ভেজাগোলাপ – Akta valobasar golpo

ভেজাগোলাপ – Akta valobasar golpo: শীতে রোদ্রির ঠোঁটগুলো থরথর করে কাঁপছে। রোদ্রির কাঁপা ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয় নীরাদ। পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে রোদ্রি।


পর্ব ১

ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে নীরাদ। একবার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁইছুঁই। আকাশে মেঘ ডাকছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। মা হয়তো তার অপেক্ষায় এখনো না খেয়ে আছে। অফিসে একটা জরুরি মিটিং ছিল। নয়তো দশটার আগেই বাড়ি ফেরে সে।

রাস্তা ফাঁকা মানুষজন নেই তেমন এই রাস্তায়। আনমনে গাড়ি চালাতে চালাতেই হঠাৎই ব্রেক কষে সে।
দ্রুত গাড়ি থেকে নামে। একটা গাড়ি এক্সিড্যানট হয়ে পড়ে আছে রাস্তার পাশে। অথচ কেউ ধরেনি পর্যন্ত।

অবশ্য এখানে মানুষজন নেই। গাড়ির সামনে যায় নীরাদ। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জালিয়ে দেখে একটা যুবক কিছুটা আহত। তবে মাথায় আঘাতের ফলে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আর কিছু না ভেবে তাকে নিজের গাড়িতে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটে চলে।

বারবার ভাইকে কল দিয়ে যাচ্ছে রোদ্রি। এত দেরি তো হয়না ভাইয়ার বাসায় ফিরতে। ফোন রিং হচ্ছে ঠিকই তবে ওপাশ থেকে রিসিভ হচ্ছে না। ভাইয়ায় চিন্তার ভাবির অবস্থা প্রায় কাঁদোকাঁদো।

~ তুমি এত চিন্তা করোনাতো ভাবি। হয়তো ভাইয়ার ফোনটা চুরি হয়ে গিয়েছে অথবা কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। সে জন্যই ধরতে পারছেনা।
ভাবি এবার কেঁদেই দিলো। হেঁচকি তুলে বললো।

~ ফোন হারালে কি হয়েছে? এত দেরি তো ওর হয়না। ও তো অনেক আগেই চলে আসে। তোর কি মনে হয় ও এখন রাস্তায় রাস্তায় ফোন খুঁজে বেরাচ্ছে?
ভাবির কথার কি উওর দিবে বুঝতে পারেনা রোদ্রি। আরো কয়েকবার ফোন করে রিদান এর ফোনে কিন্তু না একবারও রিসিভ হলোনা।

~ আমি বরং ম্যানেজার আঙ্কেল কে একটা ফোন দেই।
~ দে। তারাতারি দে।
ম্যানেজারের নাম্বারে ডায়াল করার আগমুহূর্তে রিদানের কল আসে।

“ভাইয়া ফোন দিয়েছে”বলে দ্রুত রিসিভ করে রোদ্রি। প্রচন্ড উৎকন্ঠা নিয়ে বলে রোদ্রি,
~ হ্যালো, ভাইয়া? কোথায় তুমি? ফোন ধরছিলে না কেন? কখন আসবে? এত দেরি হচ্ছে কেন? ঠি ক আছোতো তুমি? ভাইয়া?

একসাথে এতগুলা প্রশ্ন শুনে হচকচিয়ে যায় নীরাদ। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,
~ আপনি একটু শান্ত হোন মিস। আপনার..
নিজের ভাইয়ের ফোনে অন্য মানুষের গলা শুনে বেশ অবাক হয় রোদ্রি। মুহুর্তেই রাগে দপ করে জ্বলে উঠে।

এতক্ষনের উৎকন্ঠামিশ্রিত গলায় মুহুর্তেই রাগি ভাব চলে আসে।
~ এই কে আপনি? চোর নাকি? ভাইয়ার ফোন চুরি করেছেন তাইনা? এই একমিনিট..আপনি আবার ভাইয়াকে কিডন্যাপ করেননিতো? হ্যাঁ?

~ আরে কি সব উল্টা পাল্টা বকছেন আপনি? মি.রিদান মানে আপনার ভাইয়ার গাড়ি এক্সিডেনট হয়েছে।

~ কিহ্? ভাইয়া কোথায়? বলতে বলতে কথার মাঝেই কেঁদে দিল রোদ্রি।
মেয়েটার এমন হঠাৎ কান্নায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলো নীরাদ। মেয়েটার কান্না শুনে কেন জানি প্রচন্ড খারাপ লাগছে ওর। সে নিজেও জানেনা কেন? নরম গলায় বলল,

~ কাঁদবেননা মিস। আপনার ভাইয়ার কিছু হয়নি, উনি ঠিক আছেন। আপনি বা উনার ফ্যামিলির কেউ একটু হসপিটালে আসুন।

হসপিটালে পৌঁছে তড়িঘড়ি করে দোতালায় ছুটলো রৌদ্রি। ফোনের লোকটার বলা কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল সে। একটা লোক..নাহ লোক বলা উচিত না। একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে উল্টোদিকে ফিরে। ফোনে কথা বলছে।

সামনে এগোতেই কিছু কথা কানে এলো ওর।
~ হ্যালো, মা তুমি খেয়ে নাও। আমার ফিরতে দেরি হবে। একটা জরুরি কাজে আছি। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যাও। নয়তো কিন্তু অসুস্থ হয়ে পরবে। ওষুধ গুলোও খেয়ে নিও মনে করে।
ওপাশ থেকে কি বললো বুঝতে পারলোনা রোদ্রি।

~ আমি এসে খেয়ে নিবো। তুমি ঘুমিয়ে যেও। জেগে থেকোনা।
~ এক্সকিউস মি? আপনিই কি ফোন দিয়েছিলেন?
পিছন থেকে কারো মিষ্টি গলার ডাক শুনে ভ্রু উচিয়ে পিছনে ফিরে নীরাদ।
~ আচ্ছা রাখছি। শুভরাত্রি। বলে ফোনটা কেটে দেয়।

সচেতন দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকায়। মেয়েটার পরণে একেবারেই সাদামাটা একটা সালোয়ার কামিজ। মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেয়া। গায়ের রং উজ্জল শ্যামলা। চোখদুটো লাল হয়ে আছে কান্না করার কারণে।

~ জি আমিই ফোন দিয়েছিলাম। আপনার ভাইয়া কেবিনে আছে। ডকটরের সাথে কথা হয়েছে আমার। তেমন গুরুতর কিছু হয়নি উনার। মাথায় হাল্কা আঘাত পেয়েছে। আর হাতে একটু কেটে গেছে। ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে। আপনারা ভেতরে গিয়ে দেখা করে আসেন।
~ জি আচ্ছা, ধন্যবাদ।

ভাইয়ের সাথে দেখা করে ক্যাবিন থেকে বেড়িয়ে এলো রোদ্রি। ভাবি এখনও ভেতরে আছে।
ডাক্তার এর সাথে কথা বলছিলো নীরাদ। রোদ্রিকে বের হতে দেখে একবার তাকিয়ে আবারও কথায় মনোযোগী হয়।

রোদ্রি ধীরপায়ে যেয়ে নীরাদ এর পাশে দাঁড়ায়। লোকটাকে তখন কতকিছু বলেছে? অথচ এই লোকটাই ওর ভাইকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে। নিজের মধ্যেই একটা অপরাধবোধ কাজ করছে।

রোদ্রিকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নীরাদই বলে উঠে,
~ কিছু বলবেন?
নীরাদের ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে রোদ্রি। আমতা আমতা করে সে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা।

নীরাদ নি:শব্দে হাসে। মেয়েটাকে বেশ স্বাভাবিক লাগছে এখন।
~ আপনার ভাইয়াকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন। ঠিকমতো যত্ন নিলেই সুস্থ হয়ে যাবে। আর এইযে এটা নিন।

বলে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিল রোদ্রির দিকে।
রোদ্রি প্যাকেটটা নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

~ এটার মধ্য মেডিসিন আছে। সাথে প্রেসক্রিপসন ও। টাইমলি খাইয়ে দিবেন।
এবার আরো একটু কাঁচুমাচু হয়ে যায় রোদ্রি। এই অসম্ভব ভালো লোকটাকে সে কিনা চোর বলে দিল?

~ আসলে তখন..
~ তখনকার কথায় আমি কিছু মনে করিনাই। আপনি নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে। না বুঝে বলে ফেলেছেন। বাচ্চাদের কথা ধরতে নেই। সো ইটস্ ওকে।
বলে একটা মিষ্টি হাসি দিলো নীরাদ।

হাসিটা মিষ্টি হলেও রোদ্রির কাছে সেটা গা জালানো মনে হলো। লোকটা তাকে ঠান্ডা মাথায় অপমান করে দিলো?
~ আপনার আমাকে বাচ্চা মনে হচ্ছে? (দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলল)
~ আপনি কি নিজেকে কোনোভাবে বয়সক প্রমান করতে চান? ওকে ফাইন। যান আপনি বাচ্চা নন একজন বয়সক মহিলা। এবার খুশি?

রাগে এবার কান্না পেয়ে গেল রোদ্রির। নীরাদ আবারও অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মেয়েটা কখন কি করে বোঝা যায় না।

যখন তখন কান্না করে, রেগে যায়। আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। সে তো একটু মজা করছিলো। কিন্তু মেয়েটা যে সিরিয়াসলি নিবে বুঝতে পারে নাই।
~ আরে, আমি মজা করছিলাম। আপনি কাঁদছেন কেন? কাঁদবেন না প্লিজ। কাঁদলে কিন্তু আপনাকে সত্যিই বাচ্চা মনে হবে।

জোর গলায় চেচিয়ে উঠে রোদ্রি,
~ কাঁদছিনা আমি।
বলে কেবিনের দিকে হনহন করে হেটে যায়।
রোদ্রির পিছে পিছেই কেবিনে ঢুকে নীরাদ। রিদানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
~ চলুন আপনাদের বাসায় পৌছে দিয়ে আসি।

রিদান কিছু বলতে যাবে তার আগেই রোদ্রি বললো,
~ আমরা একাই যেতে পারবো।
রোদ্রির কথাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নীরাদ বললো~ এত রাতে সিএনজি পাবেননা ভাইয়া।
~ তোরা গাড়িতে আসিসনি?
~ নাহ্। আঙ্কেল তো ছুটিতে।

~ ওহ্।
~ নীরাদ, তুমিই তাহলে একটু পৌছে দিয়ে আসো। আমাদের বাসা কাছেই।
~ জি ভাইয়া অবশ্যই। আপনারা আসুন।
রোদ্রিদের বাসার সামনে থামল নীরাদের গাড়ি। ভাবি আর ভাইয়া উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভেতরে চলে গেল। রোদ্রি গাড়ি থেকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবে তখনই নীরাদ ডাকল,
~ মিস.রোদ্রি?

~ জি?
~ আপনার ভাইয়ার ফোন আর ওয়ালেট। উনার পকেটে পেয়েছিলাম। আর তখনের জন্য সরি। আমি আপনাকে কাঁদাতে চাইনি। আপনি খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে। ভাইয়ার খেয়াল রাখবেন। আল্লাহ হাফেজ।

বলে একটা মুচকি হাসি দিলো নীরাদ। চেহারায় সারাদিনের ক্লান্তি ফুটে উঠেছে।
কিছুক্ষন আগে যতটা অসহ্যকর লাগছিলো লোকটাকে এখন ঠি ক ততোটাই ভালো লাগছে। কি চমৎকার অমায়িক হাসি। অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছা করছিলো তবে কিছুই বলতে পারলোনা।

~ আল্লাহ হাফেজ।
নীরাদ গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। রোদ্রিও ভেতরে ঢুকে গেইট লাগিয়ে দিল। এটাই কি শেষ দেখা? নাকি কেবলই শুরু? আকাশে এখনো মেঘ ডাকছে। হয়তো জানান দিচ্ছে শুভসুচনার।


পর্ব ২

সকালে ভাইকে নাস্তা খাইয়ে দিচ্ছিল রোদ্রি। ভাবি রান্না করছে রান্নাঘরে।
~ কালকে তোর অনেক কষ্ট হয়েছিলো বোন? তোর ভাবি প্রেগন্যানট এই অবস্থায় ওকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলি। তার উপর গাড়ি ছিলো না।

~ কি যে বলোনা। তুমি হসপিটালে আর আমরা কি বাসায় বসে থাকবো নাকি? বাদ দাও তো এসব, তোমার ব্যাথা কমেছে?
~ কমেছে…কালকে নীরাদ ছেলেটা না থাকলে যে কি হতো। ও ঠি ক সময়ে না আসলে ওইখানেই পড়ে থাকতাম আমি। ভীষন ভালো ছেলেটা। পাশের এলাকায়ই থাকে। তোকে ওই ফোন দিয়ে জানিয়েছিল না?

~ হুম। এখন ওষুধ গুলা খাওতো ভাইয়া।
রোদ্রি ওষুধগুলো দিয়ে পানি খাইয়ে দিচ্ছিল রিদানকে। তখনই ফোন বেজে উঠল। ফোনের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড বিরক্তি লাগলেও ভাইয়ের সামনে তা প্রকাশ করলোনা। মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে ফোনটা হাতে নিল।

~ ফারহান ফোন করেছে?
~ হু।
~ যা তুই ঘরে যেয়ে কথা বল বোন। আমি একটু ঘুমাবো।
~ আচ্ছা।

ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল রোদ্রি। ফোনটা এখনো অনবরত বেজেই চলেছে। লোকটার সাথে কথা বলতে হবে ভেবেই অসহ্য লাগছে।
~ হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।

~ ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো জান?
~ দেখুন, আপনাকে আমি এসব বলতে মানা করেছি। আপনার সাথে এখনো বিয়ে হয়নি যে আপনি আমাকে জান ডাকবেন।

~ রাগ করছো কেন জান? বিয়ে হয়নি কিন্তু হয়ে তো যাবে এবং খুব শীঘ্রই।
~ অসহ্যকর।
কথাটা আস্তে বললেও ফোনের এপাশ থেকে ফারহান ঠি কই শুনে ফেলল।
~ এই অসহ্যকর মানুষটাকেই তোমার আজকে সারাটা বিকাল সহ্য করা লাগবে। সো বি প্রিপেয়ার্ড।

কথাটা শুনে ভ্রু কুচকে এল রোদ্রির। খানিকটা অবাক হয়ে বলল,
~ মানে?
~ মানে দেখা করছি আমরা। তোমাকে নিতে আসব বিকালে। রেডি হয়ে থেকো।
~ ইমপসিবল!!আমি যেতে পারবোনা। সরি।
~ কেনো?

~ ভাইয়া ভাবির অনুমতি না নিয়ে আমি কোথাও যাইনা।
~ তোমার ভাবির থেকে পারমিশন নিয়েই আমি তোমাকে বলেছি। এরপর নিশ্চয়ই তোমার কোনো সমস্যা থাকার কথা না?

রৌদ্রি কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনুরোধের সরে বলল,
~ প্লিজ আজকে না..আমি..
~ আর কোন কথা নয়। বিকেলে যেন লেট না হয়। ….আই জাস্ট নিড ইউ টুডে।
খট করে কেটে গেল ফোনটা। ঠাস করে ফোনটা ছুড়ে মারলো রৌদ্রি। খুব করে কান্না পাচ্ছে ওর। খুব!!

রোদ্রির বয়স যখন ৬ বছর তখনই ওর বাবা মারা যায় হার্ট আ্যাটাকে। বাবার মৃত্যুর শোকে সাতদিনের মাথায় ওর মা ও স্ট্রোক করে। এতিম হয়ে যায় দুই ভাইবোন। । তারপর কয়েকবছর চাচাদের সাথে নিজেদের বাড়িতেই ছিলো। ধীরে ধীরে রিদান নিজের বিজনেস দাঁড়া করায়। সেই ভিত্তিতেই আজ সে সফল বিজনেসম্যান। বর্তমানে ওরা যেই বাসায় থাকে সেটা রিদান নিজের টাকায় কিনেছে।

ওদের বাবা যখন মারা যায় তখন ওদের বাসায় জমিজমা নিয়ে বেশ ঝামেলা চলছিল। কয়েকবার ওর চাচাদের সাথে ঝগড়াও হয়েছিলো ওর বাবার। এর মধ্যেই হঠাৎ ওর বাবার এট্যাক হয়। ডাক্তার বলেছিলো অতিরিক্ত টেনশনের কারনে এট্যাক হয়েছিলো। তখন থেকেই রিদান বাবার মারা যাওয়ার পিছনে ওর চাচাদের দায়ী করে। ওর ধারনা এই সম্পত্তিজনিত কারনেই ওর বাবা টেনশনে ছিলো।

বিয়ে করার পর রিদান আর ওই বাসায় থাকেনি। বউ আর বোনকে নিয়ে নিজের বাসায় চলে আসে।
ছোট থেকে এই ভাই ই রোদ্রিকে আগলে রেখেছে। আর ভাবি তো যেন ওর মা। নিজের সন্তানের মতোই আদর করে। ভাই~ ভাবির উপর কখনোই কোনো কথা বলেনা রোদ্রি। কখনো বলতো পারবেওনা। আর বলতে চায়ওনা সে।

ফারহান ভাইয়ার বন্ধুর ছোট ভাই। ভাইয়ার পছন্দের ছেলে। রিদান যখন তার মতামত জানতে চেয়েছিলো তখন “না” বলতে পারেনাই রোদ্রি। তার সাথে বাগদান হয়ে গেছে রৌদ্রির। হয়তো বিয়েটাও হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়িই।

এমন না যে রৌদ্রি কাউকে ভালোবাসে। ফারহানকে বিয়ে করতে তার কোনো সমস্যাও ছিল না। কিন্তু লোকটা সবার সামনে যতটা ভালো দেখায় সে ততটা ভালোনা। সুযোগ পেলেই রোদ্রির সাথে অসভ্যতামি করে সে। তার কথাবার্তাও বিশেষ সুবিধার লাগেনা রোদ্রির কাছে।


সন্ধ্যা ৬:৩০ বাজে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে নীরাদ। কোন উদ্দেশ্য নেই। এমনেই ঘুরতে বেরিয়েছে। কালকে রাতের পর থেকেই ভালো লাগছেনা তার। রাতে ঘুমও হয়নি ঠি ক মতো। মনের মধ্য বারবার একটা অদ্ভুত ইচ্ছা জাগছে। কারণটা তার জানা নেই তবে তার খুব মিস.রোদ্রিকে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।

রোদ্রিদের বাসার কাছেই একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে অযথাই দাড়িয়ে আছে সে।
হঠাৎই একটা গাড়ি থামলো ওদের বাসার সামনে। রোদ্রিকে বের হতে দেখে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো নীরাদের। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল সে।
~ মিস.রোদ্রি। কেমন আছেন?

পাশ থেকে কারো ডাকে চমকে উঠলো রোদ্রি। চোখ ঘুড়িয়ে নীরাদকে দেখে বেশ অবাক হলো।
~ জি, ভালো। ..আপনি এখানে?

~ এসেছিলাম একটা কাজে। আপনার সাথে দেখা হয়ে গেলো। বেশ উৎফুল্ল শোনায় ওর গলা।
রোদ্রি কিছু বলবে তার আগেই ফারহান পাশে এসে দাঁড়ায়। হাত ধরে রোদ্রির। রোদ্রি ছাড়াতে চায় কিন্তু পারেনা। শক্ত করে ধরে আছে ফারহান। বিষয়টা চোখ এড়ায়না নীরাদের।
~ কে উনি?

~ উনিই কালকে ভাইয়াকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো।
ফারহানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় নীরাদ। হাসিমুখে বলে,
~ আমি নীরাদ আহমেদ।

ফারহানও হাত মেলায়।
~ আমি ফারহান চৌধুরি। নাইস টু মিট ইউ।
রোদ্রিকে জিজ্ঞেস করে,
~ কে হয় উনি আপনার? কাজিন?
~ নাহ্। আমার বাগদত্তা…


পর্ব ৩

রোদ্রির মুখে “বাগদত্তা” শব্দটি শুনে কিছুসময়ের জন্য নির্বাক হয়ে গেলো নীরাদ। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে একটা ভদ্রতার হাসি দিয়ে বলল,
~ ওহ, কংগ্রেচুলেশন। বিয়ে কবে আপনাদের?

নীরাদের প্রশ্ন শুনে রোদ্রিকে আরো কাছে টেনে নিল ফারহান। রোদ্রির অসস্তিবোধটা খুবই সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষন করলো নীরাদ। মেয়েটা কেমন যেন উশখুশ করছে। কিন্তু কেন?
~ সেটা হতে এখনও দেরি নীরাদ সাহেব। তার অনার্স শেষ হওয়ার আগে সে কিছুতেই বিয়ে করবেনা।

উওরে মৃদু হাসলো নীরাদ। বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। সিটে হেলান দিয়ে চোখবুজে রইল। মাথায় শুধু রোদ্রির বলা “আমার বাগদত্তা”কথাটাই ঘুরছে”। “উনি অন্যকারো”ব্যাপারটা ভাবতেই মনটা বিষিয়ে উঠছে।

ফারহানের প্রতি রোদ্রির আচরণও তাকে ভাবিয়ে তুলছে। মেয়েটার কি বিয়েতে মত নেই? নাকি শুধু সে সামনে ছিলো বলেই লজ্জা পাচ্ছিল।
ঘরে এসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিল রোদ্রি। বালিশে মুখ গুঁজে কিছুক্ষন পড়ে রইল। লোকটার সামনে কি একটা লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পরেছিল কিছুক্ষন আগে। ফারহান কিভাবে ধরে ছিল তাকে, উনার সামনে কিছু বলতেও পারছিলো না।


দরজা ঠেলে মায়ের রুমে ঢুকল নীরাদ।
মনিরা আহমেদ তখন একমনে তসবি গুনছিল। দরজা খোলার শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল সে। নীরাদ কে দেখে খুশি হলেও পরক্ষনেই মুখে চিন্তার চাপ ফুটে উঠল তার। ছেলেকে কেমন যেন বিষন্ন দেখাচ্ছে। চোখগুলো লাল হয়ে আছে। চুল উষকোখুশকো।
~ আসবো মা?

ছেলের ডাকে ধ্যান ভাঙল তার।
~ আয় বাবা।

ধীরপায়ে মায়ের পাশে যেয়ে বসলো নীরাদ। মনিরা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ কি হয়েছে বাবা? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
নীরাদ কিছু বললোনা। মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো সে। মনিরা বেগমের কপালের চিন্তার ভাঁজটা আরো একটু কুঁচকে এলো। তার ছেলের যে মন খারাপ এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারলো। আদুরে গলায় বললেন,

~ কি হয়েছে বাবা? বল আমাকে। শরীর খারাপ?
~ উহু। আমি ঠিক আছি মা।
কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার বলল,
~ আচ্ছা মা, তুমিতো বাবাকে এখনো ভালোবাসো তাইনা?

ছেলের মুখে হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে যারপরনাই অবাক হলেন মনিরা।
ছেলের সাথে সে অনেকটাই সহজ। নীরাদের যখন দশ বছর বয়স তখনই ওর বাবা মারা যায়। স্বাভাবিক মৃত্যুই হয় ওর বাবার। এরপর আজ ১৯ বছর হতে চলল ছেলেকে একাই মানুষ করেছেন তিনি।

বাসার লোকেরা অবশ্য বলেছিলো বিয়ে করতে কিন্ত প্রথমত ছেলের কথা ভেবে এবং দিতীয়ত তিনি নিজের স্বামীর জায়গা কাউকে দিতো পারবেন না এইজন্য বিয়ে করেননি মনিরা আহমেদ। স্বামীকে প্রচন্ড ভালোবাসেন উনি। হয়তো আজ মানুষটা নেই তবে ভালোবাসাটা এতটুকুও কমেনি।
স্বামীর কথা মনে পড়াতে চোখদুটোও ভিজে এল তার। একহাতে পানি মুছে সিক্ত গলায় বললেন।

~ তোর বাবা মানুষটাই এমন উনাকে ভালো না বেসে থাকা যায় নারে। বড্ড ভালো ছিলেন উনি। আল্লাহর অনেক প্রিয় নয়তো কি আর আল্লাহ এত তাড়াতাড়িই নিয়ে যান?
~ কিন্তু বাবা তো নেই।
ছেলের কথায় মৃদু হাসলেন উনি।

~ তো কি হয়েছে!উনি নেই বলে কি আমি ভালোবাসতে পারবোনা? শোন বাবা, ভালবাসাটা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। কাউকে ভালবাসলে যে সেটা প্রকাশ করতেই হবে বা সবাইকে দেখাতে হবে যে আমি তাকে ভালবাসি এমনটা নয়। মুখে না বলেও ভালবাসা যায়। কাজকর্মেও ভালবাসা প্রকাশ করা যায়। ভালবাসাটাতো আর চাপিয়ে দেয়া যায় না। জোর করে আদায়ও করা যায় না।

এটা আদায় করার মতো বস্তু না। তুই কাউকে ভালবাসলে বাসবি, সে বাসুক আর নাই বাসুক। …..এখন বলতো এসব কথা কেন বলছিস?

মায়ের কথা এতক্ষন মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো নীরাদ। বিষন্নে ভরা চেহারাটায় হাল্কা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। মায়ের কথাগুলো যেন বড্ড প্রয়োজন ছিল এইসময়।
~ না এমনেই। আচ্ছা তুমি থাকো। আমি শাওয়ার নিয়ে আসি। তারপর একসাথে খেয়ে নিবো।
~ আচ্ছা যা।

ছেলের এড়িয়ে যাওয়াটা বুঝতে পারলেন উনি। তাই আর বেশি কিছু বললেন না। তবে নীরাদ কথাবার্তায় ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছেন উনি। এইজন্যই ওই কথাগুলো বললেন। তিনি চাননা তার ছেলে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিক।
__
বিকালে হাঁটতে বেরিয়েছে মনিরা বেগম। বাড়ির পাশের একটা পার্কেই ঘুরে ঘুরে দেখছেন উনি। রোজ না হলেও প্রায়ই বিকালে হাঁটেন উনি। বাড়ির পাশেই এমন একটা পার্ক থাকায় বেশি দুরে যাননা।

এখানেই ঘোরাফিরা করেন। এই দিকটায় গাছপালা বেশি তাই মানুষ নেই তেমন।
হঠাৎই হাঁটুতে প্রচন্ড টান অনুভব করলেন উনি। একহাতে হাঁটু চেপে উবু হয়ে গেলেন। চোখমুখ ব্যাথায় কুচকে এলো তার। ঘাসের উপরই বসে পরবেন তার আগেই পাশ থেকে কেউ এসে ধরল উনাকে।

অস্থির কন্ঠে বলল,
~ কি হয়েছে আন্টি? আমাকে ধরুন নয়তো পরে যাবেন।
পাশে থাকা মেয়েটার হাতটা শক্ত করে ধরলেন মনিরা। মেয়েটা তাকে ধরে ধরে পাশের একটা বেন্চে বসাল।

~ আপনার কি হাঁটুতে ব্যাথা হচ্ছে আন্টি ?
~ হ্যাঁ রে মা। এতদিন ছিলোনা। আজকে হঠাৎই কেন হলো বুঝতে পারছিনা।
~ আপনি কার সাথে এসেছেন? আমি তাকে ডেকে নিয়ে আসি।
~ আমি একাই এসেছি মা। পাশেই আমার বাসা।

~ ওহ। তাহলে আপনার ব্যাথা একটু কমলে বাসায় দিয়ে আসি।
মেয়েটার ব্যবহারের রীতিমত মুগ্ধ মনিরা। চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখলো বেশ মিষ্টি দেখতে মেয়েটা।
~ নাম কি মা তোমার?
~ জি, আমার নাম রোদ্রি। ইমিলা জাহান রোদ্রি।
~ বাহ্। বেশ মিষ্টি নাম। নামের সাথে তুমি নিজেও বেশ মিষ্টি।

জবাবে মৃদু হাসলো রোদ্রি। মহিলাটার “মিষ্টি মেয়ে”কথাটা শুনে নীরাদের প্রথম দিন বলা”আপনি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে” কথাটা মনে পড়ে গেল রোদ্রির।
মনিরা বেগমকে বাসায় নিয়ে এসেছে রৌদ্রি। গাড়িতে উঠতে কষ্ট হবে বলে হাত ধরে ধরেই নিয়ে এসেছে উনার বাসায়। আসার পথে সারাক্ষনই উনি এটা ওটা জিজ্ঞেস করেছে। অনেক মিশুক।

মহিলা বেশ বিওবান।
বাড়িঘর দেখলেই বোঝা যায়।
বাসায় বেল বাজাতেই একজন বয়সক মহিলা দরজা খুলে দিল। কাজের লোক হবে হয়তো। মনিরাকে সোফায় বসিয়ে দিল রোদ্রি।
~ আন্টি, আমি তাহলে আসি।

~ সেকি মা, কিছু খেয়ে যাও। আমার জন্য কতটা কষ্ট হলো তোমার।
~ না না কষ্ট কেন হবে? আজকে আর কিছু খাবনা। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। বাসায় ফিরতে হবে। আল্লাহ হাফেজ।
~ আচ্ছা সাবধানে যেও। আল্লাহ হাফেজ।
বাসায় এসে ঢুকতেই সোফায় বসা মানুষটাকে দেখে বেশ ভালোই অবাক হয়ে গেল রোদ্রি..


পর্ব ৪

সোফায় বসে আছে নীরাদ। বেশ হাসসোজ্জল ভাবে কথা বলছে তার ভাইয়ের সাথে। “উনি এখানে কি করছেন? “প্রশ্নটা মাথায় আসলে মুখে বলার আগেই ভাবি পাশ থেকে বলল,
~ তোর ভাইয়াই আসতে বলেছে, বুঝলি? ডিনারটা আমাদের সাথেই করতে বলেছে। সেদিন এত সাহায্য করল কিছু না করলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়।
~ হুম, ভালো করেছো।

~ তোর ফিরতে এত দেরি হলো যে?
~ পরে বলবোনে ভাবি। এখন একটু ফ্রেশ হয়ে আসি?
~ আচ্ছা যা।

ভাইয়ের সাথে দেখা করে, নীরাদকে সালাম দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল রোদ্রি।


অন্ধকার রুমে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ফারহান। হাতে জলন্ত সিগারেট। পাশেই বিয়ারের কাঁচের বোতল। আজকাল এসবে তার নেশা হয়না। বোতলের পর বোতল বিয়ার খেলেও মাতাল হয়না সে। তার চোখেমুখে শুধু একটাই নেশা, আর সেটা হলো রোদ্রির নেশা। রোদ্রিকে কাছে পাওয়ার নেশা সে কিছুতেই কাটাতে পারে না।

গত একবছর থেকে রোদ্রিকে নানাভাবে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে গেছে। মেয়েটা অনেক ঘাড়ত্যাড়া। সামান্য ছুয়ে দিলে এত রাগের কি আছে বুঝতে পারেনা সে। বিছানায় নাহয় বিয়ের পরেই যাবে।

টেবিলে হরেকরকম খাবার সাজানো। নীরাদ বসে আছে চুপ করে। ভাবির কথায় মনে হচ্ছে সে এগুলো সব নীরাদকে খাইয়ে ছাড়বে।
“রোদ্রি কোথায় মিরা? “রিদানের প্রশ্নে মুখ তুলে তাকায় মিরা। ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
~ ডেকেছি…চলে আসবে।

মিরার কথা শেষ না হতেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে রোদ্রি। নীরাদ কয়েক সেকেন্ড পলোকহীন তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। একটা মেয়েকে সাধারণভাবেই এতটা অসাধারণ কিভাবে লাগে? এর আগে যে দুইদিন দেখা হয়েছিলো তখন রোদ্রির মাথায় ঘোমটা দেয়া ছিল। কিন্তু আজ নেই। চুলগুলো হাতখোঁপা করা।

নীরাদের একেবারেই সামনের চেয়ারটায় বসেছে রোদ্রি। রোদ্রির পাশে মিরা। টুকটাক কথা হচ্ছে তাদের মাঝে। মিরা বারাবার ওঠে এটা ওটা দিচ্ছে নীরাদের প্লেটে।
রোদ্রি একমনে খাচ্ছে। খাওয়ার সময় কথা তার পছন্দ না। হঠাৎই নীরাদ বলে উঠল,
~ আপনার বোন তো আমাকে রীতিমত চোরই বানিয়ে দিয়েছিল ভাইয়া।

রোদ্রি স্থির দৃষ্টিতে নীরাদের চোখে চোখ রাখে। লোকটার চোখে দুষ্টুমি খেলা করছে। মুখে প্রশস্ত হাসি।
~ কি বলো!! রোদ্রি নীরাদকে তুই চোর বলেছিস?
রোদ্রি রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ নীরাদের দিকে।

~ আমি কি জানতাম নাকি তুমি হসপিটালে? একজনের ফোনে অন্যকারো কন্ঠ শুনে যে কেও চোর ভাবাটাই খুব সাভাবিক নয় কি?
শব্দ করে হেসে ওঠে রিদান আর মিরা।

~ ও একটু বাচ্চামো সভাবের। তুমি কিছু মনে করো না।
~ হ্যাঁ সেটা তো আগেই বুঝেছিই।
“নীরাদ, তুমিতো কিছুই নিচ্ছো না। বলে মিরা আবারও উঠতে গেলে রোদ্রি থামিয়ে দেয়।
~ তুমি এতবার উঠোনাতো। আমি দিচ্ছি। বলে তরকারির বাটি হাতে নেয়।

দিয়ে যাচ্ছে। নীরাদ থামানোর জন্য বেখেয়ালিভাবে রোদ্রির হাত ধরে শক্তকরে। রোদ্রি থেমে যায়। চমকিয়ে নীরাদের দিকে তাকায়। নীরাদ দ্রুত ছেড়ে দেয়। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে দুজনেই। তবে রিদান আর মিরার সামনে কিছু বলেনা।

খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে রাখে রোদ্রি। নীরাদের দিকে পানি এগিয়ে দেয়। গ্লাস নেয়ার সময় নীরাদের চোখে স্পষ্ট জলজল করে উঠে রোদ্রির অনামিকা আঙ্গুলে পড়ানো সাদা পাথরের আংটি। মনে মনে দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে সে।

রিদানের থেকে কথার ছলে জানতে পেরেছে মাত্র দেড় মাস আগেই ওর বাগদান হয়েছে। ইশশ..কেন যে আর কিছুদিন আগে তার সাথে রোদ্রির দেখা হলোনা? হলে হয়তো তার সাথে এই হৃদয়ের অসহ্য দহন যন্ত্রণার সাক্ষাত হতোনা।


পর্ব ৫

দুপুরে ভার্সিটির পর বিকেল পর্যন্ত কোচিং করে তারপর বাড়ি ফেরে রোদ্রি। আজকে কোচিং করে বের হয়েই দেখে, ফারহান গেটের সামনে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। রোদ্রি এগিয়ে যেতেই হাত টেনে গাড়িতে বসায়।

রোদ্রি তাড়াহুড়ো করে বলে উঠে,
~ আমি আপনার সাথে যাবোনা। বাড়ি যাবো প্লিজ।
ফারহান সবেমাত্র সিটবেল্ট বাঁধছিলো। রোদ্রির কথায় ওর দিকে ফিরে তাকায় সে। রোদ্রির চোখে চোখ রাখে সে। চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে রোদ্রি। একহাত দিয়ে নিজের সিটবেল্টটা মুঁচরাতে থাকে সে। সে জানে ফারহান তার ভাই ভাবির অনুমতি নিয়েই তাকে নিতে এসেছে। তাই এই অযৌক্তিক যুক্তি দেখিয়ে লাভ নেই।

নতুন কোন বাহানা খোঁজার জন্য মস্তিস্কের মধ্য কয়েকবার চিরুনি অভিযান চালায় সে।
গাড়ি স্টার্টের শব্দে হুস ফিরে তার। করুণ চোখে ফারহানের দিকে তাকাতেই ভরাট গলায় বলে উঠে ফারহান,
~ সিটবেল্টটা মুঁচরানোর জন্য নয়। ওটা বাঁধো জান। নয়তো বাঁড়ি খেয়ে বাহানা খোঁজার সেই মাথাটাই থাকবে না।

একটা শয়তানি হাসি দিয়ে ড্রাইভিংয়ে মন দিলো সে।
বাধ্য হয়ে সিটবেল্ট বেঁধে সিটে মাথা এলিয়ে দিল রোদ্রি। খুব ক্লান্ত লাগছে তার। ঘুম পাচ্ছে অনেক।

আড়চোখে একবার রোদ্রির দিকে তাকাল ফারহান। এই মেয়েটাকে দেখলে ওর কামনা জাগছে ঠি কই তবে কোথায় যেন কিছু একটা বাঁধা দেয়। অনেক মেয়ের সাথেই সম্পর্ক ছিল ওর তবে ওই প্রথম মেয়ে যার সাথে জোর করে তেমন কিছুই করতে পারে না সে। মায়া লাগে খুব।
নিজের বাসার রোডে যেয়েও গাড়ি ঘুড়িয়ে ফেলে ফারহান। রোদ্রির বাসার সামনে এসে গাড়ি থামায়।

রোদ্রির কাছে যেয়ে হাল্কা করে ডাকে। রোদ্রি একটু নড়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। ফারহান একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন রোদ্রির গলার তিলটায় তাকিয়ে থাকে। হাল্কা করে ঠোঁট ছুইয়ে দেয়। ঘুমের মধ্যেই কেঁপে উঠে রোদ্রি।

ফারহান নি:শব্দে হেসে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রোদ্রিকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে।
রিদান আর মিরার প্রশ্ন এড়িয়ে রোদ্রির রুমে যেয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় আলতো করে। নরম বিছানা পেয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পরে রোদ্রি।

ফারহান নিচে নামতেই মিরা প্রশ্ন করে,
~ তুমি না বললে তোমার বাসায় নিয়ে যাবে? নিয়ে এলে যে?
~ গাড়িতেই ঘুমিয়ে গেছে, ভাবি। ক্লান্ত লাগছিলো দেখে, আজকে রেস্ট নিক। অন্যদিন নিয়ে যাবোনে।

বিদায় জানিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসে ফারহান। ওকে ঘুমাতে দেখে যে শান্তিটা লাগছে সেটা জোর করে বাসায় নিয়ে যাওয়ার মধ্য পেতোনা সে।
মেসেজের টুংটাং শব্দে ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই ফোনটা হাতে নেয় নীরাদ।

মেসেজে ঢুকে কপাল কুঁচকে যায় তার। বেশ কিছু ছবি পাঠিয়েছে ইমন। ডাটা কানেকশন স্লো তাই দেখা যাচ্ছেনা ছবিগুলো। এক মধ্যই আরিফের কল আসে। রিসিভ করে সে,
~ হ্যাঁ, আরিফ বলো।

~ স্যার, রোদ্রি ম্যাডাম আর উনার ফিওনসের কিছু ছবি পাঠিয়েছে আপনাকে। দেখেছেন?
~ না, দেখিনি এখনো। রোদ্রি ঠি ক আছে?
~ জি স্যার।

~ আচ্ছা, ঠি ক আছে। তোমার পেমেন্ট পৌছে যাবে।
~ আচ্ছা স্যার। খুশিমনে ফোন রেখে দিল আরিফ।

ছবি নিয়ে বেশি মাথা ঘামালোনা নীরাদ। রোদ্রি ঠি ক আছে এটাই যথেষ্ট তার জন্য। ফারহান ছেলেটার উপর ভরসা নেই তার। ফোনটা পাশে রেখে আবারও কাজে মন দিলো সে।
সন্ধ্যার দিকে ঘুম ভাঙে রোদ্রির। নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করে বেশ অবাক হয় সে। সে তো ফারহানের সাথে ছিলো। তাহলে এখানে কিভাবে এল?
দরজায় নক করার শব্দ হয়।

~ রোদ্রি উঠেছিস?
~ হ্যাঁ, আসো ভাবি।
রুমে ঢুকে লাইট জালায় মিরা।

~ ভাবি? আমি না উনার সাথে ছিলাম? এখানে কি করে এলাম?
রোদ্রির কথায় ওর পাশে বসে মিরা। মাথায় হাত বুলিয়ে তখনকার কথা বলে। রোদ্রি অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌছে যায়। তার ছোট্ট মাথায় একটা প্রশ্নই ঘোরে, “অসভ্য লোকটা এত ভালো হলো কেমনে”?

~ ফারহান তোর অনেক খেয়াল করে রোদ্রি। দেখবি ওর সাথে তুই অনেক সুখী হবি। তোর ভাই তোর জন্য সঠিক মানুষই বেঁছে নিয়েছে।
মিরার কথার জবাবে কিছু বলেনা রোদ্রি। ভাবে, এই মানুষ দুইটাকে সে কিভাবে মানা করতো বিয়ের জন্য?

রাতের বেলা ফোন নিয়ে বসে নীরাদ। রোদ্রিদের ছবিগুলো বের করে অলস ভঙ্গিতে। প্রেয়সীকে দেখার প্রবল ইচ্ছা ফুটে উঠেছে তার। সামনে থেকে না হোক ছবিতেই তৃষনা মিটিয়ে নিবে সে।

তবে হয় তার উল্টো মুখে হাসির বদলে মুহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। মাথাটা ভারি ভারি লাগে।
ফোনটা পাশে রেখে চোখবন্ধ করে সে। রাগ কমানোর চেষ্টা করে। চোখের সামনে রোদ্রিকে চুমু খাওয়ার দৃশ্য ভেসে উঠে। কেমন এলোমেলো লাগে তার। কিনতু এটাতো সাভাবিক তবে সে কেনো মেনে নিতে পারছেনা? রোদ্রির মত থাকলে, এটাই তো হওয়ার ছিল, সে তো জানে রোদ্রি তার না। তবে কেন এত যন্ত্রনা? কেন নিজেকে কেন গুছিয়ে বোঝাতে পারছেনা সে? কয়েকদিনে এতটা এলোমেলো কেন হয়ে গেল সে?

হাজারটা “কেন” থাকলেও উওর একটারও নেই। নিজের জীবনের “প্রিয়” টাকে অন্যকারো “প্রিয়” হতে দেখার
ব্যাথাটা বুঝি এতটা তীব্র?


পর্ব ৬

চারদিকে স্নিগ্ধ পরিবেশ। পশ্চিম আকাশে হেলে পরেছে সূর্য। পরন্ত বিকেলবেলা।
পার্কের এককোণে দাড়িয়ে আছে নীরাদ। পরণে তার সাদা রংয়ের টি~ শার্ট। সাথে কালো ট্রাওজার।

একহাত পকেটে ঢুকিয়ে আরেকহাতে ফোন স্ক্রোল করছে সে। মাঝেমধ্য চোখ উঠিয়ে মার দিকে নজর রাখছে।
একটু দুরেই মনিরা আহমেদ অলস ভঙ্গিতে হাটাহাটি করছেন। নীরাদকে একপ্রকার জোর করেই নিয়ে এসেছেন তিনি। তার অবচেতন মন বারবার রোদ্রিকে খুঁজছে। সেদিনের পর মেয়েটাকে আর দেখেনি পার্কে।

একা একা হাঁটতে ভালোলাগেনা আর নীরাদ আজকে দুপুরেই বাড়ি ফিরেছে অফিস থেকে তাই তাকে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছে সে। হঠাৎই সামনে তাকিয়ে একটা দৃশ্য চোখে পড়তেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।

কাঁধে কারো সপর্শ পেয়ে চমকিয়ে পিছনে ফিরল রোদ্রি। রাস্তার কিছু বাচ্চাদের ঝালমুড়ি কিনে দিচ্ছিল ও। ভার্সিটির পর আজ আর বাসায় যায়নি ও। সোজা এখানে চলে এসেছে।
পিছনে তাকিয়ে মনিরাকে দেখে হাসিমুখে সালাম দিল সে।

~ কেমন আছেন আন্টি? আপনার ব্যাথা কমেছে?
রোদ্রির ব্যবহারের আজও মুগ্ধ মনিরা আহমেদ। মেয়েটার মধ্যে বিরক্তি নামক শব্দটার অস্তিত্ব নেই।
~ আমি ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?
~ আলহামদুলিললাহ ভালো আছি। আপনি আজকেও একা এসেছেন আন্টি? আবার ব্যাথা হলে?

~ আজ আর একা আসিনি মা। আমার ছেলে এসেছে সাথে।
~ ওহ্, আচ্ছা।

এরই মধ্যে ঝালমুড়িওয়ালা টাকা চেলে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেয় রোদ্রি।
~ বাহ্। তুমিতো বেশ ভালো মা। কজন ই বা ওদের সাথে এমন ব্যাবহার করে?
জবাবে মুচকি হাসল রোদ্রি। কিছু বললোনা। নিজের প্রশংসা শুনলে ওর কেমন জানো অসস্তি লাগে।
পরিচিত পুরুষালি কন্ঠে ধ্যান ভাঙে ওর। সামনে নীরাদকে দেখে বেশ অবাক হয়।
নীরাদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোদ্রির দিকে। আজকে দুইদিন পর রোদ্রিকে সামনাসামনি দেখলো ও।

এতক্ষনের বিরক্তিকর মেজাজটাও কেমন ফুরফুরে হয়ে গেছে।
~ মিস রোদ্রি? আপনি এখানে?

রোদ্রি কিছু বলবে তার আগেই মনিরা আহমেদ বলল,
~ তুই ওকে চিনিস নীরাদ? ওইতো সেদিন আমাকে বাসায় পৌছে দিয়েছিল।
~ উনি আপনার মা?

ব্যাপারটা বুঝতে কয়েকসেকেনড লাগলে নীরাদের। মা সেদিন তাকে একটা মেয়ের কথা বলছিল কিন্তু সেটা যে রোদ্রি তাতো আর সে জানতোনা।
~ জি, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে সেদিন মাকে সাহায্য করার জন্য।
~ না, ঠিকাছে। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এমনটাই করত।

~ তোমরা কিভাবে একে অপরকে চিনো সেটা নাহয় পরে জানব। রোদ্রি মা, তুমি কিনতু আজকে আমার সাথে বাসায় যাবে। সেদিন কিছু না খেয়েই চলে গিয়েছিলে।

মনিরার কথা শুনে চিনতায় পরে গেল রোদ্রি। আজকে গাড়ি না নিয়েই বেরিয়েছে সে। এখন উনাদের বাসায় গেলে দেরি হয়ে যাবে। আর সন্ধ্যা হয়ে গেলে একা একা বাড়ি ফেরার সাহস ওর মধ্যে নেই। আবার সামনে দাড়ানো মনিরাকেও না করতে পারছেনা।

না পেরে কিছুটা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
~ আন্টি আমি অন্যদিন যাবোনে। বাসায় ভাইয়া ভাবি জানেনাতো। দেরি হলে চিন্তা করবে। এমনেও আজ একা এসেছি।

রোদ্রির কথার মাঝেই নীরাদ কিছুটা হন্তদন্ত গলায় বলল,
~ আপনার ভাইয়াকে আমি জানিয়ে দিব সমস্যা নেই। আর আপনাকে বাসায়ও আমিই পৌছে দিব।

এবার আর কিছু বলতে পারেনা রোদ্রি। অগত্যা রাজি হতে হয় তাকে।
নীরাদ দের বাসার সামনের বাগানে ঘুরে ঘুরে দেখছে রোদ্রি। বাসার একপাশের এতবড় বাগানটা সেদিন তাড়াহুড়োয় খেয়ালই করেনি সে। ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি নিয়ে বিস্মিত নয়নে ফুলগুলো দেখছে সে।

বড় বড় রক্তলাল রংয়ের গোলাপ ফুটে রয়েছে একপাশে। আরো অনেক রকম ফুলের গাছও আছে তবে লালগোলাপের প্রতি তার একটা আলাদা আকর্ষন কাজ করে। সে নিজেও একটা গাছ লাগিয়েছিল তবে পরিচর্যার অভাবে কোনো ফুলই ফুটেনি।
~ এগুলো কে দেখাশোনা করে মি.নীরাদ?

এতক্ষন রোদ্রির দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে ছিল নীরাদ। তার ঠোঁটের প্রশস্ত হাসিটায় গভীরভাবে মশগুল ছিল সে। রোদ্রি আশেপাশে থাকলে অন্যদিকে তাকানোর ইচ্ছা বা ধ্যাণ কোনোটাই থাকেনা নীরাদের।

~ মালীচাচা আছে। বাগানের দেখাশোনার জন্য। আর ছুটির দিনে সময়পেলে আমিও একটু আগাছা কেটে দেই।

জবাবে”ওহ্”বলে আনমনেই একটা গোলাপ ধরতে গেলে আঙুলের ডগায় কাঁটা বিধে যায় রোদ্রির। “আহ্” বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠে সে।

তড়িঘড়ি করে এসে রোদ্রির হাত চেপে ধরে নীরাদ। অস্থির কন্ঠে বলে,
~ মিস.রোদ্রি কি করলেন? এটা ধরলেন কেন? জানেননা, গোলাপে কাঁটা থাকে। বলে খুব সন্তর্পণে কাঁটাটা
বের করে ফেলে। সাথে সাথেই রক্ত বেরিয়ে আসে।

ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে রোদ্রি। ছোট থেকেই রক্ত দেখতে পারেনা সে।
রোদ্রির রক্ত দেখে বিচলিত হয়ে উঠে নীরাদের মন। নিজেকে বারবার কথা শোনায়, ও একটু খেয়াল রাখলেই ব্যাথাটা পেতোনা রোদ্রি।

সোফায় চুপ করে বসে আছে রোদ্রি। খুবই যত্ন করে তার হাতে স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছে নীরাদ। নীরাদের চেহারা দেখে ব্যাথার মধ্যেও হাসি পাচ্ছে তার। মনে হচ্ছে হাত হাতে নয় নীরাদের হাতেই কাঁটা ফুটেছে। আর ব্যাথাটাও তারই হচ্ছে। একবার স্যাভলন লাগাচ্ছে আর আরেকবার মুখ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছে নীরাদ।

রোদ্রিকে হাসতে দেখে শাসনের সুরে বলল,
~ আপনি হাসছেন? কতটা রক্ত বের হলো দেখেছেন? বলে পাশে থাকা তুলাটা উঁচু করে দেখাল।

~ আঙুলে কাটলে রক্ত একটু বেশিই বের হয় মি.নীরাদ।
~ আর ব্যাথা? ব্যাথা পাচ্ছেন না? এরকম বাচ্চামো কাজ করলেতো ব্যাথাই পাবেন। কথায় কথায় তো কান্না করে দেন, আর আজ খুব হাসি পাচ্ছে না?

কথায় কথায় কান্না বলতে যে নীরাদ সেদিন হসপিটালের কথা বলেছে ব্যাপারটা বেশ বুঝতে পেরেছে রোদ্রি। রাগে গাল ফুলিয়ে সে বলল,
~ ছাড়ুনতো, হাত ছাড়ুন আপনি। লাগবেনা আপনার কিছু করা। আপনি একটা..
আর কিছু বলার আগেই রোদ্রির ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিল নীরাদ। শাসন ভরা গলায় বলল,

~ একদম চুপ করে বসে থাকেন। কোন কথা বলবেন না।
লোকটার শাসনে কেমন যেন একটা মায়া আছে। উনার
শাসন শুনে খারাপ লাগছেনা রোদ্রির। বরং একরকম ভালোলাগা কাজ করছে।

সুন্দর করে ব্যান্ডেড নাগিয়ে যখনই উঠতে যাবে নীরাদ, তখনই আকাশের মেঘ ডাকার শব্দ হয়। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে ঠান্ডা বাতাস হচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে খুব জোরে।
~ মি.নীরাদ। আমার এখন বাসায় যাওয়া উচিত। দেখুন বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।
~ আচ্ছা, ঠিকাছে। আপনি আসুন। আমি গাড়ি বের করছি।


মাঝপথেই বৃষ্টি নেমে গেছে। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। এতক্ষন গাড়ির জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে ছিল রোদ্রি। শীতল বাতাসে কেঁপে উঠছিলো মাঝে মাঝে। নীরাদ জানালা বন্ধ করতে বললেও সে করেনি। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পরও জানালা খোলা রাখায় পানির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে রোদ্রিকে।

~ মিস রোদ্রি এবার জানালাটা বন্ধ করেন। ভিজে যাচ্ছেনতো।
নীরাদের কথায় রোদ্রির কোনো হেলদোল নেই। বাধ্য হয়ে নীরাদ নিজেই কিছুটা ঝুকে যায় রোদ্রির দিকে, একহাতে সুইচ চেপে জানালাটা লাগিয়ে দেয়। বিরক্তি নিয়ে মুখ ঘুরাতেই নীরাদকে এতটা কাছে পেয়ে হচকচিয়ে যায় রোদ্রি। সাথেসাথেই সরে নিজের সিটে বসে পরে নীরাদ।

কিছু না বুঝেই ফট করে বলে রোদ্রি,
~ আপনি এত আনরোমান্টিক কেন? কই বৃষ্টি উপভোগ করবেন, তা না করে জানালাটা বন্ধ করে দিলেন।

প্রশ্নটা করে নিজেই বেকুব হয়ে যায় রোদ্রি। ছিহ্, এটা কি বলল সে? বেশ লজ্জা পায় সে।
রোদ্রির প্রশ্নে হেসে দেয় নীরাদ। ব্যাপারটা সহজ করে দেয় রোদ্রির জন্য। হাসতে হাসতেই রোদ্রিকে বলে,
~ আপনার কি এখন রোমান্স করতে ইচ্ছে করছে? হাউ ফানি।

সারাটা রাস্তা আর একটাও কথা বলেনি রোদ্রি। । চুপ করে বসে ছিল। নীরাদও কিছু বলেনি।
দুজনের মাঝেই কেমন একটা জড়তা। অসস্তির দেয়াল। যতবারই এ দেয়াল ভাঙতে চায় নীরাদ, ততবারই রোদ্রির হাতের জলজল করা আংটিটা তার “অন্যকারো”হওয়ার জানান দেয়।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো শহর। ধুয়ে মুছে সতেজ হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। এভাবেই যদি তাদের মধ্যেকার জড়তাটাও মুছে ফেলতো পারতো এই বৃষ্টি।


পর্ব ৭

সময় গড়িয়ে চলেছে।
সেদিনের পর রোদ্রি ভেবেছিল ফারহান হয়তো আর অসভ্য আচরণ করবেনা তার সাথে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ফারহান তার আচরণে বহাল আছে। কারণে অকারণে সুযোগ পেলেই রোদ্রিকে বাজেভাবে ছুঁয়ে দেয় সে। ব্যাপারটা একদমই সহ্য হয়না রোদ্রির। কিনতু ভাই ভাবির কথা ভেবে কিছু প্রকাশ করেনা সে।

সন্ধ্যাবেলা নিজের রুমে রেডি হচ্ছিল রোদ্রি। আজ রাতে ফারহানের সাথে একটা পার্টিতে যেতে হবে তাকে। নামিদামি বিজনেস ম্যানরা আসবে সেখানে তাই ফারহান কেও ইনভাইট করা হয়েছে। তাই রোদ্রিকেও যেতে হবে তার সাথে। সে মানা করেছিল কিন্তু ফারহানের কথার সাথে পেরে ওঠেনি। বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয় তাকে। একটু পরেই তাকে নিতে আসবে ফারহান।

মেরুন কালারের একটা থ্রিপিস পরেছে রোদ্রি। চুলগুলো ছাড়া তবে মাথায় ঘোমটা দেয়া ওড়না দিয়ে। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক আর চোখে কাজল ছাড়া আর কোনো সাজগোজ নেই। তবে এতেই যেনো অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। রোদ্রির গায়ের রং ফর্সা না। সে উজ্জল শ্যামলা সেজন্যই বোধহয় মেরুন রংটা বেশি মানিয়েছে।

রোদ্রির হাত ধরে গাড়িতে বসাল ফারহান। রোদ্রির পাশে বসে ড্রাইভারকে গাড়ি স্টান্ট দিতে বলল।
ফারহান বসতেই রোদ্রি একটু চেপে গেল।
~ তোমাকে তো আজ খুব হট দেখাচ্ছে জান। আজকে কিছু করে ফেললে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবে না। বলেই বাঁকা হাসল ফারহান।

ফারহানের কথায় বুক কেঁপে উঠল রোদ্রির। শক্ত কন্ঠে বলল সে,
~ এসব কি বলছেন আপনি?

~ ডোন্ট বি এ্যাঙরি জান। রাগছো কেন? আমিতো তোমার প্রশংসা করলাম।
চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকল রোদ্রি।
~ ওখানে যেয়ে কিন্তু আমার সাথে সাথেই থাকবে। ঠিকাছে?
~ হুম।

এককোণায় ফারহানের পাশে চুপ করে বসে আছে রোদ্রি। তার পাশে বসেই ফারহান ড্রিংক্স করছে সাথে তার আরো দু তিনজন বন্ধু আছে।
আশেপাশের মেয়েগুলার ড্রেস~ আপ দেখে মাথায় রাগ উঠে গেছে ওর। মনে মনে ভাবছে, এদের কি বাসায় কাপড় নেই? কারো কারো জামা তো হাঁটু অবধি যায়নি। পুরো জায়গাটা প্রায় অন্ধকার। আবছা আবছা নীল আলো। স্লো মোশনে একটা ইংরেজি গান বাজছে।

ড্রিংক্স এর গন্ধে বমি পাচ্ছে রোদ্রির। ফারহানকে ছাড়া কাউকেই চিনেন সে আর আশেপাশের মানুষগুলোকেও বিশেষ সুবিধার লাগছেনা তার। অগত্যা এখানে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই তার।

~ ফারহান? শুনছেন? চাপা গলায় ডেকে উঠে রোদ্রি।
ফারহান তাকাতেই ওর লালচোখগুলো দেখে আৎকে উঠে রোদ্রি। তবে স্বাভাবিক কন্ঠেই ফারহান বলে,
~ হ্যাঁ, বলো।

~ আপনি ঠিক আছেন?
রোদ্রির প্রশ্নে ভ্রু কুচকালো ফারহান। তার কি হবে?
~ আমার কি হবে জান?
~ না কিছুনা। বলছিলাম যে, আপনি এতো খাচ্ছেন কেনো এইসব? কিছু হয়ে গেলে?
~ কিছু হবেনা। তুমি…হঠাৎই থেমে যায় ফারহান। সামনের দিকে ইশারা করে বলে,
~ ওটা নীরাদ না?

সামনে সত্যিই নীরাদকে দেখে চমকে উঠে রোদ্রি। মি.নীরাদ এখানে কিভাবে আসবে? পরক্ষনেই নিজের উপর বিরক্ত হয় এটা যেহেতু বিজনেসম্যানদের পার্টি তো এখানে নীরাদের আশাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
মৃদু গলায় জবাব দিলো সে,
~ জি।

ততক্ষনে নীরাদ তাদের টেবিলের কাছে চলে এসেছে। রোদ্রিকে দেখে অবাকের সাথে খুশিও হয় সে।
ফারহান উঠে সৌজন্যর হাত বাড়িয়ে দেয়।
~ হ্যালো, নীরাদ সাহেব কেমন আছেন?
~ জি ভালো। আপনি?

~ এইতো ভালোই। বউ সাথে থাকলে কি আর খারাপ থাকা যায় বলেন?
নীরাদ কিছু বললোনা। রোদ্রির দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। রোদ্রিও জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো।

ফারহান ড্রিংক্সের গ্লাস এগিয়ে দেয়। বসতে বলে তাদের সাথে। নীরাদ ভদ্রভাবে এড়িয়ে যায়। সে ড্রিংকস করেনা।
ফারহান আবার বসে যায় ড্রিংক্স করতে। রোদ্রি বারবার মানা করছে আর খেতেনা।
একপর্যায়ে হুঁশ হারিয়ে ফেলে সে। রোদ্রিকে জোড় করে উপরতলায় নিয়ে যায়। এত মানুষের সামনে রোদ্রি চিৎকারও করতে পারছেনা। ফারহানের শক্তির সাথে কোনোভাবেই পেরে উঠছেনা সে।

ফারহান যেনো নিজের মধ্যে নেই। তার মাথায় চলছে শুধু রোদ্রিকে পাওয়ার নেশা। আর কিছুনা।
একটা রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল সে। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় রোদ্রির। তবে কি আজ খারাপ কিছু হতে চলেছে?


পর্ব ৮

ফারহান দরজা বন্ধ করে পিছনে ফিরে রোদ্রির ভয়ার্ত চোখে চোখ পরে তার। শব্দ করে হেসে উঠে সে।
হাসির শব্দে ভয়টা দিগুন হয়ে যায় রোদ্রির। চোখের পানি ছেড়ে দেয় সে।

একপা একপা করে রোদ্রির দিকে এগিয়ে যায় ফারহান। রোদ্রিও পিছাতে থাকে। একসময় টেবিলের কোনায় পা লেগে পড়ে যেতে নেয়। পড়ে যাওয়ার আগেই হাত ধরে কাছে টেনে নেয় ফারহান। একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রোদ্রিকে। ফারহানের সপর্শে শরীর কেঁপে উঠে রোদ্রির। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। চোখের কোঁণ দিয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পরে পানি। কাঁপা গলায় বলে,

~ ফারহান প্লিজ ছাড়ুন। এমন করবেন না।
~ কেনো জান? আমাকে ভালো লাগে না? হুম?
ফারহান পুরোই মাতাল। কনঠ জড়িয়ে আসছে তার। কথাবার্তায় কেমন যেন জড়তা।
রোদ্রি বুঝতে পারছে ফারহান নিজের মধ্য নেই। রেগে কথা বললে সে আরো এগ্রেসিভ হয়ে পরতে পারে। তাই অনুরোধের সুরেই বলে,

~ ফারহান আপনি আমাকে ছাড়ুন। এসব ঠি ক না। আপনি কেনো বুঝতে পারছেন না? ছাড়ুন বলছি। বলে ফারহানের বাহুতে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয় রোদ্রি। কিন্তু সরাতে পারে না।
এবার আর সামলাতে পারেনা ফারহান। একহাত দিয়ে রোদ্রির মুখ চেপে ধরে।

ওড়না সরিয়ে ফেলে দিয়ে খুব রুডলি গলায় ঠোঁট চেপে ধরে। অনবরত হাত দিয়ে ধাক্কা দেয় রোদ্রি। কোনোভাবেই ছাড়াতে পারেনা নিজেকে। মনে মনে বারবার আল্লাহকে ডাকে।
উপরতলার ওয়াশরুমে এসেছিল নীরাদ। বের হতেই দেখলো রোদ্রিকে নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো ফারহান।

কপাল কিনচিত কুচকে এলো তার। রোদ্রি সেরকম মেয়েই না যে ফারহানের সাথে রুমে রাত কাটাবে। তবে কি ফারহান জোর করছে রোদ্রির সাথে? ভাবতে ভাবতেই সেই রুমের দরজার সামনে যায় নীরাদ। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে তাদের বের হওয়ার জন্য। বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলেও তারা বের হয়না।

রুমের থেকে তেমন আওয়াজ পাচ্ছেনা সে। বাধ্য হয়েই দরজায় কান লাগালো নীরাদ। মৃদু কন্ঠে চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। ভয় পেয়ে যায় নীরাদ। রোদ্রির কিছু হলোনাতো?
দরজা ধাক্কায় সে। ভরাট গলায় ডাকে,
~ মিস.রোদ্রি? মিস রোদ্রি?

নীরাদের কন্ঠ শুনে যেন প্রান ফিরে পায় রোদ্রি। ডাকতে চায় তবে পারেনা। শক্ত করে মুখ চেপে আছে ফারহান।
মুখ দিয়ে জোরে জোরে “উমম””উমম” শব্দ করে সে।
~ মিস.রোদ্রি? আপনি ঠি ক আছেন?
এবার ফারহানের হাতে কামড় বসায় রোদ্রি। “নীরাদ, প্লিজ বাঁচান আমাকে”বলে চিৎকার দেয় সে।

ফারহান একবার তাকিয়ে আবারো মুখ ডুবায়। তার কানে কোনো কথাই যাচ্ছেনা।
রোদ্রির চিৎকার শুনে নীরাদ দ্রুত কয়েকবার কাঁধ দিয়ে বাড়ি দেয় দরজায় একপর্যায়ে ছিটকিনি খুলে যায় দরজার। ভেতরে ঢুকে এই অবস্থা দেখে দৌড়ে ফারহানের কলার টেনে রোদ্রির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়। রাগে কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে নীরাদের। ফারহানের নাক বরাবর একটা ঘুষি মারতেই নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে।

এমনেই মাতাল ছিল তার উপর আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পরে যায় ফারহান।
আবারো ফারহানকে মারার জন্য হাত বারাতেই আচমকা রোদ্রি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নীরাদকে। নীরাদের বুকে মাথা রেখে পিঠের দিকের শার্ট খামছে ধরে জোরে শব্দ করে কান্না করে দেয়। অস্থির হয়ে উঠে নীরাদ। রোদ্রির কান্না সহ্য হয়না তার। মেয়েটার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে সে। রোদ্রিকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরেনা।

আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। এখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে নীরাদ।
~ মিস.রোদ্রি? শান্ত হোন। আপনি ঠি ক আছেনতো। কিছু হয়নি।
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে রোদ্রি। থেমে থেমে বলে,
~ আপনি…আপনি না থাকলে তো….

~ আচ্ছা, আমি আছিতো। কান্না থামান। ভয়ের কিছু নেই।
রোদ্রিকে আলতো করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয় নীরাদ। কেউ এই অবস্থায় দেখে ফেললে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে।

মেঝে থেকে ওড়নাটা তুলে রোদ্রির হাতে দেয়। দ্রুত গায়ে জড়ায় রোদ্রি। মনে মনে আল্লাহর কাছে হাজারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নীরাদকে পাঠানোর জন্য।
চোখের কাজল লেপটে গেছে। লিপস্টিক ছড়িয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখফুলিয়ে ফেলেছে রোদ্রি।

পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দেয় রোদ্রির দিকে। নরম গলায় বলে,
~ মিস.রোদ্রি মুখটা মুছে নিন। আর ওয়াশরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন। আপনাকে বাসায় দিয়ে আসব আমি। রাত হয়ে গেছে।

মাথা কাত করে সম্মতি দেয় রোদ্রি। হাত উঠিয়ে ফারহানের দিকে ইশারা করে।
~ ওকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবেনা। ওকে আমি দেখছি। আপনি যান। কন্ঠে তীব্র রাগ প্রকাশ প্রায় নীরাদের।


মাথা নিচু করে গাড়িতে বসে আছে রোদ্রি। হাত দিয়ে চোখ মুছছে বারবার। পাশেই নীরাদ ড্রাইভ করছে।

~ তো আপনি আপনার ভাইয়া ভাবির কথা ভেবে চুপ ছিলেন? ফারহান যে দিনের পর দিন আপনার সাথে এমন আচরণ করেছে, আপনার কি মনে হয় আপনার ভাই ভাবি এগুলো জানলে খুব খুশি হতো? আপনি মারাত্মক বোকা একজন মেয়ে। উনাদের যদি আপনি একবার জানাতেন তাহলে হয়তো আজ এই পরিস্থিতি তৈরিই হতোনা।

আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কথা?
কাঁদতে কাঁদতেই উপর নিচে মাথা নাড়ায় রোদ্রি।
কিছুক্ষণ রোদ্রির দিকে তাকিয়ে থাকে নীরাদ। মেয়েটা মনে হয় আজকে চোখের সব পানি শেষ করেই ক্ষান্ত হবে।

~ কান্না করা বন্ধ করেবেন না তাইতো? ওকে ফাইন। কান্না করেন। তারপর যখন মাথা ব্যাথা করবে তখন বুঝবেন। এমনেও আপনি নিজের ভালোটা বুঝেননা। আসলে যারা বুঝতে চায়না তাদের বুঝিতে লাভ নেই।

আর আমার কথা শুনে তো আপনার কোন লাভ নেই। আমি তো বাইরের মানুষ।
~ আপনি ভুল বুঝছেন। আমি সেরকম বলিনি। আমি..
~ আমি তো তাও ভুল বুঝেছি মিস। আপনি তো ভুল ঠি ক কিছুই বোঝেন না।
রোদ্রি কিছু বলেনা। মন খারাপ হয় তার। নীরাদ রেগে আছে। তার সাথে রাগ না দেখালেও সে বুঝতে পারছে।


বাসায় পৌছে কলিংবেল বাজাতেই গেট খুলে মিরা। খুলতে খুলতেই বলে,
~ তোর এতো দেরি হলো…এতটুকু বলে থেমে যায় মিরা। সামনে নীরাদের পাশে রোদ্রিকে দেখে অবাক হয়।
বিস্মিত কন্ঠে বলে~

~ নীরাদ তুমি? এতরাতে? রোদ্রি..তোমার সাথে? তোর চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন রোদ্রি? কি হয়েছে!!
~ ভাবি, ওকে রুমে যেতে দিন। আমি বলছি কি হয়েছে। আর রিদান ভাইয়া কি জেগে আছেন? আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা ছিল।

~ আসো ভেতরে আসো। রোদ্রি রুমে যা। আর নীরাদ আসো, রিদান জেগেই আছে।
রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো রোদ্রি। ও ভাবতেও পারেনি আজকে এমন কিছু হবে। নীরাদের করা কেয়ারগুলো প্রচন্ড ভালো লাগে ওর। কেমন একটা শান্তি শান্তি লাগে। মনে হয় নীরাদ পাশে থাকলে ওর কোন খারাপ হতে পারবেনা। নীরাদ ওর সাথে খারাপ কিছু হতেই দিবেনা।
কিছুদিনের পরিচয় অথচ কত ভরসাপূর্ণ অনুভূতি।

একটা কথা আছেনা,
ভালোবাসার জন্য অনন্তকালের প্রয়োজন নেই।
একটি মূহুর্তই যথেষ্ট!
~ ইভান তুর্গেনিভ


পর্ব ৯

জানালা ভেদ করে সকালের রোদ মুখের উপর পরতেই ঘুম ভেঙে যায় রোদ্রির। চোখমুখ কুচকে পাশ ফিরে শোয় সে। কাল রাতে মাথাব্যাথার কারণে তাড়াহুড়ো করে শুয়ে পরেছিল, তাই হয়তো পর্দা লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। নীরাদের কথা অনুযায়ী, “সত্যিই কালকে কান্না করার ফলে প্রচন্ড মাথাব্যাথা উঠেছিল তার”। উঠে গিয়ে ওষুধ খাওয়ার শক্তি ছিলোনা।

ঘোরের মধ্যই কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলো মনে নেই। মাইগ্রেনের সমস্যা আছে রোদ্রির।
তবে এখন একটুও ব্যাথা নেই। বেশ হাল্কা লাগছে তার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে পাশের টেবিলে চোখ পরতেই দেখলো সেখানে মাথা ব্যাথার ওষুধের পাতা রাখা। হাত বাড়িয়ে নিতেই দেখলো একটা ওষুধ নেই।

র মাথা ব্যাথা করছে? প্রশ্ন টা মাথায়ই থেকে গেলো ওর।
ধীরপায়ে ভাইয়ের রুমে ঢুকলো রোদ্রি। কেমন যেন অপরাধবোধ কাজ করছে। মনে হচ্ছে সে খুব করে একটা ভুল করে ফেলেছে।

~ এখানে বসো। বলে নিজের পাশে ইশারা করে রিদান।
ভাইয়ের মুখে “তুমি”সম্মোধন শুনে প্রচন্ড খারাপ লাগে রোদ্রির। মৃদু কন্ঠে বলে,
~ ভাইয়া, তুমি রেগে আছো?

রোদ্রির কথায় নড়েচড়ে বসে রিদান। রাগ ঝেড়ে একেবারেই শান্ত কন্ঠে বলে,
~ আমি রাগি আর যাই করি তাতে কি তোমার কিছু আসে যায়? তুমি কি আমাদের আদৌ আপন ভাবো?
রিদানের শান্ত কন্ঠেও চরম অশান্ত হয়ে ওঠে রোদ্রির মন।
~ ভাইয়া প্লিজ..এভাবে বলোনা। ভাবি তুমিতো বুঝো এটলিসট। চোখ দিয়ে একফোটা পানি গড়িয়ে পরে তার।

রিদান আর রাগ ধরে রাখতে পারেনা। উঠে যেয়ে রোদ্রির মাথায় হাত রাখে। একহাত দিয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়।
নরম সরে বলে,
~ তুই যদি আমাকে একটাবার বলতি বোন যে ফারহানকে তোর ভালো লাগেনা বা ও তোর সাথে মিসবিহেভ করে তাহলে তোদের বিয়ে তো দূর, আমি ওর ছায়াটাও তোর উপর পরতে দিতাম না। আমার কাছে তোর ভালো থাকাটা জরুরি বোন। কাল যদি নীরাদ না থাকতো তাহলে কি হতো একবার চিন্তা করেছিস?

নীরাদ যদি কাল আমাকে আর মিরাকে সব খুলে বলেছে। তুই তো কখনোই সংকচের জন্য বলতে পারতিনা।
কথাগুলো বলে থামলো রিদান। খুব আদরের বোন তার। কখনো চোখে পানি আসতে দেয়নি।
~ আচ্ছা, বাদ দাও এসব কথা রিদান। আর রোদ্রি তুইও এসব নিয়ে আর কোনো চিন্তা করবিনা। তোদের বিয়েটা রিদান ভেঙে দিয়েছে। ..আর এখন নিচে চলো দুই ভাইবোন। নাস্তা দিচ্ছি আমি। বলে নিচে চলে গেল মিরা।

রোদ্রি নিচে নেমে রান্না ঘরে ঢুকে। দেখে মিরা খাবার বারছে। মিরার পাশে যেয়ে দাড়ায় সে। পাশ থেকে একটা পাত্রে পানি বসায় চুলায়। উদ্দেশ্য চা বানানো।
~ তোর মাথা ব্যাথা কমেছে? নাকি এখনো আছে?
রোদ্রি এবার আশ্বস্ত হয় সে ভাবিই ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে।
~ না নেই। তুমি ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলে না রাতে।

~ আমি দেইনি। নীরাদ ওষুধ নিয়ে গিয়েছিলো তোর রুমে। বললো, তোর নাকি মাথা ব্যাথা। তুই জেগে ছিলি না?
~ না।

~ ওহ্। ছেলেটা হয়তো ঘুমের মধ্যেই তুলে খাইয়ে দিয়েছে। …তুই টেবিয়ে আয়, চা আমি বানিয়ে দিচ্ছি।
~ না হয়ে গেছে। আমি আসছি।
নীরাদের কথা ভেবে আনমনেই হেসে উঠে রোদ্রি। লোকটা যে কেনো ওর এতটা কেয়ার করে?
বুঝতে পেরেও বুঝতে চায়না রোদ্রি। কিছু কিছু জিনিস হয়তোবা না বোঝাই ভালো।


হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে ফারহান। অবস্থা বেশি ভালোনা তার। সবাই জানে মাতাল অবস্থায় ড্রাইভ করে এক্সিড্যানট হয়েছে তার।
কিন্তু আসল ব্যাপার এইটা না। নীরাদের লোকেরা তাকে আগেই একটা গো~ ডাউনে নিয়ে গিয়েছিল।

গতকালকে রোদ্রির বাসা থেকে বেরিয়ে ফারহানের কাছে যায় নীরাদ।
বেদমভাবে মারে তাকে। নিজের রাগ মিটিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়। একপর্যায়ে ফারহানের অবস্থা বেশি

খারাপ হয়ে গেলে কয়েকজন মিলে আটকায় তাকে। । তারপর নীরাদের নির্দেশে একসিডেন্ট কেস সাজিয়ে হসপিটালে দিয়ে আসে।
নীরাদের এমন রাগি রুপটা খুব কম মানুষই দেখেছে। অযথা অকারণে সে কখনোই রেগে যায়না।

অফিসে নিজের রুমের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে নীরাদ। চোখের মনিগুলো স্হিরভাবে ফোনের স্ক্রীনে আটকে আছে। স্ক্রীনে ভাসছে রোদ্রির ঘুমন্ত একটি ছবি। স্লাইড করে পরের ছবিটা দেখেই হাসলো নীরাদ, তার বুকে রোদ্রির মাথাটা পরম যত্নে রাখা।

গতকাল রাতে যখন রোদ্রিকে তুলে ওষুধ খাওয়াচছিল তখনই ছবি দুটো তুলেছিলো সে।
ভাগ্যিস মেয়েটা ঘুমিয়ে ছিল নয়তো আর ছবি তুলে মুহুর্তটা স্বৃতিতে বন্দি করে রাখতে পারতোনা। ফোনটা বন্ধ করে পাশে রাখলো। কাজে মন দিতে পারছেনা সে। একহাত দিয়ে মাথার চুল চেপে ধরলো নীরাদ।
রোদ্রি নামক “ব্যাধি”টা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে প্রবলভাবে।


পর্ব ১০

“ভালোবাসা”শব্দটা খুব ছোট হলেও এর অনুভূতির বিস্তার প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভালবাসার অনুভূতি কেবল সেই বোঝে সে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে পারে।

গত কয়েকদিনে নীরাদ আর রোদ্রির মধ্যেকার সম্পর্কটা বেশ সহজ হয়ে ওঠেছে। এখন সংকোচের পাহাড় সমান দেয়ালটা নেই তাদের মাঝে। প্রায়ই নীরাদের বাসায় আসা যাওয়া করে রোদ্রি। মনিরা আহমেদ এর সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠেছে তার। এমনকি মিরাও মাঝেমাঝে রোদ্রির সাথে নীরাদের বাসায় যায়।

একসাথে তিনজনের সময়টা বেশ ভালোই কাটে তাদের।
আজ ভার্সিটিতে পরীক্ষা ছিলো রোদ্রির। ফাইনাল পরীক্ষা ছিল তাই পড়াশোনার চাপটাও একটু বেশি ছিলো এই কয়েকদিন। দম ফেলার সময় পায়নি। বেশ রিল্যাকস মুডে ভার্সিটি থেকে বের হলো রোদ্রি। বের হতেই মুখে বিরক্তির ছাপ দেখা দিলো তার।

আশেপাশে কোথাও ড্রাইভার আঙ্কেলকে পেলোনা সে। বেশ গরম পরেছে আজকে। সুর্যের তাপ মনে হয় আজ একটু বেশিই। তাকে কি কেউ নিতে আসেনি নাকি? খুজাখুজি শেষে আবার মেইন গেটের সামনে আসতেই কপাল কুচকে চোখ ছোট ছোট করে ফেলে রোদ্রি। সামনে নীরাদকে দেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায়। নীরাদ তখন উল্টোদিকে ফিরে কানে ফোন লাগিয়ে ছিল।

~ মি.নীরাদ আপনি এখানে?
রোদ্রির কথায় দ্রুত পেছনে ফিরে নীরাদ। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে অস্থির কন্ঠে বলে,
~ মিস.রোদ্রি আপনাকে কতবার ফোন করলাম, ফোন কোথায় আপনার? রিসিভ করছিলেন না কেন? কই গিয়েছিলেন? আপনাকে না পেয়ে কতোটা টেনশনে পরে গিয়েছিলাম জানেন?
নীরাদের একঝাঁক প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে যায় রোদ্রি। পরক্ষনেই ভেতরে ভেতরে হেসে উঠে। নীরাদ তার জন্য কতো টেনশন করে।

~ আমি আসলে ড্রাইভার আঙ্কেলকে খুঁজতে একটু ওই দিকটায় গিয়েছিলাম। ভাবলাম উনি হয়তো নিতে আসেননি তাই চলে আসলাম আরকি…বলে একটা বোকা বোকা হাসি দিল রোদ্রি।

~ আঙ্কেল আসবেনা। আমিই নিতে এসেছি আপনাকে। আজ নাকি আপনার পরীক্ষা শেষ। তাই মা আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে বলেছে। আপনার ভাবিও ওখানেই। এই নিন আপনার ভাবির সাথে কথা বলে নিন।
বলে রোদ্রির দিকে ফোনটা এগিয়ে দিল নীরাদ।

ফোনটা কানে দিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা শোনা গেল মিরার,
~ হ্যালো, রোদ্রি। তুই নীরাদের সাথে চলে আয় ওদের বাসায়। চাচী আর আমি মিলে রান্না করছি। তুই চলে আয় তাড়াতাড়ি। ঠিকাছে? বেশ উৎসুক শোনায় মিরার গলা।
~ হু, আসছি।

গাড়ীর সামনের অংশ খুলে চিন্তিত চেহারায় বারবার কি যেন করছে নীরাদ। এমন একটা সময় গাড়িটা কিভাবে নষ্ট হলো বুঝতে পারছেনা সে। কিছুতেই স্টার্ট হচ্ছেনা।
পাশেই মাথায় ঘোমটা টেনে দাড়িয়ে আছে রোদ্রি। গরমে শেষ সে। সকালে যে কেন চুলগুলো বেঁধে আসেনি। বারবার ওড়না দিয়ে ঘাম মুছছে।

রোদ্রির দিকে ঘুড়ে খানিকটা ইতস্তত গলায় নীরাদ বললো,
~ রিকশায় যেতে পারবেন? গাড়িটায় কি সমস্যা হলো বুঝতে পারছিনা।
রোদ্রি তাকাল নীরাদের দিকে। রিকশায় যেতে ওর সমস্যা নেই। ও প্রায়ই রিকশায় আসা যাওয়া করে। কিন্তু নীরাদের সাথে এক রিকশায় যেতে হবে তাই একটু অসস্তি হচ্ছে।
~ জি? রিকশায়?

~ হুম। (নীরাদ জানে রোদ্রির অসস্তি হচ্ছে তাই জোর করলোনা)গরমে অসুস্থ হয়ে যাবেনতো। ঘেমে যাচ্ছেন। তাই বললাম।

নীরাদকে গভীরভাবে কয়েক সেকেন্ড খেয়াল করতেই রোদ্রি দেখল। উনার ও টি~ শার্ট অর্ধেক ভিজে গেছে। অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার চেহারাটা হাল্কা লাল হয়ে গেছে। কপালে গলায় ঘাম চিকচিক করছে রোদে। হাতের ঘন লোমগুলো ঘেমে লেপটে আছে শরীরের সাথে। ওর জন্য কত কষ্ট করে দাঁরিয়ে আছেন উনি।

~ যেতে পারবেন মিস?
~ জি আচ্ছা। সমস্যা নেই।
নীরাদ একটা রিকশা ডাকল। রোদ্রিকে উঠিয়ে দিয়ে নিজেও উঠল।
নীরাদ উঠতেই রোদ্রি একটু চেপে গেল। কিন্তু জায়গা কম হওয়াতে গায়ের সাথে গা লেগেই গেল।

রিকশায় হুটতোলা তাই দুজনেই প্রায় দুজনের নি:শ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে।
এখানে রোদ নেই তাই মাথার ঘোমটাটা ফেলে দিল রোদ্রি। চুলগুলা ঠি ক করছে তখন নীরাদ বলল,
~ খোঁপা করে ফেলেন। এই গরমে চুল খোলা রেখেছেন কেন? তার উপর যে বড় চুল আপনার। মাশাআল্লাহ।

রোদ্রি কিছু বললোনা। নিরবে চুলগুলা হাতখোপা করতে ব্যস্ত হয়ে পরল।
নীরাদ মুচকি হাসলো। রোদ্রির গালের লাল আভাটা চোখ এড়ায়নি ওর।
হঠাৎই রোদ্রির কি হলো ও নিজেও বুঝলোনা। নীরাদের ঘাড়ে হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে মুছে দিতে দিতে বলল,

~ ইশশ..আপনি তো পুরো ঘেমে ভিজে গেছেন। আমার জন্য এতটা কষ্ট করতে হলো আপনার।
নীরাদ হাসলো। রোদ্রির ছোয়াঁতে নিমিষেই নীরাদের ক্লান্তি দুর হয়ে গেলো।
~ কষ্টের কিছু নেই মিস.রোদ্রি। আপনি বুঝবেননা।
রোদ্রি এখনো হাত সরায়নি।

~ আমার ব্যাগে পানি আছে। বের করে দিব? খাবেন?
নীরাদ আচমকাই মাথা ঘুড়িয়ে রোদ্রির একদম চোখে চোখ রাখল। রোদ্রি নীরাদের দিকেই চেয়ে ছিলো। আচমকা ধরা পরে যাওয়ায় বেশ লজ্জা পেলো সে।
~ “খেয়াল রেখেন মিস.রোদ্রি, আপনার করা কেয়ারগুলো আবার আমার অভ্যাসে পরিণত না হয়ে যায়, হলে কিন্তু ঝামেলায় পরবেন”।

রোদ্রির খুব করে বলতে ইচ্ছা হলো”সেই ঝামেলায় আমি বারবার পরতে চাই মি.নীরাদ”। কিন্তু বলতে পারলোনা, কথাগুলো মনের ভিতরেই জমা হয়ে রইলো। হয়তো কোনো এক নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে সে ব্যক্ত করবে তার অব্যক্ত কথাগুলো।

বাসায় ঢুকেই বিরিয়ানির সুবাস পেলো রোদ্রি। রান্নাঘরে যেয়ে দেখলো মনিরা আর মিরা মিলে রান্না করছে। কাজের মেয়ে টাও আছে।

রোদ্রিকে দেখে উজ্জল হয়ে উঠলো মনিরার মুখ। উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
~ রোদ্রি মা। কতদিন পরে দেখলাম তোমাকে।
~ কতদিন না আন্টি। আমি ১৫ দিন আগেই এসেছিলাম। পরীক্ষা শুরু হয়েছিলো তো তাই আসতে পারিনি। আজকেই শেষ হলো।

মনিরা এগিয়ে আসলো মাথার হাত বুলিয়ে বললো,
~ কেমন হয়েছে পরীক্ষা?
~ ভালো। বসে মুচকি হাসলো রোদ্রি।
~ তুই হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আয় রোদ্রি। খাবার হয়েই গেছে।


ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই দেখলো টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে মিরা আর মনিরা।
~ সালাদটা আনতে ভুলে গেছি। বলে কাজের মেয়ে টুম্পা কে ডাকতে গেলে রোদ্রি বলে,
~ আমি এনে দিচ্ছি আন্টি। বলে দ্রুতপায়ে রান্নাঘরে ঢুকলো রোদ্রি। প্লেটটা হাতে নিতেই বিস্ফোরিত একটা শব্দ হলো। আগুনের ধোঁয়ায় ভরে গেল পুরো ঘর।

জ্ঞান হারানোর আগমুহুর্তে শুধু পরিচিত কিছু মানুষের কন্ঠের চিৎকার কানে আসলো রোদ্রির।


পর্ব ১১

রোদ্রিকে অজ্ঞান অবস্থায় কোলে নিয়ে দ্রুত নিজের ঘরে গেলো নীরাদ। যত্ন করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ডাক্তার কে কল করলো। মিরা আর মনিরা পাশে বসে কান্না করছে আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রোদ্রির।

রান্নাঘরের আগুন ততক্ষনে নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। খালি পাতিল চুলায় দিয়ে ভুলে গিয়েছিলেন মনিরা আহমেদ। পাতিল পুড়ে একপর্যায়ে ফেটে আগুন ধরে যায় আগুন বেশি না লাগলেও ধোঁয়া হয় বেশি।

নাকেমুখে ধোঁয়া ঢুকে যাওয়া আর অতিরিক্ত ভয় পেয়ে ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রোদ্রি।
সোফায় বসে হাঁটুতে হাতের কুনুই ঠেস দিয়ে দুহাতে মুখ চেপে বসে আছে নীরাদ। একটু আগেই ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিয়ে গেছে রোদ্রিকে, বলেছে কিছুক্ষন এর মধ্যই জ্ঞান ফিরবে।
মিরা ফোন করে বলাতে রিদানও তাড়াহুড়ো করে অফিস থেকে চলে এসেছে। সেও রোদ্রির পাশেই বসে আছে। কপালে চিন্তার ভাজ স্পষ্ট।
সবাই রোদ্রির প্রতি ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে পারলেও নীরাদ পারছেনা। পারছেনা সে রোদ্রিকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।

রান্নাঘর থেকে রোদ্রির চিৎকার শুনে তার আত্মাটা কি পরিমাণে কেঁপে উঠেছিলো সেটা কেবল সেই জানে।

ধীরে ধীরে চোখ খুলে রোদ্রি। আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা সময় লাগে তার ব্যাপারটা বুঝতে।
রিদান এগিয়ে এসে গালে হাত রাখে। নরম গলায় বলে,
~ শরীর খারাপ লাগছে বোন?

লো রোদ্রি। ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো সে।
~ রোদ্রি মা, আমার জন্য তোমার আজকে এত বড় একটা বিপদ হতে গিয়েছিলো। আমাকে মাফ করে দিও।
~ আরে আপনি কি সব বলছেন আন্টি। আপনার জন্য হবে কেনো? এটা জাস্ট একটা এক্সিড্যানট।

~ জি চাচি। আপনাকে কতবার বললাম আপনি নিজেকে দোষারোপ করবেন না প্লিজ।
কথার মাঝেই রোদ্রির দিকে স্যালাইন মিশানো পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো নীরাদ। মৃদু কন্ঠে বললো,
~ এটা খেয়ে নিন। পুরাটা শেষ করবেন।

এতক্ষনে নীরাদকে লক্ষ্য করে রোদ্রি। লোকটার চোখমুখ বিমর্ষ হয়ে আছে। উচ্চস্বরে কথা না বলেও কি সুন্দর শাসন করে নীরাদ ।
বিনাবাক্য পুরাটা শেষ করলো রোদ্রি। নীরাদ ঠায় দাড়িয়ে ছিলো এতক্ষন। খাওয়া শেষ হলে পানির গ্লাসটা নিয়ে পাশের টেবিলে রাখতে রাখতে বললো। “ওকে কিছু খাবার খাইয়ে দিন ভাবি, তারপর ওষুধ খেয়ে কিছুক্ষন ঘুমালেই দুর্বলতা কেটে যাবে।

মিরা বসে বসে রোদ্রিকে খাইয়ে দিচ্ছে। জরুরি মিটিং পড়ে যাওয়ায় রিদান কিছুক্ষন আগেই আবার অফিসে চলে গিয়েছে। বলেছে রাতে এসে রোদ্রি আর মিরাকে নিয়ে যাবে।
নীরাদ সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছে আর একটু পরপর আড়চোখে রোদ্রিকে দেখছে।
খাওয়া শেষ হলে মিরা প্লেট রাখতে নিচে চলে যায়। রুমে শুধু নীরাদ আর রোদ্রি।

উঠে যেয়ে পাতা থেকে ওষুধটা বের করে রোদ্রির মুখের সামনে ধরে নীরাদ।

~ হা করেন।
একবার তাকিয়ে ছোট করে মুখ খুলে রোদ্রি। ওষুধটা দিয়ে পানিটাও নিজ হাত খাইয়ে দেয় নীরাদ। ঠোঁটের কোঁণে লেগে থাকা পানি আলতো করে মুছিয়ে দিয়ে বলে,
~ এখন চুপ করে ঘুমান। রেস্ট নিলে ভালো লাগবে।
~ মি.নীরাদ।

রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল নীরাদ রোদ্রির ডাকে পিছনে ফিরলো সে।
~ কিছু লাগবে?
~ উহু….আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য।

কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নীরাদ। তারপর বেশ শান্ত স্বাভাবিক গলায় বললো,
~ আমিতো আপনাকে বাচাইনি। বাচিয়েছি নিজেকে। আমার সম্পূর্ণটা জুড়েইতো আপনি। আমার অস্তিত্বের প্রতিটা কোণায় কোণায় আপনার বিচরণ। অন্তত নিজের অস্তিত্বটা টি কিয়ে রাখার জন্যে হলেও আপনাকে বাঁচানো খুব জরুরি ছিল। নিজের অস্তিত্ব না থাকলে তো মানুষ বাঁচেনা, তাইনা মিস.রোদ্রি?

রোদ্রি কিছু বললোনা। বললোনা বললে ভুল হবে সে আসলে বলার অবস্থায় নাই।
মুচকি হাসলো নীরাদ।

~ আচ্ছা, বাদ দিন এসব কথা। আপনার এসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে। আপনি ঘুমান।
বলে দরজা আটকে বের হয়ে গেল নীরাদ। রোদ্রি বুঝতে পারছেনা তার কেমন রিয়েকট করা উচিত। মাথাটা একেবারেই খালি খালি লাগছে।

নীরাদের একেবারেই স্বাভাবিকভাবে বলা কথাগুলো প্রচন্ড অস্বাভাবিক ভাবে ভাবিয়ে তুলছে রোদ্রিকে।

রাতের বেলা বেডে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো নীরাদ। হঠাৎ পাশে চোখ পরতেই খানিকটা হেসে উঠলো সে। এখানেই একটু আগে ঘুমিয়ে ছিল রোদ্রি। জায়গাটায় একহাত রাখলো সে। বিরবির করে বললো,

~ আপনাকে এখানে পার্মানেনট ভাবে আনার ব্যবস্থা খুব শীঘ্রই করছি আমি মিস.রোদ্রি।

কেটে গেছে বেশ কিছু সময়। আজকে রোদ্রির ফাইনাল সেমিস্টারের রেজাল্ট বেরিয়েছে। বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে রোদ্রি।

ভাই ভাবিকে রেজাল্ট জানিয়ে অনুমতি নিয়ে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে বের হলো রোদ্রি।
বিকেলবেলা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বাসায় ঢুকলো সে। ঢুকে মনিরা আহমেদ কে দেখে কিছুটা অবাক হলেও খুশি হলো।

রিদান আর মিরার সাথে কিছু একটা আলোচনা করছিলেন তিনি। রোদ্রি সালাম দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। অর্ধেক সিঁড়ি উঠতেই একটা কথা কানে আসলো তার। সেখানেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলো সে।
~ রোদ্রিকে আমি আমার ছেলের বউ করতে চাই রিদান..


পর্ব ১২

মিরাকে রুমে ঢুকতে দেখেই নড়েচড়ে বসলো রোদ্রি। নিজেকে যথাসম্ভব সাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।
মিরা বেশ বুঝতে পারছে রোদ্রি মনিরা বেগমের কথাটা শুনেছে। আর তার আন্দাজমতে রোদ্রি নীরাদকে ভালোবাসে তাই তার অমত হওয়ার কথা না। কিন্তু শুধু আন্দাজ এর উপর ভিত্তি করেই সে আগেরবারের মতো কোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায় না।

মিরাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু কন্ঠে বললো রোদ্রি,
~ বসো ভাবি।
~ তোর সাথে কিছু কথা ছিলো রোদ্রি।
~ হ্যাঁ বলো।
~ তুই হয়তো চাচীর কথাটা শুনেছিস। তাইনা?
~ হুম..

~ তাহলে..তোর মত কি?
কিছুক্ষন চুপ থাকে রোদ্রি। তারপর বলে,
~ তোমরা যা ভালো মনে করো।
রোদ্রির কথায় হতাশ হয় মিরা। মেয়েটা কখনোই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা। একেবারেই চাপা স্বভাবের।

~ দেখ রোদ্রি, বিয়েটা হবে তোর আর নীরাদের। সংসার করবি তোরা। সেখানে তোর মত টা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ন। তোর যদি আপত্তি থাকে তাহলে বল আমি এক্ষুনি চাচীকে মানা করে দিব। তোকে তো তোর ইচ্ছাটা জানাতে হবে বাচ্চা।
প্রচন্ড লজ্জা নিয়ে এবার মুখ ফুটে বলেই দেয় রোদ্রি,
~ আমার আপত্তি নেই ভাবি।

হাসি ফুটে উঠে মিরার ঠোঁটের কোঁণে। রোদ্রির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে।
মিরা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ঘরের লাইট নিভিয়ে দেয় রোদ্রি। আনমনে নিজেকে প্রশ্ন করে, “সে কি সত্যিই নীরাদকে ভালোবাসে? “উওরটা সে জানেনা। আসলেই জানেনা। সে শুধু জানে, নীরাদের সংস্পর্শ তাকে শান্তি দেয়। কেমন একটা নিরাপদ নিরাপদ অনুভব হয়। মনে হয়, হ্যাঁ এমন একটা আস্থাপূর্ণ ভরসাপূর্ণ মানুষইতো সবাই চায়।

ফোনের রিংটনে ঘুম ভেঙে যায় রোদ্রির। কিছুক্ষন আগেই ঘুমিয়ে ছিল সে। পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে স্ক্রীনে চোখ পরতেই এক লাফে উঠে বসে। স্ক্রীনে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা”MR.Nirad is calling”।

এতরাতে নীরাদ কেন কল দিয়েছে? অবশ্য এখন এতরাত না মাত্র ১১:৩০ বাজে। সেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলো। নীরাদ নিশচয়ই তাদের বিয়ের ব্যাপারে বলতে ফোন করেছে? কি ভাবে কি বলবে সেসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা রিসিভ করলো সে।
~ হ্যালো, মিস রোদ্রি?

~ জি বলেন।
~ আপনি ঘুমিয়েছিলেন? তাহলে পরে ফোন দিবোনে…
~ না না বলেন। সমস্যা নেই।

~ আপনার রেজাল্টের খুব ভালো হয়েছে শুনলাম। কংগ্রেচুলেশন।
~ ধন্যবাদ।
~ কালকে ফ্রি আছেননা?
~ হুম।
~ আচ্ছা ঠি কাছে ঘুমান আপনি। আপনার কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে ঘুমিয়ে ছিলেন। গুড নাইট।
~ গুড নাইট।

__
সকালবেলা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই বিছানার উপর কয়েকটা প্যাকেট দেখতে পেলো রোদ্রি। ভ্রু কুচকে এগিয়ে গিয়ে একটা প্যাকেট হাতে নিতেই পিছন থেকে মিরা বললো,
~ দেখতো তোর পছন্দ হয় নাকি? সকাল সকাল নীরাদ এতকিছু পাঠিয়েছে তোর জন্য। সন্ধ্যায় ওরা আসবে আংটি পড়াতে। এগুলা পড়েই তৈরি হয়ে নিস। ছেলেটা শখ করে পাঠিয়েছে।
~ আজকেই?

~ হ্যাঁ, নীরাদ নাকি চাইছে যত দ্রুত সম্ভব বিয়েটা করে ফেলতে। তোর সাথে কথা হয়নি ওর?
~ হয়েছে…কিন্তু এ বিষয়ে…
মিরার ফোন বেজে উঠে। রোদ্রিকে বলে,

~ তোর ভাই ফোন দিয়েছে। আমাদের ও তো একটা প্রস্তুতির ব্যাপার আছে।
বলে ফোন কানে লাগিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

একটা একটা করে প্যাকেট খুলছে আর অবাক হচ্ছে রোদ্রি। একটা মানুষের পছন্দ এতটা সুন্দর কি করে হতে পারে ভেবে পায় না রোদ্রি। হঠাৎই ফোনের টুংটাং শব্দে চমকে উঠে সে।
হাতে নিয়ে দেখে নীরাদের মেসেজ,
~ “পছন্দ হয়েছে রোদ্রি? “


পর্ব ১৩

সকালে নীরাদের পাঠানো সবুজ রংয়ের জামদানী শাড়িটাই পরেছে রোদ্রি। হাল্কা সুতার কাজ করা শাড়িটার মধ্যে। চুলগুলো খোঁপা করে ফুল গুঁজে দেয়া। এই গাজরাটাও নীরাদের দেয়া উপহারের সাথেই ছিলো। কানে আর গলায় হাল্কা সর্ণের গহনা। আর মুখে হাল্কা সাঁজ।
সচরাচর শাড়ি পরা হয়না রোদ্রির। তাই শাড়ি সামলাতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। নেহাতই নীরাদের দেয়া বলে নয়তো আজও থ্রিপিস পরেই কাটিয়ে দিত সে।
আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখছিলো সে, হঠাৎই কারো চিৎকারে চমকে উঠলো সে। গলাটা তার চিরচেনা।

~ তুইতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি মৌ। এভাবে কেউ চিৎকার করে।
দৌড়ে এসে রোদ্রিকে জড়িয়ে মৌ। রোদ্রির ছোটচাচার ছোটমেয়ে মৌ। বয়সে মাত্র দেড় বছরের ছোট। যখন তারা ওই বাসায় ছিলো তখন ওই ছিলো রোদ্রির একমাত্র সঙ্গি। কিন্তু এখানে আসার পর তেমন একটা দেখা হয়না তাদের। আজ প্রায় অনেকদিন পর দেখা হলো তাই হয়তো আবেগ ধরে রাখতে পারেনি মৌ।

~ উফফ তোমাকে যা লাগছেনা রোপু। দুলাভাই তো চোখ সরাতেই পারবেনা।
মৌ এর মাথায় আলতো করে বাড়ি দিলো রোদ্রি। কান টেনে বললো,
~ বেশি পেকে গেছিস না? ..আচ্ছা কে কে এসেছে?

~ আমি, আব্বু~ আম্মু, আবিদ ভাইয়া। চাচা~ চাচী আসতে পারেনি, জানোইতো চাচীর শরীর খারাপ। চাচীকে বাসায় একা রেখে চাচাও আসতে পারেনি।
~ হুম, বুঝেছি।

~ আচ্ছা, দুলাভাই দেখতে কেমন? আমিতো দেখিনি পর্যন্ত। তোমার কাছে ছবি আছে?
~ আজকে আসলেই দেখে নিস বোন। ঠিকাছে?
বলে গাল টেনে দিল মৌ এর।

কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে রোদ্রির। এর আগেও তো কতবার নীরাদের সামনে গিয়েছে সে। তবে আজ এতটা লজ্জা লাগছে কেন? সিড়ি দিয়ে একহাতে কুচি সামলে নামছে সে। নামতেই মিরা ঘোমটা টেনে দেয় তার মাথায়। ঘোমটা ধরে মুখ তুলে তাকাতেই সর্বপ্রথম নীরাদের চোখে চোখ পরে রোদ্রির। গভীর দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষন করছে নীরাদ। নীরাদের পরণেও সবুজ পানজাবি।

আচ্ছা কি এতো দেখছে লোকটা?
দৃষ্টি যেন সেখানেই আটকে গেছে নীরাদের। রোদ্রিকে কখনোই শাড়িতে দেখেনি সে। আজই প্রথম।
সকালে কেবল শখ করেই শাড়িটা কিনেছিলো রোদ্রির জন্য। এখন মনে হচ্ছে তার শখ করাটা সার্থক।

মৌ হাত ধরে নীরাদের পাশে বসালো রোদ্রিকে।
সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল নীরাদ। সচেতনভাবে রোদ্রির দিকে মাথা ঝুকালো সে। চাপা গলায় বললো,
~ তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে।

নীরাদের মুখে “তুমি” শুনে অদ্ভুত ভালোলাগল রোদ্রির। নীরাদের থেকে অনেক ছোট হওয়া সত্তেও নীরাদ সবসময় তাকে”আপনি”বলেই ডাকতো কিনা।
লজ্জায় কিছুই বলতে পারলোনা রোদ্রি।
নীরাদের হাতে আংটি দিলো মনিরা।

একহাতে আংটি নিয়ে আরেকহাত এগিয়ে দিলে রোদ্রির দিকে এগিয়ে দিলো নীরাদ। আলতো করে নীরাদের হাতের উপর হাত রাখলো রোদ্রি। নীরাদ আংটি পরিয়ে দিতেই বড়রা “আলহামদুলিল্লাহ”বলে উঠলো।

হেসে উঠলো নীরাদ। নিজের হাত বাড়িয়ে দিলে রোদ্রিও আংটি পড়িয়ে দেয় তাকে।
এতক্ষন ধরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে এসবের বিভিন্নভাবে ছবি তুলছিলো মৌ। আংটি পর্ব শেষ হতেই দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো সে।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
~ এই এখন আমি ওদের ছবি তুলবো। রোপু তুমি একটু চেপে বসো না। আর ভাইয়া আপনিও।
রোদ্রি না চাপলেও নীরাদ চেপে বসলো রোদ্রির দিকে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতেই বললো,
~ এত লজ্জা পেলে হবে? একটু তো হাসো।

বেশ কিছু ছবি তুলে মৌ। তারপর ক্যামেরাটা আবিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
~ আমার কিছু ছবি তুলে দেতো ভাইয়া। তোদের চক্করে আমারই ছবি তোলা হলোনা।
বোনের কান্ডে না হেসে পারেনা আবিদ। ক্যামেরাটা নিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।
সবাই খাওয়া দাওয়া করছে। এতক্ষন সেখানেই ছিল রোদ্রি।

সবাই একটু ব্যস্ত হতেই উপরে উঠে যায় রোদ্রি। নিজের রুমের সামনে দাড়িয়ে নিচু হয়ে শাড়ি টেনে ঠি ক করে নেয়।

~ শাড়ি পড়তে অসুবিধা হয় তোমার?
পিছন থেকে নীরাদের কন্ঠ শুনে হকচকিয়ে যায় রোদ্রি। সোজা হয়ে দাড়িয়ে বলে,
~ নাহ্, আসলে সচরাচর পড়া হয়না তো। তাই একটু…পড়তে পড়তে অভ্যাস হয়ে যাবে।
~ ওহ্, তাহলে বিয়ের পর শাড়ি পরার প্ল্যান ম্যাডামের। হুম?

একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নেয় রোদ্রি। সবসময়ই কি তাকে লজ্জায় ফেলবে নাকি নীরাদ।
~ হ্যাঁ তো? আপনার কোন সমস্যা?
~ না তো। আমার কোনো সমস্যা নেই। বলে হেসে দেয় নীরাদ। এ যেনো তৃপ্তির হাসি।
_
রাতের বেলা ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে নীরাদ। মনে মনে ভাবছে,
~ আর মাত্র কিছুদিন রোদ্রি। তারপরেই তোমাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে পাবো।


পর্ব ১৪

পুরো ছাদ সাজানো হচ্ছে ফুল দিয়ে। লাইটিং করা হচ্ছে আনাচে কানাচে।
নীরাদের বাসার ছাদটা বেশ সুন্দর আর বড়। এজন্য এখানেই হলুদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।

বিয়েতে অযথা খরচ করা রোদ্রির পছন্দ না। তাই কিছুটা সাধারন ভাবেই বিয়েটা করতে চায় সে।

মৌ কালকে এখানেই থেকে গিয়েছিলো।
বিকেল হতেই রোদ্রিকে জোড় করে বসিয়ে সাজাতে শুরু করে করে সে। করুন কন্ঠে রোদ্রি বলে,

~ বোন, বেশি সাজ দিস না প্লিজ। ভুতের মতো সাজার থেকে না সাজাই ভালো।
~ ধুর, আমি কি তোমাকে ভুত সাজাবো নাকি?
জবাবে জোরপূর্বক হাসলো রোদ্রি। প্রথমত সাজগোজ তার অপছন্দ না হলেও তেমন পছন্দও নয়।

দ্বিতীয়ত ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে মেকআপ করার মতো ধৈর্য তার নেই। সে বরাবরই খুব অস্থির একটা মেয়ে।

আয়নার সামনে দাড়িয়ে ঘড়ি পরছিলো নীরাদ। পরণে তার হলুদ রংয়ের পানজাবি আর সাদা পায়জামা। তাড়াতাড়ি চুলটা ব্রাশ করে ফোন হাতে সোজা ছাদে গেলো সে।
তাদের কোন আত্মীয় নেই। শুধু তার মা আর সে। নীরাদের বাবা মা ভালোবেসে পরিবারের অসম্মতিতে বিয়ে করেছিল। তারপর থেকেই তাদের সাথে পরিবারের কারো কোনো সম্পর্ক নেই।

ছাদের যেয়ে লাইটিং এর কাজ দেখছিলো নীরাদ। রোদ্রির যেহেতু জমকালো পছন্দ নয় তাই হালকা আলোয়ই ছাদটাকে স্নিগ্ধ করে তোলার প্রচেষ্টা
হলুদ রং আর সাদা পাড় দেয়া একটা শাড়ি পরেছে রোদ্রি। পরণের গহনা গুলো গোলাপফুলের। আর্টিফিসিয়াল ফুল নয় একদম তাজা ফুল। হলুদ শাড়ির সাথে লালগোলাপের গহনাগুলো যেন একটু বেশিই মানিয়ে গেছে।

নিজেকে আয়নায় দেখে মৃদু হাসলো রোদ্রি। তার আজকে হলুদ তাও আবার নীরাদের সাথে ভাবতেই কেমন অবাক লাগছে। এইতো কয়দিন আগেই আকস্মিকভাবে তার সাথে নীরাদের দেখা হয়েছিল। জীবনের অতি আকাঙক্ষিত অধ্যায়গুলো মনেহয় এমন হঠাৎ করেই হয়।
__
নীরাদের বাসায় ঢুকতেই মনিরা এগিয়ে আসলো। মুগ্ধ নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
~ মাশআল্লাহ। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে মা।

মনিরার কথা শেষ হতে না হতেই মৌ ফট করে বললো,
~ আরে আন্টি, আপনার ছেলের পছন্দ আছে বুঝলেন।
রোদ্রি থতমত খেয়ে মৌ এর দিকে তাকাল। এই মেয়েটা যে কি!!
মৌ এর কথায় শব্দ করে হেসে দিলো সবাই।

~ এই ফুলগুলা নিচে রেখে আসো। আর তাড় গুলা সরাও, দেখতে বাজে লাগছে…আর…
এতটুকু বলেই থেমে গেল নীরাদ। রোদ্রিকে দেখে থমকে গেলো। যেনো সাক্ষাত ফুলপরি।
~ আর কি স্যার?
~ না কিছুনা। যাও।

ছাদের ডেকোরেশন দেখে মুগ্ধ রোদ্রি। এত সুন্দর লাগছে!!শুধু ফুল আর লাইট দিয়েই সাজানো তবুও অসম্ভব সুন্দর।
রোদ্রি আর নীরাদ বসলে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিল মৌ।

~ সমস্যা কি তোমার?
নীরাদের এমন রাগি গলা শুনে দ্রুত ওর দিকে তাকাল রোদ্রি।
~ জি মানে?
~ মানে এতো জালাচ্ছো কেন হ্যাঁ?

রোদ্রির মুখটা চুপসে গেলো। করুণ কন্ঠে বললো,
~ আপনি এভাবে বলছেন কেন? আমি কি করেছি?

রাগি ভাবটা আর ধরে রাখতে পারলনা নীরাদ হেসে দিলো। আদরমাখা কন্ঠে বললো,
~ করেছো তো। ইনফ্যাকট এখনো করছো। এইযে আমাকে বারবার পাগল করছো। আমার মাথার ভেতর সারাক্ষণ ঘুরঘুর করছো। তোমার রুপে যে আমি বারবার মুগ্ধ হচ্ছি রোদ্রি। কি করা যায় বলোতো?

রোদ্রি সস্তির নি:শ্বাস ছাড়ে। সে ভেবেছিলো নীরাদ আসলেই রাগ করেছে।
~ কিছু করা লাগবে না আপনার। আপনি তাকিয়েন না আমার দিকে তাহলেই তো হয়। তাকাবেন ও না মুগ্ধা হবেন না। বলে একটা গা জ্বালানো হাসি দিলো রোদ্রি।
~ আমার বউ এর দিকে আমিই তাকাবো না?

রোদ্রি হাসি বন্ধ করে। নীরাদ “বউ” বলায় লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায় রোদ্রি। বউ? হ্যাঁ, বউই তো। সে বউ। তার নীরাদের বউ।
নীরাদ আবারো হাসে। তার লজ্জাবতীর কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
~ এত লজ্জা রাখো কোথায় বউ?

~ আপনার মাথায়। …চুপ করেনতো।
এভাবেই বিভিন্ন খুনসুটির মধ্য দিয়ে সবার হলুদ লাগানো শেষ হয়। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রোদ্রির গালে হলুদ লাগিয়ে দেয় নীরাদ।


পর্ব ১৫

হলুদ করে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যাওয়ার বাসায় ফিরে গোসল করেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো রোদ্রি।
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখলো মৌ পাশে নাই। ওর সাথেই তো ঘুমিয়েছিলো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় এগারোটা বাজে। । এত বেলা হয়ে গেছে অথচ ওকে কেউ ডাকেনি কেন?

নিচে নেমে দেখলো ওর চাচা চাচীরা সবাই আছে। সকালেই হয়তো চলে এসেছে। সন্ধ্যায়ই ছোট আয়োজন করে রোদ্রির বিয়ে পড়ানো হবে। যদিও রিদানের ইচ্ছা ছিলো বোনের বিয়ে ধুমধাম করে দিবে। তবে রোদ্রির ইচ্ছাটাকেই প্রাধান্য দিয়েছে সে।

হঠাৎই মৌ দৌড়ে আসলো। উত্ফুল্লভাবে বললো,
~ চলো চলো আপু তোমাকে মেহেদি লাগিয়ে দেই।
মৌ এর কথার মাঝেই মিরা বললো,

~ আরে মেয়েটা কিছু খাক আগে..নাস্তা টা করে নিক তারপর নাহয় মেহেদি লাগিয়ে দিস। এমনেও আজকে বিশেষ একটা দিন। বিভিন্ন কাজে পরে খাওয়ার সময় পাবেনা।
~ আচ্ছা যাও খেয়ে নাও। বলে একটা বোকা বোকা হাসি দিলো মৌ।
বসে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে রোদ্রির।

মৌ বসে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে মেহেদি লাগাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে নিখুঁতভাবে রোদ্রির হাতে মেহেদি লাগাতে পারাটাই তার জীবনের মূল লক্ষ্য।
রোদ্রি অধৈর্য গলায় বললো,

~ মৌ আর কত লাগাবি? হয়েছে তো, অনেক সুন্দর লাগছে।
~ আরে ধুর..চুপ থাকো তুমি। ভাইয়া বলে দিয়েছে আমাকে পুরো দুই হাত ভরে মেহেদি লাগিয়ে দিতে। যদি না লাগাও তাহলে জোর করার পারমিশন টাও দিয়ে দিয়েছে। বুঝলা? সো এখন নো কথাবার্তা।

মৌ এর কথায় রোদ্রি অবাক হওয়ার শেষ পর্যায়ে পৌছে গেল। ভ্রু কুচকে বিস্মিত নয়নে বললো,
~ মানে?

মৌ এর হুঁশ ফিরলো এতক্ষনে, কোন কথাই পেটে চেপে রাখতে পারেনা সে। নীরাদ তাকে বলেছিলো রোদ্রিকে না বলতে। তবুও সে বলেই দিলো।
জিভে কামড় দিয়ে বললো,
~ না কিছুনা। হেহে।

~ উনি তোকে কি বলেছেন?
কাঁচুমাচু হয়ে গেল মৌ।
~ আসলে আপু, ভাইয়া বলেছে তোমাকে মেহেদি লাগিয়ে দিয়ে সুন্দর করে ছবি তুলে তাকে পাঠাতে। তোমাকে অবশ্য বলতে নিষেধ করেছিলো কিন্তু আমিতো বলেই দিলাম বাদ দাও তুমি ভাইয়াকে না বললেই হবে।

~ আচ্ছা, বলবোনা। বলে মুচকি হাসলো রোদ্রি। তার কেমন যেন খুশি খুশি লাগছে। জানেনা কেন? কিনতু খুব খুশি লাগছে।

ফোনের স্ক্রীনে থাকা ছবিটাতে রোদ্রির মেহেদি রাঙা হাত দুটোর দিকে চেয়ে আছে নীরাদ। মেহেদির মাঝেই তার নামটা ফুটে আছে। হাহ্, অবশেষে তার প্রেয়সীর হাতে তার নাম।
কোমল হাতদুটো মেহেদির রঙে কেবলমাত্র তার জন্যই রাঙানো হয়েছে।
বধুবেশে শুধু তার জন্যই অপেক্ষা করবে তার প্রেয়সী। ভালোবাসাটা মানুষকে জীবনসঙ্গি হিসেবে পাওয়ার কথাটা ভাবতেও কেমন প্রশান্তি অনুভূত হয়।

কনের সাজে একদম পুতুলের মতো লাগছে রোদ্রিকে। লাল বেনারসির তার গায়ে। মোটামোটি ভারি সাজ। গয়নাগাটি পড়ানো। পুতুলের মতোই বসে আছে সে। নিচে কাজী চলে এসেছে। নীরাদরাও হয়তো চলে আসবে কিছুক্ষণ পড়ে।
কিছুক্ষণ পরেই তার মানুষটার অর্ধাঙগীনি হয়ে যাবে সে। তাদের অপ্রকাশিত ভালোবাসা পবিত্রতা পেয়ে যাবে।

তিনবার”কবুল”বলে বিয়েটা হয়ে গেলো রোদ্রি আর নীরাদের। এখনো নীরাদ কে দেখার সুযোগ হয়নি রোদ্রির।
কাজি তার সম্মতি নিতে উপরে এসেছিলো। সে কবুল বলে সাইন করে দিতেই নিচে চলে গেছে।

সবার সাথে হাসিমুখেই কথা বলছে নীরাদ। অবশেষে তাদের বিয়েটা হয়েই গেছে। কিন্তু রোদ্রি এখনো নিচে নামছেনা কেন? সে কি বুঝতে পারছেনা তাকে বধুবেশে দেখার জন্য নীরাদ কতটা উযদগ্রীব।

অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো দুজনেরই।
রোদ্রিকে নীরাদের পাশে বসানো হলো। নীরাদ জানে রোদ্রি বরাবরই বেশি লজ্জা পায়। আজকেও তার ব্যাতিক্রম না। উল্টো আজতো লজ্জা পাবার পরিমাণটা একটু বেশিই, বউ বলে কথা। যদিও এই লজ্জা পাওয়াটাকেও ভীষণ ভালোলাগে নীরাদের।

ছবি তোলার জন্য একটু ক্লোজ হতে বললে নীরাদ একহাত দিয়ে রোদ্রিকে পিছন দিয়ে জড়িয়ে ধরে। ধীর কন্ঠে বলে,
~ এতো লজ্জা না পেয়ে ক্যামেরার দিকে তাকান মিসেস.নীরাদ।
রোদ্রি হেসে দেয়। নীরাদ মুগ্ধ হয়ে দেখে সে হাসি। নিজেও হেসে দেয়। এ যেন প্রাপ্তির হাসি। একরাশ পুর্ণতায় পরিপূর্ণ হাসি।


পর্ব ১৬

গোলাপ দিয়ে সাজানো নীরাদের ঘর। বিয়ের শাড়ি পড়ে বিছানার মাঝখানটায় বসে আছে রোদ্রি। চোখে মুখে ভর করেছে একরাশ লাজুকতা। দরজা খোলার আওয়াজে মুখ তুলে তাকায় রোদ্রি। নীরাদ এসেছে।

দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে রোদ্রির দিকে দৃষ্টি দিলো নীরাদ। গুটিশুটি হয়ে বিছানায় বসে আছে সে। ধীরপায়ে রোদ্রির পাশে যেয়ে বসে নীরাদ। হাত বাড়িয়ে রোদ্রির হাতদুটোকে আবদ্ধ করে। রোদ্রির চোখে চোখ রেখে বলে,

~ আমার সামনে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ঠিকাছে?
রোদ্রি উপরে নিচে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি দেয়।
~ খিদে পেয়েছে? খেয়েছো কিছু?
~ জি খেয়েছি। মা খাইয়ে দিয়েছে।

নীরাদ হাসে। পুরুষ মানুষের জীবনে দুইজন নারীর ভূমিকা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ন। একজন তার মা আর আরেকজন তার স্ত্রী। আল্লাহর রহমতে নীরাদের জীবনের এই দুইজন মানুষই খুবই ভালো।
একহাত রোদ্রির গালে রেখে আলতো করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় নীরাদ। চোখ বন্ধ করে ফেলে রোদ্রি। নীরাদের ভালোবাসার প্রথম ছোয়াঁ।

পানজাবির পকেট থেকে একটা বাক্স বের করে নীরাদ। খুলে দুইটা স্বর্ণের চিকন বালা বের করে। নিজেই রোদ্রির হাতে পরিয়ে দেয়। রোদ্রির গালে হাত রেখে বলে,
~ এটা কখনো খুলবেনা। ঠিকাছে?
~ আচ্ছা।

~ ওয়াশরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। মেকাপ তুলে, ভারি শাড়ি ছেড়ে হাল্কা কিছু পরে নাও।
__
একটা সুতির শাড়ি পরে বেরিয়ে আসে রোদ্রি। চুলগুলো ছাড়া। সামনের কিছু চুল ভিজে গেছে। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে নীরাদ একপাশে আধশোয়া হয়ে বসে ফোন চালাচ্ছে। পরণে সাদা স্যান্ডো গেনজি আর ট্রাওজার।

~ একসাথে ঘুমাতে প্রবলেম হবে? তাহলে আমি নাহয় সোফ..
~ কোন সমস্যা নেই। বলে মুচকি হাসে রোদ্রি।
সাধারণভাবে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে রোদ্রিকে। নীরাদ মুগ্ধ নয়নে দেখে। মেয়েটা শাড়ি পরে আছে। এলোমেলোভাবে গায়ে জড়ানো শাড়িটা। বারবার টানাটানি করছে সে। বুঝাই যাচ্ছে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।

নীরাদ নরম কন্ঠে বলে,
~ শাড়ি পরে আরামে শুতে পারবেনা, অসুবিধা হবে। সকালে শাড়ি পরো। এখন কামিজ পরে নাও।

~ কোনো অসুবিধা হবেনা। আমি শাড়িই পরবো। শাড়ি না পরলে বিয়ে বিয়ে ভাব আসবেনা।
নীরাদ শব্দ করে হেসে দেয়। রোদ্রি মুখ কুচকে তাকায়। সন্ধিহান কন্ঠে বলে,
~ হাসছেন কেন? আমি কি হাসার মতো কিছু বলেছি?

~ নাহ্। ঠিকাছে। এখন ঘুমাও। কাল আবার বৌ~ ভাত। রেস্ট না নিলে পরে অসুস্থ হয়ে পরবে।
নীরাদের বা পাশে যেয়ে শুয়ে পরে রোদ্রি। লাইট নিভিয়ে দেয় নীরাদ। সারাদিনের ক্লান্তিতে কিছুক্ষণেই ঘুমিয়ে পরে রোদ্রি। ঘুমের ঘোরে একহাত মেলে দেয় নীরাদের বুকের উপর। নীরাদ আলতো করে সেই হাতের উপর হাত রাখে। কতোইনা অপেক্ষা করেছে সে এই সময়টার জন্য।

জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পরছে রোদ্রির মুখের উপর। ঘুমন্ত মুখের স্নিগ্ধতা যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।

সকাল ৯টা।
নীরাদের ঘুম ভেঙে যায়। কাঁধে ভারি কিছু অনুভূত হতেই চকিতে তাকায় সে। তার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে রোদ্রি। বুকে রাখা হাতটা সারারাতেও ছাড়েনি নীরাদ।
একহাত দিয়ে কাঁথা টেনে দেয় নীরাদ। শাড়ি আর শাড়ির জায়গায় নেই মেয়েটার। ঘুম থেকে উঠে কাপড়ের বেহাল দশা দেখে অন্যকিছু ভেবে ফেলতে পারে।

খুব সন্তর্পণে রোদ্রির মাথাটা বালিশে রাখে নীরাদ। হাতটা ছাড়িয়ে উঠে যায়।
ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখে রোদ্রি উঠে গেছে। পিটপিট করে তাকিয়ে আছে নীরাদের দিকে।
ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে চুলটা আচরাতে আচরাতে বলে,
~ ঘুম হয়েছে?
~ হু।

~ উঠে কাপড় পাল্টে রেডি হয়ে নাও। মেহমানরা আসবে তোমাকে দেখতে। বলতে বলতে কাবার্ড থেকে দুটো বক্স বের করলো নীরাদ। টেবিলে রেখে বলল,

~ এই গহনা গুলো পরে নিও। আমি নিচে যাচ্ছি। রাতে রিসিপসন অনেক কাজ আছে।
রোদ্রি টেবিলে রাখা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। শাওয়ার নিয়ে শাড়ি পরে বেরিয়ে আসে। গহনাগুলো পরে নিচে চলে যায়।
নিচে নামতেই দেখে….


পর্ব ১৭

নিচে নামতেই দেখে মনিরা টেবিলে নাস্তা নিয়ে বসে আছে। পাশে মৌ ও আছে। কাল রাতে রোদ্রির সাথে মৌ ই এসেছে।

রোদ্রি ঠোঁটের কোঁণে হাসি বজায় রেখেই চেয়ার টেনে বসলো। নাস্তা খাচ্ছে আর টুকটাক কথা হচ্ছে তাদের। হঠাৎই মনিরা বললো,
~ তোকে কালরাতে উপহার দেয়নি নীরাদ?
মৃদু কন্ঠে রোদ্রি বললো,
~ দিয়েছে।

~ কি দিয়েছে?
হাত বাড়িয়ে বালা দুটো দেখালো রোদ্রি।
~ বাহ্, আপু খুব সুন্দর তো।

~ মাশাআল্লাহ। তোরা সুখী হ মা। বলে রোদ্রির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মনিরা।
নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয় রোদ্রির। এরকম শাশুড়ি পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার।

ছোট থেকেই মায়ের আদর সেভাবে পায়নি সে। মায়ের অভাবটা সবসময়ই অনুভব হতো। যদিও ভাবি তাকে সবসময় মায়ের মতো করেই আগলে রাখতো। তবুও ভাবিকে তো আর মা ডাকা যায় না। মনিরাকে সে মা বলে ডাকে। মা ডাকটাই মধুর।


নীরাদের পুরা বাড়ি সাজানো হয়েছে। ঝলমলিয়ে উঠেছে “আহমেদ ভিলা”। একটা উৎসব উৎসব ভাব।

বিয়েটা রোদ্রির ইচ্ছায় ছোট করে হলেও রিসিপসনটা নীরাদ বড় আয়োজন করেই করবে। নীরাদের অফিসের মানুষজন আসবে। বন্ধুরা আসবে। তার উপর নীরাদের উৎসাহ, ইচ্ছা দেখে আর না করতে পারেনি রোদ্রি।

সেই সুবাদেই জমকালো আয়োজন করেছে নীরাদ।
মেহমান আসা শুরু করে দিয়েছে। খালি বাড়িটা মানুষ জনে পরিপূর্ণ। রোদ্রির পরিবারের সবাইও চলে এসেছে।

সফল বিজন্যাসম্যান নীরাদ আহমেদ এর স্ত্রী কে দেখার জন্য মুখিয়ে আছে সবাই। এমন সময়ই লাইট কিছুটা নিভিয়ে গেলো। সিড়ির ওপর যেয়ে পরল সব লাইট। সবার চোখ এখন সেদিকেই।

রোদ্রির হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামছে নীরাদ। এতো মানুষ দেখে যাতে রোদ্রি নার্ভাস না হয় তাই শক্ত করেই হাতটা ধরে আছে সে। প্রেস মিডিয়ার কয়েকজনও এসেছে। তারা ছবি তুলছে। নীরাদ অবশ্য চেয়েছিলো এরা যেন না আসে।

পরে ভাবলো ওর বিয়ের ব্যাপারটা এরা আবার খারাপ ভাবে প্রচার করতে পারে। যেটা না হওয়াই ভালো।

একটা কালো রংয়ের গাউন রোদ্রির পরণে। গাইনের মাঝে কালো পাথরগুলো ঝলঝল করছে। পরণের গয়নাগুলো ডায়মন্ডের। চিকচিক করছে সেগুলো কানে গলায় হাতে।
নীরাদ পরেছে ব্ল্যাক সুট। আগাগোড়াই কালো পরেছে সে।

দুজনকে দেখে যে কারোরই চোখ আটকে যাবে। উপস্থিত সবাই হা করে তাকিয়ে আছে।
সবার মুখে একটাই বুলি”মেইড ফর ইচ আদার”।
সিঁড়ি থেকে নেমে নীরাদ রোদ্রির হাত ছেড়ে নরম কন্ঠে বললো,
~ যাও, ভাই ভাবির সাথে দেখা করো।

রিদান মিরা এগিয়ে এসে রোদ্রিকে জড়িয়ে ধরল। মাত্র একদিন হয়েছে রোদ্রি তাদের থেকে দূরে তাতেই যেন বহুকাল মনে হচ্ছে তাদের। বোন সুখে আছে দেখে খুশি হয়ে উঠে রিদানের মন। আজ ভাই হিসেবে সার্থক সে।
~ কেমন আছিস বোন? ভাইকে মনে পরেনি?

~ পরেছে, খুব মনে পরেছে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে রোদ্রি।
~ এই এখন আবার কান্না করে দিস না পাগলি মেয়ে। সাজ নষ্ট হয়ে যাবে কিন্তু। ভুতের মতো দেখাবে তারপর বুঝিস।

রোদ্রি হেসে দেয়, কিছু বলবে তার আগেই নীরাদ বলে,
~ আমার বউকে কাঁদলেও ভুতের মতো দেখাবে না ভাবি।
~ হুম, হয়েছে। বলে হাসলো মিরা। তার হাসিতে হাসি মিলাল রিদানও।

স্টেজে উঠে মাইক হাতে নিলো নীরাদ। ভরাট কন্ঠে স্বাগত জানালো সবাইকে। রোদ্রিকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিল সবার কাছে।
ফর্মালিটিস শেষ করে স্টেজে বসলো তারা। সবাই এসে এসে ছবি তুলছে তাদের সাথে।


রাত প্রায় বারোটা বাজে। মেহমানরা চলে গেছে ঘন্টাখানেক আগেই। এতক্ষণ পরিবারের সবাই মিলে কথা বলছিলো। বেশি রাত হয়ে যাওয়াতে রিদান মিরা আর ওর চাচারা একটু আগেই রওনা দিয়েছে।

রোদ্রির মুখ থেকে হাসি সরছিলোই না। ভাই যাওয়ার সময় মনটা একটু খারাপ হয়েছিলো তার।
পরক্ষণেই নীরাদ যখন বললো কাল দেখা করিয়ে নিয়ে আসবে তখন থেকে সেই খারাপ লাগাটাও চলে গিয়েছে।

ঘুমানোর জন্য বিছানাটা একটু ঝেড়ে দিচ্ছিলো রোদ্রি। নীরাদ সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।
বালিশ গুলো ঠি ক জায়গায় দিয়ে নীরাদকে বললো রোদ্রি,
~ আপনি এখন ঘুমাবেননা?

~ হ্যাঁ, এইতো কাজ শেষ আমার। বলে ল্যাপটপ টা বন্ধ করে দিলো নীরাদ।
সেই সময়ই ফোনটা টুংটাং শব্দ করে উঠলো রোদ্রির। এতরাতে কে মেসেজ করেছে ভেবে দ্রুত ফোনটা হাতে নিল রোদ্রি। মেসেজেটা দেখে ভয়ে গলা শুখিয়ে কাঠ হয়ে গেলো তার। মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই। নীরাদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
ভয়ার্ত চোখে কাঁপাকাঁপা হাতে ফোনটা এগিয়ে দিলো সে নীরাদের দিকে


পর্ব ১৮

“নীরাদের সাথে খুব সুখে আছো জান। সুখ কি বেশিদিন সইবে?
চোখ কান খোলা রেখো জান, তোমার নীরাদকে আবার আমি নিয়ে না যাই। তুমিতো আমার খুব প্রিয়, তাই তোমার প্রিয় মানুষগুলাও আমার খুব প্রিয় “জান”। “

ব্যাস এতটুকুই লেখা মেসেজটায়। মেসেজেটা অপরিচিত নাম্বার থেকে এসেছে। তবে এটা যে ফারহান পাঠিয়েছে সেটা বুঝতে একদমই কষ্ট হয়নি নীরাদের।
মেসেজটা দেখে যতটানা রাগ হচ্ছে নীরাদের তার থেকে বেশি রাগ হচ্ছে ফারহানের রোদ্রিকে “জান”

বলে সম্বোধন করায়। রাগে মাথায় রক্ত উঠে গেছে নীরাদের। চোখগুলো লাল হয়ে গেছে। সহজে রাগে না সে।

তবে যে তার রাগী রূপ দেখেছে সে আর দিতীয়বার রাগানোর সাহস করবেনা।
রোদ্রির অবস্থা কাঁদো কাঁদো। চোখ ছলছল করছে তার। অল্পতেই ভয় পেয়ে যায় সে। ফারহানের ব্যাপারে সে এমনেই ভীতু, তার উপর সে থ্রেট দিয়েছে তার ভালবাসার মানুষকে নিয়ে।

নীরাদ ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মারে। রাগ কমানোর চেষ্টায় অব্যাহত সে। অন্তত রোদ্রির সামনে তার রাগী রুপটা প্রকাশ হতে দিতে চায় না নীরাদ। সে চায়না তার রোদ্রি তাকে ভয় পাক।
গেনজির হাতায় টান পরতেই রোদ্রির দিকে তাকায় সে। একহাত দিয়ে তার হাতের বাহু খামছে ধরেছে রোদ্রি।

রোদ্রির চোখের দিকে তাকিয়ে থমকায় সে। রোদ্রির চোখে জল। কাঁদছে রোদ্রি। নীরাদ দ্রুত ঝুকে যায়। এক হাঁটু বিছানায় ভর দিয়ে একহাত রোদ্রির চুলের ভাজে দিয়ে রোদ্রির মাথাটা তার বুকে চেপে ধরে। আরেক হাতে দিয়ে পিঠে হাতবুলিয়ে দেয়। স্নেহের কন্ঠে ধীরে ধীরে বলে,
~ রোদ্রি, কাঁদেনা। কান্না থামাও।

কান্নার মাঝেই থেমে থেমে রোদ্রি বলে,
~ আপ..আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি..আমি..

~ আরে আমার কি হবে পাগলি? ও কিছুই করতে পারবেনা আমার। তুমি শুধু শুধু কাঁদছো। ও শুধুই আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে। তোমার নীরাদ কি এতটাই ভীতু বলো?
কিছুটা শান্ত হয় রোদ্রি। নীরাদ মাথা কিছুটা নামিয়ে রোদ্রির মাথা কপালের দিকে চুমু দেয়। এবার কান্না থেমে যায় রোদ্রির। নীরাদকে শক্তহাতে জড়িয়ে ধরে। নীরাদও কিছু বলেনা। কিছুক্ষণ পর রোদ্রি কাঁপা গলায় বলে,
~ উনি যদি..

~ হুসস, ওকে নিয়ে আর কোনো কথা নয়। ওকে?
~ হুম।

রোদ্রিকে আলতো করে ছাড়িয়ে নেয় নীরাদ। সামনে বসে একহাত গালে রাখে আর একহাত দিয়ে মুখের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে চোখ মুছে দেয়।
~ কখনো কাঁদবেনা। তোমার কান্না যে আমার সহ্য হয়না।
রোদ্রির প্রতিউওর না পেয়ে আবার বলে,

~ এখন ঘুমাবে। সারাদিনে একটু রেস্ট করতে পারোনি। বলে উঠে যায় নীরাদ। যেয়ে লাইট বন্ধ করে দেয়।

একপাশে শুয়ে রোদ্রিকে কাছে টেনে নেয়। নীরাদের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায় রোদ্রি। এই মুহুর্তে এই জায়গাটায় তার সবচেয়ে নিরাপদ মনে হচ্ছে। যেখানে নিশ্চিন্তে ভরসা করা যায়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে নীরাদের বাহুডোরে আবদ্ধ অবস্থায় পায় রোদ্রি।

লাল আভা চলে আসে তার গালে। নীরাদের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। ঠোঁটের কোঁণে হাসি ফুটিয়ে আলতো করে কোমড় থেকে নীরাদের হাতটা সরাতে চায় সে। তবে ব্যর্থ হয়। হাতটা একটু নাড়াতেই নড়েচড়ে উঠে নীরাদ।
ঘুমঘুম কন্ঠে বলে,

~ কি হয়েছে?
~ আ..আমি উঠবো। ছাড়ুন।
নীরাদ ছাড়েনা। বরং আরো শক্ত করে ধরে ঘুমায়। রোদ্রিও আর কি করবে? লোকটার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করছেনা। তাই অগত্যা সেও শুয়ে থাকে।

দশটা বাজলেই এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় নীরাদের। হাত বাড়িয়ে সেটা বন্ধ করে নীরাদ। রোদ্রির দিকে তাকিয়ে দেখে সে আগে থেকেই জেগে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
নীরাদ হেসে দেয়। সদ্য ঘুম থেকে উঠা মুখে সে হাসি অদ্ভুত সুন্দর লাগে।


সারাদিন বেশ ভালোই কেটেছে রোদ্রির। মায়ের সাথে গল্পে মেতে ছিলো সে এতক্ষন। বিকেলের দিকে নীরাদ বেরিয়েছে অফিসের কাজে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং তাই জরুরীভাবে যেতে হয়েছে তাকে। আজ যেতে পারেনি তাই বলেছে কাল ভাইয়ের বাসায় নিয়ে যাবে। রোদ্রিও আপত্তি করেনি।

টেবিলে খাবার সাজিয়ে নীরাদের জন্য অপেক্ষা করে সে। মনিরাও খায়নি, বলেছে নীরাদ আসলে তাকে ডেকে দিতে।

দশটা বেজে গেলেও নীরাদ ফেরে না। রুমে যেয়ে নীরাদের নাম্বারে ফোন করে সে। কালকে রাতের অজানা সংশয়টা আবারও মাথায় জেঁকে বসে যখনি ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে ভেসে আসে,
“দিস্ নাম্বার ইজ্ কারেন্টলি নট রিজেবল, প্লিজ ট্রাই এগেইন লেটার”


পর্ব ১৯

মুখোমুখি বসে আছে ফারহান আর নীরাদ। নীরাদের ঠোঁটের কোঁণে বাঁকা হাসি।
একহাত দিয়ে টেবিলের উপর রাখা পেপার ওয়েটটা ঘুরাচ্ছে সে। ফারহান থমথমে চেহারায় বসে আছে।

তার অফিসে এসে তার উপরই জোর খাটানো হচ্ছে ব্যাপারটা সে একদমই মেনে নিতে পারছেনা।
ফারহানকে চুপ থাকতে দেখে নীরাদই বললো,
~ কথা বলছিস না কেন? কোন সাহসে তুই রোদ্রিকে মেসেজ দিয়েছিস? রাগে চিৎকার করে উঠে নীরাদ।

~ রোদ্রি আমার। শুধু আমার। । তুই ওকে ছলনা করে বিয়ে করছিস। আমার জান কে আমি আমার করেই ছাড়বো দেখে নিস।
ধৈর্য্যর বাধ ভেঙে যায় নীরাদের। একহাত দিয়ে ফারহানের কলার চেপে দাড়া করায় সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
~ মুখ দিয়ে আর একবার জান শব্দটা বের করলে তোর জানটাই কিন্তু আমি নিয়ে নিব। সো বি কেয়ারফুল।

বলেই ফারহানের মুখ বরাবর একটা ঘুষি দিয়ে ঝামটা দিয়ে ছেড়ে দেয় কলার।
নাক আর ঠোঁটের কোণা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে ফারহানের। রক্তটা হাত দিয়ে মুছে নীরাদকে মারার জন্য তেড়ে আসে সে। নীরাদ শান্ত কন্ঠে ভ্রু উচিয়ে বলে,
~ ডোন্ট ইউ ডেয়ার।

ফারহান থেমে যায়। এই মুহুর্তে নীরাদকে ভয় লাগছে তার। সে ভাবেনি নীরাদের এমন রুপও থাকতে পারে।
রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করে ফারহানের বাবা। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে সে। অস্থির দেখাচ্ছে তাকে।

হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল,
~ মি.নীরাদ, আমার ছেলেকে ছেড়ে দিন। ওর ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এরকম কিছু হবে না। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে।
ফারহান আপত্তিকর গলায় বললো,
~ এসব কি বলছো তুমি ড্যাড?

ফারহানের বাবা ধমকে উঠে বলে,
~ কোন কথা বলবে না তুমি। আমার সম্মান তুমি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছো!!
ফারহান চুপ করে যায়। সে বুঝতে পারছে অবস্থা বেগতিক। এখন কথা না বলাই শ্রেয়।
নীরাদ তাদের কথা শুনে হাসে। তারপর হাসি থামিয়ে দুহাত পকেটে গুঁজে গম্ভীর গলায় বলে,
~ দেখুন, মি.চৌধুরি, আপনার ছেলেকে আমি চাইলে এখনই মেরে ফেলতে পারি।

কিন্তু মারছিনা শুধু আপনার অনুরোধের জন্যে। আপনি আমার অনেক বড়। আপনাকে সম্মান করেই আমি আপনার কথা রাখছি।

তবে, এরপরও যদি ও আমার ওয়াইফের সাথে কোনকিছু করার চেষ্টা করে তখন কিন্ত…আশা করি আপনি
বুঝতে পারছেন।
~ জি জি মি.নীরাদ। আর এমন হবেনা।

নীরাদ উওর দেয়না। ফারহানের দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করে বের হয়ে যায়। সোজা গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়। একহাতে ফোনটা বের করে, রোদ্রি এখনো ফোন দেয়নি ভেবে অবাক হয়। অন করতে গিয়ে দেখে ফোন অফ। মানে ফোনে চার্জ নেই। “শিট”বলে গাড়ির হ্যান্ডেলে বাড়ি দেয়। দ্রুত আরেকটা ফোন বের করে সে। রোদ্রির নাম্বারে কল দেয়।

অপরিচিত নাম্বার থেকে কল পেয়ে ভয় পেয়ে যায় রোদ্রি। ভাবে হয়তো ফারহান কল দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
~ হ্যা..হ্যালো? কে?

রোদ্রির ভয়ার্ত কন্ঠ শুনে নীরাদ দ্রুত বলে,
~ আমি নীরাদ। তুমি চিন্তা করো না। একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম ফোনের চার্জ শেষ তাই ইনফর্ম করতে পারিনাই। আমি আসছি, জাস্ট বিশ মিনিট লাগবে। ওকে?
নীরাদের বলা সবগুলো কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় রোদ্রি। প্রশ্ন না করতেই সব উওর দিয়ে দিয়েছে নীরাদ।
রোদ্রিকে চুপ থাকতে দেখে নীরাদ আবার বলে,
~ রোদ্রি?

মৃদু কন্ঠে রোদ্রি বলে,
~ জি ঠিকাছে। আপনি আসেন।


এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে নীরাদ। ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছে রোদ্রি। পাশে প্লেট সাজানো। তার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা। নিজেও খায়নি। নীরাদ কোনরকম শব্দ না করে উপরে যায়। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে। রোদ্রি এখনো আগের মতোই ঘুমিয়ে আছে।

নীরাদ যেয়ে মাথায় হাত রাখে। নরম গলায় ডাকে,
~ রোদ্রি?
একবার ডাকতেই মাথা তুলে তাকায় রোদ্রি। নীরাদের পরণে বাসার কাপড় দেখে বুঝতে পারে সে আগেই এসেছে। বিস্মিত কন্ঠে বলে,
~ আপনি কখন আসলেন?

পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে নীরাদ বলে,
~ একটু আগেই। রোদ্রির সামনে প্লেট রেখে বলে, “মা খেয়েছে না? “
~ জি। বলে নীরাদকে খাবার বেড়ে দেয়।

দুজনের খাওয়া শেষ হলে। সব গুছিয়ে উপরে যায় রোদ্রি।
রুমে ঢুকে দেখে নীরাদ বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।
কাপড় গুলা সোফায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। রোদ্রি যেয়ে সেগুলো ঠি ক করে রাখে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে চুলগুলো বেণি করে নেয়। পিছনে ঘুরতে নিলে ঘাঁড়ে কারো নি:শ্বাস অনুভূত হয়।

পিছন থেকেই রোদ্রির কোমড় জড়িয়ে ধরে নীরাদ। রোদ্রির উন্মুক্ত কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়ায়। হাল্কা কেঁপে উঠে রোদ্রি।
লজ্জামাখা মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,
~ নীরাদ, কি করছেন?

নীরাদ উওর দেয়না। রোদ্রিকে সামনে ঘুড়িয়ে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে। তার ঠোঁটজোড়া ক্রমশ রোদ্রির কাঁধে, গলায় বিচরণ করছে খুব গভীরভাবে।


পর্ব ২০ (সমাপ্তি পর্ব)

কাঁচের জানালার টেনে দেয়া পর্দার ফাঁক দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদের সুক্ষ রশ্মি চোখের উপর পরতেই নড়েচড়ে উঠলো রোদ্রি। ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে সে। ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছা করছেনা। কোনমতে চোখ খুলে মুখটা পাশে ঘুরাতেই থমকে গেল সে। নীরাদ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নীরাদের নি:শ্বাস এসে রোদ্রির চোখেমুখে আছড়ে পরছে। নীরাদের হাতের শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ সে।

নীরাদ মুচকি হেসে রোদ্রির এলোমেলো চুলগুলো মুখের থেকে সরিয়ে দিল। এখনও তার দৃষ্টি স্হিরভাবে রোদ্রির চোখে আটকে আছে।
রোদ্রি চোখগুলো ছোট ছোট করে প্রশ্ন করে,
~ এভাবে, কি দেখছেন?

~ “আমার রোদ্রিকে। “নীরাদের সোজাসাপটা উওর।
রোদ্রি চোখ নামিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
~ হাত সরান। আমি উঠবো।

নীরাদ হাত না সরিয়ে ফট করে রোদ্রিকে ঘুরিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। হাতটা আলগা করে দিতেই রোদ্রি দ্রুত উঠে যায়।
মনে মনে হাসে নীরাদ। ভাবে, মেয়েটা এতো লজ্জা পায়!!বিয়ের পর লজ্জা যেন আরো বেড়ে গেছে।

সে কি বুঝেনা”তার লজ্জামাখা চোখের চাহনি, মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে সে বারবার খুন হয়”।

ভাইয়ের বাসা থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বিদায় নিয়ে দ্রুত গাড়িতে বসে নীরাদ। রোদ্রির সিটবেল্ট বেঁধে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

খুব খুশি দেখাচ্ছে রোদ্রিকে। নীরাদ আড়চোখে একবার পরখ করে নিল তাকে। তারপর সামনে তাকিয়ে ড্রাইভিংয়ে মনযোগ দিল। রোদ্রি আশেপাশে থাকলে সে কোন কিছুতেই মন দিতে পারেনা। তার অবচেতন মনের সকল অনুভূতি সেই রোদ্রিতে গিয়েই আটকে যায়। কবে, কখন কিভাবে যে মেয়েটাকে এত বেশি ভালোবেসে ফেললো সে নিজেও জানেনা। এসব ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের কোঁণে হাসি ফুটে তার।

এতক্ষণ ধরে নীরাদকে পর্যবেক্ষন করছিল রোদ্রি। সিটে মাথা কাত করে এলিয়ে নীরাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো সে।
নীরাদকে এভাবে হাসতে দেখে ভ্রু কুচকে এলো তার। জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,
~ আপনি হাসছেন কেনো?

নীরাদ ফিরে তাকায়। রোদ্রির মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখে।
রোদ্রি আবার বলে,
~ বলেন।
~ মাথা এভাবে রেখেছো কেন? ঘাড়ে ব্যাথা করবে পরে। দেখি সোজা করো।
বলে নিজেই রোদ্রির মাথা সোজা করে দেয়।

রোদ্রি মুচকি হাসে। নীরাদের এই ছোট ছোট কেয়ার গুলা সে খুব করে ভালোবাসে।
নীরাদ এমন ধাঁচের মানুষের মধ্যে পড়ে যারা কিনা ভালোবাসতে বাধ্য করে। এরকম মানুষদের ভালো না বেসে থাকা যায় না। এদেরকে ভালোবাসা বাধ্যতামূলক। আর ভালো না বাসাটা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে।

জ্যামে আটকে আছে তাদের গাড়ি। নীরাদ ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। রোদ্রি অধৈর্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্যামের মধ্যে বসে থাকা তার কাছে প্রচন্ড অসহ্য একটা বিষয়।

গাড়ির গ্লাসে “ঠক ঠক” শব্দে দুজনেই সেদিকে তাকায়। একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখে গ্লাস নামায় রোদ্রি।
মেয়েটা একটা বেলি ফুলের মালা এগিয়ে দিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলে,
~ আফা, নিবেন?

রোদ্রি মাথা এগিয়ে মেয়েটাকে দেখে। বেশ মিষ্টি দেখতে মেয়েটা।
রোদ্রি কিছু বলবে তার আগেই নীরাদ বলে,
~ নাও।
রোদ্রি মেয়েটার হাত থেকে মালাটা নেয়। একহাত বাড়িয়ে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
নীরাদ ওয়ালেট বের করে “পাঁচশ টাকার”একটা নোট এগিয়ে দেয় বাচ্চাটাই দিকে। বাচ্চাটা ইতস্তত গলায় বলে,
~ এত টাকা ভাংতি হইবোনা স্যার।
নীরাদ হাসিমুখে বলে,

~ ভাংতি লাগবেনা। তুমি রেখে দাও।
মেয়েটার মুখে হাসির ঝলকানি দিয়ে উঠে। দৌড়ে দৌড়ে সামনে যায় সে। তারই সমবয়সী কিছু মেয়েদের সাথে গিয়ে খুশিতে মেতে উঠে।
জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষনে। রোদ্রি একহাতে মালাটা পেচিয়ে নিয়েছে। এই অতি ক্ষুদ্র জিনিসটাই তার কাছে অনেক মূল্যবান।

বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেয় মনিরা আহমেদ, রোদ্রি আর নীরাদ।
খাওয়া শেষে রোদ্রি মনিরা বেগমের রুমে যায়। তাকে ওষুধ খাইয়ে দেয়।
আকাশে মেঘ ডাকছে বৃষ্টি হবে বোধহয়। ঠান্ডা বাতাস হচ্ছে তাই মনিরার রুমের জানালাগুলো ভালো করে আটকে দেয় সে।

মনিরা আহমেদ স্নেহের সহিত হাত বুলায় রোদ্রির মাথায়। ভাগ্য করে এমন মিষ্টি একটা বউ পেয়েছে সে।

গভীর রাত।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। ঠান্ডার থেকেও ঠান্ডাময় আবহাওয়া বিরাজ করছে। শীতল বাতাসে মুখিয়ে উঠেছে পরিবেশ।
বিছানায় এলোমেলোভাবে ঘুমিয়ে আছে রোদ্রি। হঠাৎ কারো ক্ষীণ ডাকে আধো আধো ভাবে চোখ মেলে সে।
নীরাদ ডাকছে তাকে।

~ হু, বলেন। (ঘুম জড়ানো কন্ঠ তার। )
~ উঠো।
রোদ্রি চোখমুখ কুঁচকে তাকায়।
~ কেনো?
~ বৃষ্টি হচ্ছে। ভিজবো। ছাদে চলো।

নীরাদের এই তিনটি বাক্যেই যথেষ্ট ছিল রোদ্রির ঘুম উড়ে যাওয়ার জন্য। হুড়মুড় করে উঠে বসে সে। অস্থির কন্ঠে দ্রুত বলে,
~ আপনি ঠি ক আছেনতো? আপনারতো কোনোকালেই বৃষ্টি পছন্দ না। আজ হঠাৎ ভিজতে চাইছেন তাও আবার এই মাঝরাতে। ….জর এসেছে নাকি?
বলে নীরাদের কপালে হাত রাখে রোদ্রি।

নীরাদ হেসে দেয়। কপালে রাখা রোদ্রির হাতটা নামিয়ে হাতের উল্টো পিঠে চুমু খায়।
~ আমি একদম ঠি ক আছি। এত প্রশ্ন না করে দ্রুত ছাদে চলো। কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার বলে,
~ আমি জানি তোমার মাঝরাতে বৃষ্টিতে ভেজার খুব শখ।

রোদ্রি চমকায়। বেশ কয়েকমাস আগে সে নীরাদকে কথার ছলেই তার এই ইচ্ছাটা বলেছিলো। নীরাদ এখনো মনে রেখেছে ভেবে খুবই অবাক হয় সে।
~ আপনি এখনো মনে রেখেছেন সেটা? (রোদ্রির কন্ঠে স্পষ্ট বিস্ময়। )
নীরাদ উওর দেয়না। কেবলমাত্র একটু হাসে।

ছাদের ঠি ক মধ্যখান টায় দাড়িয়ে আছে নীরাদ রোদ্রি। বৃষ্টি তুমুলবেগে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাদের। দুহাত মেলে বৃষ্টি উপভোগ করছে রোদ্রি। শাড়ি লেপটে আছে শরীরে। স্নিগ্ধ মোহনীয় লাগছে তাকে। হঠাৎ নীরাদ বলে,
~ চোখবন্ধ করো।

রোদ্রি বিনাবাক্য চোখবন্ধ করে। কেন জানি প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে না তার। মনে হচ্ছে, যা হচ্ছে হোক না।
নীরাদ হাঁটু গেড়ে বসে। একহাতে সদ্য ফোঁটা একগুচ্ছ লালগোলাপ ধরা। বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার সেগুলো। ছাদের এককোণায় বেশ কিছু গোলাপ গাছ আছে। সেখান থেকে মাত্রই নিয়ে এসেছে সে।

গোলাপগুলো বাড়িয়ে রোদ্রির দিকে ধরে বলে, “চোখ খুলো”।
রোদ্রি চোখ খুলে নীরাদকে এভাবে দেখে থমকে যায়। বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
নীরাদ বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বলে,

~ আই নো, যে এটা একটু অদ্ভুত। কিন্তু তোমাকে কখনোই সেভাবে বলা হয়নি। সবাইতো বিয়ের আগেই প্রপোজ করে, আমি নাহয় একটু অন্যরকম করে বিয়ের পরেই প্রপোজ করলাম। একটু থেমে বলে, “তোমাকে কখন এতটা ভালোবেসে ফেলেছি জানিনা তবে তুমি আমার প্রতিটা শিরায় শিরায় মিশে গেছো। তুমিহীন আমিকে ভাবতেও আমার ভয় লাগে। সবসময় আমার পাশে থেকে এভাবেই আমাকে গুছিয়ে রেখো।

এই একগুচ্ছ#ভেজাগোলাপ এর সঙ্গে আমার ভালোবাসা গ্রহণ করো প্রিয়।
রোদ্রির চোখ দিয়ে নোনাস্রোত বেয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানির সাথে মিশে যায় সেই পানি। কাঁপা হাতে ভেজাগোলাপ গুলো নেয় সে।
নীরাদের পাগলামিতে আজ বিস্মিত সে।

নীরাদ দাড়িয়ে যায়। । দুহাতে কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে নেয় রোদ্রিকে।
নেশা ভরা কন্ঠে বলে,
~ তোমাকে আমি সুস্থ মানুষের মতো ভালোবাসতে পারবোনা। কারণ আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি।

রোদ্রি লজ্জায় নীরাদের বুকে মুখ লুকায়। লোকটা সবসময় লজ্জায় ফেলে তাকে।
নীরাদ দুহাত রোদ্রির দুই গালে রাখে। রোদ্রির মুখটা বুক থেকে উঠিয়ে নেয়। শীতে রোদ্রির ঠোঁটগুলো থরথর করে কাঁপছে। রোদ্রির কাঁপা ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয় নীরাদ। পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে রোদ্রি।
বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে তাদের ভালবাসার গভীরতা।

লেখা – মালিহা খান

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “ভেজাগোলাপ – Akta valobasar golpo” টি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – প্রতিউত্তর – Valobashar koster golpo Bangla

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *