আমার তুমি (সিজন ২: ১ম খণ্ড) – Notun hot bangla love story

আমার তুমি (সিজন ২: ১ম খণ্ড) – Notun hot bangla love story: তুর্য বকুলকে ডাক দেয়। মুসকানকে আমার পাশে বসিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট উল্টে কেঁদে দেয়।


পর্ব ১

আমার স্বামী আমার চোখের সামনেই তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে কথা বলে। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি। আমি তুর্যের দ্বিতীয় স্ত্রী। এই বাড়িতে আমার প্রয়োজনটা নিতান্তই একটা আয়ার মত। আমার স্বামী তার প্রথম স্ত্রীকেই মনেপ্রাণে এখনো ভালোবাসে। তুর্যের বড় স্ত্রীর নাম মায়া। দেখলেই মায়া কাজ করে। আমি বাস্তবে কখনো দেখিনি। ছবিতে দেখেছি, প্রতিদিনই দেখি। মায়ার মস্ত বড় একটা ছবি আমাদের বেডরুমে টাঙ্গানো আছে। ঘুম থেকে উঠেই তুর্য আগে মায়ার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছবিটার সাথে কথা বলবে। শুধু বেডরুমে নয়, ড্রয়িংরুমেও মায়ার ছবি। আমার ছবি কোনো ঘরেই জায়গা পায়নি এমনকি তুর্যের মনেও নয়। মায়া আর তুর্যের ছোট্ট একটা মেয়েও আছে মুসকান। মুসকানকে জন্ম দিতে গিয়েই মায়া মারা যায়। আমাকে বিয়ে করেছে মূলত মুসকানের জন্যই। মুসকানের বয়স মাত্র ১০ দিন। মুসকানের জন্মের সাতদিনের দিন এই বাড়িতে আমি বউ হয়ে আসি।

আপনারা হয়তো ভাবছেন, একজন বিবাহিত ছেলে তার একটা মেয়েও আছে এমন ছেলেকে আমি কেন বিয়ে করলাম? এর কারণও আছে। আমি তুর্যকে অনেক আগে থেকেই চিনতাম। তুর্যের অফিসে চাকরী করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। একদিন বৃষ্টির মধ্যে তুর্যের বাবার গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। কোনো গাড়িও ছিল না সেসময়।তখন আমি রিক্সায় তাকে লিফ্ট দেই। সেখান থেকেই সে আমায় চিনতো আর খুব আদর করতো। আমাকে সবসময় একটা কথাই বলতো,”যদি আমার আরেকটা ছেলে থাকতো তাহলে তোমায় আমার বাড়ির বউ করতাম।

“আমি তখন মুচকি মুচকি হাসতাম। মায়া মারা যাবার পর আমার শ্বশুরের আমার কথা মনে পড়ে। সে আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমার যখন ৬ বছর তখনই মা মারা যায়। আমায় লালন-পালন করার জন্য বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। ইন্টার পরীক্ষার কয়েকমাস আগে বাবা মারা যায়। তারপর থেকেই সৎ মায়ের সংসারে বড় হতে থাকি। এমন বড়ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসায় আমার সৎ মা বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যায়। আমিও আর বারণ করিনি। জানিনা তুর্য কেন আমায় বিয়ে করতে রাজি হলো। হয়তো আমার বাবা যেমন আমার দেখাশোনা করার জন্য আমার সৎ মাকে বিয়ে করেছিল, তুর্যও সেই একই কারণে রাজি হয়েছে। তুর্যকে ভালোবাসার শুরুটা হলো
“প্রিয়ু একটু শুনে যাও তো”

তুর্যকে ভালোবাসার কথাগুলো না হয় অন্য একদিন শেয়ার করি? এখন বরং যাই, শুনে আসি কি জন্য ডাকছে। আমি দৌঁড়ে তাড়াহুড়ো করে যেতে গিয়ে ধিরিম করে দরজার সাথে ধাক্কা খাই।”ওমাগো”বলে কপাল ধরে চিৎকার দেই। তুর্য মুসকানকে কোলে নিয়ে দরজার কাছে আসে,
“চোখে দেখো না তুমি? দেখে চলতে পারো না?”
“না মানে, আসলে তাড়াহুড়োয়”

“এত তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই প্রিয়ু। ধীরে সুস্থে সাবধানে চলবে।”
তুর্যের কথা শুনে আমার চোখে আনন্দের অশ্রু চিকচিক করছিল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম,
“ভালো না বাসলেও তুমি আমায় কত কেয়ার করো!”

কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। তুর্যের পরের কথাটি শুনে সব ফিকে হয়ে গেল। ভাবনার অবসান ঘটিয়ে তুর্য বললো,
“সাবধানে না চললে যদি তোমার কিছু হয়ে যায় তখন মুসকানকে কে দেখবে বলো? ওর জন্যই তো তোমাকে বিয়ে করা। নয়তো আমি কখনোই মায়ার অধিকার অন্য কোনো মেয়েকে দিতাম না।”
মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মনে মনে বললাম,
“অধিকার আর দিলে কোথায় তুর্য? আমি তোমার মনে তো দূরের কথা ঘরেও জায়গা করে নিতে পারলাম না।”
তুর্য চোখের সামনে হাত নিয়ে তুড়ি দিয়ে বললো,
“কি ভাবছো?”
“এ্যা? না কিছুনা। কেন ডেকেছিলেন?”

“এই তিনদিন আত্মীয় স্বজনের জন্য ভালোই সময় কাটিয়েছো। এখন থেকে মুসকানের সব দায়িত্ব তোমার। ওর যত্নের যেন ত্রুটি না হয়।”
“হুম”
“মুসকানকে কোলে নাও। আমি গোসল করে আসি।”

মুসকানকে আমার কোলে দিয়ে তুর্য গোসল করতে চলে গেল। মুসকানকে কোলে নিয়ে আমি ঘরে হাঁটছি। মুসকান মুখে চারটা আঙ্গুল পুড়ে দিয়ে চুষছে। আমি অজান্তেই হেসে দিলাম। বাচ্চা সম্পর্কে আমার কোনো আইডিয়া নেই। তবে এতটুকু আন্দাজ করতে পারছি যে, মুসকানের খিদে পেয়েছে। আমি বিছানায় মুসকানকে শুইয়ে দিয়ে রান্নাঘরে দুধ গরম করতে গেলাম।
দুধ গরম করে ফিডারে ভরে সেটা পানিতে ঠান্ডা করে নিচ্ছিলাম। হঠাৎই তুর্যের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে আমি দৌঁড়ে রুমে গেলাম। মুসকানকে কোলে নিয়ে কান্না থামাচ্ছিল। আমাকে দেখতে পেয়ে মুসকানকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আমার সামনে এসে আমাকে অবাক করে দিয়ে দুইগালে দুইটা থাপ্পড় দিলো। আমার চোখে মুহুর্তেই পানি উপচে পড়ছে।

“তোমাকে কি এই বাড়িতে সঙ সাজিয়ে রাখার জন্য এনেছি? মুসকানকে একা রেখে কোথায় গিয়েছিলে? আর একটুর জন্য ওর দম আটকে যায়নি জানো? হাত নাড়াচাড়া করতে গিয়ে ওর ছোট কাঁথাটা মুখের ওপর এসে পড়েছিল।”
“আআম”

“শাট আপ ইডিয়ট! গেট আউট।”
আমি তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। এবার তুর্য চিৎকার করে বললো,
“গেট আউট”
আমি আর এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়ালাম না। দৌঁড়ে ছাদে চলে গেলাম। এত কষ্ট কেন হচ্ছে আমার! আমি তো তার কাছে এসব চড়-থাপ্পড় ছাড়া আর কিছুই আশা করতে পারিনা।

ছাদে দাঁড়িয়ে থাকায় বাতাসে খোলা চুলগুলো উড়ছিল।পেছন থেকে কারো ডাকে হুশ ফিরে।
“প্রিয়ু”

“রিয়া তুই?”
“স্যরি রে চিটাগাং থাকায় তোর বিয়েতে থাকতে পারিনি। আর এত অল্প সময়ের মধ্যে সব ঠিক হয়েছিল যে, আসার সময়ও করে নিতে পারলাম না।”
“সমস্যা নেই। কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমি তো ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”

“হুম ভালোই আছি।”
“তুই এই বিয়েতে কেন রাজি হয়েছিস রে? তোর সৎ মায়ের জোড়াজুড়িতে তাই না?”
“নাহ্! নিজের ইচ্ছেতেই।”
“কি বলছিস! কেন? তুই কি পাগল প্রিয়ু? একটা বিবাহিত ছেলে আবার মেয়েও আছে একটা তারপরও তুই এই বিয়ে করলি?”
“হ্যাঁ করলাম। কেন করলাম সেগুলো না হয় অন্য একদিন শুনিস।”
“যাই হোক, দুলাভাই কিন্তু হেব্বি দেখতে।”
“দেখেছিস?”

“হ্যাঁ জয় ম্যাসেঞ্জারে তোদের বিয়ের ছবি দিয়েছিল। এখন আবার রুমে গিয়েও দেখলাম।”
“ওহ্! জয় কেমন আছে রে?”
“যেমন রেখেছিস!”
উত্তরে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। জয় আমার বেষ্টফ্রেন্ড। স্কুল লাইফ থেকে আমি,জয় আর রিয়া তিনজনের বন্ধুত্ব খুব গভীর ছিল। স্কুল লাইফ থেকেই জয় আমাকে পছন্দ করতো। পছন্দ থেকে ভালোবাসাও শুরু হয়। আমার বিয়েটা ও মেনে নিতে পারেনি। আর না পারাটাই স্বাভাবিক। তবুও বন্ধুত্বের খাতিরে বিয়েতে এসেছিল।
“কিরে কি ভাবছিস?”
“কিছুনা। বাসায় চল কফি খেতে খেতে কথা বলি।”

“না, ছাদেই ভালো লাগছে। পরে যাবো ঘরে।”
“আচ্ছা”
“প্রিয়ু!”
“কি?”
“তোর বাসর রাতের কথা বল?”
“ফাইজলামি করছিস?”
“ফাইজলামি করবো কেন? মানতাসার বিয়ের সময় তো ওর বাসররাতের কথা আমরা বান্ধবীরা শুনেছিলাম। তুই তো বেশি ফোর্স করেছিলি। এখন তুই কেন বলবি না? বল বল তাড়াতাড়ি বল।”
“কি বলবো?”
“দুলাভাই তোকে সেদিন কি গিফ্ট দিয়েছিলো রে?”

“শুনবি?”
“হ্যাঁ বল।”
“মুসকানকে।”
উত্তরটা শুনে রিয়ার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তবুও মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“গ্রেট! আর নিশ্চয় অনেক আদর করেছিল তাই না হুম?”

“হাহ্! মুসকানকে আমার কোলে দিয়ে আমায় কি কি করতে হবে, মুসকানের কিভাবে কেয়ার করতে হবে সেগুলোই বলছিল। এরপর সে মুসকানকে নিয়ে শুয়ে পড়ে।”
“আর তুই?”
“আমি ব্যালকোনিতে রাত্রিযাপন করি।”
“দুলাভাই বলেছিল?”
“না। কষ্টগুলো মায়ের সাথে শেয়ার করি আকাশপানে তাকিয়ে।”
“তুই ভালো আছিস তো?”

“ভালো থাকাটা খুঁজে নিবো।”
ড্রয়িংরুমে রিয়াকে বসিয়ে রেখে আমি রান্নাঘরে কফি বানাতে গেলাম। রান্নাঘর থেকে একবার ড্রয়িংরুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম, মুসকান ঘুমিয়েছে আর তুর্য ল্যাপটপে যেন কি করছে। আমি আবার রান্নাঘরে চলে গেলাম। দুই মগ কফি বানিয়ে ড্রয়িংরুমে গেলাম। আমি আর রিয়া কিছুক্ষণ গল্প করলাম। তারপর রিয়াকে বিদায় দিয়ে ড্রয়িংরুমেই বসে রইলাম। আসলে বেডরুমে যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারিনি। টিভিটা মাত্র অন করেছি ঠিক তখনই তুর্য ডাক দেয়। আমি তাড়াতাড়ি টিভি বন্ধ করে তুর্যের সামনে গেলাম। তুর্য রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তুর্য ল্যাপটপটা বন্ধ করে বিছানার পাশে রেখে আমার সামনে আসে।
“কে এসেছিল?”
“বান্ধবী।”
“কথা বলিয়ে দিলে না কেন?”

“আসলে আপনি তো রাগ করে ছিলেন তাই আরকি!”
তুর্য প্যান্টের দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটু হেলেদুলে বললো,
“হুম! এক কাপ চা হবে?”
“আনছি।”
আমি চা নিয়ে এসে দেখি, তুর্য ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে আছে। চা নিয়ে আমিও ব্যালকোনিতে গেলাম।
“আপনার চা।”

“হুম? দাও”
চা দিয়ে আমি চলে আসছিলাম তখন পেছন থেকে তুর্য ডাক দেয়।
“প্রিয়ু”
“হ্যাঁ?”
তুর্য চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,

“চা টা দারুণ হয়েছে।”
“ধন্যবাদ।”
আমি যখন আবার চলে যাওয়া ধরলাম সে আবার ডাক দিলো,
“প্রিয়ু! আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।”
আমি এবার সরাসরি গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালাম। মাথা নিচু করে বললাম,

“বলুন”
“মুসকান যে আমার কাছে কি তা আমি তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না। আমার আর মায়ার ভালোবাসার গিফ্ট মুসকান। মুসকানের কিছু হয়ে গেলে আমি কখনোই সহ্য করতে পারবো না। তাই তখন মাথা ঠিক ছিল না। আমি সত্যিই দুঃখিত! তোমাকে মারা উচিত হয়নি আমার। মুসকানই হলো আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল।”
আমি আকাশ পানে তাকিয়ে বললাম,
“আর আমি?”


পর্ব ২

তুর্য আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি কি?”
“না মানে, আমি বলছিলাম যে আমি এখন যাই। রান্না করতে হবে।”
“তুমি কেন রান্না করবে? কাজ করার জন্য একজন খালা আছে। তুমি শুধু মুসকানের খেয়াল রাখো।”

“ঘরের বাকি কাজগুলো অন্য কেউ করলেও রান্নাটা আমিই করবো। নয়তো বাড়ির বউ বউ লাগবে না।”
তুর্য আমার খুব কাছে এসে বললো,
“আমি চাই, তুমি একজন ভালো মা হয়ে দেখাও।”
কথাটা বলে তুর্য চলে গেলো।
“হায়রে আমার কপাল! বাড়ির বউ হওয়ার আগেই মা হয়ে গেলাম।”
দুপুরে হালকা রোদে মুসকানকে কোলে নিয়ে শরীর মুছিয়ে দিচ্ছিলাম। এইটুকুনি বয়সে কেমন খিলখিল করে হাসে। মাঝে মাঝে মুসকানকে দেখলে আমার কষ্ট হয়! বেচারি মায়ের আদর পেলো না। পর মুহুর্তেই মনে হলো,
“ধুর আমিই তো ওর মা। হুম মা কিন্তু সৎ মা!”

মুসকানকে নিয়ে ঘরে চলে গেলাম। শরীর মুছিয়ে দিয়ে বেবি লোশন সারা শরীরে মেখে দিলাম। এরপর ওর জামাকাপড় পড়িয়ে ওর কপালে একটা নজর টিপ দিয়ে দিলাম। মুসকান তখন হাত-পা নাড়াচাড়া করে হাসছিল। মায়ের মতই মায়াবতী হয়েছে। ফিডার মুখে দিতেই খাওয়া শুরু করলো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
“বাবু আমি কি তোর সত্যি মা হতে পারবো না?”
“সৎ মা তো সৎ মা’ই হয় মিসেস চৌধুরী।”

দরজার সামনে তাকাতেই দেখলাম একটা সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে। কথাটা মেয়েটাই বললো।
“কে আপনি?”
“তুমি আমায় চেনো না?”
“নাহ্! তো।”
“তুর্য তোমায় আমার কথা বলেনি?”
“বললে তো জিজ্ঞেস করতাম না।”

“তুমি জানো আমি ওর কে?”
“অবশ্যই বিশেষ কেউ নন। এমন হলে সে বা আমার শ্বশুর আমায় ঠিক জানাতো।”
“মুখে তো দেখছি কথার ফুলঝুরি। শোনো মেয়ে, এমন চাটুকারিতা নিয়ে তুর্যের সংসার করতে পারবে না।”
“সংসারটা আমার আর তা সামলানোর দায়িত্বও আমার।”
“আমি তুর্যের বেষ্টফ্রেন্ড অথৈ।”
“ওহ্ আচ্ছা! কিন্তু বিয়েতে তো আপনাকে দেখলাম না।”
“ইচ্ছে করেই আসিনি। আসলে কি জানো এই বিয়েটা আমি মেনেই নিতে পারিনি। প্রথমে মায়া আর এখন তুমি। ড্যাম ইট!”
“ভালোবাসেন তাকে?”

“জেনে কি করবে? চলে যাবে ওর জীবন থেকে?”
“চলে যাওয়ার জন্য তো আমি তার জীবন, সংসারে আসিনি। আপনি যদি ভালোইবেসে থাকেন তাহলে সেটা উনাকে বলেননি কেন আগে?”
“বলার সুযোগ আর পেলাম কোথায়! বাই দ্যা ওয়ে, এত কথা বলার জন্য আমি আসিনি। আমি শুধু তোমায় একবারের জন্য দেখতে আসলাম।”
“ওহ্! আপনি বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি।”

“তার আর কোনো দরকার নেই। এসব কথা তুর্যকে জানানোর দরকার নেই। আর জানালেও লাভ হবে বলে মনে হয়না।”
আমি চুপচাপ তার কথা শুনে যাচ্ছি।
“তোমার শ্বশুর কত টাকা দিয়ে কিনে এনেছিল তুর্যের জন্য?”
“একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না বিষয়টা?”

“অনেক কম বলেছি। তোমার মত মেয়েকে তুর্য বিয়ে করতে কেন রাজি হলো বুঝলাম না।”
“কথায় আছে, রতনে রতন চিনে।”
অথৈ রাগি গলায় বললো,
“কি বলতে চাইছো?”

“তেমন কিছুই না। দেখেন, আপনার যদি কিছু বলার থাকে তাহলে সেটা উনাকে গিয়ে বলেন অযথাই আমাকে জড়াবেন না।”
“আরে বলোই না কত টাকা দিলে তুমি ডিভোর্স দিবে? এখনো গরম বয়স তোমার। তুমি তুর্যের চেয়েও ভালো হ্যান্ডসাম ছেলেকে ডিজার্ব করো।”
“আপনি বরং এরকমই একটা ছেলে দেখে গলায় ঝুলে পড়ুন অযথাই উনার পিছনে কেন পড়ে আছেন। আর শুনুন, বাপের টাকা আছে বলে কথায় কথায় টাকার গরম দেখাবেন না। আমি মানুষ কোনো পণ্য নই।”
“তুর্য তোমাকে ডিভোর্স দিবেই।”
“একটা কথা জানেন, যেটা আমার সেটা শুধু আমারই। তুর্য যদি আমার হয়ে থাকে, তাহলে আমারই থাকবে।”
“দুদিনের বউ হয়েই এত কনফিডেন্স?”

“বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।”
অথৈ আর কিছু বললো না। রাগে হনহন করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল।
“বড় বড় কথা তো বলে দিলাম, কিন্তু তুর্য যদি সত্যিই আমায় ছেড়ে দেয়? বড়লোকদের কারবারের তো কোনো শেষ নেই। টাকা আছে মানে, সবকিছু হাতের মুঠোয় করে নিতে পারে। তবে কি পাওয়ার আগেই তাকে হারিয়ে ফেলবো?”

মুসকান বিছানায় শুয়ে আছে। মুখে একটা আঙ্গুল পুড়ে চুষছে। বুকের মধ্যে অজানা এক ভয় কাজ করছে। আমি বিছানায় বসে পাশের টেবিল থেকে তুর্যের একটা ছবি হাতে তুলে নিলাম।
“ভেসে আসা মেঘের মত তুমি কি তবে তুলোর মত উড়ে যাবে? নাকি তুমি আমার?”
পেছন থেকে অথৈ হেসে বলে,
“তুর্য তোমারই!”
ছবিটা বিছানার উপর রেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম।

“আপনি যাননি?”
“না, তোমার রিয়াকশন না দেখে যাই কিভাবে? আমি তো ফান করছিলাম।”
আমি হেসে দিলাম। বললাম,
“এবার তো তাহলে এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে?”
“না গো! হাতে একদম সময় নেই। অন্য একদিন খাবো। আজ আসি।”

“সাবধানে যাবেন।”
অথৈ মুচকি হেসে বলে,
“থ্যাঙ্কিউ”
অথৈ যদিও বললো ফান করেছে কিন্তু বিষয়টা মেনে নিতে পারছিনা। তার প্রথম বলা কথাগুলো তীরের মত বাঁধছিল। আচ্ছা ফানও কি এরকম হয়? এটা কি সত্যিই ফান ছিল নাকি অথৈ সত্যিই তুর্যকে ভালোবাসে!

রাত নয়টা নাগাদ মুসকান ঘুম থেকে উঠে যায়। এতবার ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই ঘুমাচ্ছেনা। তাই বাধ্য হয়ে রুমের এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হাঁটছি। গোলাকৃতির হয়ে এভাবে হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘুরে যায়। তাই ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়াই। ড্রয়িংরুমে যেতেই দেখি তুর্য সোফায় বসে”টাইটানিক”মুভি দেখছে। আমার পছন্দের ছবিগুলোর মধ্যে টাইটানিক একটা। আমিও গিয়ে তুর্যের পাশে বসলাম কিন্তু দূরত্ব রেখে। তুর্য একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার টিভি দেখায় মনোযোগ দিলো। আর এদিকে তো আমি মন, চোখ সব টিভির ওপর উজার করে দিয়েছি। তুর্য একটু আমার কাছে সরে আসলো। হালকা উপুর হয়ে মুসকানকে চুমু খাচ্ছিলো আর বলছিল,
“এত রাতে আমার মামনির চোখে ঘুম নেই?”

এসব কিছু না আমি দেখছি আর না আমি শুনছি। আমি শুধু জ্যাককেই দেখছি। হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেললাম,
“ইশ! জ্যাককে দেখলেই আমার কেমন যেন প্রেম প্রেম পায়।”
কথাটা শুনে তুর্য় সোজা হয়ে বসে। একবার টিভির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার আমার দিকে। এবার দৃষ্টি আমার দিকেই স্থির হলো। ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে বললো,
“কি বললে?”
আমি টিভির দিকে তাকিয়েই বললাম,
“কি বললাম?”

তুর্য টিভিটা অফ করে বললো,
“সেটা তো তুমি বলবে।”
আমি চেহারায় বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“টিভিটা বন্ধ করলেন কেন?”

“তার আগে তুমি বলো, জ্যাক কে দেখলে তোমার কি?”
আমি কয়েকবার চোখটা এদিক সেদিক ঘুরিয়ে মনে করার চেষ্টা করছিলাম যে, কি বলেছিলাম। যখনই মনে হলো আমি বলেছি যে, জ্যাককে দেখলে আমার প্রেম প্রেম পায় তখনই জিহ্বায় কামড় বসালাম।
“না মানে, আসলে মুখ ফসকে বেড়িয়ে গিয়েছে।”

“পাশে হাজবেন্ড বসে আছে, আর তুমি একটা পরপুরুষকে দেখে বলছো তাকে দেখলে তোমার প্রেম প্রেম পায়?”
“বাহ্ রে! জ্যাক পরপুরুষ হতে যাবে কেন? সে তো আমার ক্রাশ!”

“তো ক্রাশ কি পরপুরুষ না? আর কি বললে ক্রাশ? আরে, তুমি তো ওর হাঁটুর বয়সীও না।”
“যখন ও ছবিটা করে তখন কি আমি দুনিয়ায় ছিলাম নাকি। সে অনুযায়ী আমি ওর অনেক ছোট সেটা আমি জানি। কিন্তু এই ছবিতে তো ইয়ং! ইশ! কি দারুণ দেখতে। ড্যাসিং লুক। চোখ দুইটা তো মারাত্মক! ইশ, উম্মাহ্ উম্মাহ্ উম্মাহ্!

তুর্য দাঁত কটমট করে বললো,

“তুমি তো খুব মারাত্মক! আমার সামনে অন্য ছেলের গুণগান করছো? আবার উম্মাহ্ উম্মাহ্ করছো?
জীবিত মাছ যেমন পানি না পেয়ে লাফায়, আমার আত্মাও ভয়ে এখন তেমন লাফাচ্ছে। মনে মনে বলছি,
“পরী মানে মানে কেটে পড় তাড়াতাড়ি।”
আমি আমার আটাইশ পাটি দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে বললাম,
“আমি যাই হ্যাঁ? আপনি টিভি দেখেন।”

তুর্যকে আর কিছু বলার সুযোগ দেওয়ার আগেই আমি উঠেপড়ে দৌড় মুসকানকে নিয়ে। বিছানা ঠিকঠাক করে মুসকানকে শুইয়ে দিয়ে আমিও কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাঁথার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে বললাম,
“মুসু সোনা আমার কেঁদো না কেমন! নাহলে কিম্তু তোমার বাবাই মাম্মামকে খুব বকবে।”
মুসকান আমার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে দিলো। তুর্যের আসার শব্দ পেয়ে আবার কচ্ছপের মত খোলস মানে কাঁথার ভেতর ঢুকে পড়লাম। তুর্য রুমে এসে আমায় শুয়ে থাকতে দেখে হেসে দিলো। তারপর মায়ার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

“আমায় ভুল বুঝো না মায়া। পরী মেয়েটা নিতান্তই ছোট আর বাচ্চা স্বভাবের। তবুও ও আমাদের মেয়ের দেখাশোনা করছে, খেয়াল রাখছে, ওর মায়ের অভাব পূরণ করছে। মেয়েটার সাথে আমি কি করে খারাপ ব্যবহার করি বলো? তোমার জায়গা কখনো কেউ নিতে পারবে না। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আমি চাই মুসকান একটা মা পাক। মায়ের আদর থেকে যেন বঞ্চিত না হয়। তাই তো তোমার বিরহ কাটিয়ে উঠার আগেই বিয়েটা করতে হলো। প্লিজ আমায় ভুল বুঝোনা।

সেদিন যদি তুমি আমায় আর মুসকানকে একা করে দূর আকাশে চলে না যেতে তাহলে বোধ হয় সময়টা অন্য রকম সুন্দর হতো। ভালোবাসি তোমায় মায়া।”
কথাগুলো বলতে বলতে তুর্য কাঁদছিল। এদিকে আমি ঘুমের অভিনয় করতে গিয়ে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছি। তুর্য লাইট অফ করে ডিম লাইট অন করলো। বিছানায় গিয়ে মুসকানকে বুকের সাথে নিয়ে শুয়ে পড়লো। আমার দিকে তাকাতে তাকাতে বললো,
“দেখেছো কান্ড! গরমের মধ্যে কিভাবে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে।”

তুর্য হাত দিয়ে কাঁথাটা সরিয়ে দিলো আর সাথে সাথে আমার একগুচ্ছ অবাধ্য চুল এলোমেলো হয়ে মুখে ছড়িয়ে পড়লো। চুলগুলো নাকে মুখে পড়ে চুলকাচ্ছিল তাই ঘুমের মধ্যেই বারবার সরানোর চেষ্টা করছিলাম। বিষয়টা তুর্য খেয়াল করছিল। আলতো করে চুলগুলো সরিয়ে দেয়।

কয়েকদিন ধরেই ভ্যাপসা গরম পড়ছিল। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব কিন্তু আকাশ মেঘলা হলেও বৃষ্টিটা আর হয়নি। তবে আজ গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। একসময় গুড়িগুড়ি বৃষ্টিটা ঘনবৃষ্টিতে রূপ নেয়। ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টি পড়ছে আর সেই সাথে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মরার মত ঘুমাচ্ছিলাম বলে কিছুই টের পাইনি। কিন্তু ঠান্ডা ঠান্ডা আভাষটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম। বেশিকিছুক্ষণ এভাবে কেটে যায়। মুসকানও ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করে। মুসকানের কান্নার জন্য আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ি। মুসকানকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফিডার মুখে দেই। আস্তে আস্তে ওর কান্না কমে আসে। ঘুমে চোখ আমার ভেঙ্গে আসছিল কিন্তু কিছু করারও ছিল না। খেতে খেতে মুসকান ঘুমিয়ে যায়। ফিডারটা রেখে মুসকানকে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দেই আর সাথে সাথে মুসকান ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করে। মনে হচ্ছিল আমার শরীরের উমে ঘুমাতে পারছিল আর বৃষ্টি হচ্ছে তাই চারপাশে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আমি খাটের সাথে একটা বালিশ রেখে হেলান দিয়ে শুয়ে মুসকানকে আমার বুকের ওপর শোয়ালাম।

কাঁথা দিয়ে ভালোমত পেঁচিয়ে নিলাম। এবার সে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। আমি আলতো করে মুসকানের মাথায় আর হাতে চুমু খেলাম। এরপর একহাত দিয়ে বুকের সাথে ধরে রাখলাম। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় আর ঘুম আসছিল না। পাশে তাকাতেই দেখি, তুর্য জড়োসরো হয়ে ঘুমাচ্ছে। আমি আর মুসকান আলাদা কাঁথা গায়ে দেই আর তুর্য আলাদা কাঁথা। আমি ভালো করে কাঁথাটা গায়ে টেনে দেই। একসময় আমার চোখেও নিদ্রা ভর করছিল। হুট করেই অনুভব করলাম এক জোড়া ঠান্ডা হাত আমার পেটের ওপর। আস্তে আস্তে শরীরের কাছেও কিছু অনুভব করলাম। ফট করে চোখ খুলে ফেললাম। তাকিয়ে দেখলাম, তুর্য ঠান্ডায় আমার দিকে এগিয়ে এসেছে। আমি হেসে বললাম,
“বাপ মেয়ে দুজনই দেখছি আমার সাথে লেগে ঘুমাচ্ছে। বেশ ঠান্ডা আমারও কম লাগবে।”

তুর্য আমার কাছে আসতে আসতে একদম কাছে এসে পড়ে। আরো জোরে চেপে ধরে আমায়। কেমন যেন এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে যেটা অনুভব করতে পারছি কিন্তু বলতে পারছিনা। আমি তুর্যের হাতদুটে সরিয়ে দিতে চাইলে আরো জোরে চেপে ধরে। যাকে বলে, একদম মহা মুশকিল! শেষমেশ অনেক কষ্টে হাত দুটো সরাতে সক্ষম হই আর একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে তুর্য আমার আগেই ঘুম থেকে উঠে। আজও তার ব্যতীক্রম হয়নি। তুর্যের যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন চোখ দুটো তার বিষ্ময়ে ছানাবড়া হয়ে যায়। মুসকান আমার বুকে ঘুমাচ্ছিল আর তুর্য আমার গলায় মুখ রেখে পেটে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছিল। এদিকে আমিও মরার মত ঘুমাচ্ছিলাম। কিছু টেরও পাইনি। তুর্য এক লাফে বিছানা থেকে উঠে যায়।

পর্ব ৩

তুর্য রেডি হয়ে অফিসে চলে যায়। আমি তখনো মুসকানকে নিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। আবহাওয়া ঠান্ডা হওয়ায় ঘুমটা শান্তির হচ্ছিলো। কিন্তু সেটা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আমার পেটের ওপর ভিজে একদম একাকার। এখানে গরম পানি এলো কোথা থেকে! চোখ মেলে তাকাতেই বুঝতে পারলাম আমার গুণধর মেয়ে হিসু করে দিয়েছে। বাধ্য হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে হলো। আগে মুসকানের ড্রেস চেঞ্জ করে দিলাম। একবার ভাবলাম আমিও গোসলটা করে আসি। পরে আবার ফিরে আসলাম। সেই রাতে মুসকান খেয়েছিল এখনো তো ওর খাওয়া হয়নি। তাই আর চেঞ্জ করলাম না তখন। রান্নাঘরে গিয়ে দুধ বানিয়ে আনলাম। মুসকানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে একটা কাপড় ভিজিয়ে ওর মুখ মুছিয়ে দিলাম। খাওয়ানোর পর ছোট্ট মহারাণী এখন আর ঘুমাচ্ছে না। হাত-পা উঁচু করে খেলছে।

“মামনি লক্ষী মেয়ের মত একটু ঘুমাও সোনা। আমার গোসল করতে হবে তো!”
প্রতিউত্তরে মুসকান হেসে উঠলো। ততক্ষণে কাজ করার খালাও এসে পড়েছে। আমি রুম থেকেই ডাক দিলাম,
“খালা শুনছেন?”

রান্নাঘর থেকে খালা উত্তর দিলো,
“আইতাছি মা।”
খালা হাত মুছতে মুছতে রুমে আসলো।
“ডাকছো মা?”
“কি করছিলেন?”

“থালাবাসন মাজতাছিলাম।”
“আচ্ছা আমি পরে করে নিবো ওগুলা। আপনি একটু মুসকানের কাছে থাকেন। আমি গোসল করে আসি।”
“আচ্ছা।”
খালার কাছে মুসকানকে রেখে গোসল করতে গেলাম। গোসল সেরে বের হয়ে দেখলাম খালা মুসকানের সাথে কথা বলছে আর মুসকান হাসছে। আমিও মুচকি হেসে ভেজা কাপড়গুলো ছাদে মেলতে চলে গেলাম। ছাদ থেকে সোজা রান্নাঘরে গেলাম। দুই কাপ চা বানিয়ে আর কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে রুমে গেলাম। এক কাপ চা খালার দিকে এগিয়ে দিলাম,
“নিন খালা।”
“কি করতাছো মা? আমি তোমাগো কাপে চা খামু?”
“হ্যাঁ খাবেন। তাতে কি হয়েছে?”
“না মা আমি এটা পারমু না।”

“কেন? ঘৃণা করেন নাকি?”
“এগুলা কি কইতাছো মা? তোমরা বড়লোক আর আমরা গরীব মানুষ।”
“না খালা। আমিও আপনার মতই মধ্যবিত্ত। বড়লোক তো মুসকানের বাবা।”
“তুমি তো এহন তার বউ।”

“আপনি চা নেন তো, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
অনেক জোড়াজুড়ি করার পর খালা চা নিলো। চা খাওয়ার পর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“জানো মা সাহেবের বড় বউটাও এমন ভালো আছিলো।”

“মায়া আপু?”
“হ্যাঁ। আমি তো অনেক সময় না খেয়ে আসতাম, তখন সে আমায় জোর করে খাওয়াতো। অনেক ভালো ছিল মায়া। সাহেব অনেক ভালোবাসতো। সারাদিন কত খুনসুটি করতো তারা। মায়া মার যখন বাচ্চা পেটে আছিল তখন তো সাহেব বেশিরভাগ সময়ই বাসায় থাকতো। অনেক যত্ন করতো। এরপর তো সবাইরে ছাইড়া গেলো গা। সাহেব তো পুরো পাগলের মত হয়ে গেছিলো।”

কথাগুলো বলে খালা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলো। আমার চোখেও পানি টলমল করছে বুঝতে পারলাম। তিনি আবার বললেন,
“যখন শুনলাম সাহেব আবার বিয়া করবো তখন মনে মনে কতকিছু ভাবছিলাম। না জানি বাড়ির বউ কেমন হইবো, আর মুসকানরে কেমন চোখে দেখবো! কিন্তু তুমি মায়ার মতই অনেক দরদী মা। কত আদর করো মুসকানরে।”
আমি মুচকি হেসে বললাম,

“আমি মুসকানের সৎ মা হতে চাই না। আমি চাই মুসকান এটা জানুক যে, আমি ওর ছোট মা। সৎ মা শব্দটার সাথে অনেক ঘৃণা জড়িয়ে থাকে খালা।”
“আল্লাহ্ তোমারে সুখী করুক মা। স্বামী, সংসার আর সন্তান নিয়ে সুখে থাকো সবসময়।”

অনেকদিন ধরে ছোট ভাই আর মাকে দেখি না। মনটা খুব কাঁদছিল বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কিভাবেই বা বলবো তুর্যকে কথাটা। মুসকানের বাবা-মাও এখানে থাকেন না। তুর্যদের গ্রামে মস্ত বড় বাড়ি আছে। তারা দুজনে গ্রামেই থাকেন। তুর্য ওর বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। সারাদিন বাড়িতে একা একা কাঁটাতে আর ভালো লাগে না। ভাবলাম আজ তুর্য বাসায় আসলে একবার বলে দেখবো।
তুর্যের জন্য অপেক্ষা করছিলাম কখন আসবে।
রাত আট’টার দিকে তুর্য বাসায় আসে। আমি তুর্যের পেছন পেছন ঘুরঘুর করছিলাম। তুর্য ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বললো,
“কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ।”

“বলো।”
“বলছিলাম যে, অনেকদিন ধরে মা আর ছোট ভাইটাকে দেখি না। কাল যদি একটু নিয়ে যেতেন?”
“আমার সময় নেই পরী। অফিসে অনেক কাজ।”

“তাহলে আমি মুসকানকে নিয়ে একা চলে যাই?”
“পাগল তুমি? মুসকানকে নিয়ে তুমি একা যাবে। যদি কিছু হয়ে যায়?”
আমি আর কিছু বললাম না। তার কথার মানে বুঝতে আমার খুব বেশি কষ্ট হলো না। আমি মুসকানকে নিয়ে একা যাওয়ায় যদি মুসকানের কিছু হয়ে যায় এই ভয় পাচ্ছে। ব্যাপার না। আমার চাওয়া পাওয়ার যে কোনো দাম নেই সেটা আমার ভুলে গেলে চলবে না। আমি মাথা নিচু করে চলে যাওয়া ধরলে তুর্য পেছন থেকে ডাক দেয়।
“শোনো?”
“কি?”

“কাল সকাল দশটায় রেডি হয়ে থেকো। তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমি অফিসে যাবো।”
আমার যেন বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। খুশিতে আত্মহারা হয়ে তুর্যের গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
“থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”।

“গলা ধরে বাঁদরের মত না ঝুলে থেকে নামো প্লিজ, দম আটকে আসছে আমার।”
আমি তাকিয়ে দেখলাম, আসলেই আমি তার গলা ধরে ঝুলে আছি। আর ঝুলবোই না বা কেন? এরকম আইফেল টাওয়ার হলে তার গলা ধরে আমাকে তো ঝুলে থাকতেই হবে। আমি তাড়াতাড়ি করে তার গলা ছেড়ে দিলাম।
“তুমি এমন বাচ্চা স্বভাবের কেন বলো তো?”
আমি গলার স্বর নিচু করে বললাম,

“আমি কি করলাম?”
“কি করোনি? সারাক্ষণ বাচ্চাদের মত লাফানি ঝাঁপানি। বাচ্চার মা হয়ে গিয়েছো অথচ নিজের বাচ্চামি কমেনি।”
আমি তার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালাম। সে থতমত খেয়ে বললো,
“না মানে, মুসকান তো এখন তোমার মেয়েই। আমার খিদে পেয়েছে। খেতে দাও।”
কথাটা বলে তুর্য চলে গেলো। আমিও হেসে দিলাম।

সকাল সকাল রেডি হয়ে নিলাম। বেশ খুশি খুশি লাগছিল। ঐ বাড়িতে মায়ের স্মৃতি রয়েছে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারি মায়ের রুমে। তুর্য গাড়িতে বসে ড্রাইভ করছিল। আমি মুসকানকে কোলে নিয়ে বসে ছিলাম।
“খুব খুশি মনে হচ্ছে?”
“অনেক।”
“এত খুশির কিছু নেই। অফিস ছুটির সময় আবার গিয়ে নিয়ে আসবো।”

“এ্যা?”
“এ্যা নয় হ্যাঁ। মুসকানকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।”
খুশি হওয়ার আগেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না।
আমাদের পৌঁছে দিয়ে তুর্য চলে গেল। বাড়িতে ঢুকতেই মা দৌঁড়ে আসলো।
“পরী তুই?”
“কেমন আছো মা?”
“ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌। ছোটু কই?”
“ও তো স্কুলে গেছে। আয় ঘরে আয়।”
ঘরে যাওয়ার পর মা অনেক কিছু খেতে দিলো সাথে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসলো। সৎ মা হলেও তিনি মানুষটা ভালো ছিলেন। আর এখন তো তুর্যের সাথে বিয়ে হওয়ায় পুরোটাই চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে। সবার খুশিতেই আমার খুশি।
মা মুসকানকে কোলে নিয়ে আদর করে দিলো। এরপর রান্নাবান্না করার জন্য রান্নাঘরে চলে গেল। আমি রিয়াকে ফোন দিয়েছিলাম কাল। বাড়িতে আসতে বলেছিলাম।
কিছুক্ষণ পর রিয়া আসে। জড়িয়ে ধরে বলে,
“সুন্দরী ভালো আছিস?”

আমি হেসে বললাম,
“হ্যাঁ। তুই?”
“হুম ভালো আছি। ভালোই হয়েছে তুই আজ এসেছিস।”
“কেন? আজ কি বিশেষ কিছু?”
“আরে আমার ছোট বোনের জন্মদিন। তুইও থাকবি সেখানে।”
“নারে। তুর্য আজই নিয়ে যাবে আমায়। কিছু সময় তো মায়ের সাথেও কাঁটাতে হবে।”
“দুলাভাই কখন আসবে?”

“রাতে।”
“সমস্যা নেই। বিকালে এখান থেকে আমাদের বাড়ি যাবো। তারপর সন্ধ্যার মধ্যেই পৌঁছে দিয়ে যাবো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
সকাল থেকে বিকালটা দারুণ কেটেছে মা, রিয়া আর ছোটুর সাথে। কতদিন পর প্রাণ খুলে হেসেছি, সময় কাঁটিয়েছি। সন্ধ্যাটা আরো বেশি ভালো কাটবে। সব বন্ধু-বান্ধবীর সাথে কথা হবে, দেখা হবে।
বিকেল বেলা মাকে বলে রিয়ার সাথে বাসায় গেলাম। আমায় দেখে রিয়ার মা জড়িয়ে ধরলো।
“ভালো আছো আন্টি?”
“হ্যাঁ মা। তুই ভালো আছিস তো?”
“হ্যাঁ।”

“কোলে কি তোর মেয়ে?”
“হ্যাঁ।”
পাশ থেকে জয় বললো,

“সৎ মেয়ে আন্টি।”
জয়ের কথা শুনে মুখটা মলিন হয়ে গেল। আমি জয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
“এভাবে কেন বলছিস জয়?”
“এর চেয়েও সুন্দর করে বলতে পারিনা মিস পরী! ওপস স্যরি এখন তো আপনি মিসেস চৌধুরী! বড়লোকের বউ।”
“তুই কিন্তু আমাকে অপমান করছিস জয়।”

“মান থাকলে তো অপমান করবো। একটা বিবাহিত ছেলে, তার আবার একটা মেয়েও আছে তাকে তুই কেন বিয়ে করেছিস সেটা কি আমরা জানিনা ভেবেছিস?”
জয়ের কথাগুলো আমি হজম করতে পারছিলাম। বুক ফেঁটে কান্না আসছিল আমার। জয়ের থেকে এসব কথা শুনবো এটা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। রিয়া জয়কে একপাশে টেনে নিয়ে বললো,
“ঘরভর্তি মানুষের সামনে কি শুরু করলি তুই?”
জয় রিয়াকে সরিয়ে দিয়ে বললো,
“বলতে দে আমায়। সবাই জানুক আমাদের পরী কতটা লোভী।”
জয় আবারও আমার কাছে এগিয়ে এলো।

“টাকার খুব লোভ তোর তাই না? শুধুমাত্র টাকার জন্য তুই বিয়েটা করলি? আরে বেঈমান সেই ছোট্টবেলা থেকে তোকে পাগলের মত ভালোবেসে আসছি সেটা তুই জানতি না? বারবার ফিরিয়ে দেওয়ার পরও আশা ছাড়িনি। ভালোবেসে গিয়েছি আর তুই! তুই টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেলি?”
এমন আরো নানান ধরণের কথা বলে যাচ্ছিলো। কিচ্ছু বলতে পারছিলাম না আমি। শুধু চোখের পানি ফেলছিলাম। মুসকানও হঠাৎ কান্না করে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে আমার হেঁচকি উঠে যায়। আমি চোখের পানি মুছে বললাম,

“তুই আমাকে ভুল বুঝছিস জয়। আমি টাকার জন্য তুর্যকে বিয়ে করিনি।”
“তাই? বেশ! তাহলে তুর্যকে ডিভোর্স দিয়ে দে। ফিরে আয় আমার কাছে। এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ জানে আমি তোকে কতটা ভালোবাসি। আমার পরিবার থেকে কেউ কোনো সমস্যা করবে না। ফিরে আয় আমার কাছে।”
জয় আমার দুই গালে হাত রেখে বললো,
“আসবি বল?”

ডান হাত দিয়ে ওর দুই হাত সরিয়ে দিলাম।
“বিয়েটাকে তোর কি মনে করিস বল তো? তুই আমার বেষ্টফ্রেন্ড ছিলি, আছিস আর থাকবি। কিন্তু তোকে ভালোবাসা বা জীবনসঙ্গী কোনোটাই করতে পারবো না।”
জয় আমার দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বললো,
“কেন পারবি না তুই? তোকে পারতেই হবে।”

“জয় ছাড় আমায়। মুসকান পড়ে যাবে।”
এরমধ্যেই ছোটুকে সাথে করে তুর্য এই বাসায় আসে। জয়ের থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“এসব কি হচ্ছে? জয় তুমি না ওর বেষ্টফ্রেন্ড?”
জয় রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,

“ভালোবাসি আমি ওকে।”
তুর্য ঠান্ডা গলায় বললো,
“তাহলে ভুলে যাওয়াটাই তোমার জন্য ভালো। কারণ পরী এখন আমার ওয়াইফ। হাজার কিছু হয়ে যাক, পরী আমারই থাকবে। তাই অযথাই টাইম ওয়েস্ট করো না। চলো পরী।”
তুর্য আমার হাত ধরে বাড়ি থেকে চলে আসছিল। পেছন থেকে জয় চিৎকার করে বলছিল,
“আমিও দেখবো তুই কিভাবে সুখী হস পরী! আমাকে কাঁদিয়ে তুই কখনো সুখী হতে পারবি না।”

পর্ব ৪

সারা রাস্তায় তুর্য কোনো কথা বলেনি আমার সাথে। সত্যি বলতে আমিও এটাই চেয়েছিলাম। জয়ের এমন ব্যবহার সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল। বাড়িতে পৌঁছানোর পর মুসকানকে কোলে নিয়ে বসে আছি। মন-মেজাজ ভালো নেই। কান্না পাচ্ছে কিন্তু কাঁদতে পারছি না। এদিকে মুসকানও এখন কোলে থাকতে চাচ্ছে না। মুসকানকে নিয়ে যে হাঁটবো সেই শক্তিটুকুও মনে হচ্ছে নেই আমার। কিন্তু মুসকানের কান্না থামানোর জন্য ইচ্ছের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করে হাঁটছিলাম। তুর্য রুমে এসে আমার কোল থেকে মুসকানকে নিয়ে নিলো।
“যাও ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রেষ্ট নেও কিছুক্ষণ।”

আমিও আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। একবার ঘুরে তাকালাম তুর্য কি করছে দেখার জন্য। দেখলাম মুসকানকে কোলে নিয়ে হাঁটছে আর কথা বলছে ওর সাথে। কান্না করার কারণে মাথাটা ভারী হয়ে ছিল। তাই বিছানায় শরীর রাখতেই দু চোখে ঘুম ভর করে।

রিয়া জয়কে ইচ্ছেমত বকাঝকা করছে।

“কেন এমন করলি পরীর সাথে?”
জয় কিছু বলছে না, চুপ করে আছে। রিয়া আবার বললো,
“দেখ জয়, পরী কিন্তু তোকে কখনোই ভালোবাসেনি। আমরা তিনজন ছিলাম বেষ্টফ্রেন্ড। পরী তোকে ফ্রেন্ডের বাহিরে আর কিচ্ছু ভাবেনি কখনো। তাহলে কেন এমন করলি ওর সাথে? আজ তো ওর সাথে ভালোমত একটু কথা বলতে পারতি। দেখতি মেয়েটা কত খুশি হতো।”
“আমি কি করতাম বল? ভালোবাসি আমি পরীকে।”

“এই ভালোবাসার কোনো ভিত্তি নেই জয়। পরী এখন বিবাহিত।”
“হাহ্! সেই তো! পরী এখন বিবাহিত। টাকা! টাকাই সব এখনকার যুগে। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেল পরী।”
“তুই পরীকে ভুল বুঝছিস জয়।”
“কোনটা ভুল বলতো? একজন বিবাহিত ছেলে, তার একটা মেয়ে আছে। তাকে কি এমনি এমনিই বিয়ে করেছে?”
“হয়তো আমাদের দেখার আড়ালেও অনেক অজানা কিছু আছে যেটা আমরা জানিনা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, পরী যদি তুর্য ভাইয়ার সাথে হ্যাপী থাকে তাহলে তুই কেন মাঝখানে ঢুকবি বলতো?”
“কি করবো আমি?”
“ভুলে যা পরীকে।”

“পারবোনা।”
“বেশ! তোর যা মন চায় তুই কর। আমি গেলাম।”
“শোন?”
“কি?”

“পরীর সাথে একবার দেখা করিয়ে দিতে পারবি?”
“কেন?”
“স্যরি বলবো।”
“সত্যিই? নাকি আবার কোনো সিনক্রিয়েট করবি?”
“বিশ্বাস হয়না আমাকে?”
“আচ্ছা আমি পরীর সাথে কথা বলে জানাবো।”

আনুমানিক ৪ ঘন্টা ঘুমাতে পেরেছি। তুর্য এসে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়।
“পরী ওঠো?”

“কি হয়েছে?”
“খিদে পেয়েছে। খাবো।”
“কিচেনে সব আছে। খেয়ে নিন।”
“তুমি খাবে না?”
“না।”
“কেন?”

“এমনি ভাল্লাগছেনা।”
“কোনো এক্সকিউজ নয়। তাড়াতাড়ি ওঠো।”
“বললাম তো ভালো লাগছে না।”

তুর্য আমার কোনো কথা শুনেনি। টেনে ওঠিয়েছে। কিন্তু আমিও নাছোরবান্দা। কিছুতেই খাবো না। তুর্য আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো,
“শোনো তোমাকে টেনে ওঠিয়েছি বলে ভেবো না খেতে ওঠিয়েছি। একটা ডিম ভেজে দাও আমি ভাত খাবো।”

কি আর বলবো! কিচ্ছু বলার মত ভাষা নেই। ওঠে কিচেনে গেলাম। অন্যমনস্ক হয়ে কাঁচা মরিচ কাটতে গিয়ে ডান হাত কেটে ফেলেছি। হাত কাটার হলো এক যন্ত্রণা, তার মধ্যে মরিচ কাটতে গিয়ে হাত কাঁটলাম। হাতটা একদম জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা পানিতে কিছুক্ষণ হাতটা ডুবিয়ে রাখলাম। আমার দেড়ি হচ্ছে দেখে তুর্য কিচেনে আসলো,
“একটা ডিম ভাজতে এতক্ষণ লাগে?”, কথাটা বলতে বলতে তুর্য কিচেনে আসে।
“হাতে কি হয়েছে?”
“কেঁটে গেলো।”

“কিভাবে?”
“আরেকবার কেঁটে দেখবো?”
“ইস্টুপিট গার্ল!”

আমি মাথা নিচু করে বললাম,
“মরিচ কাটতে গিয়ে।”
“তো ঠান্ডা পানিতে হাত ডুবিয়ে রাখলে কি রক্ত পড়া বন্ধ হবে?”
আমি কিছু বলার আগেই তুর্য কিচেন থেকে বেড়িয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওয়ান টাইম এনে হাতে লাগিয়ে দিয়ে বলে,
“সরো আর ডিম ভাজতে হবে না তোমায়। আমি ভাজি তুমি দেখো।”
“হু।”
ডিম ভাজার পর সব খাবার হাতে হাতে টেবিলে নিয়ে দিলাম। তুর্য ভাত বাড়তে বাড়তে বললো,
“দেখো তো মুসকান ঘুম থেকে উঠেছে নাকি।”
রুমে গিয়ে দেখলাম মুসকান তখনও ঘুমাচ্ছে। এসে দেখি দুই প্লেটে ভাত বেড়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“দুই প্লেটে ভাত কেন?”

“আমি একাই খাবো। কোনো সমস্যা?”
“না, আমার কেন সমস্যা হবে।”
“তাহলে চুপ করে বসো।”

“আমি কেন বসবো?”
“আমি খাবো আর তুমি দেখবে তাই।”
আমিও মন খারাপ করে বসে পড়লাম। তুর্য ভাত মাখছে। এতক্ষণ রাগ আর জিদে খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু এখন খাবার দেখে মনে হচ্ছে, পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। কিন্তু এটা তো একটা স্বার্থপর। আর একবার জিজ্ঞেসও করলো না। আর একবার জিজ্ঞেস করলে ঠিকই খেতাম। কিন্তু এই পেটুক টা তো একাই দুই প্লেট নিয়ে বসেছে। মনে একটু দয়া মায়া নেই নাকি!
“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? খাবে?”
“না, আপনিই গিলেন।”

তুর্য হেসে বললো,
“তুমি কি আমায় সত্যিই পেটুক ভাবো নাকি? আর দুই প্লেটে ভাত আমার জন্য নয়। একটা তোমার। নাও খাও।”
তুর্য প্লেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। ভাবলাম, ভাতের ওপর রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। এমনিতেই পেটের ভেতর ভূমিকম্প শুরু হয়ে গিয়েছে। সব চিন্তাভাবনা মাথা থেকে বের করে হাত বাড়ালাম ভাত খাওয়ার জন্য। কিন্তু মুহূর্তেই খাওয়ার ইচ্ছেটা দমে গেল। আমার হাত তো কাটা! তুর্য এক লোকমা ভাত মুখে তুলে বললো,
“খাচ্ছো না কেন?”
“আমার হাত তো কাঁটা।”

“তাহলে চামচ দিয়ে খাও।”
আমি মনে মনে বললাম,
“ধুর আনরোমান্টিক একটা ছেলে। ভাবলাম কই একটু খাইয়ে দিবে! আবার বলে চামচ দিয়ে খাও। ইচ্ছে করছে”
তুর্য আবার বললো,
“কি হলো?”

“কিছুনা।”
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। তারপর হঠাৎই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। খাবার ছেড়ে ওঠে যাওয়ার অভিনয় শুরু করলাম। তুর্য জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“মাথাটা ব্যথা করছে। ঘুমাবো।”

“খাবার খেয়ে তারপর ঘুমাও।”
“আসলে আমি চামচ দিয়ে খেতে পারিনা। সমস্যা নেই, সকালে খালা আসলে তাকে বলবো খাইয়ে দিতে।”
কথাটা বলে আমি হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু একি! তুর্য ডাকলো না কেন? নিজে থেকে তো খাইয়ে দিতে পারতো! উফফ ঢং করতে গিয়ে এখন খিদে নিয়েই ঘুমাতে হবে। ভাবনার জগৎ থেকে হুশ এলো যখন তুর্য পেছন থেকে বললো,
“আমি খাইয়ে দিলে কোনো সমস্যা নেই তো?”

ইশ কথাটা শুনে মনে হলো তুর্যের একটা লুঙ্গি পড়ে লুঙ্গি ডান্স নেই। আমার মনে হচ্ছে পরীদের মত দুটো ডানা হয়েছে। মনটা আকাশে-বাতাসে উড়া শুরু করে দিয়েছে। আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! কিন্তু আমার পরীদের মত ডানা কই? ধুর আমি নিজেই তো পরী। ডানা কাটা পরী। আহা! গানটা মনে মনে গাচ্ছিলাম, আমি ডানা কাটা পরী আমি ডানা কাটা পরী।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে তুর্য বললো,
“সমস্যা থাকলে থাক।”

আমি লাফিয়ে তুর্যের কাছে গিয়ে বললাম,
“এই না, না! কোনো সমস্যা নেই।”
“আমার কোলে এসে বসবে নাকি?”
“এ্যা?”

আমি তাকিয়ে দেখলাম তুর্যের অনেক কাছে চলে গিয়েছি।
“হেহেহে না, না তা কেন! আমি তো এখন বড়।”
“বসো চেয়ারে।”

একটা চেয়ার টেনে তুর্যের পাশে বসলাম। আমাকে যে প্লেটে ভাত দিয়েছিল ঐ প্লেটে ভাত মাখছিল তখন আমি বললাম,
“ঐ প্লেটে ভাত মাখছেন কেন?”
“তোমার জন্য।”
“না, না ঐ প্লেট নষ্ট করার দরকার নেই। আপনার প্লেট থেকেই দিন।”
“কিন্তু?”

“আবার কিন্তু কিসের দিন তো।”
তুর্য আর কথা না বলে আমাকে খাবার মুখে তুলে দিচ্ছিলো আর আমার মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে আকাশের চাঁদ টা তুলে দিচ্ছে। মুখে খাবার নিতে যাবো তখনই কলিংবেল বেজে ওঠলো। মেজাজটা তাহলে কেমন লাগে! এত রাতে কে আসলো আবার! আমি বললাম,
“দেখে আসছি কে এসেছে।”
“খাবারটা আগে মুখে নিয়ে নাও।”
আমি এক লোকমা খাবার মুখে নিয়ে দরজা খুলে দেখি অথৈ আপু এসেছে। অথৈ আপু ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
“হাই পরী।”

আমার মুখে তখনও খাবার। কিছু বলতে পারলাম না শুধু গাল ফুলিয়ে একটা হাসি দিয়ে মাথা নাড়ালাম। দরজা লাগিয়ে ডাইনিংরুমে গেলাম। অথৈ আপুও দেখছি তুর্যের পাশে বসেছে। যতই বেষ্টফ্রেন্ড হোক ভেতরটা কেমন যেন জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। আমিও গিয়ে পাশে বসলাম। তুর্য আরেক লোকমা ভাত আমার মুখে তুলে দিতে দিতে বললো,
“এত রাতে হঠাৎ কি মনে করে আসলি অথৈ?”
“আর বলিস না, পার্টিতে গিয়েছিলাম। তোদের বাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম ভাবলাম একটু দেখা করে যাই।”
“ওহ আচ্ছা! খেয়েছিস?”
“ভাত তো খাইনি।”
“তাহলে বস, একসাথেই খাই।”

“উমম! খাওয়া যেতে পারে তবে এক শর্তে।”
“কি শর্ত?”
“আমাকেও খাইয়ে দিতে হবে।”
কথাটা শুনে আমি বিষম খেয়ে যাই। তুর্য পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। পানি খেয়ে চুপ করে বসে আছি। মেয়েটা তো দেখছি খুব পাজী। বউ পাশে বসে আছে, তার সামনেই বলছে খাইয়ে দিতে। অথৈ আমাকে বললো,
“তুমি ঠিক আছো?”
আমি জোর করে মুখে হাসি টেনে বললাম,
“হুম।”

অথৈ এবার তুর্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কিরে দিবি খাইয়ে?”
আমি আর তুর্যের উত্তরের অপেক্ষা করলাম না। জানিনা তুর্য কি করবে। কিন্তু এসব ন্যাকামো আমার একদম সহ্য হচ্ছিলো না। চেয়ার ছেড়ে ওঠে বললাম,
“মুসকান মনে হচ্ছে ঘুম থেকে ওঠে গিয়েছে। আমি যাই, তোমরা খাও।”
আমি যেতে যেতেও শুনলাম অথৈ বলছে,
“দে না খাইয়ে।”
আমার মনে হচ্ছিলো মাথায় অগ্নিকুণ্ড নিয়ে হাঁটছি আমি

পর্ব ৫

তুর্য অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এখন তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস অথৈ। নিজ হাতেই খেতে পারবি।”
“তাই? পরীও তো যথেষ্ট বড়। তাহলে ওকে খাইয়ে দিতে পারলে আমাকে খাইয়ে দিতে পারবি না কেন?”

“ও আমার ওয়াইফ অথৈ!”
“বাহ্! ওয়াইফ! মায়ার জায়গা তাহলে পরীকে দিয়ে দিয়েছিস?”

“শাট আপ! মায়ার সাথে কখনো কারো তুলনা করবি না। মায়ার জায়গা কেউ নিতে পারবে না। পরীর হাত কেঁটে দিয়েছে তাই আমি খাইয়ে দিয়েছি। নয়তো মেয়েটা খেতে পারতোনা। তাছাড়া ও আমার ওয়াইফ। ওকে খাইয়ে দেওয়াটা দৃষ্টিকটু হবে না যতটা তোকে খাইয়ে দিলে হবে।”

“ওর খাওয়া না খাওয়ায় তোর কি আসে যায়?”
“ভুলে যাস না অথৈ, পরী কিন্তু আমার মুসকানের সব এখন। আমি কতটুকু সময় দেই মুসকানকে? সারাক্ষণ বিজনেস নিয়েই ব্যস্ত থাকি। সেখানে চব্বিশটা ঘন্টাই পরী মুসকানকে দেয়। পরী আমাদের চেয়ে যথেষ্ট ছোট। এই ছোট বয়সে মেয়েটা কেমন মা হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তুই জানিস? যেখানে ওর স্বামীর সাথে ভালোবাসা আর খুনসুটিতে কাটানোর কথা সেখানে নিজের সব সময়টুকু মুসকানকে দেয়। আর সেই জায়গায় আমি পরীর কেয়ার করবো না? এতটা স্বার্থপরও আমি নই অথৈ।”
অথৈ কতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো। এরপর এক গ্লাস পানি খেয়ে বলো,
“হুম, স্যরি। আসছি এখন।”
“খেয়ে যা।”

“ক্ষুধা নেই।”
আমি এক হাত অন্য হাতের মুঠোয় নিয়ে রুমে পায়চারী করছি। এত্ত কিসের ঢং বুঝিনা বাপু! আমারও তো বেষ্টফ্রেন্ড আছে। কই আমি তো কখনো জয়কে বলিনি আমায় খাইয়ে দিতে। তাহলে ঐ বজ্জাত মেয়েটা কেন চাইলো? আর ঐ লম্বু মটকুটাই বা কিছু বললো না কেন! এখনো তো আসছেও না। নিশ্চয় খাইয়ে দিচ্ছে। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। আম্মুউউউউ! আসুক একবার! ঢং সব বের করছি।
তুর্য টেবিল গোছগাছ করে রুমে ঢুকছিল আর আমিও দেখতে যাচ্ছিলাম এখনো আসছে না কেন, ঠিক সেই মুহুর্তেই খেলাম ধাক্কা।
“উফফ বাবাগো!”
“দেখে চলতে পারো না?”

“আপনি দেখে চলতে পারেন না?”
“মুখে মুখে তর্ক করছো আবার?”
“একশবার করবো।”
“হাত-পা ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে রাখবো।”
“বেশ তো! তখন মুসকান আর আমার দেখাশোনা নিজে একাই করবেন।”

“এত্ত ঠেকা পড়েনাই আমার বুঝছো।”
“হ্যাঁ তাই তো! আপনার সব ঠেকা তো ঐ অথৈ আপুকে নিয়ে। তো পেট ভরে খেয়েছে নিশ্চয়?”
“আউলফাউল কথা বাদ দাও। আর আমার কথা শুনো।”
“আপনার কোনো কথা শোনার ইচ্ছে নেই আমার।”
“ইচ্ছের বিরুদ্ধেই শোনাবো। জয় তোমার বেষ্টফ্রেন্ড?”

“হু।”
“তোমায় ভালোবাসে?”
“হু।”
“কি হু হু করে যাচ্ছো? তুমি আমায় বলেছিলে তোমাদের বাড়ি যাবে তাহলে সেখান থেকে আবার জয়দের বাড়ি কেন গিয়েছো?”
“রিয়া আর জয় ওরা এক বাড়িতেই থাকে। আমি মূলত রিয়াদের বাড়ি গিয়েছিলাম ওর ছোট বোনের জন্মদিনের জন্য।”
তুর্য থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত ওঠাতেই আমি দুইগালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

তুর্য হাতটা নামিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললো,
“যাওয়ার আগে একবারও পারমিশন নিয়েছো? এই একদিনেই পাখা গজিয়ে গিয়েছে? নেক্সট টাইম আর কখনো কোথাও যাওয়ার কথা বইলো। জয় কিভাবে তোমার হাত ধরেছিল দেখেছো? ভুলে যেও না তুমি এখন তুর্য চৌধুরীর ওয়াইফ। যে কেউ তোমার হাত ধরতে পারে না। তোমার সাথে এখন আমার মান-সম্মান জড়িয়ে আছে।”
আমি গালে হাত দিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে বললাম,
“আপনি কাউকে খাইয়ে দিলে কোনো দোষ নেই, আর কেউ আমার হাত ধরলেই দোষ!”
“চুপ! কাঁদছো কেন? আমি কি তোমায় মেরেছি?”

“মারেননি কিন্তু মারতে তো চেয়েছেন। আবার ধমকও দিয়েছেন।”
তুর্য আবারও ধমক দিয়ে বললো,
“চুপ করো বলছি! আর একবার কান্নার শব্দ পেলে খবর আছে। আর কে বললো আমি অথৈকে খাইয়ে দিয়েছি?”
“বলতে হবে কেন? আমি তো নিজেই শুনলাম।”
“শুনেছো কিন্তু দেখো তো নাই।”

আমি গাল থেকে হাত সরিয়ে বললাম,
“ওহ আচ্ছা এখন তাহলে এসব আমাকে দেখতেও হবে?”
“অযথাই ঝগরা করছো তুমি। আমি অথৈকে খাইয়ে দেইনি।”
“জানা আছে সব আমার! বউয়ের সামনে কি আর স্বীকার করবেন।”
“কিহ্?”
“কিছুনা। আমি ঘুমালাম।”

দেখতে দেখতে ৬ মাস কেটে যায় আমাদের বিয়ের সম্পর্কের আর সেই সাথে মুসকানের বয়স। পুচকুটা এখন আরো গুলুগুলু হয়েছে। হাত-পা দিয়ে সামনে আগানোর চেষ্টা করে। বসতে পারে। আর হাসি? হাসির কথা আর কি বলবো। মেয়েটা আমার ভুবনভুলানো হাসি দেয়। এই ছয় মাসেও তুর্যের সাথে আমার স্বামী-স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। যেটা গড়ে ওঠেছে তা হলো বন্ধুত্ব। তুর্যের রাগ বেশি হলেও প্রথম থেকেই আমার কেয়ার করতো। এখনো করে তবে বিজনেসের কাজে একটু বেশিই ব্যস্ত থাকে। রাতে যেটুকু সময় পায় মুসকানকে দেয়। মুসকান ঘুমিয়ে গেলে কখনো কখনো কফি খেতে খেতে আমাকে মায়া আপুর গল্প শোনায়। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মত তার কথাগুলো শুনি। সত্যি বলতে তখন আমার একটুও হিংসে হয়না। বরং মনে মনে এটা ভাবি যে, মায়া আপু সত্যিই ভাগ্যবতী ছিল তাই তো তুর্যকে স্বামী হিসেবে পেয়েছিল। কিন্তু সুখ বোধ হয় কপালে বেশিদিন স্থায়ী হয়না। তাই তো চরম সুখ মুসকান পৃথিবীতে আসার সাথে সাথে মায়া আপু দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো।

প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে। দুমদাম এরকম বৃষ্টি আমার অনেক বেশি ভালো লাগে। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজি। কিন্তু মুসকানের কথা ভেবে আর বৃষ্টিতে ভেজা হয়ে ওঠে না। যদি জ্বরটর বাঁধাই তখন মুসকানকে দেখবে কে! তাই দুধের স্বাধ ঘোলে মেটাই মানে ব্যলকোনিতে গিয়ে বৃষ্টির পানিতে হাত ভেজাই। একসময় আকাশ অন্ধকার হয়ে ঝুমবৃষ্টি শুরু হয়। ইশ! কোনো একদিন যদি তুর্যর সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে পারতাম! বাব্বাহ্! বান্দার নাম নিতে না নিতেই বান্দা হাজির। বাঁচবে অনেকদিন। ব্যলকোনি থেকেই দেখলাম, তুর্য ছাতা নিয়ে গাড়ি থেকে নামছে।

আমিও তাড়াতাড়ি করে হাত মুছে মুসকানের পাশে শুয়ে পড়লাম। ওমা এসে দেখি ফাজিলটা এতক্ষণ ঘুমায়নি। চুপ করে শুয়ে আছে আর আঙ্গুল চুষছে। তুর্যর কাছে এক্সট্রা চাবি থাকায় আর কলিংবেল বাজায়নি। সোজা রুমে এসে ওয়াশরুমে যায়। বৃষ্টিতে অনেকখানি ভিজে গিয়েছে। গোসল করে এসে টাওয়াল দিয়ে চুলগুলো ভালো করে মুছে নেয়। কালো প্যান্ট আর কালো শার্ট পড়েছে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করা। দেখেই মাথা ঘুরে গেছে আমার। ইশ! বাসায় এত সাজুগুজু করতে হবে কেন তাকে? সে কি জানে যে, তাকে দেখে প্রতিটা মুহুর্তে মুহুর্তে তার প্রেমে পড়ি। সাঁতারও জানিনা যে, উঠে আসবো। ব্লাক, হোয়াইট, ব্লু পড়লে মনে হয় তাকে একদম খেয়ে ফেলি। ধুর! না ছিঃ! এগুলো কি ভাবছি? আমি কি রাক্ষসী নাকি যে নিজের স্বামীকে খেয়ে ফেলবো। আমার এত সুন্দর কিউট হাজবেন্ড’টা!
আমি যে তাকে নিয়ে হাজার কথা ভেবে যাচ্ছি আর এদিকে সে কখন যে কাছে এসে শুয়েছে সে খেয়ালই নেই আমার। আরেহ্, আমার না মুসকানের কাছে শুয়েছে। আমার হাতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,

“কোথায় হারিয়ে গেলে?”
“আপনার মাঝে?”
“কি?”

“না বলছিলাম যে, আপনার মাঝে কি যেন নতুন নতুন দেখছি?”
“কি নতুন দেখছো?”
“কি নতুন দেখেছি! কি নতুন দেখেছি! ওহ হ্যাঁ, আজ আপনি তাড়াতাড়ি বাসায় আসলেন তো এটাই।”
তুর্য ঈষৎ হেসে বললো,
“পাগল! বাদ দাও মুসকানকে গোসল করিয়েছো?”
“না। আজ তো অনেক ঠান্ডা।”

“ওহ্! তুমি করেছো?”
“না, না! অনেক ঠান্ডা এখন পানি।”
“তুমি কি বাচ্চা নাকি? যাও গোসল করে আসো।”

“না, না।!
“জিৎ আর কোয়েল মল্লিকের বেশ করেছি, প্রেম করেছি মুভিটা দেখেছো?”
“হ্যাঁ! কতবার দেখেছি তার কোনো হিসাব নেই।”
“হুম। তা এই মুভির কোন গানটা যেন তোমার ভালো লাগে?”
“বিয়ের আগে ভালো লাগতো, ঐ তোর মায়াবী চোখ গানটা। কিন্তু বিয়ের পর আহ্লাদে পছন্দের গানটা চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে।”
তুর্য মুচকি হেসে বললো,
“তো এখন কোনটা ভালো লাগে?”

“জানেনই তো আপনি।”
“ভুলে গিয়েছি। আবার বলো।”
“তোর এক কথায় আমি রাখবো হাজার বাজি, তোর ইশারায় আমি মরে যেতেও রাজি।”
“তুমি মরলে মুসকান তো ওর মাকে হারাবে। তার চেয়ে বরং গোসলটা করে আসো।”
“এহ্! তা কেন? এটা তো গানের লাইন ছিল।”

“তা তো আমি জানিনা।”
“এটা তো গুটিবাজি হচ্ছে।”
“একদম না। এখন গোসলে যেতেই হবে।”

“তার আগে আর একটা গানের লাইন বলি? সোহমের প্রেম আমার মুভির আর বনির পারবোনা আমি ছাড়তে তোকে মুভির গানের সংমিশ্রণ করে।”
“ঠিক আছে কিন্তু এরপর গোসলে যাবে।”
“না রে, না রে, না রে! এটা হলো সোহমের এবার বনিরটা। পারবোনা আমি গোসল করতে, কোনো মতে এখন বিছানা ছাড়তে! গোসল করতে আর আমি পারবোনা।”
“তবে রে পাজি।”
কথাটা বলেই তুর্য আমাকে টেনে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। ফ্লোরে বসিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিতেই ঝুপঝুপ করে পানি পড়া শুরু করলো আমার ওপর। আমি চেঁচিয়ে ওঠলাম,

“ও আম্মা গোওওওও”
দুজনের হাসির শব্দ পেলাম। একজন আমার স্বামী মহাশয় যিনি যমের মত আমাকে পানিতে ভেজাচ্ছে আর দ্বিতীয় জন হলো আমার পাজি মেয়েটা। খাটে বসে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। একদম বাবার মত হয়েছে। বাপ-মেয়ে দুজনই পাজি। আমিও বা কম কিসের! একা কেন গোসল করবো। তুর্যের হাত ধরে টেনে শাওয়ার নিচে বসিয়ে দিলাম।দুজনেই ভিজছিলাম। তুর্যের গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
“আমার শুকনো শরীর ভিজে গেছে শাওয়ারের পানি দিয়ে, শুধু আপনার কারণে!”
তুর্য ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে, শুধু তোমায় ভালোবেসে?”

পর্ব ৬

দুইদিন ধরে আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছি না। আসলে উঠছি না। ঠান্ডা লেগেছে খুব ভালোভাবেই। এই দুইটাদিন তুর্য অফিসে যায়নি। বাসায় থেকেছে আর মুসকানকে দেখেছে। শুধু মুসকানের নয় আমারও দেখাশোনা করেছে। সময়মত খাবার, ওষুধ সবই দিয়েছে। সারাদিন মুসকান ওর বাবার কাছে থাকলেও রাতে আমায় ছাড়া কখনোই ঘুমাতে পারে না।

এখন আমি মোটামুটি সুস্থ বলাই চলে। তবে একটা বিষয় খেয়াল করেছি, তুর্য কেমন যেন আমায় এড়িয়ে চলছে। কিছু বললেই বলছে অফিসের ব্যস্ততা। বিষয়টা এমন যেন, আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা। আমিও আর কিছু বলিনি। সারাদিন মুসকানকে নিয়েই আমার সময় কেটে যায়। ইদানীং রাতে এসেও তুর্য আমার সাথে কথা বলেনা। বলতে গেলে খুব প্রয়োজন না হলে কথাই বলছে না। একবার মনে হয় জিজ্ঞেস করি আবার ভাবি জিজ্ঞেস করায় যদি ধমক দেয়! এটা ভেবে আবার দমে যাই। এভাবেই কেটে যায় আরো বেশ কয়েকটা দিন।

একদিন তুর্য বাজার থেকে অনেক বড় বড় রুই আর ইলিশ মাছ নিয়ে আসে। তুর্যকে আমি তেমন বাজার করতে দেখিনি। আজই প্রথম। তাই তুর্যকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আজ হঠাৎ বাজার করলেন যে?”
“কালকে বাবা-মা আসবে।”
“সত্যিই?”
“হ্যাঁ।”

“ইয়ে! অনেক মজা হবে।”
তুর্য একটু হাসলো। তারপর বললো,
“খালাকে বলো মাছগুলো কেটে ভালোমত ধুয়ে ফ্রিজে রাখতে।”
“কিন্তু খালা তো আজ আসেনি।”
“কেন?”

“ফোন দিয়েছিলো সকালে। বললো অসুস্থ।”
“ওহহ। আচ্ছা আমি মুসকানের কাছে থাকছি তুমি মাছগুলো কেটে নাও।”
কথাটা বলে তুর্য রুমে চলে গেল। আর আমি ইয়া বড় হা করে দাঁড়িয়ে আছি। আমি আর মাছ? অসম্ভব। মাছ কাটা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়নি। বিয়ের আগে রান্না করতাম আমি ঠিকই কিন্তু মাছ কাটা কখনো শিখতে পারিনি। কেন পারিনি সেটা আজও আমার অজানা। মাছের আঁশ ছাড়াতে গেলেই মাঝখান থেকে দুই টুকরা করে ফেলি। ভাবেন তাহলে, আমি কেমন মাছ কাটতে পারি। কিন্তু মহারাজ তো বলে গেলেন মাছ,কাটতে। উনার আর কি? উনি তো বলেই খালাস!

তুর্য রুমে গিয়ে দেখে মুসকান ঘুমাচ্ছে। তাই ল্যাপটপ নিয়ে অফিসের কাজ করতে বসে পড়ে। ল্যাপটপ ওপেন করতেই মায়ার মায়ামাখা চেহারাটা ভেসে ওঠে। আর তুর্যের বুকের ভেতর অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়। হাজারও ভালোবাসার মুহুর্ত, খুনসুটি সবই আজ শুধু স্মৃতি। হঠাৎই তুর্যের মনে হলো মায়া মাছ কাটতে পারতো না। তুর্য নিজেই মনে মনে বললো,
“পরী মাছ কাটতে পারে তো?”
তুর্য তাড়াডাড়ি ল্যাপটপ রেখে রান্নাঘরে যায়। তুর্য যখন আসে তখন আমি একটা মাছের মাথা আর লেজ ধরে এদিক-ওদিক করছি। অজান্তেই তুর্য তখন হেসে দেয়। আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
“মাছ কাটতে জানো না?”

আমি মাথা নিচু করে বললাম,
“না।”
“রান্না করতে পারো আর মাছ কাটতে পারো না?”
“রান্না সহজ মাছ কাটার চেয়ে। কতবার চেষ্টা করেছি মাছ কাটা শিখার জন্য। কিন্তু প্রতিবারই আঁশ ছাড়াতে গিয়ে মাছ মাঝখান থেকে দুই টুকরা করে ফেলেছি।”
আমার কথা শুনে তুর্য জোরে জোরে হাসছে। হাসতে হাসতে বলছে,
“বটি দাও আমার কাছে। সিরিয়াসলি মাছ কাটতে গিয়ে দুই টুকরা হয়ে যায়?”

বলেই আবার হাসা শুরু করে। ছয় মাসের সম্পর্ক প্লাস বন্ধুত্বে তুর্য অনেকবার হাসলেও এমন প্রাণখোলা হাসি আমি কখনোই দেখিনি। যতই দেখছি ততই যেন মুগ্ধ হচ্ছি। শুনেছি, ছেলেরা নাকি মেয়েদের হাসি দেখে মুগ্ধ হয় কিন্তু এদিকে তো উল্টো হয়ে গেলো। হলে হোক! আমারই তো স্বামী।
মাছ কাটতে কাটতে তুর্য বললো,
“একটা কথা জানো পরী?”

“কি?”
“মায়াও কিন্তু মাছ কাটতে পারতো না।”

“সত্যি?”
“হ্যাঁ। তখন আমি মায়ার পাশে বসে মাছ কেটে দিতাম আর ও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো।”
“তারপর নিশ্চয় মাছ কাটা শিখে গিয়েছিল?”
“আরে ও কি মাছ কাটা দেখতো নাকি!”
“তবে?”

“আমায় দেখতো।”
“হাউ রোমান্টিক।”
“তখন আমি এই হাত দিয়ে ওর গালে ছুঁয়ে দিতাম।”
“হাত না ধুয়েই?”
“হ্যাঁ”
“এ মা! তারপর?”

“তারপর আর কি? আমার পিঠে কিল ঘুষি দেওয়া শুরু করতো। হাহাহা।”
তুর্য আবারও হাসছে। ওর এই হাসি যে বারবার আমায় ফাঁসি দিচ্ছে এটা কি তুর্য জানে? ইচ্ছে করছে একটা চুমু দিয়ে দেই। এত সুন্দর করে কেন হাসতে হবে? নিজের ইচ্ছেটাকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে তুর্যর এক গালে হাত রেখে অন্য গালে একটা চুমু দিয়ে দিলাম। তুর্য আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি তখনও তুর্যর হাসির ঘোরে মগ্ন হয়ে আছি। তুর্য যখন বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো তখনই আমার হুশ ফিরলো। হায় আল্লাহ্! কি করে ফেলেছি আমি। আমিও তখন বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে তুর্য কষিয়ে একটা থাপ্পড় দেয় আমাকে।

“নির্লজ্জ মেয়ে যেন কোথাকার। ভালো ব্যবহার করেছি বলে কি মাথায় উঠে গিয়েছো? নিজের জায়গাটা ভুলে যেয়ো না। একটা কথা মাথায় রেখো তোমাকে এই বাড়িতে শুধু আনা হয়েছে মুসকানের জন্য। ভুলেও আমার দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করো না। আমি শুধু মায়াকেই ভালোবেসেছি, ভালোবাসি আর সারাজীবন মায়াকেই ভালোবাসবো।”
এই প্রথম শেষের কথাটা শুনে আমার এত রাগ হলো। তুর্য চলে যাওয়ার সময় আমি হাড়ি-পাতিল, চামচ, প্লেট সব ছুঁড়ে ফেলে দেই। তুর্য একবার তাকিয়ে আবার চলে যাচ্ছিল। আমিও পিছন পিছন গিয়ে বললাম,
“কে বারণ করেছে মায়া আপুকে ভালোবাসতে?

মায়া আপুকে ভালোবাসেন, সারাজীবনই ভালোবাসেন। কোনো সমস্যা নেই আমার। কিন্তু কেন আমায় ভালোবাসবেন না? কি অন্যায় করেছি আমি?”
তুর্য ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি দরজায় ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলি,
“দরজা কেন বন্ধ করলেন আপনি? আপনাকে উত্তর দিতেই হবে। আমার ভালোবাসার কি কোনো দাম নেই? নাকি রোবট ভাবেন আমায় যে, আমার ভালোবাসা থাকতে পারে না।”
ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না। একসময় আমি কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়ি।
তুর্য মায়া আপুর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলছে,

“কি করবো আমি মায়া? আমি যে দিনদিন পরীর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরীর মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছি। যতই দূরে সরিয়ে দেই ততই কাছে এসে পড়ে। ওর বাচ্চামি,ওর দুষ্টুমি বারবার কাছে টানে আমায়। সেদিন একসাথে শাওয়ারের পানিতে ভেজার সময় আমি পরীর চোখে আকাশসম ভালোবাসা দেখেছি। আমিও যেন সেই চাহনীতে বারবার আটকে যাচ্ছিলাম। আমার থেকে দূরে সরাতে এই কয়েকদিন পরীকে এভোয়েড করেছি। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলিনি। আর এই এত্তগুলা দূরত্বগুলো আজ এক নিমিষেই মুছে গিয়ে পরীকে কাছে এনে দিলো। এভাবে চলতে থাকলে যে আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারবো না মায়া। কিন্তু আমি তোমার জায়গাও কাউকে দিতে পারবোনা। আমি যে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।”

আজও আকাশে ঘনকালো মেঘ। যেকোনো সময় তুমুলবেগে বৃষ্টি আরম্ভ হবে। আমি তখনো দরজার সামনে ফ্লোরে বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ পর তুর্য দরজা খুলে দেয়। এমনি এমনি খুলেনি। খুলেছে তার কারণ মুসকান ঘুম থেকে ওঠে কান্না শুরু করেছে। তুর্য অনেকবার মুসকানকে থামানোর চেষ্টা করেছে সেটা আমি স্পষ্ট শুনেছি। কিন্তু পারেনি। মুসকান অস্পষ্ট স্বরে যেন মা মা বলে আমাকেই খুঁজছিল। সব শুনেও আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলাম। তখনও আমার রাগ কমেনি। তুর্য নিরুপায় হয়ে দরজা খুলে মুসকানকে আমার কোলে দিতে আসলে আমি হাত ঝাড়া দিয়ে তুর্যকে সরাতে যাই। কিন্তু ভুলবশত আমার হাতের চুড়ির সাথে মুসকানের কপালে লেগে ব্যথা পায়। মুসকান জোরে জোরে কান্না শুরু করে দেয়। মুসকানকে কোলে নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াই আমি। হেঁটে হেঁটে কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলাম। তখন তুর্য আমার হাত ধরে টেনে মুসকানকে আমার কোল থেকে নিয়ে বললো,
“আমার রাগ তুমি আমার মেয়ের ওপর ঝাড়লে তাই না? খুব সাহস হয়ে গিয়েছে তোমার?”
“মুসকান আপনার একার মেয়ে নয়, আমারও মেয়ে।”

“হ্যাঁ কিন্তু সৎ মেয়ে। তাই চাপা রাগ সবসময় পুষে রাখতে তাই না?”
তুর্য এরকম অকথ্য ভাষায় আরো অনেক কিছু বলে যায়। যেগুলো আমি একদম সহ্য করতে পারছিলাম না। চোখ থেকে পানি পড়া শুরু হয়েছে। মুসকানও কাঁদছে তবুও তুর্য মুসকানকে আমার কাছে দিচ্ছে না। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে আমার জীবনে তুর্যর চেয়ে মুসকানের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। আমি বিছানায় বসে পড়ি। তুর্য কয়েকটা হাজার টাকার নোট আমার দিকে ছুঁড়ে দেয় আর বলে,
“এখনই এই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে। আশা করি এই টাকা দিয়ে তোমার গাড়ি ভাড়া হয়েও বেশি।”
“আমি দুঃখিত। বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে মুসুকে ব্যথা দেইনি। প্লিজ মুসুর থেকে আমায় আলাদা করবেন না প্লিজ।”
“গেট আউট।”
আমি কান্না করতে করতে হাত জোর করে বললাম,
“প্লিজ তুর্য!”

“যদি নিজের সামান্যতম আত্মসম্মান থাকে তাহলে এখনই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে।”
কথাটা বলে তুর্য অন্যরুমে চলে যায়। বাহিরে তখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আমি তুর্যর টাকা না নিয়ে আমার পার্স আর ফোনটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। চোখের পানির জন্য সবকিছু ঝাপসা দেখছিলাম। যতই দু হাত দিয়ে চোখের পানিগুলো মুছছিলাম ততই পানি এসে জড়ো হচ্ছিল। বাসস্টপে যেতেই জোরে বৃষ্টি পড়া শুরু করে। বৃষ্টির পানির সাথে চোখের পানিগুলোও মিলিয়ে যায়।

মুসকান কাঁদতে কাঁদতেই তুর্যর কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। তুর্য বাহিরে তাকিয়ে আপনমনেই বলে,
“এই বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটাকে বের করে দেওয়া কি ঠিক হলো!”

পর্ব ৭

এখনো তুমুলবেগে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি বাসস্টপে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টিতে ভিজছি। কোথায় যাবো সেই হিসাবটাই মিলাতে পারছিলাম না। বাড়িতে গেলে মা হাজারটা প্রশ্ন করে মাথা খারাপ করে দিবে। এই মুহুর্তে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মানসিকতা আমার একদম নেই বললেই চলে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আগে রিয়ার বাসায় উঠবো। ভাবনামতই কাজ করলাম। রিয়ার বাড়িতে যেতে আমার ২ঘণ্টার মত লেগে যায়। আমি দরজায় নক করতেই রিয়া দরজা খুলে দেয়।
“দোস্ত তুই এসময়ে?”
“ভেতরে আসতে দিবি না?”

আমি সরাসরি রিয়ার রুমে চলে গেলাম। রিয়া আলমারি থেকে ওর একটা টি-শার্ট আর লং স্কার্ট বের করে আমায় দিয়ে বললো,
“কি হয়েছে সেটা পরে শুনছি। আগে যা ওয়াশরুম থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে আয়।”
আমিও আর কথা না বাড়িয়ে ড্রেস চেঞ্জ করতে চলে গেলাম। ড্রেস চেঞ্জ করে এসে দেখি রিয়া দুই মগ কফি বানিয়ে এনেছে। বৃষ্টিতে ভেজায় মাথাটা ধরেছিল। তাই একটু হেসে এক মগ নিয়ে চুমুক দিলাম। রিয়া দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার পাশে এসে বললো,
“এবার বল তো কি হয়েছে?”

“পোড়া কপালে নতুন করে আর কি হবে?”
“এত উদাস কেন তুই?”
“নিজের স্বামীকে ভালোবাসা কি অন্যায় রিয়া?”
“না। কখনোই না। বরং এটা পবিত্র ভালোবাসা।”

“তাহলে তুর্য আমায় কেন গ্রহণ করতে পারে না বলতে পারিস? আমি তো কখনো মায়া আপুর জায়গা নিতে চাইনি। আমি মায়া আপুকে ভালোবাসতেও বারণ করিনি। তাহলে কেন সে আমায় গ্রহণ করতে পারে না? সে আমায় ভালো না বাসুক, আমায় কেন ভালোবাসতে বারণ করে বলতে পারিস? আমি তো রোবট না। একটা মানুষ তাই না রিয়া? বল তুই?”
কথাগুলো বলার সময় চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। রিয়া আমায় জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“আমায় ক্লিয়ার করে সবটা বলতো একটু।”

আমার অসুস্থ হওয়া থেকে শুরু করে সবটা বললাম রিয়াকে। রিয়া দাঁত কটমট করে বললো,
“আশ্চর্য ধরণের মানুষ তো সে! কোন আক্কেলে সে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো? এতদিন পর তার মনে হলো তুই মুসকানের সৎ মা? এতই যখন মায়া মায়া করে তখন নিজেই লালন-পালন করতে পারলো না নিজের মেয়েকে? তোকে কেন বিয়ে করলো? স্বার্থপর একটা মানুষ!”

আমি চোখের পানি মুছে বললাম,
“বাদ দে রিয়া। তুর্যকে নিয়ে কিছু বলিস না। হয়তো তুর্য তুর্যর জায়গায় ঠিকই আছে। আমার কষ্ট হচ্ছে মুসকানের জন্য। ও তো আমায় ছাড়া থাকতে পারবে না রে।”
“শুধু মুসকান কেন বলছিস? ঐ মানুষটারও তোকে ছাড়া চলবে না তুই দেখিস। ভাগ্য করে তোর মত মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়েছে সে। তুই চিন্তা করিস না একদম। এখন আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিবো আর তুই চুপটি করে ঘুমাবি।”

রিয়া আমার মাথার কাছে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আমিও ঘুমিয়ে পড়ি।

সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছে। এখনো ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। মুসকানকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না তুর্য। মুসকানের কান্না থামার যেন কোনো নামই নেই। সারাক্ষণ চোখ দুটি যেন মাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তুর্য দোটানায় পড়ে যায়। কি করবে এখন! এই বৃষ্টির মধ্যে মুসকানকে নিয়ে আমার কাছে আসাটাও সম্ভব না। রাত হলে মুসকানের আমাকে চাই’ই চাই। অনেক কষ্টে শেষরাতে মুসকানকে ঘুম পাড়াতে সক্ষম হয় তুর্য।
এইদিকে মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমার বুকটা যে একদম খালি। মুসকানকে ছাড়া আমার নিজেরও ঘুম আসছে না। আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি, আসলে জন্ম না দিয়েও যে মা হওয়া যায়। ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে মুসকানের কাছে চলে যাই। কিন্তু না! ঐ বাড়িতে তো আমি যাবো না। কেন যাবো আমি? তাছাড়া মুসকান তো আমার সৎ মেয়ে। হ্যাঁ সৎ মেয়ে! তুর্য তো সেটাই বলেছে। কিন্তু মুখে এসব বললেও মনকে কিছুতেই মানাতে পারছিনা আমি। এপাশ-ওপাশ করতে করতেই আমার রাত পাড় হয়ে যায়। সারা রাত দুচোখ আমি এক করতে পারিনি। একদিকে তুর্যর দেওয়া কষ্ট আর অন্যদিকে মুসকানের থেকে দূরে থাকা। কিন্তু আমাকেও তো শক্ত থাকতে হবে।

সকাল দশটার দিকে তুর্যর বাবা-মা আসে। কলিংবেল বাজছে। তুর্য তখন মুসকানকে নিয়ে রুমে হাঁটছিল। তুর্য হারে হারে বুঝতে পারছে একজন বাচ্চার জীবনে মায়ের প্রয়োজনীয়তা ঠিক কতটুকু। তুর্য মুসকানকে কোলে নিয়ে দরজা খুলে দেয়। মুসকান তখনো ঠোঁট উল্টে কান্না করছিল। দরজা খুলতেই তুর্যর বাবা-মা হাসি মুখে বাসায় ঢুকে। মুসকানের দাদী মুসকানকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কাঁদছে কেন মুসকান? ওর মা কোথায়?”

তুর্য কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তুর্যকে চুপ থাকতে দেখে ওর বাবা বললো,
“কি হলো বলো? পরী কোথায়?”
“আব্বু আমি ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি।”

“কিহ্? কেন?”
“অনেক কারণ আছে আব্বু।”
“তোমার কোনো এক্সকিউজই আমি শুনতে চাইনা। জানিনা কি কারণে তুমি পরীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছো। কিন্তু পরী কোনো ভুল করার মত মেয়ে না। আমি ওকে চিনতে ভুল করিনি।”
“বাবা তুমি”
“চুপ করো! তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না আমি। যে বাড়িতে বাড়ির লক্ষীই থাকতে পারবে না, সে বাড়িতে আমরা কেন থাকবো?”
“আমায় ভুল বুঝো না আব্বু।”

তুর্য মা ঝাঝালো গলায় বললো,
“ঠিক বোঝার মতও তো কিছু করোনি তুমি তুর্য। যাকগে, তোমার কি মনে হয় না মুসকান পরীকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে না? নিজের মেয়ের কথাও তো একবার ভাবলে না। এত কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। চলো আমাদের পরীদের বাসায় দিয়ে এসো। আমরা ওখানেই ক’টা দিন বেড়িয়ে গ্রামে চলে যাবো।”
“আম্মু”
“আর কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না চলো।”

১২টার দিকে আমি রিয়ার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি চলে আসি। ভাগ্যিস জয় বাসায় ছিল না। নয়তো কি করতো কে জানে। বাড়িতে এসে আমি মাকে কিছুই বলিনি। কিন্তু রিয়া গড়গড় করে মাকে সব বলে দিয়েছে। আমার মন-মেজাজ ভালো না দেখে মা আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। রিয়া আমার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাড়িতে চলে যায়। আমি ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তায় গাড়ি চলাচল করতে দেখছিলাম। তখনই তুর্য গাড়ি নিয়ে বাড়িতে ঢুকে। গাড়ি থেকে তুর্যকে বের হতে দেখতেই বুকের ভেতর ধুক করে ওঠে। সেই সাথে চাপা রাগটাও চলে আসে।

আমি দৌঁড়ে গিয়ে বাড়ির মেইন দরজা বন্ধ করতে যাবো তখনই দেখি মুসকানকে কোলে নিয়ে আমার শ্বশুর-শ্বাশুরী এসেছে। তাদের মুখের ওপর আমি দরজা লাগিয়ে দিতে পারিনি। কিন্তু দুই হাত দিয়ে তখনো দরজা ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। তুর্য আমার দিকে তাকাচ্ছেনা। গাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে শ্বশুর-শ্বাশুরীকে সালাম করলাম। আমাকে দেখেই মুসকান ঝাপিয়ে আমার কোলে চলে আসলো। আমার মনে হলো এতক্ষণে আমি প্রাণ ফিরে পেয়েছি। আত্মাটা ঠান্ডা হলো মুসকানকে জড়িয়ে ধরে। মুসকান আমার দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট বুলিতে যেন হাজারও অভিযোগ জানাচ্ছিল। মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানেই মুসকানের অবস্থা একদম কাহিল। পরক্ষণেই আমার মনে হলো, আমি তো ওর সৎ মা। আমার কেন জ্বলছে! আমি মুসকানকে কোলে নিয়ে তুর্যের কাছে যাই। মুসকানকে তুর্যের কোলে দিতেই অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে।
“নিজের মেয়েকে নিয়ে এক্ষুনী এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।”

“পরী!”
“কি? পরী কি? আমি তো ওর সৎ মা। তাহলে সৎ মায়ের কাছে কেন নিয়ে এসেছেন নিজের মেয়েকে? শুনুন মিষ্টার, প্রয়োজনের প্রিয়জন আমি হতে পারবো না। যেই দেখলেন মুসকানকে সামলানো আপনার পক্ষে সম্ভব না সেই নিজের বাবা-মাকে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসলেন?”
তুর্যর বাবা এসে বললো,

“ও আমাদের নিয়ে আসেনি। আমরাই চলে এসেছি। ওর মধ্যে অনুতপ্তবোধ আছে নাকি সন্দেহ হচ্ছে আমার। বিশ্বাস করো মা, ওকে আমরা এভাবে মানুষ করিনি। একমাত্র ছেলেকে আদর্শ মানুষ হিসেবেই গড়ে তুলেছিলাম। জানিনা কেন এমন হয়ে গেল। যাই হোক তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর বিষয়ে ঢুকবো না। আমরা ভেতরে গেলাম। একটু বসেই গ্রামে চলে যাবো। সংসারের এমন ঝামেলা অনেক কষ্ট দেয় আমাকে। এরপরও আমার ছেলে কি করবে আমি জানিনা।”

কথাটা বলেই আমার শ্বশুর আর শ্বাশুরী ভেতরে চলে গেল। আমি তুর্যর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন আপনি? নিজের মেয়েকে নিয়ে চলে যান।”
তুর্য কোনো কথা বললো না। মুসকানকে নিয়ে গাড়িতে ওঠা ধরলে মুসকান বুঝতে পারে যে, আমার থেকে নিয়ে যাচ্ছে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে মুসকান কান্না শুরু করে। আমি পেছন থেকে তুর্য হাত ধরি। তুর্য আরো অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। তুর্যর চোখে-মুখে কেন জানিনা মনে হচ্ছিল আনন্দের ঝিলিক দেখতে পাচ্ছিলাম।

তুর্যর হাত ছেড়ে আমি মুসকানকে তার কোল থেকে নিয়ে বললাম,
“একটা কথা জানেন তো সবাই না আপনার মত স্বার্থপর না। বিশেষ করে একজন মা কখনোই স্বার্থপর হতে পারে না। আপনার চোখে আমি মুসকানের সৎ মা হতে পারি কিন্তু আমার আল্লাহ্ আর আমি জানি মুসকানকে আমি নিজের সন্তানের মত দেখি ভালোবাসি। যখন একটা মেয়ে বাবার বাড়ি থাকে তখন মেয়েটার সবকিছু ঘিরে শুধু তার পরিবার, বাবা-মা’ই থাকে। যখন মেয়েটির বিয়ে হয় তখন মেয়েটির সবকিছু ঘিরে থাকে তার স্বামী। আর যখন মেয়েটি মা হয় তখন তার সবকিছুই ঘিরে থাকে তার সন্তান। আর সে জায়গায় আমি একজন স্ত্রী হওয়ার আগেই মা হয়ে গিয়েছি এটা আর কেউ না জানুক আপনি খুব ভালো করেই জানেন। আমি কখনো আপনার স্ত্রী হতে পারবো কি না আমি জানিনা, কিন্তু ট্রাস্ট মি সেই চেষ্টাও আর করবো না। আপনার সবকিছু ঘিরে শুধুই তো মায়া আপু?

বেশ আপনি তাহলে তাকে নিয়েই থাকেন। আপনার জীবনে আমি কিংবা মুসকানের কোনো অংশ থাকবে না। আপনি জন্ম দিয়েই সব দায় দায়িত্ব শেষ করে দিয়েছেন। কয়েকদিনের ছোট্ট মুসকানকে আমি নিজের হাতে গড়ে বড় করছি। আমি বিশ্বাস করি, শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। জন্ম না দিয়েও মা হওয়া যায়। আর আমিই মুসকানের মা। এটা মানতে নিশ্চয় আপনার কোনো সন্দেহ নেই? আপনি চাইলেই কিন্তু আমায় একটু ভালোবাসতে পারতেন। আপনি চাইলেই আমি একটু জোর দিয়ে বলতে পারতাম তুমি আমার। জানেন তো, একটা মানুষ যখন বলে আমার তুমি, শুধুই আমার তখন কথাটা অনেক জোর নিয়ে বলে। সেই জোরটা আসলে আপনার নেই। নেই আমার প্রতি কোনো ভালোবাসা। কখনো ভালোবাসার দাবি নিয়ে দাঁড়াবোও না আমি। আমার জীবনের একমাত্র লক্ষই থাকবে মুসকানকে নিয়ে। আমি প্রমাণ করে দিবো, আমি মুসকানের সৎ মা নই।”

কখন যে চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু হয়েছে বুঝতেই পারিনি। ডান হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললাম,
“যাই হোক, আপনি এখন আসতে পারেন। এই বাড়িতে আপনার জায়গা হবে না। তবে এটা ভাববেন না যে, ঐ বাড়িতে আমি ফিরে যাবো না। আমি যাবো ঐ বাড়িতে ফিরে। তবে সেটা অবশ্যই মুসকানের জন্য। কেন জানেন? কারণ আপনি আমায় আপনার স্বার্থের জন্য বিয়ে করলেও আমি ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। ভালোবাসার উপহার হিসেবে মুসকানকে পেয়েছি। আপনার বাড়ির মত বিলাসিতা আমার বাড়িতে নেই। মুসকানের কোনো কষ্ট যেন না হয় সে কারণেই আমি আপনার বাড়িতে ফিরে যাবো। আর আমি চাই না মুসকান ওর বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হোক।”

পর্ব ৮

তুর্য আর কিছু বলেনি। হয়তো বলার মত কোনো ভাষাও ছিল না। আমার কথাগুলো শুনে যে তুর্যর চোখমুখ শক্ত হয়ে গিয়েছিল সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমার শ্বশুর-শ্বাশুরী সেদিন বিকালেই গ্রামে চলে গিয়েছিল। আজ পনেরদিন ধরে আমি মুসকানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আছি। এরমধ্যে তুর্য যে আমায় ফোন দেয়নি, বিষয়টা এমন নয়। প্রতিদিনই ফোন দিয়েছে। মুসকানের খোঁজ-খবর নিয়েছে। বৃহস্পতিবার মুসকানকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে আর শুক্রবার বিকেলে আমার কাছে দিয়ে গিয়েছে। আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলার মত মুখ তুর্যর ছিল না সেটা আমি জানতাম।
তুর্য অফিসের কাজ সেরে রাত করে বাড়িতে ফিরে। এখন আর তুর্যর বাসায় ভালো লাগেনা। মায়ার সাথে কথা বলেও তুর্যর সময় কাটে না। শুধু বারবার কেন জানি মনে হয় সবকিছু ফাঁকা। প্রথমে মনে হতো মুসকানের জন্য এমন লাগে। কিন্তু ধারণাটা তখনই পাল্টে গিয়েছে যখন মুসকানকে নিজের কাছে এনে রাখার পরও শূন্যতা অনুভব করেছে। এটা আর কিছুর নয় বরং আমারই শূন্যতা। শুধু মুসকানের জন্য নয়, আমার জন্যও যে পুরো বাড়িটা ফাঁকা তা তুর্য বুঝতে পেরেছে।

তুর্য আলমারি থেকে বিয়ের এলবামটা বের করে। প্রথমেই আমাদের দুজনের তোলা একসাথে ছবিটা দেখতে পায়। এবং পরের ছবিটা শুধু আমার। তুর্য ছবিটার ওপর হাত বুলিয়ে বলে,
“কেন জানিনা তোমার জন্য আমার এত খারাপ লাগে। এত অনুশোচনা মনের ভেতর কাজ করে। তোমার পাগলামি, দুষ্টুমিগুলো আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তোমার মায়ায় না চাইতেও জড়িয়ে গিয়েছি আমি। না চাইতেও মনের ছোট্ট কুঠুরিতে জায়গা করে নিয়েছো। কেন জানিনা বারবার মনে হয় আমি তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। তোমাকে একটাবার দেখার জন্য কেমন আকুল হয়ে থাকি। তুমি দূরে যাওয়ার পরই আমি এইসব অনুভব করতে পেরেছি। প্লিজ আমার কাছে ফিরে আসো পরী। অন্তত একটা বার তো তোমায় দেখতে পারবো।”
তুর্য ছবিটার ওপর চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়।

বৃহস্পতিবার সকাল আটটার দিকে আমি মুসকানকে নিয়ে তুর্যর বাড়িতে রওনা দেই। যেতে যেতে দশটা বেজে যায়। বাড়িতে গিয়ে বেশ কয়েকবার কলিংবেল বাজানোর পরও দরজা খুলছে না। এদিকে আমার কাছে এক্সট্রা কোনো চাবিও নেই। মুসকান গাড়িতে থাকতেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। ঘুমন্ত বাচ্চাকে কতক্ষণই বা কোলে রাখা যায়। আমি জোরে দরজা ধাক্কাতে থাকি আর কলিংবেল বাজাই। বেশিকিছুক্ষণ পর তুর্য এসে দরজা খুলে দেয়। রাগে তো আমার মাথা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু তুর্যকে দেখেই আমার সব রাগ ভ্যানিস হয়ে গেল।

দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাত্র ঘুম থেকে ওঠে এলো। পড়নে ব্লাক প্যান্ট আর হোয়াইট টি-শার্ট। চুলগুলো এলোমেলো। দেখেই কেমন কেমন জানি লাগছিল। কিন্তু আমাকে তো গলে গেলে চলবে না। ঘুমের চোটে চোখ খুলতে পারছিল না তুর্য। কিন্তু আমাকে দেখে তুর্যর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। আমি সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে মুসকানকে নিয়ে রুমে চলে যাই। রুমে গিয়ে হঠাৎই মনে হলো, আমরা তো একসাথে থাকবো না। আমি মুসকানকে নিয়ে অন্য রুমে চলে যাই। মুসকানকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই তুর্য রুমে আসে।

“আমার রুমে বিছানা ঠিক করে দিচ্ছি। আমার রুমে শোয়াও মুসকানকে।”
“দরকার নেই।”
“কেন?”

“এমনিই।”
“পরী!”
“বলেন।”
“তুমি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছো?”
“রাগ করবো কেন?”
“আসলে সেদিন ঐ ব্যবহারটা করা উচিত হয়নি আমার।”
“প্রত্যেকবারই কি ভুল করার পর বুঝতে পারেন?”

“মানুষ মাত্রই তো ভুল।”
“তাই বলে কতবার ক্ষমা করা যায়? এনিওয়ে, আশা করি আর কোনোদিন এমন ব্যবহার আপনি করবেন না আমার সাথে। আসলে করবেন না বললে ভুল হবে। আমি সেই সুযোগটাই আপনাকে দিবো না। আর আপনি এখন আসতে পারেন। আমি খুব টায়ার্ড। ঘুমাবো এখন।”
তুর্যর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মাথা নিচু করে তুর্য ওর রুমে চলে যায়। আমি দরজা লাগিয়ে দিয়ে মুসকানের পাশে শুয়ে পড়ি। তুর্য রুমে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। মায়ার ছবির দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যায় ছবিটার দিকে।

“মায়া একটা কথা বলবে? পরীর এমন ব্যবহার আমি কেন মেনে নিতে পারছি না? কেন আমার কষ্ট হচ্ছে বলবে? আমি কি পরীকে ভালোবেসে ফেলেছি?”
কোনো উত্তর পায়না তুর্য। পাওয়ার কথাও নয়। মায়ার হাসিমাখা ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে বাহিরে যায় খাওয়ার জন্য। আমি বাসায় ছিলাম না বলে কাজের খালাকে বাসায় আসতে বারণ করেছিল তুর্য। বাসায় রান্নাও হয়নি বিধায় রেডি হয়ে বাহিরে যায়ওয়ার সময় ড্রয়িংরুমে কাজের খালা তুর্যকে ডাক দেয়।
“পরী মা আপনারে টেবিলে বইতে কইছে।”
“খালা আপনি? কখন আসছেন?”

“আমি তো পরী মায়ের লগেই আইছি। দোকানে গেছিলাম তাই দেড়ি হইছিল।”
“কিন্তু আমি তো আপনাকে আসতে বলিনি।”
আমি রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে আসছিলাম তখন উত্তরটা আমি দিলাম,
“আমিই আসতে বলেছিলাম।”
“তুমি?”
“হুম।”

“কিন্তু নাম্বার কোথায় পেলে?”
“আপনার মত ইররেসপন্সিবল আমি না। আমি সবদিকই সামলিয়ে চলি। খেতে বসেন আপনি।”
“বাহিরে খেয়ে নিবো।”
“ওকে।”
তুর্য হা হয়ে আছে। তুর্য ভাবতেও পারেনি যে আমি রাজি হয়ে যাবো। আমি খালাকে খাবার দিয়ে নিজেও টেবিলে বসে পড়েছি খাওয়ার জন্য। তুর্য তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি একবার তাকিয়ে বললাম,
“যাচ্ছেন না কেন?”, বলে আমি খাওয়া শুরু করলাম।

তুর্য মনে মনে বললো,
“এই কয়দিনেই এত চেঞ্জ! কেমন ডোন্ট কেয়ার টাইপ হয়ে গেছে! আমি না হয় বলেছি বাহিরে খেয়ে নিবো তাই বলে পরীকে রাজি হতে হবে? কতদিন পর ওর হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগ পেয়েছি আর আমি কি না ভাব দেখিয়ে বললাম বাহিরে খেয়ে নিবো! ধুর শালা! দোষ তো আমারই।”
তুর্য বললো,
“আমার খিদে নেই তাই বাহিরেও খাবো না।”

“ওহ। আচ্ছা।”
তুর্য দাঁত কটমট করতে করতে রুমে চলে গেল। আমি খাওয়া শেষে সব খাবার ঢেকে মুসকানের কাছে চলে গেলাম। খালা থালাবাসন সব ধুয়ে বাসায় চলে গেল।
দুপুর ২টা ১০ মিনিট
তুর্য এখনো খায়নি। শুধু রুমের মধ্যে পায়চারী করছে। নিজে আর থাকতে না পেরে খাবার খেতে চলে যায়। ডাইনিং টেবিলে সব খাবারই রাখা ছিল। হটপটের ঢাকনা খুলতেই নাক টেনে শ্বাস নিয়ে বললো,
“আহ্! আলুর পরোটা।”
তরকারীর বাটির ঢাকনা খুলে বললো,

“ওহ মাই গড! আলুর দম। আলুর পরোটা আর আলুর দম করেছে আর আমি কি না মিস করছিলাম!”
তুর্য তাড়াতাড়ি চেয়ার টেনে বসে। প্লেটে পরোটা আর আলুর দম নিয়ে খাওয়া শুরু করে। এক বসায় চারটে পরোটা খেয়ে ফেলে। পাঁচ নম্বর পরোটা ছিড়ে আলুর দম নিয়ে যেই মুখে তুলতে যাবে তখনই আমি তুর্যের সামনে এসে দাঁড়াই। আমায় দেখে তুর্যর হা করা মুখটা বন্ধ হয়ে যায়। বসা থেকে তুর্য ওঠে দাঁড়ায়।
“না মানে আসলে”

আমি কোনো কথা না বলে রান্নাঘর থেকে আরো পরোটা এনে দিয়ে বললাম,
“মানে মানে করার কিছু নেই। আপনার বাড়ি, আপনার জন্য তৈরি করা খাবার আপনি খাবেন না তো কে খাবে?”
তুর্য খুশি হয়ে খেতে বসে যায়।

সময়গুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। দুইজন দুই রুমে থাকছি। তবে একটা জিনিস আমি খেয়াল করেছি, আমি যতই তুর্যকে এভোয়েড করছি তুর্য ততই আমার কাছে আসার বাহানা খোঁজে।
সেদিন আনুমানিক ভোর চারটার দিকে আমি খেয়াল করি এক জোড়া হাত আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। আমি এদিকও নড়তে পারছি না, ওদিকও ঘুরতে পারছিনা। কারণ ঐদিকে মুসকান শুয়ে আছে। রাতে আমার রুমের দরজা লক না করেই ঘুমাই। কারণ বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে শুধু তুর্যই থাকে। কিন্তু ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে গেছে। এমনভাবে ধরে রেখেছে যে মুখও দেখতে পাচ্ছিনা। ভয়ে চিৎকারও দিতে পারছিনা। অনেক কষ্টে এক হাত সরাতে সক্ষম হই। ডিম লাইটের আলোয় মুখ দেখে তো আমার চোখ ছানাবড়া। তুর্য এই রুমে! রাগে দাঁতে দাঁত চিবুচ্ছি! তুর্যের বাহুতে ধরে ধাক্কাচ্ছি আর ডাকছি। উঠবে তো দূরের কথা বিড়ালছানার মত বুকে এসে মুখ লুকিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। বুঝতে পারছিনা আমি মানুষ নাকি কোলবালিশ! তুর্যকে আমার থেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেই যাচ্ছি কিন্তু ছাড়ার কোনো নামগন্ধ নেই।

পর্ব ৯

আমি গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতেই তুর্য ধপাস করে খাট থেকে ফ্লোরে পড়ে গিয়েছে। না, একা পড়েনি। সাথে আমাকে নিয়েই পড়েছে। ফ্লোরে পড়ে যাওয়ায় কোমড়ে প্রচন্ড ব্যথা পাই। একেই তো মেজাজ খারাপ ছিল তার মধ্যে এখন আবার পড়ে ব্যথা পেলাম। আমি”ওমাগো”বলে চিৎকার দিতেই তুর্য আমায় ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আর বলে,
“একি! আমরা ফ্লোরে কেন?”
ওর কথা শুনে আমার মনে হলো আমি কোনো আগুনের উত্তাপে জ্বলছি। ব্যথার চেয়েও রাগ বেশি হচ্ছে। তাই ব্যথাকে চাপা রেখে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
“আপনি যে এমন নির্লজ্জ সেটা তো আমি জানতাম না।”

“আমি কি করলাম?”
“কি করেননি আপনি? লজ্জা করেনা এখন আপনার? আপনি কোন সাহসে আমায় জড়িয়ে ধরেছিলেন?”
“আমি? কখন?”
“ন্যাকাষষ্ঠী! আচ্ছা এটা বলেন, আপনি এই রুমে কেন এসেছিলেন?”
“আমি মুসকানের সাথে ঘুমাতে এসেছিলাম।”

“মুসকানকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেই তো পারতেন।”
“মুসকান তো তোমায় ছাড়া ঘুমাতে পারে না। আর আমি মুসকানকে ছাড়া ঘুমাতে পারিনা। তাই বলছিলাম কি, চলো আমরা তিনজনে এক রুমেই ঘুমাই।”
“হাহ্! খুব দেখছি এখন ভালোবাসা উতলে পড়ছে? সেদিন সামান্য একটা চুমু দেওয়ায় আমার গায়ে হাত তুলতেও দুবার ভাবেননি। আর আজ? আজ আপনি কি করে আমার কাছে আসলেন? কোন সাহসে আমায় জড়িয়ে ধরলেন?”

তুর্য কিছু বলছে না। শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আবারও বললাম,
“শুনুন, সেদিন আমায় বলেছিলেন না সীমার মধ্যে থাকতে? আজ আমি আপনাকে বলছি নিজের সীমার মধ্যে থাকেন।”
আমি রুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম। আমি আজকাল তুর্যকে কেন জানি বুঝতে পারছি না। তার হঠাৎ এমন দূর্বলতা কেন আমার প্রতি? কিসের এত ভালোবাসা? তার সব ভালোবাসা তো শুধু মায়া আপুর জন্যই। তাহলে থাকুক না ভালো মায়া আপুকে নিয়ে। কেন জড়াচ্ছে এর মাঝে আমায়। কেন এভাবে পিছুটানে ফেলছে আমায়।

সকালের টুকটাক কাজ শেষ করে তুর্যর রুমে গেলাম। তুর্য তখন রুমে ছিল না। কোমড়ে খুব জোরে ব্যথা পেয়েছিলাম তাই মলম খুঁজতেই তুর্যর রুমে যাওয়া। মলম পেয়েও গেলাম। আমি বিয়ের পর এখনো পর্যন্ত কোনোদিন শাড়ি পড়িনি। কামিজটা সরিয়ে কোমড়ে মলম লাগাচ্ছিলাম তখনই বজ্জাতটা রুমে ঢুকে ছো মেরে হাত থেকে মলমটা নিয়ে নেয়। মনে মনে ভাবছিলাম, আসার আর সময় পেলো না! রুমে আসছি বলে, না জানি কতগুলো কথা শুনিয়ে দিবে এখন। কিন্তু তুর্য দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,

দেখেও যদি এমন প্রশ্ন করে তাহলে মেজাজটা কেমন লাগে বলেন তো। দাঁত কটমট করে বললাম,
“কেন আপনি লাগাবেন?”

“না, লাগিয়ে দিবো।”
“নো! থ্যাংকস।”
“আমি এমনি এমনি থ্যাংকস নেই না। তুমি না বললে লাগিয়ে দিতাম না। কিন্তু এখন যখন থ্যাংকস দিয়েই ফেলেছো তখন তো লাগিয়ে দিতেই হবে।”
“ধুর! সরেন।”
আমি রুম থেকে চলে আসার সময় তুর্য আমার হাত চেপে ধরলো। ঠোঁট কামড়ে বললো,
“যাচ্ছো কোথায়? মলম তো লাগিয়ে দেই আগে।”

“বলছি তো লাগবে না।”
“লাগবে লাগবে।”
তুর্য সামনে এগোচ্ছে আর আমি পিছাচ্ছি। পেছাতে পেছাতে একদম দেয়ালের সাথে লেগে গেছি। তুর্য আবারও দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
“কি পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেল বুঝি?”

আমি আর উত্তর দিবো কি! কেন জানিনা ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। এত জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম যে, যে কেউ দেখলে ভাববে আমি হাঁপানির কোনো রোগী। উফফ! কি বাজে এক অবস্থা। খেয়াল করলাম তুর্য একদমই আমার কাছে চলে এসেছে। তুর্যর গরম নিঃশ্বাস আমার চোখে-মুখে,ঠোঁটে এসে পড়ছে। আর এদিকে মনে হচ্ছে আমার প্রাণপাখি উড়াল দিচ্ছে। আমি তুর্যর দিকে তাকাতেও পারছিনা। কিছু বলতেও পারছিনা। এমন অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়বো জানলে কখনোই আসতাম না এই রুমে। আমি কোনোরকম অস্পষ্ট স্বরে বললাম,
“মু মু মুসু রুমে একা। আমায় যেতে হ হবে।”

“মুসকান ঘুমাচ্ছে। জেগে গেলেও সমস্যা নেই। খালা আছে ওর সাথে।”
শয়তানটা করছে কি! সব ব্যবস্থা করেই আসছে দেখছি। ইশ! আল্লাহ্ বাঁচাও এই গণ্ডারটার হাত থেকে।
তুর্য অপলকভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তুর্যর ঠান্ডা হাত আমার উন্মুক্ত কোমড়ে রাখতেই আমি সাথে সাথে শিউরে উঠি। তুর্যকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলে বাম হাত পেছনে দিয়ে আমায় ওর বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।

“চুপ! তোমার সাহায্যই তো করছি।”, বলে তুর্য কোমড়ে হাত দিয়ে মলম লাগিয়ে দিচ্ছিলো। ওর প্রতিটা স্পর্শে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। তুর্য বললো,
“তুমি শাড়ি কেন পড়ো না হুম?”
ওর উত্তর আর কি দিবো! আমার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছিল। আমি করুণস্বরে বললাম,
“দোহাই লাগে আমায় ছেড়ে দিন। আপনার সাহায্য আমার লাগবে না।”

নাহ্! আমার কথা যেন তুর্যের কানেই গেলো না। পকেট থেকে টিস্যু বের করে হাতটা মুছে নিলো। তখন আমি বললাম,
“হয়ে গেছে? এখন আমি আসি।”
তুর্য হাত ধরে টেনে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো আমায়।
“উহুম! এতক্ষণ যে তোমায় হেল্প করলাম এর বিনিময়ে কিছু দিবে না?”
“মানে?”
“মানে মানে কি হতে পারে?”

“আমায় যেতে দিন।”
“হায়রে! এমন ভাবে বলছো মনে হচ্ছে আমি ভিলেন।”
“তার চেয়ে কম কি আপনি?”
“তাই? তাহলে ভিলেনগিরি দেখাই কি বলো?”
“না একদম না।”

“পাবলিক মানবেও না গো! নায়ক ভিলেন হবে বিষয়টা কেমন যেন না?”
“নাটক শুরু করলেন নাকি আপনি?”
“না তো! এখন শুরু করবো।”
তুর্য জোরে আমার কোমড় চেপে ধরে। আস্তে আস্তে কোমড় থেকে হাত গলায় নিয়ে আসে। ইশ! হাত নাকি সাপের শরীর আল্লাহ্ মালুম! এত ঠান্ডা। আমি হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম,
“গলা টিপে মারবেন নাকি?”

তুর্য বিরক্ত নিয়ে বলে,
“তুমি এমন আনরোমান্টিক হয়ে গেলে কেন? দূরে দূরে থাকার ধান্দা সব?”
“আমায় যেতে দিন।”

“কি শুরু করলে?”, বলেই মুখটা আরো কাছে নিয়ে আসে। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে আমার ঠোঁটে চেপে ধরি। তুর্য হো হো করে হেসে দেয়।
“হাহা তুমি কি ভেবেছিলে আমি ঠোঁটে চুমু দিবো?”
কি লজ্জার প্রশ্ন! আসলেই তো আমি এটাই ভেবেছিলাম। তবুও ভাব নিয়ে বললাম,
“মোটেও এটা ভাবিনি আমি।”
“কিন্তু আমি এটাই করবো।”
“কিহ্?”
“জ্বী।”
“আম্মাআআআআ”

তুর্য হুট করেই আমার ঠোঁট জোড়া ওর ঠোঁটে আবদ্ধ করে নেয়। আমি নিজের যথেষ্ট শক্তি দিয়ে ওকে সরানোর চেষ্টা করি। কিন্তু এর ফলে তুর্য ওর দুই হাত দিয়ে আমার দুই হাত শক্ত করে ধরে রাখে। শত চেষ্টা করেও যখন আমি ছাড়াতে পারলাম না তখন হাল ছেড়ে দিলাম। বাঁধা দিতে পারলাম না আর। একসময় মনে হলো আমিও তুর্যর সাথে ওর ভালোবাসার ঘোরে মিশে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়। আমি তখনও ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ও আমার কোমড়ে ধরে ওর কাছে নিয়ে আসে। আমার গলার একপাশে ডান হাত রেখে আরেকপাশে চুমু খায়। সাথে সাথে শীতল হাওয়া বয়ে যায় শরীরে। আমি এখন সম্পূর্ণ তুর্যতে আবদ্ধ। তুর্যকে আর বাঁধা দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিল না আমার।তুর্য গালে, মুখে চুমু খেতে খেতে হঠাৎ থেমে যায় মায়ার ছবি দেখে। আমার ঠিক পিছনেই মায়ার ছবি ছিল। তুর্য তখন সঙ্গে সঙ্গে আমায় ছেড়ে দিয়ে রুমে থেকে চলে যায়।

পর্ব ১০

তুর্যর চলে যাওয়া দেখছি আমি। ইচ্ছে করছে সবকিছু ভেঙ্গে চুুরমার করে দেই। নিজে জোর করে কাছে টেনে নিবে আবার নিজেই এভাবে ছেড়ে দিবে। কি পেয়েছেটা কি সে আমি বুঝিনা! রাগ কমছেনা আমার। একটুও কমছে না। রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে তুর্যর বিছানা সব এলোমেলো করে ফেলেছি। ড্রেসিংটেবিলের সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। আর কত? কত সহ্য করবো আমি এসব!

ফোনের শব্দে রাগ থেকে আমি হুসে আসি। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আমার শ্বশুর ফোন করেছে। ফোনটা বিছানার ওপর রেখে দিলাম। পাশে তাকিয়ে দেখলাম মুসকান ঘুমাচ্ছে। আমি চুলগুলো হাত খোপা করে নিলাম। জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে পান করলাম। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বিছানায় বসলাম। ততক্ষণে ৭ বার ফোন দিয়ে ফেলেছে বাবা। আমি কলব্যাক করতেই বাবা রিসিভড করে বললো,
“কিরে মা রাগ করে আছিস?”

“তাহলে ফোন তুলছিস না যে?”
“একটু কাজ করছিলাম আরকি।”
“আচ্ছা দরজা টা তাড়াতাড়ি খোল তো। আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠছি।”
“মানে? সত্যিই আসছেন বাবা?”
শ্বশুর বাবা হেসে বললো,

“হ্যাঁ রে মা।”
আমি ফোন রেখে দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুললাম। বাবা আমাকে দেখেই এক গাল হেসে দিলো। আমি বাবা-মা দুজনকে সালাম করে ভেতরে নিয়ে আসলাম। খাওয়ার সময় মা জিজ্ঞেস করলো,
“তুর্য কোথায়?”
“জানিনা মা। কোথায় যেন গিয়েছে।”
“ফোন দাও তো।”

“ওর আসতে সময় লাগবে মা। আপনারা খেয়ে নিন।”
আমার জোড়াজুড়িতে বাবা-মা খেয়ে নিলো। তারপর মুসকানকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেললো। বিকেলের দিকে তারা মুসকানকে নিয়ে বাহিরে হাঁটতে গেল। তখন আমি তুর্যর রুমটা গুছাচ্ছিলাম। ঐ সময়েই তুর্য বাড়িতে আসে। রুমে ঢুকে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় এসে বসে। ওকে দেখেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। দ্রুত রুম গুছিয়ে আমি অন্যরুমে চলে যাই।

সব ঠিকঠাক থাকলেও সমস্যা বাঁধলো রাতে ঘুমানোর সময়। আমি যেই রুমে থাকবো সেই রুমে বাবা-মা থাকবে। তাও আবার আমার শ্বাশুরী বায়না ধরেছে যে আজ মুসকানকে সে সাথে নিয়ে ঘুমাবে। মুসকানকে মায়ের সাথে ঘুমাতে দিতে আমার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো তুর্যর সাথে আমায় এক রুমে থাকতে হবে। একটা ব্যক্তিত্বহীন মানুষের সাথে এক রুমে থাকা অসম্ভব আমার পক্ষে। তাই অনেক কষ্টে বাহানা খুঁজে মাকে বললাম,
“মা মুসকান তো রাতে আমায় ছাড়া ঘুমাতে পারেনা।”

“পারবে পরী। দাদীর কাছে ঠিকই থাকতে পারবে। তাছাড়া ও তো ল্যাকটোজেন খায়। তাই আর কোনো সমস্যাই নেই।”
আমি আর কোনো এক্সকিউজ দেখাতে পারলাম না। অসহায় হয়ে তুর্যের রুমে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে দেখি তুর্য মায়ার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখেই লুকিয়ে চোখ মুছলো। আমি দেখেও না দেখার ভান করে বিছানায় গিয়ে অন্যপাশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। তুর্য কিছুক্ষণ পর লাইট অফ করে পাশে এসে শুয়ে পড়লো। দুজনের মাঝেই যথেষ্ট দূরত্ব। ফ্যানের শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ হচ্ছে না এতটাই পিনপতন নিরবতা। তুর্য হঠাৎ বলে উঠলো,
“পরী ঘুমিয়েছো?”
“না।”
“স্যরি।”
“কেন?”
“তখনকার ঐ আচরণের জন্য।”

“পৃথিবীতে সবচেয়ে সস্তা শব্দ কি জানেন?”
“কি?”
“স্যরি শব্দটা। যত বড় ভুলই হোক না কেন একটা স্যরি বলবে ব্যস! সাত খুন মাফ হয়ে গেল?”
“আমি কি করবো বলো! মায়ার ছবি দেখে জানিনা কি হয়ে গেল আমার।”
“প্লিজ আপনার এই ডায়লগ বন্ধ করেন। আপনার থেকে এসব আচরণই আশা করি আমি। আপনি প্লিজ মায়া আপুকে নিয়েই ভালো থাকেন। আমি মুসকানকে নিয়ে ভালো আছি। আপনাকে কাছে পাওয়ার কোনো ইচ্ছে আর আমার নেই।”
“কিন্তু আমার আছে।”

“শাট আপ!”
“সিরিয়াসলি।”
“কেন? ওহহো! পুরুষ মানুষ তো। কতদিনই বা আর এভাবে থাকা যায় তাই না? তারমধ্যে ঘরে বউ আছে।”
“বিষয়টা এমন নয় পরী।”
“তবে কেমন শুনি?”

“আমি এটাই তোমায় প্রকাশ করতে পারিনা।”
“সেটা আপনার ব্যর্থতা আমার নয়। দয়া করে এখন ঘুমাতে দিন।”
তুর্য আর কিছু বলেনি। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মনে মনে ভাবছি,
“তোমায় যদি নাকানিচুবানি না খাইয়েছি তো আমার নামও পরী না হুহ।”

পরেরদিন বিকেলে শ্বাশুরীর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলাম। শ্বশুর-শ্বাশুরী আসায় বাড়িটা এখন পূর্ণ হয়েছে। অন্য রকম একটা ভালোলাগা কাজ করছে। সকাল থেকেই আমি বেশ খুশি। কিন্তু সেটাও আর বেশিক্ষণ টিকলো না। শ্বাশুরীর কথা শুনে খুশি কর্পূরের মত উড়ে গেল। শ্বাশুরী বললো,
“মা আমাদের ব্যাগটা গুছিয়ে দিও তো।”
আমি হতাশ হয়ে বললাম,
“কেন মা? কোথায় যাবেন?”

“আমার ছোট বেলার এক বান্ধবীর ছেলের বিয়ে। ওর বাসায় যাবো। তোমরাও রেডি হয়ে নিয়ো।”
তুর্য কথার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বললো,
“না মা। আমার অফিসে অনেক কাজ। আমি যেতে পারবো না। আর পরী চলে গেলে আমার খাওয়া-দাওয়ায় কষ্ট হবে। তোমরা চাইলে মুসকানকে নিয়ে যেতে পারো।”
ওর কথা শুনে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। আরে বজ্জাত, তুই যেতে পারবিনা ভালো কথা। আমায় কেন আটকাচ্ছিস! গণ্ডার একটা।
মা বললো,

“আকাশের বিয়ে আর তোরা যাবি না?”
“আচ্ছা বিয়ের দিন না হয় আমি পরীকে নিয়ে যাবো।”
“আচ্ছা তোর যা ভালো মনে হয়। আমরা তাহলে মুসকানকে নিয়ে যাই।”
মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার কোনো সমস্যা নেই তো?”
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই তুর্য বললো,

“না মা। ওর কোনো সমস্যা হবে না। আমি আছি তো।”
আমি মনে মনে বলছি,
“হু গণ্ডার আপনি তো থাকবেনই। নয়তো আমার জীবনটা তেজপাতা করবেন কিভাবে।”
সন্ধ্যার দিকে বাবা-মা মুসকানকে নিয়ে রওনা দিলো। তুর্য গেলো তাদেরকে পৌঁছে দিতে। আমি তুর্যের রুমে যেতেই দেখলাম একটা প্যাকেট আর চিরকুট। চিরকুটটা হাতে নিয়ে দেখলাম লিখা আছে,
“অনেক কষ্টে তোমার জন্য শাড়িটা খুঁজে কিনে এনেছি। আশা করি শাড়িটা তুমি পড়বে।”

চিরকুট রেখে প্যাকেট খুলে দেখলাম একটা লাল শাড়ি। সত্যিই শাড়িটা অসম্ভব সুন্দর। গণ্ডারটাকে একটা শাস্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু আমি তো শাড়ি পড়তে পারিনা।উপায় না পেয়ে পাশের বাড়ির ভাবিকে ডেকে শাড়িটা পড়ে নিলাম। ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছি। মুখে হালকা মেকাপ, কপালে ছোট্ট লাল টিপ, চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক দিয়েছি। কানে ঝুমকা, গলায় চেইন, দুই হাত ভর্তি চুড়ি আর পায়ে নূপুর পড়েছি। নূপুরের ঝুমঝুম আওয়াজ পুরো রুম মুখরিত করে তুলেছে।

রাত আট’টার দিকে তুর্য বাসায় আসে। অনেকবার কলিংবেল বাজানোর পরও দরজা খুলিনি। তুর্যর কাছে থাকা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে। বেডরুমের দরজা পেছনে আমি লুকিয়ে ছিলাম। রুমের ডিম লাইট শুধু অন ছিল। সেই সাথে বক্সে হালকা সাউন্ডে”Bol Do Na Jara”গান চলছে। তাছাড়া পুরো বাড়িটা সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। আস্তে আস্তে তুর্য রুমে ঢুকে। তুর্য রুমে ঢুকতেই আমি পেছন থেকে তুর্যকে জড়িয়ে ধরি। আজ তুর্য আমায় সরিয়ে দেয়নি। বরং হাত ধরে সামনে নিয়ে আসে। অপলকভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“অনেক সুন্দর লাগছে তোমায়।”
আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারিনি।
“বাব্বাহ্! লজ্জা পাচ্ছো?”
“মোটেও না।”
“তাই?”

“হু?”
তুুর্য আমায় কোলে করে বিছানায় বসিয়ে দেয়।
আমার পায়ের নূপুর খুলে দেয়। দুই হাতের চুড়ি খুলে দিয়ে হাতে চুমু খায়। আমি দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে লজ্জায় অন্য পাশ হয়ে শুয়ে পড়ি। তুর্য হেসে আমার পাশে শোয়। এক কান থেকে ঝুমকা খুলে কানে চুমু খায়। এবারও তুর্যের প্রতিটা স্পর্শে আমি বারবার শিহরিত হচ্ছি। আমাকে তুর্যের দিকে ঘুরিয়ে অন্যকানের ঝুমকা খুলে চুমু খায়। গলার চেইন খুলে চুমু খেতেই আমি তুর্যকে জড়িয়ে ধরি। তুর্য তখন শাড়ির আঁচল সরিয়ে বুকে, গলায়, ঘাড়ে, গালে, ঠোঁটে চুমু খেতে থাকে। আমি তুর্যর শার্ট নোখ দিয়ে খামচে ধরি। কোমড়ে হাত দিয়ে শাড়ির কুঁচিগুলো খুলে ফেলে। পেটে চুমু খায়। গলায়, ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে জড়িয়ে ধরে তখন আমি বলি,
“ছাড়েন।”
তুর্য আমার কোনো কথা শুনতেই পাচ্ছে না। সম্পূর্ণ আমার ঘোরে আছে। আমি আবারও বললাম,
“সরে যান প্লিজ।”
তুর্য বললো,

“উমম না! প্লিজ আজ বাঁধা দিয়ো না।”
“আমার অনেক খারাপ লাগছে। মাথা ব্যথা করছে হঠাৎ করে। আমি এখন কমফোর্টেবল ফিল করছিনা। ঘুমাবো প্লিজ।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তুর্য আমায় ছেড়ে দিলো। আমি গায়ে কাঁথা জড়িয়ে অন্যপাশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। মনে মনে শয়তানির হাসি দিয়ে বললাম,
“দেখো মিষ্টার তুর্য এখন কেমন লাগে! এটাকেই বলে টিট ফর ট্যাট!”

পর্ব ১১

আজ আমরা বিয়ে বাড়িতে যাবো। ঐ রাতের পর তুর্য আমার ওপর আপসেট। ঠিকমত কথা বলে না আমার সাথে। আমিও আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাই না। আমার এত ঠ্যাকা কিসের হুহ! সে দোষ করলে কিছুনা আর আমি একটু প্রতিশোধ নিলেই দোষ!
যথারীতি রেডি হয়ে আমি আর তুর্য রওনা দিলাম। তুর্য গাড়ি ড্রাইভ করছে। সারা রাস্তায় তুর্য একটাও কথা বলেনি আমার সাথে। আমি বললেও চুপ করে ছিল। বিয়ে বাড়িতে পৌঁছেই বাবা-মার সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখেই মুসকান ঝাপ দিয়ে আমার কোলে এসে পড়লো। আমার সাথে লেগে কাঁধে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। আমি মুসকানের গালে, কপালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। সন্ধ্যার সময় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। আমাকে দেখে শ্বাশুরী মা বললো,

“গায়ে হলুদে এটা কি পড়ে এসেছো?”
“কেন মা? থ্রি পিছ পড়েছি।”
“সেটাই তো দেখছি। সব মেয়েকে দেখো কি সুন্দর হলুদ শাড়ি পড়েছে। তুমিও পড়ো।”
“না মা। এমনিই ভালো আছি।”

“একদম না। আমার সাথে চলো।”
শ্বাশুরী মা হাত টেনে ভেতরের একটা রুমে নিয়ে গেল। হলুদ শাড়ির সাথে লাল ব্লাউজ। খোঁপায় গাঁদা ফুলের মালা। দুই হাত ভর্তি লাল আর হলুদ চুড়ি। আর সাথে হালকা সাজ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে আজ আমারই গায়ে হলুদ। শ্বাশুরী মা আমার থুতনিতে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বললো,
“এখন কত সুন্দর লাগছে তোমায়।”

আমি উত্তরে লাজুক হাসি দিলাম। শ্বাশুরীর সাথে বাহিরে গেলাম। এত মানুষের ভীরে আমার কাজলকালো চোখ দুটো শুধু তুর্যকেই খুঁজছিল মনে মনে। মনে হচ্ছিল তুর্যও আমায় প্রসংশিত ভালোবাসার চোখে দেখুক। অবশেষে আমি তুর্যকে দেখতেও পেলাম। সাদা পাজামা আর হলুদ পাঞ্জাবি পড়েছে। ইশরে! তুর্য আর কি ফিদা হবে আমি তো নিজেই ফিদা হয়ে গেলাম। পাঞ্জাবি পড়লে এত্ত কিউট লাগে কেন আমার কিউট বর’টাকে। ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খাই। সব লাজ-লজ্জা ভেঙ্গে আমি আটাইশ পাটি দাঁত বের করে হেসে তুর্যর কাছে যাচ্ছিলাম। আমায় দেখে তুর্যও এগিয়ে আসছিল।

ইশরে! তখন যে কি লাগছিল না! নিশ্চয় আমাকেও অনেক সুন্দর লাগছে তাই আমার মত সেও রাগ করে থাকতে পারেনি। কাছাকাছি যেতেই তুর্য আমাকে না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। দুইটা রসগোল্লা একসাথে মুখে ঢুকালে মুখের হা করা যত বড় হবে আমার অবস্থাটাও এখন ঠিক সেরকম। কেমন বজ্জাতের বজ্জার বেডা রে! হ্যাঁ আমাকে ইগনোর করা। গণ্ডার একটা। আমিও দাঁত কটমট করে একটা চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লাম। রাগে আশেপাশের কিছুই চোখে পড়ছে না আমার। কিন্তু হঠাৎ ই একটা জিনিস খেয়াল করলাম, একটা ছেলে কিছুটা দূর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কেমন জানি অস্বস্তি লাগছিল।

আমি সেখান থেকে সরে গেলাম। গায়ে হলুদের জন্য প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে যেখানে সেখানে গেলাম। এত মানুষের মধ্যে সবাই আমার অপরিচিত। গায়ে হলুদ শেষের দিকে। শুনলাম এখন নাচানাচি হবে। কি একটা বিরক্তিকর অবস্থা। মাও মুসকানকে নিয়ে ভেতরে আছে। কারো সাথে বসে দেখবো সেটারও কোনো উপায় নেই। আর তুর্য? সে তো এখন আকাশের চাঁদ হয়ে গেছে। আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। তবুও অনেক আশা ভরসা নিয়ে ওর কাছে গেলাম। ও তখন আকাশ ভাই আর ওর আরো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। আমাকে দেখেই আকাশ ভাইয়া তুর্যকে বললো,
“দোস্ত ভাবী আসছে। তোকে কিছু বলবে হয়তো।”

তুর্য ওখান থেকে ওঠে আমার কাছে এসে বললো,
“কি হয়েছে?”
“কি হবে? এখানে আমি কাউকেই চিনিনা। একা একা কি করবো? আপনি আমার সাথে থাকেন।”

তুর্য আমায় ঝাড়ি দিয়ে বললো,
“দেখছো না আড্ডা দিচ্ছি এখানে? আরো মানুষ তো আছে। তাদের সাথে আলাপ করো গিয়ে। আর না চিনলে নিজ দায়িত্বে পরিচিত হয়ে নাও।”
তুর্য কথাগুলো বলে আবার চলে গেল। কেন জানিনা তুর্যর সামান্য কথাতেও আমার চোখের কোণে পানি জমলো। সবার থেকে একটু দূরে আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে একজন অপরিচিত লোক এসে বললো,

“শুনছেন?”
আমি পিছন ঘুরে দেখলাম সেই ছেলেটা। সেও তুর্যর মত হলুদ পাঞ্জাবি পড়েছে। তুর্যকে ভালোবাসার আগে বা বিয়ের আগে হলে এটাকে দেখেও হয়তো ক্রাশ খেয়ে বসে থাকতাম। কিন্তু এখন তুর্যকে ছাড়া কাউকেই ভালো লাগে না আমার। আমি বললাম,
“জ্বী!”
“আমি রাজ। আপনি?”
“পরী।”

“পরী! আপনার সাথে নামেরও বেশ মিল।”
আমি কিছু বলতে যাবো তখন দেখলাম তুর্য উৎসুক চোখে কাউকে খুঁজছে। কিন্তু কাকে খুঁজছে সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে দেখে যখন এদিকে আসছিল তখনই বুঝতে পারলাম যে, আমায় খুঁজছে। আমাকে হার্ট করো, এড়িয়ে যাও তাই না? দেখো এবার তোমাকে কি করে পুড়াই।
আমি একটু হেসে উত্তর দিলাম,
“কেমন মিল?”
“আপনি পরীর মতই দেখতে সুন্দর।”

“তাই?”
“হ্যাঁ।”
“থ্যাঙ্কিউ।”
“ইহুম! থ্যাঙ্কিউ দিয়েন না।”
“তবে?”
“আপনার ঐ মিষ্টি হাসিটাই যথেষ্ট।”
আমি আবারও একটু হাসলাম।
“জানেন, আপনাকে না অনেক সুন্দর লাগছে।”

“অবশ্যই হাসবেন।”
ঐদিকে তাকিয়ে দেখলাম তুর্য হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ওর জেলাসের কথা ভেবেই প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে।

হুট করে ফোনে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। তুর্যর ম্যাসেজ,”এক্ষুনী ছাদে আসো।”
আমি রাজের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আসি এখন।”
“আল্লাহ্ হাফেজ।”
“আল্লাহ্ হাফেজ।”

যখন ছাদে পৌঁছালাম তখন তুর্য ছাদের দরজা লাগিয়ে দিলো। আমি ঢোক গিলে বললাম,
“দরজা লাগাচ্ছেন কেন? ঐ শোনেন একদম অসভ্যতামি করবেন না বলে দিলাম। নইলে নইলে কিন্তু”
“নইলে কি?”
“ছাদ থেকে লাফ দিবো।”
“তার কোনো দরকার নেই। আমি নিজেই এখন তোমাকে ছাদ থেকে ফেলে দিবো।”

“আম্মা গোওওও! আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল যে এই বেডায় আমারে ছাদে ডাকছেই মেরে ফেলার জন্য। মা মা গোওওও”
“ঐ থামো! আর বেডা? এসব কি ভাষা হ্যাঁ?”
“চুপ! আমি যাবো এখন মরে আর আপনি আছেন ভুল ধরা নিয়ে। মা গো মাআআআ”
তুর্য হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে বললো,

“মুখটা বন্ধ করো। কি করছিলে নিচে?”
আমি জোর করে ওর হাত সরিয়ে বললাম,
“ইডিয়ট গর্দভ, মাথামোটা একটা ছেলে। মুখে হাত দিয়ে রেখে আবার উত্তরের আশা করেন?”

“বেশি কথা না বলে, বলো কি করছিলে?”
“নাচছিলাম। আপনার কোনো সমস্যা?”
“হ্যাঁ সমস্যা। রাজের সাথে কেন কথা বলছিলে? ওকে চিনো তুমি?”
“না।”
“তাহলে কথা বললে কেন?”

“আপনিই তো বললেন আমি যেন চিনে নেই।”
তুর্য দাঁত কটমট করে বললো,
“ওটা তো আমি রাগে বলেছি।”
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বললাম,
“সেটা আপনার ব্যর্থতা।”

তুর্য সামনে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“এবার স্বার্থকতা বুঝাচ্ছি দাঁড়াও।”
আমি পিছনে যেতে যেতে বললাম,
“মুসু মুসু মা আমার! দেখ তোর গণ্ডার বাবা আমায় মেরে ফেলবে রে!”
তুর্য কিছু না বলে এগিয়ে আসছে

পর্ব ১২

তুর্য এগিয়ে আসতে আসছে একদম ছাদের রেলিংয়ের সাথে লাগিয়ে ধরেছে। রেলিংটা আমার কোমড় অব্দি। মনে হচ্ছিল এখনি পড়ে যাবো। পিছনে তাকিয়েই দিলাম এক চিৎকার। তুর্য সাথে সাথে আমার কোমড় ধরে রেলিংয়ের ওপর বসিয়ে দিলো। এবার আর আমার বাঁচার উপায় নেই। যদিও তুর্য আমার কোমড় ধরে রেখেছিল। কিন্তু এই বজ্জাতটাকে একটুও বিশ্বাস নেই। আমি দু হাত দিয়ে তুর্যর গলা জাপটে ধরি।
“প্লিজ প্লিজ ফেলে দিয়েন না। আমি চাইনা আপনি বিধবা হন”
“কিহ্?”
“না মানে বলছিলাম মুসু মা হারা হবে।”

“সারাক্ষণ মুখে শুধু আজেবাজে কথা।”
“আজেবাজে কথা? কোনটা আজেবাজে কথা হুম? আমাকে রেলিংয়ের ওপর উঠিয়েছেন কি নাগিন ডান্স দেখানোর জন্য?”

“না একটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য।”
“শিক্ষার যেমন সময় নেই মাইর খাওয়ারও কোনো বয়স নেই। মাইর যদি খেতে না চান তাহলে এক্ষুনী নামান বলছি।”
তুর্য আমায় একটু নিচের দিকে এলিয়ে দিয়ে বললো,
“আমাকে মাইর দিবা তাই না?”

আমি চোখ বন্ধ করে বললাম,
“এই কথা আমি জীবনে ভাবতেও পারিনা। সত্যি বলছি। ছেড়ে দেন প্লিজ।”
“তুমি খুব চালাক।”
“এ আবার নতুন কি!”
“কি বললে?”

“না বললাম যে, আপনি যা বলেন সবই নতুন।”
তুর্য আমার কথা শুনে একটু হাসলো। এরপর সোজা করে বসিয়ে বললো,
“তোমাকে এখানে কেন বসিয়েছি জানো?”

আমি মনে মনে বললাম,
“ওরে গণ্ডার রে! ফাঁসি দেওয়ার আগে আসামিকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তোমাকে দঁড়ি কেন পড়াচ্ছি জানো!”
মনের কথা মনে রেখেই বললাম,
“কি করে জানবো আমি?”

“উমম! না জানারই কথা। আর অপরিচিত কোনো ছেলের সাথে কথা বলবে?”
“একদম না। জীবনেও না। মরে গেলেও না।”
“হইছে থামো।”
“এবার নামান না প্লিজ।”
“যদি কথার কোনো নড়চড় হয়েছে তাহলে সত্যি বলছি ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো।”

“আম্মুউউউউ! এটা জামাই নাকি জল্লাদ।”
“তোমার জম।”
তুর্য আমায় নামিয়ে দিতেই আমি বললাম,
“একশবার অপরিচিত ছেলেদের সাথে কথা বলবো, দুইশোবার বলবো, তিনশো বার বলবো, হাজার বার বলবো। আপনার কি!”, বলেই দিলাম দৌড়।
দৌঁড়ে আর যাবো কই! একদম পড়লাম মুখ থুবড়ে। ব্যথাও পেয়েছি আল্লাহ্ দিলে সেরকম। তুর্য হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো,
“গঙ্গা ফড়িং এর মত সারাক্ষণ উড়াল, লাফানোর মজা বুঝেছো আমার তিড়িংতিড়িং কুইন?”
“এইইই আপনি আমাকে কি নামে ডাকলেন?”

“তিড়িংতিড়িং কুইন। নামটা তোমার সাথে একদম পার্ফেক্ট।”
আমি একটু কান্নাস্বরে বললাম,
“শুনেছি হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকাও নাকি লাথি মারে। আজ সত্যিই তার প্রমাণ পেলাম।”
“তাই?”
“হুহ্”

“আচ্ছা আমি যাচ্ছি। তুমি চলে এসো।”
“যাচ্ছি মানে কি হ্যাঁ? আমি তো ঠিকমত উঠেই দাঁড়াতে পারছিনা। হেঁটে যাবো কি করে? তাও আবার সিঁড়ি বেয়ে?”
“কেন? তিড়িংতিড়িং করতে করতে।”
তুর্য উঠে চলে যাচ্ছিলো। আমি পেছন থেকে বললাম,

“শুনেন না, আমার কিউট লক্ষী সোনামোনা, তামা, লোহা, দস্তা, টিন, কিউটিপাই বর, জান, কলিজা, গুর্দা, হৃদপিণ্ড পাখি, প্রাণ!”
আমি যে কত নামে ডাকলাম। তবুও মহাশয়ের একটুও দয়ামায়া হলো না আমার ওপর। হবে কি করে? বলেন না হবে কি করে! সে তো একটা গণ্ডার তাইনা! মনটাও একদম গণ্ডারের চামড়ার মত শক্ত। মাআআআ!
অনেক চেষ্টা করেও উঠে দাঁড়াতে পারছি না। বারবার চেষ্টা করার পর অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু পিছন ঘুরে পা আগাতে গেলেই পড়ে যাবো তখন তুর্য ছাদের দরজার আড়াল থেকে দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে কোলে তুলে নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি চমকে যাই। তুর্য মুচকি হেসে বলে,
“কবি বলেছিল, একবার না পারিলে দেখো শতবার! আমার বউটা কিন্তু কম চেষ্টা করেনি!”

“হুহ! বজ্জাত একটা। আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখছিলেন?”
“হুম বউটা।”
“ঢং!”

রুমে নিয়ে গিয়ে তুর্য পায়ে ওষুধ লাগিয়ে দেয়। আমি তুর্যকে দেখি আর ভাবি এই ছেলেটার সবার সামনে ভাব বাড়ে নাকি। তখন তো চিনেই না আর এখন কত্ত ভালোবাসা। সব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে আমি মুসকানের পাশে শুয়ে পড়লাম। তুর্য বাহিরের সব কাজ শেষ করে প্লেটে খাবার নিয়ে আসলো। আমি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছি। তুর্য এসে আমায় ঘুম থেকে তোলে। আমার চোখ তখন সম্পূর্ণ ঘুমের সাগরে ভাসছিল। তুর্য বললো,
“যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।”
“কেন?”
“ডিনার করবে।”
“না আমি খাবো না। ঘুম পেয়েছে।”
“আরে পাগলী রে! বিয়ে বাড়িতে এসেও এত ঘুম।”
তুর্য আমায় ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে মুখ ধুইয়ে দেয়। চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দেওয়ার পরও আমি ঘুমে ঢুলছিলাম। অনেক জোর করে তুর্য আমায় খাইয়ে দেয়। ঘুমের ঘোরে বুঝতেই পারিনি তুর্য আমায় খাইয়ে দিচ্ছে। নাহলে এই মুহুর্তটা দ্বিতীয়বারের মত চোখভরে দেখতাম। খাওয়া শেষে আমি তুর্যর জায়গায় ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি শোয়ার পরও যথেষ্ট জায়গা ছিল সেখানে। আমাকে না সরিয়ে তুর্যও আমার পাশে শুয়ে পড়ে। আমার চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
“পরী একটু বুকে আসবে?”
তার কথা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছালেও ঘুমের কারণে উত্তর দিতে পারছিলাম না। ওভাবেই শুয়ে রইলাম। তুর্য বেশ কয়েকবার কথাটা বলেও যখন কোনো রেসপন্স পেলো না তখন এক হাত কপালের ওপর রেখে চোখ বন্ধ করলো। হুট করে মুসকান হাত নড়াচড়া করে একটা হাত আমার মুখে রাখলো আর তখনই আমার ঘুম হালকা হলো। আমি সজাগ হয়ে মুসকানের বুকে আলতো করে ছুঁয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলাম। পিঠে হাত বুলিয়ে দিলাম। গালে, কপালে এত্তগুলা চুমু খেয়ে কাঁথা বালিশ ঠিক করে দিলাম। হঠাৎই মনে হলো তুর্য আমায় বুকে নেওয়ার কথা কিছু বলেছিল। তুর্যর পাশে ঘুরতেই দেখলাম কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। আমি তুর্যের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তুর্য ভয় পেয়ে যায় তখন। পরমুহূর্তে মুচকি হেসে দিয়ে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আর অন্য হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“এখনো ঘুমাওনি?”
“উমম! ঘুমিয়েছিলাম তো!”
তুর্য আরো কথা বলছিল তখন আমি বললাম,
“চুপ করেন তো এখন। ঘুমান।”

তুর্যকে চুপ করতে বলারও কারণ ছিল। আমি তুর্যকে তখন অনুভব করছিলাম। তুর্যর শার্টের পারফিউমের ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম। তুর্যর বুকে শুয়ে যে শান্তিটা অনুভব করছিলাম সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একসময় দুজনই ঘুমিয়ে পড়লাম।

বিয়ের দিন সকাল থেকেই বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। আমি টুকটাক হেল্প করতে চাইলেও কেউ দেয়নি। তাই মুসকানকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখছিলাম। তুর্যও অন্যান্য সাইড সামলাচ্ছিল। হুট করেই রাজের সাথে দেখা হয়ে গেল। রাজ বললো,
“হেয়!”
আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম তুর্য আছে নাকি। কিন্তু কেউ সেধে কথা বললে এড়িয়ে যাই কিভাবে! তাই মুখে হাসি নিয়ে বললাম,
“হাই।”
“কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। আপনি?”

“আমিও।”
রাজ মুসকানের গাল ধরে বললো,
“বাবুটা অনেক কিউট। নাম কি ওর?”
“মুসকান।”
“অনেক সুন্দর নাম। কি হয় আপনার?”
“আমার মেয়ে।”
“কিহ্? আপনার মেয়ে?”
“হ্যাঁ।”
“এটা আমায় বিশ্বাস করতে হবে?”

“বিশ্বাস না করার কি আছে?”
রাজ হাসতে হাসতে বললো,
“অবশ্য আপনারা মেয়েরা তো আবার বড় ভাই-বোনের বাবুকে নিজের বাবু বলে দাবি করেন।”
“মুসকান সত্যিই আমার মেয়ে।”

রাজ আমার কথা শুনে আরো জোরে জোরে হাসতে শুরু করলো। আর এদিকে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। ঐদিকে দূর থেকে তুর্য মনে হয় রাগে আমায় গিলে খাচ্ছে। গাল ফুলিয়ে রাগ করে সেখান থেকে চলে গেল। এই রাজ তো দেখছি আমার বারোটা বাজিয়ে দিবে।

তখন থেকে তুর্য আবারও ইগনোর করা শুরু করলো। কি যে এক মহামুশকিলে পড়ে গেলাম। আমি বারবার চেষ্টা করছিলাম কথা বলার জন্য কিন্তু প্রতিবারও তুর্য আমার দিকে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে আর আমি চুপসে গিয়েছি। দুপুরের দিকে দেখলাম তুর্য হোয়াইট শার্ট, সাদা প্যান্ট আর ব্লু কোট পড়েছে। বাম হাতে একটা ঘড়ি। আর চিরচেনা সেই পারফিউমের ঘ্রাণ! হায় আল্লাহ্ আমি তো মরেই যাবো! কিন্তু রোমান্টিক ভাবনার মুহুর্তেও ঘটে গেল এক অঘটন! হায় আল্লাহ্

পর্ব ১৩

আমার সামনে ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় রাজ উড়ে এলো। আর আমার বর মহাশয়ও তা দেখে নিলো। রাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
“ইউ আর লুকিং রিয়েলি ফেইরি!”
“থ্যাঙ্কস।”
“ওয়েলকাম। একটা কথা বলবো?”
“জ্বী।”
“তুমি এত সুন্দর কেন?”

আমি রাজের প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। আমি বললাম,
“এটা আবার কেমন প্রশ্ন?”
রাজ কিছু বলার আগেই তুর্য এসে বললো,
“রাজের প্রশ্নের উত্তরটা আমি দেই?”
রাজ বললো,
“আপনি কে?”
“আমি তুর্য। আকাশের ফ্রেন্ড। তুমি?”
“আমি রাজ। আকাশের কাজিন।”
“ওহ আচ্ছা। পরী এত সুন্দর কেন জানো?”

“উহুম।”
“কারণ ও আমার ওয়াইফ।”
“হোয়াট! পরী আপনার ওয়াইফ?”
“হ্যাঁ।”
“মজা করছেন?”
“মজা কেন করবো?”

“তাছাড়া আর কি?”
“বিশ্বাস হচ্ছে না কেন?”
“সেটা জানিনা।”
“ওর নাকে তো নাকফুল আছে। তাও বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“দেখুন মিষ্টার তুর্য, শুধু বিবাহিত মেয়েরাই যে নাকফুল পড়ে বিষয়টা এমন নয়। আজকাল নাকফুল পড়া টা হচ্ছে ফ্যাশন। বিবাহিত মেয়েদের তুলনায় অবিবাহিত মেয়েরাই এখন বেশি নাকফুল পড়ে। তাই একটা ছোট্ট নাকফুল দিয়ে এটা প্রমাণ হয়না যে, পরী বিবাহিত।”
দুজনের কথাবার্তা একদম তুমুল ঝগরা তুলে ফেলছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে এখানেই বাঁধবে এতে কোনো সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু এত সুন্দর একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে বিশ্বযুদ্ধ হবে বিষয়টা কেমন যেন না! আমি দুজনের তর্ক থামিয়ে রাজকে বললাম,
“সত্যিই তুর্য আমার হাজবেন্ড।”
“পরী তুমিও মজা নিচ্ছো?”
“একদমই না। বিশ্বাস না হলে আপনি আকাশ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে নিয়েন।”

রাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
“হুম সেটাই ভালো হবে।”
রাজ চলে যাওয়ার পরই তুর্য আমায় অন্য রুমে নিয়ে গেলো। আমি বাচ্চা বিড়ালের মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। বেশ কয়েকবার চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম চোখ থেকে আগুন ঝড়ছে! আমি বড় বড় ঢোক গিলে বললাম,
“মাঝে মাঝে মুসুর চেয়েও নিজেকে বাচ্চা মনে হয়। এমনভাবে তো ছোট থাকতেও কেউ আমায় শাসন করেনি।”
“বিয়ের আগে কেউ এভাবে শাসন করেনি বলে যে বিয়ের পর আমি শাসন করবো না এটা ভাবলে কি করে?”
“এহ্ আসছে!”

“তুমি ছোট নাকফুল কেন পড়ো?”
“তাহলে কি ডাবগাছের বড় বড় ডাবের মত ভুটকা নাকফুল পড়বো?”
“একটা ছোট উত্তরকে কেমন নাকানিচুবানি খাইয়ে তারপর উত্তর দাও।”

“হুহ্।”
“বড় নাকফুল পড়বে এখন থেকে।”
“আপনিই পড়েন।”
“কিহ্?”
“বললাম যে, আপনিই পড়িয়ে দেইখেন কেমন লাগে।”
“ঘুঘু।”

“এটা তো পাখি।”
“তুমিও তাই।”
“উড়াল দিবো কিন্তু।”
“মেরে ফেলবো একদম।”
“কচু করবেন।”
“পরী ঐদিকে দেখো তো কি!”
আমি সাইডে তাকাতেই তুর্য আমার নাকে কামড় দিয়ে দিলো।
“ও মাগোওওও! এটা কি হলো?”
“আরেকবার দিয়ে দেখাবো?”

“একদম না। শয়তান পাজি একটা নাকে কামড় দিলেন কেন?”
“বেশ করেছি। আসলে কি বলো তো তোমার নাকটা না আমার অনেক ভালো লাগে।”
“যখন ঠান্ডা লাগবে তখন নাকে কামড় দিয়েন তো দেখবো কেমন পারেন।”
“ইয়াক! ফাজিল।”
“হাহাহাহা।”
“আচ্ছা পরী তুমি এত দুষ্টু কেন বলো তো?”

“প্র্যাক্টক্যালি বুঝাই?”
“কিভাবে?”
“বেডরুমে চলেন।”
আমি তুর্যকে বেডরুমে নিয়ে গেলাম। যাওয়ার আগে হাতে একটা গাদা ফুলের মালা নিয়ে নিলাম। দরজা বন্ধ করে বললাম,
“চোখ বন্ধ করেন।”
“কেন?”

“আগে বন্ধ করেন।”
“আচ্ছা।”।
তুর্য চোখ বন্ধ করতেই আমি গাদা ফুলের মালা দিয়ে পেছন থেকে তুর্যের হাত বেঁধে দিলাম। তুর্য বললো,
“কি করছো বলো তো?”
“হুশশশ!”
আমি তুর্যর গলা জড়িয়ে ধরলাম। এক আঙ্গুল দিয়ে তুর্যর গালে হাত বুলাচ্ছিলাম। তুর্য চোখ বন্ধ করেই মুচকি মুচকি হাসছিল।
“জানতে চেয়েছিলাম দুষ্টুমির কারণ আর তুমি রোমান্স শুরু করে দিয়েছো?”
“পিকচার আভি বাকি হেয় মেরি জান।”
আমি তুর্যর কপালে আলতো করে চুমু খেলাম। তারপর তুর্যর গালে জোরে কামড় দিয়ে দিলাম দৌড়। তুর্য তখন চিৎকার করে চেঁচাচ্ছিল আর বলছিল,

“পরীর বাইচ্চা! একবার পাই তোমায়। আমায় বোকা বানানো।”
আমাকে আর পায় কে। তার সীমানার বাহিরে চলে আসছি। এহ্! আসছে আমায় কামড় দিবে। আর আমি ছেড়ে দিবো? এত্ত সোজা? পরীকে হারানো এত সোজা নয় বস!

বিয়ে শেষে আমরাও বাবা-মার সাথে গ্রামে যাই বেড়াতে। গ্রামের এত সুন্দর প্রকৃতি দেখে আমি বরাবরের মতই বিমোহিত হই। যেতে যেতে আমাদের দুপুর হয়ে যায়। ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম সবাই। বিকালের দিকে আমি, তুর্য, মুসকান আর আমার চাচা-শ্বশুরের পাঁচ বছরের নাতি তিয়াসকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। তুর্য অনেকবার বলেছিল গাড়ি নিয়ে যাই কিন্তু আমি বারণ করেছি। গ্রামের এত সুন্দর প্রকৃতি গাড়ি থেকে দেখে কোনো মজা আছে নাকি। যাওয়ার সময় আমি খালি পায়ে বের হতেই তুর্য বললো,
“একি তুমি খালি পায়ে কেন? ময়লা লাগবে তো।”

আমার দেখাদেখি তুর্যও খালি পায়ে বের হয়। তুর্য তিয়াসকে কোলে নিয়েছে আর আমি মুসকানকে। তুর্য হেঁটে হেঁটে আমায় সব দেখাচ্ছে। ওদের জমিজমা, ফসল সব দেখাচ্ছিল। মাঠের পর মাঠ সবুজ সোনালী ফসল, বিশুদ্ধ বাতাস, নদীর পানির কলকলানি সবকিছুই যেন আমায় টানছিল। সেই সাথে রাস্তার ধারে টং দোকানে বসে একসাথে চা খাওয়া। আহ্! কি এক দারুণ মুহুর্ত। হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেকদূর চলে গিয়েছি। বিকাল ঘনিয়ে সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে। এখন আমরা এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে সূর্যর রক্তিম আলো আমাদের গায়ে পড়ছে। মুহুর্তটা হারাতে চাইনা বলে তুর্য বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছে আমাদের। এখন বাড়ি ফেরা প্রয়োজন। কিন্তু এত হেঁটেছি যে এখন আর পায়ে কুলাচ্ছে না। তারমধ্যে একটানা মুসকানকে কোলে নিয়ে আছি। হাতও লেগে আছে। তুর্য আমায় পাশের টং দোকানটায় বসিয়ে বললো,
“এখানে সচারচর কোনো গাড়ি পাওয়া যায় না। তাও আবার এই সময়ে। তুমি তিয়াস আর আর মুসকানকে নিয়ে এখানে বসো। আমি দেখছি কোনো ভ্যান পাই কি না।”
“আচ্ছা।”
তুর্য চলে যাচ্ছিল আবার ফিরে এসে টং দোকানের বয়স্ক চাচাকে বললেন,
“ও চাচা আমার কলিজার টুকরা তিনটাকে এখানে রেখে যাচ্ছি। দেখো কিন্তু।”
“আইচ্ছা বাজান।”

তুর্য চলে গেল। আমি একটু হাসলাম। টং দোকানের চাচার সাথে গ্রাম সম্পর্কে শুনছিলাম। কতশত গল্প গ্রামের। তখন পেছন থেকে একজন বললো,
“যাবেন ম্যাম?”
আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি তুর্য গরুর গাড়িতে বসে আছে। আবার গাড়ির চালকও সে। সম্ভবত গাড়ির সত্যিকারের চালক পিছনে বসে আছে। তুর্য আবারও বললো,
“গরুর গাড়ি ছাড়া আর কিছু পেলাম না। গরুর গাড়িতে চড়ার অনেক মজা। যাবেন ম্যাম লাল টুকটুকে বউ সেজে?”
আমি মুচকি হেসে সুরালো গলায় গান ধরলাম,
“তোমার গরুর গাড়িতে আমি যাবো না! কারোর ঘরের ঘরোনি আমি হবো না,

আরে করবো না তো কোনোদিনই বিয়ে!”
তুর্যও সুরালো গলায় গানে উত্তর দিলো,
“যাবো তোমায় শ্বশুর বাড়ি নিয়ে।”
তিয়াস ততক্ষণে গরুর গাড়িতে বসে পড়েছে। আমাদের গান শুনে কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
“চাচিমনি তুমি কি আবার বিয়ে করবে?”
তিয়াসের কথা শুনে উপস্থিত সকলেই হেসে দিলো।

পর্ব ১৪

গরুর গাড়িতে করেই আমরা বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বাড়ি পৌঁছে আগে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর মুসকানকে কোলে নিলাম। অনেকদিন হলো মুসকানকে ঠিকমত সময় দিতে পারছিনা। মুসকানকে কোলে নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। কিন্তু মুসকানকে দেখে মনে হলো কথা বলতে নারাজ। আমি আদুরে গলায় বললাম,
“মায়ের উপর বুঝি রাগ হয়েছে?”
মুসকান শুধু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমি আবার বললাম,
“এখন থেকে ঠিকমত সময় দিবো সোনা। রাগ করে না আম্মু আমার। আমার কি দোষ বলতো? তোর ঐ গণ্ডার বাবা আজকাল আঠার মত লেগে থাকে।”

তুর্য যে পাশে বসে ফোন টিপছিল আমার সেটা একদম খেয়াল ছিল না। কিন্তু মুসকান আমার কথাটা শুনে হেসে দিলো। কি বুঝে হাসলো কে জানে! পাশ থেকে তুর্য ধমক দিয়ে বললো,
“ঐ তুমি গণ্ডার কাকে বললা?”
আমি থতমত খেয়ে বললাম,
“কই কাউকে বলিনি তো!”
“আমি স্পষ্ট শুনেছি। তুমি আমাকেই বলেছো তাই না?”
“ল্যা!”

“হোয়াটস ল্যা?”
“আপনার কেন মনে হলো যে আপনাকে বলেছি?”
“মুসুর বাবা তো আমি নাকি!”
“হ্যাঁ তো?”
“তো! এই একদম কনফিউজড করবানা বলে দিলাম।”
“সরেন তো মুসুর সাথে কথা বলতে দেন।”

“মুসুর মত আমায়ও একটু আদর করো।”
“কিহ্?”
“তোমার মাথা।”
আমি মুসকানকে বুকের সাথে লাগিয়ে কোলে নিয়েছিলাম। তুর্য আমার পায়ের ওপর বালিশ দিয়ে মাথা রাখলো।
“কি করছেন টা কি?”
“তুমি সবসময় মুসুকে কেন বেশি ভালোবাসো বলো তো?”
আমি ম্লান হেসে বললাম,
“আপনি তো মুসুর জন্যই আমায় বিয়ে করেছিলেন।”
আমার কথা শুনে তুর্যর হাসি মুখের হাসিটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। তুর্য শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,
“পরী আসলে”
আমি তুর্যকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
“থাক না পুরনো কথাগুলো।”

তুর্য আর কিছু বললো না। আমি মুসকানকে কোলে নিয়ে রুমের ভেতর হাঁটছিলাম। কিছুক্ষণ পর মা পায়েশ নিয়ে এসে বললো,
“দেখো তো পরী কেমন হয়েছে?”
তুর্য হুট করে মাঝখানে এসে বললো,
“কেন? পরী কেন দেখবে? আমি বুঝি কিছুইনা!”
“হ্যাঁ তুই এখন কিছুইনা। সর।”
“মা”

“লাভ নাই। আগে পরী খাবে।”
আমি তুর্যকে জ্বালানোর জন্য বললাম,
“মা আমাকে একটু খাইয়ে দেন তো।”
মাও আমায় খাইয়ে দিচ্ছিলো। তখন তুর্য বললো,
“ইশ! কি আদিক্ষেতা। এত বড় মেয়েকে নাকি খাইয়ে দিতে হয়।”
মা মুচকি হেসে বললো,

“তুই যে এত হিংসুটে সেটা তো জানতাম না তুর্য।”
“এখানে হিংসুটের কি হলো মা? তুমি পরীকে বেশি ভালোবাসো আর পরী মুসুকে ভালোবাসে। আমাকে কেউ ভালোবাসে না।”
তুর্যর এমন কাণ্ড দেখে আর হাসি থামাতে পারলাম না। এত হিংসুটে এই গণ্ডারটা জানতাম না তো!

রাতের খাবার খেয়ে মুসকানকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। ঘুম আসছিল না বিধায় ব্যালকোনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুর্যও ব্যালকোনিতে গিয়ে বললো,
“ঘুমাবে না?”
“ঘুম আসছেনা।”

“মাথায় হাত বুলিয়ে দিবো?”
আমি তুর্যর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
“নাহ্। লাগবে না।”
“একটা কথা তোমায় খুব বলতে ইচ্ছে করে।”
“বলছেন না কেন?”
“কিভাবে বলবো সেটাই বুঝতে পারছিনা।”

“দোটানায় আছেন?”
“না। তবে বলার প্রসঙ্গটা খুঁজে পাচ্ছি না।”
“বলেই ফেলুন।”
“থাক অন্য একদিন বলবো।”
“আজ নয় কেন?”
“মনে হচ্ছে সময়টা এখনো আসেনি।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”
“এখন চলো ঘুমাবে।”
“হুম।”
আমি বিছানায় গিয়ে মুসুর সারামুখে ইচ্ছামত চুমু খাচ্ছিলাম। তুর্য বললো,
“ওতো ঘুমাচ্ছে।”
“তাতে কি?”
“শুনেছি ঘুমন্ত বাচ্চাকে চুমু খেলে নাকি বাচ্চার অনেক জিদ হয়।”
“সেটা এমনিতেও হবে। ওর বাবা যেই রাগী!”
“ওর বাবা কিন্তু রোমান্টিকও। রোমান্স করে দেখো।”

“যান। সরেন। লজ্জা নাই।”
“বউয়ের কাছে কিসের লজ্জা?”
“উফফ আল্লাহ্।”
“আদর করি একটু?”
“ধুর! আমি ঘুমালাম।”
কাঁথার ভেতর মুখ গুজে আমি শুয়ে পড়লাম। আর উনি হিহি হেহে করে হেসে চলেছেন।

অথৈ ফোনের স্ক্রিণে তুর্যর হাসি মিশ্রিত ছবিটা দেখছে। দুচোখ অশ্রুতে ভিজে গিয়েছে। অসংখ্যবার ছবিটাতে চুমু খায় অথৈ। বুকে জড়িয়ে নিয়ে হুহু করে কেঁদে ওঠে। অথৈ এর মা অথৈ এর পাশে বসে মাথায় হাত রাখতেই চোখ মুছে নেয় অথৈ। তিনি তখনও মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আমার কাছে চোখের পানি কেন লুকাচ্ছিস মা?”
অথৈ ওর মা জড়িয়ে ধরে আরো জোরে কেঁদে দেয়। ওদের মা-মেয়ের সম্পর্ক একদম বেষ্টফ্রেন্ডের মত। এমন কোনো বিষয় নেই যেটা অথৈ ওর মাকে শেয়ার করেনি। অথৈ কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“সবসময় আমার সাথেই কেন এমন হয় মা? কেন পেয়েও আমি বারবার তুর্যকে হারিয়ে ফেলছি? প্রথমে মায়া আর এখন পরী। আমার ভালোবাসা কি মিথ্যা মা?”
“না মা। তোর ভালোবাসা সত্যি। কিন্তু পরীর সাথে তুর্যর বিয়েটা এত দ্রুত হয়ে গেল যে আমরা কিছু করতেই পারলাম না।”
“আমি তুর্যকে অনেক ভালোবাসি মা।”
“আচ্ছা তুর্য কি পরীকে ভালোবাসে?”
“জানিনা মা। কিন্তু পরী তুর্যকে অনেক ভালোবাসে।”
“দুইটা মানুষ একসাথে এক ছাদের নিচে থাকলে একসময় না একসময় ভালোবাসাটা ঠিকই তৈরি হয়ে যায়। দূর থেকে যতটা ভালোবাসা বোঝানো না যায়, কাছ থেকে তার অনেক বেশি ভালোবাসা বোঝানো যায়। প্রকাশ করা যায়।”
“কি বলতে চাইছো?”

পর্ব ১৫

অথৈ এর মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“সব ভালোবাসা যে পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তুর্য তো জানেও না যে তুই ওকে ভালোবাসিস।”
“জানানোর সুযোগটাই তো পেলাম না মা। দিনদিন এভাবে আমি অধৈর্য হয়ে পড়ছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যেকোনো মূল্যে আমার তুর্যকে চাই’ই।”
“এমন বলে না মা আমার। এখন আর কোনোভাবেই তুর্যকে পাওয়া সম্ভব না। ভুলটা তো তোরই। কেন যে বলিস নাই আগে!”
উত্তরে অথৈ আর কিছু বলেনি। আবারও আগের ন্যায় মায়ের বুকে অঝোরে কাঁদতে থাকে।

২দিন পর আমরা আবার ঢাকায় ব্যাক করি। তুর্য সারাদিন অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর আমি মুসকানকে নিয়ে। মা-মেয়ের সম্পর্ক আরো জমে উঠেছিল। তুর্যর সাথে ভালোবাসাটা এখনো চোখা

রাতে আমি মুসকানকে কোলে নিয়ে সুজি খাওয়াচ্ছিলাম। কিন্তু মেয়ে তো আমার বড্ডজেদী। মুখে দিলেই সুজিগুলো মুখ থেকে ফেলে দিচ্ছে। আমি বকছি আর কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছি। কিন্তু মেয়ে ভয় পাবে কি? খিলখিল করে হাসছে। ওকে বকে আমি নিজেই কনফিউজড যে, আমি কি মুসুকে বকছি নাকি কোনো জোক্স শোনাচ্ছি! ওকে বকতে গিয়ে আমি নিজেই হেসে ফেলি। জোর করে আর খাওয়াইনি সুজি। বিকালে ঝাল ছাড়া সবজি দিয়ে খিচুরী রান্না করেছিলাম মুসুর জন্য। যখন আমার ছোট ভাই হয় তখন মাকে দেখতাম যে এভাবে খিচুরী রান্না করে খাওয়ায়। আমার ভাইটাও অবলীলায় খেয়ে নিতো। তাই আমিও সেই পন্থা অবলম্বন করলাম। অবাক করার বিষয় হচ্ছে এবার মুসু খুব সুন্দর করে খেয়ে নিচ্ছে। ওর কান্ড দেখে একা একাই হাসি। খাওয়ানো শেষে মুখ মুছে কোলের উপর দাঁড় করিয়ে বললাম,
“এখন খুব মজা লেগেছে খেতে তাই না?”

মুসু দুই হাত একসাথে করে হাসছে। আমি আবার বললাম,
“একদম তোর বাবার মত হয়েছিস। আমার মত শান্তশিষ্ট হতে পারিসনি?”
আমার এই কথাটা শুনে খিলখিল করে হাসছে। কথাটা মনে হলো ওর বিশ্বাসই হলো না!
কলিংবেল বাজছে। আমি মুসকানকে কোলে নিয়ে দরজা খুলে দিলাম। তুর্য এসেছে। সাথে একটা মেয়েকেও দেখলাম। তুর্যর সাথে মেয়েটাকে দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি কিছু বলার আগেই তুর্য বললো,
“ভেতরে চলো।”
আমিও আর কিছু না বলে দরজা বন্ধ করে ভেতরে গেলাম। মেয়েটাকে ফ্রেশ হতে বলে আমাকে বেডরুমে নিয়ে গেল। আমি অগ্নিচোখে তাকিয়ে বললাম,

“মেয়েটা কে?”
তুর্য বললো,
“রিলাক্স সুইটহার্ট! মেয়েটার নাম বকুল। বয়স আনুমানিক ১৩/১৪ বছর হবে। কয়দিন ধরেই খেয়াল করেছি অফিসের সামনে ওর বাবার সাথে ফুল বিক্রি করতো। আজ সকালেই ওর বাবা মারা গিয়েছে। মেয়েটার আর কেউ নেইও। অফিসের সামনে বসে কাঁদছিল। তাই সাথে করে নিয়ে এসেছি। মুসুরও একটা খেলার সাথী হবে।”
“সত্যিই কি এসব?”
“তুমি কি আমায় সন্দেহ করছো?”
“সন্দেহ করাটা কি খুব বেশি ভুল?”

তুর্য আমার দুই গালে হাত রেখে বললো,
“গড প্রমিস যা বলেছি সব সত্যি। কিন্তু তুমি যদি চাও তাহলে আমি ওকে কোনো অনাথ আশ্রমে রেখে আসবো।”
“না। আমাদের সাথেই থাকবে।”
“আমি জানতাম তুমি এমনই।”
“কেমন?”
“আমার তুমিটা যেমন।”

উত্তরে আমি মুচকি হাসলাম। তুর্য কপালে চুমু দিয়ে আমার হাতে কয়েকটা প্যাকেট দিলো। মুসকানকে কোলে নিয়ে বললো,
“এখানে তোমার জন্য দুইটা শাড়ি, মুসকানের জন্য জামা-কাপড়, খেলনা আর বকুলের জন্য কয়েক সেট নতুন জামা।”
“আমার জন্য কেন আনতে গেলেন? আমি তো শাড়ি পড়তে জানিনা।”
“এটাই তো আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট।”
“মানে?”
তুর্য চোখ মেরে বললো,
“মানে আমি শাড়ি পড়িয়ে দিতে পারবো। আর সেই সুযোগে একটু আদর করতে পারবো।”
তুর্যর কথা শুনে আমি লজ্জা পেয়ে বললাম,
“ফাজিল একটা!”

“হু তোমারই তো।”
বকুল ফ্রেশ হয়ে রুমে আসলো। আমি ওর দিকে জামা-কাপড়ের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললাম,
“এখান থেকে তোমার যেটা ভালো লাগে পড়ো।”
বকুল কিছু বললো না। শুধু চুপচাপ এক সিট কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আমি তুর্যর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
“ওর মনের অবস্থাটা অনেক খারাপ!”
“এটাই তো স্বাভাবিক পরী। বাবা-মা না থাকার কষ্টটা তো অনেক।”

“সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানেনা। প্রতিটা কদমে কদমে আমি সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছি।”
“শোনো আমার লক্ষী বউ, এখন থেকে একদম নিজেকে একা ভাববে না। আমি আছি তো সবসময় তোমার সাথে।”
আমি হেসে বললাম,
“হুম।”
রাত ১০:৩০ এ সবাই একসাথে খেতে বসেছিলাম। মুসকান তখনো ঘুমায়নি। তুর্য মুসকানকে কোলে নিয়ে খাচ্ছে। কতবার বললাম যে, আমার কাছে দাও। তোমরা খাওয়ার পর আমি খেয়ে নিবো। কোনো কথাই শুনলো না। উত্তরে বললো,”দিনে তো তোমাকে কতই জ্বালায়। রাতে আমায় একটু জ্বালাক।”তাই আমিও আর কিছু বলিনি। তবে তুর্য যে ভালোমত খেতে পারছেনা সেটা আমি ঢের বুঝতে পেরেছি। বারবার টেবিলের খাবার, গ্লাস, প্লেট ধরতে চাচ্ছে মুসকান। ওদের বাপ-মেয়ের কাহিনী দেখে আমি হাসছিলাম। বকুলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম প্লেটে হাত বুলাচ্ছে না খেয়ে। আমি বকুলকে ডেকে বললাম,
“খাচ্ছো না কেন?”
উত্তরে বকুল একবার আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। আমার চেয়ার ছেড়ে আমি বকুলের পাশের চেয়ারটায় বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

“বাবাকে মিস করছো?”
এবার বকুল জমিয়ে রাখা চোখের পানিগুলো ছেড়ে দিলো। ওর কান্না দেখে আমারই বুক কেঁপে উঠছে। মনে পড়ে যাচ্ছে আমার বাবাকে হারানোর সেই দিনটা। আমি বকুলকে আমার বুকে নিয়ে আসলাম। বকুল আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল আর কি কি যেন বলছিল বাবাকে নিয়ে। কিন্তু ওর কান্নার জন্য বোঝা যাচ্ছিলো না। আমিও আটকাইনি। কাঁদুক কিছুক্ষণ। মনটা হালকা হোক। তুর্য চুপচাপ দেখছে। ওর মনটাও বেশ খারাপ বোঝা যাচ্ছে। আমার চোখের পানিও চিকচিক করছে। যেকোনো মুহুর্তে গাল বেয়ে পড়বে। বেশ কিছুক্ষণ পর বকুলের কান্না হালকা হয়। এবার শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বকুলকে সোজা করে বসিয়ে চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে বললাম,

“বাবা-মা হারানোর কষ্টটা ঠিক কত যে গভীর সেটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। যে বা যারা এই পরিস্থিতিতে পড়েছে শুধুই তারা জানে। যার দুনিয়াতে বাবা-মা নেই তার মত অভাগা এই দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টা নেই। তোমাকে এতটুকুই বলবো যে, ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না তোমার। বাবা মারা গিয়েছে মানে কি সে একেবারেই দূরে চলে গিয়েছে? না বকুল। তোমার বাবা তোমার আত্মায়, হৃদয়ে এখনো বেঁচে আছে। তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে সেও ততদিনই তোমার মনের জায়গায় থাকবে। হয়তো চাইলেই তুমি ছুঁতে পারবেনা, কথা বলতে পারবে না কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই হাজারো স্মৃতিগুলো মনে করতে পারবে। তাহলে কেন এই ভেঙ্গে পড়া? নিজেকে অসহায় ভাববে না একদম। এখন তো একদমই না। কারণ তুর্যর হাতে এসে পড়েছো তুমি। আজ থেকে তুর্য তোমার ভাইয়া আর আমি তোমার ভাবী। তোমার সব সমস্যায় আমরা তোমার পাশে আছি। জীবনে এমন কিছু করতে হবে যাতে বাবা দূর থেকে দেখেও সস্তি পায়। তাছাড়া তোমার নাম বকুল! বকুল ফুলের গুণ জানো? বকুল ফুল তাজা থেকে যতটা না সুভাষ ছড়ায়, শুকিয়ে যাওয়ার পর তার দ্বিগুণ সুভাষ ছড়ায়। তোমাকেও ঠিক তেমন হতে হবে।”

আমার কথাগুলো তুর্য আর বকুল দুজনই মনোযোগ সহকারে শুনছিল। বকুলের কান্না এখন একেবারেই থেমে গিয়েছে। শান্ত হয়ে বসে আছে। আর তুর্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের চাহনী শুধু মুগ্ধতা প্রকাশ করছে। আমি ভাত মেখে বকুলের মুখে তুলে দিয়ে বললাম,
“জানো তো বকুল, আমার না বিয়ের আগে থেকেই অনেক শখ ছিল যে আমার একটা ননদ থাকবে। দেখো এখন আল্লাহ্ সেই উইশটা পূরণও করে দিলো। ননদ কেন চাইতাম জানো? যাতে বিয়ের পর ননদ ভাবী মিলে চুল ছিঁড়াছিঁড়ি করে ঝগরা করতে পারি।”
আমার কথা শুনে বকুল আর তুর্য দুজনই হেসে ফেললো। তুর্যতো বিষম খেয়ে ফেলেছে।

লেখা – মুন্নি আক্তার প্রিয়া

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “আমার তুমি (সিজন ২: ১ম খণ্ড) – Notun hot bangla love story” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – আমার তুমি (সিজন ২: শেষ খণ্ড) – Notun hot bangla love story

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *