফোন দিয়ে ইফতির সাথে কথা বলেছে, তারপর নিজের থেকেই যোগাযোগ অফ করে দিয়েছে।

ইফতি আর স্মৃতির সংসারও খুব সুখেই কাটতেছে। ইফতি প্রেগনেন্ট, নিয়মিত চেকাব করছে। সবকিছু স্বাভাবিক আছে। মায়াকে একপ্রকার ভুলেই গেছে স্মৃতি, মায়া নামের কেউ একজন ছিল কখনো এমনটা তার ধারনায়ও আসে না।
বেশ আছে তার বউ আর অনাগত সন্তান নিয়ে।

আর কয়েকটা দিন, মায়ার কোল জুঁড়ে আসবে তার বেঁচে থাকার শেষ আশা।
মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়, এতটা পথ এসে আল্লাহ যদি কেড়ে নিয়ে যায়। কি নিয়ে বাচবে, বাঁচার জন্য তো প্রেরনা প্রয়োজন।

আর তার অনাগত সন্তানই তার সেই প্রেরনা। খুব জ্বালায় বাবুটা, ইশ কবে যে বুকে পাবে, ছোট্র ২টো কোমল হাতে ছুঁয়ে দিবে।
বুকভরা আশা নিয়ে বেঁচে আছে মায়া।

শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছেনা, মা-বাবাকে খুব মিস করতেছে। আজ অনেক দিন পর মায়ের নম্বরটায় ডায়েল করল। _ হ্যালো।
_ মা।

_ কে তুমি?
ভুল নম্বরে কল করেছ, আমার কোনো সন্তান নেই।
_ সেই জন্য বুঝি আমাকে বারবার সন্তানহারা করে দিচ্ছ?

_ ফোনটা কাটতে গিয়েও থেমে গেল মায়ার মা, ফোনটা কানে চেপে রেখেছে।
_ শেষবারের মত কিছু একটা চাইব।

_ জলদি বল, আমি বিজি আছি
_ আমার উপর থেকে অভিশাপটা তুলে নাও।

_ অভিশাপ!
_ তোমাকে যেমন সন্তানহারা করে দিয়েছি তেমনি আমাকেও উপর আল্লাহ একবার না বারবার সন্তানহারা করে দিচ্ছে।

এই অনাগত সন্তান ছাড়া আমার আর কেউ নিয়ে। প্লীজ কেড়ে নিও না তোমার অভিশাপ দ্বারা আমার বাচ্চাটাকে।
আমার যে আর বেঁচে থাকার অবলম্বনই থাকবে না।

কাঁদতে কাঁদতে ফোন কেটে দিল মায়া।
মেয়ের কন্ঠটা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তার মন বলছে, তার কলিজাল টুকরোটা ভালো নেই।
দুনিয়াতে একমাত্র মা হচ্ছে আলৌকিক শক্তি যে চোখের চাওয়ায় সন্তানের মুখের ভাষা বুঝে নেয়।

মেয়ের কান্না জড়িত কন্ঠ তাকে বড্ড জ্বালা দিচ্ছে, হয়ত অত্যাধিক কষ্ট পেয়েছে কিন্তু মায়া অশান্তিতে থাক এমনটা ভুলেও ধারনায় আসে নি।

খোঁজ নিয়ে মেয়ের অসহ্যকর অবস্থা শুনে বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে তার। তার মেয়ের এখন তাকে প্রয়োজন, হ্যাঁ বড্ড বেশি প্রয়োজন।

অনেক অভিমান করছে আর না, তার বুকে এনে রাখবে তার মেয়েকে।
বাবাকে বলার পর সেও মুখটা ফিরিয়ে রাখতে পারেনি, বেড়িয়ে পড়েন মেয়ের শশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে।

মেয়েকে দেখে চোখ দিয়ে অজরে জল পড়তেছে, আর অপ্রস্তুত ভাবে বাবা-মা কে দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি মায়া। বাবা-মাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতেছে। আজ যেন সকল কষ্ট, মান অভিমান চোখের জলের সাথে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে।

মায়াকে নিয়ে যাবে তারা, শশুড়-শাশুড়ি বাঁধা দিতে চেয়েও পাড়ল না।
এই কয়েকদিনে মেয়েটা বড্ড হিমু জন্মাই ফেলছে।

মিথ্যে সুখের সন্ধানে একদিন যে বাড়ি ছেড়ে এসেছে আজ আবার সেই বাড়িতেই পা রাখতেছে একটু সুখের আশায়।
বাবার বাড়িতে দিনগুলো ভালোই কাটতেছে, হয়ত মনের সুখটা নেই তবুও ভালো আছে।

প্রেগনেন্টের পর থেকে ইফতি বাসায় থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতি বাসায় আসার সাথে সাথেই আদুরে গলায় কোথায়ও ঘুরতে যাওয়ার আবদার করে বসল।

বিকালে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল তারা।
অন্যদিকে, মায়ার লেবার পেইন উঠছে। তাকে নিয়ে বাবা-মা হাসপাতালে চলে গেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে, সেই হাতটাকে খুব বেশী প্রয়োজন।
ইফতি যখন বাইকে বসে স্মৃতিকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।

সেই মুহূর্তে মায়া লেবার পেইনের যন্ত্রনায় হাসপাতালে বেডটাকে খামচে ধরল।


পর্ব ৫

ইফতি যখন বাইকে বসে স্মৃতিকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।
সেই মুহূর্তে মায়া লেবার পেইনের যন্ত্রনায় হাসপাতালে বেডটাকে খামচে ধরল।

দাতে দাত চেপে সহ্য করে যাচ্ছে, মাতৃত্বের ব্যাথা। আর স্মৃতি তার বউকে নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে দুনিয়া।
হাসপাতালের বেডে সুয়ে কাতরাচ্ছে আর আল্লাহকে ডাকতেছে মায়া। আর ইফতি আগামীর স্বপ্ন বুনতেছে আর সুখের স্বর্গে ভাসতেছে।

আল্লাহ মায়ার ডাকে সারা দিল এবার, এই মুহূত্বে তার রহমতের দরজা সম্পূর্ন খুলে দিয়েছে।

ব্যাথা যখন চরম মাত্রায় ঠিক সেই মুহুর্তে ডেলিভেরি হল। লেবার পেইন সহ্য করতে না পেরে আল্লাহ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল এবং জ্ঞান হারালো। মায়ার আল্লাহ বলে চিৎকারের শব্দ শুধু হাসপাতালের ভিতরে সীমাবদ্ধ ছিল না। আকাশে বাতাসও কেঁপে উঠছিল।

ঠিক সেই কম্পনে মুহুর্তেই ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ লেগে স্মৃতির বাইকটা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে মাটির সাথে পিষে যায়।
ছিটকে পড়ে গাড়ি থেকে ওরা, মারাত্বক দূর্ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় লোকজনের সহতায় হাতপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। স্মৃতির ফোনের নম্বরের শেষ কল ছিল ওর ফ্রেন্ডের, তাকে ফোন দিয়ে জানানো হয়।

ওনি যতদ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ছুটে আসে। স্মৃতির জ্ঞান ফিরলেও ইফতির অবস্থা খুবই খারাপ। ইফতির ফ্যামিলিকে ফোন দিয়ে জানানো হয়েছে।
_ মি। স্মৃতি। আপনার স্ত্রীকে দ্রুত অপারেশনের ব্যাবস্থা করতে হবে।
_ ইফতি ঠিক আছে ডক্তর? আমার সন্তান?

_ প্লীজ শান্ত হোন। বাচ্চা মিস্ক্যারেজ হয়ে গেছে আর সাথে মায়ের অবস্থা শোচনীয়। এই মুহুত্বে অপারেশন ছাড়া
ওনাকে বাঁচানো সম্ভব না।

এমন একটা পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না স্মৃতি। এই তো দুপুরেও বেবিটাকে নিয়ে কতটা স্বপ্ন দেখছে, পেটে কান রেখে কথা বলছে। ওরে কথাও দিয়েছে, অনেকগুলো খেলনা নিয়ে আসবে।

কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, ফ্যালফ্যাল হয়ে তাকিয়ে আছে। ডাক্তার ওর কোনো উত্তর না পেয়ে মুখের পানে চেয়ে আছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে ইফতির আত্মীয়-স্বজনরা হাসপাতালে এসে পৌছালো।
_ স্মৃতি, তুমি ঠিক আছ বাবা?
আমার ইফতি কোথায়, আমার মেয়ের কি অবস্থা?

_ আপনার মেয়ের দ্রুত অপারেশন প্রয়োজন। নয়ত, যত টাইম যাবে ওনার জীবন রিস্কের মুখে পড়ে যাবে।
_ আপনি দ্রুত অপারেশনের ব্যাবস্থা করেন, আমার মেয়েটাকে সুস্থ করে দিন।

সবাই যে যার সন্তান নিয়ে ব্যাস্ত। সন্তান মিস্ক্যারেজ হয়ে গেছে শুনে স্মৃতি থমকে গেছে। ইফতির বাবা-মা তার সন্তানের সুস্থতার জন্য ব্যাস্ত। মায়ার বাবা-মা তারাও তাদের মেয়ের সুস্থতার জন্য দোয়া করতেছে।

আর মায়া সে সন্তানের মুখ দেখার আশায় লেবার পেইনের মত নাড়ী ছিড়ে যাওয়া ব্যাথা দাতে দাত চেপে সহ্য করে যাচ্ছে।

ডাক্তর o। t থেকে বের হয়ে আসল।
_ ডক্তর, আমার মেয়ে (ইফতির ফ্যামিলি)
_ জী আল্লাহকে ডাকুন। এখনো কিছু বলতে পারতেছিনা।

ওনার জরায়ুতে প্রচন্ড পরিমান আঘাত লাগছে, ৯৮% ই থেতলে গেছে। ওটা কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, নয়তো ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যাবে।

দ্রুত ডিশিসন জানান, হাতে সময় খুব কম।

স্মৃতি তো শকড। বাচ্চা মিস্ক্যারেজ হয়ে গেছে, এখন যদি জরায়ু কেটে ফেলা হয় তাইলে আর সন্তান হওয়া সম্ভব নয়
_ ডাক্তার, আর কোনো উপায়?
_ দেখুন, আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারতেছি।

তবে আমরা নিরুপায়
_ হাত মুষ্ঠি করে চুপ করে আছে স্মৃতি
_ ডাক্তার যেভাবে সম্ভব আমার মেয়েকে বাঁচান। যেটা ভালো হবে তাই করেন।

ডাক্তার একবার স্মৃতির দিকে তাকিয়ে ভিতরে চলে গেল। ইফতির জরায়ু কেটে ফেলা হল। আর অন্যদিকে মায়ার জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে সামনে তাকালো, ওর মা ইশারায় পাশে তাকাতে বলল।

পাশে ফিরে তাকিয়ে মুহুত্বেই এই ৯মাস ১২ দিনের কষ্ট ভুলে গেল, মুখে তৃপ্তির হাসি ফুঁটে উঠল।
তার পাশে তার রাজপুত্র আর রাজকন্যা সুয়ে আছে, ছোট ছোট, পিট পিট করে চোখগুলো চেয়ে আছে।

হ্যা মায়া টুইন বেবি প্রসব করছে, আজ যেন তার সুখের কমতি নেই। বাচ্চাদের দিকে ফিরে উপর হয়ে, কোমল হাতগুলো দিয়ে নিজের মুখে ছুঁয়ে দিচ্ছে। এখন বিশ্বাস হচ্ছে না, সে মা হয়েছে। তাও ২টা চাঁদমুখ, ২সন্তানকে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে। ২চোখ দিয়ে সুখের অশ্রু জরতেছে।

ছেলের এক্সিডেন্টের খবর পেয়েও এতক্ষন মায়ার পাশেই ছিল ওর শশুড়-শাশুড়ি। এখন যেহেতু মায়া সুস্থ তাই তাদেরকে উঠতে হবে। একবার ভাবল, স্মৃতির এক্সিডেন্টের খবরটা জানাবে পরক্ষন্তরে ভাবনা পাল্টে নিল। কি দরকার, ওর আনন্দের মুহুর্ত্বে বিষাদের ছায়া ফেলানো।

মেয়েটা হাসতেছে, হাসুক না এভাবে বাকীটা জীবন। ২ নাতী-নাতনীকে আদর করে কিছুক্ষন তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল।

ইফতির অপারেশন কম্পিলিট, কিছুক্ষন আগে বেডে দেওয়া হয়েছে। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, এখনো জ্ঞান ফিরে নাই। বাবা-মা কে দেখে স্মৃতি জড়িয়ে ধরল।
_ বাবা, তুই ঠিক আছিস তো।

_ হ্যাঁ মা, ঠিক আছি মা। মাগো আমাদের বেবিটা নেই, ইফতি আর কখনো মা হতে পারবে না।
_ মায়ার টুইন বেবি হয়েছে। (মুখে রহস্যময় হাসি টেনে)

_ (মাকে ছেড়ে, অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে)
মা।
_ হ্যাঁ রে, তুই যখন এক্সিডেন্টের কথা জানালি ঠিক তখন আমরা হাসপাতালে ছিলাম।
এই ২হাত দিয়ে ছুঁয়ে এসেছি, আদর করে এসেছি। একদম ২টা চাঁদমুখ।

মায়ার যেহেতু নরমাল ডেরিভেরি ছিল, তাই হাসপাতালে বেশিক্ষন রাখার প্রয়োজন ছিল না। আর তাছাড়া মা, সন্তানরা ৩জনেই সুস্থ। তাই ওদেরকে বাসায় নিয়ে আসা হল। মায়ার বাবুদেরকে দেখার জন্য সব আত্মীয়-স্বজনরা আসছে।
আজকে বাবুদের নাম রাখা হবে।

মায়ার সব কাজিনরা বসে নাম সিলেক্ট করতেছে। কারো নাম কারো পছন্দ হচ্ছে না, ওদের পাগলামী দেখে মায়া হাসতেছে।

_ আচ্ছা আমরা নাম নিয়ে এভাবে ঝগড়া না করে আগে আপুর কাছে জিজ্ঞেস করে নেই।
_ ওকে। তাও ঠিক।

মায়া বাবুদের খাওয়াচ্ছে, ওরা সবাই রুমে গিয়ে ঘিরে বসল।
_ আপু তোমার আর দুলাভাইয়ের কোনো পছন্দ করে নাম রাখা আছে?

মায়া চমকে উঠল।
_ আহহ।
_ এই কি হল তিশুপাখি?
_ তোমার ছেলে লাথি মেরেছে আমাকে। এ্যাআআ

_ আরে কোথায় লাথি মেরেছে, দেখি আদর করে দিচ্ছি।

_ এই একদম না। তুমি একটা খারাপ লোক, শুধু জ্বালানোর ধান্ধায় থাক। তোমার ছেলেটাও একদম তোমার মত
_ এই এক মিনিট, ছেলে মানে? আমার একটা ছোট তিশুপাখি চাই।

_ উহু না, আমার একটা জুনিয়র স্মৃতি চাই
_ বলছি না মেয়ে বাবু
_ নাহ, ছেলে বাবু

_ ওই কুত্তা, একদম উল্টা বলবি না। বাবাই আসবে, বাবাই
_ উহু, মাম্মা আসবে। মাম্মাম
_ মায়া রাগ করে, মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে আছে।

_ স্মৃতি, মায়াকে জড়িয়ে ধরল। তিশু পাখিটা রাগ করেছে? রাগ করে না তিশুপাখিটা আমার।
দেখ, আমাদের একটা বাবাই আর একটা মাম্মাম আসবে
_ সত্যি। (বুকে মাথা রেখে)
_ হুম গো।

_ এই আমাদের বাবুদের নাম কি গো?
_ উমম। মায়ান আর তিশিন
_ উহু, স্বর্গ আর শব্দ

_ আচ্ছা তাইলে। মাম্মামের নাম হবে “তিশিন মাহবুবা স্বর্গ”
আর বাবাইয়ের নাম
মায়ান মাহবুব শব্দ

_ ইশ তুমি কত্ত ভালো। আমি তো এতক্ষন নাম নিয়ে জগড়া বাধিয়ে ফেলতাম (গলা জড়িয়ে ধরে)
_ তুমি ভালো তো তাই আমিও ভালো।

_ হিহিহি
_ পাগলী সোনা।

এইই আপু কই হারাইয়া গেলা। ওদের ডাকে চমকে উঠে মায়া।
_ হ্যাঁ, কি যেন বলছিলি তোরা
_ বাবুর নাম

_ তিশিন মাহবুবা স্বর্গ আর মায়ান মাহবুব শব্দ।
_ ওয়াও, বাবুদের মতই কিউট নামগুলো।

ইফতি কিছুটা সুস্থ এখন, ৭দিন হল হাসপাতালে। আজকে রিলেজ করে দিবে। ওর বাবা-মা নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু ইফতি যায়নি স্মৃতিকে একা রেখে। বাসার যাওয়ার পর থেকেই নিশ্চুপ ২জনেই।
স্মৃতি সিগারেট খাচ্ছে আর দাড়িয়ে আছে বারান্দায়।

অনেক বছর পর আবারও সিগারেট মুখে দিল।
হতাশ হয়ে গেছে। খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছে মায়ার সাথে।

মায়া হয়ত কখনো ক্ষমা করবে না কিন্তু একবার ইচ্ছা করতেছে বাচ্চাগুলো দেখার। ইশ না জানি কত মিষ্টি হয়েছে। কেন পারলাম না দৈয্য ধরতে। আর আজ যখন ইফতির চিরদিনের মত মা হওয়ার ক্ষমতা চলে গেছে, এখন কিভাবে থাকব।

ইফতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেটে গিয়ে হাত রাখল পিঠে, স্মৃতি চমকে উঠল। পিছে ফিরে ইফতিকে দেখল
_ তুমি উঠতে গেলে ক্যান? আমাকে ডাকলেই তো পারতে।
_ থাক আমি ঠিক আছি।

_ স্মৃতি ইফতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেছে। কেন এমন হল কেন? আল্লাহ দিয়েও কেড়ে নেয়?
_ ইফতিও কাঁদতেছে।

_ জানো, যেদিন আমাদের এক্সিডেন্ট হয়েছে সেইদিনই মায়া টুইন বেবি প্রসব করেছে।
ইফতি কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেল পরক্ষন্তরেই মুখে হাসি ফুঁটল। যার সংসার, আল্লাহ তাকে দিয়েই পূর্নতা দিল।
_ তুমি গিয়ে আপুকে নিয়ে আস।

_ মানে? তা কি করে সম্ভব? এই মুখ নিয়ে ওর সামনে যাওয়া পসিবল না
_ ওকে, আমি সুস্থ হই তারপর আমিই যাব। আমার বিশ্বাস আমাকে ফিরাবে না।

মায়ার এই কয়েকদিনে ওর কষ্টদায়ক অতিতটা ভুলেই গেছে। সে বাঁচতে চায়, তার সোনামনিদের নিয়ে আরও হাজার বছর। এই নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে এই জীবনটা।

তার অতিতের কোনো ছায়া যেন এই নিষ্পাপদের উপর না পড়ে, বাবা_মা কে বলে দূরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
তারাও চায় তার মেয়ের একটা পরিচয় হোক আর সেই পরিচয়ে সোনামনি ২টো পরিচিত হোক।


পর্ব ৬

মায়ার যখন বিয়ে হয় তখন সবেমাত্র অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। বিয়ের পর আর পড়া হয়ে উঠেনি বা নিজেই তেমন আগ্রহ দেখায়নি। এত বেশি ভালোবাসার ভরপুর ছিল যে লেখাপড়া তার নিচে চাপা পড়ে গেছে।

তবে এখন খুব বেশি আফসোস হচ্ছে, লেখাপড়াটা চালিয়ে গেলে এতদিনে কম্পিলিট হয়ে যেত। জেনারেল লাইনে পড়ার ইচ্ছা নেই।

সামনে নার্সিং এর ভর্তির ডেট পড়েছে, যদি সরকারিভাবে চান্স হয়ে যায় তাহলে আর জেনারেল লাইনে পড়বে না।
কোসিং এর ভর্তির টাইম যেহেতু শেষ, সো বাসায় বসেই লেখাপড়া শুরু করে দিয়েছে। রাতদিন এক করে লেখাপড়ায় মন দিয়েছে যদি আল্লাহ সহায় হয়।

এই ১মাস ১২দিনে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে ইফতি আর স্মৃতি। জোর করে কোনো কিছু অর্জন করার মত বৃথা চেষ্টা আর নেই। আল্লাহ বলেছেন

ধৈর্য্য ধর।
নিশ্চই আল্লাহ ধৈর্য্যকারীর সাথেই আছেন “
ধৈর্য্যর পরীক্ষায় আমি বিফল হইছি, তাই আল্লাহ এত বড় শাস্তি দিল।

হয়ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক, শান্ত হয়ে আসছে কিন্তু মনের ভিতরে যে অশান্তির আগুন জ্বলতেছে তা নিভাবে কি করে।
অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে মায়ার সাথে, যার শাস্তি ইহকাল, পরকাল ২কালেই পেতে হবে।
মায়া তার বাচ্চা আর লেখাপড়া নিয়ে এতটাই ব্যাস্ত যে ভুলেও পিছু ফিরার অবকাশ পায় না।

মায়া আদৌ কখনো
স্মৃতি বা ইফতি কাউকেই অভিশাপ দেয় নি।
কিন্তু মায়ার বুকের ভিতর যে মেঘ সৃষ্টি করে দিয়েছে স্মৃতি, দিনের শেষে বৃষ্টির ন্যায় অভিশাপসরূপ ঝড়ে পড়ে চোখের জল।

চোখের জলের চেয়ে বড় অভিশাপ ২য় কিছু আর হয়না।
দুনিয়াতে সেই বড় অপরাধী যার দেওয়া কষ্টের কথা মনে করে জায়নামাযে/মোনাজাতে ২ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে।

বাচ্চাদের খাইয়ে মায়ের কাছে দিয়ে রুমে এসে বই নিয়ে বসল মায়া। কাল এক্সাম আজকে আর কোনো রকম বিরতি দেওয়া যাবেনা। ফজরের নামায পড়ে ৮টার এলার্ম দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। এখন একটু না ঘুমালে পরীক্ষার হলে ঘুমাতে হবে।

সকালে এলার্ম বাজার আগেই বাচ্চাদের কান্নার শব্দে ঝটপট উঠে বসল মায়া।

দৌড়ে মায়ের রুমে গেল, ওর আম্মু গরুর দুধ চামচ দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেছে।
_ আরে রে কি করছ। ইশ আমার কলিজাগুলোকে কষ্ট দিচ্ছ ক্যান?
_ কাল রাতে খাইয়েছিস, এইটুকু বাচ্চার গলা শুকিয়ে যাবে তো।

_ তুমি আমাকে ডাকনি ক্যান
_ তুই তো ঘুমাচ্ছিলি তাই। আর তাছাড়া না ঘুমালে এক্সামের টেবিলে ঘুমিয়ে পড়বি।
_ সব কিছুর উর্ধ্বে আমার বাবুরা। অন্যসব গোল্লায় যাক।

মায়ার আম্মু মেয়ের এমন পাগলামী দেখে হাসতেছে। তার সেই পিচ্চি রাজকন্যাটাও আজকে কত্ত বড় হয়ে গেছে। তার বাচ্চাটাও আজকে বাচ্চা সামলাচ্ছে।

সবকিছু কতটা দ্রুত পাড় হয়ে যাচ্ছে। মায়া রেডি হয়ে ২বাচ্চাকে বুকে কিছুক্ষন জড়িয়ে রাখল, চোখে-মুখে আদর দিয়ে বাবার সাথে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল।

বিসমিল্লাহ বলে প্রশ্নপত্র হাতে নিল মায়া। ধীরে ধীরে প্রশ্নের আন্সার দিচ্ছে। অধিকাংশ প্রশ্নই তার জানা। নির্ধারিত সময়ের আগেই সকল প্রশ্নের উত্তর করা শেষ।

তবুও বারবার উত্তর সীটে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। ঘন্টা বাজার পর পরীক্ষার হল ত্যাগ করল। মনে মনে একটা আত্মবিশ্বাস জন্মে গেছে, তার মন বলতেছে সরাকারি ভাবে চান্স হয়ে যাবে।

বাসায় গিয়ে খুশিতে জড়িয়ে ধরল মাকে। মেয়ের মুখ দেখেই বুঝে গেছেন খুব ভালো হয়েছে এক্সাম।
সেই ছোটবেলার মত এক্সাম ভালো হলে বাসায় এসেই জড়িয়ে ধরত আর যদি কখনো সামান্য পরিমান খারাপ হত রুম লক করে কান্না করত।

বাচ্চাদের নিয়ে দুষ্টমিতে লেগে গেছে, নিখুঁতভাবে বাচ্চাদের পর্যবেক্ষন করতেছে। নাহ, ভাবছিল স্মৃতির মত হবে বাট একদম ওর নিজের কার্বন কপি মনে হচ্ছে।

আর হবেই না ক্যান পেটে আসার পর থেকে তো মা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল।
কখনো বাবার সংস্পর্শ তো দূরের কথা দেখাই মিলে নাই।

মামুনির উপর রাগ করিস না সোনারা। বাবার থেকে আলাদা বলে কষ্ট পাসনে। তোদের মামুনি ২জনের ভালোবাসা একাই পোষাইয়া দিবে।

বাচ্চাদের সাথে অনাবরত কথা বলেই যাচ্ছে। আর বাচ্চা ২দুটো ছোট ছোট হাত পা নড়াচড়া করে মামুনিকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষনপর ঘুমিয়ে গেল, মায়া মন খারাপ করে গাল ফুলিয়ে বসে আছে।
এই কয়েকদিনে মেয়েকে মন খারাপ করতে দেখেনি মায়ার মা।

আজকে হঠাৎ এভাবে দেখে চমকে উঠলেন, তিনি চান না তার মেয়ে আর বিন্দু পরিমান কষ্ট পাক।
_ কিরে মা, কি হল তোর? এভাবে বসে আছিস ক্যান?

(মা-বাবা ২জনেই মায়ার রুমে প্রবেশ করল)
_ দেখ না মা। আমি কতটা ফিলিংস নিয়ে ওদের সাথে কথা বলতেছি আর ওরা কিনা আমাকে ইগনোর করে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার ফিলিংস এর কোনো দাম নেই।

মেয়ের এমন কথা শুনে ২জনেই হেসে উঠল। কে বলবে এই বাচ্চাটাও ২টো ছোট্র সোনার মামুনি। এই বাচ্চাদের সাথেও কেউ অভিমান করে। ওর বাবা-মায়ের হাসি দেখে মায়া আরো গাল ফুলিয়ে ফেলছে।

মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেছে, পাগলি মেয়ে এই জন্য কেউ এভাবে অভিমান করে। ওরা এখনো ফিলিংস বুঝতে শিখে নি। ওদের কাছে আগুন পানি ২টোই সমান। তুই যদি সারাদিনও এভাবে অভিমান করে থাকিস তবুও কি ওদের আদৌ তোর অভিমান ভাঙানো সম্ভব।

তাই তো, এতক্ষন তো ভেবেই দেখে নাই। ইশ আমার বাবুরা না আমাকে বোকা ভাবা শুরু করবে। ফিক করে হেসে দিল মায়া। সাথে ওর বাবা-মা যোগ দিল।

_ যাহ ফ্রেস হয়ে আয় তারপর কিছু খেয়ে নে। নিজের অবস্থা কি করেছিস একবার আয়নায় দেখেছিস?
মায়ের কথা শুনে চুপ হয়ে গেল মায়া। তাই তো শেষ কবে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাও মনে করা দায়। আগে তো সকাল টু সন্ধ্যা নিজকে পরিপাটি করে রাখত স্মৃতির জন্য।

কিন্তু সেই মানুষটার যখন ফিরে তাকানোর সময় নেই সেদিন থেকে কখনো আয়নার সামনে দাড়ানো হয়নি বা নিজেকে সজ্জিত করেনি।

মেয়েকে মন খারাপ করতে দেখে নিজের কাছে খারাপ লাগা শুরু করে দিয়েছে। কবে যে মেয়েটা সম্পূর্ন স্বাভাবিক হবে।

_ এভাবে হুতুম পেঁচার মত বসে থাকিস না তো।

মায়ের কথায় চমকে উঠল মায়া
_ কিক কি বললে তুমি। আমি হুতুম পেঁচা। বাবা, তুমি কিছু বলবে না? বের হও রুম থেকে (জোর করে ২জনকেই বের করে দিল)

আজকে অনেক টাইম নিয়ে সাওয়ার নিল। টাওয়াল পেঁচিয়ে বের হয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো। যাক, এখন কিছুটা হলেও মানুষের মত দেখা যায়। এখন একটা ঘুমের প্রয়োজন তাইলে পুরোপুরি মানুষের রুপটা ফিরে আসবে।
তার আগে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার।

খেয়ে এসে ২দুটো কলিজার টুকরোকে ২পাশে রেখে মাঝখানে নিজে সুয়ে পড়ল। ৫টা নাগাদ ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে বাবুদেরকে দেখতে পেল না, মা নিয়ে গেছে।

উফফ অনেক ঘুমালাম নিজেকে যথেষ্ঠ সুস্থ, স্বাভাবিক আর ফুরফুরে লাগতেছে। চোখে মুখে পানি দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। বাবা আর মা তিশিন, মায়ানকে নিয়ে বাগানে হাটতেছে।

বারান্দায় আর দাড়িয়ে না থেকে নিজেও বাহিরে চলে গেল। অনেকদিন ফটোশেসন করে না। আজকে মনটা ফুরফুরে আর ওয়েদারটাও খুব চমৎকার। অনেকগুলো পিকচার তুলল।

স্মৃতি সকল সংকোচ পায়ে ঠেলে মায়ার নম্বরে ডায়েল করে যাচ্ছে বাট প্রতিবারই বন্ধ। এই পযন্ত অগনিত ফোন দেওয়া হয়েছে, তবে বিশেষ লাভ হচ্ছে না।

মায়ার এক্সামের রেজাল্ট দিছে। সরাকরি ভাবে রাজশাহী নাসিং কলেজে চান্স পেয়েছে।
সকল খুশির যেন বাধ ভেঙে গেছে আজ। মায়ার ইচ্ছা অনুযায়ী এখনকার বাসা বিক্রি করে দিয়ে পুরো ফ্যামিলি পাড়ি জমালো রাজশাহী।

ইফতি এখন সম্পূর্ন সুস্থ। ইফতি, স্মৃতি আর স্মৃতির বাবা-মা মায়াদের বাড়িতে আসল। কলিং বেল বাজানোর শব্দে এক অপরিচিত মহিলা এসে দরজা খুলে দিল।
_ কাকে চাই?

_ আমরা মায়ার শশুড় বাড়ি থেকে এসেছি। ওনারা কি বাসায় আছে?
_ জী না, ওনারা এক সপ্তাহ হল এই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে।
_ বিক্রি মানে? তাইলে ওনারা কোথায় থাকে এখন?

_ সরি সেটা তো আমরা জানি না।
এতবুক আশা নিয়ে এসেছিল কিন্তু ভাগ্য এতই খারাপ যে দেখাটুকুএ কপালে জুটল না।
ওর সকল আত্মীয়-স্বজন কারো কাছ থেকেই সঠিক কোনো তথ্য বের করতে পারেনি।
হন্য হয়ে খুঁজতেছে।


পর্ব ৭

নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিয়েছে মায়া। বরাররই মিশুক টাইপের ছিল, খুব সহজেই মানুষের মন জয় করে নেওয়ার এক অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মাইছে। অনেক ফ্রেন্ডদের সাথে ভাব জমাইয়া ফেলছে।
সবাই মায়াপু ডাকে। আর মায়ান, তিশিনকেও ভালোবেসে ফেলেছে সবাই।

কলেজ ড্রেস পড়ে রেডি হয়ে আয়নার সামনে ধারালো, ভিন্ন লুকে আবিষ্কার করল নিজেকে। বয়সের ছাপ নেই তবে কষ্টের ছাপ দেখতে পাচ্ছে। বাহির থেকে এই ছাপ হয়তো কারো চোখে পড়ার নেই, তবে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারবে।

আগের চেয়ে খানিকটা শুকিয়ে গেছে আর চোখের নিচে কালি জমে গেছে তবুও খারাপ লাগছে না তাকে।
হাতে কাজলটা নিল, চোখে একটু কাজল দিলে মন্দ হয় না।

_ এই তোমার কি আর দাড়ানোর জায়গা নেই, আয়নার সামনে এসেই দাড়াতে হবে?
_ তুমি আয়নার সামনে কি করছ?

_ আশ্চর্য! আয়নার সামনে মানুষ কি করে হ্যাঁ?
_ যে যাই করুক, কিন্তু তুমি পারবে না
_ মানে? তোমার মাথা কি গেছে?
_ হু, তুমি আজীবন আমাতে নিজেকে দেখবে।

আয়নাতে নয় আমাতে মগ্ন হয়ে নিজেকে সজ্জিত করবে।
কপালের বাঁকা টিপটা আমি সঠিক করে পড়িয়ে দিব। আমার চোখে তাকিয়ে কাজল পড়বে, আর লেপ্টে যাওয়া কাজল আমি মুছে দিব।

আয়নাতে তুমি নয়, আমি তোমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখব। আয়না ছাড়া যখন বিফল হবে আর বারবার আয়নায় নিজেকে দেখতে চেয়েও পারবে না।
তখন অভিমান করে কেঁদে দিবে।

কাজল লেপ্টে লেপ্ট যখন জল গড়িয়ে পড়বে, তখন ঠোঁটের ছোয়ায় চোখের জল মুছে দিব।
_ এভাবে বলনা গো আমি একদম পাগল হয়ে যাব। এত ভালোবাসা কি আমার কপালে সইবে? (গলা জড়িয়ে ধরে)
_ সইবে রে পাগলী।

ভালোবাসাটা যখন আল্লাহ দান করেছেন তখন সহ্য করার ক্ষমতাও তিনি দিয়ে দিবেন (চুলে মুখ গুজে)।
আর যদি তোমার সহ্য না হয় তাইলে।

(দুষ্টমি হাসি দিয়ে)
_ তাইলে কি?
_ ভাবতেছি আর একটা বিয়ে করব।

মায়া অভিমান করে স্মৃতির গলা ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাড়ালো। চোখে জল টলমল করতেছে আর রাগে নিজের হাতে নিজেই খামচে দিচ্ছে স্মৃতি গিয়ে মায়াকে জড়িয়ে ধরল

_ একদম ছোবে না আমায়, খারাপ লোক একটা।
আরো শক্ত করে বুকের মাঝে চেপে ধরল।

_ দুষ্টমি করেছি, সরি বউ। এই বউ সরি তো
_ থাক সরি বলতে হবেনা। আপনার জীবন, আপনি যাকে খুশি তাকে নিয়েই কাটাতে পারেন।
_ জীবনটা আমার কিন্তু সম্পূর্ন অধিকারটা তোর রে পাগলী।

তোর ইশারায় চলবে যেমনটা তুই চাস। বুঝিস না ক্যান তুই ছাড়া জীবনটা অসম্পূর্ন
_ তাইলে বিয়ে করবে কেন বললে (ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতেছে)

_ তোমার কান্না জড়িত মুখটা দেখার বড় লোভ জন্মালো। খুব ইচ্ছা করছিল কাজল কালো লেপ্ট যাওয়া চোখের জল দেখার তাই আর লোভ সামালাতে পারিনি।

_ কিহ? (মুহুর্ত্বের মধ্যেই অগ্নিকুন্ডের রুপ ধারন করে ফেলল)
আমাকে কাঁদাতে ভালো লাগে তাই না, ওকে দেখি কতক্ষন সহ্য করতে পার কান্না

_ বললেই হল। আর এক সেকেন্ডও না, বুকের বাম পাশটায় ব্যাথা পাই তো (এলোপাথারি আদর দিয়ে)
_ একদম ফাজলামী না।।
আর কিছু বলার সুযোগ পেল না

_ উফফ তুমি আসলেই একটা খারাপ লোক
_ হুম তোমারই তো হাজবেন্ড।

ইশ অতীতে ঘুরতে গিয়ে, কাজল লেপ্টে ফেলল মায়া।
আমি কি সত্যিই তোমার ভালোবাসা সহ্য করা ক্ষমতা রাখিনি, তাই বুঝি খুব সহজে সরিয়ে দিলে আমায়।
এখন আর তোমার ইচ্ছা করে কাঁদাতে হয়না।

তোমার সৃষ্টি কষ্টের মেঘ থেকে প্রতিনিয়ত অজরে বৃষ্টি ঝড়তেছে। এখন আর কেউ ঠোঁটের ছোঁয়ায় চোখের জল মুছে দেয়না, নিজেই মুছতে শিখে গেছি।

থেমে নেই আমি, থেমে নেই আমার প্রতিটা মুহুর্ত্ব।
হয়তো তোমার দিনগুলো সুখে ভরপুর আর আমারটা না হয় কিছুটা কম। তবু যখন এই বাচ্চা ২টির মুখের পানে তাকাই তখন আরো হাজার বছর বেঁচে থাকার প্রেরনা জাগে।

এদের তুলার ন্যায় নরম হাতগুলো যখন ছুঁয়ে দেয়, তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, ,
হ্যাঁ ভালো আছি, খুব ভালো আছি #ভালোবেসে_তোমায়।

অতীতের সুখময় স্মৃতিগুলো লেপ্টে দিচ্ছে কাজল আর তা মুছার বৃথা চেষ্টা করতেছে।
তোমার দেওয়া কষ্টের কথা মনে পড়েনা বাট মধুময় সময়গুলো স্থীর থাকতে দেয়না। কষ্টগুলো যখন মনে পড়ে তখন ভিতর থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসে।

আর সুখময় স্মৃতিগুলো যখন মনে পড়ে তখন অস্পর্শ অবিনশ্বর যে রুহ আছে সেই রুহবিন্দু ক্ষতবিক্ষত করে জল গড়িয়ে পড়ে।

একবার যদি বুঝতে বুক চিড়ে কান্না বের হয়ে আসার যন্ত্রনা তাইলে একে অপরকে কাঁদানো আগে বারবার আতকে উঠতে।

ক্লাশ, প্রাইভেট আর বাচ্চাগুলো নিয়ে দিব্যি ব্যাস্ত হয়ে গেছে মায়া। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া পিছু ফিরে তাকায়না। তাকানোর সময় পেলে তো তাকাবে। ব্যাস্ততার মাঝে ডুবে আছে। তবুএ অচেতন ভাবে কিছু স্মৃতি এসে হানা দেয়।

স্মৃতির দিনগুলো ডিপ্রেশনের মাঝে কাটতেছে। কোথাও একটু শান্তি পায় না, অনুশোচনার আগুনে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

আল্লাহ আমাকে যথাযথ শাস্তি দিচ্ছে। একটা বাচ্চার কাছে আমাদের ভালোবাসাটা কেন ঠুকনো হয়ে গেল?
মায়ার প্রতি অনুভূতি, অনুভবগুলো কী ফিকে ছিল?
কেন ইফতি নামের মেয়েটা জীবনে আসল?

আমি কখনো ইফতিকে আদৌ মায়ার জায়গায় বসাতে পেরেছি নাকি শুধু একটা বাচ্চার প্রয়োজনে?
অনুতাপের আগুন জ্বলতেছে, এই আগুন কি কখনো আর নিভে যাবে না?

একবার শুধু একবার যদি মায়ার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পেতাম তাইলে বুকের জ্বালাটা হালকা হত।
ফর্সা, চওড়া, রোমশ বুকটা একদম কাঠ হয়ে গেছে।

হাজারো চুমো দিত এই বুকটায়, এখানে মাথা রাখতে না পাড়লে পাগলামী শুরু করে দিত।
_ তিশু পাখি?

_ হুস। ডিস্টার্ব করনা, দেখনা তোমার স্মেল নিচ্ছি। জানো, তোমার শরীরে স্মেলটা যখন নিঃশ্বাসের সাথে শিরা-উপশিরা মাধ্যেমে শরীরে প্রতিটা রক্তকনার সাথে মিশে যায়। তখন এক অনাবিল শান্তি চলে আসে। নিজেকে খুব ফুরফুরে লাগে।

_ আমার কোন জিনিসটা তোমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। মানে ভালোলাগে?
_ তোমার রোমশ বুকটা আমাকে পাগল করে দেয়, এখানে মাথা রাখলে নিজেকে ধনী মনে হয়।
_ পাগলী একটা। যদি কখনো এই বুকটা আকৃষ্ট না করে তাইলে?

_ তাইলে তোমার ওই চোখ। যে চোখের দিকে তাকালে নিজেকে আর নিজের মাঝে খুঁজে পাই না ডুবে যাই ভালোবাসার অতলে
_ যদি কখনো এই চোখের প্রতি ভালোলাগা না থাকে?

_ তোমার ঠোঁটগুলো। যখন তুমি ঠোঁটগুলো নাড়িয়ে কথা বল। মনে হয় যেন সকল সৌন্দর্যটা ওখানে এসে ভিড় করছে। ইচ্ছা হয় সেই ভিড়ের মাঝে নিজেকে হাড়িয়ে ফেলি।

_ ঠোঁটগুলোর ভালোলাগা যখন হারিয়ে যাবে?
_ তোমার হাসি। আমি এক ধ্যানে কয়েক শত ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারি এই হাসির দিকে তাকিয়ে।
_ আর যদি ঠোঁটগুলোর ভালোলাগা হারিয়ে যায়?

_ তোমার হিমু মিশ্রিত কন্ঠ। ঘুম ঘুম কন্ঠে যখন।
তিশুপাখি বলে ডাক দাও।
তখন সেই ডাকের প্রতিধ্বনি হাজার বার এই হৃদয়ে বাজে। ইচ্ছা হয় খেয়ে ফেলি সেই ভালোবাসাময় পাগল করা কন্ঠটাকে।

_ উমম। একসময় এই আমিটার প্রতি থেকেই যদি ভালোলাগা চলে যায়?
কোনো ইন্টারেস্ট খুঁজে না পাও, তখন কি ছেড়ে যাবে আমায়?
_ একদম খুন করে ফেলব। তারপর এই বুকের ঘরে তোকে সমাধি দিব।

এই তুই কি আমার কোনো ভালোলাগার কোনো বস্তু হ্যাঁ? এত ভালোলাগা খুঁজিস ক্যান?
এই ছেলে শোন, তুই আমার ভালো লাগা না, যে কিছুদিন পর পর হারিয়ে যাবে।
ভালোবাসা, ভালোবাসা বুঝিস?

তুই আমার ভালোবাসা। শুধু এ যনমে না ইহকাল, পরকালেও এই ভালোবাসা বিরাজমান থাকবে।
যদি কখনো তোর প্রতি আমার ভালোবাসার কমতি পাস, সেদিন বুঝবি এই দুনিয়াতে আমি নেই।
তোকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ন। তুই আমার পরিপূর্নতা।

চোখ ভিজে উঠল স্মৃতির, বড্ড মিস করতেছে। পুরুষ মানুষদের কাঁদতে নেই। তাদের কান্না বুকের ভিতরেই ঝড়ে। মায়া আমি বলব না তুমি ফিরে আস। তবে একটু ক্ষমার চাওয়ার সুযোগটা দিও।

ইফতি শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখে স্মৃতি বারান্দায় চেয়ারে সাথে মাথা হেলিয়ে বসে আছে।
কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল স্মৃতি, পিছু ফিরে তাকালো
_ ওহ, তুমি

_ কখন আসলে অফিস থেকে?
_ এই তো
_ কোনো খোঁজ পেলে?

মায়ার খোঁজের কথা জানতে চেয়ে বুকটা জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু নিরুপায়, সে যে অক্ষম। মায়ার অক্ষমতার কারনে তাকে এই ঘরে এনেছে। কিন্তু সেই পূর্নতা মায়ার দ্বারাই হল। মাঝখানে অপূর্নতায় জড়িয়ে নিলে নিজেকে। হয়তো এক নারী হয়ে অন্য নারীর সংসার কেড়ে নেওয়ার শাস্তি ছিল এটা।


পর্ব: ৮

হাসপাতাল, সংসার আর বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব ব্যাস্ত আছে মায়া।
স্মৃতির সংসারে কোনো তারা নেই আর নেই কোনো ব্যাস্ততা। জীবনটা বোর হয়ে উঠছে আর মন-মানসিকতা সে তো অবশ্যই। সারাক্ষন ছটপট করে কাটাচ্ছে ইফতি।

_ ইফতি, এই ইফতি
_ কি হইছে, আসছি তো
_ চোখ বুঝে, হাত বাড়াও
_ উফফ। আচ্ছা।

স্মৃতি ২টা টিকেট বের করে ইফতির হাতে দিল
_ এবার চোখ খোল।
_ টিকেট(অবাক হয়ে)

_ হ্যা অফিস থেকে ৭দিনের ছুটি নিয়েছি। আর পুরো ছুটিটা কক্সবাজারে কাটাবো।
ইফতি আনন্দে স্মৃতিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অনাবরত কেঁদেই চলছে। কাঁদবেই না কেন “এই ৪বছর ৪মাস” পর স্মৃতি তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে।

এই কয়েকটা বছর নরকের যন্ত্রনার মত কাটিয়েছে। স্মৃতি নিজেকে সামলে নিয়েছে।
জোর করে আর যাই হোক ভাগ্যকে বদলানো যায় না তাই যে কয়েকদিন বেঁচে থাকবে স্বাভাবিক ভাবেই বেঁচে থাকবে।
কিন্তু আজও মায়াকে খুঁজে বেরাচ্ছে তবেই বিফলই হচ্ছে।

রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে ইফতি লাকেজ গুছাচ্ছে আর স্মৃতি হেল্প করতেছে।
মায়া তার রাজকন্যা আর রাজপুত্রকে নিয়ে ছাদে বসে গল্প করতেছে।

দিনের বেলা একদমই সময় দিতে পারে না ডিউটির জন্য। আর মাঝে মাঝে রাতেও জুরুরি ডিউটি পড়ে যায়। সেদিন তাদের কি যে অভিমান। রাতে তাদের মামুনিকে কাছে চাই চাই। তাই মায়া রাতে খুব কম ডিউটিই করে। নানা ভাই আর নানুনের সাথে তাদের ভীষন ভাব। তারাও খুব ভালোবাসে এই মাটির পুতুল ২টোকে।
_ মামুনি

_ জী, বাবাই
_ সবার বাবা আছে, আমাদের বাবা কোথায়?
ছেলের প্রশ্ন শুনে আচমকা চমকে উঠল মায়া।

প্রথম যখন কথা বলতে শিখছে
সেই সময় একদিন, ডিউটি শেষ করে বাসায় এসে ফ্রেস হয়ে, মায়ের কাছ থেকে বাচ্চাদের নিয়ে রুমে আসল মায়া।
সারাদিনের ক্লান্ত ক্লান্ত শরীরটা আর মনটা নিয়ে যখন বাসায় ফিরে নিজেকে খুব অবশ মনে হয়। কিন্তু বাসায় এসে এই হিমুময় মুখ ২টোর দিকে তাকালে অনাবিল শান্তি বয়ে যায়।

বুকের সাথে জড়িয়ে নিলে ক্লান্ত বুকটা শান্ত হয়ে যায়। সারা শরীরে আদরের পরশ দিলে ক্লান্ত দেহটা সতেজ হয়ে উঠে।

মাত্র মুখ থেকে আআআ বুলি বের হচ্ছে, ওদের অস্পষ্ঠ শব্দগুলো মায়াকে পাগল করে দিচ্ছে।
মায়া বারবার মামুনি বলানোর চেষ্টা করতেছে, কিন্তু তিশিন আর মায়ান একদমই নারাজ। তারা তাদের মত কথা বলতেছে।

মায়া যখন ব্যার্থ হয়ে বালিশে নিজেকে হেলিয়ে দিল ঠিক তখনই ২জনই আধো আধো কন্ঠে বাবা ডেকে উঠল।
সেদিনও মায়া চমকে গিয়েছিল। বাবার স্পর্শতো দূরের কথা যেখানে বাবার দেখাটাও আজও মিলে নাই সেখানে এদের মুখের প্রথম ভাষা বাবা শুনে আতকে উঠারই।

এতদিনে ভুলেই গিয়েছিল যে এরা মায়ার একার সন্তান না, হ্যাঁ এদের বাবা আছে। এই সন্তান যখন বড় হয়ে বাবাকে জানতে চাইবে তখন এদের কি জবাব দিবে।

তার সন্তানের বেড়ে ওঠার পথে এই একটা প্রশ্নই প্রভাব ফেলতে যথেষ্ঠ।

প্রথম যখন বাচ্চা পেটে আসে কতই না স্বপ্নের বীজ বুনছিল। তখন মনে হয়েছিল সুখরা যখন আসে দল বেঁধেই আসে। একদিন বাচ্চাদের প্রথম ডাক কি হবে তা নিয়ে সে কি খুনসুটি।

স্মৃতি অফিস থেকে এসেই পেটের কাপড়টা সরিয়ে অনেকগুলো আদর দিল, হাত বুলিয়ে দিল তারপর পেটের উপর মাথা রেখে ভিতরটাকে অনুভব করতে চেষ্টা করতেছে।
_ এই কি করছো?

_ হুস, আমার সোনামনিদের সাথে জরুরি মিটিং করতেছি, ডিস্টার্ব কর না তো
_ তুমি সত্যিই পাগল
_ তিশু
_ হুম

_ এই তিশুপাখি
_ কিহহ, কানে শুনতে পাও না_ রেগে যাচ্ছ ক্যান ময়নাটা।
জানো,

বাবাইটা কি বলছে
_ ভ্রুকুচকে কি জানতে চাইলো
_ বলছে। বাবা জানো।
আমি যখন কথা বলতে শিখব তখন তোমাকেই ডাকব প্রথম।
_ নাহহ, একদমই না ওর মামুনিকে ডাকবে।

_ দূর আমাকেই ডাকবে বলেছে। আচ্ছা তিশু পাখি, আধো আধো কন্ঠে যখন বাবা বলে ডাকবে। তখন অনুভূতিটা কেমন হবে বলতে পার?

ইশ আমার তো ওর মুখে আধো ভাষায় বাবা শুনতে আর তর সইছে না।
_ এই গন্ডার, হনুমান, কুত্তা। আমার বাবাই সোনাটা আমার ভিতর বেড়ে উঠতেছে তাই ওর মামুনিকে ডাকবে।
_ তুমি দেখ, বাবাকেই ডাকবে।

হ্যাঁ গো তোমার ধারনাই সঠিক। আমার কলিজার টুকরোগুলো বাবাকেই ডাকল। বাট ওদের ডাক শুনে পাগল হয়ে যাওয়া বাবাটা যে ওদের নেই।
আজ এই বাবা শব্দটাই ওদের চলার পথে বাঁধা হয়ে যাচ্ছে।

_ ও মামুনি কি হল বলছ না কেন?
আমাদের বাবা কোথায়?
মেয়ের ডাকে হুস ফিরে পেল মায়ার। বলতে শেখার পর থেকে কয়েকশত বার এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। বারবারই এড়িয়ে যাচ্ছে।

_ আকাশের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্রটা দেখতে পারতেছ না, ওখানেই তোমার বাবা থাকে।
_ আমাদের কাছে আসবে না, মামুনি?
ক্লাশে সবাই বাবার গল্প করে, তখন খুব মন পড়ে বাবাকে।

ম্যাম যখন বাবা/মা নিয়ে রচনা লিখতে বলে সেই প্রথম থেকে শুধু মাকে নিয়ে লিখছি।
জানো মামুনি।

খুব ইচ্ছা করে বাবাকে নিয়ে কখনো লিখতে।
বাচ্চাদের কথা শুনে চোখের জল আটকে রাখতে পারতেছে না মায়া।
ওদের কথাগুলো বুকে প্রচন্ড আঘাত করতেছে।

_ বাবাকে খুব প্রয়োজন তোমাদের?
_ ভীষন মিস করি।

যখন সবার বাবা তার ছেলে-মেয়েকে আদর করে আমাদেরও খুব ইচ্ছা হয় বাবার কোলে চড়তে।
_ বেশ, তাহলে আমি ওই দূর আকাশে তারা হয়ে যাই।
আর তোমাদের বাবাকে পাঠিয়ে দেই। (কেঁদে কেঁদে)

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে। বাবার মত মাকে হারানোর ভয়ে ২বাচ্চাই মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বুকের সাথে লেপ্টে রইল

_ নাহ মামুনি একথা বল না। তোমাকে ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না।
_ তাহলে আর বাবার কথা জানতে চাইবে না তো?
_ প্রমিস, আর কখনো না।

প্লীজ মামুনি তুমি কেঁদ না তাইলে বড্ড কষ্ট হয়।
_ অনেক রাত হয়েছে, এখন ঘুমাবে নয়ত ক্লাশ মিস করবে।

বাচ্চাদেরকে রুমে নিয়ে এসে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। চোখে ঘুম নেই। সব কিছু ভুলে গিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখেছে সন্তানের মুখের পানে চেয়ে, আজ সেই সন্তানই বারবার অন্ধকার অতীতটাকে সামনে টেনে নিয়ে আসতেছে।

স্মৃতিরা খুব ভোরে উঠেই রওয়ানা দিল। ইফতির মনটা খুব ভালো লাগতেছে। এতদিনে কিছুটা হলেও মনের যন্ত্রনাটা হালকা করার সুযোগ পেল।

স্মৃতির কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে ইফতি। কক্সবাজারে পৌছে হোটেলে গিয়ে কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে বিকেলবেলা সমুদ্র সৈকত দেখতে বের হল।

প্রতিদিনের মত আজকেও তিশিন আর মায়ান তার নানুন আর নানা ভাইয়ের সাথে হাটতে বের হল।
মেয়েটা একদম মায়ার কার্বন কপি, সমুদ্র বুঝি এর জীবনের একটা পার্ট।

সমুদ্র দেখলে আর স্থীর থাকতে পারে না, উত্তল ঢেউ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য।
তাই তো প্রতিটা বিকাল সকলকে পাগল করে তোলে সমুদ্র দেখার জন্য।
_ তিশিন আস্তে নানুভাই, পড়ে যাবা তো।

বলতে না বলতেই ওদের বিপরীত দিক থেকে আসা এক দম্পতির সাথে ধাক্কা লাগে।
দূভাগ্যবশত ওনাদের হাতে থাকা আইসক্রীম বক্সটা পড়ে যায়। তিশিন একবার ওনাদের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ
করে ফেলল।

আর হিমু জড়িত কন্ঠে ভয়ে ভয়ে সরি বলতেছে।
স্মৃতি কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল, বাচ্চাটা বোধহয় শুধু হিমু দিয়েই তৈরি।
ওর সরি বলা, ভয় পেয়ে ড্রেস খামচে ধরা বুকের ভিতরটায় ধুকধুক সৃষ্টি করে ফেলছে।

মায়াকে প্রথম যেদিন দেখে ভার্সিটির নবীনবরন অনুষ্ঠান। স্মৃতি তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। তারাহুরা করে গেট দিয়ে ডুকতেছে ঠিক তখনই কারো সাথে ধাক্কা লেগে হাতে থাকা কাগজগুলো পড়ে যায়।

মায়া পড়ে যাওয়া কাগজগুলো কুঁড়িয়ে হাতের মুঠে নিয়ে স্মৃতির দিকে বাড়িয়ে দিল। এতক্ষন ফোনে কথা বলায় ব্যাস্ত ছিল, কাগজগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে মেয়েটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।

নীল বোরকা, নীল হিজাব পড়া একটা হিমুবীনি, ঠোঁটগুলো হালকা গোলাপী।
ভয়ে চোখগুলো বন্ধ করে আছে আর একহাত দিয়ে কাগজগুলো স্মৃতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অন্য হাতে বোরকা খামচে ধরে আছে।

আর ভয়ার্ত মধুমিশ্রিত কন্ঠে সরি বলে যাচ্ছে।
সেদিন তার এই বহুমিশ্রিত রুপ স্মৃতিকে ঘায়েল করেছিল।

ইফতি শক্ত করে স্মৃতির হাত চেপে ধরায়, চোখের পলক ফেলল স্মৃতি। সামনে তাকিয়ে দেখে পরীটা নেই। ইফতি বুঝতে পারল স্মৃতি বাচ্চাটাকে খুঁজতেছে।

_ বাচ্চাটাকে খুঁজতেছ। এক মুরুব্বী এসে সরি বলে বাচ্চাটাকে নিয়ে গেল, তোমার তো কোনো খেয়ালই ছিল না।
মায়ার কথায় ডানে-বামে, সামনে-পিছে খুঁজে দেখতেছে। অনেক দূরে, ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে গেছে।


পর্ব: ৯

ইফতি শক্ত করে স্মৃতির হাত চেপে ধরায়, চোখের পলক ফেলল স্মৃতি। সামনে তাকিয়ে দেখে পরীটা নেই। এদিক_সেদিক খুঁজতেছে,

ইফতি বুঝতে পারল স্মৃতি বাচ্চাটাকে খুঁজতেছে।
_ বাচ্চাটাকে খুঁজতেছ। এক মুরুব্বী এসে সরি বলে বাচ্চাটাকে নিয়ে গেল, তোমার তো কোনো খেয়ালই ছিল না।
ইফতির কথায় ডানে-বামে, সামনে-পিছে খুঁজে দেখতেছে। অনেক দূরে, ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে গেছে।
_ বাচ্চাটার সাথে কে ছিল?

_ উম। একটা মুরুব্বি টাইপের লোক। হয়ত দাদু বা নানা হবে
_ ওহ।

_ কেন, কোনো প্রবলেম?
_ নাহ। বাচ্চাটা খুব কিউট তাইনা।
আচ্ছা চল সামনে যাই।

ইফতি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে স্মৃতিে বাহু ধরে হাটতে লাগল।
হোটেলে ফিরেও শান্তি পাচ্ছে না স্মৃতি শুধু বাচ্চাটার চোখ বন্ধ করে সরি বলাটা বারবার মায়াকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। অস্থিরতা কাটানোর জন্য ইফতিকে আষ্টপিষ্ঠে জড়িয়ে আদর করতে লাগল কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না।

বুকের ভিতরটা আরও অস্থির হয়ে উঠতেছে তাই ইফতিকে ঘুমাতে বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
স্মৃতির এমন আচারনে ইফতি কেঁদেই দিল কতদিন পর ভালোবেসে কাছে আসল আবার দূরে ঠেলে দিল কেন।

স্মৃতি হোটেল থেকে বের হয়ে সোজা বিচে চলে গেল একটা স্তুপের উপর বসে একের পর এক সিগারেট শেষ করতেছে।

মায়া বাচ্চাদের পড়া শেষ করে, খাইয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করতে গিয়ে বারবার তিশিনের ড্রেসটার ঘ্রান নিচ্ছে।
কেন জানি পরিচিত ঘ্রানটা নাকে লাগতেছে। মেয়েটার শরীর থেকে ওর বাবার স্মেলটা আসছে কেন?
আজ এত বছরে কখনো তো এমনটা হয়নি।

কেন ভোতা হয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলো বারবার নাড়া দিচ্ছে। ওদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেল।
_ মামুনি, কি আছে এই ড্রেসে?

_ ক কই কিছুনা মামুনি।
সুয়ে পড়।
বাচ্চাদেরকে সুয়ে দিয়ে, নিজেও এপাশ-ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে।
রাত ২টা বাজে স্মৃতি হোটেলে ফিরল। ইফতি ঘুমিয়ে আছে তাই আর নিজেও টাইম নষ্ট না করে ঘুমিয়ে পড়ল।
মায়া সকালে সব কিছু গোজগাজ করে রেখে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল।

সকাল থেকে ইফতির বুকের ব্যাথাটা বেড়েছে, ব্যাথায় পাগলের মত করতেছে।
স্মৃতি নাস্তা নিয়ে এসে দেখে এপাশ-ওপাশ করতেছে আর ব্যাথায় আতকে আতকে উঠতেছে তাই আর দেরি না করে কোলে তুলে নিল।

হোটেল থেকে বের হয়ে গাড়ি ডেকে নিল। ব্যাথায় সেন্সলেস হয়ে গেছে ইফতি।
স্মৃতির খুব কষ্ট হচ্ছে ইফতিকে এই অবস্থায় দেখে। কালকে রাতে হয়ত অতিরিক্ত হয়ে গেছে। আমার পাপের শাস্তি এই মেয়েটা কেন পাবে।

সদর হাসপাতেলের সামনে এসে গাড়ি থামল। ডাক্তার বলেছে, অতিরিক্ত মানুষিক চাপের কারনে ব্যাথার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২-৩ ঘন্টা রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।

ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে তাই হাসপাতালের করিডোরে বসে স্মৃতি ওয়েট করতেছে স্মৃতি।

তিশিন, মায়ানের স্কুল ছুটি আজকে তাই নানা ভাইয়ের কাছে বায়না ধরল হাসপাতালে মামুনির কাছে আসবে।
হাসপাতালে আসলেই সকলকে মাতিয়ে রাখে ওদের তোতাপাখির মত অনাবরত কথা দিয়ে। ওদের চিল্লাপাল্লার শব্দে পেশেন্টদের প্রবলেম হতে পারে তাই মায়া হাসপাতালে আসতে দেয় না।

আর সকলে খুব আদরও করে। এমন কিউট বাচ্চাদের কেউ আদর না করে থাকতে পারে নাকি।
_ আরে আমাদের তোতাপাখিরা যে।
কেমন আছ সোনারা?

_ খুব ভালো আংকেল।
_ আমাদের কথা মন আছে তাইলে।
_ খুব মিস করি আন্টি তোমাদের, তাইতো চলে আসছি দেখতে।
_ ওরে তোতাপাখিরা।

ওদের তোতাপাখির মত কন্ঠটা স্মৃতির কানে গিয়ে বিধলো, সামনে তাকিয়ে দেখে ২টা রাজকন্যা আর রাজকুমারী দাড়িয়ে আছে।

তিশিন স্মৃতিকে দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। বাচ্চাটার এভাবে ভয় পাওয়া দেখে আনমনে হেসে উঠে, ওদের দিকে এগিয়ে গেল।

মায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে তিশিনকে কোলে তুলে নিল
_ কি নাম তোমার, আম্মু? (কপালে চুমো দিয়ে)

তিশিন পিটপিট করে তাকালো। স্মৃতি মেয়েটার ২চোখে চুমো দিল, ইশ কতটা হিমু দিয়ে তৈরি বাচ্চাগুলো।
চেয়ারে বসে ২বাচ্চাকেই কোলে বসিয়ে কথা বলতেছে। ২জনেই স্মৃতির দিকে তাকিয়ে আছে।
হয়ত অন্তরের সুতোয় টান লাগতেছে, তারা যে একই সুতোয় বাঁধা।

_ কি হল মামুনি কথা বল না।
_ আমার নাম তিশিন মাহবুবা স্বর্গ।

নামটা শুনে বুকের ভিতরে মোচর দিয়ে উঠল।
_ আর তোমার নাম কি বাবাই (কাঁপা কাঁপা কন্ঠে)
_ মায়ান মাহবুব শব্দ।
স্মৃতি বাচ্চাদের বুকের সাথে চেপে ধরল। কেন জানি বুকে অনাবিল শান্তি পাচ্ছে। বারবার আদর করতেছে।

অফিস কক্ষে বসে বাচ্চাদের চিল্লানির শব্দ শুনতে পেল মায়া। উফফ, সুযোগ পেলেই হাসপাতালে চলে আসে। ওদের চিল্লানির শব্দে পেশেন্টের প্রবলেম হয় তবুও বাবা ওদেরকে কেন যে নিয়ে আসে।

একা একা বিরবির করতে করতে অফিস কক্ষ থেকে বের হয়ে আসল। যত সামনে এগুচ্ছে সেই পাগল করা স্মেলটা নাকে লাগতেছে। আজ এতবছর পরও এই স্মেলটা ভুলে নাই। নিশ্চই স্মৃতি আশে-পাশে কোথায়ও আছে।
_ তোমার আম্মু, আব্বুর নাম কি?

কি করে, কই থাকে?
আম্মু-আব্বু শব্দটা ওদের কাছে অপরিচিত তাই স্মৃতির মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেছে।
তখনই কেউ একজন বলে উঠল।

_ মায়া মাহবুব ওর মামুনি।
এই হাসপাতালে B। S। C নার্স হিসেবে কর্মরত আছে।

স্মৃতি পিছু দিকে ফিরে দেখে, ক্রীম কালারের শাড়ির সাথে সাদা এপ্রোন, চোখে চশমা পড়া এক নারী দাড়িয়ে আছে। এটা আর কেউ না তারই মায়া। একদম হাসিময় মুখ, আগের চেয়ে অনেকটা মুটিয়ে গেছে। দেখতে রসগোল্লা রসগোল্লা লাগে।

অনেকটা সুন্দরী হয়ে গেছে, যার ভিতরে নেই কোনো না পাওয়ার বেদনা। নাই কষ্টের ছাপ। ২চোখ ভর্তি কাজল।
যখন সংসার ছেড়ে এসেছিল, তখন চোখ ২টো শুষ্ক ছিল। যেখানে ছিল একরাশ হাহাকার। তবে কি এই চোখের কাজল পড়ানোর দায়িত্বটা অন্য কেউ।

নিয়েছে।
সেটাই কি স্বাভাবিক না। চোখ ২টো ভিজে উঠল স্মৃতির।
মায়া এখনো ঠোঁটে হাসি টেনে দাড়িয়ে আছে। তিশিন আর মায়ান দৌড়ে মামুনিকে জড়িয়ে ধরল।
স্মৃতির মুখ থেকে অস্পষ্ঠ শব্দে বের হয়ে আসল মায়া।


পর্ব ১০ (শেষপর্ব)

চোখ ২টো ভিজে উঠল স্মৃতির। মায়া এখনো ঠোঁটে হাসি টেনে দাড়িয়ে আছে। তিশিন আর মায়ান দৌড়ে মামুনিকে জড়িয়ে ধরল।

স্মৃতির মুখ থেকে অস্পষ্ঠ শব্দে বের হয়ে আসল “মায়া”
_ হ্যাঁ মায়া।
দূর আকাশের তারা হিসেবেই ওর বাবা ওদের কাছে পরিচিত।

_ মা মা নে।
_ বুঝলেন না। যারা খুব ভালো লোক ওনারা আকাশের তারা হয়ে যায়
(রহস্যময় হাসি দিয়ে)
ওদের বেড়ে উঠার জন্য ওর মামুনিই যথেষ্ঠ।

_ তিশু।
_ কত বছর পর তিশু ডাকটা শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে যায় মায়া। তবুও নিজেকে সামলে নেয়।
_ তাহলে চিনতে পেরেছেন। যাক, ধন্য হলাম।

তা বউ, বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে আসছেন নাকি?

এরপর স্মৃতি তার সাথে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা বলল। মায়া একবুক করুনা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এত্তকিছু ঘটে গেল অথচ কিছুই জানলো না। স্মৃতির চোখে মুখে অনুশোচনার আগুন দেখতে পাচ্ছে।
_ অনেক খুঁজেছি অনেক তোমায় পাগলের মত।

কিন্তু কোথায়ও একটু খোঁজ মিলল না। আমার আমিটা পুঁড়ে গেছি অপরাধ বোধের আগুনে। তোমার ক্ষমাটা খুব বেশি প্রয়োজন আমার।

_ আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। নেই কোনো রাগ বা অভিমান। তাই ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই।
_ সবটুকু জুড়েই কি ঘৃনার বসবাস?
_ মিথ্যা বলব না। হ্যাঁ প্রচন্ড ঘৃনা

_ কোথায়ও যদি এক ফোঁটা ভালোবাসা জমে থাকে, তার বিনিময়ে ক্ষমা করে দেও
_ আপনার জন্য যে অনুভূতিগুলো ছিল সব ভোতা হয়ে গেছে আর অনুভবে শেওলা পড়ে গেছে।
আর ভালোবাসা!

সেটা কালো মেঘ হয়ে বাসা বেঁধে গেছে। যদি খুব বেশি নাড়া পড়ে সেখানে, কিছুক্ষন বৃষ্টি ঝড়ে বুক চিড়ে এইটুকুই।
অপরাধ থাকলে না হয় ক্ষমা করব। অপরাধ আপনার ছিল না, অপরাধ ছিল আমার।

আপনাকে বিশ্বাস করা ছিল আমার অপরাধ, আপনাকে ভালোবাসা ছিল আমার অপরাধ, রাতে অন্ধকারে ১৯ বছরের ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে আপনার ঠুকনো ভালোবাসাকে ভরসা করে ওই ২দুটো হাতকে আকরে ধরে বের হয়ে আসা ছিল আমার অপরাধ।

আর তার যথেষ্ঠ শাস্তি আমি পেয়েছি তাই ক্ষমা চাইব না।
_ যেদিন ইফতিকে বিয়ে করেছিলাম সেদিনও স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছিলে। ফিরে যেতে বলার অধিকার আমার নেই, তবে এইটুকু বলব। বাকিটা জীবন তোমাদেরকে চোখের সামনে দেখে কাটাতে চাই। আমি প্রতিটা মুহুত্ব দগ্ধ হচ্ছি অনুশোচনার আগুনে প্রতিনিয়ত পুঁড়ে যাচ্ছি।

আগুনের তাপ এতই বেশি যে আমার ভিতরটা কয়লা হয়ে যাচ্ছে। আমি আর পারছি না, আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও

_ আগুন তো আপনি নিজের হাতে জ্বালিয়েছেন। আপনার সৃষ্টি আগুনে আপনি পুড়ছেন সেখানে আমার কিছু করার নেই। আর সেদিন আমি নিরুপায় ছিলাম, চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে যাওয়ার অভিনয় করতে হয়েছিল। কারন আমার যে পা রাখার জায়গাটুকুও ছিল না।

_ আর কত দগ্ধ হব আমি?
পুঁড়তে পুঁড়তে আমি যে আঙ্গার হয়ে গেছি। আমি আর সহ্য করতে পারতেছিনা।
_ পোঁড়তেই যখন পারবেন না, তো পুঁড়িয়েছেন ক্যান? আগুন জ্বালিয়েছেন ক্যান? ঠিক ততটাই পোঁড়বেন যতটা বিনা দোষে আমাকে পুঁড়িয়েছেন।

_ আমি তো স্বীকার করছি আমি ভুল করছি। আমাকে তোমার ক্ষমা করতে হবে না। সারাটা জীবন অভিশাপ দিও তবুও আমার চোখের সামনে থেক।

আমার দগ্ধ হয়ে যাওয়া দৃশ্যটা নিজে সামনে থেকে উপভোগ কর। ফিরে চল।
_ যাস্ট সেটাপ। আপনাকে যতটা ঘৃনা করি তার চেয়েও অধিক বেশি ভালোবাসতাম। আপনার মত সময়ের সাথে সাথে নিষ্ঠুর হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়নি।

যে একটা মানুষ চোখের সামনে ছটপট করতে করতে দগ্ধ হয়ে যাবে আর সেটা খুব উপভোগ করব।
কে বলছে আপনাকে দগ্ধ হতে। বিয়ে করে নিলেই তো পারেন। এটা তো আর আপনার কাছে কঠিন কিছু না
_ মায়াআআ।

_ চিল্লাবেন না। এটা আপনার বেড রুম না, এটা হাসপাতাল।

_ একবার শুধু একবার ফিরে চল। তুমি তোমার মত থাকবে। বিশ্বাস কর, কোনো ক্ষতি হতে দিব না
_ বিশ্বাস! তাও আবার আপনাকে, হাসালেন। আপনার মত লোককে ঘৃনা করা যায়, থু থু ফেলা যায় মিষ্টি মিষ্টি ভাষায়। বাট বিশ্বাস করা যায়না।

আর ক্ষতি! যেখানে আপনি নিজেই আমার আর আমার বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর প্রানী, সেখানে অন্য ক্ষতির কথা না ভাবলেও চলবে।

তবে একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি কেন।

এই গোটা পৃথিবীর কেউ আমার সন্তানের ক্ষতি করা তো দূরে থাক, ক্ষতির কথা চিন্তা করলেও আমি তার শেষ দেখে ছাড়ব। আর আমি চাইনা, আপনার অশুভ ছায়াটাও আমার বাচ্চাদের উপর পড়ুক। আপনার অশুভ থাবায় আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছেন বাট আমার সন্তানের দিকে চোখও দিবেন না।

চোখ তুলে ফেলব। ওদের উপর শুধু আমার অধিকার।
_ বাব্বাহ এত্ত জোর কোথা থেকে আসল?
আমার কোনো অধিকারই নেই?

নাকি অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছ সেই অধিকার?

যাই করো, ভুলে যেওনা আমিই ওদের জন্মদাতা।
_ আমার সন্তানরাই আমার জোর। আর আপনিও ভুলে যাবেন না। যে মায়া নিরবে আপনার বাসা ছেড়ে এসেছিল, সে সুধু এক অসহায় নারী ছিল। যার ছিলনা পা রাখার মত ঠিকানা, তবুও অনিশ্চিত ঠিকানার পথে পা বাড়িয়েছিল।

সেদিন তো একবারও বলেননি “থেকে যাও”। আপনি তো জানতেন এই মেয়েটার মাথা গোজার মতও জায়গা নেই।
সেদিন কোথায় ছিল আপনার দরদ হ্যাঁ?
আর আজকের মায়া একজন মা। যার অনেক দায়িত্ব।

ভুলেও অধিকার দেখাতে আসবেন না। আরে যার দায়িত্ব নেই তার আবার কিসের অধিকার। আমার বাচ্চাদের দিকে হাত বাড়াবেন না তাইলে সেই হাত উপড়ে ফেলব।
আর যদি বাচ্চারা সম্পূর্ন এডাল্ট হয়ে মনে করে আপনাকে ভীষন প্রয়োজন, সেদিন আর আমি আটকে রাখব না।
সেই পর্যন্ত আমার ইচ্ছা, মতামতই প্রাধান্য পাবে।

আর অন্য কাউকে অধিকার।
আপনার মত নিচু মেন্টালিটি আমার নেই।

ইচ্ছা হলেই কাউকে ব্যাবহার করলাম আবার প্রয়োজন শেষে ছুড়ে ফেলে দিলাম। আমার একটাই মন আর একটাই হৃদয়। আর সেখানে একজনেরই বসবাস ছিল। তাছাড়া আপনার মত তত বেশি জায়গাও আমার মনে নেই, যখন তখন কাউকে স্থান দিয়ে দিব।

স্মৃতি বুঝতে পারল, আর যাই হোক মায়া ফিরবে না। আর মায়ার উপর জোর করার অধিকার অনেক আগেই হারিয়ে ফেলছে। মায়ার চোখে মুখে পুরোটাই স্মৃতির প্রতি ঘৃনায় পরিপূর্ন যেখানে ভালোবাসা তো দূরে থাক সামান্য করুনার স্থানটুকুও নেই।

চোখ তুলে ২য়বার ওর দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। চোখ দিয়ে নিরবে জল ঝড়তেছে।
_ ফিরবে না আর?

_ যেখানে ঘৃনা করতেও ঘৃনা হয় আপনাকে সেখানে ফিরে যাব ভাবলেন কি করে।

ইফতি জ্ঞান ফেরার পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেটে বাহিরে এসে মায়াকে দেখে থমকে যায়। স্মৃতি আর মায়ার কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল, মায়া ফিরছে না এটাই বা কম কিসে।

_ মামুনি, ও মামুনি তুমি জগড়া করতেছ?
_ ক ক ই নাতো।
_ জানো মামুনি, আংকেলটা খুব ভালো। আমাকে অনেকগুলো আদর দিছে। কিন্তু।
_ কিন্তু কিরে সোনা।

_ একটা আদরও ফিরিয়ে দেইনি। এখন দেই?
_ ভীষন অন্যায় করে ফেলেছ। যাও এক্ষুনি ফিরিয়ে দিয়ে এসো।

সন্তানের মুখে আংকেল ডাক শুনে নিজের অপরাধবোধ হাজারো গুন বেড়ে গেছে। অসহায়ভাবে মায়ার দিকে তাকালো।

_ শুধু একবার বাবা ডাকটা শুনার অধিকার দও।
মায়া মুখ ফিরিয়ে নিল। যার মানে বাবা ডাক শোনার যোগ্যতা আপনার নেই। স্মৃতি বাচ্চাদের সামনে হাটু গেড়ে বসল। তিশিন আর মায়ান অনেকগুলো আদর দিল।

বাচ্চাদেরকে বারবার বুকে লুকিয়ে রাখতেছে স্মৃতি, হাজারো চুমো দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে। মায়া আর দাড়িয়ে এমন দৃশ্য সহ্য করতে পারতেছে না।
_ বাবাই, মামুনি আংকেলকে বাই বলে চলে এসো।

মামুনি বাসায় চলে যাব।
বাচ্চারা যখন স্মৃতির বুক থেকে নিজেদেরকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। মনে হচ্ছে কলিজাটা ছিড়ে কেউ বের করে নিতেছে। আটকে ধরেও রাখতে পারতেছে না

_ বাই আংকেল
_ টাটা, আংকেল
স্মৃতি ওদের মুখের পানে চেয়ে আছে। না জানি এদের মুখে বাবা ডাকটা কতটা মধুর। মায়ার ওদের হাত ধরে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা করলো।
একটু থেমে।

আপনার মুখটা দর্শন করার ইচ্ছা আমার ছিল না। ভুলক্রমে নিয়তি দেখা করিয়ে ফেলল। তবে এই দেখাটা যেন শেষ দেখা হয়। আপনার অশুভ ছায়াটাও যেন আর না পড়ে আমাদের উপর।

আমি না এদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাজারো বছর পাড় করে দিতে পারব। ২য় কাউকে জীবনে জড়ানোর মত ফালতু মেন্টালিটি নেই।
আর আপনার যদি খুব বেশিই বাচ্চার প্রয়োজন হয়, আবার বিয়ে করে নিবেন।

স্মৃতি ফ্যালফ্যাল হয়ে তাকিয়ে আছে। মায়া কিছুদূর গিয়ে পিছু ফিরে স্বস্তি, সুখময় আর তৃপ্তির একটা হাসি দিল। যার মানে ভালো আছি।

তোমার দেওয়া শেষ্ঠ উপহার নিয়ে। ওর এই হাসিটা স্মৃতির বুকে আগুনের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়েছে। যে আগুনে জ্বলবে সারা জীবন।

ভালো থাকুক এরকম হাজারো মায়া। আর জ্বলুক স্মৃতি আর ইফতি নামের কীটগুলো, নিজেদের সৃষ্টি করা আগুনে।

সমাপ্ত

পাঠক আপনাদের জন্যই আমরা প্রতিনিয়ত লিখে থাকি। আপনাদের আনন্দ দেয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ। তাই এই পর্বের “জীবনের দুঃখের গল্প” টি আপনাদের কেমন লাগলো পড়া শেষে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।

আরো পড়ুন – দ্য ভিলেন লাভার – পাগল ভালোবাসার গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *