বাঁচার দাবি – একটা কষ্টের গল্প

বাঁচার দাবি – একটা কষ্টের গল্প: হসপিটালে পৌঁছার পর ডাক্তার তাকে দেখেই আঁতকে উঠলেন। এবং ধমকাতে লাগলেন আমাদের। বললেন, ‘পেশেন্টকে তো আপনারা বাড়িতেই মেরে ফেলেছেন। সাথে পেটের বাচ্চাটাকেও!’


১ম পর্ব

আমার একমাত্র বোন শিলার কোলন ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বিয়ের ঠিক দের বছর পর এই রোগ দেখা দিলো। ওর পেটে তিন মাসের সন্তান। সেই সন্তানের মায়ায় হলেও ওর স্বামীর অতটা নিষ্ঠুর হওয়া উচিৎ হয়নি।

কিন্তু ভাগ্যের লিখন তো আর উতড়ানো যায় না। শিলার স্বামী নাইম একদিন সন্ধ্যা বেলায় ফোন করলো আমায়। ফোন দিয়ে বললো, ‘ভাইজান, আপনি আমাদের বাড়িতে আসুন একদিন। অনেকদিন আসেন না। আগামীকাল আসলে ভালো হতো।’

আমি ভাবলাম হয়তো আগামীকাল ওদের কোন বিশেষ দিন টিন হবে। তাই অনেক মিষ্টি আর ফলমূল কিনে নিয়ে ওদের বাসায় গেলাম। বাসায় যাওয়ার পরই নাইম আমায় সালাম দিলো। তারপর একটা রিপোর্ট পেপার দিলো আমার হাতে। আমি বড় অবাক হয়ে পেপারের ইংরেজি অক্ষর গুলোতে চোখ বুলাতে লাগলাম। তারপর যা বুঝার বুঝে গেলাম।

নাইম এবার বললো, ‘ভাইজান, আমি কিছু বলবো না। মা আপনার সাথে কথা বলবেন।’
নাইম তার মাকে ডাকলো। ডাকার সাথে সাথেই তার মা এলেন। আমি উনার পা ছুঁয়ে সালাম করতে যাবো তখন তিনি সড়ে গিয়ে বললেন, ‘না বাবা এসবের প্রয়োজন নাই। আসলে একটা বিশেষ কথা বলার জন্য তোমায় ডেকেছি আমি।’

এমনিতেই রিপোর্ট দেখার পর আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমার সবচেয়ে আদরের বোন। আমার একমাত্র বোন। শিলা, যাকে কোনদিন একটা ধমক পর্যন্ত দেইনি তার ভেতর বেড়ে উঠেছে এতো বড়ো রোগ!

নাইমের মা বললেন, ‘বাবা, আসলে আমার ছেলেটার বয়স কম। তাছাড়া ওদের বিয়েরও মাত্র বছর খানেক হয়েছে। ছেলের সামনে অদূর ভবিষ্যৎ। আর শিলার যে রোগ হয়েছে ডাক্তার বলেছে এটা ডেন্জারাস। খুব বেশিদিন বাঁচবে না সে। তাছাড়া চিকিৎসাও অনেক ব্যয়বহুল। আমরা চাচ্ছি কী বাবা–‘

ঠিক তখন চোখ ভরা জল আর হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে পর্দার ও পাশ থেকে বেরিয়ে এলো শিলা। সে কান্নাভেজা গলায় বললো, ‘ভাইয়ারে, এ বাড়ির দরজা আমার জন্য চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেছে!’

বলে সে আমার হাত ধরে টেনে বললো, ‘আয় ভাইয়া, আয়।’
নাইমের মা বললেন, ‘মাত্র এসেছে। খাওয়া দাওয়া হোক। একটু রেস্ট নিক। তারপর যাবে।’
শিলা রাগত স্বরে বললো, ‘আপনি ওর কী হন যে এখানে সে খাওয়া দাওয়া করবে, রেস্ট নিবে?’
নাইমের মা একদম চুপসে গেলেন শিলার কথায়।

নাইম এতোক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে সে শিলার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো, ‘শিলা, অসুখটা কমুক তোমার। তারপর তোমায় আবার নিয়ে আসবো এখানে।’

শিলা পেছনে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললো, ‘লজ্জা করে না তোমার। কোন মুখে এ কথাটা বললে? নিজের প্র্যাগনেন্ট বউকে অসুখের জন্য তাড়িয়ে দিচ্ছো আর বলছো অসুখ ভালো হয়ে গেলে তুমি আমায় ফিরিয়ে আনবে! তুমি কী ভেবেছো আমি অতটাই বেহায়া যে কোনদিন সুস্থ হয়ে গেলে তোমার কাছে আবার ফিরে আসবো?’

বলেই শিলা হাঁটা ধরলো। আমি একবারও পেছন ফিরে তাকালাম না। আমি জানি এখন পেছনে তাকালেই দেখতে পেতাম নাইম মিষ্টি করে হাসছে। হ্যা এখন তার হাসারই কথা। বাড়ি থেকে আপদটা বিদায় করতে পেরেছে ও। এবার একটা বিয়ে করবে। ঘরে নতুন বউ। আহা কী আনন্দ!

বাড়ি ফিরতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মা। সব শুনেছেন তিনি। মা এসে জড়িয়ে ধরলেন শিলাকে। শিলা মাকে। তারপর ওরা গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলো। এবং তাদের সাথে কান্নায় গলা মিশালো আমার স্ত্রী ইতু। ইতু কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘তুমি সুস্থ হয়ে যাবে শিলা। আমরা ভালো চিকিৎসা করাবো। কোন ভয় নেই তোমার!’

কিন্তু ইতুর এই প্রতিশ্রুতি সে রাখতে পারলো না। মাত্র তিন মাস পর যখন ইতু দেখলো শিলার পেছনে কয়েক লাখ টাকা চলে গেল তখন সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। কারণ আমাদের তিন বছর বয়সী একটা ছেলে আছে। আগামী বছর তাকে স্কুলে প্লেতে ভর্তি করা হবে।

ইতু এক রাতে আমাদের ছেলে প্রকাশকে এক পাশে রেখে সে আমার ঘনিষ্ঠ হলো। আমার চুলে, বুকের লোমে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘শিমুল, একটা কথা বলতে চায় তোমায় মনোযোগ দিয়ে শুনবে তুমি?’

আমি ওর পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, ‘বলো। শুনবো।’
ইতু বললো, ‘সত্যি শুনবে কি না বলো। আর রেগে যাবে না তো আবার?’
‘আমার রক্তে রাগ নাই এটা তুমি ভালো করেই জানো। এখন সুন্দর করে বলে ফেলো কী বলতে চাও তুমি।’
ইতু কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘ডাক্তার বলেছে শিলা বাঁচবে না আর।’
‘হ্যা এটা জানি।’

‘সব জেনে শুনে তুমি পাগলামি করছো কেন তবে?’
আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, ‘কী পাগলামি করছি আমি?’

ইতু আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। ওর কপালের একটা পাশ কেমন ঘামছে। ইতু বললো, ‘বোনের নিশ্চিত মরণ জেনেও কেন ওর পেছনে এভাবে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছো। কেন সঞ্চিত প্রয়োজনীয় টাকা গুলো অপ্রোয়জনে নষ্ট করে দিচ্ছো।’
ইতুর কথাটা শুনে আমার একটুও রাগ পেলো না।
কারণ আমার ধাতে রাগ জিনিসটা নাই। তাই আমি হাসলাম। সামান্য শব্দ করে হেসে বললাম, ‘ইতু, ডাক্তার বলে না দিলেও আমরা নিশ্চিত জানি আজ এই এক্ষুনি আমি কিংবা তুমি অথবা আমাদের সন্তান প্রকাশ আমাদের কেউ একজন মরে যেতে পারি।
তবুও কিন্তু আমরা আমাদের পেছনে অর্থকড়ি নষ্ট করছি। সকালের আগে মরে যেতে পারি জেনেও কিন্তু আমরা আমাদের জন্য সকালের বাজার করে রেখেছি। ড্রাইভারকে বলে রেখেছি অফিসে যাবো সকাল আটটায়। গাড়ি নিয়ে ঠিক সময় প্রস্তুত থাকতে। কেন? মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কেন আমরা এটা করছি?

ইতু আমার এই কথার কোন উত্তর দিতে পারলো না তাই চুপ করে রইলো। কিন্তু তার গা ভর্তি তখন রাগ। তার রাগের কথা আমি জানতে পেরেছি কারণ সে আর এখন আমার সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় নেই। মাঝখানে আবার প্রকাশকে ঠেলে দিয়ে সে ও পাশ ফিরে শুয়ে গেছে। হয়তো মুখ ফুটিয়ে আর কিছু বলছে না আমায়। কিন্তু মনে মনে ঠিক বকছে।

আমি তাকে এ পাশ ফিরতে বললাম না কিংবা এও বলিনি যে আমার সাথে কথা বলো। আমি শুধু বলেছি যে, ‘পৃথিবীতে কেউ কমদামী নয়। সবাই বেঁচে থাকার অধিকার রাখে। এমনকি শিলার গর্ভের সন্তান। যে এখনও পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে কিছুই জানে না!


২য় পর্ব

ইতুর আচার আচরণ এখন অদ্ভুত রকমের পাল্টে গেছে। আজ সকালে সে মার সাথে প্রচন্ড ঝগড়া করেছে। যে মেয়ে আগে মার চোখের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরেও কথা বলতো না সেই মেয়ে আজ মার সাথে উচ্চ গলায় কথা বলেছে।
সকাল বেলা মা তসবিহ পড়ছিলেন। তখন হঠাৎ ইতুকে ডেকে মা বললেন, ‘বউমা, চা করলে শিলাকে এক কাপ দিও তো।’

ইতু তখন রাগত স্বরে বললো, ‘আপনারা আমায় কী পেয়েছেন বলুন? আমি কী এ বাড়ির বুয়া টুয়া নাকি?’
মা অবাক হয়ে বললেন, ‘বউ এটা কোন ধরনের আচরণ। এক কাপ চায়ের কথা বলেছি এই জন্য বেপাস একটা কথা বলে ফেলতে পারলা তুমি!’

ইতু তখন আরো গলা বড়ো করলো। তারপর ঝাঁজালো গলায় বললো, ‘আমি অত ভালো কথা বলতে পারি না বুঝলেন মা? ভালো কথা বলার জন্য ঘরে ভালো মানুষ আনেন। আপনার ছেলের জন্য আরেকটা বিয়ে করান। আমি এখানে থাকবো না। আমার ছেলে নিয়ে চলে যাব।’
মা তসবিহ পড়া রেখে দিলেন। তারপর জায়নামাজ থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘কী হয়েছে তোমার বলতো বউমা? কেউ কিছু বলেছে?’

ইতু মার কথার কোন উত্তর দিলো না। সে চুপ করে রইলো। তার মুখ ভার ভার।
মা আবার জিজ্ঞেস করলেন।
‘কী গো বউমা উত্তর দেও কথার!’
ইতু এবার চেঁচিয়ে উঠলো এক রকম।

তার হাতে ছিল জগ। সেই জগ ভর্তি জল। সেই জল সুদ্ধ জগ মেঝেতে ফেলে দিয়ে সে বললো, ‘আমি এক্ষুনি চলে যাবো এই বাড়ি থেকে। আপনারা আপনাদের মেয়ের চিকিৎসা করান। সেবা তদবীর করতে থাকেন। অন্য কারোর কথা কিছু ভাবতে হবে না।’
মা কিছু বলার আগেই ইতু ঘরে এসে বোরকা পরে নিলো। তারপর ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। প্রকাশকে ভালো জামা পরালো।

তারপর প্রকাশকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে যাবে ঠিক তখন ইতু দৌড়ে এলো। তার শরীর এমনিতেই ভার। হাঁটতে পারে না। কষ্ট হয়। কষ্ট করেই সে এসে ইতুর হাতটা ধরে ফেললো। তারপর বড়ো অনুনয়ের গলায় বললো, ‘ভাবী, প্লিজ এমন করো না। তুমি থাকো। আমার কোন চিকিৎসা লাগবে না। আমায় কিছু করেও দিতে হবে না। আমার খাবার আমি নিজে করে খাবো।’

তবুও কাজ হলো না। ইতু ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে চলে গেল প্রকাশকে নিয়ে। শিলা ঠাঁই বসে থেকে হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। মা তাকে টেনেও ঘরে নিতে পারছেন না।

অফিস থেকে ফিরেই আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। শিলা তখনও বারান্দায় বসে আছে। এই প্রচন্ড শীতেও সে বসে আছে বারান্দার এক মাথায়। ওখানে বসে থেকে কেঁদেই যাচ্ছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এই শিলা, শিলা কী হয়েছে তোর?’
শিলা আরো জোরে কেঁদে উঠলো।
আমি এবার ইতুকে ডাকলাম।

‘ইতু, এই ইতু? ইতু শিলা কাঁদছে কেন?’
ইতু কোন সাড়া দিলো না। মা এলেন ঘর থেকে বের হয়ে। মার চোখ ভরা জল। মা এসে বললেন, ‘বউমা চলে গেছে!’
‘মানে?’

‘তুই অফিসে যাওয়ার পর থেকেই সে কেমন রাগ দেখাচ্ছে। এক কাপ চায়ের কথা বললাম শিলাকে দিতে তখন কত কথা যে বললো। সে নাকি এ বাড়ির বুয়া টুয়া না। তাকে ফুট ফরমাশ দেয়া যাবে না একদম। তারপর আমি বললাম, কেউ তোমায় কিছু বলেছে। এই কথায়ও চেঁচিয়ে উঠলো। হাত থেকে জগ ফেলে দিলো মেঝেতে। তারপর বললো, আপনারা আপনাদের মেয়ের চিকিৎসা করান। আমি প্রকাশকে নিয়ে চলে যাচ্ছি।

বলেই সে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে চলে গেল। শিলা তার হাত ধরে অনুনয় করলো। বললো, আমার জন্য আর কিছু করতে হবে না। আপনি থাকুন প্লিজ ভাবী। কিন্তু এতে কোন কাজ হলো না। বউমা শিলাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে গেল। তখন থেকেই শিলা এখানে বসে থেকে কাঁদছে।’

আমার তখন মনে হলো ইতুর বলা সেদিন রাতের কথাগুলোর কথা। একটা মানুষ হঠাৎ পরিবর্তন হয় কীভাবে? আজ তো তারও এমন হতে পারতো। আচ্ছা তার যদি এমন একটা রোগ হতো আর তার ভাইয়ের স্ত্রী তার সাথে এমন একটা আচরণ করতো তখন তার কেমন লাগতো?’

আমি শিলাকে টেনে উপরে তুললাম। তারপর ওর একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম ঘরে। বেসিনের কাছে নিয়ে গিয়ে ওর হাত মুখ ধুয়ে দিলাম। তারপর ওকে নিয়ে খেতে বসলাম
শিলা বললো, ‘ভাইয়া, আমার আর কোন চিকিৎসা লাগবে না। তুই ভাবীকে বলে ফিরিয়ে নিয়ে আয়।’

আমি তখন মৃদু হেসে বললাম, ‘কেন তোর চিকিৎসা লাগবে না? তাছাড়া তোর চিকিৎসা ইতুর কথায় বন্ধ হয়ে যাবে কেন? চিকিৎসার টাকা কী ইতু দিচ্ছে? টাকা তো খরচ হচ্ছে বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে। এই সম্পদ তোর এবং আমার দু’জনের। তোরটা তুই খরচা করছিস এতে ইতুর কী? সে যেদিন এটা বুঝতে পারবে যে এই সবের ভেতর তার নাক গলানো অনুচিত সেদিন তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে না গিয়ে। সে নিজেই ফিরে আসবে।


৩য় পর্ব

ইতুর মা একজন চতুর মহিলা। মানুষ বলে না যে মা ভালো হলে তার সন্তানেরাও ভালো হয়। কথাটা সব সময় সত্য না হলেও অধিকাংশ সময় কিন্তু সত্যই হয়। ইতু পেয়েছে তার মায়ের ধাৎ।

গতকাল অফিস করে ফেরার সময় হঠাৎ করে ইতুর মা ফোন দিলেন আমায়। আমি সুন্দর করে তাকে সালাম দিলাম। তিনি সালামের উত্তর দিলেন না। আমি কোমল গলায় এবার বললাম, ‘মা কেমন আছেন আপনি?’
ইতুর মা তখন ঝাঁজালো গলায় বললেন, ‘আমার সাথে তামাশা করো নাকি? মনে রাখবা
আমি তোমার শাশুড়ি, শ্যালিকা না!’

উনার কথা শুনে আমি ভীষণ রকম চমকে উঠলাম। এটা কোন ধরনের আচরণ! উনার সাথে আমি কী খারাপ আচরণ করেছি যে তিনি এমন করলেন আমার সঙ্গে?
আমি আস্তে করে এবার বললাম, ‘মা, আপনার সাথে তো আমি কোন খারাপ আচরণ করতে জানি না। আপনি হঠাৎ এমন করে যে কথা বললেন!’

এবার ইতুর মা বললেন, ‘কৈফিয়ত চাও তুমি আমার কাছে? অনেক বাড় বেড়েছে তোমার না! তুমি জানো আমার ছেলেদের বললে ওরা তোমায় মেরে তোমার টেং গুঁড়া করে দিবে?’
আমি ভদ্রতা বজায় রেখেই বললাম, ‘মা, আপনি কেন শুধু শুধু এমন করছেন? আপনাকে তো শুধুমাত্র আমি জিজ্ঞেস করেছি আপনি কেমন আছেন। আর দিয়েছি সালাম। এর বেশি তো কিছু বলিনি। এমন কী একটা হাঁচি কাঁশিও দেইনি পর্যন্ত!’

তিনি এবার আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বললেন, ‘হ্যা এটাই। তুমি আমায় জিজ্ঞেস করছো মা কেমন আছেন? এটা তো তুমি ইচ্ছে করে আমার সাথে তামাশা করে বলছো। তুমি নিজেই তো আমাদের দূরাবস্থার মধ্যে ফেলছো। আমার মেয়েকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিছো।

এমনকি তোমার ঔরসের সন্তানটাকেও। এতো কিছুর পরেও আমায় জিজ্ঞেস করছো আমি কেমন আছি। এটা তো ফাজলামি। তুমি তো ফাজিলের বাচ্চা ফাজিল। ইচ্ছে করতাছে তোমার গালে একটা চড় মেরে সবগুলো দাঁত ফেলে দেই!’

আমি তবুও নিজেকে শান্ত রাখলাম। এতো কিছু বলার পরেও কেউ নিজেকে শান্ত রাখতে পারবে না। কিন্তু আমি পেরেছি। নিজেকে যথেষ্ট পরিমাণ শান্ত রেখেছি। কারণ আমার ধাঁতে রাগ জিনিসটার ভীষণ রকম অভাব আছে। সহজে আমি রাগতে পারি না!

ইতুর মা আমায় চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, ‘তোমাকে আমি কিছু প্রশ্ন করবো তুমি সেগুলোর ঠিক ঠিক উত্তর দিবে।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা মা।’
তিনি বললেন, ‘তোমার কাছে তোমার আধমরা বোন বড়ো না বউ বড়ো?’
আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘মা আপনার কাছে আপনার মেয়ে বড়ো না আপনার সম্পত্তি বড়ো?’
তিনি এবার খুব রেগে উঠলেন। বললেন, ‘জীবনে অনেক খচ্চর দেখেছি কিন্তু তোমার মতন জাত খচ্চর দেখিনি একটাও।’

আমি মার কথার প্রতিবাদ করলাম না। শুধু মৃদু হাসলাম।
তিনি এবার বললেন, ‘তোমার কী ইচ্ছে ? পথের ফকির হয়ে যাবে? ভিক্ষা করে খাবে?’
‘ভিক্ষার কথা কেন বলছেন মা?’

‘বোনের চিকিৎসা করিয়ে তো একদিন ফকির হবে। তখন তো আর ভিক্ষা ছাড়া গতি নাই!’
আমি এবারও মৃদু হেসে বললাম, ‘ভিক্ষা যদি নসিবে থাকে তবে অবশ্যই করতে হবে। আপনার নসিবে থাকলে আপনাকেও করতে হবে।’

ইতুর মা এবার প্রচন্ড রাগলেন। তিনি এবার ভীষণ রকম ত্যাজি গলায় বললেন, ‘হারামজাদা।’
আমি এবার শব্দ করেই হেসে উঠলাম।

ও পাশ থেকে ইতুর মা বললেন, ‘তোর কী লজ্জা শরমের বালাই নাই রে হারামজাদা?’
আমি বললাম, ‘মা ফোন তো আমি করিনি। আপনি ফোন করেছেন!’

বলেই মুখ চেপে হেসে উঠলাম আমি। উনি কী বলবেন হয়তো খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই খানিক সময় চুপচাপ থেকে একটু পর বললেন, ‘তোকে আমি জন্মের শিক্ষা দিবো রে হারামজাদা। আমার মেয়ের উপর তুই অত্যাচার করেছিস। আমি থানায় গিয়ে নারী নির্যাতনের মামলা করবো।’

আমি বললাম, ‘মা, নারী নির্যাতন আমি করিনি। নারী নির্যাতন করেছে আপনার মেয়ে। সে আমার অসুস্থ বোনের চিকিৎসায় বাঁধা দিয়েছে। নানান কথা বলে তাকে মানসিক কষ্ট দিয়েছে। মামলা করতে হলে আপনার মেয়ে ইতুর নামে আগে করুন।’
ইতুর মা বললেন, ‘জেলের ভাত খেলেই মজার মজার কথা সব ভুলে যাবি। হারামজাদা।’
বলেই তিনি ও পাশ থেকে ফোন কেটে দিলেন।

এবার আমি খানিক সময় চুপ করে রইলাম। তারপর দূরে চলন্ত একটা ট্রেনের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এই পৃথিবীর মানুষ গুলো উপরে উপরে কী ভীষণ ভালো কিন্তু এদের ভেতর এতো কদার্যতা! এই কদার্য মানুষগুলোকে তূলনা করা যায় সুন্দর সুন্দর কাঁচের গ্লাসের সাথে। যে গ্লাসগুলো এমনিতে ভীষণ সুন্দর, চকচকে। কিন্তু ভেঙে গেলে দেখা যায় এদের ভেতর কত ক্রোধ, এদের ভেতর কত হিংস্রতা!

আমার শাশুড়ি অর্থাৎ ইতুর মাও এক সময় আমার চোখে একজন মুখোশ পরা ভালো মানুষই ছিলেন। তাকে আমি পরম ভক্তি শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু তিনি সময়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তার মুখোশের আড়ালের ভয়ংকর রূপ। সত্যি কথা বলতে সমাজের কোন মুখোশধারীই ভালো নয়। এরা সব সময় নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর। এদের বিশ্বাস করাও রাম বোকামি!


৪র্থ পর্ব

সন্ধ্যা বেলায় শিলার শরীর খারাপ হলো। তার আট মাস চলছে। ক্যান্সারজনিত সমস্যা না। পেটে ব্যথা। ভীষণ রকম ব্যথা। পানি ভাঙছে টানা। বিছানায় শুয়ে ছিল বিকেল বেলা। হঠাৎ টের পেলো তার কাপড় ভিজে গেছে। বিছানাও ভিজেছে। পেটের ব্যথাও রিম রিম করে বাড়ছে। কপালের এক পাশ ঘামছে। তার কেমন ভয় হচ্ছে। ভীষণ রকম ভয়। সে এদিক ওদিক তাকালো। তারপর ডাকলো মাকে।
‘মা, মাগো, ওমা!’

মা কিচেনে ডিম ভাজছিলেন। শিলার চিৎকার শুনে মা দৌড়ে এলেন ঘরে। এসে আতঙ্কিত গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে মা, কী হয়েছে তোর?’
শিলার চোখে জলের বিন্দু। সে তার কাঁপা কাঁপা আঙ্গুল তুলে তার ভিজে যাওয়া শায়া এবং বিছানা দেখালো।

মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘ভয় নাই মা। কোন ভয় নাই। মনে মনে আল্লারে ডাক। সাত মাস আটমাস ব্যাপার না। এমন হয়। তোর মেজো মামা জন্মেছিল সাত মাসের সময়। মানুষ এই জন্য তারে মজা করে ডাকতো সাত মাইস্যা পোলা!’
মা গেলেন ধাত্রীর খুঁজে। আমাদের এলাকার প্রসিদ্ধ ধাত্রীর নাম বেগমের মা। বেগমের মার কাছে গাইনি ডাক্তার ফেইল। নার্স টাস তো দূরের কথা! এমনটাই জনশ্রুতি। মা গেলেন বেগমের মার কাছে।

কিন্তু সমস্যা হলো বেগমের মা আছে এখন পাড়ার অন্য বাড়িতে। ওখানে আরেক মহিলার প্রসব ব্যথা উঠেছে সকাল থেকে। এখনও কিছু হচ্ছে না। বেগমের মা বললো, ‘আপনি টেনশন নিয়েন না বুবু, এই কাম সাড়তে ঘন্টা খানেক লাগবো বড়জোর। এর আগেও ডিসমিস হয়ে যাইতে পারে।

কিন্তুক হময় হাতে বেশি রাখন ভালা। আর আপনার মেয়ের তো মাত্র শুরু। বেদনা আরো চড়া হোউক। আমি আসতাছি। কোন লোক লস্কর পাডানোর প্রয়োজন নাই আমার কাছে। একটু পর আমিই আসতাছি।’
একটু পর আসতেছি বলেও দু ঘন্টা চলে গেলেও বেগমের মার ফেরার নাম নাই। এইদিকে শিলার অবস্থা ভয়াবহ। তার এখন রক্ত ভাঙছে। কিন্তু ভয়ের কথা হলো পেটের ব্যাথা এখন তীব্র না। একেবারেই কম। এই আছে এই নাই অবস্থা।
আমি বললাম, ‘মা এইসব ধাই টাই রাখো তো। আমি হসপিটালে নিয়ে যাবো শিলাকে। ওখানে যাওয়া আমাদের উচিৎ।’

মা বললেন, ‘শিলা না করছে হসপিটালে যাবে না। জার্নি করলে নাকি ওর ঝামেলা হবে। ডাক্তার তার সিজার করবে। পেট কাটবে। সে এসব ভয় পায়!’
‘কী পাগলের মতো কথাবার্তা। ওখানে গেলেই সিজার করবে কে বলেছে ওকে? তাছাড়া সিজার যদি লাগে তবে করবে এতে সমস্যা কী? সিজার আজকাল অহরহ হচ্ছে। এইগুলো তো তেমন কিছু না।

আর সে কেন বুঝতে পারছে না তার শরীরে কত ভয়ংকর একটা অসুখ বাসা বেঁধে আছে। এখন তো তার একটু সাবধান হওয়া উচিৎ। আল্লাহ না করুক কিন্তু ওর এই অবহেলার জন্য ওর যদি খারাপ কিছু হয় তখন!’
এসব বলেও লাভ হলো না। শিলা বললো, ‘মরে গেলে ঘরেই মরবো। আমি কিছুতেই হসপিটালে যেতে পারবো না। কিছুতেই না।’

মা আবার গেলেন বেগমের মাকে আনতে।
বেগমের মাকে তিনি মাঝ পথেই পেলেন। বেগমের মা মাকে দেখেই বললেন, ‘বুবু, বিপদ আর বিপদ। মেয়ের ঘরতে হইছে মেয়ে বাচ্চা। সেই বাচ্চার দম নাই নাই। কিন্তু আল্লার কুদরত। কোলার নীচে নিয়া দিলাম বাড়ি। আধাঘণ্টা ধইরা বাইড়াইলাম। হেরপর মরা মেয়ে কান্দে। ওয়াও ওয়াও কইরা কান্দে।’

মা বললেন, ‘বেগমের মা, এইসব কথা বলার অনেক সময় আছে। আমার মেয়ের অবস্থা ভালো না। আগে বাড়িতে চল।’

বেগমের মা এসে দেখলো শিলা একদম সুস্থ। পানি রক্ত কিছুই আর ভাঙছে না। পেটেও কোন ব্যথা নাই। শিলা দিব্যি সুস্থ মানুষের মতো বিছানায় পা উঠিয়ে বসে আছে।
বেগমের মা অবাক হয়ে বললো, ‘এইডা কেমুন কান্ড বুবু? আপনি বললেন মেয়ের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ এখন আইসা দেখি মেয়ে তরতাজা বইসা আছে।’
শিলা বললো, ‘হঠাৎ ব্যথা কমে গেছে।’

বেগমের মা বললো, ‘এইটা তো বিপদের কথা। বুবু, আপনার ছেলেরে বলেন মনোয়ার পীরের কাছ থিকা উতার (পানি পড়া)নিয়া আসুক। এই উতার খাইলে মেয়ে পাগলা কুত্তার মতন বেদনায় চিল্লাইবো।’

অবশেষে আমাকে যেতে হলো মনোয়ার পীরের কাছে পানি পড়া আনার জন্য। ওখান থেকে পানি পড়া নিয়ে এসে দেখি শিলা অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। তার আবার রক্ত ভাঙছে। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। ভয়ংকর বিপদ।
আমি মাকে বললাম, ‘মা, আমি আগেই বলেছিলাম ওকে নিয়ে হসপিটালে যেতে। কিন্তু ও শুনেনি তো। এখন দেখো অবস্থা!’

বেগমের মা বললেন, ‘কোন ভয় নাই বাজান। আল্লাই উদ্ধার করবো তোমার বইনরে। এরচে বড়ো বড়ো সমস্যা সমাধান করছি কতো!’
আমি বললাম, ‘ফুপু, আপনি বুঝতে পারছেন না ওর সমস্যা শুধু এটা না। ও ক্যান্সারে আক্রান্ত।’

বেগমের মা বললো, ‘চিন্তা কইরো না। পীর পাবের উতার খাইলে ক্যান্সার ফেন্সার দৌড়াইয়া পালাইবো।’
কিন্তু না শিলাকে এই উতার খাওয়ানো গেল না। তার অবস্থা ভয়াবহ রকম খারাপ। জ্ঞানই ফিরছে না কিছুতেই।

আমি দৌড়ে গিয়ে এম্বুলেন্স নিয়ে এলাম। শিলাকে নিয়ে যাওয়া হবে হসপিটালে।
বেগমের মা বলছে, ‘খারাব হইবো কিন্তুক। মেয়ের কিন্তুক নিষেধ আছিলো হসপিটালে নিয়ে যাইবার জন্য। তুমি বাজান জোরাজুরি করতাছো। জোরাজুরির ফল হয় খারাপ। আল্লাহ জোরাজুরির
কাম পছন্দ করে না।’

এই ফালতু মহিলার কথা শুনা যাবে না। এমনিতেই মহা বিপদ। পরে আরো সমস্যা হবে।
শিলাকে নিয়ে এম্বুলেন্সে উঠা হলো। তার শ্বাসকষ্ট ভয়ংকর রকম বাড়ছে। মনে হচ্ছে এই এক্ষুনি ভয়াবহ কিছু একটা ঘটবে।
শিলার মুখে মাস্ক দেয়া হয়েছে। অক্সিজেন মাস্ক।

মা কাঁদছেন। চিৎকার করে কাঁদছেন। আমিও কাঁদছি। টপটপ করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা, অনেক অনেক গুলো ফোঁটা। সেই জলের ফোঁটা গুলোর দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বললাম, ‘আল্লাহ, তুমি আমার লক্ষ্মী বোনটার জীবন ভিক্ষা দেও!


৫ম পর্ব (অন্তিম)

শিলা মারা গেলো রাত তিনটার সময়।
হসপিটালে পৌঁছার পর ডাক্তার তাকে দেখেই আঁতকে উঠলেন। এবং ধমকাতে লাগলেন আমাদের। বললেন, ‘পেশেন্টকে তো আপনারা বাড়িতেই মেরে ফেলেছেন। সাথে পেটের বাচ্চাটাকেও!’

মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তিনি শিলার হাতটা শক্ত করে ধরলেন।
ডাক্তার কঠিন হুংকার দিলেন। বললেন, ‘এখন ঢং রেখে সামনে থেকে যান। রোগীকে অটিতে নিতে হবে। এই সিস্টার্স, সিস্টার্স!’
ডাক্তার সাহেব নার্সদের ডাকতে লাগলেন।

রাত একটার সময় মা বসলেন সালাতুল হাজতের নামাজে। এই নামাজ পড়লে হাজত অর্থাৎ সমস্যা দূরিভূত হয়। মা নামাজে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে নামাজ পড়তে পারছেন না। হসপিটালের বারান্দায় যে চাদরের উপর তিনি নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছেন সেখানে দাঁড়িয়েই তিনি থরথর করে কাঁপছেন।

ঠিক এই সময়েই শিলার সিজার হয়ে গেল। তার মেয়ে সন্তান হয়েছে। সেই মেয়ে হৃষ্ট পুষ্ট। মায়াবী মুখ। নয়নকাড়া চোখ। এতো সুন্দর ফুটফুটে সন্তান জন্ম দিয়ে মরে যেতে নেই। এই মেয়ের হাসিমাখা মুখ দেখলে সমস্ত কষ্ট ভুলে যেতে পারতো শিলা। এই মেয়ের মুখে একবার মা ডাক শুনলে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতো শিলা! হলো না। এসবের কিছুই তার দেখা হলো না।

আমাদের রক্ষাকর্তা অদ্ভুত অদ্ভুত খেলা খেলেন। সেই খেলা আমরা বুঝতে পারি না। জানতে পারি না এর শুরু-শেষ। সিজারের আগেও জ্ঞান ছিল না শিলার। সিজারের পরেও আর জ্ঞান ফিরলো না তার। তিনটা বাজলে ডাক্তার আমার পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ইউর সিস্টার —-‘
আমি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কিন্তু কোন কথা বললাম না। কাঁদলাম না। শুধু বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম ঠাঁয়।

মা কেঁদে উঠলেন। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তার কোলে শিলার শূন্য দিনের রুপবতী কন্যা। এই কন্যার দিকে তাকিয়ে আমার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এক হাতের পিঠে সেই জল মুছে আমি বললাম, ‘মারে, এতো সুন্দর হয়ে জন্ম গ্রহণ করলি অথচ তোর মা আজ নাই। জন্মের পর থেকেই তুই এতিম। আহা! আহারে!

শিলার মৃত্যুর খবর শুনে ইতু এলো। সাথে তার মা। ইতুর সে কি কান্না! ইতুর মাও কাঁদছে।
ইতু শিলার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে শিলাকে স্পর্শ করতে চাইলো। ঠিক তখন আমি এক ধমক দিলাম। বললাম, ‘তোমার পাপী হাতে আমার পবিত্র বোনকে স্পর্শ করবে না। খবরদার বলছি কিন্তু!’

ইতু সাহস পেলো না শিলার গা ছুঁতে। ওর মা আমার কাছে এসে তখন বললো, ‘বাবা, ইতুকে ভুল বুইঝো না। আমার মেয়ে শিলার মৃত্যুতে খুব কষ্ট পেয়েছে।’
আমি মৃদু হাসলাম। আর বললাম, ‘আমার সন্তান প্রকাশকে রেখে আপনারা মা মেয়ে এখান থেকে বিদায় হন বলছি।

আপনারা এখানে থাকলে আমার বোনের আত্মায় কষ্ট পাবে!’
ইতু অনেক অনুনয় বিনয় করলো এখানে থাকতে। অনুরোধ করলো তার ভুল মাফ করে দিতে। কিন্তু আমি মাফ করলাম না। সব সময় সবাইকে মাফ করা যায় না। সব ভুল মাফের যোগ্য না। কিছু কিছু ভুল মাফ করে দিলে মাফ কারী দয়ালুর বদল পাপী হয়ে যায়। আমি পাপী হতে পারবো না।

দীর্ঘ বিশ বছর পরের কথা-
আমার ছেলে প্রকাশের সাথে আজ শিলার রুপবতী মেয়ে পুষ্পার বিয়ে। কী অদ্ভুত কান্ড। এই বিয়েতে একজনের মা তো এমনিতেই নাই আর অন্য জনের মা পৃথিবীতে থেকেও নাই।

লেখা – অনন্য শফিক

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “বাঁচার দাবি – একটা কষ্টের গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – প্রতিশোধ অতঃপর ভালোবাসা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *