তোমার আমার গল্প – অন্যরকম ভালোবাসার অধ্যায়

তোমার আমার গল্প – অন্যরকম ভালোবাসার অধ্যায়: সে এক প্রকার ডিপ্রেশনে ছিলো এতোদিন। আর হঠাৎ এতো বড় শক খেয়েছে যে তার ব্রেইন সেটা নিতে পারেনি। তার মধ্যে বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই।


পর্ব-১

এসএসসি মডেল টেস্ট চলছে। বিছানার সাইডে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে অংক করছিলাম। হঠৎ কি হলো বুঝলামনা সাহের ভাইয়া আমার সামনে এসে বসে আমার দু গালে হাত দিয়ে কপালে গালে কিস করে উধাও হয়ে গেলো। চোখের পলকেই যেনো সব ঘটে গেলো।

পাক্কা ২ ঘন্টা লাগলো আমার বুঝতে যে আমার সাথে কি হয়ে গেলো। মাথা তো পুরোই হ্যাং মারছে। কিসের অংক কিসের কি। আমিতো ভুলেই গেলামযে কাল আমার অংক পরীক্ষা। এ কেমন বজ্জাত ছেলেরে বাবা। গত ১ বছর যার কোনো খোঁজ খবর ছিলোনা আজ হঠাৎ এসে হাজির আবার কিস ও করে দিয়ে গেলো। নাহ এটা তো মানা যাচ্ছে না। এর কিছু একটা তো করতেই হবে।

যেইভাবা সেই কাজ হন হন সাহের ভাইয়ার রুমে চলে গেলাম। দেখি সে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলাচ্ছে। দেখে রাগ টা তো আরো বেড়ে গেলো।
কিছু বলতে যাবো তখনি,
“একটাতে মন ভরেনি নাকি আবার এসে পড়লি যে! “বলেই এক শয়তানি মারকা হাসি দিলো সাহের।

“আমার চোখ এবার খুলে হাতে এসে পরবে যা মনে হচ্ছে। এই ছেলে বলে কি। কান দিয়ে ধুয়া বের হচ্ছে। নেশাটেশা করেছে নাকি আজব তো। আমি এখান থেকে যাই বাবা না হলে এই বজ্জাতটা আবার কি করে ফেলে কে জানে।”দ্রুত সেখান থেকে নিজের রুমে চলে এলাম।

(আমি নিয়ামা। বাবা মায়ের ছোট মেয়ে। আমার বড় একজন ভাই আছে। আমরা জয়েন ফ্যামিলিতে থাকি। আমার বাবারা ৩ ভাই। সারাদিন হৈ হৈ করতেই আমাদের দিন পার হয়ে যায়। আমার বাবা ভাইদের মধ্যে সব থেকে ছোট। আর এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম সে আমার বড় চাচার ছোট ছেলে। সবার চোখের মণি। সে আমার থেকে ৪ বছরের বড়। এসএসসি দেওয়ার পরই ঢাকা চলে যায় পড়ালেখা করতে আর আমাদের বাড়ি রাজশাহী)

এই বজ্জাতের বাচ্চা আমাকে কত ইগ্নোরই না করেছে। প্রথমবার ভার্সিটি চান্স পায়নি বলে গত একটা বছর বাসার কারো সাথে যোগাযোগ করেনি তেমন। এমনকি ২ ঈদেও বাসায় আসেনি। আব্বু চাচা ছাড়া কেউই ওর খবর জানতোনা। আর আমাকে তো সেখানে গোনায়ই ধরেনি সে। সে চান্স পেয়েছে ২ সপ্তাহ হয়েছে। সেই খুশিতে আজ হুট করে হাজির হলো বাসায়। এখন আবার এই কান্ড ঘটালো।

আসলেই খবিশ একটা। দুনিয়াতে ছেলের অভাব পরেছিলো যে এই খবিশের প্রেমেই পরলাম তাও আবার ছোট থেকেই। ছোটবেলা আমার আর তার বন্ডিং অনেক ভালো থাকলেও যত বড় হতে থাকি কোনো এক অদ্ভুত কারণে সে আমাকে ইগ্নোর করা শুরু করে।
এগুলো ভাবতে ভাবতে আবার দরজায় টোকার আওয়াজ পেলাম। রুমের দরজা খুলে দেখলাম বজ্জাত টা কোলবালিশ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
“তুমি আবার কেন এসেছো?”কি চাও এখানে?”

“তোর কোলবালিশটা লাগবে দেতো। এটা নিয়ে।”

বলের হাতে রাখা কোলবালিশের দিকে ইশারা করলো।
“আজব তো তোমার হাতে তো কোলবালিশ আছে আমারটা কেন লাগবে?”
“আমি বললাম না তোরটা লাগবে মানে তোরটাই লাগবে।”

সে জোরপূর্বক আমার কোলবালিশটা নিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে চলে গেলো। প্রতিবার এই রাক্ষসটা এমন ই করে। ঢাকায় যাওয়ার পর থেকেই সে এই অদ্ভুত কান্ড টা করে। যখনই বাসায় আসে আমার কোলবালিশটা নিয়ে যায় খালি। বজ্জাতের হাড্ডি।

পরের দিন সকালে পরীক্ষা দিতে গেলাম। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় এসে দেখি সে নেই। এতো কষ্ট পেয়েছিলাম একটু বলেও গেলো না আমাকে। তাকে কল দিলাম কিন্তু ফোন ধরলো না। আবার কল দিলাম কিন্তু রিসিভ হলো না। ঐদিন সারাদিন ওকে কল দিয়েই গেলাম কিন্তু ধরলো না সে।

আমার সাথে এমন করে সে যে কি মজা পায় তা সে আর আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। দিনের পর দিন তার অপেক্ষায় কাটতে থাকে আমার। এর মধ্যে আমার এসএসসিও শেষ হয়ে যায়। এর মধ্যে সে একবারো বাসায় আসেনি। এমনকি এসএসসি দিচ্ছি এতেও যেনো তার মাথা ব্যাথাই নেই। তার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করি কিন্তু পারিনি।

আমি কলেজে ভর্তি হই। নতুন লাইফ নিয়ে বিজি হয়ে যাই। কিন্তু তাকে ভুলতে পারিনি। দিন শেষে তার কথা মনে করে চোখের জল ফেলা আমার ডেইলি রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একদিন বাসায় সবাই মিলে প্রোগরাম করলো বড় ফুপিদের বাড়ি যাবে। যথারীতি সে ও এলো। তাকে দেখে আমার খুশি দেখে কে! মনে হচ্ছিলো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। কিন্তু এই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। সে আমাকে পাত্তা তো দূরে থাক আমার দিকে তাকালো অব্দি না। এমনকি ঐদিন বিকেলে সেখান থেকে চলেও গেলো। এই ছেলের মনে যে কখন কি চলে বোঝা বড্ড দায়।

সেদিনের পর থেকে ঠিক ৩ মাস পর সে বাসায় এলো। এই ছেলে দিনে দিনে এমন হ্যান্ডসাম কেন হচ্ছে কে জানে।
আমিও এবার খুব ভাব নিয়ে রইলাম। নাহ আর কথা বলবোনা। কিন্তু কথা না বলে কি আর পারা যায়!
সে রুমে একা একা বসে আছে। আসার পর থেকেই দেখছি মন মেজাজ কেমন জানি খিটখিটে তার। চাচির সাথে চিল্লাচিল্লি করছে।

অন্য কাজিনদেরও শুধুশুধুই বকছে। আমার দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে কাঁচাই গিলে খাবে। তার রুমে যাবো কি যাবো ভাবতে ভাবতে ৩ ঘন্টা পার করে ফেলেছি। শেষে খুব ভয়ে ভয়ে তার রুমের দিকে এগুলাম। মনে মনে দুয়া দরুদ পড়ছিলাম।

সে লেপটপে কি জানি কাজ করছিলো। আমার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো
“রিমন কে রে?”
“কে আবার আমার ফ্রেন্ড বেস্ট ফ্রেন্ড।”

“এতো ছবি তার সাথে। যেখানেই যাস তাকে নিয়ে যাস এর মানে কি? কলেজে উঠে খুব পাখনা গজিয়েছে তোমার তাই না!
আমিও একটা চান্স পেয়ে গেলাম তার কাছ থেকে কথা বের করার।

খুব ভাব নিয়ে বললাম,
“হ্যা তুমি ঠিক বলেছো। ও আমার বয় ফ্রেন্ড। আর আমরা একজন আরেকজনকে অনেক লাভ করি। ও আমার অনেক কেয়ার করে। আমিতো চিন্তা করেছি ওকেই বিয়ে করবো। ও তো আর যারতার মতো…
বাকিটুকু বলতে পারলামনা তার আগেই ঠাস করে গালে লাগিয়ে দিলো। আমি হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছি গালে হাত দিয়ে।

কি হলো বুঝতে পারলাম না। সে হুট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
“আর নেক্সট টাইম এমন কিছু বললে তোমকে খুন করে ফেলবো বলে দিলাম। বলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলো।”

আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। মানুষটা এমন কেনো। ভালোবাসলে বলে দেক না। আমার মন বলে তুমিও আমাকে ভালোবাসো। নাহ আর ভাবতে পারছিনা। পড়ে যাওয়ার কারণে কোমরে অনেক ব্যাথা পেয়েছি।

পরেরদিন সে চলে গেলো। কিন্তু লক্ষ্য করলাম তার হাতে ব্যান্ডেজ করা। কিছু বুঝতে বাকি রইলোনা আমার।
এভাবে দিন কেটে যেতে থাকলো। দেখতে দেখতে আরো ৬ মাস চলে গেলো। কাল আমার বার্থডে। ভেবেই ভালো লাগছে। কিন্তু সে আমাকে উইশ করবে বলে মনে হচ্ছেনা। তারতো নিজের বিডেই মনে থাকেনা আবার আমারটা।

রাত ১২টা বাজে তখন। ফোনে কথা বলছিলাম। সবাই উইশ করছিলো। হঠাৎ বারান্দায় দরজায় টোকার আওয়াজ পেলাম। আমরা দোতালায় থাকি। আর আমার বারান্দায় গ্রিলও নেই। গ্রিলসহ বারান্দা আমার পছন্দ না। এতো রাতে কে এলো তাও আবার বারান্দা দিয়ে ভেবেই ভয় লাগছে। হাতে একটা ঝারু নিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে বারান্দার দিকে এগুলোম। দরজা খোলার সাথে সাথে…..


পর্ব ২

দরজা খোলার সাথে সাথে সাহের ভাই আমাকে বার্থডে উইশ করলো। হাতে কেক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমি তো ভুত দেখার মতো চমকে গেলাম স্বপ্ন দেখছিনাতো!নিজের হাতে নিজেই চিমটি কাটলাম। নাহ সে আমার সামনেই আছে। আমার দিকে তাকিয়ে সেই ভুবন ভুলানো হাসি দিচ্ছে।
“সাহের ভাই তুমি এতো রাতে এখানে কি করছো? আর নিজের বাসায় এমন চোরের মতো কেনো এসেছো?”

“আরো জোরে বল পুরো দুনিয়া জানিয়ে দে। আহম্মক কোথাকার”। আমাকে ঝাড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো।”
“তুমি আসলে কিভাবে এখানে?”

“তুইতো জানিসই আমার পারসোনাল হেলকপ্টার আছে ওটা দিয়ে এসেছি।
আরে গাধি বাসার পাইপ বেয়ে বেয়ে এসেছি।”

“তোর গাজাখুরি প্রশ্ন শেষ হলে এখন কেকটা কেটে আমাকে উদ্ধার কর।”
আমি কেক কাটলাম। সে আমাকে কেক খাইয়ে দিলো আবার গালেও মেখে দিলো।
“আচ্ছা নিমু আমি এখন যাই রে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে।”

সাহের ভাই আমাকে নিমু ডাকে। নিয়ামা ডাকতে নাকি তার কষ্ট হয়। তার যাওয়ার কথা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার।
হঠাৎ সে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। আমাকে ধরার সময়টুকুও দিলো না। বারান্দার পাইপ বেয়ে নিচে নেমে চলে গেলো। আমি তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম।

এভাবেই কেটে গেলো আরো দুটো বছর। কখনো তার ভালোবাসা আবার কখনো তার অবহেলা। যদিও অবহেলার পরিমাণটাই বেশি ছিলো। সব মিলিয়ে আমার মনে যে কত রকম ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো তা তার জানা নেই। আমি কলেজ পাড় করে ভার্সিটিও উঠে গেলাম। তার অনার্স তখন শেষের দিকে। এতদিনেও তার কাছ থেকে ভালোবাসি শোনা হয়নি আর না কখনো আমার মনের কথা তাকে বলা হয়েছে।

একদিন সে বাসায় জানিয়ে দিলো সে কানাডা যেতে চায় মাস্টার্স করতে। আবার সাথে নাকি তিরুও যাবে (সাহেরের খালাতো বোন)। তিরু ডাক্তারি পড়ছে। যে ভাবা সেই কাজ খুব জোরেসোরে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হলো তার যাওয়ার। বড় চাচি তো দিনরাত কাঁদতে কাঁদতে একাকার করে ফেলেছে। তার যক্ষের ধন কানাডা যাচ্ছে এত দূরে।

তার যাওয়ার কথা শুনে তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তার উপর আবার তিরু আপুও যাবে। তিরু আপু সাহের ভাইয়ের থেকে ১ বছরের ছোট হলেও তাদের বন্ডিং অনেক ভালো। ঠিক যেনো বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি তার কাছে এতই সস্তা। আমাকে একটাবারও জানালো না। ভাবতে ভাবতেই কেঁদে ফেললাম।

কিছুদিন পর সে বাসায় এলো। কানাডা যাওয়ার আগ অব্দি সে বাসায়ই থাকবে। আসার পর থেকে তার ভাব যেনো ৩-৪ গুন বেড়ে গেলো। আমাকে কথায় কথায় ঝাড়ি দিচ্ছে অপমান করছে। একদিন আমাকে ছাদে ডেকে পাঠালো সে।

ছাদে যেয়ে দেখলাম দাড়িয়ে আছে সে।
“কেমন আছিস রে নিমু?”

জি ভাইয়া ভালো। তুমি কেমন আছো?
সাহের ভাই আমার কথার উত্তর দিলোনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে এখনো। আর আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি।

“জানিস নিমু আমি আমার ড্রিম পূরণের দিকে এক ধাপ করে এগিয়ে যাচ্ছিরে। সেই বাচ্চা কাল থেকে তো একটা ড্রিমই দেখে আসছি। আমার ছোট বেলার ড্রিম”।

বাহ ভালো তো তোমার কানাডা যাওয়া যে ছোট বেলার ড্রিম আমার জানা ছিলোনা। কিন্তু আমার ড্রিমের কি হবে? আমার ড্রিম যে তুমি সাহের ভাই, মনে মনে বললাম।
হঠাৎ আমার মাথায় কি চাপলো বুঝলাম না, আমি তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“তুমি কি আমার হবে সাহের ভাই?”

নাহ তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখছি না। সে আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছে। ভাব এমন জীবনে আকাশ দেখেনি। নিজেকে বড্ড ছোট মনে হচ্ছে আজ। অপমানিতো বোধ হচ্ছে তাকে ছেড়ে দিয়ে নিচের দিকে চেয়ে আছি। চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে।
চারিদিকে পিনপতন নিরবতা, হঠাৎ সে বলে উঠলো,
“আমার আর ১ সপ্তাহ আছে কানাডা যাওয়ার। আমি যাওয়ার পর তুই আমার সাথে কোনো ধরণের কন্টাক্ট করতে পারবিনা।”

আমি অসহায়ের মতো তার দিকে চেয়ে রইলাম। এতটা নিষ্ঠুর কেউ হতে পারে। আমার দিকে একবারো তাকাচ্ছেও না। আমার কান্নাও আজ তাকে স্পর্শ করছে না বাহ। যে আমি ছোট বেলাই একটু কান্না করলেই সে পুরো বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেলতো।
“যা বলেছি মাথায় রাখিস।”

হ্যা সাহের ভাই মনে রাখবো। তোমার কোনো কথা কি আমি আজ অব্দি অমান্য করেছি যে আজ করবো!
আমি ছাদ থেকে চলে এলাম। দ্বিতীয়বার আর তার দিকে তাকিয়ে দেখিনি। অভিমানে তার উপর এক জিদ চেপে গেলো। ঐদিন থেকে আমি পারতো পক্ষে তার সামনে না যাওয়ার চেষ্টা করতাম।

সে চলে গেলো কানাডা। সে যাওয়ার পরপরই সিম চেঞ্জ করে ফেললাম ফেইসবুক আইডি ডিএক্টিভেইট করে দিলাম। যাতে তার সাথে যোগাযোগ করতে না পারি।
এভাবেই দিনের পর দিন যেতে লাগলো। আমার অভিমান রাগ জিদ ভালোবাসার সবকিছুর এক সংমিশ্রণ ঘটছিলো।

এমন কোনো রাত নেই আমি তার জন্য কান্না করিনি। সবসময় হাসিখুশি থাকা আমি কেমন যেনো হাসতেই ভুলে গেলাম। মাঝে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লাম যে আমাকে হসপিটালে ভর্তি করা লাগলো। এরপরও সে আমার খোঁজ নেয়নি। একবারও কল দেয়নি। একটা সময় কান্নাকাটি অফ করে দিলাম। কেমন যেনো পাথর হয়ে গিয়েছিলাম।

আমার অভিমানগুলো জমতে জমতে একসময় তা পাহাড় সমান হয়ে গেলো। এভাবেই কেটে গেলো ১ টি বছর।
হঠাৎ একদিন আম্মু এসে বললো সাহের আসছে নতুন বউ নিয়ে। নতুন বউ আসবে বলে বেশ হৈচৈ মেচে গেলো বাসায়।

আমি রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছি ৫ ঘন্টা যাবৎ। নিজেকে বড্ড নিম্ন জাতের প্রাণি মনে হচ্ছে। আয়ার কাছে গেলাম, আজ নিজেকে বড্ড খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। কতদিন ভালোভাবে আয়না দেখা হয়না। মনে হলো আয়নার ওপারের মানুষটাও মজা নিচ্ছে। আয়নাটা ভেঙে ফেললাম। আমি এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।

হঠাৎ আমার ডাক আসলো সাহের এসে গেছে নতুন বউ নিয়ে। আমি এক তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। রুম থেকে বের হয়ে দেখি চারদিক খুব সুন্দর করে সাজানো। বিয়ে বিয়ে ভাব একটা চারদিকে। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। সাহের ভাইয়ের তিরু আপুকে দেখতে পেলাম। খুব সুন্দর লাল টুকটুকে শাড়ি পরে আছে। কি সুন্দর মানিয়েছে তাদের।

আমাকে দেখে সাহের ভাই আমার সামনে এসে দাড়ালো। সেই ভুবন ভুলানো হাসি দিলো কি যেনো বলছে আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিনা। আমার চারদিক ঝাপসা হয়ে আসছে। সব কিছু যেনো তলিয়ে যাচ্ছে। সাহের ভাইকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম যতটা শক্তি দিয়ে ধরা যায়।
সে আমার দিকে কেমন যেনো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমার ঠোঁটের কোণে এক চিলেতে হাসি ফুটে উঠলো। খুব কষ্ট করে বললাম ভালোবাসি এতটুকু বলেই তার কোলে লুটিয়ে পড়লাম।

৪ বছর পর…

সাহের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ থেকে ঠিক ৪ বছর আগে আজকের দিনের কথা মনে করে তার ভিতরটা যেনো দুমড়ে মুচড়ে গেলো। সেদিন…

সেদিন নিমু যখন সাহেরের কোলে লুটিয়ে পরে তখন সবাই খেয়াল করে নিমুর হাত বেয়ে রক্ত পড়ছে। কারো বুঝতেই বাকি রইলোনা যে কি হয়েছে। নিমুর ভাই দৌড়ে নিমুর রুমে গিয়ে দেখে আয়ানা ভাঙা, ফ্লোরে রক্তের ফোটা, বিছানার উপর অনেক গুলো ঘুমের ঔষধের পাতা।

নিমুর ভাই এগুলো দেখে চিৎকার দিয়ে উঠে। সাহের তখনো নিমুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন আগেও যে বাড়ি আলোক সজ্জায় সজ্জিতো ছিলো এখন তা কেমন এক বিষাদময় বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কান্নার রোল পড়ে গেছে পুরো বাড়ি জুড়ে। নিয়ামার মা বাবা কপাল চাপ্রাচ্ছে।
নিমুর ভাই তুর্য এসে নিমুকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলো। সাথে সাহেরের বাবা এবং নিমুর বাবাও গেলো।

সাহের এখনো ঠাই বসে আছে সেখানে। তার মাথা কাজ করছে না। কি থেকে কি হয়ে গেলো সে কিছু বুঝতে পারছে না। এইতো কিছুক্ষন আগেও সব কিছু কত সুন্দর ছিলো। সে আজ তার নিমুকে প্রপোস করবে। সারপ্রাইজ দিবে বলে কাজিও নিয়ে এসেছে বিয়ে করার জন্য।

পুরো পরিবারকে রাজি করিয়েছে নিয়ামাকে বিয়ে করার জন্য। এত সব প্ল্যান এতো আয়োজন করেছে তার পাগলিটাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য। কিন্তু কি হয়ে গেলো এটা! সে তো এমনটা চায়নি। সাহের এবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। দেওয়ালে নিজের হাত বাড়ি দিতে লাগলো নিজেকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো।

সাহেরের মা এবং বাকি কাজিনরা এসেও তাকে সামলাতে পারছেনা। সে আবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।
“মা ও মা আমি নিমুকে বড্ড ভালোবাসি।

আমার বুঝ হওয়ার পর থেকে আমি শুধু ওকেই ভালোবেসে এসেছি মা। আমার নিমু চাই।”বলে চিৎকার করতে লাগলো।
উপস্থিত সবাই কাঁদছে। যেই ছেলে কোনোদিন কাঁদা তো দূরে থাক যেকোনো পরিস্থিতে নিজেকে শক্ত রেখেছে সে আজ বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে।
সাহের নিয়ামার রুমে চলে গেলো। সেখানে নিয়ামার ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।

“একটাবার আমার কাছে ফিরে আয়রে। যা শাস্তি দিবি মাথা পেতে নিবো। আর কোনোদিন তোকে কষ্ট দিবোনা, অবহেলা করবো না। তুই জানিসনা আমি তোকে কত ভালোবাসি। আমার ছোট বেলা থেকে একটাই স্বপ্ন তোকে নিজের বউ বানানো। তোকে হারাবার ভয় আমাকে বড্ড তাড়া করে বেড়াতো। তুই তো সব জানতি, আমাদের ফ্যামিলিতে রিলেটিভদের মধ্যে বিয়ে এলাও না। শামীম ভাইয়া (মেজো চাচার বড় ছেলে) আর তার খালাতো বোনের ( মৌ) রিলেশন নিয়ে কত ঝামেলা হয়েছিলো। বাসায় জানাজানি হওয়ার পর কত কি ই না হয়েছিলো।

তারা পালিয়েও গিয়েছিলো সবার অমতে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এমন হোক আমি তা চাইনি কোনোদিন। আমি যদি শক্ত না হতাম তাহলে দেখা যেতো কোনো ভুল করে বসতাম। তোকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা যে আমার দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিলো।

তাইতো সবসময় দূরে দূরে থাকতাম তোর থেকে। রিলেশন করলে যদি সবাই জেনে যেতো, আমাদের যদি আলাদা করে দিতো তাহলে কি হতো বল। আমি তো জানি তুই কোনোদিন ফ্যামিলির বিপক্ষে গিয়ে আমাকে বিয়ে করতি না। আমিও পারতামনা ফ্যামিলিকে কষ্ট দিয়ে কিছু করতে। তাইতো তোর থেকে দূরে থাকা।

আমাকে সবাই অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। আমি কিভাবে তাদের বিশ্বাস নষ্ট করতাম। নিজের মতো চেষ্ট করে গেছি তোকে পাওয়ার। তোকে পেতে তোর থেকে অনেক দূর কানাডায়ও গিয়েছি যাতে ভালোভাবে সেটেল হতে পারি।

জানিস কত কাঠখোড় পুড়িয়ে রাজি করিয়েছি সবাইকে। আর তুইতো সবার আদরের লাডলি বাচ্চা। তাইতো তারা চেয়েছে ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকুক। আমার সাথে বিয়ে দিতেও রাজি হয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলাম তোকে সারপ্রাইজ দিবো। তোর জীবনের সেরা উপহার তোকে দিবো। কিন্তু তুই যে আমার জন্য এতো বড় সারপ্রাইজ রেডি করে রেখেছিলি আমার জানা ছিলো না।”

সাহের পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো।
প্লিজ আমাকে আরেকবার বল না রে, “তুমি কি আমার হবে সাহের ভাই”। বিশ্বাস কর এবার তোকে ফিরিয়ে দিবোনা, বুকে টেনে নিবো।
“আমাকে আমার নিমুর কাছে যেতেই হবে। আমার নিমু কষ্ট পাচ্ছে। আমাকে যেতেই হবে।”বলেই সাহের হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

হসপিটালে পৌঁছানোর পর সে নিয়ামাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেলো। তখনই তুর্য এসে সাহেরকে ইচ্ছামতো মারতে লাগলো। সাহের কোনো প্রতিবাদ করছেনা।
“তোর জন্য আজ আমার বোনটার এই অবস্থা। তুই জানতি না আমার বোনটা তোকে ভালোবাসে। আমাকে বলিসনি কেনো।

আমি আজ পর্যন্ত তোর সব কিছুতে সাপোর্ট দিয়েছি। নিমু আমার সাথে ফ্রি ছিলোনা বেশি তাই আমি ওর সব কিছু তোর থেকে জানতাম। আর এতো বড় কথা তুই আমাকে বলিসনি। তুই আমার বোনটাকে এতটা কষ্ট কিভাবে দিলিরে। তোর একটুও মায়া হয়নি ওর জন্য!আবার এসেছিস ঢং দেখাতে। তুই জানতিস না আমি আমার বোনের জন্য সব কিছু করতে পারি। একবার বলেই দেখতি।”বলেই তুর্য কাঁদতে লাগলো।

“আমাকে নিমু এনে দাও ভাইয়া। আমি বড্ড ভুল করে ফেলেছি। আমি আর কোনোদিন ওকে কষ্ট দিবোনা।”
সাহের তুর্যের পা ধরে বসে কাঁদতে লাগলো।

ঠিক তখনি ডাক্তার বের হলো। সবাই দৌড়ে ডাক্তারের কাছে গেলো।
তুর্য ভয়ার্ত সুরে বললো,
“নিমু ঠিক আছে তো!”প্লিজ বলেন ডাক্তার।

আসলে মিস নিয়ামা ঘুমের ঔষধও খেয়েছে এবং হাতের রগও কেটেছে। অতিরিক্ত চাপ নিতে না পেরে তার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। ইন্টারনাল ইঞ্জুরি অনেক বেশি বাইরের থেকে। ইন্টারনাল যে ব্লিডিং হচ্ছে তা বেড়েই চলছে। সে নিজেকে শেষ করার জন্য সব করেছে।

সে এক প্রকার ডিপ্রেশনে ছিলো এতোদিন। আর হঠাৎ এতো বড় শক খেয়েছে যে তার ব্রেইন সেটা নিতে পারেনি। তার মধ্যে বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই। আমরা আসলে অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু…
তিরুর ডাকে সাহের বাস্তব জগতে ফিরে এলো। চোখের পানি মুছে তিরুর দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো।

তোমার জন্য চা এনেছি। চা টা খেয়ে নাও। সাহের তিরুর হাত থেকে চায়ের কাপ টা নিয়ে দোলনায় গিয়ে বসলো। তিরুও সাহেরের পাশে যেয়ে বসলো।
হঠাৎ পাশের রুম থেকে….


পর্ব ৩

সেদিন নিমু যখন সাহেরের কোলে লুটিয়ে পরে তখন সবাই খেয়াল করে নিমুর হাত বেয়ে রক্ত পড়ছে। কারো বুঝতেই বাকি রইলোনা যে কি হয়েছে। নিমুর ভাই দৌড়ে নিমুর রুমে গিয়ে দেখে আয়ানা ভাঙা, ফ্লোরে রক্তের ফোটা, বিছানার উপর অনেক গুলো ঘুমের ঔষধের পাতা।

নিমুর ভাই এগুলো দেখে চিৎকার দিয়ে উঠে। সাহের তখনো নিমুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন আগেও যে বাড়ি আলোক সজ্জায় সজ্জিতো ছিলো এখন তা কেমন এক বিষাদময় বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কান্নার রোল পড়ে গেছে পুরো বাড়ি জুড়ে। নিয়ামার মা বাবা কপাল চাপ্রাচ্ছে।
নিমুর ভাই তুর্য এসে নিমুকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলো। সাথে সাহেরের বাবা এবং নিমুর বাবাও গেলো।

সাহের এখনো ঠাই বসে আছে সেখানে। তার মাথা কাজ করছে না। কি থেকে কি হয়ে গেলো সে কিছু বুঝতে পারছে না। এইতো কিছুক্ষন আগেও সব কিছু কত সুন্দর ছিলো। সে আজ তার নিমুকে প্রপোস করবে। সারপ্রাইজ দিবে বলে কাজিও নিয়ে এসেছে বিয়ে করার জন্য। পুরো পরিবারকে রাজি করিয়েছে নিয়ামাকে বিয়ে করার জন্য। এত সব প্ল্যান এতো আয়োজন করেছে তার পাগলিটাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য।

কিন্তু কি হয়ে গেলো এটা! সে তো এমনটা চায়নি। সাহের এবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। দেওয়ালে নিজের হাত বাড়ি দিতে লাগলো নিজেকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো।
সাহেরের মা এবং বাকি কাজিনরা এসেও তাকে সামলাতে পারছেনা। সে আবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।

“মা ও মা আমি নিমুকে বড্ড ভালোবাসি। আমার বুঝ হওয়ার পর থেকে আমি শুধু ওকেই ভালোবেসে এসেছি মা। আমার নিমু চাই।”বলে চিৎকার করতে লাগলো।
উপস্থিত সবাই কাঁদছে। যেই ছেলে কোনোদিন কাঁদা তো দূরে থাক যেকোনো পরিস্থিতে নিজেকে শক্ত রেখেছে সে আজ বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে।
সাহের নিয়ামার রুমে চলে গেলো। সেখানে নিয়ামার ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।

“একটাবার আমার কাছে ফিরে আয়রে। যা শাস্তি দিবি মাথা পেতে নিবো। আর কোনোদিন তোকে কষ্ট দিবোনা, অবহেলা করবো না। তুই জানিসনা আমি তোকে কত ভালোবাসি। আমার ছোট বেলা থেকে একটাই স্বপ্ন তোকে নিজের বউ বানানো। তোকে হারাবার ভয় আমাকে বড্ড তাড়া করে বেড়াতো। তুই তো সব জানতি, আমাদের ফ্যামিলিতে রিলেটিভদের মধ্যে বিয়ে এলাও না।

শামীম ভাইয়া (মেজো চাচার বড় ছেলে) আর তার খালাতো বোনের ( মৌ) রিলেশন নিয়ে কত ঝামেলা হয়েছিলো। বাসায় জানাজানি হওয়ার পর কত কি ই না হয়েছিলো। তারা পালিয়েও গিয়েছিলো সবার অমতে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এমন হোক আমি তা চাইনি কোনোদিন। আমি যদি শক্ত না হতাম তাহলে দেখা যেতো কোনো ভুল করে বসতাম। তোকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা যে আমার দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিলো।

তাইতো সবসময় দূরে দূরে থাকতাম তোর থেকে। রিলেশন করলে যদি সবাই জেনে যেতো, আমাদের যদি আলাদা করে দিতো তাহলে কি হতো বল। আমি তো জানি তুই কোনোদিন ফ্যামিলির বিপক্ষে গিয়ে আমাকে বিয়ে করতি না। আমিও পারতামনা ফ্যামিলিকে কষ্ট দিয়ে কিছু করতে। তাইতো তোর থেকে দূরে থাকা। আমাকে সবাই অন্ধের মতো বিশ্বাস করে।

আমি কিভাবে তাদের বিশ্বাস নষ্ট করতাম। নিজের মতো চেষ্ট করে গেছি তোকে পাওয়ার। তোকে পেতে তোর থেকে অনেক দূর কানাডায়ও গিয়েছি যাতে ভালোভাবে সেটেল হতে পারি। জানিস কত কাঠখোড় পুড়িয়ে রাজি করিয়েছি সবাইকে। আর তুইতো সবার আদরের লাডলি বাচ্চা।

তাইতো তারা চেয়েছে ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকুক। আমার সাথে বিয়ে দিতেও রাজি হয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলাম তোকে সারপ্রাইজ দিবো। তোর জীবনের সেরা উপহার তোকে দিবো। কিন্তু তুই যে আমার জন্য এতো বড় সারপ্রাইজ রেডি করে রেখেছিলি আমার জানা ছিলো না।”
সাহের পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো।

প্লিজ আমাকে আরেকবার বল না রে, “তুমি কি আমার হবে সাহের ভাই”। বিশ্বাস কর এবার তোকে ফিরিয়ে দিবোনা, বুকে টেনে নিবো।
“আমাকে আমার নিমুর কাছে যেতেই হবে। আমার নিমু কষ্ট পাচ্ছে। আমাকে যেতেই হবে।”বলেই সাহের হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

হসপিটালে পৌঁছানোর পর সে নিয়ামাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেলো। তখনই তুর্য এসে সাহেরকে ইচ্ছামতো মারতে লাগলো। সাহের কোনো প্রতিবাদ করছেনা।
“তোর জন্য আজ আমার বোনটার এই অবস্থা। তুই জানতি না আমার বোনটা তোকে ভালোবাসে। আমাকে বলিসনি কেনো।

আমি আজ পর্যন্ত তোর সব কিছুতে সাপোর্ট দিয়েছি। নিমু আমার সাথে ফ্রি ছিলোনা বেশি তাই আমি ওর সব কিছু তোর থেকে জানতাম। আর এতো বড় কথা তুই আমাকে বলিসনি। তুই আমার বোনটাকে এতটা কষ্ট কিভাবে দিলিরে। তোর একটুও মায়া হয়নি ওর জন্য!আবার এসেছিস ঢং দেখাতে। তুই জানতিস না আমি আমার বোনের জন্য সব কিছু করতে পারি। একবার বলেই দেখতি।”বলেই তুর্য কাঁদতে লাগলো।

“আমাকে নিমু এনে দাও ভাইয়া। আমি বড্ড ভুল করে ফেলেছি। আমি আর কোনোদিন ওকে কষ্ট দিবোনা।”
সাহের তুর্যের পা ধরে বসে কাঁদতে লাগলো।

ঠিক তখনি ডাক্তার বের হলো। সবাই দৌড়ে ডাক্তারের কাছে গেলো।
তুর্য ভয়ার্ত সুরে বললো,
“নিমু ঠিক আছে তো!”প্লিজ বলেন ডাক্তার।

আসলে মিস নিয়ামা ঘুমের ঔষধও খেয়েছে এবং হাতের রগও কেটেছে। অতিরিক্ত চাপ নিতে না পেরে তার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। ইন্টারনাল ইঞ্জুরি অনেক বেশি বাইরের থেকে। ইন্টারনাল যে ব্লিডিং হচ্ছে তা বেড়েই চলছে। সে নিজেকে শেষ করার জন্য সব করেছে। সে এক প্রকার ডিপ্রেশনে ছিলো এতোদিন।

আর হঠাৎ এতো বড় শক খেয়েছে যে তার ব্রেইন সেটা নিতে পারেনি। তার মধ্যে বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই। আমরা আসলে অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু…
তিরুর ডাকে সাহের বাস্তব জগতে ফিরে এলো। চোখের পানি মুছে তিরুর দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো।

তোমার জন্য চা এনেছি। চা টা খেয়ে নাও। সাহের তিরুর হাত থেকে চায়ের কাপ টা নিয়ে দোলনায় গিয়ে বসলো। তিরুও সাহেরের পাশে যেয়ে বসলো।
হঠাৎ পাশের রুম থেকে….


পর্ব ৪ (অন্তিম)

হঠাৎ ভাংচুরের আওয়াজ এলো পাশের রুম থেকে। সাহের চা ফেলে দৌড়ে গেলো। তিরু সাহেরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললো এবং নিজেও উঠে দাড়ালো ঐ রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
সাহের রুমে গিয়ে দেখলো পুরো রুমের জিনিসপত্র ভাংচুর করে শেষ।
“কি করছো তুমি? প্লিজ থামো। এমন করোনা লক্ষিটি। তোমার এই অবস্থা আমি আর দেখতে পারছিনা।”

নিমু এবার চিৎকার দিয়ে উঠলো
“আমাকে সাহের এনে দাও। সাহের এনে দাও আমাকে। ও কেনো আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করলো?ও আমাকে কেনো ঠকালো?, বলেই নিমু হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

তিরু এসে অনেক কষ্ট করে নিমুকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।
সাহের এখনো নিমুর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কি মেয়ে কি হয়ে গেলো। তিরু সাহের কে ইশারা করলো তার সাথে রুম থেকে বেরোতে যাতে নিমু ঘুমাতে পারে।

“ভালোই চলছিলো সব কিন্তু গতকাল আবার নিমুর সেই এটাক হয় তার পর থেকেই শুরু আবার সেই পাগলামি। ও কি কোনোদিনো ঠিক হবে না রে? ভাগ্যের জোরে ও বেঁচে গেলেও ওর এমন অবস্থা আমি আর মানতে পারছিনা।”

তিরু সাহারের হাত ধরে বললো,
“শান্ত হও। তোমাকে যে শক্ত থাকতে হবে অনেক। ডাক্তার তো সেদিন বলেইছিলো যদি নিমু বেঁচেও যায় তবে স্বাভাবিক লাইফে ফিরতে অনেক সময় লাগবে। অতিরিক্ত ট্রমার জন্য ও অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।”

সাহের চুপ করে আছে। আজ তার জন্য নিমুর এই অবস্থা। সে নিজেকে কোনোদিন মাফ করতে পারবেনা।
“আমিতো প্রতি সপ্তাহে দুবার এসে চেকাপ করে যাই। আর ওর মধ্যে আগের থেকে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। তুমি দেখে নিও ও খুব জলদি ঠিক হয়ে যাবে। আমি এখন যাই তাহলে। তুমি তোমার এবং নিমুর খেয়াল রেখো।”

সাহের তিরুকে বিদায় দিয়ে নিমুর পাশে এসে বসলো। কি সুন্দর ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। নিমুর মাথায় হাত বুলোচ্ছে সাহের।
ডুব দিলো তার ভাবনার জগতে।

“সেদিন ৭২ ঘন্টা পর যখন তোমার জ্ঞান ফিরে এলো কতটা খুশি যে হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবার তোমাকে আর কোথাও যেতে দিবোনা। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস তুমি জ্ঞান ফিরার পর আমাকেই চিনতে পারলে না। সাহের সাহের বলে চিৎকার করতে লাগলে কিন্তু আমি যে তোমার সামনে ছিলাম তুমি চিনলে না। সেদিন বুঝেছিলাম আল্লাহ আমাকে আমার পাপের শাস্তি দিচ্ছে। আমার জন্য তুমিও শাস্তি ভোগ করছো।

১ বছর পর্যন্ত তুমি কারো সাথে কথা বলতে না। আমাকে দেখলে তো তোমার রাগ মনে হয় আসমানে উঠে যেতো। তোমার ধারের কাছেও ঘেষতে দিতে না আমাকে। সারাদিন শুধু সাহের সাহের করতে। ধীরে ধীরে তোমার মেন্টাল কন্ডিশনের উন্নতি হতে লাগলো।

তুমি বাড়ির সবার সাথে কথা বলা শুরু করলে। এমনকি আমাকেও ধীরে ধীরে চিনতে শুরু করলে। ভেবেছিলাম এবার সব ঠিক হয়ে যাবে তাই তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তার যা বললো,
“মি.সাহের নিয়ামার মেন্টাল এবং ফিজিকাল কন্ডিশন উন্নতি হলেও তা সাময়িক। তার মানসিক অবস্থা এতটাই বিপর্যস্ত হয়েছে যে তা পুরোপুরি ঠিক হতে অনেক বছর লেগে যেতে পারে আবার এমনো হতে পারে কোনোদিন ঠিক ই হবে না।

হয়তোবা সে আজ আপনাকে সবাইকে চিনতে পারলো কিন্তু এরপর যখন আবার ঐ ট্রমা ওকে এটাক করবে দেখা যাবে ও ওই আগের মতোই পাগলামি শুরু করবে। নিয়ামার ব্রেইন সেই ১ বছর আগের কাহিনি থেকে এখনো বের হতে পারেনি। কিন্তু ও যখন আবার স্বাভাবিক হবে তখন এইসব পাগলামি এগুলা কিছুই মনে রাখতে পারবেনা। আপনি হোপলেস হবেননা। আমরা যথাযথ চেষ্টা করছি। আর মিস তিরু তো রেগুলার চেকাপ করছেই তার।”

এর পর সাহের সিদ্ধান্ত নিলো সে নিমুকে বিয়ে করবে। বাসার সবাই অমত হলেও সাহেরের জোরাজোরিতে আর নিমুর কথা ভেবে সবাই রাজি হয়েগেলো। কিন্তু তুর্য কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলোনা। অনেক কাহিনি করে হলেও সাহের নিমুকে বিয়ে করে।
বিয়ের দিন রাতেই নিমু আবার পাগলামি শুরু করে। পারলে সাহেরকে খুন করে ফেলে। এমনকি বারান্দা দিয়ে লাফও দিতে গিয়েছিলো। তিরু এসে অনেক কষ্ট করে ঠান্ডা করে ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়।

সেদিন সাহের নিরবে শুধু চোখের জল ফেলেছিলো। এই রাতটা নিয়ে কত স্বপ্নই না দেখেছিলো। কিন্তু কি হয়ে গেলো। সারারাত নিমুর দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেয়।
নিমু কখনো কখনো সাহেরকে চিনতে পারে খুব স্বাভাবিক আচরণ করে। নিজেকে সাহেরর বউ বলে লজ্জায় মুখ লুকোয় সাহেরের বুকে। আবার কখনো কখনো পাগ্লামি করে ঐ বুকেই আঘাত করে। এভাবেই গত ৩ টে বছর ধরে চলছে।

রাতে নিমুর ঘুম ভাঙে,
উঠে দেখে সাহের ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ও বুঝতে পারে না প্রায়ই কেন সাহের ওর দিকে এমন তাকিয়ে থাকে। তার মাথা কেমন যেনো ভার ভার লাগছে। মাঝে মাঝেই এমন হয়। ঘুম টা বড্ড বেশি হয়ে গেছে।
“তুমি এমন করে আমার দিকে তাকিয়ে কেনো আছো বলোতো? আমার বুঝি লজ্জা করেনা!”বলেই নিমু লজ্জামাখা হাসি দিলো।

“এই ৪ বছরেও তোমার লজ্জা কমেনি। এত লজ্জা পাও কই আমাকে বলোতো। আমাকেও একটু ধার দেও”।
“এহ প্রপোস টা কিন্তু আমিই তোমাকে করেছিলাম তুমি আমাকে না। আর তুমি কি করেছিলে মনে আছে?”
সাহেরের এবার কষ্ট লাগলো। ও নিমুকে বুকে টেনে নিলো।

মনে মনে বললো
“ঐটাই যে সব থেকে বড় ভুল হয়ে গিয়েছিলো রে তার মাশুল আজ অব্দি দিচ্ছি।”
“আই শুনোনা “, নিমু খুব আহ্লাদী সুরে বললো।

“জি বলেন ম্যাডাম। নিশ্চই আপনার কিছু চাই তাইনা।”
“আই তুমি বুঝো কিভাবে হ্যা? আমাদের বিয়ের তো অনেক বছর হলো? আমাকে একটা ছোট সাহের এনে দাও।”বলেই নিমু লজ্জায় লাল পিলা হয়ে যাচ্ছে।
সাহের নিমুকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। দীর্ঘশ্বাস লুকালো।

২ সপ্তাহ ধরে খুব ভালোই কাটছে। নিমু খুবই স্বাভাবিক আচরণ করছেএবং অনেকটা সুস্থ। বেশ ভালো লাগছে সবার।
সকালের দিকে তিরু এলো নিমুকে দেখতে।
তিরু সাহেরের রুমে ঢুকে দেখলো সাহের নিমুকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে। তিরু একটা হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে এলো। এই হাসির পিছে যে কত কষ্ট আছে তা একমাত্র তিরুই জানে।

“মাঝে মাঝে বড্ড হিংসে হয় নিমুকে দেখে। সাহেরের সবটা জুড়ে শুধু নিমুই আছে। আমার ভালোবাসা কোনোদিন চোখেই পরেনি সাহেরের। ছোট থেকে আমি যে শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি। কিন্তু তোমার পুরো দুনিয়াটাই যে নিমু ছিলো।

খুব ভালো করে জানতাম সেখানে আমার কোনো জায়গা নেই। তাও এই বেহায়া মনটা যে শুধু তোমাকেই চেয়েছে। তোমরা যাতে এমন খুশি থাকো সবসময়।”চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তিরুর। নাহ তাকে ভেঙে পড়লে চলবেনা খুব শক্ত হতে হবে।
“আই শুনো না, তুমি আমাকে কোনোদিন অবহেলা করবে না হ্যা?”

“এই নিয়ে তুমি প্রতিদিন আমাকে এই কথাটা বলো কেনো? আমি কি তোমাকে এখন আর অবহেলা করি? আমার বুঝি কষ্ট হয়নি তখন তোমাকে ঐভাবে অবহেলা করে? তোমার থেকে দূরে থেকে! “ক্ষানিকাটা অভিমানি সুরে বললো সাহের।

“আমি এভাবে বলতে চাইনি। তুমি রাগ করছো কেনো?এই দেখো কান ধরলাম। এবার তো হাসো আমার লক্ষি জামাই না সরি ঘাড়ত্যারা জামাই।”বলেই ফিক করে হেসে দিলো নিয়ামা।
এবার সাহেরও হেসেদিলো। নিয়ামাকে জড়িয়ে ধরলো।
“ভালোবাসি নিমু।”

নিয়ামা মুচকি হাসি দিয়ে সাহেরকে পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে আছে।
(হয়তোবা নিয়ামা এই যাত্রায় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে তা না হলে আবার সেই পাগলামি করবে। নিয়ামার দুটো জগত। এক জগতে সে সাহের কে কাছে পেয়ে, তাকে নিয়ে অনেক হ্যাপি। আবার অন্য জগতে তার মনে রয়েছে সাহেরের প্রতি এক পাহাড় সমান অভিমান এবং সাহেরকে না পাওয়ার তীব্র কষ্ট।

কখোনো সে এই জগতে তো কখনো সে ঐ জগতে বিচরণ করে। দুটো জগতকে সে মিলাতে পারেনা। যেদিন সে তার ঐ অন্ধকার জগৎ থেকে পুরোপুরি বের হতে পারবে তার থেকে সুখী আর কেউ হবেনা। আর সেদিন থেকে শুরু হবে, তোমার আমার গল্পের এক অন্যরকম ভালোবাসার অধ্যায়।

লেখা – তানি তাসরিত

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “তোমার আমার গল্প – অন্যরকম ভালোবাসার অধ্যায়”গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – তোমার নিসা (১ম খণ্ড) – পাগল প্রেমের পাগলামি গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *