অজানা আলোর খোঁজে (১ম খণ্ড) – Valobasar Misty Golpo

অজানা আলোর খোঁজে – Valobasar Misty Golpo: আমি ঘুম থেকে দুঃস্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে খেয়াল করলাম তেজস্বিনী দাঁড়ানো। তাই ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। আমাকে হয়তো ধরে নিয়ে যাবে। কী করব আমি। আমাকে বাঁচান।


পর্ব ১

চার বছর আগে আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমার ভাবীকেও ভাইয়ের সাথে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়। নিজের সামনেই যেন সতীদাহ প্রথাটা দেখেছিলাম। বারবার বুকের ভেতরটা মুচরে গিয়েছিল। এ কি নির্মম পরিহাসের সম্মুখীন হয়েছিলাম। কখনো চিন্তা করেনি এমন একটা বিশ্রি ব্যপারের সাক্ষী হয়ে থাকব আমি।

চার বছর আগে বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় হুট করে ভাইয়ের মৃত্যু হয়। একদিন রাতে ভাইয়া বুক ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে। ডাক্তারের কাছ থেকে যখন বাড়িতে আনা হলো তখন আমার তৃতীয় মা। তৃতীয় মা কথাটা শোনে হয়তো একটু অবাক হতে পারেন।

তবে আমার বাবা মোট তিনটে বিয়ে করেছে। ঐদিন যে ভাইয়ার লাশের সাথে ভাবীকে জ্যান্ত দাফন করা হয় সে ভাইয়ার মা আয়েশা হলো প্রথম স্ত্রী। বিয়ের দুবছর পর উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তাই উনাকে পাগলা গারদে রেখে আসা হয়। শোনেছি তখন ভাইয়ার বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। তখন আমার মা সুরাইয়া বেগম দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে এ বাড়িতে পা রাখে। তারপর আমি জন্ম নিই। আমি আর ভাইয়া মায়ের আদরে বড় হতে থাকি। তবে সে আদরটাও কপালে বেশিদিন জুটেনি। উনি আমার ৫ তম জন্মদিনে আত্নহত্যা করে মারা যায়।

সেদিনের কথা মনে হলে এখনো গা টা শিউরে উঠে। সন্ধ্যায় আমার বার্থ ডে কেক আনা হয়। খুব সুন্দর করে সেজে মায়ের রুমে গিয়ে দেখলাম দরজা আটকানো। অবাক হয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। কোনো সাড়া শব্দ ছিল না। দরজা ভাঙ্গার পর খেয়াল করলাম মায়ের জুলন্ত দেহটা ফ্যানের মধ্যে আটকে আছে। কালো কাপড় দিয়ে মা গলা পেঁচিয়ে আত্নহত্যা করেছে।

মাকে যখন নামানো হয়েছিল মায়ের হাতে কালো টিক চিন্হ দেখে অবাক হয়ে গেছিলাম। গলার নীচের দিকে হলুদ মাখানো ছিল। ঠোঁটে মুখে আঁচড়ের দাগ ছিল। মনে হয়েছিল কোনো হিংস্র পশু মাকে আঘাত করেছে। মায়ের লাশটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে নিলে বাবা আটকে দেয় আমাকে। আমি জোর করে যেতে নিলে আমাকে বাবার কথায় বাবার কর্মচারী গুলো টেনে হিঁচড়ে ঘরে আটকিয়ে রাখে।

তারপর মাকে উঠানে নেওয়া হয়। তখন ঘরের জানালা দিয়ে চাঁদের আধো আধো আলোতে যা দেখলাম তা আর সহ্য করার মতো ছিল না। কচি বয়সে এত হিংস্রতার সাক্ষী হতে হবে বুঝতে পারেনি। ভাইয়াও তখন মামার বাড়িতে বেড়াতে গেছিল। তাই বিষয়টার সাক্ষী শুধু আমিই থাকি। খেয়াল করলাম মাকে আমার বাবা কুপাচ্ছে।

কুপিয়ে গলাটা আলাদা করে এক পাশে রেখে সারা শরীর পানি দিয়ে ধৌত করে হলুদ মাখাচ্ছে। আমি চিৎকার দিতে চেয়েও চিৎকার করতে পারছিলাম না। মনে হয়েছিল কন্ঠনালিতে কথা আটকে গেছে সেই সাথে জিহ্বার জড়তাটাও বেড়ে গিয়েছিল। মনের ভেতরটা যেন পুড়ে ছাড়াখাড় হয়ে যাচ্ছিল। অল্প বয়স ছিল তাই সহ্য করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল।

হলুদ মাখা শেষে মায়ের মাথাবিহীন লাশটা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বলে রাখা ভালো আমি মুসলিম পরিবারের মেয়ে। মুসলিম পরিবারের লাশকে এভাবে সৎকার করা হয় সেটা জানা ছিল না। পুড়ানোর পর সে ছাইটা বাবা সংরক্ষণ করে রাখে এরপর মায়ের মাথাটা আলাদা করে কোথায় যেন নিয়ে যায়।

উল্লেখ্য যে একটা আত্নহত্যার লাশ পুলিশে দেওয়া হলেও আমার বাবা মায়ের ব্যপারটা কাউকে জানতে দেয়নি। আমাদের বাড়িটা এমন জায়গায় ছিল যেখানে লোকালয়ের আভাস কম। যার দরুণ ব্যপারটা লুকাতে বাবার সমস্যা হয়নি। আর নানা বাড়িটা দূরে থাকায় তারা আসার আগেই রাতের আধাঁরেই কাজটা সাড়া হয় এবং তাদের বলা হয় মাকে দাফন করা হয়ে গেছে।

তারাও কোনোরুপ সন্দেহ করতে পারেনি বাবাকে। কারণ বাবার সাথে মায়ের সম্পর্কটা বেশ ভালো ছিল। সেদিনের পর থেকে মানসিকভাবে কিছুদিন ভেঙ্গে পড়েছিলাম। বাবার ভয়ে বিষয়টা কাউকে বলার সাহস পাইনি। তবে বয়স কম ছিল তাই সে হিংস্র ঘটনাটা বেশিদিন মনে টিকেনি।

মায়ের মৃত্যুর পনের দিন পর আমার বাবা তেজস্বীনি নামের এক কুমারী অল্প বয়স্ক মেয়েকে তৃতীয় বিয়ে করে। তখন থেকে তৃতীয় মায়ের কাছে আমি আর আমার বড় ভাই মানুষ হতে থাকি। বেশ ভালোই দিন কাটছিল আমাদের। এর মধ্যে তেমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেনি।

বলতে গেলে তেজনস্বিনী নিজের ছেলে মেয়েদের মতো আমাদের ভালোবাসতো। আর উনার কোনো ছেলে মেয়ে না হওয়ায় আমরায় সব ছিলাম। মায়ের কমতি টা বুঝিনি। ভাইয়ের বয়স যখন আঠার হলো তখন আমার বয়স সবে চৌদ্দতে পড়ে। ভাইয়া সবে মাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে এর মধ্যেই বেশ তাড়াহুড়া করে ভাইয়াকে বিয়ে করানো হয়। ভাইয়ার বিয়ের পাঁচমাস পর এ কাহিনিটা ঘটেছিল।

ঘটনায় আসা যাক ভাইয়াকে মৃত ঘোষণার পর যখন হাসপাতাল থেকে আনা হলো তখন রাত তিনটে বাজে। আমার তৃতীয় মা তেজস্বিনী ভাবীকে বলল,
~ গোসল করে আসো।

আমার ভাবী তখন স্বামীর শোকে পাগলপ্রায়। নিজের স্বামীর মৃত্যু সংবাদটা নিজের পরিবারকেও তখন জানাতে পারেনি। এর আগেই ভাবীর মোবাইলটা হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে আর কি হতে যাবে কেনই বা এসব ঘটনা ঘটছে। এদিকে ভাবী তেজস্বিনীর কথা না শোনে চুপ করে বসে কাঁদতেই থাকল।
তখন উনি ভাবীকে টেনে নিয়ে গোসল করিয়ে সাদা কাফনের কাপড় পড়িয়ে দিল। ভাবী একটা চিৎকার দিয়ে বলল,
~ মা আমাকে কাফনের কাপড় পড়িয়েছেন কেন?

তেজস্বিনী বিকট হেসে বলল,
~ শাদাফের সাথে তোমাকেও যেতে হবে ভালোবাস তো তাকে। ভালোবাসার মানুষের সাথে সবসময় একসাথে থাকতে হয়। এতে ভালোবাসার পূর্ণতা পায়। ( ভাইয়ার নামটায় তো বলা হলো না। আমার ভইয়ের নাম শাদাফ ছিল)।

ভাবী অবাক হয়ে বলল,
~ মানে?
তেজস্বিনী ভ্রুটা কুচঁকে কপালটা উঁচা করে বলল,
~ মানে খুব সোজা শাদাফের সাথে তোমাকেও দাফন করা হবে।

তেজস্বিনীর কথা শোনে আমি ভয়ে আঁৎকে গেলাম। চেনা মুখটা যেন বড্ড অপরিচিত লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি ভুল দেখছি না তো। তেজস্বিনীর মুখোশটা সেদিন প্রথম উন্মোচিত হয়েছিল। যার ফলে সেদিন মায়ের সাথে ঘটে যাওয়া সেই নয় বছর আগের কাহিনি আমার চোখে ভেসে আসলো। কিছু বলতেও পারছিলাম না কারণ আমি বাক প্রতিবন্ধী হয়ে গেছি মনে হচ্ছিল। যাইহোক ভাবী তেজস্বিনীর কথা শোনে আচমকা চেঁচিয়ে বলল,
~ আমি যাব না শাদাফের সাথে। আমাকে জ্যান্ত কবর দিবেন না।

বলেই ভাবী দৌঁড়ে ছুটে গেল। উনাকে বাকিরা জোর করে ধরে নিয়ে আসলো। মুরগী যেমন জবাই করার আগে প্রাণ বাঁচার জন্য ছটফট করতে থাকে ভাবীও তখন এভাবে ছটফট করতেছিল। আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আর চোখ দিয়ে অজোরে জল ফেলছিলাম।

উনাকে সবাই জোর করে ধরে রাখল আর উনি ছুটার জন্য হাত পা ছুড়তে লাগল। তখন ভাবীর মুখে বাবা যেন কী দিল সাথে সাথে উনার মুখ থেকে লালা ঝড়তে লাগল। উনি নিস্তেজ হয়ে গেল। তবে উনি জিবীত ছিল। তার মিনেট দশেক পর উনাকে ভাইয়ের সাথে কবরে নামানো হয়। ভাবী তখন কবর থেকে উঠতে নিলে সবাই ভাবীকে বাশ দিয়ে বুকের দিকে চেপে ধরে শুইয়ে দেয়। ইশ কত কষ্টটাই না পেয়েছিল উনি। আর আমার চোখ দিয়ে তখন শ্রাবণের মেঘ ঝড়ছিল।

করার মতো কিছু ছিল না। কারণ আমার হাত পা নড়ছিল না। অমানবিক ভাবে ভাবী আর ভইয়ের দাফন করা হয়। পরবর্তীতে ভাবীর পরিবারকে জানানো হয় ভাবী নিখোঁজ ভাবীর খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ আমি জানি ভাবীকে কীভাবে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে। এরপর থেকে সে অভিশপ্ত বাড়িতে আমার জীবনটা আটকে যায় আর আমি চুপ হয়ে নীরবে সব সহ্য করতে থাকি। বলতে গেলেও অজানা ভয় যেন সবকিছুতে বাঁধা দিত।
প্রতিবছরেই এ বাড়িতে তেজস্বিনী আর বাবা মৃত্যুর লীলা খেলায় মেতে উঠে। জানি না কেন এমন করে? কী কারণে এমন করে? কী লাভ বা কী ক্ষতি? তবে মনে হয় জীবনটা শেষ হয়ে গেলে হয়তো বেশ ভালো হতো। আত্নহনন বিষয়টাও বেশ কঠিন চাইলেও করা যায় না।

এভাবেই কাটে চার বছর। চার বছর পর আমার আঠারতম জন্মদিনে বাবা আমার দরজা ধাক্কাতে লাগল। আমি দরজা খুলে বাড়ির পরিবেশটা দেখে থমকে গেলাম। বেশ ভয় পেতে লাগলাম। এত থমথমা পরিবেশ কি বলব। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম গোলাপজলের বোতল পড়ে আছে। আগরবাতি জ্বলছে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আজকে হয়তো আমার সাথে খারাপ কিছু হবে। আমি নিজেকে সামলে নিলাম। বাবা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
~ যাও মা গোসল করে এসো। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব।

বাবা কখনো আমার সাথে এত ভালো ব্যাবহার করে না। বাবার এ ব্যাবহারটাও বেশ রহস্যজনক ছিল। তাই নিজেকে শক্ত করে বাবাকে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম
~ ঠিক আছে।

বাবা আমার কথা শোনে চলে গেলেন। আমি সরাসরি গোসলে না ঢুকে বাবার দিকে নজর দিলাম। বাবা তেজস্বিনীর ঘরে যেতেই দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাবা তেজস্বিনীকে আলমিরা থেকে একটা কাফনের কাপড় বের করে বলল,
~ তেজু রুকুকে সারা হাত পায়ে হলুদ মেখে এটা পড়িয়ে দিও।

(ওহ তোমাদের তো আমার পরিচয় দেওয়া হলো না আমি রুকাইয়া। সবাই নামটা ছোট করে রুকু বলে ডাকে। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি মানবিক বিভাগে। কলেজে তেমন যাওয়া হয় না। যাওয়া হয় না বলল,ে ভুল হবে যেতে দেওয়া হয় না। শুধু পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসি)
যাইহোক বাবার কথা শোনেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার সাথে আজকে খারাপ কিছু ঘটবে। হাত পা কাঁপতে লাগল আমার। বুকের পালপিটিশনটাও বেড়ে গেল। মনে হচ্ছিল এ বুঝি আমি হার্ট এটাক করব। নিজেকে বেশ সামলে নিলাম

ঘরে এসে পালানোর কথা ভাবতে লাগলাম। এদিকে হাতে টাকাও নেই কি করব বুঝতে পারছিলাম না। অনেক ভেবে বাবার পকেট থেকে কিছু টাকা চুরি করে নিই। চারদিকে আগরবাতির ঘ্রাণ আর গোলাপজলের ঘ্রাণ নাকে ভেসে এসে যেন মাথাটা ব্যাথা করতেছে। তবুও সাহস করে দরজা বন্ধ করে কিছু কাপড় আর প্রয়োজনীর জিনিসপত্র গুছাতে থাকি। এর মধ্যে দরজায় কেউ একজন খটখট করতে লাগল।

আমি খটখটের আওয়াজ শোনে কেঁপে উঠি। কোনোরকমে গুছানো জিনিস পত্রগুলো খাটের নীচে রেখে দরজা খুলে দেখি তেজস্বিনী হাতে সাদা কাফনের কাপড়টা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঢুক গিলতে গিলতে বললাম
~ মা আপনি?

তেজস্বিনী হালকা হেসে বলল,
~ হ্যাঁ আমি। তোমার জন্য এ শাড়িটা এনেছি। জন্মদিনে পড়ো কেমন।
আমি একটু ভয়ে ভয়ে বললাম
~ সাদা শাড়ি?

তেজস্বিনী মুখের হাসিটা বিস্তৃত করে বলল,
~ হ্যাঁ সাদা শাড়ি। সাদা তো শুভ্রতার লক্ষণ একে পবিত্র রঙ বলা হয়। তাই এনেছি।
তেজস্বিনীর কথা শোনে কথা না বাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সাদা শাড়িটা নিলাম। ভেবেছিলাম এটা কাফনের কাপড়। যাইহোক সাদা শাড়িটা নিয়ে তেজস্বিনীকে বললাম
~ আমি পরে আসতেছি।

তেজস্বিনী আমার কথা শোনে গালের এক কোণে হাসির রেখা টেনে চলে গেল।
আমি দরজাটা লাগিয়ে। কোনোরকমে সাদা শাড়িটা পরে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রগুলো নিয়ে বাড়ির পেছন দিয়ে বের হয়ে গেলাম। নিজেকে ভালো করে উড়না দিয়ে মুড়ে নিয়ে বাসে উঠে গেলাম। অচেনা এক শহরে যাচ্ছি মানুষগুলো বেশ অপরিচিত তবুও যেন একটু আশার আলো দেখতে পারছিলাম।

জানি না গন্তব্য কোথায় আর কোথায় এটার শেষ হবে। শুধু জানি একটা অজানা আলোর খুঁজে বের হয়েছি। যে আলোর আঁধারে কোনো হিংস্র ঘটনা থাকবে। যে আলোর এক চিলতে রশ্নিতে নিজেকে রাঙ্গিয়ে দিতে পারব।

বাসে বসে রুকু নিজের জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটা ডায়রিতে লিখে ডায়রিটা বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস নিল। মনে মনে বেশ অস্বস্থি হতে লাগল তার। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগল। নিঃশ্বাসটা যদি কোনো ফাঁকা জায়গায় নিত তাহলে হয়তো সে নিঃশ্বাসের দু তিনটা প্রতিধ্বনি ভেসে আসত। এর মধ্যে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের পরিমাণটা বাড়িয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। এ মুহুর্তে মনে হলো কেউ একজন তার পাশে এসেছে। আচমকা এমন উপস্থিতি টের পেয়ে পাশে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল..


পর্ব ২

ভাবলো তার বাবার লোক এসেছে। কিন্তু পাশে তাকাতেই দেখল একটা চিপচিপা গড়নের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো খাড়া খাড়া। মুখে এলো মেলো উসকো খুসকো খুচা খুচা দাঁড়ি। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ। উচ্চতা মাঝারি গড়নের। দাঁড়িয়ে থাকা সে ছেলেটির নাম হলো তানভীর। পড়ালেখা শেষ করে এখন ভবঘুরের মতো এদিক ওদিক দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে। বেকার জীবনটা ঘুরাঘুরি করে উপভোগ করছে। বেশ ভ্রমণ পিয়াসী ছেলেটা। তার জীবনের একটা অংশ হলো ঘুরে বেড়ানো। তানভীরকে দেখে রুকু একটু চুপ হয়ে সশব্দ নিঃশ্বাস নিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে পড়ল।

এর মধ্যেই তানভীর হাতটা বাড়িয়ে জানালা লাগাতে নিলে রুকু একটু অস্বস্থি নিয়ে বলল,
~ জানালা আটকাচ্ছেন কেন?
তানভীর ভ্রূটা কুঁচকে চোখগুলো কপালে তুলে বলল,
~ বাইরে থেকে বৃষ্টির ছাঁট আসছে৷ জানালা লাগাব না তো খুলে রাখব?

রুকু কপট রেগে গলাটা ভার করে বলল,
~ বৃষ্টির ছাঁট তো আর আপনার শরীরে আসবে না যেহেতু আমি জানালার পাশে বসেছি সেহেতু ছাঁটটা আমার কাছেই আসবে। আপনি আপনার জায়গায় বসুন।
~ আপনাকে কে বলেছে বৃষ্টির ছাঁট আমার গায়ে আসবে না।

বলেই শার্টের বুকের অংশ এগিয়ে দিয়ে বলল,
~ দেখুন অলরেডি ছাঁটটা চলে এসেছে। শার্টটা পুরো ভিজে যাচ্ছে।
রুকু তানভীরের এমন আচরণে কথার জবাব না দিয়ে চট করে জানালাটা লাগিয়ে দিল। তানভীর মুচকি হেসে বাসের পাশের সিটে বসলো। পাশে বসে কানে ইয়ার ফোন গুজে দিল।

“আমার পরাণও যাহা চায়।
তুমি তাই।
তুমি তাই গো।
আমারও পরাণও যাহা চায়।”
গানটা ইয়ার ফোনে হালকা আওয়াজে বাজতে লাগল আর তানভীর সেটা বাসের সীটে হেলান দিয়ে শোনতে লাগল। তানভীর খুব রবীন্দ্র সংগীত প্রিয়সী। ভ্রমণের মতো সারাদিন কানে ইয়ার ফোন গুজে রবীন্দ্র সংগীত শোনার একটা বদ অভ্যাস তার আছে।

এদিকে রুকুর চোখে শুধু মৃতদেহগুলো ভেসে উঠছে আর ভেতরটা কেঁপে উঠছে। মুখের আদলে ভয়ার্ত একটা ছাপ যেন রুকুকে গ্রাস করছে। এর মধ্যে মোবাইল স্ক্রিনে আবির নামটা ভেসে উঠল। উল্লেখ্য যে রুকু মোবাইলটা ব্যবহার করতো পরিবার থেকে লুকিয়ে। রুকু কলটা দেখে কলটা কেটে দিল। বারবার কল আসতে লাগল আর রুকু কল কাটতে লাগল। ঠিক সে মুহুর্তে তানভীরের নজর গেল রুকুর দিকে। রুকুকে বারবার কল কাটতে দেখে বলে উঠল,
~ কী ব্যপার কল ধরছেন না কেন?

রুকু বিরক্তি নিয়ে গলাটা খেকিয়ে জবাব দিল।
~ সবকিছু কী আপনাকে বলতে হবে?
~ নাহ তা বলতে হবে না তবে বারবার কল কাটছেন তো তাই বললাম।
~ আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই কল কাটছি আপনার কোনো সমস্যা?
~ আমার সমস্যা হতে যাবে কেন?

~ তাহলে চুপ করে বসে থাকুন। এত কথা কেন বলছেন?
এর মধ্যেই রুকুর ফোনে আবার কলটা ভেসে উঠল। রুকু কলটা কেটে দিলে পাশ থেকে তানভীর বলে উঠল,
~ কলটা বারবার না কেটে ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিলেই তো পারেন। তাহলে তো সময় ও বাঁচে আপনার কষ্টও কমে যায়।

তানভীরের কথাটা শোনে রুকুও ভাবতে লাগল যে সত্যিই তো ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিলেই তো হয়। সাথে সাথে মোবাইলটা নিয়ে নম্বরটা ব্ল্যাকলিস্টে দিল। তারপর বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসল। চারদিকে মাতাল হাওয়া বইছে। বৃষ্টির বড় বড় ছাঁটগুলো তখন বাসের কাচের জানালায় আঁচড়ে পড়ছে। এ বৃষ্টিতে ভিজে নিজেকে শীতল করতে খুব ইচ্ছা করছে রুকুর। তবে শীতল করার মতো কোনো উপায় এখন নেই। তাই মাথাটা সিটে ঠেক দিয়ে হালকা চোখটা বুজল।

এর মধ্যেই মোবাইলটা কেঁপে উঠে ভাইবার্ট হয়ে ভো ভো শব্দ করে উঠল। রুকু হালকা কেঁপে উঠে চোখটা খুলে দেখল অন্য একটা নম্বর থেকে কল আসছে। বেশ বিরক্ত নিয়ে কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে বলে উঠল,
~ রুকু আমি আবির আমার কথাটা শোনো। আমার কথাটা শোনে কলটা কাটো। অনেক কথা আছে তোমার সাথে।

কথাটা শোনার পর রুকুর বিরক্তির মাত্রাটা যেন আরও বেড়ে গেল। আস্তে বলতে চেয়েও কন্ঠটা বেশ জোরালো হয়ে গেল। তাই একটু জোরে বলে উঠল,
~ তুমি আমাকে কল দিয়ে আর ডিস্টার্ব করবে না প্লিজ। আমি এসব নিতে পারছি না। অনেক পেইন হচ্ছে আমার।

রুকুর জোর গলা শোনে তানভীর তার কানে থাকা ইয়ার ফোন টা খুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। তানভীরের তাকানোতে রুকু একটু ইতস্তত অনুভব করছিল। ইতস্তত অনুভব করে ফোনটা কেটে বন্ধ করে দিল। তারপর বাসের সিটে পুনরায় হেলান দিয়ে শুয়ে রইল। তানভীর ও আর কোনো কথা বলল, না। পুনরায় ইয়ার ফোন কানে গুজে দিয়ে গান শোনতে লাগল।

রুকু ফোনটা ব্যাগে রেখে চুপটি করে কাঁদতে লাগল। এখন রুকুর বেশ জোরে জোরে হেঁচকি তুলে কাঁদতে মন চাচ্ছে কিন্তু বাসে থাকায় সেটা পারছে না। বাসায় হলে হয়তো দেয়ালে মাথাটা আঁচড়ে দিয়ে কাঁদত। ভেতরে তার কান্নাটা জমে যেন ভ্যাবসা হয়ে বুকের ভেতরের ছাতিটা ফুলে গিয়েছে। নিজের সমস্যাগুলো তার উপর গন্তব্যহীন এক পথে যাওয়াটা তাকে অস্থির করে তুলছে।

তানভীর আঁড়চোখে রুকুকে খেয়াল করে দেখল তার চোখের জল যেন টুপ টুপ করে পড়তেছে। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। মনে হচ্ছে বাইরের বৃষ্টিটা থেমে গিয়ে রুকুর চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ছে। আঁড়চোখে তাকিয়ে থাকতে তানভীরের মাথাটা বেশ ব্যাথা করলেও রুকুর মুখ থেকে দৃষ্টি সরাতে ইচ্ছা করছিল না। কিছুক্ষণ মাথাব্যথা উপেক্ষা করে তাকিয়ে থাকলেও সে তাকানোর স্থায়িত্বটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারল না। কারণ ইতিমধ্যে তানভীরের মাইগ্রেনের ব্যথাটা বাড়তে শুরু করেছে। বাইরের দিকে জানালার কাচঁটা ভেদ করে আকাশটা দেখার চেষ্টা করলো। আকাশের রঙটা এই হলুদ, এই লাল, এই নীল হলেও এখন আকাশের রঙটা ধূসর হয়ে আছে।

মনে হচ্ছে হুরহুরিয়ে আবার বৃষ্টি নামবে। আকাশে মেঘের গর্জন দেখা গেলেও সে মেঘ বৃষ্টি হয়ে নামতে চাচ্ছে না। এর মধ্যে এক কাপ চা খেলে মন্দ হয় না। তবে বাসে যে ভীড় আর রাস্তার যে হাল চা টা খেতে গেলে নির্ঘাত ঝাঁকুনিতে চোখে মুখে ছিটকে পড়বে। তাই চা খাওয়ার ইচ্ছাটা মাটি চাপা দিয়েই ব্যাগ থেকে একটা পেপার বের করে পেপারে মুখ গুজে পড়তে লাগল। বাসের মধ্যে ভ্যাবসা গরমে যেন তানভীর অস্থির প্রায়। কিছুক্ষণ পেপারে মুখ গুজে হুট করে রুকুকে খেয়াল করে দেখল খুব মায়াময় ভাবে ঘুমাচ্ছে।

মুখের আধখানা ঢেকে আছে চুলে। চুলগুলো সরাতে ইচ্ছে করলেও সেটা পারছে না কারণ এতে অনধিকার চর্চা হয়ে যাবে। তাই বেশি কিছু না ভেবে জানালা খুলে দিল। জানালা দিয়ে শীতল বাতাস আসতে লাগল। শীতল বাতাসে রুকুর চুলগুলো উড়তে লাগল। অনেকটা কাশফুলের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছে কালো কুচকুচে চুলগুলো কাশফুলের মতো এদিক ওদিক হেল খাচ্ছে। রুকুর দিক থেকে চোখটা সরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বিকাল পাঁচটা বাজে। সদরঘাট পৌঁছাতে আরও দুই ঘন্টা সময় বাসে বসে থাকতে হবে। জ্যামের কারণে আগের জার্নিটা বেশ বোরিং লাগলেও আজকে তেমনটা লাগছে না৷

চারদিকে রিকশা, বাসের শব্দ, সেই সাথে পথচারীর ব্যস্ত ভীড়। মাঝে মাঝে কেউ বাসের জানালা দিয়ে পানি নিয়ে আসছে। আবার বাসে কেউ হরেক মালের জিনিসপত্র এক দাম এক রেটে বিক্রির স্লোগান তুলছে। এর মধ্যে বাদাম বুট, ঝালমুড়ির মাখা তো আছেই৷
ততক্ষণে তানভীরের মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করতে লাগল চোখটা প্রায় বুজে এলো। কখন যে ঘুমিয়ে গেল টের পেল না। ঘুমটা ভাঙ্গে বাসের হেল্পারের ডাকে। বাসের হেল্পার ডেকে বলল,
~ মামা ভাড়া দিবেন না?

কথাটা তানভীরের কানে আসলেও হালকা বুজে রইল কারণ এখন তাকাতে একদম ইচ্ছা করছে না। তবুও বাসের হেল্পার এমন ভাবে ডাকতে শুরু করল যে না উঠে পারল না। চোখগুলো টেনে টেনে তাকিয়ে ভ্রূটা কুঁচকে বলল,
~ একশ টাকা ভাংতি হবে?
~ হ মামা হবে।
তানভীর কথাটা শোনে পকেট থেকে একশ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
~ আমার আর পাশের জনের ভাড়াটা রাখুন।
এরমধ্যে রুকু উঠে রাগী চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
~ আমার ভাড়া আপনি কেন দিবেন? এ অধিকার আপনাকে তো আমি দেয়নি। আপনি আমার ভাড়া দিতে যাবেন কেন? সাহস তো কম না আপনার।

তানভীর হতচকিয়ে বলল,
~ আপনি ঘুমাচ্ছিলেন তাই ভেবেছিলাম আপনার ভাড়াটা দিয়ে দিই। পরে ঘুম থেকে উঠলে আপনার কাছ থেকে নিয়ে নেব। সত্যি বলতে এত ঘুমের মাঝে উঠাটা যে কতটা বিরক্তিকর সেটা শুধু আমি জানি। তাই এমন ভাবনা থেকে এ কাজটা করা। নেতিবাচক ভাবে নিবেন না দয়াকরে।

রুকু তানভীরের কথা শোনে রেগে আগুন হয়ে পার্স থেকে চকচকা একটা একশত টাকার নোট বের করে বাস হেল্পারটার দিকে এগিয়ে বলল,
~ আমার ভাড়া এখান থেকে রাখুন।

বাসের হেল্পার রুকুর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে নিজের হাতে থাকা টাকা কয়টা দেখে বলল,
~ আপা আপনি ভাংতি দেন। একশত টাকার ভাংতি হবে না।
কথাটা শোনে রুকু ব্যাগটা চেক করে দেখল ভাংতি নেই। তানভীর পাশ থেকে দাঁতটা কেলিয়ে বলল,
~ আমি ভাড়াটা দিয়ে দিই। আপনি বাস থেকে নেমে আমাকে দিয়ে দিবেন। হয়ে গেল। উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি।

রুকু আর কোনো কথা বলল, না। হেল্পার রুকুর দিকে টাকাটা বাড়িয়ে দিতেই সে হেল্পারের থেকে একশ টকা ফেরত নিয়ে ব্যাগে পুরে নিল।
হেল্পারটা তানভীরের একশত টাকা নিয়ে বলল,
~ মামা আপনারা কে কোথায় যাবেন?
তানভীর হালকা হেসে বলল,
~ আমি সদরঘাট যাব।

~ মামা আপনি সদরঘাট যাবেন ঠিক আছে আপা কোথায় যাবে?
তানভীর কপালটা কুঁচকে হেল্পারে দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
~ কে কোথায় যাবে পরে বলছি আগে বলেন আমাকে মামা আর পাশের জনকে আপা কেন বললেন? আপনি জানেন না ছেলে মেয়ে সমান অধিকার। ডাকতে হলে উনাকে আপা ডাকবেন নাহয় আমাকে ভাইয়া। সমতায় এনে ডাকবেন। একজনকে মামা একজনকে আপা এটা আবার কেমন ডাক শোনি?

বাসের হেল্পার জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,
~ সরি ভাইয়া। আপা কোথায় যাবে সেটা বলেন।
তানভীর কথাটা শোনে রুকুর দিকে তাকাতেও দেখল রুকু রাগে গজ গজ করছে। তানভীর নিজের মুখে জমে থাকা থুথুটা ঠুস করে গিলে নিয়ে বলল,
~ আমি সমতার কথা বুঝাতে চেয়েছিলাম। রাগ হয়ে আছেন কেন। কী হয়েছে?
রুকু চেহারাটা স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,
~ নাহ কিছু না। এমনি।

~ তা আপনি কোথায় যাবেন?
এবার বুঝতে পারছে না রুকু কী বলবে। চুপ হয়ে রইল একদম। রুকুর নীরবতা দেখে তানভীর পুনরায় জিজ্ঞেস করল
~ বললেন না তো কোথায় যাবেন। চুপ হয়ে আছেন কেন?
রুকু তানভীরের ডাকে সাড়া দিয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
~ আপনি কোথায় যাবেন?

~ আমি তো সদরঘার যাব।
রুকু হালকা হেসে বলল,
~ আমিও তো ঐখানে যাব।
তানভীর রুকুর কথা শোনে হেল্পারকে জবাব দিল
~ দুজনেই সদরঘাট যাব। এবার ভাড়াটা রাখো।
হেল্পার দুজনের ভাড়া কেটে বাকি টাকা তানভীরকে এগিয়ে দিল। তানভীর টাকাটা নিয়ে মানিব্যাগে ভরতে ভরতে রুকুকে বলল,
~ আপনার নামটা কী জানতে পারি?

রুকু তানভীরের কথার ভ্রুক্ষেপ না করে চোখ বন্ধ করে বাসের সিটে ঠেক দিয়ে শুয়ে পড়ল। তানভীরও পাল্টা প্রশ্ন না করে কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে পুনরায় রবীন্দ্র সংগীত শোনতে লাগল।
এদিকে টানা এক ঘন্টা ব্যস্ত শহরের জ্যাম পেরিয়ে বাসটা সদর ঘাট এসে পৌঁছাল। দুজন সিট থেকে উঠে বাস থেকে নামতে নিতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়ল।

পর্ব ৩

কারণ খেয়াল করলো রাস্তায় হাঁটু পরিমাণ পানি জমেছে। নামবে কি নামবে না বেশ দোটানায় পড়ল। এর মধ্যেই হেল্পার চেঁচিয়ে বলল,
~ মামা নামছেন না কেন? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছেন।

তানভীর আর কোনো কথা না বলে নেমে গেল পেছন পেছন রুকও নামল। পানিটা বেশ ভালোই জমেছে। পানিতে হাঁটতে গেলে ইট কাঁকরে পায়ে বেশ আঘাত লাগছে। জুতা নিয়ে হাঁটতে বেশ ঝামেলায় হচ্ছে। তানভীর কোনো কিছু না ভেবেই জুতা গুলো খুলে হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করল। তবে রুকুর জুতা গুলো খুলতে ইচ্ছা করছে না। মেয়েরা খুব সৌখিন প্রজাতির হয় তাদের মনে রুচিশীলতা আগে কাজ করে তারপর প্রয়োজনীয়তা। মূলত এ কারণের জন্যই রুকু জুতাটা খুলে হাতে নিয়ে হাঁটতে পারছে না।

কিন্তু এদিকে এ পানিতে জুতা নিয়ে হাঁটাও বেশ বিপত্তির কারণ। দিশা না পেয়ে একটা পর্যায়ে জুতাগুলো খুলে হাতে নিয়ে হাঁটতে লাগল। তানভীর রুকুর কান্ড দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। তানভীরের রহস্যময় হাসি দেখে রুকু কর্কশ গলায় বলল,
~ আপনি হাসছেন কেন?

তানভীর মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিল
~ তাহলে কি কাঁদব?
তানভীরের এমন জবাবে রুকুর শরীরটা যেন রাগে গিজগিজ করতে লাগল। তবুও রাগটাকে থামিয়ে নিয়ে বলল,
~ আপনার টাকাটা নেবেন না। ঐ যে সামনে একটা দোকান আছে ঐখানে থেকে কিছু নিয়ে টাকা ভাংতি করে আপনাকে দিয়ে দেবো।

কথাটা শোনে চট করে তানভীর বলে উঠল,
~ টাকা লাগবে না দোকান থেকে দুটো মালভোরো সিগারেট কিনে নেব। প্রতি সিগারেটের দাম পনের টাকা। দুটা সিগারেট নিলে হবে ত্রিশ টাকা। আর বাকি পাঁচ টাকা দিয়ে পাঁচটা চকলেট কিনে নেব। তাহলেই হয়ে যাবে।
রুকু ভ্রুটা কুঁচকে কপালটা ভাজ করে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আপনি সিগারেট খান?

তানভীর হাসি মাখা মুখে জবাব দিল
~ একদম না। সিগারেটের ধোঁয়াও সহ্য করতে পারি না।
রুকু অবাক হয়ে বলল,
~ তাহলে সিগারেট কিনতে চাচ্ছেন কেন?

~ সেটা আমার মামাতো ভাই এর জন্য। কুয়াকাটা যাব তো ঘুরতে আমার মামাত ভাই পটকাও সেখানে গিয়েছে। তাকে সিগারেট দুটো ধরিয়ে দিলে বেশ খুশি হবে।
রুকু মুখটা বাঁকিয়ে জবাব দিল
~ পটকা কারও নাম হয় নাকি?

~ কেন হবে না?
~ নাহ এরকম নাম রাখতে কাউকে শোনি নি তো তাই।
তানভীর থুতুনির নীচে হাত দিয়ে ভাবনার ভাব করে বলল,
~ তা ঠিক বলেছেন। আমার মামাত ভাই এর নাম সাইরিন। তবে তাকে এ নামে কেউ ডাকে না। ছোটবেলা থেকে নাদুসনুদুস হওয়ার কারণে তাকে সবাই পটকা বলেই সম্বোধন করে। আমার কী মনে হয় জানেন?

~ কী মনে হয়?
~ আমার মনে হয় ওর নামটা সাইরিন না রেখে পটকা রাখলেই যথার্থ হতো।
~ কেন?
~ কারণ সারাটা দিন দেখবেন খাওয়ার মধ্যে আছে। মনে হয় খেতে খেতে পেট টা ফুটে যাবে। তবুও বান্দা খাওয়া বন্ধ করবে না।

~ যার যেটাতে ভালো লাগে। এটা নিয়ে আমাদের নাক না গলালেও চলবে।
রুকুর কথা শোনে তানভীরের মনে হলো রুকু হয়তো চাচ্ছে না ওর সাথে বেশি কথা হোক তাই এমন গা ছাড়া জবাব দিয়েছে। তাই কথাটা জমাতে না পেরে চুপ করে হাঁটতে হাঁটতে দোকানের সামনে আসতেই রুকু দোকানদারের কাছ থেকে দুটোর জায়গায় তিনটি সিগারেট নিল। তানভীর একটু অবাক হয়ে রুকুকে বলল,
~ তিনটি কেন নিচ্ছেন দুটো নিতে বলেছি।

রুকু কথার জবাব না দিয়ে তিনটি সিগারেট আর পাঁচটি চকলেট আর একটি দিয়াশলাই নিয়ে দোকানদারকে একশ টাকার নোট দিল। দোকানদার বাকি টাকা ফেরত দিল। রুকু দুটো সিগারেট আর পাঁচটা চকলেট তানভীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
~ এ নিন আপনার দেনা শোধ হয়ে গেল।

তানভীর সিগারেট আর চকলেটটা নিয়ে পকেটে পুরে নিল। এদিকে রুকু দিয়াশলাই এর কাঠিটা জ্বালিয়ে সিগারেটটা ধরানোর চেষ্টা করলো। তানভীর অবাক হয়ে রুকুর দিকে তাকিয়ে রইল। খেয়াল করল রুকুর মুখে সিগারেটটা নিয়ে বারবার জ্বালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। বিষয়টা দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে তারপর রুকুকে বলল,
~ আপনাকে তো দেখে মনে হচ্ছে না আপনি কখনো সিগারেট খেয়েছন।

তানভীরের কথা শোনে রুকুর কপালে কপট রাগের পরিমাণ চক্ষুগোচর হলো। রুকু সিগারেটটা মুখ থেকে সরিয়ে জমে থাকা পানিতে ফেলে দিল। রুকুকে সিগারেটটা পানিতে ফেলে দিতে দেখে তানভীর চেঁচিয়ে বলল,
~ আরে আরে কি করছেন কি পনের টাকার সিগারেটটা ফেলে না দিয়ে আমাকে দিয়ে দিন। পটকাকে দিলে বেশি খুশি হবে।

তানভীরের কথা শোনে রুকুর রাগটা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল। গজগজ করে বলল,
~ আপনাকে কেন দেব? আমার টাকায় কিনেছি আমি ফেলব নাকি রেখে দেবো সেটা আমার ব্যপার। আর আপনাকে কে বলল, আমি এর আগে সিগারেট খাইনি?
তানভীর হালকা হেসে বলল,
~ সিগারেট খেলে এতক্ষণে সিগারেটটা ধরিয়ে টানতে শুরু করতেন। খান না বলেই ধরে টানতে পারছেন না।

রুকু তানভীরের কথার কোনো জবাব দিল না। এদিকে তানভীর ঘঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আট টা বাজে লঞ্চ ছাড়তে আরও ঘন্টাখানেক বাকি। এ সময় এক কাপ চা খেলে মন্দ হয় না। চায়ের দোকানের ছোট পিচ্চিটাকে ডাক দিল
~ এ পিচ্চি এদিকে আস তো একটু।

পিচ্চিটা কপালটা ভাঁজ করে তানভীরের কাছে এসে বলল,
~ পিচ্চি বলছেন কেন? কোন দিক দিয়ে আমাকে পিচ্চি মনে হলো?
তানভীর পিচ্চিটার কথা শোনে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল,
~ ওরে….. পিচ্চিরে পিচ্চি বলব না তো বুড়ো বলব?

পিচ্ছি বুক ফুলিয়ে গর্ব নিয়ে বলল,
~ আমি সুলতান। আমাকে সুলতান বলে ডাকবেন। কিং মাস্টার ও বলতে পারেন।
কথাটা শোনো তানভীর হেসে লুটোপুটো খেয়ে বলল,
~ আইছে আমার কিং মাস্টার। যা এক কাপ চা নিয়া আস তো।
~ আচ্ছা আনতেছি।

বলেই পিচ্চিটা যেতে লাগল। তানভীর পিচ্চিটাকে পেছন ডেকে বলল,
~ শোন চায়ে চিনি বেশি দিস।
~ আচ্ছা।
এর মধ্যে রুকুর দিকে তাকিয়ে দেখল। রুকু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। রুকু হাতটা বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরার চেষ্টা করেছে। প্রশস্ত হাতটা গড়িয়ে গড়িয়ে বৃষ্টি পড়ছে। মনে মনে ভাবতে লাগল রুকুর হাতে নীল কাঁচের চুড়ি থাকলে মন্দ হত না।

কাঁচের চুড়ির মধ্যে বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু কণা জমত, হাতে যেন কাঁচের চুড়ি গুলো অনেক ফুটন্ত নীল পদ্মের মতো লাগত। তানভীরের জীবনে নীল পদ্ম দেখার ভাগ্য একবারেই হয়েছিল তাও আবার পটকার সাথে গিয়েছিল। পটকা আবার এসব খুঁজে বের করাতে ওস্তাদ। তবে পটকাকে তেমন কষ্ট করতে হয়নি।

মিরপুর ~১ বোটানিক্যালে গার্ডেনে নীল পদ্মের দেখা মিলে। সেই একবারের দেখার সুযোগ পেয়েছিল। তারপর সময় সুযোগ করে আর যাওয়া হয়নি। তবে আজকে তার মনে হচ্ছে নীলপদ্মটা চোখের সামনে আবার ফুটন্ত হয়ে ফুঁটে আছে। বেশ ভালোই লাগছে হাতটা দেখতে। হাতটা দেখে ভালোবাসার সাগরে ডুব দিতে মন চাইলে সেটাতে পা বাড়াচ্ছে না তানভীর। কারণ মেয়েদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়াটা তার কাছে বোকামি মনে হয়৷ কিন্তু সে নিজেকে এত বোকা মনে করে না। এর মধ্যে সুলতান চা নিয়ে এসে ডাকতে ডাকতে বলল,
~ ভাইজান আপনার চা।

তানভীর চা টা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে ওয়াক করে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখল সুলতান রুকুর দিকে চা বাড়িয়ে দিয়েছে। রুকু চায়ে একটা চুমুক দিয়েই তানভীরের মতো ওয়াক থু করে কপালটা কুঁচকে বড় বড় করে তাকাল। তানভীর বুঝতে পেরেছিল হয়তো রুকুর চায়েও কোনো গন্ডগোল হয়েছে। এ মুহুর্তে দুজন চেঁচিয়ে উঠাটা তার কাছে একটু বেমানান মনে হচ্ছিল। তাই সে চুপ করে রুকুর মুখের দিকে হা করে রইল রুকু কি বলে শোনার জন্য। রুকু রাগে সুলতানের দিকে তাকিয়ে বলল,~
~কিরে আমি তোকে বলেছিলাম চায়ে চিনি না দিতে আর তুই এত চিনি দিলি কেন?

তানভীর বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিল তানভীরের চায়ের কাপের সাথে রুকুর কাপটা পাল্টে গিয়েছে। বরাবরেই তানভীর চিনি বেশি খায় তাই চিনি ছাড়া চা যেন তানভীরের কাছে অনেকটা পানশে আপেল কূল বড়ইয়ের মতো মনে হয়। বিস্বাদময় পানশে টাইপ খেতে। না টক না মিষ্টি। তানভীর নিজের কাপটা রুকুর দিকে বাড়িয়ে বলল,
~ পিচ্চিটার উপর রাগ দেখাবেন না। এই যে আমার চা টা খেয়ে নিন।

রাগটা বাড়িয়ে কর্কশ গলায় রুকু জবাব দিল
~ ভারি বজ্জাত তো আপনি। আপনার এঁটো চা আমি কেন খাব?
তানভীর হালকা হেসে বলল,
~ এভাবে না বলল,েও পারতেন। আমি আপনার ভালোর জন্যই বলেছিলাম।
~ এতে ভালোর কী দেখলেন শোনি?

~ কারণ সুলতান ভুল করে আপনার চা টা আমাকে দিয়ে দিছে। আমি বেশি চিনি দিয়ে চা খাই আর আপনি চিনি ছাড়া। আপনার চা টা আমার হাতে আর আমার চা টা আপনার হাতে। এজন্য বলেছিলাম এ চা টা নিতে। বাচ্চা ছেলে ইচ্ছা করে তো ভুল করেনি ওকে বকে লাভ নেই।

রুকু আর কোনো কথার জবাব দিল। চা টা চা স্টলের বেঞ্চিতে রেখে চুপ হয়ে গেল। চা টা বেঞ্চির উপর রাখতেই তানভীর চা টা নিয়ে খেতে লাগল। এঁটো চা টা এভাবে খেতে রুকু হালকা অবাক হলেও অবাক হওয়ার ছাঁপটা মুখে প্রকাশ না করে চলে গেল। এদিকে তানভীর চা টা শেষ করে পাশে তাকাতেই দেখল রুকু পাশে নেই। রুকুকে দেখতে না পেরে তার ভেতরটা কেন জানি শূন্যতায় হাহাকার করছিল। বেশ খারাপ লাগছিল বটে। তবে এত খারাপ লাগানোটা উচিত না।

তাই সুলতানকে চায়ের বিলটা দিয়ে দিল এদিকে প্রায় নয়টা বেজে গেছে। এখন লঞ্চ এ উঠার পালা। সময় নষ্ট না করেই এভি মনামী লঞ্চে উঠে গেল। দোতলায় একটা সিনগেল কেবিন ভাড়া নিয়েছে। কেবিন নম্বর 201s।
কেবিনে ঢুকে ছোট আয়নাটায় নিজেকে দেখে নিল। তারপর চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে খাটে শুয়ে পড়ল। করিডোরে যেতে ইচ্ছা করলেও এখন তানভীরের শরীরে তেমন শক্তি নেই যে করিডোরে যাবে। শুয়ে থাকতেই বেশ ভালো লাগছে। লঞ্চ ছাড়তে ছাড়তে আরও আধ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।

হালকা মাথা ব্যথাটা বেশ অস্বস্থি লাগছে তার। তাই মনে মনে ভাবল এখন একটু চোখটা বুজে নিলে খারাপ হয় না। খানিক ক্ষণের জন্য চোখটা বন্ধ করতেই রুকুর মুখটা ভেসে উঠল। কিন্তু এখন রুকুকে ভেবে আবেগে হাবুডুবু খেয়ে বোকামি করার ইচ্ছা জাগছে না তানভীরের তাই রুকুর মুখটা বারবার সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কল্পনার চোখ থেকে যেন তা সরছেই না। একটু তাকালে হয়তো ভেসে উঠা রুকুর মুখটা চলে যাবে।

তবে এখন তানভীরের তাকাতেই ইচ্ছা করছে না। কারণ মাথা ব্যথাটা ভালোই চেপেছে তার। এর মধ্যেই মনে হলো কেউ তার কেবিনের দরজাটা ধাক্কা দিচ্ছে। তবে এখন উঠে খুলতে ইচ্ছা করছে না। আর কেই বা ধাক্কা দিবে। ঘাপটি মেরে শুয়েই রইল। ধাক্কাতে ধাক্কাতে এমনিই চলে যাবে। কিন্তু তানভীরের ধারণাটা ভুল অনবরত ধাক্কাচ্ছে। তানভীর কোনোরকমে যুদ্ধ করে চোখটা খুলে বিছানা থেকে উঠে দরজাটা খুলল।

দরজাটা খুলার পর নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। খেয়াল করে দেখল রুকু দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে তানভীরের এটা কল্পনা মনে হতে লাগল। মনে মনে ভাবল হয়তো মেয়েটাকে বেশি কল্পনা করে ফেলেছে তাই দরজার সামনে এমন দেখছে। এটা নিছকেই কল্পনা। এটা ভেবে দরজা লাগাতে নিলেই পেছন থেকে রুকু বলে উঠল,
~ কী ব্যপার আপনি আমার কেবিনে কী করছেন? এটা তো আমার কেবিন।

আর আমাকে দেখে পাত্তা না দিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? দরজাটায় বা লাগাচ্ছেন কেন?
রুকুর কথায় চমকে গেল। বুঝতে পারল এটা তার কল্পনা না এটা তার বাস্তব। তাই দাঁতটা কেলিয়ে বলল,
~ আমি আপনার কেবিনে আসব কেন?
রুকু কাচুমাচু করে মুখটা গম্ভীর করে বলল,
~ দয়াকরে আপনার কেবিনে থাকার সুযোগ করে দিন। বড্ড অসহায় আমি। অনেক যন্ত্রণায় আছি।

~ কী যন্ত্রণায় আছেন জানতে পারে কি।
রুকু ঢুক গিলতে গিলতে বলল,
~ আগে দরজাটা লাগিয়ে নিন। বাইরে বাবার লোকজন আছে আমাকে শেষ করে দিবে। দয়াকরে কিছু একটা করুন।

তানভীর রুকুর কথা শোনে হেসে বলল,
~ ব্যাপর কি বলুন তো কারও সাথে পালাবেন?
~ তেমন কিছুই না দরজাটা লাগান প্লিজ।

বলেই রুকু সশব্দে কেঁদে দিল। তানভীর বেশ শক্ত মনের হলেও মেয়ে মানুষের কান্না একদম সহ্য করতে পারে না। তাই ধুম করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বলল,
~ এবার বলুন ঘটনা কী? কেনই বা এমন করছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা আপনার পরিচয়েই তো জানি না।

রুকু চোখের জল বাম হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে বলল,
~ আমার নাম রুকাইয়া। সবাই রুকু বলে ডাকে।
এর মধ্যেই কেবিনের দরজায় কেউ খটখট করতে লাগল। দরজার খটখটানো শোনে রুকু ভয়ে কুকরে গেল। তানভীর দরজা খুলতে গেলেও রুকুর তানভীরকে ঝাঁপটে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল,
~ দরজা খুলবেন না প্লিজ। এটা নিশ্চয় আমার বাবার লোক।

তানভীর কী করবে বুঝতে পারছিল না। রুকুরে ধরে বলল,
~ আপনি ভয় পাবেন না আমি দেখতেছি বিষয়টা।
বলেই দরজা খুলতে গেল। আর রুকু ভয়ে কুকরে যেতে লাগল। যখনই দরজা খুলল ঠিক তখনেই রুকু ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠে বলল,…রুকু ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল আবার চুপ হয়ে গেল। রুকুর চিৎকার শোনে ওপাশে থাকা লিয়াকত সাহেব চমকে উঠে বলল,
~ বাবা এটা কী তোমার বউ নাকি এভাবে চিৎকার দিল যে?

তানভীর লিয়াকত সাহেবের দিকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে লোকটার কিছু বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করল। খেয়াল করল লিয়াকত সাহেবের চুলগুলো কাঁচা পাঁকার মিশ্রণে মিশ্রিত অবস্থায় আছে। মুখে পান চিবাতে দাঁতের সাথে ঠোঁট টাও বেশ লাল করে ফেলেছে। বয়স আনুমানি ৪৫~৫৫ হবে। কিছুক্ষণ লিয়াকত সাহেবের বৈশিষ্ট্য নিরুপণ করে বলল,
~ উনি আমার বউ নাকি কে, সেটা নাহয় পরেই বললাম। তবে আপনি কে? এ কেবিনে কেন?

লিয়াকত সাহেব খিক করে হেঁসে দিয়ে বলল,
~ আমি লিায়াকত আলী। যাত্রাবাড়ী এসেছিলাম মেয়ের বাসায়। মেয়ের একটা কন্যা সন্তান হয়েছে দেখার জন্য। আজকে বরিশাল নিজের বাড়িতে যাব।
~ তা নাহয় বুঝলাম তবে এ কেবিনে কেন?

~ আমার কাছে মনে হলো এটা আমার কেবিন। ভুলক্রমে দরজায় শব্দ করে ফেলেছি। পরে বুঝতে পারলাম এটা আমার কেবিন না। তাই শব্দ করে চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চলে যাওয়ার পর দরজা খুলে কাউকে না দেখে আপনারা যদি ভূত ভেবে ভয় পান সেজন্য দাঁড়িয়েছিলাম।

তানভীর চোখগুলো কপালে তুলে বলল,
~ ওহ তাই বলুন। আপনার কেবিন নম্বর কত?
~ আমার কেবিন নম্বর হলো 202s.
~ ওহ আচ্ছা। পাশের কেবিনেই তাহলে। আচ্ছা একটা কথা জানতে পারে কি?
লিয়াকত সাহেব পানটা ভালো করে চিবিয়ে বলল,
~ কী জানতে চান?

~ বরিশালের হয়েও এত শুদ্ধ উচ্চারণে কথা কীভাবে বলছেন? আমি তো জানতাম বরিশালের লোকেদের কথায় একটা বরিশাল ভাষার টান থাকে। মানে বরিশাল বরিশাল ভাব থাকে। তবে এটা আমার একান্ত ব্যাক্তিগত ধারণা। সেই ধারণা থেকে বলছি আপনার কথায় তো মনে হয়না আপনি বরিশালের কেউ।

লিয়াকত সাহেব একটু হেসে বলল,
~ আমি আগের দিনের বি এ পাস। তাই শুদ্ধ করে কথা বলতে সমস্যা হয় না। আর আমি আর আমার বিবি বিবাহের পর থেকেই ঢাকায় থাকি। এখন ছেলে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর নিজের ভিটায় থাকি। তাই আমার কথায় বরিশালের কোনো টান নেই আর আমার বিবির ক্ষেত্রেও একই। যাইহোক পাশের কেবিনে গেলাম। তুমি তোমার বউকে সামলাও।
বলেই অরন্যে কাধেঁর দিকে হেলে পড়ে রুকুর দিকে তাকিয়ে বলল,
~ মৃগি বেরাম আছে নাকি তোমার বউয়ের।

তানভীরের ভেতরে ভেতরে বেশ অস্বস্থি হচ্ছিল বারবার রুকুকে তানভীরের বউ বলে সম্বোধন করায়। তবে এখন রুকুকে অন্য পরিচয় দিলে বিষয়টা বেশ গোলমেল হয়ে জটলা পাকিয়ে যাবে। তাই লিয়াকত সাহেবের কথায় জবাব দিয়ে বলল,
~ মৃগি বেরাম থাকবে কেন?

লিয়াকত সাহেব রুকুর দিকে হাতটা ইশারা করে বলল,
~ তাহলে তোমার বউ মেঝেতে পড়ে এভাবে কাপাঁকাঁপি করছে কন?
লিয়াকত সাহেবের কথা শোনে তানভীর রুকুর দিকে তাকিয়ে চমকে গেল। খেয়াল করল রুকু মেঝেতে শুয়ে খিঁচুনি দিতেছে। কথা না বাড়িয়ে দৌঁড়ে রুকুর কাছে গেল। হাতটা ধরতেই খেয়াল করল বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে। কোলে নিয়ে খাটে শুইয়ে হাত পা গরম করতে লাগল। এদিকে লিয়াকত সাহেব বেগতিক অবস্থা দেখে তার বিবি মধুমতিকে ডেকে আনে।

মধুমতি রুকুর পাশে বসেই বলল,
~ আরে পানি দাও কেউ। এ মেয়ে তো হুঁশ হারিয়েছে।
তানভীর পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
~ এই নিন।

মধুমতি বোতলটা নিয়ে রুকুর মুখে পানির ছিটা দিতে থাকল। আর হাত পা ক্রমাগত মালিশ করতে থাকল। মিনেট দশেক এরকম করার পর রুকু স্বাভাবিক হলো। রুকুর কপালটা হালকা কুচকাঁতে লাগল তারপর হালকা করে তাকিয়ে ঢুক গিলতে লাগল। রুকুকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে দেখে তানভীর রুকুকে ধরে শুয়া থেলে বসাল।

মধুমতি একটু হাসি দিয়ে বলল,
~ এইতো এখন বেশ ঠিক আছে। আমার মনে হচ্ছে অতিরিক্ত চিন্তার কারণে এমন হয়েছে। চিন্তা করো না তেমন। নিজেদের মধ্যে কোনো ঝামেলা থাকলে মিটিয়ে নিও। সংসার জীবনটায় এমন। টানা পূরাণ নিয়েই জীবন। এগুলো ভেবে এমন করলে হবে? আচ্ছা তোমরা থাকো আমি গেলাম।

তানভীর মধুমতির কথা শোনে মনে মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল বাঙ্গালি মানুষ সুযোগ পেলেই জ্ঞান দিবে। তানভীরের বিড়বিড় শোনে লিয়াকত সাহেব তানভীরের কাঁধে হাত রেখে বলল,
~ কি ব্যপার বাবা কী বিড়বিড় করতেছ?
তানভীর হতচকিয়ে বলল,
~ নাহ তেমন কিছু না।

পাশ থেকে মধুমতি লিয়াকত সাহেবের দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে বলল,
~ তুমি কথা থামিয়ে যাবে নাকি এখানেই বসে থাকবে। আর আক্কেল হলো না তোমার ওদের একটু কথা বলার সুযোগ দিবে তানা বসে আছ এখনো।

মধুমতির রাগী স্বরটা শোনে লিয়াকত সাহেব মুখটাকে বাংলার পাঁচ করে দুহাত পেছন দিকে দিয়ে হাত দুটো মুঠো করে কেবিন থেকে প্রস্থান নিল।
এদিকে তানভীর রুকুর দিকে তাকিয়ে দেখল রুকু বিষন্ন অবস্থায় বসে আছে। রুকুর বিষন্নতাটা যেন তানভীরের মাইগ্রেনের ব্যাথা বাড়ার কারণ হয়ে গেল। বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ এখন কেমন লাগছে। আর হুট করে এভাবে হালকা চেঁচিয়ে উঠেছিলেন কেন?
রুকুর গলাটা তখন শুকিয়ে খরখর হয়ে গেছিল মনে হচ্ছিল। গলা দিয়ে কথা আসছিল না। তানভীর ব্যপারটা বুঝতে পেরে রুকুর দিকে পানি এগিয়ে দিল। রুকু তানভীরের হাত থেকে পানিটা নিয়ে গদগদ করে খেয়ে সশব্দ নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
~ ভেবেছিলাম বাবার লোক তাই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম।

~ তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু একটু আগে এভাবে খিঁচুনি দিতেছিলেন কেন? মৃগি রোগ আছে আপনার? শোনেছিলাম মৃগি রোগীদের নাকি জুতা শুকালে ভালো হয়ে যায়। আপনার অবস্থা দেখে একবার ভেবেছিলাম জুতা এনে নাকে শুকিয়ে দিই।
কথাটা শোনে রুকু রাগে কপালের ভাঁজগুলো প্রখর করে বলল,
~ মৃগি বেরাম মানে? এটা থাকবে কেন?

~ আপনি যেভাবে কাঁপতেছিলেন লিয়াকত সাহেব এটাই ভেবেছিল।
~ এই লিয়াকত সাহেবটা কে?
~ ঐ যে যার বিবি আপনাকে মালিশ করতেছিল উনার স্বামী।

রুকু বিরক্ত গলায় বলল,
~ আমার কোনো মৃগি রোগ নেই। আমার অতিরিক্ত ঠান্ডা থেকে এমন হয়। একটু আগে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম তো তাই। এখন ভেজা কাপড়ে থেকে এমনটা হয়েছে।

তানভীর খেয়াল করল রুকু কারুকাজ বিহীন একটা সুতি সাদা কাপড় পরিধান করে আছে। রুকুর শাড়িটার দিকে তানভীরের এতক্ষণ নজর কেন গেল না ভাবতে লাগল। রুকুর বেশ দেখে তানভীরের মনে হচ্ছে রুকু হয়তো বিধবা। তাই হালকা গম্ভীর হয়ে আস্তে আওয়াজে বলল,
~ আপনি এ সাদা কাপড় পরে আছেন কেন?কেমন জানি বিধবা লাগছে।
রুকুর দুহাত দিয়ে মাথার দুপাশ চেপে ধরে বলল,
~ সে এক লম্বা কাহিনি এখন বলার মতো কোনো শক্তি নেই। আপনি একটু করিডোরে যাবেন আমি একটু কাপড়টা পাল্টে নিতাম। বেশ ঠান্ডা লাগছে। নাহয় আবার খিঁচুনি শুরু হতে পারে।

তানভীর কথা না বাড়িয়ে করিডোরের দিকে চলে গেল। রুকু দরজা আটকিয়ে একটা সালোয়ার কামিজ পরে নিল। তারপর দরজা খুলে দেখল তানভীর করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। করিডোরে তখন লাল নীল আলোর জ্বলকানী দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো লাল নীল জোনাকি পোকার রাজ্যে চলে এসেছে রুকু। জীবনে কখনো লঞ্চে উঠেনি রুকু।

টিভির পর্দায় এক দুবার লঞ্চ দেখছিল শুধু। আজকে লঞ্চের মনোরম পরিবেশে রুকুর চোখ যেন ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। এদিক ওদিক শুধু হা করে তাকাচ্ছে। তানভীর রুকুর দিকে তাকাতেই দেখল রুকু হালকা নীল বর্ণের একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে আছে। ফর্সা সাদা মুখটা নীলের মধ্যে একদম ফুটে উঠেছে। রুকুর এ চেহারাটা তানভীরের কাছে অনেকটা নীল অপরাজিতা ফুলের মতো লাগছে। তানভীর রুকুর কাছে গিয়ে হালকা গলায় বলল,
~ কাজ শেষ আপনার? এবার কী কেবিনে ঢুকতে পারি? নাহ মানে এক কাপ চা খাব। আমার আবার কতক্ষণ পরপর চা খাওয়ার একটা অদ্ভূত অভ্যাস আছে তো তাই।
তানভীরের ডাকে রুকু থতমত খেয়ে তাকিয়ে বলল,
~ হ্যাঁ কাজ শেষ।

বলে রুকু দাঁড়িয়ে রইল। তানভীর কেবিনের দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার আটকে গিয়ে পিছন দিকে একটু পিছিয়ে রুকুকে বলল,
~ আপনি চাইলেও এক কাপ চা খেতে পারেন। এতে মাথাটা ফ্রেশ লাগবে। আর কেন এখানে এসেছেন? কোথায় যাবেন? সোটাও তো আমার জানতে হবে। এ দুনিয়ায় পরিচিতদের ভরসা নেই আর আপনি তো একদম অপরিচিত। বিশ্বাস করা খুব কঠিন। কখন কী হয়ে যায় বলা যায় না। সুন্দর একটা মিষ্টি চেহারার আড়ালে যে কিছু লুুকানো নেই কে বলতে পারে।

তানভীরের অবশ্য এ কথাটা বলার আরেকটা পরোক্ষ কারণ হলো রুকুর সৌন্দর্যের প্রশংসা করা। অপরিচিত মেয়ে মানুষকে সরাসরি সুন্দর লাগছে বলল,ে বিষয়টা অন্য চোখে নিতে পারে তাই তানভীর পরোক্ষভাবে রুকুকে প্রশংসার জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। এদিকে তানভীরের কথা শোনে রুকু হালকা নিঃশ্বাস ফেলে কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।

রুকুকে কেবিনের দিকে আগাতে দেখে তানভীর চট করে কেবিনে ঢুকে খাটে বসে পড়ল। তারপর পাশ থেকে ব্যাগটা নিয়ে চায়ের ফ্লাস্কটা বের করে একটা অনটাইম কাপ বের করে তাতে চা ঢেলে রুকুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
~ এই যে আপনার চা তবে চিনি বেশি করে দেওয়া। কারণ আমি চিনি ছাড়া চা খেতে পারি না।

রুকু কথার কোনো প্রতি উত্তর না দিয়ে চা টা হাতে নিয়ে নিজের কোমরে গুজে রাখা মোবাইলটা বের করে অন করতে করতে চায়ে চুমুক দিল। এদিকে তানভীর ফ্লাস্কের মুখে চা ঢেলে খেতে খেতে বলল,
~ এবার বলুন কী হয়েছে? আর কেনই বা বাড়ি থেকে পালিয়েছেন৷ কারণটা কী?

রুকু চায়ে আরেক চুমুক দিয়ে বিষন্ন গলায় কিছু বলতে নিবে এর মধ্যে মোবাইলটা ভাইবার্ট হতে লাগল। মোবাইলের কাঁপাকাঁপি দেখে রুকু চা টা পাশের ডেস্কে রেখে কলটা ধরার দশ সেকেন্ড পর হালকা চেঁচিয়ে বলল,
~ তুমি কি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না? কতবার বলেছি কল দিও না। তোমার যা ইচ্ছা করো।

আমাকে আর জ্বালিও না। আমার এসব পেইন একদম ভালো লাগে না। খুব কষ্ট হয় আমার। তোমার এসব হুমকিতে আমার কিছু যাবে আসবে না। তোমার যা করার করে নিও। নিজের প্রয়োজনে কখনো তোমাকে কাছে পাইনি। তোমার কাছে তো আমি কিছুই না। আমি শুধু পরগাছার মতো তোমার কাছে ছিলাম। দয়াকরে আমাকে কল দিবে না। আমি অনেক সমস্যায় আছি। আমার সাথে এমন করো না। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। আমি নাহয় আত্নহনন করতে বাধ্য হব। আশাকরি এটা তুমি চাইবে না।

বলেই রুকু কিছুক্ষণ চুপ হয়ে গেল। ওপাশ থেকে কি বলছে তানভীর তা শোনতে পারছে না তবে রুকুর কাপালে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম বলে দিচ্ছে ওপাশ থেকে হয়তো জটিল কিছুই বলছে। রুকু হালকা চুপ থেকে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
~ তোর যা ইচ্ছা কর। আমাকে ফোন দিলে তোর খবর আছে।

বলেই ফোনটা পুনরায় বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। নিঃশ্বাস নিতে নিতে খাটে বসে হাঁটু মুড়ি দিয়ে মাথাটা হাঁটুতে ঠেক দিয়ে কাঁদতে লাগল। বেশ জোরে জোরেই হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদতে লাগল। মেয়ে মানুষের কান্না তানভীরের কাছে বেশ অসহ্যকর লাগে। রুকুর কান্নাটা দেখে যেন তানভীরের বাম বুকটা চিনচিন করে ব্যাথা শুরু হতে লাগল।

হাতে থাকা চা টা পাশে রেখে রুকুর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েও যেন ধরতে পারছিল না। কোথায় থেকে যেন অজানা বাঁধা তানভীরকে ঘিরে ধরতেছিল। তবুও সব বাঁধা অতিক্রম করে কাঁপতে কাঁপতে রুকুর মাথায় হাত দিতেই রুকু মাথা তুলে তানভীরের দিকে তাকাল। তানভীর খেয়াল করলো রুকুর চোখ দিয়ে আষাঢ়ের ঝড় বইছে। চোখ গুলো বেশ ফুলে গেছে আর লাল রক্তবর্ণ হয়ে আছে।

এটা দেখার পর তানভীরের বুকের ব্যাথাটা যেন আরও বাড়তে লাগল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
~ কী হয়েছে বলবেন? হুট করে এভাবে কাঁদছেন যে? আর কে ফোন দিয়েছিল জানতে পারে কি।
রুকু দুহাত দিয়ে চোখ দুটো কচলাতে কচলাতে উড়নার এক কোণা দিয়ে চোখ দুটো মুছে বলল,
~ আবির কল দিয়েছিল।

তানভীর উৎসুক গলায় বলল,
~ এ আবিরটা কে? আর এভাবেই বা কাঁদছেন কেন?
রুকু আস্তে গলায় জবাব দিল
~ আবির হলো…

পর্ব ৪

~ আবির হলো…..
বলেই রুকু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ধুম করে কেঁদে দিল। রুকুর কান্না যেন তানভীরের মনের অস্বস্থি বাড়িয়ে দিল। তানভীর কাঁপা হাতে রুকুর কাঁধে হাত দিতেই রুকু নিজেকে সামলে নিয়ে দুহাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
~ আবির হলো আমার বয়ফ্রেন্ড।

কলেজে যখন প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম সেদিন খেয়াল করলাম একটা লম্বা সুঠাম দেহীর একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে দেখেই বেশ ভালো লেগে গেছিল। ছেলেটার দিকে যেন চোখ আটকে গেছিল। কিন্তু বাবা পশে থাকায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাহস হলো না। এরপর জানতে পারলাম ছেলেটার নাম আবির আর আমাদের ক্লাসমেট নেহার বড় ভাই।

আবিরের প্রতি একটা ক্ষুদ্র ভালো লাগা থেকে নেহার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলি। নেহাকে আবির কলেজে দিতে আসতো আর আমি আবিরকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতাম। মনে মনে ভাবতাম এ যদি আমার পথ চলার সঙ্গী হত মন্দ হত না। তবে আমি কলেজ যেতাম খুব কম। বলা যায় পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিতাম শুধু। ক্লাস করেছি হাতে গুণা কয়েকদিন।

কথাটা শোনে তানভীর দাঁত কেলিয়ে হাসি দিয়ে বলল,
~ ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ট ছিলেন তাই তো?
তানভীরের কথা শোনে রুকু রাগে গজগজ করে বলল,
~ ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ড মোটেও ছিলাম না। তবে বাসা থেকে ক্লাস করতে দিত না।
তানভীর কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলল,
~ ক্লাস করতে দিত না কেন? অমা! কি বলেন? আমি তো জানতাম বাসা থেকে ক্লাস করার জন্য সবাই প্রেসার দেয়। আর আপনি উল্টা কথা বলছেন।

~ হ্যাঁ সত্যি বলছি। আমার পরিবার ঐরকম না। পরিবারের কাহিনি নাহয় আরেকদিন বলব।
~ আচ্ছা ঠিক আছে পরে কী হয়েছে বলুন।
রুকু দম নিয়ে দমটা ছেড়ে বলল,
~ কলেজে একদিন ক্লাস টেস্ট দিতে গেলাম। সেদিন নেহা আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
~ ভাইয়া তোকে দিয়েছে।

নেহার কথাটা শোনে বেশ চমকে গেছিলাম। আবির চিঠি দিয়েছে শোনেই মনে রোমান্টিক অনুভূতি জাগতেছিল। চিঠিটা ব্যাগে নিয়ে পরীক্ষা শেষ করেই চিঠিটা খোলার জন্য মন আনচান করতেছিল তবে বাবা সাথে ছিল তাই চিঠিটা খুলতে পারিনি। বাসায় এসেই দরজা লাগিয়ে চিঠিটা খোললাম।

চিঠিটায় লিখা ছিল
“শব্দহীন এক ভালোবাসার মায়ায় পড়ে গিয়েছি। যেখানে তোমাকে নিয়ে ঐ নীল আকাশের চাঁদটা অবলোকন করতে চাই। যেখানে ভালোবাসার রঙ্গিন চাঁদরে তোমাকে মুড়িয়ে নিয়ে চন্দ্রহীন রাতের তারা ভরা আকাশের বিশালতায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। সাঁঝের আকাশে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে তোমাকে নিয়ে উড়ে বেড়াবার স্বপ্ন দেখব। হবে কি আমার পথ চলার সাথী।”

চিঠিটা পরার পর একটা অদ্ভূত অনুভূতি জেগেছিল। পছন্দের মানুষের কাছ থেকে এমন চিঠি পাওয়াতে আবেগটা যেন বেড়ে টইটুম্বর হয়ে গেছিল। ইচ্ছা করছিল তখনেই কল করে বলে দিই যে আমি আপনার পথ চলার সাথী হতে চাই। কিন্তু আমি মোবাইল ব্যাবহার না করায় সেটা আর করতে পারলাম না। পরদিন যখন পরীক্ষা দিতে যাই তখন নেহাকে বললাম আমি আবিরের প্রস্তাবে রাজি।

কিন্তু আবিরের সাথে কথা বলার মতো কোনো উপায় নেই। নেহা আমার কথা শোনে বলল,
~ কথা বলার সুযোগ নেই কেন শোনি।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম
~ আমার তো মোবাইল নেই।

নেহা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
~ তুই চিন্তা করিস না আমি দেখতেছি ব্যাপার টা।
তারপর নেহা ব্যাপারটা আবিরকে বলল,। রুকু কথাটা বলে হাতে থাকা মোবাইলটা তানভীরকে দেখিয়ে বলল,
~ এই যে এই মোবাইলটা আবির নেহার মাধ্যমে পাঠাল। তারপর আবিরের সাথে পরিবারকে ফাঁকি দিয়ে শুরু হলো আমার কথা বলা। বেশ ভালো জমে গিয়েছিল আমাদের প্রেমটা।

কিন্তু মাস তিনেক পর আবিরের চাহিদাগুলো বাড়তে লাগল। বিভিন্ন প্রস্তাব দিতে থাকল। আমি মোটেও এসবে অভ্যস্ত ছিলাম না। তাই বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আবির এসব বিষয়গুলো নিয়েই পড়ে থাকত। যার দরুণ আবিরের সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। বেশ কষ্ট লাগত। প্রথম ভালোবাসা তো ছাড়তেও পারতাম না। অদ্ভূত মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম।

“মায়া বড়ই খারাপ জিনিস। একবার কাউকে ধরে বসলে সেটা থেকে বের হয়ে আসা অনেক কঠিন।”
মায়া নামক ব্যাধির যদি কোনো ঔষধ থাকত তাহলে হয়তো সেটা হাজারও মানুষ খেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত।
যাইহোক যার কারণে আবিরের সাথে কথা বলা বাদ দিতে পারতাম না। আবিরকে দেখতাম সবসময় আমাকে প্রয়োজন হিসেবে ব্যাবহার করতে চাইত। আমি মোটেও তাকে পাত্তা দিতাম না এসব ব্যাপারে। তবে ওকে মায়ার জন্য ছাড়তেও পারতাম না। একের পর এক হুমকি দিত। আমাকে বলত আমার ছবি ইডিট করে নেটে ছড়িয়ে দিবে। এসব নানা ধরণের ব্ল্যাকমেইল বলা চলে। এর মধ্যে আমার পরিবারে ঘটে চলে একের পর এক অদ্ভূত কাহিনি যার কারণে মন খারাপ বশত যদি তার সাথে কথা বলতে চাইতাম তাকে কাছে পেতাম না। তাই একটা সময় আমি বিষয়টা গুটিয়ে ফেলি। তার কাছ থেকে নিজেকে বের করে আনি। আর সেখানেই ঘটে বিপত্তি।

বলেই রুকু চুপ হয়ে গেল। তানভীর তখন মনোযোগ দিয়ে এক পলকে তাকিয়ে রুকুর কথা শোনছিল৷ রুকুকে থেমে যেতে দেখে তানভীর বলে উঠল,
~ কি ব্যাপার থেমে গেলেন যে। তারপর কি হলো।

রুকু সশব্দ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
~ তারপর থেকে আবির আমার প্রতি বেশ সিরিয়াসনেস দেখায়৷ বুঝায় সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি তো জানি কুকুরের লেজ ঘি দিয়ে মালিশ করলেও সোজা হবে না। এদিকে তার প্রতি আমার বিন্দু মাত্র ভালোবাসা কাজ করে না যেটা কাজ করে সেটা হলো এক অযাচিত মায়া। তাই বারবার আবির বিরক্ত করে ফোন দিয়ে। আর আমার তখন বেশ কষ্ট হয়।

তানভীর হালকা নিঃশ্বাস নিল। নাক দিয়ে যেন তানভীরের গরম নিঃশ্বাস বের হচ্ছে এখন। কি বলবে বুঝতে পারছে না এদিকে মাথায় মাইগ্রেনের ব্যাথা তো আছেই। একটা হাই তুলার সাথে সাথে দুই আঙ্গুল দিয়ে নিজের হা করা মুখের সামনে তুড়ি বাজাতে বাজাতে বলল,
~ তা নাহয় আবিরের ব্যাপারটা বুঝলাম। কিন্তু মাথায় ঢুকছে না আপনি বাসা থেকে কেন পালালেন। আমি তো ভেবেছিলাম হয়তো কোনো প্রমিকের জন্য বাসা থেকে পালিয়েছেন।

কিন্তু এখন বিষয়টা উল্টো লাগছে। আমাকে একটু খুলে বলবেন কি হয়েছে?
রুকুও তখন বেশ ক্লান্ত। খাটের দিকে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বলল,
~ বলল,ে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। তবে আমার সাথে যা হয়েছে সেটা আমার কাছেই বেশ অদ্ভূত লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় বিষয়টা দুঃস্বপ্ন। জানি না এমন কেন করেছে আমার পরিবার। এতে তাদের কি স্বার্থ সেটাও জানি না।
তানভীর চোখগুলো বড় বড় করে বলল,
~ কি এমন কথা যে বিশ্বাস করতে পারব না।

বলেই রুকুর দিকে তাকিয়ে দেখল রুকু একটা ডায়রি বের করে তানভীরের দিকে বাড়িয়ে আছে। তানভীর অবাক চোখে রুকুর দিকে তাকিয়ে বলল,
~ ডায়রি দিয়ে কী করব আমি?
রুকু জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল,
~ এটাতে সব লিখা আছে। আপনি পড়ে নিন।

কথাটা শোনে তানভীর রুকুর হাত থেকে ডায়রিটা নিয়ে পড়তে লাগল। যতই ডায়রিটা পড়ছিল তানভীরের কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামের আকৃতি বাড়ছিল। সেই সাথে তানভীরের শ্বাসকষ্টের সমস্যাটাও বেড়ে গিয়েছিল। ঘামটা গড়িয়ে গড়িয়ে বেয়ে কানের পাশ দিয়ে নামছিল। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা ব্যাপক ভাবে চেপেছে। সহ্য করতে পারছে না আর।

এরকম পরিবারও এ যুগে আছে তা যেন মানতে তানভীরের বেশ কষ্ট হচ্ছে। ডায়রিটা পড়া শেষে দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকল। মাইগ্রেন এমন একটা ব্যাথা একবার চেপে ধরলে ঔষধেও কাজ করে না। এ মুহুর্তে তানভীরের বেশ মাইগ্রেনের ব্যাথাটা চেপে ধরেছে। তাই চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল। মিনেট ত্রিশ এভাবে থাকার পর তানভীরের মনে হলো এখন বেশ স্বাভাবিক এবং ভালো লাগছে।

তাই তাকিয়ে রুকুর দিকে খেয়াল করে দেখল রুকু শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। অর্ধেকটা শরীর মোঝের দিকে ঝুলে আছে বাকি অর্ধেক খাটে। তাই রুকুকে ধরে খাটের উপরে তুলে দিল। হাত পা বেশ ঠান্ডা দেখে ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে রুকুর শরীরে জড়িয়ে দিল। ঠিক এ মুহূর্তে মনে হলো কেউ একজন কেবিনের দরজা ধাক্কাচ্ছে। তানভীর ভাবল হয়তো লিয়াকত সাহেব এসেছে তাই উঠে কেবিনের দরজা খুলল। দরজা খুলে দেখল একজন অল্প বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। খেয়াল করল মহিলার চুলগুলো হালকা কুকরা চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা এবং পরনে লাল পেরে গেরুয়া রঙ্গের শাড়ি পড়া।

তানভীর মহিলাকে দেখে মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল
~ আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। কে আপনি?
তানভীরের কথা শোনে ওপাশে থাকা মহিলাটা বলল,
~ আমি মোনালি। আর আমাকে চেনার কথাও না। একটা বিষয় জানার জন্য কেবিনটায় নক করেছি।

তানভীর হালকা হেসে বলল,
~ কী জানতে চান বলুন।
মোনাালি একটা ছবি বের করে তানভীরের দিকে ধরল। তানভীর ছবিটা দেখে চমকে গেল। কারণ এ আর কেউ না রুকুর ছবি। তানভীর চমকে গিয়েও চমকানোর ছাপটা মুখে প্রকাশ না করে মোনালিকে বলল,
~ এ ছবিটা কার? আমাকে দেখাচ্ছেন কেন?

মোনালি নিজের চশমাটা ঠিক করতে করতে বলল,
~ মেয়েটাকে চেনার কথা না তবে আশে পাশে কোথাও কী দেখেছেন? আমি খেয়াল করলাম মেয়েটা এ লঞ্চে ঢুকেছে। আমার সাথেই এসেছিলা তবে মাথায় একটু সমস্যা আছে তো তাই হুট করে কোথায় যে গেল বুঝতে পারছি না।

তানভীর মুখটাকে কাচুমাচু করে বলল,
~ আপনার জন্য তো আমার সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হবে।
মোনাালি একটু কপট রেগে বলল,
~ মানে?

তানভীর খিক করে হেসে বলল,
~ আমার স্ত্রী একটু বেশি সন্দেহবাদী উঠে যদি দেখে আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কোনো মেয়ের খু্ঁজ নিচ্ছেন তাহলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না।
এটা বলার সাথে সাথে মোনালি বলে উঠল,
~ আচ্ছা সরি।

এমন সময় রুকু ওমাগো বলে চিল্লানি দিয়ে উঠল। খেয়াল করল রুকুর গলাটা ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গা গলার চিৎকার শোনে তানভীর মোনালিকে বলল,
~ আচ্ছা যাইহোক মেয়েটাকে চিনি না। আমি গেলাম। আমার বউ হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছে। আমাকে না পেলে বেশ ভয় পাবে। কচি মেয়ে বিয়ে করলে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়।

বলেই দরজাটা লাগিয়ে খেয়াল করল রুকু ভয়ে কাঁপতেছে। রুকুর কাছে যেতেই রুকু তানভীরের হাতটা ধরে বলল,
~ তেজস্বিনী এসেছিল তাই না?
তানভীর হালকা দম নিয়ে বলল,
~ তা তো বলতে পারব না কে এসেছে তবে আপনার খুঁজ নিতে এসেছিল।
তানভীরের কথা শোনে রুকু ফিসফিস করে বলল,
~ আমি ঘুম থেকে দুঃস্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে খেয়াল করলাম তেজস্বিনী দাঁড়ানো। তাই ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। আমাকে হয়তো ধরে নিয়ে যাবে। কী করব আমি। আমাকে বাঁচান।

বলেই কাঁদতে লাগল। এমন সময় দরজায় আবার খটখট আওয়াজ আসতে লাগল। দরজার আওয়াজ শোনে রুকু তানভীরের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
~ নিশ্চয় তেজস্বিনী এসেছে। দয়াকরে খুলবেন না।
তানভীর বুঝতে পারছিল না কী করবে। তানভীর রুকুকে একটু আশ্বাস দিয়ে বলল,
~ আপনি চাঁদরটা গায়ে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ুন দেখি কে এসেছে। তেজস্বীনি আসলে আমি বাকি ব্যাপারটা মেনেজ করে নেব।

বলেই রুকুকে শুইয়ে দিয়ে চাঁদর মুড়িয়ে দিয়ে ঢেকে দিল। এদিকে তানভীরে হার্টবিটের স্পন্দর যেন ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। হার্টবিটের স্পন্দর বেড়ে চলার এ প্রক্রিয়াকে মেডিকেলের ভাষায় পালপিটিশান বলে। তানভীরের এখন মনে হচ্ছে হয়তো তার এমুহূর্তে এ রোগটার দেখা মিলেছে। তবুও নিজের মনে সাহস জুগিয়ে দরজাটা খুলতেই…

পর্ব ৫

আবির হলো…..
বলেই রুকু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ধুম করে কেঁদে দিল। রুকুর কান্না যেন তানভীরের মনের অস্বস্থি বাড়িয়ে দিল। তানভীর কাঁপা হাতে রুকুর কাঁধে হাত দিতেই রুকু নিজেকে সামলে নিয়ে দুহাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
~ আবির হলো আমার বয়ফ্রেন্ড।

কলেজে যখন প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম সেদিন খেয়াল করলাম একটা লম্বা সুঠাম দেহীর একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে দেখেই বেশ ভালো লেগে গেছিল। ছেলেটার দিকে যেন চোখ আটকে গেছিল। কিন্তু বাবা পশে থাকায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাহস হলো না। এরপর জানতে পারলাম ছেলেটার নাম আবির আর আমাদের ক্লাসমেট নেহার বড় ভাই।

আবিরের প্রতি একটা ক্ষুদ্র ভালো লাগা থেকে নেহার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলি। নেহাকে আবির কলেজে দিতে আসতো আর আমি আবিরকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতাম। মনে মনে ভাবতাম এ যদি আমার পথ চলার সঙ্গী হত মন্দ হত না। তবে আমি কলেজ যেতাম খুব কম। বলা যায় পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিতাম শুধু। ক্লাস করেছি হাতে গুণা কয়েকদিন।

কথাটা শোনে তানভীর দাঁত কেলিয়ে হাসি দিয়ে বলল,
~ ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ট ছিলেন তাই তো?
তানভীরের কথা শোনে রুকু রাগে গজগজ করে বলল,
~ ফাঁকিবাজ স্টুডেন্ড মোটেও ছিলাম না। তবে বাসা থেকে ক্লাস করতে দিত না।
তানভীর কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলল,
~ ক্লাস করতে দিত না কেন? অমা! কি বলেন? আমি তো জানতাম বাসা থেকে ক্লাস করার জন্য সবাই প্রেসার দেয়। আর আপনি উল্টা কথা বলছেন।

~ হ্যাঁ সত্যি বলছি। আমার পরিবার ঐরকম না। পরিবারের কাহিনি নাহয় আরেকদিন বলব।
~ আচ্ছা ঠিক আছে পরে কী হয়েছে বলুন।
রুকু দম নিয়ে দমটা ছেড়ে বলল,
~ কলেজে একদিন ক্লাস টেস্ট দিতে গেলাম। সেদিন নেহা আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
~ ভাইয়া তোকে দিয়েছে।

নেহার কথাটা শোনে বেশ চমকে গেছিলাম। আবির চিঠি দিয়েছে শোনেই মনে রোমান্টিক অনুভূতি জাগতেছিল। চিঠিটা ব্যাগে নিয়ে পরীক্ষা শেষ করেই চিঠিটা খোলার জন্য মন আনচান করতেছিল তবে বাবা সাথে ছিল তাই চিঠিটা খুলতে পারিনি। বাসায় এসেই দরজা লাগিয়ে চিঠিটা খোললাম। চিঠিটায় লিখা ছিল
“শব্দহীন এক ভালোবাসার মায়ায় পড়ে গিয়েছি। যেখানে তোমাকে নিয়ে ঐ নীল আকাশের চাঁদটা অবলোকন করতে চাই। যেখানে ভালোবাসার রঙ্গিন চাঁদরে তোমাকে মুড়িয়ে নিয়ে চন্দ্রহীন রাতের তারা ভরা আকাশের বিশালতায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। সাঁঝের আকাশে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে তোমাকে নিয়ে উড়ে বেড়াবার স্বপ্ন দেখব। হবে কি আমার পথ চলার সাথী।”

চিঠিটা পরার পর একটা অদ্ভূত অনুভূতি জেগেছিল। পছন্দের মানুষের কাছ থেকে এমন চিঠি পাওয়াতে আবেগটা যেন বেড়ে টইটুম্বর হয়ে গেছিল। ইচ্ছা করছিল তখনেই কল করে বলে দিই যে আমি আপনার পথ চলার সাথী হতে চাই। কিন্তু আমি মোবাইল ব্যাবহার না করায় সেটা আর করতে পারলাম না। পরদিন যখন পরীক্ষা দিতে যাই তখন নেহাকে বললাম আমি আবিরের প্রস্তাবে রাজি। কিন্তু আবিরের সাথে কথা বলার মতো কোনো উপায় নেই। নেহা আমার কথা শোনে বলল,
~ কথা বলার সুযোগ নেই কেন শোনি।

আমি গম্ভীর গলায় বললাম
~ আমার তো মোবাইল নেই।
নেহা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
~ তুই চিন্তা করিস না আমি দেখতেছি ব্যাপার টা।
তারপর নেহা ব্যাপারটা আবিরকে বলল,। রুকু কথাটা বলে হাতে থাকা মোবাইলটা তানভীরকে দেখিয়ে বলল,

~ এই যে এই মোবাইলটা আবির নেহার মাধ্যমে পাঠাল। তারপর আবিরের সাথে পরিবারকে ফাঁকি দিয়ে শুরু হলো আমার কথা বলা। বেশ ভালো জমে গিয়েছিল আমাদের প্রেমটা। কিন্তু মাস তিনেক পর আবিরের চাহিদাগুলো বাড়তে লাগল। বিভিন্ন প্রস্তাব দিতে থাকল। আমি মোটেও এসবে অভ্যস্ত ছিলাম না। তাই বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আবির এসব বিষয়গুলো নিয়েই পড়ে থাকত। যার দরুণ আবিরের সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। বেশ কষ্ট লাগত। প্রথম ভালোবাসা তো ছাড়তেও পারতাম না। অদ্ভূত মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম।

“মায়া বড়ই খারাপ জিনিস। একবার কাউকে ধরে বসলে সেটা থেকে বের হয়ে আসা অনেক কঠিন।”
মায়া নামক ব্যাধির যদি কোনো ঔষধ থাকত তাহলে হয়তো সেটা হাজারও মানুষ খেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত।

যাইহোক যার কারণে আবিরের সাথে কথা বলা বাদ দিতে পারতাম না। আবিরকে দেখতাম সবসময় আমাকে প্রয়োজন হিসেবে ব্যাবহার করতে চাইত। আমি মোটেও তাকে পাত্তা দিতাম না এসব ব্যাপারে। তবে ওকে মায়ার জন্য ছাড়তেও পারতাম না। একের পর এক হুমকি দিত। আমাকে বলত আমার ছবি ইডিট করে নেটে ছড়িয়ে দিবে। এসব নানা ধরণের ব্ল্যাকমেইল বলা চলে। এর মধ্যে আমার পরিবারে ঘটে চলে একের পর এক অদ্ভূত কাহিনি যার কারণে মন খারাপ বশত যদি তার সাথে কথা বলতে চাইতাম তাকে কাছে পেতাম না। তাই একটা সময় আমি বিষয়টা গুটিয়ে ফেলি। তার কাছ থেকে নিজেকে বের করে আনি। আর সেখানেই ঘটে বিপত্তি।

বলেই রুকু চুপ হয়ে গেল। তানভীর তখন মনোযোগ দিয়ে এক পলকে তাকিয়ে রুকুর কথা শোনছিল৷ রুকুকে থেমে যেতে দেখে তানভীর বলে উঠল,
~ কি ব্যাপার থেমে গেলেন যে। তারপর কি হলো।

রুকু সশব্দ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
~ তারপর থেকে আবির আমার প্রতি বেশ সিরিয়াসনেস দেখায়৷ বুঝায় সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি তো জানি কুকুরের লেজ ঘি দিয়ে মালিশ করলেও সোজা হবে না। এদিকে তার প্রতি আমার বিন্দু মাত্র ভালোবাসা কাজ করে না যেটা কাজ করে সেটা হলো এক অযাচিত মায়া। তাই বারবার আবির বিরক্ত করে ফোন দিয়ে। আর আমার তখন বেশ কষ্ট হয়।

তানভীর হালকা নিঃশ্বাস নিল। নাক দিয়ে যেন তানভীরের গরম নিঃশ্বাস বের হচ্ছে এখন। কি বলবে বুঝতে পারছে না এদিকে মাথায় মাইগ্রেনের ব্যাথা তো আছেই। একটা হাই তুলার সাথে সাথে দুই আঙ্গুল দিয়ে নিজের হা করা মুখের সামনে তুড়ি বাজাতে বাজাতে বলল,
~ তা নাহয় আবিরের ব্যাপারটা বুঝলাম। কিন্তু মাথায় ঢুকছে না আপনি বাসা থেকে কেন পালালেন। আমি তো ভেবেছিলাম হয়তো কোনো প্রমিকের জন্য বাসা থেকে পালিয়েছেন। কিন্তু এখন বিষয়টা উল্টো লাগছে। আমাকে একটু খুলে বলবেন কি হয়েছে?

রুকুও তখন বেশ ক্লান্ত। খাটের দিকে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বলল,
~ বলল,ে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। তবে আমার সাথে যা হয়েছে সেটা আমার কাছেই বেশ অদ্ভূত লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় বিষয়টা দুঃস্বপ্ন। জানি না এমন কেন করেছে আমার পরিবার। এতে তাদের কি স্বার্থ সেটাও জানি না।

তানভীর চোখগুলো বড় বড় করে বলল,
~ কি এমন কথা যে বিশ্বাস করতে পারব না।
বলেই রুকুর দিকে তাকিয়ে দেখল রুকু একটা ডায়রি বের করে তানভীরের দিকে বাড়িয়ে আছে। তানভীর অবাক চোখে রুকুর দিকে তাকিয়ে বলল,
~ ডায়রি দিয়ে কী করব আমি?
রুকু জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল,
~ এটাতে সব লিখা আছে। আপনি পড়ে নিন।

কথাটা শোনে তানভীর রুকুর হাত থেকে ডায়রিটা নিয়ে পড়তে লাগল। যতই ডায়রিটা পড়ছিল তানভীরের কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামের আকৃতি বাড়ছিল। সেই সাথে তানভীরের শ্বাসকষ্টের সমস্যাটাও বেড়ে গিয়েছিল। ঘামটা গড়িয়ে গড়িয়ে বেয়ে কানের পাশ দিয়ে নামছিল। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা ব্যাপক ভাবে চেপেছে। সহ্য করতে পারছে না আর। এরকম পরিবারও এ যুগে আছে তা যেন মানতে তানভীরের বেশ কষ্ট হচ্ছে। ডায়রিটা পড়া শেষে দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকল। মাইগ্রেন এমন একটা ব্যাথা একবার চেপে ধরলে ঔষধেও কাজ করে না।

এ মুহুর্তে তানভীরের বেশ মাইগ্রেনের ব্যাথাটা চেপে ধরেছে। তাই চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল। মিনেট ত্রিশ এভাবে থাকার পর তানভীরের মনে হলো এখন বেশ স্বাভাবিক এবং ভালো লাগছে। তাই তাকিয়ে রুকুর দিকে খেয়াল করে দেখল রুকু শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। অর্ধেকটা শরীর মোঝের দিকে ঝুলে আছে বাকি অর্ধেক খাটে।

তাই রুকুকে ধরে খাটের উপরে তুলে দিল। হাত পা বেশ ঠান্ডা দেখে ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে রুকুর শরীরে জড়িয়ে দিল। ঠিক এ মুহূর্তে মনে হলো কেউ একজন কেবিনের দরজা ধাক্কাচ্ছে। তানভীর ভাবল হয়তো লিয়াকত সাহেব এসেছে তাই উঠে কেবিনের দরজা খুলল। দরজা খুলে দেখল একজন অল্প বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। খেয়াল করল মহিলার চুলগুলো হালকা কুকরা চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা এবং পরনে লাল পেরে গেরুয়া রঙ্গের শাড়ি পড়া। তানভীর মহিলাকে দেখে মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল
~ আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। কে আপনি?

তানভীরের কথা শোনে ওপাশে থাকা মহিলাটা বলল,
~ আমি মোনালি। আর আমাকে চেনার কথাও না। একটা বিষয় জানার জন্য কেবিনটায় নক করেছি।
তানভীর হালকা হেসে বলল,
~ কী জানতে চান বলুন।
মোনাালি একটা ছবি বের করে তানভীরের দিকে ধরল। তানভীর ছবিটা দেখে চমকে গেল। কারণ এ আর কেউ না রুকুর ছবি। তানভীর চমকে গিয়েও চমকানোর ছাপটা মুখে প্রকাশ না করে মোনালিকে বলল,
~ এ ছবিটা কার? আমাকে দেখাচ্ছেন কেন?

মোনালি নিজের চশমাটা ঠিক করতে করতে বলল,
~ মেয়েটাকে চেনার কথা না তবে আশে পাশে কোথাও কী দেখেছেন? আমি খেয়াল করলাম মেয়েটা এ লঞ্চে ঢুকেছে। আমার সাথেই এসেছিলা তবে মাথায় একটু সমস্যা আছে তো তাই হুট করে কোথায় যে গেল বুঝতে পারছি না।
তানভীর মুখটাকে কাচুমাচু করে বলল,
~ আপনার জন্য তো আমার সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হবে।
মোনাালি একটু কপট রেগে বলল,
~ মানে?

তানভীর খিক করে হেসে বলল,
~ আমার স্ত্রী একটু বেশি সন্দেহবাদী উঠে যদি দেখে আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কোনো মেয়ের খু্ঁজ নিচ্ছেন তাহলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না।
এটা বলার সাথে সাথে মোনালি বলে উঠল,
~ আচ্ছা সরি।
এমন সময় রুকু ওমাগো বলে চিল্লানি দিয়ে উঠল। খেয়াল করল রুকুর গলাটা ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গা গলার চিৎকার শোনে তানভীর মোনালিকে বলল,
~ আচ্ছা যাইহোক মেয়েটাকে চিনি না। আমি গেলাম। আমার বউ হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছে। আমাকে না পেলে বেশ ভয় পাবে। কচি মেয়ে বিয়ে করলে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়।

বলেই দরজাটা লাগিয়ে খেয়াল করল রুকু ভয়ে কাঁপতেছে। রুকুর কাছে যেতেই রুকু তানভীরের হাতটা ধরে বলল,
~ তেজস্বিনী এসেছিল তাই না?
তানভীর হালকা দম নিয়ে বলল,
~ তা তো বলতে পারব না কে এসেছে তবে আপনার খুঁজ নিতে এসেছিল।
তানভীরের কথা শোনে রুকু ফিসফিস করে বলল,
~ আমি ঘুম থেকে দুঃস্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। তারপর দরজার ফাঁক দিয়ে খেয়াল করলাম তেজস্বিনী দাঁড়ানো। তাই ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি। আমাকে হয়তো ধরে নিয়ে যাবে। কী করব আমি। আমাকে বাঁচান।

বলেই কাঁদতে লাগল। এমন সময় দরজায় আবার খটখট আওয়াজ আসতে লাগল। দরজার আওয়াজ শোনে রুকু তানভীরের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
~ নিশ্চয় তেজস্বিনী এসেছে। দয়াকরে খুলবেন না।
তানভীর বুঝতে পারছিল না কী করবে। তানভীর রুকুকে একটু আশ্বাস দিয়ে বলল,
~ আপনি চাঁদরটা গায়ে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ুন দেখি কে এসেছে। তেজস্বীনি আসলে আমি বাকি ব্যাপারটা মেনেজ করে নেব।

বলেই রুকুকে শুইয়ে দিয়ে চাঁদর মুড়িয়ে দিয়ে ঢেকে দিল। এদিকে তানভীরে হার্টবিটের স্পন্দর যেন ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। হার্টবিটের স্পন্দর বেড়ে চলার এ প্রক্রিয়াকে মেডিকেলের ভাষায় পালপিটিশান বলে। তানভীরের এখন মনে হচ্ছে হয়তো তার এমুহূর্তে এ রোগটার দেখা মিলেছে। তবুও নিজের মনে সাহস জুগিয়ে দরজাটা খুলতেই…

পর্ব ৬

দরজাটা খুলতেই খেয়াল করল লিয়াকত সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। লিয়াকত সাহেবকে দেখে তানভীরের মনে প্রশ্ন জাগল মোনালি লিয়াকত সাহেবকে রুকুর ছবি দেখাল না তো?যদি লিয়াকত সাহেবকে রুকুর ছবি দেখিয়ে থাকে তাহলে তো বিপদ হওয়ার সম্ভবনা আছে। কি জানি ছবি দেখিয়েছি কিনা। ক্ষীণ দুশ্চিন্তার ছাপ তানভীরের চোখে মুখে চক্ষুগোচর হলো।

হালকা ভয় যেন তানভীরকে ঘিরে ধরেছে এর মধ্যেই লিয়াকত সাহেব একটা কেক আর চিপস তানভীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
~ এটা তুমি আর তোমার বিবির জন্য এনেছি। আমি আর তোমার চাচী একটু করিডোরে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। মধুমতি বলল, তোমাকে যেন এগুলো দিয়ে যাই। একটু আগেই দিয়ে যেতাম তবে একজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আর কেবিনের দিকে এগিয়ে আসিনি। করিডোরেই দাঁড়িয়েছিলাম দুজন। উনি যাওয়ার পর তোমার জন্য এটা নিয়ে আসলাম।

তানভীর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ তারা দুজন ঐ মুহুর্তে কেবিনে থাকলে বিপদের আশঙ্কা হওয়ার সম্ভবনা ছিল। তানভীর নিজের ঠোঁটের ললাটটা প্রশস্ত করে বলল,
~ এসবের কী দরকার ছিল চাচা। তা চাচী কোথায়?

লিয়াকত সাহেব ফিক করে পান দিয়ে লাল হয়ে যাওয়া তার লাল দাঁতগুলো বের করে বলল,
~ ঐ তো ঐখানে দাঁড়িয়ে আছে। তা বাবা ঐ মহিলা কে ছিল?
তানভীর কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তবে এদের সামাল দিতে না পারলে পরবর্তীতে যে মোনালি কোনো সমস্যা ঘটাবে না এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই হালকা ভয় ভয় গলায় বলল,
~ যদি কিছু মনে না করেন তাহলে চাচীকে কী একটু ডাক দিবেন। আমার আপনাদের সাথে একটু কথা ছিল। কথাটা জরুরি বলা যায়।

লিয়াকত সাহেব তানভীরের মুখে ভয়ের ছাপ দেখে কিছুটা অবাক হলো বটে। অবাক হয়ে মধুমতির দিকে তাকিয়ে হাতে ইশারা দিয়ে আসতে বলল,। মধুমতি লিয়াকত সাহেবের হাতের ইশারা পেয়েই চলে আসলো। দুজনকে কেবিনে ঢুকিয়ে লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি কে বসার জন্য জায়গা করে দিল। দুজনেই বেশ অবাক হচ্ছিল তানভীরের আচঁরণে।

এদিকে রুকুর দিকে তাকিয়ে দেখল রুকু চাঁদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি অবাক হয়ে বলল,
~ মেয়েটা এভাবে চাঁদর মুড়ি দিয়ে আছে কেন?জ্বর টর আসেনি তো?
বলতেই তানভীর হালকা গলায় বলল,
~ নাহ এমন কিছুই হয়নি। তবে একটা সাহায্য চাই করবেন।

লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি বুঝতে পারছিল না তানভীর কি বলবে। ইতস্তত করছিল বুঝার জন্য। তাই বলল,
~ হ্যাঁ বলো কি সাহায্য চাই।

তানভীর মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিল
~ চাচা আপনি একটু আগে জিজ্ঞেস করেছিলেন না ঐ মহিলাটা কে?
লিয়াকত সাহেব মাথা ঝাঁকানোর সাথে সাথে বলতে লাগল
~ হ্যাঁ ঐ মহিলাটা কে ছিল?
তানভীর মুখটা গম্ভীর করলেও কন্ঠটাকে স্বাভাবিক করে বলল,
~ ঐ মহিলাটা রুকুর খোঁজ নিতে এসেছিল।

তানভীরের কথা শোনে মধুমতি আর লিয়াকত সাহেব দুজনেই হতচকিয়ে বলল,
~ মানে?
~ হ্যাঁ চাচা আমি আর রুকু বিয়ে করে নিছি পালিয়ে। ওকে নিয়ে কুয়াকাটা এজন্য ঘুরতে যাচ্ছি। তবে ওর পরিবারের কেউ জানে না যে রুকু আমার সাথে পালিয়েছে। ঐ যে মহিলাটা এসেছিল ঐ মহিলাটা হলো রুকুর সম্পর্কে খালা হয়। রুকুর খুঁজ নিতে এসেছিল। আপনাদের কাছে যদি আসে তাহলে দয়াকরে বলবেন না রুকু এখানে। কারণ আপনারা রুকুকে দেখেছেন আর কেউ দেখেনি।

বলেই তানভীর হালকা নিঃশ্বাস নিতে লাগল। নিঃশ্বাসটা যেন তার ভারী হয়ে যাচ্ছে ক্রমশে। আঁড়চোখে রুকুর দিকে তাকিয়ে দেখল ততক্ষণে রুকু উঠে বসে রয়েছে। রুকুর দিকে লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি তাকিয়ে দেখল রুকু বেশ ভয়ে ভয়ে বসে আছে। রুকুর ভয় দেখে লিয়াকত সাহেব আর মধুমতির মনে হলো হয়তো তানভীর রুকুকে জোর করে তুলে এনেছে তাই রুকুর মাথায় মধুমতি হালকা হাত বুলিয়ে বলল,
~ মা তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? তুমি অভয়ে বলো পাশের ছেলেটা যা বলেছে সেটা কি ঠিক নাকি তোমাকে জোর করে ধরে এনেছে।

রুকু হালকা ঢুক গিলতে লাগল। গলার স্বরটা ভেঙ্গে মোটা হয়ে গেছে তার। গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে যেন তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। চাইলেও আওয়াজ করতে পারছে না। মনের অজান্তেই যেন সবচকিছু গুটিয়ে ফেলছে। রুকুর অবস্থা দেখে লিয়াকত সাহেব ক্ষেপে গিয়ে বলল,
~ আমার তো মনে হয় মেয়েটাকে তুমি জোর করে ধরে এনেছ। নাহয় মেয়েটা এমন করবে কেন? মেয়েটার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে ভয়ে আছে।

লিয়াকত সাহেবের কথা শোনে তানভীরের ভেতরটা আঁৎকে উঠল। মেয়েঘটিত কোনো বিপদে পড়বে কিনা সে ভয়ে কাঁপতে লাগল তার ভেতরটা। ধুকধুক করে যেন ভেতরের হার্টবিটটা আওয়াজ তুলছিল। লিয়াকত সাহেব আরও কিছু বলতে নিবে এমন সময় রুকু বলে উঠল,
~ চাচা ওকে কিছু বলবেন না। আমি ওকে জেনে শোনেই বিয়ে করেছি। আমার মা নেই সৎ মায়ের কাছে মানুষ। সৎ মা আমাকে বেশ জ্বালাত। অযোগ্য একটা ছেলের কাছে তুলে দিচ্ছিল তাই আমি ওর সাথে পালিয়েছি।

বলেই ধুম করে কেঁদে দিয়ে লিয়াকত সাহেবকে বলল,
~ চাচা দয়াকরে ঐ মহিলাকে কিছু বলবেন না। আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। আপনারও তো একটা মেয়ে আছে আমাকে আপনার মেয়ে মনে করে এটুকু সাহায্য করুন। আর তানভীর আমাকে জোর করে কেন তুলে আনবে বরং সে আমাকে তার জীবনে জায়গা দিয়েছে সেটাই তো আমার বড় পাওয়া।

রুকুর চোখ দিয়ে বেয়ে পড়া শ্রাবণের মেঘ যেন লিয়াকত সাহেবের মনটা গলিয়ে দিল। এদিকে মধুমতি বেশ নরম মনের মানুষ কারও কান্না সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই বলল,েই চলে। তাই রুকুর কান্না দেখে মধুমতি হালকা কেঁদে বলল,
~ না রে মা আমরা কিছুই বলব না। তুই কান্না থামা।

লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি রুকুকে সোহাগ করে বুঝাতে লাগল। এদিকে তানভীর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি এবার তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তোমরা থাকো কেমন। সাড়ে নয়টা বাজে এখনেই জাহাজ ছেড়ে দিবে। আমরা গেলাম। সাবধানে থেক।

তারপর মধুমতি লিয়াকত সাহেবের হাত থেকে চিপস আর কেকটা নিয়ে রুকুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
~ এটা দুজন মিলে খাও। আরও কিছু লাগলে বলো।
রুকু চোখগুলো মুছতে মুছতে হাত থেকে চিপস আর কেকটা নিয়ে বলল,
~ আচ্ছা।

লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি চলে গেল। তানভীর দরজা খুলতেই খেয়াল করলো মোনালি করিডোর দিয়ে অন্য দিকে যাচ্ছে। তানভীর আর দেরি না করে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর রুকুর কাছে আসতেই রুকু বলে উঠল,
~ আমি কী আপনার বউ? আমাকে আপনার বউ হিসেবে পরিচয় দিছেন কেন?

তানভীর কপালটা ভাঁজ করে বিরক্ত গলায় বলল,
~ তা না হলে আমাকে এতক্ষণে আপনাকে ধরে আনার অভিযোগে জেলে যেতে হত। বুঝেন তো কিছু না শুধু শুধু বকবক করেন। এত প্যারা নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কুয়াকাটা ঘুরতে বের হয়েছিলাম আর এমন হবে কে জানত। অসহ্য লাগছে। মাইগ্রেনের ব্যথাটাও কমে কমে আবার বাড়ছে। বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ভালো লাগছে না।

বলেই তানভীর চুপ করে খাটে দপাশ করে বসে নীচের দিকে তাকিয়ে রইল। রুকু তানভীরের কথা শোনে মুখটাকে একদম অসহায় করে বসে রইল। মিনেট পনের তারা দুজন এভাবেই বসে রইল। এর মধ্যে জাহাজটা ছেড়ে দিল। বুড়িগঙ্গার ময়লা কালো পানিতে জাহাজটা হেলে দুলে গন্তব্যের দিকে রওনা দিল। রুকুর নীরবতা দেখে তানভীর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
~ আপনাকে ঐভাবে বলা ঠিক হয়নি। সত্যি বলতে আমার হুট করে রাগ উঠে যায়। হুট করে রাগ উঠার একটা বদ অভ্যাস আছে বটে।

তানভীরের এমন কথায় রুকুর ভেতরটায় যেন প্রশান্তির বাতাস বইছে। নিজেকে প্রশান্ত করে ভাঙ্গা গলায় জবাব দিল
~ আমি কিছু মনে করেনি। আপনি আমার জন্য যা করেছেন এতেই আমি খুশি।

রুকুর গলাটা ভাঙ্গা দেখে তানভীর ফ্লাস্ক থেকে আরেক কাপ চা বের করে রুকুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
~ এ চা টা খেয়ে নিন তাহলে গলাটা ঠিক হয়ে যাবে। আর রাতে কি খাবেন বলেন আমি অর্ডার দিব।

রুকু অবাক চোখে তাকিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বলল,
~ এখন খাবার কোথায় থেকে আনবেন এখন তো জাহাজ ছেড়ে দিছে।
তানভীর রুকুর কথা শোনে হালকা হেসে বলল,
~ জাহাজে সব পাওয়া যায়।

আপনি কি খাবেন বলুন আমি অর্ডার দিলে সব চলে আসবে।
~ওহ আচ্ছা তাই বলুন। আমি কখনো জাহাজে উঠিনি তো তাই। বাইরে থেকে জাহাজটা দেখলে বুঝা যায় না এতটা সুন্দর ভেতরটা। আমার কাছে কী মনে হয়েছে জানেন।
কথাটা বলেই রুকু কৌতুহলী চোখে তানভীরের দিকে তাকাল। তানভীর রুকুর বলার কৌতুহল দেখে জিজ্ঞেস করল
~ কি মনে হয়েছে।

~ আমার কাছে মনে হয়েছে এটা যেন একটা তাজমহল।
তানভীর হালকা হেসে বলল,
~ তাজমহল এর চেয়েও সুন্দর।
রুকু বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করল
~ আপনি তাজমহল দেখেছেন?
তানভীর মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলল,
~ আমি অনেক ঘুরাফেরা করি। গতবছরেই পটকাকে নিয়ে তাজমহল দেখতে গেছিলাম। ভ্রমনপিয়াসু বলতে পারেন।

তানভীরের কথা শোনে রুকু কৌতুহলের সুরে জিজ্ঞেস করল
~ তাজমহল দেখতে কেমন?
তানভীর কিছু বলতে নিবে এর মধ্যে তানভীরের ফোনটা টুংটাং করে বাজতে লাগল। তানভীর ফোনটা হাতে নিয়ে কলটা ধরে বলল,
~ হ্যালো বল কি হয়েছে?

কথাটা বলার পর রুকু খেয়াল করল তানভীর ওপাশের কথাটা বেশ মনোযোগ সহকারে শোনছে। তানভীরের কপাল বেয়ে তখন ঘাম বের হচ্ছে। তানভীরের শ্বাস প্রশ্বাসটা যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে তানভীরের চোখগুলো লাল হয়ে যেতে লাগল। চোখের কোণে হালকা পানি জমেছে বলা যায়। ছেলেরা সহজে কাঁদতে পারে না। রুকু বুঝতে পারছিল ওপাশ থেকে কেউ হয়তো তানভীরকে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বলছে যেটা তানভীর সহ্য করতে পারছে না।

তাই তার চোখ মুখের এমন অবস্থা হয়েছে। এদিকে তানভীর কলটা কেটে চুপ হয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। চোখের কোণের হালকা পানি যেন তানভীরের এখনেই গাল বেয়ে পড়বে। মুহুর্তের মধ্যেই বেশ বিমর্ষ হয়ে গেল। চোখটা হালকা মুছে চুপ হয়ে গেল। রুকু তানভীরের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল,
~ কোনো সমস্যা?

তানভীর রুকুর কথা শোনে হালকা কেঁদে দিল। তানভীরের কান্না দেখে রুকু বুঝতে পারছিল সে হয়তো ভীষণ কষ্ট পয়েছে কিছু নিয়ে। তাই তানভীরকে স্বাত্বণা দিয়ে বলল,
~ কী হয়েছে বলবেন?
তানভীর নিজেকে স্থির করতে চাইলেও যেন পারছিল না। গলা দিয়ে কথা বলতে গেলেও আটকে আটকে আসছিল। মিনেট পাঁচেক চুপ থেকে রুকুকে জবাব দিল।

পর্ব ৭

চুপ থেকে রুকুকে জবাব দিল
~ সায়নী…. মেয়েটার নাম ছিল সায়নী।
মেয়েটার নাম শোনে চট করে রুকু বলে উঠল,
~ আপনার গার্ল ফ্রেন্ড বুঝি?

তানভীরের কপালে জমে থাকা ঘাম গুলো মুছে হালকা রাগী গলায় বলল,
~ গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ছাড়া কী কিছুই ভাবতে পারেন না আপনি?
কথাটা শোনে রুকু একদম চুপ হয়ে গেল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
~ নাহ ঠিক তা না। মনে হলো আর কি। আচ্ছা ঠিক আছে যা বলতেছিলেন বলুন।
তানভীর হালকা নিঃশ্বাস নিয়ে বলা শুরু করল।

~ মেয়েটার নাম সায়নী। আমার ফ্রেন্ড তৌসিফ মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসত। তাদের বেশ কয়েক বছর সম্পর্ক ছিল। আমাদের ভার্সিটির সেরা কাপল বলা যায়। তবে সায়নীকে আমার মোটেও ভালো লাগত না।

কথাটা শোনে রুকু বলে উঠল,
~ কেন?
~ কারণ সায়নীর ছিল অত্যাধিক চাহিদা। তৌসিফের বাবা একটা ছোটখাট সরকারি চাকুরি করে। তা দিয়ে তৌসিফের সেমিস্টার ফি দিতে দিতে বেশ হিমশিম খেয়ে যায়। প্রাইভেট ভার্সিটির সেমিস্টার ফি এর ব্যাপারটা জানা আছে কি না জানি না। কারণ প্রাইভেট ভার্সিটিতে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মোটা অঙ্কের টাকা জমা দিতে হয়।

এত কিছুর পরও তৌসিফ সায়নীকে খুশি করতে চাইত। যা চাইত তাই দেওয়ার যথা সম্ভব চেষ্টা করত। কখনো নিজের প্রিয় জিনিস বিক্রি করত আবার কখনো বন্ধুমহল থেকে টাকা ধার করত। এজন্য বেশ কয়েকজনের সাথে টাকা নিয়ে তার ঝামেলাও হয়েছে। এত কিছুর পরও তৌসিফ সায়নীর মন পেত না। অন্যের সাথে কম্পেয়ার করার একটা বিষয় তার চরিত্রে ফুটে উঠত। সবসময় এর সাথে তার সাথে তৌসিফকে কম্পেয়ার করত।

রুকু তানভীরের কথাটা ব্যাগরা দিয়ে বলল,
~ কিন্তু এত কম্পেয়ার করার মানুষ কোথায় পেত সায়নী।
তানভীর হালকা হেসে বলল,
~ ফেসবুক চালান?
রুকু মাথা নেড়ে বলল,
~ নাহ।

তানভীর পুনরায় একটু হেসে পরক্ষণে স্তব্ধ হয়ে বলল,
~ ফেসবুক চালান না তো তাই বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে আপনার ধারণা কম।
~ সেটা সত্যিই ধারণা অনেক কম বটে। কারণ পরিবারের বাইরে কারও সাথে ঐভাবে মিশা হয়নি। সত্যি বলতে সুযোগ পায়নি। আর কেন পায়নি সেটা তো জানেন।

~ হুুম। ফেসবুকে যদি কখনো চালান তখন বিভিন্ন গ্রূপে এমন কম্পেয়ার করার মতো হাজারটা পোস্ট পেয়ে যাবেন। ঐখানে কেউ সুখ শেয়ার করে আবার কেউ দুঃখ। তবে আমাদের উচিত এটা মেনে নেওয়া যে সবার জীবন এক না। সবার সামর্থ্য এক না। কারও সামর্থ্য বেশি কারও কম।

যার সামর্থ্য বেশি তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ভালোবেসে বেশি দিতেই পারে। এতে দোষের কিছু না। আবার এতে খুশি হয়ে গ্রূপ গুলোতে শেয়ার করাটাও ঐ ব্যাক্তির দোষ না তবে সেটাকে নিজের জীবনে এনে কম্পেয়ার করাটা চরম দোষ বলতে পারেন। সব মানুষের মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে আর সেটা মানিয়ে নেওয়ায় ভালো। কারও সুখের পোস্ট দেখে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষকে চাপ দিয়ে কম্পেয়ার করাটা মোটেও সমীচীন নয়। আগের মানুষ বিভিন্ন ভাবীদের বাসায় গিয়ে এমন কম্পেয়ার করে স্বামীগুলোকে অপদস্ত করত। আর এখন পৃথিবী হাতের মুঠোয় আসাতে মানুষকে কষ্ট করে কারও বাসায় যেতে হয় না। ঘরে বসেই এসব পোস্ট দেখে বিভিন্ন কম্পেয়ার করে ফেলতে পারে।

রুকু কপালটা ভাঁজ করে বলল,
~ তাহলে আপনার মনে হয় কেউ ভালো কিছু শেয়ার করবে না?
~ শেয়ার করবে অবশ্যই তবে শেয়ারকারীর শেয়ার করা বিষয়টা নিজের দিকে মানুষকে টেনে আনা বদলাতে হবে। আপনাকে আল্লাহ সব দেয়নি তাকে দিয়েছে এটা ভাবা বন্ধ করতে হবে। কারণ আল্লাহ অবশ্যই সবাইকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী সব দিয়েছে। প্রতিযোগিতা ভালো তবে হিংসা না।

যাইহোক বেচারা তৌসিফ বেশ ভালোবাসত সায়নীকে। তার আবদারগুলো নিজের সর্বস্ব দিয়ে রাখার চেষ্টা করত। এসবের মধ্য দিয়েও তাদের জীবনটা ভালোই চলছিল। এর মধ্যে ঘটে যায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত কান্ড।

বলেই তানভীর চুপ করে রইল। তানভীরের নীরবতা দেখে রুকু কন্ঠটা মোলায়েম করে বলল,
~ চুপ হয়ে গেলেন যে কি হয়েছিল বলেন।

তানভীর হালকা নিঃশব্দ নিঃশ্বাস ছাড়ল কয়েকটা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
~ তৌসিফকে একটা সময় সায়নী বেশ অবহেলা করতে শুরু করে। কল করে প্রায় সময় ব্যাস্ত পেত। জিজ্ঞেস করলে বলত আমার জীবন আমি যা ইচ্ছা করব যার সাথে ইচ্ছা কথা বলব তোমার কি?

তোমার থাকতে হলে থাকো না হলে চলে যাও। এতকিছুর পরও তৌসিফ সায়নীকে ছাড়তে পারত না। ঐ যে আপনি বললেন না মায়া তৌসিফও সায়নীর মায়ায় পড়ে গেছিল আর কি। আমি বেশ কয়েকবার তৌসিফকে বুঝিয়েছি যে সায়নী তোর জন্য না। ওর কাছে ওর চাওয়াটা আগে তারপর তুই। মেয়ের অভাব নেই তুই আরেকটা ভালো মেয়ে দেখে জীবনটা নতুন করে সাজিয়ে নে। কিন্তু তৌসিফ তখন মুখটা গোমরা করে হালকা কান্না স্বরে বলত
~ সাহিলের মতো হলে হয়তো বেশ ভালো ছিল তাই না রে তানভীর।
কথাটা শোনে রুকু বলে উঠল,
~ এ সাহিলটা আবার কে?

~ সাহিল হলো আমাদের ভার্সিটির প্লে বয়। তার জীবনে হাজারটা মেয়ের আনাগোনা বলতে পারেন। মেয়ে পটানোতে বেশ ওস্তাদ। তৌসিফ তো সায়নীকে হাজারটা গিফট দিয়েও মন পেত না অপরদিকে সাহিলকে মেয়েরা হাজার গিফট দিয়েও রিলেশন টিকাতে পারত না।
কিছু মেয়ে এমন কতগুলো ছেলেকে ভালোবাসে যারা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না আবার কিছু ছেলেও সায়নীর মতো এমন কতগুলো মেয়েকে ভালোবাসে যারা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। দেখতে গেলে প্রতারিত ছেলেরাও হচ্ছে মেয়েরাও হচ্ছে। একেই বলে হয়তো জীববিজ্ঞানের ভাষায় ইকুইলিব্রিয়াম।

যাইহোক কাহিনিতে আসা যাক তৌসিফের কথা শোনে কোনো কথার উত্তর দিতে পারতাম না তখন।
এভাবেই অযাচিত যন্ত্রণায় তৌসিফের জীবন কাটতে থাকে। একটা সময় পর তৌসিফ জানতে পারে যে সায়নীর অন্য একটা সম্পর্ক চলছে। বিষয়টা তৌসিফ নিতে পারেনি। মাস তিনেক আগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ঘরে বন্দি দশায় থাকত আর সারাদিন সায়নী সায়নী করত। একটু আগে আমার বন্ধু তুষার কল দিয়ে জানাল যে তৌসিফ আত্নহত্যা করেছে।

বলেই তানভীর কাঁদতে লাগল। ঘটনাটা শোনার পর থেকে রুকুর ভেতরটাও কষ্টে কাঁপতে লাগল। মানুষগুলো যে এত বিচিত্র কেন হয় রুকুর কাছে সে প্রশ্নের উত্তর নেই। দুজনেই বেশ নীরব হয়ে কাঁদছে তানভীর তৌসিফের কথা ভেবে কাঁদছে আর রুকু আবিরের কথা ভেবে কাঁদছে। একটা মানুষ ছেলে দ্বারা প্রতারিত হয়েছে আরেকজন মেয়ে দ্বারা।

জীবনের রঙগুলো বেশ বৈচিত্র্যময় সেখানে মানুষ সাদা কালো স্বপ্নকে রঙ্গিন ভেবে মরিচীকার পেছনে দৌঁড়াতে বেশ পছন্দ করে। এ মুহুর্তে কেবিনটায় পিনপনা নীরবতা বিরাজ করছে। সেই সাথে জাহাজটাও হেলদুল খাচ্ছে। এর মধ্যেই দুজনের নীরবতার রেশ কাটে কেবিনের দরজার খটখট আওয়াজে। দরজার আওয়াজ শোনে দুজনেই নিজেদের চোখের জল মুছে নিল। দুজনের চোখেই ফুলে লাল হয়ে গেল। রুকু দরজা খুলতে উঠতে নিলে তানভীর রুকুকে আটকে দিয়ে বলে উঠল,
~ তুমি যেও না। কারণ মোনালি আসলে ঝামেলা হতে পারে। তুমি চাঁদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ো আমি দেখে আসছি কে এসেছে।

তানভীরের কথা শোনে রুকু চাঁদরটা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। আর তানভীর দরজাটা খোলার সাথে সাথে লিয়াকত সাহেব হেসে বলল,
~ তোমার চাচী তোমার জন্য এ খাবার গুলো পাঠিয়েছে। এখানে রুই মাছ আর মুরগীর মাংস আছে খেয়ে নিও।

বলেই খাবারটা এগিয়ে দিয়ে পুনরায় বলল,
~ বাবা চোখগুলো এত ফোলা কেন? কান্না কাটি করেছ নাকি?
কথাটা শোনে তানভীরের চোখটা আরও ভারি হয়ে পানি বেয়ে পড়ল। তানভীরকে কাঁদতে দেখে লিয়াকত সাহেব তানভীরকে ধরে বলল,
~ কী হয়েছে বাবা এভাবে কাঁদতেছ কেন?
তানভীর চোখটা মুছে লিয়াকত সাহেবের হাত থেকে খাবারগুলো নিয়ে বলল,
~ আমার বন্ধু মারা গেছে তো তার জন্য।

লিয়াকত সাহেব তানভীরের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
~ মন খারাপ করো না হায়াত মৃত্যু আল্লাহর হাতে। কার কখন মৃত্যু হয় বলা যায় না।
এর মধ্যেই মধুমতি এসে বলতে লাগল
~ কি গো এত দেরি করতেছ কেন? বললাম তাড়াতাড়ি খাবার গুলো দিয়ে আসতে। এসে সেই দেরি করতেছ। তোমার দেরি দেখে আমিই চলে আসলাম।

লিয়াকত সাহেব মধুমতির দিকে তাকিয়ে দেখল মধুমতি মুখে একটু বিরক্তিকর বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। মধুমতির বিরক্তমাখা মুখটা দেখে অসহায় চিত্তে মধুমতির দিকে তাকিয়ে বলল,
~ ছেলেটার বন্ধু মারা গেছে তাই ওকে একটু বুঝাচ্ছিলাম। এজন্য দেরি হয়ে গেছে।
মধুমতি লিয়াকত সাহেবের কথাটা শোনে মুখটাকে একদম অসহায় করে ফেলল। তার চোখে মুখে কষ্টের ছাপটা বেশ ফুটে উঠেছে। কষ্ট মাখা মুখে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ বাবা মন খারাপ করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।

তানভীর যেন তাদের কথায় একটা প্রশান্তি পেল। প্রশান্তি মাখা মুখে বলল,
~ না চাচী কষ্ট পাইনি। আপনারা ভেতরে আসুন। একটু আড্ডা দিই সবাই মিলে। তাহলে মনটা হালকা লাগবে একটু।
কথাটা শোনেই লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি কেবিনে ঢুকে বসল। রুকু দুজনকে দেখেই একটা হাসি দিল। রুকুর খুশি দেখে মধুমতির পরাণটা যেন জুড়িয়ে গেল। মধুমতি নিজেও এক চিলতে হাসি দিয়ে বলল,
~ এভাবে হাসতে দেখলে বেশ ভালো লাগে। জানো আমার মেয়েটাও তোমার মতো দেখতে।
রুকু হাসতে হাসতে বলল,
~ আপনিও আমার মায়ের মতো। মাকে ছোটবেলায় দেখেছিলাম এরপর আর মাকে দেখার ভাগ্য হয়নি। আপনাকে দেখে মায়ের মুখটা বেশ মনে পড়ছে।

বলেই রুকু মধুমতির বুকে নিজের মাথাটা হেলিয়ে দিল। লিয়াকত সাহেব আর তানভীর মধুমতি আর রুকুর ভালোবাসার মুহুর্তগুলো অবলোকন করছিল। মধুমতি রুকুর মাথাটায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ তুমি আমাকে মা বলেই ডেক। তোমার মতো একটা মেয়ে আমার আছে আরেকটা হলে খারাপ হবে না।

এর মধ্যেই আধখোলা দরজায় কেউ ঠকঠক করে বলতে লাগল
~ কেউ কি আছেন একটু কথা ছিল।
তানভীরের কাছে কন্ঠটা বেশ পরিচিত লাগল। অপরদিকে রুকু কন্ঠটা শোনে ভয়ে মধুমতির বুকে মাথা লুকিয়ে রাখল। তানভীর দরজাটার সামনে যেতেই ভয়ে চমকে গেল। কারণ খেয়াল করল মোনালি দাঁড়িয়ে আছে। মোনালিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তানভীরের হাত পা হালকা কাঁপতে লাগল। সেই সাথে শ্বাসটাও বেশ ঘন হয়ে আসতে লাগল। তানভীর মোনালির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

তানভীরের তাকানো দেখে মোনালি চোখের চশমাটা হালকা ঠিক করে বলল,
~ আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
তানভীর মোনালির কথায় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
~ নাহ এমনিতে। কিন্তু আপনি আবার এসেছেন কেন?

~ একটু দরকার ছিল তাই। ঐ যে মেয়েটার ছবি দেখিয়েছিলাম। কেউ একজন বলল, মেয়েটাকে নাকি এ করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। আপনি কি দেখেছেন?
তানভীর কপট রাগ কপালে এনে বলল,
~ এর আগেই বললাম দেখিনি তবুও বারবার বিরক্ত করছেন। এমনিই আমার বউটা অসুস্থ। এর মধ্যে এমন প্যারা তো ভালো লাগছে না। বেশ মুশকিলে পড়লাম আপনাকে নিয়ে। তার উপর আমার বউ ভীষণ সন্দেহবাদী আপনাকে আসতে দেখে আমাকে সন্দেহ করে বসবে। দয়াকরে আর এমন করে আমার সংসারে ঝামেলা সৃষ্টি করবেন না।

মোনালি কপালটা ভাঁজ করে বলল,
~ আপনি একটু বেশিই তালগোল পাকাচ্ছেন। তা আপনার বউয়ের কী হয়েছে দেখি তো।
বলেই কেবিনে ঢুকে পড়ল। কেবিনে ঢুকার সাথে সাথে

পর্ব ৮

কেবিনে ঢুকে গেল। কেবিনে ঢুকার সাথে সাথে তানভীরের ভয়ে বুকটা কাঁপতে লাগল। ইষৎ ঘাম কপালে চক্ষুগোচর হলো। কি বলবে বুঝতে পারছিল না। লিয়াকত সাহেবও বেশ ঘাবড়ে গেল। তানভীর মনে মনে ভাবতে লাগল তীরে এসে তরী ডুবে যাবে না তো। এর মধ্যেই লিয়াকত সাহেব ডাহুকের মতো মাথাটা উঁচিয়ে বলে উঠল,
~ কে আপনি আপনাকে তো চিনলাম না। এভাবে কেবিনে কেন ঢুকে পড়লেন?

লিয়াকত সাহেবের কথা শোনে মোনালি হালকা কেঁপে উঠল। ভয়ে ফ্যাকাশে মুখটা নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্বাভাবিক করে জবাব দিল
~ ভাবলাম উনার স্ত্রী অসুস্থ তাই দেখতে এসেছিলাম।
লিয়াকত সাহেব কপট রাগের পরিমাণ মুখে প্রকাশ করে বলল,
~ সে আমার মেয়ের জামাই হয়। আমার মেয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ। হুটহাট চিল্লানি দিয়ে উঠে। মনের মধ্যে হাজারটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। আর অপরিচিত মানুষ সহ্য করতে পারে না। এজন্যই ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম ডাক্তার দেখাতে।

একটু আগে আপনি এসেছিলেন এটা নিয়ে বেশ পাগলামি শুরু করেছিল এখন তাকে বুঝিয়ে একটু স্বাভাবিক করেছি এর মধ্যে আপনি আবার আসলেন। এভাবে কি কাউকে বিরক্ত করা উচিত বলুন? কাউকে খোঁজতে হলে পুলিশের সাহায্য নিন। তা না করে এভাবে একা একা কেন খু্ঁজছেন?
লিয়াকত সাহেবের কথা গুলো শোনে মোনালির মুখটা একদম চুপসে গেল। কারণ লিয়াকত সাহেবের কথায় যথেষ্ট যুক্তি ছিল। তানভীরও উনার কথায় সম্মতি দিয়ে বলে উঠল,
~ সত্যিই তো কেউ নিখোঁজ হলে পুলিশের সাহায্য নিন আপনি একা একা কেন খুঁজছেন? নাকি এতে কোনো ঘাপলা আছে।

মোনালি এবার হতভম্ব হয়ে গেল কথাগুলো শোনে। কি বলবে বুঝতে পারছিল না বেশ আমতা আমতা করছিল। এমন সময় মোনালির ফোনটা বেজে উঠল। মোনালি চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে ফোনটা ধরে বলল,
~ আমি দেখতেছি কিন্তু মেয়েটাকে পাচ্ছি না। আপনি চিন্তা করবেন না একমাসের আগেই খোঁজে বের করব। হাতে তো একমাস সময় আছেই।

বলেই ফোনটা রেখে দিল। ফোনটা রেখে কাচুমাচু হয়ে মুখটাকে ফ্যাকাশে করে বলল,
~ আপনাদের এভাবে বলা ঠিক হয়নি। মেয়েটা আমার সাথেই এসেছিল হুট করে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে মেয়েটা মানসিক ভারসাম্যহীন। এ মুহুর্তে পুলিশকে ইনফর্ম করার সুযোগ পায়নি। যাইহোক আমার পক্ষ থেকে দুঃখিত।
তারপর লিয়াকত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আপনার মেয়ে হয়তো বেশ ভয় পেয়ে গেছে। এটার দোষটা হয়তো আমারি এজন্য দুঃখিত। ক্ষমার চোখে দেখবেন।

বলেই মোনালি কেবিন থেকে প্রস্থান নিল। মোনালি যাওয়ার পর তানভীর চট করে দরজাটা আটকে দিল। সবাই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তানভীর আর লিয়াকত সাহেব খেয়াল করল রুকু এখনো ভয়ে মধুমতির বুকে মাথা গুজে আছে। রুকুকে এভাবে ভয় পেতে দেখে তানভীর রুকুর পাশে বসে রুকুকে হালকা ধরতেই রুকু চমকে গিয়ে তাকাল। তানভীর খেয়াল করল রুকুর চোখ মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আছে।

চোখগুলো ফুলে লাল হয়ে আছে। রুকুর মন থেকে ভয়টা দূর করার জন্য তানভীর রুকুকে ধরে বলল,
~ ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি।
তানভীরের কথা শোনে মধুমতিও বলে উঠল,
~ হ্যাঁ মা আমরা আছি তোর পাশে। এখন চোখ মুখটা ধুয়ে একটু খাবার খেয়ে নে তো। অনেকক্ষণ যাবত হয়তো না খেয়ে আছিস। মনে কিছু নিস না তুই করে বললাম। অল্প সময়ে বেশ আপন হয়ে গেছিস তো তাই।

রুকু মধুমতির কথা শোনে চোখগুলো মুছে পুনরায় জড়িয়ে ধরে বলল,
~ ছোটবেলায় মায়ের আদর বুঝার আগেই মাকে হারিয়েছি এখন মনে হচ্ছে আল্লাহ আমাকে আপনাকে দিয়ে সে মায়ের আদরের কমতিটা পূরণ করে দিচ্ছে।
এর মধ্যেই তানভীর মধুমতি আর লিয়াকত সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
~ আমার একটা ভুল ধারণা ছিল সেটা আজকে একদম পাল্টে গেছে। আপনাদের না দেখলে সে ধারণাটা হয়তো কখনো পাল্টাত না।

তানভীরের কথা শোনে মধুমতি আর লিয়াকত সাহেব দুজনেই একসাথে বলে উঠল,
~ কি ধারণা শোনি?
~ আমি জানতাম বরিশালের মানুষ অনেক খারাপ। ছোটবেলা থেকে এমনেই শোনে এসেছি। বিভিন্ন ভাবে সবসময় দেখে এসেছি বরিশালের মানুষকে নানা ভাবে হেয় করে কথা বলা হয়। আপনাদের দেখে মনে হয় না বরিশালের মানুষ খারাপ। আপনাদের দেখে মনে হয় আপনারা একদম সরল মনের মানুষ।

লিয়াকত সাহেব তানভীরের কথা শোনে হালকা হেসে বলল,
~ সব এলাকায় ভালো মন্দ আছে কোনো এলাকায় কম কোনো এলাকায় বেশি। বরিশালেও ভালো আছে আবার খারাপও আছে তেমনি অন্য এলাকা গুলোতেও ভালো খারাপ আছে। ভালো খারাপ নিয়েই এ জগৎ। বিয়ের পর থেকে আমি আর মধুমতি সবসময় চেয়েছি মানুষকে সাহায্য করার। আমি তোমাদের সাপোর্ট করতাম না। তবে কেন করেছি জানো?
তানভীর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
~ কেন করেছেন?

~ কারণ আমিও মধুমতিকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। তাই আমার বাবা আমাকে ভিটায় থাকার জায়গা দেয়নি। এজন্য মধুমতিকে নিয়ে বরিশাল থেকে পাড়ি দিয়েছিলাম ঢাকা শহরে। শিক্ষিত হওয়ায় চাকুরির অভাব হয়নি। ঢাকায় এসে একটা ছোটখাট স্কুলে চাকুরি নিয়ে সংসার শুরু করি। তারপর বাচ্চা কাচ্চা হওয়ার পর পরিবারের সবাই মেনে নিছে।

লিয়াকত সাহেবের কথা শোনে তানভীর উৎসুক গলায় বলল,
~ আপনারা পালিয়ে বিয়ে করেছেন?
এর মধ্যে রুকুও মুখটাকে স্বাভাবিক করে বলল,
~ চাচী আপনাদের কাহিনিটা বলেন শোনি।

মধুমতি বেশ লজ্জা পাচ্ছিল তখন। একটু একটু মুচকি মুচকি হেসে বলল,
~ তোমার চাচাকে জিজ্ঞেস করো। আমি বলতে পারব না। বেশ লজ্জা লাগে আমার।
মধুমতির লজ্জা দেখে তানভীর হালকা হালকা হাসির ফিরিক তুলছে মুখে। আর লিয়াকত সাহেব একটা অট্ট হাসি দিয়ে বলল,
~ মধুমতি একটু লাজুক স্বভাবের সে বলতে পারবে না আমিই বলছি শোনো। মধুমতি তখন ক্লাস এইটে পড়ত। আমি মধুমতির লজিং মাস্টার ছিলাম। ওদের বাড়িতে থেকেই পড়াতাম ওকে। এখন এত লজ্জা পেলে কী হবে তখন বেশ চঞ্চল মেয়ে ছিল। সারাদিন পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার ধান্দায় থাকত।

কথাটা শোনে মধুমতি মুখটা বাঁকিয়ে বলল,
~ মোটেও পড়ায় ফাঁকি দিতাম না।
লিয়াকত সাহেব মধুমতির বাঁকা সুরের কথা শোনে জবাব দিল
~ সে তো কেমন ছিলে ভালোই জানি।

~ হ্যাঁ এখন বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে আমাকে লজ্জা দেওয়া হচ্ছে। তোমার চালাকি সব বুঝি আমি৷ সবসময় আমাকে ছোট করার ধান্দায় থাকো।

এক কথা দুই কথায় লিয়াকত সাহেব আর মধুমতি একটা ঝগড়া বাঁধিয়ে বসলো। তানভীর আর রুকুর তাদের ঝগড়া দেখে বেশ হাসছিল। ভালোবাসার খুঁনসুটি গুলো যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল। এদিকে মধুমতি ঝগড়ার এক পর্যায়ে গালটা ফুলিয়ে বসে রইল। লিয়াকত সাহেব মধুমতিকে রাগ করতে দেখে চুপ হয়ে এক পলকে মধুমতির দিকে তাকিয়ে রইল। তানভীর বেশ অবাক হয়ে বিষয়গুলো লক্ষ্য করতেছিল।

তাদের বয়স বাড়লেও যেন তাদের ভালোবাসার বয়স বাড়ে নি৷ দেখে মনে হচ্ছে সদ্য প্রেমে জড়ানো কোনো কপোত কপোতি প্রেম করছে। মধুমতির রাগী মাখা মুখটাতে যেন তরুণীর বয়সের একটা ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেই সাথে লিয়াকত সাহেবের চাহুনিতে একটা তরুণ যুবকের ছাপ প্রকাশ পাচ্ছে। লিয়াকত সাহেব কিছুক্ষণ তাকিয়ে মধুমতিকে ডেকে বলল,
~ আরে রাগ করে বসলে কেন?আমি তো তোমার সাথে মজা করছিলাম। কি যে করে বসো না৷

পরক্ষণেই লিয়াকত সাহেবের কথা শোনে মধুমতির মুখটা প্রশস্ত করে একটা হাসি দিল। লিয়াকত সাহেব যেন সে হাসি দেখে নিজের নয়ন জোড়াল। রুকুও তাদের খুঁনসুটি গুলো অপলক নয়নে দেখে ভাবতে লাগল ভালোবাসা কখনো বয়স মানে না। ভালোবাসা সবসময় বয়সের উর্ধ্বে। ভালোবাসা কখনো বুড়ো হয় না। ভালোবাসা সবসময় তরুণ সবসময় সজীব। এর মধ্যেই লিয়াকত সাহেব বলে উঠল,
~ কাহিনি তো এখনো বলা হয়নি। কাহিনিটা শোনো সবাই।

রুকু আর তানভীর এবার লিয়াকত সাহেবের দিকে মনোযোগ সহকারে তাকাল। এদিকে মধুমতির মুখে যেন লজ্জার বহিঃপ্রকাশ টা মুখ লাল হয়ে ফুটে উঠেছে। লিয়াকত সাহেব পুনরায় বলতে লাগল
~ মধুমতিকে যখন পড়াতাম। বেশ ভালো লাগত। তবে শিক্ষক মানুষ ছাত্রীকে প্রস্তাব কি করে দিই এই ভেবে মনের কথা বলা হত না। কয়েকবার বলার জন্য ছটফট করে বলতে নিয়েও বলতে পারিনি। এরমধ্যেই একদিন মধুমতি আমাকে প্রস্তাব দিয়ে বসলো।

কথাটা শোনে তানভীর আর রুকু বলে উঠল, আরে বাবা চাচী তো অনেক সাহসী। তানভীর আর রুকুর কথা শোনে মধুমতি লজ্জায় দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসতে লাগল। লিয়াকত সাহেব মধুমতির হাসিটা দেখেই বলল,
~ আজকে যেভাবে মুখ ঢেকে হাসছে সেদিনও মধুমতি প্রস্তাব দিয়ে এভাবে লজ্জা পেয়ে হাসছিল। মধুমতির হাসি দেখে সেদিন বুকের বাম পাঁজরে হালকা চিনচিন করে ব্যাথা হচ্ছিল। বলতে পারো ভালোবাসার ব্যাথা। সে থেকেই শুরু হয় আমাদের প্রেম কাহিনি।

মধুমতির বাবা ছিল একরোখা মানুষ। কীভাবে যেন বুঝতে পারল মধুমতির সাথে আমার সম্পর্ক চলছে তাই আমাকে পড়ানো থেকে বাদ দিয়ে মধুমতির বিয়ে ঠিক করে ফেলল। আমি তো তখন পাগল প্রায়। এখন তো ঘরে ঘরে মোবাইল আছে তখন তো মোবাইলও ছিল না। তোমার চাচীকে আবার ঘরের বাহিরেও আসতে দিত না। কি যে মুশকিলে পড়েছিলাম কি বলব। যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। বুকটা চিড়ে যাচ্ছিল। ভালোবাসার যন্ত্রণা অনেক বড় যন্ত্রণা।

এর মধ্যে জানতে পারি পনের দিন পর মধুমতির বিয়ে। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমার বাবাকে বললাম। আমার বাবা সরাসরি বলে দিল মধুমতিকে বিয়ে করলে বাড়িতে জায়গা দিবে না। তবে আমি মধুমতিকে ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারতাম না। অনেক কষ্টে রাতের অন্ধকারে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বিয়ের পাঁচদিন আগে ওর সাথে দেখা করি। জিজ্ঞেস করি আমাকে বিয়ে করবে কিনা। মধুমতি আর না করে নি। মধুমতিকে একটা চিঠি হাতে দিয়ে চলে আসলাম।

কীভাবে বাসা থেকে পালাবে সব চিঠিতে লিখে দিয়েছিলাম। সে ও তাই করলো। এরপর পালিয়ে বিয়ে করলাম। পরিবার জানার পর মেনে নেয়নি। সরাসরি মধুমতিকে নিয়ে চলে আসলাম ঢাকায়। শুরু হয় আমাদের পথ চলা আর সে পথ চলা ধরেই এখনো দুজনের পাশাপাশি আছি বেশ ভালো আছি।

বলে লিয়াকত সাহেব মধুমতির দিকে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে তাকাল। মধুমতিও তখন চুপ হয়ে রইল। দুজনের ভালোবাসার রেশ যেন কাটছে না। সে রেশটা মিনেট দশেক ছিল। কেবিনটা তখন জাহাজের হেলদুলের সাথে ভালোবাসার সাগরে হেলদুল খাচ্ছিল। নীরবতার সমাপ্তি ঘটে মধুমতির তীক্ষ্ণ কন্ঠে। মধুমতি রুকুর মাথায় হাত দিয়ে সুরেলা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠল,
~ তা মা অনেকক্ষণ তো হলো এবার খেয়ে নে। খেয়ে নিয়ে জাহাজের করিডোরে তোর স্বামীকে নিয়ে ঘুরে আস ভালো লাগবে।

রকু মাথাটা নত করে ভাঙ্গা গলায় জবাব দিল
~ এখন তো আর করিডোরে ঘুরতে পারব না। কারণ তেজস্বিনী দেখলে সমস্যা।
মধুমতি অবাক হয়ে বলল,
~ এ তেজস্বিনী টা আবার কে?
~ মেনালিই হলো তেজস্বিনী আমার সৎ মা। আমাকে
খুঁজার জন্য মোনালি সেজে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

মধুমতি রুকুর কথাটা শোনে দুগালে হাত দিয়ে মুখটা হা করে অবাকের সুরে বলল,
~ বাবারে বাবা কি সাংঘাতিক মহিলা। যাইহোক তুই চিন্তা করিস না। এখন তুই আর তানভীর খেয়ে নে। এখানে তরকারি আছে ভাত আছে খেয়ে নে। আমি আর তোর চাচা গেলাম। একটু পর আবার আসব।
বলেই লিয়াকত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তোমার মোবাইল নম্বরটা ওদের দাও তো। ওদের নম্বরটাও নাও যাতে কল দিয়ে খুঁজ নিতে পারি।

মধুমতির কথা শোনে লিয়াকত সাহেব তানভীরের সাথে নম্বর আদান প্রদান করে মধুমতিকে নিয়ে কেবিন থেকে প্রস্থান নিল। এদিকে তানভীর খাবারগুলো নিয়ে রুকুর দিকে এগিয়ে দিল। রুকুর তখন ক্ষুধায় পেট টা চুচু করছিল। সারাদিন তেমন কিছু খেতে পারে নি৷ খবারগুলো পাওয়ার সাথে সাথে গপাগপ খেয়ে নিল। তানভীর রুকুকে এমন ভাবে হুমরি খেয়ে খেতে দেখে একটু চমকালো বটে। তবে সেটা প্রকাশ না করে নিজের খাওয়াতে মনোযোগ দিল। দুজন খেয়ে একটা ঢেকুর তুলতেই তানভীরের ফোনে লিয়াকত সাহেব কল দিল। লিয়াকত সাহেবের কল পেয়েই তানভীর ধরে হাস্যমাখা মুখে বলল,
~ হ্যাঁ চাচা বলেন।

ফোনের ওপাশ থেকে লিয়াকত সাহেব বলে উঠল,
~ বাবা দরজাটা একটু খুলো।
তানভীর দৌঁড়ে কেবিনের দরজা খুলতেই লিয়াকত সাহেব একটা ব্যাগ এগিয়ে দিল। লিয়াকত সাহেবের ব্যাগটা হাতে নিয়ে কৌতুহলের সুরে বলল,
~ এটা কিসের ব্যাগ চাচা?

লিয়াকত সাহেব খিক করে হেসে দিয়ে বলল,
~ এটা তোমার চাচী রুকুর জন্য পাঠিয়েছি। এতে তোমার চাচীর একটা বোরকা আছে ওকে পড়িয়ে একটু বাইরে ঘুরতে বের হও দুজনেরেই ভালো লাগবে।
বলেই লিয়াকত সাহেব চলে গেল। তানভীর বোরকাটা নিয়ে রুকুর দিকে এগিয়ে দিয়ে হালকা হেসে বলল,
~ এ বোরকটা পড়ে মুখটা আটকে ফেলুন। আপনাকে একটু লঞ্চ টা ঘুরে দেখাই। একঘেয়েমিটা কেটে যাবে। মনটাও ফ্রেশ লাগবে।

কথাটা শোনে রুকুর মনে যেন আনন্দের চিলিক দিল। এক পসলা বৃষ্টির পর যেমন সূর্য রশ্নি উঠে পৃথিবীকে আলোকিত করে হাস্যউজ্জ্বল করে তেমনি রুকুর মনেও সূর্য় কিরণের জ্বলকানির মতো খুশির রেখা ফুটে উঠেছে। বোরকাটা তানভীরের হাত থেকে চট করে নিয়ে পড়ে নিল। সেই সাথে নিকাবটাও বেঁধে নিল। এ মুহুর্তে রুকুর চোখ গুলো শুধু তানভীর দেখতে পাচ্ছে।

রুকুর চোখগুলো দেখে তানভীর যেন সে চোখে আটকে গেল। খেয়াল করল চোখটা এত টানা টানা না কিন্তু চোখটা দুইটা ভাঁজ দিয়ে ভেতরে ঢুকে আছে তবে চোখের লেন্সটা যেন একটু উপরের দিক হয়ে ভেসে আছে। তানভীরের জানামতো ডাগর ডাগর চোখ বলা হয় সে চোখকে যে চোখের পাপড়ি গুলো বেশ বড় আর টানা টানা। তবে রুকুর চোখে এর কোনো বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান নেই কিন্তু চোখের লোন্সটা এমন ভাসা ভাসা থাকলে সে চোখেকে কি চোখ বলা হয় সেটা আপাতত জানা না থাকলেও রুকুর চোখের মায়ায় কিছুক্ষণের জন্য তানভীর আটকে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। কারণ মেয়ে মানুষের চোখের মায়ায় পড়ার মতো বোকা কাজ টা সে করতে চায় না। তবে মেয়েরা তাদের চোখ দিয়ে খুব সহজে একটা ছেলেকে মায়ার জাল বিছিয়ে কপোকাত করতে পারে। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ রুকুর চোখগুলো। তানভীরকে এভাবে তাকিয়ে দেখে রুকু হালকা অস্বস্তি নিয়ে বলল,
~ কী ব্যাপার কী দেখছেন?

তানভীর রুকুর কন্ঠটা শোনার সাথে সাথে রুকুর চোখ থেকে চোখটা সরিয়ে নিয়ে বলল,
~ নাহ কিছু না। চলুন বাইরে যাওয়া যাক।
বলেই রুকুকে নিয়ে কেবিনের বাইরে গেল। করিডোরে যেতেই রুকু থমকে গেল। কারণ…

লেখিকা: শারমিন আঁচল নিপা

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের”অজানা আলোর খোঁজে – Valobasar Misty Golpo” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – অজানা আলোর খোঁজে (শেষ খণ্ড) – Valobasar Misty Golpo

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *