মনের ব্যথার চিঠি

কাছে আসার আকুতি – মনের ব্যথার চিঠি

প্রিয় রবি,

খুব বিষন্ন সময় যাচ্ছে আজকাল। পৃথিবীটা ভালো নেই, ভালো নেই আমিও। তোমার জন্য আমার মন খারাপের তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এক জীবনে এই শোক, এই হাহাকার কাটিয়ে ওঠার নয়। ভাবছি করোনার মহামারী একটু স্বাভাবিক হলেই ছুটে চলে যাবো শিলাইদহে তোমার কুঠিবাড়িতে, তারপর যাবো কোলকাতা জোঁড়াসাকোর ঠাকুরবাড়িতে আর বোলপুরের শান্তিনিকেতনে।

শিলাইদহ তোমার খুব প্রিয় জায়গা ছিলো। শিলাইদহ, পতিসর, কালীগ্রাম, পরগণার প্রাকৃতিক পরিবেশ তোমাকে মুগ্ধ করেছিলো ভীষণ। তাই দিনের পর দিন তুমি এখানে থেকেছিলে, জোঁড়াসাকোর ঠাকুরবাড়ির মায়া ছেড়ে এখানে থাকতে প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হয়েছিলো বটে, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তুমি এখানকার গ্রাম্য পরিবেশ, গ্রামের মানুষদের সহজ সরল জীবনযাপন, টিকে থাকার অদম্য লড়াই, সবকিছুকে ভালোবেসে ফেলেছিলে। আরো ভালোবেসেছিলে পদ্মা নদীকে। দিনের পর দিন তুমি পদ্মার বুকে বজরায় করে ভেসে বেড়িয়েছো, কালজয়ী সব সাহিত্য রচনা করেছো। বজরায় ভাসতে ভাসতে পদ্মা নদীতে স্নান করতে আসা কিংবা জল নিতে আসা মানুষের গল্প শুনেছো মন দিয়ে, তাদের দুঃখবোধ ছুঁয়ে গেছে তোমাকে।

১৮৮৯ সালের ২৫ নভেম্বর, তুমি প্রথম এসেছিলে শিলাইদহের জমিদারি পরিদর্শন করতে। তারপর ভালোবেসে থেকে গেলে এখানে। যদিও কোলকাতায় তোমার নিত্য আসা যাওয়া ছিলো। কিন্তু দীর্ঘদিন এখানে থেকে এসব অঞ্চলের অভাবনীয় উন্নয়ন করেছিলে তুমি। সেই সাথে মিশে গিয়েছিলে এখানকার মানুষদের সাথে। তোমার কুঠিবাড়ির উঠোনে প্রথম যেদিন সব প্রজারা এসেছিলো, ধর্ম জাত ভেদে একেকজনের বসার স্থানে ছিলো ভিন্নতা, সেদিন তুমি সবাইকে নির্দেশ দিয়েছিলে সমস্ত ধর্মের, সমস্ত জাতের মানুষ যেন এক কাতারে একসাথেই বসে, কারো বসার স্থানের ভিন্নতা দিয়ে যেন উঁচু নিচু নির্ধারণ করা না হয়। তারপর থেকে সেখানকার মানুষ এক কাতারে বসে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঁচতে শিখেছিলো!

তুমি দেশে, বিদেশে যেখানেই যেতে, শেষমেশ শিলাইদহেই চলে আসতে। এখানকার মায়া তুমি ছাড়তে পারোনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। শুনেছি, শেষবারের মতো ১৯২২ সালে তুমি শিলাইদহে এসেছিলে। তারপর অভিমান করে আর এখানে পা রাখোনি। তোমাদের জমিদারি যখন ভাগ করে দেওয়া হয়, তখন নাকি শিলাইদহ আর পরগণা পড়ে তোমার মেজ’দার ছেলের ভাগে আর তোমার ভাগে পড়ে পতিসর আর কালীগ্রাম।
এটা তুমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেনে নিতে পারোনি। বছরের পর বছর তোমার হাতে গড়া জমিদারিতে যখন অন্য কেউ ভাগ বসায়, তখন দুঃখ পাওয়াটা স্বাভাবিক। শিলাইদহে না এলেও এখানকার প্রকৃতি আর মানুষ থেকে গেছে তোমার অন্তরে আমৃত্যু। তাইতো মৃত্যুর আগে বলেছিলে, আমার আর শিলাইদহে যাওয়া হলো না! কতোটা যন্ত্রণা নিয়ে তুমি বলেছিলে, তোমার সেই দুঃখবোধটুকু যদি আমি ছুঁয়ে দিতে পারতাম রবি!

তোমার সময়কালে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির রং ছিলো সাদা আর এখন লাল। এটা নিয়ে আমার অভিযোগ আছে। রং বদল করাটা ঠিক হয়নি। যেই রঙে, যেই চোখে এই কুঠিবাড়িটাকে তুমি দেখে গ্যাছো, আমিও সেই রঙেই দেখতে চাই। রং বদলানো মানেতো অনেকটা তোমার অস্তিত্ব খেয়াল খুশি মতো মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টা। এটা কি মেনে নেওয়া যায় বলো! অবশ্য না মেনেই বা উপায় কি। তোমার কুঠিবাড়ির রং কেমন হবে, তার ওপর তো আর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

যাক সে কথা। আচ্ছা রবি, তুমি কি ভীনগ্রহ থেকে দেখতে পাও তোমার হাতে গড়া শিলাইদহ, শান্তিনিকেতন কিংবা তোমার প্রিয় জোঁড়াসাকোর ঠাকুরবাড়ি, যেখানে কেটেছে তোমার জীবনের বর্ণিল সময়? তোমার কি ফের ছুটে আসতে ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করে না আবার শক্ত হাতে জমিদারির দায়িত্ব নিতে, পদ্মায় ঘুরে বেড়াতে, শান্তিনিকেতনে প্রার্থনা সঙ্গীত শুনতে কিংবা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণ দিকের বারান্দায় রূপকথা আঁকতে? পৃথিবীতে কোনো দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে না আমি জানি। কিন্তু যদি একবার অন্তত পুনরাবৃত্তি ঘটানোর সুযোগ থাকতো, আমি তোমার গোটা জীবনের পুনরাবৃত্তি চাইতাম! আমি আমার চর্মচক্ষুতে দেখতাম, তুমি সেই দক্ষিণের বারান্দায় হাঁটছো, শিলাইদহের বিভিন্ন গ্রামে ছুটে বেড়াচ্ছো, বজরায় বসে কবিতা লিখছো, নোবেল পেয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে যাচ্ছো, যাচ্ছো জাপানে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, শান্তিনিকেতনের আম গাছের ছায়ায় বসে গল্প করছো, আরো কত কী! এক জীবনে এরচেয়ে সুখকর চিত্রকল্প আমার জন্য আর কি হতে পারে বলো!

তোমাকে যে কী ভীষণভাবে চাই, এটা যদি তোমাকে বোঝাতে পারতাম রবি! যাই হোক, শিলাইদহ থেকে ঘুরে এসে তোমাকে আবার চিঠি লিখবো রবি। ভালো থেকো প্রণয়েশ্বর……

ইতি
কাদম্বরী দেবী

আরো পড়ুন- কাছে আসার অসমাপ্ত প্রেম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *