মানুষ দেখতে যেমন – শর্ট লাভ স্টোরি

মানুষ দেখতে যেমন – শর্ট লাভ স্টোরি: মিতুর সাথে আমার কোন যোগাযোগ নাই। কিন্তু হঠাৎ এক রাতে সে ফোন করে আমার নম্বরে। গভীর রাতে। আমি ঘুম ভেঙ্গে উঠে ওর নম্বর দেখে ভীষণ ভাবে চমকে উঠি।


১ম পর্ব

রাতে আমার পাশে শুয়ে আমার স্ত্রী মিতু বললো, একটা কথা বলি মনসুর। রাগবা না তো আবার?

আমি মৃদু হেসে বললাম, তোমার কোন কথায় কখনো আমি রাগ করেছি মিতু?
মিতু বললো, তা করোনি কিন্তু এই কথা শোনার পর রাগতে পারো!
না আমি রাগবো না। বলো।

মিতু এবার আমার হাতটা তার মুঠোয় নিয়ে ধরলো। তারপর আমার কোলে তার মাথা এনে বললো, মা তো আমাদের এখানে অনেক দিন ধরেই আছেন। এখন তিনি তোমার অন্য ভাইদের ঘরেও থাকুক না ক দিন!
আমি মিতুর কথার কোন জবাব দিলাম না।

মিতু এবার বললো, না বলছি, মার প্রতি তোমার যেমন কর্তব্য আছে ওদেরও তো আছে তাই না? তো ওদের কর্তব্য পালন করতে দিচ্ছো না কেন তুমি?
মা ওদের ওখানে থাকতে পছন্দ করেন না। আর ওরাও মাকে এভোয়েড করে।

এটা কোন ধরনের কথা! মা কী ছোট মানুষ? আর তুমিও কী কুটিপতি? যা উপার্জন করছো সব মার অষুধ পত্তরেই শেষ করে দিচ্ছো। আমাদের কী ফিউচার নাই নাকি?
মিতুর কথা শুনে আমার প্রচন্ড রাগ পায়। তবুও চুপ করে থাকি।

মিতু এবার আমার হাত ধরে শক্ত করে নাড়া দেই। বলে, আর কতোদিন এভাবে মেনিমুখো হয়ে থাকবে? মায়ের অষুধের খরচা মিটাতে গিয়ে পরে বাজার সদাই করতে হয় বাকীতে। বৌকে ভালো একটা শাড়িও কিনে দিতে পারো না! আবার সন্তান নেয়ারও নাম নেই।

সন্তান নিলে খরচা বাড়বে। মার চিকিৎসার সমস্যা হবে। অতই যখন মা মা করবে তখন বিয়ে করেছিলে কেন আমায়? শুধু আমি বলেই আজ পর্যন্ত তোমার ঘরে আছি। অন্য কোন মেয়ে হলে মা ছেলের মুখে থুথু মেরে কবেই চলে যেতো!
কথাগুলো বলে রাগে কাঁপতে লাগলো মিতু।

আমি জানি ওর কথাগুলো অনেকটা রাগ আর অনেকটা অভিমান থেকেই। আমার দোষ তাকে সন্তান দিচ্ছি না। ভালো শাড়ি দিচ্ছি না। কিন্তু এটাও তো সত্য আমার মায়ের চিকিৎসার চালিয়ে যাওয়া।

যেভাবেই হোক মায়ের চিকিৎসা করিয়ে যেতে হবে। আমার অন্য ভাইগুলো মার পেছনে খরচ করতে হবে বলে বউদের কথায় কেটে পড়েছে সেই শুরুতেই। কিন্তু আমি কেটে পড়তে পারিনি। কারণ আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে মায়ের সংগ্রামটা।

বাবা আমাদের তিন ভাইকে ছোট ছোট রেখে মারা যান। আর মা তখন অন্যের বাড়িতে কাজ করে করে আমাদের বড়ো করে তুলেছেন। পড়াশোনা করিয়েছেন। তার কারণেই আমরা আজ সম্মানের সাথে বেঁচে আছি। পৃথিবীর আলো দেখছি। সেই মাকে ছেড়ে আমি চলে যাই কীভাবে?

আমি মিতুকে বললাম, মিতু, তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলেও মাকে আমি ছাড়তে পারবো না। সরি!

মিতু বললো, তোমার যেহেতু মার প্রতি অত ভক্তি তাহলে মা নিয়েই তুমি থাকো। আমি যাচ্ছি।
বলে মিতু আমায় ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে আমার কোল থেকে তার মাথা তুলে নেয়। তারপর তার যতো কাপড় চোপড় আছে সব প্যাক করে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যায়। আমি কিছু বলি না। চুপ হয়ে শুধু দেখি।

রাতে মা আমায় ডাকেন। তিনি তো অসুস্থ। চোখে দেখেন না। কানে কম শুনেন। শরীরে নানা রোগ। টিভিও আছে। টানা কাশেন। মা আমায় ডেকে কাছে নিয়ে আমার মুখে তার তুলতুলে হাত বুলিয়ে দেন আর বলেন, বাজান, বউমা চইলা গেলো কেনো রে?

আমি বলি, মা ওর এখানে ভালো লাগে না। তাই চলে গেছে। ও না থাকলেই ভালো।
নারে মনসুর না। বউমার মনে অনেক দুঃখ। আমার পিছনে আর পয়সা খরচ করিস না বাজান। আমার তো এমনিতেই মরার সময় ঘনাইয়া আসতাছে। চিকিৎসা করাইলেও মরবো না করাইলেও মরবো। এরচেয়ে বউমার দিকে নজর দে। তার কথা শোন। সে যা বলে তা মাইনা নে!

মার কথা শুনে আমার চোখ ভিজে উঠে জলে। মাকে জড়িয়ে ধরে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠি আর বলি, ওমা, মাগো, সারাটা জীবন তুমি শুধু দুঃখই করে গেলে। আমাদের সুখে রাখার জন্য এখনও সব কিছু সয়ে যেতে পারো তুমি।

মাও কাঁদেন। কিন্তু তার শারীরিক দূর্বলতার জন্য সেই কান্না শব্দ হয়ে আকাশ বাতাস কাঁপাতে পারে না। কিন্তু তার চোখের জল। সেই জলের দিকে তাকালেই বুকটা ধুক করে উঠে! এই জলের ভার যে অহুদ পাহাড়ের চেয়েও বেশি!

রাতে মিতুর মা ফোন দেন আমায়। বলেন, বাবা, সবকিছু আবেগ দিয়ে হয় না। মা তো আর তোমার একার না। আরো দুই ভাই আছে তোমার। তারা না দেখলে তুমি একা দেখবা কেন তোমার মারে!

আমি তার কথা শুনেও চুপ হয়ে থাকি। উত্তর করি না।
মিতুর মা আমায় চুপ করে থাকতে দেখে বলেন, মিতুরে কীভাবে তুমি পাঠিয়ে দিতে পারলা? তুমি কী ভাবছো মিতুর তুমি ছাড়া অন্য কোন গতি নাই?

না বাবা, এইটা ভাইবো না। মিতুর চেহারা সুরত কম না। পড়াশোনা আছে। বাপের অর্থ বিত্ত আছে। তারে ইচ্ছে করলে আজকেই আমি আরেক বিয়ে দিতে পারি। কিন্তু দিতেছি না। এইসব ঝামেলায় না যাওয়া ভালো। মনসুর তুমি রাতে চিন্তা করো।

ভেবে দেখো কী করবা?
আমি চুপচাপ এ পাশ থেকে ফোন কেটে দেই। তারপর একটা দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে ভাবতে থাকি, পৃথিবীতে আদৌও কোন ভালো মানুষ আছে তো?


২য় পর্ব

সারারাত আমার ঘুম হয় না। জলে জলে চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। বারংবার কেবল মনে হতে থাকে মায়ের সেই সংগ্রামের কথা।

আমার ছোট ভাই ইশতিয়াক তখন পাঁচ বছরের মানুষ। ইশতিয়াকের পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে গভীর রাতে। ব্যাথায় সে চিৎকার করে কাঁদছে। আম্মা তখন ভীষণ বিপদে পড়েছেন। এই অতরাতে আমায় ঘুম থেকে ডেকে তুললেন তিনি। তারপর বললেন, মনসুর, তুই হারিকেন লইয়া আমার আগে আগে হাটবি। আর আমি সেই আলোতে ইশতিয়াকরে কোলে লইয়া হাঁটবো।

আমার মা সেদিন হাঁটতে হাঁটতে তিন মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বাজারে গেলেন। কিন্তু কোন দোকান তখন আর খোলা নেই। বাজারের পাহাড়াদারের কাছে গেলেন ডাক্তারের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করতে। সেই ডাক্তার বললো, আসেন, আপনারে আমি লইয়া যাই।
আম্মা সরল মনে বললেন, আচ্ছা।

কিন্তু তিনি তো আর জানতেন না পাহাড়াদার তাকে ভুল পথ দেখিয়ে বনের দিকে নিয়ে যাবে!
ইশতিয়াক পেটের ব্যাথায় কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে আম্মার কাঁধের উপর হেলে পড়েছে ততোক্ষণে।

আম্মা কান্নাভেজা গলায় বললেন, আরেকটু বাজান আরেকটু।
ঠিক এই সময় আমার হাত থেকে হারিকেনটা নিয়ে কোন একটা গাছের সাথে আঘাত করে সেই হারিকেন ভেঙে ফেললো পাহাড়াদার। তারপর দেখি চারদিকে ঘুটঘুটে আঁধার। সেই আঁধারে শুধু আমার মায়ের তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেলাম।

আট বছর বয়সের ছেলে আমি। না বুঝলেও অনেক কিছু বুঝি। আমার মা কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছে না। মুখে ওই অশূর চেপে ধরেছে।
আমি কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।

কিন্তু আমার কিছু করার আগেই আম্মা ওই অশূরটার কাছ থেকে কীভাবে যেন ছুটে গেলেন। তারপর ইশতিয়াককে কোলে তুলে অন্ধকারের ভেতর দৌড়াতে লাগলেন। আমিও আম্মার পেছনে দৌড়াতে লাগলাম।

আর আমাদের পেছনে ওই বাজারের পাহাড়াদার। সেদিন দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা যখন বাড়ি পর্যন্ত পৌছি তখন মসজিদে ফজরের আজান হয়। আমার চোখে তখন রাজ্যের ঘুম। আমি ঘুমিয়ে যাই। কিন্তু আম্মা ঘুমান না।

ক্লান্ত ইশতিয়াককে কোলে নিয়ে আবার বাজারে যান। ডাক্তার দেখান। তারপর ফিরে আসেন বাড়িতে। ইশতিয়াকের পেটের ব্যাথা কমার আগে ঘুম তো দূরের কথা এক ফোটা জল পর্যন্ত আম্মা ছুঁয়ে দেখেননি।

সেই জন্মদাত্রী মাকে আমি কী করে ভুলে যেতে পারি! ইশতিয়াক স্বার্থপর হতে পারে কিন্তু আমি তা পারবো না। মায়ের পায়ের নীচে যে সন্তানের বেহেশত। কিংবা বেহেশত না থাকলেই বা কী। মা নিজেই তো আট আটটি বেহেশত!

সকাল বেলা বিছানা ছেড়ে উঠে চুলোতে গিয়ে ভাত চড়াই। তরকারি খুঁটে নিজেই রান্না করি। তারপর আম্মার কাছে প্লেট ভর্তি ভাত তরকারি নিয়ে যাই। ভাত মাখিয়ে আম্মার মুখে তুলে দেই। আম্মা মুখে ভাত নিয়ে চোখ মুছেন।

তারপর ভেজা গলায় বলেন, মনসুর, বউরে ফিরাইয়া আন বাপ!
আমি আস্তে করে বলি, আম্মা, ও নিজেই আসবে একদিন। শুধু মিতু না আপনার ছোট ছেলে ইশতিয়াক আর তার স্ত্রীও ফিরে আসবে।

আম্মা আমার মুখের দিকে তাকান। কিছুই বোধহয় বুঝতে পারেন না তিনি।

আম্মাকে খাইয়ে দাইয়ে আমি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি। তারপর অফিস যাই। অফিস যাওয়ার পথে মিতুর মা ফোন করে আবার।
আমি রিসিভ করি।

মিতুর মা বলেন, কিছু ভেবেছো বাবা?
জ্বি ভেবেছি।

কী ভেবেছো?
আমার মাকে যদি মিতু টলারেইট করতে পারে তবেই কেবল আমি তাকে ফিরে আসতে বলবো। অন্যতাই তার না আসাই ভালো!
এটাই কী তোমার লাস্ট কথা?

শুধু লাস্ট না ফাইনাল কথা। আমার মা আমার কাছে অমূল্য ধন। আমি এই ধন নষ্ট করতে পারবো না!

তুমি কিন্তু আবেগে পড়ে এসব বলছো। দেখো তোমার ভাই ইশতিয়াক তো আছে। সে ছয়মাস রাখুক তোমার মাকে। বাকী ছয়মাস তুমি রাখো।
ইশতিয়াক আম্মাকে তার কাছে রাখতে চায় না।

ওর স্ত্রীর সমস্যা।
তোমার স্ত্রীরও তো সমস্যা। তুমি তাহলে রাখবে কেন?
আম্মা আমি অফিসে এসে গেছি। এখন রাখছি। পরে কথা বলবো।
বলে ফোন রেখে দেই।

তারপর অফিসে এসে টেবিলের সামনে বসে থেকে আবার ভাবি। এই পৃথিবীর মানুষ গুলো দেখতে আসলে কেমন!


৩য় পর্ব

রাতে অফিস থেকে বের হতেই আবার ফোন করেন মিতুর মা।
তার ফোন কেটে দিতে চেয়েও আমি কাটতে পারিনি। মনে হলো বড়োদের সাথে এমন করাটা বেয়াদবি। তাই আমি ফোন রিসিভ করে বললাম, আম্মা কী বলতে চান বলুন।

সব তো আগেই বলেছি। তুমি একটা কাজ করো। তোমার পাড়ার মানুষদের নিয়ে একটা বৈঠক করো। ওখানে তোমার ভাইকেও ডাকো। তারপর মুরুব্বিদের বলো তারা যেন তোমার মাকে ওর ভাগেও ফেলেন। ছয় মাস তুমি পালবে আর ছয়মাস তোমার ভাই।

আম্মা, কেউ যদি ইচ্ছে করে মায়ের ভরণ পোষণ করতে না চায় তাহলে তো তাকে জোর করে লাভ নাই!
তাহলে কী তুমিই শুধু তোমার পায়ে কুঁড়াল দিবে। নিজের সবকিছু শেষ করে ফেলবে বুড়ো মায়ের চিকিৎসার জন্য?

মিতুর মায়ের কথা শুনে আমার ভীষণ রাগ পায়। তবুও আমি হাসি। ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে বলি, আম্মা, কী বোকা আপনি! নিজের বেহেস্ত অর্জনের জন্য যে মানুষ তার ধন সম্পদ খরচ করে সে কী নিজের পায়ে কুড়াল দেয় না সফলতা অর্জন করে?

ও পাশ থেকে মিতুর মা খানিক সময় চুপ থাকেন। তারপর বলেন, বুঝেছি। তোমায় বলে আর লাভ নেই। এখন থেকে তুমি তোমার পথ দেখবে আর মিতু মিতুর পথ। ভুলেও কিন্তু তুমি মিতু কিংবা আমার নম্বরে ফোন দেয়ার চেষ্টা করবে না।
আমি বললাম, ঠিক আছে।

কিন্তু মাঝ রাতে আবার ফোন দেয় মিতু। বলে, সংসারটা তুমি নষ্ট করে দিচ্ছো তুমি?
সংসার তুমি আর তোমার মা নষ্ট করে দিচ্ছো। আমি বুঝতে পারি না পৃথিবীর শাশুড়ি গুলো এতো খারাপ কেন যে!

আমার মাকে তুমি খারাপ বলছো না?
শুধু খারাপ বলছি না আরো বলবো। তোমার মা একটা ডাইনি। মতো সব শয়তানি বুদ্ধি দিয়ে বেড়াই মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে!

আমি তোমার জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলবো টান দিয়ে!
আমি হাসি। হেসে বলি, ডাইনির ঘর থেকে ডাইনিই হয়। ডাইনিরা জিহ্বা কেন মানুষের গলায় কাটতে পারে।

তুমি কিন্তু বেশি কথা বলছো!
বেশি কথা আমি বলছি না। তোমরা বলছো। তোমাদের ফোনের যন্ত্রণায় আমি অতিষ্ঠ!
মিতু বলে, ঠিকাছে। এই ফোন কাটছি। লাজের মেয়ে হলে আর কখনো তোকে ফোন দিবো না আমি!

মিতু ফোন কেটে দেয়। আমি ফোন বিছানায় রেখে দিয়ে হাসি।
সকাল বেলা আবার মিতুর মায়ের ফোন। আমি বলি, আপনি না বললেন আর কোন যোগাযোগ থাকবে না আমার সাথে আপনাদের। তাহলে আবার ফোন দিয়েছেন কেন?
তুমি নাকি আমায় মন্দ কথা বলেছো?

উচিৎ কথা বলেছি। আপনি মন্দ ভাবলে আমি দুঃখিত!
দু টাকার চাকরির জন্য খুব বড়ো মনে করো নিজেকে?
না। মায়ের পায়ের নীচ থেকে এখনও সড়ে যাইনি বলে গর্ব করি। বড়ো মনে করি নিজেকে।
তুমি জানো এক্ষুনি পুলিশ দিয়ে তোমায় ধরিয়ে নিয়ে যেতে পারি?
কেন? অপরাধ কী আমার?

আমার মেয়েকে যৌতুকের জন্য চাপ দিচ্ছো তুমি। মেরে তক্তা বানিয়ে তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছো। যদি এটা বলি থানায় গিয়ে তখন জানো তোমার কী হবে?
আমি হা হা করে হেসে উঠি। তারপর হাসি শেষ করে বলি, আপনার ছেলেটা বিয়ে কবে জানি?

যে সময়েই থাক তোমায় বলতে হবে নাকি? তুমি কে আমার? আমার ছেলে আগামী সপ্তাহে বিয়ে করবে। শত শত রাস্তার কুকুর এসে সেই বিয়ে খাবে কিন্তু তুমি খেতে পারবে না!
আমি তখন ভীষণ শব্দ করে হেসে উঠি। তারপর হাসি শেষ করে বলি, কুকুরের বিয়ে শাদীতে তো কুকুরেরাই আসবে!

ও পাশ থেকে মিতুর মা তখন হয়তো আমায় বকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে আমি সেই সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম।

তিনদিন কেটে গেল। এখন আর খারাপ লাগে না। মনে হয় ওইসব ছোট মনের মানুষের সাথে থাকার চেয়ে একা থাকাই ভালো। একা থেকে মায়ের সেবার নিবিষ্ট হলাম। আপন মনে মার সেবা করলাম। এটাই তো আমার পূণ্যের পথ।

এইসব কিছু ভাবছিলাম অফিসে বসে থেকে। তখন হঠাৎ আমার ডিপার্টম্যান্টের দপ্তরি এসে বললো, আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কে সে? নাম কী তার?

দপ্তরি ব্যাস্ত পায়ে চলে যেতে যেতে বললো, স্যার আপনি দেখা করলেই চিনবেন। আপনার সাথে তার নাকি জরুরী দেখা করার প্রয়োজন।

আমি আরো অবাক হলাম। সাধারণত কেউ আমার সাথে অফিসে দেখা করতে আসে না। তবে কে এলো হঠাৎ আমার সাথে দেখা করতে? আর তার জরুরি কাজটাই বা কী আমার সাথে?


৪র্থ এবং শেষ পর্ব

ইশতিয়াক এসেছে আমার সাথে দেখা করতে।
কতদিন পর ইশতিয়াককে আমি দেখেছি! আরো তিন বছর আগে সে তার স্ত্রীকে নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিল তার শশুর বাড়িতে। এখানে থাকবে না। আম্মাকে নাকি তার স্ত্রীর সহ্য হতো না! তাই সে চলে গিয়েছিল।

তারপর আর যোগাযোগ নেই আমার সাথে। এমনকি ফোন নম্বরটাও চেঞ্জ করে ফেলেছিল ও!
আমায় দেখেই ইশতিয়াক চেয়ার থেকে উঠে আমায় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কি রে কী হয়েছে ইশতিয়াক? এমন করছিস কেন?
ইশতিয়াক কাঁদতে কাঁদতে বললো, বিন্দুর ক্যান্সার হয়ে গেছে–

আমি চমকে উঠে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, কী বললি ইশতিয়াক? বিন্দুর কী হয়েছে?
ভাইয়া, বিন্দুকে বাঁচাতে হলে অনেক টাকার প্রয়োজন। বিন্দুর মা কিছুদিন চিকিৎসা করিয়েছে। এখন তার ভাইয়েরা তার মাকে নিষেধ করে দিয়েছে আর যেন টাকা না খরচ করে বিন্দুর পেছনে। ওর বড় ভাই বলেছে, বোন বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।

এখন তো তাকে চিকিৎসা, লালন পালনের দায়িত্ব আমাদের না। দায়িত্ব তার হাসব্যান্ড এর।
আমি কী করবো এখন ভাইয়া? এতো টাকা কোথায় পাবো? বিন্দুর ভাবীদের কাছে অসহ্য লাগে এখন আমাদের। মনে হয় আমরা তাদের কাছে বোঝা হয়ে আছি! আমার শাশুড়ি আজ কেঁদে কেটে বললেন, বাবা, কোন উপায় বের করো। মেয়েটাকে বাঁচাও।

বিন্দু আজ সকালে হঠাৎ বললো, আমি মনে হয় আর বাঁচবো না। টানা দুঃস্বপ্ন দেখছি। আমার জীবনে অনেক ভুল আছে। তোমার মাকে অবহেলা করে আমি খুব বড়ো ভুল করেছি। তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে তোমায় সড়িয়ে এনেছি আমি আর আমার মা চক্রান্ত করে। এই জন্য শাস্তি পাচ্ছি আমি। কঠিন শাস্তি পাচ্ছি। আমি উনাদের কাছে ক্ষমা চাইতে চাই! প্লিজ আমাকে তুমি উনাদের কাছে নিয়ে যাও একবার!

ইশতিয়াকের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি কিংবা আম্মা আমরা কেউই চাইনি ইশতিয়াক কিংবা তার স্ত্রী কোন কঠিন বিপদে পড়ুক। ইশতিয়াক তো ছোট। ও ভুল করতেই পারে। আমরা আশায় ছিলাম ও তার ভুল ভেঙ্গে স্ত্রীকে সাথে করে নিয়ে একদিন আমাদের কাছে ফিরে আসবে ‌।

কিন্তু আমরা এমন ভাবে তাদের ফেরা চাইনি। আমার চোখ আর বাঁধা মানছে না। টপটপ করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে গালের উপর। সেই জল আমি মুছলাম না। ইশতিয়াককে শক্ত করে বুকের সাথে জাপটে ধরলাম।

তারপর কান্নাভেজা গলায় কাঁপতে কাঁপতে বললাম, বিন্দুর কিচ্ছু হবে না। প্রয়োজনে ভিটে মাটি বেছে দিয়ে ওর চিকিৎসা করাবো আমি। দেখিস ও সুস্থ হয়ে যাবে ভাই। আগের মতো হয়ে যাবে বিন্দু!

ইশতিয়াক আমার দিকে তাকায়। তার চোখ লাল টকটকে। মুখটা কেমন অসহায়ের মতো। তাকে এভাবে দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগে না। খুব কান্না পায় ওর জন্য। খুব খুব কান্না পায়!

বিন্দুকে নিয়ে পরদিন ফিরে আসে ইশতিয়াক। বিন্দুর সুন্দর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে বর্ণের হয়ে গেছে। চোখের নিচে গাঢ় কালি জমেছে। শরীরটা শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে গেছে। কী মায়া যে হয় ওকে দেখলে। ইচ্ছে করে চিৎকার করে কেঁদে উঠতে।

আমার তো কোন আপন বোন নেই। ইশতিয়াক যখন বিন্দুকে বউ করে ঘরে আনলো তখন থেকেই তাকে আমি বোন ভাবতাম। এই বোনটার কিছু হলে আমি বাঁচবো কী করে!
বিন্দু এসেই আম্মার পায়ে পড়ে যায়।

ঢুকরে কেঁদে উঠে ক্ষমা চায়। আম্মাও কেঁদে উঠেন ছোট্ট বাচ্চাদের মতো। বিন্দুর মাথায় তিনি তার নরম হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ভয় করো না গো মা। আল্লাহ তোমায় সুস্থ কইরা দিবেন।

ইশতিয়াক এসে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আর বলে, আম্মা, আম্মা গো। তুমি আমারে মাফ করে দাও।
আম্মা তার ভেজা গলায় বলেন, বাজান তুই যে ফিইরা আসছস এইটাই আমার শান্তি। তোর উপরে আমার কোন রাগ গোসা নাই!

তারপর বিন্দু আমার কাছে এসে মাফ চায়। আমি ওর মাথায় তখন হাত বুলিয়ে দেই। আর শান্ত গলায় বলি, তোকে আমি সুস্থ করে তুলবো বিন্দু। প্রয়োজনে সবকিছু শেষ করে দিবো। তবুও তোকে সুস্থ করে তুলবো।

বিন্দু সুস্থ হতে পারেনি আর। বাড়ি জমি ভিটে মাটি কিছুই বিক্রি করার প্রয়োজন হয়নি। আমাদের বাড়িতে ফিরে আসার মাত্র দু দিন পরই রাতে হঠাৎ করে তার অসুখ বেড়ে যায়। আমি দ্রুত এম্বুলেন্স ডাকি। কিন্তু এম্বুলেন্স এসে পৌঁছার আগেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যায় বিন্দু।

ইশতিয়াক কাঁদে। আমি কাঁদি। আম্মা কাঁদেন। চিৎকার করে আমরা কাঁদি। আমাদের কান্নার শব্দ আকাশ থেকে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। আমরা সেই প্রতিধ্বনি শুনে আরো জোরে জোরে কাঁদতে থাকি!

এক বছর পরের কথা-

মিতুর সাথে আমার কোন যোগাযোগ নাই। কিন্তু হঠাৎ এক রাতে সে ফোন করে আমার নম্বরে। গভীর রাতে। আমি ঘুম ভেঙ্গে উঠে ওর নম্বর দেখে ভীষণ ভাবে চমকে উঠি। তারপর তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ পাই।

আমি জিজ্ঞেস করি, কী হলো মিতু? কী হয়েছে তোমার?
মিতু কান্নাভেজা গলায় বলে, আজকে ভাইয়া আমাকে আর মাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। ভাইয়া এখন ভাবীর কথায় সব করছে। শুরুতে ভাবী খুব ভালো ছিল। কিন্তু এখন তার আসল রূপ দেখাচ্ছে।

ওর কথা শুনে আমার খুব দুঃখ হলো!
আমি সৌম্য গলায় বললাম, মিতু, তোমরা এখন কোথায় আছো?
আমাদের চাচার বাসায়।

টেনশন করো না। আগামীকাল আমি এসে তোমায় নিয়ে যাবো।

পরদিন সকাল বেলা আম্মার কাছে বলে আমি মিতুকে আনতে গেলাম। মিতু আমায় দেখে আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, মা আমায় মাফ করবেন তো?
আমি হেসে বললাম, মায়েরা কখনো রাগ করে থাকতে পারে না।
তারপর আমি মিতুর মাকে বললাম, আম্মা, আপনি দ্রুত রেডি হন।

মিতুর মা চমকে উঠে বললো, আমি কেন রেডি হবো বাবা?
কারণ আপনিও আমাদের বাড়িতে যাবেন। এখন থেকে আপনি আমাদের বাড়িতেই থাকবেন।

মিতুর মা আমার এ কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, বাবা, আমায় মাফ করে দাও তুমি। আসলে স্বার্থপর হয়ে কেউ কখনো ভালো থাকতে পারে না! তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছো। আমি এতো দিন ভুলের ভেতর ছিলাম!
মিতুর মায়ের কথা শুনে আমি তাকালাম তার দিকে।

তারপর মিতুর মুখের দিকে। তারপর মনে মনে আরো অনেক গুলো মুখ কল্পনা করলাম। আমার, আম্মার, ইশতিয়াক আর বিন্দুর। তারপর মনে মনে বললাম, আসলে মানুষ দেখতে কেমন?

লেখা – অনন্য শফিক

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “মানুষ দেখতে যেমন – শর্ট লাভ স্টোরি” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – মধ্য দুপুর – Ajob premer golpo

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *