নীল রংধনু – অজানা ভালোবাসার কথা

নীল রংধনু – অজানা ভালোবাসার কথা: দিন যেতে লাগলো আর মনের আকুলতা চরম ভাবে বাড়তে লাগলো কিন্তু কিছু করার ছিলো না, বৃদ্ধ আলাউদ্দিন সাহেব ওই লেখক ভেবেও ভালোবাসা একটুও কমেনি, কাউকে মন দিয়ে ভালোবাসলে বুঝি এমন হয়।

মূলগল্প

তাকে পাওয়ার শেষ আশা টাও আজ হারিয়ে গেলো। যদিও এতদিন ধরে তাকে আমি খুজেই পাইনি। কোনো দিন পাবো কিনা সেটাও জানিনা। এখন খুজে পেলেও কিছু করার থাকবে না আমার।

কারন আমি এখন বিবাহিতা, কাল বিয়ে হয়েছে আমার। বিছানায় শুয়ে আছে আমার নব বিবাহিত স্বামী হাসিব, পুরো নাম হাসিব আহমেদ, কলকাতার সল্টলেকের বাসিন্দা, সে পেশায় একজন শিক্ষক আমি আরোয়া, অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।

এখন বিয়ের ইচ্ছা না থাকলেও পরিবারের ইচ্ছায় বিয়েটা করেছি। আমি সাহিত্য প্রেমি মানুষ এক কথায় গল্প পড়ার পোকা, বাড়ি বহু লেখকের বই সংগ্রহ করা আছে।
গল্পটা শুরু হয় তিন বছর আগে, এই বই নিয়েই….

তখন আমি নতুন কলেজে উঠেছি, বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম এবার আমরা পরিবার ছাড়া নিজেরাই একসাথে মেলায় যাবো। কলকাতার বইমেলা অনেক জনপ্রিয়, বহু লেখকের নামি দামী বই প্রকাশ পায়। মেলায় গিয়ে সবার মন ঘোরার দিকে থাকলেও আমার মন পড়েছিল বইয়ের স্টলে। বইয়ের স্টলে ঘোরার সময় একটা বইতে চোখ আটকে গেলো বই টার নামআপনাকে হৃদ মাঝারে রাখবো”, নামটা বেশ অদ্ভুত লাগলো।

তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো” লাইন টা বেশ জনপ্রিয় কিন্তু এই নামটা অন্য রকম। বইটার প্রতি এক অন্যরকম টান অনুভব করছিলাম, বইটা হাতে নিয়ে দেখলাম লেখকের প্রথম বই এটা আর লেখকের কোনো পরিচয় দেয়া নেই শুধু নীল রংধনু লেখা লেখকের নামে। লেখকের প্রথম বই দেখে একটু হতাশ হলাম। কারন এর আগেও অনেক নতুন লেখক লেখাকার বই কিনেছি কিন্তু লেখার মান অনেক কম থাকে পাকা লেখক লখিকার মতো ধারালো হয় না লেখা।

অনেক দ্বিধার পর বইটি কিনলাম, কারন বইটাকে কেমন আলাদা লাগছে অন্য বইয়ের থেকে, একটা টান তো প্রথম থেকেই আছে। বাড়ি ফিরেই বইটা পড়া শুরু করলাম, কিছু পাতা পড়েই যেন ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি, লেখনীর তুলনা হয়না। বইটা যেনো মাদকতা দিয়ে ঘেরা। টানা চার ঘন্টা পড়ে বইটি শেষ করলাম। অবাক করা বিষয় হলো গল্পটি পড়ে লেখকের প্রতি ও কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।

মানুষ টাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছা করছে। লেখকের ছদ্মনাম দিয়ে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম সহ অন্য সব সোশ্যাল মিডিয়ায় খুজেও কোনো তথ্য পাওয়া গেলো না।
কেটেছে একটি বছর। এই এক বছরে পঞ্চাশ বারের বেশি পড়েছি বই টা কোনো বারই বিরক্ত হইনি। তবে সেই অজানা লেখকের মায়ায় আবদ্ধ হয়েছি বারবার।
যেখানে কৌতূহল বেশি মানুষ সেখানে যায় বেশি, আমি জানি না সেই লেখক কেমন দেখতে বা তার বয়স কতো, হতে পারে সে এক বৃদ্ধ, হতে পারে সে এক বিবাহিত পুরুষ, তবুও অবাধ্য মন এসব কিছুই মানে না, বারবার তাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে, বারবার তার মায়ায় জড়াতে বাধ্য করে।

সেই অদৃশ্য মানুষ টাকে নিয়ে গড়ে উঠেছে আমার এক কল্পনার জগৎ, এমনিতেই আমি কল্পনা প্রবন, কল্পনায় মানুষ টার সাথে আমার গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছে, তাকে নিয়ে সবসময় কল্পনায় ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে,
সেবার ও মেলায় যাওয়া হলো কিন্তু উদ্দেশ্য হলো লেখক কে খুজে পাওয়া……

সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম লেখকের নতুন বই প্রকাশ পেয়েছে নামনন্দনী”, ভাবলাম লেখক নিশ্চই এবার তার আসল পরিচয় দেবেন কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়ে এবার ও তিনি নিজের পরিচয় লুকিয়ে নীল রংধনু ছদ্মনামে লিখেছেন। মনে কষ্ট থাকলেও তার নতুন বইয়ের জন্য অনেক উৎসাহিত ছিলাম। বইটা পড়ছি কিন্তু মনে হচ্ছে এক নেশায় ডুবছি, প্রতিটা লাইনে মুগ্ধতা, একটা সাধারণ মানুষের জীবন কে কত সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন। তার লেখা পড়ে মনে হয় মানুষ টা অনেক সাধারণ, সরল মনের…

এমনিও লেখকের প্রতি যে দুর্বলতা ছিলো, দ্বিতীয় বার তার বই পড়ে তাও বেড়ে যায়।

তার প্রতি আকুল একতরফা ভালোবাসা নিয়ে সেবার সিদ্ধন্ত নিলাম বইয়ের প্রকাশকের সঙ্গে সরাসরি দেখা করবো……..

পর্ব ২ (অন্তিম)

প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করে বিশেষ কোনো লাভ হলোনা। লেখক নাকি প্রকাশকের সঙ্গেও দেখা করেন নি। এমন কী ফোনেও কথা বলেন নি। তাদের সমস্ত কথা ম্যাসেজ এর মাধ্যমে হয়, বই এর পান্ডুলিপি টাও অন্য কাওকে দিয়ে পাঠায়, লেখকের সম্মানী টাও কেউ এসে নিয়ে যায়। প্রকাশকের মুখে এই সব শুনে যথেষ্ঠ হতাশ হয়েছিলাম কিন্তু হাল ছাড়িনি।

প্রকাশক বেশ বয়ষ্ক ছিলো তার সাথে চাচা বলে বেশ অনেক সময় গল্প করলাম যেহেতু তখন দুপুর ছিল তার অবসরের সময়, তাকে চাচা বানিয়ে সাথে করে পাশের এক রেস্টুরেন্টে খাওয়ালাম। খাওয়ার সময় গল্প করতে করতে তিনি বলেন লেখকের একটি ঠাকানা তিনি জানেন যেখানে প্রথম বার লেখকের সম্মানী পাঠানো হয়েছিল, এই সব শুনে মনের মধ্য আশার আলো জেগে উঠেছিল যাক এইবার তাহলে আমার স্বপ্নের পুরুষ, আমার একতরফা ভালোবাসার দেখা পাবো।

তার থেকে ঠিকানা নিয়ে পরদিন ই চলে গেলাম রাজারহাটের গোপালপুর। চেনা কলকাতায় বাড়ির ঠিকানায় যেতে খুব একটা সমস্যা হয়নি কিন্তু গিয়ে দেখলাম বাড়িটি তালাবন্ধ। পাশের বাড়ির এক মহিলার থেকা জানলাম বাড়িটা ছিল আলাউদ্দিন আহমেদ নামের ব্যক্তির এবং তারা প্রায় দেড় বছর আগে বাড়িটি ত্যাগ করেন।
তার থেকে জানলাম আলাউদ্দিন সাহেব প্রায় পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ, এই কথা শুনেই মনে মনে ভীষন হতাশ হলাম, যদি আল্লাউদ্দিন সাহেব ওই লেখক হন তাহলে কী হবে। এই সব আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতে বাড়ি ফিরলাম।

দিন যেতে লাগলো আর মনের আকুলতা চরম ভাবে বাড়তে লাগলো কিন্তু কিছু করার ছিলো না, বৃদ্ধ আলাউদ্দিন সাহেব ওই লেখক ভেবেও ভালোবাসা একটুও কমেনি, কাউকে মন দিয়ে ভালোবাসলে বুঝি এমন হয়। সত্যি ভালোবাসাতে রূপ, দেহের রং, দেহের আকৃতি এগুলো কিছুই না। ভালোবাসতে মন লাগে, একটি বিশুদ্ধ মন
এমন ভাবে চলতে চলতে হাসিবের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় আর আমার সেই অজানা অদেখা ভালোবাসা গোপন মনেরকুঠুরি তে বন্দি হয়ে যায়। বর্তমান কেটেছে তিনটি মাস……….

আমার স্বামী হাসিব অত্যন্ত ভালোমনের মানুষ, দারুন কবিতা বলে। আমাদের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসায় বেশ সুখেই কাটছে দিন গুলি। এর মধ্যে ও জেনে গেছে আমি এক গল্প পড়ার পোকা। ও নিজেই আমাকে বইমেলায় নিয়ে আসলো। হাসিবের সাথে সংসার করলেও মনের এক কোনে সেই বিশেষ মানুষ টির অবস্থান।
মেলায় এসে আগে আমি #হৃদয়_নীল লেখকের বই খুজতে লাগলাম দেখলাম হাসিব বেশ অবাক আমার এমন আকুল হয়ে বই খোজা দেখে। লেখকের বই দেখে আরোবেশি অবাক আমি বইটার নাম আমার নামেআরোয়া”। খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছিল, হাসিব যে আমার কাজে অবাকের পর অবাক হচ্ছে তা আমি ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছি।

বাড়ি ফেরার সময় হাসিব বার বার শুনতে চাইছে এই লেখক কে এতো ভালোলাগার কারন, জানিনা কেন এই প্রথম আমি আমার পাগলামির কথা বললাম কাউকে তাও সে আমার স্বামী।

হাসিব প্রচন্ড রকমের অবাক আমার কান্ড শুনে হঠাৎ করে হাসিব কেমন গম্ভীর হয়ে গেল, আমি ভাবলাম আমার কাজে মনে হয় কষ্ট পেয়েছে বা তার থেকে এতদিন এইসব লুকিয়েছি তাই হয়তো রাগ করেছে।

বাড়ি ফেরার পথে একটিও কথা বলেনি ও। আমার নিজের ওপরে রাগ হচ্ছে কেন বলতে গেলাম ওই সব পুরানো কথা। বাড়ি ফিরে ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখি খাটে একটা চিরকুট তাতে লেখা —”প্রেয়সী নন্দিনী আরু একটা কালো শাড়ি পরে ছাদে এসো”, আমি তো প্রচন্ড খুশি হাসিব আমাকে সারপ্রাইজ দেবে। রেডি হয়ে ছাদে গিয়ে দেখি কেউ নেই, তাই রেলিং এর ধারে দাড়ালাম

হঠাৎ একজোড়া হাত পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো .”প্রয়সী আরু অনেক ভালোবাসি”।

আমিঃ তা হঠাৎ এসব কেন।
হাসিবঃ কিছু গোপন সত্যি বলতে চাই আমার ব্যাপারে।

আমিঃ বলো।
হাসিবঃ যে লেখক কে তুমি তিন বছর ধরে খুজছো সেটা আমি, লেখক #হমদয়_নীল।

ওর কথা শুনেই তড়িৎ বেগে ওর দিকে ঘুরলাম
আমিঃ কী বললে তুমি, তুমিই ওই লেখক।
হাসিবঃ হুম আমি।

আমিঃ কী দরকার ছিলো আমার থেকে লুকানোর।

হাসিবঃ তুমিও তো লুকিয়েছ, লেখক হৃদয় নীল এর জন্য পাগলা তুমি।
আমিঃ কে বলেছে আমি ওই লেখকের জন্য পাগোল। লেখক একদম ভালো না, বাজে লেখক।
হাসিবঃ হুহ তাইতো তিন বছর ধরে খুজছিলে।

আমিঃ আমি তাহলে শ্বশুর আব্বুকে লেখক ভেবেছিলাম। ওই তুমিতো নিজের পরিচয় দিয়ে লিখতে পারো?
হাসিবঃ পারি কিন্তু লিখবো না, আমার লুকিয়ে লিখতেই ভালোলাগে প্রেয়সী। মনের মধ্যে এক প্রশান্তির ছোয়া বইতে লাগলো অবশেষে পেয়েই গেলাম আমার অজানা ভালোবাসাকে।

শীত কাল দূর থেকেই এক গান বাজতে লাগলো।
“ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌর।
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌর।
আর পাবো না না না।
আরতো পাবো না।
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো।
ছেড়ে দেবো না”…..

লেখা – অমিত

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “নীল রংধনু – অজানা ভালোবাসার কথা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – তবুও তোমাকেই চাই (১ম খণ্ড) – আবেগের ভালোবাসার গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *