শিক্ষামূলক গল্প

সংসারে সংশয় – শিক্ষামূলক গল্প

সংসারে সংশয় – শিক্ষামূলক গল্প: সবেমাত্র ষোল বছর বয়স পেরিয়েছে লুনা । তবে সে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। গ্রামের ছেলেমেয়ে দের একটু দেরিতেই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। খুব বেশি দেরি না হলেও ছয় বছর বয়স পার তো হয়েই থাকে । সেখানে শহরের বাচ্চাদের চার, সাড়ে চার বছর বয়সের মধ্যেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন বাবা মা। হয়তোবা তার চেয়েও আগে করিয়ে দেন।

বিকেল বেলা খেলার সাথীদের সাথে লুকোচুরি, কানামাছি খেলছিল লুনা। সেখান থেকেই লুনা কে ধরে আনে লুনার মা আরিফা৷

লুনা চেঁচাচ্ছে আর বলছে,

  • ও মা, খেলতে দাও। কই নিয়ে যাইতেছো আমারে? আমি আরও খেলমু তো। খেলা তো শ্যাষ হয় নাই।

আরিফা চুপচাপ মেয়েকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলেন। বাড়িতে তখন বেজায় হৈ-চৈ আরম্ভ হয়েছে। পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন আসতে শুরু করেছে বাড়িতে। সেই সাত সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া লুনা খেয়ালই করেনি আজ তাদের বাড়িতে অনেক লোকজনের উপস্থিতি ৷ হঠাৎই খেয়াল হয় তার। মা কে জিজ্ঞেস করে ওঠে,

  • ও মা, নানা, নানি, মামা, মামি, শিলু, মুহি সবাই এখানে যে? ওদের সবাইরে ডাকছো ক্যান? দাওয়াত করছো?

লুনা কে বিছানায় বসিয়ে আরিফা বলেন,

  • এখানে চুপচাপ বসে থাক। বেশি কথা বলবি না। আজ তোর বিয়ে।

বিস্ফোরিত নয়নে লুনা তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। যেন মায়ের কোন কথাই তার বোধ্যগম্য হচ্ছে না। আরিফা আবারো বলেন,

  • এজন্যই সবাই আসছে। এখানেই থাক তুই। একটুপর তোর গায়ে হলুদ দিয়ে গোসল করতে হবে। তার আগে একটু খেয়ে নে। সকাল থেকে তো না খেয়ে আছিস। পেটে পিত্তি পড়ে গেল। এখন না খাইলে পরে আর খাওন পাবি না। কইয়া দিলাম আমি৷

লুনা তার কথামালা হারিয়ে ফেলেছে। বিয়ে এবং তার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা নেই তার। যে ধারণা আছে সে অনুযায়ী বিয়ে খুব মজার জিনিস। অনেক আনন্দ হয় বিয়েতে। তবে লুনা বোঝার চেষ্টাও করলো না নিজের বিয়ে আর অন্য কারো বিয়ের পার্থক্যটা। সে খুশি মনে মায়ের কথামত মাথা নাড়িয়ে তার কথায় সম্মতি জানিয়ে চুপচাপ বসে থাকলো।

গায়ে হলুদ লাগিয়ে গোসল শেষে হলুদ কাপড় পড়িয়ে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে লুনা কে বসিয়ে রাখা হল। তাকে ঘিরে আছে মামাতো বোন শিলু, মুহি, পাশের বাড়ির জিন্নাত, চাচাতো বোন হাবিবা আরও বেশ কয়েকজন৷ লুনার মামি জেসমিন লুনাকে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিয়ে চলে যায়। কাজের চাপে গায়ে হলুদের আগে লুনাতে খাওয়ানোর কথা ভুলে যান তিনি।

লুনার পাশে বসে জিন্নাত ফিসফিস করে বলে,

  • লুনা, একটা কথা শোন।
    ভ্রু নাচিয়ে লুনা জিন্নাত কে জিজ্ঞেস করে,
  • কি?
  • তোর বর টা না সিগারেট খায়। সেই রকম টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে।
    খিলখিল করে হাসতে শুরু করে জিন্নাত। এ যেন খুব মজার কথা!

লুনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

  • তুই কেমনে জানলি?
  • আরে কয়দিন আগে কয়েকজন লোক আসছিলো না তগো বাড়িত? ওদের মধ্যে শুকনা করে, বেটে লোকটাই তো রে। আমি দেখছি বাইরে গিয়ে সিগারেট টানতে। তোর মা’ই তো বলছিলো আমার আম্মা কে যে ঐ লোকটার সাথেই তোর বিয়ে হবে। তুই দেখিস নি?

ক্ষণিকের মাঝেই লুনার মুখ শুকিয়ে গেল। আতঙ্কিত গলায় বললো,

  • সেকি! মা তো আমারে সেটা কইলো না।
    ঘনঘন মাথা নাড়লো জিন্নাত। যার অর্থ সে সত্যি বলছে। লুনাও তাকে বিশ্বাস করলো। জিন্নাত মিথ্যা কথা বলবে না৷ লুনার থেকেও সে দুবছরের বড় এবং বিবাহিত। এক বছর বয়সী একটা ছেলে বাচ্চাও আছে তার।

স্মৃতির মানসপটে লুনা লোকটিকে দেখে নিল। কিছুদিন আগে কয়েকজন অপরিচিত লোক এসেছিল তাদের বাড়িতে। লুনার বাবা মা খুব করে আপ্যায়ন করেছিল তাদের। লোকগুলোর সাথে একজন মহিলাও ছিল। অন্য সব মেহমানদের মতো ভেবেই লুনা তাদের সামনে গিয়েছিল, কথাও বলেছে। মহিলাটি লুনাকে পাশে বসিয়ে অনেক অনেক কথাও বলেছিল লুনার সাথে। অনেক কিছু জানতে চেয়েছিল তার থেকে। কে জানতো তারা তাকেই দেখতে এসেছিল। তবে তাদের চেহারা মনে নেই লুনার।

গ্রামের মেয়েরা বুদ্ধিমতী, সরল হয়। তবে লুনা অন্যদের মত নয়। সে একটু বোকাসোকা ধরনের মেয়ে। গ্রামের মেয়েরা খুব কম বয়সেই ভাবী, দাদি দের থেকে অনেক পাঠ পেয়ে যায়। খুব কম বয়সে তাদের বিয়েও হয়, বাচ্চাও হয়। তবে এদিক থেকে লুনা বড্ড অবুঝ।

লুনার মুখে আঁধার নামলো মুহুর্তেই। তৎক্ষনাৎ মা কে দেখে তাকে ডেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো লুনা৷ কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে মা কে জানায়,

  • মা, আমার যার সাথে বিয়ে সে নাকি সিগারেট খায়। আমার সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না। লোকটা আমার সামনে সিগারেট খাইলে আমার কি হবে! আমি তো বমি করে ফেলবো।

লুনার মা আরিফা গর্জে উঠলেন,

  • কে তোকে এসব উল্টা পাল্টা বুঝাইছে?
  • জিন্নাত’ই তো বললো।
    ততক্ষণে জিন্নাত সটকে পড়েছে।
    জিন্নাতর ওপর রেগে গেলেন আরিফা। চোখ বুলিয়ে নিলেন ঘরটাতে। জিন্নাত কে না পেয়ে লুনাকে বললেন,
  • পুরুষ মানুষের কোন খুঁত’ই খুঁত না। একটু আকটু বাজে অভ্যাস সবার থাকেই ওমন। তাছাড়া ওদের কত বড় বাড়ি। আমাদের থেকেও ভাল। আমাদের মত টিনের বাড়ি না। ওদের ইটের বাড়ি। তাও আবার চার বিঘা জমির ওপর। বাড়ির সাথেই ফলের বাগানও আছে। অনেক বড় বাগান। কত গাছ সেখানে! আম, লিচু, কাঁঠাল আরও কত কি! আবাদি জমিও আছে অনেক। ওগুলোতে চাষ করে ছেলে। ওরা তিন ভাই, এক বোন। এটাই বড়। ভাই বোনেরা পড়াশোনা করে, আবার কাজও করে।

লুনা মনে মনে ভাবলো সে বোধহয় ভালোই থাকবে। নিজের একটা আলাদা ঘর হবে। এখানে তো এক ঘরে এক বিছানায় ওরা তিন বোন থাকতো। টিনের তিন রুম বিশিষ্ট বাড়িটার এক ঘরে ওরা তিন বোন, আর এক ঘরে তিন ভাই, অন্যটায় বাবা মা থাকে। শৌচাগার ও নেই একটা। শৌচকর্মের জন্য কখনও পাশের বাড়ি, কখনও বা জঙ্গলে চলে যেতে হয় তাদের। বাবা, মা আর ছয় ভাই বোনের সংসারে সবসময় ভালো মন্দ খাবার পাওয়া যায় না, পোশাক পাওয়া যায় না। বাজারে গিয়ে কখনও কিছু পছন্দ হলেও কিনতে পারা যায় না। এবার হয়তো তার সুখের দিন আসবে। বাবার ওপর থেকে চাপ ও কমবে।

লুনা মনে মনে ভাবলো,

  • লোকটা যখন সিগারেট খাবে তখন সে তার আশেপাশেও থাকবে না। নইলে লুকিয়ে রাখবে সিগারেটের প্যাকেট। তাহলেই তো হল।
    নিজের বুদ্ধিতে খুশি হয়ে দুষ্টু হাসে লুনা। ওকে হাসতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে চলে যান লুনার মা আরিফা।

অনেক ভেবে চিন্তেই সমন্ধ ঠিক করেছেন তারা। ছেলে একটু খাটো। লুনার চেয়েও খাটো। তবে বাকিসব দিক ঠিকঠাক। বিয়ের বাজারে যৌতুক দেওয়াটা যেন বাধ্যবাধকতা হয়ে গেছে। আর এখনকার দিনে বিয়েতে যা খরচ হয়, সেসব দিক ভেবে দেখলে লুনার বাবার ঠিক করা ছেলের সাথে বিয়ে দিলে সবদিক ঠিক থাকবে তাদের । এ কূল ও কূল দু’কূলই রক্ষা পাবে। বরপক্ষ যৌতুক চেয়েছে মাত্র ত্রিশ হাজার। পরিমাণ টা কম হলেও নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে কম নয়। এটাই অনেক। তবুও লুনার বাবা হাফিজ রাজি হয়েছেন।

অবেশেষে সন্ধ্যে নাগাদ ১০০ জনের মত বরপক্ষ হাজির হয় লুনাদের বাড়িতে। পাশের বাড়ির উঠানে বরপক্ষের বসার এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরুষ মানুষরা সেখানেই বসলো। আর মহিলারা লুনাকে যে ঘরে বসানো হয়েছে সেখানেই চলে গেল কনের পোশাক আর অন্যান্য প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে। বরপক্ষের মহিলারাই লুনাকে সাজিয়ে দিল।

বিয়ে পড়ানো এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে বিদায়ের পালা। বিদায় মুহুর্তে লুনা মরাকান্না জুড়ে দিল। বাপ মা আর ভাই বোন গুলোকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। মা কে জড়িয়ে কান্নার মাঝেই ফিসফিস করে বললো,

  • মা গো আমি না খাইয়াই থাকুম। তাও আমারে রাইখা দাও।

লুনার মায়ের চোখ ভিজে আসলো। লুনাকে বুঝিয়ে শুঝিয়ে মুন্নি আর কবিতা কেও লুনার সাথে পাঠানো হল। আরিফা ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলেন যতক্ষণ বরের গাড়িটা দেখা যায়।

এটাই যে জগতের নিয়ম। মেয়েকে লালন পালন করে বড় করে, মায়ের বুক খালি করে তাকে অন্যের বাড়ি যেতে হয়। বাবা মা এর কলিজার টুকরো মেয়েকে বড় করে তাকে পরের বাড়ি পাঠাতে হয় উপঢৌকন সাথে দিয়ে। দুনিয়ার মানুষ বোঝে না বাবা মা তাদের দামি জিনিসটাই পরের ছেলের হাতে তুলে দেয়। তার থেকে দামি আর কি হতে পারে! তবে এই তো সমাজের নিয়ম। বাবা মা মেয়ের বিয়েতে যা খরচ করে ছেলের বিয়েতে তা উসুল করে নেয়। ব্যতিক্রম আর কয়জন!


২য় পর্ব

অন্ধকার দিনের আলো শুষে নিয়ে মাকড়সার জালের মত ঘিরে ধরে এ ধরা কে। সূর্যটা সারাদিন উত্তাপ এবং আলো ছড়ানোর পর দীর্ঘ বিশ্রামে চলে যায়। অন্ধকার আকাশে তখন চাঁদ আর নক্ষত্রারাজির রাজ চলে। রাত যত গভীর হয়, ঝিঁঝি পোকার ডাক তত প্রকট হয়। একসময় তা মিলিয়েও যায়। শুরু হয় পাখির কলরব। রাতের নির্জনতা পাখির কিচিরমিচির শব্দে কেটে যায়। চাঁদ আর নক্ষত্ররাজির বিদায়ের পালা শেষে, সূর্যের দীর্ঘ বিশ্রাম শেষে পুনরায় উঁকি দেয় সে পূর্বাকাশে। পৃথিবী থেকে দূর করে দেয় তমসাকে।

দিন রাতের পালাক্রমে আগমনের মতোই বিয়ের পরেরদিনের সকাল টা লুনার কাছে সত্য। গতকাল রাতটাও যেমন তেমন ভাবে কেটে গেছে তার। মনে হচ্ছিল কোন ঘোরের মধ্যে কিংবা স্বপ্নে ছিল। ঘোরের মধ্যে থেকেই সবার কথা মান্য করে গেছে। কিন্তু সকালবেলা চোখ খুলে নিজেকে অচেনা জায়গায় অপরিচিত সব মুখের সামনে নিজেকে বড় অসহায় মনে হল লুনার। মন বলছে সে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় প্রাণীটি।

আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশীরা এসেছে নতুন বউ দেখতে। যারা গতকাল দেখেছে তারাও দেখতে এসেছে। লুনাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে আছে অনেক মহিলারা। তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লুনার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। কুরবানীর জন্য বাছাই করা পশুর মত লাগছিলো নিজেকে। সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে। আরিফা আসার আগে পইপই করে বলে দিয়েছে কারো সাথে বেয়াদবি, উচ্চবাচ্য না করতে। চুপচাপ থাকতে এবং সবার কথা মেনে চলতে।

লুনার থেকে দু হাত দূরে দাঁড়ানো দুজন কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। দুজনের মধ্যে কমবয়সী তরুণীটি বলছে,

  • চাচি, কাল বউ দেখেন নি?

মধ্যবয়সী মহিলাটি ফিসফিস করে পাশের জনকে বলছে,

  • না, বউয়ের আসল চেহারা দেখতি হইলে বিয়ার পরদিন দেখতি হয় বুঝলি মাইয়া। বিয়ার দিন তো রংচং মাইখা মাইয়ারে সুন্দরী বানায় ৷ এজন্যি কাল দেখতি আসিনি। বউ এর নকল রুপ দেইখা হইবো টা কি?

সে কথা শুনে হেসে উঠলো তরুণীটি। বললো,

  • ঠিকই বলেছেন চাচি। অনেকসময় দেখা যায়, বউ এর চেহারা বিয়ের দিন এক রকম আর বিয়ের পর সাজ তুললে আর এক রকম। বউয়ের বর’ই পরদিন বউকে চিনতে পারে না।

হাসির চোটে মেয়েটির সর্ব শরীর কাঁপতে লাগলো। পুনরায় বললো,

  • আর সাজগোজের মাধ্যমে চেহারা পাল্টানোর ভূমিকাটা পার্লারের লোকজন খুব ভালোভাবেই পালন করে থাকে। আমাদের পলাশ ভাইয়ের বউ কে দেখেননি? বিয়ের দিন কি সাজটাই না দিয়েছিল। পরে শুনেছিলাম গুণে গুণে চার হাজার টাকা খরচ করে পার্লার থেকে সেজে এসেছিল। তাও আবার বাড়ি থেকে পনের কিলোমিটার দূরে গিয়ে। ভাবা যায়?
  • আমি এত বুঝিনা বাপু। কি দরকার এই ধার করা রুপের? ধুইলেই তো শ্যাষ।
  • তবে যাই বলেন চাচি। সজল ভাই এর বউটা দেখতে ভালোই হয়েছে। বাচ্চা বাচ্চা দেখতে কিন্তু!
  • সুমি, রাখ তোর বাচ্চা বাচ্চা। বাচ্চা হইলে বুঝি বিয়া দিতো বাপ মা? কয়দিন পর দ্যাখা যাইবো ক্যামন ট্যাটন। নয়া বউ থাকতি সবাই ভোলাভালাই থাকে। পরে দ্যাখায় আসল রুপখানা। কত দ্যাখলাম জীবনে। এমনি এমনি চুল তো পাকেনি আমার।

” ও মোহনা চাচি, এদিকে আসেন তো
ভিড়ের মাঝে থেকে কারো গলা শোনা গেল। তাই শুনে মধ্যবয়সী মহিলাটি চলে গেলেন সেদিকে।

অনেকক্ষণ পর মুন্নি আর কবিতা কে দেখতে পায় লুনা। ওদের দেখে খুশিতে চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে তার। এতসব অচেনা মানুষের ভিড়ে এ দুটো মানুষই তার চেনা, বড় চেনা, বড় আপনজন। লুনা মুন্নি আর কবিতা কে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে তারা এতক্ষণ কোথায় ছিল? আরও আগে তার কাছ কেন আসেনি। মুন্নি আর কবিতা লুনা কে জানায় তাদেরকে রাতে অন্য একটা বাড়িতে ঘুমানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

মোহনার সাহায্য নিয়ে সজলের চাচাতো বোন মায়া, লুনা আর তার সাথে আসা বোন দুটোকে খেতে দিল। ক্ষুধা তে পেট চোঁ চোঁ করছিল লুনার। তবে বলতে পারে নি সে কথা। এখানে কাকেই বা বলবে সে? আর কেই বা সে খোঁজ নেবে। মায়ের বাড়িতে পান্তাভাত হলেও মা ডেকে ডেকে খাওয়াতো।

এমনিতেই অচেনা জায়গায় অচেনা মানুষের মধ্যে আছে। তার মধ্যে আবার খেতে দিয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন। লুনা খেতে নিয়েও বেশ ইতস্তত করছে। খাবার মুখে তুলতে সংকোচবোধ হচ্ছে । তবুও খিদের চোটে খাবার মুখে তুললো। নাস্তা হিসেবে সেমাই, মুড়ি আর মিষ্টি দেওয়া হয়েছে তাদের তিনজনকে। তবে মানুষ সামনে থাকায় খাবারগুলো গিলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে লুনার। অন্যদিকে মুন্নি, কবিতা সাচ্ছন্দ্যের সাথেই খেয়ে যাচ্ছে।

ওদের তিনজনকে খাবার দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মায়া আর মোহনা। ওদের কি লাগে না লাগে সেজন্য। লুনাকে খেতে দেখে মোহনা দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে মায়াকে বলছে,
” দ্যাখছোস মাইয়ার কি আক্কেল! একবার খাওয়ার কথা জিগাইলো ও না। আমি এইহানে গুরুজন মানুষ। এই মাইয়ার দেখি ভদ্রতার কোন বালাই নাই। কোন কাণ্ডজ্ঞান নাই এই মাইয়ার।

রাগে মায়ার মাথার মধ্যে যেন দপদপ করতে লাগলো। তবুও শান্ত স্বরে বললো,
” থাক না চাচি। বাচ্চা মেয়ে কিইবা বয়স তার। এখানে ঠিকভাবে ক’টা মানুষকে চেনে ও? কাউকেই তো চেনে না তেমনভাবে৷ কাকে কি বলবে! আর আমার মনে হয় লোক দেখানো অতিরঞ্জিত ভদ্রতা দেখানোর চেয়ে স্বচ্ছ থাকাই ভালো। ও যেমন তেমনই থাকুক। প্রথমদিনেই উঠে পড়ে লেগেছো কেনো ভুল ধরতে? কয়েকটা মাস চলে যাক। তারপর দেখো ও কেমন৷ তখন না হয় বইলো যা ইচ্ছা। ওর জায়গায় তো তুমিও একদিন ছিলে। ভাবো একবার কেমন লাগে এ সময়।

মায়ার কথা শুনে মোহনা মিইয়ে গেলেন। তবে মানুষের ভুল ধরার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য যাদের তারা কি আর চুপ থাকতে পারে? মোহনা সেখান থেকে চলে গেলেও তক্কে তক্কে থাকলো। এর উত্তর তাকে দিতেই হবে।

মোহনার গমনে হাফ ছাড়লো মায়া। এই মহিলাটি কে তার সহ্য হয় না৷ একেবারে বাচাল মহিলা। সারাক্ষণ মানুষ কি করে তা নিয়ে পড়ে থাকবে আর দোষ ধরবে। এসব মহিলার ঘরে শান্তি থাকে না বলে অন্য মানুষের ঘরে শান্তি আসতে দেয় না। সংসারে এমন মানুষ থাকলে ভাঙন নিশ্চিত।

মায়ার নিজেরও বিয়ে হয়েছে। চার বছরের একটা ছেলেও আছে। সে জানে শশুড়বাড়ি তে কত কথা শুনতে হয়। মায়ার যখন বিয়ে হয়, নতুন সংসারে তাকে অনেক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল, শাশুড়ীর অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছিল। এটা বোধ হয় এক প্রকার নিয়ম হয়ে গেছে নতুন বউ এর দোষ ধরা। তারা বোঝে না যারা বউ হয়ে অন্য পরিবারে যায় তারা একবার বিয়ে, সংসার করে যায় না। এ দুটো শব্দ হলেও তার গভীরতা অনেক। তার সাথে জুড়ে থাকে অনেক অনেক দায়িত্ব।

সংসার নামক শব্দটা বুঝতেই অনেক সময় লেগে যায়। দায়িত্ব কর্তব্য বুঝে নেওয়ার, সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার, মানিয়ে নেওয়ার সময়টুকু অন্তত তাকে দেওয়া উচিত। আগেই তার মাথায় সংসারের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে, প্রতিমুহুর্তে ভুল না ধরে পাশে থেকে সংসার করানো টা শেখানোও তো যায়৷ দায়িত্ব কর্তব্য গুলো বুঝিয়েও তো দেওয়া যায়। কিন্তু কয়টা পরিবারে এমন টা হয়! আফসোস! সত্যিকার অর্থেই নতুন বউয়েরা বড় অসহায় হয়। তারা বুঝে উঠতে পারে না কখন কেমন আচরণ করা উচিত। কখন আবার হীতে বিপরীত হয়ে যায় বোঝার উপায় নেই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে লুনার দিকে এগিয়ে গেল মায়া। লুনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” কিছু লাগবে?
মুচকি হেসে লুনা মাথা নাড়ালো। মায়া মুন্নি, কবিতাকে ও জিজ্ঞেস করলো কিছু লাগবে কিনা। তারা জানালো তাদের কিছুই লাগবে না। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে একটা ঘরে ওদের তিনজনকে রেখে মায়া নিজের কাজে গেল। তিনজন একা থাকায় তারা নিজেদের মত স্বাচ্ছন্দ্যে গল্পগুজব করতে লাগলো।

দরজায় দাঁড়িয়ে, দরজার বাহিরে থেকে, আবার জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েও অনেকে তাকিয়ে দেখছিল ঘরের ভিতরে।
কথা বলার মাঝেই কবিতা কানে কানে লুনা কে বললো,
” আপু, দুলাভাই তোর থেকেও খাটো। তুই আর উঁচু জুতা পড়তে পারবি না রে। হয়তোবা জুতাই পড়তে পারবি না। পাশাপাশি দাঁড়ালে কেমন লাগবে!
কবিতার কথা শুনে লুনা হেসে ফেললো। না চাইতেও হাসির শব্দ হল। বেশ জোরালো সেই শব্দ। ঠিক সেই সময় কোথা থেকে যেন উদয় হল মোহনা চাচীর। তিনি লুনাকে ধমক দিয়ে বললেন,
” বউ মানষের এত হাসা লাগে না। আক্কেল নাই কোনো?


৩য় পর্ব

মোহনার ধমকে আর কটু কথায় লুনার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। এরপর আর টু শব্দ টি করলো না সে। মোহনা মনে মনে খুব শান্তি পেল নতুন বউকে কথা শুনিয়ে। জিতে গেছেন ভাব নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন তিনি । মুন্নির ইচ্ছা হল মহিলাকে কড়া কড়া কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু বোনের শশুড়বাড়ি তে এমন করা যাবে না। তাই আর কিছুই বললো না। মুন্নি আর কবিতা মুখ বেজার করে বসে থাকলো। তবে মোহনা কে কিছু বলতে না পারার ক্ষোভ টা ভিতরে পুষে রাখলো।

মুন্নি বিড়বিড় করে বললো,
” ডাইনী একটা। ওই বুড়ির থেকে দূরে থাকবি বুঝলি?
লুনাও মনে মনে এমনটিই ভাবলো।

উঠোনের একপাশে মাটিতে বড় বড় দুটি গর্ত করা হয়েছে। সেগুলোকে চুলা হিসেবে ব্যবহার করে রান্না করা হবে। বড় বড় পাতিল উঠোনে বের করে রাখা হয়েছে। উঠোনের এক পাশে বড় আমগাছের ছায়ায় বসে কয়েকজন মহিলা পেয়াজ, রসুন, সবজি কাটছে৷ উঠোনে মানুষের অনেক ভিড়। মানুষ আসছে, যাচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা হৈচৈ করছে। রমরমা ভাব একটা!

একজন লোক তদারকি করছেন রান্নার জিনিসপত্রের । সবজি, ডাল সবকিছু হাতের কাছে ধুয়ে, কেটে প্রস্তুত করে দিতে বলছেন। মশলাপাতি বের করে আনতে বলছেন। সম্ভবত লোকটি রাঁধবেন আজকের অনুষ্ঠানের সকল খাবার ৷

লুনা ঘর থেকেই জানালার ফাক ফোঁকর দিয়ে বাইরে দেখতে থাকলো উদাসীন ভাবে। মন টা খারাপ হয়ে গেছে তার। সত্যিই খুব খারাপ লাগছে! মোহনার কথায় তো বটেই। তার সাথে স্বামীর কথা ভেবেও। লোকটাকে গতকাল রাতে সে দেখেছে, কথাও বলেছে৷

কথাবার্তার কি ছিরি! তার মোটেও ভালো লাগেনি তাকে। লোকটা সত্যিই লুনার চেয়েও খাটো। লুনার নিজেই খাটো লাগে। তার চেয়েও খাটো হলে কেমন লাগে! তখন কবিতার কথায় হেসে ফেললেও এখন কষ্ট হচ্ছে। টিভিতে দেখা সিনেমার নায়কগুলো কত সুন্দর। লুনা ভেবেছিল সেও এমন কোন নায়ককেই বিয়ে করবে। কিন্তু কি হল! ভিলেনের মত স্বামী হল তার। বুক ফেটে কান্না আসছে লুনার।

রান্না শেষে খাবারের পাত্রগুলো যথাস্থানে সাজিয়ে রাখা হল ৷ একপাশে বেঞ্চ সাজিয়ে খাবার খাওয়ানোর জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। রং বেরঙের কাপড় দিয়ে জায়গাটা ঘিরে রাখা হয়েছে। যোহরের নামাজের পর খাবার খাওয়ানো শুরু হয়। এ বাড়ির ছেলেরা থালা, বাটি ভর্তি করে খাবার নিয়ে যাচ্ছে। নিজেরাই পরিবেশন করছে। লুনার শশুড় মশাই তদারকি করছেন। সব ঠিক ঠাক হচ্ছে কিনা! খাবার পৌঁছাচ্ছে কিনা!

দু তিনটা কুকুর ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কেউ একজন লাঠি নিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তারপরও আবার আসছে কুকুরগুলো।

দুপুরের কিছু পরে সময়টা ঠিক তিনটার পরে হবে, এমন সময়ে লুনার বাড়ির লেকজন আসে। লুনাকে উঠোনেই বসানো হয়েছিল। সামনে বড় কাঠের টেবিলে পান সুপারি সাজানো। সবাই খেয়ে দেয়ে, বউ দেখে পান সুপারি নিয়ে যাচ্ছে।

বাবা মা আর নিজের আত্মীয়দের দেখে লুনা খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। চেয়ার থেকে উঠে দৌড়ে তাদের কাছে যাওয়ার উপক্রম হতেই কবিতা লুনাকে পাশ থেকে টেনে ধরলো। লুনা বাধা পেয়ে সেদিকে তাকাতেই কবিতা ইশারা করলো দৌড়ে সেদিকে না যেতে।

কবিতা চাপা স্বরে লুনাকে বললো,
” আবার ঔ ডাইনী বুড়ির গাল খাওয়ার শখ জাগছে মনে?
লুনা আহত দৃষ্টিতে কবিতার দিকে তাকালো।

কবিতা আবারো বললো,
” যাস না। সবাই এখানে এমনিতেই আসবে।
লুনার চোখে পানি টলমল করছে। লুনা মন খারাপ করে আবারো চেয়ারে বসে পড়লো।

বেয়াই বেয়াইনের সাথে কথাবার্তার পালা শেষে লুনার বাবা মা লুনার কাছে আসেন। লুনার মামী, চাচীরাও আসেন। লুনার মামী তো বলেই ফেললেন,
” হ্যা রে, তোর শশুড় বাড়ির লোকজন কেমন? আচার আচরণ ভালো?
লুনা কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়লো। মুখ ফুটে কিছুই বললো না। মা কে একলা পেলে হয়! সব বলবে সে৷

বেয়াই বাড়ির লোকজনদের সসম্মানে খেতে বসালেন লুনার শশুড় জয়নাল উদ্দীন৷ বেয়াই এর যত্ন আত্তির দেখে খুশিতে গদগদ লুনার বাবা হাফিজ। হাসিমুখে তিনিও বেয়াই জয়নালের সাথে বাক্যবিনিময় করছেন। দুজনের মুখ নিঃসৃত সকল শব্দ, বাক্যে শ্রদ্ধা, সম্মান, আন্তরিকতা ঝরে পড়ছে যেন!

খাওয়া দাওয়ার শেষ পর্বে এসে ঘটলো এক ঘটনা! শেষবারে যে দশজন খেতে বসেছিল তারা কেউ খাবার পেল না। ভাত, মাছ ভাজা, মাংস সব শেষ। ডিম সিদ্ধ টাও কেটে অর্ধেক করে দিয়েছে। তবুও পৌঁছাতে পারে নি সকলের কাছে। সামান্য সবজি’ই ছিল। সবার প্লেটে সবজি দিয়ে চুপচাপ সবাই। এখন কি করবে! নতুন করে রান্না বসালেও তো অনেক সময়ের প্রয়োজন। এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে। জয়নাল উদ্দীন গেলেন বেয়াই হাফিজের কাছে।

তিনি যথাসম্ভব সাফাই গাইতে লাগলেন নিজ । আয়োজন ঠিক’ই ছিল, তবে দাওয়াতের বাইরে অতিরিক্ত লোকজন আসায় এমনটা হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন তিনি। লুনার বাবা হাফিজ মনে মনে দুঃখ পেলেও জয়নাল উদ্দীন এর অনুশোচনায় হাসিমুখে বললেন,
” আরে ব্যাপার না বিয়াই সাব। বিয়ে, অনুষ্ঠানে এসব হইয়াই থাকে। আমরা কিছু মনে করি নাই ।

জয়নাল উদ্দীন হেসে হেসে বললেন,
” আমি আপনাদের ব্যবহারে খুবই খুশি হইছি। আমাদের দিককার একজন মাংস বেশি নরম হওয়ায় আপনাদের ওখানে যে চিল্লাপাল্লা করলো, আর আপনাদের লেকজন কোন শব্দই করলো না। আমি সত্যিই খুব খুশি হইছি।

তিনি ঘুরে উল্টে একই কথা বলতে থাকলেন। যারা খাবার পেল না তারা উঠে পড়লো। নিজেদের মধ্যে অসন্তোষজনক মন্তব্য করতে থাকলো। ফিসফিসানি তো আছেই। ব্যাপারটা খুবই অপমানজনক লেগেছে। খেতে বসে খাবার না পেয়ে উঠে আসাটা সত্যিই অপমানজনক৷ তবে রিযিকেও তো থাকতে হবে! সেটা কে বোঝে! লুনার শশুড়বাড়ির লোকজনের সম্পর্কে দুর্নাম করতে লাগলো তারা। তবে জোরে আওয়াজ করে কিছুই বললো না। হাফিজ নিজে এসে তাদেরকে বোঝালেন। লুনার শশুড় বাড়ির লোকজনকে এ নিয়ে কিছু যেন না বলে।

শত হোক জামাইবাড়ি বলে কথা। মেয়ের এখানে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে, সংসার করতে হবে। তাই চুপচাপ মেনে নেওয়াই ভাল। তবে এতেও কেউ কেউ থামলো না। লুনার শশুড় কিপটা, ছোটলোক এমন মন্তব্য ও করলো কেউ। তা না হলে খাবার কম পড়বে কেন? ছিঃ ছিঃ। আর তারাই কিনা গতকাল বিয়েতে হাঙ্গামা করে এসেছে। একজন মহিলা তো গরুর মাংস বেশি নরম হওয়ায় যা তা বলেছে। রান্না ভাল হয়নি, মুখে তোলা যায় না। আরও কত কি!

এরপর গন্ডগোল বাঁধলো। শেষে মহিলাটি রাগ করেই চলে গিয়েছিল। অবশ্য এমন ব্যবহারের জন্য তার হয়ে জয়নাল উদ্দীন ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন।

অতঃপর সব ঝামেলা মিটিয়ে রাত আটটার দিকে মেয়ে জামাই নিয়ে বাড়িতে আসলেন আরিফা হাফিজ। লুনা তো নিজ বাড়িতে ফিরে মহাখুশি। তাকে আর পায় কে!

রাতে মা কে একলা পেয়ে লুনা কাঁদোকাঁদো গলায় আরিফাকে মোহনার আচরণের কথা জানালো। এক বর্ণও বাদ দিল না। মুন্নি, কবিতা ও লুনার কথায় সায় দিল।

লুনা জেদ করতে থাকলো ওখানে সে একদমই থাকবে না৷ ফিরবেই না ওখানে আর। ওরা ভাল নয়৷ কি একটু হেসেছে। আর তো কিছু করেনি৷ তারজন্য আক্কেল তুলে কথা বলবে! প্রথমদিনেই এমন ব্যবহার করেছে! বাকি দিনগুলো তো পরেই আছে!

আরিফা রাগত স্বরে বললো,
” মেয়ে মানুষের এত জেদ কিয়ের? মেয়েগো মানাইয়া নিতে হয়। সব ঠিক হয়া যাইবো। তাই বলে কি স্বামীর ঘর ছাড়বি। একি অলক্ষুণে কথা!

আরিফার মেজাজ গরম! তিনি পারছেন না মেয়েকে থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দিতে। বাড়িতে জামাই আছে। তার কানে আবার এসব কথা না যায়। মেয়েকে ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। লুনা মন খারাপ করে চলে গেল।

দুটো দিন লুনার বাবার বাড়িতেই কাটলো। দুটো দিন কাটিয়ে না চাইতেও সজলের সাথে তার বাড়িতে ফিরে গেল। যাওয়ার আগে যদিও বায়না জুড়েছিল না যাওয়ার জন্য, তবে সে বায়না আরিফার কাছে ধোপে টেকেনি। মেয়ে মানুষের জীবনটা ভাসমান শ্যাওলার মতন। পুকুর, ডোবার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ভেসেই বেড়াবে শুধু। স্থায়ী আর হবে না৷ প্রথমে বাপের বাড়ি, তারপর শশুড়বাড়ি, আর তারপর স্বামী বেঁচে না থাকলে ছেলের কাছে তার বাড়িতে।

ছেলের কাছে জায়গা না হলে রাস্তা কিংবা বৃদ্ধাশ্রম হয়ে যায় আবাসস্থল। কোন বাড়িটাকে একটা মেয়ে নিজের বাড়ি বলতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?


৪র্থ পর্ব

লুনা শশুড়বাড়ি ফিরেছে খুব বেশিদিন হয় নি। সংসার টা কে সামলানোর মত দক্ষতা তার এখনো হয়নি। লুনার কাজে কর্মে, আচার আচরণে লুনার শাশুড়ী সেলিনা মনঃক্ষুণ্ন। বউ তার কোন কথাই শোনে না। কোন কাজ দিলে উল্টোটা করে বসে থাকে। নতুবা যে কাজ করতে বলা হবে, সেটাই করবে। তার অতিরিক্ত কোন কাজ নিজ বুদ্ধিতে করবে না। শাশুড়ীর আশায় ফেলে রাখবে। ভেবেছিলেন বউ আসলে তার ওপর সকল দায়িত্ব দিয়ে নিজে হাত গুটিয়ে নিবেন। আরাম, আয়েশে দিন পার করবেন। তবে সেটা আর হল কই!

সকালে উঠে নিজের ঘরদোর গুছিয়ে বাইরে আসতে আসতেই সাড়ে সাতটা বাজায় লুনা। তারপর আঙিনা ঝাড়ু দিতে বললে ঘণ্টা খানেক পার করে ফেলে ঝাড়ু দিতে। বাড়ির সামনে পিছনে যত বড় আঙিনা! ঝাড়ু দেওয়ার মাঝেই কতবার যে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পরে! সে হিসেব লুনা না রাখলেও সেলিনা ঠিকই রাখেন। ছেলের বউ এর এমন ধারা আনাড়িপনায় তার যেন পিত্তি জ্বলে যায়!

নতুন বিয়ের পর প্রায় সব মেয়েকেই বিব্রতকর সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হল রান্নাবান্না করা। নতুন সংসারে, বড় পরিবারে এসে কতটুকু রান্না হবে, কি পরিমাণ লবণ, মরিচ তরকারিতে দিতে হবে তা নিয়ে বড় রকমের সমস্যায় পড়তে হয়। লুনাও তেমন সমস্যায় রোজই পড়ছে। ক’দিন আগে সেলিনা তাকে রান্না করতে দিয়েছিলেন।

লুনা ভাতটা নরম করে ফেলেছিল। আর তরকারিতে যেন এক হাঁটু পরিমাণ পানি! লবনের পরিমাণ টাও বেশি হয়েছিল তরকারিতে। কম হলে দেওয়া যায়, কিন্তু বেশি হলে যে কমানোর উপায় নাই। খাওয়াই গেল না তরকারিটা। শেষে সেলিনা নিজেই রাঁধলেন নতুন করে। এতোগুলো সবজি, তেল মশলা নষ্ট হওয়ায় তার মেজাজ গরম৷ এ বউ দিয়ে তিনি কি করবেন? পুতুলের মত সাজিয়ে রাখার জন্য তো আর ছেলের বউকে ঘরে আনেন নি।

সেলিনা সেদিন যাচ্ছে তাই ব্যবহার করলেন লুনার সাথে। গ্রামের মেয়েরা তো আর কিছু পারুক বা না পারুক, রান্নাবান্না সহ ঘর সংসারের সকল কাজেই দক্ষ হয়। কিন্তু লুনা? সে তো সব কিছুতেই আনাড়ি। দুচোখের বিষ মনে হয় লুনাকে।

লুনাও তার শাশুড়িকে আজকাল সহ্যই করতে পারে না। শাশুড়ীর ওপর তার অঢেল রাগ। তার রাগের আগুনে ঘি হয়ে পড়লো চাচী শাশুড়ী সারিকার বলা কথাগুলো।

সেদিনের ঘটনার একদিন পর সারিকা লুনাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। লুনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন খুব। তিনি জানালেন সেলিনা লুনার সাথে রাগারাগি করে মোটেও ঠিক কাজ করেনি। হয়েছে তরকারিতে একটু লবণ বেশি, তাতে কি? কষ্ট করে সবার জন্য যে রাঁধলো! তার পরিশ্রমের কি কোন দাম নেই? সে কথা ভেবে হলেও লুনা কে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত ছিল। লুনার শাশুড়ী সেলিনা একদম উচিত কাজ করে নি। তিনি পারতেন লুনা কে শিখিয়ে দিতে। তা না করে রাগারাগি করেছেন!

লুনার মনটা গলে গিয়েছিল সারিকার কথা শুনে। সারিকাকে মায়ের মত আপন মনে হচ্ছিল। যে এভাবে তার পক্ষ নিয়ে কথা বললো। তবে লুনা বুঝতে পারছিল না তিনি কিভাবে জানলেন বিষয়টা! লুনার চিন্তিত মুখ দেখে সারিকা খুলে বলেছিল সবটা৷
” জানিস না তো বউ, তোর শওড়ি পুরা এলাকায় ছড়াইছে এইসব৷ এইডা কোন কথা? হইছে একটা ভুল। তার জন্যি সংসদ ভবন বসাইয়া সকলরে কওয়া লাগবো যে আমার ব্যাটার বউ কাম কাজ পারে না, রাঁধবার পারে না।

লুনা সেদিনের পর সেলিনার প্রতি আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।
সারিকা আরও বলেছিল
” প্রথম প্রথম এমনই হইবে৷ লবণ বেশি হইবে, কম হইবে। ঝাল কম বেশি হইবে। সবকিছু কি প্রথ্থমবারেই নিঁখুত হইবো নাকি? বোঝাই যাইচ্ছে তুই আগে সেভাবে রাঁধিস নি। রান্না জানলে সাধে কি আর কেউ খাবার খারাপ বানায়? পরে একদম হাত পাকা হয়ে যাইবে। তুই মিছাই চিন্তা করিস না।

তিনি আরও বোঝালেন লুনাকে,
” শওড়িরে বেশি সুযোগ দিবিনা কথা শোনানোর। মাথায় চড়ে বসবো । তারে তো বুঝতে হবে তুই ঔ সংসারের পরবর্তী গিন্নী। যতোই নিজেরে ভাল রাখতি চাইবি, তার কথা মান্যি করবি, নিজেরে দুর্বল করে দেখাবি ততোই তোর ওপর অত্যাচার চালাবে। শোন মানুষ শক্তের ভক্ত, নরমের জম৷ বুঝলি রে বউ? মাঝে মাঝে ঘুরে দাঁড়ানি দরকার। তারে বুঝাতি হবে তুই নরম নোস৷ নইলে তোর শওড়ি তোরে দাঁতের তলে পিষবো। সংসারের বোঝা তোর উপরে চাপায়া নিজে শরীলে হাওয়া লাগায়ে ঘুরবো।

লুনা তার কথা চুপচাপ গিলছিলো শুধু। আর সারিকার জন্য তৈরি হচ্ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ। লুনার যন্ত্রণায় ভরা মনে মলমের মত কাজ করেছিল সারিকার বলা শেষ কথাটি,
” নিজের পেটের মাইয়ার অনেক অবাধ্যতা, বেয়াদবি হজম করা যায়। কিন্তু ছেলের বউ, সে তো পরের মাইয়া তার দোষ মানা যায় না। ভুল করলে শুধরানির আগে কথাই শুনানি লাগবে আগে। ঔ যে পরের বেটি বলে কথা! উচিত কথা কইতে গেলি মুখে মুখে তর্ক করা হয়া যাব গা। কিরাম শওড়ি রে বাবা। আল্লাহ হিসাব নিব! পরকালের ভয় ডর নাই কোন। আমার ব্যাটার বউরে আমি কত ভালোবাসি। কয়া দেখিস!

সঠিক বুঝ দেওয়ার নাম করে সরল মেয়েটাকে নিজ সংসারের বিরুদ্ধে উসকে দিলেন সারিকা। নিজ শাশুড়ীর শত্রু বানিয়ে দিলেন। মানিয়ে নেওয়ার উপায় না শিখিয়ে ধিকিধিকি করে জ্বলে ওঠা আগুনে ঘি ঢেলে বিস্ফোরণ ঘটানোর আয়োজন করে দিলেন। সমাজের শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষগুলো বুঝি এদেরকেই বলে!

আজকাল লুনার কাছে সারিকার আসা যাওয়া অনেক বেড়েছে। সময় পেলে লুনাও গিয়ে তার কাছে বসে যায়। সংসার সম্পর্কিত ধারণা নেয়।

ছেলের বউ দোষ ক্ষমা করে দেওয়ার বদলে দোষ ধরতে তৎপর সেলিনা যেমন আছে, তেমন লুনাও আছে শাশুড়ীর কথাগুলো গালিগালাজ গুলো মনে পুষে না রেখে তাকে সরাসরি আক্রমণের জন্য। আজকাল লুনা বড়ই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন একবার করে হলেও তর্কাতর্কি লেগেই যায় বউ শাশুড়ীর। ভুল করলে মায়ের থেকে হাজারো বকা শোনা যায়। কিন্তু শাশুড়ির দু একটা কথাই সহ্য করা যায় না!

বছরখানেক পেরিয়েও গেল এভাবেই। সেলিনা অবাক ছেলের বউ এর এমনতর ব্যবহারে। এক বছর পেরিয়েছে কি পেরোয় নি তাতেই এই ব্যবহার। দিনকাল তো পরেই রয়েছে। স্বামী মারা গেলে তার দাপট যে আর থাকবে না তার সেলিনা হাড়ে হাড়ে টের পান। অবশ্য সংসারে জায়গা হবে কিনা তারই কোন নিশ্চয়তা নেই। ছেলেকেও দোষ দিতে পারেন না তিনি। সজলের সাথেও ঝগড়া করে এই মেয়ে। সজলও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

দুজন আগুন হলে কিভাবে হবে! একজন আগুন হলে অন্যজনকে পানি হতে হবে৷ যাতে নিজেদের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠা আগুনকে প্রশমিত করা যায়৷ তবে এক্ষেত্রে লুনা বা সেলিনা কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। কেউ নিজ ভুল স্বীকার করে নেবে না। রাগ করে, তর্ক করে, কান্না করে হলেও জিততেই হবে।

এক বছরে তিন চার বার আরিফা, হাফিজের কাছে বিচার দিয়েছে সেলিনা । কথা বার্তা বলে, ক্ষমা চেয়ে মেয়েটাকে বুঝি দিয়ে গেছে তারা ৷ তবুও লাভ হয় নি কোনো। যেই লাউ সেই কদু ই আছে।

সংসারে অশান্তি সৃষ্টি তে সারিকার ভূমিকা বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। গ্রামের দিকে একটা কথা প্রচলিত আছে জাত যায় না ধুলে, খাসলত যায় না মলে। আসলেই তাই এ ধরনের মানুষের স্বভার পাল্টানোর নয়। আর তারই সাথেই কিনা সখ্যতা সৃষ্টি হয়েছে লুনার!

মাস দুয়েক পরে সজলের ছোট ভাই পলাশ হুট করেই বিয়ে করে বউ নিয়ে আসলো ঘরে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে বেকার ঘুরে বেরিয়েছে। বাংলাদেশে তো যার চাকরি নেই, তার আছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো। সেখানে কিছুদিন চাকরি করে ফিরে আসলো। তারপরই এই ঘটনা। মেয়ের বাড়ি তিন চার গ্রাম পরেই।

বাড়িতে এক হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেল। সেলিনা বড় ছেলের বউ নিয়েই পারেন না, তার ওপর মেজ ছেলেটা কোথা থেকে বউ জুটিয়ে নিয়ে আসলো! চিন্তায় চিন্তায় অক্কা পাওয়ার দশা সেলিনার। জয়নাল উদ্দীন তো ছেলেকে আলাদা করে দিলেন বউসহ৷ একটা ঘর দিয়েছেন শুধু। আর কিছু দেননি। পলাশ খুশিমনে বউ নিয়ে আলাদা হলেও ওর বউ মারুফা মনে মনে খুব ক্ষেপে যায়৷

সেলিনা প্রতিদিনই হৈচৈ করে বাড়ি মাথায় তোলেন৷ তার এক কথা সে এই বউ মেনে নিবেন না। হয় পলাশের বউ এ বাড়িতে থাকবে, নয় সে থাকবে। পাগলের মত আচরণ শুরু করে দিলেন। লুনা বিরক্ত হলেও মুখ বুজে সংসার সামলে যাচ্ছে। পলাশ কেমন বউ নিয়ে আলাদা থাকবে। আর ওর ঘাড়েই এসে পড়েছে বুড়া বুড়ি। আর ছোটটা তো লেখাপড়ার জন্য বাইরেই থাকে। বছরে তিন চার বার কয়েকদিনের জন্য এসে থেকে যায়।

দিন কে দিন সেলিনার আচরণ উগ্র হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাগলের মত আচরণ শুরু করে দেন। একদিন বিকেল বেলা লুনা তখন ঘরে ঘুমাচ্ছিল। সেলিনা একা একাই বিলাপ করছিলেন উঠানে বসে। মেজ বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথা বলছিলেন। বাড়ির পুরুষরা বাড়িতে নেই। হঠাৎ চিৎকারের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে লুনার।
কে যেন বলছে,
” ও মা গো, পেটে ছুরি ঢুকাইছে…………!!


শেষ পর্ব

লুনা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো সেলিনা পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ওনার হাত, পেটের অংশ টা রক্তে ভিজে গেছে। মারুফা সেটা দেখেই চিৎকার করেছে। লুনা চিৎকার করে লোকজন ডাকতে লাগলো। চিৎকার শুনে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন এসে জমা হল। ক্ষেত থেকে ডেকে আনা হল সজল আর জয়নাল উদ্দীন কে। পলাশ ও চলে এল এর মধ্যে। সকলে হতভম্ব। এমন একটা কাজ সজ্ঞানে সেলিনা কিভাবে করলেন সেটাই প্রশ্ন!

কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে তাকে ভ্যানে তুললো। ক্ষতস্থান জোরালো ভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে, যাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ না হয়। অনতিবিলম্বে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটে চললো ভ্যানটি। সাথে গেল সজল, পলাশ আর ওদের বাবা। মহিলাদের কাউকে নিয়ে গেলেন না জয়নাল উদ্দীন। প্রায় পঁচিশ মিনিট পর সবচেয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল সেলিনা কে। পথিমধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন তিনি।

ডাক্তাররা সেলিনার চিকিৎসা করলেন। ছুরিটা বেশি ধারালো না থাকায় এবং মরিচা ধরা থাকায় বেশি গভীরে যায় নি। অভ্যন্তরীণ নরম অঙ্গ প্রতঙ্গের কোন ক্ষতি হয় নি। তবুও তিনটা সেলাই দিতে হয়েছে পেটের কাটা জায়গায়। রক্ত ও দিতে হয়েছে এক ব্যাগ। তবে তার অবস্থা আশঙ্কামুক্ত।

মায়ের এমন খবর শুনে বিপ্লব সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়েছিল। সেও ইতোমধ্যে পৌঁছে যায় হাসপাতালে। সেলিনার একমাত্র মেয়ে সাথি, যার বিয়ে হলো মাত্র মাস সাতেক আগে, সেও তার স্বামীর সাথে হাসপাতালে এসেছে। আসা থেকে কেঁদেই চলেছে। বিলাপ করে কাঁদছে আর দুই ভাবীর নিন্দে করছে। মায়ের এমন অবস্থার জন্য তাদেরকে দায়ী করছে। তার ধারণা তার মা তো এমন ছিল না। নিজেকে আঘাত করার মত মানুষ তিনি নন। নিশ্চয়ই মারুফা’ই হয়তো কুফরী/কালো জাদু করে তাদের মা কে পাগল বানিয়ে দিতে চাচ্ছে। যার কারণে তাদের মায়ের মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আর তিনি পাগলামী করে নিজের পেটেই ছুরি চালিয়ে দিলেন।

বিপ্লব চোখ মুখ শক্ত করে বোনকে আগলে বসে আছে। সাথিকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। তবে সে নিজেও শান্ত থাকতে পারছে না। বড় দুই ভাই এর বউদের কেচ্ছা কাহিনী সে রোজই মায়ের মুখে শুনতো। সংসারের এইসব ঝামেলার কারণে বাড়িতে আসা যাওয়া ও কমিয়ে দিয়েছিল। সে বরাবরই শান্তিপ্রিয় সরল মানুষ। ঝামেলা এড়িয়ে চলা মানুষ। তবে ঝামেলার জল যে এতোদূর ঘড়াবে, তার মা যে এমন ঘটনা ঘটাবে সেটা তো একেবারেই অকল্পনীয়।

দুটো দিন হাসপাতালেই থাকলে হল সেলিনা কে। তার কাছে এ দুটো দিন হাসপাতালে বিপ্লব, সাথিই থেকেছিল। আজ ফিরে যাচ্ছে বাড়িতে। আসার পর থেকে দুই ভাইয়ের সাথে একবারের জন্যও কথা বলেনি সে। জয়নাল উদ্দীন ও যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন। অত্যধিক দাপট ওয়ালা মানুষও প্রিয়জনদের কষ্টে মুষড়ে পড়ে। নিজের মানুষের সাথে কি লড়াই করা যায়? সংসারটা তার ভাঙ্গার পথে। অবশ্য ভাঙ্গার পথে নয়, ভেঙ্গেই পড়েছে বলা যায়৷

সেলিনা কে বাড়িতে আনার পর আত্মীয়স্বজনরা বাড়িতে আসছে তাকে দেখতে। একদম যাচ্ছে, আর একদল আসছে। তাদের খাওয়া দাওয়ার জোগাড় করা, রান্না করা এসব নিয়ে ভালোই ভুগতে হচ্ছে লুনা কে। মারুফা পাশটান দিয়েছে সেই কবেই। আলাদা তো আগেই হয়েছে। শাশুড়ীর এমন অবস্থায় বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে। তাই যত ঝামেলা লুনাকেই পোহাতে হচ্ছে। গত দেড় বছরের সংসার জীবন তাকে অনেকটাই পরিপক্ক করে তুলেছে।

লুনা বিরক্ত হয়ে স্বামীর কানে কথাটা তুলে দিল। বাড়ির বউ তো আর একটাও আছে। সে একা কেন এত কাজ করবে, এত দায়িত্ব নেবে? পারবেনা সে। দরকার হলে সেও বাপের বাড়ি চলে যাবে। বান্দিদাসী হয়ে থাকার জন্য সে এখানে আসে নি। গুষ্টি শুদ্ধ লোকজনের খেয়াল রাখতে গিয়ে সে একা একটা মেয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনরা শাশুড়ী দেখতে এসে দেখে চলে যাবেন তা না। দু একদিন থেকেও যাচ্ছে। এমনি অসুস্থ মানুষকে ঘিরে কাজের শেষ নেই, তারপর এসব আত্মীয়স্বজনের উটকো ঝামেলায় লুনার মেজাজ পুরোই বিগড়ে গেছে। আর সারিকা তো আছেই লুনার মগজ ধোলাই করার জন্য। সে সুনিপুণভাবে লুনাকে পরিবারের বিরুদ্ধে এগিয়ে দিচ্ছে।

সজল বেচারা না পারছে বউ এর কথা রাখতে, আর না পারছে ফেলতে। এমনিতেই সবাই বলতো তার কপালে বউ জুটবে না। শেষ পর্যন্ত যখন একটা জুটেছে, তখন আর তাকে হারিয়ে ফেলা যাবে না। রেগে মেগে যদি একেবারের জন্য বাপের বাড়ি চলে যায়, তখন হবে টা কি? সজল আর ভাবতে পারে না৷

এভাবেই পনের দিন কেটে যায়। সেলিনা একটু সুস্থ হন। বিপ্লব শহরে ফিরে গিয়েছে, আর সাথি গিয়েছে শশুরালয়ে। লুনা সজলকে ফুসলাচ্ছে আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্য। মারুফা আর পলাশের মত তারাও আলাদা থাকবে। আর কিছু মাস পড়েই তাদের প্রথম সন্তান আসতে চলেছে।

এখন লুনার পক্ষে সারাদিন খাটাখাটুনি করা, অসুস্থ শাশুড়ীর সেবা করা সম্ভব না। তাছাড়া অনাগত সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য এখন থেকেই পরিকল্পনা করা উচিত। যদিও লুনা এসব কথা সজলকে বলেছে, কিন্তু এসব কথা লুনার নিজের নয়। সারিকা চাচী এসব কথা লুনার মাথায় সস্নেহে, অতি যত্নে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। লুনারও যথাযথ মনে হয়েছে। তাই সজলকে জানালে সেও রাজি হয়। এক পর্যায়ে মা বাবার সাথে একরকম ঝগড়া বিবাদ করেই আলাদা হয়ে যায়। জয়নাল উদ্দীন তিন ছেলের মধ্যে সম্পদ ভাগ করে দেন।

ফসলী জমি, গৃহপালিত পশু থেকে তাদের অর্থ আসে। সেখান থেকেই বাবা মা নিজেদের খরচ চালাতে পারবে। সজল, পলাশ এ নিয়ে তাই আর মাথা ঘামায় না৷ বাবা মা তাদের মত করেই থাকবে। আর তাছাড়া তাদের আদরের ছোট ছেলে তো আছেই তাদের জন্য।

সম্পদ ভাগাভাগির সময় বিপ্লব বড় ভাইদের সাথে বাবা মা এর খেয়াল না রাখার জন্য তুমুল ঝগড়া করে। আর এটাও জানিয়ে দেও বাবা মা কে নিয়ে সে শহরে যাবে। তার পরীক্ষা শেষ, শুধু রেজাল্টের অপেক্ষা। এরপর একটা চাকরি হয়ে গেলে তো ভালোই। আর না হলে রিকশা ঠেলে বাবা মা কে খাওয়াবে। তবুও বাবা মা কে ফেলবে না, বউয়ের আঁচলের তলায় গুটিয়ে যাবে না। ছোট ভাইয়ের মুখে এসব কথা শুনে দুজনই বেশ চটে গিয়েছিল।

পলাশ তো বলেই বসেছিল,
” বউ আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ওর আঁচলের তলায় থাকা আমার ভাগ্য। বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনিয়ে মুদি দোকান করে দিয়েছে তাকে। তাছাড়া বাপেরবাড়ি থেকে এটা সেটা আনছেই সে। তার কথা শুনবে না তো কার কথা শুনবে?

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বিপ্লবও বলেছিলো সেদিন,
” ঠিকই বলেছো। বউ তোমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস। শশুড়বাড়ি থেকে যৌতুক, উপহার, জিনিসপত্র আনলে তোমাকে তো বউয়ের গোলামি করতেই হবে।
পলাশ বিপ্লবের কথা শুনে তাকে মারতে উদ্যত হয়। সেদিন থেকে ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায়।

বিপ্লব শহরে ফিরে যায় থাকার ব্যবস্থা করতে। সেলিনা আরও ভেঙ্গে পড়লেন। সারাদিন কাঁদেন আর বলেন,
” সোনার সংসারটা আমার ভেঙ্গে গেল।
দু মাসের মাঝে তিনি দ্বিতীয়বার আত্মহননের প্রচেষ্টা করেন। কিন্তু জয়নাল উদ্দীন দেখে ফেলায় তাকে বাধা দেন। এ খবর পেয়ে বিপ্লব বাড়ি ফেরে। সাথে সুখবর নিয়ে আসে। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের রেফারেন্সে একটা নতুন গঠিত এনজিওতে তার চাকরি হয়। বেতন মাত্র বারো হাজার টাকা। বাসা ভাড়া নিয়েছে সে, বাড়ি থেকে টুকটাক জিনিসপত্র নিয়ে যাবে।

দুদিন বাড়িতে থেকে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বাবা মা কে নিয়ে বিপ্লব চলে গেল শহরে। আসার আগে সাথির সাথে দেখা করিয়ে এনেছে। সেলিনা, জয়নাল রাজি না হলেও জোর করেই তাদের নিয়ে আসে বিপ্লব।

সময় চোখের পলকে দ্রুত ছুটে চলে। লুনার ছেলে সন্তান হয়। সবাই সুখেই আছে। সাথিও ভালো আছে স্বামী সংসার নিয়ে। সেলিনা এখন আর বড় দুই ছেলেকে নিয়ে ভাবেন না। তারা ভালোই থাকবে। ভালো থাকার জন্যই তো আলাদা করে নিয়েছে নিজেদের। এসব কথা মনে হলেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সেলিনার। নিজের ব্যর্থতা খুঁজে বেড়ান। বড় ছেলের বউ এর সাথে তার বনিবনা না হওয়ার কারণ খোঁজেন।

মেজ ছেলেকে নিজেদের পছন্দে বিয়ে করাতে চাওয়াটা অন্যায় কিনা সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। বিপ্লব কে একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিতে চান। খুব যাচাই বাছাই করে মেয়ে আনবেন বলে ভাবেন। তবে বিপ্লব রাজি না। বড় দুই ভাবিকে দেখে তার বিয়ের সাধ মিটে গেছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সে ঘটাতে চায় না। সঠিক সময় আসুক। বাবা মা কে আর কষ্ট পাওয়ার সুযোগ সে দেবে না।

দেশের ৭০-৮০% এর অধিক পরিবারগুলো এভাবেই ভেঙ্গে যায় বনিবনা না হওয়ার কারণে। মেনে চলা এবং মানিয়ে চলা দুটো আলাদা বিষয়। পরিস্থিতি সাপেক্ষে দুটোই জরুরি। কিছু সময় নিজেকে দমিয়ে রেখে অন্য মানুষগুলোর সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হয় এবং কিছু সময় মুখ বুঁজে মেনে নিতে হয় শুধুমাত্র সুখ বজায় রাখতে। তবে কখনোই অন্যায় মেনে নেওয়া কিংবা মানিয়ে নেওয়া যাবে না। একটা পরিবারে থাকতে গেলে মতের, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা হয়। সেক্ষেত্রে মানিয়ে নিতে হয়৷

পুত্রবধূর দোষ ত্রুটি অন্যের কাছে তুলে না ধরে তাকেই ধরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। তাকে পরিবারের একজন ভাবতে হবে। তাহলে পরিবারের অন্য সদস্যদের দোষ ক্ষমা করার মত তাকেও ক্ষমা করা যাবে যেটা তাকে পর হিসেবে মানলে সহজ হবে না।

তেমনি বাড়ির বউদের কোন ত্রুটি কিংবা কাজকর্মে কোন হেলাফেলা বা যেকোন সমস্যা হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের সেটা সরাসরি তাকে বলার অনুরোধ জানাতে হবে। ভুল শুধরে দিতে হবে। একসাথে থাকলে গেলে সকলের ভালো মন্দ দেখতে হবে। আন্ডারস্ট্যান্ডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য। সাথে সম্পর্কের মায়াজালে আবদ্ধ প্রতিটি মানুষের প্রচেষ্টাও জরুরি।

একটা সম্পর্ক ভাঙতে সময় লাগে না, কিন্তু গড়তে সময় লাগে। সম্পর্কের প্রতি আস্থাশীল থাকতে হয়। কখনো ক্ষমা চেয়ে, কখনো ক্ষমা করে সংসারে সুখ বজায় রাখতে হয়। কখনো কখনো অনেক পছন্দসই অভ্যাস, চাওয়া ত্যাগ করতে হয়। তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে, নিজের বিবেক কে কাজে না লাগিয়ে তাকে অন্ধ বিশ্বাস করলে লুনার মত সংসার ভাঙনের সূচনা হবেই। বিশ্বাস করা ভালো, তবে অন্ধ বিশ্বাস নয়।

( এখানেই শেষ করছি একটা ভাঙ্গা সংসারের গল্প। জানিনা কোন শিক্ষামূলক কিছু গল্পে আছে কিনা, তবে গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। একটা ভাঙ্গা সংসার খুব সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। সংসার সম্বন্ধে জ্ঞান আমার নেই বললেই চলে। ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন )

সংসারে সংশয়
সাদিয়া আফরোজ মীম

আরো পড়ুন – প্রেমের উপন্যাস

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *