অপবাদ – মন খারাপের ছোট গল্প

অপবাদ – মন খারাপের ছোট গল্প: বাবা তোর চলে যাবার তিন বছর পর মারা যান। আর তোর মা দুইদিন আগে মারা যান।


মুলগল্প

আজ ১৩টা বছর পর বাড়ি যাচ্ছি। আমি প্রবাসী নই, বা অভিমান করেও কোথাও যাইনি। এই ১৩টা বছর কেটেছে বন্দী চার দেয়ালে। অপরাধ কিছুই না, মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে ১৩টা বছর। আজ জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছি।

মানুষ মানুষকে এতো কঠিন মিথ্যে অপবাদ দিতে পারে। সেটা কখনো বুঝতে পারিনি। আমি না-কি আমার গ্রামের পাগল ফখরুলকে খুন করেছি। এই মিথ্যা অপবাদটা আমার গ্রামের লোকেরা আমার উপর দিয়েছিলো।

কোনো প্রমাণ ছাড়াই পুলিশ আমায় ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকেই শুরু হয় বন্দী জীবন।

ঠিক ২০০৭ সালের এই দিনে আমাকে মিথ্যে অপবাদের উপর ভিত্তি করে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছিলো। তখন আমার বয়স ছিলো মাত্র ১৪,
সেই সময় দেখেছি আমার মাবাবা, ভাই বোন, চাচাচাচী, এবং দাদুর আর্তনাদ।

কিন্তু গ্রাম বা পুলিশ এর লোক কেউ ওদের আর্তনাদ শুনেনি। আমাকে বন্দী চার দেয়ালে কঠিন থেকে কঠিন ভাবে নির্যাতন করা হতো প্রতিটা দিন।

সব সহ্য করেছি, কারণ সত্য একদিন প্রকাশ পাবেই, এই বিশ্বাসে।
আজ ১৩ বছর পর খোলা আকাশের নিচে মুক্ত বাতাস উপভোগ করছি।

এখন আমার বয়স ২৭,
ওই নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। কারণ আইনের লোক ব্যর্থ। পারেনি মিথ্যা অপবাদকে সত্য প্রমাণ করতে। পারেনি ফখরুলের খুনি কে বা কারা সেটা প্রমাণ করতে। তাইতো আমাকে নির্দোষ বলে ১৩টা বছর পর ছেড়ে দিলো।

ওরা কি আমার ১৩টা বছর ফিরিয়ে দিতে পারবে?
কখনো না, সময়, দিন, মাস, বছর ইত্যাদি যে গুলো চলে গেছে জীবন থেকে, তা আর কখনো ফিরে আসবে না।

ফখরুল এর খুনিরা হয়তো ম
খোলা আকাশের নিচে মুক্ত হয়ে ঘুরছে।
এই ১৩টা বছরে একবারো আমার পরিবারের কারো সাথে দেখা করতে দেয় নি আমায়। আইনের পোষাক পড়িতো লোকেরা এই কাজটা কেন করলো, আজো আমার অজানা।

আমার পরিবারের সবাই কেমন আছে, বা কোথায় আছে, কিছুই জানিনা।

বসে আছি পুলিশের গাড়িতে, অনেক দূরের জেলখানায় রাখা হয়েছিলো আমাকে।

পাশে থাকা অফিসারকে জিজ্ঞাস করলাম।
স্যার! আর কতক্ষণ লাগবে?

আমার প্রশ্নটা শুনে অফিসার মুচকি হেসে বলেন।
আরো চার ঘন্টা।

কথাটা শুনে অবাক হলাম, কোথায় রাখলো এতোদিন আমায়।
আমার পরিবার কি আমায় চিনতে পারবে? আল্লাহ ভালো জানেন।
খুব খুশি তুমি তাই না?

অফিসার প্রশ্ন করলো আমায়। আমি উনার প্রশ্নের উত্তরে বললাম।
জানেন স্যার? ছোত থাকতেই আমি পাখি পুষতাম।

আমার দুটো ময়না পাখি ছিলো। সারাক্ষণ পাখি নিয়েই থাকতাম। আমি ভাবতাম, ওরা আকাশে থাকা পাখি গুলো থেকে খুব ভালো আছে। আরামে থাকছে, সময় মতো খাবার খাচ্ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে না, খুব সুখী ওরা। কিন্তু এই ভাবনাটা ওইদিন মিথ্যে প্রমাণ হয়।

যেদিন আমি মিথ্যে অপবাদে চার দেয়ালে বন্দী হয়েছিলাম। তখন নিজের পরিবারের চেয়ে পাখি দুটোর কথা বেশি মনে পড়তো। ওদের নিয়ে যা ভাবতাম, সব মিথ্যা প্রমাণ হয়। তখন বুঝতে পারি, পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখিদের কষ্ট।

আমিও তিন বেলা খাবার পেয়েছি, আমিও বৃষ্টিতে ভিজিনি।
কিন্তু আমি ছিলাম পরাধীন, ঠিক আমার ময়না দুটোর মতো।

কথা গুলো বলে থামলাম। অফিসার তাকিয়ে আছে আমার দিকে। উনি কি বুঝেছেন, সেটা আমার অজান। আবার বললাম।
আমাকে যেদিন পুলিশ ধরে, তার দুইদিন আগে ময়না দুটোকে মুক্ত করে দিয়েছিলাম। ওরা সেদিন যেটুকু খুশি হতেছিলো, আজ আমিও ততটুকু খুশি।

অফিসার আবার মুচকি হাসেন। উনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন।
হঠাৎ অফিসার এর ডাকে ঘুম ভাঙে।

অফিসার এর দিকে তাকালাম। অফিসার বলেন।

মেরহাব এই তোমার বাড়ি। অফিসার এর মুখে কথাটা শুনে তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নামলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি, বুঝতেই পারিনি।

গাড়ি থেকে নেমে অনেক মানুষকে দেখতে পেলাম। পুলিশের গাড়ি দেখে হয়তো এতো মানুষের ভীড়।

কেউ হয়তো আমায় চিনতে পারছে না। কিন্তু আমি অনেককেই চিনতে পারছি। আমার বাবা, ভাইবোন, চাচাচাচী সবাইকে।

বাবা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেন। কান্না করছেন বাবা। ভাইবোনেরাও এসে আমায় জড়িয়ে ধরে।

মা আর দাদুকে দেখতে পেলাম না।
পুলিশ চলে যায়, মানুষের ভীড়ও কমে।

বাবাকে জিজ্ঞাস করলাম।
মা, দাদু কোথায়?

কেউ কথা বলছে না। বাবা কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। তারপর বলেন।
বাবা তোর চলে যাবার তিন বছর পর মারা যান। আর তোর মা দুইদিন আগে মারা যান।

বাবার কথাটা শুনে শব্দ করেই কেঁদে দিলাম।

একটাবার মা’কে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। একবারো মা বলে ডাকতে পারিনি।

শুধু একটা মিথ্যে অপবাদ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলো অনেক কিছু।

মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কবরের মাটি শুকায়নি এখনো। মায়ের কবরের সাথে কেঁদে কেঁদে কথা বললাম। দোয়া করলাম মায়ের জন্য।

একটু সামনে আগালাম। ফখরুল এর কবর, ওর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলাম। জীবিত থাকতে ওরে খুব জ্বালাতাম, ওর সাথেই বেশি মজা করতাম, পাগল বলে চেতাতাম।

ছোট ছিলাম পাগলকে খেপাতে ভালোই লাগতো।

কিন্তু ভাবিনি এসব এর জন্য ওর মৃত্যুতে আমায় ধরবে পুলিশ।
এই পাগলের রহস্য মৃত্যুতে আমায় এতো বছর কষ্ট পেতে হলো।
হয়তো আর কখনো ওর মৃত্যুর প্রমাণ পাবেনা কেউ।

যারা আমার উপর অপবাদ দিয়েছিলো, ওরাই জিতলো, আবার ওরাই হারলো। মধ্যে কষ্ট পেলাম আমি।

লেখক – হানিফ আহমেদ

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “অপবাদ – মন খারাপের ছোট গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – হারিয়ে খুঁজি তোমায় – ভালোবাসার অনুগল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *