জ্বীনবর (সিজন ৫) – ভয়ংকর ভুতের গল্প বাংলা

জ্বীনবর (সিজন ৫) – ভয়ংকর ভুতের গল্প বাংলা: মূহুর্তেই বুকের ভিতরটা ধপ করে উঠল। বার বার বুকে টান দিচ্ছে বুড়িমা, এই মূহুর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা। এক্ষুনি যদি কিছু করতে না পারি বুড়িমাকে হয়ত বাচাতেই পারবনা।

পর্ব ০১

দরজার সামনে এসে দাড়াতেই সশব্দে দরজার কপাটগুলো নিজে নিজে নাড়া দিয়ে উঠল। আতঙ্কে চমকে উঠলাম, যদিও এমন ঘটনা আমার সাথে প্রথমবার হচ্ছেনা।

কিন্তু এটা আমার কাছে একপ্রকার পূর্বসংকেত হয়ে উঠেছে খারাপ কিছু হওয়ার।
ভিতর থেকে শব্দ এল, তোকে কি নতুন করে ভিতরে আসার জন্য বলতে হবে? আমি কাপা কাপা কন্ঠে বলে উঠলাম,
“এইতো আসছি।”

ঘন কালো অন্ধকারপূর্ণ জীর্ণ ঘরটায় আল্লাহর নাম নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ভিতরের দিকে ভীষণ ধস্তাধস্তির আওয়াজ পাওয়া যায়, চারিদিক থেকে জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। আমি পিছু হেটে কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম।

মনে মনে আল্লাহর নাম জপ করছি যাতে ওর কোনো ক্ষতি না হয়। কিছুটা সময় পরে, মোমের আলো জ্বলে উঠল ঘরটায়। আমি কপাটের আড়াল থেকে বেরিয়ে ওর সামনে দাড়ালাম।

রাগান্বিতকন্ঠে সে আমাকে বলতে লাগল,
~ তোকে দিয়ে কোন কাজটা হয় বলতে পারিস?

তোকে সাথে করে আনাটাই আমার বড় ভুল। তাও আনি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করিসনা। ভীতুরাণী একটা। চল এখান থেকে বের হই।
আমি চুপ করে শুনে ওর পিছু হাটা দিলাম।
বাড়ীটার উঠোনে এসে দাড়ালাম দুজন।

সাহেবমত লোকটি তার চাকরসমেত এল। সালাম করে বলল, কাজটা করতে সক্ষম হয়েছেন তো?
মেয়েটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল, আমি কাজটি করতে পারবনা এমন টা আপনি ভাবলেন কি করে?
কাজটা সম্পন্ন হয়েছে, আপনি গুনে গুনে বাকি টাকা আমার বাড়ীতে পাঠিয়ে দিবেন।
~ জ্বী আমি লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বুড়িমা আমাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল, ওসব কাজে যদি ওর তোকে অনুপযুক্ত ই মনে হয়, সাথে নিতে যায় কেন? আর এত কথা~ ই বা শোনায় কেন?
আমি সহসা চমকে উঠে বললাম,
“এ কি বলছো বুড়িমা! বোনের সাথে তো বোন~ ই সঙ্গী হয়ে যাবে বলো। আমার ও ছাড়া কে আছে, ওর ই বা আমি ছাড়া কে আছে!

এসব কাজ কি সবাই পারে বলো! এসব করতে গিয়ে বোনের যদি কোনো বিপদ~ আপদ ঘটে যায়, আমি তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবনা। ওকে সাহায্য করতে না পারি, ঢাল হয়ে রক্ষা করার চেষ্টা তো করতে পারব।”

বুড়িমা আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। অতঃপর ভাত মাখাতে মাখাতে বলল, তোদের দু’বোনের মাঝে আকাশ~ পাতাল তফাৎ।
আমিও বুঝিনা, এসব জ্বীনসংক্রান্ত কারবার না করলেই বা কি হয়? বেচে থাকার জন্য আরো অনেক উপায় আছে। নিজের প্রাণের ঝুকি নিয়ে জ্বীন ধরা, তাড়ানো এসব করে ফায়দা কি?

তক্ষুনি পিছন থেকে আফরাহ বলে উঠল,
” বুড়িমা, তোমার সব বিষয়ে এত নাক গলানোর কি আছে? অনধিকাত চর্চা টুকু কি না করলেই নয়!”
মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। এখন বুড়িমাকে কত কথা শুনতে হবে বোনের কাছ থেকে। কেন যে বুড়িমা এসব বলতে যায়।
আমি বিনীতস্বরে বললাম, বোন, থাকনা এসব। বুড়িমা এমনিতেই বলছিল। আমাদের নিয়ে খুব চিন্তায় থাকেন উনি, সে দুঃশ্চিন্তা থেকেই এসব বলে ফেলেছেন।

~ শোন মুশু, আমার কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করুক সেটা আমি পছন্দ করিনা। দুবেলা ভালো~ মন্দ খেয়ে বেচে আছি এই কাজের জন্যই। আর কাজটা আমাদের বংশ পরম্পরায় হয়ে আসছে। বাবার পর কাজটা আমি হাতে নিয়েছি।
আমরণ অবধি এটাকে আমি চালিয়ে যাব।

বাহিরের কারো কথায় এসব থেকে সরে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ই উঠে না।

আর যেন এসব নিয়ে কোনো কথা না হয়, তাহলে সবাইকে আমি দূর করে দিব। মনে থাকে যেন।

বোন চলে যাওয়ার পর আমি বুড়িমার দিকে তাকালাম। চোখ দুটো ভিজে আছে। আমি বুড়িমার হাত চেপে ধরে বললাম, কষ্ট পেয়োনা। জানোই তো বোন একটু রাগী, রাগ কমে গেলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবার ফেলে যাওয়া দায়িত্ব সে কাধে তুলে নিয়েছে।
বোন দশ গ্রামের মানুষ সম্মান করে, বোন তাদের সমস্যায় তাদের পাশে থাকে এটা কি কম বল!

বুড়িমা কিছু না বলে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খায়। তারপর কিছু না বলেই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

আমি উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাহিরের ঝলমলে জ্যোৎস্না দেখতে থাকি। আমি মুশায়রা, আমার ছোট বোন আফরাহ। দু’বোন মিলেই এই ছোট বাসাটায় থাকি, দেখাশুনা বুড়িমা~ ই করেন। সেই বাবা~ মা থাকাকালীন সময়ে আমাদের দেখাশুনার জন্য এই বাড়ীতে এসেছিলেন। আমাদের বয়স যখন ১৭~ ১৮ তখন হঠাৎ বাবা মারা যান, বাবার শোকে মাও পাগল প্রায় হয়ে যান, একদিন রাতে হুট করে উধাও হয়ে যান। অনেক খুজার পর পাইনি, একদিন খবর আসে গাড়িচাপা পড়ে মা মারা গিয়েছেন।

এতদিন অবধি বুড়িমা ই আমাদের সাথে ছিলেন। অসহায় এতীম দুটো মেয়েকে সামলেছেন, নিজে পরের বাড়ীতে কাজ করে আমাদের মুখে ভাত তুলে দিয়েছেন।

এরপর বোন জ্বীনধরা, তাড়ানো এসব আয়ত্ব করে বাবার পথ অনুসরণ করে এসব কাজ শুরু করে। তারপর নিজেদের স্বচ্ছলতা ফিরে আসে।
বোনও কেমন জানি পালটে যায়। অল্পতে রেগে যায়, স্বাধীনচেতা হয়ে পড়ে। আমিও চেষ্টা করি ওকে না রাগানোর, ওর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে।
কখনো কখনো খুব কষ্ট হয় ওর আচরণে, তাও চুপচাপ শুনে থাকি। কেননা, বাবা আমার উপর দায়িত্ব দিয়ে গেছিলেন ওকে দেখে রাখার, কোনো অবস্থাতেই যেন ওকে ছেড়ে না যাই।

একটুপর আফরাহ আমার ঘরে এসে ডাক দেয়, মুশু।

আমি চোখ মুছে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যা বোন। আয়, কিছু বলবি?
~ ঘুমাসনি?
~ এইতো ঘুমাব।
~ আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস?
~ কই না তো।

আফরাহ আমার ডানহাত শক্ত করে ধরে বলল,
~ তুই তো জানিস বাবা মারা যাওয়ার পর আমি অন্যরকম হয়ে গেছি। অল্পতেই রেগে যাই, যা’তা বলে ফেলি। কি করব বল? আমার তো আমাদের কথা ভাবতে হয়।

নিজেকে যদি এই জায়গায় আমি প্রতিষ্ঠিত না করতাম কবেই আমাদেরকে সমাজের হায়েনাগুলো ছিড়ে খেত।
আমার কথা ছাড়, তুই এত সরল একটা মেয়ে। কখনোই এই সমাজে টিকতে পারতিনা।
পক্ষান্তরে, তোর ভালোর জন্যই আমি এত কঠিন হয়ে থাকি।
আমার উপর মনে কষ্ট রাখিসনা বোন।

~ না, না বোন। তোর উপর আমার কোনো মনোকষ্ট নেই। আমি তো বুঝি সব। এসব একদম ভাবিসনা।
আমি সবসময় তোর পাশে আছি, যেকোনো পরিস্থিতিতে থাকব ইনশা’আল্লাহ।

বলে আফরাহকে জড়িয়ে ধরলাম। আসলেই ওর এত সংগ্রাম~ কষ্ট সব তো নিজেদের ভালো থাকার তাগিদে।
~ অনেক রাত হল, ঘুমিয়ে পড়।
আমি আসি।
~ ঠিক আছে, আয়। বেশী রাত জাগিসনা।

আফরাহ বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি শুয়ে পড়লাম। এতক্ষণ যে খারাপ লাগাটা কাজ করছিল, সেটা সরে গেছে। অনেকটাই হালকা লাগছে নিজেকে।
জানিনা, আর কতটা দিন এভাবে আমার বোনটা ত্যাগ স্বীকার করে যাবে, ওকে কতদিন আগলে রাখতে পারব।
যাদের সাথে ও যুদ্ধে নামে তারা যে কতটা ভয়ানক সেটা ভেবেই আতকে উঠি।

বোন তো বলে, ওরা আমাদের একপ্রকার শত্রু। এরা কখনো মানুষের ভালো চায়না, ক্ষতি করে বেড়ায় সবসময়।
এদের থেকে নিজেকে বাচিয়ে চলতে হবে।

হঠাৎ প্রচন্ড এক ঝাকুনিতে ঘরটা কেপে উঠল। ভয় পেয়ে উঠে বসলাম। রুমের লাইটগুলো নিজে থেকে জ্বলতে~ নিভতে লাগল। দেয়ালে কালো ছায়া পড়ল, ছায়াটা যেন এদিক ফিরে আমাকেই দেখছে।

কাপা কাপা কন্ঠে আফরাহকে ডাকতে চাইলাম, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ ই বের হলনা। ছায়া একটু শব্দ করে উঠল,
~ হুসসস।

শব্দ দিয়ে আমাকে চুপ থাকার ইঙ্গিত দিল। আমি চুপ করে ছায়াটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলাম। চোখে হঠাৎ~ ই ঘুম নেমে আসছে, তাকিয়ে থাকতে পারছিনা এমন অবস্থা।

তারপর আর কিছু মনে নেই।
সকালে উঠে কাল রাতের ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করলাম, তেমন কোনো কিছুই মনে পড়ছেনা ঠিক। এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নাস্তা বানিয়ে বোনের রুমে ঢুকলাম। লাইট টা এখনো জ্বলছে, অনেক রাত অবধি জেগে ছিল বোন। অনেকগুলো বই~ জিনিসপত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সব তুলে জায়গামত গুছিয়ে রাখলাম। রুমটায় কেমন জানি ভ্যাপসা গন্ধ আর কালো কালো দাগ লেগে আছে মেঝেতে।
বোনকে ডাকতে গিয়েও ডাকলামনা।

এসব নিয়ে আমার বেশী প্রশ্ন করা ওর নিষেধ। জায়গাটা ভালো করে মুছে রুম স্প্রে ছড়িয়ে চলে এলাম।

পর্ব ০২

পুকুরঘাটে বসে মাছগুলোকে খাবার দিচ্ছিলাম। মাছ গুলো হালকা মাথা তুলে ঠুকরে ঠুকরে ভাসমান খাবারগুলো খাচ্ছিল। আমি কিছুটা চিন্তিত, হঠাৎ মাছের সংখ্যা কম মনে হচ্ছে।

এমনটা মাঝে মাঝে ই হয়। ভাবনা~ চিন্তা করেও যখন কূল পাইনা, হাল ছেড়ে দেই। আমাদের বাসাটা কিছুটা পুরোনো ধাচের, চারপাশে বিশাল দেয়াল দিয়ে বাউন্ডারী করা। বাবা~ ই সব করে গিয়েছিলেন। একতলা বাড়ীর উপরে ছাদ, আর সামনে কিছুটা খোলা জায়গা, তার অন্যপাশে ছোট ডোবার মত পুকুর খুড়েছি। পুকুরটায় পদ্মফুল লাগিয়ে মাছ ছেড়ে দিয়েছি, আর বাসার সামনের ফাকা অংশে কিছু সবজি~ ফুলের গাছ লাগিয়েছি।

এসবের তদারকি আমি ই করি। বোনের এদিকে নজর নেই বললেই চলে, মন ভাল থাকলে একটু ঘুরে ঘুরে দেখে যায় এই যা। বাহিরের কেউ আসেওনা যে মাছ চুরি করবে, বোনকে অজানা কারণেই এলাকার ছেলেগুলো ভয় পায়, এই বাড়ীর ত্রিসীমানায় ঘেষে না পর্যন্ত।

হঠাৎ করেই এত মাছ উধাও হয়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটা অদ্ভুত। বোনকে একবার বলে দেখব, অবশ্য এর আগেও বলেছি। ও ওতোটা গুরুত্ব দেয়নি, বলেছিল হয়ত মরে গেছে বা হাস খেয়ে ফেলেছে। ওকে বুঝাতেই পারিনি মাছ মরে গেলে তো ভেসে উঠব আর এই বাড়ীতে হাস ই বা আসবে কোথা থাকে।
যাক গে, আবার যদি একই ঘটনা ঘটে তবে আর মাছ ই রাখবনা।

বুড়িমা লাঠিতে ভর দিয়ে আমার পাশে এসে দাড়ালেন। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তুমি আবার অসুস্থ শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসলে কেন? তোমার হাপানির টান টা বেড়েছে। একটু বিশ্রাম নাও।

এদিকের কাজ আমি সামলে নিব।
বুড়িমা একটু টান নিয়ে বললেন, আফরাহ কোথায়?
~ দেখলাম বের হল। বোধহয় কোনো কাজে গেছে।
তোমার কি কিছু প্রয়োজন?

~ আমার ওষুধগুলো ফুরিয়ে গেছে। এখন নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। আফরাহকে বলবি ফেরার সময় নিয়ে আসতে।
~ তুমি আগে বলোনি কেন?

বুড়িমাকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বোনকে কয়েকবার কল দিলাম। বারবার ই বলছে, সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
সন্ধে হয়ে এল, এতক্ষণ বোন বাহিরে কি করছে। সময়মত ওষুধ না খাওয়াতে পারলে বুড়িমার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে। ফোনটা রেখে বুড়িমার ঘরে গেলাম।

চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে, আমাকে দেখে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু পারছেনা।
আমি বুড়িমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
~ খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার?

একটু অপেক্ষা করো, বোন ঠিক ওষুধ নিয়ে আসবে।

বলতে বলতে মাগরিবের আযান পড়ে গেল। বুড়িমার হাত ধরতেই খেয়াল করলাম হাত দুটো বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে।

মূহুর্তেই বুকের ভিতরটা ধপ করে উঠল। বার বার বুকে টান দিচ্ছে বুড়িমা, এই মূহুর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা।
এক্ষুনি যদি কিছু করতে না পারি বুড়িমাকে হয়ত বাচাতেই পারবনা। দেরী না করে প্রেস্ক্রিপশন টা বের করে আমার রুমে ঢুকে পার্সটা নিয়ে বের হলাম।
খুব কাছেও যে বাজার, তা নয়। ১০~ ১৫ মিনিট হেটে গেলে তবেই বাজারের শেষ দোকানটার কাছে পৌছানো যাবে।
হাতে সময় খুব কম, তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছি।

বুড়িমা সারাবাড়ীতে একা, তাড়াতাড়ি না যেতে পারলে কোনো অঘটন নিশ্চিত ঘটবে।

মাগরিবের সময় তাই রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। আমাদের এলাকায় নাকি জ্বিনের উৎপাত অনেক, তাই লোকজন সন্ধ্যের পর খুব একটা বের হয়না।

বের হলেও এই রাস্তার দিকে আসেনা, এই রাস্তায় শেষ মাথায় বিরাট বটগাছ তার অনেক বছরের জীর্ণ ঐশ্বর্য নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচলিত, এর প্রতিটি দুলায়মান শিকড়ে একটা করে জ্বীন আছে।

শর্টকাটে বাজারে পৌছাতে চাইলে এই বটগাছ পার করেই আমাকে যেতে হবে। কখনো সন্ধ্যে বেলা এদিকে আসিনি, তাই কিছুটা ভয় ও করছে। আল্লাহর নাম নিয়ে পা চালাতে চালাতে বটগাছের কাছে এসে পড়ি। চেষ্টা করছি, গাছের দিকে যাতে চোখ না যায়। কিন্তু কেন জানি বার বার মনে হচ্ছে এর উচু ডাল থেকে কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে, ফিসফিস করে কিছু বলছে।

মনে মনে দোয়া পড়তে পড়তে নির্বিঘ্নে গাছটা পার হয়ে বাজারে ঢুকলাম। প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে ফেরার সময় দোকানদার কাকু বলল, সাবধানে যাস মা।
এই পথটা কিন্তু ভালনা। আমি কি তোকে এগিয়ে দিব?
~ না কাকু। বোন জানলে আবার রাগ করবে।
আমি যেতে পারব।

~ তোর বোনের ভয়ে তো কিছু করা যায়না। আচ্ছা যা তাহলে।

ওষুধগুলো নিয়ে আবার হাটা দিলাম। বোন কেন জানি পছন্দ করেনা এলাকার কোনো লোক আমাদের সাথে অহেতুক কথা বলুক, সাহায্য করুক। সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে বলে, তাও আমি কথা বলি~ মিশি। ওরাও আমাকে খুব ভালোবাসে।
শুধু বোনের জন্য কথা বাড়ায় না বেশী একটা। এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছি, কখন যে বটগাছ টার সামনে চলে এসেছে খেয়াল ই করিনি।
হঠাৎ বিদঘুটে একটা হাসির আওয়াজে আমার সম্বিৎ ফিরে এল। গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলাম খুব গাঢ় কালো ছায়া গাছের ঝুলানো শিকড়ে দোল খাচ্ছে।
ভয়ে আতকে উঠলাম। চেচালাম, কে ওখানে?

সাথে সাথে কিছু একটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। পড়ে গিয়ে সাথে সাথে উঠার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার হাত~ পা অবশ হয়ে আছে।
একচুল নড়তেই পারছিনা। ছায়াটা উড়ে এসে আমার সামনে দাড়াল, তারপর আবার বিদঘুটে হাসির শব্দ।
আমাকে এত জোরে একটা থাপড় দিল যে আমার মাথাটা টনটন করে ব্যথা করে উঠল, চোখে অন্ধকার দেখছিলাম।
দোয়া পড়ব এমন কোনো শক্তি পাচ্ছিনা।

আবার বিদঘুটে হাসি দিয়ে ছায়াটা আমার চুল চেপে ধরে সামনে টেনে হিচড়ে কোথায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করছিল এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার। পায়ের জুতোটা খুলে ছায়াটার মুখ বরাবর ধরতেই সেটা এক লাফে সরে গেল। আমি যেন কিছুটা জোর ফিরে পেলাম, আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করলাম।

ছায়াটা একটা আত্মচিৎকার করে গাছের উপরে উঠে গেল। আর দৃষ্টিগোচর হলনা।
মাটি থেকে ওষুধের প্যাকেট টা উঠিয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ে এলাম। পুরোটা রাস্তায় একবারের জন্য ও দোয়া~ কালাম পড়া বন্ধ করিনি।
ঘরে ঢুকতেই বোনের সামনে পড়ে গেলাম। ও আমাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে টেনে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। মোম জ্বালিয়ে আগুন ছোয়াল। তারপর রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

~ কোথায় গিয়েছিলি?
~ বুড়িমার ওষুধ আনতে বাজারে গিয়েছিলাম।
~ বটতলা দিয়ে গিয়েছিলি?
~ হুম।

~ তোকে আমি বারণ করেছিলাম না আমাকে না বলে তুই বাড়ীর বাহিরে বের হবিনা।
আমি চুপ করে রইলাম। আমার চুপ দিয়ে বোন আরো জোরে ধমক দিয়ে বলল, বলেছিলাম কিনা?
~ হ্যা।
~ তাহলে?

~ বুড়িমার অবস্থা এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারত। তোকে অনেকবার কল দিয়েছিলাম, কিছুইতেই সংযোগ পাচ্ছিলামনা।
~ তোকে কতদিন বারণ করেছি। অন্যের কথা ভাবা বন্ধ করে নিজের চিন্তা কর।

এর কিছু হলে আমাদের কি! বয়স হয়েছে একসময় তো মরবেই। এটা নিয়ে এত ব্যস্ত হওয়ার কি দরকার।
~ বোন!! এভাবে বলিসনা। বুড়িমা কতগুলো বছর ধরে আমাদেরকে আগলে রেখেছে, নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছে এখন তার প্রতি আমাদের ও কিছু দায়িত্ব আছে।

বোন উত্তেজিত হয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল, নিজেকে শান্ত করে বলল,
~ সব বুঝতে পারছি। কিন্তু এই সময় বের হয়ে তোর কি অবস্থা হয়েছে দেখ। খারাপ কিছু ও তো হতে পারত।
আমি বুড়িমার ওষুধ এনেছি, আমার এটা মাথায় ছিল।
খাইয়ে দিয়েছি, উনি ঘুমাচ্ছে এখন।

কিন্তু তুই তোর অবস্থা দেখ! পুরো শরীরে মাটি লেগে আছে, ঠোটের কোণা বেয়ে রক্ত ঝড়ছে।
যাহ, ফ্রেশ হয়ে আমার কাছে আয়।
আমি ব্যান্ডেজ করে দিব।
~ আচ্ছা।

~ শোন, আর কখনো এভাবে বের হবিনা।
কোনো পরিস্থিতিতেই না।
~ ঠিক আছে।

আফরাহ ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ল। কপালে ঘামের সুক্ষ্ম রেখা ফুটে উঠল, ক্ষণেই হাতের পিঠ দিয়ে তা মুছে নিল সে।
আমি সোজা বুড়িমার ঘরে ঢুকলাম। গভীর ঘমে আচ্ছন্ন বুড়িমা। তার গায়ের উপর কাথা টেনে দিয়ে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।
অনেকক্ষণ ধরে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছি একদৃষ্টিতে। ঠোটের কোণে কালশিটে বর্ণ ধারণ করে আছে, গালটায় কিছু টা ব্যথা অনুভব করছি।
সেই ভয়াবহ মূহুর্তের কথা মনে পড়লে এখনো গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। কখনো এমন ভাবে কারো সাথে আমার লড়াই করতে হয়নি, আজ আত্মরক্ষার জন্য করতে হল।

কিন্তু ছায়াটা কিসের? আমাকে কেন আঘাত করতে চেয়েছিল? তখন মনে হচ্ছিল ছায়াটা কি একটা ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। অবশ্য সেটা নিতান্ত আমার ধারণা।

ঠিক বুঝতে পারছিনা এটাকে কি সাধারণ ঘটনা ধরে নিব নাকি কারো প্রতিশোধ ধরে নিব?
হঠাৎ ঘাড়ে কারো হাত পড়তেই চমকে উঠলাম। পিছন ফিরে দেখি বোন ব্যান্ডেজ~ ওষুধের সামগ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
~ ভয় পেলি?

~ হ্যা কিছুটা। বোন আমাকে বসিয়ে আস্তে আস্তে ওষুধ লাগাতে লাগাতে বলল, এত ভয় পেলে জ্বীনের মুখোমুখি হবি কি করে?
~ মুখোমুখি হব মানে!

~ এই কাজ আর কতদিন আমি একা করব! এইবার তোকেও এতে সামিল হতে হবে যে।
এখন থেকে আয়ত্ব করতে শিখ।

~ আচ্ছা বোন, তুই কি বলতে পারিস আক্রমণ টা আমার উপর কেন হয়েছিল?
~ সেটা আমি কি করে বলব।

এটা তো জানা কথা, বটগাছটায় খারাপ কিছুর অস্তিত্ব আছে। সন্ধ্যেবেলা সেই রাস্তায় কেউ গেলে এসবের সম্মুখীন হয়।
~ আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ছায়াটা প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে আমার উপর আক্রমণ করেছে। যেন আমি তার শত্রু।
~ এমনটা সবার সাথেই হয়।

এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা, তুই ঘুমিয়ে পড়। আমি আসছি।
~ বোন, তুই আমার সাথে আজ রাতটা ঘুমাবি?
কত দিন একসাথে শুয়ে গল্প করিনা।

~ এসবের জন্য আমার কোনো সময় নেই। আমাকে সারারাত এসব কাজে ঘাটাঘাটি করতে হয়। সবার পেটের জোগান দিতে হয়।
বলেই চলে গেল। আমি অবাক হয়ে গেলাম, বোন হঠাৎ করে এত রেগে গেল কেন? আমি তো এমন কিছুই বলিনি।
ওর মনোভাব বুঝা আসলেই দায়।

ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লাম। ভয় হচ্ছে কিছুটা, ছায়াটা কি আদৌ আমার পিছু ছাড়বে।
আজকের জন্য আল্লাহর রহমতে ছাড়া পেলাম, এরপর কি পাব!

পর্ব ০৩

মাঝরাতে বোন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমাকে জাগায়। ওর চোখে~ মুখে এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোর কি হয়েছে বোন?
বোন এতটাই হাপাচ্ছে যে কোনো কথা ই বলতে পারছেনা।

আমি উঠে পানির গ্লাস এনে ওর হাতে দিতেই এক নিঃশ্বাসে পুরো পানি খেয়ে নিল।
আমি ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
~ কি হয়েছে বোন? এভাবে হাপাচ্ছিস কেন?
খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস!

ও আমার চেহারার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়াল। আমি মুচকি হেসে বললাম, ভয় পাসনা তো, আয় আমার কোলে মাথা রাখ। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ঘুমিয়ে পড়।

বোন বিনা কথায় আমার কোলে মাথা রাখল, আমি আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ও পুরোটা ঘেমে আছে, ওরনা দিয়ে ওর ঘাম মুছে দিলাম।
আগের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। যখন ছোট্ট ছিলাম, বোনের সে কি বায়না ছিল আমার কাছে। বড় মেয়ে হিসেবে বাবার কাছে আমি একটু বেশী ই আদর পেতাম, তাই বোন যা বাবার কাছ থেকে আদায় করতে পারতনা আমার কাছে এসে বায়না করত।

দুবোনের মধ্যে অনেক ভাব ছিল। আমি ওর ২~ ১ বছরের বড়, তাই বোনের থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক টাই বেশী ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর ওর মধ্যে অনেকটাই পরিবর্তন চলে আসে, কেমন জানি নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। মুখ ফুটে কিছু বলতে চায়না, আমিও ওকে কোনো ব্যাপারে জোর করিনা। বোনটাকে খুব বিশ্বাস করি এবং ভালোবাসি।

ওর কোনো আচরণে কষ্ট পেলেও চুপ করে থাকি, পরে নিজে থেকে বুঝতে পেরে আমার সাথে সহজ হয়ে যায়। বাবা একসময় বলেছিল, ওকে দেখে রাখতে। আমি যেন সারাজীবন ওর ছায়া হয়ে আগলে রাখি। কখনো ওকে কষ্ট না দেই, ছেড়ে না দেই।
বাবাকে দেওয়া কথার মর্যাদা আমি এখনো রাখছি, ইনশা’আল্লাহ আজীবন রাখব।

ভাবতে ভাবতে ফজরের আযান পড়ে গেল। ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে ছিলাম, আযান শুনে মাথায় ওড়না দিলাম। বোন তখনো আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে খুব আরামে, আস্তে করে ওর মাথাটা বালিশে রেখে উঠে গেলাম।

ফ্রেশ হয়ে নামায সেরে বুড়িমার ঘরে গেলাম। বুড়িমা এখনো ঘুমাচ্ছে, বোধহয় বোন ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে।
বেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম, আজ মনটা বেশ ফুরফুরে। হয়ত অনেকদিন পর বোনকে নিজের কাছে আগের মত করে পেয়ে।
চা বসাতেই বোন চোখ ডলতে ডলতে রান্নাঘরে চলে এল। আমি দেখে বললাম,
~ এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে গেল?

আরেকটু ঘুমাতি, কাল তো অনেক রাত করে ঘুমিয়েছিস।
~ ক্ষুধা লেগেছে খুব। তোর এখনো নাস্তা বানানো হয়নি, বুড়িমা কোথায়?

এখনো ঘুমাচ্ছে? তুই একা একা সব করবি, উনি আছেন কি করতে তাহলে! দাড়া আমি যাচ্ছি উনার কাছে।
~ বোন, উনি অসুস্থ তুই জানিস ই তো। তুই একটু অপেক্ষা কর, আমি এক্ষুনি নাস্তা দিচ্ছি তোকে।

বলতে বলতে তাড়াহুড়োয় চা নামাতে গিয়ে কিছুটা গরম চা হাতে পড়ে গেল। মুখ থেকে “আহঃ” শব্দটা বেরিয়ে গেল।
বোন পিছন ফিরে দেখে কাছে ছুটে এসে হাতটা বেসিনের কাছে নিয়ে কল ছেড়ে দিল।
রাগান্বিত হয়ে বলল,
~ সব ব্যাপারে তোর মাতব্বরি করতেই হয় তাইনা!

নিজেকে খুব দয়ালু প্রমাণ করতে যাস তাইনা? শিক্ষা হয়না তোর একবারে!
তোকে কে এত তাড়াহুড়ো করতে বলেছে? এখন যে পুড়িয়ে ফেললি দোষ তো আমারই দিবি।
~ না বোন। সামান্য লেগেছে, সেরে যাবে।
~ আস্তে ধীরে কাজ কর।

~ আচ্ছা। তুই যা, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
~ শোন।
~ হ্যা বোন।

~ আমাদের কয়েকদিনের জন্য এলাকার বাহিরে যেতে হবে, একটা নতুন কাজের ডাক এসেছে।
সবকিছু নিয়ে তৈরী থাকিস। আমরা বিকেলেই বের হব।
~ আমরা তো এর আগে এলাকার বাহিরের কাজ করিনি।
~ তো কি হয়েছে? এবার থেকে করব।

কি কাজ পন্ড করব! উনাকে দেখাশুনার জন্য আমি বিন্দি দাদী আর ওর মেয়ের কাছে রেখে যাচ্ছি।
উনাদের কিছু টাকা দিয়ে দিয়েছি, আশা করি ঠিকমত দেখাশুনা করবে।
তুই এত কথা না বাড়িয়ে যেটা বললাম, সেটা মাথায় রাখ।
চুপচাপ শুনে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

হাতের সব কাজ সেরে ব্যাগ গুছালাম। বোন বোধহয় গাড়ি ডাকতে গেছে। বাড়ির চাবির গোছা বুড়িমার হাতে দিয়ে বললাম, নিজের খেয়াল রেখো। আর কোনো অসুবিধা হলে আমাকে ফোন দিয়ে জানিও।
আর আমি প্রতিদিন ফোন দিয়ে খোজ নিব তোমার।

বুড়িমা দুঃখীমুখ করে বললেন, আগে কখনো এলাকার বাহিরে যাসনি, তার উপর এসব ভয়ানক কাজে যাচ্ছিস। সাবধানে থাকিস। তোদের নিয়ে আমার খুব ভয় হয়।

~ আহা, বুড়িমা। চিন্তা করোনা, আল্লাহ আমার সহায় হবেন। আর বোন তো আছেই। তুমি শুধু নিজের খেয়াল রেখো।
বাহিরে থেকে বোনের ডাক ভেসে আসল। বুড়িমাকে সালাম করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে, বোন দরজা খুলে দিয়ে আমাকে ভেতরে উঠে বসতে বলে।

কিছুক্ষণ পর গাড়ি চলতে শুরু করে, এই প্রথম এলাকার বাহিরে যাচ্ছি। যেমন সংকোচ, তেমনি অস্বস্তি অনুভব করছি।
বোনকে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, আমরা কোথায় যাচ্ছি? সেটা কত দূরে? কিংবা কতদিন থাকতে হবে?

কিন্তু ও রেগে যাবে সে ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিনা। একমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছি, বোন ফোন টিপা নিয়ে ব্যস্ত।
প্রকৃতিটা যে আল্লাহ এত সুন্দর করে বানিয়েছেন, যত দেখছি মুগ্ধ হচ্ছি। জানালা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে অনেক বাতাস ঢুকে আমার চোখ~ মুখ ছুয়ে গেল, এর অনুভূতিটাই অন্যরকম।

বোন ফোন থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ জানালা খুলেছিস কেন?
~ না আসলে… বন্ধ করে দিব?
~ না থাক।

তোকে কিছু কথা বলে রাখি, আশা করি সেগুলো শুনবি আর মেনে চলবি।
এবারে যেখানে আমরা যাচ্ছি, সেটা খুব ভয়ানক জায়গা। সবকিছু খুব একটা সহজ হবেনা, তার উপর সেখানে রাত হলে হিংস্র প্রাণী এবং চোরাকারবারি দলের লোকেরা ঘুরাঘুরি করে।
অতএব, অনেক সাবধানে থাকতে হবে।

এলাকাটা জ্বীনের বাসস্থান নামেই পরিচিত। সবচেয়ে ভয়ানক আর হিংস্র জ্বীনের বসবাস সেখানে।
~ এত ঝুকিপূর্ণ জায়গা জীবনের ঝুকি নিয়ে না গেলে হত না বোন? কি দরকার এসব ঝামেলায় জড়ানোর!
ফিরে গেলে ভাল হয়না! আমার ভয় লাগছে শুনে।
~ ক্ষেপেছিস? এতদূর এসে ফিরে যাব।

তুই জানিস কাজটা করতে পারলে কত টাকা পাব আমরা। সে এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি আমাকে তলব করেছে।
~ বোন টাকার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশী।

ওদের কাছে আমরা কিছুই না, যেকোনো সময় যেকোনো ক্ষতি ওরা আমাদের করতে পারে।
চল, বোন আমরা ফিরে যাই।
~ তোকে সাথে আনাটাই আমার ভুল হয়েছে।

যা, তুই এখানে নেমে যা। বাস ধরে বাড়ি ফিরে যা, আমি সেখানে যাব ই। তোর যেতে না ইচ্ছে হলে বল, তোকে বাড়ী পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেই।
~ না আমি তোর সাথে যাব।

তে পারবনা।
~ তাহলে চুপচাপ চল।

এসব নিয়ে অযথা ঘ্যান ঘ্যান করবিনা।

বোনের জেদের কাছে হার মেনে অগত্যা চুপ করে রইলাম। ও যেহেতু একবার যাবে বলেছে, আমি শত বুঝিয়েও ওকে আটকাতে পারবনা।
কিন্তু এত ঝুকি নেওয়াটা সত্য খুব ভয়ের। আল্লাহ ই জানে, কি অঘটন ঘটতে যাচ্ছে।

সন্ধ্যে নামার আগেই সে এলাকায় পৌছে গেলাম, এলাকাটা অনেকটা উপশহর টাইপ। এমন এলাকায় জ্বীনের বসবাস থাকতে পারে ভাবা যায়না। দুইজন লোক এসে আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেল। বিরাট এক পুরোনো আমলের বাড়ীর পাশের দালানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হল।
বাড়ীটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম, এত সুন্দর টেরামাটির ফলক আকা বাড়ী কোথাও আছে বলে জানা নেই। কি নিখুত কারুকার্য এর প্রতিটি দেয়ালে!
বাহিরেটা এত সুন্দর, ভিতরটা না জানি কত সুন্দর। দালানটায় একটা পরিবার থাকে, শুনে যা বুঝলাম এই ভদ্রলোক ই এ পোড়াবাড়ীর মালিক এবং বোনের তথাকথিত প্রভাবশালী ব্যক্তি।

যাই হোক, রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বোন ক্লান্ত হয়ে এসেই শুয়ে পড়েছে।

নামায পড়ে উঠতেই ভদ্রলোক আর তার স্ত্রী আমাদের রুমে এলেন খাবার দাবার নিয়ে। ভদ্রলোক আসতেই বোন উঠে ফ্রেশ হতে গেল। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
~ আপনাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছেনা তো!
~ জ্বী না।

~ জানি কাজটা আপনাদের জন্য ঝুকিপূর্ণ তাও আমাদের কিছু করার নেই। সমস্যাটা সমাধান না করলে আমাদের জন্য ই বিপদ।
~ কিন্তু সমস্যাটা কি যদি একটু খুলে বলেন?
ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তার চোখে~ মুখে এক অজানা ভয় বিরাজ করছে।
আমি ভিতরে ভিতরে আতঙ্কিত হচ্ছি, কি এমন ব্যাপার যে উনারা সেটা বলতেই এত ভয় পাচ্ছেন।

পর্ব ০৪

ভদ্রলোক কিছু বলতে গেলেন এই সময় বোন এসে বলল,
~ এত কিছু জেনে আমাদের ফয়দা কি?

কাজ করতে এসেছি, সেটাই করি। জ্বীনরা মানুষের পাশাপাশি থেকে মানুষের ক্ষতি করে এটাই তো হয়ে আসছে যুগে যুগে।
ভদ্রলোক জোর কন্ঠে বলে উঠলেন,

~ সেটার পিছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। জ্বীনেদের প্রতিশোধ প্রচন্ড ভয়ংকর হয়। একবার যদি এরা ঠিক করে প্রতিশোধ নিবে, হাজার বছর পরেও নিয়ে নিবেই।
আমি অবাক হয়ে বললাম,

~ এই বিশাল প্রাসাদের পিছনেও কি কোনো প্রতিশোধের গল্প আছে?
ভদ্রলোক মাথা নাড়ালেন। অস্ফুটস্বরে বললেন,
~ হয়তবা।

আমি সঠিক জানিনা, আমার পূর্বপুরুষরা ই ভালো বলতে পারবেন। তবে এইটুকু ই জানি, যে করে হোক এদের দমাতে হবে। নাহলে আমাদের জীবন সংকটাপন্ন এবং প্রাসাদের ইতিকথা শেষ হয়ে যাবে।

ভদ্রলোকের কথাগুলো ভীষণ এলোমেলো লাগছে। বুঝতে পারছি না কিছুই। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব, বোন ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলল,
~ আপনি চিন্তা করবেননা। কাল রাতে আমরা ওখানে যাব।
আমরা এখন অনেক ক্লান্ত, অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি।
একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।

~ হ্যা অবশ্যই। আপনারা বিশ্রাম নিন, কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন। আসছি আমরা।
ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে প্রস্থান করলেন।

আমি উঠে জানালার পাশে এসে দাড়ালাম। এখান থেকে প্রাসাদের কিছুটা অংশ অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে কিছু বোঝার উপায় নেই। আমি বলে উঠলাম,
~ বোন ভদ্রলোকের কথা কেমন জানি গড়মিল লাগল।

বোন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে নিতে বলল,
~ তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
তোকেও এতকিছু ভাবতে হবেনা। ভালোয় ভালোয় কালকে কাজটা সম্পন্ন করতে পারলেই হল।
ঘুমাতে আয়। আমি আর কিছু না বলে শুয়ে পড়লাম। মনের খচখচানি কোনোভাবেই দূর হলোনা।

খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গল আমার। ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে নিলাম। এখানকার সকালটা ভীষণ মনোরম, পরিবেশটা দেখার জন্য বাহিরে বের হলাম।
চারিদিকে হালকা মৃদু বাতাস বয়ছে, পাখিদের কলরবে মনটা ভরে গেল। হাটতে হাটতে প্রাসাদের সামনে এসে দাড়ালাম। হালকা রোদ পড়ে প্রাসাদটাকে আরো বেশী সুন্দর লাগছে। চারিদিকটা জঙ্গলে ছেয়ে গেছে, অদ্ভুতভাবে এইদিকের পরিবেশ একদম থমথমে। কোনো পাখির ডাক পর্যন্ত নেই।
কি এক অজানা আকর্ষণ আমাকে প্রাসাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সব ভুলে আমি জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়লাম। জঙ্গলের মাঝামাঝি আসতেই কিছু একটা আমার পা চেপে ধরল। চমকে উঠে পায়ের দিকে তাকালাম, ভীষণ কিউট একটা বিড়াল আমার পা ধরে আছে।

এত্ত কিউট বিড়াল আমি আগে কখনো দেখিনি, দেখলে ই মায়া কাজ করে। বিড়ালটাকে কোলে নেওয়ার জন্য যেই হাত বাড়ালাম, সে ছুটে জঙ্গলের বাহিরের দিকে দৌড় দিল।

আমিও তার পিছু নিলাম। কখন যে জঙ্গল থেকে বের হয়ে গেলাম বুঝতেই পারলামনা, কিন্তু আশেপাশে কোথাও বিড়ালটাকে দেখলামনা।
বোন আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

~ একা একা এখানে এসেছিস কেন?
আমি আস্তে করে উত্তর দিলাম, হাটতে হাটতে চলে এসেছি।
~ তোকে বার বার নিষেধ করেছিলাম একা একা কোথাও যাবিনা। তাও এলি কেন?

তোকে খুজতে আমাকে এখানে আসতে হল? টেনশান দিয়েই তুই আমাকে মেরে ফেলবি।
~ এমনটা আর হবেনা বোন। তুই রাগ করিসনা।
~ চল এখান থেকে।

~ আচ্ছা।
বোনকে অনুসরণ করে চলে যাচ্ছিলাম, কৌতুহলবশত পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখি বিড়ালটা জঙ্গলের মুখে লেজ গুটিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এক্ষুনিতো এখানে এটাকে আমি দেখিনি, পলকে কোথায় থেকে চলে এল!
সন্ধ্যে নামতেই বোন গোছগাছ করে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল। আমি গালে হাত দিয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছি। আজ অমাবস্যা কিনা জানা নেই।
তবে চারিদিকটা ঘোর অন্ধকারে ঢেকে আছে। অজানা আতঙ্কে বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করছে। বার বার বুলি আওড়াচ্ছি, আল্লাহ আপনি আমাদের সহায় হন।

আল্লাহর নাম নিয়ে দুইবোন বেরিয়ে পড়লাম বাড়ীটার উদ্দেশ্যে। জঙ্গলটাতে ঢুকতেই এক গা ছমছম অনূভুতি বিরাজ করতে লাগল।
মনে হচ্ছে আমাদের আশে পাশে কেউ আছে, আমাদের উপর নজর রাখছে। জঙ্গল পেরিয়ে প্রাসাদের কাছাকাছি আসতেই দেখি বিশাল দরজা টা হাট করে খোলা, যেন কেউ আমরা আসব জেনে এভাবে খুলে রেখেছে।

বোন টর্চের আলো এদিক সেদিক মেরে চারিদিকটা ভাল কপ্রে দেখে নিচ্ছে। ছাদের দিকের দালানে আলো পড়তেই একদল বাদুর শব্দ করে উড়ে গেল।
জঙ্গলটাতে আর অন্য কোনো প্রাণী চোখে পড়লনা। বোন দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল, পিছু পিছু আমিও ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকে ভালোকরে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। বাহিরের দিকটার চেয়ে ভিতরের দিকটা বেশী সুন্দর, নিখুত কারুকার্য ছোয়ানো প্রতিটা দেয়াল।

যদিও কোথাও কোথাও চুন সবং আস্তর খসে পড়েছে। কোণায় কোণায় মাকড়সার জাল ঝুলে আছে, এত্ত পরিমাণ ধুলোয় পরিপূর্ণ চারিদিক যে বার বার কাশি হচ্ছে আমাদের।
হঠাৎ করে দরজাটা সশব্দে নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল। উপরের দালান থেকে চাপা কান্নার স্বর, আর্তনাদ ভেসে আসতে লাগল। এত কোলাহলের মধ্যেও কিছু একটার সুক্ষ্ম আওয়াজ আমার কাবে আসল। উপরের দিকে একবার তাকিয়ে বোনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজেও সরে পড়লাম। সাথে সাথে মাথার উপরে ঝুলে থাকা মাঝারি ঝাড়বাতি বরাবর নিচে পড়ে ভেঙ্গে গেল।

বোন এই ঘটনাতে ভিমড়ি খেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে বামদিকের সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল।
~ বোন এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?

বোন কোনো উত্তর দিলনা। উপরে উঠতেই একটা কালো ছায়া আমাদের সামনে এসে দাড়াল। বোন সেটা দেখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাওয়ার টাল সামলাতে না পেরে পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে যেতে নিল। আমি সাথে সাথে ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলাম, ধরতে গিয়ে আমার হাতের টর্চটা নিচে পড়ে বোধহয় ভেঙ্গে গেছে।
দুবোন অন্ধকারের মাঝে ডুবে গেলাম। বোনের টর্চটা যে কোথায় পড়ে গেছে! হাত টেনে বোনকে উপরে তুললাম। এই সময় মনে হল আমাদের চারপাশটা ঘুরপাক খাচ্ছে।

কেউ যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে অন্যদিকে ফেলে দিল।
ধাক্কা খেয়ে দেয়ালের সাথে বাড়ি খেলাম।

অন্ধকারে নিজেকে একটা অসহায় কীটের মত মনে হচ্ছে। আমার চারপাশে অনেকগুলো ছায়ার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি।
ঘাড়ের উপর পড়া আগুনের মত তপ্ত নিঃশ্বাস যেন আমাকে ঝলসে দিচ্ছে।
সরে পড়তে গিয়ে কিছু একটার সাথে পা বেধে মেঝেতে পড়ে গেলাম। সাথে সাথে ভারী কিছু আমার কপাল বরাবর পড়ল। চারপাশটা কেমন ঘোলা ঘোলা লাগল, হয়ত এক্ষুনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলব আমি।

পর্ব ০৫

জানিনা কতক্ষণ পর আমার জ্ঞান ফিরল, ফেরার পর নিজেকে এক মুক্ত পরিবেশে আবিষ্কার করলাম। চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকালাম, আমি পোড়াবাড়ীর ছাদের উপর দেয়ালে হেলান দিয়ে আধ~ শোয়া অবস্থায় পড়ে আছি।
ভেবেই পেলাম না আমি এখানে কি করে এলাম!

আর বোন কোথায়, বোনের কোনো ক্ষতি হলনা তো। উঠতে যাব, চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। চারিদিকটা এত অন্ধকার নামার পথটা কোনদিকে সেটাও ঠাহর করতে পারলামনা।

অসহায়ের মত আগের জায়গায় বসে পড়লাম। মাথার এক পাশটা এখনো ব্যথা করছে, বোনের কথা ভেবে আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝড়তে লাগল।

কয়েকবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বোনকে ডাকলাম। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। অসহায়ের মত হাটুতে মাথা রেখে চোখ বুজে রইলাম।
কারো পায়ের ধীর শব্দ শুনে আমার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে গেল। মাথা তুলে সামনে তাকালাম, মনে হল একটা অবয়ব আমার সামনে মূর্তিমান। অন্ধকারে কিছুই বোঝার উপায় নেই। কাপা কাপা কন্ঠে বললাম,
~ কে আপনি?

একটা সুমধুর পুরুষ কন্ঠ বলে উঠল,
~ আসসালামু আলাইকুম।

গভীর রাতের অন্ধকারে এমন নির্জন বাড়ীতে পুরুষের কন্ঠ পেয়ে আমি চমকে উঠলাম। আমার সাথে যা ঘটল তা থেকে বুঝলাম এখানে কোনো মানুষের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব।

তবে কি এই লোকটি কোনো চোরাকারবারি দলের সদস্য? নিজেকে আত্মগোপন করতে এই বাড়ীতে লুকিয়ে আছে।
ভয়~ আতঙ্ক মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,
~ কে আপনি? এখানে কি করে এলেন?
নিজের আসল পরিচয় দিন।

~ সর্বপ্রথম সালামের উত্তর নিতে হয়।
মনে মনে ভাবছি, সালামের উত্তর নিব কি করে? ভয়েই আমার কাপুনি উঠে গেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
~ ওয়ালাইকুম আসসালাম।

~ আপনার শরীর এখন কেমন?

~ আপনি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?
~ অবশ্যই দিব। তবে আগে আপনি আমার উত্তর দিন।
~ আমার শরীর এখন ঠিক আছে।

শুধু বুঝতে পারছিনা আমি এখানে কি করে এলাম!
~ শান্ত হোন। আপনি জানতেন না এই বাড়ীটা ভীষণ বিপদজনক?
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।
~ তাও আসলেন কেন? নিজের জীবনের মায়া নেই বুঝি!

আল্লাহ আপনার হেফাজত করেছেন বলেই এত বড় বিপদ থেকে বাচতে পারলেন।
আল্লাহ ‘ই সর্বোত্তম রক্ষাকর্তা।

উনার কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত লাগছে। মনে হচ্ছে, ইনি কিছুতেই খারাপ প্রকৃতির মানুষ হতে পারেননা। কিন্তু উনি ই বা কে?
এখানে থাকেন কেন! আমার বিপদের ব্যাপারে জানলেন কি করে? উনি বিনীতকন্ঠে বললেন,
~ চলুন, আপনাকে এখান থেকে বের করে দেই। আমি আর চুপ থাকতে পারলামনা, জিজ্ঞেস করেই বসলাম,
~ আপনি আসলে কে? এত রাতে এই নির্জন জায়গায় কি করছেন?
উনি হালকা শব্দ করে হেসে বললেন,
~ সত্যটা বললে ভয় পাবেন না তো?

~ ভয় পাব কেন? আপনি কি সন্ত্রাসী বা চোরাকারবারীর দলের কেউ?
~ তার ও বড় কিছু।
~ মানে?

উনি একটু চুপ থেকে বলল, ছাড়ুন। আপনাকে এখান থেকে বের করে দিই আসুন। পরিচয়ের ব্যাপারটা না হয় তোলা থাক, শুধু নিজের মনকে দূর্বল করে কোনো লাভ আছে!

~ আপনি কি আমাকে ভীতু প্রমাণিত করছেন? সত্যটা শুনলে হয়ত একটু আতঙ্ক কাজ করবে, এমন নয় যে আপনি জ্বীন বা হিংস্র প্রাণী। শুনেই ভয়ে লাফাব।

কথাটা বলার পর আমি নিজেই অবাক হলাম, এভাবে কখনো কারো সাথে তর্ক করিনি। কিন্তু, উনার পরিচয়টা না জানা অবধি শান্তি পাচ্ছিনা।
~ যদি বলি আমি ওইরকম কিছু ই।
~ মজা করছেন আমার সাথে?

~ একদম ই না। আমি সত্যিই একজন জ্বীন।

শুনে আমার ভেতরের আত্মাটা কেপে উঠল। অন্ধকারেও যেন তার দুটো চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। কাপা কাপা কন্ঠে বললাম,
~ আপনি জ্বীন!!!!

~ বললামনা, ভয় পাবেন। শুধু শুধু ই জোর করলেন। ভয় পেয়ে এখন এখান থেকে পালাতে যাবেন না যেন।
ঘন অন্ধকারে হোচট খেয়ে পড়ে যাবেন।
~ আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিনা।

একজন জ্বীন আমার সামনে, অথচ সে আমার কোনো ক্ষতি করছেনা। তখনকার মত আমার উপর নির্যাতন করছেনা।
~ আমি আপনার ক্ষতি করতে আসিনি।

আপনাকে বিভিন্ন ক্ষতি থেকে আগলে রাখতে এসেছি।
~ মানে?

~ মানে কি এখনি জানতে হবে! আল্লাহর ইচ্ছেতে যদি আবার কখনো মুখোমুখি হই, তখন না হয় বলব।
এখন আসুন, এই ভয়ংকর জায়গা থেকে আপনাকে বের করে দিই। এই জায়গাটা আপনার জন্য একদম ই নিরাপদ নয়, আর কখনো এখানে আসবেননা।
আমি আর কথা বাড়ালামনা। হয়ত পরে জানাটাই আমার জন্য ভাল হবে। আগে এই ভয়ংকর জায়গা থেকে মুক্ত হই।
চারিদিকে নিকষ অন্ধকার দেখে উনাকে বললাম,
~ এই অন্ধকারে আমি নিচে নামব কি করে?

আমি তো নিজের অবয়বটাও দেখতে পাচ্ছিনা।
~ বুঝতে পেরেছি।

আমি আপনার দিকে আমার হাতটা বাড়িয়ে দিচ্ছি, আপনি শক্ত করে ধরে সাবধানে পিছু পিছু হাটতে থাকুন।
বলার পর ই একটা শুভ্র সাদা হাত আমার দিকে এগিয়ে আসল। এতটাই উজ্জ্বল যে অন্ধকারে কিছুটা বুঝাতে পারছিলাম। আমার কাপা হাতটা যেন কিছুতেই সায় দিচ্ছেনা হাতটা ধরার। কয়েকবার ধরতে গিয়েও থমকে গেল।

উনি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে নিজেই এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরলেন। সাথে সাথে আমি শিহরিত হয়ে গেলাম, এত্ত কোমল এবং ঠান্ডা হাত কারো হয় কখনো জানা ছিলনা।

উনি আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে হাটতে লাগলেন, আমি একপ্রকার অন্ধের মত উনার পিছু পিছু পা ফেলতে লাগলাম।
নিচে নামার দু~ তিনটা সিড়ি বাইতেই সিড়ির এক অংশ ভেঙ্গে আমি পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলাম। সিড়িগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ যে, কারো পক্ষেই সাধারণ ওজন নিয়ে উঠানামা করা সম্ভব না।

অদ্ভুত ব্যাপার, আমি তাহলে কি করে ছাদে উঠলাম। আর ছেলেটিও এতগুলো সিড়ি বেয়ে নামল, তার ভারে সিড়ির কিছু হলনা।
উনি দাড়িয়ে পড়ে বললেন, অনেক পুরোনো বাড়ি, আস্তর খসে সবকিছুই ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। আপনি নিজের ভার নিয়ে এই সিড়ি দিয়ে পায়ে হেটে নামতে পারবেননা।

~ তাহলে আমি নামব কি করে!
~ যেভাবে উঠেছিলেন।

~ আমি জানি আমি কিভাবে উঠেছিলাম! আমার এখন সত্যিই দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
~ দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আপনি নামতে পারবেন।
~ কি উপায়ে!!

দেখছেন ই তো, আমার সাধারণ ভারেই সিড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে।
~ আপনাকে আমি কোলে তুলে নিচ্ছে, কোলে তুলে সিড়ি পার করে নামিয়ে দিব।
~ আমি আপনার কোলে উঠব? এসব কি বলছেন!
আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল!

~ এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। আপনি এখান থেকে উঠতেও পারবেননা আর নামতেও পারবেননা।
যে সিড়িটাতে দাঁড়িয়ে আছেন, সেটাতেও বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেননা। যেকোনো সময় সেটা ভেঙ্গে আপনি নিচে পড়ে যেতে পারেন।
~ আপনি নাকি জ্বীন? ম্যাজিক করে এক মূহুর্তে নামিয়ে দিতে পারেননা! এর জন্য কোলে নিতে হয় নাকি!
~ আমি জ্বীন বলেই আমার ভারে সিড়ির কিছু হচ্ছেনা।

দেখুন, হাতে বেশী সময় নেই। আপনি কোলে উঠবেন কিনা বলুন!

আমি তো শাকের করাতে পড়লাম। উনার কোলে উঠা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ভাবতে ভাবতেই সিড়ির কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়ে গেল।
আমি তাড়াতাড়ি করে বলে ফেললাম,

~ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন কেন? তাড়াতাড়ি আমাকে কোলে তুলে নিন, নাহলে এক্ষুনি সিড়ি ভেঙ্গে পড়ে আমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে।
উনি মূহুর্তে আমাকে পাজকোলা করে তুলে নিলেন। সাথে সাথে সিড়ি পুরোটাই ভেঙ্গে পড়ে গেল। আল্লাহ রক্ষা করেছেন, আর এক মূহুর্ত দেরী হলে যে কি হত।

ভেবেই নিজের অজান্তে উনার পোশাকের বুকের অংশটুকু শক্ত করে আকড়ে ধরলাম।
এইদিকে উনি তো একনাগাড়ে হেসেই যাচ্ছেন, আমার খুব লজ্জা লাগছে। কিছুটা বিব্রত অনুভব করছি।
কিছু বলতেও পারছিনা, সহ্য ও করতে পারছিনা। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে হাসি থামানোর জন্য উনার বুকে সজোড়ে চিমটি কাটলাম।
উনি হাসি বন্ধ করে হালকা ব্যথার শব্দ করে উঠলেন।

আমাকে বললেন,
~ চিমটি কেটেছেন কেন? এখন ফেলে দিব কোল থেকে?
~ নাহ নাহ। কি করছেন কি, আমি তো পড়ে যাব।

~ বেশ হবে। চিমটি কাটলেন কেন? ব্যথা লাগেনি আমার!

~ সামান্য চিমটির ব্যথা সহ্য করতে পারেননা কিসের জ্বীন আপনি?

~ আমি যেহেতু জ্বীন ই নই, তবে আপনাকে কোলে ধরে আছি কেন! ফেলেই দিই?
~ নাহ!! আমি মজা করেছি। ফেলবেননা, আমি আর কিছু করবনা। আপনি সাবধানে সিড়ি বেয়ে নামুন।
~ ঠিক তো?

তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত আমি সিড়ি বেয়ে শেষ না করছি, আপনি কান ধরে থাকুন।
~ এসব কি শর্ত? একদম অনুচিত এসব।

~ আপনি আমাকে জ্বালাতে পারেন, আমি পারিনা! না ধরলে আমি আর পা ও নামবনা।
এবার সিদ্ধান্ত আপনার।

~ আচ্ছা তাই হবে। আমি কান ধরছি।
আপনি দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি নামুন।
~ আমি মালবাহী গাড়ি না, বুঝলেন।

যে এত ভারী ওজনের জিনিস নিয়ে বাতাসের গতিতে ছুটব!
~ আমি অনেক ভারী!!!
~ তা নয়ত কি!

যেভাবে নামছি, ওইভাবেই নামতে দিন।
আমি চুপ করে কান ধরে রইলাম। একটু পর উনি আমাকে মেঝেতে নামিয়ে সদর দরজা খুলে দিলেন। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে জঙ্গলের বাহিরে নিয়ে এলেন।

এরপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
~ সামনে আলো জ্বলছে। এবার নিশ্চয়ই যেতে পারবেন।
~ জ্বি পারব।
~ আসুন তাহলে। ফি~ আমানিল্লাহ।
~ আল্লাহ হাফেজ।

কিছুটা এগোতেই আবার পিছন ফিরে উনাকে ডাকলাম, শুনুন। ততক্ষণে উনি সেখান থেকে গায়েব, চারপাশে কোথাও নজরে পড়লনা। হয়ত চলে গেছেন।
আমি আর না দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের ভিটের দিকে হাটা দিলাম। সামনে আলো এসে পড়েছিল বলে আর কোনো অসুবিধা হয়নি।
ভদ্রলোকের বাসার দরজার সামনে আসতেই বোনকে বলতে শুনলাম, আমি জানিনা কিছু! আপনি যে করে হোক আমার বোনকে ওখান থেকে বের করে এনে দিবেন।

আপনার দায়িত্ব এসেছি আমরা, আমার বোনকে ছাড়া আমি এখান থেকে একপা ও নড়বনা।
সব দায়ভার আপনার। যে করেই হোক, আমি আমার বোনকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক অবস্থায় আমার সামনে দেখতে চাই।
ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর শোন যাচ্ছে, আপনি শান্ত হন আফরাহ। সকাল হতে দিন আমরা ওই বাড়ী থেকে আপনার বোনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসব। এতরাতে আর কিছুই করা সম্ভব না।

আমি এক মূহুর্ত দেরী না করে ভেতরে ঢুকলাম। বোন আমাকে দেখে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল। তারপর ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই কোথায় ছিলি মুশু?

ঠিক আছিস তো? তোর কোনো ক্ষতি হয়নি তো!
~ আমি একদম ঠিক আছি বোন।
তুই ঠিক আছিস তো?

~ আমি ঠিক আছি, সামান্য চোট পেয়ে বাহিরে বের হয়ে এসেছি। পিছনে ফিরে দেখি তুই নেই, অনেকবার ডাকলাম সাড়া দিলিনা।
ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম প্রচুর। তুই কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আমার থেকে আলাদা হলি কেন!

~ আসলে আমি চোট পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারপর….. থেমে গেলাম এইটুকু বলে। জ্বীনের কথাটা কি বোনকে বলা ঠিক হবে। বোন বিশ্বাস করবে, আর যদি করেও আমাদের শত্রু ভেবে জ্বীনটাকে কিছু করে বসে।
~ চুপ করে গেলি কেন?

~ না মাবে, তারপর জ্ঞান ফিরতেই বহুকষ্টে পথ চিনে জঙ্গল থেকে বের হতে পারলাম। আল্লাহ আমার সহায় ছিলেন, উনিই আমার হেফাজত করেছেন।
ভদ্রলোক বলল, এসব নিয়ে পরে কথা হবে। আপনারা ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে বিশ্রাম নিন। অনেক ধকল গেছে আপনাদের উপর, আগে শরীর~ মনকে বিশ্রাম দিন।
~ আচ্ছা। চল মুশু, ঘরে যাই।
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে রুমের দিকে চলে গেলাম।

পর্ব ০৬

মাঝরাত শেষ হয়ে আসছে প্রায়, এখনো ঘুম আসছেনা। বার বার শুধু উনার কথা ই মনে পড়ছে। আজ যদি আল্লাহর রহমত হয়ে উনি না আসতেন তাহলে যে কি হত!

আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম না আসায় উঠে জানালার পাশে দাড়ালাম। বোনের দিকে একবার তাকালাম, সারাদিনের ঝড়~ ঝামেলার পর একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

জানালা খুলতেই হু হু করে হালকা বাতাস ঢুকল। জানালা থেকে পোড়াবাড়ীর ছাদ টা দেখার চেষ্টা করলাম। কেন জানি উনাকে বার বার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে!
হঠাৎ মনে হল, পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ঘুরাতে গেলে কেউ বলে উঠল,
~ আমার কথা ভাবছিলেন?

~ কে? বলে ঘাড় ঘুরাতেই কাউকে দেখতে পেলামনা।
~ ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি সেই জ্বীন।

~ আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছিনা কেন? কোথায় আপনি?
~ আমি অদৃশ্য হয়ে আছি তাই দেখতে পাচ্ছেননা।
~ কেন সামনে আসতে ভয় পান বুঝি!

~ তা নয়। এই ঘরে আপনি ছাড়াও অন্য একজন আছেন। তার যদি কোনোভাবে ঘুম ভেঙ্গে যায়, উঠেই যদি আমাকে দেখে নেয় কি হবে বুঝতে পারছেন?
~ বুঝতে পেরেছি। আপনি প্রাসাদ ছেড়ে এখানে আসলেন যে?

~ একটা কথা আছে জানেন তো, যদি কেউ কাউকে খুব বেশী স্মরণ করতে থাকে, সে তার সামনে আসতে বাধ্য।
আমি এই নিয়ম অমান্য করি কি করে?

~ তা কে আপনাকে স্মরণ করছে, যার টানে আপনি চলে আসলেন?

~ নিজের মুখে নিজের নাম নিতে লজ্জা লাগে নাকি আমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে?
~ আমি আপনাকে স্মরণ করেছি ঠিক ই, কিন্তু এত বেশী তো করিনি যাতে আপনাকে আমার সামনে আসতে হয়।
~ আচ্ছা, তাহলে চলেই যাই।

~ আরেহ শুনুন। এসেছেন যখন কিছুক্ষণ থাকতে সমস্যা কি! তাছাড়া আপনার নাম~ পরিচয় ও তো জানা হলনা।
~ আমার পরিচয় আমি একজন জ্বীন। এর বাহিরে আর কোনো পরিচয় নেই, হ্যা তবে একটা নাম আছে।
মেহরাব।
~ কোথায় থাকেন আপনি?

~ আপাতত আপনার পাশেই আছি।

~ আচ্ছা!! বেশ মজা করেন তো আপনি।
আমার নাম জিজ্ঞেস করবেননা?

~ জানি তো। যতটা জানার ততটুকু জেনে নিয়েছি।
~ কি জেনে নিয়েছেন?

মনে হল উনি আমার খুব কাছে এসে দাড়ালেন। তার নিঃশ্বাস আমার চোখে~ নাকে লাগছিল। আমার মধ্যে একরকম ভালোলাগা কাজ করছে।
~ এটাই জানি যে, আপনি খুব ই ভীতু।

অল্পতেই আতঙ্কে কাপুনি উঠে যায় আপনার। বলে অট্টহাসি দিল সে। রাগ লাগলেও তার হাসির শব্দ টা ভীষণ ভালোলাগছিল। মুক্তা ঝরা হাসি সম্ভবত এটাকেই বলে।

হঠাৎ ফজরের আযান পড়ে গেল। উনি হাসি থামিয়ে বলল,
~ আসি তাহলে?
~ আবার কখন আসবেন?

~ আপনি যখন খুব বেশী স্মরণ করবেন। আল্লাহ হাফেজ।
ঘরের মধ্যে থাকা বাতাস বাহিরের দিকে ছুটে গেল। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে মুখ টিপে মুচকি হাসতে লাগলাম। জ্বীন হলে কি হবে এই ছেলেটা একটা পাজির ছড়া।

জানালা বন্ধ করে ফ্রেশ হয়ে নামায পড়তে চলে গেলাম।

সারাদিনটা আমার কেমন কাটত নিজেও বুঝতামনা। অকারণেই বার বার পোড়াবাড়ীটার দিকে তাকাই। ইচ্ছে হয় আরেকবার যাই সেখানে, উনার সাথে দেখা করে আসি।

উনার কথা আর হাসি শুনি।

কিন্তু সেরাতের কথা মনে পড়লে বাড়ীটার দিকে তাকাতেও ভয় লাগে। অনেকক্ষণ জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকার পর টের পেলাম কেউ আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

তবে কি উনি এসেছেন? বেশী বেশী স্মরণ করার কারণে উনি আমার কাছে আবার এসেছেন?
এত্তটা আনন্দ নিয়ে পিছনে তাকানোর পর বোনকে দেখে মনটা ভার হয়ে গেল। বোন আমার এই অবস্থা দেখে বলল,
~ কি হয়েছে তোর?
~ কই কিছু না তো। নিঃশব্দে এভাবে দাড়িয়েছিলি যে!

~ একপলকে জানালার দিকে চেয়ে আছিস কেন? আসার পর থেকে তোকে এত অন্যমনস্ক লাগছে কেন?
সত্য করে বল তো। বলেই আমার বাহু অনেক শক্ত করে চেপে ধরল। আমি বোনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ রাগ উঠল কেন ওর!
~ তেমন কিছুনা। গতকালকের ভয়ংকর ঘটনাগুলো নিয়ে একটু ভাবছিলাম।
~ তুই কি সত্য ই এটা ভাবছিলি?

নাকি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছিস!

~ কিচ্ছু লুকাচ্ছি না বোন। আমার হাতে ব্যথা লাগছে খুব।
~ এখানে এসে তোর অনেক অধঃপতন হয়েছে। আমার কোনো গুরুত্ব ই নেই তোর কাছে, জাস্ট পাত্তা ই দিচ্ছিসনা।
শোন, অতি বাড় বাড়িসনা, ঝড়ে পরে যাবি।

~ আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দে বোন।
সত্যিই আমি হাতে খুব ব্যথা পাচ্ছি।

বোন আমার হাতটা ঝেড়ে ছুড়ে ফেলল। এত্ত জ্বলছিল আর ব্যথা করছিল হাতের উপরের অংশ। জামার হাতা একটু উঠিয়ে দেখিয়ে ওর পাচ নখের~ ই গভীর দাগ বসে গেছে।

ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল অল্প অল্প।
জ্বলুনিটা সহ্য হচ্ছেনা। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে ঢুকে পানি দিয়ে ধুয়ে নিলাম। আয়নার দিকে কান্না পাচ্ছিল খুব, কেন বোন হঠাৎ করে আমার সাথে এত কঠোর হয়ে গেল!

বাবা আমি কি তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলামনা। বোনের সাথে কোনো অন্যায় করে ফেললাম!
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বোনকে খুজতে লাগলাম। ভদ্রলোক আমাকে এভাবে ছুটতে দেখে বলল,
~ আফরাহকে খুজছেন?

~ ও কোথায় গেছে আপনি বলতে পারবেন?

~ হ্যা, বলে তো গেল আমাদের শহরের বাজারে গেল। কিছু দরকারী জিনিসপত্র লাগবে।
যাওয়ার সময় বলল, ফিরতে খানিকটা দেরী হবে।
আপনি চিন্তা করবেননা।

আমি চুপ করে ভাবতে লাগলাম, বোন রাগ করে একা বেরিয়ে গেছে। এখানকার কিছুই তো ও ঠিক করে চিনেনা, যদি কোনো বিপদে পড়ে। আল্লাহ তুমি ওর সহায় থেকো।

~ আপনার কি কিছু লাগবে মুশায়রা?
~ নাহ। কিছু লাগবেনা।

বলে বেরিয়ে দালান থেকে কিছুটা দূরে থাকা পুকুরঘাটের সিড়িতে বসে রইলাম। মনটা ভীষণ ভার হয়ে আছে।
চোখের পানি তো থামছে ই না।
সন্ধ্যা যখন যে নেমে এল সেদিকে কোনো খেয়াল ই নেই আমার। একা একা এখানে বসে থাকতে একটু ভয় লাগছেনা, ভয়~ জড়তা সব যেন মন খারাপের সাথে পালিয়ে গেছে।
ততক্ষণ এভাবে বসে ছিলাম জানিনা।

হঠাৎ পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে ভাবলাম বোন এসেছে।

প্রায় কাদতে কাদতে বললাম,
~ বোন তুই কি এখনো রাগ করে আছিস আমার উপর?

আমার কোনো ভুল হয়ে থাকলে বল আমি তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে শুধরে নিব।
সেই পরিচিত কন্ঠ বলে উঠল, মুশায়রা।
~ আপনি এখানে!!

উনি আর কিছু না বলে আমার গাল বেয়ে পড়া চোখের পানি তার কোমল হাত দিয়ে মুছে দিলেন।
উনার অন্য হাতটা আমার বাহু স্পর্শ করার সাথে সাথে আর্তনাদ করে উঠলাম। উনি অস্থির হয়ে বলল,
~ আমি কি খুব জোরে স্পর্শ করে ফেলেছি?
~ নাহ।
~ তাহলে কি হল? দেখি আপনার হাত দেখি।
~ ও কিছুনাহ। বাদ দিন। মশা কামড়েছিল তাই এমন করলাম।

~ মুশায়রা!! অন্ধকারে উনার চেহারা দেখতে না পেলেও বুঝলাম উনি বড় বড় করে রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি আস্ত একটা ঢোক গিলে জামার হাতা একটু উপরে তুললাম। ভেবেছি অন্ধকারে উনি ক্ষতস্থানটা দেখবেননা।
উনি আমার ক্ষতস্থান টায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
~ নিজের কষ্টটা চেপে রেখে কি লাভ হয়?

উনার কন্ঠটা কেমন ধরে এসেছিল। খানিক বাদেই টের পেলাম আমার ক্ষতস্থানটার উপর বিন্দু বিন্দু পানি পড়ছে।
~ আপনি কাদছেন কেন?
~ অতকিছু আপনি বুঝবেননা।

এটুকু জেনে নিন, আপনি যে প্রশস্ত হৃদয় নিয়ে এসেছেন, তার মর্যাদা দেওয়ার মত খুব কম ই মানুষ পাবেন।
আপনার সরলতা অন্যের কাছে নিতান্ত বোকামীর ন্যায়। সঠিক কদর আর ভালোবাসা আপনি আজো পাননি।

~ এসব কি বলছেন? আপনার ধারণা ভুল। আমাকে সবাই খুব ভালোবাসে, আমার বোনও আমাকে অনেক ভালোবাসে।
আমার কোনো কষ্ট নেই জানেন, খুব সুখে রেখেছেন আল্লাহ আমাকে।
~ আমার চোখে চোখ রেখে বলুন, আপনার কি আসলেই চাপা কষ্ট নেই!

আমি আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলামনা। এতক্ষণের জমানো কান্না যেন এক্ষুণি কেদে দিলাম। কাদতে কাদতে উনার বুকে নিজের মাথাটা ঠেকালাম।
উনি আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
~ ভালো মানুষের মূল্য আর কারো কাছে না থাকলেও, আল্লাহর কাছে নিশ্চয়ই আছে।

উনি অবশ্যই সঠিক প্রতিদান আপনাকে দিবেন।

~ আমার কোনোকিছুতেই কষ্ট নেই জানেন। শুধু একটাই কষ্ট আমার বোনটা আমাকে বুঝেনা। অকারণেই ভুল বুঝে রাগ করে। আমার খুব খারাপ লাগে এবং ভয় ও হয়।
এই বুঝি বাবাকে দেওয়া কথা ভঙ্গ হয়ে গেল।

~ এসব ভাববেননা। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।

উনি আমাকে আরো শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরলেন।

উনার পোশাকের কিছু অংশ আমার চোখের পানিতে ভিজে গেল। এদিকে উনার আর আমার কারোই ভ্রুক্ষেপ নেই।
আমি এক অজানা শান্তিতে লক্ষি মেয়ের মত উনার বুকে মাথা রেখে বসে আছি, উনিও অনবরত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর আমি লজ্জা পেয়ে সরে যেতে নিলে উনার ঠোটজোড়া আমার কপালে লেগে যায়। এই সাধারণ ছোয়াতেই আমি আত্মতৃপ্তি অনুভব করছি।

আমরা দুজনের কারো কাছে এটা কাম্য ছিলনা। তাই দুজনেই সংকোচিত হয়ে দূরে সরে যাই। আমি উঠে চলে আসতে চাইলে উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,
~ চলে যাচ্ছেন?
দুঃখিত এটা আমার ভুলবশত হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।

আমি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলামনা। এতটা সংকোচ এবং লজ্জা অনুভব করছি যে মনে হচ্ছে এখান থেকে পালাতে পারলেই বাচি।
কিন্তু এভাবে চলে গেলে উনি হয়ত মনে কষ্ট পাবেন। তাছাড়া এটা তো আমাদের কারো ইচ্ছেতেই হয়নি, ঘটনাক্রমে সাধারণ ছোয়া লেগে গেছে।
আমি আমতা আমতা করে বললাম,

~ এটার জন্য দুঃখিত বলবেননা। কারো ইচ্ছাক্রমে হয়নি এটা।
~ তাহলে চলে যাচ্ছেন কেন?

~ না আসলে, বোন এসে যদি আমাকে খুজাখুজি করে না পায় তাহলে তো রেগে যাবে ভীষণ।
ভুল বুঝবে আমাকে।

~ আপনার বোন এখনো ফিরেনি। আরেকটু বসে যান, নাহলে আমি ভাবনাতে এটাই আসবে আপনি আমার অনাকাঙ্কিত কাজে রাগ করেছেন।
আমি আবার আগের জায়গায় বসে পড়ে বললাম, না না। সেরকম কিছু নয়।

~ আচ্ছা আপনার কোলে যদি আমি মাথা রাখি আপনি কি খুব রাগ করবেন নাকি মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন?
~ আপনি যদি আমার কোলে মাথা রেখে একটু ভালোলাগা অনুভব করেন তাতে আমি রাগ করব কেন?
রাখবেন?

উনার উত্তরের অপেক্ষা না করে আমি কোল পেতে দিলাম। উনি আলতো করে মাথাটা রাখলেন। এই প্রথম আমি উনার মাথা স্পর্শ করলাম, মাথা ভর্তি মোলায়েম চুল। হালকা সুগন্ধি আসছে চুল থেকে। আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে চুল টেনে দিলাম।
উনার চেহারার দিকে তাকালাম, স্পষ্ট না দেখতে পেলেও বুঝলাম নূরানী চেহারা উনার, লম্বাকৃতির সরু নাক..
উনি নীরবতা ভেঙ্গে বললেন,
~ আমাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?

~ না মানে…. হ্যা, সেরকম ই আর কি।
~ দেখবেন তো অবশ্যই। যেদিন আলোতে দেখা হবে, সেদিন দেখে নিবেন।
~ এখন কেন নয়?

~ এখন যে অন্ধকারে তাই। বলে হাসতে লাগলেন, আমি মুগ্ধ হয়ে উনার হাসি শুনতে লাগলাম।
উনি বললেন, চলুন আপনাকে বাড়ীর সামনে পৌছে দিই।
আপনার বোন হয়ত এক্ষুনি এসে পড়বে।

কেন জানিনা, আমি চাচ্ছিলামনা উনার থেকে দূরে যেতে। ঠায় বসে থাকতে দেখে উনি বললেন,
~ আজো কি কোলে নিতে হবে? চাইলে কিন্তু নিতে পারি, আপনি অতটাও ভারী নাহ। ছোটখাটো আলু~ সবজির বস্তার মত আর কি।
~ মজা নেওয়া হচ্ছে তাইনা!

কোলে উঠার কোনো শখ নেই আমার। চলুন, যাওয়া যাক।

বাড়ীর কিছুটা দূরে উনিয়ামাকে ছেড়ে দিয়ে গায়েব। উনাকে বিদায় দিয়ে রুমে ঢুকার কিছুক্ষণ পর বোন চলে এল।
আমার কাছে এসে বলল,
~ দেখ তোর জন্য কি নিয়ে এসেছি!

~ আমার জন্য টাকা খরচ করে কি আনতে গেলি!!
~ এই ধর, তোর পছন্দের বেলি ফুলের মালা।

অনেকগুলা পছন্দের বেলিফুল পেয়ে সবকিছু ভুলে গেলাম আমি। এত ভালোলাগছিল তখন যে, বোনকে জড়িয়ে ধরলাম।
বোন আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ রাগ করে থাকিসনা মুশু। আমি তো সবসময় তোর ভালোর জন্য বলি। সেসব যদি না শুনিস খারাপ তো লাগেই বল। তখন রাগটা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা।

তখন খুব লেগেছে না? দেখি কতটা আচড় লাগল, ওষুধ লাগিয়ে দিব।
~ লাগেনি বোন। এখন কোনো ব্যথা নেই।

~ তোর কোনো কথা শুনছিনা। দেখা আমাকে, এসব তোর ওষুধ না লাগানোর বাহানা।

বোন জোর করে জামার হাতা উঠিয়ে দেখে, কোনো ক্ষতস্থান নেই। আমিও অবাক হয়ে গেলাম, বিকালেই তো গভীর দাগ গুলো দেখলাম, মেহরাব হাত বুলানোর আগ পর্যন্ত তো ব্যথাও ছিল। বুঝতে আর বাকি রইলনা, এটা উনার ই কাজ।
ভেবেই নিজের অজান্তে মুচকি হাসি চলে গেল ঠোটের কোণে।
ছেলেটা এত ভালো কেন!

পর্ব ০৭

খাওয়া~ দাওয়া সেরে আমি শুয়ে পড়ার আগে দেখি বোন কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
~ কি করছিস এসব নিয়ে? রাত তো অনেক হল, ঘুমাবিনা।

। একটা কিছু না করে তো আমি ফিরবনা।
এর শেষ আমি দেখেই ছাড়ব, সব জ্বীনগুলোকে ওই বাড়ী থেকে তাড়াব। তার ই বন্দোবস্ত করছি।
শুনেই আমার মেহরাবের কথা মনে পড়ল। উনি ও তো সেই পোড়বাড়ীতেই আছেন। বোন অন্য খারাপ জ্বীনদের ক্ষতি করতে গিয়ে উনার কোনো ক্ষতি করে ফেলবে না তো।
বোনকে আমি কি করে আটকাব!

~ তুই এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা ঘুমিয়ে পড়।
আমি কাজ শেষ করেই ঘুমাব।
~ বোন, আমার একটা কথা শোন না।

এসব ঝামেলায় জড়ানোর কোনো দরকার নেই। ওরা অনেক ভয়ংকর, তুই আর এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করিসনা।
বোন আমার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। আমি ওর হাত ধরে বললাম, আমি চাইনা তুই নতুন করে কোনো বিপদে পড়িস। সত্যিই প্রাসাদটা ভীষণ ভয়ংকর।
বোন সজোড়ে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
~ চুপচাপ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।

আর একটা কথা বলবি তো ভীষণ খারাপ হবে। এই মূহুর্তে আমি একা বাসা থেকে বেরিয়ে যাব।
আমি আর কিছু বলতে পারলামনা। মনে মনে মেহরাবকে অনেক বেশী স্মরণ করছি, যাতে উনি একবার হলেও আসেন। আর উনাকে আমি সর্তক করতে পারি।

কিন্তু উনি এলেননা। সারারাত ঘুমাতে পারলামনা, ছটফট করেছি শুধু।

মাঝরাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামায পড়ে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করলাম, আল্লাহ যেন উনাকে রক্ষা করেন।

ফজর নামায শেষ করে বাহিরে বের হতে গিয়ে দেখি বোন বাসার কোথাও নেই। রাতের ঘটনার পর বোনকে আমি আর দেখিনি, কোনো সাড়াশব্দ ও পাইনি।

খুব খারাপ লাগছে। এসব কি হচ্ছে আমার সাথে! এত দুশ্চিন্তা আমি আর নিতে পারছিনা, মাথায় খুব যন্ত্রণা করছে।
ভদ্রলোক কে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, উনিও কিছু বলতে পারলেননা বোনের ব্যাপারে।

আমাকে সান্তনা দিতে লাগলেন। আমার শরীরটা খারাপ হতে লাগল। এমনিতে সারারাত ঘুম হয়নি, তার উপর এতটা মানসিক চাপে আছি।
কোনোরকমে রুমে এসে শুয়ে পড়তেই চোখজোড়া যেন লেগে এল। অনেক চেষ্টাতেও খোলা রাখতে পারলামনা।

চোখ খুলতেই দেখি আমার মাথার কাছে বোন বসে আছে। ধড়পড় করে উঠে বসে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল,
~ এখন তোর শরীর ঠিক আছে তো?

হঠাৎ করে আমার মাথায় রাগ উঠে গেল। সজোড়ে বোনের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
~ কোথায় ছিলি তুই? না বলে এভাবে বের হলি কেন!

তোর এইটুকু বিবেকবোধ নেই, আমি যে টেনশানে থাকব নাকি এটা তুই জানতিস না!
বোন চুপচাপ থেকে বলল,
~ আমি কাজটা সম্পন্ন করতে গিয়েছিলাম এবং সেটা সম্পন্ন করেই এসেছি।

বলে উঠে চলে গেল। একটু পর আমার হিতাহিত জ্ঞান জাগ্রত হল, আমি রাগের বশে বোনের গায়ে হাত তুলে ফেললাম। যে আমি কখনো ওর সাথে উচু গলায় কথা পর্যন্ত বলিনি। আমি এটা কি করে ফেললাম, বোন মনে খুব কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়ই।
বাবাকে দেওয়া ওয়াদা আমি ভেঙ্গে ফেললাম।

তাড়াতাড়ি করে বোনের কাছে গেলাম।

ও জানালার পাশে বসে আনমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি গিয়ে ওর হাত ধরে কেদে কেদে বললাম,
~ বোন আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি ইচ্ছে করে তোকে আঘাত করতে চাইনি, জানিনা আমার কি হয়েছিল!
আমাকে তুই যে শাস্তি দিবি আমি সব মাথা পেতে নিব, তবু তুই আমার উপর রাগ করে থাকিসনা।
~ উঠ, নিচে বসলি কেন!

আমি রাগ করিনি। রাগ করলে উলটা তোকে ঝাড়ি দিতাম।
আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, একটু ঘুমাব।

বোনকে এভাবে কথা বলতে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বোন কখনো এত নরম ভাবে আমার সাথে কথা বলেনি, ওর গায়ে হাত তোলার পর ও এভাবে ক্ষমা করে দিল!

আমি চোখ মুছে বললাম,
~ কিছু খাসনি তো। কিছু খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে।
আমি নিয়ে আসছি, দাড়া।

এমনসময় ভদ্রলোক নাস্তা নিয়ে এসে বললেন,
~ আমি নিয়ে এসেছি, আপনারা নাস্তা করে নিন।
মিস. আফরাহ আপনার শরীর ঠিক তো?
~ হ্যা, ঠিক আছে।

আপনি বসুন, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
~ হ্যা বলুন।

~ আমি আপনার কাজটা করে দিয়েছি। পোড়বাড়ীতে যত জ্বীন ছিল সব বিতাড়িত হয়েছে।
আসলে ওরা অতটাও ভয়ংকর নয়, ওরা সেখানে নিরাপদে থাকার জন্য ভয়ানকভাবে আক্রমণ করে। কাউকে মারতে চায়না। আপনারা এবার নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
~ ধন্যবাদ মিস. আফরাহ।

অসম্ভবটাকে যে আপনি সম্ভব করবেন আমি ভাবতেই পারিনি। আপনাদের বাকি পারিশ্রমিক আপনারা পেয়ে যাবেন। আর আপনাদের দুজনকেই ভীষণ অসুস্থ দেখাচ্ছে, আপনারা আর কয়েকটা দিন এখানে বিশ্রাম নিন।
~ অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

কথাগুলো শুনে বুকের ভিতরটা কেমন হু হু করে উঠল। বোন সব জ্বীন এর চলে যাওয়ার কথা বলল, তাহলে কি মেহরাব ও চলে গিয়েছেন!
উনার সাথে আর কখনো আমার দেখা হবেনা। উনি এখান থেকে একেবারের জন্যই চলে গেছেন।
ভেবেই খুব কান্না পাচ্ছে আমার।

সেইসময় থেকে উনাকে কতবার স্মরণ করলাম, উনি একবারের জন্যও আমার কাছে এলেননা। মনে মনে ভেবে নিলাম, উনি সত্যিই চলে গেছেন৷ আর কখনো আমাদের দেখা হবেনা।

এসব ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে কয়েকফোটা পানি ঝড়ে পড়ল। বোন এসে পাশে দাড়াল আমার।
টের পেয়ে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের পানি মুছে নিলাম।
~ এখানে একা দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছিস?
~ হুম।

~ তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ মুশু?
~ নাহ তো। তোর শরীর ঠিক আছে এখন?

~ হ্যা বেশ আছে। কালকেই আমরা ফিরে যাচ্ছি, আজকেই যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু বাসের টিকেট পেলামনা।
সব গোছগাছ করে নিয়ে নে, কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব।
~ আচ্ছা।
~ চল ঘুমিয়ে পড়বি।

বেশী রাত হলে কাল বাস মিস করব।
~ তুই শুয়ে পড়। আমি গোছগাছ সেরেই ঘুমাচ্ছি।
~ আচ্ছা, আয় তাহলে।

বোন চলে যাওয়ার পর আমার চাপা কান্নাটা আর দমিয়ে রাখতে পারলামনা। কাল এখান থেকে চলে যাব, মেহরাবের সাথে আর কখনো দেখা হবেনা আমার।
এই কয়েকটা দিনের মূহুর্ত গুলো মনে গেথে গেছে, চাইলেও ভুলতে পারছিনা। মেহরাবের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, ইচ্ছে করছে পোড়বাড়ীতে গিয়ে উনার খোজ করি।

কেন জানি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা, উনি এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন।
কিন্তু সত্যটা আমাকে মেনে নিতে হবে। যতই অপেক্ষা করি উনি আর ফিরবেননা।

চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে যখন রুমের দিকে চলে যাব তখন মনে হল পিছন থেকে কেউ আমার হাতটা টেনে ধরল।
অবয়ব দেখেই বুঝতে পারলাম আর কেউ নয়, মেহরাব এসেছেন।

এক ছুটে এসে উনাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করলাম। জানিনা এভাবে কতক্ষণ জড়িয়ে ধরে ছিলাম। উনিও আমাকে জড়িয়ে ধরে শান্তস্বরে বললেন,
~ এভাবে বাচ্চাদের মত কেউ কাদে!

~ আপনি কোথায় ছিলেন এই কয়েকদিন? জানেন কত অপেক্ষা করেছি আমি! কত কষ্ট হয়েছে, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনি এখান থেকে চলে গেলেন কিনা!
~ কেন কষ্ট পেয়েছেন?

~ জানিনা আমি। এটা জানি খুব কষ্ট হয়েছিল।
~ আচ্ছা। এখন কান্না করবেননা, আমি তো এসেছি।
দেখি দেখি।
বলে আমার চোখের পানি মুছে দিলেন।

তারপরও আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলাম।
~ আহা! কাদছেন কেন বোকা মেয়ে?
~ কাল আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।

আর কখনো কি আমাদের দেখা হবে?
~ আপনি চাইলেই হবে।

~ কিভাবে? আমি তো আর এখানে আসতে পারবনা।
~ আমি তো আপনার কাছে যেতে পারব।
~ আপনি সত্যিই আসবেন?

~ আপনি স্মরণ করলে কেন আসবনা! যদি যাওয়ার পরও আমাকে মনে থাকে, স্মরণ করেন অবশ্যই আসব।
এভাবে আর কাদবেননা।

আপনাকে হাসলেই বেশী ভালোলাগে। এখন একটা হাসি দেওয়া যায়?
উনার কথা শুনে আমি হাসলাম। ভিতর থেকে বোনের ডাক এল। আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ আমাকে যেতে হবে। আপনি কিন্তু আপনার কথা ভঙ্গ করবেননা। আল্লাহ হাফেজ।
~ শুনুন।
~ হ্যা বলুন। বেশী দেরী করলে বোন এখানে চলে আসবে।

উনি একটা টকটকে লাল গোলাপ আমার হাতে দিলেন। আর বললেন, এর সৌরভ অবশ্যই আমার উপস্থিতি হয়ে আপনার কাছে থাকবে।
আল্লাহ হাফেজ।

আমি উধাও হওয়া অবধি উনার দিকে অপলকেই তাকিয়ে রইলাম। অস্ফুটস্বরে বললাম, ফি~ আমানিল্লাহ।
ইনশা’আল্লাহ আপনার উপহার আমার কাছে সযত্নেই থাকবে।

পরেরদিন বিকেলের দিকে আমরা বাড়ীতে পৌছে গেলাম। বুড়িমা আমাকে দেখে বললেন,
~ আমার মুশুকে এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

সব ভালোভাবে সমাধা করেই এসেছিস তো? কোনো বিপদ হয়নি তো!
~ না বুড়িমা, সব ঠিক আছে।
রাতে ব্যাগ থেকে পলি মোড়ানো গোলাপটা বের করলাম। এখনো সম্পূর্ণ তাজা রয়েছে এটি, একটা পাপড়িও শুকায়নি।
গোলাপটা ভীষণ টকটকে লাল আর বড়।

এমন গোলাপ আমি আর কখনোই দেখিনি। এর সৌরভটাও ভীষণ সুন্দর আর তীব্র।
মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মেহরাব আপনি কবে আসবেন? আপনাকে খুব মনে পড়ছে। আপনার উপহারটা অনেক যত্নে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি, ইচ্ছে করে আপনাকেও এভাবে সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিই।
এমনসময় বোন আমার রুমে এসে ডাকল, মুশু।

চমকে উঠলাম ডাক শুনে, সাথে সাথে গোলাপটা আমার হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। ভয় লাগছিল, বোন এটা দেখলে কি ভয়ানক কান্ড হবে!
যে ভয়টা পেয়েছি সেটাই হল। বোন গোলাপটা দেখে ফেলল, মেঝে থেকে তুলে নেড়েচেড়ে দেখে বলল,
~ এই গোলাপ তুই কোথায় পেলি?

আমি কি উত্তর দিব বুঝতে পারছিলামনা, খুব ভয় পাচ্ছিলাম। এখন কি বলব আমি! কি মিথ্যা বলব বোনকে!

পর্ব ০৮

বোন আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিস না কেন?
এই ফুল তো কোনো সাধারণ গোলাপ বলে মনে হচ্ছেনা। এত বড় আর সুগন্ধী গোলাপ পৃথিবী থাকতে পারে বলে আমার জানা নেই। সত্যি করে বল, এই গোলাপ তুই কোথায় পেয়েছিস?

আমি কাপা কাপা কন্ঠে বললাম, একজন আমাকে দিয়েছে।
~ কে দিয়েছে?
~ জানিনা ঠিক। আমার বাগানের মাটিতে পড়ে ছিল। দেখে মনে হল, কেউ সযত্নে এটা সেখানে রেখে দিয়েছিল। আমার ভালোলাগল তাই নিয়ে নিজের কাছে রাখলাম।

~ এই ফুল নিজের কাছে রাখার দরকার নেই। হতে পারে কেউ এটা দিয়ে কালোজাদু করে আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করতে চাইছে। চারপাশে তো শত্রুর অভাব নেই।

~ ফুল দিয়ে কে কালোজাদু করবে বোন!
ওটা আমাকে দিয়ে দে, আমি ফেলে দিব।

~ নাহ। এটা আমি আগুনে পুড়িয়ে ফেলব, কেউ যদি কালোজাদু করেও থাকে সেটা বিনষ্ট হয়ে যাবে।
~ না বোন, দয়া করে এটা করিসনা।

~ তুই আমাকে বার বার বাধা দিচ্ছিস কেন বল তো! তোর মতলবটা কী? এমন ভাব করছিস যেন তোকে তোর কাছের কেউ এটা দিয়েছে তাই হাতছাড়া করতে চাচ্ছিসনা।

~ না মানে এমন কিছুই না। ফুলটা আমার খুব ভালো লেগেছে। এমন ফুল আগে কখনোই দেখিনি, সচরাচর পাওয়া যায়না। তাই ভাবলাম এটাকে কোনোভাবে যদি বাগানে রোপন করে গাছ করা যেত।

~ আমি একবার কি বলেছি সেটা কি তোর কানে ঢুকেনি? আজকাল আমার কথার উপর কথা বলা তোর একটা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।
~ বোন তুই আমাকে ভুল বুঝছিস!

~ তোর সাথে ঠিক~ ভুলের হিসেব আমি পরে করছি। আগে এটার একটা ব্যবস্থা করি। খবরদার, এর ব্যাপারে আর একটা কথা বলেছিস তো খুব খারাপ হবে।
বোন গোলাপটা নিয়ে চলে গেল। আমি এখন কি করব বুঝতে পারছিনা। আল্লাহ আপনি আমার সহায় হোন, মেহরাবের দেওয়া এই স্মৃতিটুকু আমি কোনোভাবেই হারাতে চাইনা।

খুব কান্না পাচ্ছে, সামান্য গোলাপটাকে আমি নিজের কাছে সযত্নে রাখতে পারলামনা।
বোন সত্যিই কি গোলাপটা পুড়িয়ে ফেলবে?

ভেবেই এক ছুটে বোনের ঘরের দিকে গেলাম। বোন ছোট ঝুপড়িতে আগুন ধরাচ্ছে, আগুন জ্বালিয়ে ফুলটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। এক্ষুনি আমাকে কিছু একটা করতে হবে। দেরী না করে রান্নাঘরে গেলাম, চুলায় আগুন ধরিয়ে তার উপর আমার গায়ের ওড়নাটা ফেলে দিয়ে আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে লাগলাম।

সাথে সাথে বুড়িমা আর বোন ছুটে চলে এল। বোন আমার গা থেকে কোনোরকমে ওড়নাটা ছুড়ে মেঝে ফেলে সেটার আগুন নেভাল।
বুড়িমাকে বলল আমাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি বুড়িমাকে পানি আনার জন্য পাঠিয়ে সোজা বোনের জ্ঞরে ঢুকলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে, বোন গোলাপটা পুড়াতে পারেনা। সেটা ঘরের মেঝের এক কোণে পড়ে আছে।

তাড়াতাড়ি ওটা কুড়িয়ে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসলাম। খুব সযত্নে লুকিয়ে ফেললাম সবার চোখের আড়ালে।
বোন আমার ঘরে এসে বলল, কোথাও ফোস্কা পড়েছে তোর?

আমি হাতের দিকে তাকিয়ে বললাম, হাতে খানিকটায় পড়েছে।
~ দাড়া মলম লাগিয়ে দিচ্ছি।

বোন ফোস্কা গুলোতে মলম লাগাতে লাগাতে বলল, তুই আমাকে খুব বোকা ভাবিস তাইনা মুশু?
আমি পিলে চমকে উঠে বললাম, মানে!

~ তুই তো ঘরে ছিলিস, হঠাৎ রান্নাঘরে কেন গেলি? আগুনটা লাগল ই বা কি করে! আর তুই আগুন জ্বালিয়েছিস কেন রে?
আমি কুল কুল করে ঘামতে লাগলাম। বোন কি তবে সবটা বুঝে গেছে?

~ মুশু আমি তোর ছোট হতে পারি, কিন্তু ধারণা আর অভিজ্ঞতা তোর চেয়ে অনেক বেশী। কাক যেমন কখনো ময়ূর হতে পারেনা, তেমনি হাজার চালাকি করেও আমার কাছে তুই চালাক হতে পারবিনা। বোকা আছিস, বোকা ই থাকবি।
~ এসব কেন বলছিস বোন?

~ তাহলে তুই এখন রান্নাঘরে কি করছিলি?

~ আমার মাথা খুব ধরেছিল, তাই চা বানাতে গিয়েছিলাম।
তুই তো জানিস মাথা ধরলেই চা খেতেই হয় আমার।
~ জ্বালা কমেছে?
~ হ্যা, কিছুটা।
~ বিশ্রাম নে।

বোনকে দেখে মনে হল, সে আমার কথাটা বিশ্বাস করেনি। আমি যে ওর সাথে কতগুলো মিথ্যা অনবরত বলে চলেছি সেটা ভেবে নিজেই অবাক হয়ে যাই।
গভীররাতে দরজা বন্ধ করে গোলাপটা হাতে নিলাম। এর সুবাসটা আমাকে বড্ড টানে, মনে হয় উনার শরীরের সুগন্ধ এটা। উনি আমার খুব কাছেই আছেন মনে হয়।

বোন তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস, তোর সাথে চালাকি করার জন্য। এছাড়া আমার কাছে কোনো উপায় ছিলনা। আমি কিছুতেই উনার উপহার কাছ ছাড়া করতে পারবনা।

হঠাৎ কেউ দরজায় কড়া নাড়ল। এত রাতে কে এল!
বোন নয় তো!

তাড়াতাড়ি গোলাপটা লুকিয়ে ফেলে দরজা খুলে দেখলাম বোন বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে।
~ বোন তুই এত রাতে?

~ আসতে মানা আছে নাকি!
~ না তা কেন হবে? আয় ভিতরে আয়।
~ তুই ঘুমোসনি এখনো?

~ আসছিলনা, চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম। তোর শরীর ঠিক আছে তো!

~ ঠিক আছে। আমি তোকে একটা কথা বলতে আসলাম। আমি জানি তুই আমার কোনো সিদ্ধান্ত এ আপত্তি করবিনা। তাই তোকে জানানো ছাড়া একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
~ কি সিদ্ধান্ত বোন?

~ তোর বিয়ে ঠিক করেছি আমি। ছেলে আমার পরিচিত একজন। তোকে আর কয়দিন এভাবে রেখে দিব বল! বাবা~ মা থাকলে তোকে বিয়ে দিত, এখন যেহেতু তারা নেই। তোর দেখভালের দায়িত্ব আমার, অতএব আমাকে এসব করতে হবে।
~ বোন তুই এসব কি বলছিস? এটা কিভাবে সম্ভব!
~ কেন সম্ভব নয়?

~ আমার বিয়ে হয়ে গেলে তুই একা হয়ে যাবি, তোর দেখাশুনা করবে কে? আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাবনা।
আর তুই তো একদিন বলেছিলি আমাদের জীবনে বিয়ে~ সম্পর্ক কোনোকিছুই হওয়ার নয়। আমাকে বাবার ফেলে রাখা কাজগুলোতে যুক্ত করবি।
~ এখন আমি ই বলছি, এসব হওয়া খুব প্রয়োজন।

তোর একটা সুন্দর জীবন আছে, সেটা আমি নষ্ট করে দিব আমার কাজগুলোর জন্য। মা~ বাবা থাকলে যা করত, আমিও তাই করছি।
~ আমি তোকে একা ফেলে কোথাও যাবনা।

~ বেশ তো। এই বাড়ীতে থাকবি তুই, ছেলেটা এতীম। বিয়ে করে ছেলের এখানে থাকতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তুই বিয়ে করে ফেলার পর আমিও সেরে নিব ভাবছি। তুই যদি না করতে চাস, আমার পক্ষেও করা সম্ভবনা।
~ কিন্তু বোন….

~ আর কোনো কথা নয়। আমার সিদ্ধান্ত তোকে বলতে এসেছি, তোর মতামত নিতে নয়।
আগামী মাসের শুরুতে তোর বিয়েটা হচ্ছে।

বোন আমার আর কোনো কথা না শুনে চলে গেল। আমি মেহরাব ছাড়া অন্য কোনো ছেলের কথা মনেই আনতে পারছিনা, সেখানে বিয়ে তো দূরের কথা।
আল্লাহ আপনি আমাকে পথ দেখান, বলুন আমি কি করব!
বোন হঠাৎ এমন কেন করছে আমার সাথে!

কেউ নিঃশব্দে এসে আমার কাধে হাত রাখল। পিছনে ফিরে দেখি মেহরাব দাঁড়িয়ে আছে। আমি উনার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
~ বোন আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। আমি বিয়ে করতে চাইনা, আমি আপনাকে ছাড়া আর কোনো পুরুষের কথা ই মনে আনতে পারছিনা।
আপনি আমাকে বলে দিন, আমি কি করব? নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে।
~ বিয়ে করবেন আমাকে?

মেহরাবের কথা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম।
~ সেটা কি কখনো সম্ভব?

~ চাইলেই সম্ভব। কিন্তু এর জন্য একটা শর্ত আছে।
~ কি শর্ত?

~ আপনাকে আপনার পরিবার ত্যাগ করে আমার সাথে জ্বীনরাজ্যে যেতে হবে। আর সেখানেই আমাদের বিয়ে হবে। সেখানে যা কিছু হোক, বা ঘটুক আপনি তার ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবেননা।
চুপচাপ সব মেনে নিতে হবে।

যেহেতু আপনার আমার পৃথিবী~ সত্তা~ পরিচিতি সব ই আলাদা। সবকিছু মেনে নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে হবে, নতুবা আমাদের আর দেখা হবেনা কখনোই।
~ আপনি এভাবে বলছেন কেন?

~ জ্বীন হিসেবে আপনাদের নিকটে আসা আমাদের বারণ। আমার উপর আদেশ এসেছে, আপনার সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার। জ্বীনজাতির আদেশ আমি অমান্য করলে তার ফলাফল খুব ভয়ানক হবে।
আমার ও কিছু করার নেই।

আমিও আপনাকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিনা। যদি আমরা এক হতে চাই তবে এই একটা রাস্তা ই খোলা আছে, সেটা হল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া।
সেটা না হলে আর কখনোই আমি আপনার কাছে আসতে পারবনা। এখন আপনি কি পারবেন আপনার পরিবার ছেড়ে আমার মত অন্য জগতের একটা জ্বীনের সাথে চলে যেতে?

আমি চুপ করে রইলাম। বোনকে ছেড়ে আমি কি করে উনার হাত ধরে চলে যাব! এটা তো বোনের সাথে আমার নিজস্ব সত্তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
বাবাকে দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করে কি করে আমি উনার সাথে যাব! আর জ্বীনরাজ্যে আমার মত মানুষের ই বা ঠাই হবে কি করে। সবকিছু গোজামিল লাগছে আমার কাছে।

এটা কি আদৌ সম্ভব আমার পক্ষে! আল্লাহ আপনি কি এই কেমন গোলকধাধায় ফেললেন।
একদিকে আমার বোন আর বাবাকে দেওয়া ওয়াদা, অন্যদিকে আমার ভালোলাগা~ ভালোবাসা। কোনটাকে আমি বিসর্জন দেব? নিজের পরিবার নাকি নিজের ভালোবাসা?

~ মুশায়রা! আপনি কি কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে পেরেছেন?
~ মেহরাব, আমি বুঝতে পারছিনা আমি কি করব! আমি আমার রক্তের সাথে কিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করব? ওয়াদা~ দায়িত্ব অস্বীকার করে আপনার হাত ধরা উচিত হবে আমার!
~ বুঝতে পারলাম।

জ্বীনজাতি আর মানুষের মধ্যে মিলন আসলেই সম্ভব না। আমার সাথে আপনার এটাই শেষ দেখা।
আল্লাহ হাফেজ। ভালো থাকবেন।
~ মেহরাব…..
কিছু বলার আগে উনি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। আমাদের মধ্যকার ভালোবাসার হয়ত এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটল। জাতির বিভেদ আমাদেরকে চিরদিনের মত আলাদা করে দিল।

সব ভুলে আমাকে এই নির্মম সত্যটাই মেনে নিতে হবে! বিভেদ আর বাস্তবতার কাছে আমাদের অনুভূতি~ ভালোবাসা এতটাই ঠুনকো?
আর কখনোই আমাদের দেখা হবেনা মেহরাব! আপনি পারবেন আমাকে ভুলে যেতে? চিরদিনের জন্য!!

ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুমে ঢুকে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলাম। চার দেয়ালের মাঝেই আমাকে সব কবর দিতে হবে আজীবনের জন্য।
ভুলে যেতে হবে কোনো জ্বীনকে আমি ভালোবেসেছিলাম, মেনে নিতে হবে কঠিন নিয়তি যার গোলকধাঁধায় আমি~ মেহরাব দুজনেই বন্দি।

পর্ব ০৯

সারারাত ভেবেও কোনো কুল~ কিনারা পেলামনা। আমার কি এটা করা সত্যিই উচিত হয়েছে! এইসময় নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। ভালোলাগছে না কিছুই।
ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাদতে। দরজা খুলে বাহিরে চলে গেলাম একটু মন খুলে কাদব বলে। নিজের মধ্যে এসব যন্ত্রণা আর ধরে রাখতে পারছিনা।
হাটতে হাটতে ছোট্ট পুকুরের ঘাটে এসে বসলাম।

আজকের চাঁদটায় কোনো উজ্জ্বল আলো নেই, ক্ষীণ আলোতে সবকিছু আরো অন্ধকার লাগছে। মেহরাবের সাথে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি মনে পড়ছে। কত তাড়াতাড়ি আপন হয়ে গিয়েছিল, আবার কত দ্রুত ই না দূরে চলে গেল। হঠাৎ পুকুরের অপর পাড় থেকে কারো পানিতে নামার শব্দ পেলাম। পদ্মফুলের কলি আর পাতাগুলো কেমন জানি নড়ে উঠল, মাছগুলো খুব তড়পাচ্ছে মনে হল।
ধ্যান ভঙ্গ করে চিৎকার করে উঠলাম, কে ওখানে?

সাথে সাথে শব্দ থেমে গেল। কেউ পিছন থেকে আমার গলাটা শক্ত করে চেপে ধরল। আমি বারবার ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম, আর চিৎকার করছিলাম। কানে ফিসফিস আওয়াজ এল মিনমিনে গলার, একদম শব্দ করবিনা। তাহলে কিন্তু ছাড়বনা।

~ কে আপনি? এত রাতে এখানে কি করছেন? এত বড় সাহস হয় কি করে আপনার! কথাগুলো শুনে খ্যাক খ্যাক করে একটা বিশ্রী হাসি দিল।
~ আমি আসব না তো কে আসবে!

আহ, তোর চুলের আর শরীরের ঘ্রাণ আমায় বড্ড টানে। তোর এতটা কাছে আসার কত চেষ্টা ই না করেছি আমি। আজ তুই নিজেই আমাকে সুযোগ করে দিলি।

এইবার ও সে তার বিশ্রী হাসিটা হাসল। তার গায়ে থেকে প্রচন্ড আশটে গন্ধ আসছে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে তার হাতের চাপে।
~ কেউ আমার কিচ্ছু করতে পারবেনা। কেউ না…..
~ ছাড়ুন বলছি। বোন… বুড়িমা…

এত জোরে জোরে চিৎকার করছি কিন্তু কেউ মনে হয় শুনতেই পাচ্ছেনা। এমন সময় হাতটা নিজে থেকে আমার গলা ছেড়ে দিল, ছায়ামানবটা ছুড়ে পড়ল পুকুরে। দেখে আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল।

মেহরাব ফিরে এসেছে! মেহরাব একদৃষ্টিতে পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব জোরে শ্বাস নিচ্ছে, মনে হচ্ছে প্রচন্ড রেগে আছে সে।
পুকুর থেকে সে ছায়ামানব টা এক লাফে উঠে আসল। আর খুব বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল। মেহরাব হাতে কিছুটা মাটি নিয়ে কি জানি পড়ে তার দিকে ছুড়ে মারল। সাথে সাথে ছায়ামানব টা আর্তনাদ করে গায়েব হয়ে গেল।

মেহরাব এসে আমার সামনে দাড়াল, জানি কিসের বশে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, মেহরাব, আমি আপনার সাথে যেতে চাই। দয়া করে আমাকে নিয়ে চলুন।

আমি আপনার সব শর্তে রাজি, সব মেনে চলব। তাও আপনি আমাকে একা করে যাবেননা। নিয়ে চলুন আপনার সাথে।
মেহরাব শুধু একটা কথা ই বলল, কথার নড়চড় করবেননা। আর হ্যা, ওই জগত আপনার জন্য মোটেও সহজ হবেনা।
খুব কঠিন হবে ওখানে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে আপনার।
~ সব পারব আমি ইনশা’আল্লাহ।

শুধু আপনি আমার পাশে থাকবেন।

~ ঠিক আছে, কাল রাতে আমি আপনাকে এসে নিয়ে যাব। তৈরী থাকবেন।
এখন বাসায় যান, এখানে আপনার থাকাটা নিরাপদ নয়।

মেহরাবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুমে চলে এলাম। এখন শুধু কিভাবে জ্বীনজগতে নিজেকে টিকিয়ে রাখব। এটা একদম ই সহজ হবেনা আমার জন্য, সেটা বুঝতে পারছি।

সারাদিন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। কোনো রকম উদ্বেগ বা অস্বাভাবিক দুশ্চিন্তা না করতে চাইলামনা, বোনের চোখকে ফাকি দেওয়া বড্ড কঠিন। ও যদি একবার বুঝে ফেলে মেহরাবকে তো হারাব ই, সেই সাথে আমার বিয়ের দিন এগিয়ে আসবে।
বোনকে চা দিয়ে আসার সময় সে আমাকে ডাকল।
~ কিছু বলবি বোন?

~ হুম বলব। তুই কি কোনোভাবে আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিস? সকাল থেকে লক্ষ করলাম, তুই আমার সামনে খুব একটা আসছিস না, দুই~ তিন ডাকলে তবে একবার আসিস। কি হয়েছে তোর?
~ কই তেমন কিছুই না।

~ শোন, এসব রাগ~ অভিমান যতই করিস। বিয়েটা আমি দিব ই। অতএব, নিজেকে তৈরী কর। সব মেনে নিতে শিখ, আমি তো তোকে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছিনা। আর মেরেও ফেলছিনা।

বুড়িমা, আপনি তো একটু বুঝাতে পারেন। সংসার জীবনে সবার ই যেতে হয়, আজীবন এভাবে থাকবে কি করে ও। দয়া করে, আপনি একটু ভালো করে বলে দিন, আমি যা করছি মুশুর ভালোর জন্যই।
বলে বোন বাহিরে চলে গেল।

বুড়িমা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমি তোকে এসব নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। আমি জানি তুই আজীবন তোর বোনের মতকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছিস। সেটা তোর জন্য কতটা ভালো হয়েছে সেটা তুই ই ভালো জানিস।
শুধু এইটুকুই বলব, এইবার নিজের মনের কথা শোন। যেটা তোর মনে আছে সেটাকে চেপে রেখে সবকিছু মেনে নিসনা।
অনেক হয়েছে মুশু, এবার অন্তত নিজের ভালোটা নিজে বুঝতে শিখ।

নিজের জীবনে অন্য কারো হস্তক্ষেপ আর কত বল! যা করবি ভেবে চিনতে ই করিস। আল্লাহ তোর সহায় হোক।

বুড়িমার কথা শুনে অনেকটা জোর পেলাম। মনে হচ্ছিল, আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা ভুল নয়। এবার মন যেটা বলে সেটাই শুনব।
বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম, ১২টার উপরে বাজতে চলল। এখনো মেহরাব এলনা, তবে কি উনি আজ আসবেন না? নিজের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে গেল না তো উনি!

ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে টের পেলামনা। উনি আমাকে ডাকলেন, মুশায়রা।
আমি ধড়পড়িয়ে উঠে চারিদিকে তাকালাম কোথাও উনি নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
~ কোথায় আপনি? আপনাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিনা কেন?
~ আমি আয়নার ভিতরেই আছি।

~ আয়নার ভিতরে! আপনি বেরিয়ে আসছেননা কেন? আমাকে আপনার সাথে নিবেন কি করে!
~ আপনি আমার সাথে আসতে পারবেননা। আপনাকে একাই জ্বীনজগতে আসতে হবে।
~ আমি একা চিনব কি করে? আর জ্বীনরাজ্যে আমাকে ঢুকতেই দিবে বা কেন?

~ আমি আপনাকে যেভাবে বলছি সেভাবে আসুন। এটা আপনার জন্য ১ম এবং কঠিন এক পরীক্ষা। জ্বীনরাজ্যে যদি একবার ঢুকতে পারেন, কেউ আপনাকে কিচ্ছু বলতে পারবেনা।
~ আমি কি করে যাব?

~ একটু বাদেই আয়নায় একটা তীক্ষ্ণ রেখা ফুটে উঠবে, সেটায় বিসমিল্লাহ বলে আঙ্গুল রাখার সাথে সাথে আপনি আয়নাজগতে প্রবেশ করতে পারবেন।
এর জন্য আপনাকে সময় দেওয়া হবে মাত্র ১২ সেকেন্ড। এর মধ্যে না পারলে আর কখনোই আপনি ঢুকতে পারবেননা।
তারপরের গুলো আপনাকে আমি সময় করে বলে দিব।
আর একটা কথা, যতই যা হোক, পিছনে তাকাবেননা।

মেহরাবের কথা শেষ হতেই আমার দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। বাহিরে থেকে বোনের গলা শুনলাম, মুশু, দরজাটা খোল। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।

আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম লাল রঙ্গের রেখা ফুটে উঠেছে। এদিকে বোন ও খুব জোরে জোরে কড়া নাড়ছে, ওর হয়ত খুব বেশী জরুরী আমার সাথে কথা বলাটা।
দরজা খুলব নাকি রেখায় হাত রাখব বুঝতে পারছিলামনা।

বোন এত জোরে ধাক্কাচ্ছে যে মনে হচ্ছে দরজাটাই ভেঙ্গে ফেলবে।

হাতে সময় ও বেশী নেই, এক্ষুনি রেখাটায় আঙ্গুল না রাখতে না পারলে আমি আর আয়নাজগতে প্রবেশ করতে পারবনা। বোন বাহিরে থেকে চিৎকার করছে,
~ মুশু কোথায় তুই? এতজোরে ধাক্কাচ্ছি শুনতে পাচ্ছিসনা! তুই দরজা খুলবি নাকি আমি দরজাটা ভাঙ্গব! আমাকে যদি দরজা ভাঙ্গতে হয় তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে।

কয়েকবার জোরে ধাক্কা দেওয়ার সাথে সাথে দরজাটার ছিটকানিটা ভেঙ্গে গেল। বোন সাথে সাথে আমার রুমে ঢুকে পড়ল।

পর্ব ১০

আঙ্গুল রাখার সাথে সাথে কি যেন আমাকে টেনে আয়নার ভিতরের দিকে নিয়ে গেল, তখন মনে হচ্ছিল আয়নাটা এক ধরণের পাতলা পর্দা। যাই হোক, ভিতরে প্রবেশ করার সাথে তীব্র আলোর ঝলকানি আমার চোখে লাগল।

তাকাতেই পারছিলামনা। একটু বাদে আস্তে আস্তে আলো ক্ষীণ হয়ে উঠল। ভালো করে চারপাশটা তাকিয়ে দেখলাম, চারদিকে ছোট~ বড় আয়না দেয়ালে গেথে আছে। মেঝেটা পর্যন্ত স্বচ্ছ আয়না। মনে হচ্ছে এটা কোনো আয়নাঘর। এখন আমি কি করব ঠিক বুঝতে পারছিনা।
মেহরাবের পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করব নাকি নিজেই সামনের দিকে এগিয়ে যাব!

পরক্ষণেই ভাবলাম, না উনার নির্দেশ ছাড়া এক পা ও এগোনো ঠিক হবেনা। উনি আমাকে যেহেতু বারবার সর্তক করেছে, সেহেতু এখানে কোনো না কোনো বিপদ ঠিক~ ই আছে। এমনসময় মেহরাবের ক্ষীণ কন্ঠ শুনতে পেলাম, কথাগুলো এত অস্পষ্ট ভাবে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল যে আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে।
তাও মনোযোগ শোনার চেষ্টা করলাম। অস্পষ্ট ভাবে যা শুনতে পেলাম তা হচ্ছে, খুব সাবধানে বুঝেশুনে পা ফেলবেন। এখানের শেষ সীমানায় দুটো দরজা দেখবেন, বুদ্ধি~ বিবেচনা করে বেছে নিবেন সঠিক দরজাটা।
এরপর আর উনার কন্ঠস্বর শুনতে পেলামনা।

আল্লাহর নাম নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। তার আগে গায়ের ওড়না দিয়ে চোখ~ মুখ ভালো করে ঢেকে নিলাম।
যত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই ক্ষীণ আলো প্রখর হচ্ছে। চোখ ঝলসে যাওয়ার মত অবস্থা। আগে থেকে চোখ ঢেকে ভালো ই করেছি, নতুবা চোখ ঝলসে যেত। যদিও হাটতে একটু কষ্ট হচ্ছে।

অনেকটা আসার পর আলোর ঝলকানি কমে এল। দেখা গেল দুটি দরজা। একটা খুব ই সুন্দর এবং পরিষ্কার , আরেকটা খুব ই জীর্ণ~ জায়গায় জায়গায় দাগ এবং শ্যাওলায় ভর্তি। দুটোর উপরেই আরবিতে লেখা আছে, এখানে প্রবেশ করো। কনফিউজড হয়ে গেলাম কোনটায় ঢুকব! বাহিরে থেকে বোঝার উপায় নেই কোনটা কেমন। একবার ভাবলাম, জ্বীনরাজ্য হয়ত অনেক সুন্দর হবে অতএব সুন্দর দরজাটার পিছনেই জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার পথ থাকতে পারে। এই ভেবেই যেই দরজা খুলতে যাব, অন্য একটা চিন্তা মাথায় এল। উপরের আরবি লেখাটার দিকে তাকালাম। দুটো মিলানোর চেষ্টা করলাম, সুন্দর দরজাটার উপরের লেখাটায় ভুল রয়েছে।

আর বুঝতে বাকি রইলনা, কোনটায় প্রবেশ করা ঠিক হবে আমার পক্ষে।

আল্লাহর নাম দরজাটা খুলে প্রবেশ করতেই ঝাকে ঝাকে বাদুর এসে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ক্রমান্বয়ে খামচি দিতে লাগল আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে। ওড়নাটা ঝেড়ে ঝেড়ে তাড়াতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু কাজ হচ্ছেনা। একটাকে তাড়ালে আরো তিনটা এসে ঘিরে ধরছে। উপায়ান্তর না দেখে সামনের দিকে ছুটতে লাগলাম। এরা কিছুইতেই পিছু ছাড়ছেনা, ছুটতে ছুটতে খোলা প্রান্তরে চলে এলাম। এখানে ঘাসের ডগায় ডগায় বড় বড় জোকের দল আস্তানা গেড়ে আছে।

কি এক উভয়সংকটে পড়লাম! পিছনে বাদুর আর সামনে জোক। আমি কি ভুল দরজায় প্রবেশ করেছি! সেটা কি করে হয়! আল্লাহ আপনি আমার সহায় হন। বাদুর গুলো তেড়ে আসছে। দুটো রাস্তা আমার জন্য খোলা আছে। হয়ত পিছু হটে বাদুরের সাথে লড়াই করা নতুবা জোকভর্তি খোলা মাঠে নেমে যাওয়া। কোনোটাতেই বাচার উপায় নেই। বাদুরের ঝাক যেভাবে তেড়ে আসছে আমি কিছুতেই এদের সাথে পারবনা। জোকে ধরলেও সেটাকে পড়ে ছাড়ানো যাবে হয়তবা।
আর দেরী না করে খোলা মাঠে নেমে গেলাম। জোকগুলো যেন আমার নামার অপেক্ষা করছিল। চারদিক থেকে ঘিরে ধরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। পিছন তাকিয়ে দেখলাম বাদুরগুলো সব একলাইনে বসে আছে আমার অপেক্ষায়।
কি করব মাথায় ধরছেনা!

নাহ থামলে চলবেনা, হয়ত জানে বাচব নয়ত এদের হাতেই মরব। যা থাকে কপালে, আল্লাহ রক্ষা করুন। সামনে দিকে এগিয়ে যাচ্ছি জোকগুলোকে পা দিয়ে সরাতে সরাতে। দু~ একটা কামড় ইতিমধ্যে পায়ে পড়ে গেছে, এত যন্ত্রণা হচ্ছে। তাও থামছিনা, জোরে জোরে পা চালিয়ে খোলা প্রান্তর পেরিয়ে উচু ঢালুতে উঠে বসলাম। পা থেকে রক্ত বের হচ্ছে, দু~ একটা জোক এখনো কামড়ে ধরে আছে। ব্যথায় দাতে দাত চেপে আছি।

চারিদিকে তাকিয়ে দেখি এখানে অসংখ্য কাটাগাছ রয়েছে। কয়েকটা ভাঙ্গা ডাল জড়ো করে নিয়ে জোকের পেটের ধরে সজোড়ে টান দিলাম। মূহুর্তে দ্বিখন্ডিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল জোকগুলো। রক্ত পড়া জায়গাগুলোতে মাটি লাগিয়ে ওড়নার টুকরো দিয়ে বেধে নিলাম।

এখানেই লক্ষ্যে পৌছার লড়াই শেষ হয়নি বলে ধারণা করছি। এবার কোনদিকে যাব বুঝতে পারছিনা, এটাও নিশ্চিত হতে পারছিনা আদৌ আমি সঠিক পথে এসেছি নাকি! এতক্ষণে মেহরাবের সাথে আমার একবারো যোগাযোগ হয়নি, উনি কি আমার অবস্থান সম্পর্কে অবগত নন! তবে কি আমার জ্বীনরাজ্যে যাওয়া হবেনা!

এসব ভাবতে ভাবতে হেটে চলেছি কাটাগাছ গুলো কোনোরকমে সরিয়ে। নিজের পুরো শরীরকে ক্ষত~ বিক্ষত লাশ মনে হচ্ছে।
ব্যথায় হাটার জোর ও পাচ্ছিনা, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অদূরে একটা ঝর্ণা দেখতে পেয়ে বেশ খুশি ই হলাম।
ঝর্ণার কাছে এসে যেই এর পানি পান করতে গেলাম, প্রচন্ড তান্ডবে সবকিছু কাপতে লাগল। বেশ ভয় পেয়ে গেলাম, আবার কোন বিপদ ডেকে আনলাম আমি!

ঝর্ণার পানির ভিতর থেকে বেশ বড় বড় পা ফেলে এক থুড়থুড়ে অদ্ভুত চেহারার বুড়ি আমার সামনে এসে দাড়াল।
এর গায়ে সাদা কাপড় এলোমেলো ভাবে পেচানো।

চেহারায় বেশ রাগ রাগ ভাব, শরীর এত্তটাই পাতলা যে বাতাসের সাথে মিশে যেতে পারবে।
রাগান্বিত কন্ঠে বলল, তুই কে? এত বড় সাহস তোর কি করে হয় যে তুই আমার পানি স্পর্শ করিস।
~ ভুল মার্জনা করবেন বুড়িমা।

আমি ইচ্ছে করে করিনি, তেষ্টায় বড্ড কাহিল হয়ে এসেছিলাম। নিষেধাজ্ঞা আছে জানলে আমি স্পর্শ করতামনা।
বুড়ি আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল,
~ তুই কে? এখানে কিভাবে এলি!

~ আমি একজন মনুষ্যকন্যা, নাম মুশায়রা। আমি জ্বীনরাজ্যের উদ্দেশ্যে এসেছি।
বুড়ি বিকট শব্দে হেসে উঠে বলল,

~ মানুষ হয়ে জ্বীনরাজ্যে যেতে চাস? নিজের মৃত্যু ডেকে আনার খুব শখ হয়েছে। জানিস এর ফল কি হতে পারে!
~ জানি বুড়িমা। কিন্তু নিজের ভালোবাসার জন্য সব করতে রাজি আমি।

~ জ্বীন আর মানুষের মিলন কখনোই সম্ভব না জেনেও এখানে এসেছিস! এক ধাপে না হয় বেচে গেলি কিন্তু কয়বার বেচে ফিরবি এভাবে!
~ জীবন~ মরণ আল্লাহর হাতে। তার ভরসায় আমার এতদূর আসা। আপনি আমাকে বলতে পারবেন আমি সঠিক রাস্তায় এসেছি কিনা!
বুড়ি একটু নরম হয়ে বলল,

~ হুম, সঠিক রাস্তায় ই এসেছিস। তোর মনের জোর অনেক বেশী বটে।
~ আমি বুঝতে পারছিনা আমি কোনদিকে কিভাবে এগোবো! অসহায় হয়ে পড়েছি বড্ড।
~ আমি তোকে জ্বীনরাজ্যে পৌছানোর পথ দেখিয়ে দিতে পারি।
~ সত্যিই দেখাবেন বুড়িমা!

~ হুম, তবে এর বিনিময়ে আমার কিছু প্রাপ্য রয়েছে।

~ কি প্রাপ্য চান আপনি? আমার কাছে তো কিছুই নেই, তবে আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই দিব।
~ ঠিক আছে। আমি সময়মত ঠিক চেয়ে নিব।
নিজের অঙ্গীকার ভুলে যাস না কিন্তু।

~ না বুড়িমা। কথা দিচ্ছি আপনাকে, আপনি যা চান আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনাকে সেটা দেওয়ার।
বুড়িমা তার হাসি প্রসারিত করে পথ দেখিয়ে দিলেন। বুড়িমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার হাটতে লাগলাম। হাটতে হাটতে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সংকীর্ণ গুহাতে ঢুকে পড়লাম। কোনোরকম হাতড়ে হাতড়ে পথ চলছি, এমন সময় পিছন থেকে বোনের গলায় ডাক এল, “মুশু”
জবাব দিয়ে যেই পিছনে ফিরতে যাব মেহরাবের সর্তকবাণী মনে পড়ে গেল।

কোনোভাবেই পিছনে তাকানো যাবেনা। মনে হচ্ছে কেউ আমার পিছু পিছু আসছে, চারপাশ থেকে বিশ্রী গন্ধ আর হাড় চিবানোর শব্দ আসছে।
ভয় লাগছে খুব, খুব ভয়ংকর গলায় আমার নাম ধরে ডাকছে কেউ। দেয়ালে হাতড়ে হাতড়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ কিছু একটা হাতে উঠে এল। স্বল্প আলোয় দেখলাম এটা একটা কাটা মাথা, যার চোখ গুলো ঠেলে বের হয়ে এসেছে সাথে জিহবা ঝুলে পড়েছে। চিৎকার দিয়ে সেটা ফেলে দৌড়াতে লাগলাম।
ভয়ে প্রায় আধমরা হয়ে গেছি, পদে পদে হোচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছি। তাও উঠে ছুটে চলেছি। ভয়ংকর শব্দ গুলো আমার পিছু পিছু আসছে। অনেকটা দৌড়ে একটা আলোকিত জায়গায় এলাম। এখানে চারিদিকে মশাল জ্বলছে, সামনে বিশাল একটা দরজা। তাতে চোখ ধাধানো সজ্জা।
সম্ভবত এটাই জ্বীনরাজ্যের প্রবেশদ্বার।

উপরে আরবিতে কিছু লেখা আছে। যার অর্থ আমার ঠিক জানা নেই। কিন্তু আমি এই দরজা দিয়ে ঢুকব কি করে! কয়েকবার ধাক্কা দিলাম দরজায়। কোনোভাবেই খুললনা।

বিকট হাসির শব্দ শুনে পিছনে তাকালাম, অনেক গুলো ভয়ংকর কাটা মাথা লাফাতে লাফাতে আমার দিকে তেড়ে আসছে। একটা একটার চেয়েও বিভৎস দেখতে।

এখন দরজা না খুললে আমি এদের হাতেই মারা পড়ব। আরো কয়েকবার দরজা ধাক্কালাম, কিন্তু কোনো লাভ হলনা।
উপায়ান্তর না দেখে আল্লাহর নাম জপতে লাগলাম। বুড়িমার বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে ঢুকতে হলে সেখানকার সম্পর্কিত আয়াত তোকে জানা লাগবে। কিন্তু কোনো আয়াত বা কি সেটা আমাকে বিস্তারিত বলেননি।

এখন আমি কি করব! কোনো সূরা বা কোন আয়াত পড়ব।
কিছুটা সময় ভেবেও কিছু ঠাহর করতে পারলামনা।

হঠাৎ আল্লাহর রহমতে আমার মাথায় একটা ধারণা এল, এটা যেহেতু জ্বীনরাজ্য, জ্বীনের জগৎ এটার সম্পর্কিত কেবল সূরা জ্বীন ই আছে। ঝটপট সূরা জ্বীন এর প্রথম কয়েকটি আয়াত পড়তে হাট করে দ্বার খুলে গেল। চারিদিক থেকে সূরা তিলওয়াত কানে আসতে লাগল যা শুনে কাটা মাথা গুলো পালিয়ে গেল। আল্লাহর নাম নিয়ে নির্বিঘ্নে দ্বারের ভিতর প্রবেশ করলাম।
অবশেষে আমি সক্ষম হলাম জ্বীনরাজ্যে ঢুকতে।
কিন্তু মেহরাব কোথায় আছেন?

পর্ব ১১

মেহরাব কি এখনো জানতে পারেননি আমি জ্বীনরাজ্যে ঢুকে গেছি। ভাবতে ভাবতে আনমনে সামনে হাটতে লাগলাম, হঠাৎ গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। খেয়াল করলাম, চারিদিকটা ভীষণ সুন্দর। যেন আরেকটা পৃথিবী, এখানকার পরিবেশ আমাদের চেয়েও চমৎকার আর মনোরম। চারিদিকে অজস্র ছোট~ বড় গাছপালা, এক দিকে বিশাল ঝর্ণা এবং জলাশয়। গাছগুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে, ফলে নুয়ে পড়েছে। পায়ের নিচে অতি সবুজ নরম ঘাস, প্রতিটা গাছের গুড়িতে বেয়ে উঠেছে আঙ্গুর গাছ। সেখানে ঝুলে আছে থোকা থোকা আঙ্গুর। এসব দেখে ক্ষিধে পেয়ে গেল। কিন্তু এইসময় খাওয়া দাওয়া বিপদজনক হতে পারে, আর খুব উদ্বিগ্ন আমি। মেহবারের খোজ কেন এখনো পাচ্ছিনা!

জ্বীনরাজ্যে ঢুকতে পেরে যতটা আনন্দিত, ততটাই শঙ্কিত আমি। না জানি কখন কোন জ্বীন এসে আমার উপর হামলা করে, এখানে কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা। মনে হচ্ছে এ যেন কোনো ঘুমন্ত রাজ্য। প্রায় কিছুটা আসার পর কিছু মেয়েদের দেখলাম একত্রে জড়ো হয়ে কথা বলছে। তাদের কথার ভাষা ঠিক বুঝতে পারছিনা।

খুব অস্বস্তি আর ভয় কাজ করছে। এদের সাথে আমি কথা বলব কিভাবে! এরা জ্বীন আর আমি মানুষ। আমাকে দেখে এরা হামলা করবে নাতো আবার, নাকি তিরস্কার করবে!! মেহরাব আপনি কোথায়? এ কেমন পরিহাস করছেন আমার সাথে!

চুপ করে ওদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছি। মেহরাবের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে, এত পথে একটা বার ও যোগাযোগ করলনা। এখন জ্বীনরাজ্যে ঢুকার পর ও উনি লাপাত্তা। উনি ভালো করেই জানেন, আমি এখানে এলে উনাকে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন হবে। তাও এলেননা!
হঠাৎ খেয়াল করলাম মেয়েদের দল থেকে একজন সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
এসেই বলল, আপনি মুশায়রা?

আমি আস্তে করে জ্বী বলে তার দিকে ভালো করে তাকালাম। অবিকল মানুষের মতই দেখতে, বাহিরে থেকে কেউ তাদের পার্থক্য করতে পারবেনা সে মানুষ নাকি জ্বীন!

ছোট্ট থেকে জ্বীনদের ভয়ানক রুপের গল্প শুনে এসেছি কিন্তু এখন সামনাসামনি দেখে সেগুলো আজগুবি ই মনে হচ্ছে।
মেয়েটা একগাল হেসে বলল,

~ স্বাগতম, আপনার জন্যই আমরা অপেক্ষিত ছিলাম।

আপনাকে অভ্যর্থনা জানানোর সৌভাগ্য পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত। আসুন, প্রবেশ করুন জ্বীনরাজ্যের অভ্যন্তরীণ সীমানায়।
মেয়েটার মনছোয়া অভিবাদনে আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। মেয়েটা আমার বাহু কোমলভাবে ধরে বলল,
~ চলুন আপনাকে কাঙখিত স্থানে নিয়ে যাই।

আমি মুচকি হেসে বললাম, ধন্যবাদ।

মেয়েটি উত্তরে মিষ্টি হাসি উপহার দিল।

জ্বীনরাজ্যের অভ্যন্তরে ঢুকলাম আমরা। চারদিকে তাকিয়ে অবাক হচ্ছিল ক্রমান্বয়ে। মানুষের জগতের মত জ্বীনজগতেও বাসস্থান, উপশহর, হাট~ বাজার সবই আছে। চারিদিকে লোকজন নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
আমার অবাকতা দেখে মেয়েটি বলল,
~ ভীষণ অবাক হচ্ছেন?

~ হ্যা, খুব’ই। আমার ধারণা ছিলনা জ্বীনরাজ্য এত সুন্দর এবং পরিপাটি হতে পারে।

~ আপনাদের সাথে আমাদের খুব একটা পার্থক্য নেই। যে পার্থক্য রয়েছে সবগুলো অনেকটাই বাহ্যিক, মনোতাস্ত্বিক এবং সৃষ্টিগত।
যাই হোক, এগোনো যাক। সবাই আপনাত অপেক্ষায় আছেন।

~ মেহরাব কোথায়? মেয়েটি হেসে বলল,
~ উনিও আছেন। চিন্তা করবেননা, উনার নির্দেশেই আপনাকে নিতে এসেছিলাম আমরা।
আমি আর বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করলামনা।

অনেকটা হাটার পর আমরা অনেক বিলাসী একটা বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলাম। বাড়ী বললে ভুল হবে, এই যেন এক রাজপ্রাসাদ। এত মনোরম এবং সুন্দর প্রাসাদ আমি আগে কখনোই দেখিনি। বিশাল গেইটের পুরোটাই ফুলে মোড়া, গেইটের সামনেই থেকে বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা। তার একপাশে ফুল~ ফলের বাগান, দোলনা এবং ছোট্ট একটা ঝরণা, অপরপাশে বসার জায়গা রাখা হয়েছে।

আমরা গেইট পার হয়ে ভিতরে ঢুকলাম। বাড়ীটার যত কাছে এগোচ্ছি তত বুক দুরুদুরু করছে। কেমন জানি লাগছে আমার কাছে, আল্লাহ’ই জানেন আমার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে সেখানে!

বাড়ী থেকে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। বাহির থেকে ভিতর হাজারগুণ বেশী সুন্দর, একদম রাজপ্রাসাদের সমতুল্য। মেয়েগুলো আমাকে একটা মনোরম কক্ষে বসিয়ে একটু অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল।

বেশ একটা ঠান্ডা পরিবেশেও আমি কুলকুল করে ঘামছি। আশেপাশে কাউকে দেখলামনা, মেহরাব ও এখনো পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করেননি। সবকিছু কেমন যেন গোলকধাধা লাগছে, এর যত গভীরে যাচ্ছি ততই যেন রহস্য বেড়ে যাচ্ছে।

আচ্ছা মেহরাবের কথায় বিশ্বাস করে এখানে এসে কোনো ভুল করলাম না তো! ওদের দ্বারা আমার কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা নেই তো! এমন অজস্র প্রশ্ন মস্তিষ্কে ভীড় জমাচ্ছে, পরক্ষণেই নিজের উপর রেগে গেলাম এসব অহেতুক বাজে চিন্তাভাবনার জন্য।
ভালোবাসার মানুষকে এভাবে কেউ সন্দেহ করে!

খানিকবাদে একজন বুড়ো এবং প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা কক্ষে প্রবেশ করল। আমি তাদের দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। উনারা সালামের উত্তর নিয়ে আমার মুখোমুখি বসে আমাকে বসার অনুমতি দিলেন।

আমি শান্ত~ নম্র মেয়ের মত বসে রইলাম। বুড়ো মহিলা নিরবতা ভেঙ্গে বললেন, তুমি ই মুশায়রা?
~ জ্বী জনাবা।

~ তোমার ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত শুনেছি। প্রকৃতপক্ষে বলতে গেলে, তুমি অসম্ভবকে সম্ভব করতে এসেছো। জ্বীনের সাথে মানুষের বিবাহ সম্ভব নয় সেটা বলবনা, তবে অনেক কঠিন। যেটা সবার পক্ষেই সম্ভব কিছু নয়।

যাই হোক, আমি তোমাকে কিছু কথা বলি। এরপর তুমি কি সিদ্ধান্ত নিবে সেটা তুমি ঠিক করে নিও।

জ্বীনরাজ্য অবধি আসা পর্যন্ত তুমি কেমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছো সেটা তুমি ভালোই জানো। আমি বলব, এসব অনেক তুচ্ছ। জ্বীনরাজ্যে এসে একজন জ্বীনকে বিবাহ করে তার সাথে আজীবন সংসার করা তার চেয়েও বেশী বিপদসংঙ্কুল আর কঠিন।

অনেককিছুর মুখোমুখি হতে হবে তোমায়, প্রতিটি পদে পদে তোমার লড়াই। হয়ত এসবের এক পর্যায়ে তোমার জীবনসংকট হয়ে পড়বে। তখন কোনোভাবেই তুমি পিছু হটতে পারবেনা।

এখন গোটা জ্বীনরাজ্যের নিয়ম এর বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা তোমাদের বিয়ে দিলাম, পরে তুমি এই পথ সরে গেলে কি হবে বুঝতে পারছো তো!! তুমি কিন্তু সাধারণ জ্বীনকে বিবাহ করতে যাচ্ছোনা। অতএব, তুমি সবকিছু ভেবে তোমার সিদ্ধান্ত কি?
আমি একটু চুপ থেকে বললাম,

~ সবকিছুর জন্য আমার আল্লাহ ই যথেষ্ট। উনার রহমতে আজ আমি এখানে এসেছি, ভাগ্যের দায়ভার সব উনার হাতেই ছেড়ে দিলাম।
আমি যে সিদ্ধান্য নিয়ে এখানে এসেছি আমি তাতেই অটুট আছি এবং থাকব। আমার আগাম বিপদ নিয়ে কোনো ভয় কিংবা অভিযোগ নেই।
বুড়ো মহিলা আমার জবাব শুনে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
~ আল্লাহ তোমার সহায় হন।

তবে মুখের কথায় ভরসা করে তোমার এত বড় সিদ্ধান্তে আমরা মত দিতে পারছিনা। এরজন্য আমাদের কিছু দময় নিয়ে তোমাকে জানা প্রয়োজন।
আগে কিছুদিন তুমি আমাদের সাথে অবস্থান করো, তোমাকে আমরা বুঝে~ শুনে নিই। যেহেতু বিবাহ কোনো ছেলেখেলা নয়, এটা সারাজীবনের ব্যাপার। তার উর্ধ্বে এটা স্বাভাবিক বিবাহ নয়, এখানে একটা ভুল পদক্ষেপ দুটো জগতকেই উলটে পালটে দিবে।

~ আমার কোনো আপত্তি নাই। আপনারা যোগ্য মনে করলেই বিবাহ হবে, আমি আমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পর্যবসিয় হলে আপনারা যা সিদ্ধান্ত নিবেন আমি তাই মেনে নিব।
নিশ্চয়ই আপনারা আমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী।

~ ঠিক আছে, তুমি বিশ্রাম করো। অনেক ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে তোমায়, তোমার জন্য কিছু আহার~ পানীয় এবং পোশাক পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মরিয়ম এসে তোমার ক্ষতস্থানে ভেষজ লাগিয়ে দিবে।

আসি আমরা।

আমি আবার সালাম দিলাম। উনারা আমার কক্ষ থেকে প্রস্থান করলেন।

নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলাম, আমি জানতাম এটাই আমি শেষ লড়াই নয়, সামনে আরো কঠিন কঠিন ধাপ আমাকে পাড়ি দিতে হবে। এটাই অবাক ব্যাপার যে আমার মত ভীতু মেয়ে আজ প্রচন্ড মনোবল আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে এতটা আসতে পেরেছে। এসব ছিল আমার কল্পনার বাহিরে।
সব ই সম্ভব হয়েছে আল্লাহর অশেষ রহমত এবং মেহরাবের প্রতি আমার অগাধ ভালোবাসা থেকে। কিন্তু মেহরাব এখনো কেন আমার সামনে আসছেননা! অন্তত একটিবার সাক্ষাত তো করবেন। উনার জন্যই তো আমার এতকিছু করা। উনি কি এভাবে আড়ালে থাকবেন!

একটু পর মেয়েটি আসল এবং আমার ক্ষতস্থানগুলোতে কিসব লাগিয়ে দিল। মূহুর্তে অনেক আরাম বোধ করলাম, তারপর বাহিরের ঝর্ণা থেকে ফ্রেশ হয়ে তাদের দেওয়া নতুন পোশাক পড়লাম। বেশ সুন্দর গাউন, পোশাকটা যেন আমার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।

তারপর কিছু ফল খেয়ে এবং হালকা আহার সেরে নিলাম। ফলগুলোর স্বাদ একদম অন্যরকম, সাথে দিয়েছিল ক্ষীরের পায়েস। যা খেয়ে অনেক তৃপ্তি পেয়েছিলাম।

মেয়েটি আমাকে বলল, আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন। আমি পরে এসে আপনাকে ডেকে নিব।
আমি চুপচাপ সব ই করছিলাম। মনটা একটু ভার হয়ে আছে। খেয়ে চুপচাপ শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

পর্ব ১২

জানিনা কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম! মেয়েটা এসে আমাকে জাগিয়ে বলল, বোন, নামাযের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। আপনি কি নামায পড়বেন?
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম, এখন কোন ওয়াক্তের নামায?
~ মাগরিব।

~ আমাকে নামায পড়ার স্থান দেখিয়ে দিন এবং ওযুখানা কোথায় একটু বলুন।
~ আপনি আমার সাথে আসুন বোন।

মেয়েটার পিছু পিছু গিয়ে মনোরম ওযুখানায় ওযু করে নিলাম। ওযুখানার সাথেই লাগোয়া নামাযঘর। ভিতরে ঢুকে দেখি এখানে অনেক মহিলা, বাচ্চা মেয়ে। সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে নামাযে, কিছু জিজ্ঞেস করব ভেবেও করলামনা। ওনাদের সাথে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করে নিলাম। নামায শেষে কেউ নড়লনা, চুপচাপ একযোগে যিকির করতে লাগল। এ যেন এক জান্নাতী দৃশ্য! ছোট্ট ছোট্ট মেয়ে বাচ্চাগুলোও তাল মিলিয়ে যিকির করছে, এই বয়সে আমরা দুষ্টুমি করে কাটিয়েছি। আল্লাহ এদের উত্তম শেফাহ দান করেছেন। নামাযঘর টা বিশাল বড়, এর দেয়ালের উচুতে তাকে অনেকগুলো বই~ কোরআন থরে থরে সাজিয়ে রাখা আছে। দোয়ালে বিভিন্ন সূরা~ কালাম লেখা।

সেই বৃদ্ধ মহিলা তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের পালঙ্কটায় বসলেন। সালাম দিয়ে আরবি ভাষায় অনেক কথা বললেন, যেগুলো আমার বোধগম্য নয়। জ্বীনরা হয়ত আরবিতেই কথা বলে থাকে, কিন্তু যখন উনারা আমার সাথে কথা বলেন তখন স্পষ্ট বাংলা~ ই কথা বলেন। ব্যাপারটা ভীষণ অদ্ভুত!
উনার কথা শেষ হওয়ার পর সবাই বেরিয়ে গেল। আমি উঠে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃদ্ধ মহিলা আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, আল্লাহ তোমার নামায কবুল করুন।
~ আমিন।

~ এসো আমার সাথে।
উনি আমাকে ডেকে তার পালঙ্কের এক পাশে বসিয়ে বললেন, জ্বীন সম্প্রদায়ের লোকজন জামায়তে নামায পড়তেই বেশী পছন্দ করে। এইজন্য আমরা মহিলা সম্প্রদায় নামাযঘরে একসাথে পড়ি, নামায শেষে ওয়াজ~ নছিহত করি। এতে আমাদের জ্ঞান যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমন ই পারস্পরিক সম্পর্ক গুলোও অটুট হয়।

~ আপনাদের নিজস্ব জামায়াত থাকতেও আপনাদের পুরুষ সম্প্রদায় মানুষের জামায়াতে মিলিত হয় কেন?
কেন ই বা মাঝরাতে মসজিদে নামায পড়ে?

এগুলো আমার শোনা কথা, সেই সাপেক্ষেই প্রশ্ন করেছি।

~ ভালো প্রশ্ন। আমরা জ্বীনরা সবসময় জ্বীনরাজ্যে অবস্থান করিনা, আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রমে মানুষদের সাথেই বসবাস করতে হয়। সেখানেই আমরা নামায পড়ি, নিজেদের দৈনন্দিন কার্যাবলিতে লিপ্ত থাকি।

কিছু মানুষের কাছে আমাদের পরিচয় প্রকাশ হওয়ার ভয় থেকে যাই, তাই নিজেদের আত্মগোপন থাকার স্বার্থে আমরা গভীর রাতে একা নিকটস্থ মসজিদে নামায আদায় করে থাকি।
~ বুঝতে পেরেছি।

~ কোরআন পড়তে জানো?

~ জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ।
~ আমাকে একটু শোনাও। মানুষের কন্ঠে সুমধুর কোর আন তিলাওয়াত আমার খুব ই ভালোলাগে।

মরিয়ম সযত্নে একটা কোরআন শরীফ নামিয়ে নিল। এর জন্য ওর কোনো কসরতের প্রয়োজন হয়নি। চোখের পলকেই একটু লম্বা হয়ে নামিয়ে আনল।
আমার হাতে দেওয়ার পর বলল, পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তুমি যেকোনো একটা সূরা তিলাওয়াত করো।

আমি কুরআন~ শরীফ খুলে সূরা কাহাফ্ব পড়লাম। বৃদ্ধ মহিলাটি চুপ করে শুনলেন। শেষ করার পর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এই সূরাটি কেন পড়লে?
~ প্রতি শুক্রবার আমি এই সূরা তিলাওয়াত করি। কেননা, আল্লাহ পাক বলেছেন যে ব্যক্তি শুক্রবার দিনে বা রাতে এই সূরাটি তিলওয়াত করবে পরবর্তী শুক্রবার অবধি তার গৃহ থেকে মক্কা শরীফ পর্যন্ত নূর প্রজ্বলন হবে এবং ৭০০০০ হাজার ফেরেশতা তার জন্য তওবা প্রার্থনা করবে।

~ মাশা’আল্লাহ।
চলো, এবার উঠা যাক। মরিয়ম তাকে কক্ষে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসো।

আমি নামাযঘর থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলাম। এদিকে কোনো পুরুষ নেই, চারিদিকে ছোট ছোট ছেলে বাচ্চা এবং মহিলারা। বাচ্চাগুলো উঠোনে খেলছে, খেলাচ্ছলে তাদের মা পড়া শিখাচ্ছে।

ভীষণ ভালো লাগছে দেখতে। হঠাৎ থমকে দাড়ালাম, মরিয়ম আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার কি কিছু প্রয়োজন?
~ আচ্ছা বোন, মেহরাব কোথায় আপনি বলতে পারবেন?

~ তার জন্য আপনি বড্ড উতলা হয়ে আছেন। কিন্তু আমি এর সম্পর্কে অবগত নয়, আপনি সুযোগ পেলে দাদীমা কে জিজ্ঞেস করে নিবেন।
চলুন, কক্ষে যাওয়া যাক।

কক্ষে এসে বসে রইলাম জানালার পাশটিতে। মনটা এখনো বড্ড ভার। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমি, অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে আমার। এখানে জিতলে রাজপুত্র আমার, হেরে গেলে বন্দিদশা হয়ত হবেনা তবে বিতাড়িত হব এই রাজ্য থেকে। দুজন দুজনের একটু কাছাকাছি আসতেই মাঝখানে ভিন্নতার এক দেয়াল গড়ে উঠে দুজনকে দু’দিকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে।

এরপর কি হবে! আল্লাহ ই ভাল জানেন। আমার যতটা করা সম্ভব, আমি করে যাব। তারপর যা হবার হবে।
হঠাৎ কানের কাছে সেই চিরপরিচিত কন্ঠে সালাম শুনলাম।

এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
~ মেহরাব আপনি এসেছেন? এতটা সময় আপনি কোথায় ছিলেন? আপনি কি অবগত ছিলেননা, আমি জ্বীনরাজ্যে এসে পৌছেছি!
~ হ্যা আমি অবগত ছিলাম। আমি আপনার সামনে আসতে পারবনা, খুব কঠিন আজ্ঞা জারি আমার উপরে। অদৃশ্য হয়ে আপনার নিকট এসেছি আপনার অস্থিরতা দূর করতে। বেশীক্ষণ অবস্থান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

~ আমার বড্ড ভয় হচ্ছে, একাকিত্ব অনুভব করছি আপনার সঙ্গ ছাড়া।

~ আমার সঙ্গ ছাড়া আপনি এতদূর এতকিছু মোকাবিলা করে এসেছেন, দাদিমাকে জয়ের আশ্বাস দিয়েছেন সেই আপনি যদি ভয় পান তা কি আশা করা যায়!
আপনি পারবেন ইনশা’আল্লাহ।

আমাদের এক হওয়া খুব সহজ হবেনা মুশায়রা। অনেক বাধা পেরিয়ে নিজেদের প্রমাণ করে তবেই আমরা এক হতে পারব।

দাদিমা খুব আশঙ্কায় আছেন, তাই তিনি ভেবেচিন্তে বিচার করেই আমাদের সম্পর্কটা আবদ্ধ করতে চাচ্ছেন। জানিনা, উনি কি সিদ্ধান্ত নিবেন! যদি আমাদের এক হওয়া না লিখা থাকে তবে আপনি ফিরে যাবেন। আমাদের ভালোবাসা না হয় অপূর্ণ ই থাকবে, কিন্তু আপনার স্থান কেউ কখনো নিতে পারবেনা।
স্বার্থপর ভাববেন না আমায়, আমি জ্বীনজগতের ধরা~ নিয়মে অসহায়। এই নিয়মের বাহিরে কিছু করতে গেলে আমার চেয়ে বড় ক্ষতি আপনার হবে। আর সেটা মেনে হওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।
আমার হাতে উনার ঠান্ডা স্পর্শ লাগল।

~ মুশায়রা, আমাকে যেতে হবে। দাদীমা যদি জানতে পারেন তার আদেশ আমি অমান্য করে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি তবে উনি কষ্ট পাবেন এবং আপনাকে ভুল বুঝবেন।

অতএব, আমার এক্ষুনি বিদায় নিতে হবে।
আসি তাহলে?

~ আসুন। দোয়া করবেন আমার জন্য, যাতে আমি আমাদের ভালোবাসাকে জয়ী করতে পারি। যতটা সম্ভব আমি করে যাব, বাকিটা আল্লাহর হাতে। উনি যা নির্ধারণ করবেন তাই হবে।

মেহরাব চলে গেল, আমি মেঝেতে বসে পড়লাম। মেহরাব থেকে আলাদা হয়ে যাব এটা ভেবেই চোখ ভিজে যাচ্ছে। আমাদের সম্পর্কটা সাধারণ ৪~ ৫টা সম্পর্কের মত নয়। এ যেন একধরণের খেলা। হারলে সব হারাব, জিতলে সবটুকুই জিতব। জানিনা, আল্লাহ আমাদের জন্য কোনটা ঠিক করে রেখেছেন! সারারাত এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

খুব সকালে সুমধুর আযানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। উঠে দেখি সবাই আমার আগেই উঠে পড়েছে। একটু বিব্রত লাগল এই ভেবে যে, ওনারা উঠে গেছেন আর আমি তখনো ঘুমাচ্ছিলাম। নামায শেষ করার পর বৃদ্ধ মহিলা আমাকে কাছে ডাকলেন,
~ তুমি আমাকে দাদীমা ডাকতে পারো।
তুমি রান্নাবান্না পারো?
~ জ্বী। কি রান্না করতে হবে বলুন!

~ তোমার পছন্দের কিছু একটা করো। তবে অনেক লোকের রান্না এবং পদসংখ্যা ২২টি থাকতে হবে।
প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সপ্তাহে আমাদের প্রাসাদে মিলাদের ব্যবস্থা এবং রাজ্যের সবাইকে খাওয়ানোর আয়োজন করা হয়। যোহর বাদ সবাই একসাথেই খায়।
আমার গোত্রের বউরা এসব করে থাকে। যেহেতু তুমি আমাদের পরিবারের একজন হতে চাচ্ছো, সেহেতু তোমার উপর ভার দিয়ে দেখব কেমন পারো!
এটাকে পরীক্ষা হিসেবে না নিয়ে নিজের দায়িত্ব হিসেবে নিয়ে পালন করো।
আমি মাথা নাড়ালাম।

হালকা প্রাতঃরাশ সেরে মরিয়মের সাথে রান্নাঘরে ঢুকলাম। বেশ বড় রান্নাঘর এবং অনেক পরিপাটি। বড় বড় ২টি মাটির চুলা, পাশে ছোট্ট নহর রয়েছে ধোয়ামুছার কাজের জন্য। মরিয়ম এক ঝুড়ি টাটকা শাক~ সবজি এনে আমার সামনে রাখল। বিনীতকন্ঠে বলল,
~ আপনি কি কি পদ রান্না করবেন বলুন? আমি সবকিছুর যোগাড়যন্ত্র করে দিচ্ছি।
~ প্রতিবার কি কি রান্না করো তোমরা?

~ প্রতিবার গোস্ত~ মাছ থেকে শুরু করে শাক~ সবজি সব ই রান্না করা হয়। একেকজনের একেক রকম পছন্দ তো তাই, লক্ষ্য একটাই কেউ যেন অতৃপ্ত হয়ে ফেরত না যায়।

~ ২২টি পদের সব ই শাকসবজি এবং মাছ ই হয়?

~ নাহ তার মধ্যে ৪~ ৫ টা পদ আমাদের নিজেদের তৈরী মিষ্টান্ন থাকে। আমরা তো মিষ্টি খেতে বেশ ভালোবাসি তাই। শুনুন, সবকিছুতেই লবণ কম কম দিবেন। লবণ বেশী খেতে পারিনা আমরা। আপনি ঠিক করে নিন কি কি রান্না করবেন আমি চুলা জ্বালিয়ে দিচ্ছি।
~ ঠিক আছে বোন।

মনে মনে ছোট্ট একটা লিস্ট তৈরী করে নিলাম। সেই অনুযায়ী কাটাকাটি শুরু করলাম, মরিয়ম ও হাতে হাতে সাহায্য করল। রান্না বসিয়ে দিলাম বড় বড় ডেকচিতে। খেয়াল করলাম, এদের আগুনের তাপ আমাদের আগুনের চেয়ে অনেক বেশী। একটু আচে চামড়া গলে যাওয়ার মত অবস্থা, জীবনে কখনো এত তাপে এতগুলো রান্না একসাথে করিনি।

কষ্ট হচ্ছিল আবার ভয়ও হচ্ছিল। যে গুরুদায়িত্ব আমার উপর পড়েছে তা যদি ঠিকঠাক মত পালন করতে না পারি তবে একদিকে উনারা সবার কাছে ছোট হয়ে যাবেন এবং অপর দিকে আমিও মেহরাবকে হারাব।

অনেক কম সময়ে এতগুলো রান্না করাও খুব প্যারাদায়ক ব্যাপার। লবণ ঠিকমত হয়েছে কিনা চেকে দেখার সময় মরিয়ম বাধ সাধল,
~ এই রান্না সকলের পাতে উঠা ছাড়া চেকে দেখার কোনো সুযোগ নেই, দাদীমার কড়া নিষেধ এটা।

এটা শুনে ভয় আরো বেড়ে গেল। কম লবণে এত রান্না করছি না চেকে দেখলে বুঝব কি করে এটা ঠিক হয়েছে কিনা!
যোহরের আযানের কিছু পরেই রান্না শেষ হল। উঠোনের দিকে উকি মেরে দেখলাম সকলে আসতে শুরু করছে। বিশাল পাচটি কক্ষে সবার বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এত জ্বীন একসাথে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। জ্বীনরাজ্যে জ্বীনের সংখ্যা আমাদের দেশের জনসংখ্যার ও পাচগুণ হতে পারে। সবকিছু পরিবেশন করে পাঠিয়ে দিলাম, মনে মনে আল্লাহর নাম জপ করছি সব যেন ভালোই ভালোই মিটে যায়।

আমি গোসল সেরে পোশাক পালটে নামায পড়ে নিলাম। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, অনেকে ইতিমধ্যে প্রস্থান করছে। এত তাড়াতাড়ি সবার খাওয়া শেষ!! তবে কি রান্না ভাল হয়নি! জিজ্ঞেস করব এমন কাউকে পাচ্ছিনা, যে কয়েকজন প্রাসাদের সামনে গল্পে মত্ত, ওরাও নিজেদের মধ্যে কিসব বলছে বুঝতে পারছিনা।

আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের কক্ষে এসে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর মরিয়ম আমার জন্য খাবার নিয়ে আসল। আমি তার হাতটি চেপে ধরে বললাম,
~ রান্না কেমন হয়েছে বোন?

~ দাদীমা আপনাকে জানিয়ে দিবে। আমাদের কিছু বলতে বারণ করেছেন, আপনি বরং খেয়ে নিন।
~ দাদীমা কি বলবেন কে জানে! খুব চিন্তা হচ্ছে।
~ চিন্তা করবেননা, খেয়ে বিশ্রাম নিন।

খাওয়া~ দাওয়া শেষ করে বসতেই এক অপরুপা সুন্দরী মেয়ে আমার কক্ষের সামনে এসে হাজির হল। সালাম দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইল।
আমি অনুমতি দেওয়া মাত্র সে ভিতরে এসে আমার পাশে বসে বলল, কেন এসেছো তুমি এখানে?
~ এই প্রশ্ন করছেন কেন? আপনি কে?

~ তুমি বড্ড ভুল করেছো এখানে এসে। সব ধ্বংস করতে এসেছো তুমি। সব এলোমেলো করে দেওয়ার জন্য এসেছো!
~ আপনি এসব কি বলছেন?

তেমন কোনো উদ্দেশ্য নেই আমার।

~ অবশ্যই আছে। নাহলে জ্বীনের সাথে মানুষে কখনো মিল সম্ভব নয় জেনেও এখানে আসতে না।
~ মিল~ অমিল সব আল্লাহর হাতে, আমি শুধু চেষ্টা করেই এসেছি।
~ কেন বোন? আমার জীবনটা নষ্ট করে তুমি কি চেষ্টা করবে!
~ ঠিক বুঝলামনা। আসলে আপনার পরিচয় কি?

~ আমি মেহরাবের বাগদত্তা। অনেক বছর ধরেই আমরা প্রণয়ে আবদ্ধ, সামনেই আমাদের বিয়ে হবে।
কিন্তু আপনি এসে সব শেষ করে দিলেন। এ সবকিছু ভুলে আপনাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কেন আমার এত বড় ক্ষতিটা আপনি করছেন বোন?
একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়ের সম্বলটুকু কেড়ে নিচ্ছেন!!

মেয়েটার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এসব কি শুনছি আমি! ওর সব কথা কি সত্যি! মেহরাব তো কখনোই আমাকে কিছু বলেনি।
মেয়েটি আমার পায়ে ধরে বলল, বোন দয়া করে আপনি আমার এত বড় সর্বনাশ করবেননা। এতবছর ধরে একটি আশা বুকে লালন করছি, সেটা আপনি ভেঙ্গে দিবেননা।

তাহলে আমার মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবেনা।

আমি কি বলব বুঝতে পারছিনা!
মেহরাব এভাবে আমায় ঠকাল! আর কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা আমি। মেয়েটা আমার পা ধরে অনবরত কাদছে।
তাকে আমার কি বলা উচিত আমি সত্যিই জানিনা!

পর্ব ১৩

আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, উঠুন। আমার কিছু কথা শুনুন।

মেয়েটি আমার পা ছেড়ে উঠে দাড়াল। কান্না করায় তার মুখ~ চোখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। প্রচন্ড কৌতুহল নিয়ে মেয়েটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
~ একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ আমি কখনোই করবনা। দেখুন, আমি অনেক কষ্ট~ বাধা মোকাবিলা করে এখানে এসেছি, সবাইকে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছি আমি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারব। এখন যদি আমি এসব মিথ্যে করে চলে যাই আমি উনাদের কাছে ছোট হয়ে যাব। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে আমি পলায়ন করতে পারবনা।

তাই আমি আগে নিজেকে প্রমাণ করতে চাই।

~ জানতাম, আপনার কাছে এসে আমার কোনো লাভ হবেনা। আপনাকে মোহ গ্রাস করেছে, জ্বীনরাজ্য পাওয়ার মোহ, এর উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য আপনি আমার অবস্থাকে আমলে নিচ্ছেননা।
আমার সর্বনাশ ই করতে চাচ্ছেন।

~ আমার কোনো মোহ নেই। আমি এতদূর ছুটে এসেছি কেবল মেহরাবের ভালবাসা অর্জনের জন্য, উনাকে আপন করে পাওয়ার জন্য। সেটাই যখন আমার জন্য নয়, তাহলে আমার আর কিসের মোহ থাকবে!

আমি কেবল নিজেকে প্রমাণ করেই চলে যাব, কোনো দাবি থাকবেনা আমার। পরাজয় মেনে আর সবার কাছে নিজেকে ছোট করে আমি এখান থেকে যেতে পারবনা।
তাই বলছি ততদিন অবধি আমাকে সময় দিন, এরপর আমি আপনাদের মাঝ থেকে সরে যাব।
~ আপনাকে আমি ভরসা করি কি করে!

আপনি জয়ী হলে আবার মেহরাবকে পাওয়ার মোহ আপনাকে গ্রাস করবে। সব ভুলে গিয়ে আপনি মেহরাব কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবেন।
আপনারা মানুষরা বড্ড বেঈমান। নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেন।

~ আমি আপনার একটা কথায় বিশ্বাস করতে পারলে আপনি কেন পারবেননা!
মেয়েটি জোরকন্ঠে বলল, আপনি প্রমাণ চাচ্ছেন? আমি আপনাকে প্রমাণ দিতে প্রস্তুত। কি প্রমাণ চান বলুন!
~ আমার কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই।

এখন আপনি যদি চান আমি এখান থেকে চলে যাই, আপনার এই বেঈমান কেই বিশ্বাস করতে হবে।
আমি নিজেকে প্রমাণ করেই এখান থেকে কোনোকিছু দাবী না করেই ফিরে যাব।

~ নিজের কথা ভঙ্গ করবেননা। যদি করেন, তবে আপনি আমার হাত থেকে রেহাই পাবেননা। বিশ্বাসঘাতকদের কোনো ক্ষমা হয়না।
মনে রাখবেন কথাটা। আপনাকে বিশ্বাস করে যেন আমাকে ঠকতে না হয়।

~ সেই ঠকে, যে অন্যকে ঠকায়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। মেয়েটি আর কিছু না বলে কক্ষ থেকে প্রস্থান করল। খুব খারাপ লাগছে, মেহরাব এমনটা কেন করলেন আমার সাথে! এসব যদি থেকেই থাকে, তবে কি প্রয়োজন ছিল আমাকে আশ্বাস দেওয়ার।

মেয়েটিকে আরো কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। ছুটে গিয়ে বাহিরে উকি মেরে মেয়েটিকে কোথাও দেখতে পেলাম। কখনো ভাবিনি আমি এতটা আত্মবিশ্বাসী আর সাহসী হয়ে উঠতে পারব, সব ই হয়েছে মেহরাবের প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে। কিন্তু সেই মেহরাব এভাবে আমাকে ঠকাবেন স্বপ্নেও ভাবিনি।

এমনসময় মরিয়ম এসে বলল, দাদীমা আমাকে ডাকছেন। মরিয়মের সাথে দাদীমার কক্ষে প্রবেশ করলাম। উনি আমাকে দেখে বললেন,
~ আমি ভাবতে পারিনি তুমি এটা নির্ভুল এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে। জ্বীনজগতে এই প্রথম কোনো মানবী দ্বারা জ্বীনদের সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয়েছে।

এই দায়িত্ব পালনের পরীক্ষায় তুমি উর্ত্তীণ হয়েছ।
~ আলহামদুল্লিলাহ, সবই আল্লাহর অশেষ রহমত এবং আপনাদের দোয়ায়।

এমনসময় অপর কক্ষের মোটা পর্দার আড়ালে অস্পষ্টভাবে মেহরাবের অবয়ব দেখা গেল। উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু শব্দ করে মুচকি হাসলেন। মূহুর্তেই যেন আমার কষ্ট~ মন খারাপ উবে গেল। ভুলে গেলাম সবকিছুই, অপলকে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
দাদীমা সেটা খেয়াল করে গলা ঝাড়লেন। আমি লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি নিচের দিকে অবনত করলাম।

~ নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য তোমার আরেকটি শেষ পরীক্ষা দিতে হবে। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই তুমি মেহরাবকে স্বামী রুপে লাভ করবে এবং তোমাকে জ্বীনরাজ্যের সকলে প্রাসাদের রাণী হিসেবে স্বীকৃতি দিবে।
এই পরীক্ষা তোমার জন্য বড্ড কঠিন হবে।
~ আল্লাহ ভরসা। কি করতে হবে বলুন, আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব!

~ কাল খুব সকাল সকাল তোমাকে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। এমন এক স্থানে যেতে হবে যেদিকে সূর্য কালো~ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে, যে একই জায়গায় সূর্য উদিত হয় এবং অস্ত যায়। সেই জায়গার থেকে ৩৮ কদম দূরে অনেক বস্তু দেখতে পাবে। সেখান থেকে এমন একটু বস্তু নিয়ে ফিরে আসতে হবে যা দৃশ্যমান বস্তু থেকেও দামী, যার কার্যকারিতা কখনোই ফুরোয়না।

প্রতিটি কাজে এটি ব্যবহৃত হয়। আর এসব কিছু করে তোমাকে ফিরে আসতে হবে সূর্যের উদিত এবং অস্তের ক্ষণ এর দ্বিগুণ সময়ে।
পারবে তো?
~ ইনশা আল্লাহ।

অন্ধকারে বসে বসে দাদীমার কথাগুলো ভাবছিলাম। সবটাই যেন একটা কঠিন ধাধা। কোনোটার ই সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। ভেবেও পাচ্ছিনা! এমন সময় কেউ আমার পিছনে এসে দাড়াল। আমি টের পেয়ে আলো জ্বালাতে গেলে কন্ঠটি বলে উঠল,
~ আমি মেহরাব

~ আপনি এতরাতে এখানে! কেউ টের পেয়ে গেলে খুব খারাপ কিছু হবে।

মেহরাব আমার হাত দুটো তার হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
~ মুশায়রা, আপনি ই আমার যোগ্য বধু। আপনি ই পারবেন এভাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে।
ইনশাআল্লাহ কাল ও আপনি উত্তীর্ণ হয়েই ফিরবেন।

এটা আপনার জন্য হয়ত অনেক কঠিন, কিন্তু আপনার উপর ভরসা আছে।
আমি চুপ করে রইলাম, কি বলব বুঝতে পারলামনা। উনি উনার দুহাত দিয়ে আমার গাল ধরে বললেন,
~ আল্লাহ আপনার সহায় হন, ফি~ আমানিল্লাহ।

জয়ী হয়ে ফিরে আসুন। আর হ্যা নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন।
~ আচ্ছা।

~ আসি তাহলে? আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম। উনি সামনে আসলে আমি কি হয়ে যায়, আমি সব ভুলে যাই। ভুলে যাই উনি আমাকে ঠকাচ্ছেন।
জানিনা কালকের পরীক্ষায় আমি জয়ী হব কিনা! জয়ী হলেও ফিরে যাব, পরাজিত হলেও ফিরে যাব। আপনার বধু হওয়ার আকাঙখা আপনি শেষ করে দিয়েছেন মেহরাব।

বাকিটা আমি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম, উনি আমার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। এতে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই।
খুব ভোরে উঠে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে গেলাম। এখনো রাতের প্রহর পুরোপুরি কাটেনি, সূর্য উঠবে উঠবে করছে। দাদীমার কথাগুলো মনে মনে আরেকবার বিশ্লেষণ করে নিলাম। সূর্য এর কালো~ রক্তিম বর্ণ কোন দিকে দেখা যায়? পূর্ব নাকি পশ্চিম! সুর্য যখন উদিত হয় তখন হালকা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে, যখন অস্ত যায় তখন আধারের সাথে কিছুটা কালো~ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে।

তার মানে দাদীমা পশ্চিম দিকের কথা ই বলেছেন। আল্লাহর নাম নিয়ে পশ্চিম দিকে হাটা দিলাম। চলতে চলতে জ্বীনরাজ্যের জনপদ ফেলে নির্জন দিকে চলে এসেছি। এটা বোধহয় জ্বীনরাজ্যে শেষ সীমানার খানিক অংশ।

এখানে দুটো পথ দুইদিকে বেকে গেছে, দুইদিকে জঙ্গল। একদিকে ঘন আরেকদিকে ছোট ঝোপালো। দাদীমা বলেছিল এমন এক জায়গা যেখানে সূর্য উদিত ও হয় এবং অস্ত ও যায়।

ছোট ঝোপালো জঙ্গলের প্রান্তে বিশাল উচু উচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা পাহাড়ের মাথায় তো সূর্য উদয় এবং অস্ত দুটোই দেখা যায়! তাহলে পাহাড়ের চুড়া ই সেই জায়গা। আমি আমার ধাধার উত্তর পেয়ে গেছি। আল্লাহর নাম নিয়ে জঙ্গলের দিকে ঢুকলাম।
পাহাড়ের পাদদেশে হাটতে হাটতে দেখলাম পাহাড়গুলো একদম খাড়া, সিড়ির ভাজ গুলোও খাড়া ভাবে কাটা। জঙ্গলের শেষ প্রান্তে পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই আমাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি তীর ছোড়া আরম্ভ হল।

ছোট ছোট ঝোপের ভিতরে লুকিয়েও রক্ষা পেলামনা, একটা তীর শা করে আমার বা হাতের পাশ দিয়ে চলে গেল। এতে আমার হাত অনেকটা ছড়ে গেছে, একটুপর হাতটা নীলবর্ণ ধারণ করা শুরু করল এবং অবশ হয়ে গেল। তীরগুলো খুব বিষাক্ত বিষ লাগানো ছিল।

বিষ টা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছিল, যতটুকুতে ছড়াল ততটুকুই সম্পূর্ণ অবশ হয়ে যাচ্ছিল। দেরী না করে ওরনার এক অংশ ছিড়ে ক্ষতস্থানের উপর শক্ত করে বেধে দিলাম, এতে বিষ ছড়ানো আটকানো গেল। কিন্তু আমার বাম হাতটা সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গেল। পূর্বের আকাশের দিকে তাকালাম, সূর্য সবচেয়ে উচু পাহাড়ের চূড়ায় উকি দিচ্ছে। পাহাড়টা সবচেয়ে উচু এবং একদম খাড়া। এইদিকে আমার বাম হাত সম্পূর্ণ অবশ, এক হাতের সাহায্যে আমি কিভাবে এই খাড়া পাহাড়ে চড়ব?

জঙ্গল থেকে ছোট ছোটশক্ত শিকড় এবং লম্বা ডাল জোগাড় করলাম। শিকড়গুলো একটার সাথে আরেকটা বেধে ডালের সাথে শক্ত করে বেধে নিলাম। পাহাড়ে চড়ার আগে শিকড়ের দড়ি কোমড়ে পড়ে নিলাম, এবার শক্ত ডালটা একহাত দিয়ে উপরের শক্ত জায়গায় পুতে অল্প অল্প করে সিড়ি বাইতে লাগলাম। এই পাহাড় থেকে নিচে তাকালে মনে হয় নীচে বড় একটা খাদ আছে।

তাকালেই শরীরে কাপুনি উঠে। উঠতে অনেক কষ্ট হচ্ছে কিন্তু জিরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই। একটু অমনোযোগী হলেই পা পিছলে নিচে পড়ে যাব, পাহাড়ের গায়ে শ্যাওলা জনে অনেক জায়গা পিছল হয়ে আছে।

দু~ একবার পিছলে পড়ে যেতাম, কিন্তু কোমড়ে শিকড় বাধা থাকায় আল্লাহর রহমতে বেচে গেলাম। এদিকে সকাল শেষ হয়ে আসছে।
দাদীমার কথা অনুযায়ী দুপুর বিকাল হওয়ার আগেই ফিরে যেতে হবে। পাহাড়ে উঠার সময় তাড়াহুড়ো করলেও প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাই অনেকটা সময়ের পর ধীরে সুস্থে পাহাড়ের চুড়ায় উঠলাম। পাহাড়ের চূড়ায় তিনটি গুহা। তিনটিই দেখতে একইরকম, এর একটিই অনেকগুলো বস্তু রয়েছে। এখন কোনটায় ঢুকব বুঝতে পারছিনা।

প্রথমে বামদিকের গুহার সামনে এগিয়ে গেলাম, তারপর না ঢুকে আগের জায়গায় ফিরে এলাম। আবার ডানদিকের গুহার সামনে গিয়ে ফিরে এলাম। মাঝখানের টা সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম, এটাই সঠিক গুহা। এটাই ৩৮ কদম দূরে অবস্থিত। বাকিগুলোতে সাড়ে~ সওয়ার মত পার্থক্য।
খুব সুক্ষ্মভাবে খেয়াল না করলে বুঝা যাবেনা।

আল্লাহর নাম নিয়ে গুহার ভিতরে ঢুকলাম। অতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন নয় গুহাটা। কোন একটা ফাক দিয়ে প্রচুর আলো ঢুকছে, অনেকটা ভিতরে ঢুকার পর দেখলাম ৩টি বড় সিন্দুক খোলা রয়েছে। সবগুলো ক্রমান্বয়ে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং মাণিক্য দিয়ে পরিপূর্ণ। স্বর্ণের সিন্দুক পেচিয়ে বসে আছে তিন মাথাওয়ালা একটা বিশাল সাপ, রৌপ্যেরটা এক বিশাল আকৃতি ধারালো নখ~ ঠোটওয়ালা শকুন আর মাণিক্যের টায় বিশাল বিশাল জোক গজগজ করছে।
এর মধ্যে কোন বস্তুটি আমি নিব এবং কিভাবে!

কিছুই কথায় আসছেনা, হাতটা খানিকবাদে ভীষণ ব্যথা করে উঠছে।

দাদীমার কথা অনুযায়ী তিনটি হাত দিতে যাওয়ার কথা ভাবতে ওইগুলো আমার দিকে তেড়ে এল। উপায়ান্তর না দেখে আমি বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে, এরাও গুহা থেকে বেরিয়ে আমাকে তাড়া করা শুরু করল।

আমার যে অবস্থা তাতে দৌড়ে তাড়াতাড়ি এমন খাড়া পাহাড় থেকে নামা সম্ভব না।
আর কোনো উপায় না দেখে চূড়া থেকে লাফ দিলাম। ভেবে নিলাম যা থাকে কপালে, আল্লাহ সহায়।

পর্ব ১৪

আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে নিচে পড়লামনা, আমার হাতের লাঠিটা একটা খাড়া পাথরের চিপায় আটকে গেছে। এক হাতে ঝুলে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু ভয় হচ্ছে আমি উপরে উঠতে গেলে যদি লাঠিটা কোনোভাবে খুলে বের হয়ে যায়। অন্য হাত ও অবশ নতুবা সে হাতটা দিয়ে খাড়া পাথর ধরে বেয়ে উঠা যেত। এভাবে ঝুলে থাকা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।

এজন্য কয়েকবার সাহস করে লাঠিটা শক্ত করে গেথে আছে কিনা চেক করে নিলাম। বেশ শক্ত ভাবেই আটকে আছে ওটি, এর ওপর ভর দিয়ে খাড়া সিড়িতে উঠে যাব। তারপর আস্তে আস্তে নামতে সমস্যা বেশী হবেনা।

আল্লাহর নাম জপ করতে করতে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করলাম, বেশ কয়েকবারের পর উঠতে পারলাম। খাড়া পাথরগুলোর উপর দাঁড়িয়ে লাঠিটা উঠানোর জন্য বেশ কয়েকবার টানলাম। নিচের দিকে যতবার চোখ যাচ্ছে ভয় লাগছে। এখানে পড়লে মরব কিনা জানিনা, তবে হাত~ পা কিছু আস্ত থাকবেনা। তখন বিপদে মাথা কাজ করছিলনা বলে ঝাপ দিয়েছি। এখন যা করব ভেবেচিন্তে করতে হবে, এখান থেকে ফেরা খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছেনা। এর মধ্যে আকাশটা কালো হয়ে এল। লাঠিটা কোনোমতে ভাঙ্গা অবস্থায় বের করে আগের মত মাটিতে গেথে খাড়া সিড়িতে চলে এলাম। বৃষ্টি নামার আগে পাহাড় থেকে নামতে হবে আমায়, যা মেঘ করে অন্ধকার নেমে এল তাতে বুঝতে পারছিনা আমার ফেরার সময় কতটা এগিয়ে এল।

আস্তে তবে দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। উঠার চেয়ে নামাটা সহজ হলেও এখানে ততটাও নয়। খাড়া পাহাড়ের কোণ যা এমন ই, লাঠি থাকা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে ঝুকে পড়ে যাব। ঝাপ দেওয়ায় একটা ভালো হয়েছে, সমতলের মোটামুটি কাছে এসে আটকেছি। নাহলে এই পাহাড় বেয়ে নামতে সন্ধ্যা পার হয়ে যেত। খানিকটা পর পাহাড় থেকে নেমে সমতলে নেমে আসল।

এর মধ্যে আকাশের অবস্থা ক্রমশ ই খারাপ হয়ে এল। ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে, চারপাশে কোনো বড় গাছ বা আশ্রয়স্থল নেই যেখানে মাথা গুজে বজ্রপাত থেকে বাচব। বজ্রপাত গুলো আমার চারপাশে পড়ছিল, প্রচন্ড শব্দ গুলো শুনে আমি বারবার ভয়ে কেপে উঠছিলাম। আল্লাহ আমার কপালে কি রেখেছেন, তিনিই জানেন।

ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামা শুরু হল, কিন্তু তাতে অন্ধকার একটুও কাটলনা। আর কিছু ভেবে এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটতে লাগলাম। এরমধ্যেই বজ্রপাত পড়ে আমার চারপাশে আগুন ধরে গেল, আগুনের মাঝখানে আমি আটকে পড়ে গেলাম।

এর থেকে কিভাবে বের হব বুঝতে পারছিলামনা। বৃষ্টিতে আগুন একটুও নিভতে চাইছেনা, ক্রমশ দাউদাউ করে বেড়ে চলেছে। আগুনগুলো হঠাৎ বিশাল আকৃতি ভয়াবহ প্রাণীর রুপ নিল, সেগুলো আমার চারপাশে ঘুরে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে সজোড়ে হাসছিল।

বুঝতে বাকি রইলনা, এগুলো কোনো শয়তান হবে। আমার ক্ষতি করতেই এরা এসেছে। কিন্তু আমি এদের সাথে মোকাবিলা করব কি করে! আমি একজন সাধারণ মানুষ আর ওরা ভয়ানক প্রাণীরুপী শয়তান। ভয় না করে ওদের একজনের দিকে হাতের লাঠিটা ছুড়ে দিলাম, লাঠিটা ওরা হাত নেওয়া মাত্রই সেটি পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

এভাবে ওদের সাথে পারা যাবেনা কিছুতেই। আমার শেষ ভরসা, আল্লাহ তায়ালা। উনার কালাম দিয়েই লড়াই হোক। এর মধ্যে শয়তান গুলোর একজন আমার দিকে আগুনের গোলা ছুড়ে মারল, আমি বেকে যাওয়ায় আমার গায়ে লাগলনা।

এরা আমাকে চেপে ধরার জন্য চারপাশ থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি মুনাজাত ধরে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগলাম। মুনাজাতের মুষ্টিতে বৃষ্টির পানি পড়ে জমা হল, আমার ছোট মস্তিষ্কে অন্য চিন্তা এল। আমি পানিতে আয়াতুল কুরসী এবং সূরা ফাতিহা পড়ে ফুকে দিয়ে শয়তান গুলোর গায়ে ছিটালাম। সাথে সাথে এদের শরীরের আগুন নিভে উধাও হয়ে গেল।

শোকর~ আলহামদুলিল্লাহ বলে দুহাত দ্বারা চেহারা ম্যাসাহ করে আবার ছুটতে লাগলাম। আস্তে আস্তে বৃষ্টি ও বন্ধ হয়ে গেল। আমার পা দুটো আর চলছেনা, শুধু মনে হচ্ছে হেরেই গেলাম আমি। এখন এই রাজ্য থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। দাদীমার কথামত ওইস্থান থেকে কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি, শূণ্য হাতে ফিরতে হচ্ছে।

জ্বীনরাজ্যে প্রাসাদের সামনে এসে আমি আর নড়তে পারছিলাম, হঠাৎ করেই জ্ঞান হারালাম। জানিনা কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল, চোখ মেলে দেখি মরিয়ম আমার পাশে বসে আমার বাম হাতটা মালিশ করছে। হাতের নীলচে বর্ণ নেই, তবে হালকা নাড়াতেই ব্যথা করে উঠল।
মরিয়ম আমাকে বাধা দিয়ে বলল,

~ বোন এক্ষুণি নাড়াবেননা, ক্ষতের যন্ত্রণা এখনো রয়ে গেছে। আমি ভেষজ লাগিয়ে দিয়েছি, সেরে যাবে।
বিষ যা ছিল, সব বের করা হয়েছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
~ দাদীমা কোথায়?

~ উনি এতক্ষণ এখানে ছিলেন, আমাকে আপনার দেখাশুনা করতে বলে জরুরী কাজে গিয়েছেন।
আমি নিষ্প্রাণ ভাবে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার কেন জানি ভয় হচ্ছে, আজ আমি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারিনি। আমাকে মেহরাবকে ছেড়ে চলে যেতে হবে নিজের দুনিয়ায়।

কিন্তু আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? আমাকে তো এমনিতেই চলে যেতে হত, আমি যে মেয়েটিকে কথা দিয়েছি। ভালো ই তো হল, একটা অযুহাতে মেহরাবের জীবন থেকে সরে যেতে পারব। আর কখনো আমাদের সাক্ষাত হবেনা, সব এখানেই সমাপ্তি পেয়ে যাবে।

মরিয়ম আমাকে নাড়া দিয়ে বলল,
~ আপনার শরীর এখন খুব দূর্বল। একটু কিছু খেয়ে নিন।
~ আমার এখন ইচ্ছে করছেনা।

~ মেহরাব ভাই বলেছেন, এই ব্যাপারে আপনার কোনো বারণ না শুনতে। আপনি বিশ্রাম নিন, আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি।
আমি আর কিছু বললামনা। মেহরাবের সাথে স্বাভাবিক ই থাকতে চাইছি। সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই শেষ হোক।

রাতে দাদীমা আমার কক্ষে আসলেন। আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার শরীর কেমন এখন?
~ আলহামদুলিল্লাহ অনেকটা ভাল আছি।
~ খাওয়া দাওয়া করেছো?

~ জ্বী দাদী।
উনি কিছুক্ষণ নিরব থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
~ সেই বস্তুটি এনেছো? দাও আমাকে!

আমি উনার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম, তারপর ক্ষীণকন্ঠে বললাম, গুহায় যেসমস্ত বস্তু দেখেছি কোনোটাই আপনার বর্ণণা মত নয়। সোনা~ রুপা কিংবা মাণিক্য হয়ত অনেক দামী, কিন্তু এর কার্যকারীতা স্বল্পকালের জন্যই। সবকাজে এদের লাগেনা, হয় ও এদের দিয়ে।
~ তাহলে তুমি কি শূণ্য হাতেই ফিরেছো?

~ না দাদীমা, সাথে আমার আত্মবিশ্বাস~ মনোবল নিয়ে ফিরেছি। যা যেকোনো দৃশ্যমান বস্তু অপেক্ষায় অনেক দামী, এর কার্যকারীতা ফুরায়না বরং দিন দিন সেটি নতুন নতুন কার্য সৃষ্টি করে নিজস্ব কার্যকারীতা বাড়ায়। আর এটিই সেই জিনিস, যা সব কাজেই প্রয়োজন।
~ মারহাবা। তোমার মত বুদ্ধিমতী এবং সাহসী মেয়ে আমি খুব কম ই দেখেছি। তুমি তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করেছো, আমার কথানুযায়ী আমি তোমাকে আমার মেহরাবের বধূ হিসেবে স্বীকৃতি দিব।

কাল রাতেই তোমাদের বিবাহের আয়োজন করা হয়েছে।
এই কথাটা শুনে আমি খুশি হবে নাকি বেজার হব বুঝতে পারছিলামনা। কথাটা শুনে মনটা এত চঞ্চল হয়ে উঠেছে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন কোনোকিছু পেলে মানুষের মন স্বস্তি পায়। তেমন স্বস্তি পাচ্ছি আমি, কিন্তু এটা তো আমার ভাগ্য লেখা নেই।
সকালে মরিয়মসহ কিছু মেয়ে এসে হলুদ মাখিয়ে গোলাপ ভেজানো পানি দিয়ে আমার গোসলের ব্যবস্থা করে দিল। তারপর মেহেদী পড়িয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে বিশাল আয়োজন করা হচ্ছে। কানের কাছে অদৃশ্য কন্ঠ শুনে হালকা ভয় পেয়ে গেলাম,
~ আপনি এখানে? এইসময়?

~ আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব হলুদবরণ গালে আপনাকে কেমন লাগছে! বাহ, মেহেদী টা খুব সুন্দর ভাবে একেছো!
বউ বউ লাগছে একদম।

~ জানেন, কেউ যদি জেনে যায় আপনি বিয়ের আগে বউয়ের মুখ দেখতে এসেছেন কি হবে?
~ সেই ভয়ে কি নিজের বউকে দেখব না! এই মেয়েগুলোকে এত বার করে বলে দিলাম মেহেদী দিয়ে হাতে আপনার আমার নাম লিখে দিতে, লিখলনা!
~ ব্যস্ত ছিল তো তাই ভুলে গেছে।

~ সমস্যা নেই, আমি ই লিখে দিচ্ছি। ডালা থেকে মেহেদী নিয়ে হাতের মাঝখানের ফাকা জায়গাটায় আরবিতে আমাদের নাম লিখে দিল।
তারপর বলল, আপনাদের সমাজে নাকি খুব প্রচলিত যে মেয়ের হাতে মেহেদীতে লেখা নামের রঙ গাঢ় হয় সে মেয়ে স্বামীসোহাগী হয়। এসবে অবশ্য আমি বিশ্বাস করিনা, আমি জানি আপনি স্বামীসোহাগী হবেন। আপনার স্বামীর বাম পাশের পাজড় হয়ে যত্নে~ ভালোবাসায় ঘিরে থাকবেন।
আমি নিজের অজান্তে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম

উনি হেসে বললেন, লজ্জা পেলে আপনাকে লাল টুকটুকে বউ লাগে। খানিকটা হলুদ নিয়ে উনি আমার নাকে এবং গালে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, আজ নিজেকেই সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে, এমন একটা হলুদরঙ্গা লাল টুকটুকে বউ আমার ঘর আলো করবে।

কোনো স্বামী হয়ত এর আগে নিজের বউকে হলুদ ছোয়ায়নি, আমি ছুয়ে দিলাম। অনুভূতিটাই আলাদা।
বাহিরে থেকে মরিয়মের গলার স্বর শুনতে পেলাম। উনি আমার হাতে হলুদ লাগিয়ে নিজের হাতে লাগিয়ে দিলেন, অদৃশ্য অবস্থায় শুধু তার ছোয়াটাই অনুভব করলাম।
~ আপনি কি কখনো আমার সামনে আসবেননা?

~ একদিন বলেছিলামনা, যেদিন অধিকারটা তৈরী হবে সেদিন আসবে। আজ রাতেই বরবেশে আমাকে দেখতে পাবেন ইনশাআল্লাহ। তখন আবার অপছন্দ করে পালিয়ে যাবেননা যেন! আসি বউটাহ।

উনার কথাশুনে অনেককিছু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখনি মরিয়ম এসে বলল, ভাবী আপনার গোসলের ব্যবস্থা সম্পন্ন, আসুন সেরে নিবেন। চিন্তাগুলোকে এক পাশে রেখে মরিয়মের সাথে চলে গেলাম।

সন্ধ্যায় সারাপ্রাসাদে সাজ সাজ রব, চারপাশের নানা ধরণের জ্বীন এর আনাগোণা~ কলবরে মুখরিত। অবশ্য আমি দুপুর থেকেই কক্ষেই অবস্থান করছি বাহিরের দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়নি। খানিকবাদে মরিয়ম বধুর সাজসজ্জা নিয়ে উপস্থিত হল। লাল রঙ্গের বড় গাউন, তার সাথে মিলিয়ে হিজাব~ ওড়না, হালকা গয়না এবং বড় সুগন্ধী ফুলের তোড়া। সাজানোর পর যেন নিজেকে চিনতেই কষ্ট হচ্ছে আমার। এমনভাবে সাজতে কেবল আরবিয়ান দেশের বধুদের দেখেছি। মরিয়ম চুড়ি পরাতে গিয়ে আমার হাতের লেখা নামের দিকে খেয়াল করে বলল,

~ মাশা~ আল্লাহ মেহেন্দী তো বেশ টকটকে রঙ ধারণ করেছে, কিন্তু এত সুন্দর করে নামটা লিখল কে!
আমার লজ্জামাখা চেহারা দেখে বুঝতে পেরে মরিয়ম আর কিছু জিজ্ঞেস করলনা। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি নিজেই লেখা নামটা দেখছিলাম, এত সুন্দর গাঢ় রঙ হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুই আমার পাওয়ার কথা না।

অন্যের হক কেড়ে নিচ্ছি আমি, আর দেরী নয় সময় হয়েছে আমার নিজের কথা রাখার। এক্ষুনি সবার চোখ ফাকি দিয়ে পালাতে হবে।
হাতের ফুলটা রেখে বাহিরের দিকে উকি দিলাম, সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। এখনি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। পা টিপে টিপে কক্ষ থেকে বেরিয়ে লন থেকে বারান্দার দিকে গেলাম।

পর্ব ১৫

বারান্দার এদিকটা প্রায় জনশূণ্য। এখন থেকে প্রাসাদের খাম্বা ধরে নিচের দিকে নামা যাবে। নিচেও অনেক লোকজনের আনাগোণা দেখছি। কিভাবে পালাব ঠিক বুঝতে পারছিনা! আগে এখান থেকে নেমে যাই, তারপর না হয় এসব ভাবা যাবে। অনেক কষ্টেও খাম্বা বেয়ে নামতে পারলামনা। বাধ্য হয়ে বারান্দা ছেড়ে সোজা সদর দরজার দিকে চললাম, মনে মনে প্রার্থনা করছি কেউ যাতে আমাকে দেখে না ফেলে। এইজন্য আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে যেতে লাগলাম। নির্বিঘ্নে সদর দরজা পার হয়ে বাহিরে আসলাম। এখানকার সবাই নিজেদের কাজ আর খোশ~ গল্পে ব্যস্ত। কারো নজর পড়লনা আমার উপর। গেইট দিয়ে খুব সহজেই বের হওয়া যাবে।

গেইট দিয়ে বের হয়ে দৌড়ে অনেকটা চলে এলাম, ক্লান্ত হয়ে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাড়ালাম। এত দূর থেকেও প্রাসাদ টার আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে এভাবে চলে আসার জন্য, আমি স্বপ্ন তো এটাই ছিল যে মেহরাবকে নিজের করে পাব, এরকম জাকজমকভাবে আমাদের বিয়ে হবে। কিন্তু আর কিছুই হলনা…….

আমি জানিনা, এই জ্বীনরাজ্য থেকে কিভাবে বের হব! এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু ঘরবাড়ি আর গাছপালা ছাড়া কিছুই চোখে পড়লনা। যেভাবে এসেছি হয়ত সেভাবেই ফিরতে হবে, ওই জ্বীনরাজ্যের প্রবেশদ্বার দিয়ে। আর সময় নষ্ট করা উচিত হবেনা, এতক্ষণে হয়ত সবাই আমাকে না পেয়ে চারিদিকে খোজা শুরু করে দিয়েছে।
আর কিছু না ভেবে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম।

বিয়ের সময় হয়ে এসেছে। জ্বীনদের মধ্যে বড় আলেম এসে উপস্থিত হয়েছেন বিয়ে পড়ানোর উদ্দেশ্যে। দাদীমা কয়েকজনকে বর আর কনে কে ডেকে আনার জন্য পাঠালেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মেহরাব এসে উপস্থিত হল বিয়ের স্টেজে। মেয়েরা এসে জানালো, কনেকে কক্ষে পাওয়া যাচ্ছেনা। আশেপাশে কোথাও নেই। মূহুর্তেই আনন্দের পরিবেশ থমথমে হয়ে এল। কারো মুখে রা নেই, সবাই গম্ভীর হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।
মেহরাব মাথা থেকে টুপি খুলে পাশে রেখে দিল। দাদীমার সামনে এসে পায়ের কাছে বসে বললাম,

~ দাদীমা জানিনা, এই খারাপ পরিণতির কি প্রতিদান দিব আমি! আমি নিজেই এর জন্য দায়ী। সবকিছু আমার দোষে হয়েছে, তুমি আমাকে শাস্তি দাও।
আমাকে জ্বীনরাজ্য থেকে বহিঃস্কার করে জ্বীনরাজ্যের গ্লানি মুছে ফেলো। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবে।

মেহরাবের চোখ থেকে অশ্রু ঝড়তে লাগল। দাদীমা নির্বাক হয়ে একইভাবে বসে রইলেন। উনার পাশে থাকা আরেকটি জ্বীন বললেন, উপস্থিত মেহমানবৃন্দ, আসুন আপনারা আহার সেরে নিবেন। চলুন, আপনাদের সম্মানার্থে সামান্য আয়োজন করা হয়েছে। কেউ আহার সম্পন্ন না করে যাবেননা।

এই কথায় যেন কারো টনক নড়লনা, তবে সবাই নড়েচড়ে উঠল। সবাই চুপচাপ অনিচ্ছাসত্ত্বেও আহারের আয়োজন দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এইটুকু না করলে হয়ত তাদের দ্বারা দাদীমাকে অপমান করা হত। দাদীমা উঠা দাড়ালেন, চুপচাপ নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাটতে লাগলেন।

আমি উপরতলা থেকে “দাদীমা” বলে ডাকলাম। সবার মূহুর্তেই সেখানে থমকে গেল। দাদীমা অবাক চাহনীতে আমার দিকে তাকালেন। আমি ধীরে ধীরে সিড়ি ভেঙ্গে নেমে আসলাম। দাদীমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ কোথায় ছিলে তুমি?

~ আমি নামাযঘরে ছিলাম।
~ এখানে তোমার বিয়ের আয়োজন চলছে, সবাই তোমাকে খোজাখুজি করছিল আর তুমি নামাযঘরে অবস্থান করছিলে! সেখানে কি করছিলে তুমি?
~ অনেকবছর হয়েছে মা~ বাবাকে হারিয়েছি। তারা আমার বিয়েতে উপস্থিত হয়ে নিজেদের কর্তব্য সমাধা করতে পারলেননা। আমার বিয়ে নিয়ে যে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল, খুব মনে পড়ছিল তাদের কথা।

তাই নামাযঘরে বসে তাদের আত্মার মাগফেরাত এর দোয়া করছিলাম। আমি বুঝতে পারিনি যে এতটা দেরী হয়ে যাবে।
~ কাউকে তো বলে যেতে পারতে, সবাই ভেবেছে তুমি……

~ দাদীমা, তখন সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। আমি কাউকেই পাইনি ডেকে বলার জন্য। উনাদের সাথে তো আমার পরিচয় নেই কাকে বলে যাব বুঝতে পারিনি।
আমার দোষ মার্জনা করবেন।

মেহরাব তুমি নির্দিষ্ট জায়গায় বসো। মরিয়ম পর্দার ব্যবস্থা করো, সবাই এখানে চলে এসো। বিয়ের কাজ সমাধা হয়ে যাক। আমাকে আর মেহরাবকে মুখোমুখি বসানো হল, সামনে পাতলা পর্দা টেনে দেওয়া হল। দোয়া পড়া শেষ করে আমাকে আগে কবুল বলতে বলা হল। আমি একনজরে মেহরাবের দিকে তাকালাম, এতক্ষণ ওর দিকে একবারের জন্যও আমার দৃষ্টি যায়না। এই প্রথম ওকে আমি দেখলাম।

ওর রুপ~ সৌন্দর্য এবং সুদর্শনতা যে কাউকে মুগ্ধ করবেই, আমি কল্পনাও করতে পারিনি মেহরাব দেখতে এতটা সুন্দর এবং মায়াবী চেহারার অধিকারী হবে। লাল শেরওয়ানীতে ওর রুপ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।
মনে মনে মাশা~ আল্লাহ বলে ফেললাম। আশেপাশের মেয়েগুলো রসিকতা করে আমার উদ্দেশ্যে বললে, লজ্জা পেয়োনা ভাবী। বলে ফেলো।

আমি এক এক বার কবুল বলছিলাম আর মেহরাবের দিকে তাকাচ্ছিলাম। উনি মুখ টিপে হাসছিল, উনার চোখে~ মুখে প্রাপ্তির আনন্দ বিরাজ করছিল।
আমার পালা শেষে উনার কবুল বলার পালা এল। উনি এক দমে ৩বার কবুল বলে ফেললেন। দাদীমাসহ আশেপাশের লোকজন হাসছিল তার এই অবস্থা দেখে।

অতঃপর আমাদেরকে পাশাপাশি বসানো হল। আমি বারবার লুকিয়ে লুকিয়ে উনার দিকে তাকাচ্ছিলাম। উনি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
~ বরকে দেখার লোভ সামলাতে পারছোনা বুঝি!
~ ইয়ে মানে ওইসব কিছু না।
~ এই বউ!
~ হ্যা।
~ আজ তোমাকে দেখতে ভীষণ মিষ্টি লাগছে।

আমি লজ্জায় আর কিছু বলতে পারলামনা। এরপর আমরা একে অপরকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানালাম। খাওয়া~ দাওয়ার আয়োজনে আমাকে উনি খাইয়ে দিলেন। আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম তা দেখে দাদীমা বললেন,
~ স্ত্রীকে নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়া সুন্নত নাতবউ। এতে ভালোবাসাও বাড়ে।

তারপর দাদীমা আমার হাত মেহরাবের হাতে রেখে বললেন, দুজন প্রতিজ্ঞা করো একে অপরের কাছে। সবসময় একে অপরের পাশে থাকবে, একে অপরের অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করবে। নিজেদের রাগ~ অভিমানকে তোমাদের ভালোবাসার থেকে বড় করে দেখবেনা।
দুজন দুজনের ভালো থাকার দায়িত্ব নিবে।

আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ইনশা~ আল্লাহ।” দাদীমা আমার কপালে চুম্বন করে বললেন, স্বামীর প্রতি অনুগত থাকবে এবং নিজের কর্তব্য পালনে অবহেলা করবেনা। তার সব দায়িত্ব তোমার।

সমস্ত নিয়মকানুন শেষ করে আমাকে উপরে নিয়ে যাওয়া হল। পোশাক পরিবর্তন করে শাড়ী পরানো হল, বিভিন্ন গয়নাগাটি, খোপায় লাল গোলাপ সব মিলিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ বধু মনে হচ্ছিল। চোখের সামনে শুধু মেহরাবের মুখটাই ভাসছিল, ওকে দেখার জন্য যেন মনটা ছটফট করছিল। সাজসজ্জা শেষে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল প্রাসাদের থেকে খানিকটা দূরে তৈরী মনোরম কক্ষে। এখানে সবকিছু এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে যে চোখ ফেরানো যাচ্ছিলনা। পর্দা, তাজা ফুল বিভিন্ন কিছু দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে।

আমাকে বসিয়ে মরিয়ম বলল, একটু অপেক্ষা করুন, ভাইকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। শুভকামনা আপনাদের জন্য, দোয়া করি আপনাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হোক।

উত্তরে আমি ধন্যবাদ বলে মুচকি হাসলাম।

কিছুটা সময় পর মেহরাব এসে কক্ষে প্রবেশ করল। সুন্দরভাবে সালাম দিয়ে আমার পাশে বসল। তারপর আমার হাতটা ধরে বলল, শোকর~ আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই এভাবে আমাদের এক করে একটি সুন্দর জীবনের প্রদানের জন্য। এটি আমার জীবনের অন্যতম আনন্দের দিন যে আমি আপনাকে নিজের স্ত্রীরুপে পেয়েছি। কথা দিলাম, আপনার সকল দায়িত্ব আমি হাসিমুখে পালন করব। আপনি আমার গৃহের রাণীরুপে থাকবেন, আপনার কষ্ট হবে আমার কষ্ট। আপনার খুশি হবে আমার আনন্দ।

কখনো যদি আমার প্রতি কোনো অভিযোগ আসে, নির্দ্বিধায় জানাবেন। আমি শুধরে নেব। আপনি কেবল আমার স্ত্রী ই নন, আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ। আপনার উপর কোনো বিপদ আমি আসতে দিবনা।

আমার সামর্থ্য অনুযায়ী আমি মোহর ধার্য করেছে, সেগুলো গ্রহণ করে আমাকে দায়মুক্ত করুন। বলে আমার হাতে একটা ভারী লাল থলি দিলেন।
তারপর আমাকে বললেন, বউ আপনার কিছু বলার নেই। আজ আপনার মনের সমস্ত আবেগ~ ভালোবাসা বলতে পারেন। আজ আমাদের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে।
আপনার সমস্ত অনুভূতি সম্পর্কে আমি শুনব।

আমি একটু চুপ থেকে উনার হাত থেকে হাত সরিয়ে বললাম, আপনাকে স্বামী হিসেবে পুরোপুরি মেনে নেওয়ার জন্য আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। এই মূহুর্তে আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত নই।

মেহরাব আমার থেকে হয়ত এমন কথা আশা করেনি তাই উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে চাইলে আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম
~ আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, আমার কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন। আপনার আপত্তি না থাকলে আমি ঘুমাতে যাব।
মেহরাব শুকনোমুখে বলল, অবশ্যই।

তারপর আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। টের পেলাম আলো নিভিয়ে উনি বেরিয়ে গেলেন।

পর্ব ১৬

সারারাত আমিও ঘুমাতে পারলামনা, মেহরাবের হাসিমাখা মুখটা চোখের সামনে ভাসছিল। অপেক্ষা করলাম উনার আসার, কিন্তু উনি আর আসলেননা। শেষ রাতে উঠে শাড়ি~ গয়না ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে বাহিরের দিকে তাকালাম। চারিদিকে নির্জনতা বিরাজ করছে, মেহরাব কোথাও নেই। উনি কি তবে প্রাসাদে ফিরে গেলেন! চোখে ভেঙ্গে পড়ছিল ঘুমে, সারাদিনের এত ক্লান্তি যেন ভর করেছে শরীরে।

খারাপ লাগছিল তাই আবার শুয়ে পড়লাম। কখন জানি না, ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙ্গল সকালের হালকা রোদের আলোয়, বোধহয় কেউ এসে জানালা খুলে দিয়েছে। উঠতে খুব দেরী হয়ে গেছে আমার। দাদীমা কি ভাববেন কে জানে! উঠে বসতেই দেখি বেডটেবিলের উপর তাজা গোলাপের তোড়াসহ চা রাখা আছে। তোড়া হাতে নিতেই সেখানে একটা চিরকুট গোজা দেখলাম। চিরকুটে লেখাঃ “শুভ সকাল, ভালো কাটুক আপনার সারাটা দিন।”

এসব কি মেহরাব রেখে গেছেন! উনি আমাকে জাগালেননা কেন? এমনসময় মরিয়ম কক্ষে প্রবেশ করে সালাম দিয়ে বলল, আপনি উঠে গেছেন ভাবীসাহেবা?

~ হ্যা, বড্ড দেরী হয়ে গেছে। দাদীমা নিশ্চয়ই রেগে আছেন।

~ না ভাবী তেমন কিছুনা। আপনি তৈরী হয়ে প্রাসাদে আসুন, সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
~ ঠিক আছে। শুনো, উনি কোথায়? উনাকে দেখেছো?

~ নাহ ভাবী, সকাল থেকে দেখিনি। আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম কাজকর্মে, তাই খেয়াল করা হয়নি। হয়ত থাকবে আশেপাশের কোথাও। আমি তাহলে আসি?
~ আচ্ছা এসো।
ফ্রেশ হয়ে এসে চা খেলাম। চা টা ভীষণ ভালো বানিয়েছে, যেমন সুগন্ধ~ রঙ ঠিক তেমন ই স্বাদ। সব পোশাক~ প্রসাধনী গুছিয়ে প্রাসাদের দিকে চললাম। শাড়ির আচল দিয়ে বড় ঘোমটা দিয়ে দাদীমার কক্ষে প্রবেশ করলাম। উনি আমাকে দেখে ভিতরে ডাকলেন, আমি মুখে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। চারিদিক একবার দেখে নিলাম, মেহরাব এই কক্ষে নেই। দাদীমা সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,
~ কেমন আছো নাতবউ?

~ আলহামদুলিল্লাহ ভাল। আপনার সব কুশল তো?

~ আল্লাহর রহমতে সব কুশল। আজ তো তোমার অনেক দায়িত্ব, এটা আমাদের জ্বীন বংশের সব বউদের ই থাকে।
~ আজ্ঞা করুন।
~ আজ আমরা তোমাদের মানুষদের কিছু এতিমখানার বাচ্চাদের খাওয়াব, আমাদের কিছু পুরুষ দুনিয়ার কিছু জানাযায় অংশগ্রহণ করবে।
আর তোমাকে তাদের জন্য রান্না করতে হবে। তারপর পাক~ পবিত্র হয়ে গোলাপজল দিয়ে আমাদের গোপনকক্ষ মুছে নিবে। তবে সেখানকার কোনো জিনিসে হাত দিবেনা। মরিয়ম তোমাকে সব বুঝিয়ে দিবে।

~ ঠিক আছে দাদীমা। তবে আমি এক্ষুণি কাজে লেগে পড়ি।
~ আচ্ছা, সাবধানে করো।

দাদীমাকে মেহরাবের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করতে পারলামনা, উনি আবার কি মনে করে বসেন। উনি আমাকে আবার পিছু ডেকে বললেন,
~ তোমার কি একবার নিজের বাড়ী থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছে? এই কথা শুনে ভেতরটা কেমন কেপে উঠল। কতদিন বোন আর বুড়িমাকে দেখিনা, কেমন আছে তারা কে জানে! দাদীমার কথা শুনে বোনের জন্য খুব মন খারাপ লাগছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
~ আপনি যদি অনুমতি দেন তবে। তাছাড়া আপনাদের শর্তমতে, আমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করে, সব ছেড়ে চলে এসেছি। এখন এই জ্বীনরাজ্য ই আমার আপন বাড়ী।

দাদীমা আর কিছু বললেননা, ইশারায় যেতে বললেন। হালকা কিছু খেয়ে রান্নাবান্নার কাজে লেগে পড়লাম, রান্নাবান্না করতে করতে বোনের কথা খুব মনে পড়ছিল। জানি বোন আমাকে এর জন্য কোনোদিন ও ক্ষমা করতে পারবেনা। ভালোবাসার মোহে নিজের সবকিছুই হারালাম, আর যার জন্য হারালাম তার কাছে শুধু প্রতারণা ই পেলাম।

রান্নাবান্না শেষ করে প্রাসাদে ঘুরে ঘুরে মেহরাবকে খুজতে লাগলাম। কোথাও উনাকে দেখতে পেলামনা। হঠাৎ উনি সামনে এসে বললেন, আমাকে খুজছিলেন বউ?
~ হ্যা আসলে সকাল থেকে দেখা পাচ্ছিলামনা তো।

~ আমাকে এতিমখানায় খাবার সরবারাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার কাজেই ব্যস্ত। কেমন আছেন আপনি? ঘুম ভালো হয়েছে তো!
~ হুম।

একটা কাগজ মোড়ানো বস্তু আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনার জন্য।
~ কি এটা?
~ পরে খুলে দেখবেন না হয়। আমাকে যেতে হবে, আজ হয়ত ফিরতে দেরী হবে। নিজের খেয়াল রাখবেন।
~ আপনিও। ফি~ আমানিল্লাহ।

মরিয়ম এসে বলল, ভাবী আপনি এখানে? আপনাকে দাদীমা ডাকছেন বাকি কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি যেতে যেতে উনার দিকে তাকালাম, উনি হাসিমুখে বিদায় দিলেন। প্যাকেট টা নিজের কক্ষে রেখে দাদীমার কাছে গেলাম। উনি আমাকে আর মরিয়ম কে নিয়ে প্রাসাদের নামাযকক্ষে এলেন, সেখানে একটা দরজা দৃশ্যমান হল। এই দরজাটার অস্তিত্ব আমি আগে কখনোই টের পাইনি। সেই দরজায় প্রবেশ করার পর আরেকটি বড় দরজা দেখলাম।

দাদীমা কিছু বিড়বিড় করে বলা মাত্র ই দরজাটা খুলে গেল। ভিতরটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত ঝলমলে কক্ষ আমি এই প্রাসাদে আর দেখিনি। এখানকার জিনিসপত্র খুব ই অমূল্য এবং পুরনো মনে হচ্ছে। দাদীমা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই কক্ষটি তুমি গোলাপজল দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করবে এবং এর প্রতিটি কোণায় আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুকে দিবে।
~ আচ্ছা দাদীমা।

~ মরিয়ম তুই ওর কাজে সহায়তা করে পাশে থাক। কাজ সম্পন্ন হলে আমাকে খবর প্রেরণ করবি। মরিয়ম মাথা নাড়ামাত্র দাদীমা কক্ষ ত্যাগ করলেন। মরিয়ম গোলাপজল ভর্তি গোলা আমার সামনে রেখে বলল, ভাবী আপনি শুরু করুন, আমি হাতে হাতে সাহায্য করছি।
~ এই কক্ষ এত গোপনীয় কেন মরিয়ম?
~ এখানে জ্বীনজাতির সবচেয়ে দামি বস্তু সংরক্ষিত আছে বলে।
~ কি সেটা?

~ জ্বীনজাতির তলোয়ার। এই তলোয়ারের ধারের আলো তেই এই কক্ষ এত আলোকিত। ওই যে বড় সিন্দুক টা দেখছেন সেখানে এটা সযত্নে তোলা আছে।
কথিত আছে, জ্বীনদের কাজে খুশি আল্লাহর এক প্রিয় নবী আমাদের পূর্বপুরুষদের এটা উপহার দেন। এই তলোয়ার কোনো সাধারণ তলোয়ার নয়। এই তলোয়ারের আশ্চর্যজনক ক্ষমতা হল এটি দ্বারা খুব সহজেই কাফির শত্রুকে বিনাশ করে জ্বীনরাজ্যের ক্ষমতা আওতায় আনা যায়। এই তলোয়ার যার কাছে থাকে, জ্বীনরা তাকে তাদের সর্দার হিসেবে মান্য করে।

তাই তো এই তলোয়ার ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য মানুষ থেকে শুরু করে বদজ্বীনরা পর্যন্ত বারবার হানা দিয়েছে এই জ্বীনরাজ্যে। এইজন্যই এটি খুব গোপনে এবং সংরক্ষিত স্থানে রাখা হয়েছে।

আমি শুনে ভীষণ অবাক হলাম। পুরো কক্ষ পরিষ্কার করে দাদীমার কথা অনুযায়ী কাজ করলাম। তারপর মরিয়ম সহ বেরিয়ে গেলাম, খুব ইচ্ছে হল তলোয়ার টা একবার দেখতে। কিন্তু বলার সাহস হলনা। বেরিয়ে যাওয়া মাত্র কক্ষের দরজাসমূহ অদৃশ্য হয়ে গেল।

কক্ষে এসে প্যাকেট টা খুলতেই দেখলাম, এটাতে মিষ্টান্ন রাখা আছে। প্রায় কয়েকপ্রকার মিষ্টি, আমি মিষ্টি খুব একটা পছন্দ করিনা। তাও মেহরাবের উপহার বিধায় একটি মুখে দিলাম, দিয়ে চমকে উঠলাম এমন স্বাদের মিষ্টি আমি কখনোই খাইনি। ছোটবেলাউ শুনেছিলাম, জ্বীনরা মানুষের বানানো মিষ্টি কিনে নিয়ে আসে অথবা চুরি করে আনে। এগুলোর স্বাদ চেখে আমার কাছে মনে হচ্ছেনা এগুলো মানুষের তৈরী মিষ্টি।

এমনসময় আমার দরজায় কড়া পড়ল। দরজা খুলে অবাক হয়ে রইলাম। সেই মেয়েটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে, যে নিজেকে মেহরাবের বাগদত্তা বলে পরিচয় দিয়েছিল।
~ আপনি!!
~ হ্যা, ভিতরে আসব?

~ হ্যা আসুন।

মেয়েটি এসে আমার কক্ষের বিছানায় বসল। কালকের বিয়ের পোশাক~ গয়না তখনো বিছানার উপরের ই গুছিয়ে রাখা ছিল। মেয়েটি তা হাতে নিয়ে কান্না শুরু করল।
~ কাদছেন কেন?

~ এগুলো আমার স্বপ্ন ছিল, আজ সব তোমার হয়ে গেল। আমার মেহরাব ও তোমার, ওর খেয়াল রেখো। আমার যা সর্বনাশ হওয়ার তা হয়েই গেছে।
~ কিছুই হয়নি। আমাদের মধ্যে কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। বিয়েটা আমাকে করতে হয়েছে, কিন্তু আপনাকে দেওয়া কথা আমি ভুলিনি। আমি খুব শীঘ্রই জ্বীনরাজ্য ছেড়ে আমি যাব।

আপনি বার বার কেন আমাকে মনে করিয়ে দিতে আসছেন! কাল রাতেই তো আপনাকে আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলাম, এর জন্য আমি মেহরাবের সাথে খারাপ ব্যবহার ও করেছি।
~ বোন তুমি এভাবে বলছো কেন?

বিরক্ত হচ্ছো। থাক তোমায় কিচ্ছু ত্যাগ করতে হবেনা, সুখী হও বোন।
~ আমি আমার কথা রাখব মেহেরজান।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এখন আপনি আসুন। আমার শরীরটা খারাপ লাগছে।

মেয়েটা চলে যাওয়া মাত্র আমি কক্ষের দরজা বন্ধ করে কাদতে লাগলাম। কাল সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল, মেহরাবকে দেখে আমি উনার বাগদত্তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মন থেকেই মেহরাবকে স্বামী হিসেবে মেনেই নিয়েছিলাম।

আমাদের বাসরকক্ষে মেহরাবের প্রবেশের পূর্বে এসেছিল তার বাগদত্তা মেহেরজান। আমাকে প্রকাশ্য বেঈমান, প্রতারক এবং স্বার্থপর আখ্যায়িত করেছিল। বলেছিল,

“সব জেনেশুনে আমি কেবল নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মেহরাবকে বিয়ে করেছি, আমি কথা রাখিনি। আমার বংশ খারাপ।” মুখ বুযে সব শুনেছিলাম। তারপর কথা দিয়েছিলাম তাকে, আমাদের মধ্যে কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠবেনা। মেহরাব তার ই থাকবে, আমি চলে যাব কিছুদিনের মধ্যেই।
এইজন্য মেহরাবকে আমি ওভাবে বলেছি, অনেক কষ্ট হয়েছিল এসব বলতে কিন্তু কোনো উপায় ছিলনা। নিজের অপমান সহ্য করতে পারব, কিন্তু নিজের পরিবারের ব্যাপারে বাজে মন্তব্য সহ্য করতে পারিনি।

বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছি আমি, চক্রকারে ঘুরছে আমার জীবনটা। কোথাও স্থির হতে পারছিনা।

পর্ব ১৮

সারারাত আমি মেহরাবের জন্য অপেক্ষা করলাম কিন্তু মেহরাব আর ফিরলনা। আমার মাথায় কতশত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, সব মেহরাব কে জিজ্ঞেস করার ছিল। উনি তো আর ফিরলেন ই না। শেষরাতে আমি কক্ষ থেকে বেরিয়ে উনাকে খুজতে লাগলাম।
কোথাও না পেয়ে দাদীমার কক্ষে আসলাম। কক্ষের দরজা ভিতর থেকে আটকানো, ডাকব কি ডাকব না কয়েকবার দরজায় কড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে দাদীমার কন্ঠ ভেসে এল, “মুশায়রা, আমি এখন ব্যস্ত। তুমি পরে এসো।”

আমি আর না দাঁড়িয়ে কক্ষে ফিরে এলাম। মেহরাব কি দাদীমার কক্ষে অবস্থান করছে? ঠিক বুঝতে পারছিনা। মনের মধ্যে একটা দৃঢ় ধারণা হল, মেহরাব মেহেরজানের সাথে আছে। মেহরাব আমাকে অপেক্ষা করিয়ে মেহেরজানের সাথে সময় কাটাচ্ছে। কি দরকার ছিল এসব অভিনয়ের! প্রাক্তন বাগদত্তার কষ্ট উনাকে এতটাই বিমর্ষ করল যে উনি ছুটে চলে গেলেন।

এইদিকে উনার বিবাহিতা স্ত্রী সারারাত উনার জন্য অপেক্ষা করছে এতে উনার কিছুই আসে যায়না।
সারাদিন যা করেছেন, এসব উনার কেবল লোক দেখানো ভালোবাসা! আমার প্রতি কর্তব্য সমাধা! এমনসময় কক্ষে মেহরাব ফিরে এল। উনাকে কেমন বিমর্ষ দেখাচ্ছে, নিশ্চয়ই মেহেরজানকে বুঝাতে পারেননি কিংবা তার কষ্ট মেহরাবের জন্য সহ্য হচ্ছেনা! আমি মেহরাবের সামনে গিয়ে বললাম,
~ আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।

উনি বিছানায় বসে পড়ে বললেন, বলো।
~ মেহেরজানের সাথে আপনার সম্পর্ক কি?

উনি বিমর্ষতার মধ্যে চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মেহেরজানের কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?
~ আমি যা যা বলছি আপনি শুধু তার ঠিক ঠিক জবাব দিন। এর বাইরে কোনো ব্যাখার প্রয়োজন নেই।
~ মেহেরজান আমার প্র‍য়াত বাগদত্তা। ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।

~ আপনি জানতেন মেহেরজানের সাথে আপনার বিবাহ ঠিক ছিল তাহলে আপনি কোন উদ্দেশ্যে আমাকে বিবাহ করতে চাইলেন? কেন আমাকে জ্বীনরাজ্য পর্যন্ত টেনে আনলেন?

মেহরাব একটু নীরব হয়ে রইল। তারপর বললেন,
~ হ্যা আমি জানি, আমি কথা ভঙ্গকারী।

~ কেবল কথাভঙ্গকারী ই নয়, আপনি একজন প্রতারক ও বটে।

মেহরাব বিস্ফোরিত চোখে আমার পানে তাকাল। আমি তা কটাক্ষ করে বললাম,
~ যে পুরুষ বাগদত্তা থাকা সত্ত্বেও তাকে ঠকিয়ে অন্য একটা মেয়েকে বিবাহ করতে পারে, নববিবাহিতা স্ত্রীকে তোয়াক্কা না করে বাগদত্তার কষ্টে ছুটে যায় এবং সারারাত তার সাথে কাটায় তাকে কি কেবল কথাভঙ্গকারী কিংবা প্রতারক বলা যায়!

মেহরাব কিছু না বলে বেরিয়ে যেতে চাইল। আমি তাকে আটকে বললাম, এভাবে আর কতদিন পালাবেন! আর কোথাও পালানোর সুযোগ নেই আপনার।
~ মুশায়রা তুমি মাথা ঠান্ডা করো তারপর আমি তোমাকে সব খুলে বলব। তুমি যে ধারণা পোষণ করছো তা সম্পূর্ণ ভুল।
~ কোনটা ভুল? সারারাত মেহেরজান আপনার সাথে ছিলনা? আপনি বাগদত্তা থাকাসত্ত্বেও আমাকে ঠকাননি।
~ সব ই ঠিক। কিন্তু তুমি শান্ত হয়ে সবটা শুনো।

~ আর কিছুই শোনার নেই। আমার ভুলটা কি ছিল বলুন তো! আপনি জ্বীন জেনেও আপনাকে ভালোবেসে এত কিছু সহ্য করে জ্বীনরাজ্যে আসা! অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম।

আর কিচ্ছু চাইনা আমার, আমি এই সম্পর্কটা শেষ করতে চাই। আপনি আমার এখান থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
মেহরাব আমার গাল দুটো জড়িয়ে ধরে বলল,
~ তুমি এসব কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছো?
এভাবে ভুল বুঝোনা আমাকে।

~ ঠিক বুঝার রাস্তাটা আমার বন্ধ করে দিয়েছেন আপনি!

এমনসময় মেহেরজান আমাদের কক্ষের সামনে এসে দাড়াল। আমার চোখ পড়তেই আমি তাকে টেনে মেহরাবের সামনে দাড় করলাম। তারপর ওকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
~ আমার জন্য তোমার অনেক বড় সর্বনাশ হয়েছে না!
এখন আমি তোমাকে তোমার সব ফিরিয়ে দিচ্ছি।

আমি মেহরাবের জীবন থেকে চলে যাচ্ছি।

মেহেরজান আমার হাত দুটো ধরে বলল,
~ ভাবী তুমি এসব বলছো? তুমি মেহরাবের বিবাহিতা স্ত্রী। আমার কোনো সর্বনাশ হয়নি, যেটা ভাগ্যে ছিল সেটাই হয়েছে। আমি এ নিয়ে একটুও বিচলিত নই।
মেহরাব তুমি ভাবীকে আটকাচ্ছো না কেন? ভাবী অনুরোধ করছি তোমার কাছে, আমার জন্য তুমি তোমাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের সৃষ্টি করোনা।
আমার কোনো অভিযোগ নেই তোমাদের প্রতি।

আমি মেহেরজানের এই রুপ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। যে মেয়ে আমাকে এত কটু কথা শুনিয়েছে মেহরাব কে নিয়ে, সে এখন এসব বলছে। এসব কি তার ছলচাতুরী মেহরাবের সামনে নিজেকে সৎ আর ভালো প্রমাণ করার!
খানিকবাদে সে আবার এসে আমাকে কটু কথা শোনাবে বলে!

মেহেরজান আমাকে আর আমার পরিবারকে নিয়ে যথেষ্ট কটুকথা বলে এখন মেহরাবের সামনে ভালো সাজছে। আমি রেগে গিয়ে বললাম, ভালোই অভিনয় জানো তুমি। বিয়ের আগের দিন অবধি তুমি আমার পা ধরে কান্নাকাটি করে বলেছিলে আমি যেন তোমার সর্বনাশ না করি, বিবাহ করেছি বলে তুমি আমার মৃত মা~ বাবাকে অবধি কটুকথা বলেছো আর আজ তুমি ভালোমানুষি দেখাচ্ছো।
মেহরাব অবাক হয়ে বলল,

~ এসব তুমি কি বলছো?
~ ঠিক ই বলছি। এই মেয়েটা সব নষ্টের মূল, আমাদের সম্পর্কে ও ই বিষ ঢেলেছে। কি না করেছে ও!
মেহেরজান আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করল,

~ ভাবী আপনার কোথাও ভুল হচ্ছেনা। আমি এমন কিছুই করিনি। আপনারা আপনাদের কলহ মিটিয়ে নিন, আমি কথা দিচ্ছি আমি আর আপনাদের সামনে আসবনা।
~ অনেক হয়েছে মেহেরজান।

একটা সম্পর্কের মূল ভিত্তি ভেঙ্গে দিয়ে তার উপরের অংশ ঢালাই করে সেটা গড়ে তোলা কেবল বৃথা। সেই বৃথা চেষ্টা করে নিজেকে আর ভাল সাজিওনা।
তোমার মিথ্যাচার আমার সহ্য হচ্ছেনা। প্রতিটা মূহুর্ত তোমার কটুকথা, অসদাচরণ আমাকে কষ্ট দিয়েছে। প্রতিটা মূহুর্ত আমি নিজের সাথে লড়াই করেছি। আর সে তোমার মুখে এত কথা মানায় না।

মেহরাব আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তুমি এভাবে একজনকে অকারণে দোষারোপ করতে পারোনা মুশায়রা। মেহেরজান তেমন মেয়ে ই নয়, যেমন তুমি বর্ণনা দিচ্ছো।
~ খুব আঘাত লাগছে আপনার! ওর জন্য খুব খারাপ অনুভব হচ্ছে। তাহলে বিয়েটা কেন ওকে করলেননা, আমাকে নাহয় দাসী বানিয়ে রাখতেন। আপনারা জ্বীনরা তো অনেক নিচে নামতে পারেন, প্রয়োজনে অনেক হিংস্র হতে পারেন।

মেহরাব রেগে গিয়ে আমাকে চড় মারার জন্য হাত তুলেছিল। মেহেরজান আটকে দিয়ে বলল,
~ মেহরাব তুমি কি করতে যাচ্ছো? শান্ত হও। দাদীমা তোমায় এটা শিক্ষা দেননি।

~ কি করব আমি মেহেরজান? ও কোনো কথা ই বুঝতে চাচ্ছেনা, বলার সুযোগ টুকু দিচ্ছেনা। নিজের মত করে সব ভেবে যাচ্ছে, তোমার সম্পর্কে কিছু না জেনে তোমাকে অপমান করছে।

~ থামলেন কেন মেহরাব? মারুন আমাকে, এই প্রতিদান পাওয়ার জন্য ই আমার এতদূর আসা। মেহেরজান কেন আটকাচ্ছো তুমি!
~ মুশায়রা তুমি চুপ করো।

~ আর কত চুপ থাকব আমি? আমার পক্ষে আর এসব মুখ বুজে সহ্য করা সম্ভব নয়। আমি এখান থেকে ফিরে যাব, আপনার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবেনা।
আপনি আমার ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
বলে আমি কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলাম।

কক্ষ থেকে বেরিয়ে দাদীমার কক্ষে প্রবেশ করলাম আমি। দাদীমা আমাকে দেখে বলল, নাতবউ তুমি কাদছো কেন?
আমি দাদীমার পায়ে পড়ে বললাম,

~ ক্ষমা করবেন আমায়। আমার পক্ষে এখানে থাকে আপনার নাতবউয়ের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। আমার আমার নিজের বাড়ীতে ফিরে যেতে চাই, আপনি আমাকে অনুমতি দিন। দয়া করে আমাকে থাকার অনুরোধ করবেননা।
দাদীমা একটু চুপ থেকে বলল,

~ বেশ তোমাকে তোমার বাড়ীতে পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি আমি। তবে তোমাকে একটা কথা বলব, সম্পর্কটা বিচ্ছেদ করার আগে ভালভাবে চিন্তা করে নিও।

একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা যতটা কঠিন, ভেঙ্গে ফেলা ততটাই সহজ। অতএব, তুমি কিছুদিন নিজের সাথে বুঝাপড়া করে নাও। এই জ্বীনমহল আবার ফিরে আসার আহবান রইল তোমার প্রতি। এই নিয়ে কিছু বলবেনা, এটা আমার আদেশ।
আমি এক্ষুণি তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।

মেহেরজান দাদীমার কক্ষে প্রবেশ করে বলল,
~ দাদীমা আপনি ওকে যাওয়ার সম্মতি কেন দিচ্ছেন?
ও সম্পর্কটা বিচ্ছেদ করে দিতে চাইছে।

~ আমি কেবল ওকে যাওয়ার ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছি।
সম্পর্ক বিচ্ছেদের ব্যাপারে ওকে আরো ভাবার সময় দিলাম।
মেহেরজান, তুমি মেহরাবকে আমার নিকট আসতে বলো।
মুশায়রা তুমি গোছগাছ করে নাও।

~ আমার গোছগাছ করার কিছু নেই দাদীমা। আমি শূণ্য হাতে এসেছি, সেই শূণ্য হাতেই যাব।

~ আমাদের নিয়মানুযায়ী আমরা জ্বীনবংশের বউদের শুণ্য হস্তে পৈত্রালয়ে পাঠাইনা। তুমি তোমার কক্ষে গিয়ে প্রস্তুতি নাও।
বিকালের কিছু পূর্বে আমি যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। একটা ঘোড়ারগাড়ী ঠিক করা হল আমার যাওয়ার জন্য, তাতে কিছু বোঝাই করা উপহারসামগ্রী ছিল। দাদীমাকে সালাম করে বিদায় নিয়ে নিলাম। মেহেরজান এগিয়ে এসে বলল,
~ তাড়াতাড়ি ফিরে এসো ভাবী।

~ আমার চলে যাওয়ায় তোমার ই বেশী লাভ মেহেরজান। ফিরে আসার কথা তুমি না বললে খুশী হব।
মেহরাবকে নিয়ে ভালো থেকো, ওকে সুখী করো।

দোয়া রইল তোমাদের জন্য। আমি আমার কথা রেখেছি, তোমার সব তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছি।

মেহেরজান কিছু বলতে পারল না, একটা চাপা কষ্ট~ অভিমান নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ছুটে গেল। আমি গাড়ীতে উঠে বসলাম। মেহরাব আমার সামনে বসা ছিল, আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিল। আমি সারাপথ উনার দিকে তাকাইনি, কথাও বলার সুযোগ দিইনি।

অনেকক্ষণ পর আমি আমার গন্তব্যে পৌছালাম। কখন যে এসে পড়েছি নিজেকেও খেয়াল করিনি। আমি নেমে চলে যেতে নিলে মেহরাব পিছন থেকে ডাক দেয়,
~ বউ।
~ আমাকে ওই ডাকে ডাকার যোগ্যতা আপনি হারিয়েছেন। দয়া করে ওই ডাকে ডাকবেননা।
কিছু বলার থাকলে তাড়াতাড়ি বলুন।

মেহরাব উপহারসামগ্রী আমার হাতে দিয়ে আমার হাতটা ধরে বলল,
~ এভাবে চলে না গেলে হয়না? ফিরে যাই চল। একটা সুখী সংসার গড়ি।

আমি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে বললাম,
~ এসব হাস্যকর শুনাচ্ছে। আপনি মেহেরজান কে নিয়ে সুখী হন। আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবেন না।
মেহরাব একটা গোলাপফুল আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
~ এটা নিজের কাছে রাখো। কখনো মনে পড়লে না হয় স্মরণ করো।

~ তার প্রয়োজন হবেনা। আসি, আল্লাহ হাফেজ।
মেহরাবের চোখে পানি টলমল করছিল। তা দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল, কান্না আড়াল করার জন্য আমি এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে হাটা দিলাম বাড়ির দিকে। একবারো পিছু ফিরে তাকালামনা।

যখন মায়া বাড়িয়ে লাভ হয়না, তখন মায়া কাটাতে শিখতে হয়।

পর্ব ২০

চোখে~ মুখে পানির ছিটে পড়ায় চোখ মেলে তাকালাম আমি। টের পেলাম আমি কারো কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি সে আমাকে পানির ছিটে দিচ্ছে। ভালো করে তাকাতেই দেখলাম এনি একজন পুরুষ। লাফিয়ে উনার কোল থেকে মাথা সরিয়ে উঠে বসলাম। গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে বললাম, “আপনি কে?”
~ শান্ত হন। আপনার অসুস্থতার ঘোর এখনো কাটেনি।

আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। আসুন, আপনাকে বাসায় নিয়ে যাই। উনি আমার ধরে উঠাতে চাইলে আমি বাধা দিয়ে বললাম,
~ আমি একা যেতে পারব। ধন্যবাদ।

কিন্তু উঠার মত শক্তি আমার একবিন্দু ও নেই। সারাদিনের ক্লান্তি, স্ট্রেস নেওয়ার ফলে শরীর অত্যাধিক দূর্বল হয়ে গেছে, তার উপর না খেয়ে ছিলাম। উনি বুঝতে পেরে বললেন,
~ আপনি একা পারবেননা। আমি আপনাকে সামান্য সাহায্য করে আপনার রুম পর্যন্ত পৌছে দিব। আপনার বাসার সবাই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই ডাকার সাহস করিনি।

~ কিন্তু আপনি কে? আমাদের বাসায় ঢুকলেন কি করে! আপনি কোনো চোর না তো।

ছেলেটা অট্টহাসি হেসে বললাম, চোর হলে মানবতা দেখাতাম বুঝি! নিজের প্রয়োজন সেরেই পালাতাম। ওসব কথা পরে হবে, আপনি আমার হাতটা ধরুন।
অনেকটা অস্বস্তিকর মনোভাব নিয়ে উনার বাড়ানো হাতটা ধরে উঠে দাড়ালাম। উনি আমার হাত ধরে ধরে বাসায় ঢুকে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললেন,

~ এখানে একটু বসুন। তারপর রুমে যাবেন। আমি বরং আপনার বাসার বাকিদের ডাকি।
~ নাহ! সবাইকে এখন বিরক্ত করার প্রয়োজন নেই, আমি ঠিক আছি।

~ কতটা ঠিক আছেন? নিজের রুমে একা হেটে যেতে পারবেন? নিজেকে ঠিক প্রমাণ চেষ্টা না করে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করা বেটার নয়!
~ আপনার পরিচয় এখনো দিলেননা! এত রাতে আপনি আমাদের বাড়ীর বাগানে কি করছিলেন? যদি অন্য কোনো মতলবে ঢুকে থাকেন, এক্ষুণি কেটে পড়ুন।
আমার বোন জানলে আপনাকে আস্ত রাখবেনা।
~ কেন উনি বুঝি মানুষ খায়!

~ আমি মোটেও আপনার সাথে মজা করছি না। সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ, আপনি এখন আসুন।
~ আপনারা মেহমানদেরকে খালি মুখে বিদায় দেন?

আমি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালাম। একটুও ভয় নেই ছেলেটার মধ্যে, কি জানি কি উদ্দেশ্যে এখানে ঢুকেছে। বোন জানলে উনার যে কি হাল হবে!
ছেলেটা মোটামুটি শ্যামলা~ ফর্সা, উচ্চতা মাঝারি লম্বা। চুলগুলো হালকা কোকড়ানো, সামনে হালকা সোনালি বর্ণের। পড়নে টি~ শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। দেখে চোর মনে হচ্ছে না, ভদ্র ছেলে ই লাগছে।

আমি চুপ থেকে বললাম, আপনার ভালোর জন্য ই বলছি এখান থেকে চলে যান।

ছেলেটা হাসতে হাসতে আমার পাশে বসে বলল, আপনারা অতিথিদের এভাবে অ্যাপায়ন করেন? ভারী অদ্ভুত তো!

আমি কপাল কুচকে ছেলেটার দিকে তাকালাম, এত গায়ে পড়া ভাব কেন ছেলেটার! যা থাকে এর কপালে, সাহায্যের মর্যাদা দিচ্ছি জান বাচিয়ে সেটা নিতে আপত্তি।

এমনসময় ভেতরের ঘরের আলো জ্বলে উঠল। নিশ্চয়ই কোনো কারণে বোন উঠেছে। ড্রয়িংরুমের আলো জ্বলতে দেখলে তো এদিকে অবশ্যই আসবে। আমার সাথে এই ছেলেটাকে যদি উলটাপালটা কিছু ভেবে বসে কিংবা চোর সন্দেহে ছেলেটার ক্ষতি করে।
মনে মনে যা ভয় পাচ্ছিলাম তাই হল, বোন এদিকেই আসছে। আমি উনাকে কনুইয়ের গুতো দিয়ে বললাম,
~ পালান এখান থেকে!

~ কেন?
~ দূর ব্যাটা! পালাতে বলসি পালা। বোন এসে আমাদের দেখে কপাল কুচকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুই এখানে কি করছিস?
আমি কিছু বলার আগে ছেলেটাই বলল,
~ বাগানে জ্ঞান হারিয়েছেন উনি। আমি দেখে নিয়ে আসলাম ভেতরে।

আমি ভয়ে ঘামতে লাগলাম। এই কেলো করেছে! এই পাকনা ছেলেটাকে এত কথা বলতে কে বলে? সেধে এখন বড় বাশ আমাকেও খাওয়াবে আর নিজেও খাবে। বোন ছেলেটার দিকে একনজর তাকিয়ে আমাকে বলল,
~ এত রাতে বাগানে কি করছিলি তুই?

~ বাড়ী থেকে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। তোদের বোঝা হয়ে থাকতে চাচ্ছিলামনা।
~ আমি তোকে বলেছি তুই বোঝা! রাগের মাথায় কিছু বললে সেটাই তোর করা লাগবে, করতে গিয়ে উলটাপালটা কাজ করবি পরে মানুষের চোখে অপরাধী হব আমি তাই তো।

~ বোন, আমাকে ভুল বুঝিসনা। একটু আপসেট হয়ে গিয়েছিলাম, তাই যা মাথায় এসেছে তাই করেছি।
উনি আমার জ্ঞান ফিরেছেন এবং বাসা অবধি এগিয়ে দিয়েছেন।
~ ধন্যবাদ তোমাকে।

আমি অবাক হলাম, ছেলেটাকে দেখে বোন তেমন কোনো এক্সপ্রেশন দিলনা। স্বাভাবিকভাবে নিল যেন ছেলেটার এতরাতে এখানে থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
~ তুই এখানে বস, আমি তোর জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসছি। খেয়ে ঘুমাতে যা।

~ বোন, উনাকে…..
~ এত বিচলিত হবার কিছু নেই। ওর নাম ফারহান। আমাদের বাড়ীতে ভাড়াটে হিসেবে থাকে এবং পাশাপাশি আমার কাজের সহকারী। এতক্ষণ বাসায় ছিলনা তাই তুই দেখিসনি। ফারহান, তুমি তাহলে ঘুমাতে চলে যাও।

~ আমি উনাকে রুম পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েই যাচ্ছি।
বোন আর কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

ফারহান আমার পাশে বসে বললেন, এখন কেমন বোধ করছেন ম্যাম? ভয় কেটেছে তো!
~ আপনি এটা আগে বললেন না কেন?

~ আপনি সুযোগটা দিলেন কই! চলুন আপনাকে রুম পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করি।

ছেলেটা আমাকে রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে ফ্যানের সুইচ অন করে দিল। ততক্ষণে বোন খাবার নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে বলল, খেয়ে নে। আর আমার রাগের মাথায় বলা কথাগুলো ধরিসনা, অভিমান থেকেই বলেছি।
~ আমি জানি বোন।

~ আচ্ছা আমি আসছি। ফারহান?

~ আমিও যাচ্ছি। বোন চুপচাপ চলে গেল। তারপর ফারহান আমার সামনে বসে খাবারের প্লেট আমার হাতে দিল।

ক্ষিধের চোটে আমার নাড়িভুড়ি মোচড় দিচ্ছিল। তাই খাবার হাতে পেয়ে গপাগপ খেতে শুরু করলাম। অনেকটা খেয়ে লক্ষ্য করলাম ফারহান আমার এই অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছে। এটাতে লজ্জাবোধ করলাম, এমনসময় আমার খাবার গলায় আটকে গেল। কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ, ফারহান তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস নিয়ে হাতে দিল এবং আমার মাথায় কয়েকটা টোকা দিতে লাগল।
আমি স্বাভাবিক হওয়ার পর বললাম, ধন্যবাদ।

উনি মুচকি হেসে গ্লাস হাত থেকে নিয়ে ট্রেতে রেখে বলল,
~ আচ্ছা তাহলে এখন শুয়ে পড়ুন। ঘুমালে শরীর ঠিক হয়ে যাবে। আমি আলো নিভিয়ে দিয়ে যাচ্ছি, শুভ রাত্রি।
বলে ট্রে নিয়ে আলো নিভিয়ে চলে গেল।

আমি শুয়ে পড়লাম এবং ভাবতে লাগলাম,
~ বোন খুব ভালো একটা ছেলে পেয়েছে। এতদিন পুরুষবিহীন বাড়ীটায় বোনকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম, এখন একটা ভালো ছেলেও থাকছে বোনের দেখা~ শুনা করার জন্য। ভিতরে ভিতরে অনেকটা স্বস্তি পেলাম।

শরীর বেশ ক্লান্ত ছিল তাই শোয়ার সাথে সাথে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম।

মাঝরাতে টের পেলাম, কেউ খুব যত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। স্পর্শটা এতটাই যত্নের সাথে যেন বড্ড গভীর টান আমার প্রতি তার।
বোন কি এতরাতে আমার রুমে এসেছে নাকি……
মেহরাব এসেছেন? ভাবতেই ঘুম ঠেলে একলাফে উঠে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে দেখতে পেলামনা। তবে অনুভব করলাম জানালা দিয়ে খুব দমকা হাওয়া রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এটা কি মেহরাব চলে যাওয়ার সংকেত!

উনি কি সত্যিই আমার কাছে এসেছিলেন নাকি এসব কেবল আমার মনের ভুল! আমি উনার কথা এত কেন ভাবছি? উনি তো আমাকে ঠকিয়েছেন। আমার পবিত্র ভালোবাসা আর অনুভূতি অবমাননা করেছেন।

আর ভাবব না উনার কথা। আমি ভুলে যাব মেহরাব নামের কেউ আমার জীবনে ছিল। দ্বিতীয়বার উনাকে আমি আবার আমাকে ঠকানোর সুযোগ দিবনা।
দেখা হলেই এই মিথ্যা সম্পর্ক শেষ করার দাবি জানাব। মুক্ত করে দিব সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে।
ভাবতে ভাবতে চোখে পানি চলে এল।

আমি আগের মত স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম। খুব সকালে উঠে নামায পড়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম চা~ নাস্তা বানাতে। চা বানানোর সময় ফারহান রান্নাঘরের দরজায় টোকা দিলেন। আমি উনাকে দেখে বললাম,
~ আপনি এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছেন?

~ আমার খুব সকালে উঠে পরার অভ্যাস।
~ রান্নাঘরে এলেন যে? কিছু প্রয়োজন?

~ চায়ের সুগন্ধের টানে চলে এলাম। এক কাপ চা হবে?

~ হ্যা অবশ্যই। এক্ষুনি দিচ্ছি। চুলা থেকে চা নামিয়ে কাপে ঢেলে উনাকে দিলাম। উনি চুমুক দিয়ে বললেন,
~ খুব ভাল চা বানান তো আপনি। কি নাস্তা বানাচ্ছেন?

~ লুচি আর ডিমের কারি। আমার বোনের খুব পছন্দ।
~ নাম শুনেই তো জিভে জল চলে আসল।

~ এই তো লুচি ভেজেই আপনাদের নাস্তা দিয়ে দিচ্ছি।
~ আপনার কপালে বোধহয় ময়দা লেগে আছে।

~ হিহিহি, এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। ময়দা দিয়ে কাজ করতে এলে চুল সামনে চলে আসে, সরাতে গেলে কপালে ময়দা লেগে যায়।
আর কথা না বাড়িয়ে লুচি ভাজা শুরু করলাম। ফারহানের একটা কথায় মনোযোগ দিতে গিয়ে খানিকটা তেল ছিটকে আমার হাতে পড়ল। ফারহান খুব দ্রুত ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে আমার হাতে ঢেলে দিল তাতে জ্বলুনিটা কমে গেল।
~ জ্বালা কমেছে?

~ হ্যা এখন ঠিক আছে। বাকি লুচিগুলো ভেজে নিই।
~ এরপর ও লুচি ভাজবেন?

~ আরেহ এটা ব্যাপার না। জ্বলুনি কমে গেছে, রান্না শেষে মলম লাগিয়ে নিব। একদম সেরে যাবে।
বোন এসে বলল, ফারহান তুমি এখানে?

~ চা খেতে এলাম। মুশু ম্যাম চা খুব ভাল বানায়।
ডিমের কারির সুগন্ধে আর রান্নাঘর ছাড়তে মন চাইলনা।
~ বোন তুই ফ্রেশ হয়ে নে, আমি নাস্তা দিচ্ছি।

ফারহান ভাইয়া, আপনিও ডাইনিং টেবিলে যান। আমি এক্ষুনি আসছি।

ফারহান চলে যাওয়ার পর বোন আমার পাশে এসে বলল,
~ তুই কি তোর বরের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিস? আর তার সাথে সংসার করবিনা।

এই কথা শুনে আমি হাতের কাজ থামিয়ে চুপ হয়ে গেলাম। তারপর স্বাভাবিক হয়ে বললাম, এই সম্পর্কটা বোধহয় কপালে ছিলনা। একপ্রকার জোর করে হয়ে গেছে, জোর করে তো আর সম্পর্ক টিকানো যায়না। তাই বিচ্ছেদ টা হয়েই গেছে।

তুই যা ফ্রেশ হয়ে নে, লুচি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

~ কাল তুই সাথে করে কিসব প্যাকেট এনেছিস, ওগুলোতে কি আছে? আমি কাজ করতে করতে বললাম,
~ আমি ঠিক জানিনা। বড্ড ভালোবেসে দিয়েছে শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা, তাই না করতে পারিনি। তুই খুলে দেখে নিস।
খাওয়া~ দাওয়া শেষে বোন আমাকে রুমে ডাকল। আমি কাজ সেরে বোনের রুমে ঢুকে দেখি বোন প্যাকেটগুলো খুলে দেখছে। আমাকে দেখে ভিতরে ডেকে বলল,
~ এতসব দামী শাড়ি~ গয়না, প্রসাধনী এবং মিষ্টি কেন পাঠিয়েছে তারা?

~ ওদের বাড়ির বউদেরকে খালি হাতে বাপের বাড়ী পাঠায়না। তাছাড়া এমনি তো নিয়ম আছে বউয়ের আত্মীয়স্বজন দের উপহার দিতে হয়।
~ তোর শ্বশুড়বাড়ি কোথায়? আর তুই ওদের ছেড়ে এখানেই বা ফিরে এলি কেন?
~ আমার শ্বশুড়বাড়ি জ্বীনরাজ্যে।

~ মজা করছিস? এখন মজা করার সময়?

~ সত্যিই বলছি। আমি আমার জ্বীনবরকে বিয়ে করেছি।
সে জ্বীনরাজ্যের সম্ভ্রান্ত বংশউদ্ভুত একজন জ্বীন।

জ্বীনদের সাথে হয়ত মানুষের মিল হয়না, তাই বোধহয় সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেছে। তুই এসব রেখে দে, বড্ড ভালোবেসে দিয়েছে তাই ফেলতে পারবনা।
আমি রান্না বসিয়ে এসেছি, আসছি।

একপ্রকার পালিয়ে চলে এলাম বোনের সামনে থেকে। ওকে এত কিছু ভেঙ্গে বলতে চাইনা, এতে হয়ত মেহরাবের অপমান করা হবে। আর নিজের স্বামীর অপমান করার মত মেয়ে আমি নই। উনি আমার সাথে যা ই করে থাকুক, সবসময় চাইব উনি যাতে সুখে থাকেন। আল্লাহ উনাকে ভালো রাখুন।

পর্ব ২১

স্বাভাবিক হয়ে রান্নাঘরের কাজে লেগে পড়লাম। ব্যস্ত থাকলে কিছুটা ভাল থাকি। তাও মনটা মাঝে মাঝে উদাসীন হয়ে যায়, মেহরাবের সুন্দর মায়াবী চেহারাটা মনে পড়ে যায়। অজান্তেই চোখের পানি চলে আসে, ওর দুষ্টুমি গুলো মনে পড়লে নিজে নিজেই হাসি।

কখনো ভাবিনি মেহরাব দেখতে এত সুন্দর হবে, যা দেখে মনে হবে সৃষ্টিকর্তা সব রুপ দিয়ে উনাকে সৃষ্টি করেছে। যেদিন উনাকে শেরওয়ানি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম টাল খেয়ে গিয়েছিলাম। বড়~ ঘন পাপড়িওয়ালা গোল গোল চোখগুলো আমাকে খুব টানত, হালকা খোচা খোচা দাড়িতে উনাকে আরব্য দেশের রাজকুমার মনে হচ্ছিল। যখন উনি আমার কাছে আসত আমি উনার হাতের দিকে লক্ষ্য করতাম, উনার হাতের সোনালী বর্ণের লোমগুলো চিকচিক করত সবমিলিয়ে উনি ছিলেন আমার দেখা সেরা সুপুরুষ।

এসব ভাবতে ভাবতে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছি আর বাহিরে এসে বসলাম। এমনসময় দেখলাম ফারহান জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি ভ্রু নাচিয়ে বললাম, কিছু বলবেন?

~ একাই কফি খাচ্ছেন? একবার সাধলেন ও না!

~ আসলে আপনি দেখলাম বোনের সাথে কাজ নিয়ে কথাবার্তায় ব্যস্ত। তাই আর খাবেন কিনা জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করলামনা।
~ কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, এক কাপ কফি হলে খারাপ হবেনা। সাথে সস দিয়ে কাবাব বা চপ দিলে আমি মাইন্ড করবনা।
আমি উনার কথায় হেসে বললাম, আচ্ছা নিয়ে আসছি।

কাবাব বানিয়ে কফিসহ রুমে দিয়ে আসতে দেখি উনি নেই। বোনকে নিয়ে আবার বের হলেন নাকি! খেয়াল করলাম উনি বাহিরে থেকে আমাকে ডাকছেন।
অবাক হয়ে ভাবলাম, উনি বাগানে কি করছেন?

গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে এসব দেওয়ার জন্য খুজছি আর আপনি এখানে! কি করছেন?
~ বাগানটা পুরো মরেই গেছে। তাই কিছু গাছ এনে রেখেছিলাম পুতে দেব বলে, তাই সেটাই করছি।
বাগানটা আপনার ই ছিল তাইনা?

~ হ্যা, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এসে বাগানটা না দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। এই যে নিন আপনার কফি আর কাবাব।
~ পুকুরের সিড়িতে রাখুন। এখানে বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে খেতে ভালোই লাগবে।
~ বোন কোথায় আপনি জানেন?

~ রুমেই তো ছিল। আচ্ছা আমি ডেকে আনি, উনাকে না দিয়ে খেলে যদি আমার চাকরি নট করে দেয়।

ফারহান চলে যাওয়ার পর আমি ঘুরে ঘুরে বাগানটা দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। হঠাৎ পায়ের কাছে একটা গোলাপ পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিলাম। এটা তো সেই গোলাপ, যেটা সেদিন মেহরাব আমাকে দিতে চেয়েছিলেন। এটা তো আমি নিইনি, তাহলে এখানে কি করে এল! তবে কি মেহরাব কাল সত্যিই এসেছিল?
গোলাপটা অভিমান করে ফেলে দিতে পারলামনা, বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখলাম। জানিনাহ উনার সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে কিনা! তবে যেখানে যেভাবেই থাকুক ভালো থাকুক।

সন্ধ্যায় বোনের রুমে গিয়ে দেখলাম ও ব্যাগের জিনিসপত্র গুলা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি নিয়ে গায়ের উপর জড়িয়ে দেখছে। আমি বললাম,
~ শাড়ি পছন্দ করছিস? কোথাও যাবি!

~ তুই কি ভুলে গেছিস কাল হালিম চাচা এসে তার মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেল! হঠাৎ করে শাড়ি পরার ইচ্ছে হল। আমার কোনো শাড়ি নেই, তুই তো বিয়ের পরও শাড়ি পরিসনা যে তোর থেকে নিব। তোর আনা ব্যাগের কথা মনে পড়ল, সেখানকার শাড়ি ঘাটাঘাটি করছি। আপাতত কোনোটাই মনে ধরছেনা। আচ্ছা দাড়া অন্য ব্যাগটা দেখি।

বোন আলমিরা থেকে অন্য ব্যাগটা বের করে শাড়ি বাছতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি বিছানার এক কোণায় বসে বের করে রাখা শাড়িগুলো অতি যত্নে ভাজ করে রাখতে লাগলাম।

খানিকবাদে বোন বলে উঠল,
~ এই শাড়িটা তো বেশ। এত সুন্দর জামদানী শাড়ি আমি আর দেখিনি, বেশ হালকা শাড়িটা। পড়লে সামলাতে সমস্যা হবেনা, গাঢ় নীল রঙ্গটা আসলেই সুন্দর।
তোর শ্বশুড়বাড়ির লোকের পছন্দ আছে বলতে হয়।

গাঢ় নীল রঙ শুনে আমি চমকে উঠলাম। মূহুর্তেই বোনের হাত থেকে শাড়িটা কেড়ে নিলাম, এই তো সেই শাড়িটা যেটা মেহরাব আমাকে উপহার দিয়েছিল।
অনেক পছন্দ করে বাসর রাতের উপহার হিসেবে উনি এই শাড়িটা এনেছিলেন। কিন্তু আমি সেরাতে অভিমান করে শাড়িটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।
এটা ব্যাগের মধ্যে রেখে দিল কে!

বোন রেগে গিয়ে বলল, তুই শাড়িটা এভাবে কেড়ে নিলি কেন?

~ বোন এই শাড়িটা আমার কাছে অতি মূল্যবান। তুই অন্য শাড়িগুলো দেখ, সেখান থেকেই পছন্দ করে একটা পরে নে।
~ আমার এটা পছন্দ হয়েছে। তুই এমন অদ্ভুত আচরণ করছিস কেন? আমি কি শাড়িটা খেয়ে ফেলব?
তুই ই ত কাল বললি এসব শাড়ি যেন আমি রেখে দিই। সেই হিসেবে তো এই শাড়ি আমার, দিয়ে দে।
~ এটা আমি দিতে পারব না।

আমাকে ভুল বুঝিসনা, এটা তোকে দিতে আমার আপত্তি থাকতনা। কিন্তু আমার জন্য ভালোবেসে আমার বর এটা এনেছে, আমি এটা ঠিকমত খুলেও দেখিনি। উনার ইচ্ছা ছিল শাড়িটা আমি পরি।
বোন শাড়িটা আমার কাছেই থাক।

~ বাহ, তুই যে এত হিংসুটে তা তো আমার জানা ছিলনা। জ্বীনরাজ্যে গিয়ে স্বার্থপরতা শিখে এসেছিস? কই তুই তো এমন ছিলিনা। আমি যা চাইতাম তা দিতে কখনো দ্বিমত করতিনা! আজ একটা শাড়ির জন্য তুই আমার সাথে এমন ব্যবহার করছিস!

তোকে বোন ভাবতেও আমার লজ্জা করছে। এই ব্যবহার দিয়ে তুই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিস এসব দামী জিনিস কেবল তোর। তুই এসব অর্জন করেছিস, করুণা করে আমাকে দান করতে চেয়েছিলি।

~ বোন তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি মোটেও সেসব বুঝাইনি। আমি তো শুধু শাড়িটা….
আর কিছু বলার আগে বোন আমাকে চড় মারল।
~ তুই আর একটা কথাও বলবিনা।

এভাবে আমাকে অপমান না করলেও পারতিস, খুব ভালো প্রতিদান দিয়েছিস আমাকে।
তুই জ্বীনরাজ্যের বধূ, এসব পাওয়ার যোগ্যতা তোর ই আছে। আমি এসব ভুলে গিয়ে অকারণেই অধিকার ফলাচ্ছিলাম। সেটা খুব ভাল করে আমাকে বুঝিয়ে দিলি।

আমি চুপ করে শাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার আল্লাহ ই ভালো জানেন আমার মনে কি আছে! বোন তুই অকারণেই আমাকে ভুল বুঝলি।
আমার কেন জানি এই শাড়িটা তোকে দিতে মন সায় দিচ্ছেনা। কেন জানি মনে হচ্ছে মেহরাব বলছে শাড়িটা কেবল আমার লাল টুকটুকে বউটা পরবে। এইজন্য ই শাড়িটা তোকে দিতে আমার খারাপ লাগছিল, আমাকে ক্ষমা করে দিস।

এমনসময় ফারহান এসে রুমে ঢুকল। আমি তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম। ফারহান বোনের দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
~ ম্যাম, এটা আপনার জন্য।

~ এটা কি?
~ সন্ধ্যা থেকে দেখছিলাম আপনি শাড়ি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলেন, দেখে মনে হলনা একটাও আপনার পছন্দ হচ্ছে। তাই আমি শপে গিয়ে একটা পছন্দ করে নিলাম। উপহার হিসেবে নিলে আমি ধন্য হব।

বোন প্যাকেট থেকে শাড়ি বের করে উল্টেপাল্টে দেখে বলল,
~ বাহ, তোমার পছন্দ তো বেশ ভাল। মেরুন রঙটা আমার ভীষণ পছন্দের। কাল আমি এটাই পড়ে যাব।
ধন্যবাদ তোমাকে।

~ আপনি পছন্দ করেছেন এতেই আমি ধন্য হয়ে গেলাম।

আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে শাড়িটা হাতে নিয়েই আমার নিজের রুমে চলে আসলাম।

শাড়িটা থেকে মেহরাবের আতরের সুগন্ধ আসছে। সুগন্ধটা পৃথিবীর যেকোনো দামী পারফিউমকে হারিয়ে দেওয়ার মতই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাজ করা শাড়িটা দিয়ে ঘোমটা জড়িয়ে নিলাম যেভাবে মেহরাব সেদিন জড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিজেকে নিজের কাছে অপূর্ব লাগছিল।
হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ায় শাড়িটা সরিয়ে দিয়ে বললাম,
~ ফারহান আপনি এখানে? কিছু প্রয়োজন?

ফারহান আমার দিকে কিছুক্ষণ আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বলল,
~ এই শাড়িতে কেবল আপনাকেই মানায়।

আমি অস্বস্তিবোধ নিয়ে না শোনার ভান করে বললাম, কিছু বললেন!
~ না তেমন কিছুনা। আপনার গালটা বেশ লাল হয়ে আছে, কি হয়েছে?
~ কিছুনা।

~ বরফ ঘষলে লালচে ভাবটা কমে যাবে।

সবসময় চুপ থাকার ফল কিন্তু ভালো হয়না। কিছু সময় অন্যায় সহ্য না করে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী হয়ে পড়ে।
আমি ফারহানের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে বললাম,
~ এইজন্য ই আপনি শাড়িটা এনেছিলেন?

ফারহান প্রতিউত্তরে জবাব না দিয়ে মুচকি হেসে চলে গেল।

এই ছেলেটার হাবভাব কেমন জানি! বোনকে কখনো এই ছেলেটার সামনে রাগান্বিত হতে কিংবা তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি।
ছেলেটার আসল পরিচয় টা কি! কে হয় সে বোনের। ফারহান আবার এসে বাটিভর্তি বরফ আমার পাশে রেখে বলল,
~ আমাকে সন্দেহ হচ্ছে?
~ কিহ!
~ না মানে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু চিন্তা করছেন, তাই ভাবলাম গোয়েন্দার মত আমাকে নিয়ে কিছু ভাবছেন।
~ আপনি বড্ড কথা বলেন।

~ সেটা আফরাহ ম্যাম ও বলেন।

~ আমার সাথে এত কথা না বললে ই ভাল। আর আমার এত কেয়ারিং আপনাকে করতে হবেনা, অতিরিক্ত কিছুই আমি পছন্দ করিনা। আপনি বোনের কাজের সহকারী, তার প্রতি ই খেয়াল রাখুন সেইটুকু ই যথেষ্ট।

এসব শুনে ফারহান চুপচাপ চলে যাওয়ার সময় পিছনে ফিরে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল।

অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ একটা। এখন উনার এসব আমার অসহ্য লাগছে, শুধু উনার নয় সবকিছুই অসহ্য লাগছে। শাড়িটা আরো গভীরভাবে আলিঙ্গন করে শুয়ে পড়লাম। হয়ত শাড়িটা মেহরাব ভেবে একটু শান্তি খুজছি।

সকালবেলা এসে বোন আমাকে জাগিয়ে বলল,

~ রাতে দেখি শাড়ি জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিস, ভেবেছিস রাতে যদি বোন চুপিচুপি এসে শাড়িটা চুরি করে নিয়ে যায়।
~ বোন, এসব বলিসনা।

খুব খারাপ লাগে এসব শুনতে।

~ হুম এখন বোনকে খুব খারাপ লাগে সেটা আমি জানি।
এসব ব্যাপারে কথা বলে নিজের মুড নষ্ট করতে চাচ্ছিনা।
তাড়াতাড়ি কাজ সেরে তৈরী হয়ে নে বিয়ের দাওয়াতে যেতে হবে।
~ আমি যাবনা বোন।

~ আমাকে ছোট করার কোনো সুযোগ পেলে তুই সেটা ছাড়তে চাসনা তাই তো!

আমার এসব শুনতে খুব খারাপ লাগছিল। বোন আমাকে আবার ভুল বুঝার আগেই আমি বললাম,
~ বেশ আমি যাব তাএ উল্টোপাল্টা ভেবে আমাকে এভাবে কটু কথা বলিসনা।

ফ্রেশ হয়ে নীল শাড়ি পরে নিলাম। বেশী সাজসজ্জা আমার করতে ইচ্ছে হলনা। তাই চোখে হালকা করে কাজল টেনে হালকা করে লিপস্টিক দিয়ে সাধারণ খোপা করলাম।

বোন এসে বলল, তোর গলা খালি কেন? হাতে চুড়ি কই?
~ এসব পরতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।

~ গ্রামের সবাই জানে তুই পালিয়ে বিয়ে করেছিস। এটাও জানে কিছুদিনের জন্য এখানে বেড়িয়ে চলে যাবি। অতএব, নিজেকে সেইভাবে উপস্থাপন কর যেভাবে একজন নতুন বিবাহিতা করে থাকে।

না হলে এতে যেমন আমার সম্মান হানি হবে তেমন তোর বরের নিন্দে হবে।
এসব শুনে বাধ্য হয়ে হালকা গয়না পড়ে খোপায় মেহরাবের দেওয়া সেই গোলাপটা গুজে দিলাম। গোলাপটা সাথে থাকলে আলাদা স্বস্তি পাই। আগের বার বোন গোলাপ যেভাবে পুড়িয়ে দিয়েছিল সেটা ভেবে এখনো আতকে উঠি।
ফারহান এসে বলল, আপনারা তৈরি তো ম্যাম?
বোন বলল,

~ আমরা তৈরী। বাহ, নীল রঙ্গের স্যুটে তোমাকে বেশ মানিয়েছে তো। চলো বেরোনো যাক।
বুড়িমাকে আগেই সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। কয়েকদিন উনার বয়সী ওখানকার কারো সাথে থাকলে মন ভাল থাকবে।
বিয়েতে উপস্থিত হলাম সবাই মিলে। মেয়েটাকে ভীষণ মিষ্টি লাগছে। আমার বিয়ের কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছিল, সেদিন এভাবে আমি কবুল বলে মেহরাবকে সারা জীবনের জন্য স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম।

সেখানে গ্রামের কিছু মহিলারা আমাকে টিপ্পনী কেটছিল, খুব বাজে বাজে কথা বলছিল। একজন তো সরাসরি বলে বসল, কিরে মুশু, পালিয়ে মজা নেওয়া শেষ করে চলে এলি?

এত খারাপ লাগছিল এসব বাজে কথা শুনতে।

মুখের উপর বলে ফেললাম, ফুপু ঠিক করে কথা বলুন। আমি বিবাহিত এবং পালিয়ে হলেও আমার স্বামীকেই বিয়ে করেছি। এসব অশ্লীল মন্তব্য করার আগে ভেবে নিবেন আপনি নিজেকে কতটা ছোট করছেন!
~ কি দেমাগ রে বাবা।

বিয়ে যখন করেছিস তখন তোর স্বামী কোথায়? বাপের বাড়ী তো মেয়েরা একা আসেনা, স্বামীকে নিয়েই আসে।
তো দেখা তোর স্বামীকে, আমরাও তোর স্বামীকে দেখি।
আমি কিছু উত্তর না দিয়ে সেখান থেকে চলে আসতে চাইলে তারা পথ আটকে বলল,
~ পালাচ্ছিস কোথায়?

স্বামী পাবি কোথা থেকে! গিয়েছিস তো রাত কাটাতে। লজ্জা করেনা বড় বড় কথা বলতে। আবার আমাকে বলা হচ্ছে আমি নিচু মনের মানুষ।
এসব শুনে আমার চোখ থেকে পানি পড়ছে। বোন তাদের সাথে তর্কে জড়িয়ে গেল। ফারহান এগিয়ে এসে আমার কানে কানে বলল,
~ দয়া করে আপনি কোনো রিয়েক্ট করবেননা।

ফারহান তাদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
~ কাকে কি বলছেন আপনারা? মুশায়রা আসলেই বিবাহিত। দেখতে চান তার স্বামীকে। এই যে দেখুন।
আমি অবাক হয়ে ফারহানের কান্ড দেখছি, সে নিজের দিকে ইঙ্গিত করছে কেন? তবে কি সে নিজেকে আমার স্বামী হিসেবে উপস্থাপন করবে!

পর্ব ২২

এসব শুনে সবাই হা করে ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলাটা বলল, তুমি মুশায়রার স্বামী?
ফারহান চটপটে উত্তর দিল,

~ কেন? বিশ্বাস হচ্ছেনা, কাবিননামা দেখিয়ে প্রমাণ করতে হবে?
~ স্বামী হলে এতক্ষণ বলছিলেনা কেন?

~ আপনারা নিজেদেরকে কতটা নিচে নামাচ্ছিলেন সেটা দেখছিলাম। এত খারাপ মন্তব্য আপনারা কিভাবে পোষণ করেন। হতে পারে, আমাদের বিয়েটা পালিয়ে করতে হয়েছে। তার মানে এটা প্রমাণিত হয়না যে আমার বউ খারাপ। আমি ওর স্বামী।

আর কখনো কাউকে কিছু বলার আগে কয়েকবার ভেবে নিবেন তার সম্পর্কে সঠিক টা আপনি জানেন কিনা! আর আপনি কি এখানে বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছেন নাকি অন্যের সমালোচনা করতে?

মনে রাখবেন যার চরিত্র যেমন সে অন্যকে সেই রকম ই দেখে।

~ তুমি তোমার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছো জামাই? আমি তোমার গুরুজন হই, শিক্ষা~ দীক্ষার কোনো বালাই ই নেই তোমার মাঝে।
~ আপনি যদি আপনার নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকতেন তবে আমি আমার মাত্রা ছাড়তামনা। আপনাকে সেই শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য হলে আমি অবশ্যি দিতাম। যাই হোক, দয়া করে এভাবে কটুকথা বলে আর কাউকে অপমান করবেননা।

মহিলাটা লজ্জায় তখন ছোট হয়ে যাচ্ছিল সবার সামনে। আর কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল। ফারহান এসে আমার হাতটা ধরে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

বাহিরে এসে আমি উনার হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কষে একটা থাপ্পড় দিলাম।
ফারহান গালে হাত দিয়ে নির্জীব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বোন এসে বলল,
~ তুই ওকে মারলি কেন?

~ উনার সাহস কি করে নিজেকে আমার স্বামী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার? আমি কি উনার করুণা চেয়েছি!
বলেছি আমাকে অপমানের হাত থেকে বাচানোর জন্য?

এসবের কোনো প্রয়োজন ছিলনা। আপনি আমাকে আমার বিবেকের কাছে ছোট করে দিলেন।
বোন রেগে গিয়ে বলল,

~ তোর ভালোর জন্য ই করেছিল। তবে ফারহান, তোমার এটা উচিত হয়নি। নিজেকে এই পরিচয় দিয়ে এখন কত সমস্যা ডেকে আনছো!
ওর স্বামী যদি সত্যি কখনো ফিরে আসে তবে ও তখন তাকে কি পরিচয় দিবে? একদিনের অপমান থেকে বাচাতে গিয়ে তুমি ওকে সারাজীবনের জন্য চুপ করিয়ে দিলে!

ফারহান আমার সামনে এসে বলল,
~ বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়েছে। আমার এটা করা উচিত হয়নি। কিন্তু আমি আপনার অপমান টা মেনে নিতে পারছিলামনা, হয়ত আপনাদের বাড়ির নুন খেয়েছি বলেই।

এটা কে আমার করুণা ভেবে ভুল করবেননা।

আপনারা যদি চান তবে আমি এখান থেকে আজীবনের জন্য চলে যাব। আমার জন্য আপনার কোনো বিপদ হোক আমি চাইনা।
বলে ফারহান এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে চলে গেল। বোন আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ এটাই বাকি ছিল আর। খুব খুশি হয়েছিস নিশ্চয়ই!

আমার ভালো তুই আসলে কখনো ই চাসনি। তোর জন্য আমার ক্ষতি ই হয়ে গেল শুধু।
আমি চুপ করে রইলাম। বুঝতেই পারছিনা কি করা উচিত আমার। নিজেকে অনেক অসহায় লাগছে। কখনো ভাবিনি আমার একটা সিদ্ধান্ত এভাবে কাল হয়ে দাঁড়াবে আমার জন্য। এমন পরিস্থিতিতে আমি কি করা উচিত!

বাসায় ঢুকে দেখলাম ফারহান শুকনো মুখে ব্যাগ গোছাচ্ছে। আমি দরজায় কড়া নেড়ে বললাম,
~ আসতে পারি?

~ আপনি! হ্যা আসুন, আপনাদের বাসার রুমে আপনারা ঢুকতে অনুমতি নিবেন কেন?
~ আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।

~ ক্ষমা চাচ্ছেন কেন? দোষটা আমার ই ছিল। আমার এটা করা উচিত হয়নি। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
~ আমি আপনাকে ওভাবে বলতে চাইনি।

আসলে ব্যপারটা আমার কাছে খুব ই সেনসিটিভ। তাই আমি এমন রিয়েক্ট করে ফেলেছি।
আপনি যদি এখন চলে যান, আমার ই খারাপ লাগবে। নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
তাই বলছিলাম কি! এসব ভুলে যান। আমাকে ক্ষমা করে দিন।

~ এভাবে বলবেননা।

~ দয়া করে, আপনি যাবেননা। বোন আমাকে অনেক বড় ভুল বুঝবে। আমার এই অনুরোধটি রাখুন।
~ ঠিক আছে, আমি যাচ্ছিনা।

আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে, খাওয়া তো ঠিক মত হয় ই নি।

কিছু খাওয়ানো যাবে এই পেটুকটাকে?
আমি চোখ মুছে বললাম,
~ কি খাবেন বলুন?

~ যা কিছু একটা হলেই হবে।

~ ঠিক আছে। আমি নিয়ে আসছি।

রুমে এসে শাড়ি চেঞ্জ করে রান্নাঘরে এলাম। এখন মনটা একটু হালকা লাগছে। ছেলেটার ই বা কি দোষ! সব দোষ আমার ভাগ্যের। শুধু শুধু তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা আমার উচিত হয়নি।

রান্নাবান্না শেষ করে বোন আর ফারহানকে খেতে ডাকলাম। বোন খেতে খেতে বলল,
~ তুই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তোর স্বামীর কাছে ফিরে যা।
এসব অতিরিক্ত প্যারা নেওয়ার সাধ্য আর আমার নেই।
~ ম্যাম, এভাবে বলছেন কেন?

উনার ই বা কি দোষ! গ্রামের মানুষগুলোর মানসিকতা খারাপ ছিল।

~ এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরও তুমি মুশুকে সাপোর্ট করছো ফারহান? ওর দোষ তো অবশ্যই আছে। যখন জানে ই পালিয়ে বিয়ে করে স্বামীর সংসার করতে পারবেনা, তো এত নাটক করে গেল ই বা কেন!
আর ফিরে আসার ই কি প্রয়োজন ছিল।

ওর জন্য গায়ের লোকের কাছে কতটা অপদস্থ হতে হয়েছে।
রোজ রোজ এসব নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

আমি নির্লিপ্তভাবে বললাম, আমাকে কয়েকটা দিন সময় দে, আমি চলে যাব। তুই এত প্রেশার নিসনা।
আমার জন্য তোর যথেষ্ট অপমানিত হতে হয়েছে। আর হতে হবেনা।

তাকিয়ে দেখলাম ফারহান মুখ গোমড়া করে প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করছে। কিছুই খাচ্ছেনা।
~ আপনাকে কিছু দেব ফারহান?

~ না ধন্যবাদ। আমার আর খেতে ইচ্ছে করছেনা, আমি উঠছি।
~ আপনি তো কিছুই খেলেননা।
~ যা খেয়েছি যথেষ্ট।

আমি চুপচাপ ফারহানের চলে যাওয়া দেখলাম। ছেলেটাকে ঠিক বুঝতে পারিনা। তবে খুব ভালভাবে সবকিছু হ্যান্ডেল করার দক্ষতা তার আছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে বারান্দায় এসে বসলাম। বুড়িমা ফিরেছেন একটু আগে, আমাকে খুজতে এসে একা বসে থাকতে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
~ এখানে একা বসে আছিস কেন মুশু? মন খারাপ?
~ তেমন কিছুনা বুড়িমা।

~ আমি বুঝতে পারিরে মুশু। একটা কথা কি জানিস, যারা খারাপ তারা খারাপ কথা বলবেই। তাদের তুই আয়কাতে পারবিনা।
তবে তোর নিজেকে এমনভাবেই গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা খারাপ কিছু বলার সুযোগ না পায়।
~ আমার হাতে কিছু নেই বুড়িমা।

যা হচ্ছে সব উপরওয়ালার ইচ্ছেতেই হচ্ছে। উনি কখন কি করছেন তা উনি ই জানেন।

~ মুশু নাতজামাই এর সাথে সব ঠিক করে নিলে হত না! এভাবে আর কত কষ্ট ভোগ করবি, দাতে দাত চেপে সবার অপমান হজম করবি।
~ সেই উপায় নেই বুড়িমা। আমার কপালে আল্লাহ হয়ত তোমার নাতজামাইকে লিখে রাখেননি।
~ তাহলে আমি একটা কথা বলি। সেটা একটু ভেবে দেখিস, তোর খারাপ হবেনা।
~ বলো।

~ আজ এতগুলো লোকের খারাপ কথা থেকে ফারহান তোকে খুব আগলে রেখে বাচিয়ে দিয়েছে। তোর উপর হওয়া প্রতিটি অন্যায় এর সঠিক জবাব দিয়েছে।
তখন মনে হয়েছিল তোকে আগলে রাখার জন্য তোর জীবনে এমন ফারহানের খুব প্রয়োজন।
~ বুঝতে পারলামনা।

~ বলছিলাম, পুরোনো জীবনের কথা ভুলে নতুন ভাবে বাচার চেষ্টা কর নতুন পরিচয় নিয়ে। ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন, ভালোবাসা দিয়ে নতুন একটা সম্পর্ক গড়ে তোল।

ফারহান ছেলেটা সত্যিই তোর জন্য আল্লাহর রহমত স্বরুপ। তুই ওকে বিয়ে করে নে, দেখবি ও তোকে খুব ভালো রাখবে। সবসময় তোকে আগলে রাখবে। ভালো করে ভেবে দেখ একবার।

~ বুড়িমা!! তুমি জানো তুমি কি বলসো?
এই কখনোই হয়না। আমি বিবাহিত, আমার মেহেদীর রঙ্গ এখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি। আর তুমি বলছো আমি আমার স্বামীকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিব।

~ তোর সেই স্বামীর জন্য আজ তোর এই অবস্থা!
তারপরো কিসের আশায় তুই তাকে স্বামী মানবি!

~ সে যাই করুক, এটাই সত্য যে সেই আমার স্বামী। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এসব কথা আর কখনো তুমি আমাকে বলবেনা।

রুমের চলে আসার সময় ফারহানকে আমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললাম,
~ কিছু বলবেন?

~ নাহ তেমন কিছুনা। আপনি কি সত্যি ই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন?

~ আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে বলে তো নিজের বোনের জীবনটাও নষ্ট করতে পারিনা।

বলে ফারহানের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। বারবার এসব কি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাকে? আর কত সহ্য করা যায় তার চেয়ে আমাকে মৃত্যু দিতে
আল্লাহ। এত প্রেশার আমি সত্যিই আর নিতে পারছিনা।
দম বন্ধ হয়ে আসে আমার!!

সকালবেলা বাহিরে থেকে চিৎকার~ চেচামেচির আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এলাম। এসে দেখি কালকের নিলর্জ্জ ফুপু গ্রামের গণ্যমান্য লোকসহ সাধারণ মানুষজন কে নিয়ে আমাদের বাড়ীতে ঢুকে পড়েছেন।

বোনের সাথে খুব তর্কাতর্কি হচ্ছে তাদের। এমনসময় ফারহান ও বাহিরে বেরিয়ে এল। ও ঠিক বুঝতে চেষ্টা করছে ব্যাপারটা কি হচ্ছে! আমার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
আমি মাথা নাড়িয়ে বুঝালাম আমিও ঠিক জানিনা।

ফারহান তাদের সামনে এগিয়ে এসে বলল,
~ আপনি এখানে? এত লোকজন জড়ো করেছেন কেন?

মহিলাটি পানের পিক ফেলে বলল,
~ এই হচ্ছে আসল কালপ্রিট। যে গাছেরও খায়, তলার ও কুড়ায়। নিজে একটা ফালতু ছেলে হয়ে, আমাদেরকে আসে জ্ঞান দিতে।
~ ঠিক করে কথা বলুন। কেন এসেছেন এখানে?

~ তুমি তো নিজেকে মুশায়রার স্বামী বলে জাহির করেছো! তোমরা নাকি স্বামী~ স্ত্রী।
ফারহান একনজর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ হ্যা বলেছি। আর এটাও বলেছি আপনারা যদি সেটা বিশ্বাস না করেন তাতে আমাদের কিছু আসে যায়না।
~ তোমাদের আসে যাবে কেন? তোমরা তো নিচে নামতে নামতে এতটাই নেমে গেছো, যে সম্মান বলতে কিছুই নেই তোমাদের।
~ কি বলতে চাইছেন আপনি?

~ বলতে চাইছি এটাই কাল আমাকে মুশায়রার স্বামী সেজে এত অপমান করলে। তুমি যে মুশায়রার স্বামী সেটা আমরা বিশ্বাস করব কি করে!
আমি তো জেনেছি তোমার সাথে আফরার খুব মাখোমাখো সম্পর্ক। আফরার সাথে নাকি তোমার তলে তলে খুব চলছে। খুব শীঘ্রই তোমরা বিয়েও করতে যাচ্ছো।

~ মুখ সামলে কথা বলুন। এসব কথা আপনাকে কে বলেছে?
~ কেন? আফরাহ ই তো বলল।

ফারহান বোনের দিকে তাকাতে ও আমতা আমতা করতে করতে বলল, এসব বলেছি তোমাকে মিথ্যা কথার জাল থেকে বের করতে। আর মিথ্যা বলোনা উনাদের। স্বীকার করে নাও তুমি মুশায়রার স্বামী নও।
কেবল মুশায়রাকে বাচানোর জন্যই ওসব বলেছো।

আমি উনাদের সব সত্যিটা বলেই দিয়েছি, এখন উনারা মুশায়রার যা ব্যবস্থা করার করবেন। তুমি আর এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না।
মহিলা আবারো পানের পিক ফেলে বলল,
~ মুশায়রার মত নষ্টা মেয়েকে গ্রামে রেখে আমরা অন্য মেয়েদের কে তো খারাপ বানাতে পারিনা। ও একটা খারাপ মেয়ে যে পরপুরুষের সাথে যিনা করে গ্রামে ফিরে এসেছে।

পঞ্চায়েতের বিচার অনুযায়ী ওর শাস্তি হচ্ছে জনসম্মুখে অর্ধনগ্ন শরীরে তিনশ ঘা চাবুক। নাক খত দিতে দিতে গ্রামের সীমানার বাহিরে যাওয়া।
এমন শাস্তির কথা শুনে আমার অন্তর আত্মা কেপে উঠল। এত নিম্নমানের শাস্তির চেয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়াটা ভাল।
আমি করজোড়ে তাদের উদ্দেশ্যে বললাম, আপনাদের কাছে হাত জোড় করে বলছি এমন শাস্তি আমাকে দিবেন না। আমি যদি সত্যিই খারাপ হই, দরকার হলে আমাকে মৃত্যুদন্ড দিন তাও এমন শাস্তি দিবেননা।

মহিলাটি বিষমাখানো হাসি হেসে বলল,
~ এটাই তোর শাস্তি। এটাই তোকে পেতে হবে। বলতে বলতে মহিলাটির চোখ চকচক করে উঠল। এবার তার গায়ের জ্বালা জুড়াবে, কাল এক গা লোকের সামনে মুশায়রার জন্য তাকে অনেক হেনেস্তা হতে হচ্ছে।
সেটার প্রতিশোধ তোলার জন্য ই আজ তার এতকিছু করা।

এমনসময় ফারহান চেচিয়ে উঠে বলল,
~ একটা নিষ্কলংক মেয়েকে আপনারা এত বড় অপবাদ দিতে পারেননা। এসব পাপ আল্লাহ সহ্য করবেননা।
~ তুমি চুপ থাকো ছেলে।

আফরার মুখের দিকে তাকিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি বলে এটা ভেবোনা তুমি যাতা বলবে আর আমরা সহ্য করব। আর কোনো কথা যদি তুমি বলো তাহলে আমি আর আফরার কথা চিন্তা করব না।

~ আপনারা যা ইচ্ছে করতে পারেন, কিন্তু এটা আমি কিছুতেই হতে দিতে পারবনা। দরকার হলে আপনাদের সামনে আমি মুশায়রাকে বিয়ে করব।
এই কথা শুনে আমি চমকে উঠে ফারহানের মুখের দিকে তাকালাম। এসব কি বলছেন উনি! উনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল!
উনি জানেন আমি বিবাহিতা তারপরও এই কথা টা বলতে উনার বিবেকে একটুও বাধলনা।
~ বলা যত সহজ, করা তত সহজ না।

ঠিক আছে, যদি তুমি মুশায়রাকে এক্ষুনি বিয়ে করয়ে পারো তবে মুশায়রার শাস্তি মওফুক হবে এবং সম্মানের সহিত ও এই গ্রামে থাকতে পারবে।
এখন তোমার মত জানাও।
~ আমি রাজি, আপনারা ব্যবস্থা করুন।

আমি আর এক মূহুর্ত সেখান না দাঁড়িয়ে রুমে চলে এলাম। আমার পিছু পিছু ফারহান এল। আমি রেগে গিয়ে বললাম,
~ এসব কি মশকরা করছেন আমার সাথে?
আপনি জানেন আমি বিবাহিতা।

~ এই ছাড়া আমার কাছে আর পথ খোলা নেই আপনাকে বাচানোর। আপনি ভেবে দেখুন এরকম শাস্তি দিলে আপনার নিজের কেমন বোধ হবে?
হাজারটা লোকের সামনে আপনাকে অর্ধনগ্ন করে চাবুক মারবে এবং সেই অবস্থায় আপনাকে নাকে খত দিয়ে বের করে দিবে।
~ আমার পক্ষে আপনাকে স্বামী হিসেবে মানা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

~ মানতে হবেনা। আমি আপনার কাছে স্বামীর অধিকার চাইবনা। মিথ্যে ভেবে এই বিয়েটা করে নিন, কিছুদিন পার হলে এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিব।
আমি শুধু আপনাকে শাস্তির হাত থেকে বাচাতে চাচ্ছি। কথা দিলাম এই বিয়েটা কেবল মিথ্যে একটা লোক দেখানো বিয়ে হবে। কোনো অধিকার খাটানো হবেনা এবং কিছুদিন পরেই এই বিয়েটা আপনি ভেঙ্গে দিতে পারেন। এখন আপনি ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। বলে ফারহান চলে গেল।
আমি অসহায়ের মত মেঝেতে বসে পড়ে ভাবতে লাগলাম।

পর্ব ২৩

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যাই হয়ে যাক, আমি কিছুতেই ফারহান বিয়ে করবনা। এটা কখনো সম্ভব নয়। এক বিয়ে বিচ্ছেদ হওয়ার আগে কোনো মুসলিম মেয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেনা।

আমি সবাইকে বারণ করে দিব, যেকোনো শাস্তি আমি মাথা পেতে নিব তাও এত বড় পাপ আমি করতে পারবনা। এমনসময় বোন আমার রুমে ঢুকে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি বোনের চোখে পানি টলমল করতে দেখলাম।
উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
~ বোন তুই কাদছিস কেন?

বোন আমাকে সজোরে একটা ধাক্কা দিল। ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে আমি আলমিরার সাথে কপালে আঘাত পেলাম। বোন আমাকে টেনে কয়েকটা চড় মারল। শক্ত করে আমার ডান হাত মোচড়ে ধরে বলল,
~ এই ছিল তোর মনে মনে?

~ বোন আমার খুব ব্যথা লাগছে। কি হয়েছে? তুই এমন করছিস কেন?
~ এভাবে সব কেড়ে নিবি আমার থেকে! এটাই ভেবে রেখেছিলি?
~ বোন, আমি কি করেছি?

বোন আমার হাত ছেড়ে দিয়ে গাল চেপে ধরে বলল,
~ জিজ্ঞেস করছিস কি করেছিস তুই! ভালো অভিনয় করিস তুই।

~ বোন আমার খুব ব্যথা লাগছে, তোর পায়ে পড়ি আমাকে ছাড়। কোনো ভুল করে থাকলে বল আমি তা শুধরে নিব।
~ শুধরে নিবি! আমার ফারহানকে তুই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছিস, আজ তোকে আমি মেরেই ফেলব।
তোর জন্য আমি প্রতিটি পদে পদে অবহেলিত। আজ তুই আমার শেষ সম্বল ও কেড়ে নিচ্ছিস।
~ তোর ফারহান?

~ হ্যা ফারহান আমার। ওকে আমি খুব ভালোবাসি, ওকে ঘিরে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি।
আর তুই আমার স্বপ্নটা নষ্ট করে দিচ্ছিস!

বলে বোন কাদতে শুরু করল। আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল এতক্ষণ। বোনের কাধে হাত রেখে বললাম,
~ আমি তোর ফারহানকে কেড়ে নিতে চাইনা। ফারহানের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমার স্বামী আছে, আর তাকেই আমি ভালোবাসি।
আমি এই বিয়েটা কিছুতেই করবনা, যা শাস্তি হওয়ার হোক আমার। দরকার হলে আমি মরে যাব, তাও এই বিয়েতে সম্মতি দিবনা। ফারহান আমাকে বাচানোর জন্য যা ই করতে চায় না কেন আমি তাতে সায় দিচ্ছিনা।

তোর ভালোবাসা তোর ই থাকবে।

~ তুই আমাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিচ্ছিস? ভুলবনা আমি এসব কথায়। তুই ও মনে মনে ফারহানকেই বিয়ে করতে চাস।
~ আমি তোকে কথা দিচ্ছি, এই বিয়েটা আমি করবনা।

চল আমার সাথে। আমি এক্ষুনি সবাইকে বলে দিব।

আমি বোনের হাত ধরে বাহিরে চলে গেলাম। উঠানে গোল হয়ে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বসে আছেন মহিলাটার সাথে। কেউ কেউ তাড়া দিচ্ছে কাজীর আসতে এত দেরী হচ্ছে কেন!

আমি সরাসরি গিয়ে তাদেরকে বললাম,
~ আমার পক্ষে এই বিয়েটা করা সম্ভব নয়। এরজন্য আপনারা আমাকে যা শাস্তি দিবেন আমি তাই মাথা পেতে নিব।
ফারহান ছুটে এসে বলল, এসব আপনি কি বলছেন মুশায়রা?

~ দয়া করে, আপনি আর কোনো কথা বলবেননা। অনেক করুণা করেছেন আমার উপর, আর নয়। দয়া করে আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে দিন। আমার জন্য আপনি অনেক করেছেন তার জন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।
এইবার আমাকে আমার মত চলতে দিন।

ফারহান দুঃখী মুখ করে আমাকে বলল,

~ এত বড় সিদ্ধান্ত টা আপনি নিয়ে ভুল করছেন। আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম, একটা বার ভালো করে ভেবে দেখতেন।
~ আমার ভাবা হয়ে গেছে। ফুপু আমাকে অর্ধনগ্ন করে চাবুক মারুন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু পুরো গ্রামের লোকের সামনে মারবেন না। এতে আমার বাবাকে অপমান করা হবে, আমার বাবা তো সারাজীবন আপনাদের উপকার করে এসেছেন।

অন্তত তার মেয়ে হিসেবে আমাকে এইটুকু ছাড় দিন। আপনারা যা শাস্তি দিবেন আমি তাই মাথা পেতে নিব কিন্তু দয়া করে আমাকে এত বড় অপমান করবেন না।

মহিলাটা বলল, হুম তোর বাবা আমাদের উপকার করেছেন সেটা আমরা মানি। কিন্তু এর জন্য তোর অন্যায়ের শাস্তি আমরা মওফুক করতে পারিনা।
ঠিক আছে, তোকে অর্ধনগ্ন করার ব্যাপারটায় ছাড় দিলাম। সবার সামনে আমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবি, ২৫ ঘা চাবুকের বাড়ি খেয়ে তোদের পুরো বাড়ি চারপাশ ঘুরে নাক খত দিবি।

আমার বড্ড দয়ার শরীর তাই তোকে অনেক বেশী ছাড় দিলাম। নাক খত দেওয়াতে দেওয়াতে গ্রাম থেকে বের করে দিলামনা। কি বলেন সবাই? এই শাস্তি ঠিক আছেনা!

গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সবাই মহিলার কথায় সায় দিল। আমি চোখের পানি মুছে মহিলার পায়ের কাছে বসলাম।

কোনো অন্যায় করা ছাড়া আজ আমাকে কারো পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে, আল্লাহ আপনি কি করতে চান আপনিই ভাল জানেন।
ফারহান আরেকবার ডেকে বলল, মুশায়রা আপনি কোনো অন্যায় না করেও এসব শাস্তি ভোগ করবেন?
কি হত আমার কথাটা মেনে নিলে?

~ ফারহান, একজন বিবাহিত মেয়ের কাছে এসব শাস্তি ওই বড় বেচে যাওয়ার উপায় থেকে কম যন্ত্রণাদায়ক।
আপনি আর ব্যাঘাত ঘটাবেননা। আমাকে আমার শাস্তি পেতে দিন।
~ আপনি চুপ করে থাকবেন আফরাহ ম্যাম?

~ আমার হাতে কিছুই নেই ফারহান। যা হচ্ছে হতে দাও, অন্তত আমার বোন অত বড় অপমান থেকে বেচেছে এটাই অনেক।
আমি মহিলাটার পা জড়িয়ে কাদতে কাদতে বললাম,

~ আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনার সাথে যে বেয়াদপি করেছি তার জন্য আমি খুব লজ্জিত। আমার অন্যায়ের জন্য আমি আপনার পায়ে ধরে ক্ষমা চাচ্ছি।
মহিলাটা হেসে হেসে বলল,

~ আরো নম্র ভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। এতে আমার মন গলছেনা। ক্ষমা চাইতে শিখিস নি নাকি!

ফারহান নাক~ মুখ খিচে মহিলাকে কিছু বলতে উদ্ধত হলে আফরাহ আটকে দিয়ে বলল,
~ তুমি এখন খারাপ আচরণ করে মুশুর শাস্তিটা দ্বিগুণ করোনা। আমার বোনের সাথে এমনিতে কম খারাপ হচ্ছেনা।

আমি আবার উনার পায়ে ধরতে গেলে পিছন থেকে আমাকে ডাকল, মুশায়রা।

ডাক শুনে পিছনে ফিরে দেখি মেহরাব দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম উনাকে। উনি এখানে কেন এসেছেন? মেহরাব এগিয়ে এসে আমাকে মাটি থেকে উঠায়। তারপর উনার হাত দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিল।
মহিলা নাক~ মুখ খিচিয়ে বলল,

~ আপনি কে? এখানে নাক গলাতে এসেছেন কেন?
~ আমি কে জানার আগে এটা বলুন, আপনারা যে অন্যায় টা করতে যাচ্ছিলেন সেটার জন্য কি শাস্তি আপনাদেরকে দেওয়া উচিত!
~ কি বললেন? আমরা অন্যায় করছি!

এত বড় সাহস আপনার? আমরা কোনো অন্যায় করছি না আমরা কেবল ন্যায়বিচার করছি। ওর মত মেয়ে যা করেছে সেটার মাশুল ই দিচ্ছে সে।
~ আপনারা ন্যায়বিচার করার কে! কোথাকার শাসক~ রাজা আপনারা!

~ এই ছেলে, কথা কম বলো। এত জ্ঞান না দিয়ে বলো তুমি কে? কোথা থেকে উড়ে এসেছো! মুশু কি তোমার সাথেও…
~ মুখ সামলে কথা বলবেন। নিচে নামা ভাল, কিন্তু এতটা নিচে নামা ভাল নয়।

আমি মুশায়রার আসল স্বামী। আমার নাম মেহরাব, মুশায়রার সাথে আমার ই বিয়ে হয়েছিল।

~ মুশায়রার কয়টা স্বামী? এক একেক জন এক একেক বার মুশায়রার স্বামী হিসেবে নিজেকে দাবী করছে।
~ আমি ই ওর আসল স্বামী। সেটা মুশায়রা নিজের মুখেই বলবে। মুশায়রা আমার পরিচয়টা দাও।
আমি কোনোরকম কেপে কেপে বললাম,

~ উনিই আমার স্বামী মেহরাব। উনার সাথে বিবাহ হয়েছে আমার, আল্লাহর কালাম স্বাক্ষী রেখে উনাকে আমি কবুল বলেছি।
~ এবার আপনাদের বিশ্বাস হল তো! আপনারা এখন নিজেদের শাস্তি নিবেন?
~ আমরা বিশ্বাস করব কিভাবে যে তোমরা সত্যি বলছো!

~ আপনাকে বিশ্বাস করাতে আমরা যাব কেন?

আমি বরং পুলিশকে ফোন দিই। উনারা আসুক আমরা প্রমাণ দেখাই। তারপর যদি আপনাদেরকে মানহানির মামলার আসামী করে হাজতবাস করায় আমাকে কিন্তু দোষারোপ করতে পারবেননা।

এখন আপনাদের প্রমাণ লাগবে!
সবাই মূহুর্তেই চুপ হয়ে গেল। মহিলাটার মুখ শুকিয়ে গেছে ভয়ে, আমতা আমতা করে বলল,
~ পুলিশ কেন?

~ আপনারাই তো প্রমাণ চাচ্ছেন। আমি তাদের দ্বারা ই আপনাদেরকে প্রমাণ দেখাব। প্রমাণ চাই?
~ নাহ প্রমাণ দরকার নেই, আমরা বিশ্বাস করেছি।

সবাই চলো এখান থেকে। মুশায়রার আসল স্বামী ফিরে এসেছে তাই আমি ওকে ক্ষমা করে দিলাম।
~ এই যে ফুপুজি। এভাবে পালালে তো হবেনা।

আপনি ওকে যেভাবে হেনস্তা করেছেন, সেটার ফয়দা তো তুলে দিতে হবে নাকি!
এখন সবার সামনে আপনি মুশায়রার কাছে ক্ষমা চাইবেন।
~ অসম্ভব।
~ চাইবেননা তো?

~ কখনোই না।
আমি মেহরাবকে থামানোর চেষ্টা করলে উনি বলেন,
~ আমাকে আমার কর্তব্য পালন করতে দাও। উনি তোমাকে এত বড় অপমান করে পার পেয়ে যাবে এটা তো হয়না। উনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে যে তুমি খারাপ বা তুমি পালিয়ে গিয়ে খারাপ কাজ করেছো।

সেসব প্রমাণ ছাড়া উনি তোমাকে এত বড় শাস্তি দেওয়ার সাহস কি করে দেখায়! হয়ত উনি এক্ষুনি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবেন নয়ত আমি উনাকে হাজতবাস করাব।

ফুপু আম্মা, আপনার কাছে এখন দুটো উপায় আছে। এক্ষুনি মুশায়রার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবেন নতুবা মিথ্যে অপবাদ দায়ের করে মানহানি করার জন্য হাজতবাস করবেন।

একটা বেছে নিন।
মহিলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার হাত ধরে হাউমাউ করে কাদতে কাদতে বলল,
~ আমাকে ক্ষমা করে দে মুশু। এই ছেলেটার অপমানজনক কথা শুনে তোর উপর আমার ভীষণ রাগ উঠেছিল। তাই এসব করে আমি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম।

আমার ভুল হয়ে গেছেরে… আমাকে ক্ষমা করে দে তাও পুলিশের হাতে দিসনা।
~ ঠিক আছে ফুপু, ছাড়ো এসব। তোমরা বাড়ি চলে যাও। আমি এসব ভুলে গেছি, তোমাদের উপর কোনো অভিযোগ নেই আমার।
সবাই আস্তে আস্তে বাড়ী থেকে বেরিয়ে চলে গেল।

মেহরাব আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখ সরিয়ে বাড়ীর ভেতরে চলে এলাম। বুঝতে পারছিনা উনি এখানে কেন এসেছেন? মেহরাবের এভাবে আমাকে আগলে রাখায় খুব ভালো লাগছিল আমার, কিন্তু ভেতরের চাপা অভিমান টা আবার জেগে উঠেছে।
ঠিক বুঝতেই পআরছিনা উনার সাথে আমার কেমন আচরণ করা উচিত। বোন এসে বলল,
~ মুশু, সত্যি করে বল তো!

~ উনি তোর স্বামী?
~ হুম।
~ তার মানে উনি জ্বীন!!!

দেখে একবারের জন্য ও বুঝা যায়না। তোর এত সুন্দর স্বামী থাকতে তুই এখানে পড়ে আছিস। সাদা শার্ট~ কালো জিন্সের ফরমাল লুকে আমি তো ভেবেছি উনি মানুষ।

জীবনে ভয়ানক চেহারার জ্বীন ছাড়া এমন জ্বীন দেখলামনা।
সত্যিই উনি জ্বীন তো!

বোনের কথা শুনে আমার হাসি পেল। সারাজীবন জ্বীন নিয়ে স্টাডি করে, তাদের সাথে লড়াই করেও আজ সে জ্বীন দেখে আতঙ্কিত।
~ কি ভাবছিস তুই!

~ এসব নিয়ে উনার সামনে কিছু বলার দরকার নেই। তুই তো জ্বীন সম্পর্কে আমার থেকে বেশী জানিস তুই না হয় বের করে নিস উনি আসলেই জ্বীন কিনা!
বলে বের হয়ে আসতেই মেহরাব আমাকে টেনে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে বলল,
~ এমন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছো কেন?

~ কই না তো।

~ আমার দিকে তাকাও। আমি আসায় তুমি খুশি হওনি।
~ জানিনাহ। কেন এসেছেন এখানে?

এমনসময় ফারহান এসে বলল, মুশায়রা আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল মানে, আমার একটা সাহায্য দরকার ছিল, যদি একটু আসতেন।
~ জ্বী আসছি। মেহরাব আপনি ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিন। পরে আমরা এসব নিয়ে কথা বলব।
আমি ফারহানের পিছু পিছু চলে আসলাম।

~ কি বলবেন ফারহান?

~ উনি কি সত্যিই আপনার স্বামী হন?

উনাকে দেখে আমার কেমন জানি বোধ হচ্ছে। উনি একটু অন্যরকম।

ফারহানের কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। ফারহান কি বুঝতে পেরেছে মেহরাব একজন জ্বীন। উনি যদি বুঝতে পেরে যায় সেটা মেহরাবের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাড়াবেন না। এমনিতেই ফারহানের হাবভাব আমার ভাল ঠেকে না।
না ফারহানকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা এসব।

একটু কড়া করে কথা শুনিয়ে দেই যাতে উনি আর কখনো মেহরাবকে নিয়ে কিছু বলতে না পারে।
~ হ্যা উনি আমার স্বামী। আপনার এত সমস্যা কি সেটাই বুঝতে পারছিনা। দেখুন, যা হওয়ার হয়েছে আমাকে নিয়ে আপনি আর না ভাবলে আমি খুশি হব।
আমার স্বামী যদি এসব বুঝে উনার খারাপ লাগবে। আর দয়া করে আমার স্বামীর ব্যাপারে কিছু বলতে আসবেননা।
তাহলে কিন্তু আমি আপনার সাথে খারাপ বযবহার করতে বাধ্য হব। আসি।

পর্ব ২৪

রান্নাঘরে এসে দেখলাম বোন সবজি কাটছে। অবাক হয়ে বললাম, তুই এখানে?
~ কেন আসতে পারিনা বুঝি!

~ তা কেন পারবিনা। তোর কি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? আমাকে বললেই পারতি আমি বানিয়ে দিতাম।

~ আজ আমার রান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাড়ীতে দুলাভাই প্রথমবার এসেছে তাছাড়া ফারহানের ও তো সারাদিন তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। তাই স্পেশাল কিছু বানাচ্ছিলাম।

~ কি বানাচ্ছিস বল! আমি হাতে হাতে সাহায্য করে দেই, তোর একা করতে সময় লাগবে অনেক।
~ বাহিরে তো বৃষ্টি পড়ছে, এই সময় খিচুড়ি টাই জমবে কি বলিস? সাথে আলুভাজা আর চাটনী।

~ দারুণ বলেছিস তো। আচ্ছা আমি তাহলে বসিয়ে দেই। তুই সাবধানে কাটিস, হাতে না লেগে যায় আবার।

বোনকে এমনভাবে মিশতে আমি আগে কখনো দেখিনি। আজ ওর চাপা উচ্ছ্বাস, আপন এর মত ব্যবহার মনটাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। এই রুপ কোথায় ছিল এত?

ভালোবাসা সত্যিই মানুষকে বদলে দেয়। এইবার ফারহান আর ওর মিল করিয়ে দিলেই আমার মন শান্তি পাবে। রান্না চাপিয়ে বোনকে বললাম,
~ আমার বোন তো সংসারী হয়ে যাচ্ছে। এইবার তো বিয়েটা দিতে হয়! আমারো তো একটা দুলাভাইয়ের প্রয়োজন আছে।
বোন লজ্জা পেয়ে বলল, কি যে বলিস!

~ ফারহান ভাইয়াকে বিয়ের প্রস্তাব টা দিব কি?

~ নাহ তুই এখন কিছু বলতে যাস না। সময় হোক, আমিই বলব। আচ্ছা জ্বীনরাজ্য তোর কেমন লেগেছে? সেখানে যাওয়ার~ থাকার সৌভাগ্য তো তোর হয়েছে।
~ ভালোই লেগেছে। সবকিছু সাজানো~ গোছানো। আর সবচেয়ে বড় কথা হল সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে।
বলে বোঝানোর মত নয়।

~ ওহ আচ্ছা। জ্বীন তলোয়ারের ব্যাপারে তোকে কেউ বলেনি?
~ তুই কি করে জানিস এটার কথা!

~ সারাজীবন জ্বীন নিয়ে স্টাডি করলাম এইটুকু তো জানার ই কথা।
~ হুম বলেছে। সেটার কাছাকাছি গিয়েও দেখার সৌভাগ্য হয়নি তবে। শুনেছি ওটার শক্তি অনেক, ওটা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য অনেকবার শত্রুরা জ্বীনরাজ্য আক্রমণ করেছে।

~ ইস! যদি দেখতে পেতাম একবার।

~ এসব দেখার চিন্তা না করাই ভাল। আমরা সাধারণ মানুষ ওসব নিয়ে কি করব বল। ওটা জ্বীনদের সম্পদ, ওদের কাছে থাকা ই শ্রেয়।
বোন আর কিছু বললনা। আমি রান্না সেরে সব ডাইনিং টেবিলে গুছিয়ে মেহরাবকে ডাকতে গেলাম। গিয়ে দেখি ও শার্ট চেঞ্জ করছে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,

~ চেঞ্জ করে খেতে আসুন।

~ তোমার কি আমার দিকে তাকাতে লজ্জা করছে?
~ করার ই তো কথা।

~ ওহ আচ্ছা, আমি কি পরপুরুষ?

~ অতশত জানিনাহ। বলে পালিয়ে যাওয়ার সময় মেহরাব আমার হাত টেনে কাছে জড়িয়ে বলল,
~ পালাই পালাই করো কেন? এত পর বরকে কাছে পেয়েছো, কোথায় সারাক্ষণ ফেভিকলের মত জাপটে ধরে রাখবে তা নয়।
~ যে থাকার সে এমনিতেই থাকবে। কেন এসেছেন এখানে?

~ নিজের বউয়ের কাছে আসতে পারমিশন লাগে। তাছাড়া তুমি নিজেই তো দিনরাত এক করে আমাকে স্মরণ করেছো, কাছে আসার এই সুযোগটা ছাড়ি কি করে!
~ আমি কখন স্মরণ করলাম?

~ গোলাপটা সবসময় সাথে সাথে রাখো। তাই যখন স্মরণ করো, আমি তা বুঝে যাই। জিভ কামড়ে বললাম,
~ এটা তো ভুলেই গেছিলাম। শুনে মেহরাব হাসতে লাগল। আমি মুগ্ধচোখে উনার মুক্তোঝরা হাসি দেখতে লাগলাম।
এই হাসিটা আমার সব অভিমান দূর করে দেয়, তখন ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে অভিমান ঝেড়ে উনাকে মনের সব কথা বলি।
ডাইনিং রুম থেকে বোনের ডাক এল।

আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
~ চেঞ্জ করে তাড়াতাড়ি আসুন। স্পেশাল ডিস রান্না হয়েছে আপনার জন্য। বলে ডাইনিং টেবিলে চলে আসলাম। ফারহান ও প্রায় সাথে সাথে চলে এসেছে। ওর মুখটা কেমন জানি ভার ভার। আমার চোখে চোখ পড়ায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। বুঝলাম, হয়ত আমার কথাগুলোয় বেচারা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আমার ই বা কি করার, ওর জন্য একেক বার একেক মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি আমি।

পরিবেশন করতে করতে মেহরাব ও চলে গেল। ফারহান থেকে নেওয়া ডার্ক ব্লু টি~ শার্ট আর থ্রি~ কোয়ার্টার পড়েছেন। যেমন কিউট লাগছে, তেমনি পিচ্চি পিচ্চি লাগছে। গাল টেনে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করছে।

মেহরাব এতটা মিশুক তা জানা ছিলনা। বোন আর ফারহানের সাথে এত সুন্দর করে মিশে মজা~ ঠাট্টায় একদম মাতিয়ে রাখল। খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম উনি পা দিয়ে আমার পায়ে চিমটি কাটছে, এই দুষ্টুটা সবার সামনে আমাকে বিপাকে ফেলে কি যে মজা পায় কে জানে।
খাওয়ার এক পর্যায়ে আফরাহ বলল,

~ শালী, খাবারে তো একদম ই টেস্ট পাচ্ছিনা। কিছু একটা নেই নেই মনে হচ্ছে।
~ কি নেই? মুশু তুই দুলাভাইয়ের প্লেটে কি দিস নি?

~ সব ই তো দিলাম। রান্নাটা ভালো লাগেনি আপনার?
অন্য কিছু বানিয়ে দিব?

~ রান্নাটা ভালোই হয়েছে। আফটার অল, আমার শালী রান্না করেছে।
~ আপনি কি জানলেন দুলাভাই?

~ না মানে, তোমার বোন মাঝে মাঝে উকি দিয়ে পাহারা দিয়েছিলাম তাই আর কি।
এখন কি করা যায় বলতো? আমার তো ভীষণ ক্ষিধেও পেয়েছে।
~ কি লাগবে আপনি বলুন?

দুঃখী দুঃখী মুখ করে মেহরাব বললেন,
~ সব ই তো আছে। কিন্তু বউয়ের হাতে খাওয়ার স্বাদ টা ই নেই শুধু।

শুনে আফরাহ অট্টহাসি দিল। আমার লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল। সবার সামনে উনি এটা কি শুরু করলেন! এই ছেলেটা আমাকে লজ্জা দিয়ে দিয়েই মারবে।
~ এই মুশু হা করে দেখছিস কি? খাইয়ে দে।
~ আমি পারবনা।

~ থাক, শালী। সবাই কি আর সবকিছুর মর্ম বুঝে? বর থাকতেও বরের সাথে প্রেম করতে উনার অসুবিধা, না থাকলে তখন কপাল ঠুকত।
~ মুশু, এমন করছিস কেন? আমরা ই তো। দুলাভাইকে খাইয়ে দে।
একরাশ লজ্জা নিয়ে উনাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলাম। যা বলে তা করেই ছাড়ো, এমন ছেলে আমি আর দেখিনি।
দেখব ই বা কি করে, উনি তো আমার একটাই জ্বীনবর।

আফরাহ টেবিলের উপর রাখা ফারহানের হাতে হাত রাখতেই ফারহান উঠে চলে যাচ্ছিল।
~ ফারহান আর খাবেননা?

~ অনেক খেয়ে ফেলেছি মুশায়রা। আফরাহ ম্যাম, রান্নাটা অনেক ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ আপনাকে।
আমি বোনের চোখে~ মুখে তখন হালকা খুশির ঝলক দেখতে পেলাম। সবাই চলে যাওয়ার পর সব গুছাতে গুছাতে বললাম, ফারহান অনেকটা লাজুক।
~ মনে হচ্ছে। সমস্যা নেই, বিয়ের পর দুলাভাইয়ের মত রোমান্টিক বানিয়ে নিব।

সব কাজ শেষ করে নিজের রুমে এলাম। দেখলাম মেহরাব জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম,
~ এভাবে জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন যে? খুব জোরে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ছিটে গায়ে পড়বে তো।

মেহরাব কোনো উত্তর না দিয়ে আমার হাত ধরে জানালার পাশে নিয়ে এসে দাড় করাল। তারপর আমার কোমড় জড়িয়ে কাধে মাথা রেখে বলল,
~ এটাই তো প্রেম করার উপযুক্ত সময়। আচ্ছা তুমি কিভাবে পারলে এতগুলো দিন আমাকে ছাড়া থাকতে?
আমি তো প্রতিটিক্ষণে তোমাকে অনুভব করেছি। খুব ইচ্ছে হয়েছিল তোমার কাছে ছুটে আসার।

কিন্তু তোমার বাড়িতে ঢুকতে চাইতামনা, প্রতিদিন ১বার করে বাহিরে থেকে তোমাকে দেখে যেতাম। খুব ইচ্ছে করত তোমাকে একবার স্পর্শ করি, বুকে টেনে নেই।

~ কেন আসতেন? আপনাকে নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ দিলাম আমি, সেটা কাজে লাগাতে পারতেন।
ভালোই থাকতেন মেহেরজানের সাথে।
বলে উনার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম।

তারপর আবার বলতে লাগলাম,
~ এটা তো সত্যি আপনারা দুজন দুজনকে ভালোবাসতেন। আপনাদের একটা স্বপ্ন ও ছিল, যেটা আমার কারণে তছনছ হয়ে গেছে। আমি তো সেটা আবার বাস্তবায়ন করার সুযোগ দিয়ে সরে এসেছি।

তাহলে কেন এসেছেন এখানে? আমার শাস্তি হচ্ছিল বলে বাচাতে!

মেহরাব আমার মুখ আলতো করে ধরে বলল,
~ বউ আমি তোমাকে বেশীকিছু বলবনা। অল্প কয়েকটা কথা ই বলব, জানি তুমি অনেক বুদ্ধিমান সেগুলোর মর্মার্থ তুমি বুঝতে পারবে।
দেখো, আমরা দুজন আলাদা জাতি। আমাদের মধ্যে মিল বা ভালোবাসা কোনোটাই সম্ভব ছিলনা। কিন্তু সব নিয়ম~ অসম্ভবতা ছিন্ন করে আমরা এক হয়েছি। একে অপরকে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ করেছি। তাই আমাদের একসাথে চলার পথ কখনোই সম্পূর্ণ মসৃণ হবেনা। অনেক বাধাবিঘ্ন আসবেই, অন্যান্য ২~ ৩টে সম্পর্কের মত সহজবোধ্য নয় আমাদের সম্পর্ক।

আমাকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে তোমাকে সেটা তুমিও জানো। তাই বলব এমন ছোট~ বড় অনেক কিছুই আসবে যেটা আমাদের সংসার~ ভালোবাসাকে তুসের ঘরের মত ভেঙ্গে দিতে চাইবে। এক্ষেত্রে আমরা যদি শক্ত থাকে এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখি তবে কোনোকিছুই আমাদের আলাদা করতে পারবেনা। আশা করি, আমার কথাগুলো তুমি বুঝতে পারবে
বলে উনি চলে যেতে নিলে আমি উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। কাদতে কাদতে বললাম,

~ আমাকে ক্ষমা করে দিন। না বুঝে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমি বড্ড অবুঝ হয়ে গিয়েছিলাম, আমাকে ক্ষমা করে দিন।
উনি আমার থুতনি ধরে চোখ মুছে দিয়ে বললেন

~ এভাবে কাদে কেউ হুম? এইবার থেকে অবুঝ হয়োনা আর। চারপাশে আমাদের দূর্বলতার সুযোগ নেওয়ার লোকের অভাব নেই। তোমার জ্বীনবরটার উপর একটু বিশ্বাস রাখো। আমি আছি তো!

এত কিছু উপেক্ষা করে যখন তোমাকে পেয়েছি, ইনশাআল্লাহ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার হাত কখনোই ছাড়বনা।

বলে আমার কপালে একটা চুম্বন একে দিলেন। দুজন দুজনকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলাম। আজ নিজেকে সত্যিই অনেক সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। এমন বর ক’জন মেয়ে পায় যে এতটা আগলে রাখে, সবকিছু ফেলে বিপদে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ায়।

সারারাত উনার বুকে মাথা রেখে গল্প করলাম। উনি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সব শুনলেন। সব গল্প ই আমাদের ভবিষ্যতের গল্প, সংসার সাজানোর গল্প। উনি বলেছেন, জ্বীনরাজ্যে একটা সমস্যা চলছে। সেই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেলেই আমাকে নিয়ে যাবেন এবং আমরা নতুন করে সংসার শুরু করব। ঠিক নিজেদের মত করে।

গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।

সকালে উঠে দেখি মেহরাবের ঠোটজোড়া আমার কপাল স্পর্শ করে আছে। এতদিনে মনে অনেক স্বস্তি আর আনন্দ পেলাম। ঘুমন্ত অবস্থায় মেহরাবকে অনেক নিষ্পাপ দেখাচ্ছিল। দুষ্টুমি করে উনার মাথার চুল এলোমেলো করে উঠে এলাম। ফ্রেশ হয়ে দেখি বোন চুপচাপ বাহিরের সিড়িতে বসে আছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

~ কি হয়েছে বোন? এভাবে বসে আছিস কেন?

বোন কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগল। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
বোন কিছু বলতে না পারল না কেবল ফারহানের নামটাই নিল। আমি আর দেরী না করে ফারহানের রুমে চলে গেলাম। দেখলাম ও তার ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত।
~ ফারহান, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

~ আমি আর এই চাকরীটা করবনা, তাই চলে যাচ্ছি।
~ মানে কি? বললেই হল যে চলে যাবেন।

আপনি কোথাও যাচ্ছেন না। আপনি এই বাড়ির জামাই হয়ে থাকবেন।

~ আমাকে ক্ষমা করবেন মুশায়রা। আপনাদের দেওয়া প্রস্তাবে আমি রাজি নই। আপনারা আমাকে আপনাদের হাতের পুতুল ভাবতে পারেননা।
যখন যে ভাবে খুশি অপমান করবেন, তারপর নতুন করে মন ভাঙ্গার সুযোগ নিবেন।

~ আপনি এসব কি বলছেন? আমার বোনকে বিয়ে করতে আপনার আপত্তি কিসের! ও আপনাকে যথেষ্ট ভালোবাসে।
~ ঠিক ই বলছি। মনে একজন রেখে মুখে আরেকজন স্বীকৃতি দিতে আমি পারবনা।
~ আপনি তাহলে আগে বলেননি কেন আপনার মনে অন্য কেউ আছে?

~ আগে জানতামনা। আর যে আছে সে আমার হবেনা, এইজন্য আমিও কারো হতে চাই। যে মনে আছে, তাকে নিয়েই বেচে থাকতে চাই।
~ আমার বোনের কি হবে? এভাবে ওর মনটা আপনি ভেঙ্গে দিতে পারলেন?
~ আপনার বোনকে আপনি সামলে নিবেন। তাছাড়া এত স্বার্থপর আর উগ্র মেয়ের মন এত সহযে ভেঙে যাবেনা। আপনার বোন তাই হয়ত আপনি অনেককিছু ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু আমি আপনার মত এতটাও মহৎ নই।

এমন একটা স্বার্থপর মেয়েকে বিয়ে করে নিজের জীবন বরবাদ করতে পারিনা। ভাল থাকবেন আপনারা।
বলে ফারহান ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে চলে গেল, আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলনা।
আফরাহ ফারহানের পথ আটকে বলল,

~ তুমি যদি এখন এখান থেকে চলে যাও, সত্যিই অনেক খারাপ কিছু হবে।
~ আপনারা দ্বারা খারাপ কিছু করাই সম্ভব। এসব বলে আমাকে আটকাতে পারবেননা। আসি।
বলে ফারহান বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেল। বোন কাদতে কাদতে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। অনেক করে ডাকলাম তাও দরজা খুললনা। এই মূহুর্তে আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছিনা।

পর্ব ২৫

মেহরাবকে ডেকে বলতে গিয়েও কিছু বললামনা। এমনিতেই বেচারা আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত থাকে, এতদিন ধরে মেন্টাল ডিপ্রেশন এর ধকল সামলেছে। আমি বোনকে বুঝিয়ে নিব, ফারহানকে যাতে ভুলে যায়। কত আশা করেছিলাম, ফারহানের সাথে বোনের মিল হলে বোনটা সুখে থাকবে। ফারহানকে পেয়ে বোন অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। নতুন জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখেছিল, আর ছেলেটা কোনো কারণ ছাড়াই সব ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেল। পুরুষজাতিকে বুঝা আসলেই দায়!

বোনকে খাওয়ার জন্য ডাকলাম কয়েকবার, জবাব দিল খাবেনা। খুব বেশী ভেঙ্গে পড়েছে ও। কিন্তু এভাবে চললে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে, তখন কি হবে!
মনে মনে ভয় হল এই মনভাঙ্গার কষ্ট থেকে বোন আবার উলটাপালটা কিছু করে না বসে। বোনের রুমের জানালাটার কাছে গিয়ে দেখতে লাগলাম বোন কি করছে। মনে মনে যা ভয় করছিলাম তাই হল। বোনের হাতে ধারালো ব্লেড, কাদতে কাদতে হাতের রগের উপর ধরে রেখেছে। জোর চিৎকার করে ডাকলাম বোনকে। ও আমাকে দেখতে পেয়ে এসে জানালা বন্ধ করে দিল। দিগ্বশূন্য হয়ে পড়লাম আমি, কি করব বুঝতে পারছিলাম না।

তাড়াতাড়ি গিয়ে মেহরাবকে ডাকতে লাগলাম, এখন কিছু একটা করলে মেহরাব ই করতে পারে। মেহরাব সবটা শুনে অবাক হয়ে গেল, তাড়াতাড়ি গিয়ে ধাক্কা দিয়ে বোনের রুমের দরজা ভাঙ্গল। ঢুকে দেখলাম, বোনের অবশ শরীর মেঝেতে পড়ে আছে। হাত থেকে অনবরত বের হওয়া রক্তে মেঝে ভেসে গেছে। এই অবস্থা দেখে আমি হাউমাউ করে কাদতে শুরু করলাম। বোন এটা কি করল!!

এতবছর যে বোনটাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দেইনি, আজ সে কষ্টে ছটফট করছে। মেহরাব তার আঙ্গুল আফরাহর নাকে কাছে ধরে বলল, এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। মেহরাব আফরাহকে পাজকোলা করে বাড়ির বাহিরে নিয়ে গেল, একটা গাড়ি থামিয়ে আমিসহ হাসপাতালের দিকে ছুটল। ডাক্তার ভিতরে বোনকে দেখছে। আমি ওয়েটিং রুমে বসে কাদছি, মেহরাব আমার মাথাটা তার বুকে রেখে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল।
~ চিন্তা করোনা বউ। সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি জ্বীনরাজ্য থেকে ওর জন্য ভেষজ এনে দিব। ক্ষত উবে যাবে, একটু শান্ত হও।
~ এমন কেন হল মেহরাব! আজ যদি বোনের কিছু হয়ে যেত, আমি নিজেকে কি বলে বুঝ দিতাম?
~ আফরাহ এমন একটা জঘন্য কাজ কেন করতে গেল?

~ ফারহানের জন্য। ও হয়ত ফারহানকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল, ফারহান তা রিজেক্ট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেছে। আর তাই বোন….
~ বুঝতে পেরেছি। চিন্তা করোনা, ফারহানকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব। তার আগে আফরাহকে পুরোপুরি সুস্থ করতে হবে। ডক্টর বেরিয়ে এসেছেন, আমি আফরার অবস্থা জেনে আসি। তুমি বসো।

মেহরাব ডক্টরের সাথে কথাবার্তা সেরে আবার ফিরে আসল। আমার চোখ মুছে দিয়ে বলল,
~ শোকর আল্লাহ। আফরাহ এখন ঠিক আছে, হাতের শিরা কাটেনি তেমন। আপাতত সেলাই করে দিয়েছেন। শরীর থেকে অনেকটা রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় এখনো দূর্বল।

খেয়াল রাখতে বলেছেন, চাইলে আজ ই ওকে নিয়ে যেতে পারব। আমি মোনাজাত ধরে বললাম,
~ আল্লাহর কাছে লাখ শুকরিয়া। উনার রহমতে বোন বেচে আছে। আল্লাহ তুমি ওকে সুস্থ করে দাও।
মেহরাব, আমি কি এখন ওর কাছে যেতে পারব?

~ হ্যা পারবে। তুমি যাও, আমি গাড়ি ডেকে আনি। সাথে রিলিজের ব্যবস্থা করছি।
গুটিগুটি পায়ে বোনের কেবিনের ভিতর ঢুকলাম। বোন চুপচাপ পাথরদৃষ্টিতে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
~ এসব কেন করতে গেলি বোন?

আফরাহ শুকনো মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ ভালোবাসার মানুষ হারানোর কষ্ট বুঝলে এটাও বুঝবি।

~ এসব কোনো সমাধান। যদি মরেই যাস, তবে তোর ভালোবাসাকে নিজের করে পাবি কি করে?
~ সে তো, বেচে থেকেও পাবনা।

আর বেচে থেকে হারানোর যন্ত্রণায় তিলে তিলে মরতে পারবনা।
~ তোর কি আমার উপর একটুও ভরসা নেই?

~ আমার এখন নিজের উপর ই ভরসা নেই। কেন বাচালি বল তো, এখন প্রতিটি মূহুর্তে বেচে থেকেও মরব।
~ নিজেকে একটু শক্ত করো, বাড়ী ফিরে চল। এসব কথা এখন থাক। আগে তোর সুস্থ হওয়া বেশী প্রয়োজন।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে বোনকে নিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম। বোনকে এক মূহুর্তের জন্য ও একা ছাড়লামনা। ওকে হারানোর ভয়টা মনে জাপটে বসে আছে। ওর রুম পরিষ্কার করে ওকে এনে শুইয়ে দিলাম। ওর চোখ থেকে এখনো পানি ঝড়ছে। নিজের কাছে এত খারাপ লাগছে।
আমার রুম থেকে মেহরাব আমাকে ডাকল। বোনের কাছে বুড়িমাকে বসিয়ে রেখে আমি মেহরাবের কাছে এলাম।
মেহরাব আমার হাতে একটা কৌটা ধরিয়ে দিল এবং বলল,

~ এটা ঘুমানোর আগে আফরাহের হাতের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিও। ইনশাআল্লাহ সেরে যাবে, লাগানোর আগে আল্লাহর কালাম পড়ে মোনাজাত করে নিও।
আমি মেহরাবকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

~ আপনি আমার জন্য রহমতস্বরুপ। আপনি না থাকলে আজ কি হত আমি কল্পনা করতে পারছিনা।
~ তুমি আমার স্ত্রী। তোমার সবকিছুতে পাশে থাকা আমার দায়িত্ব। কথা দিলাম, ইনশাআল্লাহ তোমার সব রকম পরিস্থিতিতে তুমি আমাকে পাশে পাবে। আল্লাহ ছাড়া কেউ কখনো আমাদের আলাদা করতে পারবেনা।

~ তাই যেন হয়। সারাজীবন আপনার ছায়াতলেই যেন আমি বাচতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তওফীক দান করুন।
~ আমীন। তুমি আফরাহর কাছে যাও, ওকে বেশীক্ষণ একা রাখা ঠিক হবেনা। মনে করে এটা হাতে লাগিয়ে দিও।
~ আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

~ আমাকে একটু জ্বীনরাজ্যে যেতে হবে। চিন্তা করোনা, খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। ততক্ষণ তুমি নিজের এবং আফরাহর খেয়াল রেখো।
~ আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন। দাদীমাকে আমার সালাম জানাবেন। ফি~ আমানিল্লাহ।

মেহরাবকে বিদায় জানিয়ে আফরাহর জন্য স্যুপ নিয়ে ওর রুমে গেলাম। পাশে বসে বলল,
~ বোন, এই স্যুপটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। তোর শরীর এখনো অনেক দূর্বল।

~ আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা মুশু। নিয়ে যা তুই।

~ এসব বললে কি করে হবে? না খেলে আরো অসুস্থ লাগবে। এত ভেঙ্গে পড়িসনা তুই।
~ সুস্থ থাকব কার জন্য! কিছুই ভালো লাগছেনা আমার।

আমি বোনের হাত আলতো করে ধরে বললাম,
~ আমি তোকে কথা দিচ্ছি, ফারহানকে আমি তোর কাছে ফিরিয়ে আনব। খুব তাড়াতাড়ি ও তোর ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিবে। আমার উপর একটু ভরসা রাখ।
~ তুই কথা দিচ্ছিস?

~ হ্যা, আমি কথা দিচ্ছি। তুই জানিস, আমি নিজের কথার খেলাফ করিনা। একটু বিশ্বাস কর, তুই পুরোপুরি সুস্থ হলেই আমি ফারহানকে তোর কাছে নিয়ে আসব।

বোনকে কিছুটা স্বস্তি পেল। বোন খাইয়ে ওষুধ লাগাতে লাগাতে ভাবলাম, কথা তো দিয়ে দিলাম। এই কথার মান কি আমি রাখতে পারব? পরক্ষণে ভাবলাম, কথা যখন দিয়েছি যে করেই হোক তার মান আমি রাখব। বোনের মুখে হাসি ফুটিয়ে তাকে সুখী করব।
মাঝরাতে আফরাহর ঘুম ভেঙ্গে গেল। আবছা আলোয় দেখলাম তার রেকিং চেয়ারে কেউ বসে বসে দোল খাচ্ছে। আফরাহ একটু ভয়ে ভয়ে বলল, কে ওখানে?
আগন্তুক চেয়ারটা ঘুরিয়ে বলল, আমি।

আফরাহ কালো মুখোশ পড়া আগন্তুককে দেখে ভয় পেয়ে গেল। তাও সাহস করে বলল,
~ কে আপনি? এভাবে মুখোশ পড়ে আছেন কেন? আমার রুমেই বা ঢুকলেন কি করে!

মুশু… মুশু…..
~ চুপ! একদম চুপ। চিৎকার না করে আমার কথা ভালো করে শুনো। আমি বিশেষ কেউনা, ধরতে পারো তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।
তোমার ব্যাপারে আমি প্রায় সব ই জানি। তুমি তোমার বোনের প্রতি এতবছর ধরে চাপা রাগ পুষে আছো। কয়েকবার জ্বীন দিয়ে তোমার বোনের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছো।

শুধু ক্ষতি ই নয়, মেরে ফেলতেও চেয়েছো। কিন্তু প্রতিবার ই ব্যর্থ ফলাফল পেয়েছো। ঠিক বললামনা?
আফরাহর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। কোনোরকম হাতের তালু দিয়ে মুছার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বললাম, এসব বাজে কথা আপনাকে কে বলেছে?

~ উহু, একটাও বাজে কথা নয়। এটাই সত্যি।
~ আপনি কে? কি চান বলুন তো!

~ এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন? আস্তে আস্তে সব বলব।

তুমি কি জানো, আজ তোমার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী? শুধুমাত্র তোমার সৎ বোন মুশায়রা।
সৎ শব্দ টা শুনে আফরাহ চমকে উঠল। এই কথাটা আফরাহ আর তার পরিবার ছাড়া বাহিরের কেউ জানেনা, এমনকি মুশায়রাও না। তাহলে এই আগন্তুক জানলেন কিভাবে? আসলে উনি কে!

~ চমকে গেলে তাই তো! আমি আরো অনেককিছুই জানি। ফারহান তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ ও তোমার বোন। কারণ, ফারহান তোমাকে নয় তোমার বোনকে ভালোবাসে এবং তাকেই চায়।

তাই তোমার সত্যিকারের ভালোবাসাকে অস্বীকার করে ও চলে গেছে। এসব কিছুর জন্য একমাত্র দায়ী মুশায়রা।
তাছাড়া মুশায়রা নিজেও চায়নি তুমি সুখী হও, ফারহানকে আকড়ে ধরে তুমি ভালো হতে চেয়েছিলে, ভালো থাকতে চেয়েছিলে মুশায়রার সেটা সহ্য হয়নি। তাই ও ছলে~ বলে ফারহানকে তোমার থেকে কেড়ে নিয়েছে।
~ এসব কি বলছেন আপনি?

~ এসব ই সত্যি। তোমার বোন ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে তোমার ক্ষতিটাই করে এসেছে। কখনো তোমাকে বোন ভাবেনি, নিজের স্বার্থটাই দেখে এসেছে।
নাহলে বলো পারত তোমাকে না জানিয়ে একটা জ্বীনকে বিয়ে করে নিতে।
ভাবো আফরাহ ভাবো।

~ সত্যিই মুশু আমার সাথে অন্যায় করেছে। এর যোগ্য শাস্তি ওকে পেতেই হবে।
~ তুমি যদি আমার কথামত কাজ করো তাহলে তোমার দুটো লাভ হবে। এক. তোমার বোনকে যোগ্য শাস্তি দিতে পারবে এবং দুই. ফারহানকে তুমি ফিরে পাবে।
এখন বলো, তুমি কি আমার শর্তে রাজি?

~ আমি রাজি। কিন্তু এখানে আপনার লাভটা কি?
অকারণে কেউ কাউকে সাহায্য করেনা।

আগন্তুক হেসে বলল, বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমারো লাভ আছে, কিন্তু সেটা সময় এলেই জানতে পারবে। এসো হাত মিলাই, আজ থেকে মুশায়রা ধবংস শুরু।
বলে আগন্তুক উচ্চস্বরে হাসতে লাগল, সে হাসিতে তাল মিলাল আফরাহ ও।

পর্ব ২৬

সকাল থেকে মনটা কেমন জানি ছটফট করছিল। আগাম বিপদের সংকেত পাচ্ছিলাম মনে হল, কিছু একটা খারাপ ঘটতে যাচ্ছে। সারাদিন কাজে মন বসাতে পারলামনা। মনে মনে কয়েকবার মেহরাবকে স্মরণ করলাম।

উনি কখন আসবে সেটার অপেক্ষা করছিলাম। বোন ডেকে বলল, কি হল? তুই এত অন্যমনস্ক কেন?
~ নাহ, তেমন কিছুনা। এমনি মনটা ভার। তোর শরীর কেমন এখন?

~ ঠিক আছে এখন।
~ তুই রুমে যা, আমি তোর খাবার নিয়ে আসছি।

বোন চলে যাওয়ার পর একজন ভিখারী এল দোরগোড়ায়। তাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয়না। ভিক্ষা দিতে গেলে সেই ভিখারী আমাকে ডেকে বলল,
~ আসসালামু আলাইকুম জ্বীনবধূ।
~ ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে আপনি?

~ আমি জ্বীনরাজ্য থেকে আগত, মেহরাব এর খাসবিশ্বস্ত প্রহরী।
~ মেহরাব কেমন আছেন? ওদিকের খবর সব ঠিক তো!

~ সত্যি বলতে খুব খারাপ সংবাদ আছে। আপনাকে মেহরাব হুজুর সরাসরি বলার মত অবস্থা নেই, তাই আমার মাধ্যমে সংবাদ প্রেরণ করেছেন।
শুনে ভিতরের ভয়টা ক্রমশ বেড়ে গেল। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে বলুন?
~ আপনার দাদিমা ইন্তেকাল করেছেন।

সংবাদটা শুনে মনে হল মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মূহুর্তেই চোখের পানি চলে এল। আমি প্রহরীকে বললাম,
~ আমি জ্বীনরাজ্যে যাব।

~ না, এখন আপনার যাওয়া উচিত হবেনা। জ্বীনরাজ্য এখন বিশৃঙখল হয়ে পড়েছে, বদজ্বীনরা হঠাৎ করে আক্রমণ করে বসেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, প্রাসাদের অন্দরমহলের কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই মূহুর্তে আপনার সেখানে যাওয়া অনিরাপদ হবে। মেহরাব হুজুর একা হাতে সবটা সামলাচ্ছেন, আপনি সেখানে গেলে উনি আরো চিন্তিত হয়ে পড়বেন। আপনি নিজের খেয়াল রাখুন।

~ মেহরাব কখন আসবেন?

অনুগ্রহ করে তাকে একবারের জন্য হলেও আসতে বলবেন।
~ জ্বী আচ্ছা।

~ আমি তাহলে আসি? প্রহরীকে বিদায় জানিয়ে আমি রুমে চলে এলাম। দাদীমার কথা ভীষণ মনে পড়ছে, কিভাবে তার মৃত্যু হল আমার জানা নেই। আল্লাহ আপনি তাকে জান্নাত নসীব করুন।

বিকালের দিকে মেহরাব এলেন। তার মুখ থেকে এখনো শোকের ছায়া কাটেনি। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট বাচ্চার মত কাদতে শুরু করলেন। বারবার বলতে লাগলেন,
~ আমার আর আপন বলতে কেউ রইলনা মুশায়রা।

~ এত ভেঙ্গে পড়বেননা। আপনি ভেঙ্গে পড়লে জ্বীনরাজ্যের কি হবে? কে সামলাবে বলুন! আপনার এখন শক্ত থাকা খুব প্রয়োজন।
~ কে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল মুশায়রা? তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দাদীমাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। আল্লাহর নামে শপথ করছি আমাকে তাকে ছাড়বনা কিছুতেই।

~ আচ্ছা একটা কথা বলুন তো প্রাসাদের মধ্যে এমন কাউকে আপনার সন্দেহ হয় যে এই কাজটা করতে পারে?
~ তুমি তো জানো, অন্দরমহলের সবাই আমাদের কত বিশ্বস্ত। তারা কেউ এই কাজ করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস ই হয়না।
~ মেহেরজান কি এখনো প্রাসাদেই আছে?

~ হুম। দাদীমার শোকে কাতর প্রায়, খাওয়া~ দাওয়া একদম ই ছেড়ে দিয়েছে।
~ ওর সাথে তোমাদের আত্মীয়তা কিসের?

~ ও আমার কাকার মেয়ে। তলোয়ার নিয়ে হওয়া যুদ্ধে আমার বাবা এবং ওর বাবা মারা যায়। তাবু আক্রমণ করে আমাদের মাকে শত্রুরা বন্দি করেন। তখন আমরা দুজন ৫~ ৬ বছর বয়সী ছিলাম। ভাগ্যক্রমে দাদীমা আমাদের বাচাতে পারলেও মা~ কাকীকে উদ্ধার করতে পারেননি।
মেহেরজান আর আমাকে দাদীমা কোলে~ পিঠে করে মানুষ করেছে। তখন ই মেহেরজানের নানাভাই প্রস্তাব দেন আমার সঙ্গে মেহেরজানের বিয়ে ঠিক করে রাখতে।

মেহেরজান প্রায়শ তার নানাবাড়ীতে থাকত। তবে দাদীমাকে ও খুব ভালোবাসত এবং দাদীমাও তাকে চোখে হারাতেন।
~ আমাদের বিয়ের কথা জানার পর ওর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

~ ও একটু কষ্ট পেলেও স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছিল। আসলে ও দাদীমার প্রতি অনেক অনুগত। দাদীমার কথার বাহিরে কখনো যেতনা।
~ আচ্ছা তুমি একটু শক্ত হও। সকাল থেকেই আমার মনটা খুব ছটফট করছিল, বলতে গেলে কাল রাতে স্বপ্নে দাদীমাকে দেখে।
~ তুমি দাদীমাকে স্বপ্নে দেখেছিলে?

~ হ্যা। দাদীমা আমাকে খুব বড় একটা দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।
~ কিসের দায়িত্ব?

~ জ্বীন তলোয়ার রক্ষা করার দায়িত্ব। একমাত্র আমি ই ওটা স্পর্শ করে বহন করতে পারব। শত্রুদের কাছ থেকে নিরাপদে রাখতে পারব। আমার কাছে এটা কেবল স্বপ্ন ই মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দাদীমা সত্যিই আমায় এই দায়িত্ব দিয়েছে। মেহরাব আমার খুব ভয় করছে।

~ ভয় পেয়োনা, তোমার জ্বীনবর তোমার সাথে আছে। শক্রুরা আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, দাদীমা মারা যাওয়ায় পুরো রাজ্য ই শোকাহত। এই অবস্থায় কেউ লড়াইয়ের দিকে মনোযোগী নয়। আমিও মানসিকভাবে অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়েছি। কি করব বুঝতে পারছিনা!

~ তুমি লড়াই করো, দাদীমা এতবছর ধরে কষ্ট করে আগলে রাখা সম্পত্তি এভাবে বিনষ্ট হয়ে যেতে দিওনা। আমি আছি তোমার পাশে, যতক্ষণ দেহে প্রাণ থাকবে আমি জ্বীন তলোয়ার কিছুতেই শত্রুর হাতে যেতে দিবনা।

মেহরাব আমার গাল দুটো আলতো করে ধরে বললেন,
~ আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, উনি আমার কপালে তোমার মত সহধর্মিণী রেখেছেন। যে বিপদে আমার অভয় আর ছায়া হয়ে পাশে আছে।
~ আমি তো তোমার বুকের বাম পাজর। তোমার মতই হয়েছি। আল্লাহ ভরসা, উনি আমাদের সহায় হয়ে আমাদেরকে ঠিক রক্ষা করবেন।
মেহরাব আমার কপালে ছোট্ট চুম্বন একে বলল,
~ আমাকে যেতে হবে মুশায়রা।

~ আমি যাবনা?

~ তুমি এখানে থাকো, জ্বীনরাজ্যে ঘোর সংকট চলছে। কখন কার প্রাণহানী ঘটে বলা যায়না। আমি তোমাকে এই বিপদের মুখে কিছুতেই ঠেলে দিতে পারিনা।
~ ~ আপনার এই দুঃসময় আমি আপনার পাশে স্থান পাবনা।

~ মুশায়রা, তুমি তো আমার পাশে সবসময় আছো। কথা দিচ্ছি, যখন তোমাকে প্রয়োজন হবে আমি স্মরণ করব। তোমাকে আমার নিকট নিয়ে যাব।
কিন্তু এখন এই অনিশ্চিত সময়ে তোমাকে সুরক্ষিত রাখার নিশ্চয়তা আমি পাচ্ছিনা। তুমি আফরাহর কাছে থাকো, ওর এই খারাপ সময়ে তোমাকে বড্ড দরকার।
ও এখনো মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নয়।

~ সাবধানে থাকবেন। ফি~ আমানিল্লাহ।

আল্লাহ আপনার সহায় হোন। মেহরাব বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি নিশ্চুপ হয়ে ভাবতে লাগলাম কি করে জ্বীন তলোয়ার রক্ষা করব আমি। আমি তো নিতান্ত এক সাধারণ মেয়ে। আমার পক্ষে কি সম্ভব?

আফরাহ নিশ্চুপে মুশায়রার জানালার সামনে থেকে সরে এল। এতক্ষণ যা যা বলা হচ্ছিল, সব ই ও আড়ি পেতে শুনে নিয়েছে। এই কথাগুলো যত দ্রুত সম্ভব উনাকে জানাতে হবে। আফরাহ দেরী না করে নিজের রুমে এসে আগন্তুকটিকে স্মরণ করতে লাগল।

কিছুক্ষণ বাদেই তার রুমের আলো নিভে গেল এবং আগন্তুক এর কন্ঠ শুনা গেল। আফরাহ তার কাছে সব বিস্তারিত খুলে বলল।

আগন্তুক উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল, এখন দেখছি কাজ আরো সহজ হয়ে গেল। আর দেরী না করে আসল চালটা এক্ষুণি চেলে ফেলতে হবে। তুমি আমার সাথে আছো তো আফরাহ?
~ নাহ।

~ কেন?
~ আমি এখনো এই ভরসা পাচ্ছিনা যে আমি ফারহানকে ফিরে পাব। আপনি আমাকে আশ্বাস দিলেও আমি স্বস্তি পাচ্ছিনা। তাই আমি চাই আগে ফারহান আমার কাছে ফিরে আসুক, তারপর আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।
~ প্রেম তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে পুরোপুরি।

~ ঠিক আছে, আজ রাতেই ফারহান তোমার কাছে ফিরে আসবে। তবে তুমিও প্রস্তুত থাকো।
~ কিসের জন্য?

~ নিজের হাতে নিজের বোনকে খুন করার। বলে আগন্তুক আবারো হেসে উঠল। আফরাহ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল।

এটা কি করে সম্ভব? মুশুর সাথে ওর যা ই হোক, নিজের হাতে মারার চিন্তা ও কখনো করেনি। শত হলেও এতগুলো দিন মুশু ওকে আগলে রেখেছে, ভালোবাসা দিয়েছে নিজের বোনের মত। তাকে আফরাহ কি করে নিজের হাতে মারবে।

~ এইটা আমি পারব না!

~ কেন পারবেনা? তুমিই তো অনেকবার মুশায়রাকে জ্বীন দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছো। আজ তুমি এত সাধু সাজছো কেন?
~ আমি যাই ই করিনা কেন, মুশুকে কখনো নিজের হাতে মারতে চাইনি। সৎ হলেও ওকে আমাকে যথেষ্ট ভালোবেসে এতদিন আগলে রেখেছে।
~ তোমার হাতে এখন দুটো রাস্তা ই আছে। হয়ত তুমি তোমার বোনকে নিজের হাতে খুন করবে নয়ত ফারহানকে চিরদিনের মত হারাবে।
তুমি যে রাস্তা ই বেছে নাও, তার জন্য অগ্রীম শুভেচ্ছা। তবে আরেকটা কথা বলে রাখি, আমি আমার স্বার্থের জন্য সব করতে পারি। তোমার চোখের সামনে আমি ফারহানকেও মারতে পারি। অতএব, তুমি যদি তোমার বোনকে না মারতে পারো, আমি ফারহানকে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিব।
~ না!!!

~ ভাবো আফরাহ ভাবো। তোমার বোন তোমার সাথে আজীবন থাকবেনা, সে তার বরের কাছে জ্বীনরাজ্যে গিয়ে সুখে~ শান্তিতে থাকবে আর তুমি ফারহানকে হারিয়ে নিঃস্বের মত একা জীবনযাপন করবে।

~ আমি আপনার সবকথায় রাজি, যা বলবেন তাই করব।
দরকার হলে নিজের বোনকে খুন করব।

রাত ১০টার দিকে হঠাৎ কেউ দরজায় কড়া নাড়ল। মনে মনে ভাবলাম, এ সময় আবার কে এল! মেহরাব নয় তো। দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এটা কি আদৌ স্বপ্ন নাকি বাস্তব। ফারহান ফিরে এসেছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি?”
~ কেমন আছেন মুশায়রা?

~ হুম ভালো। আপনি ফিরে এসেছেন?

~ হুম, সত্যিকারের ভালোবাসার মান আমি বুঝতে পেরেছি। আফরাহ সত্যি আমাকে অনেক ভালোবাসে। ওর ভালোবাসা প্রত্যাখান করে আমি বড্ড ভুল করেছি, প্রতিমূহুর্তে আমার বিবেক আমাকে দংশন করছে। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আফরাহ কোথায়?
~ এসো ভেতরে আসো। বোন, তুই কোথায়?

আফরাহ রুম থেকে বেরিয়ে ফারহানকে দেখে থ হয়ে গেছে। সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ কোথায় ছিলে তুমি? জানো আমার কত কষ্ট হয়েছিল!

এভাবে আর কখনো ছেড়ে যেওনা।

ফারহানও আফরাহকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমি আর সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে এলাম, এটা মান~ অভিমান ভাঙ্গানোর সময়। ওরা ওদের মত করে কিছুটা সময় কাটাক। কিন্তু একটা খটকা রয়ে গেল, ফারহান কেন ফিরে এল? ও কি সত্যিই ওর ভুল বুঝতে পেরেছে নাকি অন্যকিছু….
উফফ! জ্বীন তলোয়ারের টেনশান মাথায় আসার পর থেকে অকারণেই সবাইকে সন্দেহ করছি।

ভালোই ভালোই শত্রুদের দমন করে জ্বীনরাজ্য থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।

মাঝরাতে আফরাহ বড় ধারালো ছুড়ি নিয়ে মুশায়রার রুমের দিকে এগোতে লাগল। রুমের দরজা ভেজানো ই ছিল।

মুশু খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। এটাই তাকে মেরে ফেলার সঠিক সময়। মুশুর কাছে দাঁড়িয়ে আফরাহ তার লক্ষ্য ঠিক করে নেয়, ছুড়িটা বসাবে এমন সময় মুশু জেগে উঠে। আফরাহর হাত থেকে ছুড়িটা মেঝেতে পড়ে যায়।

মুশু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, বোন, তুই এখানে?

~ আ~ আসলে, আমার মাথা খুব যন্ত্রণা করছে। আমার ওষুধটা ফুরিয়ে গেছে, তাই দেখতে এলাম তোর কাছে আছে কিনা।
~ তো আমায় জাগাসনি কেন? দাড়া আমি দিচ্ছি।

~ না তুই নামিসনা। বল কোথায় আছে, আমিই খুজে নিচ্ছি।
~ ড্রায়ারের উপরের বাক্সে রাখা আছে। ফারহান ঘুমিয়ে গেছে?
~ হ্যা, ইস ওষুধটা নিচে পড়ে গেল। আমি নিয়ে নিচ্ছে। ওষুধটা ফেলার নাম করে আফরাহ ছুড়িটাও উঠিয়ে নিয়ে রুমের বাহিরে চলে এল। জোর বাচা বেচে গেছে আজ।

রুমে আসতেই আগন্তুক তাকে একটা চড় মারল।
~ বোকা মেয়ে, তোকে এখন খুন করতে বলেছি?
~ আমি কি ভুল করলাম?

~ ওই মুশায়রা এখন আমার কাছে সোনার ডিম পাড়া হাস। আগে ডিম পাড়তে দে, তারপর না হয় মেরে ফেলার কথা আসবে।
আমাকে না জিজ্ঞেস করে আর কোনো কাজ করতে যাবিনা। ফারহানকে পেয়েছিস ওটা নিয়ে খুশি থাক, আমাকে আমার কাজ করতে দে।
মুশায়রার কানে একটা কথা বার বার বাজতে লাগল, মুশায়রা, তুমি জ্বীনরাজ্যে এসো। আমার খুব বিপদ। কন্ঠটা যেন মেহরাবের ই। তাহলে কি মেহরাব কোনো বিপদে পড়েছে? আমি এখন কি করে যাব জ্বীনরাজ্যে? জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার পথ তো আমার জানা নেই।

পর্ব ২৭

মনটা ভীষণ অস্থির লাগছে। কিভাবে জ্বীনরাজ্যে যাব বুঝতে পারছিনা। মনে মনে মেহরাবের খাস প্রহরীকে স্মরণ করলাম, জানিনা এতে কোনো কাজ হবে কিনা! আল্লাহর অশেষ রহমতে খাস প্রহরী আমার সামনে এসে উপস্থিত হল। আমি অস্থিরতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
~ আপনি জ্বীনরাজ্যের খোজ কিছু জানেন? মেহরাবের অবস্থান সম্পর্কে অবগত?

~ আমি তো যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। তবে মেহরাব হুজুরের খবর আমি ঠিক জানিনা। উনার সাথে আমার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। উনার কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম কয়েকবার, উনি তার কোনো উত্তর প্রদান করেননি। সেইজন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে শত্রুরা উনাকে বন্দি করেননি তো! আমি চারদিকে খোজ লাগাচ্ছি।
শুনে বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে উঠল। ঠিক এমন কিছুর আশঙ্কা আমি করছিলাম। এখন আমাকে কিছু একটা করতে হবে। নতুবা বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে মেহরাবের।

~ আপনি আমার জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। অতি সত্ত্বর আমি সেখানে যেতে চাই। অনুগ্রহ করে যেভাবেই হোক আমাকে নিয়ে যান।
~ কিন্তু মেহরাব হুজুর তো আপনাকে যেতে বারণ করেছেন
~ উনার বিপদে আমি ঘরে চুপ করে বসে থাকতে পারিনা।

~ আচ্ছা আপনি অপেক্ষা করুন। আমি আপনার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।

আফরাহ আড়াল থেকে সব শুনে আগন্তুকের নাম নিতে লাগল। আগন্তুক অদৃশ্য কন্ঠে বলল,
~ কি ব্যাপার? তুমি আমাকে ডাকছো কেন?

~ মুশায়রা জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

~ এটাই আমি চাচ্ছিলাম। যেতে দাও, আর তুমি কাদো কাদো মুখ করে মুশায়রার কক্ষে বসে থাকো।
~ কেন?
আগন্তুক আফরাহর কানে কানে কিছু একটা বলে বলল,
~ কাজটা সেরে তুমি নিজেও প্রস্তুত হও। তোমার বোনকে আজকেই খুন করবে তুমি। চলে এসো ঠিক সময়ে।
~ ঠিক আছে তাই হবে।

খাস জ্বীনপ্রহরী মুশায়রার জ্বীনরাজ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। মুশায়রা আর দেরী না করে জ্বীনরাজ্যের দিকে রওনা হল।
আফরাহ মুশায়রার রুমে কান্নার ভান ধরে বসে রইল।

এমনসময় মেহরাব তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকে মুশায়রাকে ডাকতে লাগল। আফরাহ চোখ মুছে বলল,
~ আপনি মুশুকে খুজচ্ছেন? কিন্তু ও তো আর নেই।
~ নেই মানে?

~ নেই মানে কয়েকজন ভয়ংকর লোক ওকে এখান থেকে তুলে নিয়ে চলে গেছে। আমি ওকে বাচানোর এত চেষ্টা করেও কোনোভাবেই বাচাতে পারলামনা।
~ ওরা ওকে কোথায় নিয়ে গেছে?
~ আযমসুরাহ পাহাড়ে।

~ ওটা তো বদজ্বীনের আস্তানা।
~ ওরা কি মুশুকে মেরে ফেলবে ভাইয়া?

এমনসময় মেহরাবের মাথায় কেউ ভারীকিছু দিয়ে জোরে আঘাত করল। মেহরাব জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ফারহান মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে বলল,
~ অর্ধেক কাজ শেষ। এইবার ওকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। তুমিও চলো।

মুশায়রা জ্বীনরাজ্যে এসে দেখে খোলা প্রান্তরের চারিদিকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলসে। অনেক মৃতদেহ মাটিতে পড়ে আছে, খাস প্রহরী এসব দেখে বলল,
~ আপনি এখান দিয়ে যেতে পারবেননা। ওরা আপনাকে দেখলে সোজা মেরে ফেলবে।

~ তাহলে এখন উপায়? আমাকে যে করেই হোক আগে প্রাসাদে যেতে হবে। মেহরাবের খোজ না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোনোক্রমেই শান্ত হতে পারছিনা।
এমনসময় একটা তীর আমার দিকে ছুটে আসতে লাগল। প্রহরী আমাকে সরিয়ে দিয়ে নিজের বুক পেতে দিল।

তীরটা সোজা এসে তার বুকে গেথে গেল। এই দৃশ্য দেখে আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। প্রহরী কালেমা পড়ে নিথর হয়ে গেল। এই শত্রুবাহিনী অনেক বর্বর। এদের এড়িয়ে আমি প্রাসাদে যাব কি করে!

এমনসময় একটা নিকাব পড়া মেয়ে আমার হাত টেনে ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেল। তারপর কিছু পায়ের শব্দ পেলাম, যারা লাথি মেরে মেরে মৃতদেহগুলো শনাক্ত করছিল। মেয়েটি আমাকে চুপি চুপি বলল,
~ আপনি এখানে এসেছেন কেন জনাবা? ভয় পাবেননা, আমি দাদীমার একজন সেবিকা।

~ আমার মন বলছে মেহরাবের অনেক বিপদ। মেহরাব কোথায় তুমি বলতে পারো?
~ এত বিপদের মধ্যে আপনি এখানে এলেন? মেহরাব হুজুর তো প্রাসাদে নেই। অনেকক্ষণ আগেই হন্তদন্ত হয়ে কোথাও চলে গিয়েছিলেন। তার কাছে সংবাদ এসেছে আপনার খুব বিপদ।

~ তাহলে মেহরাব কি আমাদের বাড়ীতেই গিয়েছে? নাকি শত্রুরা তাকে বন্দি করার কোনো ছলাকৌশল পেতেছে?
~ আপনার এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। আপনি আপনার সব উত্তর বড় জ্বীনহুজুরের কাছেই পাবেন। উনি আপনাকে উপায় বাতলে দিতে পারে। চলুন ঝোপের আড়ালে সাবধানে আমরা বেরিয়ে জ্বীনহুজুরের কাছেই যাই।

সেবিকার কথামতে আড়ালে লুকিয়ে বড় জ্বীনহুজুরের বাসস্থানে এলাম। উনি আমাদের দেখে তাড়াতাড়ি গৃহে প্রবেশ করতে বললেন। আমরা তাই করলাম।
~ তুমি এত বিপদে জ্বীনরাজ্যে এসেছো?

~ আমি আমার স্বামীর বিপদের আশঙ্কা করছি। আমার মনে হল, উনি বিপদে। তাই আমি এখানে ছুটে এলাম।
এখন শুনছি, উনি আমাকে খুজতে আমাদের বাড়ীতে গিয়েছেন।

~ এটা শক্রুদের পাতা ফাদ মাত্র। তারা মেহরাবকে বন্দি করার জন্য জ্বীনরাজ্য থেকে বের করে তাদের কাছে নিয়ে গেছে। কেননা, মেহরাব তাদের কাছে কিছুতেই ধরা দিচ্ছিলনা।

~ তাহলে আমি এখন কি করব? কিভাবে মেহরাবকে তাদের কাছ থেকে মুক্ত করে আনব?
~ ওরা তোমাকে প্ররোচনা দিয়ে এইজন্য ই জ্বীনরাজ্যে পাঠিয়েছে। যাতে তুমি তাদের দাবীকৃত জ্বীন তলোয়ার নিয়ে তাদের নিকট যাও।
~ তারা তো আমাকে এই ব্যাপারে কোনো খবর পাঠায়নি।
~ তুমি প্রাসাদে গেলেই খবর পাবে।

~ তাহলে কি আমি জ্বীন তলোয়ার নিয়ে তাদের কাছে যাব?

~ যাবে কিন্তু তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নয়। জ্বীন তলোয়ার দিয়ে তাদের খতম করে দেওয়ার জন্য।
~ আমি কি সেটা করতে পারব?

~ ইনশা আল্লাহ পারবে। তোমার দাদীমা নিশ্চয়ই তোমাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছেন। তার কথানুযায়ী কাজ করো তবেই তুমি সফল হবে।
তবে এর বিনিময়ে তোমাকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
~ কি ত্যাগ?
~ জ্বীন তলোয়ার ব্যবহার করার ক্ষমতা পেলে হয়ত তোমাকে আজীবন মা ডাক থেকে বঞ্চিত হতে হতে পারে।
আর যদি লাভ ও করো সেটার জন্য অনেক বাধা পোহাতে হবে। হয়ত অনাকাঙখিত ভাবে তোমার সন্তানের মৃত্যু ও হতে পারে।
~ এসব কি বলছেন জ্বীনহুজুর?

~ এটাই বদজ্বীনদের চাল। তারা শয়তানের মাধ্যমে জ্বীনসর্দারের থেকে এই শর্ত আদায় করে নিয়েছে। এইজন্য এত বছর ধরে কেউ এই জ্বীনতলোয়ার ব্যবহার করার স্পর্ধা দেখায়নি। বদজ্বীনেরা এসব কিছুই জানে, তাই তারা নিশ্চিত তুমি তাদের সাথে লড়াই করবেনা এবং এই জ্বীন তলোয়ার ব্যবহার করবেনা।
আরেকটা শর্ত কিন্তু অবধারিত।
~ কি শর্ত?

~ সেখানে যত বদজ্বীন থাকবে, তার মধ্যে একজন ও যাতে না বাচতে পারে। তাহলে তোমাদের এত ত্যাগ কোনো কাজেই আসবেনা। তলোয়ার টা অদৃশ্য হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য এবং গোটা পৃথিবী আর জ্বীনরাজ্যে বদজ্বীনের দৌরাত্ম বেড়ে যাবে। তাদের অন্যায়~ পাপে সব কিছু ছেয়ে যাবে। তাই একটি বদজ্বীন ও যেন বাচতে না পারে।

~ তাই হবে।
~ তুমি প্রাসাদে গিয়ে দেখো ওরা কোনো না কোনো সংবাদ তোমাকে নিশ্চয়ই দিয়ে থাকবে, সেই অনুযায়ী জ্বীন তলোয়ার নিয়ে তুমি ওদের কাছে যাও।
~ দোয়া করবেন, যাতে আমি সফল হতে পারি।

~ আল্লাহ তোমার সহায় হোন। তুমি পিছনের দরজা দিয়ে বের হলেই প্রাসাদের পশ্চিমমুখে পৌছে যাবে।
এমনসময় দরজায় কড়া পড়ল। জ্বীনহুজুর আমাদের লুকাতে বলে দরজা খোলামাত্র ই শত্রুর তলোয়ারের আঘাতে উনার দ্বিখন্ডিত মাথাটা মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি নির্মমতা আমাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তুলেছে যে করে হোক এই বদজ্বীনদের শেষ করতেই হবে।
অনেক লুকিয়ে~ কষ্টে প্রাসাদে ঢুকতে পারলাম। প্রাসাদটা পুরো জনশূণ্য, অথচ একসময় কত দাসদাসী তে পূর্ণ ছিল। কেউ হয়ত মারা গেছে, কেউবা জ্বীনরাজ্য ছেড়ে মানুষের মাঝে আশ্রয় নিয়েছে।

দেরী না করে মেহরাবের কক্ষে গেলাম। জ্বীনহুজুর ঠিক ই বলেছেন, ওরা এমন সংকেত দিয়ে রাখবে। দেয়ালে স্পষ্ট লেখা আছে জ্বীন তলোয়ার নিয়ে যেন আমি আযমসুরাহ পাহাড়ে যাই। বাহিরে থাকা বদজ্বীনের সৈন্য আমাকে নিয়ে যাবে গন্তব্যে।

আমি নামাযঘরে ঢুকলাম। যেখানে গুপ্ত দরজা দৃশ্যমান হয়েছিল সেখানে দাঁড়িয়ে কয়েকবার সূরা ফাতিহা পড়লাম, সাথে সাথে দরজা দৃশ্যমান হল। আমি ভিতরে ঢুকে সিন্দুকটার কাছে গেলাম। কিন্তু সিন্দুকটা স্পর্শ করতেই আমি দূরে ছিটকে পড়ছিলাম। বুঝতে পারলাম, এটা এভাবে খোলা যাবেনা। দাদীমার আদেশের কথা মনে করে সূরা জ্বীন এর শেষ কয়েক আয়াত পড়তেই সিন্দুক নিজে নিজে খুলে গেল। এত সুন্দর শুভ্র তলোয়ার আমি আগে কখনো দেখিনি, তলোয়ারের ধার থেকে যেন আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তলোয়ারের গায়ে আরবী হরফ খোদাই করা।

তলোয়ারটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সাথে সাথে কয়েকজন সৈন্য আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল। বলল,
চুপচাপ আমাদের সাথে চলুন।

গন্তব্যে পৌছে সৈন্যরা আমাকে গুহায় ঢুকিয়ে বাহিরে থেকে গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। আবছা অন্ধকারে কিছুটা হেটেই সামনে যেতেই অদৃশ্য কন্ঠে শুনলাম,
~ স্বাগতম মুশায়রা। আমি জানতাম তুমি আসবে।

~ আমি তো এসেছি, এইবার আপনারা সামনে আসুন।
আপনাদের জ্বীন তলোয়ার চাই তাই তো।

সাথে গুহার ভিতরের মশাল গুলো জ্বলে উঠল। পাশে তাকিয়ে দেখি ওরা মেহরাবকে আধমরা অবস্থায় খাচার ভিতরে আটকে রেখেছেন। মেহরাবের কাছে যেতে চাইলে
কন্ঠটা বলে উঠল,
~ ওদিকে যেওনা। তাহলে তোমার আগে মেহরাবের জানাযা পড়ানো হবে।

দেখো, তোমার স্বামীর অবস্থা। এত শক্তিশালী জ্বীন হয়েও আমাদের কাছে ও কিছুই না। ও জানত ই না, আমাদের গুহায় তার কোনো জ্বীনি শক্তি কাজ করবেনা। শুধু শুধু লড়াই করতে এসে নিজেই আধমরা হয়ে গেছে।
~ কে আপনি? সামনে আসুন।

~ সামনেই আছি, দেখো। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনের দিকে নিতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এ তো মেহেরজান, ওকে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু মেহরাবের মুখে ওর আনুগত্যতা শুনে আমি ওকে ভালোই ভেবেছি।
~ তাহলে তুমি ই সেই বিশ্বাসঘাতক?

মেহেরজান পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল,
~ হাহাহা, হ্যা আমি ই।

~ শেষ পর্যন্ত তুমি আপনলোক হয়েও বিশ্বাসঘাতকতা করলে। জ্বীনবংশের সদস্য হয়েও বদজ্বীনের সাথে হাত মিলিয়েছো!
~ কে আপনলোক! আমি মেহরাবের বংশের কেউ না। আমি বদজ্বীনের সর্দারনীর মেয়ে। কেবল মেহেরজানের পরিচয় নিয়ে জ্বীন তলোয়ার হাতিয়ে নেওয়ার জন্য এসেছিলাম। আমি একা নই, আরো অনেকে আছে আমার সাথে দেখতে চাও?
সাথে সাথে বেরিয়ে এলো মরিয়ম আর জ্বীনরাজ্যে ঢোকার পথে সাহায্যকারী বুড়িমা। মরিয়মকে দেখে আমি আরো অবাক হলাম। ভাবতে পারিনি ওকে এভাবে দেখব!
~ এখনি বিস্মিত হয়োনা। আরো আছে।

তারপর সামনে আসল ফারহান আর বোন। আমার অবাকের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল।
~ বোন তুই!!

~ হ্যা আমি। আমিও ওদের সাথে হাত মিলিয়েছি।
~ এমনটা কেন করলি বোন?

~ উফফ! চুপ, আমাকে একদম বোন বলে ডাকবিনা। তুই আমার আপন বোন নস, সৎ বোন। তোকে নর্দমার পাশে কুড়িয়ে পেয়েছিল বাবা। তোর জন্য আমি অনেককিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমার আপন মা~ বাবা আমার চেয়ে তোকে বেশী ভালোবাসত।
বাবা আমার থেকে তোকে বেশী প্রায়োরিটি দিত। এইজন্য তোকে মারার আমি খারাপ জ্বীনের সাধনা করা শুরু করেছিলাম। বাবা~ মা সব জেনে গিয়েছিল তাই আমার তাদেরকে মারতে হয়েছিল।

~ তুই এটা করতে পারলি বোন!
~ কেন করবনা? আমি আমার প্রাপ্যতা থেকে সবসময় বঞ্চিত হয়েছি। কি পেয়েছি আমি? তুই আমাকে সবসময় ঠকিয়ে এসেছিস। ফারহানকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলি, সেই রাগ থেকেই আমি এদের সাথে হাত মিলিয়েছি।

মেহেরজান হেসে বলল, কি এক অবস্থা! যাই হোক, মরিয়ম আর ফারহান আমার নিজের আপন ভাই~ বোন। আর এই বুড়িমা আমার মা, যাকে তোদের দাদীমা অভিশপ্ত করে রাক্ষসী বানিয়ে জ্বীনরাজ্যের বাহিরে ফেলে রেখেছিল।
এখন, আমরা দেনাপাওনায় আসি।

তলোয়ার টা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে সোজা পরকালে পাড়ি জমাও।

~ এই তলোয়ার আমি কখনোই দিবনা। আমার জীবন থাকতেও না। মেহেরজান রেগে গিয়ে আমার থেকে কেড়ে নিতে আসলে ও নিজেই ছিটকে দূরে পড়ে যায়।

বুড়িমা মেহেরজানকে বলল,
~ এভাবে তার থেকে তলোয়ার নেওয়া যাবেনা। যতক্ষণ না ও নিজে থেকে আমাদের হাতে দিচ্ছে, আমরা এটা নিতে পারবনা। মুশায়রা আমি তোমার কাছে বিনিময় চেয়েছিলাম মনে আছে? আজ সে বিনিময়স্বরুপ তোমাকে এই তলোয়ার দিতে হবে।
আমি তো তোমার ভালোই করে এসেছি, তাই নয় কি! তুমি বিয়ের আসর থেকে পালাচ্ছিলে, আমি ই তো তোমাকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে মেহরাবের সাথে তোমার বিয়েটা দিয়েছি।

~ সেটার পিছনে যে আপনার স্বার্থ ছিল, সেটা আজ আমার কাছে পরিষ্কার। কারণ, আপনি ভাল করেই জানতেন দাদীমা আমাকে ই জ্বীন তলোয়ার ধরার দায়িত্ব দিবেন।
আপনার বিনিময় হিসেবে আম এই তলোয়ার আপনাকে দিবনা।

~ তুমি তোমার ওয়াদা ভঙ্গ করছো মুশায়রা। নিজের ওয়াদা যদি ভঙ্গ করো আমাকে অন্য পথ ধরতে হবে। মেহরাবকে তোমার চোখের সামনে মারতে হবে। সেটা চাও?

আমি একটু চুপ করে ভাবতে লাগলাম। তারপর তলোয়ারটা উনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, নিন। আজ থেকে আপনিই হয়ে যান জ্বীনরাজ্যের সম্রাজ্ঞী।
বুড়ি আমার হাত থেকে তলোয়ার নিয়ে অট্টহাসি দিতে লাগল। মেহরাব আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি তাকে ইশারায় আশ্বস্ত করলাম।

আমি যেটা ভেবেছি সেটা হল, মেহেরজান বুড়ির হাত থেকে তলোয়ার কেড়ে নিয়ে বলল, এটা আমার প্রাপ্য। বুড়ি এইকথায় রেগে কেড়ে নিতে গেলে মেহেরজান বুড়ির গলা চেপে ধরে তাকে শূন্যে উঠিয়ে শক্ত পাথরের উপর ফেলে দেয়। বুড়ি সেখানেই মারা যায়। মরিয়ম রাগ করে মেহেরজান থেকে তলোয়ার কেড়ে নিয়ে বলল, তুই এত নিচে নামবি ভাবিনি। এই তলোয়ার তুই পাবিনা, এটার জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি। এটা কেবল আমার।
এই নিয়ে দুইবোনের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেল। আফরাহ ফারহানকে শক্ত করে চেপে ধরে বলল, তুমি ওই তলোয়ারের লোভ করোনা। আমরা এমনিই সুখে থাকব।

ফারহান বলল, আমি তলোয়ারের লোভ করিনা। আমআর শুধু মুশায়রাকেই দরকার। আপুর কথায় তোমার সাথে মিথ্যা অভিনয় করেছি মাত্র। অতএব, তুমি আমার আশা ছেড়ে দাও। আফরাহ এই কথা শুনে থ হয়ে গেল।

আমি জানতাম কাটা দিয়েই কাটা তোলা যাবে। কিছুক্ষণের লড়াইয়ে মেহেরজানের সাথে মারা পড়ল মরিয়ম। এরা স্বার্থের জন্য আসলেই সব করতে পারে। নিজের রক্ত এদের কাছে কোনো ব্যাপার না, যেমনটা আমার বোন করেছে।

মেহেরজান তলোয়ার হাতে নিয়ে বলল, এখন থেকে জ্বীনরাজ্যের সম্রাজ্ঞী আমি। সব কিছু আমার আয়ত্বে চলবে। ফারহান বলল,
~ আপু তুমি আমাকে কথা দিয়েছো মুশায়রাকে আমার হাতে তুলে দিবে। আমি জ্বীনতলোয়ারের ভাগ চাইনা, মুশায়রাকে পেলেই হবে আমার।

~ বেশ তুই সেটাই পাবি। তাহলে আফরাহ আর মেহরাবকে খুন করে ফেলি আমি। আফরাহ চিৎকার করে বলল, আপনি আমার সাথে এটা করতে পারলেন?
~ আমি কি করতে পারি তা তো এতক্ষণ দেখলে। তুমি আমার কাছে একটা গুটি ছিলে মাত্র। কাজ শেষ, তোমাকে আর প্রয়োজন নেই।
আফরাহ কান্না করতে শুরু করল। আপনার কথায় আমি কিনা করেছি, নিজের বোনের ক্ষতি করতে চেয়েছি। আর আপনি আমাকে ধোকা দিলেন।

আমি এখন ভাবছি মেহেরজানের হাত থেকে কিভাবে তলোয়ার টা নিব! একটু ভাবার পর কয়েকটা দোয়া পড়ে মেহেরজানের গায়ে ফুকে দিলাম। মেহেরজান ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে গেল। আমি মাটিতে পড়ে থাকা তলোয়ার হাতে নিয়ে বললাম, তোমার খেলা শেষ মেহেরজান।
মেহেরজান হাসতে হাসতে বলল, এই তলোয়ার দিয়ে আমাকে খতম করার আগে ভেবে নাও তুমি কি কি হারাবে।
~ আমি কোনোকিছুর ই পরোয়া করিনা মেহেরজান।

আমার লক্ষ্য কেবল তোমার মত শক্রুদের শেষ করা। আর আমি সেটাই করব।

বলে আল্লাহর কালাম পড়ে তলোয়ার দিয়ে মেহেরজান কিছু বুঝে উঠার আগে তার মুন্ডু নামিয়ে দিলাম। ছটফট করতে করতে মেহেরজানের মৃত্যু হল। এইবার আমি ফারহানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলাম। আফরাহ তা বুঝতে পেরে আমার সামনে হাত জোর করে বলল,
~ বোন আমাকে ক্ষমা করে দে, শয়তানীর কথার ফাদে পড়ে আমি তোর ক্ষতি করতে চেয়েছিলাম। দয়া করে তুই আমার ফারহানকে মারিসনা। আমি কথা দিচ্ছি ওকে ভালো করে দিব। আর কখনো তোদের ক্ষতি করবনা আমরা।

বোন আমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে লাগল।

~ বোন আমি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি, কিন্তু এই ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। ফারহানকে আমার মারতেই হবে।
নাহলে সবকিছু বৃথা যাবে। আমাকে ক্ষমা করিস।

ফারহান আমার সাথে লড়াই করতে চাচ্ছেনা। নিজের প্রাণ রক্ষার্থে গুহার বাহিরে বেরিয়ে দৌড়াতে লাগল। আমিও ওর পিছু নিয়ে বের হয়ে গেলাম। পাহাড়ের শেষ প্রান্তে এসে ফারহান দেখল তআর বাচার আর কোন পথ নেই। আমি ওর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম, বোন পিছন থেকে বারবার বলসে, মুশু দোহাই লাগে ওকে মারিসনা।

শেষপর্যন্ত আমি ফারহানের পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলাম। ও নিস্তেজ হয়ে পাহাড় থেকে নিচে পড়ে গেল।
আফরাহ পাথরের মূর্তির মত মাটিতে বসে পড়ল। মেহরাব আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ আমি জানতাম তুমি পারবে। তুমি তো তোমার জ্বীনবরের লাল টুকটুকে বউ।
~ আপনি যে আমার শক্তি মেহরাব। আমি পেরেছি দাদীমার কথা রাখতে, আর কোনো বাধা আমাদের জীবনকে এলোমেলো করে দিতে পারবেনা।
একসাথে সুখে থাকতে পারব আমরা।

মেহরাব আমার কপালে চুম্বন একে বলল,
~ আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। আমি আফরাহর দিকে তাকাতে মেহরাব বলল, ওকে ক্ষমা করা উচিত হবেনা। ও অনেক অন্যায় করেছে তোমার সাথে।
~ ও প্ররোচনায় পড়ে এসব করেছে। শত হলেও ও আমার বোন। ওকে ক্ষমা না করে আমি থাকতে পারি বল! আমি ছাড়া ওর আর কে আছে।
আমি বোনের কাধে হাত রেখে বললাম,
~ বোন এসব ভুলে যা। ফারহান শুধু তোকে ব্যবহার করেছে। তুই নতুন করে তোর জীবন শুরু কর, আমরা তোর পাশে আছি।

আফরাহ মুশায়রার হাত শক্ত করে ধরে মুশায়রার দিকে ভেজাচোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
কে জানে সেই দৃষ্টিতে ভালোবাসা ছিল নাকি সীমাহীন ক্ষোভ!

লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “জ্বীনবর (সিজন ৫) – ভয়ংকর ভুতের গল্প বাংলা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – জ্বীনবর (সিজন ৬) – ভয়ংকর ভূতের গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *