হঠাৎ তুমি এলে (১ম খণ্ড) – First love story bangla

হঠাৎ তুমি এলে (১ম খণ্ড) – First love story bangla: তুলি ছুরিটা হাতে নিয়ে সিট বেল্টটা লাগাতে গিয়ে বেশ মুশকিলে পড়ে গেল। না পারছিল সিট বেল্ট লাগাতে না পারছিল ছুরিটা রাখতে। বলা যায় উভয় সংকটে পড়ে গেছে।


পর্ব ১

অরন্য ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে একা একাই বিড়বিড় করছিল। রাত তখন বারোটা। অরন্যের রোজকার অভ্যাস এ ব্রিজের পাশে এসে ধূলিমিশ্রিত বাতাসে এক ঘন্টা কাটানো। আজকেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। যখন এক ঘন্টা কাটিয়ে বাড়ি যেতে পেছনে ঘুরল ঠিক তখন তুলি ব্রিজের পাশে এসে দাঁড়াল।

তার পরনে ছিল লাল বেনারসি শাড়ি আর শরীরে হালকা গহনা। মনে হচ্ছে বিয়ের আসর থেকে এই মাত্র পালিয়ে এসেছে। তাকে দেখে কেন জানিনা তার মতিগতি অরন্যের কাছে ভালো ঠেঁকল না। তাই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে তুলির দিকে নরজ দিল। সে যখনই ঝাঁপ দিতে যাবে তখনই অরন্য তুলির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
~ বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছেন? যার জন্য পালিয়েছেন উনি আসে নি। তাই ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিতে এসেছেন তাই তো।

তুলি অরন্যের কথা শুনে শাড়ির আঁচলের নীচে রাখা ছুরিটা বের করে জোরে জোরে হাঁপাতে লাগল। তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ বিকটভাবে যেন প্রতিধ্বনি তুলছিল। প্রচন্ডভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুরিটা হাতে নিয়ে অরন্যের দিকে তাক করে বলল,
~ একদম আমার কাছে আসবেন না। আমার কাছে আসলে খুন করে দেব।

অরন্য দুহাত উপরে তুলে ভয় ভয় চোখে বলল,
~ আরে আরে কী করছেন? আমি আপনাকে কিছুই করব না। শুধু শুধু ছুরিটা এভাবে ধরে ভয় দেখাবেন না। বেশ ভয় পাচ্ছি।

তুলি ছুরিটা হাতে নিয়েই একটু হাঁপিয়ে দম নিয়ে ছুরিটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
~ এসব বলে ভুলানোর চেষ্টা করবেন না। কাছে আসলে সত্যি সত্যি আপনাকে মেরে দেব।

ভয় ভয় চোখ নিয়ে অরন্য বলল,
~ আসব না তো বললামেই। তা বিয়ে করবেন না বলে পালিয়েছেন ভালো কথা কিন্তু হাতে ছুরি নিয়ে পালিয়েছেন কেন? নাকি স্বামীকে বাসর রাতে মেরে চলে এসেছেন।
কর্কশ গলায় তুলি বলল,
~ একদম আজেবাজে কথা বলবেন না।

হালকা হেসে অরন্য বলল,
~ বুঝেছি যার জন্য পালিয়েছেন উনি লাপাত্তা। লজ্জায় এখন বাসায় গিয়েও মুখ দেখাতে পারছেন না আবার বিয়েটাও করতে পারছেন না। তাই ঝাঁপ দিতে এসেছেন।
~ ঐরকম কিছুই না। আপনি এরকম হাবিজাবি বলা বন্ধ করুন। অসহ্য লাগছে আমার।

~ আচ্ছা, আর হাবিজাবি কিছু বলব না! তবে আপনার বেশভূষা দেখে এর বাইরে অন্য কিছু মনে আসছে না। যাহোক, আমি অরন্য(পুরো নাম তানভীর রহমান অরন্য)। এখান থেকে একটু দূরে আমার বাসা। এই মুহূর্তে যদি কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকে, তাহলে আমার বাসায় যেতে পারেন। কাল সকালে ভেবে সিদ্ধান্ত নেবেন কোথায় যাবেন বা কী করবেন। অবশ্য চাইলে আমার বাসায় কয়েকদিন থাকতেও পারবেন। তবুও আত্নহত্যা করবেন না। কারণ, আত্নহত্যা কোনো সমাধানের পথ নয়।

অরন্যের এরকম প্রস্তাবে তুলি বুঝতে পারছে না কী করবে? এ মুহুর্তে ব্রিজের পাশে থাকাও তুলির জন্য বিপদজনক। কী করবে বুঝতে না পেরে একদম চুপ হয়ে রইল। তুলির নীরবতা দেখে অরন্য পুনরায় বলল,
~ আমাকে হয়তো আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু শুধু শুধু জীবনটাকে কেন নষ্ট করবেন? একজনকে ভালোবেসে পাননি তাই বলে কী জীবন নষ্ট করে দেবেন। দেখুন আমি একজন ডাক্তার। একটু দূরে যে হাসপাতালটা আছে আমি ঐ হাসপাতালেই কর্মরত অবস্থায় আছি। আপনি চাইলে নির্ভয়ে আমার সাথে যেতে পারেন।

তুলি অরন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে কেন জানি না একটা ভরসার আলো খুঁজে পেল। শত অবিশ্বাসের পরও অরন্যকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল। তুলির এরকম চাহুনি দেখে অরন্য চমকে গেল। কারণ অরন্যের কাছে এ চাহুনিটা বড্ড চেনা চেনা লাগছে।
অপরদিকে তুলি চিন্তা করল অরন্যের সাথে যাওয়ায় উত্তম হয়। কোন ঝামেলা হলে সাথে ছুরিতো আছেই। তাই অরন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আপনি বড্ড বেশি বকবক করছেন। আপনার বাসাটা এখান থেকে কত দূরে? কতক্ষণ সময় লাগবে যেতে?

অরন্য ভরসামাখা মুখে বলল,
~ খুব বেশি সময় লাগবে না। এখন রাস্তা ফাঁকা এইতো আধা ঘন্টার মতো লাগবে। আমি সাথে গাড়ি নিয়ে এসেছি।
তুলিকা হালকা দম নিয়ে বলল,
~ চলুন যাই। একটু তাড়াতাড়ি গেলে ভালো হয়। নাহয় আমাকে যারা খুঁজছে তারা ধরে নিয়ে যাবে।

অরন্য মুচকি হেসে বলল,
~ আপনার বাবা বুঝি পেছনে গোন্ডা লাগিয়েছে? আগে বাংলা সিনেমায় এমন কাহিনি দেখতাম। আজকে সামনাসামনি দেখছি। নিজেকে কেন জানিনা মনের অজান্তেই হিরো মনে হচ্ছে।
রাগী গলায় তুলি বলল,
~ আপনি বড্ড বেশি বকবক করেন দেখি গাড়িতে চলুন।

অরন্য পুনরায় হেসে তুলিকে নিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে পেছনের দরজা খুলে দিল। কিন্তু তুলি গাড়ির পেছনের সিটে না বসে অরন্যকে বলল,
~ আমি গাড়ির সামনের সিটে বসব। আপনি যদি কোন উল্টা পাল্টা করতে চান তাহলে পেছনে থেকে টের পাব না। আমাকে সামনে বসতে দিন। আর সাবধান কোন ঝামেলা করার চেষ্টা করলে কিন্তু খুন করে দেব।

অরন্য খেয়াল করল তুলির হাতটা কাঁপছে। অরন্য হাতটা এভাবে কাঁপতে দেখে বলল,
~ ছুরি ধরেই তো আপনার হাত কাঁপাকাঁপি শুরু করছে। খুন করার সময় কী হয় কে জানে।
এবলে একটা অট্ট হাসি দিল। অরন্যের হাসি দেখে তুলি রাগে হালকা চেঁচিয়ে দাঁত কামড়ি দিয়ে বলল,
~ কতবার বলতেছি তাড়াতাড়ি করুন। এখানে আমার থাকাটা বিপদজনক।

অরন্য গাড়ির সামনের দরজাটা খুলে বলল,
~ যান গিয়ে বসুন। বিয়ে করবেন না ভালো কথা, বিয়ের আগেই বাবাকে বুঝাতে পারতেন। বিয়ের সময় কেন এমন করলেন। বেচারা যে বিয়ে করতে এসেছে তার কপালটা পুড়ল।
এ বলে অরন্য হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বলল,
~ সিট বেল্টটা একটু লাগান তো।

তুলি ছুরিটা হাতে নিয়ে সিট বেল্টটা লাগাতে গিয়ে বেশ মুশকিলে পড়ে গেল। না পারছিল সিট বেল্ট লাগাতে না পারছিল ছুরিটা রাখতে। বলা যায় উভয় সংকটে পড়ে গেছে।
অরন্য তুলির বেহাল দশা দেখে একটু মুচকি হেসে সিট বেল্ট লাগানোর জন্য হাতটা বাড়াতেই তুলি ছুরিটা অরন্যের দিকে ধরে বলে উঠল~
~ একদম কিছু করতে আসবেন না খুন করে ফেলব।
বিরক্ত গলায় অরন্য বলল,
~ আরে বাবা! এভাবে ছুরি হুটহাট সামনে আনলে তো আমি ভয়েই মরে যাব। আমি সিট বেল্ট লাগানোর জন্য হাতটা বাড়িয়েছি আপনাকে কিছু করার জন্য না। কী যে ভাবছেন নিজেকে কে জানে?

অরন্যের কথা শুনে তুলি একদম চুপ হয়ে গেল। অন্যদিকে অরন্য তুলির সিট বেল্টটা লাগানোর পর গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়িটা আপন গতিতে চলছে। গাড়ির জানালা দিয়ে আকাশটার দিকে তাকাল তুলি। খেয়াল করল গাড়ির গতির সাথে চাঁদটাও বেশ গতিশীল হয়ে গাড়ির সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে সমবেগে চলছে। তারা গুলো চাঁদের আশপাশে জোনাকি পোকার মত জ্বলছে আর নিভছে। বাইরে একটা ধূলি মিশ্রিত বাতাস শরীরটাই লাগছে আর শরীরটাও বেশ নেতিয়ে পড়ছে। এই বুঝি চোখটা বুজে এল। তবুও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল। কারণ এখন ঘুমালে চলবে না। কোন উদ্দেশ্যে কোন গন্তব্যে যাচ্ছে তার কাছে সবকিছুই অজানা। কখন কী হয় বলা যায় না। তাই ঘুমের সাথে লড়াই করতে লাগল। চোখ গুলো বারবার বুজে গেলেও টেনে টেনে তাকাবার চেষ্টা করছিল। ঘুম ঘুম ভাবটা যেন চোখ থেকে কোনভাবেই কাটছে না। এর মধ্যেই সে লক্ষ্য করল গাড়িটা থেমে গেছে। অরন্য গাড়ি থেকে নেমে তুলিকে বলল,
~ বাসায় চলে এসেছি, এবার নামুন।

তুলি গাড়ি থেকে নেমে দেখল একটা ছয়তলাবিশিষ্ট বাড়ির সামনে গাড়িটা থেমে আছে। তুলি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ কয়তলায় থাকেন আপনি?
শান্ত গলায় অরন্য বলল,
~ পাঁচ আর ছয় তলা মিলিয়ে থাকি। আপনার ভয় নেই আপনি আলাদা রূমে থাকতে পারবেন। ভাববেন না আমি একটা রূমে থাকি আর আপনাকে সে রূমে থাকতে হবে। বাংলা নাটকে এমন হয় বাস্তবে না।

তুলি অরন্যের দিকে যতবারই তাকাচ্ছিল ততবারই একটা আশার সুক্ষ্ম আভাস পাচ্ছিল। তাই তেমন কোন কথা না বলেই অরন্যের পেছন পেছন যেতে লাগল। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কারণ শরীরে একদম শক্তি নেই। মনের জোরটা বাড়িয়ে অনেক কষ্টে পাঁচতলায় উঠল। পাঁচ তলায় উঠার পর অরন্য দরজার লকটা খুলে বলল,
~ এ হলো আমার বাসা। আশাকরি আপনার এখানে থাকতে মোটেও সমস্যা হবে না।

তুলি ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে দেখল অনেক পরিপাটি করে সাজানো। অরন্য তুলিকে একটা রুম দেখিয়ে বলল,
~ আপনি এ রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিন। দেখি আপনার জন্য কোন কিছু রান্না করতে পারি কিনা। ব্যাচেলর মানুষ তাই খাওয়া দাওয়ার কোন নিয়ম মাফিক নেই।
তুলি অরন্যের দেখানো রুমের মধ্যে ঢুকে চমকে গেল।


পর্ব ২

তুলি রুমে প্রবেশ করে চমকে গেল। কারণ রুমটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোন মেয়ের রুম। ভাবতে লাগল লোকটা একটু আগে বলল ব্যাচেলর তাহলে এতগুলো মেয়েলি জিনিসপত্র দিয়ে কি করে? তাহলে কি লোকটা ভালো না? এসব ভাবতেই তার মনটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল। তাই সে মনে মনে ভাবছে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু হয় তাহলে একদম খুন করে দেবে তবুও নিজের ইজ্জত কারও কাছে তুলে দেবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই অরন্য এসে তুলিকে বলল,
~ আপনি এখনো ফ্রেশ হন নি?

তুলি অরন্যের হঠাৎ এমন ডাকে চমকে উঠে বলল,
~ হ্যাঁ হচ্ছি। আচ্ছা আপনি তো বলেছেন আপনি ব্যাচেলর তাহলে এ রুমে এত মেয়েলি জিনিসপত্র কেন? এ রুম দেখেই মনে হচ্ছে এটা কোন মেয়ের রুম।
অরন্য হেসে বলল,
~ এটা আমার স্ত্রী রুপার রুম।

অরন্যের এরকম জবাবে তুলির বিস্ময়ের পরিমাণটা বেড়ে গেল। বিস্মিত হয়ে অরন্যকে বলল,
~ আপনার স্ত্রীর রুম হলে আপনি নিজেকে কেন ব্যাচেলর দাবি করছেন?
একটু রহস্যময় হেসে অরন্য বলল,
~ আমাকে আপনি বলতে পারেন বিবাহিত ব্যাচেলর।

তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে উৎসুক চোখে বলল,
~ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না বিবাহিত আবার ব্যচেলর কীভাবে সম্ভব?

অরন্য পুনরায় রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলল,
~ সময় হলে ঠিকেই বুঝবেন। এখন এত কিছু বুঝতে হবে না। আপনি ফ্রেশ হয়ে কী পরবেন? বিয়ের শাড়ি পরেতো ঘুমাতে পারবেন না। বাসার থেকে পালানোর সময় মনে হয় কাপড় চোপড় নেওয়ার সুযোগ পান নি তাই না?

কর্কশ গলায় তুলি বলল,
~ আপনি বড্ড বেশিই বকবক করেন। আমি এভাবেই থাকব।
~ এত ভারী শাড়ি পড়ে ঘুমাতে পারবেন?

~ হ্যাঁ পারব।
অরন্য একটু হেসে রূমে প্রবেশ করতেই তুলি ছুরিটা ধরে পিছিয়ে গিয়ে বলল,
~ একদম এগুবেন না। কিছু করার চেষ্টা করলে খুন করে দেব।

অরন্য তুলির দিকে না গিয়ে আলমিরা বরাবর এগিয়ে আলমিরা থেকে কাপড় বের করতে করতে তুলিকে বলল,
~ আমি আপনার জন্য কাপড় বের করতে রুমে ঢুকেছিলাম। এতটাও খারাপ না যে আপনাকে একা পেয়ে কিছু করে বসব। বারবার এ ছুরির ভয় দেখাবেন না তো। এমনেই দুর্বল চিত্তের মানুষ তার উপর ছুরির এমন ভয় দেখালে এমনেই মরে যাব। মরে গেলে কি দায়ভার আপনি নিবেন?

অরন্যকে যতই দেখছে তুলি ততই ভিন্ন মাত্রার একটা রহস্য খুঁজে পাচ্ছে। অরন্য কেন এতকিছু করছে সেটাও তার বুঝার অন্তরায়। তাই ছুরিটা নীচে নামিয়ে নীচু গলায় অরন্যকে বলল,
~ আমি কোন মানুষকে বিশ্বাস করি না। মানুষ অনেক রকমের মুখোশ পড়ে থাকে যা সহজে উন্মোচন করা যায় না।

অরন্য আলমিরাটা খুলতে খুলতে বলল,
~ বিশ্বাস করাটা বোকামি তবে আস্থা রাখাটা বোকামি না। আমাকে বিশ্বাস করার দরকার নেই তবে কিঞ্চিৎ আস্থা রাখুন।
এ বলে অরন্য তুলির জন্য কাপড় বের করে দিয়ে বলল,
~ এগুলো রূপার কাপড়। আপনি দরজা লাগিয়ে কাপড় পাল্টে নিন, আমি আপনার খাবার গুলো এখানে নিয়ে আসছি।

তুলি অরন্যকে যতই দেখছে ততই যেন অবাক হচ্ছে। এদিকে মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে। দরজা লাগিয়ে কাপড়টা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল লোকটার বউ কোথায় তাহলে? আরও অনেক ভাবনায় মাথায় আসছে, তবে কোন উত্তরেই পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর শাড়িটা খুলে পাল্টে নিল। এখন বেশ ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে তার। জামাটাও একদম গায়ে সুন্দর করে লেগেছে। সে বুঝতেই পারছিল অরন্যের স্ত্রী ও তার গড়নের। কিছুক্ষণ পর অরন্য আসলো খাবার নিয়ে।

খাবারগুলো সামনে পেয়ে ক্ষুধার তাড়নায় হাতটা না ধুয়েই খেতে লাগল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এক প্লেট ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলল। তুলির খাওয়ার শেষে অরন্য বলে উঠল~
~ সারাদিন মনে হয় কিছু খেতে পারেন নি। বিয়ে বাড়িতে তো অনেক রান্না হয় কিছু লুকিয়ে নিয়ে আসতেন। আমি হলে তো খাবার লুকিয়ে নিয়ে আসতাম। কত মজাদার করে রান্না হয় বিয়ে বাড়িতে। মনে হয়ে এখনেই জিভে জল চলে আসছে।

অরন্যের এরকম গা ছাড়া কথা শুনে তুলির মাথায় রাগ চড়ে গেল। অরন্যের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই অরন্য এঁটো প্লেটগুলো নিয়ে চলে গেল। আর তুলি দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে অরন্যের ডাকে তুলির ঘুম ভাঙ্গল। দরজা খুলতেই অরন্য তাকে আলমিরা থেকে আরও কাপড় বের করে দিল, সবসময় পরার জন্য। বাসায় কোথায় কি আছে সব বুঝিয়ে দিল।
এভাবেই থাকতে লাগল তুলি। সে খেয়াল করল অরন্য সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি করে আর রাতে বাসায় ফিরে খাবার খেয়ে আবার রাত এগারোটায় কোথায় যেন চলে যায়। তুলি বুঝতে পেরেছিল অরন্য খুব খামখেয়ালে স্বভাবের। কেন জানি না অরন্যের সাথে কথা বলতে বেশ ভালো লাগত। অরন্যের চোখে ভালোবাসার ছন্দ খুঁজে পেত। তবুও নিজেকে সামলে নিত কারণ অরন্য বিবাহিত। আশ্চর্যের বিষয় হলো দেখতে দেখতে এ বাসায় দুমাস পার করে ফেলল তুলি। কিন্তু অরন্যের কোন পরিবর্তন হলো না আর রূপার ও দেখা পেল না। অরন্যের প্রতি একটা ক্ষীণ বিশ্বাস জাগল।

অপরদিকে অরন্যের ও মনে হল তুলির বিষয়ে জানা উচিত। তাই তুলির কাছে আসলো। সবসময় খামখেয়ালে হয়ে কথা বললেও সেদিন অরন্য তুলির পাশে বসে সিরিয়াস হয়ে বলল,
~ আমার বাসায় তো দুমাস যাবৎ আছেন। আশাকরি আমি কেমন বুঝতে পেরেছেন। এখন পর্যন্ত আপনার নামটা বলেন নি। আমি কী জানতে পারি আপনি কে? আর কেন আত্নহত্যা করতে চেয়েছিলেন যদি ভরসা করতে পারেন তাহলে বলুন।
তুলি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বলল,
আমার বিয়ের এক বছরে আমি যে কষ্ট সহ্য করেছি বলে বুঝাতে পারব না।

ফেসবুকে পরিচিত হয়ে আমি আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখাতেই আমার স্বামী আমাকে জোরপূর্বক তুলে এনে বিয়ে করেছিল। তখন আমার স্বামীর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল শুধু। আর সে বন্ধুত্বের দাবি নিয়েই দেখা করতে গিয়েছিলাম।
প্রথম দেখাতেই বসেছিলাম একটা রেস্টুরেন্টে। খাওয়া আর পরিচয় পর্ব শেষে আমার স্বামী আমাকে বলল,
~ আমি সাথে গাড়ি নিয়ে এসেছি চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিই।

আমিও ভরসা করে গাড়িতে উঠেছিলাম। কিন্তু কে জানত মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষটা এত কুৎসিত। গাড়িতে উঠিয়েই আমাকে তুলে নিয়ে গেল উনার বাসায়। যে রুমে জোর করে বসাল সে রুমটায় খেয়াল করে দেখলাম বাসর সাজানো। বাসর সাজানো দেখে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম~
~ আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন?

লোকটা আমার কাছে এসে বলল,
~ আমি তোমাকে প্রথম কথা বলাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তোমাকে যেন না হারাতে হয় তাই এ ব্যবস্থা করেছি। তুলি আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।
আপনাকে তো আমার পরিচয় দেওয়া হল না। আমি তুলি, একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। আর আমাকে যে তুলে এনেছে তার নাম নিলয়। ঘটনার দুমাস আগে ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল। বলেছিল একটা সরকারি চাকুরি করেন।

ঘটনায় আসা যাক। মুখোশধারী ভদ্রলোকের কথা শুনে আমার শরীরটা রাগে গিজগিজ করতে লাগল। রাগী গলায় বললাম,
~ আপনার সাথে তো আমার কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল না তাহলে এমন করছেন কেন? দয়াকরে আমাকে যেতে দেন।
আমার স্বামী আমার কোন কাকুতি মিনতি সেদিন শুনেনি। জোর করে কাজী এনে আমাকে বিয়ে করল। আর রাতে তার পুরুষত্ব দেখাল।
সেদিনের পর থেকে আমার জীবনের কালো অধ্যায়ের শুরু। বিয়েটা যেমন করেই হোক না কেন ভেবেছিলাম বিয়েটা যেহুত হয়ে গিয়েছে তাহলে মেনে নেওয়ায় শ্রেয়। সেদিন রাতে নিলয় ঘুমানোর পর আমার ফোনটা চুপিচুপি নিয়ে মাকে কল দিলাম। মা আমার কন্ঠ শুনে আঁৎকে উঠে বলেছিল~
~ তুলি তুই কোথায়? তোকে সবাই খুঁজতে খুঁজতে হয়রান।

ভেবে পাচ্ছিলাম না মাকে কী উত্তর দিব। চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। মা আমার নীরবতা দেখে ছটফটাতে ছটফটাতে বলল,
~ কি রে তুলি কথা বলছিস না কেন? তোর ফোন এতক্ষণ বন্ধ পাচ্ছিলাম কেন? এত বড় মেয়ে, না বলে বাসার বাইরে থাকলে কতটা চিন্তা হয় সেটা কী তুই জানিস না?

এভাবে যে আমি ফেঁসে যাব কে জানত? মাকে তো আর এতকিছু বলা যাবে না। তাই মাকে সরাসরি বললাম,
~ মা আমি পালিয়ে বিয়ে করে নিয়েছি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। ছেলেটার নাম নিলয়। সরকারি চাকুরি করে।
মা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
~ আমাদের বললে কী হত না? সবার কাছে আমাদের মাথাটা এভাবে নীচু করতে পারলি? কাজটা করার আগে আমাদের কথা একবারও ভাবলি না?

কর্কশ গলায় জবাব দিলাম~
~ পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর সকালে কথা হবে। এত রাতে আর কথা বলতে পারব না।
এ বলে ফোনটা কেটে ঘরে প্রবেশ করে খেয়াল করলাম আমার স্বামী রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখে বলল,
~ এত রাতে কার সাথে কথা বলেছিস। নিশ্চিত তোর আগের বয়ফ্রেন্ডের সাথে।

নিলয়ের মুখে এমন ভাষা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কারণ এক তো জোর করে বিয়ে করেছে তার উপর বিয়ের রাতে তুই তোকারি। আমার স্বপ্নের আকাশটা নিমিষেই হুমরি খেয়ে পড়ল। কি বলব খুঁজে না পেয়ে ঠাঁই চুপ হয়ে রইলাম।
নিলয় আমার দিকে তাকিয়ে আমার বাহু দুইটা তার দুহাত দিয়ে চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
~ কিরে তুই চুপ হয়ে আছিস কেন?

আমি নিজেই নিলয়ের এরকম ব্যবহারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ করতে চাইলেও যেন করতে পারছিলাম না। নিলয় আমার প্রশ্নের কোন জবাব না পেয়ে আমার গালে একটা চড় দিয়ে বলল,
~ মুখ দিয়ে কথা বলছিস না কেন?

এ বলে দুই আঙ্গুল দিয়ে মুখটা চেপে ধরে বলতে লাগল~
~ জবাব না দিলে আজকে তোর মুখটাই ভেঙ্গে ফেলব।
এমন ভাবে চেপে ধরেছিল যে আমি কোন নিঃশ্বাসেই নিতে পারছিলাম না। কোনরকমে আওয়াজ করে বললাম,
~ মাকে ফোন দিয়েছিলাম।

আমার উত্তর শুনে মুহুর্তের মধ্যে নিলয় কেমন জানি বদলে গেল। আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ এ কথাটা আগে বললে কী আমি তোমাকে এভাবে আঘাত করি বলো? মায়ের সাথে কথা বলতে মন চাইলে আমাকে বলেই বলবে। তবে আমাকে না বলে কিছু করলে মোটেও ভালো হবে না।
সেদিনেই বুঝে গিয়েছিলাম আমার স্বামী মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ। সেদিন রাতটা কোন রকমে কাটালাম।

সকালে উঠে মাকে কল দেওয়ার পর মা বলল,
~ তুলি যা করেছিস তো করেছিস আমি তোদের মেনে নিয়েছি। এবার একটা অনুষ্ঠান করে তোকে বিদায় দেই, না হয় মানসম্মান থাকবে না।

এমন সময় নিলয় আমার কান থেকে ফোন নিয়ে বলল,
~ মা কিছু মনে করবেন না। আপনাদের কে কে আসবেন বলুন আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব। আমার বাবা, মা কেউ নেই আর আত্নীয়স্বজনও নেই। আপনারা যা করার আমার বাসায় করুন।
খেয়াল করলাম মা ও নিলয়ের কথায় রাজি হয়ে গেল। পরদিন সকালে আমার মা, বাবা, আর কাছের কাজিনগুলো আসলো আমার বাসায়। নিলয় সব ঠিক করে গুছিয়ে রাখল।
এর মধ্যে হুট করে আমার কাজিন পরশ আমার চোখ চেপে ধরে বলল,
~ বলতো কে আমি?

পরশ আমার বড় চাচার ছেলে। পিঠাপিঠি হওয়ার দরুণ আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটাও বেশ ছিল। আমি পরশের কন্ঠ শুনে হাসিমাখা গলায় বললাম,
~ তোরে চিনব না। চোখ খুল পরশ।

পরশ হতাশ গলায় বলল,
~ আরে যাহচিনে ফেলেছিস।
ঠিক এ মুহুর্তে আমার স্বামী আমাকে ডাক দিল~
~ তুলি একটু রুমে আসো তো। কথা আছে।

নিলয়ের ডাক শুনে পরশকে বললাম
~ তুই এখানে দাঁড়া আমি এখনেই আসতেছি।
এ বলে নিলয়ের কাছে গেলাম।


পর্ব ৩

কাছে যেতেই নিলয় ঘরের দরজাটা লাগিয়ে আমাকে চেপে ধরে বলল,
~ ঐ ছেলের সাথে এত ঢলাঢলির কী আছে। ওর সাথে তোর কী শুনি?

নিলয়ের এরকম অস্বাভাবিক আচরণের কারণ গুলো আমার অজানা ছিল। আমি নিলয়কে বললাম,
~ ও আমার চাচাত ভাই হয়। আমি নিজের ভাইয়ের মতো মনে করি। আর তুমি কী না তাকে নিয়ে আমাকে আজেবাজে কথা বলছো। কেন এমন করো তুমি? আমার সাথে এরকম করে কি আনন্দ পাচ্ছ?

আমার কথাগুলো শুনে নিলয়ের রাগটা আরও বেড়ে গেল আমাকে চেপে ধরে বলল,
~ আমার কথা মতো থাকলে তোকে মাথায় করে রাখব। কিন্তু আমার অপছন্দের কাজ করলে একদম ভালো হবে না।

আমি এর জবাব কী দিব বুঝতে পারছিলাম না। শুধু মাথা নেড়ে গেলাম। বাবা মাকেও বিচার দিতে পারব না। কারণ সে মুখ তো আমার নাই। সবকিছু আমি নিজেই নষ্ট করে দিছি। কোনরকমে সারাটাদিন পরশের থেকে দূরে দূরে থেকে সবাইকে বিদায় দিলাম। বেশ অশান্তি হচ্ছিল ভিতরে। সেদিন রাতে চুপ হয়ে বিছানার এক কোণায় বসে রইলাম। শুধু একটা ভাবনায় ডুবে রইলাম। কী হবে আমার জীবনে? কী হতে চলেছে? হঠাৎ করে নিলয় রুমে ঢুকল। হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে। খাবারের প্লেট টা নিয়ে আমার কাছে এসে বলল,
~ সারাদিন খেয়াল করলাম তেমন কিছু খাও নি। দুপুরেও অল্প ভাত নিয়ে এঁটো করে রেখেছ। এখন এগুলা সব শেষ করতে হবে।

“মেয়ে মানুষ হচ্ছে আবেগের মোম। সামান্য ভালোবাসায় গলে যায়।”
তেমনি নিলয়ের কথা শুনে আমি একদম গলে গেলাম। নিমিষেই আমার অভিমানটা বেড়ে গেল। আর বললাম,
~ আমি খাব না। তুমি খেয়ে নাও।

নিলয় আমার কাছে এসে বলল,
~ এত রাগ করতে হবে না। আমি কী ইচ্ছা করে তোমার সাথে এমন করি। তুলি আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তুমি কেন এটা বুঝতে চাও না বলো। তুমি মাঝে মাঝে আমার অপছন্দের কাজ গুলো করো তাই আমার রাগ বেড়ে যায়। আমাকে ক্ষমা করে দাও।
সেদিন নিলয়ের কথা শুনে মুহুর্তের মধ্যেই আবেগী হয়ে গেলাম।

“মেয়েরা খুব আবেগপ্রবণ। মেয়েদের আবেগের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে মায়া। এ মায়ার কারণে মেয়েরা আবেগের অতল তলে নিমজ্জিত হয়ে যায় আর বারবার নিজের মধ্যে থাকা অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়।”
আমিও নিজের স্বামীর এমন কথায় নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। নিলয়ের হাত দুটো ধরে বললাম,
~ আমার শুধু একটাই অনুগ্রহ তুমি আমার সাথে হুট করে এমন ব্যবহার করো না যাতে আমার কষ্ট হয়। আমি এখন তোমার স্ত্রী হই চাইলেও অন্য কারও হওয়া সম্ভব না। বিয়েটা তো ছেলে খেলা না, করলাম আবার ছেড়ে দিলাম।

নিলয় আমার কথা শুনে তার কান ধরে বলল,
~ আমার আর কখনও এমন হবে না। দেখে নিও।
কিন্তু কথায় আছে
“মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাস মানুষকে নীচে নামাতেও দ্বিধা করে না”
ঠিক তেমনি নিলয়ের মধ্যে একটা অভ্যাস ছিল আমাকে কারণে অকারণে সন্দেহ করা। কোন ঝামেলা হলেই প্রশ্নের তীর আমার দিকে ছুরে দেয়া।

সেদিন ডিশ লাইন ঠিক করতে লোক এসেছিল। সে সময় নিলয় বাথরূমে ছিল। যার দরুণ আমি দরজা খুলে দিয়েছিলাম। লোকটা এসে লাইন ঠিক করতে লাগল। নিলয় বাথরুম থেকে এসে লোকটাকে দেখে ক্ষেপে গেল। লোকটার সামনেই আমাকে দু এক ঘা প্রহার করল। লজ্জায় আমার এমন অবস্থা হয়েছিল যে তখন যদি মাটিটা ভাগ হত আর আমি ঢুকে যেতে পারতাম তাহলে হয়ত সবচেয়ে ভালো হত।

প্রহার করা আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং ডিশ লাইনের লোকটাকেও দুই এক ঘা বসিয়ে দিল। লোকটা তো পেটের দায়ে এসেছিল। কে জানত তার কাপলে এরকম অপবাদ জুটবে। এরপর থেকে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে লাগল। আমার পরিবার যেন বাসায় আসতে না পারে সেজন্য বাসা বদল করে ফেলেছিল। আমার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়েছিল। আমি তো এ ব্যাথা কাউকে বলে বুঝাতে পারছিলাম না। শারীরিক মানসিক দুইভাবেই নির্যাতিত হয়েছি। কি নির্মম ভাবে আঘাত করা হয়েছে আমাকে সেটা শুধু আমি জানি।

এভাবেই কেটে গেল পাঁচ মাস। একদিন মায়ের জন্য অনেক খারাপ লাগছিল। প্রতি মুহুর্তে মাকে মিস করতেছিলাম। মাকে কল দেওয়ার ও কোন উপায় পাচ্ছিলাম না। সারাদিন বাসার মধ্যে বন্দি করে কোথায় যে যেত উনি জানতাম না। আমি একা বন্দী পাখির মত ছটফট করতে থাকতাম। আমার যে অস্তিত্ব আছে আমি সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম।

মায়ের কথা মনে হয়ে একটু কাঁদলেও আমার স্বমী মাঝ রাতে উঠে আমাকে পিটাত। ভাবত আমি কোনো প্রাক্তনের জন্য কাঁদছি। বুঝতেই পেরেছিলাম সে এক মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। কিন্তু সেদিন রাতে একটু সাহস করে চুপি চুপি তার ফোনটা চুরি করে হাতে নিলাম। আস্তে করে বারান্দায় গেলাম। মাকে ফোন করার জন্য অর্ধেক নম্বর সবে মাত্র টাইপ করেছি ঠিক এ মুহুর্তে পিঠে এক অদ্ভূত জ্বলা অনুভব করলাম। নিমিষেই চেঁচিয়ে উঠে খেয়াল করলাম নিলয় আমার পিঠে জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরে রেখেছে। আমি যন্ত্রণার চুটে ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বললাম,
~ কী হয়েছে তুমি এভাবে আমার গায়ে সিগারেট ধরে রেখেছ কেন?

আমার কথা শুনে নিলয় তার চোখ রক্ত বর্ণ করে আমার চুলের মুঠিটা ধরে বলল,
~ এত রাতে কোন ছেলেকে ফোন দিতেছিলি বল?

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। এতটা হিংস্র হয়ে গিয়েছিল যে আমি ভয়ে মোচড়ে গেলাম। একদম চুপ হয়ে রইলাম। আমার নীরবতা দেখে নিলয় আরও ক্ষেপে গেল। ক্ষেপে গিয়ে চুলের মুঠিটা আরও জোরে শক্ত করে ধরে মেঝেতে আঁচড়ে ফেলল। তারপর একের পর এক কিল, ঘুষি, লাথি মারতে লাগল।

মারতে মারতে নিলয় হয়তো এক পর্যায়ে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেল তাই আমার গায়ে হাত, পা তোলা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
সেদিন আমার সারা শরীর ব্যথায় টনটন করতে লাগল। মাথাটা মনে হচ্ছিল ব্যথার চুটে ভেঙ্গে ফেলি। সারাটা রাত ব্যথায় মোচড়াতে মোচড়াতে পার করলাম।
এভাবেই দিন মাস যেতে লাগল। বিয়ের পাঁচ মাস পর্যন্ত আমি শুধু জানতাম নিলয় আমাকে অতিরিক্ত ভালোবাসে এজন্য হয়তো সন্দেহ করে এমন করতেছে। কিন্তু সেদিন নিলয়ের দ্বিতীয় মুখোশটা আমার সামনে উন্মোচিত হয়ে যায়। আর ভাবলাম আমি এত বোকা কেন?

বরাবরের মত ঐ বাসায় আমার কোন স্বাধীনতা ছিল না। সারাদিন পরগাছার মত পড়ে থাকতাম। নিলয়ের কথার বাইরে গেলেই মাইর খেতাম।
পারছিলাম না কোনভাবে এ জীবন থেকে বের হতে আবার পারছিলাম না সহ্য করতে। স্বাধীনতা না থাকার দরুণ নিলয় ঠিক কি চাকুরি করে বিষয়টা সঠিকভাবে জানতাম না। সত্যি বলতে জানার কোন উপায় ছিল না। ফেসবুকে কথা বলার সময় বলেছিল একটা সরকারি চাকুরি করে।

তবে বিয়ের পাঁচ মাস পর জানতে পারলাম নিলয় কোন চাকুরি করে না। সে ড্রাগসের ব্যবস্যা করে। আর এ কথাটা জানতে পারি নিলয়ের ড্রয়ারে ড্রাগসের প্যাকেট আর কোথায় কোথায় পাঠাতে হবে সেটার একটা তালিকা দেখে।
এ কথাটা জানার পর কেন জানি না আমি রাগটা ধরে রাখতে পারলাম না। ঐদিন নিলয় বাসায় আসার সাথে সাথে নিলয়কে বললাম,
~ কী করে পারলে এত বড় মিথ্যা ধোঁকা দিতে? কী ক্ষতি করেছিলাম তোমার?

নিলয় চোখগুলো রক্তবর্ণ করে বলল,
~ কী করেছি আমি? এভাবে চিল্লাচ্ছিস কেন?
আমি চেঁচাতে চেঁচাতে বললাম,
~ চিল্লাব না তো আনন্দে নাচব। তুমি না সরকারি চাকুরি করো তাহলে এসব কী?

আমি ড্রাগসের প্যাকেট গুলো নিলয়ের দিকে ছুরে মারলাম। নিলয় তখন ড্রাগসের প্যাকেট গুলো দেখে আমার দিকে তেড়ে এসে আমার চুলগুলো ধরে বলল,
~ তুই আমার অনুমতি ছাড়া আমার ড্রয়ারে ধরেছিস কেন? এত বড় সাহস তোকে কে দিয়েছে?

আমি চেঁচিয়ে বললাল~
~ আমি তোমার স্ত্রী হই। তোমার ড্রয়ার ধরার জন্য আমাকে অনুমতি নিতে হবে কেন? আর আমাকে এভাবে বন্দি করে রেখেছ কেন? আমাকে আমার পরিবারের সাথে কথা বলতে দিচ্ছ না কেন? আমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাই। আমি তো মানুষ। কতদিন এভাবে একা বন্দি পাখির মত থাকব বলো?
নিলয় আমার চুলগুলো আরও শক্ত করে ধরে বলল,
~ তোকে এভাবেই পচিয়ে মারব। ফের যদি অনুমতি ছাড়া কিছু ধরেছিস খবর আছে তোর।

এ বলে রান্না ঘর থেকে খুন্তি গরম করে এনে আমার পিঠে লাগিয়ে দিল। আমি ওমাগো বলে চিল্লানি দিয়ে তখন বলেছিলাম~
~ আমাকে ছেড়ে দাও। আমাকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছ। এগুলা আমি সহ্য করতে পারছি না।
নিলয় খুন্তিটা আরও চেপে ধরে বলল,
~ যদি আমার অনুমতি ছাড়া আমার ব্যপারে কিছু করতে চাস তাহলে তোকে এভাবেই শাস্তি দিব মনে রাখিস।

তারপর সে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। সেদিনের কথা মনে হলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। পিঠে হাত দিতে পারছিলাম না ব্যথায়। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। শুতেও পারছিলাম না ব্যাথায়। কি যে সময় পার করেছিলাম সেটা মনে হলে বুকের ভিতরটা এখনো কেঁপে উঠে।
এমন করে জীবনটা শেষ হয়ে যাবে বুঝতে পারি নি। এ জীবন থেকে বেরিয়ে আসতেও পারছিলাম না। কারণ আমার করার মতো কিছু ছিল না। হাত পা বাঁধা ছিল। আমার বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেলেও কিছুই বলতে পারতাম না। কারণ সেদিন আমার বলার মতো কোন বাকস্বাধীনতা ছিল না।

সেদিন নিলয় রাতে আবার বাসায় ফিরে। যতই হোক স্বামী তো এতকিছুর পরেও কেন জানি না তার প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছিল। মেয়েরা তো মায়ের জাত তাই হয়ত মায়াটা বেশি কাজ করত। এত মায়া কাজ করাও যে জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ তা তখন টের পাই নি। নিলয় আসার সাথে সাথে আমি একদম স্বাভাবিকভাবে বসেছিলাম। খেয়াল করলাম নিলয় আমার রুমে না এসে পাশের রুমে চলে গেল। আমি পাশের রুমের দরজার কাছে গিয়ে দেখলাম দরজা লাগানো। দরজার এপাশ থেকে বুঝতে পারলাম কারও সাথে কথা বলছে সে।

দরজা নক করার সাহস ও হলো না। কারণ আমি জানতাম আমি দরজা নক করলেই আমাকে এসে পিটাবে। শরীরের ও একটা সহ্য ক্ষমতা থাকে যেটা আমি হারিয়ে ফেলতেছিলাম দিন দিন।
তাই ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। চোখটা যখন ঘুমে আচ্ছন্ন হল হালকা, তখন মনে হল কেউ একজন আমার হাতটা ধরে কিছু করছে। কিন্তু শরীরে শক্তি ছিল না আর পিঠের ব্যথায় এপাশ হতে পারছিলাম না তাই উঠতেও পারছিলাম না। কেন জানি না সে রাতে কড়া ঘুম হল। এত ভালো ঘুম কখনও হয় নি। তবে উঠার পর থেকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কামড়ের দাগ পেলাম। শরীরে কামড়ের দাগগুলো দেখে বেশ ভয় পেতে লাগলাম। কীভাবে এগুলো হল ভাবতে লাগলাম। ভাবনার কোন কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না। অপরদিকে পিঠের ব্যথা তো আছেই।

কাপড় চোপড় ও আমার এলোমেলো হয়ে আছে বিছানাও এলোমেলো হয়ে আছে। আমি এটা নিশ্চিত ছিলাম যে কেউ আমার সাথে নোংরা কাজ করেছে। আশে পাশে চোখ বুলাতে লাগলাম। হুট করে খেয়াল করলাম একটা সিরন্জ পড়ে আছে। আমি সিরিন্জটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম আমার সাথে কী হয়েছে আর কে করেছে। আর কেন আমার এত কড়া ঘুম হল।

কারণ সিরিন্জটা ছিল ঘুমের ঔষধের। আমি হালকা ঘুমের পর আমাকে এটা দেওয়া হয়েছিল। ঐ যে আমার মনে হয়েছিল কেউ একজন আমার হাত ধরে কিছু করছে তখন নিলয়েই ছিল সেটা আর আমাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছিল। এরপর আমার সাথে কুকর্ম করেছিল। এমনিতে তো আমাকে কাছে পেতে চাইলে চিল্লায়তাম। হয়তো তার আমার আর্তনাদ ভালো লাগত না। তাই নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য এমন করেছিল। তার উপর সেদিন আমার পিঠে ব্যথা ছিল। কতটা বিকৃত মস্তিষ্কের সে, আমি আরও ভালো করে বুঝে গিয়েছিলাম।

ঘঁড়ির কাটায় খেয়াল করে দেখলাম নয় টা বাজে। আর নিলয় বাথরুমে গোসল করছে। লক্ষ্য করে দেখলাম নিলয়ের ফোনটা বিছানায় রেখে গিয়েছে। ফোনটা হাতে নিতে বেশ ভয় লাগছিল। বুকের ভিতরটা ধুক ধুক করছিল। হার্টবিটটাও যেন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি জোরে স্পন্দিত হচ্ছিল ভয়ে। এত জোরেই স্পন্দিত হচ্ছিল যে আমি নিজের হার্টবিটের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। তবুও আমি সাহস করে কাঁপা কাঁপা হাতে নিলয়ের ফোনটা হাতে নিলাম।

পর্ব ৪

নিলয়ের ফোনটা হাতে নিয়ে প্রথমেই খেয়াল করলাম ফোনে কোন লক দেওয়া নেই। এর আগে মায়ের কাছে যেদিন ফোন দিয়েছিলাম এরপর থেকে ফোন লক করে রাখত। চাইলেও কাউকে কল দিতে পারতাম না। ভাবলাম মাকে কল দেই। যখন কল দিতে যাব ঠিক এ মুহুর্তে প্রাপ্তি নামের একটা মেয়ের মেসেজ মেসেন্জারে আসলো। আমি মেসেজটা ওপেন করে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আর যাইহোক এটা ভেবেছিলাম যে নিলয় আমাকে ছাড়া আর কোন মেয়ের সাথে কিছু করবে না। তবে সে বিশ্বাসটাও সেদিন উঠে গেল। প্রাপ্তি নামের মেয়েটা মেসেজ দিল~
~ কী গো বাবুই তুমি কোথায় তোমাকে খুব মিস করছি। সেদিনের আদর এখনও ভুলতে পারছি না।

মেসেজটা দেখে মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। আমি নিলয়কে এভাবে আবিষ্কার করব কখনও চিন্তা করে নি। মেসেন্জারটা চেক করতে থাকলাম। চেক করতে করতে দেখলাম মেসেন্জারে এরকম আট থেকে দশটা মেয়ে ছিল যাদের সাথে নিলয়ের প্রেম চলতেছে। হায়রে আমি কতটা বোকার রাজ্যে ছিলাম এখনো ভাবলে হাসি পাই। একের পর এক মেসেজ দেখতে লাগলাম আর বিস্মিত হতে লাগলাম। খেয়াল করলাম সবার সাথে একইরকম কথা একই রকম মেসেজ। সব মেয়েকে একইভাবে ফাঁদে ফেলতেছে। কারও কারও সাথে বন্ধুত্ব রেখেছে।

কারও কারও সাথে দেখা করার তারিখ বরাদ্ধ করেছে। সেদিনের পর থেকে নিলয়ের প্রতি যে মায়াটা অবশিষ্ট ছিল সে মায়াটা চলে গিয়েছিল। নিলয়ের এমন প্রতরণা মেনে নিতে পারছিলাম না।
রাগে শরীরটা গিজ গিজ করতে লাগল। এতটা রাগ কখনো উঠেছে কি না মনে নেই। তবে সেদিনের সে রাগটা আমাকে আরও বেশি ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি সেই সময়টাই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে নি।

নিলয় বাথরুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আমি নিলয়ের দিকে তেড়ে গেলাম। নিলয় ও একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল আমার এরকম তেড়ে আসাতে। নিলয় কিছু বুঝে উঠার আগেই নিলয়ের দিকে তেড়ে গিয়ে মোবাইলটা আছার মেরে বললাম,
~ এসব কী নিলয়? আমাকে তুমি এত কষ্ট দিয়েছ আমি কখনো তোমাকে কিছু বলে নি। মুখ বুজে সব সহ্য করেছি। বন্দি পাখির মত আটকে রেখেছ কিছু বলার সুযোগ দাও নি। তোমাকে কখনো আমি কিছু বলতে গেলেই ইচ্ছামত শারিরীক নির্যাতন করেছ। আমার সারা শরীরে তোমার আঘাতের চিন্হ ছাড়া কিছু নেই। বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে দাও না। বাবা, মা যেন আসতে না পারে তাই বাসা বদলে ফেলেছ। তাও আমি মেনে নিয়েছি।

যেদিন জানতে পারি তোমার ড্রাগসের ব্যবস্যা আছে সেদিনও তোমাকে মেনে নিয়েছি। শত কষ্ট হলে ও আমি চুপ করে সব সহ্য করেছি। তবে এটুকু বিশ্বাস করেছিলাম যে তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সাথে কিছু করতে পারবে না। কিন্তু আজকে সে বিশ্বাসটাও ভেঙ্গে দিলে। একটা না, দুইটা না, দশ থেকে বারোটা মেয়ের সাথে তোমার চক্কর চলতেছে। কোনো স্ত্রী এসব মানবে বলো?

আমাকে রেহাই দাও নিলয়। আমাকে তুমি ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমি বাবা, মায়ের কাছে চলে যাব। আমার পক্ষে এসব মানা সম্ভব না। জীবনে কী পাপ করেছিলাম আর তোমার মত মানুষের সাথে আমার পরিচয় হলো। ছয়টা মাসে আমি একটা মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছি। শারিরীক মানসিক সবভাবে নির্যাতিত হচ্ছি। আর সহ্য করতে পারব না।
আরও কিছু বলতে নিব ঠিক এমন সময় আচমকা একটা লাথি আমার পেটের উপর পড়ল। আমি ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলাম। এত জোরে লেগেছিল যে আমি ব্যাথায় বলে উঠলাম ~
“আল্লাহ্ গো আমায় বাঁচাও। মা গো সহ্য করতে পারছি না।”

তখন নিলয় আমার কাছে এসে আমার মুখটা চেপে ধরে বলল,
~ একদম চিল্লাবি না। চিল্লালে মুখটা ভেঙ্গে দিব।
সাহস কী করে হয় আমার ফোন ধরার। তোকে হাজার বার নিষেধ করেছি যে ফোন ধরবি না। তাহলে ফোন ধরলি কেন? আর তুই কি ভেবেছিস এসব বললে আমি তোকে ছেড়ে দেব? আর তোকে ছেড়ে দিলে তুই আমার নামে মামলা করবি তাই না? আমার ড্রাগসের ব্যবস্যার কথা ফাঁস করে দিবি। আমি কি তোর নাটক বুঝি না। আর আমার ফোন দিয়ে আমি যার সাথে ইচ্ছা কথা বলব তাতে তোর কি আসে যায়।

আমি ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বললাম,
~ আমি কিছুই করব না। কোন মামলা করব না। একদম মায়ের কাছে গিয়ে থাকব। তোমার এসব কথা কাউকে বলব না। আমাকে শুধু যেতে দাও। না যেতে দিলে মায়ের সাথে একটু কথা বলতে দাও। কতদিন যাবৎ মায়ের সাথে কথা বলি না। মাকে খুব মনে পড়ে।

এটা বলার পর নিলয় আমাকে আরও দুইটা লাথি দিয়ে বলল,
~ তুই কী আমাকে বোকা পেয়েছিস? তোর মাকে আমি কল দেই আর তোর মা আমার নামে মামলা করুক তারপর পুলিশ আমার নম্বর ট্র্যাক করে আমার ঠিকানা জেনে যাক তাই না? আর তখন আমার সব কুকর্ম ফাঁস করে দিবি তাই তো?

কথায় আছে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। আমি এরকম কিছুই ভাবি নি। আর নিলয় কত কিছু ভেবে বলে ফেলল। একে আর কি বলব আমি। পেটের ব্যাথায় তখন মোচড়ে যেতে লাগলাম। মাথাটা বেশ ঘুরতে লাগল। মনে হল ঘরটা উল্টে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই আমি জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম নতুন একটা রুমে। আমি বেশ অবাক হলাম এটা ভেবে যে একটা নতুন রুমের নতুন বিছানার উপর আমি শুয়ে আছি কীভাবে? চারপাশ তাকিয়ে দেখলাম, আর বুঝতে পারলাম সত্যিই রুমটা নতুন। কিন্তু আমি এ রুমে কিভাবে আসলাম ভেবে পাচ্ছিলাম না।

বিছানা থেকে নামতে নিলাম পেটে বেশ ব্যথা অণুভব করলাম পিঠেও অনেক ব্যাথা পেলাম। পিঠের ফুসকাটা গলে পানি পড়ছে। আর এজন্যই এত জ্বলছে। মাথায়ও অনেক ব্যথা হতে লাগল।
এর মধ্যে পেটের ব্যথাটাও প্রবল হতে লাগল। এ ব্যথা নিয়ে কোনরকমে উঠলাম। কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না এ নতুন বাসায় আমি কি করে আসলাম। আর নিলয়েই বা কোথায় গেল সেটাও মাথায় আসছে না। এদিকে ক্ষুধায় আমার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে। পেট ব্যথা নিয়ে পা হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে রন্না ঘরে গেলাম। কিছু ফল পেলাম। তা নিয়ে খেয়ে ফেললাম। কারণ এত ক্ষুধা লেগেছিল কী বলব। তারপর কাতরাতে কাতরাতে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।

কয়টা বাজে তাও জানি না। খেয়াল করলাম এ রুমের সাথে বারান্দা আছে। বারান্দা দিয়ে হালকা আলো ঘরে পড়েছে। কোন রকমে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গেলাম একটু। আজকে অনেকদিন পর আকাশ দেখছি। আগের বাসায় থাকতে বারান্দায় যাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। যে রুমের সাথে বারান্দা ছিল সে রুমটা সবসময় নিলয় তালা দিয়ে রাখত। আর আমার রুমের চারপাশে বিশাল বিশাল অট্টালিকা ছিল যার জন্য বাইরের কোন আলো প্রবেশ করত না। ছয় মাসে আকাশ দেখতে কেমন হয় ভুলে গিয়েছিলাম। আজকে আকাশটা দেখে মনটা বেশ শান্ত লাগছে। কতদিন এ আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ, সূর্য দেখি নি। এ বন্দি জীবন থেকে কবে যে মুক্তি পাব জানি না।

ঠিক সে মুহুর্তে খেয়াল করলাম কিছু পাখি কিচিরমিচি করে উড়ে যাচ্ছে। আহ! কি শান্তিতে স্বাধীন ভাবে উড়ছে। আমি যদি একটু উড়তে পারতাম কত ভালোই না হত। কিন্তু আমার উড়ার ডানা দুটো যে আজকে ভেঙ্গে থুবরে পড়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামল। বারান্দা থেকে যেতে ইচ্ছা করছে না তবে মাথাটা অনেক ঘুরাচ্ছে। তাই বেশিক্ষণ বারান্দায় থাকার ধৈর্য ছিল না।
যার দরুণ ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম নিলয় এসেছে।

পর্ব ৫

নিলয় ঘরে এসেই আমার পাশে বসে পড়ল। নিলয়কে দেখে তখন খুব ঘৃনা হতে লাগল। কতটা পাশবিক আচরণ আমার সাথে করেছিল।
কিন্তু ঐদিন নিলয়কে একদম অন্য একটা মনুষ হিসেবে আবিষ্কার করলাম। সেদিন নিলয় আমার পাশে বসেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি তার এরকম আচরণে চমকে গেলাম। কারণ এতটা ভালো সে কখনো হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। তার উপর নতুন বাসায় নিয়ে এসেছে।

কারণ ছাড়া এরকম করার মানুষ নিলয় ছিল না ব্যাপারটা খুব গোলমেলে মনে হয়েছিল। আমি নিলয়ের দিকে তাকিয়ে উঠে বসতে নিয়েও পারছিলাম না শরীরের ব্যথায়। নিলয় আমার হাতটা ধরে বলল,
~ আরে আরে তোমাকে কষ্ট করে উঠতে হবে না। দেখো তুলি আমি তোমাকে এভাবে আঘাত করে ঠিক করে নি। তোমার দিক টা আমার ভাবা উচিত ছিল। ইশ! দেখি তো তোমার পিঠটা।
এ বলে নিলয় আমাকে টান দিয়ে তুলে বিছানায় বসিয়ে আমার পিঠটা দেখে নিজের কপালে নিজের হাত দিয়ে চাপরাতে চাপরাতে বলল,
~ হায় আল্লাহ্ এ আমি কী করলাম। এতটা কষ্ট তোমাকে কী করে দিলাম। দাঁড়াও আমি মলম নিয়ে আসতেছি।

এ বলে নিলয় মলম আনতে গেল। আমি নিলয়ের এমন ব্যবহারে কিছুটা ভয় পাচ্ছিলাম এটা ভেবে যে আবার কী করে বসে কে জানে। কারণ নেশাগ্রস্ত মানুষদের কোন বিশ্বাস নেই।
“নেশা মানুষের মনকে ব্যধিতে রুপান্তর করে। শরীর নেশাগ্রস্ত থাকলে মানুষ কখন কি করে সেটা তার নিজের আয়ত্ত্বে থাকে না”
তাই মনে মনে অনেক ভয় পাচ্ছিলাম।

তখন ভয়ে ভিতরটা বারবার কম্পন দিতে লাগল। ভয়টা বেশি লাগত শারীরিক নির্যাতনের জন্য। কারণ আমার শরীরটা কোন আঘাত সহ্য করার অবস্থায় ছিল না। খানিকক্ষণ পর খেয়াল করলাম নিলয় এসেছে হাতে মলম নিয়ে। এসেই আমার পাশে বসে আমার পিঠটা বের করে মলম লাগাতে লাগাতে বলল,
~ এভাবে আঘাত করা সত্যিই ঠিক হয় নি।

আগেই বলেছিলাম মেয়েরা আবেগের মোম একটু সহানুভূতি পেলে গলে যায়। আমিও নিলয়ের এমন ব্যবহারে গলে গেলাম। তবুও নিলয়কে ব্যপারটা বুঝতে দিলাম না। চুপ করে বসে রইলাম। নিলয় মলম লাগিয়ে শেষ করে আবার রুম থেকে বের হয়ে গেল। নিলয় রুম থেকে বের হওয়ার পর আরও বেশি ভয় লাগতে শুরু করল। মনে হতে লাগল এখন না কিছু করে বসে। ভয়ে ভয়ে বিছানার এক কোণে বসে রইলাম। পিঠে মলমটা লাগানোর পর বেশ আরাম পাচ্ছিলাম।

খানিকক্ষণ পর খেয়াল করলাম নিলয় আমার রুমে আবার প্রবেশ করেছে আর হাতে ভাতের প্লেট নিয়ে। প্লেট টা হাতে নিয়ে আমার পাশে বসল। আমার পাশে বসে ভাত মাখাতে লাগল আর বলতে লাগল~
~ সারাদিন হয়ত কিছু খাও নি। আর নতুন বসায় হয়ত কোথায় কি আছে সেটাও জানো না।
এবার বাসার কথা জিজ্ঞেস করার মুখ্য সময় পেলাম। আমি দেড়ি না করেই নিলয়কে জিজ্ঞেস করলাম~
~ আমি এ নতুন বাসায় কী করে আসলাম? আর আগের বাসাটা কি হয়েছে?

প্রশ্নটা করার পর নিলয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ নিলয়ের চোখগুলো লাল হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এখন মাইর দিলে সহ্য করতে পারব তো? ভয়ে ভয়ে আবারও নিলয়ের দিকে তাকালাম। এবার তাকিয়ে অনেক অবাক হলাম। কারণ নিলয় তার রাগটা দমিয়ে নিয়ে একটা হাসি দিল। নিলয়ের হাসিটা দেখে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার সাহস পেলাম। তাই পুনরায় নিলয়কে জিজ্ঞেস করলাম~
~ বললে না তো এ নতুন বাসায় কী করে আসলাম।

নিলয় ভাতের দলা মাখিয়ে মুখের কাছে ধরে বলল,
~আগে খেয়ে নাও তারপর সবটা বলতেছি। না খেতে খেতে শরীরের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছ। এখন খেয়ে নাও তো।
আমিও এর বেশি জোরাজোরি করার সাহস পেলাম না। ভাতের লোকমাটা মুখে নিয়ে চিবাতে লাগলাম। একের পর এক ভাতের লোকমা দিতে লাগল আর আমি খেতে লাগলাম। অনেকদিন পর মনে হলো এক প্লেট ভাত খেলাম। নিলয় হাসতে হাসতে বলল,
~ একটু নিজের যত্ন তো নিতে পার। আর পানিটা দিয়ে এ ঔষধটা খেয়ে শুয়ে পড়ো। এ ঔষধটা খেলে ব্যথা কমে যাবে।

আমি নিলয়ের কথা মত ঔষধ টা খেয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর নিলয় আমার মাথার কাছে বসে বলল,
~ তুমি না জানতে চেয়েছিলে ঐ বসাটা কেন ছেড়েছি।
~ নহ্যাঁ বলো। এ নতুন বাসায় আমি কখন আসলাম।

নিলয় তখন আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ এটা আমার আরেকটা বাসা। এ বাসায় খালা থাকে। এতদিন তো খালা বিয়ের কথা জানত না। তাই খালাকে জানিয়েছি। জানানোর পর খালা বলল তোমাকে নিয়ে চলে আসতে। তুমি আমার ফোন দিয়ে তোমার মাকে কল করেছ কিনা সেটাও তো আমি জানি না। কারণ ফোনটা ভেঙ্গে গুড়া করে দিয়েছ। আমার কাছে মনে হল তুমি তোমার মাকে হয়ত বলেছ আমার কথা আর তোমার মা হয়তো তোমাকে নিতে চলে আসবে। তাই সকালে তোমার জ্ঞান চলে যাওয়ার পরেই এ বাসায় নিয়ে এসেছি। কারণ তোমাকে আমি হারাতে পারব না।

আর ওয়াদা করছি তোমার সাথে আমি উল্টা পাল্টা ব্যবহার করব না। শুধু একটায় অনুগ্রহ যে, তুমি তোমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করো না। কারণ এতে আমি তোমাকে হারানোর অনিশ্চয়তায় ভুগি।
নিলয়ের এরকম কথায় আমি আবারও গলে গেলাম। নিলয়ের হাতটা বুকের কাছে এনে বললাম,
~আমি শুধু চাই তুমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসো।

নিলয় ভরসা দিয়ে বলল,
~ একদম সব ঠিক করে নিব। চিন্তা করো না। আর কালকে খালা আসবে। খালা অনেক ভালো মানুষ তোমার অনেক যত্ন নিবে। তোমার আর একা লাগবে না। আর কোন মেয়ের সাথে ও কথা বলব না কথা দিচ্ছি।

নিলয়ের এ কথাগুলো শুনে একটা ভরসা পেয়ছিলাম সেদিন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই খেয়াল করলাম একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা ড্রয়িং রুমে বসে আছে। আমি ড্রয়িং রুমের কাছে যেতেই নিলয় বলে উঠল~
~ আরে তুলি শরীর খারাপ নিয়ে আসলে কেন? আমাকে ডাক দিতে পারতে।

অপরদিকে পাশের মহিলাটা আমাকে দুচোখ বড় বড় করে দেখে নিলয় কে বলল,
~ কী রে নিলয় বউ এর যত্ন নিস না নাকি। এত শুকনা হইলে চলব বল। শরীরে তো হাড় ছাড়া কিছু নেই।
উনার একথা শুনেই আমি বুঝলাম উনি নিলয়ের খালা। উনাকে দেখে মনে একটা শান্তি পেলাম। যাইহোক কথা বলার মানুষ পেয়েছি একজন।

অপরদিকে খালার কথার জবাবে নিলয় আমতা আমতা করে বলল,
~ সত্যি বলতে খালা ও একটু অসুস্থ। তুমি চিন্তা করো না একটু যত্ন নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

খালা নিলয়ের প্রত্যুত্তরে বলল,
~ ফের যেন যত্নের ত্রুটি না হয়। আর আমি তো এসেছি। বউমার চেহারায় বদলে দেব যত্ন করে।
নিলয় লজ্জা মাখা মুখে নীচের দিকে তাকিয়ে রইল। আর খালা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ এদিকে আসো তো।
আমি আস্তে আস্তে হেঁটে খালার কাছে গিয়ে বসলাম।

পর্ব ৬

খালার কাছে বসার পর মনে হলো খালাকে সালাম করা দরকার। সেদিন প্রথম আমি আমার শ্বশুর বাড়ির মানুষ দেখলাম। তাই খালাকে সালাম করতে নিলাম। কিন্তু সালাম করতে নেয়ার সময় পিঠে টান পড়ে পিঠের ব্যথা এবং জ্বলুনিটা বেড়ে যায়। তাই ব্যথায় আঃ করে উঠলাম। খালা আমার এমন বিকট শব্দ শুনে আমাকে ধরে বলল,
~ কী হয়েছে তোমার? এরকম বিকট শব্দ করলে যে?
~ মনে হয় কোমরের রগে টান দিয়েছে।

~ দেখিত কোমরটা। এখানে এসে আস্তে করে বসো আমি কোমর মালিশ করে দেই। তাহলে রগে টান ভালো হয়ে যাবে।
আমি খালাকে কোমর মালিশ করতে দিতে চাচ্ছিলাম না। কারণ কোমর মালিশ করতে গেলেই খালার নজর আমার পিঠে পড়বে। কিন্তু খালা খুব নাছোরবান্দা আমি যতই না করতেছিলাম খালা ততই জিদ ধরতেছিল। ভয়ে ভয়ে নিলয়ের দিকে তাকালাম। নিলয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম নিলয় খুব স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে। অপরদিকে খালা জোরাজোরি করতেই থাকল। খালার জোরাজোরিতে নিলয় আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ খালা চাচ্ছে যেহুত মালিশ করতে দাও। এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।

নিলয়ের কথা শুনে খালাকে মালিশ করতে দিলাম। মালিশ করতে নিয়েই খালা বলে উঠল~
~ কী গো বউমা তোমার পিঠে কি হয়েছে। জামাটা একদম পিঠের সাথে লেপ্টে চট লেগে আছে যে?
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। আমতা আমতা করতে লাগলাম আর নিলয়ের দিকে তাকালাম। খেয়াল করলাম নিলয় উঠে পাশের রুমে চলে গেল। তখন আমার ভয়টা আরও বেশি কাজ করল খালাকে কী জবাব দিব এটা ভেবে। এর মধ্যে খালা আমার পিঠে হাত দিল। পিঠে হাত দেওয়ার সাথে সাথে এত ব্যথা হল আমি “ওমাগো” বলে চিল্লানি দিয়ে উঠলাম। খালা আমার চিল্লানি শুনে আস্তে আস্তে জামাটা উপরে তুলে পিঠ দেখে মাথায় হাত দিয়ে বলল,
~ কী গো বউমা তোমার পিঠে পুড়ল কিভাবে?

বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে খালাকে হুট করে জাবাব দিলাম~
~ রান্না করতে গিয়ে আগুনের ছ্যাঁকা লেগেছে।
খালা আমার মুখটা উনার দিকে ফিরাল আর চোখ গুলো বড় বড় করে বলল,
~ আমাকে কি তোমার বোকা মনে হয়?
~ নাহ মানে খালা।

খালা রাগী গলায় বললেন~
~ রান্না করতে গিয়ে পিঠে ছ্যাঁকা লাগে এরকম আজব কাহিনী কখনও শুনে নি। নিশ্চয় এটা নিলয় করেছে। কিছু নিয়ে হয়তো ঝগড়া লেগেছিলে আর তখন হয়তো রাগের মাথায় খুন্তি লাগিয়েছে পিঠে। ঠিক বলেছি কি না বলো।
~ ঠিক তা না খালা।

~ আর বুঝাতে হবে না। যা বুঝার আমি বুঝে গিয়েছি। আমি নিলয়কে গিয়ে এখনেই জিজ্ঞেস করতেছি এরকম কেন করল।
এ বলে খালা উঠে নিলয়ের রুমে চলে গেল। আর এদিকে আমি ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছিলাম এটা ভেবে যে হয়তো নিলয় ভেবেই নিবে যে আমি খালাকে ইচ্ছা করে নালিশ করেছি।

কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম খালা নিলয়ের রুম থেকে বের হচ্ছে আর সাথে নিলয় ও। নিলয়কে দেখে তখন তীব্র ভয় কাজ করতেছিল কি করে বসে এটা ভেবে। তবে নিলয় তেমন কিছুই করল না। বেশ শান্ত হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আর খালা আমার কাছে এসে বলল,
~ তুমি চিন্তা করো না। নিলয় ঔষধ আনতে গিয়েছে। ঔষধ লাগালে তোমার ব্যথা কমে যাবে।

তুমি জামাটা পাল্টে একটা ঢিলাঢালা জামা পরে নাও। আমি রান্না ঘরে গিয়ে কিছু রান্না করি।
এ বলে খালা রান্না ঘরের দিকে রওনা দিল। আর আমি রুমে এসে যখনই জামাটা খুলতে নিলাম তখনই পিঠে টান পরল, সাথে সাথে মনে হল আমার কলিজাটা বের হয়ে যাচ্ছে। এতটা অসহ্য জ্বলুনি হচ্ছিল বলে বুঝানোর ক্ষমতা নেই। জামাটা খোলার পর জামাটার পিঠের অংশ দেখে গা টা শিউরে উঠল। কারণ জামাটার পিঠের অংশে ফুসকার গলে যাওয়া পানি আর রক্ত লেগেছিল।

জামাটা খুলে খালি গায়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম পাখার নীচে। পিঠে বাতাস লাগাতে একটু জ্বলাটা কমেছে আর ভিতরে শান্তি শান্তি ভাবও লাগছিল। খানিকক্ষণ পর নিলয় দরজা ধাক্কা দিতে লাগল জোরে জোরে। নিলয়ের এরকম দরজা ধাক্কানোতে আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারাহুরা করে জামাটা পড়ে ভয়ে ভয়ে দরজা খুললাম। দরজা খুলার পর নিলয় আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
~ হঠাৎ দরজা লাগিয়েছিলে কেন? তুমি তো কখনো দরজা লক করো না। আজকে দরজা লক করে কী করছিলে?

আচমকা নিলয়ের এমন কথা শুনে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। এত শান্ত গলায় নিলয় কথা বলছে এটা যেন মানতে একটু হিমশিম খাচ্ছিলাম। আমি নিলয়ের হাতটা ধরে বললাম,
~ আরে আমি তো কাপড় বদলাতে দরজা লাগিয়েছিলাম। আগের বাসায় তো একা ছিলাম তাই দরজা লাগানোর প্রয়োজন পরত না, এ বসায় তো খালা আছে তাই দরজা লাগিয়ে নিয়েছিলাম।
~ অহ! তাই বলো। আমি তো বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম রাগ করে কি থেকে কি করে বসো।

~ কেন কি ভেবেছিলে? আমি মরে যাব?
নিলয় আমার মুখটা চেপে ধরে বলল,
~ এমন কথা মুখেও আনবে না।

নিলয়ের এরকম আচরণে আমি মোটেও অভ্যস্ত ছিলাম না। সেদিন যতই নিলয়কে দেখেছি ততই বিস্মিত হয়েছি। এর মধ্যে নিলয় আমার গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ পিঠটা দেখাও দেখি মলম লাগিয়ে দিই। এ মলমটা লাগালে জ্বলা কমে যাবে। ব্যথাও কমে যাবে।

এবলে নিলয় আমার পিঠের কাপড়টা তুলে পিঠে মলম লাগিয়ে দিল। তারপর আস্তে করে আমাকে শুইয়ে দিয়ে মাথার চুলে আলতো আলতো হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ আমি তোমার মাথাটা হাত বুলিয়ে দিচ্ছি তুমি একটু বিশ্রাম নাও।

আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আমি কোন স্বপ্ন দেখছি না তো? একজন মানুষ একদিনে এত পরিবর্তন কী করে হতে পারে? প্রশ্নগুলো মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। কোনভাবেই কোন ঘটনার মানে বুঝতে পারছিলাম না। আজকে যেন নতুন একটা নিলয়ের পরিচয় পেলাম। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম টেরেই পাই নি।

কানে হালকা আওয়াজ আসছে কেউ একজন ডেকে বলছে~
~ কি গো উঠবে না? উঠে দুপুরের খাবার খাও। না খেতে খেতে তো শরীর অবস্থা খারাপ করে দিয়েছ। এভাবে মরার মত পড়ে থাকলে হবে।
ঘুম ঘুম চোখে কন্ঠটা চিনার চেষ্টা করলাম। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম খালা ডাকছে। কিন্তু চোখে ঘুমের এত তীব্রতা ছিল যে তাকাতে পারছিলাম না। বরাবরের মত ব্যথার ট্যাবলেট খাওয়ার পর আমার তীব্র ঘুম হলো। এ ঘুমের জগৎ থেকে বের হয়ে আসতে মন চাচ্ছিল না। তাকাতে চাইলেও তাকাতে পারছিলাম না।

তবে খালা অনবরত ডেকেই যাচ্ছিল। আমি খালার ডাকে শরীরের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে চোখ দুটো খুললাম। চোখ খুলেই খালার হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখলাম। খালার হাসি মাখা মুখটা দেখে মায়ের কথা মনে পড়ল। মা ও ঠিক এমন করে খাবারের জন্য ডাকত। আমিও খলার দিকে হেস বললাম,
~ হ্যাঁ খালা উঠতেছি। ব্যথার ঔষধ টা খাওয়ার পর কড়া ঘুম হলো। তাই ইচ্ছা করলেও উঠতে পারছিলাম না
~ সব সেড়ে যাবে। এখন উঠে খাও। তারপর আবার ঘুমিও।

আমিও খালার কথায় উঠতে নিলাম। কিন্তু ঘুমের তীব্রতায় শরীরটা এত দুর্বল হয়ে গিয়েছিল যে উঠার শক্তি পাচ্ছিলাম না। উঠতে নিলেই মাথাটা চক্কর দিতেছিল আর শরীর অবশ অবশ লাগতেছিল। খালাকে ঘুম ঘুম চোখে বললাম,
~ খালা উঠার শক্তি পাচ্ছি না।

~ দাঁড়াও আমি ধরে বসাই। তারপর ভাত এনে খাইয়ে দিচ্ছি। ভাত খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
এ বলে খলা আমাকে দুহাত ধরে তুলল। আমি ঘুম ঘুম চোখ নিয়েই খাটে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর খালা প্লেট ভর্তি ভাত নিয়ে আসলো। আর আমার মুখে লোকমা তুলে দিতে লাগল আর বলতে লাগল~
~ না খেয়ে নিজের কি অবস্থা করেছ দেখেছ? সবসময় বেশি বেশি করে খাবে।

খালার কথাগুলো শুনে মায়ের কথা বেশি মনে পড়ছিল। তবুও কিছু করার নেই মাকে কল দিতে পারব না। তবে খালা আসার পর একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম। নিলয়ের পরিবর্তনটাতে যদিও সন্দেহ আছে তবে খালার ভালোবাসাতে কোন সন্দেহ নেই। খেতে খেতে খালাকে বললাম,
~ খালা নিলয় কোথায়?
~ মিস করতেছ নাকি?

আমি শুধু খালার কথা শুনে একটু মৃদু হাসলাম। খলা আমার হাসি দেখে বলল,
~ আমি তোমার মায়ের মতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। নিলয় একটু বাইরে গিয়েছে।
এর মধ্যে খালা খাওয়ানো শেষ করে পুনরায় বলল,
~এখন ঘুমাও আরাম করে।
আমার চোখে এত ঘুম ছিল যে আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম। হুট করে কারও স্পর্শ অনুভব করলাম।

পর্ব ৭

স্পর্শটা পেয়ে আমি খপ করে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়লাম। খেয়াল করলাম নিলয় পাশে বসে আছে। অহ! তার মানে নিলয় ছিল। নিলয় আমাকে এভাবে চমকে উঠতে দেখে বলল,
~ কি ব্যাপার ভয় পেয়ে গেলে নাকি?

~ হঠাৎ করে এভাবে স্পর্শ করেছ ভাবলাম কে না কে?
নিলয় অট্টহাসি দিয়ে বলল,
~ বোকা মেয়ে এ বসায় আর কে আসবে? আমি, তুমি খালা ছাড়া এ বাসায় কেউ নেই। যাইহোক ঘুম কেমন হল বলো।
আমি মুখে হাই তুলতে তুলতে বললাম,
~ আজকে ঘুম অনেক ভালো হয়েছে।

~ আর পিঠের ব্যাথাটা কমেছে তো।
আমি নিলয়ের দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এ নিলয় কি সে নিলয় যে নিলয় আমাকে দীর্ঘ ছয় মাস ধরে অত্যাচার করেছে নাকি এটা অন্য কোন নিলয়। আমার অপলক চাহুনি দেখে নিলয় একটা অপ্রস্তত কাশি দিয়ে বলল,
~ কি ব্যপার এভাবে চেয়ে আছ যে, ব্যথাটা কমেছে কিনা জিজ্ঞেস করতেছিলাম।

~হ্যাঁ ব্যথাটা কমেছে।
নিলয় আমার পিঠের কাপড় টা আবার তুলে পুনরায় মলম লাগিয়ে দিল। এখন মলম লাগানোর সময়েও এত ব্যথা হলো না। ঔষধ টা খাওয়ার পর ব্যথাটা অনেক কমে গিয়েছিল। মলম লাগানোর শেষে নিলয় বলল,
~ আজকে অনেক ঘুমিয়েছ। এবার উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করো। না হয় শরীর বেশি দুর্বল লাগবে।

নিলয় যতবারই ভালোভাবে কথা বলছিল ততবারই নিলয়কে আমার বেশ অপরিচিত লাগছিল। তার উপর বাসা পরিবর্তন এর বিষয়টাও বেশ গোলমেলে লাগছিল। তবুও কিছু করার ছিল না কারণ যা হচ্ছিল তা জানার কোন উপায় ছিল না। নিলয়ের কথায় হালকা হাঁটাহাঁটি করে ড্রইং রুমে বসলাম। খালা আমার পাশে বসে বলল,
~ কী গো মা এখন কেমন লাগছে?

~ এখন অনেক ভালো লাগছে।
খালা হাসতে হাসতে বলল,
~ শরীর ভালো হলে কিন্তু আমাকে সব কাজে সাহায্য করবে। আর নিলয় ও কিছুদিনের জন্য বাইরে থাকবে। বসায় শুধু তুমি আর আমি।
নিলয় বাইরে যাবে শুনেই একটা অজানা ভয় বুকে চিলিক দিয়ে উঠল। আমি নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ তুমি কোথায় যাবে?

নিলয় আমার দিকে তাকিয়ে যখনই বলতে নিল আমি ঠিক তখনই খালা নিলয়ের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল,
~ নিলয় রিহ্যাবে যাবে। রিহ্যাবে গেলে নিলয় নেশাটা ছাড়তে পারবে। তাই নিলয় তিনমাসের জন্য রিহ্যাবে যাবে।

খালার মুখে এমন কথা শুনে সেদিন আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম বুঝানোর ভাষা আমার নেই। কারণ আমার কাছে সবসময় মনে হত নিলয় নেশা করে বলেই নিলয়ের হিতাহিত জ্ঞান কাজে করে না। আর সেজন্য নিলয় আমার সাথে এমন করে। আর এখন নিলয় রিহ্যাবে গিয়ে কোনোরকমে নেশা ছাড়তে পারলে আমার সকল সমস্যা দূর হয়ে যাবে। বিয়েটা যে করেই হোক না কেন মেনে নিয়েছিলাম। এত কষ্ট দেওয়ার পরও আমি কেমন করে যেন নিলয়ের প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে মেয়েরা কারও কাছে হাজার বার আঘাত পেলেও সামান্য ভালোবাসায় গলে যায়।

“মেয়েরা খুব মায়াবী হয়। তাদের ভালোবাসা জড়ানো মন বাচ্চাদের মত মায়া মাখা। তারা একটু ভালেবাসায় গলে টইটুম্বুর হয়ে যায়”
আবেগ জড়িত কন্ঠে নিলয়কে জাবাব দিলাম~
~ এটা তো উত্তম সিদ্ধান্ত। তোমার যতদিন লাগে তুমি থেকে আসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।

নিলয় ভরসা দিয়ে বলল,
~ সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি শুধু এ বাসায় খাবে ঘুমাবে আর খালার সাথে গল্প করবে। তিন মাস পরে আমরা নতুন ভাবে সংসার শুরু করব।

ঐদিন নিলয়ের এরকম কথা শুনে অনেক শান্তি লেগেছিল। আমি একটা পরম শান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এমতাবস্থায় খালা বলল,
~ আমি খাবার নিয়ে আসছি। সবাই একসাথে খাব।
এ বলে খালা রান্না ঘরের দিকে রওনা দিল। খানিক্ষণ পর খালা দুই হাতে দুইটা প্লেট নিয়ে আসলো। আমি খালার হাত থেকে দুইটা প্লেট নিয়ে টি টেবিলে রেখে জিজ্ঞেস করলাম~
~ খালা এখানে নিয়ে আসলেন যে খাবার।

~ ভাবলাম টেবিলে না বসে এখানে সবাই টেলিভিশন দেখতে দেখতে খাই। আচ্ছা দাঁড়াও আমি বাকি জিনিসপত্র গুলো নিয়ে আসি।
খালাকে আটকে দিয়ে বললাম,
~ খালা আমি নিয়ে আসি আপনি বসেন।

খালা রাগ রাগ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তোমার শরীর ভালো না আর তুমি কাজ করবে? চুপ করে এখানে বসো। কাজ করার সময় তো চলে যায় নি। সামনে অনেক সময় আছে তখন কাজ করো। এখন নিজেকে একটু সময় দাও বিশ্রাম করো।

খালা এমন ভাবে বলল আমি একদম বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লাম। তারপর খালা পুনরায় খাবার আনতে গেল। অতঃপর সব আনা শেষ হলে আমরা সবাই একসাথে খেতে বসি। সেদিন ছিল আমার বিয়ের পর কাটানো সবচেয়ে ভালো দিন। সেদিন খুব গল্প করে খাওয়া পর্ব শেষ করে যে যার রুমে গেলাম।
কিন্তু আমি রুমে যেতেই মাথাটা একটু ঘুরাতে লাগল। নিলয় আমাকে ধরে খাটে বসাল। তারপর হাতে এক গ্লাস দুধ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
~ এটা খেয়ে শেষ করো।

আমার তখন দুধ খেতে একদম ইচ্ছা করছিল না। অনেক গা গুলাচ্ছিল। আমি নিলয়কে নাক ছিটকাতে ছিটকাতে বললাম,
~ আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।

নিলয় আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
~ কালকে তো রিহ্যাব এ চলে যাব। তিনমাস আর কথা হবে না। দেখা হবে না। আজকে না হয় আমার হাতে দুধটা জোর করে খেলে। না হয় মন খারাপ লাগবে আমার।
নিলয়ের এহেম কথায় আমি পুনরায় গলে গেলাম। হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে চট করে খেয়ে ফেললাম। দুধটা খেয়ে নিলয়কে বললাম,
~ আচ্ছা কথাও কি হবে না?

নিলয় মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল,
~ কথা হবে। তবে খালার ফোনে কল দিব। তোমাকে আলাদা ফোন দিয়ে গেলে তুমি আবার তোমার মা, বাবাকে কল দিবে। এত অনিশ্চয়তার মধ্যে তোমাকে রেখে যেতে পারব না। খালার ফোনে কল দিলেই তোমার সাথে কথা হবে।

নিলয়ের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না তাই শান্তভাবে মেনে নিলাম। এদিকে আর কথা বলার কোনো শক্তি পাচ্ছিলাম না। ঘুমে চোখটা একদম বুজে যাচ্ছিল। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে কথা বলতে বলতে ঘুমের রাজ্যে কখন যে পদার্পণ করেছি টের পাই নি। সকালে হালকা হালকা ঘুম নিয়ে চোখ মেলে দেখলাম বারান্দা দিয়ে আসা কড়া রোদ আমার মুখে পড়ছে।

পাশে তাকালাম খেয়াল করলাম নিলয় পাশে নেই। ঘঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম এগারোটা বাজে। এগারোটা বাজতে দেখেই আমি খপ করে উঠে পড়লাম। এর মধ্যেই খালা রুমে এসে বলল,
~ সেই কখন থেকে ডাকতেছি তুমি এত ঘুমিয়েছ যে টেরেই পাও নি। তোমাকে ঘুমাতে দেখে নিলয় তোমাকে না বলেই চলে গিয়েছে।
খালার কথা শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারণ নিলয়কে শেষবার দেখতে পারলাম না।

আমি চুপ করে দম ধরে কিছুক্ষণ বসে থেকে খালাকে বললাম,
~ কেন জানি এত ঘুম হলো বুঝতে পারছি না। আমার ইদানিং খুব ঘুম পায়। কি যে হলো আমার। নিলয়কেও এ ঘুমের জন্য শেষবার দেখতে পারলাম না।
~ আরে কিচ্ছু হয় নি তোমার। নিলয় সুস্থ হয়ে তো ফিরে আসবেই, এরমধ্যে একটু ভালমন্দ খেয়ে শরীর স্বাস্থ্য ভালো করতে হবে। শরীর দুর্বল তাই এত ঘুম পাচ্ছে তোমার।
আমিও খালার কথায় বেশ ভরসা পেলাম। সেদিনের পর থেকে আমার জীবনটায় অন্য একটা মোড় নিল। খালার কাছে সব আদর পেয়েছিলাম। বিয়ের পর ঐ সময়টা ছিল আমার কাটানো সবচেয়ে ভালো সময়।

খালা আমাকে কোন কাজেই করতে দিত না। এক মাসে আমি বেশ বদলে গিয়েছিলাম। আমার শরীরের ওজন বাড়ল। আমার চেহারার রুপ খুলতে লাগল। শরীরে আগের থেকে বেশি শক্তিও পাচ্ছিলাম। তবে একটাই সমস্যা হত আমার রাতে কড়া ঘুম হত। খালার প্রতিদিন কাজেই ছিল আমার যত্ন নেওয়া। সারাদিন আমাকে এটা ওটা খেতে দিত। আর রাতে এক গ্লাস দুধ দিয়ে যেত।

ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমার খেতে হত। কারণ খালাকে নাকি নিলয় কড়া করে বলে গিয়েছে প্রতিরাতে যেন আমাকে দুধ দেয় খাওয়ার জন্য। তাই খালা নিলয়ের কথা রাখতে আমাকে রাতে এক গ্লাস দুধ দিতে ভুলত না। নিলয়ের সাথে মাঝে মাঝে খালার ফোন দিয়ে কথা হত। দেখতে দেখতে দুইটা মাস সুখেই কেটেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন একটা ঘটনা আমার সামনে স্পষ্ট হয়। প্রতি রাতেই দুধ খেলেও সেদিন খালা দুধ দিয়ে যাওয়ার পর তেমন খেতে ইচ্ছা করল না। আমি দুধটা পাশে রেখে খালাকে বললাম,
~ আমি খেয়ে নিব আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে যান।

খালা তার রুমে যেতে যেতে বলল,
~ মনে করে খেয়ে নিও। আমি এসে দেখে যাব কিন্তু।

এ বলে খালা পাশের রুমে চলে গেল। আমি দুধটা পাশে রেখে দরজাটা হালকা চাপিয়ে দুধটা বাথরুমে ফেলে দিলাম। কারণ খালা দুধের গ্লাস খালি না দেখলে জোর করে খাওয়াবে। আর এখন আমার মোটেও দুধ খেতে ইচ্ছে করছে না। তাই এ কাজ করতে বাধ্য হলাম। দুধের গ্লাসটা খালি করে বিছানার পাশেই রেখে দিলাম। আর আমি শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর খালা এসে বলল,
~কি গো বউমা দুধটা খেয়েছ।

আমি খালি গ্লাসটা খালাকে দিয়ে বললাম,
~ এই যে খালা খেয়ে নিয়েছি। এখন ঘুম পাচ্ছে ঘুমাব।
~আচ্ছা ঘুমাও।

এ বলে খালা চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ চোখ বুজে হালকা ঘুমিয়ে গেলাম। হঠাৎ বিড়বিড় আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙল। অন্ধকারে আওয়াজ টা কোথায় থেকে আসছে বুঝতে পারছিলাম না। তবে চুপটি মেরে আওয়াজটা শুনার চেষ্টা করছিলাম। খালা কাকে যেন বলছিল~
~ তুই ঐখানে দাঁড়া আমি দেখে আসি মেয়েটা ঘুমিয়েছে কিনা।
এ বলে খালা আমার রুমে আসল।

পর্ব ৮

ব্যবহারটা কেন জানি খুব রহস্যময় মনে হল। তাই ঘটনা যেন উদঘাটন করতে পারি সেজন্য ঘুমের ভান ধরে শুয়ে রইলাম। খালা আমার রুমে এসে রুমের লাইটটা জ্বালাল। আমি লাইট জ্বালানোর পরও ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলাম। খালা লাইট জ্বলিয়ে আমার কাছে এসে আমাকে ডাকতে লাগল।

খালার ডাকে সাড়া দিব কিনা বেশ দুটানায় পড়ে গেলাম। তবে কেন জানি না মনে হলো এখন সাড়া দিলে বিপদে পড়তে পারি। তাই ঘুমঘুম ভাব নিয়েই শুয়ে রইলাম। খালা আমাকে কতক্ষণ নেড়ে চেড়ে লাইটটা বন্ধ করে রুমে থেকে চলে গেল। পুরো বাড়ি তখন অন্ধকার অথচ খালার ফিসফিসের আওয়াজ আমার কানে আসছে। আমি আস্তে আস্তে উঠে পা টিপে টিপে দরজার সামনে গেলাম।

দরজার কাছে গিয়ে আমি হালকা উঁকি মেরে দেখলাম একটা ছেলে খালার সাথে কথা বলতেছে। ড্রয়িং রুমটা অন্ধকার হওয়ায় মুখটা এত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। খেয়াল করলাম খালা ছেলেটাকে নিয়ে নিজের রুমে গেল। রহস্যময় লাগল বিষয়টা। আমিও পা টিপে টিপে খালার রুমের পাশে দাঁড়ালাম। ছেলেটা ফিসফিস করে কথা বলছে তাই ছেলেটার কথা এত স্পষ্ট শুনতে পারছিলাম না। তবে খালা একটু আওয়াজ করেই কথা বলছে। ছেলেটা হয়ত বলেছিল দরজাটা লক করে দিতে। খালা অট্ট হাসি দিয়ে বলল,
~ ধুর পাগলা ঐ মেয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে দরজা লক করতে হবে না। তুই তোর কাজ চালা। আয় আমার কাছে আয়।

আরও কতগুলো নোংরা কথা যেগুলো আমার মুখ দিয়ে আসছে না। আমি বিষয়টা আন্দাজ করতে পারলেও পুরোপুরি পরিষ্কার হতে পারছিলাম না। তাই আস্তে করে খালার রুমে উঁকি মারলাম। উঁকি মেরে যা দেখলাম তা দেখে আমি চমকে গেলাম। খালা ঐ ছেলেটার সাথে কুকর্ম করছে। তবে ঘরের আলো কম হওয়ায় ছেলেটার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। আমি চুপ করে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। আর ভাবতে লাগলাম ঐ ছেলেটা কে? এতদিন খালুর কথা আমার মনে না আসলেও আজকে প্রশ্ন জাগল খালু কোথায় আছে।

খালার কি কোন ছেলে মেয়ে নাই। এসব ভাবতে ভাবতে এক ঘন্টা পার হলো। ছেলেটা এক ঘন্টা পর বের হয়ে গেল। আমি সারারাত ছটফটাতে ছটফটাতে কাটালাম। যে মহিলাকে আমি মায়ের চোখে দেখেছিলাম সে মহিলার এমন কুকর্ম মানতেই পারছিলাম না। সকালে উঠেই খলার কাছে গেলাম তবে চেহারাটা প্রতিদিনের মতই স্বাভাবিক রাখলাম। যাওয়ার সাথে সাথে খালা বলল,
~ কি গো মা ঘুম হয়েছে?

খালার এমন কথা শুনে ঘৃনায় গা জ্বলে গেলেও নিজেকে সংবরণ করে খালাকে বললাম,
~ হ্যাঁ।
খালা বলল এদিকে আসো তোমার চুলে তেল দিয়ে দেই। আমি ও চুলে তেল দেওয়ার জন্য খালার পাশে গিয়ে বসলাম। খালা চুলে তেল দিতে থাকল। এসময় খালাকে হুট করে প্রশ্ন করে বললাম,
~ খালা বাসায় আসার পর থেকে আপনাকে দেখছি। খালুকে দেখলাম না। খালু কোথায়? আপনার কি কোন ছেলে মেয়ে নেই?

এ বলে খালার মুখের দিকে তাকালাম। খালা আমার এরকম প্রশ্নে মোটেও প্রস্তুত ছিল না সেটা খালার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছিল। খালা অপ্রস্তুত গলায় বলল,
~ আমি তো বিয়ে করেছিলাম অনেক আগে। বিয়ের এক বছর পরেই তোমার খালু মারা যায়। বাচ্চা কাচ্চা হয় নি। তারপর থেকে নিলয়ের কাছে থাকি। নিলয়েরও কেউ নেই। নিলয়ের বাবা মা নিলয়রে জন্মের পরেই মারা যায়। তাই আমি নিলয়ের কাছেই থেকে যাই। তবে পুরোপুরি মানুষ করতে পারি নি ছেলেটাকে।
এ বলে খালা হুহু করে কাঁদতে লাগল। আমি খালাকে মিথ্যা শাত্ত্বনা দেওয়ার ভান করে বললাম,
~ খালা কাঁদবেন না। আমরা আছি তো।

সারাদিন কোনরকমে কাটল রাতে খালা দুধ নিয়ে আসলো। আমি দুধটা খেলাম। খেয়াল করলাম দুধটা খাওয়ার পর খুব ঘুম আসতেছিল। আমার মাথায় প্রশ্ন জাগল গতকাল আমি দুধ খাইনি তাই আমার তেমন ঘুম হয়নি। আর আজকে দুধ খাওয়ার পর থেকেই ঘুম ঘুম লাগছে। তাহলে কি খালা দুধে কিছু মিশিয়ে দেয় যাতে করে আমি তার কুকর্ম ধরতে না পাড়ি। এসব ভেবতে ভাবতেই আমি ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে খালার ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। খালা বলতে লাগল~
~ কী গো মা আর কত ঘুমাবে উঠো?

এ মহিলাকে ঘুম থেকে উঠে দেখতে খুব বিরক্ত লাগছিল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
~হ্যাঁ খালা উঠতেছি।
আমি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে গেলাম। খেয়াল করলাম খালা খাবার নিয়ে বসে আছে। প্রতিদিনের মতো সেদিন ও আমাকে জিজ্ঞেস করল,
~ রাতে ঘুম ভালো হয়েছে তো?

সেদিনও সারাটাদিন আমার অসহ্য ছটফটানিতে কাটল। রাতের বেলা আমার নজর ছিল খালার উপর। আমি জানতাম খালা দুধ নিয়ে আসবে। আমার ধারণা খালা দুধে কিছু মিশায়। তাই আমি খালাকে একটু নজরে রাখলাম। রাত ঠিক দশটা বাজে খালা গেল আমার জন্য দুধ বানাতে আমিও চুপি চুপি রান্না ঘরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম খালা প্যাকেট থেকে তিনটা ট্যাবলেট দুধে মিশিয়ে নাড়তে থাকল। আমার বুঝতে বাকি রইল না খালা দুধে ঘুমের ঔষধ মিশাচ্ছিল। খালা বুঝে উঠার আগেই আমি সে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলাম। খালা প্রতিদিনের মত আমার রুমে এসে দুধ খেতে বলল। আমি খালাকে বললাম,
~ খালা রেখে যান আমি একটু পর খাব আমার এখন গা গুলাচ্ছে।

~ আমি রেখে যাচ্ছি খেয়ে নিও। আমি এসে কিন্তু দেখে যাব। নিলয় ও ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবে খেয়েছ কী না।
~ আরে খালা চিন্তা করবেন না। আমি কতক্ষণ পর খেয়ে নিব।
খালা আমার কথা শুনে রুম থেকে চলে গেল। আমি সুযোগ মত দুধটা বাথরুমে ফেলে দিলাম। খালা কিছুক্ষণ পর এসে বলল,
~ কি গো মা দুধটা খেয়েছ।

আমি ঘুমঘুম চোখের ভাব নিয়ে খালাকে খালি গ্লাস দেখিয়ে বললাম,
~ এই যে খালা খেয়ে নিয়েছি। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।
খালা হাসতে হাসতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
~ তুমি ঘুমাও মা।

বলেই খালা খালি গ্লাসটা নিয়ে চলে গেল। আর আমি ঘুমের ভান ধরে শুয়ে রইলাম। আগের রাতের মতই কিছুক্ষণ পর একটা ফিসফিসের আওয়াজ পেলাম। আওয়াজটা পেয়ে আমি একদম মরার মত পড়ে রইলাম। গত রাতের মত খালা আমার রুমে আসলো। একইভাবে চেক করল আমি ঘুমিয়েছি কিনা। তারপর লাইট টা বন্ধ করে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ এভাবে শুয়ে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে খালার রুমে গেলাম। আজকে খালার রুমে লাইট জ্বলানো ছিল। আমি একটু খুশি হলাম এটা ভেবে যে আজকে ছেলেটার মুখ আমি দেখতে পারব। এ ভেবে আমি যখন উঁকি মারলাম আমি ছেলেটাকে দেখে চমকে গেলাম। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।

এভাবে আমি কিছু দেখব তা কল্পনাও করতে পারে নি। কারণ ছেলেটা আমার স্বামী নিলয় ছিল। নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবুও নিজেকে সামলে নিজের রুমে চলে আসলাম। আর ভিতরটা তখন পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছিল। নিলয় তার খালার সাথে এমন করছে। আর খালাও কেমন নিজের বোনের ছেলের সাথে ছিঃ। মহিলার মিষ্টি মুখের আড়ালে এত ঘৃনিত একটা রুপ আছে ভেবেই যেন গা গুলিয়ে যাচ্ছিল। ঘৃনায় মনটা বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছিল। আদৌ কি নিলয়ের খালা ঐ মহিলা নাকি অন্য কিছু। আমার সন্দেহের মাত্রাটা বেড়ে গেল। তবে এখন না জেনে চিল্লাচিল্লি করা ঠিক হবে না, কারণ এর আগে এসব করে অনেক আঘাত পেয়েছি। ইশ! কতটা কষ্ট যে হয়েছিল সেদিনের কথা মনে হলে এখনো বুকটা ফেটে যায়। সারারাত কি যে ছটফটানিতে কেটেছে আমি বলে বুঝাতে পারব না। এক বিন্দু ঘুমও চোখে আসে নি। সকালে খালা এসে আমাকে ডাক দিল কী গো মা বলে। খালার মুখটা দেখে এত ঘৃনা হচ্ছিল যে বলে বুঝাতে পারব না।

তবুও নিজেকে সামলে নিলাম। শুরু হল আমার নতুন যন্ত্রণা। প্রতিদিন খালা দুধ দিয়ে যেত আর আমি দুধ না খেয়ে ফেলে দিতাম আর নিলয়কে খালার সাথে নোংরা ভাবে আবিষ্কার করতাম। কেটে গেল পনেরদিন। আমার সহ্যের সীমা চলে গিয়েছিল। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই একদিন নিলয় আর খালাকে হাতেনাতে রুমের মধ্যে ধরে ফেলি। তারা আমাকে এভাবে দেখে বেশ চমকে গেল। তারা তো ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি। কিন্তু তারা তো এটা জানত না যে আমি দুধটা না খেয়ে ফেলে দিতাম। তারপর

পর্ব ৯

খালা আমাকে দেখে চমকে গিয়ে বলল,
~তুমি এখানে?
জবাবে খালাকে বললাম,
~ কেন কী ভেবেছিলেন? আমি ঘুমিয়ে আছি। আর আপনারা নোংরা কাজ করছেন সেটা আমি কখনো টের পাব না। আমার ভাবতেও ঘৃনা লাগছে যে আপনি নিজের বোনের ছেলের সাথে এমন করছেন। নিলয় তো রিহ্যাবে গিয়েছিল তাহলে এখানে আসলো কীভাবে? সারাদিন আমাকে মা, মা ডেকে রাতে আমার স্বামীর সাথেই নষ্টামি করতেছেন ছিঃ। এত বড় মুখোশধারী আপনি? আপনাকে নিজের মায়ের মত মনে করতাম। লজ্জা করল না হাঁটুর বয়সী ছেলের সাথে এমন কাজ করতে। আদৌ কী আপনারা খালা ভাগ্নে নাকি অন্যকিছু?

আমার কথাগুলো শুনে নিলয় তেড়ে আসতে নিল আমার দিকে। নিলয়ের সেই চিরাচায়িত রুপটা আবার ফুটে উঠল। আমার বুঝতে আর বাকি রইল না কয়েকদিন আগে যা ঘটেছিল সেটা নিলয়ের অভিনয় ছিল। আর এ অভিনয়টাও করেছিল নিজের স্বার্থের জন্য। নিলয় যখন তেড়ে এসে আমাকে মারতে নিল, শয়তান মহিলাটা নিলয়কে আটকে দিয়ে বলল,
~ মারতে যাইস না। অনেক কষ্ট করে এ কয়দিনে খানাপিনা দিয়া নাদুসনুদুস বানাইছি যাতে করে ভালো উপার্জন করতে পারি। তুই এখন মাইরা চেহারা নষ্ট করিস না।
মহিলার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে হয়ে জিজ্ঞেস করলাম~
~ আমাকে আদর যত্ন করার পেছনেও কারণ আছে তবে সেটা কী কারণ? আর ভালো উপার্জন হবে মানে কী? আপনি কে? তাহলে আপনি কি নিলয়ের খালা না?

মহিলা বিদঘুটে হাসি দিয়ে বলল,
~ আমি নারী ব্যবসায়ী। নিলয় আমার উপযুক্ত অংশীদার। নিলয়ের কাজেই হচ্ছে মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে তুলে আনা। আর আমার কাজ হচ্ছে মেয়েদের দিয়ে উপার্জন করা। তুই কী ভেবেছিলে নিলয় তোকে অনেক ভালোবাসে তাই তোকে সন্দেহ করে কারও সাথে কথা বলতে দেয় না। তাহলে বলব ভুল ভেবেছিস। নিলয় তোর সাথে এমন নাটক করত যাতে করে তুই কারও সাথে যোগাযোগ করতে না পারিস। কিন্তু নিলয়ের সাথে কথা ছিল তোর সাথে ছয় মাস থেকে তোকে আমার হাতে তুলে দেবে। তাই ছয় মাস পরে তোকে আমার বাসায় নিয়ে আসে। তোকে দেখেই নিলয়ের উপর রাগ হয়েছিল। কারণ নিলয় তোর এমন হাল করেছিল যে তোকে বেঁচার মতো অবস্থা ছিল না।

আর তখন যদি তোকে এসব বলতাম তুই কখনো নিজে থেকে সব করতে চাইতি না। খাওয়া দাওয়া না করে আরও শুকাইতি। তাই এ নাটক করে তোরে নাদুসনুদুস বানিয়ে নিয়েছি। এক খদ্দের তোকে পছন্দ করেছে সে বিদেশ থেকে আসবে আরও একমাস পর, তাই তোকে এতদিন পুষে রাখতেছি। আমার কথা মতো কাজ করলে মজাও পাবি টাকাও পাবি। আমার কথার বাইরে গেলেই একদম হাড়গুড় ভেঙ্গে দেব।

মহিলার কথা শুনে আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
~ আমি তো আপনার মেয়ের মত আমাকে যা ইচ্ছা করুন তবে শরীরের ব্যবস্যায় নামাবেন না। আমি এসব পারব না।
কিন্তু শয়তান মহিলাটা হাসতে হাসতে বলল,
~ তোর মত কত মেয়েই আমার কাছে একেই কথা বলেছে হিসাব নেই। তাদের যখন ব্যবস্যায় নামিয়েছি তারাও এখন দিব্যি রোজগার করছে। একবার নেমে গেলে দেখবি মজা আর মজা। টাকা আর টাকা।

এসব কথা শুনার পর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার মতো রুচি জাগল না। বুঝে গিয়েছিলাম হাজার কাঁদলেও মহিলা আমার কথা শুনবে না। চুপ করে আমার রুমে চলে আসলাম। কলিজাটা ফেটে যাচ্ছিল। একটা মায়ের বয়সী মহিলা যে কিনা মা, মা করত সে মহিলার এত নোংরা রুপ হতে পারে ভাবনার বাইরে ছিল। মানুষের মুখের আড়ালে যে এত মুখোশ থাকে সেটা চেনা বড় দায়।
“পৃথিবীটা কত বৈচিত্র্যময়। এখানে শত শত মুখোশের আড়ালে মানুষবেশে শত শত অমানুষের বাস।”

সেদিন রাতটা আমার কাঁদতে কাঁদতে গেল। সকালে উঠেই খালা খাবার এনে বলল,
~ আরও এক মাস কষ্ট করে তোকে পুষতে হবে। নাহয় পাঁচ লাখ টাকা হাতছাড়া হবে। এই নে এ খাবার গুলো গিল।

এ বলে খাবার গুলো ফিকা মেরে বিছানার উপর রেখে গেল। আমিও গপগপ করে খাবারগুলো খেয়ে নিলাম। সেদিন খেতে পারলেও পরে আর খাবার গলা দিয়ে নামে নি। সারাদিন শুধু চিন্তা করতাম কীভাবে এখান থেকে বের হব। কিন্তু বের হওয়ার কোন রাস্তা ছিল না। দুই একবার পালাতে নিয়েও ব্যর্থ হয়েছি। একমাস পর খেয়াল করলাম একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে মহিলার সাথে কী কথা যেন বলছে। মহিলা লোকটাকে আমার ঘরে নিয়ে এসে বলল,
~ এই যে আপনার মাল। আপনি যখন খুশি নিয়ে যেতে পারেন। টাকা দিলে এখনেই নিয়ে যেতে পারবেন। তবে দামটা একটু বেশি আগেই বলেছি।

খেয়াল করলাম লোকটা আমার দিকে নোংরা নজরে তাকাচ্ছে। একজন বাবার বয়সী লোকের এরকম লোভী চাহুনির সাথে আগে পরিচিত ছিলাম না। লোকটার চাহুনি দেখে লোকটার প্রতি একটা ঘৃনা জন্মে গেল। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ দেখে বলল,
~ আমি মাল আজকেই নিতে চাই। কত টাকা দিব বলেন?
~ এর জন্য পাঁচ লাখ টাকা দিলেও কম হবে। তবে পাঁচ লাখে কথা হয়েছে তাই আর বাড়ালাম না।

~ এজন্যই তো আপনাকে আমি এত পছন্দ করি।
এ বলে বিদঘুটে হাসি দিয়ে লোকটা টাকার চেকে স্বাক্ষর করে মহিলার হাতে দিল। আর মহিলাটা বাবু আপনি সত্যিই লক্ষী এ বলে চেঁচাতে লাগল। তারপর লোকটা আর শয়তান মহিলাটা রুম থেকে বের হয়ে গেল। আর নিলয় আমাকে ধরে বলল,
~ চল তোকে দিয়ে আসি। আর কাজ সুন্দর করে করবি। কোন অভিযোগ আসলে খবর আছে।

আমি নিলয়ের পায়ে ধরে বললাম,
~ আমার সাথে এমন করো না। আমি তো তোমার স্ত্রী। কাজী এসে আমাদের বিয়ে পড়িয়েছে। তুমি আমাকে মারো, কাটো যা ইচ্ছা করো তু্বুও আমাকে এভাবে অন্যের হাতে নষ্ট হতে দিও না। নিজের বউকে এভাবে অসম্মান করো না।

আমার একথা শুনে নিলয় আমার চুলগুলো ধরে বলল,
~ তোকে পুষে আমার কি লাভ বল? তোকে বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছি। আর বাকি রইল বিয়ের কথা। যে কাজীর কথা বললি সে কাজীও আমার দলের লোক। আমার কাজেই মেয়েদের তুলে এনে এভাবে জোর করে বিয়ে করে ফাঁসিয়ে দেওয়া। তোর মত আরও ত্রিশ, চল্লিশটা মেয়েকে বিয়ে করেছি তাদের জন্য মায়া হয় নি আর তুই আসছিস ন্যাকা কান্না নিয়ে। একদম যদি কেঁদেছিস তোকে শেষ করে দিব। লোকটার সাথে যাবি, যা করতে বলে করবি। যদি কোন ঝামেলা করেছিস তোকে ঐখানেই পচিয়ে মারব।

এ বলে নিলয় আমাকে নিতে চাইল। কিন্তু আমি মেঝেতে শক্ত করে চেপে রইলাম। নিলয় ও আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিতে পারছিল না। আমার সাথে জোর খাটিয়ে না পেরে নিলয় শয়তান মহিলাকে ডাক দিল। শয়তান মহিলা এসে বলল,
~ এ মেয়ের সাথে পারছিস না কেমন পুরুষ হয়েছিস।

এ বলে শয়তান মহিলাও আমাকে টানতে লাগল। কিন্তু আমি মেঝেতে শক্ত করে চেপে শুয়ে রইলাম। কেউ টেনেও পারছিল না। শয়তান মহিলাটা বলে উঠল~
~ ঐ রুম থেকে সিরিন্জ নিয়া আয়। এ মাইয়ারে ইনজেকশন না দিলে, নেয়া যাবে না। খাওয়ায়ে দাওয়ায়ে এ মাইয়ার শক্তি বাড়াইয়া দিছি।
নিলয় মুখোশধারী মহিলার কথা শুনে পাশের রুম থেকে ইনজেকশন আনতে গেল। আর এদিকে মহিলাটা আমার চুল ধরে টানতে লাগল। মহিলাটা অসভ্য ভাষায় গালি দিতে লাগল। সবসময় জানতাম মহিলারা মায়ের জাত হয়। আর সে মায়ের জাত ও এতটা নীচু হয় টাকার জন্য সে মহিলাকে না দেখে বুঝতাম না। অতঃপর নিলয় ইনজেকশন এনে বলল,
~ ইনজেকশন এনেছি।

মহিলাটা আমার চুল টানতে টানতে বলল,
~ মাইয়ার হাতটা ঠিক করে ধর। আমি ইনজেকশন দিচ্ছি।

তারপর দুজন মিলে আমাকে জোর করে ধরে ইনজেকশনটা দিল। ইনজেকশনটা দেওয়ার পর শরীরের সব শক্তি যেন নিমেষে চলে যেতে লাগল। মাথাটা চক্কর দিতে লাগল। তারপর কী হল বুঝতে পারি নি। হুট করে আমার মাথাটা হালকা ব্যাথা করতে লাগল। ব্যাথায় চোখটা মেলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবুও জোর করে চোখ মেলে চারপাশ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমি একটা নতুন রুমে শুয়ে আছি। আমি সমস্ত শক্তি খাটিয়ে চোখটা তাকিয়ে দেখলাম সেই বাবার বয়সী লোকটা অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় বসে সিগারেট টেনে ধোঁয়া উড়াচ্ছে। আর আমি বউ সাজে শুয়ে আছি।

আমাকে বউ সাজানো হলো কখন বুঝতে পারছিলাম না। হয়ত জ্ঞান চলে যাওয়ার পর খবিশ মহিলাটা আমাকে এভাবে সাজিয়ে পাঠিয়েছে। আমি ভয়ে শুয়া থেকে উঠে বসে পড়লাম। লোকটা আমাকে বসতে দেখেই সিগারেটটা নীচে ফেলে আমার কাছে বসে বলল,
~তোমার ঘুম ভাঙ্গার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

পর্ব ১০

এ বলে লোকটা আমার দিকে লোভী চোখে তাকাল। লোকটার চাহুনি দেখে ভয় পেয়ে বিছানা থেকে উঠে দূরে যেতে চাইলাম। কিন্তু লোকটা আমার হাত টা তার বুকে নিয়ে চাপ দিয়ে ধরে বলল,
~ কোথায় যাচ্ছ? আমাকে ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তোমাকে কিছুই করব না শুধু আদর করব। আমাকে খুশি করলে তোমারেই লাভ। যা চাইবে তা পাবে। এত টাকা দিয়ে কী করব আমি। একা জীবন আমার। এ একা জীবনটাকে একটু ভালোবেসে সুন্দর করে দাও।

লোকটার কথা শুনে ঘৃনায় বুক ভরে গেল। আমি লোকটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
~ আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি এসব কাজ করতে পারব না। আমাকে জোর করে আপনার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আমি আপনার মেয়ের বয়সী। নিজের মেয়ে মনে করে ছেড়ে দিন।
এ বলে আমি লোকটার থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য দূরে যেতে নিলাম। কিন্তু লোকটা আমার হাতটা ধরে টানতে টানতে বলল,
~ আমি তোমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছি সেটা কি এমনি এমনি। ওরা পাঁচ লাখ পেয়েছে তুমি আমাকে খুশি করলে তোমাকে এক লাখ দিব। আসো সুন্দরী আমার কাছে আসো।

এ বলে লোকটা আমার এসে ঝাঁপটে ধরে আমার উপর সমস্ত শক্তি খাটাতে লাগল। আমিও আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললাম,
~ আমার কোন টাকার দরকার নেই। আপনি আমাকে ছেড়ে দিন। আমি এসবে জড়াতে চাই না।

লোকটা একটা বিকট হাসি দিয়ে বলল,
~ এর আগে অনেক মেয়েকে কিনেছি সবাই একই কথা বলেছে। কিন্তু জোর করে করার পর সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। একবার আসো, করলেই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এ লাইনে নতুন তাই এমন বলছো। পুরাতন হলে দেখবে এগুলো কিছু না। আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দিব।

বলেই লোকটা আমার উপর আসতে নিল। আমি আমার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পুনরায় উনাকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিলাম। উনি তাতে আরও ক্ষেপে গিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল। নিজেকে বাঁচানোর জন্য বিছানা থেকে নীচে চলে গেলাম।

উনি আরও হিংস্র হয়ে আমার কাছে আসতে লাগল। আমি ঘরের দরজা খুলে ডাইনিং রুমে দৌঁড়ে চলে গেলাম।
লোকটাও আমার পেছন পেছন আসতে নিল। আমিও আর নিজেকে রক্ষা করতে পারছিলাম না। মনে হলো এ জীবনে যাওয়ার আগে মরে যাওয়া ভালো। তবে এ পশুর হাত থেকে মরার আগে নিজেকে বাঁচাতে পারব তো সে চিন্তায় করছিলাম। তারপর
এ বলে তুলি জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। অপরদিকে তুলির কাহিনী শুনে অরন্যের চোখে অশ্রুজল চিকচিক করতে লাগল। অরন্য তুলির দিকে তাকিয়ে বলল,
~চুপ হয়ে গেলেন কেন?

তুলি আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। অরন্য তুলির কান্না দেখে হালকা ঝাড়ি দিয়ে বলল,
~কান্না করলে বুঝব কীভাবে কী হয়েছে?

তুলি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
~ তখন আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না।
আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলাম যাতে করে লোকটাকে আঘাত করে নিজেকে বাঁচাতে পারি। কিন্তু তেমন কিছুই পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ টেবিলের উপর ফল কাটার ছুরি দেখলাম। সেটা নিয়ে উনাকে বললাম,
~ আমার কাছে আসলে একদম খুন করে দিব।

লোকটা হেসে হেসে বলল,
~তুমি আমাকে খুন করতে পারবে না। অহেতুক ভয় দেখাবে না। কাছে আসো আমার। মামনি ছুরিটা ফেলে দাও।
পুনরায় লোকটা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে নিল। অপরদিকে লোকটার মুখে মামনি ডাক শুনে আমার শরীরটা আরও জ্বলে গিয়েছিল।

মামনি ডেকে একটা মেয়ের সম্মান কেড়ে নিতে চাচ্ছে ছিঃ। ঘৃনায় আমার হিতাহিত বুদ্ধি লোপ পেল। আমি কী করব বুঝতে না পেরে ছুরিটা লোকটার পেটে ঢুকিয়ে দিলাম। আর লোকটা সাথে সাথে নীচে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগল। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম খুব। এভাবে কাউকে খুন করতে হবে কখনো ভাবি নি। তবে লোকটা মারা যাওয়ার সময় ঐ মহিলাকে কল দিয়েছিল।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম এ বাসায় থাকাটা আমার জন্য বিপদজনক হয়ে যাবে। তাই ছুরিটা লোকটার পেট থেকে বের করে শাড়ির নীচে লুকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। বাসা থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর কিছু লোক আমার পিছু নিল। আমি সাথে সাথে দৌঁড়ে লুকানোর চেষ্টা করলাম।

লুকিয়ে লোকগুলাকে ফাঁকি দিয়ে ঐ ব্রিজের কাছে আসলাম। খুন করে এসেছি তাই বাসায় যেতে পারছিলাম না। অপরদিকে পুলিশের কাছেও যেতে পারছিলাম না। কারণ তারা আমাকেই প্রহার করবে এটাই মনে হয়েছিল। কোন কিছু উপায় না পেয়ে ব্রিজের দিকে তাকিয়ে রইলাম কতক্ষণ। তারপর মনে হলো এ পাপী জীবনে যাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভলো। এজন্য ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিতে নিলাম।

এর মধ্যেই আপনি আসলেন। আর বাকি কাহীনি তো জানেন। সেদিন এত অবিশ্বাসের ভিড়ে আপনাকে খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল। বেশ দুটানায় পড়ে গিয়েছিলাম আপনার সাথে আসব কিনা এটা ভেবে। পরে চিন্তা করলাম আপনিও যদি এমন কিছু করেন ছুরি তো আছেই আপনাকেও শেষ করে দিব। এ ভেবে আপনার সাথে আপনার বাসায় আসি। আর দুমাস আপনার বাসায় কাটাই।

অরন্য তুলির কথা শুনার পর একটু অশ্রুজল অরন্যের চোখের কোণায় আসলেও মুখের হাসি দিয়ে তা নিবারণ করে বলল,
~ তার মানে আপনি একটা মার্ডার করেছেন?

তুলি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
~ হ্যাঁ। তবে সেটা আমি পরিস্থিতির শিকার হয়ে করেছি। নিজের সম্মানটাকে বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে।

অরন্য দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বলল,
~ আচ্ছা মার্ডার করার পর আপনার অনুভূতি কেমন ছিল জানতে পারি কি? জীবনে এ প্রথম কোন মার্ডার করা আসামির সামনে বসে আছি। আমার খুব শখ ছিল একজন মার্ডার করা আসামিকে সামনাসামনি দেখব। বন্ধুত্ব করব। আজকে সে ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছে। আমার তো বেশ ভালোই লাগছে।

তুলি ভালোই বুঝতে পেরেছিল অরন্য তার সাথে এ বিষয়টা নিয়েও মজা করছে। এ দুমাসে অরন্যকে একটু হলেও চিনেছে সে। বড্ড খামখেয়ালে ছেলে অরন্য। তাই তুলি ছুরিটা বের করে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
~ দেখুন আমি এখনও মানুষ চিনতে ভুল করতে পারি। মানুষের বাইরে আপনি যে কোন অমানুষ না তার তো প্রমাণ নেই।

অরন্য ছুরিটা লক্ষ্য করে বলল,
~ ঐরকম কিছু হলে হাতে তো ছুরি আছেই আমাকে মার্ডার করে দিয়েন। একটা করতে পারছেন আরেকটা করলে সমস্যা হবে না। আসার পর থেকেই ঐটা নিয়েই ঘুরছেন। এ ছুরিটা দেখে কেন জানি একটা ভাব আসছে শরীরটায়। কি পাওয়ার এ ছুরির, একটা মানুষ মেরে ফেলল। দোষটা তো আপনার না। দোষটা ছুরির। কারণ মেরেছে তো ছুরি। আপনি শুধু ছুরিটা ধরেছিলেন এই যাহ
অরন্যের এরকম খামখেয়ালে কথা শুনে তুলি রেগে গিয়ে বলল,
~ থামবেন আপনি?

~ আচ্ছা থামলাম। তবে আপনি কি কফি বানাতে পারেন?
কর্কশ গলার তুলি বলল
~ না, আমি কোন রান্না পারি না।

অরন্য হাসতে হাসতে বলল,
~ আমি রেসিপিটা শিখিয়ে দিচ্ছি। সমপরিমাণ পানি, কফি আর চিনি নিয়ে কাটা চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে ফোম বানিয়ে নিবেন। তারপর দুধের উপর ঢেলে গুলিয়ে খেয়ে ফেলবেন।
তুলি রাগী চোখে অরন্যের দিকে তাকাল। অরন্য তুলির রাগী চোখ দেখে দুহাত তুলে বলল,
~ আরে রেসিপিটা বলেছি তার মানে এই না যে আপনাকে এখনেই বানিয়ে খাওয়াতে হবে। আপনি পরের বার বানাবেন। আজকে আমিই বানাব।

এ বলে অরন্য টেবিল থেকে একটা ডায়রি তুলির দিকে এগিয়ে বলল,
~ এই ডায়রিটা পড়ুন।
তুলি কৌতুহল চোখে অরন্যকে বলল
~ এটা কার ডায়রি?

~ ডায়রির উপরে নাম লিখা আছে দেখুন।
তুলি ডায়রির উপরে খেয়াল করে দেখল ~ সাবিহা জন্নাত নিরা লিখা। তুলি ডায়রিটার উপরের নামটা পড়ে বলল,
~ এটা তো কোন মেয়ের ডায়রি?
~ হ্যাঁ। তাইতো পড়তে দিয়েছি।

~ ঐ মেয়ের অনুমতি ছাড়া আমি কেন ঐ মেয়ের ডায়রি পড়ব।
~ ঐ মেয়ের অনুমতি নেওয়া আছে।
~ এটা কি আপনার বউ এর ডায়রি।

~ নাহ। আমার বউ এর নাম তো রূপা ছিল। আর এ মেয়ের নাম নিরা।
তুলি সন্দেহ চোখে তাকিয়ে বলল,
~ তাহলে কি এটা আপনার কোন প্রেমিকার ডায়রি?
~ আপনি পারেনও কথা প্যাঁচাতে। আপনি ডায়রিটা পড়ুন আগে। আমি এর মধ্যে কফিটা বানিয়ে নিয়ে আসছি।

অরন্য এ বলে রুম থকে প্রস্থান নিল। আর তুলি ডায়রিটা খুলে খেয়াল করল ডায়রিটার প্রথম পৃষ্ঠায় কোন লিখা নেই। তারপর কয়েক পৃষ্ঠায় লিখা না পেয়ে তুলি ভাবল, অরন্য হয়তো ইচ্ছা করে তুলির সাথে মজা করেছে। তুলি রাগে ডায়রিটা বিছানায় ছুরে মারার সাথে সাথে একটা মেয়ের ছবি বের হয়ে আসলো। তুলি ডায়রিটা আবার হাতে নিয়ে মেয়ের ছবিটা ভালো করে দেখল। তুলি বুঝতে পারল এ ডায়রিটার মালিক এ ছবির মেয়েটা। ডায়রিটা পুনরায় খুলে দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে খেয়াল করল কয়েক পৃষ্ঠা পর একটা কাহীনি লিখা ছিল। কাহিনীটার প্রথম টুকু পড়ে তুলির বেশ আগ্রহ জাগল ডায়রিটা পুরোটা পড়ার। তাই পুনরায় তুলি ডায়রিটা পড়তে লাগল। কাহীনিটা হলো

পর্ব ১১

আজকে আমার পাকা দেখা। এ নিয়ে মোট তেরো বার আমাকে পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছে। আর প্রতিবারেই ঠিক একটা করণে বিয়েটা ভেঙ্গে গিয়েছে। বিয়ে ভাঙ্গার বিষয়টা প্রথম প্রথম অস্বাভাবিক লাগলেও এখন অতি স্বাভাবিক মনে হয়। কারণ কোনকিছুর পর্যায়ক্রমিক অভ্যাস মানুষকে সে বিষয়টার প্রতি স্বাভাবিক করে তোলে।

প্রতিবারের মত আজকেও নিজেকে প্রস্তুত করছি পাত্র পক্ষের সামনে যাওয়ার জন্য আর আমি এটা নিশ্চিত যে পাত্রপক্ষ আমাকে দেখার পর সে কাঙ্ক্ষিত ফলাফলেই জুটবে।
বিয়ে ভাঙ্গার কারণ বলার আগে আমি আমার পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমি সাবিহা জান্নাত নিরা। অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করে বেকার জীবনযাপন করছি। আমার মা এবং বাবাকে এ শহরে বাস। স্বাভাবিকভাবে মেয়েদের যে গুণ গুলো থাকা দরকার সবকিছুই আমার মধ্যে আছে।

তার মধ্যে সেলাই কাজ, রান্না, সুতার কাজটাও রপ্ত করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার এসব গুণ গুলো চাপা পড়ে গিয়েছে আমার শরীরের রঙয়ের কাছে। প্রথম প্রথম কয়েকবার বিয়ে ভাঙ্গা নিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তবে এখন আর সেটা লাগে না। ঐ যে বললাম পর্যায়ক্রমিক অভ্যাস।
বিয়েতে বাতিল হয়ে যাওয়ার কিছু কাহীনি বলি তাহলে। প্রথম আমাকে দেখতে এসেছিল আমার বাসায়। ছেলে সরকরি চাকুরি করে। অনেক আশা নিয়েই তাদের সামনে গিয়েছিলাম। আমাকে ছেলে প্রথম দেখেই বলল,
~ আপনি পড়াশুনা শেষ করে চাকুরি করছেন না কেন?

~ মন মতো চাকুরি জুটছে না। (উত্তরে আমি)
ছেলেটা সরাসরি মুখের উপর বলে দিল~
~ গায়ের এরকম রঙ দেখেই বুঝা যাচ্ছে আপনার চাকুরি করার যোগ্যতা নেই।

সেদিন আমার অনেক কষ্ট হলেও পাত্র পক্ষের সামনে মুচকি হেসেছিলাম। তারপর পাত্র পক্ষ কল দিয়ে বলল আমার নাকি যোগ্যতা নেই, তাই তারা বাদ দিয়েছে আমাকে। আমার গায়ের রঙ কালো ছিল তবে আমি যোগ্য না এটা শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সেদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই কতক্ষণ কেঁদেছিলাম জানি না।
পরের বার দেখতে আসলো যে পাত্র সে পাত্রের ও নিজের একটা মস্ত বড় ভূড়ি আর গায়ের রঙ কালো ছিল। সে পাত্র এসেও প্রথম বলল,
~আমি একটা ফর্সা সুন্দর মেয়ে খুঁজছিলাম, আপনি বেশ কালো। যোগ্যতাও নেই তেমন।

লোকটার মুখে এমন কথা শুনে সেদিন আর চুপ থাকি নি। লোকটাকে মুখের উপর বললাম,
~ আপনি আমার গায়ের রঙ দেখেই বুঝে ফেললেন আমার যোগ্যতা নেই। আপনার আমাকে পছন্দ না সরাসরি বলে ফেলুন তবে যোগ্যতা নেই এ কথাটা কেন বললেন? আর আপনি নিজেও কালো তাহলে আমাকে কালো বলার আগে একটু ভেবে বলা দরকার ছিল না?
পাত্র মুখের উপর আমাকে বলে দিল~
~ ছেলেরা কালো হলে কিছু যায় আসে না। কারণ ছেলেরা সমাজের সিংহ।

এবলে লোকটা চলে গেল। আর আমার পরিবারকে কল দিয়ে বলল এরকম কালো মেয়ে তাদের পরিবারের বউ হওয়ার যোগ্য না। আমি কথা গুলো শুনে ভাবতে লাগলাম এ কেমন সমাজ ব্যবস্থা? একটা মেয়ের গায়ের রঙ কালো হলে সমস্যা। আর একটা ছেলের গায়ের রঙ কালো হলেও সে সমাজের সিংহ।
পরেরবার আবার দেখতে আসলো। পাত্র আমাকে দেখে বলল,
~ সত্যি বলতে আমি পরীর মত সুন্দর বউ চাই। বউরা একটু সুন্দর হওয়া লাগে।

হালকা ব্যাঙ্গ হাসি দিয়ে বললাম,
~ কেন বউকে দিয়ে কি মডেলিং করাবেন? আমি জানতাম মডেলরা সুন্দর হওয়া লাগে। এটা জানতাম না যে বউদের সুন্দর হওয়া বাঞ্চনীয়।
লোকটা কথার জাবাব না দিয়ে চলে গেল। হয়তো লোকটার কাছে এর উত্তর ছিল না।

আর একবার এক পাত্রের কাহীনি দেখে খুব হেসেছিলাম। সেদিন পাত্রের সাথে আমার রেস্টুরেন্টে দেখা করার কথা ছিল। আমি পাত্রের আগে রেস্টুরেন্টে পৌঁছালাম। পাত্র আমাকে দেখে দৌঁড়ে পালাল। এটা দেখে হাসতে হাসতে বাসায় আসার পর মা জিজ্ঞেস করল,
~ কিরে পাত্রের সাথে কথা হয়েছে?
অট্ট হেসে বললাম,
~ পাত্র আমাকে রেস্টুরেন্টে দেখতে গিয়ে পেত্নী ভেবে চলে গিয়েছে। কথা বলার সুযোগ পাই নি।

~ কি বলছিস? একটু গুছিয়ে বল হেয়ালি রেখে।
বুকে কষ্ট চেপে মুখে এক বিন্দু মিথ্যা হাসি নিয়ে বললাম,
~ পাত্র আমাকে দেখে কোন কথা না বলেই চলে গিয়েছে। মেনে নিলাম আমাকে পছন্দ হয় নি। তার মানে এই না যে আমাকে রেখে চলে যেতে হবে। আমি তো জোর করে ধরে উনাকে বিয়ে করতাম না। মা এবার আমাকে ক্ষমা করো। আর পাত্রের কাছে গিয়ে নিজেকে ছোট করতে পারব না। আত্নসম্মানে আঘাত লাগে খুব।

মা আমার মাথায় ধাক্কা দিয়ে বলল,
~ পড়াশুনা শেষ করে তো বেকার বসে আছিস। তোকে ঘরে পালব নাকি। একটা চাকুরি করলে নাহয় মেনে নিতাম। তাও তো জুটাতে পারিস না। রিটেনে টিকিস ভাইবা তে গেলেই বাদ পরিস, এর মানে বুঝলাম না। ভাইবাতে গিয়ে কী কিছু বলতে পারিস না নাকি?
পুনরায় অট্ট হেসে মাকে বললাম,
~ ভাইবাতে তো আমাকে প্রশ্নই করে না।

ভাইবাতে আমাকে দেখে বলে আমাদের এ পদের জন্য একটা স্মার্ট মেয়ে দরকার। অথচ যেসব মেয়েরা সিলেক্ট হয় তারা আমার থেকেও অযোগ্য। শুধু মাত্র আমার চামড়ার জন্য আমাকে বাদ পড়তে হয়। সেখানে কেউ আমার যোগ্যতা দেখে না মা। সেখানে সবাই আমার চেহারা দেখেই বলে ফেলতে পারে আমি সে কাজটা করতে পারব না। সত্যি বলতে এরকম কালো হওয়ার পেছনে আমার দোষটা কোথায় বলতে পারবে?
মা আমার কথা শুনে জবাব না দিয়েই চলে গেল। আর এদিকে আমি ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে যাচ্ছিলাম, আবার নিজেকে গড়ে নিচ্ছিলাম।

অনার্সে উঠার পর একটা প্রেমও হয়েছিল। সে প্রমটা দুই মাসের উপর টিকে নি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ছেলেটা আমাকে ভালোবাসে না। কারণ রিলেশনের এক মাস পর থেকে শুধু শারিরীক সম্পর্কের জন্য বলত। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম ছেলেটা আমাকে বিকৃতভাবে পাওয়ার জন্য আমার সাথে প্রেমের নাটক করছে। তাই শারিরীক সম্পর্ক করতে রাজি হয় নি। আর এজন্য আমার বি এফ আমাকে কালো বলে ব্রেক আপ করে দিল।

কয়েকদিন পর দেখলাম একটা সুন্দর মেয়ে নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার সেদিন কী যে কষ্ট হয়েছিল বলার ভাষা নেই।
অথচ ছেলেটাকে মনে প্রাণে অনেক ভালোবেসেছিলাম। এভাবেই বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দিয়েই আমি আমার জীবনের এতটা বছর পার করেছি। যাইহোক এবার কাহীনিতে আসা যাক। পাত্র পক্ষ আসলো আমাকে দেখতে। মা আমাকে ডাক দিয়ে হাতে শরবতের গ্লাস ধরিয়ে বলল,
~যা মা ওদের সামনে যা।

মায়ের কথা শুনে শরবতটা নিয়ে যখনই যেতে নিলাম ঠিক তখনেই মা আমাকে ডেকে তার কাপড়ের আঁচল দিয়ে আমার চোখ থেকে কাজল মুছতে লাগল। আমি মাকে এরকম করতে দেখে বললাম,
~ মা তুমি কাজল মুছতেছ কেন?

মা রাগ রাগ গলায় জাবাব দিল~
~ এমনেই গায়ের রঙ কালো। তার মধ্যে কাজল আরও কালো। কাজলটা মুছলে একটু ফর্সা লাগবে।
অসহায় গলায় মাকে বললাম,
~ মা কাজল পড়তে আমার ভালো লাগে মুছো না দয়াকরে।

মা আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল,
~ ভালো লাগলেও আজকে পড়া যাবে না। কাজল ফর্সা মেয়েদের জন্য কালোদের জন্য না।

আমি আর কিছু বললাম না। মা কাজলটা ভালো করে মুছে, হাতে এক গাদা পাউডার নিয়ে আমার মুখে দিয়ে বলল,
~ এবার যা। এবার তোকে একটু ফর্সা লাগছে।

অতঃপর হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে পাত্র পক্ষের সামনে গেলাম

পর্ব ১২

পাত্র পক্ষের সামনে গিয়ে আমার প্রথমেই চোখ গেল পাত্রের দিকে। পাত্রকে দেখে আমি ভেবেই নিয়েছি এ জায়গায় আমার বিয়ে হবে না। কারণ পাত্র দেখতে অনেক সুন্দর ছিল। আর এত সুন্দর ছেলে আমাকে বিয়ে করবে সেটা সম্ভব না। শরবতটা টেবিলে রেখে আমি পাশেই দাঁড়ালাম। পাত্রের পাশে থাকা মহিলাটা আমাকে বলল,
~ তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? এখানে বসো।

আমি মহিলার কথা শুনে আমার পাশেই খালি সোফাটায় বসলাম। আমি বসার পর ভদ্র মহিলাটা আমাকে ভালো করে দেখে জিজ্ঞেস করল,
~ তোমার নাম কি?

~ সাবিহা জান্নাত নিরা।
~ তোমার ভাইবোন কয়জন?
~ আমি একাই।

~ তোমার বাবা কি করে?
~ ছোটখাটো ব্যবস্যা করে।
~ তেমার চাচা ফুফুরা কতজন?

~ দুই চাচা, এক ফুপি।
~ চাচা বড় নাকি ফুপি বড়?
~ আমার চাচা বড় ফুপি ছোট।

~ তোমার মামা খালারা কতজন?
মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম উনার এরকম প্রশ্নে। মনে হচ্ছে আমার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়বে এ মহিলা। আমি বিরক্তিটা ভিতরে ভিতরে রেখে বললাম,
~ মামা সবার বড় তারপর আমার মা তারপর আমার ছোট খালা।
~ কিসে পড়তেছ?

~ সাইকোলজিতে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি।
~ ঘরের সব কাজ পার?
~ হ্যাঁ।
~ রান্না পার?
~ হ্যাঁ।

তারপর ভদ্র মহিলা আমার বাবাকে বললেন~
~ আমার যা জানার জেনে নিয়েছি। একটু ছেলে মেয়েকে আলাদা করে কথা বলতে দিন।
আমার বাবা হাসতে হাসতে বলল,
~ হ্যাঁ তা তো অবশ্যই।

তারপর আমাকে আর আগত পাত্রকে একটা রুমে নেওয়া হলো। আর আমি মনে মনে অপমানিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে প্রথম বলল,
~ এত পড়াশুনা করে বসে আছেন যে, চাকুরি করবেন না।
আমি মাথা নীচু করে ছেলেকে জবাব দিলাম
~ সত্যি বলতে ঐরকম মনমতো চাকুরি গায়ের রঙ এর জন্য পাই নি।
~ ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছা আছে?

বিনয়ের সুরে উত্তর দিলাম
~ আপাতত বিয়ে হলে মন দিয়ে সংসার করার ইচ্ছা আছে। আর চাকুরি হলে পাশাপাশি চাকুরি করব।
এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে পাত্র আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আপনার পা টা কি দেখা যাবে। যদি কিছু মনে না করেন?

~ কেন দেখানো যাবে না অবশ্যই দেখানো যাবে। ভাবছেন আমি আরও কালো? (হাসতে হাসতে)
মাথা নীচু করে পাত্র বললেন
~ নাহ মানে ঠিক তা না। মুরব্বিদের কাছে শুনেছি মেয়ে দেখতে গেলে পা দেখতে হয় তাই আর কী। আপনি না দেখাতে চাইলে সমস্যা নেই।

আমি লোকটার কথা শুনে একটু জোরেই হাসি দিয়ে ফেললাম। আর লোকটা আমার হাসি শুনে বেশ লজ্জা পেয়ে জিজ্ঞেস করল,
~ আমি কি ভুল কিছু বলেছি? আমার নানীমা আসার সময় আমাকে একথা বলে দিয়েছে তাই আপনাকে বলা।

আমি হাসতে হাসতে আমার পা দুখানি বের করে লোকটার সামনে গিয়ে বললাম,
~ এই যে আমার পা। আমার পা ও মুখের মত কালো।
মুখে কোন ঘষা মাজা করি নি। পা আর মুখ এক ররম ভালো করে মিলিয়ে নিন।

আগত পাত্র মুখটা গোমড়া করে জবাব দিলেন
~হুম আপনি একটু কালোই।
পাত্রের মুখ দেখেই বুঝে ফেলেছিলাম পাত্রের আমাকে পছন্দ হয় নি। তাই চুপ করে বসে রইলাম। ইতিমধ্যে পাত্র বের হয়ে ড্রইং রুমে চলে গেল।

এরপর তারা কোন মতামত না জানিয়েই চলে গেল। আজকের ছেলেটাকে আমার মনে মনে অনেক পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু আমি জানি এ বিয়েটাও ভেঙ্গে যাবে। চুপচাপ শাড়ি না খুলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম মনে মনে ভাবতে লাগলাম আকাশের মত বিশাল কী কারও মন হতে পারে না। কেউ কী এমন নেই যে, আমার চেহারা না দেখে মন দেখবে।

একটু মুচকি হেসে মনে মনে বললাম এমন মানুষ দুনিয়াতে হয়তো নেই। থাকলেও সে মানুষটার সাথে আমার দেখা মিলবে না। আকাশের বিশালতায় মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতে মন চায়। বিশাল আকাশটা যেমন শূন্যতায় ভুগছে তেমনি আমার মনের আকাশটা এত বিশাল হওয়ার পরও ধুুধু মরভূমির মত খাঁ খাঁ করছে। নিজের গায়ের রঙ নিয়ে কত যে অপমানতি হয়েছি সেটা ভেবে যাচ্ছিলাম। আর মনের অজান্তেই কখন যে কেঁদে ফেললাম খেয়াল নেই।

পরক্ষণেই আমার মা হাঁপাতে হাঁপাতে আমার রুমে আসলো। কান্নার ব্যপারটা আড়াল করার জন্য আমি মাকে দেখেই আমার চোখের জল মুছে ফেললাম। হাঁপাতে হাঁপাতে আমার রুমে এসেই আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম মা কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবার মায়ের মুখে কথাটা আটকে যাচ্ছে। আমি মায়ের বাহু দুটো ধরে মাকে বললাম,
~ কী হয়েছে মা? পানি দিব খেতে?

মা কথা বলতে পারছিল না। হাত দিয়ে শুধু ইশারা করে না করল যে পানি লাগবে না। আমি মাকে ধরে বললাম,
~ কী হয়েছে বলবে তো?

মা দম নিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিল কতক্ষণ তারপর বলল,
~ তোর যে সম্বন্ধ এসেছিল
মায়ের কথাটা কেড়ে নিয়ে বললাম,
~ ভেঙ্গে গিয়েছে তাই তো। কতবার বলেছি মা। এসব ছেলেরা আমাকে পছন্দ করবে না। শুধু শুধু এমন করো।
উচ্চ স্বরে মা বলল,
~ আরে তুই চুপ করবি আমাকে বলতে দে।

~ কী বলবে বলো।
মা আমার হাতটা ধরে বলল,
~ ওদের নাকি তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। ছেলেও নাকি বিয়ে করতে রাজি।

মায়ের কথাটা শুনে মিনিট খানিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মুহুর্তের মধ্যে কোন জগতে চলে গিয়েছিলাম জানি না। কথায় আছে
“অতি আবেগে মানুষ একদম স্তবির হয়ে যায়। সেই স্তবিরতা মানুষকে কিছুক্ষণ স্থির করে রাখে। পরক্ষণে আবার অস্থির করে তুলে তখন সে উচ্ছাসে ভেঙ্গে পড়ে”
আমিও অতি আবেগে স্তবির হয়ে গয়েছিলাম। যখন আমার স্তবিরতা কেটে গেল আমিও অস্থির হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সজোরে একটা কান্না করে উচ্ছাস প্রকাশ করলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
~ তুমি কী মশকরা করতেছ নাকি? এত সুন্দর ছেলে পছন্দ করেছে মানতে পারছি না।

~ তোর সাথে কী আমার মশকরার সম্পর্ক নাকি যে মশকরা করব। সত্যিই একটু আগে পাত্র পক্ষ তোর বাবাকে ফোন দিল। তোর বাবা কল টা পেয়ে আমাকে বলল,
~ কি গো নিরার মা কলটা কি ধরব? আমার তো মনে হচ্ছে না নিরাকে তারা পছন্দ করেছে। কলটা ধরে না শব্দটা শুনতে ইচ্ছা করছে না। তুমি কি বলো কলটা ধরব?
আমিও হতাশ গলায় বললাম,
~ আমারও মনে হয় না এত সুন্দর ছেলের জন্য তারা নিরাকে পছন্দ করবে। কিন্তু ভদ্রতা বলেও একটা কথা আছে। তুমি কলটা ধরে ভালো মন্দ বলে রেখে দাও।

তোর বাবা আমার কথা শুনে কলটা ধরল। কলটা ধরে কথা বলার পর তোর বাবা কলটা কেটে কাঁদতে লাগল। আমি তো ভেবেছিলার তারা না করে দিয়েছে, তাই তোর বাবা কাঁদতেছে। তাই তোর বাবাকে শাত্ত্বণা দেওয়ার জন্য তোর বাবার কাছে গিয় বললাম,
~ যা হবার তা তো হয়েছে তা নিয়ে এত কান্না করার কিছু নেই। নিরার কপালে যা আছে তাই হবে। কেউ না কেউ নিরাকে পছন্দ করবে দেখো। তুমি মন খারাপ করো না।
তোর বাবা আমার হাতটা ধরে বলল,
~ জানো রাবেয়া আজকের কান্নাটা কষ্টের না। আজকের কান্নাটা সুখের। আমাদের নিরাকে পাত্র পক্ষ পছন্দ করেছে।

তোর বাবা যখন একথা বলল আমিও ঠিক কি করব, খুশিতে বুঝে উঠতে পারি নি। দৌঁড়ে তোর রুমে আসলাম~
এ বলে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে পুনরায় বলল,
~ আল্লাহ তোর একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে এতটা খুশি লাগছে বলার ভাষা নাইরে নিরা।

এ বলে মা চলে গেল। আমি আকাশের দিকে তাকালাম আবার। তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম তাহলে কি সে ছেলেটার সন্ধান আমি পেয়েছি। নাকি আমি কোন দিবাস্বপ্ন দেখছি। দেখিতো হাতে একটু চিমটি কেটে। এ বলে নিজের হাতে নিজে চিমটি কাটলাম আর আঃ! করে উঠলাম। নাহ সত্যিই তো ঘটনা।

তাহলে কি আমার স্বপ্নের পুরুষকে আমি পেতে যাচ্ছি। ভেবেই যেন গায়ে ভালোলাগার শিহরণ দিয়ে উঠল। দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। আর আমার চোখে শুধু যেদিকে তাকাচ্ছিলাম উানাকেই দেখছিলাম। সারারাত না ঘুমাতে ঘুমাতে সকালে হালকা ঘুম হলো। কিন্তু সকালে মায়ের চেঁচামেঁচিতে ভয় পেয়ে ঘুম থেকে উঠি। মা যেভাবে চেঁচাচ্ছিল মনে হচ্ছে কিনা কি হয়েছে। আমার মনে হলো তাহলে কি আমার বিয়ে ভেঙে গেল আর এজন্য কী মা চেঁচাচ্ছে?

পর্ব ১৩

আমি বুঝে উঠার আগেই বাবা আমার রুমে এসে জোরে জোরে কেঁদে বলল,
~ ওরা কালকে তোকে আংটি পড়িয়ে দিয়ে যাবে। তোকে নাকি ওদের অনেক পছন্দ হয়েছে তাই বিয়ের কাজ দেড়ি করতে চায় না। অবশেষে আমার মেয়েটাও শ্বশুড় বাড়ি যাবে।
বাবার কথা শুনে বিশ্বাসেই করতে পারছিলাম না যে, কেউ আমাকে বিয়ে করার জন্য এত তারাহুরা করছে। আমি কোন কথা বলতে পারছিলাম না। বাবার মত আমিও কাঁদতে লাগলাম।

বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
~ থাক মা কাঁদিস না। আমি যাই বাজার সদাই করতে হবে। কালকে তোকে আংটি পড়িয়ে যাবে। একটু ভালো মন্দ তো ওদের খাওয়াতে হবে। মা রে এতদিন বিয়ের জন্য শুধু মন খারাপ হত এটা ভেবে যে, কবে তোর বিয়ে হবে। আজকে মন খারাপ হচ্ছে এটা ভেবে যে তুই আমাদের ছেড়ে চলে গেলে এ ঘরটা যে শূন্য হয়ে যাবে মা।

এ বলে বাবা হুহু করে কেঁদে দিল। বাবার কথা শুনে বাবাকে ছেড়ে থাকতে হবে এটা মনে করে আমিও হুহু করে কাঁদতে লাগলাম। বাবা আমার চোখ মুছতে মুছতে বলল,
~ তুই থাক। আমি বাজারে গেলাম। তোর কিছু লাগলে বল।
~ না বাবা কিছু লাগবে না। তুমি তোমার মত করে যা ইচ্ছা নিয়ে আসো।

বাবা পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে বলল,
~ এ টাকা কয়টা দিয়ে একটা ভালো শাড়ি কিনিস। ওদের সামনে গেলে তো একটু গুছিয়ে যেতে হবে। আমার মা টা কে পরীর মত লাগতে হবে।
আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
~ নাহ বাবা তোমার মেয়ে কালো, পরী কেন হবে তোমার মেয়ে তো পেত্নী।

বাবা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল
~ তুই জন্ম নেওয়ার পর থেকে আমি তোর গায়ের রঙ নিয়ে কখনো অসন্তোষ প্রকাশ করি নি। আমার কাছে তুই সবসময় পরীর মত সুন্দরী ছিলি এখনো আছিস। তুই যে আমার রাজকন্যা মা।
আমি বাবার কথা শুনে হেসে দিলাম। সত্যি বলতে একমাত্র এ লোকটা আমাকে কোনোদিন গায়ের রঙ নিয়ে কিছু বলে নি। এ লোকটা সবসময় আমাকে ভালোবাসার চাঁদরে ঢেকে রেখেছে। আমি বাবাকে হাসি মুখে বললাম,
~ রাজা সাহেব এবার আপনি বাজারে যান। নাহয় আপনার রানীসাহেবা যদি দেখে এখনো আমার সাথে বসে আছেন বাড়ি মাথায় করে তুলবে চিল্লাতে চিল্লাতে।
~ আমি গেলাম তাহলে।

বলেই বাবা হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল। আর আমি আমার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী তোরাকে কল দিয়ে আসতে বললাম। তোরার বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে। ওর স্বামী প্রবাসে থাকে। তোরাও স্বামীর সাথেই থাকত। তবে কিছুদিনের জন্য দেশে একাই ঘুরতে এসেছে। কারণ ভাইয়া ছুটি পাই নি। কল দিয়ে খবরটা বলার পর তোরা বলল,
~ অবশেষে আমার বান্ধবীর বিয়ে হচ্ছে। সবসময় দোআ করতাম তুই যেন একটা ভালো বর পাস। আমি দুপুরেই আসতেছি। কি যে খুশি লাগছে নিরু।

তোরার খুশি দেখে হাসতে হাসতে বললাম
~ আরে হয়েছে হয়েছে এত খুশি হতে হবে না। এত খুশি হলে খুশির চুটে অক্কা পাবি। তাড়াতাড়ি আয় তোকে নিয়ে শাড়ি কিনতে যাব।

এ বলে কলটা কেটে বসে বসে তুর্জের কথা ভাবতে লাগলাম। এর মধ্যে মা ডাক দিতে লাগল~
~নিরা কই তুই? হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে আয়। খাবার নিয়ে বসে আছি। তোর খাওয়া শেষ হলে বাকি কাজ করব।

মায়ের ডাক পেয়ে আমি ওয়াশরুমে হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে খেতে বসলাম। মা আমাকে পরোটা দিয়ে বলল,
~ এগুলা সব সবজি দিয়ে খাবি। এ কয়দিন সবজি খাবি তাহলে স্কিন সুন্দর হবে। দেখতে সুন্দর লাগবে।

অট্ট হেসে বললাম
~ কি যে বলো না মা। যে কালো তাকে ঝামা দিয়ে ঘষলেও ফর্সা হবে না। এটা ফেয়ার এন্ড লাভলির এড না যে সাতদিন মেখে ফর্সা হয়ে যাব।
বিরক্ত গলায় মা জবাব দিল
~ তুই এত কথা বলিস কেন? খেতে বলেছি খা।

মায়ের বিরক্ত মুখটা দেখে হালকা হেসে বললাম
~ খাচ্ছিতো। মা দুপুরদিকে তোরা আসবে। বাবা আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে শাড়ি কিনার জন্য। ও আসলে দুপুরের দিকে বের হব।
মা রাগী গলায় বলল,
~ বের হওয়ার কি আর সময় পেলি না। এ ভর দুপুরে বের হলে এমনেই কালো আরও কালো হয়ে যাবি। দুপুরে বের হওয়ার কোন দরকার নেই।

~তুমি পারও বটে। এত রাগ দেখাতে হবে না। তোরা আসলে বিকেলে বের হব এবার ঠিক আছে। আজকে তুমি একটু বেশিই আল্লাদ আর বকবক করছো।
মা আমার বিলাপ জুড়ে দিয়ে বলল
~ আমি যাই করি তা শুনেই তো তোর গায়ে লাগে। আমার কথা তো তোর ভালো লাগে না।

জন্মের পর থেকে মায়ের এ বিলাপ শুনে বড় হয়েছি। বাবা তো মনে হয় বিয়ের পর থেকেই শুনেছে। আমি মাকে কিছু বলতো যাব এমন সময় কলিং বেল এর আওয়াজ আসলো কানে। মা দৌঁড়ে দরজা খুলল। দরজা খুলার সাথে সাথ তোরা কথা শুনতে পেলাম। তোরার কথা শুনে আমি দৌঁড়ে গিয়ে তোরাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
~ তোর না দুপুরে আসার কথা। এত তাড়তাড়ি চলে আসলি যে।
~ তাড়াতাড়ি চলে এসে সমস্যায় ফেলে দিলাম মনে হয়।

~ আরে ধুর কি যে বলিস না। তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
~তোর বিয়ের কথা শুনে আমার ঘরে আর মন টিকল না। তাই চলে আসলাম
পাশ থেকে মা বলে উঠল~
~ এসেছিস ভালো করেছিস। এখন বিয়ের আগ পর্যন্ত থেকে যাবি।

তোরা তার হাতটা পেটে ধরে মাকে বলল
~ আন্টি আগে আমাকে কিছু খেতে দাও। তোমার হাতের রান্না খাব বলে না খেয়েই চলে এসেছি।
~ এই দেখ তোকে খেতে না দিয়েই বকবক করছি। তাড়াতাড়ি আয় পরোটা আছে খেয়ে নে।

তারপর তোরার নাস্তা শেষে দুজন রুমে গিয়ে শুয়ে দুনিয়ার যত আজাইরা গল্প আছে করতে লাগলাম। কথায় আছে
“দুজন মেয়ে মানুষ যদি এক হয় আর তারা যদি বেস্ট ফ্রেন্ড হয়। তাহলে তাদের কথা কোন সুস্থ মানুষ শুনলেও পাগল হয়ে যাবে।”

আমাদের অবস্থাও ঠিক এমন কত কি যে বলছি হিসাব নেই। মোটকথা মুখের নিস্তার নেই। কখন যে সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেল সেই হিসাব নেই। মায়ের ডাকে আমাদের আড্ডার ঘোর কাটল। মা ডাকতে ডাকতে বলল,
~ কিরে আর কত কথা বলবি? এদিকে যে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে সে খেয়াল আছে নাকি। কখন খাবি কখন শপিংয়ে যাবি।

মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বললাম
~ আসছি মা। চিন্তা করো না। চটপট খাওয়া শেষ করে চলে যাব।
তারপর আমি আর তোরা খওয়া শেষ করে শপিং গেলাম। মার্কেট ঘেটে একটা লাল শাড়ি কিনলাম। তবে আমার চোখ, মন পড়েছিল কালো শাড়িতে। জন্মের পর থেকে কালো হওয়ার জন্য কালো কিছু কখনও পড়তে পারি নি।

যাইহোক টুকিটাকি আরও কিছু জিনিস কিনে বাসায় ফিরলাম দুজন। তোরা যেতে চাইলেও তোরাকে জোর করে রেখে দিলাম। সারারাত রাত তোরার সাথে কথা বলতে বলতে পার করলাম। সকালে উঠেই টানা দুই ঘন্টা তোরা আর মা মিলে আমার উপর রুপচর্চার যত টিপস আছে সব প্রয়োগ করল। একটু পরেই পাত্র পক্ষ আসবে আমাকে আংকটি পড়াতে। ভেবেই যেন আমি আনমনা হয়ে গেলাম। তোরা আমার আনমনা হতে দেখে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
~ কিরে এখনেই এ হাল বিয়ের পর কী করবি কি জানি।
~আরে কী যে বলিস না।

এ বলে বেশ লজ্জা পাচ্ছিলাম তোরা আমার লজ্জা মাখা মুখ দেখে বলল,
~ আরে আরে আমার বান্ধবী দেখা যায় লজ্জাও পায়।
~ থামবি তুই।

~ আচ্ছা থেমে গেলাম।
এ বলে তোরা হুট করে নাক শুকে একটা টান দিয়ে বলল
~ ও আন্টি মনে হয় মেজবানি রান্না করতেছে। কি সুঘ্রাণ বের হচ্ছে। আজকে তো আমি কব্জি ডুবিয়ে খাব। আমি যাই আন্টিকে একটু সাহায্য করি।

এবলে তোরা মাকে সাহায্য করতে চলে গেল। আর আমি এদিকে আনমনা হয়ে তার কথা ভাবতে লাগলাম। তাকে ভাবতে ভাবতে ভাবনার জগৎ এ হারিয়ে গেলাম। হঠাৎ তোরার আচমকা আওয়াজে ভয়ে ওওও করে উঠলাম। বুকে থুথু দিয়ে বললাম,
~ কি হয়েছে এভাবে চেঁচিয়ে উঠলি কেন?

তোরা মাথা নাড়তে নাড়তে রহস্যময় মুখ করে বলল,
~ তোর নায়ক তো এসে পড়েছে।
একথাটা শুনে যে কি ভালো লাগছে বলে বুঝাতে পারব না। বিয়ের আগে যে মেয়েরা এত আনমনা হয়ে যায় নিজেকে না দেখলে বুঝতাম না। আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম।

এমন সময় মা এসে তোরাকে বলল,
~ তোরা নিরাকে পাঠা, ওদের সামনে যেতে হবে।
তোরা আমার হাতে একটা শরবরতের ট্রে ধরিয়ে বলল
~ যা এ শরবত দিয়ে জাদু করে আয়।

~ ~তুই আমার সাথে চল।
~ না রে নিরু এক মেয়েকে দেখতে আসলে অন্য মেয়েদের যেতে নেই, মুরব্বিরা না করে তুই একাই যা।
আমি কোন কথা না বলে শরবতের ট্রে টা হাতে নিয়ে পাত্র পক্ষের সামনে গেলাম।
পাত্র পক্ষের সামনে গিয়ে প্রথমেই আমার

পর্ব ১৪

পাত্র পক্ষের সামনে গিয়ে প্রথমেই আমার চোখ গেল তুর্জের দিকে(অহ! নামটা তো বলায় হল না পাত্রের নাম তুর্জ)। এত মায়া তুর্জের মুখে যেকোন মেয়ে তাকে দেখে প্রেমে পড়ে যাবে। আমি শুধু আড়চোখে তুর্জের দিকে তাকিয়ে রইলাম। পাশে থাকা ভদ্রমহিলা আমাকে বলল,
~ কি গো মা শরবতের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে।

ইশ কি করলাম আমি। তু্র্জের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমার হাতে শরবতের ট্রে। কেন যে এত আনমনা হয়ে যাচ্ছি বারবার বুঝতে পারছি না। আমি তুর্জের ভাবনা থেকে নিজেকে বের করে এনে শরবতটা টেবিলের উপর রাখলাম। রেখে আবার দাঁড়িয়ে রইলাম। পাশে থাকা ভদ্রমহিলাটায় আমার হবু শ্বাশুড়ি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার হবু শ্বাশুড়ি আমাকে পুনরায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
~কি গো মেয়ে দাঁড়িয়েই থাকবে নাকি বসবে।

এই বলে তুর্জকে বলল,
~ তুর্জ নিরাকে একটু এদিকে এসে জায়গা করে দে।
তুর্জ আমার হবু শ্বাশুড়ির কথা শুনে মাথাটা একটু উপরে তুলে পাশে জায়গা করে দিয়ে আবার মাথাটা নীচে নামিয়ে ফেলল। আর আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বলল
~
~ এই যে মা তুর্জের পাশে বসো তো।
আমি তুর্জের পাশে বসতে নিলাম। মনে হচ্ছিল আমার সারা শরীর কাঁপতেছে। ভয়ও পাচ্ছিলাম আবার ভালো লাগাও কাজ করছিল। কি যে এক অনুভূতি বলে বর্ণনা করা সম্ভব না। কি যে ভালোলাগা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। উফ! ভাষায় প্রকাশ করার মত না। মনের মধ্যে আবেগের ব্যাপক যুদ্ধ হতে লাগল। আবেগের যুদ্ধে নিজেকে জয়ী করে তুর্জের পাশে বসলাম। আমার হবু শ্বাশুড়ি তুর্জের পাশে বাসার পর বলল,
~ বাহ! দুজনকে তো বেশ মানিয়েছে।

তারপর উনি আমার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন~
~ বেয়াই সাহেব আমাদের তো আপনার মেয়েকে অনেক পছন্দ হয়েছে। তুর্জের বাবা থাকলে উনিই সবটা করত। তবে নিয়তির লিখন তো খন্ডানো যায় না তাই উনি নেই বলে আমাকেই সবটা করতে হচ্ছে। আংকটিটা কি আমি পড়াব নাকি আপনি পড়াবেন।

বাবা হাসতে হাসতে বললেন~
~ একজন পড়ালেই হলো। আমরা আমরাই তো। তবে ছেলেকে দিয়ে পড়ালে কেমন হয়। আপনি সম্মতি দিলে ছেলেই না হয় মেয়েকে আন্টি পড়াক।
~ এ তো উত্তম প্রস্তাব। তাহলে তাই করা হোক।

তারপর আমার শ্বাশুড়ি আংকটিটা তুর্জের হাতে দিয়ে বলল,
~ বাবা তুমি নিরাকে এ আংকটিটা পড়িয়ে দাও।

তুর্জ আংকটিটা হাতে নিয়ে আমাকে পড়াতে নিল। আমার তখন হাত কাঁপতেছিল, বুক টা ধপধপ করতে লাগল। ভালো লাগার একটা অনুভূতি জাগল। আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। আমার কাঁপা হাতটা তুর্জ ধরল। তুর্জের স্পর্শ পেয়ে অনুভূতিরা যেন আকাশে ডানা মেলল। তুর্জ আমার হাতটা আরও কাছে নিল তারপর আমার হাতে আংকটিটা পড়িয়ে দিল।
আংকটি পড়ানোর পর তুর্জের মা বলল,
~ ওদের একটু একান্তে কথা বলতে দেওয়া উচিত।

আমার বাবাও বলল,
~ হ্যাঁ তা তো দেওয়া উচিত।
তারপর আমাকে আর ওকে আলাদা কথা বলতে দেওয়া হল। আমি প্রথমেই রুমে ঢুকে তুর্জের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তারপর তুর্জকে বললাম,
~ আমাকে বিয়ে করতে আপনার আপত্তি নেই তো।
~ আপত্তি কেন থাকবে সেটা বলুন তো।

~ এই যে আমি কালো আপনার তো আপত্তি থাকতেই পারে। বউ মানুষ নাকি সুন্দর হওয়ায় ভালো।
~ সংবিধানের কোথায় লিখা আছে যে বউদের সুন্দর হতে হবে।
তুর্জের কথাটা শুনে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নীচু করে বললাম,
~ তা লিখা নেই। তবে এর আগে আমাকে যারা দেখতে এসেছে তারা বলেছে।

~ সবার চোখে সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটা এক না। আমার কাছে আপনি অনেক সুন্দরী। আপনার গায়ের রঙ আমার কাছে কিছু না। আপনার ঐ চোখ দুটোই আমাকে টেনে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে। আচ্ছা আপনি চোখে কাজল পড়েন নি কেন?
এ প্রথম আমাকে কেউ প্রশংসা করছে। তাই অনেক আবেগী হয়ে বললাম,
~ মা আমাকে কাজল পড়তে দেয় নি। কারণ কাজল পড়লে নাকি আমাকে কালো দেখায় তাই।

তুর্জ আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ বিয়ের পর কাজল কিনে দিলে পড়বেন তো।
আমি খুশিতে আটখানা হয়ে বললাম,
~ পড়ব না কেন? আমার তো কাজল পড়তে অনেক ভালো লাগে। আপনি কিনে দিলে তো খুশি হয়ে পড়ব। আচ্ছা আমার গায়ের রঙ কালো এতে আপনার সমস্যা নেই তো সত্যি করে বলেন।
~ আপনি বড্ড হাস্যকর একটা প্রশ্ন করলেন
~যেমন?

~ এই যে আপনি বললেন আমার সমস্যা আছে কি না। সমস্যা থাকলে কি আর আমি বিয়ে করি। সমস্যা নেই বলেই তো বিয়েতে রাজি হয়েছি।
উনার কথা শুনে মনের অজান্তেই চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু ছলছল করছিল। উনি আমার কাছে এসে বলল,
~ আপনার ঐ চোখে জল মানায় না। কাজল মানায়। শুধু শুধু কাঁদবেন না।

আমি চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম,
~ আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ এভাবে বলে নি। কারও মুখে কখনও এত প্রশংসা শুনে নি। দিনের পর দিন অযোগ্য পাত্রদের হাতেও রিজেক্ট হয়েছি বারবার। এরপর থেকে মনের সব আত্নবিশ্বাস চলে গিয়েছিল। আজকে নতুন করে মনে হচ্ছে সে আত্নবিশ্বাস টা ফিরে পাচ্ছি। আচ্ছা আমাকে নিয়ে আপনি আপনার বন্ধুদের সামনে যেতে পারবেন?
~ অবশ্যই পারব।

উনার সাথে কথা বলে উনার প্রতি তীব্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জন্মাল। কথা শেষে দুজনেই ড্রইং রুমে গেলাম। আমার হবু শ্বাশুড়ি বলল,
~ আপনাদের কোন আপত্তি না থাকলে আমার একটা চাওয়া ছিল।
মা আর বাবা দুজনেই হাসতে হাসতে বললেন~
~ কি চান বলুন। এতে এত সংকোচিত হওয়ার কি আছে।

আমার হবু শ্বাশুড়ি মৃদু একটা হাসি দিয়ে আমার তুতনির নীচে হাত দিয়ে আমার মুখটা উপরে তুলে বলল,
~ আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি চাচ্ছি আগামি শুক্রবারেই নিরার সাথে তুর্জের বিয়ে হোক।
বাবা একটু আপত্তি জানিয়ে বলল,
~ কিন্তু তিনদিন পর বিয়ে হলে এতকিছু সামলানো কষ্ট হয়ে যাবে। আয়োজন তো করতে হবে।

তুর্জের মা বাবার তাকিয়ে অট্ট একটা হাসি দিয়ে বলল,
~ বেয়াই সাহেব আমার এসব অণুষ্ঠান ভালো লাগে না। আমরা খুব সাদাসিধা মানুষ। তাই বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে সাড়তে চাই যদি আপনার কোন দ্বিমত না থাকে।
পাশ থেকে মা হাসতে হাসতে বলল,
~ দ্বিমত থাকবে কেন? আমাদের মেয়ে আপনাদের কাছে গিয়ে সুখে থাকলেই হবে।

আমার শ্বাশুড়ি মাকে ভরসা দিয়ে বললেন~
~ আপনার মেয়ে কি আমার মেয়ে না বেয়াইন? এসব নিয়ে একদম ভাববেন না। তাহলে ঐ কথায় রইল যে আগামি শুক্রবার বিয়ে। এর মধ্যে তো কথা হবেই।

তারপর উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ এই যে নিরা মা কালকে একটু সময় রেখ তুর্জ তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে। তোমার যা যা দরকার মনমত তুমি পছন্দ করে কিনবে কেমন। এই যে এ কাগজে তোমার হবু বরের নম্বর দেওয়া আছে। সময় করে কল দিও ওকে। ও তো একটু লাজুক তোমার নম্বর নিয়েও কল দেওয়ার সাহস পায় নি। তুমিই কল দিও ওকে।
হবু শ্বাশুড়ি মায়ের কথা শুনে বেশ লজ্জামাখা মুখে কাগজটা নিয়ে মাথায় নেড়ে বললাম,
~ আচ্ছা।

তারপর উানারা দুপুরের খাবার খেয়ে চলে গেল। আমি দৌঁড়ে কাগজ হাতে নিয়ে তোরার কাছে আসলাম। তোরার কাছে আসতেই তোরা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ তোর বিয়ে নিয়ে অনেক চিন্তায় ছিলাম দোস্ত। কারণ কেউ তোর ভিতরেরই সৌন্দর্য টা দেখত না। আজকে এমন একটা মানুষের সাথে তোর বিয়ে হচ্ছে যে কিনা তোর ভিতরের সৌন্দর্যটা অণুভব করেছে। দোআ করি অনেক সুখী হ।

এ বলে তোরা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমিও তোরাকে ধরে একটু কাঁদলাম। আমার কান্না দেখে তোরা হাসি দিয়ে বলল,
~ এই যাহ আমি তো কান্নার অভিনয় করছিলাম। আর তুই এতেই কেঁদে দিলি। এমন করলে হবে? কি যে করিস না। তোর হাতে ঐটা কিসের কাগজ দেখি।
লজ্জায় মাথা নত করে বললাম,
~ তুর্জের নম্বর।

~ ওরে আমার বান্ধবী কি লজ্জা পাচ্ছে রে।
এরপর তোরা আর আমি কথা বলতে লাগলাম। কথা বলতে বলতে রাত হয়ে গেল। রাতে তোরা বলল,
~ এবার তো উনাকে কল দে নাকি তুই ও লজ্জা পাচ্ছিস।

আমি সত্যিই লজ্জা পাচ্ছিলাম। প্রথম কল দিয়ে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। আমার দুটানা দেখে তোরা আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে তোরা তুর্জকে কল দিয়ে বলল,
~ বলুন তো আমি কে?
~ আপনি কল দিয়েছেন আমি কি করে বলব আপনি কে?

তোরা তুর্জের সাথে মজা করতে লাগল আর তুর্জ ও বাচ্চাদের মত ক্ষেপতে লাগল। এক পর্যায়ে বেশ ক্ষেপে গেল। তারপর তোরা নিজের পরিচয় দিল। পরিচয় শুনে তুর্জ বেশ লজ্জা পেল। এরপর তোরা বলল,
~এবার আপনার হবু বউ এর সাথে কথা বলুন।
বলেই তোরা আমাকে ধরিয়ে দিল। আমি কথা বলার জন্য এতটা প্রস্তুত ছিলাম না। অপ্রস্তুত হয়েই ফোনটা হাতে নিলাম।

পর্ব ১৫

কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
~হ্যালো।
ও পাশ থেকে উনিও সুমধুর কন্ঠে বলল,
~ হ্যালো, কেমন আছেন?

~~ হ্যাঁ ভালো আছি? আপনি?
~ আমিও ভালো আছি। কি করতেছেন?
~ এই তো বেস্টির সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম আপনি?
~ অফিসের কাজ করছিলাম।

~ অহ! আপনি কিসে চাকুরি করেন সেটা কিন্তু জানতে পারলাম না।
~ না জেনেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন।
~ মা বাবা ঠিক করেছে যেহুত ভালো জায়গায় করেছে।
~ বুঝা যাচ্ছে মা বাবার অনেক বাধ্য মেয়ে।

~ তা একটু বলা যায়।
~ মাল্টিন্যাশনাল একটা কোম্পানিতে চাকুরি করি। ভাবছিলাম আপনাকে কল দিব কিন্তু সাহস পাচ্ছিলাম না। আপনার কল এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যদিও এগারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম যদি না দিতেন তাহলে আমিই কল দিতাম। এর মধ্যে আপনি দিয়ে ফেললেন।

~ ইশ! আগে কল দিয়ে মনে হয় ভুল করে ফেললাম।
~ আরে ভুল করবেন কেন? আপনি কল দিয়েছেন বরং আমার সুবিধা হয়েছে। আপনি কল না দিলে হয়তো এতগুলো কথা বলতে পারতাম না। ঐরকম কোন মেয়ের সাথে কথা বলে অভ্যস্ত না তো তাই।

~ আরে আমি তো মজা করে বলেছি। যাইহোক রাতে খেয়েছেন?
~ নাহ এখনও খাই নি। আপনি খেয়েছেন?
~ হ্যাঁ খেয়েছি। অনেক রাত তো হলো খেয়ে নিন।
~ হুম খাব।

~ আচ্ছা শুনেন মা বলছিল কালকে এগারটায় আপনাকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে বিয়ের শপিং করার জন্য। আপনি একটু প্রস্তুত রাখবেন নিজেকে।
কালকে উনি আমাকে নিতে আসবে এটা শুনেই মনটা আনচান করতে লাগল। তাই উানাকে জিজ্ঞেস করলাম
~ আপনি আসবেন নিতে?

~ আমার হবু বউকে নিতে কি তাহলে অন্য কেউ আসবে।
উনার কথা শুনে আবেগে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। এক উত্তাল ভালোবাসার ঢেউ মনে বইতে লাগল। আমি চুপ হয়ে মৃদু কন্ঠে উনাকে বললাম,
~ আচ্ছা আমি প্রস্তুত রাখব নিজেকে। তবে একটা আবদার ছিল।
~ বলেন কি আবদার?

~ আমি আমার সাথে আমার বেস্টিকে নিয়ে যেতে চাই যদি কিছু মনে না করেন।
~ আরে এটা তো ভালো কথা। কিছু মনে করব কেন? আপনি আর আপনার বেস্টি নাম কি যেন?
~ তোরা।

~ হ্যাঁ তোরা দুজনেই একসাথে এগারটায় তৈরী হয়ে থাকবেন। আমি নিতে আসব।
এ বলে উনি ফোন রেখে দিলেন। উনি ফোন কাটার পর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের আলো আমার মুখে এসে পড়েছে। আমি চাঁদটাকে ফোনের ক্যামেরা দিয়ে বন্দি করে রাখলাম। চাঁদের দিকে তাকিয়ে আবার ও আনমনা হয়ে গেলাম। মুহুর্তের মধ্যে স্বপ্নের রাজ্যে চলে গেলাম। তোরার ধাক্কায় আমার স্বপ্নের ঘোর কাটল, তোরা ধাক্কা দিয়ে বলল,
~ কি রে নিরু এত আনমনা হয়ে যাচ্ছিস কেন? এত ভালোবাসায় ডুবে থাকলে হবে?

~ কি যে বলিস না তোরা।
~ তা তুর্জ কি বলল?
~ তুর্জ বলেছে কালকে তোকে নিয়ে যেন প্রস্তুত থাকি আমাদের নিয়ে শপিংয়ে যাবে।

~ তোদের মধ্যে আমি নাই। (দুহাত উপরে তুলে)
আমি তোরার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে বললাম
~ তুই না গেলে বড্ড অসহায় আর ভয় লাগবে। তুই সাথে না গেলে আমি যাব না।

তোরা আমার দিকে তাকিয়ে একটা অট্ট হাসি দিয়ে বলল,
~ আমাকে বডিগার্ড হিসেবে নিতে চাচ্ছিস তাই না। আচ্ছা যাব।
আমি তোরাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
~আচ্ছা এবার খেতে চল।

তারপর দুজন খাওয়া শেষ করে রুমে এসে শুলাম। তোরা ঘুমিয়ে গেলেও আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। কারণ সবকিছু আমার কাছে স্বপ্ন মনে হতে লাগল। আমার চোখের পাতা বন্ধ করলেই উনার ছবি ভেসে আসছিল। তবুও জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। একটা সময় ঘুমিয়েও গেলেও সকাল ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। ছোটবেলায় ঈদের আগের দিন আমার এমন হত আর আজকে ঈদ ছাড়াই এমন হলো। তবে আজকের খুশিটা ঠিক ছোটবেলার ঈদের দিনের খুশিটার মতো। আমার সাথে তোরা উঠে গিয়ে বলল,
~ কি রে সারারাত ঘুমাতে পারিস নি তাই না? আমার বিয়ের সময়েও আমার এমন হয়েছিল। ব্যপার না ঠিক হয়ে যাবে।

ঘুম থেকে উঠেই চুপ করে আনমনা হয়ে বসে রইলাম আর বারবার ঘঁড়ির কাঁটা দেখতে লাগলাম আর ভাবতে লগলাম কখন যে এগারটা বাজবে আর তুর্জ আসবে আমাকে নিতে। আজকে যেন ঘঁড়ির কাঁটাটা নড়ছেই না। অপেক্ষার প্রতিটা সেকেন্ড যেন একেকটা ঘন্টার মত মনে হলো। আর শুধু বুকে ধুকবুক করতে লাগল। নাস্তা খেতে নিয়েও যেন গলা দিয়ে নামছিল না। কিযে এক অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করার ভাষা নেই।

অবশেষে অপেক্ষার প্রহর কেটে এগারটা বাজল। আমি এর মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেলাম যাওয়ার জন্য। আর তোরাও নিজেকে তৈরী করে নিল। এগারটা দশে ফোনে কল বাজল। খেয়াল করে দেখলাম তুর্জ কল দিয়েছে। তুর্জের কল টা ধরে বললাম,
~হ্যালো।

ওপাশ থেকে আমার স্বপ্নের পুরুষ বলল,
~ তৈরী হয়েছেন তো? আমি আপনার বাসার নীচে চলে এসেছি।
~ তাহলে বাসায় আসুন।

~~ বিয়ের আগে যাওয়া ঠিক হবে না। আপনি চলে আসুন নীচে। আর শুনুন একটা আবদার ছিল।
আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম আবদারের কথা শুনে। জানিনা কি আবদার করে বসে আর আমি যদি সেটা রাখতে না পারি, তাই ভয়ে ভয়ে বললাম,
~ কি আবদার বলুন। রাখার চেষ্টা করব।
~ একটু কাজল পড়ে আসবেন।

উনার আবদারের কথা শুনে আমি খুশিতে ভিতরে ভিতরে নাচতে লাগলাম। উনাকে খুশি মনে জাবাব দিলাম~
~ আমি এক্ষুনি কাজল পড়ে আসছি।
তারপর চোখে মনমত গাঢ় করে কাজল দিয়ে তোরাকে নিয়ে নীচে গিয়েই দেখলাম তুর্জ দাঁড়িয়ে আছে। আমি তুর্জের কাছে যেতেই তুর্জ বলল,
~ গাড়িতে বসুন দুজন।

আমি গাড়ির পিছনে বসতে নিলে তোরা আমাকে আটকে দিয়ে বলল,
~ আরে নিরা কি করছিস।
আমি অবাক হয়ে তোরার দিকে তাকিয়ে বললাম
~ কেন কি হয়েছে?

~ আরে তুই আর তুর্জ সামনে বস আমি পিছনে বসছি। একসাথে বসলে একটু গল্প করতে পারবি।
তোরার কথা শুনে তুর্জ আর আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম। অতঃপর তুর্জ সামনে বসে আমাকে তার পাশে বসার জায়গা করে দিল। তুর্জের পাশে বসতে গিয়েও আমার বুক আর পা কাঁপছিল খুব। অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে তুর্জের পাশে বসলাম। তারপর গাড়ি গন্তব্যের দিকে চলতে লাগল। মাঝপথে তুর্জ যখন বলল আপনার চোখ দুটো অনেক সুন্দর লাগছে।

আমি তো লজ্জা আর খুশিতে স্তবির হয়ে গিয়েছিলাম। আপরদিকে গাড়ি চলতে চলতে গন্তব্যে পৌঁছাল। তুর্জ আগে গাড়ি থেকে নেমে আমাকে নামতে বলল। আমিও নামলাম তারপর তোরাকে নিয়ে শপিং করতে লাগলাম। কিন্তু আমার চোখ শুধু কালো শাড়ির দিকেই যাচ্ছিল। তোরা আমার কানে কানে বলল,
~ তোর যদি কালো শাড়িটা পছন্দ হয়, নিয়ে নে। বিয়েতে লাল পড়িস। আর ঐ বাড়িতে গিয়ে কালো পড়িস।

~ তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস। আমি বিয়ের পর ওদের বাড়িতে কালো শাড়ি পড়ব? আমি এমনেই কালো ওদের বাড়িতে কালো শাড়ি পড়লে মানুষ তো ভূত বলবে।
তোরা হালকা চিমটি কেটে বলল,
~ তাহলে খালি কালো শাড়ির দিকে তাকাচ্ছিস কেন?

আমি ফিসফিস করে বললাম,
~ কালো শাড়িটা পছন্দ হয়েছিল তাই তাকাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাকে পড়লে পেত্নী লাগবে তাই সাহস করে কিনতে পারছি না। আর আসছি তুর্জের সাথে ও যা কিনে তাই নিব।
এর মধ্যেই তুর্জ আমাকে ডেকে বলল,
~ আপনি একটু এদিকে আসবেন।

তুর্জের কথাটা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে তোরা বলল,
~ আরে ভাইয়া এখন ও আপনিতে পড়ে আছেন। দুইদিন পর আপনার বউ হবে তুমি করে বলেন।

তোরার কথায় তুর্জ বেশ লজ্জা পেয়ে বলল,
~ আচ্ছা ঠিক আছে তুমি করেই বলব। নিরা একটু এদিকে আসবে?
~ হ্যাঁ আসছি।

তারপর উনার কাছে যেতেই উনি আমাকে একটা শাড়ি দেখিয়ে বলল,
~ এটা কেমন?

~ অনেক সুন্দর।
~ এটা নিব।
~ হ্যাঁ নিন।
অতঃপর শাড়ি গয়না সব কিনা শেষ হল। গাড়িতে উঠলাম পুনরায়। গাড়িতে চলতে চলতে অবশেষে বাসায় পৌঁছালাম। গাড়ি থেকে নেমে তুর্জকে বিদায় দিয়ে যখন বাসায় আসব ঠিক তখনেই তুর্জ আমার হাতটা ধরে টান দিল। আমি বিস্মিত হয়ে তুর্জের দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ কিছু বলবেন?

তুর্জ গাড়ি থেকে একটা প্যাকেট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল,
~ এ কালো শাড়িটাতে তোমাকে বেশ মানাবে।

~ এটা তো আমার অনেক পছন্দ হয়েছিল আপনি বুঝলেন কি করে? (অবাক হয়ে)
~ চোখ দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম। এবার সাবধানে বাড়ি যাও।

তুর্জ আমাকে কালো শাড়ি দিয়েছে এটা যে কত ভালো লেগেছে বুঝানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। তোরা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আল্লাহ্ তোর মনমত কাউকে জুটিয়ে দিয়েছে। অনেক ভালো থাকবি দেখিস।
এরপরে দুজন বাসায় আসলাম।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে আসল। ঘরোয়া পরিবেশে বেশ শান্ত ভাবে আমাদের বিয়ে হলো। বাড়ির সবাইকে ছেড়ে এক অচেনা গন্তব্যে নতুন জীবনের জন্য রওনা হলাম। এরমধ্যে তুর্জের সাথে হালকা কথা বলতাম। আবার একটু চুপ করে থাকতাম এভাবেই ছয় ঘন্টার পথ পার করলাম। অবশেষে শ্বশুড় বাড়ি এসে পৌঁছালাম।

পর্ব ১৬

নামানো হল। কিন্তু আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম একটা বিষয় দেখে যে, সে বাড়ির আশে পাশে আর কোন মানুষ নেই। সাধারণত নতুন বউ আসলে আশে পাশের মানুষ ছুটে আসে কিন্তু সে বাড়িটা খুব নিস্তব ছিল। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বরণ করে রুমে নিয়ে গিয়ে বলল,
~ শুনো বউমা এ বাড়িতে তুমি আমার মেয়ের মত থাকবে। কোন অসুবিধা হলে আমাকে বলবে অথবা তুর্জকে বলবে। শুধু একটা আবদার যে আশেপাশের লোকজনের সাথে কথা বলতে যেও না। আশেপাশের লোকজন খুব খারাপ। তোমাকে উল্টা পাল্টা বলে তোমার খারাপ করে দিবে। আমরা মা মেয়েতে মিলে থাকলে হবে না?

শ্বাশুড়ি মায়ের কথা শুনে উনার প্রতি তীব্র শ্রদ্ধা জাগল এটা ভেবে যে উনি হয়ত চাচ্ছেন না আমি কারোর হাসির পাত্র হই। আমি মায়ের কথায় সম্মতি দিয়ে বললাম,
~ আপনি পাশে থাকলে আর কিছু লাগবে না। আমরা মা মেয়েতেই হয়ে যাবে।

আমার কথা শুনে আমার শ্বাশুড়ি মা আমাকে খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ আমার মেয়ের মতো কথা বলেছ একদম। আচ্ছা তুমি তো তোমার মাকে মা বল। তাহলে আমাকে কি বলে ডাকবে?

আমি একটু ভেবে বললাম,
~ আপনাকে আম্মু বলে ডাকলে কি খুশি হবেন?
উনি এক চিলতে হাসি দিয়ে বলল
~ আম্মু বলে ডাকলেই খুশি হব। এবার চলো তোমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই।

বলেই আম্মু আমাকে নিয়ে নানীমার ঘরে গেলেন। নানীমার ঘরে নিয়ে গিয়ে আম্মু আমাকে ইশারা দিয়ে বললেন নানীমা কে যেন সালাম করি। আমি নানীমাকে সালাম করার জন্য এগিয়ে যেতেই নানীমা আমাকে ধরে বলল,
~ তুই বুঝি আমার তুর্জের বউ। বাহ! দেখতে তো ভারী মিষ্টি। সালাম করতে হবে না।

নানীমার মুখে প্রসংশা শুনে আমার চোখের জল ছলছল করতে লাগল। আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এভাবে প্রসংশা করে নি। চোখে ছলছল জল নিয়ে বললাম,
~ নানীমা ঠিক বলেছেন আমি আপনার তুর্জের বউ। কেমন আছেন আপনি?

~ আর কি ভালো থাকা যাবে এখন তুই এসে গেছিস। এখন তো চাইলেও ভালো থাকা যাবে না।
ভয়ে ভয়ে নানীমাকে জিজ্ঞেস করলাম~
~ কেন নানীমা আমি কি কোন ভুল করেছি?

আমর ভয় মাখা চেহারাটা দেখে নানীমা বলল
~ আরে বোকা ভুল করবি কেন? তুর্জ তোকে পেয়ে এখন এ বুড়িটাকে ভুলে যাবে তাই বললাম।
নানীমার কথা শুনে একটা স্বাস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নানীমাকে বললাম,
~ আপনার মতো সুন্দরী রেখে তুর্জ আমাকে চাইবে না। এত অস্থির হওয়ার কিছুই নেই।
~ আহ! দেখা যাবে। খুব ভালো পাম দিতে পারিস তুই।

পাশ থেকে আম্মু নানীমাকে বলে উঠল~
~ মা এবার বকবক থামাও। ওকে তুর্জের রুমে দিয়ে আসতে হবে। আর কিছু বলার থাকলে বলে দিও।
নানীমা আম্মুকে বলল,
~ আরে তুই বলে দে। এখন তো আধুনিক যুগ। শ্বাশুড়িরা বান্ধবীর মতই। যা বলার তুই বলে দিস।

আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ বউমা চলো আমার সাথে। একটু কথা বলব। তারপর তুর্জের রুমে দিয়ে আসব। এখানে বসে থাকলে মা তোমার মাথা খাবে কথা বলতে বলতে। পরে কথা বলো মায়ের সাথে।
আমি শান্তভাবে নানীমাকে বিদায় জানিয়ে আম্মুর রুমে গেলাম। তবে ভয় লাগছিল এটা ভেবে যে না জানি আম্মু কি বলে। আম্মুর রুমে যাওয়ার পর আম্মু বলল,
~ শুনো মা সরাসরিই একটা কথা বলি আমার একটা নাতির শখ। তুমি কোন ঔষধ খেও না। আমি চাচ্ছি তোমাদের কোল জুড়ে খুব তাড়াতাড়ি সন্তান আসুক। কথা
মায়ের কথা শুনে লজ্জা মাখা মুখে মাকে বললাম,
~ আপনি চিন্তা করবেন না। যেভাবে বলবেন সেভাবেই চলব।

এবলে লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললাম। এরপর আম্মু আমাকে তুর্জের রুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে বলল,
~ তুমি এখানে বসো। আমি তুর্জকে পাঠাচ্ছি। আর ঐ টেবিলে দুধ রাখা আছে তুর্জকে দিও।

লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নেড়ে বললাম আচ্ছা। তারপর আম্মু চলে গেল। আর আমি তুর্জের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। মিনেট পনের পর তুর্জ আসলো। তুর্জ আসার সাথে সাথে আম্মুর কথা মতো তুর্জের জন্য টেবিলের উপর থেকে দুধের গ্লাসটা হাতে নিলাম। তারপর তুর্জের কাছে গেলাম। তবে বিপত্তি ঘটল যে আমি দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে তুর্জকে কিভাবে সালাম করব এটা ভেবে। কোন উপায় না পেয়ে ভাবলাম দুধটা আবার টেবিলের উপর রেখে আসি তারপর সালাম করে দুধটা তুর্জকে দিব। যেই ভাবনা সেই কাজ। আমি দুধের গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখতে যেতে নিলাম এসময় তু্র্জ আমার শাড়ির আঁচল ধরে টেনে বলল,
~ কি ব্যপার চলে যাচ্ছ যে?

~ নাহ মানে দুধের গ্লাসটা রেখে আপনাকে সালাম করব তো তাই।
~ আরে বোকা সালাম করতে হবে না। দাও দুধের গ্লাসটা আমি খেয়ে নিচ্ছি।
লাজুক মুখে নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে দুধের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
~ নিন।

~ আমাকে কি তুমি বলা যায় না? এখনও আপনিতে পড়ে আছ যে? (রাগ গলায়)
~ নাহ মানে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি দুধটা খান।
~~ আবার আপনি? এবার কিন্তু রাগ হচ্ছে খুব।
~ সরি তুমি।

~ এইতো গুড গার্ল
তুর্জ দুধটা খাওয়া শেষে আমাকে হুট করে কোলে তুলে নিল। আমি ভয়ে উনার গলায় জড়িয়ে ধরে বললাম
~ কি করছ কি? পরে যাব তো।
~ আমার উপর কি তোমার ভরসা নেই।
~ তা তো আছেই।

এ বলে আমি উনার ঘাড়ে আরও শক্ত করে ধরলাম। উনি আস্তে করে আমাকে বিছানায় শুয়াল। তারপর ভালোবাসার গভীর সাগরে নিমজ্জিত হয়ে গেলাম। আবেগের সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। ভালোবাসার উত্তাল ঢেউ যেন সব তছনছ করে দিয়ে শান্ত হয়ে গেল। শীতলতার অনুভুতিটা যেন সারা শরীরে শিহরণ দিল। এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে উঠে দেখলাম আমার এলো মেলো কুকরা চুলগুলো উনার বুকের উপর বিছিয়ে আছে। আমি উঠতে নিলাম উনি আমাকে শক্ত করে ধরে বলল,
~ আরেকটু শুয়ে থাকো
লজ্জায় কিছুই বলতে পারছিলাম না। চুপ করে উনার হার্টিবিটের স্পন্দনটা শুনার চেষ্টা করলাম।

কিছুক্ষণ পর মা দরজায় নক করে বলল,
~ নিরা মা ফ্রেশ হয়ে তুর্জকে নিয়ে খেতে আসো।

আমি মায়ের ডাক শুনে উনাকে বললাম,
~ এবার তো আমাকে ছাড়ো। মা ডাকছে।

উনি আমার কাপলে আলতো চুমু দিয়ে বলল,
~ যাও ফ্রেশ হও।

আমি উঠে ওয়াশ রুমে গেলাম। নিজেকে ফ্রেশ করে ওয়াশ রুম থকে বের হয়ে খেয়াল করলাম তুর্জ ঘরটা সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। তুর্জ আমাকে দেখে বলল,
~ তোমার মা কল দিয়েছিল। আমি ধরে কথা বলেছি। তুমি কল দিয়ে কথা বলে নিও।
এবলে তু্র্জ খাবার রুমে গেল। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে মাকে কল দিলাম। ওপাশ থেকে মা বলল,
~ কি রে মা কেমন আছিস?

~ হ্যাঁ মা অনেক ভালো আছি। ওরা যে এত ভালো মা, আমি না আসলে বুঝতে পারতাম না। অনেক আদর করছে আমায়। কোন কষ্ট হচ্ছে না মা।
মা স্বস্তিভরা কন্ঠে বলল,
~ মারে তোর কথা শুনে শান্তি পেলাম। কত চিন্তা ছিল তোরে নিয়ে আজকে তোর কথা শুনে সব দূর হল। কাল পরশু তোর বাবা আসবে তোকে দেখতে।
~ মা তুমিও আসবে কিন্তু।

~ সে দেখা যাবে। এখন রাখলাম। শ্বাশুড়ির সাথে একটু কাজকর্ম করিস।
এ বলে মা ফোন রেখে দিল। খেয়াল করলাম তোরার দুইটা মিসকল তাই তোরাকে কল দিলাম। তোরাকে কল দেওয়ার সাথে সাথে তোরা বলল,
~ তা কেমন কাটল বাসর।

লজ্জা মাখা মুখে বললাম,
~ অনেক ভালো।
~ তা কেমন আছিস সেটা বল ঐখানের মানুষ কেমন?
~ অনেক ভালো।

তোরার সাথে কথা বলতে বলতে আম্মু ডাক দিল~
~ নিরা তাড়াতাড়ি আসো। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
আম্মুর ডাক শুনে তোরাকে বললাম,
~ আম্মু খাওয়ার জন্য ডাকছে পরে কথা হবে রাখলাম।

এ বলে ফোনটা রেখে মাথার তোয়ালে টা খুলে চুল গুলো মুছে বারান্দায় তোয়ালে টা নাড়তে গেলাম। বারান্দায় তোয়ালে নাড়ার সময় পাশের বাসার এক মহিলা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
~ তুমি কি এ বাসায় কাজ করতে এসেছ।

আমি একটু কষ্ট পেলাম এমন কথা শুনে। কষ্টমাখা মুখে জাবাব দিলাম~
~ না কাজ করতে আসি নি। আমি তুর্জের বউ
মহিলাটা কথাটা শুনে অবাক হয়ে বলল,
~ মনে কিছু নিও না ওভাবে বলা তোমাকে ঠিক হয় নি। কিন্তু তুর্জ আবার বিয়ে করেছে। পারেও তারা। যেমন মা তেমন ছেলে।

মহিলার কথা শুনে অবাক হলাম এটা ভেবে যে আবার বিয়ে করেছে এটার মানে কি? আমি মহিলাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিব এর মধ্যে আম্মু আবার ডাকতে লাগল খাওয়ার জন্য। আম্মুর ডাকে সাড়া দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম মহিলা আর পাশের বারান্দায় নাই।

আমি ভাবনার একটা দেয়ালে আটকা পড়ে খাবার রুমে গেলাম। খেয়াল করলাম মা অনেক কিছু রান্না করে রেখেছে। মা আমাকে আদর করে খাওয়াতে লাগল। মহিলার কথাটা এত সুখের মাঝে বেমালুম ভুলে গেলাম। পরদিন সকালে বাবা, মা আসলো। রাতে মা আমাকে কাছে নিয়ে বলল,
~ কি রে এ বাড়িতে কি আশে পাশের কেউ আসে না।

~ আরে মা আশেপাশের মানুষ দিয়ে কি করবে? আমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করত। তাই হয়ত মা না করে দিয়েছে।
মা হাসতে হাসতে বলল,
~ কপাল করে এমন শ্বাশুড়ি পেয়েছিস।

আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
~ একদম ঠিক কথা বলেছ।
পরদিন মা বাবা চলে গেল। আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইল কিন্তু শ্বাশুড়ি মা দিল না। বলল পরে উনি নিয়ে যাবে। তাই মা বাবাও জোর করল না আর। ভালোই যাচ্ছিল আমার সংসার বেশ আদরেই কাটল দুমাস। দুমাস পরে একটা বিষয় নিশ্চিত হয়ে খুব খুশি হলাম।

পর্ব ১৭

কারণ আমি জানতে পারলাম। আমি মা হতে চলেছি। জানার পর কতটা যে খুশি হয়েছি লিখে বর্ণনা করা সম্ভব না। সন্ধ্যায় তুর্জ অফিস থেকে আসার সাথে সাথে আমি তুর্জকে জড়িয়ে ধরলাম। তুর্জকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
~ একটা কথা বলার ছিল। কিভাবে যে বলি।

তুর্জ আমাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ আমার বউটা আজকে এত খুশি কেন? কি হয়েছে শুনি?
~ আমি কি জন্য খুশি সেটা জানার পর তুমিও খুশি হয়ে যাবেন।
~ তা বলো শুনি কি হয়েছে?

~ তুমি মা‌! উফ! না আমি মা আর তুমি বাবা হতে যাচ্ছ।
এটা বলার পর তুর্জ আমাকে ধরে খুশিতে হাসতে হাসতে বলল,
~ এখন কি বাংলা সিনেমার মত তোমাকে কোলে নিয়ে ঘুরাব?

~ কি যে বলো না তুমি সবসময় এমন মজা করো। বাচ্চার বাবা হচ্ছ, এখনও বাচ্চামি করলে হবে? (মৃদু হেসে)
~ হয়েছে এত পাকামি করতে হবে না। খবরটা মাকে দিয়ে আসো আগে।
~ আমি পারব না আমার লজ্জা লাগে তুমি দিয়ে আসো গিয়ে।

~ আমার সাথে মায়ের রুমে চলো, দুজন একসাথে খবরটা দেই। তাহলে মা খুশি হয়ে যাবে।
তুর্জ আমাকে নিয়ে মায়ের রুমে গিয়ে আম্মুকে ডেকে বলল
~ মা তোমাকে একটা খুশির খবর দেওয়ার ছিল।

মা আমার মুখের দিকে প্রথমে তাকাল তারপর বলল,
~ নিরার মুখের দিকে তাকিয়েই আমি বুঝতে পেরেছি তুই কি বলবি। এটাই তো বলবি যে আমি দাদীমা হতে চলেছি। কিগো নিরা মা ঠিক বলে নি?

আমি লজ্জায় মাথাটা আরও নীচু করে ফেললাম। মা আমার মাথাটা তুতনিটা ধরে উপরে তুলে বলল,
~ এত লজ্জা পেলে চলবে? এখন থেকে আমি যেভাবে বলি সেভাবে চলবে। আর তুর্জ বাসার বাইরে কম থাকবি। বউমাকে সময় দিবি বেশি। আমার কথা মত চলতে হবে কিন্তু।
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
~ আপনি যা বলবেন তাই হবে।

উনি আমার আমার মাথায় আলতো স্পর্শ করে বলল,
~ তোমার মাকে কি খুশির খবর টা দিয়েছ?

আমি মাথা নেড়ে না বললাম। তারপর উনি বলল
~~আমি জানাচ্ছি। তুমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।

কথাশেষে আমি আম্মুর রুম থেকে তুর্জকে নিয়ে চলে আসলাম। তুর্জ বাথরূমে গোসল করতে ঢুকল এর মধ্যে মা কল দিল। মায়ের কলটা ধরার সাথে সাথে মা ওপাশ থেকে বলে উঠল~
~ কি রে তোর শ্বাশুড়ি যে খুশির সংবাদটা দিয়েছে তা কি সত্যি? আমি নাকি নানীমা হতে যাচ্ছি।
~ হ্যাঁ মা সত্যি।

~ শুন এসময় কোন চিন্তা করবি না। ভালো মন্দ খাবি। আর তোর শ্বাশুড়ি কে বলেছিলাম তোকে নিয়ে আসতে। তোর শ্বাশুড়ি বলল উনার নাতি উনার বাসায় হবে। তাই আমি আর বাড়াবাড়ি করে নি।
~ আরে মা চিন্তা করো না উনি আমার অনেক যত্ন নেন। তুমি শুধু শুধু এসব ভাবছ, কপাল গুণে এমন শ্বাশুড়ি পেয়েছি।

মা হাসতে হাসতে বলল,
~ তা একদম ঠিক বলেছিস। আচ্ছা আমি রাখলাম তোর বাবাকে খবরটা দেই।
বলতে বলতেই মা ফোনটা রেখে দিল। আমি তোরাকে একটা কল দিলাম। ও কে কিছু না জানালে আমার পেটের ভাত হজম হয় না। তোরাকে কল দেওয়ার সাথে সাথে হালকা চেঁচিয়ে বললাম,
~ তুই খালা মনি হতে যাচ্ছিস।

তোরা একটা জোরে চিল্লানি দিয়ে বলল,
~ আমার পরে বিয়ে করে আমার আগে খুশির সংবাদ দিলি। ওরে নিরা তুই সেই উইকেট ফেলছিস।
~ আরে ধুর কি যে বলিস না তুই।

~ হাহা ভালো থাকিস আর নিজের যত্ন নিস। সাবধানে চলিস।
~ আচ্ছা আচ্ছা সব ঠিকঠাক করে করব। এবার ফোনটা রাখি। মাথা খারাপ করিস না আর। পারিস ও এত বকবক করতে।
~ হাহাহাআচ্ছা।

বেশ সুখেই যাচ্ছিল আমার সময়। আম্মু আমাকে নিজের মেয়ের মত যত্ন করতে লাগল। আমার মত মেয়ে এতটা ভালোবাসা আর সম্মান পাবে কখনও বুঝে নি। নিজেকে সবচেয়ে সুখী মনে হচ্ছে এমন একটা পরিবারে বিয়ে হওয়ার পর। আজকে বেশ তেঁতুল খেতে মন চাচ্ছে তাই তেঁতুল হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে খাচ্ছিলাম। এর মধ্যে আবার সেই মহিলা বারান্দায় আসলো। সেই মহিলাকে দেখেই আমার আগের কথা মনে হয়ে গেল। মহিলাকে ডেকে বললাম,
~ ঐদিন আপনি কি বলেছিলেন আমি কিন্তু বুঝতে পারি নি। তুর্জ আবার বিয়ে করেছে মানে কি?

মহিলা গলার আওয়াজ টা একটু নীচু করে বলল
~ আরে মেয়ে আস্তে কথা বলো তোমার শ্বাশুড়ি যদি দেখে আমাদের সাথে কথা বলছ তোমার বারোটা টা বাজাবে। আগে তুমি তোমার রুমের দরজা নক করে আসো, না হয় কখন তোমার শ্বাশুড়ি রুমে ঢুকে যাবে খেয়াল থাকবে না। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।

মহিলার কথা শুনে একটু রহস্যময় লাগছিল। আমি দৌঁড়ে আমার রুমের দরজা লাগিয়ে বারান্দায় এসে বললাম,
~ এবার বলুন কি হয়েছে?

মহিলা এরপর যা বলল তা শুনে আমার ভিতরটা কেঁপে গেল। এরকম কিছু শুনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ মহিলা বলল,
~ শুনো মেয়ে তুমি করেই বললাম। কারণ তুমি আমার ছোট হবে। সময় থাকতে এ বাড়ি থেকে চলে যাও।
~ কেন চলে যাব? কি হয়েছে?

~ এটা একটা অভিশপ্ত বাড়ি। কেউ এ বাড়ির আশে পাশে যায় না। তোমার আগে তুর্জ তিনটা বিয়ে করেছিল। আর প্রতিটা বউ এর মৃত্যু ঘটে গর্ভবতী হওয়ার পাঁচ মাস সময়ে। আর তুর্জ এত সুন্দর ছেলে হয়েও কেন জানি অন্যরকম মেয়ে বিয়ে করত। এর মানে বুঝলাম না এখনও?
~ অন্যরকম মেয়ে মানে?

~ প্রথম বিয়ে করেছিল মেয়ের চোখে কম দেখত। দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল মেয়ের বাবা গরীব অনেক। তৃতীয় বিয়ে করেছিল মেয়ের কথায় জড়তা ছিল। আর তুমি তো অনেক কালো। প্রতিবারেই বাচ্চা হওয়ার পাঁচ মাসের সময় কেন বউরা মরে সেটা আজও বুঝলাম না। আর উনাদের তো এত টাকা পয়সা ছিল না প্রথম বউ মারা যাওয়ার পর এত টাকা পয়সা হয়েছে। তুমি এ অসময়ে তেঁতুল খাচ্ছ যে তার মানে তুমিও গর্ভবতী। যাইহোক সাবধানে থেক। আমার বলার দরকার ছিল বললাম। এটা আবার তোমার শ্বাশুড়ি কে জিজ্ঞেস করো না।

এবলে মহিলা চলে গেল। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম মহিলার কথা কি সত্যি নাকি মিথ্যা? এ বাড়িতে এসে কখনও খারাপ কিছু পাই নি। তবে একটা মহিলা শুধু শুধু এত মিথ্যা কেন বলবে? এটা বলে উনার তো কোন লাভ নেই। আর সত্যিই তো এ বাড়িতে কেউ আসে না। আমি কি করব বুঝতে না পেরে তোরাকে কল দিয়ে সবটা জানালাম। তোরা বরাবরেই খুব বিচক্ষণ মেয়ে ছিল।

তাই তোরা সবটা শুনার পর বলল,
~ দোস্ত আমার কাছে ব্যপার রহস্যময় লাগছে। এ আধুনিক যুগে অভিশাপ বলে এগুলা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। মহিলার কথা সত্যি হলে এর পিছনে গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। আমাকে অনুমতি দিলে তোর শ্বাশুড় বাড়ি এসে ব্যপারটা খুঁজ নিতে পারি। এমন ভাবে নিতে হবে যেন কেউ টের না পাই।

~ অনুমতির কি আছে তুই কালকে চলে আয়। আমি মাকে বুঝাব নে। তবে এত ভালো মানুষের খারাপ দিক থাকতে পারে এটা ভাবতেই যেন কষ্ট লাগছে।
~ আরে বোকা আগে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে দে। আর একদম চুপ করে থাকবি। ওদের সাথে না জেনে এ ব্যাপারে কথা বলবি না। যদি ব্যাপারটা মিথ্যা হয় তাহলে ওরা কষ্ট পাবে। আর যদি বিষয়টা সত্যি হয় তাহলে রহস্য তো বের করতে হবেই। আমি কালকে চলে আসব বুঝছিস।

আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে দিলাম। সারাদিন একটা চিন্তার মধ্যে গেল। খেতে ইচ্ছা করছিল না তবুও আম্মু জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে বলল,
~ আরে এসময় না খেলে চলবে?

বলেই জোর করে খাইয়ে দিল। এমন মানুষ গুলার খারাপ দিক আছে আমি ভাবতেই পারছি না। নাহ ঐ মহিলা হয়ত মিথ্যা বলেছে। একবার কি জিজ্ঞেস করব আম্মুকে, নাহ তোরা না করেছে কিছু বলার জন্য। তাই আমি শুধু মাকে বললাম,
~ মা তোরাকে কিছুদিন এর জন্য আপনাকে না জিজ্ঞেস করেই আসতে বলেছি। ওর সাথে সময় কাটালে একটু মন ভালো থাকবে তাই।
~ আসতে বলেছ ভালো করেছ। তোমার যা ভালো লাগে করো। এবার যাও বিশ্রাম নাও।

আমি মায়ের কথায় বিশ্রাম নিতে রুমে আসলাম। তবে আমার চিন্তা পড়ে রইল সেই মহিলার কথার মধ্যে। রাতে তুর্জ আসল। খুব বেশি কথা বললাম না। তুর্জ আমার নীরবতা দেখে বলল,
~ কি গো আমার বউ এর কি হয়েছে? আজকে এত চুপচাপ কেন?

তুর্জের কথা শুনে ভাবতে লাগলাম এমন ভালো মানুষ আমাকে ঠকাতে পারে বলে মনে হয় না। একবার কি তুর্জকে জিজ্ঞেস করব! নাহ থাক আগে তোরা আসুক। আমি তুর্জকে বললাম,
~ নাহ একটু শরীর দুর্বল লাগছে তো তাই।
তুর্জ আমার পাশে এসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ এ সময় নাকি একটু এমনি লাগে। তুমি একটু চুপ করে শুয়ে থাকো।

~ হুম
সারারাত ছটফট করতে করতে গেল। তুর্জের মুখের দিকে তাকিয়ে কোনভাবে মনে হচ্ছিল না যে তুর্জ এমন করতে পারে। প্রতিদিনের মতই অজশ্র ভালোবাসায় সকালটা শুরু হল। শ্বশুড় বাড়িতে এত আদর পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার ছিল। তবুও মহিলার কথাটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। আর বিয়ের প্রথম দিন থেকে মা আমাকে কারও সাথে মিশতে দিত না। তাহলে কি এ কারণে মিশতে দিত না। এসব কথা মাথায় বাজতে লাগল। তোরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। হুট করে বিকেল দিকে কলিং বেলের শব্দ পেলাম আম্মু গিয়ে দরজা খুলল। তোরার কন্ঠ শুনে দৌঁড়ে গেলাম। তোরা আম্মুকে জিজ্ঞেস করছে~
~ আন্টি কেমন আছেন?

~ হ্যাঁ ভালো আছি তুমি?
~ ভালো আছি আন্টি।

~ যাও ভিতরে নিরা আছে। অহ! এই যে নিরা চলে এসেছে। নিরা তোরাকে নিয়ে ভিতরে যাও। আর ওকে ফ্রেশ হওয়ার পর টেবিলে শরবত রাখা আছে দিও। আমি একটু নাস্তা বানাই কেমন।
~ আচ্ছা আম্মু।
এরপর তোরাকে আমার রুমে নিয়ে এসে বললাম,

~ আমার খুব অশান্তি হচ্ছিল তোর এত দেড়ি হল কেন? সে কখন রওনা দিয়েছিস।
~ কারণ আছে। আমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসছি। এসে তোকে সবটা বলছি। তুই একটু নিজেকে প্রস্তুত রাখ।
~ কেন কোন কিছু কি হয়েছে? আমাকে বল দয়াকরে। আগে বলে তারপর যা।

~ আরে বোকা এত অস্থির হলে চলবে নাকি? একটু স্থির হ। অসময়ে এ অস্থিরতা অনেক বিপদে ফেলে।
আমি তোরার কথা শুনে নিজেকে স্থির করে বললাম
~ আচ্ছা ঠিক আছে তুই ফ্রেশ হয়ে আয়।

খানিকক্ষণ পর তোরা ফ্রেশ হয়ে আসার পর শরবত এনে দিলাম। তোরা শরবতটা খেতে খেতেই আম্মু তোরার জন্য নাস্তা এনে বলল,
~ রুমেই নিয়ে আসলাম। ভাবলাম নিরার সাথে কথা বলতে বলতে খাও। কিছু মনে করো না
~ কিছুই মনে করে নি। বরং আরও খুশি হয়েছি।
~ আচ্ছা মা তুমি খাও আমি গেলাম।

~ আচ্ছা যান আন্টি।
আম্মু চলে গেল আর তোরা নাস্তা খেতে খেতে বলল,
~ একটা বিষয় আমি আসার সময় জেনে এসেছি।
~ কি জেনে এসেছিস বল?

~ তুর্জের আগের বিয়ের বিষয়টা। আচ্ছা দরজাটা খুলা রেখে কথা বলা সমস্যা। কেউ এসে শুনে ফেললে হিতে বিপরীত হতে পারে। দরজা লক করলে কি কেউ কিছু বলবে?
~ আরে না কেউ কিছু বলবে না। দাঁড়া লক করে আসি।
তোরা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
~ তোর এ শরীর নিয়ে বারবার উঠতে হবে না। তুই বস আমিই লক করে আসছি।
এরপর তোরা দরজা লক করে আমার পাশে বসে বলল,

পর্ব ১৮

~ এটা ঠিক যে তুর্জের আগে তিনটা বিয়ে হয়েছে আর প্রতিবারেই গর্ভবতীকালীন সময়ে তুর্জের আগের স্ত্রীদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সবাই বিষয়টা অভিশপ্ত বললেও আমার কাছে মোটেও অভিশপ্ত মনে হচ্ছে না। এর পিছনে কোন না কোন রহস্য তো আছেই। আর তুর্জ সবসময় অসহায় মেয়েদের ধরে এনেই বা কেন বিয়ে করছে। তিনটা বিয়ের বিষয় গোপন করেছে আর কাউকে বুঝতেও দেয় নি।

তারা বিয়ের ব্যপারটা এমন ভাবে এগিয়েছে যে খুঁজ খবর নেওয়ার সময় দেন নি। তবে এটা খুঁজ নিয়ে জানতে পারি প্রথম স্ত্রী এর মৃত্যুর পর হুট করে তুর্জদের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো হয়ে যায়। এটা কি করে সম্ভব? তুর্জ তো কোন ব্যবস্যা করে না। চাকুরির টাকায় এত বড়লোক একবারে হওয়া অনেক কঠিন ব্যপার। তার উপর প্রথম বউ এর আর্থিক অবস্থা এত ভালো ছিল না। আমার কাছে ব্যপারটা খুব সহজ দেখা গেলেও বেশ ঘাপলা লাগছে। এর পিছনে অবশ্যই কোন কারণ আছে।

~ কি কারণ থাকতে পারে বল?
~ এখন তো কিছু বলতে পারছি না। তবে ধীরে ধীরে জেনে যাব। তোকে শুধু আমার কথামত কাজ করতে হবে।
~ সব করতে রাজি। কি করতে হবে বল।

~ তুর্জ কোথায় কি রাখে সব খুঁজ নিবি। আর বাড়ির প্রতিটা লকারের চাবি তুই বুদ্ধি করে এ সবানে ছাপ দিয়ে নিবি। সাবধানে নিবি যাতে কেউ টের না পাই। আমি বাইরে থেকে চাবি বানিয়ে নিব। তারপর সুযোগ মত সব কাজ করব। পারবি না?
~ হ্যাঁ পারব। এ আর কষ্ট কি।

এর মধ্যে মা দরজা নক করল আমি দরজা খুলে দিলাম। তোরাকে মা অন্য রুম দেখিয়ে দিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বলল। তোরাও ঐ রুমে চলে গেল। রাতে তুর্জ আসার পর তুর্জ, আমি, তোরা, আম্মু, নানীমা মিলে খেতে বসলাম। মা সবার সামনে বলল,
~ নিরা তোমার তো দুই মাস চলতেছে মনে হয়। ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার। কালকে প্রস্তুত থেক। তুর্জ বিকেল দিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে কারণ ঐ ডাক্তার সন্ধ্যায় বসে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
~~ আচ্ছা মা।

রাতে ঘুমাতে আসলাম। তুর্জ ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও ঘুমানোর চেষ্টা করতে নিলাম। হঠাৎ মনে হল কোন একটা আওয়াজ আমার কানে আসল। সরাসরি জানালা দিয়ে একটা আলো আসল। আর আমি তাকিয়ে একটা বিভৎস বাচ্চার মুখ দেখে চিল্লানি দিয়ে উঠলাম। তোরা আমার রুমে দৌঁড়ে আসল। আম্মু ও আসল। তুর্জ ঘুম থেকে উঠল। সবাই বলতে লাগল কি হয়েছে? আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
~ জানালা দিয়ে কি জানি দেখলাম।

আম্মু বলল,
~ ও কিছু না। ঘুমিয়ে পড়ো। হয়ত দুঃস্বপ্ন দেখেছ।

তোরাও একটু শাত্ত্বণা দিয়ে চলে গেল। তারপর তুর্জকে ঝাপটে ধরে কোনরকমে রাতটা পার করলাম।
সকালে তোরা আমার কাছে এসে বলল,
~ রাতে কি সত্যিই এমন কিছু দেখেছিলি নাকি দুঃস্বপ্ন?
~ সত্যিই দেখেছিরে।

তখন তোরা একটু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
~ আমার সাথেও এমন ঘটেছে তবে আমি ঐ চেহারায় ছুরি দিয়ে আঘাত করে দিয়েছিলাম। তারপর মনে হল কেউ একজন মাথায় হালকা আঘাত করল। কিছু একটার গন্ধ পেলাম আর তীব্র ঘুম হল আমার। সত্যিই কি এ বাড়ি অভিশপ্ত কি না বুঝতেছি না।
আমি তোরাকে চেঁপে ধরে বললাম,
~~ল তাহলে কি ঐ মহিলার কথা ঠিক?

~ জানি না রে আমি মঙ্গলবার চলে যাব। বিষয়টা নিয়ে আরও ভাববো। তুই একটু সাবধানে থাকিস।
~ নাহ তোরা যাস না তুই। তুই গেলে আরও অসহায় লাগবে।
~ আরে বোকা মেয়ে আমি এক মাস পর আবার আসব। এর মধ্যে ফোনে যোগাযোগ হবে।

অপরদিকে সন্ধ্যায় তুর্জ আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তার সব চেক করে বলল সবকিছু ঠিক আছে। এক মাস পর যেন আবার যাই। ডাক্তার দেখানো শেষে তুর্জকে নিয়ে বাসায় আসলাম। অপরদিকে তোরা মোট পাঁচদিন থেকে চলে গেল। তোরা যাওয়ার পর অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় গুলো আরও বেশি ঘটতে লাগল। ঐ চেহারাটা বারবার ভেসে আসত। কেন এমন হত বুঝতাম না। মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলছিলাম আমি। আমার কাছে এবার বিশ্বাস হতে লাগল এটা একটা অভিশপ্ত বাড়ি। না হয় এমন কাহিনী কেন ঘটবে?

একদিন রুমে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। খেয়াল করলাম সেই বিভৎস চেহারাটা আমার উপরে এসে পড়ল। আমি ভয়ে সেটা ঢিল মেরে চিল্লাতে লাগলাম। ঢিল মারার সাথে সাথে ঐটা থেকে রক্ত বের হতে লাগল। আমি আম্মুকে ডাক দিলাম আম্মু এসে বলল,
~ কি হয়েছে এমন করছো যে?

আমি পুতুলটাকে ঈশারা করে বললাম
~ এই যে দেখুন আম্মু পুতুল থেকে রক্ত বের হচ্ছে।

আম্মু আমার হাতের ঈশারা বরাবর তাকিয়ে বলল
~ কোথায় বউ মা আমি তো কিছু দেখছি না।
আম্মুকে বারবার দেখানোর চেষ্টা করলাম আম্মু একই কথা বলল। এক পর্যায়ে আম্মু আমাকে নিয়ে নানীমার ঘরে গেল। আর নানীমার সাথে শুয়ে থাকতে বলল। আমি নানীমার সাথে শুয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।

খানিকক্ষণ পর সাহস করে আমার রুমে গিয়ে অবাক হলাম কারণ কোন পুতুলেই সেখানে ছিল না রক্তও না। তোরাকে কল দিয়ে সবটা বলার পর তোরা বলল,
~ চিন্তা করিস না আমি কিছুদিনের মধ্যে আবার আসব। তুই সাবধানে থাক একটু৷ ঐ বাড়িতে কিছু তো একটা রহস্য আছে।
এক মাস কেটে যাওয়ার পর তোরা আবার আসলো। তোরা আসার পর অদ্ভুত কাহিনীগুলো ঘটা একদম বন্ধ হয়ে গেল। তোরা এসেছে দুইদিন হলো এর মধ্যে কোন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল না। এর কারণটা মিলাতে পারছিলাম না। তোরাকে বলার পর তোরাও কোন রহস্য উদঘাটন করতে পারল না।

তোরার মন মানছিল না যে এটা অভিশপ্ত বাড়ি। তবে আমার সাথে যা ঘটেছে তার জন্য তোরার একটু বিশ্বাস হলেও একদিনের একটা ঘটনায় সে বিশ্বাসটা ভেঙ্গে যায়। কারণ তোরা একদিন আম্মুর রুমে গিয়ে আম্মুর সাথে গল্প করতেছিল। আম্মুর সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তোরার ফোনটা হাত থেকে নীচে পড়ে যায়। তোরা ফোনটা তুলে আম্মুর রুম থেকে কথা শেষ করে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আম্মু বাজার করতে বের হলে তোরা আমাকে নিয়ে আম্মুর রুমে গিয়ে খাটের নীচে থেকে একটা পুতুল বের করে বলল,
~ এ বিভৎস পুতুল তোর শ্বাশুড়ির খাটের তলায় কেন?

পুতুল টা দেখে আমার একদম চিনতে ভুল হয় নি। এ পুতুলটাকেই তো আমি দেখতাম বারবার। তোরাকে বললাম।
~ এটাই তো সেই পুতুলটা।

তোরা আমার কথা শুনে পুতুলটা ভালো করে দেখে বলল,
~ এই দেখ এ পুতুলটাকে আমি ছুরি দিয়ে আঘাত করেছিলাম সে দাগটা এখানে আছে। তাহলে ঐদিন আমিও এ পুতুলটাই দেখেছিলাম। এটা কোন ভৌতিক কাহিনী না তোকে ভয় দেখানো হচ্ছে। এর পিছনে বড় কোন রহস্য রয়েছে। তুই এখন স্বাভাবিক ভাবে থাক আমি বিষয়টা দেখছি।

সেদিনের পর থেকে আমার ও একটু সন্দেহ আসলো মনে। আমিও বুঝতে পারলছিলাম না আমাকে ভয় দেখিয়ে আম্মুর কি লাভ? সবকিছু যেন মাথার উপর দিয়ে যেতে লাগল। এর মধ্যে তোরা আমাকে ইশারা দিয়ে বলল,
~ তুই নানীমার সাথে কথা বল আমি একটু ঐ কর্ণারের রুমে যাই ঐটা স্টোর রুম ঐখানে কিছু তো অবশ্যই পাব।

আমি তোরার কথা শুনে নানীমার রুমে গিয়ে নানীমাকে বিভিন্ন কথায় ব্যস্ত রাখলাম। আধা ঘন্টা পর তোরাও নানীমার রুমে আসলো। নানীমার রুমে এসে নানীমাকে বলল,
~ আরে নানীমা এবার তো নাতিন বউকে ছাড়ুন। ও একটু বিশ্রাম নিক। আন্টিও এখন আসলো না
নানীমা হাসতে হাসতে বলল
~ হ্যাঁ নিয়ে যাও তোমার বান্ধবীকে। আর তোমার আন্টির আসতে একটু দেড়ি হবে। নিরার ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়ে আসবে তো তাই।
~ আচ্ছা নানীমা গেলাম।

বলেই তোরা আর আমি নানীমার রুম থেকে বের হলাম। রুম থেকে বের হওয়ার পর আমি কিছু বলতে নিলে তোরা হাত চেপে ইশারা দিল রুমে গিয়ে সব কথা হবে। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। সরাসরি রুমে চলে আসলাম। রুমে আসার পর তোরা দরজা লক করে আমাকে বলল,
~ এই দেখ দুইটা গর্ভপাতের কাগজ পেয়েছি। আর দুইটাই তুর্জের আগের স্ত্রীদের।

তার মানে তুর্জের বউ ছিল সেটা ভালোভাবে নিশ্চিত হলাম। ভিতরটা কষ্টে কাপঁতেছিল। আরও অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস শুনতে হবে বুঝতেই পারছিলাম। কারণ তোরার অভ্যাস আছে এরকম কাহিনী ঘেটে বের করার। আমার মুখ ভার দেখে তোরা বলল,
~ তুই এভাবে মন খারাপ করে থাকলে কিন্তু কিছুই বলব না।
মুখে জোর করে হাসি এনে তোরাকে বললাম
~ আরে মন খারাপ করি নি বল।

তোরা চমার হাতটা ধরে হালকা ভরসা দিল। তারপর বলল
~ গর্ভপাতের কাগজটা দেখে মনে হচ্ছে বাচ্চার পাঁচ মাসের সময় লিঙ্গ পরীক্ষা করানো হয়েছে। তবে এখানে বাচ্চার লিঙ্গ কি ছিল সেটা বুঝতে পারছি না। কারণ দুইটাতে নাইন লিখা। এদিকে আমার যাওয়ার সময়ও হয়ে গিয়েছে।

পরপর দুইবার আসলাম তোর এখানে। বারবার আসলেও ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। আর তুই যে সাবানে চাবির ছাপ দিয়েছিস আগেরবার তা দিয়ে চাবিগুলো বানিয়ে এনেছি। তুই এটা রেখে দে কখনও কাজে লাগলে আমি বলব। আপাতত কালকে চলে যাব।
আমি তোরাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
~ এখনি যাস না। খুব গোলমেলে আর ভয় লাগছে। নিজেকে স্থির রাখতে পারব না। কি হচ্ছে কিছুই বুঝছি না।

তোরা অসহায় গলায় জাবাব দিল~
~ দেখ নিরা তোর দুলাভাই ডিটেকটিভ এর কাজ পছন্দ করে না বলে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন যদি শুনে আমি এসব করছি রাগ করে বসবে। তার উপর আমার যাওয়ার তারিখ চলে এসেছে। আমি কাগজ গুলো সাথে নিয়ে যাব। ফোনে তো আমাদের কথা হবেই। তোকে মনে সাহস রাখতে হবে। আমার ফ্লাইট আর পনেরদিন পর। বিদেশ গেলেও তোর সাথে মেসেন্জারে যোগাযোগ হবে।
আমি তোরাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
~ আমি সব করব। তবে তুই আমার পাশে থাকিস।

তোরাও আমাকে শক্ত করে ধরে বলল
~ সেটা নিয়ে ভাবিস না। আমি তোর পাশেই আছি আর সবসময় থাকব।

এর মধ্যে আম্মু বাজার থেকে এসে আমাকে বলল,
~ নিরা সন্ধ্যায় তৈরী থেক। একমাস তো হয়ে গেল। ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়ে এসেছি। তুর্জ নিয়ে যাবে সন্ধ্যায়।
আমি বাধ্য মেয়ের মত জবাব দিলাম~
~ আচ্ছা আম্মু।

সন্ধ্যায় তুর্জ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার সবকিছু দেখে আগেরবারের মতই বলল সব ঠিক আছে। বসায় চলে আসার জন্য রওনা দিলাম। মাঝপথে আইসক্রিম দেখে চেয়ে রইলাম। তুর্জ আমার চাহুনি দেখে বলল
~ আইসক্রিম খেতে মন চাচ্ছে বুঝি।
আমি আমতা আমতা করে বললাম
~ নাহ মানে?

তুর্জ গাড়ি থেকে নেমে বলল,
~ তুমি বসো আমি আইসক্রিম কিনে নিয়ে আসছি।
এ বলে তুর্জ দুইটা কোণ আইসক্রিম কিনে এনে বলল,
~ এই নাও এবার মন ভরে খাও।

আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
~ দুইটা আনার কি দরকার ছিল?
তুর্জ হাসতে হাসতে ভালোবাসার সুরে বলল
~ আমি জানি তোমার খেতে ইচ্ছা করছে। তোমার চোখ দেখেই মনে হচ্ছে। নাও তো ধরো। এবার আয়েশ করে খাও। না খেতে পারলে তো আমি আছিই বোকা মেয়ে।

আমি তুর্জের হাত থেকে আইসক্রিম নিতে নিতে ভাবলাম তুর্জের মত স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। বলার আগেই সব বুঝে ফেলে। তুর্জ আমাকে ঠকাতে পারে বিশ্বাসেই হচ্ছে না। এসব ভেবে আনমনা হয়ে গেলাম। তুর্জ আমাকে আনমনা হতে দেখে একটু ধাক্কা দিয়ে বলল,
~ কি হয়েছে খাচ্ছ না যে?

আমি ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় আসলাম। বাসায় আসার পর তোরা ডাক্তারের ঠিকানাটা নিয়ে নিল।
পরদিন তোরা চলে যাওয়ার পর মনটা বেশ বিষন্ন হয়ে গেল। সেই সাথে আরও বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় ঘটতে লাগল। মনে মনে ভীষণ ভেঙ্গে পড়ছিলাম। তবে তোরা কল দিয়ে সাহস জুগাত। সবসময় একটা অশান্তিতে ভুগতাম। একদিন বারান্দায় গিয়ে পুনরায় ঐ মহিলাকে পেলাম। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম ~
~ এর আগে কি তুর্জের কোন স্ত্রী এর সাথে আপনার কথা হয়েছে? প্রেগন্যান্ট এর সময় কি কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা বলেছে।

মহিলা একটু আস্তে করে বলল,
~ প্রথম দুই বউ এর সাথে কথা হয় নি। তারা ঠিক করে বরান্দায় আসত না। কথা বলতে চাইলেও বলত না। তোমার আগে যে বউ ছিল সে বলেছিল এ বাড়িতে নাকি বিভিন্ন ভৌতিক বিষয় ঘটত।
মহিলার কথাটা শুনে মনে হল আমিই প্রথম না, তারমানে এর আগের বউদের সাথেও এমন ঘটেছে। আমি তোরাকে কল দিয়ে সব বলতাম। সে সময় তোরায় আমার ভরসা ছিল। কাউকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। মা ফোন দিলেও তেমন কিছু বলতাম না কারণ চিন্তা করবে বেশি।

এসব দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও দুটা মাস। একদিন তোরা কল দিয়ে যা বলল তা শুনে আমার হাঁত পা কাঁপতে লাগল। মনের ভিতরটা ভয়ে কুকরে যেতে লাগল। নিমিষেই বিশ্বাসের চাঁদরটা সরে গেল। মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষ গুলোকে চিনা শুরু করলাম। মানুষ এত বড় প্রতরণা আর নাটক করতে পারে তা যেন ভাবতে পারছিলাম না। মনের গহীনে একটা বড় ধাক্কা লাগল। এখান থেকে কিভাবে বের হব সেটাও একটা বড় বিষয় ছিল। এমন একটা জালে ফেঁসে যাব কে জানত। এত বড় নোংরা খেলার গুটি হব সেটাই বা কে জানত?

লেখিকা: শারমিন আঁচল নিপা

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “হঠাৎ তুমি এলে – First love story bangla” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – হঠাৎ তুমি এলে (শেষ খণ্ড) – First love story bangla

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *