প্রাপ্তির অপ্রাপ্তি (শেষ খণ্ড) – প্রেমের দুঃখের গল্প

প্রাপ্তির অপ্রাপ্তি – প্রেমের দুঃখের গল্প: লিনোর আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আনন্দে লিনোরের চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসছে। বাবা হওয়ার জন্য মানুষ এতোটা খুশি হয় এই প্রথম দেখলাম।


পর্ব ১০

বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে আছে জোহান। পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে পিঠে দাগ গুলোতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে মাধু। জোহানের মাঝে যন্ত্রনার লেশ মাত্র নেই। যেন সে এমনিতেই এইভাবে শুয়ে আছে। মাধুর নাক টেনে টেনে কান্নার আওয়াজ শুনে মেজাজ খরম হচ্ছে তার।

শেষ মেষ না পেরে দিল এক ধমক
~ এই চুপ করবি তুই? ফেস ফেস করে কাঁদছিস কেন এইভাবে? মনে হচ্ছে মার আমি খাইনি তুই খেয়েছিস। একদম কাদবিনা। লাগবেনা তোর মলম লাগানো। এবার যা আমি ঘুমোবো একটু।

~ আচ্ছা আর কাদবোনা। তুমি শান্ত হয়ে শুয়ে পড়ো। আমি মলম দেওয়া শেষ করেই চলে যাবো। তারপর তুমি ঘুমিয়ো। কিভাবে মেরেছে তোমাকে ওরা।

এই বলে মাধু আবারো কাঁদতে থাকে। জোহান ঊঠে বসে বলে
~ এতো যে তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করি তাও তো তুই আমাকে ছাড়িস না। এমন কেন করিস বলতো? কি পাস তুই এমন করে?

~ আমি অনেক কিছুই পাই। কিন্তু তুমি বোঝবেনা। আমার কোন উপায় নেই। আমি যদি তোমার এইটুকু খেয়াল না রাখতাম তাহলে তুমি এতদিন বেচে থাকতেনা জোহান ভাই। তোমার বেঁচে থাকার জন্য হলেও আমাকে আসতে হবে এখানে।
~ বাব্বাহ তুমিতে নেমে গেছিস! ভালোই। আমি বাঁচতে চাই না।

~ তুমি এতো স্বার্থপর কেন জোহান ভাই? আমরা কি তোমার কাছে কিছুই না? তুমি না থাকলে বড়মার কি হবে ভেবে দেখেছো একবার? আমার কথা নই নাইবা বললাম। আপন তো আর ভাবোনা। তোমাদের কাছে থাকি খাই তারজন্য আশ্রিতা মনে করো।

~ এগুলো কি ধরনের কথা মাধু? এগুলো ভাবা বন্ধ কর। তোর জন্য ছেলে দেখছি। খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে এই বাড়ি ছাড়া করবো।

~ আল্লাহ কে বলো আমাকে যেন মৃত্যু দেয়। তাহলে এবাড়ি ছাড়বো। নিজেও শান্তিতে মরব আর তুমিও শান্তি পাবে।
মাধু কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় রুম থেকে। জোহান শুয়ে পড়ে।

একটা রাত ও থাকতে পারলাম না নিজের বাসায়। লিনোর কে ফোন করে পাপা জোহানের আসার কথাটা বলে দিয়েছে। লিনোর তখনি আমাকে নিয়ে চলে এসেছে শুশুর বাড়িতে। এভাবে চলে আসায় শাশুড়ী জিজ্ঞাসা করতেই সব বলে দিলো লিনোর। আমি চুপ চাপ হয়ে শুধু শুনে গেলাম।

কিইবা বলার আছে আমার? লিনোর আসছি থেকে একটা কথাও বলছেনা আমার সাথে। শাশুড়ি মা ও এড়িয়ে চলছে। সাফিয়াও তেমন কথা বলছে না। নিজেকে একটা কিট লাগছে নিজের কাছে। এভাবে কেউ কখনো বাঁচতে পারে না। মরে যাচ্ছি আমি। আমি বাঁচতে চাই। আমার বাচার জন্য তোমাকে প্রয়োজন জোহান।

আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি জোহান। তুমি আমার অতীত নও। তুমি আমার মনের ভিতর ছিলে আছ থাকবে। আমি এই অট্টালিকা চাইনা। আমি ভালবাসা চাই। তোমার ভালবাসার ছোট্ট ঘরে সংসার পাততে চাই। তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে ভালোবাসেনা জোহান। কেউ না।

রাতে বেলকনিতে এসে দাড়িয়েছি। বার বার ফোন বেজে যাচ্ছে। আম্মু ফোন দিয়েছে ভেবে তুলছিনা। অনেক অভিমান জমা হয়ে আছে তোমার প্রতি আম্মু। তুমি অনেক কিছুই করতে পারো আমার জন্য। কিন্তু কিছুই করছোনা। বড্ড স্বার্থপর তোমরা আম্মু পাপা। মেয়ের আর্তনাদ তোমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। এখনো ফোন বেজেই যাচ্ছে। একপ্রকার বিরক্তি নিয়েই ফোনটা রিসিভ করতে হলো।

স্কিনে আননোন নাম্বার দেখে ধরবো কি ধরবোনা বলে বলে ধরেই ফেললাম। কানে নিয়ে হ্যালো হ্যালো করছি কিন্তু কোন রেসপন্স পাচ্ছিনা। ফোন রাখতে যাবো তখন একটা দীর্ঘশ্বাস এর আওয়াজ পেলাম। জোহান _
~ কথা বলছোনা কেন? তুমি কি জানোনা তুমার শ্বাস প্রশ্বাস আমার খুব চেনা। অন্য নাম্বার থেকে ফোন দিয়েছো কেন? আগের নাম্বার কোথায়?

~ আগের নাম্বার থেকে ফোন দিলেতো ধরোনা তুমি। কথা বললে যদি রেখে দাও তাই বলিনি। তোমার ভয়েজটা খুব শুনতে ইচ্ছা করে তো তাই ফোন দিয়ে জালাই।
~ বোকা কথাকার।

~ তোমাকে না বলা অনেক কথা জমে আছে এলিজা। সেগুলো বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। এই কষ্টে আমি মরে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচাবে একটু প্লিজ _ ~ বলো শুনছি ~ ভালোবাসি
এলিজা চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। বুকের ভেতরে আবার উথাল পাথাল শুরু হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করেই বলে, তারপর বলো।

~ ভালোবাসি
~ নেক্সট
~ ভালবাসি
~ তুমিকি এই কথা ছাড়া অন্য কোন কথা বলবেনা? তুমি কেন বুঝনা জোহান __আমিও যে তোমায় প্রচন্ড ভালোবাসি। তোমার এই ভালবাসি কথাটা আমাকে প্রত্যেক বাল মরন যন্ত্রনা দান করে। আমি বাঁচতে চাই জোহান।
~ কি করবো বলো ভালোবাসি তো। খুব ভালোবাসি।

প্রত্যেক দিন ঘুমানোর আগে ভালবাসি না বললে তুমি রাগ করতে। তোমার নাকি ঘুম হয়না। কতদিনের এই ভালোবাসি কথাটা জমে আছে বলোতো? এই কথাটা বের হয়ে আসতে চাচ্ছে।
এলিজা কেঁদে দেয় শব্দ করে। জোহানো নিঃশব্দে কাদে।
~ বলো। বলতে থাকো। আমি শুনবো সব।

জোহান এক নাগাড়ে বলতে থাকে ভালবাসি ভালবাসি ভালবাসি __
লিনোর রুমে এসেছে অনেকক্ষণ। এসেই এলিজার সামনে বসে আছে। আর এদিকে এলিজা চোখ বন্ধ করে কানে ফোন তুলে জোহানের ভালোবাসি কথাটা শুনে যাচ্ছে। লিনোর কয়েকবার ডাকলেও সাড়া পায় না।

এবার লিনোর জোরে ধমক দিয়ে উঠে এলিজা বলে। এলিজা চমকে উঠে। হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। কাঁপতে থাকে এলিজা। লিনোর বলে
~ কতক্ষণ থেকে ডাকছি। ফোন কানে নিয়ে কেউ এভাবে ঘুমোয় নাকি? বসে বসে ঘুমিয়ে চোখ লাল করে ফেলেছো দেখছি। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। শুয়ে পড়বো চলো।

এলিজা বাথরুমে চলে যায়। যাওয়ার সময় ফোনটা সাথেই নিয়ে যায়। দেখে জোহান এখনো লাইনে আছে। জোহানকে কিছু না বলেই ফোন কেটে দেয়।

এদিকে জোহান সব কথা শুনে স্তব্ধ। নিজের চুল নিজেই টেনে ছিড়ছে। আজ এলিজার সাথে তার টাইম স্পেন্ড করার কথাছিল। আর আজ ও একা আর এলিজা অন্য কারো সাথে __। ভালবাসার পাখি দুটো আজ আলাদা। নিয়তি এদের দু পৃথিবী দান করেছে।

সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যের উদয় হওয়া দেখছি। কতো সুন্দর করে আস্তে আস্তে ফুটে উঠেছে আলো। আচ্ছা আমার জীবনে কেন আলো ফুটে ওঠে না? কবে ফুটবে আলো? আদৌ কি ফুটবে? লিনোর এখনো নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। প্রতিরাত নিজের স্বামীর হাতে ধর্ষিত হচ্ছি আমি। যখন আমার মন প্রাণ শরীর তোমায় চাইতো তখন আমি যাইনি তোমার কাছে। আর আজ যখন আমার সব কিছু তোমার নামে করে দিয়েছি তখন অন্য একজন এসে লুফে নিচ্ছে সব কিছু।

সুপ্তকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি। আজকাল প্রতিদিনকার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার সুপ্ত কে স্কুলে আনা নেওয়া করা। ভালোভাবে নিশ্বাস নেওয়ার জন্য আমি এই সময়টাই পাই। তাই বাইরে বেড়োনোর এই সুযোগটা মিস করিনা কিছুতেই। সুপ্তোও আমার সাথে স্কুলে আসতে চায়। ওর সব দুষ্টুমি গুলো সায় দেই। একদম বকি না। তাই ও আর আমাকে ছাড়েনা।

স্কুলে পৌঁছে দিতেই দেখি জোহান সামনে দাঁড়িয়ে।
~ এখন বাসায় না গেলে হয় না? সুপ্তকে নিয়ে একেবারেই ফিরো।

বুঝলাম। জোহানকে ইশারা করে হাটতে লাগলাম। প্রতিদিন জোহান এখানে আসে আমাকে দেখার জন্য। কিছু বলার জন্য উশখুশ করে। আমি দুর থেকে দেখে বুঝতে পারি। কিন্তু আমার সামনে এসে দাড়ায় না। ফোনে প্রতিদিন কথা হয়। তার একটা কথাই শুনি শুধু।”ভালোবাসি”। আজ কিভাবে যেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

বাসায় বললেই হবে যে সুপ্ত বায়না ধরেছিল থাকার জন্য। তাই আসতে পারিনি। জোহানকে নিয়ে পার্কে চলে এসেছি হাটতে হাটতে। এর মাঝে দুজনেই টু শব্দ অব্দি করিনি। চুপ চাপ একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। জোহানকে পাশে ইশারায় বসতে বললাম। জোহান পাশে বসলো। বললাম
~ কেমন আছো?

~ বেঁচে আছি। তুমি?
~ আমিও বেঁচে আছি।
~ ভালবাসি তোমাকে। এ ভালোবাসা কখনো ফুরাবেনা। থাকতে পারিনা তোমাকে ছাড়া। এখনো তোমাকে চাই।
~ আমি কি আর তোমার আছি নাকি?

~ আছো। আমা জানি তুমি আমার আছো আমার ছিলে আমারই থাকবে।
~ ভালোই জানো।
~ তুমি আমাকে ছাড়া ভালো নেই এলিজা। প্লিজ চলে আসো আমার কাছে। আমি আমার সবটা দিয়ে ভালো রাখবো প্রমিজ করছি তোমায়।

~ কিন্ত জোহান __
~ কোন কিন্তু নেই। তুমি বলতে পারবে তুমি আমাকে ভুলে গেছো? তুমি বলতে পারবে তুমি ঐ লিনোরের সাথে ভালো আছো? তুমি বলতে পারবে ঐ লিনোর তুমাকে ভালোবাসে? তুমি বলতে পারবে তুমি আমার জন্য প্রতিরাত কেদে বালিশ ভিজাও না? কোনটা মিথ্যা এলিজা? এলিজা আমি তোমাকে ভালবাসি। এর থেকে বড় সত্যই কিছুই নেই।

আমার কাছে তুমি সবসময় পবিত্র। আমার তোমাকে পাশে চাই শুধু অন্যকোনকিছুতে বিন্দু মাত্র ভাবনার লেশ নেই আমার। আমার হিরোইনের মুখ দেখে সকালের আলো দেখতে চাই। আমার হিরোইনকে দেখেই রাতে চোখ বুজতে চাই। আমার এই বুকে আমার হিরোইনকে লুকিয়ে রাখতে চাই। আমার তোমাকে চাই এলিজা। প্লিজ আমার কাছে চলে আসো। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে আর কখনো কষ্ট পেতে দিবো না।

জোহান কাঁদছে আর আমি জোহানের দিকে তাকিয়ে আছি। এতোকেন ভালবাসে ছেলেটা আমাকে? এভাবে কি কেউ কখনো ভালোবাসতে পারে কাউকে? আমি উত্তর না দিয়েই চলে এলাম।
রাতে জোহানকে ফোন দিলাম
~ বলো এলিজা।

~ আমাকে নিয়ে পালাবে জোহান?
জোহান অবাক হয়ে বলল ~ কখন আসবো বলো।


পর্ব ১১

বার বার ভাবছি আর আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। পালাবো আমি জোহানের সাথে। যে কাজটা আগে করতে পারি নি তা এখন করবো। আর কোন পিছুটান রাখবোনা আমি। মনে মনে খুশির ঝর বয়ে যাচ্ছে আমার আর সাথে ভয় ও করছে।

সকাল থেকেই মনটা খুচ খুচ করেছে। খুব নরমালি অন্যান্য দিনের মতো কাজ করছি, সবার সাথে মিশছি। ফাকে ফাকে রুমে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি। সন্ধ্যার পর সবাইকে খাবার দিলাম। যে যার মতো খেয়ে রুমে চলে গেলো। লিনোর রুমে এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো।

লিনোর যদি সারারাত এসবি করে তাহলে আমি পালাবো কি করে? লিনোর ডাক দিয়ে বললো এসিটার পাওয়ার বাড়িয়ে দিতে। এসি রিমোট হাতে নিতেই আমার বুদ্ধি খুলে গেলো। আমি পাওয়ার বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলাম। জোহানকে একটা মেসেজ করে দিলাম
“বের হয়ে গলির সামনে অপেক্ষা করো। লিনোর ঘুমোলেই বের হবো।”

কিচেনে গিয়ে একগ্লাস শরবত বানালাম। শরবতে তিনটা ঘুমের ঐষধ মিক্স করে দিলাম। রুমে এসে লিনোরকে বললাম”আপনার শরবত।”

লিনোর মুচকি হেসে শরবত টা খেয়ে নিলো। এবার আমি সামনে থেকে ল্যাপটপ টা সরিয়ে লিনোরকে বেডে এসে বসিয়ে দিলাম। লিনোর হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো”কি ব্যপার? খুব প্রেম দেখছি আজ।”আমিও জড়িয়ে ধরে বললাম”এইভাবেই থাকুন একটু প্লিজ।”লিনোর কিছু বললোনা।

কিছুক্ষন পর দেখি লিনোর বেল্যন্স হারিয়ে ফেলেছে। বুঝলাম কাজ হয়ে গেছে। লিনোর কে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিলাম। আবার ব্যাগ টা চেক করে নিলাম কোন প্রয়োজনীয় জিনিস বাদ থাকলো কিনা তাই দেখার জন্য। জোহানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

জোহান ব্যাগ গুছাচ্ছে তা দরজার সামনে এসে দেখেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মাধু। জোহানের খুশি মনে কাজ করা দেখে অবাক হয়ে পড়ে। গুন গুন করে গান গাইছে জোহান। তার এই গুনগুনানি গান শুনতে শুনতেই যেন মাধূ এককালে প্রেমে পড়েছিল। এই গান শুনার জন্য জোহানের সামনে সামনে থাকতো সব সময়।

কিন্তু আজ এই গান তার শুনতে ইচ্ছা করছে না। এই গানে ভয় ডুকে গেছে তার। তারাতারি করে জোহানের সামনে এসে বলে, জোহান ভাই কোথায় যাচ্ছ তুমি? এতো কাপড় চোপড় কেন নিচ্ছো? তুমি কোথাও যাবে না। তুমি অসুস্থ অনেক। আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না। মাধুর কণ্ঠে ভয় স্পষ্ট জোহান বুঝতে পারে।

~ মাধু আমি কয়টা দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। আসতে দেরি হবে। মার খেয়াল রাখবি। আর বিছানার নিচে টাকা আর দুইটা ট্রেনের টিকিট পাবি। কাল সকালেই মাকে নিয়ে মামার বাড়ী চলে যাবি। আমি এখানে থাকবোনা যেহেতু সেহেতু তোদেরো থাকাটা রিক্স হয়ে যাবে। গুছিয়ে নে এখনি।
~ তুমি এলিজার সাথে যাচ্ছ তাইনা?

~ হুম।
~ ও অন্যের বউ ভাইয়া। লিনোর মাহমুদ চৌধুরী জানতে পারলে তোমায় মেরে ফেলবে। তুমি বোঝার চেষ্টা করো এলিজা আর তোমার নেই।

~এলিজা আমার ছিল আছে আর থাকবে। কিছুদিন পর আর ও অন্যের বউ থাকবেনা। আমার বউ হয়ে যাবে। তুই মাকে এ ব্যপারে কিছু বলবিনা।
~ তোমার বউ হবে মানে?

~ আমরা পালিয়ে যাচ্ছি। দোয়া রাখিস আমাদের জন্য। বলেই জোহান বেড়িয়ে আসে। মাধু ও জোহানের পিছে পিছে দৌড়ে গেইট পর্যন্ত আসে। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যতদুর জোহানকে দেখা যায়। একসময় জোহান অদৃশ্য হয়ে গেলে দুহাতে মুখ চেপে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করে। ওখানেই গেইটে হেলান দিয়ে বসে বসে কাঁদতে থাকে। আজযে তার কাদার দিন তার। শেষ কান্নার সময়।

শাড়ি ছেড়ে থ্রি পিচ পড়ে নিলাম একটা। তখনি জোহান কল দিল। আমি কলটা কেটে দিয়ে এস এম এস দিলাম”বাসার সামনে আসো। এখন সবাই ঘুমোচ্ছে।”

বারান্দা দিয়ে সব ফেলে দিয়ে পাইপ বেয়ে নেমে এলাম নিচে। পায়ে ভীষন চোট পেয়েছি। তাই হাটতে কষ্ট হচ্ছে। ব্যাগ জোহানের হাতে দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে লাগলাম। দুজনের মুখেই প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠেছে। আমার খুঁড়িয়ে হাটাটা আজ স্বার্থক। কিন্তু শরীরটা ভীষন খারাপ লাগছে। আমার মুখে ক্লান্তির ছাপ উঠেছে। সোডিয়াম লাইটের আলোই খুব ভালোই বোঝা যাচ্ছে।

জোহান আমাকে বললো, তুমিকি খাওনি রাতে? জোহানের প্রশ্নে এবার আমার খেয়াল হলো রাতে কেন আমি তো সকালে দুপুরেও খায়নি। জোহানের সাথে পালানোর চিন্তায় খাবারের কোন হুস নেই। এখন যদি বলি খাইনি তখন তো জোহান অস্থির হয়ে পড়বে। তখন দেখা যাবে খাবারের তোড়জোড় করতে গিয়ে আমার পালানোই হলো না। তাই বললাম, খেয়েছি আমি।

রাস্তায় একটা রিকশাও পেলাম না। তাই হেটেই বাসটেন্ড এর দিকে এগুতে লাগলাম। শরীর এখন আর আমার চলছেনা। মাথাটা ঘোরাচ্ছে। বমিও পাচ্ছে। হয়তো না খেয়ে আছি তাই এমন লাগছে। জোহানকে বললাম আমি আর পারছিনা। জোহান আরেকটু কষ্ট করে হাটতে বললো। হাটতে থাকলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই মনে হলো আমি যেন নিভছি।

চোখ মেলে দেখি আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। পাশে একজন নার্স ছাড়া কেউ নেই। জোহান কোথায়? নার্স আমাকে দেখেই বলে উঠল”এখন শরীর কেমন লাগছে?””ভালো। আমার সাথে একজন ছিলো। উনি কোথায়?” “আপনার স্বামী ডক্টরের রুমে আছেন। এই অবস্থায় নাকি না খেয়ে আছেন আপনি। নিজের যত্ম রাখুন নইতো বেবি সুস্থ থাকবে কি করে?”
চমকে উঠলাম আমি।”

বেবি মানে?””হা আপনি দুইমাসের প্রেগনেন্ট।”মুহুর্তেই মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো আমার। এ আমি কি শুনছি। হটাৎ করে এমন হয়ে গেলো কেন? মাথাটা আবার ঝিম ঝিম করছে। কি হবে এখন? দেখলাম জোহান আসলো। হাতে ব্রেড আর কলা। কলা ছিলে আমার মুখের সামনে ধরলো। কতো স্বাভাবিক ও। ওকি জানে না আমার প্রেগনেন্ট হওয়ার কথা? কাপা কাপা গলায় বললাম
~ জোহহহানন একটা কথাআআ।

~ কথা পড়ে হবে আগে খেয়ে নাও। একটু সুস্থ হোও নইতো পড়ে আর এনার্জি পাবে না।
জোহান খাইয়ে দিচ্ছে আর আমি খাচ্ছি। গলা দিয়ে নামছে না তবুও খাচ্ছি। খাওয়ানো শেষে জোহান উঠে চলে গেল। কিছুক্ষন পর ফিরে এসে বললো চলো।

আমি জোহানের পিছে পিছে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছু বলতে পাচ্ছি না আমি। একদম শান্ত হয়ে আছে জোহান। একটা রিকশা ডেকে এনে বললো উঠো। আমি উঠে বসে জোহানের জন্য জায়গা করে দিলাম। কিন্তু জোহান ভাড়া দিয়ে পেছনের দিকে চলতে লাগলো। রিকশা মামাও রিকশা টেনে নিলো। আমি জোহানকে ডাকছি কিন্তু জোহানের পাত্তা নেই।

রিকশা মামাকে থামিয়ে দৌঢ়ে জোহানের সামনে দাঁড়িয়ে একনাগারে বলতে লাগলাম
“জোহান আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার জন্য আমি সব ছেড়ে চলে এসেছি। এখন তুমি আমাকে এভোয়েড করোনা প্লিজ। আমি এই বাচ্চা রাখবোনা। এব্রোশন করাবো আমি। ঐ লিনোর চৌধুরীর কোন অস্তিত্ব আমার সাথে রাখবোনা আমি। চলো এখনি এব্রোশন করবো।

জোহানের হাত ধরে টানতে লাগলাম কিন্তু জোহান আমাকেই থামিয়ে দিলো। আমার পেটে হাত ছুইয়ে বললো”আমি কোন প্রানকে ধ্বংস করতে পারবোনা এলিজা। এ অধিকার আমার নেই। বাসায় ফিরে যাও তুমি। যার বউ যার অনাগতো সন্তানের মা তুমি তার কাছে ফিরে যাও। আমাকে তোমার অতীতের খাতায় লিখে নাও। আমায় ভুলে ভালোভাবে সংসার করো। সুখী হোক।”
“এগুলো কি বলছো তুমি জোহান? তুমি তাকাও আমার দিকে। দেখো আমি তোমার কাছে এসেছি। কোন অমানুষের সাথে আমি থাকতে চাইনা। আচ্ছা তুমি এব্রোশন করাতে চাওনা তাইতো? ওকে ফাইন। বেবি হওয়ার পর না হয় আমি লিনোরকে বেবি দিয়ে দিবো। তার পর তোমার আর আমার বেবি হবে জোহান। তোমার আর আমার।”

“আমি ভুল ছিলাম এলিজা। আমি অন্যের সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছিলাম অবৈধ ভাবে। আমি এ ভুল থেকে বেরিয়ে আসছি শুধুমাত্র। বাড়ি চলে যাও। আমি রিকশা ডেকে দিয়েছি।”

“এ হয়না জোহান। আমি আর ফিরবোনা কিছুতেই। তুমি আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিতে পারোনা জোহান। আমি শেষ হয়ে যাবো। তুমি শুধু একবার বলো তুমি এসব না বুঝে বলছো। আচ্ছা একটু শান্ত হোওও তার পর নয় কথা বলি। তুমি শুধু একবার ডাকো আমি তোমার চরন তলে নিজেকে শপে দিবো।”

“আর নাও দেখা হতে পারে। বাড়ি ফিরে যাও।”
জোহান চলে যাচ্ছে আর আমি তাকে ডেকে যাচ্ছি। একটু তাকালোওনা আমার দিকে। চলে গেলো। সব শেষ করে চলে গেলো।

পুরো রাস্তা হেটেই বাড়ি ফিড়ছে জোহান। তার এই দেখাই শেষ দেখা ছিল তার ভালবাসাকে যেখানে আজ থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত সর্বক্ষন দেখার কথা ছিলো। আজ তার মনে হচ্ছে ভালবাসা অহেতুক কষ্টের শুধু। ক্ষনিকের সুখের জন্য সারাজীবনের কষ্ট শুধু। এ ভালবাসা না হলেও পারতো।

গেইটের কাছে আসতেই কারো ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ পায়। এই কান্না তার খুবই চেনা। তারাতাড়ি করে গেইট খুলে দেখে মাধু হাটুমুড়ে বসে সেখানেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। জোহান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। মাধুর কোলে মাথা রেখে সেও কাঁদতে থাকে। মাধুও জোহানকে ঝাপটে ধরে কাদে।

সারা রাত বাইরে কাটিয়ে ভোরের দিকে পা রাখলাম নিজের বাড়িতে। সিকিউরিটি আমাকে দেখে চমকে উঠলো ~ আপামনি এতো সকালে আপনি যে। আমি কিছু না বলে বললাম গেইট খুলো। বাড়ির মেইন ডোরে কলিং বেল বাজাচ্ছি কোন সাড়া শব্দ নেই। অনেকক্ষণ বাজানোর পর আম্মু দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলে দিতেই আমি ভিতরে ঢুকে গেলাম। আম্মু এখনো দরজায় অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তসবি।

হয়তো নামাজ পড়ছিলো এতোক্ষণ। আমি কিছু না বলে রুমে চলে আসলাম। ওয়াশ রুমে এসে একটা লম্বা সাওয়ার নিলাম। অনেক বার একটু কাদার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কাঁদতে পারলাম না। কে জানে চোখে পানি আছে কিনা আদৌ। চেঞ্জ করে রুমে এসে দেখি পাপা আম্মু বসে আছে।

আম্মু আমাকে হাত ধরে এনে তাদের দুজনের মাঝে বসালো। আব্বু মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “মা.. এলিজা। এতো সকালে আসলে যে। একা এসেছো কেন? আমাকে ফোন দিলেইতো আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম নইতো গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।”
“আমার খুব ঘুম পেয়েছে পাপা। আমি একটু ঘুমাবো।


পর্ব ১২

থেকে উঠে ঘড়ির দিকে চোখ রাখলাম। তিনঘন্টার বেশি ঘুমিয়েছি আমি। ফ্রেশ হয়ে আসতেই পাপা ডাকলো। পাপার সাথে এখনো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলি না। ডাইনিং এ যেতেই পাপা আমাকে পাশে বসালো। আম্মু সামনে ওমলেট রাখলো আর জুস দিলো। পাপা বললো খেয়ে নিতে। আমার ক্ষুধা লাগলেও খাওয়ার কোন ইচ্ছা নাই। তাই চুপচাপ বসে থাকলাম। পাপা নিজের হাতে খাইয়ে দিলেন। আমিও খেয়ে নিলাম।

খাওয়ার সময় পাপার উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কতক্ষণ। কিছু কিছু বড়ো বোকা মানুষ আছে আমার পাপার মতোন। তাদের কথা মতো সব কিছু হলে বড্ড খুশি হন তারা। তারা ভাবেন তাদের সন্তান সুখে আছে তাই তারাও সুখী। কিন্তু তাদের সন্তান দের যে অনেক সময় জ্যান্ত লাশ বানিয়ে দেয় তা বুঝার ক্ষমতা নেই তাদের।

এক্ষেত্রে আবার অনেকে জেনে বুঝেও অবুঝ হয়ে থাকে। তারা ভাবে একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। তাদের প্রতি খুব হাসি পায় আমার। জ্যন্ত লাশের সব ঠিক হলেই কি বা না হলেই কি.? তাদের তো মৃত্যু হয়েই গেছে। দেহের মারাকেই কি মরা বলে? মনের মরা কি কিছুই নয়? কে দেবে এর উত্তর?

পাপা আম্মুকে বললো, মেয়ে তো কিছু বলবেনা। ও কি লিনোর কে বলে এসেছে? আমার তো মনে হয় না। এলিজা মা তোদের মাঝে কি ঝগড়া হয়েছে?

কতো অদ্ভুত লোক এরা। বিনা দোষে মেয়েকে প্রহার করার পর সামনে দেখেও বুঝতে পারে না আর ভোর সকালে এসেছি জন্য বুঝে নিলো ঝগড়া করে চলে এসেছি। মাথা নাড়িয়ে না বললাম।
পাপা ~ আমার ফোন টা দাও লিনোরকে ফোন দিই।
আম্মু ফোন এগিয়ে দিলে পাপা লিনোর কে ফোন দেয়।

আম্মু ~ লাউড স্পিকারে দাও আমিও শুনি এদের মধ্যে কি হলো।
পাপা ফোনটা লাউডে দিল। আমি চুপ করেই বসে আছি। লিনোর ফোন তুলে ঘুমের ভয়েজে বললো
~ হ্যালো..
~ লিনোর কোথায় তুমি?

~ বাসায়।
~ কি করছো?
~ ঘুমাই।

~ এলিজা কোথায়?
~ রুমে তো নেই। কিচেনে মনে হয়। আমি কি ডেকে দিবো?
এবার পাপা ভিষন রেগে রেগে গেলো লিনোরের উপর।

~ এলিজা কিচেনে না। এলিজা আমার কাছে। বেদ্দপ ছেলে আমার মেয়ে সকালে ভোরে চলে এসেছে আর তুমি জানোইনা ও কোথায়? পরে পরে ঘুমোচ্ছ তুমি। আমার মেয়ের খেয়াল রাখতে পারো নাতো বিয়ে কেন করেছো? ইরেসপন্সেল জামাই পেয়েছি আমি একটা। আহাম্মক। এই মুহুর্তে তুমি এখানে আসবে। রাখছি।

পাপা বক বক করতেই থাকে। আমি রুমে চলে আসলাম। রুমে এসে কয়েকবার জোহানের ফোনে কল দিলাম। কোনো রেসপন্স নেই। এভাবেই তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে জোহান? পারবে কি আমাকে তুমি ভুলতে? হয়তো পারবে। কিন্তু আমি তো পারবোনা তোমাকে ভুলতে। কতো সহজেই সব শেষ করে দিলে তুমি। ছেড়েই যদি যাবে তাহলে বেবির বাহানা দেওয়া কি খুব দরকার ছিল? আমি তো তোমাকে এমনিতেই চলে যেতে বলতাম। তোমার সুখেই যে আমার সুখ।

শরীর ভালো না তাই বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছি। দরজার শব্দে চমকে বসলাম। লিনোর এসেছে। ডুলে ডুলে হাটছে। চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ানো উচিত হয়নি মনে হয়। অভ্যাস নেই তাই রেকশন টা বেশিই পড়েছে।

আমার সামনে এসে বসে বললো
~ এখানে কেন এসেছো? সকালে কেন এসেছো? আমাকে বলতে আমি নিয়ে আসতাম। আজ কেন জানি ঘুম ছাড়ছেনা আমার। কি হয়েছে বুঝতে পারছিনা। আমি একটু সাওয়ার নিয়ে আসি।

লিনোর এই বলে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। কিছুক্ষন পর টাওয়েল পেচিয়ে বের হয়ে আসলো।
~ মাই ডিয়ার আমার জন্য ড্রেসে ব্যবস্থা করো। এইভাবেই থাকবো নাকি?
আমি আলমারি থেকে তার একটা শার্ট আর একটা প্যান্ট বের করে দিলাম। পাপা এনেছিল উনার জন্য এখনো দেওয়া হয়নি।

আলমারিতেই ছিলো তাই দিলাম। লিনোর চেঞ্জ করে আমার কাছে এসে বললো
~ এভাবে চলে আসার মানে কি? পাপার কাছে আমাকে বকা খেতে হলো কতোগুলো। ফোনেও দিলো আবার এখানেও আসার সাথে সাথে বকার বন্যা বইয়ে দিল। কি করছি আমি হ্যা? ?
~ লিনোর মাহমুদ চৌধুরী ইজ ব্যাক ইন হিজ বিহেভিয়ার। গুড। বেরি গুড।

লিনোর নিভলো। আমার পাশে এসে বসলো।
~ আমি একেবারে চলে এসছি লিনোর। আপনার ঐ বাড়িতে আর যাবো না। আপনি চলে যান।

লিনোর আমার কথায় স্তব্দ হয়ে গেল। আমার সামনে বসে হাত দুটো তার হাতে নিয়ে বললো
~ এসব কি বলছো তুমি? যাবে না মানে কি হ্যাঁ? কিছু কি হয়েছে তোমার? আমার উপর রাগ করেছো? মা, সাফিয়া এদের উপর রাগ করেছো? রাগ করলে আমি সরি। আর রাগ হবে না আমার উপর। আচ্ছা কেন যাবে না তুমি বলো। এভাবে কাউকে না বলে কেন চলে এলে? বলো প্লিজ। না বললে আমি জানবো কিভাবে?
~ আই এম প্রেগন্যন্ট।

লিনোর চুপ হয়ে গেলো। তার যেন বিশ্বাস ই হচ্ছে না।
~ কি বললে আবার বলো।
~ আমি প্রেগনেন্ট।
লিনোর খুশিতে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।

~ তাই আমি সব ছেড়ে চলে আসছি। আমি আর ঐ বাড়ি যেতে চাইনা। আমি আপনার কাছে ফিরতে চাইনা লিনোর। আমি আমার বেবিকে ভালোভাবে জন্ম দিতে চাই। আমি চাইনা এই সময়ে আপনার প্রহারে আর কটুক্তি তে আমার আর আমার বেবির কোন ক্ষতি হোক। না জানি আপনি আমার বেবির দিকেও আঙুল তোলে বলবেন যে আমার বেবি কার না কার উরশজাতের। আমাকে তো খারাপ বলে পরিচিত করেই দিয়েছেন সবার সামনে।

লিনোর আমার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো। আমার চোখে চোখ রেখে বললো
~ চুপ আর একটাও কথা না। এই বেবি আমাদের বেবি। আমি পাপা আর তুমি আম্মু। এর মাঝে আর কোন কথাই আসবেনা আর। আমার বেবি। তুমি জানো আমার কতো শান্তি হচ্ছে এই বুকে। দেখ তুমি। লিনোর বুকে মাথা ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরলো আমায়। শুন। শুনতে পাচ্ছ আমার হার্ট কতো ফাস্ট হয়ে গেছে। আজ আমি সব থেকে বেশি খুশি এলিজা। থ্যাঙ্কু ডিয়ার। আই লাভ ইউ এন্ড আওয়ার বেবি। আই লাভ ইউ লট।

লিনোর আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আনন্দে লিনোরের চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসছে। বাবা হওয়ার জন্য মানুষ এতোটা খুশি হয় এই প্রথম দেখলাম। লিনোরের মুখ থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে না খুশিতে।

জোহানকে এখনো ফোনে পায় নি। কিন্তু হাল ছাড়বো না আমি। আমার ফোন ওকে তুলতেই হবে। লিনোরের সামনেই ফোন দিই। লিনোর তাকিয়েও দেখে না কাকে ফোন দিচ্ছি আমি। আজ পাচ দিন থেকে লিনোর এখানেই পড়ে আছে। তার এক কথা তার বউ বাচ্চা যেখানে সেও সেখানে। সারাক্ষন আমার খেয়াল রাখে অফিস থেকে এসে। এটা না ওটা খাবো সব নিজের হাতে খাওয়ায়। কখন কি লাগবে সব নিজে এনে দেয়। আমাকে কাজ করতে দেয় না কোন।

বাবা হোওয়ার খুশিতে যেন পাগলিই হয়ে গেছে। শাশুড়িমা বার বার ফোন দিয়ে যেতে বলছে। আমার জন্য নাকি তার চিন্তায় ঘুম আসেনা। আমি কি খাচ্ছিনা খাচ্ছি, সুস্থ আছি কিনা, কি করছি না করছি, এসব উনি নিজে তদারকি করতে পাচ্ছেন না বলে অস্থির হয়ে উঠেছেন।

আম্মুর কাছে আসবো বেবি হওয়ার আগ মুহূর্তে। এতোদিন তার কাছেই থাকবো এই তার শেষ কথা। লিনোর বার বার বলছে তার সাথে ফিরে যেতে। পাপাও সায় দিচ্ছে তাকে। আমি নিরব দর্শক হয়ে তাদের দেখে যাচ্ছি। একটা বেবিই সব ঠিক করে দিতে পারে। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে যাদের স্বামী পরিবার তাদের মেনে নিতে পারে নি তাদের এই মুহুর্তেই কনসিভ করা উচিত।

জোহানকে ফোন দিতেই ফোন বেজে উঠলো। সাতদিন পর আজ ফোনে পেলাম তাকে। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। কিন্তু ফোন বেজে গেল তুললো না। আমি আবার ফোন দিলাম। এইবার ফোন রিসিভ হলো। কিন্তু জোহানের কন্ঠে না জোহানের মায়ের কন্ঠে হ্যালো শুনলাম।
~ মা আমি এলিজা বলছি।

~ ও এলিজা। কেমন আছো মা? জামাই কেমন আছে? শুনলাম তোমার নাকি বাচ্চা হবে। তো স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী হইও মা।
কেঁদে দিলাম আমি। আমাকে ছেলের বউ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন উনি। আর আজ আমি আরেকজনের ছেলের বউ।
~ মা_
~ আন্টি বলো মা। আমি তোমার মা নই। আর ভালো থাকো। রাখছি।

~ মা জোহান __
~ জোহানকে এইবার একটু মুক্তি দাও গো মা। অনেক জালিয়েছো আর জালিও না। ও আর তোমার সাথে কথা বলবেনা। ফোন আমার হাতে ধরিয়ে চলে গেছে। বলছি কি মা বিয়ে হয়ে গেছে সামনে বাচ্চা হবে এখন নিজের সংসারের প্রতি মন দাও। আমার ছেলেটাকে ভুলে যাও গো মা। নিজেও আর কষ্ট পেও না আর আমার ছেলেটাকেও বিয়ে শাদী করে সুখী হইতে দাও।
~ জোহানকে একটু দিন না মা শেষ বারের মতো কথা বলবো।

~ জোহান নেই। ওর সাথে আর যোগাযোগ হবে না তোমার। ভুলে যাও ওকে তুমি।
ফোন কেটে দিলো।
পেছনে ফিরতেই দেখি লিনোর দাঁড়িয়ে। চমকে উঠলাম আমি। সব শুনে নেয়নিতো আবার? আমাকে অবাক করে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো লিনোর। কপালে বেশ আওয়াজ করে একটা চুমু দিলো।

~ আমার বাচ্চার মা চলো আমরা আমাদের বাসায় ফিরে যাই। আমাদের ভালবাসার সংসার গড়ে তুলি আমাদের ছোট্ট সোনামনিকে নিয়ে। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে তোমার আর তোমার সোনামনির কোন অযত্ম হতে দিবো না আমি কখনো। সব সময় আগলে রাখবো। অনেক অনেক ভালোবাসবো। আমার বউ রানীকে কেউ কিছু বলবেনা এখন থেকে। সবাই ভালোবাসবে। চলো যাবে না আমার সাথে? প্লিজ আর রাগ করে থেকো না। চলে যাই চলো।
~ হু।

~ কিহ সত্যই যাবে?
~ হুমম যাবো। সন্ধ্যায় যাই?
~ ওকে আমার বাবুর আম্মু। লাভ ইউ সো মাচ।


পর্ব ১৩

একটা লাল শাড়ি পড়ে নিলাম। হাতে লাল চুড়ি, লাল লিপস্টিক, খোপায় লাল গোলাপ চোখে কাজল দিয়ে নিলাম। মাথায় ঘোমটা টেনে নিলাম। নতুন জীবনের সূচনা করতে যাচ্ছি। সুখী হতে চাই আমি এই কষ্টের গন্ডি পেরিয়ে। কার জন্যই বা কষ্ট পাবো আমি? সেতো আমায় চায় না তবে আমি কেন তাকে চেয়ে আমার জীবন নষ্ট করবো?

ভালোই মনে হয় আছে আমার আমি ছাড়া। সবার ভালোবাসা প্রকাশের ধরন এক হয়না। হয়তো লিনোর সত্যিই আমাকে ভালোবাসে আমিই হয়তো বুঝতে পারছি না। মানুষটা কতো খুশি হয়েছে, আমার জন্য এখানে পড়ে আছে। তাকে আর অপেক্ষা না করাই।

দরজার শব্দে পেছনে তাকিয়ে দেখি লিনোর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার কাছে এসে কপালে চুমু দিয়ে বললো, আমি কি আমার বউকে নিয়ে রওনা দিতে পারি এখন?
আমি মৃদু হেসে বললাম, অবশ্যই। চলুন।

লিনোর আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো পাপা আম্মুর থেকে বিদায় নিয়ে। গাড়িতে লিনোরের সাথে সামনের সিটে বসে আছি আমি। লিনোর ড্রাইভ করছে আর বার বার আমার দিকে দেখছে। ঠিক সেই বউভাতের দিনের মতো। তখনতো অনুভব করতে পারি নি মনের মধ্যে একজন ছিল বলে।

কিন্তু আজ ঠিকই অনুভব করার চেষ্টা করছি। অনুভব করছিও। লিনোর একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমার বউটা কি একটু তার নরম হাতের ছোঁয়া দেবে আমায়? ফিক করে হেসে দিলাম আমি তার কথায়। লিনোরের মধ্যেও যে এতো রোমান্টিকতা আছে আগে তো বুঝতে পারি নি আসলে চাইনি।

হাতটা লিনোরের হাতে রাখলাম। লিনোর শক্ত করে ধরলো হাতটা। বললো, তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে এলিজা। আমি চোখ ফেরাতে পারছিনা। তুমি এতো সুন্দর কেন প্লিজ বলবে আমায়?
আমি মুচকি হেসে বললাম, হয়তো আপনার জন্য।

বাড়ির দরজায় পা রাখতেই দেখি শশুর বাড়ির সবাই হাজির। সাফিয়া দৌড়ে এসে বলে~ ভাবি কতক্ষণ থেকে ওয়েট করছি তোমার জন্য। এতো টাইম কেন লাগলো? আমি বললাম, তোমার ভাই গাড়ি আস্তে চালিয়েছে। জোরে চালালে নাকি সমস্যা হবে। শাশুড়ি মা হাতে একটা বড় থালা নিয়ে হাজির। কি কি নাকি নিয়ম আছে এগুলো করতে হবে। আমার দাঁড়িয়ে থাকতে একদমি ইচ্ছা করছে না। বার বার লিনোরের দিকে তাকাচ্ছি।

শাশুড়ি মা যে তার নিয়ম পালন সেই কখন শুরু করেছে এখনো শেষ হবার নয়। আমি বুঝিনা মর্ডান ফেমেলি হয়ে কিভাবে করে এই কাজ গুলো। এক পর্যায়ে লিনোর বলে, মা তোমার কি হলো? আর কতোক্ষন এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো বলোতো? শাশুড়ী মা বললেন, এইতো শেষ বাবা। এবার বউমাকে কোলে করে ভিতরে নিয়ে আয়।

লিনোর সাথে সাথে আমাকে কোলে তুলে নিলো। আচমকা এভাবে তুলার জন্য আমি লিনোরের গলা পেঁচিয়ে ধরেছি ভয়ে। লিনোর কোলে করেই রুমে নিয়ে এলো আমাকে। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আমার পর তুমিও ফ্রেশ হয়ে আসবে।

ফ্রেশ হয়ে বসে আছি। শাশুড়ি মা দরজায় নক করলে আমি বলি ~ আসুন মা। শাশুড়ি রুমে এসে আমার সামনে বসলো। পেছন দিয়ে দেখি সাফিয়াও এলো হাতে বড় ট্রে নিয়ে। ট্রে টা পাশে রাখলো।

শাশুড়ি মা আমার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বললো
~ মা এলিজা আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না আমি কতোটা খুশি হয়েছি খবরটা শুনে। এই বংশধর আসছে তোমার গর্ভে। দাদু হবো আমি। আমার এই বংশধরের মা তুমি। মা গো তুমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি। অনেক কটু কথা বলেছি আমি। আমাকে ক্ষমা করো মা। আমার ভয় হতো তোমাকে নিয়ে আমার লিনোরকে নিয়ে।

লিনোর তোমাকে অনেক ভালোবাসে মা। তাইতো তোমাকে জোর করেই বিয়ে করলো। আমি ভয় পেতাম না জানি তুমি আমার ছেলেকে ছেড়ে চলে যাও। আমার ছেলেটা অনেক কষ্ট পাবে গো মা। কিন্তু আমার আর ভয় নেই। তোমার সুবুদ্ধি হয়েছে। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী হও মা। আমার এই সংসার টাকে নিজের করে আগলে রেখো।

শাশুড়ী মা কে আস্বস্ত করে বললাম, আমি কিছু মনে রাখিনি মা। আপনার নাতির জন্য দোয়া রাখবেন তাতেই হবে। এইটাতো এখন আমার সংসার। আমার সংসার আমি নিজে হাতে সবসময় আগলে রাখবো।

শাশুড়ী মা মুচকি হেসে ট্রেটা সাফিয়াকে সামনে দিতে বলে। সাফিয়া সামনে দিতেই দেখি কিছু ফল কাটা আছে। শাশুড়িমা নিজের হাতে আমাকে খাওয়ালেন। কেন জানি চোখ থেকে পানি আসতে শুরু করলো। সাফিয়া আমার চোখ মুছে দিলো। কতো আদরের আমি আজ। আগে কি ব্যবহার পেতাম আর এখন কি পাচ্ছি এটা ভেবেই চোখ থেকে পানি পড়ছিলো আমার।

সকালে বাগানে একটু হাটা হাটি করছি। সুপ্ত আমাকে দেখে দৌড়ে কোলে উঠে পড়লো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো ~ মামনি তোমার নাকি বেবি হবে? ঐ বেবিকে আমায় দিবে? আমি নিয়ে খেলবো।
~ দেবো তো। অবশ্যই দেবো। তোমার কি চাই বলো? বোন চাই নাকি ভাই চাই?
~ আমার সুন্দর একটা বউ চাই।

আমি তো অবাক। ~ কিহহ? কে শিখিয়ে দিয়েছে তোমার বউ চাই?
~ পাপা বলেছে। বলেছে তোমার মামনিকে গিয়ে বলবে তোমার সুন্দর একটা বউ চাই। তোমার পেট থেকে বউ হবে। আমি নিয়ে খেলবো, চকলেট দিবো, গোছল করিয়ে দিবো, জামা পরিয়ে দিবো, বউ সাজিয়ে দিবো, কোলে নিয়ে থাকবো।

আমার মাথা ঘোরার উপক্রম। তলে তলে এতোদুর কাহিনী। কি বেবি হবে জানলামিনা আর এরা এতোকিছু ভেবে আছে। সুপ্ত কে বললাম, আর কি করবে বাবা? সুপ্ত আমার গালে একটা চুমু দিয়ে বলে, পাপ্পি দিয়ে আদর করবো।

এই বাচ্চা এগুলো শিখে কার থেকে? সবসময় তো বড়দের সাথেই থাকে। এরমধ্যেই সাফিয়া এসে জোর করে সুপ্ত কে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। সুপ্ত কে বললো, বাবা কোল থেকে নামো। আর কোলে উঠবেনা। বেবি ব্যাথা পাবে। সুপ্ত টুপ করে পেটে চুমু খেয়ে বলে, বউ ব্যথা পেও না। তারাতারি আমার কাছে চলে আসো বলেই দৌড়। সাফিয়া হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম আমার মতো সাফিয়াও শকড।

লিনোর যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ আমার কাছেই থাকে। আমি এখন তার কাছে ছোট বাচ্চা। আমাকে খাওয়ানো, গোসল করানো সব ও নিজেই করে। শাশুড়িমা সাফিয়া আমাকে কোন কাজ ই করতে দেয় না। খেতে খেতে দিনে দিনে মুটিয়ে যাচ্ছি আমি। খুব ভালো দিন কাটছে আমার। লিনোরের ভালোবাসায় পুরো মুড়িয়ে গেছি আমি। ওর পাগলামো দেখে হাসতে হাসতে প্রান যায় আমার।

লিনোরের সাথে হসপিটালে এসেছি চেক আপ করাতে। ডক্টর বেশ কয়েকটা টেস্ট দিলো। একটা একটা করে টেস্ট শেষ করলাম। টেস্ট করিয়ে চলে আসতে চাইলাম কিন্তু লিনোর বললো রিপোর্ট নিয়েই যাবে। কাল তার সময় হবে না আসার। দু ঘন্টা লেট হবে রিপোর্ট আসতে। ওয়েটিং রুমে বসেই ওয়েট করতে লাগলাম। হটাৎ পেছন থেকে কে জানি শাড়ির আচল ধরে টান দিলো। তাকিয়ে দেখি একটা পিচ্চি মেয়ে। খুব কিউট পিচ্চিটা। পিচ্চিটাকে বললাম, হাই কিউটি। নাম কি তোমার? কিছু বলবে?

পিচ্চিটা কোন উত্তর না দিয়ে আমার দিকে ছোট একটা বক্স এগিয়ে দিয়ে বললো, এইটা তোমার। নাও।
আমি হাতে নিতেই দৌড়ে চলে গেলো। পাশে তাকিয়ে দেখি লিনোর নেই। একটু দুরে একজন লোকের সাথে গল্পে মেতেছে। হয়তো পরিচিত কেউ।

বক্সে কি থাকতে পারে আর কে দিলো ভাবতে ভাবতেই আমি বক্সটা কে আনবক্স করা শুরু করি। বক্সটা খুলতেই সুন্দর একটা কার্ড দেখতে পেলাম। কার্ডের গায়ে সুন্দর করে লেখা আছে”হেপি বার্থডে টু ইউ হিরোইন”। কলিজায় ছাত করে উঠল। হিরোইন তো আমায় জোহান বলতো। তার মানে এইটা জোহান পাঠিয়েছে? জোহান আশে পাশেই তাহলে আছে। আমি আশে পাশে দেখতে লাগলাম কোথায় জোহান।

সিট থেকে উঠে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলাম। অনেক ক্ষন খুজার পরে ও পেলাম না। । তার মানে জোহান চলে গেছে। নাকি আমার সামনে আসবেনা বলে লুকিয়ে আছে। আবার এসে আগের জায়গায় বসলাম আমি। কার্ডটা খুলে দেখলাম উপরে বড় বড় করে লেখা”ওপেন দ্যা মেইন বক্স”। নিচে দেখি আরেকটা বক্স। বক্সটি তারাহুরো করে খুলে দেখি কয়েক ডজন চুড়ি।

কাচের চুড়ি আমার খুবই প্রিয়। তা জানতো জোহান। আমাকে গত জন্ম দিনে ও বলেছিল নেক্সট আমাকে আমার খুবই পছন্দের একটা জিনিস উপহার দিবে। তুমি কেন দিলে এটা জোহান? তখন তো আমি তোমার ছিলাম আজ তো আমি আর তোমার নেই। তবু কেন তুমি দিলে? আমি তো ভালোই ছিলাম তবে কেন আমার বুকে ঝড় তুলতে আসো তুমি? তুমি কি আমাকে সত্যিই ভালবাস জোহান? আমার কথা কি ভাবো এখনো আগের মতো করে?

লিনোর এসে দেখে আমি হাতে চুড়ির বক্স নিয়ে বসে আছি। আমাকে অবাক হয়ে বললো, এলিজা তুমি কি বাইরে গিয়েছিলে এই চুড়ি কেনার জন্য? আমি তো এখানেই আছি। আমাকে বললেই তো পারতে আমি নিয়ে এসে দিতাম। নয়তো সাথে যেতাম তোমার। দেখো এই অবস্থায় বার বার সিড়ি দিয়ে ওঠানামা করা ঠিক না। চলো ডক্টরের কাছে। রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছে।

আমি আর লিনোর ডক্টরের রুমে এসে বসি। ডক্টর সব গুলো রিপোর্ট দেখে বললো আমি অল রাইট। আর আলট্রার রিপোর্ট দেখে বললো আমার ছেলে হবে। ছেলের কথা শুনে লিনোর ডাক্টারের সামনেই খুশিতে ঝাপ্টে ধরে আমাকে। আমি ঠেলে দুরে সরিয়ে ইশারায় ডক্টর কে দেখিয়ে দেই। লিনোর লজ্জা পেয়ে যায়। ডক্টর হেসে বলে, ইটস ওকে। এমন হয় হয়।


পর্ব ১৪

বাসায় আসতেই দেখি আম্মু আর পাপা এসেছে। আমাকে দেখেই দুজনে এসে জড়িয়ে ধরলো। দুজনেই একসাথে ~ মেনি মেনি রিটার্ন অফ দিজ ডে মাই চাইল্ড।

আমার খুশি আর দেখে কে? শাশুড়িমা, সাফিয়া এসেও জড়িয়ে ধরলো আদর করে। স্বরাজ উপর থেকে দৌড়ে এসে বললো, আমি মনে হয় লেট। স্বরাজ ও চলে এসেছে আমার জম্মদিনের জন্য দেখে আরো ভালো লাগলো। কিন্তু ওর জন্য খারাপ লাগছে আমার মেয়ে হলো না। ইসস ওর মনের আশাও পুরন হলো না।

এখন কিছু নাই বলি ওকে যদি মন খারাপ করে। তাই পরেই বলি। সুপ্তকে খুজতে লাগলাম। দেখি ও সিড়ি থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামছে আবার লাফ দিয়ে উঠছে। আহারে আমার না হওয়া মেয়ে জামাই কি দুষ্টুমিটা করছে। লিনোর আমাকে ধরে ভির ঠেলে সামনের দিকে এগোতে লাগলো। আমি তার দিকে তাকিয়েই হাটছি। ইশারায় সামনে তাকাতে বললে আমি সামনে তাকাই।

আমি তো পুরো শকড। এত্তো সুন্দর করে ডেকোরেট করেছে যা বলার মতো না। স্বারাজ আমার সামনে টেবিলে কেক রাখলো। আমি টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। লিনোর আমাকে অবাক করে দিয়ে হাটু মুড়ে বসে হাতে একটা ডায়মন্ড রিং রেখে বললো
“হেপি বার্থডে আমার ছেলের আম্মু”।

সাফিয়া ওয়াও বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। ছেলে হবে ছেলে হবে বলে খুশীতে প্রায় নাচতেই লাগলো। সবার মুখে খুশির আমেজ ফুটে উঠেছে। স্বরাজ ও হাসতে হাসতে বললো, এর পরের বার মেয়ে হবে দেখে নিও তোমরা। আর হোওয়ার পরপরই আমার ছেলের বউ করে নিবো। সবাই একনাগারে হেসে উঠলো। লিনোর বললো, রিংটা কি এক্সেপ্ট করা যাবে এখন?

আমি হেসে হাতটা এগিয়ে দিলাম। লিনোর সুন্দর ভাবে হাতে রিং পড়িয়ে দিলো। খুব সুন্দর হাতে মানিয়েছে রিংটা। এবার আমি কেক কাটলাম। একে একে সবাইকে কেক খাইয়ে দিলাম। রাতে সবাই একসাথে ডিনার করে নিলাম। আম্মু পাপা থাকবে আজ এ বাড়িতে।

দেখতে দেখতে প্রেগ্নেন্সির আট মাস চলে গেল। আর কয়েকটা দিন প্রায় আছে তাহলেই আমার কোল জুড়ে আমার রাজপুত্রের আগমন হবে। এতো মোটা হয়েছি আমি তবুও লিনোর কোলে তুলে নিয়ে থাকে সময় সময়। কোন কাজই করি না শুধু একটু হাটা হাটি করি। দিন গুলো এভাবেই চলে যাচ্ছে। লিনোরকে ইচ্ছা মতো বকা ঝকা করি সবসময়। কিছুই বলে না। এতো রেস্ট এ থাকতে থাকতে পিঠে ব্যাথা হয়ে গেছে।

বিছানায় শুয়ে আছি। লিনোর রুমে এলো দেখে চোখ বন্ধ করে নিলাম। চোখ খুলা দেখলেই বলবে একটা কিছু খেতে। তাই ঘুমের ভান ধরে থাকি প্রায় সময়। লিনোর এসে আমার পাশে বসলো। পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বললো আমার বাবুর আম্মু কি ঘুমিয়ে গেছে? আমি কোন কথা বললাম না।

লিনোর আমার পেটে চুমো দিচ্ছে। আমি উসখুশ করতে শুরু করেছি। লিনোর বললো, বাহ আমার বাবুর আম্মু কতো সুন্দর করে ঘুমোচ্ছে। একটুও নড়াচড়া করছে না। একটুও কাতু কুতু লাগে না বাবুর আম্মুর বলে কাতু কুতু দিতে থাকে। আমার রাগ উঠে যায়। হাত দুটো ধরে বললাম
~ কি শুরু করেছেন? ঘুমোতে দিবেন না নাকি?

~ তুমি বুঝি ঘুমুচ্ছিলে __তাহলে তোমার চোখ পিট পিট করা, ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসা, নরমাল ভয়েজ এসব কি হুম?
~ বেশি বুঝেন আপনি।

~ হুম বেশি বুঝি। এখন চলো লাস্ট বারের মতো চেক আপ করাবো।
~ দু দিন পর পর কিসের চেক আপ? এতে আরো বেবির ক্ষতি হবে। একেবারে পেইন হলে দেখা যাবে। এখন আর যাবোনা।
~ এইটাই লাস্ট বললাম তো। প্লিজ।

ডক্টর দেখিয়ে গাড়ি রাস্তায় দাড় করিয়ে লিনোর ঐষধ আনতে রাস্তার ওপাশে গিয়েছে। বড় ফার্মেসি এখান থেকে একটু দুরেই আছে। তাই গাড়িতে আমাকে বসিয়ে গিয়েছে। এসিটা নষ্ট তাই গরম লাগছে প্রচুর। তাই গাড়ি থেকে বাইরে বেরোলাম। রাস্তার পাশে শাড়ি শাড়ি গাছ। পাশেই খেলার মাঠ বাচ্চারা খেলছে।

হাটতে ভাল লাগছে তাই হাটছি। হটাৎ হাটতেই পায়ে চোট লাগে। চোট টা জোরেই লেগেছে। চোখে একদম পানি চলে আসছে। উবু হয়ে পা টা দেখতেও পাচ্ছি না পেটের কারনে। চোখ বন্ধ করে ব্যথাটা সহ্য করার চেষ্টা করছি। হটাৎ ই পায়ে কারো স্পর্শ পেলাম। চোখ খুলে দেখি আর কেউ না জোহান আমার পায়ের কাছে বসে আমার পায়ে হাত বুলোচ্ছে। স্তব্ধতা ঘিরে ধরে আমায়।

এতোদিন পর সেই মুখটা আবার দেখছি আমি। সেই হাতের স্পর্শ আমাকে কাদাতে চাচ্ছে গভীর ভাবে। জোহান আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল ~ হাটতে পারবে? চেষ্টা করে দেখো তো। আমি হাটার চেষ্টা করলাম। হাটতে পাচ্ছি বাট কষ্ট হচ্ছে। জোহান আমার হাত ধরে পাশের বেঞ্চিতে নিয়ে গিয়ে বসায়। আমার সামনে বসে পা মালিশ করে দিচ্ছে।

~ মচকে গেছে। এখনি ঠিক হয়ে যাবে।
~ কেমন আছো জোহান?
~ আলহামদুলিল্লাহ।
~ বিয়ে করেছো?

~ আমার কথা জানা তোমার কর্ম নয়। গাড়ি থেকে নামা ঠিক হয়নি। আবার গিয়ে বসে পড়ো।
~ আশেপাশে থাকো আমার। এভাবে লুকোচুরির কোন মানে হয় না। এতোই যখন ভালোবাস তাহলে ছেড়ে গিয়েছিলে কেন?
~ তোমার ভালো থাকার জন্য। ভুল করেছিলাম তোমাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে।

কিন্তু ভাগ্য ভালো ভুলটা বুঝতে পেরে তখনি তোমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা যেখানেই যাইনা কেন তোমার হাজবেন্ড ঠিকই আমাদের আলাদা করার জন্য উঠে পড়ে লাগতো। তুমি ভালো থাকতে না। তার মধ্যে তুমি একা নোও। তোমার হাজবেন্ডের সন্তান তোমার গর্ভে। এটাই তোমার জন্য বেস্ট ছিলো। তুমি তো এখন অনেক সুখে আছো। তুমি সুখে থাকলেই আমি সুখী।

জোহান পাশ ঘুরে হাটা দিলো। আমার কথার অপেক্ষা করলো না। অনেক বার ডাকার পরো সুনলো না আমার কথা। আমি সেখানেই বসে কাঁদতে লাগলাম। তোমাকে অনেক কথা বলার ছিলো জোহান। আমার মন আজো তোমাকে ভালোবাসে _আজো তোমাকে চায়। তোমার জন্য কাঁদে।

আমার সবটুকু ভালোবাসা তোমাকে উজাড় করেছি আমি। এতো আদর যত্ম ভালোবাসার মাঝেও আমি সুখে নেই জোহান। লিনোরের জায়গায় তোমাকে ভেবে আমি দিন গুলো পাড়ি দিচ্ছি। আমার প্রথম প্রেম তুমি। তোমাকেই শেষ পর্যন্ত ভালোবাসবো। তোমার জারগায় আর কেউ পৌছাতে পারে নি জোহান। লিনোরের তো পৌছানোর যোগ্যতাই নেই। অন্য কাউকেও সেখানে পৌছতে দিবে না সে।

লিনোর এসে আমাকে নিয়ে গাড়িতে বসালো। সাথে অনেক বকা ঝকাও করছে ~ কতো খানি হেঁটে এসেছো দেখেছো? গাড়িতে একটু বসলে কি হতো? পায়ে তো ব্যাথা পেয়েছো। এই অবস্থায় কেউ হাটে কখনো? আজকাল আমার কোন কথা শুনোনা তুমি। এতটা কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারো?

গাড়িতে একটা কথাও বললাম না। লিনোর তো ইচ্ছা মতো বকা ঝকা করেই যাচ্ছে আমাকে। আমার কান দিয়ে কিছুই ডুকছেনা শুধু বুঝতে পারছি যে তার মুখ থেকে কথার ফুলঝুরি ফোটেছে আজ। আমার চোখে শুধু জোহানের অস্তিত্ব, কানে শুধু জোহানের কন্ঠ, মস্তিষ্কে তাহারি বিচরণ।

রাস্তায় মাধু আর জোহান হাটছে। সামনেই শপিং এ নিয়ে গিয়েছিল মাধুকে। শপিং শেষে এবার বাড়ি ফেরার পালা। বাড়ী কাছেই তাই হেটেই যাচ্ছে। ফুটপাতের রাস্তা দিয়েই দুজনে হাটছে। পুরো রাস্তা ফাঁকা।

কোন গাড়ি নেই। মাঝে মাঝে দু একটা রিকশা যাচ্ছে। হটাৎ কোথা থেকে যেন একটা গাড়ি ফুটপাতের উপর দিয়েই এসেই পেছন থেকে জোহানকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। মাধু হেচকা টান দেওয়াতে প্রানে বেঁচে যায়। রাগে চিল্লিয়ে জোতা ছুড়ে মারে
~ রাসকেল রাস্তা দিয়ে গাড়ী চালাতে পারিস না? গাজা খেয়ে গাড়ি চালাস। মানুষ মারতে ফুটপাত দিয়ে গাড়ি চালাস। রাস্তা কি তোর বাপের যখন ইচ্ছা তখন এইভাবে গাড়ি চালাবি।

গাড়ির নাম্বার দেখে আরো রাগ উঠে যায় মাধুর। রাগ কে প্রশ্রয় না দিয়ে দৌড়ে জোহানের কাছে আসে। বাম পাশের হাতে বেশ ব্যথা পেয়েছে জোহান। একটু ছিলেও গেছে। মাধু জোহানকে নিয়ে ফার্মেসি তে গিয়ে ঐষধ লাগিয়ে নেয়।
সারারাত মাধু ঘুমোতে পারে না। রাগে তার হাত পা এখনো কাপছে। আজ কি হয়ে যেতো যদি না ও সাথে থাকতো। তার জোহানকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলতো।

জোহানের মা মাধুকে পায়চারী করতে দেখে বলে, মাধু __জোহানের অল্প একটু চোট লেগেছে মা। ওরোকম এক্সিডেন্ট হয়েই থাকে। এর জন্য এতো ঘাবরে গেলে তো চলবেনা। জোহান তো এখন ঘুমুচ্ছে। তুইও ঘুমা এবার এসে। অনেক বড় ফারা থেকে আমার ছেলেটা বেঁচে গেছে। মানুষ দিন দুপুরে আজকাল উল্টাপাল্টা খেয়ে গাড়ি চালায়।

মাধু এবার ডুকরে কেঁদে ওঠে। জোহানের মা অবাক হয়ে যায় মাধুর কান্না দেখে। মাধুকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেঁদে ফেলে। ~ এতো কেন ভালবাসিস আমার ছেলেটাকে? তুই তো জানিস ও অন্য কাউকে ভালোবাসে। তবুও তুই কেন ছাড়তে পারছিস না ওকে? এতো টুকুতেই এভাবে কাঁদছিস।

~ জোহানকে মারতে চেয়েছিলো বড়মা। এলিজার হাজবেন্ড জোহান ভাইকে মারতে চায়। আমি এতোদিন ধরে আগলে রাখছি জোহান ভাইকে। একদম এলিজার কাছে ঘেঁষতে দেইনা। তবুও ঐ লোকটা আমার জোহানকে মেরে ফেলতে চাইছে।

বড়মা ঐ লোকটা যদি কিছু করে ফেলে তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো মা? আজ গাড়ি চাপা দিতে চেয়েছে কাল আরো কিছু করার চেষ্টা করবে। আমি কিভাবে বাঁচাবো ওকে? তুমি বলো তোমার ছেলেকে কিভাবে বাঁচাবো আমি?
~ এলিজার হাজবেন্ডের সাথে সরাসরি কথা বল। দরকার পড়লে সব ছেড়ে দুরে কোথাও চলে যাবো। তবুও এ লোকের হাত থেকে বাঁচতে চাই।


পর্ব ১৫

অফিসে কাজ করছে লিনোর। দরজায় নক করে সুজন মিয়া বলে, স্যার আপনার সাথে একটা মেডাম দেখা করতে চায়। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।

লিনোর ~ আমি এখন বিজি তাকে গিয়ে বলো। পরে দেখা করবো।
~ স্যার এখনি কথা বলতে চায়। মাইয়ার নাম বলতে বলছে আপনাকে।
~ কি নাম?

~ মাধু নাম বললো।
লিনোর একটা মেকি হাসি দিয়ে বলে আসতে বলো মাধুকে। সুজন গিয়ে মাধুকে বলতেই মাধু রুমে ঢুকে পড়ে। লিনোরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, কি চান আপনি? লিনোর শব্দ করে হেসে ওঠে। মাধুর রাগ উঠে যায়। লিনোরের চোখে চোখ রেখে বলে, মি. লিনোর মাহমুদ চৌধুরী আপনি ক্ষমতা বান লোক মেনে নিলাম।

আপনি জোহান ভাইয়ের কাছ থেকে তার ভালোবাসাকে কেড়ে নিয়েছেন মানলাম। আপনি এলিজা আপুর জীবনটাকে নরক বানিয়েছেন তাও মানলাম। আপনার কথা মতো জোহানকে দুরে সরিয়ে চোখে চোখে রাখছি আমি। তবুও আপনি জোহান কে গাড়ি চাপা দিয়ে মারতে চেয়েছিলেন। কেন? আর কি চান আপনি? মানুষটা বেচেও মরে আছে। এখন জানে মারতে চান?

এতো সেলফিস লোক আপনি। ছিহ। কি ক্ষতি করেছি আমরা আপনার? উল্টে আপনিই আমাদের সুখ শান্তি কেড়ে নিচ্ছেন। কেন এমন শকুনের চোখে দেখেন আমাদের?
~ কারন জোহান আমার এলিজার দিকে আবার হাত বাড়াতে চাইছে। সেদিন আমার এলিজাকে স্পর্শ করেছে। ওর সাহস কি করে হয় এমন করার?

ওকে তো মেরেই ফেলা উচিত। আরো আগে ওকে মেরে দিতাম কিন্তু তোমার ভরসায় ওকে ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু না তুমি কোন কাজের নোও। কাজের হলে এতোদিনে বিয়েটা করে ফেলতে পারতে।
~ আমি কি করবো না করবো সেটা আমার ব্যপার। আপনি বলার কে?

~ আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। জোহানকে এলিজার থেকে সরিয়ে নাও। নিজের ভালবাসাকে নিজের করে নাও। তাতে তো তোমার ই লাভ আর আমারো লাভ। অবশ্য তুমি একটু লাভ ক্ষতি কমই বোঝ। যদি বুঝতে তাহলে ফ্রিতে এতোগুলো টাকা পেয়েও রেখে যেতে না। শুধু শুধু আমাকে কষ্ট করে জোহানকে মারতে হলো।

~ মারতে হলো মানে? (আৎকে উঠে)
~ তোমার জোহান আর নেই। বনানীর রাস্তায় ওর লাশ পেতে পারো।

~ নাহহহহহহ_ এ কিছুতেই হতে পারে না। কিছুক্ষন আগে আমি ওকে ঘরে রেখে এসেছি।
~ বিশ্বাস না হলে তোমাকে একটা ভিডিও দেখাচ্ছি।

লিনোর ভিডিও টা সামনে প্লে করে। মাধু ভিডিও দেখে কাঁপতে থাকে। চিৎকার করে লিনোরের কলার চেপে ধরে। ~ আমার জোহানকে মেরে ফেললি তুই। কুত্তার বাচ্চা আমি তোকে ছাড়বোনা। বলে গলায় চাপ দিয়ে ধরে।

আচমকা এমন আক্রমনে লিনোর একটু এলোমেলো হয়ে যায়। গলা দিয়ে কাশি বেরোতে থাকে। কোন মতে ছাড়িয়ে মাধুর গালে থাপ্পর মাড়ে।
~ ফকিরের বাচ্চা তোর সাহস কি করে হয় আমার গায়ে হাত তুলার? আমার সংসারে চোখ দিবে আর ওকে এই দুনিয়াতে রাখবো ভেবেছিস।

~ আরে কিসের তোর সংসার? কোনটা তোর? তোর কিছুই নেই। আমার জোহানকে মেরে ফেলে তুই ভাবছিস তুই সব পেয়ে যাবি? কিচ্ছু পাবি না তুই। কিছুই তোর নয়। এলিজা তোকে না জোহানকে ভালবাসে। এখনো ভালবাসে সব সময় বাসবে।

আর ঐ বাচ্চা তোর এতোটা সিউর কিভাবে হস? বড্ড বোকা তুই। জোহানের সাথে অনেকবার দেখা করেছে এলিজা তোকে ফাকি দিয়ে। তুই বোকা বুঝতেও পারিস নি। আরে তোকে বোকা বানিয়ে তো পালিয়েও গিয়েছিল। বউ ~ বাচ্চা নিজের কিনা যাচাই না করে তুই সংসার বলিস। সবার সুখ কেড়ে নিয়ে তুই কোনদিন সুখি হবি না। দেখে নিস।

মাধু এক দৌড়ে বেরিয়ে যায়। লিনোরের কানে বার বার শুধু ওই কথা গুলোই রিপিট হতে থাকে। মাথা ধরে যায়। হিসেব মিলিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার করে নেয়। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে গাড়ি নিয়ে বের হয়। গন্তব্য নিজের বাসা আর এলিজা।

গোসল শেষে বারান্দায় ভেজা টাওয়েল নেড়ে দিচ্ছি। পেছন থেকে লিনোর চুলের মুষ্টি ধরতেই ব্যথায় কাকড়ে ওঠে আমি।
~ কি করছো লিনোর ছাড়ো। ব্যাথা লাগছে।
~ লাগুক ব্যাথা। বল জোহানের সাথে এখনো সম্পর্ক রেখেছিস কিনা? পরকীয়া করছিস তুই। কয়টা লাগে তোর হারামজাদী। আমাকে দিয়ে শখ মিটে না কুত্তি তোর?

~ লিনোর কি বলছো এসব? ছাড়ো ব্যথা লাগছে।
~ বল এই বাচ্চা কার? কার বাচ্চা পেটে তুলেছিস তুই?
~ এই বাচ্চা তোমার লিনোর।

~ সত্যি করে বল বাচ্চা কার? জোহানের বাচ্চা তুই আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাস হারামজাদী। বল এই বাচ্চা কার?
~ এই বাচ্চা তোমার লিনোর। আমার সন্তানের বাবা তুমি। বিশ্বাস করো আমাকে।
~ আবার মিথ্যা কথা বলিস তুই। দাড়া।

লিনোর প্যান্টের বেল্ট খুলে ইচ্ছামতো মারতে থাকে। এলিজা চিৎকার করতে থাকে। চিৎকার শুনে শাশুড়ি আর সাফিয়া দৌড়ে আসে। এরকম গরু পেটানো মার দেখে দুজনেই কেঁদে দেয়। সুপ্ত ভয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। সাফিয়া আর শাশুড়ি মা ছাড়াতে এলে তাদের গায়েও মার লাগে। লিনোরের কোন হুস নেই।

যেভাবে পাচ্ছে সেভাবেই পেটাচ্ছে। মারতে মারতে চুলের মুষ্টি ধরে সিড়ি দিয়ে আছড়ে নামিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আমি ছিটকে গিয়ে সোফার সাথে ধাক্কা খাই। সোফার হাতল আমার পেট বরাবর লাগতেই প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠি।

হাসপাতালে ইমার্জেন্সি তে নেওয়া হলো আমাকে। আমার অর্ধেক জ্ঞান আছে আর অর্ধেক যেন নেই। তবুও ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদছি আমি। আম্মু আর শাশুড়ি মা ও কাঁদছে। আমি তাদের দিকে মুখ করে চিৎকার করে যাচ্ছি। পাপা দৌড়া দৌড়ি করছে। ডক্টর দের বলছে তারাতারি ট্রিটমেন্ট করার ব্যবস্থা করুন আমার মেয়েটা মরে যাচ্ছে।

আমি সত্যিই ব্যথায় মরে যাচ্ছি। লিনোর নেই আমার পাশে। হাসপাতালে আসবে কি না জানিনা। আসার সময় পাপা অনেক কথা শুনিয়েছে, গালে চড় পর্যন্ত মেরেছে। তাকে আশা করাই অহেতুক বিষয়। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে আমি চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম।

লিনোর বাসায় থাকতে না পেরে হাসপাতালে চলে এসেছে। কোন ফ্লোরে আছে তা জানার জন্য রিসিপশন এ কথা বলতেই দেখে মাধু দাঁড়িয়ে আছে। মাধু লিনোরকে দেখে তাচ্ছিল্যএর হাসি হেসে এগিয়ে এসে বললো
~ আপনার বউ আর বাচ্চা ফোর্থ ফ্লোরে আছে।

~ কেউনা _কেউনা আমার ওরা।
মাধু হা হা করে হেসে ফেলে। মাধুর হাসি দেখে লিনোরের গা জ্বলে যাচ্ছে।

~ কেউনা বলবেন না। আপনার বউ, আপনারি বাচ্চা। ছিহ এতো ঠুনকো বিশ্বাস আপনার। আপনার মতো লোক এর পক্ষে সব ই সম্ভব। কি ভেবেছেন আমার সর্বনাশ করে আপনি সুখী হবেন? আমার জোহানকে মেরে ফেলবেন? কই মারতে তো পারলেন না। আল্লাহ ঠিকই বাচিয়ে দিলো। আপনার প্রতি করুনা হচ্ছে। আপনার মতো এতোটা খারাপ মানুষ আমি নই। নিঃশ্বার্থে আপনার বউ আর বাচ্চার জন্য দোয়া করে দিলাম তারা যেন সুস্থ থাকে।

মাধু চলে গেলো। লিনোর সেখানেই বসে পড়লো মাথায় হাত দিয়ে। তার বউ, তার বাচ্চা। অন্যের কথায় অবিশ্বাস করলাম। কেমন খারাপ আমি। কিভাবে মারলাম এলিজাকে। এক দৌড়ে ফোর্থ ফ্লোরে চলে আসে লিনোর। পাগলের মতো অবস্থা হয়ে গেছে তার।

জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি কেবিনে শুয়ে আছি। বাইরে ডাক্তার পাপা আর লিনোরের চেঁচামেচি আর আম্মুর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। এখান থেকে স্পষ্ট ভাবে শুনতে পাচ্ছি আমি।

লিনোর ~ ডক্টর আমার বাচ্চাটাকে বাচান। আমার একটাই বাচ্চা। আমার ছেলে।
পাপা : ডাক্টর আপনি আমার মেয়ে টাকে বাচান। ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই। লিনোরের কথা শুনবেন না।

ডক্টর : দেখুন বাচ্চা বাচার সম্ভাবনা খুবই কম। হয় বাচ্চা নয়তো মা যে কোন একটাকে চুজ করেন আপনারা। আর মা বাচলেও সে আর মা হতে পারবেনা।

প্রচন্ড আঘাতে তার__
আর শুনতে পারলাম না আমি। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকারে আম্মু, শাশুড়ি মা, নার্স দৌড়ে এলো। পাপা শব্দ করে কাঁদছে শুনতে পেলাম। কিন্তু আমার সামনে এলো না। আমাকে অটিতে নেওয়া হলো।

লিনোর কথা বার্তা চালিয়েই নিচ্ছে। শেষমেশ ঠিক হলো বাচ্চাকে পৃথিবীতে আনবে। সবাই সবার বাচ্চাকে চায়। এলিজার পাপা জোরে কেদে উঠলো। তার সন্তান আর তার সামনে থাকবেনা। নাতিকে আনার জন্য তার মেয়েকে হারাতে হবে। এর থেকে কষ্টের আর কিইবা থাকতে পারে। তার তো মেয়ে হলেই চলবে। বুকের ধনকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আর সে আটকানোর চেষ্টা করেও পারছেনা।

এক ঘন্টা পর খবর এলো বেবিটাকে বাঁচাতে পারে নি। তবে এলিজা বেঁচে আছে। একদিন পর কেবিনে দেওয়া হয়। সবাই এলিজার সাথে দেখা করতে আসে কিন্তু লিনোর আসে না। কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবে সে এলিজার সামনে।

নিজের এতো প্রত্যাশিত বাচ্চাকে নিজের হাতে মেরেছে সে। একটা মেয়ের পুরো জীবন টাই শেষ করে দিয়েছে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে নিজের ভেতরে। সে আর যেতে চায় না এলিজার সামনে। শুধু মনে মনে আল্লাহ কে বলে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করো।

এলিজার পাপা মেয়েকে পেয়ে মেয়ের কাছ থেকে একমুহুর্ত জন্য সরতে চায়না। মেয়ের ঘুমন্ত মুখটার পানে তাকিয়েই তার দিন যায়। প্রয়োজন ছাড়া পাশ থেকে উঠে না। ডাক্তার আসে চেকআপের জন্য। আজ যে ডাক্তার অপারেশন করেছে এলিজাকে সেই ডাক্তার ডিউটি তে আছে। ডাক্তার কে দেখে বলে
~ ডাক্তার সাহেব আমার মেয়েটাকে বাচানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আমার মেয়েটাকে বাচানোর কথা ছিলো না। বাচ্চাকে বাচানোর কথা ছিলো। কিন্তু আপনি আমার মেয়েকে বাচিয়েছেন।

~ আপনার মেয়ের হায়াত ছিলো তাই বেঁচে আছে। আর আমি অটিতে যাওয়ার আগে একজন ছেলে এই হসপিটালেই ভর্তি ছিল সেই অনেক কান্নাকাটি করেছে আপনার মেয়েকে বাচানোর জন্য। আমিও ভেবে দেখেছি বিষয় টা। তারপর ঐ ছেলের বোন আপনার মেয়েকে ব্লাড ডোনেট করেছে। ধন্যবাদ দিতে হলে তাদের কে দিন।
~ ছেলেটার নাম কি লিনোর ডক্টর?
~ না জোহান নাকি নাম ছিল।

ডক্টর চলে যায়।
শকড খেয়ে যায়। চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। মেয়েকে সুখের নাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ যাকে মারতে চাইলো সেই এসে তার মেয়ের প্রান বাচালো।


পর্ব ১৬

সাত দিন পর আজ রিলিজ দিবে আমায়। এই সাত দিনে লিনোর একবার ও আসেনি। লিনোর ছাড়া বাকি সবাই আমাকে এসে দেখে গেছে। যার সূত্রে আমি সেই বাড়ির মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছি সেই যদি না আসে তাহলে আমি অন্য দের দিয়ে কি করবো? পাপা সব কাগজ পত্র ঠিকঠাক করে এসেছে।

আম্মু সব গুছিয়ে নিয়েছে। আমি হাটতে পারি কিন্তু কষ্ট হয়। তবুও লিফট পর্যন্ত যাওয়ার জন্য হাটতেই হবে। আম্মু এসে আমাকে ধরলো। আম্মুর উপরে ভর করেই হাটছি আমি। আম্মু ~~~ একটু কষ্ট করে হাটো। সামান্য একটু।

আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। কেবিন থেকে বেরোতেই দেখি শ্বশুর বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে। পেছনে লিনোর ও আসছে। শাশুড়ী মা এসে আমাকে ধরে বললেন, চলো মা বাড়ি ফিরে যাই আমরা। পাপা ঘোর আপত্তি করে বললেন, না বেয়াইন। আমার মেয়ে এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে। আমার মেয়ের জীবন এতোটা অহেতুক নয় যে আমি জেনে শুনে মৃত্যু গৃহে মেয়েকে পাঠিয়ে দিবো। আমার মেয়ের জীবন আমার কাছে অনেক বড়।

শাশুড়ি মা ~ দেখুন বেয়াই সাহেব যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন আপনি মান অভিমান করে মেয়েকে আটকে দিলে তো আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। আমাদের বাড়ির বউ আমরা নিয়ে যাবো।

পাপা ~ আমি দেব না আমার মেয়েকে। আপনাদের বাড়ির বউ বলেই আমার মেয়েকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। সাতদিন আগের ঘটনা কোন দিন ভুবোনা আমি। আমার মেয়েকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।

এই নিয়ে হসপিটালেই তুমুল ঝগরা চলছে। শেষ মেশ আম্মু ওদের বুঝিয়ে বলে যে ~ মেয়েটা আমার কাছে কটা দিন থাক তারপর না হয় নিয়ে আসবেন। বুঝতেই তো পারছেন এতো বড়ো একটা ধকল গেল মেয়েটার উপর দিয়ে এখন আমাদের কাছে থাকলে ভালো থাকবে। শেষ মেষ রাজি হলো ওরা।

এতোক্ষণ ধরে জগড়া চললো আশেপাশের মানুষ জন ও এসে তাল দিলো কিন্তু আমার জানোয়ার স্বামীর মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হলো না। চুরের মতো পেছনে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আর চোখ দুটো আমার চোখে স্থির হয়ে আছে। আমিও অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। চোখের নিচের কালি দেখে বুঝতে পারছি যে ঘুম হয়নি। হবেই বা কি করে? কতো সাধের বাচ্চা পেতে চেয়েছিল বউকে মেরে তা তো আর হলো না। তার এ যাত্রায় আর বাবা হওয়া হলো না।

তাকে দেখে যে কেও কষ্ট পাবে। কিন্ত আমি তো তার কষ্ট দেখছিনা। আমি তো খুজছি তার হিংস্রতাকে। সুদর্শন পুরুষ। কতো ইনোসেন্ট ফেইস। এতোকিছুর মধ্যে তার হিংস্রতা টি কোথায় লুকিয়ে আছে? আমি তো খুঁজছি পাচ্ছি না কেন?
লিনোর অবশেষে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো, এলিজা __মাফ করে দাও প্লিজ। ফিরে চলো।

আমি কোন কথায় বললাম না। বলার আর কিছু নেই আমার। সব শেষ হয়ে গেছে। আমার কথা কেউ ভাবে না। কেউ বুঝে না আমাকে। আমার কারো প্রতি কোন অভিযোগ নেই। সব আমার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। কিছু না বলেই হাটা দিলাম। নিচে এসে পার্কিং সেট এ গিয়ে লিনোরের গাড়িতে উঠে পড়লাম। আমার এরকম করাতে লিনোরের পরিবার খুশি হলো। তারা পাপার কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে এসে বসলো। লিনোর ড্রাইভার সিটে এসে বসে গাড়ি স্টাট করলো।

আমার এরোকম কার্যে পাপা আম্মু দুজনেই অবাক। আসার সময় তাদের মুখের দিকে একবার শুধু তাকিয়ে ছিলাম আমি। আমার জন্য আজ বাপের বাড়ি শশ্বুর বাড়ি দুটোই সমান। বাপের বাড়িতে আমাকে জ্যান্ত লাশ বানানো হয়েছিল আর শশ্বুর বাড়িতে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আমি আর আমার সন্তান দুজনেই জন্মদাতার হাতেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছি। কি মিল তাইনা?

বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথে বুকটা কেপে উঠলো। সাত মাস আগে এই বাড়িতে পা রেখেছিলাম আমি। সন্ধ্যা টি ছিল অনেক সুন্দর ময়। চারিদিকে আলোতে ঝলমল করছিল। সবার হাসির শব্দে মুখরিত ছিল চারিপাশ টা। আজোতো ঐরকম হতে পারতো। আমার কোলে থাকতো নতুন অতিথি।

শাশুড়িমা বড়ো থালা সাজিয়ে বরন করতো তাকে। আজ কেন এতো সব কিছু অন্ধকার হয়ে আছে? থেমে যাই আমি। আমার থামা দেখে শাশুড়ি মা এসে আমাকে ধরে রুমে নিয়ে এলেন। এই রুম কে আমার কবর মনে হচ্ছে। চারদিকে বাবুর ছবি দেয়ালে টানানো।

খেলনা, ছোট ছোট জামা কাপড় সব কিছুর অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছি আমি। মনে হচ্ছে আমার ছেলে বাবু আমাকে বলছে মাম্মা আমি জামা পলবো, মাম্মা আমি গালি নিয়ে কেলবো, মাম্মা আমি কাবো, মাম্মা আমাকে তোলে নাও __ আরসহ্য করতে পারছি না আমি। বার বার যেনো কানে বাজছে কথা গুলো। দু হাতে কান চেপে চিৎকার করে উঠলাম।

চোখ খুলে দেখি আমি বেডে শুয়ে আছি। পাশে সবাই দাঁড়ানো। ডক্টর এসেছেন। ডক্টর লিনোরকে উদ্দেশ্য করে বললো, মি. লিনোর আপনার ওয়াইফ মেন্টালি খুবই ডিস্টার্ব। এই অবস্থায় এমন হয়। আপনি বরং কয়েকটা দিন ঘুরে আসুন উনাকে নিয়ে।
~ ডক্টর ও তো অসুস্থ।
~ তাও ঠিক। সুস্থ হলেই না হয় যাবেন। আমি তাহলে আসি। উনার দিকে খেয়াল রাখবেন।

আমার দিন গুলো কাটছে ওদের সাথেই। সুপ্ত সবসময় আমার সাথে থাকে। যেন ওই আমার ছেলে। সুপ্ত একদমি ওর মায়ের কাছে যেতে চায়না। রাতেও আমার সাথে শুয়ার জন্য বায়না ধরে বসে থাকে।

সাফিয়া প্রায় সময় মেরে ধরে নিয়ে যায়। আর সবসময় কথা শুনায়। আমি নাকি তার ছেলেকে কেড়ে নিচ্ছি তার কাছ থেকে। নিজের মা হওয়ার ক্ষমতা নেই অন্যের বাচ্চার দিকে নাকি চোখ তুলে তাকিয়েছি এবার। তার ভাইয়ের জীবনটাও নাকি শেষ করে দিয়েছি। আমার জন্য তার ভাইকে আবার বিয়ে করাতে পারছেনা।

বিয়ে করিয়ে নতুন ভাবী আনবে, ভাইপো ভাইঝি পাবে কতো সপ্ন তার। তার সব ইচ্ছেতেই নাকি আমি জল ঢেলে দিয়েছি। আমি মনে মনে শুধু হাসি তাদের কথা শুনে। এও কপালে ছিল আমার। দোষ না করেই দোষী আমি আজ।
পাপা লিনোরের সাথে প্রায়ই ফোনে কথা বলে। একপ্রকার কথা কাটা কাটিই করে। আডালে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনি।

পাপা লিনোরকে বলে”একটা বাচ্চা এডাপ্ট করতে। লিনোর বরাবরি না করে। পাপা বোঝায় যে একটা বেবি তো তোমাদের লাগবে। তোমার আর আমার মেয়ের ভবিষ্যত এর কথা ভেবেও হলে একটা বেবি এডাপ্ট করো।”লিনোর সোজা সাপটা উত্তর দেয়”অন্যের বাচ্চা কে নিজের বাচ্চা হিসেবে কখনোই মেনে নিতে পারবো না। আমি তো অক্ষম নয় যে বাবা হতে পারবো না।

দরকার পড়লে বিয়ে করবো আরেকটা।”পাপা বলে”আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও তুমি তাহলে।”লিনোর রাজি হয় না। সে আমাকেও রাখবে আবার বিয়েও করবে। পাপার সাথে অনেক ঝগড়া হয় এই নিয়ে।

এখন অনেকটা সুস্থ ও হয়ে গেছি। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথা বলি না। লিনোর বার বার আমার সাথে কথা বলতে আসে কিন্তু আমি বলিনা। কথা আর কি বলবো? আমার ভেতর থেকে কোন কথা আসে না। এখনো লিনোর আমার সাথে কথা বলার এসেছে। আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে আছি।

~ এলিজা প্লিজ কথা বলো। এভাবে আর কতো থাকবে বলো। এভাবে কথা না বলে থাকলে তো তুমি টোটালি ডিপ্রেষ্ড হয়ে যাবে। এভাবে কি চলে বলো?

লিনোরের অসহায় মুখটা দেখে আমার কেন জানি ভালো লাগছে। ওর কি চোখের জল নেই? একটু পড়ে না কেন? একটূ দেখতাম আর কি। শান্তি লাগতো অনেক।
~ এলিজা প্লিজ কথা বলো আমার সাথে।

এবার আর চুপ করে থাকতে ইচ্ছা করলো না। লিনোরকে বললাম, জানেন অনেক কথা জমা করে রেখেছিলাম আমার বাচ্চার সাথে বলার জন্য। এখনো আছে কথা জমে। আমার বাচ্চাকে কোথায় রেখেছেন আপনি?
লিনোর চুপ হয়ে গেল। কিন্তু আমার মুখ চলতেই আছে।

~ লিনোর আমার না আর বাচ্চা হবে না। আমার বাচ্চাটাকে নাকি আপনি কেড়ে নিয়ে ছেন? কোথায় রেখেছেন? এনে দিন না প্লিজ। মায়ের কোল থেকে সন্তান কে কেড়ে নিতে নেই কখনো। আপনার মায়ের কাছ থেকে আপনাকে কেড়ে নিলে আপনার কেমন লাগবে বলুন? অনেক কষ্ট হবে তাইনা? আমার বাচ্চাটাও আমি ছাড়া কষ্ট পাচ্ছে। এনে দিন না প্লিজ।

লিনোর এবার শব্দ করে কাঁদতে থাকে।
লিনোরের কান্না দেখে আমি পৈশাচিক হাসি। এতোদিন পর মন খুলে হাসছি আমি। মনে হচ্ছে বুকটা খালি হয়ে যাচ্ছে পাথর গুলো নেমে গিয়ে।

লিনোরের সামনে বসে ওর চোখ গুলো মুছে দিয়ে বললাম
“আপনি ভালোবাসা কি বুঝেন? জানেন কিভাবে ভালোবাসতে হয়? আমি তো কখনো আপনার কোন ক্ষতি করিনি। আপনি কেন আমার সাথে এমন করলেন? জানেন একজন কে ভালোবেসে অন্য একজন এর সাথে সংসার করলে কেমন লাগে? আপনি জানেন না। কাউকে ভালোবাসা থেকে ছিনিয়ে আনলে তাকে আগের ভালোবাসা থেকে শক্ত ভালোবাসায় বন্দি করে নিজের করতে হয়।

আপনি তো ভালোবাসা দুর বিশ্বাস টাই করতে পারেন নাই। দিনের পর দিন সব মুখ বুঝে সহ্য করেছি। বিনিময়ে আজ আপনি আমার সব কেড়ে নিলেন। আমি তো আপনার ই হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। আপনার সন্তান গর্ভে ধারন করেছিলাম। সুখেই তো ছিলাম এই কয়মাস থেকে। আপনি আমাকে অনেক ভালোবেসেছেন, বাকি জীবন এভাবেই ভালোবাসবেন প্রমিজ করেছেন।

কই কিছুই তো আর বাকি নেই। আপনার ভালোবাসা হারে হারে পাচ্ছি আমি। আর চাইনা। আমার এবার মুক্তির পালা। আপনাকে মুক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করলাম আমি। সব প্রাপ্তি হওয়ার পরেও দেখেন আজ আপনার অপ্রাপ্তির দিন। প্রাপ্তির সুখ গুলো স্মৃতি হয়েই অপ্রাপ্তির দিকে পা এগুবে। বিদায় লিনোর সাহেব।”
লিনোর অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে এলিজার প্রত্যেক টি পদাচারন এর দিক।


অন্তিম পর্ব

বাসায় এসে গেছি শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে। মোটামুটি ভালোই বাড়ি থেকে বের হই। মাঝে মাঝে দেখি লিনোর দাড়িয়ে আছে। সামনেও আসতে চায়। কিন্তু আমার তার সামনে যাওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। তাই এই ব্যাপারটা একেবারে শেষ করে দেবার জন্য উকিল এর কাছে এসেছি ডিভোর্স পেপার রেড়ি করতে। লিনোর কোন ভাবে হয়তো জানতে পেরেছে।

তাই এখানে চলে এসেছে। বাইরে পাপার সাথে কথা বলছে। পাপাকে হয়তো অনুরোধ করছে ডিভোর্স এর ব্যবস্থা না করতে। তার ইচ্ছা সে আমাকে নিয়েও থাকবে আবার তার অন্য বউ নিয়েও আমার সাথেই থাকবে। তার সন্তান কে আমি আদর করবো।

তার সন্তানের বড়মা হবো। কিন্তু আমি তো পারবোনা এসব হতে। আমার সন্তান কে মেরে ফেলেছে আমি কি করে তার আর অন্য একজনের সন্তানের বড়মা হতে যাবো। এ সম্মব না কিছুতেই আমার দ্বারা।
পাপার সাথে রাগারাগি করে চলে গেলো লিনোর। আমি আমার কাজ করে চলে এলাম। কোর্ট বসার ডেট জানতে পারলাম। ১৫ দিন পর পেপারস সাবমিট করা হবে।

পাপা আম্মু দুজনেই খুশি আমাদের ডিভোর্স এর ব্যাপারে। লিনোর এর মধ্য বেশ কয়েকবার এসেছে। লিনোরের পরিবার ও এসেছে। আমাকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে যাতে ওদের বাড়ি ফিরে যাই ডিভোর্স টা না দিতে পারি। কিন্তু আমি টু শব্দটিও করিনি তাদের সাথে। নির্বাক মানুষের সাথে কেউ পেরে উঠে না। তারাও পারেনি।

কোর্টে আমাদের দুজনের ই বয়ান নেওয়া হলো। আমার সমস্ত অভিযোগ সত্য বলে ডিভোর্স টা হয়ে গেল। আমাকে নির্যাতন করে আর সন্তান কে হত্যার অভিযোগ এ লিনোরের জেল ডাকা হলো। কতো বছরের হলো বলতে পারবো না। চলে এসেছি আমি। ওসব শুনার কোন ইচ্ছাও নেই আমার।

বাসায় ফিরতেই আম্মু আমাকে ধরে কেঁদে দিলেন। তার কান্নার একমাত্র কারন তার মেয়েটা খারাপ সময় থেকে চলে এসেছে। আমার জীবনে যা কিছুই ঘটবে তা যেন এখন ভালো কিছু ঘটে। মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলাম
~ আম্মু আমার তো বাচার কথা ছিল না। তবু কেন বাঁচলাম আমি?

~ এমন কথা বলিস না মা। জোহান আর মাধু তোকে বাচিয়েছে মা।
অনেক দিন পর জোহানের নাম শুনলাম। ভালো লাগলো অনেক। আম্মুর গলায় ত্রীব্র মিনতি
~ যা হবার হয়েছে। এবার তুই জোহানের কাছে ফিরে যা মা। ছেলেটা সত্যি তোকে ভালবাসে। সব কিছু ভুলে নতুন জীবন শুরু কর।

~ আমার এই অভিশপ্ত জীবন কারো ভালো জিবনের, সাথে মেশাতে চাই না। সম্ভব না আম্মু। আজ যদি আমি মরে যেতাম তাহলে তুমি যেমন নিঃশ হয়ে যেতে আজ তেমনি আমিও নিঃশ হয়ে গেছি।
আম্মু মুখ নিচু করে আবারো কাদতে লাগলো। ওদের কান্না আমার গায়ে লাগে না আর।

জোহানের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। ভেতরে ঢুকার সাহসটা ঠিক ঠাক আয়ত্ব করতে পারছিনা।

তবুও এতদুর এসেছি যখন তখন দেখা না করে যাবো না। এগিয়ে গেলাম বাসার দিকে। আমাকে মা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন। আমার কাছে এসে হাত দুটো ধরে সোফায় বসালেন। সারা মুখে হাত বুলিয়ে দেখলেন। তার বিষন্নতা পূর্ণ মুখটা আমি দেখছি শুধু। আমাকে বললেন
~ কেমন আছো মা?

~ আমি ভালো আছি মা। আপনি আর মাধু কেমন আছেন? জোহান কেমন আছে?
~ আমি তো ভালোই দেখতে পাচ্ছ। ওরা সবাই ভালো আছে। দুজনে সুন্দর করে ঘর সাজিয়ে সংসার করছে।
~ বুঝলাম না মা।

~ ওমা তুমি জানো না? ওরা তোমাকে বলে নি? জোহানের সাথে মাধুকে তো বিয়ে দিয়েছি। কি আর বলবো মা। । তুমি চলে যাওয়ার পর আমার ছেলেটা পুরো শেষ হয়ে গিয়েছিল। বার বার মৃত্যুর হাত থেকে বেচে এসেছে। অবশ্য ঐ এক্সিডেন্ট তোমার স্বামী ই করিয়েছে।

তবুও আমরা মাপ করে দিয়েছি তোমার স্বামী কে। তুমি আছো তার সংসারে বলে কথা। জোহানটা বিয়েই করতে চায়নি। অনেক চেষ্টার পর মাধুকে দু মাস হলো বিয়ে করেছে। মাধু আমার ছেলেটা কে পুরো গুছিয়ে নিয়েছে মা। খুব ভালোবাসে আমার জোহান টাকে। খুব সুখে আছে তারা।

~ আলহামদুলিল্লাহ। ভালো হয়েছে অনেক মা। ওরা সুখে থাকুক দোয়া করি।
~ হা মা দোয়া করো।

~ জোহানের সাথে একটা দরকার ছিলো মা। ও মনে হয় ভিতরেই আছে। যেতে পারি?
মায়ের মুখটা মলিন হয়ে গেল। হয়তো আমার মুখের উপর বলতে পারছে না যে জোহানের বিয়ে হয়ে গেছে এখন ওদের কাছ থেকে দূরে থাকো। ওদের ঘরে যেও না। কিন্তু আমার যে দেখা করতে হবে অন্তত একবার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। পা এগুলাম জোহানের ঘরের দিকে। দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে বললো”কাম ইন।

“আমি ভেতরে ডুকতেই আমাকে দেখে চমকে গেলো। আমাকে তার বাসায় এভাবে হয়তো আশা করেনি।”
~ তুমি এখানে? এলিজা এখানে কেন আসছো তুমি? লিনোর জানে তুমি এখানে এসেছো?
~ আমাকে বাচানো কি খুব প্রয়োজন ছিল?

~ প্রয়োজন ছিল কিনা জানিনা। তবে তুমি ভালো থাকো, তোমার কোন সমস্যা না হক তাই চাই আমি।
~ আমি যে ভালো আছি তা তোমাকে কে বললো? তুমি তো আর দেখতে যাও নি হাসপাতাল থেকে আসার পর।
~ এলিজা আই এম সরি। সেদিন যদি আমি তোমাকে ছেড়ে না দিতাম তাহলে হয়তো আজ এমন কিছুই হতো না।

তোমার বেবিটা সুস্থ ভাবে পৃথিবীর বুকে থাকতে পারতো। আমি সত্যিই এমন কিছু চায়নি। আমি বুঝতে পারিনি লিনোর এমনটা করবে।
~ এখন বুঝে লাভটা কি বলো? আমার জন্য অপেক্ষা ও তো করলে না। নাকি তুমিও সন্তান এর জন্যই মেয়েদের ভালোবাসো লিনোরের মতো?

জোহানের গলায় কথা আটকে যাচ্ছে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি।
~ এমন কিছুই না এলিজা। লিনোরের সাথে দেখা হয়েছিল কয়েকদিন আগে। বেচারা সত্যিই অনুতপ্ত। তোমাকে নিয়ে হেপি থাকতে চায়। লিনোর সত্যিই তোমাকে ভালবাসে।

~ আমি যে তোমাকে ভালোবাসি জোহান। তুমি কি এখন আর আমাকে ভালোবাসোনা? সত্যই আমাকে চাও না? তুমি একবার বললে আমি আজো তোমার কাছেই আসবো জোহান।
~ আমি মাধুকে ভালোবাসি। মাধু আমার স্ত্রী।

জোহানের কথায় আমার কোন ভাবান্তর হলো না। আমি জানতাম এরোকমি কথা শুনবো আমি। প্রস্তুত ছিলাম আমি। ওদেরকে বললাম না যে লিনোরের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। জানিয়েই বা কি লাভ আর। আস্তে আস্তে ঘর থেকে চলে এলাম।

দরজায় মাধুকে দাড়ানো দেখলাম। এখানে দাঁড়িয়ে হয়তো শুনছিলো আমাদের কথা। মেয়েটাকে শাড়ি পড়ে বউ বউ লাগছে। বউ __ আমার জোহানের বউ। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলাম। বললাম, “অনেক সুখী হোও। ভালবাসা দিয়ে সবাইকে ভরিয়ে তোলো। নিজের জিনিসটার যত্ম নিও।”
চলে এলাম সে বাড়ি থেকে।

এলিজা চলে যেতেই এক দৌড়ে জোহানকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মাধু। রুমে আসার সময় জোহানের শেষের কথা টা শুনে ফেলে সে। দু মাস বিয়ে হলেও স্বামীর অধিকার দেয় নি জোহান মাধুকে। এই ভালোবাসি কথাটা মাধুর জন্য অনেক বড় কিছু। জোহানকে জড়িয়েই মাধু বলে, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি জোহান। প্লিজ এভাবে আর দুরে রেখো না আমায়। আমি যে তোমার আমার ভালোবাসার সংসার গড়তে চাই।

জোহানের সে দিকে ভাবান্তর নেই। তার চোখের বন্যা বইছে আজ। এলিজা যদি একবার পিছু ফিরতো তাহলে দেখতে পেত এই চোখের জল গুলো। ভালোবাসাকে পেয়েও বার বার ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। সব প্রাপ্তির পর আজ তার #প্রাপ্তির অপ্রাপ্তি ঘটেছে। মাধুকে জড়িয়ে ধরে জোহান। মাধুর বুকে ফেলে তার অপ্রাপ্তির জলরাশি।

বাড়িতে পা রাখতেই পাপা সামনে এসে দাঁড়ালো। তার মুখে হাসির বুলিরেখা ফুটানো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো ~ জোহানের বাসায় গিয়েছিলি?
~ হু।

~ বাসায় ডাক ওর ফেমেলিকে।
~ কেন?
~ আলাপ করে দেখি। তোর সুখেই আমার সুখ।

পাপা কি বলছে তা আমার বুঝতে দেরি হলো না। মানুষ কতো স্বার্থপর তাই না? নিজের মেয়েটাকেও ছাড়ে না।
~ ইউ আর সো লেইট পাপা। তোর সুখেই আমার সুখ কথাটা আর কখনো বলো না প্লিজ। এই ধরনের কথা শুনলে আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে না। আত্মহত্যা মহা পাপ। আমি সেটা করতে চাই না।
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

এক বছর পর __
~ মাম্মা যাবো। আমি মাম্মার কাছে যাবো।

~ আমিও মাম্মার কাছে যাবো। তোর একার মাম্মা নাকি? আমাদেরো মাম্মা হয়।
~ না আমার একাই মাম্মা। মাম্মা আমার।

~ না মাম্মা আমার।
~ আমার মাম্মা আমার।
~ আমারো মাম্মা।

অরফানেজ এর ভেতর ঢুকতেই রহিমা দৌড়ে এলো। হাপাতে হাপাতে বললো, আপা আপনাকে নিয়ে বাচ্চারা ঝগড়া শুরু করে দিছে। একজন বলছে আমার মাম্মা আরেকজন বলছে আমার মাম্মা। দুপুরে খাইও নি আপনার জন্য। তারাতারি চলুন।
আমি তারাতারি করে ভেতরে ঢুকে দেখি চুল টানা টানি পর্যন্ত শুরু হয়েছে। আমি কথা বলতেই সব এক দৌড়ে এসে আমাকে ঘিরে ধরলো।

~ আমি না থাকলেই মারা মারি শুরু হয়ে যায় তাইনা? (রাগ দেখিয়ে)
সবাই একসাথে ~ আর হবে না মাম্মা। সরি। তুমি তো আমাদের মাম্মা।
~ হা আমি তোমাদের সবার মাম্মা। চলো চলো সবাই খাবে চলো।

সবাই কে নিয়ে খাইয়ে দিলাম। আমি এখন এই অরফানেজ এই থাকি। অনেক গুলো বাচ্চার মাম্মা আমি আজ। এদের ভালোবাসার মাঝেই আমার প্রাপ্তি। মাঝে মাঝে মনের ভিতর অপ্রাপ্তি গুলো ঠিকই উকি দিতে আসে।

সব মিলিয়ে প্রাপ্তির অপ্রাপ্তি গুলো নিয়ে ভালোই আছি।

আমি চিৎকার করে উঠলাম ~ নাহহহহহহহহহহহহহহহ।

জোহানের সাথে? নাকি অন্যকিছু?

লেখা – লাবিবা তানহা লিজা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “প্রাপ্তির অপ্রাপ্তি – প্রেমের দুঃখের গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ। )

আরো পড়ূন – প্রাপ্তির অপ্রাপ্তি (১ম খণ্ড) – প্রেমের দুঃখের গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *